1 of 3

১.২৫ বাড়িতে অসময়ে কোনো অতিথি এসে

বাড়িতে অসময়ে কোনো অতিথি এসে পড়লে বাবলুকেই পাঠানো হয় পাড়ার দোকান থেকে মিষ্টি কিনে আনতে। এই দায়িত্বটা পেলেই খুব খুশী হয় বাবলু। কাজটা বেশ অর্থকরী। এক টাকার রসগোল্লা কিনলেই ষোলটার বদলে দেওয়া হয় সতেরোটা। অথবা যোলটা দিয়ে এক আনা দস্তুরী। সেটা সাধারণত চাকর বাকররাই পায়। বাবলু মিষ্টির দোকানের কাঁচের আলমারির ওপর টাকাটা রেখে বলে, ষোলোটা রসগোল্লা দেবেন! এইভাবে তার কিছু পয়সা জমে। তাকে অনেক টাকা জমাতে হবে তো, নইলে বড় হয়ে সে ঘুড়ির দোকান খুলবে কী করে?

দু পয়সায় একখানা ঘুড়ি, সেগুলো আধতে। একতে কিংবা দেড়তে ঘুড়ি বাবলু এখনো ঠিক সামলাতে পারে না, টানের সময় তার আঙুল কেটে যায়। বিশ্বকর্মা পুজোর আগে পাড়ার ছেলেরা যখন রাস্তার এক ল্যাম্পপোস্ট থেকে আর এক ল্যাম্পপোস্ট পর্যন্ত সুতোয় মাঞ্জা দেয়, তখন বাবলু জুটে যায় তাদের সঙ্গে। কিছু কাজ করে দিলে সে-ও খানিকটা মাঞ্জা পাবে। যেহেতু তার পয়সা নেই, সেই জন্য তাকে দেওয়া হয় সবচেয়ে বাজে কাজটি, হামানদিস্তেয় কাঁচ-গুড়ো করা। কাঁচও তাকেই জোগাড় করতে হবে। ভাঙা কাঁচ না পেলে বাবলু বাড়ি থেকে চুপি চুপি দুটি আস্ত কাঁচের গেলাস নিয়ে এসে অবলীলাক্রমে হামানদিস্তায় ফেলে দেয়।

পাড়ার ছেলেদের যে মোড়ল সেই পরেশদা এসে মাঝে মাঝে কাঁচের মিহিনত্ব পরীক্ষা করে, ঠিক মনোমতন না হলে সে বলে, এই বালে, ফাঁকি মারা হচ্ছে? বার্লি খাস নাকি, হাতে জোর নেই। এই বলেই সে একটি চাঁটি কষায় বাবলুর মাথায়।

পরেশদা অন্যান্য ছেলেদের যখন তখন চাঁটি মারতে ভালোবাসে, সেইজন্যই সে মোড়ল।

ঘুড়ি ওড়ানোতে বাবলু এখনো দক্ষ হতে পারে নি। খানিকটা দূরেই বোসদের বাড়ি। তাদের প্রকাণ্ড ছাত, সেখানে অনেকগুলো ভাই এক সঙ্গে হৈ হৈ করে ঘুড়ি ওড়ায়। বাবলু তার ঘুড়ি নিয়ে বাড়তে না বাড়তেই বোসদের টকটকে লাল রঙের দেড়তে ঘুড়ি ডাকাতের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে, বাবলু লাট খেলবার সুযোগই পায় না, বোসদের ঘুড়ি গোঁত মারার সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুড়ি কুচ্‌ করে কেটে যায়। রাগে-দুঃখে আফসোসে বাবলুর তখন হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে, চোখে জল এসে যায়, ওদিকে বোসদের ছাদে তখন ভোম মারা বলে বিকট জয়োল্লাস!

বোসদের উপদ্রবেই পরেশদারা পাড়া ছেড়ে ঘুড়ি ওড়াতে যায় শ্যাম পার্কে। বাবলুর সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই।

দিনে একখানার বেশি ঘুড়ি কেনার ক্ষমতা নেই বাবলুর। সেখান কেটে যাবার পর সে ম্লান মুখে বসে থাকে ছাদে। যতক্ষণ অন্ধকার না হয়, তার নিচে যেতে ইচ্ছে করে না। বড় হয়ে সে ঘুড়ির দোকান খুলবে, তখন তার আর ঘুড়ির অভাব থাকবে না, লাটাই ভর্তি ভর্তি মাঞ্জা, নাজির সাহেবের দোকান থেকে সে সব মাঞ্জা কিনে আনবে। তখন কে পারবে তার সঙ্গে? তার নিজস্ব নাম লেখা ঘুড়ি থাকবে, এক এক করে অন্য সমস্ত ঘুড়ি কেটে সে ফাঁকা করে দেবে আকাশ। আর কেউ থাকবে না, সে শুধু হবে আকাশের রাজা। দূর থেকে সবাই বলবে, ঐ যে উড়ছে অতীন মজুমদারের ঘুড়ি। বাসের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে লোকেরা বললে, হা, কলকাতা শহরের আকাশটা এখন অতীন মজুমদারের!

সেই দিনটা আসতে কত দেরি? বাবলুর আর ধৈর্য থাকে না। এখন তাকে ঘুড়ির অভাবে প্রায় বিকেলই বসে থাকতে হয়। মাঝখানে সে একটা আঁকশি বানিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ছুটে ঘুড়ি ধরা শুরু করেছিল। আঁকশিটা হাতে নিয়ে ওপরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয়। প্যাঁচের খেলা দেখতে দেখতে একটা ঘুড়ি কেটে গেলেই সেটাকে লক্ষ্য করে ছুট। এ কাজে অবশ্য প্রতিযোগিতা আছে খুব, পাশের বস্তির ছেলেরাও সঙ্গে সঙ্গে ছোটে, তাদের অভিজ্ঞতা বেশি, বাবলুর চেয়ে ঢ্যাঙা ছেলেদের সুবিধেও বেশি। তবু মাঝে মাঝে তাতে দু একটা ঘুড়ি বাবলু পেয়ে যেত। একদিন বাবার চোখে পড়ে যাওয়াও তাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। প্রতাপ কান মুচড়ে ধরে বলেছিলেন, ফের যদি তোকে রাস্তায় ঘুড়ির পেছনে ছুটতে দেখি, তা হলে তোকে বস্তিতেই থাকতে হবে, বাড়িতে ঢুকতে পারবি না!

ঘুড়ির পেছনে তাড়া করতে করতে বাবলু একদিন ঢুকে পড়েছিল একটা অচেনা বাড়িতে।

সে বাড়ির পেছনটায় একটা পাঁচিল ঘেরা অব্যবহৃত ছোট মাঠ, নানান রকম আগাছায় ভর্তি। অনেক ঘুড়ি গিয়ে সেই মাঠটাতেই পড়ে। সে বাড়িতে বাবলুদের বয়েসী কোনো ছেলে নেই, ঘুড়ি সম্পর্কে কারুর কোনো আগ্রহ নেই, তবু ঘুড়িগুলো ওখানেই যায় কেন? ঐ মাঠটা যেন ঘুড়ির কবরখানা!

একটা কালো অপূর্ব সুন্দর চাঁদিয়াল ঘুড়িকে সেই মাঠটায় পড়তে দেখে একদিন বাবলু আর লোভ সামলাতে পারেনি।

ঐ বাড়িটাতে কুকুর আছে, তিনতলায় মাঝে মাঝে ডাক শোনা যায়। সদর দরজটা খোলা। বাবলুর ভয় ভয় করে, কিন্তু কালো চাঁদিওয়ালটা যেন তাকে জাদু করেছে। কড়ি টানা, তেল চকচকে গা, ওরকম একটা ঘুড়ি দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখলেও ঘর আলো হয়ে যায়।

বাবলু ভাবলো, এক ছুটে ভেতরে গিয়েই নিয়ে আসবে, কেউ দেখবে না। দরজা দিয়ে ঢুকে বাবলু প্রথমে চোরের মতন দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। কুকুরটার কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, মানুষজনও কেউ নেই। একতলায় বোধহয় কেউ থাকে না।

ভেতরে একটা চাতাল, তারপর পেছন দিকের মাঠটায় যাওয়ার একটা দরজা, সেই দরজায়। তালা লাগানো, অনেক দিনের মর্চে পরা তালা। কিন্তু তার প্রায় পাশেই দেয়ালে ইঁট ভেঙে ভেঙে মানুষ প্রমাণ গর্ত। অর্থাৎ জমিটির মালিকানা নিয়ে বিতর্ক আছে, তাই দরজা তালা দিয়ে বন্ধ থাকে, গোপনে ব্যবহার হয়। বাবলুর কাছে এটা একটা মজার ব্যাপার মনে হলো, সে ঢুকে পড়লো সেই গর্ত দিয়ে।

মাঠটিতে বড় বড় ঘাস গজিয়ে গেছে, এখানে সেখানে রয়েছে কচু গাছ আর শ্যাওড়া, একটা দুটো পেয়ারা গাছও রয়েছে। ছেঁড়া জুতো, রক্তমাখা তুলো, ভাঙা পুতুল, সিগারেটের খালি প্যাকেট আর কত কী যে সেখানে রয়েছে তার ঠিক নেই।

মাঠটার শেষ প্রান্তে একটা পেয়ারা গাছে লটকানো কালো চাঁদিয়ালটাকে দেখতে পাচ্ছে বাবলু, তার বুক ধক ধক করছে, এতদিনে তার হাতে আসবে এই দুর্লভ উপহার। যাতে শব্দ না হয় সেইভাবে পা টিপে টিপে এগোচ্ছে, আর কোনো দিকে তার মনোযোগ নেই।

পেয়ারা গাছের ডাল পর্যন্ত বাবলুর হাত যায় না, খুঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে, বাবলু চটিজুতো খুলে সবে পা দিয়েছে, এমন সময় যেন কোনো চুম্বক তার চোখের দৃষ্টি ডান পাশে ফেরালো, সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো।

সেখানে সেই ঘাস জঙ্গলের মধ্যে ছেঁড়া মাদুরের ওপর বসে আছে একটি স্ত্রীলোক, মধ্যবয়সী, কালো শাড়ি পরা, তার হাতে তাস। স্ত্রীলোকটি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাবলুর দিকে।

দুপুর শেষ হয়ে এখনো বিকেল হয়নি, রোদ্দুরের রং গাঢ়, তার মধ্যে সেই অদ্ভুত রকম অবস্থায় বসে থাকা রমণীটিকে দেখে বাবলুর গলা শুকিয়ে গেল, বুকের মধ্যে জয়ঢাক পেটার শব্দ হতে লাগলো। সে মনে মনে বলতে লাগলো, রাম, রাম, রাম, রাম…

বেশ কয়েক মুহূর্ত সেখানে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর বাবলু আস্তে আস্তে বললো, আর করবো না, আর কোনোদিন করবো না!

রমণীটি কোনো কথা বললো না, শুধু চেয়ে রইলো।

পেয়ারা গাছের ডাল থেকে আপনা-আপনিই খসে পড়লো ঘুড়িটা। সেইটুকু শব্দেই বাবলু ভয় পেয়ে দারুণ চমকে উঠলো। ঘাড় ফিরিয়ে ঘুড়িটাকে দেখে বাবলুর লোভটা ফিরে এলেও সেটাকে তুলে নেবার সাহস পেল না।

সে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই স্ত্রীলোকটি কর্কশ গলায় বললো, এই! এদিকে আয়!

বাবলু হাত জোড় করে বললো, আমি আর কোনো দিন আসবো না, আর কোনোদিন এরকম করবো না।

স্ত্রীলোকটি হাত থেকে তাসগুলো ফেলে দিয়ে বললো, এই, আয়, এদিকে আয় বলছি!

আগাছার জঙ্গলে একা বসে থাকা একটি স্ত্রীলোককে বাবলু কিছুতেই রক্তমাংসের মানুষ বলে ধরে নিতে পারে না। কিন্তু এখনো তার বুক কাঁপতে থাকলেও প্রাথমিক ভয়টা ভেঙে গেছে, ডাক শুনে সে কাছে গেল না, এক ছুটে পালালোও না, খানিকটা দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো।

স্ত্রীলোকটি আবার বললো, এই খোকা, আয়, আমার কাছে আয়, তোকে একটা জিনিস। দেবো! তুই কাদের বাড়ির ছেলে রে?

এইবার বাবলু লক্ষ করলো, মহিলাটির মুখখানা প্রায় ফর্সা হলেও তার গলার কাছটা মিশমিশে কালো, তার বাহুতে কালো পোড়া পোড়া ছাপ, তার চোখের মণি দুটো স্থির। ঘন ঘন নিঃশ্বাসে তার বুক দুটি উঠছে আর নামছে।

বাবলু আর দাঁড়াতে পারলো না। উল্টো দিকে ফিরে বন্য প্রাণীর মতন একটা দৌড় লাগালো।

পাঁচিলের গর্ত দিয়ে চলে এসে, চাতালটা পেরিয়ে, বাইরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় সে ধাক্কা খেল একজন লোকের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠলো, আমি কিছু করিনি। আমি…

লোকটি ভৃত্য শ্রেণীর, তার দু হাত ভর্তি জিনিসপত্র, নইলে সে বাবলুকে জড়িয়ে ধরতো। বাবলু মুহূর্তের মধ্যে সেটা বুঝতে পেরে, আবার দৌড় মারলো।

তারপর থেকে সে আর ঐ বাড়িটির পাশের রাস্তাটাতেই নিজে থেকে যায় না কখনো। দৈবাৎ বাবা-দাদার সঙ্গে যেতে হলেও সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে এবং বুকের মধ্যে টিপ ঢিপ শব্দটা নিজের কানে শুনতে পায়।

কিন্তু ঐ আগাছার জঙ্গলে বসে থাকা স্ত্রীলোকটির কথা তার প্রায়ই মনে পড়ে। সে কি সত্যিই মানুষ ছিল? কেউ কি ঐ রকম জায়গায় বসে একা একা তাস খেলে? সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সেই নারীর মর্মভেদী দৃষ্টি। কেন সে আয় আয় বলে ডেকেছিল?

বাবলুর গোপনে পয়সা জমানোটা পিকলু একদিন জেনে ফেলো। তার ফলে বাবলুকে। বিপদে পড়তে হয় একদিন।

পাড়ার কচুরি রাধাবল্লভির দোকানে লেখা আছে, চিল হইতে সাবধান! বাবলু ঐ লেখার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু একদিন আকাশের চিল তাকে দারুণ জব্দ করে দিল।

বাড়ি থেকে বাবলুকে পাঠানো হয়েছে দু টাকার রাধাবল্লভি কিনে আনতে। মস্ত বড় একটা শালপাতার ঠোঙা হয়েছে, তার তলার দিকে আলুর তরকারি, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝোল গড়িয়ে পড়ছে বলে বাবলু এক হাতে টিপে আছে সেই জায়গাটা। ওপরে ঘুড়ির আওয়াজ হলেই তার চোখ সে দিকে চলে যায়।

বোসদের বাড়ির লাল ঘুড়ি একটা পেটকাট্টাকে কাটবার জন্য পড়পড় শব্দে নেমে আসছে। ফলাফল দেখবার জন্য বাবলু সেদিকে তন্ময় হয়ে চেয়ে আছে, হঠাৎ রাস্তার অনেক লোক এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো, এই, এই এই! গেল, গেল, গেল!

বাবলু কিছু বোঝবার আগেই রাধাবল্লভির ঠোঙাটা তার হাতছাড়া হয়ে গেছে, একটা চিল ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছে। সেই ঠোঙা থেকে টুপ টাপ করে রাধাবল্লভি খসে পড়ছে শূন্য থেকে, অন্য দুটি চিল সেগুলো লুফে নেবার চেষ্টা করছে, কোথা থেকে এসে গেছে এক ঝাঁক কাক।

কয়েকদিন আগেই বাবলু একটা শিকারের গল্পে পড়েছিল যে, বন্দুক তুলে রাখা সত্ত্বেও চোখের সামনে একটি খরগোশকে টপ করে তুলে নিয়ে একটা চিতাবাঘ লাফিয়ে পালিয়ে। যেতেই শিকারী রাজা উপেন্দ্রনারায়ণের ‘রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়িতে ইচ্ছা হইয়াছিল’। বাবলুর এখন ঠিক সেই রকম অবস্থা। এখন তার নিজের মাথার চুল ছিঁড়েই শাস্তি পাওয়া উচিত! সে কাল্পনিক বন্দুক তুলে চিলগুলোকে ঠিক টিপ করে পর পর তিনটি গুলিতে খতম করে দিল। সত্যি সত্যি সে একদিন বন্দুক কিনে কলকাতার আকাশ থেকে সব চিল নিশ্চিহ্ন করে দেবে। যখন এখানে একলা শুধু তার ঘুড়ি উড়বে, তখন একটা চিলকেও থাকতে দেওয়া হবে না।

কিন্তু বাড়িতে এসে তো বলতেই হবে। সামান্য চিলের কাছে এরকম পরাজয়ে তার মাথা। হেঁট হয়ে যাচ্ছে, অথচ উপায়ও তো নেই। মমতা এই দুর্ঘটনার কথা শুনে বাবলুকে বকলেন না, শুধু বললেন, থাক, আর তোকে যেতে হবে না, কানুকে পাঠাচ্ছি!

পিকলু এই ঘটনা শুনে কেমন কেমন চোখে যেন বাবলুর দিকে তাকালো।

সন্ধেবেলা পড়ার টেবিলে বসে পিকলু এক সময় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলে, বাবলু, তোর বইয়ের সুটকেসে একটা জদার কৌটো ঝনঝন করে কেন রে? তুই পয়সা কোথায় পেলি!

বাবলু চমকে মুখ তুলে বললো, তুমি আমার সুটকেসে হাত দিয়েছো কেন?

পিকলু বললো, একটা স্কেল খুঁজছিলাম। পয়সা পেলি কোথায়, সেটা বল!

–আমি জমিয়েছি!

–কোথা থেকে জমালি, অত পয়সা!

–যেখান থেকেই জমাই না কেন, তোমার তাতে কী?

–আজ বিকেলে সত্যি দু টাকার রাধাবল্লভি চিলে নিয়ে গেছে! ঠিক করে বল তো? কয়েক মুহূর্তের জন্য বাবলুর সমস্ত রোমকূপ খাড়া হয়ে গেল। দাদা কি ভেবেছে যে সে চিলের গল্প বানিয়ে বলে টাকাটা নিজে নিয়ে নিয়েছে? এ রকম কোনো কথা তো তার মাথাতেই। আসেনি!

দাদা যদি এই কথাটা বলে দেয়, তাহলে মা বাবা সবাই দাদার কথা বিশ্বাস করবে। দাদা ভালো ছেলে, লক্ষ্মী ছেলে, দাদা মিথ্যে কথা বলে না! মা আর পিসিমা যখন গঙ্গা স্নান করতে যায়, তখন দাদা সঙ্গে যায়, বাবলুকে নিয়ে যেতে সাহস পায় না, কারণ বাবলুর দায়িত্বজ্ঞান নেই। দাদাকেই সবাই ভালোবাসে, বাবলুকে কেউ ভালোবাসে না।

উঠে গিয়ে সুটকেস খুলে জদার কৌটোটা নিয়ে সে পিকলুর কোলে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, তোমার যা ইচ্ছে গিয়ে বলো!

পিকলু হাসতে শুরু করে। ছোট ভাইয়ের নামে নালিশ করার কথা সে একবারও ভাবেনি।

সে বললো, কত জমিয়েছিস দেখি তো! মাঝে মাঝে আমাকে ধার দিস!

শীতকালে ঘুড়ি ওড়াবার পাট নেই। পাড়ার ছেলেরা তখন ডাংগুলি খেলে কিংবা ক্যাম্বিসের বলকে ফুটবল বানিয়ে পেটায়। ওরই মধ্য দিয়ে গাড়ি-ঘোড়া চলে। কিছুদিন আগেই সামনের বড় রাস্তায় একটি বাচ্চা মেয়ে লরি-চাপা পড়েছে বলে বাবলুর রাস্তায় খেলা নিষেধ।

কিন্তু ঘরের মধ্যে কিছুতেই বেশিক্ষণ বাবলুর মন টেকে না। পিকলু কিংবা তুতুলের মতন সর্বক্ষণ পড়ার বই কিংবা গল্পের বই মুখে করে বসে থাকার মতন ধৈর্য তার নেই। আর মুন্নিটা বড্ডই ছোট। বাবলুর খেলার কোনো সঙ্গী নেই।

নিষেধাজ্ঞা না মেনে সুড়ুৎ সড়াৎ করে বেরিয়ে যায় বাবলু। একটা জিনিস সে আবিষ্কার করেছে। ঠিক বাড়ির সামনের রাস্তায় না খেলে সে যদি পাশের বস্তিটায় খেলতে যায়, তাহলে বাড়ির কেউ দেখতে পাবে না। বস্তির ছেলেরা পয়সা দিয়ে কড়ি খেলে। এক আনায় দশটা কড়ি। চৌকো ঘর কেটে তার মধ্যে কড়ি ছড়িয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট কড়িটাকে দূর থেকে বাটখাড়া দিয়ে মারতে হবে। লাগলে জিৎ, না লাগলে হার। যার কড়ি ফুরিয়ে যায়, সে অন্যের কাছ থেকে পয়সা দিয়ে কেনে।

বাবলুর বেশ নেশা লেগে গেল। সে মাঝে মাঝেই দু আনা, চার আনা জেতে। বস্তির ছেলেদের কাছ থেকে নতুন নতুন ভাষাও সে শিখছে।

একদিন বস্তির মধ্যে কী একটা মারামারি লাগতেই সব কড়ি-খেলুড়েরা দুদ্দাড় করে ছুটে পালালো। বাবলু বাড়ির দিকে দৌড়ে আসতে গিয়ে পড়ে গেল একেবারে প্রতাপের মুখোমুখি। তার এক হাতের মুঠোয় কড়ি, অন্য হাতে পয়সা।

প্রতাপ বাবলুর ঘাড় চেপে ধরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে এলেন ওপরে। হঠাৎ রাগ এসে গেলে তিনি নিজেকে দমন করতে পারেন না।

শয়ন ঘরে এসে প্রতাপ বাবলুর চুলের মুঠি ধরে প্রথম গর্জন করতে যাবেন, এমন সময় মমতা দৃঢ়ভাবে বললেন, দাঁড়াও!

খাটের ওপর বসে মমতা বাবলুরই একটা ছেঁড়া জামা সেলাই করছিলেন, সে সব রেখে নেমে এসে বললেন, ছেড়ে দাও ওকে! তুমি যখন তখন ছেলেটাকে বকবে আর মারবে? ওর সব সময় দোষ? আর কারুর কিছু দোষ নেই? ওর খেলতে ইচ্ছে করে, খেলবে কোথায়? এইটুকখানা ফ্ল্যাটের মধ্যে এতগুলো মানুষ। তুমি আমাদের এখানে বন্দী করে রেখেছে। সারা জীবনই কি এরকমভাবে কেটে যাবে?

বাবলুকে ছেড়ে দিয়ে প্রতাপ হতবাক হয়ে মমতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মমতার মুখোনি গনগনে লাল। এ যেন সর্বংসহা ধরিত্রীর সহসা অগ্নি-উদগীরণ! মমতা কখনো কোনো অভিযোগ জানান না। এখন বোঝা গেল, তার মনের মধ্যে অনেক তিক্ততা. জন্মেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *