1 of 2

২৫. অমরনাথ হতভম্ব

অমরনাথ হতভম্ব। সন্ন্যাসীর বয়স অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে তাঁর দীর্ঘদেহের গৌরবর্ণ ত্বক যেরকম কুঁচকে গিয়েছে তাতে আশির কাছাকাছি হওয়াই সঙ্গত। মাথার জটা প্ৰায় সাদা, দাড়িতে লাল ছাপ লেগেছে সাদার গায়ে। সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, কত বছর বয়সে এই চাকরিতে যোগ দিয়েছ তুমি?

অমরনাথ জবাব না দিয়ে পারলেন না, অল্প বয়সেই। এখন বলুন কি করতে পারি আপনার জন্যে। রাত অনেক হয়েছে।

তোমার জানতে নিশ্চয়ই কৌতূহল হচ্ছে। আমি কি বলতে এসেছি?

স্বাভাবিক।

আমি যা বলব। তার আগে আমার কয়েকটা তথ্য জানা দরকার। তুমি কি তোমার মাতুলালয়ে বড় হয়েছ? সন্ন্যাসী অমরনাথের মুখের দিকে তাকালেন।

হ্যাঁ। সেখানে থেকেই আমি স্কুলে পড়েছি।

তোমার পিতা–?

তিনি আমার জন্মের আগেই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন।

কী রকম দুর্ঘটনা?

নৌকোড়ুবি।

তোমার পিত্ৰালয়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই?

না। কিন্তু আপনি এইসব তথ্য জানতে চাইছেন কেন?

প্রয়োজন আছে। সন্ন্যাসী হাসলেন, এটি কে?

আমার মেয়ে। অমরনাথ বুঝতে পারছিলেন যে তিনি সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্বের কাছে পবাস্ত হচ্ছেন। মানুষটিব দৃষ্টিতে এমন সম্মোহনী শক্তি রয়েছে যে তিনি ওঁর আদেশ পালন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অমরনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে অঞ্জলি এবং দীপাকে দেখলেন।

তোমার সংসারে এখন কজন মানুষ?

ছয় জন। আমার দুটি পুত্রসন্তান, এরা, আর আমার মা।

তোমরা কি সুখে দিনযাপন করছ?

অমরনাথ উত্তর দিলেন না। আজ দুপুরের পর থেকে ঈশ্বর তাঁর জীবন থেকে সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছেন। দিনযাপন করতে হয় বলেই করা।

সন্ন্যাসী বললেন, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

গৃহী মানুষের জীবন কি সুখে বাঁধা থাকে?

থাকে না। তবু গৃহী পার্থিব সুখের চেষ্টা করে। তুমি করেছ নিশ্চয়ই!

করেছিলাম।

পাওনি? ব্যর্থ হয়েছ?

হঠাৎ দীপা জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি চান?

সন্ন্যাসী হাসলেন, উত্তরটা তোমার ঠাকুমা থাকলে দিতে ভাল লাগত।

তিনি এখন পুজো করছেন?

পুজো? তিনি কি দীক্ষা নিয়েছেন?

হ্যাঁ। দীপা উত্তরটা দেওয়ামাত্র অঞ্জলি ফিসফিস করে বলল, দ্যাখ, ঠাকুমার বোধ হয় পুজো হয়ে গিয়েছে। হলে ওঁকে এখানে ডেকে আন।

দীপা একটু জেদ দেখিয়ে বলল, দাঁড়াও, আগে শুনি ওঁর কথা।

সন্ন্যাসী দীপার দিকে তাকালেন, তুমি ছাত্রী?

হ্যাঁ। আমি কলেজে পড়ি?

হুঁ। অনেক পড়াশুনা হবে তোমার।

অঞ্জলি এতক্ষণ উশখুশ করছিল। এবার সুযোগ পেয়ে বলে ফেলল, দেখুন তো, ইনি আবার জেদ ধরেছেন জলপাইগুড়ির কলেজে পড়তে যাবেন না।

জেদ? না পড়ার জন্যে জেদ! কেন? নিজের স্বভাবের উল্টো আচরণ করছি কেন?

আমার কি স্বভাব তা আপনি জানেন? দীপা জিজ্ঞাসা করল।

তোমাদের বংশে কি কোন মেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে?

প্রশ্নটা উত্তর দিলেন অমরনাথ, না। ও প্রথম। অবশ্য—!

অবশ্য কি?

দীপা আমাদের মেয়ের চেয়ে আপন। জন্মমাত্র ওকে আমরা সস্তানের মত লালন করেছি। আমার শ্যালিকা ওকে জন্ম দিয়েই মারা গিয়েছিল। সেই দিন থেকে যদিও বক্তেব কোন সম্পর্ক নেই কিছু আমরা মনে করি হৃদয়ের সম্পর্ক রক্তেব চেয়ে মূল্যৱান।

সন্ন্যাসী দীপার মুখের দিকে আবার তাকালেন, পড়াশুনা তোমাকে করতে হবেই মা! ত থেকে তোমার নিষ্কৃতি নেই। কিন্তু একটা কথা, অন্তত তিরিশ বছর না হলে বিবাহ করো না। বাঙালি মেয়েদের পক্ষে বয়সটা যদিও খুব বেশী। তবু তিরিশ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত।

অঞ্জলি কৌতূহল দমন করতে পারল না, কেন?

শুনতে খারাপ লাগবে কিন্তু এ মেয়ের কপালে বৈধব্য লেখা আছে যদি অল্প বযসে বিবাহ হয়। এ ছাড়া মেয়েটি নিজের ভাগ্য নিজে গডে নেবে। অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, আপনি হাত দেখতে পারেন?

সন্ন্যাসী সশব্দে হেসে উঠলেন, না মা। ওসব বিদ্যে আমার জানা নেই। তবে গুরুব তাশীবাদে কখনও কখনও কারো মুখেব দিকে তাকালে কেউ যেন কানে কানে আমাকে তার সম্পর্কে কিছু বলে যায়।

দীপা হেসে ফেলল, এই বাড়িতে আমার আগে বুঝি আপনি এখানকার কারো সঙ্গে আমাদের বিষযে, আলোচনা করেছেন?

সন্ন্যাসী অবাক হলেন, মানে? দীপা বললে, আপনি যেসব কথা বলছেন তা এখানকার সবাই জানেন।

সন্ন্যাসীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, কারো সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাছাড়া তোমার ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা সবাই জানবে কি করে?

আপনি যা ভবিষ্যতে হবে বলছেন তা অতীতে ঘটে গিয়েছে।

সন্ন্যাসী অবাক হয়ে গেলেন। অমরনাথ চুপচাপ শুনছিলেন। দীপাকে তাঁর বেশ বাচাল বলে মনে হচ্ছিল। অন্যথৰ্ক কথা বাড়াচ্ছে সে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বলছিলেন আমার সঙ্গে আপনার কিছু কথা আছে। সেটা যদি শেষ করেন তাহলে ভাল হয়। রাত বাড়ছে। আমি খুব ক্লান্ত।

সন্ন্যাসী বললেন, এ-সময়ে এসেছি বলে আমি দুঃখিত। বেশ, আমার কথা শেষ করি।

এই সময় অঞ্জলি মুখ ঘুরিয়ে দেখল মনোরমা আসছেন। সে বলল, মা এসে গিয়েছেন। আসুন মা! সন্ন্যাসী মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তাঁর চোখ এখন অঞ্জলির পাশে, দরজার দিকে। মনোরমা ধীরে ধীরে সেখানে এসে দাঁড়ালেন।

মনোরমা সন্ন্যাসীকে দেখলেন। এত রাত্রে একজন সন্ন্যাসী কখনও কারো বাড়িতে আসে বলে তিনি শোনেননি। অমরনাথ বললেন, ইনি আমার মা!

হ্যাঁ। ওঁর চেহারার সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। সন্ন্যাসী মৃদুস্বরে বলতেই মনোরমা চমকে উঠলেন। তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। দুচোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি। তাঁর সমস্ত চেতনা লোপ পেয়ে গেল। শেষবাব চেষ্টা করলেন দরজা আঁকড়ে ধরতে। সন্ন্যাসী বলে উঠলেন, ওঁকে ধরে। তাঁর গলার স্বর এত উচ্চগ্রামে ছিল যে অঞ্জলি চমকে গিয়ে শাশুড়িকে পড়ে যেতে দেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। অমরনাথ ছুটে এলেন। তিনিও মনোরমাকে আর এক পাশে ধরলেন। সন্ন্যাসী বললেন, ওঁকে ওখানে শুইয়ে দাও।

মনোরমাকে খাটের ওপর শুইয়ে দেওয়া হল। ঘরের কেউ মনোরমার এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারছিল না। অঞ্জলি দ্রুত পাখা নিয়ে এসে বাতাস করা শুরু করল। অমরনাথ মনোরমার ওপর ঈষৎ বুকে ডাকতে লাগলেন, মা, মা তোমার কি হয়েছে?

অঞ্জলি বলল, তুমি ডাক্তারবাবুকে খবর দাও।

সন্ন্যাসী বললেন, মুখে একটু জল দাও। ডাক্তারের প্রয়োজন হবে না। দীপা এতক্ষণ চুপচাপ সব লক্ষ্য করছিল। সন্ন্যাসীর উপদেশ শেষ হওয়ামাত্র সে জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে দেখামাত্র ঠাকুমার এমন হল কেন?

সন্ন্যাসী গম্ভীর মুখে বললেন, এ থেকে প্রমাণিত হল মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক রয়েছে। আমার ভাবতে ভাল লাগছে তোমার ঠাকুমার মনের কোন পরিবর্তন হয়নি।

এই সময় মনোরমা চোখ মেললেন। অঞ্জলি বুকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, মা, কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে?

মনোরমা জবাব দিলেন না। তাঁর নিঃশ্বাস দ্রুত পড়ছিল। অঞ্জলি আবার হাওয়া করতে চাইলে তিনি নিষেধ করলেন, থাক। তারপর চোখ বন্ধ করলেন। ঘরের কেউ কোন কথা বলছিল না। মিনিটখানেক চুপচাপ শুয়ে থাকার পর মনোরমা উঠে বসলো অঞ্জলির আপত্তি সত্ত্বেও। তাঁর চোখ এবার সন্ন্যাসীর দিকে। সন্ন্যাসীও চোখ ফেরাচ্ছিলেন না। মনোরমা বেশ রুগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে?

আমাকে দেখে যা মনে হয়। আমি তাই।

তাহলে এখানে এসেছেন কেন?

তুমি অসুস্থ। কথা বললে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়বে।

সেটা আমি বুঝব। কেন এসেছেন?

সন্ন্যাসীরও সংসারের প্রতি কিছু দায় থাকে। সেই দায় মোটানোর প্রয়োজন হয়। পঞ্চাশ বছর সাধনার পর। তবে আমার আসার জন্যে কারো কোন ক্ষতি হোক আমি চাই না।

মনোরমা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সন্ন্যাসীকে দেখলেন। তারপর অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সবাই এই ঘর থেকে যাও তো! আমি একা ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি ডাকলে এ ঘরে এসো।

অঞ্জলি অমরনাথের দিকে তাকালে তিনি ইশারা করলেন আদেশ মান্য করতে। যদিও তাঁর এই রহস্যময় ব্যাপারে কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছিল। অঞ্জলি দীপাকে ডাকলেন ঘর থেকে চলে আসবার জন্যে। ওরা সবাই চলে গেলে মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, না, আমার ভুল হতে পারে না। আপনার প্রকৃত পরিচয় জানতে চাই। বলুন?

সন্ন্যাসী বললেন, প্ৰথমে বলে রাখি তুমি খেয়াল রাখবে যে হিন্দুঘরের বিধবা হিসেরে তোমার যা করণীয় তা থেকে সরে আসার কোন কারণ ঘটেনি। কোন গৃহী যখন সন্ন্যাসীব জীবন যাপন করেন তখন সংসারী মানুষের কাছে তিনি মৃত হয়ে যান। মনোরমা, তোমার অনুমান অভ্রান্ত। নৌকোড়ুবিতে আমার শারীরিক মৃত্যু ঘটেনি, আমাকে তুমি ঠিকই দেখছি। নদীতে ড়ুবে যাওয়ার পর কোথায় ভেসে উঠেছিলাম, কোন সাধুর প্রভাবে পড়ে আমি হিমালয়ে গেলাম। সেসব কথা এখন অবান্তর। নৌকোড়ুবিতে আমার সাংসারিক অস্তিত্বের মৃত্যু ঘটেছে। এবং সেই কারণেই তোমার এই বৈধব্যজীবন ধর্মমতে সঙ্গত।

মনোরমা থারথার করে কেঁপে উঠলেন। তারপর দু-হাতে মুখ ঢেকে যুঁপিয়ে উঠলেন। তাঁর কান্নার শব্দ সম্ভবত ভেতরের ঘরেও যাচ্ছিল। এবং আচমকা তিনি হাত সরিয়ে ভেজা চোখে বলে উঠলেন, বিশ্বাস করি না। আমার বাবা সব জায়গায় খবর নিয়েছিলেন। আমি যাঁকে বিয়ে করেছিলাম। তিনি অনেকদিন আগে ঈশ্বরের পায়ে চলে গিয়েছেন।

বেশ তো! আমি তোমাকে কিছুই বিশ্বাস করতে বলিনি। তোমাকে নিজে থেকে কোন কাহিনী শোনাইনি। আমার গলার স্বর শোনামাত্ৰ তুমি চৈতন্য হারালে—!

এই সময় ভেতর থেকে অমরনাথের গলা পাওয়া গেল, মা, কি হয়েছে, কাঁদছ কেন?

মনোরমা জবাব দিলেন না। সন্ন্যাসী বললেন, তোমার ছেলেকে এখানে আসতে বলো।

মনোরমা দ্রুত মাথা নাড়লেন, না। আপনি বুজাকক। আপনাকে আমি চিনি না। সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন, না। আমি বুজরুক নই। চিনতে চাইছ না। সেটা তোমার ইচ্ছে। পঞ্চাশ বছর পর সন্ন্যাসীকে এক দিনের জন্যে তার গহে ফিরে আসতে হয়—।

এসব কথা আমি শুনতে চাই না। মনোরমা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর গম্ভীর ভঙ্গীতে ঘর থেকে বেরিয়ে ভেতরের ঘরে পা দিতেই অমরনাথের মুখোমুখি হলেন। অমরনাথ অত্যন্ত বিস্মিত। আজ পর্যন্ত তিনি মায়ের এই চেহারা দেখেননি। ইতস্তত না করেই তিনি প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে তোমার? কাঁদছিলে কেন খারাপ কিছু বলেছে না কি?

মনোরমা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বললেন।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে, দেখছি। অমরনাথ মনোরমার পাশ কাটিয়ে বাইরের ঘরে এসে হাত জোড় করলেন, কিছু মনে করবেন না। আপনার আচরণ আমাদের কাছে রহস্যময় ঠেকছে। আপনি বৃদ্ধ এবং সন্ন্যাসী। কিন্তু এর বেশী আমাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। তাছাড়া রাতও অনেক হয়েছে, এবার আপনি চলে গেলে খুশি হব।

সন্ন্যাসী বললেন, আমি এখানে থাকার জন্যে আসিনি। পথেঘাটে রাত কাটানোব অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেই যোশীমঠ থেকে অনেক ঘুরে তোমাদে, ঠিকানা বের করে শেষ পর্যন্ত যে কারণে পৌঁছাতে পেরেছি তা সম্পূৰ্ণ হলেই আমি চলে যাব।

কারণটা তাড়াতাড়ি বলুন।

তুমি ঈশ্বরের নামে যে কোন খাদ্যবস্তু আমাকে দান কবো।

মানে? অমরনাথ আবার হতভম্ব।

তুমি মনোরমার পুত্র। অতএর এই দানের অধিকারী তুমিই।

কেন আমি আপনাকে দান করতে যাব? আপনি যদি অভুক্ত থাকেন তাহলে আমার স্ত্রীকে বলছি আপনাকে কিছু খাবার দিতে। অঞ্জলি– স্ত্রীকে গলা তুলে ডাকলেন অমরনাথ। অঞ্জলি কাছাকাছি ছিল। ডাক শুনে চটপট চলে এল। তাকে দেখে অমরনাথ বললেন, কিছু খাবার এনে ওঁকে দাও। নাটকটা শেষ হোক।

নাটক! সন্ন্যাসী হাসলেন, ঠিকই বলেছ, জীবন থেকে নাটক তৈরী হয়। কিন্তু অনেক সময় জীবন নাটককে ছাপিয়ে যায়। মা, তোমার বাড়িতে কোন ফল আছে? অঞ্জলি মাথা নাড়ল, না। সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, অন্ন? ভাত?

শুধু ভাত?

হ্যাঁ।

সকালের রাঁধা কিছুটা রয়েছে।

তাই হবে। একটা পাত্রে তার সামান্য কিছু নিয়ে এস।

হঠাৎ অমরনাথ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, দাঁড়াও। আপনি কি করতে চাইছেন?

আমার চাওয়াটা খুবই সামান্য অমরনাথ। সন্ন্যাস নিয়ে সংসার ত্যাগ করে গেলে কোন কোন গোষ্ঠীর সন্ন্যাসী যদি পঞ্চাশ বছর জীবিত থাকেন তাহলে তাঁকে এক দিনের জন্যে তাঁর সংসারে ফিরে এসে পুত্ৰ কন্যা অথবা স্ত্রীর হাতের দান গ্রহণ করতে হয়। নইলে তাঁর সাধনা সম্পূর্ণ হয় না। বলতে পার নিজের স্বার্থেই আমি তোমাদের কাছে এসেছি। সন্ন্যাসী খুব ধীর গলায় কথাগুলো বলে গেলেন।

অমরনাথের দুই চোখ বিস্ফারিত। তাঁর কথা বলার শক্তি লোপ পেয়ে গেল। কয়েক মুহুর্তের জন্যে। এই সময় অঞ্জলি চিৎকার করে উঠল, এ আপনি কি বলছেন?

আমি সত্যি কথাই বলছি মা।

না! তীব্র স্বরে শব্দটি উচ্চারণ করে মনোরমা দরজায় ছুটে এলেন, ওঁর কথা বিশ্বাস করো না বউমা, মিথ্যে মিথ্যে, সব বুজরুকি!

সন্ন্যাসী চোখ বন্ধ করলেন। সাদা দাড়ি গোঁফ সত্ত্বেও তাঁকে পাথরের মত দেখাচ্ছিল। অমরনাথ এবার চেতনায় এলেন, আপনি যা বলছেন তা দায়িত্ব নিয়ে বলছেন।

দেখো, তোমাদের কাছে আমার অন্য কিছু চাওয়ার নেই। না। টাকা পয়সা, না বিষয সম্পত্তি। মিথ্যাচার করে আমি কি পেতে পারি? এখনই এই রাত্রে আমি চলে যাব। হয়তো এই জীবনে তোমাদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমার গোষ্ঠীর নিয়ম পালন করতেই তোমাদের বিরক্ত করতে এসেছি। তোমরা অসংযত হয়ে না।

হঠাৎ অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়লেন অমরনাথ। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন! এই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী তাঁর পিতা? যে মানুষটিকে জন্মইস্তক মৃত বলে জানেন তিনি তাঁর সামনে বসে দান চাইছেন? পিতৃস্নেহের প্রতি তাঁর লোভ ছিল ছেলেবেলা জুড়ে। বন্ধুদের প্রত্যেকের বাবা ছিল শুধু তাঁর নয়। সেই মানুষটিকে আজ সামনে পেয়ে–। না, মনোরমা স্বীকার করেননি এখনও। বাবার চেহারার যে বৰ্ণনা তিনি শুনেছেন তার সঙ্গে সন্ন্যাসীর বয়স সত্ত্বেও কিছু মিল রয়েছে। তিনি চোখে দেখেননি। কিন্তু চিনতে যদি কেউ পারেন তিনি হলেন মনোরমা। অমরনাথ মায়ের দিকে ঘুরে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন, মা, তুমি বল, ইনি আমার বাবা?

মনোরমা মুখে আঁচল চাপা দিলেন।

অমরনাথ বললেন, মা, তুমি চুপ করে থেকে না। যদি ইনি মিথ্যা কথা বলেন তাহলে যাতে এই চা-বাগান থেকে সশরীরে না বেরুতে পারেন তার ব্যবস্থা আমি করার।

মনোরমা অস্ফুট বললেন, না।

অমরনাথ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি স্পষ্ট বল মা, এটা সত্যি?

মনোরমা সেই অবস্থায় মাথা নাড়লেন, আমি জানি না। তার মুখ থেকে আবার কান্না ছিটকে উঠল। এবং এতক্ষণ চুপচাপ দেখে গিয়ে দীপা ঘরের মাঝখানে এগিয়ে এল, তোমরা একটু চুপ কর। শুনুন, আপনি যে পরিচয় দিচ্ছেন তার সপক্ষে কোন প্রমাণ আছে?

সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন, না নেই। ধরে মা, তোমাকে এখান থেকে তুলে যোশীমঠে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে কেউ কখনও তোমাকে দেখেনি। হঠাৎ যদি কেউ তোমাকে সেখানে বলে যে তুমি কে প্রমাণ দাও। তাহলে দিতে পারবে? তোমার ঠিকানা নাম যতই বল তাতে তো তুমি এই তুমি প্ৰমাণিত হবে না। যতক্ষণ না সেটার সত্যাসত্য পরীক্ষা করতে কেউ এখানে আসে। তাই না? পরিচিত মানুষ-সমাজ থেকে আমরা চলে গেলে পরিচয় প্ৰমাণ করা বড় শক্ত হয়ে পড়ে।

দীপা সন্ন্যাসীর.. কথা মন দিয়ে শুনে জিজ্ঞাসা করল, তাহলে আপনার পরিচয় জানতে যোশীমঠে যেতে হবে। আমাদের? ব্যাপারটা কি আদৌ বাস্তব?

ঠিকই বাস্তব নয়। তাহলে আর একটা উপায় থেকে যাচ্ছে। সেটা হল যিনি চিনতে পারবেন। অথাৎ একমাত্র পূর্বপরিচিত ব্যক্তিই শনাক্ত করতে পারেন।

এখানে আপনার পূর্বপরিচিত কেউ নেই। বাবাও পঞ্চাশ বছর আগে জন্মাননি। ঠাকুমাও যে কথা বললেন, তা আপনি শুনেছেন।

শুনেছি।

এত রাত্রে আপনি কোথায় যাবেন?

পথে বের হবার আগে পথ নিয়ে কি কোন সন্ন্যাসী চিন্তা করে মা?

যিনি সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারেন—।

সন্ন্যাসীদের স্বার্থপর হতে হয়?

এক অর্থে তুমি সত্যিা বলছি।

নিজের স্বার্থ ছাড়া যারা চিন্তা করতে পারে না তারা কি ধরনের মানুষ?

বিচার করতে হবে কোন স্বাৰ্থ? ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন হয়ে পার্থিব সম্পর্ক থেকে যিনি গুটিয়ে নেন নিজেকে তাঁর সঙ্গে ধনলোভী স্বার্থাম্বেষী তুলনা করা কি ঠিক?

ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন থেকে যিনি নিজের পারিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হন তিনি কি একই ঈশ্বরকে পেতে চান না? তার স্ত্রীপুত্র যদি ভেসে যায়। তবু তিনি নিজের পুণ্যোব জােনা সন্ন্যাসী হয়ে দিন কাটান না? অর্থাৎ ঈশ্বরকে পেতে তিনি একাই চান নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে। তফাতটা কোথায় আমি বুঝতে পারছি না।

এই সময় অমরনাথ ধমকে উঠলেন, দীপা! এত কথা বলার কোন দরকার নেই।

আর মনোরমা বললেন, না। অমর। দীপা ঠিকই বলছে।

খুব অবাক হয়ে গেল দীপা। যে ঠাকুমা দিনরাত ঠাকুর পুজো আর বস্তাপচা সংস্কার আঁকড়ে থাকেন তাঁর মুখ থেকে এমন কথা সে শুনবে ভাবতে পারেনি। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ঠাকুমা, ভাল করে চেয়ে দেখো তো, ইনি তোমার স্বামী ছিলেন?

মনোরমা জবাব দিলেন না। দীপা একবার বাবার দিকে তাকাল। তারপর বুলল, বাবা, ঠাকুমার কাছে ঠাকুর্দার অনেক গল্প শুনেছি। ওঁর  বা দিকের বুকে একটা বড় আচিল ছিল। ছোটবেলায় সেটা কাটতে গিয়ে ঘা করে ফেলেছিলেন। এই নিয়ে ঠাকুমা তাঁকে খুব ক্ষ্যাপাতেন। তুমি দেখবে সেই দাগটা ওঁর শরীরে রয়েছে কিনা?

মনোরমা বললেন, আঃ। তোমরা থামবে? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না কেন?

অমরনাথ এক পাও এগোলেন না। সন্ন্যাসী হাসলেন। তারপর তীর আলখাল্লার বাঁধন খুলে উধ্বাঙ্গের কিছুটা উন্মুক্ত করে বললেন, সম্ভবত এই দাগটির কথাই উনি তোমাকে বলেছিলেন।

তাঁর কথা শেষ হওয়ামাত্ৰ মনোরমা ছিটকে বেরিয়ে গেলেন ঘরের বাইরে। অমরনাথ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন চেয়ারে। অঞ্জলি দ্রুত শাশুড়িকে অনুসরণ করল।

দীপা বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।

ঠিক হল না। এই চিহ্ন যে কােন মানুষের শরীরে থাকতে পারত। কাকতালীয় ভাবে সে যদি তোমাদের কাছে মিথ্যে বলতে এসে সেটা দেখাতো তাহলে এত তাড়াতাড়ি তাকে স্বীকার করা কি ঠিক?

দীপা মাথা নাড়ল, না। আর কোন প্রমাণের দরকার নেই।

কেন? সন্ন্যাসীর চোখে কৌতুক।

ঠাকুমার আচরণ প্ৰমাণ করছিল। তিনি আপনাকে চিনতে পেরেছেন?

তুমি তো অসাধারণ বুদ্ধিমতী।

তাতে কিছু লাভ হচ্ছে না। কিন্তু এটা কি আপনি ঠিক করলেন! একটি মানুষ এতকাল ধরে জেনে এসেছেন যে তিনি বিধবা। তাঁর সমস্ত সত্তায় সেই ধারণা বসে গিয়েছে। এতদিন বাদে তিনি এই আঘাত কি করে সহ্য করবেন?

আমি তো তাঁর কাছে মৃত।

কিন্তু সেটা এখন তো সত্যি নয়।

কেন নয়! আমার সাংসারিক সত্তা তো সেই করে মরে গিয়েছে।

এটা আপনি যেভাবে ভাবতে পারেন ঠাকুমা তা পাববেন কেন? তিনি আপনার শ্ৰাদ্ধ পর্যন্ত করেছেন ও আমি বুঝতে পারছি না কি হবে?

ঠিকই বলছি তুমি? মৃত মানুষ ফিরে এলে মানুষের সুখের বদলে দুঃখ বাডে। আমি নিজের কথাই ভাবতে গিয়ে এ দিকটা চিন্তা করিনি।

কিন্তু নৌকোড়ুবির পরে আপনি কি করে সন্ন্যাসী হলেন? ঠাকুমার কথা আপনার মনে পড়েনি? তাঁকে বঞ্চিত করে যাচ্ছেন একথা মনে হয়নি?

না। কারণ যে সাধু আমাকে প্ৰাণে বাঁচিয়েছিলেন, দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে তাঁর কাছে থাকার পরে জানতে পেরেছিলাম। তিনি হিমালয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আমি তার অনুমতি নিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে জেনেছিলাম তোমার ঠাকুমা ইতিমধ্যে শ্ৰাদ্ধ করে বৈধব্যজীবন যাপন করতে আরম্ভ করেছেন। কেমন ধিক্কার এল মনে। আমি পৃথিবীতে বেঁচে আছি। অথচ আমার প্রিয়জনেরা মৃত ভেবে নিয়ে তাঁদের মত জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেই মানসিকতায় আমি সাধুব কাছে ফিরে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন হিমালয়ে। ওঁকে যদি কেউ বঞ্চিত করে থাকেন তাহলে তিনি ঈশ্বর। আমি নই। সন্ন্যাসী কথা শেষ করতেই ঘড়িতে শব্দ বাজল। রাত গম্ভীর হচ্ছে। সন্ন্যাসী অমরনাথের দিকে তাকালেন।

অমরনাথ বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে এতক্ষণ কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার চোখাচৌখি হতে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন, বাবা?

সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন না। অমরনাথ এগিয়ে এলেন দুই হাত জোর করে, বাবা, আমাকে ক্ষমা করুন।

তুমি স্বাভাবিক আচরণ করেছ অমরনাথ। এখন কি তোমার কাছে দান পেতে পাবি?

বাবা, আপনি যেতে পারবেন না।

মানে?

আপনাকে আমাদের কাছে থাকতে হবে। অমরনাথের গলার স্বর কাঁপছিল।

অসম্ভব। সন্ন্যাসী কখনও গৃহবাসী হতে পারে না। আপনাকে আমরা পেতে পারি না বাবা? না। সন্ন্যাসী বললেন, আমার প্রার্থনা এবার পূর্ণ কর অমরনাথ।

বাবা। এ জীবনে আপনার দর্শন এভাবে পাব। কখনও ভাবিনি। আমার অনেক সমস্যা। পিতা হয়ে আমাকে কিছু উপদেশ দিয়ে যান। দয়া করে। আজ রাতটা অন্তত থাকুন

না। রাত্রিবাস করা সম্ভব নয়।

কিন্তু এখানে কোন হোটেল দূরের কথা ধর্মশালা পর্যন্ত নেই।

সেই চিন্তা তোমার নয়। সন্ন্যাসী হাসলেন, তোমার নিজস্ব জীবনযাত্রা বলে দেবে সমস্যায় পড়লে তোমার কি ধরনের আচরণ হওয়া উচিত। সংসারী জীবন এবং তার সমস্যা সম্পর্কে কোন আগ্রহ আমার আর অবশিষ্ট নেই।

অমরনাথ ঠোঁট কামড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সন্ন্যাসী দীপার দিকে তাকালেন, তোমার নামটি কি যেন?

দীপাবলী।

বাঃ। আলোকিত কর। নিজেকে প্ৰকাশ কর।

কি ভাবে?

নিজের চারপাশের অন্ধকার দৃব করে। আমি অনুমান করছি তোমার বিবাহ হয়েছিল। তোমার স্বামী বিগত। কিন্তু এখন এই বয়সে–, বিভ্রম হচ্ছে।

আমার বাবা বোধ হয় এই ব্যাপারে। আপনার উপদেশ চাইছিলেন। ওঁরা কেন যে বালিকা অবস্থায় আমার বিয়ে দিলেন তা এখনও আমি বুঝতে পারিনি। বিয্যের দুদিন বাদেই সেই ছেলেটি অসুস্থতায় মারা গেল। তার বাবার হাত থেকে আমি কোনমতে রক্ষা পেয়ে চলে এসেছিলাম। তার দীর্ঘদিন বাদে যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখন জানতাম না যে সেই ভদ্রলোক প্ৰায়শ্চিত্ত করার জন্যে আমার বাবার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ব্যাঙ্কে আমার নামে টাকা রেখেছিলেন যাতে আমি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারি। খবরটা ওর মৃত্যুর পরে আমি জেনেছি। জানাব পর ওঁর নোংরা টাকাব্য আর পড়াশুনা করতে আমি রাজী নই। জলপাইগুড়ি শহরের কলেজ থেকে আজ আমি চলে এসেছি।

সন্ন্যাসী হাসলেন, যা ভাল মনে করেছ তাই হয়েছে।

দীপা বলল, কিন্তু আমাকে সবাই বোঝাতে চাইছেন আমি ভুল করছি।

তাদের নিশ্চয়ই বোঝাবাব অধিকার আছে। সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়ালেন, অমরনাথ কি করবে? বলতে না বলতে অমরনাথ এবং অঞ্জলি ফিরে এলেন। আমন্ত্ৰ  থৈর হাতে একটি থালায় রাতের খাবার। তিনি বললেন, আপনি হাত মুখ ধুয়ে তারপর নিশ্চয়ই এসব গ্ৰহণ করবেন?

সন্ন্যাসী বললেন, তার প্রয়োজন হবে না। এত কেন এনেছ? আমি সামানা অন্ন চেয়েছি তোমার কাছে। তুমি ওই থালা থেকে একমুঠো। আমার হাতে তুলে দাও।

আপনি আমার এখানে রাতেব খাবার খাবেন না?

না। সন্ন্যাসী দুটো হাত অঞ্জলির মত এগিয়ে ধরেও সরিয়ে নিলেন। তিনি দীপার দিকে তাকালেন, শোন মা। তুমি পথিক, পথ তোমার। সেই পথ রাজা তৈরী করেছেন না কোন অসৎ ধনীর টাকায় তৈরী হয়েছে তা তো তোমার জানার কথা নয়। পথিকের কাজ পথ ধরে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। শরীরের জন্যে জীবন নয়, জীবনের জন্যে শরীর। লক্ষ্যে পৌঁছে পথিক পায়ের ধুলো ধুয়ে ফেলে জলে। সেটাই তো উচিত। পথ পড়ে থাকে পথে। সন্ন্যাসী আবার অমরনাথের দিকে ফিরলেন, দাও।

তাঁর বাড়ানো দুই হাতের চেটোয় এক মুঠো অন্ন তুলে দিলেন অমরনাথ। সন্ন্যাসী মনে মনে কিছু বললেন। তাঁর দুটো ঠোঁট কাপছিল। সযত্নে ওই অন্ন তিনি নিয়ে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। নেমে দাঁড়ালেন অন্ধকার আকাশের নিচে। তারপর মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে সেই অন্ন ছড়িয়ে দিতে লাগলেন মাটি, জল, আলো, বাতাস এবং আকাশের উদ্দেশে। হ্যারিকেনের আলোর যে সামান্য অংশ বাইরে আসতে পেরেছিল তাতে তাঁকে খুব রহস্যময় মনে হচ্ছিল। উৎসর্গ শেষ হলে তিনি যখন স্থির হলেন তখন অমরনাথ এবং অঞ্জলি তাঁর পায়ের সামনে নতজানু হলেন। সন্ন্যাসী হাত তুলে আশীর্বাদ করে ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আসাম রোডের দিকে এগিয়ে চললেন। আর তখন অমরনাথ ড়ুকরে কেঁদে উঠলেন। অঞ্জলি তাঁকে বলল, তুমি ওঁকে চলে যেতে দিচ্ছ? তোমার বাবা না? যাও, আটকাও। মায়ের কথা ভাবতে পারছি? উনি চলে গেলে ওঁর কি হবে?

অমরনাথ বললেন জড়ানো গলায়, থাকলে কি ভাল হবে অঞ্জলি?

অঞ্জলি সেটা বুঝতে চাইল না, স্বামীকে পঞ্চাশ বছর পরে ফিরে পেতে স্ত্রীর ভাল লাগবে না? কি যাতা বলছ? তাছাড়া এত রাত্রে এই জঙ্গুলে জায়গায় উনি কোথায় থাকবেন?

দীপা চুপচাপ শুনছিল। তার চোখের সামনে একটি মানুষ বংশধরের কাছ থেকে অন্নের ডেলা গ্ৰহণ করে পঞ্চভূতে ছড়িয়ে দিয়ে নির্বিকারভাবে চলে গেলেন। এই সংসার এই অন্ধকার কোন কিছুই তাঁর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারল না। সে বলল, মা, বাবা ঠিকই বলেছেন। ওঁকে ডেকে কোন লাভ হবে না।

দীপা ভেতরে চলে এল। বসার ঘর শোওয়ার ঘর পেরিয়ে উঠোনের বারান্দায্য পৌঁছে মনোরমার ঘরের দিকে তাকাল। দরজা ভেজানো। আলো জ্বলছে। সে নিঃশব্দে দরজা খুলল। মনোরমা বসে জপ করছেন, রোজ যেমন করেন। ঠাকুমার পুজো এর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে বলে সে জানত। দীপা খাটের ওপর বসল।

তার চোখের সামনে এক বৃদ্ধার টানটান শরীর, যে শরীরে কম্পন নেই। একমাত্র একবার কেঁদে ওঠা ছাড়া ঠাকুমা সমানে অস্বীকার করে গিয়েছেন ঠাকুর্দার অস্তিত্ব। যাওয়ার সময় ঠাকুর্দা ভুলেও ওঁকে ডাকেননি। উনি জানেন না এখনও, ঠাকুর্দা চলে গিয়েছেন। সত্যি কি ঠাকুমা মনে করছেন উনি ঠাকুর্দা নন! কিন্তু কি স্বাৰ্থ নিয়ে মানুষটা এখানে আসবেন? মনোরমা যেভাবে বসে আছেন তাতে মনেই হচ্ছে না কোন কিছু তাঁকে আলোড়িত করেছে। পুজোর সময় তাঁকে ডাকা নিষেধ। দীপা অপেক্ষা করতে লাগল।

এ বাড়ির কোথাও কারো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তত আধঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর প্ৰণাম সেরে মনোরমা উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর নজর পড়ল দীপার ওপর। দীপা তাঁর চোখের দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তুমি বিশ্বাস করো উনি ঠাকুর্দা নন।

নিশ্চয়ই। মনোরমা জবাব দিলেন।

কিন্তু উনি তো প্ৰমাণ দিলেন।

কিসের প্রমাণ? বুকের দাগ আর অতীতের গল্প গ্য তাতে কি হয়েছে? এই যে আমি পঞ্চাশ বছর ধরে বৈধব্যজীবন পালন করছি সেটা মিথ্যে হয়ে যাবে এক নিমেষে? আমার বাবা পঞ্চাশ বছর আগে অনেক খবর নিয়ে জেনেছিলেন তিনি মারা গিয়েছেন। আজ ভূতের মত বেঁচে ফিরে এলেই হল? উঃ, আর কত বুজরুকি দেখব!

তাহলে তুমি কাঁদলে কেন? কেন চলে এলে?

আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।

কিন্তু ধরে ঠাকুর্দা তখন মারা যান নি, আজ সত্যি উনি ফিরে এসেছেন  কে বলল। মারা যায়নি! যখন মানুষের মন থেকে টান চলে যায়। তখন সে বেঁচে থাকে না কি, নে ওঠ, খেয়ে নে।

অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দীপা। তার মনে হল। ঠাকুমা ঠিকই বলছেন। ঠাকুর্দা যদি ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্যে পঞ্চাশ বছর ধরে স্বার্থপরতা দেখান, যদি আজ সংসারে এক মুহুর্তের জন্যে এই ফিরে আসাটা স্বার্থের কারণে হয়ে থাকে তাহলে ঠাকুমা ঠিকই করেছেন তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। সে বলল, দাঁড়াও!

দীপা মনোরমাকে প্ৰণাম করল। মনোরমা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। দীপা ফিসফিস করে বলল, তুমি শক্ত হও ঠাকুমা, তুমি একজন সন্ন্যাসীর চেয়েও অনেক বড়। একটু শান্ত হয়ে মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কলেজে ফিরে যাবি তো?

দীপা মাথা নাড়ল, যাব। মনে মনে সে উচ্চারণ করল, পথ তুমি কার? পথিকের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *