এখনও জলপাইগুড়ির রাস্তায় কোন হোস্টেলের মেয়ে একা ঘুরে বেড়ায় না। দীপা এমন কাণ্ড করেছে কয়েকবার। সুপারিনটেনডেন্ট ঘরে ডেকে বেশ কড়া কথা শুনিয়েছেন। পরিষ্কার বলেছেন, দেখো, তোমাদের দায়িত্ব আমার ওপর দেওয়া হয়েছে। কিছু ঘটলে কৈফিয়ত আমাকেই দিতে হবে। তোমাদের বয়সের মেয়েকে এক রাস্তায় দেখলে এমনিতেই মানুষের কৌতূহল হয় তার ওপর হোস্টেলের মেয়ে জানলে তো কথাই নেই।
হোস্টেলের মেয়ে কি আলাদা? দীপার পছন্দ হচ্ছিল না কথাগুলো।
হ্যাঁ। আলাদা। সাধারণ মানুষের ধারণা যেসব মেয়ে হোস্টেলে থাকে তারা খুব স্বাধীন। বাবা মায়ের চোখের ওপর থাকতে হয় না বলে যা ইচ্ছে তাই করে। একটু চেষ্টা করলেই এদের কাজ করা যায়। ঘরের মেয়েদের থেকে তোমাদের আলাদা চোখে দেখে যখনই কলেজে যাবে দলবেঁধে যাবে।
ব্যাপারটা একেবারে মিথ্যে নয়। হোস্টেলের উল্টোদিকে সকাল থেকে সন্ধে কিছু ছেলে সাইকেল নিয়ে বসে থাকে। কলেজে যাওয়ার সময় সাইকেলে চেপে একটা না একটা মন্তব্য টুড়ে দিয়ে যায়। ওরা দাঁড়ায় না। তাই প্রতিবাদ করার সুযোগ পাওয়া যায় না। মেয়েদের কমনরুমে প্রথম দিকে দুটো ভাগ স্পষ্ট দেখা যেত। যারা বাড়িতে থেকে কলেজে পড়ে তারা যেন একটু দূরত্ব রাখত। আলাপ হলে কেউ কেউ বলে ফেলেছে, তোমরা খুব স্বাধীন, না? আচ্ছা, বাড়ির জন্যে মন কেমন করে না? হোস্টেলে মেয়েরা সিগারেট খায়, তাই না? ইয়া, আমি যদি হোস্টেলে থাকতে পারতাম!
কলেজে পৌঁছে মেয়েদের কমনরুমে ঢুকে যেতে হয়। দীপা লক্ষ্য করেছে সেখানে কেউ পড়াশুনার কথা বলে না। হয় শাড়ি নয় কোন ছেলেকে নিয়ে আলোচনা অথবা দুজন বিবাহিতা ছাত্রীকে ঘিরে তার ব্যক্তিগত জীবনের গল্প শুনেই সময় কাটে মেয়েদের। প্রতিটি পিরিয়ডের আগে স্যার এসে দাঁড়ান দরজার বাইরে। তাঁর ক্লাসের যারা ছাত্রী তারা তাঁকে অনুসরণ করে ক্লাসে যায়। ক্লাসরুমে ছেলেদের স্পর্শ বাঁচিয়ে মেয়েদের আলাদা বসার বেঞ্চি আছে। সেটা সাজানো থাকে অধ্যাপকের মুখোমুখি। কিন্তু প্রতিটি ক্লাসেই বেঞ্চিতে বসার পরে কেউ না কেউ চিরকুট পায়। তাতে যেমন কবিতার লাইন থাকে তেমনি অশ্লীল শব্দাবলীও বাদ যায় না। ক্লাসের পর কমনরুমে পৌঁছে তাই নিয়ে জোর হাসােহাসি চলে মেয়েদের মধ্যে। কেউ কেউ আবার নিজের নাম না দিয়ে জবাব লেখে। চাপান উতোর পালার কি পরিণাম হবে তা দীপা জানে না।
আজ বেঞ্চিতে বসতেই দীপা দেখল ডেস্কের ফাঁকে একটা কাগজ ভাঁজ করা রয়েছে। অধ্যাপক তখন রোল কল করছেন। দীপা কাগজটা টেনে বের করল। তাতে লেখা রয়েছে, হাসি কেন নেই মুখে, বাজে দাগা এই বুকে। তারপর একটা গোমরা মুখের স্কেচ পাশে তার নাম লেখা। নিজের নম্বরের সময় সাড়া দিয়েছিল দীপা। অধ্যাপক রেজিস্টার সরিয়ে পড়ানো শুরু করতে যাচ্ছেন এই সময় সে উঠে দাঁড়াল। এখন পর্যন্ত ক্লাসরুমে কোন মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অধ্যাপককে প্রশ্ন করেনি। ফলে সমস্ত ক্লাস অবাক হয়ে তাকিয়েছে তার দিকে। দীপার একটু অস্বস্তি হল। অধ্যাপক বই রেখে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি কিছু বলতে চাও?
দীপা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আমরা যখন ক্লাসে এসে বেঞ্চিতে বসি তখন এইরকম কাগজের টুকরো দেখতে পাই। প্ৰায় প্রতি পিরিয়ডের আগে আপত্তিকব কথা লিখে এখানে রাখা হয়।
অধ্যাপক যেন নার্ভাস বোধ করলেন, কি লেখা আছে ওতে, দেখি।
দীপা ডেস্ক ছেড়ে বেরিয়ে এসে ভদ্রলোকের হাতে কাগজটা তুলে দিল। তিনি সেটি খুলে পড়লেন, পড়ে হাসলেন। দীপা আড়চোখে দেখল সমস্ত ক্লাস চুপ করে রয়েছে। ছেলেরা টানটান। অধ্যাপক বললেন, রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে শুধু সবুজ ঘাস পারে এমন কথা নেই, পাথরের টুকরো কাচের কুচিও পড়ে। সেগুলোকে অবহেলায় এড়িয়ে যেতে হয়। এই চিরকুটকে কোন মূল্য দিও না।
দীপা বলল, আপনি কি মনে করেন না যে এসব লেখা খুব নিচু মনের পরিচয়? নিশ্চয়ই। কুরুচিই প্ৰকাশ পায়। তবে এইরকম উৎপাত তো অনেক বছর ধরেই চলে আসছে। কোন মেয়েকে প্রতিবাদ করতে শুনিনি। তুমি করেছ, ভাল লাগছে। কি নাম তোমার?
দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়।
দীপা ফিরে এসেছিল নিজের জায়গায়। তখনই ছেলেদের মধ্যে গুঞ্জন উঠেছিল। অনেকেই নড়েচড়ে বসেছিল। অধ্যাপক পড়ানো আরম্ভ করেছিলেন। দীপা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল বারংবার। কাগজের ছবিটার কথা ভাবলেই রাগ হয়ে যাচ্ছিল তার। ক্লাস শেষ হলে অধ্যাপকের পেছন পেছন তারা যখন বের হচ্ছে তখন হঠাৎ একটি ছেলে বলে উঠল, কাল কেউটে। সঙ্গে সঙ্গে চাপা হাসি ছড়িয়ে পড়ল। পেছনে।
দীপা ঘুরে দাঁড়াল, শুনুন, আমরা সবাই এক বয়সী, একই ক্লাসে পড়ি। যদি কারো কথা বলার ইচ্ছে হয়ে থাকে সে সোজাসুজি কথা বললে ভাল হয় না? সেটাই কি উচিত না? আমরা মেয়ে কিন্তু অন্য গ্রহের জীব তো নই। আপনাদের বাড়িতে যেসব মহিলা আছেন তাঁদের সঙ্গে কি আপনারা কথা বলেন না?
ছেলেগুলো হকচকিয়ে গেল। এ ওর মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল। দীপা আর দাঁড়াল না। তার সঙ্গিনীরা অনেক আগেই কমনরুমে চলে গিয়েছে। দীপা সেখানে পৌঁছনোমাত্র মেয়েরা এসে ঘিরে ধরল। তাকে।
এখন মেয়েরা দুভাবে বিভক্ত। কারো মতে দীপা ঠিক করেছে। প্রতিদিন ওই সব কথার সঙ্গে অশ্লীল শব্দ পড়তে ঘেন্না করে। ছেলেদের একটু বুঝিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। তবে ছেলেরা যদি কথা বলতে চায় হোস্টেলের মেয়ে হিসেরে দীপা কথা বলতে পারে। কিন্তু তাদের পক্ষে সবার সামনে কথা বলা সম্ভব না। বাড়িতে জানলে পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। বিপ্লক্ষের মতে, অত ডাঁট দেখানো উচিত হয়নি। ছেলেদের লেখা কাগজ তাদের পড়তে খারাপ লাগে না। শুধুই তো পড়া, কেউ গায়ে পড়ে কথা বলতে এলে দাদা কাকাকে বলে ধোলাই-এর ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়। কিন্তু এই খেলার সুখ থেকে বঞ্চিত করার কোন অধিকার দীপার নেই। দ্বিতীয় দল অবশ্য প্রকাশ্যে চেঁচিয়ে মতামত ব্যক্ত করল না। কিন্তু চাপা অসন্তোষ বুঝতে অসুবিধে হয়নি।
ছুটির পরে দীপা আরও দুজন মেয়ের সঙ্গে ফিরছিল। এই মেয়েদুটি খুবই শান্ত। হোস্টেলে এসে আরও গুটিযে গিয়েছে। পড়াশুনা আর কলেজের বাইরে অন্য কিছুতে মন নেই। কলেজ গেটের সামনে পৌঁছতেই হঠাৎ একটি ছেলে এগিয়ে এল নমস্কার। আপনার সঙ্গে একটা কথা বলতে পারি?
দীপা থমকে দাঁড়াল। ওর সঙ্গিনীরাও। ছেলেটি বলল, আমার নাম নিশীথ। আপনার সঙ্গেই পড়ি। আজ আপনি যেভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাতে আমরা খুব লজ্জিত হয়েছি। ওভাবে কাগজ রেখে আর আপনাদের বিরক্ত করা হবে না, কথা দিচ্ছি।
এই কথাগুলো ক্লাসেই বলতে পারতেন।
পারতাম। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে যে সময় লাগল।
খুব ভাল ব্যাপার। ওগুলো পড়লে শরীর মন ভাল থাকে না।
আসলে কেউ কেউ বসিকতা করতে চেয়েছিল।
দীপা এর পর কি বলতে পারে। সে দেখল সঙ্গিনীরা উশাখুশ করছে। অতএর আর কথা নাড়াল না, এবার চলি।
নিশীথও বোকার মত হাসল। দৃশ্যটা সমস্ত কলেজ দেখছে দূর থেকে। মুখে মুখে ঘটনোটা ছড়িয়ে পড়েছে। কলেজ শুদ্ধ ছেলের দল অপেক্ষা করছিল দীপাকে দেখবে বলে। নিশীথ এই সুযোগে হিরো হয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে দীপা সেটা বুঝতে পারল। একেবারে শেষ মুহুর্তে তার কানে এল, কেউ একজন চিৎকার করছে, মাস্টারনি।
হোস্টেলে ফেরার পর মেয়েরা তাদের ঘরে এল। এখনও মায়া ফেরেনি। ঘরটা তাই তার একার অধিকারে। দীপকে গোল করে ঘিরে সবাই জানতে চাইল কাগজটায় কি লেখা ছিল, কলেজ গেটে সেই ছেলেটা তাকে ঠিক কি বলেছিল! কারণ যে দুটি মেয়ে দীপার সঙ্গে ছিল তারা বলছে যে কিছুই শোনেনি। হোস্টেলে ফেরার সময় একটা ছেলে আগবাড়িয়ে কথা বলতে শুরু করায় তারা নাকি নাভাস হয়ে গিয়েছিল। দীপা সরল গলায় ঘটনাটা বলামাত্র সবাই হই চই করতে লাগল। যেন বিরাট জয় হয়েছে মেয়েদের।
কিন্তু পরদিনই কলেজে গিয়ে দেখা গেল দীপার নামকরণ করা হয়েছে। এখন সবাই মাস্টারনি বলতে দীপাকেই বোঝে। কানের কাছে ওই শব্দটা ঘন ঘন উচ্চারিত হতে লাগল। প্ৰথমে খুব ক্ষেপে গিয়েছিল দীপা। এমন কি মিতা পর্যন্ত কমনরুমে বসে বলল, জানিস, মাস্টারনি ছাড়া তোর আর একটা নাম হয়েছে, পিসিমা। দীপার মনে হয়েছিল এবার প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে অভিযোগ করা উচিত। কিন্তু মিতা তাকে নিষেধ করল, দুর! তুই যত রাগ করবি ওরা তত আনন্দ পারে।
মিতার এই কথাটা খুব পছন্দ হল দীপার। কলেজে ঢোকামাত্র তার কানে মাস্টারনি এবং পিসিমা শব্দদুটো বশার মত বিধতে লাগল। ঠোঁট কামড়াতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল সে। প্রথম পিরিয়ডে ক্লাসে ঢুকে প্রত্যেকটা মেয়ে আবিষ্কার করল ডেস্কেব ফাঁকে কিছু গোঁজা নেই। ক্লাস শেষ হলে অধ্যাপকেব। পেছন পেছন যখন মেয়েরা বেরিয়ে যাচ্ছে দীপা ঘুরে দাঁড়াল। ছেলেরা সবাই বেঞ্চি ছেড়ে বেরুবোব জন্যে তৈরী হচ্ছিল, দীপাকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে নিস্তব্ধ হল। ততক্ষণে অধ্যাপকেব। সঙ্গে সমস্ত ছাত্রী চলে গিফোছে কমনরুমের দিকে। দীপা নিশীথের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে ধন্যবাদ। আমার অনুরোধ রেখেছেন বলে খুশি হয়েছি।
নিশীথ কিছু বলার আগেই লম্বামত একটা ছেলে বলল, আমরা ভদ্রলোক, পছন্দ না করলে বিরক্ত করব কেন?
দীপা বলল, বারে, বিরক্ত হতে কেউ পছন্দ করে নাকি।
ছেলেটি মাথা নাড়ল, করে করে। মেয়েরা যা চীজ।
দীপার মুখ মুহূর্তেই পাল্টে গেল, মানে?
ছেলেটি ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে, চট করে নিজের কানন্দুটো দু হাতে ধরে জিব বের করে বলল, সরি। আর কক্ষনো হবে না দিদিমণি। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল। দীপার একবার মনে হল ঘর ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু প্ৰায় জেদ করেই সে থেকে গেল, আপনার বযস কত?
সতের। ছেলেটি বলল।
আমি পনের পার হয়েছি। আমি কি করে তোমার দিদিমণি হব?
তোমার? তুমি, আপনি আমাকে তুমি বললেন? ছেলেটা হতভম্ব।
নিশ্চয়ই। এক ক্লাসে পড়ি, তোমার বয়স সতের, তুমি মেয়ে হলে কি আপনি বলতাম? তুমি কি কোন ছেলেকে আপনি বল?
বলি না। তাহলে আমিও তোমাকে তুমি বলব।
সহপাঠী যখন তখন নিশ্চয়ই বলতে পার।
প্রতি পিরিয়ডের শেষে মিনিট দিশেকের জন্যে কমনরুমে যেতে হত মেয়েদের। কিন্তু দীপা থেকে গেল ক্লাসেই। সাত-আটটি ছেলে তাকে ঘিনে বেঞ্চিতে বসে কথা বলতে লাগল। লম্বা ছেলেটির নাম হরিপদ। খুব মজার মজার কথা বলে। সে বেশি বলছিল, শোন, মাইরি। আমার যা আনন্দ হচ্ছে, উঃ, আজ রাত্রে ঘুমতে পারব না।
ওমা কেন? দীপা ওর কথা বলার ধরনে হেসে ফেলল।
সারারাত স্বপ্ন দেখব। আমি মরুভূমির মাঝখানে ওয়েসিস পেয়ে গেছি।
ওয়েসিস?
তাই নয় তো কি? আমাদের বাড়িতে সব দেবতার পা। বাবার নাম বিষ্ণুপদ, কাকার নাম শিবপদ, আমি হরিপদ, ভাই গোবিন্দপদ, কোন মেয়ে নেই চাবিপাশে। আপনি, মানে, তুমি হলে প্ৰথম মেয়ে যার সঙ্গে এইভাবে কথা বলছি।
তোমার মা নেই?
না। ভাই-এর জন্মাবার পর মা বিষ্ণুর কাছে চলে গিয়েছে।
বিষ্ণুপদ মানে কিন্তু বিষ্ণুব পা নয়।
হরিপদ হকচকিয়ে গেল। নিশীথ বলল, পদ মানে তো পা।
হ্যাঁ, কিন্তু বিষ্ণুপদ মানে আকাশ। দীপা জানাল।
বিস্ময়সূচক শব্দ মুখগুলো থেকে বেরিয়ে এল। হরিপদ বলল, আমার বাবা আকাশে? অসম্ভব। বাবার সঙ্গে আমাদের কোন মিল নেই। বাবার গায়ের রঙ অন্ধকারের চেয়ে কালো।
আবার হাসিব ফোযারা উঠল। নিশীথ জিজ্ঞাসা করল, বিষ্ণুপদ মানে যদি আকাশ বিষ্ণুপদী তাহলে সাগর, না মাটি?
দীপা বলল, গঙ্গা।
হবিপদ বলল, তুমি তো অনেক জানো। কোন স্কুলে পড়েছ।
আমি চা-বাগানের স্কুলে পড়তাম! কিন্তু আমার। একজন মাস্টারমশাই ছিলেন। যিনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন।
কলেজের একটি মেয়ে, ছেলেদের সঙ্গে মেশে, তুমি তুমি করে কথা বলে, শহরে খবরটা চাউর হতে বেশি সময় লাগল না এখন আর দীপাকে কেউ দুব থেকে আওয়াজ দেয় না। কমনকমেব চেয়ে ব্লকাসকমেই সে বেশি আডডা দেয। আর এই ঘটনার পনে কী পা মেয়েদের কাছে একঘরে হয়ে পড়ল। বেশিবভােগ মেয়েই তাকে এডিযে যায়। একজন তো বলেই ফেলল, ভাই আমরা কলেজে পড়তে এসেছি, তোমার মত ছেলেদের সঙ্গে বেলোপনা করতে তো আসিনি। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এমন কি মিতা আর আগের মত গল্প করে না। সবার সামনে। মন ভাল ছিল না দীপার। ছেলেদের নিয়ে যারা চব্বিশ ঘণ্টা আলোচনা করে তারা কেন এমন ব্যবহার করবে। কেউ ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে।
প্ৰথম প্রথম একটু চক্ষুলজা ছিল, এখন হরিপদ বা নিশীথেরা সঙ্গে কলেজ থেকে হোস্টেলে আসতে একটুও খারাপ লাগে না। নিশীথ ভাল ছেলে কিন্তু হরিপদকে ওর বেশি পছন্দ হয়। ও যখন কথা বলে, তখন কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে এমন ভাবনা যেন মাথায় কাজ করে না। মেয়েরা তাকে এখন আড়ালে মক্ষীরানী বলে ডাকতে শুরু করেছে। ছেলেরা আর আওয়াজ দেয় না। তবে এখন পর্যন্ত ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গেই আড্ডা মারে দীপা। ব্যাপারটা উঁচু ক্লাসের ছেলেদেরও চমকিত করে। কলেজে মেয়েদের সংখ্যা কম। সিনিয়ার মেয়েদের একজন তাকে ডেকে বলেছিল, তোমার তো খুব সাহস। এইভাবে কেউ কখনও ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারেনি, তা জানো? দুনামের ভয় পাওনা?
দুর্নাম হবে কেন? আমার সঙ্গে যারা পড়ে তারা কি নোংরা?
নোংরা হতে যাবে কেন, তারা মেয়ে নয়, ছেলে।
তাতে দোষ কিসের? কেউ তো কারো ভাই দাদা অথবা ছেলে। ওরা যখন বাড়িতে থাকে তখন বাড়ির মেয়েরা ওদের সঙ্গে কথা বলে না?
বাড়ির মেয়ে আর আমরা এক হলাম?
একই। আলাদা ভাবলেই কমপ্লেক্স তৈরি হয়।
কমপ্লেক্স? একটা ইংরেজি শব্দ বলে দিলেই হল। বাড়ির মেয়ের সঙ্গে কেউ প্ৰেম করে না। কিন্তু আডা মারলে একটা বাজে ছেলে প্রেম করতে চাইতে পারে, জানো?
কেউ যদি একা একা প্রেম করে তাহলে কিছু করার নেই। কিন্তু আমার সঙ্গে কেউ প্রেম করতে এলে আমি তাতে মত দিয়ে দেব? কি বোকা বোকা কথা!
সিনিয়ার মেয়েটি অবাক হয়ে বলেছিল, তুমি তাকে কি বলবে?
বলব, সহপাঠীর মত যদি মিশতে পারো মেশো না হলে কথা বলো না।
মেয়েটি আর কথা বলেনি। মফস্বল শহরের ইতিহাসে এমন ব্যাপার বড় একটা ঘটেনি। কলেজের সিনিয়ার ছেলেরা আগ বাড়িয়ে আলাপ করতে চাইল। কিন্তু দীপা ঠিক করে নিয়েছিল সে কি করবে। ছেলেগুলো ওর শীতল কথাবার্তায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে গেল। দিন দশেকের মধ্যেই সে প্রচারিত হয়ে গোল কলেজ এবং সংলগ্ন মহলে। শেষপর্যন্ত সুপারিনটেনডেন্টের ঘরে ডাক পড়ল তার। ভদ্রমহিলা বললেন, তোমার সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলছে। আমাদের দেশে এখনও ফ্রি মিক্সিং চালু হয়নি, কেউ মেনেও নিতে পারে না। এটা বুঝতে পারো না কেন?
দীপা শান্ত গলায় বলল, ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলাকে কি ফ্রি মিক্সিং বলে? আমি ঠিক মানে জানি না।
ভদ্রমহিলা আরও গম্ভীর হলেন, ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মাবাব কি দরকার? মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে সুখ হয় না তোমার?
দীপা হেসে ফেলল, সত্যি কথা বলব?
হ্যাঁ, নিশ্চয়।
মেয়েদের সঙ্গে পাঁচ মিনিটের বেশী কথা বলা যায় না। কারণ ওরা পৃথিবীর কিছুই জানতে চায় না। শাড়ি গয়না। আর বিয়ে ছাড়া কোন চিন্তা করতে পারে না। ছেলেদের নিয়ে রসিকতা করেই আরাম পায়।
আর ছেলেরা এসব করে না বুঝি? করে হয়তো তবে শাড়ি গয়না নিয়ে কথা বলে না। আমি থাকলে কোন মেয়েকে নিয়ে রসিকতা করে না। নিশীথ গল্প লেখে। জলপাইগুড়ির কাগজে ওর লেখা বেরিয়েছে। ওর সঙ্গে কথা বললে সাহিত্যের অনেক খবর পাই। রথীন সারা পৃথিবীর খেলাধুলোর হিসেব জানে। আর যারা রাজনীতি করে তারা তত্ত্ব নিয়ে যে আলোচনা করে তা আমাদের কোন মেয়ে বুঝতেই পারবে না।
আচ্ছা। তা এতে তোমার কি মোক্ষলাভ হচ্ছে?
আমার মাস্টারমশাই বলতেন ভাল সঙ্গ পেলে মনের উন্নতি হয়। ওদের সঙ্গে মেশার–আগে আমি অনেক কিছু জানতাম না।
তোমাকে বলা হয়েছিল হোস্টেলের মেয়েদের সঙ্গে দল বেঁধে কলেজে যেতে। তুমি আমার কথার অবাধ্য হয়েছ। এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য আছে?
হ্যাঁ। যাওয়ার সময় কাউকে সঙ্গী পেলেও আসার সময় কেউ আমার জন্যে অপেক্ষা করে না। তা ছাড়া দিনের বেলায় একটা সভ্য শহরে একা হেঁটে যাওয়াটা কি অপরাধ?
এই প্রশ্নের জবাব তোমাকে আমি দের না। আমার হোস্টেলে থাকতে হলে তোমাকে কিছু নিয়মকানুন মানতে হবে। তোমার আচরণের জন্যে অন্য অভিভাবকরা যদি তাঁদের মেয়েদের এখানে না রাখতে চান তাহলে তোমাকেই হোস্টেলে থাকতে দিতে পারি না আমি।
তর্ক করার ঝোঁক কোনমতে সামলে নিল দীপা। চুপচাপ ঘরে ফিরে এসে সে শুয়ে পড়ল। সে কোন অন্যায় করছে না। অথচ এরা সবাই মিলে তাকে শাসচ্ছে। কেন যে সহজ কথাটা কেউ বুঝতে চাইছে না সেটাই বিস্ময়ের। কিন্তু সত্যি যদি ওরা তাকে এই হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দেয়? জলপাইগুড়ি শহরে তার আর কোন থাকার জায়গা নেই। অমরনাথের মুখ মনে পড়ল। খবরটা শোনামাত্র তিনি প্ৰচণ্ড খেপে যাবেন। ভাল ছাত্রী বলে যে মানুষটা তার খরচ দিচ্ছেন তিনিও সেটা বন্ধ করলে অমরনাথ দীপাকে চা-বাগানে ফেরত নিয়ে যাবেনই। আর এই ফিরে যাওয়া মানে চিরকালের জন্যে পড়াশুনা শেষ হয়ে যাওয়া। ভাবতেই শিউরে উঠল দীপা। সত্যসাধন মাস্টারের সামনে সে দাঁড়াবে কি করে? সত্যসাধন মাস্টার তাকে বলেছিলেন পড়াশুনা করে যেতে, সে কথাও দিয়েছিল। আর পড়াশুনা না করে বাড়িতে বসে থাকলে তো আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত তার ভবিষ্যৎ কোন বিশেষ খাতে বইবে না। স্বীকার করুক বা না করুক, বিধবা শব্দটার ছাপ সে চাইলেও লোকে মুছতে দেবে না।
রমলা সেনের মুখ মনে পড়ল। এরকম অবস্থায় রমলা সেনকে দরকার তার। একমাত্র তিনিই বলতে পারেন কি করা উচিত। কিন্তু ভদ্রমহিলা তাকে নিষেধ করেছেন একা শিলিগুড়িতে যেতে। বলেছেন, প্রয়োজন পড়লে চিঠি দিতে। রমলা সেনকে চিঠিতেই সব জানাবে সে। কিন্তু তখনই মনের গভীরে জমে থাকা অস্বস্তিটাকে সে টের পেল। ওই মানুষটি, যিনি রমলা সেনের বন্ধু, স্বামী কিংবা আত্মীয় নয়, অথচ মাঝেমাঝেই একসঙ্গে থাকেন, এইটে সে মেনে নিতে পারছে না। অথচ ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তার খুব পছন্দ হয়েছিল। ওঁকে। ওদের দুজনের সম্পর্ক খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে বুকের গভীর থেকে উঠে আসা একটা বোধ যা তার রক্তে মিশে আছে, ওই স্বাভাবিক ব্যাপারটাকে আর মেনে নিতে পারছে না। এবং এই কারণেই রমলা সেন আর তার মধ্যে একটা স্বচ্ছ আড়াল তৈরি হচ্ছে। ক্রমশ বিপরীত চিন্তা মনে এল। তাকে না জানিয়ে শিলিগুড়িতে যেতে নিষেধ করেছেন রমলা সেন যাওয়াটা নিরাপদ নয় বলেই কি? সে গেলে ওঁদের অসুবিধে হবে ভেবে নয়তো? খারাপ লাগল, খুব খারাপ, এরকম ভাবলে নিজে ছোট হয়ে যেতে হয়, তবু ভাবনাটা থেকে সে মুক্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। আর যতক্ষণ সেটা পরিষ্কার না হচ্ছে ততক্ষণ রমলা সেনের কাছে সাহায্য চাইতে যাবে কেন? তা ছাড়া এমনি পরিচিত মানুষ কেন তার সমস্ত খরচ বহন করবেন? রমলা সেনের কাছে গেলে নিশ্চয়ই অমরনাথ তাকে টাকা পাঠাবেন না। না, এই মুহুর্তে সে এমন কাজ করতে পারে না যাতে অমরনাথ এবং অঞ্জলিকে অপমান করা হয়। এই দুটি মানুষ না থাকলে সে এই অবধি পৌঁছতে পারত না। জন্ম দিয়েই যে মহিলা চলে গিয়েছিলেন পৃথিবী ছেড়ে তিনি তার মা নন। এই শরীরটাকে যিনি যত্নে বড় করেছেন অনেক ভালবাসা দিয়ে, ঘটনা যাই হোক, তাকে ছাড়া আর কাউকে মা বলে ভাবতে পারবে না সে। আর যে মানুষটা স্ত্রী মারা যাওয়ামাত্র তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিল সে কি করে বাবা হবে? দীপা বিছানা থেকে নেমে এল। তার শরীর ভারী এবং বুকের মধ্যে চাপ বাড়ছিল। সুপারিনটেনডেন্ট-এর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সে একটু ইতস্তত করল। তারপর পদ। সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। টেবিলে বই রেখে তার ওপর ঝুঁকে ছিলেন ভদ্রমহিলা। দীপা ডাকল, বড়দি!
ভদ্রমহিলা মুখ তুললেন, ও, তুমি? কি ব্যাপার?
দীপা ঢোঁক গিলল, আমি নিয়মকানুন মেনে চলব।
খুব ভালো। তাহলে আমার আর কিছু বলার থাকবে না।
কিন্তু।
এর মধ্যে আবার কিন্তু কেন আসছে?
যেসব ছেলের সঙ্গে আমার এর মধ্যে আলাপ হয়ে গিয়েছে তাদের আমি কি বলব? ওরা কথা বলতে চাইলে– দীপা শেষ করতে পারল না।
তাদের মধ্যে এমন কেউ আছে নাকি তুমি যাকে এডাতে পারবে না।
হ্যাঁ। হরিপদ।
হরিপদ? হু ইজ হি? ছি. ছি. ছি. এই জন্যেই মেয়েদের এত বদনাম হয়।
না বড়দি। ও আমাকে দিদি বলে ডাকে। খুব সরল।
ও, তাহলে ওকে বলবে পাবলিক প্লেসে কথা বললে তোমার বদনাম হবে। ও যদি নিজেকে তোমার ভাই হিসেরে ভাবে তাহলে বদনামটা চাইবে না। ঠিক আছে? যাক, তোমার মতিগতি পাল্টালো বলে খুশি হলাম। হাত বাড়িয়ে তিনি একটা খাম টেনে নিলেন, তোমার ব্যাপারটা অমরনাথবাবুকে জানিয়ে এই চিঠিটা লিখেছিলাম। তুমি কথা দিলে আর পোস্ট করব না। কথা দিচ্ছ?
দীপা অনেক কষ্টে মাথা নেড়ে বলল, হঁ। সুপারিনটেনডেন্ট-এর আঙুল চিঠিটাকে ছিঁড়তে লাগল কুচি কুচি করে।
বিকেলের ডাকে চিঠিটা এসেছিল, দীপা পেল রাত্রে। খামটা খুলে সে হতভম্ব। মায়া লিখেছে। মেয়েটার হাতের লেখা সত্যি খারাপ। তার ওপর বানানও ভুল। সম্বোধন দেখে হেসে ফেলল দীপা। আমার প্রাণ পাপিয়া দীপা। আমি কেন যাচ্ছি না। তাতে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছ। আমার পড়াশুনা করতে ভাল লাগত না, সেই দাযি থেকে মুক্ত হলাম। আমি আর পড়াশুনা করব না। কারণ আগামী সপ্তাহে আমার বিয়ে। ছেলে থাকে মালদায়। তাদের বাড়িতেও পড়াশুনার কোন চল নেই। আর আমাকে বই নিয়ে বসতে হবে না। আমি জানি তোমার পক্ষে আমার বিয়েতে আসা সম্ভব নয়। তাই আর নিমন্ত্রণ করলাম না। বিয়ের খবর এখানকার সবাই জানে। শুনেছি সে নাকি প্ৰথমে খুব রাগ পরে কান্নাকাটি করেছে। কারুক আমি আর ভয় পাই না। কারণ তার কাছে যেসব চিঠি আছে তা তোমার লেখা। আমাকে ধরতে পারবে না। আমি একজনকে দিয়ে তাকে ঘটনাটা জানিয়েও দিয়েছি। হয়তো সে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারে। এখন তোমার যা ইচ্ছে। যে ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে সে ব্যবসাদার। টাকার কোন অভাব নেই। আমার বাবা পঞ্চাশ ভরি সোনা আর পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দিচ্ছেন। তাছাড়া আর যা দিচ্ছেন তা বলতে গেলে চিঠি বড় হয়ে যাবে। জানি না। আর কখনও তোমার দেখা পাব কিনা। কিন্তু কথা দিচ্ছি। কোনদিন ভুলব না। সবশেষে, তোমার পায়ে পড়ি, এই চিঠি পড়ামাত্র কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেল। ইতি ভাগ্যবতী, মায়া।
দীপা আবার খামটাকে দেখল। পেছন দিকে লেখা আছে, সাড়ে চুয়াত্তর। প্ৰচণ্ড রাগ হয়ে গেল দীপার। অনুরোধ না থাকলেও এই চিঠি সে জমিয়ে রাখত না। একেবারে শেষ টুকরোটা ছিডেও শান্তি পেল না সে। অশিক্ষিত একটা মেয়ে কতখানি স্বার্থপর হতে পারে মায়া তার বন্ড উদাহরণ। প্ৰথম রাত্রে যে মেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল তার জন্যে তার কপালে এই নাচছিল? মিতার কথা শোনামাত্র সে ঠিক করে নিল যার সঙ্গে প্রেম করা যায় তাকে বিয়ে করতে নেই? অসম্ভব। ওর একটা বাতানা দরকার ছিল। টাকা পয়সা গয়নাগাঁটিব আড়ালে বাঙালী মেয়ে যে সুখ পায় তা ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনেব কুঁকি নিতে বোধ হয় ও কখনই চায়নি। হ্যাঁ, সে নিজেও মায়াকে কোনদিন ভুলবে না। একটি প্ৰতারককে যদ্দিন মনে রাখা যায়, রাখবে।
তারপরেই ভাবনাটা মাথায় এল। মায়ার প্রেমিক কেন তার কাছে আসবে? তার ভূমিকা তো সামান্য। ও অনুরোধ করত বলেই চিঠিগুলো সে লিখে দিয়েছে। কথা ছিল দীপা বন্যানটা লিখে দিলে মায়া তা নকল করে পাঠাবে। মায়া যে সেটা কখনই করেনি তা খেয়াল রাখেনি সে। লোকটা এসে কি বলতে পারে? আপনি কেন ওর হয়ে চিঠি লিখলেন? এতটা সাহস পারে সে? দীপা স্থির করল, এ নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই, লোকটা আগে আসুক।
পরদিন কলেজে গেল সে দল বেধেই। সঙ্গের মেয়েরা দীপার সঙ্গে তেমন কথা বলছিল না। দীপারও ইচ্ছে করছিল না। খানিকটা যাওয়ার পর সে নিশীথকে দেখতে পেল। থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গতকাল সে এখানেই ছিল। দীপার সঙ্গে গল্প করতে করতে কলেজে গিয়েছে। আজ দীপা বাধ্য হল মুখ ঘুরিয়ে নিতে। নিশীথ এগিয়ে এল, কি ব্যাপার, দেখতে পােচ্ছ না নাকি?
এবার অন্য মেয়েরা হনহ নিয়ে হাঁটা শুক করল। দীপা ওদের ডাকল, এই, তোমরা এক মিনিট দাঁড়াবে? খুব অনিচ্ছা নিয়ে ওরা দাঁড়াল কিন্তু অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। নিশীথ কাছে আসতেই দীপা বলল, কিছু মনে কব না। আমার হোস্টেলে থাকা এবং পড়াশুনা করা অসম্ভব হয়ে, যাবে। যদি তোমাদের সঙ্গে কথা বলি। বাধ্য হয়ে আমাকে এই হুকুম মানতে হচ্ছে। তোমরা ক্লাসের বাইরে আমার সঙ্গে কথা বল না। যদি আমার ভাল চাও। কথা শেষ করে সে আর দাঁড়াল না। সঙ্গিনীদের কাছে গিয়ে বলল, ____। এবার মেয়েরা হেসে উঠল। একজন বলল, উঃ, আমার যা ভয় করছিল। তোমার খুব সাহস।
বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে সে শুনল একটি লোক নাকি দুবার তাকে খুঁজতে এসেছিল। বড়দিবি সঙ্গে দেখাও করেছে! জলপাইগুড়ি শহরে কোন পরিচিত মানুষ নেই যে তার সঙ্গে হোস্টেলে এসে দেখা করতে পারে। আধঘণ্টা পারে বড়দির ঘরে তার ডাক পড়ল। দীপা তখন বই নিয়ে বসেছিল। যেমন ছিল তেমন এলোমেলো অবস্থায় চলে এল। পদাঁ সরিয়ে ভেতরে পা দিতেই সে বড়দির সামনে দুজন মানুষকে দেখতে পেল। একজন বৃদ্ধ, বাডিাব কর্মবাচীর মত দেখতে, অন্যজন বছর চল্লিশের মহিলা, শাড়ির ওপর একটা পাতলা চাদর জড়ানো।
বড়দি বললেন, এরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তোমার আত্মীয়।
দীপা শেষ শব্দটা শুনে অবাক হয়ে তাকাল। এবং তখন তার মনে হল মহিলার মুখটাকে সে যেন কোথায় দেখেছে। চট করে কিছুতেই মনে আসছে না। মহিলা উঠে দাঁড়িয়েছিল, কেমন আছ, ভাল?
দীপা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। কিন্তু—।
তুমি আমাকে একদম ভুলে গিয়েছ। তোমার বাবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। কি, মনে পড়ছে না। আমাকে? আমি আনা।
ধক করে বুকে লাগল শব্দটা। আনা। হুড়মুড় করে বিস্মৃতির দেওয়ালটা খসে পড়ল। আনা। হ্যাঁ, এই মহিলাই তাকে বাড়ি থেকে বের করে রিকশায় তুলে দিয়েছিল, এর দেওয়া টাকাতেই ভাড়া মিটিয়ে সে চা-বাগানে পৌঁছাতে পেরেছিল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে এল, এখানে কি করতে এসেছে এই মহিলা?
আনা জিজ্ঞাসা করল, কি, এবার চিনতে পারছ?
বড়দি অকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে। দীপা ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ। ভাল আছেন?
আছি। হাসার চেষ্টা করল আনা।
বড়দি বললেন, ঠিক আছে, তুমি এদের নিয়ে গিয়ে গেস্টরুমে বসে কথা বল।
দীপা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তাকে অনুসরণ করল দুজন। মাথায় কিছুই ঢুকছিল না দীপার। তার সঙ্গে কি কথা বলতে এসেছে। এরা। ওই সম্পর্কটা তো একদম মুছে ফেলেছে। মন থেকে। একটা অমঙ্গলের আশংকা করতে লাগল সে।
গেস্টরুম খালি। আনা সেখানে ঢুকে লোকটিকে বলল, তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও গগনদা। বৃদ্ধ মাথা নেড়ে চলে গেল বাইরে। আনা একটা চেয়ারে বসে বলল, বসো। দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়?
দীপা বসল। তাকে ভাল করে দেখল আনা। তারপর বলল, তুমি বেশ সুন্দর হয়েছ দেখতে। ষড়যন্ত্র করে তোমার কপাল পোড়াল ওরা। আমি তোমার মাকে সাবধান করে। দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বোধ হয় বুঝতে পারেননি।ওই সময় আমি আর কি বেশী বলতে পারতাম। ভাবলে খুব খারাপ লাগে আমার।
দীপা ধীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি কেন এসেছেন?
আনা গলার স্বর শুনে চোখ ছোট করল। তাবপিব জানতে চাইল, এইেব মধ্যে তোমার বাবা কি এখানে এসেছিলেন?
বাবা? না তো! কেন?
ওঁর আসার কথা ছিল। বলেছিলেন সাতদিনের মধ্যে আসবেন। কিন্তু আসেননি। ওঁকে আমার খুব দরকার। তোমাদের চা-বাগানের বাড়িতে একা মেয়েছেলে গেলে খারাপ দেখাবে। তাই তোমার কাছে খোঁজ নিতে এলাম।
বাবাকে আপনার কি দরকার?
তুমি কিছু জানো না?
কি ব্যাপারে?
ও। তাহলে তোমার না জানাই ভাল।
আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
দেখো, যা কিছু বলার তা তোমার বাবাই বলবেন। আনা উঠে দাঁড়াল, আচ্ছা, তোমার কাছে হরদেব ঘোষাল আসে?
কে?
হরদেব। শকুনের মত দেখতে। তোমার বাবার সঙ্গে খুব ভাব।
দীপার মনে পড়ল লোকটাকে। সে ঘাড় নাড়ল, না তো।
যাক। লোকটা কখনও এলে তুমি দেখা করো না। শয়তান।
এ কথা বলছেন কেন?
তোমার শ্বশুরের বন্ধু ছিল এককালে। মেয়ে মানুষের ওপর লোভ ছিল কিন্তু সাহস ছিল না। অবশ্য টাকা পয়সার জন্যে নরকেও যেতে পারে লোকটা।
যার বন্ধু ছিলেন তিনি কি আলাদা?
একই। তবে সে এখন খাবি খাচ্ছে। সেটা জানো নিশ্চয়ই।
না।
তুমি জানো না যে প্রতুলবাবু মৃত্যুশয্যায়? অনেকদিন পড়ে আছেন?
না। ওদের সম্পর্কে আমার কোন আগ্রহ নেই। কিছু জানতেও চাই না। আমি। এসব কথা আমাকে কখনও বলতে আসবেন না।
বারে মেয়ে। বোকার মত কথা বলছি কেন? ব্যানার্জী বাড়ির মালিক হতে যােচ্ছ তুমি, এখন নাক ফুলিযে অভিমান দেখালে কাজ হবে?
সম্পত্তি? আমি না খেয়ে মরে যাব তবু ওদের কিছু নেব না।
কথাটা লিখে দিতে পারবে?
নিশ্চয়ই। আপনি যদি চান এখনই লিখে দিতে পারি। অন্য কেউ হলে আমি কথা বলতাম না। কিন্তু সেদিন আপনি—। যাক, বড়দিকে কি আমার কথা কিছু বলেছেন আপনি?
না। বলেছি আত্মীয়। যাক, যেটা বলেছ সেটা লিখে রাখবে গগনদা এসে নিয়ে যাবে। তাহলে আর তোমার বাবাকে কোন খবর দিতে হবে না! বলার দরকারও নেই। আমি এসেছিলাম। চলি। আনা বেরিয়ে গেল। কিন্তু পরের দিন সকালবেলায় অমরনাথ চলে এলেন হোস্টেলে।