১.১ প্রথম খণ্ড –প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮১৫ সালে মঁসিয়ে শার্লস ফ্রাঁসোয়া বিয়েনভেনু মিরিয়েল যখন দিগনের বিশপ হন তখন তার বয়স প্রায় পঁচাত্তর। ১৮০৬ সাল থেকে এই বিশপের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি।
যে কাহিনী আমি বলতে যাচ্ছি তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও তার বিশপ পদ লাভের সময় তাকে কেন্দ্র করে যেসব গুজব রটে, তার কিছু বিবরণ আমাকে অবশ্যই দিতে হবে। কোনও মানুষ সম্বন্ধে লোকমুখে যেসব গুজব শোনা যায়, তার কীর্তিকলাপের মতো এইসব গুজব বা জনশ্রুতিরও একটা বড় রকমের প্রভাব দেখা যায় তার জীবন ও ভাগ্যে। মঁসিয়ে মিরিয়েল ছিলেন আইকস পার্লামেন্টের কাউনূসেলার ও নোবলেসি দ্য রোব-এর সদস্যের পুত্র। শোনা যায় তার বাবা তার মৃত্যুর পর তাঁর পদে যাতে অধিষ্ঠিত হতে পারে তার জন্য ছেলের অল্প বয়সে অর্থাৎ আঠারো থেকে কুড়ি বছরের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করেন তার। পার্লামেন্টের সদস্যদের পরিবারে এই ধরনের প্রথাই প্রচলিত ছিল সেকালে। কথিত আছে এই বিয়ে সত্ত্বেও শার্লস মিরিয়েলকে কেন্দ্র করে অনেক গুজবের সৃষ্টি হয়। তার চেহারাটা বেঁটেখাটো হলেও তিনি বেশ সুদর্শন ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি বিয়ে করে সংসারী হন এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেন।
তার পর ফরাসি বিপ্লব শুরু হতেই পার্লামেন্টের সদস্যদের পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং মিরিয়েল দেশ ছেড়ে ইতালিতে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে নতুনভাবে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর স্ত্রী এই সময় বুকের গোলমালে ভুগে মারা যান। তাঁদের কোনও সন্তানাদি ছিল না। যাই হোক, এই বিপ্লবের পর কী ঘটল মিরিয়েলের জীবনে
তবে কি তার আপন পরিবার ও পুরনো ফরাসি সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক ভাঙন, বিদেশ থেকে দেখা দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া ১৭৯৩ সালের মর্মান্তিক ঘটনাবলি এক বৈরাগ্যবাসনা আর নিঃসঙ্গতার প্রতি প্রবণতা জাগিয়ে তোলে? যেসব বিক্ষুব্ধ ঘটনাবলির উত্তাল তরঙ্গমালা তাঁর জীবনের বহিরঙ্গের ওপর আঘাত হেনে চলেছিল ক্রমাগত সেই আঘাত হয়তো তাঁর মধ্যে সঞ্চার করেছিল এক রহস্যময় জীবনবিমুখতা, যা তাঁর স্বভাবটাকে একেবারে পাল্টে দিয়ে পাহাড়ের মতো এমন এক উতুঙ্গ প্রশান্তি দান করে, যার ফলে জীবনের সকল ঝড়ঝঞ্ঝা ও দুঃখবিপর্যয়ের মাঝে অটল ও অবিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু এমন কথা কেউ ঠিকমতো বলতে পারে না। তার সম্বন্ধে শুধু এইটুকুই জানান যায় যে ইতালি থেকে দেশে ফিরে এসেই তিনি যাজকের পদ গ্রহণ করেন।
১৮০৪ সালে মিরিয়েল ব্রিগনোলের পল্লি গির্জার যাজক হন এবং সেখানে এক নির্জন পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে থাকেন।
সম্রাট নেপোলিয়ঁনের রাজ্যাভিষেকের সময় মিরিয়েলকে তাঁর গির্জার কিছু কাজের ব্যাপারে একবার প্যারিসে যেতে হয়। এই সময় যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, সম্রাটের কাকা কার্ডিনাল ফ্রেস্ক তাদের অন্যতম। একদিন তিনি যখন কার্ডিনালের ঘরের বাইরে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন সম্রাট নেপোলিয়ঁন তাঁর কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তার ঘরে। ঘরে যাওয়ার পথে নেপোলিয়ঁন মিরিয়েলকে তাঁর পানে সশ্রদ্ধভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করেন, কে আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন?
মিরিয়েল উত্তর করেন, মহাশয়, আমার মতো একজন অতিসাধারণ ব্যক্তি আপনার মতো এক মহান ব্যক্তির পানে তাকিয়ে আছে। এতে হয়তো আমরা উভয়েই উপকৃত হতে পারি।
সেদিন সন্ধ্যায় ম্রাট নেপোলিয়ঁন কার্ডিনালকে মিরিয়েলের কথা জিগ্যেস করেন। তার কিছু পরেই একথা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে যান মিরিয়েল যে তিনি দিগনের বিশপ পদে নিযুক্ত হয়েছেন।
মঁসিয়ে মিরিয়েলের বাল্যজীবন সম্বন্ধে কেউ কিছু জানত না বা জোর করে কোনও কিছু বলতে পারত না। ফরাসি বিপ্লবের আগে তাঁর পরিবার সম্বন্ধে যারা সব কিছু জানত তাদের কেউ ছিল না তখন। একটা সামান্য গাঁ থেকে একটা ছোট শহরে আসার পর তাকে নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। অনেকে অনেক কথা বলতে থাকে। কিন্তু পদমর্যাদার খাতিরে সব কিছু সহ্য করে যেতে হয় তাঁকে। তবে তাঁর সম্বন্ধে এইসব চর্চা নিতান্ত অর্থহীন গুজব আর মনগড়া কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।
যাই হোক, দিগনের বিশপ হিসেবে আসার পর থেকে বছর কয়েকের মধ্যে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া সব গুজব আর যত সব গল্পকাহিনী স্তব্ধ হয়ে যায়। সেসব কথা ভুলে যায় সকলে। কেউ কোথাও সেসব কথা আর উল্লেখ করত না।
মঁসিয়ে মিরিয়েল যখন দিগনেতে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর অবিবাহিত বোন ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনে আর মাদাম ম্যাগলোরি। ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনে ছিল বিশপ মিরিয়েলের থেকে দশ বছরের ছোট আর ম্যালোরি ছিল বাপতিস্তিনের সহচরী দাসী আর সমবয়সী। ঘরসংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সব ম্যাগলোরিই করত।
বিগতযৌবনা ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনের চেহারাটা ছিল বরাবরই লম্বা আর রোগা। যৌবনের কোনও সৌন্দর্য ছিল না তার দেহে। কিন্তু চেহারাটা রোগা হলেও তার চোখে-মুখে এমন এক শান্তশ্রী ছিল, যাতে তাকে এক নজরেই একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা বলে মনে হত। সততা আর মহানুভবতার যে একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, বাপতিস্তিনে সারাজীবন জনহিতকর কাজ করে আসার জন্য সেই সৌন্দর্যের একটি স্নিগ্ধ জ্যোতি সব সময় আচ্ছন্ন করে থাকত তার মুখমণ্ডলকে। যৌবনে তার যে দেহটি ছিল শীর্ণ ও অস্থিচর্মসার, প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক স্বচ্ছ উজ্জ্বলতার আধার হয়ে ওঠে সেই শীর্ণ দেহটি। তার চেহারা দেখে যৌবনেই মনে হত সে যেন কোনও কুমারী নারী, এক বিদেহী আত্মা, এক অবয়বহীন ছায়া, যে ছায়া থেকে সব সময় বিচ্ছুরিত হতে থাকে এক আশ্চর্য জ্যোতি। তার বড় বড় আয়ত দুটি চোখের দৃষ্টি সব সময় অবনত থাকত মাটির উপর। মনে হত তার আত্মা মাটির পৃথিবীতেই বিচরণ করে বেড়ায় সদাসর্বদা।
বিশপ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দিগনেতে আসার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি বিধান অনুসারে প্রচুর সম্মান পেতে থাকেন মিরিয়েল। পদমর্যাদার দিক থেকে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের সেনানায়কের নিচেই। তিনি দিগনেতে আসার পর যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করেন তারা হলেন মেয়র আর কাউনসিলার প্রেসিডেন্ট। আর তিনি যাদের সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা হলেন প্রধান সেনাপতি আর পুলিশ বিভাগের প্রধান।
তিনি বিশপ পদ গ্রহণ করার পর থেকে তার কাজকর্ম দেখার জন্য উৎসুক হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল শহরের লোকেরা।
.
২
দিগনেতে বিশপের প্রাসাদোপম বাড়িটি ছিল হাসপাতালের পাশেই। আগাগোড়া পাথর দিয়ে গড়া প্রাসাদটি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের ডক্টর পুগেৎ আর দিগনের তদানীন্তন বিশপ সিমুরের অ্যাবটের দ্বারা নির্মিত হয় ১৭১২ সালে। আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম ব্যবস্থাই ছিল প্রাসাদের মধ্যে। সেখানে ছিল বিশপের নিজস্ব কামরা, বসার ঘর, শোবার ঘর আর সামনের দিকে ছিল বিস্তৃত এক উঠোন। উঠোনের চারদিকে ছিল ফুল ও ফলের সুন্দর সুন্দর গাছে ভরা এক বাগান। বাগানের কাছে একতলায় খাবার ঘরটি ছিল যেমন বড় আর তেমনি সুন্দরভাবে সাজানো। ১৭১৪ সালে মঁসিয়ে পুগেৎ এই খাবার ঘরেই কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এক ভোজসভায় আপ্যায়িত করেন। সেইসব ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন ফিলিপ দ্য ভেঁসেম, গ্রাদ প্রিয়র অব ফ্রান্স, চতুর্থ হেনরির প্রপৌত্র আর গ্যাব্রিয়েল দেস্ত্রি। সাতজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তির পূর্ণাবয়ব চিত্র এই ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছিল এবং চিত্রগুলোর তলায় মর্মরপ্রস্তরের উপরে সোনার অক্ষরে লেখা ছিল ওই ব্যক্তিদের পরিচয়লিপি।
হাসপাতালের বাড়িটি ছিল দোতলা এবং তার সামনেও একটি বাগান ছিল। তবে বাড়িটা খুব একটা বড়সড় ছিল না।
দিগনেতে আসার পর তৃতীয় দিনে হাসপাতালটা দেখতে যান বিশপ মিরিয়েল। দেখার পর হাসপাতালের ডিরেক্টরকে তার প্রাসাদে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।
খাবার ঘরে বসে ডিরেক্টরকে প্রশ্ন করেন মিরিয়েল, কতজন রোগী আছে হাসপাতালে।
পঁচিশজন মঁসিয়ে।
রোগীর সংখ্যা তো দেখছি অনেক।
রোগীদের বিছানা ও খাটগুলো গাঁয়ে গায়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে স্থানাভাবে।
তা তো দেখছি। ওয়ার্ডগুলো এক একটি ছোট ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাতে আলো-বাতাস খেলে না।
হ্যাঁ। ব্যাপারটা তাই।
আবহাওয়াটা উজ্জ্বল থাকলেও একটু সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের বাগানে বসার জায়গা থাকে না।
আমারও তাই মনে হয়।
আর কোনও মহামারী দেখা দিলে যেমন এ বছর টাইফাস রোগ মহামারীর আকার ধারণ করে এবং বছর দুই আগে এক মারাত্মক সামরিক জ্বর দেখা দিলে একশো জন রোগীকে সামলাতে হয় আমাদের এই হাসপাতালে। তখন কী যে করব, তা বুঝে উঠতে পারি না।
মিরিয়েল বললেন, আমিও সে কথা ভেবেছি। আচ্ছা, এই ঘরটাতে কতগুলো রোগীর বিছানা ধরতে পারে?
ডিরেক্টর আশ্চর্য হয়ে বললেন, বিশপের খাবার ঘরে?
বিশপ ঘরখানার আয়তন ঘুরে দেখে আপন মনে বললেন, অন্তত কুড়িটা বিছানা ধরবে।
এরপর স্পষ্ট করে বললেন, শুনুন মঁসিয়ে ডিরেক্টর, একটা ভুল হয়ে গেছে। আপনাদের পাঁচ-ছ’টা ছোট ঘরে ছাব্বিশটা রোগী থাকে, অথচ আমাদের এই এত বড় বাড়িতে যেখানে ষাটজন লোক থাকতে পারে সেখানে আমরা মাত্র তিনজন থাকি। এমন অবস্থায় আমরা বরং ওই বাড়িতে চলে যাব আর আপনারা এই বাড়িটা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করবেন।
পরদিনই বিশপের প্রাসাদে ছাব্বিশজন গরিব রোগী চলে এল আর বিশপ চলে গেলেন হাসপাতালের বাড়িতে।
মঁসিয়ে মিরিয়েলের ব্যক্তিগত কোনও সঞ্চয় ছিল না। বিপ্লবে তাঁর পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। তাঁর বোনের বার্ষিক যে পাঁচশো ফ্রাঁ আয় ছিল, গত এক বছরে সেই আয় নানা পারিবারিক প্রয়োজনে খরচ হয়ে যায়। কারণ সামান্য এক গ্রাম্য যাজক থাকাকালে তার আয় খুব কম ছিল। বিশপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাৎসরিক বেতন পনেরো হাজার ফ্রাঁতে দাঁড়ায়। এই টাকা থেকে সারা বছরে ব্যক্তিগত খরচ হিসেবে মাত্র এক হাজার ফ্রাঁ রেখে বাকি সব টাকা তার এলাকার মধ্যে নানা ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজে ব্যয় করার একটি খসড়া তৈরি করেন। তার থেকে বোঝা যায় তার এলাকায় গরিব-দুঃখীদের দুঃখমোচন, গরিব ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি, কারাগারের উন্নতি, দুস্থ পরিবারের রোজগারি বন্দিদের মুক্তি, যত সব গ্রাম্য গির্জার ও যাজকদের উন্নতি প্রভৃতির ব্যাপারে তিনি তার আয়ের প্রায় সবটাই খরচ করতেন।
দিগনের গির্জায় মঁসিয়ে মিরিয়েল আসার পর থেকে তার সংসারের আয়-ব্যয় সম্বন্ধে যে ব্যবস্থা করেন তা তাঁর বোন ম্যাদময়জেল বাপতিস্তিনে অকুণ্ঠভাবে মেনে নিতে বাধ্য হন। বাপতিস্তিনের কাছে মিরিয়েল ছিলেন একাধারে বড় ভাই, মহামান্য বিশপ এবং পরম বন্ধু। মিরিয়েলকে তিনি এতই ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন যে বিশপ যখন কোনও কথা বলতেন বা কাজ করতেন তখন তাঁর বোন মাথা নিচু করে তার সব কথা শুনতেন, তার সব কাজ সমর্থন করতেন। একমাত্র ম্যাগলোরি মাঝে মাঝে ক্ষোভ প্রকাশ করত। বিশপের আয়-ব্যয়ের যে খসড়া পাই তার থেকে জানতে পারি তিনি বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত খরচের জন্য মাত্র এক হাজার ফ্রাঁ রেখে দিতেন। তাঁর বোনের পাঁচশো ফ্রাঁ বাৎসরিক আয় ছিল। দু জনের মোট পনেরোশো ফ্রাঁ আয়ে তাদের সংসার চালাতে হত।
এই আয়ের মধ্যেই তাদের অতিথিদের আপ্যায়ন করতে হত। দিগনের গির্জায় যখন কোনও গ্রাম্য যাজক যোগদান করতে আসতেন বিশপের সঙ্গে তখন তারা সাধ্যমতো খরচ করে আদর-আপ্যায়ন করতেন।
দিগনেতে আসার তিন মাস পরে বিশপ একদিন বাড়িতে বললেন, এখনও আমার অর্থের টানাটানি চলছে।
ম্যাগলোরি বলল, আমারও তাই মনে হয়। মঁসিয়ে সরকারের কাছে আপনার ভ্রমণকার্যের জন্য যানবাহন খরচ বাবদ কিছু অর্থের জন্য আবেদন করতে পারেন।
বিশপ বললেন, ঠিক বলেছ ম্যাগলোরি।
সত্যি সত্যিই সরকারের কাছে আবেদন জানালেন বিশপ। কিছুদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে বিশপের যানবাহন ও ডাকখরচের জন্য বাৎসরিক তিন হাজার ফ্ৰাঁ মঞ্জুর করলেন।
এই অর্থ মঞ্জুরির ব্যাপারটা শহরের বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে এক আলোড়ন সৃষ্টি করল। এক চাপা প্রতিবাদের গুঞ্জনধ্বনি শোনা যেতে লাগল অনেক জায়গায়। সম্রাটের কাউন্সিলার একজন সিনেটার মন্ত্রীর কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়ে এক চিঠি লিখলেন। তিনি লিখলেন, যানবাহন খরচ? যে শহরে চার হাজারেরও কম লোক বাস করে সেখানে আবার যানবাহন খরচ কিসের? ডাকখরচ আর গ্রামযাত্রাই-বা কিসের? গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবারই-বা কী দরকার? পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে কোনও রাস্তাঘাট বা যাতায়াত ব্যবস্থা নেই সেখানে গাড়িতে করে নিয়মিত চিঠি বিলি করার কীই-বা প্রয়োজন? লোকে ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করে। শাতো আর্নোতে দুরান্স নদীর উপর যে সেতু আছে তা বোধ হয় গরুর গাড়ির ভার সহ্য করতে পারবে না। সব যাজকই এক প্রকৃতির লোভী ও কৃপণ। এই বিশপটি প্রথম প্রথম কিছু গুণের পরিচয় দিয়ে এখন আবার আর পাঁচজন সাধারণ যাজকের মতই নিজমূর্তি ধারণ করেছে। তাঁর আবার গাড়ি চাই, যানবাহনের। ব্যবস্থা চাই। আগেকার আমলের বিশপরা যেসব বিলাসব্যসন ভোগ করতেন ইনিও তাই চান। এইসব যাজক দ্বারা কোনও কাজই হবে না।
ম্যাগলোরি কিন্তু অর্থ মঞ্জুরির কথাটা জানতে পেরে খুশি হল। সে একদিন বাপতিস্তিনেকে বলল, মঁসিয়ে প্রথমে পরের কথা খুব ভাবতেন, এখন তাকে নিজের কথা কিছু ভাবতে হচ্ছে। তিনি দানের কাজে সব অর্থ খরচ করে ফেলেছেন। এখন এই তিন হাজার ফ্রাঁ আমাদের হাতে থাকবে।
কিন্তু সেইদিন সন্ধ্যাতেই কিভাবে ওই তিন হাজার ফ্রাঁ খরচ করবেন তার একটা খসড়া তৈরি করে তার বোনের হাতে দিয়ে দিলেন বিশপ।
এছাড়া চার্চের ধর্মীয় ব্যাপারে ও দানের কাজে আরও যেসব খরচ হত সে খরচের অর্থ তিনি ধনীদের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে আদায় করতেন। ধনীদের কাছ থেকে অনেক সময় চাঁদা তুলে গরিবদের দান করতেন। যেসব ধনীর কাছে চাঁদা বা ভিক্ষা চাইতে যেতেন না মিরিয়েল, তারাও তার নামে দানের টাকা পাঠিয়ে দিতেন। এইভাবে অনেকেই সাহায্য করত। এক বছরের মধ্যেই দানের ব্যাপারে মোটা অঙ্কের অর্থ এসে জমল বিশপ মিরিয়েলের হাতে। কিন্তু এত সব টাকা হাতে আসা সত্ত্বেও মিরিয়েলের জীবনযাত্রার কোনও পরিবর্তন হল না। দানের জন্য জমা টাকা থেকে একটা পয়সাও ব্যক্তিগত ব্যাপারে খরচ করতেন না তিনি। তাছাড়া হাতে টাকা আসতে না আসতেই তা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন মিরিয়েল। দানের থেকে দারিদ্র্য ও অভাব সব সময়ই অনেক বেশি বলে মাঝে মাঝে টাকার টানাটানি হত। তখন তাঁকে ব্যক্তিগত সংসারের খরচের টাকা থেকে সে টাকার অভাব পূরণ করতে হত।
তখনকার দিনের একটি প্রথা ছিল : বিশপরা যখন গ্রামাঞ্চলে তাঁদের কোনও চিঠি বা নির্দেশপত্র পাঠাতেন তখন সেই সঙ্গে তাঁদের খ্রিস্টীয় নামগুলো ও ডাকনামগুলোর একটি তালিকা দিতে হত তাঁদের। সেইসব নাম থেকে যে নামটি সবচেয়ে অর্থপূর্ণ মনে হত গ্রামবাসীদের, বিশপকে তারা সেই নামে ডাকত। বিশপ মিরিয়েলকেও তার এলাকার গ্রামবাসীরা ‘বিয়েনভেনু’ এই নামে ডাকত। ‘বিয়েনভেনু’ কথাটির অর্থ হল স্বাগত।
আমরা বিশপ মিরিয়েলের যে জীবন-চিত্র আঁকতে চলেছি তা হুবহু সত্য না হলেও তার সঙ্গে তাঁর জীবনের অনেক মিল আছে।
.
৩
বিশপ যদিও যানবাহন খরচের টাকাটা গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন তবু গ্রাম পরিক্রমার বা পরিদর্শনের কাজে কোনওরূপ অবহেলা করতেন না তিনি। দিগনে অঞ্চলটা ছিল পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এবং তার ভূমিপ্রকৃতি ছিল বন্ধুর। সমতল জায়গা খুব কমই ছিল। দিগনের অধীনস্থ এলাকার মধ্যে ছিল বত্রিশটা গ্রাম্য গির্জা, একচল্লিশটা ছোট গির্জা আর দুশো পঁচিশটা ব্যক্তিগত গৃহসংলগ্ন উপাসনাকেন্দ্র। এই সমস্ত গির্জা আর উপাসনাকেন্দ্র ঘুরে বেড়িয়ে দেখা কোনও লোকের পক্ষে সত্যিই এক কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু বিশপ মিরিয়েল শত কষ্টকর হলেও তা করতেন। তিনি নিকটবর্তী গ্রামগুলো পায়ে হেঁটে যেতেন, সমতল জায়গাগুলো মালবাহী গাড়িতে এবং পার্বত্য এলাকাগুলো ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া-আসা করতেন। তাঁর বোন ও ম্যাগলোরিও প্রায়ই তাঁর সঙ্গে যেতেন। তবে যেসব জায়গায় পথ খুবই দুর্গম সেখানে বিশপ একাই যেতেন।
একদিন সিনেজ নামে একটি ছোট শহরে যান বিশপ মিরিয়েল। সেখানে যাজকদের এক সরকারি অফিস ছিল। তিনি সেখানে একটি গাধার পিঠে চেপে যান। তাঁর হাতে তখন পয়সা বেশি না থাকায় অন্য কোনও যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। তাঁকে গাধার পিঠে শহর ঘুরতে দেখে মেয়র তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসে আশ্চর্য হয়ে যায়। শহরের লোকরা হাসাহাসি করতে থাকে।
মিরিয়েল তখন শহরের সমবেত জনগণের উদ্দেশে বলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, আমি বুঝতে পেরেছি, কেন আপনারা আশ্চর্য হয়েছেন। আপনারা ভাবছেন, আমার মতো সামান্য এক যাজক কেন যিশু খ্রিস্টের মতো গাধার পিঠে চড়ে এসেছে এবং ওটা তার অহঙ্কারের পরিচায়ক। কিন্তু আমি আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি, এ কাজ আমি অভাবের বশবর্তী হয়েই করেছি, অহঙ্কারের বশে নয়।
এইভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে শান্ত ও সহজভাবে কথাবার্তা বলতেন মিরিয়েল। প্রথাগত ধর্মীয় প্রচার বা বক্তৃতার পরিবর্তে সরলভাবে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জনগণকে শিক্ষা দিতেন। এমন কোনও গুণানুশীলনের কথা তিনি বলতেন না, যা সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে।
এমন কোনও যুক্তি বা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করতেন না, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে না। কোনও অঞ্চলের অধিবাসীর গরিবদের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করলে তিনি প্রতিবেশীদের দৃষ্টান্ত দিয়ে তাদের বোঝাবার বা শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ব্রিয়ানকলের লোকদের কথা একবার ভেবে দেখ। তার গরিব, নিঃস্ব ও বিধবাদের আর সকলের থেকে তিনদিন আগে খড় কেটে নেওয়ার সুযোগ দেয়। গরিবদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেলে গাঁয়ের সঙ্গতিসম্পন্ন লোকেরা বিনা পয়সায় তাদের ভাঙা ঘর মেরামত করে দেয়। এইভাবে সেখানকার লোকেরা সুখে-শান্তিতে বাস করছে। তিনশো বছরের মধ্যে সেখানে কোনও খুন হয়নি।
যেসব গাঁয়ের লোকে নিজেদের ফসল লাভের ব্যাপারটাকেই বড় করে দেখত তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য মিরিয়েল বলতেন, এমব্রামের অধিবাসীদের কথাটা একবার ভেবে দেখ তো। যেসব বাড়ির মালিক একা অর্থাৎ যাদের ছেলেরা সৈন্যবিভাগে কাজ করে এবং মেয়েরা শহরে চাকরি করে, ফসল কাটার সময় গায়ের লোকেরা সেইসব বাড়ির কর্তাদের সাহায্য করার জন্য নিজেরা তাদের ফসল কেটে দেয়। গায়ের কোনও লোক রুগ্ণ বা পঙ্গু হয়ে পড়লে অন্য সব লোকে তাকে সাহায্য করে এবং তার ফসল কেটে সব শস্য তার ঘরে এনে দেয়।
কোনও গায়ের কোনও পরিবারের উত্তরাধিকারের ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ উপস্থিত হলে বিশপ তাদের বলতেন, একবার দোভোলির পার্বত্য অধিবাসীদের কথা ভেবে দেখ দেখি, ওই অঞ্চলটায় বারো মাসই শীত; বসন্ত আসে না কখনও। প্রায় পঞ্চাশ বছরের মধ্যে একটিবারের জন্যও কোনও নাইটিঙ্গেল পাখি ডাকেনি কখনও। সে গাঁয়ে এক ব্যক্তি মারা গেলে তার ছেলেরা সব পৈতৃক সম্পত্তি বোনদের বিয়ের জন্য রেখে শহরে চাকরি খুঁজতে যায়।
কোনও গাঁয়ের কৃষকরা মামলা-মোকদ্দমায় অনেক খরচপত্র করলে মিরিয়েল তাদের বলেন, একবার কেরাম উপত্যকার অধিবাসীদের কথা ভেবে দেখ। সেখানে তিন হাজার কৃষক বাস করে। যেন একটি ছোটখাটো প্রজাতন্ত্র, তাদের কোনও আদালত বা বিচারক নেই। সেখানে মেয়র সব কিছু করেন। তিনি অধিবাসীদের অবস্থা ও আয় অনুসারে কর ধার্য করেন, কর আদায় করেন, ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে দেন, উত্তরাধিকারের সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে দেন। বিভিন্ন অভিযোগের বিচার করেন, কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনও পয়সা নেন না। তিনি ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি বলে সকলেই তাঁর কথা মেনে চলে।
কোনও গাঁয়ে কোনও স্কুলমাস্টার না থাকলেও বিশপ কেরাম উপত্যকার কথা উল্লেখ করেন। বলেন, ওখানকার অধিবাসীরা কী করে জান? যেসব ছোট ছোট গাঁয়ে মাত্র দশ-পনেরোটা পরিবার বাস করে, যেসব গাঁ একটা স্কুল চালাতে পারে না বা কোনও মাস্টার রাখতে পারে না, সেইসব গায়ের জন্য কেরাম উপত্যকার অধিবাসীরা নিজেরা চাঁদা তুলে কয়েকজন ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক নিয়োগ করে। সেইসব শিক্ষক এক একটি গাঁয়ে গিয়ে এক এক সপ্তাহ করে কাটিয়ে সেইসব গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে লেখাপড়া শেখায়। এইসব ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক গ্রাম্য মেলাগুলোতেও যায়, আমি নিজে তা দেখেছি। যেসব শিক্ষক শুধু পড়তে শেখায় তাদের মাথার টুপিতে একটা করে কলম গোঁজা থাকে, যারা পড়তে এবং অঙ্ক কষতে শেখায় তাদের দুটো কলম আর যারা পড়তে, অঙ্ক কষতে আর লাতিন ভাষা শেখায় তাদের তিনটে করে কলম থাকে। তবে এই শেষোক্ত শিক্ষকরাই বেশি জ্ঞানী। কিন্তু অজ্ঞতা বা নিরক্ষরতা সত্যিই বড় লজ্জাজনক ব্যাপার। কেরাম উপত্যকার লোকদের মতো তোমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
এমনি করে গম্ভীরভাবে কথা বলে গ্রামবাসীদের শিক্ষা দিতেন বিশপ মিরিয়েল। যখন হাতের কাছে কোনও বাস্তব দৃষ্টান্ত খুঁজে পেতেন না তখন বাইবেল থেকে যিশুর কোনও কথামৃত তুলে ধরতেন। কোনও গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যবহার না করে অল্প কথায় মূল শিক্ষণীয় বিষয়টি তুলে ধরতেন। বাগ্মিতা হিসেবে যিশুর কথকতার রীতি অবলম্বন করতেন। তিনি যখন কিছু বলতেন তখন অনুপ্রাণিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তা বলতেন। অন্তরের গম্ভীর হতে উৎসারিত সেসব কথা সহজেই অনুপ্রাণিত করে তুলত শ্রোতাদের।
.
৪
বিশপ মিরিয়েলের সব আলাপ-আলোচনার স্রোত হালকা আর সরস সুরে এক বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়ায় প্রবাহিত হত। যে দু জন নারী অর্থাৎ তার বোন বাপতিস্তিনে আর ম্যাগলোরি তাঁর চিরজীবনের সাথি ছিল, তিনি তাদের থেকে কখনও বড় ভাবতেন না নিজেকে। তিনি নিজেকে তাদের স্তরের মানুষ হিসেবেই ভাবতেন। যখন তিনি কথা বলতে বলতে কোনও কারণে হাসতেন তখন মনে হত তিনি যেন কোনও সরলমতি বালক।
ম্যাগলোরি সব সময় মিরিয়েলকে ‘হে মহান বিশপ’ বলে সম্বোধন করত। একদিন বিশপ তার পড়ার ঘরে একটি আর্মচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন। সহসা তার অন্য একটি বইয়ের দরকার হয়। কিন্তু বইটা সবচেয়ে উপরের তাকে থাকায় তিনি উঠে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকটা নাগাল পেলেন না, কারণ তিনি বেঁটেখাটো ছিলেন। তাই তিনি ম্যাগলোরিকে বললেন, ম্যাগলোরি, দয়া করে একটা চেয়ার এনে দেবে? তার উপর দাঁড়িয়ে বইটা পাড়ব। তুমি আমাকে মহান বললেও আমার মাথাটা ওই তাকটার মতো উঁচু নয়।
কোঁতেসি দ্য লো নামে বিশপ মিরিয়েলের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ছিল। কোঁতেসি প্রায়ই বিশপের কাছে এসে তার তিন ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করত। সুযোগ পেলেই বিশপের কাছে এসে সে শুধু তার ছেলেদের কথা তুলত। কোঁতেসির কয়েকজন ধনী বৃদ্ধ আত্মীয় ছিল যাদের মৃত্যুর পর তার ছেলেরা তাদের সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। তার ছোট ছেলে তার বাবার এবং কাকার মৃত্যুর পর তার সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে; মেজ ছেলে তার কাকার সব সম্পত্তি পাবে পোষ্যপুত্র হিসেবে আর বড় ছেলে একজন লর্ডের সব বিষয়সম্পত্তি পাবে উত্তরাধিকারী হিসেবে। মিরিয়েল সাধারণত কোঁতেসির এইসব কথা দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে শুনে যেতেন। আপন সন্তানদের ভবিষ্যতের আশায় উদ্দীপিত কোনও এক মায়ের নির্দোষ আবেগের সুরে বলা কথাগুলো একঘেয়ে হলেও সহ্য করে যেতেন তিনি। কিন্তু সেদিন অন্যমনা হয়ে কী ভাবছিলেন মিরিয়েল। কোঁতেসি তাই মৃদু রাগের সুরে বলল, কী যে ভাবছ তা ঈশ্বরের নামে বলছি বুঝতে পারছি না।
বিশপ বললেন, আমি ভাবছি সেন্ট অগাস্টিনের কথাটা। অগাস্টিন বলতেন, তোমার সব আশা সেই তাঁর হাতে সমর্পণ করো যাঁর কোনও উত্তরাধিকারী নেই।
আর একবার স্থানীয় কোনও এক ভদ্রলোকের মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে বিশপকে এক চিঠি পাঠায় মৃতের আত্মীয়রা। সে চিঠিতে মৃতের যত সব উপাধি আর তার পারিবারিক সম্মানের কথা লেখা ছিল। চিঠিখানা পড়ে মিরিয়েল বললেন, মৃত্যুর পিঠটা কত চওড়া! মৃতের কত সম্মানের বোঝ সে পিঠকে বহন করতে হয়। মানুষ তার গর্ব ও আত্মগরিমার পরিচয় দেওয়ার জন্য সমাধিস্তম্ভকেও মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে।
মাঝে মাঝে কোনও ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে কিছু হাস্যপরিহাসের কথাও বলতেন বিশপ। একবার যুবকবয়সী এক গ্রাম্য যাজক দিগনে বড় গির্জায় ধর্মীয় প্রচারের কাজে আসে। একদিন দানশীলতা সম্বন্ধে আগেবপূর্ণ এক বক্তৃতা দেয়। ধনীরা যাতে মৃত্যুর পর নরকযন্ত্রণা পরিহার করে স্বর্গলাভ করতে পারে, তার জন্য তাদের মুক্ত হাতে গরিব-দুঃখীদের দান করতে উপদেশ দেয় সেই যুবক যাজক। নরকের বিভীষিকাটা সে ভাষা দিয়ে আবেগের সঙ্গে ফুটিয়ে তোলে। সেই সভায় মঁসিয়ে জেবোরাদ নামে এক কৃপণ ধনী ছিল। সে কাপড়ের ব্যবসা করে অনেক ধন সঞ্চয় করে, কিন্তু গরিবদের কোনও কিছু দান করত না। এই বক্তৃতা শোনার পর মঁসিয়ে জেবোরাদ প্রতি রবিবার উপাসনা শেষে গির্জা থেকে বার হওয়ার সময় ফটকের কাছে যেসব বৃদ্ধা ভিখারিণী ভিড় করে থাকত তাদের একটি করে পয়সা দিত। একথা বিশপ মিরিয়েলের কানে যেতে তিনি মন্তব্য করলেন তার বোনের কাছে, মঁসিয়ে জেবোরাদ এক পয়সার বিনিময়ে যতটুকু স্বর্গ পাওয়া যায় তাই কিনছেন।
ধনীদের কাছে দান চাওয়ার সময় অনেকে তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করত। তবু তাতে দমে যেতেন না বিশপ। একবার এক ধনী কৃপণ প্রকৃতির মানুষকে গরিবদের কিছু দান করতে বলেন মিরিয়েল। মাকুঁই-এর কাঁধের উপর হাত রেখে তিনি বলেন, আমাকে কিছু দান করুন মার্কুই।
মার্কুই যখন সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলেন, আমার নিজের অনেক গরিব আত্মীয় আছে বাড়িতে।
বিশপ তখন উত্তর করেন, ঠিক আছে, আপনার সেই গরিবদের আমার হাতে তুলে দিন।
একদিন গির্জার উপদেশ দানের সময় এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ফ্রান্সে কুড়ি হাজার তিনশো কৃষকের বাড়িতে একটা করে দরজা আর দুটো করে জানালা আছে প্রতি ঘরে। আঠারো হাজার আটশো বাড়িতে একটা করে জানালা আছে আর একটা করে দরজা আছে। আর ছেচল্লিশ হাজার তিনশো বাড়িতে প্রতি ঘরে একটা করে মাত্র দরজা আছে। প্রতি দরজা ও জানালা পিছু কর ধার্য থাকার জন্যই এই জানালা-দরজার সংখ্যার এই রকম তারতম্য দেখা যায়। ঈশ্বর বাতাস দান করেছেন, কিন্তু মানুষের আইন সেই বাতাস কেনাবেচা করছে, তা নিয়ে ব্যবসা করছে। আমি আইনকে আক্রমণ করছি না বা দোষ দিচ্ছি না, আমি শুধু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। ঈসেয়ার, ভার প্রভৃতি আল্পস পর্বতের নিম্নাঞ্চলে কৃষক অধিবাসীরা এমনই গরিব যে তাদের ময়লা ফেলার গাড়ি নেই, পিঠে করে তারা ময়লা ফেলে। রাত্রিতে জ্বালার মতো বাতি নেই। তারা শুকনো ডালপালা আর রেড়ির তেলে ভেজা সলতে পুড়িয়ে অন্ধকার দূর করে। ডফিনে প্রভৃতি উত্তরাঞ্চলে রুটি তৈরি করতে পারের না বছরের সব সময়। তারা ছয় মাস ঘুঁটের জ্বালে রুটি তৈরি করে রেখে দেয়। পরে ছয় মাস দারুণ শক্ত হয়ে যাওয়া সেই রুটিগুলো ধারালো দা দিয়ে কেটে চব্বিশ ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রেখে তবে খায়। সুতরাং হে আমার প্রিয় ভাইসব, দয়া করো, তোমাদের চারপাশে যারা আছে তাদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিশীল হও।
বিশপ মিরিয়েলের গ্রামাঞ্চলে জন্ম হওয়ায় তিনি গাঁয়ের মানুষের কথা বুঝতে পারতেন। মিদি, ডফিনে, ল্যাঙ্গুয়েদক প্রভৃতি আল্পসের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের গ্রামবাসীদের ভালো বুঝতে পারতেন বলে তারা তাকে তাদের কাছের মানুষ বলে ভাবত। তিনি বড় বাড়িতে ও কুঁড়েঘরে সব জায়গায় সহজভাবে থাকতে পারতেন ও সকল শ্রেণির লোকের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতেন। তিনি অনেক গুরুগম্ভীর কঠিন বিষয়কে সহজ সরল ভাষায় স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিতদের বুঝিয়ে দিতে পারতেন। তাদের ভাষা বলতে ও বুঝতে পারায় তাদের অন্তরে সহজেই পথ করে প্রবেশ করতে পারতেন। শৌখিন ধনী অথবা সাধারণ লোক সকলকেই সমান জ্ঞান করতেন তিনি। তিনি তাড়াহুড়ো করে কোনও কিছু বিচার করতেন না। আনুপূর্বিক সমস্ত অবস্থা খুঁটিয়ে না দেখে কোনও বিষয়ে মন্তব্য করতেন না। কারও কোনও শোকের কথা শুনলে তিনি প্রথমেই বলতেন, আগে আমাকে দেখতে দাও, শোকটার উদ্ভব কী করে হল। তিনি নিজে অতীতে একদিন পাপ করায় পাপ সম্বন্ধে তাঁর নীতিটি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করার জন্য কোনও ভূমিকা না করেই বলতেন, মানুষের দেহের মাংস একই সঙ্গে তার বোঝা আর প্রলোভনের বস্তু। এই প্রলোভন সম্পর্কে সতর্ক থেকে তার লোভকে সংযত করে বলতে হবে। একমাত্র যখন কোনও মতেই তা সম্ভব নয় তখনই সে দেহের দাবি মেনে চলবে। এই দাবি মেনে চলার ব্যাপাটা শোকের হতে পারে, কিন্তু সে শোক তুচ্ছ। এতে মানুষের যে পতন হয় তা সম্পূর্ণ পতন নয়, এ পতন তার হাঁটুর কাছে এসে থেমে যায় অর্থাৎ সে নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেই শোক থেকে মুক্ত হয় সে। সাধু হওয়াটা অবশ্য একটা ব্যতিক্রম, সবাই তা পারে না, কিন্তু সবাই ইচ্ছা করলেই সত্যবাদী হতে পারে। ভুল করো, দোষ করো, পাপ করো, কিন্তু সত্যবাদী হও, খাড়াখাড়ি ব্যবহার, অকপট সরলতার সঙ্গে তা প্রকাশ করো। যতদূর সম্ভব কম পাপ করাটাই হল মানবজগতের নীতি। কিন্তু একেবারে পাপ না করাটা দেবদূতদেরও স্বপ্নের বস্তু। সকল পার্থিব বস্তুই পাপের অধীন, যেন কোনও মাধ্যাকর্ষণজাত শক্তি তাদের পাপের দিকে টানতে থাকে।
কারও কোনও দোষ সম্বন্ধে মানুষের কোনও অবিবেচনাপ্রসূত ঘৃণা বা ক্রোধের অভিব্যক্তি দেখে তিনি হেসে বললেন, এ দোষ তো সকলেই করে। যারা ভণ্ড তারাই সে দোষ বা অপরাধ গোপন করে রাখতে চায়।
সামাজিক শাসনের দ্বারা প্রপীড়িত নারী ও শিশুদের প্রতি তিনি ছিলেন বিশেষভাবে সহানুভূতিশীল। তিনি বলতেন, নারী, শিশু, ভৃত্য, দরিদ্র, দুর্বল এবং অজ্ঞ ব্যক্তিদের অপরাধ বা কোনও পাপ হল আসলে স্বামী, পিতা, প্রভু, ধনী ও বলবানদেরই পাপ।
তিনি আরও বলতেন, অজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের শিক্ষা দান করো যতদূর সম্ভব। সকলকে অবৈতনিক শিক্ষা দান না করার জন্য সমাজকেই দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখার জন্য সমাজই দায়ী। এ অন্ধকার সমাজেরই সৃষ্টি। অন্ধকারাচ্ছন্ন আত্মাই পাপ করে। কিন্তু প্রকৃত পাপী হল সে-ই যে সে অন্ধকার সৃষ্টি করে।
এইভাবে আমরা দেখতে পাই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বিশপ মিরিয়েলের এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আমার মনে হয় এ দৃষ্টিভঙ্গি তিনি লাভ করেন বাইবেলের উপদেশামৃত থেকে।
একদিন বিশপ যখন তাঁর বৈঠকখানা ঘরে বসে ছিলেন তখন কোনও এক লোকের অপরাধ সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল। এই অপরাধের কথাটা তখন শহরের সকলের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছিল। সেই অপরাধের জন্য অপরাধী অভিযুক্ত হয়েছিল আদালতে এবং অল্প দিনের মধ্যে সে বিচারের রায় বার হবে। অপরাধী লোকটি একটি মেয়েকে ভালোবাসত। তাদের একটি সন্তান হয়। লোকটির সঞ্চিত অর্থ সব ফুরিয়ে যাওয়ায় সে দারুণ অভাবে পড়ে এবং সেই অভাবমোচনের জন্য জাল নোটের কারবার করে। সেকালে জাল নোট ছাপার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। সেই লোকটার তৈরি প্রথম জাল মুদ্রাটি এক জায়গায় চালাতে গেলে মেয়েটি গ্রেপ্তার হয়। মেয়েটিকে আটক করা হলে সে কোথায় কার কাছ থেকে সে মুদ্রা পেয়েছে, সে কথা প্রকাশ করল না। তার হাতে সেই মুদ্রা ছাড়া আর কোনও তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া গেল না। সে ইচ্ছা করলেই তার প্রেমিককে ধরিয়ে দিতে পারত এবং তার ধ্বংস ডেকে আনতে পারত। কিন্তু কোনও কথাই বলল না সে এবং এ বিষয়ে জেদ ধরে রইল। তখন সরকারপক্ষের উকিল এক ফন্দি আঁটল মেয়েটির কাছ থেকে আসল কথা বার করার জন্য। কতকগুলি জাল চিঠি বার করে সরকারপক্ষের উকিল মেয়েটিকে বলল, তার প্রেমিক অন্য এক মেয়েকে ভালোবাসে এবং তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। মেয়েটি সে কথা বিশ্বাস করে তার প্রেমিকের ওপর রেগে যায়। তখন সে ঈর্ষা ও প্রতিশোধ বাসনার বশবর্তী হয়ে সব কথা ফাঁস করে দিয়ে তার প্রেমিককে ধরিয়ে দেয়। দু জনেরই বিচার হবে আদালতে এবং লোকটির জেল অথবা ফাঁসি হবে। সরকারি উকিলের বুদ্ধি ও কৌশলের কথা উল্লেখ করে শহরের সব লোক উল্লসিত হয়ে উঠতে লাগল। এই উকিল ভদ্রলোক মেয়েটির ঈর্ষাকাতরতা এবং প্রতিশোধপ্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে আসল সত্যকে প্রকাশ করে ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষা করে।
সব কিছু নীরবে শোনার পর বিশপ বললেন, ওদের বিচার কোথায় হবে?
উপস্থিত সবাই বলল, এইক্সের আদালতে।
বিশপ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, সরকারপক্ষের উকিলের কোথায় বিচার হবে?
দিগনেতে একবার একটি বড় সকরুণ ও মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে। এক খুনের আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়। আসামিটি একেবারে নিরক্ষর নয়। আবার খুব একটা শিক্ষিতও নয়। তার বিচার শহরের লোকদের মনে এক বিরাট কৌতূহলের সৃষ্টি করে। লোকটির ফাঁসির দিনে এই কারাগারের যাজক অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফাঁসির সময় একজন যাজকের দরকার। স্থানীয় হোট গির্জার যাজককে ডাকা হলে সে বলে এটা তার কাজ নয়, তাছাড়া সে অসুস্থ। তখন বিশপ মিরিয়েলকে এই খবরটা জানানো হয়।
বিশপ তখন বলেন, যাজক ঠিকই বলেছেন, এ কাজ তাঁর নয়, আমার।
তিনি তৎক্ষণাৎ জেলখানায় সেই ফাঁসির আসামির ঘরে চলে গেলেন। তিনি লোকটির নাম ধরে ডেকে তার একটি হাত ধরে তার সঙ্গে পরম আন্তরিকতা ও অন্তরঙ্গতার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। কোনও কিছু না খেয়েই সারাটি দিন ও রাত। তিনি লোকটির সঙ্গে জেলখানাতেই রয়ে গেলেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন তিনি। তাকে আত্মস্থ হওয়ার জন্য উপদেশ দিলেন। জীবন, মৃত্যু ও ঈশ্বর সম্বন্ধে গভীরতম সত্যের কথাটি খুব সহজ ও সরলভাবে তাকে বললেন। তিনি তার সঙ্গে এমনভাবে মেলামেশা করতে লাগলেন যাতে মনে হবে তিনি একেবারে লোকটির পিতা, ভ্রাতা এবং বন্ধু। আবার বিশপরূপে তাকে আশীর্বাদ করলেন। লোকটি ফাঁসির কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়ে। নিবিড়তম হতাশার মধ্য দিয়েই। জীবনাবসান ঘটত তার। যে মৃত্যুকে সে এক অন্ধকার শূন্যতা বলে ভাবত সেই মৃত্যুর সামনে এসে এক অপরিসীম বিভীষিকার কথা চিন্তা করে কাঁপতে থাকে সে। যে রহস্যময় এক অবগুণ্ঠন মৃত্যুকে জীবন ও আমাদের চোখের দৃষ্টিপথ থেকে আড়াল করে ঢেকে রাখেন, লোকটির মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ সে অবগুণ্ঠনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। তখন সেই ছিন্নভিন্ন অবগুণ্ঠনের অচ্ছন্দ অবকাশের মধ্য দিয়ে মৃত্যুলোকের পানে তাকিয়ে সে শুধু দেখতে পেল রাশিকৃত এক বিপুল অন্ধকার। কিন্তু বিশপ সেই অন্ধকারের মাঝে আলো দেখালেন তাকে।
পরদিন সকালে আসামিকে যখন বধ্যভূমির দিকে হাতবাঁধা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন বিশপও তার পাশে পাশে যাচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় ছিল বিশপের মস্তকাচ্ছাদন আর গলায় ক্রসটা ঝোলানো ছিল। লোকটির যে মুখখানা গতকাল বিষাদে কালো হয়ে ছিল আজ সে মুখ এক অজ্ঞাত, অকারণ ও অনাবিল আনন্দের জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জীবনের শেষ মুহূর্তে মৃত্যুলোকের দ্বারপ্রান্ত অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরকে পাওয়ার আশায় সহসা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে যেন তার প্রশান্ত ও স্থিতধী আত্মা। ঘাতকের খড়গ লোকটির উপর পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বিশপ তাকে চুম্বন করে বললেন, মনে রেখো, মানুষ যাকে হত্যা করে ঈশ্বর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ভাইরা কাউকে বন্দি করলে পরম পিতা ঈশ্বর তাকে মুক্ত করেন। এখন প্রার্থনা কর, ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখ এবং মহাজীবনের পথে গমন কর যেখানে আছেন তোমার পরম পিতা।
বিশপ যখন তাঁর কাজ শেষ করে বধ্যভূমি থেকে বেরিয়ে এলেন তখন তার চোখের দৃষ্টি দেখে সবাই বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। সে দৃষ্টির মধ্যে তখন একই সঙ্গে ছিল এক সকরুণ গ্লানিমা আর উজ্জ্বল প্রশান্তি। কোনটা বেশি আকর্ষণ করছে তাদের, তা বুঝতে পারল না কেউ।
সেদিন বাড়ি ফিরে বিশপ তাঁর বোনকে বললেন, আমি এতক্ষণ আমার কর্তব্য পালন করছিলাম।
জীবনে এমন অনেক মহৎ কাজ আছে যার মানে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। দিগনে শহরের অনেক লোকও তেমনি বিশপ মিরিয়েলের অনেক মহৎ কাজের মানে বুঝতে পারত না। বলত, ওটা বিশপের এক কৃত্রিম আবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে বিপশ সম্বন্ধে একথা বিলাসী ধনী ব্যক্তিরাই তাদের বসার ঘরে বসে আলোচনা করত। শহরের সাধারণ মানুষ বিশপের দয়া-মমতার জন্য সত্যিই গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত তাঁকে।
ফাঁসির যন্ত্র হিসেবে গিলোটিন প্রচলিত হতে ব্যক্তিগতভাবে বিশপ একটা জোর আঘাত পান মনে। এ আঘাতটা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল তার।
সাধারণত যখন নতুন করে কোনও বধ্যভূমি নির্মাণ করা হয় তখন এক গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় মানুষের মনে। তবে গিলোটিন বস্তুটি নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত মানুষের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতাম না আমরা। কিন্তু গিলোটিন দেখার পর হতে মৃত্যুদণ্ডের সপক্ষে বা বিপক্ষে আপন আপন মত প্রকাশ করতে শুরু করেছে সব মানুষ। জোসেফ দ্য মেন্তার মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন। কিন্তু সিজার দ্য বেকারিয়া মৃত্যুদণ্ডকে এক জঘন্য ব্যাপার বলে অভিহিত করেন। গিলোটিনকে অনেকে মানুষের অপরাধ সম্বন্ধে আইনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসেবে গণ্য করলেও আসলে তা হল প্রতিহিংসার মূর্ত প্রতীক। তা কখনই নিরপেক্ষ হতে পারে না অথবা আমাদের নিরপেক্ষ থাকতে দিতে পারে না। যারা এই গিলোটিনকে দেখে নিজের চোখে, তারা ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে যায়, শিউরে ওঠে। গিলোটিনের ওই ধারালো খড়গের আঘাতে সব সামাজিক সমস্যা যেন এক শেষ পরিণতি লাভ করে। গিলোটিন লোহা, কাঠ আর দড়ি দিয়ে গড়া যেন এক নিষ্প্রাণ যন্ত্রমাত্র নয়, এটি যেন এক অবাধ অনিবারণীয় ইচ্ছার ভাবমূর্তি যে সব সময় তার কুটিল উদ্দেশ্যগুলো সাধন করে চলেছে একের পর এক করে। এ যন্ত্রের প্রতিটি অঙ্গ ও অংশ যেন মানুষের সব কথা শুনতে পায়, যেন বুঝতে পারে, দেখতে পায় সব কিছু। ঘাতকের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই গিলোটিন যেন মৃত মানুষের মাংস গ্রাস করে, তার রক্ত পান করে। এটি যেন বিচারক আর যন্ত্রনির্মাতার হাতে গড়া এক রাক্ষস, যে রাক্ষস সাক্ষাৎ মৃত্যুর ভেতর থেকে তার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে নিজের প্রাণবস্তু আহরণ করে এক ভয়ঙ্কর জীবন যাপন করে চলে।
বিশপ মিরিয়েল যখন প্রথম গিলোটিন দেখেন তখন এই কথাই তার মনে হয়। গিলোটিনে কোনও এক লোকের এই প্রথম ফাঁসি দেখে দুঃখে শোকাভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। বাড়িতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে সেই ভয়ঙ্কর প্রশান্তিটা মিলিয়ে গেল। তার মনের মধ্যে সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার কথাটা ভূতের মতো আনাগোনা করছিল বারবার। সাধারণত তিনি কোনও কর্তব্য পালন করে বাড়ি ফিরলে এক তৃপ্তির অনুভূতি তাঁর চোখে-মুখে ফুটে থাকে। কিন্তু এবার তৃপ্তির পরিবর্তে তাঁর মন ছিল এক পাপচেতনার দ্বারা ভারাক্রান্ত। সাধারণত তিনি বাড়িতে অনেক সময় আপন মনে বিড় বিড় করে কথা বলতেন। সেদিনও তিনি এমনি করে এক একাত্মক সংলাপে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন আর তার বোন সে সংলাপ মন দিয়ে শুনছিল।
বিশপ বলেছিলেন, আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা এত ভয়ঙ্কর। মানবজগতের বিধিনিষেধ ও নিয়মকানুনের প্রতি এভাবে উদাসীন থেকে শুধু ঐশ্বরিক বিধি নিয়ে এতখানি মগ্ন থাকা আমার উচিত হয়নি। মৃত্যু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ঈশ্বরের হাতে। মৃত্যুর মতো এমন একটা অজ্ঞাত ও রহস্যময় ব্যাপারের ওপর খবরদারি করার কোনও অধিকার নেই মানুষের।
এইসব চিন্তা-ভাবনা কমে একে একে মিলিয়ে গেল বিশপের মন থেকে। তবে সেদিন থেকে বধ্যভূমির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পথটা যতদূর সম্ভব এড়িয়ে যেতেন তিনি।
বিশপ মিরিয়েলকে যে কোনও সময়ে ডাকলেই তিনি যে কোনও রুগ্ণ ও মুমূর্ষ ব্যক্তির শয্যাপাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। এটা যে তার জীবনের এক প্রধান আর মহান কর্তব্য একথা ভুলে যেতেন না তিনি। কোনও অনাথ বা বিধবার বাড়ি যাওয়ার জন্য তাঁকে ডেকে পাঠাবার কোনও প্রয়োজন হত না। কোনও মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেই চলে যেতেন। যে ব্যক্তি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়েছে অথবা যে মাতা সন্তানহারা হয়েছে তার পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নীরবে বসে থাকতেন। তার শোকে সান্ত্বনা দিতেন। কখন কথা বলতে হবে বা কখন চুপ করে থাকতে হবে, তা তিনি বুঝতেন। তাঁর সান্ত্বনা দানের পদ্ধতিটা ছিল উন্নত ধরনের। তিনি কখনও শোকার্ত ব্যক্তিকে বিস্মৃতির অতলগর্ভে তার শোক-দুঃখকে বিলীন করে দেওয়ার উপদেশ দিতেন না, তিনি চাইতেন শোকার্ত ব্যক্তি এক নতুন আশা ও ঈশ্বরবিশ্বাসের সাহায্যে তার সব শোকদুঃখকে এক বিরল মহত্ত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে তুলুক। তিনি শোকসন্তপ্ত ব্যক্তিদের বলতেন, মৃতের প্রতি তোমারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কর। পচনশীল এক মানবদেহের জন্য শোক-দুঃখ করে কোনও লাভ নেই। তোমরা যদি স্থিরভাবে ভেবে দেখ তা হলে দেখবে তোমারে মৃত প্রিয়তমের অমর আত্মার আলো ঈশ্বরের বুকের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে।
তিনি জানতেন বিশ্বাসই মানুষকে শক্তি দেয়। শোকার্ত ব্যক্তিকে তিনি সব সময় ঈশ্বরের প্রতি নিবিড় আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে শান্তি পেতে বলতেন। যে দুঃখ শুধু মৃত্যুর অন্ধকার গহ্বরটাকে বড় করে দেখে সে দুঃখকে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো হিসেবে দেখতে শেখাতেন।
.
৫
মঁসিয়ে মিরিয়েলের ব্যক্তিগত জীবন আর সামাজিক জীবনের মধ্যে কোনও ভেদ ছিল না। দুটি জীবন সমান্তরালভাবে এক ধারায় চলত। যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখত তারা তাঁর সে জীবনের কঠোরতা আর আত্মনিগ্রহ দেখে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে যেত।
বেশির ভাগ বৃদ্ধ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মতো মিরিয়েল খুব কম ঘুমোতেন। কিন্তু যতটুকু সময় ঘুমোতেন তার ঘুমটা গম্ভীর হত। সকালবেলায় তিনি এক ঘণ্টা ধ্যান করতেন। তার পর তিনি বড় গির্জায় অথবা তার নিজস্ব বক্তৃতামঞ্চ থেকে সমবেত উপাসনাসভা পরিচালনা করতেন। সভার কাজ শেষে তিনি তাঁর নিজের গরুর দুধ আর রুটি খেয়ে তার কাজ শুরু করতেন।
একজন বিশপকে অনেক কাজ করতে হয়। সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। তার অধীনস্থ নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন চার্চের যাজকদের সঙ্গে দেখা করতে হয় প্রতিদিন। অনেক ধর্মীয় সভায় তাঁকে সভাপতিত্ব করতে হয়, বিধান দান করতে হয়, বিভিন্ন গির্জা থেকে প্রকাশিত কাগজপত্র দেখতে হয়, এই ধরনের অজস্র ধর্মীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন গ্রাম্য গরিব যাজকদের কাছে চিঠি দিয়ে পাঠাতে হয়, যাজকদের নীতি-উপদেশমূলক বক্তৃতার লিপিগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় মেয়র ও যাজকদের মধ্যে কোনও বিরোধ বাধলে তার মীমাংসা করতে হয়। তার পর পোপ ও সরকার-সংক্রান্ত চিঠিপত্রগুলো দেখে তার জবাব লিখতে হয়। মোট কথা, তাঁকে হাজার রকমের কাজকর্ম সম্পন্ন করতে হয়।
এইসব কাজকর্ম সম্পাদনা করে যেটুকু সময় পেতেন মিরিয়েল সেই সময় তিনি গরিব-দুঃখীদের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের কাজে ব্যয় করতেন। এর পরেও যদি কিছু অবসর পেতেন তা হলে তিনি তার বাগানে গিয়ে গাছপালার যত্ন করতেন, অথবা ব্যক্তিগত লেখাপড়ার কাজ করতেন। পড়ালেখার কাজ আর বাগানের কাজ একই জাতীয় বলে তিনি মনে করতেন। তিনি বলতেন মানুষের মন বা আত্মাটাও এক বাগান। পড়াশোনা বা জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে যে বাগান পরিমার্জিত হয়।
দুপুরবেলায় তিনি যা খেতেন তা প্রাতরাশের থেকে সামান্য কিছু বেশি। বেলা দুটোর সময় আবহাওয়া ভালো থাকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন তিনি। হয় তিনি গ্রামাঞ্চলে চলে যেতেন হাঁটতে হাঁটতে অথবা শহরের রাস্তা দিয়ে গরিব-দুঃখীদের বাড়ি যেতেন। একটা লম্বা ছড়ি হাতে মাথাটা নিচু করে চিন্তাষিতভাবে পথ হাঁটতেন তিনি। তাঁর জুতোজোড়া ছিল ভারী এবং মোজা দুটো ছিল নীলচে রঙের। মাথায় থাকত ঝালর দেওয়া বিশপের টুপি।
যে পথ দিয়ে তিনি যেতেন সে পথের দু’ধারে একটা আলোড়ন পড়ে যেত। যত সব শিশু আর বৃদ্ধরা তাদের বাড়ির দরজার কাছে বেরিয়ে এসে সাদর অভ্যর্থনা জানাত তাঁকে, শীতার্ত ব্যক্তিরা যেমন প্রতপ্ত সূর্যালোককে অভ্যর্থনা জানায়। যারা অভাবগ্রস্ত তাদের তিনি তাদের বাসায় গিয়ে দেখতেন। তিনি সকলকে আশীর্বাদ করে তাদের ধন্য করতেন এবং নিজেও ধন্য হতেন। পথে যেতে যেতে মাঝে মাঝে থেমে অনেক শিশু আর তাদের মায়েদের সঙ্গে হেসে কথা বলতেন। যখন তার হাতে টাকা থাকত তখন তিনি গরিবদের বাড়ি যেতেন আর যখন টাকা থাকত না তখন তিনি ধনীদের বাড়ি যেতেন।
বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় বিশপের আলখাল্লাটি তিনি পরে যেতেন। সেটি একেবারে অচল না হওয়া পর্যন্ত পরতেন। সেটা দু-এক জায়গায় ছিঁড়ে গেলেও তা গ্রাহ্য করতেন না। তবে গরমকালে সেটা পরে বাইরে বেরোতে কষ্ট হত।
সন্ধে সাড়ে আটটার সময় তিনি বাড়িতে তার বোনের সঙ্গে রাতের খাওয়া খেতেন। ম্যাগলোরি পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। তাঁর নৈশভোজনের মধ্যে থাকত শাকসবজির ঝোল আর শুকনো রুটি। এর থেকে কম খরচের খাওয়া আর হতে পারে না। যদি কোনও যাজক নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকত তা হলে ম্যাগলোরি সেই সুযোগে কিছু মাছ বা। মাংসের ব্যবস্থা করত। যাজকরা তাঁর বাড়িতে খেতে ভালোবাসত আর বিশপও তা সমর্থন করতেন।
নৈশভোজনের পর আধ ঘণ্টা তার বোন আর ম্যাগলোলারির সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন মিরিয়েল। তার পর নিজের শোবার ঘরে চলে যেতেন। তাঁর শোবার ঘরটা ছিল নিচের তলায়। বাপতিস্তিনে আর ম্যাগলোরি উপরতলায় তাদের শোবার ঘরে চলে যেত। শোবার ঘরে গিয়ে পড়ালেখার কাজ করতেন মিরিয়েল অনেক রাত পর্যন্ত। তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনশাস্ত্রে তাঁর প্রচুর পড়াশোনা এবং পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি বাইবেলের ‘জেনেসিস’ বা সৃষ্টিতত্ত্বের একটি পঙক্তির ওপর একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। সেই পঙক্তিটাতে ছিল ‘জেনেসিস’ সৃষ্টির আগে শুধু ছিল জল এবং ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর ঘুরে বেড়াত। তিনি এই পঙক্তিটির সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বের উল্লিখিত অনুরূপ পঙক্তিগুলো মিলিয়ে দেখেন। আরবি শাস্ত্রে লিখিত একটি পঙক্তিতে আছে, ‘ঈশ্বরের বাতাস বইতে লাগল।’ ফ্লোবিয়াস জোসেফ লিখেছেন, স্বর্গ থেকে বাতাস নেমে এল মর্তে। চ্যালভিনয় অনূদিত রব্বি অঙ্কেলোতে আছে, ঈশ্বরপ্রেরিত বাতাসের রাশি জলের উপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল।
আর একটি প্রবন্ধে তিনি টলেমার ভূতপূর্ব বিশপ শার্লস লুই হুগোর ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কিত লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। এই রচনাগুলো আগের শতাব্দীতে কয়েকটি পুস্তিকা ও প্রচারপত্রে প্রকাশিত হয়।
কখনও কখনও কোনও গভীর বিষয় পড়তে পড়তে দিবাস্বপ্নের মধ্যে মগ্ন হয়ে পড়তেন। তার মাঝে মাঝে সেই দিবাস্বপ্নের গম্ভীর হতে উঠে এসে দু একটা পঙুক্তি লিখতেন। যে বই তাঁর হাতে থাকত, সেই বই-এর কোনও না কোনও পাতার উপর পর্ভূক্তিগুলো লিখতেন। এই লেখাগুলোর সঙ্গে তাঁর হাতের বই-এর কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমরা একটি বইয়ের উপর তাঁর লেখা কয়েকটি ছত্র পাই। তাতে এক জায়গায় লেখা ছিল, তুমি হচ্ছ এই :
যাজক সম্প্রদায় তোমাকে বলে ‘সর্বশক্তিমান’, ম্যাকারিরা তোমাকে বলে ‘স্রষ্টা’, একেসীয়দের কাছে লিখিত পত্রাবলিতে তোমাকে ‘স্বাধীনতা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, বারুক তোমাকে বলেছেন ‘অনন্ত’, বাইবেলের প্রার্থনাস্তোত্রে তোমাকে বলা হয়েছে ‘প্রজ্ঞা আর সত্য’, দ্য বুক অব কিংস, তোমাকে বলেছেন “লর্ড’ বা প্রভু, ওল্ড টেস্টামেন্টের কাজোড়াসে বলা হয়েছে তুমিই ‘ঐশ্বরিক বিধান’, লেভিটিকাস বলেছেন, তুমিই ‘পবিত্রতা’, এসড্রাস তোমাকে বলেছেন, ন্যায়পরায়ণতা, সৃষ্টিতত্ত্বে তোমাকে বলা হয়েছে ‘ঈশ্বর’, মানুষ তোমাকে বলে ‘পরম পিতা’; কিন্তু সলোমন বলেছেন তুমি ‘পরম করুণা’ এবং এইটিই তোমার সবচেয়ে সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠ নাম।
রাত্রি নটা বাজতেই বাড়ির মহিলা দু জন উপরতলায় তাদের শোবার ঘরে চলে যেত। এবার দিগনের বিশপ যে বাড়িতে বাস করতেন সে বাড়ির একটি বিবরণ দান করা উচিত।
.
৬
যে বাড়িতে বিশপ বাস করতেন তার দুটি তলা ছিল। প্রত্যেক তলাতে ছিল তিনটি করে ঘর। এছাড়া ছাদের উপর একটি ঘর ছিল। বাড়িটির পেছন দিকে এক একর সমান একটি বাগান ছিল। বাড়ির মেয়েরা উপরতলায় আর বিশপ নিচের তলায় থাকতেন। বিশপের যে তিনটি ঘর ছিল তার মধ্যে রাস্তার দিকের ঘরটি খাবার ঘররূপে ব্যবহৃত হত। দ্বিতীয় ঘরটি শোবার ঘর ও পড়ার ঘররূপে ব্যবহার করতেন। তৃতীয় ঘরটি তাঁর বক্তৃতার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। বক্তৃতার ঘরের এক প্রান্তে একটি বিছানা পাতা থাকত অতিথিদের জন্য। বিছানাটির পাশে পর্দা ফেলা থাকত। গির্জা-সংক্রান্ত ব্যাপারে গ্রাম্য যাজকদের প্রায়ই বিশপের কাছে আসতে হত। পর্দা দিয়ে আড়াল করে রাখা হত বিছানাটা; যেন মনে হত একটা শোবার ঘর।
বিশপের এই বাড়িটি আগে ছিল হাসপাতাল। হাসপাতালের যে ঘরটিতে ওষুধ দেওয়া হত রোগীদের সেই ঘরটিকে দু’ভাগ করে ভাঁড়ার ঘর ও রান্নাঘরে পরিণত করা হয়। বাগানের একটি অংশে একটি গোয়ালঘর তৈরি করে সেখানে দুটি গরু রাখা হত। গরুতে যা দুধ দিত তার অর্ধেক বিশপ বাড়িতে রেখে অর্ধেক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতেন।
বিশপের শোবার ঘরটি ছিল বড়। শীতকালে ঘরটাকে উত্তপ্ত করার জন্য অনেক কাঠের দরকার। দিগনেতে কাঠের দাম খুব বেশি হওয়ার জন্য শীতকালে প্রয়োজনমতো জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে পারতেন না। শীতকালে রাত্রির দিকে শীতে খুব কষ্ট হওয়ায় বিশপ গোয়ালঘরের একটি দিক ঘিরে সন্ধ্যার সময় সেইখানে বসে পড়াশোনা করতেন। তিনি বলতেন, ‘এটি আমার শীতের বিশ্রামাগার।’ কিন্তু তার সেই শীতের বিশ্রামাগারে একটি কাঠের টেবিল আর চারটি চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাব ছিল না। একটি কাঠের বোর্ডকে বক্তৃতার ঘরে বেদি হিসেবে সাজিয়ে রাখা হত।
দিগনের ধনী ধার্মিক ও ভক্ত মহিলারা বক্তৃতাকক্ষে একটি ভালো বেদি তৈরির জন্য কয়েকবার চাঁদা তুলে টাকা দিয়েছিল বিশপের হাতে। কিন্তু সে টাকা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেন বিশপ। তিনি বলেন, যে সব হতভাগ্য নিরুপায় হয়ে ঈশ্বরের কাছে অন্তরের সঙ্গে সান্ত্বনা চায় তাদের আত্মাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বেদি।
বসার ঘরে বেশি চেয়ার ছিল না। দুটি মাত্র বসার টুল ছিল। তাঁর শোবার ঘরে মাত্র একটি আমচেয়ার ছিল। যখন বিশপের বসার ঘরে ছ সাতজন অথবা দশ-এগারো জন্য অতিথি আসত, বিভিন্ন ঘর থেকে চেয়ার আনতে হত। এগারো জনের বেশি অতিথি এলে বিশপকে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হত। আর গ্রীষ্মকাল হলে চেয়ারের অভাবে তিনি অতিথিদের বাগানে নিয়ে গিয়ে বেড়াতে বেড়াতে কথা বলতেন।
অতিথিদের বিছানার পাশে যে একটা চেয়ার ছিল তার একটা পা ভাঙা থাকায় সেটা দেয়ালের গাঁ ঘেঁষে সেঁটে রাখা হয়েছিল। সুতরাং সেটা বার করে ব্যবহার করা চলত না। বাপতিস্তিনের ঘরে ইজি চেয়ার ছিল, কিন্তু সিঁড়িগুলো সরু থাকায় জানালা দিয়ে ঘরে ঢোকানোর সময় ভেঙে যায়। তার ফলে সেটাও ব্যবহার করা চলত না। বাপতিস্তিনের অনেক দিনের ইচ্ছা মেহগনি কাঠের আর হলুদ ভেলভেটের গদিওয়ালা একটা আর্মচেয়ার কিনবে। কিন্তু তার দাম পাঁচশো ফ্রাঁ। অথচ গত পাঁচ বছরের মধ্যে সে মাত্র বিয়াল্লিশ ফ্রাঁ দশ সু জমাতে পেরেছে। ফলে সেই দামি আর্মচেয়ার কেনার আশাটা ত্যাগ করতে হয় বাপতিস্তিনকে। এমনি করে অনেক স্বপ্নই সফল হয় না আমাদের।
বিশপের শোবার ঘরের মতো এমন সাদাসিধে ঘর দেখাই যায় না। এ ঘরে ছিল বাগানের দিকে একটি জানালা আর দুটি দরজা –একটি দরজা খাবার ঘরে যাওয়ার জন্য আর একটি বক্তৃতার ঘরে যাবার জন্য। একটি লোহার খাটে বিছানা পাতা থাকত, তার উপরে ছিল সবুজ সার্জের এক চাঁদোয়া। খাবার ঘরে যাওয়ার দরজাটার পাশে ছিল বইয়ের তাক। তাকগুলো বইয়ে ভর্তি ছিল। আগুন রাখার জায়গাটার ছিল কাঠের, কিন্তু দেখে মনে হত মার্বেল পাথরের। তার সামনের দুটো ফুলদানিতে দুটো কুকুরের মূর্তি ছিল। দেয়ালের গাঁয়ে যেখানে আগুন জ্বালানো হয় তার উপর যে তাক ছিল তার মাথায় আয়নার পরিবর্তে চারকোনা একখণ্ড ভেলভেটের উপর একটা তামার ক্রস ঝোলানো ছিল। জানালার পাশে একটা বড় টেবিলে অনেক কাগজপত্র ছড়ানো ছিল আর তাতে একটা দোয়াত ছিল। টেবিলের পাশে ছিল একটা কমদামি আর্মচেয়ার আর বিছানায় খাটের পাশে প্রার্থনা করার জন্য একটা টুল ছিল। এই টুলটা আসলে বক্তৃতার ঘরে থাকত এবং দরকারের সময় আনা হত।
বিছানার দু’পাশে দুটি ফ্রেম আঁটা ছবি ছিল। ছবি দুটি ভূতপূর্ব এক বিশপ ও কয়েকজন যাজকের। ছবি দুটি ছিল আগেকার হাসপাতালে। হাসপাতালের এই বাড়িটাতে আসার পর থেকে বিশপ এগুলো উত্তরাধিকারসূত্র পেয়ে যান যেন। ছবিগুলো
এ বাড়িতে আসার পর ম্যাগলোরি যখন ঝাড়ামোছা করছিল তখন তা দেখতে পেয়ে যান বিশপ। দেখেন ছবিতে আঁকা বিশপ ও যাজকরা সবাই ১৭৮৫ সালের এপ্রিল মাসে কাজে নিযুক্ত হন। জানালায় যে পর্দাটা ছিল তার অনেকটা ছিঁড়ে যায় এবং ম্যাগলোরি বাধ্য হয়ে সেই ছেঁড়াটা ঢাকার জন্য তালি দিয়ে দেয়। তালিটা দেওয়া হয় ক্রসের আকারে। তা দেখে খুশি হন বিশপ। গোটা বাড়িটাকে ব্যারাক বাড়ি বা হাসপাতালের মতই রঙ করা হয়েছিল।
খাবার ঘরের টেবিলে ছয়টা রুপোর কাঁটা-চামচ চকচক করত আর দুটো রুপোর ভারী বাতিদান ছিল। বিশপের নিজস্ব ধনসম্পদ বলতে এছাড়া আর কিছু ছিল না। এই রুপোর জন্য গর্ব অনুভব করত ম্যাগলোরি। কোনও সম্মানিত অতিথি খেতে এলে সেই বাতিদানে মোমবাতি রেখে তা জ্বালত। বিশপ একদিন রুপোর কাঁটা-চামচগুলো সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, এই রুপোর জিনিসগুলোর সাহায্য ছাড়া খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারছি না আমি।
বাগানটা চারদিকে একটা সাদা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। বাগানের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটায় বর্গক্ষেত্রাকার চার টুকরো জমি ছিল। তার তিনটেতে ম্যাগলোরি শাকসবজি লাগাত আর একটাতে ফুলগাছ বসিয়েছিলেন বিশপ। বাগানে কিছু ফলের গাছও ছিল। একদিন ম্যাগলোরি রাগের সঙ্গে বিশপকে বলেছিল, মঁসিয়ে, আপনি আমাদের সবকিছুর সদ্ব্যবহার করার জন্য উপদেশ দেন। কিন্তু আপনি ফুলগাছ বসিয়ে জমিটা নষ্ট করছেন। ফুলের থেকে চাটনির দরকার বেশি। তাই ওখানে ফুলের বদলে চাটনির জন্য কিছু সবজি লাগালে ভালো হত।
বিশপ তার উত্তরে বলেন, ভুল করছ তুমি। সংসারের প্রয়োজনীয় বস্তুর মতো সুন্দরেরও প্রয়োজন আছে। বোধ হয় সুন্দর যে কোনও বস্তুর থেকে বেশি প্রয়োজনীয়।
প্রতিদিন বাগানে দু-এক ঘণ্টা করে কাটাতেন বিশপ। ফুলগাছগুলোর যত্ন করতেন। কখনও তিনি গাছের গোড়া থেকে আগাছা উপড়ে ফেলতেন, কখনও মাটি খোঁচাতেন, কখনও বা নতুন গাছ বসাতেন। কিন্তু মালীর দক্ষতা তাঁর ছিল না। গাছগুলোর কিভাবে ক্ষতি বা বৃদ্ধি হয় সে জ্ঞানও তাঁর ছিল না। উদ্ভিদধিদ্যায় কোনও আগ্রহ ছিল না তার। যেসব পোকামাকড় গাছের চারাগুলোর ক্ষতি করে সেগুলোকে ওষুধ দিয়ে মারার কোনও ব্যবস্থা করতেন না তিনি। তার একমাত্র আগ্রহ ছিল ফুলের প্রতি। তিনি ফুল ভালোবাসতেন। পণ্ডিত লোকদের শ্রদ্ধা করতেন তিনি। গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি নিজের হাতে জলপাত্র হাতে বাগানের গাছগুলোতে জল দিতেন।
বাড়ির কোনও দরজায় তালাচাবি দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা করেননি বিশপ। বাপতিস্তিনে ও ম্যাগলোরি বিশপকে অনেক করে তার শোবার ঘরের দরজায় খিল দিতে বলেন রাত্রিতে। কিন্তু বিশপ তা শোনেননি। তার দেখাদেখি তারাও আর খিল দিত না। ম্যাগলোরি অবশ্য মাঝে মাঝে ক্ষোভ প্রকাশ করত এ ব্যাপারে।
মিরিয়েল এ ব্যাপারে তাঁর নীতির কথাটি একদিন বাইবেলের একটি পাতার উপর লিখে রাখেন, ‘ডাক্তারের সঙ্গে যাজকের এখানেই তফাৎ। ডাক্তারের বাড়ির দরজা কখনও বন্ধ করা চলবে না। যাজকের বাড়িও সব সময় খোলা রাখতে হবে।’ ‘অ্যা ফিলজফি অব মেডিক্যাল সায়েন্স’ নামে একখানি বইয়ের উপর একদিন তার একটা লেখা পাওয়া যায়। তাতে লেখা ছিল, আমিও কি একজন ডাক্তার নই? আমারও রোগী। আছে। রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা হতভাগ্য, যারা দীন-দুঃখী তারাও তো মনের দিক থেকে রুগুণ এবং সেই রোগ প্রতিকারের জন্যই তারা আসে আমার কাছে।
আর একটি বইয়ে তিনি একবার লেখেন, রাত্রিকালে যদিও কোনও লোক বাড়িতে আশ্রয় চাইতে আসে তা হলে তার নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করো না। যে ব্যক্তি দেখবে তার নাম-ধাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক তারই আশ্রয়ের বেশি দরকার।
একদিন এক যাজক বিশপের সঙ্গে দেখা করতে এসে ম্যাগলোরির অনুরোধে বিশপকে প্রশ্ন করেন, কেন আপনি সব সময় সব ঘরের দরজা খুলে রাখেন? তালা বা খিল কিছুই দেন না। এতে বিপদ ঘটতে পারে একসময়।
বিশপ মিরিয়েল তখন যাজকের কাঁধের উপর একটি হাত রেখে একটি প্রার্থনাস্তোত্র থেকে একটি ছত্র উদ্ধৃত করে বলেন, ঈশ্বর যদি কোনও নগর রক্ষা করতে না চান তা হলে প্রহরীর দৃষ্টি যতই সজাগ থোক তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
এই থেকে তিনি বলেন, কোনও সেনাদলের কর্নেলের মতো একজন যাজকেরও সমান পরিমাণ সাহস আছে। তবে সে সাহস বড় শান্ত এবং নিরুচ্চার।
.
৭
এই সময় একদিন আর একটি ঘটনা ঘটে, যা বিশপের চরিত্রের ওপর বেশ কিছুটা আলোকসম্পাত করে। সুতরাং ঘটনাটির উল্লেখ না করে পারা যাবে না।
একসময় গাসপার্দ বে’র মতো ভয়ঙ্কর দস্যুদল অলিউনের পার্বত্য অঞ্চলের আশপাশের গাগুলো লুটপাট করে তাণ্ডব চালাতে থাকে। ক্রাভাত্তে নামে এই দস্যুদলের এক নেতা পুলিশের ভয়ে পাহাড়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। যেসব দস্যু বেঁচে ছিল এবং যারা ধরা পড়েনি তাদের নিয়ে প্রথমে সে বিলেতে ও পরে পিদমতে কিছুদিন লুকিয়ে থাকার পরে প্যারিসের বার্মিলোনেত্তে অঞ্চলে এসে ওঠে।
ক্রাভাত্তের সাঙ্গপাঙ্গদের প্রথমে জঞ্জিয়ারে ও পরে তুলেতে দেখা যায়। পরে তারা জুং দেল এগলে পাহাড়ের গুহায় পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। রাত্রিকালে গুহার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসে তারা পার্শ্ববর্তী গাঁগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা পারত লুটপাট করে পালাত।
কোনও এক রাতে ক্রাভাত্তে তার দলবল নিয়ে এমব্রাসের একটি বড় গির্জায় ঢুকে ধর্মীয় জিনিসপত্র সব চুরি করে নিয়ে যায়। তার অত্যাচারে গ্রামবাসীরা সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। পুলিশ তাদের অনুসরণ করে ধরার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু সব বারেই তারা পাহাড়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। কখনও কখনও আবার পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে পালিয়ে যায়। সত্যিই ক্রাভাত্তে ছিল এক দুর্ধর্ষ দুর্বৃত্ত।
এইভাবে যখন এই অঞ্চলে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছিল তখন সেখানে একদিন পরিদর্শনের কাজে এসে পড়েনে বিশপ মিরিয়েল। আসার পথে চাস্তেলার নামে এক জায়গায় সেখানকার মেয়রের সঙ্গে তার দেখা হয়। মেয়র ফিরে যেতে বলেন বিশপকে। লার্কে পর্যন্ত সমস্ত পার্বত্য এলাকাটা তখন একরকম ক্রাভাত্তের দখলে। তার ওপারেও তার আধিপত্য বিস্তৃত। সঙ্গে রক্ষী নিয়েও ওদিকে যাওয়া যাবে না। ওদিকে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক, শুধু শুধু তিন-চারজন রক্ষীর প্রাণ যাবে।
তা শুনে বিশপ বললেন, সত্যিই তাই? আমি রক্ষী সঙ্গে না নিয়েই যাব।
মেয়র আবার বললেন, মঁসিয়ে, ওখানে যাওয়ার কথা মনেও ভাববেন না।
বিশপ মিরিয়েল বললেন, আমি এই কথাই ভাবছি যে ওখানে আমি কোনও রক্ষী ছাড়াই যাব এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমি রওনা হব।
একা যাবেন?
হ্যাঁ একা।
না মঁসিয়ে, যাবেন না।
বিশপ তখন বললেন, ওই পাহাড় অঞ্চলে আদিবাসীদের একটি গাঁ আছে। আমি সেখানে তিন বছর যাইনি। ওইসব আদিবাসী বন্ধু। তারা বড় শান্তিপ্রিয়। উপত্যকায় ছাগল চরায় আর বাঁশি বাজায়। মাঝে মাঝে ঈশ্বর সম্বন্ধে তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একজন লোকের দরকার। একজন বিশপ যদি দস্যুর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাদের কাছে না যায়, তা হলে কী ভাববে তারা? আমি যদি না যাই হলে আমার সম্বন্ধেই-বা কী ভাববে?
মেয়র বললেন, কিন্তু মঁসিয়ে, আপনি যদি দস্যুদের কবলে পড়েন?
বিশপ বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই পড়তে পারি। আপনি যখন বললেন তখন আমি অবশ্যই দেখা করব তাদের সঙ্গে। ঈশ্বরের কথা তাদের বলার জন্য তাদেরও নিশ্চয় একজন লোকের দরকার।
কিন্তু তারা তো একদল নেকড়ের মতো।
আর সেইজন্যই হয়তো যিশু আমাকে তাদের রাখাল হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। ঈশ্বরের বিধানের কথা কে বুঝতে পারে?
তারা আপনার সব কিছু অপহরণ করবে।
আমার কিছুই নেই।
ওরা আপনাকে হত্যা করতে পারে।
মন্ত্র উচ্চারণরত একজন বৃদ্ধ যাজককে কেন তারা মারবে?
আপনি যদি তাদের সঙ্গে দেখা করেন ঈশ্বর যেন আপনার মঙ্গল করেন।
আমি আমার গরিবদের জন্য তাদের কাছে ভিক্ষা চাইব।
মঁসিয়ে, আমার অনুরোধ, যাবেন না। শুধু শুধু আপনার জীবন বিপন্ন করবেন না।
বিশপ তার উত্তরে বললেন, আপনার সব কিছু বলা শেষ হয়েছে মঁসিয়ে মেয়র? আমার জীবন রক্ষার জন্য আমাকে কিন্তু এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়নি। আমাকে পাঠানো হয়েছে মানুষের আত্মাকে রক্ষা করার জন্য।
সুতরাং কারও কোনও নিষেধ বা অনুরোধ বাধা দিতে পারল না বিশপকে। তিনি চলে গেলেন। বিশপের এই অনমনীয় জেদের কথাটা ক্রমে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। সকলে তার কথা ভেবে ভয় পেয়ে গেল।
তার বোন ও ম্যাগলোরিকে সঙ্গে নিলেন না বিশপ। শুধু পথ দেখাবার জন্য এক স্থানীয় ছেলেকে সঙ্গে নিলেন। তারা টাটু ঘোড়ায় চেপে গেলেন। পথে কারও সঙ্গে দেখা হল না। নিরাপদেই তারা সে পার্বত্য আদিবাসীদের গাঁয়ে পৌঁছলেন। সেখানে পুরো একপক্ষকাল রয়ে গেলেন বিশপ। তাদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করলেন, ধর্মে দীক্ষা দিলেন, অনেক নীতি শিক্ষা দিলেন।
অবশেষে গাঁ ছেড়ে আসার আগে একদিন প্রার্থনাসভার শেষে ‘তে দিউম’ বা ‘হে ঈশ্বর, তোমার প্রতি’ নামে এক স্তোত্রগানের অনুষ্ঠান করতে বললেন স্থানীয় যাজককে। কিন্তু এই অনুষ্ঠান করতে গিয়ে একটা সমস্যা দেখা গেল। সেই গ্রাম্য গির্জায়
এই অনুষ্ঠানের উপযুক্ত ধর্মীয় পোশাক পাওয়া গেল না।
বিশপ তবু বললেন, যাই হোক, তোমরা ঘোষণা করে দাও নীতি উপদেশ দানের পরই ‘তে দিউম’ অনুষ্ঠিত হবে। কিছু না কিছু একটা উপায় হবেই।
আশপাশের গির্জাগুলোতে পোশাকের জন্য লোক পাঠানো হল। বিভিন্ন গির্জা ঘুরে যা কিছু পাওয়া গেল তাতে দেখা গেল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে না।
এমন সময় কোথা থেকে হঠাৎ দু জন অশ্বারোহী এসে একটা বড় সিন্দুক বিশপের কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। সিন্দুকটা নামিয়ে দিয়েই অশ্বারোহী দু জন চলে গেল। সেটা খুলে দেখা গেল কিছুদিন আগে এমব্রাসের গির্জা থেকে যেসব মূল্যবান সোনা ও হীরের জরি বসানো ধর্মীয় পোশাক চুরি গিয়েছিল সেইসব পোশাক সিন্দুকটাতে গুছিয়ে রাখা আছে। তার সঙ্গে একটা কাগজে লেখা ছিল, ক্রাভেত্তে এগুলো মঁসিয়ে বিয়েনভেনু’র হাতে তুলে দিল।
বিশপ বললেন, দেখলে তো? আমি আগেই বলেছিলাম কিছু একটা উপায় হবে। যে সামান্য ফুলে বা গ্রাম্য যাজকের পোশাকে সন্তুষ্ট থাকে ঈশ্বর তাকে একদিন আর্কবিশপের পোশাক দান করেন।
গ্রাম্য যাজক বলল, কিন্তু যে লোকটি এ পোশাক দিয়ে গেল সে ঈশ্বর না শয়তান?
বিশপ তার পানে কড়াভাবে তাকিয়ে বললেন, ঈশ্বর।
বিশপ চাস্তেলারে ফিরে দেখলেন তাঁকে দেখার জন্য পথের দু পাশে শহরের সব লোক সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শহরের গির্জায় তার জন্য বাপতিস্তিনে আর ম্যাগলোরি অপেক্ষা করছিল। বিশপ তাদের বললেন, আমি ঠিক বলিনি? একজন গরিব যাজক গরিব পার্বত্য উপজাতিদের কাছে গিয়েছিল শূন্য হাতে, ফিরে এল হাত ভর্তি করে। আমি গিয়েছিলাম একমাত্র ঈশ্বরবিশ্বাসকে সম্বল করে। কিন্তু ফিরে এসেছি একটি গির্জার হারানো ধনসম্পদ নিয়ে।
সে রাতে বিছানায় শুতে যাওয়ার আগে বিশপ বললেন, দস্যু ও নরঘাতকদের কখনই আমাদের ভয় করা উচিত নয়। এরা যেসব বিপদের সৃষ্টি করে তা বাইরের ব্যাপার, সে বিপদ তুচ্ছ। আমরা নিজেরাই হচ্ছি নিজেদের ভয়ের বস্তু। কুসংস্কার হচ্ছে প্রকৃত দস্যু আর হিংসা হচ্ছে প্রকৃত খুনি। আমাদের দেহের উপর আঘাত হানার বা অর্থহানি ঘটাবার কেউ যদি ভয় দেখায় তা হলে কেন আমরা ভয় পাব বা বিব্রত বোধ করব? আসলে আমাদের আত্মার নিরাপত্তা সম্পর্কে, দেখতে হবে আমাদের আত্মাকে কেউ যেন ভয় না দেখায় বা তার কোনও বিঘ্ন না ঘটে।
এবার বিশপ তার বোনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, একজন যাজক কখনও আর পাঁচজনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার কথা ভাববে না। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া কোনও কাজ হতে পারে না। ঈশ্বর মানুষকে যে কাজ করার অনুমতি দেন মানুষ সেই কাজই করতে পারে। আমরা শুধু বিপদে পড়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারি। কিন্তু আমাদের নিজেদের জন্য কোনও কিছু প্রার্থনা করা উচিত নয়, আমরা প্রার্থনা করব যাতে আমাদের জন্য আমাদের ভাইরা যেন কোনও পাপকর্মে জড়িয়ে না পড়ে।
এই ধরনের ঘটনা অবশ্য খুব একটা বেশি ঘটত না। আমরা শুধু যেসব ঘটনার কথা জানি সেইসব ঘটনার কথা বলতাম। তবে এই ধরনের কাজ জীবনে অনেক করে যেতেন মিরিয়েল।
এমব্রাস গির্জার হারানো ধনগুলো নিয়ে বিশপ কী করেছিলেন সে কথা আমরা ঠিক জানি না। সেগুলো সত্যিই বড় মূল্যবান বস্তু, বড় লোভনীয়। গরিবদের মঙ্গলের জন্য সেগুলো সত্যিই খুব উপযুক্ত, সেগুলো আগেই অপহৃত হয়েছিল। এবার সেই অপহৃত দ্রব্যগুলো অন্য পথে পরিচালিত করে সেগুলোর একটা সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে! তবে আমরা কোনও মন্তব্য করতে চাই না এ বিষয়ে। এ বিষয়ে আমরা বিশপের একচ্ছত্র লেখা পেয়েছিলাম এক জায়গায়। তিনি লিখেছিলেন, এবার আমাকে স্থির করতে হবে এগুলো আমি গির্জাকে ফেরত দেব, না হাসপাতালে নিয়ে যাব।
.
৮
যে সিনেটর ভদ্রলোকের নাম আমরা আগেই উল্লেখ করেছি সে সিনেটর ছিল এমনই একজন লোক যে এক দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণ করে যেত, যে তার স্বার্থপূরণের পথে বিবেক, ঈশ্বরবিশ্বাস, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যপরায়ণতা প্রভৃতি কোনও কিছুর দ্বিধা বা বাধা মানত না বা তার আপন লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হত না। এই সিনেটর আগে ছিল এক দক্ষ সরকারি অ্যাটর্নি যে তার ছেলে, জামাই ও আত্মীয়-বন্ধুদের স্বার্থটা সব সময় বেশি করে দেখত এবং তার লাভের পথে পাওয়া যে কোনও সুযোগ হাতছাড়া করত না। কারণ এ সুযোগ হাতছাড়া করাটাকে সে বোকামি এবং অবান্তর বলে ভাবত। সে ছিল বুদ্ধিমান এবং সুশিক্ষিত। সে নিজেকে দার্শনিক এপিকিউরাসের শিষ্য বলে ভাবত, যদিও পিগল্ট ব্রোনের মতো নিচু স্তরের লেখকদের নীতিই সে বেশি মেনে চলত। সে চিরপ্রতিষ্ঠিত চিরন্তর সত্যের কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দিত এবং আমাদের মহান বিশপের কাজকর্মকে বাতুলতা বলে তার সাক্ষাতে-অসাক্ষাতে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত।
একবার আধা-সরকারি অনুষ্ঠানে এই সিনেটর মঁসিয়ে মিরিয়েল আর পুলিশের এক বড়কর্তার সঙ্গে এক ভোজসভায় মিলিত হয়। খাওয়ার পর সে মদের ঘোরে বলতে থাকে, আসুন মঁসিয়ে, এবার কিছু কথা বলা যাক। একজন সিনেটর আর বিশপের মধ্যে নীতির দিক থেকে খুব একটা মিল হতে পারে না। আমরা দু জনেই ঈশ্বরের অনুগৃহীত ব্যক্তি। তবে আমি স্বীকার করছি আমার এক নিজস্ব জীবনদর্শন আছে।
বিশপ বললেন, তা তো বটেই। কোনও মানুষের জীবনদর্শন হচ্ছে তার বিছানার মতো, যার উপর সে শোয় প্রতিদিন। আপনার সে জীবনদর্শনের শয্যা হচ্ছে কুসুমশয্যা।
সিনেটর বলল, এখন কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষের মতো কথা বলব।
সাধারণ শয়তান বলতে পারেন।
আমি একথাও স্বীকার করি যে মার্কুই দ্য আর্গেনস, পাইরো, হবস, মঁসিয়ে নাইজিওন প্রমুখ দার্শনিকদের ভণ্ড পাণ্ডিত্যাভিমানী বলে মনে করি না। তবে আমার বইয়ের তাকে আরও অনেক দার্শনিকের বই আছে।
যাদের দর্শন আপনার নিজস্ব দর্শনের মতো।
সিনেটর বলল, আমি দিদেরোকে মোটেই পছন্দ করি না। তিনি হচ্ছেন ভাববাদী, বাগাড়ম্বরসর্বস্ব বাগ্মী, এমন একজন বিপ্লবী যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। তিনি ভলতেয়ারের থেকে আরও গোড়া। ভলতেয়ার বলতেন, নিডহ্যাম স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বরের কল্পনা আর বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে স্বতঃস্ফূর্ততার নীতি এই দুটি পরস্পরবিরুদ্ধ বিষয়কে তলিয়ে ফেলেছেন। এই নিয়ে বিদ্রূপ করেছেন নিডহ্যামকে নিয়ে। কিন্তু ভলতেয়ারের এটা অন্যায়। কারণ নিডহ্যাম যে পাঁকাল মাছের কথা বলেছেন তাতে এই কথাই প্রমাণ হয় ঈশ্বরের কোনও প্রয়োজন নেই সৃষ্টির ব্যাপারে। পাকাল মাছের মতো জগৎ ও জীবনের সৃষ্টির ব্যাপারেও পরম পিতার কোনও প্রয়োজন থাকতে পারে না। হে আমার প্রিয় বিশপ, এ বিষয়ে জেহোভা তত্ত্বও আমি বুঝতে পারি না। এ তত্ত্ব থেকে শুধু শীর্ণ আর রিক্তমস্তিষ্ক মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। আমি মহান সর্বস্ব থেকে মহান শূন্যতা বেশি পছন্দ করি। স্বীকারোক্তি হিসেবে আমি আপনার কাছে সরলভাবে স্বীকার করছি, আমি একজন সরল সাদাসিধে মানুষ। আপনাদের যিশুর প্রতি আমার কোনও ভালোবাসা নেই। তিনি শুধু বৈরাগ্য আর আত্মত্যাগ প্রচার করে গেছেন, যা ভিক্ষুকদের প্রতি কৃপণের উপদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ বৈরাগ্য এ ত্যাগ কিসের জন্য? একটি নেকড়ে কখনও অন্য নেকড়ের মঙ্গলের জন্য কিছু ত্যাগ করেছে একথা আমি কখনও শুনিনি। প্রকৃতিকে অনুসরণ করা উচিত আমাদের। যেহেতু মানুষ হিসেবে আমরা সব জীবের ঊর্ধ্বে, আমাদের এক উন্নততর জীবনদর্শন থাকা উচিত। আপনি মানুষ হয়ে যদি অন্য কোনও মানুষের নাকের ডগা ছাড়া আর কিছু দেখতে না পান তা হলে সব কিছু বিষয়ে মাতব্বরি করে লাভ কী? যে জীবন আমরা পেয়েছি সে জীবন যতদূর পারি সুখে কাটানো উচিত! এ জীবনের পর স্বর্গ বা নরক বলে কিছু আছে, একথা আমি পরিষ্কার অবিশ্বাস করি। আপনি শুধু ত্যাগ করে বৈরাগ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা আমাকে বলবেন। আমাকে প্রতিটি কাজ চিন্তা-ভাবনা করে করতে হবে, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ নিয়ে আমার মস্তিষ্ককে বিব্রত থাকতে হবে সব সময়। কিন্তু কেন? কারণ পরে তার বিচার হবে, সব কর্মাকর্মের জন্য আমাকে জবাব দিতে হবে। কখন? না, আমার মৃত্যুর পরে। আমার মৃত্যুর পর আমাকে ধরার জন্য নিশ্চয় এক চতুর বিচারকের প্রয়োজন হবে। কারণ তখন আমার প্রেতাত্মার হাতে একমুঠো ধুলো ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। কী উদ্ভট কল্পনা! আমরা বাস্তব সত্যকে স্বীকার না করে যারা আইসিসের আঁচলের তলায় উঁকিঝুঁকি মারে তাদের নিয়ে মাতামাতি করি। আসলে ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই। চাই উন্নতি সব কিছু বাদ দিয়ে একমাত্র বাস্তব সত্যকে আমাদের খোঁজা উচিত। সব কিছু তলিয়ে দেখতে হবে, বস্তুর স্বরূপকে দেখতে হবে। তাই নয় কি? সত্যকে ধরার জন্য দরকার হলে পৃথিবীর তলদেশের শেষ প্রান্তে যেতে হবে। বলিষ্ঠ হয়ে গড়ে উঠে আনন্দ উপভোগ করাটাই গৌরবের। আমি যদি বলিষ্ঠতার সঙ্গে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারি এটাই যথেষ্ট। মানুষের অমরত্ব একটা বিশ্বাস মাত্র, এক মধুর প্রতিশ্রুতির মিথ্যা সান্ত্বনা–আপনি ইচ্ছা করলে তা বিশ্বাস করতে পারেন। আদম হতে পারাটা কত আনন্দের কথা অথবা কোনও বিদেহী আত্মা অথবা পিঠে নীল ডানাওয়ালা কোনও দেবদূত হবে মানুষ? তার্তুলিয়া না কে যেন বলছিল না ঈশ্বরের অনুগৃহীত বা আশীর্বাদধন্য মানুষ একদিন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করে বেড়াবে। আমরা হব আকাশের ফড়িং। আমরা ঈশ্বরকে দেখব। যত সব বাজে কথা। ঈশ্বর হচ্ছে এক অদ্ভুত ধরনের ভণ্ড প্রতারক। একথা আমি অবশ্য লিখব না, একথা আমি শুধু মদ্যপানের সময় আমার বন্ধুদের কাছে চুপি চুপি বলব। স্বর্গের লোভে এ জগতের সব কিছু ত্যাগ করা হল বস্তুকে ফেলে ছায়াকে ধরতে যাওয়ার মতোই এক বাতুলতামাত্র। অনন্তের হাতের পুতুল হওয়া আমার ধাতে সইবে না, আমার দ্বারা তা হবে না। আমি কে? কিছুই না। আমি একজন সিনেটর। কিন্তু জন্মের আগে কি আমার কোনও অস্তিত্ব ছিল? না। মৃত্যুর পর কি আমার কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। আমি শুধু একমুঠো মাটির দ্বারা গঠিত এক বস্তু। আমি পৃথিবীতে কী করব? আমাকে সেটা ঠিক করে নিতে হবে।
আমি দুঃখ ভোগ করতে পারি অথবা আনন্দ উপভোগ করতে পারি। আমাকে সেটা বেছে নিতে হবে। এই দুঃখভোগের শেষ পরিণতি কী? এর পরিণতি হচ্ছে বিস্মৃতি। তবু আমাকে দুঃখভোগ করে যেতেই হবে। আনন্দ উপভোগেরই-বা পরিণতি কোথায়? বিস্মৃতিতে। তবু আমি আনন্দ উপভোগ করেই যাব। আমি এটা স্থির করে ফেলেছি, এটা আমি বেছে নিয়েছি। মানুষ হয় খাবে, অথবা কারও দ্বারা খাদিত হবে। আমি খেয়েই যাব। ঘাসের থেকে দাঁত থাকা ভালো। আপনি যা কিছুই করুন-না কেন, পরিণামে মৃত্যু আপনার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুর পর তাদের উজ্জ্বল কীর্তির সমাধিস্তম্ভ লাভ করবে, কিন্তু সবাইকেই নরকে যেতে হবে। মৃত্যুতেই সবার সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। এক সম্পূর্ণ সর্বভূতে বিলুপ্তি, সবাই অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমার মৃত্যুর পর কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে এবং আমাকে কিছু বলবে এই কথা শুনলে আমার হাসি পায়। এটা বুড়িদের এক অবান্তর অর্থহীন রূপকথা। শিশুদের জন্য আছে শয়তান আর বয়স্ক লোকদের জন্য আছে জেহোভা। না, আমাদের মৃত্যুর পর সব কিছুই অন্ধকার। আপনি সাধু বা শয়তান। সার্দানাপেলাম বা ভিনসেন্ট পল যাই হোন না কেন, সমাধির ওপারে সকলের জন্যই বিরাজ করছে নরকের অন্ধকার। এইটাই হল সত্যি কথা। মানবজীবনের একমাত্র কাজ হল বাঁচার মতো বাঁচা। যতদূর সম্ভব জীবনের সদ্ব্যবহার করুন। আমার এক নিজস্ব জীবনদর্শন আছে, আমার বাছাই করা একজন দার্শনিকও আছে। তবে আমি যতসব আজগুবি কথা বিশ্বাস করে বোকা বানাতে চাই না নিজেকে। তবে আমি একথা বলতে চাই না যে এ বিশ্বাসের কারও কোনও প্রয়োজন নেই একেবারে। যারা নিঃস্ব, দরিদ্র, যারা পেট ভরে খেতে পায় না, যাদের কোনও ঘরবাড়ি নেই, যারা অধঃপতিত বা নিজে নেমে গেছে, তাদের বাঁচার জন্য একটা বিশ্বাস চাই। আমরা তাদের পুরাণ ও গল্পকথা শোনাই, আত্মা, অমরত্ব, স্বর্গ, ভাগ্য এইসব কিছুর কথা বলে সান্ত্বনা দিই এবং তারা এই কথাগুলো গোগ্রাসে গিলে খায়। তারা মাখনের পরিবর্তে এইসব কথার অমৃত তাদের শুকনো রুটিগুলোতে মাখিয়ে নেয়। যাদের কিছুই নেই, একেবারে নিঃস্ব, তাদের ঈশ্বর আছে। কিছু না থাকার থেকে এটা ভালো এবং আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমার কথা স্বতন্ত্র। আমি চাই বস্তুবাদকে আঁকড়ে ধরে থাকতে। ঈশ্বর থাক সাধারণ মানুষদের জন্য।
বিশপ হাততালি দিয়ে উঠলেন।
তিনি আবেগের সঙ্গে বললেন, চমঙ্কার কথা। এ ধরনের বস্তুবাদ কী চমৎকার জিনিস! সকলেই এ বস্তুবাদ লাভ করতে পারে না। কিন্তু যে ব্যক্তি তা লাভ করে সে তো আর নিজেকে বোকা বানাতে পারে না। সে তো আর কেটোর মতো নির্বাসিত করতে পারে না নিজেকে। স্টিফেনের মতো পাথরের আঘাত খেয়ে মরতে পারে না অথবা জোয়ান অব আর্কের মতো জীবন্ত দগ্ধ হতে পারে না। একজন দায়িত্বহীন মানুষের সব আনন্দ সে লাভ করতে পারে, সে তার সহজ অতিসরল মন নিয়ে সারা পৃথিবীটাকে পরিক্রমা করতে পারে–এই ধরনের একটা আত্মপ্রসাদও সে অনুভব করতে পারে–অনেক সম্মান ও শক্তি সে লাভ করতে পারে, লাভজনক নাস্তিকতা, বিশ্বাসঘাতকতা, বিবেকের সঙ্গে সুবিধাজনক আপোস এইসব কিছুকেই সে প্রশ্রয় দিতে পারে। এইসব কিছুই উদরস্থ করে সে তার সমাধিতে যেতে পারে। কত আনন্দের কথা! আমি আপনাকে তিরস্কার করছি না মঁসিয়ে সিনেটর। আমি আপনাকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারছি না। আপনি বলেছেন, আপনারা যারা সমাজের উপরতলার মানুষ তাদের এক নিজস্ব জীবনদর্শন আছে। যে দর্শন সূক্ষ্ম, মার্জিত, যে দর্শন শুধু ধনীদের ক্ষেত্রেই থাকে, সব অবস্থাতেই যা খাপ খায় সে দর্শন জীবনের যত কিছু আনন্দলাভের পক্ষে নিঃসন্দেহে এক চমৎকার হাতিয়ার। যারা এ বিষয়ে সিদ্ধ তাদের অন্তরের গম্ভীর হতে এ দর্শন উৎসারিত। কিন্তু আপনি সহৃদয় ব্যক্তি, যেসব সাধারণ মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তাদের প্রতি আপনার কোনও ঈর্ষা বা ক্ষোভ নেই।
.
৯
দিগনের বিশপ কিভাবে তাঁর পারিবারিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন এবং তাঁর বাড়ির দু জন মহিলা তাদের কর্ম, চিন্তা, প্রবৃত্তি ও জীবনের উদ্দেশ্যকে বিশপের কর্ম ও চিন্তার অনুগত করেছিল তা লিখে প্রকাশ না করে তার সারা জীবনের বান্ধবী ভিকেঁতেসি দ্য বয়শেনকে লেখা একখানি চিঠি উদ্ধৃত করব।
দিগনে, ১৬ ডিসেম্বর
প্রিয় মাদাম,
তোমার কথা না বলে আমাদের একটা দিনও কাটে না। এটা যেন আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে তোমাকে চিঠি লেখার আর একটা কারণ আছে। এখানে আসার পর আমাদের ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে ম্যাদময়জেল ম্যাগলোরি দেয়ালে একটা জিনিস দেখতে পায়। কাগজের তলায় কিছু দেয়ালচিত্র দেখতে পাই আমরা। একটা চিত্রে দেখা যায় টলেমা মিনার্ভার কাছ থেকে নাইট উপাধি গ্রহণ করছেন। তাতে সন তারিখ সব লেখা আছে। আর একটি চিত্র উলেমার বাগানবাড়ির, যে বাগানে একটি রাত রোমের মহিলারা কাটান। ম্যাগলোরি ঘরটা ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে এবং সেটা এখন জাদুঘরের মতো দেখাচ্ছে। ছবিগুলো রঙ করতে ছয় ফ্রাঁ খরচ হবে। কিন্তু টাকাটা গরিব-দুঃখীদের দান করাই ভালো। তার থেকে আমার ঘরের জন্য একটা গোল মেহগনি কাঠের টেবিল কিনব।
আমি সুখেই আছি। আমার দাদা খুব ভালো লোক। তিনি তার যথাসর্বস্ব আর্ত ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের দান করেন। আমাদের সংসারে কখনই সচ্ছলতা থাকে না। এ অঞ্চলে শীত খুব বেশি এবং এ অঞ্চলের অভাবগ্রস্ত শীতার্ত ব্যক্তিদের শীত নিবারণের জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হয়। যাই হোক, কোনও রকমে আমরা নিজেদের গরম রাখার ব্যবস্থা করি এবং অন্ধকারে আলো জ্বালি না, এটাই আমাদের বড় যন্ত্রণার কথা।
আমার দাদার কিছু দোষও আছে। কিন্তু উনি বলেন এ দোষ বিশপের থাকা উচিত। তুমি হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না, আমাদের ঘরে কখনও তালাচাবি দেওয়া হয় না। যে কোনও লোক ইচ্ছা করলেই আমার দাদার ঘরে সোজা ঢুকে পড়তে পারে। তিনি কোনও কিছুই ভয় করেন না, রাত্রিতেও ভয় করেন না। তিনি বলেন, এটা তার এক ধরনের সাহস।
তিনি আমাকে বা ম্যাগলোরিকে তার সম্বন্ধে কোনও কথা ভাবতে দেন না। তিনি যত সব বিপদের ঝুঁকি নেবেন, অথচ আমাদের তা নির্বাক দর্শকের মতো দেখে যেতে হবে। তাকে বুঝতে, শিখতে হবে। তিনি বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যান, কাদার উপর দিয়ে যাতায়াত করেন, দারুণ শীতকেও গ্রাহ্য করেন না। তিনি অন্ধকার, দুর্গম পথ বা পথের বিপদ-আপদ কোনও কিছুই ভয় করেন না।
গত বছর তিনি এমন এক অঞ্চলে একা যান যে অঞ্চলটা ভয়ঙ্কর দস্যুদের দ্বারা অধ্যুষিত। আমাদের কাউকে তিনি সঙ্গে নিয়ে গেলেন না। তিনি সেখানে একপক্ষকাল ছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম তিনি মারা গেছেন দস্যুদের হাতে। কিন্তু তিনি অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসে বললেন, ‘আমি তোমাদের দেখাব আমি কিভাবে অপহৃত হয়েছি।’ এই বলে তিনি একটি বাক্স খুলে সেইসব ধনরত্ন বার করলেন, যা কিছুদিন আগে এমব্রাস গির্জা থেকে চুরি যায় এবং সেগুলো ডাকাতরা তাকে ফিরিয়ে দেয়। তিনি যখন সেখান থেকে ফিরে আসেন আমি তখন অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। তাকে কিছুটা তিরস্কারও করেছিলাম, কিন্তু এমনভাবে তিরস্কারের কথাগুলো বলেছিলাম যাতে কেউ তা শুনতে না পায়।
ক্রমে আমি ভাবতে থাকি, কোনও বিপদ তাঁকে কোনও কাজে বাধা দিতে পারবে না, তিনি নির্ভীক, দুর্জয়। এইভাবে তাঁর জীবনযাত্রা প্রণালীর সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে উঠি আমি। ম্যাগলোরি যাতে তাঁকে বিরক্ত না করে তার জন্য নিষেধ করি আমি। তিনি ইচ্ছামতো যত সব বিপদের ঝুঁকি নেন। আমি রোজ রাতে ম্যাগলোরিকে তার ঘরে শুতে পাঠিয়ে আমি আমার ঘরে তার জন্য প্রার্থনা করি, তার পর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি। ভাবি, তার যদি কোনও বিপদ ঘটে তা হলে আমাদেরও তাঁর সঙ্গে মরতে হবে। তা হলে আমার ভাই এবং বিশপের সঙ্গে আমাদেরও মৃত্যুপুরীতে যেতে হবে। তাঁর এই হঠকারিতা আমার যেতে ম্যাগলোরির পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এখন সে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং শোবার আগে সে-ও আমার সঙ্গে প্রার্থনা করে। শয়তান যদি তার ঘরে ঢোকে কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে কোনও কিছু হারাবারই-বা কি আছে? আমাদের সঙ্গে এমন একজন সব সময় আছেন যিনি সবার থেকে শক্তিমান। শয়তান আমাদের বাড়িতে আসতে পারে, কিন্তু সেই সর্বশক্তিমান আমাদের বাড়িতে বাস করেন।
এই হল তাঁর কথা। আমার দাদা আমাকে আর কোনও কথা বলেন না। তিনি কিছু বললেও তার সব কথা আমি বুঝি এবং ঈশ্বরের বিধানে আস্থা রাখি। এক মহান আত্মার সঙ্গে এইভাবে আমরা বাস করি।
ফক্স পরিবারের যেসব কথা তুমি জানতে চেয়েছ সেসব কথা তাঁকে জিগ্যেস করেছিলাম আমি। তুমি জান তিনি এই ব্যাপারে সব কিছুই জানেন এবং সব কিছুই তাঁর মনে আছে। তিনি এখনও মনে-প্রাণে রাজতন্ত্রবাদীই রয়ে গেছেন। ফক্স পরিবার কেন অঞ্চলের এক প্রাচীন নর্মান পরিবার। ওই পরিবারের রুল দ্য ফক্স, আঁ দ্য ফক্স, টমাস দ্য ফক্সের পাঁচশো বছরের পুরনো অনেক নথিপত্র আছে। এরা সবাই সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। এই পরিবারের সেনার দ্য বশেফোর্ট নামে এক ভদ্রলোক বড়দরের একজন সামন্ত ছিলেন। এই পরিবারের শেষ বংশধর লি এতিয়েন আলেকজান্দার সামরিক বিভাগের একজন কর্নেল ছিলেন এবং তিনি তোর ছোটখাটো এক অশ্বারোহী দলের সেনাপতিত্ব। করেন। তাঁর কন্যা মেরি লুই ফরাসি বাহিনীর এক বড় সামরিক অফিসার, দাক লুই দ্য গ্রেদ্রতের পুত্র আমিয়েঁ শার্লসকে বিবাহ করেন। এই পরিবারের নাম ফক্স বা ফক।
আশা করি মাদাম, তুমি তোমার সাধুপ্রকৃতির আত্মীয় কার্ডিনালকে আমাদের কথা বলবে। তোমার প্রিয় সিলভানি তোমার কাছে সব সময় থাকে এবং তোমাকে চিঠি লিখতে দেয় না। কিন্তু সে ভালো আছে জেনে সুখী হলাম। সে আমাকে আজও ভালোবাসে জেনে খুশি হলাম। আমার শরীর ভালোই আছে, তবে দিন দিন চেহারাটা রোগা হয়ে যাচ্ছে। আমার কাগজ ফুরিয়ে আসছে। প্রীতি নিও। ইতি।
বাপতিস্তিনে।
তোমার বউদি এখন এখানেই আছে তাঁর ছোট সংসার নিয়ে। তোমার ভাইপোর ছেলেটি বেশ সুন্দর। সে পাঁচ বছরে পড়েছে। সে তার ছোট ভাইকে নিয়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে।
এই চিঠিটি থেকে বোঝা যাবে এই দু জন মহিলা তাদের সহজাত নারীসুলভ বুদ্ধির দ্বারা একজন মানুষকে ভালোভাবেই চিনতে পেরেছিল এবং বিশপের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। বিশপ ইচ্ছামতো তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন। অনেক সময় তিনি অনেক দুঃসাহসিক কাজ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে করতেন। তা দেখে তাঁর বোন শিউরে উঠত ভয়ে। ম্যাগলোরি প্রতিবাদ করতে যেত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে উঠত না। কোনও কিছুই তাঁকে তাঁর কর্তব্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারত না। তারা বুঝতে পারত তারা বিশপের ছায়া মাত্র; বিশপের কোনও কাজের ব্যাপারে বাধা দেওয়ার মতো কোনও ক্ষমতাই তাদের নেই। তারা শুধু সময়মতো চেষ্টা করে যেত। ক্রমে বিশপের ব্যাপারটা ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দেয়।
বাপতিস্তিনে জানত এবং মুখে বলত তার দাদার মৃত্যু মানেই তাদের মৃত্যু। ম্যাগলোরি মুখে এ কথা না বললেও মনে মনে তা জানত।
.
১০
বাপতিস্তিনে তার বান্ধবীকে চিঠিটা লেখার পর অল্প দিনের মধ্যেই এমন একটি দুঃসাহসিক কাজ করেন বিশপ, যা দস্যু-অধ্যুষিত সেই পার্বত্য এলাকায় যাওয়ার থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক। দিগনের অনতিদূরে একজন লোক নিভৃতে আত্মগোপন করে ছিল। লোকটি বিপ্লবী কনভেনশনের একজন ভূতপূর্ব সদস্য ছিল।
দিগনের সমস্ত লোক লোকটার নাম শুনলেই ভয়ে শিউরে উঠত। লোকটা যেন এক রাক্ষস। কনভেনশনের সদস্য–যেন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যদিও সে রাজার মৃত্যুর সপক্ষে ভোট দান করেনি তথাপি নীতিগতভাবে সে তাই চেয়েছিল। তাই রাজহত্যায় তার হাত ছিল বলে একটা কুখ্যাতি ছিল তার। তা যদি হয় তা হলে বৈধ রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তার বিচার হল না কেন? তারা তার মাথা কাটতে পারত, আবার সে জীবন ভিক্ষা চাইলে তাকে মার্জনা করা হত। আবার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তাকে নির্বাসিত করাও হত। আর সব বিপ্লবীর মতো সে আবার নাস্তিক ছিল। তাই শকুনির চারদিকে ভিড় করা সন্ত্রস্ত রাজহাঁসের দলের মতো শহরের লোকটার ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে দেখত তাকে।
কিন্তু লোকটা কি সত্যিই একটা ভয়ঙ্কর শকুনি ছিল? সে তো নির্জনে নিভৃতে এক জায়গায় বাস করত।
রাজার মৃত্যুর ব্যাপারে সে ভোট না দেওয়ায় নির্বাসনদণ্ডে দণ্ডিতদের তালিকায় তার নাম ছিল না। তাই সে ফ্রান্সে থাকতে পেরেছিল। শহর থেকে কিছু দূরে এমন একটা নির্জন উপত্যকায় বাস করত যেখানে যাওয়ার কোনও রাস্তাঘাট ছিল না। লোকে বলত সে নাকি একটুকরো জমি চাষ করত এবং নিজের থাকার জন্য আদিম কালের মতো একটা কুঁড়ে তৈরি করে ছিল, যেটাকে একটা পশুর গুহা বলা যেতে পারে। কেউ তার কাছে যেত না। লোকে বলত সেটা ঘাতকের ঘর। সেই উপত্যকায় যাওয়ার যে একটা পথ ছিল লোকটা সেখানে বাস করতে যাওয়ার পর থেকে কেউ সেখানে যাতায়াত না করায় পথটায় বন গজিয়ে ওঠে।
একমাত্র বিশপ সেই উপত্যকা দিয়ে যেতে যেতে তার শেষ প্রান্তে গাছপালাগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে ভাবতেন, ওখানে এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তি বাস করে। তার পরই মনে ভাবতেন, তার কাছে একবার আমার যাওয়া উচিত।
তবে কথাটা প্রথমে স্বাভাবিক এবং সরল মনে হলেও কিছুটা ভাবনা-চিন্তা করার পর সেটা অদ্ভুত আর অসম্ভব মনে হল তার। কিছুটা বিতৃষ্ণা জাগল তাঁর মনে। কারণ সাধারণ লোকে যা ভাবত তা তিনিও ভাবতেন। একজন ভূতপূর্ব নাস্তিক বিপ্লবী তাঁর মনে স্বাভাবিকভাবেই যে বিতৃষ্ণা জাগায় তা ক্রমে ঘৃণায় পরিণত হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এটাও ভাবতেন যে রাখাল কি কখনও ভেড়াকে ভয় বা ঘৃণা করে সরে যায় তার থেকে কখনই না। কিন্তু এ ভেড়াটা তো শয়তান। বিশপ একটা অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েন। তিনি কয়েকবার লোকটার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে আসেন।
একদিন শহরে একটা কথা শোনা গেল। যে একটা গ্রাম্য ছেলে লোকটার কাছে কাজ করত, সে হঠাৎ শহরে ডাক্তারের খোঁজে আসে। লোকটার নাকি খুব অসুখ। জানা গেল তার শরীরের একটা অঙ্গ পক্ষাঘাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। শহরের লোকেরা। বলাবলি করতে লাগল, বুড়ো রাক্ষসটা মরতে বসেছে, কেউ কেউ আবার বলতে লাগল, ভালোই হয়েছে।
সেদিন বিকালের দিকে তার ছেঁড়া আলখাল্লাটা ঢাকার জন্য একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে ছড়ি হাতে বেরিয়ে পড়লেন বিশপ।
তিনি যখন পশুর গুহার মতো বুড়ো লোকটার কুঁড়েতে পৌঁছলেন তখন দিগন্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। একটা খাল পার হয়ে একটা ঝোঁপের পাশ দিয়ে একটা ছোটখাটো বাগানের বেড়া ঠেলে এগিয়ে গিয়ে কুঁড়েটা দেখতে পেলেন বিশপ। একটু দূর থেকে দেখতে পেলেন তিনি, বৃদ্ধ পাকা চুলওয়ালা লোকটি সেই কুঁড়ের দরজার কাছে একটা সাদাসিধে ইজি চেয়ারের উপর বসে সূর্যাস্ত দেখছে আর যে ছেলেটা তার ফাইফরমাশ খাটত সেই ছেলেটা তার হাতে একটা বাটি দুধ দিচ্ছে।
দুধটা খেয়ে লোকটা ছেলেটার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ! এখন এটাই আমি চাইছিলাম।
বিশপের পায়ের শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকাল লোকটা। দীর্ঘকাল পর একজন মানুষকে তার কাছে আসতে দেখায় সীমাহীন বিস্ময়ের এক অনুভূতি তার চোখেমুখে ফুটে উঠল।
লোকটা বিশপকে বলল, আমি এখানে আসার পর থেকে একমাত্র আপনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আমার কাছে এলেন। আপনি কে মঁসিয়ে?
বিশপ উত্তর করলেন, আমার নাম বিয়েনভেনু মিরিয়েল।
বিয়েনভেনু মিরিয়েল! এ নাম আমি তো কখনও শুনিনি। তবে লোকে যাকে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু বলে আপনি কি সেই?
হ্যাঁ, তাই।
লোকটি হাসিমুখে বলল, তা হলে আপনি তো আমারও বিশপ।
অল্পবিস্তর তাই।
করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল লোকটি। কিন্তু বিশপ তা ধরলেন না। তিনি শুধু বললেন, তা হলে কি আমি ভুল খবর পেয়েছি? আপনাকে তো খুব একটা অসুস্থ দেখাচ্ছে না।
বৃদ্ধ লোকটি বলল, আমার সব কষ্টের অবসান হতে চলেছে।
একটু থেমে সে আবার বলল, তিন ঘণ্টার মধ্যেই আমি মারা যাব। আমি চিকিৎসাবিদ্যার কিছুটা জানি। আমি জানি আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। গতকাল শুধু আমার পা দুটো অসাড় হয়ে যায়। আজ সকালবেলায় সেই অসাড় ভাবটা হাঁটু পর্যন্ত উঠে আসে, এখন আবার দেখছি সেটা কোমর পর্যন্ত উঠে এসেছে। এই পক্ষাঘাত রোগটা আমার হৃৎপিণ্ডটাকে আক্রমণ করলেই আমি আর বাঁচব না। সূর্যাস্তটা সত্যিই খুব সুন্দর। তাই না কি? আমি ছেলেটাকে চেয়ারের চাকাটাকে ঘুরিয়ে এই দিকে আনতে বললাম যাতে আমি শেষবারের মতো পৃথিবীটা দেখতে পারি। আপনি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন, আমি বিরক্তবোধ করব না। আপনি একজন মুমূর্ষ লোককে দেখতে এসে ভালোই করেছেন। এই সময় একজন সাক্ষী দরকার। সব লোকেরই এক একটা খেয়ালখুশি থাকে। আমি চেয়েছিলাম আগামীকাল সকাল পর্যন্ত বাঁচতে, কিন্তু আমি জানি আমার জীবন আর মাত্র তিন ঘণ্টা আছে। দিনের আলোর আর প্রয়োজন নেই, আমি নক্ষত্রের আলোয় মরব।
এরপর ছেলেটার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, যাও তুমি শোওগে। তুমি গতকাল সারারাত জেগেছ, এখন ক্লান্ত।
ছেলেটা ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। লোকটি তখন নিজের মনে বলতে লাগল, ও যখন ঘুমোবে তখনই আমার মৃত্যু হবে। দুটি ঘুম পাশাপাশি চলবে।
রুগণ মুমূর্ষ লোকটির অবস্থা দেখে বিশপ যতটা বিচলিত হবেন ভেবেছিলেন ততটা বিচলিত তিনি হলেন না। এই ধরনের লোকের মধ্যে ঈশ্বরের কোনও উপস্থিতি অনুভব করতে পারলেন না তিনি। তাঁর প্রতি লোকটার ভাবভঙ্গি ভালো লাগল না। সাধারণ মানুষের মতো মহান ব্যক্তিদের স্বভাবে কতকগুলি অসংগতি থাকে। সে বিশপ সাধারণত কারও কাছ থেকে কোনও সম্মান চান না, তাঁকে মহান বিশপ’ বলে সম্বোধন করলে তিনি তা হেসে উড়িয়ে দিতেন, বিরক্ত বোধ করতেন। আজ এই ভূতপূর্ব বিপ্লবী তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান না দেখানোয় এবং তাঁকে মঁসিয়ে হিসেবে সম্বোধন না করায় তিনি ক্ষুণ্ণ না হয়ে পারলেন না। সাধারণ যাজক আর ডাক্তাররা অবশ্য সর্বত্র যথাযোগ্য সম্মানের প্রত্যাশা করে এবং তা না পেলে ক্ষুণ্ণ হয়। কিন্তু বিশপ তো সে ধরনের লোক নন। কারও কাছ থেকে কোনও সম্মান প্রত্যাশা করা তাঁর স্বভাব নয়, এটা তাঁর অভ্যাসের বাইরে। বিপ্লবী কনভেনশনের ভূতপূর্ব সদস্য, জনগণের প্রতিনিধি এই বৃদ্ধ লোকটি একদিন সত্যিই খুব সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন।
লোকটা বিশপকে যথাযোগ্য সম্মান না দেখালেও তার কথাবার্তায় একটা অন্তরঙ্গতার ভাব আর একটা নম্রতা ছিল, যে নম্রতা সব মুমূর্ষ লোকের মধ্যে দেখা যায়।
বিশপ লোকটির প্রতি কোনও অযথা বা অসংযত কৌতূহল না দেখালেও সহানুভূতিমিশ্রিত এক মনোযাগে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন তাকে। সেই সহানুভূতির বশে অন্য কেউ হলে তিনি তাকে তিরস্কার করতেন। কিন্তু বিপ্লবীদের অন্য চোখে দেখতেন। তাঁর মতে বিপ্লবীরা হল পলাতক দস্যুদের থেকে একটু উপরে এবং দানশীলতার পরিসীমার বাইরে।
লোকটি অল্প সময়ের মধ্যে মরবে বললেও তখনও সে শান্তভাবে খাড়া হয়ে বসেছিল। তার স্পষ্ট পরিষ্কার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছিল চারদিকে। এই অশীতিপর মুমূর্ষ লোকটি যেকোনও মনোবিজ্ঞানীকে তাক লাগিয়ে দেবে। বিপ্লবের সময়ে এই ধরনের সহিষ্ণু ও শক্তিমান লোক অনেক দেখা গেছে। কিন্তু লোকটার সহ্য করার শক্তি সত্যিই অসাধারণ। ঠিক এই মুহূর্তে মৃত্যু তার এত কাছে ঘনিয়ে আসা সত্ত্বেও তাকে দেখে সুস্থ ও সবল বলে মনে হচ্ছে। তার দৃষ্টির স্বচ্ছতায়, তার কণ্ঠের দৃঢ়তায়, তার কাঁধ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বলিষ্ঠ সঞ্চালনে এমন একটা উদ্ধত অনমনীয় ভাব দেখা যায় যা মৃত্যুকে অস্বীকার করছে, যা। কখনই মাথা নত করতে চায় না মৃত্যুর কাছে। মুসলমানদের মৃত্যুদূত আজরাইল আজ তার আত্মাকে এই সময় নিতে এলে সে নিজে নিজেই ফিরে যাবে, ভাববে সে ভুল করে এ দরজায় ঢুকে পড়েছে। মনে হচ্ছে লোকটা যেন ইচ্ছামৃত্যু বরণ করে নিচ্ছে। সে মরতে চাইছে বলেই সে মরছে। মৃত্যু জোর করে ধরে নিয়ে যেতে পারছে না তাকে। রোগযন্ত্রণার মধ্যে একটা মুক্তির আনন্দ তাকে আচ্ছন্ন করে আছে যেন। তার একটা পা গতি হারিয়ে ফেলেছে আর তাই মৃত্যুর অন্ধকার একমাত্র সেই জায়গাটাতেই এসে চেপে ধরেছে। তার একটা পা শুধু মরে গেছে, কিন্তু তার মাথাটা পরিপূর্ণভাবে বেঁচে আছে। এখনও এবং মনে হচ্ছিল তার সমস্ত প্রাণশক্তি এখনও তার আয়ত্তেই আছে। এই বিরল মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন প্রাচ্যের এক রূপকথার নায়ক রাজা, যার দেহের উপর দিকটায় মাংস আছে আর নিচের দিকটা মর্মর প্রস্তরে গাঁথা।
কুঁড়েটার সামনে যে একটা পাথর ছিল তার উপরে বসলেন বিশপ। বসেই কোনও ভূমিকা না করেই তার ধর্মীয় উপদেশ দানের কাজ শুরু করলেন। তিনি প্রথমে বললেন, একটা বিষয়ের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি আপনাকে। আপনি অন্তত রাজার মৃত্যুর জন্য ভোট দেননি।
‘অন্তত’ কথাটার যে একটা ঝাঁঝ ছিল তা লক্ষ করে কড়াভাবে লোকটি বলল, আমাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে কিন্তু খুব একটা বেশি দূর যাবেন না মঁসিয়ে। আমি এক অত্যাচারীর উচ্ছেদের জন্য ভোট দিয়েছিলাম।
তার মানে? বিশপ জিজ্ঞাসা করলেন।
তার মানে এই যে মানুষ আসলে শাসিত হয় এক অত্যাচারীর দ্বারা, যার নাম হল অজ্ঞতা। এই অত্যাচারীরই উচ্ছেদ আমি চেয়েছিলাম। এই অত্যাচারীই রাজতন্ত্রের জন্ম দেয়। রাজতন্ত্রের যা কিছু শক্তি ও প্রভুত্ব তা মিথ্যার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু জ্ঞানের যা কিছু শক্তি তা সত্যের ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষ শাসিত হবে জ্ঞানের দ্বারা।
বিশপ বললেন, জ্ঞান আর বিবেক।
ও দুটো এক জিনিস। বিবেক হচ্ছে জ্ঞানেরই অন্তর্নিহিত এক শক্তি।
আশ্চর্য হয়ে এই কথাগুলো শুনতে লাগলেন বিশপ। তাঁর মনে হল এটা যেন। জীবনকে দেখার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। বিপ্লবী আবার বলতে লাগল, রাজা ষোড়শ লুইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর মৃত্যুর বিরুদ্ধে আমি ভোট দিয়েছিলাম। আমি মনে করি না কোনও মানুষকে হত্যা করার অধিকার আমার আছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, অন্যায়কে উচ্ছেদ করা আমার কর্তব্য। আমি নারীদের বেশ্যাগিরি, ক্রীতদাসপ্রথা, শিশুদের ওপর অবিচার প্রভৃতি অত্যাচারগুলোর উচ্ছেদের জন্য ভোট দিয়েছিলাম। প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়ে আমি আসলে এইসব অত্যাচারের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলাম। আমি সৌভ্রাতৃত্ব, ঐক্য আর এক নতুন যুগের প্রভাতের জন্য ভোট দিয়েছিলাম। সমস্ত রকমের কুসংস্কার আর মিথ্যাচারের পতন ঘটাতে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এগুলোর ধ্বংস। হলেই সব অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর যুগ আসবে। দুঃখের পৃথিবী অনাবিল আনন্দের আধারে পরিণত হবে।
বিশপ বললেন, কিন্তু সে আনন্দ অনাবিল আনন্দ নয় নিশ্চয়।
বিপ্লবী বলল, আপনি বলতে পারেন এটা অনিশ্চিত আনন্দ, কারণ রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অতীত আবার ফিরে আসায় সে আনন্দ বিলীন হয়ে যায়। হায়, আমার কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেল। আমরা পুরনো রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামোটাকে ধ্বংস করেছিলাম, ভেঙে দিয়েছিলাম, তার ভাবধারাকে ধ্বংস করতে পারিনি। শুধু অত্যাচারের উচ্ছেদ ঘটালেই চলবে না, যুগ-যুগান্তব্যাপী প্রথাগুলোরও পরিবর্তন দরকার। আমরা কারখানাটাকে ভেঙে ফেলেছিলাম কিন্তু তার যন্ত্রটা আজও চলছে।
আপনারা ধ্বংস করেছিলেন; ধ্বংসেরও প্রয়োজন আছে ঠিক। কিন্তু আমার বিশ্বাস যে ধ্বংসকার্য ক্রোধের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয় সে ধ্বংসকার্য কোনও শুভ ফল দান করতে পারে না।
হে আমার লর্ড বিশপ, ন্যায়পরায়ণতার এক নিজস্ব ক্রোধ আছে। সেই ক্রোধই হল অগ্রগতির বা প্রগতির এক উপাদান। ফরাসি বিপ্লব সম্বন্ধে যা-ই বলা হোক না কেন, খ্রিস্টের আবির্ভাবের পর থেকে এ বিপ্লব মানবজাতির পক্ষে অগ্রগতির পথে এক বিরাট পদক্ষেপ। অসমাপ্ত রয়ে গেলেও এ বিপ্লব মহান। সমাজের অবরুদ্ধ আবেগকে এ বিপ্লব মুক্ত করে দেয়। অনেক বিক্ষুব্ধ অন্তরকে শান্ত করে, সারা বিশ্বে সভ্যতার এক নবজোয়ার এনে দেয়। অন্ধকারে আলো দেখায় অজস্র মানুষকে। ফরাসি বিপ্লব যেন মানবজাতির পবিত্র তৈলাভিষেক।
বিশপ গুঞ্জনধ্বনির মতো বলে উঠলেন, কিন্তু ১৭৯৩ সালের বিভীষিকা?
বিপ্লব কনভেনশনের সেই ভূতপূর্ব সদস্য চেয়ারে সোজা হয়ে বসে গম্ভীরভাবে গলার স্বর উঁচু করে বলল, হ্যাঁ, ১৭৯৩ সালের কথায় আসছি। পনেরশো বছর ধরে মেঘ ঘন হয়ে উঠছিল, অবশেষে ১৭৯৩ সালে ঝড় ওঠে। আপনারা এই ঝড়কেই বজ্র বলে ধিক্কার দিচ্ছেন।
বিশপ কথাটার মানে বুঝতে পারলেন। তবু প্রতিবাদের সুরে বললেন, বিচারক যা কিছু বলেন বা করেন তা সব ন্যায়বিচারের নামে চালিয়ে দেন। যাজক বলেন করুণার কথা যে করুণা ন্যায়বিচারের এক ঊর্ধ্বতন স্তর। বজ্র কখনও ভুল করে না। আর ষোড়শ লুই?
মুমূর্ষ বিপ্লবী হাত বাড়িয়ে বিশপের একটি হাত ধরে বলল, আপনি কি ষোড়শ লুই-এর জন্য শোকে বিলাপ করছেন? তিনি যদি এক নিষ্পাপ শিশু হতেন তা হলে আমিও আপনার সঙ্গে কাঁদব। আমার কাছে রাজপরিবারের দুটি শিশু হত্যা খুবই দুঃখজনক। শুধু কাশের ভাই হওয়ার জন্য একটি নির্দোষ শিশুকে প্লেস দ্য গ্রেভে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং পঞ্চদশ লুই-এর পৌত্রকে শুধু রাজার পৌত্র বলেই হত্যা করা হয়।
বিশপ বললেন, অতশত নাম আমার জানার দরকার নেই। কাত্রুশ না পঞ্চদশ লুই? কার নামে আপনার আপত্তি?
কিছুক্ষণ দু জনেই চুপ করে রইলেন। এখানে আসার জন্য অনুশোচনা বোধ করতে লাগলেন বিশপ। তবু তিনি বেশ কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠলেন। কেন তা তিনি বুঝতে পারলেন না।
মুমূর্ষ বলল, শুনুন মঁসিয়ে, আপনি সত্যের স্থূল দিকটা গ্রাহ্য করেন না। কিন্তু খ্রিস্ট তা করেন, সুদখোর উত্তমবর্ণের মন্দির থেকে বিতাড়িত করেন। তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের দ্বারা অনেক সত্যকে তুলে ধরতেন। তিনি বলতেন, যারাই আমার কাছে আসবে তাকেই কষ্টভোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি শিশু-বৃদ্ধের মধ্যে কোনও পার্থক্য মানতেন না। হেরদের পুত্রের সঙ্গে বারাব্বাসের পুত্রের মেলামেশাটাকে তিনি খারাপ ভাবতেন না। নির্দোষিতার একটি নিজস্ব মর্যাদা আছে; বাইরের কোনও পৃথক মান-মর্যাদার প্রয়োজন হয় না। ছেঁড়া কাপড়ে ও রাজপোশাকে নির্দোষিতা সমান মর্যাদাজনক, তার মহত্ত্ব সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে থাকে অম্লান আর উজ্জ্বল।
বিশপ শান্ত নিচু গলায় বললেন, তা অবশ্য বটে।
বিপ্লবী বলল, আপনি সপ্তদশ লুই-এর নাম করেছেন। আমাদের পরস্পরের বক্তব্য ভালো করে বোঝা দরকার। আপনি কি অভিজাত, নীচজাত, ছোট-বড় নির্বিশেষে সব নির্দোষ, আর শহিদ, সব শিশুর জন্য চোখের জল ফেলতে বলছেন? তা হলে আমিও আপনার সঙ্গে কাঁদব তাদের জন্য। কিন্তু আমাদের ৯৩ সাল ও সপ্তদশ লুই-এর আগে চলে যেতে হবে। আপনি যদি শিশুদের জন্য অশ্রুপাত করেন তা হলে আমিও রাজপরিবারের শিশুদের জন্য অশ্রুপাত করব।
বিশপ বললেন, আমি সকলের জন্যই অশ্রুপাত করব।
কিন্তু সকলের জন্য সমানভাবে অশ্রুপাত করতে হবে। তবে তুলনামূলকভাবে সাধারণ জনগণের শিশুদের দাবিই বেশি কারণ তারাই দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ভোগ করে এসেছে।
কিছুক্ষণ আবার দু জনেই চুপ করে রইল। বিপ্লবী এবার কনুই-এর উপর ভর দিয়ে তার এক দিকের গালে আঙুল দিয়ে একটা চিমটি কেটে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুমূর্ষ জীবনের স্তিমিতপ্রায় প্রাণশক্তির একটা জ্বলন্ত আগুন জ্বলতে লাগল তার দুচোখে। তার কথাগুলো বিস্ফোরণের মতো জ্বালাময় শব্দ করে উঠল বিশপের কানে।
বিপ্লবী বলতে লাগল, জনগণ বহুদিন ধরে বহু দুঃখকষ্ট ভোগ করে এসেছে মঁসিয়ে। সেইটাই সব নয়। আমাকে প্রশ্ন করার এবং সপ্তদশ লুই সম্বন্ধে আমার সঙ্গে কথা বলার আপনি কে? আমি আপনাকে চিনি না। এখানে আসার পর থেকে আমি কাউকে দেখিনি, কেউ আমার কাছে আসেনি, আমি কোথাও যাইনি। শুধু এই ছেলেটা আমার কাছে কাজ করে এবং একেই আমি দেখি। অবশ্য আপনার নাম আমার কানে এসেছে এবং এটাও শুনেছি যে লোকে আপনাকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু তাতে কিছু বোঝা যায় না। চতুর লোকেরা নানা উপায়ে সাধারণ লোকের মন জয় করে, তাদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। আমি আপনার গাড়ির চাকার শব্দ কোনওদিন শুনিনি। আপনি নিশ্চয় গাড়িটা দূরে কোথাও রেখে এসেছেন। আমি আবার বলছি আমি আপনাকে চিনি না। আপনি বলছেন আপনি বিশপ। কিন্তু তাতে আপনার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ পায় না। আমি আবার আপনাকে প্রশ্ন করছি, আপনি কে? আপনি বিশপ, চার্চের রাজা, প্রভূত ঐশ্বর্য ভোগের অধিকারী এক ব্যক্তি। দিগনের বিশপের মাইনে বছরে পনেরো হাজার ফ্রা, দশ হাজার ফ্রাঁ তার পেছনে খরচ। সব মিলিয়ে বছরে পঁচিশ হাজার ফ্রাঁ। আপনি এক বিরাট প্রাসাদে বাস করেন, অনেক চাকরবাকর আছে সে প্রাসাদে, আপনার রান্নাঘরে অনেক খাবারের প্রাচুর্য। প্রতি শুক্রবার মুরগির মাংস পরিবেশন করা হয় খাবার টেবিলে। খ্রিস্টের নামে আপনি গাড়ি চড়ে বেড়ান অথচ খ্রিস্ট নিজে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতেন, উচ্চপদস্থ যাজক হিসেবে প্রচুর ভোগ-সুখ ও আরাম-স্বাচ্ছন্দের উপকরণ আপনি ভোগ করেন। কিন্তু এতে আপনার আসল স্বরূপ বা সত্তার পরিচয় পাওয়া যায় না। আপনি তা হলে আমাকে জ্ঞানের কথা শোনাতে এসেছেন মনে হয়। কিন্তু কার সঙ্গে আমি কথা বলছি? কে আপনি?
বিশপ মাথা নত করে একটি প্রার্থনাস্তোত্রের একটি ছত্র উদ্ধৃত করে বললেন, আমি একটি কীটমাত্র, মানুষ নই।
মুমূর্ষ বিপ্লবী যত কঠোর ভাব ধারণ করল বিশপ ততই বিস্ত্র হয়ে উঠলেন। তিনি শান্তভাবে বললেন, মনে করুন আপনি যা বললেন তা সব সত্য। আমার আয়, আমার ঐশ্বর্য, আমার গাড়ি, আমার খাওয়া-দাওয়ার যেসব কথা বললেন তা সব সত্য হলেও একটা কথা আপনাকে ব্যাখ্যা করে বলতে হবে। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে করুণা কেন মানবজীবনের একটা প্রধান গুণ নয়? মার্জনা কেন মানবজীবনের প্রধান কর্তব্য নয় এবং ১৭৯৩ সালটি কেন ক্ষমার অযোগ্য নয়?
বৃদ্ধ বিপ্লবী কপালে হাত দিয়ে কিছু মুছল। তার পর বলল, আপনার কথার উত্তর দেওয়ার আগে প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি মঁসিয়ে। আপনি আমার অতিথি এবং যথাযোগ্য সৌজন্য দেখাতে পারিনি। আমরা আমাদের আপন আপন ভাবধারার কথা আলোচনা করছি এবং এক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে সব কথা বলতে হবে; আপনার সম্পদ আর সুযোগ-সুবিধাভোগ তর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি সুবিধার জন্য, কিন্তু এটা সুরুচির পরিচায়ক নয়। কিন্তু এগুলো আর আমি উল্লেখ করব না।
বিশপ বললেন, এজন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে।
আপনি আমাকে একটা জিনিস ব্যাখ্যা করতে বলেছেন। আপনি বললেন ১৭৯৩ সাল ক্ষমার অতীত।
বিশপ বললেন, হ্যাঁ। মারাও যে গিলোটিন নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সে বিষয়ে কী বলতে চান আপনি?
সৈন্যরা যখন প্রোটেস্ট্যান্টদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছিল কানে বুসতে তখন ‘তে দিউম’ গানের অনুষ্ঠান করেছিল সে বিষয়েই বা আপনি কী বলতে চান?
উত্তরটা খুবই কড়া। তীক্ষ্ণ তরবারির মতো এ উত্তরটা বিদ্ধ করল বিশপকে। বিশপ কেঁপে উঠলেন। তিনি কোনও উত্তর খুঁজে পেলেন না। তবে বুসেতের উল্লেখ করায় তিনি রেগে গেলেন। যারা মহান ব্যক্তি তাদের কিছু না কিছু দুর্বলতা হয়তো থাকে, কিন্তু তর্কের খাতির তাঁদের অশ্রদ্ধা করাটা সত্যিই রাগের কথা।
বৃদ্ধ বিপ্লবী হাঁপাতে লাগল। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে তাতে একটুও ম্লান হয়নি তার দৃষ্টির স্বচ্ছতা। সে বলতে লাগল, আমরা আর একটু এগিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে পারি। সমগ্রভাবে বিচার করলে দেখা যাবে বিপ্লব মানবতার এক বিরাট স্বীকৃতি, শুধু ১৭৯৩ সালটাই তার ব্যতিক্রম। আপনি এ সালটাকে ক্ষমা করতে পারেন না। কিন্তু মঁসিয়ে, সমগ্রভাবে বিচার করলে রাজতন্ত্রই কি ক্ষমার যোগ্য? স্বীকার করি ফ্যারিয়ার অপরাধী, কিন্তু মন্ত্রী ভানকে কী বলবেন? ফুকিয়ের তিনভিল একজন শয়তান ছিল ঠিক, কিন্তু লাময়গনান বেতিলকে কী বলবেন? ম্যালিয়ার্দ ঘৃণ্য হতে পারেন, কিন্তু সয়তানে কী? জের্দে কুপ তেতির থেকে মার্কুই দ্য লুভয় কি বেশি ভয়ঙ্কর মঁসিয়ে, আমি রানি মেরি আঁতানোতের মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করি ঠিক, কিন্তু হুগোমত নারীর জন্যও কম দুঃখ বোধ করি না। রাজা লুই-এর আমলে সেই নারীকে একটা খুঁটিতে কোমর পর্যন্ত অনাবৃত অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় আর তার শিশুসন্তানকে তার সামনে ধরে রাখা হয়। শিশুটি তার স্তনদুধ খাবার জন্য জোরে কাঁদতে থাকে। তখন মেয়েটিকে বলা হয় তার শিশুসন্তানের জীবন আর তার শালীনতা–এই দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে তাকে। একটি মাতার ওপর এই অত্যাচারকে আপনি কী বলবেন মঁসিয়ে? আপনাকে একটা কথা মনে রাখতে হবে। বিপ্লবের অবশ্যই কতকগুলি কারণ আছে। এর যা কিছু ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের মানুষ তা ভুলে গিয়ে এর কারণগুলো বুঝতে পারবে। এর একমাত্র ফল এক নতুন জগতের উদ্ভব। এই বিপ্লবের মধ্যে অনেক ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক কাজ অনুষ্ঠিত হলেও তার থেকে একটা ভালো জিনিস বেরিয়ে আসে–সেটা হল মানবতার প্রতি অকুণ্ঠ আলিঙ্গন। যাই হোক, এ বিষয়ে আর আমি কিছু বলব না। আমার বলার আরও কিছু আছে। তাছাড়া আমার মৃত্যু আসন্ন।
বিশপের দিকে না তাকিয়েই বৃদ্ধ বলতে লাগল, অগ্রগতির পথে যেসব নিষ্ঠুরতা দেখা দেয় তাকে আমরা বিপ্লব বলি। বিপ্লবের শেষে আমরা দেখি অনেক মারামারি কাটাকাটি ও অনেক কিছু ধ্বংস হয়েছে ঠিক, কিন্তু মানবজাতি তা সত্ত্বেও কিছুটা এগিয়ে গেছে।
কথাগুলো বলে বৃদ্ধ আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও সে বুঝতে পারেনি, তুকের পথে সে বিশপের আত্মরক্ষার অনেকগুলো বেড়া একে একে ভেঙে ফেললেও একটা প্রধান বেড়া তার শক্তির এক দুর্ভেদ্য দুর্গ তখনও অজেয় রয়ে গেছে।
বিশপ এবার কিছুটা কড়াভাবেই বললেন, সব প্রগতিরই উচিত ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলা। অধর্মাচরণের দ্বারা কোনও মঙ্গলই সাধিত হতে পারে না। কোনও নাস্তিক কখনও মানবজাতির ভালো নেতা হতে পারে না।
বৃদ্ধ এ কথার উত্তর দিল না। তার দেহটা একবার কেঁপে উঠল। সে আকাশের পানে একবার তাকাল। তার চোখ থেকে একবিন্দু জল গালের উপর গড়িয়ে পড়ল। সে আকাশের দিকে মুখ করেই আমতা আমতা করে বলতে লাগল, তুমি হচ্ছ পূর্ণ! তুমিই একমাত্র সত্য।
একটু থেমে বৃদ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, অনন্তের একটা অস্তিত্ব আছে এবং সে অস্তিত্ব একমাত্র ওখানেই আছে! এই অনন্তের যদি আত্মা না থাকে তা হলে কোনও জিনিসই থাকবে না। কিন্তু আত্ম আছে। অনন্তের আত্মাই হল ঈশ্বর।
শেষের কথাগুলো সে বলল স্পষ্ট ভাষায়, আবেগকম্পিত সুরে। তার পর সে চোখ বন্ধ করল। কথাগুলো বলতে পরিশ্রম হয়েছে তার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যেন কয়েকটা বছর পার হয়ে গেছে। সে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আগের থেকে আর এই ক্লান্তিই যেন মৃত্যুর আরও কাছে এনে দিয়েছে তাকে।
বিশপ দেখলেন নষ্ট করার মতো সময় নেই। তিনি যাজক হিসেবে এখানে এসেছিলেন। তাঁর সকল ঔদাসীন্য ক্রমে পরিণত হল এক গভীর আবেগে। বৃদ্ধের মুদিত চোখ দুটির পানে তাকিয়ে তার হিম হয়ে যাওয়া রুগ্ণ হাতটি ধরে তার উপর ঝুঁকে বললেন তিনি, এখন এই মুহূর্তটি ঈশ্বরের। এ মুহূর্তের যথাযথ সদ্ব্যবহার করতে না পারাটা সত্যিই কত দুঃখজনক, সেটা আপনি মনে করেন না?
বৃদ্ধ চোখ খুলে তাকাল। এক ছায়াচ্ছন্ন গাম্ভীর্য ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। দুর্বলতার জন্য সে ধীরে ধীরে বলতে লাগল, হে আমার লর্ড বিশপ, পড়াশোনা, চিন্তা আর ধ্যানের মধ্য দিয়ে আমি জীবনযাপন করেছি। আমার বয়স যখন ষাট তখন দেশের কাজের জন্য আমাকে ডাকা হয়। আমি সে ডাকে সাড়া দিই। দেশের মধ্যে অনেক কুপ্রথা এবং কুসংস্কার ছিল, আমি তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলাম, অনেক অত্যাচার-অবিচার আমি ধ্বংস করেছিলাম, অনেক মানবিক অবিচার এবং নীতিকে আমি প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমার দেশ যখন আক্রান্ত হয় তখন আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম। ফ্রান্সকে বিদেশিরা আক্রমণের ভয় দেখালে আমি দেশের জন্য প্রাণ-মন উৎসর্গ করি। আমি কখনই ধনী ছিলাম না, এখনও আমি গরিব। রাষ্ট্রের কর্তাদের মধ্যে আমি একজন ছিলাম। আমাদের রাজকোষ এত বেশি ধনরত্নে পূর্ণ ছিল যে সোনা-রুপোর চাপে দেয়ালগুলো ভেঙে যাওয়ার ভয়ে দেয়ালগুলোর বাইরে থাম গেঁথে সেগুলোকে ঠেকা দিয়ে জোরালো করতে হয়। তবু আমি পভার্টি স্ট্রিটের একটা হোটেলে বাইশ স্যুতে খেতাম। আমি উৎপীড়িতদের দুঃখমোচন করি এবং আর্তদের সান্ত্বনা দিই। আমি বেদির কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছিলাম তা ঠিক, কিন্তু দেশের ক্ষতস্থান বেঁধে দেওয়ার জন্যই তা করেছিলাম। আলোকোজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের পানে মানবজাতির অগ্রগতির জন্যই আমি সংগ্রাম করেছিলাম। ক্ষমাহীন অত্যাচারের অগ্রগতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। বহুক্ষেত্রে আমি আপনাদের বিরুদ্ধবাদী হলেও অনেক যাজককে রক্ষা করেছিলাম। ফ্ল্যান্ডার্সের অন্তর্গত পিথেঘেমে যেখানে একদিন মেরো-ভিঙ্গিয়ান রাজাদের গ্রীষ্মকাল ছিল তার কাছাকাছি একটা চার্চ ছিল। ১৭৯৩ সালে ধ্বংসের কবল থেকে সে চার্চকে রক্ষা করেছিলাম। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি, আমার যথাশক্তি মানুষের মঙ্গল সাধন করেছি। এতে আমার যশের হানি হয়, আমাকে পীড়ন সহ্য করতে হয়, আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়, আমাকে বিজ্ৰপ করা হয়। আমি জানি এখনও পর্যন্ত অনেক লোকে বিশ্বাস করে আমাকে ঘৃণ্য করার তাদের অধিকার আছে। বহুলোকের কাছে আমি ধিকৃত। আমি তাই ঘৃণার বস্তুরূপে নির্জনে বাস করে আসছি, অথচ আমি কাউকে ঘৃণা করি না; এখন আপনি আমার কাছে কী চান?
সঙ্গে সঙ্গে নতজানু হয়ে বিশপ বললেন, আপনার আশীর্বাদ।
বিশপ যখন মুখ তুলে তাকালেন তখন দেখলেন বৃদ্ধ লোকটির চোখেমুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশপ দেখলেন তার মৃত্যু হয়েছে।
সেদিন রাতে চিন্তামগ্ন অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন বিশপ। সারারাত তিনি প্রার্থনা করে কাটালেন। পরদিন কিছু কৌতূহলী লোক বিশপকে সেই জনপ্রতিনিধির কথা জিজ্ঞাসা করায় বিশপ শুধু নীরবে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে কী দেখালেন। তার পর থেকে দুস্থ ও আর্তদের প্রতি বিশপের মায়ামমতা আরও বেড়ে যায়।
এরপর কেউ যদি বুড়ো শয়তান বলে অভিহিত করত সেই বিপ্লবীকে তা হলে বিশপ চুপ করে কী ভাবতেন। তিনি ভাবতেন যে লোকটি তার সামনে মারা গেল, তার উন্নত বিবেক তাঁর নিজের পূর্ণতার প্রতি সংগ্রামকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে।
তবে সেই বিপ্লবী বৃদ্ধটির মৃত্যুকালে তার কাছে যাওয়ার জন্য শহরের অনেকেই সমালোচনা করতে থাকে বিশপের। যখন সব বিপ্লবীই নাস্তিক, যেখানে তাদের কাউকেই ধর্মান্তরিতকরণের কোনও আশা নেই সেখানে কেন গিয়েছিলেন বিশপ? তার আত্মাটাকে শয়তানে কিভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখার জন্যই কি গিয়েছিলেন তার শয্যাপাশে?
মৃত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী এক বিধবা মহিলা ঔদ্ধত্যকে বুদ্ধি বলে ভাবত। সে একদিন বিশপকে বলল, আমরা আশ্চর্য হয়ে সবাই ভাবছি মঁসিয়ে, আপনি হয়তো একদিন বিপ্লবীদের মতো মাথায় লাল ফিতে ব্যবহার করবেন।
বিশপ বললেন, লাল রংটা এমনই যে তা সব ক্ষেত্রেই চলে। আশ্চর্য এই যে যারা বিপ্লবীদের লাল ফিতেকে ঘৃণার চোখে দেখে তারাই আবার লাল টুপি পরে।
.
১১
এর থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ভুল হবে যে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু একজন দার্শনিক যাজক ছিলেন। সেই জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের পর থেকে তার মনে যে বিস্ময় জাগে সে বিস্ময় তাকে আরও শান্ত করে তোলে।
যদিও রাজনীতি নিয়ে তিনি কখনও মাথা ঘামাতেন না তথাপি সেকালে দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব কী ছিল সে বিষয়ে কিছু বিবরণ দান করা উচিত। আর তার জন্য কয়েক বছর পেছনে যেতে হবে আমাদের।
বিশপের পদে তিনি অধিষ্ঠিত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে সম্রাট তাঁকে আরও কয়েকজন বিশপের সঙ্গে ব্যারন পদে ভূষিত করেন। আমরা যতদূর জানি, ১৮৩৯ সালেই ৫, ৬ জুলাই পোপকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফরাসি ও ইতালীয় বিশপদের এক ধর্মীয় সভায় যোগদানের জন্য নেপোলিয়ঁন তাঁকে ডাকেন। এই সভা প্যারিসের নোতার দ্যাম গির্জায় কার্ডিনাল ফ্রেস্কের সভাপতিত্বে ১৮১১ (রাজা, দুটি সালে মিলছে না) সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় মোট পঁচানব্বই জন বিশপের মধ্যে মঁসিয়ে মিরিয়েলও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তিনি মূল সভা ছাড়া আরও তিন-চারটি ছোটখাটো সভায় যোগদান করেন। মনে হয় যে পার্বত্য অঞ্চলে তিনি থাকতেন সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়া সকল গ্রাম্য জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত থাকার জন্য তাঁর কৃষকসুলভ বেশভূষা ও জীবনযাত্রা প্রণালী সভায় বিশেষ কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তিনি সভার জাঁকজমকপূর্ণ আদবকায়দায় অস্বস্তিবোধ করায় তাড়াতাড়ি দিগনেতে ফিরে আসেন। এ বিষয়ে তখন তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার উপস্থিতিতে ওরা অস্বস্তিবোধ করছিল। যে বাইরের জগৎ সম্বন্ধে তারা একেবারে অনবহিত, আমি যেন সেই জগতের এক ঝলক অপ্রত্যাশিত হাওয়া আমার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম তাদের কাছে। বাইরের জগতের রুদ্ধ দরজাটা সহসা আমি যেন খুলে দিয়েছিলাম তাদের সামনে।
তিনি আরও বলেছিলেন, তোমরা কী আশা করতে পার? অন্যান্য বিশপরা যেন এক একজন রাজপুত্র। আমি সামান্য একজন চাষিদের যাজক ছাড়া আর কিছুই নই।
মোট কথা, তিনি সেই সভায় যোগদান করতে গিয়ে অসন্তুষ্ট হন। একদিন তার এক নামকরা সহকর্মীর বাড়িতে গিয়ে বলেন, কত সব বড় বড় দামি ঘড়ি, কত সুন্দর সুন্দর কার্পেট, কত সব জমকালো সাজ-পোশাক পরা চাকর-বাকর–আমার পক্ষে এসব সত্যিই অস্বস্তিকর। এইসব বিলাসব্যসনের মধ্যে আমি থাকতে পারব না। এসবের মধ্যে থাকলে আমার প্রায়ই মনে পড়ত কত লোক ক্ষুধায় ও শীতে কষ্ট পাচ্ছে। কত গরিব আছে। কত সব গরিব।
বিলাসব্যসনের প্রতি বিশপের ঘৃণা খুব একটা যুক্তিসংগত নয়। কারণ বিলাসিতাকে ঘৃণা করলে বিলাসের উপকরণের সঙ্গে জড়িত অনেক শিল্পকর্মকেই ঘৃণা করতে হয়। কিন্তু একজন যাজকের পক্ষে তার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের বাইরে যেকোনও বিলাসের উপকরণই ঘৃণ্য ও বর্জনীয়। সেক্ষেত্রে বিলাসিতা এমনই একটি মনোভাব যার সঙ্গে বদান্যতা বা দানশীলতার কোনও সম্পর্ক নেই। ধনী যাজক এক বৈপরীত্যের প্রতিমূর্তি। যাজকদের অবশ্যই গরিবদের আপনজন হিসেবে তাদের কাছাকাছি থাকা উচিত। কিন্তু একজন কিভাবে গরিবদের দুঃখকষ্টের সংস্পর্শে দিনরাত আসতে বা থাকতে পারে যদি না তার বেশভূষা বা চালচলনের মধ্যে দারিদ্রের ছাপ না থাকে? আমরা কি এমন কোনও লোকের কল্পনা করতে পারি যে সারাদিন কোনও জ্বলন্ত লোহার হাপরে বা ফার্নেসের সামনে কাজ করবে, অথচ তার গায়ে তাপ লাগবে না, অথবা সে তার মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাটবে না অথবা তার হাতের নখে কালো দাগ ধরবে না বা তার মাথা বা গাঁ থেকে এক ফোঁটা ঘাম ঝরবে না অথবা তার মুখে একটুকরো ছাই থাকবে না। এক যাজকের দানশীলতার প্রথম প্রমাণ হল দরিদ্রসুলভ জীবনযাত্রা।
এটাই ছিল দিগনের বিশপের ব্যক্তিগত মত এবং যাজকবৃত্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। তবে তার মানে এই নয় যে সে যুগের ভাবধারার কোনও অংশই তিনি কোনও ব্যাপারে গ্রহণ করতেন না। বরং কতকগুলি সমস্যামূলক ব্যাপারে সে যুগের প্রচলিত ভাবধারারই অনুবর্তন করে চলতেন। তিনি তখন যেসব ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা সভা হত তাতে খুব একটা বেশি যোগদান করতেন না। রাষ্ট্র ও চার্চসংক্রান্ত কোনও বিরোধমূলক সমস্যা সম্পর্কে তিনি কোনও মন্তব্য করতেন না। কিন্তু যদি কোনও সময় এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতেন তা হলে দেখা যেত তার মনের মধ্যে রক্ষণশীলতার থেকে অতি আধুনিকতার উপাদানই বেশি থাকত। আমরা যেহেতু তার একটি পূর্ণ জীবনচিত্র আঁকছি এবং কোনও কিছুই গোপন রাখতে চাই না সেইহেতু আমরা অবশ্যই একথা স্বীকার করব যে নেপোলিয়ঁনের পতন শুরু হওয়ার সময় তিনি তাঁর ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৮১৩ সাল থেকে তিনি সম্রাটবিরোধীদের বিক্ষোভ মিছিলকে সমর্থন করতেন এবং অভিনন্দন জানাতেন। এলবা থেকে ফেরার সময় ম্রাট নেপোলিয়ঁন যখন বিশপের অঞ্চল দিয়ে যান তখন তিনি দেখা করতে চাননি সম্রাটের সঙ্গে। সম্রাটের সংকটের সময় তিনি কোনও সমবেত প্রার্থনাসভার অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেননি।
এক বোন ছাড়া বিশপের দুই ভাই ছিল। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন ছিল সামরিক বিভাগের বড় অফিসার আর একজন পুলিশের বড় কর্তা। বিশপ তাঁর ভাইদের সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখতেন। কিছুদিন ধরে তাঁর যে ভাই সৈন্যবিভাগে সেনাপতিত্বের কাজ করত তার সঙ্গে মনকষাকষি চলছিল বিশপের। কারণ তাঁর সেনাপতি ভাই একবার বারোশো সৈনিকের একটি দলের সেনাপতি হিসেবে নেপোলিয়ঁনকে ধরার জন্য তাঁর পিছু ধাওয়া করে, কিন্তু আসলে তার ধরার ইচ্ছা ছিল না অর্থাৎ এমনভাবে যায় যাতে হাতের নাগালের বাইরে চলে যেতে প্রচুর সুযোগ পান নেপোলিয়ঁন। তার অন্য ভাই পুলিশের কাজ থেকে অবসর গ্রহণের পর প্যারিসে বাস করছিল। সে মানুষ হিসেবে খুবই ভালো ছিল বলে বিশপ তাকে মেহের চোখে দেখতেন।
আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো মঁসিয়ে বিয়েনভেনুও কোনও এক রাজনৈতিক দলমতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তেন। মাঝে মাঝে অনেক তিক্ততা আর মোহমুক্তির বেদনা অনুভব করতেন। বিশপের মহান আত্মা সব সময় যতসব চিরন্তন ও শাশ্বত আধ্যাত্মিক বিষয়ে নিমগ্ন থাকলেও সমকালীন সমাজজীবনের বিক্ষুব্ধ ঢেউগুলোর আঘাতে একেবারে অবিচলিত থাকতে পারত না। অবশ্য তাঁর মতো লোকের রাজনৈতিক মতামতের সঙ্গে জড়িয়ে না-পড়াই উচিত ছিল। তবে এ বিষয়ে ভুল বুঝলে চলবে না আমাদের। আমরা যেন রাজনৈতিক মতামতের সঙ্গে প্রগতিবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, মানবতাবাদ প্রভৃতি যেসব প্রত্যয় বা বিশ্বাসগুলো সব মনীষী ও মহাপুরুষের সকল চিন্তাশীলতার মূল ভিত্তি সেগুলোকে গুলিয়ে না ফেলি বা এক করে না দেখি। যেসব বিষয়ের সঙ্গে আমাদের এই বইটি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়, শুধু পরোক্ষ বা গৌণভাবে জড়িত সেইসব বিষয়ের গভীরে না গিয়ে আমরা শুধু এই কথাই বলতে পারি যে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু রাজতন্ত্রবাদী না হলেই ভালো হত। ধ্যানস্নিগ্ধ প্রশান্ত চিন্তার যে উদার ক্ষেত্রটি জুড়ে সত্য, ন্যায় ও বদান্যতার শাশ্বত নীতিগুলো এক অম্লান অন্তহীন ভাস্বরতায় উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করে সেই মহান ধ্যানসমুন্নতির স্তর থেকে তাঁর দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য বিক্ষুব্ধ মানবজীবনের সমস্যাবলির ওপর নেমে না এলেই আরও ভালো হত তার পক্ষে।
যদিও আমরা স্বীকার করি, ঈশ্বর মঁসিয়ে বিয়েনভেনুকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পাঠাননি তবু সম্রাট নেপোলিয়ঁন ক্ষমতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করেন তখন তিনি যদি বিপদের ঝুঁকি নিয়েও সম্রাটের বিরোধিতা করে উচ্চ মনের পরিচয় দিতেন তা হলে আমরা তাঁর গুণগান না করে পারতাম না। কিন্তু উদীয়মান কোনও নক্ষত্রের ক্ষেত্রে যা প্রশংসনীয় ও গৌরবময়, সে নক্ষত্র অস্তম্লান হয়ে পড়লে তা আর তেমন প্রশংসনীয় বা গৌরবময় মনে হয় না। যে যুদ্ধ বিপজ্জনক আমরা সেই যুদ্ধকেই শ্রদ্ধা করি এবং সে ক্ষেত্রে যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যায় তারাই চূড়ান্ত জয়ের গৌরব লাভ করে। যে মানুষ কারও সুখসমৃদ্ধির সময়ে কোনও কথা বলে না তার বিরুদ্ধেই তার দুঃখ-বিপদের সময় কোনও কথা বলা উচিত নয়। সাফল্যের সময়ে যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে একমাত্র সে-ই তার পতন ঘটাবার বৈধ অধিকারী। ঈশ্বরের বিধানের কাছে আমরা মাথা নত করে থাকি। ১৮১২ সাল থেকেই যে আইনসভা এতদিন সমর্থন করে আসছিল ১৮১৩ সালে সম্রাটের বিপর্যয়ে উৎসাহিত হয়ে সহসা নীরবতা ভঙ্গ করে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এটা খুবই পরিতাপ আর লজ্জার কথা। এ কাজ কোনওমতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। ১৮১৪ সালে মার্শালরা বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং সিনেটের অধঃপতন ঘটে। এ যেন এতদিন কাউকে দেবতা বলে মেনে পরে তাকে অপমান করা; পৌত্তলিক হয়ে পুতুল বা প্রতিমার উপর থুতু ফেলার মতো এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। ১৮১৬ সালে যখন শেষ বিপর্যয়ের ধ্বনি শোনা যায় আকাশে-বাতাসে, যখন সমস্ত ফ্রান্স তা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠতে থাকে, নেপোলিয়ঁনের ওপর ঘনিয়ে ওঠা ওয়াটারলু যুদ্ধের ছায়া দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়, যখন ভাগ্যাহত যে পুরুষের দিকে সেনাদল ও সাধারণ মানুষ বেদনার্ত হৃদয়ে শেষবারের মতো হাত বাড়িয়ে সম্ভাষণ জানায় তখন সে পুরুষ কখনই উপহাসের পাত্র নন। এক বিশাল শূন্যতার মাঝে পতনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এক মহান জাতির সঙ্গে এক মহান পুরুষের যে মিলন ঘটে সেই মিলনের নিবিড়তার মাঝে যে একটি মহৎ ও মর্মস্পর্শী দিক ছিল সে দিকটি না দেখা বা উপেক্ষা করা দিগনের বিশপের মতো একজন মহাত্মা ব্যক্তির পক্ষে ভুল হয়েছে।
এছাড়া বিশপের আর কোনও দোষ ছিল না। তিনি ছিলেন সত্যবাদী, সরলমনা, বুদ্ধিমান, বিনয়ী এবং যোগ্য। তিনি ছিলেন পরোপকারী, সত্যিকারের একজন যাজক, সাধুপ্রকৃতির লোক এবং মানুষের মতো মানুষ। এমনকি তার রাজনৈতিক মতামতের আমরা সমর্থন করতে পারি না, এবং যার জন্য আমরা তার নিন্দা করে থাকি, সেইসব রাজনৈতিক মতামতের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন উদার।
সম্রাট সৈন্যবিভাগের এক ভূতপূর্ব সার্জেন্টকে টাউন হলের কর্মকর্তা নিযুক্ত করেন। লোকটি আগে অস্টারলিজের যুদ্ধে এক বিরাট বাহিনীতে যোগদান করে বীরত্ব দেখিয়ে সম্মানসূচক পদক পায়। কিন্তু সে যখন-তখন এমন সব মন্তব্য করত যেসব মন্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথা বলে মনে করত লোকে। তার পদক থেকে সম্রাটের মুখটা মুছে গেলে সে আর পদক তিনটে পরত না। সে বলত, আমার বুকের উপর এই তিনটে বিষাক্ত ব্যাঙ চাপিয়ে রাখার থেকে মরা ভালো। নেপোলিয়ঁনের দেওয়া ক্রসটাও সে পরত না। আবার সপ্তদশ লুই সম্বন্ধে কোনও কথা উঠলেও সে বুদ্ধি করে কিছু বলতে পারত না। বরং সে বলত, উনি তো প্রুশিয়া চলে যেতে পারতেন। এর দ্বারা প্রুশিয়া আর ইংল্যান্ডের প্রতি তার ঘৃণার ভাবটাকে প্রকাশ করে। সে এসব কথা প্রায়ই বলত বলে তার চাকরি যায় এবং তার ফলে স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে সে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বিশপ তখন তাকে ডেকে গির্জার দেখাশোনার ভার দেন।
মঁসিয়ে বিয়েনভেনু ছিলেন একজন সার্থক যাজক, সকল মানুষেরই বন্ধু। দিগনেতে তিনি নয় বছরের যে যাজকজীবন যাপন করেন তাতে তাঁর সরলতা আর শান্ত স্বভাব দেখে সেখানকার জনগণের মনে ভক্তি জাগে তার প্রতি। এমনকি নেপোলিয়ঁনের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবটাকে লোকে ক্ষমার চোখে দেখতে থাকে। সাধারণ সরলমনা জনগণ তার কাছে ভিড় করত। তারা যেমন তাদের সম্রাটকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করত দেবতার মতো, তেমনি বিশপকেও ভালোবাসত।
.
১২
কোনও সেনাপতির অধীনে যেমন অনেক ছোটখাটো অফিসার থাকে তেমনি একজন বিশপের অধীনেও অনেক ছোট ছোট যাজক থাকে। প্রত্যেক বিশপের অধীনে চার্চে একজন করে লোক থাকে যারা তাঁর ফাইফরমাশ খাটে। এইভাবে তারা বিশপের কাজকর্ম করে তাঁর মন জয় করতে পারলে তাদের পদোন্নতি ঘটে।
সেকালে প্রতিটি চার্চ এক একটি রাষ্ট্রের মতো ছিল। চার্চের বিশপরা যেমন ধর্মীয় কাজকর্ম করে যেতেন তেমনি শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিশপের চারদিকে ভিড় করে রাজনীতির কথাবার্তা বলত, তারা দেশের ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে যোগসূত্র বজায় রেখে চলত। ছোটখাটো যাজকরাও আপন আপন পদোন্নতির চেষ্টা করত। বিশপরাও প্রায় সকলেই উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং আপন আপন উচ্চাভিলাষ পূরণের চেষ্টা করে যেতেন। একজন বিশপ ভালো কাজ দেখিয়ে বিশপ থেকে আর্চবিশপ ও পরে কার্ডিনাল হতে পারতেন। এইভাবে সেকালে একজন যাজক ভবিষ্যতে রাজা পর্যন্ত হতে পারতেন। এইভাবে প্রতিটি বড় চার্চে ছোট-বড় যাজকদের মধ্যে উচ্চাভিলাষ আর দিবাস্বপ্নের স্রোত বয়ে যেত।
কিন্তু মঁসিয়ে বিয়েনভেনুর মনে উচ্চাভিলাষের কোনও আগুন জ্বলত না। তিনি ছিলেন শান্ত, বি মিতব্যয়ী। গরিবানার মধ্য দিয়ে তিনি তার জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন। তাঁর চার্চে রাজনীতি বা কূটনীতির কোনও আলোচনা বা জল্পনা-কল্পনা চলত না। তার ফাইফরমাশ খাটা বা হুকুম তামিল করার জন্য কোনও লোক ছিল না। বিশপের মনটি ছিল যেন এক শান্ত সাজানো সুন্দর বাগান। সে বাগান তার সারা জীবনব্যাপী যে এক স্নিগ্ধ ছায়া বিস্তার করেছিল সে ছায়ায় ভবিষ্যতের কোনও গোলাপি স্বপ্নের কোনও আলো দেখা যেত না। কোনও উচ্চাভিলাষের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ওঠার কোনও সুযোগ পেত না সে বাগান। তাঁর অধীনে যেসব যাজক কাজ করত তারাও তাদের পদোন্নতি ঘটিয়ে কোনও উচ্চাশা পূরণের সুযোগ পেত না। আর তার জন্য কোনও যুবকবয়সী যাজক বেশিদিন থাকতে চাইত না তার কাছে। চার্চে কোনও বিশপের অত্যধিক আত্মনিগ্রহ এবং দারিদ্র্যসুলভ জীবনযাত্রা অন্য যাজকদের মধ্যে সংক্রামিত হয় সমাজে। তাদের ভোগবৃত্তিগুলো অবদমিত ও কঠিন হয়ে পড়ে ক্রমশ, এই ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে যাজকরা তাদের উন্নতির পথে বাধা বলে মনে ভাবত। তাই তারা বিশপ বিয়েনভেনুকে ছেড়ে চলে যেত। আমরা এমন এক অদ্ভুত সমাজে বাস করি যেখানে সাফল্যলাভ না উচ্চাভিলাষ পূরণ মানেই দুর্নীতি। দুর্নীতির উচ্চভূমি থেকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে রস পড়ে, তাই হল এখানে সাফল্য।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে সাফল্য মানেই এক কুৎসিত ব্যাপার। মানুষ ভুল করে এটাকে একটা বড় রকমের গুণ বা যোগ্যতা বলে ভাবে। সাধারণ মানুষের জীবনের সাফল্যের প্রভাব ও প্রভুত্ব অসাধারণ। সাফল্য অর্জনের যে ক্ষমতা এক ভণ্ড প্রতিভা ছাড়া আর কিছুই নয়, যে ক্ষমতা বা প্রতিভা আবহমান কাল হতে প্রভুত্ব করে আসছে। মানবসমাজের ওপর, ইতিহাস হল তারই সবচেয়ে বড় শিকার। সাফল্য মানেই রক্তপাতের পথে উচ্চাভিলাষ পূরণ আর এই রক্তপাতের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাকেই মানুষ যোগ্যতা ও প্রতিভা বলে এসেছে, বীরত্ব হিসেবে তা খ্যাত হয়ে এসেছে ইতিহাসে। একমাত্র জুভেনাল আর ট্যাসিটাস এই প্রতিভাতে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন না। আজকাল আবার এই সাফল্যের ঘরে এসে এক দরকারি জীবনদর্শন বাসা বেঁধেছে। সাফল্যলাভই তার নীতি। সমৃদ্ধি লাভই হল যোগ্যতা। লটারিতে জিতে যাও, তা হলেই তোমাকে সবাই বলবে চতুর লোক। বলবে যোগ্য আর বুদ্ধিমান। ভাগ্যই হচ্ছে সব; কোনও রকমে একবার সৌভাগ্য লাভ করতে পারলেই তোমাকে বড় বলবে সবাই। এ শতাব্দীতে দেখা যায় সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাভক্তির ব্যাপারটা বড় ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন। গিল্টি করা নকল সোনাকেই তারা আসল সোনা ভাবে। কোনও রকমে পেলেই হল। জনগণ হচ্ছে এক বৃদ্ধ নার্সিসাসের মতো যে শুধু নিজেকেই ভালোবাসে, নিজের আত্মার উপাসনা করে। মোজেস, এসকাইলাস, দান্তে, মিকালাঞ্জেলো অথবা নেপোলিয়ঁনের বিরাট গুণ ও প্রতিভাগুলোকে সাধারণ মানুষ ছোট করে দেখে এবং তারা মনে করে এ গুণ এ প্রতিভা যে কোনও মানুষ চেষ্টা করলেই অর্জন করতে পারে। সাধারণ মানুষ ভাবে, যে কর্মচারী কোনও রকমে ডেপুটির পদ পায়, যে বাজে ব্যর্থ নাট্যকার কোনওরকমে কর্নেলের মতো এক হাসির নাটক লিখে নাম পান, যে সেনাপতি কোনও মতে একটা যুদ্ধ জয় করে, অথবা যে যোদ্ধাপ্রহরী কোনওরকমে হারেম জয় করে বসে তারা সবাই প্রতিভাবান। যে ধুরন্ধর ব্যবসায়ী সৈন্যবিভাগে জুতো সরবরাহ করে বছরে চার হাজার পাউন্ড আয় করে, যে সুদখোর বছরে কোনওরকমে আট মিলিয়ন পাউন্ড আয় করে, যে যাজক জোর গলায় ধর্মপ্রচার করে বিশপ পদে উন্নীত হয়, কোনও এস্টেটের যে গোমস্তা টাকা রোজগার করতে করতে অবসর গ্রহণ করার পর অর্থমন্ত্রী হয় লোকে এদের সবাইকে প্রতিভাবান বলে। লোকে আজকাল কোনও মেয়ে মুখে রঙ মাখলেই তাকে সুন্দরী বলে, আর ভালো দামি পোশাক পরলেই তাকে রাজসম্মান দান করে। কাদার উপরে পাতিহাঁসের নক্ষত্রাকার ছাপ দেখলে লোকে তাকে আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র ভাবে।
.
১৩
দিগনের বিশপের ধর্মীয় গোঁড়ামির সমালোচনা করা আমাদের কাজ নয়। তার মতো এক মহান আত্মা শুধু শ্রদ্ধা জাগায় আমাদের মনে। একজন খাড়াখাড়ি লোকের জীবনসত্যকে তার নিজস্ব খাতিরেই মেনে নিতে হবে নির্বিবাদে। বিভিন্ন মানুষের স্বভাবের ভিন্নতা সত্ত্বেও মানবজীবনের মহত্ত্বের যে একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে সে সৌন্দর্য সহজ বিশ্বাসের মধ্য দিয়েই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে, বরণীয় হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিশপের যে কতকগুলি গোপন রহস্যের দিক ছিল, তা একমাত্র মৃত্যুর পরেই প্রকটিত হয়ে উঠতে পারে। তবে আমরা শুধু এইটুকু জোর করে বলতে পারি যে তার ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোনও ভণ্ডামি ছিল না। হিরেতে যেমন কোনও খাদ থাকে না, তার ধর্মবিশ্বাসেও কোনও খাদ ছিল না। এই নিখাদ ধর্মবিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই তিনি তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম করে যেতেন। তাতে তাঁর বিবেক তৃপ্ত হত। তিনি যে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত সে বিষয়ে নিশ্চিত হতেন তিনি।
ধর্মবিশ্বাস ছাড়া বিশপের আর একটি গুণ ছিল। মানুষের প্রতি এক নির্বিশেষে নিখাদ ভালোবাসার অন্তহীন প্রবাহে তাঁর অন্তর প্লবিত হত সতত। এই ভালোবাসার জন্য শহরের আত্মম্ভরী, অহঙ্কারী ও তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিকরা তাঁকে দুর্বলমনা ভাবত। বিশপের এই ভালোবাসার আতিশয্যটা আসলে কী, তা অনেকে বুঝে উঠত না। আসলে এটা ছিল এমনই পরোপকার প্রবৃত্তি যা সকল মানুষ ও এমনকি ইতর প্রাণীদের পর্যন্ত আলিঙ্গন করত এবং সর্বত্র প্রসারিত ছিল। কোনও কিছুকেই ঘৃণা করতেন না তিনি, ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে সব কিছুকেই তিনি ভালোবেসে যেতেন। এমনকি অনেক ভালো ভালো মানুষের প্রতি উদাসীন থেকে পশুদের ভালোবাসা দান করতেন। অন্য যাজকদের মধ্যে এ বিষয়ে যে অসহিষ্ণুতা দেখা যেত দিগনের বিশপের মধ্যে তা ছিল না। তিনি ব্রাহ্মণদের মতো অত সাত্ত্বিক পূজারি না হলেও তিনি প্রায়ই স্তোত্রগান করতেন আপন মনে। কে জানে মহান ব্যক্তিদের আত্মা কেন ঊর্ধ্বে গমন করে আর পশুদের আত্মা কেন নরকের দিকে গমন করে। কোনও কোনও কুৎসিত চেহারা বা বিকৃত কোনও প্রবৃত্তি তাঁকে ভীত করে তুলতে পারত না। তিনি অবশ্য তাতে বিচলিত হতেন, মাঝে মাঝে দুঃখবোধ করতেন এবং জীবনের এইসব অবাঞ্ছিত বহিরঙ্গের অন্তরালে কী কারণ থাকতে পারে, তা খোঁজার চেষ্টা করতেন। তিনি মাঝে মাঝে ঈশ্বরের কাছে জীবন ও জগতের সব কিছু পুনর্গঠিত করার জন্য প্রার্থনা করতেন। এক স্থিতধী প্রজ্ঞা আর প্রশান্তির সঙ্গে তিনি জীবনের যত সব অসংগতি, প্রকৃতি জগতের যত কিছু বিশৃঙ্খলার কথা চিন্তা করতেন এবং সেই চিন্তাভাবনার কথা মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে স্বগতোক্তির মতো বেরিয়ে আসত। একদিন তিনি যখন বাগানে বেড়াচ্ছিলেন তখন এই ধরনের একটা কথা বেরিয়ে আসে তাঁর মুখ থেকে। তিনি ভাবছিলেন তিনি একা আছেন। কিন্তু তার থেকে কয়েক পা দূরে তাঁর বোন ছিল তিনি তা দেখতে পাননি। মাটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তিনি। একটা বড় কালো মাকড়সা দেখতে পেলেন।
বাপতিস্তিনে শুনতে পেলেন তার ভাই বলছেন, হায় হতভাগ্য প্রাণী, বেচারার কোনও দোষ নেই।
এইসব আপাত-অবান্তর মহত্ত্ব ও মহানুভবতার কথাগুলো নথিভুক্ত করে রাখা হয়নি কেন কে জানে। এইসব কথাগুলো যদি ছেলেমানুষির পরিচায়ক হয় তা হলে সেন্ট ফ্রান্সিস ও মার্কাস অরেলিয়াসের কথাগুলোকে ছেলেমানুষি হিসেবে ধরতে হবে। একবার একটি পিঁপড়েকে তাঁর পথে দেখতে পেয়ে তাকে পা দিয়ে না মাড়িয়ে কষ্ট করে সেটাকে পাশ কাটিয়ে যান। এক একসময় তিনি বাগানের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু তাঁকে সে অবস্থায় দেখে আরও শ্রদ্ধা জাগত মনে।
মঁসিয়ে বিয়েনভেনুর বাল্যজীবন ও যৌবনের যেসব কথা শোনা যায় তার থেকে জানা যায় তিনি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলেন এবং তিনি হিংসার আশ্রয় নিতেন না। সকল মানুষ ও জীবের প্রতি তার যে করুণার স্রোত সতত প্রবাহিত হত, সে করুণার স্রোত তাঁর কোনও সহজাত প্রবৃত্তি হতে উৎসারিত হত না, উৎসারিত হত এমন এক গভীর প্রত্যয় থেকে যে প্রত্যয় তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে বিভিন্ন চিন্তার ভেতর দিয়ে জলের ফোঁটার মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ত তার অন্তরে। পাহাড়ের উপর থেকে জল ঝরে পড়ার জন্য যেমন ঝরনা বা গিরিখাতের সৃষ্টি হয়, মানুষের স্বভাবের মধ্যেও তেমনি প্রত্যয়ের জল ঝরে পড়ে পড়ে একটি নদীখাতের সৃষ্টি হয়।
১৮১৫ সালে তার বয়স হয় পঁচাত্তর। কিন্তু তাকে দেখে ষাট বছরের বেশি বলে মনে হত না। তার চেহারাটা লম্বা ছিল না, তবে স্থূলতার দিকে একটা ঝোঁক ছিল এবং এই স্থূলতার ভাবটাকে কমাবার জন্য তিনি রোজ অনেকটা করে হাঁটতেন। তিনি যখন লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতেন তখন তাঁর পিঠটা একটু ধনুকের মতো বাঁকা দেখাত। এর থেকে অবশ্য কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। যোড়শ পোপ গ্রেগরি আশি বছর বয়সেও খাড়া হয়ে হাসিমুখে চলতেন। তবু পোপ হিসেবে খ্যাতিলাভ করতে পারেননি। বিশপ বিয়েনভেনুর চেহারাটা সুদর্শন ছিল, কিন্তু তাঁর ব্যবহারটা এমনই মধুর ছিল যে তার চেহারার কথাটা কেউ মনে রাখত না।
তার কথাবার্তায় যে শিশুসুলভ এক সরলতা আর সুষমা ছিল তাতে সকলেই স্বচ্ছন্দ অনুভব করত। তার সমস্ত দেহ হতে একটা জ্যোতি বিচ্ছুরিত হত। তিনি যখন হাসতেন, তখন তাঁর সাদা ঝকঝকে সুন্দর দাঁতগুলো বেরিয়ে আসত, তখন সবাই তার শিশুসুলভ সরলতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তাদের আপনজন ভাবত। অনেকে বলত, “যেন এক সুন্দর ছেলে। আবার অনেক বলত, কী ভালো লোক! নেপোলিয়ঁন যখন তাঁকে প্রথম দেখেন তখন তার মনেও এই ভাব জাগে। যে কোনও লোক তাঁকে প্রথম দেখলেই এইরকম ভাব মনে জাগত তার। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা তার কাছে থাকলে দেখা যেত তাঁর চিন্তামগ্ন চেহারা ক্রমশ পাল্টে আরও মনোহারী হয়ে উঠছে। তার মাথায় পাকা চুল থাকায় তার প্রশস্ত উদার ললাট আরও গম্ভীর দেখাত। তিনি প্রায়ই ঈশ্বরচিন্তায় বিভোর ও ধ্যানমৌন থাকার জন্য সে ললাট আরও মহান ও উন্নত দেখাত। অন্তরের সততা থেকে এক স্তব্ধমহান গাম্ভীর্য উৎসারিত হয়ে ছড়িয়ে থাকত তার সারা দেহে। তাকে দেখলেই এক সদাহাস্যময় দেবদূতের কথা মনে পড়ত যে দেবদূত পক্ষবিস্তার করে হাসি ছড়াচ্ছে। তাকে দেখলেই এক অবর্ণনীয় শ্রদ্ধা জাগত সকলের মনে, মনে হত তারা যেন এসে পড়েছে পরম করুণাময় এক মহান ব্যক্তির কাছে যার সর্বাঙ্গ থেকে সতত এক সর্বব্যাপী করুণা ও মমতার মধু ঝরে পড়ছে।
আমরা আগেই দেখেছি দৈনন্দিন জীবনে সব সময় তিনি কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত থাকতেন। প্রার্থনা, অফিসের কাজ, ভিক্ষাদান, আর্তদের সান্ত্বনাদান, বাগানের কাজ, তার দেহটি যখন এইসব কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকত, মনটি তখন তাঁর সৌভ্রাতৃত্ব, মিতব্যয়িতা, আতিথেয়তা, ত্যাগ, বিশ্বাস আর পড়াশোনার কথায় ভরে থাকত। এইভাবে সৎ চিন্তা আর সৎ কর্মের মধ্য দিয়েই দিনগুলো কেটে যেত তার। কিন্তু সারাদিন সব কাজ করেও তার মনে হত কিছু করা হল না যদি না রাত্রিতে শোবার আগে আবহাওয়া ভালো থাকলে বাগানে দু’এক ঘণ্টা একা না কাটাতেন। ঘুমোবার আগে স্তব্ধগম্ভীর নৈশ আকাশের তলে কিছুক্ষণ ধ্যান ও ঈশ্বরচিন্তা করাটা এক অত্যাবশ্যক আনুষ্ঠানিক কর্ম বলে ধরে নিয়েছিলেন তিনি।
বাড়ির মহিলা দু জন তখন শুতে চলে যেত। তারা উপরতলায় গিয়ে যদি ঘুমিয়ে না। পড়ত তা হলে তারা শুনতে পেত বাগানের পথে একা একা পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন বিশপ। আপন নিঃসঙ্গতায় আপনি বিভোর হয়ে তিনি যেন আকাশে উদার প্রশান্তির সঙ্গে আপন অন্তরের প্রশান্তিকে মিলিয়ে নিয়ে দৃশ্য-অদৃশ্য সকল বস্তুর মাঝে ঈশ্বরের ঐশ্বর্যের সন্ধান করে চলতেন মনে মনে। অজ্ঞাতলোক হতে যেসব চিন্তা ঝরে পড়ত নিঃশব্দে তার সামনে তাঁর অন্তরকে প্রসারিত করে দিতেন তিনি। এইসব মুহূর্তে বিশ্বসৃষ্টির সর্বব্যাপী ঐশ্বর্যের দ্বারা পরিবৃত হয়ে নক্ষত্রালোকিত রাত্রির মাঝে ক্রমোন্মীলিত গন্ধবিহীন কুসুমরাজির মতো তিনি যখন ধীরে ধীরে আপন অন্তরকে উন্মীলিত করে দিতেন তখন তিনি বুঝতে পারতেন না, তিনি কী পেলেন বা কী দিলেন, বাইরে থেকে কী এসে প্রবেশ করল তার অন্তরে আর তাঁর অন্তর থেকেই-বা কী বেরিয়ে গেল, বুঝতে পারতেন না কী ঘটত তার অন্তর্জগতে। এইভাবে বিশ্বসৃষ্টির অনন্তত্বের সঙ্গে তার আপন অন্তরের অনন্তত্ত্বের এক রহস্যময় আদান-প্রদান চলত।
জাগতিক সব বস্তুর মধ্যে ঈশ্বরের মহত্ত্ব এবং জীবন্ত অস্তিত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা। করতেন বিশপ। অনন্ত অতীত ও অনন্ত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেন। তাঁর বোনের সামনে পরিদৃশ্যমান শান্ত সসীম বস্তুর মাঝে অসীম অনন্তকে ধরার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বোধাতীত এইসব বিষয়কে বুঝতে না পেরে তিনি শুধু চিন্তা করে যেতেন। তিনি ঈশ্বরকে নিয়ে বিচার-বিবেচনা করতেন না, তিনি শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে ঈশ্বরের মহিমা উপলব্ধি করে যেতেন। অণু-পরমাণুর যে সুষম সমন্বয় প্রতিটি বস্তুর অবয়বকে গড়ে তুলে তাকে সত্তা দান করে, তাকে শক্তি দেয়, একের মধ্যে অসংখ্য এবং সমগ্রের মধ্যে ভিন্নতার সৃষ্টি করে এবং এক আলোক বিকীরণ করে তার মাধ্যমে সৌন্দর্যের জন্ম দেয়, সেই আণবিক সমন্বয়ের কথা ভাবতেন তিনি। এই সময় এবং অন্তহীন যোগ-বিয়োগের লীলাই জীবন এবং মৃত্যু।
বাগানে একটি বেঞ্চের উপর বসে তার ভাঙা রডের গায়ে পিঠটা হেলান দিয়ে ফলের গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আকাশের তারার পানে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। সারা বাড়িটার মধ্যে এই জায়গাটা বড় প্রিয় ছিল তার কাছে।
সারা দিনরাতের মধ্যে এই অবসরটুকু ছাড়া আর কিছুই চান না বিশপ। রোজ দু বার করে বাগানে যেতেন তিনি–একেবার দিনের বেলায় বাগানের কাজ করতেন, গাছের যত্ন নিতেন আর রাত্রিবেলায় বাগানে বসে ঈশ্বরচিন্তা করতেন। তাঁর কর্মব্যস্ত দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে মুক্ত আকাশের চন্দ্রাতপতলে এই ছোট্ট জায়গাটুকু ঈশ্বরোপাসনার পক্ষে যথেষ্ট। পায়ের তলায় ছড়ানো অসংখ্য ফুল আর মাথার উপরে অসংখ্য তারা নিয়ে এই স্বল্পপরিসর জায়গাটুকুতে পায়চারি আর চিন্তা করা–আর কী চান তিনি।
.
১৪
আমরা বিশপের যে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিবরণ দান করেছি তাতে মনে হবে তিনি ছিলেন সর্বেশ্বরবাদী। কিন্তু আসলে বিশপ এক নিজস্ব জীবনদর্শন গড়ে তুলেছিলেন। তার নিঃসঙ্গ নির্জন মনের উদার পটভূমিতে সঞ্জাত এই জীবনদর্শন অনেক সময় প্রথাগত প্রচলিত ধর্মমতের সঙ্গে খাপ খেত না। যারা মঁসিয়ে বিয়েনভেনুকে চিনত ও জানত তাদের এই ধারণাই হত তার সম্বন্ধে। তারা বুঝত তাঁর অন্তরই ছিল সব চিন্তার উৎস, অন্তরের আলো থেকেই তাঁর সব ভাব ও প্রজ্ঞার উদ্ভব হত।
কিন্তু কোনও এক বিশেষ দার্শনিক তত্ত্ব সৃষ্টি করেননি তিনি। অনেক দার্শনিক কথা চিন্তা করতেন তিনি শুধু নির্জনতার শান্ত আকাশে। এইসব নির্জন চিন্তার ফলে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেসব তত্ত্বকথা তাঁর অন্তর থেকে বেরিয়ে আসত সেইসব কথাই বাইরে বলতেন তিনি। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে তার যুক্তিকে বিব্রত করে তুলতেন না কখনও। একজন ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষ অনেক বেশি সাহসের পরিচয় দিতে পারেন। কিন্তু একজন বিশপকে সতর্কতার সঙ্গে চলতে হয়। যেসব সমস্যা দেশের বড় বড় চিন্তাশীল ও ধর্মগুরুদের ভাবনার বস্তু সেইসব সমস্যা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাতেন না তিনি। সেইসব জটিল সমস্যার দ্বারপ্রান্তে এসে এক ধর্মগত ভয়ে থমকে দাঁড়াতেন তিনি। যে দ্বারপ্রান্তের ওপারে অন্ধকার প্রশস্ত বারান্দা প্রসারিত হয়ে আছে, কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য অশ্রুত কণ্ঠস্বর যেন যেখানে প্রবেশ করতে নিষেধ করতে তাকে। যে দুঃসাহসী ব্যক্তি সেখানে জোর করে প্রবেশ করে তাকে দুঃখ পেতে হয় পরিশেষে। কিছু কিছু প্রতিভাধর পুরুষ সীমাহীন নির্বিশেষ কল্পনা আর অন্তহীন ধ্যান-ধারণার গভীরে গিয়ে যেসব তত্ত্ব উপলব্ধি করেন সেগুলোকে তারা প্রথমে ঈশ্বরকেই সমর্পণ করেন। সেই তত্ত্বকথাগুলোই এক একটি ব্যক্তিগত ধর্মমতে পরিণত হয়। তবু তার মধ্যে অনেক প্রশ্নের অবকাশ আছে, অনেক দায়িত্ব জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে।
মানুষের চিন্তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষ কোনও কিছু বুঝতে না পারলেও সেই দুর্বোধ্য বিষয়কে সে তার উদ্ধত চিন্তা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। প্রাকৃত বা বস্তুজগৎকে ফেলে সে এক তুরীয়লোকে উঠে যায়। সেখানে চিন্তার কর্তা এবং চিন্তার বস্তু মিলে মিশে এক হয়ে যায়। যাই হোক, কিছু লোক অবশ্য আছেন যারা তাদের চিন্তা দিগন্তের ওপারে পরম সত্যের চূড়াটি স্পষ্ট দেখতে পান। সে যেন এক ভয়ঙ্কর অন্তহীন সীমাহীন এক বিশাল পাহাড়। মঁসিয়ে বিয়েনভেনু এইসব নেতাদের একজন ছিলেন না; তাঁর সে প্রতিভা ছিল না। তিনি সেই বিশাল পাহাড়ের অভ্রভেদী চূড়াগুলোকে বিশ্বাস করতে পারতেন না, যার থেকে সুইডেনবার্গ ও পাস্কেলের মতো মহান পণ্ডিতরা পড়ে গিয়ে উন্মাদ হয়ে যান। অবশ্য এইসব শক্তিশালী চিন্তাশীলের চিন্তার একটা মূল্য আছে, কারণ এই চিন্তার থেকেই আমরা পূর্ণতার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি। কিন্তু বিশপ বিয়েনভেনু সে পথে না গিয়ে এক সহজ পথ ধরেন। সে পথ হচ্ছে বাইবেলের হোলি গসপেলের পথ।
তিনি এলিজার পোশাক পরে বর্তমানের কুয়াশাচ্ছন্ন কঠিন ঘটনাজালের ওপর ভবিষ্যৎ দৃষ্টির কোনও আলোকসম্পাত করতে চাইতেন না। সেই দূরদৃষ্টির আলোকটিকে এক উজ্জ্বল জ্যোতিতে পরিণত করতে পারতেন না। তিনি ভবিষ্যদ্রষ্টা বা ঋষি ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক সাধারণ সরল প্রকৃতির মানুষ যিনি সকলকে নির্বিশেষে ভালোবেসে যেতেন।
তিনি ধর্মগত সীমাকে অতিক্রম করে তার প্রার্থনার বস্তুকে অতিমানবিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্য পর্যন্ত প্রসারিত করতেন ঠিক। কিন্তু আমাদের ভালোবাসার যেমন একটা সীমা আছে, তেমনি প্রার্থনারও একটা সীমা আছে। তবে ধর্মগত সীমার বাইরে ধর্মগ্রন্থনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু বাইরে প্রার্থনা করাটা যদি খ্রিস্টীয় ধর্মমতের বিরোধিতা হয় তা হলে সেন্ট টেরেস ও সেন্ট জেরোফ খ্রিস্টবিরোধী ছিলেন।
তাঁর অন্তর শুধু মানুষের দুঃখমোচনের চিন্তায় সব সময় বিব্রত থাকত। তাঁর মনে হত সারা জগৎ অন্তহীন দুঃখদুর্দশায় ভরা। তিনি সর্বত্রই দেখতেন শুধু দুঃখকষ্টের উত্তাপ এবং সে দুঃখকষ্টের কারণ জানতে না চেয়ে সেই দুঃখের ক্ষত নিরাময় করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতেন তিনি। বাস্তব দুঃখদুর্দশার ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মমতা ও সমবেদনা বেড়ে গেল। সেই দুঃখদুর্দশার হাত থেকে কিভাবে মুক্ত করা যায় মানুষকে তিনি তার উপায় খুঁজতেন এবং আর পাঁচজনকে সে উপায় বলে দিতেন। তাঁর কেবলি মনে হত পৃথিবীর সব মানুষ যেন এক অসহনীয় দুঃখের নিবিড়তায় সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।
অনেক মানুষ সোনার জন্য খনি খোঁড়ে। কিন্তু বিশপ বিয়েনভেনুর কাছে দুঃখ-দারিদ্রই ছিল সোনার খনি। সে খনি খুঁড়ে তার থেকে শুধু করুণা কুড়িয়ে আনতেন তিনি। বিশ্বব্যাপী দুঃখকষ্টের জন্য বিশ্বব্যাপী বদান্যতার এক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। ‘পরস্পরকে ভালোবাস’–এই ছিল তার নীতি এবং এই নীতিই ছিল তার জীবনের সব। এর বেশি আর কিছু চাইতেন না তিনি।
যে সিনেটরের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, যিনি বিশপকে দার্শনিক বলতেন, তিনি একদিন তাকে বলেন, আপনি দেখুন, এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ একে অপরের সঙ্গে সংগ্রামে মত্ত এবং যে বলবান সে-ই জয়লাভ করে সে সংগ্রামে। পরস্পরকে ভালোবাস–এই নীতি এক নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই না।
বিশপ তখন তাঁর সঙ্গে কোনও বিতর্ক না করে বলেন, ঠিক আছে, এটা যদি নির্বুদ্ধিতা হয়, তা হলে সব মানুষের আত্মার উচিত ঝিনুকের মধ্যে মুক্তোর মতো সে নির্বুদ্ধিতাকে বুকের মধ্যে ধরে রেখে তা বহন করা। তিনি তাই করতেন। সেই নির্বুদ্ধিতাকে বুকের মধ্যে ঢেকে রেখে তিনি চলতেন, যেসব বড় বড় প্রশ্ন এক একটি অন্তহীন বিশাল শূন্যতা গভীরতা নিয়ে চিন্তাশীল মানুষদের মোহমুগ্ধ ও ভীত করে তোলে, তিনি সেগুলোকে এড়িয়ে যেতেন। আস্তিকরা এইসব প্রশ্নের বিশাল গভীরতার মধ্যে ঈশ্বরকে দেখতে পায়, আর নাস্তিকরা সেখানে ঈশ্বরকে না পেয়ে নরকে গমন করে। মানুষের ভাগ্য, ভালো-মন্দ, মানুষ মানুষে বিবাদ-বিসম্বাদ, মানুষের ও পশুর চেতনা, মৃত্যুতে মানুষের রূপান্তর, সমাধিতে মানুষের পুনর্জীবনের কল্পনা, গতিশীল আত্মার নতুন নতুন প্রেমের অভিজ্ঞতা, বস্তু ও তার সত্তা, মানুষের আত্মার স্বরূপ, স্বাধীনতা, প্রয়োজন, খাড়াই পাহাড়ের মতো এইসব সমস্যামূলক প্রশ্নগুলো বিরাট চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অভিভূত করে। লুক্রেশিয়া, পল ও দান্তের মতো দার্শনিক ও চিন্তাশীল এইসব প্রশ্নের অন্তহীন অন্ধকার শূন্যতার মাঝে সন্ধানী দৃষ্টির আলো ফেলে তার সমাধান খুঁজতে গিয়ে সেই অনন্ত শক্তির সন্ধান পান, যা সমস্ত আলোর উৎস।
মঁসিয়ে বিয়েনভেনু ছিলেন এক সরল মানুষ, যিনি এইসব প্রশ্ন ও সমস্যাগুলোকে বাইরে থেকে দূর থেকে দেখতেন, তাদের খুব কাছে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন না। এইসব প্রশ্নের দ্বারা মনকে কখনও পীড়িত হতে দিতেন না। ইহলোক অতিক্রম করে পরলোকের চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতেন।