১.১ সুলতান মাহমুদ গযনবীর জন্ম

ভারত অভিযান (মাহমূদ গজনবীর ভারত অভিযান) (প্রথম খণ্ড)
এনায়েতুল্লাহ আলতামাস / অনুবাদ – শহীদুল ইসলাম
সুলতান মাহমুদ গজনবীর ঐতিহাসিক সিরিজ উপন্যাস

.

উৎসর্গ

মাতৃত্বের সুখানুভূতি বুঝে ওঠার আগেই কোলজুড়ে আসা ফুটফুটে ছেলেটি নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে চলে গেলো জান্নাতের শিশুকাননে।

ছেলে হবে দীনের সৈনিক, দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে দেবে উজাড় করে, মায়ের সেই শাশ্বত স্বপ্ন রয়ে গেলো অধরা।

রাব্বুল আলামীন তাকে বীরক সন্তানের গর্বিতা মা হিসেবে কবুল করুন।

–অবাদক

.

প্রকাশকের কথা

আলহামদুলিল্লাহ। বর্তমানে এদেশে উর্দুভাষী ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ’র পরিচয় দেয়ার নিষ্প্রয়োজন, তদ্রূপ বিশিষ্ট লেখক গবেষক ও অনুবাদক শহীদুল ইসলাম-এরও বিশেষ পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন নেই।

ইসলামী উপন্যাসের রুচিবান পাঠক মাত্রই তার অনুবাদ ও লেখার সাথে পরিচিত। কালজয়ী ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ-এর অন্যতম কীর্তি সুলতান মাহমুদ গজনবীর ভারত অভিযান সিরিজ এর এটি প্রথম খণ্ড। পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

নানাবিধ সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা এটিকে সার্বিক সুন্দর করার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। পাঠক পাঠিকা মহলে এ সিরিজ আদৃত হলেই আমাদের প্রয়াস স্বার্থক হবে বলে আমি মনে করছি।

–প্রকাশক

.

লেখকের কথা

“মাহমূদ গজনবীর ভারত অভিযান” সিরিজের এটি প্রথম খণ্ড। উপমহাদেশের ইতিহাসে সুলতান মাহমূদ গজনবী সতের বার ভারত অভিযান পরিচালনাকারী মহানায়ক হিসেবে খ্যাত। সুলতান মাহমূদকে আরো খ্যাতি দিয়েছে পৌত্তলিক ভারতের অন্যতম দু’ ঐতিহাসিক মন্দির সোমনাথ ও থানেশ্বরীতে আক্রমণকারী হিসেবে। ঐসব মন্দিরের মূর্তিগুলোকে টুকরো টুকরো করে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন মাহমুদ। কিন্তু উপমহাদেশের পাঠ্যপুস্তকে এবং ইতিহাসে মাহমূদের কীর্তির চেয়ে দুষ্কৃতির চিত্ৰই বেশী লিখিত হয়েছে। হিন্দু ও ইংরেজদের রচিত এসব ইতিহাসে এই মহানায়কের চরিত্র যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে তার সুখ্যাতি চাপা পড়ে গেছে। মুসলিম বিদ্বেষের ভাবাদর্শে রচিত ইতিহাস এবং পরবর্তীতে সেইসব অপইতিহাসের ভিত্তিতে প্রণীত মুসলিম লেখকরাও মাহমূদের জীবনকর্ম যেভাবে উল্লেখ করেছেন তা থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের বোঝার উপায় নেই, তিনি যে প্রকৃতই একজন নিবেদিতপ্রাণ ইসলামের সৈনিক ছিলেন, ইসলামের বিধি-বিধান তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। জাতিশত্রুদের প্রতিহত করে খাঁটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও দৃঢ় করণের জন্যেই নিবেদিত ছিল তার সকল প্রয়াস। অপলেখকদের রচিত ইতিহাস পড়লে মনে হয়, সুলতান মাহমূদ ছিলেন লুটেরা, আগ্রাসী ও হিংস্র। বারবার তিনি ভারতের মন্দিরগুলোতে আক্রমণ করে সোনা-দানা, মণি-মুক্তা লুট করে গজনী নিয়ে যেতেন। ভারতের মানুষের উন্নতি কিংবা ভারত কেন্দ্রিক মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা তার কখনো ছিলো না। যদি তঙ্কালীন ভারতের নির্যাতিত মুসলমানদের সাহায্য করা এবং পৌত্তলিকতা দূর করে, ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়ার একান্তই ইচ্ছা তার থাকতো, তবে তিনি কেন মোগলদের মতো ভারতে বসতি গেড়ে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেন না? ইত্যাকার বহু কলঙ্ক এঁটে তার চরিত্রকে কলুষিত করা হয়েছে।

মাহমূদ কেন বার বার ভারতে অভিযান চালাতেন? মন্দিরগুলো কেন তার টার্গেট ছিল? সফল বিজয়ের পড়ও কেন তাকে বার বার ফিরে যেতে হতো গজনী? ইত্যাদি বহু প্রশ্নের জবাব; ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ সৈনিক সুলতান মাহমূদকে তুলে ধরার জন্যে আমার এই প্রয়াস। নির্ভরযোগ্য দলিলাদি ও বিশুদ্ধ ইতিহাস ঘেটে আমি এই বইয়ে মাহমূদের প্রকৃত জীবন চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রকৃত পক্ষে সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর মতোই মাহমূদকেও স্বজাতির গাদ্দার এবং বিধর্মী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়াই করতে হয়েছে। যতো বার তিনি ভারত অভিযান চালিয়েছেন, অভিযান শেষ হতে না হতেই খবর আসতো, সুযোগ সন্ধানী সাম্রাজ্যলোভী প্রতিবেশী মুসলিম শাসকরা গজনী আক্রমণ করছে। কেন্দ্রের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাধ্য হয়েই মাহমূদকে গজনী ফিরে যেতে হতো। একপেশে ইতিহাসে লেখা হয়েছে, সুলতান মাহমুদ সতের বার ভারত অভিযান চালিয়েছিলেন, কিন্তু একথা বলা হয়নি, হিন্দু রাজা-মহারাজারা মাহমূদকে উৎখাত করার জন্যে কতত শত বার গজনীর দিকে আগ্রাসন চালিয়ে ছিল।

সুলতান মাহমুদের বারবার ভারত অভিযান ছিল মূলত শত্রুদের দমিয়ে রাখার এক কৌশল। তিনি যদি এদের দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হতেন, তবে হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকতাবাদ সাগর পাড়ি দিয়ে আরব পর্যন্ত বিস্তৃত হতো।

মাহমূদের পিতা সুবক্তগীন তাকে অসীয়ত করে গিয়েছিলেন, “বেটা! ভারতের রাজাদের কখনও স্বস্তিতে থাকতে দিবে না। এরা গজনী সালাতানাতকে উৎখাত করে পৌত্তলিকতার সয়লাবে কাবাকেও ভাসাতে চায়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময়ের মত ভারতীয় মুসলমানদেরকে হিন্দুরা জোর জবরদস্তি হিন্দু বানাচ্ছে। এদের ঈমান রক্ষার্থে তোমাকে পৌত্তলিকতার দুর্গ গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ভারতের অগণিত নির্যাতিত বনি আদমকে আযাদ করতে হবে, তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে।”

আলবিরুনী, ফিরিশতা, গারদিজী, উতবী, বাইহাকীর মতো বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদগণ লিখেছেন, সুলতান মাহমূদ তৎকালীন সবচেয়ে বড় বুযুর্গ ও ওলী শাইখ আবুল হাসান কিরখানীর মুরীদ ছিলেন। তিনি বিজয়ী এলাকায় তার হেদায়েত মতো পুরোপুরি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তিনি নিজে কিরখানীর দরবারে যেতেন। কখনও তিনি তাঁর পীরকে তার দরবারে ডেকে পাঠাননি। উপরন্তু তিনি ছদ্মবেশে পীর সাহেবের দরবারে গিয়ে ইসলাহ ও পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তিনি আত্মপরিচয় গোপন করে কখনও নিজেকে সুলতানের দূত হিসেবে পরিচয় দিতেন। একবার তো আবুল হাসান কিরখানী মজলিসে বলেই ফেললেন, “আমার একথা ভাবতে ভালো লাগে যে, গজনীর সুলতানের দূত সুলতান নিজেই হয়ে থাকেন। এটা প্রকৃতই মুসলমানের আলামত।”

মাহমূদ কুরআন, হাদীস ও দীনি ইলম প্রচারে খুবই যত্নবান ছিলেন। তার দরবারে আলেমদের যথাযথ মর্যাদা ছিল। সব সময় তার বাহিনীতে শত্রু পক্ষের চেয়ে সৈন্যবল কম হতো কিন্তু তিনি সব সময়ই বিজয়ী হতেন। বহুবার এমন হয়েছে যে, তার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। তখন তিনি ঘোড়া থেকে নেমে ময়দানে দু’রাকাত নামায আদায় করে মোনাজাত করতেন এবং চিৎকার করে বলতেন, “আমি বিজয়ের আশ্বাস পেয়েছি, বিজয় আমাদেরই হবে।” বাস্তবেও তাই হয়েছে।

অনেকেই সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী আর সুলতান মাহমূদকে একই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের বীর সেনানী মনে করেন। অবশ্য তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য একই ছিল। তাদের মাঝে শুধু ক্ষেত্র ও প্রতিপক্ষের পার্থক্য ছিল। আইয়ুবীর প্রতিপক্ষ ছিল ইহুদী ও খৃষ্টশক্তি আর মাহমূদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল হিন্দু পৌত্তলিক রাজন্যবর্গ। ইহুদী ও খৃস্টানরা সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর সেনাদের ঘায়েল করতে প্রশিক্ষিত সুন্দরী রমণী ব্যবহার করে নারী গোয়েন্দা দিয়ে আর এর বিপরীতে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে এরা ব্যবহার করতো শয়তানী যাদু। তবে ইহুদী-খৃস্টানদের চেয়ে হিন্দুদের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল দুর্বল কিন্তু সুলতানের গোয়েন্দারা ছিল তৎপর ও চৌকস। । তবে একথা বলতেই হবে, সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর গোয়েন্দারা যেমন দৃঢ়চিত্ত ও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল ছিল, মাহমূদের গোয়েন্দারা ছিল নৈতিক দিক দিয়ে ততোটাই দুর্বল। এদের অনেকেই হিন্দু নারী ও যাদুর ফাঁদে আটতে যেতো। অথবা হিন্দুস্তানের মুসলিম নামের কুলাঙ্গররা এদের ধরিয়ে দিতো। তারপরও সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর চেয়ে সুলতান মাহমুদের গোয়েন্দা কার্যক্রম ছিল বেশি ফলদায়ক।

ইতিহাসকে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য, বিশেষ করে তরুণদের কাছে হৃদয়গ্রাহী করে পরিবেশনের জন্যে গল্পের মতো করে রচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থ। বাস্তবে এর সবটুকুই সত্যিকার ইতিহাসের নির্যাস। আশা করি আমাদের নতুন প্রজন্ম ও তরুণরা এই সিরিজ পড়ে শত্রু-মিত্রের পার্থক্য, এদের আচরণ ও স্বভাব জেনে এবং আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হয়ে পূর্বসূরীদের পথে চলার দিশা পাবে।

–এনায়েতুল্লাহ
লাহোর।

.

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

৯৭১ সালের পয়লা নভেম্বর, ৩৫৭ হিজরী সনের দশই মুহররম। সেদিন মানবেতিহাসে সূচিত হলো এক নতুন অধ্যায়। জন্ম নিলো এমন এক কালজয়ী মহাপুরুষ, যার নাম শুনলে হাজার বছর পরে আজো মূর্তিপূজারী হিন্দুদের গা কাঁটা দেয়। কলজে কেঁপে ওঠে। সেই মহাপুরুষের নাম সুলতান মাহমুদ গযনবী। ইতিহাসে যিনি আখ্যা পেয়েছেন ‘মূর্তি সংহারক’ নামে।

হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে পৃথিবীতে ঘটে গেছে কতো ঘটনা, কতো বিবর্তন। কতো রাজা, মহারাজা, দুঃশাসন, সুশাসন দেখেছে প্রাচ্য এশিয়ার জমিন। এখানকার মাটিতে কতো বনি আদমের খুন মিশে আছে তার ইয়ত্তা নেই। কতো আদম সন্তান, এক আল্লাহর ইবাদতকারী বহু দেবতাপূজারী মূর্তিপূজকের নির্যাতনে নিষ্পিষ্ট হয়েছে এরও নেই সঠিক পরিসংখ্যান। কিন্তু একটি কথা ইতিহাসের পাতায় চির সমুজ্জ্বল মূর্তি ভাঙ্গার ইতিহাস। পৌত্তলিকদের মনগড়া দেবদেবীর মিথ্যা স্বর্গ ভেঙ্গেচুরে মহাজগতের সত্য ও প্রকৃত স্রষ্টা মহান আল্লাহর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। একবার দু’বার নয়, পরাজয়-পরাভবকে দু’পায়ে দলে সতের বার ভারতের মূর্তিপূজারী পৌত্তলিক প্রভুদের সৃষ্ট সাম্রাজ্য খান খান করে ধুলায় মিশিয়ে দেয়ার ইতিহাস। সেই কালজয়ী ইতিহাসেরই জনক সুলতান মাহমুদ।

সুলতান মাহমূদ ইতিহাসের এক জীবন্ত কিংবদন্তী। এখনও জীবন্ত তার কর্মকৃতি। বেঈমানদের কাছে মাহমূদ গয়নবী হিংস্র, সন্ত্রাসী, খুনী, অত্যাচারী কিন্তু মুসলমানদের কাছে সুলতান মাহমূদ মর্দে মুজাহিদ, মহানায়ক, ভারতীয় মজলুম মুসলমানদের ত্রাণকর্তা, মূর্তিবিনাশী।

আজ থেকে হাজার বছর আগে। মহাভারত জুড়ে ছিল মূর্তি ও মূর্তিপূজারীদের একচ্ছত্র রাজত্ব। মানুষ ছিল মানুষের দাস। মানুষের উপর প্রভুত্ব করতো মানুষ। মানুষের হাতে তৈরি মূর্তি-পদতলে জীবন দিতো মানুষ।

আজ ভারতের মন্দিরে মন্দিরে শোভিত যে মূর্তি, সেসব কাদা মাটির ঘূর্তিকে ভেঙ্গেচুরে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে সুলতান মাহমূদ সেই সময়ের পরাজিত পূজারীদের বলেছিলেন, “কাদা-মাটির এসব ভূত ও মূর্তি মানুষের প্রভু হতে পারে না, যদি তোমাদের মাটির ওইসব দেবদেবীর কোন ক্ষমতা থাকে তবে বলল, নিজেদের ক্ষত-বিক্ষত টুকরোগুলোকে পুনর্গঠিত করে আমাকে এভাবে টুকরো টুকরো করে ফেলুক।”

পারেনি। ধ্বংসাবশেষ থেকে দুমড়ানো মুচড়ানো মূর্তির টুকরো আর জোড়া লাগেনি। মাটিতে মিশে যাওয়া দেবদেবীরা খাড়া হয়ে রুখতে পারেনি মূর্তিসংহারী মাহমূদকে। সুলতান মাহমুদের বিজয়ী সৈনিকেরা কাদা-মাটির মূর্তির উপর দিয়ে তাদের ঘোড়া হাকিয়ে দিলো। সোমনাথ থানেশ্বরের বিশালকায় মূর্তিগুলো মাহমূদ গযনবীর অশ্ববাহিনীর খুরাঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো, পদাতিক বাহিনীর পদতলে পৃষ্ঠ হয়ে মাটির সাথে মিশে গেলো। প্রতিরোধ করবে তো দূরে থাক আত্মরক্ষাও করতে ব্যর্থ হলো। সে সময়ের ব্রাহ্মণেরা দেবতাদের অক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেছিল, স্বীকার করেছিল এক আল্লাহ্র বড়ত্ব, মেনে নিয়েছিল এক আল্লাহ্র গোলাম মাহমূদ গযনবীর বশ্যতা। অতঃপর পেরিয়ে গেল অনেক দিন।

এক সময় অতীত হয়ে গেলেন মাহমূদ গযনবী। ভারতের মন্দিরে মন্দিরে আবারো শুরু হলো শঙ্খধ্বনি, শুরু হলো গীত-ভজন। মন্দিরের শূন্য বেদীতে পুনঃস্থাপিত হলো আরো বিশাল বিরাটাকার পাথর-কংক্রীটের শক্ত মূর্তি। ব্রাহ্মণরা নতুন উদ্যোগে পুনরোদ্যমে শুরু করলো ভগঃভজনা। ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ খুঁড়িয়ে দিয়ে হিন্দু-তপস্বীরা মূর্তিসংহারের প্রতিশোধ নিলো; জানিয়ে দিলো, সন্ন্যাসীরা মূর্তিনাশীদের প্রতিশোধ নিয়েছে, মুসলমানদের ইবাদতখানা মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে সেখানে মূর্তি স্থাপন করেছে। তারা মুসলমানদের শক্তি, বীরত্ব, কীর্তি গাঁথার ইতিহাসকে মুছে দিয়েছে।

বিগত হাজার বছরে মুসলমানরা ভারতের পৌত্তলিকদের কাছেই শুধু আত্মবিসর্জন দেয়নি, পৃথিবীর যে সব ভূখণ্ডে মুসলমানরা ছিল দণ্ডমুণ্ডের মালিক, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিধর্মীদের কাছে এসবের কর্তৃত্ব চলে গেছে। মুসলমানরা হারিয়েছে ঈমানী শক্তি, জাতীয়তা বোধ, বিস্মৃত হয়েছে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বনবীর দেয়া শিক্ষা থেকে দূরে সরে পড়েছে। পরিণতিতে ভিমরুলের মতো চতুর্দিক থেকে হামলে পড়েছে বেঈমানেরা, সম্বিত হারানো ব্যাঘ্রের মতো মুসলিম নওজোয়ানরা দংশিত হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রহিত হয়ে গেছে নিজেদের সৃষ্ট তুফানে। এখন মুসলমানদের অবস্থা টালমাটাল।

পুনরায় ভারতে ফিরে এসেছে পৌত্তলিকতার জৌলুস। গষনবী যেসব দেবালয় ধ্বংস করেছিলেন সেগুলো এখন আগের চেয়ে আরো বেশি জমজমাট। আধুনিকতার রঙিন ফানুসে উজ্জ্বলতার মূর্তিগুলো যেন পরিহাস করে বলছে, মুসলমানদের খোদা এখন আর নেই, এখন আর নেই মূর্তিসংহারী কোন মাহমূদ। ওরা সব মরে গেছে।

মিথ্যার ভূত ধ্বংসকারীদের চারিত্রিক রূপ কেমন হয়ে থাকে, আর ইসলামের শিকড় কীভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে কেটে দেয়া হয়, সেই সব জিজ্ঞাসার জবাব এবং অজানা অধ্যায়গুলোর চাপা পড়া ভয়ঙ্কর সব ঈমান কেনাবেচার উপাখ্যান জানতে হলে ফিরে তাকাতে হবে অতীতের দিকে, উন্মোচন করতে হবে ইতিহাসের ভাগাড় ঘেঁটে প্রকৃত সত্যকে, ঐতিহাসিকের দৃষ্টি যেখানে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। সমকালীন শাসকদের তৈরি কঠিন প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে কোন পর্যবেক্ষকের সন্ধানী দৃষ্টিও নাগাল পায়নি প্রকৃত সত্যের, অন্ধকার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এই প্রকৃত সত্য ইতিহাস, চেপে রাখা ইতিহাস।

সত্য চাপা পড়ার কারণে মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামী বীর সেনাদের কীর্তি বদলে গেছে, সত্যের পতাকাবাহীরা কথিত ইতিহাসে আখ্যা পেয়েছেন খলনায়ক আর খলনায়কদের দেয়া হয়েছে মহানায়কের আসন। সত্য-মিথ্যার আলো-আঁধারে মিশ্রিত ইতিহাসের জঞ্জাল যাচাই করে প্রকৃত সত্য উঘাটন করা যে কঠিন তা আন্দাজ করা যায় এ থেকেই যে, সুলতান মাহমূদ গযনবীকে সমকালীন প্রখ্যাত দুই মুসলিম ইতিহাসবিদও চিত্রিত করেছেন এভাবে :

“মাহমূদ গযনবী ছিলেন সোনা-দানা ও সম্পদ প্রাচুর্যের প্রত্যাশী। মন্দির ও মূর্তি ধ্বংসে তার বেশি আগ্রহের কারণ ছিল সেগুলোর ভেতরের মণি-মুক্তা, সোনা-দানা কজা করা”। অথচ অনেক হিন্দু ইতিহাসবিদও অকপটে বলেছেন যে, “মাহমূদ গযনবীর মণি-মুক্তা, সোনার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তিনি সোমনাথের মূর্তিগুলোকে আট আটটি টুকরো করে বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন, তার সৈনিকেরা এগুলোকে পায়ে পিষে ফেলেছিলো, মূর্তির গায়ে কিংবা মন্দিরের কোথাও সোনা-দানা, মণি-মুক্তা গচ্ছিত রয়েছে কি-না অথবা মূর্তির গায়ে অলঙ্কার জড়ানো ছিল কি না এসবের প্রতি তাদের আদৌ ক্ষেপ ছিল না। মাটি ও পাথরের তৈরি এসব মূর্তির প্রতি মাহমূদ ও তার সৈনিকের ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। এগুলোর প্রতি আগ্রহভরে তাকানো, এসব থেকে সোনা-দানা খুলে নেয়ার কথা প্রকৃতপক্ষে মাহমুদের প্রতি আরোপিত চরম অপবাদ।”

মিথ্যা গুজবে ভর করে চলে। মিথ্যা ধ্বংসকারীদের সন্তানেরাই যখন গুজবকে সত্য বলে স্বীকার করে নেয়, পূর্বপুরুষদের প্রতি তাকায় সংশয় ও সন্দেহভরা দৃষ্টিতে, তখন সত্যের ভিত কেঁপে ওঠে, সত্যের শিকড় মূল থেকে ছিন্ন হতে থাকে, সত্যাশ্রয়ীরা আখ্যা পায় অত্যাচারীরূপে।

সেই ইতিহাসের অন্ধকারেই আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যদিও সত্যের নাগাল পাওয়া কঠিন। তবে ইতিহাসের দিক-নির্দেশনা চিহ্নগুলোকে অবলম্বন করে সামনে অগ্রসর হলে অবশ্যই সত্যের নাগাল পাওয়া যাবে, বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো সত্যের উপাদানগুলো একত্রিত করতে পুরো ঘটনা পূর্বাপর বেরিয়ে আসবে, খসে পড়বে মিথ্যার পলেস্তরা। তখন মাটিচাপা সত্য জীবন্ত হয়ে দেখা দেবে। একটু অনুসন্ধান করলেই বোঝা যায়, ইতিহাসকে মিথ্যার আবর্জনা দিয়ে চেপে রাখা যায় না, কীর্তিকে কলমের খোঁচায় মিটিয়ে দেয়া যায় না, জীবনত্যাগী শহীদ ও মজলুমদের আর্তনাদ ভুলে থাকা যায় না। কান পেতে শুনলে মাটি সত্য কথা বলে, সত্যাশ্রয়ীদের রক্তের উষ্ণতা অনুভব করা যায়, মজলুমের আহাজারি আজো ইথারে ভেসে বেড়ায়। এ সবকিছু অনুধাবন ও উদ্ধার করার জন্যে দরকার ঈমানদীপ্ত অনুভূতি, আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হৃদয়। ইথারে ভাসমান সেসব ঈমানদীপ্ত বীর সেনানীদের ঈমান জাগানিয়া তকবীর ধ্বনি, বেঈমানদের প্রতি তেজদীপ্ত-হুংকার ও তরবারীর ঝনঝনানি হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে থাকতে হবে হৃদয় খাঁচায় হেরার নূরের জ্যোতি। হৃদয়ে ঈমানের দ্যুতিহীন আল্লাহর অভিশপ্ত সে সব মানব-পশুদের দলে থেকে মুমিন ও বেঈমানদের মধ্যে পার্থক্য পরখ করা অসম্ভব। যেহেতু আল্লাহ নিজেই ওইসব মিথ্যাবাদীদের আখ্যা দিয়েছেন পশুদের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে। ঘোষণা করেছেন, “যারা সত্য বিমুখ ওদেরকানে সীসা ঢেলে দেয়া হয়েছে, ওদের অনুভূতিকে ভোতা করে দেয়া হয়েছে, ওরা দুনিয়াতেও ঘৃণিত অপমানিত আর আখেরাতেও ওদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। মহান আল্লাহ্ ভালো জানেন, আখেরাতের শাস্তি কতো যন্ত্রণাদায়ক।”

৯৪০ সালের দু’চার বছর আগে বা পরের ঘটনা। ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক ইরানের বাদশাহ নওশেরোয়ার শাসন অতীত হয়ে গেছে। ইরানের ক্ষমতার সিংহাসনে যারা আসীন হয়েছে ন্যায় ও ইনসাফের প্রতি তাদের চরম অনাগ্রহ। তারা ক্ষমতাপ্রিয়, ভোগ ও বিলাস-ব্যসনে মনোযোগী। তারা নিজেদের মনে করতো দেশের মালিক-মোখতার আর সাধারণ জনগণকে ভাবতো তাদের প্রজা-দাসানুদাস। প্রজাদের বেলায় ন্যায় ও আদল-ইনসাফের নীতিবাক্য তারা ছিঁড়ে ফেলে মানুষকে গোলাম-বাঁদীতে পরিণত করার সব ধরনের ব্যবস্থাই রপ্ত করেছিল। তাদের নীতি ছিল, প্রজাদের ভুখা রাখো, ওদের মুখ বন্ধ করে দাও, সত্যকে গলা টিপে মেরে ফেলে। সুবিচার ও রাজ সুবিধা ওদের দাও যারা শাসকদের গুণ গায়, রাজ্য জুড়ে তোষামুদে তৈরি কর। মোসাহেব ও তোষামোদকারীদের মধ্য থেকে উজির নাজির বানাও। প্রজাদের অবস্থা এমন করে রাখো, যাতে মানুষ কুকুরের মুখ থেকে হাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে সন্তানের আহার যোগাতে বাধ্য হয়। ইরানের শাসকেরা বাদশাহ নওশেরোয়ার বপিত ইনসাফের বৃক্ষকে উপড়ে ফেলে দিয়ে ইরান থেকে ইনসাফ ও সুশাসন বিদায় করে ন্যায় ইনসাফের প্রতীক নওশেরোয়ার বংশধরদেরকেও ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য করে। জুলুম ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নওশেরোয়ার অধঃস্তন পুরুষেরা ইরান ছেড়ে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ল। ক্ষমতার মসনদ থেকে ছিটকে পড়ে নওশেরোয়ার বংশধরেরা জীবন বাঁচানোর তাকিদে যে দিকে পারল বেরিয়ে পড়ল। জীবন-জীবিকার যাতনা ও দুর্ভোগ তাদের স্থান থেকে স্থানান্তরে যাযাবরে পরিণত করলো ।

যারা ছিল ন্যায়ের ঝাণ্ডাবাহী, তারা অন্যায় ও জুলুমের যন্ত্রণায় দূর দেশে পাড়ি জমাল। তাদের বয়স্করা দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছিল। শিশুরা বড় হতে লাগল অতি কষ্টে। আর এ দুরবস্থার মধ্যেই নওশেরোয়ার বংশে আরো নতুন নতুন শিশুর জন্ম হতে থাকল।

এই বংশের এক টগবগে যুবক কিবারুল হাকাম বিন কিরার আরসালান। মাঝারী গড়ন, দীপ্তিময় চেহারা চেহারায় উচ্চ বংশের ছাপ পরিস্ফুট কিন্তু দারিদ্র্যের মলিনতায় বংশীয় আভিজাত্যের পেলবতা দূরীভূত।

বুখারার এক মেঠো পথে নতুন ঠিকানার উদ্দেশে চলছে যুবক। ক্লান্ত শ্রান্ত কিরার আল হাকাম একটি গাছের ছায়ায় বসে পড়ল। জায়গাটি জঙ্গলাকীর্ণ, ঝোঁপঝাড়ে ভরপুর। কানে ভেসে আসছে ছোট শিশু-কিশোরদের হৈ চৈ। আল হাকামের দৃঢ় বিশ্বাস, ওপাশে হয়তো কোন যাযাবর দল তাবু ফেলেছে। ক্লান্ত আল হাকাম মাথার নীচে কাঁধের পুটলিটা রেখে শুয়ে পড়ল।

কচি শিঙা হৈ চৈ, খেলাধুলা ও দৌড়-ঝাপে মগ্ন হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। এলাকাটা নীরব নিস্তব্ধ। দুপুর গড়িয়ে তখন পড়ন্ত বেলা। গুন গুন একটি মিষ্টি আওয়াজ আল হাকামকে মুগ্ধ করল । তখনও সে বুঝে উঠতে পারছিল না, আওয়াজটা কোত্থেকে আসছে, এটি কিসের আওয়াজ! কিন্তু তার মনের কোণে আওয়াজটা হঠাই কেমন যেন নাড়া দিল। গভীরভাবে কান পেতে বুঝতে চেষ্টা করল আল হাকাম। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠলো গুঞ্জরণ। আর কিছু নয়, তিলাওয়াত। কোন নারী কন্ঠের আওয়াজ। গভীর মনোনিবেশে মনের মাধুরী মিশিয়ে তিলাওয়াত করছে কোন নারী। আওয়াজের ধরন থেকেই আল হাকাম বুঝতে পারলো, এটা বয়স্ক নারী কণ্ঠ নয়, কোন কিশোরী-যুবতীর কণ্ঠ। বেশ সুন্দর। পড়ন্ত বেলায় এই বিজন এলাকায় কিশোরীর তিলাওয়াত অপেক্ষাকৃত দূর থেকেও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে আল হাকাম।

আল হাকাম আর শুয়ে থাকতে পারল না। শরীরের ক্লান্তি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। বেশ ফুরফুরে লাগছে তার। তাড়াতাড়ি হেঁটে ঝোঁপঝাড়ের এপাশটা ঘুরে আওয়াজটার দিকে এগিয়ে দেখল, তিন-চারটে ছেঁড়া ফাড়া কাপড়ের তাঁবু টাঙ্গানো। কাছেই একটি কিশোরী কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন। কণ্ঠ যেমন মধুর, কিশোরী দেখতেও তেমনটি হৃদয়কাড়া। তাঁবু থেকে একটু দূরে দুই বুড়ো বসে রশি পাকাচ্ছে। তাবুর অন্য পাশে কজন মহিলা আর কয়েকটি ছোট শিশু। কজন শক্ত সামর্থ্য পুরুষও আছে।

কিরার আল হাকামকে আসতে দেখে সবাই তার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। লম্বা লম্বা পা ফেলে আল হাকাম তাদের কাছে এসে দাঁড়াল।

“আপনাদের এ মেয়েটি একটি আয়াত ভুল পড়েছে”। বুড়োদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলল আল হাকাম।

“আপনারা অনুমতি দিলে আমি তার ভুল শুধরে দিতে পারি।”

“ও কি ভুল শুদ্ধ পড়েছে আমরা শুনিনি। কাজে ব্যস্ত ছিলাম।” বলল এক বুড়ো।

“আপনাদের শোনা উচিত। কোত্থেকে এসেছেন আপনারা?” জিজ্ঞেস করল আল হাকাম

“আমরা তুকী। তুর্কী মুসলমান।” এক বুড়ো বলল।

তা তো আপনাদের দেখেই আমি বুঝতে পারছি আপনারা মুসলমান। ঠিক আছে আমি আগে ওর ভুলটা শুধরে দেই।

ধীর পায়ে এগিয়ে তেলায়াতকারী কিশোরীটির কাছে গিয়ে বসল আল হাকাম। অজ্ঞাত কেউ কাছে বসছে ঠাহর করে কিশোরী মুখ ফেরাল এবং কুরআন শরীফ পড়া বন্ধ করে দিল। অচেনা পুরুষকে কাছে বসতে দেখে সে জিজ্ঞাসুনেত্রে বুড়োদের দিকে তাকাল। তার চোখের চাওনিতে অপার জিজ্ঞাসা, কে এই পুরুষ এভাবে তার কাছে এসে আসন গ্রহণ করল?

আল হাকাম কোন ভণিতা না করেই বলল, “কুরআন শরীফ খোল। তুমি এক জায়গায় ভুল পড়ছিলে”। কিশোরী সে আয়াত থেকে আবার তিলাওয়াত করেও ভুল পড়ল।

আল হাকাম তার ভুল শুধরে দিলো। নিজের ভুল ধরতে পেলে কৃতজ্ঞচিত্ত দৃষ্টিতে কিশোরী আল হাকামের মুখের দিকে তাকাল।

এই আয়াতের অর্থ জানো?

কিছু কিছু বুঝি, পরিষ্কার না, লাজনম্র ভাষায় বলল কিশোরী। আমাদের সাথে এক বুযুর্গ ব্যক্তি থাকতেন। তিনি আমাকে কুরআন শরীফ পড়িয়েছেন, অর্থও শিখাতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সাপের দংশনে তিনি মারা গেছেন। এখন

আমি কিছু কিছু অর্থ বুঝি কিন্তু সব আয়াতের অর্থ বুঝি না।

আমার কাছে শোন! আমি তোমাকে অর্থ বলে দিচ্ছি :

“ইবরাহীমকে স্মরণ কর, নিশ্চয়ই তিনি সত্য নবী ছিলেন। তিনি তাঁর পিতাকে বলেছিলেন, আপনি এমন সব জিনিসের পূজা করেন, যেগুলো কোন কিছু শুনতে পারে না। আমার কাছে এমন তথ্য আছে যা আপনার জানা নেই। আপনি আমার কথা মানুন, আমি আপনাকে সঠিক পথের সন্ধান দিব।”

আল হাকাম কিশোরীকে পঠিত আয়াতের অর্থ বুঝিয়ে দেয়ার পর বলল, সামনের আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন

“অতঃপর ইবরাহীম যখন ওসব মূর্তি ও মূর্তিপূজারীদের থেকে ভিন্ন হয়ে গেলেন, তখন আমি তাকে ইসহাক ও ইয়াকুব দান করেছি এবং সবাইকে নবী বানিয়েছি।”

তুমি জানো, এখানে আল্লাহ্ তায়ালা কোন্ ঘটনা বললেন? ওরা মূর্তি পূজা তো আর ওই সব মাটির মূর্তির কাছে নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য না করতো। তুমি তো জানো, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই।

আল হাকাম কিশোরীকে বলছিল, যেসব মূর্তি কিছু বলতে পারে না, শুনতে পারে না, কিছু করতে পারে না পৌত্তলিকরা সে সবের পূজা করে, আসলে সবই এদের হাতে তৈরি মাটির পুতুল।

আল হাকামের মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল কিশোরী, আর তয় হয়ে শুনছিল তার কথা। মুখে কোন শব্দ ছিল না। তার হৃদয় মনে অবিল আনন্দের ঢেউ তরঙ্গায়িত হচ্ছিল। গোত্রের অন্যান্য পুরুষও ইতোমধ্যে আল হাকামের পাশে এসে বসে গেল।

হঠাৎ গমনোদ্যত হলো আল হাকাম। পা বাড়াল চলে যাওয়ার জন্য। বুড়োরা তাকে থামাল। কিশোরীর কাছ থেকে একটু দূরে বড়দের আগের জায়লায় গিয়ে বসল সে।

তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো? কোথায় যাবে? জিজ্ঞেস করল এক বুড়ো।

ইরানের মাটি আমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেছে। বলল আল হাকাম। যাদের বাপ-দাদা ন্যায়-ইনসাফের দ্বারা ইরানের মানুষকে দিয়েছিল সীমাহীন মর্যাদা, যারা মানুষের জন্য ইরানকে পরিণত করেছিল সুখের ঠিকানা, তাদের সন্তানেরা আজ জঙ্গলের জীবজন্তুর মত বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তো কোন কীট-পতঙ্গ ছিলাম না যে, পেটের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে ঝাড়জঙ্গলে বসবাস করবো, কিন্তু তিন চার পুরুষ যাবত আমাদের তাই করতে হচ্ছে। জালেমদের অত্যাচার ও জুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের খান্দান যাযাবরে পরিণত হয়েছে। যেদিকে যখন মন চায় সে দিকে চলতে থাকে।

তুমি কি বলতে চাচ্ছো, তুমি ন্যায় শাসক নওশেরোয়ার বংশধর? বলল এক বুড়ো।

আমাদের বাপ-দাদার মুখে তার অনেক কিচ্ছা-কাহিনী শুনেছি, কিন্তু আমাদের কাছে ওই সব কাহিনী রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়।

আচ্ছা, তোমরা কোথায় তাঁবু ফেলেছো? জিজ্ঞাসু নেত্রে প্রশ্ন করল অপর বুড়ো।

আমি একা। বলল আল হাকাম।

ছোটবেলা থেকেই কুরআন শরীফের সাথে আমি জীবনের অধিকাংশ সময় মসজিদেই কাটিয়েছি।

তোমার কথা দারুণ সুন্দর। বলল এক বুড়ো। যদি থাকতে চাও আমাদের সাথে থাকতে পারো, আর যেতে চাইলেও অন্তত একদিন আমাদের এখানে আতিথ্য গ্রহণ করো।

আজ রাতটা এখানেই থেকে যাওয়ার চিন্তা করল আল হাকাম। খুব একটা জ্ঞান-গরীমাওয়ালা লোক নয় আল হাকাম, কিন্তু যাযাবরদের কাছে আল হাকামর্কে মনে হলো বুযুর্গ লোক। থেকে যাওয়ার প্রস্তাবে রাজী হওয়ার পর তার পাশে দাঁড়ালো সবাই।

আল হাকামের কথা সবাইকে রূপকথার গল্পের মতো স্বপ্নলোকে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই বিকেল থেকে রাত অবধি একনাগাড়ে তার কথাই শুনছিল তাবুর সব লোক।

রাত যখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গম্ভীর হতে থাকল, একজন দু’জন করে উঠতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত যুবক, পৌঢ়, শিশু-কিশোর, মহিলা সবাই তাঁবুতে চলে গেল। বুড়ো দু’জন খোলা আকাশের নীচে বিছানা পেতে আল হাকামের কাছেই শুয়ে পড়ল। নানা কথার ফাঁকে দু’বুড়ো জোর দিয়ে বলল :

তুমি আমাদের সাথে থাক।

আল হাকাম ভাবছিল, ওরা কেন তাকে তাদের সাথে থাকতে বলছে। আল হকামের মনের কোণে কিশোরীর শান্ত সৌম্য কান্তিময় চেহারা উঁকি মারল। কিন্তু বেশি ভাবনায় না গিয়ে সরাসরি বুড়োদের জিজ্ঞেস করে বসল আল হাকাম:

“আমার দ্বারা কি আপনাদের কোন কাজ হবে?”

আমাদের গোত্রে পুরুষ কম, মহিলা বেশি। পুরুষ বেশি থাকতে সুবিধা। আমাদের নানাবিধ ভয়। জঙ্গলের হিংস্র জীব-জন্তুই নয় এর চেয়েও হিংস্র অনুষ-লুটেরা, ডাকুদের ভয়টা বেশি। ওই যে মেয়েটা, ওকে নিয়ে আমাদের ভীষণ দুশ্চিন্তা। আমাদের দলে কোন অবিবাহিত পুরুষ নেই। বড়দের সবার বউ আছে, আর বাকীরা ছোট। এই মেয়েটার জন্য কোন বর পাওয়া যাচ্ছে না। ওটা আমাদের ঘাড়ে কঠিন দায়িত্বের বোঝা হয়ে আছে। বলল এক বুড়ো।

‘ওকে তো তুমি দেখেছো, ওর কুরআন পড়া শুনেই তো তুমি এদিকে এলে। ও কুপও হয়তো দেখে থাকবে তুমি। তুমি আমাদের সাথে থাক, আর ওই মেটোকে বিয়ে কর।’ বলল অপর বুড়ো।

আমি ছাড়া আর কোন মানুষ কি আপনারা পাননি? আর কোন মানুষের কাছে কেন ওকে বিয়ে দেননি? নাকি আমিই আপনাদের কাছে আসা প্রথম পুরুষ ব্যক্তি?

অনেক লোকই এসেছে। ওকে নিয়ে কাড়াকাড়িও হয়েছে বেশ। কিন্তু ওদের সবাই ব্যবসায়ী। মেয়েটাকে কিনে নিতে চাইলো। কে কার চেয়ে বেশি দেবে এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ওকে নিয়ে বিবাদও পর্যাপ্ত হয়ে গেছে। আমরা একবার ব্যবসায়ীদের হাতে ওকে তুলে দেয়ার চিন্তাও করেছিলাম। কিন্তু মেয়েটা বড়ই জেদি। এমন করলে সে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দিল। এরপর এ সিদ্ধান্ত বাদ দিলাম।

সেই সময় অবাধে নারী কেনা-বেচা হতো। ধনাঢ্য ও আমীর-উমরা, পছন্দ মতো নারীদের টাকার বিনিময়ে সগ্রহ করে নিজেদের হেরেম গুলজার করতো। ইরানী বেদুঈন ও যাযাবর মেয়েদের অঙ্গসৌষ্ঠব, রূপলাবণ্য, সৌন্দর্য কিংবদিতুল্য। এ জন্য এ ধরনের যাযাবর গোত্রে নারীলোভীরা মেয়ের তালাশ করতো। মেয়ে বেচা-কেনা করা বেদুঈন ও যাযাবর গোত্রের মধ্যে কোন দোষণীয় ছিল না। অনেকটাই রেওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। রীতিমতো মানুষ কেনা-বেচার হাট বসতো। ওসব হাটে সব ধরনের নারী-পুরুষ বেচা-কেনা হতো। যুবতী নারী ও বালক-বালিকাদের সরবরাহ আসত ডাকাতদের কাছ থেকে। ওরা মুসাফিরদের আক্রমণ করে ধন-সম্পদ ও ছোট ছেলে-মেয়ে ও যুবতী মেয়েদের অপহরণ করে বাজারে এনে বিক্রি করে দিতে। ওসব হাটের সুন্দরী যুবতী-কিশোরীদের কদর ছিল বেশি। অধিকাংশ আমীর ক্ষমতাবান লোকেরা সুন্দরী মেয়েদের চড়া দামে খরিদ করে নিজেদের হেরেমের শোভা বর্ধনা করতো। শরিফ মেহমানদের মনোরঞ্জন, আপ্যায়ন ও নিজেদের সেবা-যত্নের কাজে, আত্মদৈহিক মনোরঞ্জনে ব্যবহার করা হতো এদের। ক্ষমতার মসনদে থাকা লোকদেরকেও স্বার্থান্বেষী মহল সুন্দরী যুবতী উপঢৌকন দিতো।

কোন যাযাবর বেদুঈন মেয়ে বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এমন তো শুনিনি। আপনারা ওর কথা মেনে নিলেন কেন?

ও এমন সব কথা বলে যে, এতে আমাদের ভয় হয়। বলল এক বুড়ো।

তুমি হয়তো জানো, আমাদের মতো ছন্নছাড়া মানুষের মধ্যে ধর্ম-কর্ম তেমন থাকে না। কোন মানুষ যদি সুন্দরী মেয়েকে চড়া দামে বিক্রি করে দিতে পারে, নিজ স্ত্রীকেও বেশি টাকা পেয়ে তালাক দিতে পারে, তার আর ধর্ম থাকে! কিন্তু আমরা মুসলমান। ধর্ম-কর্ম ঠিকমতো পালন না করলেও খোদার ভয় তো আছে। আমরা কুরআন কিতাব ভয় করি। মরণেরও ভয় আছে। এই মেয়েটা কুরআন পড়ে। ও আমাদের বলেছে, সে নাকি সাদা ও দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখেছে। তিনি তাকে বলেছেন, “তুমি কখনও কোন ব্যক্তির কেনা দাসী হবে না। তুমি বিয়ে করে কারো স্ত্রী হবে। তোমার পেটে এমন এক সন্তান জন্ম নেবে যে পথ ভোলা বিভ্রান্ত মানুষকে ধর্মের সঠিক পথ দেখাবে, দুঃখী মানুষের সেবা করবে।”

ওকি প্রায়ই এমন স্বপ্ন দেখে আমিও মাঝে মধ্যে এ ধরনের স্বপ্ন দেখি। বলল আল হাকাম।

দুই চাঁদ আগের ঘটনা। আমরা মেয়েটিকে বিক্রি করে দিয়েছিলাম। ক্রেতার হাতে পুরো দাম ছিল না। আমরা মেয়েটির বিনিময়ে স্বর্ণমুদ্রা দাবী করেছিলাম। বিক্রির কথা শুনে মেয়েটি বলছিল, আমি পালিয়ে যাব।

ওর পালানোর কথা শুনে রাতে ওর তাঁবুর বাইরে দুজনকে পাহারা দিতে বললাম। ওর পালানোর পথ আটকে দেয়ার কথা শুনে বলল, “আমার উদর থেকে কোন হারামজাদার জন্ম হবে না। জীবন থাকতে আমি তা হতে দেবো না। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাইলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।”

মধ্যরাতে মেঘের গর্জনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রচণ্ড ঝড় আর ভারী বর্ষণে আমাদের সব তাঁবু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। বিজলি আর আকাশের ভয়ঙ্কর গর্জনে আমরা ভড়কে গেলাম। বিজলির ঝলকানি আর মেঘের গর্জনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠতে লাগল। হঠাৎ করে বিজলি থেমে গিয়ে ঘন অন্ধকার নেমে এলো। আমরা নিজের হাতটাও ঠাহর করতে পারছিলাম না। ভয়ে আতঙ্কে ছোট ছেলে-মেয়ে, নারী-শিশু চিৎকার জুড়ে দিল। কোলের বাচ্চাগুলোকে বড়রা বুকে চেপে ধরে জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করল। কিন্তু আকাশের বিকট গর্জন আর ঝড়ের ভাবে বড়রাও ভয়ে কাঁপছিল। বিজলির এককটা ঝলকানিতে মৃত্যুর সাক্ষাত পাচ্ছিলাম আমরা। অথচ এই মেয়েটি ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার নিরুদ্বিগ্ন। আমরা যখন জীবন বাঁচানোর কোন আশ্রয় পাচ্ছিলাম না, সে তখন একটি তাঁবু ধরে অবিচল বসেছিল। এমন সময় একটি গাছের ডাল এসে আমাদের সামনে ভেঙে পড়ল। মৃত্যু আশঙ্কায় সবাই এক সাথে চিৎকার করে উঠল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মরণ থেকে লুকাতে চাচ্ছিল। কিন্তু এই মেয়েটি নির্ভয়ে চিৎকার করে বলছিল, কেউ আযান দাও আর বাকীরা যে যেখানে আছে সে জায়গায় লুটিয়ে পড়।’ তিনজন ওর কথামতো আযান দিতে শুরু করল। বাকীরা প্রলয়ঙ্করী ঝড়-বৃষ্টিতে কাদা-পানির মধ্যেই সে জায়গায় লুটিয়ে পড়লো। আর আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা ভিক্ষা…।

অনেকক্ষণ পর তুফান থামল। এর চেয়েও তীব্র তুফানের মুখোমুখি আমরা হয়েছি কিন্তু এমন আতঙ্কিত হইনি কখনো। মাথার উপরে আসমান ও পায়ের নীচে মাটি, এই তো আমাদের ঠিকানা। আসমান তার অফুরন্ত নেয়ামত দিয়ে আমাদের প্রাণ বাঁচাতে সহযোগিতা করে আবার কখনো আমাদের উপর দুর্ভোগও চাপিয়ে দেয়। আসমান-জমিনের আপতিত এসব সুখ-দুঃখ মিলিয়েই আমরা বেঁচে আছি। এসবে কখনও ভীত হই না, কিন্তু ওই রাতের ঝড়-বৃষ্টি ছিল ভয়ঙ্কর, তার চিত্র ছিল ভয়াল। আমরা সেই ঝড়কে এই মেয়ের অভিশাপ মনে করছিলাম।

রাত পোহাল। সবাই তখনও কাঁপছে। ভয়ে-আতঙ্কে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছে, কারো মুখে রা’ করার হিম্মতটুকু ছিল না। এই মেয়েটি আমাদেরকে চোখ উল্টে উল্টে ভৎর্সনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু দূরে সরে গেল। আমরাও লজ্জায় ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না। ওর হুঁশিয়ারী আমাদের কানে বাজছিলো : আমার উদরে কখনও হারাম সন্তান আসবে না, এর অপচেষ্টা করলে তোমরা সব ধ্বংস হয়ে যাবে। তখনও সে কুরআন শরীফ বুকে চেপে রেখেছিল আর অনুচ্চস্বরে কি যেন পড়ছিলো…।

আমরা ছেঁড়া-ফাড়া তাঁবুগুলো আর বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র একত্র করে ওকানোর ব্যবস্থা করলাম। বেলা চড়লে দুই অশ্বারোহী এসে হাজির হলো। তারা আমাদের প্রত্যাশিত স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এলো। মুদ্রা ভর্তি থলে আমাদের পায়ের কাছে ছুঁড়ে মেরে বলল, “এই দিনারগুলো নাও আর মেয়েটিকে আমাদের হাতে তুলে দাও।”

আমি থলেটি তুলে এক অশ্বারোহীর হাতে দিয়ে বললাম, “তোমরা দিনার নিয়ে চলে যাও, আমি মেয়ে দিতে পারব না।”

অপর আরোহী আরো দুটি দিনার আমার পায়ের দিকে ছুঁড়ে বলল, “আরও চাইলে বল। যা চাও তাই দেবো তবুও মেয়েটিকে আমাদের দিতেই হবে।” কিন্তু মেয়েকে তাদের হাতে না দিয়ে ফিরিয়ে দিলাম।

“ও কার মেয়ে?”

“মেয়েটি আমার ভাতিজী, এতীম।” শ্বেতশ্মশ্রুধারী বুড়ো বলল।

আল হাকাম দুহাত দেখিয়ে বলল, আমার হাত খালি, মেয়ের দাম দেয়ার মতো কিছুই আমার হাতে নেই। আপনারা কি আল্লাহর ওয়াস্তে বিনা দামে আমাকে মেয়ে দেবেন?

আমাদের সাথে তোমাকে থাকতে হবে। প্রতি রাতেই ডাকাতের আক্রমণাশঙ্কা থাকে। তুমি থাকলে পুরুষের সংখ্যা বাড়বে। পুরুষের সংখ্যা বেশি থাকলে ভয় কম থাকে। এই মেয়েটাকে যে কত লুকিয়ে-ছাপিয়ে এ পর্যন্ত রেখেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। ভারী গলায় বলল পক্ককেশী বুড়ো।

বুডোর প্রস্তাবে সম্মত হলো আল হাকাম। সেই মেয়েটির সাথে বিয়ে হয়ে গেল আল হাকামের। বেদুইন যাযাবরদের বিয়ে। কোন আয়োজন প্রস্তুতি নেই। বড়দের সিদ্ধান্ত আর পাত্রের আগ্রহ এই যথেষ্ট। অধিকাংশ যাযাবর মেয়েদের সতীচ্ছেদ ঘটে বিয়ে ছাড়াই। হয়তো ডাকাতের হাতে, না হয় কোন বেশি দামের ক্রেতার শয্যায়। বিবাহকালীন ধুমধাম আহার আয়োজনও ওদের সমাজে নেই।

“আমার জীবন ও স্বাধীনতার বিনিময়ে তোমাকে পেলাম। তোমাকে দাসী করার পথ বন্ধ করে নিজে গোলাম হয়ে গেলাম। প্রথম রাতেই স্ত্রীকে বলল আল হাকাম।

“আমি বন্দীদশায় থাকার মানুষ নই। তোমার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে গেছি একথাও ঠিক নয়। তোমার চাচা তোমার আদি-অন্ত সব কাহিনী আমাকে শুনিয়ে তোমাকে বিয়ে করে এখানে থাকতে প্রস্তাব করলো, তাৎক্ষণিক তোমার ইজ্জত ও আকাক্ষার প্রতি মমত্ববোধ আমাকে রাজী হতে বাধ্য করেছে। যদি কখনও আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই তুমি আমার সাথে যাবে?”

“আমি আল্লাহর নামে আপনাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমার জীবন-মরণ আপনার হাতে। এরা আর আমাকে বন্দী করে রাখতে পারবে না। আপনাকে প্রথম দেখাতেই আমার মন বলছিল, এই লোক যদি তোমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে তুমি গ্রহণ করতে পার।”

শুনেছি, এক শ্বেতশুভ্র-শশ্রুধারী লোক নাকি তোমাকে স্বপ্নে বলেছিল যে, এমন এক সন্তান তুমি জন্ম দেবে যে পথভোলা মানুষকে আল্লাহর পথের দিশা দেবে।

সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। বললো, এটা আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল । আকাক্ষাটা এমনভাবে আমার মধ্যে শিকড় গেড়েছিল যে, আমি নিজের কানে শুনতে পেতাম, “তোমার কোলে এমন শিশু জন্ম নেবে যে সত্যের পথে এতো খ্যাতি অর্জন করবে পৃথিবীর মানুষ তাকে চিরকাল স্মরণ রাখবে।”

তুমি জানো না, হত-দরিদ্র ঘরের সন্তানেরা মিথ্যা বিনাশী হয় না, পেট পূজারীই হয়ে থাকে। এটা তোমার অলীক আকাঙ্ক্ষা। এই অসম্ভব কল্পনা ছেড়ে নিজে সত্য পথের উপর থাকো এটাই যথেষ্ট। আমাদের সন্তান আমাদের মতোই যাযাবর হবে, নয়তো কোন আমীরের ঘরে নোংরা কাজের চাকর হবে।

“আমি কি অবাস্তব কল্পনা করছি। আমার এই আকাক্ষা কি অসম্ভব?”

“যে আকাক্ষা অবাস্তব, তা কল্পনা হয়ে মানুষের মনে সুখ দেয়।” বলল আল হাকাম।

“সেদিন আপনি আমার ভুল শুধরে দেয়ার জন্যে এসেছিলেন। আপনি আমাকে আয়াতের তরজমায় বলেছিলেন, ইবরাহীম (আ.) তাঁর পিতাকে বলেছিলেন, আপনি কেন মূর্তিপূজা করেন, যেগুলো কিছু শোনে না, বলতে পারে না, করতে পারে না, আপনি আমার সাথে আসুন, আমি আপনাকে সত্য পথ দেখাব।’ সে কথাগুলো আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। এরপর আমি কুরআন পড়তে বসলেই আমার কানে শুধু একথাই বাজে- তুমি এক ইবরাহীমকে জন্ম দেবে। আমি রাতে নূরানী চেহারার এক সৌম্য কান্তিময় ব্যক্তিকে দেখেছি, তিনি আপনার মতোই আমার ভুল শুধরে সেই আয়াতটিই পড়াচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, সুন্দর ফুটফুটে অথচ নির্বোধ সন্তান হলে তুমি বেশি খুশি হবে না। কদাকার কিন্তু বুদ্ধিমান সন্তান পেলে সুখী হবে? আমি সেই বুযুর্গ ব্যক্তিকে বলেছি, আমি ইবরাহীমের মতো এমন সত্যের বাহক সন্তান চাই যাঁর পিতা বিপথে থাকলেও পিতাকে ত্যাগ করতে দ্বিধা করবে না। আর মেয়ে হলে যাতে এমন কদাকার হয় যে, কোন ডাকাতের দৃষ্টি ওর প্রতি না পড়ে, কেউ ওকে কিনে নিতে না চায়।”

“তোমার মধ্যে তোমার গোত্রের রীতিনীতি বিরোধী স্বভাব কি করে এলো? যাযাবরদের মেয়েরা তো বিক্রি হতে অপছন্দ করে না।”

“জানি না আমার মধ্যে কীভাবে এ আকাক্ষা জন্ম নিলো যে, তুমি বিয়ে করে একজন পুরুষের স্ত্রী হিসেবে থাকবে।’ একথা আমাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। আমার কল্পনাই আমার কানে বাজতো। হৃদয়ের একথা শুনতে শুনতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো, আমার আকাক্ষা সফল হবে।”

“তোমার অনাগত সন্তান বড় হয়ে বিখ্যাত হবে এমন অলীক কল্পনা মন থেকে দূর কর। এ স্বপ্ন তোমার মাথা খারাপ করে ফেলবে।” বলল আল হাকাম।

বংশ ধ্বংসের ভয় ও রাতের প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি, আকাশের গর্জন কাকতালীয় । ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু দুই অশ্বারোহী দিনার ভর্তি থলে নিয়ে এসে ঠিকই কিশোরীর জন্য সাক্ষাত আপদ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিল। আকস্মিক এই ঝড়-বৃষ্টি, আকাশের গর্জন অসহায়-অবলা এক কিশোরীর সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক কিশোরীর মান রক্ষায় এগুলো বেশ কাজ করেছে। আল হাকাম বাস্তববাদী মানুষ। সে এগুলোকে অলৌকিক কিছু মনে করেনি, ভিত্তিহীনও ভাবেনি। তবে যে বিষয়টি তাকে নাড়া দিয়েছে তা হলো, এ কিশোরী সত্যিকার অর্থে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র মনের অধিকারিণী। ওর দৈহিক রূপলাবণ্যের চেয়েও আত্মিক সৌন্দর্য অনেক বেশি।

বিয়ে করে আল হাকামও যাযাবরদের সাথে মিশে গেল। কেটে গেল অনেক দিন। দু’বছরের মাথায় তাদের একটি ছেলে জন্ম নিল। আল হাকাম ছেলের নাম রাখল “সুবক্তগীন”। ছেলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার স্ত্রীর স্বপ্ন আরো দৃঢ় হলো। তার বিশ্বাস, এই ছেলে বিখ্যাত হবে। আল হাকাম তার স্ত্রীর কথা শুনে সময় সময় হাসতো। একদিন স্ত্রী আল হাকামকে জিজ্ঞেস করল, “এই ছিন্নমূল যাযাবর জীবন কি এখন আর আপনার বিরক্তিকর লাগে না?”

“আমার মধ্যে এ জীবন নিয়ে এখন আর কোন অস্বস্তি নেই। কিন্তু আমার ছেলেকে আমি এই জংলী জীবন থেকে দূরে নিয়ে যাবো। জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো কি কোন সভ্য মানুষের জীবন হতে পারে?” বলল আল হাকাম।

“আমার বিশ্বাস ছিল, এ আশাও এখন আমার পূর্ণ হবে যে, আমার কোলের সন্তান লেখাপড়া শেখার মতো জায়গায় পৌঁছতে পারবে। অবশ্য আমি তোমার মতো দুনিয়ার কোথায় কি আছে জানি না।” বলল হাকামের স্ত্রী।

“কোন আমীর-শরীফ লোকের ঘরে মজদুরী তো মিলতেই পারে। খোদার জগত তো আর ছোট্ট নয়। যে আল্লাহ্ তোমাকে বাচ্চা দিয়েছেন তিনি তার রিযিকের ব্যবস্থা করেই রেখেছেন।” বলল আল হাকাম।

“লুকিয়ে ছাপিয়ে আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।” বলল আল হাকামের স্ত্রী। এই গোত্রের লোকেরা তোমাকে এমনিতে যেতে দেবে না। কারণ, তুমি টাকা ছাড়াই বিয়ে করেছো, এর বিনিময়ে তোমাকে পেয়ে ওদের শক্তি বেড়েছিল অনেক। আমি তোমাকে একটা ফন্দির কথা বলি, “আগামীকাল আমরা লাকড়ি কুড়াতে বের হয়ে আর ফিরে আসবো না।”

স্ত্রীর কথামতো পরদিন তারা গোত্রের অন্যদের মত কাঠ কুড়ানোর কথা বলে ছেলেকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ছেলের বয়স তখন ছয়। মাস মাত্র।

দুপুর গড়িয়ে গেল। তখনও তাদের তাঁবুতে ফেরার নাম নেই। বুড়োদের সন্দেহ হলো। শক্ত সামর্থ্য দুই ব্যক্তি ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওদের খোঁজে। বুড়োদের সন্দেহ ছিল বিবিধ। আল হাকামের পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তো ছিলই তার চেয়ে বেশি ছিল সুন্দরী ওই যুবতী অপহরণের শিকার হওয়ার। তারা আশঙ্কা করছিল, না জানি কোন ডাকাতের পাল্লায় পড়ল কিনা ওরা। দৈবাৎ এক পথিক সন্ধানী-অশ্বারোহীদের বললো, এক যুবককে সুন্দরী যুবতী ও একটি শিশুকে নিয়ে সে নদীর দিকে যেতে দেখেছে।

সন্ধানকারীরা পথিকের কথা মতো ওদিকেই ঘোড়া হাকিয়ে দিল, তাদের সন্দেহ ছিল, আল হাকাম হয়তো তাদের মেয়েটিকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আল হাকাম ও তার স্ত্রী হেঁটে যাচ্ছিল। পথ ছিল অসমতল এবড়ো থেবড়ো। তারা যে পথে যাচ্ছিল তার পাশেই ছিল নদী। হঠাৎ পিছন থেকে ঘোড়ার আওয়াজ শোনা গেল। পিছন ফিরে দেখলো, দুই অশ্বারোহী তাদের দিকেই ধেয়ে আসছে। একটু অগ্রসর হলেই আল হাকাম তাদের চিনে ফেলল। আরোহীরা খাপ থেকে তরবারী বের করে আক্রমণোদ্যত হয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। আল হাকাম নিরস্ত্র ছিল। এটা ছিল আল হাকামের মারাত্মক ভুল যে সে কোন অস্ত্র সাথে রাখেনি। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হতাশার দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল।

“নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়।” বলল তার স্ত্রী।

“অনেক গভীর তীব্র স্রোত, ওরা তো ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেবে।” বললো আল হাকাম।

“আমি তোমাকে বলছি, তুমি নদীতে ঝাঁপ দাও! বাচ্চাকে তুমি বাঁচাও, ওকে ছাড়া আমি সাঁতরাতে পারব।” স্ত্রী কথাগুলো এমন দৃঢ় প্রত্যয়ের সুরে বলল যেন সে আল্লাহর নির্দেশে বলছে।

“বেশি কিছু চিন্তা-ভাবনার অবকাশ ছিল না। আল হাকাম স্ত্রীর কোল থেকে সুবক্তগীনকে নিয়ে এক হাতে ওকে ধরে নদীতে ঝাঁপ দিল। এক হাতে সঁতরাচ্ছিল আল হাকাম। স্ত্রীও তার সাথে সাথেই সাঁতরে ওর পাশাপাশি থাকতে চেষ্টা করছিল। নদী ওই দিকেই প্রবাহিত হচ্ছিল যে দিকে যাত্রা করেছিল তারা। সন্ধানী অশ্বারোহীরা এদের নদীতে ঝাঁপ দিতে দেখে তীরে ঘোড়া থামাল এবং চিৎকার করে ওদের হুশিয়ার করল। কিন্তু ততক্ষণে ওরা নদীর মাঝামাঝি চলে গেছে। ভাগ্যক্রমে নদীর ওপারে গভীরতা কম ছিল। এক পা আর এক হাতে সঁতরাতে সাঁতরাতে অবশ হয়ে আসছিল আল হাকামের হাত-পা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে নিজেকে ও শিশুকে পানির উপর ভাসিয়ে রাখছিল। এক পর্যায়ে অবস্থা এমন হলো যে, আল হাকাম আর সাঁতরাতে পারছিল না। তার পা সোজা পানির তলদেশে তলিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সে প্রাণপণ বাচ্চাকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে শরীরের শেষ শক্তিটুকু প্রয়োগ করলেও বাচ্চা আর নিজের জীবনের আশঙ্কা দেখা দিল। প্রায় তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো আল হাকামের। হঠাৎ তার পা মাটি স্পর্শ করল। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। শুকুর আল্লাহর। নদীর কূল যেন তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এলো। গলা পানিতে দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে দেখলো সে। এখনো অনেক দূরে। তলিয়ে যাচ্ছে, আবার হাত-পা ছুঁড়ে এগুতে চাচ্ছে। চিৎকার করে বলল আল হাকাম, “দাঁড়িয়ে যাও ওখানে, ওখানে পানি কম।” কিন্তু ওর কানে যাচ্ছিল না সেই ডাক। আল হাকামও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, স্রোতের তীব্রতায় শক্ত করে দাঁড়ানো অসম্ভব। আল হাকাম তবুও আগালো স্ত্রীর দিকে। ধরে ফেলল ওর চুলে, টান দিয়ে সোজা করতেই স্ত্রীর পা মাটি স্পর্শ করল। সেও দাঁড়াল। স্বপ্নে দেখার মতো তাকাল বাচ্চা ও হাকামের দিকে। যেন মরতে মরতে বেঁচে গেল। মুখে কোন কথা উচ্চারণ করা সম্ভব হলো না। নদীর এপারে এসে গেছে তারা। এখন আর পাকড়াও হবার ভয় নেই। পানি থেকে তীরে এসে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল স্ত্রী। আল হাকামও ছেলেটিকে কোলে শুইয়ে দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত উভয়ে। শরীরে হাঁটার মতো শক্তি তাদের নেই।

অনেকক্ষণ বিশ্রাম করে তীর থেকে অদূরে শহরের দিকে তারা অগ্রসর হল। পৌঁছল শহরে। এখানকার লোকগুলো তাদের দিকে তাকাচ্ছিল চিড়িয়াখানার আজব চিড়িয়া দেখার মতো। বেশভূষায় এরা এ শহরে নবাগত, তাই দেখছিল সবাই। অনুন্নত কাপড়ে আচ্ছাদিত আল হাকামের স্ত্রী। তার রূপই ছিল এদের দৃষ্টি কাড়ার বড় কারণ। স্বামী-স্ত্রী হাঁটছিল লক্ষ্যহীন গন্তব্যে। গলির যুবক পুরুষেরা রূপসী এই যুবতী ও শিশুসহ আল হাকামের দিকে তাকিয়ে ঈর্ষান্বিত হলি ক্ষণিকেই। চোখ ফেরাতে পারছিল না আল হাকামের স্ত্রী থেকে অনেক কামুক পুরুষ।

আল হাকামের স্ত্রীর সৌন্দর্য তাৎক্ষণিক তাদের ফায়দা দিল। এক ধনাঢ্য ব্যক্তির আস্তাবলের নওকরী পেয়ে গেল আল হাকাম। আস্তাবলের পাশেই একটি বুপড়িতে থাকতে দিল তাদের। স্ত্রী ঝুপড়িতেই কোলের ছেলে নিয়ে সংসারের গোড়াপত্তন করল।

বেশি দিন আর ঝুপড়িতে থাকা হলো না হাকাম পত্নীর। ডাক এলো মহল থেকে। তাকে নিয়োগ দেয়া হলো মহলের পরিচারিকার পদে। পরদিন যখন আমীরের মহলে হাকামের স্ত্রী কাজের জন্য উপস্থিত হলো, তাকে এগিয়ে এসে নিয়ে গেল এক বয়স্কা মহিলা। মহিলা তাকে গোসল করাল এবং খুব দামী জরিদার শাহী জামা পরিয়ে দিল। জামার নকশা-ই বলে দেয় এটা মামুলী পরিধেয় বস্ত্র নয়। এটা এমনভাবে ডিজাইন করা আর কাপড় এত পাতলা যে, শরীরের ভাঁজগুলো দেখা যায়। হাতে বাজু, গলা, বুকের অর্ধাংশ খোলা থাকে। হাকাম পত্নীর এসব কাপড় পরতে ভালো লাগছিল না। যাযাবর হলেও শরীর ঢেকে রাখতে অভ্যস্ত ছিল হাকামের স্ত্রী।

মহিলাটা তাকে বোঝাল, আমাদের মালিক নোক্সামি পছন্দ করেন না, তিনি পরিপাটি দেখতে অভ্যস্ত। এগুলোতে সেজে থাকলে তোমাকে দেখে খুশি হবেন। কাপড় গায়ে জড়িয়ে তাকে একটি আরশীর সামনে নেয়া হলো। আরশীতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেল। নিজেকে শাহজাদী মনে হতে লাগল। তার চুল আঁচড়ে দেয়া হল। ছড়িয়ে দেয়া হল পিঠের উপর। মহিলা তার সারা শরীরে মনমাতানো সুগন্ধি ছিটিয়ে দিল। নতুন এই সাজে আল হমের স্ত্রীকে পরীর মতো মনে হচ্ছিল।

দেরী না করে মহিলা তাকে নিয়ে গেল মনিবের সামনে। বিশাল এক সুসজ্জিত ঘর। মেঝেতে এমন কার্পেট, সাজানো ঘর, ঝলমলে আলো দেখেনি জীবনে যাযাবর যুবতী। আমীর উমারার জীবন-জীবিকার গল্পেই যা শুনেছে।

আল হাকামের স্ত্রীকে দেখে আমীরের দৃষ্টি ওর শরীরেই আটকে রইল। ভূতে পাওয়ার মতো ওর দিকে তাকিয়ে রইল দীর্ঘক্ষণ। জ্বলজ্বল করে উঠল তার চোখ। নেশাগ্রস্তের মতো কণ্ঠে মহিলাকে বলল, তুমি যাও! মহিলা চলে গেল।

আমীর আল হাকামের স্ত্রীকে কাছে ডাকল। বসতে বলল। কিন্তু যুবতী বসল না। আমীর দাঁড়িয়ে তার দুই বাজু ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করল, কিন্তু যুবতী মোচড় দিয়ে দূরে সরে গেল। তার বুঝতে বাকি রইল না, পরিচারিকার কাজের কথা বলে আসলে তাকে কেন আমীরের কাছে নিয়ে আসা হয়েছে।

শুনেছি তুমি যাযাবর মেয়ে। এখন তো দেখছি, তুমি নিজেকে শাহজাদী মনে করছো। দেখ আমি তোমার উপর কোন হুকুম চালাব না। তোমাকে উপযুক্ত এনাম দিব, আমার হেরেমে শাহজাদী হয়ে থাকবে।

একথা শুনে যুবতী দরজার কাছে সরে গেল। আমীরের চেহারা আগুনের মতো লাল হয়ে উঠল।

“আমি সোনার দিনার ভর্তি থলিতে লাথি মেরে এখানে ফেরার হয়েছি। নিজেকে নিলামে বিক্রি করতে ইচ্ছুক নই। তা না হলে বিয়ে করে স্বামী নিয়ে নদী সাঁতরে কেন পালিয়ে এসেছি নিজের গোত্র ছেড়ে। আমার স্বামীকে তোমার দশ মেয়ে দিলেও আমি তোমার কাছে যেতে পারব না।”

“স্বামী থেকে হাত ধুয়ে ফেল লাড়কী। বাচ্চার মমত্বও ভুলে যাও। এসো, আমার কাছে এসো।”

তুফানের মতো দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হাকামের স্ত্রী। সোজা চলে গেল সেই ঘরে যেখানে ওর পরিধেয় কাপড়গুলো ফেলে এসেছিল।

রাগে গর্জে উঠল আমীর। ডাকল বয়স্ক মহিলাকে। দৌড়ে এলো বয়স্কা মহিলা, আরো এক সেবিকা এবং হেরেমের দু’ নারী। তারা মনিবের রাগত চেহারা দেখে হতভম্ব।

“হারামজাদী! শরমালে ভিন্ন কথা ছিল, কিন্তু ও আমাকে অপমান করে বেরিয়ে গেল।”

আমরা ওকে চুল ধরে নিয়ে আসছি। বলল এক খাদেমা।

না। এই যাযাবর ভিখারিনীকে আমি এমন কঠিন শাস্তি দেবো, যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বহুদিন। আমীর দু’জন বিশেষ প্রহরীকে ডেকে বলল, আমার আস্তাবলের পাশের ঝুপড়িতে যে হতভাগা থাকে ওকে আজ রাতে হত্যা করে ওর স্ত্রীকে আমার কাছে নিয়ে আসবে, আর ওদের কোলের বাচ্চাটিকে বিক্রি করে দেবে।’

হেরেমের মেয়েরা পরস্পর চোখাচোখি করল। উভয়েই নির্বিকার। মনিব ক্ষোভে জ্বলছে।

“কোন শাহজাদী হলে না হয় এমন দেমাগ সহ্য করা যেতো। হতভাগী এক যাযাবর ভিখারিনীর এতো স্পর্ধা যাও, সবাই এখান থেকে চলে যাও।”

গভীর রাতে আল হাকামকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে অপহরণ করার চক্রান্ত করা হলো। বেলা অস্ত যাওয়ার পর আল হাকাম তার ঝুপড়িতে এলো। স্ত্রী নিজের কাপড়েই। আমীরের রক্ষিতা যে পোশাক তাকে পরিয়েছিল তা খুলে ছুঁড়ে ফেলে এসেছিল সে।

ভাবছিল আজকে তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চক্রান্তের কথা তার স্বামীকে বলবে কি-না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সে নিয়ে ফেলেছে, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না। স্বামীকে নানাভাবে সে এখানে না থাকার বিষয়টি বোঝাতে পেরেছিল। কিন্তু ঘূর্ণাক্ষরেও তার এই ব্যাপারটি জানা ছিল না যে, আজই সে স্বামীকে জীবিত দেখছে, তার কলিজার টুকরো সন্তানকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চক্রান্ত করা হয়েছে, তার ইজ্জত-সম্ভ্রম লুটে নেয়ার ষড়যন্ত্র পাকা হয়ে গেছে।

সে স্বামীর সাথে যাবতীয় কথা শেষ করে তার সামনে খানা পরিবেশন। করল। ঠিক এ সময় ঝুপড়িতে এক অপরিচিতা মহিলা প্রবেশ করল। সে প্রবেশ করেই ঝুপড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি খানা শেষ করে ছেলে। এবং স্ত্রীকে নিয়ে এখনই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাও, কোথাও দাঁড়াবে না।”

এই মহিলা ছিল আমীরের বিশেষ আস্থাভাজন দুই রক্ষিতার একজন। সে আমীরের চিৎকার শুনে খাস কামরায় প্রবেশ করে আল হাকামকে হত্যা ও তার স্ত্রীকে অপহরণের চক্রান্ত শুনে ফেলেছিল। সে আল হাকামের স্ত্রীকে এক ঝলক দেখেও ছিল। নিষ্পাপ এই মেয়েটির সম্ভ্রম ও তার নিরপরাধ স্বামী-সন্তানের জীবন বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিল সে। আরো একজনকে সাথে নিল। নিজেদের দুরন্ত স্বপ্নময় কৈশোরের কথা মনে পড়ল ওদের। তাদেরও স্বপ্ন ছিল বিয়ে করে স্বামী সংসার নিয়ে সুখের ঘর বাঁধবে। কিন্তু টাকার বিনিময়ে এই লম্পট আমীর তাদেরকে চার দেয়ালের ভেতর যৌনদাসীতে পরিণত করেছিল। নিজেদের রূপ-যৌবন ও তারুণ্যের বিনিময়ে ওরা ভোগ করছিল বিলাসী জীবন। বিলাস উপকরণ ও ভোগ্যপণ্যের অভাব নেই এখানে।

আমীরের হেরেমে ওরা দু’জন নিজেদের ধূর্তামি, চাতুরীপনা ও কূটকৌশলে আমীরের নষ্ট জগতকে আরো সমৃদ্ধ করেছিল। নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিল আমীরের ঘনিষ্ঠজন ও আস্থাভাজনরূপে। নিজেদের ধর্মীয় জীবন ও নারীকে বিলিয়ে দিয়েছে এরা। হেরেমের চক্রান্ত আর কূটচালে ওব্রা সিদ্ধহস্ত। স্বয়ং আমীর ছিল ওদের হাতের পুতুল। কিন্তু নারীত্বের ঐশ্বরিক চেতনা আর স্বামীর সংসার নিয়ে সুখময় জীবনের স্বপ্নটা যে মাঝে মধ্যে তাদের কাদাত না তা নয়। মানুষের সহজাত পবিত্র সত্তাকে কখনো ছাইচাপা দিয়ে রাখা যায় না। ব্রা যখন দেখল, একটি নিরপরাধ যুবতী, দুগ্ধপোষ্য নিষ্পাপ সন্তান ও বিদেশ-বিভূঁইয়ে অসহায় গরীব এক সৎ পুরুষ এক লম্পট আমীরের লাম্পট্যের শিকারে খুন হতে চলছে, তখন তাদের মধ্যে নিজেদের স্বপ্নময় যৌবনকে পঙ্কিলতায় ডুবিয়ে দেয়ার প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু প্রতিশোধের ব্যবস্থা করতে না পারলেও তারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলো, এদের জীবন বাঁচাবেই।

আল্লাহ তায়ালা রহমতের ছায়া বিস্তার করে আল হাকামের স্ত্রীকে সকল কলঙ্ক থেকে পবিত্র রেখেছিলেন। হাজারো বিপদের পরও এই যাযাবর মেয়েটির চরিত্রে সামান্যতম পাপের আঁচড় পড়তে পারেনি। নিজেরা আকষ্ঠ পাপে ডুবে থেকেও এই দুমহিলাকে আল্লাহ্ তায়ালা আল হাকামের স্ত্রীর সম রক্ষায় উসিলা বানিয়ে দিলেন। হয়তো এটা ছিল আল হাকামের স্ত্রীর পবিত্রতার পুরস্কার।

“আমার পক্ষে বেশিক্ষণ এখানে থাকা সম্ভব নয়, আর এর চেয়ে বেশি কিছু বলাও সম্ভব নয়। তুমি এখান থেকে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও, এটাই আমার প্রত্যাশা।” এই বলে মহিলা বেরিয়ে গেল।

ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়াবিষ্ট নেত্রে স্ত্রীর প্রতি তাকাল আল হাকাম। দিনের বেলায় আমীরের বাড়িতে যা ঘটেছিল স্বামীকে বলল হাকামের স্ত্রী। চিন্তায় পড়ে গেল হাকাম। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্ত্রী তাকে তাড়া দিল, ওঠ! আগে এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু আল হাকামের মধ্যে পালানোর ভাড়া নেই। সে বলল, এই মেয়েলোকটি মনে হয় আমীর বাড়ির সেবিকা। কেন সে আমাদের এখনই চলে যেতে বলল। আমি আমীরের সাথে দেখা করব। কিন্তু স্ত্রী তাকে সাথে নিয়ে ঝুপড়ি ছেড়ে এক্ষুণি বেরিয়ে পড়তে জিদ ধরল। বলল, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকাও নিরাপদ নয়।

যে ঘাতককে নির্দেশ করা হয়েছিল আল হাকামকে খুন আর স্ত্রীকে অপহরণ করতে তারা তখন মদের হাড়ি নিয়ে বেহিসেবে গিলছে। তাদের হাতে উন্নত হাতিয়ার। ছিন্নমূল এক হতদরিদ্রকে খুন করে তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে আসা এদের জন্যে মামুলী ব্যাপার। সন্ধ্যার আগেই তারা ঝুপড়িটা ভালো করে পরখ করে এসেছিল। কোন বাধা-বিপত্তি, আইন-কানুনের ভয় ছিল না তাদের। তারা এই ভেবে উৎফুল্ল ছিল, একটা পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ হয়েছে।

ভারত অভিযান ৩০

এরা মদপান শেষ করে আল হাকামের ঝুপড়ির দিকে রওয়ানা হল। ঠাট্টা-বিদ্রূপ, আনন্দ-উল্লাস করে তারা আল হাকামের ঝুপড়ির কাছে গেল। ঝুপড়ির দরজা বন্ধ ছিল। একজন অপরজনকে বলল, তুমি মহিলাকে ধরে ফেলবে। আমি মরদটাকে সাইজ করবো।

বন্ধ দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। ওরা গর্জে উঠল। কে আছিস, বের হ! কিন্তু নিস্তব্ধ। ওদের হুংকার ওদের কানেই ধ্বনিত হলো। অন্ধকারে হাতড়ে খোঁজাখুজি করল, কোন মানুষজন পেলো না। বুপিড়ি ভুল হয়েছে ভেবে ওরা সেখান থেকে অন্য ঝুপড়ির খোঁজে বেরিয়ে গেল।

ততক্ষণে আল হাকাম স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শহরের বাইরে চলে এসেছে।

“আমাদের জন্য আল্লাহর জমিনও বুঝি সংকীর্ণ হয়ে গেছে। হতাশ কণ্ঠে বলল আল হাকাম।

“অধৈর্য হয়ো না সুবক্তগীনের বাপ। তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর আর না কর কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা এমন কোন পাপতো করিনি যে জন্যে আমাদের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমার কোন সন্দেহ নেই যে, আমি সেই কাঙ্ক্ষিত সন্তানকেই ভূমিষ্ঠ করেছি যার ইশারা আমি পেয়েছিলাম।”

“তুমি একটি বদ্ধপাগল। তোমার জন্যেই আমাদের এই শাস্তি।” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল আল হাকাম। “সম্পূর্ণ একটা ভ্রান্ত বিশ্বাসে লিপ্ত রয়েছ তুমি। বিরাট ওলী-বুযুর্গ জন্ম দিয়ে ফেলেছে, এই বিশ্বাস দেমাগ থেকে দূর না করলে তোমার কপালে দুর্ভোগ শেষ হবে না। কুরআন শরীফকে তাবীজ মনে করো না। তোমাকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল হয়েছে। গরীবের বউ অসুন্দর হলেই শান্তিতে থাকা যায়। এখন আমি তোমাকে পাহারা দে না পেটের আহার যোগাব?”

“আমার হেফাযত আমিই করবো, তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি কুরআন পড়তে জান, অর্থ বোঝ, এরপরও মুখে এমন কথা কিভাবে উচ্চারণ কর!” . স্ত্রীর জবাবে কোন কথা বলল না আল হাকাম। রাগে-ক্ষোভে, নিঃশব্দে ভাগ্যের মুণ্ডপাত করছিল আল হাকাম। ইসলাম ও আল্লাহ্র রহমত থেকে সে এখন নিরাশ।

চল ফিরে যাই।

কোথায়?

তোমাদের কবিলায়। হয়তো ওখানে, নয়তো আশেপাশেই পাওয়া যাবে তাদের। বলল হাকাম।

“ওখানে না গিয়ে বরং ঘোড়াওয়ালা মনিবের কাছেই চল। আমার শরীর বিক্রি করে তোমাকে কাড়ি কাড়ি টাকা এনে দেবো। তুমি আরাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে খাবে আর আত্মপ্রসাদে মেতে থাকবে এই ভেবে, বউটা আমার সুযোগ্যই বটে! শুনি, কোন ধাতের পুরুষ তুমি? দেখো, আমি আমার ছেলেকে তোমার মতো কাপুরুষ হতে দেবো না।” ক্ষুব্ধ বাঘিনীর মতো ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল স্ত্রী।

“আগে তোমার ছেলে বাঁচুক সেই দু’আ কর। তারপর না হয় শাহনশাহ বানাবে।” তিরস্কারের সুরে বলল আল হাকাম।

“আমার ছেলে বেঁচে থাকবে। দেখো, একদিন ইবরাহীমের মতো তোমাকে বলবে, আব্ব, আমি যে জ্ঞান লাভ করেছি তা তোমাকে দেওয়া হয়নি। তুমি আমার হেদায়েত মতো চলো, আমি তোমাকে কামিয়াবির পথ দেখাব।”

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের আদর্শিক লড়াই শুরু হয়ে গেল। পুরুষালী উদ্বেগ আর হতাশা হাকামকে কাবু করে ফেলেছিল। সেই সাথে স্ত্রীর মধ্যে বিরাজ করছিল নিজের স্বপ্নের প্রতি অবিচল আস্থা। স্বামীর বিরূপতায় ও স্বপ্ন পূরণের বিঘ্নতায় হতাশা তাকে বিব্রত করছিল, কিন্তু পূর্বাপর ঘটনা তাকে নিজের আত্মবিশ্বাসে আরো অবিচল করেছিল। ফলে দুজনের দুই মেরুকরণে লাগামহীন হয়ে পড়েছিল ভাষা। পরস্পর বিতর্কের মাঝে পথ চলছিল তারা। এক পর্যায়ে চুপ হয়ে গেল আল হাকাম।

সেই রাত থেকে আবার তারা যাযাবর জীবনে ফিরে আসে। ব্যতিক্রম এতটুকু যে, আগে তারা থাকতো লোকালয় থেকে দূরে আর এখন থাকে লোকালয়ে। শহরের উপকণ্ঠে এখানে সেখানে। শহরে এটা ওটা করে পানাহার যোগাতে আল হাকামের তেমন কোন বেগ পেতে হয় না। দিন কোনমতে চলে যায়।

দুই বছর এক শহরে থাকার পর আল হাকাম অন্য এক শহরে পাড়ি জমাল। স্ত্রী তার কাছে বায়না ধরল, এখন আর ভবঘুরের মতো এখানে ওখানে থাকা নয়, কোথাও স্থায়ী ডেরা ভোলো। ছেলেকে কোন মসজিদে পড়তে দিতে হবে, নয়তো ওরও আমাদের মতো এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে জীবন কাটাতে হবে।

বছর খানিক আগেই আল হাকাম ও তার স্ত্রী ছেলেকে কুরআন শরীফ পড়াতে শুরু করেছিল। মা লক্ষ্য করছিল, তার ছেলে অন্য যাযাবর শিশুদের চেয়ে ভিন্ন। সে অন্য শিশুদের থেকে আলাদা চরিত্রের। কেমন যেন গম্ভীর, ভাবুক, কথা বলে বুদ্ধিদীপ্ত। অন্য বাচ্চাদের মতো বাজে জিনিসের বায়না ধরে না, কোন জিনিসের জন্য জেদাজেদি করে না। মা এও লক্ষ্য করেছে, তার ছেলে পড়ালেখার প্রতি খুব মনোযোগী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তার পছন্দ।

এক পর্যায়ে মায়ের সে আশা পূর্ণ হল। আল হাকাম এখন মনস্থির করল, এখানে কিছুদিন থাকবে। ছেলেকে নিয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের নিকট গেলে ইমাম সাহেব ছেলেকে মক্তবে ভর্তি করে নিলেন। ছেলেকে ইমাম সাহেব ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করায় আল হাকাম ও তার স্ত্রী ইমাম সাহেবের যথাসাধ্য সেবাযত্ন করতে লাগল।

প্রথম দিনের সবকে এ ইমাম সাহেব বুঝতে পারলেন, এই ছেলে অন্য দশটি ছেলের চেয়ে ভিন্ন। একেবারে প্রাথমিক স্তরের পড়া সে বাবা-মায়ের কাছেই শিখে ফেলেছিল। সাধারণত পাঁচ-ছয় বছরের শিশুদের যে ধরনের জ্ঞান থাকে এ ছেলের তার চেয়েও অনেক বেশি মেধা ও প্রজ্ঞা তিনি দেখতে পেলেন। তাকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে বসিয়ে দিলেন। সেখানেও সে অন্যদের তুলনায় এমন কৃতিত্ব দেখাল যে, ইমাম সাহেব ভাবলেন, এ বাচ্চা অসাধারণ, অনন্য। এখানে শিশু সুবক্তগীন প্রায় চার বছর লেখাপড়া করল।

সুবক্তগীনের বয়স এখন দশ-এগারো। এর মধ্যে সে কুরআন শরীফ তরজমা ও তফসীরসহ পড়ে ফেলেছে। বেশ কটি হাদীসের কিতাবও সে ইমাম সাহেবের বিশেষ তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে পড়েছে। সুবক্তগীনের জ্ঞান-পিপাসা উস্তাদের জ্ঞান পরিধিকেও ছাড়িয়ে যেতে চায়। উস্তাদের কাছে সে এমন এমন জটিল সমস্যা তুলে ধরে যেগুলোর সমাধানে উস্তাদেরও হিমশিম খেতে হয়। এমন এমন জ্ঞানগর্ভ প্রশ্ন করে যা তাকে পেরেশান করে তোলে। উস্তাদ বুঝতে পারলেন, এর জ্ঞান-পিপাসা মিটানোর জন্য একে নিজের কাছে না রেখে বড় জ্ঞানীর নিকট কিংবা বড় প্রতিষ্ঠানে পাঠানো দরকার। সুবক্তগীন একদিন উস্তাদকে প্রশ্ন করে, উস্তাদজী! আমল ছাড়া এম কি পূর্ণতা পায়? তরবারীর জোরে আল্লাহর রাসূল (স.)-এর পয়গামের প্রসার ঘটানো কি জায়েয? আমি যদি সারা দুনিয়াতে কুরআন-হাদীসের পয়গাম ছড়িয়ে দিতে চাই তবে এর পদ্ধতি কি হওয়া উচিত? ও এ ধরনের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে লাগলেন সুবক্তগীনের স্ত্র উস্তাদ। শিষ্যের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। অনেক ভেবে-চিন্তে একদিন আল হাকামকে ডেকে তিনি বললেন, তুমি ছেলেকে বুখারা নিয়ে যাও। স্ত্র তিনি একজন বিজ্ঞ আলেমের ঠিকানা দিয়ে বললেন, তোমার ছেলের মধ্যে আমি এলেমের যে তৃষ্ণা দেখেছি, তা নিবারণ করতে না পারলে ও পাগল হয়ে যাবে। শুধু জ্ঞান-পিপাসাই নয় ওর মধ্যে আমি সুপ্ত যে বীরত্বের লক্ষণ দেখছি, ওকে যদি সমর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তবে এই ছেলে একদিন বিখ্যাত হবে। বর্তমানে চতুর্দিকে যুদ্ধ বিগ্রহ চলছে। মুসলমান রাজা-বাদশাহরা পারস্পরিক হানাহানিতে লিপ্ত রয়েছে। এর সুযোগে কাফের-বেঈমানেরা মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করে গোলামে পরিণত করছে। এই ছেলে এসব নিয়ে গভীর চিন্তা করে। সাধারণত গরীবের ঘরে এমন মন-মানসিকতার ছেলে-মেয়ে জন্ম নেয় না। বড় কিছুর আশা করাও গরীবের সন্তানের জন্য মানায় না। তবুও যদি ভাগ্য প্রসন্ন হয়, কোন সুযোগ পায় তবে এই ছেলে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন কায়েম করে ক্ষান্ত হবে। মুশকিল হলো, ওর মধ্যে দারুণ নীতিবোধ কাজ করে। নীতি-আদর্শের উপর অটল থেকে জীবনে বড় কিছু করা বড়ই কঠিন, তবে নীতিবানের দ্বারাই বড় কিছু হওয়া সম্ভব। সুবক্তগীন এমন এমন নীতি-আদর্শের কথা বলে যা কখনও আমি তাকে বলিনি। হয়ত ওকে ওর জীবনে বহু ঝড়-তুফান মোকাবেলা করতে হবে।

‘নীতি-নৈতিকতার কথা ওকে আমি বলেছি’- বলল আল হাকাম। আমার এলেম কালাম বেশি নেই। তবে আমি ন্যায়ের প্রতীক নওশেরোয়ার অধঃস্তন বংশধর। আমি বাপ-দাদা ও মুরব্বীদের কাছে যেসব ন্যায়নীতি ও ইনসাফের কথা শুনেছি, সে সব আমি ছেলেকে বলেছি। তাছাড়া বাড়িতে সারাক্ষণ ওকে কুরআন-কিতাব নিয়ে পড়তে দেখেছি। কিতাবাদি থেকেও সে আদর্শ বাণীগুলো রপ্ত করেছে।

“তুমি একে বুখারায় নিয়ে যাও! আমি একখানা চিঠি লিখে দিচ্ছি। ওখানে তোমার ভালো কর্মসংস্থানও হয়ে যেতে পারে। আর হ্যাঁ! একা যেয়ো না। ওই পথটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পথে ডাকাত, লুটেরাদের খুবই উৎপাত। তোমার তেমন কোন সহায়-সম্পদ না থাকলেও তোমার স্ত্রীই বড় রত্ন। এমন যেন না হয় যে, এই বিদূষী মহিলাকে জীবনের জন্যে হারিয়ে ফেল। তাছাড়া এ ধরনের শিশু-কিশোররাও খুব বেশি অপহরণের শিকার হয়। কাজেই কোন বণিক দলের সঙ্গী হবে। কিছুদিন অপেক্ষা কর, বড় কোন কাফেলা ওই দিকে গেলে আমিই তোমাকে খবর দেব।” বললেন মসজিদের ইমাম।

ওই যুগে দূরের কোন সফরে ডাকাত-লুটেরাদের থেকে আত্মরক্ষার জন্যে দল বেঁধে লোকজন সফর করতো। এক দু’জনকে পেলেই ডাকাত-লুটেরা দল সর্বস্ব লুটে নিত। কখনও পুরো কাফেলা আক্রমণ করতো ডাকাতেরা। অস্ত্রের মুখে ছেলে-মেয়ে ও নারীদের অপহরণ করে গোলাম দাসী হিসেবে বাজারে বিক্রি করে দিত।

যাদের দায়িত্ব ছিল লুটেরা-ডাকাতদের আক্রমণ-অত্যাচার থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা, সেসব আমীর-উমরারা ডাকাতদের কাছ থেকে সুন্দরী মেয়ে ও ছোট শিশুদের দাস-দাসী হিসেবে কিনে নিতো। এতে ডাকাত লুটেরারা উৎসাহ পেত। ইমাম সাহেবের আশঙ্কা ছিল যথার্থ। আল-হাকামের স্ত্রী যেমন ছিল সুন্দরী, তার ছেলে সুবক্তগীনের ছিল বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। তার চেয়েও বড় কথা, ইমাম সাহেব বুঝেছিলেন, এই ছেলের মা কোন সাধারণ যাযাবর মহিলা নয়, তার ভেতরে অবশ্যই অসাধারণ গুণ রয়েছে যা অন্য মহিলাদের নেই। ভালো মা ছাড়া এ ধরনের শিশু জন্ম নিতে পারে না। সুবক্তগীনের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই ইমাম সাহেব আল-হাকীমকে সতর্ক করেছিলেন। ইমাম সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন, ওর বাবার চেয়ে ওর মায়ের অবদান বিশেষ গুরুত্ব রাখে এক্ষেত্রে।

স্থানীয় কোন কাফেলার যাত্রা-সংবাদ দীর্ঘ দিনেও পাওয়া গেল না। একদিন দেখা গেল, তিনশ’ জনের এক বিরাট কাফেলা নারী-শিশু ও বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে সমরকন্দ-বুখারার দিকে যাচ্ছে। কাফেলার অধিকাংশ লোক সওদাগর মনে হল। ছেলের ভবিষ্যতের দিকে খেয়াল করে আল-হাকাম সওদাগর কাফেলার সাথে মিলে অভিষ্ট লক্ষ্যে যাত্রা করল। সারা দিন বিরামহীন চলল কাফেলা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে একটি ময়দানে কাফেলা যাত্রা বিরতি করল। তবু ফেলে রান্না-বান্না হল। ক্লান্ত-শ্রান্ত যাত্রীরা যে যার মতো গা এলিয়ে দিল ঘুমের কোলে। কয়েকজন তাবুর আশে-পাশে পাহারায় নিযুক্ত হল। তাদের হাতে তীর-ধনুক, ঢাল-তরবারী। তখন রাত প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ প্রহরীদের কানে ভেসে এলো অশ্বখুরের আওয়াজ। সতর্ক প্রহরীরা ধনুকে তীর যোজনা করল। ক্রমেই আওয়াজ নিকটতর হচ্ছিলো। এক সময় মনে হলো, এক, বিশাল সৈন্যবাহিনী এই দিকে ধেয়ে আসছে, হয়তো কোন দিকে যুদ্ধ যাত্রা করেছে কোন সৈন্যদল। আগন্তুকদের সংখ্যাধিক্য আন্দাজ করে প্রহরীরা কাফেলার শক্ত-সামর্থ্য কয়েকজনকে জাগিয়ে দিল। অন্যেরা তখনও ঘুমে অচেতন। জাগিয়ে ভোলা ব্যক্তিদের মধ্যে আল-হাকামও ছিল। ভাবসাব দেখে প্রহরীরা নিশ্চিত হলো, আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী। সৈন্যদল হলেও এরা বণিক কাফেলার মাল-সামিন হস্তগত করবে, আর ডাকাত হলে তো সবই লুটে নেবে। ওরা সংখ্যায় বহু। তাই তারা অশ্বারোহী দলের আক্রমণ আশঙ্কায় কাফেলার নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হলো।

দেখতে দেখতে এক বিশাল বাহিনী মশাল জ্বালিয়ে দ্রুত বেগে অগ্রসর হচ্ছে তাঁবুর দিকে। তাঁবুর পাশে এসেই ডাকাত দল মশালগুলোকে তাঁবুতে ধরিয়ে দিল। বীভৎস ডাক-চিৎকার শুরু করল। ডাকাতেরা ওদের ঘোড়াগুলোকে এভাবে বিক্ষিপ্ত হাঁকাতে শুরু করল যে, তাঁবুর লোকেরা ঘুম থেকে উঠে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ওদের ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হতে লাগল। মহিলা ও শিশুরা আর্তচিৎকার দিয়ে যে যেদিকে পারল দৌড়াতে লাগল। মহিলারা কোলের বাচ্চাকে বুকে চেপে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু ডাকাতদের তীব্র আক্রমণে কারো পক্ষেই নিরাপদ স্থানে যাওয়া সম্ভব হলো না।

আল-হাকাম ঘটনার আকস্মিকতায় স্ত্রীকে বগলদাবা করে টেনে একটা ঝোঁপের আড়ালে নিতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর মনে পড়ল, তাদের কলিজার টুকরো সুবক্তগীন তাদের সাথে নেই। স্ত্রী চিৎকার শুরু করল ছেলের জন্যে। আল-হাকাম ওকে অনেক কষ্টে বুঝাল যে, তুমি চেঁচালে ডাকাত তোমাকে নিয়ে যাবে। স্ত্রীকে আড়ালে রেখে নিরস্ত্র হাকাম বেরিয়ে পড়ল ছেলের খোঁজে। এদিকে তখন ডাকাত দল ঘোড়া থেকে নেমে দু’হাতে ধন-সম্পদ লুটে মেয়ে ও শিশুদের বেঁধে এক জায়গায় জড় করছে। কাফেলার লোকদের আর্তচিৎকার, মহিলাদের ক্রন্দনরোল আর শিশুদের আর্তনাদে ময়দানে কেয়ামত নেমে এসেছে। ডাকাতদের প্রতিরোধ করার সামর্থ্য তাদের নেই। তীব্র আক্রমণে প্রহরীদলের সবাই নিহত হয়েছে। নিহত হয়েছে প্রতিরোধকারীরাও। পুরো কাফেলা এখন ডাকাতদের কজায়। সব মাল-সামান, নারী-শিশু, উট, ঘোড়া ডাকাতরা নিয়ে চলে গেল।

রাত পোহালো । আহতদের যারা আড়ালে গিয়ে কোন মতে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিল তাদেরও আর বাঁচার আশা রইল না। রক্ত আর লাশে একাকার। কোন সক্ষম পুরুষকেই ডাকাতরা প্রাণে বাঁচতে দেয়নি। যেসব মহিলা ও শিশু ওদের নির্দেশমতো দাসত্ব বরণে গড়িমসি করেছে, সময় ব্যয় না করে হিংস্র জানোয়ারগুলো তাদেরও হত্যা করেছে। সকাল বেলা আল-হাকামের স্ত্রী স্বামী-সন্তানের জন্যে পাগলের মত চিৎকার করে ময়দান জুড়ে খুঁজতে থাকে, কিন্তু সে প্রিয় সন্তানটিকে খুঁজে পেল না। স্বামীকে পেল, সেও আর জীবিত নয় মৃত। আল-হাকামের দেহ তরবারীর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছিল ডাকাতেরা। তার সারাদেহ রক্তে ডুবে গিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছিল, সে অনেক। লড়াই করেছে, ডাকাতদের উপযুপরি আক্রমণে তার মৃত্যু হয়েছে।

সুবক্তগীনের মা ময়দানের সব লাশ ওলট-পালট করে দেখছিল, আর যাকেই পাচ্ছিল বলছিল, তোমরা কি আমার মানিক সুবক্তগীনকে দেখেছ? ও খুব সুন্দর। কাফেলায় আমার ছেলের মতো এতো সুন্দর আর বাচ্চা ছিল না। লাশের পর লাশ ওলট-পালট করে স্বামীহারা স্ত্রী একমাত্র সন্তানের দেখা না পেয়ে পাগল হয়ে গেল।

বালিয়াড়ীর আড়ালে, ঝোঁপ ঝাড়ের ভেতর, টিলার চূড়ায় আর ময়দানে হাকামের স্ত্রী সন্তানের খোঁজে পাগলিনীর মতো দৌড়াচ্ছে। ডাকাতদের রেখে যাওয়া তাবু আর বিক্ষিপ্ত মাল-সামান ও প্রতিটি লাশকে বারবার ওলট-পালট করে দেখল, কিন্তু সুবক্তগীনকে পেল না। টিলায় চড়ে গলা চড়িয়ে ডাকল, সুবক্তগীন! বাবা, আমার কাছে আয়! বাবা সুবক্তগীন! আমার কোলে আয় । সুবক্তগীন! সুবক্তগীন! সুবক্তগীন!

লুটন্ত কাফেলার যারা বেঁচে ছিল, তারা সাক্ষাত মরণ থেকে রক্ষা পেয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত জীবনটা টেনে হেঁচড়ে কোন মতে লোকালয়ে ফিরে চলল। দেখতে দেখতে ময়দান জনশূন্য হয়ে গেল। শিয়াল, শকুন আর হিংস্র হায়েনাদের খোরাক হল মৃতদেহগুলো। আধমরা মানুষগুলোর ওপরও হুমড়ি খেয়ে পড়ল শেয়াল শকুনের দল। তখনও আল-হাকামের স্ত্রী ময়দান, বালিয়াড়ী ও ঝোঁপ ঝাড়ে তার সন্তানটিকে তালাশ করছিল। ডাকছিল– সুবক্তগীন! বাবা সুবক্তগীন। আমি এখানে, আয় বাবা সুবক্তগীন! আয় সুবক্তগীন!

বেশ কিছুদিন পর্যন্ত যতো কাফেলা, ডাকাতদল, সৈন্যবাহিনী এ পথে গিয়েছে একটি নারীকণ্ঠের আর্তনাদ আর সুবক্তগীন সুবক্তগীন ডাক তারা সকলেই শুনেছে। অনেকেই এই আওয়াজ নিয়ে নানা রূপকথার জন্ম দিয়েছে, আবার অনেকে এটাকে মনে করেছে কোন প্রেতাত্মার ডাক। দেখা গেলো, এই ডাকের ভয়ে এ পথে লোকের চলাফেরাই বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ প্রেতাত্মার ভয়ে এ পথ এড়িয়ে অন্য পথে গেছে। কেউ সাহস পাচ্ছে না এ পথে চলতে। যদিও সুবক্তগীনকে ডাকা কোন নারীকণ্ঠ এখন আর ঐ টিলা থেকে ভেসে আসছে না। তবুও টিলার দিকে ভয়ে কেউ তাকাচ্ছেও না। আল-হাকাম নিহত হয়েছে। যদি সে জীবিত থাকত তাহলে এই মুহূর্তে স্ত্রীকে টেনে হেঁচড়ে নিরাপদে কোথাও নিয়ে যেত আর বলতো, আমি যা বলেছিলাম তা বুঝতে চাইছিলে না যে, গরীবের ছেলে সত্যের পূজারী হয় না, পেট পূজারী হয়। তোমার কল্পনার শ্বেত-শুশ্রুধারী লোকের সেই ঘটনা বাস্তব নয় অলীক, কল্পনা, অবাস্তব স্বপ্ন। ভোগ-বিলাসিতা, ধন-সম্পদ, মিথ্যা আর প্রতারণার যেখানে দাপট সেখানে সত্য ও ন্যায়নীতির মৃত্যু ঘটতে বাধ্য। আজ জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের পরিবর্তে পাষণ্ড, বেঈমান-বদমায়েশরাই সুখ্যাতি পাচ্ছে। সুবক্তগীনের মা! কুরআনের ইঙ্গিত আমাদের মতো ভবঘুরের সন্তানের ভাগ্যে ফলে না। সাধ হোক আর আকাঙ্ক্ষা হোক, কল্পনা হোক আর বাস্তবই হোক। জনমানবহীন বিজন প্রান্তরে আল-হাকামের স্ত্রীর সুবক্তগীন, সুবক্তগীন আওয়াজ আর কেউ শুনল না। ইতিহাসের পাতা থেকে অন্ধকারে চলে গেল সুবক্তগীনের মায়ের অহাজারি ও কান্না।

ইসলাম মানুষকে দাসী-বদীতে রূপান্তরের ব্যাপারটি প্রায় বিলুপ্তির নিকট নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু খেলাফতে রাশেদার পর রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার আশ্রয়ে গোলাম-বাদীর বেচা-কেনা আবার জমে উঠল। বাদশাহ, শাহানশাহ ও সম্রাটরা ভোগ আহ্লাদে ডুবে গেল। মুসলিম শাসকদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র বেড়ে গেল। রাজতন্ত্রের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কবলে খেলাফত ভেঙ্গে খান খান হল। নামে মাত্র একজন খলিফা রইল। প্রকৃত খেলাফতের কিছুই অবশিষ্ট রইল না। রাষ্ট্র পরিচালিত হতে লাগল আমীর উমারার ইচ্ছেমত। আমীর শ্রেণীর হেরেমগুলো গোলাম-বাদীতে ভরে গেল। আরাম-আয়েশ ভোগ-বিলাসিতার আয়োজনে শাসক শ্রেণীর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। দাস-দাসীরা পরিগণিত হলো আভিজাত্যের প্রতীকস্বরূপ।

বুখারার এক মাঠ লোকে লোকারণ্য। অসংখ্য মানুষের ভীড়। হাঁক ডাক হচ্ছে। ডাক উঠছে। মানুষের মেলা। বনি আদম কেনাবেচার হাট। দলবেঁধে ছেলে-মেয়ে, তরুণ-তরুণী ও মহিলাদের সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে। নিলাম হচ্ছে কয়েকটি কাঠের মাচাং-এ। উপরে তাবু টানানো?। একটি মাচাং-এ কয়েকটি তরুণী। আনকোরা । ডাক উঠছে,…ইনটেক, কুমারী, সম্পূর্ণ অব্যবহৃত। সরাসরি ঘর থেকে নিয়ে আসা। উমদা তমাল দাম কম। মাত্র প্রতিটি একশ’ দিনার। কে আছে বল….একশ’ একশ’ একশ। দু’কিশোরীর কাঁধে হাত রেখে হাঁক ছাড়ল এক বিক্রেতা।

এই কিশোরী দল এখানে বিক্রিপণ্য। কাফেলা লুটের শিকার । উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ওদের শরীর আর চেহারা পরখ করছে ক্রেতাদল। আমির-উমরার হেরেমের রক্ষিতা, আদম ব্যাপারী ও মেয়েদের ফেরীওয়ালা, যারা ওদের নাচ-গান শিখিয়ে বাজারে বাজারে ব্যবসা করে এমন লোকেরা এখানকার ক্রেতা।

একটু দূরে একটি টিলাসদৃশ জায়গায় আরেকটি জটলা। ওখানে বালক, শিশু আর পুরুষদের হাট। ক্রেতারা গরু-ছাগলের মতো ওদের নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী বালকদের দাম বেশি। দশ বারো বছরের কয়েকটি বালক অঝোর ধারায় অবিরাম কাঁদছে। একটি ছেলে ওদের ব্যতিক্রম। অন্যেরা কাঁদলেও তার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। নিরুদ্বেগ, গম্ভীর। এসব বালককে বণিক কাফেলা থেকে অপহরণ করা হয়েছে- যে কাফেলার সাথে আল-হাকাম তাঁর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বুখারার পথ ধরেছিল। নিরুদ্বেগ বালকটিই সুবক্তগীন। দেখতে সে অন্য বালকদের মতো ফর্সা না হলেও প্রাণবন্ত। সুস্থ সবল চেহারায় তার আভিজাত্যের ছাপ।

ক্রেতাদের মধ্যে হাজী নসর-এর প্রতিনিধিও উপস্থিত। হাজী নসর বুখারার উপকণ্ঠের এক জমিদার লোক। সে তার প্রতিনিধিদের বলেছিল, বয়স্ক গোলামের চেয়ে তার দরকার কমবয়েসী কয়েকটি বালক। যাদের তিনি নিজের মতো করে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলবেন, আস্থাভাজন হিসেবে নিজের বিশেষ কাজে ব্যবহার করবেন। সুবক্তগীনকে দেখে হাজী নসরের প্রতিনিধিদের পছন্দ হলো। তাকে খবর দিলো। হাজী নসর এসে বালকদের কান্না দেখে হতাশ হলেন, কিন্তু নির্বিকার শান্ত-সুবক্তগীনের চেহারায় তার দৃষ্টি আটকে গেল। রাশভারী গলায় তিনি বললেন, এসব বালকদের সামলানো সহজ ব্যাপার নয়। তবে একে নিয়ে নাও। সুবক্তগীনের প্রতি অঙ্গুলি ইশারা করে বললেন তিনি। দাম মিটিয়ে সুবক্তগীনসহ আরো ক’টি বালককে টেনে নিয়ে এলো হাজীর লোকেরা।

ঘরে এসে সুবক্তগীনকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন হাজী নসর, তোমার কী নাম?

সুবক্তগীন।

তোমার মা-বাবা কি জীবিত?

জানি না। আমরা তাঁবুতে ঘুমিয়ে ছিলাম। ডাকাতরা তাঁবু আক্রমণ করল, আমি দৌড়ে পালাতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু এক লোক আমাকে ধরে অনেক লোকের সাথে একত্র করে হাত-পা রশিতে বেঁধে ফেলল। এরপর এখানে নিয়ে এল। আব্দু-আম্মু কোথায় আমি জানি না।

তোমার আব্ব কি কাজ করত?

আমীরদের ঘরে কাজ করতো।

তুমি কাঁদছো না কেন?

এর উত্তর দেয়ার আগে আমি জানতে চাই, আপনার ধর্ম কি?

আমি মুসলমান। আমি হাজী। বললেন হাজী নসর।

তাহলে আমার নয় আপনার রোদন করা উচিত।

আপনার হজ অর্থহীন। আমাকে আব্ব বলেছিলেন, কুরআনের নির্দেশ হলো, কোন মানুষ কোন মানুষকে গোলাম বানাতে পারে না। আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, আমি কাঁদছি না কেন? আমি বুঝতে পারছি না এ অবস্থায় আমি কাঁদবো না হাসবো। আমার বয়স আপনার মতো হলে হয়তো এ কথার সঠিক জবাব আমি দিতে পারতাম।

হাজী নসর অবাক হয়ে গেলেন সুবক্তগীনের জবাব শুনে। এতটুকু বালকের মুখে এ ধরনের বিজ্ঞোচিত জবাব আর পাল্টা প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন এমনটি তিনি কল্পনাও করেননি।

এ ধরনের কথা তোমাকে কে শিখিয়েছে?

আমার এক উস্তাদ আমাকে কুরআন-হাদীস পড়িয়েছেন। তিনি যে মসজিদের ইমাম ছিলেন, সেই ঠিকানা এবং বুখারায় পাঠানোর জন্যে লেখা তার চিঠির কথাও সে বলল। আরো বলল, তার বাবা নওশেরোয়ার বংশধর। সে তার বাবার মুখে ন্যায় ও ইনসাফের বহু কাহিনী শুনেছে। শুনেছে, তাদের পূর্ব পুরুষদের বহু কীর্তি-কাহিনী। এও বলল, আমার আম্মা প্রায়ই স্বপ্ন দেখতেন, তাকে শ্বেতশুভ্র এক দাড়িওয়ালা বুযুর্গ ব্যক্তি বললেন, তুমি এমন এক ছেলের জন্ম দেবে যে বড় হয়ে অন্যায় রোধ করবে, আর দুনিয়াতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে। বুযুর্গ এ কথাও বলতেন, সেই ছেলে যদি আমি নাও হই তবে আমার বংশে এমন ছেলে অবশ্যই জন্ম নেবে।

তুমিও তোমার মায়ের স্বপ্নে বিশ্বাস কর?

মায়ের কথায় কিভাবে বিশ্বাস করব । গোলাম দাসীদের আবার আত্মবিশ্বাস ও ঈমান-আকীদা থাকে নাকি? আপনি কি আমাকে জানোয়ারের মতো মনে করে টাকার বিনিময়ে কিনে আনেন নি? যারা কেনা গোলাম তাদের নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্বাসের কোন মূল্য আছে কি?

তোমরা যদিও আমার কেনা গোলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে জীব-জন্তুর মতো রাখবো না। তোমাদেরকে আমি মানুষের মতো করেই গড়ে তুলব। হাজী নসর বললেন।

তুমি কোন কাজ জান?

আমাকে আব্দু-আম্মু বুখারায় নিয়ে আসছিলেন পড়ালেখার জন্যে। বলল সুবক্তগীন।

আমি তোমাদেরকে আমার ছেলেদের গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে দিচ্ছি।

তুমি তার সেবাযত্ন করবে, আর লেখাপড়া করতে চাইলে তাও করতে পারবে।

সুবক্তগীন রচিত ‘পান্দে নামা’ নামক একটি পুস্তক থেকে জানা যায়, সুবক্তগীন তিন বছরকাল হাজী নসর-এর বন্দী দশায় ছিলেন। কিন্তু সেখানে দৃশ্যত গোলাম হলেও তার জীবন গঠনে হাজী নসর-এর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল কল্যাণকামী অভিভাবকের মত। হাজী নসর অধিকাংশ সময় সফরে কাটাতেন। ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব যে, প্রকৃতপক্ষে হাজী নসর কোন আমীর শাসক ছিলেন না, শুধু ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তবে একথা বোঝা যায়, হাজী নসর অন্যদের তুলনায় অনেকটা ন্যায়পরায়ণ ছিলেন।

সুবক্তগীন গৃহশিক্ষকের হাতে ন্যস্ত হলেও গৃহশিক্ষক প্রথমে তাকে গোলামের চেয়ে বেশি কিছু মনে করেন নি। কিন্তু প্রথম দিনেই সুবক্তগীন গৃহ শিক্ষককে বুঝিয়ে দিন, সে জন্মসূত্রে গোলাম নয়, ভাগ্য বিড়ম্বিত এক বালক। দুর্ভাগ্যক্রমে সে এখানে ভৃত্যে পরিণত হয়েছে।

হাজী নসরের এক ছেলে কুরআন শরীফ ভুল পড়ছিল। সুবক্তগীন তার ভুল নিজে না শুধরিয়ে গৃহশিক্ষকের কাছে গিয়ে বলল, সাহেবজাদা ভুল পড়ছে। গৃহশিক্ষক সুবক্তগীনের উপস্থিতবুদ্ধি ও বিদ্যা দেখে বিস্মিত হলেন এই ভেবে যে, এই পুঁচকে ভৃত্য কুরআন শরীফের ভুলও ধরতে পারে। তিনি সুবক্তগীনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কুরআন শরীফ পড়া কোথায়, কার কাছে শিখেছ? জবাবে সুবক্তগীন গৃহশিক্ষককে তার মা-বাবা, উস্তাদ এবং তার অপহরণের সব ইতিবৃত্তই শোনাল। গৃহশিক্ষক সুবক্তগীনের আচরণ ও কথাবার্তায় মুগ্ধ হলেন এবং তার প্রতি একটু বেশি মনোযোগী হয়ে পড়লেন। কিন্তু হাজী নসর এদের এতটুকুই লেখাপড়া শিখাতে ইচ্ছুক ছিলেন যতটুকু করলে সৈনিক ও সিপাহী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এদের জন্য এর বেশি শিক্ষাকে তিনি নিজের জন্যে ক্ষতিকর ভাবছিলেন।

নিজ সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারেও হাজী সাহেবের একটা সীমা নির্ধারিত ছিল। যতটুকু লেখাপড়া করলে ধর্মের জরুরী জ্ঞান লাভ করা যায় আর যে সব কলাকৌশল রপ্ত করলে তেজস্বী অশ্বারোহী, বীর সেনাপতি আর বাহাদুর যোদ্ধা হওয়া সম্ভব ছেলেদেরকে তিনি এই পরিমাণ যুদ্ধকৌশল ও বিদ্যা শেখানোর জন্যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন গৃহশিক্ষকের উপর । কিন্তু হাজী নসর-এর ছেলেদের কেউই সুবক্তগীনের মতো দূরদর্শী এবং মেধাবী ছিল না। যুদ্ধ বিদ্যা, তীর চালানো, ঘোড় সওয়ার কি পুঁথি-পুস্তক কোন ব্যাপারেই খুব একটা আগ্রহ ছিল না হাজীপুত্রদের মধ্যে। পক্ষান্তরে কিছু দেখে, কিছু শুনে এবং কিছুটা নির্দেশনা পেয়েই সুবক্তগীন দ্রুত যুদ্ধ কৌশল, ঘোড় সওয়ার ও তীর ধনুক-তরবারী চালনায় সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠছিল।

গৃহশিক্ষক যেমন সুবক্তগীনের প্রতি ঝুঁকে পড়লেন, অন্য ছেলেরাও সুবক্তগীনের প্রতি সশ্রদ্ধ ছিল। সে কথা বলতে সহাস্যবদনে। কখনো কাউকে কটাক্ষ করে কথা বলতো না। তার আচরণ ও মার্জিত ব্যবহার শিক্ষককে তার প্রতি মনোযোগী করে তুললো। শিক্ষক তার অভিজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্য উজাড় করে দিয়ে তাকে জ্ঞানের রাজ্যে ডুবিয়ে দিতে লাগলেন। মাত্র তিন বছরে হাজী নসরের আশ্রয়ে পরিপূর্ণ যোদ্ধায় পরিণত হয় সুবক্তগীন। শিক্ষক তাকে ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যেরও শিক্ষা দেন। অপরদিকে আয়েশী হাজীপুত্ররা সুবক্তগীনের কৃতিত্বে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ না হয়ে ভোগ-বিলাসিতায় তলিয়ে যেতে থাকে।

দীর্ঘ সফর থেকে ফিরে হাজী নসর যখন সুবক্তগীনকে দেখলেন, তখন মনে হলো তিনি অন্য কাউকে দেখছেন। কৈশোর পেরিয়ে সে তখন পূর্ণ স্বাস্থ্যবান সুঠাম যুবকে পরিণত হয়েছে। একদিন হাজী নসর সুবক্তগীনের যুদ্ধকৌশল, তীরন্দাজী ও অশ্বারোহণ দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ হলেন। সুবক্তগীনের সমর নৈপুণ্যে হাজী নসর তাকে তার নিজস্ব রক্ষী বাহিনীর দলনেতা এবং গোলামদের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব দিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই সুবক্তগীন হাজী নসর-এর ডান হাতে পরিণত হল।

সে সময় আলপ্তগীন বুখারার গভর্ণর ছিলেন। তুর্কী খেলাফতের মসনদে দ্বিতীয় আব্দুল মালেক সমাসীন। হাজী নসর আলপ্তগীনের খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন। এক তথ্য মতে ৯৫৭ সাল মোতাবেক ৩৪৮ হিজরীতে একদিন হাজী নসর আলপ্তগীনের সাথে মোলাকাত করতে গেলেন। সে সময় সুবক্তগীনও সাথে ছিল। তখন সুবক্তগীনের বয়স বিশ-একুশ বছর। ইতিহাসে হয়তো এটাই প্রথম ঘটনা যে, কোন যাযাবরের অপহৃত ছেলে গোলাম হিসেবে বিক্রি হওয়ার পরও বুখারার গভর্ণর হাউজে প্রবেশাধিকার পেল। সাক্ষাতের পর আলপ্তগীন হাজী নসরকে বললেন, আপনি এই গোলামকে আমার হাওলা করে দিন। আলপ্তগীন বিভিন্ন সূত্রে হাজী নসর আশ্রিত সুবক্তগীনের কর্মকুশলতার সংবাদ আগেই পেয়েছিলেন। সাক্ষাতে সুবক্তগীনকে দেখেই তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, এই যুবকের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া আলগীনের কন্যা ছাড়া প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করার মতো কোন যোগ্য উত্তরাধিকারও তার নেই। তিনি মনে মনে এমন যোগ্য এক উত্তরসূরি খুঁজছিলেন।

কিন্তু এমন দামী রত্ন হাজী নসর হাতছাড়া করতে কোন মতেই রাজী ছিলেন না। অনেক বলা কওয়ার পর অভাবনীয় উচ্চমূল্যের প্রস্তাব দিলে হাজী নসর সুবক্তগীনকে হস্তান্তর করতে সম্মত হলেন।

সে সময় আলপ্তগীন, সুবক্তগীন ধরনের নাম সাধারণত তুর্কীরা রাখতো। সুবক্তগীনের মা তুর্কী হওয়ার কারণে ছেলের নাম তুর্কী ধাচে রেখেছিল। সে সময় তুরস্কের শাসন ক্ষমতা ছিল অমুসলিমদের হাতে। শাসকদের অত্যাচার-উৎপীড়নে মুসলমানরা তুরস্ক ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছিল। দেশ ছাড়াদের মধ্যে সুবক্তগীনের মায়ের বাপ-দাদাও ছিল।

দৈহিক সৌন্দর্য আর মেধা-মননে তুর্কীরা ছিল অন্যদের তুলনায় আকর্ষণীয়। এ জন্য ডাকাত ও লুটেরাদের হাতে বন্দী হয়ে যেসব তুর্কী বিক্রির জন্য হাটে উঠত তাদের দাম অন্যদের চেয়ে বেশি হতো। বলখ, গজনী, বুখারা ও আশ-পাশের এলাকায় বহু তুর্কী গোলাম-বাদী পাওয়া যেতো। দেশ জুড়ে এদের গোলামীর সুখ্যাতি ছিল। এরা খুবই বিনয়ী, অনুগত ও বিশ্বস্ত। মুনিবের স্বার্থ রক্ষায় এরা অতুলনীয়।

তুমি কি সে সব গোলাম বংশের, যাদের বেলায় এই অঞ্চলের বেশ সুখ্যাতি রয়েছে? আলপ্তগীন সুবক্তগীনকে জিজ্ঞেস করলেন।

সুবক্তগীন তখন তার দরবারে মাথা নীচু করে ক্রীতদাস হিসেবে দণ্ডায়মান। মনিবের প্রশ্নের জবাবে নিরুত্তর।

তুমি আমাকে তোমার আদব-আখলাক দিয়ে বুঝাতে চাচ্ছো যে, তুমি গোলাম হিসেবে খুবই বিশ্বস্ত হবে, তাই না?

আলপ্তগীন ধীর পায়ে গোলামের কাছে এসে পিঠে আলতো চপেটাঘাত করে জোর গলায় বললেন, বেটা! মাথা উপরে উঠাও, বুকটান করে দাঁড়াও, আমার চোখে চোখ রেখে দেখ, আমিও তুর্কী, তুমিও তুর্কী।

সুবক্তগীন মাথা তুলে মনিবের দিকে তাকাল। মনিব তাকে নিজের কাছে বসিয়ে বললেন, তুমি যেমন বুদ্ধিমান, তের্মনি সৎ ও কৌশলী যোদ্ধা। আসলে মানুষ শুধু জ্ঞানের দ্বারা আলেম হতে পারে না, শুধু আমল দ্বারাও পূর্ণ মানুষ হতে পারে না। মানব জীবনে ইলম ও আমলের সমন্বয় থাকতে হয়। আরো একটা ব্যাপার আছে, ইলম থাকা সত্ত্বেও আমল বিশুদ্ধ হয় না যতক্ষণ না সে ব্যক্তি কোন বুযুর্গ ব্যক্তির নির্দেশনামতো নিজেকে গঠন করে। তোমার সৌভাগ্য যে তুমি জন্মসূত্রে ধর্মীয় চেতনা পেয়েছ আর দু’জন বুযুর্গ ব্যক্তির সংস্পর্শে দীক্ষা নিয়েছ। তোমার মধ্যে ইলম ও আমলের সমন্বয় ঘটেছে। এটা বড় গুণ।

আমার মধ্যে এমন কোন গুণ নেই যা দেখে বুখারার গভর্ণর মুগ্ধ হতে পারেন। বলল সুবক্তগীন।

এটাই তো তোমার বড় গুণ যে, তুমি একই সাথে তুর্কী ও গোলাম । তোমার মত আমিও তুর্কী এবং গোলাম ছিলাম। ছোটবেলায় আমাকেও এমন কঠিন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যেমন কঠিন গোলামীর জীবন তুমি বয়ে চলেছ। তবে তুমি জন্মসূত্রে মুসলিম আর আমার মা-বাবা ছিলেন অমুসলিম। আমি গোলাম অবস্থায় মুসলমান হয়েছি। আমি দীর্ঘদিন একজন বুযুর্গ ব্যক্তির মুখে ইসলামের নীতি ও আদর্শের কথা শুনেছি। ইসলামের কথা শুনে শুনে আমার মন সত্যধর্ম গ্রহণের জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। একদিন সেই বুযুর্গের হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেলাম।

ইসলাম বলে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। কেউ কারো প্রভু অথবা গোলাম নয়, টাকায় বিক্রি হওয়ার পণ্য নয় মানুষ । আল্লাহর জমিনে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করবে মানুষ। নিজের মর্জি মতো মানুষের উপর প্রভুত্ব করার অধিকার কোন শাসকের নেই। শাসকরা প্রভু নয় সেবক। আমি যদি মুসলমান না হতাম, আমার মনে যদি ইলম ও আমলের তৃষ্ণা সৃষ্টি না হতো, তাহলে হয়তো আজো গোলামই রয়ে যেতাম, এ সম্মান ও ক্ষমতার আসন পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব হতো না আমার।

সুবক্তগীন বললো, আমার আম্মু আমাকে বলতেন, তুমি বড় হলে অনেক সুনাম কুড়াবে। তোমার তরবারীর আঘাতে মিথ্যা অপসারিত হবে। তিনি আমাকে কুরআনের সেই আয়াত সম্পর্কে বলতেন যা হযরত ইবরাহীম তার পিতাকে বলেছিলেন, “আপনি এই সব জড় পদার্থের পূজা করেন যেগুলো শোনে না, বলতে পারে না, কিছু করতে পারে না। আপনি আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে সঠিক পথে নিয়ে যাব।” আর আমার মা আমাকে বলতেন, “তুমি সে সব মূর্তি পূজারীদের সেই পবিত্র মা’বুদের পথ দেখাবে যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) তাঁর বান্দা ও রাসূল (স.)।” আমার মা’র এসব কথা শুনে আব্বা বলতেন, “তোমার মা’র আকীদা সঠিক কিন্তু তার আকাক্ষা অলীক। কারণ, গরীবের সন্তান সুখ্যাতি পায় না, ওদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠা, বীরত্ব থাকে না, তারা হয় পরমুখাপেক্ষী ও কাপুরুষ। সুখ্যাতি অর্জন করতে হলে বীরত্ব, সত্যনিষ্ঠ হতে হয় এবং শাসক রাজা-বাদশাহদের সাথে মোকাবেলায় অবতীর্ণ হতে হয়। ন্যায় নিষ্ঠা দিয়ে মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে হয় কিন্তু গরীবের সন্তানদের চরিত্রে এসব বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটে না, ঘটাতেই পারে না, সৎ গুণাবলী অর্জনের সুযোগই তারা পায় না।”

আলপ্তগীন বললেন, তবে আমি বিশ্বাস করি, গরীবের সন্তানও বড় হতে পারে। কেন পারবে না, আরবের বেদুইন উট ও মেষ রাখালরা যদি সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আধা পৃথিবীর রাজত্ব করতে পারে তাহলে তুমি কেন পারবে না? বুঝতে হবে, যাযাবরের সন্তানরা এবং গোলাম হওয়ার পরও তুমি এখন আমার সাথে পাশাপাশি বসে আছ। কোন জাত-গোলাম এমনটি স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। আমার মনে হয়, তোমার মায়ের স্বপ্ন সফল হবে। তোমার বিশ্বাস, আস্থা ও কর্মনিষ্ঠা তোমাকে এ পর্যায়ে উন্নীত করেছে। আমি তোমার মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। তুমি যদি চেষ্টা কর তবে জীবনে উন্নতি করতে পারবে অবশ্যই।

আমার নিজের জন্যে কোন চাহিদা নেই। কোন পদ-পদবীর আগ্রহ আমার নেই। তবে আমি অবশ্যই একটা কিছু প্রত্যাশা করি, কিন্তু সেটা কি তা বুঝাতে পারবো না। বলল সুবক্তগীন।

হেসে ফেটে পড়লেন আলপ্তগীন। বললেন, এমন অবস্থা আমারো গেছে। আমিও বুঝে উঠতে পারতাম না আমার কি করা উচিত। সময়ই আমাকে বলে দিয়েছে আমার কি করণীয় ও কর্তব্য। তুমিও অচিরেই বুঝতে পারবে, কি তুমি চাও, কি তোমাকে করতে হবে। আজ থেকে তুমি নিজেকে আর গোলাম মনে করো না। এখন থেকে তুমি স্বাধীন। শুধু স্বাধীন নও, আমার প্রশাসনের একজন সম্মানিত জিম্মাদার ব্যক্তি।

সুবক্তগীনের হৃদয়ে ছিল এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। মিথ্যাকে দূর করে সত্যের বিজয় কেতন উড়ানো, মানুষের বিশ্বাসের নোংরামি দূর করে তাদের সঠিক পথের দিশা দেয়া এবং সুন্দরের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা তার হৃদয়ে যেন অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে চাইত কিন্তু পরিস্থিতি তাকে দমিয়ে রাখতো। এতটুকু সে বুঝতো, একটি নির্ভেজাল, সুন্দর, সত্য দিন দিন তার মধ্যে পুষ্ট হচ্ছে, বেড়ে উঠছে। তারুণ্য যৌবনের তাড়না তার মাঝে ছিল না এমন নয়, কিন্তু তা কখনও তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারত না। সে প্রচণ্ডভাবে অনুভব করছে, বিপ্লব তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এক যুদ্ধ-বিজয় তার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে।

পরদিন পড়ন্ত বিকেলে আস্তাবল থেকে একটি তাজী ঘোড়া নিয়ে ভ্রমণের জন্যে বেরিয়ে গেল। শহর থেকে বেরিয়ে সুবক্তগীন ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল এবং জোরছে ঘোড়া ছুটাল। ধুলি উড়িয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটে চলল সওয়ারী। হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো নারী কণ্ঠে আর্তনাদ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, এক সওয়ারী ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাচ্ছে, লাগামহীন ঘোড়া ছুটছে, ঝুলে রয়েছে মহিলা আরোহী। সুবক্তগীন বুঝতে পারল, ঘোড়ার জীন ঢিলে হওয়ায় সওয়ারী এদিক সেদিক হেলে পড়ছিল। ঘোড়া এই সুযোগে সওয়ারীকে ফেলে দিয়েছে। মগড়া স্বভাবের ঘোড়া সাধারণত এমনটিই করে থাকে অথবা সওয়ারী এদিক ওদিক হেলে পড়ার কারণে ঘোড়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সওয়ারী ফেলে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে এ কাণ্ড করেছে। সুবক্তগীন তার ঘোড়া মহিলার দিকে ছুটাল।

ঘোড়াটি এলোপাতাড়ি দৌড়াচ্ছিল। মহিলা শুধু চিৎকারই করছিল আর বলছিল, রিকাব থেকে অমার পা ছাড়িয়ে দাও, লাগামটা ছিঁড়ে ফেল, কিন্তু ভড়কে যাওয়া ঘোড়া ওর পিছনে অন্য সওয়ারীর আগমনে বেসামাল হয়ে এদিকে ওদিকে এঁকে বেঁকে প্রাণপণে পলায়নের চেষ্টায় দ্রুত গতিতে দৌড়াতে শুরু করল। পাশেই ছিল বহতা নদী। দিকভ্রান্ত ঘোড়া শেষ পর্যন্ত নদীর দিকেই ধাবিত হল। সুবক্তগীন নিজের ঘোড়াকে আরো তীব্র বেগে ছুটাল। বিদ্যুত গতিতে তার ঘোড়া পলায়নপর ঘোড়াকে তাড়িয়ে ছুটল। এক পর্যায়ে সুবক্তগীনের ঘোড়া মহিলার ঘোড়ার গতিরোধ করতে আগে বেড়ে পথ রোধ করতে চাইল। সুবক্তগীন তখন লক্ষ্য করল, এতো সাধারণ কোন মহিলা নয়। এতো আমীর বা রাজকন্যা হবে। উদ্ভিন্ন যৌবনা, উর্বষী তরুণী। মাথার চুল এলোমেলো হয়ে তার মুখ ঢেকে ফেলেছে, ওড়না রেকাব আর লাগামে পেঁচিয়ে বেচারীর দুর্দশা আরো বাড়িয়েছে। সুবক্তগীন চকিতে হাত বাড়িয়ে রেকাবে আটকে যাওয়া তরণীর পা ছাড়িয়ে দিল এবং ত্বরিৎ গতিতে তরুণীর ঘোড়ার লাগাম ওর মুখের কাছ থেকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল । তরুণীকে সে নির্দেশের সুরে বলল, তুমি লাফ দিয়ে আমার ঘোড়ায় উঠে আস। মুখের কথা শেষ না হতেই সে নিজের ঘোড়া থেকে নেমে ওই ঘোড়াটাকে বাগে আনার চেষ্টা করল। ইত্যবসরে তরুণীর ঘোড়া হেচকা টান মেরে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। টানের তীব্রতা সামলাতে না পেরে তরুণীও ছিটকে পড়ল পানিতে।

পাহাড়ী নদী। প্রচণ্ড স্রোত। তরুণী পানিতে পড়ে হাবুডুবু খেয়ে সাঁতরাবার চেষ্টা করছিল। ঘোড়া ওকে ফেলে থমকে দাঁড়ায়। সুবক্তগীন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তরুণীকে উদ্ধার করতে। তার ধারণা ছিল তরুণী হয়তো সাঁতরে উঠতে পারবে না। সে তরুণীকে নিজের কাঁধে তুলে তীরে রাখা ঘোড়া দুটিকে ধরে একসাথে এনে দাঁড় করাল। এমন দুরবস্থার শিকার হয়ে যে কোন তরুণীর ঘাবড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু তরুণী ভীত হওয়া তো দূরে থাক সুবক্তগীনের দিকে তাকিয়ে-খিলখিল করে হেসে উঠল।

তুমি বোকা না দুঃসাহসী! আজ তোমার মৃত্যু অবধারিত ছিল। বলল সুবক্তগীন।

আমি এমন বাপের বেটি যিনি বোকা নন সাহসী। বলল তরুণী। আমি বুখারার শাসক আলপ্তগীনের কন্যা। চলল, তোমাকে পুরস্কার দেবো। তুমি আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে।

না, আমার এই পুরস্কারই যথেষ্ট যে, আমার শুভাকাক্ষীর কন্যাকে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করেছি। আমি তোমার ঘোড়ার জীন বেঁধে দিচ্ছি।

তরুণী আর সুবক্তগীনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান তেমন নয়। উভয়েই তরুণ। টগবগে যুবক-যুবতী। তরুণী প্রাণোচ্ছল, সুদর্শনা, পটলচেরা চাহনী, মসৃণ ত্বক ও লাবণ্যময় চেহারার অধিকারিণী। সুবক্তগীনের গায়ের রং পোড়ানো তামাটে হলেও তার দেহের গড়ন পৌরুষদীপ্ত, সুঠাম ও আকর্ষণীয়। উভয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পাশাপাশি বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছে। পথে যেতে যেতে তরুণী যুবককে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল, কি তার পরিচয়, তার ঠিকানা কোথায়। সুবক্তগীন তার জীবন ও এখানে আগমন বৃত্তান্ত অতি সংক্ষেপে তরুণীকে বলল।

রাতে আব্বা তোমার কথাই বাড়িতে আলোচনা করেছিলেন। তিনি হয়তো সেনাবাহিনীতে তোমাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দান করবেন।

নিজের সেনা বাহিনী সেনাবাহিনী তার হয় কি করে, সেনাবাহিনী তো থাকে কেন্দ্রীয় শাসকের অধীনে!

তোমার কথা ঠিক, কিন্তু আব্বা হয়তো অন্য কিছু ভাবছেন। তিনি হয়তো হুকুমত নিজের কজায় নিতে চাচ্ছেন। এ জন্য বুখারাতে যে সেনা ইউনিট রয়েছে এদের মধ্যে নিজস্ব লোকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় শাসন এখন শিথিল হয়ে গেছে, তারা আরাম-আয়েশ ও ভোগ বিলাসে ডুবে আছে। এরা ধর্ম সম্পর্কে কটুক্তি করছে, ধর্ম সম্পর্কে এদের অনাস্থা মাত্রা ছড়িয়ে গেছে। তিনি এই জমিনে প্রকৃত ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় একান্ত আগ্রহী। গত রাতে তোমার সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, যুবকটি খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ও কুশলী।

বাড়ির সদর গেটে উচ্চ পদবীর এক লোককে তারা অতিক্রম করছিল। লোকটি তরুণী ও সুবক্তগীনকে গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছিল। তরুণী ও সুবক্তগীন উভয়ের কাপড় ভেজা, তখনো কাপড় থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে। তরুণীর ভেজা কাপড় সেঁটে গিয়েছিল গায়ের সাথে। তার নারী অঙ্গগুলো প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সিক্ত বসনে। মাথার চুলগুলো ছড়ানো পিঠে-কাঁধে। তার চেহারা রক্তিম। রাগে গড়গড় করছিল লোকটি। চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। উভয়ে লোকটির কাছে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল।

কোথা থেকে আসা হচ্ছে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তরুণীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল লোকটি। এই ছোড় কে?

হু, আপনি কে যে একেবারে হাকিমের মতো জেরা শুরু করেছেন? তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব দিল তরুণী। আমার ঘোড়া বেসামাল হয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রেকাবীতে পা আটকে আমি পড়ে গিয়েছিলাম। এ লোক আমাকে উদ্ধার করেছে। বুঝলেন হাকিম সাহেব! কিছুটা তাচ্ছিল্য বর্ষণ করে তরুণী সুবক্তগীনের বাজু ধরে তাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

এ লোক কে? তরুণীকে জিজ্ঞেস করল সুবক্তগীন। আমার বাগদত্তা। এখন থেকেই আমার উপর তিনি কর্তৃত্ব চালাতে চাচ্ছেন, কথায় কথায় হুকুম করেন, আগ বেড়ে খবরদারী চালান। কিছুটা শ্লেষমাখা কণ্ঠে বলল তরুণী। তুমি একে পাত্তা দিও না, ভয় করারও কিছু নেই।

হঠাৎ তরুণী সুবক্তগীনের বাজু ধরে বলল, তোমার কি স্ত্রী আছে, তুমি কি বিবাহিত?

না।

কোন মেয়েকে কি তোমার পছন্দ হয়নি? কারো সাথে কি তোমার ভাব নেই?

না। মেয়েদের প্রতি আমি কখনও দৃষ্টি দেই নি। এই সুযোগও আমার নেই।

তরুণী আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, আমাকে কি তোমার ভালো লাগছে না? নিরুত্তর সুবক্তগীন। তরুণীর কথায় সে দৃষ্টি অবনত করে ফেলল।

হু, তুমি আমাকে বেহায়া মনে করছে, তাই না? বলল, বলল সুবক্তগীন! যদি তুমি আমাকে বেহায়া ও বখাটে মেয়ে ভেবে থাকো তাহলে আর কখনও তোমার দৃষ্টিসীমায় আসবো না।

তোমাকে ভাল লাগা না লাগার কি আছে, তুমি তো আরেকজনের বাগদত্তা!

এটা আমার পারিবারিক পছন্দ। ওই না-মরদটাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। সে আমাকে দাসী বানাতে চায়। সে আমাকে ঘোড়-সওয়ারী হতে বারণ করে। সে চায়, আমি শুধু তার হেরেমের শোভা বর্ধন করি। চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ হয়ে থাকি। ওসব আমার অসহ্য। আমি চাই এমন। লোক যে তোমার মতো সুপুরুষ, যে আমার পাশাপাশি ঘোড়া দৌড়াবে, নদীতে ঝাঁপ দেবে। ওসব আয়েশী রাজা-বাদশাহদের বুঝিয়ে দিতে চাই, নারী শুধু হেরেমের শোভা বর্ধনের উপকরণ নয়, নারীর দেহ শুধু পুরুষের কামরিপু চরিতার্থ করার ক্ষেত্র নয়। তারা নারীকে ভোগের দাসী বানিয়ে নিজেরা মদে ডুবে থেকে ইসলামের অপমান করছে। আমি বুঝিয়ে দেব, ইসলাম নারীকে দিয়েছে মাতৃত্বের সম্মান, স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের অধিকার। সমাজ-সংসারে নারীরও দায়িত্ব আছে। সেও দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাববার দাবিদার। আমি ওদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই, হেরেমের বাইরে বের হলেই নারী নষ্ট হয়ে যায় না, এতে নারীর শাশ্বত সত্তার পবিত্রতাও নষ্ট হয় না। ওরা চায়, নারীরা হেরেম নামের জিন্দান খানায় বাইজী হয়ে বহু পুরুষের ভোগের সামগ্রী হোক। ওদের ধারণা, নারী হলো শুধুই ভোগের বস্তু। তারা মনে করে, কর্তৃত্ব আর বীরত্বের তকমা গলায় বেঁধে দাস-দাসী ও বাইজীর আসর জমানোই হলো বীরত্ব। নারীও যে সত্যিকার অর্থে বীরত্বপূর্ণ কাজ করতে পারে, পারে ইসলামের সেবায় নিজেকে উজাড় করে দীনের স্তম্ভকে শক্তিশালী করতে তা ওরা ভুলে গেছে। আজ মুসলিম নেতৃবর্গ ইজ্জত নয় জিন্নতির জীবন যাপন করছে। কেন, এর কারণও ওরা খুঁজে দেখতে চাচ্ছে না। মুমেন নারী যে বিরাট শক্তির আধার তা নতুন করে ওদের আমি জানিয়ে দিতে চাই।

সুবক্তগীন! মদে-মাতাল ওসব শাসকের হেমেরে কখনও বীরপুরুষ জন্ম নিতে পারে না, ওদের ঘরে কাপুরুষই বেড়ে ওঠে। ইসলামের পতাকা বহন করার হিম্মত ওদের হয় না। ওদের জন্মই ইসলাম অবমাননার কারণ। আমি এমন সন্তানের মা হতে চাই, যে ইসলামের খাদেম হবে, ইসলামকে পৃথিবীর প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত করবে। শুধু আলেম ও মুবাল্লিগের বেশে নয় বিজয়ী বীরের বেশে। কূটনীতিতে সে সফল হবে, যার তরবারীতে শক্তি বেশি থাকবে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ক্ষোভে উত্তেজনায় হাঁফাতে লাগল তরুণী।

আমার মাও তোমার মতোই স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু তার স্বপ্নের ছেলে দাস হিসেবে আদম বাজারে বিক্রি হয়ে গেছে।

ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী তোমার মতো গোলাম আর আমার আব্দুর মতো আদর্শবান দাসরাই হতে পারে। কেন, আমার আন্ধু তোমাকে বলেননি যে, তিনিও তোমার মতোই আদম বাজারে দাস হিসেবেই বিক্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের কর্মনিষ্ঠা ও সতোর জোরে আজ তার অবস্থান এবং মর্যাদা দেখো। দেখো তাঁর কর্মতৎপরতা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা।

তোমাকে কে বললো যে, তোমার গর্ভে যে ছেলের জন্ম হবে সে বাহাদুর এ আর দীনের সিপাহসালার হবে। এটা তোমার তারুণ্যের আবেগ, যৌবনের ও আকাক্ষা।

এটা আমার হৃদয়ের আকাক্ষা, দীর্ঘ দিনের লালিত বাসনা। এটা আমার অস্তিত্বের চাওয়া, আমার নারী মনের আর্তি। আমার এই আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সাধকে তুমি যৌবনের আবেগ, শব্দের ব্যঞ্জনা আর খেয়ালীপনা মনে করো না সুবক্তগীন! হ্যাঁ। তুমি আমার ভালবাসাকে উপেক্ষা করতে পারো, কিন্তু আমার ইচ্ছা ও পবিত্র আকাঙ্ক্ষাকে অপমান করো না। আমি ওই গবেটটাকে কিছুতেই স্বামীত্বে বরণ করতে পারবো না। আবেগ ও উত্তেজনায় কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলল তরুণী।

সুবক্তগীন ওখান থেকে বেরিয়ে এলো। মনের মধ্যে তার তুমুল ঝড়। জীবনের গতি সম্পর্কে এখনও সে স্থির নয়। বুঝে উঠতে পারছিল না, আশৈশব লালিত তার আকাঙ্ক্ষা ও মায়ের স্বপ্ন বাস্তবরূপ লাভ করবে কিনা। এমন সময় এই তরুণীর কথা তার হৃদয়ে চেপে থাকা দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষাকে আরো তীব্র করে তুলল। সুবক্তগীন কল্পনাও করতে পারেনি, কোন রাজ হেরেমে এমন ঈমানদীপ্ত তরুণী থাকতে পারে, ইসলামী ঈমান আকীদার দুর্গরূপী এমন মেয়েও জগতে আছে।

বহুদিন পরে তার সুপ্ত বেদনা আবার উথলে উঠল, স্মৃতিগুলো ভাস্বর হয়ে দৃশ্যমান হতে থাকল। জীবনে মা ছাড়া তার অনুভবে কোন নারীর অস্তিত্ব নেই। মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় মায়ের কোলের উষ্ণতা পেলে প্রশান্তিতে ভরে যেতো তার দেহমন। মা তাকে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে ঘুম পড়াতেন, কোলে নিয়ে আদর করতেন, তার স্বপ্নের কথা বলতেন, খ্যাতিমান হওয়ার সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতেন। আর আজ এই তরুণী তার মায়ের স্বপ্নেরই পুনরাবৃত্তি করছে। একই আকাক্ষার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে ওর কণ্ঠে।

অথচ সে এই যুবতাঁকে যখন পিঠে করে নদী থেকে উদ্ধার করেছিল, তখন তরুণী তার গলা জড়িয়ে ধরেছিল দু’হাতে, তার ভেজা বসন লেপ্টে গিয়ে শরীরের ভাজ ও নারী চিহ্নগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। কিন্তু একটি বিপদাপন্ন তরুণীকে উদ্ধারের ব্রত ভিন্ন কিছুই তখন ভাবতে পারেনি সুবক্তগীন। তরুণীর তপ্তশ্বাস ও হৃদয় মোহিনী হাসিও তার মধ্যে কোন তারল্যের উদ্ভব ঘটাতে পারেনি। কিন্তু এখন কী হলো, সব কিছুই যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। অজানা ভবিষ্যত, আবাল্য স্বপ্ন, মায়ের সাধ আর তরুণীর নিবেদনে কেমন যেন উদভ্রান্ত করে তুলছে তাকে প্রতিক্ষণ। প্রচণ্ড এক আলোড়ন অনুভব করছে মনের মধ্যে সুবক্তগীন। তরুণীর কথাগুলো বারবার কানে বাজছে তার। সে ঠিকই বলেছে, সম্পদ ও ক্ষমতার সুযোগে আমীর-উমারার হেরেমগুলো জাহান্নামে পরিণত হয়েছে। যে নারী ছিল প্রশান্তির আধার, তাদের আজ শারীরিক উত্তেজনা উপশমের উপাদানে পরিণত করা হয়েছে।

পুৰুষ আজ আর এক নারীতে তৃপ্ত নয়। ধৈর্য, স্থিরতা, নীতি, আদর্শ, বীরত্ব, বাহাদুরী সবই শাসক শ্রেণীর লোকেরা মদ আর নারী ভোগে খুইয়ে ফেলেছে। শুধু নারীসঙ্গ ভোগের জন্যে মুসলিম সমাজের মাথাগুলো রাজা-বাদশাহকে তোষামোদ করে দামী উপঢৌকন দেয়, শাসকদের মধ্যে বিরোধ বাধায়, নিজের জাতি-ধর্মের ইজ্জত হুরমত ধুলায় লুটিয়ে দিয়ে ঈমানের সওদা করে। তারপরও যখন স্বস্তি পায় না, নিশ্চিত করতে পারে না দূরাকাতক্ষা, তখন কওম ও জাতির সর্বনাশ করতে গিয়ে দুশমনদের ভূতখানায় হাজিরা দিয়ে স্বস্তি আর সুখ নিশ্চিত করে। অধঃপতনের এসব কিছুর শুরুটা নারীর থেকেই ঘটে। মুসলিম মাতৃত্বকে হত্যা করে পুরুষের ঔরসকে কলঙ্কিত করে আমীর-উমরা শ্ৰেণী শুধু নিজেদের অস্তিত্বের ভিতে ধসই নামায় না, মাযহাব ও মিল্লাতের ভিত্তিকেও গুঁড়িয়ে দেয় আমিও কি সে পথেই অগ্রসর হচ্ছি। অবশ্য ভোগবাদীরা সমূলে ধ্বংস করতে চাচ্ছে এই শক্তিটাকে।

“নারী কোন সৌন্দর্য বর্ধনকারী বিলাস সামগ্রী নয়, নারী নির্মলতার প্রতিচ্ছবি, অফুরন্ত জীবনী শক্তির আধার।” তরুণীর আবেগাপ্লুত এই কথাগুলো তোলপাড় সৃষ্টি করে সুবক্তগীনের মনে।

সুবক্তগীনের মনে পড়ল তার মায়ের স্মৃতি। এক আমীর বহু মূল্য, বিলাস-ব্যসন ও মণি-মুক্তার টোপ দিয়ে তার মাকে খরিদ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পূতঃপবিত্র মা সোদানা মণিমুক্তা আর বিলাস ব্যসনকে লাথি মেরে ঝুপড়িতে ফিরে এসেছিলেন ভিখারিণীর বেশে। নিজের আদর্শ ও পবিত্রতা রক্ষায়, ইসলাম ও ঈমানের শুভ্রতা রক্ষায় সর্ব ফেলে পথে নেমেছিলেন স্বামীকে নিয়ে। তবুও নিজের বিশ্বাস ও পবিত্রতাকে কলঙ্কিত হতে দেননি। জাগতিক সুখের সওদা করেননি ঈমানের রত্ন দিয়ে। আলপ্তগীনের মেয়ের মতো তার মাও চেয়েছিলেন এক বাহাদুর সন্তানের মা হতে। রক্ষিতা হতে চাননি কারো। তার মনে বাবার মতোই সংশয় দোলা দিল, “মেয়েরা কি তাহলে এমন স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণই হয়ে থাকে?” পরক্ষণেই মনে পড়ল উস্তাদজীর কথা। উস্তাদজী বলেছিলেন, “ন্যায় ও আদর্শের প্রতীক নওশেরোয়াও মায়ের উদরেই জন্ম লাভ করেছেন। নারীকে যদি তামাশা আর ভোগের পণ্য বানিয়ে ফেলা হয় তবে তাদের গর্ভে আর জন্ম নেবে না তারেক, মুসা ও নওশেরোয়া।”

গভর্ণর হাউজ থেকে বেরিয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে অধমুখে আস্তাবলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ইত্যাকার ভাবনায় ডুবে যায় সুবক্তগীন। সেই সাথে তরুণীর প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করল মনের গহীনে। মনে মনে বলল, অনন্য এই তরুণী। ওর সাথে অন্য হেরেমের অন্য ললনাদের তুলনাই অর্থহীন। তরুণী তাকে বলেছে, সে আবার আমার সাথে দেখা করতে অবশ্যই আসবে। এসব কথা ভেবে তরুণীর মধ্যে কেমন যেন আস্থা অনুভব করল সুবক্তগীন।

এই দাঁড়াও!

আধো প্রেম, আধো সংকট, আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে আনমনে হাঁটছিল সুবক্তগীন। জগতের অন্য কিছুর প্রতি খেয়ালই ছিল না তার। হঠাৎ কর্কশ ডাকে সম্বিত ফিরে দেখল, তরুণীর বাগদত্তা দ্রুত পায়ে তার দিকে আসছে। সে দাঁড়াল।

রক্তচক্ষু আগন্তুকের। গর্জে উঠে সুবক্তগীনের উদ্দেশে বলল, হাজী নসর-এর বিক্রিত গোলামকে যেন আর কোনদিন শাহজাদীর আঙ্গিনা মাড়াতে না দেখি। তুমি যদি বুখারার শাসনকর্তার মেয়েকে নদী থেকে উদ্ধার করেও থাকে, সেটা তোমার আহামরি কোন বাহাদুরি নয়। এ ছিল তোমার কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন না করলে বরঞ্চ আমরা তোমাকে জেলখানায় আটকে না খাইয়ে হত্যা করতাম। এ কাজের জন্যে পুরস্কারের যোগ্য নও তুমি।

আমি গোলাম নই, স্বাধীন। বরঞ্চ গোলাম আপনি। খুব মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলল সুবক্তগীন।

অ্যাঁ! এত স্পর্ধা! ছোট মুখে বড় কথা শুনে রাখ, আর কোনদিন অনুমতি ছাড়া আস্তাবল থেকে ঘোড়া নিতে পারবে না! ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলল তরুণীর বাদগত্তা।

তুমি তো নসরের গোলাম- বলল সুবক্তগীন।

তোর দেহ থেকে মাথা কেটে ফেলব! কোমরে বাঁধা তরবারী কোষমুক্ত করে বাঘের মতো গর্জে উঠল ভাটাপড়া যৌবনের অধিকারী পৌঢ়-প্রায় লোকটি।

সুবক্তগীনের কোমরেও খঞ্জর ছিল। সে ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিয়ে কোমর থেকে খঞ্জর বের করে বলল, দেড়হাত লম্বা তরবারী যদি আধহাত খঞ্জর দিয়ে আমার পায়ের নীচে না ফেলতে পারি, তবে তোমার তরবারীর নীচে মাথা পেতে দেবো। আমার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দিও আপত্তি নেই, কিন্তু এর আগে তোমার বাগদত্তা শাহজাদীকে জিজ্ঞেস করে এসো যে, সে তোমাকে ভালোবাসে, না ঘৃণা করে!

লোকটি সুবক্তগীনের সাহস ও আত্মবল পরখ করল। কিছুক্ষণ দূর থেকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে রাগে গড় গড় করে তরবারী কোষবদ্ধ করে স্থান ত্যাগ করল। সুবক্তগীন পুনরায় খঞ্জর কোমরে খুঁজে ঘোড়ায় চড়ে আস্তাবলের দিকে চলে গেল।

তখন সন্ধ্যার আঁধার চতুর্দিকে ছেয়ে গেছে। আস্তাবলে ঘোড়া রেখে মাত্র নিজের থাকার ঘরে প্রবেশ করেছে সুবক্তগীন। তখনই এক লোক খবর দিল, গভর্ণর আপনাকে তলব করেছেন। ভেজা কাপড়েই গভর্ণর হাউজের দিকে রওয়ানা হল সুবক্তগীন।

আবু ইসহাকের সাথে কি নিয়ে ঝগড়া করলে? জিজ্ঞেস করলেন গভর্ণর আলগীন।

সুবক্তগীন তাকে ঘটনা বিস্তারিত বলল। একথাও বললো, যা তার মেয়ে তার উদ্দেশ্যে বলেছে। সুবক্তগীনের অকপট ও অকৃত্রিম বক্তব্য ভাল লাগল গভর্ণরের কাছে।

আমার একটা অনুরোধ জাঁহাপনা। আপনার আদুরে মেয়েকে আমার মতো হতচ্ছাড়ার হাতে তুলে না দেওয়াই ভাল। কিন্তু আমি আপনাকে করজোড়ে নিবেদন করছি, ওই লোকের হাতে ওকে সোপর্দ করা মোটেই ঠিক হবে না। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন গভর্ণর। অনেকক্ষণ নীরব থেকে বললেন, এখন তুমি গিয়ে আরাম কর সুবক্তগীন। পরে তোমাকে ডাকব।

জাঁহাপনা! আপনি অসন্তুষ্ট হলেও আপনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করার মত কোন অপরাধ আমি করিনি। মিথ্যা কথা আমি কখনো বলি না।

আলপ্তগীন মুচকি হেসে তাকে চলে যাওয়ার জন্যে ইশারা করলেন। সুবক্তগীন গভর্ণর হাউজ থেকে নিজের থাকার ঘরে চলে এল।

পরদিন আলপ্তগীনের কন্যা প্রতিদিনের মতো ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সুবক্তগীনও আস্তাবল থেকে একটা ঘোড়া নিয়ে নদীর তীরের দিকে চলল। প্রথম দিকে দুজন দুদিকেই ঘোড়া দৌড়াল। অনেক দূর গিয়ে উভয়ে নদীর তীরের দিকে গতি ঘুরিয়ে দিল। নদীর তীরে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে এসে উভয়ে মুখোমুখি হল এবং ঘোড়া থেকে নেমে নদীর তীরের সবুজ ঘাসের উপর গিয়ে বসল।

ওই গবেটটা আমার কাছে গিয়েছিল। বাগদত্তা সম্পর্কে বলল তরুণী। খুব রেগে ছিল। আমাকে বলল, আমি সেনাবাহিনীর কমান্ডার। তুমি একটি গোলামের সাথে আমার সম্পর্কে কটুক্তি করে বলেছো, তুমি আমাকে পছন্দ করো না। আমাকে এমন অপদস্ত করার হেতু কি? সে প্রথমে আমাকে খুব ধমকালো, পরে আবার হাতজোড় করে মিন মিন করতে লাগল। আমি ওকে পরিষ্কার বলে দিয়েছি, ‘পিতার মর্যাদা রক্ষার খাতিরে আমি তোমার বাগদত্তা হতে রাজী হয়েছিলাম। তাকে বললাম, এ ব্যাপারে তুমি আব্বার সাথে কথা বল।‘

রাতে আব্বা আমাকে একাকী ডেকে বললেন, সুবক্তগীন আমার কাছে। তআমাদের পূর্বাপর সব ঘটনা বলে দিয়েছে। আব্বা তোমার অকপট সত্যবাদিতায় দারুণ খুশি হয়েছেন। তোমার সাহসী উচ্চারণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমি আব্বাকে বলে দিয়েছি, এই বাগদত্তা আমার একদম সহ্য হয় না। অবশ্য সে খুব বড় অফিসার। মনে হয় আজ দিনের কোন এক সময় সে আব্বার সাথে এ নিয়ে কথাও বলেছে।

সুবক্তগীন তরুণীকে গভীরভাবে দেখছিল। গতকালের চেয়ে আজ তাকে আরো বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছিল। তরুণী সুবক্তগীনের হাত তার হাতে নিয়ে খেলছিল আর সুবক্তগীনও গভীর দৃষ্টিতে তাকে পরখ করছিল। তারা পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিল। তরুণী তার শরীর ঘেষে বসে চোখে চোখ রেখে অনর্গল কথা বলছিল। সুবক্তগীন তরুণীর কথা ও রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলল, “তোমাকে দেখলে, তোমার কথা শুনলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে।”

“তোমার ছেলেও এই কথাই বলবে।” বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল তরুণী।

সূর্য নদীর ওপারের টিলার আড়ালে শেষ আলো বিকিরণ করে ডুবে যাচ্ছে। পশ্চিমাকাশে সূর্যের লালিমা ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। আর এপারে দু’ যুবক-যুবতী হাতে হাতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছে।

মাসখানিক পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে আলগুগীনের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিল সুবক্তগীন। আলপ্তগীন তাকে একান্ত সচিবের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে বললেন, “মুসলিম জাতির চেতনা নষ্ট হয়ে গেছে। শাসকশ্রেণী আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসিতায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। রাজ্যগুলো প্রতিদিন টুকরো টুকরো হচ্ছে। বেঈমান আমীররা প্রধান শাসককে ভোগবাদে নিমজ্জিত করে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করছে জাতির মাঝে। আমাদের নেতারা বেঈমানদের দেয়া পুরিয়া গিলে পরস্পর খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছে। যে খেলাফত ছিলো মুসলমানের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র তা এখন খেয়ালী রাজার সিংহাসনে পরিণত হয়েছে। সুলতান আব্দুল মালেক আমাদের কেন্দ্রীয় শাসক। তিনি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। অথচ তার সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকারদের মধ্যে এখনই বিবাদ শুরু হয়ে গেছে। আমরা চাচ্ছি, সুলতানের অবর্তমানে তার কনিষ্ঠ ছেলেকে সিংহাসনে বসাব। কিন্তু বড় সাহেবজাদা আমীর মনসুর তা কখনও হতে দিতে চাইবেন না। এই ফাঁকে আমি গজনীকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা ঘোষণা করব।”

আপনার সেনাবাহিনী বিশেষ করে যারা বুখারায় আছেন তারা আপনার সহযোগিতা করবে? জানতে চাইলো সুবক্তগীন।

এখানকার সেনাপতি কেন্দ্রের চেয়ে বেশি আমার অনুগত। কেন্দ্রের প্রতি সে খুবই ক্ষুব্ধ। আমার নির্দেশ পালনে সে গর্ববোধ করে, আমার নীতি-আদর্শের প্রতি সেনাপতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। আমি আশা করি, গজনীকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এ অঞ্চলের ছোট ছোট রাজ্যগুলো একত্রিত করে কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হবো। আমরা যদি এটা করে যেতে না পারি তাহলে আমার ভয় হয়, টুকরো টুকরো মুসলিম রাজ্যগুলো কাফেরদের চক্রান্তে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে। ওদের বিজয় স্রোতে মদ, নারী আর বিলাসিতায় আচ্ছন্ন মুসলিম আমীররা খড়কুটোর ন্যায় ভেসে যাবে। এই জমিন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে মুসলিম শাসনের নাম নিশানা। আমি শুনতে পেলাম, হিন্দুস্তানের মহারাজা খায়বার গিরিপথ দিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করার পাঁয়তারা করছে।

গজনীর তখত উল্টে ফেলার কাজটা আমাকে সোপর্দ করতে পারেন। এজন্য তেমন কোন সৈন্য সমাবেশের দরকার হবে না। মনসুর ও মনসুর-এর সহযোগী শাসকদের গ্রেফতার করাও তেমন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রাসঙ্গিক ও আনুষঙ্গিক দিকগুলো আরো গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। সম্ভাবনা ও আশংকাগুলো চিহ্নিত করে সামনে এগুতে হবে আমাদের। বললো সুবক্তগীন।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে সুবক্তগীন আরো বলল, “এখনও উপযুক্ত সময় হয়নি। এ ধরনের পরিকল্পনার সফলতা অনেকখানি নির্ভর করে গোপনীয়তার উপর। আপনার মেয়ের মুখে আপনার পরিকল্পনার কথা আমি শুনেছি। অথচ এ সব ব্যাপার তাদের জানার কথা নয়। আপনাকে আরো গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে এবং সতর্ক হতে হবে। আপনার পরিকল্পনা যদি প্রকাশ না পায়, আর অন্যদের তৎপরতার আগাম খবর যদি আপনি সংগ্রহ করতে পারেন, তাহলে যুদ্ধের অর্ধেক বিজয় এমনিতেই হয়ে যায়।”

আলপ্তগীনের দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস ছিল যে, সুবক্তগীন যোগ্য সালার ও বুদ্ধিদীপ্ত যুবক। কিন্তু সে এতোটা দূরদর্শী তা আগে অনুধাবন করতে পারেননি। যুদ্ধ পরিকল্পনায় তার ভুলগুলো সুবক্তগীন এমন সরল ও সুনিপুণভাবে বুঝিয়ে দিল, যার ফলে আলপ্তগীন আস্থার সাথে যুদ্ধকৌশল নির্ধারণের কাজ তার উপর ন্যস্ত করলেন। কিন্তু সুবক্তগীন তার অদক্ষতা ও অনভিজ্ঞতার কথা সামনে তুলে ধরে বলল, পরিকল্পনা আপনি করুন, আমি নিজেকে এ কাজে উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত আছি।

দীর্ঘ পর্যালোচনার পর নতুন একটি রণকৌশল চূড়ান্ত করা হলো। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারটি আবারো আলপ্তগীনকে স্মরণ করিয়ে দিল সুবক্তগীন।

ওদিকে যখন গজনীকে ইসলামী সালতানাতের কেন্দ্র বানানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো, এদিকে তখন সুবক্তগীনকে হত্যার পরিকল্পনাও পাকা হয়ে গেছে। এ পরিকল্পনার নায়ক আলপ্তগীনের কন্যার বাগদত্তা আবু ইসহাক। এরা রাতে একটি সামরিক মহড়ার পরিকল্পনা করল। অশ্বারোহী বাহিনীর একটি সামরিক মহড়ায় সুবক্তগীনকে দাওয়াত দেয়া হল। আবু ইসহাক নিজেও সেই মহড়ায় অংশ গ্রহণ করবে।

অনেকগুলো রথ-গাড়ীতে ঘোড়া জুড়ে দেয়া হল। আবু ইসহাক ও সুবক্তগীনের জন্য বরাদ্দ করা হলো প্রথম সারির বিশটি রথের দু’টি। মহড়া শুরু হল। বাতাসের বেগে তাজী ঘোড়া রথ নিয়ে দৌড়াতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আবু ইসহাক সুবক্তগীনের রথকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে তার রথ এগিয়ে নিল। সুবক্তগীন লক্ষ্য করল, আবু ইসহাক উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে একদিকে চেপে রাখতে চাচ্ছে, আর বারবার সে সামনের দিকে তাকিয়ে কি যেন পরখ করছে। রথের ঘোড়া দৌড়াচ্ছে উধশ্বাসে। ব্যাপারটি উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে ভেবে সুবক্তগীন তার ঘোড়া আগ বাড়িয়ে আবু ইসহাকের রথকে ঠেলে সোজা চলতে তৎপর হলো। সাধারণ দর্শকরা একে দুই বড় কর্মকর্তার লড়াই ভেবে চিৎকার করে ময়দান মুখরিত করে তুলল। সারা ময়দান জুড়ে বিশেষ মহড়া দেখার জন্যে অসংখ্য লোক সমাগম হল। সকলের মুখে উল্লাস ও হর্ষধ্বনি। সারা ময়দান অসংখ্য মশালে উদ্ভাসিত, উৎসব মুখর।

সুবক্তগীন অবস্থাদৃষ্টে বুঝে ফেলল, আবু ইসহাকের দৃষ্টি মহড়ায় বিজয়ী। হওয়ার চেয়ে তাকে এক পাশে রাখার প্রতি নিবদ্ধ। সুবক্তগীন তার রথ নিয়ে আবু ইসহাকের রথের আগে আগে দৌড়াতে লাগল। আবু ইসহাকের গতিপথ ঠেলে সোজা চালাতে বাধ্য করছিল। এক পর্যায়ে আবু ইসহাক ঘোড়াতে আঘাত করার হান্টার দিয়ে সুবক্তগীনের মাথা লক্ষ্য করে আঘাত করল, কিন্তু সুবক্তগীনের রথ তখন আবু ইসহাকের রথ ঠেলে আগে চলে গেছে। হান্টার লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। আবু ইসহাক চিৎকার দিয়ে বলল, খোদার কসম! তুমি এদিক থেকে সরে যাও! সুবক্তগীন তার ঘোড়াকে দূতগতিতে অপরদিকে ঘুরিয়ে নিল। ইত্যবসরে আবু ইসহাকের ঘোড়া জমিনে ধসে গেল। রথ ছিঁড়ে উপরে উঠে উল্টে জমিনে আছড়ে পড়ে অগ্রভাগ ধসে গেছে। আবু ইসহাক তাল সামলাতে না পেরে শূন্যে উঠে গিয়ে উল্টে যাওয়া রথের নীচে চাপা পড়ল। দ্রুত পিছনে ছুটে আসা রথগুলোকে চালকেরা সামলাতে পারল না। সেগুলো আবু ইসহাকের উল্টে যাওয়া রথকে মাড়িয়ে চলে গেল। আবু ইসহাক রথের চাপে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল। সে আর দাঁড়াতে পারল না। ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হল। সুবক্তগীন নিজের রথকে ঘুরিয়ে যাত্ৰাস্থলে ফিরে এলো। উৎসব মুহূর্তের মধ্যে থেমে গেল, নেমে এলো বিষাদের ছায়া। হাহাকার বয়ে গেল সবার মুখে। কী হলো? কী হলো?

সবাই দৌড়ে গেল অকুস্থলে। রথের চাকা ও ঘোড়ার খুরের আঘাতে নিহত হল আবু ইসহাক। দেখা গেল, আবু ইসহাকের ঘোড়া গভীর গর্তে ধসে গেছে। উপরে বড় বড় গাছের পাটাতন। অথচ গতকাল পর্যন্ত কেউ কোন গর্ত এখানে দেখেনি। হঠাৎ গর্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। দুর্ঘটনার তদন্ত তখনই শুরু হয়ে গেল। কিভাবে এখানে গভীর গর্ত হল, কি আছে এই দুর্ঘটনার অন্তরালে?

আলপ্তগীন জলদগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, এই গর্ত ও দুর্ঘটনার কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে। কেউ যদি এই গর্তের উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করে, তবে তাকে রাজকীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হবে।

পরদিন বেলা ডোবার আগেই রহস্য বেরিয়ে পড়ল। জানা গেলো, এই রাতের মহড়ার আয়োজক যেমন আবু ইসহাক, গর্তের নায়কও সে। আবু ইসহাক তার এক বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে সুবক্তগীনকে মহড়ায় অংশ গ্রহণে সম্মত করিয়েছিল, আর অতি সংগোপনে রাতের আঁধারে বিশাল গর্ত খুঁড়ে মাঠে মাটি ছড়িয়ে গর্তের উপরিভাগে গাছের পাটাতন দিয়ে তাজা ঘাস ও মাটি দিয়ে তা ঢেকে দেয়া হয়েছিল। যাতে কেউ গর্তের অস্তিত্ব ঠাহর করতে না পারে। জায়গাটি নিজে চেনার জন্যে একটি আলামত রেখেছিল আবু ইসহাক। এজন্যই দৌড় শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই সে সুবক্তগীনের রথকে ঠেলে গর্তে ফেলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু বিচক্ষণ সুবক্তগীন আবু ইসহাকের চক্রান্তের আশঙ্কা আঁচ করে আগাগোড়া দৌড়ের মধ্যে থেকেও নিজেকে সচেতন রেখেছিল সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্যে। দুর্ভাগ্যবশত নিজের খনন করা গর্তে আবু ইসহাক নিজেই কুপোকাত হল। আবু ইসহাক তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বলেছিল, মহড়ার মোড়কে সুবক্তগীনকে হত্যা করে সে আলপ্তগীনের কন্যাকে বিয়ে করবে। পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়ার জন্যেই আবু ইসহাক আয়োজন করেছিল ষড়যন্ত্রের এই সামরিক মহড়া। কিন্তু নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই ফেঁসে গেল।

“আল্লাহ তোমার দ্বারা বড় কোন কাজ নেবেন, এজন্যই নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তোমাকে।” বললেন আলপ্তগীন। আমি তোমাকে ওয়াদা দিচ্ছি যে, আমার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্যে তুমি যে পরিকল্পনা পেশ করেছিলে সে অনুযায়ী এখনি কাজ শুরু করতে হবে। তুমিই আমার মেয়ের জামাতা হবে, এজন্যে আমি গর্বিত।”

এ ঘটনার প্রায় এক বছর পর গজনীর শাসক আব্দুল মালেক মৃত্যুবরণ করলেন। আলপ্তগীন প্রাণান্ত চেষ্টা করেও আব্দুল মালেকের কনিষ্ঠ পুত্রকে গদীনশীন করাতে ব্যর্থ হলেন। বড় ভাই মনসুরের বর্তমানে বাস্তবায়িত হলো না তার এই স্বপ্ন। দুদিন পর সুবক্তগীন তিনশ’ নির্বাচিত অশ্বারোহী সৈনিক নিয়ে গজনী উপস্থিত হল। সে দৃশ্যত ভাব দেখাল যে, তারা বুখারার গভর্ণরের পক্ষ থেকে নতুন গদীনশীনকে মোবারকবাদ জানাতে এসেছে। কিন্তু রাজপ্রাসাদে ঢুকেই তারা মনসুরকে গ্রেফতার করল। আর তার সাথীরা পূর্ব নির্দেশনা মতো প্রতিরক্ষা বাহিনীর চৌকিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গজনী বাহিনীকে নিরস্ত্র করে ফেলল। পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায়ে দ্রুত বেগে আলপ্তগীন শহরের প্রধান প্রধান স্থাপনাগুলো দখল করে নিলেন। তিনি অগ্রভাবে সুবক্তগীনকে পাঠিয়ে বেশি সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শহরের বাইরে অপেক্ষমান ছিলেন, যাতে প্রথম অপারেশনের পর দ্বিতীয় পর্যায় দ্রুততার সাথে সমাধা করা যায়। হাটে-বাজারে, অলি-গলিতে প্রচার করা হলো, “জালেমদের শাসন শেষ, এখন থেকে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক শাসন চলবে। আমরা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধানমতো শাসন কাজ চালাব”। প্রথম দিন থেকেই ইসলামী অনুশাসন চালু করা হল। দিন যত যেতে লাগল, মানুষ দেখতে পেল, সত্যিকার অর্থেই জুলুম ও নিপীড়নের পরিবর্তে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মানুষের মন থেকে জুলুম-অত্যাচারের আতঙ্ক দূর হয়ে গেছে। শাসকদের প্রতি মানুষের মনে ঘৃণার বদলে শ্রদ্ধা জন্মাতে শুরু করেছে। গজনীর অধিবাসীরা নতুন শাসকদের মোবারকবাদ জানাল হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা উজাড় করে।

ঐতিহাসিকদের মতে ৯৬২ ইংরেজী মোতাবেক ৬৫১ হিজরী সনে আলগীন গজনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি সুবক্তগীনকে প্রধান উজীর নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু অল্পদিন পর তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। পরের বছরই তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর ছেলে ইসহাক পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়। কিন্তু পিতার মতো ন্যায় ও ইনসাফের পরিবর্তে সে মোসাহেব ও তোষামোদকারীদের বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাকে দিয়ে সুবিধাজনক সব নির্দেশ জারী করিয়ে নিতে থাকলে দেশে আবার অশান্তি দেখা দেয়। জনগণ আবার নতুন হয়রানির কবলে পড়ে।

সুবক্তগীনকে আবার দুঃসাহসী ভূমিকা নিতে হয়। তিনি বাধ্য হয়ে নীতি ও আদর্শচ্যুত শাসক ইসহাককে বন্দী করে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করেন। দেশের মানুষ যখন শুনল, বিপথগামী ইসহাককে বন্দী করে আমীরুল উমারা সুবক্তগীন ক্ষমতাসীন হয়েছেন তখন তারা স্বস্তিবোধ করে এবং শান্তির আশায় আশ্বস্ত হয়।

ইসহাককে ক্ষমতাচ্যুত করাটা সুবক্তগীনের জন্যে ছিল কঠিন বিষয়। এই সুকঠিন ও অসম্ভব কাজটিকেই তিনি সম্ভব করতে পেরেছিলেন মানুষের ভালোবাসা ও আস্থার জোরে।

তার উন্নত চরিত্র, ন্যায় নিষ্ঠা ও সদাচারে সেনাবাহিনীর সিপাই থেকে সালার পর্যন্ত সবাই ছিল তার প্রতি সশ্রদ্ধ ও অনুগত। ন্যায় বিচার ও সতোর আস্থা সাধারণ নাগরিকের হৃদয়ের মণিকোঠায় নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন সুবক্তগীন। নাগরিকরা তার শাসনে নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করার অধিকার পেয়েছিল। যার ফলে তার প্রতিটি হুকুম ও নির্দেশ বাস্তবায়নে সাধারণ মানুষ নিজেদের উৎসর্গ করে দিয়েছিল। অল্পদিনের মধ্যে আশপাশের রাজ্যগুলোকে নিজের কজায় নিতে সক্ষম হয়েছিলেন সুবক্তগীন। গঠন করতে পেরেছিলেন এক জীবনবাজী সেনাবাহিনী। গজনীর অবস্থা কিছুটা স্থিতিতে এনেই তিনি মনোযোগী হয়েছিলেন হিন্দু শাসিত অত্যাচরিত ভারতীয়দের প্রতি।

এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন সুবক্তগীন, তার ঘরের ছাদ ভেদ করে একটি গাছ বেড়ে উঠছে। বাড়তে বাড়তে গাছটি এমন বিশাল ও বিস্তৃত হলো অর্ধেক পৃথিবী সেই গাছের ছায়া ঢেকে নিলো।

স্বপ্ন দেখে খুব বিচলিত হলেন সুবক্তগীন। স্ত্রীকে বললেন স্বপ্নের কথা। স্ত্রী নীরবে শুনলেন, কোন মন্তব্য করলেন না। এ দিনই তার ঘরে জন্ম নিল প্রথম সন্তান; স্বপ্নের সুবিস্তৃত মহীরুহ। পুত্রের আগমনে তার উৎকণ্ঠা দূর হয়ে গেল। এবার স্ত্রী তাকে বললেন, আপনার দেখা স্বপ্ন আপনার চোখের সামনে বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি সেই পুত্রটি প্রসব করেছি যে পৃথিবী থেকে মিথ্যা দূর করবে। আজ মুহররম মাসের দশ তারিখ। আল্লাহর ইঙ্গিত অনুধাবন করে আমাদের তাঁর দরবারে অবনত মস্তকে বিগলিত হৃদয়ে শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিত।

সুবক্তগীন ছেলের নাম রাখলেন মাহমুদ। দেখতে তার ছেলে খুব একটা হৃদয়গ্রাহী চেহারার অধিকারী না হলেও পিতার সব চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা-আগ্রহের কেন্দ্র ছিল এই সন্তান।

অতি শৈশবে-ই পিতা ছেলেকে কুরআন শরীফ হিফয করালেন। বার বছরের মধ্যে জরুরী কিতাবাদির ইলম শেখার পর্ব শেষ করিয়ে ফেললেন। পনের বছরে পদার্পণ করলে সুবক্তগীন ছেলেকে হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠিয়ে বললেন, “তোমাকে মূর্তিসংহারী হতে হবে।”

গজনীর শহরতলী থেকে একটু দূরে মাঠের মধ্যে একটি মনোরম বাগান। বাগানের মাঝখানে এক দৃষ্টিনন্দিত বালাখানা। বাগানের মনোহারী গাছগাছালি, রঙ বেরঙের হাজারো ফল-ফুলের সমারোহ আর এর পরিপাটি সাজানো গোছানো পরিবেশ বহুদূর থেকেই মানুষের নজর কাড়ে। প্রথমেই তারা ভাবত আলীশান এ কাজ কোন সাধারণ জমিদারের নয়। অবশ্য কোন শাহজাদা কিংবা উজির গড়ে তুলেছে এ বাগান ও সুরম্য সৌধ। অথচ কিছুদিন আগেও জায়গাটা ছিল ধূ ধূ প্রান্তর, ছিল গাছপালা শূন্য। গজনীর মানুষ দল বেঁধে এই বাগান ও বালাখানা দেখতে যেতো, পথিকরা এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতো, পথিক এখানে এসে থমকে দাঁড়াতো। দর্শকদের মুখে সুবক্তগীনের পুত্র মাহমূদের প্রশংসা ও গুণকীর্তন শুনে জনতা তার প্রতি আরো সশ্রদ্ধ হতো।

এই বাগান বাড়ি, অবকাশ কেন্দ্র মাহমূদ তার বাবা সুবক্তগীনের অজ্ঞাতে তার মায়ের অনুমতি নিয়ে গড়ে তুলেছিল। মাহমূদ ছিল তার মা-বাবার কদাকার ও বেঢপ চেহারার কাঙ্ক্ষিত পুত্র। মাহমূদের তুলনায় তার ছোট ভাই দৈহিকভাবে ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। কয়েক বছর আগে মাহমূদ যখন মাকে বলেছিল, সে একটি মনোরম বাগানবাড়ি বানাচ্ছে, একথা শুনে মা তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে কেঁদে ফেলেছিলেন।

মায়ের চোখে পানি দেখে মাহমূদ বলল, মা আমি যদি একথা বলে আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে মাফ করে দিন। আমি আর বাগানবাড়ি বানাচ্ছি না।

না বেটা! বাগানবাড়ি তোমাকে আমিই বানিয়ে দেব। তাহলে আপনার চোখে পানি কেন?

বেটা! আমার মনে পড়ছে সেই স্মৃতি। তোমার বাবার সাথে তখন আমার বিয়ে হয়নি। আমি ছিলাম এক বড় কর্মকর্তার বাগদত্তা। কিন্তু তোমার বাবার প্রতি আমার মনে প্রচণ্ড টান অনুভব করছিলাম। আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমি বাগদত্তাকে এজন্য পছন্দ করতে পারছিলাম না, সে আমাকে হেরেমের চার দেয়ালে বন্দী রাখতে চেয়েছিল। সে হেরেমের সৌন্দর্য বর্ধনের সামগ্রী মনে করতো নারীকে। আমার ঘুরে বেড়ান, ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া ও সাঁতার কাটায়ও তার ছিলো চরম আপত্তি। আমি নিজেকে হেরেমের শোভা করে। রাখতে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তোমার আব্বাকে বলেছিলাম, আমি এমন স্বামী চাই, যে আমার সাথে ঘোড়া দৌড়াবে, নদীতে সাঁতার কাটবে।

আমি তোমার আব্দুকে বলেছিলাম, হেরেমের রক্ষিতা-নারীদের গর্ভজাত সন্তান কখনো ইসলামের প্রহরী হয় না। আমি এমন ছেলের মা হতে চাই, যে সুদূর ভারত পর্যন্ত ইসলামের পয়গাম প্রচার ও ইসলামী সালতানাত সম্প্রসারিত করবে। মুবাল্লিগের বেশে নয় বিজয়ী সুলতান বাহাদুর হিসেবে, শুধু কূটনীতির বলে নয় তরবারীর জোরে। তোমার আব্লু হেসে বলেছিলেন, “তোমার মতো আমার আম্মুও এ কথাই বলতেন, কিন্তু আমি তো দাস-দাসীর হাটে বিক্রি হওয়া এক গোলাম।” তোমার আব্বকে আমি বলেছিলাম, “ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী তোমার মতো কর্তব্যনিষ্ঠ গোলামরাই হতে পারে। দৌলতওয়ালা আমীর-উমারা শ্ৰেণী ইসলামের রক্ষক হবে তো দূরে থাক ইসলামকে তারা ডুবাচ্ছে। দেখ না, আমার আব্বাও তোমার মত হাটে গোলাম হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজের কর্মনিষ্ঠা ও চেষ্টায় আজ বুখারার শাসক পদটি অলঙ্কৃত করে  আছেন। আরো একটি কথা আমি তোমার আন্ধুকে বলেছিলাম। বলেছিলাম, আমি যে মহানায়কের কথা ভাবি, সেই সন্তান তোমার ঔরসে আমার গর্ভে সঞ্চারিত হোক, তা আমি একান্তভাবে কামনা করি। আমি সেই কাঙ্ক্ষিত সন্তানের গর্বিত মা হতে চাচ্ছি। তোমার আব্দুর প্রতি আমার এই আকর্ষণ ও ভালবাসায় বিন্দুমাত্র যৌবনের তাড়না আর কৈশোরের উন্মাদনা ছিল না। ছিল নির্ভেজাল পবিত্র আকাক্ষার হৃদয়তন্ত্রী ছেঁড়া যন্ত্রণার জীবন্ত ছবি আঁকার এক বিনীত নিবেদন। আমার মনের গহীনে আশৈশব লালিত স্বপ্নের বাস্তবচিত্র দেখতে মনটা বেকারার ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় ও তোমার আব্বার দূরদর্শিতায় আমার সাথে তার বিয়ের সব বাধা অল্পতে দূর হয়ে যায়। দাসের হাটে বিক্রিত গোলাম সুবক্তগীন একদিন গজনীর সুলতান হিসেবে আমার আব্বার স্থলাভিষিক্ত হলেন। তোমার আব্বকে আল্লাহ তাআলা বিস্ময়কর এক স্বপ্ন দেখালেন। এর পরদিনই তুমি জন্মগ্রহণ করলে। আমি তাকে বললাম, আপনার গতকালের স্বপ্নের ব্যাখ্যা আজ মূর্তি না হয়ে আমার কোলে ঘুমিয়ে আছে। সেদিন ছিল আশুরা। দশই মুহররম। তোমার আব্দুকে আমি বললাম, আজ দশই মহররম, ইতিহাসের বহু শ্রেষ্ঠ ঘটনা আজ ঘটেছে। আমার এই ছেলের জীবন-কাহিনীও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি সেই বাহাদুর কাঙ্ক্ষিত ছেলের জন্ম দিয়েছি, যে পৃথিবীতে ইসলামের ঝাণ্ডা বুলন্দ করবে, বাতিল ধ্বংস করবে, মূর্তিসংহারী হবে।”

“মা! এসব কাহিনী এর আগেও আপনি আমাকে শুনিয়েছেন কিন্তু আজ আপনি এত আবেগাপ্লুত কেন?”

“বাবা আমার চোখ থেকে আজ পানি ঝরছে এই আশঙ্কা করে যে, তোমার মন যেন বিলাস-ব্যসন, আরাম-আয়েশ, সুন্দর বাগান আর অট্টালিকার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পড়ে। তুমি শাহজাদা হলেও আমি চাই, তোমার আকর্ষণ থাকবে ময়দানে, যুদ্ধে, পাহাড়-মরুর কঠিন রণক্ষেত্রে। আমি তোমাকে এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রাসাদ সরগরম ও সুসজ্জিত করার জন্যে তোমার জন্য নয়। তুমি দুনিয়াতে এসেছো ময়দানে লড়াই করতে। বাগানবাড়ি গড়ে তোলায় আপত্তি নেই। আমি তার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে যুদ্ধ শেষে যখন ক্লান্ত হয়ে গজনী ফিরবে তখন এখানে তুমি আরাম করবে। আমার কাম্য এটাই।

মায়ের অনুমতি ও সহায়তায় বাগাবাড়ি তৈরি শুরু করে দিল মাহমুদ। বিভিন্ন এলাকা থেকে অট্টালিকা ও বাগান তৈরির অভিজ্ঞ লোকদের আনা হল। দ্রুতগতিতে শেষ করা হলো অবকাশ যাপন কেন্দ্রের কাজ। রাজা জয়পাল যখন গজনী আক্রমণ করতে এল তখন বাগান বাড়ির মনোরম দৃশ্য ও সুরম্য অট্টালিকার চারপাশে বাহারী রঙের ফুলের সমারোহ ও সবুজের মেলা তার চোখ ধাধিয়ে দিয়েছিল। পাঞ্জাবের রাজা জয়পাল গজনী আক্রমণ করে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হল। সুবক্তগীনের বাহিনী আগাম খবর পেয়ে শহরের বাইরেই রাজার বাহিনীকে মোকাবেলায় বাধ্য করে। জয়পালের বাহিনী গজনী অবরোধের সময়টুকুও পায়নি। জয়পালের সাথে সুতান সুবক্তগীনের কঠিন লড়াই হল। কিন্তু জানবাজ সুবক্তগীনের সেনাবাহিনী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে জয়পালের বিশাল সমর সজ্জাকে গুঁড়িয়ে দেয়। ডজন ডজন হাতি, হাজারো অশ্বারোহী-যোদ্ধা ও তোপ কামানের সহযোগিতা নিয়েও গজনীর সুবক্তগীনের রণকৌশলের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হয় জয়পাল। সুবক্তগীনের আশাতীত এ বিজয়ে এতো বিপুল পরিমাণ মালে গনীমত হস্তগত হয় যে, জয়পালের রেখে যাওয়া হাতি, অসংখ্য ঘোড়া ও মাল-আসবাব গোছাতে পনের দিনেরও বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। বিজয়ী সুবক্তগীন যুদ্ধ শেষে গজনী ফিরে এলে মাহমূদ তাকে জানাল তার অবকাশ কেন্দ্রের কাজ শেষ হয়েছে। মনোরম বাগান বাড়ি দেখে আপনি অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। আলু, আপনি কি একবার বাগানবাড়িটি দেখতে যাবেন? আরজ করল মাহমুদ।

মাহমূদের মা সুবক্তগীনকে বাগানবাড়ি সম্পর্কে আগেই অবহিত করেছিলেন। পিতা ভেবেছিলেন, খেয়ালের বশে ছেলে হয়তো কিছু গাছগাছালি রোপণ করে ওখানে একটি ছোট্ট ঘর তৈরি করেছে। কিন্তু মাহমূদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাগান দেখতে গিয়ে তিনিও বিস্মিত হলেন। সুরম্য অট্টালিকা আর রাজসিক উদ্যানের কারুকার্য ও বিন্যাস মাহমূদের উন্নত কর্মকুশলতার স্বাক্ষর বহন করছিল। মুগ্ধ হলেন সুলতান সুবক্তগীন। ছেলের উদ্দেশে বললেন–

“মাহমূদ! তোমার এই উদ্যান, মহল ও আয়োজন মোবারক হোক। স্থাপত্যকলায় তোমার রুচি ও দক্ষতা প্রশংসার যোগ্য। তোমার এ কাজ এক শাহজাদার পরিচয় বহন করছে, কিন্তু মনে রেখো, তুমি শুধু একজন শাহজাদা নও। তোমাকে আমি ইসলামের তরে নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক হিসেবে দেখতে চাই। তুমি মামুলী কোন রাজকুমারও নও, এক মুসলিম যোদ্ধার ঔরসজাত সন্তান। তুমি ভুলে যেয়ো না, প্রকৃতপক্ষে তুমি নগণ্য এক গোলামের ছেলে। আল্লাহ তা’আলা মেহেরবানী করে তোমার বাবাকে গজনীর সালতানাতের আসনে অভিষিক্ত করেছেন। সেই সাথে জন্মসূত্রে এক মহান দায়িত্ব আমাকে বহন করতে হচ্ছে, যা আমার বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার অনেক আগে থেকেই আমার মা বহন করছিলেন। এ গুরুদায়িত্ব জাগতিক সবকিছুর চেয়ে আমার কাছে বেশি প্রিয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, আল্লাহ তাআলা এই মহান কর্তব্য পালনের দায়িত্ব আমার ও আমার উত্তরসূরিদের কাঁধে ন্যস্ত করেছেন। তোমার মা ও আমার মুখে বহুবার তুমি শুনেছে যে, তোমার জন্ম অন্য সাধারণ শাহজাদাদের মতো আদৌ মামুলী নয়। তোমার জন্মের ইঙ্গিত তোমার দাদু ও তোমার দাদী বহু পূর্বে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তিন পুরুষ ধরে আমার বাপ-দাদা তোমার আগমন আকাঙ্ক্ষায় ধীর অপেক্ষায় সময় কাটিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস ও আশা, তুমি মূর্তিসংহারীরূপে ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী শাসক হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি বয়ে আনবে।”

আব্বু! আপনি বলছেন যে, এই সুরম্য অট্টালিকা আর হৃদয়কাড়া বাগানবাড়ি তৈরি করা আমার উচিত হয়নি! একটু ম্লান মুখে বলল মাহমুদ।

না মাহমূদ! এই বাগানবাড়ি তৈরি করা তোমার উচিত, কি উচিত নয়, সে ভিন্ন কথা। আমি তোমাকে বোঝাতে চাচ্ছি, যে কোন সম্পদশালী লোকের পক্ষেই এমন প্রাসাদ ও উদ্যান তৈরি খুব সহজ, কিন্তু তোমার কাঁধে যে গুরু দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে তা যে কারো পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। রাজা-বাদশা ও শাহজাদারা উঁচু প্রাসাদ, মহল, অট্টালিকা ও স্মৃতিস্মারক এ জন্যই তো তৈরি করে যে, মানুষ তাদের দীর্ঘদিন মনে রাখবে। কিন্তু মনে রেখো, ইট-পাথরের এসব দালান-কোঠা চিরস্থায়ী নয়। মাটির উপরে নয়, মানুষের হৃদয়ে এমন স্মৃতি সৌধ নির্মাণ কর যার জন্য মানুষ তোমাকে অনাদিকাল স্মরণ করবে। ইতিহাসের পাতায় তোমার কীর্তি চিরদিন জীবন্ত হয়ে বিরাজ করবে। চার দেয়ালে ও ইটপাথরের দালানে নিজের জীবনকে আবদ্ধ করো না। নিজের মেধা ও কর্ম দিয়ে ইতিহাসের পাতা দখল কর। নিজের নাম এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত কর যা কোনদিন ম্লান হবে না, রঙ হারাবে না, নষ্ট হবে না। মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে চিরকাল।

মাহমূদ! সম্পদের প্রাচুর্য, সুন্দরী নারী আর সুরম্য প্রাসাদ সৎ নেতৃত্বের জন্যে বড় বাধা। মানুষের বড় দুর্বলতা, এসবের মধ্যে কেউ নিজেকে আটকে ফেললে সে ভোগ-বিলাসিতার শিকলে বাঁধা পড়ে যায়, সে শয়তানের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। এখন তুমি পূর্ণ যুবক। তারুণ্য ও যৌবনের মিলন মোহনায় তুমি উপনীত। এ এক কঠিন ক্রান্তিকাল। অধিকাংশ মানুষ এই সময়ে লক্ষ্যচ্যুত হয়, জীবন ও কর্মের পরিণতি ভুলে যায়। তুমিও যদি এ সময়ে আরাম আয়েশ, রঙিন স্বপ্ন ও বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দাও, ভোগের গভীরে নিজেকে তলিয়ে দাও, তবে সেখান থেকে ফিরে আসা আর সম্ভব নয়। বিলাসী শরীরের তন্ত্ৰীগুলো মরে যায়, এই মরা মানুষ দিয়ে কি পৃথিবীর ইতিহাস গড়া যায়? এজন্য প্রয়োজন ত্যাগী মানুষ। জীবন্ত মানুষ। তোমাকে আমি আদর্শ মানুষরূপে দেখতে চাই।

এ সব কথা শুনে মাহমুদ বললো, আব্ব! আপনি আমাকে ওই বাগান বাড়িতে আর দেখবেন না। আমি আমার পূর্বসূরিদের উত্তরাধিকার কখনও বিস্মৃত হব না। আমার হৃদয়ে এ কথা গেঁথে নিয়েছি, আমি ময়দানের লোক, রণাঙ্গনের লড়াকু সৈনিক, যুদ্ধক্ষেত্র আমার আসল ঠিকানা।

তুমি যদি ইসলামের ঝাণ্ডা বুলন্দ করতে গিয়ে লড়াই করে শাহাদাত বরণ কর, তবে আমি তোমার তৈরি উদ্যানে তোমাকে সমাহিত করবো, তোমার কবরের চারপাশে বাহারী রঙের অগণন ফুলের সমারোহ ঘটাবো। এই বাহারী বাগানে চিরসুখে শুয়ে থাকবে। এ বাগান হবে তোমার চির সুখনিদ্রার ঠিকানা।

পিতার উপদেশ ও অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছিলেন শাহজাদা। সুবক্তগীনের কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছিল তার জীবনে। সতের বার ভারত আক্রমণের স্মৃতিবাহক সতেরো স্তম্ভের এখন আর কোন খোঁজ নেই। সুলতান মাহমুদের বাগান বাড়িরও কোন হদিস নেই। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় জীবন্ত হয় আছে সুলতান মাহমূদ ও তার ঐতিহাসিক ভারত অভিযান। এখনও পৌত্তলিক হিন্দুদের কাছে, মূর্তিপূজারীদের কাছে সুলতান মহাতঙ্ক, মূর্তিসংহারী, বিজয়ী অবয়ব। পৃথিবীর মানুষ তাকে স্মরণ করবে চিরকাল।

কিছুদিন আগে রাজা জয়পাল যখন পেশোয়ার হয়ে গজনীর দিকে যাচ্ছিল, তখন তার রাজকীয় জৌলুস ও জাকজমক দেখে পাহাড়-নদীও যেন কুর্নিশ করে তার চলার পথ করে দিতো। সাধারণ মানুষ জয়পালের হস্তিবাহিনী ও বিশাল অশ্বারোহী সৈন্যদের দেখে ভয়ে দূরে চলে যেতো। আর আজ গজনী থেকে পালিয়ে আসা রাজাকে দেখে পেশোয়ারের প্রজারা বিস্মিত হলো। তারা চিনতেই পারছিল না, এ লোক কি তাদের রাজা না এটা রাজার প্রেতাত্মা!

রাজার বিশাল সামরিক বাহিনী বিক্ষিপ্ত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে বেহাল অবস্থায় ফিরে আসে। যে সব হাতি রণসাজে মাথা উঁচু করে যুদ্ধযাত্রা করছিল, সেগুলোর মাথা ছিল ক্ষত বিক্ষত অবনমিত। এদের চলার গতি দেখে মনে হচ্ছিল, এরা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাবে এখনই।

পেশোয়ারের রাজপ্রাসাদে রাজাকে অভ্যর্থনা জানাতে নাকারা বেজে উঠল। দুই সারিতে নিরাপত্তা রক্ষীরা দাঁড়িয়ে গেল দু’পাশে। রাজা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, এসব বাদ্য-বাজনা বন্ধ কর। একান্ত রক্ষীদের একজনকে বলল, “পণ্ডিত দু’টোকে এক্ষুনি আমার সামনে হাজির কর।”

পেশোয়ার রাজমহলে নেমে এলো মৃত্যুর বিভীষিকা। রাজমহলের বাসিন্দারা যেন সব মৃতবৎ। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। মাত্র দু’তিনজন হাঁক ডাক করছিল, এ পণ্ডিত কোথায়, কোথায় পণ্ডিত মহারাজ?”

রাজা একটি বদ্ধ কক্ষে রাগে, ক্ষোভে, অপমানে, আত্মগ্লানিতে টলছিল। = নিজের উরুতে নিজেই থাপ্পড় মারছিল আর দু’হাত কচলাচ্ছিল। কখন দু’পণ্ডিত ন তার খাস কামরায় প্রবেশ করে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছে সে দিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।

সবচেয়ে বড় পণ্ডিত বাটাণ্ডায় থাকতো। রাজা যখন গজনী আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয় তখন পণ্ডিত মহারাজও লাহোর আগমন করে। এই পণ্ডিতই রাজাকে গজনী অভিযানের শুভক্ষণ বলে দিয়েছিল। পণ্ডিতরা রাজাকে এই নিশ্চয়তাও দিয়েছিল যে, পৃথিবীর কোন শক্তি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হবে না, রাজার বিজয় অবশ্যম্ভাবী।

“মহারাজ! আমরা আপনার দরবারে হাজির হয়েছি”- বলল বড় পণ্ডিত। চকিতে রাজা ঘুরে দাঁড়াল। তার চেহারা অপমান, ব্যর্থতা আর ক্ষোভে পাণ্ডুর, গোস্বায় তার চোখ দুটি দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। সত্য আর মিথ্যার দোলাচলে দোদুল্যমান রাজার মন।

“তোমরা মিথ্যা বলেছিলে, না যে পুঁথি দেখে তোমরা শুভ দিন নির্ধারণ করেছিল ওগুলোতে মিথ্যা লেখা হয়েছে?” গম্ভীর আওয়াজে পণ্ডিতদের জিজ্ঞেস করল রাজা।

আমরাও মিথ্যা বলিনি, পুঁথির কথাও মিথ্যা নয়। তারকা কখনও মিথ্যা নির্দেশ দেয় না মহারাজ! এক পণ্ডিত বলল। আমরা আপনাকে এখনো শুভক্ষণটা হিসেব কষে দেখাতে পারব।

“তোমরা লক্ষবার হিসাব করোগে! কিন্তু আমার সামনে চরম অবমাননাকর পরাজয়ের বাস্তবতা বিদ্যমান। আমি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছি। ধ্বংস হয়ে গেছে আমার সেনাবাহিনী।

“তোমাদের ওসব ভবিষ্যদ্বাণীর কি হলো? তোমরাই আমাকে উদ্বুদ্ধ করে বলেছিলে, শুভ এই অভিযান। তোমরাই তো শোনালে আমাকে দেবতার আশীর্বাদের দৈববাণী। তোমরাই পণ্ডিতদের সাথে নিয়ে যেতে বলেছিলে এবং উপদেশ করেছিলে, লড়াই শুরু করার আগে এই মূর্তি আর কৃষ্ণ দেবতাকে সিপাইদের সামনে রেখে পূজা-অর্চনা করে লড়াই শুরু করতে। এসব করলে আমার সৈনিকরা পাহাড় ধসিয়ে দিতে সক্ষম হবে। তোমাদের কথামতো সব আয়োজনই আমি করেছিলাম। লড়াই শুরু করার আগে মূর্তি আর দেবতাদের পূজা-অর্চনা শুরু হলো, কিন্তু তা শেষ না হতেই মুসলিম সৈন্যরা আমাদের উপর ঝড়ের বেগে হামলা করল। প্রচণ্ড তুফানের মতো এসে ওরা সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে ফেলল, আমরা খড়কুটোর মতো পিষ্ট হতে লাগলাম। ওরা আমাদের দেবতা, অবতার আর মূর্তিগুলোকে ভেঙেচুরে মাটিতে মিশিয়ে দিল। তোমরা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে দেখে এসো, আমাদের দেবমূর্তিকে মুসলমানরা কিভাবে পায়ে পিষে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে!

তোমরা হয়তো মনে করবে, ওরা বিশাল বাহিনী নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করেছে। না, রাতের বেলায় আমরা যখন সৈনিকদের সামনে কৃষ্ণ আর দেবমূর্তি রেখে প্রার্থনা শুরু করেছি, পণ্ডিত শ্লোক গাইতে রু করেছে, এ সময় মাত্র শতাধিক মুসলিম আমাদের সৈনিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সবকিছু তছনছ করে দিল। এরপর দিনের বেলায় আর আমরা শত্রু সৈন্যদের মোকাবেলায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না। আমার সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। পণ্ডিত পালিয়ে গেল। সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আমিও পালিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। অথচ আমার বাহিনীতে তিন লাখের বেশি সৈন্য ছিল। ওরা ছিল আমাদের এক চতুর্থাংশেরও কম।”

“আমরা আবার হিসাব কষে বলব মহারাজ। মনে হয় তারায় তারায় সংঘর্ষ হয়ে গেছে।”

রাজা জয়পালের ক্ষোভ তখন চরমে। চরম অপমান, লজ্জা, তিক্ত পরাজয়ের বাস্তবতা তার সামনে। আর ওসব পণ্ডিত ব্যস্ত রয়েছে তাদের জ্যোতিষীপনার সত্যতা প্রমাণে। রাজা তিন লাখের বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পুরো আফগানিস্তানকে মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গজনী বিজয়ের আশায় অভিযান চালিয়েছিল। তার স্বপ্ন ছিল মহাভারতের সীমানার মধ্যে সে হিন্দুকুশ পর্বতমালাকেও অন্তর্ভুক্ত করবে। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো, বিরাট সেনাবাহিনীকে সে সুবক্তগীনের মর্জি আর কৃপার সামনে ত্যাগ করে এসেছে। নিজের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। পেশোয়ার পৌঁছার আগ পর্যন্ত পিছন ফিরে দেখার সাহসটুকু সে হারিয়ে ফেলেছিলো। তার জন্যে আরো বিপর্যয়কর বিষয় হলো, সে শুধু তার নিজের সৈন্য নিয়ে গজনী যায়নি, বিজয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আশ-পাশের আরো পাঁচ-ছয়টি রাজ্যের সৈন্যদেরকেও সঙ্গী করেছিল। সে সব রাজার কাছে মুখ রক্ষার কিছুই আর জয়পালের অবশিষ্ট থাকলো না।

এছাড়া তৎকালীন ভারতে রেওয়াজ ছিল, কোন রাজা যদি পরপর দু’বার শত্রু বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় তবে তাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হতো। রাজা জয়পালের পরাজয়ের সংখ্যা সেই মাত্রা অতিক্রম করে ফেলেছে। এখন তার পক্ষে সিংহাসনে টিকে থাকার প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যান্য রাজারা চাপ দিলে ছেলের হাতে রাজক্ষমতা ত্যাগ করা ছাড়া তার কোন উপায় নেই। জয়পালের ছেলে আনন্দ পাল তখনও কিশোর। সুবক্তগীন যেমন মাহমুদকে যুদ্ধকৌশলে দক্ষরূপে গড়ে তুলেছিলেন তেমনি আনন্দপালকেও রণবিদ্যার বহু কৌশল রপ্ত করিয়েছিলেন। কিন্তু আনন্দপালের রাজ্যপাট সামলানোর মতো বয়স হয়নি। আনন্দপালের হাতে রাজ্যপাট ন্যস্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার সময় এখনো আসেনি। উপরন্তু অন্য রাজারা তাদের বিপুল সৈন্য ও রসদ ক্ষয়ের ক্ষতিপূরণ দাবী করে বলতে পারে, এর ক্ষতিপূরণ স্বরূপ সিংহাসন ও রাজ্য আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। এসব চিন্তায় রাজা জয়পালের মাথা বিগড়ে যাওয়ার উপক্রম। এমতাবস্থায় যখন পণ্ডিতেরা পরাজয়ের কারণ নির্ণয়ের জন্যে আবার তারার অবস্থান হিসেব করে কোথায় ভুল হয়েছে তা খতিয়ে দেখার কথা বলল তখন ক্ষোভে-অপমানে রাজা কাঁপতে শুরু করল।

“আমি তোমাদের পরিষ্কার বলছি যে, মুসলমানরা তোমাদের মতো যুদ্ধের গনা শুনে আসেনি। ওরা তারার গতিপথ দেখে গণক-জ্যোতিষীদের কথামতো বিজয়ের শুভ-অশুভ যাত্রা দেখে আসেনি। আমাদের হাতে মুসলিম সৈন্য খুব কমই বন্দী হয়ে এসেছে। তন্মধ্যে দু’জন অফিসার রয়েছে। এদেরকে তোমরা দেখ, ওরা তোমাদের মতো মুসলিম মৌলভীদের কোন বিজয়-আশ্বাস নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল কি? আমার তো সন্দেহ হয়- মুসলমানদের কথা সত্য মনে হয়। ওরা বলে কাদামাটি আর পাথরের তৈরি এসব দেবতা মিথ্যা; আর ওরা যে খোদার ইবাদত করে তাই সত্য।”

“ছিঃ ছিঃ ছিঃ মহারাজ! মুসলমান ম্লেচ্ছ। ওদের নাম উচ্চারণ করাও অশুচি। আপনার পরাজয়ের কারণে দেবতাদের মিথ্যা আখ্যা দেয়া মহাপাপ হবে। এই পরাজয়ের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। পরাজয়ের কারণ এই নয় যে, মুসলমানদের ধর্ম সত্য, আমাদের দেব-দেবীরা ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।”

কারো ঘরে ডাকাত পড়লে সেই ঘর উজাড় হয়ে যায়। বলল অপর পণ্ডিত। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ডাকাতদের খোদা সত্য আর লুণ্ঠিতদের খোদা মিথ্যা।

“আমি তো আমার ধর্মকে সত্য জেনেই মুসলমানদের দেশে এই সত্য ধর্মকে বিস্তৃত করতে চেয়েছিলাম। দেবতারা আমাকে কেন সহায়তা করল না? মুসলমানরা আমাদের দেবতাদেরকে টুকরো টুকরো করে উপহাসে মেতে উঠল। এসব কি সহ্য করার মত?” বলল রাজা জয়পাল।

“মহারাজ! আমাদেরকে আবার যাচাই করে দেখার সুযোগ দিন।”

আমি আবার তোমাদের গণনা যাচাই করে দেখার সুযোগ দিচ্ছি। একথা বলে রাজা জয়পাল গমনোদ্যত পণ্ডিতদের বলল, তোমরা একটু বস। আমি মুসলিম কয়েদীদেরকে তোমাদের সামনে হাজির করছি। রাজা তার খাস কামরায় ঝুলানো ঘণ্টা বাজাল। এক দারোয়ান ভেতরে প্রবেশ করলে রাজা দু’তিনজন সিনিয়র জেনারেলের নাম বলে দারোয়ানকে হুকুম দিলেন বিশেষ কামরায় বন্দী দু’জন কয়েদীকে নিয়ে জেনারেলদের এখানে হাজির হতে বল।

রাজা জয়পাল সিংহাসনে সমাসীন। দরবারের দস্তুর মতো দুই পণ্ডিত রাজার ডানপাশে এবং তাদের পাশে দুই জেনারেলকে বসানো হল।

সুদর্শন, সুগঠিত দেহ, দীর্ঘকায় দু’জন বন্দীকে ভেতরে আনা হল। তাদের হাতে হাতকড়া, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ী বাঁধা। কয়েদী হলেও তাদের চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ পরিস্ফুট। তারা নিরুদ্বিগ্ন। কোন ধরনের ভীতির ছাপ নেই তাদের চেহারায়। কেননা তারা বিজয়ে গর্বিত, তারা সুলতান সুবক্তগীনের বাহিনীর সৈনিক। পদবীতে কমান্ডার। তারা শেষ যুদ্ধে রাতের আঁধারে দুঃসাহসী গেরিলা হামলা করে শত্রুপক্ষের ব্যুহে ঢুকে পড়ে গ্রেফতার হয়েছিল। এদের সেনারা শত্রুপক্ষের বহু ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিল বটে, কিন্তু তাদেরও কুরবানী দিতে হয়েছে প্রচুর।

রাজা জয়পালের দরবারের এক লোক গজনীর ভাষা জানতো। রাজা তার সহায়তায় বন্দীদের সাথে কথা বলল, “আমি তোমাদের কাছে যুদ্ধের কোন গোপন কৌশলের কথা জিজ্ঞেস করব না। তোমরা শুধু আমাকে একথা বলবে, যুদ্ধ যাত্রার আগে সুলতানকে কোনদিন যাত্রা করলে শুভ হবে, তারার অবস্থান গুনে তোমাদের মৌলভী কিংবা জ্যোতিষীরা কি এরূপ কিছু বলে?”

“না, আমাদের ধর্মীয় গুরুরা এসব কিছু বলেন না।” বলল নেজাম আউরিজী নামের বন্দী কমান্ডার।

“আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের মোকাবেলায় লড়াই করি। আমাদের শত্রু আপনারা, খৃস্টান ও ইহুদীরা। আমাদের স্বধর্মীয় লোকদের মধ্যেও আমাদের শত্রু রয়েছে। আমরা যে যুদ্ধ করি আমাদের দৃষ্টিতে এটিকে জেহাদ বলা হয়। আমরা রাজ্যের পরিধি বিস্তারের জন্যে যুদ্ধ করি না, আমরা আল্লাহর জন্য আল্লাহর সত্য ধর্মের বিজয়ের লক্ষ্যে যুদ্ধ করি। যুদ্ধ যাত্রা কিংবা যুদ্ধ শুরুর জন্যে বিশেষ কোন ক্ষণ বা দিনের জন্যে আমরা অপেক্ষা করি না। প্রত্যেক দিন বা সকল মহূর্তকেই আমরা শুভ মনে করি। দিন হোক রাত হোক, ঝড়-বাদল, শীত-গ্রীষ্ম সবই আল্লাহর। এই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা যুদ্ধ করি। অপারেশনে নেমে পড়ি। আল্লাহর প্রতিটি দিন ও মুহূর্ত শুভ ও সুন্দর। এটাই আমাদের বিশ্বাস।”

তোমাদের মসজিদগুলোতে কি তোমাদের মৌলভী ও ইমাম সাহবেরা তোমাদের জন্যে বিশেষ কোন দু’আর আয়োজন করে?

প্রত্যেকেই জিহাদে গমনকারীদের জন্যে দু’আ করে।

আমাদের ছোট-বড় ছেলে-বুড়ো সবাই সব সময় আল্লাহ তা’আলার সাথে কথা বলতে পারে। বলল নিজাম আউরিজী।

আচ্ছা! তোমরা কি জান তোমাদের বিজয়ের রহস্য কি? তোমরা কি আমার সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে আগে জানতে জিজ্ঞেস করল রাজা।

আপনার সৈন্য সংখ্যার ব্যাপারটি জানা-না জানার বিষয়টি আমাদের সুলতান এবং সেনাপতিদের দায়িত্ব। ওসব নিয়ে আমরা ভাবি না। আমাদের সাফল্যের রহস্য হলো আমরা যুদ্ধ করি আল্লাহর জন্যে। আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হই বাঁচার জন্যে নয় শাহাদাঁতের আকাক্ষা নিয়ে।

তা আমি জানি। বলল রাজা। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আমার বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে তোমরা এতো অল্পসংখ্যক লোক কিভাবে বিজয়ী হলে। তোমাদের যুদ্ধের কৌশল কি?

এটা একান্তই গোপনীয় বিষয়। এ ব্যাপারে আমি যেমন আপনাকে কিছু বলতে পারব না, আমার সাথীও আপনাকে কিছু বলতে পারবে না। তবে একথা বলতে পারি, আল্লাহর উপর ঈমানদার কোন ব্যক্তি তারার গতিবিধিতে বিশ্বাস করে না। যতক্ষণ ঈমান মজবুত থাকে, ততক্ষণ মুমেন আকাশের বিজলীর ন্যায় দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে চলে। আমাদের উলামায়ে কেরাম বলেছেন, হিন্দু ও পৌত্তলিকরা কাদামাটি ও পাথরের মূর্তির পূজা করে। ওদের বিশ্বাস দুর্বল এবং অক্ষম ওদের দেবদেবীরা। আমরা আপনাকে বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছি, হাতে গড়া কাদা-মাটি ও পাথরের দেবদেবী প্রকৃত খোদার সাথে টক্কর দিলে ধুলোর সাথে মিশে যায়। আপনি কি দেখেননি, আপনার সৈনিকরা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল বহু দেবদেবী, সে সব কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি? আপনার একজন সৈন্যও কি অক্ষত ফিরে আসতে পেরেছে।

এই ম্লেচ্ছ আমাদের দেবদেবীকে অপমান করছে মহারাজ! রাগতস্বরে বলল এক পণ্ডিত।

এই গবেট এখনও বুঝতে পারছে না যে, সে আমাদের বন্দী, বলল রাজা। এরা তাদের কঠিন পরিণতি সম্পর্কে বেখবর। এরা যদি যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে আমাকে ওদের গোপন রহস্য প্রকাশ না করে তাহলে আমি ওদের চামড়া তুলে ফেলব। তখন দেখবে, যন্ত্রণায় গড়গড় করে সব বলে দেবে।

আমাদের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে মহারাজ! বলল অপর বন্দী। আমাদের হত্যা করেও আপনি রহস্য জানতে পারবেন না এবং আপনার লজ্জাকর পরাজয়কেও বিজয়ে পরিণত করতে সক্ষম হবে না।

এদের নিয়ে যাও! শিকলে বেঁধে রাখো। আর অন্যগুলোকে হত্যা করে ফেল। রাজা হুকুম দিল।

উভয় কয়েদীকে খাস কামরা থেকে নিয়ে গেল প্রহরী। রাজা পণ্ডিতদের উদ্দেশে বলল, আমি পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করতে চাই। তোমরা জেনে শুনে জলদি বল এ কাজ কিভাবে করা সম্ভব।

পণ্ডিতরা চলে যাওয়ার পর রাজা জয়পাল তার দুই জেনারেলকে বলল, এ দুই কয়েদীকে লাহোর নিয়ে যাবো। আগামীকাল এখান থেকে আমরা রওয়ানা হব। এদেরকে নেয়ার ব্যবস্থা কর।

এদের কাছ থেকে আপনি কি রহস্য জানতে চান মহারাজ! জিজ্ঞেস করল এক জেনারেল।

আমাদেরকে পরাজয়ের রহস্য আবিষ্কার করতে হবে। সুবক্তগীন আমাদের রণপ্রস্তুতি আর আক্রমণের খবর আগেই জেনে ফেলেছিল। আগাম খবর নিয়ে মুসলমানরা ওঁত পেতে রাতের আঁধারে আমাদের সৈনিকদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। পাহাড়ের আড়ালে ওদের সৈনিকরা আগে থেকে ওঁত পেতেছিল আর রাতে গেরিলা হামলা করেছিল। সুবক্তগীনের গুপ্ত বাহিনী গেরিলা হামলার জন্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। তখন আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত।

যুদ্ধের রহস্য উন্মোচন করতে হলে আপনাকে আগে খোঁজ নিতে হবে, আমাদের যাত্রা ও প্রস্তুতির খবর কিভাবে গজনী পৌঁছল। সুবক্তগীনের গোয়েন্দারা আমাদের আশেপাশে ঘাপটি মেরে আছে। এদের খুঁজে বের করার ব্যবস্থা আগে করতে হবে মহারাজ!

রাজা জয়পাল বার্ধক্যে উপনীত। উপরন্তু উপযুপরি পরাজয়ের গ্লানিতে তার দেমাগ বিগড়ে গিয়েছিল। অন্য কারো কথা বা পরামর্শ শোনার মতো মানসিকতা তার ছিল না। রাজা পরাজয়ের কারণ নিজে যা বুঝতে পেরেছিল সেরূপ প্রতিকার ব্যবস্থা নিচ্ছিল। কিন্তু পরাজয়ের কারণ যে তার ধারণা ভিন্ন অন্য কিছু, হতে পারে এটা তাকে বোঝনোর ক্ষমতা কারো ছিল না। নেজাম আউরিজী যখন বলল, তাকে হত্যা করলেও যুদ্ধের রহস্য সে ফাস করবে না, এরপর রাজা এদের মুখ থেকে রহস্য উদঘাটনের ফন্দি আঁটতে লাগল। যে করেই হোক রহস্য সে এদের মুখ থেকে বের করবেই।

লাহোরের সবচেয়ে বড় মন্দিরের প্রধান মূর্তি সরস্বতির সামনে আতর, গোলাব, ধূপ, লোবান, আগরবাতি জ্বালিয়ে একান্ত মনে পূজায় বসেছে পণ্ডিত। মন্দিরের ভেতর-বাহির ধুয়ে মুছে ঝকমকে করা হয়েছে। আলোকমালায় গোটা মন্দির ঝলমল করছে। আজ মন্দিরে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। বিশ-পঁচিশটি কুমারী মন্দিরের ভেতরে ফুলের ডালি নিয়ে দাঁড়ানো। এরা বিশেষভাবে তৈরি পোশাকে সজ্জিত হয়ে মন্দিরের প্রবেশ পথে দু’সারিতে দাঁড়িয়েছে। মন্দিরের সদর দরজার সামনে রাজার বিশেষ নিরাপত্তা অফিসাররা টহল দিচ্ছে। ইত্যবসরে ঘোষণা শোনা গেল, মহারাজের সওয়ারী আসছে।

রাজার আগমনী সংবাদে বাদক দল বিশেষ সঙ্গীতের তুফান তুললো। বাজনার তালে তালে নেচে উঠল তরুণী দল। গোটা এলাকা হারিয়ে গেল কান ফাটা ঢাকঢোল আর বাদ্যযন্ত্রের শব্দে। রাজা সদর গেটে এলে কুমারীরা কুর্নিশ করে গমন পথে তার পদতলে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিল। তাজা ফুলের পাপড়ি মাড়িয়ে তরুণীদের বেষ্টনী পেরিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করল রাজা। প্রবেশ করল বিশেষ এক কক্ষে। যেখানে পণ্ডিত মহারাজ তন্ত্রমন্ত্র জপছিল। এক পণ্ডিত তাকে কুর্নিশ করে মাথায় তিলক পরিয়ে দিল। অন্য পণ্ডিতেরা ঘটি, শাখা বাজাতে শুরু করল। রাজা জয়পাল দু’হাত জোর করে সরস্বতীর পা ছুঁয়ে চোখে-মুখে হাত বুলাল। আর শপথ করল, যে করেই হোক সে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবেই নেবে। প্রতিজ্ঞা করল মূর্তির সামনে, পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করে সুদূর বুখারা পর্যন্ত আমি দেব-দেবীর ডঙ্কা বাজাব। ইসলামের সূতিকাগার পর্যন্ত আমি সনাতন ধর্মের সীমানা বিস্তৃত করে ক্ষ্যান্ত হব। দেবদেবীদের মর্যাদা বুলন্দ করতে ব্যর্থ হলে যুদ্ধেই আমি প্রাণ ত্যাগ করব।”

রাজার প্রার্থনা শেষ হলে শুরু হল পণ্ডিতদের পালা। পণ্ডিতেরা ওদের নিজস্ব সংস্কৃত ভাষায় অনেক কিছু বলল, যা অন্যদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ঘণ্টা আর শাখা ধ্বনি আরো তীব্র হল। হঠাৎ ভীষণ গর্জন শোনা গেল- যেন আসমান ভেঙে পড়েছে। বাইরে যেন রাতের আঁধার নেমেছে। পরপর কয়েকবার গর্জন শোনা গেল। পণ্ডিতেরা পরস্পর চোখাচোখি করল, বুড়ো রাজা পণ্ডিতদের কাতর অবস্থা আর ঘন কাঁপানো গর্জনে ভয়ে কেঁপে উঠল। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বড় পণ্ডিত দেবতার সামনে আরো জোরে জোরে মন্ত্র পড়ছে আর রোদন করছে। বাইরে নেমে এলো গভীর অন্ধকার। শুরু হল চেঁচামেচি, হাঁকডাক আর চিৎকার।

মহারাজ! দেবতা খুব নাখোশ হয়েছে। গজনীর যুদ্ধে দেবদেবীদের অপমান করা হয়েছে। এই অপমান দেবতা কখনও ক্ষমা করবে না। রাজার সামনে দু’হাঁটু গেড়ে নীচু গলায় বলল বড় পণ্ডিত।

এ সময় হঠাৎ আকাশে এমন বিকট বিজলী-গর্জন শুরু হলো যে, মন্দির কেঁপে উঠল, মূর্তিগুলো নড়ে গেল।

রাজা কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠল, পণ্ডিত!

জ্বী মহারাজ!

দেবী মা কি চায়? কতো মানুষের বলি চায় দেবী? যতো নরবলি চায় বলুক, আমি দেবীর পদতলে হাজারো নরবলী দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করব।

এ সময় রাজা জয়পাল, পণ্ডিত ও মন্দিরের সেবায়েতদের মধ্যে আকাশের অবিরাম বিকট গর্জন আর বিজলীর ভয়াবহ ঝলকানিতে ধুকপুকানি শুরু হয়েছে। ভিতরে ভিতরে ভয়ে সবার বুক শুকিয়ে গেছে।

মন্দিরের অনতিদূরে মুসলমান কৃষকরা নির্বিঘ্নে ক্ষেতে কাজ করছিল। তাদের খুশি দেখে কে। দীর্ঘদিন পর কাক্ষিত মুষলধারার বৃষ্টিতে আনন্দ উচ্ছ্বাসে তারা বলাবলি করছিল, “এবার ফসল ভালো হবে, আল্লাহ রহম করেছেন। ভাইয়েরা! বাড়ি গিয়ে সবাই নফল নামায পড়ো, শুকরিয়া আদায় করো।” মুসলিম কৃষকদের আনন্দ উল্লাস আর হর্ষধ্বনি মন্দির থেকেও শোনা যাচ্ছিল।

মুসলমানদের জন্যে যা ছিল আল্লাহর দয়া মন্দিরের মূর্তিপূজকদের বিবেচনায় তা ছিল দেবতার ক্রোধ, ভগবানের গযব। মুসলমানরা ভারী বর্ষণ-বৃষ্টিকে আল্লাহর রহমত ভেবে শুকরিয়া জ্ঞাপনার্থে নফল নামায পড়ার জন্যে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুসলমান শিশুরা বৃষ্টিতে ভিজে কাদা-পানিতে খেলতে নেমেছে, হৈ চৈ, চেঁচামেচি করে উল্লাস করছে। অপর পক্ষে রহমতের এই বারিধারা ও মেঘের গর্জনে মন্দিরের পূজারী ও রাজার চেহারা মলিন হয়ে গেছে। গযবের আশঙ্কায় মন্দিরের সর্বত্র ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।

বড় পণ্ডিত হাতজোড় করে বড় দেবতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছিল, এদিকে রাজাও ভগবানের শাস্তি আশঙ্কায় কাতর। বাইরে সারি বেঁধে দাঁড়ানো যুবতীরা দ্বিতীয়বার আকাশের গর্জনে ভীত হয়ে দৌড়ে মন্দিরে এসে কাঁপতে শুরু করেছে।

দীর্ঘক্ষণ পর এক পণ্ডিত মুখ তুলে বলল, মহারাজ! এক কুমারীর বলিদান!

মাত্র একটি?

জ্বী মহারাজ! মাত্র একটি কুমারী হলেই চলবে। বলল পণ্ডিত।

কোন মুসলমান কুমারীকে ধরে এনে এক্ষণই আমার সামনে বলি দিয়ে দাও। হুকুম করল রাজী।

না-না মহারাজ! ভগবান কোন ম্লেচ্ছ বলিদান গ্রহণ করবেন না। খাঁটি বামুন কুমারী চাই।

রাজা জয়পালের দৃষ্টি পড়ল পাশে দাঁড়ানো কুমারীদের প্রতি। এরা সবাই মন্দিরের চিরকুমারী! সেবায়েত এই চিরকুমারীরাই একটু আগে তার গমন পথে ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছিল।

এরাও তো কুমারী। এদের একজনকে বলিদানের জন্য রেখে দিন। পণ্ডিতের উদ্দেশে বলল রাজা।

রাজার কথা শুনে মেয়েরা পরস্পর চোখাচোখি করল এবং বাঁকা ঠোঁটে হাসল। পরক্ষণেই তাদের এই আচরণে পণ্ডিতদের ক্রোধাগ্নি আঁচ করতে পেরে দমে গেল সবাই। পণ্ডিতরা একটু চুপসে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা ইতস্তত হল। কারণ, এই মেয়েরা জনসাধারণের দৃষ্টিতে খুবই সম্মানের পাত্রী, মন্দিরের সেবাদাসী, দেব-দেবীর জন্য উৎসর্গিত চিরকুমারী। মন্দিরে এদের অবাধ যাতায়াত। একাকী অথবা জোড়ায় জোড়ায় দল বেঁধে যখন ইচ্ছে এদের জন্যে মন্দিরে গমনাগমনে কোন বিধিনিষেধ নেই। বাইরের মানুষ এদেরকে সতি-সাধ্বী ভেবে ইজ্জত করলেও মন্দিরের পণ্ডিত আর ওরা জানে, তারা কোন ধরনের কুমারী। বারবার তাদের বাঁকা দৃষ্টি পণ্ডিতদের বিব্রত করছিল এবং তা কুমারীদল ও পণ্ডিতদের মাঝে এক জটিল সম্পর্কের ইংগিত বহন করছিল।

রাজা জয়পাল তন্মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির বাজু ধরে পণ্ডিতকে বলল, একে বলিদান করুন।

‘আমি আপনার পায়ে জীবনোসর্গ করতে প্রস্তুত মহারাজ’ স্বগতোক্তি করল মেয়েটি। আমি দেবীর পদতলে জীবন উৎসর্গ করবো তাতে আপত্তির কী আছে! কিন্তু মহারাজ! আমি যে কুমারী নই।

তোমার বিয়ে হয়েছে, তবে মন্দিরে এলে কেন?

“আমি কারো বিবাহিতা স্ত্রী নই মহারাজ। এই মন্দিরের দাসী। কিন্তু পণ্ডিতজী আমার সতীত্ব…।” অপকটে বললো মেয়েটি।

বলিদানের জন্যে একটা বিশেষ ধরনের দৈহিক গড়ন, অঙ্গসৌষ্ঠব আর কুমারী নারী দরকার মহারাজ! মেয়েটির কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল বড় পণ্ডিত। এই গুণ এখানকার কুমারীদের মাঝে অনুপস্থিত। বলিদানের জন্যে উপযুক্ত মেয়ে আমরা খুঁজে নেব, এজন্য আপনি নিশ্চিত থাকুন। সেই কুমারীকে আমরা এই চাঁদের পূর্ণিমা থেকে আগামী চাঁদের পূর্ণিমা পর্যন্ত আমাদের হেফাযতে রাখব। ওকে বিশেষ ধরনের খানা, বিশেষ পোশাক পরাতে হবে এবং বিশেষ ধরনের তালিম দিতে হবে। সে নিজে থেকেই বলি হওয়ার জন্য আর্জি পেশ করতে থাকবে। সে আপনার আকাক্ষা সফলের জন্য আশীর্বাদ করবে। তাকে এখানে নয় একটা বিশেষ স্থানে নিয়ে বলীদান করা হবে মহারাজ!

এ কাজ খুব জলদি হওয়া দরকার। বলল রাজা।

আপনি বলিদানের ইচ্ছে ব্যক্ত করার সাথে সাথেই দেবতা খুশি হয়ে গেছেন। তার রাগ কমে গেছে। দেখলেন না, আপনি বলিদানের কথা বলার সাথে সাথে দেবতা শান্ত-নিরব। বন্ধ হয়ে গেছে গর্জন। থেমে গেছে ঝড়। আকাশ একেবারে পরিষ্কার।

রাজা জয়পাল মন্দির থেকে বেরিয়ে গেল। বলি হওয়ার ভয়ে মেয়েদের চেহারা পার বর্ণ ধারণ করেছিল। এরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। পণ্ডিতের কথায় অন্য কুমারী বলিদানে রাজা সম্মতি দিল। এরা রাজার কথায় আশঙ্কা করছিল, না জানি তাদের মধ্যে কাউকে আবার বলিদানের শিকার হতে হয়।

আজ তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে, কেন আমরা তোমাদের কুমারীত্ব নষ্ট করেছি। না হয় আজ তোমাদেরই বলি হতে হতো। নির্লজ্জের মত বলল বড় পণ্ডিত। কুমারীত্ব নষ্ট না করলে একের পর এক তোমাদেরকেই বলিদান বরণ করতে হতো। তোমরা তোমাদের শরীর বলিদান করে জীবন দান থেকে মুক্তি লাভ করেছে। বড় পণ্ডিত কুমারীদের উদ্দেশে এমন গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলছিল, যেন সে বেদ পুরানের কোন শ্লোক আবৃত্তি করছিল।

রাজা জয়পালের বহর ভারী বর্ষণের ফলে কাদা-মাটির মধ্য দিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে রওয়ানা হল। রাজার প্রস্থানে তার রক্ষী-প্রহরী সৈন্যরা মন্দির এলাকা ত্যাগ করল। বড় পণ্ডিত কুমারীদের পিছনের কামরায় চলে যেতে নির্দেশ দিয়ে নিজেও সেই কামরায় প্রবেশ করল। সদর গেট বন্ধ করে দেয়া হল।

রাজা যখন মন্দিরে গেলো তখন গজনীর দুই বন্দীকে রাজপ্রাসাদে আনা ল। রাজার হুকুম ছিল এখানে এদের হাজির করার। রাজার ফেরায় বিলম্ব দেখে একটি ঘরে তাদের বসিয়ে দেয়া হল। রাজার হুকুম ছিল, ওদেরকে কয়েদখানায় বিমানের আহার না দিয়ে ভাল আহার দেবে, আরাম বিছানার ব্যবস্থা করবে।

রাজার চেষ্টা ছিল ওদের প্রতি একটু সদয় ব্যবহার করে মুসলিমদের যুদ্ধ জয়ের গোপন রহস্য উদ্ধার করার। কারণ, রাজার কাছে তাদের যুদ্ধ কৌশলের রহস্য বলতে এরা অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

রাজা তার জেনারেলদের বলেছিল, বন্দীদেরকে আরাম-আয়েশে রেখে তাদের মন জয় করার মাধ্যমে রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করতে হবে। তাতেও যদি কাজ না হয় তবে কঠিন শাস্তি দিয়ে ওদের পেট থেকে রহস্য বের করে আনতে হবে।

তাদের জন্যে যখন আহার আনা হল তখন তারা বলল, এই খাবার কে বেঁধেছে? তাদের বলা হল, রাজ মহলের বাবুর্চিরা পাকিয়েছে এই খাবার। তারা বলল, তারা কোন হিন্দুর পাকানো খাবার খাবে না। তাদেরকে কোন মুসলমানের রান্না করা খাবার দেয়া হোক এবং খাবার কোন মুসলমানকে দিয়ে পাঠানো হোক। রাজার যেহেতু নির্দেশ ছিল মেহমানের মতো এই দুই বন্দীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার, তাই রাজমহলের খানা ফিরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পর এক মুসলমানকে দিয়ে খাবার পাঠানো হল। বন্দীরা যখন নিশ্চিত হল, খানাবাহক প্রকৃতই মুসলমান তখন আগ্রহভরে আহার করল।

ওরা যখন আহার করছিল, তখন পাহারাদার সিপাই ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার পাশে চলে গিয়েছিল। এরা শিকলে বাঁধা, তাই পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল না। আহার বহনকারী মুসলমান কর্মচারী আহাররত বন্দীদের পাশে বসল। সে আড়চোখে দেখে নিল, প্রহরী ঘরের বাইরে চলে গেছে। সে নীচু স্বরে ফারসীতে বলল, তোমাদের খুব আদর-যত্ন করা হচ্ছে এই ভেবে তোমরা খুশি হয়ে যেয়ো না। এমন ব্যবস্থা ওসব বন্দীর বেলায়ই নেয়া হয় যাদের কাছে দামী কোন রহস্য থাকে।

উভয় বন্দী গভীরভাবে ওকে দেখল।

খানাবাহক বলল, আমার দিকে তাকিয়ো না, খানার দিকে চোখ রেখে নিঃশব্দে কথা বলো। এরা দেখলে সন্দেহ করবে, আমি তোমাদের লোক। যদি তোমাদের কাছে সত্যিই কোন রহস্য থাকে তবে তা কখনও প্রকাশ করো না, কিন্তু ওদের লোভ দেখাবে। ওদের ধোকা দিয়ে আস্থা অর্জন করো, যাতে ওরা তোমাদের পায়ের ডাণ্ডাবেড়ি ও কোমরের শিকল খুলে দেয়। সুযোগ পেলেই আমি তোমাদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবো। দেখো কোন প্রলোভনে পড়ে গোপন তথ্য ফাঁস করো না যেন। তাহলে তোমরা ফেঁসে যাবে। একবার ফেঁসে গেলে আর রক্ষা পাবে না। এমন কঠিন শাস্তি দেবে পরাণ ঠোঁটের সাথে ঝুলে থাকবে। মরেও মরবে না।

এরা যখন কথা বলছিল তখন বাইরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির শব্দে এদের কথার আওয়াজ বাইরে যাচ্ছিল না। বৃষ্টি থামতেই রাজা প্রাসাদে এলো এবং এদের ভিতরে নিয়ে বলল, আমি তোমাদের কাছ থেকে সুবক্তগীনের যুদ্ধ জয়ের রহস্য জানতে চাচ্ছি!

“আমরা পরাজয় চিনি না। আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে নতি স্বীকার করি । আপনি ও আপনার জাতির লোকেরা মুসলমানদের ধোঁকা দেয়া ও প্রতারণা করাকে নেক কাজ মনে করেন। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাকে মনে করেন বুদ্ধিমত্তা। এই ধূর্তামি আমরা জানি না। শিকলে বাঁধা অবস্থায় যদি আমরা আপনাকে রহস্য বলে দেই তবে এর অর্থ দাঁড়ায় গ্রেফতারীর যন্ত্রণায় আমরা কওমের সাথে বেঈমানী করেছি। বন্দী অবস্থায় আমরা আপনার সাথে কোন কথা বলতে পারব না।”

রাজা শ্লেষ মাখা স্বরে বললো, “তাহলে কি আমি তোমাদের অতিথি করে রাখবো?”

যা ইচ্ছে তা করতে পারেন। শিকলে বন্দী থেকে আমরাই কি আপনাকে বন্ধু ভাবতে পারি? বলল এক বন্দী কাসেম বলখী। আপনি আমাদের উধ্বতন নেতৃস্থানীয় লোকদের কয়েদখানায় হত্যা করেছেন, আমাদের সুলতানের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। আমাদের মুখ থেকে রহস্য জেনে যাওয়ার পর আমাদের সাথেও এমন ব্যবহার করবেন না এর নিশ্চয়তা কি?

আমরা আপনাকে বলতে পারি, যতো বেশি সৈন্য নিয়েই আপনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন না কেন পরাজয় আপনার হবেই। অবশ্য আমরাই কেবল আপনাকে বলতে পারি বিজয়ের রহস্য কি। কিভাবে আমাদের পরাজিত করা সম্ভব।

আমি তোমাদের ভাণ্ডাবেড়ি ও শিকল খুলে দিচ্ছি। তোমাদেরকে কয়েদখানার বাইরে রাখার ব্যবস্থা করছি।

“আমরা যদি রহস্যের কথা আপনাকে বলি আপনি কি আমাদের ছেড়ে দেবেন? গজনী পর্যন্ত যেতে আমাদের বাহনের ব্যবস্থা করবেন? প্রশ্ন করল নিজাম।

“তোমরা যা চাইবে তাই দেব, নিশ্চিন্ত থাক।”

আমরা এ ব্যাপারে কয়েক দিন চিন্তা করব। এরপর বলব। পরখ করে নেব, এই সময়ের মধ্যে আমাদের সাথে আপনি কেমন আচরণ করেন। কারাগারের বাইরে আর ভিতরে আপনি আমাদের যেখানেই রাখেন আমরা পালিয়ে আর কোথায় যাব! একটা ব্যাপারে আপনি খেয়াল রাখবেন, আমরা মুসলমানের রান্না করা খাবার ছাড়া আহার করব না, আজও এক মুসলমানের রান্না করা খাবার আমাদের দেয়া হয়েছে। আমাদের আবদারে এক মুসলমান কর্মচারী খাবার দিয়ে গেছে আমাদেরকে।

পরাজয়ের গ্লানিতে বিপর্যস্ত রাজা বন্দীদের শর্ত মেনে নিল। হুকুম করল, আজ যে মুসলমান কর্মচারী বন্দীদের খাবার নিয়ে এসেছিল একেই তাদের তদারকিতে নিযুক্ত করা হোক।

বন্দীদের ভিন্ন ভিন্ন দুটি ঘরে রাখা হল। তাদের থাকার ঘরে মেহমানদের মতোই আহার বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হল। তবে তারা জানতে পারেনি যে, তাদের ঘরের বাইরে সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

একাধারে কয়েক সপ্তাহ ধরে সকল মন্দির ও শহরে-বাজারে প্রচার করা হচ্ছে, মুসলমানরা এদেশে আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছে। এরা কোন মন্দির ও পণ্ডিতকে জীবিত রাখবে না। কোন নারীর সতীত্বকেও অক্ষত রাখবে না। মুসলিম সেনাদের প্রতি হিন্দু প্রজাদের ঘৃণা বাড়ানোর জন্যে বোঝানো হল, বাপ-দাদার ধর্ম, নিজেদের মন্দির ও ধর্মগুরু বিশেষ করে মা-বোনদের ইজ্জত বাঁচানোর তাগিদে তাদের সরকারী কোষাগারে অকাতরে অর্থ-কড়ি দেয়া জরুরী। প্রতিটি মন্দির থেকে প্রচার করা হচ্ছে, মুসলিম আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে না পারলে হিন্দুদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। অপপ্রচারে কাজ হলো। প্রজাসাধারণ তাদের সম্পদের সিংহভাগ অকাতরে রাজকোষে ঢেলে দিল।

লাহোরের সবচেয়ে বড় মন্দির থেকে ঘোষণা করা হল, এখন বেশি করে প্রজাদের উচিত, মন্দিরে হাজির হয়ে ভগবানের ভজনা করা। সেই সাথে প্রত্যেকের কুমারী কন্যা-বোনদের নিয়মিত মন্দিরে নিয়ে আসা। কুমারীদের ভজনায় দেবতা বেশি খুশি হয়ে থাকেন। . পণ্ডিতরা একথাও প্রচার করল যে, মহারাজা এখন সৈন্যবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত। তিনি দ্রুত মুসলমানদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করবেন, যাতে মুসলমানরা লাহোর আক্রমণের অবকাশই না পায়। তাই প্রজাদের উচিত এই কঠিন সময়ে বেশি করে মন্দিরের পূজা-অর্চনায় শরীক হওয়া এবং যথাসম্ভব রাজাকে সাহায্য করা। রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বার্থেই এখন ভজনা ও অর্থ সাহায্য উভয়টাই রাজার জরুরী।

মন্দিরের প্রচারণায় সুফল ফলল। হিন্দু প্রজারা কুমারী মেয়েদের মন্দিরে পাঠাতে শুরু করল। বড় পণ্ডিত কুমারীদের পূজা-অর্চনা পরিচালনা করতো। কিভাবে দেবতাদের সামনে হাতজোড় করে পূজো দেবে তা তদারকি করতো। আর কুমারীদের নিরীক্ষণ করতো। কারণ, তার একজন কুমারীকে দেবতার পদতলে বলিদানের জন্যে বাছাই করা জরুরী।

গজনীর দুই বন্দীর খোঁজ নেয়ার অবকাশ রাজার আর হল না। প্রতিবেশী রাজ্যের রাজারা সবাই লাহোর এসে হাজির হল। তারা প্রত্যেকে জয়পালের গজনী আক্রমণে সৈন্য ও রসদ দিয়ে সাহায্য করেছিল। এতে দিল্লী, কনৌজ, গোয়ালীয়রের রাজার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। টানা কয়েকদিন পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক হল। কিন্তু মুসলমানদের পুনরায় হামলা করে কিভাবে গজনী দখল করা যায় তর্ক-বিতর্ক এ পর্যায়ে আটকে রইল । পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানে কিংবা পুনর্বার সহযোগিতা না করার কথা কেউই উচ্চারণ করল না।

আমরা গজনী দখল করতে পারলে ওখান থেকে আরব পর্যন্ত আক্রমণের পথ খুলে যাবে। বলল কালিঞ্জরের মহারাজা। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এ প্রতিজ্ঞা বদ্ধমূল হওয়া উচিত যে, বিশাল মহাভারতের স্বপ্ন আমাদের বাস্তবায়ন করতেই হবে। মহাভারতের সীমানা ফোরাত ও দজলা পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে। এ কাজ আমরা না করতে পারলে আরব এলাকা খৃস্টানদের দখলে চলে যাবে। আমার কাছে খবর এসেছে, মুসলমান রাজারা একে অন্যের বিরুদ্ধে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। এর অন্তরালে প্রধান ভূমিকা রাখছে খৃষ্টান গোয়েন্দারা। তারা মুসলিম আমীর-উমারাকে সুন্দরী মেয়ে ও মদের টোপ গিলিয়ে ওদের অন্দর মহল পর্যন্ত নিজেদের কজায় নিয়ে নিয়েছে।

আমাদেরও এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। বলল রাজা জয়পাল। মুসলমানদেরকে আমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে, যুদ্ধবিদ্যায় আমরা কত পারদর্শী। তবে এ মুহূর্তে আমাদের সৈনিকদের মধ্যে মুসলিম যোদ্ধাদের প্রতি প্রচণ্ড ভীতি রয়েছে। এরা মনে করে মুসলিম যোদ্ধারা দুঃসাহসী ও ভয়ঙ্কর। কখনো ওদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। এই ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে জনসাধারণের মাঝেও। তাই দ্রুত সুলতান সুবক্তগীনের সৈন্যদের পরাজিত করে আমাদের সৈন্য ও প্রজাদের মন থেকে এই আতঙ্ক দূর করতে হবে। গজনী আমাদের দখলে চলে আসলে ওখান থেকে আমরা খৃস্টানদের কৌশল অবলম্বন করে সহজে কাজ করতে পারব।

আমাদের মেয়েরা ইহুদী ও খৃস্টান মেয়েদের তুলনায় বেশি সুন্দরী ও মেধাবী। বলল কনৌজের মহারাজ। আমাদের শত্রুদের পরাস্ত করতে, দেব-দেবীদের আদর্শ প্রচার ও প্রসারিত করতে, সর্বোপরি আমাদের প্রধান শত্রু মুসলমানদের ধর্মকে বিকৃত করার কাজে হাজারো মেয়েকে আমরা বলি দিতে প্রস্তুত রয়েছি। আমাদের যে মেয়েরা স্বামীর মৃত্যুতে জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দিতে পারে তারা নিজের ধর্ম ও জাতির কল্যাণে জীবন দিতে মোটেও দ্বিধা

করবে না। বস্তুত এ কাজে জীবন দেয়ার দরকার হবে না, সম্ভ্রমের বিনিময়ে মুসলিম সৈনিক ও নেতাদের ভেড়া বানানোর খুবই সহজ কাজ। এটা আমাদের মেয়েরা সানন্দে করবে।

আমি একটি কুমারী বলিদান করছি। বলল জয়পাল। অন্য রাজারা রাজা জয়পালের পরাজয়ে ক্ষতিপূরণের দাবী না তুলে নতুন করে তারই নেতৃত্বে গজনী, আক্রমণের ফয়সালা করে চলে গেল। জয়পাল সুবক্তগীনের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে রাতদিন নতুন সৈন্য সংগ্রহ, তাদের ট্রেনিং ও রসদ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে গেল।

মন্দিরে মন্দিরে পণ্ডিতেরা সাধারণ মানুষকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উৎসাহিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলতে বিরামহীন কাজ করে চললো।

আর এদিকে নিজেরা মুসলিম সুলতানকে ধ্বংসের আয়োজনে পুরোদমে লেগে পড়ল। গজনীর আশপাশে মুসলিম রাজারা একজোট হয়ে একের পর এক সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। অথচ যদি তিন লাখ হিন্দু বাহিনীর হাতে সুলতান সুবক্তগীন পরাজিত হতেন, তাহলে অন্য ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো জয়পালের সৈন্য-স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতো। সুলতান শুধু নিজের অধিকৃত রাজ্যই রক্ষা করেননি, তিনি জীবনবাজি রেখে ইসলাম ও অন্যান্য ছোট ছোট রাজ্যের মুসলমানদের ঈমান, ইজ্জত, জীবন ও জমিন রক্ষা করেছেন। তবুও কেউ তার সহযোগী হল না। সবাই তার ওপর বিরূপ। তার ছেলে মাহমূদ একমাত্র তার সহযোগী।

সুলতান সুবক্তগীন হিন্দুস্তানের জায়গায় জায়গায় গড়ে তুলেছিলেন নিবিড় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। হিন্দু রাজা-মহারাজাদের মতিগতির খবর এরা তাকে খুব দ্রুত সরবরাহ করত। সুবক্তগীন এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন, জয়পাল আবার আক্রমণ করবে তার উপর। অবশ্য তিনি ধারণা করেছিলেন, এতো ক্ষয়ক্ষতি ও লোকবল হারিয়ে রাজা খুব তাড়াতাড়ি হামলা করার হয়তো সাহস পাবে না। এদিকে তার নিজের সৈন্যবাহিনীর অবস্থাও ছিল শোচনীয়। বিশাল বাহিনীকে অল্পসংখ্যক সৈন্য দিয়ে মোকাবেলা করতে গিয়ে তারও বহু জানবাজ যোদ্ধ। হারাতে হয়েছে। শুধু জয়পালের আক্রমণ আশঙ্কাই নয় আরো বহুবিধ সমস্যায় পতিত হয়েছিলেন সুবক্তগীন। প্রায় সকল প্রতিবেশী মুসলিম রাজা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র শানাচ্ছিল। এই কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি দু’ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিলেন। সকল প্রতিবেশী মুসলিম রাজ্যে দূত পাঠালেন, তারা যেন সবাই হিন্দু আগ্রাসন মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। কিন্তু কেউ তার প্রস্তাবে সাড়া দিল না। সুলতান সুবক্তগীনের দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল, পেশোয়ারের উত্তর-পশ্চিমের ছোট ছোট দুর্গগুলোর নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়া। তিনি সুনির্বাচিত ও দক্ষ কিছু সৈনিক নিয়ে এ অঞ্চলের আফগান ও খিলজী বংশজাত লোক অধ্যুষিত দুর্গগুলো দখল করে নেন। বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাদেরও যুদ্ধের জন্য প্রভাবিত করেন। আলেম-উলামার দ্বারা ইসলামের মাহাত্ম প্রচার করে এ অঞ্চলের সবাইকে ইসলামের পতাকা তলে সমবেত করতে সক্ষম হলেন।

আফগানী ও খিলজীদের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী ছিল না। তারা সুবক্তগীনের সাথে সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করল এবং তাদের প্রচুর সংখ্যক যুবককে সুবক্তগীনের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করাল।

এভাবে কেটে গেল আরো সময়। মাহমূদের বয়স এখন তেইশ বছর । সুলতান সুবক্তগীন তাকে খোরাসানের গভর্নর নিযুক্ত করলেন। তখন মুসলিম সালতানাতের অন্যান্য অংশে গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল । বুখারার বাদশাহ আবুল মনসুরের ইন্তেকালে তার ছেলে নূহ মসনদে আসীন হলে ফায়েক নামক এক হাকিম বিদ্রোহ করল। নূহের সৈন্যরা সুলতান সুবক্তগীনের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানাল। সুলতান সুবক্তগীন নিজে নূহের সাথে দেখা করে তার জন্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলেন।

সুবক্তগীনের নিজের রাজ্যেই বিদ্রোহ দেখা দিল। আমীর বু আলী হাসান খোরাসানের কিছু অংশ দখল করে নিল। সে বিদ্রোহী ফায়েককে আশ্রয় দিল। এ সুলতান সমঝোতা চুক্তির পয়গাম পাঠালেন কিন্তু আলী হাসান কোন পাত্তাই দিল না। ওদের শিকড় উপড়ে ফেলা ছাড়া সুলতানের আর বিকল্প কোন পথ রইল না। ৯ বিদ্রোহী মুসলিম ভাইদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা ছাড়া তার আর উপায় রইল না। ৪ এদিকে বু আলী হাসান ও অন্যদের পর্দার আড়ালে থেকে খৃস্টানরা সার্বিক সহযোগিতা ও উস্কানী দিচ্ছিল। এরা বিধর্মীদের উস্কানিতে কমণ্ডজ্ঞান হারিয়ে আত্মগর্ভে বুঁদ হয়ে পড়েছিল। শেষতক সুলতান সৈন্য নিয়ে বলখ পৌঁছলেন, এদিকে নূহও তার সৈন্য নিয়ে সুলতানের সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন।

ফায়েক ও আলী হাসান জ্বরজানের শাসক ফখরুদ্দৌলাকে দলে ভিড়িয়ে নিল। ফখরুদ্দৌলার দারা নামের এক সেনাপতি ছিল। তার বীরত্বের কীর্তিগাথা দূর পর্যন্ত মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো।

এসব রাজা তাদের বাহিনী নিয়ে হেরাত পর্যন্ত অগ্রসর হল। সুলতান সুবক্তগীন ও তার বাহিনী হেরাতের একটি ময়দানে উপনীত হলেন। তার কাছে যুদ্ধের জন্য এ স্থানটি ছিল খুবই যুৎসই। এই শক্ত প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় সুলতানের সহযোগী একমাত্র বাদশাহ নূহ। সে কিশোর ও অনভিজ্ঞ হওয়ার কারণে আমীর ফায়েক তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এই আশায় যে, সে ভীত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। সুলতানের বড় শক্তি শাহজাদা মাহমূদ এখন কৈশোর পেরিয়ে এক টগবগে যুবক। ওদিকে সারা হিন্দুস্থানের রাজা-মহারাজারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানতে প্রস্তুত। এদিকে নিজ ভূমিতে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে মুসলিম সেনারা পরস্পরের মুখোমুখি। একজন অপর জনের রক্তপিপাসু। এমন কঠিন সময়ে সুলতান সুবক্তগীন যখন যুবক মাহমূদ আর তরুণ নূহের দিকে তাকালেন তখন তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল।

“আব্বা আপনার চোখে পানি!” বিস্ময়মাখা প্রশ্ন মাহমূদের।

“ইসলামের কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ঝরানো ছাড়া আর কি করার আছে মাহমূদ!” ধরা গলায় বললেন সুলতান সুবক্তগীন।

“মুসলমানরা যখন ঐক্যবদ্ধ ছিল ইউরোপ-কুফরীস্তানেও তারা ইসলামের বিজয় কেতন উড়াতে সক্ষম হয়েছিল। মুসলমানদের অনৈক্যের কারণে ইউরোপ থেকে আজ ইসলাম নির্বাসিত। হিন্দুস্থানেও ইসলামের ঝাণ্ডা আজ ভূলুণ্ঠিত। বহু মুসলিম দেশ খৃস্টানরা দখল করে নিয়েছে, আরো দখলের চেষ্টা করছে। অপরদিকে হিন্দুরাও আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। তোমাদের দেখে আমার চোখে পানি এসে গেছে এই ভেবে যে, আমরা তো পরস্পর লড়াই করে একদিন শেষ হয়ে যাবো, সন্তানদের জন্যে কি রেখে যাচ্ছি। আমরা তো তোমাদের জন্য পতিত এক ইসলামী সালতানাত রেখে যাচ্ছি। ক্ষমতার লোভ, গৃহবিবাদ আর ঈমান কেনাবেচার বাজার আজ সরগরম। ঐ সব ঈমান বিক্রেতা, ক্ষমতালিলুর সন্তানেরা ক্ষমতার লোভে ইসলামের শত্রুদের হাতে নিজের ঈমান-ইজ্জত বিক্রি করতে মোটেও দ্বিধা করবে না। কুফরীস্তানের মূর্তি ভাঙা ছিল আমার দায়িত্ব। বাতিল বিরোধী সংগ্রামের দায়িত্ব তোমাদের হাতে সোপর্দ করতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু আমার মুসলিম ভাইয়েরা–আমরা যারা একই খোদা, একই কাবা, একই কুরআনের আদর্শে চলি–একই রাসূল (স.)-এর আনুগত্য করি তারাই আজ আল্লাহর পথ ভুলে বসেছি। বাবা! মুসলিম মিল্লাতের ভবিষ্যত অন্ধকার। ক্ষমতা ও মসনদের লোভ আর মদ ও মেয়েতে ডুবে গিয়ে ওরা মুসলিম জাহানকে টুকরো টুকরো করছে। তোমরা দেখতে পাচ্ছ, প্রত্যেক মুসলিম রাজ্যে অবিশ্বাস, বিবাদ, প্রতারণা কিভাবে বিস্তার ঘটেছে। বর্তমান মুসলমানরা দৃশ্যত ঐক্যবদ্ধ হলেও এদের মনে প্রতারণার বীজ সুপ্ত রয়েছে। একে অন্যের প্রতি এরা ভীষণ অসহিষ্ণু। এরা মতভিন্নতাকেও মনে করে শত্রুতা। এরা শুভাকাঙ্ক্ষীকেও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। আমাদের উঁচু মহল থেকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নির্বাসিত হয়ে গেছে। খেলাফত আছে নামে মাত্র।” দীর্ঘক্ষণ কথা বলে সুলতান নীরব হয়ে গেলেন। এরপর মাথা উঁচু করে বললেন, “মাহমূদ ও নূহ! তোমাদের বাহিনীকে আমার সামনে এনে দাঁড় করাও।”

মাহমূদ ও নূহের সৈন্যরা সুবক্তগীনের সামনে এসে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছে। সুবক্তগীন নিজের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আছেন। সুবক্তগীন যেখানে দাঁড়ানো সে জায়গাটি একটি টিলার মতো। সেখান থেকে আমীর ফায়েক, আলী হাসান ও ফখরুদ্দৌলার বাহিনীর তবু দৃশ্যমান। সুবক্তগীন চোখ বুলালেন নূহ ও মাহমূদের বাহিনীর প্রতি। অনুক্ত যন্ত্রণায় তার বুক ভারী হয়ে উঠল। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে সৈনিকদের প্রতি উচ্চ আওয়াজে বলতে লাগলেন–

“আল্লাহর সিপাহীগণ! আমি তোমাদের মত একই ধর্মের অনুসারী, একই বেশ-ভূষায় সজ্জিত আরেকটি বাহিনী দেখতে পাচ্ছি। তারা আমাদের প্রতিপক্ষ। তোমরা আর ওরা যদি এক হয়ে যাও, পরস্পর শত্রুতা পরিহার করে ঐক্য গড়ে তোল তাহলে ইসলামের ঝাণ্ডা আবার তারেক বিন যিয়াদ ও মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজিত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ তোমাদের ও ওদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। শত্রু ও চক্রান্তকারীরা আমাদেরকে পরস্পর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের জন্যে জীবনত্যাগী আর ওরা সিংহাসন ও ক্ষমতার পূজারী। তারা দীন, ঈমান, ইজ্জত ও হুরমতকে নিলাম করে দিয়েছে। হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকরা আমাদের উপর দু’বার হামলা করেছে, তোমরা ওদের তুলনায় অনেক কম লোকবল নিয়েও তাদের পরাজিত করেছে। বলতে পারো, কোন শক্তিবলে তোমরা এতো বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলে? সেই শক্তি হলো তোমরা আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর নাম বুলন্দ করার লক্ষ্যে মরণপণ যুদ্ধ করেছে। আর তারা ক্ষমতা, মসনদ ও তাগুতের জন্যে জীবনবাজি যুদ্ধ করেছে। আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে তোমরা শাহাদাঁতের আশায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে, তাই বিজয় তোমাদের পদচুম্বন করেছিলো।

এখন আমাদের প্রতিপক্ষে যারা দাঁড়িয়েছে এরা পৌত্তলিকদের মতোই খোদাদ্রোহী ও আল্লাহর দুশমন। এরা আল্লাহর দুশমনদেরই সহায়তা করছে; আমাদের নিঃশেষ করে ওরা আমাদের চিরশত্রু ও ইসলামের দুশমনদের শক্তি বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে। তোমরা ওদের মুখে নারায়ে তাকবীর’ শুনে বিভ্রান্ত হয়ে তরবারী কোষবদ্ধ করে ঘোড়ার গতি ঘুরিয়ে নেবে না। তোমরা এই প্রতারক-শত্রুদের দ্বারা বিভ্রান্ত হলে এই ভূখণ্ড থেকে ইসলাম চিরতরে বিদায় নেবে। এরা শয়তানের দোসর। এরা চাঁদ-তারা খচিত ঝাণ্ডা বহন করছে তোমাদের ধোঁকা দিতে। চেনা শত্রুদের আগে ছদ্মবেশী এই শত্রুদের নিঃশেষ করতে হবে। এরা ঘরের শত্রু বিভীষণ, ভাইয়ের বেশে হন্তারক, শত্রুপক্ষের ক্রীড়নক।

আমি ওদেরকে এই যুদ্ধ থেকে বিরত রাখার জন্যে চেষ্টা কম করিনি, কিন্তু তারা আমার বিনীত প্রস্তাব ও জাতির কল্যাণের কথা মোটেও বিবেচনা করল না। আমি আমার কোন ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারি, কিন্তু ধর্মের অপমান সহ্য করা অসম্ভব। ইসলামের শক্তি অজেয় রাখতে আমরা জীবন বিলিয়ে দেব, কিন্তু শত্রুদের দূরাশা পূরণ করতে দেবো না।

আল্লাহর সৈনিকগণ! ইসলামের সৈনিকেরা রাজত্বের জন্যে লড়াই করে না, ইসলামের সৈনিকরা আল্লাহর হুকুমত মজবুত এবং গোমরাহ মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের শামিয়ানার নীচে একত্রিত করতে জীবনপণ জিহাদে অবতীর্ণ হয়। তোমরা কি ভুলে গেছো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো কাফেরদের কজায় চলে যাওয়ার পর সে সব মা-বোনের কথা, যাদের ইজ্জত নিয়ে বেঈমানেরা উল্লাস করেছিল? তোমরা কি চাও ওরা আমাদের কন্যাদের উপর নারকীয় বর্বরতা চালাক? অথচ তোমাদের বিপরীতে যেসব মুসলিম নামের কাপুরুষ আমীর-উমারা যুদ্ধসাজে সজ্জিত তারা নিজ কন্যাদের ইজ্জত বেঈমানদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে। যারা স্ত্রী-কন্যার ইজ্জত-সম্ভ্রমের মূল্য দেয় না, তাদের কাছে ইসলাম ও ধর্মের মর্যাদা আর জাতির কল্যাণের আশা করা দুরাশা নয় কি? ইসলামের পরাজয় ও মর্যাদাহানিতে ওদের কিছুই যায় আসে না।”

আবেগ, উত্তেজনায় সুলতান সুবক্তগীনের ভাষণ আরো জোরালো ও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছিল। তার অগ্নিঝরা বক্তৃতা শুনে নূহ ও মাহমূদের সৈনিকরা প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষোভে টগবগ করছিল। যোদ্ধাদের শরীরের রক্তে যেন আগুন ধরে গিয়েছিল প্রতিপক্ষের সবকিছু তছনছ করে দিতে। কিন্তু যোদ্ধাদের এই উজ্জীবন ও উত্তেজনায় সুলতানের মধ্যে কোন আশার সঞ্চার করল না। তার মলিন চেহারার কালিমা দূর হল না। তার চেহারা তখনও দুঃখে কাতর, বিষাদে ভারাক্রান্ত। দীর্ঘ বক্তৃতার পর তিনি সৈনিকদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের পর লড়াইয়ের কৌশল বলে দিলেন। সুবক্তগীন ও মূহ অবস্থান নিলেন বাহিনীর মাঝখানে। প্রতিপক্ষে দারা নামের এক বিখ্যাত যোদ্ধা রয়েছে। নিজ রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়েও বহু দূর-দূরত্ব পর্যন্ত মুখে মুখে ফেরে তার বাহাদুরি ও বীরত্বের কাহিনী । সে যখন সুলতানের বাহিনীকে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে দেখল, সাথে সাথে নিজ দলের সৈনিকদের সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিল। দারা জানতো, সে যদি সুলতানকে আগে আক্রমণের সুযোগ দেয় তবে বিজয়ী হওয়া কঠিন। একটু সুযোগ পেলেই সুলতানের বাহিনী সব তছনছ করে দেবে। সুলতানের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা ছিল। দারা ছিল সদা সজাগ ও সতর্ক ব্যক্তিত্ব।

এক অভিনব কৌশল করল দারা। সে মাঝের সৈনিকদের স্থিতাবস্থায় রেখে অনেক ঘুরপথে এসে সুলতানের বাহিনীর দুই প্রান্তবাহুতে আক্রমণ করে বসল। দারার এই আক্রমণ ছিল ধারণাতীত এবং প্রচণ্ড ।

সুলতানের জন্যে দারার এই চাল ছিল একেবারেই আন্দাজের বাইরে। আকস্মিক এই আক্রমণে সুলতানের বাহিনী বেঘোরে প্রাণ দিতে লাগল এবং ভড়কে গেল। দারার সেনাশক্তিও প্রচুর। তদুপরি সে নির্বাচিত ও দক্ষ বিপুল সৈন্য রেখেছিল মধ্যভাগে। সে জানতো, প্রতিপক্ষের দু’বাহু একই সাথে আক্রমণের শিকার হলে সুলতানকে দু’দিকেই সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। এতে মধ্যভাগের প্রতিরক্ষা ব্যুহ দুর্বল হয়ে পড়বে, আর এ সুযোগে সে প্রচণ্ড আক্রমণ করে বিজয় ছিনিয়ে নেবে।

সুলতানকে দারার কৌশলের ফাঁদেই পড়তে হলো। পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠল। তখন তিনি মধ্যভাগের রিজার্ভ সৈন্যদের প্রান্ত বাহুকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দিলেন। ফলে তার রক্ষণভাগ দুর্বল হয়ে পড়ল। তিনি দিব্যি দেখতে পেলেন, মধ্যভাগেও আক্রমণ অত্যাসন্ন। তিনি মাহমূদ ও নূহকে বললেন, বেটা! হয়তো আজই আমার জীবনের শেষ যুদ্ধ, তোমরা সচেতন থাকো, অগ্রপশ্চাতে খেয়াল রেখো। যুদ্ধের গতি এখন শত্রুদের অনুকূলে। একটু অসতর্কতা বিরাট অঘটন ঘটাতে পারে।

সেই যুগের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ফেরেশতা লিখেছেন, সুলতানের দৃষ্টিতে যখন পরাজয়ের ক্ষণ ঘনিয়ে আসছিল তখন ধূলি উড়িয়ে প্রচণ্ড বেগে একজন অশ্বারোহী সুলতানের দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেল। শত্রুসৈন্যদের ব্যুহ থেকে আসতে দেখলেও তার তরবারী ছিল কোষবদ্ধ, ঢালটি পিছনে বাঁধা ছিলো। আগন্তুকের অবস্থা বলে দিচ্ছিল, সে কোন প্রস্তাব নিয়ে আসছে। দূত বা বার্তাবাহক হয়তো হবে।

সে সুলতানের কাছে এলে সবাই বিস্ময়ে হতবাক। এতে কোন সাধারণ দূত বা বার্তাবাহক নয়– শত্রুপক্ষের সেনাপতি দারা নিজে হাজির। দারা সুলতানের কাছে এসে সামরিক অভিবাদন ও সালাম দিয়ে নিজের ঢাল-তরবারী সুলতানের পায়ের কাছে ফেলে দিল।

দারা বলল, সম্মানিত সুলতান! আমি ইসলাম-দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত, আপন ভাইদের বিরুদ্ধে আমি তরবারী চালাতে অক্ষম। আমি আমার দেহরক্ষীসহ সব অনুগত সৈন্যদের নিয়ে আপনার দরবারে হাজির হয়েছি। আমি যাদের সেনাপতি আজ তারা ক্ষমতার জন্যে লড়াই করছে। আমি সারাজীবন ইসলামের জন্যে জিহাদ করেছি। আমি আমার সারাজীবনের অর্জিত জিহাদের সওয়াব ও পুণ্য নষ্ট করতে চাই না। আমাকে আপনার বাহিনীতে জায়গা দিয়ে আল্লাহর দরবারে আনুগত্য প্রকাশের সুযোগ দিন, সুলতান!

দারা তার সাথে আসা বাহিনীকে নির্দেশ দিল, তোমরা আবার ঘুরে ক্ষমতালিম্বু আমীর ফায়েক ও তার দোসরদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করো। দারা শুধু নির্দেশ দিয়ে ক্ষান্ত হলো না, ত্যাজ্য বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ হানতে অনুসারীদের নিজে কমান্ড দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেল। সুলতান সুবক্তগীন তার সকল রিজার্ভ সৈনিকদের দু’ভাগে বিভক্ত করে দুই প্রান্তবাহিনীকে সহযোগিতার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন। মাহমূদকে দিলেন এক বাহুর কমান্ডিংয়ের দায়িত্ব। নূহকে নিজের কাছে রাখলেন। সম্মুখ যুদ্ধে অনভিজ্ঞ নূহকে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তিনি তার কোন বিপদ দেখতে চাননি।

অপরাধী কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। কৃত অপরাধ অপরাধীকে তাড়া করে বেড়ায়। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার মতো মনোবল অপরাধীর থাকে না। আমীর ফায়েক ও বু আলী হাসান তার সৈন্যদের সুলতান সুবক্তগীন ও দারার দয়ার উপর ছেড়ে দিয়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেল। তাদের সাথে কিছু সৈন্যও পালাতে সক্ষম হল। এরা এতই ভীত হয়ে পড়েছিল যে, দৌড়িয়ে সুদূর জ্বরজানে গিয়ে থামল। জ্বরজানের বাদশাহ ফখরুদ্দৌলা তাদের আশ্রয় দিল। সেনাপতি দারার ঈমান ও আবেগ ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল। তিনি ইসলামের গাদ্দারদের জ্বরজান পর্যন্ত তাড়া করার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন, কিন্তু সুলতান সুবক্তগীন তাকে এই বলে নিবৃত্ত করলেন, তিনি এই গৃহযুদ্ধকে আর বিস্তৃত করতে আগ্রহী নন বরং তিনি তাদেরকে সমঝোতার জন্যে আহ্বান করতে চান। দারার মতো মাহমূদও গাদ্দারদেরকে তাড়া করে অগ্নিপ্রতিশোধ স্পৃহা নিবৃত্ত করতে উদ্যত ছিলেন। ছদ্মবেশী দুশমনকে নিশ্চিহ্ন না করে ক্ষান্ত হতে তার টগবগে তারুণ্য ও উদ্দীপিত ঈমান সায় দিচ্ছিল না, তবুও পিতার আদেশ অম্লান বদনে মেনে নিল।

সুলতান সকল সৈনিককে একত্রিত করে নূহকে তার সৈন্যসহ বুখারায় ফিরে যেতে বললেন। মাহমূদ তার নিয়ন্ত্রিত বাহিনী নিয়ে নিশাপুর রওয়ানা হলেন। সুলতান রওয়ানা হলেন গজনীর পথে। সেনাপতি দারাকে তিনি নিজের সঙ্গী করে নিলেন।

মাহমূদ নিশাপুর পৌঁছে নিঃশ্বাস নেয়ার আগেই তার এক সীমান্ত সেনা-দূত হন্তদন্ত হয়ে তাকে খবর দিল, ফখরুদ্দৌলার সাহায্যপুষ্ট হয়ে আমীর ফায়েক ও বু আলী হাসান যুদ্ধসাজে নিশাপুরের দিকে এগিয়ে আসছে। ফখরুদ্দৌলা পূর্ব থেকেই সুলতান সুবক্তগীনের যুদ্ধ-পরিণতির দিকে দৃষ্টি রাখছিল। যখন সে সংবাদ পেল, সুলতান অধিকাংশ সৈন্য সাথে নিয়ে গজনী গেছেন এবং মাহমূদের কাছে মাত্র কিছুসংখ্যক সৈন্য রয়ে গেছে। সে তখন মাহমুদের বাহিনীর উপর আক্রমণকে সুযোগ মনে করল। অকস্মাৎ প্রচণ্ড আক্রমণ করে বসল।

মাহমূদ সেই দূতকে দ্রুত সুলতানকে সংবাদ জানাতে পাঠিয়ে দিয়ে সৈন্যের কমান্ড নিজ হাতে নিয়ে ময়দানের দিকে অগ্রসর হলেন। ততক্ষণে প্রতিপক্ষের সৈন্যে ময়দান ছেয়ে গেছে। মাহমূদের বাহিনীকে ঘিরে ফেলে প্রতিপক্ষ। মাহমূদের দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি ও যুদ্ধের অবসাদ দূর হওয়াতো দূরে থাক যাত্রা শেষ করার সুযোগটুকুও তার হয়নি। তার সৈন্য সংখ্যা প্রতিপক্ষের তুলনায় অতি নগণ্য। মাহমূদ প্রতিপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়াতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। মাহমূদ পশ্চাদপসারণের চিন্তা করলেন। কিন্তু পিছনে ফেরারও তেমন সুযোগ নেই। শত্রুবাহিনীর ঘেরাও ছিল খুব মজবুত। বাহ্যত মাহমূদ ছিলেন মৃত্যু ও বন্দী হওয়ার মুখোমুখি।

মাহমূদের সংবাদবাহী দুই দূত উল্কার বেগে সুলতানের উদ্দেশে ছুটে চলে। মাহমূদের ভাগ্য সুলতানের সাহায্যের উপর অনেকাংশে নির্ভর হয়ে আছে। কিন্তু পথ ছিল যেমন দুর্গম তেমনই দীর্ঘ।

ঐতিহাসিকগণ বলেন, পরদিন আলী হাসান ও আমীর ফায়েক দেখল, তাদের পিছনের আগমন পথে ধূলি উড়ছে। তারা ভাবল, হয়ত ফখরুদ্দৌলা তাদের জন্য আরো সাপোর্ট বাহিনী পাঠিয়েছে। তারা এখন নিশাপুরের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তাদের আকাঙ্ক্ষা দুরাশায় পরিণত হলো। তারা দেখল, সুলতান সুবক্তগীনের সৈন্য দুই দিক থেকে তাদের বাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে। তারা ধারণাই করতে পারেনি যে, সুলতান সুবক্তগীন এতো দ্রুত মাহমূদের সাহায্যে এত দূর পৌঁছে যাবেন। সুলতান ও দারা তাদের বাহিনীকে দুই বাহুতে প্রলম্বিত করে শত্রুদের ঘিরে ফেললেন। বিদ্রোহীরা যখন দেখল, তাদের পশ্চাদপসারণের পথ রুদ্ধ, তখন তারা নিজ বাহিনীকে একত্রিত করে সুবক্তগীনের মধ্য বাহিনীতে আক্রমণ করে বসল। পশ্চাদপসারণরত মাহমূদ ঘুরে প্রচণ্ড আক্রমণে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

যুবক মাহমূদ এমনিতেই গাদ্দারদের প্রতি রাগে ফুঁসছিলেন। কিন্তু মুখোমুখি হওয়ার মতো অবস্থা তার ছিল না। তিনি সুলতানের আগমন প্রত্যাশায় কালক্ষেপণের জন্যে শুরু থেকে বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখার লক্ষ্যে পশ্চাদপসারণের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দেখলেন, প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত গতিতে সুলতান বাহিনী নিয়ে শত্রুপক্ষকে ঘিরে ফেলেছেন, তখন তার ক্ষোভ ও প্রতিশোধের আগ্নেয়গিরি অগ্নৎগিরণ করতে শুরু করল। তিনি শত্রু বাহিনীর উপর ব্যাঘ্রের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শত্রুবাহিনী তার অল্প সংখ্যক সৈন্যের আক্রমণেই ধরাশায়ী হয়ে গেল। কিন্তু কুচক্রী আমীর ফায়েক ও বু আলী হাসান কোন ফাঁকে পালিয়ে গেল কেউ টের পেল না। তাদের সৈন্যরা কচুকাটা হল । সাপের উদ্যত মাথা নীচু হয়ে গেল। এক বিশাল বিজয় সুবক্তগীনের পদচুম্বন করল।

এদিকে লাহোরের রাজা-মহারাজারা মিত্রবাহিনী প্রস্তুতিতে রাতদিন জোরদার তৎপরতায় ব্যস্ত। তারা গজনী, বুখারা, বলখ, খোরাসান দখল করার স্বপ্নে বিভোর। এবার শুধু সরকারী সেনারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবে না, হিন্দু প্রজা সাধারণ নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল পৌত্তলিক ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতিতে লিপ্ত। নিজেদের ঘরে রক্ষিত সোনা-গহনা, উপার্জিত পুঁজি-পাট্টা, মাল-আসবাব, রসদ উপকরণ যে যা পারল সবই সুলতান সুবক্তগীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতিতে বিলিয়ে দিল। হিন্দু পণ্ডিত-পুরোহিতেরা নাগরিকদের মনে মুসলিম বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। পুরোহিতরা সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এই ধারণা জন্মাতে সক্ষম হয়েছিল, এখনই মুসলমানদের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ওদের রাজ্য দখল করতে না পারলে ভবিষ্যতে ভারতে কোন হিন্দুর অস্তিত্বই থাকবে না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু রাজা-মহারাজাদের কর্তব্য নয়, প্রত্যেক হিন্দুর ধর্মীয় দায়িত্ব।

অপরদিকে ইসলামী ভূখণ্ডে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরস্পর খুনোখুনিতে লিপ্ত মুসলিম নেতৃত্ব। ক্ষমতালিন্দু মুসলিম আমীরেরা মুসলিম রাজ্যগুলোকে টুকরো টুকরো করে পরস্পর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিজেদের অমিয় শক্তি ক্ষয়ে লিপ্ত।

পেশোয়ার, লাহোর ও রাটাভায় সুলতানের গোয়েন্দারা জীবনবাজি রেখে রাজা-মহারাজাদের প্রতিটি পরিকল্পনা ও কার্যক্রম যথাসময়ে সুলতানকে অবহিত করছিল। তাদের ত্যাগ, বীরত্ব, সাহস ও দায়িত্ববোধের পরাকাষ্ঠা আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। এরা ছিল গুমনাম আত্মপরিচয় গোপনকারী ছদ্মবেশী- যারা কর্তব্য পালনের স্বার্থে নিজেদের নাম পর্যন্ত বদলে ফেলত। কিন্তু এদের অমূল্য অবদানকে ম্লান করে দিচ্ছিল হাতেগোনা কিছু সংখ্যক বেঈমান।

সুবক্তগীন রণক্লান্ত সৈনিকদের অবকাশ ও নিজেও কিছুটা বিশ্রামের জন্যে নিশাপুর থেকে বলখ চলে গেলেন। এরই মধ্যে তিনি নতুন সৈন্য ভর্তি ও সংগ্রহ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু লাগাতার যুদ্ধ আর প্রশাসনিক কাজের মধ্যে ডুবে থাকায় নিজের শরীর ও স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টি দেয়ার অবকাশ তার হয়নি। ইতোমধ্যে বার্ধক্য ও রোগ তার শরীরে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। চিকিৎসকরা তাকে দীর্ঘ বিশ্রামের পরামর্শ দিলেন। চিকিৎসকরা তাকে যতো দ্রুত সম্ভব সুস্থ করে তুলতে চেষ্টা করছিলেন। অপরদিকে অসুস্থতা তার চেয়েও বেশি দ্রুত বেগে বাড়তে শুরু করল। এক পর্যায়ে তিনি গজনী চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং গজনীর উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। কিন্তু পথিমধ্যে তাকে যাত্রা বিরতি করতে হলো। তার পক্ষে আর পথচলা সম্ভব হলো না। একদিন সুলতান সুবক্তগীন শাইখ আবুল ফাতাহকে অসুখের প্রচণ্ডতায় বলছিলেন, “আমরা অসুস্থ হলে সুস্থ হওয়ার জন্যে চিকিৎসা করি, এক সময় সুস্থও হই। আবার অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হই, আবার চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হই। কিন্তু একদিন এমন আসে যখন আর সুস্থতা ফিরে আসে না। দুনিয়ার কোন চিকিৎসাই মৃত্যু থেকে মানুষকে রেহাই দিতে পারে না। কসাইরা যেমন খুব যত্ন করে খাসিকে ঘাস-পানি দেয়। খাসি কসাইয়ের আদর-যত্নে ভাবতে থাকে, সে চরিদিনই এমন আদর-যত্নেই থাকবে। কিন্তু হঠাৎ কসাই খাসির গলায় ছুরি চালিয়ে নিমিষে তার সকল আদর-যত্নের অবসান ঘটায়। মৃত্যুও কসাইয়ের মতো। যতো আরাম-আয়েশেই আমরা এখন থাকি না কেন, একদিন এই নির্মম মৃত্যু আমাদের জীবন কেড়ে নেবে, মৃত্যু থেকে কারো রেহাই নেই।” সমকালীন বুযুর্গ শাইখ আবুল ফাতাহকে একথা বলার ঠিক চল্লিশ দিন পর হঠাৎ সুলতানের অসুখ খুব বেড়ে গেল। তিনি কিছু বলার জন্য চোখের ইশারায় নির্ভরযোগ্য লোক খুঁজছিলেন, তার বাকশক্তি রহিত হয়ে আসছিল। নিরাপত্তারক্ষীর কমান্ডার তার সামনে এগিয়ে গেলে তিনি বলেন, “মাহমূদকে বলবে, তোমাকে মূর্তিসংহারী হতে হবে। তাকে কর্তব্য ও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হবে।” একথা বলে তিনি নীরব হয়ে গেলেন। পরক্ষণেই তাঁর দেহ নিথর হয়ে গেল। মৃত্যুবরণ করলেন, সুবক্তগীন।

সময়টি ছিল ৯৯৭ সালের আগস্ট মোতাবেক ৩৮৭ হিজরী সনের শাবান। ৫৬ বছর বয়সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন সুলতান সুবক্তগীন। ছিন্নমূল যাযাবর পুত্র, দাসের হাটে বিক্রিত গোলাম ইসলামি ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করে, মূর্তিসংহারী বিশ্বখ্যাত সন্তান জীবন্ত কীর্তি রেখে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন। ইতিহাস তাকে চিরদিন সত্যের পূজারী ও মিথ্যার বিরুদ্ধে অকুতোভয় বীর যোদ্ধা হিসেবে স্মরণ করবে।

মাহমূদ পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনে পিতার শিয়রে হাজির হলেন। মৃতদেহ নিয়ে গেলেন গজনী। সেখানে কাফন ও জানাযা শেষে তাকে কবরে সমাহিত করলেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুতে তাকেই কাঁধে তুলে নিতে হলো রাজ্যপাটের গুরুদায়িত্ব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *