ঐক্য নিয়ে আরো কিছু চিন্তাভাবনা
বাংলাভাষায় একটি শব্দের ব্যবহার ক্রমে বাড়ছে–শব্দটি চিন্তক। যিনি ভক্ষণ করেন। তিনি যেমন ভক্ষক, যিনি গান করেন তিনি যেমন গায়ক, যিনি চিন্তন করেন তিনি তেমনি চিন্তক। বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি বহুব্যবহৃত, কিন্তু খুব সন্তোষজনক নয়। বুদ্ধিকে জীবিকার জন্য ব্যবহার করেন যিনি তিনিই তো বুদ্ধিজীবী। আইনজীবীরা অবশ্যই এঁদের ভিতর পড়েন। কিন্তু আইনকে ফাঁকি দিতেও বুদ্ধি লাগে। চোরাকারবারি বুদ্ধি খাঁটিয়ে খান, সেটাই তাঁর জীবিকা। বুদ্ধিজীবী শব্দটার ভিতর চিন্তার বিশুদ্ধতা অথবা কোনো বৃহৎ লক্ষ্যের আভাস স্পষ্ট নেই। চিন্তন শব্দটির ভিতর সেই আভাস অনেকটা আছে। মন সকলেরই আছে, সংসারে ভালোমন্দ চিন্তা সবাই করেন; কিন্তু মনন অথবা চিন্তনের একটা গভীরতর তাৎপর্য আছে। জীবনের সঙ্গে সেটা যুক্ত, কিন্তু জীবিকার সামান্যতায় তবু আবদ্ধ নয়।
যিনি সার্থক চিন্তক, যিনি মনস্বী, তিনি খও ঘটনাকে, বিভক্ত বস্তুকে, বৃহত্তর কিছুর সঙ্গে যোগ করে দেখেন। এইভাবেই খণ্ডের সঙ্গে তাঁর পরিচয় পূর্ণতা লাভ করে। আসলে সাধারণ মানুষও এইভাবেই বোঝে, এটাই জানবার সাধারণ পদ্ধতি। আমরা যখন কোনো ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাই তখন সেই ব্যক্তির উৎপত্তিস্থল, তাঁর পিতামাতার নাম, দেশ অথবা জন্মস্থান, তিনি এখন কোন কর্মে নিযুক্ত আছেন, এইসবের ভিতর দিয়ে তাঁকে পরিচিত করা হয়ে থাকে, অর্থাৎ, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রেই ব্যক্তিকে আমরা জানি। কোনো ঘটনার কারণ ও পরিণতি সম্বন্ধে ধারণা লাভ হলে তবেই বলি যে ঘটনাটা আমরা বুঝেছি। যুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে যোগস্থাপন। মানুষের স্বভাবের ভিতরই এই ঝোঁকটা আছে। তবে আরো নানা বিপরীত আবেগে, ভয়ে লোভে উন্মাদনায়, এই যোগস্থাপনের প্রচেষ্টা পদে পদে বিপর্যস্ত হয়। বিপর্যয় সম্বন্ধে মানুষকে সতর্ক করা, উচ্চতর ঐক্যের দৃষ্টিতে দ্বন্দ্বমূলক প্রশ্নগুলির বিচার করা, বুদ্ধিজীবীরা যদিও সর্বত্র সুবেদী নন তবু মনন ও চিন্তনের এই কর্তব্য।
বহু দেশ নিয়ে এক পৃথিবী। কথাটা বলা সহজ, কিন্তু বিভিন্ন দেশের ভিতর দ্বন্দ্বের শেষ নেই। এই শতাব্দীতেই আমরা দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি, আঞ্চলিক যুদ্ধ তো অসংখ্য অবিরত চলেছে। দ্বন্দ্ব শুধু দেশে দেশে নয়, দেশের অভ্যন্তরেও সংঘর্ষ লেগেই আছে। এক একটি দেশ নানা জাতি গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সমষ্টি। এদের ভিতর অসাম্য ও অশান্তির শেষ নেই। প্রতিটি গোষ্ঠী আবার বহু পরিবার ও ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত। ব্যক্তির সঙ্গে বৃহত্তর গোষ্ঠীর সামঞ্জস্যরক্ষা, ব্যক্তিস্বাধীনতা আর সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে মেলানো, সমাজের মৌল সমস্যা। প্রতিটি পরিবারের ভিতরই এই মূল সমস্যার আঘাত কিংবা ধ্বনিপ্রতিধ্বনি কোনো না কোনো ভাবে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ, বিভেদের ভিতর ঐক্যস্থাপনের প্রশ্ন মানুষের বৃহৎ সমাজে বহুস্তরে বহুরূপে দেখা দেয়। তবু এদের ভিতর কোথাও একটা মিল আছে। যে-কোনো জটিল সমস্যাকেই বুঝবার সুবিধার জন্য নানা অংশে ভাগ করে নিতে হয়। এটাই বিশ্লেষণী যুক্তির অভ্যাস। অথচ কোনো আংশিক সমাধানই যথেষ্ট নয়, একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী শেষ পর্যন্ত আবশ্যক হয়ে পড়ে।
এই মুহূর্তে এদেশের ও বিশ্বের সামনে কিছু জরুরী প্রশ্ন আছে, ভয়ংকর সমস্যা আছে। এসব হয়তো সাময়িক, তবু অগ্রাহ্য করা যায় না। ভবিষ্যতে আজকের কোনো কোনো প্রশ্ন তুচ্ছ মনে হবে, তবু আজ তাদের মুখোমুখি হওয়া চাই। যা নিতান্ত সাময়িক তাও একেবারে মিথ্যা নয়, তাকে মিথ্যা বললে এগিয়ে যাবার রাস্তা তৈরি হয় না। অথচ সাময়িকতার ঊর্ধ্বে কোনো উচ্চতর সত্য অথবা আদর্শ নেই এই বিশ্বাসে মানুষ শুধুই সুবিধাবাদে বা ভোগবাদে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তাতেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না। মানুষের জন্য কোনো অনিবার্য পথ নই, তাকে পথ বেছে নিতে হয়। অনিবার্যতার তত্ত্ব ইতিহাসে স্বীকার্য নয়। সময়ের সীমানার মধ্যেই পদে পদে একাধিক বিকল্প সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর ভিতর কোনটা শ্রেয় সেটাই বড় প্রশ্ন। সেই পথই খুঁজে নেওয়া আবশ্যক। যাতে সাময়িক সমস্যা উপেক্ষিত নয়, তবু উচ্চতর সত্যের সঙ্গে যার যোগ আছে। চিন্তক সাহায্য করেন সচেতনভাবে পথ বেছে নিতে, খণ্ডকালের সঙ্গে বৃহৎকালের যোগসাধন করতে।
.
২
বহু দেশকে একসূত্রে গাঁথবার চেষ্টা ইতিহাসে বারবার হয়েছে। সাম্রাজ্য, বাণিজ্য এবং ধর্মের ভূমিকা এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রোমক সাম্রাজ্য আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে ইউরোপের দক্ষিণ ভাগের অনেক দেশকে এক কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে এনেছিল। পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর। আফ্রিকার কিছু ভূখণ্ড একসময়ে এই সাম্রাজ্যের সীমানার ভিতর এসে যায়। রোমক সাম্রাজ্য কিন্তু ইতিহাসের প্রাচীনতম সাম্রাজ্য নয়, বিশালতমও নয়। ভারতের ইতিহাসে অশোকের সাম্রাজ্য স্মরণীয়। চেঙ্গিজ খানের যে সাম্রাজ্য একদিন মাঞ্চুরিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল আয়তনে সেটা আরো বিশাল। কালের গতিতে রুশ দেশ থেকে একদিন তার আধিপত্য অপসারিত হল। তারপর ক্রমে গড়ে উঠল অন্য এক সাম্রাজ্য, সাইবেরিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপ অবধি যার প্রসার। সাম্রাজ্যের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বহুবার হয়েছে এবং ভেঙেছে।
প্রাচীন যুগেও সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের একটা সম্পর্ক প্রায়শ দেখা যেত, আমাদের যুগে সেটা আরো স্পষ্ট। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একদা সূর্য কখনো অস্ত যেত না তার সঙ্গে বাণিজ্যের যোগ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেদিন পৃথিবীর দুই গোলার্ধেই।
সাম্রাজ্যের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক প্রাচীন। সম্রাট অশোক বুঝেছিলেন যে যুদ্ধজয়ই যথেষ্ট নয়; তিনি বৌদ্ধধর্মের বাণী প্রচারে আগ্রহী হলেন। রোমক সাম্রাজ্যের প্রথম যুগে যদিও খ্রষ্টধর্ম অবজ্ঞাত ছিল তবু কালক্রমে সেই ধর্মই রাজধর্ম হয়ে উঠল। পয়গম্বর মোহাম্মদের মৃত্যুর একশত বছরের মধ্যে পারস্য থেকে স্পেন পর্যন্ত একে একে বহু রাজ্য ইসলামের পদানত হল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম পৌরাণিক যুগ থেকেই হিন্দু রাজাদের আনুকূল্য লাভ করেছে। হিন্দুধর্মের নানা শাখা আছে, কোনো রাজা শৈব কেউবা শাক্ত কেউ বিষ্ণুভক্ত। ইংরেজ রাজশক্তির সঙ্গে খ্রীষ্টধর্মের যোগের কথা সবাই জানেন, সেটা সবিস্তারে বলা সম্ভবত নিষ্প্রয়োজন। খ্রীষ্টধর্মেরও বহু শাখা, বহু চার্চ। এইরকমই একটি বিশেষ শাখার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পুরনো রুশদেশের সম্রাট। ১৯১৭ সালের লেনিনপন্থী বিপ্লবের পর মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ হয়ে উঠল নতুন রাষ্ট্রধর্ম, এক রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের সূত্রে বাঁধবার চেষ্টা হল সাইবেরিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্যকে।
আধুনিক যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তকে পারস্পরিক প্রভাবের বৃত্তের মধ্যে টেনে আনবার কাজে বাণিজ্য যেমন কার্যকর হয়েছে আর কিছুই বোধহয় তেমন নয়। বাণিজ্যের সঙ্গে বিত্তবানের ক্ষমতা এবং শ্রেণীদ্বন্দ্বের কথাটা জড়িয়ে আছে। কিন্তু আরো কিছু কথা আছে যা তুচ্ছ নয় সভ্যতার ইতিহাসে। বাণিজ্যের ফলে ভৌগোলিক দূরত্বের বাধা সরে যাচ্ছে, মানুষ সচল হচ্ছে, এক দেশের খবর অন্য দেশে অনবরত পৌঁছচ্ছে, বাজারের প্রসার ঘটছে অর্থাৎ দেশে দেশে সম্পর্ক বাড়ছে, উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি একটা আন্তজার্তিক মাত্রা পেয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের ভিতর পারস্পরিক অজ্ঞতা যত কমবে ততই বিভেদও অবশেষে হ্রাস পাবে, ঐক্যবদ্ধ মানবসমাজের ভিত্তি তৈরি হবে, এইরকম চিন্তা আধুনিক যুগের প্রভাতে অনেকের মনে উদিত হয়েছিল। তরুণ মার্ক্সের মনেও এই চিন্তা প্রভাব ফেলেছিল। ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি। “National differences and antagonisms between peoples are daily more and more vanishing, owing to the development of the bourgeoisie, to freedom of commerce, to the world-market, to uniformity in the mode of production and in the conditions of life corresponding thereto. The supremacy of the proletariat will cause them to vanish still faster.” অর্থাৎ মার্ক্স আশা করেছিলেন যে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসারের ফলে দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে প্রভেদ কমে যাবে, আর শ্রমিকশ্রেণীর অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এইসব বিভেদ আরো দ্রুত দূর হয়ে যাবে।
বিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে পৌঁছে আমরা যা প্রত্যক্ষ করলাম তার সঙ্গে পূর্বের ঐ প্রত্যাশার অনেকটাই পার্থক্য আছে। ভৌগোলিক দূরত্বকে মানুষ জয় করেছে, সংবাদের। প্রসারে আশ্চর্য উন্নতি হয়েছে, বাণিজ্যের পরিমাণ ও ভূপর্যটকের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু ভাষা ধর্ম এইসব আশ্রয় করে সাম্প্রদায়িক ও জাতীয় বিভেদের চেতনা এখনো প্রবল। ইসলাম একদিন দুনিয়াটাকে এক ধর্মের বন্ধনে, এক ভ্রাতৃত্বে, আবদ্ধ করবার স্বপ্ন দেখেছে। সাম্রাজ্য একদিন সসাগরা পৃথিবীকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিল। তা হয়নি, তা হবার নয়।
সাম্রাজ্যের জোরে পৃথিবীকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে এমন সম্ভাবনা আজ লুপ্ত। সাম্রাজ্যের দিন ফুরিয়ে এসেছে। পৃথিবীর সব মানুষ ক্রমে ক্রমে এক ভাষা এক ধর্ম এক মতাদর্শ গ্রহণ করবে এমন কোনো কল্পনাকেও মনে স্থান দেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। তবে পৃথিবীতে ঐক্য আসবে কোন পথে?
প্রশ্নটা জরুরী, এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। একদিকে ঐক্যের পূর্বকল্পিত পথগুলি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। অন্যদিকে ঐক্যের প্রয়োজন বেড়েই চলেছে। এমন এমন সমস্যা ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে যার সমাধানের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আবশ্যক, তা ছাড়া উপায় নেই। এর কিছু উদাহরণ সহজেই দেওয়া যায়।
গত দেড়শ’ বছরে যেসব মতবাদ জগতে প্রধান হয়ে উঠেছে তার ভিতর গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র ছাড়াও জাতীয়তাবাদ ও সাম্যবাদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছবার সোপান হিসাবে কখনো কখনো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু কার্যত ভিন্ন ভিন্ন জাতির স্বার্থের দ্বন্দ্বই সকলের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে এবং জাতীয়তাবাদকে উত্তেজিত করে তুলেছে। এযুগের জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভিতর ক্ষমতা নিয়ে কখনো-ঠাণ্ডা-কখনো-গরম যে লড়াই চলে তারই পরিপোষক মতাদর্শ এযুগের। জাতীয়তাবাদ। মানুষের যেখানে স্বার্থের ঐক্য জাতীয়তাবাদের মনোযোগ সেদিকে নয়। এযুগের সাম্যবাদকেও এদিক থেকে বিচার করা আবশ্যক। ধনতন্ত্রের প্রথম যুগে মালিক ও শ্রমিকের ভিতর দ্বন্দ্ব যখন তীব্র হয়ে উঠেছে, উনিশ শতকী সাম্যবাদের সেটাই জন্মলগ্ন। শ্রেণীতে শ্রেণীতে স্বার্থের দ্বন্দ্বটাই সাম্যবাদী তত্ত্ব ও ভাবাবেগকে পরিপুষ্ট করেছে। সমাজের বিভিন্ন অংশের স্বার্থের সংঘাতের উর্ধ্বে সর্বমানবের হিতের কথা একটা রাজনীতিক ধাপ্পা মাত্র, শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রবক্তারা এইরকম ভাবতেই অভ্যস্ত। এই অভ্যাসটার আজ সংশোধন আবশ্যক।
গত কয়েক দশকে পরিবেশরক্ষা ও বৃক্ষরোপণ নিয়ে নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কেউ হয়তো বলবেন যে, গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে নির্বিচারে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির স্বার্থে। এর দীর্ঘকালীন ফলাফল কিন্তু শিল্পপতিসহ সারা সমাজেরই স্বার্থের বিরোধী। নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে দেশে অবশেষে মরুভূমির রাজত্বই বাড়বে, তাতে ক্ষতি সর্বশ্রেণীর মানুষেরই। এই সমস্যাটি সম্বন্ধে বহুদিন আগেই দেশবাসীকে সচেতন করে তুলতে চেয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। শ্যামলা পৃথিবীকে মরুভূমিতে গ্রাস করে নিচ্ছে, যুদ্ধটা এই আগ্রাসী রুক্ষতার বিরুদ্ধে। “মরুবিজয়ের কেতন উড়াতে আহ্বান জানিয়েছিলেন কবি বৃক্ষরোপণ উৎসবের ভিতর দিয়ে। এই উৎসব ও সংগ্রাম সবমানুষের স্বার্থে।
সমস্যাটা আরো একটু বড় আকারে দেখা যাক। তাপ ও বাষ্পের শক্তিকে উৎপাদন ও পরিবহণের কাজে নিযুক্ত করবার কৌশল আয়ত্ত করে শিল্পবিল্পব শুরু হল। আধুনিক শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানির প্রয়োজন বেড়ে চলল। কয়লা ও তেল ছাড়া আধুনিক শিল্পের অনেকটাই অচল। অথচ কয়লা ও তেলের সরবরাহ অফুরান নয়। তা ছাড়া এইসব জ্বালানি পোড়াবার ফলে আবহাওয়াতে বিষাক্ত বা অনিষ্টকর গ্যাস জমে ওঠে। একটা মাত্রা পর্যন্ত সেটা বিপজ্জনক নয়! মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেই বিপদ। আধুনিক শিল্প যতই ছড়িয়ে পড়ছে বিপদটা ততই বাড়ছে। এ বিষয়ে আমাদের নগরসভ্যতা বহুদিন পর্যন্ত অজ্ঞ ও নিরুদ্বিগ্ন ছিল। ইদানীং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে নতুন নতুন তথ্য উদঘাটিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে উদ্বেগের কারণও বাড়ছে। আধুনিক শিল্প ও নগরসভ্যতা যে পথে চলেছে সে পথে আর বেশীদূর অগ্রসর হওয়া নিরাপদ নয়।
ভোগবাদের বৃদ্ধি ও দ্রুত প্রসার এই সময়কার আরেক লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য। আধুনিক শিল্প ও প্রযুক্তি নতুন নতুন ভোগ্যবস্তু মানুষের দৃষ্টির সামনে নিয়ে আসছে। দূরদর্শনের গুণে ধনী দেশ ও ধনী পরিবারের আধুনিকতম ভোগের উপকরণ দরিদ্র দেশেরও মানুষের নজরে আসছে। তোগের তৃষ্ণা ছড়িয়ে পড়ছে। কেতাবী নৈতিকতা দিয়ে আমি এর বিচার করছি না। প্রশ্নটা সহজভাবে এই। যে ভোগের তৃষ্ণা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা মেটাবার মতো সম্পদ কি পৃথিবীতে আছে? আমরা আগেই দেখেছি যে আধুনিক শিল্পের সীমাহীন প্রসার মানুষের পরিবেশের পক্ষে নিরাপদ নয়। অথচ ভোগবাদী জীবন কিছু মানুষের ভিতর সীমাবদ্ধ থাকবে আর অধিকাংশ মানুষ সেদিকে আকৃষ্ট হয়েও বঞ্চিত থাকবে এই অবস্থা সামাজিকভাবে অসুস্থ ও বিপজ্জনক। কোনো এককালে সাধারণ মানুষ অসাম্যকে নিরুপায়ভাবে মেনে নিয়েছিল। আজ সেই অবস্থা নেই। ভোগবাদ আজকের সমাজে অসাম্যের পীড়নকেই অসহনীয় করে তুলছে। বিষাক্ত বাষ্পের মতোই সামাজিক পরিবেশ এক সর্বব্যাপী অসন্তোষে দূষিত হচ্ছে। এটা সকলের পক্ষেই বিপদের কথা, ধনীনির্ধন কেউই এর মার থেকে রক্ষা পাবেন না। এইখানে আমরা সাম্যের তত্ত্বে ফিরে আসছি, অন্য এক যুক্তির পথে। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের কথাই এখানে প্রধান।
শক্তির উৎস হিসাবে কয়লা ও তেলের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করবার জন্য পারমাণবিক শক্তির উপর নির্ভরতার কথা অনেকে ভাবছেন। পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ একাধিক কারণে বিপজ্জনক। সতর্কতা সত্ত্বেও এতে পরিবেশদূষণের ভয়ংকর পথ খুলে যাবে, চেনোবিলের বিপদসঙ্কেত উপেক্ষা করবার মতো নয়। বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। তবে একটা কথা বিশেষভাবে বলা আবশ্যক। আমরা পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের কথা যতই বলি না কেন, সেই শক্তির হিংসাত্মক ব্যবহারের বিপজ্জনক সম্ভাবনা রোধ করা কঠিন। চল্লিশ বছর আগে কেবল বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তির সামনেই ঐ পথ খোলা ছিল। আজ ছোটো ছোটো দেশও ঐ পথে অগ্রসর হচ্ছে, আমাদের ঘরের কাছেই উদাহরণ আছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন অধোম্মাদ কোনো সন্ত্রাসবাদী দল যে ভবিষ্যতে ঐ ভয়ঙ্কর অস্ত্র ব্যবহার করবে না, এমন কথা কি জোর করে। বলা যায়? পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যাপারে আমাদের অত্যন্ত সাবধানে চলাই ভালো। মনে রাখা প্রয়োজন যে, মানুষ অবশেষে এমন এক শক্তি আয়ত্ত করেছে যা দিয়ে গোটা মনুষ্যসমাজকেই ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। অথচ নৈতিকভাবে মানুষ এখনও পশুত্বের খুব উর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
এইমাত্র কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা গেল, এইসব প্রধানত বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সমস্যা। এইসবের ভিতর দিয়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী ক্রমে আকার গ্রহণ করছে। উনিশ শতকী দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা পৃথক। আমরা আজ জানি যে, যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নটা আর দেশবিশেষের অথবা শ্ৰেণীবিশেষের জয়পরাজয়ের প্রশ্ন নয়, সেটা সমগ্র মানবসভ্যতার অস্তিত্বরক্ষার প্রশ্ন। আমরা আরো জানি যে, কোনো বৃহৎ শক্তির অধীনে পৃথিবীকে ধরে রাখা যাবে না, সব দেশের ও সম্প্রদায়ের জন্য যথাসম্ভব। স্বায়ত্বশাসন ও আত্মবিশ্বাসের পথ খোলা রাখতে হবে। আমরা আরো জানি যে, বৃহৎ শিল্পনির্ভর নগরসভ্যতার যে জয়যাত্রা এতদিন অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছিল তারও দিকপরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। এইরকম কিছু কথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এদেশের ও সারা বিশ্বের পুনর্গঠনে যা প্রাসঙ্গিক।
সমাজদর্শনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর আগমনে পুরনো মতবাদ সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয় না; কিন্তু কথার ঝোঁকটা বদলে যায়, কাজেই ভাষারও পরিবর্তন ঘটে। উনিশ শতকের কিছু মতবাদে দ্বন্দ্বের ওপর জোর পড়েছিল। আজও দ্বন্দ্বের বাস্তবতা অস্বীকার করা হচ্ছে না, তবু শান্তি যে অবিভাজ্য, হিংসা ও অসংযম যে আত্মঘাতী হতে পারে, এই কথাটার ওপর। জোর দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে কিন্তু আমাদের বিশ্বদৃষ্টিটাই পালটে যাচ্ছে।
.
৩
সারা পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে যে কথাগুলি এপর্যন্ত বলা হল, ভারত নিয়ে চিন্তাভাবনায় সেসব অগ্রাহ্য হতে পারে না।
প্রায় দু’শ বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ঐক্যের ধারক ছিল। ১৯৪৭ সালে খণ্ডিত ভারত থেকে ব্রিটিশ রাজের সার্বভৌম ক্ষমতা অপসৃত হল। তারপর পাকিস্তান আবারও দু টুকরো হয়েছে। ভারতেও “বিচ্ছিন্নতাবাদী” শক্তি সক্রিয়। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, যদিও চিন্তিত হবার কারণ আছে।
মনে রাখতে হবে, ভারত তার অশেষ বৈচিত্র্য নিয়ে ছোটখাটো একটি পৃথিবী। বিশ্বের প্রতিটি প্রধান ধর্ম এখানে উপস্থিত। এত ভাষা আর কোনো দেশে নেই। ভারতের নিকটতম তুলনা চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। সেখানে কম্যুনিস্ট মতাদর্শকে আশ্রয় করে একদলীয় সর্বগ্রাসী জবরদস্ত রাষ্ট্রতন্ত্র এতদিন চলছিল। সেই শাসন যখন শিথিল হল তখনই সেখানেও “বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির অস্তিত্ব ভালভাবেই টের পাওয়া গেল। এটাকে একটা পৃথিবীব্যাপী ধারা বলে মেনে নেওয়াই ভাল। গোরবাচভ যে-পথে এই সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন সেটা শিক্ষাপ্রদ। সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্যগুলি একের পর এক স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্যের অধিকার দাবি করছে। গোরবাচভ চান, সোভিয়েত দেশের ঐক্য অটুট থাকুক। কিন্তু তিনি জানেন যে, আজ আর সেটা শুধু জোরজুলুমের দ্বারা সম্ভব হবে না। অঙ্গরাজ্যগুলিকে যথাসম্ভব স্বাতন্ত্র ও স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দিতে হবে। ভারতকেও এইরকম কোন পথেই এদেশের সমস্যার সমাধান করতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ। সংখ্যাধিক সম্প্রদায়ের ইচ্ছা অনুযায়ীই দেশ চলবে, এটাই গণতন্ত্রের পথ। গণতন্ত্রের এই ব্যাখ্যা শ্রদ্ধেয় নয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ইচ্ছা অনিচ্ছা অগ্রাহ্য করে যদি শাসন চালানো হয় তবে তাতে গণতন্ত্র রক্ষা পায় না। পরমতসহিষ্ণুতা, অপর সম্প্রদায়ের প্রতি প্রীতির ভাব, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য আবশ্যক। মার্কিন দেশে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় সংখ্যায় অধিক, কৃষ্ণাঙ্গেরা সংখ্যালঘু। কিন্তু মার্কিন দেশের যে ভাবধারা কৃষ্ণাঙ্গের প্রতি সহানুভূতিহীন সেটা সে দেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। একটা মানবিক ঔদার্য গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ!
কেউ কেউ দাবি তুলেছেন, ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বলে ঘোষণা করতে হবে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ যদি ইসলামি রাষ্ট্র হয় তবে ভারত কেন হিন্দুরাষ্ট্র হবে না? এটা সুযুক্তি নয়। পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্র বলেছেন যাঁরা তাঁরা কি গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবান? আমরা তাঁদের পথে যাব কেন? তাতে আমাদের দেশের মানুষের কোন উপকার হবে? ওঁরা বলছেন, তাতে ভারতের ঐক্য দৃঢ়তর হবে? কথাটা কি সত্য? ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বলে প্রচার করলে শিখদের মনে এদেশের সঙ্গে একাত্মবোধ বাড়বে? নাগা মিজোদের মনে? ভারতীয় মুসলমানদের তাতে ভারতের প্রতি আনুগত্য বাড়বে? না। কি যতটুকু আনুগত্য আছে সেটা এরপর আরো কমে যাবে?
এমন কথাও কেউ কেউ বলেন যে, প্রয়োজন হলে মুসলমানদের ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য করতে হবে। এ দেশের কোটি কোটি মুসলমান ভারত ত্যাগ করে কোথায় যাবেন? বাংলাদেশ ওঁদের নেবে না, পাকিস্তান ওঁদের নেবে না–পাকিস্তান বিহারী মুসলমানদের। নিতে রাজি হয়নি। এসব কথার পরিণাম কি? এ শুধু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে দেবার পথ। এ পথে ঘাতকবাহিনীর সংখ্যা ও প্রতাপ বাড়বে, জুলুমবাজ ফাশিপন্থীদের ক্ষমতা বাড়বে। হিন্দু-মুসলমানসহ সারা দেশের সাধারণ মানুষের এতে অমঙ্গল। যেমন সারা বিশ্বে বহু বিচিত্র সংস্কৃতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আবশ্যক, সেই পথেই শান্তি ও মানুষের মঙ্গল, তেমনি ভারতেও কোনো প্রবল কেন্দ্রীয় শক্তির চাপে সকল সম্প্রদায়কে একপথে। চালনা করবার চেষ্টায় দেশের শুধুই অকল্যাণ, সেটা ভারতের শ্রেষ্ঠ সাধনার বিপরীত। সেই সাধনা এখনো পূর্ণ হয়নি, যুগ যুগ ব্যাপী একটি প্রয়াস রূপেই সেটা আছে, সেটাই পথ। ভারত-ইতিহাস-চচা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ কথাটা স্পষ্ট করেই বলেছেন “কী করিলে পরস্পরে মিলিয়া এক বৃহৎ সমাজ গড়িয়া উঠে, অথচ পরস্পরের স্বাতন্ত্র্য একেবারে বিলুপ্ত না হয়, এই দুঃসাধ্য সাধনের প্রয়াস বহুকাল হইতে ভারতে চলিয়া আসিতেছে, আজও তাহার সমাধান হয় নাই।” রবীন্দ্রনাথ ঐক্যসাধন ও একাকারীকরণের মধ্যে একটা গুরুতর প্রভেদ দেখেছিলেন। যাঁরা আজ ঐক্যসাধনের নামে একাকারীকরণের চেষ্টায় নেমেছেন তাঁদের কাছে বিনীতভাবে তবু দৃঢ়ভাবে সমস্যাটা পুনর্বিবেচনা করবার জন্য অনুরোধ জানানো ছাড়া গত্যন্তর নেই।
হিন্দুরা নিজেদের ভিতর ঐক্যবদ্ধ নয়। মুসলমান-বিদ্বেষের সাহায্যে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা যাবে এ ধারণা ভুল। সমস্যা সমাধানের শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে আমাদের অভ্যস্ত হতে হবে। তা নইলে যে হিংসার শক্তি নিয়ে আজ আমরা অপর সম্প্রদায়কে আক্রমণ করব সেই হিংসাই কাল আত্মঘাতী হয়ে ফিরে আসবে, হিংসার আগুন গৃহযুদ্ধের আকারে কেবলই ছড়িয়ে পড়বে। হিংসাকে হিংসা দিয়ে ঠেকানো যাবে না।
জাতপাতের সংঘাত সম্প্রতি বেড়ে গেছে। জাতিভেদপ্রথা সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। যে আকারে এই প্রথা প্রচলিত তাতে ঘোরতর অসাম্য আছে। একদিকে এ দেশের গণতান্ত্রিক সংবিধান, যাতে সকলের সমান অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উচ্চারিত, অন্যদিকে বিভেদমূলক জাতিভেদপ্রথা, এই দুয়ের সহাবস্থান অশান্তি সৃষ্টি করবেই। যেমন আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের ভিতর ধনী-দরিদ্রের দারুণ পার্থক্য অসন্তোষ সৃষ্টি করে তেমনি দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতিসম্প্রদায়ের ভিতর ঘোরতর অসাম্য সামাজিক অস্থিরতার কারণ হয়।
স্বীকার করা প্রয়োজন যে, এই অসাম্য দূর করবার জন্য এদেশে তেমন কার্যকর কোনো চেষ্টা এখনো দেখা যায়নি। চেষ্টা নানাদিক থেকেই হতে পারে। শিক্ষাগত মানে অনুন্নত জাতগুলি অনেকখানি পিছিয়ে আছে। এদের ভিতর শিক্ষার অভাব দূর করবার জন্য বিশেষ কার্যক্রম প্রয়োজন। আসলে এটাই সর্বপ্রথমে প্রয়োজন। বিভিন্ন জাতের মানুষের ভিতর দ্বন্দ্ব না বাড়িয়েই এ কাজে অনেকটা অগ্রসর হওয়া সম্ভব, আর দ্বন্দ্ব যদি বাড়েও তবু এ কাজটা করে যেতে হবে। তাছাড়া ভূমিসংস্কার এবং নানারকম স্বনিযুক্ত কাজে সুযোগবৃদ্ধির ভিতর দিয়ে পিছিয়ে-পড়া দুর্বল মানুষের অবস্থার উন্নতি হতে পারে। সংরক্ষণনীতি নিয়ে সম্প্রতি দেশের ভিতর সংঘাত বেড়ে গেছে। সংরক্ষণ মানে এখানে সরকারি চাকরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ। মনে রাখা দরকার যে, সরকারি চাকরীতে নিয়োগের জন্য একটা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা চাই। অনুন্নত জাতগুলিতে সেই যোগ্যতাসম্পন্ন লোকেরই খুব অভাব। কাজেই শিক্ষায় উন্নতির দিকেই মনোযোগ দেওয়া বিশেষ আবশ্যক। এ কাজটা কঠিন, কিন্তু এটা না হলে অন্য কিছুতেই বিশেষ ফল হবে না। আর এটা হলে অন্য সবই অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যাবে।
আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দরকার একটা বড় রকমের সাংস্কৃতিক রূপান্তর। হিন্দুদের অনেক মন্দিরে আজও তথাকথিত নীচুজাতের মানুষের প্রবেশের অধিকার নেই। এটা অত্যন্ত লজ্জার কথা। নতুন মন্দির গড়ার চেয়েও পুরনো মন্দিরের দ্বার অপমানিত মানুষের জন্য অবারিত করা সত্য ও মনুষ্যত্বের বিচারে বেশি জরুরী। শুচিতা অশুচিতা নিয়ে সূক্ষ্ম স্তরভেদ হিন্দুর আচারে বিচারে অভ্যাসে এমনভাবে ঢুকে আছে, আমরা অনেকে তাতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, যে এর হীনতা ও অমানবিকতা আমরা লক্ষ করতেই ভুলে গেছি। কিন্তু যাঁদের আমরা ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রেখেছি তাঁরাও আজ জাগছেন। মনুষ্যত্বের অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ক্রমে বাড়ছে, বাড়বে। যাঁরা এতদিনের সুবিধাভোগী তাঁরাই যদি এগিয়ে এসে পিছিয়ে-পড়া মানুষের সঙ্গে হাত মেলান তবে পরিবর্তনটা অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণভাবে ঘটতে পারে।
ক্ষমতা যতই রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীকৃত হচ্ছে ততই রাষ্ট্রযন্ত্রে স্থানলাভের জন্য মারামারি বাড়ছে। সংরক্ষণের প্রশ্নটাও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। অনেক সমস্যারই মূল। এখানে। সমাজে রাষ্ট্রযন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের স্থানটা সংকুচিত করা দরকার। রবীন্দ্রনাথ একথা বহুবার বলে গেছেন অনেকদিন আগে। আজকাল পঞ্চায়তী রাজের কথা অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছে। আমাদের সংবিধানে ঐ কথাটা বীজরূপে আছে, যদিও তার পরিণত রূপ নেই। সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : “The State shall take steps to organise village panchayats and endow them with such powers and authority as may be necessary to enable them to function as units of self-government.” এদেশে স্বায়ত্তশাসনের বনিয়াদ তৈরি করবে গ্রাম পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েত সমিতিতে পিছিয়ে-পড়া জাতের জন্য আসন সংরক্ষিত করা যেতে পারে। জনগণের প্রতিনিধিত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে এতে আপত্তি হওয়া উচিত নয়, উচ্চবর্ণের মানুষই বরাবর নিম্নবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করবে এটা অসঙ্গত। অবশ্য এমন সময় আসতে পারে যখন এই রকম সংরক্ষণের আর প্রয়োজন থাকবে না। তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা পালটানো উচিত হবে।
এদেশে পঞ্চায়েতসহ সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানেরই বিকৃতির কিছু সাধারণ কারণ আছে। অনেক বছর ধরে যে শাসনব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছে তার ঝোঁক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দিকে। রাজনীতিক দলগুলির লক্ষ গদিতে বসা, গদি আঁকড়ে থাকা। যেহেতু ক্ষমতা নিয়ে লড়াইটাই মুখ্য, কাজেই এই দলগুলিও লড়াইয়ের অস্ত্র হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি আরো বেড়েছে ভোগবাদের প্রচণ্ড প্রভাবে। নতুন মধ্যবিত্তের এই নেশা বেড়েই চলেছে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে পঞ্চায়েতের জন্ম। পঞ্চায়েতও হয়ে উঠেছে কোথাও আমলাতন্ত্রের আজ্ঞাবাহী, কোথাও দলীয় লড়াইয়ের পদাতিক ও হাতিয়ার এবং প্রায়শ দুর্নীতিগ্রস্ত। তাছাড়া রাষ্ট্র যেমন তার অধিকারের কোনো সীমা মানতে চায়, ক্ষমতায় অধিষ্ঠত দল যেমন সবকিছুকেই নিজের নিয়ন্ত্রণের ভিতর নিয়ে আসতে চায়, পঞ্চায়েতের তেমনি স্বৈরাচারিতার দিকে ঝোঁক দেখা দিচ্ছে। এইসবই দুঃখজনক। গ্রামোন্নয়নের জন্য এমন অনেক কাজই আছে, যেমন বৃক্ষরোপণ, পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা ও শিক্ষার প্রসার, উপযোগী প্রযুক্তির প্রচার ও প্রবর্তন, যেখানে পঞ্চায়েতের একটা সদর্থক ভূমিকা সম্ভব ও প্রয়োজন, কিন্তু সেখানে। দলীয়তা যত কম থাকে ততই ভাল। সুনিয়মের সীমার ভিতর ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে যথাসম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। স্বায়ত্তশাসন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণই লক্ষ্য।
একই সঙ্গে ঐক্য চাই, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে ঐক্যের বিরোধ নেই। ক্ষমতা নিয়ে লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে দেশ টুকরো টুকরো হতে চলেছে। এই হিংস্র লড়াইটাকে কী করে সংযত করা যায় সেটাই প্রশ্ন, তা নইলে সর্বনাশ। এদেশের মনস্বীরা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কথা বলেছেন। বিকেন্দ্রীকরণ ও মৌল বা “তৃণমূল” স্বায়ত্তশাসনের ভিতর দিয়েই এই বৈচিত্র্যবিধৃত ঐক্য রক্ষা করা সম্ভব। বাঁচবার জন্যই ঐক্যের প্রয়োজন, ঐক্যের আরো। প্রসার প্রয়োজন। রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতি সবই এইখানে এসে মিশেছে। দেশভাগের ভিতর দিয়ে ঐক্যের প্রয়োজনটাই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তার পথ সম্বন্ধে আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে।
ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কিছুদিন আগে এদেশের এক প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তানকে আটকাবার জন্য ভারতের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকা একান্ত আবশ্যক। সারা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আমরা যুদ্ধসাজের যে দৃশ্য দেখে এসেছি ভারতীয় উপমহাদেশে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। পার্থক্য এই, পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলির তুলনায় আমাদের দেশ অনেক দরিদ্র। ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশের মতো অতি দরিদ্র দেশে খাদ্য-বস্ত্র বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের যতই অভাব থাকুক না কেন যুদ্ধের অস্ত্রসংগ্রহের জন্য অকাতরে অর্থব্যয় চলেছে, এই অবস্থাকে আমরা অসহায়ভাবে মেনে নিচ্ছি, এর চেয়ে দুভাগ্যের কথা আর কী হতে পারে! দেশকে যতই টুকরো টুকরো করা হবে ততই যুদ্ধশিবিরের সংখ্যা বাড়বে, সেনাবাহিনীর ভার সামলাতে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে। যাবে। এই পথে কারো নিরাপত্তা নেই, যুদ্ধ যদি বাধে তবে তার আঘাত সকলের পক্ষেই ভয়ংকর হবে। এই পরিস্থিতি থেকে কি উদ্ধার নেই?
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপে দুই যুদ্ধশিবির গড়ে উঠেছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর এই অবস্থাটাকে অনিবার্য মনে হয়েছে, পরিবর্তনের কোনো আশাই দেখা যায়নি। অবশেষে ১৯৯০ সালে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেছে। ইউরোপ শান্তি ও পুনর্মিলনের দিকে পা বাড়িয়েছে। এটা কোনো যুদ্ধের পথে ঘটেনি, ঘটতে পারত না। অহিংসা শব্দটি অথবা তার প্রতিশব্দ এখন ইউরোপীয় নেতাদের মুখে বারবার শোনা যাচ্ছে। মানুষের ইতিহাসে ভষ্যিদ্বাণী করা যায় না, তবু ইউরোপ যে একটা নতুন পথ। খুঁজে পেয়েছে সেটা স্পষ্ট। ভারতের সামনে কি নতুন পথ নেই? সমগ্র ভারতীয়। উপমহাদেশের জন্য একটাই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকবে, একটিই সেনাবাহিনী, এটা কি অসম্ভব স্বপ্ন? অতিসীমিত কিছু দায়িত্ব নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় শাসন, অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য স্বায়ত্তশাসনের উদার অধিকার, গ্রামপঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিকে স্বায়ত্তশাসনের বনিয়াদী প্রতিষ্ঠান বলে স্বীকৃতি দান, এই পথেই তো শান্তি স্বাধীনতা ও ঐক্যের জন্য নতুন সংবিধান রচনা সম্ভব। এটা হয়তো আজও দূরের লক্ষ্য। কিন্তু ইতিহাস অভাবনীয় পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা রক্ষা করা ছাড়া উপায় কী?
নবচিন্তকেরা নতুন আশার জন্ম দেন, তাকে লালন করেন, ক্রমে সেটা বাস্তবে পরিণত হয়। সংকটের অন্ধকারের মধ্যেই নতুন আশা অংকুরিত হয়, স্বপ্নের কুঁড়িরা আলোর জন্য। উৎসুক হয়ে ওঠে, ক্রমে নবচেতনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এইরকমই বারবার হয়েছে।
এ দেশে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন শীঘ্র আশা করা যায় না। উন্নতির কোনো অনিবার্য ঊর্ধ্বরেখাও নেই। তবু মনে রাখতে হবে যে আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যেখানে শেষ পর্যন্ত ঐক্যের বিকল্প নাস্তি, ঐক্যের বিকল্প বিনাশ। পথ যদিও পতন-অভুত্থানে বন্ধুর তবু লক্ষ্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণাটা পরিষ্কার হওয়া চাই। ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে যে বৃহৎ ঐক্যের কথা এইমাত্র বলা হয়েছে, সারা পৃথিবীর ঐক্যের যেটা আঞ্চলিক প্রতিচ্ছবি, তাকেই লক্ষ্য বলে জানতে হবে। লক্ষ্য স্থির হলে বিচার পরিষ্কার হয়। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছিলেন “দুঃসাধ্যসাধনের প্রয়াস”, আমরা প্রত্যেকে গ্রামে শহরে সর্বত্র, নিজ নিজ ছোটো বৃত্তের ভিতর, তারই অনুকূল সমাজ ও সংস্কৃতির রচনার কাজে যদি সাধ্যমতো নিযুক্ত থাকি তবেই রামায়ণের সেই ক্ষুদ্রা কাঠবেড়ালটির মতো ঐতিহাসিক সেতু রচনার কাজে আমরা সামান্য কর্মীর মর্যাদার অধিকারী হব। এ দায়িত্ব হিন্দুর, এ দায়িত্ব মুসলমানের, প্রতি সম্প্রদায়ের, প্রতিটি ব্যক্তির। গান্ধীর মৃত্যুদিবসে কি আমরা নতুন করে শপথ নেব?
দেশ, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১