1 of 3

১.২৮ কলকাতার ভদ্রলোকদের বাড়িতে ঝি-চাকর

কলকাতার ভদ্রলোকদের বাড়িতে ঝি-চাকররা আসে বস্তি থেকে। আগে প্রত্যেক যৌথ পরিবারেই একজন-দু’জন স্থায়ী রাঁধুনী বা দাস-দাসী থাকতো। অনেকে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতো কাজের লোক। এখন যৌথ পরিবারগুলো ভাঙছে, ভাড়া বাড়ির দু’ আড়াইখানা ঘরের ছোট সংসারে ঝি-চাকরদের শোওয়ার জায়গা দেওয়া যায় না, খাই খরচও অনেক পড়ে যায়, তাই এখন ঠিকে নোক রাখাই সুবিধেজনক। এই ঠিকে লোকদের চাহিদা মেটাতে আস্তে আস্তে সম্প্রসারিত হচ্ছে শহরের বস্তিগুলো। নগরপালকদের সেদিকে হুঁস নেই।

সম্প্রতি অবশ্য রিফিউজি কলোনিগুলি থেকেও ঝি-চাকরের যোগান হচ্ছে বেশ। এই রিফিউজিরা এক সময় নানারকম বৃত্তিতে নিযুক্ত স্বাধীন সংসারী ছিল, দেশান্তরী হয়ে ভিক্ষুক বা ঝি-চাকর হতে প্রথম প্রথম তাদের আত্মসম্মানে বেঁধেছে। কিন্তু খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। আস্তে আস্তে তাদের নামতে হলো পথে। যে-কোনো কাজ, যত কম মজুরিতেই হোক, তা আঁকড়ে ধরার জন্য এগিয়ে গেল শত-সহস্র হাত। পূজারী বামুনের ছেলে মোট বইতে লাগলো বাজারে, চাষীর বউ হোটেলে বাসন মাজতে যায়। যুবতী মেয়েরা কেউ কেউ নার্সের কাজ করার নামে দুপুরে কলোনি থেকে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাতে।

কলকাতার উত্তরে আর দক্ষিণে এখন শত শত জবরদখল কলোনি। তারা সকলে মিলে। সঙ্ঘবদ্ধ হলে একটা বড় রকমের শক্তিতে পরিণত হতে পারতো, কিন্তু সেরকম নেতৃত্ব দেবার কেউ নেই।

হারীত মন্ডল পুলিসের হাতে ধরা পড়ার পর তার স্ত্রী পারুলবালাকে বাধ্য হয়ে কাজ নিতে হলো এক বাড়িতে। ঠিক ঝি-গিরি নয়, তিনটি বাচ্চাকে দেখাশুনো করা, এ দেশে বলে আয়ার কাজ। গৃহকত্রী বেশ সহৃদয়া, তিনি প্রায়ই হাঁপানিতে ভোগেন, শরীর খুবই দুর্বল, কিন্তু মুখের কথা খুব মিষ্টি। যখন তাঁর হাঁপানির টান কম থাকে তখন তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পারুলবালার জীবনকাহিনী জানতে চান। শুধু কৌতূহল নয়, আন্তরিক সমবেদনার সুরও ফুটে ওঠে তাঁর কথায়। গৃহকত্রীর নাম প্রীতিলতা, তিনি কখনো পূর্ববঙ্গ দেখেননি।

পূর্বজন্মের স্মৃতির মতন পারুলবালা শুধু ফেলে আসা দেশের গল্পই শোনায়। জবর-দখল। কলোনির কথা শুনতে এদেশের অনেকেই পছন্দ করে না। তাছাড়া পারুলবালার স্বামী খুনের অভিযোগে জেল খাটছে, এ খবর জানাজানি হলে চাকরি থাকবে না হয়তো!

হারীত মণ্ডলের ছেলে-মেয়ে তিনটি। তার মধ্যে বড় ছেলে সুচরিতের মাথা খুব পরিষ্কার। খুব বাচ্চা বয়স থেকেই সে মুখে মুখে বেশ শক্ত শক্ত অঙ্ক কষে দিতে পারতো। কাশীপুরের একটি স্কুলে তাকে ভর্তি করানো হয়েছে এবং অ্যানুয়াল পরীক্ষায় সে থার্ড হয়েছে।

কিন্তু স্কুলটি জুনিয়র হাইস্কুল, ক্লাস এইটের বেশি নেই। সুচরিতকে এবারে বড় ইস্কুলে যেতে হবে। হারীত মণ্ডল পুলিসের হাতে ধরা পড়ার পর পাড়ার একজন নেতাগোছের ব্যক্তি পারুলবালার কাছে সমবেদনা জানিয়ে সুচরিতকে নিজের বাড়িতে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল। অর্থাৎ বিনা মাইনেতে চাকরের কাজ। সুচরিত কিছুতেই যেতে চায়নি, সে আরও পড়তে চায়। কিন্তু নতুন ইস্কুলে যাওয়া মানেই ভর্তির টাকা, মাইনে, বইপত্র কেনার খরচ। রিফিউজি ছাত্রদের জন্য সরকার কিছু কিছু বৃত্তির কথা ঘোষণা করেছেন বটে, কিন্তু চিঠিপত্র লিখে সেসব জোগাড় করা ঝঞ্ঝাটের কম কাজ নয়। জবরদখল কলোনির অনেকে এখনো বৈধ রিফিউজি। সার্টিফিকেটের কাগজই পায়নি!

স্কুলে যেতে পারছে না বলে সুচরিত কান্নাকাটি করে, সেই জন্য পারুলবালা একদিন সঙ্কুচিতভাবে তার মনিবপত্নীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানালো। প্রীতিলতার বয়েস কম হলেও পারুলবালা তাকে বৌদি বলে ডাকে।

প্রীতিলতার স্বামী অসমঞ্জ রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরিজির অধ্যাপক। কয়েকটি বাজার-চলতি স্কুল কলেজের নোট বই লিখে তিনি বেশ টাকাকড়ি করেছেন। নানান সভা-সমিতির সঙ্গেও যোগ আছে, বেশ ব্যস্ত মানুষ। ‘

প্রীতিলতার কাছে প্রস্তাবটি শুনে অসমঞ্জ রায় বললেন, দ্যাখো, রিফিউজিদের জন্য আমাদের পক্ষে যার যতটা সম্ভব সাহায্য করা উচিত, এটা আমি মানি। আমি সেরকম চেষ্টাও করেছি। কয়েকবার। কিন্তু ওরা বড্ড ঝামেলা করে। নির্মল বলে সেই ছেলেটাকে তো তুমিই জুটিয়েছিলে, মনে নেই।

প্রীতিলতা বললেন, হ্যাঁ, তার কী হয়েছে? সে তো চাকরি বাকরি পেয়ে ভালোই আছে শুনেছি?

অসমঞ্জ রায় বিরক্ত ভাবে বললেন, হ্যাঁ, সে তো ভালোই আছে। কিন্তু আমাদের বিজয়ের প্রাণ ওষ্ঠাগত! বিজয় আমাকে বলে, তুমি আমার গলায় এমন কাঁটা গেলালে

–কী করেছে নির্মল?

–খেতে পাচ্ছে না বলে তোমার পায়ে কেঁদে পড়েছিল। ছেলেটি দেখতে শুনতে ভালো, তুমি অমনি দয়ায় গলে জল হয়ে গেলে। কিন্তু ছেলেটি যে জাতে বামুন, তুমি তা জানতে?

–হ্যাঁ, জানতুম তো। বামুন হওয়ার দোষ কী হয়েছে?

–তুমি জানলেও সে কথা আমাকে বলোনি। ছেলেটি যে-কোনো একটা কাজ চেয়েছিল। লেখাপড়া তো ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। আমি বিজয়কে বলে ওর অফিসে ঢুকিয়ে দিলুম। মার্চেন্ট অফিস, মাইনে খারাপ নয়, পার্মানেন্ট হলে বোনাস পাবে…।

–ও তো পার্মানেন্ট হবার পর আমাদের এক বাক্স সন্দেশ দিয়ে গিয়েছিল।

–হ্যাঁ, পার্মানেন্ট হবার আগে মা-বেচারা সেজে ছিল, তারপরেই কুলোপানা চক্কর বার করেছে! এখন সব সময় ফোঁসফুঁসিয়ে ভয় দেখায়।

–তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে?

–আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে কেন? আমার সঙ্গে কী সম্পর্ক? আমাকে দেখলে বিগলিতভাবে হাসে। কিন্তু বিজয়ের হাড় জ্বালাচ্ছে। ক্লাস সিক্স অবধি বিদ্যে, ও আর কী চাকরি পাবে, বিজয় ওকে বেয়ারার কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। অফিসের বেয়ারারা কী করে, কাজ খুব হাল্কা। বসেই তো থাকে বেশিরভাগ সময়। মাঝে মাঝে ফাঁইলপত্তর আনতে হয়, বাবুদের জল-দেওয়া, টিফিন আনা, এই তো! তা তোমার ঐ নির্মল এখন বলে যে, ও বাবুদের এটো জলের গেলাস ধুতে পারবে না, কারণ ও ব্রাহ্মণ! বাবুদের জন্য টিফিন এনে দেবে। কিন্তু এ টেবিল থেকে এটো শালপাতা তুলবে না, চা এনে দেবে কিন্তু খালি কাপ নিয়ে যাবে না, কী আবদার বলো তো!

প্রীতিলতার ব্রাহ্মণদের বিষয়ে সংস্কার আছে। সহসা কিছু বলতে পারলেন না। তাঁর বাপের বাড়িতে তিনি ব্রাহ্মণ অতিথিদের পা ধুইয়ে দিতে দেখেছেন ছেলেবেলায়। তাঁর মা এক বাচ্চা পুরুতের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন।

অসমঞ্জ রায় বললেন, ব্রাহ্মণদের কাজ ছিল এক সময় লেখাপড়ার চর্চা করা। যে লেখাপড়া শেখেনি, সে আবার বামুন কিসে?

প্রীতিলতা বললেন, অফিসের লোকরাই বা কেমন! নিজেদের এঁটো গেলাস বা কাপ-ডিস নিজেরা ধুয়ে নিতে পারে না?

–দ্যাখো, এতকাল ধরে একটা ব্যবস্থা চলে আসছে, অফিসের বেয়ারারাই এসব কাজ করে। এখন এই সার্ভিস না পেলে কেরানিবাবুরা বিরক্ত হবেই। তারা বিজয়ের কাছে নালিশ করে।

–বিজয়বাবু তো নির্মলকে অন্য একটা কাজ দিলেই পারেন!

–কী কাজ দেবে? ঐ নির্মল আবার নাকি ইউনিয়নের পাণ্ডা হয়েছে, কমুনিস্টদের মতন কথাবার্তা বলে। একদিকে বামুন আর এক দিকে কমুনিস্ট, বোঝে ঠ্যালা! বিজয়ের হাড় ভাজাভাজা করে তুলেছে! আর কারুর জন্য আমি চাকরি জোগাড় করতে পারবো না। বিজয় বলেছে, এর পর থেকে ওর অফিসে আর বাঙালীই নেবে না।

–কিন্তু পারুলের ছেলে তো চাকরি চায় না, পড়াশুনো করতে চায়।

অসমঞ্জ রায় ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। যদিও ছুটির দিন তবু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরই তাঁর বেরুবার কথা আছে। রেড ক্রসের মিটিং, তিনি আঞ্চলিক শাখার সভাপতি।

–পড়শুনো করতে চায় তো করুক। তার জন্য আমি কী করবো? সে কি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চায় নাকি?

–না, ইস্কুলের ছাত্র।

–টাকা চায়?

–না, ক্লাস নাইনে ভর্তি হবে, তোমার তো অনেক চেনাশুনো, তুমি যদি ফ্রি করে দিতে পারো, আর রিফিউজিদের জন্য কী সব টাকা পাওয়া যায়, যদি ব্যবস্থা করে দাও..

চোখ থেকে চশমাটা খুলে অসমঞ্জ রায় মুখ মুছলেন। তারপর বললেন, দ্যাখো, আমি লেখাপড়ার লাইনের মানুষ। কেউ যদি সত্যি সত্যি পড়াশুনো করতে চায়, আমি তাকে সবরকম সাহায্য করতে পারি। কিন্তু রিফিউজি কলোনিতে থেকে কতদূর লেখাপড়া হবে? আসলে ওরা কী চায়, ভালো করে বুঝে দ্যাখো। মনে তো হচ্ছে, ছেলেটিকে গছাতে চায় আমাদের বাড়িতে। কিন্তু আমি বাড়িতে পুরুষ চাকরও রাখতে চাই না।

অসমঞ্জ রায়ের এই কথা বলার কারণ আছে। পুরুষ চাকর সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা খুবই মন্দ। একবার একজন এ বাড়ি থেকে ঘড়ি-রেডিও সব চুরি করে পালিয়েছে। আর একবার। একজন জোয়ান ভৃত্যের সঙ্গে তাঁর বিধবা বোনের একটা অসৎ সম্পর্কের আভাস পাওয়া। গিয়েছিল। সেই বিধবা বোন এখনও এ বাড়িতেই থাকে, তার মাথায় ঈষৎ গণ্ডগোল আছে।

তবু প্রীতিলতার অনুরোধে তিনি পরদিন পারুলের ছেলের সঙ্গে একবার অন্তত কথা বলতে সম্মত হলেন।

সকালবেলা চা-জলখাবারের পর বসবার ঘরে শুরু হলো ইন্টারভিউ। পারুলবালা সুচরিতের হাত ধরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অসমঞ্জ রায় এই প্রথম তাঁর ছেলেমেয়ের আয়াকে দেখলেন ভালো করে। পারুলবালার শরীরে বা মুখে কোনো দৈন্যের ছাপ নেই, নিচু ঘরের স্ত্রীলোক মনে হয় না, তার দৃষ্টিতেই আত্মসম্মানবোধ স্পষ্ট। পরনের শাড়িখানা দু’এক জায়গায় সেলাই করা হলেও পরিষ্কার। অসমঞ্জ রায় যেন ঠিক এরকম ভাবেননি। সুচরিতের স্বাস্থ্য ভালো নয়, সে রোগা ও লম্বাটে, দেখলেই বোঝা যায় লাজুক স্বভাবের।

অসমঞ্জ রায় দু’জনকেই একটুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর তিনি পারুলবালাকে বললেন, ঠিক। আছে, বাছা, তুমি ভেতরে কাজে যাও, আমি শুধু তোমার ছেলের সঙ্গে কথা বলবো।

তারপর তিনি সুচরিতের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ঐ কোণে ঐ যে টেবিল-চেয়ার আছে, ওখানে বসো। দ্যাখো, ওখানে কাগজ-পেন্সিল আছে। আমি ডিকটেশন দিচ্ছি, লেখো?

তিনি হাতের স্টেটসম্যান পত্রিকাটি খুলে প্রথম সম্পাদকীয়র অর্ধেকটা শুতি লিখন দিলেন। তারপর বললেন, এটা ভালো করে পড়ে, বুঝে বাংলা অনুবাদ করে আমাকে দেখাও। কুড়ি। মিনিট সময়।

ঠিক কুড়ি মিনিট বাদে তিনি খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে বললেন, কই দেখি!

সুচরিত তখনও কাটাকুটি করে লিখে যাচ্ছিল, তিনি উঠে এসে বললেন, যা হয়েছে সেটাই দেখাও!

স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদকীয়-লেখকগণ যদি একটি ক্লাস এইটের রিফিউজি বালকের পক্ষে সুবোধ্য ইংরিজি লেখে, তা হলে তাদের চাকরি যাবার কথা। অসমঞ্জ রায় ইচ্ছে করেই কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছেন।

সুচরিত কোনো সাংঘাতিক প্রতিভাবান কিশোর নয়। ইংরিজির বদলে অঙ্কের পরীক্ষা নিলে সে বেশি স্বস্তি বোধ করতো। তার লেখায় অনেকগুলি বানান ভুল, বেশ কয়েকটি ইংরিজি শব্দের সে মানে বুঝতে পারেনি, তবু সে মোটামুটি একটা বাংলা অনুবাদ খাড়া করেছে।

অসমঞ্জ রায় চশমার ফাঁক দিয়ে ছেলেটিকে আবার দেখলেন ভালো করে। অনেক বছর ধরে তিনি ছাত্র চরাচ্ছেন, মুখ দেখলেই তিনি অনেকটা বুঝতে পারেন।

তিনি বললেন, ঠিক আছে, এতেই হবে। শোনো, তুমি যদি মন দিয়ে লেখাপড়া করতে চাও, আমার কাছ থেকে সবরকম সাহায্যই পাবে। একেবারে এম এ পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা করে। দেবো। আর যদি ফাঁকি মারো, তা হলে আমার কাছে কোনো দয়া নেই। এ দেশে ঢের ঢের অপগণ্ড ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না। বুঝলে? মুখ নিচু করে আছো কেন? তাকাও আমার দিকে। রিফিউজি ছেলেদের বাঁচার একমাত্র উপায় এখানকার ছেলেদের সঙ্গে লেখাপড়ায় কমপিট করা–।

অসমঞ্জ রায়ের বক্তৃতার মাঝ পথে কয়েকজন বাইরের লোক এসে পড়লো। দু’জন পুরুষ, একজন মহিলা। তাদের দেখে অসমঞ্জ রায় স্পষ্টত খুশি হয়ে উঠলেন, চেয়ার ছেড়ে উঠে। দাঁড়িয়ে তিনি আপ্যায়নের ভঙ্গিতে বললেন, আরে, এসো, এসো!

অতিথিদের তিনি পাশের সোফা-সেটটিতে বসিয়ে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। যুবতীটি হাতের একটি ফাঁইল খুলে বললো, আমরা দুটো নতুন প্রজেক্ট নিয়েছি, সেই ব্যাপারে আপনার সঙ্গে ডিসকাস করতে চাই..।

পুরুষ দু’জন প্যান্ট-শার্ট পরা, তাদের তুলনায় যুবতীটি বেশি সপ্রতিভ। চোখে মুখে বুদ্ধির দীপ্তি, সে-ই কথা বলছে বেশি, পুরুষ দু’জন হা হা করে যাচ্ছে। এরা স্থানীয় একটি সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, আন্তজাতিক দু’একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে ধুবুলিয়া। উদ্বাস্তু শিবিরে হাতের কাজ শিক্ষা, তাঁত চালানো ইত্যাদি পরিকল্পনা চালু করতে চায়।

অসমঞ্জ রায় অবশ্য অন্য দুটি পুরুষের মতন এই উজ্জ্বল-আনো যুবতীটির সব কথা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেন না, তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন, হ্যাঁ, ভেবে দেখতে হবে, সব দিক ভেবে দেখতে হবে, ওভারহেড খরচ কত হবে, সেটা ঠিক করতে হবে আগে, তারও আগে একবার সাইটে যেতে হবে।

যুবতীটি বললো, চলুন, আজই চলুন, এখনই বেরিয়ে পড়া যেতে পারে, আমাদের সঙ্গে জিপ আছে।

হুট করে কারুর কোনো কথায় রাজি হওয়া বোধ হয় অসমঞ্জু রায়ের স্বভাবে নেই। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, আজ হবে না। তারপর চোখ বুজে একটু চিন্তা করে বললেন, পরশু হতে পারে।

অন্য যুবকদের একজন বললো, উইক ডেইজের মধ্যে গেলে আমাদের একটু অসুবিধে আছে।

যুবতীটি বললো, আমার কোনো অসুবিধে নেই। আমি ফ্রি আছি।

অসমঞ্জ রায় বললেন, তা হলে চন্দ্রা, তুমি আর আমিই পরশু গিয়ে একবার দেখে আসি। ওরা হয় পরে যাবে।

ঢ্যাঙা বালকটি দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এক কোণে। সুচরিতকে কেউ চলে যেতে বলেনি। তাকে কেউ লক্ষও করছে না। কিন্তু সুচরিত প্রায় হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। চন্দ্রানাম্নী যুবতীটির মতন কোনো নারীকে সে আগে দেখেনি। চন্দ্রার পরনে একটা হালকা হলুদ শাড়ি, সেই রঙেরই ব্লাউজ, ব্লাউজের হাতায় জরির কাজ। সেই জরি যেন তার ফসা বাহু কামড়ে ধরে আছে। চন্দ্রার চুল খুব যত্ন করে বাঁধা। এক একজন নারীর শরীর যেন তার পোশাক থেকে খানিকটা উপছে বেরিয়ে আসে, চন্দ্রারও সেরকম। চন্দ্রার ঠোঁটে রং, সে সিগারেট খায়।

সুচরিত এ পর্যন্ত দেখে এসেছে যে পুরুষরা বড়, মেয়েরা ছোট। পুরুষরা দরকারি কথা বলে, মেয়েরা শোনে। মেয়েরা মাঝে মাঝেই ঝগড়া করে বটে, কিন্তু পুরুষদের মতন হুকুমের সুরে কথা বলতে জানে না। কিন্তু চন্দ্রা এখানে মধ্যমণি, সে কথা বলছে, অন্যরা শুনছে। অসমঞ্জ রায়ের মতন ইংরিজি জানা মানুষকেও সে মাঝে মাঝে আঙুল তুলে বোঝাচ্ছে কোনো কোনো কথা। ইংরিজি বলছে ফরফর করে। একবার সে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করতেই অসমঞ্জু রায়ের মতন রাসরি মানুষ নিজে দেশলাই জ্বেলে সেটা ধরিয়ে দিল! এক বালকের মনোজগতে এ এক সম্পূর্ণ নতুন চরিত্রের আবির্ভাব।

এক সময় অসমঞ্জ রায় তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, এই, ইয়ে, তোমার কী নাম যেন, ভেতরে গিয়ে বলো তো চার কাপ চা পাঠিয়ে দিতে।

সুচরিত বাড়ির মধ্যে ঢুকে তার মাকে খুঁজে সেই কথা জানালো, তারপর আবার ঐ ঘরে ফিরে এসে এক কোণে দাঁড়িয়ে রইলো দেয়াল ঘেঁষে। সে সব কিছু দেখতে ও শুনতে চায়।

চা-পান ও অন্যান্য কথাবার্তা শেষ করার পর ঐ তিনজন যখন বিদায় নিচ্ছে, দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়ে অসমঞ্জ রায় বললেন, চন্দ্রা, একটু শোনো, ফাঁইলগুলো আমার কাছেই রেখে যাও, আমি এর মধ্যে ভালো করে পড়ে রাখব।

যুবক দু’জন বাইরে, চন্দ্রা আবার ঘরের মধ্যে এসে ফাঁইলগুলো খুলে কী সব বোঝালো।

অসমঞ্জ রায় চার কাঁধে হাত রেখে গাঢ় গলায় বললেন, তা হলে, পরশু?

চন্দ্রা মুখ তুলে, তার হাসিতে অনেকখানি কিরণ ছড়িয়ে বললো, হ্যাঁ, ঠিক রইলো…

এই সময় চন্দ্রা এক পলক দেখলো সুচরিতকে। গ্রাহ্য করলো না। বালক হলেও সুচরিত বুঝতে পারলো, সমাজ সেবা ছাড়াও এই দু’জন নারী-পুরুষের মধ্যে অন্য কোনো বন্ধন আছে।

ওরা চলে যাবার পর অসমঞ্জ রায় ফিরে এসে সোফায় বসে এক মনে সিগারেট টানতে লাগলেন। তিনি কোনো গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। সুচরিতের কথা তাঁর মনে নেই। সুচরিতও নিজে থেকে কিছু বলতে পারছে না।

খানিকবাদে একটা কিছু শব্দ পেয়ে অসমঞ্জ রায় মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, এই, তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর সঙ্গে তো কথা হয়ে গেছে?

সুচরিত ভয়ে ভয়ে বললো, আমি কোন্ ইস্কুলে পড়বো?

–ভর্তি করে দেবো, এ পাড়ায় যেটা ভালো স্কুল…

–কবে ভর্তি হবে?

–তোরা থাকিস কোথায়?

–কাশীপুরে, সেভেন ট্যাঙ্কস লেনের কাছে।

–ঠিক আছে, ওর কাছাকাছি কোনো স্কুল দেখতে হবে। তোর বাবা-বাবা আছে তো?

সুচরিত মাথা নাড়লো।

–কাল তোর বাবাকে পাঠিয়ে দিস। আমি সব লিখেটিখে দেবো!

সুচরিত কয়েক মুহূর্ত মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

–বললুম তো, তোর বাবাকে পাঠিয়ে দিস। এখন যা।

–বাবা আসতে পারবে না। বাবা এখানে নেই।

–তোর বাবা কোথায়? দেশেই থেকে গেছে?

–আমাকে যদি লিখে দ্যান, আমি নিজেই ভর্তি হতে পারবো!

–তোর বাবা কোথায়? এবারে মুখ তুলে সে অসম রায়ের দিকে সেজাসুজি তাকালো। তারপর বললো, আমার বাবার নাম হারীত মণ্ডল। সে এখন জেলে।

রিফিউজি কলোনিগুলির বাইরে হারীত মণ্ডল কোনো বিখ্যাত লোক নয়। সুচরিতের ধারণা, তার বাবার নাম খবরের কাগজে বেরিয়েছিল, তাই সবাই নাম শুনেই চিনতে পারবে। কিন্তু অসমঞ্জ রায়ের মনে কোনো দাগ কাটলো না।

তিনি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে তারপর বললেন, তুই ভেতরে যা। তোর মাকে পাঠিয়ে দে।

পারুলবালাকে নিয়ে সুচরিত আবার ফিরে এলো। অসমঞ্জ রায় এবারে খানিকটা ধমক দিয়ে বললেন, শুধু তোর মাকে আসতে বলেছি! তুই যা, গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়া!

অসমঞ্জ রায়ের পত্নী অনেকদিন ধরে রুগ্না বলে তিনি যে-কোনো স্বাস্থ্যবতী রমণীর সর্বাঙ্গ চোখ বুলিয়ে দেখতে ভালোবাসেন। সেইভাবে পারুলবালাকে আবার দেখে তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, শোনো বাছা, তোমার স্বামী যে জেল-খাটা আসামী তা আমরা জানতুম না। তোমার ছেলে যে এক কথায় তা স্বীকার করেছে, লুকোবার চেষ্টা করেনি, তাতে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু ছেলের মুখে তার বাপের পাপের কথা আমি শুনতে চাই না। তুমিই বলো, কী করেছে। তোমার স্বামী? চুরি, ডাকাতি?

পারুলবালা কোনো উত্তর দিতে পারলো না। হঠাৎ কান্না এসে বুজিয়ে দিল তার কণ্ঠস্বর। কিন্তু অন্যের সামনে কাঁদাও তার স্বভাব নয়। সে মুখটা ফিরিয়ে নিল একপাশে, তার শরীর কাঁপতে লাগলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *