২৫
চণক ভদ্র! চণক ভদ্র!—বাতাসের সঙ্গে ক্ষীণ ডাক ভেসে আসে। যেন উত্তরের বাতাসই ডাকছে। চণকের এমনিই মনে হয়। উত্তর, তার দেশ, এখন সুদুর হয়ে গেছে। এক সময়ে তার দেশ তার কাছে বদ্ধ জলাশয়ের মতো মনে হয়েছিল। তক্ষশিলার গুরুকুলও সাধারণভাবে সেই বদ্ধতার দায়ভাগী। সমগ্র গান্ধার জুড়ে ব্রাহ্মণ উপাধ্যায় আচার্যর ঘরে, সম্পন্ন গৃহস্থর ঘরে, রাজন্য, রাজপুরুষদের ঘরে খালি যজ্ঞের ধোঁয়া কুণ্ডলীকৃত হয়ে উঠছে। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যাবে ‘অগ্নে ব্রীহি বৌষট্’—অগ্নি তুমি খাও এবং দেবতার জন্য বহন করে নিয়ে যাও, ‘সোমস্য অগ্নে ব্রীহি বৌষট্’—অগ্নি, তুমি সোম ভক্ষণ করো, বহন করো। শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে চণকের এক সময়ে মনে হয়েছিল—কী প্রয়োজন এই অতি বিশদ, জটিল পূজাপদ্ধতির? এগুলি কেন? কেন?
‘চণক ভদ্র! চণক ভদ্র! পেছনে ধুলোর কুণ্ডলী উড়িয়ে এক অশ্বারোহী আসছে। পাহাড়ের পথে অশ্বর ক্ষুরের শব্দ শোনাচ্ছে বৌ-ষট্ বৌ-ষট্ বৌ-ষট্। চণক ফিরে দাঁড়াল। অশ্ব থেকে এক লাফে নামছে অশ্বারোহী। এক সুন্দর যুবক। কেশগুলি মনোহরভাবে তরঙ্গায়িত হয়ে পড়েছে কাঁধের ওপর। উত্তরীয়র একপ্রান্ত কটিবন্ধে শক্ত করে বাঁধা। অন্য প্রান্তটি বাতাসে উড়ছে। পতাকার মতো। বুকে উপবীত দেখা যাচ্ছে। ছুটতে ছুটতে আসছে যুবক।
চণক ভদ্র আপনি এখানে? বালকের মতো উল্লাসে মুখ উদ্ভাসিত করে বলে উঠল যুবক—আমাকে একটুও স্মরণ করতে পারছেন না?
—কোথায় দেখেছি? কোথায় দেখেছি? মুখটি চেনা-চেনা। তক্ষশিলায়, না?
—আমি তিষ্য। গুরু সংস্কৃতির কাছে ছিলাম। শস্ত্রগুরু সুধন্বার ওখানে আপনাকে দেখেছি। দেখেছি অনেক স্থানেই। পরিচয় হয়নি। আচার্য দেবরাতের অন্ত্যেষ্টির সময়ে আমি উপস্থিত ছিলাম। এক নিশ্বাসে সাগ্রহে অনেক কথা বলে গেল তিষ্য। তার চোখে সম্ভ্রম, সে যেন কোনও মহৎ প্রাপ্তির প্রতীক্ষায় হাত পেতে আছে।
দু এক মুহূর্ত। তারপরেই তিষ্যকে আলিঙ্গন করল চণক। বলল—সুখী হলাম।
উদ্ভাসিত মুখে তিষ্য বলল—আমি সাকেতের রাজা উগ্রসেনের জ্যেষ্ঠকুমার। আপনি বন্ধুল মল্লর নাম শুনেছেন?
—শুনেছি।
—ওঁর কাছেও কিছুদিন অস্ত্র শিক্ষা, রণকৌশলের পাঠ নিয়েছি। এই সব পরিচয় এবং তথ্যকে সে যেন চণকের সঙ্গে আলাপিত হবার যোগ্যতা বলে নিবেদন করতে চায়। দুজনে গৃধ্রকূট বেয়ে উঠছে এখন। বড় বড় পায়ে, সামনে ঝুঁকে ঝুঁকে। চণক বলল, কোশল রাজসভায় কর্ম করেন?
—না। না। শুধু রণকৌশল শিখছিলাম।
—সাকেতে পিতার রাজ্যপাট দেখেন?
—তাও না। তিষ্য উজ্জ্বল মুখে বলল, চণক ভদ্র, আমি জানি না বুঝি না আমার বিদ্যা, অভিজ্ঞতা, দর্শন এসবের যথার্থ প্রয়োগ কোথায়, কীভাবে হতে পারে। আমি একটা বিভ্রান্ত বিমূঢ় অবস্থার মধ্য দিয়ে কালক্ষেপ করছিলাম, কাউকে খুঁজছিলাম, আপনার মতো কাউকে, যিনি আমায় পথ দেখাতে পারবেন, যাঁর সঙ্গে আমি এ বিষয়ে আলাপ করতে পারবো। চণক ভদ্র ‘আপনি’ বলবেন না আমায়। আমি আপনার অনুজের মতো। আপনি যখন সদ্য সদ্য সমাবৃত্ত হবার পরই দণ্ডনীতির বিশেষ পাঠ দিচ্ছিলেন তখন কোনও কোনও আলোচনাসভায় বিমুগ্ধভাবে উপস্থিত থেকেছি। আচার্য সংকৃতির অবমাননার ভয়ে আপনার শিষ্য হতে পারিনি। আমায় ভাই না হোক বন্ধুর স্থান অন্তত দিন। তিষ্য যে অত্যন্ত উত্তেজিত তার কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।
মধ্যদেশ—চণক ভাবলো। এখানে রাজা থেকে কবি, রাজপুত্র থেকে বনের মানুষ পর্যন্ত কথা বলে অনেক। উচ্ছাস-আবেগ গোপন করে না। এক অর্থে আত্মাভিমান লক্ষণীয়ভাবে অল্প। দ্রুত বন্ধুত্ব করতে পারে। উত্তরের মানুষগুলি স্বল্পভাষী। নিজেকে অপরের কাছে প্রকাশ করে ধরার অভ্যাস তাদের নেই। এবং প্রচণ্ড দাম্ভিক। এভাবে দূর থেকে অল্প পরিচিত একজনকে দেখে উচ্ছ্বসিত হওয়া, সঙ্গে সঙ্গে পরিচয় করা, সখ্যে পৌঁছে যাওয়া—এ গান্ধারবাসীরা ভাবতেও পারে না। চণক নিজেও এর ব্যতিক্রম নয়। সে হেসে বলল—বন্ধু? আপনি আমার বন্ধুত্ব চাইছেন আমায় না জেনে?
—আমি আপনাকে জানি। কে না জানে তক্ষশিলায়? দৈবরাত চণককে? আপনি আচার্য দেবরাতের আরব্ধ-কর্ম সমাপ্ত করছেন। আপনি ভাবছেন সূক্ষ্মতর দণ্ডনীতি নিয়ে…আমি জানি। অনেক কাল থেকে আপনাকে বন্ধুরূপে পাবার বাসনা আমার।
চণক আকাশের দিকে তাকাল। তরল নীল আকাশ। সূর্য এখন উত্তরায়ণে। তির্যকভাবে রোদ পড়েছে গৃধকূটের মাথার ওপর। সঞ্চিত বারি শেষ করে দিয়ে মেঘগুলি এখন শ্বেত, লঘু। সে হঠাৎ কটি থেকে তরোয়াল খুলে ধরে সেটি আকাশের দিকে তুলে দাঁড়ালো। বলল, ভালো, তিষ্য, আকাশ সাক্ষী। রৌদ্র সাক্ষী। আজ থেকে চণক তিষ্যর বন্ধু, সাকেতক তিষ্যর, কেমন?
তিষ্য তরোয়ালের উপর ন্যস্ত চণকের মুঠির ওপর হাত রাখল। বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলল, বন্ধু। মেঘগুলি সাক্ষী। গৃধ্রশিখর সাক্ষী। সাক্ষী রাজগৃহ।
—রাজগৃহ তোমার ভালো লেগেছে, তিষ্য?
—রাজগৃহ অনবদ্য। অনবদ্য!
—কেন?
—কেন?—চণকের পেছন পেছন উঠতে উঠতে তিষ্য চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিল একবার। বলল, একই সঙ্গে পাহাড়, অরণ্য। মধ্যদেশে তো পাহাড় সুলভ নয় ভদ্র, গয়া থেকে এদিকে এলে প্রচুর পাহাড় দেখা যায়, কিন্তু সে সব বড় রুক্ষ। এ পাহাড়গুলি পুরোপুরি শ্যামল না হলেও যেন অত কঠিন, নীরস নয়। পাহাড়ের সানুদেশে প্রচুর গাছ। দুরারোহও নয় পাহাড়গুলি, নগরীটি যেন দেবতারা সুরক্ষিত করে দিয়েছেন।
ভালো। আর কোনও কারণ?
এইটুকু পরিসর এ নগরের। তবু চোখ এবং মন ক্লান্ত হয় না। বৈচিত্র্য আছে। শুধু গৃহ, পথ এবং কানন বিন্যাসের বৈচিত্র্য নয়। আরও কিছু…আরও কী, তিষ্য ভাবতে লাগল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চণক বলল, আর কী, বন্ধু তিষ্য?
তিষ্য চিন্তিত মুখে বলল, আছে কিছু। এখুনি তাকে বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারছি না ঠিক। কিন্তু কোশলের রাজধানী শ্রাবস্তীর ঐশ্চর্যও তো দেখেছি। রাজগৃহও রাজধানী। এখনকার সবচেয়ে বড় না হোক, সবচেয়ে সমৃদ্ধ না হোক, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রাজ্যের রাজধানী। এখানে সেই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় বোধ হয়। যদিও প্রজাদের চোখে-মুখে শুধু সমৃদ্ধির চিহ্ন ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনি। তবু…
চণক বলল, সাধু, তিষ্য, সাধু। তোমার দেখার সঙ্গে আমার দেখা অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ কখনোই আকস্মিক নয়। আমাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল। অবশ্যই কথা ছিল।
দুজনে উঠতে উঠতে পাথরের চন্দ্রাতপের তলায় ভিক্ষু অস্সজিকে দেখতে পায়। আজকাল এই সময়ে অস্সজি ধ্যানমগ্নই থাকেন। তিনি পাছে উত্ত্যক্ত হন, তাই ইদানীং চণক গিরিশিরে ওঠার এই সহজ পথটি এড়িয়ে যায়। আজ তিষ্যর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভুলে গিয়েছিল। তাকে অভ্যস্ত পথে চালিয়ে নিয়ে এসেছিল তার মন। সেই অঞ্চলটুকু পার হয়ে তিষ্য মৃদুস্বরে বলল, চণক ভদ্র, আপনার কখনও মনে হয় না সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, পরিব্রাজক এঁদের সংখ্যা এত কেন? সমগ্র কোশল, মগধ, উত্তরাঞ্চলও যেন দিনে দিনে ভরে যাচ্ছে শ্রমণে।
চণক চমকে তাকাল, বলল, এভাবে মনে হয়নি। তুমি বললে বলে মনে হয়। এর হেতু কী বলতে পারো?
তিষ্য লজ্জিত হয়ে বলল, প্রশ্নই আসে মনে। উত্তর দিতে পারি না। উত্তরে দেখতাম প্রব্রজ্যা নিলে সন্ন্যাসীরা একেবারে জনহীন দুর্গম হিমবন্তে গিয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে এসে লোকালয়ে কিছুদিন বাস করে যেতেন। কিন্তু আমাদের এদিকে পথে বেরোলেই কোনও না কোনও পরিব্রাজক শ্রমণের সঙ্গে আপনার ঠোকাঠুকি হয়ে যাবে। এঁরা যেমন পাহাড়ে বা কাননে বাস করেন, তেমনি লোকালয়েও নিত্য নেমে আসছেন।
—কিন্তু তিষ্য, তোমার জন্মেরও বহুকাল আগে থেকেই তো এই প্রকার চলে আসছে!
—তা আসতে পারে ভদ্র। কিন্তু তাই বলে তাকে প্রশ্ন করব না?
—তা বলছি না। শিশুকাল থেকে যা দেখে আসা যায়, মানুষ সাধারণত তাকে নিজের অজ্ঞাতেই মেনে নেয়। প্রশ্ন করে না। তুমি করছো। তোমার দৃষ্টির একটি বিশেষ ভঙ্গি আছে।
—কী জানি কেন চণক ভদ্র, শ্ৰমণ-সন্ন্যাসী এঁদের দেখলেই চিরকালই আমার কেমন একটা বিতৃষ্ণা হয়। বুঝতে বা বোঝাতেও পারি না কেন। তাই-ই হয়ত প্রশ্ন জেগেছে।
—বিতৃষ্ণা কেন। এ প্রশ্নের উত্তর আগে তোমাকে ভেবে বার করতে হবে তাহলে।
দুজনে নীরবে উঠতে লাগল। বেশ খানিকটা ওঠবার পর বসার স্থান ঠিক করে চণক বসল। তার মুখ দক্ষিণে। ওই দিকে বন, যে বনের চরিত্র জানবার জন্য তার পরিব্রজন-ব্রত নেওয়ার কথা ছিল। একটার পর একটা ঘটনা ঘটে তার এই ব্রতকে বিলম্বিত করে দিচ্ছে। রাজগৃহে আসবার আগে সে ছিল একজন বন্ধনহীন মুক্ত যুবক। তার জীবনের প্রধান কাজ তখন “রাজশাস্ত্র” সমাপ্ত করা। এই শাস্ত্র যথাযথ লেখবার জন্য যে চিন্তাই যথেষ্ট নয়, জীবনের সঙ্গে, বহু স্তরের মানুষের সঙ্গে ভাবনাকে মিলিয়ে মিলিয়ে নেওয়া প্রয়োজন এই কথা বুঝে সে গান্ধার থেকে বেরোবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। রাজ্যগুলি দেখবে, বিশেষত মগধ, আদর্শ রাজা, রাজ্য এবং তন্ত্র কোথায় পাওয়া যায় অনুসন্ধান করবে, সেই সঙ্গে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর বিন্যাস, শ্রেণীগুলির ধ্যান-ধারণার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগে আসবে এমনটাই তার অভিপ্রায় ছিল। তার মনের সূক্ষ্ম পরিবর্তন হল ওই বনে। এই বন্যরা কোনও বিন্যস্ত শ্রেণীতে নেই। এদের আটবিক বলে উল্লেখ করা হয় এবং সেই উল্লেখের মধ্যে নিহিত থাকে সমাজের একটি মন্তব্যও—এরা উৎপাত। উপদ্রব। কিন্তু এদের কাছাকাছি বাস করে চণক বুঝেছে জম্বুদ্বীপের মাটিতে যদি তাদের, অর্থাৎ শ্বেতকায়দের অধিকার থাকে, যদি মিশ্রবর্ণ নাতিশ্বেত মানুষদের অধিকার থাকে, তাহলে ওই কৃষ্ণকায় মানুষগুলিরও পুরোপুরি অধিকার আছে। এই মাটিতে, এই অরণ্যেই ওরা যুগের পর যুগ, বংশের পর বংশ জন্মেছে, বড় হয়েছে, নিজেদের গোষ্ঠীর নিয়মগুলি মেনে জীবনযাপন করেছে, মরে গিছে, আবার জন্মেছে। এদের উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোনমতেই না। এমন কি চণকের একেক সময়ে সংশয় হয় এই আটবিকরাই কি জম্বুদ্বীপের আদি অধিবাসী? তারা কি পরে এসেছে? তারা যে প্রথমে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে ছিল, তারপরে ছিল সরস্বতী-দৃষদ্বতীর মধ্যভাগে, তারও পরে এসেছে গঙ্গা-যমুনার অববাহিকায়, অর্থাৎ ক্রমশই উত্তর-পশ্চিম থেকে পূর্বে এবং দক্ষিণ-পূর্বে তারা ছড়িয়ে পড়েছে—এ কথা সে বেদ অধ্যয়ন করবার সময়েই বুঝতে পেরেছিল। তাহলে? যখন তারা শুধু সপ্তসিন্ধু অঞ্চলেই বসবাস করছিল, তখন এই মধ্যদেশ কী রূপ ছিল? এখন পুবদেশ, দক্ষিণদেশ যেমন ঘন অরণ্যে আবৃত তেমনই নিশ্চয়ই। কারা তখন এখানে বাস করত? তার যুক্তি তাকে বলে—আটবিকরা। বন্যরা। অর্থাৎ যেখানেই বন, সেখানেই এরা বসবাস করত। এখন কল্পনা করা যাক, শ্বেতকায় মানুষগুলি আরও ভূমির সন্ধানে অস্ত্র-শস্ত্র যন্ত্র নিয়ে ক্রমশই এই মহাবনের ভেতরে প্রবেশ করছে। কেটে ফেলছে গাছ। পরিষ্কার করে ফেলছে যতেক গুল্ম। হিংস্র জন্তুগুলিকে হত্যা করছে। আটবিকরা তাদের বিরাট সংখ্যা, উন্নত অস্ত্র-শস্ত্র, যন্ত্র দেখে ভয় পেয়ে যাচ্ছে। পালিয়ে যাচ্ছে, আরও গভীরে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। মাঝে মাঝে চোরের মতো আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করে তুলছে শ্বেতকায়দের। কিন্তু তাড়াতে পারছে না। বিজয়ী এবং বিজিতের যে স্বাভাবিক সম্পর্ক তা-ও কিন্তু তাদের সঙ্গে আটবিকদের এখনও পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি। এই যে মহারাজ বিম্বিসার অঙ্গ রাজ্য জয় করেছেন, তার অর্থ কি তিনি অঙ্গে বসবাসকারী সমস্ত মানুষকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তা তো নয়। তারা যেমন তাদের নিজ নিজ বৃত্তি অনুসরণ করে জীবনযাপন করছিল, তাই-ই করে যাচ্ছে। শুধু রাজশক্তির পরিবর্তন হয়েছে, হয়ত কতকগুলি নীতিও স্বতন্ত্র হয়ে গেছে। এই পর্যন্ত কিন্তু বন্যদের বেলায়, তাদের সমস্ত অধিকার যেন অস্বীকার করা হচ্ছে। হিংস্র জন্তুগুলিকে পর্যন্ত। এভাবে শেষ করে দেওয়া হয় না। শাকভোজী পশুগুলিকে তো বিচরণ করবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েই থাকে। নাঃ। আর্যমানুষের একটি প্রাচীনতম অপরাধ এই আচরণ। এরই জন্য অংশত জম্বুদ্বীপ কতকগুলি পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নরগোষ্ঠীর সমষ্টি। একটি সুন্দর বস্ত্র যদি মাঝে মাঝেই ইদরে কেটে দেয় বস্ত্রটি যেমন তার মহিমা হারায়, অব্যবহার্য, অর্থহীন হয়ে পড়ে—জম্বুদ্বীপও তাই হয়েছে। কোনও অর্থ নেই এর।
চণক তার এই নতুন ভাবনায় কাউকে দীক্ষিত করতে পারেনি। মহারাজ বিম্বিসার তার কথা মন দিয়ে শুনেছেন। পুরোপুরি মেনে নিয়েছেন এমন কোনও লক্ষণ দেখাননি। তবে নতুন ভাবনার কাজ বাতাসে-ওড়া তুলোর বীজের মতো। উড়ে উড়ে বেড়াবে, তারপর পড়বে ভূমিতে কোথাও, ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় চলে যাবে মাটির গভীরে, তারপর অনেক রোদ, জল পান করে এক সময়ে অঙ্কুর মেলবে। লোকে নেবে কি নেবে না এই ভেবে চিন্তক কখনও তাঁর চিন্তাগুলিকে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকবেন না। থাকা উচিতও নয়।
এই আটবিকদের, যদি আর্যমানুষদের আচরিত সমাজবিধির মধ্যে নিয়ে আসা না যায়, তাহলে আর্যমানুষরা এদের কোনদিন স্বীকার করবে না। বিম্বিসার রাজার প্রতিক্রিয়া থেকেই তা বোঝা যায়। অথচ…এদের…এই বন্যদের কি পরিবর্তিত করা যাবে? আদৌ? এদের জীবনযাত্রার গভীরে না-ঢুকলেও যেটুকু সে জেনেছে তাতে মনে হয় এদেরও সমাজ-বিধি আছে নির্দিষ্ট। সেই বিধি এদের আচরণ নিয়ন্ত্রিত করে। এদের আছে যথেষ্ট আত্মাভিমানও। আমানুষরা যেমন এদের অশুচি মনে করে এরাও তেমনি আমানুষদের অশুচি-অস্পৃশ্য মনে করে। এদের নিজেদের মতো ‘সু-সভ্য’ করা কঠিন কাজ মনে করেই কি দীর্ঘ সময় ধরে এদের মেরে নিঃশেষ করে দেওয়া হচ্ছে? এ কাজ কি সভ্যমানুষ সচেতনভাবে পরিকল্পনা করে করছে? না, না-ভেবেই করে যাচ্ছে? প্রথমে সমাজ ছিল শুধু বৈদিক। এখন বেদ-পন্থা অস্বীকার করেও তো বহু মানুষ চমৎকার জীবনধারণ করে আছে? সুতরাং বেদ মানা না মানার ওপর এখন মোটেই সভ্যতার পরিমাপ নির্ভর করছে না। অথচ একটি সূত্র চাই। একটা কিছু সামান্য সূত্র যাতে এই বিশাল দেশের সব নরগোষ্ঠীকে এক ও আপন করতে পারে!
অথচ, জীবনে এখন এমন জটিলতার উদ্ভব হয়েছে যে চণক বেরোতে পারছে না। জিতসোমা যদি পুরুষ হতে অনায়াসে তাকে নিয়ে এই দুরূহ যাত্রাপথে সে বেরিয়ে পড়তে পারতো। কিন্তু সোমাকে ফেলে সে কোথায় যাবে? কে জানে কী দুর্দৈব আবার নেমে আসবে ওই প্রিয় নারীর জীবনে, সে যদি তাকে একা এখানে রেখে যায়! সোমার ভাবনাও তার জীবনের একটা মূল ভাবনা। সোমা তক্ষশিলার রাজপুরে চলে যাবার পর সে গভীরভাবে বিষন্ন, ক্রুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে-ও বোধহয় একজন সুযোগসন্ধানী এবং কাপুরুষ। তার মধ্যে তেজের অভাব আছে। তা নয়ত সোমার এই রাজপুরী-যাত্ৰা সে মেনে নিল কেন? কোনক্রমেই কি সে সোমাকে নিয়ে পালিয়ে আসতে পারতো না? তার ভেতরের কাপুরুষটা দায়িত্ব নামিয়ে দিয়ে চলে এসেছিল। হ্যাঁ, কর্কশ লাগলেও এটাই সত্য কথা। এখানে, রাজগৃহে মহামাত্র দর্ভসেন যখন সোমাকে দান করে দিলেন, তখন? তখনও তো সে বিদ্রোহ করেনি! শুধু কৌশলে তাঁকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছে। না পেরে,আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। সোমার বুদ্ধিতে এবং ঘটনাচক্রে মহারাজ বিম্বিসারের বদান্যতার কারণে সোমা মুক্ত হয়েছে। এখন সে প্রতিদিন নতুন করে অনুভব করছে নিজের অক্ষমতা।
তিষ্য দেখল অপরাহ্ণের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। ক্রমশ তা চণকের মুখের ওপর এক গাঢ় বিষন্নতার চক্র রচনা করল। তারা দুজনে বহুক্ষণ নীরবে বসে আছে। এই চণক তার কিশোর ও তরুণকালের আদর্শ। সে যখন নিজের সহাধ্যায়ীদের সঙ্গে তৃপ্ত হতে না পেরে আলোচনাসভায় বিতর্কসভায় ঘুরে বেড়াত অস্থির হয়ে তখন চণককে দেখেছে। দেখেছে খুব সংযতভাবে বিতর্কে যোগ দিতে, মন দিয়ে আলোচনায় যোগ দিতে, আলোচনা করতে। প্রথম প্রথম অতিশয় দাম্ভিক বলে মনে হত। তক্ষশিলায় তার শেষ বছরগুলিতে তিষ্য বুঝেছিল চণক কোনও চিন্তায় ডুবে থাকেন; আচ্ছন্ন থাকেন, সেই সব দুরূহ চিন্তার জগতে তিনি নিঃসঙ্গ। তক্ষশিলায় সবাই চণককে সমীহ করত। অনেকেই বলতেন—‘এ যুবক নিতান্ত অল্প বয়সে আচার্য হয়ে গেল। এটা ঠিক নয়। ও ধারাবহির্ভুত চিন্তা করছে।’ কেউ কেউ সংশয়ী মুখে বলতেন—‘ও বিদ্রোহী।’ কিন্তু তারজন্য চণকের সম্মান কখনও ক্ষুণ্ণ হয়নি। তিষ্য সে সময়ে স্বপ্ন দেখত সে চণকের সঙ্গে বসে নিজেদের একান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে, দেখত বসে আছে কোনও তরুমূলে সে ও চণক। কেমন করে সে স্বপ্ন সফল হল? সম্ভব হল? সে কি কখনও ভেবেছিল তক্ষশিলার বিদ্যা ও জ্ঞানের মণ্ডল ছেড়ে চণক এই ব্রাত্য মধ্যদেশে কোনদিন আসবেন? তার নিজেরই দেশে প্রায় চণকের সঙ্গে তার পথের বাঁকে দেখা হয়ে যাবে! যেন এ রূপ হয়েই থাকে। এ একটা সাধারণ ঘটনা! সে কি ভেবেছিল প্রথম দেখায় নিজের প্রীতির কথা সে এইভাবে স্বচ্ছন্দে বলতে পারবে এবং চণক এইভাবে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধন স্বীকার করে নেবেন? এইরূপ অস্ত্র, আকাশ, ভূমি সাক্ষী রেখে।
এই সময়ে চণক মুখ ফিরিয়ে বলল, কী তিষ্য? কী ভাবছো? তার মুখে একটু অস্পষ্ট হাসি।
সত্যি কথা কি বলতে চণকই ভাবছিলেন, তিষ্য তাঁকে চিন্তামগ্ন দেখে নীরব ছিল মাত্র। কিন্তু এখন সে সে-কথা উল্লেখ করল না। বলল সংসার ত্যাগী পরিব্রাজক ও সন্ন্যাসীর আধিক্যের একটা হেতুর কথা আমার মনে এসেছে ভদ্র।
—বলো, বলো। চণক উৎসাহিত হয়ে উঠল।
—আমাদের বৈদিক ভাবনাই তো সন্ন্যাসকে গুরুত্ব দিয়েছে। সন্ন্যাসকে মানুষের জীবনের শিখরে স্থান দিয়েছে। এই লোক নয়, লোকোত্তর কোনও সত্যই যে খোঁজা হচ্ছে এমন ইঙ্গিত কি বারবার আমরা যজ্ঞবিধির মধ্যেও পাই না?
—অথচ এই যজ্ঞবিধি বা সংহিতার সূক্তগুলির ঋষি যাঁরা, তাঁরা তো পরিপূর্ণভাবেই গৃহী ছিলেন? চণক বলল এমন কি ব্রহ্মবাদের প্রবক্তা যাঁরা। যেমন রাজা প্রবাহণ বা চিত্র গার্গ্যায়ন এঁরা তো রাজা ছিলেন। একই সঙ্গে রাজত্ব করা, রাজৈশ্বর্য ভোগ করা এবং লোকোত্তর রহস্যের চিন্তা করা যে সম্ভব তা-ই তাঁরা দেখিয়েছেন। তবু এত সংসার-বিরাগী, কেন?
তিষ্য বলল, তবে কি এই বিশাল সংখ্যার মানুষের সত্যিই সংসার ভালো না লাগবার কোনও কারণ ঘটে, চণক ভদ্র? এঁরা কি সংসারে কষ্ট পেয়েছে? প্রত্যেকে?
চণক বলল, ঠিক এই কথা, অর্থাৎ সংসার দুঃখের, জীবন দুঃখময়, এই কথাই তো.শ্ৰমণ গৌতম বলছেন।
—শ্ৰমণ গৌতম? তিষ্য উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, ওঁকে আমি দেখেছি, যেদিন প্রথম রাজগৃহে এলাম। তর্ক করতে পারেন, ভালো। অন্যান্যদের নিজের মতে নিয়ে আসার ক্ষমতা অসাধারণ।
—কী করে জানলে?
—আমার সামনেই তো কতকগুলি শ্রমণকে নিজের মতো আনলেন। তারা সব নিগণ্ঠ মত ত্যাগ করে বেলুবন নামক স্থানে চলে গেল।
চণক আশ্চর্য হয়ে বলল—তুমি দেখলে?
—দেখলাম। শুনলাম।
—আমিও দেখেছি। শুনেছি। দেবতার মতো সৌম্যদর্শন। অসাধারণ বুদ্ধিমান ইনি। কিন্তু তিষ্য, আমি যতদূর শুনেছি ইনি বেদ তো মানেনই না। তুমি যেভাবে সংসার-বিরক্ত হওয়ার কথা বলছো ইনি সেভাবে হননি। ব্যক্তিগত জীবনে এঁর মতো সুখী কেউ ছিল না। ধনবান, ক্ষমতাশালী পিতা, মমতাময়ী মা, সুন্দরী পত্নী যিনি ছিলেন একেবারে সঙ্গীর মতো। একটি পুত্রও হয়, তারপরই ইনি গৃহত্যাগ করেন। এখন নিজেকে সুখী বলেন, সুখী যে তা মুখভাবেই বোঝা যায়। এই সুখী অভিজাতপুত্র দুঃখবাদের কথা বলেন। নিবৃত্তি ও নির্বাণের কথা বলেন। অথচ তিষ্য, আমি চণক শৈশবে মাতৃহীন, যৌবনারম্ভে পিতৃহীন, সংসারে একা, এঁর মতো ধন-সম্পদ-বিলাসও আমার আয়ত্তে নেই, অথচ এই আমি পৃথিবীকে, জীবনকে আনন্দময় মনে করি। এতো আনন্দময় যে নির্বাণের কথা শুনলে আমার হৃৎকম্প হয়। তা ছাড়াও আমার মনে হয়, মনে হয়…জীবনকে সংসারকে আরও সুন্দর, সুশৃঙ্খল করাই আমার কাজ। শুধু আমার কেন, আমাদের সবার। তিষ্য, তুমি কি ব্যক্তিগত সুখের কথা ভাবো?
তিষ্য এক ধরনের গৌরববোধে দৃপ্ত মুখে বলল, সে-কথা ভাবলে গৃহত্যাগ করতাম না চণক ভদ্র। আমি ভাবি সুন্দর, সুষমাময়, সুবিচারশীল রাজ্যসৃষ্টির কথা।
—সত্য? তাহলে তিষ্য, সেই রাজ্যের সুবিচার তুমি কেমন কল্পনা করো? বলবে আমাকে? সেই রাজ্যের সমাজ নিয়েও তুমি নিশ্চয় ভাবো!
—ভাবি বই কি! সে রাজ্যের প্রতিটি গ্রামে, সব বৃত্তির লোক থাকবে। খাদ্য উৎপাদন, বস্ত্র উৎপাদন, যন্ত্র এবং তৈজসপত্র উৎপাদন, রথ প্রস্তুত। পথ সু-সমান এবং পরিষ্কার রাখা, পথ-ভয় দূর করা এ সমস্ত ব্যাপারেই সজাগ থাকবে সে রাজ্যের শাসনযন্ত্র।
—বিচারের কথা বলো।
ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সুবিচার যাতে পায়, তার ব্যবস্থা থাকবে। ধনী-দরিদ্র বলে যাদের নির্দেশিত করছে, তারা কারা, তিষ্য?
—অর্থাৎ?
—তারা কি আমাদের মতো মানুষ? সবাই?
—বুঝলাম না চণক ভদ্র।
—ধরো কৃষ্ণকায় মানুষ।
—তারাও তো প্রজা, তারাও সুবিচার পাবে!
—ধরো যারা বনে থাকে, তারা?
—নিষাদদের কথা বলছেন? নিষাদরাও অবশ্যই সুবিচার পাবে।
—নিষাদও নয়। যে-সব বন্যদের সঙ্গে আমাদের কোনও আদান-প্রদান নেই, তারা!
—ভদ্র আমি দক্ষিণে অর্থাৎ বিন্ধ্য পর্বতের ওপারের আদর্শ রাজ্য স্থাপনের কথা চিন্তা করি। শুনেছি সেখানে গভীর অরণ্য। হিংস্র নরখাদক যক্ষ ইত্যাদিতে পূর্ণ সে-সব। এরাই সবচেয়ে বড় বাধা। কিন্তু এদের সবাইকে হত্যা করবার মতো সৈন্যবল আমি কোথায় পাবো। যথাসম্ভব এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতিই গ্রহণ করতে হবে।
—তাহলে এই বন্যদের তুমি মানুষ বলেই মনে করো?
—মানুষই তো এরা। অশিক্ষিত, অসভ্য, কিছুটা হিংস্র এইমাত্র। আমরা শিশুকালে শুনতাম এদের মাথায় শিং আছে। দাঁতগুলি হাতির দাঁতের মতো বেঁকে বেঁকে বাইরে বেরিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের সাকেতের গৃহেই দুটি বন্য দাস আছে। তারা মোটেই এ রূপ নয়! শিশুকাল থেকে তাদের দেখছি। নিকটের বন থেকেই নাকি এক সময়ে তাদের ধরে আনা হয়েছিল। এখন তারা আমাদের অন্যান্য দাসেদের মতোই। কোনও প্রভেদ নেই।
চণক অবাক হয়ে শুনছিল। সে বলল, ধরো দক্ষিণে যেসব বন্য-মানুষের সংস্পর্শে তুমি আসবে তাদের সবাইকে তুমি দাস করে রাখবে?
—চাইলেই কি তা পারবো চণক ভদ্র? তাদের নিজেদের দেশে তারা আমাদের থেকে শক্তিশালী হবে। তা ছাড়া দেখুন, তাদের বুদ্ধিতে যদি সেবা ব্যতীত অন্য কোনও কাজ সম্ভব না হয়, তা তো তারা সেবক ছাড়া আর কী-বা হবে?
—কিন্তু যে বনে তারা বাস করছে তুমি রাজ্যস্থাপনের উদ্দেশ্যে সেখানে না-যাওয়া পর্যন্ত তারা স্বাধীন। তাদের কোনও বুদ্ধির পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হচ্ছে না তারা কোন কাজের যোগ্য। তিষ্য, ভালো করে ভেবে দেখো, তুমি তাদের কাছে অবাঞ্ছিত, উপদ্রব, তাদের শত্রু। তাদের স্বাধীনতা হরণ করবার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তিষ্য বলল, আপনার কথা আমি বুঝলাম, আবার বুঝলাম না। অর্থাৎ চণকভদ্র, আপনার যুক্তি আমি স্বীকার করছি, কিন্তু… কিন্তু… রাজ্য জয় করবার অধিকার কে-ই বা কাকে দেয়? যে মনে করে রাজ্য চাই, সে-ই রাজ্য জয় করে, তাই না?
চণক বলল, তাই-ই। কিন্তু তুমি ন্যায়ের কথা বলছিলে, সুবিচারের কথা বলছিলে, তাই এ সব কথা আমার মনে হল। তিষ্য, একদিনে এই জটিল সমস্যার সমাধান হবে না। চলো আমরা এবার নামি।
—নামতে নামতে তিষ্য ম্লানমুখে বলল—আপনি দণ্ডনীতির ওপর শাস্ত্র লিখছেন। রাজা, রাজ্য স্থাপন, রাজ্য বিস্তার এ সব না থাকলে দণ্ডনীতির প্রয়োজন কী ভদ্র? বন্যরা মানুষ, কিন্তু তারা বদ্ধ। তাদের যদি সে ভাবেই থাকতে দেওয়া হয় তো বিদ্যার অর্থ কী? সমাজ-জীবনে তো কোনও গতি থাকবে না সে-ক্ষেত্রে!
চণক বলল, তুমি ঠিকই বলেছ তিষ্য। কিন্তু এই সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও একটা জটিল গ্রন্থি আছে বন্ধু। যেটি আমি মোচন করতে পারছি না, এবং তুমি বোধহয় দেখতে পাচ্ছো না। কোথায় থাকো তুমি?
—অতিথিশালায়।
—চলো, সন্ধ্যা হল। আমার একটি গৃহ আছে। তিষ্য, তুমি অতিথিশালা ছেড়ে সেখানে থাকতে পারো।
তিষ্য বলল, পরে ও কথা হবে। আপনার সঙ্গে কোথায় দেখা হবে বলে দিন। আমার অতিথিশালাটি উত্তর সীমান্তে। জম্বু-বীথিকার পথে।
চণক আশ্চর্য হয়ে বলল, আমার গৃহের কাছেই তো থাকো তুমি। এত কাছে ছিলাম আমরা। সর্ব অর্থে। অথচ এত দূরে! আশ্চর্য!
গৃধ্রধ্রকূটের সানুদেশ এখন নির্জন হয়ে এসেছে। পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে কিছু দরিদ্র পল্লী। নগরের দিকে যেতে হলে এ পল্লী চোখে পড়ে না। কিন্তু বাইরের দিকে যেতে গেলে, পাশ দিয়ে যেতে হয়। চণক যে সময়ে অটবীতে আশ্রয় নিয়েছিল, তখন অনেকবার দেখেছে। আজ দুজনে ঘোড়ায় উঠছে। সেই পল্লীর দিক থেকে কয়েকটি রমণী ছুটে এলো। একজন উৎকণ্ঠিতভাবে বলল—অজ্জ, অজ্জ আপনারা কি একটি বালক ও একটি বালিকাকে এদিকে আসতে দেখেছেন?
—কই না তো? চণক এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল।
রমণী দুটি কপালে করাঘাত করে কাঁদতে লাগল।
—কী হয়েছে? বলো, আমরা সাধ্যমতো সাহায্য করব।
একটি রমণী বলল, এর মেয়ে আর আমার ছেলে বড় দুঃসাহসী। খেলতে খেলতে কখনো পাহাড়ে, কখনও বনের দিকে চলে যায়। বনে রাক্ষস আছে মানে না। পাহাড়েও শ্যেন পাখির উপদ্রব। এই গিজ্ঝকুট থেকে গতকালও ওদের সন্ধ্যার আগে ধরে নিয়ে গেছি। এদিকে যখন আসেনি, নিশ্চয় বনের দিকে গেছে। এখন কী হবে?
চণক বলল, সর্বনাশ! একটু পরেই তো প্রাকারের দ্বার বন্ধ হয়ে যাবে। তোমরা একজন কেউ আমার ঘোড়ার পিঠে উঠে এসো। তিষ্য, তুমি পাহাড়ের দিকটা অনুসন্ধান করো তো।
রমণীটি ঘোড়ায় চড়তে ইতস্তত করতে লাগল।
—বিলম্ব করো না— অসহিষ্ণু স্বরে বলল চণক। হাত বাড়িয়ে রমণীটিকে উঠতে সাহায্য করলেন। বেশ বাস রুক্ষ ধরনের হলেও এর স্বাস্থ্য চমৎকার। চুলগুলি কোনমতে জড়িয়ে নিয়েছে। ঘোড়ায় চড়তে কোনও অসুবিধাই হল না। বলল, অজ্জ আমরা হাটে শাক বেচি। গাম থেকে নিয়ে আসে আমার পতি। আমার ছেলে বড় দস্যি। এক নিমেষও তাকে এক স্থানে বসিয়ে রাখা যায় না। সাত বছর বয়স। আমাদের প্রতিবেশীর মেয়েটিও অতি চঞ্চল। দুজনে মিলে এমন দস্যিপনা করে! প্রহারও খায়! কিন্তু শিক্ষা হয় না। দেখুন না, আমাদের পতিরা গামে গেছে শাক আনতে, এসে যদি দেখে এই কাণ্ড!
চণকের ঘোড়া কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাকার দ্বারে পৌঁছে গেল। রক্ষী জ্যেষ্ঠক তাঁকে চেনে। চণক বলল, এই রমণীটির পুত্র-কন্যা, দুটি সাত আট বছরের বালক-বালিকাকে তোমরা কেউ দেখেছ না কি?
প্রতিদিন এই বিশাল দ্বার দিয়ে কত মানুষ আসা-যাওয়া করছে, রক্ষী জ্যেষ্ঠক কী করে বলতে পারবে?
কিন্তু তার সহকারী একজন রক্ষী বলল, বালক-বালিকা বুঝিনি। দুটিই বালক। মাথায় চুড়া বাঁধা কী?
রমণীটি সাগ্রহে বলল—হ্যাঁ হ্যাঁ।
—চোখে কাজল?
—হ্যাঁ, ওই তো…
—প্রহর কয় আগে দ্বার দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কোথায় যাও? তা বললে—পিতা আছেন বাইরে। পিতার কাছে যাচ্ছি। এখনও ফেরেনি?
রমণী কাঁদতে কাঁদতে বলল, কোথায় পিতা সে বালক জানবে কী করে। নিশ্চয় পথ হারিয়েছে।
চণক বলল, শীঘ্র চলো। দ্বার বন্ধ করতে একটু তো বিলম্ব আছে?
—আর এক প্রহরের মতো। দেখে আসুন। রক্ষী বললো।
কিছুদূর এগিয়ে গেলেই একদিকে পথ চলে গেছে উরুবেলার দিকে। কিছুটা এগিয়ে এই পথ দুভাগ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় শাখাটি যাবে অঙ্গের দিকে। ডান দিকে আরম্ভ হচ্ছে অরণ্য। প্রথমে ছাড়া ছাড়া গাছ, গুল্ম, ক্রমেই ঘন হয়ে উঠবে। কিছুদূর উরুবেলার পথে যেতেই ওদিক থেকে কয়েক জন লোক মাথায় বোঝা নিয়ে আসছে দেখা গেল। রমণীটি ত্বরিতে ঘোড়া থেকে নেমে সেদিকে ছুটে যেতে যেতে বলল, ওই তো আমার পতি।
চণক দাঁড়িয়ে রইল। রমণী তার পতিকে সঙ্গে নিয়ে এলো। উৎকণ্ঠিতভাবে বলল, গামের দিকে ওরা যায়নি অজ্জ।
পুরুষটি বনের দিকে দৌড়তে লাগল তার বোঝা ফেলে। চিৎকার করে ডাকছে, চুন্দ! চুন্দ! ঘোষা! ঘোষা!
পেছনে পেছনে তার স্ত্রীও ছুটছে। প্রাণপণে ডাকছে ঘোষা! ঘোষা! ঘোষা! চুন্দ! চুন্দ! বনভূমি তাদের উৎকণ্ঠিত ডাক যেন গিলে নিচ্ছে।
চণক ঘোড়া নিয়ে বনের মধ্যে খানিকটা অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। মানুষ চলাচলের একটি ক্ষীণ। পথ আছে। কিন্তু কোথাও সে কিছু চিহ্ন দেখতে পেল না। পরে ফিরে বলল, কিন্তু এই বনে তো হিংস্র পশু তেমন নেই! আর সাত আট বছরের বালক-বালিকাকে শৃগালে টেনে নিয়ে যেতে পারে না।
—এই বনে যক্ষরা থাকে। ভয়ে বিবর্ণ হয়ে পুরুষটি বলল।
রমণীটি উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠল।
নগরদ্বার থেকে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে। দ্বার এবার বন্ধ হয়ে যাবে তারই ইঙ্গিত।
চণক পর্ণের বোঝা সমেত রমণীটিকে তুলে নিল, পুরুষটি পেছনে ছুটতে ছুটতে আসছে।
দ্বারের কাছে পৌঁছে রমণীটি আর্তগলায় চেঁচিয়ে উঠল, দ্বার বন্ধ করো না প্রহরী। বালক-বালিকা দুটি যদি ফিরে আসে, ঢুকতে পাবে না!
প্রহরীরা কথা না-বলে ঘড় ঘড় শব্দে লোহার দরজা বন্ধ করতে লাগল। রমণীটি সেখানেই লুটিয়ে পড়ল—চুন্দ! চুন্দ রে! কোথায় গেলি বাপা!
দিনটি যেভাবে আরম্ভ হয়েছিল, সেভাবে শেষ হল না। রমণীগুলির কান্নার শব্দ পেছনে মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। কিন্তু হৃদয় থেকে মিলোল না। ওরা রাজসভায় বিচার প্রার্থনা করবে। এমন। সুন্দর নগরী, এত বড় রাজ্যের রাজধানী সেখানে শিশু বা বালক হারিয়ে গেলে রাজ্যের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করার কোনও ব্যবস্থা নেই? তিষ্য বলল, কী হয়েছে মনে হয়?
চণক বলল, বুঝতে পারছি না তিষ্য। যদি অরণ্যের মধ্যে পথ হারিয়ে থাকে, তাহলে রাত হলে ভয়েই শিশুদুটি মরে যাবে। যথেষ্ট সংখ্যক রক্ষী বা রাজভট সঙ্গে নিয়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অরণ্যে আমাদের প্রবেশ করা উচিত ছিল। রক্ষীগুলি তো বলল সন্ধ্যার পর স্বয়ং রাজা আদেশ করলেও দ্বার ওরা খুলতে পারে না। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
তিষ্য বলল, দেখছেন তো, শাসনযন্ত্রে কত প্রকার ত্রুটি থাকে? যতক্ষণে সকাল হবে, রাজাদেশে রক্ষী ও রাজভটরা প্রস্তুত হবে, ততক্ষণে কি আর শিশু দুটি জীবিত থাকবে মনে করেন?
কিছুদিনের মধ্যেই রাজগৃহের প্রান্তবর্তী পল্লীগুলিতে দারণ আতঙ্কের সৃষ্টি হল। শিশু চুরি যায়। আর খুঁজে পাওয়া যায় না। রাত্রির অন্ধকারে কয়েকটি কালো কালো ছায়া দেখে কেউ। সে তাদের ভয়ের ছায়া না সত্য তা-ও বোঝা যায় না। অধিকাংশ শিশুই একেবারে শিশু। প্রাচীরের ও দিকের দরিদ্র, অন্ত্যজ পল্লীগুলিতে বাস করে। মহাভয়ে তারা রাত্রি জাগতে আরম্ভ করল। রক্ষীরা সতর্ক হল। রাজার কর্ণগোচর হল সংবাদ। জনশ্রুতি—নরমাংসাদ যক্ষ- যক্ষিণীর আবির্ভাব হয়েছে। যখের ভয়ে সন্ধ্যার পর নগরীর কেন্দ্র ব্যতীত অন্য সব স্থান জনবর্জিত হয়ে আসতে লাগল। আরও তাড়াতাড়ি নগরের দ্বার গুলি বন্ধ করবার ব্যবস্থা হল। নগরের বাইরে কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থা করা গেল না। রাজভটগুলি রাজার ভয়ে গিয়ে দাঁড়ায় বটে। তাদের অস্ত্র হাতে নিয়ে সারারাত প্রহরা দেবার কথা। কিন্তু তারা চোর, দস্যু এদের ধরতে বা শাস্তি দিতে যথেষ্ট বীরত্ব দেখালেও অপ্রাকৃত প্রাণীর ভয়ে অন্ধকার হতেই গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে হানা দেয়।
দুমদাম আঘাতে ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে গৃহস্থ হয়ত মুখটি বার করল। রক্তবর্ণ বসন পরা, লাঠি, তলোয়ার ও ধনুবাণে সজ্জিত রাজভটটি বলবে, অনেকক্ষণ প্রহরা দিয়েছি। রাত হয়েছে একটু আশ্রয় দেবে?
গৃহস্থ—এটা চণ্ডালপল্লী কিন্তু ভদ্দ। আমরা অশুচি।
—তাতে কী হল? ঘরের একধারে বসে বসে রাতটা ঠিক কাটিয়ে দেবো।
—পাহারার কী হবে?
—আরে চণ্ডাল, নিজেদের শিশুগুলিকে ঘরের ভেতর বেঁধে রাখো না। আমি দ্বারের কাছে বসে রইলাম। ভয় কী?
চণ্ডাল হেসে বলবে, ভয়টিকে তো ধরতে হবে, ভদ্দ? ধরার জন্যই তো আপনাদের নিয়োগ করা হয়েছে!
—উঁহু হু। প্রেত কি ধরা যায়? হাত নেই, পা নেই, ধরবো কী করে?
—হাত নেই তো আমাদের ঘরের বচ্চগুলিকে ধরে কী করে?
—নিশ্বাসে উড়িয়ে নিয়ে যায় রে। নিশ্বাসের বাতাসে উড়িয়ে নেয়।
—তাহলে তো ঘরের মধ্যে থেকেও উড়িয়ে নিতে পারে।
—পারেই তো। তাই তো বলি শিশুগুলিকে বেঁধে-হেঁদে রাখ। ওরে বাপা, উহুহুহু।
চণ্ডাল হেসে বলে, শ্মশানে মশানে ঘুরি। কখনও প্রেত দেখলাম না, ভদ্দ। মড়ার মাথার খুলির ভেতর দিয়ে হাওয়া বয়, মনে হয় প্রেতে চিৎকার করছে। শিবা, তরক্ষুর ডাক শুনে মানুষ ভয় পায়। পাগল, পাগলিনী শ্মশানে ঘোরে, অদ্ভুত তাদের বেশ বাস, অদ্ভুত কথাবার্তা, লোকে বলে প্রেত। আমরা জানি পাগল।
—তবে যে তোরা ভূত-প্রেতের কথা বলে ভয় দেখাস!
চণ্ডাল হেসে বলে, ভয় না দেখালে আমাদের শ্মশানের রাজ্যটুকুও তো আর নিজের থাকবে না। লোভী লোকগুলি আমাদের প্রাপ্যেও ভাগ বসাবে। সাক্কপুত্তীয় সমনরা তো এখনই শ্মশান থেকে বস্তর নিতে আরম্ভ করেছে। এর পর শয্যা, রুপা, তামা, সোনা যা পাওয়া যায় সেগুলিও নিতে থাকবে হয়ত।
এইভাবে গল্প করতে করতে রাজভটটি প্রাচীরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। গৃহস্থ ও তার স্ত্রী। সারারাত শিশুগুলিকে পাহারা দিয়ে জেগে থাকে। সকালের আলো ফুটলে, ক্লান্ত রক্তিম চোখ নিয়ে যে যার কাজে যায়।
কিন্তু, এরপর দিনে-দুপুরেও শিশু চুরি হতে লাগল। চোরেরা বনের দিকে থেকে আসে। বনে চলে যায়। শৃগালের মতো চতুরতার সঙ্গে কাজ সারে। রাজগৃহে আতঙ্ক, প্রান্তিক পল্লীগুলিতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। নরমাংসাদ যক্ষিণী। অনেকেই নাকি তাকে দেখেছে। কৃষ্ণকায়, বিকৃত দর্শন। সঙ্গে যক্ষ। উভয়েই অতি ভয়ানক। নিমেষের জন্য দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়।
রাজাদেশ হল—এই যক্ষ-দম্পতিকে ধরতে হবে—জীবিত বা মৃত। যে ধরবে সে পুরস্কার পাবে।
একদিন সকালে তিষ্যর অতিথিশালায় এসে চণক দেখল সে বুকে লৌহজালিকা আঁটছে। অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত।
—কোথায় যাচ্ছো, তিষ্য?
তিষ্য হেসে বলল, যক্ষ ধরতে, চণক ভদ্র।
চণক বলল, একটু অপেক্ষা করো তিষ্য, আমিও যাবো।
চণক এতদিন কেন যায়নি! ওই মহাবন, অন্তত তার কিছু অংশ তো তার পরিচিতই! সেই পরিচয়ের ওপর নির্ভর করেই তো সে যক্ষের সন্ধানে যেতে পারতো! কেন উদ্যোগ নেয়নি চণক! সে কি নিজের প্রাণ বিপন্ন করতে চায়নি? না না। সে তো নিরস্ত্র ওই অরণ্যের মধ্যে দিনের পর দিন কাটিয়ে এসেছে? তবে? কী জটিল রহস্য তোমার চরিত্রে, তোমার আচরণে হে উদীচ্য ব্রাহ্মণ! যা কৃত্য কর্ম বলে মনে করো, যেসব বিষয়ে এতো গভীর চিন্তা করো, বিষগ্ন হও, চিন্তাগুলি লিপিবদ্ধ করে যাও লিপির এবং লেখনীর বহু অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও, কেন তার কোনটাই করতে উদ্যোগ নাও না? তোমার কর্মোদ্যোগহীন, চিন্তক চরিত্র কি এইবার নির্দিষ্ট হয়ে যেতে আরম্ভ করল? দেখো তো, তিষ্যকুমার, ক্ষত্রিয়যুবা কেমন দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পেরেছে! কবচ আঁটছে এখন। তোমার মতো জ্ঞানী না-হলেও, সে-ও কিন্তু চিন্তা করে, সেই সঙ্গে কর্মোদ্যোগও তার চরিত্রে স্পষ্ট। সে যা ভাবে, তাই করে। একদিন তুমিই না এই রাজগৃহের পথে দাঁড়িয়ে এক মাগধকে বলেছিলে—তুমি আপাতত ব্রাহ্মণ কিন্তু বৃত্তির পরিবর্তনও হতে পারে। কী মনে ছিল তোমার চণক? কী ভেবেছিলে? কোন বৃত্তির কথা? রাজা বিম্বিসার তোমাকে উচ্চপদ দিতে চেয়েছিলেন রাজসভায়। তা-ও তো তুমি নাওনি? সে পদ নিলেও করার মতো কাজ অনেক করতে পারতে। তখন বলেছিলে তুমি মুক্ত থাকতে চাও। জম্বুদ্বীপ পরিক্রমা করে দেখবে কোথায় তার সীমা! যাবে পূর্ব দিকে। আবিষ্কার করবার চেষ্টা করবে জনমনের সেই মূল সূত্রটি, যা জম্বুদ্বীপকে সংহত করবে। হায় গ্রন্থকার, চিন্তক, ভাবক, প্রজ্ঞাবান ব্রাহ্মণ আর কতদিন! কত দিন এই দ্বিধা, এই দোলাচল চিত্ত নিয়ে তুমি কোন কর্তব্য সম্পাদন করবে?
তিষ্য বলল, তাহলে কবচ পরে নিন ভদ্র। আমার কাছে দ্বিতীয় তো নেই! চলুন আপনার গৃহে যাই।
—কবচ প্রয়োজন হবে না তিষ্য। তুমি সশস্ত্র চলো আমি তোমার সঙ্গে থাকবো। ভয় কী!
—কিন্তু বিষাক্ত তীর কোনওদিক থেকে যদি এসে বেঁধে?
—মাথায় উষ্ণীষ পরে নিচ্ছি। এই উর্ণার উত্তরীয় যথেষ্ট স্থূল।
—চণক ভদ্র আপনার জীবন মূল্যবান। এভাবে আপনাকে বিপন্ন হতে দিতে আমি পারি না।
—শ্ৰমণরা তো বিনা অস্ত্রেই সর্বত্র ঘুরে বেড়ান। কিছু তো হয় না!
—আপনি তো শ্ৰমণ নন!
তিষ্য কিছুতেই সম্মত না হওয়ায়, তার ভৃতক চণকের গৃহ থেকে কবচ ও ধনুর্বাণ এনে দিল।
বাহুবলে বলীয়ান ক্ষত্রিয়র পেছন পেছন চিন্তাবিদ ব্রাহ্মণ চলল অরণ্যের অন্ধকার জয়ের প্রথম অভিযানে।
তাদের জীবনে প্রথম হলেও, এ অভিযান সত্যিই প্রথম কী? বিস্মৃত অতীতে যাননি কি এভাবে ইন্দ্র, এবং ত্বষ্টা? পাণ্ডব এবং দ্ৰোণ? অর্জুন এবং কৃষ্ণ? সুদূর ভবিষ্যতেও এভাবে যাবেন না এঁরা? বীরপুরুষ এবং ভাবুক পুরুষ? কর্মী এবং তাত্ত্বিক?
যদি বলা যায় তিষ্যকুমার তো পুরোপুরি কর্মী ও বীর নয়। তার মধ্যে কমৈৰ্ষণার সঙ্গে মিলে আছে প্রশ্নোপনিষদ। প্রশ্নের কাছে নিরন্তর গতায়াত। যদি বলা যায় দৈবরাত চণকও তো নয় শুধু তাত্ত্বিক। তার কর্মের পরিকল্পনা অস্পষ্ট ভাবজগৎ থেকে স্পষ্টই নেমে এসেছে ভূমি স্পর্শ মুদ্রায়, তাহলে বুঝতে হবে ভেতরে ভেতরে মাটি ভেঙে দিক পরিবর্তন করছে যুগজীবন, যুগমানস। কতটা পারছে, পেরেছিল তার চেয়েও বড় কথা—চাইছে। তারা চেয়েছিল।
২৬
গৌতম বুদ্ধ বললেন—শিশুদুটিকে আগে খেতে দাও।
—কী দেবো, ভগবান? আমাদের তো কিছু সঞ্চয় নেই! —আনন্দ বললেন। তাঁর দু’চোখ থেকে অশ্রুধারার মতো করুণা ঝরে পড়ছে। যেন কাষায়ধারী শ্ৰমণ নয়, পিতা। কিন্তু গৃহস্থ পিতার চোখে কি এমন করুণা ঝরে? যেন শিশুটির সর্বাঙ্গ শুধু নয় তাদের অন্তর, তাদের বর্তমান, তাদের ভবিষ্যৎ—সবই তিনি অভিষিক্ত করে দিচ্ছেন।
শিশুদুটি জীবকের আম্রবনের গাছের ফাঁকে ফাঁকে খেলা করে বেড়াচ্ছে। কৃষ্ণবর্ণ দুটি ব্যাঘ্ৰশিশুর মতো। সুকুমার ত্বক দিয়ে স্বাস্থ্যের দীপ্তি ফুটে বেরোচ্ছে। পায়ের ভাঁজগুলি, কী সুন্দর! অবোধ শিশু। নিজেদের পরিবেশে যে নেই সে-কথা বুঝতে পারছে না। বা অস্পষ্টভাবে বুঝলেও তাদের কোনও ভাবান্তর নেই।
চণক বলল—আমরা যাচ্ছি। দুধ কিনে আনছি। যত তাড়াতাড়ি পারি আসব। কাননের প্রান্তে ঘোড়াদুটি বাঁধা ছিল। দু’জনে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
তিষ্য কৌতুকে মুখ উজ্জ্বল করে বলল—শিশুদুটিকে নিয়ে কী করবেন শ্রমণ গৌতম? ওদের ওপর কি ওঁর বিখ্যাত ইন্দ্রজাল খাটবে, চণকভদ্র?
চণক হেসে বলল—দুধ না খেয়েই ওরা যেভাবে মল্লযুদ্ধ করে যাচ্ছে, তাতে শ্রমণ গৌতম এবং তাঁর ভিক্ষুরা খুব শীগগীরই রীতিমতো পর্যুদস্ত হয়ে পড়বেন মনে হচ্ছে। এরপর উদরপূর্তি হয়ে গেলে কী করবে কে জানে!
আজ চণক ও তিষ্যর বড় বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে, বর্ম এঁটে দু’জনে বনপথে হারানো শিশু এবং জনশ্রুতির যক্ষযক্ষিণীর সন্ধানে বেরিয়েছিল। যে চণ্ডাল-পল্লী থেকে সবচেয়ে অধিক সংখ্যায় শিশু চুরি গেছে, সেই পল্লীর কাছের বনাঞ্চলে ঢোকে তারা। ঝোপঝাড়, লতা এ সব ভেঙে পড়ে থাকায়, তাদের মনে হয় এটি একটি যাতায়াতের পথ। খানিক দূর যাবার পর তারা আশ্চর্য হয়ে দ্যাখে শ্ৰমণ গৌতম তাদের আগে আগে চলেছেন। দু’জনে দুদিক থেকে গিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে—ভদন্ত, কোথায় চলেছেন?
মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। গৌতম বললেন—বৃথা শব্দ করো না। রাক্ষস ধরতে যাচ্ছি।
তিষ্য বলে—আমরাই তো সে জন্যে আছি। সংসার-ত্যাগী শ্রমণের কষ্ট করবার প্রয়োজন কী?
—ত্যাগী কোথাও আবদ্ধ নয়, তার পক্ষেই ধরা সহজ আয়ুষ্মান।
তৃণগুল্ম এবং শুষ্ক পত্রাদির শব্দ হতে থাকে। সাবধানে উপানৎ হাতে ধরে দু’জনে শ্রমণের পেছন পেছন গিয়ে আবিষ্কার করে—একটি পরিষ্কৃত স্থান। মাটিতে অগভীর গর্তের মধ্যে নিভে যাওয়া আগুন। কাছেই একটি অপরিচ্ছন্ন পর্ণকুটির। সামনে দুটি কৃষ্ণকায় উলঙ্গ শিশু খেলা করছে।
শ্রমণ গৌতম বললেন—সম্ভবত এখানেই রাক্ষসীর বাস। আয়ুস্মন, কুটিরের মধ্যে এবং চারপাশে একটু দেখে এসো তো শিশুগুলির সন্ধান পাও কি না।
তিষ্য চলে যায়। এই সময়ে চণক অগ্নিকুণ্ডটির কাছে এগিয়ে গিয়ে একটি বৃক্ষশাখা দিয়ে ভস্মস্তূপটি পরীক্ষা করতে করতে একটি শিশুর কনুই পর্যন্ত আধপোড়া হাত দেখতে পায়। সেদিকে শ্রমণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তিনি সহসা বলেন—ওই শিশুটিকে তুলে নিয়ে এসো।
ততক্ষণে তিষ্য কুটির পরিক্রমা সেরে বেরিয়ে এসেছে। —‘কই, কাউকেই তো দেখতে পেলাম না। তবে এইগুলি পেয়েছি।’ সে পেতলের কয়েকটি ছোট ছোট বালা দেখাল। চণক নীরবে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে কেই শিশু-হাতটির দিকে আঙুল দেখায়। তিষ্য শিউরে চোখ বুজে ফেলল। চণক শিশুটিকে দু’হাতে তুলে নিতে তারা প্রথমটা তার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে। বড়টি তাকে কামড়েও দেয়। সেই সময়ে হঠাৎ শ্ৰমণ গৌতম এগিয়ে এসে দুই বাহুতে দুটি শিশুকে শক্ত করে কক্ষের কাছে চেপে ধরে, দ্রুত নগরীর দিকে ফিরে যেতে থাকেন।
সেই শিশুদুটিই এখন আম্রবনে নিশ্চিন্তে পরস্পরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করছে। এবং চণক ও তিষ্য তাদের জন্য দুধের সন্ধানে পোপ-পল্লীর দিকে যাত্রা করেছে।
যথেষ্ট পৰিমাণে দুধ এবং কিছু খেলনা কিনে আম্রবনে ফিরে এসে ওরা দেখল বড় শিশুটি শ্রমণ গৌতমের কোলে বসে তার বিস্মিত চোখ দিয়ে শ্রমণের মুখ নিরীক্ষণ করছে। কচি কচি আঙুল দিয়ে তাঁর কান টানছে। গালে হাত বুলোচ্ছে, চীবর নিয়ে টানাটানি করছে।
ওদিকে ছোটটি ঠোঁট ফুলিয়েছে। আনন্দ নামে শ্রমণ তাকে তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিতে সে আনন্দর একটি আঙুল মুখে পুরে চুষতে লাগল।
বর্ষার অন্তে অনেক ভিক্ষুই এদিক ওদিক ভিন্ন গ্রামে, জনপদে বেরিয়ে গেছেন প্রচার কর্মে। অল্প কয়েকজনই আছেন। তাঁদের মধ্যে অল্পবয়স্করা শিশুদুটির কাণ্ড দেখে হাসছেন। একজন প্রৌঢ় ভিক্ষু আরেকজনকে মৃদুস্বরে বললেন—রাহুল জন্মাবার পর শিশুর মায়া কাটাবার জন্যেই তো ভগবান আরও সত্বর গৃহত্যাগ করলেন। রাহুই বটে। তা এখন কী করবেন? নিজপুত্রকে কখনও কোলে করেননি। এখন এই বন্যশিশুকে কেমন খেলা দিচ্ছেন দেখো!
অন্য ভিক্ষুটি বললেন—আমি দেখেছি, বেলুবনে একদিন ধ্যানভঙ্গ হবার পর উনি রাহুলের পরিবেণের কাছে বহুক্ষণ পদচারণা করতে থাকলেন। রাহুলের ঘুম ভাঙার সময় হলে যেন বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে সেখান থেকে চলে গেলেন।
—দেশনা করবার সময়ে ওঁর চোখ যখন রাহুলের ওপর পড়ে, আমি দেখি যেন স্নেহ টলটল করছে! ভগবান তীর্থিক কি আজীবিকদের মতো শুকনো সন্ন্যাসী তো নন!
—তা যদি বলো, রাহুলকে দেখলে আমারই করুণা হয়। রাজার পুত, রাজার বংশ ধর; ভালো করে কিছু বোঝবার আগেই ভিক্ষাপাত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
—শ্রমণ হয়ে এ কথা বলছো?
—আমি তো শ্ৰমণ হয়েছি পরিণত বয়সে। পুত্ৰদুটি অকালে মারা গেল। পত্নী কেমন যেন শোকবিহ্বল হয়ে গেলেন। আমার মনে হল এই দুঃখই সত্য। এতদিন যা ভোগ করেছি সে সবই মায়া, মিথ্যা! একদিন ভগবানের দেশনা শুনতে বেলুনে গিয়েছিলাম উভয়ে। ফিরে এসে দু’জনেই স্থির করলাম প্রব্রজ্যা নেবো। তা দেখো ধর্মশীল, সন্তানের অকালমৃত্যুর শোক কী আমি জানি। সন্তান-স্নেহ কী বস্তু তা-ও আমি ভুলিনি। কিন্তু রাহুল ওই বালকটি জন্ম থেকে পিতৃস্নেহ জানল না। মাতৃস্নেহই কি জেনেছে? পাঁচ সাত বছরের শিশুকে যখন দেবী রাহুলমাতা পিতৃধন চাইবার জন্য ভগবানের কাছে পাঠালেন তিনি কি জানতেন না পার্থিব ধন বলতে কিছুই তাঁর কাছে নেই? তিনি বুদ্ধিমতী নারী। চেয়েছিলেন পুত্রের দায়িত্ব পিতা নিক। সে যেভাবেই হোক। পিতৃহীন শিশু মায়ের স্নেহচ্ছায়ে বড় হতেও তো পেল না। রাহুল খেলা জানল না, বিচিত্র খাদ্যরস জানল না। পিতামাতার স্নেহ জানল না। দুঃখভোগের আগেই তাকে দুঃখনিরোধের কঠিন পথে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। উপরন্তু, রাহুল বন্ধনস্বরূপ এইরূপ নাম দিয়ে তাকে চিরদিনের জন্য কলঙ্কিত করা হল।
—আপনি কি ভগবানকে নিন্দা করছেন ভিক্ষু ধর্মরক্ষিত?
—নিন্দা করি না। বুঝতে পারি না তাঁর সব কিছু এটাই বলেছি। আর রাহুলের প্রতি করুণা। প্রকাশ করেছি।
—ওকে দেখলে কি আপনার মৃত পুত্রদের কথা মনে হয়?
—হয় ধর্মশীল, হয়। বলতে বলতে ভিক্ষু দ্রুত স্থান-ত্যাগ করলেন।
চণক অদূরে দাঁড়িয়ে ভিক্ষুদের আলোচনা শুনছিল। তিষ্য একটি শ্রমণের সঙ্গে শুকনো ডাল-পাতা জ্বালিয়ে দুধ গরম করছে। দেখতে দেখতে, এবং শ্রমণদের কথা শুনতে শুনতে কেন কে জানে তার শ্রীমতীর কথা মনে পড়তে লাগল। শ্রীমতী তাকে সযত্নে খাওয়াচ্ছে। ব্যজন করছে। শ্ৰীমতী তার হাতে জল দিল। ওই শ্রীমতী তার বীণা নিয়ে তাকে, একমাত্র তাকেই গান শোনাবার জন্য বসেছে। এতে ধীর, এতো নম্র, করুণ! সে বহুদিন শ্রীমতীর কাছে যায়নি, তার সংবাদ রাখে না। অথচ এক গভীর আত্মিক সঙ্কটে শ্ৰীমতীই তাকে সঙ্গ দিয়েছিল। সে তার কাছে প্রার্থী হয়ে গিয়েছিল। আত্মসমর্পণ করেছিল। শ্রীমতী তাকে পুরোপুরি সাহায্য করেছে। সে কিছু দেয়নি ওই নারীকে। গৃহস্থ, বিবাহিত পুরুষের মতো গন্ধ, মাল্যবস্ত্র ইত্যাদি কিনে নিয়ে গিয়েছিল একদিন। অভিমান ভরে শ্রীমতী বলেছিল—‘মূল্য দিচ্ছেন নাকি?’ চণক কিন্তু তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেননি—এ ঠিক মূল্য দেওয়া নয়। তার হৃদয়ের প্রীতিরই প্রকাশ এ। সে শুধু ক্ষান্ত হয়েছিল। আর ওইসব বস্তু কেনেনি। সহসা তার জিতসোমার কথাও মনে হল। জিতসোমা আর সাজ-সজ্জা করে না। অতি সাধারণ রমণীর মতো বেশ করে। শ্রদ্ধাভরে চণকের রাজশাস্ত্রর প্রতিলিপি করছে সে। চোখের সামনে সে যেন দেখতে পেল জিতসোমা হাতে পালকের লেখনী নিয়ে লিখতে লিখতে মুখ তুলে তাকাল। কেমন বিষগ্ন দৃষ্টি। কী ভবিষ্যৎ জিতসোমার? চণক অস্পষ্টভাবে চিন্তা করে কিন্তু জিতসোমার প্রতিই কি তার কর্তব্য পালন করতে পারছে সে?
শিশুদুটি দুধ খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়ল। মাটির পাত্র দুহাতে ধরে ঢকঢক করে খেয়ে নিল। তারপর চোখ বুজে আসতে লাগল তাদের। বুদ্ধ বললেন—আনন্দ, ওদের ভিক্ষুণীদের উপাশ্রয়ে দিয়ে এসো। বলবে, ওদের পালন করতে, যতদিন না আবার চাই।
আনন্দ বললেন—যাই, ভগবান।
আনন্দ একজনকে কোলে নিলেন, আরেকজন ভিক্ষু বড়টিকে নিলেন।
মধ্যাহ্ন পার হয়ে যাচ্ছে। দু’জনে গৃহের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। তিষ্যকে আজও নিজের গৃহে আপ্যায়ন করতে পারেনি চণক। যবে থেকে সে বুঝতে পেরেছে চণকের গৃহে একজন রমণী থাকেন, সে কোন মতেই কোনও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে চায় না। থাকা তো দূরের কথা।
প্রধান পথ রাজগৃহে মাত্রই দুটি। কতকগুলি উপপথ দক্ষিণে এবং বামে চলে গেছে শাখা-প্রশাখার মতো। বৈভার গিরির কোল ঘেঁষে চণকের গৃহে যাবার পথটি। দু’ধারে সমান ব্যবধানে ছায়াতরু। ফাঁক দিয়ে পাহাড়ের ঢাল দেখা যায়। দক্ষিণের পথটি ক্রমে রাজপুরীর প্রাচীরে পৌঁছেছে। বামের পথটি ধরে যেতে যেতে ক্রমশই জামগাছ বাড়তে থাকে। মহীরুহ সব। তারপর উত্তর প্রান্তে গিয়ে বাঁদিকে আরও একটি বাঁক নিলে শুধুই জামগাছ। পথটি এমন ছায়াময় হয়ে থাকে যে মধ্যাহ্ন-সূর্যও যেন একে তপ্ত করতে পারে না। এখন বর্ষা চলে গেছে। হিমঋতু এলো বলে। এ পথ দিয়ে যাতায়াতের সময়ে উত্তরীয়টি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হয়। চণক এবং তিষ্যর এখনও বর্ম পরা রয়েছে। যোদ্ধৃবেশ। এই বেশও নগরীর মধ্যে অতি সুলভ নয়। সেনারা বাস করে নগর থেকে অদূরে সেনানী গ্রামে। নগরের মধ্যে অল্পস্বল্প অস্ত্রধারী যাদের দেখা যায় তারা হল রাজভট এবং রক্ষী। রক্ষীদের আগার রয়েছে নগরের উত্তর ও দক্ষিণ প্রাকারের দ্বারের কাছে। রাজপুরীতেও অবশ্য আছে তারা যথেষ্ট সংখ্যায়।
পথে লোক অল্প। যারা চলছে, কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে দুই অশ্বারোহীকে দেখছে। হয়ত রক্ষী ভাবছে। বিশেষত তারা চলেছে উত্তর সীমান্তের দিকে। তিষ্য তার অতিথিশালার দিকে বেঁকে যাবার সময়ে বলে গেল অপরাহ্ণে সে জীবকাবনে যাচ্ছে। চণক বলল—সে-ও যাবে।
কাননে ঢোকবার পর তার দাসেদের হাতে অশ্বটি দিয়ে চণক গৃহের দিকে চলল। মুক্ত বাতায়নপথে দেখা যাচ্ছে জিতসোমা রোদে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দাঁড়াল। সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে চণক দেখছে—না জিতসোমা হাসছে। সে দ্বার দিয়ে ঢুকে দাঁড়াতে এগিয়ে এসে তার বর্ম খুলতে খুলতে বলল—কী? যক্ষ-রক্ষ ধরতে পারলেন?
চণক হেসে বলল—আমরা ধরিনি, তবে শ্রমণ গৌতম ধরেছেন মনে হচ্ছে? সোমা অবাক হয়ে বলল—শ্ৰমণ গৌতম? যক্ষ ধরেছেন? ইন্দ্রজাল জানেন, না কী?
চণক বলল—কিছুই বুঝতে পারছি না। যক্ষিণীর শিশুপুত্ৰদুটিকে ধরে নিয়ে এসেছেন। এই দ্যাখো, একটি শিশু আমাকে কীভাবে কামড়ে দিয়েছে!
সোমা শিউরে উঠে হাতটি পরীক্ষা করতে করতে বলল—‘সর্বনাশ! যক্ষের শিশু! দাঁতে যদি বিষ থাকে।
চণক বলল—ভয় নেই গাছের পাতার নির্য্যাস দিয়ে ভিক্ষুরা মনোরম চিকিৎসা করেছেন। আর শিশুটি, যক্ষের ঘরের হলে হবে কি, অবিকল আমাদের ঘরের শিশুদের মতো দেখতে। শুধু অমাবস্যার আকাশের মতো ধুম্রবর্ণ। তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাঁতগুলিও অবিকল মানব-শিশুর দাঁতের মতো। দুধও খায়। যদিও আমাকে কামড়ে দিয়েছে, তবু রক্তপিপাসু বলে ঠিক মনে হল না। আজ অপরাহ্ণে যাবো। দেখি শ্রমণ গৌতমের কী পরিকল্পনা।
সোমা তার উষ্ণীষটি নিতে নিতে বলল—‘শ্ৰমণ গৌতম কেমন?’
—তোমার-আমারই মতো। আবার স্বতন্ত্র। সোমা শ্ৰমণ গৌতম অদ্ভুত মানুষ। এই দেখবে আকাশের চাঁদ, আবার পরক্ষণেই দেখবে পথের পাশে তোমার প্রতিদিনের দেখা তরু। তোমার দেখতে ইচ্ছা হয়?
—আগে হয়নি। আজ হচ্ছে। অপরাহ্ণে আপনার সঙ্গে যাবো।
চণক সাগ্রহে সম্মত হল। এই প্রথম সোমা বাইরে যেতে চাইল। কোনও বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করল।
এতদিনে এখানে এসেছে, কিন্তু সোমা রাজগৃহ চেনে না। এক অন্তঃপুর থেকে আরেক অন্তঃপুরে যাতায়াত করেছে শুধু। তক্ষশিলার পথ-ঘাট তবু চেনা ছিল। নিজস্ব যান তো ছিলই। পায়ে হেঁটে চলাফেরাও সম্ভব ছিল। রাজগৃহে সে বিদেশিনী। তাকে দেখলেই বিদেশিনী বলে চেনা যায়। এখানে সে বড় বেশি অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
অপরাহ্ণে সে দেখল দ্বারের কাছে একটি চারঘোড়ার রথ এসে থামল। চণক বলবামাত্র দাসেরা গিয়ে রাজপুরী থেকে রথ নিয়ে এসেছে। অতঃপর এই রথটি তাদের কাননেই থাকবে—রাজ-অশ্বশালার প্রধান বলে পাঠিয়েছেন।
আজ সোমা প্রথম এ নগরের পথঘাট দেখল। নিজেদের কাননে সে অবসর সময়ে ঘুরে বেড়ায়। তখন দেখে দূরের পাহাড়। কিন্তু সারাপথই যে এইভাবে পাহাড় সঙ্গে সঙ্গে যাবে সে জানত না। চণক তাকে দেখায়—‘ওই যে দূরে যে পাহাড় দেখছ। ওর ওপরে আছে তপোদারাম। পাহাড়ের অভ্যন্তর থেকে তপ্ত বারি বেরিয়ে আসছে। সর্বরোগহর।’
সোমা আশ্চর্য হয়ে বলল—‘এই নগরীর ওপর দেখি দেবতাদের অশেষ কৃপা! মহারাজ বিম্বিসার মহাত্মা বলেই কি অগ্নিদেব, বরুণদেব এভাবে তাঁকে আশীবাদ করছেন। আর্য?
চণক হেসে বলল—‘মহারাজ বিম্বিসারকে দেবতারা তপোদারামগুলি দেননি। এগুলি এবং অন্যান্য নানা সুবিধাগুলি আছে বলেই, চতুর রাজাটি এইখানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছেন।
—কিন্তু এতো শ্ৰমণ! সন্ন্যাসী! দেখুন দেখুন!
পাহাড়ের দিকে দু’জন শ্ৰমণ চলে যাচ্ছেন সোমা দেখাল। তারপর বলল—আমি কানন থেকেও দেখি, আর্য। বহু শ্ৰমণ বাস করেন এখানে। এ-ও তো মহারাজের একটা পুণ্যফল!
—পাহাড়গুলি দেখেছ সোমা? শ্ৰমণ ও সন্ন্যাসীরা পাহাড়ে থাকতে ভালোবাসেন। তাই ওঁরা এতো অধিক সংখ্যায় আছেন এখানে। মহারাজও সব মত সব পথের সন্তদের সমাদর করেন। এদিকে শ্ৰমণ গৌতমকে তথাগত বুদ্ধ বলে প্রণাম করছেন, ওদিকে আবার নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্রকে জিন বলে সমাদর করছেন। অজিত কেশকম্বলীর নাম শুনেছ?
—কই না তো!
—উনি একজন অদ্ভুত শ্ৰমণ। সর্বাঙ্গে ভল্লুকের মতো রোম। নাস্তিক। কোনও দেবতায় বিশ্বাস করেন না। মনে করেন মৃত্যুর পর জীব চার মহাভূতে মিশে যায়, পুনর্জন্ম নেই। যতদিন জীবিত আছে, সৎভাবে সুখে বাঁচো।
—আশ্চর্য তো! আর্য চণক, এরূপ কি সম্ভব?
—কী সম্ভব সোমা?
—এই…দেবতা নেই। ব্রহ্মা প্রজাপতি নেই। মৃত্যুর পর দেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাবে, এ-ও কি সম্ভব?
—দেবতারা আছেন কি না, প্রজাপতি আছেন কি না, কোনও মানুষ মৃত্যুর পর আবারও কোথাও জন্মগ্রহণ করেছে কি না তা-ও তো আমরা দেখিনি, জানি না সোমা। কোনও প্রমাণ নেই। কোথাও কেউ বলেছে সে ইন্দ্রকে দেখেছে? অগ্নির শিখার মধ্য থেকে কোনও দেবতাকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে?
—তাহলে যজ্ঞে যে আমরা হবিঃ দান করি, সে কাকে, আর্য? পশুমাংস, যবের পুরো ডাশ আহুতি দিই, সে কি কোথাওই পৌঁছয় না?
—এঁরা বলছেন এইসব যাগযজ্ঞ, তিনবেদ, অগ্নিহোত্র, কিম্বা ত্রিদণ্ডধারণ, ভস্ম মাখা এগুলি সব পৌরুষ ও বুদ্ধিহীন মানুষের জীবিকা-অর্জনের উপায় মাত্র।
—কী আছে তাহলে? কোন আচরণই বা ঠিক আর্য!
—এখনও জানি না সোমা। তবে এতদিন যা পালন করে আসছি, বিশ্বাস করে আসছি তার ভেতর কোথাও একটা বিরাট ভুল বোঝা আছে যা এই মধ্যদেশের শ্রমণরা নাকি ধরতে পেরেছেন। আজ যে শ্রমণ গৌতমের কাছে যাচ্ছি, উনিও যাগযজ্ঞ মানেন না। তোমার যদি আগ্রহ থাকে, আজ যদি ওঁর কথা ভালো লাগে, তাহলে আমরা মাঝেমাঝেই ওঁর কাছে যেতে পারি।
সোমা বলল—মহারাজ বিম্বিসার জটাজুটধারী বেদবিৎ সন্ন্যাসীদেরও পূজা করেন কিন্তু। একইসঙ্গে বিপরীত মতবাদে বিশ্বাস করা যায়?
চণক হেসে বলল—মহারাজের সঙ্গে দেখা হলে, এরপর কথাটা তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো। তবে আমার মনে হয় রাজা-মহারাজাদের ক্ষেত্রে বিশ্বাসটাই বড় কথা নয়। নানা মতের চিন্তকদের সমর্থন পাওয়ার জন্যই এঁরা এরূপ করে থাকেন। এটা ধর্ম নয় সোমা, রাজনীতি। তুমি যে পুঁথির প্রতিলিপি করো সেখানে এ কথা পাবে। পিতা স্বয়ং লিখে গেছেন।
সোমা বলল—তাহলে আপনারা এতো চিন্তা করে যা স্থির করলেন, মহারাজ বিম্বিসার সহজাত বোধেই তা বুঝে গেলেন? ইনি তো সাধারণ রাজা নন!
চণক বলল—ইনি কোনমতেই সাধারণ রাজা নন। এ কথা একশবার সত্য। তবে ভুলো না, রাজনীতির পাঠ ইনি নেন আচার্য দেবরাতের কাছে।
—আর্য চণক, রাজশাস্ত্রে আপনি যে একরাট্ এর কথা বলেছেন, চক্রবর্তীর কথা বলেছেন, এই রাজা তা হতে পারেন না?
—ক্ষমতা আছে, অভিরুচি নেই বোধহয় সোমা।
—তাহলে সমগ্র জম্বুদ্বীপ জুড়ে এক চক্রবর্তীর রাজ্য যা আপনারা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন, তা কীভাবে সম্ভব হবে?
—অহিংসার পন্থ যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে, তাতে ব্যাপারটা ক্রমশই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মৌলিক বেদপন্থা আমাদের বীরপুরুষ হতে বাধা দেয়নি। এই শ্রমণদের উপদেশ লোকে গ্রহণ করতে থাকলে কয়েক পুরুষের মধ্যেই আমরা নিবীর্য অস্ত্রভীরু হয়ে যাবো। রক্ত দেখলে মুর্ছা যাবো। —চণকের মুখ ক্রমশ গম্ভীর, চিন্তাকুল হয়ে উঠতে লাগল। —সে কিছুক্ষণ পরে বলল—কিন্তু এ-ও সত্যি যে বেরে কর্মকাণ্ড এখন এতো বিশদ হয়ে গেছে, সাধারণজনের জীবন থেকে এতো সরে গেছে যে বহু সৎ চিন্তাশীল মানুষের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বেদের মন্দর সঙ্গে বেদের ভালোও এঁরা অস্বীকার করতে চাইছেন?
—কিন্তু বেদ তো অপৌরুষেয় আর্য। তাকে অস্বীকার করতে চাইছেন?
—বেদ অপৌরুষেয় কী অর্থে সোমা? আমি অনেক ভেবেছি। বেদ যে ধ্রুব নয়, সে-কথা কিন্তু প্রতিদিন প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, প্রমাণ করে দিচ্ছেন শ্রমণ গৌতম, যাদের দেবতা বলা হয়েছিল তারা যে প্রাকৃতিক বস্তু ও শক্তি এ বিষয়ে অনেকেই এখন নিঃসংশয়। তারপরে দেখো, বেদ ঋষিদের কাছে প্রকাশিত হয়েছিলেন এই কথাটি ধরেই আমি বলতে পারি আমার পরিচিত এক কবি বোধিকুমারের বর্যা-শ্লোকও তাঁর কাছে স্বপ্রকাশ হয়েছিল। এই কবি আমাকে বললেন তিনি আম্রকুঞ্জে বসেছিলেন, এমন সময়ে বৃষ্টি এলো। বৃষ্টি দেখতে দেখতে শ্লোকগুলি পরপর তাঁর সামনে যেন উদ্ভাসিত হল। সোমা এই শ্লোকসমূহকেও তাহলে অপৌরুষেয় বললা। ঋষি বামদেব তো এই অভিজ্ঞতার কথাই বলছেন, মনে পড়ছে?
সোমা বলল—“এতা অর্ষন্তি হৃদ্যাৎ সমুদ্ৰাৎ
শতব্রজা রিপুণা নাবচক্ষে।
ঘৃতস্য ধারা অভি চাকশীমি
হিরণ্যয়ো বেতসো মধ্যে আসাম্…”
—‘তবে?’ চণকের চোখদুটি হর্ষে জ্বলছে। সে বলল—এই যে শতধারায় উজ্জ্বল রসের ধারা হৃৎ-সমুদ্র থেকে বইছে, যার মধ্যে ঋষি সোনার বেতসের মতো দুলছেন—এ কি বোধিকুমারের মতো কোনও কবির অভিজ্ঞতা নয়? আবার দেখো ঋষির নিজেরও যে কিছু কর্তৃত্ব আছে ঋক্রচনায় তারও নির্ভুল প্রমাণ রয়েছে তক্ষ ধাতুর ব্যবহারে। অগ্নির উদ্দেশে ঋভুরা বাণীতক্ষণ করছেন, ইন্দ্রর জন্য মন্ত্ৰতক্ষণ করছেন নোধা গৌতম। অর্থাৎ সবটাই স্বতোৎসারিত নয়। সযত্নে কেটে-হেঁটে মসৃণ করে তবে মন্ত্র নির্মাণ হচ্ছে।
—তাহলে? আপনি কী বলতে চান? বেদ-বিদ্যাকে আমরা ত্যাগ করবো?
তা কেন সোমা! এতৎ সত্ত্বেও বেদ কিন্তু এক মৌলিক, বিশ্বজনীন চিন্তার অবয়ব নির্মাণ করে দিয়েছেন। যত বিচিত্র পথেই তোমার চিন্তা যাক না, তার সঙ্গে বেদের সম্পর্ক রয়েই যায়। বৈদিক চিন্তাই নানান নতুন মতের জন্ম দিচ্ছে ঠিক যেমন এক সিন্ধু পাঁচ নদীর জন্ম দিয়েছিল। যেমন এক গঙ্গা থেকে শত শাখানদী কত দিকে চলে যাচ্ছে।
—কিন্তু এই নাস্তিক্যবাদ?
—নাস্তিকরা যে চতুর্মহাভুত অর্থাৎ পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ুর কথা বলেছেন, সে চারটি তত্ত্ব তত বেদেই রয়েছে। ধরো আমি যদি বলি, যাকে এঁরা বস্তু বলে উপস্থিত করছেন, বেদের ঋষি তাকেই দেবতা বলে স্তুতি করেছেন, মানুষের জীবনে তার অশেষ প্রভাবের কথা স্মরণ করে?
—কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেদ তো দেবলোক, অমৃতলোকে বিশ্বাস করেন।
—সোমা, তুমি ব্রহ্মবাদের কথা শুনেছ নিশ্চয়ই। জৈবলি প্রবাহণ থেকে বাজসনেয় যাজ্ঞবল্ক্য পর্যন্ত সবাই ব্রহ্মের কথা বলছেন।
—শুনেছি। আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
—ঋক্ সংহিতার দশম মণ্ডলে নাসদীয় সূক্ত ব্যাখ্যা করেছিলাম। মনে আছে সোমা?
নাসদাসীন্ নো সদাসীত্ তদানীং নাসীদ্ রজো নো ব্যোমা পরো যৎ
কীমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্ অম্ভঃ কিমাসীদ্ গহনং গভীরম্…?
তখন অসৎ ছিল না, সৎ ছিল না, কোনও লোক ছিল না, সব লোকের পারে যে ব্যোম তা-ও ছিল। কে কাকে আবৃত করবে? কার আশ্রয়ে? গহন গভীর যে সলিল, তা-ও তো ছিল না।
সোমা বলল—মৃত্যু ছিল না। অমৃত ছিল না। দিনরাত্রির কোনও চিহ্ন ছিল না। আপন শক্তিতে নিবায়ু অবস্থাতেও নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন সেই একম্।
চণক স্মিত মুখে বলল—এই তো, তোমার স্মরণে আছে!দেখো, এই যে নেই, আবার প্রাণন কার্য করছে, এই ধরাছোঁয়ার বাইরে বিশ্বের আদি প্রাণ—এর থেকে যেমন ব্রহ্মবাদ, তেমন নাস্তিক্যবাদও এসেছে বলে আমার মনে হয়। এই অজ্ঞেয়তার মধ্যে, জীবনের মূল কোথায় এই প্রশ্ন করতে জীবনের পরিণতি সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা জাগে। নাস্তিকরা এই অজ্ঞেয়তাবাদের মধ্য থেকে সংশয়টুকু তুলে নিয়েছেন। তাকেই পুষ্ট করেছেন। এখন বলছেন প্রত্যক্ষ ব্যতীত কোনও প্রমাণ মানব না। শ্ৰমণ গৌতম কিন্তু পুনর্জন্ম মানেন। তিনি কী বলতে চান দেখা যাক।
জীবকাম্রবনে আজ শ্রোতার সংখ্যা অন্যান্য দিনের মতো নয়। অন্য দিন ভরা দিঘির মতো লাগে শ্ৰমণ গৌতমের দেশনাস্থল। চণক ইতস্তত দৃষ্টিপাত করে দেখল কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন। যেমন রাজগৃহ-শ্রেষ্ঠী অহিপারক, রক্ষী-জেষ্ঠক, কয়েকজন পরিচিত রাজপুরুষ, ভিক্ষুরা এবং ভিক্ষুণীরা। শ্ৰেষ্ঠীদের গৃহ থেকে রমণীরাও এসেছেন। জিতসোমা তাঁদের কাছে গিয়ে বসল।
বর্ষার অন্তে বুদ্ধ পরিব্রজন করেন। করেন অন্যান্য ভিক্ষুরাও। ভিক্ষুণীদের মধ্যে যাঁরা ইচ্ছা করেন, তাঁরাও যান। রাজগৃহের বুদ্ধভক্ত সাধারণজন অনেকেই জানে না বুদ্ধ এখন ঠিক কোথায়। চণকের পাশে বসা এক বর্ষীয়ান কুলপুত্র পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলেন—ভগবান আর কতদিন রাজগৃহে থাকবেন, জানো না কি? দ্বিতীয় ব্যক্তি বললেন—উনি তো ঠিক রাজগৃহে নেই। সেনানীগ্রাম ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিলেন। কোনও কারণে আবার এসেছেন। হয়ত কালই দেখবেন, চলে গেছেন।
তিষ্য এসে চণকের পাশে বসল। চণক দেখল মহারাজ বিম্বিসার আসছেন। নিজস্ব কুটি থেকে শ্ৰমণ গৌতম বেরোলেন। সংঘাটিতে ভালোভাবে সারা দেহ আচ্ছাদিত। পেছনে পেছনে আনন্দ আসছেন। সকালে দেখা সেই শ্ৰমণ দুটিকেও বসে থাকতে দেখল সে।
তিষ্য মৃদুস্বরে বলল—আনন্দ নামে ওই শ্ৰমণটির কথা কিছু জানেন?
—উনি শ্ৰমণ গৌতমের কেমন ভাই হন।
—তাই এত মিল! অর্থাৎ ইনিও শাক্য! শাক্যদের কী দুর্দিন চণকভদ্র! একেই তো ওরা কোশলের পদানত হয়ে গেছে। তার ওপর এঁদের মতো সক্ষম, প্রতিভাবান পুরুষরা সব সংসার ত্যাগ করলেন।
—শুধু ইনি নন তিষ্য, চণক বলল, শাক্যদের আরও রাজকুমাররা নন্দ, অনিরুদ্ধ, ভদ্রিক, ভৃগু, কিম্বিল এঁরা, শ্ৰমণবুদ্ধের মা, পত্নী পুত্র, বহু শাক্যরমণী সংঘে প্রবেশ করেছেন।
তিষ্য বলল—শ্ৰমণ গৌতমের মা ও পত্নী, কিংবা শাক্যরমণীদের প্রব্রজ্যা নেওয়া বুঝতে পারি। কিন্তু যুবক রাজকুমাররা কেউ স্বদেশ স্বজাতির প্রতি তাঁদের কর্তব্যের কথা ভাবলেন না? একেই তো স্বাধীনতা হারিয়েছেন।
—হয়ত সেটাই কারণ তিষ্য। দীর্ঘদিন ধরে পরসেবী থাকতে থাকতে একটা জাতির মধ্যে গভীর আত্মগ্লানি জমা হতে পারে, আত্মগ্লানি থেকেই দুঃখবাদ, ঔদাস্য, সংসার-বিরাগ।
—কিন্তু চণকভদ্র, হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টাও তো এঁরা করতে পারতেন।
—তার আগে বলো, বিজিত জাতি রূপে কোশলের কাছে এঁরা কী ব্যবহার পান?
তা যদি বলেন, কোশলরাজ এঁদের যথেষ্ট সম্মান করেন। কপিলবস্তু এবং সন্নিহিত অঞ্চলে রোহিণী নদীর ওপারে শাক্যরা নিজেদের মতো থাকেন। কুলগৌরব অত্যন্ত বেশি। অহঙ্কারী বলা যায় এঁদের। কেননা, অন্যান্য বিজিত জাতির মতো এঁরা শ্রাবস্তীর রাজসভায় কোনও কাজ নেননি এসে। বন্ধুল, কোশলের সেনাপতি মল্ল জাতীয়। বজজি ও শাক্যদের মতো মল্লদেরও এক সময়ে সমৃদ্ধিশালী রাজ্য ছিল। কিন্তু এখন সে সব ভেঙে গেছে খুব সম্ভব অন্তর্কলহের ফলে। পাবা আর কুশীনারায় ওঁদের দুটি শাখা রয়েছে কোনওক্রমে টিকে। বন্ধুল বলেন, বদ্ধ জলের মতো সে-সব মল্লরাজ্য। তিনি তো কোশলরাজ্যের কাছে কাজ নিয়েছেন। সৈনাপত্য করেন বলে তবু খানিকটা সম্মান, প্রতিষ্ঠা ও সন্তোষ পেয়েছেন।
সামনের পঙ্ক্তিতে বসা একজন সম্রান্ত ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে বললেন—কী তখন থেকে বকবক করছেন? দেখছেন না ভগবান তথাগত সভায় এসে গেছেন।
তিষ্য আরক্ত মুখে নীরব হয়ে গেল। তার কপালে ভ্রূকুটি।
ওদিকে মহারাজ বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন বলে উঠলেন—আপনার কাছে কিছু নিবেদন ছিল ভন্তে।
বুদ্ধ নিজের আসন থেকে বললেন—বলুন মহারাজ।
—আমি সংবাদ পাচ্ছি বহু সৈনিক নাকি পব্বজ্জা নেবার উদ্যোগ করছে। এ কথা কী সত্য ভন্তে?
—হতে পারে, ধীর গলায় বললেন তথাগত। মহারাজ, সেনানী গ্রামে কদিন দেশনার পর উত্তরোত্তর ভিড় বাড়ছিল।
—কিন্তু ভন্তে, সৈনিকরা যদি সন্ন্যাসী হয়ে যায়, রাজ্য রক্ষা করবো আমি কাদের দিয়ে? বুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে রইলেন।
সমস্ত সভাও সেই সঙ্গে স্তব্ধ।
—মহারাজ, বুদ্ধর গম্ভীর অনুরণনময় কণ্ঠ শোনা গেল—মানুষ বদ্ধ জীব। জীবনের বন্ধন। কর্মের বন্ধন। সমাজ পরিবার পরম্পরার বন্ধন। সর্বত্রই শুধু অধিকার হরণের খেলা। একমাত্র পব্বজ্জা গ্রহণের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না।’
—কিন্তু ভগবান, জাতির প্রতি, দেশের প্রতি দায়িত্ব বলেও তো কিছু আছে! আজ আমি যদি পব্বজ্জা নিয়ে চলে যাই, মগধবাসীর প্রতি তা সুবিচার হবে কী?
—তবু আপনার সে অধিকার আছে মহারাজ।
অধিকার থাকুক। আমার দায়িত্ববোধ আমাকে উপাসকত্ব নির্বাসন করতে বলে। মগধবাসীর মুখ চেয়ে।
—হয়ত আপনার মনে পূর্ণ বৈরাগ্য উদয় হয়নি, মহারাজ।
—এ কথা বহু সৈনিকের সম্পর্কে, আরও বহু পব্বজ্জাকামী মানুষের পক্ষেও সত্য হতে পারে ভগবন। বৈরাগ্য উদয় হয়নি। কিন্তু কর্মত্যাগ করার সুযোগ অনেকেই ছাড়তে চায় না। যুদ্ধক্ষেত্র, সংগ্রাম, প্রাণ যাবার সম্ভাবনা, এ সবের চেয়ে শ্ৰমণ-জীবন যাপন করা অনেক নির্ঝঞাট ব্যাপার।
কিছুক্ষণ সব স্তব্ধ। তারপর বুদ্ধ বললেন—তাই হবে। সৈনিকরা সংঘে প্রবেশ করতে পারবে। তিনি স্তব্ধ হয়েই বসে রইলেন। ধীরে ধীরে তাঁকে নমস্কার করে অধিকাংশ লোকই চলে গেল! আজ দেশনা হবে না, বুঝতেই পারা যাচ্ছে।
মহারাজ বিম্বিসার মাথা নত করে বসে আছেন। সভা প্রায় শূন্য হয়ে এলে তিনি বললেন—আমার উপায় ছিল না ভগবন্। তথাগতের পথ আর রাজকর্তব্যের পথ, দুটির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন…
—সামঞ্জস্যের চেষ্টা যে তথাগত করছেন না, এ কথা তো সত্য নয় মহারাজ! আপনার অনুরোধেই উপোসথ প্রবর্তিত হয়েছে প্রতি পূর্ণিমাতে, অমাবস্যায় শুধু লোর্করীতির প্রতি শ্রদ্ধাবতশই, নয়তো সংঘবাসী ভিক্ষুরা তো সর্বদাই সংযম পালন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, স্বতন্ত্রভাবে উপপাসথের সংযমের কোনও প্রয়োজন নেই।…
এই সময়ে বিপরীত দিক থেকে একটা ক্রুদ্ধ চিৎকার, কিছু বাদ-প্রতিবাদের শব্দ শোনা গেল। অচিরেই সভাস্থলে ঝড়ের মতো প্রবেশ করল এক নারী। কৃষ্ণকায়। চুলগুলি পিঙ্গলবর্ণ, অপরিচ্ছন্ন, মাথার চারপাশে যেন বিষধর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। সামান্য একটি মলিন, ছিন্ন বসন কোনমতে কটিতে জড়ানো।
—আমার ছেলে দুটো কে হরেছে, কে হরেছে? বলতে বলতে সে তার লাল চোখ চারদিকে ঘোরাতে লাগল।
বুদ্ধ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। বললেন—কে তুমি, জননী!
—হারিটি, আমি হারিটি। আমার ছেলে কে হরেছে? তুই? বলে যক্ষিণী বুদ্ধর দিকে ধেয়ে গেল। দীর্ঘ নখ সমেত তার হাতগুলি সামনে প্রসারিত। তিষ্য এবং চণক সবিস্ময়ে দেখল, যক্ষিণী বুদ্ধের বেদীর ওপর আছড়ে পড়েছে। বুদ্ধ সরে গেছেন। যক্ষিণী আবার উঠে ক্রোধে অন্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পেছনের আম গাছের কাণ্ডে এবার আছড়ে পড়ল সে। বুদ্ধ সরে গেছেন। এইভাবে সে ডাইনে ঝাঁপালে বুদ্ধ বাঁ দিকে সরেন, সে বাঁ দিক ঝাঁপালে তিনি চকিতে ডাইনে সরে যান, কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিটির মুখে, বুকে রক্ত দেখা দিল। সে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ক্ষান্ত হল। গর্জনের সঙ্গে কান্না মিশিয়ে সে বলল,—আমার ছেলে দে! জাদুকর!
বুদ্ধ বললেন—আমাদের শিশুগুলি দাও আগে।
—তোদের ছেলে আমি জানি নে, জানি নে।
—তোমার শিশুদের কথাও আমি জানি না।
তখন যক্ষী কাঁদতে লাগল। সে কী ভয়ানক কান্না! ঝড়ের পরে যেন প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে।
—ও যতি, আমার ছেলে দে। ও জাদুকর, আমার ছেলে দে। আমি ওয়াদের না দেখে থাকতে পারি নে। ও যতি, আমার বুক টনটনাচ্ছে। কতক্ষণ ওয়ারা এসে দুধ খায়নি। —কাঁদে আর দাঁত কড়মড় করে সে।
আরও একটি কালো ছায়া প্রবেশ করল ধীরে ধীরে। একটি নগ্নপ্রায় পুরুষ। এতক্ষণ সম্ভবত গাছের আড়ালে লুকিয়েছিল। সে এগিয়ে আসতে তিষ্য এক দিক থেকে, চণক এক দিক থেকে তাকে শক্ত করে ধরল। যক্ষিণীটি এমন অতর্কিতে এসে হানা দিয়েছিল, যে তারা কিছু বোঝবার আগেই সে বুদ্ধকে আক্রমণ করে।
যক্ষ বলল—আমি কিছু করব না, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি পাঞ্চি। হারিটি আমার বউ। ও জ্ঞান হারিয়েছে দুঃখে। ওকে নিয়ে যাবো।
বুদ্ধ বললেন—পাঞ্চি রাজগৃহের শিশুগুলিকে ফিরিয়ে দাও। তাদের মায়েরা ঠিক তোমার পত্নীর মতোই শোকে জ্ঞান হারিয়েছে।
পাঞ্চি বলল—কী করে ফিরিয়ে দেবো? সেগুলিকে তো হত্যা করে খেয়ে ফেলেছি।
অমনি চারদিক থেকে একটা হুতাশের ধ্বনি উঠ। সমবেত ভিক্ষুরা, উপস্থিত রমণীরা যে যেখানে ছিলেন সবাইকার বুক চিরে একটা আর্তনাদ। কোনও কোনও রমণী অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আম্রবনে একটা যেন সাড়া পড়ে গেল, কে জল আনছে। কে কাকে ডাকছে প্রাণপণে।
এরই মধ্যে বিম্বিসার তাঁর রক্ষীদের ইঙ্গিত করলেন, তারা গিয়ে হারিটিকে ধরল।
বুদ্ধ বললেন—এখানে যাঁরা রয়েছেন কেউ শিশুগুলির মাতা বা পিতা নয়, তবু এঁরা দুঃখে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ছেন। হারিটি তুমি কি ভেবেছিলে, তুমি একাই মা? তোমার শিশুই শিশু? আর কেউ মা নয়, অন্য মায়েদের শিশুগুলিকে তাদের মায়েরা স্নেহ করে না?
হারিটি তীব্র স্বরে বলল—অজ্জদের আমরা আমাদের মতো ভাবি না! ভাবি না। তারা আমাদের বন নিয়ে নিয়েছে। পশুগুলো মেরে শেষ করে দিয়েছে। আমরা ভিক্ষে করে খাই। তাও এই নগরের লোকেরা মুখের ওপর দোর বন্ধ করে দেয়। বলে বন্য, ঘৃণ্য, কুৎসিত, কদাকার। কী করে জানব অজ্জরা ছেলেদের ভালোবাসে!
বিম্বিসার রুক্ষ কণ্ঠে বললেন—রক্ষীন, এই যক্ষ-যক্ষী দুটিকে বন্দীশালায় নিয়ে যাও।
—একটু অপেক্ষা করুন মহারাজ, বুদ্ধ বললেন—হারিটি, পাঞ্চি—কান্না থামাও! শুনতে পাচ্ছো? শুনতে পাচ্ছো! তাঁর কণ্ঠ যেন জলভরা মেঘের ডাকের মতো সজল, গম্ভীর।
চণক দেখল রমণীরা সকলেই কাঁদতে কাঁদতে ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে। ভিক্ষুদের চোখ দিয়ে দরদর ধারে জল পড়ছে।
আনন্দ মুখ ঢেকে বসে আছেন। ভিক্ষু ধর্মরুক্ষিত হাহাকার করে বললেন—তোমরা আমাকে নিয়ে গেলে না কেন? আমাকে হত্যা করে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে পারতে, আর্যদের ওপর তোমাদের এত রাগ! আমাদের মতো সংসার-বিরক্ত পরিব্রাজকের হত্যা করে শোধ তুলতে পারতে। শিশুগুলি, আহা অবোধ শিশুগুলি তো কিছুই জানে না, কিছুই করেনি। পাপ কী, এখনও তা জানে না! কী করলে তোমরা! এ কী করলে! বলতে বলতে ভিক্ষু ধর্মরক্ষিত কাঁদতে লাগলেন।
তখন একটি অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি হল। বুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন অম্ব বৃক্ষতলে বেদীর ওপর। মুখের ভাব অসাধারণ কোমল, করুণ। চোখ দুটি ভরা দীঘির মতো। মহারাজ বিম্বিসার বসে আছেন প্রস্তরমূর্তির মতো। রক্ষীগুলি হাতের পাতা দিয়ে চোখ মুছছে। তিষ্য প্রাণপণে আত্মসংবরণের চেষ্টা করছে, পারছে না। চণক আরেক প্রস্তর মূর্তি। ভিক্ষুগুলি অস্ফুটে হাহাকার করছেন। ওদিকে রমণীদের মধ্যে মুর্ছা, পতন, হাহাকার চলছেই, চলছেই।
হঠাৎ হারিটি ভূমিতে সাষ্টাঙ্গ পড়ে গেল। উপুড় হয়ে। সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পাঞ্চিও বসে পড়েছে। দু হাতে সে নিজের বুকে আঘাত হানছে। —উঃ, শিশুগুলিকে আমরা খেয়েছি। শিশুগুলিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে খেয়েছি। আমাদেরই শিশু তারা। আমাদেরই..আমাদেরই…
পাঞ্চি দু হাত বাড়িয়ে বলল—ধরো, বাঁধো, আমাকে নিয়ে যাও গো রক্ষীরা। মেরে ফেলো।
হারিটি বলল—ও জঙ্গল-মা, জঙ্গল-মা, ও বেলগাছের দেবতা, বটগাছের দেবতা আমি সইতে পারছি নে। আমাকে মেরে ফেলল। মেরে ফেললা গো!
বুদ্ধ মৃদু, দৃঢ় স্বরে বললেন—মহারাজ ওদের ধরার, বন্দী করার প্রয়োজন নেই।
তিনি ধীরে ধীরে বেদী থেকে নেমে নিজের কুটির দিকে চলে যেতে লাগলেন। তাঁর পেছন পেছন চলে গেলেন ভিক্ষুরা, ভিক্ষুণীরা। সবাই স্তব্ধ, যেন এক শোকযাত্রা চলেছে। আম্রবনের পত্ৰজাল যেন শোকে ধূসর হয়ে গেছে।
মহারাজ বিম্বিসার রক্ষীসহ বেরিয়ে এলেন। চণক ও তিষ্য বেরিয়ে এলো। সোমা বেরিয়ে এলো। নিস্তব্ধ মানুষগুলি যে যার গৃহের দিকে চলে গেল। যেন সবাই একটা গভীর বিষাদের ঘোরের মধ্যে রয়েছে।
তিষ্য আজ আর নিজের আবসাথাগারের দিকে গেল না। চণকের সঙ্গে জম্বুবনে প্রবেশ করল।
আসনশালায় বসে চণক মদৃস্বরে জিজ্ঞাসা করল—সোমা, কেমন দেখলে?
সোমার চোখ দুটি এখনও অরুণবর্ণ হয়ে রয়েছে। সে বল—বুদ্ধ তথাগত যে মানববেশী দেবতা তাতে কোনও সংশয়ই নেই।
চণক বলল—বড় তৃষ্ণা, সোমা, কিছু পানীয়ের ব্যবস্থা করো।
দুজন দাসী এসে দাঁড়িয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চলে গেল। স্ফটিকের পাত্রে পানীয় এলো। সোমা পাত্র তুলে দুই বন্ধুর হাতে দিল।
চণক বলল—তুমি নাও সোমা। সে তিষ্যর দিকে ফিরে বলল—তুমি কি সোমার সঙ্গে একমত? শ্ৰমণ গৌতম মানববেশী দেবতা?
তিষ্য বলল—ওঁকে যে মহারাজ বিম্বিসার সেনাপতির পদ দিতে চেয়েছিলেন, শুধু শুধু নয়।
—এ কথা কেন বলছেন? সোমা জিজ্ঞাসা করল।
তিষ্য বলল—ভদ্রে, আমি মল্লবিদ্যা শিক্ষা করেছি ভালা করে, যদিও শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করি না এখনও। কিন্তু আমার আচার্য বন্ধুলকে দেখেছি তো! ইনি, এই বুদ্ধ, তাঁর চেয়েও কুশলী। মল্লক্ষেত্র আর শাক্যক্ষেত্র প্রায় পাশাপাশি। ইনি মল্লবিদ্যার এই দ্রুত স্থান-পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এমন শিখেছেন যে, সহসা দেখলে ইন্দ্রজাল মনে হয়।
চণক উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল, বলল—তিষ্য, তুমি সংশয়ী বটে! অজিত কেশকম্বলী কিংবা প্রক্রুধ কাত্যায়নের থেকেও।
তিষ্য হাসল, বলল—কিন্তু চণকভদ্র, ইনি আমাকে চমৎকৃত করেছেন অন্য কারণে।
—বলো শুনছি—চণক পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল।
—চণকভদ্র, জীবনে এই প্রথম আমি কাঁদলাম। সে কী বিপুল দুঃখের বেগ ভদ্রা, আপনিও বোধ হয় তার থেকে মুক্ত ছিলেন না। চণক আমি দেখলাম, চোখের সামনে দেখতে পেলাম যেন নিস্পাপ শিশুগুলিকে এরা দুজনে মিলে হত্যা করছে। সেই অগ্নিকুণ্ডটি চোখের সামনে ভাসিত হল। আধপোড়া শিশুদের শব.। ওহ্, চণক, আমার কিন্তু ক্রোধ হল না। সঙ্গে সঙ্গে বধ করতে পারতাম ওই যক্ষীকে। কিন্তু ক্রোধের আগুন যেন নিবিয়ে দিল দুঃখের জল। যতক্ষণ বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে গৌতম ওইভাবে কথা বলছিলেন বা শুধু দাঁড়িয়েছিলেন সমগ্র আম্রবনে করুণা, ক্রন্দনের একটা তরঙ্গ উঠছিল। এত তীব্র যে কাননের গাছগুলিও বোধ হয় তা থেকে মুক্ত ছিলে না।
একটু থামল তিষ্য। তারপর বলল—চণকভদ্র, আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি?
—বুঝেছি,তুমি ওঁর প্রভাবশক্তির কথা বলছ।
—এ প্রকার প্রভাব ঋদ্ধিমান পুরুষ না হলে থাকে না—সোমা বলল। পানীয়টি এখনও তার হাতে ধরা—তা ছাড়া আর্য চণক, আমরা কি একটা বাইরের প্রভাবে অত কষ্ট পেলাম! তা নয়, আমাদের হৃদয়ের মধ্যে যে বৎসহারা জননীর ব্যথা আছে, তাকেই উনি যেন চেতিয়ে তুললেন। সেই ব্যথার সূত্র ধরে এলো আমার ব্যক্তিগত সমস্ত ব্যথার দুঃখ, তারপর…তারপর আরও যে যেখানে আছে, সবার সর্বপ্রকার দুঃখের মধ্যে মিলে গিয়ে তা এক মহাদুঃখ হয়ে হৃদয় দীর্ণ করতে লাগল। অন্তত আমার।
তিষ্য মুখ নত করে বলল—আমারও ঠিক এই অনুভূতি। ঠিক এই। ভদ্রা অবিকল বর্ণনা দিয়েছেন। হৃদয়টি যেন ইন্দ্রকীল, দুঃখগুলি সব হস্তিযূথ। প্রাণপণে হৃদয় ভেঙে দিচ্ছে।
সোমা পানপাত্র নামিয়ে ত্বরিতপদে ভেতরে চলে গেল। অনেকক্ষণ পরে তিষ্য মৃদুস্বরে বলল—চণকভদ্র উনি কে? এই ভদ্রা?
—ওঁর পূর্ণ পরিচয় তোমায় পরে দেব তিষ্য। এখন শুধু জেনে রাখো এই নারী বিদূষী, সঙ্গীত নৃত্য ইত্যাদি বহু চারুকলায় এঁর সমকক্ষ পাওয়া কঠিন কাজ। ইনি আমাদের পিতা-পুত্রের জীবনের প্রধান কৃতি রাজশাস্ত্রের প্রতিলিপি প্রস্তুত করছেন।
—ইনি আপনার পত্নী বা পত্নীস্থানীয়া নন? সসঙ্কোচে জিজ্ঞেস করল তিষ্য।
—না, না। তিষ্য, একেবারেই না।
দাসীরা এসে জানাল—রাত্রের আহার্য প্রস্তুত।
বহু প্রকার খাদ্য-দ্রব্য ভারে ভারে সামনে এনে রাখল দাসীরা। অদূরে ছায়ামূর্তির মতো বসেছে সোমা। কারওই আহারে তেমন রুচি নেই। সোমাও কাউকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করছে না। সে জানে আজ এদের খাদ্যে রুচি থাকবে না। তিষ্য অবশেষে দুধের পাত্র তুলে নিল। পান করতে করতে ভাবল—এই ভদ্রা কে? ইনি ব্যক্তিগত দুঃখের কথা কী বলছিলেন! এঁর মুখশ্রী গম্ভীর। বৃথা ভদ্রতা করেন না। এঁর ব্যক্তিগত দুঃখগুলি কী? এখন যেমন স্থির বসে রয়েছেন, আম্রবনেও তেমনি ছিলেন। শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। গাল ভেসে যাচ্ছিল। ইনি বিবাহিতা বলে মনে হচ্ছে না। অথচ বৎসহারা জননীর কথা কী যেন বলছিলেন?
২৭
নগরীতে ভয়ানক গোলমাল। চণক তিষ্যকে নিয়ে যাচ্ছিল এক গোষ্ঠীতে। বোধিকুমার, চারুবাক এঁরা তো থাকেনই, আরও চার-পাঁচজন বিশিষ্ট কবি, বিদ্বান, কুলপুত্র আসেন এখানে। চণকের উদ্দেশ্য ছিল তিষ্যকে এদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। একটু আগেই বেরিয়েছে ওরা। চণক বলল— চলো অনুচিত্তর পানাগারে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। এত শীঘ্র গেলে হয়তো অনর্থক অপেক্ষা করতে হতে পারে।
অনুচিত্তর পানাগারটি হাটের একেবারে মধ্যিখানে। নানা ধরনের লোকেরা তার ক্রেতা। দুধারে গন্ধ, মাল্য, ফুল ইত্যাদির আপণ। এইখানেই কয়েস মাস আগে একটি মাগধ চর, কিংবা হয়ত চর নয়, চতুর এক নাগরিক চণকের ছদ্মবেশ ভেদ করে তাকে মহা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। স্থানটি প্রধান রাজপথের একটি শাখা, বৈপুল্লগিরি থেকে যাওয়া-আসার পথে পড়ে। প্রধান রাজপথগুলির দু পাশে কানন, প্রাসাদ। প্রাসাদগুলিও অধিকাংশই কানন বেষ্টিত। কিন্তু হাট বা কোনও আপণ নেই। মৎস্য, মাংস, শাক এবং অন্যান্য খাদ্যবস্তুর হাট উত্তরের এবং দক্ষিণের দুটি উপপথে রয়েছে। সেখানেও পানাগার আছে, তবে তা একেবারে নিম্নশ্রেণীর জন্য। বৈপুল্লগিরির সানুদেশের এই পথটিকে বিলাসদ্রব্যের হাট বলা যায়। সূক্ষ্ম বসন, শিশুদের খেলনা, কিংবা অন্য শিল্পদ্রব্য যেমন ইন্দ্রর মূর্তি যক্ষিণী মূর্তি—এ সবই এখানে পাওয়া যায়।
মালা কিনবার জন্য দুজনে একটি বড় আপণের সামনে থাকল। আপণের সামনে কয়েকজন বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল।
একজন আরেক জনকে বলল—তুমিই বলো না অসুরেন্দ্র, এর পর ওই মুণ্ডক শ্ৰমণ রাজ্য চালাবে,
আমাদের মহারাজ! অন্যান্য শ্রমণরা নিজেদের আধ্যাত্মিক ব্যাপার নিয়ে থাকেন। ধ্যান-ধারণা করেন, লোকে চাইলে উপদেশ বা ভাষণ দেন, দুটি ভিন্ন পন্থের মধ্যে বিতর্ক হলেও আমরা উপকৃত হই। উত্তেজক হয় ব্যাপারটা। এই মুণ্ডকের মতো কেউ সব বিষয়ে নাক গালচ্ছে কী? কাকে শাস্তি দিতে হবে না-হবে, সে রাজা বুঝবেন!
অসুরেন্দ্র নামে লোকটি বলল—রাজা নিজেই সমাদর করে করে এঁর মাথাটি চর্বণ করেছেন। এখন বুঝুন!
তিষ্য এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল—কী হয়েছে ভদ্র?
অসুরেন্দ্র বলল—আর বলবেন না আয়ুষ্মন্ আমরা এই রাজগহের নাগরিকরা জ্বলেপুড়ে গেলাম, জ্বলেপুড়ে গেলাম। আপনি নিশ্চয়ই এখানে আগন্তুক?
—হ্যাঁ, দু এক মাস হল এসেছি।
—তাই জানেন না। এক ন্যাড়ামুণ্ড শ্রমণ কয়েক বছর ধরেই এ নগরে যাতায়াত করছে। নিজেকে বলে বুদ্ধ। আমাদের মহারাজকে এমনভাবে সম্মোহিত করে ফেলেছে যে তিনি এর সমস্ত বাক্য বেদবাক্যের মতো মানতে আরম্ভ করে দিয়েছেন।
এই সময়ে অন্য একটি লোক মৃদুস্বরে কী বলল। অসুরেন্দ্র তাতে একটু না দমে বললেন—চর? চর আমার কী করবে? আমি অন্যায় কিছু বলেছি? যক-যক্ষিণী নাগরিকদের শিশু চুরি করে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলল। কেউ তাদের ধরতে পারছিল না। কী করে ধরবে! ভিক্ষুক সেজে ছল করে লোকের বাড়িতে ঢুকত আর শিশুগুলিকে চুরি করত। ওই মুণ্ডকের বুদ্ধিতে না হয় তাদের ধরা গেল। রাজার রক্ষীরা তাদের বেঁধেছিল, এমন সময়ে মুণ্ডক কি না বলে ওদের ছেড়ে দাও! মহারাজও দিব্য ছেড়ে দিলেন! শুনছি নাকি আবার সাক্কপুত্তীয় সমনরা নিজেরে ভিক্ষাভাগ ওদের নিত্য দেবে। ওদের দুঃখে হৃদয়গুলো সব গলে জল হয়ে গেছে। রাক্ষসীর উদরে যে আমাদের শিশুগুলি জীর্ণ হচ্ছে সেটা কিছু না। রাজা নাকি যক্ষিণীর পল্লীতে রক্ষী নিয়োগ করেছেন, যাতে ওদের কেউ ক্ষতি করতে না পারে।
মালা কিনে চণক ততক্ষণে পানাগারের দিকে পা বাড়িয়েছে। তিষ্যর পেছন পেছন রাজগৃহর এই নাগরিকগুলিরও একই গন্তব্য। যে-যার আসনে বসে, সুরার কথা বলে আবার একই প্রসঙ্গ আরম্ভ করল ওরা।
কয়েকটি পীঠের ওপর পরিষ্কার ভুল আচ্ছাদন পেতে দিয়েছে এরা। উপাধান ইতস্তত ছড়ানো। চতুর্দিকে ফুলের মালা ঝুলছে। কয়েকটি বড় বড় মাটির কলসে সুরা রয়েছে নানাপ্রকার। তীক্ষ্ণ এবং মৃদু উভয়ই রয়েছে। অনুচিত্তর দুজন সুবেশ দাস ও সুকেশী দাসী সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রে সুরা পরিবেশন করছিল।
চণক পানীয়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল—আপনাদের কারও গৃহে কি শিশু চুরি গেছে?
অসুরেন্দ্র বললেন—কী যে বলেন ভদ্র! আমার…আমাদের সবার গৃহই যথেষ্ট সুরক্ষিত। ধনী সেট্ঠিদের মধ্যে দ্বারপাল না থাকতে পারে কিন্তু শিশুগুলিকে দেখাশোনা করবার জন্য দাসদাসীর অভাব নেই। ধাত্রীরা রয়েছে, মায়েরাও সতর্ক। এসব শিশু চুরি ঘটেছে প্রান্তিক পল্লীতে।
চণক বলল—আমিও তাই ভেবেছিলাম।
অসুরেন্দ্র বললেন—দেখুন ভদ্র, আমাদের উচ্চশ্রেণীর গায়ে না লাগলে আমরা যদি এসব ব্যাপারে গুরুত্ব না দিই, ভবিষ্যতে তাতে কি আমাদের ভালো হবে? আমরা নগরবাসীরা প্রতিদিনের কার্যাকার্যে এই নিম্ন শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল। আজ ছ’দিন হল আমাদের বর্জ্য কুটিরের মল পরিষ্কার করার জন্য নিযুক্ত অন্ত্যজরা আসেনি। মাতঙ্গ নামে এক চণ্ডাল ওদের নেতা। মাতঙ্গর একমাত্র সন্তান নাকি যক্ষীর উদরে গেছে। এখন ভদ্র, চণ্ডাল হলেও তো সে পিতা; শিশুঘাতিনীর শাস্তি না হলে সে ক্রুদ্ধ হতেই পারে। কী হে ভৃগু তোমার কী মত?
ভৃগু নামে ব্যক্তি বললেন—ঘটি কলস তৈজসাদি চুরি করলে যেখানে হাত পা ছেদন করে শাস্তি দেওয়া হয়, সেখানে একজন শিশুঘাতিনী যক্ষীকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হল, আবার তার নিত্যভোজনের ব্যবস্থা হল, এর মধ্যে কোনও যুক্তি আছে? এই বুদ্ধ সমন আমাদের সর্বনাশ করবেন।
আরেক ব্যক্তি বলে উঠল—মহারাজ বিম্বিসার এতদিন প্রজাপ্রিয় লোকপাল ছিলেন। আমরা গর্বিত ছিলাম আমাদের রাজ্য ন্যায়ের রাজ্য, শান্তির রাজ্য বলে। আর এখন?
পানীয় শেষ করে চণক তিষ্যর দিকে তাকাল, নিম্নকণ্ঠে বলল—এখন আর গোষ্ঠীতে গিয়ে কাজ নেই, চলো একবার আম্রবনে গিয়ে দেখি শ্রমণের দেখা পাই কি না।
যতই আম্রবন এগিয়ে আসে ততই অস্বস্তি বাড়তে থাকে উভয়ের। পথে যেন ভিড় বাড়ছে। আম্রবনের প্রবেশপথে তারা একদল নিম্নশ্রেণীর লোক দেখতে পেল। পরনে কটিবস্ত্র। উধ্বাঙ্গে অধিকাংশেরই কিছু নেই। কেউ কেউ বাকল জাতীয় বস্ত্রও পরে রয়েছে। এরা অপরিচ্ছন্ন, শ্মশ্রূ-গুম্ফ বিশেষ কাটে না। গায়ের বর্ণ সবারই যে কৃষ্ণ তা নয়, কয়েকজন তাম্রবর্ণ, এমন কি গৌরবর্ণও আছে, কিন্তু বড় মলিন। ভিড়ের মধ্যে একটি বিশালদেহী যুবককে আঙুল দিয়ে দেখাল তিষ্য—দেখুন, চণকভদ্র দেখুন!
লোকটির কটিতে রক্তবসন, মাথায় কেশগুলি কুণ্ডলীকৃত হয়ে রয়েছে। হাতে একটি যষ্টি। চোখগুলি একে রক্তবর্ণ, এখন যেন তাতে আগুন জ্বলছে। সে উন্মত্তের মতো বলছে—রাক্ষসীর শিশু ফিরিয়ে দেওয়া হল, আমার শিশু, আমাদের শিশুগুলিকে কে ফিরিয়ে দেবে? সমন তার জাদু দেখাক। দিক ফিরিয়ে আমার চন্দকে। দিক, আমি কিছু বলব না। দেওয়ার সাধ্য তার আছে?
বলতে বলতে মাতঙ্গ ঝড়ের মতো আম্রবনে ঢুকতে লাগল। কিছু দূর থেকে চণক ও তিষ্য তাদের অনুসরণ করল।
—কী করবে ওরা? তিষ্য উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, শ্রমণ গৌতমকে বধ করতে যাচ্ছে না কি?
চণক বলল—তা মনে হয় না, তবে এদের কথার উত্তর শ্রমণকে দিতে হবে। তিনি কী উত্তর দেবেন তিনিই জানেন।
আম্র তরুমূলে বেদীটি শূন্য। একজন ভিক্ষু বেরিয়ে এলেন, বললেন—কে তোমরা? কী চাও?
—বুদ্ধ কোথায়? বুদ্ধ?—মাতঙ্গ কণ্ঠস্বরে প্রচণ্ড ক্রোধ ও ব্যঙ্গভরে বলল।
—তথাগত আজ ভোরেই পরিব্রজন করতে বেরিয়ে গেছেন। এখন তো আর ফিরবেন না। তাঁর সন্ধান করছ কেন আবুস?
মাতঙ্গ বলল—যক্ষিণী আমার শিশুকে খেয়েছে, তার শাস্তি তিনি বন্ধ করেছেন কেন? উত্তর দিন! আপনি কে? সমন বুদ্ধকে না পেলে আমরা আপনার কাছ থেকেই উত্তর চাইব।
—আমি তথাগত বুদ্ধর অগ্গসাবক মোগ্গল্লান। তোমরা কার শাস্তি চাও? এসো, দেখো।
মোগ্গল্লান মাতঙ্গের দলকে একটি কুটিরের দিকে নিয়ে গেলেন। সবাই দেখল স্বল্প-পরিসর কুটিরের মধ্যে দুটি বন্য নরনারী শুয়ে আছে। অচৈতন্য। তাদের সর্বাঙ্গ ক্ষতে পূর্ণ। কোনও কোনও ক্ষত দিয়ে এখনও রক্ত ঝরছে। যক্ষীটির গলার চারপাশে আঙুলের চিহ্নে।
মাতঙ্গর দলের একজন অবাক হয়ে বলল— সমন ওদের এভাবে শাস্তি দিয়েছেন?
মোগ্গল্লান ধীরে ধীরে বললেন— সেই শাস্তিই সবার বড় শাস্তি যা মানুষ নিজে নিজেকে দেয়। দুদিন, দুই রাত ধরে এই বন্য দম্পতি উন্মাদের মতো নিজেদের হত্যা করবার চেষ্টা করেছে। এতদিনে এদের হৃদয় জেগেছে বুঝতে পেরেছে কী পশুর মতো আচরণ করেছে এরা। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। অন্তর। তিনি দলটির দিকে চেয়ে বললেন ‘কে তোমাদের দলপতি? নাম কী?’
কয়েকজন বলে উঠল— মাতঙ্গ। মাতঙ্গ।
মোগ্গল্লান বললেন— মাতঙ্গ! তোমাদের তো চিরকালই ওই প্রান্তিক পল্লীতে বনের ধারেই থাকতে হবে?
—তা তো হচ্ছেই। মাতঙ্গ রুক্ষ কেশভরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
—‘তোমরা চিরকালের মতোই নিরাপদ হতে চাও তো?’
একজন বলল— তা তো চাই-ই সমন, নিত্যি-নিত্যি ঝামেলা কে পোয়াবে?
—আজ একজন যক্ষীকে হত্যা করলে কাল আরেকজন শিশুঘাতী যক্ষ আবির্ভূত হবে না এ কথা কেউ বলতে পারে?
—হতেই পারে। এই বনে যক্ষই থাকে তো!
—ওদের নরমাংস খাওয়া ছাড়াতে পারলে, সভ্য মানুষের মতো কাজকর্ম করে বাঁচবার সুযোগ দিলে ওদের মধ্যে থেকে এই ঘৃণ্য অভ্যাস তো চলে যেতে পারে?
—ওরা রাক্ষস, ওরা আমাদের মতো মানুষ নয়, সমন!
বেশ ওদের দেখে এসো ভালো করে, রাক্ষসের কী লক্ষণ ওদের আছে দেখো। আমাদেরই মতো হাত পা, মুখ, কেশ, আমাদেরই মতো চোখ মুখ। শুধু ভাষা একটু ভিন্ন। তা-ও আমরা বুঝতে পারি এমন কথা ওরা বলতে আরম্ভ করেছে। অজ্ঞান, অনাহার, অভাব এবং প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি থেকে ওরা এই কাজ করেছে। এখন যদি ওদের হত্যা করা হয়, বন্যরা আরও ভয় পেয়ে যাবে মাতঙ্গ, আমাদের শত্রু হয়ে উঠবে। কিন্তু একজনকে যদি ক্ষমা করা যায় ওরা আমাদের বিশ্বাস করবে, শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসতে আরম্ভ করবে। তোমাদের পল্লী যক্ষভয় থেকে চিরকালের জন্য রক্ষা পাবে। মাতঙ্গ, ওরাই বনের মধ্যে তোমাদের রক্ষী হয়ে থাকবে। এ সুযোগ তোমরা হাতছাড়া করো না।
জনতার মধ্যে একটা গুঞ্জন ধ্বনি উঠল। তিষ্য দেখল বিশাল বক্ষপট চেতিয়ে মাতঙ্গ ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছে। সে পায়ের দুমদাম শব্দ করে চলে গেল। তার মুখ মেঘাচ্ছন্ন। অন্য লোকগুলি ভিক্ষু মোগ্গল্লানকে নমস্কার করল। অনেকে বলে উঠল—সমন, সত্যি সত্যি আমরা এবার নিরাপদ তো?
—আমি জানি এই পাঞ্চিক আর হারীতি, তোমাদের এবং তোমাদের শিশুদের রক্ষা করবে। ওদের সভ্য, শিষ্ট মানুষ হয়ে উঠতে আর বিলম্ব নেই। তোমরা সাহায্য করো।
—কিন্তু শিশুগুলিকে তো আর আমরা ফিরে পাবো না। আমাদের অনেকেরই শিশু গেছে।
—তোমাদের ঘরে আরও শিশু আসুক আবুস। যেগুলি গেছে তারা মুক্তাত্মা। মহাত্মা। সংসারের দুঃখচক্র থেকে মুক্তি নিয়ে চলে গেছে। তাদের জন্য শোক করো না।
লোকগুলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। মাতঙ্গ যেতে যেতে ফিরে দাঁড়িয়ে প্রবল বেগে একবার মাটিতে পা ঠুকলো। তারপর শব্দ করে থুৎকার করল—থুঃ, থুঃ থুঃ।
সে একা একা প্রায়ান্ধকার পথ বেয়ে চলে গেল। অন্য লোকগুলি চলতে চলতে বলতে লাগল—আমাদের বচ্চগুলি চণ্ডাল পুকুশের জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে। সমন বলেছেন ওরা মহাত্মা।
—সমন বলেছেন ওরা মহাত্মা। আমাদের নন্দু লোহিচ্চ, সচ্চ—সব মহাত্মা।
—ভবচক্র থেকে মুক্তি পেয়েছে।
—মুক্তি পেয়েছে … ওরা মহাত্মা। এই ঘৃণিত জীবন থেকে ওরা রক্ষা পেয়েছে।
—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্তিয়, বৈশ্যরাই শুধু মুক্তি পায় না গো, নিচু বন্নের মানুষও মুক্তি পেতে পারে। মহাত্মা হতে পারে। সমন বলেছেন।
জীবকাম্রবন ছাড়িয়ে অনেকটা চলে আসার পর দুজনেরই লক্ষ্য পড়ল গোষ্ঠীতে যাবার পথ তা ছাড়িয়ে এসেছে। দীপদণ্ডগুলি জ্বলতে আরম্ভ করেছে পথের পাশে। অজানা বুনোফুলোর মাদক গন্ধ পাহাড়ের দিক থেকে বয়ে আনছে বাতাস। তপোদারাম যাবার উপপথটির মুখে আসতে বেশ কয়েকজন তীর্থিক পন্থের শ্রমণকে দেখতে পাওয়া গেল। তাঁরা পাহাড়ের দিকে চলে যাচ্ছেন। রথ এবং ঘোড়ায় চড়ে কিছু নাগরিক চলাচল করছেন। দু একটি শিবিকাও চলে গেল। শান্ত রসের সন্ধ্যা।
তারা দুজন ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ঘোড়াদুটিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নইলে কথা বলবার সুবিধে হয় ন।
তিষ্য বলল— এই মোগ্গল্লানকে পূর্বে দেখেছেন না কি, চণকভদ্র?
—নাঃ।
—এঁরা সকলেই সম্মোহন বিদ্যা জানেন দেখছি।
—তিষ্য, তুমিও যে দেখছি রাজগৃহের নাগরিকদের মতো হলে?
—আপনি কি বলছেন শ্রমণের ওই সব কথা সত্য? শিশুগুলি মহাত্মা, মুক্ত হয়ে চলে গেছে? চণক হেসে বললেন— মৃত্যুর পর মানুষ জড় উপাদানসমূহের বন্ধন থেকে মুক্তই তো হয়! আত্মায় বিশ্বাস করি না করি, এটুকু তো অন্তত বুঝতে অসুবিধা নেই!
—কিন্তু মহাত্মা? শ্ৰমণ কি যক্ষীর জঠরে যাওয়া সব শিশুগুলিকে দেখেছেন? দেখে না থাকলে তারা মহাত্মা এরূপ ধারণা ভিত্তিহীন অনুমান ছাড়া কী? এক যদি এই শ্ৰমণরা সর্বজ্ঞ হন।
—শ্রমণ গোতম নাকি বলেন কেউ সর্বজ্ঞ নয়। হতে পারে না।
—তাহলে?
—তিষ্য তুমি সন্মোহন দেখছ, আমি দেখছি কুটনীতি। শ্ৰমণ গোতম কুটনীতি প্রয়োগ করে বন্যদের বশ করলেন। তাঁর শিষ্য মোগ্গল্লান কূটনীতি প্রয়োগ করে বিদ্রোহী চণ্ডাল-পুক্কুশদের বশ করলেন। এমন আমি আর দেখিনি।
—একে আপনি কূটনীতি বলছেন চণক ভদ্র? কূটনীতির মধ্যে একটা চতুরতার প্রবঞ্চনার ব্যাপার আছে। জেনেশুনে তাকে প্রয়োগ করেন কূটনীতিক। এই শ্ৰমণদের ঠিক ধূর্ত, চতুর মনে করতে আমার দ্বিধা হচ্ছে।
চণক বলল—সাধারণ রাজপুরুষ যিনি গতানুগতিক পথে চলেন তাঁর হাতে কূটনীতি চতুরতাপ্রসূত হতে পারে তিষ্য। কিন্তু আমি যে কূটনীতির কথা বলছি তা রাজশাস্ত্রের সূক্ষ্মতম এমন কি বলতে পারো মহত্তম নীতি। এর জন্ম হৃদয় থেকে, রাজায় রাজায়, রাজায় প্রজায় পরিপূর্ণ মৈত্রী স্থাপনের হার্দ্য ইচ্ছা থেকে।
কিছুক্ষণ থেকেই পেছনে অশ্বক্ষুরধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। এই সময়ে অশ্বারোহী দুই পথিকের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। এক লাফে নেমে অশ্বারোহী বললেন-‘মান্যবর, আপনাদের আলোচনায় যোগ দিতে পারি?
তিষ্য অবাক এবং বিরক্ত হয়ে দেখল একটি সৈনিক। শ্মশ্রূ, গুম্ফ বেশ যত্নে লালিত। বক্ষে লৌহজালিকা। মাথায় করোটিকা শিরস্ত্রাণ। চণকের থেকে সামান্য খর্ব। কিন্তু বিশাল বক্ষপট। কটিদেশ বৃকর মতো। বরপুরুষ বটে। কিন্তু তিষ্য অত সহজে মুগ্ধ হবার পাত্র নয়। সে ভ্রূকুটি করে বলল— ‘না পারেন না। আপনি উচ্চপদস্থ যোদ্ধা হতে পারেন, কিন্তু সহসা পথের পেছন থেকে এসে কোনও আলোচনায় যোগ দিতে হলে আপনাকে আমাদের পরিচিত হতে হবে।’
অশ্বারোহীর শ্মশ্রূ-গুফের ফাঁকে হাসি খেলে গেল। বললেন— অবশ্যই। যদিও নাম রূপ ক্ষণকালীন, নিতান্ত নশ্বর বস্তু, যে কোনও মুহূর্তে কপূরের মতো উবে যেতে পারে, তবু আপনার প্রীতির জন্য জানাই আমি জনৈক সৈনিক। দেখতেই পাচ্ছেন, মগধের সৈন্যদলে কাজ করি। নাম লোকপাল। পদের তুলনায় নামটি কিঞ্চিৎ ভারী। উপায় নেই। পিতা স্বর্গত। তাঁর সঙ্গে তো এখন আর বিবাদ করা যায় না।
চণক বলল— ভদ্র লোকপাল, পথে পথে আলোচনা না করে আমার গৃহে যদি আসেন। এই অল্প দূরেই, এসে পড়েছি।
লোকপাল সহাস্যে বললেন কিন্তু আপনার সঙ্গী যুবাটি সম্মত হবেন কী? আমার নাম বললাম, বৃত্তি বললাম, কিন্তু আয়ুস্মন আপনি তো পরিচয় জানালেন না?
তিষ্যর বিরক্তি এখনও যায়নি। সে অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল—উনি চণক। তক্ষশিলার নমস্য আচার্য দেবরাতের পুত্র, আপনাদের মহারাজ বিম্বিসারের বিশেষ প্রীতিভাজন। আমি তিষ্য, সাকেতের রাজকুমার।
—আপনি কি মহারাজ বিম্বিসারের অপ্রীতিভাজন না কি?
তিষ্য বলল— আপনাকে বয়সে বড় মনে হচ্ছে। আপনার অসম্মান করতে চাই না, কিন্তু অকারণ প্রগল্ভতায় কাজ কী?
লোকপাল নামে সৈনিক হঠাৎ অট্টহাস্য করে উঠলেন।
চণকের জম্বু কানন এসে গেছে। সে বলল—আসুন ভদ্র লোকপাল, তিষ্য এসো।
তিষ্য অপ্রসন্ন মুখ বলল—আমি বরং আজ যাই।
সহসা তার ডান হাত শক্ত করে ধরে লোকপাল বললেন—আপনার মতো বিদ্বান বুদ্ধিমান, গম্ভীর যুবা উপস্থিত না থাকলে আলোচনার রস নষ্ট হয়ে যাবে। দয়া করে আসুন।
চণক বলল—‘তিষ্য, আপত্তি করো না। আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। বিশেষ তোমার পক্ষে।’
তিষ্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঢুকল। অশ্বশালার দাসেরা তিনটি ঘোড়াই নিয়ে গেল। আসনশালায় প্রবেশ করতেই কোথা থেকে সোমা ছুটে এসে সৈনিককে আভূমি প্রণাম করল। তারপর সৈনিকের বর্ম, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদি খুলতে সাহায্য করতে লাগল। তারই ইঙ্গিতে সম্ভবত দাসীরা ছুটে এলো। তাদের হাতে বড় বড় সুগন্ধি জলের পাত্র, মার্জনী বস্ত্র।
সোমা বলল— কী পানীয় আনব দেব?
—কিছু না, জল খালি। বিশুদ্ধ পানীয় জল।
—উষ্ণ কিছু আনব না? হিমে এতখানি পথ এলেন!
—তিষ্যকুমার, আপনার কী অভিরুচি?
তিষ্য কিছু বলবার আগেই চণক বলল—তিষ্য, ইনি মহারাজ বিম্বিসার।
তিষ্য এতো চমকে গেছে যে সে সঙ্গে সঙ্গে তার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার মুখের বর্ণ দেখবার মতো।
সেদিকে চেয়ে মহারাজ বিম্বিসার হাত বাড়িয়ে বললেন—প্রগলভতার জন্য ক্ষমা করো আয়ুষ্মান। গম্ভীর রাজ-পরিবেশে দিন কাটাতে কাটাতে একটু চপলতার জন্য, লঘু কৌতুকের জন্য বড় তৃষ্ণা বোধ করি। চণক, ছদ্মকণ্ঠ ধারণ করতে পেরেছি তো?
তিষ্য ততক্ষণে নতজানু হয়ে নমস্কার করছে। হাত ধরে তাকে তুলে বিম্বিসার বললেন সাকেতের রাজকুমার বললে—রাজন্য উগ্রসেনের পুত্র না কি?
—হ্যাঁ, দেব—তিষ্য কোনমতে বলল।
—পিতার কোন কাজে রাজগৃহে এসেছ?
—পিতার কাজ নয়। নিজেরই আগ্রহে। ভ্রমণ করছি।
—ও, সেই সূত্রেই চণকের সঙ্গে বন্ধুত্ব? ভ্রমণ পিপাসা?
চণক বলল—মহারাজ, তিষ্যকুমার তক্ষশিলার স্নাতক। শ্রাবস্তীতে বন্ধুল মল্লর কাছেও অস্ত্রশিক্ষা করেছে। ও উচ্চ পদের যোগ্য। অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের যুবক।
—সে-কথা আমি আগেই বুঝেছি— বিম্বিসার স্মিত মুখে বললেন—এখন সোমাকে উত্তর দাও তিষ্যকুমার শীতল পানীয় খাবে না উষ্ণ কিছু?
তিষ্য বলল—যা ঘটল আজ, তাতে তীক্ষ্ণ সুরা না হলে স্বস্তি ফিরে পাবো বলে মনে হচ্ছে না।
বিম্বিসার হেসে বললেন—যাক, তিষ্য কুমারের মন ভালো হয়েছে। সোমা, তীক্ষ্ণ সুরা আননা, আমাদের আজ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে।
সোমা নম্র কণ্ঠে বলল—আমি উপস্থিত থাকতে পারি?
—অবশ্যই।
দাসীরা পানীয় নিয়ে এলো। বিবিধ খাদ্যও। চণক বলল—‘মহারাজ কি আম্রবনে উপস্থিত ছিলেন না কি?’
—‘সংবাদ এলো, অন্ত্যজ পল্লীতে অসন্তোষ। ওরা আম্রবনে ভিক্ষুদের আক্রমণ করবে। সৈনিক পাঠিয়েছিলাম কিছু। কিন্তু নিজেরও অত্যন্ত কৌতূহল ছিল।’ রাজা বললেন—‘স্বয়ং উপস্থিত থেকে দেখতে চেয়েছিলাম কী হয়।’
চণক বলল— মহারাজ, শ্রমণ মোগ্গল্লান একরূপ উত্তর দিয়ে বিদ্রোহী অন্ত্যজদের ক্ষান্ত করলেন। আমার জানতে ইচ্ছা হয় আপনার মত কী! আপনি হলে কী উত্তর দিতেন।
রাজা কিছুক্ষণ নীরবে থেকে ধীরে ধীরে বললেন—অন্ত্যজদের অভিযোগ তো সত্য চণক। সম্পূর্ণ সত্য। যাদের পুত্র-কন্যার ওই নৃশংস পরিণতি হয়েছে তারা কী করে বন্যদের ক্ষমা করবে? অথচ তথাগতর কথাও সত্য। কোথাও আমাদের পারস্পরিক হিংসার এই কর্মকাণ্ড থামাতে হবে। রাজা অন্যায়কারীর শাস্তিবিধান করতে পারেন কিন্তু তথাগত তার যে মানসিক পরিবর্তন ঘটালেন তা কি অলৌকিক নয়? তিষ্যকুমার তুমিও তো স্বচক্ষে দেখেছ, বলো!
তিষ্য দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল—‘দু পক্ষই যেখানে ঠিক, সেখানে সুবিচার করা কী ভাবে সম্ভব হবে, মহারাজ!’
—সেই কথাই ক দিন ধরে ভাবছি তিষ্যকুমার। এর পরে যখন চৌর্য, দস্যু-বৃত্তি, প্রতারণা, হত্যা ইত্যাদির জন্য শাস্তিবিধান করতে যাবো, তখন আমার অন্তরের মধ্যে তর্জনী আস্ফালন করে ওই মাতঙ্গ কি বলবে না—তোমার বিচারের পেছনে কোনও নীতি নেই রাজা, বিচার হবে সবার জন্য এক। বিচারের মানদণ্ড দুই প্রকার হয় না। …
হাতের পাত্রটি নিয়ে রাজা শুধু নাড়াচাড়া করছেন, পান করছেন না। বিষগ্ন, নীরব।
কিছুক্ষণ পর চণক বলল—‘মহারাজ, আমার মনে হচ্ছে কোথাও আপনার একটা সূক্ষ্ম ভুল হচ্ছে। সভ্য মানুষ, সামাজিক মানুষ যখন চৌর্যবৃত্তি, দস্যুবৃত্তি করে তখন জেনে শুনে করে। আপন সমাজের মানুষের প্রতি অন্যায় করে। কিন্তু বন্যরা প্রথমত সভ্য নয়, দ্বিতীয়ত তারা আমাদের ভিন্ন শ্রেণীর জীব বলে মনে করে। শুনলেন না ওই যক্ষী কী বলছিল? আমরা ওদের বন নিয়ে নিয়েছি। বনের পশু মেরে শেষ করে দিয়েছি। ভিক্ষা চাইতে এলে দ্বার বন্ধ করে দিই। … ওদের জয় করতে হলে, ওদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করতে হলে আপনার দিক থেকে ওদের ভয় ভাঙতে হবে, বিদ্বেষ দূর করার চেষ্টা করতে হবে।’…
তিষ্য বলল—চণক ভদ্র, আপনি তো শ্ৰমণ মোগ্গল্লানের মতো বলছেন অবিকল।
চণক বলল—এ-ও হতে পারে তিষ্য ওই শ্ৰমণ চণকের মতো করে ভাবেন। অবিকল। চণক পুনরাবৃত্তি করছে না। চিন্তার এই সূত্র চণকের মনের মধ্যে কিছুকাল থেকেই ঘোরাফেরা করছে। তবে চণক ওঁর মতো মানুষকে অভিভূত করবার ক্ষমতা রাখে না।
—দৈবরাত চণক প্রথম থেকেই বন্যদের পক্ষে রাজা লঘু গলায় বললেন। তারপর তিষ্যর দিকে ফিরে বললেন—তিষ্যকুমার, এই যে আজ বন্যদের জয় করতে গিয়ে অন্ত্যজদের অসন্তুষ্ট করতে হল, তথাগত বুদ্ধর কথাকে মান দিতে গিয়ে প্রজাদের ন্যায্য অভিযোগের মীমাংসা করতে পারলাম না, এর ফল কী হতে পারে, মনে করো? তুমিও তো দণ্ডনীতি বোঝো।
তিষ্য বলল—শ্রমণ মোগ্গল্লান তো ওদের বুঝিয়ে দিয়েছেন মহারাজ। ওদের শিশুগুলি সব মহাত্মা ছিল, ভবচক্র থেকে মুক্তি পেয়েছে। চণকভদ্র আমায় বলছিলেন এই-ই হল কূটনীতির পরাকাষ্ঠা। হার্দ্য কূটনীতি।
চণকের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন বিম্বিসার। চণক বলল—হ্যাঁ মহারাজ, আমি তিষ্যকে উন্নত ধরনের কূটনীতির তত্ত্ব ব্যাখ্যা করছিলাম যা হৃদয়ের যথার্থ মৈত্রী ভাবনা থেকে উৎপন্ন হয়। আমি যে চক্রবর্তী রাজার কল্পনা করি তাঁর কূটনীতি হবে গভীরতম মানবধর্ম থেকে উৎসারিত। সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার অস্ত্র নয়।
মহারাজ একটু বিষগ্ন হাসলেন, বললেন—আচার্যপুত্র, আজ দেখি তথাগতর দেশনা আর তোমার রাজনীতির তত্ত্ব কোথাও মিলে যাচ্ছে। আমি হয়ত উভয়কেই অনুসরণ করে দেখব। আমার বিবেক তাই বলে। কিন্তু লোকচরিত্রে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার অধিকারে বলছি অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ প্রজার প্রশ্নহীন ভক্তি, আনুগত্য ভালোবাসা আমি ধীরে ধীরে হারাতে থাকবো। তথাগত এবং তাঁর সংঘের ভিক্ষুদের মতো মানুষকে অভিভূত করার সাধ্য আমারও নেই।
সোমা এই সময়ে মৃদুস্বরে বলল—মহারাজের জয় হবে।
চণক বলল—অন্ততপক্ষে তার জন্য চেষ্টা তো করতে হবে।
তিষ্য সহসা অসংলগ্নভাবে বলল—মহারাজ, আমি প্রস্তুত।
বিম্বিসার অন্যমনস্ক ছিলেন, চমকে মুখ তুলে বললেন—তোমরা সবাই আমার শুভার্থী? বাঃ। তিষ্যকুমার, তুমি কিসের জন্য প্রস্তুত?
—আপনার যাতে জয় হয়, তা করতে মহারাজ!
বিম্বিসার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—তাহলে তিষ্য তোমায় যদি শ্রাবস্তীতে কিছুকালের জন্য পাঠাই, মগধের রাজপ্রতিনিধি বলে! আপত্তি আছে?
তিষ্যর মুখের ওপর দিয়ে যেন একটা ছায়া সরে গেল। একটু পরে সে বলল—দূত?
দূত নয়। রাজপ্রতিনিধি। তোমার কী করণীয় হবে রাজপুরীতে কূটকক্ষে বিশদ আলোচনা করব আগামী কাল। পরে এভাবেই তোমায় যেতে হবে অবন্তী, কৌশাম্বী, ইন্দ্রপ্রস্থ।
মহারাজ বিদায় নিয়ে চলে গেলে চণক উদ্বিগ্ন হয়ে বলল— তিষ্য, তোমার যে দক্ষিণ দেশে যাবার আকাঙ্ক্ষা, সে-কথা মহারাজকে বললে না কেন? সহসা আবেগের বশে এ কী করলে?
সোমা উৎকণ্ঠ চোখে তাকিয়ে ছিল। কিছু বলছিল না। তিষ্য ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বলল—চণকভদ্র, দক্ষিণ দেশে রাজ্যস্থাপন করার প্রসঙ্গ তুলে আমায় আর লজ্জা দেবেন না। কিছুই জানি না, কোনও অভিজ্ঞতা নেই। লোকবল নেই। স্বপ্ন দেখি শুধু। আপনার মতো চিন্তক, ভদ্রা জিতসোমার মতো বিদুষী, মহারাজ বিম্বিসারের মতো কুশলী মহাপ্রাণ রাজা, আর ওই শ্ৰমণদের মতো অলৌকিক প্রভাবসম্পন্ন মানুষদের সংস্পর্শে এসে বুঝতে পেরেছি আমাকে প্রস্তুত হতে হবে। নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তারপর যদি সময় থাকে … যদি অর্জন করতে পারি কিছু … তাহলে … তখন দেখা যাবে।
সে দুজনকে নমস্কার করে বিদায় নিয়ে চলে গেল। যেন স্বপ্নচালিতবৎ।
২৮
হিম ঋতুর শান্ত ভোরবেলা। কুজ্ঝটিকায় আবৃত চারিদিক। শ্রাবস্তী নগরী যেন জলের তলার নগরী। পাতালপুরী। রাজগৃহ বা সাকেতের মতো পরিকল্পিত নগরী নয় শ্রাবস্তী। ঠিক শ্ৰেষ্ঠী-পল্লী বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু এখানে নেই। মিগারের ত্রিতল প্রাসাদ ও বিশাখার বিবাহ-যৌতুকের দ্বিতল বিলাসগৃহটি যে সুন্দর কাননের মধ্যে অবস্থিত, তার আশেপাশে আর কোনও ধনীগৃহ নেই। আছে কিছু একতল ইষ্টক নির্মিত বা দারুময় গৃহ। উচ্চতায় বা গঠন সৌকর্যে আভিজাত্যের গর্ব করতে পারে না। কিন্তু প্রাঙ্গণ, কক্ষ, অন্তঃপুর, বাহিবাটি মিলিয়ে প্রায় প্রত্যেকটিই অনেকটা স্থান নিয়ে আছে। বিশৃঙ্খলভাবে। যখন যেমন প্রয়োজন হয়েছে, ঘর তোলা হয়েছে। বিশাখা এরূপ দৃশ্যে অভ্যস্ত নয়। সৌন্দর্য, সুষমা, শালীনতা এগুলিতে তার চোখ, কান, মন এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, কুশ্রী কিছু দেখলে, শুনলে, সঙ্গে সঙ্গে তার মনে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তার গৃহটি কাননের এক প্রান্তে হওয়ায়, বাতায়ন ও অলিন্দ থেকে সে বাইরের দৃশ্য, অন্যান্য গৃহের অন্তরঙ্গ দৃশ্যও দেখতে পায়।
ও পাশের গৃহটির অঙ্গনে দাসীর সঙ্গে গৃহিণীর তুমুল কোন্দল লেগে যায়, যখন তখন। চাল ঝাড়া, মণ্ড প্রস্তুত করা, শস্য শুকোনো সবই ওই অঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। গভীর রাতে ঘুম না এলে এই অলিন্দ থেকে সে ওই অঙ্গনে নরনারীর সঙ্গম দৃশ্যও দেখেছে। খুব সম্ভব দাসী ও প্রভুপুত্র। দাসী ও বর্ষীয়ান প্রভুটিও হতে পারেন। এ ছাড়াও এ পল্লী খানিকটা নির্জন বলে কাছাকাছি কোনও কাননে বোধহয় প্রণয়ীরা মিলিত হয়। পথ দিয়ে নীলকৃষ্ণ বসন-পরা মাথায় অবগুণ্ঠন দেওয়া অভিসারিকা রমণীদের দ্রুত চলে যেতে দেখা যায়। তাদের প্রণয়ীরাও যায় পায়ে হেঁটে। এরা সব সময়ে তরুণ-তরুণী হয় না। তার বাতায়নের তলায় কাননপ্রান্তে একদিন সে চুম্বনরত এক প্রণয়ী-যুগলকে দেখতে পায়। পুরুষটি প্রৌঢ়। নারীটি কোন শ্রেণীর তা সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু সে বিবাহিত। চুম্বনের ফাঁকে ফাঁকে সে নিজ পতির মুণ্ডপাত করছিল। মিগারের গৃহেও এর কোনও ব্যতিক্রম নেই। মিত্তবিন্দ নামে যে সূতটি কাকে প্রণয় নিবেদন করেছিল এখন দেখা যাচ্ছে সে। আরও অনেককেই অনুরূপ কথা বলেছে। কহ্না আঘাত পেয়েছে। ধনঞ্জয়-গৃহে আজন্ম লালিত সে। বিশাখার সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে তাদের সবার রুচিই খানিকটা বিশাখার মতো হয়ে গেছে। কহ্না মিত্তবিন্দকে রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তা সত্ত্বেও লোকটি যখন-তখন কাকে বিরক্ত করে। এ সব কথা গৃহকতার কানে তুললে মিত্তবিন্দর কপালে দুঃখ আছে। তাই কহ্না বা বিশাখা নিজে কিছুই বলে না। মিগার ও তাঁর গৃহিণী দাস-দাসীদের ওপর নির্মম। যদি শাস্তি দেবেন মনে করেন, তবে কঠোর শাস্তিই দেবেন।
শ্রাবস্তীতে পচন ধরেছে। পচে গেছে নগরীটি। বিশাখা কুজ্ঝটিকাগ্রস্ত পথ-ঘাট গৃহ-প্রাঙ্গণ কানন ইত্যাদির দিকে চেয়ে মনে মনে বলে— কোশল, কোশল দেশটাই পচে গেছে। তার বালিকাকালের সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা মনে হয়। সে দেশে দেশে ভ্রমণ করতে চেয়েছিল। বাল্যকাল সম্ভবত দর্পণের মতো। তখনই সঠিক চিন্তা সঠিক আকাঙ্ক্ষাগুলির প্রতিবিম্ব পড়ে মনোভূমিতে। বাল্যকালে তো কেউ পুরুষ অথবা নারী থাকে না, সেই সময়টাই শ্রেষ্ঠ সময়। তবে কি সে পুরুষ হতে পারেনি বলে দুঃখ বোধ করে? তাও তো নয়! পুরুষ মাত্রেই কেমন রুক্ষ, কর্কশ, ব্যাভিচারী, অমার্জিত। সে পুরুষ হয়নি বলে তার দুঃখ নেই। দুঃখ একটাই। তার ভেতরে সে বিপুল শক্তির নড়াচড়া টের পায়। কর্মৈষণা। কর্মের ক্ষমতা। রাজদণ্ড হাতে রাজ্যশাসন করতে পারলে হয়তো সে তৃপ্ত হত। কুমার কুনিয়র রানী নয়, দেবী মল্লিকার মতোও নয়। সে মহারাজ বিম্বিসারের মতো সভা ডেকে, প্রজানিচয়ের মঙ্গলবিধান করবে, সীমান্ত-দস্যুদের দমন করবে, ভিন্ন দেশের রাজদূতদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দণ্ডনীতির বিষয়ে আলোচনা করবে, কূটগৃহে মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করবে। এর সুযোগ, অত্যন্ত ক্ষীণ হলেও সুযোগ একটা এসেছিল, একটা নয় দুটো। তিষ্যর মাধ্যমে, এবং কুমার কুনিয়র সঙ্গে বিবাহের সম্ভাবনায়। কিন্তু বিশাখা তখন মনে মনে প্রণয়ভিক্ষু ছিল। সে জানতো না, প্রণয় বলে কিছু নেই। কিছু থাকবে না। আবেগের মোহন আবরণে ঢাকা দেহ-কামনাকেই লোকে প্রণয় বলে।
সে যদি পিতার মতো শ্রেষ্ঠী হতো? বিবাহ না করলেই সে তা হতে পারতো। পিতা তো তাকে শেখাচ্ছিলেনই! মায়ের যে দুঃসাহসিক বাণিজ্য যাত্রার কথা সে শুনেছে, সেইভাবে সেও যেতে। দেশে দেশে, অশ্বপৃষ্ঠে, জলযানে, যাতায়াত করত। গৃহে ফিরে ছোট বণিকদের গোষ্ঠী পরিচালনা করতো। না হয় অমাজুরা, জরৎকুমারী বলতো লোকে, নিন্দা করতে আড়ালে। সে পেত এমন জীবন, যা কর্মে পরিপূর্ণ, অর্থপূর্ণ কর্মে। সর্বোপরি নিজের জীবনটি তার নিজের হাতেই থাকত। কিন্তু একবারও তার এসব কথা তখন মনে হয়নি। বিবাহ যেন রক্তের মধ্যে সংস্কার হয়ে ঢুকে ছিল। উপরন্তু, তার হৃদয় ছিল প্রণয়ের জন্য উন্মুখ! এখন সে কী করবে?
তা হলে কি সে নারী বলেই এই নিয়তি তাকে মেনে নিতে হবে? নারী হলেও সে যে মিগার-পত্নী, এমনকি তার সখী সুপ্পিয়ার মতোও নারী নয়। তার রক্তে যে দেবী সুমনার উত্তরাধিকার। সে এই সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে আছে, কিংবা পিছিয়ে আছে কী? মা সুমনা, পিতামহী পদ্মাবতী তাকে, তাদের কাহিনী শোনাতেন সব নারী যোদ্ধার—মুদগলিনী, বিশ্পলা বধ্রিমতী শশীয়সী…। আরও কাহিনী শুনেছে সে ঋষি বাক্, ঋষি সূর্যার, মহাবিদুষী গার্গী কীভাবে বাজসনেয় যাজ্ঞবল্ক্যর সঙ্গে বিদেহ রাজসভায় ব্রহ্মবাদ নিয়ে তর্ক করেছিলেন। ঠিক যে নারী যোদ্ধা অথবা ব্রহ্মবাদিনী হওয়ার দিকেই তার ঝোঁক তা-ও বলা যায় না। বিশাখা তার নীলকৃষ্ণ কেশগুচ্ছ হাতে নিয়ে তদগত হয়ে যায়। এই কেশ সে বড় ভালোবাসে। ভালোবাসে এই অনুপম হাতগুলি, হাতের অগ্রভাগে আধ-ফোটা পদ্মকলির মতো হাতের পাতা আর আঙুলগুলি। বস্তুত তার অতুলনীয় সৌন্দর্য বিশাখার জীবনের গভীর আনন্দ, আত্মপ্রত্যয় ও প্রসন্নতার একটি উৎস। সে কখনও এই সৌন্দর্যকে তুচ্ছ বলে মনে করেনি। এ যে দেবতাদের দান, এক অমূল্য আশীর্বাদ এবং বিশেষ সুবিধা তার জীবনে তা প্রতিদিন অনুভব করে সে। সে কি গর্বিত? নিজেকেই নিজে জিজ্ঞাসা করে বিশাখা। না, ঠিক গর্ব নয়। বিশিষ্ট হবার অহঙ্কার কী? না, বোধ হয় তাও না। তা হলে? তা হলে? প্রকৃত কথা, দৈহিক সৌন্দর্য তার মানসিক গঠন, গুণাবলী, চরিত্র এ সবের সঙ্গে এমন খাপ খেয়ে গেছে যে, সর্বদা এই সৌন্দর্য সম্পর্কে মোটেই সচেতন থাকে না সে। আজ এখন কুয়াশায় ভরা ভোর বেলাতে যখন পৃথিবী শান্ত, পাখিদের ঘুম-ভাঙা স্বর সবে শোনা যেতে আরম্ভ করেছে তখন সহসা নিজের আঙুলগুলির দিকে চোখ পড়ে, মনে পড়ে যায় তার কেশও ঠিক অমনি সুন্দর। চোখগুলিও। হাত, পা, সমস্ত অবয়বই কী সুন্দর! বিশাখার মনে হয় সে বোধহয় স্বয়ংসম্পূর্ণ। পুণ্যবর্ধন যে তার মনোমতো, তার যোগ্য পতি হল না, এ দুঃখকে সে আর প্রশ্রয় দেয় না। প্রথমটা একটা তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তা যতটা দুঃখে তার চেয়েও বেশি অপমানে। সে পিতা-মাতার জন্য, সাকেতের জন্য, বিবাহ-পূর্ব জীবনের স্বস্তি ও শান্তি, আদর ও স্নেহের জন্য আকুল হয়ে কেঁদেছিল। কিন্তু সেই ভয়ংকর রাতেই বোধ হয় বিশাখার কৈশোরের ওপর পূর্ণচ্ছেদ পড়ে গেছে। পুরনো বিশাখার ভস্ম-স্তূপের মধ্য থেকে নতুন বিশাখা দাঁড়িয়ে উঠেছে। তার চারপাশ থেকে আরক্ষার স্নেহচক্রগুলি যত খসে পড়ছে, ততই একা হয়ে যাচ্ছে সে। ততই যেন তার নিজস্ব শক্তি আবিষ্কার করছে সে। বিশাখা স্বভাবে নেত্রী। যোদ্ধ্রী। কিন্তু যুদ্ধ তো শুধু রণক্ষেত্রে হয় না!
তার প্রথম জয় হল পুণ্যবর্ধনের পলায়ন। পুণ্যবর্ধনের কথা ভাবলে এখন বিশাখার আর রাগ হয়, হাসি পায়। ভীরু। মায়ের আদরের পুত্ত হতে পারে, কিন্তু মাকে ভয় পায়, পিতাকে তো পায়ই। এখন, পত্নীকেও ভয় পাচ্ছে। হতভাগ্য মানুষটির কোনও চরিত্রই গড়ে ওঠেনি। বারাণসীতে গুরুগৃহে গিয়ে কী শিখে এসেছে, শঙ্কুদেবই জানেন! কুসঙ্গে পড়ে আর অর্থহীন প্রশ্রয়ে দাসেরও অধম হয়ে গেছে। বিশাখাকে অল্পবয়সী ও সুকুমারী দেখে পৌরুষ দেখাতে গিয়েছিল। যখন ছিটকে শয্যায় পড়ে গেল! কী হতবুদ্ধিই না হয়ে গিয়েছিল! বিশাখার ক্রোধেরও যোগ্য নয়। দু দিন আর গৃহে ফেরেইনি। তৃতীয় দিনে এলো। সন্ধ্যাবেলায় ময়ূরীকে ডেকে বলল, তোমার স্বামিনীকে বলল, আমি উপার্জন করতে বিদেশ যাচ্ছি।’
মিগার প্রায়ই বলছেন এতদিনে পুত্তটার সুবুদ্ধি হয়েছে। তার শ্বশ্রূও আহ্লাদিত। বিশাখা ঘটনাটি পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। যদি পুণ্যবর্ধন শুধু চলেই যেত, তা হলে মনে হতো, সে রাগ করেছে। বিশাখার সঙ্গে আর বসবাস করতে চায় না। কিন্তু বলে চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে, হতভাগ্য তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করছে। উপার্জন করতে যাচ্ছে বলে গেল, অর্থাৎ সে তার পুরনো অলস, বিলাসী জীবন ত্যাগ করে নতুন কিছু করতে চায়, বিশাখার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করার এটাই এখন একমাত্র পন্থা মনে করেছে। মুখোমুখি হল না। হয়তো একটু অভিমানও আছে। যাই হোক, আপাতত এই লোকটি এ গৃহ থেকে চলে যাওয়ায় সে স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু যতই উপার্জন করুক, আর অলস জীবন ত্যাগ করুক পুণ্যবর্ধন কি কোনওদিন শ্রদ্ধার যোগ্য হয়ে উঠতে পারবে? পচে গেছে। এই শ্রাবস্তীর মতো, এই কোশলরাজ্যের মতে, এই সমাজের মতো পুণ্যবর্ধন একেবারে পচে গেছে। ইদানীং এখানে এই প্রকার নরনারীই দেখা যাচ্ছে। এই পচা-গলা কুৎসিত মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষটিকে কি সে কোনওদিন স্বীকার করতে পারবে? যাক, আপাতত সে অনুপস্থিত। তাই সমস্যাটাও নেই।
কিন্তু বিশাখা আরও যুদ্ধ জয় করেছে। সে বহুজনের সামনে নিজেকে নিরপরাধ এবং মিগার শ্ৰেষ্ঠীকে ভুল, প্রমাণ করতে পেরেছে। সে মিগার-পত্নীকেও জয় করতে পেরেছে। সেই বিচার-সভার দিন থেকে কোনও রহস্যময় কারণে তার শ্বশ্রূ তাকে অত্যন্ত সমাদর করছেন। মাঝে মাঝেই বলেন— সদ্য সদ্য বধূ ঘরে নিয়ে এসে তার অপরাধের বিচার করবার জন্য সভা না বসালেই চলছিল না? নিজেকেই অপদস্থ হতে হলো তো! ভালো হলো। গহপতি এবার বুঝুন। তাঁর কথাই শেষ কথা নয়।
আবার কখনও কখনও বিশাখাকে ডেকে বলেন— নিগ্গণ্ঠদের তিরস্কার করে ভালো করেছে। বিশাখা। গহপতির ঘরে ভোজ্য-খজ্জ খেয়ে, উদর পুরে, কতকগুলি নীরস, অর্থহীন কথা বলে যাবে— সবাইকে হাত জোড় করে তদ্গত হয়ে শুনতে হবে। কেন? সবার যদি ভালো না লাগে? কী ভাবে কর্তৃত্ব করে আবার নগ্ন সমনগুলি। ঘরে এসেই দর্প প্রকাশ করবে। আমরা এই তপস্যা করি, সেই তপস্যা করি। বলি, মুখে বস্ত্রখণ্ড বেঁধে রাখলে কী হবে, ছেঁকে জল খেলেই বা কী হবে, বাতাসে যদি কীট কীটাণু থাকে তা হলে যখন ভোজন করছেন, তখনও তো সেগুলি মুখের মধ্যে ঢুকছে, না কী? সব শঠ, প্রবঞ্চক! বিশাখা ওগুলিকে তাড়াও, তাড়িয়ে ছাড়ো। বোঝা যাচ্ছে মিগারপত্নী দীর্ঘদিন ধরে নির্গ্রন্থদের নিয়ে মিগারের বাড়াবাড়ি ভক্তি ভালো মনে করেননি। সববিষয়েই কর্তার ইচ্ছা মেনে চলাও তাঁর মনোমত ছিল না।
আজ সশিষ্য বুদ্ধ তথাগত আসবেন। মিগার তাঁর কথা রেখেছেন। নির্মীয়মাণ জেতবন বিহারে গিয়ে বুদ্ধ এবং তাঁর সংঘকে নিমন্ত্রণ করে এসেছেন। তবে এখন বর্ষাবাসের সময় তো নয়। সংঘের ভিক্ষুরা এখন মধ্যদেশের নানান স্থানে ছড়িয়ে আছেন। বুদ্ধ ভগবান নিজেও অল্প দু-এক দিন হল শ্রাবস্তীতে এসেছেন। আবার শীঘ্রই বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা। জনা দশেক ভিক্ষু নিয়ে তিনি আসবেন। বিশাখার নিজ গৃহের ভোজনশালায় তাঁদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়েছে। বিশাখা বলেনি কিছু! মিগার নিজেই বললেন— ‘তোমার আগ্রহেই নিমন্ত্রণ। বিসাখা, তোমার গৃহেই আয়োজন করো।’ ভালো। বিশাখা তাই করবে। তাই করেছে।
ভোজনশালাটাকে ঘষে মেজে তকতকে করেছে তার দাস-দাসীরা মিলে। সমস্ত গৃহটিই মার্জনা করা হয়েছে। কিন্তু ভোজনশালাটি বিশেষ করে। দু-তিন দিন ধরে অনবরত চন্দনচুর্ণ পুড়িয়ে ঘরটি সুগন্ধ করা হয়েছে। রন্ধনগৃহে যাবার দ্বারে গৈরিক বস্ত্রাবরণী। বড় বড় অশ্বত্থ পাতায় শিউলি ফুল দিয়ে সুন্দর সুন্দর অলঙ্করণ রচনা করেছে তার সইয়েরা। সেগুলি কক্ষপ্রাচীরে বসানো হয়েছে। উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎ-কলসে আম্রপল্লবের, কুমুদ কহ্লারের সজ্জা। বসবার আসনগুলি স্থূল কোমল কম্বলের। তার ওপর গৈরিক রেশমের আচ্ছাদন। ভোজন ফলকগুলি সব চন্দনকাঠের। পায়া-অলা। সব নতুন নির্মিত হয়েছে বিশাখার নির্দেশ অনুযায়ী। গজদন্ত বর্ণের কাসিক বস্ত্রের ওপর বিশাখা সেই অশ্বথবৃক্ষের চিত্র লিখেছে, যে বৃক্ষের তলায় গৌতম বোধিলাভ করেছিলেন। চিত্রট কক্ষের মাঝখানের প্রাচীরে প্রলম্বিত আছে।
দুই গৃহের মধ্যবর্তী অঙ্গনটিও আজ দু-তিন দিন ধরে বহু পরিশ্রম করে মাজা-ঘষা হয়েছে। সেখানে একটি আম গাছের মূলে নাতি-উচ্চ বেদী নির্মিত হয়েছে।
প্রাঙ্গণটি সুন্দর সব অঙ্গদেশীয় নলপট্টিকায় ঢাকা। বড় বড় মৃৎপাত্রে তুষের আগুন রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে। ভিক্ষু সংঘ আসবার কিছুক্ষণ আগে থেকেই তাতে চন্দনচূর্ণ ছড়ানো হবে।
বিশাখা এখন নিশ্চিন্ত, পরিতৃপ্ত। পরিমার্জন, চিত্ৰণ বিশেষত চন্দনচূর্ণের কল্যাণে তার গৃহের বাতাবরণ থেকে আজ সমস্ত অপ্রসন্নতা, অপবিত্রতা, হতাশার গ্লানি দূর হয়ে গেছে। কোনও উদ্বেগ নেই, আছে একটি শান্ত প্রতীক্ষা। ভদ্দিয়তে সেই সাত আট বছর বয়সের পর সে আর বুদ্ধ ভগবানকে দেখেনি। তাঁর সম্পর্কে তার ভক্তির চেয়েও কৌতূহল বেশি। অল্প বয়সে তখন বুঝতে না। অভিভূত হবারই বয়স সেটা। কিন্তু পরে সে দেখেছে তার পিতা ধনঞ্জয়, মাতা সুমনা এঁরা কেউই ঠিক যাকে বলে ভক্তি গদ্গদ্— তা হননি। তাঁরা নোকাচার পালন করেন, পারিবারিক বিধি পালন করেন, বুদ্ধের উপদেশগুলিকে বিচার করে যা নেবার নেন, অবশিষ্ট সম্পর্কে নীরবে থাকেন। অর্থাৎ সবার ওপরে কাজ করে তাঁদের নিজেদের বিচার বুদ্ধি, মন। বিশাখাও সেই রীতিতেই চলতে অভাস্ত। তারও বিচার বুদ্ধি অত্যন্ত প্রখর। সে যে কী পাবার আশায় বুদ্ধ-সংঘকে নিমন্ত্রণ করে আনিয়েছে, তা তার কাছে স্পষ্ট নয়। ভক্তি নয়, স্মৃতি, বাল্যস্মৃতির ঘোর। সমর্পণ নয়, শ্রদ্ধা। আবেগ নয়, সন্ধিৎসাই খুব সম্ভব আজ তার এই নিমন্ত্রণের পেছনে কাজ করছে।
ধনপালী তাকে স্নানের জন্য তাড়া দিতে এসেছে। তার এই তিন সই আজ দারুণ উত্তেজিত। তাদের উত্তেজনার কারণ অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন। প্রথমত তারা সকলেই শুনেছে এই বুদ্ধ ভগবান অসাধারণ সুদর্শন। এখন তাঁর চল্লিশের যথেষ্ট ওপর বয়স হয়েছে, কিন্তু দেখায় নাকি তরুণের মতো। এই সুন্দর পুরুষটি কেমন সুন্দর— এই তাদের প্রধান কৌতূহলের বিষয়।
ময়ূরী ঘোষণা করেছে— দেখিস, যতটা লোকে বলে ততটা নয়। সব কিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা লোকের স্বভাব।
ধনপালীর মত— বজ্জিদের মতো সুন্দর তো কেউ নয়। কিন্তু ওই নাতপুত্ত? উনি তো বজ্জি। উনি কি সুন্দর? একটুও নয়। তবে? বুদ্ধ তথাগতও এক প্রৌঢ় সন্ন্যাসী ব্যতীত আর কিছু না। কহ্নার কৌতূহল— শোনা যায় এঁর দেহে বত্রিশটি মহাপুরুষ-লক্ষণ আছে। সে ওই লক্ষণগুলি গুনে গেঁথে দেখতে চায়।
ময়ূরী তাতে বলে— তুই কি তবে বুদ্ধ ভগবানকে মুখ হাঁ করতে বলবি? চল্লিশটা দাঁত আছে কি দেখবার জন্য?
সবাই তাতে হাসতে আরম্ভ করলে ময়ূরী বলে— অন্যগুলি দেখব। কত দীর্ঘ হাত। মাথায় সহজাত উষ্ণীষ আছে কিনা। দেহ-ত্বকে সত্যি সত্যি ধুলো লাগলে ঝরে যায় কিনা!
তখন আবার ময়ূরী বলে— তুই কি ওঁর গায়ে ধুলো ছুঁড়ে দেখবি? কহ্না কিছু বলে না! মৃদু মৃদু হাসে।
বিশাখা তাইতে সাবধান করে দিয়েছে ওদের— কোনও অভদ্র আচরণ ওরা যেন আবার করে না। ফেলে।
স্বামিনীর দেহটি নবনী ও হরিদ্রার অবলেপ্য দিয়ে বেশ করে মাজবার পর এবার ওরা তাকে পীঠিকায় বসিয়ে কলসে করে দুগ্ধমিশ্রিত জল ঢালছে। বিশাখার চুলগুলি এখন চুড়ো করে বাঁধা। দধি এবং ভেষজ দিয়ে আগেই তাদের পরিষ্কার করা হয়েছে। কোমল ক্ষার মৃত্তিকা দিয়ে এবার সর্বাঙ্গ লেপে দিল ধনপালী। চন্দন জল ঢালল তারপর। সবশেষে পরিষ্কার কাকচক্ষুর মতো নির্মল জল দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব ধোয়া হল। এবার অতি কোমল মার্জনী বস্ত্র দিয়ে মুছিয়ে দেবার পর চন্দনের পাপড়ির মতো কোমল, পদ্মবর্ণ দেহত্বক দেখা দিল, আরও উজ্জ্বল, আরও কান্তিমান।
চুলগুলি মেলে দিয়েছে বিশাখা। জ্বালা হয়েছে সুগন্ধি ধূপ। ব্যজনী দিয়ে বাতাস করছে ময়ূরী। ধনপালী সেগুলিকে খুলে মেলে মেলে দিচ্ছে। কহ্না বস্ত্র বার করেছে পেটিকা থেকে। লঘুভার সূক্ষ্ম চম্পক বর্ণের দুকূল। বার করে কহ্না বলল— ভদ্দা, এই বর্ণ কিন্তু কাষায়বর্ণের কাছাকাছি। সমনরা আবার এই দেখে তোমাকে পব্বজ্জা দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠ্বেন না তো?
বিশাখা বলল— কেন? যদি নিই-ই পব্বজ্জা!
অমনি তিন সই ছুটে এসে বিশাখার দুই পা, দুই হাত নিজেদের হাত দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলল।
—কী করিস? কী করিস? —বিশাখা হাসতে থাকে।
কহ্না দৌড়ে গিয়ে চম্পকবর্ণের দুকূলটি তুলে ফেলল। —না, এই বসন তুমি আজকে পরবে না ভদ্দা। আমরা তোমার বেশকারিণী, আমরা যা বলব তাই শুনতে হবে। সই বলো না আমাদের?
—সে একটি আকাশের মতো নীল, অথচ সকালের রোদের মতো স্নিগ্ধোজ্জ্বল বসন বার করে।
বিশাখা সেদিকে এবার তাকিয়ে বলে— যদি তথাগত মনে করেন আমি রূপগর্বিত! দেবী ক্ষেমার মতো আমার অবস্থা করেন যদি! এই নীল দুকূলে বড় বেশি সজ্জিত লাগে আমাকে।
ধনপালী বলল— সজ্জিত বলো না, সুন্দর বলো। তা কোন বর্ণে তোমাকে অসুন্দর দেখাবে বলো তো! বলে দাও! সেটাই বার করি।
বিসাখা বলল— শ্বেতবর্ণ দে।
ময়ূরী বলল— শ্বেতবর্ণে তোমাকে পূজনীয়া দেবীর মতো লাগে। বেশ তাই ইচ্ছা হয় তাই পরো, কিন্তু ভিক্ষুরা ভক্তি গদগদ হয়ে প্রণাম করলে আমরা জানি না।
বিশাখা র্ভৎসনা করে বলল— ছি ময়ূরি, এত অহংকার ভালো না। যাঁরা নির্বাণ পথের পথিক তাঁদের কাছে সুন্দরী ও বানরীতে কোনও পার্থক্য থাকে না।
—তুমি কী করে জানলে?
—আমি ঠিক জানি। শ্বেত দুকূলটি কটিতে বাঁধতে বাঁধতে বিশাখা বলল। শ্বেত নীবিবন্ধে বাঁধা পড়ল বসনটি। ঊর্ধ্বাঙ্গে শ্বেত ঊর্ণার উত্তরীয় ভালোভবে জড়িয়ে নিল বিশাখা! সর্বশ্বেত। শুধু তার স্তনপট্টের শ্যামল বর্ণ উত্তরীয়ের মধ্য দিয়ে আভাসিত হতে লাগল।
এই ভাবেই রন্ধনগৃহে গেল সে। ভিক্ষুদের জন্য পায়স ও অপূপ নিজ হাতে প্রস্তুত করল। উডুম্বর, অলাবু, কুষ্মাণ্ড, বতিঙ্গণ সৌভঞ্জন বিভিন্ন শাক ও মেথিকা পলঙ্ক্য ইত্যাদি পর্ণ দিয়ে সুস্বাদু ব্যঞ্জন প্রস্তুত হয়েছে। উত্তম ঘৃতৌদন, তিলৌদন, দধি, মিষ্টান্ন। ঘৃত, নবনীত, গুড়, সুবৃহৎ সুমিষ্ট কদলী।
মিগার-পত্নী এসে আয়োজন দেখে প্রশংসা করলেন। বললেন— এই দশবলকে দেখতে আমি বড় উৎসুক রয়েছি বিসাখা! ইনি মহারাজ প্রসেনজিৎকে পর্যন্ত বশ করেছেন।
মধ্যাহ্ন সমাগত। পুরনারীরা সবাই সমবেত। বিশাখা মিগার সেট্ঠিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। অবশেষে তার একজন দাস এসে জানাল, মিগারকে তাঁর গৃহের পেছন দিককার কাননে নিগ্গণ্ঠ শ্ৰমণদের সঙ্গে আলাপ করতে দেখা গেছে। নিগ্গণ্ঠরা নাকি দলে দলে এসে মিগারকে তাঁর কর্মকক্ষ থেকে এক প্রকার তুলে নিয়ে গেছেন। দাসটি এসে বলল— প্রভু বললেন, বধূই নিমন্ত্রণ করে এনেছে। বধূর গৃহেই ভোজনের আয়োজন হয়েছে, বধূই ভিক্ষুদের আপ্যায়ন করুক। তিনি কাজে ব্যস্ত আছেন।
এমন সময়ে ময়ূরী এসে সংবাদ দিল দেখো, দেখো, সমনেরা আসছেন! ধনপালী ও কহ্না তাড়াতাড়ি শাঁখে ফুঁ দিল। বিশাখা তার গৃহের উন্মুক্ত সুসজ্জিত দ্বারদেশের সামনে বদ্ধাঞ্জলি হয়ে দাঁড়াল।
খর রোদে কাষায় চীবরগুলির ওপর যেন আগুন লেগেছে। চোখ ঝলসে যাচ্ছে। শীতসকালের আকাশপটে ছড়িয়ে থাকা ময়ুখসমূহই কি সংহত হয়ে শ্রাবস্তীর পথে নামল নাকি? পার হয়ে আসছে মিগার-গৃহের দ্বার, কানন, বিশাখার পরিমার্জিত, সজ্জিত প্রাঙ্গণে ঢুকবে বলে? নাকি এগুলি সেই হব্যবাহন অগ্নির শিখা সমুদয়, যে অগ্নির সেবা করতে বিশাখা অস্বীকৃত হয়েছিল? বিশাখা অদ্ভুত এক সম্মোহে, দৃষ্টিবিভ্রমে দেখে আগুনের শিখাগুলি কাঁপছে—লেলিহান নয়, তাই ভয় জাগায় না, কিন্তু জ্বলছে। দীপ্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে, ওই এবার কাননে প্রবেশ করলো। জ্বলছে, অথচ দাহ নেই তো! চোখ ঝলসে দিল দীপ্তিতে, দাহে নয়। কানন পার হয়ে যখন তার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলো তখন সে সবিস্ময়ে উপলব্ধি করল, এ আগুন, শীতল আগুন। তার চিত্তের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোণগুলিতে প্রবিষ্ট হচ্ছে এ আগুনের শীতল ভাস্বর শান্তি। গুনগুন করে কোনও সূক্ত বলতে বলতে সারিবদ্ধভাবে আসছেন ওঁরা। প্রত্যেকের দেহদণ্ড কাষায় চীবরে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছাদিত, পরিষ্কার মুণ্ডিত মস্তকগুলি দেহদণ্ডের ওপর দীপের মতো শোভা পাচ্ছে, চলার কী অনুপম ছন্দ! যেন কোনও অদৃশ্য মৃদঙ্গের তালে তাল মিলিয়ে ওঁরা আসছেন। আরও নিকটবর্তী হলে সে সেই মৃদঙ্গের ধ্বনিগুলি, বাণীগুলি শুনতে পেল :
অনেক জাতি সংসারং সন্ধ্যাবিসসং অনিব্বিসং
গহকারকং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্পনং।
গহকারক দিট্ঠোসি পুনগেহং ন কাহসি
সব্বা তে ফাসুকা ভগ্গা গহকূটং বিসংখিতং
বিসংখারগতং চিত্তং তনহানং খয়মজঝগা।
গৃহকারককে তোমার দেখেছ হে সমনগণ! এ কথা সত্য? অনেক জন্ম ঘুরে ঘুরে সন্ধান করেছ! ব্যর্থ হয়েছ, তবু ছাড়োনি? এই দেহগৃহের রচক! কে সে? সংস্কার, তৃষ্ণা সব খসে পড়ে গেছে? গৃহকূট ভেঙে তবেই বিপুল শান্তি? আশ্চর্য! কী আশ্চর্য কথা বলছো? আমি যে এই গৃহকূটকেই ভালোবেসেছি, কষ্ট পাচ্ছি, একেই যে পরম বলে মনে করেছিলাম।
ধনপালী সোনার ভৃঙ্গার এগিয়ে দেয় —ভদ্দা! ভদ্দা! কী করছো! আত্মবিস্মৃত হলে যে! সমনদের অভ্যর্থনা করো!
এক আঘাতে দেহগৃহে ফিরে আসে বিশাখা, ধূলিলিপ্ত চরণগুলিতে জল ঢালে, জল ঢালে, জল ঢালে।
সত্থি, সত্থি— কে উচ্চারণ করছেন? কে?
প্রত্যেকেই। প্রত্যেকেই তো! অথচ যেন মনে হচ্ছে একজন!
স্বস্তি উচ্চারণ করে ভিজে পায়ের চিহ্ন ফেলে ঢুকছেন, মিগার-পত্নী মার্জনী বস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছেন। প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু এই সেবা নিচ্ছেন না সমনরা। স্মিত মুখে মার্জনী বস্ত্র হাতে নিয়ে চরণ মুছে নিচ্ছেন…সত্থি, সত্থি।
—সব্বে সত্তা সুখিত্তা হোন্তু…
রৌদ্র-ভরা, মোহদিগ্ধ চোখ দুটি এতক্ষণে তোলে বিশাখা। তার সামনে দাঁড়িয়ে পঙ্ক্তির সর্বশেষ শ্ৰমণ। রূপলোকের দেবতারা যেখানে থাকেন সেখানে কি একটি পলাশবৃক্ষ আছে? মহা মহীরুহ,? সেই পলাশই তবে আজ ফুটেছে এখানে! দেবকাননের দিব্য পলাশ! কী মহান! কী স্নিগ্ধ! কী অপার করুণাময় চোখ দুটি! সমস্ত হৃদয় জলের মতো তরল হয়ে টলটল করে তারপর স্রোত হয়ে ধুয়ে দিতে চায় ওই চরণ দুটি।
প্রবেশ করছেন উনি শ্লোকের শেষে পূর্ণচ্ছেদের মতো। বুঝি অনন্তযৌবন। দৃঢ়কায়, কিন্তু অসামান্য কোমল। সাত বছর বয়সে ওঁকে দেখেছিল। সেই স্মৃতি ছিল একটি অস্পষ্ট চিত্রের মতো। তাকে আজ পরিমার্জনা করে, উজ্জ্বল করে তার ভাগ্য তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। কে বলে পুরুষ রুক্ষ, কর্কশ, অমার্জিত! এই তো পুরুষ। এই পুরুষের জন্যই কতকালের প্রতীক্ষা তোমার নারী! বলিষ্ঠ অথচ রুক্ষ নয়, দৃষ্টিতে মহাপ্রেম মহাক্ষেম। কই রিরংসা তো নেই! কী লাবণ্য অথচ কী দার্ঢ্য! সঙ্গীরা বলেছিল না সিদ্ধার্থই সেই পুরুষ যিনি…
বিশাখা নিজেকে সবলে ভেতর থেকে আঘাত করে। এ কী চিত্তবিকার! তার হাত পা কাঁপছে কেন? অঙ্গে রোমহর্ষ। বিন্দু বিন্দু স্বেদজল কপালে। সে যেন স্বপ্নের ঘোরে। এবং কোথা থেকে কেউ ডাকছে ‘ভদ্দা, ভদ্দা, শীঘ্র এসো, আপ্যায়ন করো, ভগবান তথাগত ও সমনদের ভোজনে আপ্যায়ন করো।’ বনকপোতের ডাকের মতো দুরাগত উন্মনা আহ্বান।
কুমারী বিশাখা এগিয়ে যাচ্ছে। এখনও সে কুমারীই। দত্তা কিন্তু গৃহীতা নয়। সে পথ দেখতে পাচ্ছে না। আবিষ্টের মতো এগিয়ে যাচ্ছে। কহ্ন আর ময়ূরী দু পাশ থেকে তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। তারা খুব সম্ভব বুঝতে পেরেছে তার বিহ্বল অবস্থা।
শ্ৰমণ দলের পুরোভাগে বুদ্ধ তথাগত। ওঁর হাতে জল ঢেলে দিতে হবে। তখন উনি এই ভোজন-আপ্যায়ন গ্রহণ করতে সম্মতি দেবেন। দান গ্রহণের এই-ই নিয়ম। হতবুদ্ধির মতো বিশাখা তথাগতর দিকে চায়, হাতে জল দেয়। উনি স্মিত মুখে গ্রহণ করেন। এ কি রহস্য হে শক্কদেব! সারির প্রথমেও তথাগত! শেষেও তথাগত? ইনি বলিষ্ঠ এক প্রাজ্ঞ পুরুষ, সিংহকটি। জ্বল জ্বল করছে দেহত্বক। মুণ্ডিত শিরের মধ্যভাগ অল্প উঁচু। ওরা বলেছিল, ওঁর মাথায় সহজাত উষ্ণীষ আছে। প্রশান্ত গম্ভীর মুখমণ্ডল, যেন জ্যোতি বেরোচ্ছে এমনি চম্পক গৌরাঙ্গ। দুই ভ্রূর মাঝখানে দুর্বাঘাসের মতো এক গুচ্ছ রোম। যেন তৃতীয় নয়নের অধিষ্ঠান বোঝাচ্ছে। যে নয়ন দিয়ে তিনি লোকাতীতকে প্রত্যক্ষ করেন, প্রত্যক্ষ করেন লক্ষ বছরের ইতিহাস, এবং আগামী সময়। প্রণত হল বিশাখা। পুরোভাগে যদি তথাগত তবে পঙ্ক্তির শেষে উনি কে? কাকে সে সিদ্ধার্থ ভেবেছিল? ইনি যদি দিব্য আগুন, উনি তবে দিব্য পলাশ। ইনি যদি পশুরাজ উনি তবে মৃগযূথপতি! বিশাখা মুখ নত করে রইল।
শ্রমণেরা ধীরে ধীরে বসছেন। বিশাখার গৃহ আলোময় হয়ে উঠছে। তথাগত শ্রমণদের পরিচয় দিচ্ছেন। মুখে প্রসন্ন মৃদু হাসি। বিসাখা— ইনি সারিপুত্ত। এঁকে ধম্মসেনাপতি বলা হয়। মহাপণ্ডিত। আর ইনি হলেন মোগ্গল্লান-মহাইদ্ধিমান। এঁরা তথাগতর অগ্গসাবক। এঁরা দুজনেই ধম্মের সবচেয়ে কুশলী প্রবক্তা। যদি তোমার বা পুর-ইত্থিদের কারও কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে, তথাগতকে প্রশ্ন করবে না বচ্চে, এঁদের দুজনকে প্রশ্ন করবে।
বয়স্থ দুই অগ্রশ্রাবক এবং অন্যরাও স্মিতমুখ। কৌতুকে উজ্জ্বল মুখ পুরনারীদের। তথাগত তাহলে অন্য সমনদের মতো গুরুগম্ভীর নন! লঘু আনন্দের হিল্লোল মৃদু স্বস্তিকর দখিনা বাতাসের মতো ছুঁয়ে যায় বিশাখার ভোজনশালা।
—ইনি তিস্স—বিশাখা চমকে ওঠে— লোকে এঁকে স্থূলতিসস্ বলে, অন্য সমনরা তাতে বাধা দিতে পারেন না। যা সচ্চ তাকে তো মানতেই হবে। বলো? ইনি ভোজনপটু। তোমার আয়োজনের সদ্ব্যবহার করবেন। স্থূলতিষ্য হাসছেন। কিন্তু তাঁকে ঠিক লোভী বলে মনে হচ্ছে না।
এবার নারীদের মধ্যে হিল্লোল আর একটু স্পষ্ট হয়। যদিও সবাই কায়সংযমের কথা স্মরণে রাখে।
—ইনি কৌণ্ডিন্য। মৃগদায়ে তথাগতকে প্রথম আসন দিয়েছিলেন। না দিলে তথাগত আজও মৃগদায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
ইনি অর্হৎ যশ— অতি অল্প সময়ের মধ্যে অৰ্হত্ত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। সত্যই যশস্বী।
ইনি উপালি—সঙেঘর শ্রেষ্ঠ বিনয়ধর হয়ে উঠছেন ক্রমশই।
ইনি ভিক্ষু অনঘ আর ইনি ভিক্ষু সুভদ্দ —এঁরা সংঘের প্রথম গান্ধার দেশীয় ভিক্ষু। এঁরা তথাগতর উদীচ্য-জয়ের স্মারক বলতে পারো বিসাখা।
আর ইনি। এঁকে দেখো বচ্চে। ইনি আনন্দ। নিজেকে সবার পেছনে রাখতে ভালোবাসেন। যদিও আদৌ পশ্চাৎপদ নন। বরং অসামান্য সুকৃতির অধিকারী। ভিক্ষুণীসংঘ এঁর ইচ্ছাতেই স্থাপিত হয়েছে। নারীদের দুঃখ ইনি সবচেয়ে ভালো বোঝেন।
জ্যোতির্ময় শাক্যসিংহ আম্রবৃক্ষের তলায় সুরচিত মৃৎবেদীর ওপর থেকে মধুর গম্ভীরস্বরে কী উপদেশ দিলেন, বিশাখা তা জানল না। শুধু ধ্বনি শুনল। অপূর্ব কোনও মৃদঙ্গের মতো। সে জানল না, শাক্যসিংহ লক্ষ করেছেন গহপতি উপস্থিত নেই। তাঁর দেশনাকে তাই তিনি সচেতনভাবে করেছেন আরও মর্মস্পর্শী। পার্থিব জীবনের সমস্ত দুঃখগুলিকে তিনি দু হাতে ধরে ভালো করে ঝাঁকিয়ে এক একটি অয়োমুখ শায়কের মতো নিক্ষেপ করছেন এবং তা নির্ভুল লক্ষ্যে আবরণীর পেছনে বসা মিগার সেট্ঠির হৃদয়ে বিঁধে যাচ্ছে। তথাগত যেন ব্যক্তিগতভাবে জানেন মিগারের সব অপমানের দুঃখ, প্রতিযোগিতায় হারের দুঃখ, প্রিয়সঙ্গগুলি না পাওয়ার দুঃখ, অপ্রিয় সঙ্গের দুঃখ, ধনক্ষয় হওয়ার দুঃখ, বয়স বৃদ্ধির দুঃখ, জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রতি মুহূর্তের নিরন্তর সংগ্রামের দুঃখ, মনোমত সন্তান না হওয়ার দুঃখ, জীবনের সব ক্ষেত্রে দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ হওয়ার দুঃখ। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে দেহত্বকের মতো জীবের গায়ে লেগে যায় এই সমস্ত দুঃখ। সম্মা দিট্ঠি, সম্মা সংকপ্পো, সম্মা বাচা, সম্মা কম্মন্তো, সম্মা আজীবো, সম্মা ব্যায়ামো, সম্মা সতি, সম্মা সমাধি— এই আটটি সম্যক্ পালন করলেই জীবচক্র থেকে মুক্তি পাবে। যেতে হবে না কৃচ্ছের কঠিন সাধনে, শুধু অপরিমিত বিলাস ও ভোগের স্রোতে গা ভাসিও না, সচেতন থাকো, দান করো হে কৃপণ, ধন কুক্ষিগত করে রেখো না। দানই সেই সহায়ক যা তোমাকে নির্বাণলোকে নিয়ে যাবে।
বিশাখা দেখল, তার রুক্ষমূর্তি, কটুভাষী শ্বশুর অসহিষ্ণু মিগার সেট্ঠি বুদ্ধকে ভূলুণ্ঠিত হয়ে প্রণাম করছেন। ও কি, তিনি যে এবার তাকিয়ে আছেন তারই দিকে! চোখে শ্রদ্ধা বিস্ময়— বিসাখা বিসাখা সুহ্না আমার, বালিকা বলে তোমাকে উপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু তুমিই এতদিনে মিগারের সত্যিকার দাহশান্তির কারণ হলে। মাতৃস্তনধারার মতো শান্তিধারায় তুমি আমায় স্নান করালে মা। আজ থেকে তুমি মিগারের মাতা। ভন্তে, আপনি কদিন নিত্য মিগারের ঘরে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করুন।
তথাগত স্মিতমুখে মৌন হয়ে রয়েছেন। হতাশ নির্গ্রন্থের দল ক্রুদ্ধ মুখে কানন থেকে চলে যাচ্ছে। তারা সারাক্ষণ অন্তরাল থেকে দেখেছে এই দ্বৈতযুদ্ধে কীভাবে নাতপুত্তকে পরাজিত করে সমন গোতম অনায়াসে জয়ী হলেন। মায়াবী। সত্য সত্যই ইন্দ্রজাল আয়ত্ত করেছে লোকটি।
উনি আসবেন? ওঁরা আসবেন। মিগারের গৃহে! বিশাখার গৃহে? বিশাখার আপন গৃহে? উনি? উনি আসবেন তো? ওই পরমানন্দ? কত কি বলার ছিল বিশাখার। হে শক্কদেব, ভাষা দাও, হে ইড়া, সরস্বতী, বাক্ হয়ে জিহ্বায় ভর করো। কিংবা এমন ভাষা দেবে কী? যা না বলেও বলতে পারে?
২৯
যোতীয়, কাকবলীয়, জটিল, পুণ্যক— এঁরা সবাই রাজগৃহে থাকেন। পঞ্চ মহাশ্রেষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র মেণ্ডকই বেছে নিয়েছেন ভদ্দিয়। তিনি ছাড়া আর চারজন আজ সমবেত হচ্ছেন রাজগৃহ-শ্রেষ্ঠী অহিপারকের গৃহে। অহিপারক অন্যদের চেয়ে ধনে ন্যূন হলে হবে কি, তিনি মগধের রাজসভার স্বীকৃত শ্ৰেষ্ঠী। রাজা ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ প্রত্যক্ষ এবং ঘনিষ্ঠ। তাঁর মর্যাদাই স্বতন্ত্র।
অহিপারকের বহির্বাটিতেই, কিন্তু তাঁর নিজস্ব নিভৃত কক্ষে আজ মৃদু কিন্তু উৎকৃষ্ট সুরার ব্যবস্থা হয়েছে। শূকর-বৎসের তুলতুলে মাংসখণ্ড সব ভাজা হয়েছে। ভাজা হয়েছে রক্তালুক বা রাঙালুর খণ্ডও। তিল ও উত্তম গুড় দিয়ে মোদকও প্রস্তুত হয়েছে। শ্রেষ্ঠীরা এলে তাঁদের যথাবিধি অভ্যর্থনা করে খাদ্য ও সুরা দাসীরা দিয়ে যাবে। তার পর আর কেউ যেন ব্যাঘাত না করে, সেই মতোই ব্যবস্থা করেছেন অহিপারক। শ্রেষ্ঠী-জ্যেষ্ঠক হলেন যোতীয়। ইনি রাজগৃহের শ্রেষ্ঠীদের মুখপাত্র তো বটেই, সারা মগধে বিভিন্ন স্থানে যত ছোট বড় বণিক আছে, তারা নিজেদের নগরী অথবা গ্রামে ক্ষুদ্রতর বণিক সঙঘ করেছে। সেই বণিক সঙঘগুলি আবার রাজগৃহের শ্রেষ্ঠী-জ্যেষ্ঠকের কাছে তাদের যা-কিছু অসুবিধা-আবেদন নিবেদন জানায়। মগধের চার শ্রেষ্ঠী এবং শ্রেষ্ঠী অহিপারক আজ এই জাতীয় কোনও বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসবেন। আবেদনগুলি স্বভাবতই এসেছে যোতীয়র কাছে, তিনি জানিয়েছেন অন্যদের। তাঁর গৃহেই সভা বসত। কিন্তু অহিপারক কোনও বিশেষ কারণে নিজ গৃহেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এঁদের।
সময়টা সন্ধ্যা। দীপদণ্ডগুলি জ্বললেও, বাতাসের অভাবে সান্ধ্য কুয়াশা সূক্ষ্ম লতাতন্তুর মতো নগরীর ওপরে বিস্তৃত রয়েছে। সন্ধ্যা আর একটু গাঢ় হলেই সরে যাবে। এখন নগরীর সব রন্ধনশালায় কাঠের আগুন জ্বালানো হয়েছে উনানগুলিতে। সেই ধোঁয়াও কুয়াশায় অংশ নিয়েছে। শীতের জন্য লোক চলাচল ধীরে ধীরে অল্প হয়ে যাচ্ছে। বেরিয়েছে তিন শ্রেণীর মানুষ। দাস-দাসীরা, তাদের কোনও-না-কোনও কাজের কারণে; বণিক ও পর্ণিকরা, তাদের নানাবিধ আপণ ছড়ানো রাজগৃহের হাটে, না বেরোলে তাদের চলে না। আর বেরিয়েছে সেইসব প্রমোদ-বিলাসীরা যাদের প্রমোদ-তৃষ্ণার আকর্ষণ দুর্বার। বেরিয়েছে সুরালুব্ধ নাগরিক, সারা দিনের পর শৌণ্ডিকগৃহে না গেলে এদের অন্ন জীর্ণ হয় না। গণিকাসক্ত নাগরেরাও বেরিয়েছে, কেউ একা, কেউ সদলে। নৃত্য গীত বাদন, গণিকার সঙ্গে রসালাপ— এ তাদের নিত্যকৃত্য। গৃহে প্রচুর সঞ্চিত ধন, গ্রামাঞ্চলের শস্যক্ষেত্র থেকে এসে যাচ্ছে। পরিশ্রম নেই, কায়ক্লেশ নেই। সারা দিন গৃহের বাইরের কক্ষে সেই সম্পদের গোনাগাঁথা করে। কিছু মল্লক্রীড়া বা নিতান্ত বালসুলভ শস্ত্র-শস্ত্র খেলা খেলে, সন্ধ্যা হতেই এরা বেরিয়ে পড়ে। এদের মিলিত হবার জন্য নির্দিষ্ট ব্যবস্থা হল গোষ্ঠী। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে রাজগৃহের ধনী, সচ্ছল, নানা বিষয়ে আগ্রহী পুরুষেরা মিলিত হয়ে বহুপ্রকার আলোচনায় কাল কাটায়। পাশা খেলা হয়, তবে পণ রেখে পাশা খেলার আরও ভালো ব্যবস্থা সুরাগৃহগুলিতে। সেখানে সুরা পরিবেশন করবার জন্য অধিকাংশ সুরাবণিকই নিয়োগ করে সুন্দরী দাসীদের। কখনও কখনও সুরাবণিকের নিজের কন্যা বা কন্যাস্থানীয়রাও আপ্যায়ন করে ক্রেতাদের। আর গণিকাদের গৃহে গেলে সর্ববিধ প্রমোদের সুপ্রচুর আয়োজন পাওয়া যায়। সুরা, চারুকলা, নারী, নানান উচ্চশ্রেণীর বিদ্যা ও জ্ঞানের আদানপ্রদান।
রাজগৃহ যখন প্রথম গড়ে উঠেছিল তখন এ নগরের গণিকাসম্পদ বলবার মতো কিছু ছিল না। অতি তরুণ রাজা তখন রাজ্য বিস্তার, অর্থাৎ সংগ্রাম এবং নিজের রাজ্যে সর্বপ্রকার প্রজার সুখবিধান করতেই ব্যস্ত ছিলেন। ধনসম্পদে ঋদ্ধ শ্ৰেষ্ঠীশক্তি সেই সময়ে রাজার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সর্বপ্রকার সাহায্য দেয়। সার্থবাহ অর্থাৎ বণিক দলের নেতারা বিভিন্ন জনপদে ঘুরে ঘুরে অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আসতেন। কোন রাজ্যের কী বিশেষত্ব, কোথায় কোন্ কারণে বণিক সমাগম অধিক হয়, এসবের চতুর বিশ্লেষণ একমাত্র তাঁরাই করতে পারতেন। যোতীয়, জটিল এঁরা তাই-ই করেছিলেন—রাজগৃহে নদী না থাকায় তাঁরা পাটলি গ্রামটিকে বাণিজ্যদ্বার বলে ব্যবহার করতেন, এখনও করে থাকেন। এখানে গঙ্গা ও হিরণ্যবাহর সঙ্গম। পাটলি গ্রাম বারাণসীর মতো পট্টন না হলেও, অতিশয় সমৃদ্ধ একটি নিগম গ্রাম। এঁরাই রাজাকে পরামর্শ দেন বৈশালীর মতো রাজনটীর প্রথা প্রবর্তন করতে। এই নটীকে রাষ্ট্রের ব্যয়ে শিক্ষিত করা হবে। এর আকর্ষণে পাটলিতে পণ্য নামিয়ে চলে যাবে না বণিকরা। একটু পথ এগিয়ে রাজগৃহে আসবে। আর কে না জানে, বণিকদের চলাচলই যে-কোনও নগরীর, যে-কোনও রাজ্যের সমৃদ্ধির উৎস। শালবতী নামে এক সুন্দরীকে অতঃপর নিয়োগ করা হল। তাঁর মায়ের তত্ত্বাবধানে শালবতী হলেন নৃত্যগীত ও অন্যান্য গুণে অলঙ্কৃতা এক অপরূপা গণিকা। তাঁর জন্য তাঁর মা দাবি করলেন এক রাত্রির জন্য সহস্ৰ কার্ষাপণ। বৈশালীর গণিকা-শ্ৰেষ্ঠা আম্রপালীর দক্ষিণা ছিল তার অর্ধেক। এই নিয়ে রাজগৃহ ও বৈশালীর মধ্যে তীব্র মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। যাই হোক, এখন এই শালবতী বা সালাবতী ছাড়াও রাজগৃহে আরও তরুণী সুন্দরী গণিকাদের বসবাস হয়েছে। সকলে শালবতীর মতো উচ্চমূল্যের এবং রাজা ও রাজপুরুষ-ভোগ্যা নন। নানা শ্রেণীর পুরুষের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা রাজগৃহে প্রবর্তন করেছেন শ্ৰেষ্ঠীরা। বা বলা যায় তাঁদের প্রথম উদ্যোগের পর আপনা-আপনি এই ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কেননা, নগরী, বিশেষত রাজধানীতেই তো যত ধনী, অবসরপ্রাপ্ত যুবাপুরুষদের ভিড়। প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরাও অবশ্য বাদ যান না। মগধের বিভিন্ন স্থান থেকে, সংলগ্ন রাজ্যগুলি থেকেও এই গণিকাদের আকর্ষণে আসে বহু লোক। বাণিজ্য রমরম করতে থাকে। সর্বপ্রকার বাণিজ্য। আবসথাগার, আরাম, সুরাগৃহ, বহুবিধ বিলাসদ্রব্য, বসন, অলঙ্কার, ভৈষজ, খাদ্যদ্রব্য। শ্রেষ্ঠীরা যথার্থই বলতে পারেন— এই নগরীর প্রতিষ্ঠার, স্থান নির্বাচনের, আরক্ষার গৌরব যদি মহারাজ বিম্বিসারের, নগর-পরিকল্পনার গৌরব যদি স্থপতি মহাগোবিন্দর, তবে এর সমৃদ্ধি এবং সমারোহের গৌরব নিঃসন্দেহে শ্ৰেষ্ঠীদের। তবে তাঁরা এসব কথা প্রকাশ্যে বলেন না। ভাবুক না রাজারা, ক্ষত্রিয়রা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবাতে তো কোনও দোষ নেই! ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত-পুরোহিত এঁরাও নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে থাকুন। ক্ষত্রিয়রা বা সাধারণভাবে সব শস্ত্রধারী যোদ্ধাই, সে ক্ষত্রিয়ই হোক, ব্রাহ্মণই হোক, সংগ্রামে প্রাণ দিয়েও ভূমি-ধনসম্পদ রক্ষা করবে। তাদের আত্মশ্লাঘার প্রসন্নতায় স্থিত রাখা ভালো। পণ্ডিত-পুরোহিত-আচার্যরাও বহু ক্লেশ করে ধরে রেখেছেন জাতির সঞ্চিত বিদ্যা। এঁরাও দেশের গৌরব। কিন্তু প্রকৃত শক্তির স্বাদ পাচ্ছেন এখন শ্ৰেষ্ঠীরা।
প্রধানত আজ এঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু এই-ই। এই নবলব্ধ শক্তি কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, কীভাবে এ শক্তির যথার্থ প্রয়োগ করা যায়—এ নিয়েই এঁরা চিন্তিত।
যোতীয় এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। তাঁর কেশ তো শুভ্র বটেই, ভ্রূগুলিও পেকে গেছে। তার ওপর তিনি সিংহভ্রূ। যোতীয়র গাত্রবর্ণ তামাটে। তিনি শ্বেত বস্ত্র ছাড়া অন্য কিছু পরেন না। কপালে তিন-চারটি স্পষ্ট বলিরেখা, হাসলে চোখ এবং ওষ্ঠাধরের পাশে কুঞ্চন দেখা যায়। কিন্তু নাতিদীর্ঘ দেহটি বলিষ্ঠ, দেহত্বক এখনও লোল হয়নি। ঊর্নার আচ্ছাদনে তিনি ভালো করে ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢেকেছেন, পায়ে কোমল মৃগচর্মের উপানৎ। হঠাৎ তাঁকে দেখলে সম্ভ্রম হয়। কিন্তু শ্বেত স্থূল ভ্রূর তলায় তাঁর চোখ দুটি অতিশয় ধূর্ত এবং দর্পী। তিনি অতি স্থূল বা অতি কৃশ নন।
যোতীয় রথ থেকে নামতেই, অহিপারকের ভূতকরা তাঁকে সাহায্য করবার জন্য সসম্ভ্রমে এগিয়ে এলো। যোতীয় হাতের যষ্টিটি আস্ফালন করে বললেন, ‘সাহায্যের প্রয়োজন নেই, দূরে যাও’— তাঁর বলবার ভঙ্গি ঈষৎ রুক্ষ।
অহিপারকের মুখ্য লেখক বসু অদূরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি চোখের ইঙ্গিতে ভৃতকদের নিরস্ত করে শ্রেষ্ঠীকে পথ দেখিয়ে মন্ত্রণাগৃহে নিয়ে গেলেন।
প্রশস্ত মণিকুট্টিমের ওপর বসবার জন্য শয্যা বিছানো। তার ওপর ইতস্তত উপাধান। কতকগুলি ত্রিপদীও ইতস্তত ছড়ানো আছে। যোতীয় আসতেই অন্যরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন।
শ্রেষ্ঠী কাকবলীয় একটি খর্বকায় বলিষ্ঠ প্রৌঢ়। তাঁর পরনে ধূসর বর্ণের বসন। শ্মশ্রু গুম্ফ দুটিতেই তামাটে ভাব। কিছু কিছু পক্ক কেশও আছে। ইনি বিরলকেশ।
ইনি যদি বিরলকেশ হন তো জটিল একেবারেই কেশহীন। মাথায় একটি সুগোল ইন্দ্রলুপ্ত। সেটির অস্তিত্ব ইনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। সর্বদাই হাত বোলান। অল্প শ্মশ্রু ও গুম্ফ পরিষ্কার ছাঁটা। ইনি কিছুটা স্থূল এবং শিথিলকায়। গৌরবর্ণ শরীরটি যে ভোগীর, তা দেখলেই বোঝা যায়। এঁর পরনের বস্ত্রে গোরোচনার চিত্র করা। উত্তরীয়টি হরিদ্রা বর্ণে রঞ্জিত।
পুণ্যক মানুষটি অতিশয় দীর্ঘকায় এবং শীর্ণ। সুগৌর, প্রায় যুবক এই শ্রেষ্ঠী পিতার উত্তরাধিকারকে অতি অল্প বয়সেই শতগুণ বাড়িয়েছেন শোনা যায়। ইনিই শ্রেষ্ঠীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। লোকে বলে, সম্পদগুলি ইনি স্বর্ণপিণ্ডে পরিবর্তিত করে ভিন্ন ভিন্ন গুপ্ত স্থানে পেটিকায় তাম্রকলসে রেখে দেন। অতি ব্যয়ের ভয়ে ভালো করে খান না। পরিজনদের তো দেনই না। ব্যয়ের ভয়েই এঁর গৃহে একটি মাত্র পত্নী। এঁর পুত্ররা নাকি খেলার ছলে শ্রেষ্ঠীর উদ্যানে গুপ্তধনের কলসগুলি সন্ধান করে বেড়ায়। সখাদের কাছে বলে, একটি কলস বা পেটিকার সন্ধান পেলেই চম্পট দেবে। পিতৃগৃহের খাদ্য বা বলা যায় অখাদ্য তাদের নাকি আর সহ্য হচ্ছে না। একটি মাত্রই কন্যা, তার বিবাহ দিয়েছেন অহিপারকের এক পুত্রের সঙ্গে। এই কন্যা মাধবিকা। আজ সাত বছর শ্বশুর গৃহে এসেছে, পিতার গৃহে একেবারেই যেতে চায় না। বলে, ‘পিতা কৃপণ, কন্যা জামাতা গেলে ব্যয়ের ভয়ে তাঁর বুক ফেটে যাবে। ভাইগুলি দুঃশীল, গেলেই বলবে কয়েক কহাপন দিয়ে যাও জেট্ঠা বড় প্রয়োজন আছে।’ একমাত্র মাতাকে দেখতে এবং তাঁর জন্য উপহার নিয়ে যেতেই মাধবিকা পিতৃগৃহে মধ্যে মধ্যে যায়। তার নিয়ে যাওয়া কাসিক দুকূল দেখে শ্ৰেষ্ঠী পুণ্যক শিহরিত হন— কী করেছ কন্যা, এত ব্যয় করেছ? অহিপারক আমার চেয়ে অনেক ধনী তা জানি, তাই বলে তার ধন এভাবে ক্ষয় করতে তোমার বাধে না!
মাধবিকা মনে মনে হেসে বলে, ‘এ ধন সেট্ঠির নয়, পিতা, তাঁর পুত্রের।’
—জামাতাকে এ ভাবে ধনহীন করে দিচ্ছো? তুমি তো দেখছি পুণ্যকের অপবাদের কারণ হবে। মাধবিকা এবার বিরক্ত হয়ে বলে, ‘অপবাদ হয় আমার হবে। আপনার কী? আপনার জামাতা বারাণসী থেকে এই বস্ত্র মায়ের জন্য বিশেষ করে এনেছেন।’
এইবার পুণ্যকের মুখ দিয়ে সত্য কথা বেরোয়, ‘এ প্রকার বস্ত্র দিতে থাকলে, তোমার মা তো আমার কাছ থেকেও এরূপ দাবি করবেন, পুত্তগুলিও প্রভাবিত হবে। এর পর পুত্তগুলির বিবাহ দিতে হবে, তখন তাদের বধূরা…, তিনি আর বলতে পারেন না। তাঁর হৃৎকম্প হচ্ছে।
পুণ্যকের পত্নী অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে সাশ্রু নয়নে কন্যাকে বলেন, সারা জীবনই তো রুক্ষ বসন পরে কাটলো, মাধবী তুই এ বসন নিয়ে যা, আমার চাই না।’
মাধবিকা তখন বড় রাগ করে। সে পিতাকে বলে, ‘আমি মাতাকে নিয়ে বারাণসী চলে যাবো, তখন আপনার গৃহে দাসীবৃত্তি কে করে, আমি দেখব।’
পুণ্যক গতিক ভালো নয় দেখে স্থানত্যাগ করেন।
শ্রেষ্ঠী অহিপারক এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন। অধিক কথা বলেন না। যখন বলেন, একটি মর্যাদাবোধ তাঁকে ঘিরে থাকে। রাজসভায় তাঁর নিত্য যাতায়াত। মহারাজ, অন্যান্য রাজপুরুষ ও রাজকুমারদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা। তাঁর মার্জিত আচরণ ও স্বভাবের জন্যই তিনি রাজশ্রেষ্ঠীর পদ পেয়েছেন, না রাজশ্রেষ্ঠী বলেই এমন পরিমার্জিত হয়ে উঠেছেন, বলা কঠিন।
অহিপারককে হঠাৎ দেখলে অক্ষত্রিয় মনে হয় না। যদিও ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যের মধ্যে তেমন কোনও মৌলিক পার্থক্য নেই। তবে ক্ষত্রিয় পুরুষরা ব্যায়াম ও অস্ত্রশিক্ষায় অনেক সময় ব্যয় করেন বলে তাঁদের আকৃতিতে একটি সুগঠিত সুঠাম পৌরুষের ব্যঞ্জনা থাকে। শ্রেষ্ঠী অহিপারক, মহারাজ বিম্বিসারের সমবয়সী হবেন। তিনি নিয়মিত শস্ত্রচর্চা করেন, ব্যায়াম করেন। তাঁর গৃহে একটি মল্লভূমি আছে। পুত্ৰ পরিজনদেরও তিনি বলশালী, শাস্ত্রনিপুণ ও সুদেহী হতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। যদিও তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মাধবিকার স্বামী উদয় কিছুটা কৃশকায়।
অহিপারক সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনা করলেন জ্যেষ্ঠ যোতীয়কে।
—আসুন আসুন সেট্ঠি। আপনার জন্যই আমরা সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছি। সংবাদ সব ভালো তো?
সতর্ক চোখে চারিদিকে তাকিয়ে যোতীয় বললেন, ‘ভালো মনে করলেই ভালো। কী বলো কাকবলীয়?’
অহিপারকের ইঙ্গিতে বসু চলে গেল। অহিপারক দ্বারটি বন্ধ করতে করতে মুখ বাড়িয়ে বসুকে যথাসময়ে সুরা ও খাদ্য পরিবেশন করার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
যোতীয় বললেন, ‘আজ এত সাবধানতা? অহিপারক, আজ কি আমরা পুন্নকের সুবন্নকলসগুলির সংখ্যা জানতে পারছি, না কি?’
অহিপারকের মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। কাকবলীয় বললেন, ‘পুন্নকের স্বর্ণকলস? কী যে বলেন, সেট্ঠি জেট্ঠক। পুন্নকের ঘরে কয়েকটি মাটির কলস ভিন্ন আর কিছুই নেই। তার ভিতরে আবার ভস্ম ভরা।’
সকলের পরিমিত হাসির মধ্যে পুন্নকের ক্ষীণ প্রতিবাদ শোনা গেল, ‘ধনীরা সর্বদাই অল্পধন সেট্ঠিকে নিয়ে যথেচ্ছ কৌতুক করে থাকেন, কী আর বলবো! এ অপমান আমার সহ্যই হয়ে গেছে।’
যোতীয় নিজেকে সংবরণ করে নিলেন। ভালোভাবে বসে, মেরুদণ্ড সোজা করে, তিনি তাঁর দিকে এগিয়ে দেওয়া উপাধানটি জটিলের দিকে সরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘যোতীয় তোমাদের চেয়ে বয়সে বড় হতে পারে বিলাসের অভ্যাসে বড় নয়। দৈহিক ক্ষমতায়ও ছোট নয়।’
অহিপারক বললেন, ‘মহা সেট্ঠি। গোট্ঠিগুলির সংবাদ কী?’
‘সেটাই তো কথা’, যোতীয় গলার স্বর মৃদু করে বললেন, ‘গোট্ঠীগুলি বলছে, মগধের মধ্যে বাণিজ্যের কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু কোসলে বড় পথদস্যু জলদস্যু। কোসল ও লিচ্ছবি রাজ্যে যথেচ্ছ শুল্ক দাবি করে রাজপুরুষেরা। কোসল ছাড়িয়ে বংস রাজ্যে অবন্তী, কুরু-পাঞ্চালে গেলে তো কথাই নেই! শুল্ক দিতে দিতে সার্থবাহরা উত্ত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে, এবং মুদ্রার কোনও মান না থাকায় তারা বিনিময়ে বাধ্য হচ্ছে। অনেক সময়েই তাদের মনে হচ্ছে, তারা প্রবঞ্চিত হচ্ছে, ক্রেতারাও বহু ক্ষেত্রে তাদের প্রবঞ্চক বলছে। একটি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা এর সমাধান চায়। স্বভাবত এবং ন্যায়ত আমাদেরই কাছ থেকে।’
কাকবলীয় বললেন, ‘এরা তো তবু মগধের মধ্যে নিরাপদ। আমাদের তরুণ বয়সের কথা মনে করুন ভদ্দ! কীভাবে, কত বিপদ, বন্য জন্তু, বন্য মানুষ, নরখাদক, দস্যু, চোর, ভিন্ন ভিন্ন দেশের চোর, রাজপুরুষ এদের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ করে করে, তবে আজ ধনশালী হয়েছি। সংগ্রাম সবাই করে। ক্ষত্রিয় যোদ্ধা একভাবে, আমরা বণিকরা আরেকভাবে।’
জটিল বললেন, ‘নিশ্চয়। আমরা যখন সার্থবাহ ছিলাম, সঙ্গে বীরপুরুষ স্থলনিয়ামক নিয়েছি, আরও যোদ্ধা নিয়েছি। কিন্তু শুল্ক ও রাজপুরুষদের অন্যায় লোভ তো আর নিবারণ করতে পারিনি। এরা আমাদের কাছ থেকে কী আশা করে?’
পুণ্যক করুণ মুখে বললেন, ‘এইসব কারণেই তো আমি আর বৈদেশিক বাণিজ্যে ধন নিয়োগ করি না। কুসীদিন বলে অপমান করে লোকে, কিন্তু শুল্ক দিয়ে দিয়ে আর চোর দস্যুর হাতে নিজের ধন তুলে দিয়ে নিঃস্ব হবার কোনও সাধ নেই আমার।’
অহিপারক ধৈর্য ধরে সবার কথা শুনছিলেন। এবার ধীরে ধীরে বললেন, ‘মহাসেট্ঠি যোতীয়, জেট্ঠ জটিল, ভদ্দ কাকবলীয়, ভাই পুন্নক— আমরা কি ভাবিনি মগধ রাজ্য আরও বিস্তৃত হবে? মহারাজ বিম্বিসার যখন অঙ্গদেশ জয় করলেন তখন আমাদের ধনক্ষয় অল্প হয়নি। পরাজয়ের বিভীষিকাও যে সামনে ছিল না তা নয়, কিন্তু আমরা মহারাজের রাজ্য বিস্তারে উৎসাহিত হয়েছিলাম। হইনি কি?’
যোতীয় কুটিল চোখে চেয়ে বললেন, ‘অবশ্যই। আমরা ভেবেছিলাম, আজ অঙ্গ-মগধ এক রাজ্য হল। এর পর অঙ্গ-মগধ-কোসল-বেসালী এক রাজ্য হবে। এই বিশাল রাজ্যের অধীশ্বর হওয়া মহারাজ বিম্বিসারের পক্ষে এমন কিছু কঠিন নয়। কিন্তু হল না। কোসল, বেসালী উভয়ের সঙ্গেই মৈত্রী স্থাপন করলেন তিনি। এ কি তোমাদের অভিপ্রেত ছিল?’
জটিল বললেন, ‘মৈত্রীই তো ভালো মহাসেট্ঠি। যুদ্ধ হলেই সব কিছু অস্থির হয়ে যায়। জীবনটা তো ভোগের জন্যই। তা দীর্ঘদিন যুদ্ধবিগ্রহ চললে কি আর নিশ্চিন্তে আনন্দ করা যায়?’
পুন্নক বললেন, ‘ঠিক। একেবারে ঠিক। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। বৃহৎ সংসার সব। আয়-ব্যয়ে সমতা রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
যোতীয় বললেন, ‘মহারাজ বিম্বিসার যখন অঙ্গদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন তখন তোমার কত বয়স পুন্নক? তখন তোমার পিতা মহাসেট্ঠি অনঙ্গ তোমাকে বাণিজ্যযাত্রায় উত্তরে পাঠিয়েছিলেন। সে সময়ে তুমি অনেক উপার্জন করেছ। বলি তোমার কোনও বাধা-বিপত্তি হয়েছে? তোমার পিতার বৃহৎ সংসার চালিয়েও এত সঞ্চয় হয়েছিল যে তুমি মাত্র কয়েক বছর বাণিজ্যযাত্রা করেই বসে গেলে। তখন মগধ এত সংহত ছিল না। খুদ্দ খুদ্দ রাজ্যপাট। এখন মগধের শৃঙ্খলা শাসন ব্যবস্থা ত্রুটিহীন। রাজগহের ভেতরে তোমার কিসের অসুবিধা? এসব অর্থহীন শঙ্কাকে প্রশ্রয় দিও না। অহিপারক, মহারাজ বীরপুরুষ, কূটবুদ্ধিও ধরেন। লিচ্ছবি দেশে তাঁর সম্পর্ক ছেটক রাজার সঙ্গে, অন্য গণরাজাগুলি তো আর তাঁর শ্বশুর নয়! গঙ্গার উত্তরে রাজ্য বাড়াতে তাঁকে কে বাধা দিচ্ছে? ওদিকে রয়েছে সাক্করা, মল্লরা, এগুলি তো পুরোপুরিই প্রায় কৃষিকার্য নিয়ে থাকে। এগুলিকে নিজ রাজ্যভুক্ত করতে বাধা কি?’
অহিপারক তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘সাক্কদের আক্রমণ করার তো প্রশ্নই উঠছে না। ভগবান বুদ্ধ সাক্কজাতীয় না? ওঁদের বিরুদ্ধে মহারাজ কখনই অস্ত্র তুলবেন না।’
‘এই এক মহাসমস্যা হয়েছে’, যোতীয় বলে উঠলেন, ‘রাজা যুদ্ধ করবে, আচার্য শিক্ষা দেবে, সেট্ঠি ধন উপার্জন করবে, কস্সক শস্য ফলাবে, নারী পুত্রোৎপাদন করবে, দাস সেবা করবে— সমাজ এভাবেই গঠিত হয়েছে, এভাবেই স্থিতি পেয়েছে, এই নিয়মশৃঙ্খলা অনুসরণ করেই উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে সমাজের। এই নিয়মকে হঠাৎ লণ্ডভণ্ড করে দেবার কি প্রয়োজন পড়ল? করুক না রাজা তপস্যা। সন্ধান করুক অতীন্দ্রিয় আনন্দ, তার একটা সময় আছে। মহারাজ যদি রক্তপাতে বিতৃষ্ণা বোধ করেন, বিবাদে অসুখী হন তো…’
‘তো কী?’ অহিপারক জিজ্ঞেস করলেন।
তাঁর দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে শ্রেষ্ঠী যোতীয় বললেন, ‘অহিপারক, তুমি তো শুধু শুধু নগরসেট্ঠি হওনি বাপা। বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ মানুষ বলে অনেক কথা, অনেক মত অনেক সংশয়ের কথা বলে ফেলি। বলবার অধিকার আছে বলেও মনে করি। পদাধিকার। মগধের যতেক বণিকসেট্ঠি তাদের সুখ-দুঃখের অভাব-অভিযোগের কথাগুলি আমাকেই শোনায়, আমার থেকেই তাদের প্রতিকার আশা করে কি না!’
অহিপারক হেসে বললেন, ‘সত্য কথা। অবশ্যই বলবেন।’
—কিন্তু তুমি তো আর শুধু শুধু নগরসেট্ঠি হও নাই।
—ও। আপনি বলছেন আমি এ সব কথা রাজার কর্ণগোচর করব?
—আমি কিছুই বলছি না। বলছ তুমি।
—শুনুন মহাসেট্ঠি রাজবাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে আমি যেমন এ সমস্যার একদিক জানি, আপনিও আপনার পদাধিকারবলে সেই সমস্যার অন্য দিক জানেন। আলোচনা প্রয়োজন বলেই আপনাদের সাদরে ডেকে পাঠিয়েছি। আমাদের সেট্ঠিদের স্বার্থ এক। সেই সেট্ঠি সংঘ ভেদ করবার উদ্দেশ্য থাকলে…’
কাকবলীয় তাঁর গুফের কেশগুলি টানতে টানতে বললেন, ‘আহা হা হা, এ তো স্বাভাবিক সতর্কতা ভদ্র অহিপারক। মহাসেট্ঠি আপনিই বা এত সন্দেহাকুল হচ্ছেন কেন?’
এই সময়ে দ্বারে মৃদু করাঘাত হল।
অহিপারক শ্ৰেষ্ঠীদের সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে অবশেষে যোতীয়র ওপর তাঁর দৃষ্টি স্থির করলেন, বললেন, ‘আমার আজকের আর এক অতিথিকে এই সভায় উপস্থিত করবার অনুমতি প্রার্থনা করছি মহাসেট্ঠি।
যোতীয় একটু ক্ষুব্ধ হয়েই যেন বলে উঠলেন, ‘গৃহ তোমার, আয়ুষ্মান অহিপারক, তুমি যে-কোনও অতিথিকে যে-কোনও সভায় উপস্থিত করতে পারো। অনুমতির প্রয়োজন হবে কেন? তবে আমাদের সভার কাজ আর হবে না।’
অহিপারক বললেন, ‘ক্ষুব্ধ হবেন না মহাসেট্ঠি। এই অতিথির কথা শুনলেই স্থির করতে পারবেন সভার কাজ এগোবে না স্থগিত থাকবে।’
তিনি দ্বার খুললেন। যিনি ঢুকলেন তাঁকে দেখে উপস্থিত সবাই চমকে উঠলেন। পুরুষটি অহিপারকের কাছাকাছি বয়সের হবেন। তাম্রাভ গৌরবর্ণ। মুখশ্রীর মধ্যে কোনও বৈশিষ্ট্য নেই যাতে তাঁর সম্পর্কে কারও কোনও ধারণা হতে পারে। নাসা, চক্ষু, ওষ্ঠাধর সবই অতিশয় সাধারণ। রাজগৃহের পথে ঘুরলে এই ধরনের আকৃতি অনেক দেখা যেতে পারে। মাথায় এঁর যথেষ্ট কৃষ্ণ কেশ, কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। একটি অত্যন্ত সাধারণ বস্ত্র ও উত্তরীয় পরনে। তিনি এসেই কটি থেকে সমস্ত শরীর সামনে নত করে সবাইকে নমস্কার করলেন। তারপর গৃহস্বামীর অনুমতি নিয়ে বসলেন।
অহিপারক বললেন, ‘রাজসচিব বস্সকারের সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিই।’
পুণ্যক হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘সেট্ঠি আমি কি একটু ভেতরে যেতে পারি?’ প্রয়োজন পড়েছে।‘ পুণ্যক অবশ্য অহিপারকের অনুমতির অপেক্ষা করলেন না, বস্সকারের পেছন দিয়ে দ্বারপথে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
জটিল তাঁর সুগোল ইন্দ্রলুপ্তের ওপর থেকে হাতটা নামিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আমাদের আর নূতন করে পরিচয় করাবার প্রয়োজন কী? ওঁকে আমরা সবাই চিনি।’
দ্বারে আবার শব্দ হল। অহিপারক উঠে দ্বার খুললেন। সবাই ভেবেছিলেন পুণ্যক। কিন্তু পুণ্যক নয়। দাসীরা সুদৃশ্য ভৃঙ্গার বয়ে আনছে দেখা গেল। তক্ষিত দারুফলকের ওপর খাদ্যসম্ভার নিয়ে প্রবেশ করছে দাসেরা। সব কিছু রাখা হলে, অহিপারকের ইঙ্গিতে দাস-দাসীরা চলে গেল। অহিপারক বসুকে নিম্নকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পুণ্যকভদ্র কোথায় গেলেন?’
বসু ঈষৎ হেসে বলল, ‘তিনি একেবারে অন্তঃপুরের দিকে চলে গেলেন, আমায় বলে গেলেন বৈবাহিক যেন আমাকে আর সভায় না ডাকেন, আমার অসুখ বোধ হচ্ছে।’
অহিপারক ঘরে ঢুকে বললেন, ‘আপানারা আলাপ করুন। আমি একটু আসছি। বসু তুমি খজ্জগুলি পরিবেশন করে যাও।’
প্রথমে তাঁর এ পরিকল্পনা ছিল না। বসু যদিও তাঁর নিজের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। কিন্তু মহাসেট্ঠি যোতীয়র সদা-সন্দিগ্ধ চরিত্রের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট পরিচয় আছে। অন্যেরাও গোপনতা চাইবেন। তাই তিনি বসুকে যথাসাধ্য দূরে রাখতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর সাময়িক অনুপস্থিতিতে আপ্যায়নের ভার গৃহস্বামীর পক্ষ থেকে কাউকে তো নিতেই হয়!
পুণ্যকের সন্ধানে অন্তঃপুরের ভেতরে অবশ্য তাঁকে যেতে হল না। দুই পুরের মধ্যবর্তী কাননে আম্রবৃক্ষের তলায় পাষাণবেদীতেই পুণ্যকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গেল।
পুণ্যক শ্ৰেষ্ঠী বেদীর ওপর বসে একটি চরণ দোলাতে দোলাতে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে গাছের মধ্যে কী নিরীক্ষণ করছিলেন তিনিই জানেন। অহিপারক ব্যস্ত হয়ে সেখানে এসে বললেন, ‘কী হল পুণ্যকভদ্র সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছেন যে!’
পুণ্যক গম্ভীরভাবে বললেন, ‘বিরক্ত করবেন না সেট্ঠি, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি এখন।’
—কী কাজ? কী এমন গুরুত্ব তার যে সভা উপেক্ষা করছেন।
অহিপারক শুধু বিস্মিতই নন, বিরক্তও বটে। তাঁর এই কুটুম্বটি তাঁকে মাঝে মাঝে এমন বিপদে ফেলেন! তাঁর মর্যাদা রক্ষা হয় না।
—আপনার এই অম্ববৃক্ষটির পাতা গুনছি। এই কাজ—পুণ্যক একইভাবে বললেন।
—তার অর্থ? সেট্ঠি পুন্নক, আপনি একজন ধনবান নাগরিক, সেট্ঠিকুলের স্তম্ভ, তার ওপরে আমার বৈবাহিক…
—হ্যাঁ, আর সেই জন্যই আপনি আমাকে ধ্বংস করবার ব্যবস্থা করেছেন। বাঃ। সাধু সাধু সেট্ঠি অহিপারক।
—অর্থ কী এসব কথার?
—আপনার আচরণের অর্থটাই আমাকে আগে বুঝিয়ে দিন! সামান্য কুসীদজীবী বণিক আমি। মহাসেট্ঠি স্নেহ করেন বলে আপনারা নিজেদের সমিতিতে স্থান দিয়েছেন। নিজের সামান্য অবস্থা নিয়েই তো আমি সন্তুষ্ট আছি। কই কারও গৃহে তো চৌর্যবৃত্তি করতে যাইনি। বড় বড় পদ, মর্যাদা, এসবের ওপরেও তো কোনও লোভ করিনি।
শ্রেষ্ঠী অহিপারক হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
পুণ্যক বললেন, ‘ওই রাজসচিব বস্সকারকে ডেকে এনে আমার মতো সামান্য লোকের কথা, নাম, ধাম তাঁর কর্ণগোচর করবার জন্য আপনি ব্যস্ত কেন? রাজরোষে পড়ে, কিংবা রাজভৃত্যদের লোভের লক্ষ্য হয়ে সামান্য যেটুকু শান্তি বা ধন সঞ্চয় করেছি, সেটুকু হারাই এই চান? এই কি জ্ঞাতকের ব্যবহার!’
পুণ্যক মহা উত্তেজিত হয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। এতক্ষণে অহিপারক ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পারলেন। তিনি হাসি গোপন করে বললেন, ‘এই কথা? রাজসচিব বস্সকার আমাদের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করতে এসেছেন। অনেক গভীর নীতি সম্পর্কে তিনি আজ আমাদের সঙ্গে একমত। সেই জন্যই তাঁর প্রার্থনাতেই আমাদের সভায় তাঁকে ডেকেছি। আপনার ভয় বা সংশয়ের কোনও কারণই নেই।’
পুণ্যক বললেন, ‘রাজপরিষদের লোকদের সঙ্গে সখ্য করবার আমার বিন্দুমাত্র সাধ নেই, সেট্ঠি, আর রাজনীতিরই বা আমি কী বুঝি? বুঝতে চাইও না। আপনি দয়া করে আমায় ছেড়ে দিন।
—কিন্তু ওঁদের কী বলব? যথেষ্ট উৎকৃষ্ট সুরা ও খজ্জের আয়োজন হয়েছে। সবাই একত্রে ভোজন করব…..
—আমার অংশটি না হয় অন্তঃপুরের ভোজনশালার পাঠিয়ে দিন। আপনার পত্নী সমাদর করে খাওয়াবেন এখন। আর ওঁদের বলুন, আমার সহসা অসুখ…ঠিক আছে বলে দিন উদরাময় হয়েছে….উদরে শূল বেদনাও অনুভব করছি…না না, এতটা বলবেন না। এঁদের আবার যেমন স্নেহের আধিক্য হয়ত দেখতে এসে পড়বেন…যা হয় বলুন, আপনার মাথায় কি আর বুদ্ধির অভাব আছে?
—আপনি কি সত্যিই যাবেন না?
—না না। পুন্নক এক কথা দ্বিতীয়বার বলে না।
অহিপারক বিরক্ত মুখে ফিরে আসতে লাগলেন। তাঁর কপালে ভ্রূকুটি। এই পুণ্যকের পিতা মহাসেট্ঠি অনঙ্গ ছিলেন যোতীয়র আগে গোষ্ঠীজ্যেষ্ঠক। তখনও অবশ্য মগধ রাজ্যরূপে এভাবে সংহত হয়নি। কয়েকটি ছোট ছোট অঞ্চল ছিল স্বাধীন, সার্বভৌম। গোষ্ঠীপতিদের মধ্যে বিম্বিসার পিতা ক্ষেত্রৌজা ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী। তাঁর মধ্যে বৃহৎ রাজ্য গঠনের স্বপ্ন ছিল। অনঙ্গ সে সময়ে কত দুঃসাহসিক অভিযানই না করেছেন। বাণিজ্যপথের সর্বপ্রকার খুঁটিনাটি তিনি জানতেন। তাঁর অতুল ধনসম্পদ পেয়েছে পুণ্যক। কিন্তু এমন নিরুদ্যম, কৃপণ, এমন অকারণে ভীত মানুষ তিনি আর দেখেননি। মহাসেট্ঠি অনঙ্গর যে এ প্রকার পুত্র হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। অথচ প্রথম যৌবনে এই পুণ্যকই ছিল একেবারেই ভিন্ন চরিত্রের।
নিজের মন্ত্রণাগৃহে আসতে আসতে অবশ্য তাঁর কপাল মসৃণ হয়ে এলো। প্রকৃত অবস্থা এবং তাঁর মনোভাব এঁদের কাছে প্রকাশ করা যাবে না। তাঁর সম্মানহানি হবে। বস্সকারেরও।
তিনি ঘরে প্রবেশ করে পেছনে কপাট দুটি বন্ধ করে দিলেন। জটিলের মুখে মাংসখণ্ড। তিনি শুধু চোখ তুলে চাইলেন। কাকবলীয় বললেন, ‘কী হল?’
—আরে আমার বৈবাহিক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উদরাময়। অন্তঃপুরে পাঠিয়ে দিয়েছি। একটু সুস্থ বোধ করলেই আসবেন।
যোতীয় মৃদু হেসে বললেন, ‘ভোজনের আগেই?’
বর্ষকার ভেতরের কথা, পুণ্যকের চরিত্র কিছুই জানেন না। তিনি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের কথা। আমারই দুর্ভাগ্য। যাক, কিছু ভৈষজের ব্যবস্থা করেছেন তো?’
—নিশ্চয়ই! অহিপারক বসতে বসতে বললেন।
একটু পরে হাত মুখ প্রক্ষালন করে, সবাই পানপত্র তুলে নিলে, অহিপারক বললেন, ‘মহামান্য বস্সকার, আপনার কী যেন বলবার ছিল…’
চারিদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ে বর্ষকার বললেন, ‘আমার বলবার কথা নির্ভর করবে, আপনাদের বক্তব্যের ওপরে।’
জটিল পানীয়ে চুমুক দিয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘বক্তব্য? আমাদের? আপনার কাছে? কিছু তো নাই! কী মহাসেট্ঠি। মান্যবর রাজসচিবের কাছে আমাদের কী-ই বা বক্তব্য থাকতে পারে?’
যোতীয় বললেন, ‘আমাদের বণিক গোষ্ঠীর লাভালাভ, অভাব-অভিযোগের ব্যাপার আমরা নিজেরাই সমাধান করি। নেহাত না পেরে উঠলে মহারাজ আছেন। তা এখনও সেরূপ অবস্থা হয়নি।’
অহিপারক বললেন, ‘মহাসেট্ঠির অনুমতি নিয়ে দু-চারটি কথা নিবেদন করছি। আপনি জানতে চাইছেন বলে। দেশ থেকে দেশান্তরে যাতায়াতকালে শুল্ক এবং মুদ্রা নিয়ে বণিকদের বড়ই সমস্যা হচ্ছে। এ কথা আমরা রাজ সন্নিধানে পরবর্তী সভাতেই জানাবো।’
ভাবলেশহীন মুখে বর্ষকার বললেন, ‘আপনাদের কোনও সমস্যারই সমাধান হবে না। মুদ্রার জন্য যে বিপুল পরিমাণ ধাতু প্রয়োজন তা আমাদের নেই। মগধ রাজ একটি অচলাবস্থায় এসে পৌঁছেছে মহামান্য সেট্ঠিগণ। বজ্জিরা সাম্রাজ্যলোভী, অবন্তীও তাই। কোসল একটি বৃহৎ শূন্যগর্ভ কলসের মতো। মগধ সামান্য একটু তৎপর হলেই বিশাল বিশাল রাজপথ আপনাদের সামনে খুলে যাবে, মগধাধিপ ছাড়া আর কারুকে শুল্ক দিতে হবে না। রাজনীতি সেদিকেই চলেছিল, কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’ কাকবলীয় কখন নিজের অজান্তেই ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন।
—কিন্তু নীতির পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, আমরা রাজার মন্ত্রণাদাতা। রাজ্যের পক্ষে যা ভালো তাই পরামর্শ দিয়ে থাকি। সেট্ঠিদের অসুবিধাগুলি দূর করতে না পারলে, কী ভাবে রাজ্যের সমৃদ্ধি সম্ভব?
—নীতির পরিবর্তন ঘটছে কেন? যোতীয় সাবধানে প্রশ্ন করলেন।
বস্সকার আবার একবার চারদিকে তাকিয়ে নিলেন, বললেন, ‘অবশ্যই গৌতম বুদ্ধ নামক শ্রমণের জন্য। আমাদের রাজা, শুধু আমাদের কেন সাধারণভাবে সৎ রাজামাত্রেই শ্রমণদের ওপর, সন্ন্যাসীদের ওপর শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু রাজার কর্তব্যাকর্তব্যে এঁরা কেউই হতক্ষেপ করেন না। এই শ্ৰমণ করছেন। অনেকেই এ ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছেন না।’
—যেমন?
—যেমন রাজপরিবারের অনেকে, বহু অমাত্য, প্রজারা, এবং আপনারা— শেষের দিকে বর্ষকারের মুখ সহাস্য হয়ে উঠল!
—আমরা? জটিল হতবুদ্ধি হয়ে প্রশ্ন করলেন।
—হ্যাঁ সেট্ঠিবর, এই শ্রমণ রাজস্বার্থবিরোধী। বণিকস্বার্থবিরোধী। এমন কি প্রজাস্বার্থবিরোধীও বটে। অনঙ্গ নামে ওই বিদ্রোহী চণ্ডালের কথা কি শুনেছেন?
—কিছু কিছু কানে এসেছে বটে— যোতীয় তাঁর অবিচলিত গরিমায় বললেন।
“>—অনঙ্গের নেতৃত্বে প্রথম দিকে রাজগৃহের ঘরে ঘরে মলভাণ্ড বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তাদের দাবি ছিল শিশুচোর যক্ষ-যাক্ষিণীকে শাস্তি দিতে হবে। মহারাজ তা দিতে উদ্যতও হয়েছিলেন। তাঁর কাজে বাধা দিলেন শ্রমণ গৌতম। চণ্ডাল পুক্কুসদের কী বোঝালেন তিনিই জানেন, তারা শান্ত হয়ে কাজে যোগ দিল। শুধু অনঙ্গ এখনও দু চোখে আগুন ছড়িয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। সে বিদ্রোহী। রাজদ্রোহীও বলতে পারেন। নগরের পথে পথে সে শ্ৰমণদের, রাজামাত্যদের, রাজনীতিকে গালি দিতে দিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকটি প্রায় উন্মাদ। কিন্তু পুরোপুরি নয়। এখন উচিত কাজ হল তাকে কারাদণ্ড দেওয়া, কিন্তু মহারাজ তো সে আদেশও দিচ্ছেন না। তাঁর বোধ হয় আশা শ্ৰমণরাই তাকে শান্ত করবেন!
কিছুক্ষণ পর যোতীয় বললেন, ‘দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, কিন্তু এর মধ্যে আমাদের জ্ঞাতব্যই বা কী? কর্তব্যই বা কী?’ তাঁর চোখ দুটি এখন আবার ধূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি যে নিজেদের পক্ষের কথা সম্পূর্ণ গুপ্ত রেখে, ধীরে ধীরে বর্ষকারের মনের কথা জেনে নিচ্ছেন এই আত্মপ্রসাদে তাঁর প্রাচীন মুখে এখন যথেষ্ট দীপ্তি।
বর্ষকার বললেন, ‘আপনারা ওই শ্রমণকে সংযত করুন এই প্রার্থনা। সোজা হয়ে বসলেন চার শ্রেষ্ঠী, কী ভাবে?’
—আপনাদের আনুগত্য, পূজা, উপহার দিয়ে। এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যাতে আপনাদের প্রার্থনা, আপনাদের ব্যবহারিক প্রজ্ঞা অমান্য করতে উনি না পারেন। শ্রাবস্তীতে তো শুনছি উনি সেট্ঠি সুদত্তর একেবারে বশীভূত হয়ে গেছেন। মান্যবর অহিপারক বলতে পারবেন।
অহিপারক বললেন, ‘সুদত্ত আমার জ্ঞাতক। সে জেতকুমারের কাছ থেকে শ্রাবস্তীর শ্রেষ্ঠ কাননটি ক্রয় করেছে। সেখানে প্রাসাদোপম আরাম নির্মাণ করছে ভিক্ষুদের জন্য। তার প্রধান দ্বারই এত বৃহৎ, এমন কারুকার্যমণ্ডিত যে বহু ধনী পণ্ডিত যাঁরা গৌতমের সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছুক, তাঁরা ভয়ে সম্ভ্রমে ফিরে যাচ্ছেন। তা শ্ৰমণরা তো চিরকাল গুহায়, বৃক্ষতলে, বড় জোর পর্ণকুটিরে বাস করে এসেছেন। আশ্রয়ের নামে এই বিলাসগৃহ যখনই গৌতম গ্রহণ করেছেন তখনই তিনি সেট্ঠিকুলের আয়ত্তের মধ্যে এসে গেছেন, জানবেন। আমাদের এ বিষয়ে একটু তৎপর হতে হবে।’
বর্ষকার সকলকে নমস্কার করে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘আপনারা বুদ্ধিমান, দলে দলে দাস-দাসী, রোগী, দণ্ডিত বা দণ্ডযোগ্য ব্যক্তি সাক্ক পুত্তীয় সমনসংঘে প্রবেশ করছে, যাচ্ছে সাধারণ গৃহস্থ, নারীকুল— মনেও করবেন না সবাই নিবাণ চায়। আর… এটি প্রথম পদক্ষেপ, মগধকে শক্তিশালী করবার আরও কাজ পড়ে রয়েছে। তবে দক্ষ স্থপতি আগে গৃহনির্মাণের জন্য নির্বাচিত স্থানটি সমান করে নেয়। কণ্টক গুল্মগুলি তুলে ফেলে… তাই না?’
বর্ষকার পেছন ফিরলেন, অহিপারক তাঁকে সঙ্গে করে বাইরে নিয়ে গেলেন। কাকবলীয় সাবধানে দ্বার বন্ধ করে বললেন, ‘কী বুঝলেন মহাসেট্ঠি? ভদ্র জটিল কী মত আপনার?’
যোতীয় বললেন, ‘সমন গোতম সম্পর্কে যা বলে গেল ভালো কথা, যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু প্রথম পদক্ষেপ… অর্থাৎ দ্বিতীয় তৃতীয় পদক্ষেপও আছে এঁর উর্বর মস্তিষ্কে। সাবধান জটিল, কাকবলীয়, ভাবনা-চিন্তা করে আমাদের পা ফেলতে হবে। এই বস্সকার আমাদের মনের গোপন অভিপ্রায়গুলিই যেন ব্যক্ত করে গেল। কিন্তু…’
এই সময়ে অহিপারক ঢুকলে সবাই নীরব হয়ে গেলেন।
অহিপারক একবার সবার দিকে তাকালেন। মৃদু হাসি তাঁর মুখে। কোনও পরিস্থিতিতেই তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন না। তিনি বললেন, ‘এই রাজসচিব বস্সকার… বুঝতেই পারছেন রাজস্বার্থের সঙ্গে বণিকস্বার্থের মিলন ঘটাতে চান।’
‘ইনি আমাদের ব্যবহার করতে চান, আর কিছু না, এবং স্বার্থটা ওঁর নিজের… ব্যক্তিগত স্বার্থ, কাকবলীয় ঈষৎ উত্তপ্ত হয়ে বললেন, ‘প্রথম পদক্ষেপ… দ্বিতীয় পদক্ষেপ— এ সব বলতে উনি কী বোঝাচ্ছেন? প্রথমে কণ্টক তুলবেন, সমন গোতমকে উচ্ছেদ করবেন। তারপর? তারপর কী মহারাজকেই…’
‘আহা হা হা’, যোতীয় তাঁর প্রাচীন হাত তুলে বাধা দিলেন, ‘যা অবক্তব্য তা কখনও বলবে না। এই রাজসচিব যদি আমাদের ব্যবহার করতে চান আমরাও ওঁকে ব্যবহার করতে পারি। এটা কোনও সমস্যা নয়। তা ছাড়া উনি আপাতত একটি কূটনীতিক সমাধানের কথা বলেছেন— সমন গোতমকে বশ করে নিজেদের সুবিধামতো তাঁকে কিছুটা চালনা করার প্রস্তাব তো মন্দ কিছু নয়। অহিপারক, বস্সকারকে এনে তুমি ভালোই করেছ।’
জটিল চতুর হাসি হেসে বললেন, ‘ধন দিয়ে, বিলাসের উপকরণ দিয়ে শ্রমণদের বশীভূত করা কিছুই নয়। এই তো পুরন কাস্সপের শিষ্যরা। সেবার ওই মহাত্মা ক মাসের জন্য রাজগহে এলেন। তো কদিন এঁর দেশনা শুনলাম— ইনি পাপ-পুণ্য মানেন না, ঠকানো, হত্যা, মিথ্যাচার, পরস্ত্রী গমন কিছুই এঁর মতে পাপ নয়, আবার সত্য কথন, দান, দয়া, সংযম এসবের দ্বারাও পুণ্যলাভ হয় না। অর্থাৎ কি না কর্মের কোনও ফল নেই। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— হত্যা, চুরি, ব্যভিচার— এগুলি আপনার মতে পাপ না হতে পারে কিন্তু এগুলির প্রত্যক্ষ ফল তো রাজদণ্ড। উনি বললেন— অবশ্যই। কিন্তু পরলোকে গিয়ে এসব তথাকথিত পাপের জন্য কাউকে কণ্টকবনের মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, কাউকে জ্বলন্ত কটাহে নিক্ষেপ করা হয়— এ ধারণা সর্বৈব ভুল। যে কদিন রাজগহে ছিলেন, আমি প্রায়ই এঁর দেশনা শুনতে যেতাম এবং প্রচুর পরিমাণে ভোজ্য নিয়ে যেতাম, মহাত্মা পুরন কাস্সপের শিষ্যদের কাছ থেকে যে পরিমাণ আশীর্বাদ পেয়েছি তাতেই মনে হয় আমার এ জীবনটা চলে যাবে। আমার ধারণা এই তীর্থঙ্কর ও তাঁর সম্প্রদায় এর পর এখানে এলে আমার কোনও প্রার্থনা অপূর্ণ রাখবেন না।’
কাকবলীয় বললেন, ‘ওই চার্বাকদের মতো আর কি! পরলোক মানে না, ইহলোকে সর্বপ্রকার সুখ সম্ভোগ করতে চায়। এঁদের বশ করা আর এমন শক্ত কাজ কি?’
যোতীয় গর্ব ও প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, ‘সমন গোতমকে বশ করাও শক্ত কাজ হবে না! নিশ্চিন্তে থাকো।’