লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্
লেকিন য়েহী কেহ্ ‘রফৎ’ গয়া অওর ‘বুদ’ থা ॥
আত্মপ্রকাশ বলে একটা কথা আছে। হাঁচিতে আমাদের আত্মপ্রকাশ হল। দু’জনে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললুম, আমরা।
আমার ভয় পাবার কারণ আছে। প্রবীরদা কেন যে ভয় পাচ্ছেন এত?
প্রবীরদা সোজা টর্পেডোর মতো পিতৃদেবের পায়ের ওপর পড়লেন। প্রফুল্লকাকা পিতার হয়ে বলতে লাগলেন, এসো বাবা, এসো, দীর্ঘজীবী হও, শতায়ু হও। চটাস করে নিজের পায়ে একটা চাটা মেরে বললেন, বড় মশা হয়েছে হে। ম্যালেরিয়া না হয়।
পিতৃদেব গম্ভীর গলায় বললেন, আপনি কে?
আজ্ঞে, আমি আপনার শিষ্য।
কবে থেকে এ অবস্থা হল?
প্রবীরদা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, আজ্ঞে কী অবস্থা!
এই মস্তিষ্ক বিকৃতি, এই উন্মাদ অবস্থা।
আজ্ঞে, আমি তো উন্মাদ নই। আমাদের পাশের বাড়িতে এক পাগলি আছে। ওই যে ওর। কপালে ইট মেরেছে।
তার মানে?
পিতা গর্জন করে উঠলেন। প্রবীরদার কি কোনও বুদ্ধিসুদ্ধি নেই? দুম করে এই কথাটা বলা কি উচিত হল!
তুমি তা হলে তোমার মামার সঙ্গে সিনেমাপাড়ায় যাওনি।
আজ্ঞে হ্যাঁ গিয়েছিলুম।
তা হলে?
মামা অদৃশ্য হলেন।
কেন? সে কি পি সি সরকারের মতো ম্যাজিশিয়ান হয়েছে নাকি? দৃশ্য থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল!
আজ্ঞে না, তিনি আমাদের ফেলে রেখে কোন এক বড়লোকের বাড়ি মার্বেল পাথর খুলতে চলে গেলেন।
সে আবার কী? সকালে ছিল মিউজিক ডিরেক্টর, বিকেলে রাজমিস্ত্রি।
প্রফুল্লকাকা ফোড়ন কাটলেন, কত রঙ্গ জানো যাদু, কত রঙ্গ জানোনা, সর্প হয়ে দংশ তুমি ওঝা হয়ে ঝাড়ো। প্রবীরদা আবার বোস বলে ফেললেন, আজ্ঞে না, তা নয়, ওই মার্বেল পাথর বেচে বাইজিদের পাওনা মেটাবে।
সেকী? এত অধঃপতন। বলে গেল সিনেমা করছি, চলে গেল বাইজি বাড়ি?
প্রফুল্লকাকা বললেন, বয়েসের দোষ।
প্রবীরদা বললেন, আমাদের বলাটা ঠিক হচ্ছে না, তাই আপনাদের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে।
তুমি কে বলো তো? তোমার পরিচয়টা আগে জানা দরকার।
আমি জয়ের ছাত্রজীবনের বন্ধু।
প্রফুল্লকাকা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তার মানে তবলচি।
আজ্ঞে না, তবলচি নই। চিত্রশিল্পী। গান লিখি। তেমন গাইতে পারি না।
প্রফুল্লকাকা বললেন, রোজ সকালে ভাল করে গলা সাবধা। গান কি মুখের কথা। বিখ্যাত গাইয়ে ওমপ্রকাশ শর্মা কী করতেন জানো? রোজ ভোরবেলা কৃষ্ণা নদীর একগলা জলে…
পিতা বললেন, ভূগোলে তুই বড় কাঁচা প্রফুল্ল, উত্তরভারতে কৃষ্ণা আসবে কী করে! গঙ্গা নদী।
হ্যাঁ হ্যাঁ, গঙ্গানদীতে আর্লি মর্নিংয়ে, একগলা জলে দাঁড়িয়ে রেগুলার গলা সাধতেন, এ তানা। যোবানা পরমানানা।
পিতা হাত তুলে বললেন, থামো, বড় বেলাইনে চলে যাচ্ছ। তুমি তা হলে জয়ের বন্ধু।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমার ছেলেকে কোথায় পেলে?
ওই যে, বিডন স্ট্রিটের মুখে জয়ের গাড়ি একজনকে চাপা দেবার জোগাড় করেছিল।
বহত আচ্ছা।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন তোমাকে যেখানে-সেখানে যেতে দিই না দেখেছ?
প্রবীরদা বললেন, আজ্ঞে হুলো বেড়াল আর উঠতি বয়সের ছেলেকে কদিন ধরে রাখবেন?
থামো, তোমাকে আর মোড়লি করতে হবে না। তোমার ছেলে আছে?
আজ্ঞে না, আমিই তো ছেলে।
ছেলে কী করে মানুষ করতে হয় আমাকে নাই বা শেখাতে এলে।
আজ্ঞে, অন্যায় হয়ে গেছে।
সেই চাপা-পড়া লোকটি আছে না গেছে?
আছে। চাপা পড়েনি। সাইকেল থেকে ছিটকে পড়েছিল। খুব গোলমাল হতে পারত। আমার। পাড়া তো, সব ঠান্ডা করে দিলুম, তারপর আমিও গেলুম ওদের সঙ্গে স্টুডিয়ো পাড়াতে। আপনার ছেলের আজ দিব্যজ্ঞান হয়েছে।
কোথায়? বাইজি পাড়ায়?
প্রফুল্লকাকা বললেন, নাচ দেখলে? কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচ? অখাদ্য ভক্ষণ করেছ? যদি করে থাকো, আগে স্নান করে নাও।
পিতা বললেন, প্রফুল্ল, আমার মনে হয়, তোমার এখন নীচে যাওয়াই ভাল।
কেন বলো তো, কেন বলো তো? আমি তো আজ আর কাঁধকাটা গেঞ্জি পরে আসিনি। এই। দেখো ফতুয়া পরে এসেছি।
এলে কী হবে? তোমার অতীত দুধের মতো উথলে উঠছে। তুমি না কোন বাইজির সঙ্গে তবলা বাজাতে?
বাজাতে মানে? এখনও বাজাই, বিখ্যাত কমলী বাই।
তা হলে তুমি অবশ্যই নীচে যাবে।
এখানে তো বেশ লক্ষ্মীছেলের মতো বসে আছি। কেমন ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে!
নাই বা কথা বাড়ালে। জানোই তো আমার মেজাজ বিশেষ সুবিধার নয়।
প্রফুল্লকাকা উঠে পড়লেন। ফতুয়ার পকেটে দেশলাই আর বিড়ির কৌটো শব্দ করে উঠল।
প্রবীরদা বললেন, আজ্ঞে বাইজিজ্ঞান নয়, দিব্যজ্ঞান। আমরা আজ দু’জনে জয়ামাতার কাছে গিয়েছিলুম। আমার বোন ঊষাও গিয়েছিল। সে খুব ভাল গান গায় তো!
তিনি কার শিষ্যা?
আমার ঠিক জানা নেই। তবে সাংঘাতিক শক্তি। পিন্টুকে আজ চৈতন্য দিয়েছেন। একদিনেই অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছেন। বড় ভাগ্যবান ছেলে। সামান্য বিভূতিও পেয়েছে। মানুষের ভেতর দেখতে পাচ্ছে।
তাই নাকি? নিজের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে? কী হে, পাচ্ছ?
প্রবীরদার মতো বোকা মানুষ দেখা যায় না। কার কাছে কী কথা বলছেন! নিজের ভেতর যেদিন দেখতে পাব সেদিন কি আর সংসারে থাকব। ছার এ সংসার বলে বেরিয়ে পড়ব। আজ সেই অনন্তের সিংহদুয়ারের চৌকাঠ থেকে ফিরে এসেছি। একঝলক দেখেছি, এপারের ওপারে কী। আছে। সতীমা আমাকে ভবিষ্যৎ দেখিয়েছিলেন, ইনি আমাকে অনন্ত দেখিয়ে দুয়ারটি বন্ধ করে দিলেন। চাবি আমার কাছে নেই।
পিতা প্রবীরদাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি কী জন্যে এসেছ?
ঈশ্বরের সন্ধানে।
ঈশ্বর! তিনি কে? কোথায় তাকে পাওয়া যায়?
অসহায়ের মতো, পড়া-না-পারা ছাত্রের মতো প্রবীরদা বললেন, আমি তো জানি না।
কেউ কি জানেন?
অনেকে যে বলেন!
বিকারের রোগীও তো অনেক কিছু বলে! তোমার কি ভোগ শেষ হয়েছে?
কী ভোগ?
দুর্ভোগ।
আজ্ঞে সে তো সেই তিন বছর বয়েস থেকে ভুগেই চলেছি।
আসক্তি গেছে?
কীসের আসক্তি?
কামিনী কাঞ্চন।
আমার নেই।
মিথ্যেবাদী, তুমি মিথ্যেবাদী, ড্যাম ল্যায়ার। জগৎ যাতে লাট খাচ্ছে, তুমি তার বাইরে? তা হলে তুমি কেন বাপু ঈশ্বর খুঁজছ! তুমিই তো ঈশ্বর।
আমি জানি না। বিশ্বাস করুন, আমি জানি না। আমার ভেতরটা ভীষণ ছটফট করে।
সেটা তোমার কামনা। তোমার ভেতরটা পুড়ছে। অঙ্ক জানো?
সামান্য।
তা হলে আমার কাছে আসা-যাওয়া করো। ঈশ্বর হলেন গণিত, ঈশ্বর বিজ্ঞান। কীর্তন নয়, নাক টেপা নয়, উপবাস নয়, সন্ন্যাস নয়, সাধক নয়, সাধিকা নয়, ঈশ্বর হলেন কর্ম, ঈশ্বর হলেন পারফেকশন।
আমি আপনার বড় ছেলে।
কেন?
আপনি আদর্শ পিতা, তাই।
হা হা করে পিতৃদেব হেসেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আমি হাসছি, একী আমি হাসছি! জানো আজ আমার কী হয়েছে, আমার পুত্রোপম ছাত্র মারা গেছে। তুমি জানো আজ কী সর্বনাশ হয়েছে?
কী হয়েছে?
পিতার গলা আবেগে রুদ্ধ, দীনু মারা গেছে।
সেকী?
হ্যাঁ, কে বলেছে ঈশ্বর আছে। ড্যাম লায়ার, চিট, এই কি ঈশ্বরের পৃথিবী, আই স্ট্যাম্প অন ইট, আই কিক দিস আর্থ, দিস ডাস্ট, ইটস লজ অ্যান্ড বাইলজ, এ ক্রুয়েল, আনোন ক্রিয়েটার, ফিয়ারড অ্যান্ড রেসপেক্টেড উইদাউট অ্যানি রিজন।
দীনু মারা গেছে। এই তো সেদিন দীনু বেঁচে ছিল। সুস্থ, সবল, প্রাণপ্রাচুর্যে টগবগে! বিশ্বাস করা যায় সে মারা গেছে! মৃত্যু এত সহজ!
কীভাবে মারা গেল?
নিয়তি। মানুষের নিয়তি। এর মাঝে কবে ও যেন মোটরসাইকেলে দুর্গাপুর গিয়েছিল। ওর সেই বন্ধু সুখেনের কাছে। ফেরার পথে বর্ধমানের কাছে জিটি রোডে দুর্ঘটনা। ছিটকে পথের পাশে মাঠে গিয়ে পড়েছিল। মাথাটা একেবারে চুরমার হয়ে গেছে। বর্ধমান পুলিশ ফোন করে জানিয়েছে এই কিছুক্ষণ আগে। দীনুর বাবা এখন বিলেতে। বাড়িতে এখন কেউ নেই। কে নিয়ে আসবে মৃতদেহ! আমি একবার যাই।
আপনি এখনও ভাল করে হাঁটতে পারছেন না, আপনি কোথায় যাবেন? আমি যাচ্ছি।
তুমি! তুমি কি কিছু করতে পারবে? তুমি তো নিজেকেই সামলাতে পারো না।
চেষ্টা করে দেখি। হয়তো পারব।
প্রবীরদা বললেন, ছেলেটি কে?
আমার বন্ধু, বাবার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র।
চলো চলো, আমিও যাই তোমার সঙ্গে।
দীনুদের বাড়িটাকে বাগানবাড়িই বলা চলে। সিংহ দরজার দু’পাশে থাবা গেড়ে বসে আছে দুটো সিংহ। সারাবাড়ি এই সেদিন রং করা হয়েছে। সাদা সিংহ আলো-অন্ধকারে অদ্ভুত নিষ্ঠুরতায় হাসছে। যেন এইমাত্র দীনুকে মেরে এসে বিশ্রামে বসেছে। দু’পাশে বাগান। দু-একটা স্ট্যাচু আছে। সামনেই গাড়িবারান্দা। মৃদু আলোয় স্বপ্ন মায়া খেলছে।
বিশাল বৈঠকখানা। বার্মা কাঠের ঝকঝকে দরজার দুটো পাল্লা দু’পাশে হাট খোলা। কিছু নেই, বাধা দেবার কোনও ক্ষমতা কারুরই নেই। সবকিছু এ সংসারে বড়ই অবারিত। দরজা যত বড়ই হোক, যে যাবে, সে যাবে।
ঘরের সবকটা ঝাড় জ্বলছে। বিশাল বিশাল সোফায় এ পাড়ার অনেক গণ্যমান্য মানুষ বসে আছেন। গাড়িবারান্দার একপাশে কালো রঙের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। পেট্রলের মৃদু গন্ধ। গাড়িটা মনে হয় দীনুর মেসোর। কলকাতা পুলিশের দুটো গাড়ি আমি চিনি। একটা নীল আর একটার রং চকোলেট।
ভেতরে যারা বসে আছেন, তাদের দেখলেই মনে হতে পারে এ বাড়ির কোনও উৎসবে নিমন্ত্রণ রাখতে এসেছেন। একটা ব্যাচ বসেছে। উঠলেই এঁদের ডাক পড়বে। অনেকে আবার সিগারেট ধরিয়েছেন। মৃদু মৃদু টান মারছেন। অনেকের চোখ বেশ ঘুমঘুম। বহুক্ষণ বসে থাকার ক্লান্তি।
প্রবীরদা বললেন, এঁরা যে খুব বড়লোক গো। এখানে আমরা কী করব?
সত্যিই তাই। পিতৃদেব দূর থেকে বুঝতে পারেননি। তিনি এলে বড় অস্বস্তি পেতেন। দীনুর মাকে আমি দু’-একবার সামনাসামনি দেখেছি। বেশ অহংকারী। দুই দাদা বাইরে থাকেন। কাল তাঁরা নিশ্চয়ই এসে পড়বেন। আজও এসে পড়তে পারেন। দিল্লি আর বম্বে প্লেনে বর্ধমানের চেয়েও কাছে।
প্রবীরদা বললেন, চলো, সরে পড়ি।
হ্যাঁ, তাই চলুন। বড়লোককে বড়লোকরাই সাহায্য করতে পারেন। এখানে আমাদের বোকাবোকা লাগছে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছি। ঝাউগাছের অন্ধকার থেকে ভারী গলায় কে যেন প্রশ্ন করলেন, কী চাই?
সিগারেটের আগুন বড় হচ্ছে, ছোট হচ্ছে। সেই দিকে তাকিয়ে বললুম, কিছু চাই না।
মজা দেখতে এসেছ?
আজ্ঞে না, দীনু আমার বন্ধু ছিল।
অ, বন্ধু ছিল, যত র্যাজাটে বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ছেলেটা শেষ হয়ে গেল। যাও, সরে পড়ো।
গেটের কাছে এসে প্রবীরদা জিজ্ঞেস করলেন, লোকটি কে বল তো?
মনে হয় এ পরিবারের কোনও হিতৈষী।
বাব্বা, বিপদেও মানুষের অহংকার যায় না।
রাস্তায় এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। মন ক্রমশই বিষণ্ণ হয়ে উঠছে। দীনু আর দীনুর পিতা সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। দীনুর মা বিরাট বড়লোকের মেয়ে। তার কাছাকাছি একবার যেতে পারলে হত। কিন্তু কী করে যাই।
প্রবীরদা বললেন, আমি তা হলে যাই। আর একদিন আসব। তোমার বাবা আজ খুবই চঞ্চল হয়ে রয়েছেন। পারো তো তুমি একবার কাল এসো না! অনেক কথা আছে। কাজের কথা।
চেষ্টা করব, যদি ছাড়া পাই।
ধুলো উড়িয়ে আমাদের সামনে দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। পেছনের আসনে কে বসে?
প্রবীরদা ঠিক দেখেছেন, বললেন, জয় না? মরেছে, আমাদের খুঁজতে এসেছে।
গাড়ির ন্যাজ তখনও দেখা যাচ্ছে। রাস্তার বাঁক ঘুরছে। প্রবীরদা, জয় জয় বলে ছুটতে আরম্ভ করলেন। রাস্তার পাশে একটা নেড়ি নিশ্চিন্ত আরামে শুয়ে ছিল। প্রবীরদার দৌড় দেখে তারও খুব ছুটতে ইচ্ছে করল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পেছন পেছন ছুটল, ঘেউ ঘেউ করে।
গাড়ির পেছনে কেউ ওভাবে ছুটে পারে! সামনের বাঁক ঘুরে গাড়ি তো সোজা চলে যাবে। পরিষ্কার কঁকা রাস্তা। মাঝখান থেকে কুকুরের কামড় না খান।
বাড়ির সামনে গাড়ি থেমেছে। মাতুল ওপরে উঠেছেন। প্রবীরদা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন বিষণ্ণ বদনে। প্রফুল্লকাকা নীচের তলায় দড়ি পাকাচ্ছেন। কাকিমা একটা দিক ধরে আছেন। পাক যত পেকে উঠছে কাকা কেবলই সাবধান করছেন, দেখো ছেড়ে দিয়ো না যেন, ছেড়ে দিয়ো না সুন্দরী।
প্রবীরদা বললেন, ধরতে পারলুম না, ওপরে উঠে গেল।
গেছেন, যান না, তাতে আমাদের কী?
আরে বুঝছ না কেন? ধরতে পারলে তোমার বকুনিটা একটু কম হত।
আমি বকুনি-প্রুফ। আমার জন্যে ভাববেন না। চলুন ওপরে চলুন।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে পাকের টানে কাকিমা দড়ি ফসকেছেন। কাকা লাফাচ্ছেন, আরে মাগি, সবই কি তোর ফসকা গেরো! মারব মুখে জুতোর বাড়ি। খাচ্ছে দাচ্ছে গতর বাগাচ্ছে, কুচবিহারের মহারানি।
কাকিমা বলছেন, তুমি টানলে কেন, না বলে?
ওরে আমার কুইন ভিক্টোরিয়া রে; বলে টানতে হবে, বলে টানতে হবে। তখন থেকে আমি জপে যাচ্ছি, ওরে ছাড়িসনি, ওরে ছাড়িসনি।
স্বামী-স্ত্রীর সোহাগ দেখে প্রবীরদা হা হয়ে গেছেন। দাম্পত্য জীবনের এক চাকলা দড়ির পাকে পাকে ক্রমশই রসস্থ হচ্ছে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, এঁরা কারা?
পরে বলব, এখন ওপরে চলুন।
পিতার সামনে একটা চেয়ারে গম্ভীর মুখে মাতুল বসে আছেন। আমরা দুজনে চোরের মতো, ন্যাজ গুটোনো দুটো কুকুরের মতো পায়ে পায়ে পাশে সরছি। জানলার পাশে দাঁড়াতে পারলে, রাস্তা দেখা যাবে। জীবনের মিছিল চলেছে যেখানে বকুনি খেলেও তেমন দুঃসহ লাগবে না। বাইরে কিছু উড়িয়ে দেওয়া যাবে।
মাতুল কিন্তু বকলেন না, শান্তগলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী দেখে এলে? ডেডবডি আনার ব্যবস্থা হয়েছে?
ঠিক বোঝা গেল না।
কেন?
বহু বড় বড় লোক এসেছেন। দীনুর মেসোমশাই এসেছেন, যিনি লালবাজারে আছেন।
যাক, তা হলে আর কোনও চিন্তা নেই।
পিতা হাসলেন শব্দ করে। মুখে আলোর ছায়া পড়েছে। মাতুলের কথার উত্তরে বললেন, বেশ বলেছ, আর কোনও চিন্তা নেই। মৃত এবার ফিরে আসবে মায়ের কোলে।
মাতুল বললেন, তোমরা খুব অন্যায় করেছ। আমাকে না বলে চলে এলে কেন?
প্রবীরদা বললেন, তুমি ছিলে না, তাই ওকে নিয়ে চলে এলুম আমাদের বাড়িতে, সেখান থেকে আমরা গেলুম জয়ামাতার কাছে। এটা তুমি স্বীকার করবে জয়, তোমার ওই সিনেমা পাড়ার চেয়ে মহাগিরি আশ্রম ঢের ভাল। ওখানে গেলে মানুষের দিব্যজ্ঞান হয়।
হ্যাঁ, তা হয়। তবে তোমাদের না দেখে বড় দুশ্চিন্তায় ছিলুম, আমার একটা দায়িত্ব আছে তো।
তোমার আজকের কাজ সব ঠিকমতো হয়েছে তো!
প্রতাপ আমাকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছে।
কোন প্রতাপ?
ওই যে আমাদের হাটখোলার প্রতাপ।
আমাদের সেই গড়পারের প্রতাপের কী খবর জয়?
সে এখন চুটিয়ে ব্যাবসা করছে। বাড়িগাড়ি করে ফেলেছে। প্রতাপ আমাকে যা প্যাঁচে ফেলেছে।
পিতা বললেন, সে তো তোমার প্রাণের বন্ধু ছিল হে।
ওই যে, ওই ব্যারিস্টার ভদ্রলোক এখন কলকাঠি নাড়ছেন। বড়মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ফাঁইন্যালাইজড। এইসব বিষয়ী মানুষ যেখানে গিয়ে ঢুকবেন সেখানে একেবারে জ্বলেপুড়ে যাবে। টানতে টানতে কাছা কোঁচা খুলে ছেড়ে দেবে। প্রতাপ এমন বদলে গেছে, ভাবা যায় না। এক দিকে বাঘা শ্বশুর, আর এক দিকে সুন্দরী স্ত্রী। বেচারার মাথা ঘুরে গেছে। আমার নাম জয়নারায়ণ, আমি যা ধরি তা করে ছাড়ি। বড়লোক হবার জন্যে পৃথিবীতে আসিনি। আলুওয়ালাও বড়লোক হতে পারে। কয়লার গোলা করে আমাদের পাড়ার নবাবু তিনতলা বাড়ি করেছে। আমি কীটসের ভক্ত। আমার কাছে, আর্ট ফর আর্টস সেক।
নীচে খুব ধুমধাম শব্দ শুরু হয়ে গেছে। মাতুলের কথা বন্ধ হয়ে গেল। মুখ প্রশ্নবোধক। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, নীচে কী হচ্ছে বল তো? মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্য?
একসঙ্গে গোটাকতক কাপডিশ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। প্রফুল্লকাকার গলা, বেশ কষকষে করে বলছেন, মারব মুখে জুতোর বাড়ি, মারব মুখে জুতোর বাড়ি। ওরে আমার কুচবিহারের মহারানি।