1 of 3

১.২৪ হারীত মণ্ডলকে নিয়ে ত্রিদিব

হারীত মণ্ডলকে নিয়ে ত্রিদিবকে ইদানীং বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। সুলেখার প্রশ্রয় পেয়ে সে বাড়িতে যখন তখন এসে উপস্থিত হয়, সময়-অসময় মানে না, দরজা খোলা থাকলে ওপরে উঠে যায় সরাসরি। কথা বলায় কোনো শ্রান্তি নেই তার। রাজনীতি বিষয়ে সে অনর্গল উগ্র মন্তব্য করে অন্যদের চমকে দিতে ভালোবাসে।

পূর্ব বাংলার সঙ্গে ত্রিদিবদের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ হলেও রিফিউজিদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি আছে। তা হলেও একজন রিফিউজি নেতা যখন তখন বাড়িতে এসে উপদ্রব করলে তা সহ্য করা শক্ত।

ত্রিদিব অবশ্য অতিশয় ভদ্র। কোনোদিনই সে মুখ ফুটে হারীত মণ্ডলকে নিষেধ করতে পারবে না। হারীত এমনিতে আসা-যাওয়া করলে ত্রিদিবের কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু

মুশকিল হচ্ছে অন্যান্য অতিথি-অভ্যাগতদের সঙ্গে কথা বলার সময়েও হারীত এসে সেখানে। বসে, আলোচনায় অংশ গ্রহণ করে, এবং এমন সব অদ্ভুত মতামত প্রকাশ করে যাতে কেউ কেউ অপমানিত বোধ করতে পারে। হারীতের চেহারা ও পোশাক ও কথা বলার ধরন অন্যান্য অতিথিদের চেয়ে এতই আলাদা যে তাঁরা অবাক হয়ে ত্রিদিবের দিকে তাকান।

তা ছাড়া ত্রিদিব জানতে পেরেছেন যে হারীত কাশীপুরের যে জবরদখল বাড়িটিতে থাকে, সে বাড়ির মালিক ছিলেন প্রতাপের দিদির স্বামী অসিতবরণ এবং সেই বাড়ি দখলের হাঙ্গামাতেই অসিতবরণ সেখানে মারা যান। প্রতাপ হারীতকে চিনতে পারলে নিশ্চিত মর্মাহত হবেন। যে ব্যক্তি তাঁর ভগ্নীপতির মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে দায়ী, সেই ব্যক্তিকে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে খাতির যত্ন পেতে দেখলে তাঁর পক্ষে ক্ষুব্ধ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

এই সমস্যার কথা বলতেই সুলেখা ব্যথিত বিস্ময়ের সঙ্গে বলে ওঠেন, ইস, ছি ছি ছি, অসিতদা কী ভালোলোক ছিলেন…এখন কী করা যায়?

ত্রিদিব বললেন, ঐ হারীত তোমাকে মা জননী, মা জননী বলে ডাকে।

–শুনলে আমার হাসি পায়!

–তুমি ওকে বারণ করতে পারবে? যাতে এ বাড়িতে আর না আসে?

–আমি? না, না তুমি বলে দাও, আমি যখন বাড়িতে থাকবো না।

শেষ পর্যন্ত আর বলা হয়ে ওঠে না। এরা দু’জনেই ভদ্রতার-শিকার!

ত্রিদিব মনে মনে ঠিক করে রাখলেন, এর পর প্রতাপ এলে তিনি তাঁর কাছে হারীত মণ্ডলের প্রকৃত পরিচয় দিয়ে দেবেন। তারপর প্রতাপ যা ভালো বুঝবেন করবেন। কিন্তু প্রতাপ কয়েক সপ্তাহ হলো আর আসছেন না এদিকে।

এক সন্ধেবেলা নিচের বৈঠকখানা ঘরে ত্রিদিব গল্প করছেন কয়েকজনের সঙ্গে, চা পরিবেশন। করছেন সুলেখা। এই সময় হারীত এসে ঢুকলো সেখানে। এক কোণে নিজের স্থান করে নিল।

ইংল্যাণ্ড থেকে একটি থিয়েটার দল এসেছে কলকাতায়, তাদের তিনটি শেক্সপীয়ারের নাটক দেখতে ভিড় একেবারে আছড়ে পড়েছিল। এখানে আলোচনা হচ্ছে সেই নাটকগুলির। উৎকর্ষ-অপকর্ষ বিষয়ে। হারীত মণ্ডলের এই সব বিষয় একেবারেই বোধগম্য হবার কথা নয়, তবু সে মন দিয়ে শোনে। তার কৌতূহলের শারীরিক লক্ষণ ফুটে ওঠে, মুখটা খানিকটা হাঁ হয়ে যায়। চোখের দৃষ্টি স্থির, কানদুটি খরগোশের মতন বেশি লম্বা মনে হয়।

ত্রিদিব বললেন, রিচার্ড দা থার্ড আমাদের দেখা হলো না। শুনেছি ঐটাই সবচেয়ে ভালো—

সুলেখা বললেন, আমার খুব দেখার ইচ্ছে ছিল, তুমি তো টিকিট জোগাড় করতে পারলে!

ত্রিদিব বললেন, কী করবো বলো, যা লম্বা লাইন!

ত্রিদিবের এক বন্ধু বললেন, আমায় বললে পারতে, আমি ব্রিটিশ কাউনসিল থেকে ব্যবস্থা করে দিতে পারতুম। অবশ্য আমি লণ্ডনে লরেন্স অলিভিয়ারের প্রোডাকশন দেখে এসেছি, এটা ততটা ভালো নয়!

আর একজন বললেন, আশ্চর্য শহর এই কলকাতা! কদিন ধরে পাঁউরুটি পাওয়া যাচ্ছে না জানো তো, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সামনে বিরাট লাইন দেখে এলুম। এই শহরের মানুষ পাঁউরুটির জন্যও লাইন দেয় আবার শেক্সপীয়ারের নাটকের জন্যেও লাইন দেয়!

অন্যরা হেসে উঠতেই সেই সুযোগ নিয়ে হারীত বললো, সত্যিই আইশ্চর্য শহর। শিয়ালদহ ইস্টিশানে রিফিউজি থিকথিক করত্যাছে, তারই মধ্য দিয়া হৈ হৈ করতে করতে বর্ন-ভোজন পার্টি যায়।

এরকম একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গ এসে পড়ায় সবাই চুপ করে গেলেন। বস্তুত আলোচনার বিষয়। হিসেবে রিফিউজিদের সাবজেক্টটা এখন তেতো হয়ে গেছে। প্রথম দিকের খানিকটা সমভ্রাতৃত্ববোধ, খানিকটা বেদনা, খানিকটা উদাসীনতা কেটে গিয়ে এখন অনেকেই বিরক্তভাবে অনুভব করতে শুরু করেছে যে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর অধ্যাসে সর্বনাশ হতে বসেছে কলকাতা শহরটার।

হারীত বললো, সার, আপনারা গুণী-জ্ঞানী মানুষ, আপনাগো কাছে জানতে চাই, এই যে। আমাদের মতন রিফিউজিদের জোর করে দণ্ডকের জঙ্গলে পাঠাইত্যাছে, এটা কী ঠিক হইতাছে?

ত্রিদিবের পাশে বসা তাঁর এক সুবেশ, সুপুরুষ বন্ধু এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, আমার তো মনে হয়, এটাই খুব ভালো ব্যবস্থা হয়েছে। রিফিউজিদের দায়িত্ব শুধু পশ্চিমবাংলা নিতে যাবে কেন, এটা সারা ইন্ডিয়ার লায়াবিলিটি! পশ্চিমবাংলা এমনিতেই ওভার পপুলেটেড, তার ওপরে যদি লাখ লাখ রিফিউজি এখানে এসে গাদাগাদি করে তাতে লাভ কী হবে? চাকরিবাকার, জমি-জমার ভাগ নিয়ে মারামারি শুরু হবে, গোটা ওয়েস্ট বেঙ্গলের ইকোনমিটাই ধ্বংস হয়ে যাবে! তার চেয়ে ইণ্ডিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ওদের ছড়িয়ে দিলে সেখানে সেখানে বেঙ্গলি পকেট হবে, তাতে আমরাই লাভবান হবো!

অন্যরাও এই যুক্তিতে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।

হারীত সেই সুবেশ ব্যক্তিটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, আপনি যখন এই কথা কইলেন, তখন আপনারে একটা কোশ্চেন করি। মনে করেন, আপনে কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে বিপদে পড়ে সাহায্য চাইতে গ্যালেন, সেই আত্মীয় যদি বলে, আমার বাড়িতে তো জায়গা হবে না, আমার বাড়ির পিছনের বাগানেও নেপালী আর বিহারীগো থাকতে দিছি, তুমি বাপু জঙ্গলে গিয়া বাঘ-সিংহের সাথে লড়াই কইর্যা ঘরবাড়ি বানায়া লও! তখন সেই কথা শুনে আপনের ক্যামন লাগতো?

বন্ধুটি বললেন, আপনার এই প্রশ্নটি বড় বেশি হাইপথেটিক্যাল। আমার এরকম ভাবে কারুর কাছে আশ্রয় চাওয়ার কখনো কোনো কারণ ঘটে নি। সুতরাং এর রি-অ্যাকশানও আমি। বুঝতে পারবো না। তবে, দণ্ডকারণ্যে গিয়ে আপনাদের বাঘ-সিংহের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কেন? সরকার আপনাদের জন্য নতুন টাউনশীপ বানাবে। দেখুন না, পাঞ্জাবীরা…।

–শোনেন সার, আর একটা কথা শোনেন। আমার একখান নিজস্ব বাড়ি আছিল, টিনের চালা, তিনখান কামরা। রান্না ঘর, গোয়াল ঘরও আছিল। এছাড়া, একটা ছোট পুকুর, আর একখান বড় শরিকী পুষ্করিণীর ভাগ পাইতাম, তেরো বিঘা ধান জমি, সম্বৎসরের মাছ-ভাতের কোনো চিন্তা ছিল না। এইসব কিছু বিনা দোষে পরিত্যাগ কইরা আমি চইলা আসতে বাধ্য হইলাম ক্যান? আপনাগো মতন শিক্ষিত মানুষদের জন্যই তো!

–আমাদের জন্য?

–আলবৎ! আপনি তো মোছলমান। আপনারাই তো পার্টিশান চাইছিলেন।

ত্রিদিবের এই বন্ধুটির নাম শাজাহান চৌধুরী। অত্যন্ত মার্জিত ও রুচিশীল স্বভাবের মানুষ। ওঁদের আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা আছে, তা ছাড়া জলপাইগুড়ি জেলায় নিজস্ব চা বাগান আছে, বেশ কয়েক পুরুষের ধনী। শাজাহান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের খুব ভক্ত, গুলাম আলি খাঁ, বিলায়েৎ খাঁর মতন ভারতবিখ্যাত কলাকারেরা তাঁদের বাড়িতে এসে ওঠেন মাঝে মাঝে। ত্রিদিব তাঁর এই প্রাক্তন কলেজসহপাঠীর প্রভাবেই ইদানীং ঐসব গান বাজনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। সুলেখাও খুব পছন্দ করেন শাজাহানকে।

হারীত মণ্ডলের আকস্মিক কটুক্তিতে শাজাহানের গৌরবর্ণ মুখোনি আরক্তিম হয়ে গেল।

ত্রিদিব তাড়াতাড়ি বললেন, এসব আপনি কী বলছেন, হারীতবাবু? সব মুসলমানরাই পার্টিশানের জন্য দায়ী নাকি? এরকমভাবে আপনার কথা বলা উচিত নয়।

হারীত উদ্ধতভাবে বললো, সব মোছলমান দায়ী, সে কথা তো আমি বলি নাই! আমাগো আশপাশের গ্রামে যেসব গরিব মোছলমান আছিল, তারা তো অনেকেই বোঝে নাই পাকিস্তান কী বস্তু! তাগো সাথে আমাগো কোনো ঝগড়া কাজিয়া ছিল না। আমরা চইল্যা আসার সময় তাগো মইধ্যে কেউ কেউ কান্দছে। আমি কইছি শিক্ষিত মোছলমানগো কথা। তারাই তো পলিটিক্স কইরা দেশটার সর্বনাশ করলো। তারা পার্টিশান করাইলো আবার তাগো মইধ্যেই অনেকে ভারতে রইয়া দিব্যি গাড়ি হাঁকায়!

প্রথম আঘাতটা সামলে নিয়ে শাজাহান চৌধুরী কঠোরভাবে বললেন, আপনি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বা অধ্যাপক হুমায়ন কবিরের নাম শুনেছেন কি না জানি না। এরা সেই পার্টিশান বা পাকিস্তান আইডিয়া সমর্থন করেননি। আপনি যদি—

হারীত মণ্ডল উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত ছুঁড়ে বললেন, ঐসব পুতুলগো কথা বাদ দ্যান। আপনি নিজে সেসময় কী করছিলেন? আপনি প্রটেস্ট করছিলেন? আপনি থাকবেন কলকাতা শহরে আর আমাগো যাইতে হবে দণ্ডকারণ্যে? ক্যান?

সুলেখা মাঝখানে চলে এসে বললেন, ছি ছি ছি, হারীতবাবু, এসব কী বলছেন! আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? চলুন, আপনি ওপরে চলুন, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

সুলেখা কারুর অঙ্গ স্পর্শ করেন না, এখন তিনি হারীতের একটা হাত ধরে বললেন, চলুন!

অন্য কেউ এই তর্কস্থান থেকে হারীতকে সহজে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারতো না, কিন্তু। সুলেখার ধমকে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

একটুক্ষণ আড়ষ্ট নীরবতার পর ত্রিদিব লজ্জিতভাবে বললেন, ওর খানিকটা মাথার গোলমাল আছে। তুমি কিছু মনে করো না, শাজাহান!

ত্রিদিবের আর এক বন্ধু অমিতাভ বললেন, ওরা নিজস্ব বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে, এখানেও কুকুর-বেড়ালের মতন তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে যদি কারুর মাথার গোলমাল হয়ে যায়, সেটা অস্বাভাবিক কিছু না!

শাজাহান চৌধুরীর মুখোনি পাথরের মূর্তির মতন স্থির।

ত্রিদিব অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছেন। তাঁর বাড়িতে এসে তাঁর কোনো বন্ধু অপমানিত হলো। এরকম আগে কখনো ঘটেনি। এখনই চাচামেচি করে হারীতকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে হয়তো শাজাহানকে খানিকটা তৃপ্ত করা যায়। কিন্তু চাচামেচি করাটাই যে ত্রিদিবের স্বভাবে নেই। তিনি ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হতে লাগলেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘোর ভেঙে শাজাহান আপন মনে বললেন, টু নেশান থিয়োরি! ইণ্ডিয়ার লীডাররা যতই তা অস্বীকার করুক, সাধারণ মানুষের চামড়া কেটে একেবারে ভেতরে গেঁথে গেছে এই থিয়োরি। ভারতীয় হিন্দুরা আর কোনোদিন ভারতীয় মুসলমানদের বিশ্বাস করবে না!

ত্রিদিব বললেন, না, না, না, এটা তুমি কী বলছো? রেফিউজিরা হাই স্ট্রাং হয়ে আছে। ওদের মতামত উগ্র হতেই পারে এখন। কিন্তু আমাদের পুরো ব্যাপারটা হিস্টোরিক্যাল পারসপেকটিভে দেখতে হবে!

শাজাহান বললেন, রেফিউজিরা প্রত্যক্ষ সাফারার, তারা রাগে-দুঃখে নানারকম কথা বলতে পারে তা জানি। কিন্তু অন্যদেরও মনের কথা তাই। অমিতাভও তো এইমাত্র ওদেরই সমর্থন করে বললো।

অমিতাভ ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন, না, না, আমি সে সেসে বলিনি। আমি বলতে চাইছিলুম, ওরা অসহায় অবস্থায় পড়েছে বলেই–

শাজাহান বললেন, আমি লক্ষ করেছি, যেখানে শুধু হিন্দুরা থাকে, সেখানে আমি হঠাৎ গিয়ে পড়লে তারা থেমে যায়। যেন তারা যে আলোচনা করছিল, সেটা আমার শোনা উচিত নয়। অপ্রস্তুত হয়ে তারা প্রসঙ্গ পাল্টায়। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই এরকম দেখেছি!

অমিতাভ বললেন, এটা তোমার একটা কমপ্লেক্স, ভাই! আমরা এমন কোনো কথা বলি না–

শাজাহান হাত তুলে বললেন, ওয়েট, ওয়েট। আমার কথা শেষ হয়নি। এর অন্যদিকও. আছে। আমাদের মুসলিম সমাজে প্রায়ই পাকিস্তানের প্রসঙ্গ ওঠে। প্রত্যেকেই মনে মনে পাকিস্তানের সাপোটার। অনেকেই ইস্ট পাকিস্তানে কিছু সম্পত্তি কিনে রাখার কথা ভাবে। কিন্তু কোনো হিন্দু সেখানে এসে পড়লে তারা এইসব কথা উচ্চারণও করবে না। সেই জন্যই বলছিলাম, টু নেশান থিয়োরি…

এই সময় সুলেখা হারীত মণ্ডলকে নিয়ে ঢুকলো। হারীত এগিয়ে এসে শাজাহান চৌধুরীর হাত জড়িয়ে ধরে নাটকীয়ভাবে বললো, আমারে ক্ষমা করেন, সার। আমি অন্যায় করছি। আমার মাথা গরম, পাগল-ছাগল মানুষ, কখন কী কই তার ঠিক নাই। আপনাগো কোনো দোষ নাই, আমরা রিফিউজি হইছি, সেটা আমাগো ভাগ্যের দোষ!

ব্যাপারটা সেদিনকার মতন মিটে গেলেও তার রেশ রয়ে গেল।

এর দু’দিন বাদেই ত্রিদিব সস্ত্রীক গেলেন শাজাহানের বাড়িতে। প্রায় তিন ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে এলেন। এবং পরের শনিবারের জন্য তিনি শাজাহান-পরিবারকেও নেমন্তন্ন করে এলেন তাঁর বাড়িতে সান্ধ্য আহারের জন্য।

এর মধ্যে প্রতাপ একদিন এসেছিলেন। ত্রিদিব আর সুলেখা হারীত মণ্ডলের সব ব্যাপারটা খুলে বলতে প্রতাপের মনে বিশেষ কিছু প্রতিক্রিয়া হলো না। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, লোকটাকে একদিন এখানে দেখেছিলাম বটে, তখন চিনতে পারিনি!.তা সে যদি এ বাড়িতে আসে, আমি আপত্তি করবো কেন?

ত্রিদিব বললেন, মজুমদার সাহেব, আমরা চাই, আপনি লোকটাকে একটু ধমকে দিন। যাতে সে এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে। আপনার জামাইবাবুর সম্পত্তি ওরা দখল করেছে

প্রতাপ বললেন, শুনুন, আপনাদের সঙ্গে আমার একটা বেসিক তফাত আছে। আপনারা ছিন্নমূল নন, কলকাতা শহরে অনেকদিন থেকেই আপনাদের শিকড় ছিল। কিন্তু আমি তো উদ্বাস্তু! নিজেদের সম্পত্তি ফেলে এসে এখানে ভাড়া বাড়িতে মাথা গুঁজে আছি। আবার ঐ রিফিউজিদের জন্যই আমার দিদি বিধবা হয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। দিদির শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি ওরা গ্রাস করেছে। তা হলেও কি আমি রিফিউজিদের বিরুদ্ধে যেতে পারি?

–ঐ হারীত মণ্ডলের নামে যদি একটা মামলা আসতো আপনার এজলাসে, আপনি কী করতেন?

–আমি আদালত থেকে লম্বা ছুটি নিতাম। আমার পক্ষে এখানে ন্যায় বিচার করা অসম্ভব।

চমকপ্রদ ঘটনাটি ঘটলো পরের শনিবার।

সেদিন বিকেল থেকেই হারীত মণ্ডল হাজির। সে এবাড়িতে এসে কোনো রকম সাহায্য চায় না, টাকা-পয়সা সাহায্যের সামান্য ইঙ্গিত করলেও জিভ কেটে প্রত্যাখ্যান করে। খাদ্যদ্রব্যের প্রতিও তার আসক্তি নেই। অশোক বনে সীতার সামনে হাত জোড় করা হনুমানের ছবির মতন সে শুধু সুলেখার সামনে মেঝের ওপর বসে নানারকম গল্প শোনাতে ভালোবাসে। দারিদ্র্য, অবিচার, অত্যাচার, বুকের মধ্যে জমে থাকা ক্রোধ, এইসব কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়ে সে যেন এ বাড়িতে সুস্থ জীবনের, জীবন-সৌন্দর্যের খানিকটা ঝাঁপটা নিতে আসে।

এই শনিবার এসে সে প্রথম একটা দাবি জানালো। সে সুলেখাকে বললো, মা জননী, আজ রাত্তিরটা আপনাগো বাড়িতে আমারে থাকতে দেবেন? আজ কাশীপুরে যাওয়ার একটু অসুবিধা আছে আমার।

সুলেখা আমতা আমতা করে বললেন, আজ বাড়িতে কিছু লোকজন আসবে নেমন্তন্ন খেতে….

হারীত বললো, আমি চাকরদের ঘরে শুইয়া থাকবে। তাতে আমার কোনো অসুবিধা নাই!

এর পর আর না বলা যায় না। একজন মানুষ বাড়িতে আশ্রয় চাইছে। অবস্থার বিপাকে হারীত মণ্ডল এখন অতি দরিদ্র হলেও তার একটা ব্যক্তিত্ব আছে। যে-কোনো মানুষের চোখের দিকে সরাসরি চেয়ে কথা বলতে পারে। তাকে হেলাফেলা করা সহজ নয়। সুলেখা বললেন, শাজাহান সাহেবরা আসছেন, তুমি তাঁর সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করবে না!

কথায় কথায় জিভ কাটা স্বভাব হারীতের। সেই রকম ভঙ্গি করে সে বললো, আরে না, না! মাপ চাইছি তো সেদিন। যদি চান তো আমি চৌধুরী সাহেবের পা টিপ্যা দিতে পারি।

সন্ধের পর একে একে আসতে লাগলেন অতিথিরা। শাজাহান চৌধুরী তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে। এলেন সাড়ে সাতটায়। তাঁর স্ত্রী চলে গেলেন ওপরে, পুরুষরা বৈঠকখানায় বসে গল্প-গুজব করতে লাগলেন। হারীত মাঝে মাঝে শাজাহান’সাহেবকে অ্যাসট্রে এগিয়ে দেয় কিংবা অনুরোধ করে, আপনি মাঝখানটায় এসে বসুন, এখানে বেশি বাতাস পাবেন। আইজ যা গরম পড়ছে!

আচ্ছা বেশ জমে উঠেছে, এমন সময় দুয়ারে করাঘাত। এ ডাক অন্যরকম, ঠিক অতিথিদের মতন নয়। ত্রিদিবের গৃহভৃত্য দু’জন অবাঞ্ছিত অতিথিকে দরজা খুলে বৈঠকখানায় নিয়ে এলো। দু’জন পুলিশ অফিসার।

একজন অফিসার বললেন, ত্রিদিববাবু কার নাম? আপনার এখানে হারীত মণ্ডল নামে কেউ—

তারপর হারীতের দিকে চোখ পড়তেই তিনি বললেন, ও এই তো! একেবারে জলজ্যান্ত হারীত মণ্ডল! চলুন!

ত্রিদিব বললেন, কী ব্যাপার? আপনারা

অফিসারটি বললেন, এই চিড়িয়াটিকে আমরা অনেকদিন ধরে খুঁজছি। একে আমরা অ্যারেস্ট করতে এসেছি।

হারীত মণ্ডল খুব একটা অবাক হয়েছে বলে মনে হয় না। মুখে ভয়ের চিহ্নও নেই। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি।

সে পুলিশ অফিসারটিকে জিজ্ঞেস করলো, আমারে আপনারা একদিন না একদিন ধরবেন, তা জানতাম। কিন্তু কী করে জানলেন যে আইজ আমি এইখানে থাকবো?

পুলিশ অফিসারটি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ওহে, আমরাই লোককে প্রশ্ন করি। অন্যের প্রশ্নের উত্তর দেবার অভ্যেস আমাদের নেই। এবার চলো। চক্রবর্তী, ওর হাতে গয়না পরিয়ে দাও!

অন্য অফিসারটি হারীতের হাতে হাতকড়া লাগালো। হারীত মুখ ফিরিয়ে শাজাহানের দিকে তাকিয়ে বললো, সার, আপনে আমারে ধরায় দিলেন? আর দুই চারটা দিন যদি সময় পাইতাম!

শাজাহানের মুখোনি বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেন, আমি ধরিয়ে দিয়েছি? ফর গডস্ সেক….

হারীতকে নিয়ে বেরিয়ে গেল পুলিশদ্বয়।

শাজাহান ত্রিদিবের হাত চেপে ধরে বললেন, তুমি বিশ্বাস করো! আমি এর বিন্দুবিসর্গও জানি না।

ত্রিদিব বললেন, আমি জানি! আমি জানি! সে প্রশ্নই ওঠে না!

শাজাহান আবার বললেন,পুলিশের সঙ্গে আমার কোনো কানেকশানই নেই…তা ছাড়া আমি জানতুমই না যে ও আজ এখানে…ত্রিদিব, তুমি ওয়ারেন্ট দেখতে চাইলে না কেন?

ত্রিদিব বললেন, ডোন্ট গেট আপসেট। পরে ভেবেচিন্তে একটা ব্যবস্থা করা যাবে, শাজাহান, প্লীজ, তুমি ওর কথায় গুরুত্ব দিও না।

সুলেখা খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে নেমে এলেন ওপর থেকে। তখন পুলিশ হারীতকে বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলছে। খালি পায়েই রাস্তায় চলে এসে সুলেখা প্রায় হাহাকার করে  বললেন, একী, ওকে নিয়ে যাচ্ছেন? আমাদের বাড়ি থেকেও কিছু খায়নি, একটু দাঁড়ান, একটু সময় দিন….

বড় পুলিশ অফিসারটি মাথা থেকে টুপী খুলে নরম গলায় বললো, আমরা দুঃখিত, ম্যাডাম, আমাদের কিছু করার নেই। এর নামে ক্রিমিন্যাল কেস আছে।

সুলেখা অন্য দিকে মুখ ফেরালেন, তাঁর দু’চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এলো। সেই দৃশ্য দেখে পুলিশ দু’জনও অনড় হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

হারীত মণ্ডল ধরা গলায় বললো, আপনি আমার মতন একটা নগইন্য মানুষের জন্য চক্ষের জল ফ্যাললেন? মা জননী, আমি ধন্য হইলাম। পুলিশে আর আমার কী করবে, বড় জোর ফাঁসী দেবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *