1 of 4

১.২৫ নাপিতের কাহিনী

নাপিতের কাহিনী

দর্জি বলতে থাকে, আমরা সবাই সাগ্রহে চুপ করে বসে রইলাম, আর নাপিত তার কাহিনী শুরু করলো।

আপনারা তো শুনেছেন, আমি বাগদাদের অধিবাসী। আমি যখন বাগদাদ পরিত্যাগ করে আসি তখন বাগদাদের সুলতান ছিলেন অল-মুসতানসির বিল্লাহ। খুব ধাৰ্মিক বাদশাহ।

তার সালতানিয়তে কখনও কোন অনাচার অবিচার ছিলো না। সবাই সুখে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতো। সুলতান সবাইকে, বিশেষ করে গরীব-দুঃখীদের বড় ভালোবাসতেন। জ্ঞানী গুণীর সমোদর করতেন খুব।

একদিন খলিফা খবর পেলেন, শহরের কাছেই দশজন সমাজ-বিরোধী খুনী ছেনতাই-এর আস্তানা আছে। মাঝে মাঝেই তারা হানা দিয়ে গৃহস্থ মানুষের ধনসম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট দেয়। সুলতান তার ছোটা সুবাদারকে বললেন, আমার দেশে এই সব রাহাজনী এ আমি বরদাস্ত করবো না। যেমন করেই হোক তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসো।

একদিন বিকালবেলা টাইগ্ৰীসের উপকূলে বেড়াতে বেরিয়েছি। দেখি, একটা ছোট নৌকায় দশজন লোক চেপেছে। নৌকাটা ছাড়বে বলে নোঙর তুলছে। আমি ভাবলাম, এরা সবাই সান্ধ্য-ভ্বমণে বেরিয়েছে। আমিও সঙ্গী হই তাদের। আপনারা জানেন, আমি খুব অল্প কথার মানুষ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথাও মুখে আসে না। সেই কারণে, তাদের কাছে কোনও অনুমতিও চাইলাম না। অহেতুক কথা বাড়বে। সোজা গিয়ে উঠে বসলাম নৌকায়। নোঙর ততক্ষণ তোলা হয়ে গেছে। এমন সময় একদল সিপাই এসে ঘিরে ফেললো নদীর পাড়। সঙ্গে স্বয়ং দরোগা সাহেব। তার হুকুমে আমাদের সবাই-এর হাতে হাত কড়া, পায়ে বেডি পরানো হলো। গলায় শিকল বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গেলো সোজা সুলতানের দরবারে। সারাটা পথ কেউ কারো সঙ্গে একটি কথাও বললো না। আর আমার কথা তো স্বতন্ত্র। আমি তো প্রয়োজনেই কারো সঙ্গে কথা বলি না। তা আবার ওদের সঙ্গে কি খোশ গল্প করবো?

আমাদের দেখা মাত্র খলিফা জল্লাদকে হুকুম করলেন, এক্ষুণি এই খুনী বদমাইশ দশজনের গর্দান নাও। সুলতানের সামনে আমাদের সবাইকে হাঁটুগেড়ে বসতে বললে। জল্লাদ। আমরা সুবোধ বালকের মতো হাঁটু গেড়ে বসে গলা বাড়িয়ে দিলাম। জল্লাদ তখন তার ফিনফিনে পাতলা তরবারী দিয়ে এক কোপে এক একজনের মুণ্ডু কেটে নামিয়ে দিলো। এইভাবে দশজনের মাথা মাটিতে পড়ে গেলো। বাকী রইলাম আমি। আল্লাহ আমাকে বাঁচাবেন, সুতরাং সুলতান আর কি করে মারবেন। তা না হলে সারির সব শেষেই বা আমাকে দাঁড় করাবে কেন? যাই হোক, দশজনের ধড় মুণ্ডু আলাদা করার পর জল্লাদ তরবারী রেখে দিলো। আমি অবাক। অবাক সকলেই। সুলতান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ওকে বাদ দিলে কেন?

-জী হুজুর, আপনার যেমন হুকুম তাই করেছি।

—আমি তো তোমাকে সবারই গর্দান নিতে বললাম। তাওকে বাদ দিলে কেন?

–নফরের গোস্তাকি মাফ করবেন জাঁহাপনা, আপনি দশজনের জান নিতে বলেছেন, আমি তামিল করেছি। আপনি গুণে দেখুন, হুজুর, দশটা কাল্লা আছে কিনা!

সুলতান এবং সবাই গুণে দেখলেন, হ্যাঁ জল্লাদ ঠিকই বলেছে। হুকুম হয়েছিলো দশজনের প্ৰাণদণ্ড। দশজনকেই কেতিল করেছে সে।

সুলতান বিস্ময় প্রকাশ করলেন।—তবে? তবে এ লোকটা কে? কোথা থেকে এলো সে। এই, এদিকে সামনে এসে দাঁড়াও। কে তুমি? এই খুনী ডাকাতদের দলে এলে কি করে?

আমার স্বভাব কম কথা বলা। তাই এতক্ষণ চুপ করেছিলাম। এবার সুলতান যখন জিজ্ঞেস করলেন, বাধ্য হয়ে তখন আমাকে মুখ খুলতেই হলো। বললাম, ধর্মাবতার, আমি খুব কম কথা বলি বলে লোকে আমাকে সীমিত বলে ডাকে। আপনি যখন আপনার জল্লাদকে হুকুম করলেন ‘এই দশজনের গর্দান নাও’ আমি তখন জানতাম। আপনি ভুল করেছেন। কিন্তু যেহেতু আমি মৌনব্রতী মানুষ, সেই জন্যে আপনি ভুল করছেন জেনেও আমি কোন বাক্য উচ্চারণ করতে পারিনি। কারণ বিনা প্রয়োজনে অহেতুক কথা বলা আমার স্বভাব নয়। আর শুধু কম-কথা বলাই না, আমার আরও বড় গুণ অযথা অন্যের ব্যাপারে কখনও নাক গলাই না। আমার প্রগাঢ় জ্ঞান, বিচক্ষণতা এবং উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসায় সবাই পঞ্চ-মুখ। আমার জাত ব্যবসা ক্ষৌরকর্ম করা। আমরা সাত ভাই। এবার এখানে এদের সঙ্গে কি করে এলাম, সে-কথা বলি। আজ বিকালে নদীর ধারে বেড়াবো বলে টাইগ্ৰীসের উপকূলে গিয়েছিলাম। বেড়াতে বেড়াতে দেখলাম। এই দশজন একটা ছোট নৌকায় চেপেছে। নৌকাটা ছাড়বো ছাড়বো করছে এমন সময় আমি ঠিক করলাম ওদের সঙ্গে নৌকা বিহারে যাবো। আমি নৌকাতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার লোকজন আমাদের গ্রেপ্তার করে ফেলে। আমি তখন বুঝলাম লোকগুলো ডাকাত। কিন্তু যেহেতু আমি মৌনব্বতী মানুষ সেই কারণে আপনার লোকজনদের বা আপনাকে আমি কোন কথা বলিনি। আমি যে নিরপরাধ, নির্দোষ-তা প্রমাণ করার কোনও চেষ্টা করিনি। সারাটা পথ কারো সঙ্গে কোনও কথাবার্তা বলিনি। সেই কারণে আমার সঙ্গে যে আর কারা গ্রেপ্তার হয়েছিলো, কী তাদের পরিচয় কিছুই জানি না।

এইভাবে আমি আপনার দরবারে এসে পড়েছি। আপনার জল্লাদকে যখন হুকুম করলেন গর্দান নিতে, তখনও আমি আমার অসীম ধৈর্য এবং সাহসের পরিচয় দিয়ে চুপ করেছিলাম। আমার মতো সৎসাহসী এবং ধৈৰ্যবান ব্যক্তি আপনি খুব বেশী পাবেন না, হুজুর। এবং আমি জানতাম আমার সততা, আমার সহনশীলতা, আমার অসম-সাহসিকতা এবং সর্বোপরি, আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও ভক্তি আমাকে সমস্ত বিপদ থেকে মুক্ত করে দেবে।

সুলতান আমার কথায় প্রসন্ন হলেন। এবং দরবার কক্ষে সর্বসমক্ষে আমার ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলেন।—তোমার মতো মিতবাক, বিদ্বান, বিচক্ষণ পরোপকারী, নিভীক সাহসী ব্যক্তি বিরল।

অথচ একটু আগে, নাপিত বলতে থাকে, আপনারা শুনলেন সেই ল্যাংড়া যুবক আমার নামে কি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে গেলো। আমি নাকি বাজে বকবক করি। আমি নাকি তার পা-খানা ল্যাংড়া করার একমাত্র গোঁসাই।

সুলতান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, প্রাজ্ঞ সেখ। নাপিত প্রবর, তুমি তো বললে, তোমার আরও ছয় ভাই বর্তমান। তা তারা সবাই কেমন? তোমারই মতো স্বল্পভাষী, বিচক্ষণ জ্ঞানীগুণী তারা?

–না, না, হুজুর, আমি বললাম, একদম না। তারা সবাই আমার থেকে এক্কেবারে আলাদা। আশমান জমিন ফারাক। তাদের সঙ্গে তুলনা করে আপনি আমাকে খাটো করলেন জাঁহাপনা। তাদের অবিবেচকের মতো আনতাবড়া কথা বলা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতা, কাপুরুষতা, অজ্ঞতা, স্বার্থপরতা সর্বজন বিদিত। তাদের মতো চরিত্রহীন হীনমন্য, পরছিদ্রান্বেষী, পরশ্ৰীকান্তর জঘন্য মানুষ খুব বেশী পাওয়া যায় না। দেখতে বেঁটে বামন। আমার চেহারা দেখছেন হুজুর, কেমন লম্বা চওড়া জাঁদরেল, কিন্তু ওরা একজন খোঁড়া, একজন কানা, একজনের মুখ পোড়া, আর একজন একেবারেই অন্ধ, আমার পঞ্চ ভ্রাতার নাকটা নাই। আর ষষ্ঠজন কানে শুনতে পায় না।

আপনি ভাববেন না, জাঁহাপনা, এতোটুকু বাড়িয়ে বলছি জঙ্গলঃ আমি। এক এক করে তাদের গুণের কথা সব বলছি আপনাকে, শুনলেই বুঝবেন ওদের সঙ্গে আমার কতো ফারাক।

 

নাপিতের প্রথম ভাই বাকবুকের কাহিনী :

আপনি তো শুনেছেন, জাঁহাপনা, আমার বড় ভাই বাকবুক ল্যাংড়া। তাকে সবাই বাকবুক বলে ডাকে, তার কারণ-সব সময় মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের করে-ঠিক যেনো মনে হয়, ভরা কুঁজে থেকে জল ঢালা হচ্ছে।

এক সময়ে বাগদাদ শহরে দর্জির কাজ করতো। একটা ছোট্ট দোকানে সেলাই-এর কাজ করতো সে। দোকান ঘরটা ভাড়া নিয়েছিলো এক বিরাট সওদাগরের কাছে। সেই বাড়িরই উপরতলায় থাকতো তার বাড়িওলা। আর নিচে ছিলো একটা কলুর ঘানি। আর তার বলদ রাখার একটা ছাপরা;

একদিন আমার ভাই বসে কাজ করছিলো তার দোকানে। এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়লো, ওপর তলার কডিডোরে দাঁড়িয়ে একটি বিবি একমনে রাস্তার লোকজন দেখছে। পরে জেনে ছিলো বাড়িওলার বিবি সে। তার হরিণ চপল চোখ আর পিনোদ্ধত বক্ষ দেখে ওর মনের মধ্যে ভালোবাসা আঁকুপাকু করতে থাকে। একেবারে প্রথম দর্শনেই প্রেম। সারাদিন আর সূচে সুতো ভরলো না। এক ফোড় সেলাই করতে পারলো না। সারাদিন। মুখ তুলে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবার যদি সে কডিডোরে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু না, সেদিন আর এলো না তার মানসী। পরদিন খুব সকালে এসে দোকান খুললো। সূৰ্চ সুতো নিয়ে বসলো। কিন্তু চোখ তার চাতালে। কখন করিডোরে এসে দাঁড়াবে সে, নয়ন স্বার্থক হবে। এই আশায় ঘন ঘন তাকাতে লাগলো। ফলে সারাদিনে যতবার কাপড়ে না সূচ ফুড়লো তার চেয়ে বেশীবার বিধিলো তার আঙ্গুলে। কিন্তু সেদিনও সারা দিনে তার দেখা মিললো না। এইভাবে আরও কয়েকটি দিন কেটে গেলো, কিন্তু তার আর দেখা পাওয়া গেলো না। সে আর কডিডোরে এসে দাঁড়ালো না। এদিকে কাজকমেও কিছুই এগোলো না। রোজগার পাতির নামে লবডঙ্কা। ফলে যা হবার তাই হলো। বাজারহাট হয় না। হাডি না চড়ার হাল!

বাড়িওলার বিবিটা ইচ্ছে করেই এই নাচানোর খেলায় মেতেছিলো আমার ভাই-এর সঙ্গে। সে চেয়েছিলো, দুইদিক থেকে সে তাকে দেওলিয়া করে দেবে। প্রথমত তার রুজিরোজগার বন্ধ করা, দ্বিতীয়ত তার বুকে ভালোবাসার আগুন ধরিয়ে দেওয়া। এক ধরনের মেয়ে আছে—যারা পুরুষদের নাচিয়ে তাদের কাজকাম নষ্ট করে আনন্দ পায়। সে ছিলো সেই জাতের ছোড়া-নাচানো ছেনাল।

একদিন বাকবুক তার দোকানে বসে আছে খন্দেরের আশায় এমন সময় মেয়েটি এসে দাঁড়ালো করিডোরের সামনে। আমার নির্বোধ ভাই-এর বুকে আগুন ধরে গেলো। সে ভাবলো, মেয়েটি তার প্রেমে পড়েছে। কিন্তু সে তো জানতো না, এই ধরনের মেয়েদের এটা একটি ফাঁদ ফেলার কায়দা। এর আগেও সে এইভাবে একটু হোসে, একটু চোখ মেরে বহু ছেলের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।

পরদিন সকালে বাড়িওলা নেমে এলো। হাতে তার এক থান রেশমী কাপড়। বললো, আমার কয়েকটা কোর্তা করে দিতে হবে।

দর্জি তো হাতে স্বৰ্গ পেলো। বললো, নিশ্চয়ই করে দেবো। মাপটা দিয়ে যান।

সারাদিন ধরে কুড়িটা কোর্তা বানালো সে। সন্ধ্যেবেলা বাড়িওলা এলো। কোর্তাগুলো দেখে খুব খুশি। বললো, বাঃ খুব সুন্দর হয়েছে। তা কতো দিতে হবে?

এমন সময় করিডোরে এসে দাঁড়ালো সেই মেয়েটি। চোখের ইশারা করে, আর হাত নেড়ে জানালো, মজুরী নিও না।

তখন বাকবুক গদগদ হয়ে বললো, না না, সে কি! আপনার নিজের ব্যবহারের জন্যে কাঁটা কোর্তা বানিয়ে দিলাম, তার জন্যে মজুরী নিতে পারি? না না, সে হয় না।

সেদিন আমার ভাই-এর হাতে একটা কানাকডিও নাই। বাড়িতে সবাই উপোষ করে আছে। দুপুরে তার নিজেরও খাওয়া হয়নি। অথচ নিজের কাজের ন্যায্য মজুরীটা হাত পেতে নিতে পারলে না—এমনই রামছাগল। সে ভাবলো, তার স্বামীর পোশাক সে বিনি। পয়সায় বানিয়ে দিয়েছে বলে মেয়েটি তার ওপর আরও প্রসন্ন হবে। কিন্তু বোকাটা জানে না, এটা তাদের স্বামী-স্ত্রীর যুক্তি করা চাল।

পরদিন সকালে আবার এলো বাড়িওলা। বগলে এক বোঝা কাপড়। বললো, কোর্তাগুলো ভারি সুন্দর বানিয়েছে, ভায়া। কিন্তু ওর সঙ্গে মানান-সই পাতলুন না হলে তো পরে সুখ নাই। তাই পাতলুনের কাপড় কিনে এনেছি। যে কটা হয়, বানিয়ে দাও।

বাকবুক বললো, বিলক্ষণ, খুব ভালো মানাবে কোতাঁর সঙ্গে। আজই করে দিচ্ছি।

সারা দিন না খেয়ে না দেয়ে, খুব যত্ন নিয়ে কুড়িটা পাতলুন বানালো সে। বাড়িওলার অপেক্ষায় না থেকে নিজেই নিয়ে গেলো। সে ওপর তলায়। বাড়িওলা দেখে খুব প্রশংসা করলো, তোমার হাত বড় চমৎকার। এমন সূক্ষ্মকাজ সবাই করতে পারে না। তা তোমার মজুরী কতো? কী দিতে হবে বলো?

এমন সময় দরজার পাশে দু’টো চোখ উকি দিলো। বাড়িওলার বিবি এসে দাঁড়িয়েছে। ভাই-এর আমার অবস্থা তখন কাহিল। সারাদিন যার চিন্তায় সে বিভোর, একবার চোখে দেখার জন্যে হা পিত্যেশ করে চেয়ে ঠ থাকে ওপরে, সে এখন তার এতো কাছে, একেবারে চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটি চোখের ইশারা করে, ঘাড়নেড়ে বোঝালো, নিও না, কোন পয়সাকডি নিও না। হাতে একটা দিরহাম নাই। সেই জন্যে সারা দিন নাস্তা পানিও করতে পারেনি সে। পয়সার বড় প্রয়োজন। কিন্তু মেয়েটার ইশারায় সব গোলমাল হয়ে যায়। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, না না, এর জন্যে আপনাকে কিছু দিতে হবে না। গায়ে গাঁতরে খেটে আপনার একটু উপকারে আসতে পেরেছি। তাতেই আমি ধন্য।

বাড়িওলা টাকা বের করে ওর হাতে দিতে যাচ্ছিলো। বাকবুকের আপত্তি দেখে টাকাগুলো আবার জেবে ভরে ফেললো। সবটাই পূর্ব-পরিকল্পিত সাজানো ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে স্যাট করে তাকে নাস্তানাবুদ করছে। আমার গর্দভ ভাই কিন্তু সে-সব বুঝতে পারে। না।

বাড়িওলা বললো, তুমি আমাদের জন্য এতো করছে, আমার বিবি বলছেন, এর একটা প্রতিদান দেওয়া দরকার। টাকা পয়সা যখন হাত পেতে নেবেই না, অন্য কীভাবে তা পুষিয়ে দেওয়া যায়, সে বিযয়ে উনি একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তার হয়ে আমি তোমাকে বলছি। আমাদের বাড়িতে একটা এদেশীয় ঝি আছে। বয়স অল্প, দেখতে ভারি সুন্দর। একেবারে ডাগর। তোমার সঙ্গে খুব ভালো মানাবে। আমার বিবি চান, তুমি মেয়েটাকে শাদী করো। তাহলে তো তুমি আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে থাকবে।

বাকবুক ভাবলো, এ-সব তার বিবির চাতুরির খেলা। ওই মেয়েটার সঙ্গে তার শাদী হলে বাড়ির অন্দরে ঢোকার অবাধ গতি হয়ে যাবে তার। তার পর তার সঙ্গে আচ্ছা-সে। মহব্বৎ করতে আর বাধা কোথায়? বাড়িওলার বিবির এই কৌশল দেখে বাকবুক অবাক হয়। মেয়েছেলের কি বুদ্ধি! স্বামীকে কলা দেখিয়ে তার সঙ্গে প্রেম করবে, তার জন্যে কি চমৎকার মতলব সে এটেছে। বাকবুক বললো, আপনারা দুজনেই যখন চান, আমার কোনও অমত নাই।

পর দিন বিনা আড়ম্বরে শাদী হয়ে গেলো। নিচের ঘানি ঘরে ওদের বাসর শয্যা পাতা হয়েছিলো। কারণ দোকান ঘরটা ছোট। ঘানির ঘরটা অনেক বড়। সার রাত যাতে তারা বেশ সুখে স্বচ্ছন্দে কাটাতে পারে সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা। মনে অনেক আশা নিয়ে বাসর ঘরে গেলো আমার ভাই। কিন্তু সদ্য শাদী করা বিবি তার বিমুখ। বললো, আজ কিছু হবে না, আজ আমার শরীর খারাপ হয়েছে। মেয়েদের শরীর খারাপ হলে শোয়া দূরে থাক, পুরুষের সঙ্গে এক বিছানায় বসতেও হয় না। তাই আজ রাতে একাই তুমি থাকো এখানে। আমি ওপরে শোবো।

এই বলে পাত্রী উপরে পার হয়ে গেলো। আর আমার ভাই মনের দুঃখে একলা শুয়ে রইলো সেই ঘানি ঘরে, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলো চেচামেচি চিৎকারে। ঘানি ঘরের মালিক রেগে আগুন। আমার হুকুম ছাড়া আমার কারখানায় ঢুকেছো। দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি।

এই বলে সে আমার ভাই-এর ঘাড় ধরে হিডি হিডি করে টেনে নিয়ে গেলো ঘানির জোয়ালে, আজ ব্যাটা তোকে দিয়েই টানাবো। নে ধর, খুব জোরে জোরে ভালো করে টানবি, না হলে পিটিয়ে লাট করে দেবো।

সপাং করে চাবুকের ঘা পড়লো পিঠে-কথা কানে যাচ্ছে না। আমার খদ্দোররা এসে পড়বে এখুনি। তাদের তেল দিতে হবে। আর নবাব পুত্তুর চলেছেন গজেন্দ্র গমনে! এইভাবে ঘানি টানলে সারা দিনে কতটুকু তেল বেরুবে? আমার একটা খদেরও যদি ফিরে যায়, তোর পিঠের ছাল চামড়া আমি তুলে দেবো। এখনো বলছি, বাপের সুপুত্ত্বরের মতো পা চালিয়ে টানো, তা না হলে দেখছো এই চাবুক-তোমার পিঠে ভাঙ্গবো।

এই বলে আবার সপাং সপং করে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলো তার পিঠে-পাছায়। মারের চোটে বাই বাই করে টেনে ঘোরাতে লাগলো ঘানি। সারাটা দিন একটানা। তারপর বিকালে যখন ছাড়া পেলো, শরীরের আর কিছু নাই। মরার মতো অসাড়া অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইলা দোকানে। সারা গা হাত পা ব্যথায় টনটন করছে। চাবুকের ঘায়ে কেটে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে পিঠে-পাছায়।

বাড়িওলা এসে অনেক দুঃখ জানালো, আহা-হা একি হয়েছে তোমার দশা! আমি ভাইবাড়ি ছিলাম না, তাই এই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। যাক যা হয়ে গেছে তার তো আর চারা নাই। মনে কোন দুঃখ করে না ভাই। এটা একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই না। আমি থাকলে এমনটা ঘটতে পারতো না।

বাড়িওলা মনে মনে হাসলো। ব্যাটার প্রেম করার সাধ মেটাচ্ছি।

বাড়িওলা দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেলে চাকরানীটা এলো। বললো, মালকিন শুনে তোমার দুঃখে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। এতো বড়ো মারাত্মক ভুল কি করে হলো এই নিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে ভীষণ ঝগড়া করেছে।

চাকরানীটা চলে গেলে এলো সেই শাদীর সাক্ষী। গতকাল সে শাদীর কবুল নামায় একমাত্র সাক্ষী সেজেছিলো। বাকবুককে বললো, তা ভাইসব, শাদীর প্রথম রাতটা কাটলো কেমন? দেখে মনে হচ্ছে, পাত্রী তোমাকে সুখের সায়রে ডুবিয়ে রেখেছিলো। তা হবে না কেন বলো? আমন কচি বয়স। আর কি মজবুত শরীরের বাঁধুনী। একেবারে ভরা যৌবন। অমন ডবকা মেয়েকে নিয়ে রাত কাটালে শরীর তো এমন নেতিয়ে পড়বেই। তা ভালো তা ভালো, দেখে খুব খুশি হলাম। তোমার মধু-যামিনী বড় মধুর কেটেছে।

বাকবুক আর কি বলবে। চুপ করে সব শুনলো। আর মনে মনে জ্বলতে লাগলো।—মধুযামিনী!

সাক্ষী বললো, মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো। দেখো, শুধু গত রোতই না, জীবনের প্রতিটি রাত্রিই সে তোমাকে মধু ঢেলে দেবে। তার ভালোবাসায় ভরে যাবে তোমার জীবন।

বাকবুক তখন রাগে ফুসছে। মনে হতে লাগলো, এই ধাপ্লাবাজ লোকটাকে একটা লাথি মেরে দোকান থেকে নিচে ফেলে দেয়। কিন্তু পারে না। শুধু চিৎকার দিয়ে ওঠে, থামো, তোমার ওই সব মন ভোলানো কথায় আমার জ্বালা জুড়াবে না। ফুলশয্যা, মধুযামিনী? শালা, সারাদিন ধরে আমাকে কলুর ঘানি টেনে মরতে হয়েছে—আর উনি এসে আমাকে রঙের রসের বাক্যি শোনাচ্ছেন। দূর হও তুমি, আমার দোকান থেকে। তোমাদের জন্যেই আমার আজ এতে কষ্ট। তোমরা সব শালা, শয়তান, বদমাইশ!

লোকটা এবারে থাতমত খেয়ে যায়। একটু পরে বলে, তা সবই নসীবের খেলা। তোমার ভাগ্য মন্দ। তা না হলে প্রথম শাদীর রাত এই ভাবে কাটে কখনও? আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটার রাশিচক্ব তোমার সঙ্গে এক্কেবারে উল্টো। মোটেও খাপ খাবে না। তুমি এক কাজ করো, ওকে তালাক দিয়ে দাও।

—বালা তো খুব সোজা। কিন্তু বলি, তালাক দিতে গেলে যে আক্কেল সেলামী লাগবে সেটা দেবে কে? তুমি দেবে? দূর হও তুমি আমার সামনে থেকে। তোমাদের শয়তানীর জন্যেই আজ আমার এই দশা।

লোকটা চলে যাওয়ার একটু পরে আবার এলো সেই চাকরানীটা। ফিসফিস করে বললো, আমার মালকিন তোমার প্রেমে পাগল, সে বলছে তোমাকে কাছে না। পেলে সে গলায় দড়ি দেবে। আমার ডর লাগছে, তুমি যদি রাজি না হও, সে তো তবে আত্মঘাতী হবে। আজ রাতে আমাদের মালিকবাড়ি ফিরবে না। কি যেনো কাজে বাইরে গেছে। তুমি যদি মেহেরবানী করে একটিবারের জন্যে তার ঘরে যাও, তোমাকে পেলে তার সব জ্বালা যন্ত্রণা মিটে যাবে। একটিবার সে তোমাকে কাছে পেতে উইিকেত চায়, আদর করতে চায়। আজ রাতটা তোমাকে খাটে নিয়ে খুব মৌজ করে আনন্দ করতে চায়। আমার কথা বিশ্বাস না হয় তুমি একবার করিডোরের দিকে চেয়ে দেখো। সে দাঁড়িয়ে আছে, কখন তুমি একবার চোখ তুলে তাকাবে, সে তোমাকে প্ৰাণ ভরে একবার দেখবে–শুধু এই আশায়।

বাকবুক বিগলিত হয়ে গেলো। উপরে তাকাতেই দেখতে পেলো, তার প্রিয়া তার মানসী। সাশ্রু নয়নে দাঁড়িয়ে আছে তারই দিকে চেয়ে। চোখে চোখ পড়তেই সে দু’হাত এক করে কাতর কাকুতি জানাতে লাগলো। আকারে প্রকারে জানালো, আজ রাতে মালিকবাড়ি থাকবে না, তুমি আমার ঘরে এসো। সারা রাত আমরা এক সঙ্গে কাটাবো। আরও বোঝালো, আমার এই দেহ, আমার এই দিল, সে শুধু তোমারই জন্যে। তোমাকে কাছে নিতে পারি না বলে এ যৌবন আমার বিফলে চলে যাচ্ছে।

এর পরে আর কোন ক্ষোভ থাকে না। মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মনে হয়, সব ক্লান্তি সব ব্যথা-কষ্ট নিমেষে জল হয়ে গেলো! ঘাড় নেড়ে জানায়, যাবো, নিশ্চয়ই যাবো। আজকেই হবে। আমার সত্যিকারের বাসর-রাত-মধুযামিনী.

মনে স্ফুর্তি নিয়ে আবার কাজে মন দিলো। মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলো। আজ রাতে সে যাবে অভিসারে। তার প্রিয়া প্রতীক্ষা করে বসে থাকবে তার পথ চেয়ে। তারা আজ একসঙ্গে খানা পিনা করবে। তারপর তার এতোকালের সাধ আজ সে প্ৰাণ ভরে মেটাবে। তাকে নিয়ে সারা রাত ধরে কতো গল্প করবে, কতো আদর করবে। গোপন মিলনের বাসনায় দেহ-মনে এক অপূর্ব আনন্দের শিহরণ জাগে।

কিন্তু ওদিকে ওপরতলায় বাড়িওলা আর তার বিবি তখন নতুন ফন্দী আঁটছে। লোকটার আহম্মকী ভেবে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে দুজনে। স্বামীটা বললো, দেখো বিবি, আজ রাতে লোকটা যখন তোমার ঘরে আসবে তখন কি করবো বলে তো? আমার মনে হয়, তার আগে কোতোয়ালিতে একটা খবর দিয়ে রাখা ভালো।

বিবি বললে, সে জন্যে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না, যা করার আমিই করবো। ভালোবাসার সখ ওর চিরজন্মের মতো ঘুচিয়ে দেবো।

তাদের এই বদ মতলবের কোন কিছুই জানতে পারলো না সে। রাত যখন একটু গম্ভীর হয়ে এলো, চাকরানীটা এসে তাকে উপরে নিয়ে গেলো। বাড়িওলার বিবি ওকে সাদরে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো।—তোমার পথ চেয়েই বসে আছি, সোনা। তোমাকে দেখার জন্যে বুকের মধ্যে আঁকুপাকু করছে। শুধু ভাবছি, কখন রাত হবে, কখন আমার স্বামী হতচ্ছাড়াটা বিদেয় হবে। তোমাকে কাছে পাবো। আমার দেহের জ্বালা জুড়াবো।

আর থাকতে পারে না বাকবুক। মেয়েটার ভালোবাসার কথায় তার শরীর গরম হয়ে ওঠে। চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে যায়। তার দিকে। ছলনাময়ী নারী তখন তাকে নিরস্ত করে।—না, না, এখন না। আগে একটু বসে। খানাপিনা করি। তারপর সারা রাত ধরে তুমি আর আমি-শুধু ভালোবাসা করবো।

মেয়েটির কথায় শক-খাওয়া খরগোসের মতো আবার ফিরে এসে বসে পড়ে চেয়ারে। মনে মনে লজ্জা পায়। তাই তো, রাতভর যাকে নিয়ে শুয়ে কটাব, এখনই তাকে দিলামলাই করার জন্যে অধৈৰ্য হচ্ছে কেন সে?

এমন সময় দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো তার স্বামী-বাড়িওলা। তার সঙ্গে দু’জন নিগ্রো। দমা দম কয়েকটা ঘুসি মেরে নিচে ফেলে দিলো আমার ভাইকে। তারপর আষ্টেপিষ্টে বাঁধলো, রশি দিয়ে। চাবুকের ঘায়ে কেটে সারা শরীরে রক্ত ঝরতে লাগলো। কিন্তু এখানেই শেষ না, মার খেতে খেতে সে যখন অচৈতন্য, ওকে কাঁধে করে নিয়ে গেলো। ওরা কোতোয়ালিতে। কোটালের কাছে।

দুশো ঘা বেত লাগানো হলো তার পিঠে। তারপর একটা উটের পিছনে বেঁধে সারা শহর টেনে ঘোরাবার হুকুম দিলে কোটাল। উটের পিছনে বাঁধতে–যাওয়ার সময় বিকট চিৎকার করে পা ঝাড়া দিয়ে লাফিয়ে উঠেছিলো উটটা। আর সঙ্গে সঙ্গে ভাই আমার ছিটকে পড়ে। সাত হাত দূরে।

সেই সময়ই তার পায়ের একটা হাড় ভেঙে যায়। সেই থেকে সে ল্যাংড়া-লাঠি নিয়ে খুঁডিয়ে খুঁডিয়ে সামান্য চলা-ফেরা করতে পারে। কোটাল তাকে কিছুকালের জন্য শহর থেকে বহিষ্কারও করে দিয়েছিলো। এখন সে আবার ফিরে এসেছে। আমার কাছেই আছে। বিশেষ চলাফেরা করতে পারে না। কাজ কামই বা করবে কি করে। আমার। ঘাড়েই খায়।

খলিফা আল-মুসতানসির বিল্লাহ আমার ভাই-এর এই কাহিনী শুনে হেসে গড়িয়ে পড়লেন। বাহবা দিয়ে বললেন, বাঃ সেরা তোমার কাহিনী। আর চমৎকার তোমার গল্প বলার কায়দা।

আমি বললাম, জাঁহাপনা, এতো শুধু আমার এক ভাই-এর বোকামীর কাহিনী শোনালাম। আমার আর সব ভাইদের কীর্তি কাহিনী যদি শোনেন আরও মজা লাগবে আপনার। এবং তখন বুঝতে পারবেন, আমার ভাইদের থেকে কতো ভিন্ন আমার স্বভাব প্রকৃতি কতো আমার বিচক্ষণতা এবং কতো আমি মিতভাষী?

খলিফা বললেন, সে আমি এখনই বেশ বুঝতে পারছি। যাই হোক, এক এক করে তোমার সব ভাইদের কাহিনীগুলো বলো। শুনতে ভারি আমোদ লাগছে।

এবার আমার দ্বিতীয় ভাই অল-হাদ্দারের কাহিনী শুনুন, জাঁহাপনা।

 

নাপিত বলতে থাকে :

তাকে সবাই অল-হাদার নামে ডাকতো। তার কারণ উটের মতো গলাটাকে একবার সামনে বাড়িয়ে দিতো এবং পরীক্ষণেই আবার পিছনে টেনে নিতো। আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ তুলতো, মনে হতো উটের ডাক। তার মুখটা ছিলো পোড়া কয়লার মতো। দেখতে বড় বিশ্ৰী। অহেতুক মেয়েদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সে যে কতরকম কাণ্ডকারখানা করেছে তার সীমা সংখ্যা নাই। তার একটা ঘটনার কথা শোনাই আপনাকে।

একদিন সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলো, এমন সময় এক বৃদ্ধ এসে তার কাছে একটা প্রস্তাব করলো, শোনো বাছা তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। তুমি সেটা শুনতেও পারো, আবার নাও শুনতে পারো। সবই তোমার খুশি।

হাদ্দার বললো, বেশ তো, বলো না শুনছি।

বৃদ্ধা বললো, বলবো, আমার প্রস্তাব শোনার পর তোমার যদি মনে হয়-তুমি তাতে রাজি হতে পারো, অথবা গররাজীও হতে পারো। কিংবা চিন্তা করে দেখতে পারো রাজি হতে পারো কি পারো না।

হাদ্দার বললো, ঠিক আছে। বলো, শোনার পর বলবো, রাজি হবো কি হবে না।

বৃদ্ধ বললো, একটি শর্ত আছে, বাবা। আমার প্রস্তাব শুনে, অযথা ফালতু কোন প্রশ্ন করবে না। আনতাবাড়ী কোন কথাবার্তা বলবে না।

হাদার বললো, ঠিক আছে, তাই হবে। এবার বলে।

বৃদ্ধ বললো, তোমাকে আমি এক সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতে পারি যার মনোহর দৃশ্য দেখলে তুমি আর ফিরে আসতে চাইবে না। কুলকুল করে নদী বয়ে চলেছে। চারদিকে ফলেফুলে ভরা নানা জাতের লতা গুল্ম বৃক্ষ। ঝর্না দিয়ে ঝরে পড়ছে সরোব। আর চারদিকে বেহেস্তের পরীর মতো খুবসুরৎ সব মেয়ে-গান গাইছে নাচছে আর আনন্দে এ-দিক ও দিক ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। তুমি যাওয়ামাত্র তোমাকে ঘিরে ধরবে তারা। তোমাকে আদর করবে। চুমু খাবে। তারপর সারারাত তোমাকে নিয়ে শুয়ে থাকবে। তোমাকে আমি সেই স্বপ্নের দেশে, সেই প্রমিলা সঙ্গমে নিয়ে যাবো-কিন্তু একটা শর্ত তোমাকে মানতে হবে।

আমার ভাই হাদ্দার অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কিন্তু দুনিয়াতে এতো মানুষ থাকতে আমাকেই বা সেখানে নিয়ে যেতে চাও কেন? আমার মধ্যে কী গুণ দেখলে?

—আমি তো তোমাকে আগে বলেছি, বাছা, অহেতুক ফালতু প্রশ্ন করবে না বা অযথা কৌতূহল জানাবে না। আমি যা বলি, শোনো, কোনও প্রশ্ন করো না।

আর একটি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বৃদ্ধ তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো এক প্রকাণ্ড প্রাসাদে। প্রাসাদটা বাইরে থেকে দেখতে যতো না সুন্দর ভিতরটা তার চেয়ে অনেক বেশি। প্রাসাদের দোতলায় উঠে এলো তারা। সেখানে দেখলো, চারটি পরমাসুন্দরী মেয়ে মেজের গালিচায় বসে সুর করে গান করছে। কি অপূর্ব তাদের কণ্ঠ। কি মিষ্টি।

মেয়েদের মধ্যে যে সবচেয়ে সেরা সুন্দরী সে উঠে এসে স্বাগত জানালো তাকে। এক পেয়ালা সরাব এনে ধরলো তার ঠোঁটে। আমার ভাই খেলো। আরও এক পেয়ালা ভরে এনে দিলো সে। সে পাত্বও টেনে নিলো হাদার। এবার মেয়েটি সরে এসে তার গলাটা এক হাতে চেপে ধরে আর এক হাতে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো তার গালে।

আমার ভাই খুব রেগে ওঠে। উঠে চলে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু বৃদ্ধ চোখের ইশারা করে বলে, না যেও না, বসে।

হাদার ভাবলো, সে বৃদ্ধার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই আবার বসে পড়ে। মেয়েটি তাকে থাবড়াতে লাগলো, চিমটি কাটতে লাগলো, শেষে এলোপাথাড়ী কিল আর লাথি মারতে থাকলো। বাকী তিনটি মেয়েও কিন্তু চুপ করে বসে রইলোচনা। একজন মাথার চুল ধরে টানতে লাগলো, আর একজন কান দু’টো মলতে থাকলো আর অন্যজন তার ধারালো নখ বসিয়ে দিলো তার গালে।

এই সব অসহ্য কাণ্ডকারখানা যখন চলছে, বৃদ্ধ কিন্তু তখন বলছে ধৈর্য ধরে চুপচাপ বসে থাকো বাছা। কোনও কথা বলে না, কোনও প্রতিবাদ করো না।

আমার ভাই হাদার অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিলো। একটা কথাও বললো না। এতো চড়াচাপড় লাথি খেয়েও কোনও রা-টি করলো না। অবশেষে প্রথম মেয়েটি হাদারকে তুলে দাঁড় করিয়ে তার জামা পাতলুন সব খুলে নিলো। একেবারে ন্যাংটো করে ফেললো তাকে। তারপর একটা সোনার পিচকারী এনে তার সারা গায়ে গোলাপ জল পিচকারী করে দিলো। এবং বললো, আমি কোনও দাঁড়ি গোঁফওয়ালা মানুষকে সহ্য করতে পারি না। তারা যখন চুমু খায় তখন আমার নরম গালে বিশ্ৰী খোঁচা লাগে। তুমি যদি আমার সঙ্গে ভালোবাসা করতে চাও তবে আগে তোমার ঐ বিশ্ৰী দাড়ি গোঁফগুলো কমিয়ে এসো।

সেই বৃদ্ধ তখন হাদারকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে ক্ষুর দিয়ে তার দাড়ি গোঁফ আর ভুরুন্টুরু সব কামিয়ে দিলো। তারপর লাল আর সাদা রঙের ডোরা কেটে দিলো তার সারা মুখে। পাশের ঘর থেকে এ ঘরে এসে মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়াতেই মেয়েগুলো ওরা ওই চেহারা দেখে প্রথমে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর হো হো করে হেসে মেজেতে গড়াগডি যেতে লাগলো।

প্রথম মেয়েটি উঠে এসে বললো, মালিক তোমার অপরূপ রূপে আমি মুগ্ধ। এবার একটু নাচো।

হাদ্দার বুঝলো তামাশা করছে। ক্ষুব্ধ হয়ে সে ফিরে দাঁড়ালো। কিন্তু মেয়েটি সামনে এসে ওর দুটি হাত ধরে কাছে টেনে বললো, রাগ করলে? কিন্তু সত্যি বলছি, তোমার এই মন ভোলানো রূপে আমি পাগল হয়ে উঠেছি। এবার একটু নাচোঁ। তারপর আমরা ভালোবাসা করবো।

অতঃপর এক টুকরো রেশমী কাপড় কোমরে জড়িয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নাচলো সে উদ্দাম নৃত্য। তার আসুরিক কায়দায় হাত-পা চালনার ফলে ঘরের ফুলদানী মদের ঝারি, গেলাস অনেক কিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে লাগলো। মেয়েরা হেসে লুটোপুটি হলো।

নাচ তখনও চলছে, প্রথম মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। এবং এক এক করে সব জামা কাপড় খুলে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। আর এমন অঙ্গভঙ্গী করতে থাকলো, যা দেখে আমার ভাই-এর অবস্থা তখন তুঙ্গে। সারা শরীর শির। শির করতে থাকে। মাথাটা গরম হয়ে ওঠে। চোখ দুটো ছানাবড়ার মতো গোল গোল হয়ে যায়। এসব কি দেখছে সে? এসব কি করছে মেয়েটা। উফা! সে আর চাইতে পারছে না। হাদার নাচ থামিয়ে দিলো।

বৃদ্ধ বললো, মেয়েটা ছুটবে, তোমাকে কিছুতেই ধরা দিতে চাইবে না। কিন্তু তোমার কাজ হবে, যেন তেন-প্রকারেন তাকে ধরে ফেলা। এটাই এখানকার রীতি। মেয়েটা এঘর থেকে ওঘরে, ওঘর থেকে সে-ঘরে তোমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলবে। তোমার একমাত্র লক্ষ্য-তাকে ধরা। ধরতে পারলেই সে তোমার অঙ্কশায়িনী হবে।

মেয়েটি দৌড় শুরু করে, আর হাদার তাকে ধরার জন্যে তার পিছনে পিছনে ছুটতে থাকে। মেয়েটি বই বঁই করে ছুটে দু-দুবার ঘুরে এলো সারা মহল, কিন্তু হাদার তাকে ধরতে পারলো না।

এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

একত্রিশতম রজনী।

আবার গল্প শুরু হয়। শাহরাজাদ বলে, তারপর শুনুন শাহজাদা, চীন-সুলতানের সামনে দাঁড়িয়ে সেই দর্জিতার কাহিনী বলে চলেছেঃ

নাপিত তার দ্বিতীয় ভাই অল-হাদ্দারের নিবুদ্ধিতার সেই কাহিনী শোনাচ্ছে বাগদাদের সুলতান সমীপে :

হাদার তখন উন্মত্ত হয়ে ধাওয়া করে চলেছে সেই মেয়েটির পিছনে পিছনে। মেয়েটি হাসছে, আর কায়দা করে তাকে পাশ কাটিয়ে পালাচ্ছে।

বাকী তিনটি মেয়ে মজা পেয়ে হেসে লুটিয়ে পড়ছে। ধরি। ধরি করেও যখন ধরতে পারছে না, হাততালি দিয়ে উঠছে।

মেয়েটি এবার সিঁড়ি বেয়ে তার তার করে উপরে উঠে পালায়। ছেলেটি যায়। পিছনে পিছনে। এঘর ওঘর তাড়া করে ছুটতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারে না। একবার মেয়েটি পাশের একটা ঘরে ঢুকতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে হোচট খেয়ে ছিটকে পড়ে যায়। হাদার ভাবে, এইবার আর সে পালাতে পারবে না। ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ঘরের ভিতরটা মিশমিশে কালো—অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। হাদার অন্ধের মতো হাতড়ায়। কোথায় গেলো মেয়েটা? এপোশ ওপাশ হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু চোখে কিছু দেখা না গেলে খুঁজে পাবে কি করে? অন্ধকারের মধ্যে তাই আন্দাজে চলতে চলতে এক সময় বিপত্তি ঘটে। বুঝতে পারেনি কার্নিশে পা পড়তেই উল্টে গিয়ে পড়লো নিচে রাস্তায়। একটা মুচির দোকানের সামনে। দোকানের মালিক বেরিয়ে এসে দেখে, একটা কিন্তুত কিমাকার লোক-সম্পূর্ণ উদ্দাম, দাড়ি গোঁফ ভুরু কামানো সারা মুখে লাল সাদা রঙের ডোরা কাটা, যেন একটা জোকার—উপর থেকে পড়ে গেছে। দোকানী ভাবলো, লোকটা চোর বদমাইশ। সবাই মিলে বেদম পেটালো। অতোটা উপর থেকে পড়ে গেছে, তার উপর চামড়ার চাবুকের পিটানি সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়লো হাদার। তখন সেই মুচি তাকে একটা গাধার পিঠে চাপিয়ে কোতোয়ালিতে নিয়ে এলো। কোটালের প্রশ্নের জবাবে মুচি বললো, লোকটা বোধ হয় আমাদের উজির সাহেবেরবাড়ি ঢুকেছিলো চুরি করতে। কিন্তু অন্ধকারে ঠাওর করতে না পেরে খোলা বারান্দার কানিশে পা দিতেই আমার দোকানের সামনে পড়ে যায়।

কোটাল তাকে দুশো ঘা বেত-এর সাজা দিয়ে শহর থেকে বের করে দেয়। আমি খবর পেয়ে গোপনে আমার ভাইকে ঘরে নিয়ে এসে লুকিয়ে রেখেছি। তার নিবুদ্ধিতার দোষে সে আজ পঙ্গু। আমি আমার সহজাত উদারতায় তাকে আশ্রয় দিয়েছি। এখন সে আমার ঘাড়েই খায়।

কিন্তু জাঁহাপনা, আমার তৃতীয় ভাই-এর কাহিনীটা একটু অন্যরকম, বলছি শুনুন।

 

তৃতীয় ভাই বাকবক-এর কাহিনী।

বাগদাদের ভিখিরিদের সে পাণ্ডা। একেবারে পুরোপুরি অন্ধ। একদিন ভিক্ষেয় বেরিয়ে চলতে চলতে এক বিরাট বড়লোকের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো।–কই গো, কে আছো?

আমার এই অন্ধ ভাই বাকবক-এর ভিক্ষে করার কায়দা একটু অন্যরকম। প্রথমে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে শুধু ওই একটি কথা-ই উচ্চারণ করবে, ‘কই গো, কে আছে’। দরজা খোলার আগে সবাই একবার জিজ্ঞেস করে, ‘কে’? কিন্তু আমার ভাই আর রাটি কাড়বে না। ভিজে বিড়ালের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। কেননা, বেশিরভাগ লোকই, যদি বুঝতে পারে ভিখিরি, দরজা না খুলে বলে দেয়, ‘এখানে কিছু হবে না, বাছা, অন্য জায়গায় দেখো।’ ও সেই জন্যেই দরজা খোলার আগে কোনও কথা বলে না। এর ফল। কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বেশ ভালো হয়। অন্ধ লোককে সামনে দেখলে স্বভাবতই আমরা একটু বেশী মাত্রায় করুণা পরবশ হয়ে পড়ি।

সে-দিনও সে সেই বড়লোকের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে যথারীতি একটা হাঁক দিলো, কই গো, কে আছো?

একটু পরে উপরতলা থেকে আওয়াজ এলো, কে?

আমার ভাই কিন্তু দারুণ সেয়ানা। কোন জবাব দিলো না। আবার প্রশ্ন এলো, কে? কে ওখানে? কথা বলছে না কেন?

কিন্তু তখনও ভ্রাতা আমার নিরুত্তর। একটু পরে সশব্দে দরজাটা খুলে গেলো।-কে?

এবার বাকবক করুণ কাকুতি কণ্ঠে বলে, আমি অন্ধ নাচার, বাবা। আপনাদের দয়াতে বেঁচে আছি। এক মুঠো ভিক্ষে চাই।

লোকটি কাছে এগিয়ে এসে বললো, দেখি তোমার একখানা হাত!

আমার ভাই বাড়িয়ে দিলো তার ডান হাতখানা। লোকটা বললো, আমার সঙ্গে এসো।

এই বলে সে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে অনেক সিঁড়ি ভেঙে তিনতলার ছাদের ওপরে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো তাকে। আমার অন্ধ ভাইটি ভাবলো, লোকটা বোধ হয় খুব ধর্মপ্ৰাণ। ভালোমন্দ অনেক কিছু খাওয়াবে তাকে।

কিন্তু ওর খোয়াব কেটে গেলো। লোকটা বললো, তোমাকে যখন বারবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে? কে?’ তুমি সাড়া দিলে না কেন? কেন আমাকে তিনতলা থেকে নিচে নামালে? কেন আমাকে দিয়ে দরজা খোলালে? কেন? আমি কি তোমার নফর। তোমাকে এই তিনতলা থেকে নিচে ফেলে দেবো। আমি-শয়তান কঁহাকা। যাও ভাগে, আর কোনও দিন এরকম বেয়াদপি করবে না।

বাকবক মুখ কঁচুমাচু করলো। কোন জবাব দিলো না। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে অতি সন্তৰ্পণে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলো। কিন্তু নসীবে যা লেখা আছে তাকে সে এড়াবে কি করে। দোতলা থেকে একতলা নামতে গিয়ে লাঠি হড়কে পড়ে গেলো সে। তারপর গড়াতে গড়াতে একেবারে নিচে এসে পড়লো। সারা শরীর ব্যথায় টনটন করতে লাগলো। মনের দুঃখে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। এমন সময় তার আর দুজন সঙ্গী এসে জুটলো। তারাও অন্ধ। ভিক্ষে করে খায়। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে যাচ্ছে শুনে, কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কি গো, ওস্তাদ কি হলো? অমান কাতরাচ্ছে কেন?

বাকবক তার দুঃখের কাহিনী বললো। তারা শুনে সমবেদনা জানায়। বলে, আজ তোমার নসীব খারাপ, আজ আর ভিক্ষে করে কাজ নাই, বাসায় ফিরে যাও।

বাকবক বলে, আমিও তাই ভাবছি, বাসাতেই ফিরে যাবো। ঘরে যা জমানো টাকা আছে তার থেকে কিছু বের করে দু’খানা রুটি কিনে খাবো। কিন্তু আমার সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে। তোমরা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলো। না হলে যেতে পারবো না। ওরা বললো, ঠিক আছে চলো, তোমার রুটি তরকারী কিনে এনে দেবো।

ওরা যখন এই সব কথা আলোচনা করছে সেই সময় একটা চোর ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। অন্ধদের কথা শুনে তাদের পিছু পিছু চলতে লাগলো। সে তিন অন্ধ এসে বাকবকের ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো। পা টিপে টিপে চোরটাও ঢুকে পড়লো। বাকবক বললো, দরজাটা বন্ধ করে দাও। তারপর ভালো করে হাতড়ে দেখো, আমাদের পিছনে অন্য কোন লোক ঢুকে পড়েছে কিনা। উপর থেকে একটা সিকে ঝুলছিলো, ওটা ধরে চোরটা উপরে উঠে গিয়ে টঙ্গে বসে থাকলো। অন্ধ যখন হাতের লাঠি দিয়ে ঘরের চারপাশ হাতড়ে দেখে নিশ্চিন্ত হলো, না, কোনও বাইরের লোক ঢোকেনি, বাকবক তখন তার লুকিয়ে রাখা জমানো টাকার থলেটা বের করলো। তিনজনে মিলে গুনলো। দশ হাজার দিরহাম। এগুলো সে সারাজীবন ধরে ভিক্ষে করে। জমিয়েছিলো। বাকবক তার থেকে কয়েকটা দিরহাম নিয়ে একজনকে বললো, আমাদের জন্যে তিনখানা রুটি আর একটু শব্জী নিয়ে এসো। সবাই বসে খাই। তারপর আমি শুয়ে পড়বো। মনে হচ্ছে হাড়গোড় সব ভেঙে গেছে। ব্যথায় টনটন করছে। সারা শরীর।

অন্ধটা রুটি আর শাজী নিয়ে এলে তিনজনে মিলে খেতে বসলো। এমন সময় চোরটা খুব সন্তৰ্পণে নিচে নেমে এসে, ওদের পাশে বসে রুটির কোনা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগলো।

আমার ভাই-এর কান খুব ভালো। বুঝতে পারলো, আরও একজনের চোয়ালের শব্দ হচ্ছে। চিৎকার করে উঠলো, চোর চোর, পাকড়াও।

এই বলে সে হাত দু’খানা এদিক ওদিক ঘোরাতে লাগলো। চোর দেখলো বেগতিক-উঠে পড়ে পালাতে যাবে, বাকবকের হাতে ধরা পড়লো তার পা দু’খানা। গড়মড় করে চেপে ধরতেই ধড়াস করে পড়ে গেলো লোকটা। তখন ওরা তিনজনে মিলে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করতে লাগলো। চোর তখন প্ৰাণ ভয়ে পালাবার পথ খুঁজছে। কিন্তু না, ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে তারা।

বাকবক চিৎকার করতে লাগলো, -চোর চোর চোর। কে আছো, মুসলমান ভাইসব, ছুটে এসো, চোর চোর

বাকবকের সঙ্গে ওর। দুই সঙ্গীও সমানে ‘চোর চোর’ বলে আওয়াজ তুলতে থাকে। পাড়পড়শীরা ছুটে এলো।

–কী ব্যাপার, কি হয়েছে?

চোরটা তখন তার চোখ দুটো বন্ধ করে অন্ধের ভান করে বলে, দেখো তো ভাইসব, আমরা চারজন একসাথে ভিক্ষে করি। এতোকাল ধরে আমার ভাগে দশ হাজার দিরহাম জমেছে। সেই টাকাটা আজ নিতে এসেছিলাম। তা টাকা তো দেবেই না, আবার উল্টে চোর চোর বলে চোঁচাচ্ছে। তোমরা আমাদের থানাতেই নিয়ে চলো, ভাই সব। কোটালসাহেব এর ন্যায্য বিচার করবেন। আমার ভাগের ন্যায্য পয়সা আমি পাবো না?

চোরের কথা শুনে আমার ভাই-এর আক্কেল গুড়ুম। বলে কি ব্যাটা! পাড়াপরাশীরা বললো, তাই ভালো, চলো তোমরা কোতোয়ালিতে চলো। যা করার কোটাল সাহেবই ব্যবস্থা করবেন।

চারজনকেই কোতোয়ালিতে নিয়ে এলো তারা। দশ হাজার দিরহামের থলেটা নিয়ে এসে দিলো কোটাল সাহেবের হাতে।

প্রথমে চোরটাই জবান-বন্দী দিতে উঠলো। চোখ দুটো তার তখনও বন্ধ। বললো, হুজুর টাকাটা আমার ভাগের ন্যায্য পাওনা। কিন্তু ওরা আমাকে দেবে না। আমাকে চোর সাব্যস্ত করে আপনার হাতে তুলে দেবে এই ছিলো তাদের ফন্দী। আপনি ধর্মাবতার, ন্যায্য বিচার করুন।

বাকবক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, সব মিথ্যে কথা, হুজুর। ও লোকটা চোর। আমরা তিনজন যখন ঘরে ঢুকি, আমাদের পিছু নিয়ে সেও ঢুকে পড়েছিলো। কোটাল মহা ফাপড়ে পড়লো। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না, এমন সময় চোরটা প্রস্তাব করলো, হুজুর আমি বলি কি, আমাদের সবাইকে পিটুনি লাগান। তা হলে, মারের চোটে বাছাধনরা কবুল করতে পথ পাবে না।

কোটাল ভাবলো, হুঁ, লোকটা তো ঠিকই বলেছে। পিটানিই এখানে একমাত্র ওষুধ। একজন সিপাইকে বললো, লোগাও চাবুক।

চোরটা সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো, আমাকে দিয়েই শুরু করুন, হুজুর।

চাবুকের কয়েক ঘা পিঠে পড়তেই যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো চোরটা। চোখ দু’টো খুলে কোটালের দিকে ড্যাবি ড্যাবি করে তাকাতে লাগলো।

কোটালের চোেখও ছানা বড়া-সে। কি! তুমি না অন্ধ?

—আজ্ঞে, কেউ আমরা অন্ধ নই। ওটা আমাদের ভিক্ষের সাজানো মূলধন। অন্ধ সাজলে লোকের মনে দয়া মায়া একটু বেশি হয়। এমনি ভিখিরিদের চেয়ে আমরা অনেক বেশি রোজগার করি।

–তাজ্জব ব্যাপার, কোটাল বললো, বাকী তিনজন? ওরাও কি তোমারই মতো?

—জী হুজুর। কেউই অন্ধ না; বিশ্বাস না হয় চাবুক চালান। দেখবেন, চোখ খুলতে পথ পাবে না, বাছাধনরা। অন্ধ সেজে। শুধু পয়সাই বেশি রোজগার হয় না, আরও কিছু ফাও মেলে।

কোটাল প্রশ্ন করে, কী রকম?

–অন্ধ সেজে বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে গেলেও কারো কোনও আপত্তি থাকে না। বাড়ির কর্তারা ভাবে, আহা, বেচারী অন্ধ। চোখে দেখতে পায় না। তা যাক না। অন্দরে। ওর জন্যে তো মেয়েদের আব্রু নষ্ট হবে না।

কিন্তু মেয়ে-মহলে ঢোকার পর যখন আমরা চোখ খুলে দিই, মেয়েরা খুব অবাক হয়। হাতে স্বৰ্গ পায়। কারণ, সারাজীবন ধরে কোনও পরপুরুষের মুখ দেখার, সঙ্গ পাওয়ার সৌভাগ্য হয় না। তাদের; আমাদের দিয়ে প্রাণের সাধ মিটিয়ে নেয়। তারা। এই সব ক্ষেত্রে ভিক্ষের মাত্ৰাট অনেক বাড়িয়ে দেয় মেয়েরা।

কোটালের হুকুমে বাকবক আর তার দুই সঙ্গীর পিঠে চাবুক পড়তে থাকে। কিন্তু চোখ আর খোলে না তারা। কোটাল ভাবে, ব্যাটারা একেবারে রাম ঘুঘু। মার খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। যায় তিনজন। একেবারে বেশি। কিন্তু তবুও চোখ খোলে না। কোটালের হুকুমে ওদের তিনজনকে শহরের বাইরে ফেলে দিয়ে আসে সেপাইরা। বাকবকের টাকার থলে থেকে আড়াই হাজার দিরহাম চোরটাকে দিয়ে কোটাল বলে, যা ভাগ। এগুলো ওদের তিনজনের জন্যে রইলো।

চোর তো মহাখুশি হয়ে চলে যায়। কোটাল কিন্তু বাকী টাকাটা নিজের জেবে পুরে ফেলে।

আমি যখন খবর পেলাম, আমার প্রাণের ভাই বাকবিককে মেরে অজ্ঞান করে শহরের বাইরে ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে, আমি আর থাকতে পারিনি। সবারই অলক্ষ্যে তাকে ঘরে এনে সেবা-যত্ন করে সরিয়ে তুলি। এখন সে অনেকটা সুস্থ। কিন্তু তাকে আর ভিক্ষে করতে পাঠাই না। আমার রোজগারেই সে খায়। এখন জাঁহাপনা, আপনিই ভেবে দেখুন, আমি কতো উদার, কতো মহৎ।

খলিফা আল-মুসতানির বললেন, একশোবার। তোমার মতো উদার, পরোপকারী, মিতবাক, দূরদশী ব্যক্তি আমি খুব কম দেখেছি। আমি তোমাকে খুশি হয়ে একশো দিনার পুরস্কার দিচ্ছি। ওটা নিয়ে তুমি বাড়ি যাও।

আমি বললাম, কিন্ত হুজুর আপনি আমার বাকী তিন ভাই-এর কথা শুনবেন না? খুব সংক্ষেপেই বলছি। কারণ, আপনি তো জানেন, জাঁহাপনা, বেশী বকবক করা আমার ধাতে সয় না।

খলিফা বললেন, ঠিক আছে, শোনাও।

নাপিতের চতুর্থ ভাই অল-কুজের কাহিনী।

নাপিত বলতে শুরু করে : আমার এই ভাইয়ের নাম যুশবান-আল-কুজ। তার অর্থ হলো-কাঁসার কুঁজে ঠোকর আওয়াজ। এক সময়ে বাগদাদের খুব নাম করা কষাই ছিলো সে। বেছে বেছে সেরা ভেড়া কিনে আনতো। তার চেকনাইওলা গোস-এর প্রশংসা করতো সবাই। শহরের যত বড় বড় খদের সব ভীড় করতো তার দোকানে। তার মতো ভালো মাংস আর কেউ দিতে পারতো না। ফলে, অল্পকালের মধ্যেই সে অনেক পয়সা বানিয়ে ফেলে। কিন্তু পয়সা সকলের ভাগ্যে চিরদিন সহ্য হয় না।

একদিন এক সাদা দাডিগোঁফওলা বৃদ্ধ তার দোকান থেকে খানিকটা মাংস কিনলো। সদ্য তৈরি বাকবীকে রূপের দিনারে দাম মিটিয়ে চলে গেলো। আমার ভাই অল-কুজ পয়সাগুলো নেড়ে চেড়ে উল্টেপাল্টে দেখলো-সবগুলোই রূপোর এবং আনকোরা নতুন ঝকঝকে। অল-কুজ পয়সাগুলো আলাদা একটা বাক্সে ফেলে রাখলো। এমন সুন্দর পয়সা খরচ করতে মায়া হয়। বৃদ্ধ রোজই দোকানে আসে। রোজ মাংস কেনে, আর রোজই একই ধরনের ঝকঝকে আনকোরা রূপের দিনার দিয়ে যায়। অল-কুজ যথারীতি সে-গুলো সেই বাক্সে ফেলে রাখে। ভাবে, পরে বেশ কিছু টাকা জমে গেলে ভালো দাম দিয়ে একজোড়া লড়াই-এর ভেড়া কিনবে সে! (এক সময় বাগদাদের ভেড়ার লড়াই-এর খুব নামডাক ছিলো। বহু দূর থেকে লোকে দেখতে আসতো)।

অবশেষে একদিন টাকাটা গুণবে বলে বাক্সটা খুলে দেখলো টাকা পয়সা কিছু নাই। আছে শুধু কতকগুলো গোলগোল সাদা কাগজের টুকরো। আল-কুজের মাথায় বাজে ভেঙে পড়ে। একি সর্বনাশ করে গেছে লোকটা। যাদুমন্ত্র করে টাকার বদলে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেছে তাকে। নিজের গাল নিজেই থাবড়াতে লাগলো। মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলো। চোঁচামেচি কান্নাকাটি শুনে অনেক লোকজন জড়ো হতে লাগলো। তাদের সবাইকে বললো, বৃদ্ধটা কি সর্বনাশ তার করে গেছে। কিন্তু তার এই আজগুবি গল্প বিশ্বাস করতে চাইলো না কেউ। এমন সময় ভীড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ালো সেই বৃদ্ধ। আর তখনই অল-কুজ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করতে লাগলো, এই সেই শয়তান, জোচ্চোর-আমাকে ঠকিয়ে সাদা কাগজ দিয়ে ভালো ভালো মাংস নিয়ে গেছে।

বৃদ্ধের দাড়ি গোঁফ খামচাতে থাকে অল-কুজ। বৃদ্ধ কিন্তু শান্ত ভাবে চুপচাপ সহ্য করতে লাগলো তার এই মারধোর। কোন বাধা দিলো না। শুধু আস্তে খুব আস্তে আস্তে বললো, ছাড়ো, ছেড়ে দাও আমাকে।

অল-কুজ বলে, ছাড়বো? চলো তোমাকে কোতোয়ালিএ নিয়ে গিয়ে কোটালের হাতে তুলে দেবো। লোক ঠকানোর মজা টের পাইয়ে দিচ্ছি।

বৃদ্ধ তখনও বলে, আমাকে ছেড়ে দাও, তাতে তোমার ভালো হবে। না হলে তোমার কপালে অশেষ দুঃখ আছে। আমি তোমাকে নগদ পয়সা দিয়েছি-মাংস নিয়েছি। এর মধ্যে ঠিকাবার কি প্রশ্ন থাকতে পারে?

—নগদ পয়সা দিয়েছে? এগুলো পয়সা? ঠগ, জোচ্চোর কোথাকার।

বৃদ্ধ তেমনিভাবেই বলে, ওসব বুট কথা বলে লোক হাসাচ্ছে কেন? আমি কাগজের টুকরোগুলো দিয়েছি আর তুমি তার বদলে আমাকে ভালো ভালো মাংস দিয়েছে? এ কথা বিশ্বাস করবে। কেউ? জিজ্ঞেস করো, এখানে যারা হাজির আছেন?

কিন্তু কেউ বিশ্বাস সূচক সম্মতি জানালো না। বরং বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো, তা কি করে সম্ভব? তুমি কি পয়সাকডি বাজিয়ে নাওনি?

অল-কুজ বললো, আপনারা বুঝছেন না, ও ব্যাটা যাদুকর। ঠগ, প্রতারক।

বৃদ্ধ বললো, প্রতারক আমি, না তুমি? ভেড়ার মাংস বলে দিনের পর দিন মানুষের মাংস বিক্ৰী করছে—তুমি লোক ঠকাচ্ছে, না। আমি ঠকাচ্ছি?

উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গেলো সে কথা শুনে। একটুক্ষণের মধ্যেই গুঞ্জন উঠলো।—সেকি? মানুষের মাংস খাইয়েছে আমাদের?

বৃদ্ধ বলল, হ্যাঁ। মানুষের মাংস বিক্ৰী করেছে সে। আর ভেড়ার চেকনাই মাংস বলে বেশীদাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেছেন আপনারা।

—মিথ্যে কথা, আল-কুজ চিৎকার করে ওঠে, আমার মাংস সাচ্চা ভেড়ার মাংস। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে ভেজাল মাংস বিক্র করি আমি, সারাজীবন গোলাম হয়ে থাকবো তার। আমার সর্বস্ব দিয়ে দেবো তাকে।

বৃদ্ধ হাসলো, অত বাহাদুরী করো না, এখুনি আমি তোমার গুমোর ফাঁক করে দেবো।

এই বলে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আল-কুজের ভিতরের কামরায় ঢুকে পড়লো। এখানে সে ভেড়া জবাই করে ছালচামড়া ছাড়িয়ে মাংসের বড় বড় খণ্ড তৈরি করে। বৃদ্ধ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বলতে লাগলো, এই দেখুন ভাই সব, যে মাংসের খণ্ডগুলো টাঙানো আছে তার মধ্যে এইগুলো ভেড়ার আর এইগুলো মানুষেরা। কিন্তু ঐ নিচের দিকে তাকিয়ে দেখুন ঘরের ঐ কোণে তিনটি মানুষের মাথা।

সবাই দেখে শিউড়ে উঠলো। একজন তো অজ্ঞান হয়ে পড়েই গেলো মাটিতে। জনতার রুদ্র-রোষে। তখন আমার ভাই-এর যে কি দশা-আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, জাঁহাপনা। কিল চড় লাথি যে যে-ভাবে পারলো মারতে থাকলো। আমার নিরপরাধ ভাই কিছুতেই বোঝাতে পারলো না, এ সব তোমরা বিশ্বাস করো না। লোকটা যাদুকর। তোমাদের সবাইকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। মেরেই তারা ক্ষান্ত হলো না। হিডি হিডি করে টানতে টানতে নিয়ে গেলো কোতোয়ালিতে। কোটাল শুনে তিনশো বেতের ঘা সাজা দিলো তাকে। বেচারী অল-কুজ! মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো। কোটাল তার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দেশ থেকে তাডিয়ে দিলো তাকে। উন্মত্ত জনতা যখন তার ওপর চড়াও হয়ে কিল চড় ঘুসি চালিয়েছিলো সেই সময় তার বা চোখে একটা প্রচণ্ড ঘুসি এসে লাগে। ফলে চোখটা কানা হয়ে যায়।

মনের দুঃখে আল-কুজ অন্য এক অচেনা দেশের অচেনা শহরে চলে গেলো। একটা রাস্তার মোড়ে বসে জুতো সারানোর কাজ করতে থাকে। সারাদিন খেটে কোন রকমে পেটের খাবার জোগাড় হয়।

একদিন ওই রাস্তার মোড়ে বসে জুতো সেলাই করছে, এমন সময় ‘হট যাও হট যাও’ রব উঠলো। অল-কুজ তাকিয়ে দেখে, একদল পল্টন ঘোড়া ছুটিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। লোক মুখে শুনলো, সুলতান শিকারে যাচ্ছে, তাই তার পল্টনরা ভিড় হটাচ্ছে। একটু বাদেই দেখা গেলো, বিরাট একটা ঘোড়ার পিঠে চেপে সুলতান আসছেন। তার সামনে পিছনে সশস্ত্ব পল্টনবাহিনী। মোড়ের মাথায় এসে বা চোখে ঠুলী পরা আল-কুজের ওপর চোখ পড়তেই চিৎকার করে ওঠে সুলতান।-হায় আল্লাহ একি দেখলাম আমি। কানা লোক দেখলে যে অযাত্রা হয়। সুলতানের আর শিকারে যাওয়া হলো না। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে প্রাসাদের দিকে ফিরে চললেন। বলে গেলেন, এই অপয়া অযাত্রা লোকটাকে শায়েস্তা করো।

সুলতানের হুকুম শোনামাত্র তার দেহরক্ষীরা তার উপর বাঁপিয়ে পড়ে এলোপাথাড়ী ডাণ্ডা মারতে লাগলো। বেচারী আল-কুজ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলে কোনরকমে বুকে হেঁটে হেঁটে আস্তানায় ফিরে আসে। হাড়গোড় সব ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে। সে শুধু ভাবতে লাগলো, কী তার অপরাধ? কেন তাকে ওরা আমনভাবে মারলো? একজনকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা ভাই বলতে পারো, কেন আমাকে ওরা এইভাবে মারলো?

লোকটি রাজদরবারে চাকরী করে। বললো, সে কি। তুমি জানো না? আমাদের সুলতান কোনও কানা লোককে সহ্য করতে পারেন না। বিশেষ করে সে আবার যদি বা চোখ কানা হয়। সুলতানের বিশ্বাস, বা চোখ-কানা লোক দেখলে সব শুভ কাজ পণ্ড হয়ে যায়। সেই জন্যে তার হুকুমই আছে বাঁচোখ কানা লোক নজরে পড়া মাত্র হত্যা করবে। তা তোমার তো অনেক বরাত জোর, তা না হলে জানে বাঁচলে কি করে তুমি?

লোকটির একথা শুনে আল-কুজ শঙ্কিত হয়। হয়তো পল্টনগুলো ভেবেছিলো, সে মরে গেছে, তাই তারা ফেলে দিয়ে চলে গেছে। অল-কুজ। ঠিক করলো, আর এক মুহূর্ত এ শহরে থাকবে না, যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাবে। জুতো সেলাই-এর যন্ত্রপাতিগুলো বেঁধেছেদে নিয়ে সেইদিনই রাতের অন্ধকরে গা ঢাকা দিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে সে। চলতে চলতে এমন এক শহরে এসে পৌঁছলো যেখানে কোন সুলতান বাস করে না।

বেশ কয়েকটা দিন ভালোয় ভালোয় কাটলো। মনে হলো জায়গাটা মন্দ না। একদিন বিকালবেলা বেড়াতে বেরিয়েছিলো সে। পাহাড়ের পাদদেশে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি নির্জন। হঠাৎ ঘোড়ার খুরের আওয়াজে চমকে উঠলো অল-কুজ। মনে হলো তীর বেগে ছুটে আসছে একদল ঘোড়সওয়ার। ভয় হলো তার, হয়তো বা পল্টনবাহিনী। উধ্বশ্বাসে দৌড়তে লাগলো সে। কিন্তু নিজেকে লুকোবার মতো একটা জুতসই জায়গা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ চোখে পড়ে অদূরেই একটা পোড়ো বাড়ি। দরজা জানিলা সব হাট করে খোলা। সোজা গিয়ে বাড়িটার অন্দরে ঢুকে পড়লো। বারান্দায় একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে থাকে, ঘোড়সওয়ারগুলোর গতিবিধি। হঠাৎ দুটি লোক পিছন দিকে চেপে ধরলে তাকে।—এইবার বাছাধন, যাবে কোথায়? তিন তিনটে দিন আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে? শালা, কিছুতেই ধরতে পারি না। একেবারে পাকাল মাছের মতো হাতের নাগাল থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে। এবার? এবার কি হবে। দমাদম ঘাকিতক কিল চড় বসিয়ে দিলো তারা। বললো, চল ব্যাটা, চল কোতোয়ালিতে। কেমন প্যাদানী দেবে কোটাল সাহেব, দেখবি চল?

হিড় হিডি করে টানতে টানতে নিয়ে চললো তারা। আমার ভাই-এর কোন প্রতিবাদই কৰ্ণপাত করলো না। কোতোয়ালিতে নিয়ে গিয়ে সোজা একেবারে কোটালের হাতে। অল-কুজ তার দুর্ভাগ্যের কথা, তার দেশান্তরী হওয়ার কথা সবিস্তারে বললো কোটালের কাছে। কিন্তু সে কথায় কোনও কাজ হলো না। হুকুম হলো, ন্যাংটো করে চাবুক লাগাও।

জামা-কাপড় খুলতেই কোটাল দেখলো লোকটার সারা শরীরে চাবুকের আর ডাণ্ডার কালো কালো দাগ। হো হো করে হাসলো সে–পুরোনো পাপী। এর আগেও অনেকবার কোতোয়ালের জল খেয়েছো, দেখছি। তা এই নিয়ে ক’বার হলো?

অল-কুজ বলতে চায়, না হুজুর, চুরি আমি জীবনে কখনও করিনি। কিন্তু মাির খেয়েছি প্রচুর, কবুল করছি। কিন্তু কিভাবে কেন খেয়েছি সে-কাহিনী তো আপনাকে বললাম। আপনি বোধহয় খেয়াল করে শোনেননি।

-চোপরাও বদমাইশ চোর। মার খেয়ে খেয়ে সারা গায়ে চাবুক ডাণ্ডার কলসিরা পড়ে গেছে, আর বলে কিনা চুরি করেনি। কোতোয়ালের লোক-এর সঙ্গে তোমার শক্বতা আছে তো? তাই জন্যে তারা তোমাকে শুধু শুধু ধরে ঠেঙিয়েছে! লাগাও চাবুক।

কোটালের হুকুমমাত্র সপাংসপাংকরে চাবুকের ঘা পড়তে থাকে। অল-কুজ আর সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এক এক করে গুণে গুণে একশো বেতের ঘা তাকে সহ্য করতেই হয়। এর পর উটের পিছনে বেঁধে সারা শহরের পথে পথে ঘোরানো হলো তাকে! কোটাল বললো, এবারের মতো অল্পে ছেড়ে দিলাম। পরে যদি শুনি আবার চুরি করতে ঢুকেছিস কারো বাড়ি, তা হলে আর জান থাকবে না তোর।

আমার ভাই-এর হেন দুরবস্থার কাহিনী শুনে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। সবার অলক্ষ্যে বাগদাদ শহরে আমার বাসায় নিয়ে এলাম তাকে। সেই থেকে সে আমার কাছেই থাকে, খায়। মার খেয়ে খেয়ে তার শরীরের হাড়গোড় কিছু আস্ত নাই। কাজ কাম করার সামৰ্থ্যও হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তাই বলে আমি ছোট ভাই হয়ে তাকে তো আর ফেলে দিতে পারি না। অন্য লোকে হলে হয়তো পারতো। কিন্তু আমার মতো উদার এবং মহৎ মানুষের পক্ষে তা পারা তো সম্ভব নয় জাঁহাপনা!

খলিফা অল মুসতানসির বিল্লাহ বললেন, তা তো ঠিকই। তা এবার কি তুমি তোমার পঞ্চম ভাই-এর কথা শোনাবে? না, আরও একশো দিনার বকশিস নিয়েবাড়ি রওনা হবে?

–না। হুজুর, আমার পঞ্চম ভাই অল-আসার-এর অসাধারণ কাহিনী আপনাকে শোনাতে না পারলে সোয়াস্তি পাবো না।

 

নাপিতের পঞ্চম ভাই অল-আসারের কাহিনী।

নাপিত বলতে থাকে, আমার এই ভাই-এর দেহের তুলনায় পেটটা বেশ মোটা। মনে হয়, একটা ছোটখাটো জয়ঢাকা। নড়াচড়া করতে পারে না বললেই চলে। সারা দিন। সারা রাত শুয়ে ঘুমিয়ে কাটায়। যাকে বলে পিপু-ফিশু গোছের। আমাদের বাবা যখন মারা যান, প্রত্যেক ভাই-এর জন্যে একশো দিরহাম নগদ রেখে যান। অল-আসারের মাথায় হাজারো রকম ব্যবসার ফিকির ঘুরতে থাকে। কোনটা ছেড়ে কোনটা করবে ভেবে পায় না। অবশেষে ঠিক করলো কাচের বাসনপত্র কেনাবেচার কারবার করবে। এতে পরিশ্রম কম। মহাজনের ঘর থেকে কিনে নিয়ে এসে রাস্তার উপর বসে পড়লেই হলো। পথ চলতি লোকের নজরে পড়বে। যার দরকার ঠিকই কিনবে।

সুতরাং একশো দিরহাম পুঁজি সম্বল করে আল-আসার কাচের বাসন-এর সওদাগর বনে গেলো। রোজ বিকালে মস্ত একটা ঝুডিতে সাজিয়ে রাস্তার মোড়ে বসে পড়ে। সুর করে। হাঁকে-লে লে বাবু ছে। আনা, যা লিবে তাই ছে। আনা। চমকদার ছে। আনা… ইত্যাদি ইত্যাদি নানারকম ছড়া বিচিত্র সুরে আওড়াতে থাকে।

কিন্তু ক্রেতার চেয়ে শ্রোতার ভিড়ই বেশী হয়। একদিন জুম্মাবার দুপুরবেলায় শুয়ে শুয়ে আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখছিলো সে :

আমি আমার পুরো পুঁজিটা কাচের বাসনের কারবারে লাগিয়েছি। নিশ্চয়ই মালগুলো দুশো দিরহামে বিক্রী হবে। সেই দু’শো দিরহাম দিয়ে আবার বাসনপত্র কিনে আনবো। সেগুলো বেচে চারশো পাবো। সেই চারশো দিয়ে বাসন এনে আরও চারশো লাভ করবো। এইভাবে প্রতি দফায় দ্বিগুণ হতে থাকবে আমার মূলধন। শেষে যখন বেশ মোটামুটি লাভ হবে তখন একটা দোকান ভাড়া নিয়ে আতরের ব্যবসা শুরু করবো। শুনেছি আতরের ব্যবসায় অনেক লাভ। একশো দিনারের আতর নাকি পাঁচশো দিনারে বিক্ৰী হয়। এইভাবে লাভের অঙ্ক যখন বেশ মোটা হয়ে দাঁড়াবে তখন তা দিয়ে বিশাল একখানা ইমারাৎ কিনবো আমি। অনেক দাসদাসী হাতী ঘোড়া কিনবো। দামী দামী গালিচা পর্দায় ঘর দোর সাজাবো। মেহগনি কাঠের বাহারী আসবাবে ঘর ভরে দেবো। ভালো ভালো খানাপিনার ব্যবস্থা হবে। নাচ গানের আসর বসাবো। শহরের নামী বাঈজীরা আসবে মুজরো করতে। নামকরা উজির আমীরদের কন্যার সঙ্গে আমার শাদীর কথাবার্তা চলতে থাকবে। কিন্তু প্রধান উজিরের নিচের কোন অমাত্যের মেয়েকে আমি শাদী করবো না। তাও সে-মেয়ে রূপে গুণে দুনিয়ার সেরা হওয়া চাই। এছাড়া আমার ইজ্জত খাটো হয়ে যাবে। আমার যদি পোত্রী পছন্দ হয় তবে দেন মোহর হিসাবে নগদ এক হাজার মোহর দেবো। তাকে। কিন্তু আমার প্রস্তাবে। যদি সেই উজির গররাজি হয় তা হলে জোরজবরদস্তি করে তার নাকের ডগা দিয়ে মেয়েকে তুলে নিয়ে আসবো আমার প্রাসাদে। দশটা বাছাই-করা খোজা কিনাবো। এমন জাকজমক সাজে। সেজে–গুজে থাকবো শাহ-সুলতানরা ভিরমি খেয়ে যাবে। আমার ঘোড়ার জীন-লাগোম একটা দেখার মতো জিনিস হবে। শহরের সেরা জহুরীকে ডেকে নানারকম হীরা চুনী পান্না মুক্তো বসিয়ে সাজাবো। বাদাবী মরুভূমির বিখ্যাত একটা ঘোড়া কিনে আনবো অনেক দাম দিয়ে। তারপর অসংখ্য ক্রীতদাস সমভিব্যাহারে শহর পরিক্রমায় বেরুবো। রাস্তার দু’ধারে লোক দাঁড়িয়ে পড়বে। আমাকে দেখবে বলে। রাস্তার দু’পাশের বাড়ির জানিলা খুলে যাবে। মুখের নাকাব সরিয়ে মেয়েরা দেখবে আমাকে। টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আমি গিয়ে পৌঁছবো প্রধান উজিরের প্রাসাদে। উজির শশব্যস্ত হয়ে উঠে এসে অভ্যর্থনা জানাবে। নিজের আসনে নিয়ে গিয়ে আমাকে বসাবে। আর নিজে দাঁড়িয়ে থাকবে কোরবাণীর খাসীর মতো। কারণ আমি তার কন্যার পানি প্রার্থী। আমার দুই নফরের প্রত্যেকের হাতে থাকবে হাজার মোহরের রেকবী। একটা রেকগবী আমার শাদীর দেন মোহর। আর একটা রেকবী শ্বশুরকে আমার সদিচ্ছা-উপহার। উজির দেখে আমার দিল দরিয়া মেজাজের তারিফ করবে। টাকাটা যে আমার কাছে কোনও ব্যাপারই না, এমনি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভরে রেকবী দু’খানা এগিয়ে দেবো উজিরের দিকে। খুশিতে গদ গদ হয়ে হাত পেতে গ্রহণ করে। ধন্য হয়ে যাবে সে। এর পর বেশ। আসবো আমি। উজির আমায় জানাবে। আমার প্রাসাদে ফেরার শুভেচ্ছা বাণী বহন করে। আমি মোহর বকশিস দেবো। এতে তাদের প্রত্যেককে নতুন পোশাক এবং আমার মর্যাদা অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু উজির যদি কোন উপহার সামগ্ৰী পাঠায়, আমার পক্ষে তা গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। তাকে বোঝাতে হবে,। পরের দ্রব্যে আমার কোনও লোভ নাই। আমিই ঠিক করবো আমার শাদীর তারিখ। এবং শাদীর সব খরচ আমার। তাদের কোনো খরচপত্র করতে দেবো না। এবং আম্নি সেটা সগর্বে তাদের জানিয়ে দেবো। শাদীর আসরে নামক্রয়া মুজরো দলের নাচ গান হবে। এবং সে সব খরচও আমার। সারা বাড়িটা দামী পারস্য গালিচায় মুড়ে দেবো। আর ফুলে ফুলে ভরে দেবো সব মহল। দামী আতরের খুশবুতে সাজপোশাক হবে সবচেয়ে সেরা-খানদানী। শাহনশাহ সিংহাসনে বসার সময় যে সাজে। সেজে যান, ঠিক সেইরকম। শাদীর আসরটা সাজানো হবে ছবির মতো করে। আমার হবু বিবি যখন তার হীরা জহরতের অলঙ্কার পরে এসে দাঁড়াবে আমার সামনে, মনে হবে, বেহেস্তের কোনও এক হুরী নেমে এসেছে বুঝি। তার রূপের জেল্লায় জেল্লায় আলোময় হবে যাবে সারা মহল। মনে হবে, রমজানের পূৰ্ণচাঁদের মেলা। আমি কিন্তু ধীর স্থির হয়ে বসে থাকবো। না তাকাবো পাত্রীর দিকে, না তাকাবো এদিক ওদিক। যাতে সবাই ভাবে, আমি একজন দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমার বিবি আমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকাবে। তার মনমোহিনী রূপ আর দেহের সুবাস আমাকে বিচলিত করবে কিন্তু আমার মুখে তার বিন্দুমাত্র প্রকাশ পাবে না। এমন ভাব দেখাবো, যেন এমন কিছুই না, এমন রূপ যৌবন আমি আকছার দেখেছি। আমার পাত্রী আমার চার পাশে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে। তারপর এক সময় সে বলবে, মালিক আমি এসেছি, আমি তোমার বিবি, আমাকে গ্রহণ করো। আমি তোমার দাসী হয়ে থাকবো। কিন্তু আমার কোনও ভাব বৈলক্ষণ্য প্রকাশ পাবে না দেখে সে ভীত, বিচলিত হবে। ভাববে তাকে বুঝি আমার মনে ধরেনি। কাতর অনুনয় করে বলবে, আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো, আমাকে বসতে বলবে না? ঘরের অন্য সব মেয়েরা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কিন্তু একটি কথাও বলবো না আমি। সবাই ঘর ছেড়ে চলে গেলে মাত্র এক পলকের জন্যে তার দিকে চেয়ে থাকবো; কিন্তু ঐ একবারই। তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে গুরুগম্ভীর হয়ে বসে থাকবো। ক্রীতদাসীরা পাত্রীকে নিয়ে যাবে। পোশাক পালটাবার জন্যে। সেই ফাঁকে আমিও আরো জমকালো আরো দামী শাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে ফিরে আসবো। আমার পাত্রীও নব সাজে সেজে এসে দাঁড়াবে। আরো দামী, আরো বাহারী সাজ। আগের রত্নালঙ্কার খুলে রেখে নতুন অলঙ্কার পরে আসবে। পুরো জড়োয়া গহনা। অসংখ্য তারার মতো রত্নরাজি ঝকমক করতে থাকবে। আরো দামী খুশবুতে ভরে যাবে সারা বাসরকক্ষ। পাত্রীর সখীরা আমাকে বার বার অনুরোধ জানাবে—একবার যেন তার দিকে তাকিয়ে দেখি, তার রূপ যৌবন তার সাজসজ্জা, অলঙ্কার আভরণ। কিন্তু আমি নির্বিকার-উপরের দিকে চোখ রেখে কডিকাঠ গুণতে থাকবো। যতক্ষণ ধরে শাদীর বাসরের এই সব আচার অনুষ্ঠান চলতে থাকবে, আমি একটিও কথা বলবো না, একটিবারও চেয়ে দেখবো না তাকে।

এই সময় রাত্রি হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

বত্রিশতম রজনী।

শাহরাজাদ বলে, শুনুন জাঁহাপনা, নাপিত তার পঞ্চম ভাই-এর কাহিনী বলে চলেছে :

অল-আসার দিবাস্বপ্ন দেখছে :

…এইভাবে বাসরঘরের সব আচার অনুষ্ঠান শেষ হলে আমি আমার এক নফরকে ইশারা করবো। একটা সোনার রেকবী করে পাঁচশো সোনার মোহর নিয়ে এসে ধরবে আমার সামনে। মুঠো মুঠো নিয়ে সারা ঘরময় ছুঁড়ে দেবো আমি। উপস্থিত যে সব গাইয়ে নাচিয়েরা ছিলো এবং যতো নফর তৃত্য-সব হুমডি খেয়ে পড়বে। যে যা পারবে কুড়িয়ে নেবে। পাশের ঘরেই আমাদের ফুলশয্যা রচিত থাকবে। মেয়ের সহচরীরা তাকে এবার নিয়ে যাবে সে ঘরে। আমি যাবো বেশ কিছুক্ষণ পরে। পালঙ্কে মখমলের গদিতে দামী রেশমী চাঁদর পাতা। বাঘ-সিংহ, নর্তক নর্তকী—নানা প্রকার সূক্ষ্ম সূচী কর্ম করা এই চাঁদরখানা কিনে আনা হবে পারস্যের এক বড় সওদাগরের দোকান থেকে। আতর আর আগরবাতির গন্ধে সারা ঘর ভরপুর। আমার প্রবেশে পাত্রীর সহচরীরা দু’ সারিতে বিভক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে কুর্নিশ জানাবে। আমি গিয়ে বসবো সোফায়। আর পাত্রী বসে থাকবে পালঙ্কে। কিন্তু একবারও দৃষ্টি বিনিময় হবে না। আমাদের। আমার সঙ্গে যাতে মেয়েরা ফাজিল রসিকতা না করতে পারে সে জন্য দারুণ গাম্ভীর্য নিয়ে বসে থাকবো আমি। এক গ্লাস গুলাবী সবরৎ এনে ধরবে আমার সামনে। হাতে নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট চুমুক দিয়ে খেতে থাকবো। আমার বিবি। অধৈৰ্য হয়ে উঠবে। সে চাইবে, আমি তার পাশে গিয়ে বসি। কিন্তু মেয়েদের সম্পর্কে আমার যে কোন মোহ নাই সেটা বোঝাবার জন্যে আমি নিরাসক্ত ভাব দেখিয়ে সোফাতেই বসে থাকবো। আমার বিবি যদি গোড়াতেই বুঝতে পারে আমি তার রূপে পাগল, তা হলে আর রক্ষে থাকবে না। সারাটা জীবন সে আমাকে তার পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখবে। সেই জন্যে কষ্ট হলেও শাদীর রাতে আমাকে মুখখানা এটে বসে থাকতেই হবে। কিছুতেই বুঝতে দেবো না, তাকে দেখে আমার সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। এর পর পাত্রীর মা—আমার শাশুড়ী এসে আমার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলবে, ‘বাবা আমার মেয়েকে কি তোমার পছন্দ হয়নি? একটা কথাও বলছে না, একটু হাসিও দেখছি না মুখে? কিন্তু বিশ্বাস করো, বাবা, আমন ভালো মেয়ে হয় না। যেমন রূপ তেমনি তার গুণ। রূপ চোখেই দেখতে পাচ্ছে কিন্তু গুণের কথা তো ক্রমশঃ জানতে পারবে? আজ শাদীর রাত, তোমরা একটু হাসি হল্লা করো, তবে তো ভালো লাগবে; আমার আহ্লাদ হবে?’ আমার শাশুড়ীর এই সনির্বন্ধ অনুরোধ আমাকে টলাতে পারবে না। একটি কথাও উচ্চারণ করবো না। আমার শাশুড়ী মাতা এবারে শঙ্কিত হয়ে পড়বে। তাহলে হয়তো সত্যি সত্যিই মেয়ে পছন্দ হয়নি জামাই-এর। সে এবার আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরে কঁদো কঁদো গলায় বলবে, তা হলে কি বাবা, সে তোমার উপযুক্ত হবে না, মনে করছো? কিন্তু আল্লাহর নামে হলফ করে বলছি বাবা, আমার মেয়ে অপাপবিদ্ধ শিশু। ও এখনও কোন পুরুষের ছায়া মাড়ায়নি। তাকে তোমার ভালো লাগবেই। যাও বাবা, পালঙ্কে যাও তার কাছে, তোমাকে সব দিক দিয়ে খুশি করার জন্যে তৈরি হয়ে আছে সে। রাতটা তার সঙ্গে কাটাও, তাহলেই বুঝতে পারবে তার আচার ব্যবহার আদব কায়দা। আমি নিজে হাতে করে তাকে শিখিয়েছি সব। যে-সব গুণ থাকলে একটা নারী তার পুরুষের চোখে আদর্শ বলে গণ্য হতে পারে তার সবটাই সে খুব ভালো করে জানে। যাও, ওঠে, তোমার প্রতীক্ষাতেই বসে আছে সে। যেভাবে তাকে চাইবে সেইভাবেই পাবে—আমি সেইরকম করেই তাকে গড়েছি।’ আমার শাশুড়ী উঠে গিয়ে এক গেলাস সরাব ঢেলে তার মেয়ের হাতে দেবে। গেলাসটা হাতে নিয়ে আমার হাতে তুলে দেবে সে। লক্ষ্য করবো, সরাবের গেলাসটা আমার হাতে দেবার সময় হাতটা তার ঠিক ঠক করে কাঁপতে থাকবে। তার দিকে না তাকিয়েই হাতটা বাড়িয়ে গেলাসটা নেবো। আর তার হাতের আঙ্গুলের সঙ্গে আমার হাতে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যাবে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা শরীরে এক অভূতপূর্ব শিহরণ খেলে যাবে। কিন্তু মুখে তার কোন ভাব প্রকাশ করবো না। আমার সামনে অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকবে সে। তার রূপ যৌবনের গমক আর সাজপোশাকের বাহার দেখে মনে হবে, কোন এক শাহজাদী দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। তার গাল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়বে। কান্না বিজডিত কণ্ঠে বলবে, ‘মালিক, মেহেরবানী করে আমার গোস্তাকি মাফ করুন। আমার প্রতি একটু সদয় হোন। আমি আপনার দাসানুদাসী।’ সে আমার আরও কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে আসবে। আমার চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দেবে। আমি কিন্তু তখন ভীষণ ক্রুদ্ধ হবো। হাতখানা ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াবো। এই সব ন্যাকামী একদম বরদাস্ত করবো না। ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেবো তার গালে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার ছল করবো। আমার সামনে বসে পড়ে পা-দু’টো জড়িয়ে ধরতে যাবে। জোর-সে এক লাথি মেরে দূরে ছুঁড়ে দেবো তাকে…

স্বপ্নের ঘোরে এমন জোরেই আল-আসার লাথি ছুঁড়লো যে, পায়ের কাছে কাচের বাসনের ঝুডিটাতে লেগে একেবারে উল্টে গেলো। আর সব বাসনপত্র মাটিতে পড়ে খান খান হয়ে ভেঙে সারা মেজেয় ছড়িয়ে পড়লো।

আমি যদি সেদিন সেখানে উপস্থিত থাকতাম, হুজুর, ওকে ধরে আমি পেটাতাম। অতগুলো টাকার জিনিস, সারা পুঁজিটা এক নিমেষে সব নষ্ট করে ফেললো। এত বড় আহম্মক কে আছে, এইরকম আকাশ কুসুম কল্পনা করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে?

অল-আসার নিজের গালে নিজে থাপ্পড় দিতে থাকলো। জামা কাপড় ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে লাগলো। হায় হায়, তার সারা পুঁজিটা খতম হয়ে গেলো। এখন সে কি করবে, উপোষ করে। মরতে হবে তাকে। পাড়াপাড়শীরা ছুটে এলো। কেউ তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো। আবার কেউ বা তার অলীক কল্পনার কাহিনী শুনে হেসে লুটিয়ে পড়লো।

মনের দুঃখে ভাই আমার কঁদিছে-তার এত সাধের ব্যবসা এক পলকে নষ্ট হয়ে গেলো। এমন সময় সামনের পথ দিয়ে এক সম্রান্ত মহিলা দাসদাসী সমভিব্যহারে খচ্চরের পিঠে চেপে মসজিদে যাচ্ছিলো। তার সাজ পোশাক তার চেহারা দেখে মনে হয়, খুব বড়লোক খানদানী ঘরের মেয়ে সে। একটা নফরকে বললো, দেখে আয়তো, ওই লোকটা অমন করে কাঁদছে কেন?

একটু পরে নফরটা ফিরে তার মালকিনকে বললো, আকাশকুসুম কল্পনা করতে করতে বিভোর হয়ে পড়েছিলো। এবং সেই সময় পায়ের এক লাথি মেরে তার সমস্ত পুঁজিতে কেনা। কাচের বাসনপত্র ভেঙে ফেলেছে সে। আল-আসারের অলীক কল্পনার পুরো কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ দিলো নফর। তখন সেই মহিলা বললো, তোমার সঙ্গে যা টাকা পয়সা আছে ওকে দিয়ে এসো। এবং বলে এসো, আবার যেন সে নতুন করে ব্যবসা আরম্ভ করে।

নফরের সঙ্গে পাঁচশো সোনার মোহর ছিলো। মালকিনের হুকুমে সবটাই অল-আসারকে দিয়ে এলো সে। অল-আসার তো আশমানের চাঁদ হাতে পায়। ‘ওরে বাবা, এতো টাকা! এ যে রাতারাতি বড়লোক।

প্রথমে একটা সুন্দর দেখেবাড়ি ভাড়া করে উঠে গেলো অল-আসার। এবার জাঁকিয়ে ব্যবসা করতে হবে। নানারকম ব্যবসার ফিকির খুঁজতে লাগলো। এতো টাকা হাতে পেয়েছে। এবার সে বড় রকমের একটা লাগসই ব্যবসায় নেমে পড়বে। একদিন ঘরে শুয়ে শুয়ে এই সব ভাবছে, এমন সময় সদর দরজার কড়া নাড়ার শব্দে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে এক অচেনা বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। বৃদ্ধটি বললো, বাবা, আজ জুম্মাবার, দুপুরের নামাজের সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু আমি এখনওবাড়ি পৌঁছতে পারলাম না। নামাজটা তোমার এখানে সেরে নিতে পারি?

অল-আসার বললো, নিশ্চয়ই। আপনি ভিতরে আসুন। হাত মুখ ধুয়ে নিন।

অল-আসার তাকে কলঘরে নিয়ে গিয়ে বললো, আপনি এখানে হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিন।

একটু বাদে আমার ঘরে এসে একটা মাদুর বিছিয়ে তার নামাজ শেষ করলো। আমার ভাই ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধার প্রতি প্রসন্ন হয়ে দু’টো মোহর তার হাত দিয়ে বললো, এটা রাখুন।

কিন্তু বৃদ্ধ হাত পেতে নিলো না। বললো, না বাবা, পয়সায় আমার প্রয়োজন নাই। তোমার কাছেই রাখে ওটা তোমার অনেক কাজে দেবে। তোমার উদারতার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ তোমার ভালো করবেন। আর তোমার যদি একান্তই প্রয়োজন না থাকে এই পয়সার, তা হলে যার কাছে থেকে হাত পেতে নিয়েছিলে তাকেই তা ফেরৎ দিয়ে দিতে পারো।

বৃদ্ধার কথায় অবাক হয় আল-আসার।-সে। কি! আমার সব কথা এই বৃদ্ধ কি করে জানলো? বললো, যে মহিলাটি দয়া করে আমাকে এতোগুলো মোহর দিয়ে গেলেন তার সঙ্গে আমার এক পলকেরও পরিচয় হয়নি। আপনি কি জানেন তাকে? একটি বার তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারেন?

বৃদ্ধ বললো, সেই সুন্দরী মেয়েটি তোমাকে ঐ টাকাগুলো দিয়েছিলো কেন জানো? দিয়েছিলো তোমার বয়স দেখে। আহা মেয়েটা, ধন দৌলতের কোন অভাব রাখেননি আল্লাহ, কিন্তু একটা জায়গায় মেরে দিয়েছেন। মেয়েটির স্বামী পুরোপুরি ধ্বজভঙ্গ। একটা ভরা যুবতী মেয়ে—তার কী দুর্ভাগ্য বলো? ধনদৌলত দিয়ে সে কি করবে। তার যৌবনটাই তো ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। যাক আর দেরি করো না বাছা। তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাবো বলেই এসেছি। ঘরে তালা দিয়ে, চলো বেরিয়ে পড়ি। সোনার মোহরগুলো ঘরে রেখে যেও না। কোমরে বেঁধে নাও। কি জানি চোর-ডাকাতের কথা তো কিছু বলা যায় না।

খুশিতে মন নেচে উঠলো। সেই দিন থেকে তাকে দেখার তার সঙ্গে একটু আলাপ করার সাধ ছিলো। কিন্তু নাম ঠিকানা কিছুই জানতাম না, কি করে কোথায় গিয়ে তার দেখা পাবো? আল্লাই তার সন্ধান করে দিয়েছেন। তা না হলে এই বৃদ্ধাই বা তার কাছে আসবে কেন?

পথে যেতে যেতে বৃদ্ধ বললো, অনেককাল থেকে আমি তার চাকরী করছি। আমাকে দিয়ে অনেক নিষিদ্ধ গোপন কাজ সিদ্ধি করে নিয়েছে। তোমাকে শুধু একটা কথা শিখিয়ে দিচ্ছি, তার কাছে গিয়ে কথা বলবে খুব কম। যেটুকু বলবে, খুব হিসেব করে ধীরে সুস্থে বলবে। কথার চেয়ে কাজই সে বেশী ভালোবাসে। তুমি যদি তাকে খুশী করতে পারো, বাবা, তা হলে তো তোমার পোয়া বারো। তার মতো রূপসী মেয়েকে হাতের মুঠোয় তো পাবেই, সেই সঙ্গে তার বিষয় আশয়, ধনদৌলত সবই তোমার কোজায় এসে যাবে।

আমার ভাই তো আনন্দে দিশাহারা। এবার আর কে পায় তাকে। তোফা কাটানো যাবে সারাটা জিন্দগী। একটা বাড়ির দরজায় এসে অদ্ভুত কায়দায় কড়া নাড়লো বৃদ্ধা। একটা গ্ৰীক পরিচারিকা এসে দরজা খুলে দিয়ে একটু মুচকী হাসলো। ভিতরে ঢুকে এগোতেই একটা রেশমী পর্দা ঝোলানো দরজা-ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালো। মেঝোয় দামী গালিচা পাতা। চারপাফশ সোফা সেঠি সাজানো। এক ধারে মখমলের গদি বিছানো পালঙ্ক। একটু পর আর একটা দরজার পর্দা ঠেলে একটি মেয়ে ঢুকলো। তার রূপ যৌবনের বর্ণনা দেওয়া আমার সাধ্য নয়, জাঁহাপনা। এক কথায় বেহেস্তের হুরী। রূপের ছটায় সারা ঘর আলো হয়ে যায়। বিমুখ হয়ে চেয়ে থাকে আমার ভাই। মেয়েটির কোন লজ্জাশরাম বলে কিছু নাই। কোন কথাবার্তা বলার আগেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আমার ভাই-এর গা ঘেসে বসে গলাটা জডিয় ধরে চুমু খেলো সে। আল-আসারের সারা দেহে অপূর্ব এক শিহরণ ধরিয়ে দেয়। এবার মেয়েটি পালঙ্কে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আমার ভাই তখন উন্মত্ত হাতীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটির ওপর।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে মেয়েটি আবার দরজা খুলে দেয়। আমার ভাইকে বলে, তুমি একটু বসো, আমি এখুনি আসছি। আমি না। আসা পর্যন্ত কোথাও যাবে না।

মেয়েটি চলে যেতেই যমদূতের মতো এক নিগ্রো এসে ঢুকলো। এক হাতে তার শাণিত ছোরা, আর এক হাতে চাবুক।

—এই শুয়ার কা। বাচ্চা, এখানে কেন এসেছিস? কে তোকে নিয়ে এসেছে, বল?

অল-আসার কি বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু বলা আর হলো না। নিগ্রোর আধমনি একটা ঘুষি এসে লাগলো ওর চোয়ালে। আর সঙ্গে সঙ্গে উল্টে পড়ে গেলো গালিচার ওপর। এলোপাথাড়ী চাবুক মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেললো তাকে। তারপর ছোরার ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললো। আমার ভাই তো তখন অচৈতন্য। অসাড় মরার মতো পড়ে রইলো। নিগ্রোটা বোধ হয় ভাবলো, খতম হয়ে গেছে। ওর কোমর থেকে মোহরের থলেটা ছিঁড়ে নিয়ে ঘর থেকে উধাও হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলো এক নিগ্রো যুবতী।। এক থালা নুন হাতে নিয়ে। অল-আসার-এর ক্ষতিগুলোর গর্তে নুন পুরে দিতে থাকলো সে। এমন সময় সেই বুড়িটা নাকি সুরে কাঁদতেকাঁদতে  ছুটে এলো, ওরে বাবারে। আমার সোনার বাছার এ হাল কে করলো রে! অতগুলো সোনার মোহর ছিলো। সবগুলো কে নিয়ে গেলো রো। ওরে বাবারে, আমার কী হলো রে!

শয়তান বুড়িটা তখন আমার ভাই-এর পা দু’টো ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে উঠানে নামিয়ে আনলো। উঠানের ওপাশে এক কোণের দিকে একটা খুপরী ছিলো। আল-আসার-এর লাসটা সেই খুপরীর মধ্যে নিয়ে গিয়ে রেখে এলো। প্রতিদিন এ বাড়িতে যারা ঢোকে, তারা আর জান নিয়ে বেরুতে পারে না। নিগ্রোটার হাতে প্ৰাণ হারাতেই হয়। নিগ্রো মেয়েটা ক্ষতর গর্তে নুন ভরে দেয়, আর বুড়িটা টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে লাসটা রেখে আসে এই খুপরীর মধ্যে। নুনের জন্যে লাসগুলো পচে দুৰ্গন্ধ ছড়ায় না।

দুদিন বাদে আল-আসারের যখন জ্ঞান ফিরে এলো দেখে সে লাসের গাদার ওপর শুয়ে আছে। প্রতিদিন যত লোককে মারা হয় তাদের সবাইকে ছোট্ট এই খুপরিতেই ভরে রাখতে গেলে একটার উপরে আর একটা লাস গাদা করে রাখতেই হবে। তার আশে পাশে আরও অনেকগুলো গাদা লক্ষ্য করলাম। আল্লাহর কি অপার দয়া, আমার ভাই কিন্তু প্ৰাণে বেঁচে গেলো। তার একটা কারণ বোধহয়, হিডি হিডি করে টেনে এনে লাসের গাদার ওপরে তুলে ফেলার সময় ওর ক্ষত থেকে নুনগুলো সব ঝরে গিয়েছিলো। এবং তার ফলেই শরীরের সব রক্ত বেরিয়ে যেতে পারেনি। জমাট বেঁধে বন্ধ হয়ে গেছে।

রাত্রি তখন অনেক। ওপরের শার্সি দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। অল-আসার ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু সারা শরীর টনটন করছে। খুব কষ্ট হয়। শরীর কাঁপতে থাকে। তবু মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে। লাসের গাদার ওপরে দাঁড়াতেই শার্সির পাল্লাটা নাগালে পায়। খুব সন্তৰ্পণে খুলে ফেলে, সেই ফাঁক দিয়ে শরীরটাকে গলিয়ে দিয়ে বাইরে নেমে পড়ে।

আর কোনদিকে দৃকপাত না করে সোজাবাড়ি যায় আল-আসার। একেবারে নিজের বাড়ি। আমি তাকে মোক্ষম দাওয়াই দিয়ে খুব তাড়াতাডিই সারিয়ে তুললাম। আমার দাওয়াই এমনই—যে রোগ দু-মাসে সারার কথা দুদিনে সেরে যাবেই।

যাইহোক মনে তার দারুণ প্রতিহিংসা। বদলা সে নেবেই। সেই বুড়ি, সেই নিগ্রো, সেই নিগ্রি (নিগ্রোর স্ত্রী) সেই বারবণিতা-কাউকে বাদ দেবে না সে। বিলকুল সাফ করে ফেলবে।

এক কেতা-দূরস্ত পারসী সাহেবের মতো করে দাড়ি গোঁফ ছাঁটলো। আজানুলম্বিত এক শেরোয়ানী মাথায় জুলফি-টুপী পরলো। বুকে গুজলো একটা লাল গোলাপ। সারা গায়ে ছিটালো পারসী খুশবু।

সেই বাড়িটার অদূরে দাঁড়িয়ে দরজাটার দিকে লক্ষ্য করতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদে বুড়িটা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে পথ চলতে থাকে। অল-আসার-এর কাছে

স্যাকরার দোকান আছে বলতে পারেন?

বলার ঢং, উচ্চারণ সবই পারসীয়! বুড়িটার চোখ চিকচিক করে ওঠে। লোকটা এদেশী নয়। বিদেশী মক্কেলদের ট্যাকে মোটা মাল-কডি থাকে। আডি চোখে তাকিয়ে দেখলো, ওর ট্যাকে গোঁজা একটা মোটাসোটা থলে। বললে, কেন বাবা, স্যা করার দোকানে কী দরকার?

অল-আসার বলে, না মানে, একটা মাল বিক্রী করে ন’শো সোনার দিনার পেয়েছি। তা ওজন করে দেখবো। আমাদের পারসী টাকায় কতো টাকা হবে।

বুড়ি এবার চোখ দু’টো বড় বড় করে। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে বলে। সে আর এমন অসুবিধা কী? আমার সঙ্গে এসো, ভালো দোকানে নিয়ে যাচ্ছি। এক পয়সার হেরফের হবে না।

বুড়ির পিছনে পিছনে চলে অল-আসার। শেরওয়ানীর ভিতরে হাত ঢুকিয়ে অনুভব করে দেখে ছোরাটা। দরজার সামনে এসেই সেই অদ্ভুত কায়দায় কড়া নাড়ে বুড়ি। আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দাঁড়ায় সেই গ্ৰীক পরিচারিকা। সেই চেনা মুচকীহাসি। একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়েবসায় সেই গালিচা পাতা সোফা-সেঠি সাজানো ঘরে। একটু পরেই আসে। সেই মেয়েটি। হাসে। দরজা বন্ধ করে গা ঘেসে বসে পড়ে। আচমকা চুমু খায়। তারপর ধরতে গেলেই পালিয়ে গিয়ে পাশের পালঙ্কে শুয়ে পড়ে। অল-আসার উত্তেজিত হয়। কাঁপিয়ে পড়ে। সাব-সব একই ঘটনার যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। ঘন্টাখানেক বাদে মেয়েটি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সেই একই ঢং-এ বলে, ‘তুমি একটু বসে, আমি আসছি। আমি না। আসা পর্যন্ত যেও না কিন্তু।’ মেয়েটি বেরিয়ে যাবার আগেই খুলে রাখা শেরওয়ানীটা গায়ে চাপিয়ে নেয় অল-আসার। আর একবার অনুভব করে দেখে—ছুরিটা ঠিক আছে কিনা। মেয়েটা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দৈত্যের মতো। হুঙ্কার ছেড়ে ঘরে ঢেকে সেই নিগ্রোটা। এক হাতে শাণিত ছোরা, অন্য হাতে চাবুক। মুখে সেই একই প্রশ্ন, এই শুয়ার কা বাচ্চা, কেন এখানে ঢুকেছিস? কে তোকে এনেছে বল?

অল-আসার বলে, সেকি, ঐ তো তোমার পিছনে যে সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে, ওকেই জিজ্ঞেস করো না; ও-ই আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিলো তোমার ঝিাঁটার হাতে। নিগ্রোটা চিৎকার করে পিছন ফিরে তাকায়। আমার পিছ–

কথা আর শেষ করতে পারে না। পিছনে কে-দেখার জন্যে ঘাড় ঘোরাতেই ক্ষিপ্রবেগে ছুরিটা বের করে প্রচণ্ড জোরে এক কোপ বসিয়ে দেয় অল-আসার। নিগ্রোর মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। ঘাড়টা দু’খানা হয়ে মাথাটা ঝুলে পড়ে। এমন সময় এক থালা নুন নিয়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় নিগ্রি মেয়েটা। তার গলাতে আর এক কোপ। ধর মুণ্ডু আলাদা হয়ে ছিটকে পড়ে যায়। এর পর ছুটে আসে গ্ৰীক মেয়েটি। তাকেও সাবাড় করে ফেলে এক কোপে। সব শেষে বুড়িটা ছুটে আসে খদ্দেরের লাসটা সরিয়ে ফেলার জন্যে। তার চুলের মুঠি ধরে এক ধাক্কায় ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিচে, ওরে শয়তানী, বুড়ি খানকী, তোমার দালালী খাওয়ার শখ আমি জন্মের মতো মিটিয়ে দিচ্ছি।

সোজা ওর বুকের মধ্যে গেঁথে দিলো ছুরিখানা। টুকরো টুকরো করে কাটলো তার হাত পা মুণ্ডু। তারপর রক্তমাখা ছুরি হাতে খুঁজতে লাগলো সেই মেয়েটাকে। দুদিনই যার দেহটা তাকে অনেক সুখ দিয়েছিলো।—সেই মেয়েটার তাজা খুন এখন চেখে দেখবে সে। খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেলো। কয়েক ঘর ছাড়িয়ে একটা ঘরের চৌকির তলায় লুকিয়ে কাঁপছিলো। অল-আসার টেনে বের করলো তাকে। মেয়েটা ঢং জানে। পা-দুটো জড়িয়ে ধরে সে-কি কান্না।—তুমি আমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করো, সাহেব। এখানে এতকাল এরা আমাকে বন্দী করে রেখেছে। আমি যা নাই সেই কাজ আমাকে দিয়ে করিয়েছে। আমি অবলা মেয়েছেলে। কি করবো বলো, পালাতে পারিনি। চব্বিশ ঘণ্টা দরজায় পাহারা। আসলে আমি কিন্তু অনেক খানদানী ঘরের মেয়ে। আজ বিপাকে পড়ে। এই জাহান্নামে এসে পড়েছি।

আমার ভাই অল-আসার তখন মেয়েটিকে তুলে বসালো। হাজার হলেও সে তার শয্যাসঙ্গিনী। দুদণ্ডের শান্তিও তো দিয়েছিলো। ওর কান্নায়, মনটা কিছু নরম হয়ে আসে। বলে, কী করে এখানে এলে? কে নিয়ে এলো?

—কে আবার! ঐ শয়তান দালাল বুড়িটা। যে তোমাকে ভুলিয়ে এনেছিলো। যে ফিদিন কত মক্কেলকে ভুলিয়ে এনে তাকে জানে প্ৰাণে মারে। আমি এক খানদানী বংশের মেয়ে। আমাদের বাড়িতে ঝি-এর নকারী নিয়ে কাজে ঢুকেছিলো ঐ বুড়িটা। কথাবার্তা কি মিষ্টি। একদিন আমার এক আত্মীয়ের শাদীর নিমন্ত্রণ ছিলো। মা বাবা বললেন, ‘বুড়িমাকে নিয়ে যাও। সকাল সকাল ফিরে আসবে।’ আমি আর বুড়ি রাস্তায় বেরুলাম। কিন্তু আমি তো আর পথঘাট চিনি না। কি করেই বা চিনবো? পথেঘাটে একদমই বেরুই না। বুড়ি বলেছিলো, সারা বাগদাদ তার নখদপণে। ঠিকানা জানা থাকলে সব জায়গায় সে যেতে পারে। তাই ভরসা করে মা-বাবা তাকে সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়েছিলো। তাছাড়া বুড়ি মানুষ, কথায় বার্তায় তো চৌকস, দুদিনেই বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিলো তাদের! বুড়ি কিন্তু আমাকে নিমন্ত্রণ বাড়িতে নিয়ে গেলো না। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে তুললো এই ডেরায়। এই গোলক ধাধায় একবার যে ঢুকেছে তার আর বেরুবার পথ নাই। আমিও বেরুতে পারলাম না। নিগ্রোটা আমার উপর বলাৎকার করে আমার সতীত্ব শেষ করে দিলো। তারপর খাড়া উচিয়ে ভয় দেখাতে লাগলো–সে যা বলবে অক্ষরে অক্ষরে না মানলে আমার গর্দান নেবে। জানের ভয়ে আমাকে গণিকা হতে হলো। এছাড়া আমার বাঁচার কোন উপায় ছিলো না।

আমার ভাই অল-আসার জিজ্ঞেস করলো, -এতদিন ধরে তো বহু লোকের সর্বনাশ করেছে। ব্যাটা। অনেক পয়সা লুঠ করেছে। তা সে-সব পয়সাকডি, সোনাদোনা সব কোথায়?

মেয়েটি গলা খাটো করে বললো, সব-সব আছে সাহেব। ওই পাশের ঘরে, সিন্দুক ভর্তি। সোনার মোহর ঠাসা। দেখবেন, চলুন।

–চলো, যাই দেখিমেয়েটির পিছনে পিছনে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলো সে। সিন্দুকটা খুলতেই চোখ ঝলসে যায়।

মেয়েটি বললো, চলুন, এগুলো নিয়ে আমরা এখান থেকে পালাই। এতোটাকা। সারা জীবন খুব আরামে কাটাবো। আমরা দু’জন।

অল-আসার-এর চোখ জ্বল জুল করে ওঠে। এত টাকা! এত টাকা নিয়ে সে—মানে তারা কি করবে? ভাবতে পারে না। মেয়েটি বলে, দাঁড়াও আমি কতকগুলো বস্তা নিয়ে আসি।

বারেখানা বস্তায় ভর্তি করা হলো সোনার মোহরগুলো। এক একটা বস্তা কি পোল্লাই ভারি। নড়ানো যায় না। মেয়েটি বলে, কী করে নেবে। বারোটা কুলীর কম হবে না।

অল-আসার বলে, তুমি দাঁড়াও, আমি কুলী ডেকে আনছি।

রাস্তায় বেরিয়ে এলো সে কুলীর সন্ধানে। কিন্তু বারোটা কুলী এক সঙ্গে জোগাড় করতে একটু বেশীই দেরি হয়ে গিয়েছিলো। কুলীগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে, বামাল সুদ্ধ পাখী। পালিয়েছে। কিন্তু পালালো কি করে? খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেলো—পিছন দিকে একটা খিডিকীর দরজা আছে।

মেয়েটা যদিও সোনাদানা সবই নিয়ে পালিয়েছে, অল-আসার দেখলো, ঘরে তবুও অনেক দামী দামী সাজ-পোশাক, আসবাব এবং আরো অনেক সামানপত্র রয়ে গেছে। তার দামও অনেক। একটা জীবনের পক্ষে সে সম্পদ যথেষ্ট। এগুলো বেচে যা পাওয়া যাবে তা দিয়ে ব্যবসা করলে দিব্যি ভালোভাবে চলে যাবে তার। কিন্তু এসব জিনিস সে নিয়ে যাবে কি করে। ঠিক করলো, আজ থাক, কাল সঙ্গে গাড়ি এনে বোঝাই করে নিয়ে যাবে। সেদিনের মতো সদর দরজায় তালা দিয়ে চলে গেলো অল-আসার।

পরদিন সকালে গাডিঘোড়া নিয়ে এসে হাজির হলো আবার। কিন্তু সামানপত্র আর ওঠানো হলো না। তার আগেই প্রায় জনা বিশেক সিপাই ঘিরে ফেললো সারা বাড়িটা। আল-আসার গ্রেপ্তার হলো। কোটাল বলতে থাকে, আমি সব শুনেছি। কীভাবে কতগুলো মানুষকে তুমি খুন করেছে। এবং সেখান থেকে টাকাকডি সব লোপাট করেছে।

অল-আসার চিৎকার করে ওঠে, কোটাল সাহেব? এ আপনি কী বলছেন? এক মিনিট ধৈর্য ধরে আমার কথাগুলো আগে শুনুন, তারপর আপনার যা অভিরুচি করবেন।

কোটাল বললো, বেশ বলো।

তখন অল-আসার গোড়া থেকে সব কাহিনী বিস্তারিতভাবে খুলে বললো। একটুও বাদ দিলো না-বা গোপন করলো না। তারপর কোটালকে একটা প্রস্তাব দিলো সে।—এখন শুনুন কোটাল সাহেব, আসল মাল কডি তো মেয়েটা নিয়ে পালিয়েছে—তবু এখনও যা জিনিসপত্র আছে তার দামও নেহাৎ কম না। আমি বলি কি, এসবই তো এখন বেওয়ারিশ মাল। সরকার জানতে পারলে বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যাবে। তা সরকারের হাতে তুলে দিয়ে কী লাভ? আসুন আমরা দুজনে ভাগাভাগি করে নিই। এতে মুফতে আমিও কিছু পেয়ে যাবো, আপনি পাবেন।

অল-আসার-এর প্রস্তাব শুনে কোতোয়াল রেগে কীই!-কী এতবড় কথা? অন্যের সম্পত্তি আমি হাতিয়ে নেবো? আমি ঘুষ খাবো? সরকার আমাকে বেতন দেয় না? এই কে আছিস, লোকটাকে রাতের অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে এই সলতানিয়তের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসবি। এ রাজ্যে তোমার মতো অসৎ লোকের জায়গা হবে না। নির্বাসিনই তোমার যোগ্য সাজা।

কোটাল আমার ভাইকে সেইদিনই রাতের অন্ধকারে অন্য দেশে পাচার করে দিয়ে আসে। তার কারণ, সে কোনও ভাগ দিতে চায় না, সে কোনও সাক্ষী রাখতে চায় না। আমি খবর পেয়ে আমার ভাইকে গোপনে ফিরিয়ে আনি আমার কাছে। কোতোয়াল টের পেতে পারে এই আশঙ্কায় তাকে ঘর ছেড়ে বেরুতে দিই না। আমার আশ্রয়েই রেখেছি তাকে। আমার রোজগারেই সে খেয়ে পরে বেঁচে আছে।

এই হলো অল-আসারের কাহিনী।

খলিফা কোনও মন্তব্য করলেন না। কোনও বাহবা দিলেন না। নাপিত বললো, আর একটিমাত্র ভাই-এর কাহিনী শুধু বাকী আছে। খুব সংক্ষেপে একটানা বলে শেষ করে দিচ্ছি, জাঁহাপনা।

 

নাপিতের ষষ্ঠ ভাই শাক্কাশিক-এর কাহিনী।

তাকে সবাই শাক্কাশিক বলে ডাকতো। তার কারণ ওর গলার স্বরটা ছিলো ভাঙ্গা কঁসীর মতো। তার মতো গরীব দুঃখী এ সংসারে আর কেউ ছিলো না। নিজের রোজগারের অন্ন সে কোনও দিনই খায়নি। অন্যের দুয়ারে চেয়ে চিন্তে খেয়েই তার দিন কাটতো। বাবা মারা যাওয়ার সময় আমাদের প্রত্যেক ভাইকে একশোদিরহাম করে দিয়ে গিয়েছিলেন। সে-টাকিও সে কোনও কাজে লাগাতে পারেনি। এক ছেনতাই দলের পাল্লায় পড়ে এক দিনেই তা নষ্ট হয়ে যায়।

শাক্কাশিক ছিলো একটা হাঁদা বোকা মানুষ। তার এই বোকামীতে মজা পেতো অনেকেই। বিশেষ করে বিত্তবানরা। আর তার এই নিবুদ্ধিতায় মজা পেতো বলেই অনেক বড় লোকের বাড়িতে সে পাত পেড়ে খেতে পেতো।

এক দিন শাক্কাশিক দুমুঠে খাবার-এর প্রত্যাশায় দরজায় দরজায় ঘুরতে ঘুরতে দিনান্তে এক বিরাট বড়লোকের বাড়ির সামনে এসে হাজির হলো। প্রাসাদের মতো বাড়ি। অনেক লোকজন দাসদাসী পরিপূর্ণ। সদর দরজার প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁ গা, এতো পোল্লাই এই বাড়িটা করা?

প্রহরী জবাব দেয়, সে কি সেখ, জানো না! এতো সেই বারম্যাকী সাহেবদের বাড়ি। এককালে কত নাম ধাম ছিলো। খলিফার দরবারে এরা বংশানুক্রমে উজিরের পদে বহাল থাকতো। এখন যিনি মালিক, বৃদ্ধ হয়েছেন। দরবারের কাজে ইস্তফা দিয়ে বিশ্রাম করছেন। ছেলেপুলে কেউ নেই। একা। তা তোমার কি চাই?

শাক্কাশিক বলে, সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। যদি কিছু খানাপিনা পাওয়া যায়…

প্রহরী বলে, যাও না, ভিতরে যাও। মালিক আমাদের খুব ধর্মাত্মা। কারো দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারেন না।

প্রহরীর কথায় আশী হয়। এক পা এক পা করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। সামনের বিশাল প্রাঙ্গণে ফুলের বাগিচা; মাঝখানে একটা জলের ফোয়ারা। নানা জাতের পাখীর কলরবে মুখর হয়ে আছে সারা কুঞ্জবন।

শ্বেত পাথরের সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসে শাক্কাশিক। প্রশস্ত বারান্দা পেরিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে এক বিরাট কক্ষে। দামী গালিচায় মোড়া ঘরের মেজে। বাদশাহী আসবাবপত্ৰে সাজানো গোছানো-ঝকঝকে তকতকে। একটা আরাম কেদারায় অর্ধশায়িত অবস্থায় এক শুভ্বকেশ বৃদ্ধ। শাক্কাশিককে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই তোমার?

শাক্কাশিক বলে, আজ সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। যদি মেহেরবানী করে কিছু খেতে দেন—

বৃদ্ধ আহত হলেন, সে কি? আমার তো ধারণা ছিলো, এই বাগদাদ শহরে কেউই অভুক্ত থাকে না। ভালো হোক, মন্দ হোক, সাধ্য মতো খান্নপিনা সকলেই পায়। কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে-আমার ধারণা তো ভুল! এসো, এখানে বসো, আহা রে, সারাটা দিন অভুক্ত রয়েছে, আর আমি ভুরি ভোজ করে দিব্যি শুয়ে বসে দিন কাঁটাচ্ছি।

বৃদ্ধ তার একজন নফরকে ডেকে হাত মুখ ধোয়ার জল দিতে বললেন, সঙ্গে সঙ্গে সাবান, জল এলো। বৃদ্ধ বললো, নাও, আর দেরি করো না, মুখ হাত ধুয়ে নাও, আমরা দুজনে এক সঙ্গেই খাবো। আজ তুমি আমার মেহেমান।

এরপর নফর চাকররা নানারকম উপাদেয় খানা এনে সাজালো টেবিলে। বৃদ্ধ বললেন, নাও এসো, খানাপিনা তৈরি। এবার বসা যাক।

বৃদ্ধ কিন্তু কিছুই খেলেন না। শুধু খাবার-এর থালাগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করে হাত মুখে ঠেকালেন। খাওয়ার অভিনয় করে পরমানন্দে চিকুতে থাকলেন, আর মাঝে মাঝে, ‘বাঃ কি চমৎকার’ বলে তারিফ করতে থাকেন। শাক্কাশিক বুঝতে পারে না, কী ব্যাপার? দারুণ খিদে! পেয়েছিলো, গ্রোগ্রাসে খেতে থাকলে সে। বৃদ্ধ বললেন, এই যুক্ত শাহী কোপ্তাটা খেয়ে দেখো, ভারি স্বাদের হয়েছে। আমি ই একটা নিগ্রো মেয়ে রাঁধুনী রেখেছি-পাঁচশো মোহর দিয়ে। বড় ভালো রাধে মেয়েটি।

শাক্কাশিক খেয়ে তারিফ করলো, চমৎকার। এতো ভালো রান্না সে কোথাও খায়নি।

—আহা-হা, ওই মোরগ মোসাল্লামটা খাচ্ছে না কেন, ও জিনিস কোন সুলতান বাদশাহর বাড়িতে পাবে না।

আমার ভাই এক এক করে সবই উদারস্থ করতে থাকে। বৃদ্ধ এবার আপেল-ডিমের থালাটা এগিয়ে দিয়ে বলেন, সবগুলো খেতে পারবে। মাত্র চুয়াল্লিশটা আছে! তোমার মতো বয়সে আমি একশো চুয়াল্লিশটা খেতাম।

শাক্কাশিক বলে, দেখি, চেষ্টা করে দেখি।

একটা একটা করে মুখে পুরে নেয়। এইভাবে থালাটা শূন্য করে ফেলে। বৃদ্ধ খুব খুশি হয়, তুমি তো বেশ খাইয়ে লোক আছো হে। তোমার মতো লোককে খাইয়ে সুখ আছে। আজ থেকে তুমি আমার এখানেই থাকবে-খাবে। আমি যতদিন বাঁচি। সেই থেকে আমার ভাই সেখানেই থেকে গেলো। বৃদ্ধ আরও বিশ বছর জীবিত ছিলেন। এই বিশটা বছর তঁাকে আর অন্য কোথাও যেতে হয়নি।

কিন্তু বৃদ্ধের মৃত্যুর পরে, যেহেতু তার অন্য কোন ওয়ারিশ ছিলো না, কোতোয়াল তার ই সুব-সম্পত্তি আত্মসাৎ করে শক্কাশিককে দেশ থেকে বহিষ্কার করে দিলো।

মনের দুঃখে ভাই আমার মক্কার পথে যাত্রা করে। মনের বাসনা, জীবনের বাকী দিনগুলো আল্লাহর নাম গান করে সেখানেই কাটিয়ে দেবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক।

তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে মরুপ্রান্তর পার হওয়ার সময় দুর্ধর্ষ আরব্য-দসু্যদের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হলো সবাই। পয়সাকডি যার কাছে যা ছিলো তা নিয়ে ক্রীতদাস করে নিয়ে গেলো। দলের সর্দার তার নিজের বাড়ির নফর করে রাখলো শাক্কাশিককে। মাঝে মাঝেই তার উপর অত্যাচার চালাতো সে। বলতো, ওহে নবাব পুতুর হাত চালিয়ে কাজ কাম করো, মনে হচ্ছে, কোন দেশের আমীর ওমরাহ ছিলে তুমি। মাল-কডি অনেক আছে বুঝি দেশে। তা নিয়ে এসো না, তোমাকে ছুটি করে দেবো।

শাক্কাশিক বলে, এক কানা কডিরও মুখ দেখিনি কখনও। সারাজীবন পরের অন্নে প্রতিপালিত হয়েছি। কোথায় পাবো টাকা পয়সা?

দস্যু সর্দার বিশ্বাস করে না, থু করে থুথু ফেলে বলে, মিথুক, তাহলে থাক, এখানেই পচে মর।

সর্দারের বেঁটা ছিলো খুব সুন্দরী। বয়সে কঁচা-ডাগর। যেমন তার রূপ তেমনি তার উদাম যৌবন। সর্দার বেরিয়ে গেলেই বেঁটা আমার ভাই-এর কাছে ঘেঁসে আসতো! গায়ের কাপড় ফেলে দিয়ে বলতো, আহা চোখটা তুলে দেখো না। আমার এই রূপ এই ভরা যৌবন ওই বুড়ো সর্দারটা এর কি মর্ম বুঝবে, বলো! তুমি জোয়ান মর্দ-তোমার হাতের পরশ পেলে আমার গায়ে ফুল ফুটবে গো। আহা, লজ্জা কি, এসো না!

শাক্কাশিকের হাত ধরে টানতে থাকে মেয়েটা। কিন্তু ভাই আমার ওসব ব্যাপারে একেবারেই হাঁদা। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, নানা, আমার ওসব ভালো লাগে না।

মেয়েটা ঠোঁট ওলটায়, তোমার মতো একটা জোয়ান পুরুষ, ইচ্ছে করে না, কি গো! তুমি কি হিজারে নাকি?

এইভাবে আরো কিছুদিন কাটে। সর্দার বেরিয়ে গেলেই মেয়েটা ওর কাছে আসে। জামা কাপড় খুলে ফেলে শাক্কাশিককে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু ভাই আমার অন্য ধাতুতে গড়া। কিছুতেই উত্তেজিত করতে পারে না তাকে। একদিন বেঁটা এসে বললো, তুমি যদি আমার কথা শোনো, তাহলে তোমাকে পালাবার ব্যবস্থা করে দেবো আমি। দেখো, ভেবে দেখো আমার কথা।

শাক্কাশিকের মনে তখন একটা কথাই ঘোরাফেরা করে। মুক্তি পেতে হবে। যেভাবেই হোক, এই কয়েদখানা থেকে পালাতেই হবে তাকে। বেঁটার কথায় ভরসা হয়। ওকে খুশি করতে পারলে পালাবার శt পথ করে দিতে পারে বোধহয়। অনেক ভেবেচিন্তে একদিন রাজি হয়ে গেলো শাক্কাশিক। মেয়েটা তো হাতে স্বৰ্গ পায়। শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে পালঙ্কে শুয়ে পড়ে। মেয়েটি তাকে খুব আদর করতে থাকে—চুমু খায়। একটা পুরুষকে জাগ্রত করার সব কৌশলই জানা আছে তার। শাক্কাশিক উত্তেজিত হয়ে ওঠে। দেহের রক্তে নাচন শুরু হয়। হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। এখনি ঝড় উঠবে। এমন সময় যমদূতের মতো দরজার সামনে এসে খাড়া হয়। সেই দস্যু সর্দার। এ সময়ে তার আসার কথা নয়। কিন্তু শাক্কাশিকের নিয়তির লেখা বুঝি এইরকমই ছিলো। ডাকাতটা হুঙ্কার ছাড়ে, তোর ঘাড়ে কটা মাথা, রে? আমার বৌ-এর সঙ্গে-বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা। এসো বাছাধন তোমাকে একটু শিক্ষা দিই।

এই বলে কোমরের শাণিত ছোরা বের করে প্রথমে শাক্কাশিকের ঠোঁট দু’টো কেটে নিলো–আহা-হা ওই ঠোঁটে চুমু খেয়েছিলে, বাছাধন?

যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে শাক্কাশিক। কিন্তু ডাকাতটা তখন পিশাচের। হাসিতে ফেটে পড়ছে।-আহা, এতেই এত কাতর হলে চলবে কেন, এবার যে তোমার আসল অঙ্গটা কেটে নেবো। সারা জনম আর যাতে অসভ্যতা করতে না পারো তার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি।

তারপর কি বলবো, জাঁহাপনা, সেই শয়তান ডাকাতটা আমার ভাই-এর পুরুষাঙ্গটাও কেটে ফেললো। শাক্কাশিক তখন অচৈতন্য। ডাকাতটা ভাবলো মরে গেছে। একটা উটের পিঠে চাপিয়ে উটটাকে পাহাড়ের পথে পাঠিয়ে দিলো। পাহাড়ে ওঠার পথে উটের পিঠ থেকে হড়কে পড়ে যাবে সে।

মক্কা যাত্রীরা এই পাহাড়ের পথ ধরেই যায়। তাদের কেউ কেউ চিনতে পেরেছিলো আমার ভাইকে। তাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমি ছুটে যাই। নিজের কাছে নিয়ে আসি। আমার দাওয়াই-এর গুণে ওর ক্ষত সারাতে বেশী সময় লাগে না। কিন্তু একেবারে অক্ষম হয়ে পড়ে আছে। আমার কাছেই থাকে। আমার ঘাড়েই খায়।

নাপিত বললো, এক এক করে আমার ছটি অপদাৰ্থ অপরিণামদর্শী, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ভাইদের কাহিনী আপনাকে শোনালাম জাঁহাপনা। এবার আপনিই বিচার করে দেখুন, আমি কত বিচক্ষণ, কত জ্ঞানী, মহৎ। পরোপকারী উদার আর স্বল্পভাষী।

খলিফা-আল-মুসতানসির বিল্লাহ ঘাড় নেড়ে বললেন, তোমার মতো সর্বগুণসম্পন্ন মানুষ দুনিয়াতে বিরল। তাই আমি আর তোমাকে এই ছোট্ট বাগদাদ শহরের সীমিত গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাই না। তোমার মতো বিচক্ষণ, উদার, পরোপকারী মানুষ দুনিয়ার বহু দেশেই নাই। আমার নির্দেশ, আজই—এক্ষুণি তুমি বাগদাদ ছেড়ে দুনিয়া সফরে বেরিয়ে পড়ো।

দুনিয়ার মানুষ তোমার সাহচর্য পেলে অনেকভাবে উপকৃত হবে।

এই বলে তিনি আমাকে সেইদিনই বাগদাদ থেকে বহিষ্কার করে দিলেন। আমি তাই নানা দেশ ঘুরতে ঘুরতে শেষে আপনাদের এই চীন দেশে এসে হাজির হয়েছি। আসার আগে হলফ করে এসেছি, যতদিন না খলিফা মুসতানসির বিল্লাহ মারা যাবেন ততদিন আর বাগদাদের মাটিতে পা রাখবো না। তিনি খলিফা হতে পারেন, কিন্তু গুণীর কদর বোঝেন না। আর এই ল্যাংড়া যুবকের উন্মার কথাও সব শুনেছেন আপনারা। এবার বিচার করুন, আমি কি সত্যিই বেশী কথা বলি? আমার তো বিশ্বাস, আমার মতো মিতভাষী মানুষ আর দ্বিতীয় নাই। আর দূরদর্শিতার কথাই ধরুন-আমি তো সেই যুবককে পইপই করে বারণ করেছিলাম, এখন আপনি কোন নতুন কাজে যাবেন না। সময়টা খারাপ চলছে। কিন্তু আমাকে অগ্রাহ্য করে সে গেলো। পরিণামে কি বিপত্তি বলুন? সময় মতো আমি সেখানে না গেলে মেয়েটির বাবা কাজী সাহেবের হাতে তার প্রাণটাই খোয়া যেত। আমার জন্যে সে যে একটা মাত্র পা-এর ওপর দিয়েই বেঁচে গেলো, সে জন্যে ধন্যবাদ তো দিলো না? আজকালিকার দুনিয়াটাই এইরকম। যার আপনি উপকার করবেন, সেই আপনাকে বাঁশি দেবে।

নাপিতের এই সুদীর্ঘ কাহিনীর কচকচানী শেষ হলে আমরা উপস্থিত অভ্যাগতরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। উফ! লোকটা কি বকবকই না করতে পারে। আর বলে কিনা-আল-সামিতএকেবারে স্বল্পবাক! কি হামবড়াই ভাব। সে নাকি সেই সওদাগর ছেলেটিকে মৃত্যুর হাত থেকে বঁচিয়েছে। লোকটা ডাহা মিথুক, শয়তান, বদমাইশ। তার হঠকারিতার জন্যেই ছেলেটির পা-টা খোড়া হয়ে গেছে। সে যদি চুল কামানোর সময় ঐ রকম বক বক করে ফালতু সময় নষ্ট না করতো তাহলে, যথা সময়েই সে মেয়েটির কাছ থেকে ফিরে আসতে পারতো। তার দোষেই সে ঠিক সময়ে যেতে পারেনি। দেরি করে পৌছালেও সে কিছুতেই কাজীর হাতে ধরা পড়তো না। কিন্তু অনৰ্থক হৈচৈ বাঁধিয়ে খুঁচিয়ে সবাইকে জানানোর জন্যেই যত বিপত্তি ঘটলো। আমাদের মনে হতে লাগলো, দর্জি বলতে থাকে, নাপিতটা শয়তানী করেই ঐ কাণ্ডটা করেছিলো।

সবাই রাগে ফুঁসতে লাগলো। নাপিতটাকে শায়েস্তা করা দরকার। তার জন্যেই আমরা আজ এক মুসাফীর মেহমানকে হারালাম। ঠিক করা হলো, ওর সঙ্গে আমরাও কেউ খানাপিনা করবো না। ওকে পাশের একটা ঘরে চ্যাংদোলা করে তুলে ঢুকিয়ে দিয়ে তালা মেরে দেওয়া হলো। ঘরটায় অসংখ্য ধাড়ী ইদুরের আড়ডা। এঘরে আমরা যখন খানা খাচ্ছি তখন তার কান্না আর চিৎকার কানে আসতে লাগলো, ওরে, বাবারে, আমাকে খেয়ে ফেললো রে। আমরা সে দিকে কৰ্ণপাত করলাম না। খুব মৌজ করে সরাব খেলাম। আকণ্ঠ খানা খেলাম। তারপর বিকেলবেলা বিবির জন্যে খানিকটা খাবার বেঁধে নিয়েবাড়ি ফিরে এলাম।

বিবি আমার রেগে আগুন।–সারদিন তুমি আমাকে একা বাড়িতে ফেলে মজা করতে বেরিয়েছে। আমি এই দৈত্য পুরীতে এক এক কাটাই কি করে? তোমার কি কোনও আক্কেল বুদ্ধি নাই? আজই-এক্ষুণি যদি আমাকে নিয়ে বেড়াতে না যাও তা হলে, এই আমি চললাম কাজীর কাছে। তোমাকে তালাক দেবো।

আমি খুব শান্ত মেজাজের লোক, কোন সময়ই চেঁচামেচি ঝগড়াঝাটি সইতে পারি না। অশান্তি আমার ভালো লাগে না। তাই বললাম, নাও চলো, কাজীর কাছে আর গিয়ে কাজ নেই, এখন চলো একটু বেডিয়েই আসি।

সুতরাং আমরা সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত নানা জায়গায় ঘুরলাম—দেখলাম। তারপর যখনবাড়ি ফিরছি এমন সময় দেখা হয়ে গেলো এই কুঁজোটার সঙ্গে। খুব টেনেছিলো সে। একেবারে বেহেড মাতাল অবস্থা। মনের আনন্দে আবোল তাবোল বকছে কখনও বা বেসুরোভাবে দু-একটা পরিচিত গানের কলি গাইছে। আবার কখনও বা বিনা কারণেই হো হো করে হাসছে। পথ চলতি মানুষের কোতাঁর কোেনা টেনে দিয়ে পালাচ্ছে! আবার কখনও বা ধেই ধেই করে নাচছে। আমার বিবি এবং আমি দুজনে মিলে ঠিক করলাম, লোকটাকেবাড়ি নিয়ে গেলে বেশ মজা হবে। মদের নেশায় বিভোর সে। সুতরাং লজ্জা-শরমের বালাই নাই—প্ৰাণ খুলে নাচ গান হল্লা করে মাতিয়ে রাখবে।

কুঁজোকে বলতেই এক কথায় রাজি হয়ে গেলো। সেদিন ঘরে কিছু খাবার দাবার ছিলো না। আসার পথে দোকান থেকে প্রয়োজন মতো কিনে নিলাম। আমার বিবি পর পুরুষের সামনে বের হন না। কিন্তু কুঁজোকে তিনি কোনও মানুষ জ্ঞান করলেন না। একটা পুতুল বলে মনে হয়েছিলো তার। সুতরাং সকলে মিলে এক সঙ্গে খেতে বসলাম। কুঁজোটা তার কলা-কৌশল দেখাতেই মত্ত। মদের নেশায় খানার দিকে তার তখন নজর নাই। আমার বিবি এক টুকরো মাছ তার মুখে পুরে দিলো—জোর করেই। কুঁজোটা কিছুতেই মুখে নেবে না, আমার বিবিও ছাড়বে না। এই জোর করে খাওয়ানোর মধ্যেও বেশ একটা মজা পাচ্ছিলো সে। কিন্তু বিপদ হলো ওখানেই। একটা মাছের টুকরো জোর করে গিলতে গিয়ে আটকে গেলো গলায়। আর সেটা উগরে নিচে না নিতে পারায় সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ হয়ে গেলো।

আমরা তো ভয়ে অস্থির। আমার বিবি তখন তাকে কোলে নিয়ে চললো হেকিমের কাছে। আমিও গেলাম সঙ্গে। হেকিমের বাড়ির সিঁড়ির ধাপে তাকে বসিয়ে রেখে চলে আসি আমি।

এর পরের কাহিনী তো আপনি হেকিম, বাবুর্চি ও খ্ৰীষ্টান দালালের জবানীতেই শুনেছেন। এখন বলুন, জাঁহাপনা, যে কাহিনী আপনাকে শোনালাম-—সেই ল্যাংড়া তরুণ সওদাগর, সেহ নাপিত আর তার ছয় ভাই-এর কাহিনী কি আপনার এই কুঁজোর আশ্চর্যজনক মৃত্যুর কাহিনীর চেয়ে আরো অদ্ভুত না?

চীনের সুলতান তারিফ করে ঘাড় দোলালেন, নিশ্চয়ই। তোমার কাহিনী আরও তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছে আমাকে? কিন্তু সেই নাপিতটা কোথায়? তাকে আমি দেখতে চাই। তার মতো অদ্ভুত মানুষ তো আমি দেখিনি কখনও! তাকে যদি আনতে না পারো তোমাদের চারজনের কাউকেই ছাড়বো না।

দর্জি বললো, এ আর এমন বেশি কথা কি জাঁহাপনা। আপনার লোকজন আমার সঙ্গে দিন, আমি এক্ষুণি আপনার সামনে তাকে হাজির করে দিচ্ছি।

সুলতান বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। যা লোকজন দরকার নিয়ে যাও। ধরে হোক, বেঁধে হোক, যেভাবে পারো তাকে নিয়ে এসো। নাপিতকে নিয়ে আসার পর কুঁজোকে কবর দিতে হবে। তার সমাধির উপর আমি একটা স্মৃতিসৌধ বানাবো। সে আমার বড় প্রিয় বয়স্য ছিলো।

সুলতানের লোক-লস্কর নিয়ে দর্জি গেলো নাপিতের সন্ধানে। ঘণ্টাখানেক বাদে নাপিতকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো তারা। সুলতান দেখলো, নাপিতের বয়স প্রায় নব্বই হবে। দাড়ি গোঁফ সবই দুধের মতো সাদা। কান দুটো ফুটো করা। নাকটা ভীষণ চোখা। চোখ দুটো হাতীর মতো একেবারে খুদে। সুলতান তাকে দেখে হেসে খুন।

—ওহে নাপিত, তোমার কাহিনী শুনে আমি ভারি মজা পেয়েছি। তাই তোমাকে সামনাসামনি দেখার জন্যে ডেকে পাঠিয়েছি। আমার লোকজন হয়তো তোমাকে ধরে বেঁধে এনে অনেক কষ্ট দিয়েছে। যাই হোক কিছু মনে করো না। শুনেছি তুমি খুব স্বল্পভাষী লোক। তা তোমার মজার মজার কাহিনীর দু একটা আমাকেও শোনাও।

নাপিত বললো, তা হুজুর মিথ্যে কিছু শোনেননি। গল্প আপনি যতো শুনতে চান শোনাবো। সাত দিন সাত রাত অনর্গল বলে যেতে পারি। তাতে আমার কোন ক্লান্তি নাই। কিন্তু তার আগে হুজুর, আমাকে বলুন, এই খ্ৰীষ্টান, এই মুসলমান, এই ইহুদী আর কুঁজোর লাস-এরা সব এখানে কেন? কী ব্যাপার? আপনি শুনেছেন, আমি একেবারে স্বল্পভাষী। এবং কোন কিছু জানার জন্যে অহেতুক কৌতূহল আমি একদম বরদাস্ত করতে পারি না। তবুও আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, এরা সব এখানে কেন?

সুলতান বললেন, এসব ব্যাপারে তোমার এতো আগ্রহ কেন, নাপিত? এদের কাহিনী শুনে তুমি কী করবে?

নাপিত বললো, আমার দূরদৃষ্টি দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি, আগাগোড়া ব্যাপারটাই একটা ভুলের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। সেইজন্যেই, আমি মিত-বাক হওয়া সত্ত্বেও আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। এবং আপাতদৃষ্টিতে আপনার মনে হতে পারে-আমি অহেতুক কৌতূহল প্রকাশ করছি, কিন্তু এই কৌতূহল অহেতুক নয়, তাও আপনাকে আমি প্রমাণ করে দেবো।

সুলতান বললেন, ঠিক আছে, শোনো।

কুঁজের মৃত্যু থেকে শুরু করে খ্ৰীষ্টান দালালের ফাঁসীর হুকুম পর্যন্ত সমস্ত কাহিনী নাপিতকে শোনানো হলো।

নাপিত সব শুনেটুনে বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়তে লাগলো।–তোমাদের কেউ কুঁজোর মুখের কাপড়টা সরিয়ে দাও, দেখি–

একজন কাপড়টা সরিয়ে নিলো। নাপিত কুঁজোটার মৃতদেহর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে নিবিষ্ট মনে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে থাকলো। অনেকক্ষণ ধরে। তার চোখ মুখ গলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, দেখলো। তারপর এক সময় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে হো হো করে হাসতে লাগলো। মুখের ভাবখানা-সব সমস্যার জলের মতো সমাধান করে ফেলেছে সে।-হুম, মারা সে সত্যিই গেছে। দুনিয়াতে এমন কোনও হেকিম বদ্যি নাই, যে ওকে আবার বাঁচাতে পারে। কিন্তু আমি পারি। আমি ওকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারি।

সুলতান সহ দরবারের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। এমন অদ্ভুত কথা কি কেউ শুনেছে কখনও। মরা মানুষ আবার বেঁচে উঠবে?

সুলতান বললো, দর্জি তোমার সম্বন্ধে অনেক মজার কথাই আমাকে শুনিয়েছে, কিন্তু এমন আজগুবি ব্যাপার তুমি ঘটাতে পারো, তেমন তো কোনও আভাষ পাইনি।

নাপিত বললো, আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? না হওয়ারই কথা। যাই হোক, এক্ষুণি আপনার সামনেই দেখিয়ে দিচ্ছি। কী করে আবার কুঁজোটা বেঁচে ওঠে, একবার দেখুন।

কোমরে গোঁজা সন্নাটা হাতে নিয়ে কুঁজোর কাছে এগিয়ে গেলো। এক হাত দিয়ে মুখটা হাঁ করিয়ে অন্য হাত দিয়ে সন্নাটা ঢুকিয়ে দিলো মুখের ভিতর। কয়েক মুহূর্ত। সন্নাটা বের করলো। তার মুখে মাছের একটা টুকরো।

সঙ্গে সঙ্গেই, কি আশ্চর্য কুঁজোটা চোখ মেলে তাকালো। তাজ্জব ব্যাপার। এ-ও সম্ভব। মরা মানুষ বেঁচে উঠলো?

সুলতান হতবাক। হতবাক সকলেই। অবাক বিস্ময়ে সবাই চেয়ে দেখে কুঁজোটাকে-চেয়ে থাকে নাপিতের মুখের দিকে।

নাপিত তখন নির্বিকার। এমন ভাব-যেন বিশেষ কিছুই হয়নি। এ আর এমন কি-আরও অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটাতে পারে সে।

সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো। খোদার পয়গম্বর ছাড়া এমন অলৌকিক ঘটনা কে ঘটাতে পারে? মুহুর্তের মধ্যে নাপিত সম্পর্কে সকলের ধারণা আমূল পাল্টে গেলো। কোনও ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী না হলে এরকম ঘটনা কি করে সম্ভব? নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে স্বয়ং এখানে পাঠিয়েছেন।

সুলতান বললেন, জীন্দগীতে অনেক আশ্চর্য ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু তুমি আজ যা দেখালে নাপিত, তার জবাব নাই। এরকম তাজ্জব ঘটনা একমাত্র আল্লাহর পয়গম্বর ছাড়া আর কেউ ঘটাতে পারে না। আমার মনে হচ্ছে, তিনিই তোমাকে পাঠিয়েছেন। আমার দরবারের প্রিয়তম বয়স্য এই কুঁজো। এর বিয়োগে আমার দরবারে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছিলো। তুমিই আবার আলো জ্বলিয়ে দিলে। আমার মুখে হাসি ফোটালে। সবই তীর অপার লীলা। তিনিই তোমাকে পাঠিয়েছেন। না হলে, দর্জির সঙ্গেই বা তোমার দেখা হবে কেন? আর সেই বা বলবে কেন তোমার অলৌকিক গুণের কাহিনী? দর্জির মুখে শোনার পর থেকে আমার কিন্তু বারবারই মনে হচ্ছিলো, তোমার ভেতরে এমন একটা কিছু গুণ আছে যা অন্যের চোখে ধরা পড়ছে না। তুমি এলে তাই প্রিয় বয়স্যর প্রাণ রক্ষণ পেলো। সে নিশ্চিত মারা গেছে—আমরা তার শেষকৃত্যু করবো বলে তৈরি হচ্ছিলাম। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার দেহ সমাহিত করা হতো। শুধু তোমার কল্যাণে আমরা আবার তাকে ফিরে পেলাম। এর চেয়ে আশচর্য ব্যাপার কি ঘটতে পারে?

সুলতান তার মহাফেজখানার প্রধানকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনার বিবরণ স্বর্ণীক্ষরে লিখে সযত্নে রেখে দাও। ভাবীকালের মানুষ পড়ে এর থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করতে পারবে।

এর পর দর্জি, ইহুদী হেকিম, বাবুর্চি এবং খ্ৰীষ্টান দালালকে মূল্যবান সাজপোশাক ও স্বর্ণমুদ্রায় পুরস্কৃত করে বিদায় দিলেন সুলতান। কুঁজোকেও নানা পোশাক পরিচ্ছদে ভূষিত করে আবার দরবারে বসালেন। আর নাপিতকে দিলেন। হীরা জহরৎ বসানো সোনার জ্যোতিষ দর্পণ, সোনার কঁচি, সোনার ক্ষুর। তাছাড়া নানারকম দামী দামী সাজপোশাক দিয়ে বললেন, আজ থেকে তুমি আমার সভার আর এক বয়স্য হলে। তোমাকে আমি আমার ব্যক্তিগত ক্ষৌরকার নিযুক্ত করলাম।

শাহরাজাদ একটুক্ষণের জন্য থামালো। এখানেই এ কাহিনীর শেষ। কিন্তু শাহজাদা, এর চেয়েও চমৎকার কাহিনী আছে। আপনি শুনে আরও তাজ্জব বনে যেতে পারেন।

বাদশাহ শারিয়ার বললো, কী সেই কাহিনী?

মধুমিতা এবং আলী নূরের কাহিনী এবার শোনাবো আপনাকে। এ কাহিনী আরও মজাদার আরও চমৎকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *