1 of 3

১.২৬ Death dances like a fire-fly

Death dances like a fire-fly, Life coughs
its last laugh in burning pyres.

দশটা বাজতে এখনও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি। পাছে দেরি হয়ে যায় সেই ভয়ে অনেক আগে এসে পড়েছি। বেশ ভয়ভয় করছে। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। প্রথম যেদিন দাড়ি গোঁফ কামিয়েছিলুম সেদিন একরকম মনের অবস্থা হয়েছিল, অদ্ভুত এক বিষণ্ণ অনুভূতি, যাঃ বড় হয়ে গেলুম, বিদায় শৈশব, বিদায় কৈশোর!

স্বপ্ন দেখার নিশ্চিন্ত দিন শেষ হয়ে গেল!

আর কেউ খোকা বলবে না। বাস বা ট্রামের নারী-আসন থেকে ঠেলে তুলে দেবে। কোনও মহিলা বলবেন না, খোকা তুমি আমার কোলে বোসো। মলিমাসি বলবেন, পিন্টু, তুমি একটু বাইরে গিয়ে বোসো, আমি একটু সাজগোজ করে নিই।

আর আজ মনে হচ্ছে, আমি আমার বহু মূল্যবান স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতে এসেছি। আমার দিন গেল, রাত গেল। পিতার চেয়ে বড় হয়ে উঠবে এই বিশাল বাড়ির কর্মদাতা প্রভুরা। প্রভু ‘আমি’ থেকে হয়ে যাব দাস ‘আমি’। মাস গেলে পাঁচশো টাকা। পাঁচশো টাকাও কি এঁরা দেবেন! এখন মনে হচ্ছে, ইয়ারকি না করে, আর একটু ভাল করে লেখাপড়া করলে হত। যদি আই সি এস হতে পারতুম, তা হলে ওরই মধ্যে একটু বড় দাস হতে পারতুম। গ্রেজ ইন থেকে যদি ব্যারিস্টার হয়ে আসতে পারতুম, কিংবা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তার। পিতা বহুবার বলেছিলেন। বললে কী হবে, মানুষ যে ভাগ্য নিয়ে আসে। কেউ রাজা হয়, কেউ খাজা।

সুটেড বুটেড, টাই পরা এক ভদ্রলোক বাড়িটার দিকে আমার মতোই সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছেন। পায়ের জুতো কালির বিজ্ঞাপনের মতোই জেল্লা ছাড়ছে। ইনি যদি চাকরির উমেদার হন, আমার আশাভরসা খুবই কম। এমন একটা স্মার্ট গাইকে ছেড়ে কে আর এই দিশি গাইকে বেছে নেবে। এ তো আর খাটাল নয়! বড় ঘাবড়ে গেলুম। ভদ্রলোক আমার প্রতিযোগী না-ও হতে পারেন। মশা মারার জন্য কেউ এমন কামান দাগতে আসবে না। ভদ্রলোক সিগারেট টানছিলেন। টুকরোটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গটগট করে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। সাংঘাতিক ডাট। চরিত্রে এমন একটা প্রভু-প্রভু ভাব কীভাবে আনা যায়! খুব মাংস খেলে মনে হয় হতে পারে। বাঘ, যেমন বাঘ, ছাগল যেমন ছাগল।

দেউড়িতে চাপরাশ পরা প্রহরী। ভদ্রলোককে দেখে সট করে টুল ছেড়ে উঠে সেলাম বাজাল। যাক বাবা ইনি তা হলে আমার প্রতিযোগী নন। অন্য কেউ। বিগ বস গোছের কিছু একটা ব্যাপার! নীল জামা পরা আমার মতোই আর এক ন্যালাখ্যাবলা এসেছেন। এঁরা যা মাইনে দেবেন তাতে আমাদের মতো এইরকম ঝলঝলে খলখলে মালই জুটবে। নীলজামা কপালের দু’পাশে পাটিসাপটার মতো পেতে চুল আঁচড়েছেন। বেশ গুড বয় গুড বয় চেহারা হয়েছে। চোখদুটো বড় বড়। চশমাটা বেশ ভারিক্কি মানুষের মতো। বেশ কাশি হয়েছে। শব্দটাও বিদঘুঁটে। শুনলে মনে হবে ভেতরে আর কেউ ঢুকে কাশছে।

কাশতে কাশতে জিজ্ঞেস করলেন, ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?

হ্যাঁ, আপনি?

আমিও খ্যাঁক। কীরকম তৈরি হল, খ্যাঁক।

কী তৈরি?

আরে, প্রেপারেশন, ঘ্যাঁক ঘ্যাঁ। ইন্টারভিউয়ের ভ্যাঁচ প্রেপারেশন। উঃ মরে গেলুম। দাঁড়ান একটু যষ্টিমধু খাই, ফ্যাঁচাত, খাবেন নাকি!

না, আমার কিছু হয়নি।

না হলেও খাক ভাল।

উঃ সর্দি আর কাশিতে ভদ্রলোক নাস্তানাবুদ। ভালই হয়েছে, অনেক মাইনাস পয়েন্ট। প্রতি কথায় একটা করে হাঁচি বা কাশির পাংচুয়েশনে ইন্টারভিউয়ে খুব বেশি দূর এগোতে পারবেন না। যাঁরা নেবেন তারা বলবেন, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।

দেউড়ির সেই গোপদাদা বললে, সামনেই সিঁড়ি, দোতলায় চলে যান।

দোতলায় একটা ঘরের বাইরে লেখা রয়েছে, ম্যানেজিং ডিরেক্টার। দরজাটা বেশ বাহারি। অর্ধেকটা কাঠ, অর্ধেকটা কাঁচ। কাঁচে মিছরির দানার মতো আলো আটকে আছে, যেন একটু আগে আলোর বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঘরের বাইরে টানা বারান্দা, এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে গেছে। গোটাকতক চকচকে বেঞ্চ পাতা। দু’-চারজন বসে আছেন। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সন্দেহের চোখে দেখছেন। কটা পদ খালি জানা নেই, প্রার্থী অনেক। কার ভাগ্যে শিকে ছিড়বে বিধাতাই জানেন।

কোম্পানির এক কর্মচারী এসে আমাদের হাত থেকে ছোঁ মেরে মেরে ইন্টারভিউয়ের চিঠিগুলো নিয়ে গেলেন। এইবার নম্বর মিলিয়ে একে একে ডাক আসবে। আমার পাশে যিনি বসেছিলেন তিনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে?

স্বাস্থ্যমন্ত্রী? স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কী হবে?

প্রশ্ন করবেন না। যদি জানা থাকে বলুন।

আজ্ঞে জানা নেই। প্রধানমন্ত্রী জানা আছে। স্বাস্থ্য এমন কিছু ইমপর্ট্যান্ট পোর্টফোলিয়ো নয়।

বুঝবেন ঠ্যালা, যখন জিজ্ঞেস করবে। এঁরা ওষুধবিষুধ তৈরি করেন, স্বাস্থ্যটাই আগে ধরবেন।

ধরলে বলব জানি না।

আপনি জানেন, তবু বলবেন না। মুখ দেখেই বুঝেছি ভীষণ স্বার্থপর। কাল মাসির ছেলের অন্নপ্রাশন ছিল, তাই জেনারেল নলেজটা ভাল করে আর একবার দেখা হল না। চাকরিটা পেয়ে গেলে বড় ভাল হত। বাবা পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে আজ দেড় বছর পড়ে আছেন।

আমার এ পাশের ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি ব্যাকিং আছে?

আজ্ঞে না।

আমি এত চেষ্টা করলুম একটাও শালা ব্যাকিং জোগাড় করতে পারলুম না। ব্যাকিং ছাড়া চাকরি হয়!

কোম্পানির কর্মচারী হাঁকলেন, শেখর সামন্ত।

সেই নীলজামা-পরা কেশো ছেলেটি বলির পাঁঠার মতো দরজা ঠেলে ম্যানেজিং ডিরেক্টারের ঘরে ঢুকে গেলেন। এত ভয়ের কী আছে কে জানে। আমরা তো আর সত্যিই পাঁঠা নই যে কাবাব করে খেয়ে নেবে! এখানে না হয় অন্য কোথাও হবে।

সেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবার এক ফ্যাচাং বের করলেন, আচ্ছা কোন পাখি আকাশে ডিম পাড়ে?

আকাশে ডিম পাড়ে? লাইফে শুনিনি।

তা শুনবেন কেন? শুনলে যে আমার একটু সুবিধে হত। তিন-তিনটে বোন মাথায় মাথায়, বিয়ে দিতে হবে। আপনার বোন আছে?

না।

আপনার বাবাকে ধন্যবাদ। ভাই আছে?

না।

এমন মানুষের পায়ের ধুলো রোজ সকালে উঠে নিতে হয়। মা আছেন?

না।

তাই বলুন। আমাদের এ বেলা সাতটা পাত, ও বেলা সাতটা পাত। ছাত্র ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে লাইফ হেল হয়ে গেল। আপনার কে কে আছে?

আমি আর আমার পিতা।

আপনি কেন দাদা চাকরির খোঁজে এসেছেন?

এ পাশের ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ব্যাকিং আছে?

একটু আগেই যে বললুম, নেই।

ও, বলেছিলেন, যাক, তা হলে ফেয়ার কম্পিটিশন হবে।

নীলরতন হালদার, হাক পড়ল। শেষমাথা থেকে বেঁটে, গাঁটাগোট্টা এক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। জিভ দিয়ে টুকটুক করে ওপর আর নীচের ঠোঁট চেটে নিলেন। নীলজামা-পরা ভদ্রলোক একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। আমাদের দিকে আর ঘেঁষলেন না। সোজা চলে গেলেন সিঁড়ির দিকে। এদিকে এলে দু-চার কথা জিজ্ঞেস করা যেত। যাক গে আমার অত দুশ্চিন্তা নেই। হলে হবে, না হলে হবে না।

হোমা পাখি! যিনি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি এমন আচমকা চিৎকার করে উঠলেন।

কী হোমা পাখি?

আরে মশাই যে-পাখি আকাশে ডিম পাড়ে। কিছুতেই মনে পড়ছিল না। তখন থেকে মনে মনে অ এ অজগর, আ এ আম করতে করতে হ-এ এসে হদিশ মিলল। হাতি হাতি করতে করতে, হোম হোম সুইট হোম, হাতি, হোম, হোম, হোম, হাতি, পেয়ে গেলুম হোমা। স্মৃতি এমনই জিনিস, না চালালে চলে না।

এসব প্রশ্ন কি ওঁরা করবেন?

করলেই হল। ইন্টারভিউ মানে জামাই-ঠকানো প্রশ্ন। দাঁড়ান ওই কায়দায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীটা বের করে ফেলি। ভদ্রলোক চোখ বুজিয়ে ধ্যানস্থ হলেন।

গৌর মল্লিক। আবার পেয়াদার হাঁক। ভদ্রলোকের ধ্যান ভঙ্গ হল। তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন।

কী মশাই পেলেন?

না, যা হয় হবে, ভগবানই ভরসা।

ভদ্রলোক বাঘের খাঁচার দিকে গুটিগুটি এগিয়ে গেলেন।

পরপর সাতজন চলে গেলেন। আমার ডাক আর আসেই না। বোঝাই গেছে সব শেষে যাকে ডাকা হয় তার সম্ভাবনা খুবই কম। বেঞ্চ প্রায় কঁকা। আমরা আর মাত্র তিনজন, চুপসে বসে আছি। পারের ডাক কখন আসে!

যিনি হাঁকডাক করছিলেন, তিনি জানালেন, এখন লাঞ্চের সময়। আবার এক ঘণ্টা পরে বুলফাইট শুরু হবে। ইচ্ছে করলে আমরাও ঘুরে আসতে পারি। যো হুকুম জাঁহাপনা।

বেপাড়ার অফিস। অফিস আর কারখানা একসঙ্গে। বেশ নামী প্রতিষ্ঠান। ওষুধ, সাবান, পেস্ট নানারকম জিনিস তৈরি হয়। কারখানা পেছন দিকে। বিশাল একটা চিমনি আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেছে। চারপাশের বাতাসে রকম রকম গন্ধ ভাসছে। আশেপাশে তেমন দোকানপাট নেই। বসতবাড়িই বেশি। উচ্চমধ্যবিত্তের পাড়া। রাস্তায় বেরিয়ে এলে মনেই হবে না চাকরি করতে এসেছি। মনে হবে পাড়া বেড়াতে এসেছি। দোতলা তিনতলার বারান্দায় মেয়েরা দুপুরের মতো গা এলিয়ে দিয়ে গল্প করছেন। দুপুরের গান বাজছে রেডিয়োতে। এ পাড়ার ডাকসাইটে পুরুষরা এখন এসপ্ল্যানেডে, ড্যাবহাউসিতে, বড়বাজারে। এখানে মেয়েদের আধিপত্য চলেছে। বারান্দায় বারান্দায় কথা ছোঁড়াছুড়ি চলছে। কোনও কোনও বারান্দায় শাড়ির বদলে চুল ঝুলছে। বৃদ্ধরা পুরুষের দলে পড়েন না। মানুষ বৃদ্ধ হইলেই বিড়াল হইয়া যান। এ পাড়ার বৃদ্ধদের সম্বল দেখছি তিনটি। একটি ইজিচেয়ার, একখানি খবরের কাগজ, আর হয় একটি পুতুল-পুতুল নাতি না হয় নাতনি। বাইরের ঘরেই তাদের আস্তানা।

মোড়ের মাথায় একটি ঘুমঘুম মিষ্টির দোকান। নীল কাপড় ঢাকা শো-কেসের আড়ালে সেই থোড়বড়িখাড়া মিষ্টি। চায়ের দোকান চোখেই পড়ল না। পড়লে এক কাপ চা খাওয়া যেত। ট্যাকে তেমন পয়সার জোর নেই যে গোটাকতক রসগোল্লা চালিয়ে দোব। হাঁটতে হাঁটতে একটা নির্জন পার্কে এসে পৌঁছেলুম। ভবঘুরে চেহারার দু-একজন চেত্তা খেয়ে এখানে-ওখানে পড়ে আছেন। বেশ মজা, কোনও কাজকর্ম নেই। আকাঙ্ক্ষা নেই। যা হল, হল। যা হল না, হল না। টকটকে গেরুয়া পরে এক সন্ন্যাসী চলেছেন রাজার মতো। মাথায় মহারাজদের মতো করে বাঁধা গেরুয়া। পাগড়ি। দশাসই চেহারা, খাড়া নাক, টানা চোখ, গৌর বর্ণ। রাস্তা কাপিয়ে হেঁটে চলেছেন। পোশাকের ধরন দেখে মনে হচ্ছে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে, মৃদু হেসে ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন।

কী দেখছ?

আপনাকে।

প্রণাম করার জন্যে নিচু হতেই হাত ধরে সোজা করে দিলেন, আমি কারুর প্রণাম গ্রহণ করি না।

নে মহারাজ?

অনেক দেরি আছে রে ভাই। আগে বিশুদ্ধির শেষ ধাপে পৌঁছেই তারপর প্রণাম। তুমি কে?

আমি, আমি এখানে ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। শুরু হতে দেরি আছে দেখে একটু ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছি।

অমন অবাক হয়ে কী দেখছিলে?

আমার ভীষণ সন্ন্যাসী হতে ইচ্ছে করে। হিমালয়ের কোনও এক গুহায় নির্জনে একা একা।

হিমালয়ে গেছ?

আজ্ঞে না, হরিদ্বারে গেছি, আর একটু এগোতে পারলেই হিমালয়।

দেহে না মনে?

প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলুম না!

মন না রাঙায়ে কাপড় রাঙালে যোগী, গানটা শুনেছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমি এখন কোথায় ঘুরছি?

এইখানে।

কেন ঘুরছি? কর্ম, কর্ম! ধ্যানের স্বাধীনতা কোথায়! যতদিন শ্বাসপ্রশ্বাস ততদিন কর্ম। মনে বৈরাগ্যের বাতিটি জ্বালিয়ে রাখো, হিমালয়কে কলকাতায় নামিয়ে আনো। সাধুসঙ্গ করো?

তেমনভাবে নয়।

শাস্ত্রটাস্ত্র কিছু পড়ো?

মাঝেমধ্যে।

তা হলে শোনো, দুর্লভং এয়মেবৈত দ্দৈবানুগ্রহ হেতুকম। মনুষ্যত্বং মু্মূক্ষুত্বং মহাপুরুষ সংশ্রয় ॥ কিছু বুঝলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। মনুষ্যত্ব, মুমূক্ষুত্ব ও মহাপুরুষের আশ্রয় প্রাপ্তি এই তিনটেই সংসারে দুর্লভ। ঈশ্বরের দয়া ছাড়া হয় না।

বাঃ, খুব সুন্দর। যে কাজে এসেছ জয়ী হও। জীবন, সন্ন্যাস, কোনও কিছু সম্পর্কেই রোজি আইডিয়া রেখো না। পোড়াতে জানো?

একটু বুঝিয়ে বলুন।

রসায়নে একটা শব্দ আছে, দহন, কম্বাসন। ধিকিধিকি একটা আগুন জ্বালাও ভেতরে, বাইরে নয়, ভেতরে হোম। একদিন আশ্রমে এসো, তোমাকে একটু বাজিয়ে দেখব।

এইবার একবার প্রণাম করি।

না, প্রণাম নেবার অধিকার আমার জন্মায়নি। যদি কোনওদিন আসো, সন্ন্যাসাশ্রমে আমার নামটা মনে রাখো ধীরানন্দ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

মহারাজ পথের বাঁকে হারিয়ে গেলেন। মনে বেশ একটা বল এসে গেল। ইন্টারভিউ! কীসের ইন্টারভিউ! আমার কে আছে যে চাকরির পরোয়া করব! ইন্টারভিউ না দিলেই বা কী হয়! না, দোব, একবার পরীক্ষা করে নোব ‘আপ সাচ্চা তো জগৎ সাচ্চা’ কত সত্য। সৎ, যাকে বলে মজ্জায় মজ্জায় সৎ, সাহসী। হাসি পাচ্ছে, নারকেলের ছোট্ট খোলে সমুদ্রের আলোড়ন। কী কী আছে আমার, কী কী নেই? যেতে যেতে হিসেব করি। হিংসে আছে? হয়তো আছে। ভাইবোন থাকলে বোঝা যেত। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে? হয়তো আছে। ক্ষমতা নেই তাই ‘দ্রাক্ষা ফল টক’ বলে পালিয়ে আসি। ভোগের ইচ্ছে? কে না ভোগ করতে চায়? ভোগ না হলে ত্যাগের গর্ব থাকে! গর্ব? হয়তো আছে! নিজেকে বিশ্লেষণ করা কি অতই সহজ।

পলাশ চট্টোপাধ্যায়। নকিব ফুকারে।

যাক, দ্বিতীয়ার্ধে প্রথমেই আমার নাম ডাকা হল। বুক সামান্য কাপল। স্বামী ধীরানন্দের মতো ধীর পায়ে আধাকাঁচের দরজা ঠেলে ম্যানেজিং ডিরেক্টারের ঘরে ঢুকে পড়লুম। অর্ধচন্দ্রাকার টেবিলে চারজন বসে আছেন দরজার দিকে মুখ করে অর্ধচন্দ্র দেবার জন্যে। ঘরটি বেশ মনোরম। সব অনুষঙ্গই আছে। কার্পেট। ঝকঝকে ফার্নিচার। পেলমেট থেকে ঝোলা ভারী পরদা। ফুলও আছে। দুর্বল বুকে চেপে বসার মতো আবহাওয়া। ঘর বলছে, দাস হবি আয়, দাস হবি আয়। মাঝের আসনে সৌম্য চেহারার এক বৃদ্ধ। মাঝখানে সিঁথি। সোনার ফ্রেমের চশমা। দুগ্ধশুভ্র ধুতি পাঞ্জাবি। কবজিতে সোনার ঘড়ি। সেই সুটেড বুটেড ভদ্রলোকও বসে আছেন। মুখ অসম্ভব গম্ভীর। মনে হয়। বেশ ভয় পেয়েছেন। হয়তো আমাকে দেখে। ছাগলের যেমন ভয় থাকে, বাঘেরও তো সেইরকম ভয় থাকতে পারে। টেবিলের এদিক আর ওদিক। ওদিকের ভয়ে এদিক তটস্থ। কারণ ওঁরা দেবেন। ওঁরা না দিলে এদিক পাবে না। কিন্তু এদিক যদি কিছুই না চায়। ছাগল যদি বাঘ হয়ে যায়। বাঘে বাঘে লড়াই। দেখা যাক কী হয়।

ইয়োর নেম প্লিজ? সুটেড-এর প্রশ্ন।

তা প্রথম রাতেই বেড়াল কাটা যাক। দু’জনেই বাঙালি, তা হলে কেন এই ইংরিজিতে কেরানি। আমার পালটা প্রশ্ন, ইয়োর নেম প্লিজ?

চারজন ভদ্রলোকের মধ্যে তিনজনের মুখ যেন কেমন হয়ে গেল। সামনে ঈষৎ ঝুঁকে বসে থাকা বৃদ্ধ ভদ্রলোকের মুখেই কেবল একটু হাসি খেলে গেল। উপভোগের হাসি। টেবিলের কোণে আঙুলের ট্যাপ ট্যাপ শব্দ করলেন।

হরিদাস ব্যানার্জি। ভদ্রলোক কোনওরকমে বললেন।

থ্যাঙ্ক ইউ মি. ব্যানার্জি, মে আই টেক মাই সিট?

ইয়েস।

নাও, লেট আস গেট আওয়ারসেলভস ইন্ট্রোডিউসড। আই অ্যাম পলাশ চ্যাটার্জি, ইয়োর নেম প্লিজ, দি জেন্টলম্যান সিটিং বাই ইয়োর সাইড, চিউইং বিটল লিফ।

থলথলে কালো মোটা ভদ্রলোক থতমত খেয়ে গেলেন, আমার নাম, মাই নেম?

ইয়েস ইয়োর নেম?

মি? মাই নেম ইজ রমেশ সেন।

হোয়াট ইউ আর প্লিজ?

হোয়াট?

ইয়েস, হোয়াট ইউ আর প্লিজ?

আই অ্যাম এ জেন্টলম্যান।

এইবার আমার হাসার পালা। একটু বিলিতি কায়দায় ওয়ারেন হেস্টিংসের মতো হাসি। তাড়িয়ে তো দেবে নিশ্চয়ই। পাগল ছাড়া এরকম বিদঘুঁটে সাহস কার হবে, ইয়েস, ইও আর এ জেন্টলম্যান, বাট, আই আসকড অ্যাবাউট ইয়োর প্রফেশন, ইয়োর পজিশন ইন দিস কোম্পানি। আমরা সবাই যখন বাঙালি তখন বাংলা বলতে আপত্তি কীসের? দেশ তো অনেকদিন হল স্বাধীন হয়েছে। আপনারা করবেটের মাই ইন্ডিয়া’ পড়েছেন?

সেই সুটেড ভদ্রলোক বললেন, হি ইজ কোয়াইট হোসটাইল, প্রবেবলি ইনসেন, উই ক্যান টার্ন হিম আউট।

ইয়েস ইউ ক্যান, কিন্তু তার আগে করবেট সাহেবের মন্তব্যটা শুনে নিন, তা হলে আর সায়েব হতে ইচ্ছে করবে না, মাইকেলের মতো বাঙালি হয়ে যাবেন। করবেট লিখছেন, ভারতীয়দের ইংরেজি শুনে সায়েবরা ভয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে পালালেন। ভাবলেন, আর বেশিদিন থাকলে কুইনস ইংলিশের বারোটা বেজে যাবে। কুইট ইন্ডিয়া টু সেভ আওয়ার ল্যাঙ্গোয়েজ। আচ্ছা, আমি তা হলে আসি, নমস্কার।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক হাসিহাসি মুখে তাকালেন, বোসো বোসো৷ তোমাকে আমি তুমি বলতে পারি? পারি তো? আমার অনেক বয়স হয়েছে।

আজ্ঞে হ্যাঁ, তুমি বলতে পারেন।

ইংরিজির ওপর তোমার এত ছেলেমানুষি রাগ কেন?

কই, না তো। ইংরিজির ওপর রাগ নয়, রাগ ইংরেজিয়ানার ওপর।

বাঃ, ছোকরা ভাল বলেছে, তোমরা শুনলে?

শুনেছি, ওর অ্যাটিচিউড বড় ইনসালটিং।

এবার আমার প্রতিবাদের পালা, বাংলায়, সর্বনামে একটা চন্দ্রবিন্দু যোগ না করলে অভদ্রতা হয়। আমি তো এখনও চাকরিতে বহাল হইনি, এখনও অপরিচিত, খাস ইংরেজ হলে সেই শব্দই ব্যবহার করতেন, যাতে ‘ওঁর’ বোঝায়।

তুমি আমাদের চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট।

বয়সে ছোট হলেই সম্মানে ছোট হয়ে যায় না, অতএব তুমি নয় আপনি।

সুটেড ভদ্রলোক বললেন, এই ভেরি রেসপেক্টেবল পার্সনটিকে আমি শূন্য দিলুম।

বাকি দু’জন বললেন, আমরাও শূন্য দিলুম।

সৌম্য বৃদ্ধ বললেন, কীসের ভিত্তিতে দিলে? কোনও প্রশ্নই তো ওকে করা হল না।

প্রশ্নের প্রয়োজন নেই, ওই এঁড়ে স্বভাবের ছেলে কোথাও চাকরি করতে পারবে না। হি ইজ অ্যাবসোলিউটলি এ মিসফিট। এ রেবেলিয়াস স্পিরিট।

সৌম্য বৃদ্ধ বললেন, তা হলে ওকে আমি পুরো নম্বর দিলুম। মিনমিনে বাঙালি আমি চাই না।

সুটেড বললেন, হি ইজ ইনসেন, আনকালচার্ড।

আমি পাগলদের ভীষণ ভালবাসি, নিজে পাগল তো, আর কালচার? ঈশ্বর ওকে বাঁচিয়েছেন, তোমাদের কালচার ভাগ্যিস রপ্ত করে বসেনি! তা হলে এঁড়ের সঙ্গে ইংরিজি মিশিয়ে কেলেঙ্কারি করে বসে থাকত। তোমাদের কালচার হল সেরিকালচার। চকচকে রেশমের গুটি, ভেতরে কিলবিল পোকা। গরম জলে সেদ্ধ না হলে সিল্ক বেরোবে না।

হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক বললেন, বেশ, এই যদি আপনার সিদ্ধান্ত হয়, তা হলে আমাদের আর অপমান করবেন না। আপনিই বাজিয়ে নিন।

হ্যাঁ, আমিই একটু বাজাই, তবে তোমাদের অফিসের কেরানিগিরির জন্যে নয়, আমার ল্যাবরেটরির জন্যে। ছেলেটি যখন সায়েন্স গ্রাজুয়েট তখন একটু তালিম দিলেই কেমিস্ট হতে পারবে। প্রদ্যোতের হাতে ফেলে দিলেই মানুষ করে দেবে। তোমার অ্যানালিসিসের হাতটি কেমন বাবা?

আজ্ঞে, খুব একটা খারাপ নয়।

শোনো, পিপেট আর ব্যুরেট হল অ্যানালিস্টের দুই সহধর্মিণী, ওই দুটিকে যে কন্ট্রোল করতে পারে তার আর মার নেই, হ্যাঁ তার সঙ্গে চোখও থাকা চাই, সদা জাগ্রত দুটি আঁখি। এই অ্যাপ্লিকেশনটা কি তোমার হাতে লেখা?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বাঃ, ভারী পরিচ্ছন্ন হাতের লেখা হে তোমার। দু’পাশে সমান মার্জিন, সমান্তরাল অক্ষরের সারি। ওহে তোমরা দেখো, ছেলেটি কত অরগ্যানাইজড তার প্রমাণ এই দরখাস্ত। তোমরা অমন অভিমানী স্ত্রীলোকের মতো মুখ গোমড়া করে বসে আছ কেন?

আপনার ব্যাপার আপনি বুঝুন।

তা না হয় বুঝলুম, পরে আবার শত্রুতা করবে না তো? আমার সঙ্গে নয়। আমাকে তোমরা পারবে না। এর সঙ্গে?

সেই স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোক বললেন, শত্রুতা করব কেন?

কেনর কি কোনও জবাব আছে হে। আমরা যে বাঙালি। আচ্ছা, তুমি এখন এসো। তোমার পরিচয় আমার এই ফাঁইলে আছে, সেইটাই যথেষ্ট। হরিশঙ্কর কেমন আছে?

চমকে উঠলুম। মরেছে, ইনিই বোধহয় সেই পিতৃবন্ধু। আজ্ঞে, ভাল আছেন।

বড় ভাল ছেলে, বড় ভাল ছেলে। তোমার রক্তে হরিশঙ্কর আছে। ওর কেমিস্ট্রি কেমন চলছে?

খুব জোর চলছে।

বড় ভাল ছেলে, বড় ভাল ছেলে। বাপকো বেটা, সিপাহি কো ঘোড়া, কুছ নেহি হায় তো হোড়া থোড়া।

বিদায়ের সময় সায়েবা বলেন, গুডবাই, সুটেড ভদ্রলোক ছোট্ট একটি চাট ছুড়লেন, এ আমাদের আর এক দাদাঠাকুর। ভেঁপো দি গ্রেট।

সাংঘাতিক কিছু একটা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল, মেজাজ থিতিয়ে গেছে। এইটুকুই বলতে পারলুম, আশীর্বাদ করুন তাই যেন হতে পারি।

অফিসের বাইরে রাস্তায় পা রেখে মনে হল, বুদ্ধিসুদ্ধি এখনও তেমন পরিপক্ক হয়নি। অকারণে বাহাদুরি দেখাবার লোভ স্বভাবে প্রবল। কোনও প্রয়োজন ছিল না ছেলেমানুষের মতো পাকাঁপাকা কথা বলার। চাকরিটা যদি হয় নিজের কৃতিত্বে হবে না, হবে পিতার পরিচয়ে।

শরীরকে এবার একটু কষ্ট দেওয়া যাক। দক্ষিণ থেকে উত্তরে হেঁটে হেঁটে যত দূর যাওয়া যায় যাওয়া যাক। যখন আর পারব না তখন একটা কিছুতে উঠে পড়ব। বেলা বেশ পড়ে আসছে। লিন্ডসে স্ট্রিটের কাছে ট্রাফিক সিগন্যালে একটা গাড়ি থেমেছিল, কাছাকাছি আসার আগেই, সবুজ পেয়ে কঁকি মেরে এগিয়ে গেল। মনে হল প্রতাপ রায় চালাচ্ছেন। পেছনে বসে আছেন দু’জন মহিলা একজন পুরুষ। ঠিকই দেখেছি। মেসোমশাই হবু জামাইকে নিয়ে মার্কেটিংয়ে বেরিয়েছিলেন।

ধুঁকতে ধুঁকতে পাড়ায় ঢুলুম। শহর পড়ে আছে বহুদূরে। কালীবাড়িতে আরতির কাসর ঘন্টা বাজছে। শীতলাতলায় মায়ার পিসি ঠুংঠুং ঘণ্টা নাড়ছে। মায়ার সঙ্গে বহুদিন দেখা হয়নি। কোথাও একটা কিছু হয়েছে। লোক চলেছে নেচে নেচে। কে বললে, দীনু এসেছে।

দীনু আসবে কী করে? দীনু তো আর আসবে না। দীনুর শরীর এসেছে। ধবধবে সাদা একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের দরজা খোলা। বরফের চাঙড়ার ওপর সাদা চাদর ঢাকা মৃতদেহ। ফিনফিনে নীল কুয়াশায় মৃত্যুর প্রেয়সী-আলিঙ্গন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *