1 of 2

২৬. তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি

তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি চলছে জলপাইগুড়িতে। আকাশ জুডে মেঘ। রাস্তাস একটাও রিকশা নেই। মেয়েরা। কেউ আজ হোস্টেল থেকে বেরিয়ে কলেজে যাওয়ার নাম করছে না। দীপার কিছু ভাল লাগছিল না। জানালায বসে সে শূনা চোখে রাস্তা, এক তল{ বাড়িগুলো ভিজতে দেখছিল। আর এক মাস বাদে ফাইনাল পরীক্ষা। সব কটা পেপারেব নোটস নেওয়া শেষ। শুধু পড়া আর লেখার বাইরে অন্য কিছুতে সে মন দেবার আগ্রহ পায় না। আজকাল। তার বিরুদ্ধে এতদিনের যে অভিযোগ তা এখন একদম মিইয়ে গিয়েছে; দীপা আর ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারে না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করে না, আদ্ভুত গান্তীর্য ওকে সব সময় ঘিরে থাকে। ওর এই পরিবুর্তন ছেলেরা বুঝতে পারে না, মেয়েরা জল্পনা করে। নতুন কমমেট পর্যন্ত কথা বল,র বেশী চেষ্টা করে না। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলতে যে চায় না। তার সঙ্গে আড্ডা মারতে কে চায়।

টিপুস টিপুস বৃষ্টি পড়তে পড়তে একসময় থমকালো। মেঘ নেমে এসেছে নিচে রাস্তায় কয়েকটা মানুষ। দিনদুপুরেই সন্ধ্যে হামা দিচ্ছে। এই সময় দাবোয়ান এসে খবর দিলে, দীপা দিদি, আপনার গেস্ট।

দীপা মুখ ফেরালো। এই কয়মাসে কোন গেস্ট তার কাছে আস্সানি। এমন কি অমরনাথও নিতান্ত বাধা না হলে আসেন না। প্রতুলবাবুর মৃত্যুর দিন সাতেক বাদে, সে যখন আবার হোস্টেলে ফিরে আসতে বাধা হয়েছিল। তখন একদিন হরদেব ঘোষাল এসেছিলেন। কলেজ থেকে ফিরে দীপা শুয়েছিল খাটে। খবর পেয়ে নিচে নেমে এসেছিল খোলা চুলে আঁচল গলায় জডিাযে। হরদেব বসেছিলেন গেস্টরুমে। তাকে দেখামাত্র বলেছিলেন, এসো মা, তোমাদের বাগানের বাড়িতে গিয়ে শুনলাম তুমি হোস্টেলে ফিরে এসেছ। দরকারটা খুবই জরুরী। শোক তো কম না; আর কবি জানে। শোক তাও দেখতে হবে। শহরের কোন মানুষ নেই যিনি ওঁকে চিনতেন না। তাঁর কাজ বলে কথা।

দীপা স্থির চোখে তাকাল। কোন কথা বলল না। হরদেব সেটা লক্ষ। করে জিভে প্লেট চাটলেন, না, মানে, তুমি তো ও-বাড়ির বউ। অস্বীকার যতই কর আইন মানবে না। যতক্ষণ ডিভোর্স না হচ্ছে। আমি অবশ্য জানি না। স্বামী মারা যাওয়ার পর স্বামীবা সংসারেব সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করতে আদালতে গিয়ে ডিভোর্স চাইতে হয় কি না। পাঁচজনেও কথা শোনাতে ছাড়বে না।

দীপা এবারও জবাব দিল না। হরদেব অস্বস্তিতে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বলেই ফেললেন, শোন মা, তুমি ও-বাড়ির বউ; তোমার শ্বশুরের কাজের সময় তোমার গিয়ে দাঁড়ানো উচিত।

উচিত? আজ যাঁর কাজের ব্যাপারে আমাকে বলতে এসেছেন তিনি কিন্তু তাঁর ছেলের কাজের সময় আমাদের কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করেননি।

ও। আসলে তখন তো প্ৰথম প্ৰথম, রক্তও গরম ছিল। আজ আমাকে আনা পই পাই করে বলে দিয়েছে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

আমার রক্ত এখন ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। আপনাকে কে বলল?

মানে? হরদেব থতমত।

শুনুন। ওই মানুষটিকে আমি কোনদিন শ্রদ্ধা করতে পারব না। তাই তাঁর শ্রাদ্ধের সময় আমি অশ্রদ্ধা নিয়ে উপস্থিত থাকতে চাই না। তাছাড়া এইসব ব্যাপার নিয়ে কেউ আমার কাছে আসুক তা আমি একদম চাই না। দীপা ফেরার জন্যে পা বাড়াল।

হরদেব উঠে দাঁড়ালেন, শোন।

দীপা দাঁড়াল। মুখ ফেরাল, চোখে জিজ্ঞাসা এবং কিছুটা বিরক্তি।

প্রতুলের সম্পত্তির দাবি কি তুমি করছ না?

না।

কিন্তু সেটা কাগজে কলমে হলে ভাল হয় না?

না। দীপা মাথা নাড়ল, আমি যদি লিখে দিই ওই সম্পত্তি আমি চাই না তার মানে দাঁড়াবে ওই সম্পত্তির মালিকানা আমার ছিল। আমি সেটুকু ভাবতেও চাই না। আমি লিখে দেব না। কিন্তু কোনদিন দাবি করতেও আসবো না।

তাহলে কেউ তো বিক্রী করতে পারবে না। মানে যেই মালিকানা নিক আইনসম্মত করতে তোমার লেখা কাগজ তো দরকার হবে।

আমি অপরাগ।

কিন্তু ধরো, পরে যদি তোমার মতের পরিবর্তন হয়?

হবার কোন সম্ভবনাই নেই।

হরদেব হাসলেন, উত্তম। তোমার অহঙ্কার দেখে বেশ ভাল লাগছে। কিন্তু প্ৰতুল জীবিত থাকতে তোমার বাবা যে টাকা তার কাছ থেকে নিয়ে ব্যাঙ্কে রেখেছিলেন, যাব সুদের টাকায় তোমার এই পড়াশুনা চলছে সে ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ জানতে ইচ্ছে করছে।

টাকাটা বাবা নিয়েছিলেন, আমি নিইনি। আমি জানলাম। বাবা আমার পড়ার খরচ দিচ্ছেন। তা তিনি চুরি করে না ডাকাতি করে দিচ্ছেন তা আমার জানার দরকার আছে বলে মনে করি না। এই ঋণ আমি শোধ করবো এমন অহঙ্কার আমার নেই। তবে যে টাকা আমার পড়ার জন্যে উনি দিচ্ছেন তা ভবিষ্যতে ফিরিয়ে দের এমন আস্থা নিজের ওপর আছে।

ব্যানার্জী বাড়ির বউ হয়ে তুমি চাকরি করবে? আঁতকে উঠলো হরদেব।

প্ৰথম কথা আমি আর কারো বাড়ির বউ নই। আর শিক্ষা যদি চাকরির উপযুক্ত হয় তাহলে সেই চাকরি করতে কোন লজ্জা নেই। বাড়ির বউরা চাকরি করলে দোষ হবে কেন?

পাঁচটা বাইরের লোকের সঙ্গে কাজ করতে হবে না? তাদের দৃষ্টিতে কু থাকতে পারে!

চমৎকার। বাড়ির ছেলে যদি সারাজীবন লাম্পট্য করে তাতে কোন দোষ নেই, বাড়ির মান যায় না, না? তার চোখে যদি নিজের বউমা পর্যন্ত একটা ভোগের সামগ্ৰী হয় তাতে কোন দোষ হয় না, না? আপনাদের এই প্ৰাগৈতিহাসিক কথাবার্তা শুনলে আমার বমি পায়। আপনি আসুন। সে আর দাঁড়ায়নি। বড় বড় পা ফেলে ওপরে উঠে এসেছিল।

হরদেব তারপরে আর আসেননি। কোন গেস্ট এর পরে দেখা করতে আসেনি তার সুঙ্গে। আজ এই ভিজে মেঘের দুপুরে কে আসতে পারে! অমরনাথ নিশ্চয়ই এই আরহাওয়ায় এতদূর ঠেঙ্গিয়ে আসবেন না। দীপা ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বড়দির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার। বড়দি বললেন, দুটি ছেলে এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। কি ব্যাপার?

দীপা বুঝতে পারছিল না। বড়দি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কিছু জিজ্ঞাসা করিনি, যদি প্রয়োজন মনে কর। তবেই কথা বলতে পার।

মাথা নেড়ে নিচে এল দীপা। গেস্টরুমে ঢুকে সে তাজ্জব হয়ে গেল।

ওরা বসেছিল! দেখামাত্র প্রায় লাফিয়ে উঠল। দুজনের মুখেই হাসি।

দীপা জিজ্ঞাসা করল, তোরা!

বিশু বলল, তোর সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

খোকন হাসল, লেডিস হোস্টেলে কখনও আসিনি তো, কেমন লজ্জা লজা করছিল।

দীপা ওর বলার ধরনে হেসে ফেলল, কেন?

বাঃ, এত মেয়ে একসঙ্গে কখনও দেখেছি নাকি? খোকন জবাব দিল।

বিশু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে প্রশ্ন করল, এসে অবধি কটা মেয়ে দেখেছিস?

খোকন মাথা নাড়ল, তা সত্যি। মেয়েরা সব কোথায় বে। কাউকে চোখে পড়ছে না। শুধু বিশাল এক ভদ্রমহিলা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, দীপারলির সঙ্গে জরুবাঁ দরকার আছে? আমি কোনমতে হ্যাঁ বলতেই চলে গেলেন।

দীপা বলল, বড়দি। বস তোরা।

ওরা মুখোমুখি বসলে বিশু পকেট থেকে সিগাবেটের প্যাকেট বের করল, এখানে ধরানো যাবে? একটাও অ্যাসট্রে দেখতে পাচ্ছি না।

না ধরানোই ভাল।

সেকি রে? এটা কলেজ না স্কুল হোস্টেল?

মেয়েদের তো কখনই এদেশে অ্যাডাল্ট ভাবা হয় না। এলি কেন?

খোকন জবাব দিল,  তোকে দেখতে।

ভ্যাটি! নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। সেকি রে, তুই দাডিগোঁফ কামিয়েছিস?

খোকন আবার লাজুক লাজুক হাসি হাসল, আমরা চলে যাচ্ছি।

কোথায়?

মিলিটারিতে।

দীপা অবাক হয়ে গেল, কি বাজে কথা বলছিস?

এবার বিশু বলল, না রে কথাটা সত্যি। আমাদের পড়াশুনা হবে না। বাবার পয়সা নষ্ট করে কোন লাভ নেই। পরের ভাইবোনদের জন্যে ওটা খরচ হোক। এমনিতে কোথাও চাকরি পাবো না। স্কুল ফাইনাল পাশ বলে হয়তো অনেক কষ্টে শ্যামলদার মত একটা চাকরি জুটতে পারে চা-বাগানে কিন্তু তার জন্যে হ্যাঁ করে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। বাড়িতে দিনরাত খোঁচাচ্ছে একটা কিছু যেন করি। তাই দুজনে ঠিক করেছিলাম মিলিটারিতে জয়েন করব। তিনচার দিন এসে পরীক্ষাটরীক্ষা দিয়ে পাশ করে অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার পেয়ে গেছি। আজ সন্ধেবেলার নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেসে রওনা হব। ভাবলাম, তোকে জানানো দরকার, করে দেখা হবে কে জানে, তাই চলে এলাম।

খোকন প্রশ্ন করল, আমরা না বলে চলে গেলে তুই দুঃখ পেতিস না?

দূর! আমি বিশ্বাসই করি না তোদের। মিলিটারিতে যাবি, বললেই হল? কথা বলতে বলতে দীপার নজরে পড়ল দরজার গোড়ায় দুটো পুরোনো স্যুটকেস রয়েছে। বিশু সেটা লক্ষ করে বলল, এবার বিশ্বাস হয়েছে। ওর মধ্যে সমস্ত কাগজপত্র আছে, সন্দেহ না গেলে দেখাতে পারি।

দীপা গালে হাত দিল। ওরা এখনও সেই অর্থে বড় হয়নি। বিশু যদিও কিছুটা ব্যক্তিত্ব পেয়েছে খোকন মোটেই নয়। ওর মুখে এখনও সারল্য লেগে আছে। মিলিটারিতে জয়েন করার বয়স হয়েছে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। পড়াশুনায় ভাল ছিল না, দু-এক বছরের বড় হতে পারে। কিন্তু তাই বলে কোন কিছু না ভেবে একেবারে মিলিটারিতে। দীপার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আংরাভাসা নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া, হাটে ঘুরে বেড়ানোর ছবিগুলো চট করে। মনের সামনে চলে এল। সে জিজ্ঞাসা করল, বাবা মা আপত্তি করেনি?

বিশু বলল, দিন রাত যারা বকর বকর করত। ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে খবরটা পেয়ে যদি একটু মন খারাপ অথবা কান্নাকাটি করে তাহলে তা নিয়ে মাথা ঘামিযে কি হবে। যাক, যে জন্যে এসেছি। আমাদের ট্রেন সন্ধ্যেবেলায়। তুই কি আজ কলেজে যাবি?

মাথা খারাপ? কলেজে। আজ রেইনি ডে।

এটা আবার বৃষ্টি নাকি! চা-বাগানে এর চেয়ে বেশী বৃষ্টি দেখিসনি? তুই হোস্টেল থেকে আমাদের সঙ্গে বাইরে বেরুতে পারবি?

কোথায় যাব?

এখানে ওখানে। আমরা তিনজন একসঙ্গে দুপুরে কোন হোটেলে খাব। বিশু বলল।

দারুণ। খোকন হাসল, তোর সঙ্গে কোনদিন হোটেলে গিয়ে বসিনি। সেটা আজ হত্যুে যাবে। তুই আমাদের ফেব্যাবওয়েল দিবি। দীপু, চল।

হঠাৎ দীপা তীব্র আকর্ষণ রোধ করল। এই দুটি ছেলের সঙ্গে সে জ্ঞান হবার পাব থেকে এক সঙ্গে বড় হয়েছে। অনেক ঝগড়াঝাঁটি, মান অভিমান, আনন্দের শবিক হয়েছে। একটু বড় হবার পর এদের সঙ্গে মেশার কারণে বাড়ির লোকের কাছে বকুনি খেতে হয়েছে। এরাই তার বিয়ের রাত্রে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময় শব্দ করে কেঁদে উঠেছিল। এখন এই যৌবনের প্রথম প্রহরেও এরা তার বন্ধু। আর এই বন্ধুত্বে কোন স্বাৰ্থ নেই। প্ৰেম-ভালোবাসা যা দুটি নারীপুরুষের মধ্যে এই বয়সে গড়ে ওঠে তা কখনও মাথায় আসেনি। জলপাইগুড়ির রাস্তায় ছেলেদের সঙ্গে সাদামাটা কথা বলার দায়ে তাকে অনেক অভিযোগের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। এখন কলেজে কোন ছেলের দৃষ্টি দেখলেই অস্বস্তি হয়। ছেলেরা এই বয়সে সহজ চোখে তাকাতে পারে না। অথচ দুজন একই রকম বয়ে গেছে। ওরা মিলিটারিতে চলে গেলে সে দুজন ভাল বন্ধুকে হারাবে। অথচ এতদিন সে এদের কোন খোঁজ খবর করেনি। চিঠি দেওয়ার কথা মনে আসেনি। অথচ চলে যাওয়ার মুহুর্তে ওরা তো মনে করে এসেছে। দীপা মাথা নাড়ল, চল, তাহলে। আমি বড়দিকে বলে আসি। তোদের কাছে টাকা পয়সা আছে?

একশো টাকা করে আছে? খোকন জানাল।

থাক। আমি দেখছি কি আনতে পারি। আজ আমি তোদের খাওয়াবো। দীপা উঠে পড়ল।

বড়দির মুখোমুখি হয়ে দীপা খুব সহজ গহ্বায় বললো, আমি একটু বেরুবো।

ভদ্রমহিলা শরৎচন্দ্র পড়ছিলেন। চোখ তুলে জানতে চাইলেন, কোথায়?

ওই যাদের দেখলেন। ওদের সঙ্গে। চা-বাগানে আমাদের বাড়ির গায়ে থাকে। ওরা আজ মিলিটারিতে চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে কিছু কেনাকাটা করতে চায়।

মিলিটারিতে! ওইটুকু ছেলে।! নিশ্চয়ই বদ। পড়াশুনায় ইতি দিয়ছে। কোন গতি নেই তাই। ঠিক আছে, যা ভাল বোঝা কব। কিছুদিন তো বেশ লক্ষ্মী মেয়ের মত ছিলে। যাও, কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে ভাই, বন্ধু বলার দরকার নেই। বড়দি বই-এর পাতায্য চোখ রেখে হঠাৎ মুখ তুলে দীপাকে ডাকলেন, শোন।

দীপা দাঁড়াল।

বড়দি জিজ্ঞাসা করলেন, বন্ধু বললে, কি ধরনের বন্ধু?

দীপা বড় চোখে তাকাল। তারপর বলল, আমরা কখনও ভাবিনি কে ছেলে কে মেয়ে।

বড়দি হতবাক। কথা না বলে ঘাড় নাড়তে পারলেন শুধু। দীপা বেরিয়ে এল।

বুদ্ধি করে রুমমেটের কাছ থেকে ছাতা চেয়ে এনেছিল দীপা। রাস্তায় বেরিয়ে বলল, যাচ্চলে, আবার বৃষ্টি আসছে। তোদের সঙ্গে ছাতা নেই, ভিজে যাবি।

বিশু বলল, ঘণ্টা দুয়েকোব মধ্যে বৃষ্টি নামবে না।

কি করে বুঝলি?

মেয়েদের চরিত্র আমি জানি।

বাপস। দীপা শব্দ করে হাসল। এবং তুখনই তার মনে পড়ল অনেক মাস পরে সে এভাবে হাসতে পারল। সে জিজ্ঞাসা করল, মিলিটারিতে গিয়ে তোরা কোথায় থাকবি?

জানি না। কোলকাতার ফোর্ট উইলিযামে দেখা করতে বলেছে।

তোরা দুজন একসঙ্গে থাকবি?

কি জানি! হয়তো না। কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে পাবি। ওই যখন ট্রেনিং হবে। তারপর আমি হয়তো আসামে আর ও পাঞ্জাবে।

দীপা নিশ্বাস ফেলল, তোদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে?

খোকন বলল, বাঃ, কেন হবে না। বছরে ছুটি পাবো তো। বাধা যদ্দিন চা-বাগানে চাকরি করবে তদ্দিন দেখা হবেই। আর তুই যদি অনেক পড়াশুনা করে মাস্টারনি হয়ে যাস আর তখন যদি আমাদের মত অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে কথা না বলিস।

খোকন কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই দীপা প্ৰায় চিৎকার করে উঠল, এক থাপ্পড় খাবি। বলেই চারপাশে তাকাল। ওরা এখন রূপ।শ্ৰী সিনেমাব সামনের রাস্তায়। ভাগ্যিস এখন পথে তেমন মানুষ নেই। নইলে এই নিয়ে আবার গল্প চালু হত।

বিশু বলল, তুই জলপাইগুড়ির রাস্তাঘাট চিনে গিয়েছিস, না রে?

কিছুটা। কয়েকদিন থাকলেই জানা যায়।

বৃষ্টি পড়া শুরু হল আচমকা। ওরা দৌড়ে থানার সামনে রুবি বোর্ডিং-এর বারান্দায় উঠে পড়ল। দীপা এল ধীরে সুন্থে। এসে জিজ্ঞাসা করল, ভিজেছিস তো?

ওরা অল্প ভিজেছিল। বিশু রুমালে চুল মুছে চিরুনি চালাল। এবার বৃষ্টি জোর পেয়েছে। দীপা বলল, মেঘেরা তাহলে মেঘেদের মত চলে।

খোকন এপােশ ওপাশে তাকিয়ে বলল, বৃষ্টি এখনই থামবে বলে মনে হয় না। খেয়ে. নিলে হয়। তোর খিদে পায়নি বিশু?

এখানে ভাত পাওয়া যায়? বিশু জিজ্ঞাসা করল।

উত্তরটা দীপারও জানা নেই। সে ভেতরে পা বাড়াল। বেশ কয়েকটা টেবিল চেয়ার অনেকটা রেস্টটুরেন্টের মত, একটা কাউন্টারও রয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন মানুষ নেই। একটা অদ্ভুত গন্ধ ভাসছে বাতাসে। অনেকটা রসুনের মত মনে হল দীপার। সে এপাশ ওপাশে তাকাচ্ছে এমন সময় একটি প্রৌঢ় লোক সামনে এসে দাঁড়াল, কিছু বলবেন দিদি?

আপনাদের এখানে ভাত পাওয়া যায়?

অবশ্যই। বোর্ডাররা তো এখানে এসে খান। কজন আছেন?

তিনজন।

কি খাবেন বলুন? ভাত, ডাল, এঁচোড়ের তরকারি, বেগুন ভাজা, ভেণ্ডি, রুই, কাতলা, চিতল মাছ এমন কি কই মাছ পর্যন্ত পারেন এখানে।

ভাত ডাল ভাজা তরকারি। আর চিতল মাছের কত দাম?

রিপিট না হলে আড়াই টাকা।

তাই দিন। তিন জায়গায়। দীপা দশ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল হোস্টেল থেকে।

খুব তৃপ্তি করে খেল ওরা দুজন। চিতল মাছের পেটি প্লেট ছাপিয়ে গিয়েছে। খোকন বলল, এরকম মাছ জীবনে বাড়িতে খাইনি রে।

দীপার খুব ভাল লাগছিল। ওরা ভাত এবং ভাজা আবার নিলে ওর মনে ভয় ঢুকল। যদি দশ টাকার বেশী খরচ হয়ে যায় তাহলে মুশকিলে পড়তে হবে কিন্তু বিল এল মাত্র সাড়ে আট টাকার।

বিশু বলল, দীপা, আজকের এই দুপুরের খাবার আমি চিবকাল মনে রাখব।

দীপা বলল, বাড়িয়ে বলিস না। তোরা যখন প্ৰথম মাইনে পাবি তখন আমার নাম করে। খেয়ে নিস। তাহলেই আমার ভাল লাগবে।

হঠাৎ বিশু বুকে পড়ল, দীপা, তোকে একটা কথা বলব?

বল। দীপার মনে হল বিশু খুব একটা স্বাভাবিক নয়।

আমরা তোর বন্ধু। আমাদের কথা শুনিবি?

বল না!

তুই আবার বিয়ে থাকবে সংসারী হবি। বুঝলি। তুই তো নিজেকে কখনও বিধবা বলে মনে করিসনি তাই চাকরি পেলে কাউকে বিয়ে করে ফেলিস।

না পেলে করব না বলছিস?

টাকা না থাকলে কেউ পাত্তা দেয় না, বুঝলি। খোকন বলল, আমরা যখন চাকরি করে। টাকা জমাবো। তখন সবাই আমাদের পাত্তা দেবে।

বৃষ্টি আবার বন্ধ হল। দীপা দাম মিটিয়ে দিচ্ছিল। বিশুর প্রবল আপত্তি, সে কিছুতেই রাজি নয়। হোস্টেলে তারা নিছক ঠাট্টা করেছিল। কিন্তু দীপা ওকে আমলাই দিচ্ছিল না। এখন কাউন্টারে ক্যাসিয়ার এসেছেন। দীপার হাত থেকে টাকা নিয়ে ভদ্রলোক বললেন তোমাকে খুব চেনা মনে হচ্ছে! কোন পাড়ায় থাকো?

দীপা গম্ভীর হয়ে গেল, কদমতলায়।

হ্যাঁ। এদিক দিয়েই তো তোমাকে রোজ কলেজে যেতে দেখি। কলেজে পড় তো? বাবার নাম কি, বাড়ির ঠিকানাটা বল তো!

কেন আপনার কি দরকার?

বলছি। এরা তোমার আত্মীয়!

হ্যাঁ।

জলপাইগুড়ির কোন মেয়ে আমাদের হোটেলে এসে খাওয়া-দাওয়া করে না। কোন চায়ের দোকানে একটা মেয়েকেও দেখবে না ছেলেদের সঙ্গে বসে চা খেতে। সবাই ভাবে বদনাম হয়ে যাবে, লোকে ছি ছি করবে। তুমি যেভাবে ওদের সঙ্গে এসে এখানে খাওয়া-দাওয়া করলে তাতে আমার ভাল লাগল। তোমার বাবার সঙ্গে একটু কথা বলব।

বদনাম করতে পারবেন বলে? ফেরত-পয়সা নিয়ে দীপা ঘুরে দাঁড়াল, ওরা রাস্তায় পা দিতেই খোকন বলল, যাঃ মৌরি নিলাম না। বলে সে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। রাস্তা ভিজে, মেঘেরা আরও ঘন, এমন সময় হাওয়া রইল। দীপা দেখল শোঁ শোঁ করে মেঘেদের নাকাল করছে ওপরের বাতাস। মুখ নামিয়ে বলল, বাঙালিরা চল্লিশ পেরিফে গেলেই কেমন খোঁকুড়ে হয়ে যায়। কারো ভালো দেখতে পারে না।

বিশু জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ?

ওই দেখলি না, আমার ঠিকুজি চাইছিল!

এই দাঁড়া। পেছন থেকে চিৎকার করল খোকন। সে হোটেল থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসছিল। বাবু পাড়ার মুখে এসে ধরে ফেলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল,  ওঃ, দারুণ ব্যাপার, দীপার একটা হিল্লে হয়ে গেল।

মানে? দীপার কপালে সঙ্গে সঙ্গে ভাঁজ জমল।

হোটেলের ওই লোকটা তোর ঠিকানা জানতে চাইছিল কেন জানিস দ্য ওর এক ভাইপো নাকি দিল্লীতে চাকরি করে। স্মার্ট, সংস্কারবিহীন অথচ ভদ্র বাঙালি মেয়ে না পেলে বিয়ে কুববে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। তোকে দেখে কাকার খুব পছন্দ হয়েছে। আমাকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল।

তুই কি বললি?

তুই বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করবি না।

বিশু শব্দ করে হেসে উঠল। খোকন বলল, আর কিছু মাথায় এল না যে।

দীপা বলল, তোর মাথাটা বড্ড ছোট। কোথায় যাবি বল? এই সময় একটা বিকসাওয়ালা নেতাজী পুলের দিক থেকে দ্রুতগতিতে আসতে আসতে থানার সামনে দাঁড়ানো একজনকে চেঁচিয়ে বলে গেল, ঘাট বন্ধ হো য়া।

দীপা বিশুকে জিজ্ঞাসা করল, ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে মানে? তোবা। আজ আসিসনি?

খোকন জবাব দিল, হ্যাঁ! কিন্তু খুব ভয়া করছিল। তিস্তা কত চওড়া হয়ে গিয়েছে, কি কালো কালো ঢেউ। দু-দুবার উল্টে যেতে যেতে বেঁচে গেছে নৌকো।

দীপা পা চালালো। রাস্তায্য এখন কিছু লোক। বৃষ্টি নেই বলেই যে যার কােজ সারিতে বেরিয়েছে। মিনিট আটোকোব মধ্যে তিস্তার পাড়ে পৌঁছে ওর চক্ষুস্থির। তিস্তা এখন সমুদ্রেব মত হয়ে গিয়েছে। শুধু জল আর জল। খেয়া পাবাপাব তো বন্ধ হয়েই গেছে, কাছাবিব ঘাট থেকে দোকানদারবা জিনিসপত্র সরাতে আরম্ভ করেছে। পুলিসেব লোক চোঙা নিয়ে ঘোষণা করছে যে কোন মুহূর্তে বন্যা আসতে পারে। সবাই যেন সতর্ক থাকে। একটা নদীর চেহারা এমন হিংস্র হতে পারে না দেখলে কল্পনা করতে পাবত না দীপা। সে বলল, ভাগ্যিস তোরা সকাল সকাল পার হয়ে এসেছিলি।

বিশু ততক্ষণ একটা বুড়োমতো লোকের সঙ্গে কথা বলতে চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, তাড়াতাড়ি পা চালা।

খোকন জানতে চাইল,  কেন?

জল বাড়লে ট্রেন বন্ধ হয়ে, যেতে পারে। মণ্ডলঘাটের ওদিকে অলরেডি লাইনের ওপর জল উঠে গেছে। খুব পড়ে যাব তাহলে।

কিন্তু এখন তো কোন ট্রেন নেই।

আমরা বাসে যাব। বাসে শিলিগুড়ি, ওখান থেকে নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস ধরব। ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো রিকশা ধরতেই বৃষ্টি নামল ইলশেগুঁড়ি। সামনের রিকশায় দীপা বসেছিল একা। হোস্টেল থেকে স্যুটকেস নিয়ে ওরা কদমতলার মোড় থেকে বাসে উঠবে। প্ৰায় সমবয়সী ওই দুটো ছেলের যে স্বাধীনতা এদেশে আছে তার সেটা নেই। রাস্তা খারাপ হবে এই আশঙ্কায় ওরা স্বচ্ছন্দে পথ বদল করে ফেলতে পারল আগাম। হয়তো তাতে নিশ্চিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মেয়েদের সেই স্বাধীনতা না থাকায় জেনেশুনে নিশ্চিত আত্মহত্যার দিকে এগোতে হয়। একা রিকশায় ত্রিপলঘেরা সিটে বসে হঠাৎ খুব বিষণ্ণ বোধ করছিল দীপা। ওরা চলে যাবে। মিলিটারিতে গিয়ে ওরা কি এমন সহজ থাকবে। বরেন বসুর লেখা রঙরুট পড়েছে সে।

হোস্টেল থেকে স্যুটকেস নিয়ে কদমতলার মোড়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখা গেল খবর এখানেও পৌঁছেছে। সন্ধেবেলার লোকাল ট্রেন ধরে শিলিগুড়িতে পৌঁছে যারা নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেসে উঠে কলকাতায় যাবে বলে ঠিক করেছিল তাদের কিছু কিছু চলে এসেছে এখনই বাস স্ট্যান্ডে। বৃষ্টি পড়ছিল। বিশু আর খোকন এর মধ্যে ভিজে একসা। ছাতি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দীপা। দুদুটো বাস একসঙ্গে শিলিগুড়িতে যাচ্ছে। সুযোগ পেয়ে ট্যাক্সিওয়ালারা দর হাঁকিছে। চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা যাচ্ছে না। প্ৰায় মারপিট করেই ড্রাইভারের কেবিনে ওরা দুটো জায়গা করে নিয়ে জািনলা দিয়ে মুখ বেবি করল। ওরা কি বলল দীপা শুনতে পাচ্ছিল না। কাদা বঁচিয়ে ও একটু এগিয়ে গেল।

খোকন চিৎকার করল, কখনও ভুলে যাবি না তো?

দীপা মাথা নাড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিশু ধমকে উঠল, অ্যাই, খবরদাব, এখন তুই কাঁদবি না।

হাসতে গিয়ে দীপা আবিষ্কাব করল ঝডেব মত সমস্ত শরীর কাঁপিযে কান্না উঠে আসছে গলায়। সে ঠোঁট কামড়ালো। সে ওদের দিকে তাকাতে পারছিল না। এবং তখনই বাসটা চলতে শুরু করল। ওরা কিছু চেঁচিয়ে বলল। কিন্তু দীপা মুখ তুলে তাকাল না। বাস যখন শিল্পসমিতি পাড়ার দিকে বাঁক নিয়েছে তখনও মুখ ঘোরালো না। কোনমতে নিজেকে সামলে ছাতি মাথায় সে হোস্টেলে ফিরতে লাগল। আর তখনই চোঁচামেচি শুক হল। রাস্তার সামান্য লোকজনও দৌড়ে পালাচ্ছে। দুপাশের বাড়িগুলোয্য ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। দীপা প্ৰথমে কারণটা বুঝতে পারছিল না। এই সময়। একজন চিৎকার করে উঠল, তাড়াতাড়ি বাড়ি যান, বন্যা আসছে।

শহরের মাঝখানে বন্যা। হঠাৎ নজরে পড়ল দুপাশের ড্রেন দুটো ঘোলা জলে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। এই জল তিস্তার। দীপা দৌড়াতে লাগল। পাহাড়ি পাড়ার মোড় থেকে ওদের হোস্টেলে আসতেই একদম ভিজে গেল সে। হোস্টেলের গেটের কাছে ড্রেন উপচে জল জেগেছে। পার হতে গিয়ে পায়ে নোংরা লাগল। দারোয়ান গেট বন্ধ করতে আসছিল। ওকে দেখে থমকে গিয়ে বলল, জলদি আইয়ে দিদি।

বাথরুম থেকে শুকনো কাপড় পরে চুল মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে দেখল জানলায় বেশ ভিড়। নীতা বলল, তোমার সাহস খুব, এই ওয়েদারে বেরিয়েছিলে?

দীপা জবাব না দিয়ে চুল আচড়ালো। যাদের ঘর রাস্তার দিকে নয়। তারা এখানে ভিড় করেছে। এখন বিকেল অথচ মনে হচ্ছে সন্ধে হয়ে গেছে। সে আলো জ্বালল। তারপর জানলার দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তার যেটুকু নজরে এল তাতেই তার চক্ষুস্থির। জলের স্রোত বইছে এখন। সে যদি পাঁচ মিনিট দেরি করত তাহলে ওই স্রোতের মধ্যে পড়তে হত তাকে। খুব কপালজোর তাই বিশুরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু পথে যদি তিস্তার জল চলে আসে? না, তিস্তা থেকে বাসটা দূরে সরে সরে যাবে। আর তখনই নীতা বলে উঠল, উঃ, কি দৃশ্য! যেন ভেনিসে আছি আমরা।

সন্ধে সাড়ে ছটায় জলপাইগুড়ি শহর নিম্প্রদীপ হল। পাওয়ার হাউসের ভেতর জল ঢুকে গিয়েছে। শহরের কোথাও আর বিদ্যুৎ নেই। খানিক আগে বৃষ্টির তেজ বেড়েছে। মুষলধারে শুরু হয়ে গিয়েছে এখন। জানলা বন্ধ করতে হয়েছে অনেকক্ষণ। মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে আশে পাশে। বড়দি এসে ঘরে ঘরে বলে গিয়েছেন নটার মধ্যে শুয়ে পড়তে। একতলার মেয়েদের দোতলায় তুলে দেওয়া হয়েছে। দীপাদের ঘরেও দুজন এসেছে। তারা মাটিতে বিছানা করে শোবে। রাত্রের খাবার ইতিমধ্যেই খাওয়া হয়ে গিয়েছে সবার। বড়দি বললেন, তিস্তার জল নাকি করলা দিয়ে ঢুকে শহরে আসছে। হাকিমপাড়া ইতিমধ্যে জলের তলায় কারণ তার দুদিকে দুটো নদী।

রাত বাড়ছে। সেই সঙ্গে চিৎকার। সমস্ত জলপাইগুড়ির মানুষ আর্তনাদ করছে যেন। যাদের বাড়ি একতলা তারা দোতলায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে জল ভেঙে। কেউ কেউ এই হোস্টেলের গেটে এসেছিল আশ্রয়ের জন্যে। কিন্তু গেট তালা বন্ধ থাকায় তারা ঢুকতে পারেনি। উৎসাহীরা খবর আনল জল ঢুকে গিয়েছে নিচের গেস্টকমে, একতলার ঘরগুলোতে। জল্পনা হচ্ছিল জল যদি আরো বাডে, যদি দোতলায় উঠে আসে তাহলে এই বৃষ্টিতেও ছাদে যেতে হবে। মানুষ যে প্রকৃতির কাছে কত অসহায় তাই নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল।

দীপা চুপচাপ বসেছিল চেয়ারে। খোকনরা কি ঠিক সময়ে শিলিগুড়িতে পৌঁছে যেতে পেরেছে। মাঝ রাস্তায় যদি ওদের বাস আটকে যায় আর সেই ফাঁকা জায়গায় যদি জল বাড়তে থাকে, দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল সে। নীতারা গল্প করছিল, কি হল? অ্যাই দীপা, কী হয়েছে?

দীপা কান্না থামাল। মাথা নেড়ে বলল, কিছু না।

নীতা এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, অদ্ভুত।

 

জল নামল পরদিন বিকেলে। কিন্তু শহরময় রেখে গেল পুরু পলিমাটি, মরা গকিবাছুর ছাগল, কিছু মৃত মানুষ আর অর্ধমৃত মানুষের ভিড়। পরদিন বিকেল থেকেই হোস্টেলে খাবারের টান। রাত্রে শুধু খিচুড়ি। বড়দি বলে দিলেন যে যার বাড়িতে চলে যাক। কিন্তু যাওয়ার পথটাই বন্ধ। শহর থেকে জল নামলেও ফেরিঘাট বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। ড়ুয়ার্সের দিকে ব্ৰিজ ভেঙেছে কয়েকটা। হোস্টেলের ভাগ মেয়েই এসেছে। চা-বাগানগুলো থেকে। তাদের ফিরে যাওয়ার সহজ পথ বন্ধ। যেতে হলে আট মাইল হেঁটে শিলিগুড়ির রাস্তায় যে সাঁকোটা ভেঙেছে সেখান থেকে বাস ধরতে হয় শিলিগুড়ির। তার পর সেবক হয়ে ড়ুয়ার্সে। মেয়েদের মধ্যে কান্নাকাটি পড়ে গেল। জলপাইগুড়ি শহরের জন্যে প্রথম ত্ৰাণসামগ্ৰী এল শিলিগুড়ি থেকে। সেটা চাহিদার তুলনায় খুবই অল্প। রাজনৈতিক দলগুলো উদ্ধার কাজে নেমে পড়েছে। দীপারা ঠিক করল হোস্টেলেই থাকবে। দুবেলা শুধু খিচুড়ি খাবে। তবু এখান থেকে যাবে না। বড়দির সঙ্গে মেয়েদের হয়ে কথা বলতে গিয়ে ঝগড়া হয়ে গেল তার। ভদ্রমহিলার যুক্তি ছিল শহরে যখন কোন বাজার নেই তখন চাল ডালই বা আসবে কোত্থেকে?

দীপা বলল, আপনি যদি থাকতে পারেন তাহলে আমরাও পারব। শহরের অন্য মানুষ তো পালিয়ে যাচ্ছে না।

কিন্তু থাকব বলা সহজ থাকার সমস্যাটার সমাধান সহজে হচ্ছে না। যে সব দোকানে জিনিসপত্রের স্টক ছিল, যারা বাঁচাতে পেরেছিল তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ। শহরের মানুষ তাই কিনছে। এই সময় হোস্টেলের একটি মেয়ে, যার নাম গোপা, খুবই সাধারণ চেহারার শান্ত মেয়ে জানাল তার দাদার শ্বশুর থাকেন জেলা স্কুলের পেছনে। ভদ্রলোকের চাল ডালের ব্যবসা আছে। গোপাকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ দীপারা বেরিয়ে পড়ল। করলার জল নামেনি। দীনবাজার হয়ে কাদা মাড়িয়ে ওরা কোনমতে সেনপাড়া দিয়ে সেই ভদ্রলোকেব দোতলা বাড়িতে যখন পৌঁছাতে পারল তখন কাউকেই ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। জল পলি লেগে শাড়ির রঙ পাল্টে গিয়েছে।

ভদ্রলোক মেয়ের ননদকে এতগুলো মেয়ের সঙ্গে দেখে আতকে উঠলেন। প্ৰথমে কুশল সংবাদ দিয়ে বললেন, বুঝতে পারছি। তোমরা বরং এক কাজ করো। দুবেলা এখান থেকেই খিচুড়ি যাবে তোমাদের হোস্টেলে। যদ্দিন সব নমলি না হয় তদ্দিন এই ব্যবস্থাটা চলুক। যা ন্যায্য দাম তা দিয়ে দিও।

খিচুড়ির আবার কোন দাম ঠিক করা যায়? দীপা জিজ্ঞাসা করল।

দ্যাখো মা, লোকে সন্দেহ করছে আমার কাছে চাল ডাল লুকোনো আছে। আমি বলছি নেই। হাওয়া না বুঝে মুখ থেকে সত্যি কথা বলতে রাজি নই। এখন যদি তোমাদের জন্যে চাল ডাল বের করি তাহলে এ বাড়ি লুট হয়ে যেতে পারে। আমার ক্ষতি হোক তা নিশ্চয়ই তোমরা চাও না।

সেটা তো খিচুড়ি গেলেও বুঝতে পারবে।

পারবে না। বলব। রিলিফ পাঠাচ্ছি। এতে আমার সুনাম বাড়বে। কতজন?

দীপা সংখ্যাটা বলল। ভদ্রলোক বললেন, আজ রাত্রে তোমাদের হোস্টেলের ঠাকুর যেন রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে এখানে আসে। রাত নটাব পরে। এই কদিন সে আমার কাছেই থাকবে। রিলিফ নিয়ে দুবেলা আমার জিপ তোমাদের হোস্টেলে যাবে। টাকা পয়সার ব্যাপার নিয়ে আমি তোমাদের সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে পরে কথা বলব।

তবু একটা সুরাহা হল। হঠাৎ প্রতুলবাবুর কথা মনে এল দীপার। এই লোকটা রিলিফ দেবার নাম করে সুনাম কিনবে আবার রোজগারও হবে। রান্নাকরা খাবারেব দাম নিশ্চয়ই বেশী। ঠিক প্রতুলবাবুর চরিত্র। ওরা হাঁটতে হাঁটতে হাকিমপাড়া দিয়ে আসছিল। রাস্তায় একহাঁটু পলিমাটি। ড়ুবে যাওয়া পা তোলাই মুশকিল। আশেপাশের এক তলা বাড়িগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। কান্নাকাটি থামেনি এখনও। হঠাৎ বাড়িটাকে চিনতে পারল সে। কয়েক হাজার বুনো মোষ যেন বাগানটাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। পলির স্তুপ জমেছে। বাড়িটার একাংশ ধসে গিয়েছে। কিছু মানুষের ভিড় সেখানে। দীপাকে দাঁড়াতে দেখে নীতা জিজ্ঞাসা করল, এই বাড়ির লোকদের চেন তুমি?

দীপা জবাব দিতে গিয়ে থেমে গেল। দুজন মানুষ পলি মাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল, দুদিন ধরে পচেছে। জল বাড়লে বেরুতে পারেনি। মেয়েছেলেটা ঢোল হয়ে গিয়েছে। হরদেবদাকেও চেনা যাচ্ছে না। পাপের বেতন মৃত্যু, বুঝলে।

সঙ্গীরা এগিয়ে যাচ্ছিল। দীপা কোনমতে তাদের অনুসরণ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *