এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ৫ (দ্য সার্পেন্টস্ টুথ) / অ্যালেক্স রাদারফোর্ড / অনুবাদ : জেসি মেরী কুইয়া
অনুবাদকের উৎসর্গ – যারা অনুবাদ বই পড়তে ভালোবাসেন
প্রথম পর্ব – হাজারো বার শুভ রাত্রি! রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট
১.১
আগ্রা দুর্গ, উত্তর-পশ্চিম ভারত, ১৬২৮
একেবারে শেষ মুহূর্তে শাহজাহানের চোখে পড়ল সূর্যের আলো পড়ে ঝিক করে ওঠা ছোরার ফলা। গলা বাঁচাতে ডান হাত তুলে ধরতেই অনুভব করলেন কনুইয়ের ঠিক নিচের পেশীতে ঢুকে গেছে ধারালো ব্লেড। রুপালি সিংহাসনের উপর গড়িয়ে পড়তে লাগল রক্তের ফোঁটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সিংহাসন হেলে পড়তে লাগল পিছন দিকে, তারপরেও আবারো আঘাত করার আগেই ধরে ফেললেন আততায়ীর হাত। সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারলেন লোকটাকে। লোকটা গিয়ে অল্পের জন্য মার্বেলের বেদী ছুঁতে গিয়েও পারল না, পড়ে গেল। এর উপরেই দাঁড়িয়ে আছে সিংহাসন। মার্বেলের গায়ে ধাক্কা খেতেই লোকটার মাথা থেকে পড়ে গেল বেগুনি পাগড়ি আর হাতে থাকা ছোরা। শাহজাহান এত জোরে আততায়ীর হাত দুটোকে পিছনে টেনে ধরলেন যে কব্জি ভাঙ্গার শব্দ পাওয়া গেল স্পষ্ট। লোকটার হাতের ছোরা কেড়ে নিয়ে দুই হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন আততায়ীর বুকের উপর। এরই মাঝে পৌঁছে গেল ওনার সবুজ পোশাকের দেহরক্ষীর দল। কিন্তু তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারলেন যে তাঁকে রক্ষা করার মত যথেষ্ট দ্রুত ছিল না সেই দল।
আবারো উঠে দাঁড়াতেই শাহজাহানের স্যান্ডেলের নিচে পড়ল সিংহাসন থেকে খুলে পড়া রুবি আর টারকোয়াজ। কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন আততায়ীর দিকে। দেহরক্ষীর দল প্রথমে লোকটাকে দাঁড় করিয়ে হাত দুটো বেঁধে ফেলল পিছমোড়া করে। তারপর লাথি মেরে বাধ্য করল হাঁটু গেড়ে বসতে। শাহজাহানের মনে হল যেন চিনতে পেরেছেন আততায়ীকে-কোটের জোব্বা গায়ে থাকলেও বোঝা গেল বয়সে তরুণ লোকটা।
কে তুমি? কেন তোমার সম্রাটকে আক্রমণ করেছো?
প্রথম দিকে কোনই উত্তর দিল না তরুণ, এরপর কালো দাড়িওয়ালা একজন দেহরক্ষী পাঁজরে সজোরে লাথি কষালো দুবার। তারপরই কথা বলে উঠল আততায়ী।
ইসমাইল খান। জানির ভ্রাতুস্পুত্র। জানি মারা গেছেন, কারণ আপনি তার স্বামীকে হত্যা করেছেন। আপনারই সত্তাই খসরু। স্বামী ছাড়া তিনি বাঁচতে চাননি। তাই আমি ওনার হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছি। আমার পিতামাতা মারা যাবার পর আমাকে তার পরিবারে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে, ইসমাইল খান…সিংহাসনে আরোহণের পর পত্নী মমতাজের আগ্রহে দরবারে স্থান দিয়েছিলেন তাকে। পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল যে তিনি একটু বেশিই দয়া দেখিয়েছেন। এটাও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে, যে ধরনের গৃহযুদ্ধের পরে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেছেন তা এত সহজে বা দ্রুত মুছে যাবে না। ডান হাতে ব্যথা বাড়তেই নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন সোনালি টিউনিক ভিজে গেছে রক্তে। হাত আর আঙুল বেয়ে রক্তের ধারা সাদা মার্বেলের উপর পড়ে তৈরি হয়েছে ছোট্ট একটা লাল পুকুর। তাড়াতাড়ি এ ক্ষতের শুশ্রূষা দরকার। হাত উঁচু করে চাইলেন রক্ত পড়া কমাতে, ঠিক যেমনটা করেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত হলে।
কোন সন্দেহ নেই যে, তুমি মারা যাবে ইসমাইল খান। কিন্তু তার আগে যতক্ষণ পর্যন্ত না, আমি, তোমার সত্যিকারের সম্রাট আহত ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে আসছি, বসে বসে মৃত্যু-ভয়ে ভীত হও আর অনুশোচনা করো কৃতকর্মের জন্য। কীভাবে মারা যাবে সেটা নির্ভর করবে আমাকে কতটা সত্যি কথা বলবে, তার উপর।
*
আমি আমার দোষ স্বীকার করছি, জাহাপনা। এক ঘন্টা পরে আবারো শাহজাহানের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ইসমাইল। তবে এবার আগ্রা দুর্গের বাইরের প্যারেড গ্রাউন্ডে।
আর কিই বা করার আছে তোমার? ঘটনাস্থলেই ধরা পড়েছে। কড়া স্বরে উত্তর দিলেন শাহজাহান। শুধুমাত্র ইচ্ছেশক্তির জোরে এখনো বসে আছেন তিনি। নয়তো একটু আগেই প্রচণ্ড যন্ত্রণা দিয়ে হাকিম ছোরার ফলা ঢুকে যাবার ক্ষতে সুঁই দিয়ে দশটা সেলাই করেছে, এরপর নিমের মলম লাগিয়ে বেঁধে দিয়েছে শক্ত করে। এখনো যন্ত্রণা হচ্ছে ক্ষতে কিন্তু সাদা তুলোর ব্যান্ডেজ দেখে বোঝা গেল রক্ত পড়া থেমেছে। দ্রুত সেরেও যাবে। যদি না…ইসমাইল খান তার অস্ত্রে বিষ না মাখায়। তুমি কী তোমার ছুরির ফলায় বিষ মাখিয়েছিলে?
না, জাহাপনা। তাড়াতাড়ি উত্তর দিল ইসমাইল খান। তরুণ মুখে ভয়ের ছাপ। না, আমি এটা করতামও না। তাহলে আপনি যেমন করেছেন সে রকমই অসম্মানের কাজ হত। খসরুকে মারার জন্য যাকে পাঠিয়েছেন, ইতিমধ্যে বাবার হাতে অন্ধ হয়ে গেছে…আমি নিজের হাতে পরিষ্কার আঘাত করতে চেয়েছি।
এমনকি পুরুষ হিসেবে দাবি করার স্বপক্ষে বয়স কম হলেও শাহজাহান তরুণের সাহস দেখে প্রশংসা না করে পারলেন না। একই সাথে মনে মনে স্বস্তিও পেলেন যে, যাক মাত্র পাঁচ মাস আগে পঞ্চম মোগল সম্রাট হিসেবে মুকুট পরিধানের সময় যে উচ্চাকাঙ্খাগুলো ছিল সেগুলো পূরণ করার জন্য আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন তিনি। তারপরেও, কোন ক্ষমা নেই। কোন অনুতাপ নেই তার জন্যে যে কিনা সম্রাটকে আক্রমণের সাহস করেছে। ইসমাইল খানকে মারা যেতেই হবে। কিন্তু তার আগে এই ষড়যন্ত্রে আর কারো হাত ছিল কিনা তাও জেনে নিতে হবে।
আর কে সাহায্য করেছে তোমাকে কোন সাহায্য ছাড়া আমার দেহরক্ষীদের হাত থেকে নিশ্চয়ই ছাড়া পাওনি?
আমাকে কেউ সাহায্য করেনি। পারিবারিক সম্মানের জন্য এমনটা করেছি আমি। ইসমাইল খানের তরুণ চোখ জোড়াতে ফুটে উঠল আত্মপ্রত্যয়। চিবুক সামনে বাড়িয়ে বলে উঠল, আমিই সব দায়িত্ব নিচ্ছি। আমি জানতাম যে যদি সফল হইও প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব না। আপনার মৃত্যু কোন অপরাধ হত না। বরঞ্চ আপনার পাপের শাস্তি হত। আপনাকে হত্যা করে আমি আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাই পূর্ণ করতাম।
ইসমাইল খানের চেহারার দিকে তাকিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন শহীদের সত্যিকারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞভাব। এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হতে গেলেন যে এ আক্রমণের পুরো পরিকল্পনা তার একার। কিন্তু তারপরেও নিশ্চয়ই কেউ ছিল সাথে। হতে পারে নির্যাতনের মাঝেও তাদের নাম বলবে না। তাহলে দেরি কিসের? জল্লাদ, তোমার কাজ সেরে ফেলল।
শাহজাহানের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল জল্লাদ। এগিয়ে এলো সামনে। স্থূলকায় লোকটার পরনে লাল পোশাক। সাথে লাল চামড়ার অ্যাপ্রন। হাতে খোলা তলোয়ার দুই ফুট লম্বা, মাথার দিকে খানিকটা বাঁকানো। তাড়াতাড়ি করে মাটিতে পাটের একটা ম্যাট পেতে দিল তার এক সহকারী। দুজন প্রহরী ধাক্কা দিয়ে এর উপর নিয়ে আসলো ইসমাইলকে। গলা বাড়িয়ে দাও। আদেশ দিল জল্লাদ। এক মুহূর্ত পরেই তার তলোয়ার সূর্যের আলো ঝিক করে উঠল ইসমাইলের উপর, ঠিক যেমন করে তরুণের ছোরা ঝিক করে উঠেছিল শাহজাহানের উপর। কিন্তু ইসমাইল খানের নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গেছে। হাত দুটো পিছনে বাঁধা; তাই নিজেকে বাঁচানোর কোন সামর্থ্য নেই তার। মসৃণ চামড়ায় দ্রুত বসে গেলো তলোয়ার। নরম মাংস ভেদ করে ঢুকে গেল ঘাড়ে। এরপর হাড় আর মাংসপেশী হয়ে কবন্ধ থেকে পৃথক হয়ে গেল ধড়। এক মুহূর্তের জন্য খোলা চোখ তাকিয়ে রইল শাহজাহানের দিকে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই দ্বিখণ্ডিত শরীর থেকে রক্তের ফোয়ারা ছোটার আগেই জল্লাদের দুই সহকারী পাটের ম্যাটের উপর মাথা আর শরীর পেঁচিয়ে তুলে নিয়ে গেল।
প্যারেড গ্রাউন্ডের ধারে জড়ো হওয়া মানুষের ভিড় উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। খানিকটা আরাম বোধ করলেন শাহাজাহান। যদিও জীবন তাঁকে ভালোই শিক্ষা দিয়েছে যে মানুষের স্নেহ ভ্রম ছাড়া কিছু নয়। যদি ভাগ্য তার সাথে না থাকে তাহলে তারা তাঁর মৃত্যুতেও হাততালি দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। তাকে নিশ্চিত করতে হবে যে এরকম যেন না হয়। এছাড়া যদিও তিনি ইসমাইল খানকে সম্মানজনক মৃত্যুবরণ করার সুযোগ দিয়েছেন, তার আত্মাহীন মৃতদেহের সাথে তো এমনটা করা যাবে না। দুই হাত তুলে জনতাকে শান্ত করে বলে উঠলেন শাহাজাহান, তো, সকল বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি আমার পুরস্কার হবে একই, তাদের পদমর্যাদা যাই হোক না কেন অথবা আমার সাথে যত আত্মীয়তাই থাকুক না কেন। তাই আমার প্রজাদেরকে ভাগ্য সম্পর্কে জানিয়ে দেয়ার জন্য ইসমাইল খানের শরীরকে টুকরো টুকরো করে পচন না ধরা পর্যন্ত বাজারের প্রতিটি কোণায় ঝুলিয়ে রাখা হোক। খণ্ডিত মস্তক গেঁথে দেয়া হোক দুর্গের প্রধান দরজার মাথায়।
যেমনটা তিনি ভেবেছিলেন, গর্জন করে উঠল ভিড়ের জনতা। এছাড়াও শোনা গেল নানা প্রশস্তিসূচক বাক্য। জিন্দাবাদ সম্রাট শাহজাহান। সম্রাট শাহজাহান চিরজীবী হোন। যদিও তিনি ভালোভাবেই জানেন যে ষড়যন্ত্রে জড়িত আছে তাঁর রাজ কর্মকর্তারাও।
এখনো শেষ করেননি শাহজাহান। হাতে সেলাই করার সময় কামরান ইকবালের সাথে কথা বলেছিলেন তিনি বহু দিনের সঙ্গী, পিতা আর সভাতৃদ্বয় খসরু আর শাহরিয়ারের সাথে সিংহাসন নিয়ে যুদ্ধের সময়ও শাহজাহানের সাথী ছিল কামরানই ইসমাইল খান যে প্রহরীদের সহায়তা নিয়েছিল তাদেরকে চিহ্নিত করে আটক করার ব্যাপারে। শাহজাহান নিশ্চিত যে অন্তত একজন হলেও পাওয়া যাবে।
বন্দিদেরকে নিয়ে এসো। নির্দেশ দিলেন তিনি। কয়েক মিনিট পরে মোগল দেহরক্ষীদের সবুজ পোশাক পরিহিত দুজন রক্ষী সামনে এলো কিন্তু তাদের লোহার দেহবর্ম আর হেলমেট সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দুই হাত একত্রে কব্জির কাছে বেঁধে রাখা। দুর্গের দেয়ালের ছোট্ট একটা দরজা দিয়ে তাদেরই সশস্ত্রসঙ্গীরা নিয়ে এলো দুজনকে। এরপর শাহজাহানের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। কয়েক গজ সামনে দাঁড়ালেও দুজনকেই চিনতে পারলেন শাহজাহান। প্রথম জন হরি সিং, লাহোর থেকে আগত এক সামরিক পরিবারের সদস্য। শাহরিয়ারের সময়েও নিয়োজিত থাকা এ লোকের দাদাজানের অনুরোধে এ দায়িত্ব দিয়েছে তাকে শাহাজাহান। সেই দাদাজান আবার তার নিজের দাদাজান সম্রাট আকবরের সমসাময়িক সঙ্গী ছিলেন। দ্বিতীয় জন একজন উজবেক, মজিদ বেগ, বহু বছর ধরেই আছে শাহজাহানের সশস্ত্রবাহিনীতে। উভয়কেই বেশ শান্ত দেখাচ্ছে।
কামরান ইকবাল আমাকে জানিয়েছে যে, ইসমাইল খান তোমাদের দুজনকে হটিয়ে আমার উপর আক্রমণ করেছে। কেন তোমরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে? কেন তাকে থামালে না? সে তো খুব বেশি একটা শক্তিশালীও নয়। উত্তর দিল না কেউই। কথা বল নয়তো লোহা গরম করতে বলব।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মজিদ বেগ, আমার মনে হয় হরি সিং একটু দূরে সরে গেছে যখন ইসমাইল খান আমাদের দুজনের মাঝে দিয়ে পার হয়ে গেছে। যদিও আমি তাকে থামানোর অনেক চেষ্টা করেছি।
তো ঘটনা তাহলে এই, ভাবলেন শাহজাহান। চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন হরি সিংয়ের দিকে। লোকটা এখনো শাহরিয়ারের অনুগত, যেমনটা ছিল ইসমাইল খান জানি আর খসরুর প্রতি। নিজেকে বাঁচাতে কী বলার আছে তোমার?
সরাসরি শাহজাহানের দিকে তাকাল হরি সিং। জাহাপনা! আমি। পিছনে হটিনি, শপথ করে বলছি। আমি চেষ্টা করেছি আপনাকে রক্ষা করতে…ইসমাইল খানকে থামাতে। পা জোড়া ধরে মাটিতে ফেলে দিতে প্রায় সমর্থ হয়েই যাচ্ছিলাম। অন্যরা পরিষ্কার দেখেছে।
আর মজিদ বেগ? যেমনটা সে বলেছে ঠিক সেভাবে চেষ্টা করেছিল?
আমি জানি না। এছাড়া সেও আমার সহযোদ্ধা।
ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না। হরি সিং, তোমাকে বলতেই হবে।
হরি সিং আবার কিছু বলার আগেই শাহজাহান দেখতে পেলেন দেহরক্ষীদের নেতা এগিয়ে এল শুকনো প্যারেড গ্রাউন্ডে। বাতাসের তোড়ে লাল ধুলো উড়তে শুরু করেছে। কী হয়েছে?
আপনি যেমনটা নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমরা ওদের মিলিটারি ব্যারাকে খোঁজ করে এই ব্যাগটা পেয়েছি। কথা বলতে বলতে দেহরক্ষীদের নেতা এক হাতে সবুজ রঙের একটা ভেলভেটের ব্যাগ তুলে ধরল। নিচে ধুলার উপর গড়িয়ে পড়ল বেশ কয়েকটা সোনার মোহর।
কার থলে এটা? জানতে চাইলেন শাহজাহান।
মজিদ বেগের।
এটা হরি সিংয়ের নয়, জানতে পেরে বিস্মিত শাহজাহান। কিছুই না বলে চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর জানতে চাইলেন, এগুলো কী মজিদ বেগ? ষড়যন্ত্রের পুরস্কার?
না, আমার সঞ্চয়। নিজের কথায় অটল রইল মজিদ বেগ।
এটা সত্যি নয়, জাহাপনা, কথা বলে উঠল দেহরক্ষী প্রধান। অন্য প্রহরীদের একজন আমাকে জানিয়েছে যে জুয়ারী হিসেবে খ্যাতি আছে মজিদ বেগের আর এখন সে মেয়ের বিয়ের যৌতুক মেটাতে অর্থ জোগাড় করছে। সেই-ই অপরাধী।
হরি সিং, এবার তুমি বলো। তাগাদা দিলেন শাহজাহান।
আমি পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কোন সহকর্মীকে দোষ দিতে পারি না। কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে আমার কাছ থেকে সরে গিয়েছিল। আস্তে করে বলে উঠল হরি সিং। তবে এবার তার চোখ মাটির দিকে নামিয়ে রাখল। এ সময় মজিদ বেগ চাইল মরিয়া হয়ে প্রহরীদের হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিতে, কিন্তু চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল প্রহরীরা।
মজিদ বেগ, এটা তোমারই কাজ।
হা, জাহাপনা।
কে বলেছে করতে?
মজিদ বেগ একেবারে ভেঙে পড়ল। ইসমাইল খান। আমাকে এও বলেছে যে এক প্রহরীর কাছ থেকে আমার অর্থের প্রয়োজনের কথা শুনেছে।
আর কেউ জড়িত ছিল?
না…আমার জানা মতে না, জাহাপনা।
ইসমাইল খানের মত তুমিও মারা যাবে মজিদ বেগ। কিন্তু তার মত করে না, কেননা তুমি আরেকজন নিরপরাধ ব্যক্তির উপর দোষ দিতে চেয়েছে। তোমার মৃত্যু হবে হাতির পায়ের নিচে। জল্লাদ হাতিকে সামনে নিয়ে এসো।
ধীরে ধীরে বিশাল বড় এক হাতি, কানের কিনারা দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল বয়সের ভার, দুর্গের দেয়াল থেকে বের হয়ে সামনে এলো। পিঠের উপর বসে আছে হাতির মতই বয়সের ভারে ন্যূজ মাহুত। একই সাথে প্রহরীর দল টানতে টানতে মজিদ বেগকে গ্রানাইটের পাথরের তৈরি মঞ্চের উপর নিয়ে গেল। চার কোণায় থাকা লোহার আংটার সাথে বেঁধে ফেলা হল মজিদ বেগের হাত আর পায়ের গোড়ালি। প্রথমে মনে হল কোন বাধা দেবার চেষ্টা করল না সে, বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিল ভাগ্য। জল্লাদ হাতি এগিয়ে এল পাথরের দিকে। মজিদ বেগের উপর পড়ল ছায়া। আস্তে করে ডান পা উঁচু করল মজিদ বেগের পেট লক্ষ্য করে, এবার নড়ে উঠল মজিদ বেগ। ছাড়া পাবার জন্য যুদ্ধ শুরু করে দিল, চিৎকার করে বলে উঠল, আমার অতীতের কাজ স্মরণ করুণ, জাহাপনা! আমাকে ক্ষমা করুন!
আমি তা করব না। উত্তর দিলেন শাহজাহান। হত্যা করো।
নিজের হাতে থাকা লোহার রড দিয়ে হাতির মাথায় আঘাত করল মাহুত, মজিদ বেগের পেটের উপর পা নামিয়ে আনল হাতি। পশুর মত চিৎকার করে উঠল মজিদ বেগ। পেলভিক হাড় ভাঙ্গার শব্দ শোনা গেল। শক্ত গ্রানাইটের সাথে চুরমার হয়ে গেল হাড়। পাকস্থলীর দেয়াল ছিঁড়ে যেতেই বাতাস বের হয়ে এলো। গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই থেমে গেল সব চিৎকার।
মাহুতের কাছ থেকে আরেকটা নির্দেশ পেয়ে আবারো পা তুলল হাতি। আস্তে আস্তে ঘুরে গিয়ে হাঁটা ধরল দুর্গের দিকে। ডান পায়ের প্রতি পদক্ষেপের সাথে রক্ত মাখা কমলা রঙের ধুলা উড়তে লাগল বাতাসে।
তো, শেষ হল আরেকজন বিশ্বাসঘাতক। ভিড়ের জনতার চিৎকার শুনে আবারো বলে উঠলেন শাহজাহান। এরপর ফিরে তাকালেন হরি সিংয়ের দিকে। তুমি মুক্ত আর তোমার প্রত্যাখানের জন্য–এমনকি তোমার নিজের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছিল–মজিদ বেগের অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েও কিছু বলনি, ধুলার মাঝে পড়ে থাকা মোহরগুলো নিয়ে যাও। মজিদ বেগের বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য তোমার বিশ্বস্ততার পুরস্কার।
প্রহরি হরি সিংয়ের হাতের বাঁধন কেটে দিতেই নিচু হয়ে মোহর কুড়াতে লাগল সে। দুর্গের দিকে ফিরে গেলেন শাহজাহান। হাত নেড়ে সরিয়ে দিলেন সভাসদদের শুভেচ্ছা। শাহানশাহের বেঁচে যাওয়া আর নিজেদের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে চেয়েছিল তারা। শাহজাহান যেতে চান হারেমে, মমতাজের কাছে। ক্ষতস্থানে প্রলেপ লাগানোর সময়ে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন এই হত্যাকাণ্ডের প্রচেষ্টা সম্পর্কে কিছু না জানানো হয় মমতাজকে। শাহজাহানের কাছ থেকে শুনলে আর নিজ চোখে দেখলে যে তিনি সুস্থ আছেন হয়তো মমতাজের আশংকা কেটে যাবে। কিন্তু একই সাথে মমতাজ হয়ত এও চেষ্টা করত যেন ইসমাইল খানকে ক্ষমা করে দেন শাহজাহান। জানির ভয়ংকর সমাপ্তি স্বামীর হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে গরম কয়লা গিলে ফেলেছিল–এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় মমতাজকে। কিন্তু যেহেতু শাহজাহান মমতাজকে খুশি করতে চান, একবারের জন্য তিনি তাঁর অনুরোধ মেনে নিতে পারলেন না।
*
না…না…রোশনারা…!
সম্রাজ্ঞী, কী হয়েছে?
জেগে গেলেন মমতাজ। সারা শরীর কাঁপছে। কপাল ঘেমে একসা। সাথে সাথে বিশালদেহী পারস্যবাসী ভৃত্য সাত্তি আল নিসা হলুদ সিল্কের রুমাল দিয়ে মুছে দিল ঘাম। আমি স্বপ্ন দেখেছি যে আমি আর সম্রাট উন্মত্ত মহনদী নদীতে ষাঁড়ের গাড়ি দিয়ে পার হবার সময় একটা জন্তু পা হড়কে পড়ে যায়, গাড়ি উল্টে যায়…ঢেউ এসে রোশনারাকে নিয়ে যায় আমার কোল থেকে…আমি সাঁতার কেটে ওর কাছে যাবার চেষ্টা করলেও পারি নি…আমি বুঝতে পারছিলাম যে মেয়েটা ডুবে যাচ্ছে কিন্তু পানিতে ডুবে যাচ্ছিলাম আমি নিজেও…মাথার উপরে পানি গলার মাঝে ঢুকে যাচ্ছে পানি…আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
শশশ। কিছুই হয়নি সম্রাজ্ঞী। আপনি আবারো দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। রোশনারা জাহানারার কাছে আছে। আমি মাত্র আধা ঘণ্টা আগেও আপনার মেয়েদেরকে একসাথে দেখেছি। এত নরম স্বরে সাত্তি-আল নিসা কথা বলতে লাগল যেন চল্লিশ বছর বয়স্ক কোন ম্রাজ্ঞী নয়, সে কথা বলছে কোন শিশুর সাথে। স্বস্তির সাথে আবারো শুয়ে পড়লেন মমতাজ। কিন্তু আরো কয়েক মিনিট কাটার পর অবশেষে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি থেমে গেল। মধ্যাহ্নের খাবারের পরপরই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু ঘরময় ছায়া এখন। এতক্ষণ নিশ্চয়ই ঘুমাননি তিনি। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন যে ঘুমানোর পরে জানালাগুলোতে তত্তি সুগন্ধময় কাশফুলের শিকড়ের ঘাস দিয়ে তৈরি পর্দা দিয়ে গেছে ভৃত্যেরা, যেন গ্রীষ্মের কড়া রৌদ্র কামরাতে ঢুকতে না পারে। ফোঁটা পড়ার শব্দে তিনি এও বুঝতে পারলেন যে পর্দার উপর গোলাপ জল ছিটিয়ে দিয়ে গেছে তারা, যেন বাতাসও সুগন্ধময় হয়ে ওঠে।
মমতাজ পাশ ফিরে শুলেন, চিকন রশ্মির মত করে সূর্যের আলো আসছে পর্দা ভেদ করে, কাউচের চারপাশে দামি পারস্যের কার্পেটের উপর নাচছে আলোর পুকুর। মনে পড়ে গেল সেই মুহূর্তের কথা যখন তাঁর ছোট কন্যা প্রায় ডুবেই যাচ্ছিল পানিতে। শাহজাহান বাঁচিয়েছিলেন মেয়েকে। সম্রাটের সেই দুঃখ ভরা দৃষ্টি মমতাজ কখনো ভুলতে পারবেন না–পানিতে ভিজে চুপচুপে মেয়েকে কোলে দিয়েছিলেন শাহজাহান, কিন্তু তখনো নিঃশ্বাস ফেলছিল রোশনারা–শাহজাহানের পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে সারা ভারত চষে বেড়াচ্ছিলেন তারা, শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটাই তখন একমাত্র লক্ষ্য ছিল। অবাক লাগে ভাবতে যে, এখন তিনি ম্রাজ্ঞী, নিরাপত্তা আর আয়েশে মোড়ানো জীবন, তারপরও ও সেই দিনগুলি কখনো মনে পড়ে যায়। কখনো কখনো অবাক হয়ে ভাবেন রোশনারার কী কিছু মনে আছে, যদিও সে অনেক ছোট ছিল তখন। মমতাজের অন্য ছেলেমেয়ের চেয়ে রোশনারাই বেশি চাইতো মায়ের কাছে থাকতে। মায়ের অনুপস্থিতি অনেক দিন ধরে ভয়ে ফেলে দিত মেয়েটাকে।
সাত্তি আল-নিসা, আমার আদেশ জানিয়ে দাও, আমি চাই আমার ছেলে-মেয়েরা আজ সন্ধ্যায় আমাদের সাথে খাবার গ্রহণ করবে। তাদের সাহচর্যে উদ্দীপনা ফিরে পাবেন, ভাবলেন মমতাজ। এখন যখন খুশির দিন এসেছে, অন্ধকারের কথা ভাবাতে নিজের উপরই বিরক্তি এলো মনে। ছয়টি সন্তানই কি প্রমাণ নয় যে অতীতের পরীক্ষা সত্ত্বেও আল্লাহ তার সাথে আছেন? আর এখন শুধু এটুকুই যথেষ্ট যে একে অপরের সাথে যতটা পারা যায় সময় কাটানো উচিত। দুই সপ্তাহের মাঝে দারা শুকোহ আগ্রা ছেড়ে যাবে পারস্যের শাহের দরবারে মোগল দূতাবাস স্থাপন করতে। শাহজাহানের মতে, চৌদ্দ বছরের কাছাকাছি বয়স্ক দারা শুকোহ্ কয়েকদিনের মাঝেই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষে পরিণত হবে। তাই রাজকীয় কাজের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। একমত হয়েছেন মমতাজ।
মনে প্রশান্তি ভাব আসতেই আড়মোড়া ভাঙ্গলেন তিনি। শীঘ্রই তৈরি হতে হবে আসন্ন সন্ধ্যার জন্য। সেবা দাসীরা সুগন্ধি তেল লাগিয়ে দেবে মসৃণ দেহত্বকে, চোখে কাজল আর এমন পোশাকে অঙ্গ সাজিয়ে দেবে যেভাবে ম্রাজ্ঞীকে দেখতে পছন্দ করেন সম্রাট। মসলিনের পায়জামা যেটিকে দরবারের কারিগররা নাম দিয়েছে বহতা পানি আর অ্যামব্রয়ডারি করা চোলি। হঠাৎ করেই মমতাজ শুনতে পেলেন ড্রামের শব্দ, যার অর্থ সম্রাট হেরেমে প্রবেশ করেছেন। অবাক হয়ে উঠে বসলেন তিনি–এমনটা তো হবার কথা না…সাধারণত সূর্য ডোবার পরেই আগমন ঘটে সম্রাটের। খানিক পরেই জোড়া দরজা মেলে ধরল ভৃত্যেরা, প্রবেশ করলেন শাহজাহান।
একবার তার দিকে তাকিয়েই মমতাজ বুঝতে পারলেন যে কিছু একটা ঘটেছে। জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? কী ঘটেছে?
কিছুই না বলে নিজের কাছে পত্নীকে টেনে নিলেন শাহজাহান। মমতাজের শরীরের উষ্ণতা, চুলের পরিচিত জেসমিনের সুগন্ধ পেয়ে মনে মনে আবারো ধন্যবাদ জানালেন যে, ইসমাইল খান সফল হতে পারেনি। তিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। কিন্তু যাদেরকে ভালোবাসেন তাদেরকে ছেড়ে যাওয়া…অবশেষে ছেড়ে দিলেন মমতাজকে। কোট ঠিক করে ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসলেন। ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত দেখতে পেলেন মমতাজ। আপনার সাথে কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে?
না, দুর্ঘটনা নয়। আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে…চিন্তা করো না, চিন্তার কিছু নেই। মাংস কেটে গেছে। হাকিম এর পরিচর্যা করে দিয়েছে।
কে? ভয়ত কণ্ঠে ফিসফিস করে উঠলেন মমতাজ।
ইসমাইল খান। আমার রক্ষীদেরকে সরিয়ে ছুরি মেরেছে।
জানির ভ্রাতুস্পুত্র? কিন্তু ও তো একটা ছোট ছেলে…কেন? কী হয়েছে ওর? আর আপনিই বা কী করেছেন তার সাথে?
সে জানির হয়ে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। ইতিমধ্যে শাস্তিও পেয়েছে। আমি বরঞ্চ দয়াই দেখিয়েছি–আমি তাকে দ্রুত মৃত্যু অনুমোদন করেছি। আমি তাকে বাঁচতে দিতে পারি না…আমাকে হত্যা করার চেষ্টার পর তো নয়ই।
সম্ভবত না, কিন্তু… থেমে গেলেন মমতাজ।
শাহজাহান আলতো করে নিজের হাতের মাঝে ধরলেন পত্নীর মুখ। বললেন, বিবাহের পর থেকে আমি যা কিছু করেছি তা আমাদের জন্য, আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য…আমাদের নিরাপত্তা আর ভবিষ্যতের জন্য।
আমি কখনো এমনটা সন্দেহ করিনি, কখনো না…এত বছরে না। কিন্তু এর মাধ্যমে কিছুতেই নিজেকে অপরাধী হিসেবে ভাবা বন্ধ করতে পারছি না। খানিকটা ভয়ও পাচ্ছি। আমরা যা চেয়েছি পেয়েছি, কিন্তু এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে রক্ত দিয়ে।
হাত নামিয়ে নিলেন শাহজাহান। যদি আমি তাদেরকে হত্যা না করতাম তাহলে আমার সম্ভাইয়েরা আমাকে হত্যা করত…আমাদের পুত্রদেরও। তাদের মৃত্যুতে আমি গর্বিত নই, কিন্তু এগুলোর প্রয়োজন ছিল। এটা বললে মিথ্যে বলা হবে যে আমি এ কাজ অসমাপ্ত রাখতে চেয়েছি। যদিও অতীত এসে প্রায়ই জ্বালাতন করে আমাকে–আমি জানি তোমাকেও কিন্তু এক্ষেত্রে আমার কিছুই করার নেই।
আপনি তা-ই করেছেন, যা করার দরকার ছিল…আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কেমন হবে যদি ইসমাইল খানই হয় প্রথম? আর কত জন আছে যারা আপনার কাজের প্রতিশোধ নিতে চাইবে?
আমি মোগল সম্রাট আর শত লক্ষ্য আত্মার পরিচালক। তাই আমার জীবনে ঝুঁকি থাকবেই। কিন্তু আমি আমার আর আমার পরিবারকে রক্ষা করবই…এর কখনো অন্যথা হবে না। আমি সকলকে নিরাপদে রাখব, প্রতিজ্ঞা করছি।
*
রৌপ্য সিংহাসনে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য অবলোকন করছেন শাহজাহান। সারি বেঁধে এগিয়ে আসলো বারোজন রাজকীয় ভৃত্য। সবার হাতে একটি করে সোনালি মোমদানি যার মাথার জ্বলছে লম্বা কর্পূরের সুগন্ধযুক্ত মোমবাতি। দরবারের সামনে এসে প্রত্যেকেই একবার করে কুর্নিশ করল সম্রাটকে, এরপর মোমবাতি নিয়ে চলে গেল দিয়া জ্বালাতে। বিশাল পাত্রের মাঝে সরষের তেলে ডুবানো সলতে–দুর্গের আঙিনার চারপাশে রাখা আছে পিতলের দিয়াগুলো। রক্ষীবাহিনীর নেতার নেতৃত্বে কাজ শেষ করল সকলে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাটকে জানালো, রাতের জন্যে দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে জাহাপনা। এরপর শাহজাহানের পছন্দের দরবার শিল্পী–গভীর সুললিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী, তরুণ তাজিক গেয়ে উঠল সম্রাটের নামে প্রশস্তিগীতি আর তাঁর পবিত্র শাসনামল অক্ষত টিকে থাকার জন্য প্রার্থনা সঙ্গীত। সম্রাট আকবর প্রবর্তিত এই নিশি জাগরনী অত্যন্ত উপভোগ করেন শাহজাহান। দাদাজানের সফল শাসনামলের সাথে নিজের কথা ভাবতে ভাবতে মনে হল এই সিংহাসনের যোগ্য উত্তরসূরী তিনিই; মাথা নত করে রাখা রক্ষীবাহিনীর সামনে দিয়ে এরপর উঠে চলে গেলেন হারেমে, মমতাজের কাছে। হাতে ধরা সবুজ ভেলভেট রিবনে বাঁধা একতোড়া কাগজ।
আমি তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি-দরবারের একজন কবি তোমার নামে কবিতা রচনা করেছেন। নিচু হয়ে মমতাজের অধর চুম্বন করলেন শাহজাহান।
কী লেখা আছে এতে?
একটু বেশি বাক্যালংকারপূর্ণ হলেও আমার ভাবনাই ফুটে উঠেছে।
হতে পারে, কারণ আপনি তাকে আগেই বলে দিয়েছেন যে কী লিখতে হবে।
হুম, যাই হোক, হতে পারে। পড়ব?
অবশ্যই। বলে উঠলেন মমতাজ। হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়লো সারা মুখে। রিবন খুলে পড়া শুরু করলেন শাহজাহান :
তাঁর আচরণের কোন ধুলাই
ছায়া ফেলে না সম্রাটের মনের আয়নায়
তিনি সব সময় রাজাকে খুশি
করার চেষ্টায় রত;
ভালোভাবেই জানেন রাজাদেরও
রাজার অনুভূতি।
তার চোখে খেলা করে আলো
কিন্তু শেষ করার পূর্বেই দরজার সোনালি তারকা আর চন্দ্রখচিত অ্যামব্রয়ডারি করা পাতলা মসলিনের পর্দা সরিয়ে এগিয়ে এল সাত্তি আল-নিসা।
কী হয়েছে? জানতে চাইলেন শাহজাহান, আমি আদেশ দিয়েছি যেন বিরক্ত না করা হয়।
আমি দুঃখিত জাহাপনা। কিন্তু দক্ষিণ থেকে আবদুল আজিজ এসে পৌঁছেছে। আমি তাকে জানিয়েছি যে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী রাতের জন্য বিশ্রাম করছেন, কিন্তু আপনার সাথে দেখা করার জন্য তাড়া করছে সে।
আমি আসছি। জানিয়ে দিলেন শাহজাহান। কী এমন ঘটেছে যে দাক্ষিণাত্যে তাঁর সেনাপতির পুত্র এত রাতে দেখা করার জন্য জেদ করছে? একটা ব্যাপার তো নিশ্চিত যে, কোন দুঃসংবাদই হবে। তাড়াহুড়োয় কক্ষ ছেড়ে হারেমের আঙিনা দিয়ে যেতে যেতে ভাবতে লাগলেন শাহজাহান। চাঁদের আলোয় চকচক করছে দুই সারি ঝরনা। গেট হাউছে পৌঁছে মশালের আলোয় এ মাথা থেকে ও-মাথা পায়চারি করতে থাকা কৃশকায় আবদুল আজিজকে দেখতে পেলেন। সম্রটাকে প্রধান আঙিনায় নেমে আসতে দেখে নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তরুণ। তারপর হাঁটু গেড়ে সম্রাটকে সম্মান জানাল।
উঠে দাঁড়াও। নির্দেশ দিলেন শাহজাহান। আবদুল আজিজ উঠে দাঁড়াতেই দেখা গেল তার সারা গায়ে ঘাম আর ধুলা। সম্রাটের সামনে আসার আগে এমন কি গোসল করে পোশাক পরিবর্তনের কথাও খেয়াল নেই। কী কারণে তোমাকে এত তাড়াহুড়োয় আমার কাছে নিয়ে এলো?
আমার পিতা অবিলম্বে আপনাকে এ সংবাদ জানাতে বলেছেন যে, দাক্ষিণাত্যের সম্রাটের সৈন্যরা কতটা দুর্ভোগের মুখে পড়েছে। গোলকুন্ডা আর বিজাপুরের শাসকেরা আপনার প্রতি আনুগত্য ভুলে গিয়ে দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করেছে। আমাদের সীমান্তের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে দিয়ে সরাসরি ভূ-খণ্ডের গভীরে চলে এসেছে। আমার পিতা যুদ্ধ হাতি আর আধুনিক কামান দিয়ে সুসজ্জিত বিশাল সেনাবাহিনী একত্রিত করে তাপ্তি নদীর থেকে নব্বই মাইল দক্ষিণে তাদেরকে মোকাবেলা করেছেন। প্রথম দিকে আক্রমণকারীরা যুদ্ধ করতে পারছিল না, কিন্তু আমার পিতা তাদেরকে বাধ্য করেছেন।
তিনি একজন দক্ষ সেনাপতি।
হ্যাঁ জাহাপনা তিনি ছিলেন…দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল আবদুল আজিতের মুখমণ্ডল। পুরো একদিন যুদ্ধ হয়েছে; কিন্তু কোন পক্ষই সুবিধা করতে পারেনি। শুধুমাত্র গরম আর পানির অভাবেই আততায়ীর হাতেই নিষ্ক্রিয় হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সেনারা। সূর্যাস্তের দিকে খানিকটা পরাজিত হতে শুরু করে আক্রমণকারীরা। আমার পিতা শেষবারের মত তাদেরকে পিছু হটিতে দিতে অগ্রসর হয় নিজের ধূসর তেজী ঘোড়া নিয়ে…আমি অনুনয় করেছি আমাকে সাথে নিতে, কিন্তু আমার কাতরতা শোনেননি তিনি।
আবদুল আজিজের ধুলি ধূসরিত মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুবিন্দু। আমাদের ঘোড়সওয়ারদের দক্ষতায় আক্রমণকারীদের অনেকেই ধরাশায়ী হয়। আমার পিতা কামানের দিক লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলে একজন গোলন্দাজ গোলা ছুঁড়ে বসে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, গোলা এসে আঘাত করে পিতার ডান বাহুতে, আমাদের লোকদের উদ্দেশে হাত নাড়ছিলেন তিনি তখন। কনুই থেকে পুরো পেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু শত্রুবাহিনী পিছু না হটা পর্যন্ত কোন চিকিৎসা নিতে রাজি হননি তিনি। এরপর হাকিম ক্ষত পরিষ্কার করে রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা নেন। ব্যথা প্রচুর রক্তক্ষরণের পরেও এই রাতে ভালোভাবেই নিদ্রা গিয়েছেন পিতা আর আমিও আশা করে ছিলাম যে তিনি দ্রুতই সেরে উঠবেন… থেমে গেল আবদুল আজিজ।
পরের দিন সকাল বেলা পিতা আবারো শত্রুর পিছু নেবার হুকুম দেন। আমাদের চরের মাধ্যমে জানা যায় যে শত্রুবাহিনী দক্ষিণে ছুটছে। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনের দুপুর বেলা দুপাশে পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকা বেয়ে নামার সময় হঠাৎ করেই গোলকুন্ডার বিশাল বড় এক অশ্বরোহী বাহিনী এসে আমাদের পথরোধ করে। কোন আদেশের আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আমাদের সৈন্যরা। প্রথম আঘাতেই আমাদের সারি ভেঙে দুটুকরা হয়ে যায়। পেছনদিকে চক্রাকারে এগিয়ে আসে আক্রমণকারীরা। সেখানেই ছিল কামান আর রসদবাহী গাড়ি। কাটতে কাটতে এগিয়ে আসে শত্রুরা। বিশৃঙ্খলার মাঝে পড়ে যায় আমাদের লোকেরা। কয়েকজন পালিয়ে যায় কিন্তু কিছু কাপুরুষ বৃথাই এই চেষ্টা করে, কেননা পেছন থেকে তাদেরকে মেরে ফেলে গোলকুন্ডার ঘোড়সওয়ারা।
পেছনের বাকি সৈন্যরা চেষ্টা করে একত্রিত হয়ে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে। অন্যদিকে সামনের অংশে বাকি সৈন্যদের নিয়ে পিতা চেষ্টা করেন বন্দুকবাজদের প্রস্তুত করতে। তাদের প্রচেষ্টা সফল হয় শত্রুদের পিছু হটাতে। অশ্বারোহীদের বেশিরভাগ এসে পিতার পাশে জড়ো হয়, কিন্তু পদাতিকেরা হয়ে পড়ে সংখ্যায় নগণ্য। আমি দেখেছি কমলা পোশাক পরিহিত একদল পদাতিক রাজপুত শত্রুবাহিনীর অশ্বরোহীদের বর্শার আঘাত ঠেকাতে এক হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকবার রাজপুতদের তলোয়ারের আঘাতে গর্জে ওঠা ঘোড়া ফেলে দিয়েছে আরোহীকে। কিন্তু এটা ছিল অসম প্রতিযোগিতা। খুব কম সুযোগই পেয়েছে রাজপুত সৈন্যরা তাদের অস্ত্র ব্যবহার করার। তাই ফলাফল ছিল একটাই। শুধুমাত্র দুজন রাজপুত ফিরে আসতে পেরেছে আমাদের সারিতে। দুজনেই প্রচুর রক্ত হারিয়েছিল। এরপর আক্রমণকারীরা জ্বলন্ত ন্যাকড়া বাঁধা তীর ছুঁড়ে মারে। ফলে ভয় পেয়ে যায় আমাদের যুদ্ধ হাতিরা। কয়েকটা তো এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যে একে অন্যের সাথে গুতোগুতি শুরু করে দেয়, অস্ত্রের মুখ ঘুরে যায়।
পিতা আদেশ দেন বাকি সৈন্যরা যেন উপত্যকার শেষপ্রান্তের কাছাকাছি নিচু পাহাড়ে চলে যায়, সেখানে গিয়ে আমরা আবার একত্রিত হবার সুযোগ পাবো। শত্রুপক্ষের উপর্যুপরি আক্রমণ সত্ত্বেও আমরা সেই রকমই করলাম। কাছাকাছি পৌঁছতেই পর্বতে লুকিয়ে থাকা কয়েকজন শত্রু তীরন্দাজ তীর ছোড়ে। তিনটা তীর এসে পিতাকে বহনকারী পালকিতে আঘাত করে। দুইটা তীর সাথে সাথে আগুন ধরিয়ে দেয়, তৃতীয়টা পিতার উরুতে আঘাত করে। কাপড়ে আগুন ধরে যায়। সাথে সাথে পিতার ভূতেরা আগুন নিবিয়ে তাঁকে বাইরে বের করে আনে। চেতনা থাকলেও পিতা বেশ বুঝতে পারেন যে এই ক্ষত সারিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই হাকিমের।
ব্যথার সাথে যুদ্ধ করে তিনি নেতৃত্ব তুলে দেন সেকেন্ড ইন-কমান্ড জাকির আবাসের হাতে। নির্দেশ দেন যতটা সম্ভব সুশৃঙ্খলভাবে পিছিয়ে যেতে। এরপর আমাকে ডেকে পাঠান। আমার হাত ধরে নির্দেশ দেন যেন এই পরাজয়ের খবর পৌঁছে দিই আপনার কাছে…আপনাকে জানাতে বলেছেন যে সৈন্যদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত আর এই মুহূর্তে সুদক্ষ সৈন্যবাহিনী না পাঠানো হলে দক্ষিণে আমাদের ভূ-খণ্ড হাতছাড়া হয়ে যাবে।
সারা শরীর কাঁপিয়ে ফোঁপাতে লাগল আবদুল আজিজ। জাহাপনা! ভৃত্যেরা আমার পিতার দাড়িতে লেগে যাওয়া আগুন নিভাতে পারেনি। চেহারা থেকে খসে পড়েছে পোড়া চামড়া…পুড়ে যাওয়া ঠোঁট…কথা বলতে পারেননি তিনি। কয়েক মিনিট পরেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তোমার পিতা একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আমি। তুমিও তোমার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন তুমি ঘুমাতে যাও। বাকি কথা সকালে হবে।
আবদুল আজিজ প্রস্থান করতেই, তার পিতার মৃত্যুর খবরে কাঁপতে লাগল সৈন্যরা। ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে হারেমের দিকে চলে গেলেন শাহাজাহান। দক্ষিণে সৈন্যদল পরিষ্কারভাবেই পরাজিত হয়েছে। এক নতুন সেনাপতির অধীনে নতুন সৈন্যবাহিনী পাঠাতে হবে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। কিন্তু কে হবেন এই সেনাপতি?
যদি মহবৎ খান, সম্রাটের খান-ই খানান এই মুহূর্তে হিমালয়ের পাদদেশে নেপালের রাজা আর তার গুর্খা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত না থাকতো, তাহলে স্পষ্ট প্রথম পছন্দ ছিল সে-ই। কিন্তু তাকে ডেকে পাঠানো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
ঝরনা পার হতে হতে আরো বেশ কয়েকজন সেনাপতির নাম মনে মনে ভাবলেন শাহজাহান। বিশ্বস্ত বন্ধু কামরান ইকবাল, আগ্রা দুর্গের সেনাপ্রধান, তবে তাকে এখানেই বেশি প্রয়োজন। এছাড়া লাহোরে শাহরিয়ারের সাথে যুদ্ধে আহত ক্ষত থেকে এখনো সেরে ওঠেনি সে, পুরোপুরি হয়ত কখনোই সেরে উঠবে না।
শ্বশুর সাহেব আসফ খান বৃদ্ধ হয়েছেন। অভিযানে যাবার মত সামর্থ্য নেই এখন আর। অন্যান্য হয় বেশি রাগী অথবা বেশি সাবধানী। কয়েকজন আছে স্থানীয়দের সাথে বেশ খারাপ আচরণ করতে অভ্যস্ত, পারিশ্রমিক না দিয়েই তাদের শ্রম চায়। কিন্তু এ ধরনের আচরণ দাক্ষিণাত্যের গর্বিত আর অশান্ত স্বভাবের লোকদের সাথে খাটবে না। না। আর কোন উপায় নেই। তিনিই যাবেন, দক্ষিণে, তাঁকেই দিতে হবে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব।
কয়েক মিনিট পরে আরো একবার সোনালি অ্যামব্রয়ডারি করা মসলিনের পর্দা সরিয়ে ঢুকলেন মমতাজের রুমে। পদ্মখচিত রেশমী কাপড়ের গোল বালিশে পিছন ফিরে শুয়ে তরমুজের রস পান করছেন মমতাজ। চোখ তুলে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, আবদুল আজিজ কী চেয়েছে?
দাক্ষিনাত্যের বিরাট পরাজয় আর বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। আমাকে এখনই সেনাবাহিনী জড়ো করে রওনা দিতে হবে।
কখন রওনা দেবো আমরা?
আমি একা যাবো। তোমরা এখানে থাকবে।
দাক্ষিণাত্যে এই অভিযান অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা কেন? আমি সবসময় আপনার সঙ্গী হয়েছি আর আপনিও কখনো আপত্তি করেননি।
হ্যাঁ, তুমি আমার সাথে গেলে আমিও খুশি হতাম। যদি না জানা থাকতো যে তুমি আবার মা হতে চলেছ। শেষবার প্রথমগুলোর চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলে তুমি। এখানেই ভালো হাকিমের বন্দোবস্ত থাকবে।
যেমনটা আমি আপনার প্রথম অভিযানের সময়ই বলেছিলাম, আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে চাই না। সর্বশ্রেষ্ঠ হাকিমেরাও তো আমাদের সাথেই আসতে পারে।
হুম পারে সম্ভবত।
না, কোন সম্ভবত নেই। আমি, আমাদের ছেলেমেয়েরা আর আপনি যত হাকিম চান, সকলেই আপনার সাথে যাচ্ছি। একসাথে বিজয়ের উদ্দেশে রওনা হব আমরা।
বোঝা গেল কিছুতেই নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন না মমতাজ।
.
১.২
আগ্রা দুর্গের বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে মলিন সূর্যের আলোয় নিজের তলোয়ার তুলে নিলেন শাহজাহান আর মাথার উপর তুলে তিনবার ঘোরালেন। ভোরের একেবারে শুরু হচ্ছে মাত্র। এই ইশারা পেয়ে, সেনাবাহিনীর গোলন্দাজেরা ছোট কামান থেকে গোলা ছুড়লো। দাক্ষিণাত্য থেকে আবদুল আজিজের বয়ে আনা সংবাদের পর থেকে দুর্গের নিচে যমুনা নদীর তীরে জড়ো হওয়া শুরু করেছিল সৈন্যরা। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল সকলে। এর বিশালত্বের দিকে তাকিয়ে–এমনকি পারস্যের শাহও এতবড় সুসজ্জিত দল একত্রিত করতে পারবেন না রণক্ষেত্রে, গর্ব ভরে ভাবলেন শাহজাহান।
প্রথম বিশ হাজার হল অশ্বারোহীদের অগ্রগামী সৈন্য। বাতাসে উড়ছে তাদের সবুজ সিল্কের তৈরি স্মারকচিহ্ন। এরপর হাতির পিঠে চড়ে চলেছে সম্রাটের বয়স্ক ও প্রধান সেনাপতির দল। জমকালো ভেলভেট আর সোনার কাপড় পরিহিত হাতিদের ঘণ্টা আর শিকলগুলো সোনা ও রুপার তৈরি হওয়ায় শব্দও বাজছে। এরপর দুধ-সাদা ষাঁড়ের দল টেনে নিয়ে চলেছে কাঠের গাড়িতে থাকা বিশাল ব্রোঞ্জের কামান। ষাঁড়ের শিঙে এর মাথায় সবুজ আর সোনালি ডোরাকাটা দাগ। এদের পেছেন এগোচ্ছে পদাতিক বাহিনীর বিশটি সারি, একেবারে পাশাপাশি অবস্থায় অনুসরণ করছে বিশাল রসদের সারি। রসদবাহী হাতিগুলোর পায়ের বদৌলতে মনে হচ্ছে ধুলার সাগরে জাহাজ চলেছে। এদের পেছনেই আছে উট, গরুর গাড়ির দল।
সময় হয়ে গিয়েছে সম্রাটের হাতি অগ্রসর হবার। দুর্গের চওড়া বহির্ঘার দিয়ে যখন তিনি বের হচ্ছেন, পেশীবহুল বাজনাবাদকেরা সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিল ঢাকের তালে তালে যে, মোগল সম্রাট যুদ্ধে চলেছেন। প্রদর্শনের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করো না, বিশেষ করে শক্তি প্রদর্শনকে। হাসি দিয়ে আকবর বলেছিলেন একদা শাহজাহানকে। তরুণ বয়সে এই ধাঁধা দ্বিধায় ফেলে দিত তাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে ঠিকই বুঝতে পারেন এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। জনগণের সামনে নিজের এবং তাঁর সাম্রাজ্যের ভাবমূর্তি যেন এতটুকু ক্ষুণ্ণ না হয়, শিখে ফেলেন শাহজাহান। অভিযান অথবা দরবার রাজকার্য পরিচালনা উভয় ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। আর এই কারণেই স্থাপত্যবিদদের আদেশ দিয়েছেন যেন তাঁদের অনুপস্থিতিতে আগ্রা দুর্গের সংস্কার কাজ করা হয়, বর্তমান বালি পাথরের প্রাসাদে লাগান হবে সাদা মার্বেলের আচ্ছাদন। রক্তলাল বালি পাথর ধারণ করে আছে তাঁর সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির নিদর্শন, অন্যদিকে সাদা মার্বেল ঘোষণা করবে সমৃদ্ধি আর প্রাচুর্যকে।
রত্নকারেরা ও ব্যস্ত হয়ে পড়বে। জমকালো তক্ত-ই-তাউস, ময়ূর সিংহাসন নির্মাণের কাজে। ঠিক যেমন সিংহাসনে বসে এক সময় ন্যায়ের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন মহান বাদশাহ সোলেমান। এ উদ্দেশ্যে দুই হাজার পাউন্ড বিশুদ্ধ স্বর্ণ বরাদ্দের পাশাপাশি শাহজাহান নিজে আগ্রা রাজকোষ থেকে পছন্দ করে দিয়েছেন অনিন্দ্য সুন্দর সব রত্ন পাথর। এগুলোর উজ্জ্বল আভাতে প্রায় প্রচণ্ড দেহ সুখের অনুভূতি অনুভব করেছেন তিনি। নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন যে অভিযান সফল হবেই। আর তাহলে গোলকুণ্ডার খনি থেকে তাজা হীরের যোগান নিয়ে ফিরবেন তিনি। রত্নপাথরের মাঝে হীরের প্রাচুর্যই বেশি একমাত্র গোলকুণ্ডাতে। এ ছাড়াও তিনি ভেবে রেখেছেন–কয়েকটি হীরে বসিয়ে দেবেন সিংহাসনের আসনে ওঠার সিঁড়ি তিনটিতে। আর তাহলেই যতবার তিনি সিংহাসনে আরোহণ করবেন শত্রু ততবারই পদানত হবে।
প্রস্থানরত সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে অভিবাদনের উদ্দেশ্যে আরো একবার তলোয়ার উঠিয়ে বারান্দা থেকে নেমে এলেন শাহজাহান। মমতাজের কাছে যেতে হবে। হারেমের আঙিনাতে পৌঁছে দেখতে পান স্বর্ণমণ্ডিত ও পর্দাঘেরা শিবিকা আর এটি বহনকারী আটজন নপুংসকও প্রস্তুত। কিছুক্ষণ পরে মমতাজ নিজে এসে হাজির হন। সাথে আসে পনের বছর বয়সী জাহানারা আর বারো বছর বয়সী রোশনারা।
আমি খুশি হয়েছি যে তুমি শিবিকা ব্যবহারে একমত হয়েছে– তোমার এই অবস্থায় হাতির পিঠে চড়ে ভ্রমণ নিরাপদ নয়।
আপনার পরামর্শ আমি খুব কমই প্রত্যাখ্যান করেছি।
আরেকটা কথা। এই মুহূর্তে এটাই ভালো হবে যে তুমি আর হারেমের দলবল ভিন্ন একটি পথ দিয়ে যাবে, যেন প্রধান সারির সৃষ্ট ধুলায় সমস্যা না হয়। আমি খোঁজাদের আদেশ দিয়েছি যেন তোমার শিবিকার পাশে হেঁটে ময়ূর পাখনা দিয়ে বাতাস করে আর অন্যরা সামনের রাস্তায় গোলাপ পানি ছিটিয়ে দেবে। তোমার নিরাপত্তাও অটুট থাকবে। আমার রাজপুত অশ্বারোহী বাহিনীর পাঁচশ জন শ্রেষ্ঠ সৈন্য এ দায়িত্ব পালন করবে।
আপনি আমাকে নিয়ে একটু বেশিই উদ্বিগ্ন থাকেন।
কারণ আমি জানি, আমাদের সামনে দীর্ঘ আর কঠিন একটি ভ্রমণ আসছে।
আমি নিজেই এটি নির্বাচন করেছি। আপনি যতটা ভাবছেন আমি তার চেয়েও শক্ত। আগেও এর প্রমাণ পেয়েছেন আপনি। অন্তত প্রতিটি দিনের ভ্রমণ শেষে আপনাকে মুবারক মঞ্জিল স্বাগতম জানাতে পারব আমি।
*
আমার মনে হয় আমাদের আরো দ্রুত এগোনো উচিত–যতদিন যাচ্ছে শত্রুকে তার অবস্থান সুসংহত করার সুযোগ দিচ্ছি আমরা। মালিক আলীর লম্বাটে চেহারা একাগ্রতা ফুঠে উঠল। এরকম অঞ্চলে আমরা সহজেই অন্তত পাঁচ…এমনকি দশ মাইলও পার হতে পারি একদিনে।
কিন্তু কেন? চর মারফত আজ সকালে জানতে পেরেছি যে, জাকির আবাস সফলতার সাথে আমাদের বাহিনীকে বোরহানপুরে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, ক্ষত-ক্ষতির পরিমাণ যতটা আশংকা করেছিলাম ততটা হয়নি। কোন না কোন কারণে বিজাপুর আর গলকোণ্ডার বাহিনী আমাদের সৈন্যদের তেমন একটা লুট বা ধ্বংস করেনি। নিজের যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সদস্যদের উপর চোখ বোলালেন শাহজাহান। অর্ধ-চন্দ্রকারে ম্রাটকে ঘিরে চাঁদোয়ার মত তাঁবুর নিচে বসে আছে সকলে।
কেন তারা তাদের সুযোগের সদ্বব্যবহার করেনি? আমার মনে হয় এক্ষেত্রে কোন কৌশল বা ষড়যন্ত্র আছে। বলে উঠল সাদিক বেগ, বেলুচিস্তানের পর্বত থেকে আগত ধূসর দাড়িওয়ালা সেনাপ্রধান। কথা বলতে বলতে সামনে রাখা পিতলের থালা থেকে তুলে নিল মুঠো ভর্তি আমন্ড বাদাম, তৃপ্তি ভরে চিবোতে লাগল।
চওড়া কাঁধ নেড়ে শ্রাগ করে উঠলেন শাহজাহান। বলা কঠিন যে এ জাতীয় কোন চিন্তা আছে নাকি তাদের মাথায়। হতে পারে নিজেদের সফলতা দেখে আমাদের মতই বিস্মিত হয়ে গেছে তারা। তাই পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে তর্কে মেতেছে। বিজাপুর আর গোলকুন্ডা প্রতিবেশী হিসেবে কখনোই ভালো ছিল না। আমাদের প্রতি তাদের যে হিংসা আর ঘৃণার মনোভাব, পরস্পরের বিরুদ্ধেও তাই। কিন্তু আরো কিছু সংবাদ আছে…মনে হচ্ছে এই আক্রমণ আমাদের দক্ষিণ সীমান্তের একটি বা দুটি প্রজা রাষ্ট্রকে উসকে দিয়েছে নিজেদের স্বাধীনতা আদায়ের জন্য। মাভুতে আমার প্রাদেশিক শাসকেরা প্রতিবেদন পাঠিয়েছে যে মীরাপুর প্রদেশে স্থানীয় রাজা তিনজন মোগল কর-সংগ্রাহককে বটগাছের সাথে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে আর শকুনদের খাদ্য হবার জন্য মৃতদেহগুলো সেভাবেই রেখে দিয়ে আমাদের শত্রুর সাথে হাত মিলিয়েছে।
এই ধরনের একটা সংবাদই তো যথেষ্ট আমাদের যত দ্রুত সম্ভব ছোটার জন্য। আবারো নিজের মতের উপর জোরারোপ করল মালিক আলী।
তাঁর ঘোড়াদের রাজা ছোট্ট একটা কুকুরের মত আচরণ করছে, একটা ইঁদুরকেও ছাড়তে নারাজ, ভাবলেন শাহজাহান।
এ জাতীয় কয়েকটা আন্দোলন প্রায় অপ্রতিরোধ্য। যতক্ষণ পর্যন্ত এরা সংখ্যায় নগণ্য আর কার্যকরণেও ততটা আগ্রগামী নয়। আমাদের বর্তমান বাহিনীই যথেষ্ট তাদেরকে দমনের জন্য। আর বোকা ষড়যন্ত্রকারীদেরকেও তাদের যথোচিত শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু মীরাপুরের রাজার আচরণ একটু বিশেষ। নিজের বয়সের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। প্রায়, আর এ কথা শোনা যায় যে শাসনকাজ দেখা-শোনা করে তার তরুণী স্ত্রী–বিজাপুর রাজ পরিবারের সদস্য। স্ত্রীর সার্বক্ষণিক জোরাজুরিতে রাজা বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে। যদি আমাদের সত্যিকারের কোন কারণ থাকে তাহলে আমরা অবশ্যই চলার গতি দ্রুত করব অথবা দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশে অগ্রগামী সৈন্যদল পাঠিয়ে দেবো। এখন পর্যন্ত আমি যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়েও দ্রুত এগোতে পেরেছি আমরা। এর চেয়ে দ্রুত ছুটলে আমাদের সৈন্যরা শুধু ক্লান্তই হবে। পশুদেরও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন, তাহলেই শত্রুর উপর আক্রমণ ফলপ্রসূ হবে। তাই শত্রুকে দ্রুত পরাজিত করতে আমিও আগ্রহী; কিন্তু গতি বাড়ালে তেমন একটা সুবিধা পাব না।
মাথা নাড়ল সাদিক বেগ। হ্যাঁ অপেক্ষা করুক আমাদের শত্রুরা…ঘেমে নেয়ে উঠুক। গোলকুত্তা আর বিজাপুরের শাসকেরা নিজেদের নির্বুদ্ধিতার অনুশীলন করুক। একে অন্যের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ক যে কে যাবে সবার সামনে, অভিযানে কার তাঁবুতে গর্ব ঝরে পড়বে।
*
নিজের আসনে বসে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে তাকালেন শাহজাহান। দিগন্তের কাছে ঝুলে আছে ভারী ধুলার পর্দা। এর মাঝে দিয়ে দেখা যাচ্ছে সৈন্যদের লম্বা-চওড়া মাথার বর্শা। পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে অসংখ্য মানুষ আর প্রাণীর পদভারে। পুরো সারি থেকে ভেসে আসছে বাদক দলের তালে তালে বাজনার শব্দ। এর মাধ্যমে সৈন্যবাহিনী নিজেদের চলার গতি সুশৃঙ্খল রাখে। তার কর্মচারীরা প্রতিদিনের যাত্রাপথের হিসাব রাখে গিঁট বাঁধা দড়ির মাধ্যমে, এরপর সন্ধ্যা বেলা জানানো হয় ম্রাটকে। ষষ্ঠ সপ্তাহ পরে উজ্জয়নী শহরের দিকে অগ্রসর হল পুরোদল। বোরহানপুরের পথে দুই-তৃতীয়াংশ রাস্তা শেষ হয়েছে। আগামীকাল মমতাজের জন্মদিন। মনে মনে এ আনন্দ উদযাপনের জন্য সমস্ত পরিকল্পনা আবারো ভেবে দেখলেন শাহজাহান। সব কিছুই হতে হবে একেবারে নির্ভুল…।
হঠাৎ করে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসা ঘোড়ার খুরের শব্দ পাওয়া গেল। ডানদিকে দেখা গেল এগিয়ে আসছে একজন একাকী ঘোড়সওয়ার। সাথে সাথে দেহরক্ষীরা সম্রাটের হাতির চারপাশে নিজেদের জায়গা মত দাঁড়িয়ে গেল। হাতে উদ্যত তলোয়ার। কিন্তু ঘোড়সওয়ার এগিয়ে আসতেই শাহজাহান চিনতে পারলেন ঈগলের মত নাক বিশিষ্ট তার দূতদের মধ্যে অন্যতম প্রধান একজনকে–একজন তরুণ রাজপুত। রায় সিং। হাত নেড়ে নিজের প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন যেন তরুণকে এগিয়ে আসতে দেয়া হয়। ঘোড়া থেকে নেমে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়াল রায় সিং।
কী হয়েছে? কথা বলো!
জরুরি সংবাদ, জাহাপনা। চম্বল নদীর উপর নৌকা আর কাঠ দিয়ে আমাদের বানানো সেতু ভেঙে পড়েছে প্রথম কামান আর রসদবাহী গাড়ি পার করার সময়। আমাদের কয়েকজন লোক ডুবে গেছে। এছাড়া দুটো কামান আর এগুলোর সঁড়ের দলও হারিয়ে গেছে।
নিশ্চয়ই সেতু নির্মাণে ত্রুটি ছিল। কে ছিল এর দায়িত্বে?
সুলাইমান খান। কিন্তু জাহাপনা, তিনি বলেছেন সেতু নির্মাণে কোন ত্রুটি হয়নি। তিনি বিশ্বাস করেন যে নিশ্চয়ই কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে সেতুর দড়ি কেটে দিয়েছে। তাই আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আপনাকে জানাই।
সরষের মাঝে ভূত? যদি তাই হয় তাহলে এটাই প্রথম নয়, ভাবলেন শাহজাহান। দুই সপ্তাহ আগে কেউ একজন প্রাণীদের খোয়াড়ে ঢুকে হত্যা করেছে কয়েকটা গাভীকে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একেবারে মৃত্যুর আগমুহূর্ত ধরা পড়েছে অসহায় জন্তুগুলো। তাই আর কোন উপায় ছিল, মেরে ফেলতে হয়েছে অবোধ পশুগুলোকে। এই ক্ষেত্রে যদিও তিনি কোন স্থানীয় চোরকে দায়ী করেছেন; কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে শত্রুপক্ষ উত্তরে লোক পাঠিয়েছে সেনাবাহিনীর গতিরোধ করতে। আমার ঘোড়া নিয়ে এসো। আদেশ দিলেন শাহজাহান।
দশ মিনিট পরে শাহজাহান রায় সিংয়ের পাশে ঘোড়া ছুটালেন চম্বল নদীর উদ্দেশে। নদীর উত্তর তীরে বালিয়াড়ীর কাছে পৌঁছাতেই দেখতে পেলেন উড়ে গেল একজোড়া বক পাখি, তপ্ত নীলাকাশে দেখা যাচ্ছে ওগুলোর পাতলা, সরু পা। মনোযোগ দিলেন নিচে, নদীর দিকে। সৈন্যরা দ্রুত বহমান সবুজ পানিতে কাঠের দঙ্গলের সাথে যুদ্ধ করছে, চেষ্টা করছে নৌকাগুলো থেকে রসদ আর যন্ত্রপাতি উদ্ধার করতে যেন ক্ষয়-ক্ষতি আর না হয় সেতুটির। কয়েকটা নৌকা স্রোতের টানে নিচের দিকে ভেসে চলেছে, আরেকটু হলেই গাঢ় আর থকথকে আবর্জনার ভিড়ে হারিয়ে যাবে। তাকাতেই দেখতে পেলেন দুজন সৈন্য মিলে পিচ্ছিল নদী তীরে টেনে আনছে এক সহযোদ্ধাকে। লোকটার চেহারায় ফুঠে উঠেছে। স্পষ্ট যন্ত্রণা, রক্তমাখা হাত একেবারে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। অন্য আরো দুজন কাঠ দিয়ে তৈরি স্ট্রেচার বহন করে আনছে নদী তীরে। এর উপরে শুয়ে থাকা দেহটার হাত ঝুলছে পাশে। এর বেশ খানিকটা দূরে নদী তীরে দেখা গেল মৃতদেহের স্তূপ। কোনমতে ঢেকে রাখা তুলার কম্বলের নিচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে এলোমলো পা।
সুলাইমান খানকে এখনি পাঠাও আমার কাছে। রায় সিংকে বলে উঠলেন শাহজাহান, নিজে ঘোড়র গায়ে লাথি দিয়ে নদীর ঢালু তীরে নেমে গেল রায় সিং। অপেক্ষা করতে করতে চারপাশে তাকিয়ে ধ্বংসের পরিমাণ জরিপ করে দেখলেন সম্রাট। নৌকা-সেতুর অর্ধেকেরও বেশি অংশ নদীর মাঝ বরাবার থেকে একটু দূরে সরে গেলেও এখনো অক্ষত আছে। কিন্তু অবশিষ্ট অংশ একেবারে ভেঙে গেছে, শুধুমাত্র তিনটা অথবা চারটা কাঠের খুঁটি, যা নৌকাগুলোকে আটকে রেখেছিল, কোনমতে টিকে আছে। কামানের লম্বা ব্যারেল দেখা যাচ্ছে পানির উপরে আর পাশেই ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা একটা ষাঁড়ের মৃতদেহ, এখনো বাধা অস্ত্রের গাড়ির সাথে। পানির কিনারে মৃত আরো দুটো পশুর দেহ দেখা গেল। এই ধরনের হীন কাজ কী কেউ সত্যিই ইচ্ছেকৃতভাবে করেছে তার গতি থামিয়ে সৈন্যদেরকে বিপদে ফেলতে, নাকি এটা নিছক দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই ফল? নিশ্চিত হতে পারলেন না যে কোনটি বেশি দুশ্চিন্তার।
ক্রোধ আর হতাশায় ছেয়ে গেল তাঁর মন, দেখলেন বালিয়াড়ী বেয়ে অনেক কষ্ট করে এগিয়ে আসছে সুলাইমান খান শক্তিশালী এক পুরুষ-ঘামে ভিজে গেছে পরনের পোশাক।
জাহাপনা, মাথা নত করে কুর্নিশ করল সুলাইমান খান।
সত্যি কথা বল। দায়িত্বে অবহেলা করেছিলে?
কখনোই না, জাহাপনা। এই ঠিকঠাকভাবে আর মজবুত করে তৈরি করা হয়েছিল–আমি আমার জীবনের নামে শপথ করে বলছি। ভালো কাঠ আর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দড়ি ব্যবহার করেছি আমরা। গত রাতেই কাজ শেষ করেছিলাম। আর এর শক্তি পরীক্ষা করতে আমি নিজে একটা ভারী গাড়ি চালিয়ে নিয়ে দেখেছি। সেতুটা ভেঙে পড়েছে কারণ কেউ এখানে দুর্নীতি করেছে। দেখুন জাহাপনা…
বুকের কাছে ঝুলতে থাকা পাটের ব্যাগ থেকে দুই মিটার দড়ি বের করে দেখালো সুলাইমান খান। এই ধরনের ছোট ছোট বন্ধনী দিয়ে নদী তীরে সেতু নির্মাণ করেছি আমরা। দেখুন প্রান্তটা কীভাবে কাটা হয়েছে– এগুলো কোন ধরনের ঘষা খেয়ে ক্ষয় হয়নি। এ রকম কাটা দড়ি আমরা আরো পেয়েছি। যদি বড় বড় গিঁটগুলো পরীক্ষা করি, তাহলে নিশ্চিত একটা ফলাফল পাওয়া যাবে।
আমাকে দেখতে দাও, দড়ির প্রান্ত পরীক্ষা করে ফিরিয়ে দিলেন শাহজাহান। ঠিক বলেছো তুমি। এটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে। গত রাতে প্রহরীরা কিছু দেখতে পেয়েছিল?
না, জাহাপনা।
প্রহরীর সংখ্যা বাড়াও আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেতু মেরামত করে ফেলল। আমি পার্শ্ববর্তী গ্রামে পুরস্কার ঘোষণা করে সৈন্য পাঠাচ্ছি যেন বিশ্বাসঘাতকের খোঁজ পাওয়া যায়।
প্রধান সারির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে যাবার সময় পুরো ঘটনাটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন শাহজাহান। বিদ্রোহী আর আক্রমণকারীরা নতুন ধরনের কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করছে। সেনাবাহিনী যতই দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছে, ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। তাই তিনি নিজে কঠোর হবার পাশাপাশি তার সৈন্যদের শক্তিও নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রাপথে ঘোড়সওয়ারদের যথেষ্ট অস্ত্রে সুসজ্জিত করতে হবে। কিন্তু শিবির ঠিক কতটা ঝুঁকিতে আছে? রাজকীয় তাঁবুগুলো যথেষ্ট নিরাপদ। এরপর ভাবনা ঘুরে গেল মমতাজের দিকে। প্রতিদিনের ভ্রমণ শেষে মমতাজ আর কন্যাদেরকে চারপাশে ঘেরা কাঠের বেষ্টনীতে নিয়ে যাওয়া হয়। দেয়াল বেশ মোটা, লোহা দিয়ে বাঁধা ও কাঠ দিয়ে তৈরি, চারপাশে বেগুনি কাপড় দিয়ে ঘেরা আর চামড়ার বন্ধনি দিয়ে বাঁধা।
কিন্তু বাকি বিশাল তাঁবুর অংশ? বায়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি আর সভাসদদের তাঁবুগুলোও থাকে রাজকীয় তাবুর পাশপাশি। এরপরে সারিবদ্ধভাবে থাকে অন্যান্য সৈন্য–আর শাহজাহানের সৈন্যের তাঁবু, এছাড়াও আছে সীমাহীন দড়ির ঘেরাও, যার মাঝে রাখা হয় পশুর পাল। কিন্তু এর পরের পৃথিবী তো একেবারে বিশৃঙ্খল। আরো হাজারো তাঁবুবাসী যেগুলো সবসময় থাকে একটা সৈন্যবাহিনীর পিছনে। ব্যববসায়ী আর ঘোড়ার বণিক, নাচুনে দল আর শিল্পীরা, দড়িবাজ, জাদুকর, দেহপসারিনী–সকলেই আসে জীবিকার খোঁজে। এই দঙ্গলে শত্রুর আগমন ঠেকানো দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু চেষ্টা তো করতেই হবে। তাঁবুর প্রহরায় থাকা সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি চৌকি বসিয়ে সন্দেহজনক ব্যক্তির তল্লাশির ব্যবস্থাও করতে হবে।
*
প্রথম হাউইটা আকাশে উড়ে যেতেই সোনালি তারার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রাতের আকাশ। চকচকে একটা পর্দা মতন তৈরি হয়ে ঝরে পড়তে লাগল রুপালি বৃষ্টির মত। চাইনিজ বাজি নির্মাতারা হতাশ করেনি, ভাবলেন শাহজাহান। এই ধরনের একটি প্রদর্শনী কেবল একজন সম্রাজ্ঞীর জন্মদিনেই মানায়। হারেমের তাঁবুতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মমতাজ বিস্ময়ে থ হয়ে গেলেন বহু উপরে বিশাল ময়ূয়ের স্যাপায়ার আর এমেরান্ডের লেজ দেখে। পত্নীর খুশি দেখে সেতু নিয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ভাবনা অনেকটাই হালকা হয়ে গেল। এছাড়াও সংবাদ পেয়েছেন যে আগামীকালই সেতু মেরামতের কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে আর নিজের যাত্রা আবারো শুরু করতে পারবেন তিনি পুরো ছত্রিশ ঘণ্টা বিলম্ব শেষে।
তাঁবুর আগুন থেকে ভেসে এলো মুখরোচক সুভাস। অন্ধকার চিরে দিল কমলা আগুনের রশ্মি। শাহজাহান আদেশ দিয়েছেন যেন হাজারে হাজারে ভেড়া ক্রয় করে সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়; যেন তারা ভোজ উদ্যাপন করতে পারে। অন্যদিকে ভোরের কুয়াশা কাটার আগে থেকেই কাজে নেমে পড়েছে রাজকীয় বঁধুনী। পাখির মাংস জোগাড় করা, মসলা পেষা, বাছাই করা, অ্যাপ্রিকট, চেরী আর কিশমিশ, সাথে আছে আমন্ড আর ওয়ালনাট মিশিয়ে সুগন্ধযুক্ত মাখন, ঘি আর পেতার সস্ তৈরি করা। বয়স্ক আর খোঁড়া রাজকীয় গৃহভৃত্য আসলাম বেগ লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে ঘুরে তদারক করছে সমস্ত প্রস্তুতির। ভর্ৎসনা করছে রাধুনীদের। এছাড়া নির্ভেজাল সোনা আর রুপার থালা বের করে রাজকীয় টেবিলে পরিবেশনের পূর্বে প্রতিটি পদ পরীক্ষা করে ঢেকে দেয়ার দায়িত্বও তার।
শাহজাহান আশা করছেন খাদ্যের প্রতি সুবিচার করবেন মমতাজ। যদিও মমতাজ মানতে চাননা, কিন্তু তিনি টের পেয়েছেন যে মমতাজের খাদ্যশৃহা–যদিও কখনোই খুব বেশি ছিল না–একেবারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। চেহারা প্রায়ই যন্ত্রণাকাতর দেখায়, চোখের নিচেও ক্লান্তির ছায়া। কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই পাহাড়ে চড়বেন তারা, ঠাণ্ডা নির্মল বাতাসে হয়ত অবস্থার উন্নতি হবে।
সর্বশেষ আতশবাজিটা স্বর্গের উদ্দেশে রওনা দেবার পর শাহজাহান শুনতে পেলেন মমতাজের মৃদু ভর্ৎসনা, কী ভাবছেন আপনি? বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে?
তাই নাকি? কিছু না তো!
সত্যি? আমি শুনেছি একটু আগে সন্ধ্যায় নাকি আপনার কাছে সংবাদবাহক এসেছিল? কে সেতুর ক্ষতি করেছে সে ব্যাপারে কিছু জানা গেছে?
এতটুকুই জানা গেছে যে, কয়েকদিন আগে তিনজন ঘোড়সওয়ারকে চম্বল নদীর আশেপাশে দেখা গেছে কথার টানে মনে হয়েছে দক্ষিণী। আমাদের গতিবিধি, কোথায় সেতু নির্মাণ করতে চাই সে সম্পর্কে খোঁজ খবর করছিল। তাদের খোঁজে লোক পাঠিয়েছি আমি। যদিও জানি যে অনেক আগেই সরে গেছে তারা।
আপনার কী মনে হয় লোকগুলো গোলকুণ্ডা আর বিজাপুর থেকে এসেছিল?
হুম, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
বেশি উদ্বিগ্ন হবেন না। আমি জানি যে বিলম্ব হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন কিন্তু শীঘ্রিই তো আমরা বোরহানপুরে পৌঁছে যাব। অপেক্ষার পালা শেষ হবে আর রণক্ষেত্রে শত্রুর মোকাবেলা করতে পারবেন আপনি। আমি জানি এ ব্যাপারে কতটা উৎসুক হয়ে আছেন।
ঠিক বলেছো। আমি এই অভিযান দ্রুত শেষ করতে চাই। বর্তমান সীমান্ত প্রতিরক্ষার চেয়ে বরঞ্চ ভূ-খণ্ড আরো বাড়াতে চাই আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় পূর্বপুরুষ বাবরের ভূ-খণ্ড পূর্ণ দখল করে নেবো…এমনকি সানালি সমরকন্দও দখল করার ভাবনা আসে মনে…।
এ উচ্চাশা পূরণের সময়ও আসবে। কিন্তু প্রতিবারে একটি পদক্ষেপে। আমাদের শত্রুরা যথেষ্ট শক্তিশালী। কোন কিছুকেই চিরস্থায়ী হসেবে ভাববেন না।
*
সামনের খুঁড়ের নিচে শুকনো ঘাসের খোঁচা খাওয়ায় পথ থেকে সরে একপাশে নাড়া খেলো শাহজাহানের ঘোড়া। অপ্রস্তুত অবস্থায় গভীর চিন্তামগ্ন আচ্ছন্ন ম্রাট ঝাঁকুনি খেলেন। গতকাল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে আসিরগাঁ দুর্গে। লাল বালি-পাথর দিয়ে তৈরি এই দুর্গে তিনি এবং মমতাজ পার করেছেন পরবাসের বহু বিদ্রি আর উদ্বিগ্ন মাস। এখানে থাকতেই খবর পেয়েছিলেন যে, পিতা তাঁকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করেছেন। মাথার মূল্য ধার্য করে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছেন খুঁজে বের করতে। আসলাম বেগ যদিও বলছিল যে, রাজকীয় পরিবারবর্গ নিয়ে আসিরগাঁ দুর্গে রাত কাটাতে, শাহজাহান বরাবরের মত শিবিরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর আজ রাতে অন্তত বোরহানপুরে পৌঁছাতেই হবে। অভিযানের বাকি পরিকল্পনা করা সহ মমতাজের বিশ্রামেরও সুবন্দোবস্ত হবে।
পত্মীর চিন্তা মাথায় আসতেই ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে পিছনে ছুটলেন হারেম দলের দিকে। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে প্রধান সারির সাথেই ছুটছে এখন তারা, কেননা শত্ৰুভূমি ক্রমশ কাছে চলে আসছে। আট নপুংসকের কাঁধে চড়ে একাকী একটি পালকিতে ভ্রমণ করছেন মমতাজ। পর্দার মাঝে সোনালি কারুকাজ করা ফোকর দিয়ে শাহজাহানকে দেখতে পেয়ে অভিবাদন জানালেন মমতাজ।
আজ আমাদের চলার গতি বেশ ভালো হয়েছে সূর্য ডোবার মাঝেই বোরহানপুরে পৌঁছ যাব। শিবিকা বাহকদের সাথে একইতালে চলতে লাগলেন শাহজাহান।
ভালোই হল। আমিও খেয়াল করেছি সবকিছু বেশ উত্তপ্ত আর শুষ্ক দেখাচ্ছে।
গত বছর অনাবৃষ্টি হয়েছে…সবাই বলছে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। বোরহানপুরে গেলে সব জানা যাবে।
শাহজাহান…
কী?
এখানে ফিরে আসাটা কী অদ্ভুত মনে হচ্ছে? গত কয়েকদিনে কেন যেন আমার বারেবারে মনে পড়ছিল। সবকিছু-ধুলার গন্ধ, ডুবে যাওয়ার আগে লাল সূর্যটাকে দেখে যেন মনে হয় বিস্ফোরণের জন্য তৈরি। এই পাহাড়ের সারির চুম্বক সৌন্দর্য স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। প্রথমবার যখন এখানে এসেছি, একেবারে তরুণ ছিলাম আমরা আর জীবনটাও ছিল সাদাসিধে। ভেবে মন খারাপ হয় যে সময় কত দ্রুত চলে যায়।
আমরা এখনো তরুণ।
আপনি নিশ্চিত?
চলতে চলতে মমতাজের কথা গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন শাহজাহান। অতীত–ভালো-মন্দ মিলিয়েই–ভয়ংকর জায়গা, রোমন্থন না করাটাই অধিক শ্রেয়। গতরাতে, মমতাজ পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন অবস্থায় মোমবাতির আলোয় শাহজাহান আবারো পড়লেন আকবরের জীবনীকার রচয়িতার লেখা :
তারা জানলো যে বোরহানপুরের একটা কুখ্যাতি আছে। অভিশপ্ত আর অন্ধকারচ্ছিন্ন এই জায়গায় কোন মানুষ উন্নতি করতে পারে না। কিন্তু এই কুসংস্কার শুনে হাসলেন তিনি আর মোগলদের জন্য দখল করে নিলেন। জানালেন এ স্থান তিনি বিজয় আর সমৃদ্ধির নিশান উড়াবেন…আর করলেনও তাই।
শাহজাহান সবসময় এই কথাগুলো ভেবে সন্তুষ্টি লাভ করেন যে আকবরের সময় হতেই বোরহানপুর বস্তুত মোগল বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে কাজ করেছে। তরুণ শাহজাদা হিসেবে যে তিনি নিজেও এই জায়গা থেকেই সামরিক বিজয়ের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। আর পরবর্তীতেও তাই করতে চান। তবে এবার যুদ্ধের পরিবর্তে দেখলেন ভিন্ন কিছু অন্ধপ্রায় খসরু অসহায়ের মত শুয়ে আছে বোরহানপুরের পাতাল ঘরে আস্তে করে খুলে গেল দরজা। জীবনের সেই মুহূর্তগুলোতে কী ভাবনা বইছিল তার মনে? ভাবতে কেমন লাগে যে তুমি মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছো আর জানো যে এমনটা ঘটতে যাচ্ছে তোমার আপন ভাইর নির্দেশে? জোর করে এহেন চিন্তা একপাশে সরিয়ে দিলেন শাহজাহান। নিজেকে বোঝালেন এসব দুর্বলতাকে প্রশয় না দিতে। বিশেষত যখন সবকিছু তারই যা তিনি চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কেমন যেন অস্বস্তি হল। বোরহানপুরে আসাটা কী ভুল হয়েছে? চাইলে অন্য যে কোন জায়গায় নিজের দরবার বসাতে পারতেন হতে পারে মান্ডুতে…
আবারো মমতাজের শিবিকার কাছে এলেন শাহজাহান, চারপাশে বেগুনি সূর্যাস্তের আলো। প্রবেশ করলেন বোরহানপুরের প্রাচীন প্রবেশ দ্বার দিয়ে ভেতরে, দুপাশে দুটি পাথরে নির্মিত যুদ্ধহাতি যুদ্ধ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে, যদিও ধুলিঝড় আর বর্ষার বৃষ্টিতে আকৃতি অনেকটাই বিকৃত হয়ে গেছে। হারামের ভেতরের আঙিনাতে পৌঁছে অসংখ্য ঝরনার কাছে গিয়ে থামলেন শাহজাহান। পর্দা সরিয়ে তুলে নিলেন ঘুমন্ত মমতাজকে আর ধীরে ধীরে নিয়ে গেলেন ভেতরে।
.
১.৩
শাহজাহানের মাথার পাশ দিয়ে শিস কেটে চলে গেল বন্দুকের গুলি। নিজের যুদ্ধহাতির পিঠে বসে ঘুরে তাকালেন তিনি। উত্তপ্ত সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচাতে হাত তুলে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলেন হঠাৎ শুরু হওয়া যুদ্ধদৃশ্য। একটু পরেই আরেকটা গুলি এসে লাগল হাতির কানের পিছনে বসে থাকা মাহুতের গলায়। আস্তে করে পাশ ফিরে পড়ে গেল লোকটা। রক্ত ছুটছে ফিনকি দিয়ে ক্ষত থেকে, পাথুরে ভূমিতে গিয়ে শায়িত হল মাহুত। শুড় তুলতেই গতি কমে গেল হাতির, ভয় পেয়ে মাথা নাড়তে শুরু করল এপাশ-ওপাশ।
নিজের হাওদার পার্শ্বদেশ ধরে স্থির হতে চেষ্টা করলেন শাহজাহান। দ্বিতীয় মাহুত দ্রুত উঠে এসে কথা বলতে লাগল হাতির ডান কানে। শান্ত হও, শান্ত হও এরপর কাঁধের উপর বাড়ি মারল লোহার রড দিয়ে। নিশ্চিন্ত হয়ে লাল বর্ণের শুড় নিচে নামিয়ে আনল হাতি।
চারপাশে পুরো যুদ্ধসারি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। গুলি বহনকারীরা নিজেদের ঘোড়া থেকে নেমে ব্যারেলে বারুদ ঢুকিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিল। একটু দূরে শাহজাহানের হাতির সামনে একজন নিম্নপদস্থ সৈন্য সবুজ টিউনিক পরনে চিৎকার করে নিজের ছোট্ট পদাতিক বাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছে শৃঙ্খলিত হবার জন্য। আরো একবার গোলার গর্জন শুনতে পেলেন শাহজাহান। আর ভেঙেচুরে পড়ে গেল দুজন পদাতিক সৈন্য। একজন মুহূর্তের মাঝে স্থির হয়ে গেল। অন্যজন এলোমেলোভাবে শুয়ে পা নাড়তে লাগল। তার একজন সঙ্গী, বয়স্ক দাড়িওয়ালা সৈন্য সাহায্য করতে এগিয়ে আসার পর নিজেও গুলি খেলো। পড়ে গেল সঙ্গীর দেহের উপরেই।
চারপাশ জুড়েই শব্দ আর বিশৃঙ্খলা। এখনি তাকে কিছু একটা করতে হবে। নতুবা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে, ভাবলেন শাহজাহান। আর এরকম কিছু করতে হলে হাতি থেকে নেমে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে এগোতে হবে। তাই মাহুত কতক্ষণে হাতিকে হাঁটু গেড়ে বসাবে সেই জন্য অপেক্ষা না করে, রত্নখচিত হাওদার একপাশে গিয়ে মাটিতে নেমে গেলেন। আঘাত ঠেকাতে ভাজ করে নিলেন নিজের হাঁটু। হালকা পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কর্চিকে চিৎকার করে আদেশ দিলেন, আমার ঘোড়া নিয়ে এসো। কিন্তু তার আগেই ধুলা আর গুলির ধোঁয়ার মাঝে উদয় হল একদল ঘোড়সওয়ার, শাহজাহানের সামনের পদাতিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। সবুজ পোশাক পরিহিত সেনাপতির উৎসাহে পদাতিক সৈন্যরা নিজেদের ভূমি ছাড়ল না। সেনাপ্রধানের আদেশে সকলে ভি আকৃতি করে এগোতে লাগল। ঘোড়সওয়ারের দল কাছে এগিয়ে আসতেই সম্ভবত বিশ জনের একটা দল–বাকিদেরকে ফেলে সামনে এগিয়ে এলো ঘামে ভেজা ধূসর যুদ্ধঘোড়র উপর বসে থাকা কৃশকায় দেহের তরুণ। শিরস্ত্রাণবিহীন মাথায় লম্বা চুল উড়ছে পেছন দিকে।
ভি আকৃতির মাথায় থাকা সৈন্য যদিও শক্তভাবেই নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে, তারপরেও কাঁপা কাঁপা হাতে বর্শা ছুঁড়ে মারায় লাগাতে পারল না বিজাপুরের সৈন্যের গায়ে। আক্রমণকারীর ধূসর ঘোড়া সাথে সাথে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। ঘোড়ার খুড়ের নিচে পড়ে ফেটে গেল মাথার খুলি। এ সময় তার পিছনে আর বাম দিকে থাকা সৈন্যরা এগিয়ে এলো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। এরপর সাবধানে হাঁটু গেড়ে থাকা অবস্থায় বর্শা ছুঁড়ে মারল। যেমনটা চেয়েছিল এবার ঠিক সেভাবেই বিধে গেল ঘোড়ার গলায়। সাথে সাথে পড়ে গেল জটা, আরোহী বহু দূরে উড়ে গিয়ে মাথা গেড়ে পড়ল মাটিতে। নিজের রক্ত আর মগজের মাখামাখি চুল নিয়ে পড়ে রইল বিজাপুরের আগম্ভক সৈন্য।
তাঁর নিজের ঘোড়া কোথায় গেল? চারপাশে তাকিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন বাদামি রঙা তৈজী ঘোড়া নিয়ে দৌড়ে আসছে কর্চি। দ্রুত ঘোড়ার পিঠে লাফ দিয়ে উঠেই দেহরক্ষীকে আদেশ দিলেন, আমাকে অনুসরণ করো। তলোয়ার বাগিয়ে ধরে এগিয়ে গেলেন পদাতিক সৈন্যদেরকে ঘিরে ফেলা শত্রু ঘোড়সওয়ারদের দিকে। আক্রমণকারীদের একজন সর্বশক্তি দিয়ে নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ভয় পাইয়ে দিল শাহজাহানের ঘোড়াকে। ফলে খানিকটা পিছনে হেলে গেলেন তিনি। আরেকজন ঘোড়সওয়ার লম্বা বল্লম নিয়ে নিজের কালো ঘোড়াকে ঘুরিয়ে এগিয়ে এল শাহজাহানের দিকে। কাছাকাছি আসতেই বন্যপশুর মত আক্রমণ করল সম্রাটকে। কিন্তু বেঁচে গেলেন শাহজাহান তবে তিনি ভুল করলেন না। নিজের তলোয়ার দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন শত্রুর বাহুতে। নিজের বল্লম ফেলে দিয়ে ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল আক্রমণকারী সৈন্য, একই পথে এগিয়ে আসছিল তার সঙ্গী। উদ্যত ঘোড়াকে থামাতে পারল না সে ও; ফলে পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল দুটি ঘোড়াই, সাথে তাদের আরোহীরা।
তৃতীয় আরেকজন ঘোড়সওয়ার মাথার উপর বন্যভাবে বাঁকানো ভোজালি ঘুরাতে ঘুরাতে এগিয়ে এলো শাহজাহানের দিকে। একেবারে সময় মত সাবধান হয়ে গিয়ে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেন শাহজাহান। প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া করলেন তিনি। তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে গেলেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে নিজের ভোজালি দিয়ে আঘাত প্রতিহত করে দিল তৃতীয় সৈন্য। আবারো চেষ্টা করলেন শাহজাহান। এবার তলোয়ার গিয়ে আঘাত করল সৈন্যটার পেটে। পড়ে গেল লোকটা। এরপর চারপাশে তাকিয়ে সম্রাট দেখতে পেলেন বাকি আক্রমণকারী ঘোড়সওয়াররা ঘুরে গিয়ে ঘোড়া নিয়ে চলে যাচ্ছে–যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই।
যুদ্ধে উন্মাদনায় ধুকপুক করতে থাকা হৃদয়ে, শাহজাহান প্রথমেই ভাবলেন পিছু ধাওয়া করে এই ছোট্ট দলটাকে নিঃশেষ করে দেবেন, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন যে এমন করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না। সেনাপ্রধান হিসেবে এ দায়িত্ব অন্যদের উপর দিলেন। বরঞ্চ প্রধান সারির মাঝখানে গিয়ে দেখা দরকার যে কী অবস্থা, সেখান থেকেই মূলত এর উৎপত্তি।
ধোঁয়া আর ধুলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেলেন নিজের অসংখ্য সৈন্য মাটিতে স্থির হয়ে পড়ে আছে। সাথে আছে বেশ কয়েকটি ঘোড়া আর একটা যুদ্ধহাতির মৃতদেহ। আরেকটা ঘোড়ার বাম পা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও কোনমতে দাঁড়িয়ে কাতর আর্তনাদ করছে। যাই হোক, মাঝ বরাবার যেতেই যুদ্ধের তেমন কোন চিহ্ন দেখতে পেলেন না; এখানে রসদ আর বারুদের গাড়ি রয়েছে।
চারপাশে কালো ধোঁয়ায় ঘন মেঘের মত সৃষ্টি হয়েছে, এর মধ্য দিয়েই কোনমতে শাহজাহান দেখতে পেলেন কয়েকটা ছয় চাকার গরুর গাড়ি ইতস্তত ঘুরছে। প্রথম গাড়িটা টানছিল এমন দুটি গরু আহত হয়ে গিয়েছে। চালকেরা চেষ্টা করছে রশি কেটে মুক্ত করে দিতে, পেছনে চিৎকার করছে অন্য রসদবাহী গরু আর চালকেরা। ঠিক সেই মুহূর্তেই সম্রাট দেখতে পেলেন আগাগোড়া কালো পোশাকে মোড়া ছয়জন ঘোড়সওয়ার এগিয়ে আসছে গরুগাড়িগুলির দিকে। প্রত্যেকের হাতে দুইটি করে ধনুক, সাথে আরো একজনের হাতে ধরা তীরের মাথায় জ্বলন্ত ভেজা ন্যাকড়া। ঠিক এই কৌশলেই হত্যা করা হয়েছে আবদুল আজিজের পিতা আহমেদ আজিজকে।
ধনুকে জ্বলন্ত তীর লাগানোর আগেই কিছু একটা ভাবতে হবে, বুঝতে পারলেন শাহজাহান। ঘোড়র পাদানিতে দাঁড়িয়ে ধনুকে তীর লাগিয়ে তৈরি হয়ে নিল লোকগুলো রসদবাহী গাড়িতে আগুন লাগানোর জন্য। চালকেরা এতক্ষণে প্রথম গরুগাড়ি থেকে আহত গরুকে রশি কেটে মুক্ত করতে পেরেছে। একটা বন্দুকের গুলি গিয়ে আঘাত করল কালো পোশাকধারী ধনুচিদের দিকে, নিজের তীর ছোঁড়ার আগেই পড়ে গেল লোকটা। আর এই কারণে জ্বলন্ত তীর থেকে নিজের কাপড়েই আগুন ধরে গেল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠে, মাটিতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল লোকটা।
এরপর গরম বাতাসের হলকা ধেয়ে এলো শাহজাহানের দিকে। বধির করে দিয়ে প্রায় জিনের উপর থেকেও ফেলে দিচ্ছিল আরেকটু হলে। নিজের ঘোড়াকে থামানোর চেষ্টা করতে করতে ভাবতে লাগলেন কী ঘটেছে। বুঝতে পারলেন যে, নিশ্চয়ই গাড়ি ভর্তি বারুদ ছিল। অন্তত একজন ঘোড়সওয়ারের তেল লাগান ন্যাকড়া গিয়ে ভেতরে থাকা বারুদের বস্তায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। নিজের ঘোড়াকে শান্ত করতে পারলেও বাম গালে তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন। দস্তানা খুলে আঙুল দিয়ে ব্যথার জায়গায় পরীক্ষা করে আবিষ্কার কললেন ছোট্ট কাঠের টুকরো। বালুকণা আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চোখে নিচে তাকিয়ে দেখলেন ঘোড়ার পার্শ্বদেশে আর জিনের গায়েও অসংখ্য স্প্রিন্টার ঢুকেছে। তার মতই সবকিছুর গায়ে লাল রঙের আঠালো কী যেন লেগে রয়েছে–গাভী আর চালাকের মৃতদেহের মাংস। ধুলা একটু কমতেই দেখতে পেলেন বিস্ফোরিত হয়েছে দুটি গাড়ি। চারপাশে ছড়িয়ে আছে মনুষ্য দেহের থেতলানো মাংসপিণ্ড, কোন কোন টুকরার গায়ে এখনো লেগে আছে কাপড়ের অবশিষ্টাংশ, একসাথে দলা পাকিয়ে গেছে গরু আর গাড়ির দেহাবশেষের সাথে পোড়া মাংসের গন্ধের সাথে মিশে গেছে ঝাঁঝালো বারুদের গন্ধ।
একজন সেনাপতিকে উঠে দাঁড়াতে দেখলেন শাহজাহান। দেখতে পেলেন তার ঠোঁট নড়ছে, বুঝতে পারলেন যে লোকটা কিছু একটা বলছে, কিন্তু শুনতে পেলেন না কিছুই। তবে খুব শীঘ্রিই শ্রবণশক্তি ফিরে পেয়ে বুঝতে পারলেন সেনাপতির কথা, তারা পালিয়ে যাচ্ছে জাহাপনা বিস্ফোরণের ফলে আচ্ছন্ন চেতনাতেও শাহজাহান জানেন যে পালিয়ে যাওয়া শব্দটি সঠিক হল না। তিনি তো তাঁর শত্রুদের পরাজিত করতে পারেননি। সফলভাবে তাঁর সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করে কৌশলগতভাবে পিছু হটছে তারা। মোগলরা নয়–তারাই আজকের বিজয়ী।
কিন্তু এভাবে হবার কথা নয়…কেননা সম্ভবনাকে সত্যি প্রমাণিত করে উদ্ধত স্বভাবের গোলকুন্ডা সৈন্যরা বিজাপুরের সৈন্যদেরকে রেখে নিজেদের ভূ-খণ্ডে ফিরে গেছে, যুদ্ধ এখন বিজাপুরকে একাই লড়তে হবে। এতটা তো শাহজাহান কখনো ভাবেননি যখন এক মাস আগে বোরহানপুর থেকে প্রধান সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাপ্তি নদীর তীরে আক্রমণকারীদের দলকে প্রতিহত করার জন্য, যারা দুর্গ সমূহে অতর্কিত বিচ্ছিন্ন হানা দিয়ে হত্যা করেছে তাঁর কসিড, বার্তাবাহক আর কর সংগ্রাহকদেরকে। বস্তুত বেশ কয়েকটি ব্যাপারেই বেশ অবাক হয়েছেন তিনি। যেমন, তাঁর সৈন্যরা বন্দি করতে পেরেছে এমন আক্রমণকারীদের মাঝে আছে স্থানীয় জনগণরাও। জীবনের ভয়ে ভীত হয়ে ষড়যন্ত্রে নিজেদের অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে নানা অজুহাত তৈরি করছে লোকগুলো; কেউ দাবি করছে এই ভীষণ দুর্ভিক্ষে খাদ্যের সংস্থানের জন্য শত্রুপক্ষ যোগ দিয়েছে তারা। অন্যরা অনুনয় করে বলছে যে সম্রাটের বিশাল সেনাবাহিনীর ভরণ-পোষণের জন্যে আরোপিত কর দিতে গিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো।
কিন্তু সম্রাটের হাতে তেমন কোন উপায় ছিল না। যদি তিনি কর না বাড়াতেন তাহলে আক্রমণকারী ঠেকাতে এত বড় একটা সেনাবাহিনী কীভাবে তৈরি করতেন রাজকোষ অক্ষত রেখে? এই অ্যামবুশ বা চোরা আক্রমণ হবার আগপর্যন্ত এই অভিযানের সফলতা নিশ্চিত ছিল। প্রায় প্রতিবারেই তাঁর সেনাবাহিনী শত্রু যোদ্ধাদের সাথে লড়াই করেছে, শত্রুরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এই মাত্র যতটা ক্ষতি হয়ে গেল, এমনটা আর কখনো হয়নি আগে।
এক ঘণ্টা পরে, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে নিজের চারপাশে চক্রাকারে বসে থাকা সেনাপতিদের মুখোমুখি হলেন শাহজাহান। কেমন করে শত্রু আমাদেরকে একেবারে অন্ধকারে রেখে আক্রমণ করতে সফল হল? মধ্যম প্রহরী দলের নেতা আশোক সিংয়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। আম্বারের রাজাদের পুত্রদের একজন এই তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল সেনাপতি।
তারা আমাদেরকে এগিয়ে আসতে দেখেছে, জাহাপনা। একজন বন্দি জানিয়েছে কেমন করে আমাদের সারির একটু সামনেই জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল কয়েকজন শত্রুপক্ষের দল। পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে এসেছিল তারা–সাথে এমনকি বাড়তি ঘোড়াও নিয়ে এসেছিল লুটের মাল আর নিজেদের আহতদের নিয়ে যাবার জন্য। আর এভাবেই আমাদের মধ্যম ভাগ ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর সরাসরি পিছন থেকে আক্রমণ করেছে। আমাদের চলার পথে সৃষ্টি হওয়া ধুলার মেঘের সুবিধাটুকু নিয়েছে। ফলে একেবারে আমাদের উপর আঘাত হানার আগ পর্যন্ত কিছু বুঝতেই পারি নি আমরা।
মধ্যম ভাগে রক্ষী নিযুক্ত করে নি তুমি?
না জাহাপনা, আমি দুঃখিত।
তোমার উচিত ছিল। কিন্তু শুধু তোমাকে দোষারোপ করে লাভ নেই। এই ঘটনা থেকে আমাদের সকলেরই উচিত শিক্ষা নেয়া। শুধুমাত্র আরো বেশি রক্ষী নিযুক্ত করার প্রশ্নই নয়। আমাদের শত্রুদের চিন্তাধারা ও কৌশলও বুঝতে হবে। শুধুমাত্র মাথা নাড়ানো ছাড়া আর কোন প্রত্যুত্তর এলো না সেনাপতিদের কাছ থেকে। শাহজাহান আবারো বলে চললেন, একত্রে আমরা সফল হবই। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু এখন ঠিক করতে হবে যে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। কতজন সৈন্য হারিয়েছি আমরা?
বেশি নয়–শত মানুষ থেকে কয়েকজন কম, আমার মনে হয়। কিন্তু রসদবাহী গাড়িতে আঘাত হওয়ায় প্রচুর মালামাল হারিয়েছি। বারুদ বোঝাই গাড়িতে, রসদবাহী গাড়িতে বিস্ফারণের ফলে বেশ কয়েকটি কামান বাঁধন ছেড়ে আলগা হয়ে গেছে আর খাদ্যের গাড়িতেও আগুন লেগে গেছে।
তো ঠিক আছে, বোরহানপুর ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন কিছু করার নেই। সেখানে আমরা বিশ্রামের পাশপাশি পুনরায় রসদ জোগাড় করতে পারব। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন শাহজাহান। সভা শেষ করা হল।
সেনাপতিরা ফিরে যেতেই শাহজাহান ভাবলেন এরা প্রত্যেকেই বিশ্বস্ত আর ঘটনার ভয়াবহতাও ঠিক তার মতো করেই অনুভব করতে পেরেছে। কিন্তু এটা বিবেচ্য বিষয় নয়। তাদেরকে অবশ্যই–এর মাঝে তিনি নিজেও আছেন–আহমেদ আজিজের পরাজয় থেকে শিক্ষা নিতে হবে। শত্রুর ধূর্ততা আর শক্তিকে অবজ্ঞা করলে নিজেদের ধ্বংসই শুধু ডেকে আনবে তারা।
*
বোরহানপুরের পর্দা ঘেরা জানালায় একে অন্যের বাহুতে হাত রেখে দিগন্তে কমলা রঙের সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে আছেন শাহজাহান আর মমতাজ। দেখুন ওখানে কয়েকটা চিল উড়ছে। বলে উঠলেন সম্রাট পত্নী। ওখানকার সমভূমিতে নিশ্চয়ই কয়েকটা অবলা জন্তু মরে পড়ে আছে। মাথা নাড়লেন শাহজাহান। এই দৃশ্য বেশ স্বাভাবিক এখন। বর্ষাকাল এখনো আসেনি। সূর্যাস্তের আলোয় দেখা গেল গাছগুলোতে কোন উজ্জ্বলতা বা পাতার সমারোহ নেই। ঘাস প্রায় দেখাই যায় না, ফসলও তোলা শেষ। সবসময়কার চওড়া তাপ্তি নদী হয়ে গেছে থকথকে ঘোলাটে। মানুষ আর পশু যুদ্ধ করে নালা থেকে মূল্যবান পানি খুঁজে নিতে আর চারপাশের কয়েকটি সবুজ কর্দমাক্ত ডোবা ও এ কাজে। ব্যবহৃত হয়। গৃহপালিত-বন্য সব ধরনের পশুই মারা যাচ্ছে। শুকনো ভূমিতে পড়ে থাকছে মৃতদেহের শুকনো চামড়া আর হাড়।
চারপাশের গ্রামগুলো থেকে আসা সংবাদের মাধ্যমে জানা গেল যে। সেখানেও অকাতরে মানুষ মারা যাচ্ছে। বেশির ভাগই অনাহারে, অন্যরা গিয়েছে ক্ষুধার্ত বাঘের পেটে। খালি পেট ভরাবার জন্য জঙ্গল আর পবর্ত থেকে নেমে আসছে বাঘের দল। গ্রামের কিছু কিছু মানুষ কোটরে বসা চোখ আর হাড় জিরজিরে শরীর নিয়ে এসে পৌঁছাচ্ছে বোরহানপুরে। বাচ্চাগুলো মায়েদের দুধহীন, শুষ্ক স্তনে মুখ পুরে রেখেছে।
শাহাজাহান নির্দেশ দিলেন যেন সেনাবাহিনীর উদ্ধৃত্ত যোগান থেকে খাবার বিলি করা হয় এদের মাঝে; কিন্তু যেহেতু বিদ্রোহ এখনো শান্ত হয়নি, তাই সৈন্যরাই সবকিছুর প্রধান ভাগ পাবে। সম্ভবত পরিকল্পনামত আগামীকাল তিনি যে লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হবেন, তাতে সফল হলে শত্রুরা বাধ্য হবে তাঁর দাবি মেনে নিতে। কৌশল পরিবর্তন করে ভারী অস্ত্র আর পদাতিক বাহিনী রেখে ঘোড়সওয়ারদের ডিভিশন নিয়ে এগোবেন তিনি। ফলে দ্রুত এগিয়ে যাবে তাঁর প্রধান সারি আর শত্রুরা যতটা তৎপরতা দেখিয়েছে তেমনিভাবে আক্রমণে তিনিও সফলতা লাভ করবেন। তার চেয়েও বড় কথা, এই নতুন বাহিনীর গতির দ্রুততা কাজে লাগিয়ে ধরা পড়ার আগেই শক্রর কাছাকাছি পৌঁছে যাবেন তিনি।
মনে হল যেন তার মনের কথা পড়তে পারছেন মমতাজ, এমনভাবে জানতে চাইলেন শাহজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে, আগামীকাল আপনাকেই কেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নিতে হবে? বেশির ভাগ সৈন্য তো এখানেই থাকবে আর আপনার যোগ্য সেনাপতিরও অভাব নেই। এ কাজে তাদের উপর কেন নির্ভর করছেন না?
হেসে ফেললেন সম্রাট। এই প্রশ্নটা তিনি নিজেও বেশ ভেবে দেখেছেন। তাই উত্তরটাও তৈরি ছিল। আমাকে যেতে হবে, কারণ তাহলে উদ্যম ফিরে পাবে আমার সৈন্যরা। এছাড়া গ্রামের লোকদের সামনে উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করতে চাই আমি। তাদের অনেকেই বিদ্রোহীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে। কেননা তাদেরকে প্রচুর লাভের লোভ দেখিয়েছে তারা। আমি আমার দাদাজান আকবরের সোনার কাজ করা দেহবর্ম আর শিরস্ত্রাণ পরে যাবো। তিনি আমাকে সবসময় বলতেন যে একজন ম্রাটকে সবসময় সাধারণ মানুষের চেয়ে শক্তি প্রদর্শনের ব্যাপারে যত্নশীল হতে হয়। এক্ষেত্রে ভাবমূর্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে সাধারণ জনগণ তাদের ম্রাটকে বেশি ভালোবাসবে। সময়ের সাথে সাথে বারংবার নিজের উক্তির যথার্থতা প্রমাণ করেছেন তিনি।
কিন্তু এভাবে জনসমক্ষে যাওয়াটা আপনার জন্য ঝুঁকি হয়ে যাবে, তাই না? ভুলে যাবেন না যে অস্ত্র আর আহত হবার ভয় অন্যদের মত আপনারও আছে।
আমি জানি, আমি অন্য যে কোন মানুষের মতই মরণশীল। নিজেকে প্রকাশ করা হয়তো পাগলামীরই সামিল; কিন্তু এই ঝুঁকি আমাকে নিতেই হবে আমাদের রাজবংশ আর সাম্রাজ্যের জন্য।
পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মমতাজের মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারলেন যে পত্নীর সন্দেহ এখনো দূর হয়নি, তাই শাহজাহান তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, এছাড়া আমি নিজের খেয়াল রাখবো আর দেহরক্ষীরা তো থাকবেই। এই ফাঁকে সূর্যের শেষ রেশটুকুও মিলিয়ে গেল পশ্চিম দিগন্তে। নিচু হয়ে চুম্বন করলেন মমতাজকে। কতটা হারাতে হবে তাকে।
*
ঘোড়া থেকে নেমে দ্রুত শাহজাহানের দিকে এগিয়ে এলো রায় সিং। জাহাপনা…আমরা অতর্কিতভাবে আক্রমণ করেছি একদল বিজাপুর সৈন্যের উপরে। মধ্যাহ্নের খাবারের পর বিশ্রাম নিচ্ছিল লোকগুলো। কোন এক পশুপালকের পরিত্যক্ত কুড়ে ঘরে বসে সূর্যতাপ থেকে বাঁচতে ছায়ার কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে দুজন পালিয়ে গেছে–একজন যে ঘোড়াগুলো পাহারা দিচ্ছিল, আর দ্বিতীয়জন কোন একভাবে পালিয়ে নিজের ঘোড়ায় উঠে চলে যেতে সমর্থ হয়। কিন্তু বাকিদেরকে বন্দি করেছি আমরা–দেখুন, তারা আসছে।
বিকেলবেলার সূর্যের আলোয় তামার ঝকঝকানি থেকে চোখের উপর হাত রেখে শাহজাহান দেখতে পেলেন রায় সিংয়ের সাথে পাঠানো সৈন্যের দলকে-শিবিরের দিকে চলেছে সবাই। পাঁচজন ধরে রেখেছে ঘোড়াগুলোর লাগাম, এর সাথে চলেছে হাত পিছমোড়া করে বাঁধা বন্দি সৈন্যের দল। চারজন বন্দির বয়স হবে তার নিজের বয়সের কাছাকাছি কিন্তু পঞ্চম জন বেশ তরুণ। লম্বা তরুণের কৃশকায় দেহে ঝুলছে ময়লা লাল সোনালি টিউনিক। বাকিদের কাছ থেকে তাকে আলাদা করে রেখেছে প্রহরীরা। ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে তরুণ।
তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলে রায় সিং? জানতে চাইলেন শাহজাহান।
হ্যাঁ, জাহাপনা। আমরা দুজন তাদেরকে একজন একজন করে কুঁড়েঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম। চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল প্রত্যেককে। আর আমার সঙ্গী নির্যাতনের পাশাপাশি পুরস্কারের আশ্বাসও দিয়েছে। চারজন বেশ সাহসী, কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে; কিন্তু তরুণ সৈন্যরা ভয়ে পাজামা নষ্ট করে দিয়েছে যখন আমি ভয় দেখিয়েছি যে লোহার সাঁড়াশি গরম হচ্ছে তার পেট খুঁড়ে দেবার জন্য। একমাত্র সে-ই আমার সঙ্গীর নরম কথায় রাজি হয়েছে মুক্ত হবার বিনিময়ে যা জানে তা বলে দিবার জন্য। অন্য বিজাপুর সৈন্যরা সন্দেহ করেছে যে তরুণটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা এমনকি বিভিন্ন হুমিও দিয়েছে যে কি করবে তরুণের সাথে। এই কারণে তরুণকে আমরা পৃথক করে রেখেছি।
বেশ ভালো কাজ করেছো রায় সিং। কী বলেছে সে তোমাকে?
*
এগিয়ে চলো! গর্জন করে আদেশ দিলেন শাহজাহান। তিনি এবং তাঁর সৈন্যরা এগিয়ে যেতে লাগলেন দেড় মাইল দূরে অবস্থিত বিজাপুরের শিবিরের দিকে। তাঁবু বলতে এখানে আছে বেশ কয়েকটি হাতে বানানো আশ্রয়স্থান, যেগুলো নির্মিত হয়েছে আঠালো মাটির সাথে মড়া গাছের ডাল দিয়ে। কোন এক উপহৃদের অবশিষ্টাংশ এ জায়গা। এর থেকে বেশ খানিকটা দূরে কোন মতে এই খরার সময়েও টিকে আছে কয়েকটা কুঁড়েঘর, বোঝা গেল কোন এক সময় একটা গ্রাম ছিল সেখানে। বন্দি তরুণের কাছ থেকে শত্রু শিবিরের অবস্থান আর শক্তি সম্পর্কে জানতে পারার পর নিজের সেনাপতিদের সাথে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পরে শাহজাহান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সূর্যোদয়ের ঠিক পরপরই আক্রমণ করার। এ সময় প্রাতঃকৃত্য আর প্রাতঃরাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে শত্রু সৈন্যরা।
চাঁদের আলোয় দীর্ঘপথ ঘোড়ায় চেপে আসতে আসতে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে, যেহেতু দুজন পালিয়ে গেছে, শত্রুপক্ষ কতটা সচেতন তাঁদের ব্যাপারে। যাই হোক, নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিলেন যে, যদি শত্রুরা পালিয়ে আসা দুজনের কথা মেনেও নেয় তারপরেও পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারবে না যে শাহজাহান এত দ্রুত কোন পদক্ষেপ নেবেন। এছাড়া আক্রমণ আর তাঁবুর মাঝে ত্রিশ মাইল দূরত্ব এতটা দ্রুত অতিক্রম করবে ম্রাটের সৈন্যরা, এটাও তারা ভাবতে পারবে না।
কিন্তু অনর্থক বলে প্রমাণিত হবে এই ভয়, কেননা কয়েকটা ছোট পাহাড়ের উপর থেকে নিচে শত্রু শিবিরের দিকে তাকিয়ে শাহজাহান ও তার সৈন্যরা দেখতে পেলেন রান্নার আগুনের ধোঁয়া, সারি বেঁধে থাকা ঘোড়া আর প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত শত্রু সৈন্যরা। পাহাড়ের চারপাশে পাহারারত কয়েকজন সৈন্যকে দ্রুত নাস্তানাবুদ করে ফেললো মোগল সৈন্যরা। টগবগ করে সামনে এগিয়ে গেলেন তিনি আর সৈন্যরা, বাতাসে উড়ছে সবুজ ব্যানার, কঠিন পোড়ামাটিতে ঝড় তুলছে ঘোড়ার খুর।
অন্যদিকে বিজাপুরের তাঁবুতে ঘোড়ার সারির দিকে ছুট লাগালো সৈন্যের দল, খাপমুক্ত করল তলোয়ার, পিরামিডের মত করে সাজিয়ে রাখা বর্শার সারি থেকে তুলে নিল যার যার অস্ত্র, প্রস্তুত হয়ে গেল মোগলদেরকে ঠেকাতে। কিন্তু যথেষ্ট সময় নেই তাদের হাতে। ভাবলেন শাহজাহান। আরো দ্রুত বেগে এগিয়ে চললেন নিজের ঘোড়া নিয়ে।
এরপর হঠাৎ করে সৈন্যের রণহুঙ্কার আর ঘোড়ার খুরের শব্দ ছাপিয়েও শুনতে পেলেন ভারী পতনের শব্দ, একের পর এক। আওয়াজগুলো আসছে তার সামনের দিক আর বাম পাশ থেকে।
সেদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেলেন বিজাপুর আশ্রয়স্থলের গাছের ডালগুলো একের পর ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। বের হয়ে পড়ল ইতিমধ্যে গোলা ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত কামানের নল। গোলন্দাজও হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে গেছে কামানের পেছনে। লম্বা ব্যারেলের অস্ত্র প্রস্তুত হয়ে গেল নিমিষেই। কামান আর গোলার বল লক্ষ্য খুঁজে পেল।
নিজের ঘোড়সওয়ারাদের সৃষ্টধুলার ফাঁক দিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন পা ভেঙে পড়ে গেল সামনের সারির একটা মোগল ঘোড়া। পড়ে যেতেই জায়গাচ্যুত হল পতাকাবাহক মাথা ফেটে গেল মাটির সাথে। একটু পরেই পিছন থেকে এগিয়ে আসা ঘোড়সওয়ারদের পায়ের চাপে আরোহী আর ব্যানার দুটোই নাই হয়ে গেল। কিন্তু এখন পড়ে যাচ্ছে অন্যরাও। একটা আহত ঘোড়া পা ভেঙে পড়ে রইলো রাজপুত অশ্বরোহীদের পথের উপর। দুজন সৈন্য সময়মতো নিজ নিজ ঘোড়ার লাগাম না টেনে ধরতে পারায় তিনজনেই একসাথে রক্ত-মাংসের দলা পাকিয়ে গেল। যাই হোক বিপর্যয় সত্ত্বেও শাহাজাহান ও তাঁর সৈন্যেরা যত শক্তি নিয়ে সম্ভব এগিয়ে গেল সামনে দিকে। খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেল শত্রুদের কাছাকাছি, ফলে সবাই মিলে একটা জায়গায় যুদ্ধে লেগে যাওয়ায় গোলন্দাজরাও কিছু করতে পারল না, কারণ শত্রু-বন্ধু আলাদা করা দায় হয়ে পড়ল।
একেবারে শেষ মুহূর্তে সামনে দেখা গেল একটা কাঁটার বেড়া সম্ভবত গৃহপালিত পশুর জন্যেই তৈরি করা হয়েছিল কখনো। শাহজাহান নিজের ঘোড়র পেটে গুতো দিয়ে লাফ দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। নিরাপদে বেড়ার মাঝে পৌঁছেই তাকিয়ে দেখতে পেলেন একদল শত্রু অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে। এত দ্রুত কীভাবে অস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে গেল তারা? অথবা নাকি বিজাপুরের সৈন্যরা জানতো যে তিনি আসবেন, তাই কামানের মত সশস্ত্র যোদ্ধাদেরও লুকিয়ে রেখেছিল একেবারে তৈরি অবস্থায়? এখন আর এসব ভাবার সময় নেই। যুদ্ধে মনোযোগ দিতে হবে। একেবারে সামনের শত্রু যোদ্ধা ডান হাতে লম্বা বল্লম নিয়ে সরাসরি তার দিকেই ছুটে আসছে।
শাহজাহান জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে চেষ্টা করলেন এগিয়ে আসা সৈন্যেরা বামপাশে সরে যেতে, যেন বর্শা দিয়ে ঠিকমতো লাগাতে না পারে সম্রাটের গায়ে। লোকটা পার হয়ে যেতেই শাহজাহান তলোয়ার উন্মুক্ত করলেন। শত্রুঘোড়াকে আঘাত করতেই আরোহীকে ফেলে দিল মাটিতে। আরেকজন বিজাপুর সৈন্য চেষ্টা করল তলোয়ার দিয়ে আঘাত করতে, নিজের অস্ত্র দিয়ে ঠেকিয়ে দিলেন সম্রাট।
নিজেদের ঘোড়া ছুটিয়ে আবারো একে অপরের দিকে ছুটে এলো দুজনে। ক্রমাগত বাড়ি দিয়ে ঘোড়াকে ছুটিয়ে নিয়ে আসছে।
এবার প্রথম আঘাত করলেন শাহজাহান, কিন্তু ঘাড় নিচু করে আঘাত এড়িয়ে তার দেহবর্মে পাল্টা আঘাত করল শত্রুসৈন্য। নিজের সক্ষমতার প্রমাণ দিল দেহবর্ম, কোন ক্ষতিই হল না। আবারো পরস্পরের দিকে ধেয়ে এলো দুজন। আবারো দ্রুত আঘাত করলেন শাহজাহান আর এবার মোক্ষম জায়গায় উদ্ধত তলোয়ার গিয়ে আঘাত করল শত্রুর অরক্ষিত চিবুকে, কণ্ঠনালি চিড়ে গেল। কোন চিৎকার না করেই ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে গেল মাটিতে।
তুলার কাপড় দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ধোঁয়া আর ধুলার মাঝেই সমানে লড়ছে তাঁর দল। আরো শত্রুসৈন্য এসে যোগ দিচ্ছে দলে দলে, শাহজাহান স্বচক্ষে দেখলেন হ্রদের পেছনের গ্রাম থেকে এলো অনেকে। পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলেন যে বিজাপুরের সৈন্যরা তাঁর আগমন সম্পর্কে ধারণা করে সৈন্যদের লুকিয়ে রেখেছিল কুঁড়েঘরসহ যেখানে সেখানে সম্ভব সর্বত্র। আরো একবার শত্রুর ক্ষমতাকে খাটো করে দেখেছেন তিনি। আর এখন তারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। দেরি হবার পূর্বেই কিছু একটা করতে হবে।
এগিয়ে আসতে থাকা অশ্বরোহীদের মাঝে খুব বেশি হলে ডজনখানেক হবে এমন একদলের উপর চোখ পড়ল সম্রাটের। সবার প্রথমে দুজনে সৈন্য বহন করে আনছে সোনারঙা, বিজাপুরের পতাকা সর্পের জিহ্বার ন্যায় আকৃতি। এদের মাঝখানে প্রায় নিজের মতই চকচকে দেহবর্ম পরিহিত এক অশ্বারোহী। মাথায় পাখনাওয়ালা শিরস্ত্রাণ। এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই বিজাপুরের সেনাপ্রধান আর যদি খবর সত্যি হয় তাহলে সুলতানের একাধিক পুত্রের একজন। যদি শাহজাহান একে হত্যা করতে পারেন তাহলে শত্রুদের অগ্রগতি ব্যাহত হবার পাশাপাশি মোগলরা শৃঙ্খলিত হবার সুযোগ পাবে।
তোমরা যে যে পারো আমার সাথে এসো। কাছাকাছি থাকা কয়েকজনকে ডেকে চিৎকার করে জানালেন ম্রাট। মোগল সৈন্যরা তাই করল, সকলে মিলে এগোতে লাগল বিজাপুরের সেনাপ্রধানের দিকে। বড়জোর ছয়শ গজ দূরত্ব দুই পক্ষের মাঝে। দ্রুত এগোতে লাগল শাহজাহানের ঘোড়া, ঘাড়ের কাছে সাদা ঘামের রেখা, কিন্তু তারপরও অন্যদের রেখে সামনে এগিয়ে গেল দ্রুত।
এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি পৌঁছে গেলেন বিজাপুরের সৈন্যদলের কাছে। প্রথম আঘাত করলেন পতাকাবাহক এক সৈন্যের অরক্ষিত বাম পায়ে। হাঁটুর ঠিক উপরে আঘাত করে হাড় পর্যন্ত কেটে ফেললেন মাংস। আরেকটু হলে শাহজাহানের অস্ত্রটাই পড়ে যাচ্ছিল। যাই হোক, কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে দেখতে পেলেন পতাকাবাহক পড়ে গিয়ে ধুলায় লুটিয়ে পড়ল সোনালি পতাকা। এ সময় আরেকজন অশ্বারোহী এসে আঘাত করল সম্রাটকে, কিন্তু বুকের বর্মে লেগে পিছলে গেল তলোয়ার। তবে ধাক্কা খেয়ে পিছনে হেলে গেলেন তিনি। আবারো নিজের ভারসাম্য ফিরে পেয়ে দেখতে পেলেন সেনাপ্রধানকে আঘাত করার মত যথেষ্ট নৈকট্য পেয়ে গেছেন। তাই সর্বশক্তি দিয়ে তলোয়ার চালালেন বিজাপুর সেনাপ্রধানের চকচকে বুকে বর্মের ঠিক নিচের অংশে। যদিও ঘোড়ার পিঠেই বসে রইল, তারপরেও তলোয়ার ফেলে দিয়ে দুহাতে পেট চেপে ধরল লোকটা। তাড়াতাড়ি শাহজাহান আবারো তলোয়ার হাতে নিলেন শত্রু সৈনপ্রধানকে একেবারে শেষ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু এই করতে গিয়ে নিজের মাথায় আঘাত অনুভবের সাথে সাথে শিরস্ত্রাণ পড়ে যেতে দেখলেন। দস্তানা পরা হাত উঠালেন। শিরস্ত্রান ঠিক করতে, কিন্তু কানে মনে হল তালা লেগে যাবার জোগাড়। চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে চোখের সামনে নাচতে দেখলেন সাদা তারার ঝলকানি। দৃষ্টিশক্তিও ঝাপসা হয়ে এল। এখনি রণক্ষেত্র থেকে সরে গিয়ে নিজের চেতনা ফিরে পাবার জন্য অপেক্ষা করা উচিত।
অবচেতনেই সামনে বাড়ার জন্য তাগাদা দিলেন নিজের ঘোড়াকে, হাত আর পা দিয়ে তাড়া করলেন। নিজের সর্বোচ্চ গতি নিয়ে ছুটতে শুরু করল প্রাণীটা, কিন্তু কানের মাঝে ঘণ্টাধ্বনি আর চোখের সামনে আলোর নৃত্য বেড়ে গেল যেন। নিজের ঘোড়ার গলা জাপটে পড়ে গেলেন শাহজাহান…
*
কী তাঁকে এমন করে ধাক্কা দিচ্ছে? তিনি এবং মমতাজ যেন তারার রাজ্যে ভেসে চলেছেন। কিন্তু কিছু একটা যা কেউ একজন টেনে পত্নীর কাছের থেকে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে। মমতাজের বিবর্ণ মুখে ভেসে উঠল ভয় আর আকুতি। এরপরই যেন বেগুনি অন্ধকারে হারিয়ে গেল মমতাজ। কিছুই বুঝতে পারলেন না শাহজাহান। তিনি মমতাজের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছেন নাকি তাঁকেই শাহজাহানের কাছ থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হল? এটা হতে পারে না…তিনি কখনোই এটা হতে দেবেন না। চেষ্টা করলেন হাত বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু মনে হল কাপড়ে বেঁধে আটকে গেল হাত। কেউ একজন বস্তুত সত্যিই তাঁর কাপড় ধরে টানছে, নিয়ে যাচ্ছে মমতাজের কাছ থেকে না, না। বিড়বিড় করে উঠলেন তিনি। মাথা নাড়াতে লাগলেন মমতাজ, আমি তোমার সাথেই থাকব। এরপরেই মনে হল যেন তীক্ষ্ণ নখের হাত চেপে ধরল গলা।
চোখ খুললেও তন্দ্রাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন ইঞ্চিখানে দূরেই উজ্জ্বল চোখের একটা মুখ। বিস্ময়ের ভঙ্গিতে অর্ধ খোলা ঠোঁট, তারপরেও দেখা যাচ্ছে কালো দাঁত। সাদা লম্বা চুল পিছনে টেনে বাঁধা বুড়ো আঙুল ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর গলায়, খুঁজে ফিরছে অ্যাডামস অ্যাপেল। এই উন্মাদ নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করতে চাইছে। অভ্যাসবশেই শাহজাহান হাত তুলে সরিয়ে দিলেন এই হাড়সর্বস্ব আঙুলগুলো নিজের গলা থেকে। এরপর হাত দিয়ে ধাক্কা দিলেন শয়তানটার মুখে। বিস্মিত হয়ে খেয়াল করলেন যে বিশ্রি দেহটা বেশ গরম, নাকে এসে ধাক্কা মারল বোটকা গন্ধ। মাথা পিছনে নিয়ে ঝাঁকি দিলেন শাহজাহান। শুনতে পেলেন কিছু একটা ভাঙ্গার মত শব্দ হল, আর এই অপচ্ছায়টা যুদ্ধ করতে করতে শাহজাহানের উপর লাফ দিতে চাইলো, চেহারার উপর গড়িয়ে পড়তে লাগল গরম লালা। হালকা দেখালেও ওজনও আছে। ভূতটার।
ভারী বোঝার চাপ আর গাল বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকা তরলের প্রবাহে পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠলেন শাহজাহান। ধাক্কা দিয়ে গায়ের উপর থেকে সরিয়ে দিলেন দেহটাকে, মাথা পরিষ্কার হয়ে চোখের দৃষ্টিও ফিরে এলো। উঠে বসে চারপাশে তাকাতে লাগলেন। অসম্ভব তাপ ছড়িয়ে গনগন করছে মধ্যাহ্নের সূর্য, পাতাবিহীন গাছের নিচে তিনি সম্পূর্ণ একা। আস্তে করে তাকিয়ে দেখে ভয়ে জমে গেলেন সম্রাট। বুঝতে পারলেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে বেঁকে যাওয়া মাথা ঝুলে যাওয়া জিহ্বা আর চোখ খুলে তাকিয়ে থাকা দেহটা একজন নারীর, বয়স্ক নারীর! বাতাসে উড়ছে লাল শাড়ির প্রান্ত। পাঁজরের হাড় আর শুকিয়ে যাওয়া চামড়ায় কোন এক সময় হয়তো পাকস্থলী ছিল, সব দেখা যাচ্ছে। বহুদিনের অনাহারী বোঝা গেল। শাহজাহান খুন করেছেন তাকে। কেন? আর তিনি একাই বা কেন?
ধীরে ধীরে খাপছাড়া স্মৃতি–অস্ত্রের ঝনঝনানি, উৎসাহ আর বেদনার রণহুঙ্কার–ফিরে আসতে লাগল মনের মাঝে। মনে পড়ে গেল ঘোড়া ছুটিয়ে বিজাপুরের শিবিরের দিকে যাওয়া ঘোড়ার খুড়ের শব্দ, একটু পরেই সেনাপ্রধানের উপর হামলা, কিন্তু তারপর কী হল? অবশেষে মনে পড়ল নিজের মাথায় আঘাত পাবার কথা। সামনের দিকে পড়ে যাচ্ছেন তিনি…তার ঘোড় নিশ্চয় তাকে এখানে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে বহু মাইল দূরে নিয়ে এসেছে। চারপাশে তাকিয়ে না যুদ্ধ না নিজের ঘোড়া কিছুই দেখতে পেলেন না, কোন শব্দও পাচ্ছেন না। চারপাশের বালি পরীক্ষা করে কয়েকটা চিহ্ন দেখতে পেলেন খুরের নিচে। পড়ে যাবার পর নিশ্চয়ই তাঁকে ফেলে চলে গেছে ঘোড়া। কিন্তু এই নারী এলো কোথা থেকে? মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন মাটিতে পড়ে আছে তার আংটি–বড় একটা বাঁকানো এমরান্ড–আর হ্যাঁ, তাঁর হালকা, পোশক রুপার বন্ধনী দ্বারা আটকানো ছিল, এখন পড়ে আছে বৃদ্ধার পাশে। হুম, তাহলে ঘটনাটা এই-ই–সম্রাটের দেহ তল্লাশী করে লুটপাটের চেষ্টা করেছিল। ধূসর পকূকেশ নারী, নড়ে উঠতেই তারপর খুন করার চেষ্টা করে।
পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল যে টিকে থাকার চেষ্টায় ভুলে গেছে নারী দুর্লভ মমতা আর প্রতিরক্ষার বোধ। নিশ্চয়ই একা বেঁচে থাকতে গিয়েই এমন হয়েছে এই বৃদ্ধা। পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর পর কী গ্রাম ছেড়ে খাবারের সন্ধানে বের হয়েছে? নাকি তারা আশেপাশেই কোথায় পড়ে আছে কিন্তু এতটাই দূর্বল যে নড়াচড়া করতে পারছে না? নাকি তারা এই বৃদ্ধাকে পরিত্যাগ করেছে? যাই হোক, কোনমতে টিকে থাকাই মানুষের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন এখন। একই কারণে শাহজাহানকেও খুন করতে চেয়েছে সে…কিন্তু তিনি কেন হত্যা করলেন…কেননা বস্তুত তিনিও তার সত্তাইদের হত্যা করিয়েছেন। এখন আরো একবার বাঁচার জন্য যুদ্ধ করলেন।
মৃতদেহের পাশ থেকে নিজের পোশাক তুলে নিয়ে কোনমতে মাথায় জড়িয়ে নিলেন, সূর্যের কড়া তাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য। বুকের বর্মের উজ্জ্বলতা হয়তো শত্রুতাই করে বসবে শত্রু খুঁজতে, এছাড়া বহন করার পক্ষে বেশ ভারীও এটি। তাড়াতাড়ি খুলে ফেলে বালিতে হালকা গর্ত করে লুকিয়ে রাখলেন। এরপর তাকালেন দাগগুলোর দিকে, সেগুলোকে তিনি তাঁর ঘোড়ার খুরের দাগ বলে ভাবছেন। পড়ে যাওয়ার আগে মনে হল উত্তর-পশ্চিম দিকে থেকেই ছুটে এসেছেন, এরপর দাগগুলো চলে গেছে দক্ষিণ দিকে। তিনি এখন কী করবেন? ঘোড়ার খুরের দাগ অনুসরণ করে এটির পিছু নেবেন, নাকি পিছনে গিয়ে রণক্ষেত্রের দিকে যাবেন? ভেবে দেখলেন ঘোড়ার খোঁজেই যাওয়া উচিত। নিশ্চয়ই একটু এগিয়েই থেমে গেছে কোথাও। অন্যদিকে যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কেও কিছুই জানেন না তিনি। হতে পারে গিয়ে দেখবেন নিজের সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে, মৃত্যু অথবা বন্দিত্বই তখন ললাট লিখন হবে।
পাতাবিহীন গাছদের নিচ দিয়ে ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে এগোতে শুরু করলেন। ঘোড়ার খুরের দাগ অনুসরণ করলেও আস্তে আস্তে তাও হারিয়ে যেতে বসেছে, কেননা ঝোঁপের কিনারে মাটি বেশ শক্ত। গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন যে দূতদের সাথে বসে লুকিয়ে চলাফেরার কৌশল রপ্ত করা কতটা জরুরি ছিল। ঝাপসা হয়ে যাওয়া দাগের উপর থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিগন্তের দিকে তাকিয়ে চেষ্টা করলেন ঘোড়ার কোন চিহ্ন দেখা যায় না কিনা তা খুঁজতে। এর বদলে দেখতে পেলেন খুব বেশি হলে এক মাইল দূরত্বে উত্তর দিক থেকে ধূলি উড়িয়ে এগিয়ে আসছে একদল অশ্বরোহী। শাহজাহান জানেন না এরা বন্ধু নাকি শত্রু। তাই দ্রুত গিয়ে লুকিয়ে পড়লেন বড় একটা গাছের গুঁড়ির পেছনে। সাবধানে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন পরিচিত চিহ্ন চোখে পড়ে কিনা। কিছুই বুঝতে পারলেন না, দলটা একেবারে কাছে চলে এলো। এরপরই বিভক্ত হয়ে গেল। অর্ধেক এগিয়ে গেল ঝোঁপের এক দিকে, বাকিরা ঝোঁপের অন্যদিকে। সবাই প্রায় অর্ধেক নিচু হয়ে খুঁজতে লাগল কী যেন। আরো কাছে চলে আসতেই শাহজাহান গুঁড়ির গায়ে হেলনা দিয়ে যতোটা সম্ভব গুটিসুটি মেরে বসে রইলেন। হঠাৎ করেই স্বস্তি নিঃশ্বাস ফেলে চিনতে পারলেন সেনাপতিকে লম্বা এক রাজপুত সৈন্য কালো ঘোড়ার উপর বসে আছে। লোহার বুক বর্মের নিচে কেশর রঙা আলখাল্লা। অশোক সিং। সৈন্য তাঁর নিজ বাহিনীর। গাছের গুঁড়ি থেকে বের হয়ে ঝোঁপের কিনারে দৌড়ে গেলেন শাহজাহান।
জাহাপনা, আপনি? আপনি কী আহত হয়েছেন? ঘোড়া থেকে নামতে নামতে চিৎকার করে জানতে চাইল অশোক সিং।
হ্যাঁ–আর না, তেমন গুরুতর কিছু না, আল্লাহর অশেষ দয়া যে তোমরা আমাকে খুঁজে পেয়েছে। আমি আঘাত পেয়েছিলাম আর আমার ঘোড়া আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে মনে হয়।
আমরা ঘোড়াটাকে খুঁজে পেয়েছি, বেশি দূরে যেতে পারে নি।
যুদ্ধে কি আমাদের জয় হয়েছে?
হা জাহাপনা। যুদ্ধে আমরাই এগিয়ে থেকেছি আর তখনি আপনাকে হারিয়ে ফেলি দৃষ্টিসীমার বাইরে। অন্যদিকে বিজাপুরে সৈন্যরা তাঁবু ছেড়ে বিস্তর ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পিছু হটেছে।
এখনো পিছু ধাওয়া করছ?
না। আমাদের ক্ষতিও কম হয়নি। আপনার অনুপস্থিতিতে সেনাপতিরা ভেবে দেখলেন যে পিছু ধাওয়া করার চেয়ে আহত সেবা আর পুনরায় শৃঙ্খলিত হওয়া বেশি জরুরি। সবাই ভয় পাচ্ছিলেন আহমেদ আজিজের মত কোন চোরা হামলা যদি হয় আর আপনাকে খুঁজে বের করাও জরুরি।
তো, বিজয় তাহলে সম্পূর্ণ হল না, ভাবলেন শাহজাহান। কিন্তু এর আগে যে সমস্যাগুলোর মুখে পড়েছিলেন তার চেয়ে এই আংশিক সাফল্যও ভালো।
দুই ঘণ্টা পরে আবারো নিজের ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলেন শাহজাহান। লুকানো জায়গা থেকে এক সৈন্য আবার দেহবর্মটাও উদ্ধার করে এনেছে। পরে নিলেন তিনি। কাছাকাছিই আবার ঝোঁপের মড়া ডাল জ্বালিয়ে তাড়াতাড়ি একটা চিতা তৈরি করল রাজপুত সৈন্যরা। পোশাক দেখে এটুকু নিশ্চিত যে বৃদ্ধ নারী হিন্দু, তাই আচার মাফিক শেষকৃত্য সম্পন্ন হল। কিন্তু তুলোয় মোড়া দেহ থেকে আগুনে শিখা বের হতেই অপেক্ষা করার প্রয়োজন রইল না।
এই বৃদ্ধা একাই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে এই মরুভূমিতে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নিজের বাহিনীর সাথে একত্রিত হতে হবে, নতুবা গুজব ছড়িয়ে যাবে যে সম্রাট আহত হয়েছেন অথবা মৃত্যুবরণ করেছেন। চিতার কালো ধোঁয়ার দিকে আরেক নজর তাকিয়ে ক্লান্ত ঘোড়াকে ছুটে চলতে তাগাদা দিলেন তিনি।
প্রথম কয়েক মাইল জুড়ে চারপাশে দেখা গেল শুধু শুষ্ক ভূমি। একটিও কোন জীবিত প্রাণীর দেখা মিলল না। কিন্তু এর পরই শাহজাহান দেখতে পেলেন যেন ছোট একটা গ্রাম–ছয় থেকে সাতটা গোলাঘরের বেশি না। ডানদিকে পড়ল সেই গ্রাম। হতে পারে এখানে হয়তো এমন কোন কুয়া পাওয়া যাবে যেটা এখনো শুকিয়ে যায়নি, নিজেদের ঘোড়াকে পানি খাওয়াতে পারবেন তারা। নিজের লোকদের ইশারা করে ঘোড়া ছুটিয়ে মাটির ইট দিয়ে তৈরি নিচু ঘরগুলোর দিকে চললেন তিনি। কাছাকাছি এগোতেই দেখা গেল কয়েকটা পাতা ঝুলছে এমন একটা বট গাছের নিচে সরু পা ছড়িয়ে বসে আছে এক বৃদ্ধ পুরুষ। এত লিকলিকে পা যে মনে হল নিজের ভার বইতেও অক্ষম লোকটা।
খাবার দাও, বাপু, আমি ভিক্ষা চাইছি…ফেটে যাওয়া ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কথা বলে উঠল লোকটা। নিজের ঘোড়ার পিঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন শাহজাহান, তোমাদের খাদ্যের গুদাম কি শেষ হয়ে গেছে? শেষ কবে খেয়েছিলে তোমরা?
উঁচু গালের হাড়ের উপরে কোটরে বসা বৃদ্ধের চোখ সূর্যের আলোয় চকচকে ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইল সম্রাটের দিকে।
ছয় সপ্তাহ আগেই ফুরিয়ে গেছে আমাদের শস্য। এর কয়েক দিন পর থেকে মারা যেতে শুরু করে গবাদিপশু। এগুলোর মৃতদেহও খেয়ে ফেলি আমরা, চামড়া আর নাড়ি-ভুড়িসহ। এছাড়া হাড়গুলোকেও মাটিতে পুঁতে রাখি এক ধরনের ময়দা তৈরির জন্য। ভাগ্যক্রমে কুয়োতে এখনো পানি আছে। কিন্তু এছাড়া খাওয়ার মত শুকনো পাতা ছাড়া আর কিছুই নেই। কয়েকদিন আগে দুইটি বনবিড়াল ধরেছিলাম, এই-ই।
অন্য গ্রামবাসীরা কোথায়?
তিন দিন আগে চলে গেছে অন্য কোথাও খাবার পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে; কিন্তু আমার স্ত্রী অনেক দুর্বল হওয়ায় আমি রয়ে গেছি।
আমাদের যা খাবার আর বাড়তি পানির বোতল আছে তাকে দিয়ে দাও, অশোক সিংকে নির্দেশ দিলেন শাহজাহান। দুর্ভিক্ষের এতটা প্রকোপ আমি তো বুঝতেই পারি নি।
অবস্থা বেশ খারাপ, জাহাপনা। বোরহানপুরের দেয়ালের চারপাশে আমি দেখেছি পশুর মলের ভেতরে হজম না হওয়া অক্ষত শস্যদানা নিয়ে মারামারি করছে পুরুষের দল। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব গ্রামের অবস্থা আরো খারাপ। এমনও শোনা যাচ্ছে যে, কয়েকটা মুদ্রার লোভে পিতা মাতারা, নিজ সন্তানদেরও বিক্রি করে দিচ্ছে ক্রীতদাস হিসেবে, এই আশায় যে, এতে করে উভয় পক্ষই ভালো থাকবে। এছাড়া পাহাড়ের লোকদের মাঝে তো স্বজাতির মাংস খাওয়ার গুজবও শোনা গেছে; যাদের ভেড়া আর ছাগলের মাংস শেষ।
রাজপুত সৈন্যরা লোকটাকে খাবার আর পানি দিয়ে দিলেও শাহজাহান কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারলেন না হাড় দিয়ে ময়দা তৈরি বা স্বজাতের মাংস খাবার মত ব্যাপারগুলো। কিন্তু এতে তো অবাক হবার তেমন কিছু নেই। একটু আগে তিনি নিজেও তো খুন করে এসেছেন এক বৃদ্ধাকে। যাই হোক, অন্য আরেকটা চিন্তা এলো মাথায়। মানুষটা নিশ্চয়ই তার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসে, তাই অন্য গ্রামে গিয়ে খাবারও খুঁজতে যায় নি পত্নীকে একা রেখে। যেমন তিনিও করতেন মমতাজের সাথে। যদি জন্তুর মতো টিকে থাকাই হয় একমাত্র স্বার্থপর চেতনা, তাহলে মানুষের মাঝে এর চেয়েও মহৎ গুণ আছে…যেমন ভালোবাসা।