একা একা জল ঠেলে নৌকোটাকে পুকুরঘাটে নিয়ে এল ঝুমা। আর আসতেই দেখা গেল, বাগানের ভেতর সুধা সুনীতি আনন্দ রুমা এবং ঝিনুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিকার-কাহিনীর আসর তা হলে ভেঙেছে।
সুধারাও বিনুদের দেখতে পেয়েছিল দেখামাত্র ছুটে এল। উদ্বেগের সুরে সুধা বলল, এই, তোরা কোথায় গিয়েছিলি রে? সুনীতি-আনন্দ রুমাও সেই একই প্রশ্ন করল। ঝিনুক অবশ্য কিছু বলল না। তীক্ষ্ণ কুটিল চোখে ঝুমা আর বিনুকে দেখতে লাগল।
বিনু নীরব। ঝুমা লাফ দিয়ে নৌকো থেকে মাটিতে নামল। তারপর বলল, আমরা ফুল তুলতে গিয়েছিলাম। এই দেখ কত নিয়ে এসেছি–পদ্ম শাপলা আর কচুরি ফুলে নৌকো বোঝাই হয়ে আছে। সেগুলো দেখাল ঝুমা।
রুমা বলল, কী দস্যি মেয়ে তুই!
এদিকে নিঃশব্দে বিনুও নেমে এসেছিল। সুধা তাকে ধরল, ওইটুকু বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে গিয়েছিলি, যদি জলে পড়ে যেতিস? তুই তো সাঁতার টাতার জানিস না! বলতে বলতে তার চোখ প্রখর হয়ে উঠল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিনুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে বলল, এদিকে আয় তো–
ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গেল বিনু। ছোটদির যা চোখ, ওকে বিশ্বাস নেই। হয়তো তার জলে ডোবার ব্যাপারটা ধরেই ফেলেছে। দূর থেকেই সে বলল, না, যাব না।
তোর চুল কিরকম ভেজা ভেজা, জামা-প্যান্ট কোঁচকানো মোচকানো। জলে ভিজেছিলি নাকি?
আরেকটু দূরে সরে আবছা গলায় বিনু কী বলল, বোঝা গেল না।
সন্দিগ্ধ চোখে বিনুর হাবভাব দেখতে দেখতে আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল সুধা, এই সময় রুমা বলে উঠাল, এই ঝুমা, তোর চুলগুলোও তো ভেজা, ইজের ফ্ৰেক কোঁচকানো কোঁচকানো। কী করছিলি বল তো তোরা?
বিনু লক্ষ করল, ঝুমা একটুও ভয় পেল না। যেন কিছুই হয় নি, এমনভাবে নিরীহ ভালমানুষের মত মুখ করে ডাহা মিথ্যে বলে গেল, বিনুদাদা না আমার গায়ে জল ছিটিয়ে দিচ্ছিল, আমিও ওর গায়ে দিয়েছি। তাই ভিজে গিয়েছিলাম।
পাজি মেয়ে–
ব্যাপারটা আরও কিছুক্ষণ হয়তো চলত, তার আগেই আনন্দ বলে উঠল, আমার একটা প্রস্তাব আছে।
সবাই উৎসুক চোখে তার দিকে ফিরল। সুধা জিজ্ঞেস করল, কিসের প্রস্তাব?
কবজি উলটে ঘড়ি দেখে নিয়ে আনন্দ বলল, সবে এগারোটা বাজে। খাওয়াদাওয়ার এখনও দেরি আছে। ততক্ষণ নৌকোয় করে আমরা একটু ঘুরে আসি না কেন?
সুধা বলল, খুব ভাল, খুব ভাল–
সুনীতি কিছু বলল না। তবে ঘাড় কাত করে জানালো, এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। রুমা তো প্রায় হাততালি দিয়ে উঠল, আমরা নৌকোয় চড়ব। কী ভাল যে লাগছে!
আনন্দ বলল, সবাই যখন রাজি তখন আর দেরি করে দরকার নেই। আসুন–আসুন–
সুনীতি সবার আগে ছিল। সে প্রথমে নৌকোয় উঠল। তারপর উঠল আনন্দ। আনন্দর ঠিক পরেই ছিল সুধা। নৌকোর দিকে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল সে।
আনন্দ বলল, কী হল?
সুধার মাথায় ততক্ষণে অনেকখানি দুষ্টুমি ভর করে বসেছে। কৌতুকের আভায় তার নীলচে চোখ ঝিকমিক করছে। ঠোঁট টিপে সে বলল, কিছু হয় নি।
তা হলে উঠে পড়ুন।
ভুরু কুঁচকে কেমন করে যেন আনন্দর দিকে তাকাল সুধা। বলল, উঠব?
আনন্দ বলল, বাঃ, বেশ! নৌকোয় করে ঘোরা হবে বলে কথা হল। না উঠলে ঘুরবেন কী করে?
সুধা উত্তর দিল না। কেউ কিছু বুঝবার আগেই হঠাৎ এক কান্ড করে বসল সে। গলুই ধরে জোর ধাক্কায় নৌকোটাকে গভীর জলের দিকে ঠেলে দিল।
আনন্দ প্রথমটা বিমূঢ়। পরক্ষণে চেঁচিয়ে উঠল, এটা কী হল, এটা কী হল!
সুধার ষড়যন্ত্রটা ধরতে পেরে সুনীতিও চিৎকার করছে, বাঁদর মেয়ে, পাজি মেয়ে—
সুধা পুকুরঘাট থেকে গলা তুলে বলতে লাগল, আনন্দদা, দিদি আপনার শিকারের গল্প খুব ভালবাসে। শুনতে শুনতে একেবারে মুগ্ধ-মুগ্ধ-মুগ্ধ হয়ে যায়। সুযোগ করে দিলাম, যত পারেন শুনিয়ে দেবেন। বলে হেসে হেসে গলে পড়তে লাগল।