প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.২৪ কাল রাত্তিরেই বই বার করে

কাল রাত্তিরেই বই বার করে রেখেছিলেন সুরমা।

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মুখটুখ ধুয়ে হেমনাথ আর ঝিনুকের সঙ্গে প্রথমে সুর্যস্তব সেরে নিল বিনু। তারপর পড়তে বসল। পুজোর ছুটির পর স্কুল খুললেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা। এখন থেকেই একটু আধটু পড়াশোনা না করে গেলে ডাহা ফেল।

বিনু একাই না, সুধা সুনীতিও আজ তাড়াতাড়ি উঠে বই নিয়ে বসেছে। কলেজ খুললেই অবশ্য তাদের পরীক্ষা নয়। তবু চর্চাটা রাখা ভাল। নইলে সব ভুলে বসে থাকবে।

পুবের ঘরের বারান্দায় তিন ভাই বোন পড়তে বসেছিল। দূর প্রান্তে বসে ছিলেন হেমনাথ, তার পাশে ঝিনুক।

পড়ার ফাঁকে বিনুর চোখ বার বার ঝিনুকের দিকে চলে যাচ্ছিল। ঝিনুকও একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

বিনু শুনতে পেল, অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর নিচু গলায় ঝিনুক হেমনাথকে ডাকল, দাদু–

হেমনাথ দূরে ধানখেতের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছিলেন। মুখ ফিরিয়ে বললেন, কী রে–

আমি পড়ব।

খুব ভাল কথা। পড় না—

আমাকে বই দাও—

কোথায় তোর বই?

আমাদের বাড়িতে।

আচ্ছা আনিয়ে দেব’খন। তখন পড়িস।

ঝিনুক শুনল না। মাথা ঝাঁকিয়ে বঁকিয়ে বায়না জুড়ে দিল, এক্ষুণি আনাও, এক্ষুণি আনাও–

হেমনাথ বললেন, এক্ষুণি তোদের বাড়ি কে যাবে? ও বেলা–

না না—

আরে বাপু, একবেলা না পড়লে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

বায়নার সঙ্গে এবার কান্না জুড়ে দিল ঝিনুক, বিনুদাদা পড়ছে যে—

চোখ বড় বড় করে বিস্ময়ের গলায় হেমনাথ বললেন, ও, বিনুদাদা পড়ছে বলে পড়তে হবে!

হ্যাঁ– ঝিনুক ঘাড় কাত করল।

হিংসের জ্বালা কত! বলেই গলা তুলে ডাকতে লাগলেন হেমনাথ, স্নেহ-স্নেহ—

স্নেহলতা ভেতর-বাড়িতে ছিলেন, বড় বড় পা ফেলে চলে এলেন। তাঁর সঙ্গে সুরমা।

স্নেহলতা বললেন, এত চেঁচামেচি কেন? হয়েছে কী?

তাড়াতাড়ি খেতে দাও। আমি বেরুব।

কী রাজকার্য আছে শুনি?

রাজকাৰ্যটা কী, হেমনাথ বললেন।

শুনে হাসলেন স্নেহলতা, তা হলে তো যেতেই হবে।

কোমল গলায় ওধার থেকে সুরমা বললেন, আহা পড়ক, পড়ক। বিনুকে হিংসে করে মেয়েটা যদি মায়ের কথা ভুলে থাকে তো থাক। ওর অন্যমনস্ক হওয়া দরকার।

সুরমারা চলে গেলেন।

একটু পর সকালবেলার খাবার এসে গেল।

খাওয়া যখন আধাআধি হয়ে এসেছে সেই সময় বাগানের দিক থেকে অবনীমোহন এলেন।

হেমনাথ বললেন, কী ব্যাপার অবনী, ওদিকে কোথায় গিয়েছিলে?

অবনীমোহন বললেন, ঘুম থেকে উঠে রাস্তা ধরে একা একা অনেকখানি ঘুরে এলাম। ভারি ভাল লাগছিল। কলকাতার ধোঁয়া নেই, ভিড় নেই, গুতোগুতি ধাকাধাক্কি নেই। মনে হয়, এখানেই থেকে যাই। আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।

হালকা গলায় হেমনাথ বললেন, বেশ তো, থাকো না। তারপরেই কী মনে পড়ে যেতে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, মুখ টুখ ধুয়েছ?

আজ্ঞে না।

চট করে ধুয়ে খেয়ে নাও। তোমাকে নিয়েই বেরুই—

কোথায় যাবেন?

হেমনাথ বললেন।

অবনীমোহন উৎসাহিত হয়ে উঠলেন, ওই সঙ্গে একবার শিশিরবাবুদের বাড়িটা ঘুরে আসব।

হেমনাথ শুধোলেন, কেন বল তো?

আনন্দর কাছ থেকে একটা বন্দুক চেয়ে আনব। কাল নিশিন্দার চরে যাবার কথা হল না? অনেকদিন তো প্র্যাকটিশ নেই। আগে থেকে একটু মহড়া দিয়ে রাখব।

হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভাল।

তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে সকালবেলার খাওয়া যখন শেষ করে এনেছেন অবনীমোহন, বিনু পড়াট ছেড়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, দাদু–

হেমনাথ তার দিকে ফিরে বললেন, কী বলছিস দাদাভাই?

আমি তোমাদের সঙ্গে যাব।

হেমনাথ বললেন, তুই তো এখন পড়ছিস। আমাদের সঙ্গে গেলে পড়াটা নষ্ট হবে।

ওধার থেকে অবনীমোহন বললেন, এখন যেতে হবে না।

বিনু বলল, ওবেলা ঠিক পড়ব।

এবার রাগের গলায় অবনীমোহন বললেন, ওবেলা টোবেলা নয়। পড়তে বসেছ, পড়ে যাও। কদিন তো বই টই খুলে দেখ নি। আজ যদিও বা বসলে, বাঁদরামি শুরু করে দিয়েছ। বেলা দশটা পর্যন্ত কোনও দিকে তাকাবে না, মন দিয়ে শুধু পড়া। ছুটির পরেই পরীক্ষা, খেয়াল যেন থাকে।

বিনু এবার লাফালাফি শুরু করে দিল। সেই সঙ্গে নাকি সুরের একটানা ঘ্যানঘ্যানানি চলল, আমি যাব, আমি যাব–

অবনীমোহন ধমক দিতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই হেমনাথ বলে উঠলেন, লম্ফ ঝম্ফ আর কান্নাকাটি থামা বাপু–

বল, নিয়ে যাবে–

যাব। তবে এক শর্তে—

দাদু যখন ভরসা দিয়েছেন তখন যাওয়া নিশ্চয়ই হবে। তার ওপর অবনীমোহন কথা বলবেন না। কিন্তু শর্তটা কী, বোঝা যাচ্ছে না। লাফ ঝাঁফ থামিয়ে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকল বিনু।

হেমনাথ বললেন, শর্তটা হল, এখন যদি যাও দুপুর-সন্ধে দু’বেলাই পড়তে হবে। তখন কিন্তু গোলমাল করতে পারবে না।

বিনু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, মোটে গোলমাল করব না। দুপুরবেলা সন্ধেবেলা যতক্ষণ পড়তে বলবে ততক্ষণ পড়ব।

এখন তো খুব ভাল ভাল কথা বেরুচ্ছে। ফিরে এসে দেখা যাবে’খন। হেমনাথ হাসলেন, যা, জামা প্যান্ট বদলে আয়।

বিনু ভেতর-বাড়ির দিকে ছুটতে যাচ্ছিল, সেই সময় তীক্ষ্ণ, চাপা গলায় ঝিনুক চেঁচিয়ে উঠল, না না–

হেমনাথ বললেন, তোর আবার কী হল রে?

ঝিনুক আগের সুরেই বলল, বিনুদা যাবে না–

একে তো অনেক কষ্টে, বহু কান্নাকাটির পর বেড়াতে যাবার সনদ মিলেছে, আর ঝিনুক কিনা বাগড়া দিতে চাইছে! মাথার ঠিক থাকল না বিনুর। জিভ ভেংচে চেঁচিয়ে উঠল, যাবে না! ইল্লি রে! যাব তো, নিশ্চয়ই যাব। বলেই আর দাঁড়াল না, লম্বা পা ফেলে চোখের পলকে ভেতর বাড়িতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

চোখ কুঁচকে বিনুর যাওয়া দেখল ঝিনুক। তারপর আস্তে আস্তে হেমনাথের পাশ থেকে উঠে ভেতরে চলে গেল।

ঝিনুক যখন বিনুকে খুঁজে বার করল তখন তার প্যান্ট-জামা পরা শেষ, নটি বয় শু পায়ে দিয়ে ফিতে বাঁধছে। সোজা গিয়ে ঝিনুক তার মুখোমুখি দাঁড়াল, এবং কোমরে হাত দিয়ে ঘাড় হেলিয়ে দেখতে লাগল।

ফিতে বাঁধতে বাঁধতে একবার ঝিনুককে দেখে নিল বিনু। তারপর খুব বিরক্তভাবে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল।

ঝিনুক ডাকল, অ্যাই–

তাকিয়েই বিনু সাড়া দিল, কী?

তুমি তা হলে যাবে?

হ্যাঁ।

আমার কথা শুনবে না?

না।

বেশ। আমি মাসিমাকে সেই কথাটা বলে দিচ্ছি।

বিনু শুধলো, কোন কথাটা?

খুব আলতো করে ঝিনুক বলল, সেই যে জলে পড়ে গিয়েছিলে—

বিনু ভয় পেয়ে গেল। অনুনয়ের সুরে বলে, না না, বলো না।

আমার কথা না শুনলে বলবই।

বিনু এবার বোঝাতে চেষ্টা করল। সে গেলে ঝিনুকের তো কোনও ক্ষতি নেই। ঝিনুক কিন্তু কোনও কথাই কানে তুলল না। বলল, তুমি গিয়ে ঝুমার সঙ্গে দেখা করবে। ওর এয়ার-গান আছে, লুডো আছে। ক্যারম আছে, আমি সব জানি।

বিনু অবাক। হতভম্বের মতো বলল, ঝুমার সঙ্গে খেললে তোমার কী?

ন্‌না —

কী?

তুমি ওর সঙ্গে খেলতে পারবে না।

পুবের ঘরের বারান্দা থেকে হেমনাথের গলা ভেসে এল, কী হল রে দাদাভাই, জামা প্যান্ট পরতে কতক্ষণ লাগছে? শিগগির আয়–

ঝিনুক বলল, বলে দাও তুমি যাবে না।

বিনু বিদ্রোহ করতে যাচ্ছিল। তার চোখমুখ লক্ষ করে ঝিনুক দ্রুত বলে উঠল, না বললে সেই কথাটা কিন্তু–

বিনু ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। মনে মনে বানিয়ে গলা তুলে বলল, আমি যাব না দাদু, বড় পেট ব্যথা করছে। বলে ধীরে ধীরে একে একে জুতো জামা খুলে ফেলতে লাগল। ভাবল, ঝিনুক নামে এই মেয়েটা বয়সে ছোট হলে কী হবে, অত্যন্ত সাঙ্ঘাতিক। একটা অমোঘ অস্ত্র পেয়ে গেছে সে। সেটা দেখিয়ে চিরকাল হয়তো ঝিনুক নিজের ইচ্ছেমতো বিনুকে চালিয়ে যাবে।

একটু নীরবতা। তারপর বিনু ঝাঁঝিয়ে উঠল, যেতে তো দিলে না, এখন আমি কী করব?

খুব নিরীহের মতো মুখ করে ঝিনুক বলল, পড়বে। পড়া হলে আমার সঙ্গে খেলা করবে।

রাগে বিনুর গা জ্বলতে লাগল। পারলে ঝিনুকের ঝুঁটি ছিঁড়ে দিত। তার বদলে চেঁচিয়ে মেচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল, বয়ে গেছে এখন পড়তে, বয়ে গেছে তোমার সঙ্গে খেলতে।

দুপুরবেলা ঝিনুকের বই আর একখানা বন্দুক নিয়ে ফিরে এলেন হেমনাথরা। তারপর বাকি দিনটা বন্দুকের পরিচর্যা করে কাটালেন অবনীমোহন, সেই সঙ্গে সমানে শিকারের গল্প চলল। জিম করবেট থেকে শুরু করে পৃথিবীর বাঘা বাঘা শিকারিদের চমকপ্রদ কীর্তিকাহিনী বলে গেলেন তিনি। শুনতে শুনতে মনে হল, পশুপাখির প্রাণ নেওয়া ছাড়া জগতে অন্য কিছু জানা নেই অবনীমোহনের। সারা জীবন এই একটা কাজই তিনি করেছেন। মোট কথা, যখন যে স্রোতটি আসে সেটাই অবনীমোহনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *