যেমন কর্ম তেমন ফল
মশা মারতে গালে চড়
একশো নয়, শেষপর্যন্ত কুড়ি টাকায় হিন্দুস্থানি গোয়ালা সন্তুষ্ট হয়ে দুধের ক্যান আর সাইকেল তুলে নিয়ে সরে পড়ল। আহা কী দৃশ্য! যেন হরিহর ছত্রের মেলা। কুকুরে দুধ চেটে চেটে খাচ্ছে। একটা হোঁতকা ষাঁড়ও এসে জুটেছে। সেই কবে কোন শৈশবে, যখন এতবড় পেল্লায় ষাঁড় হয়নি, তখন কোনও এক গোমাতার দুধ খেয়েছিল। এখন আর কোন গাভী এই ভয়ংকর দামড়াকে দুধ খাওয়াবে। ষণ্ড তো আর চণ্ডী পাঠ করেনি যে গোরুতে মাতৃদর্শন হবে। বলবে স্ত্রীয়া সমস্তা সকলা জগৎসু। সে এক দৃশ্য! ষাঁড়ে দুধ চেটে চেটে খাচ্ছে। মাতুলের কুড়ি টাকার সদগতি হচ্ছে।
এদিকে মুগুর অ্যায়সা আড়াই দাঁচ মেরে বসে আছে। কুমিরের গলায় বঁড়শি আটকেছে। বেশি টানাটানি করতে ভয় লাগছে। যদি হাতল ভেঙে যায় আমিও আর আস্ত থাকব না। এদিকে মাতুল প্রবীরবাবুকে পেছনের আসনে তুলতে চান। কথায় কথায় জানা গেছে, তিনি চিত্রকর, আবার গান। লেখেন। আর রক্ষে আছে! সিনেমায় হরেকরকমের প্রচারের কাজ আছে। বাল্যবন্ধুকে হাতের কাছে পাওয়া গেছে। আর কি সহজে ছাড়া যায়।
প্রবীরবাবু উঠবেন কী করে? পায়ের কাছে মুগুরদ্বয়ের ষড়যন্ত্র। মুগুর মনে হয় স্ত্রীলিঙ্গ প্রাণী! দু’জনে পাশাপাশি সদ্ভাব বজায় রেখে শান্তিতে অবস্থান করতে পারে না। চুলোচুলি করে বসে আছে। অনেক অঙ্ক কষে প্রবীরবাবু মুগুরকে সুস্থ করে আমার পাশে উঠে বসলেন। বেশ ভালই জায়গা নিলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল।
মাতুল সামনের আসনেই বসে আছেন। পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বের করে, সাবধানে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে চালককে বললেন, হিসেব রেখো।
আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনশো কুড়ি হল।
তা হলে দু’মাসের জন্য নিশ্চিন্ত।
আমার সংসার কী করে চলবে স্যার?
যেভাবে গাড়ি চলছে, সেইভাবেই চলবে। তুমি একের পর এক অ্যাকসিডেন্ট করে যাবে, আর আমি টাকা গুনে যাব?
আপনি যে হঠাৎ হঠাৎ ডাইনে, বামে, পেছনে যেতে বলেন?
কাল তুমি রিকশাওয়ালাকে মারলে কেন?
আপনি এত সুন্দর সুর ভঁজছিলেন, আমার খেয়ালই ছিল না যে আমি এক গরিব ড্রাইভার। মনে হচ্ছিল হায়দ্রাবাদের নিজাম।
মনে তো হবেই। কী সুর জানো?
আজ্ঞে না, তবে ভারী সুন্দর।
আহির ভৈঁরো। প্রবীর, আহির ভৈঁরোর ওপর কথা বসা তো। সুরের চলনটা এইরকম হবে, হুঁ হুঁ, হুঁহুঁ, না না, তুম, হুঁ, হুঁউঁ।
প্রবীরবাবু যেন হাতে স্বর্গ পেলেন, দাঁড়া দাঁড়া, বড় ব্যথার সুর, বেদনার বাণী বসাতে হবে।
ধরেছিস ঠিক। প্রেমিকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শীতের ভোর। ফিনফিনে আঁচলের মতো কুয়াশার কেশর উড়ছে। তেরছা হয়ে নেমে আসছে প্রথম সূর্যের কিরণ। ওদিকে বাঁধের ওপর দিয়ে রেলগাড়ি চলেছে। প্রেমিক গাইছে আর কাশছে।
আবার কাশি ঢোকাচ্ছিস কেন?
আহা অসুস্থ যে। এই রোককে রোককে।
চালক দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ব্রেক কষল। ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থামতেই বললে, এইজন্যেই অ্যাকসিডেন্ট হয়। মাতুল গ্রাহ্যই করলেন না। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা বোস, আমার এক ছাত্রীকে তুলে আনি।
সামনেই সাবেক কালের এক বাড়ি। বেশ বড়। গাড়িবারান্দা, থাম, লতানে গাছ, জানলায় লাল নীল কাঁচ। সব মিলিয়ে বেশ একটা বনেদি চেহারা।
এতক্ষণ লক্ষ করিনি, প্রবীরবাবুর পকেট থেকে একটা নোট খাতা বেরিয়েছে। পাতা ওলটাচ্ছেন আর আড়ে আড়ে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তুমি কে?
আমার মামা।
দেখেই বুঝেছি। মুখটা একেবারে কেটে বসানো। মামার গুণ কিছু কিছু পেয়েছ?
কী করে বলব?
গান জানো?
ইচ্ছে করে।
ওইতেই হবে। দেখো তো এই গানটা। আচ্ছা এক দায়িত্ব দিয়ে গেল!
খাতাটা আমার হাতে দিলেন। তিন ছত্রের একটি গান,
এ জীবনে আর কোনও প্রয়োজন নাই
ব্যাকুল বাতাস হৃদয়ে
আমার
মরিয়া
মরিয়া কাঁদে।
প্রবীরবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগছে তোমার আস্থায়ীটা?
দারুণ।
সুরটা শুনবে?
হুঁ হুঁ করে দু’বার সুর ভেঁজে প্রথম দুটো লাইন গেয়ে ফেললেন। ভীষণ আতঙ্কে ছিলুম। গলা দিয়ে কী বেরোয়, কে জানে। না, খুব একটা খারাপ কিছু বেরোল না। ভালই বলা চলে। গাড়ির চালকও বললে, বাঃ বাঃ বেশ হচ্ছে।
প্রশংসায় প্রবীরবাবুর কাতর হয়ে পড়লেন, আমার গলায় ভাই একটা সপ্তকই খেলে। তোমার মামার মতো তিন সপ্তকে গলা খেলে না। চড়ায় উঠলেই ক্র্যাক করে। অন্তরাটা গাইব দেখবে?
করুন না।
প্রবীরবাবু প্রথম লাইন দুটো আর এক পক্কড় গেয়ে তারসপ্তকে ঠেলে উঠলেন,
তুমি যাবে চলে রজনী পোহালে
ঝরাপাতা ঝরে উতলা বাতাসে।
সাংঘাতিক শব্দ। মনে হল কে যেন গলা টিপে ধরেছে আর প্রাণবায়ু ঝারির জলের মতো বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। প্রবীরবাবু নিজেকে সংযত করে নিলেন। সময়টা সকাল। রাস্তায় লোক চলাচল করছে। করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী বুঝলে? খুব খারাপ? আমি জানি চড়ার দিকে গলাটা আমার সেইরকম হয়ে যায়। না বাবা, বলব না। ভাগ্য একটু খুলব খুলব করছে। নাম করলেই সব কেঁচে যাবে।
বলতে হবে না, বুঝতে পেরেছি।
পারবেই তো, পারবেই তো। কার ভাগনে দেখতে হবে তো! স্কুলের ফার্স্ট বয়, কলেজের সেরা ছাত্র, গানে ভারত বিখ্যাত। নুনজলের গার্গল করে করে ঘামাচির ধাত হয়ে গেল, গরমকালে কী কষ্টই পাই, নুনের পাহাড় শেষ করে ফেললুম, গলার কিছুই উন্নতি হল না।
গার্গল করলে ঘামাচি হয়?
আরে আমার কথা আর বলো কেন। নুনজল মুখে নিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে যেই ঘড়ড় করতে যাই, ব্যস, ঢাকাস করে আদ্দেক চলে গেল পেটে, আদ্দেক বেরিয়ে এল নাক দিয়ে, চোখ দিয়ে। যার খারাপ হয়, তার সবই খারাপ। গলার দু’পাশে প্রহরীর মতো দুটো টনসিল থাকা উচিত, আমার মনে হয় সে মাল দুটো নেই। আলজিভটাও আছে কি না কে জানে? হাঁ করেছ কী সুয়েজ ক্যানেল খুলে গেল। অত নুন শরীরে সয়! চামড়া যেন ডায়মন্ডহারবারের নোনা মাটি। গ্রীষ্মের ফসল চাবড়া চাবড়া ঘামাচি।
আপনি আর একটা টোটকা করে দেখতে পারেন।
কী বলল তো? কী বলো তো?
গোটাদুয়েক গোলমরিচ দিয়ে এক চামচে গাওয়া ঘি। গলাটা বেশ ঝরঝরে হয়ে যাবে।
আর ভাগনে সে উপায় কি রেখেছি! লিভারের বারোটা বেজে গেছে। মুখ দিয়ে ঢুকবে পশ্চাদ্দেশ দিয়ে…না বাবা বলব না, তুমি আমাকে অসভ্য ভাববে।
আপনি কী বলতে চান বুঝে গেছি।
বুঝতেই হবে। কার ভাগনে দেখতে হবে তো?
ওরও একটা দাওয়াই আছে।
শুনি শুনি।
আগে একটা পিপুল খেয়ে নেবেন, তা হলে ঘি-মরিচ সহজেই সহ্য হবে।
পিপুল? সে আবার কী বস্তু। লোকের পিপুল পাকে শুনেছি।
ওটা অসভ্য পিপুল। আমি বলছি সভ্য পিপুলের কথা। গাছে হয়। কবিরাজরা ব্যবহার করেন।
মনে থাকবে না ভাগনে, দাঁড়াও লিখে নিই।
নোট খাতায় লিখতে লাগলেন। ওদিকে মাতুল আসছেন। সঙ্গে কে রে বাবা! রোদের কী চমক। ওঁর সাজসজ্জার রঙের চমকে প্রকৃতিরও পা পিছলে যাচ্ছে। সঙ্গে আবার এক বৃদ্ধ। তার সব সাদা, যেন শরতের মেঘ। মাথার দিকটা রুপোলি। সামনে সিথি। হাফ পাঞ্জাবি, হাতায় গিলে। দিশি ধুতি, একটু উঁচু করে পরা, পায়ে বার্নিশ করা চটি, হাতে আবার একটি ছড়ি, চোখে রিমলেস চশমা। পুরো নম্বর দেবার মতো মিহিবাবু। মহিলার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, মেজাজ খারাপ করে দেবার মতো ধরনধারণ। শাস্ত্রীয় সংগীতের মতো, শাস্ত্রীয় পরীক্ষা। দেখবে তবু টলবে না, হেলবে তবু টসকাবে না। হরি ও তৎসৎ। বাগিচার বুলবুলি। গণ্ডদ্বয় এত গোলাপি হল কী করে? ওষ্ঠদ্বয় এমন করমচার মতো লাল হল কী করে। চক্ষুদ্বয় কোণ ছেড়ে কর্ণ অবধি বিস্তৃত হল কোন মায়াবলে! ঘোর বেগুনি বর্ণের ফিনফিনে শাড়ি, ব্লাউজ বেগুনি। গাত্রবর্ণ এর চেয়ে ফরসা হলে আয়ারল্যান্ডে পাঠাতে হত।
আমার বিস্ময় প্রবীরবাবুর কণ্ঠে শব্দরূপ পেল। তিনি বললেন, বাপস, কী সেজেছে রে ভাই।
মাতুল এগিয়ে এসে পেছনের দরজা খুলে ধরে আমাদের বললেন, তোমরা একটু সরে বোসো। এঁদের বসতে দাও।
আমাদের প্রাণ আছে। আমরা না হয় সরে বসলুম। দুটো মুগুরের তো প্রাণ নেই। দুটোকে নিয়ে মহা জ্বালাতনে পড়া গেছে। নীচের দিকটা ভারী, মাথার দিকটা হালকা। সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। একটু এদিক-ওদিক হলেই, সখি গো! বলে টাল খেয়ে উলটে পড়ছে। তেমনি ভারী। কোনওক্রমে কোলে তুলে নিয়ে সরে বসতে গেলুম। একটা ডান পাশে হেলে ছোট্ট একটু হাত ছুড়ল। তাইতেই প্রবীরবাবু কাত। সেই বাল্যে, ছাত্রজীবনে গাঁট্টা খেয়েছিলেন, আজ এইমাত্র আর একবার খেলেন। স্মৃতি, তুমি বেদনা। পাপের বেতন পেলেন। মাতুলের চড়া পরদায় বাঁধা রূপসি ছাত্রীকে দেখে মনে মনে বড় ছটফট করছিলেন। রগে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, তখন থেকে এই বেয়াড়া জিনিস দুটোকে নিয়ে কী যে তুমি করতে চাইছ। দাও দাও, একটা আমাকে দাও।
একটাকে তার কোলে তুলে দিলুম। যমজ নিয়ে বড় বিব্রত হয়ে পড়েছিলুম। নিন, মোহ-মুদগর কোলে নিয়ে অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করুন।
রূপসি আমার পাশে ঘট স্থাপনে উদ্যোগী হয়ে ধনুক-ভাঙা ভুরুতে আড়ে আড়ে দেখতে লাগলেন। মাতুল বললেন, আমার ভাগনে, তুমি আরাম করে বসতে পারো। ওর পাশে আমার বন্ধু প্রবীরকুমার, গীতিকার, নাট্যকার, চিত্রকার।
সাহস পেয়ে তিনি এত আরামে বসলেন, পুচুত করে ক্ষীণ একটি আর্তনাদ কানে এল। বাঁপাশে জামার পকেটটা গেল। সিকি-আধুলির ভারে অভ্যস্ত পকেট, এমত রূপসির দেহভারের ভগ্নাংশ বহনের ক্ষমতা রাখবে কী করে। দু’বছরের পুরনো জামা। জায়গায় জায়গায় পিজে এসেছে।
রূপসি একটু আর্তনাদ করে উঠলেন। আমার জন্যে নয়। আসনের স্প্রিং খোঁচা মেরেছে। সাবধান করার সুযোগ পেলুম কই। সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ দেহভার ছেড়ে দিলেন। গাছ থেকে তাল পড়ে, গাইয়ে তালে ঝাঁপিয়ে পড়েন, জামার আধখানা নিয়ে রূপসি পড়েন বরাতে। দিন কয়েক আগে কনক ঘাড়ে পড়েছিল। কনকের কথা আর চিন্তায় আনব না। সেই মহীয়সী ভাল বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে চলেছেন। অক্ষয়বাবু ঠিকই বলেছিলেন, হরিদা, এর রাশিফল বলছে, সারাজীবন শুধু চোট খেয়ে যাবে, এমনকী ঘোড়াতেও চাট মারতে পারে।
সেকী হে, ঘোড়া আসবে কোথা থেকে! অশ্বযুগ শেষ হয়ে, অশ্বশক্তির যুগ এসেছে।
বরাত হরিদা, বরাত। কোথা থেকে এসে, কাকে যে চাঁট মেরে যায়।
বৃদ্ধকে গাড়িতে তোলার জন্য সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দাদু আসুন, দাদু উঠুন, দাদু উঠুন। প্রথমে ভেতরে এল ছড়ি। আর একটু হলেই চোখটা যেত। মুগুর কোলে বসে আছি বলে রক্ষে পেয়ে গেল। তারপর ঢুকল বার্নিশ করা চটি সমেত একটা পা। নাতনি হাঁ হাঁ করে উঠল, আমার শাড়িটা গেল, শাড়িটা গেল।
হ্যাঁ, তোর অমনি শাড়িটা গেল। এইটুকু গাড়িতে এত বড় শরীরটা ঢোকে! কাস্টাম বিল্ট রোলস রয়েসে চেপে যৌবন কাটালুম, তোদের কালে এসে, এই বুড়ো বয়েসে ক্যানেস্তারা চাপতে হচ্ছে।
চুপ করে বোসো তো।
নাতনির ধমক খেয়ে দাদু কাছাকোঁচা, ছড়ি, সামলে বসলেন। কানের পাতায় খাড়া খাড়া লম্বা লম্বা চুল। কানে চুল থাকলে মানুষ পয়মন্ত হয়। পয়মন্ত না হলে রোলস রয়েস চাপতেন! গাড়ি চলতে শুরু করল। মাতুল সোনার ঘড়িতে সময় দেখে বললেন, চিত্রা, তুমি সাজতে গুজতে অনেক সময় নিয়েছ। দেরি হয়ে গেল।
নাতনির দাদু বললেন, কেন যে এত রং মাখিস! তোর নিজের রূপ নকলে চাপা পড়ে যায়। তোর মতো মেমের বাচ্চা…
আঃ চুপ করো তো।
রূপসি কটাক্ষ হানলেন। আমার কোলের মুগুরে আর প্রবীরবাবুর মুগুরে ঠোকাঠুকি হয়ে গেল। চকমকি হলে আগুন ছুটত। কার গর্ভে যেন মুষল জন্মেছিল! সেই মুষলে কৃষ্ণ মরেছিলেন। পাশাপাশি আমাদের দুজনের গর্ভে প্রমাণ মাপের দুটি মুগুর এসেছে যেন। সদ্যোজাত শাবকের মতো জাপটে বসে আছি। প্রবীরবাবু ফিসফিস করে বললেন, মায়ের কথা স্মরণ করো।
গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে নির্দেশটা ঠিকমতো বুঝতে পারলুম কি না সন্দেহ হওয়ায় প্রশ্ন করলুম, কী বললেন?
ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, কিছু না।
একই কথা দু’বার বলতে হলে অনেকেই ভীষণ রেগে যান। আমিও যাই। আমারই ভুল হয়েছে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করা। ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে বসে আছি! পাশেই মাতুলের ছাত্রী। স্বাস্থ্যবতী। পরনে আবার পিচ্ছিল সিল্কের শাড়ি। তার ওপর ছটফটে। মাঝপুকুরের মাছের মতো মাঝে মাঝে ঘাই মারছেন। আমি ভাবছি, বলে না বসেন তোমার হাঁটু আমার হাঁটুতে ঠেকছে। তোমার ওপর বাহু। আমার ওপর বাহুতে ঘষে যাচ্ছে।
মহিলা হঠাৎ আমার হাত মুঠোয় চেপে ধরে বললেন, আমার ভীষণ ভয় করছে।
কীসের ভয়। এদিকে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। মহিলায় ধরলে ভূতে ধরার মতোই অবস্থা হয়। মাঝরাতে ঘরে চোর ঢুকলে গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। গেরস্থ ক্ষীণ কণ্ঠে চোও চোও করতে থাকেন।
আমি কোনওক্রমে প্রশ্ন করলুম, ভয় করছে কেন?
মহিলা ডাইনে বাঁয়ে শরীর মুচড়ে বললেন, কী জানি বাবা! কী হয়! ভয়ে আমার বুক দুরদুর করছে।
ভীষণ সাহসে জিজ্ঞেস করলুম, কীসের ভয়?
অত হ্যান্ডস ফ্যান্ডস নিয়ে কোনওদিন তো গান রেকর্ড করিনি। তা ছাড়া গুরুজির গান গাওয়া খুব শক্ত। একটু এদিক-ওদিক হলেই সুর ফসকে যায়, তাল হড়কে যায়। আর তখন উনি যে দৃষ্টিতে তাকান। বাবা। না বাবা, আমি পারব না।
গরম জলে হাত লেগে গেলে মানুষ যেভাবে হাত ঝাড়ে, তিনি সেইভাবে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে চোখে চাপা দিলেন। তারপর দু’আঙুলের ফাঁক দিয়ে এক চোখে আমাকে দেখতে লাগলেন। মরেছে। মাথার গোলমাল নেই তো!
চোখ থেকে হাত সরিয়ে ফিক করে হাসলেন। হেসে বললেন, তোমাদের কোলে ও দুটো কী। যন্ত্র? একেই কি বলে গুপী যন্ত্র?
মাতুল সামনের আসন থেকে বললেন, না রে বাবা, ও দুটো হল মুগুর। আমাদের শুটিংয়ে লাগবে। যারা সিনেমার মাল সাপ্লাই করে, তারা একগাদা টাকা ভাড়া চাইত, তাই আমার ভাগনের বাড়ি থেকে নিয়ে যাচ্ছি। কিছু টাকা বাঁচবে।
দাদু বললেন, সিনেমায় রিয়েল জিনিস চলবে? ওখানে তো সবই নকল মাল চলে।
প্রবীরবাবু বললেন, আসলে নকলে মিলিয়ে একটা কিছু দাঁড়ায়।
দাদু খুব আর্টের ঢঙে প্রশ্ন করলেন, হু আর ইউ?
প্রবীরবাবু থতমত খেয়ে গেলেন। মাতুল বললেন, আমার বাল্যবন্ধু, আর্টিস্ট, গীতিকার। আমার ছবির কিছু কিছু গান ও লিখছে।
প্রবীরবাবুর উৎসাহ ফিরে এল। আমি অলরেডি তোমার আহির ভৈঁরোতে বাণী বসিয়ে ফেলেছি জয়।
তাই নাকি? চিত্রাকে দেখাও।
প্রবীরবাবু আমার বুক ফুঁড়ে এপাশ থেকে ওপাশে হাত বাড়িয়ে সেই নোট বইটা মহিলাকে দিলেন।
মাতুল বললেন, চিত্রা, প্রথম লাইনটা সুরে ভেড়াও তো।
প্রবীরবাবু তাকিয়ে আছেন যেন গাছ থেকে পাকা ফল পড়বে। নীচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়েছে। চিত্রাদেবী সহসা শুরু করলেন, এ জীবনে আর কোনও প্রয়োজন নাই। শাবাশ, একেবারে সাধা গলা। মিছরির দানার মতো খেলছে। বরফে জমানো মধুর মতো মিঠে গলা। ঝাউয়ের পাতায় বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো শনশনে।
এঁর নাকি গান গাইতে ভয় করছিল।
মাতুল বললেন, আমি আর একটু চড়া পরদা থেকে ধরতে চাই। চড়ায় করুণ রস জমে ভাল। মাতুল ধরলেন,
এ জীবনে আর কোনও প্রয়োজন নাই
ব্যাকুল বাতাস হৃদয়ে আমার
মরিয়া মরিয়া কাঁদে।
চিত্রাদেবী আমার হাতে প্রচণ্ড একটা চিমটি কেটে, একটা চোখ ছোট করে, বললেন, আহা, এইরকম যেদিন গাইতে পারব, আমি সেইদিন হব শান্ত। বলেই, মাতুলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দিলেন।
মাতুলের চোখ ছিল রাস্তার দিকে। ব্যাকুল বাতাসে মীড়ের কাজ করতে গিয়ে হইহই করে উঠলেন, বাঁয়ে বাঁয়ে।
চালক আবার দু’হাতে স্টিয়ারিং ধরে বাঁয়ে হেলে পড়ল। ভাগ্য ভাল কোনও দুর্ঘটনা হল না। গাড়ি গোঁত করে এক রাস্তা ছেড়ে আর এক রাস্তায় ঢুকে পড়ল। চিত্রাদেবীর দাদুর মাথা ঠুকে গেল। সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, রোলসে এই ঝাঁকুনিটা একদম লাগে না। এমন কায়দায় তৈরি, যেন হাওয়ায় ভেসে চলেছি।
রোককে।
গাড়ি থামাতে হলে বাঙালিরা হিন্দি বলবেনই। বাংলায় গাড়ি থামিয়ে তেমন সুখ হয় না। হিন্দির মতো ব্রেক নেই। গাড়ি থেমে পড়ল। মাতুল নামতে নামতে বললেন, আপনারা একটু বসুন। আরও কয়েকজন হ্যান্ডস উঠবে। অন্ধকার-অন্ধকার একটা গলিতে ঢুকে পড়লেন।
মাতুল চলে যেতেই প্রবীরবাবু বললেন, তুমি আমার জায়গাটায় একটু সরে বসবে। আমি তা হলে ওঁর সঙ্গে আলোচনা করে বাণীটানিগুলো একটু ঠিকঠাক করে নিতে পারি।
উত্তর দিলেন দাদু, ন্যাঅ্যা। যে যেখানে আছ, সেইখানেই থাকো। নাতনি আমার বড় হয়েছে। লাইনটা তেমন ভাল নয়। চোখেচোখে রাখার হুকুম নিয়ে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি।
চিত্রাদেবী খিলখিল করে হেসে উঠলেন, তোমরা সব পাগল। তুমি পাগল, মা পাগল, বাবা পাগল।
তুই-ই আমাদের পাগল করে ছেড়েছিস। জানিস না, শিল্পীদের একটু লুজ ক্যারেক্টার হয়।
প্রবীরবাবু করুণ মুখে, উদাস দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বেশ হয়েছে। যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়। মাতুল আসছেন। সঙ্গে কুঁজোমতো এক ভদ্রলোক। চলার ধরনটা বকের মতো। প্রতি পদক্ষেপে মাথাটা সামনে এগিয়ে গিয়ে বাতাসে হোঁচট খেয়ে ফিরে আসছে। ছন্দটা অনেকটা এইরকম, কত ধানে কত চাল, কত ধানে কত চাল। সাজপোশাক দেখলেই মনে হয় মুসলমান। মাথায় লেস-তোলা সাদা টুপি, চোগা, গাঢ় রঙের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিতেও লেসের কাজ। পায়ে নাগরা জুতো। সঙ্গে আসছে একজন কিশোর। তার হাতে একটা বাদ্যযন্ত্র। মনে হয় সারেঙ্গি।
মাতুল আর ক’জনকে তুলবেন! এটা তো রবারের গাড়ি নয়, যে চারপাশ ফুলে উঠে সকলকে জায়গা করে দেবে। মানদার মুখে পান জর্দার খিলির মতো। যখনই দেখো ডান গালটা ফুলে আছে।
মাতুল গাড়ির ভেতরটা একবার দেখে নিলেন। কীভাবে বসাবেন ভাবছেন। ঠিক হল, ছেলেটি চলে আসবে পেছনে পেছনে এখনও একটু জায়গা আছে। ওস্তাদজি বসবেন সামনে। তাই হল। চিত্রাদেবী আমার দিকে আরও কিছুটা সরে এলেন। আমি প্রবীরবাবুকে দরজার দিকে আরও কিছুটা চেপে দিলুম। দাদু বললেন, তোমাদের কোলের ওই দুটোকে গাড়ির পেছনে রেখে দাও না। আরাম করে বসতে পারবে।
গাড়িতে উঠতে উঠতে মাতুল বললেন, পেছনে,ন স্থানং তিল ধারণং। যেমন আছে, বেশ আছে, আর তো মাত্র একজন উঠবে।
দাদু বললেন, অ্যাঁ বলো কী। এখনও আর একজন উঠবে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের গাড়ির মতো অবস্থা হয়ে যাবে যে রে বাবা।
তা একটু হবে। কী আর করা যাবে বলুন।
ওস্তাদজি জানলার ধারে বসেছেন। সাজপোশাকে যত বাহার, চেহারায় তত বাহার নেই। দারুশিল্পের মতো আকৃতি। পকেট থেকে একটা রুপোর কাঠি বের করে সঁাত খোঁচাচ্ছেন, আর বাঁ দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফুতুস ফুস করে জানলার বাইরে ভুক্তাবশেষ ছুড়ছেন।
যতবারই তিনি ফুতুস করেন ততবারই আমাদের দাদু আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত তুলে ডায়ে হেলে পড়ে বলেন, মুশকিল করলে রে বাপু।
সামনে ফুতুস, পেছনে মুশকিল করলে রে বাপু। পর্যায়ক্রমে এই চলতে লাগল আর গাড়ি এগোতে লাগল টালিগঞ্জ স্টুডিয়োপাড়ার দিকে।
চিত্রাদেবী আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, বাপস।
কী বাপস? ছেলেটা মাথায় হেকিমি তেল মেখেছে। কী বিশ্রী গন্ধ।
আমার চোখের সামনে যেন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের কপালে চাঁদ। চাঁদের নাকে হাকিমি তেলের গন্ধ। আমার নাকে গুলবাগিচার খুশবু।
চিত্রাদেবী ভেলভেটের হাতব্যাগ থেকে একটা রুপোর আয়না বের করে মুখ দেখতে লাগলেন। গরম, ধুলো উড়ছে। পাশাপাশি ঠাসাঠাসি বসা। গালের গুলাল গলে গলে পড়ছে। মহিলারা সুন্দরী হলে বড় জ্বালা। সামাল সামাল রব ওঠে। তরী করে টলমল পাশরাতে ওঠে জল। মাতুল হইহই করে উঠলেন, ডাঁয়ে, ডাঁয়ে।