১.২০ বারাণসীর পশুহাটে

২০

বারাণসীর পশুহাটে গিয়ে তিষ্য কিন্তু মন্দ্রাকে পেল না। তবে অশ্ববণিকদের সঙ্গে সাবধানে আলাপ করতে সে ছাড়ল না। ভালো মন্দ নানা রকম অশ্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘সবই তো দেখছি পিঙ্গল, সাদা, কালো, অন্য প্রকার নেই?’

‘কি রকম চান? ছোপ ছোপ?’

‘হ্যাঁ, ভেতরে অশ্বশালায় নিয়ে গেল লোকটি। কয়েকটি চিত্রাশ্ব আছে। কোনটাই মন্দ্রা নয়।’

এরই মধ্যে একটিকে দেখিয়ে সে বলল, ‘ধরুন, এই রূপই শ্বেত। কিন্তু পিঙ্গল, আরও গাঢ় পিঙ্গল, বৃত্তাকার, অর্ধবৃত্তাকার সব দাগ থাকবে!’

বণিক বলল, ‘একটি তো ছিল। বিক্রি হয়ে গেছে।’

‘কোথায়?’

‘তা কী করে জানব অজ্জ, অশ্বীটি সুশিক্ষিত, অতি সুন্দর ছিল। কিন্তু যারা তাকে নিয়ে এসেছিল, তারা অশ্বের কিছুই জানে না, বোঝে না। আমরা কেনবার সুযোগ পেলাম না। লোকগুলি সুচতুর। একজন রাজপুরুষকে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে, কহাপনগুলি বাজাতে বাজাতে চলে গেল। মনে হয় চোরাই অশ্ব।’

‘আপনি বলতে পারেন, যে রাজপুরুষ তাকে কিনেছেন, তিনি কোথায় থাকেন?’

বণিকটি বলল, ‘অশ্বটি আপনার না কি?’

তিষ্য ঘাড় নাড়তে, বণিক বলল, ‘চুরি গেছে? তখনই ধরেছি চোরাই অশ্ব। কীভাবে মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হ্রেষা করছিল। আমরা অশ্ব চিনি। বলে দিতে পারি। কিন্তু অজ্জ, আমরা আসছি সেই সিন্ধু দেশ থেকে। এখানে বাণিজ্য করতে আসি। ক্রেতা রাজপুরুষকে তো চিনি না!’

তিষ্যর মুখ হতাশায় কালো হয়ে যাচ্ছে দেখে সে বলল, ‘খুবই দুঃখের বিষয়, ঘোড়াটা চমৎকার ছিল। কিন্তু কী আর করবেন বলুন, বরং এই ঘোড়াটাকেই কিনে নিয়ে যান, অল্প করে মূল্য নেব।’

তিষ্য মুখ ফিরিয়ে বলল ‘না, চিত্রাশ্ব আমার আর চাই না। আমায় একটি পিঙ্গল বর্ণের অশ্ব দিন, ওই যে বাইরে যেটা দেখছিলাম।’

দুজনে বাইরে এলো। মাজা তামার মতো রঙ ঘোড়াটার। সাজ-সমেত এক শত পঞ্চাশ কহাপন দিয়ে তাকে কিনে তিষ্য নগরের দিকে ধীরে ধীরে চলল। এ ঘোড়াটার হাব-ভাব দেখে সে বুঝেছে এর কিছু শিক্ষা আছে, একেবারে বন্য নয়। বণিক গর্ব করছিল, তিন পুরুষে শিক্ষিত সৈন্ধব আজানেয়, কিন্তু অতটা নয়। তবে ঘোড়াটি মন্দ্রার চেয়েও অল্পবয়স্ক। কেশরগুলি চলার সময়ে ভারি সুন্দর লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। তার মনটা শান্ত হয়ে এলো। যদিও বিষন্নতা গেল না। পিতা মাতা, ভাই, বোন, নিজের দেশ সবই ত্যাগ করে চলে এসেছে, তবু প্রিয় বাহনটির জন্য মমতা তাকে ভেতরে ভেতরে যেন কাঁদাতে লাগল।

দু একজন পথিককে জিজ্ঞেস করে সে একটি আবসথাগারে পৌঁছল। এখানে স্নান, বেশ পরিবর্তন, ও উত্তম ভোজনের পর সে একটু সুস্থ বোধ করল। এবং নিজের কক্ষে এসেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। সে শয্যায় শোয়নি। বসেছিল শুধু। তার পাঁচ তলিকা বিশিষ্ট পাদুকার মধ্যে তার যাবতীয় অর্থ। এক প্রস্থ বস্ত্র সে সঙ্গে এনেছে। আর কিছু নেই। পাদুকা দুটি সাবধানে খট্টার তলায় রেখে সে দুয়ারে অর্গল দিয়ে দেয়। তারপর শয্যায় এসে বসে। বসে বসেই কখন ঘুম এসেছে, শুয়ে পড়েছে নিজেই জানে না। অনেকক্ষণ পরে, সন্ধ্যা হবে হবে, সে দেখল তার কক্ষের অর্গল খুলে যাচ্ছে। সভয়ে সে উঠে বসল। কোষ থেকে ছুরিকা বার করল টেনে। ঢুকলেন সেই যুবতী পরিব্রাজিকা। চোখ তেমনি দীপ্ত, মুখ গম্ভীর, দাঁড়ানোর ভঙ্গি তেজস্বান।

‘আপনি!’ সবিস্ময়ে তিষ্য বলে উঠল।

‘কী চাও যুবক? লক্ষ্য স্থির করোনি?’

‘এখনও তো তেমন কিছু…’

‘একটি সামান্য অহংকারী বালিকার জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়লে! ধিক্ তোমাকে।’

‘না, তা নয়। এখনও ভেবে উঠতে পারিনি।’

‘শোনো। তোমার জীবনে অনেক উন্নতির সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। বৃথা সময় ব্যয় করো না। রাজগৃহে যাও।’

‘রাজগৃহে? সেখানেই সেই সাহসিকা কন্যা আছে না?’

সাহসিকা কন্যা ছাড়াও আরও অনেক কিছু আছে রাজগৃহে, যা শ্রাবস্তীতে নেই। সাকেতে নেই। তক্ষশিলায় নেই। যাও।’ বলে ব্রাজিকা অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

‘কোথায় যান? শুনুন, একটু শুনে যান…।’ তিষ্য ডেকে উঠল। তারপরেই সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। শূন্য পান্থশালার ঘরে একলা শয্যায় ঘুমচোখে সে কাকে চিৎকার করে ডাকছে? কোথাও কেউ নেই। অর্গল বন্ধ। সন্ধ্যা সত্যই ঘনিয়ে এসেছে। সে স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু কী জীবন্ত স্বপ্ন! নিশ্চয় ওই কুণ্ডলকেশ প্রব্রাজিকা ঋদ্ধিবলে এসেছিলেন। সে লক্ষ্যভ্রষ্ট, যত্র তত্র বিচরণ করে বেড়াচ্ছিল। ভুলে গিয়েছিল তার এটা নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে। সে স্বপ্ন দেখে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করবার। কিন্তু সে তো একদিনে হবার নয়! তার জন্য আয়োজন চাই! প্রব্রাজিকা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন তার আদর্শের কথা, বলে দিয়ে গেলেন কোন পথে গেলে তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে। সে স্থির করল, আগামীকাল প্রত্যূষেই সে রাজগৃহের পথে যাত্রা করবে। কিন্তু আজ? আজ সন্ধ্যা, রাতের প্রথম যাম অন্তত বারাণসী নগরী ঘুরে-ফিরে দেখা প্রয়োজন।

অশ্বশালায় গিয়ে ঘোড়াটির পিঠে আদর করে থাবড়া মেরে সে বলল, ‘কি হে তাম্রক, খাওয়া-দাওয়া সব ঠিকঠাক হয়েছে তো?’

রক্ষক বলল, ‘ভারি সুশীল অশ্বটি, ভালো করে ঘাস খাইয়েছি অজ্জ।’

রক্ষককে কয়েক কাহন দিয়ে সে তাম্রকের পিঠে চড়ে বসল।

বারাণসীর পথগুলি শ্রাবস্তীর চেয়েও জনবহুল। পথগুলিও তেমন ভালো না। অথচ এই নগরীর আশেপাশে সে শুনেছে দন্তকার বীথি আছে। গজদন্তের নানা বস্তু সেখানে প্রস্তুত হয়। বারাণসীর বস্ত্রের তো পৃথিবীজোড়া খ্যাতি। কাঠের কাজেও এরা দক্ষ। নগরীর থেকে অল্প দূরেই আছে বর্ধকিগ্রাম। সেখানে নিকটবর্তী বনভূমি থেকে গাছ কেটে, দীর্ঘদিন ধরে কাঠ প্রস্তুত হয়, তারপর তা থেকে অন্যান্য দ্রব্য, যেমন, পল্যঙ্ক, খট্টা, চতুষ্পদিকা, ভদ্রপীঠ, এসব তো হয়ই। বড় বড় হর্ম্যের কাষ্ঠকর্মগুলি প্রস্তুত হয়। দ্বার, বাতায়ন, অলিন্দ, সোপান, এসব তো বটেই, স্তম্ভ, ছাদ, প্রাচীর— সব। এদের কথা সে জানতো না। এবার সাকেতে বিশাখার বিবাহের কল্যাণে জানল, দেখল। ঠক ঠক, খট্টা, খট্টা, শব্দে কিছুদিন কান পাতা দায় হয়ে উঠেছিল, তারপর দেখা গেল, চমৎকার চমৎকার সব প্রাসাদ উঠে গেছে। সেইসব বর্ধকি, তক্ষা, দন্তকার সবাই তো এই জনপদে বাস করে। এমন সমৃদ্ধ, উন্নত স্থান! অথচ দেখো নগরীর পথগুলি, সম্ভবত ঘোড়া, হাতি, রথ, পণ্যদ্রব্যবাহী গো-শকট ইত্যাদির আসা-যাওয়ার ফলেই, ভেঙে ভেঙে গেছে। প্রধান পথগুলি দিয়ে ঘুরে ঘুরে তিষ্যর ধারণা হল বারাণসী বৃহৎ নগরী হতে পারে, পট্টন হতে পারে, কিন্তু সৌন্দর্যে সাকেত কেন শ্রাবস্তীর সঙ্গেও তার কোনও তুলনা হয় না। সে দেখে শুনে একটি শোভন-দর্শন পানাগারে গিয়ে বসল।

বেশ সুন্দর শয্যা বিছোনো রয়েছে। স্কুল, নানা আকারের উপাধান, বসতেই পানাগারিকের কর্মকর তার সামনে একটি নিচু ত্রিপদী রেখে গেল। সে কাপোতিক সুরা চাইল। অল্প দূরেই দল বেঁধে কয়েকজন গল্প করতে করতে সুরা পান করছিল। অতিরিক্ত চেঁচিয়ে কথা বলার অভ্যাস এদের। কিছুক্ষণ পর তাদের একজন বলল, ‘আমরা চম্পা থেকে আসছি ভদ্র, আপনি কোথা থেকে?’

‘সাকেত।’ অতি সংক্ষেপে উত্তর দিল তিষ্য, অনিচ্ছা সত্ত্বেও।

‘একা একা পান করবেন কেন, আমাদের সঙ্গে যোগ দিন। আমরা বণিক। আপনি?’

‘রাজকুমার।’ এখনও তিষ্যর স্বরে কোনও আগ্রহ নেই।

‘আসুন আসুন।’ তিষ্য না এগোলেও, তারা নিজেদের উপাধান এবং পানপাত্র নিয়ে তিষ্যর আশেপাশে এসে বসে পড়ল। তিষ্য প্রথমটা বিরক্ত হয়েছিল। এদের কৌতূহল অতিরিক্ত হলে তার অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু দেখা গেল, এরা নিজেদের গল্পেই মত্ত। পুণ্যশীল নামে একটি যুবক বলল, ‘আমি যদি কখনও সুযোগ পাই তো সমুদ্রবাণিজ্যে যাবোই। শুনেছি সমুদ্রপারের দেশগুলিতে আমাদের দেশের সামান্য বস্তুরও অনেক মূল্য পাওয়া যায়।’

সুজাত নামে একটি যুবা তিষ্যর দিকে চেয়ে বলল, ‘শুনুন ভদ্র, সুযোগ পেলে, ও না কি সমুদ্রবাণিজ্যে যাবেই। যবে থেকে পুণ্যশীলকে দেখছি এই কথা ওর মুখ থেকে শুনে আসছি। ও সমুদ্রে যাবেই। সুযোগ বলতে ও কী বোঝাচ্ছে, বলুন তো?’

সঙ্গে সঙ্গে একটা হট্টগোল উঠল ‘সত্যিই তো পুণ্যশীল, সুজাত ঠিকই বলেছে। সুযোগ বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছো?’

‘পিতার সঞ্চিত অর্থও তোমার অল্প নয়। নদীবাণিজ্যে হাত পাকালে তা-ও অনেক দিন হল।’

সবাই চেপে ধরলে পুণ্যশীল বলল, ‘গৃহে কান্না আরম্ভ হয়, সমুদ্রে যাবার কথা বললেই। কী করি বল?’

‘গৃহে? অর্থাৎ তোমার পত্নী?’

‘পত্নী, মাতা।’

‘তা, পত্নী বা মাতার কান্নাকাটি তো কোনদিনই থামবে না, রমণীর কান্না থামবার আশায় বসে থাকলে তো বাণিজ্যই বন্ধ করে দিতে হয়। তা হলে শুধু শুধু বড়াই করো কেন! যা পারবে, তা বলবে। যা পারবে না, তা কখনও বলবে না।’

পুণ্যশীল বলল, ‘সে তোমরা যতই উপহাস করো, আমি বলব। সব মানুষেরই একটা স্বপ্ন থাকে। হতে পারে, আমি কোনদিনই যেতে পারব না। কিন্তু একদিন যাবো এই আশাটি আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হলে, সত্য বলছি, আমার জীবন বৃথা মনে হবে।’

‘কেন তুমি কি যথেষ্ট উপার্জন করছো না? পিতৃধন অন্তত দেড়গুণ তো বাড়িয়েছ ভাই। তুমি যথেষ্ট চতুর বণিক। সেবার শ্রাবস্তীর কাংস্য তৈজসগুলি মদ্রদেশের গ্রামে কী ভাবে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করলে?’

পুণ্যশীল বলল, ‘আহা-হা উপার্জনের কথা হচ্ছে না। চার পুরুষে জলবাণিজ্য করছি ভাই, এখনও যদি এটুকু চাতুর্য না এসে থাকে স্বভাবে, তাহলে বণিকবৃত্তি তো ত্যাগ করাই ভাল। কিন্তু সমুদ্রবাণিজ্য আমাকে টানে উপার্জনের জন্য নয়, সমুদ্রযাত্রার রোমাঞ্চের জন্য। চিন্তা কর তো অকূল বারিধি, স্থলভূমির দেখা নেই। নক্ষত্র দেখে দিঙ্‌ নির্ণয় করে করে চলেছি। ঝড় উঠল।’

‘—হ্যাঁ হ্যাঁ, জলস্তম্ভ উঠল। সেটি ভীমবেগে তোমার পোতগুলির ওপর আছড়ে পড়ল। তারপর তুমি তোমার পণ্য-সন্য লোকজন সব নিয়ে জলের তলায় নাগলোকে গিয়ে বাসুকি ভদ্রের সঙ্গে দেখা করলে…’

‘বাসুকি ভদ্র তোমাকে বেশ কয়েকটি নাগকন্যা এবং উজ্জ্বল একটি মণি দিলেন তার বিভায় তুমি স্বর্লোক পর্যন্ত সমস্ত দেখতে পেলে…’

সবাই হাহা হোহো করে হাসতে লাগল। তিষ্যরও অধরের কোণে মৃদু একটু হাসি ফুটে উঠল।

পুণ্যশীল কিন্তু দমল না। সে বলল, ‘আছে, সে সম্ভাবনাও আছে। ঝড়, জলস্তম্ভ এ-সব হতে পারে। আবার এ-ও তো হতে পারে বন্ধু যে, একেবারে ববেরু দেশে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেখানে ময়ুরের নৃত্য দেখিয়ে স্বয়ং রাজা রানিদের বশ করলাম, এক একটি ময়ূরের পরিবর্তে সমান ওজনের সোনা পেলাম। না, না, প্রথমে ময়ূর নয়, প্রথমে দেব কাক; তার পরে বার করব কপোত, তার পরে কোকিল, কোকিলের গান শুনিয়ে ওদের মুগ্ধ করব, তার পর শেষকালে বার করব ময়ূর।’

‘তুমি ওই আনন্দেই থাকো ভাই পুণ্যশীল। ববেরু দেশে পাখি নেই, সামান্য একটা কাকও সেখানে সিংহশাবকের মতো সম্মান পায় এসব পুরনো কথা আমরাও জানি। কিন্তু এই চমৎকার জীবন ছেড়ে, ধন-সম্পদ, আরাম-বিলাস ছেড়ে সমুদ্র বাণিজ্যের বিপদে সাধ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে যে চায় সে মূঢ়, মূঢ় ছাড়া কী? বলুন ভদ্র!’ সুজাত নামে বণিকটি তিষ্যর দিকে তাকিয়েছে। তিষ্যর চকিতে মনে হল পুণ্যশীল নামে এই যুবকটি বৃত্তিতে বণিক হতে পারে, কিন্তু মনোবৃত্তিতে তার এর সঙ্গে মিল রয়েছে। তার ভেতরে একটি মধুর অথচ জোরালো নারীকণ্ঠ বলে উঠল, ‘হঠকারিতা, এসব হঠকারিতা।’ আবার আর একটি আরও তেজস্বী নারীকণ্ঠ বলে উঠল, ‘তোমার জীবনে অনেক উন্নতির সম্ভাবনা দেখছি। রাজগৃহে যাও।’

এর আগে যখন নতুন দেশে গিয়ে নতুন জনপদ স্থাপন করবার কথা সে ভেবেছে, পথে কত রকম বিপদ আসতে পারে সেগুলি নিয়ে অধিক চিন্তা করেনি। মনে হয়েছিল অতি সহজ হবে সবটাই। মাঝে মাঝে অস্ত্রবল দেখাবার সুযোগ আসবে। তাতে তো সে অবশ্যই জয়ী হবে। বাকিটা অতি পরিষ্কার। এবার গৃহত্যাগ করে সত্যি সত্যি একা হওয়ার পর তার যেটুকু অভিজ্ঞতা হল, তাতেই সে খানিকটা দমে গিয়েছিল। সামান্য একটা অশ্ব সে রক্ষা করতে পারেনি। কতকগুলি গ্রাম্য তস্কর তাকে বুদ্ধিতে, ক্ষিপ্রতায় হারিয়ে দিয়েছে। অনার্য রমণীগুলি পর্যন্ত তাকে যেন গ্রাহ্য করল না। তবে কি তার পক্ষে স্বাধীন রাজ্য গড়বার কল্পনা করা হঠকারিতাই?

সে বণিকযুবার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘দেখুন ভদ্র, সুরক্ষিত গৃহ, আত্মীয় পরিজন, ধনসম্পদ, পুরুষানুক্রমিক বৃত্তি এরই মধ্যে কেউ সুখে থাকতে চায়। কারুর আবার এই জীবনকে বদ্ধ জলাশয়ের মতো মনে হয়, তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে এই প্রতিবেশে, সে নতুন দেশে পা বাড়াতে চায়। হয়ত হঠকারী। কে জানে হয়ত বা মূঢ়ও। কিন্তু কী করা যাবে! এটাই তার স্বধর্ম।’

পুণ্যশীল নামে যুবাটি বসে বসেই প্রায় যেন নৃত্য করতে লাগল, ‘কেমন? কেমন? বলিনি? ক্ষত্রিয়কুমার বীরপুরুষ, তিনি আমার স্বপ্নের মর্ম বুঝতে পেরেছেন, তোমরা কী জানো? গড্ডলিকা। সামনে তোমাদের পালক চলেছে, তোমরা কিচ্ছু দেখছ না শুনছো না, শুধু সামনের গড্ডলটি যেদিকে যাচ্ছে, মুখ নিচু করে, শিঙ বাঁকিয়ে সেই দিকেই চলেছ।’ উৎসাহে সে আঙুলে ছোটিকার শব্দ করতে লাগল।

তিষ্য বলল, ‘আচ্ছা ভদ্রগণ, আমি এবার উঠি।’

‘কোথায় যাবেন? কার গৃহে?’

‘কারও গৃহে তো নয়! পান্থশালায় ফিরব।’

‘পান্থশালা? সে কী? কেন?’

সুজাত নামে বণিক যুবা বলল, ‘কোনও বিশেষ পক্ষপাত বা রুচির ব্যাপার না থাকলে ভদ্রাবতীর ওখানে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। বারাণসীর সবচেয়ে মহার্ঘ গণিকা।’

পুণ্যশীল বলল, ‘আবারও বলছি, তোমরা সব গড্ডল। ভদ্রাবতী সবচেয়ে মহার্ঘ হতে পারে, এবং সেইজন্যই তোমরা চোখ কান বুজে সেখানে চলে যেতে পার। যাও। তবে ভদ্র, আপনাকে আমি এমন একজনের কাছে নিয়ে যেতে পারি, যার গান আপনি জীবনে ভুলতে পারবেন না। পরিচর্যাও।’

‘কার কথা বলছ পুণ্যশীল!’

‘সে আমি তোমাদের বলছি না। যদি এই ক্ষত্রিয়কুমার, কী যেন নাম আপনার?’

‘তিষ্য।’

‘হ্যাঁ এই তিষ্যকুমার যদি যেতে চান, নিয়ে যেতে পারি।’

তিষ্যর ভেতরটা বিতৃষ্ণায় কুঁকড়ে গেল। প্রথম যৌবন থেকে সে বিশাখাকে, শুধু বিশাখাকে ভেবে এসেছে। অন্য কোনও নারী তাকে আকর্ষণ করেনি কখনও। এটা তার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে।

পুণ্যশীল বলল, ‘চলুন!’ সে উঠে দাঁড়াল।

তিষ্য বলল, ‘আপনি যান। আমাকে কাল অতি প্রত্যূষে বেরিয়ে পড়তে হবে।’

‘বেশ, যাবেন না। আসুন, আপনার পান্থশালাটিতে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’ বলে পুণ্যশীল তার কাঁধের ওপর তার ভারী হাতটা রাখল।

তিষ্য এ ধরনের অন্তরঙ্গতা ভালবাসে না। লোকটির হাত কর্কশ এবং লোহার মতো ভারী। নাম পুণ্যশীল হলেও এর মধ্যে পুণ্য বা শীল কোনটারই অস্তিত্ব আছে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এত লোকের সামনে বণিকটি তাকে নিয়ে টানাটানি করবে, বেশ কিছু সরস মন্তব্যের আদান-প্রদান হবে তাকে ঘিরে, এটা তার মনঃপূত হল না। সে সুরার মূল্য দিয়ে পানাগার থেকে বেরিয়ে পড়ল। অশ্বরক্ষক তাম্রককে নিয়ে আসতে পুণ্যশীল বলল, ‘ও, আপনার সঙ্গে ঘোড়া রয়েছে। ভালই হল, আপনার পেছনে বসেই চলে যাব।’

লাফিয়ে সে তিষ্যর পেছনে উঠে পড়ল, তার অনুমতির অপেক্ষা করল না। তিষ্যর বিরক্তি উত্তরোত্তর বেড়ে যাচ্ছিল। কী ভেবেছে এ লোকটি! এক পানাগারে বসার সূত্রে সে কি তিষ্যর সমকক্ষ হয়ে গেল! এই সব বণিকদের আচার-আচরণ একেবারেই ভাল না! যদিও তার জীবনে এমন নির্লজ্জ সে অল্পই দেখেছে, তবু তার ধারণা, ক্ষত্রিয়দের তুলনায় আর সকলেই হীন। এই লোকটিকে ঝেড়ে ফেলতে না পারলে সে স্বস্তি পাচ্ছে না। সে বলল, ‘চলুন, আপনাকে কোথায় পোঁছে দিতে হবে দিয়ে আমি নিজের পান্থশালায় যাব।’

‘তা হলে তো চমৎকার হয়! চলুন আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’

ক্রমশই নদীর দিক থেকে শীতল বাতাসের স্রোত আসতে লাগল। অস্পষ্ট কোলাহল, পুণ্যশীল বলল, ‘আমরা পট্টনের দিকে যাচ্ছি, বুঝেছেন তো!’

‘আপনার পোত কি পট্টনে নোঙর করা আছে না কি?’

‘হ্যাঁ। আমরা সাতজন বণিক আছি দলে। পনের ষোলটি তরী রয়েছে।’

‘চম্পা থেকে আসছেন, বললেন না? ওখানেই থাকেন?’

‘হ্যাঁ, চম্পাতেই আমাদের তিন পুরুষের বাস। আমার পিতামহ রাজা ব্রহ্মদত্তের সময়ে বজ্জিদের একটি গ্রাম থেকে ওখানে গিয়ে বসবাস করেন।

‘রাজা ব্রহ্মদত্ত! কে তিনি?’

‘ব্রহ্মদত্ত অঙ্গদেশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন, জানেন না? বৃদ্ধ বয়সে মগধের ওই উঠতি রাজার সঙ্গে বিবাদ লাগালেন। হয়ে গেল সর্বনাশ। দেশটি ক্রমে ক্রমে হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন তো লোকে বলে অঙ্গ-মগধ। অবশ্য তাতে আপনারই কি, আমারই বা কি! আমার অল্পবয়সে উপরাজ বিম্বিসার অঙ্গ শাসন করতেন, চম্পায় থেকে, তার পরে এখন তো তাঁর পুত্র অজাতশত্রু করছেন। আমরা পার্থক্য কিছু বুঝছি না। তবে পিতা বলেন, ব্রহ্মদত্তের সময়ের থেকেই বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। গঙ্গাবক্ষে দস্যুদের উপদ্রব প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আরও একটা সুবিধে হয়েছে। আগে প্রতি পট্টনে স্বতন্ত্র শুল্ক দিতে হত, যত পট্টন, তত রাজা। এখন রাজা একই হওয়ায় অঙ্গ-মগধে শুল্কে অত ব্যয় হয় না। পিতা বলেন, সমস্ত উত্তরাখণ্ড এক চক্রবর্তী রাজার অধীনস্থ হলে আমাদের সুবিধে হয়। যাতায়াত যত অবাধ হবে আমাদের পক্ষে ততই ভাল। মুদ্রাও এক হয়। এখন ধরুন, চম্পা থেকে গঙ্গাপথে যদি যমুনায় বাঁক নিয়ে হস্তিনাপুর পর্যন্ত যাই, মুদ্রা নিয়ে বড়ই বিপর্যয় হয়। বৈশালী, কোশল, বৎস, মধুরা, কুরু, পঞ্চাল, প্রত্যেক রাজ্যে স্বতন্ত্র শুল্ক, স্বতন্ত্র মুদ্রা।’

‘স্বতন্ত্র মুদ্রা বলবেন না, চিহ্নগুলি স্বতন্ত্র।’

‘ওই হল। আমরা তো এই কারণেই এখনও বিনিময়-রীতি চালাচ্ছি। কিন্তু তার কত অসুবিধা বলুন! কোন পণ্যের কী মূল্য হবে স্থির করার কোনও ব্যবস্থা নেই।’

‘কেন অর্ঘকারকরা রয়েছেন তো?’

“সে তো শুধু রাজভাণ্ডারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য। অর্ঘকারক তো অন্য কিছুরই মূল্য স্থির করে দেন না! ফলে, ওই যে আমার বন্ধুরা বলছিল না, আমি চতুর! ওই চাতুর্যের আশ্রয় নিতে হয়।’

‘কী প্রকার? তিষ্য কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল।’

‘ধরুন, এই যে বারাণসী থেকে বহুবিধ বস্ত্র তুলব, গজদন্তের দ্রব্য, কাঠের দ্রব্য তুলব, এ সব নিয়ে এ বছর যে বণিকদল সর্বাগ্রে বিদেশের পট্টনে গিয়ে পৌঁছতে পারবে, সে সবচেয়ে ভাল মূল্য পাবে।’

‘আপনারা তো সাতজনে দল বেঁধে যাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে আপনি একা কীভাবে সুবিধে পেতে পারেন?’

‘দল বেঁধে যাচ্ছি যতক্ষণ নদীতে আছি, ততক্ষণ। পট্টনে নেমে যে যার মতো ক্রেতা সন্ধান করে বার করি। আমি কি করি জানেন? পট্টনে নেমেই অমনি অন্যদের মতো সব পণ্য বিকিয়ে দিই না। কতকগুলি নিদর্শন নিয়ে একটু ভেতরের দিকে চলে যাই। সেখানে গিয়ে সত্যঙ্কার (বায়না) নিয়ে আসি। তারপর সেই সব ক্রেতারা শকটে করে আমার পণ্য সব নিয়ে যায়।’

‘তা আপনার সহচর বণিকরা এ কৌশল লক্ষ করেনি? তারাও যদি এই উপায় নেয়, তখন কাঁ করবেন?’

‘ওরা লক্ষ করেছে বই কি? গোপনে কাজ সারার চেষ্টা করলেও কেউ কেউ লক্ষ করেছে। কিন্তু ওই যে বললাম— গড্ডলিকা। যা সবাই করে, তাই করবে। অন্য পথে পা বাড়াবে না। তা ছাড়া, ভদ্র, আপনি বণিক নন বলেই এ সব কথা আপনাকে বললাম, অন্য বণিকদের কাছে সাবধানে মন্ত্রগুপ্তি রাখি। বণিকের একটা মস্ত প্রয়োজনীয় গুণ কী জানেন? বাক্‌পটুতা। আমি তো বেশির ভাগ সময়েই ভাব দেখাই আমার আর তর সইছে না, আমি পট্টনে কোনও মুহুত্তিয়ার কাছে যাচ্ছি। মুহুত্তিয়া জানেন তো? তিষ্য কিছুটা অনুমান করেছিল কিন্তু সঠিক জানবার জন্য বলল, ‘না।’

‘এহ্, আপনি দেখছি একেবারে নাবালক! তবে কি জানেন, আপনারা তো পট্টনে থাকেন না, বা বাণিজ্য করতে করতে বৎসরের পর বৎসর গৃহ ছাড়া থাকতে বাধ্য হন না তাই এত সব জানেন না। মুহুত্তিয়া হল পণ্যস্ত্রীই। বণিকদের প্রবাসে গৃহসুখ দেয়। একেক জন এত ভাল হয়, কী বলব!’

সাকেতে সরযূতীরে আজকাল বণিকদের আসা-যাওয়া যথেষ্ট বেড়েছে। কিন্তু তিষ্য তাদের পট্টনে মুহূর্তিকা আছে বলে মনে করতে পারল না। থাকলে সরযূতীরে এদের ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত। সে যতটুকু সাকেতে থেকেছে, এদের দেখেনি। সাকেতের ব্যাপার অবশ্য স্বতন্ত্র। সাকেতের সবই অভিজাত, শ্রীমণ্ডিত। একটি অপেক্ষাকৃত সরু পথের সামনে এসে পুণ্যশীল বলল, ‘এইখানে আমি নামব। আপনি আসুন না। যে গায়িকার কথা বলেছিলাম, এইখানে থাকে।’

তিষ্য বাঁকা হেসে বলল, ‘আপনার মুহুত্তিয়া?’

—‘ঠিক ধরেছেন।’ পুণ্যশীল যেন একটু লজ্জা পেলো। তারপর বলল, ‘আপনাকেও সে অভ্যর্থনা করবে, সেবা করবে। আমি কিছু মনে করব না, আসুন না।’

তিষ্য রুক্ষ কণ্ঠে বলল, ‘আমি গান ভালবাসি না।’ তাম্রকের পেটে চাপ দিতেই সে ঘুরে দাঁড়াল, তিষ্য অস্বাভাবিক চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি যান ভদ্র পুণ্যশীল, আমি স্ত্রীলোকও ভালবাসি না। ঘৃণা করি বললেই হয়। সংগীত, নৃত্য, নারী সব।

বিস্মিত বণিক যুবকটিকে পথের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে তিষ্য পূর্ণবেগে ঘোড়া চালিয়ে দিল।

পরে পুণ্যশীল নামে ওই বণিক যুবা সহচর বন্ধুদের এই গল্পটি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে করে। সে বলে, ‘কুমারটি অসম্ভব দাম্ভিক। কিন্তু প্রথমটায় আমি তা একেবারেই বুঝতে পারিনি।’

একজন বন্ধু বলে, ‘কুমারটি নিজের মনে বসেছিল। প্রথমটা তো আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চায়নি।’

‘সেটা অপরিচয়ের আড়ষ্টতাও হতে পারে।’

‘লক্ষ করেছিলে, ও বিশেষ কথা বলেনি!’

‘না, না। কথা তো বলল। ওই যখন আমরা সবাই মিলে পুণ্যশীলকে উপহাস করছিলাম সমুদ্রবাণিজ্য নিয়ে, তখন তো অনেক কথাই বলল।’

‘দেখো, আমরা গুরুগৃহে যাইনি, কোনক্রমে উপনয়ন সংস্কারটি নামে হয়েছে। তারপর থেকে তো অর্থের সাধনাই করছি। ওই কুমারটি আমার মনে হয় উচ্চশিক্ষিত। উচ্চারণ দেখেছিলে? ক্ষত্রিয় মাত্রেই আজকাল ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, এ ব্যক্তি তো আবার রাজকুমার, তার ওপর উচ্চশিক্ষিত। দাম্ভিক তো হবেই!’

পুণ্যশীল বলল, ‘আশ্চর্যের কথা এই, প্রথমটায় কিন্তু আমার একবারও লোকটিকে দাম্ভিক-টাম্ভিক মনে হয়নি। সুখে লালিত, এবং ওই যা বললে, উচ্চশিক্ষিত। এ প্রকার রাজকুমারের রূপ এবং বাগ্‌ভঙ্গিতে একটা স্বাতন্ত্র্য তো থাকবেই। আমাদের মতো রোদেপোড়া, জলেভেজা, সাত ঘাটের জল খাওয়া তো আর নয়! খুব মন দিয়ে আমাদের বৃত্তির কথা শুনছিল। কোথা থেকে কীভাবে পণ্য আনি, কোথায় বিকোই, অনেক প্রশ্নও করছিল।’

সুজাত এতক্ষণ নীরব ছিল, এবার বলল, ‘থামো থামো, আর বলতে হবে না, বুঝতে পেরেছি।’

সবাই মিলে অনেকক্ষণ অনুরোধ করবার পর সুজাত বলল, ‘বুঝতে পারলে না, লোকটা চর। শুনলে না সাকেত থেকে আসছে। কোশলের চর। বণিকরা কোথায় কী লাভ করছে, কোন রাজার প্রতি কী মনোভাব, এ সমস্ত সমেক্ষণ করছে। কে জানে পুণ্যশীল গবগব করে আবার কী বলে ফেলেছে!’

২১

শয়নকক্ষের দুয়ারে উপর্যুপরি করাঘাতে বিশাখার ঘুম ভেঙে গেল। এই কক্ষে এখন সে একাই ঘুমোয়। মিগার গৃহের পাশেই একটি প্রশস্ত অঙ্গন, তারপর এই নতুন বাড়ি তুলে দিয়েছেন ধনঞ্জয়। বিশাখা ব্যবস্থা করেছিল তার দাস-দাসীরা এই গৃহে থাকবে, আর একটি প্রাঙ্গণ পার হয়ে কিছু দূরে অশ্বশালা ও গোশালা, এদের দেখাশোনার সুবিধাও হবে। এই দাস-দাসীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্বও তারই। কিন্তু গৃহটি এতই সুন্দর যে, এ ব্যবস্থা তার শ্বশ্রূ মেনে নিতে পারেননি। প্রশস্ত সুন্দর সুসজ্জিত শয়নকক্ষ বিশাখার। শ্বশ্রূর আদেশে সে এখানেই রাতে ঘুমোয়। কিন্তু পুণ্যবর্ধন পুরনো বাড়িতে তার পুরনো কক্ষেই রাত্রিযাপন করে। এই ব্যবস্থায় বিশাখা ভেতরে ভেতরে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে যেন এক প্রকার মুক্তিও পেয়েছে। সে এবং তার পুরো দাস-দাসীর দলটিকে যেন স্বতন্ত্র করে রাখা হয়েছে। সে এতে উৎকণ্ঠিত, কিন্তু বেশ স্বস্তিও পাচ্ছে। এই প্রকার বিপরীত মনোভাব তার হচ্ছে।

পুণ্যবর্ধনের সঙ্গে প্রথম আলাপের রাতটি ছিল বড় অদ্ভুত।

দাসীরা তাকে সাজিয়ে, শয়নকক্ষটি সুবাসিত সুসজ্জিত করে চলে গেল। সে ঘরে ঢুকে দেখল পুণ্যবর্ধন তার প্রিয় সোনার ধনুকটিতে তীর যোজনা করতে করতে হাসছে। বিশাখা ঢুকে পর্যঙ্কের ওপর বসল।

পুণ্যবর্ধন মাথা তুলে বলল, ‘ও কি? আমি অনুমতি না দিতেই বসলে যে!’

বিশাখা অবাক হয়ে বলল, ‘বসতে হলে আপনার অনুমতি নিতে হবে, এমন নিয়মের কথা তো আমি শুনিনি?’

‘আচ্ছা, ক্ষমা করলাম। এখন বলো তো বিসাখা, তোমার পিতার কত অর্থ আছে?’

‘এ আবার কী প্রসঙ্গ!’ বিশাখা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমার পিতার অর্থ নিয়ে এখন আলোচনার প্রয়োজন কী?’

‘না। যৌতুকের পরিমাণ দেখে মনে হল রাজা-রাজড়ার সঙ্গে কোনও পার্থক্যই নেই। আচ্ছা ধরো, আমার পিতার মৃত্যুর পর, সব ধন হাতে পেয়ে আমি যদি আমার ইচ্ছামতো ব্যয় করে উড়িয়ে দিই, তোমার পিতা আমাকে আবার যত ধন লাগবে সব দিতে পারবেন তো?’

বিশাখা তার স্বভাবিক দৃপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘আর্যপুত্র, ইচ্ছামতো ব্যয় করে উড়িয়ে দেওয়া ছাড়া ধনের আর কোনও ব্যবহার যদি আপনার জানা না থাকে, তা হলে আপনি যাতে ধন হাতে না পান, বিসাখা তা দেখবে। এবং বিসাখা বরং মৃত্যুবরণ করবে তবু পিতাকে কখনও জানাতে পারবে না যে তাঁর জামাতা অমিতব্যয়ী। উপার্জন করতে জানে না।’

চমৎকৃত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে এই সময়ে পুণ্যবর্ধন বলেছিল, ‘বাহা, বাহা, বাহা, তুমি তো দেখছি অম্বপালীরই মতো। অমনি রূপ, অমনি মহিমা,’ তার চোখে প্রশংসা, সেই সঙ্গে লোভ।

‘অম্বপালী কে?’

‘অম্বপালী কে, জানো না? হাঃ হা, অম্বপালী বৈশালীর শিরোমণি। অম্বপালী লিচ্ছবিদের হৃৎকমল। বৈশালীর জনপদকল্যাণী, নগরশোভিনী।’

বিশাখার মনে পড়ল তার দাসীরা তাকে জনপদকল্যাণী বলেছিল। সেইসঙ্গে উল্লেখ করেছিল গণরাজাদের দেশে সুন্দরী নারীদের প্রতিযোগিতা হয়, শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে গণভোগ্যা হতে হয়।

সে বলল, ‘আপনি দেবি অম্বপালীকে দেখেছেন?’

‘দেবী অম্বপালী!’ হা হা করে কিছুক্ষণ হাসল পুণ্যবর্ধন। তার পরে বলল, ‘দেবী? তা হবেও বা! তার রূপের মধ্যে যতটা আকর্ষণীশক্তি ঠিক ততটাই তেজস্বিতা। অবশ্য সে ভালো অভিনয় জানে, তেমন তেমন নাগরের জন্য তেজস্বী ভাবটা ত্যাগ করে শুনেছি। তখন শুধুই মধুর। মধুবে মধুর।’

‘আপনি তাঁকে এই প্রকার ভাব পরিবর্তন করতে দেখেছেন?’

‘তোমাকে বলব কেন? আগে আমার পা সংবাহন করে দাও।’

বিশাখা বলল, ‘আপনার কি পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে?’

‘না তো!’

‘তা হলে শুধু শুধু পা সংবাহন করতে যাবো কেন?’

‘তা হলে আমি বলবও না।’

‘ঠিক আছে। আমার শুনে কাজ নেই।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, বলছি। অম্বপালীর কাছে দল বেঁধে যাওয়ার নিয়ম নেই। মাঝে মাঝে সে তার অত্যুৎকৃষ্ট নৃত্য ও গীতের সভা বসায়। নিজগৃহের মণ্ডপেও হয়, কোনও ধনী বা রাজা কোনও উদ্যানে ব্যবস্থা করলেও হয়। সেখানেই গুটিকতক লোক আমন্ত্রণ পায়। কিন্তু এ ছাড়া রাত্রিবাসের জন্য সে এক বারে এক জনকে ছাড়া ঢুকতে দেয় না।’

‘এক জনের বেশি প্রবেশ করবে? এক বারে!’ দারুণ বিস্মিত হয়ে বিশাখা বলল।

‘তুমি তো বালিকামাত্র, কামকলার কী-ই বা তুমি জানো? নির্জন ভোগের স্বাদ একপ্রকার, আবার সখাদের নিয়ে একত্রে ভোগের স্বাদ অন্য প্রকার।’ বলে পুণ্যবর্ধন সাগ্রহে তাকে আলিঙ্গন করতে আসে।

বিশাখার তখন বুকের মধ্যে ভূমিকম্প হচ্ছে। সে বালিকা হতে পারে, কিন্তু পুণ্যবর্ধনও এমন কিছু বয়স্ক নয়। তিষ্যর থেকে যদি সামান্য বড় হয়। এ এই বয়সেই কামকলার স-ব জানে? নির্জন ভোগের স্বাদ, সখাদের নিয়ে একত্র ভোগের স্বাদ—এ সব কী বলছে এ? তখন গদগদ স্বরে পুণ্যবর্ধন বলছে, ‘বিসাখে, অম্বপালীকে পাঁচ শত কহাপন দিয়ে কিনলাম, কিন্তু সে তার দৃপ্ত তেজস্বী ভাব আমার সামনে একবারও ত্যাগ করেনি। আমার কামতৃপ্তি হল না। চলে আসবার সময়ে শুনতে পেলাম সে তার প্রধানা দাসীকে বলছে, “এ যে বালক, আমার পুত্রের বয়সী! এদের ঢুকতে দিস কেন? ওহ্ আর কতকাল হে শক্কদেব! আর কতকাল এই ঘৃণ্য কাজ করতে হবে! কী সে মহাপাপ হে দেবতা, যার জন্য পারিজাতকুসুমকে দুর্গন্ধ বিষ্ঠাক্ষেত্রে এমনি করে নিক্ষিপ্ত হতে হয়!” তা যতই বললা, যতই করো, নগরবধূ হয়েছ যখন তখন যে তোমার মূল্য দেবে, তাকে তো সেবা করতেই হবে! জানো বিসাখে সেই থেকে আমার পঞ্চকল্যাণীর সাধ। তা তুমিও দেখছি অম্বপালীর মতোই তেজস্বী…’ আরও অনেক কিছু বলছিল পুণ্যধর্বন। বলে যাচ্ছিল।

কিন্তু বিশাখার চৈতন্য তখন অস্পষ্ট হয়ে আসছে, সে ভাবছে এই লম্পট শ্রেষ্ঠিকুমার বালকের মতো দেখতে, বৃদ্ধের মতো কামলোলুপ—এরই জন্যে আমি তিষ্যর একান্ত প্রণয় নির্মমভাবে ফিরিয়ে দিয়েছি, উপেক্ষা করেছি রাজপুত্রবধূ হওয়ার আহ্বান… এর চেয়ে মন্দ কিছু কি হত সেখানে! প্রণয়ের কথা ভেবেছিলাম… প্রণয় তো আকাশকুসুমের চেয়েও দুর্লভ দেখছি! সংসার সেবা করব মনে করেছিলাম, কই, তাও তো আমার আয়ত্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে! হায়… এই ব্যক্তি হবে আমার সন্তানের পিতা! ভাবতে ভাবতে সে কখন হারিয়ে গেছে। আর কেউ নেই। সুসজ্জিত কক্ষ তার সুবাসিত সাত স্তর শয্যা সহ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে পুণ্যবর্ধনের মুখ, সে নিজেও হারিয়ে গেছে।

যখন চৈতন্য হল তখন অবিরত জল সিঞ্চনে তার মাথার চুল প্রায় সমস্ত ভিজে গেছে। বিশাখা কিছু জানে না। সে অবসন্নের মতো পাশ ফিরল। তার শ্বশ্রূর কণ্ঠ শুনতে পেল যেন, ‘এমন মুর্ছা ওর মাঝে মাঝেই হয় নাকি?’

ধনপালীর গলা, ‘না তো দেবি, কোনওদিন এ প্রকার তো দেখিনি।’

‘সত্য বলছ তো?’

‘সত্যই বলছি দেবি!’

‘জানি নে বাপু, কী প্রকার সুহ্না এলো গেহে। একরাশি রূপ! তো সে তো চিত্রগৃহে সাজিয়ে রাখা যাবে না! রমণী হবে জলের মতো, যখন যে পাত্রে, তখন তেমন।’

তিনি পুণ্যবর্ধনকে কিছু বলেছেন কি না বিশাখা জানে না, কিন্তু সেই থেকে পুণ্যবর্ধন আর রাত্রে এ শয়নকক্ষে আসছে না। পিতা, পুত্র যখন ভোজন করেন মধ্যাহ্নে সে উপস্থিত থাকে, পরিবেশন করে স্বহস্তে। তখন পুণ্যবর্ধন এক একবার চোখ তুলে কখনও কেমন সন্ধিৎসু দৃষ্টিতে, কখনও আকুল চোখে, কখনও অপরাধীর মতো তাকায়। কিন্তু রাত্রে আর এ গৃহের দিকে পা বাড়ায় না।

বিশাখা কোনও দুর্লক্ষ্য দৈব-উপস্থিতির কথা মনে করে ঠিক অম্বপালীর মতোই উচ্চারণ করে, ‘গত জন্মে কী মহাপাপ করেছিলাম হে তথাগত যে, পারিজাতকুসুমকে দুর্গন্ধ পঙ্কে এমন করে নিক্ষিপ্ত হতে হয়! কত কাল! সারা জীবন?’

দুয়ারে উপর্যুপরি আঘাত। বিশাখা উঠে বসে। বেশবাস গুছিয়ে নিয়ে দ্বার খুলে দেয়। তার মুর্ছা হওয়ার পর শ্বশ্রূর আদেশ হয়েছিল ঘনিষ্ঠ দাসীরা যেন তার কক্ষে শোয়। প্রথম ক’দিন তাই হয়েছিল। ভিষক্‌ এসেছিলেন। তারপর সে তো এখন যথেষ্ট ভালো আছে। শ্বশ্রূ জানেন না, সে দাসীদের স্বতন্ত্র কক্ষে পাঠিয়ে দিয়েছে। দ্বারের বাইরে তার তিন ঘনিষ্ঠ সহচরী। ধনপালী, কহ্না আর ময়ূরী। কহ্না বলল— ‘বিসাখাভদ্দা ঘোটকীটার প্রসববেদনা উঠেছে। কী করব!’

‘আমি যাচ্ছি’, বিশাখা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘তোরা যথেষ্ট গরম জল ঈষদুষ্ণ তেল আর মধু নিয়ে আয়।’

আগে আগে উল্কা নিয়ে যাচ্ছে ময়ূরী। পেছনে পেছনে বিশাখা। গৃহের বাইরে প্রাঙ্গণ পার হয়ে অশ্বশালা। প্রথমেই গর্ভবতী অশ্বীটির জন্য স্বতন্ত্রিত স্থানে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। কয়েকজন অশ্বীটিকে প্রায় বহন করে সেখানে নিয়ে গেছে। অশ্বীটি ব্যথা পাচ্ছে। অশ্বরক্ষককে জিজ্ঞাসা করল বিশাখা, ‘এত কষ্ট পাচ্ছে কেন, এ অশ্বীটি?’

অশ্বরক্ষক বলল, ‘বন্য অশ্ব তো নয় দেবী। এইসব আজানেয় অশ্বীর একটু কষ্ট সহ্য করতেই হয়।’

বিশাখা অশ্বীর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ধনপালী এবং আরও কয়েকজন মিলে গরম জল নিয়ে এসে পৌঁছল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি চমৎকার রজতকান্তি বৎস প্রসব করল অশ্বীটি। উভয়কে পরিচ্ছন্ন করে, প্রসবাগারে তাদের আরামের ব্যবস্থা করে, বৎসটিকে ভালো করে তৈল সংবাহন করে দিয়ে, মুখে মধু দিয়ে বিশাখা যখন গৃহে ফিরল, তখন রাত সামান্যই আছে। তবু সহচরীদের অনুরোধে সে আর একটু ঘুমিয়েও নিল।

ভোরবেলা অন্যান্য দিনের মতো স্নান প্রসাধন সমাপ্ত করে সে যখন দাসীদের সঙ্গে তার শ্বশুর এবং শ্বশ্রূর সেবা করতে গেল, দেখল তাঁদের মুখ যেন অন্যান্য দিনের চেয়েও গম্ভীর। সে বিধিমতো তাঁদের চরণ বন্দনা করল, পাকশাল থেকে নিজ হাতে সুগন্ধ, সুমিষ্ট যবাগু নিয়ে এলো তাঁদের প্রাতরাশের জন্য, তার স্বামীও এসে বসল। কিন্তু কেউই তাকে কোনও প্রশ্ন করলেন না। রাত্রে ঘুম হয়েছিল কি না, শরীর ভালো আছে কি না— এসব জিজ্ঞাসা করলেন না। পরে সে নিজগৃহে গেলে ধনপালী বলল, ‘বিসাখাভদ্দা, কাল যখন আমরা দীপবর্তিকা নিয়ে অশ্বশালে গেলাম, তোমার শাস শ্বশুর ও বাড়ির বাতায়ন থেকে দেখছিলেন। বললেন, “ওই দ্যাখো, গৃহের অগ্গি বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।”

বিশাখা বলল, ‘ভালো।’ সে মনে মনে হাসল। কিন্তু কারও সঙ্গেই শ্বশুর-শ্বশ্রূ বা স্বামীর চরিত্র বা আচরণ নিয়ে আলোচনা করতে পিতা বারণ করে দিয়েছেন। তার নিজেরও এ প্রবৃত্তি নেই। যদিচ ধনপালী ক্রমশই তার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। শুধু ধনপালীই বা কেন, এই ত্রয়ী—ধনপালী, কহ্না ও ময়ূরী তাকে যা ভালোবাসে, শ্রাবস্তীতে আসার পর তারা যেভাবে তাকে আগলে রাখে, বিবেচনা ও বুদ্ধির পরিচয় দেয় তাতে বিশাখার এক এক সময় লজ্জা হয় যে, সে এখনও এদের সঙ্গে প্রকৃত সখীর মতো আচরণ করতে পারে না।

সে হঠাৎ ধনপালীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘পালি, তোর বিবাহ করতে ইচ্ছা হয় না!

ধনপালী লজ্জা পেয়ে বলল, ‘এ কথা কেন বিসাখাভদ্দা?’

‘না, তুইও তো, তোরা সকলেই তো বিবাহযোগ্যা, আমার ইচ্ছা হয় তোরা সংসার করিস।’

ধনপালী বলল, ‘একটা কথা বলব ভদ্দা!’

‘একটা ছেড়ে দশটা বল না!’

‘দাঁড়াও আগে তোমার চুল শুকোনোর ব্যবস্থা করি!’

ধনপালী বড় বড় পাত্রে মৃদু আগুন নিয়ে এসে তাতে সুগন্ধিচূর্ণ ছড়িয়ে দিয়ে দ্বার বন্ধ করে দিল। বিশাখার চুলগুলো নেড়েচেড়ে শুকোতে শুকোতে বলল, ‘কহ্না বড় উৎকণ্ঠিত রয়েছে।’

‘কেন রে?’

‘এ গৃহের একটি দাস মিত্তবিন্দ ওকে বিবাহ করতে চায়।’

‘মিত্তবিন্দ কোন জন?’

‘ওই যে প্রভুপুত্তের রথ চালায়।’

‘ও, সূত! তো কহ্না কী বলে?’

‘ কহ্নারও সম্মতি আছে। কিন্তু…’

‘কিন্তু কী?’

‘তুমি যদি ক্রুদ্ধ হও!’

‘আমি ক্রুদ্ধ হবো কেন?’

‘যদি এ গেহের প্রভু অসন্তুষ্ট হন!’

‘সে আমি বুঝব’খন। কহ্না যদি সম্মত থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই এ বিবাহ হবে। কাকে আমি মুক্তি দিয়ে দেবো।’

ধনপালী বলল, ‘সেটাই, তো কথা। কহ্না মুক্তি চায় না। বিসাখাভদ্দা, আমরা কেউই তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাই না।’

বিশাখা বুঝতে পারল ধনপালীর গলায় অশ্রুর আভাস। সে নম্রকণ্ঠে বলল, ‘পালি, কেন মুক্তি চাস না! ওই দ্যাখ পিঞ্জরে শুকটা বসে রয়েছে, পায়ে সোনার শেকল। ও যতই সুন্দর বুলি বলুক না কেন, দেখলেই আমার মনে হয় ওর শেকলটা কেটে দিই।’

‘তুমি আমাদের ভালো না বাসতে পারো। আমরা তোমাকে এখন কিছুতেই ছেড়ে যেতে পারব না।’

‘কে বলে, আমি তোদের ভালবাসি না? তোরা তা হলে মূর্খ, কিছুই জানিস না। কিন্তু এখন ছেড়ে যেতে পারবি না বলছিস কেন!’

ধনপালী মুখ নিচু করে ধীরে ধীরে বিশাখার কেশের মধ্য দিয়ে আঙুল চালাতে লাগল।

‘বল!’

কী বলব! সব কথা কি বলার অপেক্ষা রাখে!’

বিশাখা বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না, পালি বল!’

ধনপালী বলল, অপরাধ নিও না ভদ্দা, কিন্তু এমন গেহে তোমার বিবাহ হবে, তা কি আমরা কখনও ভাবতে পেরেছি? তোমার মতো সুহ্না পেয়েও এঁরা সুখী নন। দিবারাত্র প্রভু আর তাঁর পত্নী শলা-পরামর্শ করছেন। আর… আর… ভদ্দা… রাগ করো না.. প্রভুপুত্ত আমাদের ডেকে ডেকে তোমার সম্পর্কে অনুসন্ধান করেন। পিতৃগৃহে তুমি কোন কোন আচার্যর কাছে বিদ্যাশিক্ষা করেছ। এমন কি, এমন কি… ময়ূরীকে জিজ্ঞাসা করেন, ওখানে কারও সঙ্গে… কোনও দাসের সঙ্গেও যদি প্রণয় থেকে থাকে।’

বিশাখা ধনপালীর হাত থেকে কেশগুলি টেনে নিয়ে ঘুরে বসল, বলল, ‘কী বললি! সত্য বলছিস?’

‘সত্য বই মিথ্যা বলব কেন, ভদ্দা। কত চিন্তা করেছি, তোমাকে বলতে কত দ্বিধা করেছি, কিন্তু আজ কথায় কথায় বেরিয়ে গেল। ‘ধনপালীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে।

বিশাখা বলল, ‘এতদিন গোপন রেখে ভালো করিসনি ধনপালি। এর পর থেকে কিছুই আমার কাছে গোপন করবি না। যদি আমার মঙ্গল চাস।’

‘আমাদের মুক্তি দিয়ে দেবে না তো ভদ্দা!’

‘কেন পালি, মুক্ত হয়ে ইচ্ছা হলে ভূতিকা হয়ে থাকবি। ক্রীতদাসীর যে পুত্র-কন্যা সবই প্রভুর সম্পত্তি হয়ে যায়। আজ না হয় আমি প্রভু, এর পর তো আমার পুত্র-কন্যারা প্রভু হবে। তারা যদি আমার মতো না হয়!’

ধনপালী কেঁদে ফেলে বলল, তোমার পিতার ঘরে দাস-পিতার মেয়ে হয়ে জন্মেছি। তোমার সকল সুখ-দুঃখে পাশে পাশে থেকেছি। আর কিছু জানিওনি, শিখিওনি। তোমাকে ছাড়া পৃথিবী আঁধার দেখি যে ভদ্দা! অন্যদের কথা একেবারে সঠিক হয়তো বলতে পারি না। কিন্তু আমাকে তুমি কোনদিন তোমার কাছ-ছাড়া করলে আমি মরে যাবো।’

শ্রাবস্তীশ্রেষ্ঠীর গৃহে দ্বিপ্রহরে নিমন্ত্রণ। ধনপালী চুল শুকোনো শেষ করে কহ্না ও ময়ূরীকে ডাকল, তিন জনে মিলে বিশাখাকে সাজিয়ে দিল। বিশাখা বেছে নিল শ্বেত বসন। তাতে সবুজ রঙের পট্টিকা বসানো, শুভ্র বক্ষবন্ধনী, শুভ্র উত্তরীয়। মুক্তার অলংকারে সর্বশ্বেত। তার ঘন ময়ূরপুচ্ছের মতো কেশ সে দিনের বেলায় খুলে রাখতে ভালোবাসে। কেশে ছোট ছোট পদ্মকুঁড়ির মালা জড়িয়ে দিল ময়ূরী। কহ্না মধ্যে রক্ত ও শ্বেতচন্দনের পত্ৰলেখা এঁকে দিল।

তিন সহচরীকে নিয়ে মিগার-পত্নীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল বিসাখা। গম্ভীর মুখে শ্বশ্রূ বললেন, ‘মাথায় গুণ্ঠন তুলে দাও বিশাখা।’

বিশাখা বলল, ‘মাতা, প্রাকৃত রমণীর ন্যায় আমার গুণ্ঠিত হতে বলছেন কেন! গুণ্ঠনের মূল কারণ সম্ভ্রম রক্ষা, কায় মন ও বাক্‌ যার সংযত তাকে তো সম্ভ্রম রক্ষার জন্য অবগুণ্ঠিত হতে হয় না!’

মিগার পত্নী বললেন, ‘তুমি বড় বেশি বিদ্যা শিখে ফেলেছ, আমি তোমার চেয়ে বয়সে কত বড় বলো তো? আমার মুখের ওপর কথা বলছ!’

বিশাখা নীরব রইল। কিন্তু অবগুণ্ঠন দিল না।

তার শ্বশ্রূ বললেন, ‘কী হল, ধনীকন্যা বলে কি পুজনীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের কথাও শুনবে না?’

বিশাখা বলল, ‘বয়োজ্যেষ্ঠদের পূজা নিশ্চয় করব, সেবাও করব। কিন্তু তাঁরা যুক্তিসিদ্ধ বাক্ না বললে মানতে পারব না। অবগুণ্ঠন দিলে স্বীকার করে নেওয়া হয় আমার কায়সংযম নেই। অথচ আমি ভিক্ষুণীর মতো সংকচ্ছিকা ব্যবহার করি। উত্তরীয় দ্বারা উত্তমরূপে অঙ্গ আবৃত করে বেরোই। আর মাতা, আমার এসব আচরণের সঙ্গে ধনের কোনও সম্পর্ক নেই। ধনীকন্যা বলে নয়, বিসাখা বলেই আমি এমন করে থাকি।’

কিছুক্ষণ বাক্যহীন হয়ে রইলেন মিগার-পত্নী। ভেতরে-ভেতরে ক্রুদ্ধ। কিন্তু এ কথা সত্যি, অবগুণ্ঠন দেওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। শেষে তিনি বললেন, ‘তুমি জনপদকল্যাণী বধূ। তোমার রূপ দেখে যদি কেউ লুব্ধ হয়! হরণ করতে আসে!’

বিশাখা আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সাবত্থিতে এমন ঘটনা হয় নাকি? কই আমাদের সাকেতে তো হয় না মা! তবু যখন কুমারী ছিলাম, কিছু কিছু নিয়ম মেনে চলতেই হত চলাফেরার ব্যাপারে, কিন্তু এখন তো বধূ হয়ে গেছি! কে এমন লম্পট আছে যে, প্রকাশ্য রাজপথে বধূর প্রতি লুব্ধতা প্রকাশ করবার পরেও নিজেকে নাগরিক বলবে? মা, আপনি ভয় করবেন না, আমার সহচরীরা তো রইলই, তারা না পারলেও বিসাখা একাই দশজন পুরুষকে ভূলুণ্ঠিত করে দিতে পারে।’

সে শ্বশ্রূ-মাতার পদধূলি নিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে শিবিকায় গিয়ে উঠল। হুম হুম করতে করতে শিবিকাটি চলে গেলে মিগার-পত্নী কপাল চাপড়ে স্বামীকে অন্তঃপুরে ডেকে পাঠালেন।

‘এ কি বধূ না দস্যু? কারও কথা শুনবে না, মানবে না, বলে কি না দশজন পুরুষকে ভূলুণ্ঠিত করে দিতে পারে!’

অসময়ে অন্তঃপুরে এসে পত্নীর এই খেদোক্তি শুনে মিগার ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ‘কী ব্যাপার?’ বারে বারে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পান না। অবশেষে রাগ করে আবার ফিরে যাচ্ছেন, তখন পত্নী সব খুলে বললেন। শুনে মিগার বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাঁর সুহ্নাটি রূপে ধনে বলবতী। সে যদি বলে থাকে দৈহিক বলও তার আছে, তো নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেনি। ক্ষত্রিয়দের ঘরের কন্যারা শরীর-চচা শস্ত্র-চর্চা করে বটে, কিন্তু শ্ৰেষ্ঠীদের ঘরে?… নাঃ ততটা চল নেই। কিন্তু কে নিজের প্রাসাদ-প্রাচীরের আড়ালে কীভাবে কন্যাপালন করছে কে জানে! সন্দেহ নেই তিনি উচ্চতর বংশ থেকে বন্ধু এনেছেন। সে এখানে অবলীলায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে যাচ্ছে। তাঁরাই—তিনি, তাঁর পত্নী, কে জানে হয়ত বা পুত্রও বরং মানাতে পারছেন না। তবে হ্যাঁ, তাঁর হাতে এখনও অস্ত্র আছে বইকি! কন্যার প্রতি ধনঞ্জয়ের উপদেশগুলি স্মরণ করে তিনি মনে মনে বেশ হৃষ্ট হয়ে ওঠেন। ধনঞ্জয় ও তাঁর কন্যা উভয়কেই দমন করার উপায় তাঁর জানা আছে। পত্নীকে সেগুলি খুলে বলেন। পত্নী একটু আশ্বস্ত হন।

ওদিকে বিশাখার শিবিকা শ্রাবস্তী শ্ৰেষ্ঠীর অন্তঃপুরে গিয়ে পৌঁছলো। গৃহের যে যেখানে আছে সবাই বরণ করে নিতে এলো বধূকে। শ্ৰেষ্ঠী স্বয়ং রাজসভায় যাবার আগে তাকে আশীর্বাদ করে গেলেন। শ্রেষ্ঠী-পত্নী মহাসমাদরে তাকে সম্ভাষণ করলেন। নিজেদের গৃহ, উদ্যান সব দেখালেন। এবং বিশাখার শ্রেষ্ঠ লাভ হল— সে-গৃহের বধূ সুপ্‌পিয়ার সঙ্গে সখিত্ব। সুপ্রিয়ার সঙ্গে তার অনেক পার্থক্য। কিন্তু তবু কোথায় যেন গভীরতর এক সাদৃশ্যের বন্ধন!

শ্ৰেষ্ঠী-পত্নী তাকে বহুবিধ পদ সহকারে ভোজনে আপ্যায়িত করলেন। পরে বললেন, ‘বধূ বিসাখা, তুমি সাবত্থির হৃদয়-লক্ষ্মী। আমাদের সবাইকে তোমার রূপে-গুণে বশীভূত করে ফেলেছ। কিন্তু তোমার আপন ঘরের মানুষগুলিকে জয় করতে পেরেছ তো?’

বিশাখা সদানন্দময়ী। সে স্মিতমুখে বলল, ‘মাতঃ, আপনাদের তো আর নিত্য বিসাখার সঙ্গে বাস করতে হয় না, আপনাদের জয় করা সহজ।’

সুপ্রিয়া হাসতে হাসতে বলল, ‘দেখেছেন মা, বিসাখা মিথ্যা বলে না, কিন্তু নিন্দাবাদেও তাকে সহজে প্রবৃত্ত করা যাবে না।’

সুপ্রিয়ার শাশুড়ি বললেন, ‘আমরা তো মিগার-পত্নীকে চিনি, নানান সমাজ-উৎসবে দেখাশোনা হয়, আমাদের গহপতিও মিগার-সৌঠিকে ভালোই চেনেন। বড় কৃপণ। ব্যয়েও কৃপণ, আচরণেও কৃপণ। কত পুণ্য না জানি করে এসেছিলেন, তাই ওঁরা তোমার মতো সুহ্না পেয়েছেন।’

সুপ্রিয়া মৃদু হেসে বলল, ‘আর আপনারা বুঝি পুণ্য অল্প করেছিলেন মা, তাই সুপ্‌রিয়ার মতো সুহ্না পেয়েছেন?’

বিশাখা তার কথা শুনে হাসতে লাগল। বলল, ‘এখন কী উত্তর দেবেন মাতা, দিন। সুপ্রিয়া প্রকৃতই দুঃখ পেয়েছে। দেখুন ওর চোখ দুটি কেমন ছলছল করছে!’

সুপ্রিয়ার শাশুড়ি অমনি তাকে কাছে টেনে আদর করে বললেন, ‘আমরা যে অনেক পুণ্য করে সুপ্‌পিয়াকে পেয়েছি তাতে কি আর সংশয় আছে। আমি বলছিলাম মিগার সেটঠির ঘরের কথা। ওঁরা কেউ অত পুণ্য করেছেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না বচ্চে।’

সারাক্ষণই সুপ্রিয়া তার শাশুড়ির বক্ষলগ্ন হয়ে কটাক্ষে বিশাখার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। তাদের কৌতুক শাশুড়ি-মা ধরতে পারেননি।

এর পর বিশ্রামের জন্য সুপ্রিয়া বিশাখাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ফুল দিয়ে সাজানো প্রেঙ্খায় বসে দুলতে দুলতে দুই সখী বহু বিষয়ে আলাপ করল। শ্রাবস্তীর রীতি-নীতি, রাজা প্রসেনজিৎ, জেতবন বিহার প্রস্তুত হচ্ছে, তার কথা। বিশাখার মতে, সাকেত অনেক সুন্দর, রুচিসম্মত। সুপ্রিয়া বারাণসীর মেয়ে। সে বলল, ‘প্রথম প্রথম আমারও ওই প্রকার মনে হত বিসাখা, কিন্তু এই সাবত্থি মহানগরীর আকর্ষণ এক মহা-আকর্ষণ। ধীরে ধীরে দেখবে সাবত্থিই তোমার আপন, তোমার ধ্যান হয়ে উঠছে।’

বিশাখা কখনও বারাণসী যায়নি। কিন্তু পিতার কাছে শুনেছে সে এক মহা হট্টরোলের স্থান। সে মনে মনে বলল— সাকেত, সাকেত, তার অঞ্জনবন, তার সরযূতীর, তার সেট্‌ঠি-গেহ নিয়ে অনন্য। এখন তার কাছে ভদ্দিয়র স্মৃতি ম্লান হয়ে গেছে, জাগরূক রয়েছে ধনঞ্জয়-সুমনার নির্মিত সাকেত। এ সব কথা সে এক্ষুনি সুপ্রিয়াকে বলল না। পরে এক সময়ে বলবে। এখন মাতা-পিতার কথা মনে করে তার চোখে জল আসছে।

গৃহে ফিরতে বিশাখার সন্ধ্যা হয়ে গেল। সুপ্রিয়ার শ্বশ্রূ-মা শিবিকার সঙ্গে সাতটি উল্কা দিয়ে দিলেন। সারি সারি আলোর মধ্যে দিয়ে গৃহে ফিরে শ্বশুর ও শ্বশ্রূর সংবাদ নিল বিশাখা। তারপর নিজ কক্ষে বেশবাস পরিবর্তন করতে গেল। ধনপালী বলল, ‘ভদ্দা, তুমি যখন হাতে উল্কা নিয়ে গেহে ঢুকছিলে ও বাড়ির অলিন্দ থেকে তোমার শ্বশ্রূ-মা দেখছিলেন।’ অতঃপর ওঁরা উভয়েই নেমে এলেন। গহপতি বললেন, ‘বাইরের অগ্গিও তো ঘরে নিয়ে এলো দেখছি!’

বিশাখা হেসে বলল, ‘ভালো।’

তারপর একদিন মিগার ও তাঁর পত্নী বিশাখাকে ডেকে বললেন, ‘আমরা তোমাদের নতুন বাড়িতে অগ্নিগৃহ করে দিচ্ছি। তুমি পিতৃগৃহ থেকে এত দাস-দাসী, রক্ষী, সূত, শিবিকাবাহক, আজ্ঞাপালক, ধনরত্ন, গাভী, অশ্বাদি নিয়ে এসেছ যে, সে সব দিয়ে একটা স্বতন্ত্র গ্রামই করে ফেলা যায় ইচ্ছা হলে। আমাদের অধীনে তোমাদের থাকবার প্রয়োজন কী? অগ্নিগৃহ হোক। অগ্নিহোত্র পালন করে দু’জনে যথাযথ দম্পতি হও। গার্হস্থ্যধর্ম পালন করো।’

বিশাখা বলল ‘পিতা, আমি তো অগ্নিহোত্র পালন করতে পারব না!’

মিগার বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সে আবার কী! যে কোনও গৃহস্থেরই কর্তব্য অগ্নিহোত্র পালন করা। গার্হপত্য অগ্নি দিয়ে গার্হস্থ্যকর্ম করবে, আহবনীয় অগ্নিতে দেবতাদের হব্য দেবে, দক্ষিণাগ্নিতে হব্য দেবে পিতৃপুরুষকে। তোমার পিতৃগৃহে দেখোনি?’

শেষের প্রশ্নটি অগ্রাহ্য করল বিশাখা, তাদের গৃহে অগ্নিহোত্র পালন করা হয়। কিন্তু বিশ্বাস করা হয় না। শুধু লোকাচার। এক প্রকার বিশ্বাস করা হবে, আর এক প্রকার হবে আচার— এ বৈষম্য তার অভিপ্রেত নয়। সে বলল, ‘জানি পিতা। কিন্তু অগ্নি যে কোনও দেবতা নয়, বস্তুমাত্র, প্রাকৃতিক শক্তিমাত্র—এ কথা তথাগত বুদ্ধ প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমি আর অগ্নি পরিচর্যা করব না। যা বিশ্বাস করি না তার আচরণও করতে পারি না পিতা।’

বলো কী? বুদ্ধ বুদ্ধ সাবত্থিতে তো রাতদিন শুনছি। বুদ্ধ হয়েছেন! অতই সহজ! তো সেই বুদ্ধ সাকেতকেও ভেদ করেছে নাকি?’

বিশাখা শ্বশুরের এইসব উক্তির উত্তর দিল না। শুধু বলল, ‘তা ছাড়া, আপনি আর মাতা আমার পরমপূজ্য। এই গৃহের সব কিছুই আমার পরিচর্যার অপেক্ষা রাখে। এই পূজা ও কর্তব্য থেকে আমায় বঞ্চিত করবেন কোন অপরাধে?

তখন মিগার কুটিল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেন! তোমার পিতা তোমাকে সুখাসনে বসতে, সুখে ভোজন করতে, সুখে শয়ন করতে উপদেশ দিয়েছেন না?’

বিশাখা মনে মনে হাসল, ইনি তার পিতার উপদেশের মর্ম বুঝতে পারেননি। মুখে বলল, ‘তাই-ই তো বলছি পিতা—আপনাদের সেবা না করে তো আমি অশনে-বসনে-শয়নে সুখ পাবো না!’

পুত্রবধূর বিনয়বচনে সুখী হতে পারলেন না মিগার! এ বালিকার মুখের দিকে তাকালে মুগ্ধ হতে হয়, বচন শুনলে সম্ভম জাগে, আচার-আচরণে একটা অনায়াস কর্তৃত্ব। এ তো দেখি সত্যসত্যই মিগার-গৃহের সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠছে! মিগার-দম্পতি আর কী করেন! তখনকার মতো নিবৃত্ত হতেই হল। এবার বধূকে পরিপূর্ণ গৃহধর্মে গ্রহণ করতেই হয়। তিনি তাঁর গুরু নিগ্‌গণ্ঠ নাতপুত্তকে সংবাদ পাঠালেন। উৎসবের আয়োজন করতে হবে। নববধূকে তাঁরা আশীবাদ করবেন।

ইতিমধ্যে হিমঋতু এসে গেছে। মিগারের কমান্ত গ্রাম থেকে সংবাদ আসে শস্যক্ষেত্রগুলো এবার দ্বিগুণ, ত্রিগুণ উৎপাদন করেছে। গাভীগুলো যা দুধ দিচ্ছে তাতে নবনীত এবং ঘৃত হচ্ছে অপরিমিত। সারা বর্ষা অবন্তীর কতকগুলি গ্রামে ক্রয়-বিক্রয় সমাপ্ত করে মধুরা, ইন্দ্রপ্রস্থে বাণিজ্য করে কাশ্মীরের দিকে চলে গেছে তাঁর বণিকদল। সার্থবাহ দ্রুতগামী এক অশ্বারোহীর হাতে পত্র পাঠিয়েছে। বর্ষা কেটে গেল, তবু ফিরল না দেখে মিগার হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, এরা নিশ্চয়ই দস্যুর হাতে বিনষ্ট হয়েছে। গেছে পাঁচ শো শকট। তার মধ্যে তিন শো শকটই তাঁর। সঙ্গে আপনজনের মধ্যে গেছে তাঁর দুই ভ্রাতুস্পুত্র। সার্থবাহ শ্রাবস্তীরই অতি দক্ষ লোক। শ্রাবস্তীর সমস্ত শ্রেণীজ্যেষ্ঠক সে যাচ্ছে জানলেই নিজেদের পণ্য চোখ বুজে দিয়ে দেয়। কিন্তু মিগারের ভয় ছিল। তাঁর সব সময়েই ভয় হয়, সংশয় হয়, দ্বিধা হয়। এই ভ্রাতুস্পুত্র দুটিকে গ্রামের গৃহ থেকে এনে কাজ-কর্ম সব বোঝাচ্ছেন। নিজের পুত্রটি তো তার মায়ের চোখের মণি, তাকে মায়ের অঞ্চলচ্যুত করে কাজে পাঠানো অতি দুরূহ ব্যাপার। সে-ও আছে ভালো। আজ কাব্যসভা, কাল বিতর্কসভা, পর দিবস নৃত্যসভা, তারও পরদিন গীতসভা। গণিকা গৃহে যে শুধু চারুকলা চর্চা হয় না তিনি ভালো করেই জানেন। অল্প বয়সে নিজেও বহুবার গিয়েছেন। ধনক্ষয়ের এমন ব্যবস্থা তাঁর আর জানা নেই। অথচ পুণ্যবর্ধন দু-তিন দিন পর বাড়ি ফিরলে তিনি যদি অসন্তোষ প্রকাশ করতেন, সে বলত, “ও সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপার পিতা, আপনি কী বুঝবেন? বাস তো করেন স্বর্ণপিণ্ডের স্থূল জগতে!” তার মা-ও এতে যোগ দিতেন। পুত্রকে তক্ষশিলায় না পাঠিয়ে যে কী ভুল করেছেন!

যা-ই হোক, সার্থবাহর পত্র নিয়ে দূত এসেছে। আশাতীত লাভ হওয়ায় তারা কাশ্মীর গেছে। নূতন পণ্য নিয়ে ফিরতে ফিরতে হয়ত আরও ছয় মাস কাটবে। কিন্তু মিগার যেন নিশ্চিন্ত থাকেন। দূতের সঙ্গে স্থবিকা-ভর্তি স্বর্ণও পাঠিয়েছে তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র।

মিগারের গণক ও লেখকরা এক বাক্যে বলছে— এসব নববধূর ভাগ্যে ঘটছে। সত্যি, রাজা প্রসেনজিৎ পর্যন্ত যে- কোনও উপলক্ষে বধূর নাম করে মহার্ঘ উপহার পাঠান। বধূর উপোসথ? রাজবাড়ি থেকে ভারে ভারে ফল, ক্ষীর, মিষ্টান্ন, ক্ষৌমবস্ত্র, তৈজস সব এসে পৌঁছল। রানি মল্লিকার পুরে নিমন্ত্রিত হয়ে গেল বধূ। স্বর্ণদণ্ডী নিজের শিবিকায় করে নিয়ে গেলেন রানি। এক গা গহনা তো দিলেনই, শিবিকাটিও রানি বিশাখাকে দিয়ে দিলেন। গহনা, শিবিকা সমস্ত আবার বিশাখা এসে তার শ্বশ্রূকে অর্পণ করল। কাজেই, মিগার-গৃহ এখন এমন একটি কলস যার দুগ্ধ কখনও ফুরোয় না, এমন মোদকের পাত্র যা থেকে যত মোদক নেবে, ততই তা আরও পূর্ণ হয়ে উঠবে। অন্যান্য শ্ৰেষ্ঠীরা, এমন কি অন্যান্য লোক যেমন সম্পন্ন ব্রাহ্মণ বা রাজ পরিবারের মানুষও বলতে আরম্ভ করেছে— বিশাখা সুভগা বধূ। সে আসার দিন থেকেই শ্রাবস্তীর সর্ববিধ শ্রেণীতে সমৃদ্ধি আসছে। এখন শ্রাবস্তীর যে-কোনও গৃহের, যে-কোনও উৎসবে বা সংস্কারে বিশাখাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও গর্ভিনীর পুংসবন হবে বিশাখা যাবে, কার পুত্রের নামকরণ কি উপনয়ন উৎসব হচ্ছে গুরুগৃহে যাবার জন্য, বিসাখা যাচ্ছে। কে বিশেষ তিথি উপলক্ষে উপোসথ পালন করবে বিসাখাকে চাই, একত্রে ধর্মাচরণ করবে। বিসাখার সদা-হাস্যমুখী, সহমর্মী উপস্থিতি ছাড়া কোনও কাজ যেন আরম্ভই হতে পারে না।

নতুন শালিধানের সরু চাল কমান্ত গ্রাম থেকে বহু বহুতর শকটে করে এসে পৌঁছল। সেই সঙ্গে তৈল, ঘৃত, নবনী, শাক, পর্ণ, গুড়, তিল, কী নয়! মিগার-পত্নী ডাক দিলেন ‘বিসাখা! ডাকবার আগেই বিশাখা এসে গেছে। মিগারের ঘরের দাস-দাসী গুলি তো রইলই, আরও রইল বিশাখার দাসীরা। সব ভাণ্ডারজাত করতে হবে। সারা বৎসরের ব্যবস্থা। ঝাড়া, বাছা, ধোওয়া, শুকোনো, সব বিশাখা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করালো। সারা দিন পরিশ্রমে বিশাখার মুখ যেন আরক্ত কমলের মতো দেখাচ্ছে। শ্বশ্রূ-মা আজ তার ওপর সত্যিই সন্তুষ্ট। তাঁর সন্তোষের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ রাত্রে শয়নকক্ষে প্রবেশ করে সে দেখল পুণ্যবর্ধন সাজ-সজ্জা করে বসে আছে। তার কণ্ঠে স্বর্ণহার, বাহুতে অঙ্গদ, কানে কুণ্ডল।

বিশাখাকে দেখেই সে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে উঠল, ‘এসো এসো প্রিয়ে, বসো, বসো।’

বিশাখা তাকে অভিবাদন করে অদূরে একটি ভদ্রপীঠে বসল।

পুণ্যবর্ধন বলল, ‘এত দিন বিরহে বড়ই কষ্ট পেয়েছ প্রিয়ে, আমায় ক্ষমা করো। কাজে বড়ই ব্যস্ত ছিলাম।’

বিশাখা মৃদু হেসে বলল, ‘সারা রাতই আপনি কাজ করেন? অমন করলে শরীর নষ্ট হয়ে যাবে যে!’

‘কৌতুক করছ?’ পুণ্যবর্ধন হেসে উঠল। সে রসিক। তা ছাড়া আজ এতদিন পর বিশাখার কক্ষে আসার অনুমতি পাওয়ায় তার মনটা অত্যন্ত স্ফূর্তিতে আছে।

বিশাখা বলল, ‘আর একটা প্রশ্ন করব, সেটাকে যেন কৌতুক বলে নেবেন না।’

‘করো, করো। আজ তোমাকে শত প্রশ্ন করার বর দিলাম। সব প্রশ্নের যথাযথ সুসঙ্গত উত্তর পাবে।’ দু’ হাত প্রসারিত করে বর দান করল পুণ্যবর্ধন।

‘শত প্রশ্ন নয়। একটাই প্রশ্ন আছে। আমার কোন দাসীটি আপনার সবচেয়ে মনঃপূত?’

‘দাসী তো তোমার সবগুলিই চমৎকার!’

‘তবু, তার মধ্যে?’

‘কেন বিসাখা! হঠাৎ এ প্রসঙ্গ!’

‘আপনি আমার দাসীদের মধ্যে একজনকে শয়নসঙ্গিনী বেছে নিন। অবশ্য তারও সম্মতি চাই। যে সম্মত হবে তাকে পাবেন, অন্যদের না।’

পুণ্যবর্ধনকে যেন কেউ কশাঘাত করেছে। সে বলল, ‘কী বলছ বিসাখা। আমি দাসী নিয়ে কি উপপত্নী নিয়ে রাত্রিযাপন করবো, আর তুমি?’

‘এই গৃহে আরও কক্ষ আছে। সমান সুখদ ও মনোহর, আমি সেইখানে শয়ন করবো।’

‘কেন?’

‘অনেক কুলপুত্ৰই তো দাসীদের সঙ্গে ব্যভিচার করে থাকেন, কেউ তো দোষ দেয় না! এমন কি দাসীরাও তো সম্পত্তিই! তাদের ব্যবহার করলে, তা তো ব্যভিচার বলেও গণ্য হয় না দেখি। আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন কেন?’

গর্বিত কণ্ঠে পুণ্যবর্ধন বলল, ‘তা যদি বলো, আমার রুচি অতি সূক্ষ্ম বিসাখা, তুমি জানো না তাই বলছ। এ গৃহে তুমি আসবার পূর্বেও যৌবনবতী দাসী ছিল। আমি কোনওদিন তাদের শয্যায় ডাকবার কথা চিন্তাও করিনি। মূর্খ, নীচ ওই সব স্ত্রীলোক হবে পুণ্যবর্ধনের শয্যাসঙ্গিনী!’

‘তবু আপনাকে এখন বিশাখার পরিবর্তে বিসাখার দাসীতেই তুষ্ট হতে হবে। কারণ বিসাখা দাসের সঙ্গে প্রণয় করতে পারে এ কল্পনা যদি আপনার পক্ষে সম্ভব হয়, তা হলে সুমনাপুত্রী আপনাকে দাসীভোগ্য ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।’

‘ও হো, আমি তোমার সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছিলাম বলে ক্রুদ্ধ হয়েছ?’

পুণ্যবর্ধন তার কুন্দশুভ্র দাঁতের পঙ্‌ক্তি বার করে, তার সুকুমার ওষ্ঠাধর বিস্তৃত করে হাসতে লাগল, ‘সে দেখো বিসাখা, তুমি নববধূ, কুমারী কন্যা, অথচ আমার প্রতি তোমার কোনও আকর্ষণ দেখছি না, আমার মনে সংশয় হবে না! তার পরে দেখো, নারীরা স্বভাবতই কামপরায়ণ। পণ্ডিতেরা বলেন স্ত্রীলোককে কখনও বিশ্বাস করবে না। সেই কহ্না নামের রমণীর গল্প জানো না? যার পাঁচ পাঁচটি রূপবান, গুণবান, বীর্যবান পতি ছিল, তবু সে এক কুব্জ পরিচারকের প্রণয়াসক্ত হয়ে, তার অনুগত হয়ে পতিদের প্রবঞ্চনা করত! রমণীরা সুযোগ পেলেই স্বামীর সখা, সূত, দাস, এমন কি ভ্রাতা বা পিতার সঙ্গেও…’

বিশাখা গম্ভীর গলায় বলল, ‘স্তব্ধ হোন। আর একটিও ইতরবাক্য উচ্চারণ করলে তার ফল ভালো হবে না।’

পুণ্যবর্ধন বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা না-ই বললাম।’ কিন্তু তার মুখ এবার অপ্রসন্ন।

‘নারীদের সম্বন্ধে এরূপ ধারণা যে পোষণ করে সে আমার দাসীদেরও যোগ্য নয়’, বলে বিশাখা কক্ষ ত্যাগ করতে উদ্যত হল।

পুণ্যবর্ধন এক লাফে উঠে এসে তার হাত শক্ত করে ধরল, কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘এত সাহস তোমার যে, সামান্য নারী হয়ে স্বামীকে, প্রভুকে উপেক্ষা করো! গালি দাও!’ বলতে বলতে সে বিশাখার মৃণালের মতো সুগোল কমনীয় মণিবন্ধটিতে মোচড় দিতে লাগল।

বিশাখা সামান্য একটা হাত ঝাড়ার মতো ভঙ্গি করতেই পুণ্যবর্ধন ছিটকে পড়ে গেল শয্যার ওপরে। তার নিম্নাঙ্গ পালংক থেকে ঝুলছে। বিশাখা অটল মহিমায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সামান্য নারী বিশাখা নয়। কিন্তু তুমি অতি অধমেরও অধম পুরুষ। তোমার লজ্জা নেই তাই অগণিত গণিকাগৃহে গিয়ে গিয়ে নিজের কৌমার নষ্ট করেছ। অন্যান্য সঙ্গীদেরও তাই করতে দেখেছ। তারও পরে তোমার নারী-নিন্দা করবার সাহস হয়! প্রভু! স্বামী! এ পৃথিবীতে বিসাখার প্রভু কেউ নেই। আর বিবাহিত স্বামী বলে যদি নিজেকে বিসাখার প্রভু বলতে চাও, বলতে পারো। কিন্তু বিসাখা কোনওদিন তোমার মতো হীন ব্যক্তিকে প্রকৃত স্বামী বলে স্বীকার করবে না।’

বিশাখার উত্তেজিত বাচনে, তার বক্তব্যে, তার কথার বাঁধুনিতে এবং ক্রোধে যত না বিস্মিত হয়েছিল, তার চেয়েও অনেক বিস্মিত হয়েছিল পুণ্যবর্ধন তাকে ওভাবে এক ধাক্কায় শয্যায় ফেলে দেওয়ায়। সে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কি নারীবেশী পুরুষ? কোনও ঋদ্ধিমান জাদুকর? কে তুমি?’

বিশাখা তপ্তকণ্ঠে বলল, ‘সেদিন শ্বশ্রূ-মা জিজ্ঞাসা করেছিলেন কোনও দুবৃত্ত তোমাকে আক্রমণ করলে কী করবে? আমি তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলাম এই বলে যে, দশজন পুরুষকে ধরাশায়ী করাও আমার কাছে কিছু না। তখন ভাবিনি আমার বিবাহিত পুরুষই হবে প্রথমতম দুবৃত্ত, যাকে আমায় ধরাশায়ী করতে হবে। শোনো পুন্নবদ্‌ধন, ঋদ্ধিও নয়, জাদুবিদ্যাও নয়, আমার পিতা-মাতা আমাকে মল্লবিদ্যা, শরসন্ধান, ভারোত্তোলন সব শিখিয়েছেন। তা তোমারই ওপর প্রথম প্রয়োগ করতে হল। ধিক, ধিক তোমাকে। বিসাখা নারী কি পুরুষ, কি ছদ্মবেশী দেবতা জল্পনা করতে থাকো, আমি এখন চললাম।’

হতবুদ্ধি পুণ্যবর্ধনকে শয্যার ওপর উপবিষ্ট রেখে, কক্ষ ত্যাগ করল বিশাখা। ক্রুদ্ধ সর্পিনীর মতো নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিজের প্রসাধনগৃহে ঢুকল। ধনপালী কিছু অবশিষ্ট কাজ সারছিল। সে দেখল তার স্বামিনীর মুখ একেবারে রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে। যেন কিংশুক ফুটেছে একগুচ্ছ। চোখ দুটি অঙ্গারখণ্ডের মতো জ্বলছে। তার পদক্ষেপ অতি দৃঢ় এবং সশব্দ। সে যেন স্বয়ং দক্ষিণাগ্নি মূর্তি ধরেছে। কিংবা যক্ষী, কালপুরুষী, ঠিকমতো হব্য না দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

ধনপালী ভয়ে বিবর্ণ হয়ে ছুটে এলো, ‘ভদ্দা, বিসাখাভদ্দা, কী হয়েছে?’

বিশাখা ততক্ষণে প্রসাধন ঘরের পর্যঙ্কিকায় শুয়ে পড়েছে। সে বলল, ‘কস্তুরী-গন্ধ জল নিয়ে আয় পালি, আমার সর্বাঙ্গ মুছিয়ে দে। দেহ যে জ্বলে যায়, মন জ্বলে যায়। ধূপ জ্বালা, বড় দুর্গন্ধ। বাতায়নগুলো খুলে দে না। না, বন্ধ করে দে, বন্ধ কর। এখানে কি কাছাকাছি কোথাও মলক্ষেত্র আছে? হায় পালি, পিতা কই আমার? পিতা! মা! মাতা কোথায় গেলেন? আমায় আমার মাতার কোলে, পিতার কোলে ফিরিয়ে দিয়ে আয়। আর তা যদি সম্ভব না হয় তো জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড কর, বারাণসী বর্ধকিদের এই শিল্পকীর্তি ভেঙেচুরে যজ্ঞের আয়োজন কর, মহাযজ্ঞ। আহুতি দে, আহুতি দে বিশাখাকে। কে, কোথায় কোন দেবতা আছেন জানি না, বিশাখা-মাংস আহুতি দিয়ে তুষ্ট কর, তুষ্ট কর সেই নিষ্ঠুরকে…’ বলতে বলতে শয্যার ওপর গড়াগড়ি খেতে লাগল বিশাখা, যেন সত্যিই তার সারা শরীরে আগুন লেগে গেছে।

ধনপালী ততক্ষণে দ্রুত হাতে কস্তুরী-জল নিয়ে এসেছে। ছুটে ছুটে খুলে দিয়েছে সব গবাক্ষ। ঘণ্টা বাজিয়ে ডেকেছে কহ্না ও ময়ূরীকে। দুয়ার বন্ধ করে তিনজনে মিলে যা যা কৌশল জানে সমস্ত প্রয়োগ করে শান্ত করবার চেষ্টা করছে বিশাখাকে। দেবী সুমনা বলে দিয়েছিলেন, “বিবাহের পর গোড়ায় গোড়ায় অনেক সময়ে শয়ন-কলহ হয়। তোমরা বিসাখার প্রতি দৃষ্টি রেখো। সে বড় তেজস্বী কন্যা।” কিন্তু এখন বিশাখাভদ্রার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এ শুধু শয়ন-কলহ নয়। তাদের প্রভুকন্যা তেজস্বী হলেও চিরদিন সংযত, আত্মস্থ। আজ যেন সে নিজের ওপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।

অনেকক্ষণ পর যখন বিশাখা অপেক্ষাকৃত শান্ত হয়ে এসেছে, বারবার সুবাসিত স্নিগ্ধ জল দিয়ে তার শরীর মোছা হয়েছে, হাতে-পায়ে গণ্ডে শ্বেতচন্দনের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে, ময়ুরপাখার বীজনী দিয়ে বাতাস করা হয়েছে সমানে, সে তার অশ্রুমুখী তিন দাসীর দিকে চেয়ে তর্জনী তুলে বলল, ‘ময়ূরি, কঙ্কা, পালি, আজ থেকে তোরা আমার সই, কেউ যেন তোদের দাসী না বলে।’

ময়ূরী তার পায়ের ওপর মাথা রেখে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আমরা তোমার সেবা করতেই যে চাই ভদ্দা! তোমাকে সাজিয়ে দেবো, তোমার শুশ্রূষা করবো, তোমার আজ্ঞা পালন করব— এতেই আমাদের সুখ। এর অধিক সুখ, সত্যি বলছি, আমাদের আর কিছুতেই নেই।’

বিশাখা উপুড় হয়ে শুয়ে তার অশ্রুজল গোপন করল। নিতান্ত সাধারণ স্বামিনীর মতো সে এই সুন্দর মেয়েগুলিকে পুণ্যবর্ধনের দিকে এগিয়ে দিতে চেয়েছিল, নিজে বাঁচবার জন্যে। ধিক, ধিক তাকে। সে বাষ্পভরা গলায় বলল, ‘তোরা যেভাবে থেকে আনন্দ পাস পালি, সে ভাবেই থাক। কিন্তু জেনে রাখিস তোদের শেকল কেটে দিয়েছি। তোদের পিঞ্জর খুলে রেখেছি। ধনশালী পিতার কন্যা বলে যে আকাশে উড়তে শিখেছি সেই আকাশে তোদের ওড়াবো। উড়তে শেখাবো। দাসী কথাটা আর কখনও উচ্চারণ করবি না।’

ধীরে ধীরে বিশাখার চোখ বুজে আসে। কহ্না তার পা সংবাহন করছে। ধনপালী তার মাথাটি কোলে নিয়ে বসে ধীরে ধীরে নতুন করে চন্দনের প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে। ময়ূরী সারা শরীরে তার কোমল আঙুলগুলি বোলাচ্ছে। বিশাখা ঘুমোচ্ছে বুঝতে পেরে তারা এক সময়ে ধীরে ধীরে নেমে যায়, কাষ্ঠকুট্টিমের নানান স্থানে নিজেদের শয্যা পেতে শুয়ে পড়ে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে। এ ওকে পাশ ফিরিয়ে দেয়, ও এর বুকের ওপর থেকে হাত নামিয়ে রাখে। সাবধান! নাসিকা গর্জনে আবার ভদ্দার ঘুম ভেঙে না যায়!

বিশাখা ঘুমোয় অথচ ঘুমোয় না। তার ভেতরে, অন্তরের অন্তস্তলে কোথাও সে যেন জেগে থাকে। দেখতে থাকে কৃষ্ণবর্ণ আকাশ, দীপ্যমান নক্ষত্র সব। এই জ্যোতিষ্কগুলির অনেকেই নাকি মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। সত্য? এ কথা সত্য? তা হলে কর্মফল কী? মানুষের জীবন নক্ষত্ৰসকলের নিয়ন্ত্রণে? না কর্মফলচক্রের নিয়ন্ত্রণে? ওই আকাশের আচ্ছাদনটি খুলে ফেললে কি ওপারে স্বর্গলোক দেখা যাবে? সেখানে দেবতারা বিচরণ করেন? কে এই দেবতারা? এঁরাও তো ক্ষমতাশালী? এঁরাও তো মানুষের ওপর ক্রোধ, দ্বেষ, প্রীতি দেখান। অগ্নি, বায়ু, এগুলি জড় প্রাকৃতিক শক্তি, তথাগত বলেছিলেন, কিন্তু ইন্দ্র? সোম? এঁরা! এঁদের সম্বন্ধে তো কিছু বলেছেন বলে মনে পড়ছে না। ইন্দ্র, সোম, রুদ্র এঁদের তুষ্ট করতে পারলেও তো বাঞ্ছিত বস্তু মেলে। তা হলে এরাও জীবন-নিয়ন্ত্রণে অংশ নিচ্ছেন! প্রকৃত নিয়ন্তা কে? কে ঠিক করে দিল বিশাখা ধনঞ্জয়-সুমনার গৃহে জন্মাবে? মিগারের ঘরে নয়? কে ঠিক করল বিশাখা বিশাখাই হবে। ধনপালী, খুজজ উত্তরা বা তিষ্য কি তিষ্যর সেই বন্ধু আত্রেয় নয়? কে স্থির করল বিশাখার জননী সুমনা প্রণয় জানবেন কিন্তু তার কন্যা বিশাখা জানবে না! কোথায় ছিল এই পুন্নবদ্‌ধন আর তার পিতামাতা। তার জীবনের কোনও কোণেই তো ছিল না! কার নির্দেশে সহসা সে উৎক্ষিপ্ত হল সাকেতের ধনঞ্জয়লোক থেকে সাবত্থির মিগারলোকে? কে জুড়ল এই দুটি মানুষকে যাদের কোথাও কোনও সাদৃশ্য নেই! অথচ যাদের হৃদয় বিনিময় করতে বলা হচ্ছে, দেহে মিলিত হতে বলা হচ্ছে, প্রজা উৎপাদন করতে বলা হচ্ছে, শতবর্ষ পর্যন্ত জীবিত থেকে সন্ততির ক্রমপ্রসরমাণ ধারা দেখে যেতে বলা হচ্ছে, কার ব্রতে সে হৃদয় দেবে? কাকে অনুসরণ করবে? কাকে হবিঃ দেবে? কাকে! কাকে! কাকে।

২২

কৃষ্ণপক্ষের রাত। ওপরে আকাশে যেমন নক্ষত্রগুলি বিশেষ জ্যোতিষ্মান, নিচের বনভূমিতে, কাননেও তেমনি অসংখ্য খদ্যোৎ জ্বলছে নিবছে, জ্বলছে নিবছে। ঝিল্লির ঝননন ক্রমশই আরও, আরও সশব্দ হয়ে উঠছে। বহু প্রকার নৈশকুসুমের গন্ধে রাজগৃহ নগরের অঞ্চলপ্রান্ত আমোদিত। অট্টালিকাগুলিতে আজকের মতো দীপ নিবে গেছে। খালি জম্বুবনের মধ্যবর্তী এই সদ্য নির্মিত কাঠের একতল প্রাসাদের প্রধান কক্ষে দীপ জ্বলছে। দীপটিকে মৃদু করে দেওয়া হয়েছে। তবু কিছু বন্য কীট তার আলো লক্ষ করে ঘুরছে, মাঝে মাঝে পোড়া কীটদেহের কটু গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে। বাতাস। পরক্ষণেই, বাতায়নের পাশে রাখা সুগন্ধিচূর্ণের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে ঘরে ঢুকছে, সঙ্গে সঙ্গে সুরভিত হয়ে যাচ্ছে সব।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর চণক গভীর স্নেহ ও স্বস্তিভরা চোখে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘বলো সোমা, কী করে এ অসম্ভব সম্ভব করলে? তুমি নিশ্চয় জানো, আমার গান্ধার ত্যাগ করার একটি কারণই ছিলে তুমি। যখন দিবারাত্র ভাবছি কী করে তোমাকে মুক্ত করবো সেই সময়ে হঠাৎ একদিন তুমি আমাকে হতাশার সমুদ্রে নিক্ষেপ করে রাজপ্রাসাদে চলে গেলে।’

চণক দীর্ঘ ঘরটির মধ্যে পদচারণা করছে, এক একবার থামছে, কোনও স্তম্ভের বেদীতে ডান পা তুলে দিয়ে কনুই তার ওপর রেখে দাঁড়াচ্ছে। কথা বলছে আবার পদচারণা করছে। তার পক্ষে যতটা উত্তেজনা প্রকাশ করা সম্ভব বোধ হয় সে করেছে।

জিতসোমা মাটিতে বসে। সে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে মেঝেয়। কখনও তার বাঁ হাতের অনামিকা থেকে বৈদুর্যমণির বিশাল অঙ্গুরীয়টি খুলে ফেলছে, আবার পরছে। দুজনেই যে অতিশয় উত্তেজিত তা তাদের আচরণ দেখলেই বোঝা যায়। অদূরে একটি ভৃঙ্গারে শীতল পানীয় রেখে গেছে দাসীরা। কৃষ্ণবর্ণের মৃত্তিকার উজ্জ্বল চিত্র-করা পানপাত্র। জিতসোমা একটি পাত্রে পানীয় ঢেলে মৃদুস্বরে বলল, ‘এটা পান করে নিন। রাত্রের আহার্য তো কিছুই স্পর্শ করেননি!’

চণক বলল, ‘সে কি তুমিই করেছ? সোমা, আজ ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে যাওয়ার দিন। বলো, শীঘ্র বলো, আমি অধীর হয়ে রয়েছি।’

‘আপনি জানেন না মা আমাকে কী বলে গিয়েছিলেন!’ সোমা বলল।

‘কেমন করে জানবো? কিছুটা হয়ত অনুমান করতে পারি!’

‘মা আমাকে বলেন, এই তোর পিতৃপরিচয় সোমা, আর সে জন্যই চতুঃষষ্টিকলাতেই যাতে তোর মন না থেমে থাকে তাই তোকে বেদবিদ্যা শেখাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তুই গণিকাবৃত্তি নিস না।’ একটু থেমে সোমা বলল, ‘এ কাজ কত কঠিন, তা তো আপনি জানেন! যতদিন মা ছিলেন আমাকে আড়াল করে ছিলেন, তার পর?’

‘জানি’, নিশ্বাস ফেলে চণক বলল, ‘আর তাই-ই মহামাত্র যখন তাঁর উপঢৌকনের ঝুলি থেকে ঐন্দ্রজালিকের মতো তোমায় বার করলেন তখন যত না বিস্মিত হয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি হয়েছিলাম বিষন্ন।’

‘বিষন্ন কেন?’

‘সে কী? এক রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুর থেকে আরেক রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরে স্থানান্তরিত হয়ে গেলে, প্রকাশ্য সভায় তোমায় দান করে দেওয়া হল, এতেও বিষন্ন হব না! তবে সোমা কষ্টিপাথরে সোনার ক্ষীণ রেখার মতো একটু আলোও যেন দেখতে পেয়েছিলাম।’

জিতসোমা মুখ তুলে বলল, ‘সত্যি! কেন?’

‘গান্ধারে গণিকার মুক্তির উপায় নেই, কিন্তু মগধে দেখছি আছে। গণিকা-কন্যা এমন কি গণিকারও বিবাহের কথা শুনছি এখানে। সে যদি রাজকোষ থেকে ভৃতি পায় তো তার জন্যে নিষ্ক্রয় দিয়ে তাকে মুক্ত করা যায়। মগধ অনেক উদার, অকুণ্ঠ, নতুন নতুন চিন্তাধারা সাদরে গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে সোমা, মগধই আমাদের ভবিষ্যৎ। তোমার আমার শুধু নয়, আমাদের সবার। এ সম্পর্কে পরে তোমাকে আরও অনেক কথা বলবার আছে। এখন তুমি বলো কীভাবে তক্ষশিলার রাজান্তঃপুর থেকে এ পর্যন্ত এলে।’

জিতসোমা বলল, ‘কীভাবে এলাম তার চেয়েও বড় কথা আর্য, কেন এলাম! কী তীব্র মুক্তির ইচ্ছা তার পেছনে কাজ করছিল।’

‘বলো, বিশদ বলো।’

‘আমার জননী যদি জ্ঞান হয়ে থেকে নানাভাবে আমাকে মুক্তির কথা না বলতেন, তা হলে আমি হয়ত ভাবতাম, গতজন্মের কুকর্মের ফলেই গণিকার ঘরে জন্মেছি।’ কিন্তু মা বলতেন : “আমি তো গণিকার ঘরে জন্মাইনি, ভাগ্য নয়, একটার পর একটা মানুষের ষড়যন্ত্রের ফলেই গণিকা হয়েছি।” জানেন নিশ্চয় মা ছিলেন কাশ্মীরের এক আচার্যের কন্যা। বড় আদরের। বছর দশেক বয়স পর্যন্ত আচার্যের অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে নিয়মিত বিদ্যাভ্যাস করতেন। ভয়ানক অহিবাতক রোগে আমার সেই মাতামহ-মাতামহী, তাদের শিষ্যগুলি, শিশুপুত্র সবাই মারা যান। তখন রাজারই উচিত ছিল মায়ের মতো অনাথ-অনাথাদের ব্যবস্থা করা। তা তো তিনি করলেনই না, উপরন্তু গ্রামের একজন লোভী লোক সেই দশ বছরের বালিকাকে তার জ্ঞাতকদের কাছে পৌঁছে দেবার নাম করে তক্ষশিলায় এনে বেচে দিল। ক্রেতা ছিলেন মহামাত্র দ্যুমৎসেন। দর্ভসেনের পিতা। তাঁর স্নানের সময়ে ঘটে করে জল এনে দেওয়া ছিল মায়ের কাজ। একদিন মহামাত্র বললেন, এ বালিকা তো দেখি অতিশয় রূপসী! রাজাকে জানাতে হচ্ছে! রাজকোষ থেকে এর শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শুনে, জানেন আর্য, মা ভেবেছিলেন তার বিদ্যাশিক্ষার আয়োজন হচ্ছে বুঝি। তিনি উৎফুল্ল হয়েছিলেন। একটি বয়স্কা দাসীকে সে কথা বলায় সে তো হেসেই আকুল! কিছুদিন পর প্রোঢ়া গণিকা অভয়ার কাছে রেখে তাকে চতুঃষষ্টিকলা শেখাবার ব্যবস্থা হল। সঙ্গীত, নৃত্য, বীণাবাদন, কাব্যরচনা, দূতক্রীড়, গন্ধযুক্তি, সজ্জা, অলঙ্করণ, অলঙ্কার নির্মাণ, রত্নপরীক্ষা, বিষনির্ণয় তার প্রতিবিধান! আর্য চণক এ সবই আমাকেও শিখতে হয়েছে। আচ্ছা আপনিই বলুন, বিদ্যাগুলি কি মন্দ?’

‘কখনওই নয়। এ সব বিদ্যা যে জানে সোমা, সে তো বিশেষ সম্ভ্রমের যোগ্য।’ চণক ভাবতে ভাবতে বলল, ‘সে সম্ভম যে তাদের দেওয়া হয় না, তাও নয়। সমাজ-উৎসবগুলিতে নগর-গণিকার সমাদর তো দেখেইছ সোমা। আচ্ছা, এই যে রাজপুরুষরা তাদের “আসুন আসুন” বলে বিশেষ অভ্যর্থনা করে, সাধারণেরা সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দেয়, অলঙ্কৃত বিশেষ আসনে তাদের বসবার ব্যবস্থা হয়— এই সমাদর কি সম্পূর্ণ অন্তঃসারশূন্য?’

সোমা বলল, ‘সোনার পিঞ্জরে ময়ূর দেখেছেন আর্য? এ সেই প্রকার সমাদর। মা বলতেন— “সঙ্গীত, নৃত্যকলা কী গভীরভাবেই না ভালোবেসেছিলাম! তার পরে ধীরে ধীরে বুঝলাম এইসব ছন্দোবদ্ধ অঙ্গক্ষেপ যার নাম নৃত্য, যা আমাকে আনন্দের তুরীয়লোকে নিয়ে যায়, আর এই যে সুরলহরী বীণা থেকেই আসুক, কি কণ্ঠ থেকেই, যা আমার নাম, রূপ, অস্তিত্ব সব ভুলিয়ে দেয় তা কিছু কামলোলুপ মানুষের দেহে-মনে উত্তেজনা জাগাবার কাজে লাগবে। সত্যিকারের কলারসিকের দেখা সারা জীবনে যে পাইনি, এ কথা বললে অন্যায় হবে। কিন্তু অধিকাংশই সুরাপানের বিকল্প বলে, ইন্দ্রিয় উত্তেজক বলে, দেহভোগের ভূমিকা বলে দেখে নৃত্য-গীতকে। লোকের বিকৃত রুচিকে তুষ্ট করতে কামকলার কত যে খুঁটিনাটি শিখতে হয়েছে!” এই সব বলতে বলতে আমার হতভাগিনী জননী কখনও কখনও খালি কাঁদতেন, কখনও ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গিনীর মতো নিশ্বাস ফেলতেন। আর বারবার বলতেন—“তুই চলে যাবি সোমা, তুই এই বিষবৃত্ত থেকে বেরিয়ে যাবি।” তারপর তো অল্পদিনের ব্যাধিতে মারাই গেলেন!’

জিতসোমা নীরবে তার অঙ্গুরীয়টি আঙুলের ওপর ঘোরাতে লাগল। এটাই সম্ভবত তার মুদ্রাদোষ।

চণক বুঝল সে এখন কাঁদছে। বাইরে নয়। ভেতরে ভেতরে। আর্দ্র হয়ে রয়েছে তার হৃদয়-মন। দেখতে দেখতে সে ভাবল— এই আর্দ্রতার পাশাপাশি কি অগ্নিও আছে? যা জিতসোমার মা জনপদশোভিনী আর্যা দেবদত্তার ছিল! তাঁর নৃত্য-গীত দেখবার সুযোগ কখনও হয়নি চণকের। সোমাকে বেদবিদ্যা শেখাতে গিয়ে সে আর অনঘ এই দীপ্তিমতীকে দেখেছিল, দেখত প্রায়ই। তারা শুনেছিল তাঁর অগ্নিগর্ভ বাক্। কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে যেতে যেতে তিনি তাদের উপস্থিতি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে সহসা-মনে-আসা শব্দযুথ আবৃত্তি করতেন। চণক বসে আছে। জিতসোমা নিবিষ্ট মনে তার ভাষ্য শুনছে। সহসা সেই গরিমাময় কণ্ঠস্বর :

ঋঙ্ময়ী আগে ছিলাম শুনতে আসত ভাবুক

বায়ুর মতো বয়ে গেছি সংহিতায় তখন

জলের মতো হিল্লোলে কল্লোলে জীবন

এখন তবে কিংময়ী? আসছে কেন কামুক?

মাটির ঘট ভাঙ্‌ তোরা ঊর্জে ওঠ্ আগুন

ঝলসে দিক সর্বদিক সর্বজীব সর্বদেব অহম্ আবাং বয়ম্

এই আগুন যদি থাকে, তবেই জিতসোমার কান্নার জল বাষ্প হবে। ভেতরে এক মহাশক্তির উত্থান হবে। যেমন নদীসকলের জলের ওপর সূর্যের তেজ ক্রিয়া করলে বাষ্প উত্থিত হয়! এই বাষ্প ঊর্ধ্বে উঠে যায়, জন্মায় মহামেঘ। মেঘে মেঘে ঘৃষ্ট হলে তবেই উৎপন্ন হবে মহাশক্তি—বিদ্যুৎ, বজ্র।

নিজেকে খানিকটা শান্ত করে জিতসোমা বলল, ‘মা-ই আমাকে বলেছিলেন মহামাত্র দর্ভসেনকে তুষ্ট করে রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরে স্থান করে নিতে। বলেছিলেন—“বরং রাজকুমারীদের সৈরিন্ধ্রী হয়ে থাকবি, কদাপি রাজা বা রাজকুমারদের ছত্রধারিণী, চামরগ্রাহিকা, সংবাহিকা এসব হবি না।” অবশেষে যেতে পারলাম, মহামাত্র দর্ভসেনকে তুষ্ট করে—’ বলতে বলতে জিতসোমার চোখ মুখ বিকৃত হয়ে উঠতে লাগল, সে হঠাৎ উদ্‌ভ্রান্ত ঘৃণায় বলে উঠল, ‘গণিকাদের কামকলার এত খুঁটিনাটি শেখায়, কিন্তু গণিকাভোগী পুরুষগুলোকে তো দেখি কিছুই শেখায় না। প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত সব এক একটি গর্দভ, জরদগব হয়ে থাকে…’ শিউরে শিউরে উঠতে লাগল সে। বেশ কিছুক্ষণ পর তার বোধ হয় চেতনা হল—সে মাথা হেঁট করে বলল, ‘ক্ষমা করুন আর্য। এ সব কথা আপনার সামনে আমার বলা উচিত হয়নি।’

চণক একটি বেদীতে বসেছিল, নত মুখে। সে সেভাবেই বলল, ‘না, না, সোমা উচিত-অনুচিতের কথা নয়। তোমার কাছ থেকে আমি অনেক নতুন কথা জানতে পারছি। পুরনো জানার ওপর ভিন্ন দিক থেকে আলোকপাত হচ্ছে। কিছুই তুমি বাদ দিও না। জীবনের দিগ্‌দর্শন করতে হলে পরোক্ষ অভিজ্ঞতাকে যথাযথ মূল্য দিতে হয়। কে বলতে পারে, তুমিই হয়ত আমাকে পথ দেখাবে!’

জিতসোমা এতক্ষণে হেসে ফেলল, বলল, ‘আচার্য চণককে পথ দেখাতে পারবো কি না জানি না, কিন্তু নিজের যে এক ধরনের ভূয়োদর্শন হয়েছে এ কথা স্বীকার করতেই হয়। মা আরও কী বলতেন জানেন?’

‘কী?’

‘বলতেন, রাজকুমারীদের, রানিদের তুই যা-যা জানিস সব শিখিয়ে দিবি। বিদ্যাগুলি তো ভালোই 1 কুলনারীরা সামান্য কিছু সাজসজ্জা, অলঙ্করণ, রন্ধনবিদ্যা এই তো শেখে, তাই প্রমোদের সন্ধানে পুরুষগুলো অন্যত্র যায়। কুলনারীরাও যখন নৃত্য-গীত শিখবে, কাব্যরচনা করতে পারবে, দূতক্রীড়ায়, তর্কে, আলোচনায় পুরুষের সঙ্গী হতে পারবে তখন ওগুলি গৃহসীমার মধ্যে থাকতে শিখবে। সত্যিকার গৃহস্থ হবে।’

চণক দাঁড়িয়ে উঠে সবিস্ময়ে বলল, ‘সত্যিই তো সোমা, এভাবে এ কথা কেন আমার আগে মনে হয়নি?’

সে যেন আবিষ্কারের আনন্দে বাম হাতে ডান হাত দিয়ে মুষ্ট্যাঘাত করল। আপন মনে বলল, ‘এক শ্রেণী গৃহরক্ষা করবে, প্রজা উৎপাদন করবে। আরেক শ্রেণী চিত্তের, মস্তিষ্কের সূক্ষ্মতর ক্ষুধাগুলি মেটাবে। আশ্চর্য, এই সুস্পষ্ট বিভাজন কবে থেকে হল, কেন হল, কেমন করে হল? তোমরা কি চিরদিনই এমনি ছিলে সোমা! আমি তোমার আচার্য ছিলাম আমি জানি কোনও পুরুষ-শিষ্যর থেকে মেধা, উদ্‌ভাবনীশক্তি, প্রয়োগক্ষমতা তোমার ন্যূন নয়। আমার দুই ভগ্নী ছিল। অসাধারণ তীক্ষ্ণধী। তা হলে?’

সে আবার পদচারণা করতে করতে মাঝে মাঝে থেমে বলতে লাগল, ‘আমি সাধারণ বারস্ত্রী বা বেশ্যার কথা বলছি না। কিন্তু যাঁরা এই বৃত্তিতে শ্রেষ্ঠ, তাঁদের কিন্তু রাষ্ট্রের ব্যয়েই শিক্ষিত করা হয়, যেমন আর্যা দেবদত্তাকে করা হয়েছিল। কী অদ্ভুত দেখো! রাষ্ট্রের কী স্বার্থ এতে?’

জিতসোমা বলল, ‘কেন আর্য? ধরুন বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি। যে নগরে খ্যাতনামা গণিকা থাকেন, সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে বণিক আসে তুলনায় অনেক। আসেন রাজপুরুষরাও। শুধু স্বদেশের নয়, বিদেশেরও। আপনি কি জানেন, এই যে মগধের সঙ্গে লিচ্ছবিদের বন্ধুত্ব এর মধ্যে বৈশালীর বারমুখ্যা আম্রপালীর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে!’

‘সত্য নাকি?’

‘হ্যাঁ আর্য। তখন মহারাজ বিম্বিসারের অল্প বয়স, সবে রাজগৃহনগরী গড়ে উঠেছে। কোশলের সঙ্গে সখ্য হয়েছে, মহারাজের চিত্র দেবী আম্রপালীর হাতে পড়ে, মহারাজও দেবীর খ্যাতি শুনে ছিলেন, উভয়ে উভয়ের অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তখন লিচ্ছবিদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয়, মহারাজ ছদ্মবেশে আম্রপালীর কাছে যান। পরে সব জানাজানি হয়ে গিয়েছিল, তাইতেই তো লিচ্ছবিকুমারী ছেল্লনা দেবীকে বিবাহ করে মহারাজ তাদের শান্ত করেন। আপনি আম্রপালীর পুত্র কুমার বিমলকে দেখেননি?’

‘নাঃ। আমি রাজার সঙ্গে বাইরে বাইরে ঘুরি। রাজপরিবারের কারও সঙ্গেই আমার পরিচয় নেই।’

‘কুমার বিমল স্বতন্ত্র প্রকৃতির মানুষ। যাই হোক, তা হলে দেখলেন, গণিকার পৃষ্ঠপোষকতার পেছনে কীভাবে রাজস্বার্থ কাজ করে! বিদেশের সংবাদ, অনেক গোপন সংবাদ গণিকার জানা হয়ে যায়। দেশের রাজপুরুষরাও অনেক প্রকার চক্রান্তে মত্ত থাকেন, গণিকার কাছে সেসব প্রকাশিত হয়ে পড়ে। যেমন জিতসোমা জানতে পেরেছিল কাত্যায়ন চণককে মগধে দূতজ্যেষ্ঠক করে পাঠানোয় মহামাত্র দর্ভসেন ক্রোধে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন।’

‘তাই-ই, না? এবং দেব পুষ্করসারী তাঁকে আমার পৃষ্ঠরক্ষার ছলে পাঠাতে এক প্রকার বাধ্যই হন! আমি তা হলে ঠিকই অনুমান করেছি?’

জিতসোমা হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল।

চণক বলল, ‘তা হলে গণিকারা মুখ্যত না হলেও গৌণত চর। কিন্তু চরকীট গণিকাপুষ্পের মধ্যে এমনভাবে লুকিয়ে থাকে যে, বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। বর্ণ, গন্ধ, রূপ এসব দিয়ে কীটটি ঢাকা থাকে। এই-ই রাজস্বার্থ! কিন্তু সোমা, কুলনারী আর বারনারীর মধ্যে শিক্ষার এই স্পষ্ট ভেদরেখা কার স্বার্থে? আমি সত্যই বলছি, বিভিন্ন বিদ্যা আয়ত্ত হবার ফলে উচ্চশ্রেণীর গণিকার মধ্যে একটা গরিমা আসে, যা অধিকাংশ কুলনারীর থাকে না।’ একটু থেমে সে বলল, ‘থাকলে ভালো হত।’

জিতসোমা বলল, ‘কেন হবে না বলুন? কীভাবে দাঁড়াতে হবে, কী ভাবে বসতে হবে, কী প্রকার স্বরে কাব্যালোচনায় যোগ দিতে হবে, সবই তো আমাদের শেখানো হয়। শেখানো হয় বুঝতে নিজেদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কোনটি? কোনটি সবচেয়ে কুশ্রী! কী ভাবে সুন্দরটিকে অতিব্যক্ত করে কুশ্রীতাকে অব্যক্ত রাখতে হবে। আপনি অলম্বুষাকে চিনতেন?’

‘সে কে?’

‘আমাদের ওই পল্লী থেকে অদূরে থাকত। সঙ্গীতের জন্য বিশেষ খ্যাত ছিল!’

চণক হেসে বলল, ‘তুমি কি মনে করেছ দিগ্‌দর্শনের জন্য আমি সব গণিকার গৃহেই যাতায়াত করে থাকি?’

জিতসোমাও হাসছে! এতক্ষণে তার মধ্যেকার বিষাদের ধূসরতা ছাপিয়ে কৌতুকের রশ্মিচ্ছটা যেন দেখা যাচ্ছে। সে বলল, ‘অলম্বুষা ছিল শম্বোষ্ঠেী। কিন্তু তার চোখ দুটি অদ্ভুত। দীর্ঘ, সামান্য একটু বক্র, চোখের মণি দুটি গোমেদের মতো উজ্জ্বল তাম্রবর্ণ। সে হিঙ্গুলচূর্ণ ব্যবহার করে ত্বকের উজ্জলতা তো বাড়িয়ে ছিলই, চক্ষু দুটিকে কাজল দিয়ে এমনভাবে শোভিত করত যে, তার ওষ্ঠের দিকে কারও দৃষ্টিই পড়ত না।’

চণক স্মিতমুখে বলল, ‘ভালো। গণিকার সূক্ষ্ম আকর্ষণের অনেকটাই তা হলে শিক্ষানির্ভর! এখন এই শিক্ষা পুরস্ত্রীদের কাছ থেকে গুপ্ত রাখা হয়েছে কেন? যাতে তারা পুত্রার্থে ছাড়া অন্য কোনভাবেই সমাদর না পায়? দেখো সোমা, গণিকাদের বলে স্বাধীনা। কোনও কুলস্ত্রীকে স্বাধীনা বললে সেটা পরিবাদ হবে। এ সব এক দিনে হয় না। আমার জানতে ইচ্ছে করে যযাতির সময়ে, তার আগে, তারও আগে কী ছিল। বিদুষী রমণী যে ছিলেন না বা নেই তা তো নয়— অম্ভৃণ কন্যা বাক, বাচক্নবী গার্গী, মৈত্রেয়ী, শাশ্বতী বা সুলভার কথা মনে করো। আমাদের ছাত্রাবস্থায় তক্ষশিলায় দেখেছি উপাধ্যায় সুমতি ও দৃষদ্বতীকে। এখানে এসে দেখছি নির্গ্রস্থদের প্রব্রাজিকাদের। এদের সম্পর্কে লোককে বলতে শুনি, নারী হয়েও এঁরা যেন পুরুষ। অথচ তোমাকে বা আমার ভগ্নীদের দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে জানি, বিদ্যার কোনও পক্ষপাত নেই। সে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে যে-কোনও নিষ্ঠাবান পাত্রকেই আশ্রয় করতে পারে। অথচ কেন এই ধারণা! বিদ্যা আয়ত্ত করলে নারী আর নারী থাকছে না। চারুকলা আয়ত্ত করে নিজের রূপ ও বাচনকে পরিমার্জিত করলে সে গণিকাসম হয়ে যাচ্ছে। কেন এই অদ্ভুত বিপ্রতীপ আচরণ? এতে করে কি পরোক্ষে পুরুষদের গণিকাসংসর্গ করতে বাধ্য করা হচ্ছে না! গণিকাবৃত্তিকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না! সে কি তাদের কাছ থেকে অনেক পরিমাণে রাজবলি আসে বলে? ওদিকে পুরস্ত্রীকে বাধ্য করা হচ্ছে কুক্কুরীর মতো প্রজাবৃদ্ধি করতে! গর্দভীর মতো গার্হস্থ্যের বিপুল ভার বইতে। সে তার রূপ-যৌবন জীবনের অর্থ সব হারিয়ে ফেলছে। গণিকারও যেমন আপন ইচ্ছা বলে কিছু নেই, পুরস্ত্রীরও ঠিক তেমনই। কারওই কোনও উপায় নেই। অত্যন্ত দুঃখ এবং লজ্জার বিষয় সোমা, তোমার এবং তোমার জননীর সঙ্গে পরিচিত না হলে এসব কথা কোনদিন হয়ত ভাবতাম না। আজ তোমার সঙ্গে আলোচনাচ্ছলেও বেরিয়ে এলো কত কথা! তুমি না থাকলে পিতার অসমাপ্ত “রাজশাস্ত্র” শেষ করবার জন্যই হয়ত জীবন দিয়ে দিতাম। ভূয়োদর্শনের জন্য ভ্রমণে বেরোতাম ঠিকই। কিন্তু যেমন দেখে, বিচার করে, নির্বাচন করে চিন্তার সূত্রগুলি সাজায় সেই মন একচক্ষু হয়ে থাকত। আমি একজন বিদ্বান বলে পরিচিত ব্যক্তি, একজন চিন্তক, আমিই যদি এরূপ অন্ধ হই, কোনও সমাজবিধিকে প্রশ্ন না করি তো ইতরজনে কী করবে?’ কিছুক্ষণ পর চণক ঈষৎ তরল গলায় বলল, ‘তা সোমা, রাজবাড়ির মেয়েদের তোমার বিদ্যা শেখাতে পেরেছিলে?’

সোমা বলল, ‘রাজবাড়ি বা ধনীঘরের মেয়েদের কিন্তু বেশবাস, গন্ধযুক্তি এসব কিছু কিছু শিখতে হয়। আমি চেষ্টা করেছিলাম বিশেষ করে তাদের নৃত্য-গীত শেখাতে। পাশা খেলা শেখাতে।’

‘শিখল?’

জিতসোমা বলল, ‘ছন্দ ও সুরের প্রকরণ আয়ত্ত করতে আমাদের কত দিন, কত রাত বিপুল পরিশ্রম করতে হয় জানেন? শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। পা আর চলছে না, খেলাম পায়ে লাঠির এক ঘা। সুরের একটি খণ্ডাংশ আয়ত্ত হচ্ছে না কিছুতেই, আদেশ হল যতক্ষণ না আয়ত্ত করতে পারছি, কঠিন খাদ্য কিছু খেতে পাবো না। সে তিন প্রহরও হতে পারে, তিন দিবসও হতে পারে। তা রানিই বলুন, রাজকুমারীই বলুন, তাঁদের কি এত ধৈর্য থাকে? তবে অমি রাজা পুষ্করসারীর যে কন্যাটির কাছে ছিলাম সে সন্ধিৎসু স্বভাবের ছিল। তাকে বলতাম…’ বলে জিতসোমা হাসতে শুরু করল। হাসিতে তার উত্তরীয়ে আবৃত শরীর ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।

চণকের মধ্যেও তার হাসি সংক্রামিত হয়েছে। সে স্মিতমুখে বলল, ‘কী বলেছিলে তাকে? এত হাসির কী হল?’

জিতসোমা অতি কষ্টে হাসির বেগ সংবরণ করে বলল, ‘তাকে বলতাম, তোমার তো একদিন বিবাহ হবে, সপত্নী চাও?’

‘না, না, একেবারেই না।’

‘তোমার পতি তোমাকে ফেলে গণিকালয়ে যাক, চাও?’

‘না, এরূপ পতির সঙ্গ করতে হবে ভাবলেও আমার জুগুপ্সা বোধ হয়।’

‘তা হলে আমি যেসব বিদ্যা জানি সেসব মন দিয়ে শেখো। পতিকে বেঁধে রাখতে পারবে। সেই কুমারীটি তার গৃহে আরও কুমারীদের নিয়ে আসত, ভাবী পতিদের বেঁধে রাখবার আশায় তারা প্রাণপণে নৃত্য-গীত শিখত।’

‘কত দূর সফল হয়েছিলে?’

‘যাদের স্বাভাবিক সুকণ্ঠ ছিল তারা তো ভালোই শিখেছিল। কিন্তু যারা কেকাকণ্ঠী তাদের কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারতাম না যে নিয়মিত চর্চা করলে স্বর পাল্টে যাবে। আর নৃত্যের কথা কী বলবো আর্য! ময়ূরের যেমন নৃত্য স্বভাবের অঙ্গ, মেয়েদেরও তেমনি নৃত্য আপনা থেকে আসে। তবে কঠিন, কুশলী নৃত্যের কথা স্বতন্ত্র।’

‘তা হলে কিছু নারীকে অন্তত সপত্নীদুঃখ, পতির গণিকাসক্তিদুঃখ ইত্যাদি থেকে বাঁচিয়ে এসেছ বলো।’

জিতসোমা হেসে বলল, ‘পাশা খেলা এমন শিখিয়েছি যে, নিষ্কর্মা পতিগুলো হয়ত স্বগৃহেই পাশার গুটিকা নিয়ে মত্ত থাকবে। পণের অর্থ সব আবার পত্নীর হাতেই ফিরে আসবে। তবে আর্য, অগ্নিতে যতই হবিঃ দিন না কেন, অগ্নি কি প্রশমিত হয়? সে আরও চায়, আরও শিখা বিস্তার করে। বাসনার আগুন বড় বিচিত্র বস্তু। হব্য নয়, হয়ত একমাত্র নির্বাসনার ভস্ম চাপা দিলেই আগুন নেবে।’

জিতসোমার কথাগুলো চণকের মনের মধ্যে কেমন প্রতিধ্বনির মতো শোনালো। এ কথা যেন সে কোথায়, কার মুখে শুনেছে! মনে করবার চেষ্টা করছে। পারছে না। শাস্ত্রবাক্য কী?

জিতসোমা বলল, ‘কী করে তক্ষশিলা থেকে মগধে এসে পৌঁছলাম জানতে চাইলেন না তো?’

‘হ্যাঁ, এ এক আশ্চর্য সমাপতন। নানা কথা, নানা ভাবনার মাঝখানে তোমার ভ্রমণকাহিনীর সূত্রটি যেন কেমন করে হারিয়ে গেছে।’

‘মোটেই সমাপতন নয়’, সোমা প্রতিবাদ করে উঠল, ‘এর জন্য মহামাত্রকে আমায় বহু কৌশল করে বোঝাতে হয়েছে।’

চণক আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তাই বুঝি?’

‘আপনি এত বিজ্ঞ হয়ে এসব ঘটনাকে সমাপতন বা দৈব কী করে ভাবেন আর্য? সাধারণে ভাবতে পারে। আপনি তো সব ঘটনার আড়ালে সেই কূটকক্ষের কথা জানেন যেখানে নীতি নির্ধারিত হয়, দৈব নির্ধারিত হয়! রাজ-অন্তঃপুরে প্রবেশের মূল্যস্বরূপ আমাকে কতবার দর্ভসেনের কুঞ্জে যেতে হয়েছে জানেন?’

চণক কথা বলল না। একটু পরে জিতসোমা বলল, ‘একদিন দর্ভসেন বললেন, “যাক মহারাজকে সম্মত করাতে পেরেছি। আমি সর্বাধিনায়ক হয়ে রক্ষী সৈন্য নিয়ে মগধ যাত্রা করছি শীঘ্রই। শুধু একটা কথাই ভাবছি। চণক তো মগধরাজের উপঢৌকন নিয়ে গেছে আটটি শাল। কীভাবে আরও কিছু নিয়ে গিয়ে তার মনে বিশ্বাস জন্মানো যায় আমিই প্রকৃত দূত, দূতজ্যেষ্ঠক, তাই অবশিষ্ট উপহারগুলি নিয়ে এসেছি। পারস্যের বণিকদের কাছ থেকে মহামূল্য সভচ্ছদ কিছু কেনা হয়েছিল, ওরা বলে গালিচা। তা-ই ভাবছি একটি নিয়ে যাবো। আমাদের উত্তরের দিকে রাজারা এই সভাচ্ছদ ব্যবহার করলেও মধ্যদেশে হয়ত এ বস্তু এখনও যায়নি। কিন্তু, মাত্র একটি উপহার দিয়ে কি চণককে বোঝানো সহজ হবে?” তখন আমি বলি, ‘আপনারা তো দাস-দাসী দ্যান, “তা দিই। কিন্তু ও উপহার বড় সাধারণ হয়ে গেছে, যাগ-যজ্ঞে অনবরত দেওয়া হচ্ছে। আমি চমকপ্রদ কিছু দিতে চাই।” আমি বলি—অনেক দেবেন কেন? দাসীই বা দেবেন কেন? একটি মাত্র নৃত্য-গীত কুশলী নটী নিয়ে যান না, এমন একজন যে একাই যথেষ্ট হবে! উনি বললেন, “দু একদিনের মধ্যে কোথায় এখন এমন পাই, বলো?” তখন আমি বললাম—আমি কি যথেষ্ট রূপসী, যথেষ্ট নৃত্যগীতদক্ষ বলে আপনার মনে হয় না! উনি বললেন, “তুমি! তুমি স্বেচ্ছায় যেতে চাইছ সেই দূর বিদেশে, অচেনা রাজার অন্তঃপুরে?” আমি বললাম—গান্ধারের সেবা করার এমন একটা সুযোগ! আমার তুচ্ছ জীবন দিয়ে এটুকু যদি করতে পারি নিজেকে ধন্য মনে করব। দৰ্ভসেন উল্লসিত হয়ে উঠলেন। দু একদিন পরেই রাজাদেশ অন্তঃপুরে এসে পৌঁছল। আমার শিষ্যা রাজকুমারীগুলি কান্নাকাটি করতে লাগল। আমি তাদের বললাম— পারো যদি নিজেদের জীবনে ক্রীতদাসীদের এই অনিশ্চিত জীবনযাত্রা, তাদের প্রতি এই তৈজসের মতো ব্যবহার থামাবার চেষ্টা করো, কেঁদে কী ফল? তা তারাই আমার পেটিকা গুছিয়ে দিল, রাজকোষ থেকে যা যা এসেছিল তার ওপর তাদের উপহার। এই যে রুপোর কাঞ্চী পরে আছি এটি আমিই চিত্র নির্মাণ করে করিয়ে দিই রাজকুমারী রম্ভার জন্য। সে কাঁদতে কাঁদতে এটাই আমায় পরিয়ে দিল, বলল, এটা পরলে তোমার আমার কথা, আমাদের কথা মনে পড়বে।’

‘কোন সাহসে, কী আশায় তুমি এত বড় দায় নিলে সোমা?’ চণক আশ্চর্য হয়ে বলল।

‘কী আশা তা জানি না আর্য, আমি শুধু ভাবছিলাম বহু দূর চলে যাবো। গর্তের মধ্যে মরা ইদুরের মতো আমার মৃতদেহটা যেন কাউকে কোনদিন গান্ধার রাজপুরীর অন্তঃপুর থেকে টেনে ফেলে দিতে না হয়। কে বলতে পারে কী ঘটবে? অশুভ যা তা তো ঘটেই আছে! এর চেয়ে মন্দ আর কী হবে? মনে মনে এও ভেবেছিলাম আপনার দেখা তো পাবই, তখন আপনি হয়ত কিছু করবেন।’

চণক বলল, ‘কত চেষ্টা করলাম সোমা, মহামাত্রকে কিছুতেই নিবৃত্ত করতে পারলাম না। উনি তোমাকে উপঢৌকন দেবেনই। তুমি জানো না পারলে আমি মহামাত্রকে হত্যা করতাম!’

জিতসোমা বলল, ‘ওঁর তত দোষ তো নেই! আমিই ওঁকে সর্বক্ষণ প্ররোচিত করছিলাম।’

‘সে কী? কেন সোমা?’

‘না হলে কী হত? আবার তো গান্ধারে ফিরে যেতে হত। আবার সেই রাজপুরী। সেই মহামাত্রের কুঞ্জবন। … আপনি কি মনে করছেন মহামাত্রর কাছ থেকে আমায় কিনে নিতে পারতেন?’

‘পারতাম না?’

‘কখনই না। মহামাত্র যদি একবারও টের পেতেন আমার ওপর আপনার বিশেষ স্নেহ আছে, তিনি আরও যত্ন করতেন কীভাবে আমাকে আপনার থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। কাজেই ও চেষ্টা ফলবতী হত না। অথচ দেখুন, মগধের রাজধানীর প্রান্তে, এই অনুপম গৃহের কক্ষে আমরা—আমি ও আপনি সেই তক্ষশিলার সুন্দর দিনগুলির মতো আলাপ-আলোচনা করছি। করছি না?’

জিতসোমা উৎফুল্ল মুখে চণকের দিকে তাকাল। চণক বসে পড়ে বলল, ‘এও কি সমাপতন নয় সোমা? রাজা তো বন্ধু চণকের জন্য অন্য কাউকেও পাঠাতে পারতেন!’

‘না, পারতেন না’, সোমার মুখে রহস্যময় হাসি।

‘এর মধ্যেও তা হলে তোমার চক্রান্ত আছে বলো’, চণকের মন এখন অনেক শান্ত, অনেক লঘুভার।

জিতসোমা বলল, ‘আমাকে পাঠানো হল মহাদেবী ছেল্লনার প্রাসাদে। আড়াল থেকে শুনলাম তিনি একজনকে বলছেন— ভগিনী উপচেলা! এ যে দেখছি মহাসপ্পিনী! রূপে গনগনে অগ্‌গি! রাজা আর কত পুড়তে চান? দেখতে দেখতে তো এ রাজার এক অগ্‌গমহিষী হয়ে উঠবে!’

‘এর পর রাজা ছেল্লনা দেবীর গৃহে এলেই আমার কথা জিজ্ঞেস করতেন। দেবী অমনি সন্ত্রস্ত হয়ে বলতেন—গান্ধার নটী অসুস্থ। শুয়ে আছে। আমরা বেজ্জ দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। রাজা চলে গেলে একদিন আমায় ডেকে বললেন—সচ্চ বলো তো মেয়ে? কী অভিপ্পায় তোমার? রাজার বয়স হয়েছে, তোমার মতো নবযুবতী তাঁর কাছে কী চায়?’

‘তাতে আমি বিনত হয়ে বললাম—আমার কোনও অভিপ্রায়, অভিসন্ধি নেই দেবি, যেমন নিযুক্ত হবো, তেমনই করবো। তখন ওঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আমাকে কুমার কুনিয়র প্রাসাদে পাঠিয়ে দিলেন।’

চণক বলল, ‘সর্বনাশ।’ গলায় শব্দটা আটকে সে ভয়ানক কাশতে লাগল। দাস-দাসীরা ছুটে এলো। জিতসোমা তার মাথায়, ঘাড়ে হাতের পাতার পাশ দিয়ে মৃদু আঘাত করতে লাগল। তারপর তাকে জল পান করতে দিল। একটু সুস্থ হয়ে চণক বলল, ‘একটা কাণ্ডই বাধিয়েছ সোমা!’

বিষন্ন গলায় সোমা বলল, ‘শত হলেও তো আমি নিজের কর্ত্রী নই!’

‘তুমি মুক্তি চাইলে না কেন? বুঝতে পারছ তো ছেল্লনা দেবী তোমাকে তাঁর প্রতিযোগিনী ভেবে পুত্রের দিকে ঠেলে দিতে চাইলেন।’

‘বুঝব না কেন? কিন্তু মুক্তি চাইলেই কি তাঁরা দিতে পারতেন? সে অধিকার কি তাঁদের ছিল? তা ছাড়া মুক্ত হয়ে এই বিদেশে একজন নটী কোথায় শেষ পর্যন্ত যেতে পারে ভাবুন! অত সহজে স্থৈর্য হারিয়ে ফেললে জিতসোমাকে আর এখানে এসে পৌছতে হত না।’

‘তার পরে?’

‘কুমার কুনিয় তখন চম্পায় ছিলেন। আমি কিছুটা সময় পেলাম চিন্তা করবার। আমাকে কুমারের প্রাসাদের প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছিল। ওরা বলত কম্মিকা-জেট্‌ঠা। সবাই জানত আমার নৃত্য-গীত কুশলতার কথা। সাধারণ দাসীর কৃত্য তো আমায় দিয়ে করাতে পারে না! কুমারের প্রাসাদের সাজসজ্জা, পরিচ্ছন্নতা, তাঁর পরিচর্যার ব্যবস্থা অর্থাৎ তিনি এলে কী পাক হবে, কোন দাস, কোন দাসী তাঁর কোন কাজের ভার নেবে—এসবের ব্যবস্থা করলাম। কিছুদিন পর মহাদেবী ক্ষেমার প্রব্রজ্যা গ্রহণ উপলক্ষ্যে কুমার রাজগৃহে এলেন। প্রব্রজ্যা-উৎসব তাই নগরীর প্রাসাদের বাতাবরণ ছিল ভিন্ন প্রকার। সকলেই গম্ভীর। কিংবা ভক্তি গদ্‌গদ। এর মধ্যে কুমার নৃত্য-গীতাদিতে উৎসাহ দেখাবার সুযোগ পাননি।

‘ও দিকে মহাদেবী বেণুবনে চলে গেলে, কুমারও চম্পায় ফিরে গেলেন। দাসীদের কাছে শুনেছি মহারাজ একদিন ছেল্লনা দেবীর গৃহে এসে কথায় কথায় আমার প্রসঙ্গ তোলেন। কুমার কুনিয়র প্রাসাদে পাঠানো হয়েছে শুনে তিনি অতিশয় ক্রুদ্ধ হন। তিনি নাকি উত্তেজিতভাবে পদচারণা করতে করতে বলছিলেন—এই গান্ধার রমণী গান্ধার পুরুষের কাছেই যাবে। আমি তার ব্যবস্থা করছি। যেন অন্যথা না হয়। পল্লবিত হয়ে কাহিনীটি আমার কাছে পৌঁছল। গান্ধার পুরুষ কে হতে পারে বুঝিনি। একটি প্রতীহারীই বলল—গান্ধার দূতদের মধ্যে কে একজন আছেন রাজার আচারিয়পুত্ত। তিনি এখনও রাজগহেই আছেন। রাজার সঙ্গে নাকি গভীর মিত্ততা। তখন, একমাত্র তখনই আমি বুঝলাম আমার এতদিনের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা সফল হতে চলেছে। বুঝলাম দেবতারা আমাকে দয়া করেছেন। আমার মুক্তি। এইবার আমার মুক্তির সময় এসে গেছে।’

গান্ধারবাসীরা মগধের মানুষদের মতো আবেগপ্রবণ ধাতুর নয়। তবু জিতসোমার চোখ থেকে এখন বিন্দু বিন্দু অশ্রু তার কোলের ওপর ঝরে পড়তে লাগল। চণকের ভেতরেও আনন্দ-বিষাদ মিলিয়ে এক কণ্ঠরোধকারী অনুভূতি। এই আবেগের হাত থেকে রক্ষা পেতে, জিতসোমাকে অন্যমনস্ক করবার জন্যও বটে, সে একটু ইতস্তত করে বলল—নারী গণিকা হয়েছে মূলত রাজস্বার্থে, রাষ্ট্রস্বার্থে, এমন একটা মত যদি পোষণ করি, তা হলে তার বিপরীতে নারী ক্রমশই উপনয়ন বঞ্চিত গৃহবন্দী হয়ে যাচ্ছে কেন বলে তোমার মনে হয় সোমা?’

জিতসোমা চোখ মুছে বলল, ‘জানি না। জানি না আর্য। আমি নিজে দাসীত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছি এই চিন্তা ছাড়া এখন আর আমার মাথায় কিছুই নেই। সত্যিই মুক্তি পেয়েছি তো? আপনি তো কই কিছুই বললেন না?’ তার গলায় অশ্রুর আভাস।

চণক তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে হাত দুটো ধরে বলল, ‘বাহুল্য বলে বলিনি সোমা। তোমার কি এখনও সংশয় আছে এ সম্বন্ধে? তোমার বিবাহ দেবো আমি। বলছিলাম না মগধই আমাদের ভবিষ্যৎ! সোমা, কেন মনে করলে তোমার মুক্তিতে আমি আনন্দিত হইনি? তোমার মুক্তি যে আমার প্রথম সাফল্য! যদিও এ মুক্তি সম্ভব করেছ তুমিই। সত্যি বলতে, আমি আজকাল ভাবি “রাজশাস্ত্র”র যে পরিকল্পনা পিতা করেছিলেন, তার অনেক কিছুই পাল্টাতে হবে। আরও বিস্তৃত হবে এর সীমা। পিতা মানবযূথকে বৃত্তি অনুযায়ী ভাগ করেছিলেন— আচার্য, কর্ষক, মণিকার, সূত্ৰধার, যুদ্ধব্যবসায়ী, বণিক, কিন্তু সোমা অন্য একটি দিক থেকে দেখতে গেলে আরও একটি মৌলিক ভাগ আছে মানবসমাজের। নর এবং নারী। তুমি দেবী দেবদত্তার যোগ্য কন্যা। এই মৌলিক বিভাজনের কথা তুমিই আমাকে বুঝিয়ে দিলে।

জিতসোমা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তাকে প্রণাম করে বলল, ‘আপনি আমার আচার্য বা অন্য কোনও সম্পর্কের জন্য নয়, আপনি পূজ্য বলেই আপনাকে প্রণাম করলাম। কিন্তু আপনি বিবাহের কথা কী বলছিলেন? আমার অনুরোধ ও চিন্তা বা চেষ্টা আপনি করবেন না। আমি মুক্তি পেয়েছি, এই-ই আমার অনেক।’

চণক চিন্তিত হয়ে বলল, ‘কিন্তু বিবাহ না করলে সেই মুক্তি নিয়ে তুমি কী করবে সোমা? তাকে রক্ষা করবে কী করে? হয় গণভোগ্যা, নয় দাসী, আর নয় কুলনারী—বিবাহিতা ও গৃহকত্রী— এর বাইরে তো কোনও পথ খোলা দেখতে পাই না!’ একটু থেমে সে বলল, ‘না, আরেকটি পথ আছে। নারীদের ধর্মাচরণে কেউ বাধা দেয় না দেখি। শ্ৰমণা হতে পারো। কিন্তু শুধু আর কোনও পথ খোলা নেই বলে, শুধু স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, কোনও প্রবণতা না থাকা সত্ত্বেও, বৈরাগ্য বিনাই প্রব্রজ্যা? সে-ও তো বন্দিত্বই? একটা শেকল অত কষ্ট করে ছিন্ন করে সোমা তুমি কি তবে আরেকটা শেকল পরবে?’

চণক যেন শুধু সোমাকে প্রশ্ন করছে না? জিজ্ঞাসা করছে কক্ষের প্রাচীরগুলিকে, বাতাসকে। সে যে কোথাও থেকে কোনও সদুত্তর পাবে না—এ-ও যেন সে আগে থেকেই জেনে গেছে। সেই হতাশার দীর্ঘশ্বাস এবং নিরুপায় ক্রোধ তার গলায়।

জিতসোমা ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনিই যদি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন, কে তবে আর পারবে? আমি অপেক্ষা করে থাকবো। অপেক্ষা করবো এবং চিন্তা করবো। হয়ত আর কেউ না পারলে আমাকেই সন্ধান করে বার করতে হবে এর উত্তর। এবার বিশ্রাম করুন আর্য।’

সে উঠে দাঁড়াল। চণকের শয্যার আচ্ছাদনের ওপরটা হাত দিয়ে ঝেড়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াল। যেন কিছু বলবে, তার পরে চলে গেল কিছুই না বলে।

কিন্তু চণক অত সহজে ঘুমোতে পারল না। সে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। বাতায়নপথে দুর্লক্ষ্য ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে রইল। শৈশবে মাতৃহীন চণক পিতা দেবরাতের কাছে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছিল, সঙ্গে তার দুই জ্যেষ্ঠা ভগ্নী। পিতার শিষ্যদের সঙ্গে একত্রে তিনজনে বিদ্যাভ্যাস করত। ভগ্নীদের যখন বিবাহ হয়ে গেল পিতা বড় দুঃখ পেয়েছিলেন, বলেছিলেন— এ দুটিও পূত্র হলে দেবরাতের বিদ্যা নির্ভয় হত। কন্যা দুটিকে দিয়ে অনেক কিছু করাবো ভেবেছিলাম। তখন, একমাত্র তখনই কিশোর চণক অনুভব করে স্ত্রী-জাতীয়দের ভাগ্য ভিন্ন প্রকার। গৃহ ও সন্তান ধারণের জন্য তাদের বদ্ধ হতে হয়। বিদ্যা খর্ব করতে হয়। হয়ত তার নিজের মাকে দেখা ছিল না, হয়ত কোনও পূর্ব সংস্কার ছিল না বলেই সে গভীরভাবে ভাবিত, আহত হয়েছিল। তারপর জিতসোমার আচার্যত্ব, নগরশোভিনী দেবদত্তার সঙ্গে পরিচয়। যা হয়ত কখনও দেখতে পেত না দেবদত্তা তাই দেখালেন। যা কখনও অনুভবের সীমার মধ্যে আসত না জিতসোমা তাই অনুভব করালো। কারণ একমাত্র শ্রদ্ধা, স্নেহ, প্রেমই আমাদের প্রশ্ন করতে বাধ্য করে এরূপ হয়েছে কেন? অন্য রূপ কেন নয়?

অবশেষে অনেক রাতে চণক তার পেটিকার মধ্য থেকে একটি পুঁথি বার করল। কখনও কাজলের রস, কখনও কুঙ্কুম রাগ দিয়ে পুঁথিটি লেখা। অসমাপ্ত। সে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করল। নারী—রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার স্থান—বিভিন্ন ভূমিকা, বৃত্তি—ভবিষ্যৎ। লিখছে সে অনন্য মনে।

কিন্তু এই ভূর্জপত্রের ওপর তার পালকের লেখনী দ্রুত চলতে চায় না। চিন্তা তার চেয়ে অনেক দ্রুতগ। লিখতে লিখতে সে আরেকটি মন দিয়ে ভাবতে লাগল। লেখার এই অসুবিধা দূর করবার কোনও চেষ্টাই কেউ করে না। লিপিরও অনেক ত্রুটি। সমস্ত বিদ্যাই কণ্ঠস্থ করবার নিয়ম। লেখার প্রয়োজন হয় শুধু গণক-লেখকদের এবং পত্ররচনার জন্য। কিন্তু আচার্য দেবরাত যে শাস্ত্রর কথা ভাবছিলেন তা উচ্চতর দণ্ডনীতি। অনেক চিন্তার পর, প্রত্যক্ষ-দর্শন ও বিচার-বিশ্লেষণের পরে লেখা। তিনি পুঁথি রচনার কথাই তাই ভেবেছিলেন। অনেক সময়ে চণকের মনে হচ্ছে কোনও কোনও অধ্যায় নতুন করে সাজানো প্রয়োজন। এর জন্য কত ভূর্জপত্র নষ্ট হবে। কোনও উপায়ে যদি অন্য কোনও প্রকার পত্র পাওয়া যেত, এবং কোনও রস, যা দিয়ে সহজে লেখা যাবে। লেখনী নিয়েও সে নানা পরীক্ষা করছে। রস নিয়েও। কিন্তু ভূর্জপত্র ভঙ্গুর। পিতা দেবরাত ও পুত্র চণকের রাজশাস্ত্র যদিবা শেষ পর্যন্ত লিখিত হয়, কত দিন পর্যন্ত তা রক্ষা করা যাবে? বিশেষত তাকে যে ভ্রমণ করতে করতে লিখতে হবে!

২৩

বারাণসীতে গঙ্গা পার হওয়ার পর থেকে ক্রোশের পর ক্রোশ চলেছে তাম্রক। তার সাজসজ্জায় ধুলো। আরোহীর দশাও তেমনই। মাঝে কোনও নিগমগ্রাম পড়লেও থামেনি তিষ্য। ফল, দুধ, মিষ্টান্ন দিয়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেছে। তাম্রককে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন বুঝলে ঢুকে পড়েছে কোনও উপবনে। সেখানে আরামিক কেউ থাকলে নিশ্চিন্তে জল খেয়েছে, তাম্রককেও ঘাস-জল খাইয়েছে। কিন্তু বারাণসীর পর থেকে নিদ্রাকে সে আর প্রশ্রয় দেয়নি। সাকেত থেকে রাজগৃহের পথে বহু দস্যু, চোর আছে, এটা সে জানত। কিন্তু পুরো গ্রামই চোর হবে, তার প্রতিবেশী গ্রামও চোরগ্রাম হবে এটা তার জানা ছিল না। নগর ছেড়ে যতই রাজ্য সীমানার দিকে এগিয়েছে ততই অরাজক অবস্থা দেখা গেছে। এখন বোঝা যাচ্ছে কেন কোশলরাজকে মাঝে মাঝেই সীমান্তে দস্যু-দমন করতে যেতে হয়। গ্রামের পর গ্রাম যদি ক্ষুধার্ত থাকে তা হলে তো তারা বিদ্রোহী, দস্যু হবেই। মগধের সীমার মধ্যে প্রবেশ করার পর গ্রামগুলিকে খানিকটা সুবিন্যস্ত দেখল সে। কতকগুলি হাটে লোহিত অধোবাস, লোহিত উত্তরীয় ও যষ্টিধারী রাজভটদেরও সগর্বে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। কিন্তু তাদের সাহায্য নেওয়ার ইচ্ছে তার হয়নি। ভাবা যায় সাকেতের রাজকুমার, বন্ধুল মল্লর প্রিয় শিষ্য তিষ্য সামান্য রাজভটর অনুগ্রহ চাইছে! নিজের বাহুবল ও বুদ্ধিবলেই সে পথভয় জয় করবে। খালি মনের মধ্যে খচখচ করছে—কোশল। তার দেশ। এত বড় রাজ্য। মাথার ওপরে রাজা, ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে রাজার কনিষ্ঠ ভাইরা সব উপরাজ। অত ধনসম্পদ, বণিকদের যাতায়াত, যত দূর সে জানে শুল্কর জন্য কর্মিক, বিচারের জন্য বোহারিক। সেনা দেখাশোনার জন্য সেনাধ্যক্ষ। রাজস্ব সংগ্রহের জন্য গ্রামভোজক এবং চোর ও দস্যুদমন করবার জন্য রাজভটরা রয়েছে। অর্থাৎ ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় তা সবই আছে। অথচ কাজ ঠিকমতো হয় না। সব যেন অরক্ষিত, অরাজক। নগরীতে তো এসব বোঝা যায় না, বোঝা যায় দূরে বেরোলে। আর ওই বেণদের গ্রামটিই বা অমন কেন? অত সুন্দর গোচর রয়েছে, গোধন নেই? ছাগ বা মেষও তো দেখা গেল না, সামান্য দুটি গাভীর জন্য সেই স্ত্রীলোকটির কী আকৃতি! মন্দ্রাকে বিক্রি করে ওরা গাভী কিনতে চায়। মন্দ্রার কথা মনে করে ক্রোধে, হতাশায় তিষ্যর নিশ্বাস গাঢ় এবং গরম হয়ে উঠতে লাগল। ওই বেণগুলি কী বোকা অথচ কী ধূর্ত! অত ভূমি পড়ে রয়েছে! বলে কি না কস্‌সন তো জানি না! রাজার কী এসব সন্ধান রাখা কাজ নয়! দলিদ্দ গাম! ভূমিগুলি কর্ষণ করলেই তো ওদের অবস্থা ফিরে যাবে। অথচ! সে, তিষ্য যখন রাজ্য স্থাপন করবে তখন দেখবে প্রজাদের মধ্যে সব বৃত্তির লোক আছে কিনা। কূপ এবং পুষ্কর্ণী থাকবে প্রত্যেক গ্রামে পর্যাপ্ত সংখ্যায়। এবং ভূমি এরূপ অকর্ষিত ফেলে রাখা চলবে না। এই সব হীন জাতি যারা বংশানুক্রমে একটি বৃত্তি নিয়ে আছে, তাদের যদি দারিদ্র্য না ঘোচে তো কর্ষণ শিখতে হবে। নিজেদের খাদ্যটুকু অন্তত নিজেরা উৎপাদন করে নিক! তার রাজ্যেও পথে পথে রাজভট থাকবে, রক্ষীদের আগার থাকবে কিন্তু দস্যুবৃত্তি করার প্রয়োজনই হবে না, এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা সে করবে। হোক ছোট রাজ্য। না হোক কোশল বা মগধের মতো সম্পদশালী। হীরক যেমন আকারে ক্ষুদ্র হলেও কুশলী মণিকারের হাতে পড়লে ঝকঝক করে, তার রাজ্যও হবে তাই। তিষ্যর স্বপ্ন সফল হবেই।

অবশেষে রাজগৃহ। বিশাল প্রাচীর। তোরণ। ইন্দ্ৰকীল। যাতে হাতিতে ভাঙতে না পারে। তোরণ পেরিয়ে যখন সে প্রশস্ত রাজমার্গে পৌঁছল, তখন সকালের আলো সবে ফুটতে আরম্ভ করেছে। রাত্রে বিশ্রাম বা নিদ্রা বলতে তেমন কিছুই হয়নি। তবু নতুন দেশে, নতুন নগরে আসার উত্তেজনায় তার অদ্ভুত রোমাঞ্চ হচ্ছিল। প্রথম দর্শনেই মনে হচ্ছে নগরীটি সুন্দর। একে চিত্রের মতো করে সাজানো হয়েছে। বিশেষত দু’ দিকেই পাহাড়। কোলে কোলে বহু ছায়াবৃক্ষ। যেতে যেতে সে বাঁ দিকের একটি সরু পথে ঢুকল। বন্ধুর পথ। সম্ভবত পাহাড় কেটেই নির্মিত হয়েছে, ঢেউ খেলে খেলে চলেছে পথটি। তার ওপর তাম্রকের ক্ষুরের আওয়াজ শোনাচ্ছে খট্টমট্ট, খট্টমট্ট, খট্টমট্ট।

এক পথিককে ডেকে সে জিজ্ঞাসা করল ‘এই পথ কোথায় গেছে?’—ইসিগিলি বলে—লোকটি চলে গেল। তার হাতে বেতের সাজিতে ফুলের মালা, বিম্ব, তুলসীপত্র, ধূপ প্রভৃতি বহু উপকরণ। কারও বন্দনা করতে যাচ্ছে নাকি? বিশেষ কথা বলতেও উৎসুক মনে হল না। বিদেশি দেখেও কৌতূহল নেই। অথচ, সে শুনেছিল মগধবাসীরা নাকি সর্বদাই বকবক করে। শোনা কথায় আর নিজের চোখে দেখা, নিজের কানে শোনায় অনেক পার্থক্য। সে-কথা তিষ্য ভালোভাবেই বুঝতে পারছে এখন। শ্রাবস্তীতে রাজসভার কোনও পদপ্রাপ্তির জন্য ফিরে না-গিয়ে সে ভালই করেছে। সুরক্ষিত স্থান এবং বহুজনের পদচিহ্ন লাঞ্ছিত পথ তাকে সমৃদ্ধি দিতে পারে, স্বস্তিও দিতে পারে, কিন্তু সে যে অন্য কিছু করতে চায়। ওই যে পুণ্যশীল নামে বণিক যুবাটি বলছিল সবই গড্ডলিকা। সে-ও তাই মনে করে। তবে এই গজ্জলস্রোতেরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু তা গড্ডলদের জন্যই। সবাই যদি মৌলিক চিন্তা করবে তবে তার প্রয়োগ হবে কাদের ওপর? সবাই যদি অজপালক হবে তো অজ হবে কারা? সে চিন্তক, পালক। সাকেতকুমার, সর্বশাস্ত্রবিদ্‌, তক্ষশিলার সম্মানিত স্নাতক তিষ্য প্রণয়ে প্রত্যাখ্যাত হতে পারে দর্পী আঢ্যকন্যার দ্বারা। তার ঘোড়াটিও চুরি গিয়ে থাকতে পারে প্রথমবারের অনবধানতায়। কিন্তু সে তো আর গড্ডল নয়!

এই সময়ে, একটি বাঁক ফিরতেই সে পাহাড়ে ওঠার আঁকাবাঁকা উর্ধ্বমুখ পথটি সুষ্ঠু ইসিগিলি পাহাড় দেখতে পেল স্পষ্টভাবে। পাহাড়ের কোলে কোলে কুটী। সবচেয়ে কৌতুকের বিষয় পথের দু’ পাশে সে কয়েকজন নগ্ন সন্ন্যাসীকে দেখতে পেল। অন্য সময় হলে সে বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিত। কিন্তু সন্ন্যাসী গুলি এমন গাছের শুকনো, মরা ডালের মতো দেখতে, মাথাগুলি এমন নিঃশেষে মুণ্ডিত, তার ওপরে এক পায়ে এমন বকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন যে, তার কৌতূহল হল। এঁরা কি আজীবক? এ ধরনের তপস্বী সে আগে দেখেনি। তক্ষশিলার সংলগ্ন বনে সে বহু মুনি দেখেছে। তাঁরা ব্রাহ্মণের অবশ্যকৃত্য যজ্ঞাদিও করে থাকেন। বনবাসী জ্ঞানীজনেরা অধিকাংশই শিষ্যগ্রহণ করেন। বিবাহাদি করেন, প্রায়ই একাধিক! জীবনকে ভালই উপভোগ করে থাকেন। কিন্তু এরূপ কৃচ্ছ্রসাধন করেন এমন তপস্বী সে উত্তরের দিকে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। তবে শ্রাবস্তীতে, সাকেতে এই কুশ্রী, মলিন লোকগুলিকে দেখেছে। প্রকৃত কথা, তপস্বী, শ্রমণ সন্ন্যাসী এঁদের দেখবামাত্র সে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কোনও দিন ভালভাবে লক্ষ্য করে না। সম্প্রতি এক ঋদ্ধিমতী শ্ৰমণার সঙ্গে ঘটনাচক্রে দেখা হয়ে যাওয়া এবং তাঁর গরিমামণ্ডিত আচরণ ও অলৌকিক ক্ষমতার দর্শনে তার কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে। সে দেখল, তার থেকে সবচেয়ে দূরে যিনি দাঁড়িয়ে সেই তপস্বীর সঙ্গে একজন কাষায়ধারী গৌরবর্ণ শ্রমণ যেন কথা বলছেন। তা হলে, তপস্যারত হলেও এঁরা কথা বলে থাকেন! সে তাম্রকের পিঠ থেকে নেমে তার রাশ ধরে এগিয়ে গেল।

গৌরবর্ণ শ্রমণ তার দিকে পাশ ফিরে আছেন। তাঁর উন্নত শির, দীর্ঘ সুগোল গ্রীবা, বৃষস্কন্ধ এবং দাঁড়াবার অপূর্ব রাজকীয় ভঙ্গি দেখে তিষ্য মুগ্ধ হয়ে গেল। তার মনে পড়ে গেল কুণ্ডলকেশী শ্রমণার কথা। এঁরা কি একই সম্প্রদায়ের? শ্ৰমণা কিন্তু শ্বেত বস্ত্র পরেছিলেন, এই শ্ৰমণ পরেছেন রক্তকাষায়। পথের পাশে দণ্ডায়মান তাপসদের সঙ্গে এই শ্রমণের কী আকাশ-পাতাল পার্থক্য!

শ্ৰমণ তাপসদের বললেন—আবুস, একভাবে এ প্রকার দাঁড়িয়ে আছ কতদিন?

—তা তিনদিন তো হবেই সমন।

—কিন্তু এভাবে শরীরকে কষ্ট দিয়ে কী লাভের আশা করছ?

—পূর্ব জন্মের পাপগুলি সব জীর্ণ করছি সমন, নূতন পাপও আর হচ্ছে না, এইভাবে শীঘ্ৰ কর্মক্ষয় হয়ে আগামী জন্মেই সব দুঃখের অবসান হবে।

—আচ্ছা নিগ্‌গণ্ঠ তাপস, তোমরা পূর্বজন্মে ছিলে কি ছিলে না, জানো কী?

—না, তা জানি না, নাতপুত্ত বলেছেন তাই জানি।

—আচ্ছা, পূর্ব জন্মে পাপ করেছিলে কি করোনি অন্তত এটুকু নিশ্চয় জানো!

—না, তা জানি না।

—আচ্ছা, তবে পাপগুলি কী প্রকারের ছিল, তা জান?

—না, এটাও জানি না।

—বেশ, তোমাদের কতখানি দুঃখ নষ্ট হয়েছে, কতটা এখনও অবশিষ্ট আছে?

—তা-ও জানি না।

—তা হলে কিছুই নিশ্চিত না জেনে তোমরা এরূপ কষ্ট বরণ করবে?

একজন বয়স্ক তাপস তখন বললেন, আয়ুষ্মান গোতম, সুখে সুখ পাওয়া যায় না। দুঃখেই সুখ পাওয়া যায়। যদি সুখে সুখ পাওয়া যায় তা হলে রাজা বিম্বিসার আয়ুষ্মান গোতমের থেকে অধিক সুখী। কেমন কিনা?

বয়স্ক তাপসের শুকনো আমলকীর মতো মুখটি ঝিকমিক করছে, ভাবটা—কেমন বিপাকে ফেলেছি?

তিষ্য এই ধরনের তর্কাতর্কি, তক্ষশিলায় থাকতে কোনও কোনও আচার্য গৃহে শুনেছে। সে উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে ইনি কী উত্তর দেন।

মৃদু হাসলেন কাষায়ধারী শ্ৰমণ। বোঝা যাচ্ছে ইনি বেশ রসিক ব্যক্তিও। তারপর বললেন— হে নিগ্‌গণ্ঠ, ভালো করে বিচার করে এ কথা বললে কী? বলি, রাজা বিম্বিসার সাতদিন অনবরত সোজা হয়ে বসে একটিও কথা না বলে নির্জনসুখ অনুভব করতে পারবেন?

তাপসরা মাথা নাড়লেন—না। তা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর নয় বটে।

—সমন গোতম কিন্তু ওভাবেও, অর্থাৎ নির্জনব্রতেও সুখ অনুভব করতে পারেন। তা হলে এখন রাজা বিম্বিসার ঐশ্বর্য নিয়ে অধিক সুখী না সমন গোতম চীবর বস্ত্র আর ভিক্ষাপাত্র নিয়ে?

—যদি তা-ই হয় তাহলে সমন গোতমকেই অধিক সুখী বলা উচিত।

শ্রমণের জয়ে তিষ্য মনে মনে আহ্লাদিত হয়। ‘সাধু সাধু’ বলে উঠবে কি না ভাবে। কিন্তু শ্ৰমণ তার আগেই কথা বলে উঠলেন।

—কিন্তু আবুস, সমন গোতম সর্বাবস্থায় সুখী থাকার এই ক্ষমতা কৃচ্ছ্রসাধন করে অর্জন করেননি। তিনি প্রথমে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। তিনি এমন তপস্যা করেন যে, তাঁর শরীরের গাঁটগুলি অসীতক লতার মতো দেখাত, মেরুদণ্ড সুতার গুটির মালার মতো হয়ে যায়, ভাঙা ঘরের খুঁটিগুলি যেমন নড়বড়ে হয়ে যায় তাঁর ঘাড়ও সেইরূপ হয়ে গেল। চোখের তারা এত ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল যেন গভীর কুয়োতে নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব পড়েছে। শিরদাঁড়া ও পেটের চর্ম এক হয়ে গিয়েছিল। শরীরে হাত বুলালে রোমগুলি আপনি ঝরে পড়ত। কিন্তু তাতে তাঁর দুঃখনিবৃত্তি হয়নি, সুখে বিচরণ করবার ক্ষমতাও হয়নি। শরীরকে অধিক দুঃখ দিলে চিত্ত অস্থির হয়, আবুস। অস্থির চিত্ত দ্বারা শুভ বিতর্কে মনকে স্থাপন করা যায় না। মন সংস্থাপিত না হলে ধ্যান সম্ভব হয় না। একমাত্র ধ্যান দ্বারাই বাসনাচ্ছেদ করা যায়। বাসনাচ্ছেদই সুখী হবার একমাত্র উপায়।

—সমন গোতমের কথা যুক্তিসিদ্ধ। একজন তাপস বললেন।

আরেকজন বললেন—কিন্তু নাথপুত্তের কথা আমাদের ভালো লাগে। পরের জন্মে সব দুঃখের অবসন হবে ভাবলে এ জন্মে আমি অগ্নি থেকে উত্থিত ধোঁয়া পান করেও কাটাতে পারি।

সৌম্য শ্রমণ ততক্ষণে চলতে শুরু করেছেন। তাঁর হাতে ভিক্ষাপাত্র। তিষ্য লক্ষ্য করল তাঁর মাথায় কুঞ্চিত কেশ সবে জন্মাতে আরম্ভ করেছে। মাথার মাঝখানটা একটু উঁচু। হঠাৎ দেখলে মনে হবে মাথায় ছোট একটি চূড়া বাঁধা হয়েছে। শ্ৰমণ নগরের দিকে প্রবেশ করছেন। তিষ্যও তাঁকে বিরক্ত না করে তাঁর পেছন পেছন যেতে লাগল।

হঠাৎ পেছন থেকে তিন-চারজন নগ্ন তাপস ছুটে এসে শ্রমণের পথ রোধ করে দাঁড়াল। একজন বলল—ভন্তে, আপনি কি বলছেন তপস্যা দ্বারা পাপক্ষয় হয় না?

—অতিরিক্ত কৃচ্ছ্রে শক্তিই ক্ষয় হয় আবুস, পাপ ক্ষয় হয় বলে জানি না।

—আপনি যে-পথ আবিষ্কার করেছেন তাতে সুখী হওয়া যায়?

—অনন্ত সুখের অভিমুখে যা নিয়ে যায় তাই সদ্ধম্ম।

—আমরা যদি আপনাকে অনুসরণ করি, নিয়মমতো আহার করতে পারব? বস্ত্র পরতে পারব? এভাবে লোকালয়ে যেতে আমাদের লজ্জা হয়।

তিষ্য দেখল শ্রমণের মুখ সামান্য স্মিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘সাক্কপূতীয় সমনরা একবেলা আহার করে, রাত্রে দুগ্ধ ঘোল পান করতে পারে, উত্তমরূপে শরীর আবৃত না করে জনপথে বের হওয়া তাদের নিষিদ্ধ।’

—আর তপস্যা?

—ধ্যান মার্গ। অন্য তপঃ নেই। আচারিয়র কাছে কর্মস্থান জেনে নিয়ে ধ্যান করতে হয় হে নিগ্‌গন্ঠ তাপস। নিজের সমস্ত কাজ করতে হয়। সংঘের যে কাজের ভার পাবে, তা-ও।

—সংঘং সরণং গচ্ছামি—একজন তাপস বলে উঠলেন।

শ্ৰমণ মৃদু হেসে বললেন—সত্যই যদি সমন গোতমের কথায় আস্থা হয়ে থাকে তবে তিসরণ নিতে হবে। বেলুবনে যেও, তখন কথা হবে। এখন আমি ভিক্ষায় বেরিয়েছি।

শ্ৰমণ এগিয়ে গেলেন।

ইতিমধ্যে একজন তাপস হঠাৎ তিষ্যর দিকে এগিয়ে এসে বললেন—ভদ্দ, আমাদের কৌপীন বস্ত্রের মতো টুকরো কিছু দিতে পারেন? এভাবে বেলুবনে গেলে সাক্কপুত্তীয় ভিক্‌খুরা আমাদের উপহাস করবে।

তিষ্য বলল—নীল রঙের বস্ত্রে হবে? আমার কাছে যে উত্তরীয় ও শাটক আছে তাতে আপনাদের চারজনেরই লজ্জা রক্ষা হয়ে যাবে।

—যদি অনুগ্রহ করে দেন।

তিষ্য তৎক্ষণাৎ তার বেত্ৰপেটিকা থেকে বস্ত্র বার করে দিল। তাপসরা সে দুটি নিয়ে আবার ইসিগিলির দিকে প্রস্থান করলেন। তিষ্য পেছন থেকে হেঁকে বলল—কই শ্ৰমণ। আমাকে তো আশীবাদ করলেন না?

যেতে যেতে একজন মুখ ফিরিয়ে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বললেন—দান করার সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যফল পাবে। আশীবাদের প্রয়োজন কী?

তাদের শুকনো ডালের মতো শরীর। কালিবর্ণ দেহত্বক। তার ওপরে গাঢ় নীল বস্ত্র কী রকম মানাবে কল্পনা করতে গিয়ে তিষ্যর হাসি পেয়ে গেল। সে তাম্রকের পিঠে চড়ে আপনমনেই হাসতে হাসতে এগোল। কিছুক্ষণের মধ্যেই উজ্জ্বলকান্তি শ্রমণকে ধরে ফেলল সে। বেশ হনহন করে চলছিলেন শ্রমণ। অথচ এই দ্রুতগতির মধ্যেও কোনও তাড়া ছিল না। তিনি যখন কথা বলছিলেন, মনে হচ্ছিল আরেকটু বলুন। এখন চলছেন, মনে হচ্ছে আর একটু চলুন। বস্তুত তার সারা জীবনে তিষ্য এমন কান্তিমান কাউকে কখনও দেখেনি। সন্ধ্যা হলে সে মনে করত ইনি কোনও দেবতা। হয়ত স্বয়ং ইন্দ্রই নেমে এসেছেন স্বর্গ থেকে। সন্ধ্যা হলে দেবতার আবির্ভাব সে কেন বিশ্বাস করতে পারত, দিনের আলো বলে কেনই বা বিশ্বাস করতে পারছে না এ কথা তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে অবশ্য বলতে পারবে না। এখন তাকে অতিথিশালার সন্ধান দেখতে হবে, একটি দাস কিনতে পারলে ভালো হয়, বস্ত্র যা ছিল নগ্ন তাপসদের দিয়ে দিয়েছে, তাও কিনতে হবে। স্নানাহার, নিদ্রা, রাজগৃহে অতঃপর সে কী করবে এ নিয়েও নানা চিন্তা করবার আছে। কিন্তু এই শ্রমণকে সে যেন কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। ইনি শ্ৰমণ গোতম। থাকেন বেলুবন নামক স্থানে। এটুকু জানা গেছে। এঁর সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী সে।

শ্রমণের পাশে পৌছে সে এক লাফে ঘোড়া থেকে নামল। চেঁচিয়ে বলল—ভো শ্ৰমণ! আমার কথা একটু শুনবেন!

শ্ৰমণ দাঁড়িয়ে গেলেন। কিন্তু মনে হল তিনি অন্যমনস্ক। কিছু একটা ভাবছেন। তিষ্য বলল—আমি সাকেত থেকে আসছি। ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর। ক্লান্তও। এ নগরের কিছুই জানি না। ওই যে বেলুবনের নাম করলেন। ওখানে কি আমার আশ্রয় হতে পারে?

শ্ৰমণ বললেন—আয়ুষ্মান, তুমি কি পব্‌বজ্জা নিতে চাও?

—না, না।

—ধম্মের আশ্রয় যে নিতে চায়, সে বেলুবনে যেতে পারে। পৃথক-জনেরা যাক রাজমার্গের আবসথাগারে। এখান থেকে দক্ষিণে গেলেই প্রশস্ত মার্গ পাবে।

—আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন, শ্রমণ?

—তথাগত কোথাও যান না আয়ুষ্মান, তিনি পৌঁছে গেছেন। তিনি শুধু ধীরে ধীরে চারণ ও চংক্রমণ করেন।

—কিন্তু আমি তো দেখলাম আপনি অত্যন্ত দ্রুতবেগে যাচ্ছেন!

তথাগতের পক্ষে যা ধীরতা, পৃথকজনের পক্ষে তাই দ্রুতি। তথাগত যা সহজে পারেন, পৃথকজনের তাই করতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতে পারে।

শ্ৰমণ আর দাঁড়ালেন না। সেই একই প্রকার উদাসান মুখে যেদিকে যাচ্ছিলেন, চলে গেলেন।

তিষ্য রাজমার্গের দিকে চলতে চলতে ভাবল এঁরা অর্থাৎ ইনি এবং সেই কুণ্ডলকেশী শ্ৰমণা এঁরা সকলেই কেমন রহস্য-ভাষায় কথা বলেন। যেন যা বলছেন তার চেয়ে অনেক বেশি বলছেন মনে হয়। যেন অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পান এঁরা। ভবিষ্যৎ জানেন। সাধারণ জ্যোতিষীর মতো নক্ষত্রের অবস্থান দেখে ভবিষ্যৎ নির্ণয় করা নয়। কোনও স্থান, কোনও মানুষকে দেখবামাত্র এগুলির সম্পর্কে সব জানতে পারেন। ঋদ্ধি। এ এক প্রকার ঋদ্ধি!

এই শ্রমণ নিজেকে তথাগত বলছেন। এই শব্দটা সে যেন কোথায় শুনেছে। মনে করতে পারছে না। যাক এঁর বাসস্থান কোথায় জানা গেছে। সে আগে একটা আবসথাগার ঠিক করে নিক। বেলুবনে সে যাবে।

যে অতিথিশালায় রাজকুমার তিষ্য আশ্রয় নিল সেটি রাজগৃহের অপর প্রান্তে। নগরীর উত্তরদিকের প্রাকার আর কিছুদূর থেকেই আরম্ভ হয়েছে। আশ্রয় পাবার পর তিষ্য বুঝতে পারল সে কত ক্লান্ত। বস্তুত তার তেইশ-চব্বিশ বছরের জীবনে দীর্ঘপথ ভ্রমণ সে অনেকবার করেছে। সাকেত থেকে তক্ষশিলা, শ্রাবস্তী থেকে সাকেত। কিন্তু এই যাত্রাগুলোর শেষে সবসময়েই কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকত। আশ্রয়ের আশ্বাস তো থাকতই। আরও শেখা হচ্ছে, আরও জানা হচ্ছে। উন্নতির পথ ক্রমশই প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে, এরপরে সব কাম্যই পাওয়া যাবে এইরকম একটা স্থির ধারণা থাকত! তা-ই-ই সম্ভবত ক্লান্তি আসত না, এলেও দূর হত অচিরেই।

দীর্ঘ পথ পার হয়ে তক্ষশিলায় যখন পৌঁছল আচার্য সংকৃতির কাছে তখন শিষ্য বলে গৃহীত হতে সময় লাগেনি। তক্ষশিলার প্রান্তীয় অরণ্যে তার আবাস। প্রচুর গোধন। তারা সব ছাত্র মিলে সেই গরুগুলির সেবা করত, সমিধ্ আহরণ করে আনত, পানীয় জল আনত। পুণ্য শিষ্যরাই অবশ্য করত অধিক। কিন্তু তাদেরও যথেষ্ট করতে হত। তারপর ঋক্‌ আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে আরম্ভ হত প্রতিদিনের পাঠ। সারাদিন থেমে থেমে চলত। আলস্যের কোনও অবকাশই ছিল না। গুরুপত্নীরা মাঝে মাঝেই উত্ত্যক্ত করতেন। তাঁদের নানা প্রকার অনুরোধ-উপরোধ-আদেশ থাকত। বিশেষত কনিষ্ঠা গুরুপত্নী অলভা ছিলেন তার থেকে সামান্য বড়। স্বভাবে চঞ্চল। ভয়ানক জ্বালাতন করতেন। বিশেষ করেই তিষ্যকে।

—তিষ্য কুমার, তিষ্য! ফুল তুলে আনো। শীঘ্র যাও। মালা গাঁথব। ফুল তুলে আনার পর অসন্তোষ প্রকাশ করতেন—শুধু শ্বেত ফুল এনেছ কেন? এর সঙ্গে পীত, রক্তবর্ণ সব মিলিয়ে আনবে তো? এ কি তোমার বৃদ্ধ গুরুর জন্য না কি?

—তবে কার জন্য?

—গুরুপত্নীর জন্য। যার মাথার কেশগুলির সব পাকা সে পরুক গিয়ে শ্বেত মালা, বলতে বলতে হাসতে থাকেন অলভা। আবার ছোটাতেন তিষ্যকে। ফিরে এলেই বলবেন—বিপণি থেকে এলাচি এনে দেবে আমায় কাল? এলাচি, যাউতে দেবো। সে যদি বলত তার গুরু সুধন্বার কাছে যাবার আছে, অলভা চোখ পাকিয়ে বলতেন—গুরুপত্নীকে দক্ষিণা না দিলে কোনও বিদ্যাই লাভ হবে না তা জানো? গুরুকে একবারে দিলেই হয়। গুরুপত্নীকে দিতে হয় বারে বারে। যাও এখন পুরোডাশের যবপিণ্ডটি থেসে দাও তো! শক্ত হয়ে গেছে। তোমার পেশীবল বাড়বে। কই দাঁড়িয়ে রইল কেন, যাও?

তিষ্য রাগ করে বলত—আপনি তবে কী করবেন?

—আমি এখন উড়ম্বর পাড়তে যাচ্ছি’, বলে অলভা গাছে উঠে বসে থাকতেন। এ ছাড়াও ঘৃত প্রস্তুত হচ্ছে, অতিরিক্ত পুড়ে না যায় দেখো। দুগ্ধ জ্বাল হচ্ছে; দাঁড়িয়ে থাক ঠায়। গুরুপত্নীরা সব গা ধুয়ে সাজসজ্জা করতে ব্যস্ত। তার অনেক সহাধ্যায়ী এসব সাগ্রহে করত। এই সব কাজ পাঠের একঘেঁয়েমির মধ্যে বৈচিত্র্য আনত হয়ত। অনেকের আবার দৃঢ় ধারণা ছিল গুরুসেবা করলে পাঠ্য তাড়াতাড়ি কণ্ঠস্থ হবে। গুরুর আশীবাদ না পেলে বেদ হৃদয়স্থ হবে না।

তিষ্য কিন্তু পরীক্ষা করে দেখেছিল যেদিন অতিরিক্ত গৃহকর্ম করতে হত সেদিন তার পাঠের পরিমাণও কমে যেত। গুরুর ব্যাখ্যা মাথায় ঢুকত না। ঘুম এসে যেত। আচার্য তাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। বিনয়ে অবনত অমনোযোগী ছাত্রের চেয়ে তিনি মেধাবী মনোযোগী ছাত্রদের ভালবাসতেন। সেবা একটু অল্প করলেও কিছু মনে করতেন না। একদিন সাহস করে সে জিজ্ঞাসা করেছিল—পুরাকালে শুনেছি অনেকে শুধু গুরুসেবা করেই বিদ্যা লাভ করেছেন, এমন হয়?

আচার্য হেসে বলেছিলেন—কেন? তিষ্যর কি মেধা হঠাৎ অল্প হয়ে গেল? না কি অধ্যয়নে আর মন নেই?

—তিষ্যর মেধা বা মনোযোগের কথা তার আচার্যদেবই ভালো জানেন। কিন্তু যার মেধা নেই, সে কি শুধু সেবা করেই…

আচার্য গম্ভীর হয়ে বললেন—না তিষ্য। কথাটা ঠিক তা নয়। কিন্তু মেধা অনেক সময়ে সুপ্ত থাকে। সম্যক বাধাপ্রাপ্ত হলে তবে জাগ্রত হয়। এ ছাড়াও আবার অনেক অল্পবুদ্ধি শিষ্য সেবার মধ্য দিয়ে অনেক ব্যবহারিক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে, আপনা থেকেই তার মনে প্রশ্ন জাগে, একাগ্রতা আসে। প্রশ্ন জাগানোই শিক্ষার উদ্দেশ্য। এই প্রশ্নের পথ ধরেই আসেন বেদ।

—কিন্তু আচার্য, আমরা তো সবই নির্বিচারে কণ্ঠস্থ করতেই শিখি।

আচার্য বললেন—কী আছে না জানলে কী প্রশ্ন করতে হবে জানবে কী করে! তা ছাড়া তিষ্য, বিদ্যা এক, কিন্তু তার প্রয়োগ বহু। অধিকারভেদ আছে। প্রতি বৎসর আমাদের কাছে শত শত শিষ্য আসে। সকলেই কী এক কাজ করবে? আচার্য হবে, কিংবা চিন্তক হবে, জীবনের মূল রহস্যগুলি ভেদ করতে চাইবে এমন শিষ্য কজন? তুমি নিজেই বলো না, তুমি কী উদ্দেশ্যে এসেছ এখানে? পণ্ডিত হবে? বৈয়াকরণ হবে? জীবনরহস্যের সমাধান করবে?

—না, আচার্য, তা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি যোগ্য রাজ্যের যোগ্য রাজা হতে চাই। কিন্তু রাজা হতে গেলে শুধু ধনুর্বেদ জানাই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি না। বড় বড় মানুষ কী ভেবেছেন, ভাবছেন, সেই তত্ত্বগুলি জানতে জানতে আমার চরিত্র শোধিত, শীলিত, মার্জিত হয়ে উঠছে। এই বিদ্যা আমার মনকে সঠিক পথে চিন্তা করতে শেখাচ্ছে, প্রত্যয় দিচ্ছে।

তিষ্য আরও বলতে যাচ্ছিল, আচার্য তাকে থামিয়ে বললেন, তাই-ই বলছিলাম বিদ্যা এক, কিন্তু বহুধা হয়ে যায়। প্রয়োগ ভেদে, উদ্দেশ্য ভেদে। অধিকারী-ভেদে। এখন বুদ্ধিও তো সবার সমান নয়! নিরলস সেবার গুণে যদি গুরুর বিশেষ স্নেহদৃষ্টি খুলে যায় তা হলে তিনি কঠিন বিষয়কে সরলতর করে বুঝিয়ে দেবার প্রেরণা পান। গুরু-শিষ্য পরস্পরকে এইভাবে সাহায্য করেন। তবে অতিশয় নির্বোধ হলে আর কিছুতেই কিছু হয় না। সেই লাঙলের ঈষের কাহিনী জানো না?

—কী কাহিনী আচার্যদেব?

—নির্বোধ শিষ্য বহু সেবা করার পর গুরু মনে করলেন তাকে সহজতম পন্থায় শেখাবেন। তিনি তাকে কাষ্ঠ ও পত্র সংগ্রহ করে আনতে বললেন। ফিরে এলে জিজ্ঞাসা করলেন—কী দেখেছ?

—সর্প দেখেছি।

—সর্প কী প্রকার?

—লাঙলের ঈষের মতো। —এইভাবে হাতি দেখে এসেও সে বলল—হাতি ঈষের মতো।

গুরু ভাবলেন, হাতির শুঁড়ের কথা মনে করে এই উপমা ব্যবহার করছে শিষ্য। তিনি হৃষ্টচিত্তে তাকে আবার পাঠালেন। কিন্তু নির্বোধ যা দেখে আসে তাকেই লাঙলের ইষার মতো বলে বর্ণনা করে। তিনি ভেবেছিলেন উপমা প্রয়োগ ও কার্যকারণ সম্বন্ধে স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে তার শিক্ষারম্ভ হবে। এখন তিনি বুঝলেন—না, এর দ্বারা কিছু হবে না।

গুরু সংকৃতির কাছ থেকেই তিষ্য জানতে পারে বহু আচার্য এইভাবে, সেবা লাভ করবার জন্য সেবার মাহাত্ম্য রটিয়ে থাকেন। যাঁদের প্রচুর ভূমি এবং দাস আছে তাঁদের অসুবিধা হয় না। কিন্তু যাগ-যজ্ঞ উপলক্ষে দাস-দাসী পাওয়া গেলেও ভূমি অত সহজে মেলে না। ভূমি না থাকলে দাস-দাসী পালন করা যায় না। ভূমি নিয়ে এইসব কুলপতি আচার্যরা করবেনই বা কী? ভূমি কর্ষণের জটিল কাজ পরিদর্শন করবারই বা তাঁদের সময় কই! তাই তাঁরা অধিকাংশই দাস-দাসীগুলি বিক্রি করে দেন। শিষ্যরা গৃহকর্ম, গো-সেবা করে দিলে খুবই সহজে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আচার্য অবশ্য ঠিক এভাবে বলেননি। শুধু ইঙ্গিত করেছিলেন। তার থেকেই তিষ্য বুঝতে পারে গুরুসেবা করে বিদ্যা লাভ করবার কাহিনীগুলি চতুর মস্তিষ্কের উদ্ভাবন। তবে এসব কথা জানবার, বোঝবার পরেও সে তার যেটুকু কর্তব্য সেটুকু সেবা দিয়েছে। কখনও কখনও ভেতরে ভেতরে একটা অহঙ্কার মাথা তুলত— আমি সহস্র কার্যাপণ দক্ষিণা দিয়ে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে তার মন তাকে বোঝাত গুরু বিরূপ হলে বহু সহস্ৰ কাষাপণেও কিছু হবে না। সামান্য বাঁকা হাসি ভেতরে ভেতরে হেসে সে তার ভাগের গাভীগুলিকে দোহন করত, সকাল-বিকেল পরিচর্যা করত। সতীর্থ ছিল অনেক। কিন্তু প্রাণের বন্ধু কেউ না। বেদ-বেদাঙ্গগুলি শিখে পরম সন্তুষ্ট হয়ে স্নাতক হয়ে চলে যেত। কারও কাছেই মনের গোপন প্রশ্নগুলি করতে পারত না তিষ্য। হঠকারিতা করে তো কোনও লাভ নেই। অন্যান্য আচার্যের শিষ্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার চেষ্টা সে যে করেনি তা নয়, কিন্তু সকলেই নিজের অধ্যয়নে এত একাগ্র যে, বন্ধুত্বে তেমন গাঢ়তা জন্মাবার সুযোগই হত না। গুরু সংকৃতি তার অস্থিরতা উপলব্ধি করে মাঝে মাঝে বলতেন— গুরুগৃহে শিক্ষার কাল পূর্বজদের আহৃত বিদ্যা হৃদয়ঙ্গম করার কাল, বৎস। প্রশ্নগুলি সমাবর্তনের পর যখন দেশে দেশে জীবিকার জন্য ভ্রমণ করবে তখন কোরো।

—তখন আপনাকে কোথায় পাবো?

সংস্কৃতি হেসে বলতেন—তখন দেখবে পথে, ঘাটে, নদীতে, অরণ্যে, রাজদ্বারে, শ্মশানে সর্বত্রই গুরু। শুধু চিনতে পারলেই হল।

—সর্বত্রই গুরু? গুরু অতো সুলভ হলে এত যোজন পথ পার হয়ে আমরা তক্ষশিলায় আসি কেন?

—যার থেকে সামান্যতম হলেও জ্ঞান লাভ করা যায়, সেও গুরু। এই যে তুমি ত্রিবেদ শিক্ষা করলে, তুমি ক্ষত্রিয় সন্তান, যদি ক্ষত্রিয় বৃত্তিই অবলম্বন করো, তা হলে এ বিদ্যা তোমার সেভাবে কাজে লাগবে না। এ শুধু তোমাকে দেবে একটি সম্যক দৃষ্টি। সে দৃষ্টি দিয়ে বিচার করতে পারবে। আর পাবে একটি অন্তরিক্ষ। অন্তরিক্ষটি ভেতরে থাকলে জীবনের কোনও কাজ কঠিন লাগে না, নীরস লাগে না।

—কিন্তু আচার্য আপনি যে বলেছিলেন প্রশ্নের পথ ধরেই বেদবিদ্যা আসে?

—সে স্বতন্ত্র প্রশ্ন বৎস তিষ্য। আমার এক সহাধ্যায়ী ছিলেন সুহোত্র। সামান্য পণিকের পুত্র। তিনি তো দ্রষ্টা ঋষি হয়ে যান। প্রতিদিন শতাধিক গাভী নিয়ে গো-চারণে চলে যেতেন ভোরবেলায়। দেখতেন কীভাবে ধীরে ধীরে রাত কেটে ভোর হচ্ছে। সতেজ ঘাসগুলি উদর পুরে খাওয়ার পর সুহোত্রর ধেনুরা এতই সন্তুষ্ট হত যে, সেই গো-চরেই তাদের দুগ্ধক্ষরণ হত। সুহোত্রর অসুবিধা হবে বুঝে ধেনুগুলি একের পর এক তার দুগ্ধভাণ্ডগুলির ওপর এসে দাঁড়াত। কেউ তাদের শেখায়নি। সেই দেখতে দেখতে সুহোত্রর হৃদয়ে ঋক্ প্রবেশ করল।

আদিত্যের গোষ্ঠ থেকে আলো
ধেনুর মতো ধাক।
আকাশ মাঠে চরতে যাক তারা
প্রাণের ক্ষীর ক্ষরাক ॥
আকাশ আছে ধেনুতে
ধেনুও আছে আকাশে।
দুগ্ধ যেমন ভূমিতে
ভূমিও তেমন দোহতে ॥

বাক্ স্বয়ং যদি বরণ না করেন, তবে ঋষি ঋক্ দেখতে পান না। সুহোত্র দেখতে পেতেন। তাই বলতেন :

হে ধেনু এবার হরষিত করো
আমার চিত্ত তুমি।
পান করাও। স্নান করাও
ভাসাও, ডোবাও, দেখাও আলোর উৎসরণের ভূমি ॥
আলোয় আঁধার হয়ে পান করো
জীবন, তোমার পেয়
আঁধারে মানিক হয়ে জ্বলে ওঠো
দেখাও কোথায় গেহ ॥

গুরু সংকৃতি তিষ্যকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে সেবার তত্ত্ব থেকে আলোর তত্ত্ব, আলোর তত্ত্ব থেকে অমৃতের তত্ত্বে পৌঁছেছিলেন ঋষি সুহোত্র। কীভাবে জীবনের মূল তত্ত্ব জানবার পর মৃত্যুভয় জয় করেছিলেন। সুহোত্র বলতেন, পূর্বজরা যে গো কামনা করতেন তার সবটাই শুধু গোধনের জন্য আকাঙ্ক্ষা নয়, তাঁরাও অনেক সময়ে ‘গো’ বলতে আলো বুঝিয়েছেন। ‘দ্বয়ি’ অর্থে সব সময়ে পার্থিব ঐশ্বর্য নয়, আলোর তত্ত্ব জানতে চাইতেন। যজ্ঞগুলি তাই নিরর্থ হয়ে যায় যদি মন্ত্রের অন্তর্নিহিত অর্থ না-বুঝে শুধু ধেনুর কামনাতেই যজ্ঞ করা হয়। সুত্রের মত ছিল যজ্ঞ— মানসযজ্ঞ। অরণ্য-পৃথিবী-আকাশ বেষ্টিত মানুষের প্রাণপণে সৃষ্টিতত্ত্বের ভেতরে প্রবেশ করতে চাওয়া। সুহোত্রর এই ব্যাখ্যায় অনেকেই তুষ্ট হতে পারেনি। বিশাল কর্মকাণ্ডের অনেকটাই তো তাহলে মিথ্যা হয়ে যায়। যজ্ঞ, যজ্ঞ উপলক্ষ্যে মহতী সভা, সাধুজন সমাবেশ, দান-দক্ষিণা সবই বন্ধ হয়ে যায়। কেউ অস্বীকার করছে না, যজ্ঞে যজমান নিজেকেই দেবতার কাছে বলি দেন। পশুগুলি যজমানেরই প্রতীক। কিন্তু সুহোত্র বলতে থাকেন এই প্রতীকের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই ঋত্বিকের। যজ্ঞ মানে দেবতার উদ্দেশ্যে ত্যাগ। নিজের যা সবচেয়ে প্রিয় সেই আপনাকে ত্যাগ হলেই যজ্ঞ অর্থময় হয়ে ওঠে। এতে প্রয়োজন নেই ঋত্বিকের। মানুষ নিজেই অধ্বর্যু, নিজেই হোতা, নিজেই ব্রহ্মা, নিজেই অগ্নীৎ। নিজেকে সম্পূর্ণ তন্ময় করাই আত্মোৎসর্গ। তবে সুহোত্রর তাঁর মতামতগুলি প্রচারে মন ছিল না। তিনি থাকতেন তাঁর ছোট কুটিরে। অল্পসংখ্যক অনুরাগী শিষ্যের ওপর নির্ভর করে। ঘুরে বেড়াতেন আপন আনন্দে। সে সময়ে রাত্রে দেখা যেত নক্ষত্রময় কালো আকাশের তলায় আবিষ্টের মতো ঘোরাফেরা করছে একটি দীর্ঘদেহী, দীর্ঘকেশ মানুষ। ঋক্ প্রকাশিত হচ্ছেন তাঁর কাছে। সুহোত্র অল্প বয়সেই মারা যান। তঁর ঋক্‌গুলি রয়ে গেছে কোনও কোনও শিষ্য, কোনও কোনও অনুরাগীর কণ্ঠে :

ওই জ্যোতিষ্কগুলি জয় করবার পিপাসা নিয়ে আমি
এই রাত্রির স্তরে স্তরে রেখে গেলাম আমার আয়ুধ।
প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান, হৃৎ, চিৎ এবং অহম্।
হে বাক্। বরদাত্রী, মধুক্ষরী বধূ, সন্তত হও, সন্তত হও
আমাকে সন্তত করো ভূলোকে, দ্যুলোকে
তারও পরে যা আছে সেই অনন্ত বিভাময় বিভাবরীতে
আমাকে সন্তত করো!

রাজগৃহের প্রান্তবর্তী আবসথাগারের শীতল ছায়াময় কক্ষের মধ্যে ক্লান্তি দূর করতে করতে কুমার তিষ্যর মনের মধ্যে এইসব পূর্বস্মৃতি ঘোরাফেরা করে তাদের সূক্ষ্ম গন্ধ, স্পর্শ, রস নিয়ে। সেই সমিধে ফুঁ দিয়ে আগুনকে তেজস্বান করা। দুধ আহুতি দেবার পোড়া গন্ধ। আজাহুতির তীব্র সুগন্ধ, সহাধ্যায়ী পূর্ণ অর্যমা, বরুণ, তক্ষশিলার সেই হিমরাত্রিগুলি যখন খড়ের গাদার ওপর উর্ণার কম্বল গায়ে দিয়ে শীত কাটত না। তুষের আগুন করতে হত কুটিরের একধারে। বহুদিন পর্যন্ত সেই পর্ণ কুটিরে ঘুম হত না তিষ্যর। সে ভাবত সাকেতের সুন্দর ছায়াময় পথগুলির কথা। প্রহরে প্রহরে মায়েদের, দাস-দাসীদের পরিচর্যার কথা। বন্ধুদের সঙ্গে অশ্বতরের পিঠে চড়ে প্রতিযোগিতা।

তারপর তক্ষশিলা থেকে সমাবর্তন শেষে বাড়ি ফিরল। তখন সে অন্য তিষ্য। তার বাহু, পা, পেট, বুক, কাঁধের পেশীগুলি দিয়ে অন্য শক্তিস্রোত বইছে, মুখে তারুণ্যের সঙ্গে বিদ্যাজাত প্রত্যয় এবং কর্তৃত্ব করবার সহজ ক্ষমতা এমনভাবে মিশেছে যে নিজের পিতাই তাকে সমীহ করতে আরম্ভ করেন। মা ও অন্য ভাইদের তো কথাই নেই। তিষ্য তখন শুধু যাউ খেয়েও সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারে। আবার বহু উপচারের ভোজনও তার কাছে কিছুই নয়। দু তিন দিন শুধু জল বা বনের ফল খেয়ে থাকা তার কাছে সহজ ব্যাপার। সারা দিন পথ চলতে পারে সে। ক্লান্তি কাকে বলে জানে না। গৃহে অনবরত দাসেদের পরিচর্যা তখন কিছুদিন তার কাছে অসহ্য মনে হত। অসহ্য মনে হত গতানুগতিক, তুচ্ছ কথাবার্তা। সেইজন্যেই আরও সে শ্রাবস্তীতে বন্ধুলের কাছে চলে যায়।

জীবনে ওই একটি মানুষের মতো মানুষ দেখেছে তিষ্য। বন্ধুল মল্ল।

প্রথম যেদিন দেখা হল, নিজের অস্ত্রাগারে হাঁটু গেড়ে বসে তরোয়ালে শান দিচ্ছিলেন আর পানীয়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। রাজা প্রসেনজিৎ পানীয় হাতে উচ্চাসনে। বিশাল মানুষটি বন্ধুল! খালি গায়ে পেশীর পর পেশীর তরঙ্গ। তরোয়ালটা সামনে পেছনে বিদ্যুদ্বেগে আসছে যাচ্ছে, আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে, আর তাঁর পেশীর তরঙ্গে হিল্লোল উঠছে। মুখটা বালকের মতো। সরল, হাসিতে ভরা।

বন্ধুল বলছিলেন, মহারাজ, এই যে কৃপাণটিতে শান দিচ্ছি, এইটি দিয়েই কিন্তু আপনার মূল্যবান গলাটি কুচ করে কেটে নিতে পারি। নিভৃত এই অস্ত্রাগার। কেউ দেখতেও আসবে না।

প্রসেনজিৎ হাহা করে হেসে বললেন, তোমার অস্ত্রাগারে বুঝি ওই কৃপাণের সঙ্গে লড়বার মতো আর কোনও অস্ত্র নেই, বন্ধুল? আমার ক্ষিপ্রতাতেও সন্দেহ প্রকাশ করছো না কি?

—আপনার ক্ষিপ্রতা এখনও সম্পূর্ণ নষ্ট হয়নি মহারাজ, একথা ঠিক। কিন্তু এ অস্ত্রাগারের অস্ত্ররা একমাত্র আমার কথাই শোনে যে।

—সে ক্ষেত্রে দ্বাররক্ষীরা আছে। তারা আমার বৃত্তিভোগী।

—না মহারাজ, তারা আগে আমার ভৃতক, তারপর আপনার। যুদ্ধের নিয়ম ওদের আমি যা শেখাই তা হল আগে ওদের ঊর্ধ্বতন প্রত্যক্ষ প্রভুর আজ্ঞা পালন করবে। ওরা আপনাকে সম্মান করবে। কিন্তু প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার কারণ ঘটলে আমারই পক্ষে যাবে। ওরা আমার বশ।

—বলো কি বন্ধুল! তাহলে তো তোমার পেছনে চর লাগিয়ে রাখতে হয়। এমন চর যে কৃমিকীটের মতো তোমায় আঁকড়ে থাকবে! —প্রসেনজিৎ হাসছেন। সবকিছু অগ্রাহ্য করার, তুচ্ছ করার হাসি। একটা অতিরিক্ত উচ্ছাস। বন্ধুলও হাসছেন, কিন্তু ভারি বুদ্ধিমত্ত হাসি। বললেন— চর নিয়োগ করতে কি এখনও বাকি রেখেছেন নাকি মহারাজ? বারে বারে বলি সতর্ক হোন। সতর্ক হোন। একটা ভোঁতা তরোয়াল কটিতে না ঝুলিয়ে রেখে সত্যিকার অস্ত্র বহন করুন। সঙ্গে নিজস্ব রক্ষী রাখুন। এইভাবে যে কোনও কাননে, পানশালায়, পথে, বিপথে … না মহারাজ আপনি বড়ই অসতর্ক।

—তা যদি বলো বন্ধুল, কোশলের প্রতিটি রন্ধ্র এই অসতর্ক প্রসেনজিৎকে ভালোবাসে। সকলেই বলে…

এই সময়ে তিষ্যর ওপর চোখ পড়ল দু জনের।

—ও, তুমি সেই সাকেত কুমার না? বন্ধুল বলে উঠলেন, কদিন ধরেই আমার অতিথি গৃহে এসে রয়েছ?

—হ্যাঁ আচার্য।

—আমার অস্তেবাসী হতে চাও?

—সে রূপই ইচ্ছা।

—তক্ষশিলায় শিক্ষা।

—হ্যাঁ

—কার কাছে ধনুর্বেদ শিখেছ?

—আচার্য সুধন্বা।

—তবে তো ভালো আচার্যই পেয়েছো! তরবারি, ভল্ল, মুষলের ব্যবহার জানো? রথ এবং অশ্ব থেকে যুদ্ধ চালনার কৌশল শিখেছ?

—অস্ত্রগুলির ব্যবহার ভালোই জানি। কিন্তু রথযুদ্ধ, অশ্ব বা হস্তীর পৃষ্ঠে যুদ্ধ ভালো আয়ত্ত হয়নি। তক্ষশিলায় অভ্যাসের সুযোগ ছিল না, আচার্য।

—আমি এখনও তোমার আচার্য হইনি কুমার। স্তুতিবাদে আমি সুখী হই না।

তিষ্যর মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছিল। সে স্বভাবে অহঙ্কারী, নত হওয়া তার স্বভাব নয়, কাযোদ্ধারের জন্য স্তুতিবাদের তো কথাই নেই। সে বলল— তাহলে অনুমতি দিন, আমি ফিরে যাই।

—সে কী? ক্রোধ হল নাকি? হা হা করে হাসলেন বন্ধুল। রাজার দিকে ফিরে বললেন— এই হল যথার্থ ক্ষত্রিয়, বুঝলেন? নীচ আচরণ তো করবেই না, নীচ আচরণের অভিযোগ সহ্য করবে না। আপনার সভায় এই জাতীয় ক্ষত্রিয় ক’জন আছে, মহারাজ?

তিষ্যর দিকে ফিরে এবার বন্ধুল বললেন—ইনি কোশলরাজ প্রসেনজিৎ। অভিবাদন করো আয়ুষ্মান।

তিষ্য রক্ষীদের সঙ্গে ঢুকে আগেই দুজনকে অভিবাদন করেছিল। কিন্তু এঁরা গল্পে মত্ত ছিলেন, লক্ষ্য করেননি। সে আগে কোশলরাজকে, পরে বন্ধুলকে অভিবাদন করল। কিন্তু শুষ্ক অভিবাদন। মুখের ক্রুদ্ধভাব তখনও রয়ে গেছে।

পরে বন্ধুল তাকে বলেছিলেন— তিষ্য তুমি দুর্বিনীত না হলেও, তেমন বিনয়ীও নও! তিষ্য চুপ করেছিল।

হঠাৎ হেসে উঠে বন্ধুল বলেছিলেন, শুধু এই কারণেই সেদিন তোমায় অস্তেবাসী বলে গ্রহণ করলাম। বিনয়-টিনয় আমি ভালোবাসি না। অহঙ্কার। অহঙ্কার থেকেই আসে আত্মশক্তি। আত্মশক্তি না থাকলে তুমি কীভাবে মানুষকে পরিচালনা করবে। মানুষ তো আর অজপাল নয়?

—কিন্তু আচার্য। আমি তো দেখি মানুষ অজপালই।

—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ— বন্ধুলের অট্টহাসিতে বুঝি মল্লক্ষেত্র ফেটে যাবে। কিছুক্ষণ পর তিনি আত্মসংবরণ করে বললেন— ভালো। এই হল প্রথম অহঙ্কার। আর সব অজপাল, আমি একা স্বতন্ত্র। সিংহ। কী বলো?

—সিংহ না হলেও, অন্ততপক্ষে অজ নই!

—শোনো তিষ্য, ক্রমে দেখবে অজ হলেও মানুষ কিন্তু পুরোপুরি অজও নয় আবার। কখন কোথায় হঠাৎ ফুলিঙ্গ উত্থিত হবে, দেখা দেবে শ্বদন্ত, অজপাল হয়ে যাবে বৃকপাল তা তুমি জানো না। তাই দ্বিতীয় অহঙ্কার হল— অন্যরা অজই হোক, বৃকই হোক, আমিই প্রকৃত মানুষ। পশুগুলির প্রাণ আছে, কিছু সংস্কার আছে, কিন্তু আমার বুদ্ধি আছে। বুদ্ধিই আমার শৌর্য, বুদ্ধিই আমার অস্ত্রজ্ঞানকে প্রকৃত শক্তি যোগায়।

তিষ্য নীরবে শুনছিল।

—কিছু বলবে না?

—না, আচার্য, শুনছি।

বন্ধুল মৃদুস্বরে বললেন— এর ওপরেও তৃতীয় অহঙ্কার আছে এক। কী বলো তো? ভেবে-চিন্তে তিষ্য বলল—জানি না আচার্য।

—জানবে না। কেন না তোমার এখনও সে অহঙ্কার আসেনি তিষ্য। তৃতীয় অহঙ্কার হল— চতুর্দিকে মানুষ। বুদ্ধিবল সম্পন্ন, বীর্যবল সম্পন্ন, যোগ্য, কর্মক্ষম মানুষ। কিন্তু যতই বুদ্ধিমান, যতই বীর, যতই যোগ্য হোক, আমি যোগ্যতম। “তর” নয়, “তম”। এই “তম”’তা যদি তোমার অহংবোধে প্রবেশ করে তবেই তুমি সত্যি-সত্যি অহঙ্কারী হলে। যে অহঙ্কার দিয়ে কিছু করা যায়। পাহাড় চূর্ণ করা যায়, যেমন ইন্দ্র করেছিলেন, নদীর স্রোত ভিন্নমুখী করা যায়, যেমন করেন ভগীরথ, লোকপাল রাজা হওয়া যায় যেমন আজও প্রকৃতপক্ষে কেউ হয়নি, শুধু আমাদের কল্পনাতেই আছে…

—কিন্তু আচার্য, আমরা শিখেছি বিনয়ই প্রকৃত গুণ।

আবার হাসছেন বন্ধুল।

—বিনয় না থাকলে বিদ্যা মিথ্যা, কেমন? আচার্য সংকৃতি, আচার্য সুধন্বা এইসব শিখিয়েছেন তো? তিষ্য জেনো, বিনয় হল একটি নীতি, দণ্ডনীতির সূক্ষ্মতম তত্ত্ব। ভালো করে ভেবে দেখো আমাদের লক্ষ্য কী? কিছু প্রাপ্তি, কিছু সম্পাদন করতে পারা। বীর্য দিয়ে নয়, আস্ফালন দিয়ে নয়, স্পর্ধা দিয়ে নয়, বিনয় দিয়েই তা অনেক সময়ে সবচেয়ে সহজে হয়। হয় না?

গায়ে মাটি মেখে অনায়াসে তাকে মাথার ওপর দুপাক ঘুরিয়ে মল্ল ক্ষেত্রে ফেলে দিয়েছেন বন্ধুল। বলছেন— এই দৈহিক বল, এই মল্লবিদ্যার কূটকৌশল আদ্যোপান্ত জানা— এর থেকে তোমার মুখভাবে গর্ব, দীপ্তি, ফুল্লতা আসবে, তাকে বিনয়ের আবরণে ঢেকে প্রতিপক্ষের কাছে যেতে হবে। পুরাকালে নিয়ম ছিল স্পর্ধা করে প্রতিপক্ষকে রাগিয়ে দেওয়া, এখন নিয়ম সূক্ষ্মতর হয়ে গেছে, এখন বিনয় প্রকাশ করে প্রতিপক্ষকে প্রতারিত করতে হয়।

সরোবরে স্নান করছেন দুজনে। সর্বশ্বেত বসন পরে ফুলের মালা ধারণ করে, শ্বেতচন্দনে সেজে অন্তঃপুরে ঢুকতে ঢুকতে হেঁকে বলছেন বন্ধুল— মল্লিকা, মল্লিকা তিষ্যকে ভালো করে ষণ্ডমাংস খাওয়াও, সঙ্গে যবের পুরোডাশ। বলবীর্য না বাড়লে তিষ্য কী করে বীরশ্রেষ্ঠ হবে! সামান্য বন্ধুলের সঙ্গেই পারছে না।

—সামান্য বন্ধুল! বলছেন কী আচার্য! একটু আগেই যে বিনয়ের নিন্দা করছিলেন!

—করছিলাম বুঝি? কী বলেছিলাম বলো তো!

—বলছিলেন বিনয় প্রকৃতপক্ষে প্রবঞ্চনা, ছল। বিনয় একটা নীতি যাকে অবলম্বন করে লক্ষ্যে পৌঁছনো যায়।

—বলেছিলাম?— বন্ধুল ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে সকৌতুকে তাকালেন। তারপর মুখ নিচু করে হঠাৎ ভীষণ মনোযোগ দিয়ে খেতে লাগলেন।

তিষ্যর খাওয়ার গতি শ্লথ হয়ে গেছে। তার ভেতরে চিন্তা ঢুকেছে। একটু পরে তার মনে হল— বন্ধুল নিজেকে সামান্য বলে তাকে আরও তাতিয়ে দিতে চাইছেন। আর কিছুই না। নীতিই বটে। কতো কাজে লাগে?

তাম্রকের পিঠে চড়ে ছোট্ট রাঙাগৃহ নগরটির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত শুধু ঘুরে বেড়ায় তিষ্য। যেন তার কোনও কাজ নেই। কখনও চলে যায় হাটে, কখন আপণশ্রেণীর পথে। সে যায় না নির্জন গিরিশৃঙ্গে, কি কাননগুলিতে। বেলুবনের কথা, ইসিগিলির কথাও যেন সে ভুলে গেছে। সে নিবিষ্ট হয়ে লক্ষ্য করে জনযাত্রা। একান্ত মনোযোগে শোনে মানুষের কথা। আপণে, হাটে, সুরাগৃহে, পথে। সবাই দারুণ ব্যস্ত। কে কয়েক কাহনের শাক ও পর্ণ কিংবা গুড় বা চাল কিনবে, মূল্য ঠিক করতে বিবাদ লেগে যাচ্ছে। ওই কয়েক কাহনের ওপর যেন ক্রেতা-বিক্রেতার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। এক দল রমণী চলে গেল পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, অতি সামান্য কথা, কিন্তু এমন ডুবে আছে সেই কথার ভেতরে যেন ওইখানেই জীবনের পরমার্থ পেয়েছে। ঘোড়া কিংবা রথে চড়ে চলে গেল কেউ, হয়ত যাচ্ছে গণিকাগৃহে, কি শৌণ্ডিকগৃহে, কি হয়ত রাজসভায় উপস্থিত হতে, ওই গন্তব্যটুকুই যেন শেষ লক্ষ্য। তিষ্যর মনে হয় এরা সব ঘুমিয়ে রয়েছে। সাকেতেও এ কথা মনে হত। শ্রাবস্তীতেও। কিন্তু ঠিক কী মনে হচ্ছে সে বুঝতে পারতো না। এতদিন পরে রাজগৃহের জনপথে এসে সে নিজের অনুভূতি যথাযথ বিশ্লেষণ করতে পারল। অভ্যস্ত কাজকর্ম প্রতিদিন করে যাওয়া, অভ্যস্ত চিন্তায় কাল কাটানো, অভ্যস্ত সামাজিক আচরণের চতুঃসীমার মধ্যে নিরন্তর ঘোরাফেরা করা তো নিদ্রাই! কালনিদ্রা! এইসব নগরীর বাইরের সৌন্দর্য আর ভেতরের অন্তঃসারশূন্যতা সে যেন পাশাপাশি দেখতে পায়। একেক সময়ে দুঃসহ লাগে তার। গলায় মালা পরে, নির্বোধের মতো হাসতে হাসতে যে লোকগুলি সন্ধ্যার পর পথে পথে ভিড় করে তাদের ঝাঁকিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার। মনে হয় বলে— অ হে, মাগধ কী করছো? করছো কী? এইভাবেই চালিয়ে যাবে নাকি? এই ভাবেই কাল কাটাবে?

দাঁত-বার-করে-হাসতে-থাকা মূঢ় নাগরিকগুলিকে ঝাঁকাবার পরিবর্তে সে নিজেকেই ঝাঁকিয়ে নেয় অবশ্য। ভাবে, তবে কি এতদিনে সে বন্ধুল-বর্ণিত দ্বিতীয় অহঙ্কারের পর্যায়ে পৌঁছল? এই মানুষগুলি মানুষ নয়, পশুমাত্র, সে একাই মানুষ? এই উপলব্ধি হচ্ছে না কি তার? না কি এ পর্যায়ও পার হয়ে সে তৃতীয় অহঙ্কারে পৌছে গেল? চূড়ান্ত অহঙ্কারে? না। চূড়ান্ত নয় বোধহয়। কেন না কোথায় সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যের রূপরেখা? কোথায়ই বা সেই দৃঢ়তা তার প্রত্যয়ে? সে তো এখনও পথই খুঁজে যাচ্ছে! পথই খুঁজে যাচ্ছে!

এইভাবে, চূড়ান্ত একাকিত্বের এক স্বরচিত বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে, কখনও ক্রুদ্ধ, কখন হতাশ, কখনও বিমর্ষ হতে হতে একদিন তিষ্য রাজগৃহের পথে এমন একজনকে আবিষ্কার করল, যার সঙ্গে দেখা-হওয়ার সৌভাগ্য কোনদিন হবে, সৌভাগ্যই বলতে হবে, কেন না এ তার বহুদিনের সাধ, সে কল্পনাও করেনি।

২৪

শ্রাবস্তী আর বৈশালী প্রায় পাশাপাশি নগরী মাঝে ব্যবধান বিস্তীর্ণ গ্রামভূমির। নগরী দুটি রাজধানী। মাঝে আছে শাক্যক্ষেত্র ও মল্লক্ষেত্র। শাক্যনগরী কপিলবস্তু বা মল্লনগরী কুশিনারা এদের সঙ্গে তুলনায় আসে না। বৈশালী গণরাজাদের দেশ। কোশলের রাজধানী শ্রাবস্তীতে একজনই রাজা। শ্রাবস্তী কোশলের রাজধানী। দুটি নগরই ধনে-জনে পরিপূর্ণ। দুটিই শ্রমণদের প্রিয়। নিজেদের মত প্রচারের জন্য শ্রোতা মেলে প্রচুর। ভিক্ষার অভাব নেই। অনেক ধনীর বাস। সুতরাং পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ভাবনা করতে হয় না। বৈশালীর একটি গর্ব আম্রপালী। সৌন্দর্যে, নৃত্য-গীতে অতুলনীয়। বৈশালীর দ্বিতীয় গর্ব নির্গ্রন্থ নাথপুত্র বা নিগ্‌গণ্ঠ নাথপুত্ত। কুন্দগ্রামের জাতক, সম্ভ্রান্ত বংশে জন্ম। বিবাহও করেছিলেন। কিন্তু ত্রিশ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন। গৃহস্থ-জীবনের নাম ছিল বর্ধমান। এখন তিনি বিবসন শ্ৰমণ। তাঁর শিষ্যরা তাঁকে জিন অর্থাৎ মুক্তপুরুষ বলে জানে। নির্গ্রন্থদের সঙ্গে আজীবকদের এক সময়ে যথেষ্ট সখ্য ছিল। কেন না নির্গ্রন্থদের গুরু বর্ধমান আজীবকদের গুরু মক্‌খলি গোসালের দিগম্বর-ব্রত গ্রহণ করেন। বর্ধমানের আগে পার্শ্বমুনির সম্প্রদায় একবস্ত্র কিম্বা তিনবস্ত্র পরতেন। বর্ধমান বা নাতপুত্তর সময় থেকে এঁরা নির্বস্ত্র হলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মক্‌খলি গোসলের সঙ্গে নাতপুত্তর তুমুল বিবাদ লাগল। উভয়েই মানতেন মানুষের জন্ম হল চুরাশি লক্ষ বার। কিন্তু মক্‌খলি গোসল আরও মানতেন নিয়তিবাদ। অর্থাৎ সর্ব জীব নিয়তি সঙ্গতি বা পরিস্থিতি ও স্বভাবের বশে নানা পরিণতি প্রাপ্ত হয়। বল নেই, বীর্য নেই, পুরুষ শক্তি নেই! বুদ্ধিমান, মূর্খ, সকলেই চুরাশি লক্ষ মহাকল্পের চক্রের মধ্য দিয়ে যাবার পর দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে। গোসলের এই মত নাথপুত্ত মানতে পারলেন না। তাঁর মত তপস্যা ও চতু্র্যাম পালন করলে বিগত সব জন্মের পাপ ক্ষয় হয়ে এক জন্মেই কৈবল্য লাভ করা সম্ভব। নাতপুত্তের মতবাদ লোকের ভালো লাগল। যদিও তিনি কঠোর তপশর্যা করতে বলছেন, তবু তো কৈবল্যলাভের আশ্বাস দিচ্ছেন! পাপক্ষয়ের আশ্বাস দিচ্ছেন। মক্‌খালি গোসালের মত মানতে গেলে পাপ-পুণ্য শুদ্ধি-অশুদ্ধি বলে কিছু থাকে না। কর্মের কোনও অর্থ থাকে না। চেষ্টার কোনও মূল্যও থাকে না। এক গভীর হতাশা এবং আলস্য এসে ছেয়ে ফেলে অস্তিত্ব। সুতরাং নাতপুত্তর শিষ্য-সংখ্যা দিন দিন তো বাড়ছিলই। গৃহী শিষ্যও তাঁর মধ্যদেশের নগরগুলিতে প্রচুর।

এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য শ্রাবস্তীর মিগার শ্রেষ্ঠী। এবার বৈশালী থেকে তাঁর শ্রাবস্তী যাবার প্রধান কারণ মিগারের গৃহে উৎসব। সে পুত্রের বিবাহ দিয়েছে। পুত্রবধূকে গুরুর কাছে উপস্থিত করতে চায়। গুরুর আশীর্বাদ ভিন্ন তাকে পুরোপুরি গৃহধর্মে গ্রহণ করতে পারছে না। অনেক দিন ধরেই বলছে। কিন্তু নাতপুত্ত ব্যস্ত ছিলেন। বর্ষাবাস করেছেন বৈশালীতে। সে সময়ে তিনি বা তাঁর সম্প্রদায়ের কেউই ভ্রমণ করেন না, বহু প্রকার কীট অনুকীট গুল্ম ইত্যাদি জন্মায়। চলতে চলতে তাদের পদদলিত করবার সম্ভাবনা। শ্রাবস্তীতেও তাঁর সম্প্রদায়ের শ্রমণরা রয়েছেন। তাঁদের দিয়েও কাজ চালিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু মিগার সে-কথা শুনবে না। অগত্যা কার্তিকী পূর্ণিমার পর যাত্রা করে নাতপুত্ত এসে পৌঁছেছেন শ্রাবস্তীতে।

মিগারের গৃহ আজ বিশেষ সাজে সজ্জিত। কাননের মধ্যে শ্বেত চন্দ্রাতপ খাটিয়ে সশিষ্য গুরুর বসবার জন্য মনোরম পরিবেশ রচনা করেছেন মিগার। গৃহে রান্না হচ্ছে নানা প্রকার সুখাদ্য। ভিক্ষার সময়ে কেউ মৎস্য মাংস দিলে নাতপুত্ত আপত্তি করেন না। কিন্তু তাঁরই জন্য মারা হয়েছে। এমন পশু-পাখির মাংস তিনি গ্রহণ করেন না। সুতরাং আজ নানা প্রকার শাক, অন্ন, পায়স, মোদক প্রভৃতির ব্যবস্থা হয়েছে।

বিশাখার আজ মনে অকস্মাৎ যেন মুক্তির বাতাস লেগেছে। উৎসবের আনন্দ, তার ওপর সে উৎসব কিছু সাধু ব্যক্তিকে ঘিরে। এতে সে তার পিতৃগৃহের, বিশেষত ভদ্দিয়র স্মৃতি ফিরে পায়। মিগার-গৃহে সবসময়ে শুধু ধন সংগ্রহ এবং সঞ্চয় নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকে। এঁরা যথেষ্ট ধনী হওয়া সত্ত্বেও এখনও ধনপ্রাপ্তিতে এমনভাবে উল্লসিত হন যে বিশাখার মার্জিত রুচিতে বড় আঘাত লাগে। তার পিতা ধনঞ্জয়ও তো ছিলেন ধনবান শ্ৰেষ্ঠী। কিন্তু নিজের কর্মগৃহের বাইরে বেরোবার পর ধনঞ্জয় আর ধনপ্রসঙ্গ তুলতেন না। বিশাখাও যখন তাঁর কাছে কাজকর্ম শিখত তখন এবং সেখানেই ধনপ্রসঙ্গ শেষ করে দিয়ে আসত। ধনঞ্জয় বলতেন— ‘ধন সংগ্রহ করি আমার পরিজনরা নির্ভাবনায় নিজের নিজের প্রকৃতিদত্ত গুণাবলীর চর্চা করতে পারবে বলে। আমার বৃত্তি অল্প ধন নিয়োগ করে অধিক ধন অর্জন করা। আমি এ নিয়ে ব্যাপৃত থাকলেও থাকতে পারি। কিন্তু আমার পরিজনরাও সেইভাবে ভাবিত হবে এ আমি চাই না।’

কিন্তু মিগারগৃহে উঠতে বসতে খালি ধনেরই কথা। দ্বিপ্রহরে মিগার ভোজনে বসলে তাঁর পত্নী প্রতিদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন— ‘আজ কতো উপার্জন হল?’ মিগার পরম পরিতোষ সহকারে একটি সংখ্যা বলবেন। ততোধিক পরিতোষের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী বলবেন ‘তাম্ৰ কহাপন? না স্বর্ণ কহাপন? ঠিকঠাক বললা!’ উত্তর শুনে বিমর্ষ মুখে বলবেন—‘এর চার ভাগের তিন ভাগই তো চলে যাবে পরিজন প্রতিপালন করতে। কী-ই বা লাভ উপার্জন করে!’

এঁরা বড় কৃপণও। উৎসবে ছাড়া শালিধানের চাল খান না। ভূতক ও দাসদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করা আছে। নিজেদের খাদ্যের মানও যে তার চেয়ে উৎকৃষ্ট তা বলা যায় না। মিগার-পত্নী বিরাট ভাণ্ডারের প্রতিটি বস্তুর সংবাদ নেন প্রতিদিন। যে দাসীরা ভাণ্ডারের দায়িত্বে আছে তারা তিতিবিরক্ত হয়ে যায়। প্রায়ই তাদের চোর অপবাদ শুনতে হয়। ভৃতি দেন যথাসম্ভব অল্প। কর্মান্ত গ্রাম থেকে সরল লোকগুলিকে আনান, ভূতের মতো খাটান, তারপর তাদের যেই একটু বুদ্ধি হয়, অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকে অমনি তাড়িয়ে দেন। মিগার-পত্নী সারা দিন এ ঘর ও ঘর, এ আঙিনা সে আঙিনায় ঘুরে বেড়ান আর আতঙ্কিত মুখে বলেন— ‘এইভাবে ব্যয় হতে থাকলে। তো আমরা কিছুকালের মধ্যেই গজ-ভুক্ত কপিত্থের মতো হয়ে যাবো! সবগুলি রাক্ষস। রাক্ষস। রক্ত চুষে খাচ্ছে।’

কাদের কথা তিনি বলতে চাইছেন পরিষ্কার ভাবে না বললেও বিশাখার এবং তার অন্তরঙ্গদের এতে অপমান বোধ হয়। এ গৃহের দাস-দাসীরা অবশ্য প্রভু-পত্নীব কথা শুনে হাসাহাসি করে। কুলোয় করে চাল ঝাড়ছে দাসীরা। অদূরে প্রভু-পত্নীকে দেখা গেলেই এ ওকে ঠেলবে, বলবে ‘আক্ষস, আক্ষস! অক্তগুলি সব চুষে খেয়ে নিলে রে!’

দাসেরা হয়ত গো দোহন করছে। বড় বড় পাত্রে সফেন দুধ পড়ছে। ভরে যাচ্ছে একটার পর একটা পাত্র। মিগার পত্নী এসে দাঁড়াবেন, কটিতে দু হাত রেখে বলবেন ‘বিসাখা, বিসাখা, দেখে যাও।’

সুন্দর ভোর বেলাটি। বিশাখার স্নান প্রসাধন সারা। সে গো দোহনের সময়ে উপস্থিত থাকে। সে কাছে আসলে শ্বশ্রূ বলবেন— ‘বলেছিলাম কি না!’

কী বলেছিলেন, মা!

গোচরেই এরা কিছুটা করে দুধ দুয়ে নেয়। দেখছ না ভাঁড়গুলি সব পুন্‌ন হয় নি।

দাসেরা সবই শুনতে পাচ্ছে। এদের মধ্যে বিসাখার সাকেতের দাসরাও আছে। বিসাখা লজ্জিত, অপ্রতিভ বোধ করে। মৃদু স্বরে বলে— ও সব আপনার ভ্রম মা! ভাঁড়গুলি পূর্ণ হলে তো দুধ উপছে পড়বে! নষ্ট হবে!

সে আর দাঁড়ায় না। তাড়াতাড়ি অন্য দিকে চলে যায়। সাকেতের দাসগুলির মুখ গম্ভীর। কিন্তু শ্রাবস্তীর দাসেরা বিশাখা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গোলমাল আরম্ভ করে দেয়। প্রভু-পত্নীর সঙ্গে যথেচ্ছ কৌতুক করে। একজন বলবে— আপনি জানতেন না মা! আমরা তো গাভীর বাঁটে মুখ লাগিয়ে চোঁ চোঁ করে খানিকটা দুধ খেয়ে নিই আগে। নিজের উদর না ভরলে কি আর পরের উদর ভরানোর কাজে মন লাগে মা?

প্রথমটা তাদের কৌতুক বুঝতে পারেন না মিগার গৃহিণী। তর্জন করে বলেন—‘কী? স্বীকার করলে তো! তা হলে তোমাদের প্রভুকে বলি! বলি।’ দাঁত বার করে আরেক জন বলে শুধু দুধ নাকি! এই গৃহের যেখানে যা ভোজ্য আছে সবই আমরা চুরি করে করে খাই। আমরা সব আপনার গৃহপালিত মার্জার যে! বিলার সব বিলার।’

এইবারে কৌতুকের ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাদের প্রভু-পত্নী ক্রুদ্ধ হয়ে সেখান থেকে চলে যান।

পরে সাকেতের দাসেরা এসে বিশাখার কাছে অভিযোগ করলে, সে বলে শ্বশ্রূ-মা আমার পূজনীয়। তাঁর নিন্দা শুনতে আমার ভালো লাগে না, তোমরা যদি মুক্তি চাও আমি তোমাদের মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি। তোমরা অন্য কোনও স্বামীর গৃহে মনোমত কাজ খুঁজে নাও।

কেউ কেউ এতে সাগ্রহে সম্মত হয়ে যায়। অন্যরা যেতে চায় না। কয়েকটি দাসকে এভাবে মুক্ত করে দেবার পর, মিগার-পত্নীর কানে আসে কথাটা। তিনি বলেন— “তুমি কী প্রকার সুহ্না বিসাখা, আমার অনুমতি না নিয়ে দাসগুলিকে মুক্তি দিলে?

বিশাখা বলে— ‘ওরা উদ্বৃত্ত হয়ে যাচ্ছিল। ওদের অন্নসংস্থান করতেও তো সেট্‌ঠি বাড়ির ধনক্ষয় হয় মা! অনর্থক!’

খানিকটা হৃষ্ট হয়ে মিগার-পত্নী বলেন— ‘কথাটা সত্যি। কিন্তু আমার অনুমতি নেওয়া কি তোমার উচিত ছিল না!

বিশাখা বলে— “ওদের আমি যৌতুক পেয়েছি পিতার কাছ থেকে। ভেবেছিলাম আমিই ওদের প্রথম কর্ত্রী। যৌতুকের দাসগুলিকে অন্নক্ষয়ের ভয়ে মুক্তি দিতে হচ্ছে ভেবে যদি আপনি অপ্রতিভ হন— তাই আর বলি নি।

বিশাখার কূট চালে মিগার-গৃহিণী দোলাচল। হৃষ্ট হবেন না রুষ্ট হবেন ভেবে পান না। বলেন— ‘মুক্তি না দিয়ে বিক্রয় করে দিলে ভালো মূল্য পাওয়া যেত।’

বিশাখা এবার ক্লান্ত কণ্ঠে বলে— ‘উদ্বৃত্ত মা, শ্রাবস্তীতে প্রতি গৃহে দাস প্রয়োজনের তুলনায় বড়ই অধিক হয়ে গেছে মা! কে-ই বা কিনবে?

আজ সেই কৃপণ গৃহের বাতাবরণ প্রফুল্ল, প্রসন্ন। পায়সের সুগন্ধে গৃহের রন্ধনশালার কাছাকাছি স্থানগুলি আমোদিত হয়ে রয়েছে। অন্যান্য পদ পাচকরা রাঁধলেও পরমান্ন বিশাখা নিজের হাতেই প্রস্তুত করছে। ধনপালী ও ময়ূরী তার নির্দেশে কাঠের দর্বী দিয়ে বিশাল কড়াইয়ে উৎকৃষ্ট দুধ ঘন করছে। কহ্না এলাচ ও অন্যান্য সুগন্ধি চূর্ণ করছে। মাপমতো উৎকৃষ্ট চাল, অত্যুকৃষ্ট ঘিয়ে ভেজেছে বিশাখা। চতুর্দিকে তার পবিত্র গন্ধ।

দীর্ঘ অলিন্দে সব স্থূল ফুলের মালা ঝুলছে। ধূপ। বড় বড় পাত্রে আরও নানা সুগন্ধি চূর্ণ ধারে ধীরে পুড়ছে।

সাধুরা সব এসে গেছেন। চন্দ্রাতপের তলায় উচ্চাসনে বসে নানা প্রকার তত্ত্বালোচনা করছেন। মিগার-পত্নী সহ অন্য কুলস্ত্রীরা অদূরে বসে শুনছেন। মিগারও যাতায়াত করছেন। তাঁর নির্দেশ সুহ্না রন্ধনশালার কাজ সেরে স্নান ও প্রসাধন করে প্রস্তুত হোক। ইতিমধ্যে নিগ্‌গণ্ঠরা ভোজন করে পরিতৃপ্ত হোন, তারপর নাতপুত্ত ধর্মদেশনা আরম্ভ করবেন। সেই সময়ে সুহ্না যাবে, গুরুবন্দনা করবে। পুত্র ও পুত্রবধূকে একত্রে উপস্থিত করলেই ভালো হত। কিন্তু পুত্রের সহসা কর্মে মতি হয়েছে। সে প্রথমে শ্রাবস্তীর উপকণ্ঠে তাঁর কমান্ত গ্রামে যায়। সেখানে কিছুদিন কাজ-কর্ম দেখাশোনার পর পিতাকে বলে পাঠায় সে বারাণসী যাচ্ছে। অতঃপর বারাণসী থেকে মূল্যবান বস্ত্র ও গজদন্তের দ্রব্য নিয়ে সে নাকি কৌশাম্বীর দিকে যাত্রা করেছে। ভালো। মিগার অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়েছে। এই সুহ্নাটি গৃহে আসায় তাঁর গৃহে যে-সব শুভ লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তাদের মধ্যে এইটিই শুভতম। গৃহিণী ও সুখী। নববিবাহের পর বিশাখার মতো রূপবতী গুণবতী ভার্যার সঙ্গে অধিক দিন বসবাস করলে পুত্রটি হয়তো তার বশীভূত হয়ে যেত। সে আশঙ্কা থেকে আপাতত তিনি মুক্ত। বিশাখাকেও ঠিক বিরহক্লিষ্ট দেখায় না। প্রোষিতভর্তৃকার মতো আচরণও সে করে না। পতি-পত্নীতে নিভৃতে আলোচনা করেন, সুহ্নাটি কিছুটা বালিকা স্বভাব। এখনও পতি কী বুঝতে শেখে নি। খেলাধুলো, গৃহকর্ম, স্নান প্রসাধন, সখীদের সঙ্গে শ্রাবস্তীর ঘরে ঘরে নিমন্ত্রণ রক্ষা, সুপ্রিয়া ইত্যাদি সখীদের সঙ্গে কোনও কাননে গিয়ে আমোদ-প্রমোদ, এইসবেই মন।

শুভ্র কাসিক রেশম পরে, গন্ধমাল্যে সুসজ্জিত হয়ে বিশাখা আসছে, সঙ্গে তার প্রিয় সখীরা। অলিন্দ পার হল, নববধূর মতো সলজ্জ পদক্ষেপে। মুখ নিচু। কাননে আসতে মিগার সাদরে তাকে নিয়ে গেলেন নাতপুত্তর কাছে। বসেছিলেন গুরুদেব। আশীর্বাদ করবেন বলে দুই হাত প্রসারিত করে উঠে দাঁড়ালেন। বিশাখা পলাশবর্ণ হয়ে এক ঝটকায় মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছে। —‘এ আমাকে কার কাছে আনলেন, পিতা! শুনেছিলাম সাধু।’ তার কণ্ঠস্বরে ক্রোধ গোপন নেই।

সভাশুদ্ধ সবাই হতচকিত। মিগার ব্যস্ত হয়ে বললেন— ইনিই তো সেই সাধু পুরুষ। নিগ্‌গণ্ঠ নাতপুত্ত। ইনি জিন। বারো বছরের কঠোর তপস্যায় সর্ববিধ ইন্দ্রিয় জয় করেছে।

—ইনি অশালীন, অসভ্য। ধিক্, ধিক্‌ আপনাদের। এই নির্বসন উন্মাদের কাছে আমায় আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে নিয়ে এসেছেন? —বিশাখা তার তিন সখীকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সভা-ত্যাগ করল। মিগারের বাড়িতে দাঁড়াল না পর্যন্ত। সোজা চলে গেল নিজের গৃহে।

নাতপুত্তর সমবেত শিষ্যরা কোলাহল করে উঠল। — কী দুঃসহ স্পর্ধা বালিকার! যথোচিত শাস্তি হওয়া উচিত এর।

যারা নাতপুত্তর দেশনা শুনতে সমবেত হয়েছিল, সেই সব পুরস্ত্রীরা, দাস-দাসীরা ভয়ে চুপ। তার মধ্যে দিয়ে নাতপুত্তর ভীষণ কণ্ঠ শোনা গেল— ‘অলক্ষণা ওই সুহ্নাকে এক্ষুণি ত্যাগ করো মিগার। এই মুহূর্তে। নইলে তোমার গৃহে অকল্যাণ নেমে আসবে।’ তিনি মঞ্চ থেকে নেমে শিষ্য সমেত তক্ষুনি চলে গেলেন। যাবার সময় পাশেই যে নিগ্‌গণ্ঠটি ছিল তাকে মৃদুস্বরে বললেন— ‘এ নির্ঘাৎ সেই পাপাত্মা সমনটার শিষ্য। রাজগহেও আমাদের সম্প্রদায় থেকে এমন ভাঙিয়ে নিয়েছে, এখানেও নিচ্ছে। দেখো মিগার যেন একে অবিলম্বে ত্যাগ করে।’

মিগার হতবাক। তিনদিন ধরে উৎসব হবার কথা। সেই মতো আয়োজন হয়েছে। শ্রাবস্তীতে নাতপুত্তর অনেক শিষ্য। তাঁদের অনেকেই দেশনা শুনতে এসেছেন। এখন সব মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে করতে চলে যাচ্ছেন। গৃহের মধ্যে বিশৃঙ্খলা। বিশাখা বা তার সখীদের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মিগার নিজের কক্ষে গিয়ে পত্নীকে বললেন— সুহ্নাটাকে ডেকে নিয়ে এসো।

গৃহিণী বললেন— ‘যা বলবে ভেবে বলো। তিনি বিশাখাকে ডাকতে পাঠিয়ে চলে গেলেন। কী কাণ্ড! এই জটিল সমস্যার ভেতরে তিনি মোটেই থাকবেন না। মিগার বুঝুন এখন।

বিশাখা এসে দাঁড়িয়েছে। মিগার বললেন— ‘তুমি নগ্ন সন্ন্যাসী, তীর্থিক, আজীবক এদের আগে দেখো নি?

—না।

—তোমার পিতা এঁদের নিমন্ত্রণ আপ্যায়ন করতেন না?

—না।

—তাহলে কি তোমরা শুধু বেদপন্থীদেরই পূজা করো, সাকেতে?

—আমাদের পুরোহিত আচার্য ক্ষত্রপাণি আছেন। গৃহের যাবতীয় পূজা হোম ইত্যাদি তিনিই করেন।

—যাগ-যজ্ঞ করেন না কি তোমার পিতা?

—না। তবে অগ্নিগৃহ আছে। গৃহ্য কর্মগুলি হয়। যেমন আমার বিবাহই তো হল। কিন্তু শ্ৰৌত যাগ আমার পিতামহই বন্ধ করে দিয়েছেন।

—তবে? এই তো তাঁরা বৈদিক ক্রিয়া-কাণ্ডের অসারতা বুঝতে পেরেছেন। আমরাও তোমার পিতা-পিতামহের মতো বিবাহ, বাস্তু প্রতিষ্ঠা, উপনয়ন, ইত্যাদি গৃহ্য ব্যাপারে বেদপন্থী। কিন্তু পূর্ণিমা অমাবস্যায় যাগ, সোমবাগ এ সব জটিল ব্যাপারে আর লিপ্ত থাকি না। আমরা শ্ৰমণ পথই শ্রেষ্ঠ পথ মনে করি। তোমার পিতা-পিতামহ এঁরা কাকে বিশ্বাস করেন?

বিশাখা ধীরে ধীরে বলল— তথাগত বুদ্ধকে।

—‘কিন্তু কল্যাণি। এই যে নিগ্‌গণ্ঠ ইনি এমন তপঃ করেছিলেন যে এঁকে লোকে মহাবীর বলে। ইনি জিন। একজন সমনকে পিতৃগৃহে বন্দনা করতে বলে, আরেকজন সমনকে শ্বশুর-গৃহে এসে অশ্রদ্ধা দেখাবে, এ কেমন শিক্ষা তোমার?

বিশাখা বলল—পিতা আমি দুঃখিত। কিন্তু সমনরা যে যতবড় জিনই হোন না কেন যখন লোকশিক্ষার্থে সমাজে বাস করছেন, তখন সমাজের ন্যূনতম নিয়ম তাঁদের মেনে চলতেই হবে। অরণ্যে, পাহাড়ে, কন্দরে থাকেন সে স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু এতো লোকের সামনে, বিশেষত নারী, তরুণী নারীদের সামনে বিবসন হয়ে ধর্মোপদেশ দিতে এসেছেন? এঁদের লজ্জা হওয়া উচিত।

—এঁরা লজ্জা জয় করেছেন বিসাখা।

—এঁরা জয় করে থাকতে পারেন, কিন্তু শ্রোতারা, দর্শকরা, নারীরা, তরুণ তরুণী বালক-বালিকাগুলি? তারাও কি লজ্জা জয় করেছে? কিম্বা পিতা, হঠাৎ যদি তারা বলে আমরাও নাতপুত্তের দেশনা শুনে লজ্জা-ত্যাগ করেছি, আর বসন পরব না, তা হলে আপনার, এই সমাজের, নগরের কী অবস্থা হবে? চিন্তা করুন। আপনি কি তা মেনে নেবেন?

—‘না, তা কী করে মেনে নেবো! বিসাখা!

—‘তা হলে? সাধু ব্যক্তিদের এমন কিছু করা উচিত নয় যা অনুসরণ করলে সমাজের লজ্জার কারণ হতে পারে। তথাগত বুদ্ধ কখনও এরূপ কিছু করেন না।’

সমন গোতম তো শুনেছি মায়াবী। মায়া দিয়ে মানুষকে বশ করে। মিথ্যা মিথ্যা বলে সে অমৃত লাভ করেছে। আজীবক তীর্থিক, নিগ্‌গণ্ঠ সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, অন্যদের শিষ্য ভাঙিয়ে নেয়।

বিশাখা বলল, পিতা, আমি বড় হবার পর আর তথাগতকে দেখিনি। বালিকা বয়সের স্মৃতি যা আছে, তাই থেকেই বলছি, তথাগত বুদ্ধকে দেখলে তাঁর ধম্ম ব্যাখ্যা শুনলে আপনি শান্তি পাবেন। তিনি এ প্রকার রুক্ষ, শুষ্ক, লজ্জাহীন সাধু নন।

বিশাখা চলে গেলেন মিগার ভাবতে লাগলেন। গুরু বলেছেন বধূটি দুর্লক্ষণা, অকল্যাণী। অথচ চার মাস কালের কিছু অধিক সে তাঁর গৃহে এসেছে। সুখ-সৌভাগ্য, ধন-জন, উথলে পড়ছে। সবাই, গৃহের গোবৎস গুলি পর্যন্ত তার বশীভূত। দাসেরাও জানে বিশাখা সুভগা বধূ। মিগার-গৃহে, শ্ৰেষ্ঠী-পল্লীতে, এমন কি সারা শ্রাবস্তীতে সে সৌভাগ্য এনেছে। তাঁর অকালকুষ্মাণ্ড পুত্রটা? সেটা পর্যন্ত কাজ কর্মে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। নাতপুত্ত বললেই তো আর সে অকল্যাণী হয়ে গেল না! তাঁর ক্রুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সুশীলা শালীন, অভিজাত ঘরের কন্যা যদি নগ্নতা দেখে বিরক্ত, ক্রুদ্ধ হয় তো সত্যিই বলবার কিছু নেই।

একটু পরে যখন পত্নী এসে জিজ্ঞাসা করলেন— কী স্থির করলে? মিগার বললেন— গুরুর কথায় ধনঞ্জয় সেট্‌ঠির কন্যাকে পরিত্যাগ করে মরি আর কি? এমন বধূ আর কার ঘরে আছে? বলুন ওঁরা। বলতে দাও। আমি অন্যভাবে ওঁদের তুষ্ট করবো এখন। সুহ্নাকে পরিত্যাগ করার প্রসঙ্গ যেন তুলো না।

মিগার পত্নী বললেন— ঠিক বলেছ।

মিগার বিনীতভাবে গেলেন গুরু নাতপুত্তর কাছে। বললেন নেহাত বালিকা আমার সুহ্নাটি অতিশয় লজ্জাশীলাও। কোনদিন নগ্নতা দেখেনি সে। তাকে ক্ষমা করুন ভন্তে।

নাথপুত্ত বললেন— তবে অবশিষ্ট দু দিন তোমার গৃহে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আর আমরা যাচ্ছি না।

মিগার বললেন—আমি আপনাদের এখানেই ভোজনে আপ্যায়িত করব। কষ্ট করে আমার গৃহে যাবার প্রয়োজন নেই। আমার পরিজন সব এখানেই আসবে, তাদের আপনার উপদেশ শুনিয়ে কৃতার্থ করুন ভন্তে। তারপর আমার সুহ্নাকে আমি আপনার দেশনা শোনবার যোগ্য করে নিই। ধীরে ধীরে সে আপনাকে বুঝতে শিখবে। জিনকে বোঝা কি আর সেদিনের বালিকাটার কম্ম?

নিগ্‌গণ্ঠ নাতপুত্ত ক্রোধ জয় করেছেন। মাঝে মাঝে তাঁর প্রশান্তি ক্ষুণ্ণ হয় বটে। কিন্তু এখন তিনি আবার উদাসীন। মুখে অপ্রসন্নতার চিহ্নও নেই। একটি তিক্ত ঘটনা ঘটেছে। তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু এখন আর সেই ক্রোধ তিনি পুষে রাখতে ইচ্ছুক নন। তিনি মিগারকে অভয় দিলেন।

অতএব পরের দুদিন মিগার-গৃহ থেকে পুরাঙ্গনারা, কর্মকররা, যে যেখানে আছে সব নাতপুত্তর কাছে উপদেশ শুনতে গেল। ভারে ভারে পক্ক খাদ্যও গেল শ্ৰমণদের আপ্যায়নের জন্য। শুধু বিশাখাই তার অন্তরঙ্গ সখীদের নিয়ে নিজগৃহে রইল।

ধনপালী বলল— ঠিক করেছ ভদ্দা। ছি ছি ছি। দেখে তো আমি লজ্জায় মরি। বিশ পঁচিশ জন পুরুষ, একেবারে কি না ল্যাংটা?

কহ্না মুখ বেঁকিয়ে বলল— আহা, কী শ্রীই খুলেছিল, দু পায়ের ফাঁকে সব দীর্ঘ দীর্ঘ লিঙ্গ ঝুলছে! আমার তো হাসি পাচ্ছিল।

ময়ূরী বলল— এ প্রকার বলিস না। শত হোক সমন এঁরা। সংসার ত্যাগ করে কষ্টসাধ্য তপস্যা করেছেন সব, অমৃত পেয়েছেন। মৃত্যুর পর স্বর্গে যাবেন।

কাহ্না মুখভঙ্গি করে বলল— কোন স্বর্গে যাবে রে ওরা? আমাকে তো সেই স্বর্গে নিয়ে যেতে চাইলেও যাবো না। ইন্দ্রিয় সংযম করতে হলে বস্তরত্যাগ করে ফেলতে হবে এমন কথা তো জন্মেও শুনি নি। বুঝিও না। পথে বেরোলে কুকুর তাড়া করে না? দেখবি একদিন এঁরা দারুণ বিপদে পড়বেন। নগরে-হাটে ঘোরেন। একদিন যেখানে যত কুকুর আছে ঘিরে ফেলবে। যেটুকু মাংস শরীরে আছে ছিঁড়ে নেবে। তখন এঁরা আবার বস্তর পরবেন।

ধনপালী বলল আমি দেখছি দ্বিতলের বাতায়ন থেকে বালক বালিকাগুলি ঝুঁকে ঝুকে কী দেখছে আর হাসছে। দেবী সুপ্‌পিয়ার শিশুপুত্তুরটি তো মুখে আঙুল পুরে সেই যে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল, তাকে আর ভোজনের জন্য ঘরে আনতেই পারি না।

বিশাখা বিরক্ত হয়ে বলল— ‘তোরা স্তব্ধ হবি? উঃ, কী বকতেই না পারিস!’ সে প্রাণপণে হাসি চেপে মুখের ভাবে বিরক্তি ফুটিয়ে তুলেছে।

ময়ূরী বলল— কিন্তু, সমন বিসাখাভদ্দাকে কী ভাবে গালি দিলেন? অলক্ষণা! অকল্যাণ হবে। গহপতিকে তো বললেন একে পরিত্যাগ করো! আমার কিন্তু বুক কাঁপছিল। অভিসম্পাত তো! এঁরা রেগে গেলে কী না করতে পারেন। ইদ্ধি আছে তো!

বিশাখা এবার হেসে বলল— আমিও বহু প্রকার জানি। ইদ্ধি না হলেও জাদু জানি। তা জানিস! মায়ের কাছ থেকে পিতার কাছ থেকে তো শিখেছিলামই, আবার পিতামহ যে বিবাহের আগে এসে সাকেতেরইলেন, পিতামহর কাছ থেকেও শিখে নিয়েছি। আমাকে আঘাত করলে আমিও প্রত্যাঘাত করতে জানি।

কহ্না দুষ্টু হাসি হেসে বলল— তা হলে এমন কোনও জাদু করো না বিসাখাভদ্দা যাতে ওই সমনগুলো হঠাৎ লজ্জায় অভিভূত হয়ে যায়! ল্যাংটা থাকা ঘুচে যাবে একেবারে।

বিশাখা বলল— তার জন্য ইদ্ধি চাই। জাদুতে হবে না। তবে এ গেহ থেকে ওদের তাড়াবার জন্যে যা করার প্রয়োজন তা আমি অবশ্যই করবো।

এবং এই সংকল্পের জন্যই বিসাখার জীবনের পরবর্তী সংকট ঘনিয়ে এলো।

উৎসবের তৃতীয় দিনে গুরু এবং গুরুভাইয়ের ভোজনাদি করিয়ে মিগার ফিরে এসেছেন। বিসাখা নিজের হাতে যত্ন করে তাঁকে খেতে দিয়ে বসে বসে ব্যজন করছে। এমন সময়ে দ্বারের কাছে কাষায় চীবর পরিহিত এক শ্ৰমণ এসে দাঁড়ালেন, হাতে ভিক্ষাপাত্র। শাক্যপুত্রীয় শ্রমণরা অধিকাংশ সময়েই মুখ ফুটে ভিক্ষা চান না। নিষেধ আছে। ভগবান বুদ্ধ এইভাবেই ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। তাই তাঁর সংঘের ভিক্ষুরাও অনেকেই তাঁকে অনুকরণ করেন।

বিশাখা বলল— পিতা, একজন শ্রমণ ভিক্ষার্থে এসেছেন।

মিগার মনোযোগ দিয়ে খেতে লাগলেন। যেন শুনতেই পান নি।

এবার ভিক্ষু পুরোপুরি দ্বারের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কাষায় বস্ত্রের আভা সূর্যালোকে দীপ্ত হয়ে কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করছে। মৃদু স্বরে ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন শ্রমণ।

মিগার একবার চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়ে আবার খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

তখন বিশাখা উঠে গিয়ে ভিক্ষুকে লক্ষ্য করে বলল—ভগবন, এ গৃহের স্বামী পুরানো খান। আপনি অন্যত্র দেখুন।”

এতদিনে মিগারের ধৈর্যচ্যুতি হল। তিনি পায়সের পাত্র ছুঁড়ে ফেলে দিলে চিৎকার করে উঠলেন : “কী বললে? আমি পুরানো খাই? উত্তম অন্ন দিয়ে উত্তম পায়স প্রস্তুত হয়েছে, গুরুকে ভোজন করিয়ে এখন নিজে সেই সুস্বাদু খাদ্য ভক্ষণ করছি, আর তুমি বললে আমি পুরানো খাই? ধনী পিতার গর্বে তুমি জ্ঞান হারিয়েছে। বহু অপরাধ তোমার ক্ষমা করেছি। আমার গুরুকে সর্বসমক্ষে অপমান করলে ত পর্যন্ত ক্ষমা করেছি অবোধ বালিকা বলে, কিন্তু আর না। তোমাকে অবিলম্বে সাকেতে প্রেরণ করবো। পরিত্যাগ করবো।

মিগারের কণ্ঠ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। দাস-দাসী, পুরস্ত্রীরা মিগার-পত্নী সব যে যেখানে ছিল ছুটে এলো।

এই ধনগর্বী দুর্বিনীত সুহ্নাকে আমি ত্যাগ করলাম— আবার ঘোষণা করলেন মিগার। রাগে তিনি কাঁপছেন।

বিশাখা প্রথমটা একটু হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। এতোজনকে সমবেত দেখে সে দৃপ্তকণ্ঠে বলল— পিতা আপনি বললেই তো আমি ত্যক্ত হতে পারি না। আমি তো একটা সাধারণ রমণী নই যাকে পথ থেকে দয়া করে তুলে এনেছেন! রীতিমতো দূত পাঠিয়ে, বহু অনুসন্ধানের পর আমার রূপ, গুণ, কুলগৌরব সম্পর্কে নিঃসংশয় হয়ে তবেই যথেষ্ট সাধ্যসাধনা করে আমার পিতার কাছ থেকে আমাকে প্রার্থনা করে এনেছেন। আমি এই গৃহের সুহ্না। এ গৃহে আমার পূর্ণ অধিকার আছে। প্রমাণ করুন আমি অপরাধ করেছি। সবার সামনে প্রমাণ হয়ে যাক কে ভুল করছে, কে ঠিক। আমি অরক্ষিত নই, পিতা আমার দোষ-গুণ বিচারের জন্য যাঁদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, আসুন তাঁরা।

তখন, মিগারের মনে পড়ল তাই তো! এমন একটা ব্যবস্থা ধনঞ্জয় সেট্‌ঠি করেছিলেন তো বটে! তিনি বিনা বিচারে একার সিদ্ধান্তে এই সুহ্নাটিকে ত্যাগ করতে তো পারেন না। কী বিপদেই না পড়া গেল!

ততক্ষণে বিশাখা সে স্থান ত্যাগ করে নিজের গৃহে চলে গেছে। চলে গেছে তার দাস-দাসী, সখী যে যেখানে ছিল সবাই। মিগার গৃহে অকস্মাৎ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। সব থমথম করছে। পুরাঙ্গনা ও দাস দাসী যারা ছিল, সবার মুখই শুকিয়ে গেছে। কারো কারো চোখে অশ্রু। বিশাখা এই ক’ মাসেই এদের আপন করে নিয়েছে। তার স্বাভাবিক গরিমা; সরলতা, উদারতা এবং প্রীতির ক্ষমতায় সে মিগার গৃহের সবাইকেই জয় করে নিয়েছে।

কিন্তু মিগার এবার তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। তিনি মধ্যস্থতা করবার জন্য শ্রাবস্তীর চার গৃহপতিকে ডাকতে পাঠালেন। সাকেতেও অশ্বারোহী দূত চলে গেল ঝড়ের বেগে।

যে কাননে মাত্র কদিন আগে নিগ্‌গণ্ঠদের নিয়ে উৎসবের আয়োজন হয়েছিল সেখানে সেই চন্দ্রাতপের তলায় সেই মঞ্চেই আজ আটজন বয়স্থ মানী ব্যক্তি ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠীর কন্যা বিশাখার বিচার করবার জন্য এসে বসেছেন। এসেছেন মিগার গৃহের সবাই। দাস-দাসীরাও আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে।

বিশাখা তার প্রসাধন কক্ষ থেকে বেরোল। সোনার কাজ করা রক্তবর্ণ দুকুল তার পরনে। সে যত্ন করে প্রসাধন করেছে। মহালতাপসাদন ধারণ করে চলছে যেন আনন্দময়ূরী। স্থির আনন্দের অকম্প শিখা তার মুখে। তার ডান হাতে একটি পত্র। সুমনা উদ্বিগ্ন হয়ে লিখেছেন : “বিসাখা আদরিণী কন্যা আমার, শ্রাবস্তী থেকে যে সংবাদ এসেছে তা সুখের না দুঃখের বুঝতে পারছি না। যাঁরা তোমাকে বুঝলেন না তাঁদের সঙ্গে যত শীঘ্র তোমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় ততই মঙ্গল। তোমার পিতা বলছেন তুমি চলে এসো সসম্মানে। তোমার মোক্ষক্রিয়া (বিবাহ-বিচ্ছেদ) এখান থেকেই সম্পাদন করাবো।

তোমার জননী কিন্তু নিশ্চিত আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে বিসাখা এমন কিছু করবে যাতে বোঝা যাবে সে বিসাখাই। সে অন্যান্য কারো মতো নয়। সে শুধু নিজের সম্ভ্রম, নিজ পিতৃকুলের এবং নারীদের গৌরবই বৃদ্ধি করবে না, সে এমন একটা কীর্তি স্থাপন করবে যা বহুকাল ধরে সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকবে। সুমনা উৎকণ্ঠিত নয় জেনো। ”

পরিশেষে মা তাকে স্নেহচুম্বন করছেন। আশীবাদ করছেন সে জয়ী হবে। সেই পত্রটিই সে তার ডান হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরে আছে।

ধনপালীর চোখে অশ্রু। সে বলল— ভদ্‌দা এতো সেজেছ আজ? বিশাখা বলল— আজ আমার বড় আনন্দের দিন পালি আমি পিতৃগৃহে ফিরে যাবো। আমার প্রবাসের কাল শেষ হয়েছে।

কহ্না বলল— সেই ভালো। এই কৃপণ সেট্‌ঠির ঘরে আমারই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তার তুমি। বলছে কিন্তু তার মুখ যেন বারিগর্ভ মেঘের মতো।

ময়ূরী তার স্বামিনীর অপমানের ভয়ে এতোই বিবশ হয়ে গেছে যে তার জ্বর এসে গেছে। সে গিয়ে তার নিজের ঘরে শুয়েছিল। বিশাখা তাকে শয্যা থেকে তুলে আনল। ময়ূরী ভেবে পায় না ভদ্‌দার মুখের প্রসন্ন হাসির কারণ। পিতৃগৃহে যাওয়া আনন্দের কথা, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে, এই ভাবে?

ঋষি মধুচ্ছন্দার বর্ণিত উষার মতো যে অনুপম লাবণ্যবতী বেশে শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করেছিল সেই ভাবেই সভাগৃহে এলো সে। খালি ঊষার মৃদুতার স্থান নিয়েছে এক যোদ্ধৃর দৃপ্ততা কিম্বা সে এমন একজন যে এখনও জম্বুদ্বীপের কল্পনায়, জম্বুদ্বীপের পুরাণে জন্মায়নি। কোনও আসন্ন ভবিষ্যতের সে বীজরূপা।

মিগার বললেন— আপনারাই বিচার করুন। এই সুহ্না ঘোষণা করে বলে আমি নাকি বাসি খাই। আমি গৃহপতি মিগার। সাবত্থির সবচেয়ে মাননীয়, সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে একজন। আমি এতো কৃপণ যে আমি বাসি খাই। আর এই কথা বলা হল কখন? না আমি যখন উত্তম সুগন্ধযুক্ত অন্ন দিয়ে, উত্তম পাটল গাভীর দুধ দিয়ে প্রস্তুত পায়স খাচ্ছি। দ্বারে এক সমন এসেছিল, তাকে এ বলল— এ গৃহের স্বামী পুরানো খান, আপনি অন্যত্র যান।

এ কথা শুনে সাকেতের বলভদ্র শ্রেষ্ঠী বলে উঠলেন— এ কী বলছেন মিগারভদ্র, আপনি পুরানো ভক্ষণের অর্থ জানেন না? আমরা তথাগত বুদ্ধের প্রদর্শিত মার্গকে নূতন বলি। তাই তুলনায় অন্যান্য শ্রমণ পন্থের মতগুলিকে পুরানো বলে থাকি। বচ্চে বিসাখা, তুমি এ কথা তোমার শ্বশুরকে বুঝিয়ে বলো নি?

বিশাখা বলল— আমি তো প্রথমে বুঝতেই পারি নি ইনি কেন এতো ক্রুদ্ধ হয়েছেন। যখন বুঝতে পারলাম, ততক্ষণে এঁর আমাকে ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করা হয়ে গেছে। চতুর্দিক থেকে গৃহের যে যেখানে ছিল ছুটে এসে মহা কোলাহল আরম্ভ করে দিয়েছে। শ্রাবস্তী কোসলের রাজধানী। এখানে কত শ্ৰমণপন্থ, কত সন্ন্যাসীর আসা-যাওয়া। কিন্তু এই সামান্য নূতন মার্গ পুরাতন মার্গ, নূতন ভক্ষণ, পুরানো ভক্ষণের কথা যে এঁরা জানেন না, আমি কী করে জানবো?

মিগার অত্যন্ত অপ্রতিভ হলেন। মধ্যস্থ গৃহপতিরা সকলেই তাঁর দিকে র্ভৎসনার দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন। কে কোথায় যেন হেসে উঠল।

মিগার তাঁর লজ্জা চাপা দেবার জন্য আরও বীররসাত্মক ভঙ্গিতে বলে উঠলেন তা যেন হল, কিন্তু এই সুহ্না তো এর পিতার দেওয়া উপদেশগুলিও পালন করে না। অত্যন্ত অবাধ্য। পিতা নিষেধ করে দেওয়া সত্ত্বেও এ গৃহের অগ্‌গি বাইরে নিয়ে যায় গভীর রাতে, আবার বাইরের অগ্‌গি ভিতরে নিয়ে আসে। গৃহাগত দেবতাদের পূজা করতে বলেছিলেন আমার বৈবাহিক। এ বধূ তো আমার গুরুর চরণ স্পর্শ না করেই ধিক্কার দিয়ে ফিরে এলো। গুরু কি গৃহাগত দেবতা নয়?

তখন বিশাখা বলল— পিতৃব্যগণ, ইনি আমার পিতার উপদেশের মর্মার্থ বুঝতে পারেননি। গৃহের আগুন বাইরে নিয়ে যাওয়ার অর্থ, গৃহের গোপন কথা বাইরে আলোচনা করা, বাইরের আগুন ঘরে আনার অর্থ, বাইরে শ্বশুরগৃহের সম্পর্কে কোনও নিন্দাবাদ শুনলে তা তাঁদের কর্ণগোচর করা। এ গুলি করলে গৃহে শান্তি থাকে না। তাই পিতা আমাকে এ উপদেশ দ্যান। আমি রাত্রিতে একটি ঘোটকীর প্রসববেদনা ওঠায় তার পরিচর্যার জন্য উল্কা নিয়ে অশ্বশালায় গিয়েছিলাম। আর নিমন্ত্রণ রক্ষা করে গৃহে ফিরতে সন্ধ্যা হলে উল্কা নিয়ে অন্ধকার পথ দিয়ে ফিরি। বলুন, আমি কি অপরাধ করেছি!

সকলেই মাথা নেড়ে বললেন— না, না। এর মধ্যে অপরাধের কী আছে। বরং বিসাখার করুণা, কর্তব্যবোধ এবং সতর্কতারই চিহ্ন এগুলি।

বিশাখা বলল— আমার পিতা গৃহাগত দেবতা বলতে অতিথিদের বুঝিয়েছিলেন। তাঁদেরই পূজা অর্থাৎ সেবা করতে তিনি উপদেশ দ্যান। এখন আপনারাই বলুন…

মিগার তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে নেড়ে বলে উঠলেন— ‘তা যেন হল, কিন্তু ধনঞ্জয় যে অগ্নিপূজা করতে উপদেশ দিলেন তুমি তো সোজাসুজি বলে দিলে অগ্নিগৃহ স্থাপন করবার প্রয়োজন নেই। অগ্নিপূজা তুমি করবে না। এবার বলো, উত্তর দাও।’ তিনি বিজয়গর্বে চারদিকে তাকাতে লাগলেন।

বিসাখা মৃদু হেসে বলল— অগ্নি বলতে পিতা শ্বশুর ও শ্বশ্রূকে বুঝিয়েছেন। অগ্নিহোত্রীর আগুন নয়। আমি আপনাদের সেবা, আপনাদের বন্দনা করব বলে, ভিন্ন গৃহে যাওয়ার যে প্রস্তাব আপনি করেছিলেন, তাতে সম্মত হইনি। আরও শুনুন, আমার পিতা বলেন যে দেয়, যে দেয় না উভয়কেই দেবে। যে দেয় সে সচ্ছল ধনী জ্ঞাতক, যে দেয়না সে দরিদ্র আত্মীয় পরিজন। এবং অন্যান্য দরিদ্রজন। শ্রেষ্ঠীর গৃহে প্রচুর বন থাকে, উদ্বৃত্ত অন্ন থাকে। যার গৃহে প্রচুর থাকে তাকে এ ভাবে দান করতে শিখতে হয়, না হলে তো দেশে খালি ধনীরাই বেঁচে থাকবে, দরিদ্ররা ধীরে ধীরে অল্পাহারে পশুরও অধম জীবনযাপন করতে বাধ্য হবে। পৃথিবীতে সমাজে এইভাবেই সৌষম্য রক্ষা করতে হয় দানের দ্বারা। এ কথা পিতা আমাকে শিশুকাল থেকে শিখিয়েছেন। আরও বলি শুনুন পিতা আমাকে সুখে উপবেশন, ভোজন এবং শয়ন করতে বলেছিলেন। এখন যদি এঁরা ভাবেন তার অর্থ হল কোমল শয্যায় শয়ন, উচ্চাসনে উপবেশন এবং সর্বদাই মহার্ঘ খাদ্য ভোজন তাহলে তো মহা বিপদ! প্রকৃতপক্ষে, সুহ্নার ক্ষমতা থাকলে সাধ্যমতো শ্বশুর-শ্বশ্রূর পরিচর্যা করা উচিত। তাঁরা মান্য তাঁদের উপস্থিতিতে উচ্চাসনে বসাই অস্বস্তির কারণ, তাঁদের ভোজন না হলে সুহ্না ভোজনে সুখ পায় না। তাঁরা নিদ্রা না গেলে সে নিজেও নিশ্চিন্তে নিদ্রাও যেতে পারে না। আমার সাধ্য আছে, তাই পিতা আমাকে এ রূপ উপদেশ দিয়েছেন।

গৃহপতিরা একযোগে বলে উঠলেন— ‘সাধু! সাধু! বিসখা তুমি যথার্থই উচ্চবংশের কন্যা। তোমারই যথার্থ শিক্ষা হয়েছে। তুমি যেমন বিনয়ের পাঠ নিয়েছ, তেমনি অন্যায় অভিযোগের বিরুদ্ধে বিতর্কে দাঁড়াবার পাঠও পেয়েছো। ধন্য তোমার পিতা মাতা। গৃহপতি মিগার আপনি ধন্য যে এমন সুহ্না পেয়েছেন। এ-ই আপনাদের গৃহের প্রকৃত অগ্নি। একে সযত্নে রক্ষা করুন।’

তখন পরিজনেরা আনন্দে কোলাহল করে উঠল। অনেকের চোখে সুখের অশ্রু দেখা দিল। মিগার যার-পর-নাই অপ্রতিভ হলেন। লজ্জায় অধোদন হয়ে বসে রইলেন, কিছুই বলতে পারছেন না। তাঁর এতো দিনের শানানো তীরগুলি এখন তাঁর নির্বুদ্ধিতা প্রমাণ করে তাঁরই বুকে ফিরে এসে আঘাত করেছে। এমন বৃহৎ জন সমাবেশ যেখানে বয়স্থ, মানী গহপতি থেকে কুল-ইত্থিরা, দাসরা, দাসীরা পর্যন্ত উপস্থিত রয়েছে সেখানে এমনভাবে অপদস্থ হওয়া! নিজের দোষে! কেউ হাসছে না, তবু তিনি যেন চারদিক থেকে কৌতুকের হাসি শুনতে পাচ্ছেন। এর পর কি আর তাঁর দাস-দাসী ভৃতক কর্মকররা সেভাবে তাঁকে মান্য করবে? পথে বেরোলে যদি ধিক্ ধিক্ ধ্বনি শুনতে পান? সাবত্থি অত্যন্ত পরচর্চা-পরায়ণ নগর। এখানে কাকের মুখে সংবাদ ছড়ায়। সুহ্নাটার ওপর তাঁর ক্রোধ হচ্ছে। কেমন একটা ধারহীন ক্রোধ। তাকে কিছু বলা প্রয়োজন— সান্ত্বনার কথা ক্ষমাপ্রার্থনার কথা, কিন্তু তিনি শত চেষ্টাতেও মুখ খুলতে পারছেন না।

এই সময়ে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত। মিগারপত্নী যিনি এতো দিন অন্তঃপুরের ভেতরে থেকে শুধুই মিগারের কৃপণতা, অনুদারতা ও বুদ্ধিহীন কার্যকলাপের অনুকরণ করে যাচ্ছিলেন, যেন বাইরেও যেমন মিগার-নীতি ভেতরেও তেমনি মিগার-নীতি চলতে থাকে, তাঁর হৃদয়ের মধ্যে অকস্মাৎ কেমন একটা শিহরন, একটা গৌরববোধ হতে লাগল। ওই যে বধূটি প্রজ্বলিত বহ্নির মতো, বহ্নির অধূমক শিখার মতো দাঁড়িয়ে সভার বহু পুরুষের সামনে অকম্প্র সাহসে আত্মপক্ষ সমর্থন করছে, ও যেন তাঁরই সুপ্ত বাসনা। তাঁরই হৃদয়ের নিদ্রিত মানবতা। জেগে উঠেছে। শিশুকাল থেকে তিনি একটি কাহিনী শুনে আসছেন। পাঞ্চাল-কন্যা, কুরুকুলবধূ কহ্নাকে নাকি দ্যূতসভায় পণ রাখা হয়েছিল, এবং সভামধ্যে তাঁর বস্ত্রহরণ করা হয়েছিল। এই কাহিনী শুনে তাঁর মা ও তাঁর অজজা-মার মতো তিনিও একসময়ে রোষে ফুলে ফুলে উঠতেন, আজ তাঁর সুহ্না যেন কেমন ভাবে সেই কহ্না কাহিনীটিরই কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আপন মর্যাদা আপনি রক্ষা করল। যেন এতদিনের রোষের, লজ্জার শান্তি হল। তিনি ধীরে ধীরে সভার মধ্যে এগিয়ে এসে বিশাখার পাশে দাঁড়ালেন, বললেন— ‘এসো মা!’

তখন বিশাখার চক্ষে অশ্রু ঝিকমিক করতে লাগল কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে সে বলল— ‘মাতা, পিতৃব্যগণ, বিসাখার বিচারের আয়োজন হয়েছিল, বিসাখা নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছে। তার পিতা-মাতার মর্যাদা সে রক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু এই শ্বশুরগৃহের ওপর যে অধিকারের কথা, সে পূর্বে বলেছিল, এখন সে তা স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে যাচ্ছে।’

সখীদের দিকে তাকিয়ে সে বলল—পালি, রথ প্রস্তুত করতে বল্। আমি সাকেত চলে যাবো।’

তখন সেই স্তব্ধ উৎকণ্ঠিত সভার মধ্যে মিগার সেট্‌ঠি সহসা বিশাখার সামনে একেবারে শুয়ে পড়লেন। বললেন—‘আমাকে ক্ষমা করো বিসাখা, আমি মূঢ়, তোমার ওপর অত্যন্ত অন্যায় করেছি, কিন্তু এখন অপরাধ স্বীকার করছি। আমায় ক্ষমা করো। চলে যেও না মা।’

বিশাখা অভিমানিনীর মতো মুখ ফিরিয়ে রইল, সে যেন সত্যিই এক আদরিণী বালিকা এখন। ঠোঁট দুটি ফুলে ফুলে উঠছে। চোখ দুটি সজল। কিন্তু অশ্রুপাতও করছে না তাই বলে। মিগার অনেক কাকুতি-মিনতি করার পর অবশেষে সে অশ্রুভরা চোখে বলল—থাকতে পারি। এক শর্তে। যদি তথাগত বুদ্ধকে এ গৃহে আপ্যায়ন করতে পারেন। যদি এই কাননে ওই মঞ্চে তাঁর দেশনা শুনতে পাই। তবেই।

মিগার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন— ‘তাই হবে। তাই হবে।’

তখন মিগার পত্নীর বুকে তার দৃপ্ত মুখ গুঁজে দিয়ে বিসাখা নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।

ময়ূরী দূর থেকে সে দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ সবার অলক্ষ্যে সভা থেকে বেরিয়ে যায়। সে নিজের কক্ষে যাচ্ছে। তার বুকের মধ্যে কী এক অজানা অনুভূতি! এ কি আনন্দ না সব-হারানোর শূন্যতা? তার স্বামিনী এত দিনে শ্বশুরগৃহে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হল একথা সে বুঝতে পারছে। মর্যাদায় এবং ভালোবাসায়। শ্বশ্রূ কী ভাবে দু হাত দিয়ে তাকে বেষ্টন করে আছেন! সুখী হওয়ার কথা। অথচ তার চক্ষু জ্বালা করে জল আসছে। এ তো আনন্দাশ্রু নয়! এ যেন শোক! প্রিয় বিচ্ছেদের দুঃখ! ময়ূরীর, কহ্নার, ধনপালীর কি এবার কাজ ফুরোল? সত্যিই কি এতো দিনে তাদের স্বর্ণপিঞ্জরের সোনার শেকল কাটল না কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *