মহাস্থবির জাতক – প্ৰথম পৰ্ব
বর্ষার রাত্রি, তায় অনিদ্রারোগ–মণিকাঞ্চনযোগ যাকে বলে। নিদ্রার বিরহে বিছানায় পড়ে এপাশ-ওপাশ করে প্রায় পাঁচ-সাত মাইল গড়িয়েও ঘুমের দর্শন যখন পেলুম না, তখন অভিমানে শয্যা ত্যাগ করলুম।
সন্ধ্যায় রেডিওতে ঘোষণা করেছে–রবীন্দ্রনাথের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তখন থেকেই মাথার মধ্যে বারে-বারে এই কথাগুলোই ঘা দিচ্ছে। শ্রাবণ মাসে, শুক্লাত্রয়োদশীর রাত্রি, সামনেই ঝুলন-পূর্ণিমা। কবিপ্রয়াণের উপযুক্ত সময় বটে। এবার কি কবি, তবে সত্যিই চললে?
ছাতে বেরিয়ে পড়লুম। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত ছাতে পায়চারি করতে আরম্ভ করে দিলুম। মাথার মধ্যে চিন্তাকীটগুলো যেন ক্রমেই নির্জীব হয়ে আসছে।
সামনেই ছাতের এক কোণে যে ঘর, তার মধ্যে আমার স্ত্রী-কন্যারা শুয়ে আছে–দরজা-জানলা হাট করে খোলা। আমরা ছেলেবেলায় শুনতুম, রাত্রে দরজা-জানলা খুলে শুলে সান্নিপাতিক হয়। আমার সন্তানেরা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে আর বইয়ে পড়েছে, দরজা-জানলা না খুলে শুলে যক্ষ্মা প্রভৃতি রোগ হবার সম্ভাবনা। ফলে আমার ঘরে রাত্রে দুয়ার-জানালা বন্ধ আর তাদের খোলা–অথচ উভয় পক্ষই বেশ সুস্থ।
চিন্তার চক্র ঘুরে চলেছে–ঘর্ঘর–ঘর্ঘর। সন্ধেবেলা রেডিওতে খবর দিয়েছে–কবি অচৈতন্য; কথা বন্ধ।
কবি, এবার কি ‘পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ মর্ত্য-জন্ম-শিখা’ সত্যিই নিবল?
ধীরে ধীরে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালুম। ভেতরে যারা শুয়ে আছে, কে তারা? তারা আমার আপনার লোক। কিরকম আপনার?
মনে হতে লাগল, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আপন গৃহকোণে যাদের আপনার বলে পেয়েছিলুম,-–বাবা মা, আজ দুজনেই তাঁরা যবনিকার অন্তরালে। তিন ভাইয়ে একসঙ্গে মানুষ হয়েছিলুম, –বড় ভাই আজ পঁয়ত্রিশ বছর হল বিদেশে গিয়েছে, সেই থেকে তার সঙ্গে আর দেখা নেই। আমার ছোট যে, সে আজ সাতাশ বছর আগে ওপারে যাত্রা করেছে। আরও ভাই বোন যারা, তারা আমার চেয়ে অনেক ছোট। সংসার-পথে চলতে চলতে পথের মাঝে নিবিড় সঙ্গ দিয়ে যারা আমার জীবনকে মধুময় করেছে, পথের বাঁকে-বাঁকে তাদের অনেকেই বিদায় নিয়েছে। যারা আজও জীবিত, তাদের মধ্যে দু’একটি ছাড়া সকলের সঙ্গেই অন্তরের বন্ধন শিথিল হয়েছে।
আকাশে মেঘ ঘনিয়ে উঠছে। তারই সমারোহে শুক্লাত্রয়োদশীর জ্যোৎস্না ম্লান হয়ে এল। চলন্ত মেঘখণ্ডগুলো দেখে মনে হচ্ছে, যেন তারা নিঃশব্দে ছুটে চলেছে কবিপ্রয়াণ দেখতে।
সেই স্তিমিত চন্দ্রালোকে, রাত্রিশেষে ছাতের ওপরে দাঁড়িয়ে জীবনে আবার একবার আপন সত্তায় অনুভব করলুম, পৃথিবীতে আমি একাকী।
বছর দশ-বারো আগে আমার একবার অসুখ করেছিল। তেমন বাড়াবাড়ি অসুখ নয়, দিনের মধ্যে মাত্র একবার প্রাণপাখি খাঁচা ছাড়া হবার চেষ্টা করত। ডাক্তার কবিরাজ এলে আমার মা চেঁচামেচি করতে থাকতেন। কেঁদে তাঁদের হাতে পায়ে ধরতেন। তাঁর সোনার চাঁদ ছেলের প্রাণ তাঁদেরই হাতে রয়েছে, তাঁরা দয়া করলেই সে বেঁচে যাবে।
এই সময়ে একদিন মাকে ডেকে বলেছিলুম, মরণেই যদি আমায় টেনে থাকে, তবে ডাক্তার কবিরাজ কেউ কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু দোহাই তোমার, থেকে থেকে অমন চিৎকার পেড়ে কেঁদো না মা, আমায় শান্তিতে মরতে দাও।
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁর মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু অসুখের মধ্যে আর তাঁর কান্নার শব্দ আমার কানে পৌঁছয়নি।
আজ সংসারের শত ঝঞ্ঝার মধ্যে মনে হয়, যদি সে কণ্ঠস্বর একবার শুনতে পাই!
মাথার ওপরে পুঞ্জে পুঞ্জে মেঘ এসে জমেছে। কিসের বেদনায় তারা ফুলে ফুলে গুমরে গুমরে উঠছে? শুক্লাত্রয়োদশীর রাত্রি অমাবস্যার অন্ধকারে ঘিরে ফেলেছে কেন? আকাশের দিকে জিজ্ঞাসু হয়ে চেয়ে আছি। কি সর্বনাশ লুকিয়ে আছে ওই নীল রহস্যের মধ্যে?
হঠাৎ বহুদিনবিস্মৃত এক শিশুকণ্ঠের তীব্র চিৎকারে চমকে উঠলুম, দেখ না মা, স্থরে কি করছে!
কার কণ্ঠস্বর এ? স্তম্ভিত বিস্ময়ে আকুল হয়ে আমি ছাতের চারিদিকে খুঁজে বেড়াতে লাগলুম–কোথায়, কোথায় রে তুই? আমার চেতনাকে রুদ্ধ করে কালচক্র যেন মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে আবার বিপরীত দিকে আবর্তিত হতে লাগল। হু-হু করে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বৎসর অতীতে এসে চক্র থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কণ্ঠস্বরে আবার চেতনার দ্বার উন্মুক্ত হল–কি করছিস স্থরে? কেন ওকে জ্বালাতন করছিস?
ক্রিশ্চান ঊনবিংশ শতাব্দী প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের হীরক জুবিলি হয়ে গেছে। বৎসরের শেষ দিনের শেষ রাত্রি।
কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের ওপরে একখানা নীচু-গোছের দোতলা বাড়ির একটা ঘর। ঘরের এক কোণে দুটি ছেলে দাঁড়িয়ে। অঙ্গে তাদের গরম নিকার-বোকার সুট, মাথায় অদ্ভুত টুপি। পায়ে ভীষণ কুটকুটে গরম ফুল-মোজা, তার ওপরে বুট-জুতো। কেল্লার বাজারের মুচিকে ফরমায়েশ দিয়ে সে জুতো তৈরি। স্থবিরের বয়েস ছয় আর অস্থিরের বয়েস চার বছর। সেই ভোর-রাত্রে তারা সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে আছে কাল পয়লা জানুয়ারির সকালে গড়ের মাঠে সৈন্যদের কুচকাওয়াজ হবে, আর সঙ্গে সঙ্গে হবে কৃত্রিম যুদ্ধ, তাই দেখতে যাবার আয়োজন চলেছে।
ওদিকে বিছানার ওপরে এদের বড় ভাই স্থির সাজসজ্জা করছে। স্থিরের বয়েস ন বছর। তার পছন্দ-অপছন্দ কিছু প্রবল, তাই নিয়ে মায়ের সঙ্গে বচসা চলেছে। মধ্যে মধ্যে চড়-চাপড়ও চলছে।
কুটকুটে মোজা পরতে স্থির প্রবল আপত্তি জানালে। তাদের মা হাল ছেড়ে দিয়ে স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, ওগো, দেখ, তোমার বড় ছেলে মোজা পরতে চাইছে না।
ছেলেদের বাপ মহাদেব শর্মা দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ পুরুষ। ঘরের এক কোণে হিসের হ্যারিকেন লণ্ঠনের ওপরে একটা বড় কাঁসার বাটিতে দুধ গরম করবার চেষ্টা করছিলেন। স্ত্রী-র আওয়াজে ঘাড় ফিরিয়ে স্থিরের দিকে ফিরে বললেন, বছরের প্রথম দিনেই মার খাবে স্থির? মনে রেখো, একেবারে খুন করে ফেলব।
স্থির বিনাবাক্যব্যয়ে কুটকুটে মোজার ভেতরে সোজা পা ঢুকিয়ে দিলে।
দুধটা যথোচিত গরম হয়েছে কি না বোঝবার জন্যে মহাদেব ডান হাতের তর্জনীটা বাটির মধ্যে ডুবিয়ে দেখে স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, এমন হতভাগা ছেলে আমার কেন হল বুঝতে পারি না। ওই তো স্থবির রয়েছে, অস্থির রয়েছে, ওদের দেখ। কোথায় তোমাকে দেখে ওরা শিখবে, না, তুমি শিখবে ওদের কাছে!
কাল স্থবিরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সন্ধেবেলা সামান্য একটু উৎসবের আয়োজন হয়েছিল। তারই অবশিষ্ট গোটাকয়েক কমলালেবু ও সন্দেশ রাখা হয়েছিল। এবার ছেলেদের মা তাদের হাতে একটা করে সন্দেশ ও কমলা দিলেন। সন্দেশগুলো যে যার মুখে টপাটপ পুরে দিলে, কমলা তখুনি খাওয়া বারণ। ফেরবার সময় যখন গলা শুকিয়ে উঠবে, তখন খাওয়া হবে।
ইতিমধ্যে অস্থিরের কমলাটি স্থবির নিজের পকেটে পুরে ফেলেছে। অস্থির দু-একবার চেষ্টা করে স্থবিরের কাছ থেকে সেটা আদায় করতে না পেরে মার কাছে আপিল করলে, দেখ না মা, স্থরে কি করছে!
স্থবির তাড়াতাড়ি কমলাটা অস্থিরের পকেটে গুঁজে দেবার চেষ্টা করতে লাগল।
মা ঘাড় ফিরিয়ে এ দৃশ্য দেখে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছিলেন। তিনি ধমক দিয়ে উঠলেন, এই স্থরে, কি হচ্ছে?
তারপর স্বামীর দিকে ফিরে বলতে লাগলেন, নাঃ, এ ছেলেটাও নষ্ট হয়ে গেল দেখছি। বড়টার দেখাদেখি ছোটরাও তো শিখবে! আমার যেমন বরাত।
মহাদেব গরম দুধের বাটিটা তখন সবেমাত্র হ্যারিকেনের চূড়া থেকে ঠন করে মাটিতে নামিয়ে পাখির ডানা-ঝাড়ার মতন হাত ঝাড়ছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনে একবার রোষষায়িত লোচনে স্থিরের দিকে চাইলেন। বেশ বোঝা গেল, বাটির উষ্ণতার কিছু অংশ তাঁর মেজাজেও সঞ্চারিত হয়েছে।
পিতার স্থির দৃষ্টির আঘাতে স্থির অস্থির হয়ে উঠল। করুণ চোখে স্থবির ও অস্থির একবার বাবার দিকে চাইতে লাগল। এক মুহূর্ত পরেই যে ব্যাপার ঘটবে, এই বয়সেই তিন ভাইয়েরই তার অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু ফাঁড়াকেটে গেল। মহাদেব আর কিছু না বলে ঘাড় হেঁট করে তিনটে বাটিতে সমান ভাগে দুধ ঢালতে লাগলেন।
মা বললেন, নাও খেয়ে নাও।
তিন ভাই এগিয়ে এল। পিতা তাদের হাতে একে একে দুধের বাটি তুলে দিলেন।
তারপরে সুপসাপ হুসহাস শব্দ করে চুমুকের কনসার্ট শুরু হল।
জামা পরতে পরতে মহাদেব হুঙ্কার ছাড়লেন, কিসের এত আওয়াজ হচ্ছে? কতদিন বলে দিয়েছি না, খাবার সময় শব্দ করবে না–মনে থাকে না?
তারপর স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, এত অবাধ্য এরা কেন হল বল তো?
স্থির মনে মনে ত্রস্ত হতে লাগল। এর পরের তালটা নিশ্চয়ই তারই ওপর পড়বে, সে সবার অগোচরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রাস্তা। তখনও গ্যাসের আলো নিবানো হয়নি, ট্রামও চলতে আরম্ভ করেনি। শীতের শেষরাত্রি, হু-হু করে উত্তুরে বাতাস বইছে। নির্জন পথ। চার বাপ-ব্যাটার পায়ের আওয়াজে রাস্তা গমগম করছে। থেকে থেকে মহাদেব ছেলেদের উপদেশ দিচ্ছেন। তাঁর যেমন বিশাল দেহ, তেমনই কণ্ঠস্বর। আস্তে কথা বলা তাঁর ধাতে সয় না।
পেন্টুলানের দুই পকেটের মধ্যে হাত ঠেসে দিয়ে ছেলেরা চলেছে। মহাদেব বলতে আরম্ভ করলেন, আজ এই নতুন বছরের সকালে প্রতিজ্ঞা কর–আমরা ভালো ছেলে হব, ভালো করে লেখাপড়া শিখব, কখনও মিথ্যে কথা বলব না।
একটু চুপ করে থেকে আবার বলতে লাগলেন, স্থির, এ বছর তোমার পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি। আসছে বছর ফার্স্ট হতে হবে, বুঝলে?
অতি ক্ষীণস্বরে স্থির বললে, হ্যাঁ বাবা।
আবার কিছুক্ষণ সকলে চুপচাপ চলতে লাগল। তাদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া রাস্তায় আর কোনো শব্দ নেই। রাস্তার গ্যাসের আলো একে একে নিবতে লাগল। চলতে চলতে ডান দিকের একটা বাড়ি দেখিয়ে মহাদেব বললেন, এই বাড়িটা চেন?
তিন জোড়া শিশুচক্ষু রাত্রির অন্ধকার ও বড় বড় গাছের আবরণ ভেদ করে খানিকটা সাদা দেওয়াল ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলে না।
মহাদেব আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কি, চেন?
স্থির অন্ধকারে ঘাড় নেড়ে জানালে, না।
মহাদেব বললেন, অন্ধকারে মাথা নেড়ো না। কতদিন বারণ করেছি, কিছুতেই কি তোমার এ অভ্যেস যাবে না? এটা প্রেসিডেন্সি কলেজ। বড় হয়ে তোমাদের এখানে পড়তে হবে। এখানকার মাইনে বারো টাকা।
কিছুক্ষণ কারুর মুখে কোনো কথা নেই, নিঃশব্দে সবাই এগিয়ে চলেছে গড়ের মাঠের দিকে। একটু পরেই ঢং-ঢং শব্দ করতে করতে প্রথম ট্রাম বেরিয়ে গেল। ট্রামে লোক ভরতি, সবাই ‘প্যারেড’ দেখতে চলেছে।
মহাদেব আবার শুরু করলেন, প্রাতঃকালে ঘুম থেকে উঠেই ভগবানের নাম করে পড়তে বসবে। সাতটা-আটটার সময় কিছু খেয়ে নিয়ে আবার পড়বে নটা অবধি। তারপরে স্নান করে খেয়ে ইস্কুলে যাবে। ইস্কুল থেকে ফিরে হাতের লেখা লিখবে আর অঙ্ক কষবে সন্ধে অবধি। তারপর আমি আপিস থেকে ফিরে যে উপাসনা করি, সেই উপাসনায় বসে ভগবানের নাম করবে। তারপর পড়বে সেই সাড়ে নটার তোপ পড়া পর্যন্ত। তারপরে খেয়ে-দেয়ে ভগবানের নাম করে শুয়ে পড়বে।
স্থিরের বয়স নয়, স্থবির কাল পাঁচ পূর্ণ হয়ে ছয়ে পড়েছে, আর অস্থিরের চার চলেছে।
চলতে চলতে প্রায় ফরসা হয়ে এল, কিন্তু কুয়াশায় তখনও স্পষ্ট কিছুই দেখা যায় না।
মহাদেব বললেন, মনে বড় সাধ ছিল, ভালো করে লেখাপড়া শিখব, কিন্তু ছেলেবেলায় বাপ-মা মারা গেলেন, কত চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলুম না।
মহাদেবের কণ্ঠস্বর শীতের কুয়াশার চেয়েও ভারী। স্থবির একবার আড়চোখে পিতার গম্ভীর বিষণ্ণ মুখের দিকে চাইলে। সহানুভূতিতে তার বুকের মধ্যে মোচড় দিতে লাগল। পাশেই অস্থির চলছিল। সে খুব আস্তে তাকে বললে, একটু এগিয়ে চল।
অস্থির চলতে চলতে হাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রায় দেড় মাইল রাস্তা চলে একটু বিশ্রামের জন্যে আস্তে আস্তে চলছিল। মহাদেব তার অবস্থা দেখে টপ্ করে বাঁ হাত দিয়ে তাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বললেন, মাথাটা ধর।
অস্থির তার ছোট ছোট হাত দিয়ে বাপের মাথাটা জড়িয়ে ধরলে।
স্থবির আর স্থির আগে আগে চলতে লাগল। স্থবির জিজ্ঞাসা করলে, এবার কাতে কাতে যুদ্ধ হবে দাদা?
স্থির বিজ্ঞের মতো বললে, শিখে আর ইংরেজে।
কারা জিতবে?
শিখরা। কেন, গেলবারে দেখিসনি। গেলবারেও তো শিখরাই জিতেছিল।
শিখদের সঙ্গে কেউ পারে না বুঝি?
ইংরেজরা কি লড়াই করতে জানে! সব জুচ্চুরি করে জেতে। এক-একটা শিখের চেহারা দেখেছিস তো?
স্থবির শিখ-সৈন্য দেখেছে। এই বয়সেই নিজের ও ভাইদের জুতো আনার জন্যে বার আষ্টেক সে কেল্লার মধ্যে গিয়েছে। কেল্লার মধ্যে পিরামিডের মতন করে গোল গোলা সাজানো আছে, সারে সারে ছোট বড় কামান সাজানো আছে, মাঠের মধ্যে একটা উঁচু জায়গায় ভরতপুরের যুদ্ধে-জেতা একটা বড় কামান তাও অনেকবার দেখেছে। শিখ-সৈন্যেরা দেখতে ইয়া লম্বা-চওড়া, কিন্তু ইংরেজগুলো বেঁটে বেঁটে। তবুও সেই লালমুখ কটা-কটা চোখওয়ালা লোকগুলোকে দেখলে কি জানি তার বুকের ভেতরটা গুরগুর করতে থাকে। দাদার কাছে শুনেছে, শিখরা বড় ভদ্রলোক, কিন্তু কায়দা করে ইংরেজরা তাদের কাছ থেকে দেশ কেড়ে নিয়েছে। দাদার বয়স এখন ন-বছর, এরও দেড়-দু বছর আগে থাকতেই’ সে এ কথা শুনে আসছে।
চলতে চলতে অস্থির বললে, ইংরেজ-সৈন্যগুলোকে দেখলে কিন্তু ভারী ভয় লাগে দাদা। দূর বোকা! হুঁ, ভয়! সেদিন রাস্তায় একটা সোলজারকে ধরে অ্যায়সা মার দিয়েছি যে, ব্যাটা বুঝতে পেরেছে কার সঙ্গে চালাকি করতে এসেছিল।
স্থবির শিউরে উঠল। দাদা যে একজন মস্ত লায়েক লোক, এ বিষয়ে স্থবির আর অস্থিরের কোনো সন্দেহই কোনোদিন ছিল না। কিন্তু তার লায়েকত্বের মাত্রা কতখানি উঁচু, আজ তার কিছু প্রমাণ পেয়ে অহঙ্কারে তার বুক ফুলে উঠল। এমন একটা সংবাদ অস্থির শুনতে পেল না ভেবে, তার দুঃখ হতে লাগল। সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলে, অস্থির নিশ্চিন্তে বাবার কাঁধে চড়ে পেছনে পেছনে আসছে।
স্থবিরের কল্পনায় নানা ছবি প্রতিভাত হতে লাগল। কি করে দাদাতে আর সেই লালমুখো ইংরেজ-সৈন্যতে ঘুষোঘুষি চলেছিল, সেই ছবি নানা আকারে ফুটে উঠতে লাগল। তাদের তিন ভাইয়ের যে বিনা অনুমতিতে দোতলা থেকে একতলায় নামবার হুকুম নেই, সেই সোলজারের সঙ্গে মারামারির উত্তেজনায় সে কথা সে স্রেফ ভুলেই গেল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ চলবার পর স্থবির জিজ্ঞাসা করল, মারামারিটা কোথায় হয়েছিল দাদা?
স্থির গম্ভীরভাবে বললে, মেছোবাজারের নাম শুনেছিস তো?
খেলো হবার ভয়ে স্থবির বললে, মেছোবাজারের নাম আবার শুনি নি!
বড় ভয়ানক জায়গা। বড় করিমের আখড়া সেখানে। তুই যদি সেখান দিয়ে বুক ফুলিয়ে যাস তো একটি এমন ঘুঁষো মারবে তোর বুকে যে, পিঠ দিয়ে হাত বেরিয়ে যাবে, বুঝলি?
স্থবির চমকে উঠল। ঘুঁষোটা যে কে মারবে, কেন মারবে–সে প্রশ্ন মনের মধ্যে উদয় হবার আগেই সে সংকল্প করে ফেললে, আর যাই করি, মেছোবাজারের মধ্যে দিয়ে বুক ফুলিয়ে কখনও চলা হবে না।
চলতে চলতে স্থির বললে, বাঁটলে বলেছে, আমায় শিগগির বড় করিমের সাগরেদ করে দেবে।
বাঁটলে কে?
আমাদের ক্লাসের একটি ছেলে। নাম হচ্ছে বজ্রবাঁটুল বড়াল। আমরা বাঁটলে বলে ডাকি। তাদের বাড়িতেই আখড়া আছে। কিন্তু সে বড় করিমের সাগরেদ বলে মেছোবাজারে তারই আখড়ায় লড়তে যায়।
স্থবির এবার দাদার মর্দানির কথা ভুলে গিয়ে বজ্রবাঁটুলের কথা ভাবতে লাগল। বজ্রবাঁটুল নামটার মধ্যেই কিরকম জোয়ান-জোয়ান ভাব। এই ব্যক্তি বড় করিমের সাগরেদ আর দাদার বন্ধু! গৌরব, উল্লাস ও শীত–এই ত্রিবিধ উত্তেজনায় তার বুকের মধ্যেটা গুরগুর করতে লাগল।
দাদা যে-ইস্কুলে পড়ে, সেখানে কবে যে সে পৌঁছবে তার কোনো ঠিকানাই নেই। এখনও পর্যন্ত ইস্কুল যে কি বস্তু, তার চাক্ষুষ পরিচয় স্থবিরের হয়নি। দাদা ও দাদার যে-সব বন্ধু তাদের বাড়িতে আসে, তাদের মুখে গল্প শুনে ইস্কুল সম্বন্ধে যতটুকু ধারণা তার হয়েছে, তার সবটুকুই মধুময় নয়। সেখানে বেত্রাঘাত আছে, গলায় ইটের মেডেল আছে, নীল-ডাউন আছে। তবুও ইস্কুলে যারা যায় তারা, এখনও ইস্কুলে যারা যায়নি তাদের চাইতে অনেক উচ্চশ্রেণীর লোক, নিজের সম্বন্ধে খুব উচ্চ ধারণা থাকা সত্ত্বেও মনে মনে সে তা স্বীকার করে।
স্থবির শুনেছে, এবার তাকে ইস্কুলে দেওয়া হবে। তাদের বাড়ির পাশেই ব্রাহ্মদের একটা মেয়ে ইস্কুল আছে, সেখানে ছেলেরাও পড়তে পারে–মেয়েদের মেয়ে বলে চিনতে পারার আগে পর্যন্ত। ছেলেদের একেবারে কঠোর পুরুষ মাস্টারদের জাঁতার মধ্যে ছেড়ে দেবার আগে অনেক ব্রাহ্ম পরিবারের ছেলেদের এইখানেই প্রথম তালিম দেওয়া হত। স্থবিরের দাদা স্থিরও একদিন এই ইস্কুলের ছাত্র ছিল। বছর দুই হল, সে ছেলেদের ইস্কুলে গিয়েছে। ছেলেদের ইস্কুলে যারা পড়ে, মেয়েদের ইস্কুলের ছেলেদের তারা নেহাত নাবালক মনে করে থাকে। স্থবির এখনও মেয়েদের ইস্কুলে ঢোকেনি। মেয়েদের ইস্কুলে কতদিন পড়তে হবে, কে জানে! তারপরে ছেলেদের ইস্কুল, তারপরে বজ্রবাঁটুল বড়ালের মতন বন্ধু, তারপরে বড় করিমের আখড়া ও মেছোবাজারের মধ্যে দিয়ে বুক ফুলিয়ে যাবার অধিকার! ওঃ, সে যে কল্পকাল!
স্থবিরের মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে বললে, আমিও বড় করিমের সাগরেদ হব দাদা।
স্থির অত্যন্ত অবজ্ঞার দৃষ্টিতে একবার স্থবিরের দিকে চেয়ে তার চেয়েও অবজ্ঞার সুরে বললে, তোকে? তোকে এখন সাগরেদ করবে না।
হায় হায়! বছরের প্রথম দিনের সকালবেলায় নকল লড়াই দেখতে যাবার পথে এমন দারুণ দুঃসংবাদ শুনলে কার মন স্থির থাকতে পারে? স্থবিরের কণ্ঠরোধ হয়ে আসতে লাগল। জ্ঞান হয়ে অবধি দাদাকে সে আদর্শ পুরুষ বলে জেনেছে। দাদার মতন বিদ্যা বুদ্ধি, দাদার মতন শৌর্যশালী আজও তার অজ্ঞাত। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রাত্রে শুতে যাবার সময় পর্যন্ত দাদা যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ সে পার্শ্বচরের মতন তার আশেপাশে থাকে। সেদিন ছাদের উপর বসে যখন চিলেকোঠার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাদা গাইছিল–’তুমি মম সুধাসম চিরজীবনে,’ গানের কথার মানে বুঝতে না পারলেও সুরটা তার ভালো লেগেছিল। কিন্তু ভালো লাগলে কি হবে। পরে সে ব্রহ্মসঙ্গীতের প্রত্যেক পাতায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে এ গান তার মধ্যে নেই। ব্রহ্মসঙ্গীতের পাতায় যে গান নেই, সে গান যে অগেয়, অন্তত তাদের বাড়িতে ছাতে বসে যে সে গান গাওয়া গৃহদণ্ডবিধি অনুসারে মহা বিদ্রোহিতার অপরাধ, সে পরমতত্ত্ব জেনেও মাকে সে কথা বলে দেয়নি। এই সব আনুগত্যের প্রমাণ সত্ত্বেও স্থির যখন অতি নির্মমভাবে প্রকাশ করলে যে, তাকে বড় করিমের সাগরেদ করা হবে না, তখন স্থবিরের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে পড়ল।
স্থির একবার ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে বললে, আচ্ছা, আগে আমি সাগরেদ হই, তারপর তোকে নিয়ে যাব। বাড়িতে কিছু বলিসনি যেন।
বছরে প্রথম দিনে স্থবির হাতে স্বর্গ পেল।
.
গড়ের মাঠ। আজ যেখানে কার্জন উদ্যান, সেদিন সেখানে বড় পুকুর ছিল ও সেইখান থেকেই মাঠ শুরু। মনুমেন্টের নীচে অসংখ্য লোকসমাগম হয়েছে। ফরসা হয়ে গেলেও কুয়াশায় সব ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ভিড়ের অধিকাংশই নিম্নশ্রেণীর লোক। আজকাল যেমন নিম্নশ্রেণী ও উচ্চশ্রেণীর মধ্যে সংমিশ্রণ হয়ে গেছে, তখন তা ছিল না। তখনকার দিনে পয়সা রোজগারের মাপকাঠিতে ভদ্রলোক-ছোটলোকদের বিচার হত না। কে যে কোন শ্রেণীর লোক তা একটা পাঁচ বছরের ছেলেও মুখ দেখেই বলে দিতে পারত।
মানুষের চিৎকারে অত শীতেও জায়গাটা গরম হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ লোকই চেঁচাচ্ছে হারানো সঙ্গীদের নাম ধরে। থেকে থেকে হঠাৎ ভিড়ের খানিকটা এক দিকে দৌড়ে আবার থেমে যাচ্ছে। ব্যাপার কি?
স্থবির দেখলে, তিনটে পুলিশ হাজার তিনেক লোকের মাথায় বেপরোয়া রুল মারছে। সেই দৃশ্য দেখে অস্থির কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে। স্থবির বললে, কাঁদিসনি, আমার হাতখানা চেপে ধর।
অস্থির তার ছোট হাত দিয়ে স্থবিরের একখানা হাত প্রাণপণে চেপে ধরলে।
মহাদেব পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, তিনজনে হাত-ধরাধরি করে থাক, নইলে হারিয়ে যাবে। হারিয়ে গেলে পকেটে যে কার্ড আছে, সেই কার্ড পুলিশকে দেখালে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। খবরদার, পুলিশ ছাড়া অন্য কাউকে কার্ড দেখিও না।
কার্ডখানা ঠিক আছে কি না দেখবার জন্যে অস্থির একবার পকেটে হাত দিয়ে দেখলে, কমলালেবুটা তখনও অনাদৃত অবস্থায় পড়ে আছে। পিতার অলক্ষ্যে সেটাকে পকেটেই ছাড়িয়ে ফেলবার ব্যবস্থা করছে, এমন সময় হঠাৎ সেই বিশাল জনসমুদ্র ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। দেখা গেল, লোকেরা জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগ্বিদিকে ছুটতে আরম্ভ করেছে। সে কি দৌড়! দৌড় বলা ঠিক হবে না, লোকগুলো যেন চারদিকে ছিটকে পড়তে লাগল। স্থবিররা তিন ভাই একত্রে এক জায়গায় ঠিকরে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দেখলে, তিন-চারটে ঘোড়সওয়ার পুলিশ সেই বিপুল জনসংঘের ওপর দিয়ে নির্মমভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। সওয়ারদের মধ্যে দুটো লালমুখো আর দুটো দিশি। দিশি সওয়ারদের মধ্যে একজন শিখ আর একজন বোধ হয় পাঠান হবে। তার দুই গালে গালপাট্টা আর ইয়া গোঁফ। এরা দুজনে ভিড়ের ওপরে শুধু ঘোড়া চালিয়ে নিশ্চিন্ত নয়, সেই নিরস্ত্র নিরীহ তামাশা-বিলাসীদের নিদারুণ যষ্টিপ্রহারে জর্জরিত করতে করতে ছুটে আসছে।
স্থবিরের পাশ দিয়েই একটা সওয়ার তীরবেগে বেরিয়ে গেল। তিন ভাই অবাক হয়ে দেখলে, ঘোড়ার নাক-মুখ আর গা দিয়ে হু-হু করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। স্থবির বললে, দাদা, ঘোড়াটার পেটে আগুন লেগেছে।
স্থির বললে, দূর বোকা! এই দেখ, আমার মুখ–আমার মুখ দিয়েও ধোঁয়া বেরুচ্ছে। এই বলে স্থির একবার হাঁ দিতেই তার মুখ দিয়েও ভকভক করে খানিকটা ধোঁয়া বেরুল। এবার স্থবিরও একবার হাঁ দিয়ে দেখলে, তার মুখ দিয়েও ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অস্থিরও একবার দেখলে। তারপর দেখা গেল, মাঠের সেই হাজার হাজার লোকের মুখ দিয়ে হু-হু করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অস্থির বললে, দাদা, সবার মুখেই আগুন লেগেছে।
মুখপোড়াদের দল দৌড়তে দৌড়তে রেড রোড পার হয়ে, এখন যেখানে যুদ্ধের মৃত সৈন্যদের স্মৃতিস্তম্ভ হয়েছে, সেই মাঠে এসে হাঁপাতে লাগল।
এতক্ষণ প্রাণভয়ে ও উত্তেজনায় পিতার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ছেলেরা একেবারেই উদাসীন হয়ে পড়েছিল। সওয়াররা ভিড়কে সেইখান অবধি পৌঁছে দিয়ে যখন চলে গেল, তখন স্থির বললে, বাবা কোথায়?
মহাদেব কাছাকাছি ছিলেন। তিনি ভিড় ঠেলে ছেলেদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার অপরাধে এখুনি হয়তো স্থিরকে বকুনি খেতে হবে, এই আশঙ্কায় স্থবিরের মনটা করুণ হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু সে বাপের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলে, তিনি যেন কিরকম অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন।
মাঠের মধ্যে তখনও ঘন কুয়াশা। দূরে গাছপালা, লাটের বাড়ি কিংবা জাহাজের মাস্তুল কিছুই দেখা যায় না। পূর্বদিকে সূর্য উঠেছে, কিন্তু তার যেন কোনো তেজই নেই। সূর্যকিরণ সেই ঘন কুয়াশার ওপর পড়েছে বটে, কিন্তু তা ভেদ করতে পারছে না; জলের ওপরে তেলের ফোঁটাগুলো যেমন করে ভাসতে থাকে, তেমনই ধোঁয়াটে কুয়াশার মাঝে মাঝে এক-এক জায়গায় খানিকটা করে আলো ভাসছে মাত্র।
ভিড়ের মধ্যে নানা আকারের, নানা শ্রেণীর, নানা বয়সের লোক, তার মধ্যে লম্বা ওভারকোটওয়ালা থেকে আরম্ভ করে লেংটি-পরা লোক পর্যন্ত। প্রায় সকলেই চিৎকার করছে, অধিকাংশই হারানো সঙ্গীদের নাম ধরে–বাংলা, ওড়িয়া, মেছোবাজারি উর্দু এবং গয়া ও ছাপরা জেলার হিন্দি মিলিয়ে বিচিত্র সে কলরব!
স্থির, স্থবির ও অস্থির যে জায়গাটাতে এসে দাঁড়াল, তারই কাছে পাঁচ-ছজন লোক উবু হয়ে বসে বিড়ি ফুঁকছিল, আর যাকে কাঁচা খিস্তি বলে তাই ছোটাচ্ছিল। স্থির, স্থবির ও অস্থির তিনজনেরই সে ভাষা অজ্ঞাত। তবু যৌনবিজ্ঞানের পরমতথ্যপূর্ণ সেই রহস্যময় বাক্যগুলি শিশুমনের সহজাত আকর্ষণে তাদের মনে একেবারে মুদ্রিত হয়ে যেতে লাগল। সেই কথাগুলো শুনতে শুনতে স্থির ও স্থবিরের মনে একটা নতুন চেতনার ইঙ্গিত উঁকি মারতে লাগল। যদিও অজ্ঞান আঁধারে তা মগ্ন, নিষেধ-শাসনের শঙ্কা ও অজানার কঠিন আবরণে আচ্ছন্ন, তবুও সে ইঙ্গিত রহস্যময়।
তিন ভাই একমনে লোকগুলোর কথা গিলছে, এমন সময় ভিড়ের চিৎকার যেন বেড়ে উঠল। কুয়াশার আবছায়ার মধ্যে দিয়ে দূরে দেখা গেল, চার পাঁচজন সওয়ার সেই ভিড়ের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। ভিড়ের মধ্যে সওয়ারেরা ঢুকে পড়তেই লোকে দিগ্বিদিকে ছুটোছুটি করতে আরম্ভ করে দিলে। সওয়ারদের হাতে এক-এক গাছা করে বেতের খেঁটে, আর তারা ঘোড়ার ওপর বসে সেই ফেঁটে দিয়ে সজোরে মারতে মারতে সেই বিশাল ভিড় তাড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে লাগল। প্রায় দশ হাজার লোকের ভিড়–সওয়ার পুলিশ বোধ হয় সর্বসমেত পাঁচটা। তার মধ্যে একজন গোরা আর বাকি চারটে দিশি লোক। স্থবির অবাক হয়ে দেখলে, দিশি সওয়ারেরাই মারছে, তারা একজনও বাঙালি নয়, গোরা-সওয়ার পেছনে পেছনে আসছে মাত্র।
মধ্যে মধ্যে কতকগুলো লোক আনমনায় তাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ামাত্র তারা ঘোড়া ছুটিয়ে তাদের কাছে গিয়ে নির্দয় প্রহারের তাড়নায় ভিড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে লাগল। তারপরে সেই বিশাল জনসাগর এগিয়ে চলতে লাগল, পেছনে ও পাশে তাদের পাঁচটি সওয়ার পুলিশ, কুকুর যেমন করে পালে পালে মেষ তাড়িয়ে নিয়ে চলে, একটিকেও যূথভ্রষ্ট হতে না দিয়ে।
মহাদেব কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে ঢুকলেন না। সওয়ারদের কাণ্ড দেখেই তিনি ছেলেদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, এইখানে দাঁড়িয়ে থাক, এক পা নড়বে না।
স্থির ও স্থবির বাপের দু-পাশে দাঁড়াল। অস্থিরকে তিনি নিজের কাছে টেনে নিলেন। তাদের চোখের সামনে সেই প্রহৃত ও তাড়িত নরসমুদ্র দূর হতে ক্রমেই দূরতর হতে লাগল। ক্ৰমে তারা আবার রেড রোড পেরিয়ে ওপারে চলে গেল। তারপর সমস্ত ছবিখানার ওপর ধূসর কুয়াশার আবরণ পড়ে গেল।
জনশূন্য সেই ময়দানে মহাদেব তিন ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন–স্থির পাথরের মূর্তির মতন। ওই যে জনসমুদ্র পশুর মতো তাড়িত হতে হতে চোখের সামনে মিলিয়ে গেল, তিনি যেন তাদেরই অন্তরাত্মা। তিনি যেন এই লাঞ্ছিত, প্রহৃত, অপমান বোঝবার ক্ষমতা পর্যন্ত অপহৃত পশুমনোভাবাপন্ন মানবকুলের মূর্তিমান প্রতিবাদের মতন অটল হয়ে সেইখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্থবির একবার স্থিরের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে, তার অত বড় পালোয়ান এবং সর্ববিদ্যাবিশারদ বজ্রবাঁটুল বড়ালের বন্ধু ন-বছরের দাদার মুখ কিসের চিন্তায় যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। একবার আড়চোখে বাপের দিকে চেয়ে দেখলে, পিতার গৌরবর্ণ মুখের ওপর বালসূর্যের কিরণ পড়ে টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রশস্ত ললাটের বাঁ দিকে একটা একআঙুল চওড়া কাটা দাগ–ঠিক ভ্রূর নীচ থেকে আরম্ভ করে সোজা মাথার ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে। তাঁর স্বভাববিষণ্ণ গম্ভীর মুখ কি যেন একটা গভীর বেদনায় কাতর।
কিছুক্ষণ সেই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর মহাদেব অস্থিরকে কোলে তুলে নিয়ে ছোট্ট একটি কথায় বললেন, চল।
লোকের ভিড়কে যে দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মহাদেব সেই দিক লক্ষ্য করে চললেন। প্রায় দশ মিনিট মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে তারা আর একটা মাঠে গিয়ে পৌঁছল। এখানে বিষম ভিড়, এইখানে তামাশা দেখানো হবে।
স্থির আর অস্থির হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, যুদ্ধ আরম্ভ হয়নি তাহলে!
একটা মস্ত জায়গা দড়ি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। দড়ির চারদিকে মানুষ দাঁড়িয়ে। কুয়াশা কেটে যাওয়ায় সব বেশ ভালো করে দেখা যাচ্ছে। মহাদেব ঘুরে ঘুরে অপেক্ষাকৃত একটু ফাঁকা জায়গা আবিষ্কার করে বয়সের তারতম্য ও উচ্চতা অনুসারে আগে অস্থির, তারপর স্থবির ও পরে স্থিরকে দাঁড় করিয়ে সবার পেছনে তিনি আড়াল করে দাঁড়ালেন, ধাক্কা সামলাবার জন্যে।
তখনও চারদিক থেকে দলে দলে পালে পালে লোক আসছে। দেখতে দেখতে মহাদেবের পেছনে আরও তিন-চার থাক লোক দাঁড়িয়ে গেল। লোকের ধাক্কাধাক্কিতে লাইন ঠিক রাখা মুশকিল। পেছন থেকে মাঝে মাঝে আচমকা এমন এক-একটা ঢেউ আসে, যার ঠেলা সামনের লোকেরা সামলাতে না পেরে দড়ির ও-দিকে অর্থাৎ ঘেরা জায়গার মধ্যে গিয়ে পড়তে থাকে। দড়ির ও-ধারে দিশি কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছিল। তারা ছুটে এসে ছিটকে-পড়া লোকদের রুলের আঘাতে জর্জরিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাতৃকুলের ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে লাগল। কথায় যদি বংশবৃদ্ধি হ’ত, তা হলে বৎসরের প্রথম দিনের প্রভাতে এই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কলকাতার লোকসংখ্যা বোধ হয় দ্বিগুণ হয়ে যেত।
ওদিকে মাঠের মধ্যে তখন মহাব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে। খচ্চরবাহিত কামান-গাড়ি ঝমঝম
আওয়াজ করতে করতে এসে একদিকে সারবন্দী হয়ে দাঁড়াতে লাগল। দলে দলে জঙ্গী গোরা ও ঘোড়সওয়ার ব্যস্তভাবে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে আরম্ভ করে দিল। তাদের দেখে স্থবিরের মনে হতে লাগল, আসল যুদ্ধ এখনও লাগেনি, এ বোধ হয় যুদ্ধের আগের ঝগড়াঝাঁটি চলেছে।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, ওই দেখ, তুরুক-সওয়ার আসছে।
দেখা গেল মাঠের এক দিক দিয়ে একদল ঘোড়সওয়ার ছুটে আসছে। স্থবির ভাবতে লাগল, এগুলোকে তুরুক-সওয়ার কেন বলে?
হায় রে তুরুক! তুমি কবে এলে, কখন উড়ুক হয়ে গেলে, তার ওপরে ইতিহাসের অনেক পাতা চাপা পড়ে গেছে, কিন্তু তোমার ভূত এখনও আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে রয়েছে।
হঠাৎ স্থবিরের চোখে পড়ল, যেন একখানা মাঠজোড়া রঙিন ছবি বনবন করে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। কালো কুচকুচে পেন্টুলান, লাল টকটকে কোট, অদ্ভুত এক রকমের টুপি মাথায়, সঙ্গিন-লাগানো বন্দুক উঁচু করে সহস্র পায়ে এগিয়ে আসছে। অপরূপ সে ছবি! সকালের সোনালি রোদ ঝকঝকে কিরিচগুলোর ওপর পড়ে মনে হচ্ছিল, যেন কোন স্বপ্নপুরীর মানুষ তারা, বিদ্যুতের নিশান উড়িয়ে এই পৃথিবীতে নেমে এসেছে।
খুব কাছে আসতে তবে তারা বুঝতে পারলে, সেটা একদল সৈন্য। ঠিক এই রকম পোশাক-পরা গোরা-সৈন্যের একটা রঙিন ছবি তাদের বাড়িতে আছে। স্থবির অস্থিরকে নাড়া দিয়ে বললে, দেখেছিস? ওরা সব সোলজার।
কিছুক্ষণ বাদে ছোটলাট অর্থাৎ তখনকার দিনের লেফটেনান্ট গভর্নর, তার একটু পরে বড়লাট অর্থাৎ গভর্নর জেনারেল বড় বড় ফিটনে চড়ে এল। তারা আসতেই সেই কামানের সারির একটা একটা করে ফুটতে লাগল, দুম্–দাম্।
স্থবির অস্থিরকে বললে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
তাদের সামনেই একেবারে দড়ি ধরে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল, বয়েস তার সাতাশ-আটাশ বছর হবে, বেঁটে আর বেশ ষণ্ডা-গোছের চেহারা। বোধ হয় মাসখানেক আগে তার মাথা কামানো হয়েছিল, এখন আধ ইঞ্চিটাক খোঁচা খোঁচা চুল বেরিয়েছে–এই লোকটা এতক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে খুব মজার মজার কথা বলে লোক হাসাচ্ছিল। স্থবিরের কথা শুনতে পেয়ে সে ভাঙা বাংলায় বললে, যুদ্ধ এখনও শুরু হতে দেরি আছে খোঁকা।
লোকটা এমনভাবে কথাগুলো বললে যে, আশেপাশের লোকগুলো সব হেসে উঠল। স্থবির অপ্রস্তুত হয়ে এমন একটা ভাব দেখাতে লাগল, যেন কথাগুলো তাকে উদ্দেশ করে বলা হয়নি। ঠিক সেই সময় মাঠের মধ্যে চড়চড় করে আওয়াজ হতেই সবাই সেদিকে ফিরে দেখলে যে, গোরা-পল্টনের সার বন্দুক ছুঁড়ছে। গোরাদের বন্দুকের আওয়াজ শেষ হতেই দিশি সৈন্যেরা বন্দুক ছুঁড়ল। তার পরে ফটাফট্ চটাচ দুম্দাম্ শব্দের পাগলা হর্রা শুরু হয়ে গেল।
মাঠের মধ্যেকার এই মহাযুদ্ধ দর্শকের প্রাণেও অনুপ্রাণিত হতে বিলম্ব হল না। হঠাৎ তাদের মধ্যেও ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেল। এই রকম যখন সামনে-পেছনে ভীষণ ঠেলাঠেলি চলছে, সেই সময়ে পেছন থেকে একটা প্রবল ধাক্কা আসায়, সামনের সেই বেঁটে ষণ্ডা লোকটা কিরকমে ছিটকে একেবারে দড়ির ওপারে গিয়ে পড়ল। দড়ির ধারে ধারে ঘুরে যে পাহারাওয়ালা সেখানকার শান্তিরক্ষা করছিল, এই দৃশ্য দেখে সে তিন লাফে সেখানে এসে হাতের রুল দিয়ে লোকটার মাথায় সজোরে ঢাঁই ঢাঁই করে আট-দশ ঘা বসিয়ে দিলে।
নিমেষের মধ্যে সেই বিষম ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়ি থেমে গেল। স্তম্ভিত জনমণ্ডলী নির্বাক বিস্ময়ে সেই পাহারাওয়ালাটার দিকে চেয়ে রইল। ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত প্রদেশের লোক সেই ভিড়ের মধ্যে ছিল–পাঁচ বছরের শিশু থেকে আরম্ভ করে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত ধনী, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, ভদ্রলোক, ছোটলোক, কেরানি, ব্যবসাদার ও অন্য চাকুরে; কারুর মুখ দিয়ে একটা ছোট্ট প্রতিবাদ–একটু সহানুভূতির ভাষা বেরুল না।
এই অত্যাচারের মধ্যেই বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের বীজ প্রোথিত হয়ে ছিল।
মার খাবার সময় লোকটার মুখে যে যন্ত্রণার রেখা ফুটে উঠল, স্থবির চারিদিকে চেয়ে দেখলে, অনেকের মুখেই সেই যাতনার প্রতিবিম্ব পড়েছে। একবার পেছনে ফিরে দেখলে, স্থিরের চোখ দুটো ছলছল করছে।
মানুষ মানুষকে মারছে–এ দৃশ্য স্থবিরের চোখে নতুন নয়। তার বাবা তো প্রায় প্রতিদিনই স্থিরকে মারেন। পাঁচ বছর জীবনের মধ্যে সেও মার খেয়েছে অনেকবার। কিন্তু প্রহারের এমন বীভৎস রূপ ইতিপূর্বে সে দেখেনি। তার মনে হতে লাগল, ওই লোকটার বদলে তার বাবা যদি ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন! এই চিন্তা তার মনকে আঁকড়ে ধরে এমন পীড়া দিতে লাগল যে, সে অস্থির হয়ে উঠল।
বাবার হাতের প্রহারকে সে অত্যন্ত ভয় করত, কিন্তু সেদিন বুঝতে পারলে, পুলিশের মার বাবার মারের চেয়ে অনেক সাংঘাতিক
প্রহৃত লোকটা ওই ভাবে লাঞ্ছিত হয়ে দু-পা পেছিয়ে এসে আবার লাইনবন্দী হয়ে দাঁড়াল। লজ্জায় অপমানে সে আর কারুর দিকে না চেয়ে মাঠের দিকে চেয়ে রইল। মিনিটখানেক এই ভাবে কাটবার পর ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন লোক চেঁচিয়ে তাকে বললে, এই, তোমার মাথা ফেটে গেছে, রক্ত পড়ছে যে!
সবার দৃষ্টি একসঙ্গে গিয়ে পড়ল তার মাথার ওপরে। দেখা গেল, তার দুই কাঁধ আর ঘাড়ের কাছে জামাটা রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে। স্থবির দেখলে, তার কানের পাশ দিয়ে রক্তের একটা সরু ধারা নেমে এসে জামার ওপর পড়ছে।
এই দৃশ্য দেখে জনতার মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। এদের মধ্যে যারা অসমসাহসী, তারা সেই কনস্টেবলের অমানুষিক অত্যাচারের ক্ষীণ প্রতিবাদ করতে আরম্ভ করে দিলে। মাঠের মধ্যে তখনও দুমদাম, চড়পড় আওয়াজ চলেছে–হঠাৎ সেই চার-পাঁচ সার মানুষের স্তর ভেদ করে মহাদেব একেবারে সামনে এসে আহত লোকটাকে ধরে চিৎকার করে উঠলেন, এই, কে–কোন পাহারাওয়ালা তোমায় মেরেছে?
পাহারাওয়ালার মারের ধমক তখনও সে সামলে উঠতে পারেনি। তার হয়তো মনে হল, এ লোকটাও বোধ হয় পুলিশেরই লোক। একজন মাথা ফাটিয়ে গেছে, এ বোধ হয় হাতটা-পাটা ভেঙে দেবে।
মহাদেব আবার চিৎকার করে উঠলেন, কে মেরেছে, বল?
ইতিমধ্যে যে পাহারাওয়ালাটা মেরেছিল, বীরদর্পে পা ফেলতে ফেলতে সে সেখানে এসে দাঁড়াল। আহত লোকটা কাঁপতে কাঁপতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে ওই লোকটা মেরেছে।
পাহারাওয়ালা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ধমকে জিজ্ঞাসা করলে, কি হয়েছে?
মহাদেব তাকে বলতে লাগলেন, তুমি একে মেরেছ? দেখ দিকিন, এর মাথাটা ফেটে গিয়েছে। পুলিশের চাকরি কর বলে কি মানুষের চামড়া তোমার গায়ে নেই! ওর যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে তো ওকে ধরে নিয়ে থানায় যাও, হাকিম আছে, সে সাজা দেবে। তুমি কে হে সাজা দেবার?
পাহারাওয়ালা মহাদেবকে ধমকে উঠল, তুমি কে হে?
প্রশ্ন শুনে মহাদেব একটু হচকিয়ে গেলেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, আমাকে চিনতে পারছ না–আমি তোমার বাবা!
পেছনের লোকেরা হো-হো করে হেসে উঠল। স্থির ও অস্থির-তারা এই বয়সেই বাপকে কিছু কিছু চিনেছিল, তারা হাসতে পারল না। মহাবিপদের সূচনায় তাদের শিশুহৃদয় শঙ্কিত হয়ে উঠল। স্থবিরের মনে হতে লাগল, এই সময় মা যদি কাছে থাকত, তা হলে, এ হাঙ্গামা আর বাধতেই পারত না।
মহাদেবের মুখে ওই কথা, তার ওপরে যে লোকগুলো এতক্ষণ তার দাপটের চোটে কেঁচো হয়ে ছিল, তাদের সেই ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি শুনে পাহারাওয়ালা-পুঙ্গব একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে চিৎকার করে উঠল, কি বললে?
মহাদেব নীচু হয়ে দড়ি গলে বাইরে একেবারে তার সামনে গিয়ে তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন, আমি তোর বাপ। এই নিরপরাধ লোককে এমন নির্দয়ভাবে প্রহার করার জন্যে আমি তোমায় এমন সাজা দোব যে, ‘চিরকাল বাবাকে মনে থাকবে।
এবার আর জনতার মধ্যে হাসির হর্রা উঠল না, ব্যাপারটা ক্রমেই সাংঘাতিক আকার ধারণ করছে দেখে ভিড়ের লোক আস্তে আস্তে সরে পড়তে আরম্ভ করল।
আজকের দিনে বাঙালির চোখে এ ব্যাপারটা অত্যন্ত লজ্জাকর ঠেকতে পারে। কিন্তু ক্রিশ্চান আঠারো শো ছিয়ানব্বই অব্দে কলকাতার নকল যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে পাহারাওয়ালাকে গালাগালি দেওয়া এবং মারতে উদ্যত হওয়া তো দূরের কথা, সে দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখতে পারে এমন লোকও এক লক্ষে একটাও ছিল না।
কথাগুলো বলেই মহাদেব গায়ের র্যাপারখানা খুলে ভিড়ের মধ্যে ফেলে দিতেই স্থির সেখানা লুফে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলে। ওদিকে পাহারাওয়ালাটা ফিরে গজ পঁচিশেক দূরে তার জুড়িদারকে হাঁকলে। জুড়িদার তখন সেদিকে ভিড়ের ওপর রুলের গুঁতো চালিয়ে শান্তিরক্ষার চেষ্টা করছিল। একবার এদিকে চেয়ে আবার সে নিজের কর্তব্যে মন দিলে।
জুড়িদারের মুখ দেখে পাহারাওয়ালার বুকে বোধ হয় সাহস ফিরে এল। সে রুল উঁচিয়ে মহাদেবকে বললে, শুয়োরের বাচ্চা, শিগগির দড়ির ওপারে যাও, নইলে এই রুল দেখছ– মহাদেব এবার জামাটা খুলে মাঠের ওপর ফেলে দিয়ে বললেন, তোমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে–
এই বলে তার হাত থেকে রুলটা টপাস করে কেড়ে নিয়ে বললেন, মাথার পাগড়ি খোল, এর খালি মাথায় যেমন মেরেছ, তেমনই তোমারও খালি মাথায় মারব–যতক্ষণ না রক্ত বেরোয়।
মহাদেবের চুয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতি আর সাড়ে উনিশ ইঞ্চি বাহুর বেড় দেখে পাহারাওয়ালার বাচ্চা স্তম্ভিত হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইল।
মহাদেব চিৎকার করতে লাগলেন, খোল মাথার পাগড়ি। পাগড়ির ওপরে মারলে লাগবে না, তোমার খালি মাথায় মারব–ব্যাটা, মনে করেছ কি? খোল পাগড়ি।
প্রতি নিশ্বাসে তিনি যেন ফুলতে লাগলেন।
পাহারাওয়ালার মুখে বাক্য নেই। রুল ফেলে সে চলেও যেতে পারে না। ততক্ষণে ভিড় অনেক পাতলা হয়ে গেছে; ওদিকে একটু দূরে এমন ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেছে যে, তিন-চারটে পাহারাওয়ালা মিলে ভিড়ের ওপর নিদ্দম রুল পিটেও সামলাতে পারছে না। স্থবির ও অস্থির হাউহাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। স্থির বেচারি বাপের র্যাপারখানা হাতে নিয়ে কাঁদ-কাঁদ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মাঠের মধ্যে দুমদাম ফটাফট্ তো চলেইছে–সব আওয়াজ ছাপিয়ে মহাদেবের গলা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে–খোল পাগড়ি, নিজের হাতে খুলতে হবে। মাথায় রুলের বাড়ি কিরকম লাগে, তা তোমাকে একটু বুঝিয়ে দোব।
এদিকে ভিড় একটু পাতলা হতেই আহত লোকটি বসে পড়েছিল। মহাদেব যখন এই ভাবে চেঁচাচ্ছেন, তারই মধ্যে সে শুয়ে পড়ল। ভিড়ের লোকেরা বলতে লাগল, অজ্ঞান হয়ে গেছে, হাওয়া ছেড়ে দাও, সরে যাও–
কথাগুলো মহাদেবের কানে যেতেই তিনি পেছন ফিরে দাঁড়ালেন। তারপর রুলটা মাটিতে ফেলে, একেবারে সেই লোকটার পাশে গিয়ে বসে পড়লেন। পাহারাওয়ালা-নন্দন ইত্যবসরে তার রুলটা টপ করে তুলে নিয়ে ধীরপদভরে বিপরীত দিকে হনহন করে চলে গেল
মহাদেব বললেন, কেউ দয়া করে একটু জল এনে দিতে পারেন?–লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেছে।
ভিড়ের ভিতর থেকে একজন বললে, এখানে জল কোথায়? ওই পুকুর আছে একটু দূরে। মহাদেব একবার করুণ দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে টপ করে মাটি থেকে জামাটা তুলে কাঁধে ফেললেন। তারপরে ঠিক সেই ভাবেই টপ করে লোকটাকে দু-হাতে তুলে ভিড় ঠেলে ফাঁকায় গিয়ে চিৎকার করে বললেন, স্থির, স্থবির, অস্থির বেরিয়ে এস।
হুকুম পাওয়ামাত্র ছেলেরা ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপরে মহাদেব হু-হু শব্দে ছুটতে আরম্ভ করে দিলেন–ছেলেরা তাঁর পিছু পিছু ছুটতে লাগল।
আজকের বেঙ্গল ক্লাবের সামনে মাঠের মধ্যে যে বড় পুকুর আছে, মহাদেব দৌড়তে দৌড়তে এসে সেখানে লোকটাকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। দৌড়বার সময়, ঝাঁকুনির চোটেই হোক অথবা অন্য কোনো কারণেই হোক, লোকটার ততক্ষণে জ্ঞান ফিরে এসেছিল। তাকে মাটিতে শুইয়ে দিতেই সে ফ্যালফ্যাল করে চাইতে লাগল। মহাদেবের সেদিকে হুঁশই নেই, তিনি তড়বড় করে পাড় দিয়ে জলের দিকে নেমে গেলেন।
ঘাটবিহীন পুকুর, চারদিকেই আঘাটা। গড়ানে পাড় দিয়ে জলের দিকে এগুতে গিয়ে কিরকম করে পা হড়কে মহাদেব একেবারে প্রায় কোমর জলের মধ্যে পড়লেন। তারপরে সে টানাটানি আর ধস্তাধস্তি। পুষ্করিণী পাঁকে পরিপূর্ণ। মহাদেবের দুই পা একেবারে হাঁটু অবধি পাঁকে বসে যাচ্ছে। এক পা তোলেন তো আর এক পা বসে যায়–ভারী শরীর, পাঁকে সামলাতে পারেন না। কিছুক্ষণ আগেই যে লোক ব্রিটিশ গভর্মেন্টের পাহারাওয়ালাকে শায়েস্তা করতে উদ্যত হয়েছিলেন, এক-হাঁটু পাঁকের মধ্যে তাঁর এই আঁকুপাঁকু অসহায় অবস্থা দেখলে করুণার উদ্রেক হয়।
যা হোক, অনেক কষ্টে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে তো তিনি পাড়ে উঠলেন। এক-পাটি জুতো জলের তলাতেই রয়ে গেল। ওদিকে আহত লোকটি ততক্ষণে উঠে বসেছে। মহাদেব কোঁচা নিংড়ে নিংড়ে তার ক্ষতস্থান ধুয়ে দিতে লাগলেন। একেবারে হল না, বার দু-তিন কোঁচা ভিজিয়ে আনতে হল। তারপরে কোঁচাটা ছিঁড়ে ব্যান্ডেজ আরম্ভ হল। সে এক অদ্ভুত ব্যান্ডেজ! একটা চোখের একটুখানি ছাড়া লোকটার কান মাথা মুখ গলা পর্যন্ত সব সেই ব্যান্ডেজে ঢাকা পড়ে গেল।
যা হোক, পঞ্চাশ বার খুলে, ঠিক করে, আবার বেঁধে, আবার খুলে–এই রকমে ঘণ্টাখানেক ধরে ব্যান্ডেজ বাঁধার পালা শেষ করে মহাদেব আবার জলে নামলেন জুতো খুঁজতে। কিন্তু আধ ঘণ্টা ধরে জলের মধ্যে ডুবোডুবি করেও সে পাটির যখন সন্ধান পাওয়া গেল না, তখন তিনি হতাশ হয়ে উঠে পড়লেন। তাঁর মাথা থেকে পা সর্বাঙ্গ কর্দমলিপ্ত, ধুতি যতটুকু অবশিষ্ট আছে তার দ্বারা কোনো রকমেই ভদ্রভাবে লজ্জানিবারণ হয় না।
অত্যন্ত বিষণ্ণ মুখে জামাটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে তিনি কাঁধে ফেলে স্থিরের হাত থেকে র্যাপারটা নিয়ে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে নিলেন। তারপরে সেই কাদালেপ্টানো এক পাটি জুতো হাতে নিয়ে ছেলেদের বললেন, চল।
লোকটা তখনও সেখানে বসে ছিল। দু-পা এগিয়ে গিয়ে মহাদেব আবার তার কাছে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি বাড়ি যেতে পারবে?
ব্যান্ডেজ-মণ্ডিত মুখ তুলে মহাদেবের দিকে কৃতজ্ঞভাবে চেয়ে থেকে সে বললেন, বাবু, তুমি, বড় ভালো লোক। তুমি বাড়ি যাও, আমি একলাই যেতে পারব।
মহাদেব একটু হেসে বললেন, এমন তামাশা আর দেখতে এসো না, বুঝলে?
চৌরঙ্গীর রাস্তা দিয়ে মহাদেব চলেছেন। আবক্ষ কালো দাড়ি কাদা ও জলে প্রায় জটিয়া-বাবা। গায়ে একখানা রুক্ষ কমলালেবু রঙের আলোয়ান, পরনে আধখানা ধুতি, হাতে কাদা-মাখানো এক-পাটি জুতো।-পেছনে তিন ছেলে গটগট করে চলেছে। দুধারের লোক এই অপূর্ব শোভাযাত্রা বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে দেখতে লাগল।
মহাদেবের কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তাঁর দৃষ্টি একেবারে সম্মুখে নিবদ্ধ, মুখে বাক্য নেই, ছেলেদের উপদেশ দেওয়া বন্ধ। তারা পেছনে আছে কি না-আছে, সে জ্ঞানও তাঁর নেই–বন্ করে তিনি এগিয়ে চলেছেন। ছেলেরা তাঁর সঙ্গে সমানে চলতে পারছে না, ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। এমনি করে পিতা ও পুত্রদের মধ্যে ব্যবধান বাড়তে লাগল। তারপর কখন যে তিনি দৃষ্টির আড়ালে জনতার মধ্যে হারিয়ে গেলেন, ছেলেরা তা বুঝতেই পারলে না।
স্থির, স্থবির ও অস্থির তাদের শিশুসামর্থ্যে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি চলেছে। বাপকে দেখতে না পেলেও রাস্তা তাদের চেনা। হঠাৎ স্থবিরের মনে পড়ল, পকেটের কমলালেবুটা তখনও অনাদৃত অবস্থায় পড়ে আছে। টপ করে পকেটের মধ্যে হাত পুরে আধ ছাড়ানো লেবুটা বের করে সে খেতে আরম্ভ করে দিলে।
.
আর এক রাত্রিশেষের কথা। মাঘ মাসের প্রায় মাঝামাঝি, ব্রাহ্মসমাজের উৎসব চলেছে। রাত্রি প্রভাত হলেই ১১ই মাঘ, সাধারণ-ব্রাহ্মসমাজে সমস্তদিনব্যাপী উৎসব। এই এগারোই মাঘ সাধারণ-ব্রাহ্মসমাজের লোকদের বড়দিন। মহাদেব রাত্রি তিনটেয় উঠে উপাসনা সেরে ছেলেদের তুলেছেন। তারা মনে করেছিল, বাবা একলাই ভোরে মন্দিরে চলে যাবেন; কিন্তু তা হয়নি।
মফস্সলের অনেক ব্রাহ্ম-পরিবার এই উৎসব উপলক্ষ্যে কলকাতায় আসেন। এই ১১ই মাঘের দিনটা অনেকেই সারা দিন ও রাত্রের উপাসনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্দির ও মন্দির-প্রাঙ্গণে কাটান। কলকাতাবাসী অনেকেই তাই করেন। এই সময়ে দূর থেকে এমন অনেক ছেলেমেয়ে সেখানে আসে, যাদের বছরের মধ্যে উৎসবের এই দিনগুলি ছাড়া অন্য সময়ে আর আসা হয়ে ওঠে না। এই দিনগুলি ছোট ছেলেমেয়েদের মহা আনন্দের দিন। কত পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, কত মজার কথা, কত রকমের খেলা–শাসনমুক্ত নিরঙ্কুশ সেই দুর্লভ দিন–চণ্ডালের খুলিতে স্বাতী নক্ষত্রের জলের মতন দুর্লভ সেই দিনটির সকাল মন্দিরে বসে উপাসনার জন্য তৈরি হয়নি।
স্থির, স্থবির ও অস্থির তিনজনেই বাপের ডাকে উঠে পড়েছে বটে, কিন্তু বুকের মধ্যে আপত্তির ঘূর্ণিবায়ু মাথা খুঁড়ে মরছে।
মহাদেব ছেলেদের বললেন; উপাসনা সেরে নিয়ে চল, স্নান করে মন্দিরে যেতে হবে।
মাঘ মাসে রাত চারটের সময় এমন কথা শুনলে পৃথিবীর কোন শিশুর মনে ভগবান সম্বন্ধে প্রেমভাব থাকতে পারে! তবুও হুকুম পাওয়ামাত্র তিন ভাই টপ টপ আসনপিঁড়ি হয়ে বসে গেল, তারপর হাত জোড় করে চোখ বুজে ফেললে।
ছেলেদের মা প্রতিবাদ করে বললেন, এই মাঘের শেষরাত্রে বুড়োমানুষে ঠাণ্ডা জল মুখে দিতে পারে না, আর তুমি এই কচি ছেলেগুলোকে নাইয়ে মারবে নাকি?
অন্য দিন হলে এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে লেগে যেত বাক্যের মহাসমর। কিন্তু এগারোই মাঘের প্রাতঃকাল, তার ওপরে মন্দিরে যাবার মুখে স্ত্রীর সঙ্গে একটা ঝগড়া-হাঙ্গামা হয়, এটা মহাদেব চান না। তাই বিশেষ কথা-কাটাকাটি না করে তিনি বললেন, স্নান করে দেহ ও মনে পবিত্র হয়ে ঈশ্বরের উপাসনা-মন্দিরে যাবে-এর শীতকাল গ্রীষ্মকাল নেই।
বাস্! এমন অকাট্য যুক্তির ওপর ছেলেদের মা আর কোনো কথা কইলেন না।
ছেলেরাও কোনো আপত্তি জানালে না। আপত্তি করবার মতন দুঃসাহস তাদের নেই। বাপের মুখ থেকে দ্বিতীয়বার হুকুম বের হওয়ার আগেই ওয়ান–টু–থ্রি–ঠিক ড্রিলের চালে, স্থির, স্থবির ও অস্থির অঙ্গের আবরণ ও লজ্জানিবারণ খুলে ফেলে বিনাবাক্যব্যয়ে কদম্বকণ্টকিত দেহে সুড়সুড় করে চলে গেল একতলার উঠোনের কোণে জলের কলের কাছে। অত রাত্রে বা অত ভোরে কলে জল নেই। হিমঠাণ্ডা চৌবাচ্চার জলে নর্থ-ওয়েস্ট-সোপ-কোম্পানির সাবানের ঘর্ষণে তাদের দেহ পবিত্র হতে লাগল।
স্নান করাতে করাতে মহাদেব ছেলেদের বললেন, তোমরা ব্রাহ্মঘরে জন্মেছ, এজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও।
ছেলেরা মনে মনে ধন্যবাদের ভাষা খুঁজতে লাগল। শিশু তারা, ভাষাজ্ঞান তখনও পরিপক্ক হয়নি।
.
সাধারণ-ব্রাহ্মসমাজ-মন্দির। এগারোই মাঘ উপলক্ষ্যে মন্দিরের ভেতর-বার নানা লতাপাতা ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ভেতরে গ্যাসের বাতি জ্বলছে, সিলিঙে দুটো বড় বড় গ্যাসের ঝাড় জ্বলছে, আর চলেছে খোলকরতালসহ কীর্তন।
মহাদেব তিন ছেলেকে নিয়ে মন্দিরের মধ্যে ঢুকে বেদীর নীচে যেখানে কার্পেট পাতা আছে, তারই এক কোণে গিয়ে বসলেন। তাঁদের আগেও দু-চারটি ব্যাকুলাত্মা এসে স্থান সংগ্রহ করেছেন। সর্বাঙ্গ র্যাপারে মোড়া এক-আধুনিক ধ্যানী-মূর্তির মতন দেখাচ্ছে তাঁদের। কার্পেটের আর এক কোণে কয়েকজন মিলে ভীষণ হুঙ্কারে কীর্তন করছেন, ‘তীক্ষ্ণ বিষব্যালী সম সতত দংশায় রে–’
মহাদেব বসে চক্ষু বুজলেন। তাঁর দেখাদেখি ছেলেরাও চক্ষু বুজল। ঈশ্বর অকৃতজ্ঞ নন, স্নান করবার সময় বিনা কারণে তারা তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল, তিনিও অচিরেই তাদের চোখে ঘুমের প্রলেপ বুলিয়ে ভোরে ওঠার দুঃখ ভুলিয়ে দিলেন।
কতক্ষণ এই ভাবে চলল। ঢুলতে ঢুলতে মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত লাগায় স্থবিরের ঘুম ছুটে গেল। সে দেখল, অস্থিরের মাথাটা ঢুলে একেবারে তার নাকের গোড়ায় এসেছে। অস্থিরের মাথাতেও চোট লেগেছিল। সেও চোখ চেয়ে দেখলে, স্থবিরের মাথাটা তার মাথার সামনে। দুজনে চোখাচোখি হতেই তারা ঘাড় ফিরিয়ে দেখলে, বাপের চোখ কোথায়।
মহাদেব নির্বিকল্প হয়ে চোখ বুজে পিঠ সোজা করে বুক চিতিয়ে বসে আছেন দেখে তারা নিশ্চিন্ত হল বটে, কিন্তু চোখ বুজতে আর সাহস করলে না। কি জানি, বিশ্বাসঘাতক ঘুম ইতিপূর্বে পাঠমন্দিরে অনেক লাঞ্ছনার কারণ হয়েছে, ব্রহ্মমন্দিরে এত লোকের সামনে সে ব্যাপারের পুনরাভিনয় যাতে না হয়, সে বিষয়ে তারা সচেতন হবার চেষ্টা করতে লাগল।
স্থবির চারিদিকে চেয়ে দেখতে লাগল। কীর্তনীয়ার দল ততক্ষণে শ্রান্ত হয়ে যে-যার একটু জায়গা যোগাড় করে র্যাপারে সর্বাঙ্গ ঢেকে ধ্যানস্থ হয়ে বসেছেন। একটু আগেই এই লোকগুলিই যে বিবিধ ভঙ্গীতে বদনব্যাদান ও অস্বাভাবিক হস্তপদ চালনা করে বিষব্যালীর দংশনের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি জানাচ্ছিল, এখন তাদের শান্ত মুখমণ্ডল ও সমাহিত অবস্থা দেখে তা বোঝবার জো নেই। মন্দিরগৃহ লোকে পরিপূর্ণ। গ্যাসের আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। জানলা-দরজা দিয়ে ভোরের মৃদু আলো আসায় ফুলসজ্জায় সজ্জিত মন্দিরগৃহ, দেওয়াল, থাম ও বেদী অপূর্ব শ্রীতে মণ্ডিত হয়ে উঠেছে। কীর্তনীয়াদের কণ্ঠনিঃসৃত সেই গগনভেদী আর্তনাদ স্তব্ধ হওয়ায় সেখানে অপূর্ব গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। সকলেই উন্মুখ আগ্রহে যেন কিসের প্রতীক্ষায় রয়েছে। ব্রাহ্মমুহূর্তে সেই আধ-আলো আধ-অন্ধকারের বুকে হঠাৎ ভৈরবীর সুরধারা নেমে এল করুণার প্রস্রবণের মতন–
“হেরি তব বিমল মুখভাতি
দূর হ’ল গহন দুখ-রাতি।”
‘স্থবির দেখতে পেলে, তাদের একটু দূরে একজন কালো প্রিয়দর্শন যুবক কোকিলকণ্ঠে গান শুরু করেছে। গানের বাচ্যার্থ অথবা ভাবার্থ বোঝবার মতন বয়স বা শিক্ষা তার তখনও হয়নি, তবুও তার মনে হতে লাগল, তীক্ষ্ণ বিষব্যালীর ওপর এ যেন বিশল্যকরণীর প্রলেপ, কোথা থেকে–কোন অদৃশ্যলোক থেকে আসছে যেন আশার বাণী, কি আনন্দের উৎস রয়েছে ভৈরবের ওই ভৃঙ্গারে–রাত্রি চারটের সময় উঠে সেই ঠাণ্ডা জলে স্নান, সকালবেলাকার অমন আড্ডার বদলে বয়স্কদের সঙ্গে মন্দিরের মধ্যে তন্মনস্ক হয়ে বসে ঈশ্বরাধনার কৃচ্ছ্রসাধন বালকের মনে যে বিদ্রোহের ঝড় তুলেছিল, নিমেষে তা অপসারিত হয়ে গেল।
গান শেষ হতেই আচার্য ঢুকলেন মন্দিরে। সাধারণ-ব্রাহ্মসমাজের মুখ্য আচার্য পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী–দীর্ঘকায় শ্যামবর্ণ ব্যক্তি। লম্বা দাড়ির অধিকাংশই পাকা। মাথায় বিরল রুক্ষ কেশ। গায়ে একটা সবুজ রঙের ফ্লানেলের শার্ট। মুখ দেখলেই মনে হয়, সাধারণ লোকের সঙ্গে এঁর যেন কোথায় একটা প্রভেদ রয়েছে। স্থবির শাস্ত্রী মশায়কে চিনত। চলতি কথায় বলতে গেলে, তিনি তাদের কুলগুরু। শাস্ত্রী মশায় তার পিতাকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন; মহাদেবের বিবাহেও তিনি পৌরোহিত্য করেছেন। কিন্তু ব্রাহ্মরা গুরু মানে না, তাই বোধ হয় গুরু না ভেবে তারা তাঁকে গুরুর চাইতে আরও বড় একটা কিছু মনে করত। যাক, শাস্ত্রী মশায় এসে বেদীতে উঠে বসলেন। দু-তিনটি যুবক খাতা পেনসিল নিয়ে বেদীমূলে বসে গেল আচার্যের উপদেশ সঙ্গে সঙ্গে লিখে নেবার জন্যে। শাস্ত্রী মশায় বেদীর ওপরে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে ভাঙা গলায় বললেন, সঙ্গীত।
সঙ্গে সঙ্গে ওপর থেকে বাজনার শব্দ ও তার সঙ্গে গান আরম্ভ হয়ে গেল।
সঙ্গীতান্তে শাস্ত্রী মশায় চিৎকার করে কি সব বলতে আরম্ভ করলেন। সে সব ভালো ভালো কথা, গূঢ় তার অর্থ, নানা অলঙ্কারপূর্ণ সে ভাষা–শিশুর কাছে তা প্রহেলিকা। স্থবিরের মনে হতে লাগল, এ যেন একটা ইস্কুল। বেদীর ওপরে বসে আছেন ওই মাস্টার মশায় — চেঁচিয়ে পাঠ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। চতুর্দিকে এই সব নরনারী, তারা ছাত্র ও ছাত্রীর দল। এ ইস্কুলের ছাত্রছাত্রীকে বোধ হয় ‘নাড়ুগোপাল’ হতে হয় না, গলায় তাদের ইটের মেডেলও ঝোলে না। সে একবার বাপের দিকে চেয়ে নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুজে ফেললে।
পেছনে হেলান দেবার একটু দেওয়াল পাবার ফলে এবারের নিদ্রাটি স্থবিরের বেশ গাঢ়ই হয়েছিল–হঠাৎ কান্নার আওয়াজে তার অমন মনোরম ঘুমটি ছুটে গেল। চোখ চেয়ে সে দেখতে পেল, তার পাশেই একটি বৃদ্ধ হেঁচকি তুলে কাঁদছে আর বিড়বিড় করে কি বলছে!
ব্যাপার স্থবিরের কাছে ভারি অদ্ভুত ঠেকল। সে তার আশপাশে তাকিয়ে দেখলে, আরও দু-তিনজন ভদ্রলোক ওইরকম হেঁচকি তুলে কাঁদতে আরম্ভ করে দিয়েছে। স্থবিরের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে একটি ভদ্রলোক বসে ছিলেন, তাঁকে তারা চিনত। এই লোকটি সমাজের মধ্যে একজন নামজাদা গম্ভীর ও রাশভারী লোক। সে দেখলে, ইনিও নিঃশব্দে অশ্রুবিসর্জন করছেন। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুজলও তাঁর বিশালদাড়ির এখানে সেখানে আটকে নোলকের মতন দুলছে।
এই দৃশ্য দেখে স্থবির স্থির বুঝতে পারলে, ব্যাপারটি বিশেষ সুবিধাজনক নয়। নিশ্চয় কোনো অপরাধের জন্যে শাস্ত্রী মশায় তাঁদের ধমক দিচ্ছেন।
ইতিমধ্যে শাস্ত্রী মশায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওই যে বিহঙ্গ শূন্যপথে মুক্তপক্ষে প্ৰয়াণ করিল—’
স্থবিরের পাশের লোকটি, যিনি এতক্ষণ কান্নার সঙ্গে বিড়বিড় করে বকছিলেন, হঠাৎ তিনি ডাক ছেড়ে ডুকরে উঠলেন, জয় দয়ারাম, জয় দয়াময়–
স্থবির ভাবলে, এবার বোধ হয় শাস্ত্রী মশায় বেদী ছেড়ে নেমে এসে এদের প্রহার আরম্ভ করবেন। সে সন্ত্রস্ত হয়ে র্যাপারখানা টেনে গায়ের সঙ্গে সেঁটে উদ্গ্রীব হয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়, তারই অপেক্ষা করতে লাগল।
কিন্তু শাস্ত্রী মশায় বেদী থেকে নামলেন না। তাঁর চিৎকারের মধ্যে ধমকের সুরটা যেন ক্রমেই কমে আসতে লাগল। ক্রমে তা যেন একেবারে করুণ সুরে এসে পৌঁছল। তাঁর কণ্ঠস্বর ধাপে ধাপে নামতে নামতে শেষে অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।
শিবনাথ শাস্ত্রী স্থবিরের পিতৃগুরু। তিনি যতক্ষণ চিৎকার করে পুরুষোচিত অভিব্যক্তিতে বলে যাচ্ছিলেন, ততক্ষণ তার ভালোই লাগছিল। শুধু যে ভালো লাগছিল তা নয়, তাদেরই শাস্ত্রী মশায় যে এতগুলো লোককে ধমকে কাঁদিয়ে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন, তার মধ্যে নিজেও সে খানিকটা গৌরব অনুভব করছিল। কিন্তু হঠাৎ তাঁরও সুর অনুনয়ের পর্দায় নেমে আসায় তার শিশুচিত্ত শুধু বিহ্বল নয়, কিছু উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ল। স্থবিরের মনে হতে লাগল, কে সে নিষ্ঠুর, কোথায় তার বাড়ি, কেমন ভীষণ তার চেহারা, কত শক্তি সে ধরে, যাকে এমনভাবে অনুনয় করা হচ্ছে, অতি বড় পাষাণও যাতে দ্রবীভূত হয়!
স্থবির স্থির করলে, বড় হয়ে এইজনকে খুঁজে বার করতেই হবে। আজও স্থবির তারই অনুসন্ধানে ফিরছে।
.
জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ। জন্মের ইতিহাস আমার জানা নেই। শুনেছি, প্রারব্ধ, কর্মফলভোগের কিছু বাকি ছিল, তাই আমাকে জন্মাতে হয়েছে, নইলে আমি মুক্তপুরুষ। মৃত্যুর ইতিহাস লেখবার অবকাশ আমার হবে না–কারুরই হয় না। বিবাহের ইতিহাস লিখতে নেই, শাস্ত্রের মানা আছে। অতএব–অতএব অয়ম্ বিদ্যারম্ভ।
বাড়ির পাশেই ব্রাহ্মদের যে মেয়ে-ইস্কুল ছিল তাতেই আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। সহ-শিক্ষা উচিত কি অনুচিত, তাই নিয়ে আজ পর্যন্ত দেশে আলোচনারই শেষ হল না, কিন্তু আজ থেকে চল্লিশ বছরেরও আগে আমার জীবনযাত্রা সহ-শিক্ষার সদর-রাস্তাতেই শুরু হয়েছিল।
আমাদের ক্লাসে ছিল জন পাঁচ-ছয় ছেলে ও গুটি-ত্রিশেক মেয়ে। ছেলেদের বয়েস ছয় থেকে দশ, আর মেয়েদের বয়েস আট থেকে বারোর মধ্যে। এর চেয়ে কম বয়সের মেয়েও ছিল, তবে তাদের সংখ্যা দু-তিনটির বেশি নয়।
ইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন পুরুষ, এম.এ. পাস। এম.এ. পাস শুনলে আজকাল যেমন রাস্তার মুটের মনেও কোনো সম্ভ্রম জাগে না, তখনকার দিনে তা ছিল না। তখন বি.এ. পাস না করেও অনেকে হেডমাস্টারি করতেন এবং এখনকার দিনের এম.এ.-র পরেও আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ী হরপ লাগানো অনেকের চাইতে সে কাজে যশই অর্জন করে গেছেন।
হেডমাস্টার মশায় ছিলেন ব্রাহ্ম। কালো লম্বা চাপদাড়ি, চোখ দুটি লাল টকটকে, পুরুষমানুষের পক্ষে বামন অবতার না হয়ে যতখানি বেঁটে হওয়া সম্ভব তত বেঁটে। দেহ বেশ পুষ্ট ও জোরালো। ইনি ছাড়া আর জন-তিনেক পুরুষ-মাস্টার ছিলেন। বাকি সব মহিলা-শিক্ষয়িত্রী।
আমাদের ক্লাসে পাঁচ ঘণ্টায় দুজন মহিলা-শিক্ষয়িত্রী পড়াতেন। উচ্চতায় তাঁরা যে-কোনো সাধারণ বাঙালি পুরুষের চেয়েও উঁচু ছিলেন, শরীরের ব্যাসও যথোপযুক্ত ছিল। হেডমাস্টার তাঁদের সামনে দাঁড়ালে তাঁকে বালকের মতন দেখাত। এখন মধ্যে মধ্যে ভাবি যে, তখনকার দিনে তো এগারো-বারো হাত শাড়ি ছিল না, তাঁরা দশ হাত শাড়িতে লজ্জা-নিবারণ করতেন কি করে! অথচ তাঁদের শাড়ি পরবার ধরন সে সময়ে অনেকে অনুকরণ করতেন। দেখতেও তাঁরা অসুন্দর ছিলেন না, বাঙালি-ঘরের মেয়ের পক্ষে সুন্দরীই ছিলেন।
বাংলাদেশের অনেক মহিলা-জমিদার এবং দেবী-চৌধুরানি প্রভৃতির প্রতাপের কথা অনেকেই শুনেছেন, কেউ কেউ দেখেছেনও। আমিও আমার জীবনে অনেক খাণ্ডারনি-শাশুড়ি, কোকেন-আড্ডার কর্ত্রী, মহল্লার চৌধুরায়েন প্রভৃতি দেখেছি; কিন্তু মেয়ে-ইস্কুলের কড়া শিক্ষয়িত্রীর সংস্পর্শে আসবার দুর্ভাগ্য যাঁর হয়নি, নারীর প্রতাপ কতখানি হতে পারে এবং সে প্রতাপ কিরূপ অখণ্ড, সে ধারণা তাঁর হতে পারে না।
সমস্ত ইস্কুলের মধ্যে বোধ হয় শ-দেড়েক ছেলেমেয়ে ছিল। এদের মধ্যে দু-চারজন ছাড়া সকলে একই সমাজের ছেলেমেয়ে। একেবারে ওপরের ক্লাস থেকে আরম্ভ করে একেবারে নিম্নশ্রেণীর ছাত্র ও ছাত্রী প্রত্যেকেই প্রায় প্রত্যেককে চেনে। শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের প্রত্যেকেই প্রায় প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর বাবা-মাকে চেনেন।
এখানকার মতো কাঞ্চনকৌলীন্য আমি আর কোনো ইস্কুলে দেখিনি। সেখানকার সেই শ-দেড়েক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তিনটি সূক্ষ্ম বিভাগ ছিল। প্রথম যারা, তারা ধনীর ছেলেমেয়ে। দ্বিতীয় যারা, তারা সমাজের মাতব্বরদের সন্তান। এদের মধ্যে ধনীর সন্তানও অনেক ছিল। তৃতীয় যারা, তারা হচ্ছে আসলে দরিদ্রের ছেলেমেয়ে, ভদ্রতা হিসাবে যাদের এখনও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেপিলে বলা হয়।
শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের এই রকমে দু-ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একদল শিক্ষক ও শিক্ষয়িত্ৰী, তাঁরা প্রথম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অতিশয় মমতাসম্পন্ন ছিলেন। দ্বিতীয় দল দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বিশেষ মমতাসম্পন্ন হলেও প্রথম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী সম্বন্ধে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতেন। কিন্তু এই দুই শ্রেণীর শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীই তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ও ছাত্রীদের বিদ্যানুশীলন ও তাদের আচার-ব্যবহারের প্রতি খুব কড়া নজর রাখতেন। শুধু তাই নয়, তাদের কোনো অপরাধ বা সামান্য ত্রুটি তাঁরা উপেক্ষা করতেন না। বিশেষ করে অপরাধী যদি ছেলে হত এবং ফরিয়াদি পক্ষ যদি তাঁদের অনুগৃহীত কোনো পক্ষের ছেলে অথবা মেয়ে হত।
শিক্ষয়িত্রীদের নামের সঙ্গে ‘দিদি’ কথাটি যোগ দিয়ে ডাকাই আমাদের রীতি ছিল। অবশ্য প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগের অনেক ছেলেমেয়েই এঁদের কেউ বা ‘মাসি’, কেউ বা ‘পিসি’ বলে ডাকত। পুরুষ-শিক্ষকদের সকল শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা ‘অমুকবাবু’ বলে ডাকত। তাঁদের কাউকে কেউ ‘খুড়ো’ ‘মামা’ বা ‘মেসোমশায়’ বলত না।
আমি অভাগা ছিলুম এই তৃতীয় বিভাগের লোক। আমার বাবা ধনী তো ছিলেনই না। তাদের অনেকেরই সম্বন্ধে তাঁর ঘৃণা অতিমাত্রায় প্রকাশমান ছিল। তিনি ছিলেন বদরাগী ও দুনিয়াকে গ্রাহ্য না করার জন্য কুখ্যাতই ছিলেন। এই সব অমার্জনীয় অপরাধের ওপর আবার আমি ছিলুম পুরুষ-শিশু। কি হিংস্রভাবে আমার ওপর অত্যাচার চলত, সে কথা স্মরণ করলে আজও আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। সান্ত্বনা এই যে, এ জীবনে আর কখনও মেয়ে-ইস্কুলে পড়তে হবে না। আর যদি-বা পড়তে হয়, তা হলেও বাঁচোয়া এই যে, যাঁদের হাতে ইস্কুলে আমার বিদ্যারম্ভ হয়েছিল, তাঁরা সকলেই ঈশ্বরের কৃপায় আজ পরলোকগত।
অত্যাচার যে কোথা দিয়ে কেমনভাবে আসত, তার হদিশই পেতুম না। দু-একটা নমুনা দেবার প্রলোভন সামলাতে পারছি না।
সে সময় আমাদের প্রতিদিন ‘কপাটি’ খেলা হত। ইস্কুল বসবার আগে ও টিফিনের সময় খুব জোর কপাটির প্রতিযোগিতা চলত। এই খেলায় ছোট বড় সব মেয়ে ও ছেলেই থাকত। কপাটি খেলায় কয়েকদিনের মধ্যেই আমি মহা মাতব্বর হয়ে উঠলুম। আমি ধরলে দু-তিনটে ছেলে ছাড়া আর কেউ পালিয়ে যেতে পারত না। ইস্কুলে গুটিকয়েক বড় মেয়ের গায়ের জোরের ভারি গর্ব ছিল। একদিন এদের দুতিন-জনকে আমি আমাদের কোর্টে এমন ধরলুম যে তারা আমার হাত ছাড়িয়ে পালাতে পারল না। আমার মতো ছোট ছেলের হাত ছাড়িয়ে পালাতে না পারায় তাদের অভিমানে আঘাত লাগল ও আমার ওপরে চটে রইল, যদিও তারা আমার চেয়ে অনেক উঁচু ক্লাসে পড়ত।
একদিন ইস্কুল বসবার আগে ছেলেমেয়েদের মধ্যে গায়ের জোরের কথা হচ্ছে, এমন সময় আমি বীরত্ব করে বললুম অমুক অমুক ছেলে ছাড়া আর কোনো ছেলে কিংবা মেয়ে আমার সঙ্গে গায়ের জোরে পারে না। আমার সঙ্গে চালাকি করতে এলে মজা টের পাইয়ে দোব।
একজন বড় মেয়ে বলল, তা হলে হেডমাস্টার মশায়ও তোর সঙ্গে পারেন না?
আমি বললুম, তা কেন?
তা নয় কেন? তুই বললি, কোনো ছেলে পারে না;–হেডমাস্টার মশায় কি ছেলে নন?
তখন সবাই হৈ-হৈ করে উঠল। দশ মিনিটের মধ্যে সারা ইস্কুলময় রটে গেল– স্থবির বলেছে যে, হেডমাস্টার মশাই তার সঙ্গে গায়ের জোরে পারেন না, তিনি যেন তার সঙ্গে বেশি চালাকি না করেন।
ইস্কুল বসে যাবার মিনিট পাঁচেক পরেই লাইব্রেরি-ঘরে আমার ডাক পড়ল, হেডমাস্টার মশায় আমাকে ডাকছেন।
ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মৃদু গুঞ্জন কানে গেল। আমি মনে মনে ‘দয়াময়’ ‘দয়াময়’ নাম জপতে জপতে লাইব্রেরি-ঘরে গিয়ে ঢুকলুম।
হেডমাস্টারমশাই আমারই জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমি গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াতেই তিনি সেই লাল চক্ষু তুলে কটমট করে আমার দিকে চাইলেন। অহো, সে কি দৃষ্টি! আমি চিত্রকর নই, তাহলে সে কটাক্ষ তুলি দিয়ে লিখে অমর করে রাখবার চেষ্টা করতুম। মহিষের চোখে মানুষী ক্রোধ ফুটিয়ে তোলা যদি সম্ভব হয়, তাহলে তার সঙ্গে দৃষ্টির তুলনা করা যেতে পারে।
কিছুক্ষণ সেইভাবে আমার দিকে চেয়ে থেকে ডান হাতে বেশ করে আমার বাঁ কানটি বাগিয়ে ধরে রগড়াতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক এই ভাবে ‘সাইলেন্ট প্যানটোমাইম’ চলবার পর ‘টকি’ শুরু হল–কেন রে? আমার ওপর তোর এত রাগ কেন রে? আমাকে তুই কি বুঝোবি রে? হ্যাঁ, দাঁড়া, কালই তোর বাবাকে গিয়ে বলছি-
কথার সঙ্গে ‘অ্যাকশন’ অর্থাৎ কর্ণবিমর্দন সমভাবেই চলতে লাগল। এই রকম আধঘণ্টা দলনমর্দনের পর কানটা ছেড়ে দিয়ে আমাকে একটা জোর ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন, যা–ক্লাসে যা, তোর বাবার সঙ্গে একবার দেখা হলে হয়।
ক্লাসে ঢুকতে না ঢুকতে আমাকে দেখে সমস্ত ছেলেমেয়ে হো-হো করে হেসে উঠল। শিক্ষয়িত্রী তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে আবার অধ্যাপনায় নিযুক্ত হলেন। অবসর বুঝে আমি পাশের মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলুম, হাসছিলে কেন?
সে বললে, তোমার একটা কান কালশিরে পড়ে একেবারে কালো হয়ে গিয়েছে, আর একটা লাল টকটকে। যা চেহারা হয়েছে! দেখলে হাসি পায়।
সেদিন টিফিনের ছুটির সময় সমস্ত ছেলেমেয়ে আমাকে ‘লাল-কালো’ বলে ডাকতে আরম্ভ করে দিলে। অপমানে লজ্জায় ভয়ে আমি তাদের চোখের আড়ালে থেকে ছুটিটা কাটিয়ে দিলুম। রাত্রে কানের যন্ত্রণায় ঘুমুতে পারলুম না। সেই থেকে আজ অবধি আমার বাঁ কানটা জখম হয়ে আছে।
বাড়িতে এক অস্থির ছাড়া ব্যাপারটা আর কাউকে জানাইনি। অদৃষ্ট কিছু সুপ্রসন্ন থাকায় কানটা অন্য কেউ তেমন লক্ষ করেনি। পরের দিন বিকেলবেলায় কানের অবস্থা হঠাৎ মার চোখে পড়ায় তিনি একেবারে শিউরে উঠলেন। কি করে কানের এই মুমূর্ষু অবস্থা হল, সে সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন আমাকে না করেই বাবার উদ্দেশে নানা কথা বলতে আরম্ভ করে দিলেন–এই রকম করে ছেলেগুলোকে খুন করে ও কোন দিন ফাঁসি যাবে! আমার মরণ হয় না, এত লোকে মরে, ইত্যাদি–
বাবা আপিস থেকে না ফেরা অবধি অত্যন্ত শঙ্কায় সময় কাটতে লাগল। কি জানি, ব্যাপারটা এবারে কোন দিকে গড়াবে!
বাবা আপিস থেকে ফেরামাত্র মা তাঁকে বকতে আরম্ভ করে দিলেন। তারপর আমাকে টেনে এনে তাঁর সামনে দাঁড় করিয়ে কানটা দেখিয়ে কেঁদে বললেন, এ কি করেছ দেখ তো, এই কচি দেহ–
মা কাঁদতে লাগলেন।
বাবা তো আমার কানের রঙচঙে চেহারা দেখে একেবারে চমৎকৃত। আমরা তিন ভাই-ই বলতে গেলে সকালে কি সন্ধ্যায় প্রায় নিয়মমতো প্রহার সেবন করতুম। তার মধ্যেও কোনো দিনের অপরিমিত সেবনের ফলে যে এই ব্যাপারটা ঘটেছে, তা অনুমান করবার চেষ্টাও তিনি করলেন না। আমাকে ডেকে কাছে বসিয়ে আদর করে বলতে লাগলেন, বাবা স্থবির, তুমি তো আমার ভালো ছেলে, ভালো করে লেখাপড়া করবে, আমাদের কথা শুনবে, তা হলে তো আর মারতে হয় না। কথা না শুনলেই আমার রাগ হয়, আর রাগ হলে আমার জ্ঞান থাকে না।
একটা পতাকী ফাঁড়াকেটে গেল।
এর পরে সেই হেডমাস্টার তিন বছর আমাদের ইস্কুলে ছিলেন। এই তিন বছরের মধ্যে যতদিন যতবার তাঁর চোখের সামনে পড়েছি, ততবার তিনি আমাকে ব্রাহ্মভাষায় গালাগালি দিয়েছেন। একদিনের জন্যেও তাঁর মুখে একটা সহানুভূতির কথা শুনিনি।
ইনি এখনও বেঁচে আছেন এবং সাধুচরিত্রের লোক বলে সমাজে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। এঁর কথা যখন মনে পড়ে, তখন ভাবি, রত্নাকর হে! তুমি ধন্য! কি পন্থাই বাতলে দিয়ে গিয়েছ গুরু, তোমায় শতকোটি নমস্কার! তোমার রামায়ণ যদি কোনোদিন জগৎ থেকে লুপ্ত হয়ে যায়, তবুও তোমার স্মৃতি জাগিয়ে রাখবার লোকের অভাব বিশ্বে কোনোদিনই হবে না।
.
বাল্যকাল অতি সুখের কাল! কে বললে, বাল্যকাল অতি সুখের কাল? অধিকাংশ লোকেরই বাল্যকাল অতি দুঃখেই কাটে। সেই দুঃখের গভীরতা বোঝবার ক্ষমতা বালকের প্রায়ই থাকে না, তাই পরিণত পাটোয়ারী মস্তিষ্কের প্রবীণরা বেপরোয়া বলে দেন, বাল্যকাল অতি সুখের কাল।
এ কথা সত্য যে, বাল্যকালে স্ত্রীপুত্রপরিজন প্রতিপালন করবার দায়িত্ব থাকে না। সঙ্গে সঙ্গে এও সত্য যে, স্ত্রীপুত্রপরিজন থাকার সুখ থেকেও সে বঞ্চিত। যাঁরা বলেন, বাল্যকাল অতি সুখের কাল, তাঁদের বাল্যকাল হয়তো সুখেই কেটেছে কিংবা তাঁরা বর্তমান জীবনের দুর্দশার তুলনায় অতীতকে সুন্দর দেখেন কিংবা বাল্যকালে তাঁদের সূক্ষ্ম অনুভূতি ছিল না।
বাল্যকাল মোটেই সুখের কাল নয়। মানুষ, পশু, পক্ষী, বৃক্ষ, লতা প্রভৃতি এই ধরণীতে প্রাণবন্ত যা কিছু আছে, তার সম্যক বিকাশের জন্য চাই স্বাধীনতা। বাল্যকালের প্রতি মুহূর্তেই সেই স্বাধীনতা আহত হয়। ওরে, রাস্তায় বেরুসনি, ছাতে উঠিসনি, কেন শিস দিচ্ছিস? ওই ছেলেটার সঙ্গে আবার কথা বলবি তো হাড় গুঁড়িয়ে দোব। ‘ষগ্নবতি’ বানান কর তো। বেড়ালছানা, কুকুরছানা, পাখিরছানা –কোথা থেকে আপদ জুটিয়ে নিয়ে এলি? প্রতি পদে বাধা, প্রতি পদে আঘাত।
তারপর বাল্যকালের বিদ্যাভ্যাস!
যাঁদের মতে বাল্যকাল অতি সুখের কাল, তাঁদের হিসাবমতো আমার বাল্যকাল পরম সুখে কেটেছে। কিন্তু আমি বলছি আমার বাল্যকাল অতি দুঃখেই কেটেছে। বালকের মনের কথা অতি অল্প লোকেই বুঝতে পারে। বাল্যে মানুষের মন অত্যন্ত কোমল ও ভাবপ্রবণ থাকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে দীন বালক কাতরস্বরে ভিক্ষা করে, তারও প্রচণ্ড মান-অপমান-জ্ঞান আছে–সব অনুভূতিই তার প্রখর। আর যে-বালকের অন্তর সামান্য আঘাতেই উদ্বেল হয়ে ওঠে, চারিদিকের প্রাচুর্যের মধ্যে নিজের জীবনের ও সংসারের দৈন্য নিয়ত যার চিত্তকে আঘাত করে, দারিদ্র্যবিলাস যার অন্তরে কোনো গৌরববোধই জাগিয়ে তুলতে পারে না, অবজ্ঞা, অবহেলা ও শারীরিক শাসনে যার সমস্ত সত্তা পীড়িত হয় সে-বাল্যজীবনে সুখ কোথায়?
বাল্যকালে আমাদের ওপর কড়া হুকুম ছিল, দোতলা থেকে একতলায় নামতে পারবে না। দুপুরবেলায় কাজকর্ম সারা হয়ে যাবার পর মা ঘুমুতেন। আমি আর অস্থির দুজনে রাস্তার ধারের বারান্দায় গিয়ে চুপ করে রাস্তার দিকে চেয়ে বসে থাকতুম। ‘কথামালা’ আর বিদ্যাসাগর মশায়ের ‘দ্বিতীয় ভাগ’ খোলা থাকত আমাদের সামনে, কিন্তু আঁখি-পাখি পক্ষবিস্তার করত তার কল্পলোকে–যেখানে দিয়ে ঘোড়ায় ট্রাম টেনে নিয়ে চলেছে, কত রকম বেরকমের ঘোড়ায়-টানা গাড়ি, গরুর গাড়ি চলেছে। কত রকমের মানুষ, ফেরিওয়ালা, ভিখারি চলেছে কত অঙ্গভঙ্গি করে। আমাদের মনও তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে যেত–কোথায় তাদের বাড়ি, কেমন তাদের জীবনযাত্রা!
ছোট ছেলেমেয়ে দেখলেই আমরা ডাক দিতুম, কি ভাই, কোথায় যাচ্ছ? অনেকেই মুখ তুলে একবার দেখে চলে যেত। যে কথার উত্তর দিত, সে হত আমাদের বন্ধু। বন্ধুকে কিন্তু ওপরে ডাকতে পারতুম না, বাইরের ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসার মহা-অপরাধে অনর্থ ঘটবে এই আশঙ্কায়।
বাল্যকালে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে এক ভিখারিনি রালিকা ভিক্ষা করতে করতে চলে যেত। বেচারির হাঁটু থেকে পায়ের বাকি অংশটা ছিল বিকৃত। সে দু-হাত আর দু-হাঁটুতে জুতো পরে হামাগুড়ি দিয়ে ঘেঁষড়ে ঘেঁষড়ে চলত। তার মুখখানি ছিল করুণ, আর ভারি একটা কমনীয়তা ছিল সে-মুখে। এমন অদ্ভুত চাহনি ছিল তার চোখে, যা আজও পর্যন্ত আমি ভুলতে পারিনি। তখন তার বয়ঃসন্ধি। আসন্নযৌবনসমারোহের আগমনী বিচিত্র রাগিণীতে তার দেহে লীলায়িত হতে আরম্ভ করেছে মাত্র। হয়তো তাকে দেখে আমার সুপ্ত মানসলোকে যৌনচেতনা সাড়া দিত, কিংবা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক, আমাকে সে খুব বেশি আকর্ষণ করেছিল। আমার রাস্তায় নামবার হুকুম ছিল না। আমি থাকতুম বারান্দায় দাঁড়িয়ে, আর সে থাকত রাস্তায়। সেইখান থেকে সে মুখ তুলে কাতর সুরে আমাকে ডেকে বলত, রাজাবাবু, একটা পয়সা দে। আর আমার চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসত, আমার সঙ্গে অস্থিরও কাঁদতে থাকত।
ভিখারিনি প্রতিদিন আসত না। কিন্তু যেদিন সে আসত, সেদিন আমার মন একেবারে উদাস হয়ে পড়ত। কোথায় তার বাড়ি, কি খায় সে? তার বাপ-মা আছে কি না? তার বাপ তাকে মারে কি না? বাবা হয় অথচ মারে না–এমন অবস্থা আমরা কল্পনা করতে পারতুম না কিনা। সন্ধেবেলা পড়তে বসে তার কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়ার ফলে একাধিকবার জীবন-সঙ্কট উপস্থিত হয়েছে, তবুও তাকে ভুলতে পারতুম না।
একদিন ভিখারিনি আমাদের বারান্দার সামনে এসে ওই রকম কাতরভাবে অনুনয় করতে লাগল, রাজাবাবু, একটা পয়সা দে। তুই রাজা হবি। তুই রোজ বলিস, কিন্তু পয়সা দিস না। তুই রাজা হবি, দে একটা পয়সা।
রাজপুত্র না হয়েও ভবিষ্যতে রাজত্বলাভের সম্ভাবনায় মনটা তখনই রাজোচিত দাক্ষিণ্যে ভরে উঠল। ঠিক করলুম, আজ মার কাছ থেকে পয়সা চেয়ে নিয়ে নিশ্চয় তাকে দোব। তক্ষুণি মার সন্ধানে ছুটলুম কিন্তু সারা বাড়ি ঘুরে মাকে কোথাও খুঁজে পেলুম না, মা তখন কলতলায়। মায়ের পয়সা আলমারির কোন তাকে থাকে, তা আমাদের সব ভাইয়েরই জানা ছিল। সেখান থেকে মাকে না বলেই একটি পয়সা নিয়ে দৌড়তে যাব, এমন সময় দেখি–বাবা।
আর কথা নেই, অমনিই তিনি এক হাতে আমার কোমরটা ধরে শূন্যে তুলে বাড়ির মধ্যে নিয়ে এসে উঠোনে মারলেন এক আছাড়। আমার সংজ্ঞা লুপ্ত হবার অবস্থা। তখনও কিন্তু ভিখারিনির জয়স্তুতি আমার কানে মধুবর্ষণ করছিল। মাটিতে লুটিয়ে পড়তে-না-পড়তে বাবা আমার ঘাড়টা এক হাতে ধরে কুকুরের বাচ্চাকে যেমন করে নিয়ে যায় সেই ভাবে, ওপরে অর্থাৎ দোতলায় নিয়ে এলেন।
তার পরের অবস্থাটা আর বর্ণনা করে কাজ নেই। প্রলয়ের শেষে, প্রকৃতি একটু সাম্যাবস্থা পাবার পরের দৃশ্য–মা কলঘর থেকে বেরিয়েছেন, প্রদীপ জ্বালা হয়েছে, শতরঞ্চির কোণ ঘেঁষে দাদা ও অস্থির বসেছে, তাদের সামনে বই খোলা রয়েছে, আর আমি বাবার সামনে বসে।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কেন রাস্তায় গিয়েছিলে, বল?
কোনো উত্তর নেই।
সঙ্গে সঙ্গে মাথার কিছু চুল বেহাত অর্থাৎ বাবার হাতে চলে গেল।
উত্তর দাও।
কোনো উত্তর নেই। উত্তর দিতে গেলে বলতে হবে, মাকে না বলে পয়সা বের করে নিয়ে ভিখারিনিকে দিয়েছি। সে অপরাধের সাজা কল্পনা করতেও মূর্ছা আসে, তাই উত্তর নেই।
সঙ্গে সঙ্গে চপেটাঘাত এবং সর্ষপকুসুমদর্শন।
কিছুক্ষণ এইভাবে চলবার পর অনেক ভেবে-চিন্তে বলে ফেলা গেল, একটা ভিখিরি ডেকেছিল বলে নীচে নেমেছিলুম।
অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল। আমার কথা শুনে পাশের ঘর থেকে চুল বাঁধতে বাঁধতে হাউমাউ করে মা বেরিয়ে এসে বলতে লাগলেন, ও মা, আমি কোথায় যাব! এ ছেলেকে নিয়ে আমি কি করব? ভিখিরি ডাকলে, আর তুই নীচে নেমে চলে গেলি তার কাছে! আমার মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছে করছে। ভিখিরিরা এই রকম করে ছেলেদের ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে হাতটা-পাটা ভেঙে দিয়ে ভিক্ষে করায়।
এই রকম বলতে বলতে মা এমন একটা আবহাওয়ার সৃষ্টি করলেন যে, বাবা পর্যন্ত দস্তুরমতন ভড়কে গেলেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হতে লাগল যে, ভিখিরিদের সম্বন্ধে ভবিষ্যতে তিনিও বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করবেন–এই রকম একটা সঙ্কল্প মনে মনে আঁটছেন।
ইতিমধ্যে পাড়ার একটি বর্ষীয়সী মহিলা এসে উপস্থিত হয়েছিলেন আমাদের সেই সান্ধ্য-বৈঠকে। এঁকে বাবা ‘দিদি’ বলে ডাকতেন এবং কি জানি তাঁর কথার উপরে বাবা কখনও কথা বলতেন না বা তর্ক করতেন না। আমরা তাঁকে পিসিমা বলে জানতুম, কিন্তু ডাকতুম ‘মা’ বলে। আমাদের তিন ভাইকে ইনি নিজের সন্তানের মতন দেখতেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা নিজের ভাইয়ের মতন আমাদের দেখত এবং তারা যে আমাদের পিসতুতো ভাইবোন নয়, বেশ বড় হয়ে তা জানতে পেরেছি। ভিখারিতত্ত্বে মার এই পাণ্ডিত্য দেখে আমাদের এই মারও তাক লেগে গেল। বাবার মুখ দেখে তো আমার ওই অবস্থাতেও হাসি পেতে লাগল।
কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে হকচকিয়ে চেয়ে থেকে হঠাৎ বাবা ক্ষিপ্তের মতো গর্জে উঠে দুদ্দাড় করে আমায় প্রহার করতে শুরু করে দিলেন। ভাগ্যে মা (পিসিমা) ছিলেন, নয়তো সেই দিনই পুত্র-হত্যার অপরাধে পিতাজী নিশ্চিত চালান হতেন। মা (পিসিমা) বাবাকে যাচ্ছেতাই অর্থাৎ ব্রাহ্মভাষায় যাচ্ছেতাই বকতে লাগলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ–তুমি অত্যন্ত রাগী; ছেলেপুলে শাসন করা ও তাদের মানুষ করার পদ্ধতি এ নয়; ইত্যাদি।
নিরবচ্ছিন্ন খারাপ বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। বাল্যজীবনের সুখ আমি কিছু অনুভব করলুম বটে, কিন্তু দাদা আর অস্থির সেদিন পড়ার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেল।
অনেক রাত্রে খেতে বসবার সময় দাদা আমাকে বললে, কোন ভিখিরিটা তোকে ডেকেছিল আমায় একবার দেখিয়ে দিস তো। ব্যাটা কত বড় ভিখিরি একবার দেখে নোব
সেদিন শোবার সময় মা আমাদের ডেকে বললেন, স্থরে, আমার কাছে শুবি আয়।
আমরা মার কাছে শুতে পেতুম না। মা ডাকামাত্র তড়াক করে উঠে মার কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। মা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভিখারিদের সম্বন্ধে কত কথাই বলতে লাগলেন, আমার কানে তখন কোনো কথাই যাচ্ছিল না। প্রাণপণে মাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে রইলাম। তারপরে কখন ঘুমিয়ে পড়লুম মনে নেই।
আমাদের বাল্যকালে কলকাতার অধিবাসী প্রায় সকল বাঙালির বাড়িতেই হিন্দুস্থানী চাকর থাকত। এদের সাধারণত ‘খোট্টা’ বলা হত। এরা বেশির ভাগই আসত বিহারের গয়া ছাপরা ত্রিহুত প্রভৃতি জায়গা থেকে–তখন বিহার বাংলাদেশেরই অন্তর্গত ছিল। পাঁচ টাকা থেকে আরম্ভ করে আট টাকা ছিল এদের মাইনে। এরা বাঙালির হেঁসেলে খেত না, কারণ তখনকার দিনে পাঞ্জাব ছাড়া সারা ভারতবর্ষের লোক বাঙালিকে ম্লেচ্ছ জ্ঞান করত। সেই মাইনেতে তারা নিজেরা দু-বেলা রেঁধে খেত। কাপড় পরত আর দেশেও টাকা পাঠাত।
আমাদের ঘরে শাপভ্রষ্ট হয়ে যে মহাপুরুষ এসেছিলেন, তাঁর নাম ছিল দুখিয়া। আমরা তাকে ‘দুঃখী’, বলে ডাকতুম। দুঃখের এমন জীবন্ত প্রতিমূর্তি আমি আজও দেখিনি। সে বেচারি ছিল বুড়ো আর রাতকানা। রাত্রিবেলা সে পা ঘেঁষটে ঘেঁষটে চলত। আমরা দূর থেকে বুঝতে পারতুম, দুঃখী মহারাজ আসছেন। মার কোনো বকুনি-ধমকানির জবাব সে দিত না। তার মাইনে ছিল ছ-টাকা। তা থেকে প্রতি মাসে সে তিনটি টাকা দেশে পাঠাত–ছাপরা জেলার কোন এক গ্রামে, যেখানে তার বুঢ়িয়া ‘বহু’ আর ছেলেরা থাকে।
একটি সিঁড়ির তলায় সে থাকত, সেখানে থাকত তার একটা পোঁটলা আর সেখানেই তোলা-উনুনে তার রান্নাবান্না চলত।
রাত্রিবেলা সব কাজকর্ম সারা হয়ে যাবার পর আমি আর অস্থির মাঝে-মাঝে সবার অগোচরে এই সিঁড়ির তলায় তার কাছে গিয়ে উপস্থিত হতুম। আমাদের তিনজনের সেখানে জমাট আসর বসততা। অতি-মৌন মুখিয়া আমাদের কাছে মুখর হয়ে উঠত। তার দেশের কত রকম গল্প করত।
পেতলের কানা-উঁচু থালায় বেড়ালে ডিঙতে পারে না এমনই ভাতের পর্বতের ওপর খানিকটা অড়রডাল-সেদ্ধ ঢেলে দুখিয়া শপশপ আওয়াজ করে খেত, আর আমরা দু-ভাই বলাবলি করতুম, বেড়ে ডিনার চলেছে।
দুখিয়ার সেই দুঃখী ডিনার দেখে আমাদের দুঃখ হত। আমরা বলতুম, দুখিয়া তুই আমাদের সঙ্গে খাস না কেন?
ও বাবা, জাত যাবে।
জাত যাওয়ার ব্যাপার আমাদের সমাজে চলন ছিল না, কাজেই ও-জিনিসটার গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারতুম না। আমরা ভাবতুম, এই বুদ্ধি না হলে ও আর চাকর হয়েছে!
যা হোক, তবুও দুখিয়া ছিল আমাদের পরম বন্ধু। কত ‘প্রাইভেট’ কথা যে তার সঙ্গে হত, তার ঠিকানা নেই।
হঠাৎ একদিন কি কারণে দুখিয়ার চাকরি চলে গেল। সে দিনটি আজও আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।
একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে শুনলুম, দুখিয়ার চাকরি গেছে। দুই ভাইয়ে একেবারে দমে গেলুম। অনধিকারচর্চা করে বললুম, কেন মা, দুখিয়া তো বেশ লোক।
মা বললেন,’ না বাবা, ও বুড়ো হয়ে পড়েছে, খাটতে পারে না–আমিও সামলাতে পারি না।
বুড়ো হয়ে খাটতে না-পারার অপরাধের গুরুত্ব সেদিনও বুঝিনি, আজও বুঝতে পারি না। সে রাত্রে আমরা যখন দুখিয়ার ডিনারের সময় তার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলুম, তখন সে সেই পেতলের কানা-উঁচু থালায় যবের ছাতু মেখে খাচ্ছিল। দুখিয়া বললে, কাল ভোরে উঠেই সে চলে যাবে, তাই আজ আর রান্নার হাঙ্গামা করেনি।
আমরা তাকে অনেক কথা বলতে লাগলুম–দুখিয়া, তুই যাসনি, কোথায় যাবি আমাদের ছেড়ে, ইত্যাদি।
ছাতু গিলতে গিলতে সে মাঝে মাঝে আমাদের দিকে চাইতে লাগল। দেখলুম, দুখিয়ার রাতকানা চোখ দুটো কথা বলতে বলতে সজল হয়ে উঠেছে।
সকালবেলা দুখিয়া তার ছোট পুঁটলিটা পিঠের সঙ্গে বেঁধে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি আর অস্থির তার পেছনে পেছনে রাস্তায় এসে দাঁড়ালুম। দেখতে দেখতে আমাদের চোখের সামনে রাস্তার জনস্রোতে দুখিয়া ডুবে গেল।
অপস্রিয়মাণ ন্যুব্জ দুখিয়া-মূর্তি আজও মনের মধ্যে ঝকঝক করছে। তার কথা স্মরণ করে রাত্রে বিছানায় শুয়ে কতদিন কেঁদেছি, তার ঠিকানা নেই। মনের এ বোঝা কারু কাছে নামাবার উপায় নেই–না বাড়িতে, না ইস্কুলের বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে। এ দুঃখ অনুভব করবার শক্তি যে অভাগ্য বালকের আছে, সে ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। বাল্যকাল সুখের কালই বটে!
যাক্, আবার বাল্যকালের ইস্কুল-জীবনে ফিরে যাই। আগেই বলেছি, আমাদের ক্লাসে দুজন শিক্ষয়িত্রী পড়াতেন। একের নম্বর ছিলেন কিছু বেশি কঠিনা। দ্বিতীয়াও কঠিনা কম ছিলেন না, তবে একের-নম্বরের তুলনায় কিছু কম। ইস্কুলের প্রথম ও দ্বিতীয় ঘণ্টায় দুই নম্বরের শিক্ষয়িত্রী আমাদের অঙ্ক আর ইংরেজি শেখাতেন। ক্লাস বসলেই সর্বপ্রথম কার্য ইংরেজি হাতের লেখা দেখানো। একদিন তিনি হুকুম দিলেন–কাল থেকে সবাই রুল-টানা এক্সারসাইজ বুকে হাতের লেখা লিখে আনবে।
বাড়িতে বাবার কাছে এক্সারসাইজ বুকের কথা বলতেই বাবা বললেন, না না, ওসব বিলাসিতা চলবে না। কেন, বালির কাগজ কি খারাপ? বিদ্যাসাগর মশায়, কি গুরুদাস বাঁড়ুজ্জে লেখাপড়া শেখেননি? সেই কেরী সায়েবের আমল থেকে এই কাগজে লিখে বাঙালি মানুষ হল, আর আজ বাবুর এক্সারসাইজ বুক চাই! ইস্কুলে বলবে, বাবা বলেছেন–এ রকম বিলাসিতা করা ঠিক নয়।
তাঁদের ছেলেবেলায় তাঁরা কত কষ্টে কাগজ জোগাড় করতেন, তারও একটা ফিরিস্তি শুনতে হল।
পরের দিন সব ছেলেমেয়েই এক্সারসাইজ বুকে হাতের লেখা লিখে নিয়ে এল। সবার দেখে শিক্ষয়িত্রী হাঁকলেন, কই স্থবির, হাতের লেখা দেখালিনি! তোমায় না ডাকলে বুঝি মনে থাকে না?
অগত্যা সেই বালির কাগজের খাতা নিয়ে হাজির হলুম। শিক্ষয়িত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, এক্সারসাইজ বুক কোথায়?
বিলাসিতা সম্বন্ধে পিতৃপ্রদত্ত উপদেশগুলি উদ্গার করব কি না ভাবছি, ইতিমধ্যে কৰ্ণে আকর্ষণ অনুভব করলাম। দু-তিনটি মধ্যম রকমের টিপ্পনী পড়তেই কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রতা হলেন বলে ফেললুম, বাবা বলেছেন, এই খাতাটা শেষ হয়ে গেলে তার পরে এক্সারসাইজ বুক কিনে দেবেন।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই শুনে আসছি–সদা সত্য কথা কহিবে; সত্য বিনা কদাচ মিথ্যা কহিবে না। বাল্যজীবনে সেই সূত্র অনুকরণ করে যদি চলতুম, তা হলে বার্ধক্যে এই সত্য বলবার অবকাশই ঘটত না। কর্ণমর্দনের ফলে টপ করে কিছু বানিয়ে বলে ফেলার প্রতিভা সেইদিন থেকে যে আমার খুলে গেল, তারই কৃপায় ভবিষ্যতে অনেক সাংঘাতিক বিপদের হাত থেকে ত্রাণ পেয়েছি। এর জন্যে কার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করব? পিতার কাছে? আমার কর্ণবিমর্দিনীর কাছে? না, সৃষ্টির আদিমতম যুগ থেকে আত্মরক্ষার যে নীতি অপ্রতিহতরূপে ধরণীতে প্রবাহিত হচ্ছে তার কাছে?
মাসখানেক বাদে আবার যেদিন বালির কাগজের নতুন খাতায় হাতের লেখা নিয়ে উপস্থিত হলুম, তখন আমার শিক্ষয়িত্রী ক্ষেপে গিয়ে মহা চিৎকার শুরু করে দিলেন।
একটা বড় মার্বেল-পাথরের ঠাকুর দালানে আমাদের ক্লাস বসততা; আমাদের পাশেই সেই দালানে আর একটা ক্লাসও বসততা। আমার শনি-মহারাজ বোধ হয় সে সময় রন্ধ্রগত ছিলেন। কারণ সেই ক্লাসে তখন আমাদের একের-নম্বরের শিক্ষয়িত্রী পড়াচ্ছিলেন। দুয়ের নম্বরের চিৎকার ও চটাচট চপেটাধ্বনি শুনে তিনি সবৎসা ধেনুর মতো মন্থর গমনে আমাদের ক্লাসে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?
দুয়ের নম্বর উত্তর দিলেন, দেখ দিকিনি! এ ছেলেকে নিয়ে আমি কি করব? একটা কথা শোনে না! আজ এক মাস ধরে একে দিয়ে একখানা এক্সারসাইজ বুক কেনাতে পারলুম না! একের নম্বর অগ্রসর হয়ে বললেন, কিস্সু হবে না এর, দেখে নিও। আমার হাতে পড়লে দু-দিনে সিধে করে দিতুম।
বলা বাহুল্য, দৈনিক তিন ঘণ্টা করে তিনি আমায় সিধে করবার চেষ্টা করতেন এবং প্রতি কর্ণমর্দন ও চপেটাঘাতের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণ করতেন–কিস্সু হবে না এ ছেলের, আমি বলে দিচ্ছি, লিখে রাখ তোমরা, কিস্সু হবে না এর।
হে অসামান্যা ভবিষ্যদ্দৃষ্টিসম্পন্না ঘোরে! মর্ত্যপুরুষ-শিশুদলনে পটিয়সী হে অমর্ত্যলোকবাসিনী বিদেহী! আপনার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। আমার কিসুই হয়নি। কিসুই হবে কি করে? যে শিশুর জীবনযাত্রা শুরুই হল মেয়ে-চড় খেতে খেতে, তার ভবিষ্যৎজীবন যে কেবল চুম্বন ও আলিঙ্গনেই ভরে উঠবে না, সে তো জানাই কথা।
এই ব্যাপারের পর প্রায় তিন মাস অর্থাৎ পুজোর ছুটির কিছু আগে পর্যন্ত প্রতিদিন ইস্কুলের প্রথম ঘণ্টায় আমার জন্য রকমারি শাস্তি তোলা থাকত। দ্বিতীয়বার বাবার কাছে এক্সারসাইজ বুক চাইবার সাহস হত না। আবার বাবা যা বলেছেন, তা ইস্কুলে বলবার সাহস হত না। প্রতিদিন অতি ক্ষুণ্নমনে নিরুৎসাহিত চিত্তে ইস্কুলে গিয়ে শাস্তির জন্য অপেক্ষা করতুম। শাস্তির ঘণ্টা পার হয়ে গেলে (অবশ্য শাস্তি পেয়ে) তবে শান্তি পেতুম।
যে ছেলে প্রতিদিন ইস্কুল বসতে-না-বসতেই শাস্তি পায়, তার সুনাম থাকে কি করে! এরই মধ্যে একটা দিনের কথা কষ্টিপাথরে সোনার কষের মতন মনের মধ্যে আজও ঝকঝক করছে।
আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল ক্রিশ্চানদের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি মিশন। এখানে থাকতেন পাদ্রি ব্রাউন সায়েব। অতিশয় মহাজন ছিলেন এই রেভারেন্ড ই. এফ. ব্রাউন। দুনিয়ার লোকের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রেমভাব। তিনি যখন রাস্তা দিয়ে চলতেন, রাজ্যের ছেলেরা তাঁকে ঘিরে চলতে থাকত। তিনি তাঁর পাদ্রির জোব্বার দুই পকেট থেকে ছবিওয়ালা কার্ড বের করে করে তাদের বিলোতেন। পথ দিয়ে চলতে চলতে বারান্দার ওপর থেকে কিংবা অন্য ফুটপাথ থেকে ডাক দিলে, তিনি সেইখানে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে তাদের সঙ্গে বাংলায় আলাপচারী করতে থাকতেন। চেনা লোক দেখলে, সে ছেলেই হোক কি বুড়োই হোক, তাকে জড়িয়ে ধরে দু-গালে চুমু খেয়ে ভালোবাসা জানাতেন। মনে আছে, একদিন খাটাপায়খানার মেথরকে চুমু খেয়েই আমাদের দুই ভাইকে চুমু খাওয়া-মাত্র আমরা বাড়িতে ফিরে আধ ঘণ্টা ধরে সাবান দিয়ে মুখ ধুয়েছিলুম।
দাদা, আমি আর অস্থির সায়েবকে ‘দাদা’ বলে ডাকতুম। তিনিই ‘দাদা’ বলে ডাকতে শিখিয়েছিলেন। অন্য লোকের চাইতে সায়েবের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠতর। তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং আমাদের মার সঙ্গেও গল্পগুজব করতে তাঁকে দেখেছি।
আমাদের পরিবারের সঙ্গে ব্রাউন সায়েবের ঘনিষ্ঠতার একটু কারণ ছিল। কারণটা বলি–আমার জ্ঞান-সঞ্চার হবার কিছু পূর্বে সাধারণ-ব্রাহ্ম-সমাজের ঠিক সামনে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ওপরেই একটি নারীহত্যা হয়েছিল। মন্দিরের ধারের সরু গলির মধ্যে অনেক ব্রাহ্ম-পরিবার বাস করতেন। এইসব পরিবারের অনেক মেয়ে বেথুন কলেজে অথবা মিস নীলের ইস্কুলের পড়তে যেতেন। হেদোর সামনে যে গির্জা আছে, তারই সংলগ্ন ছিল মিস নীলের ইস্কুল। সে স্কুলের প্রকাণ্ড বাড়ি এখন বেথুন কলেজ কিনে নিয়েছে।
মিস নীল ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিয়ে বিলেত চলে যাবেন; সেই উপলক্ষ্যে সেদিন সন্ধেবেলায় ইস্কুলে ছিল জলসা। ব্রাহ্ম-পাড়া থেকে মিস নীলের ছাত্রীরা গিয়েছিলেন সেই উৎসবে যোগ দিতে। রাত্রে ইস্কুলেরই বাস-গাড়িতে তাঁরা বাড়ি ফিরলেন। সমাজ-পাড়ার সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে–মেয়েরা একে একে নেমে যাচ্ছে, এমন সময় আততীয়ারা এসে একটি– মেয়েকে হত্যা করে। মেয়েটি ছিল হিন্দু-ঘরের বিধবা। ‘নব্যভারত’-সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরীর গৃহে আশ্রিতা এবং সেইখানে থেকেই সে লেখাপড়া শিখছিল। কেন এই মেয়েটির হত্যা করা হল, হত্যাকারী কারা–সে এক অন্য ইতিহাস।
আমার বাবার সে সময় ছিল চামড়ার কারবার। বেশ সমারোহের সঙ্গে কারবার চলছে। ব্রাহ্মণসন্তান চামড়ার কারবার করেছেন–এই গৌরবে, তাঁর মতে, শহরের মধ্যে বেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই সময় এক রাত্রে কাজকর্ম সেরে বাড়িতে ফিরে রাত্রি প্রায় দশটার সময় আহারে বসেছেন, এমন সময় নৈশ নিস্তব্ধতা ভেদ করে নারীকণ্ঠের করুণ চিৎকার উঠল–বাবা গো, মেরে ফেললে!
বাবা খাওয়া ফেলে এঁটো হাতেই ছুটে রাস্তায় গিয়ে দেখলেন, তিনজন লোক মিলে একটি মেয়েকে রাম-দা দিয়ে কোপাচ্ছে। রাস্তায় অন্য লোকজন, এমনকি একটি পাহারাওয়ালা পর্যন্ত নেই–দুয়ার রুদ্ধ ভবনে ভবনে। শুধু বাস-গাড়ির ঘোড়া দুটো অবাক হয়ে মানুষের এই কীর্তি দেখছে।
বাবা এই দৃশ্য দেখে তখুনি তাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মেয়েটিকে উদ্ধার করবার জন্যে। বারান্দার ওপর থেকে যাঁরা এই দৃশ্য দেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু-তিনটি মহিলার কাছে আমরা শুনেছি যে, চোর-চোর খেলার মতন দুই ফুটপাতে সেই মেয়েটিকে নিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে দৌড়োদৌড়ি হতে লাগল। কখনও বা.তাদের কাছ থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিয়ে বাবা বাড়ির দিকে দৌড় দেন, কখনও বা তারা তিনজনে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। রাস্তায় রক্তস্রোত বইছে, এমন সময় একটা লোক এসে বাবার মাথায় মারলে এক রামদার কোপ। হাতের কাছে পেয়ে তিনি তখুনি তাকে তুলে মারলেন এক আছাড়। লোকটা আঘাত পেয়ে সেইখানেই অর্ধমূর্ছিত হয়ে পড়ে রইল। মাথায় তখনও রাম-দাখানা গেঁথে বসে আছে, সেই অবস্থাতেই মেয়েটির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন, এমন সময় আর একটা লোক এসে তাঁর মাথা থেকে রাম-দাখানা সাঁ করে টেনে নিলে। সঙ্গে সঙ্গে তার রগে একটা চপেটাঘাত পড়ল, যার ফলে চোখের কতগুলো শিরা তার ছিঁড়ে গেল এবং তারই যন্ত্রণায় হাসপাতালে গিয়ে সেই রাত্রেই সে ধরা পড়ে।
আততায়ীরা দুজন রাম-দাখানা নিয়ে পালিয়ে গেল। মেয়েটি ফুটপাথের ওপরে পড়ে গোঁ-গোঁ করতে লাগল। হতভাগিনীকে দুর্বৃত্তেরা চব্বিশ ঘা কোপ মেরেছিল।
বাবার মাথার মধ্যিখান থেকে ডান চোখের ভুরু অবধি একেবারে দুখানা–বাক্শক্তি তাঁর রহিত হয়ে গেছে, ডান চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। মেয়েটিকে মাটি থেকে তুলছেন আর ঘুরে ঘুরে আছাড় খেয়ে পড়ছেন।
কল্পনার চোখে একবার সে দৃশ্য দেখবার চেষ্টা করুন। ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা শহরের কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ওপরে একটি মৃতকল্প নারীকে একজন মরণাপন্ন আহত যুবকের অন্তিম-সাহায্যের সেই বিফল প্রয়াস! এমনই সময় মিস নীল হেদোর ধার থেকে দৌড়া দৌড়তে এসে সেখানে উপস্থিত হলেন। খুনের ব্যাপার আরম্ভ হতেই সহিস-কচুয়ানেরা গাড়ি ফেলে দৌড় মেরেছিল। তারাই মিস নীলকে গিয়ে খবর দেয়।
মিস নীল মেয়েটিকে বাসে তুলে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলেন, আর বাবা চললেন হেঁটে মেডিকেল কলেজের দিকে। কিছুদূর অগ্রসর হবার পর পাড়ার এক হিন্দুস্থানী খাবারের দোকানের লোকেরা তাঁকে সেই অবস্থায় দেখে ধরে বাড়িতে নিয়ে এল। তার কিছু পরে পাড়ার লোকেরা এসে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
এর পরের অধ্যায়টা তত করুণাত্মক নয়। চারিদিক থেকে বাবার নামে চিঠি প্ৰশংসাপত্র ইত্যাদি আসতে শুরু হয়ে গেল। মার নামে চিঠি আসতে লাগল–এমন বীরের পত্নী তিনি, তাঁর মতন ভাগ্যবর্তী আর কে আছে!
আট-দশটা ঘড়ি ও মেডেল তো আমরাই দেখেছি।
বাবার যেমন বড় কারবার, তেমনই বড় লেনদেনও ছিল। পাওনাদারেরা মিলে ব্যবসা, মালপত্র, জমিজমা কেড়ে নিলে। কি করে যে হল, মা তা বুঝতেও পারলেন না। তিনি তখন অন্তঃসত্ত্বা, তার ওপরে স্বামী-চিন্তায় তাঁর অন্য কোনো জ্ঞানই ছিল না। প্রায় চল্লিশ দিন পরে বাবা প্রথম চোখ চাইলেন ও প্রায় ছ-মাস পরে তিনি বাক্শক্তি ফিরে পেলেন।
ইতিমধ্যে প্রশংসাপত্র রোজ আসতে থাকে বিশ-পঞ্চাশখানা। সংসার অচল। দাদাকে ও আমাকে আমাদের অন্য মা অর্থাৎ পিসিমা নিয়ে গেলেন। আত্মীয় যাঁরা, তাঁরা বাবা ব্রাহ্ম হওয়ার জন্য বিষম বিমুখ। অমিত্রনীদের ঘনঘটায় ‘পন্থ বিজন অতি ঘোর’, এমনই দুর্দিনের এক সকালে মার নামে একখানা চিঠি এল। খাম খুলে দেখা গেল, তার মধ্যে একশো টাকার একখানি নোট আর একখানি ছোট্ট চিঠি–ইংরেজি ভাষায় লেখা, পত্রপ্রেরকের নাম-ধাম কিছুই লেখা নেই। বাবা সেরে উঠতে অর্থাৎ চলে ফিরে বেড়াতে প্রায় দেড় বৎসর সময় লেগেছিল। এই সময় একদিন ব্রাউন সায়েবই বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কথায় কথায় প্রকাশ পেল যে, সেই একশো টাকার নোটখানা তিনিই পাঠিয়েছিলেন। ব্রাউন সায়েবই চেষ্টা করে সরকারি আপিসে বাবার চাকরি করে দিয়েছিলেন। এই চাকরির মেয়াদ শেষ করে পেনশন ভোগ করতে করতে তাঁর ইহলীলা সাঙ্গ হয়েছে। এই ব্রাউন সায়েব অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের পরিবারের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। বাবা, মা ও আমাদের তিন ভাইকে যে তিনি কত স্নেহ করতেন, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারা যায় না। আমাদের তিন ভাইয়ের বিনা অনুমতিতে দোতলা থেকে একতলায় নামবার হুকুম ছিল না বটে, কিন্তু ব্রাউন সায়েবের বাড়ি গেলে বাবা কিছু বলতেন না। দাদা রোজ সেখানে যেত ফুটবল খেলতে। অক্সফোর্ড মিশনের পিছনে খানিকটা খালি জমি পড়ে ছিল, যেখানে এখন অক্সফোর্ড মিশন হস্টেল রয়েছে, এ জমিতে ছেলেদের খেলা হত। দাদা রোজ সন্ধেবেলা বাড়িতে ফিরে আমাদের কাছে খেলার নানা কায়দা দেখাত ও বোঝাত। একবার কি-একটা অপরাধে দাদার অক্সফোর্ড মিশনে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
মিশনে যাওয়া বন্ধ হল বলে খেলা বন্ধ হল না। আমাদের ফুটপাথেই পাশাপাশি কতগুলো বড় কদমগাছ ছিল (তার একটাও আজ নেই)। তখন বর্ষাকাল। দাদা নিত্য কোন সুযোগে বিকেলবেলা চট করে একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে একরাশ কদম নিয়ে আসতে লাগল। এই কদম দিয়ে প্রতিদিন দোতলার ওপরকার নেড়া ছাদে আমাদের তিন ভাইয়ের ফুটবল খেলা শুরু হয়ে গেল। দাদা থাকত একা এক দিকে, আমি আর অস্থির আর এক দিকে।
খেলা খুব জমে উঠতে লাগল। দাদা রোজ আমাদের ‘ক্যারি’, ডজ’, ‘ড্রিবলিং’ সব নতুন নতুন প্যাঁচ শেখাতে লাগল। শেষকালে একদিন মোক্ষম প্যাঁচ শেখালে —-পুশ’–Push।
পুশটা কিন্তু জমল সবচেয়ে বেশি। দাদা আমায় লাগায় পুশ, আমি দাদাকে লাগাই পুশ–এই রকমে প্রতিযোগিতা বাড়তে বাড়তে দাদা একবার আমায় এমন একটি পুশ লাগালে যে, আমি ঠিকরে পড়ে একেবারে আলসে থেকে বেরিয়ে পড়লুম। দাদা তখুনি ছুটে এসে আমার পা দুটো ধরে ফেললে। আমার মাথাটা নীচু দিকে, পা দুটো দাদার হাতে, ফুটপাত থেকে প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচুতে শূন্যে ঝুলতে লাগলুম। দাদার সঙ্গে অস্থিরও এসে যোগ দিলে। দুই ভাই মিলে টানাটানি করে আমাকে ওপরে তোলবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু তাদের সাধ্য কি! তখন আমায়’ মাধ্যাকর্ষণে টেনেছে–তারা তো তখন বালক, কতটুকু শক্তি তাদের!
আমার কিন্তু আলসের ধারে পড়ামাত্র প্রায় সংজ্ঞালোপ হয়েছিল। স্বপ্নের মতন বোধ হচ্ছিল, যেন দাদা আর অস্থির আমার পা ধরে টানাটানি করছে। কিছুক্ষণ সেই ভাবে ঝুলে থাকবার পর তাদের হাত ফসকে একেবারে রাস্তায় এসে পড়লুম।
রাস্তায় পড়লুম বললে ঠিক বলা হবে না। গতজন্মে এক ব্যক্তি আমার কাছে প্রভূত ঋণ করে সরে পড়েছিল। সেই আমার জন্মান্তরের খাতক সে সময় আমাদের বাড়ির ধার দিয়ে গুটিসুটি চলে যাচ্ছিল–আমি এসে পড়লুম তার পিঠের ওপরে।
আমার যখন জ্ঞান হল, তখন দেখলুম, উঠোনে বসিয়ে আমার মাথায় বালতি বালতি জল ঢালা হচ্ছে আর মা ছুটে আসছেন। আমি ‘মা’ বলে চিৎকার করতেই তিনি আমায় কোলে তুলে ওপরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।
তারপরে মার কান্না, বাবার চেঁচামেচি, ডাক্তার ডাকাডাকি ইত্যাদি।
আমার সেরে উঠতে বোধ হয় দিনদুয়েক সময় লেগেছিল। ছাত থেকে পড়ার সময় বারান্দার রেলিঙে বাঁ পায়ের হাঁটুটায় চোট লেগেছিল। দিন দুয়েক মালিশ-টালিশ করতেই ভালো হয়ে গেল। ঠিক চার দিনের দিন আবার বালির কাগজের খাতায় হস্তলিপি নিয়েই স্কুলে গিয়ে হাজির হলুম।
প্রথম ঘণ্টায় যথারীতি দুই নম্বরের শিক্ষয়িত্রী সবার হাতের লেখা দেখে নাম-সই করে দিলেন। প্রতিদিন কার্যারম্ভেই যে হতভাগ্য তাঁর মেজাজ বিগড়ে দেয়, সে না থাকায় হয়তো মনটা তাঁর খুশিই ছিল। ‘রয়েল রিডার ওল্ড নং ১’-এর ঘোড়ার গল্প খুলে পড়াতে গিয়ে আমার দিকে চোখ পড়তেই তিনি বললেন, কে রে, স্থবির এসেছিস! আয় আয়, এদিকে আয়।
এ যেন একেবারে অন্য কোনো লোক! আমি ধীরে ধীরে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে স্নেহার্দ্র স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছিস?
ভালো আছি।
তিনি আমাকে আরও কাছে নিয়ে সস্নেহে গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন, কাল তোর মার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি কত দুঃখ করতে লাগলেন। তোর নাকি আরও ফাঁড়াআছে, আর ছাতে উঠিসনি–ইত্যাদি কত কি যে বলতে লাগলেন, বিস্মৃতির অতল সাগরে সে-সব কথা তলিয়ে গেছে। শুধু মনে আছে, তাঁর স্নেহের সেই স্পর্শ, তাঁর কণ্ঠস্বরের মধ্যে আমার সুখদুঃখের প্রতি গভীর সহানুভূতি আমার মর্মে গিয়ে আঘাত করতেই দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনমাসব্যাপী প্রতিদিনের সেই পীড়নের ইতিহাস অশ্রুজলে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। কুকুর যেমন নিঃশব্দে মনিবের আদর গ্রহণ করে, তাঁর স্নেহের পরশ আমি তেমনই করে উপভোগ করতে লাগলুম। কত কথা, কত কৃতজ্ঞতা সেই শিশুমনের মধ্যে গুমরে গুমরে ফুলতে লাগল, তা কোনোদিন প্রকাশ করবার অবকাশ পাইনি। আজ সম্ভ্রমের সঙ্গে তাঁর সেই ঋণ স্বীকার করছি।
আমার আরও ফাঁড়া আছে–এ কথাটা যে কেমন করে বাড়ির লোক জানতে পারলে, জানি না। রাস্তায় বেরুনো বন্ধ তো ছিলই, এই ঘটনার পর ছাতে ওঠাও আমাদের বন্ধ হয়ে গেল। পুজোর সময় পাছে সারাদিন দুরন্তপনা করে বেড়াই, সেই ভয়ে ছুটি হতে-না-হতে আমাকে মার সঙ্গে চালান করে দেওয়া হল পূর্ববঙ্গের এক গ্রামে। আমার তত্ত্বাবধানের জন্যে দেবীসিং দরওয়ান চলল আমার সঙ্গে।
এই ছ-বছর বয়সে বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হল। এর আগে কলকাতার আশেপাশে দু-একটা বাগানবাড়ি দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। পল্লীগ্রামে এসে আমার মনে হল, আমি যেন প্রকাণ্ড একটা বাগানে এসে উপস্থিত হয়েছি। আহা! আহা! কি মজা! কি মজা! শিশুচিত্তের যে উল্লাস আমি কোন ভাষায় বর্ণনা করব! আজকের পল্লীমাতার অঙ্গ দুর্গন্ধে ভরে উঠেছে, কিন্তু সেদিন প্রথমেই আমায় আকর্ষণ করেছিল পল্লীগ্রামের সেই গন্ধ–যা শহরে দুর্লভ। দিনের বেলায় কত ফুল চারিধারে ফুটে থাকে! কি বিচিত্র রঙ ও রেখার কারিগরি! তাদের নাম জানি না, কিন্তু দেখামাত্র মনে হয়, কতদিনের পরিচয় যেন তাদের সঙ্গে! কত অদ্ভুত পোকা, কত রঙ-বেরঙের পাখি! কত বাহারের নামই-বা তাদের! রাত্রে রহস্যময় শেয়ালের ডাক–যে শেয়ালের গল্প শুনতে শুনতে কতদিন মার কাছে ঘুমিয়েছি; আর গাছে গাছে জোনাকির ফুলঝুরি–কোথায় লাগে কালীপুজোর ফুলঝুরি তার কাছে! প্রকৃতির সঙ্গে কত ভাবে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হতে লাগল। আরও বাকি থাকে–প্রতিদিনই নতুন কিছু দেখি, নতুন কিছু শিখি। প্রকৃতির ভাণ্ডারে কত রত্ন! পাঁচ-ছ মাস ইস্কুলে যাতায়াত করে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, এখানে এসে যেন বেঁচে গেলুম।
দু-দিনেই বন্ধুবান্ধবী জুটে গেল বোধ হয় বিশ-পঁচিশটি। তাদের সঙ্গে যেন কতদিনের পরিচয়! এই আনন্দের মধ্যে অস্থির ও দাদার জন্যে মাঝে মাঝে ভারি কষ্ট বোধ হত। রাত্রে মার পাশে শুয়ে তাঁর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে খোশামোদ করতুম, দাদা আর অস্থিরকে নিয়ে এস না মা।
মা বলতেন, আরে দাঁড়াও বাপু! তোমাকে এখন ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচি। যা ছেলে জন্মেছ তুমি!
একেবারে দমে যেতুম।
নিরবচ্ছিন্ন ফুর্তির আর একটি বাধা ছিল আমার দেবীসিং! যেখানেই যাই, ছায়ার মতন ব্যাটা সঙ্গে সঙ্গে ফেরে, আর আধ ঘণ্টা অন্তর আমাকে মন্ত্রপূত শরবৎ খাওয়ায়, বোধ হয় ফাঁড়া কাটাবার জন্যে। এই দুটি রাধা ছাড়া–ওঃ, কি ফুর্তি! কি ফুর্তি।
ফুর্তির আরও একটু বাকি ছিল। সেই কথাটাই এখন বলি।
আমরা যাঁদের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলুম, তাঁরা হচ্ছেন জমিদার। সেখানকার হালচালই আলাদা। সে হালচাল কলকাতার সাধারণ লোক কল্পনাই করতে পারবে না। একটা উদাহরণ দিই–লাট্টু ঘোরাতে আমি বড্ড ভালোবাসতুম এবং সেই বয়সেই আমি একটি পাকা লাট্টু ঘুরিয়ে হয়ে উঠেছিলুম। আমার নিজের আট-দশটা লাট্টু ছিল। কিন্তু আসবার সময় ভুলে সেগুলো কলকাতাতেই ফেলে এসেছিলুম। এখানে এসে লাট্টুর শোকে মার জীবনটি অতিষ্ঠ করে তুললুম। পাড়াগাঁয়ে তিনি লাট্টু পাবেন কোথায়! সবেমাত্র তেতলার ছাত থেকে পড়ে বেঁচে-যাওয়া ছেলেকে যে অন্য শিক্ষা দিয়ে লাট্টুর শোক ভুলিয়ে দেবেন, তাও প্রাণ ধরে পেরে উঠছেন না। এমন সময়ে একদিন লাট্টুর জন্যে আমাকে কাঁদতে দেখে জমিদার-গিন্নি বললেন, কি হয়েছে বাবা, চোখে জল কেন?
লাট্টু।
তিনি মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, লাট্টু কি?
লাটিম।
ও লাটিম চাই? এই কথা! তা কান্না কিসের?
তখুনি কুঁদো কাঠ এসে গেল। কোথায় ছিল মিস্তিরির দল, তাদের ডেকে আনা হল। তারা চাকা ঘুরিয়ে লাট্টু কুঁদতে আরম্ভ করে দিলে। রাজ্যের ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়াল উঠোন ঘিরে। সন্ধে নাগাদ প্রায় পঞ্চাশটা লাট্টু এসে গেল আমার খাস তাঁবে।
আমার মনে হতে লাগল, এই যেন আমার আসল জায়গা। এইখান থেকে উপড়ে নিয়ে গিয়ে আমাকে শহরের টবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তারপর যেদিন শুনলুম, গ্রামের ত্রিসীমানার মধ্যে ইস্কুল বলে কোনো পদার্থের বালাই নেই, তখন মাকে বলে ফেলা গেল, মা, আমি এইখানেই থাকব।
জমিদার-বাড়ির কয়েকজন মহিলা আমায় বললেন, আমরা তোমায় যেতে দোব না, তোমরা এইখানেই থাকবে।
ফুর্তির চোটে তিন লাফ মেরে বেরিয়ে পড়লুম বাড়ি থেকে! দেবীসিং ছুটল পিছু-পিছু। ছুটলুম নদীর ধারে–যেখানে রঙ-বেরঙের হাঁস সারাদিন চরে বেড়ায়, সন্ধেবেলা কোথায় উড়ে চলে যায়–হিমালয়ের বুকে মানস সরোবরে; যেখানে পাড়ে কত রকমের পোকা-মাকড়, শামুক–ছোট ছেলে দেখলেই গর্তে ঢুকে পড়ে, ধরতে পারা যায় না, মাটির বুকে যেখানে নদীর স্রোত প্রতিদিন বিচিত্র অক্ষরে মনের কথাটি লিখে রাখা যায়; দেবীসিং ব্যাটা তার কি বুঝবে!
জমিদার-বাড়িতে খুব ধুম করে সমস্ত পুজো হত। সেদিন বোধ হয় কালীপুজোর ভাসানের দিন। শোনা গেল, নদীতে বাচ-খেলা হবে আর হবে বাই-নাচ। সমস্ত দিন উৎকণ্ঠায় কাটতে লাগল। বাচ-খেলা আবার কিরকম খেলা? ফুটবল-খেলার ধকল কাটতে-না-কাটতে এ আবার এক নতুন খেলা–এ খেলার নাম দাদা পর্যন্ত শোনেনি নিশ্চয়।
বাই-নাচ জিনিসটাই বা কিরকম? ‘পুতুল-নাচের কথা শুনেছিলুম বটে, কিন্তু চোখে কখনও দেখিনি। বাই-নাচ যে কি জিনিস, তা কল্পনা করতে চেষ্টা করতে লাগলুম। আমার মানসপটে স্থাবর জঙ্গম যা কিছু সব বিবিধ অঙ্গভঙ্গিতে নাচতে শুরু করে দিলে।
সন্ধে হতে-না-হতে দেবীসিংসনাথ নদীর ধারে গিয়ে হাজির হলুম। কতকগুলো গাধাবোট-গোছের নৌকো পাশাপাশি বেঁধে তারই পাটাতনের ওপর বড়-গোছের একটি ঢালা বিছানা পাতা হয়েছে। দুটি স্ত্রীলোক খুব সেজেগুজে সেই আসরের এক কোণে চুপ করে বসে আছে। তাদের আশেপাশে দু-তিন জোড়া তবলা বাঁয়া। আসরে ছোট ছেলেপুলে কেউ নেই, জমিদার-বাড়ির আমারই বয়সি একটি মেয়ে ছাড়া; আর যারা আছে, তাদের সকলেরই বয়েস অন্তত ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। আমি আসতেই তাঁরা সকলেই হৈ-হৈ করে আমার অভ্যর্থনা করতে আরম্ভ করলেন, আসুন আসুন স্থবিরবাবু, আসুন। বাড়ির সকলে ভালো তো?…ইত্যাদি। যেন আমিই সে আসরের প্রধান অতিথি।
ব্যাপারটা যে আমাকে ঠাট্টা করা হচ্ছে, তা বুঝেও যতদূর সম্ভব গাম্ভীর্য, অবলম্বন করে তো নৌকোতে উঠলুম। আমার অঙ্গে টকটকে লাল বনাতের কোট। তার পিঠে হাতে সব জরির কল্কা দেওয়া। পরনে লাল জরিপেড়ে শান্তিপুরি ধুতি-কোঁচানো। পায়ে লাল ফুলমোজা, তার ওপরে ডসনের বাড়ির সামনে পেতলের নাল লাগানো বুটজুতো, মাথায় ঘন কোঁকড়া চুলে যতখানি সম্ভব কলকাতাই অ্যালবার্ট টেরি।
এই সজ্জায় সজ্জিত হয়ে বাঁ হাতে কোঁচার ফুলটি আলগোছে ধরে যখন আসরস্থ হলুম, তখন বয়স্কদের মধ্যে হাসির ধুম পড়ে গেল। দেবীসিং বসল আমার পাশে।
নৌকো চলতে শুরু হল। জলের মধ্যে নানা রকমের আতশবাজি ছাড়া হতে লাগল। সেগুলো চ্যা-চো আওয়াজ করতে করতে পাগলের মতন জ্ঞানশূন্যভাবে দিগ্বিদিকে ছুটে লাফিয়ে বেড়াতে আরম্ভ করে দিলে। ব্যাপারটা বেশ মজার লাগতে লাগল।
কিছুক্ষণ আগুনের খেলা চলবার পর গানের হুকুম হল। তবলা বাঁধা শুরু হল–তবলা বাঁধা শেষ হল। যতদূর মনে পড়ে, হারমোনিয়াম ছিল না, সারেঙ্গীর সঙ্গে গান আরম্ভ হল।
সে ধরনের গান আমি ইতিপূর্বে কখনও শুনিনি। আমাদের মন্দিরে বাড়িতে কিংবা ইস্কুলে উপাসনার আগে যে-সব গান শুনেছি, এর সঙ্গে তার কোনো মিলই নেই। একটার পর একটা গান চলতে লাগল–কখনও বাংলায়, কখনও হিন্দিতে। গান শুনতে শুনতে বাবুদের উষ্মা যেন ক্রমেই পড়ে আসতে লাগল। একজনের চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরতে দেখলুম। কেউ কেউ চোখ মুছতে লাগলেন, কেউ বা অশ্রুভারাক্রান্ত জড়িত কণ্ঠে তারিফ করতে লাগলেন, বা বাইজী, বা!
বেশ–বেশ!
আমি সেই সঙ্গীত বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলুম। তান-কর্তব-বাঁটের মধ্যে গানের ভাষা খুঁজে বের করবার চেষ্টা করতে আরম্ভ করে দিলুম। কখনও ভালো লাগে, আবার কখনও হাসি পায়, এই রকম করতে করতে কখন যে সঙ্গীতের মধ্যে ডুবে গেলুম জানি না। আমার মনে হতে লাগল, সমস্ত আকাশ জুড়ে একটা বিরাট আকৃতির ঝড় বইছে। তার মধ্যে কি আকুলতা, কি অনুনয়! কে যেন নিষ্ঠুর চলে গেছে–কে সে, তার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। সে আসবে না, সে আসে না, কিন্তু তাকে পাওয়াই চাই। সে অনুনয়ের মধ্যে মিনতি আছে, অশ্রু নেই, সর্বস্ব সমর্পণ করে তার কাছে অতি হীন হতে চাই, কিন্তু তবুও সে নিঃস্বতার মধ্যে অগৌরব নেই।
আমাদের মাথার ওপরে তারকাখচিত অতি ঘনকৃষ্ণ চন্দ্রাতপ, নীচে কল্লোলময়ী কালিন্দী। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। নৌকোর মধ্যে যে আলো জ্বলছে, তাতে আসরের সবটা আলোকিত হয়নি। কোনো রকমে সকলের মুখ দেখা যাচ্ছে মাত্র। মধ্যে মধ্যে সুরের জাল ভেদ করে দাঁড়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে–ছপ্ ছপ্
গান শুনতে শুনতে আমার মনের মধ্যেও যেন একটু আকুলতা জাগতে লাগল। সে যেন এক বেদনাময় আকুলতা। কাকে যেন চাই, তার সঙ্গে আমার কত দিনের পরিচয়! সে বাবা-মা-ভাই-বোনদের মধ্যে কেউ নয়। কে সে? এই কি যৌনচেতনার উন্মেষ? না, শিশুচিত্তের এই প্রথম জাগরণ?
আবার মুখ তুলে সবার দিকে ভালো করে দেখলুম। সবার মুখই যেন বিষাদে ম্রিয়মাণ। আমার মনে হতে লাগল, আমার মুখও কি ওদের মতোই বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে?
তাদের দেখতে দেখতে আমার চিন্তাধারা আবার অন্য মুখে প্রবাহিত হল। মনে হতে লাগল, ব্রহ্মমন্দিরের মতন এও যেন একটা মন্দির। সেখানে তারা ঘরের মধ্যে বসে, এরা বসেছে প্রশান্ত আকাশের নীচে–জলের ওপরে। তারা মন্দির সাজায়–এরা জলে বাজি ছোঁড়ে। সেখানে বেদীর ওপর বসে শাস্ত্রী মশায় চেঁচামেচি করেন, এখানে ওই মেয়েটি দাঁড়িয়ে গান গায়। শাস্ত্রী মশায়ের ধমক শুনে সেখানে লোকে কাঁদে, মেয়েটির গান শুনে এখানেও লোকে কাঁদে। মনে মনে শঙ্কিত হতে লাগলুম, কোন দিন না আবার এরা রাত্তির চারটের সময় উঠিয়ে স্নান করায়! নৌকো চলেছে, গান চলেছে, তবলা সারেঙ্গী চলেছে, আরও বোধ হয় কিছু কিছু চলছিল, এমন সময় আসরের সবাই একযোগে হৈ-হৈ করে দাঁড়িয়ে উঠল। কি হল? কি হল? নৌকোর তলা ফেঁসে গেছে।
কোথায় রইল অবলা বাইজী আর কোথায় রইল তার তবলা! যে যার নদীর জলে টপাটপ লাফিয়ে পড়তে আরম্ভ করে দিলে।
দেখতে দেখতে আসরের চাদর পর্যন্ত ভিজে উঠল। সবার সঙ্গে আমিও উঠে দাঁড়িয়েছিলুম। বাঁ হাতে কোঁচার ফুল একটু শক্ত করে ধরে ব্যাপারটা কি যে হল তাই হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছি, এমন সময় জমিদার-বাড়িরই একটা চাকর আমায় বললে, স্থবিরবাবু, দাঁড়িয়ে দেখছ কি?
বলেই লোকটা গোঁৎ খেয়ে জলের মধ্যে ঢুকে গেল। দেবীসিং আমার ডান হাতখানা আরও চেপে ধরলে।
ছেড়ে দে দেবীসিং, লাফিয়ে পড়ি।
বলামাত্র দেবীসিং আমার হাতখানা ছেড়ে দিলে। মারলুম লাফ জলের মধ্যে। মনে হল দেবীসিংও যেন আমার সঙ্গে লাফিয়ে পড়ল।
জলের মধ্যে পড়েই আঁকুপাঁকু শুরু হল। একবার তলিয়ে যাই, আবার ভেসে উঠতে-না- উঠতে আবার তলিয়ে যাই। এরই মধ্যে মাঝে মাঝে কে যেন আমাকে ধরবার চেষ্টা করে কিন্তু ধরে রাখতে পারে না।
কিছুক্ষণ বড় কষ্টে কাটল। তারপর একটা আরামের আবেশে সমস্ত দেহ-মন ভরে উঠতে লাগল। ছাত থেকে পড়বার সময় আলসের ধারে পড়ামাত্র প্রায় জ্ঞান লোপ পেয়েছিল–এ যেন সেরকম নয়। টনটনে জ্ঞান আছে, কিন্তু শারীরিক যন্ত্রণা অনুভব করবার ইন্দ্রিয়টি যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুভয় হয়নি, কারণ মৃত্যুর বিবরণ তেমন জানা ছিল না। মনে হতে লাগল, অতি ধীরে ঘুরতে ঘুরতে যেন আমি নীচের দিকে নেমে যাচ্ছি। দাদা অস্থির কিংবা ইস্কুলের বন্ধু-বান্ধবী কারুর কথা মনে এল না। আরামে গা ঢেলে দিয়ে আমি ধরণীর ভিত্তিভূমির দিকে নেমে যেতে লাগলুম। নামতে নামতে এক জায়গায় এসে গতি স্তব্ধ হয়ে গেল। আমার চারিদিকে অপূর্ব এক রকমের আলো উদ্ভাসিত হতে লাগল। এ রকমের আলো আগে কখনও দেখিনি। পার্থিব কোনো আলোর সঙ্গে তার তুলনা হয় না। সঙ্গীতময়ী সে দীপ্তি। তা থেকে বিচিত্র সুরের ঝরনা নেমে এসে আমার কানে বাজতে লাগল ঝিরঝির করে। সেই আলোর মধ্যে একবার কি দুবার মার মুখখানা নিমেষের জন্য ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল, তারপর আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান হল, মনে হল, কঠিন ভূমিতলে আমি রয়েছি। আমার পাশ দিয়েই, বোধ হয় হাতখানেক দূরেই, নদী বয়ে যাচ্ছে। তারই ছলাক ছলাক আওয়াজ কানে আসতে লাগল।
চোখ চেয়ে দেখলুম, মাথায় ওপরে শশীতারাহীন ফ্যাকাশে আকাশ, আর তার ওপর দিয়ে কালো মেঘের পিণ্ড গড়াতে গড়াতে দৌড়চ্ছে।
আমি যে একটা মারাত্মক রকমের বিপদে পড়েছিলুম, তা থেকে উদ্ধার পেয়েছি; কোথায় এসে পড়েছি; এখান থেকে বাড়ি কত দূরে, কেমন করে সেখানে যাব–এসব কোনো চিন্তাই তখন মনের মধ্যে উদয় হল না। শুধু মনে হতে লাগল, আমি একা, কেউ কোথাও নেই। বাবা, মা, ভাই, বন্ধু, বান্ধবী, জন্তু, জানোয়ার, পখি, গাছ, ফুল, গাড়ি, ঘোড়ার যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে সে সবই যেন স্বপ্নে দৃষ্ট। এ ধরায় আমি যেন এই প্রথম এলুম, ইস্কুল-টিস্কুল সেসব দুর্ঘটনা যেন পূর্বজন্মে ঘটে গিয়েছে, সে ভোগ আর ভুগতে হবে না। কাল সকালে রাজকন্যা এই নদীর ধারে নাইতে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে আদর করে তুলে নিয়ে যাবে তার প্রাসাদে।
মনের মধ্যে বেশ একটা উৎসাহের তাড়া পেয়ে উঠে বসলুম। হায়, হায়! দেহের দিকে চেয়ে একেবারে দমে গেলুম। আমার অত সাধের ডসনের বুট আর খুনিরঙের মোজা, অমন বাহারের শান্তিপুরের জরিপেড়ে কোঁচানো ধুতি কোথায় উধাও হয়েছে! গায়ে সেই লাল বনাতের কোটটি ছাড়া কোমরের নীচে থেকে পা অবধি কোথাও একগাছি সুতোর চিহ্নমাত্র নেই। সাংসারিক বুদ্ধি না থাকলেও এটা বেশ বুঝতে পারলুম, এ অবস্থায় রাজকুমারীর চোখে পড়লে অভ্যর্থনাটা মোটেই মনোরম হবে না।
চুপ করে বসে ভাবতে লাগলুম। একে একে বাড়ির সবার কথা মনে পড়ে কান্না পেতে লাগল, আর করতে লাগল শীত। ও! কি দারুণ শীত সে!
কতক্ষণ এই ভাবে বসে ছিলুম, ঠিক বলতে পারি না, বোধ হয় ঘণ্টাদুয়েক হবে। তারপরে হঠাৎ আকাশের এক দিকে অনুরু অরুণের আগমনবার্তা আলোর অক্ষরে ফুটে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ভরসায় বুক ভরে গেল।
তখনও আকাশচত্বরে সূর্য দেখা দেয়নি, কিন্তু দূরে কাছে সব জিনিস বেশ দেখা যাচ্ছে। আমি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দূরে দেখবার চেষ্টা করছি এমন সময় দেখতে পেলুম, কে যেন ঝপাঝপ আওয়াজ করে সাঁতার কাটতে কাটতে তীরের দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটা বুকজলে এসে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে তারপরে জল ঠেলে ঠেলে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। দূর থেকে তাকে মোটেই চিনতে পারিনি, একেবারে কাছে এলে দেখলুম, সে দেবীসিং।
আমি চিৎকার করে ডাকলুম দেবীসিং, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
দেবীসিং আমার কাছে এসে হাঁপাতে লাগল। কোথায় গেছে তার বিশাল পাগড়ি, হাঁটু অবধি ঝোলা মোটা ছিটের পিরান তাও অঙ্গে নেই। ধুতিটা বাঁধা আছে বটে তারও অনেক জায়গা ছিঁড়ে গেছে। সেই অবকাশ দিয়ে তার রোমশ ব্যায়ামপুষ্ট দেহ দেখা যাচ্ছে। সমস্ত মুখ গা হাত পা তার সাদা হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমাকে দেখে সে উবু হয়ে বসে বললে, পিঠে চড়।
এক লাফে পিঠে চড়ে বেশ করে তার গলাটা জড়িয়ে ধরলুম। আর কোনো কথা না বলে সে জলের মধ্যে নেমে ঝপাঝপ করে সাঁতরে চলল যে দিক থেকে এসেছে সেই দিকে।
প্রায় আধ ঘণ্টা সাঁতার কেটে এপারে এসে দেবীসিং পিঠ থেকে নামিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকল। তখন রোদ বেশ চড়চড়ে হয়েছে, গ্রামের লোকজনেরাও বেরিয়েছে। আমাদের আসতে দেখে আগেই তারা ছুটে বাড়িতে গিয়ে খবর দিলে। আমি দেখলুম, মা দৌড়ে আসছেন, তাঁর পেছনে আরও কয়েকটি পুরমহিলা ছুটছেন, তাঁদের পেছনে লোক-লস্কর ও এক পাল ছেলেমেয়ে। মার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েই আমি অজ্ঞান হয়ে গেলুম।
কয় ঘণ্টা বা কয় দিন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলুম জানি না, কিন্তু আমার জন্যে ডাক্তারকে বেশি ভুগতে হয়নি। গ্রামের ডাক্তার আর কবিরাজ মাকে নিয়ে মুশকিলে পড়ল। আমাদের নৌকো বানচাল হওয়ার সংবাদ পাবার পর থেকে আমাকে ফিরে পাওয়া পর্যন্ত মা এমন মাথা কুটেছিলেন যে, তার ঘা সারতে ডাক্তার-বদ্যি ঘায়েল হয়ে পড়ল।
মাস দেড়েক বাদে আমরা কলকাতায় ফিরে এলুম।
অস্থির বললে, স্থরে, তুই, মরে গিয়েছিলি ভাই, আমি তোর জন্যে কত কাঁদলুম!
মা অস্থিরকে ধমক দিয়ে বললেন, অমন কথা আর কখনও মুখে এনো না।
দাদা বললে, খুব ছেলে তৈরি হয়েছিস স্থরে! যেখানে যাবে, সেখানেই হাঙ্গামা বাধাবে!
মা বললেন, আর বোলো না! আমার হাড় ভাজা-ভাজা করলে!
বাবা বললেন, এই ছেলেকে নিয়ে তোমায় অনেক ভুগতে হবে।
মা বললেন, আমার বরাত।
বাবা বললেন, ওর আরও অনেক ফাঁড়া আছে। এখন থেকে সাবধান না হলে নিজেই ভুগবে।
বাবার কথা মিলে গেছে। সেই থেকে ফাঁড়াএখনও আমার সঙ্গ ছাড়েনি, তবে তার আক্রমণের ধারাটা বদলিয়েছে মাত্র।
.
আমাদের ছেলেবেলায় মোটরগাড়ি অথবা রিকশাগাড়ির চলন ছিল না। ট্রামগাড়ি ঘোড়ায় টানত। বড় রাস্তায় মাঝে মাঝে ট্রামের ঘোড়াদের আস্তাবল ছিল। ইলেকট্রিক ট্রামের চলন হওয়ায় কোম্পানি সে-সব আস্তাবলের জায়গা বিক্রি করে দিয়েছে। বোধ হয় বলে রাখা ভালো যে, বাংলা বইয়ের বিখ্যাত প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্সের বর্তমান দোকান এই রকম একটা ট্রামের আস্তাবলের জায়গায় তৈরি।
ট্রাম এই আস্তাবলের কাছে পৌঁছলে ঘোড়া বদল হত। ট্রামগাড়ির দু-দিকেই পাদান থাকত। লোক যে দিক দিয়ে ইচ্ছে উঠত নামত। কালীঘাট কি খিদিরপুরের ট্রাম ইঞ্জিনে টানত।
ঘোড়ায়-টানা ট্রামের চালকের মুখে থাকত একটা বাঁশি, সামনে লোক দেখলেই সে কিরকির করে বাঁশি বাজাত। কলকাতার প্রায় প্রত্যেক ছোট ছেলেরই এই রকম একটা বাঁশি থাকত। রাতে তো পথে তখন এত আলো ছিল না, সেইজন্যে সন্ধে হতে-না-হতেই ট্রামের ঘোড়ার গলায় ঘণ্টা বেঁধে দেওয়া হত। পথঘাট অপেক্ষাকৃত নির্জন হয়ে গেলে অনেক দূর থেকে ট্রাম আসার শব্দটা আমাদের বেশ লাগত।
এখনকার মতো ট্রামে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী ছিল না। একখানা ট্রাম, আর তাতে সর্বশ্রেণীর লোকই যাতায়াত করত। ট্রামের ভাড়া শ্যামবাজার থেকে গড়ের মাঠ অবধি ছিল পাঁচ পয়সা। টিকিটের ওপর বাংলা ভাষায় যেসব নির্দেশ লেখা থাকত, তার নিদর্শন আমাদের সহিত্য-পরিষদের মিউজিয়ামে থাকা উচিত।
ঘোড়ার গাড়ি চলত অনেক রকমের। ডাক্তারেরা অনেকেই গোল গাড়ি চড়ে ঘুরতেন এবং ছোট বড় প্রায় সব ডাক্তারই দিশি পোশাকে রুগি দেখতে বেরুতেন। ডাক্তারদের গাড়ি দেখলেই চিনতে পারা যেত। এছাড়া পাল্কিগাড়ি, ফিটনগাড়ি, ভিক্টোরিয়া ফিটন, মি-লর্ড ফিটন, ল্যাভো প্রভৃতি আরও অনেক রকমের গাড়ি চলতি ছিল। জুড়ি-ঘোড়ার গাড়ি তো হরদমই চলত। মাঝে মাঝে, বিশেষ করে বিয়ের শোভাযাত্রা ইত্যাদিতে তিন চার ছয় আট ষোলো, এমনকি চব্বিশ ঘোড়ার গাড়িও রাস্তায় বেরুত। শৌখিন বাবুরা বিকেলবেলায় নিজেরা টমটম হাঁকিয়ে বেড়াতে বেরুতেন। আরামপ্রিয় ধনীরা বেরুতেন জুড়ি-গাড়িতে, দেখতুম কেউ কেউ গাড়িতে বসেই গড়গড়ায় তামাক টানছেন। সহিস-কোচুয়ানদের পোশাক খুবই জগমগে ছিল। ল্যান্ডো বা ফিটন ইত্যাদি বড় গাড়িগুলোর পেছনে সাজগোজ করে দুজন সহিস দাঁড়াত। কোনো জায়গায় মোড় ফেরবার দরকার হলে সহিস দুজন একসঙ্গে চলতি গাড়ি থেকে তড়াক করে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে দৌড়ে গাড়ি পেরিয়ে গিয়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে চিৎকার করত, হেই-ও-ও-ও! অর্থাৎ পদব্রজে যারা যাতায়াত করছ, তারা সতর্ক হও, আমার মনিবের গাড়ি আসছে। গাড়ি ততক্ষণে এসে মোড় ঘুরলেই আবার তারা তড়াক করে গাড়ির পেছনে লাফিয়ে উঠে পড়ত। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে বেশ সমারোহ ছিল।
ঘোড়া জানোয়ারটা আমাদের শিশুচিত্তে খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল। ঘোড়া সম্বন্ধে কত তথ্যই যে শিখেছিলুম, তা মনে পড়লে হাসি পায়। প্রায় রোজই দেখতুম, কোনো-না-কোনো গাড়ির ঘোড়া ক্ষেপে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়চ্ছে। কত লোক চাপা পড়ছে, কেউ-বা একটুর জন্যে বেঁচে যাচ্ছে, রাস্তার দু-ধারে লোক হৈ-হৈ করে চেঁচাচ্ছে। কোচুয়ান কিছুতেই সামলাতে পারছে না, অসহায়ভাবে রাশ টানাটানি করছে, তারপরে দড়াম করে কোনো গ্যাসপোস্টে কিংবা কোনো বাড়ির দেওয়ালে গিয়ে লাগল গাড়ি। কোচুয়ান গিয়ে পড়ল বিশ গজ ছিটকে, আরোহীদের কারুর মাথা চুর হয়ে গেল, কেউ বা বেঁচে গেল।
এ দৃশ্য হামেশা আমাদের চোখের সামনে ঘটত। আমাদের মধ্যেও ঘোড়া-ঘোড়া খেলার খুবই চলন ছিল। একদিন ঠিক আমাদের ইস্কুলের সামনেই ট্রামের ঘোড়া দুটো ক্ষেপে গেল। অন্য গাড়ির ঘোড়া ক্ষেপল তারা মারত রাম-দৌড়, ‘কিন্তু ট্রামের ঘোড়া ক্ষেপলে তারা দাঁড়িয়ে যেত, কিছুতেই নড়তে চাইত না। মারধর, টানাটানি, ঠেলাঠেলি, অন্য ঘোড়া এনে তাদের দুপাশে জুতে দিয়ে টানাবার চেষ্টা করিয়েও যখন কিছুতেই তারা স্বীকৃত হত না, তখন তাদের খুলে নিয়ে অন্য একজোড়া ঘোড়া এনে জুতে দেওয়া হত।
সেদিনও এই রকম হল। ঘোড়া দুটো অনেক রকমের নির্যাতন সহ্য করেও জেদ করে দাঁড়িয়ে রইল। বোধ হয় ট্রাম-কোম্পানির ঘোড়াদের কাছ থেকেই মানুষের মনে নিরুপদ্রব অসহযোগের অনুপ্রেরণা এসেছে।
যা হোক, ইস্কুলের ছেলেদের মধ্যে সেদিনকার সেই অশ্বিনীতনয়-যুগলের বীরত্ব একটা সাড়া জাগিয়ে তুললে। ছোট ছেলেদের মধ্যে আমি ও আর একটি ছেলে খুব ভালো ঘোড়া বলে বিখ্যাত ছিলুম! তক্ষুনি কোথা থেকে লাকলাইন দড়ি এসে গেল। আমাদের জুড়িতে জোতা হল। আমাদের চেয়ে বড় দুজন ছেলে কোচুয়ান হল, দুটো লম্বা কঞ্চির ছিপটিও দেখতে দেখতে তৈরি হয়ে গেল।
ঘোড়া ছুটতে লাগল, ছুটতে লাগল বলা ভুল হবে, উড়তে লাগল–পক্ষীরাজ ঘোড়া কিনা! ইস্কুলের উঠোন, ঠাকুরদালান, সিঁড়ি কাঁপিয়ে হ্রেষাধ্বনি উঠতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে শপাং শপাং চাবুক চলেছে। যেখানে সে চাবুক পড়ছে, একেবারে লাল দাগ হয়ে যাচ্ছে। ইস্কুলের অন্য ছেলেরাও এসে খেলায় যোগ দিতে লাগল, কেউ সহিস, কেউ বা আগে চিৎকার করতে করতে ছুটেছে–হৈ-হৈ ব্যাপার, মেয়েরা একেবারে তটস্থ।
এতক্ষণ চলছিল মন্দ নয়, কিন্তু চাবুকের কিছু বাহুল্য ঘটায় হঠাৎ ঘোড়ারা ক্ষেপে উঠল। তারা এবার দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে আরম্ভ করে দিল। হ্রেষার সঙ্গে সঙ্গে চাঁটও চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে চাবুকও চলেছে শপাশপ। এই রকম যখন চলেছে, তখন সামনেই একটা মানুষ পড়ে গেল, দেখতে না দেখতে ক্ষ্যাপা ঘোড়ারা গিয়ে তাকে চাপা দিলে অর্থাৎ মারলে এমন ধাক্কা যে সে পপাত ধরণীতলে-
মেয়েটি আমাদের সঙ্গে পড়ত। সে ছিল একের নম্বরের আহ্লাদী আর ছিঁচকাঁদুনে। তাদের পয়সাকড়ি ছিল এবং সে থাকত বোর্ডিঙে। পড়ে গিয়েই সে কাঁদতে শুরু করে দিলে ও একটু পরেই বোর্ডিঙের সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে নালিশ করতে ওপরে চলে গেল। বোর্ডিঙের সুপারিন্টেন্ডেন্টের বিক্রমের কথা আমরা সবাই জানতুম। তাঁর কড়া মেজাজের নানা কাহিনি রোজই ইস্কুলে বোর্ডিঙের মেয়েদের কাছে শোনা যেত, কিন্তু তিনি বোর্ডিঙের লোক বলে ইস্কুলে তাঁকে দেখতে পাওয়া যেত না।
আমাদের কিন্তু তখন সে-সব কথা মনে এল না। আমরা তখন একে ঘোড়া বনে গিয়েছি, তার পরে হয়েছি ক্ষিপ্ত। আমরা দুজনে সেইখানে দাঁড়িয়ে চিঁহিচিঁহি করে চেঁচাতে লাগলুম আর সহিস-কোচুয়ানদের চাঁট ছুঁড়তে আরম্ভ করে দিলুম। সঙ্গে সঙ্গে চাবুকও চলল শপাশপ্।
ঠিক এমনই সময়ে ওপর থেকে তিন-চারজন বড় মেয়ের সঙ্গে আমাদের আহ্লাদী নেমে এল।
তারা আমাদের বললে, ওপরে চল।
ব্যাস্! আগুনে যেন জল পড়ল। কোচুয়ান দুজন তখুনি রাশ ছেড়ে দিলে, সহিসদের মুখ কাঁচুমাচু। আমাদের দুজনের অর্থাৎ ঘোড়াদের বুকও দুড়দুড় করতে আরম্ভ করে দিলে; কিন্তু তা প্রকাশ হয়ে পড়লে ঘোড়ার ইজ্জত থাকে না, তাই আমরা চিঁহি-চিঁহি করতে করতে মাটিতে শুয়ে পড়লুম। মেয়েরা আমাদের চ্যাংদোলা করে তুলে ওপরে নিয়ে গেল।
আমাদের সঙ্গে সঙ্গে সহিস-কোচুয়ানে মিলিয়ে প্রায় পনেরো-ষোলটি ছেলে-আসামি ওপরে উঠে এল। মকদ্দমার ফলাফল দেখতে ইস্কুল-সুদ্ধ মেয়েও এল তাদের পেছনে পেছনে। আমাদের তো সেই অবস্থায় এনে ঘরের মেঝেয় শুইয়ে দেওয়া হল, আমরা শুয়ে-শুয়েই হাত-পা ছুঁড়তে লাগলুম।
হঠাৎ ঘরের একদিককার পর্দা সরিয়ে তোয়ালেয়, হাত মুছতে মুছতে একটি মহিলা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
ওরে বাপ রে! সেই মূর্তি চোখে পড়ামাত্র আমাদের ক্ষিপ্রতা নিমেষের মধ্যে অপসারিত হয়ে গেল।
ঘরের মধ্যে যিনি এলেন, পূর্বে তাঁকে কখনও দেখিনি। মাথার ওপরেই অর্থাৎ ইস্কুলের দোতলায় এমন ভয়ানক একটি জিনিস কি করে আত্মগোপন করে ছিল, তাই ভাবতে লাগলুম। টকটকে গৌর বর্ণ, তার ওপর ঈষৎ লালচে আভা। নাক, চোখ ও মুখাবয়ব প্রায় পুরুষ গ্রিকমূর্তির মতন, কিন্তু দেহ, বিশেষ করে উদরের ব্যাস, বিপুল। মুখভাব এমন কঠিন যে, শিশু তো দূরের কথা, শিশুর বাপও তা দেখলে বিচলিত হয়ে পড়বে।
ঘরের মধ্যে ঢুকে একবার চারদিক চেয়ে তিনি ভূশয্যাশায়ী ঘোঁটকদ্বয়কে ধমক দিয়ে বললেন, উঠে দাঁড়াও।
আজ্ঞা পাওয়ামাত্র কাঁপতে কাঁপতে আমরা উঠে দাঁড়ালাম। তারপর যারা আমাদের পেছনে পেছনে তামাশা দেখতে এসেছিল, সেইসব মেয়েদের দিকে চেয়ে বললেন, তোমরা যাও।
মেয়েরা চলে গেল। তারপর এক এক করে সমস্ত সহিস-কোচুয়ানদের জবানবন্দি নিয়ে শুধু দুটি কোচুয়ান ও ঘোড়া দুজনকে রেখে তিনি সবাইকে বেকসুর মুক্তি দিলেন। সকলে চলে যাওয়ার পর আমাদের বললেন, ওইখানে গিয়ে ‘নীল ডাউন’ (Kneel down) হও।
কিছুক্ষণ সেই অবস্থায় কাটাবার পর আমার ডাক পড়ল, এদিকে এস।
কাঁপতে কাঁপতে উঠে কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। আমার একখানা হাতে জোরে নাড়া দিয়ে বললেন, সেদিন তেতলার ছাত থেকে পড়ে আক্কেল হয়নি তোমার? এখনও এই রকম দুরন্তপনা চলেছে? লজ্জা নেই? দাঁড়াও তোমার মাকে সব বলে দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটবার পর আবার একবার জোরে নাড়া দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলি?
আমরা ঘোড়া-ঘোড়া খেলছিলুম।
ঘোড়া ঘোড়া খেলছিলি তো ওকে ধাক্কা মারলি কেন?
ঘোড়া ক্ষেপে গিয়েছিল যে!
আমার উত্তর শুনে তাঁর সেই কঠোর মুখখানার ওপর দিয়ে বোধ হয় এক মুহূর্তের জন্য ছোট্ট একটু হাসির ঝলক খেলে গেল; কিন্তু সেটা সামলে নিয়ে বললেন, মানুষ-ঘোড়া ক্ষেপে যদি জানোয়ার-ঘোড়ার মতন ব্যবহার করে, তা হলে মানুষে আর জানোয়ারে তফাৎ রইল কোনখানে রে বোকা? তুই কি জানোয়ার-ঘোড়ার মতন ঘাস খাস?
এ কথার কোনো জবাব নেই।
চুপ করে থাকতে দেখে তিনি বললেন, যাও, এমন কাজ আর কখনো কোরো না।
বেঁচে গেলুম। কোচুয়ানদ্বয়কে ডেকে বললেন, খবরদার! আর যদি কখনও দেখি এমন করে কারুকে চাবুক মেরেছ, তা হলে ওই রকম চাবুক তোমাদের পিঠেও পড়বে। বুঝলে?
এসব কথা কি আর বুঝতে দেরি হয়! সবাই মুক্তি পেয়ে গেলুম, কিন্তু ঘোড়ার নেশাটা জন্মের মতো ছুটে গেল’।
এই মহীয়সী মহিলার নাম ছিল লাবণ্যপ্রভা বসু, ইনি সাহিত্য-সেবাও করতেন, ইনি আচার্য জগদীশচন্দ্রের সহোদরা।
কিছু বড় হবার পর আমরা এঁর কাছে পড়বার সুযোগ পেয়েছিলুম। নিজের দেশ, দেশাচার এবং ধর্মের প্রতি যে অসাধারণ অনুরাগ এঁর দেখেছি, তা- আজও বিরল। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, বেদ ও উপনিষদের এক-একটি কাহিনি বর্ণনা করতে করতে তাঁর মুখ লাল টকটকে হয়ে উঠত, অমন কঠিন চক্ষু জলে ভরে আসত। ধনী, দরিদ্র, বয়সে বড় অথবা ছোট, ছেলে কিংবা মেয়ে, কোনো রকম পক্ষপাতিত্বের ধার তিনি ধারতেন না। কোনো রকম ন্যাকামি অথবা নীচতা তিনি সহ্য করতেন না। তাঁর অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে এক ঘণ্টার জন্যে এলেও জীবনে তাঁকে ভুলতে পারা অসম্ভব হত। তখনকার দিনের তুলনায় তিনি উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন, কিন্তু কোনো রকমের গর্ব বা বিলাসিতা তাঁর দেখিনি। বাইরে থেকে দেখতে কঠিন হলেও অন্তর তাঁর মমতায় পূর্ণ ছিল। তাঁর কাছ থেকে অনেক কঠিন শাস্তি পেয়েছি, কিন্তু তার মধ্যে নীচতার লেশমাত্রও থাকত না। আমাদের মনে দেশাত্মবোধের প্রেরণা ইনিই প্রথমে জাগিয়ে তুলেছিলেন। বাল্যজীবনে যত লোকের সংস্রবে এসেছি, তার মধ্যে এঁর মূর্তিই সবার চেয়ে উজ্জ্বলরূপে আমার
মনের মধ্যে ঝকঝক করছে।