ভাটির দেশ – অমিতাভ ঘোষ
অনুবাদ : অচিন্ত্যরূপ রায়
The Hungry Tide by Amitav Ghosh
প্রথম প্রকাশ ২০০৪
এই উপন্যাসে ব্যবহৃত সমস্ত নাম, চরিত্র, স্থান এবং ঘটনা কাল্পনিক। কোথাও কোনওভাবে যদি কোনও বাস্তবের সঙ্গে মিল ঘটে থাকে তা নিতান্তই কাকতালীয়।
প্রথম আনন্দ সংস্করণ নভেম্বর ২০০৯
পঞ্চম মুদ্রণ এপ্রিল ২০১৯
উৎসর্গ : লীলাকে
সূচি
প্রথম পর্ব – ভাটা
দ্বিতীয় পর্ব – জোয়ার
লেখকের কথা
অনুবাদ প্রসঙ্গে
.
প্রথম পর্ব – ভাটা
ভাটির দেশ
স্টেশনে পা দিয়েই মেয়েটাকে দেখতে পেল কানাই। ছোট করে ছাটা চুল, ঢিলে ট্রাউজার্স আর ঢোলা সাদা জামা পরা–যে কেউ দেখলেই হঠাৎ আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে বলে ভুল করবে। কিন্তু কানাইয়ের হল জহুরির চোখ। স্টেশনের ওই চা-ওয়ালা আর চানাচুর-ওয়ালাদের ভিড়ের মধ্যেও ঠিক নজর করেছে। ব্যাপারটা ভেবে মনে মনে একটু অহংকারই বোধ করল কানাই। মেয়েদের চেনার ব্যাপারে ওর জুড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন। চেহারাটা মন্দ নয় মেয়েটার–সরু লম্বাটে মুখ, হাতে চুড়ি বালা কিছু নেই বটে, কপালে টিপও নেই, তবে রোদে পোড়া চামড়ার ওপর কানের রুপোলি দুলদুটো ঝকঝক করছে, এত দূর থেকেও চোখে পড়ছে সেটা।
কিন্তু মেয়েটার ভাবভঙ্গিতে কেমন একটা অচেনা ছাঁদ রয়েছে। যে ভাবে পা দুটো ফাঁক করে লাইটওয়েট বক্সারের মতো দাঁড়িয়ে আছে–ঠিক চেনা মেয়েলি ভঙ্গি তো এটা নয়। বিদেশি কি? শুধু গায়ের রঙে আর নাকের নথে কীই বা বোঝা যায়? অথবা হয়তো জন্মসূত্রে ভারতীয়, কিন্তু বহুদিনের প্রবাসী। হতেই পারে। পার্ক স্ট্রিটের কলেজের মেয়েদের ভিড়ে ওকে দেখলে হয়তো কানাইয়ের এরকম মনে হত না, কিন্তু এই ধুলো আর জঞ্জালে ভরা ঢাকুরিয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ওর অচেনা ভঙ্গিটা খুব বেশি করে চোখে পড়ছে। তবে বিদেশিই যদি হয় তো এইখানে কী করছে মেয়েটা? টুরিস্ট ক্যানিং যাবার এই রেলরাস্তা তো ডেইলি প্যাসেঞ্জাররাই বেশি ব্যবহার করে। টুরিস্টরা তো আজকাল সুন্দরবন যাবার জন্য কলকাতা থেকেই লঞ্চ-টঞ্চ ভাড়া করে বলে শুনেছে কানাই। তা হলে কী করছে ও এখানে?
ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের লোকটাকে কী যেন একটা জিজ্ঞেস করল মেয়েটা। খুব লোভ হল কানাইয়ের, ও কী বলছে সেটা শোনার। আড়াল থেকে লোকেদের কথাবার্তা শুনতে ওর বেশ মজা লাগে। মানুষের কথাবার্তা, ভাষা, এইসব নিয়েই তো ওর কারবার। আর শুধু তো পেশা নয়, এটা ওর নেশাও বটে।
ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ঠেলেঠুলে কাছাকাছি পৌঁছে ও মেয়েটার প্রশ্নের শেষটুকু শুধু শুনতে পেল। শুধু শেষ ক’টা শব্দ–”ট্রেন টু ক্যানিং?”
পাশে দাঁড়ানো লোকটি হাতমুখ নেড়ে ওকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু সে বলছিল বাংলায়, আর মেয়েটা তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছে বলে মনে হল না কানাইয়ের। লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে খানিকটা ক্ষমাপ্রার্থীর মতো ও বলল, “আমি বাংলা জানি না।”
যে অদ্ভুত উচ্চারণে মেয়েটা বাংলা শব্দগুলি বলল, তাতেই কানাই পরিষ্কার বুঝতে পারল যে ও মিথ্যে বলছে না। সাধারণত সর্বত্রই বিদেশিরা যা করে, ও-ও তাই করেছে–নিজের বোধের অক্ষমতাটুকু জানিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শব্দক’টা শিখে নিয়েছে।
এই প্ল্যাটফর্মে অবশ্য কানাইও একজন ‘বাইরের লোক’, আর বহিরাগত হিসেবে সেও যে নিত্যযাত্রীদের খানিকটা মনোযোগ আকর্ষণ করেনি তা নয়। উচ্চতায় মাঝারি, এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সেও যথেষ্ট ঘন চুল, জুলফির উপরে অল্প পাক ধরেছে। কানাইয়ের ঘাড় হেলানো আর দাঁড়ানোর ভঙ্গির মধ্যে রয়েছে একটা নিশ্চিত ভাব, যে-কোনও পরিস্থিতির টক্কর নেওয়ার মতো একটা দৃঢ় প্রত্যয় ওর সারা শরীরে যেন ফুটে বেরোচ্ছে। মুখে বয়সের ছাপ পড়েনি বিশেষ, চোখের কোনার চামড়ায় সামান্য ভাঁজ পড়েছে মাত্র। সেটাও ওর প্রাণোচ্ছল ভাবটাই আরও বেশি করে ফুটিয়ে তুলছে। একসময়ে রোগাপাতলা থাকলেও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কোমর একটু ভারী হয়েছে, কিন্তু চলাফেরার ক্ষিপ্রতা তাতে যায়নি। আর তার সাথে আছে এক ধরনের সতর্ক ভাব, একটা পর্যটকসুলভ মুহূর্তযাপনের প্রবৃত্তি।
কানাইয়ের সঙ্গে ছিল টানা-হাতল আর চাকা লাগানো একটা এয়ারলাইন ব্যাগ। ক্যানিং লাইনের ফিরিওয়ালাদের কাছে ওই ব্যাগ কানাইয়ের মাঝবয়সি চাকচিক্য আর শহুরে স্বাচ্ছল্যের একটা অংশ–ওর সানগ্লাস, কüরয় ট্রাউজার্স আর সোয়েডের জুতোরই মতো। ফলে হকার, ভিখিরি আর চাঁদা-তোলা ছেলেছোকরার দল ওকে ছেকে ধরল। অবশেষে সবুজ-হলুদ রঙের ইলেকট্রিক ট্রেনটা ঘস ঘস করে স্টেশনে ঢোকার পর ওদের হাত থেকে রেহাই পেল কানাই।
গাড়িতে ওঠার সময় কানাই লক্ষ করল বিদেশি মেয়েটা চলাফেরায় যথেষ্ট অভ্যস্ত। ট্রেন স্টেশনে ঢুকতেই ও চট করে ওর বিশাল পিঠব্যাগদুটো নিজেই তুলে নিয়ে গোটাছয়েক কুলিকে পাশ কাটিয়ে দিব্যি এগিয়ে গেল। ওই ছোটখাটো দেখতে হলে কী হবে, হাতে-পায়ে শক্তিও আছে মেয়েটার। আর যে ভাবে ব্যাগদুটোকে ট্রেনের কামরায় তুলে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেল অনায়াসে, তাতে বোঝাই গেল এরকম একা চলাফেরার অভ্যাস ওর আছে। কানাই একবার ভাবল ওকে বলবে কিনা যে মেয়েদের জন্যও একটা আলাদা কামরা আছে এই ট্রেনে, কিন্তু কিছু বলার আগেই গাড়ির ভিড় মেয়েটাকে গিলে ফেলল। ওকে আর দেখতেই পেল না কানাই।
ঠিক তক্ষুনি হুইসল বেজে উঠল আর কানাই নিজেও ধাক্কাধাক্কি করে উঠে পড়ল কামরাটায়। একটু ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়েই একটা খালি সিট দেখতে পেয়ে বসে পড়ল টুপ করে। ও ঠিক করেছিল এই ট্রেন জার্নির সময় কয়েকপাতা পড়ে নেবে, কিন্তু সুটকেস থেকে কাগজপত্রগুলো বের করতে গিয়েই টের পেল সিটটা মোটেই সুবিধের নয়। খুব একটা আলোও আসছে না, আর ঠিক ডানদিকেই এক মহিলার কোলে একটা বাচ্চা হাত-পা ছুঁড়ে সমানে চাঁচাচ্ছে। সারাপথ যদি ওই বাচ্চার খুদে হাত-পায়ের ঘুষি-লাথি সামলাতে সামলাতে যেতে হয়, তবে তো পড়ার দফা রফা। বাঁদিকের সিটটায় বসতে পারলে চমৎকার হত। দিব্যি আরামে পড়তে পড়তে যাওয়া যেত জানালার ধারে বসে। কিন্তু সেখানে একটা লোক বসে নিবিষ্ট মনে একটা বাংলা খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছে। লোকটাকে একটু মেপে নিল কানাই। নিরীহগোছের বয়স্ক মানুষ–একটু চাপাচাপি করলেই সরে যাবে মনে হয়।
“দাদা, একটু শুনবেন?” হাসি হাসি মুখে কানাই জিজ্ঞেস করল লোকটাকে। ভদ্রলোক কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকাতেই ভারী ভালমানুষের মতো বলল, “আপনার অসুবিধা না থাকলে আমার সঙ্গে সিটটা চেঞ্জ করবেন? আমাকে আসলে একগাদা কাজ করতে হবে, জানালার কাছে বসলে আলোটাও একটু বেশি পাব–কাগজপত্রগুলো পড়তে সুবিধা হবে।” লোকটা একটু আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকাল। মুহূর্তের জন্য মনে হল বোধহয় মুখের ওপর ‘না’ বলে দেবে। কিন্তু কানাইয়ের পোশাক-আশাক চেহারাছবি দেখে শেষপর্যন্ত মনে হল মত পালটাল লোকটা। হয়তো ভাবল, কে জানে বাবা এর হাত কত লম্বা, হয়তো পুলিশ-দারোগা নেতা-টেতা চেনাশোনা আছে– কিছুই বলা যায় না। ঝামেলায় গিয়ে কাজ নেই, তার থেকে সিটটা পালটে নেওয়াই ভাল। মানে মানে সরে গিয়ে কানাইয়ের জন্য জায়গা করে দিল লোকটা।
যাক বাবা, বিশেষ ঝামেলা ছাড়াই সিটটা পাওয়া গেল। মাথা নেড়ে লোকটাকে ধন্যবাদ জানাল কানাই। মনে মনে ঠিক করল চা-ওয়ালা এলে ওকে একটা চা অফার করবে। গুছিয়ে বসে সুটকেসের সামনের ফ্ল্যাপ থেকে এক গোছা কাগজ টেনে বের করল ও। খুদে খুদে অক্ষরে বাংলা লেখা। হাঁটুর ওপর পেতে হাত দিয়ে পাতাগুলো সমান করে নিয়ে পড়তে শুরু করল কানাই।
“কথিত আছে, মহাদেব যদি তার জটার মধ্যে গঙ্গার প্রবল স্রোতকে সংযত না করতেন, তা হলে মর্তে অবতরণের সময় নদীর তীব্র গতি পৃথিবীকে চূর্ণ চূর্ণ করে দিত। এই কাহিনি থেকে গঙ্গার একটি বিশেষ রূপ কল্পনা করা যায় : যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা বিশাল এক জলের বেণী এলিয়ে পড়েছে এক শুষ্ক, তৃষ্ণার্ত সমভূমির ওপর। কিন্তু এই নদীকাহিনিতে যে কোথাও একটা মোচড় থাকতে পারে, গঙ্গার গতিপথের একেবারে শেষ পর্যায়ে আসার আগে সেটা বোঝাই যায় না। তবে গল্পের সেই চমকপ্রদ শেষাংশ কেউ কোথাও লিখে যাননি। হয়তো কল্পনাই করেননি কেউ। আমার মনে হয়, এইভাবে তা লেখা যেতে পারে : এই এলিয়ে পড়া জলরাশির বেণী এক সময় সম্পূর্ণ খুলে যায় এবং মহাদেবের জটপাকানো কেশগুচ্ছ ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এক অঞ্চল জুড়ে। একটা সময় নদী সব বাঁধন ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ে শত শত–হয়তো বা সহস্রাধিক–পরস্পরগ্রন্থিত জলধারায়।
“এখানে সমুদ্র এবং বাংলার সমতলভূমির মধ্যে সংযোগসাধন করেছে এক বিশাল দ্বীপপুঞ্জ। তার বিশাল বিস্তার চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রায় তিনশো কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই দ্বীপগুলি–পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মেঘনার তীর পর্যন্ত।
“এই দ্বীপগুলি যেন ভারতমাতার বস্ত্রের প্রান্তভাগ, যেন তার লুটিয়ে পড়া শাড়ির আঁচল–সমুদ্রের লোনা জলে আধো ভেজা। হাজার হাজার এইরকম দ্বীপ ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলে। তাদের মধ্যে কয়েকটির আয়তন বিশাল, আবার কয়েকটি ছোট্ট বালির চর মাত্র। কিছু দ্বীপ আছে লিখিত ইতিহাসের সমান বয়সি, কিছু আবার গজিয়ে উঠেছে মাত্র দু’-এক বছর আগে। এই দ্বীপগুলি যেন মাটির পৃথিবীর কাছে জলের ক্ষতিপূরণ–সারা যাত্রাপথে ধরিত্রীমায়ের কাছ থেকে সে যা গ্রহণ করেছে, এখানে সাগরে পড়ার আগে সে যেন সেই ঋণ শোধ করে দিয়ে যেতে চায়। তবে এই দানের ওপর জল কিন্তু তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। তার স্রোতধারা ছড়িয়ে থাকে সমস্ত স্থলভাগের ওপর সূক্ষ্ম এক জালের মতো। এখানে জল-স্থলের সীমা সর্বদাই পরিবর্তনশীল–সতত অনিশ্চিত।
“নদীপ্রণালীগুলির মধ্যে কয়েকটি আয়তনে বিশাল–এক তীর থেকে অন্য তীর দেখা যায় না। আবার অনেকগুলি মাত্র কয়েকশো মিটার চওড়া, লম্বায় খুব বেশি হলে দু-তিন কিলোমিটার। তবুও এদের প্রত্যেকেই একেকটি নদী, প্রতিটির একটি করে আশ্চর্য দ্যোতনাময় নামও রয়েছে। এই নদীগুলি যেখানে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়–একটা দুটো নয়, চার পাঁচটা, এমনকী কখনও কখনও ছ’টা পর্যন্ত–সে সঙ্গমস্থলের বিস্তার প্রায় দিগ্বলয়কে স্পর্শ করে। দূরে আবছায়া দেখা যায় জঙ্গল, দিগন্তের কাছে স্থলভূমির প্রতিধ্বনির মতো। কথ্য ভাষায় এই সঙ্গমের নাম মোহনা–এক আশ্চর্য মনোমুগ্ধকর শব্দ, প্রায় মাদকতাময়।
“এইখানে মিঠেজল আর লোনাজল, নদী আর সমুদ্রের মধ্যে কোনও সীমারেখা নেই। জোয়ারের স্রোত উজানে তিনশো কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছয়, আর প্রতিদিন বানের সময় হাজার হাজার একর জঙ্গল চলে যায় জলের তলায়। ভাটা এলে জল নেমে যায়, আবার মাথা তুলে ওঠে অরণ্য। জলের স্রোত এমনই তীব্র যে দ্বীপগুলির আকৃতি প্রায় প্রতিদিনই বদলে যায়। কোনওদিন হয়তো গোটা একটা উপদ্বীপ বা ছোটখাটো অন্তরীপ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় স্রোতের টানে, আবার কখনও বা জলের মধ্যে। হঠাৎ জেগে ওঠে একটা নতুন চর।
“এইভাবে জোয়ার-ভাটার টানে যখনই একটা নতুন চর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, প্রায় রাতারাতি সেখানে গজিয়ে উঠতে থাকে ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছ। পরিবেশ যদি অনুকূল হয়, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ঘন জঙ্গলে ছেয়ে যায় পুরো দ্বীপ। এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য যেন সম্পূর্ণ আলাদা এক জগৎ–অন্য কোনও বনজঙ্গলের সঙ্গে কোনও মিলই নেই এর। অন্য জঙ্গলের মতো কোনও আকাশছোঁয়া গুল্মশোভিত গাছ এখানে নেই, ফার্ন বা জংলা ফুল নেই, কাকাতুয়ার মতো পাখিও এখানে চোখে পড়ে না। ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছের পাতা হয় পুরু এবং শক্ত। গ্রন্থিল শাখা এবং ঘন পল্লবরাজির জন্য এ ধরনের জঙ্গল হয় একেবারে দুর্ভেদ্য। বনের গভীরে আলো প্রায় ঢোকে না বললেই চলে। ফলে দিনের বেলাতেও সামান্য দূরের জিনিস কষ্ট করে ঠাহর করতে হয়। বাতাসও এখানে নিশ্চল আর পূতিগন্ধময়। এ বনে ঢোকা মাত্রই যে কারও মনে হবে এ এক ভয়ংকর শত্ৰুপুরী। জীবন্ত এক ধূর্ত প্রাণীর মতো যেন তেন প্রকারেণ এই জঙ্গল আগন্তুককে হয় প্রাণে মারতে চায়, নয়তো দূর করে দেয় তার ত্রিসীমানা থেকে। প্রতি বছরই এই দুর্ভেদ্য অরণ্যে প্রাণ দেয় বহু মানুষ হয়–বাঘের হাতে, নয়তো কুমির বা সাপের কামড়ে।
“এ অরণ্যে এমন কিছুই নেই কোনও বহিরাগতের কাছে সুন্দর বলে মনে হতে পারে। তবুও সারা পৃথিবী এই দ্বীপপুঞ্জকে ‘সুন্দরবন’ নামেই জানে। অনেকে মনে করে ম্যানগ্রোভজাতীয় সুন্দরী গাছ–হেরিটেরিয়া মাইনর–এখানে বেশি আছে বলে এ বনের নাম সুন্দরবন। তবে এ জঙ্গলের নাম বা ইতিহাস খুঁজে বের করা এক কঠিন কাজ, কেননা মুঘল আমলের নথিপত্রে এই জায়গার প্রসঙ্গে কোনও বিশেষ গাছের নাম করা হয়নি, বরং উল্লেখ করা হয়েছে নদীর স্রোতবিশেষের–ভাটির। এখানকার দ্বীপবাসীরাও এ দেশকে ভাটির দেশ বলেই জানে। জোয়ার নয়, সমুদ্রমুখী জলের টান, অর্থাৎ ভাটা থেকেই এ জায়গা তার নাম পেয়েছে। কেননা জোয়ার যখন আসে, এ অঞ্চলের অধিকাংশই তখন চলে যায় জলের তলায়। কেবল মাত্র ভাটার সময়ই জল থেকে জন্ম নেয় জঙ্গল। অরণ্যের এই জন্মপ্রক্রিয়া (যেখানে ধাইয়ের কাজটা করে চাঁদ) লক্ষ করলেই বোঝা যাবে যে ‘ভাটির দেশ’ নামটি শুধু যথার্থই নয়, এটাই আসল নাম হওয়া উচিত এই অঞ্চলের। কারণ রিলকের কবিতার হ্যাঁজেল গাছ থেকে ঝুলন্ত তন্তুজাল বা কালো মাটির ওপর বসন্তের বৃষ্টির মতো, ভাটার স্রোতের দিকেও যখন আমরা তাকাই,
এই আমরা, যারা আনন্দকে
জেনেছি উদীয়মান, ঊর্ধ্বগামী, আমাদেরও হয় অনুভূত
সেই সূক্ষ্ম আবেগ, যা প্রায় বিহ্বল করে যখন আনন্দময় কোনো-কিছু
পড়ে যায়।”
.
আমন্ত্রণ
শহুরে এলাকা ছাড়িয়ে মিনিট বিশেক চলার পর ট্রেনটা একটা স্টেশনে এসে থামতেই কপালজোরে জানালার পাশের সিটটা পেয়ে গেল পিয়া। এতক্ষণ ও ঘুপচিমতো একটা কোনার দিকে ভিড়ে ঠাসা বেঞ্চির ওপর কোনওরকমে আলগাভাবে বসেছিল। সামনে পড়েছিল গন্ধমাদনের মতো বিশাল পিঠব্যাগগুলো। জানালার পাশে এসে এবার একটু হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পেল। বাইরে তাকিয়ে দেখল স্টেশনটার নাম চম্পাহাটি। প্ল্যাটফর্মটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে কতগুলো নোংরা ঝুপড়ির কাছে, তারপর ডুব দিয়েছে একটা এঁদো ডোবার মধ্যে। ডোবার ঘোলাটে জলে থকথকে ময়লা ফেনা ভাসছে। কামরার ভেতরে এখনও তিলধারণের জায়গা নেই। তার মানে ক্যানিং পর্যন্ত এইরকমই চলবে। রেললাইন বরাবর ঝুপড়ি-বস্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে ও ভাবছিল, কে বলবে যে সুন্দরবনের প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে ট্রেনটা?
প্ল্যাটফর্মে একটা লোক চা বিক্রি করছে। জানালা দিয়ে হাত বার করে ইশারায় ওকে ডাকল পিয়া। দাম মিটিয়ে জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে গরম ভাড়টা যেই ও হাতে নিয়েছে, সামনের সিটে বসা লোকটা কীসের যেন একটা পাতা ওলটাল, আর তার হাতের ধাক্কায় ভাড় থেকে চলকে পড়ল খানিকটা চা। চট করে হাত ঘুরিয়ে নিয়ে পিয়া চেষ্টা করল যাতে বেশিরভাগটাই জানালার বাইরে পড়ে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কয়েকটা ফোঁটা গিয়ে পড়ল লোকটার হাতের কাগজে। “ওহ, আই অ্যাম সো সরি”–একেবারে মরমে মরে গেল পিয়া। কামরার সবগুলো লোকের মধ্যে বেছে বেছে এই লোকটার সঙ্গেই এরকম হল! ঢাকুরিয়া স্টেশনেই ওকে লক্ষ করেছিল পিয়া। লোকটার ঘাড় হেলিয়ে দাঁড়ানোর মধ্যে এমন একটা আত্মতুষ্ট ভাব ছিল যে সেটা নজর না করে পারেনি ও। স্টেশনের অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা করে চোখে পড়ছিল লোকটাকে; অসংকোচে চারপাশের প্রত্যেকের দিকে তাকিয়ে দেখছিল–প্রতিটা লোককে খুঁটিয়ে নজর করে, যেন মনে মনে মেপেজুপে আলাদা আলাদা করে রেখে দিচ্ছিল যার যার নিজের জায়গায়। অন্যকে নিজের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার একটা অনায়াস দক্ষতাও আছে লোকটার, লক্ষ করেছিল পিয়া, যখন পাশের ভদ্রলোককে জানালার কাছের সিটটা থেকে সরিয়ে দিল ও। ওকে দেখে নিজের কয়েকজন কলকাতার আত্মীয়র কথা মনে পড়ছিল পিয়ার। মনে হচ্ছিল তাদেরই মতো অনেকটা এই লোকটা, এরা মনে করে যেন পৃথিবীর যাবতীয় সুখসুবিধা এদেরই প্রাপ্য (শ্রেণিগত কারণ, না শিক্ষা?), আশা করে যেন ছোটখাটো সমস্যা-টমস্যাগুলো ওদের সুবিধার জন্য আপনা থেকেই সরে যাবে।
“এই নিন,” লোকটার দিকে একমুঠো টিস্যু পেপার এগিয়ে দিল ও। “আমি হেল্প করছি আপনাকে কাগজগুলো মুছতে।”
“দরকার নেই। একেবারে বারোটা বেজে গেছে।” বিরক্ত মুখ করে দুমড়ে মুচড়ে কাগজগুলো জানালার বাইরে ছুঁড়ে দিল লোকটা।
একটু থতমত খেয়ে গেল পিয়া। মিনমিন করে বলল, “খুব একটা ইম্পর্ট্যান্ট কিছু ছিল না তো?”
“সেরকম অপূরণীয় ক্ষতি কিছু হয়নি। একটা লেখার জেরক্স কপি ছিল ওগুলো।”
এক মুহূর্তের জন্য পিয়ার মনে হল লোকটাকে বলে যে ওরই হাতের ধাক্কায় পড়েছিল চা-টা, কিন্তু ওর মুখ দিয়ে শুধু বেরোল, “আমি খুবই দুঃখিত। কিছু মনে করলেন না আশা করি।”
“মনে করেও কি লাভ আছে কিছু?” ব্যঙ্গের চেয়ে চ্যালেঞ্জের ভাবই যেন বেশি প্রশ্নটার মধ্যে। “আজকের দুনিয়ায় আমেরিকানদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কেউ কি সুবিধা করতে পারে?”
ঝগড়া করার ইচ্ছে ছিল না, তাই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল পিয়া। বদলে একটা তারিফের ভাব দেখিয়ে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, “কী করে বুঝলেন?”
“কী বুঝলাম?”
“যে আমি আমেরিকান? আপনার চোখ আছে বলতে হবে।”
একটু যেন শান্ত হয়ে লোকটা আরাম করে সিটে হেলান দিল। “বোঝার কিছু নেই, আমি জানতাম।”
“কী করে জানতেন? আমার উচ্চারণ শুনে?”
“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল লোকটা। “উচ্চারণ শুনে লোক চিনতে ভুল আমার কমই হয়। আসলে আমি ট্রান্সলেটর। দোভাষীর কাজও করি। এটাই আমার পেশা। উচ্চারণের সামান্য তফাতও সেই জন্যে আমি চট করে ধরে ফেলতে পারি।”
“সত্যি?” পিয়া হাসল। ওর ডিমাকৃতি শ্যামলা মুখে সাদা দাঁতগুলো ঝিকিয়ে উঠল। “কটা ভাষা জানেন আপনি?”
“ছ’টা। ডায়লেক্টগুলো বাদ দিয়ে।”
“ওয়াও!” সত্যি সত্যি তারিফের সুর এবার পিয়ার গলায়। “আমি তো শুধু ইংরেজিটাই জানি, আর সেটাও যে খুব একটা ভাল জানি তা নয়।”
একটু আশ্চর্য হল লোকটা। “আপনি বলছিলেন আপনি ক্যানিং যাচ্ছেন, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু পথঘাট চেনেন না, বাংলা-হিন্দি না জানলে ওখানে গিয়ে তো মুশকিলে পড়বেন।”
“মনে হয় না। এসব অভ্যেস আছে আমার,” হেসে ফেলল পিয়া। “কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যায়। তা ছাড়া আমার যা কাজ তাতে কথাবার্তার বিশেষ কোনও দরকারও পড়ে না।”
“কী কাজ করেন আপনি, জানতে পারি?”
“আমি সিটোলজিস্ট। মানে–” ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে যাচ্ছিল পিয়া, কিন্তু মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিল লোকটা।
“সিটোলজিস্ট মানে আমি জানি। আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না। আপনি জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিয়ে কাজ করেন, তাই তো?”
“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল পিয়া। “আপনি তো অনেক কিছু জানেন দেখছি। জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ওপরই গবেষণা করি আমি–ডলফিন, তিমি, ডুগং এইসব। কাজের জন্য অনেকটা সময়ই আমাকে জলের ওপর কাটাতে হয়। কথা বলার মতো ধারে কাছে কেউ থাকেই না। অন্তত ইংরেজি বলার মতো কেউ তো নয়ই।”
“তা হলে কাজের সূত্রেই আপনি ক্যানিং যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ। সুন্দরবনের এইসব জলচর প্রাণীদের স্টাডি করার ইচ্ছে আছে আমার। আশা করি কোনওরকমে পারমিট একটা জোগাড় হয়ে যাবে।”
এবার একটু থমকাল লোকটা। একটুই অবশ্য। “সুন্দরবনে এরকম প্রাণী আছে নাকি? আমি তো জানতামই না।”
“আছে। মানে একসময় ছিল তো বটেই। প্রচুরই ছিল।”
“তাই? সুন্দরবন মানেই তো আমাদের ধারণা শুধু বাঘ আর কুমির।”
“জানি। সুন্দরবনের অন্য সব জলচর প্রাণীর কথা লোকে প্রায় ভুলেই গেছে। কারণটা বলা মুশকিল। হতে পারে যে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে জীবগুলো। অথবা, এদের নিয়ে কখনও কোনও গবেষণা হয়নি, সে কারণে সাধারণ মানুষ এদের কথা জানে না, তাও হতে পারে। এমনকী ঠিকমতো সার্ভেও কখনও করা হয়নি।”
“কেন?”
“হয়তো পারমিশন পাওয়া যায় না বলে। গত বছর একটা টিম এসেছিল এখানে সার্ভের জন্য। বেশ কয়েকমাস ধরে ওরা প্রস্তুতি করেছিল, দরকারি কাগজপত্র ঠিকঠাক পাঠিয়েছিল, কিন্তু শেষে যেতেই পারল না নদী পর্যন্ত। একেবারে লাস্ট মোমেন্টে পারমিট বাতিল করা হল।”
“আপনার ক্ষেত্রেও তো একই ব্যাপার ঘটতে পারে?”
“একা থাকলে কঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাওয়াটা অনেক সোজা।”
একটু থেমে মুচকি হাসল পিয়া–”তা ছাড়া কলকাতায় আমার এক কাকা আছেন বেশ উঁচু সরকারি পদে। উনি ক্যানিং-এ ফরেস্ট অফিসে একজনের সঙ্গে কথা বলে রেখেছেন। এখন দেখা যাক কী হয়।”
“আই সি!” পিয়ার এই অকপট অথচ চালাক-চতুর ভাবটা লোকটার ভাল লেগেছে মনে হল। “তা হলে ক্যালকাটায় আত্মীয়স্বজন আছে আপনার?”
“হ্যাঁ। আমার নিজের জন্মও ওখানেই। আমার বাবা-মা দেশ ছেড়েছেন যখন আমার এক বছর বয়স।” কথাটা বলেই লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ও ভুরু তুলে বলল, “আপনিও দেখছি ক্যালকাটা বলেন। আমার বাবাও এখনও বলেন ক্যালকাটা।”
মাথা নেড়ে ভুলটা স্বীকার করল কানাই। “ঠিকই বলেছেন, একটু খেয়াল রাখতে হবে নামটা বলার সময়।” হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিল ও–”পরিচয়টা সারা যাক। আমার নাম কানাই দত্ত।”
“আমি পিয়ালি রয়। সবাই পিয়া বলেই ডাকে।”
ওর এমন পরিষ্কার বাংলা নাম শুনে কানাই একটু আশ্চর্য হয়েছে বুঝতে পারল পিয়া। আরও বিশেষ করে এইজন্য যে পিয়া নিজে ভাষাটা জানে না। কানাই হয়তো ভেবেছিল পিয়ার বাবা-মা ইন্ডিয়ার অন্য কোনও অঞ্চলের লোক হবে।
“আপনার নামটা তো দেখছি বাঙালি, কিন্তু আপনি বাংলা জানেন না?”
“দোষটা ঠিক আমার নয়,” তাড়াতাড়ি বলল পিয়া। “আমি আমেরিকায় বড় হয়েছি। আর আমরা যখন দেশ ছেড়ে গেছি তখন আমি এত ছোট যে ভাষাটা শেখার সুযোগই পাইনি।”
“সেরকম হিসেব করলে তো আমারও ইংরেজি বলার কথা নয়। কারণ আমি বড় হয়েছি কলকাতায়।”
“আসলে ভাষার ব্যাপারে আমার মাথা বিশেষ কাজ করে না…” কথাটা শেষ করল না ও, যেন বাতাসে ভাসিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আপনি কেন ক্যানিং যাচ্ছেন, মিস্টার দত্ত?”
“কানাই–আমাকে কানাই বলে ডাকতে পারেন।”
“কান-আয়,” একটু হোঁচট খেয়ে উচ্চারণ করল পিয়া। ওকে শুধরে দেওয়ার জন্য কানাই বলল, “হাওয়াই-এর সঙ্গে মিলিয়ে বলতে পারেন।”
“কানাই?”
“দ্যাটস রাইট। এবার আপনার প্রশ্নের জবাব দিই–আমি আমার এক মাসির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।”
“উনি ক্যানিং-এ থাকেন?”
“না। উনি থাকেন লুসিবাড়ি বলে একটা ছোট্ট দ্বীপে। ক্যানিং থেকে বহুদূর।”
“ঠিক কোন জায়গায়?” পিঠব্যাগের চেন খুলে একটা ম্যাপ বের করল পিয়া। “জায়গাটা কোথায় এই ম্যাপে একটু দেখিয়ে দিন আমাকে।”
ম্যাপটা খুলে ধরে আঙুল দিয়ে একটা লম্বা আঁকাবাকা কাল্পনিক রেখা টানল কানাই। “ট্রেনে করে এলে ক্যানিং হল সুন্দরবনে ঢোকার দরজা। আর লুসিবাড়ি হল এই যে, এইখানে–একেবারে শেষপ্রান্তে। এর পরে আর কোনও দ্বীপে মানুষ থাকে না। অ্যানপুর, জেমসপুর, এমিলিবাড়ি ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা নদীপথে গেলে আপনি লুসিবাড়ি পৌঁছবেন।”
ম্যাপ দেখতে দেখতে ভুরু কোঁচকাল পিয়া, “অদ্ভুত সব নাম।”
“সুন্দরবনের কত জায়গার নাম যে ইংরেজি থেকে এসেছে জানলে আশ্চর্য হয়ে যাবেন। লুসিবাড়ি মানে হল লুসির বাড়ি।”
“লুসির বাড়ি?” অবাক হয়ে তাকাল পিয়া। “মানে লুসি নামের কোনও মেয়ের বাড়ি?”
“একজ্যাক্টলি,” কানাইয়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “আপনি একবার এসে দেখে যেতে পারেন জায়গাটা। লুসিবাড়ি নামটা কী করে হল আপনাকে শোনাব।”
“নিমন্ত্রণ করছেন?” মুচকি হেসে পিয়া জিজ্ঞেস করল।
“অবশ্যই। চলে আসুন। আপনি এলে আমারও বনবাসের ভার একটু কমে।”
পিয়া হাসল। শুরুতে মনে হচ্ছিল কানাই একেবারেই আত্মকেন্দ্রিক একটা লোক, কিন্তু এখন মনে হল আরেকটু উদারভাবে দেখা যেতে পারে মানুষটাকে। কোথাও যেন একটা বৈপরীত্য রয়েছে ওর চরিত্রের মধ্যে। আর তার জন্যেই ওর আত্মকেন্দ্রিক ভাবটাও খানিকটা ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে। অন্তত পিয়া প্রথমে যা ভেবেছিল তার তুলনায় তো বটেই।
“কিন্তু আপনাকে পাব কোথায়? কোথায় গিয়ে খুঁজব?”
“আপনি সোজা লুসিবাড়ি হসপিটাল চলে যাবেন। সেখানে গিয়ে মাসিমার খোঁজ করলেই লোকে আপনাকে আমার মাসির কাছে নিয়ে যাবে। আর মাসির সঙ্গে দেখা করলেই আমার খোঁজ পেয়ে যাবেন।”
“মাসিমা?” পিয়া জিজ্ঞেস করল। “মাসিমা তো আমারও একজন আছেন। মাসিমা মানে মায়ের বোন তো, তাই না? শুধু মাসিমা বললেই হবে? আরও অনেকেরই নিশ্চয়ই মাসিমা থাকতে পারেন ওখানে?”
“আপনি যদি হসপিটালে গিয়ে মাসিমার কথা বলেন, যে কেউ বুঝবে আপনি কার সঙ্গে দেখা করতে চান। ওই হসপিটালটা আমার মাসিই শুরু করেছিলেন, আর যে সংস্থা ওটা চালায়–বাদাবন ট্রাস্ট–উনি তার সর্বেসর্বা। ওঁর নাম নীলিমা বোস, কিন্তু সবাই ‘মাসিমা বলেই ডাকে ওখানে। আমার মেসো আর মাসি ছিলেন একেবারে যাকে বলে রাজযোটক–ওখানকার সকলের সার’ আর ‘মাসিমা।”
“সার? তার মানে?”
কানাই হেসে ফেলল। “ওটা হল sir বলার বাংলা ধরন। আসলে উনি ছিলেন ওখানকার স্কুলের হেডমাস্টার। তাই সব ছাত্ররা ওনাকে sir-ই বলত। লোকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল ওনার একটা আসল নাম আছে–নির্মল বোস।”
“আপনি ওনার বিষয়ে পাস্ট টেন্স-এ কথা বলছেন যে?”
“হ্যাঁ। উনি বহুদিন হল মারা গেছেন।” মুখটা একটু বিকৃত করল কানাই; যেন মনে মনে স্বীকার করতে চায় না ব্যাপারটাকে।
“তবে এই মুহূর্তে কী মনে হচ্ছে আমার জানেন তো? মনে হচ্ছে মেসো যেন বেঁচেই আছেন এখনও।”
“কী রকম?”
“কারণ উনি প্রায় কবর খুঁড়ে উঠে এসে ডেকে পাঠিয়েছেন আমাকে,” হাসল কানাই।
“আসলে মারা যাওয়ার সময় মেসো কিছু কাগজপত্র আমার জন্য রেখে গিয়েছিলেন। এত বছর সেগুলোর কোনও হদিশ ছিল না, কিন্তু রিসেন্টলি পাওয়া গেছে। সেইজন্যই আমি লুসিবাড়ি যাচ্ছি। মাসির খুব ইচ্ছে আমি একবার গিয়ে কাগজগুলো দেখি।”
ওর কথার মধ্যে ক্ষীণ একটা বিরক্তির আভাস পেল পিয়া। “মনে হচ্ছে আপনার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না আসার?”
“ধরেছেন ঠিক। আদৌ ইচ্ছে ছিল না,” বলল কানাই। “হাতে এমনিতেই প্রচুর কাজ, আর এই সময়টাতে কাজের চাপ খুবই বেশি থাকে। এখন এক সপ্তাহ ছুটি নেওয়া–”
“ও। এই প্রথম আপনি যাচ্ছেন ওখানে?”
“না, প্রথম নয়। অনেক বছর আগে আরেকবার আমাকে ওখানে পাঠানো হয়েছিল।”
“পাঠানো হয়েছিল? কেন?”
“সে গল্প বলতে গেলে একটা ইংরেজি শব্দের কথা টানতে হয়, বুঝলেন?” হাসল কানাই। “রাস্টিকেট’ শব্দটা জানেন তো?”
“না। কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।”
“এটা আসলে ছিল একটা শাস্তির ব্যবস্থা, দুষ্ট্র স্কুলছাত্রদের জন্য, কানাই বলল। “আগেকার দিনে এরকম দুরন্ত ছেলেদের সব গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হত গেঁয়ো, মানে রাস্টিক, লোকেদের কাছে। যখন ছোট ছিলাম, আমার ধারণা ছিল অনেক কিছুই আমি আমার মাস্টারমশাইদের থেকে বেশি জানি। একবার আমি একজন টিচারকে সবার সামনে অপদস্থ করেছিলাম। সে ভদ্রলোক কিছুতেই ‘লায়ন’ শব্দটা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না। বলতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে ফেলতেন, ফলে অদ্ভুত শোনাত শব্দটা, খানিকটা ‘গ্রয়েন’-এর সঙ্গে ছন্দে মিলত। আমার বয়স তখন দশ। তো, তারপর অনেক ঝামেলা-টামেলা হল, স্কুল থেকে আমার বাবা-মাকে জানানো হল যে আমাকে রাস্টিকেট করা হবে। সেই সময়ে আমাকে মাসি-মেসোর কাছে লুসিবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল,” ঘটনাটা মনে করে হাসি পেল কানাইয়ের। “সে কতকাল আগের কথা, ১৯৭০।”
ট্রেনের গতি কমতে শুরু করেছিল; কানাইয়ের কথার মাঝখানেই হুইসল বাজল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে স্টেশনের হলুদ সাইনবোর্ডটা দেখতে পেল ও–”ক্যানিং।”
“এসে গেছি,” ট্রেনের আলাপ এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ যেন মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল কানাইয়ের। এক টুকরো কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে খসখস করে কয়েকটা শব্দ লিখে ও পিয়ার হাতে দিল–”এটা রাখুন, আমাকে খুঁজে বার করতে কাজে লাগবে।”
ট্রেন থামতেই কামরার সব লোক হুড়মুড় করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পিয়াও দাঁড়িয়ে উঠে পিঠব্যাগগুলো কাঁধে ঝোলাল। “আবার হয়তো দেখা হয়ে যাবে।”
“আশা করি।” হাত নাড়ল কানাই। “মানুষখেকো বাঘ আছে কিন্তু, সাবধানে থাকবেন।”
“আপনিও ভাল থাকবেন। চলি।”
.
ক্যানিং
প্ল্যাটফর্মের ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া পিয়ার পিঠের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে রইল কানাই। বিয়ে-টিয়ে এখনও করেনি যদিও, কিন্তু নিজেকে ও বলে “রেয়ারলি সিঙ্গল”–কদাচিৎ সঙ্গিনীহীন। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু মহিলা ওর জীবনে এসেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পর্কগুলো একটা মধুর আন্তরিকতায় শেষ হয়েছে–অথবা টিকে রয়েছে। শেষবারের বিচ্ছেদের ঘটনাটা অবশ্য খুব একটা মধুর হয়নি। মেয়েটি ছিল বিখ্যাত এক কমবয়সি ওড়িশি নৃত্যশিল্পী। সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রচণ্ড রেগেমেগে কানাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে ওকে ফোনে আর যোগাযোগ করতে বারণ করেছিল। ব্যাপারটা তখন খুব সিরিয়াসলি নেয়নি কানাই। কিন্তু তারপরে যখন মেয়েটির মোবাইলে ফোন করল, দেখল সেটা ও ওর ড্রাইভারকে দিয়ে দিয়েছে। ঘটনাটায় বেশ জোরালো একটা ধাক্কা খেয়েছিল কানাইয়ের অহমিকা। তারপর থেকেই সেই ভাঙা অহংকারকে জোড়া দিতে ও যে-কোনও একটা সংক্ষিপ্ত সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করছে–এমন একটা সম্পর্ক, যার শুরু আর শেষের চাবিকাঠি ওরই হাতে থাকবে। কিন্তু এ যাবৎ সে চেষ্টায় বিশেষ কোনও ফল হয়নি। লুসিবাড়ি ভ্রমণের সময়টায় কানাই ভেবেছিল এই বান্ধবী খোঁজার চেষ্টায় একটা সাময়িক বিরতি দেবে। তবে এটাও ও জানে যে জীবনে অনেক সম্ভাবনারই জন্ম হয় খুব অপ্রত্যাশিত ভাবে। যেমন, পিয়ার সঙ্গে আজ ট্রেনের আলাপটা। এরকম প্রায় ঘঁচে-ফেলা আদর্শ একটা সিচুয়েশন খুব সহজে মেলে না : নদিন পরে ওকে ফিরতেই হবে, কাজেই কেটে পড়ার রাস্তাও পরিষ্কার। আর পিয়া যদি ওর নিমন্ত্রণ রাখতে লুসিবাড়ি শেষপর্যন্ত যায়, তা হলে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলারও কোনও মানে হয় না।
ট্রেনের ভিড় পাতলা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কানাই। তারপর প্ল্যাটফর্মে নেমে এসে সুটকেসটা দুপায়ের মাঝে রেখে ধীরেসুস্থে চারিদিকে তাকাল।
নভেম্বর শেষ হয়ে আসছে। মিঠে রোদ্দুর আর ঠান্ডা বাতাসে বেশ একটা খড়খড়ে ভাব। হাওয়া বইছে, তবে খুব জোরে নয়। কিন্তু কীরকম যেন একটা ক্লান্ত মরকুটে ভাব স্টেশনটার, যেন ক্ষয়টে মাটি-বেরোনো ঘাসহীন একটা শহুরে পার্ক। চকচকে রেললাইন বরাবর স্তরে স্তরে জমে আছে পেচ্ছাপ পায়খানা আর যত রাজ্যের আবর্জনা; আর প্ল্যাটফর্মটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেমন যেন মাটিতে গেঁথে বসে গেছে মানুষের পায়ের চাপে।
এই স্টেশনে প্রথম ও এসেছিল তিরিশ বছরেরও বেশি আগে, কিন্তু এখনও কানাই পরিষ্কার মনে করতে পারে কেমন আশ্চর্য হয়ে ও মাসি-মেসোকে জিজ্ঞেস করেছিল, “এখানে এত লোক থাকে?”
মজা পেয়ে হেসেছিল নির্মল। “তুমি কী ভেবেছিলে? শুধু জঙ্গল থাকবে?”
“হ্যাঁ।”
“লোকজন ছাড়া ওরকম জঙ্গল শুধু সিনেমাতেই হয়। এখানে একেকটা জায়গা আছে যেখানে একেবারে কলকাতার বাজারের মতো ভিড়। আর কোনও কোনও নদীতে যত নৌকো দেখতে পাবে, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডেও তত ট্রাক থাকে না।”
নিজের সমস্ত গুণের মধ্যে কানাইয়ের সবচেয়ে গর্ব ওর স্মৃতিশক্তি নিয়ে। লোকে যখন এতগুলো ভাষা জানার জন্য ওর প্রশংসা করে, কানাইয়ের ধরাবাঁধা জবাব হল পরিষ্কার কান আর ভাল স্মৃতিশক্তি থাকলেই যে-কোনও ভাষা শেখা যায়; আর ওর সৌভাগ্য যে এ দুটোই ওর আছে। তাই এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও নির্মলের গলার স্বর আর কথা বলার ধরন স্পষ্ট মনে আছে দেখে বেশ একটু আত্মতৃপ্তি অনুভব করল কানাই।
শেষ যেবার নির্মলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেবারের কথা মনে পড়তে বেশ একটু হাসিই পেল ওর। সেটা সত্তরের দশকের শেষ দিক, কানাই তখন কলকাতায় কলেজে পড়ে। ক্লাসে যেতে দেরি হয়ে গেছে বলে ও তাড়াহুড়ো করে হাঁটছিল। ইউনিভার্সিটির ফুটপাথে পুরনো বইয়ের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে প্রায় দৌড়ে যাওয়ার সময় একটা লোকের গায়ে গোঁত্তা খেল কানাই। ভদ্রলোক দোকানে দাঁড়িয়ে একটা বই উলটে পালটে দেখছিলেন। কানাইয়ের আচমকা ধাক্কায় বইটা হাত থেকে উড়ে গিয়ে পড়ল পথের পাশে জমা জলে। “রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতে পারো না বোকাচোদা”–বলে লোকটাকে খিস্তি করতে গিয়েই মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে মেসোর হকচকিয়ে যাওয়া চোখদুটো ওর নজরে এল।
“আরে কানাই নাকি?”
“আরে তুমি!” নিচু হয়ে মেসোকে প্রণাম করার সময় জলে-পড়া বইটাও তুলে নিল ও। বিধ্বস্ত মলাটটায় চোখ পড়ল কানাইয়ের–ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের Travels in Mughal Empire.
দোকানদার ততক্ষণে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে–”এত দামি বইটার বারোটা বাজিয়ে দিলেন মশাই, এটার দাম দিয়ে যেতে হবে আপনাকে।” মেশোর কাঁচুমাচু মুখের দিকে একঝলক তাকিয়েই কানাই বুঝতে পারল এত পয়সা মেশোর সঙ্গে নেই। ঘটনাচক্রে ও নিজে সেদিনই কিছু টাকা পেয়েছিল–একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে কাগজে, তার পারিশ্রমিক। পকেট থেকে ওয়ালেট বার করে দাম মিটিয়ে বইটা নির্মলের হাতে গুঁজে দিল কানাই। পুরো ব্যাপারটাই ঘটে গেল লহমার মধ্যে। অপ্রস্তুত মেসোকে কোনও কৃতজ্ঞতার কথা বলার সুযোগ না দেওয়ার জন্য ও তড়বড় করে বলল, “আমাকে এখন দৌড়োতে হবে, ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।” একলাফে জল-জমা একটা গর্ত পেরিয়ে সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেল কানাই।
এরপর কতবার ওর মনে হয়েছে আবার কখনও ঠিক এভাবেই দেখা হয়ে যাবে মেশোর সঙ্গে–দোকানে দাঁড়িয়ে কোনও দামি বই নেড়েচেড়ে দেখবে নির্মল, সে বই হয়তো তার কেনার সামর্থ্য নেই, আর কানাই তখন এসে বইটা মেসোকে কিনে দেবে। কিন্তু সেরকম কিছু আর ঘটেনি। কলেজ স্ট্রিটের সেই দুপুরের প্রায় দু’বছর পরে দীর্ঘদিন রোগে ভুগে লুসিবাড়িতে মারা গেল নির্মল। মৃত্যুশয্যায় মেসোর ওর কথা মনে পড়েছিল, নীলিমার কাছ থেকে পরে শুনেছে কানাই। নিজের কোনও একটা লেখা কানাইকে পাঠিয়ে দিতে বলেছিল। কিন্তু মারা যাওয়ার বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই মেসোর কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে গিয়েছিল, তাই নীলিমা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি কী করবে। নির্মল যাওয়ার পর সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল–যদি কোথাও কিছু থেকে থাকে। কিছুই পাওয়া যায়নি। নীলিমারও তাই মনে হয়েছিল ওসব লেখা-টেখার কথা হয়তো প্রলাপের ঘোরেই বলা। শেষের দিকে এমনিতেই তো অকারণে বিড়বিড় করত মানুষটা।
কিন্তু মাসদুই আগে একদিন সকালে দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের ফ্ল্যাটে হঠাৎ মাসির একটা ফোন পেল কানাই। নীলিমা ফোন করেছিল গোসাবার একটা বুথ থেকে–লুসিবাড়ির কাছেই আধা শহর-আধা গঞ্জ একটা জায়গা। ফোনটা যখন বাজল, কানাই তখন ব্রেকফাস্টের অপেক্ষায় খাওয়ার টেবিলে বসে।
“কানাই বলছিস?”
দু’-একটা এটা সেটা কথা, কুশল প্রশ্নের পরেই ওর মনে হল মাসির গলায় কেমন একটা বাধোবাধো সুর। যেন কী একটা বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। “কিছু হয়েছে নাকি মাসি?
তুমি কি কিছু বলবে আমাকে?” কানাই জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ রে, একটা কথা বলার ছিল,” নীলিমার স্বর একটু অপ্রতিভ।
“কী ব্যাপার? বলো না।”
“আমি ভাবছিলাম, মানে, তুই যদি একবার কয়েকদিনের জন্য লুসিবাড়িতে আসতে পারিস খুব ভাল হয় রে কানাই। তুই কি পারবি?”
একটু অবাকই হল কানাই। ঠিকই, নীলিমার ছেলেপুলে নেই, নিকট আত্মীয় বলতে একমাত্র ও-ই, কিন্তু এরকম দাবি মাসি আর কখনও করেছে বলে মনে পড়ল না ওর। নীলিমা বরাবরই একটু চাপা প্রকৃতির, কারও কাছে কোনও অনুগ্রহ চাওয়া তার স্বভাবে নেই। “কেন বলো তো?” আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই।
ফোনের ওপারে কয়েকমুহূর্ত কোনও শব্দ নেই। তারপর নীলিমা বলল, “তোর মনে আছে কানাই, অনেক বছর আগে আমি বলেছিলাম নির্মল তোর জন্য একটা লেখা রেখে গেছে?”
“হ্যাঁ, মনে তো আছেই। কিন্তু সে লেখাটা তো পাওয়া যায়নি?”
“সেটাই তো,” বলল নীলিমা। “মনে হয় শেষপর্যন্ত পেয়েছি। তোর নাম লেখা একটা মোটা প্যাকেট খুঁজে পাওয়া গেছে।”
“কোথায় পেলে?”
“নির্মলের পড়ার ঘরে। আমি যেখানে থাকি, ট্রাস্টের গেস্টহাউসে, তার ছাদের ওপর। ও মারা যাওয়ার পর এত বছর ধরে ঘরটা তালাবন্ধ পড়েছিল। কিন্তু এবার ওটা ভেঙে ফেলতে হবে, বাড়িটা আর একতলা বাড়াব। দু’একদিন আগে সেজন্য ঘরটা পরিষ্কার করতে গিয়ে পেলাম প্যাকেটটা।”
“ভেতরে কী ছিল?”
“নিশ্চয়ই ওইসব প্রবন্ধ, কবিতা-টবিতা যা লিখেছিল এত বছর ধরে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমি জানি না। আমার মনে হয় ও থাকলে তোকেই প্রথম ওগুলো পড়াতে চাইত। আমার লিটারারি জাজমেন্টের ওপর ওর কখনওই কোনও ভরসা ছিল না, আর আমিও সত্যি সত্যিই কিছু বুঝি না ওসব। তাই ভাবছিলাম তুই যদি একবার আসিস। হয়তো তুই লেখাগুলো ছাপানো-টাপানোরও ব্যবস্থা করতে পারবি। তোর তো অনেক পাবলিশারের সঙ্গে জানাশোনা আছে।”
“তা আছে,” কানাই বলল। মাথার মধ্যে কেমন সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল ওর।
“কিন্তু এখন লুসিবাড়িতে যাওয়া—এতদূরে–দিল্লি থেকে যেতেই তো দু’দিন লাগবে। মানে, গেলে ভালই লাগবে, কিন্তু–”
“তুই এলে আমি খুব খুশি হব, কানাই।”
নীলিমার কথা বলার এই শান্ত অথচ দৃঢ় ভঙ্গিটা কানাই খুব চেনে। কিছু একটা করবে বলে মনস্থির করলেই ওর কথা বলার ধরনটাই যেন পালটে যায়। কানাই বুঝতে পারছিল মাসি সহজে ছাড়বে না। ওদের পরিবারে তো নীলিমা তার জেদের জন্যই বিখ্যাত। আর ওই ছিনে-জেঁকের মতো লেগে থাকার ক্ষমতা আছে বলেই ও আজকের এই বাদাবন ট্রাস্ট গড়ে তুলতে পেরেছে। গ্রামের মানুষদের নিয়ে যেসব এনজিও কাজ করে, তাদের মধ্যে এই ট্রাস্টকে এখন আদর্শ বলে জানে সবাই।
“প্যাকেটটা ডাকে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না, মাসি?” শেষ চেষ্টা কানাইয়ের।
“এরকম একটা জিনিস আমি ডাকে পাঠাব? কোথায় হারিয়ে যাবে তারপর!”
“মানে, ব্যাপারটা কী জানো তো, এখন আমাদের খুব কাজের চাপ। এক্কেবারে দম ফেলার সময় পাচ্ছি না।”
“তুই তো সব সময়ই ব্যস্ত।”
“সেটা ঠিকই।” কানাইদের ফার্মটা ছোট হলেও চড়চড় করে উন্নতি করছে। এই কোম্পানি ওর নিজের হাতে গড়া, আর ও-ই এটার হর্তাকর্তা-বিধাতা। দিল্লির বিভিন্ন দূতাবাস, বহুজাতিক সংস্থা আর দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানের কাজে যে সমস্ত বিদেশি লোকজনেরা আসে, ওর কোম্পানির লোকেরা তাদের জন্য অনুবাদ আর দোভাষীর কাজ করে। এই ধরনের আর কোনও সংস্থা দিল্লিতে নেই বলেই এ লাইনে ওদের প্রায় একচেটিয়া দখল, আর চাহিদাও প্রচণ্ড। ফলে অফিসের লোকেদের সবাইকেই মুখে রক্ত তুলে খাটতে হয়; কানাইকে পরিশ্রম করতে হয় সবচেয়ে বেশি।
“তুই তা হলে আসছিস তো?” নীলিমা আবার জিজ্ঞেস করল। “প্রতি বছরই বলিস আসবি, কিন্তু শেষপর্যন্ত আর আসিস না। আমারও তো বয়স হচ্ছে, নাকি?”
একটু আগেও কানাই ভাবছিল কোনওরকমে কাটিয়ে দেবে নীলিমাকে, কিন্তু মাসির গলায় অনুনয়ের সুরটা শুনে মত পালটাল ও। বরাবরই কানাই নীলিমার একটু ন্যাওটা। মা মারা যাওয়ার পর টানটা আরও বেড়েছে। চেহারায়, স্বভাবে ওর মায়ের সঙ্গে এই মাসির খুবই মিল। মাসির জন্য কানাইয়ের শ্রদ্ধায়ও কোনও খাদ নেই। নিজের ব্যবসাটা গড়ে তুলতে গিয়ে ও হাড়ে হাড়ে বুঝেছে বাদাবন ট্রাস্টের মতো একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য কী ঝড়টা সামলাতে হয়েছে নীলিমাকে। আর ওর ব্যবসার তুলনায় নীলিমার কাজ ছিল আরও অনেক কঠিন, কারণ বাদাবন ট্রাস্ট লাভের জন্য কাজ করে না। প্রথমবার লুসিবাড়িতে গিয়ে তো ও নিজের চোখেই দেখেছে কী নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটায় ভাটির দেশের মানুষরা। আর ওরা যাতে একটু অন্তত ভাল থাকতে পারে তার জন্যই নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছে মাসি। নীলিমার এই গুণটার কোনও তুলনা খুঁজে পায় না কানাই। কেন এই জীবন মাসি বেছে নিল তারও কোনও ব্যাখ্যা ও খুঁজে পায় না। নিজের কাজের জন্য নীলিমা কোনও স্বীকৃতি পায়নি তা নয়–এই গত বছরই তো রাষ্ট্রপতির সম্মানপদক আর বড়সড় একটা উপাধি পেল। কিন্তু তাও কানাই ভাবে, যে পরিবেশ থেকে তার মাসি এই বাদাবনে এসেছিল, তাতে তার পক্ষে লুসিবাড়িতে এতগুলো বছর কাটিয়ে দেওয়াটা একটা আশ্চর্য ঘটনা। মা-র কাছ থেকে কানাই শুনেছে, তার মামাবাড়িতে আরাম-বিলাসের কোনও কমতি ছিল না। আর সে তুলনায় লুসিবাড়িতে তো সাধারণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেরও কোনও ব্যবস্থা নেই।
.
বন্ধুদের কাছে কানাই কতবার গল্প করেছে, তার মাসি কত স্বার্থত্যাগ করেছে সাধারণ মানুষের জন্য–যেন নীলিমা কোনও স্বর্ণযুগের এক চরিত্র, যে যুগে বড়লোকদের মধ্যে এত সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ছিল না। এই সমস্তকিছুই মনের মধ্যে কাজ করছিল বলে মাসির অনুরোধটা শেষপর্যন্ত ফেরাতে পারল না কানাই।
“ঠিক আছে, তুমি যখন যেতে বলছ, তা হলে তো করার আর কিছু নেই, যেতেই হবে।” একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই ও বলল। “দিনদশেকের জন্য যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমাকে কি আজকালের মধ্যেই রওয়ানা হতে বলছ?”
“না না,” নীলিমা তাড়াতাড়ি বলল। “এক্ষুনি আসার কোনও দরকার নেই।”
“তা হলে অবশ্য অনেক সহজ হয়ে যায় ব্যাপারটা আমার পক্ষে,” স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল কানাই। সেই ওড়িশি শিল্পীর সঙ্গে ওর টক-ঝাল সম্পর্কটা তখন একটা ইন্টারেস্টিং মোড় নিচ্ছিল। সেই মুহূর্তে তার ছন্দপতন ঘটানোর মতো একটা ত্যাগ স্বীকার করতে মন চাইছিল না। শেষপর্যন্ত সেটা করতে হল না ভেবে খুশি হল কানাই। “ঠিক আছে। মাস দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাব আমি। এদিকটা একটু গুছিয়ে নিয়েই তোমাকে জানাব।”
“ওকে। আমি অপেক্ষা করে থাকব।”
আর এখন, এই ক্যানিং স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কানাই দেখল শেডের নীচে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে তার মাসি–প্রায় জনাবিশেক লোক তাকে ঘিরে রয়েছে। তাদের কেউ কেউ নীলিমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে, আর কেউ রয়েছে বৃত্তের বাইরের দিকে, ভিড় ঠেলে ভেতরে পৌঁছতে পারছে না। চুপচাপ হেঁটে গিয়ে কানাই ভিড়টার পাশে দাঁড়াল। লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে মনে হল এরা কেউ এসেছে কিছু কাজের খোঁজে, আর উঠতি নেতাগোছের কিছু লোক এসেছে নীলিমার সাহায্যের আশায়। কিন্তু জটলাটার বেশিরভাগ লোকই স্রেফ শুভাকাঙ্ক্ষী। তারা শুধু নীলিমাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চায়, তার সান্নিধ্যের ছোঁয়া নিতে চায়। আর কিছু না।
এই ছিয়াত্তর বছর বয়সে নীলিমা বোস আকারে প্রায় গোল, তার টোল-পড়া গোল ঘঁদের মুখে পূর্ণিমার চাঁদের আদল। গলার স্বর নরম, কিন্তু চেরা বাঁশের গায়ে টোকা দিলে যেমন আওয়াজ বের হয় সেরকম, একটু ভাঙা। ছোট্টখাট্টো মানুষটি, মাথার চুল এখনও যথেষ্ট কালো–পেছনদিকে পুঁটলি করে বাঁধা। পরনে সর্বদাই বাদাবন ট্রাস্টে বোনা সুতির কাপড়, পাড়ে বাটিকের কাজ করা। এরকমই একটা আটপৌরে সরু কালো পাড় শাড়ি পরে নীলিমা চলে এসেছে, কানাইকে রিসিভ করতে।
এমনিতে নীলিমার ব্যবহারে সব সময়ই একটা আলগা প্রশ্রয়ের ভাব থাকে, কিন্তু দরকার পড়লেই বেরিয়ে আসে ভেতরের কঠিন মানুষটা–সে সময় তাকে অমান্য করার সাহস কারও নেই। কারণ সবাই ভাল করেই জানে, সব মা-মাসিদের মতোই নীলিমা একদিকে যেমন স্নেহময়ী, তেমনি দোষীদের কখনও ছেড়ে কথা বলা তার ধাতে নেই।
. ভিড়ের বাইরে কানাইয়ের চেহারাটা নজরে আসতেই হাতের ইশারায় লোকগুলোকে থামিয়ে দিল নীলিমা। আর জটলাটা যেন মন্ত্রবলে দু’ভাগ হয়ে গিয়ে কানাইয়ের জন্য পথ করে দিল।
“কানাই! কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আমি তো ভাবছি ট্রেন মিস করলি বোধ হয়”–প্রণাম করার জন্য নিচু হতেই হাত দিয়ে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিল নীলিমা।
“ঠিক সময়েই পৌঁছে গেছি তো৷” একহাতে মাসিকে জড়িয়ে ধরে দাঁড় করাতে করাতে কানাই ভাবছিল কী রকম বুড়িয়ে গেছে নীলিমা এই ক’বছরে। মাসির কনুইটা ধরে ধীরে ধীরে স্টেশনের গেটের দিকে এগোল ও। জটলার লোকগুলো মালপত্র নিয়ে আসতে লাগল পেছন পেছন।
“তুমি আবার খামকা ক্যানিং পর্যন্ত ঠেঙিয়ে আসতে গেলে কেন বলো তো? আমি ঠিকই পৌঁছে যেতে পারতাম।” এ কথাটা অবশ্য নিছক ভদ্রতার খাতিরেই বলা, কারণ একা খুঁজে খুঁজে লুসিবাড়ি যেতে হলে বেশ একটু মুশকিলেই পড়তে হত ওকে। আর ক্যানিং-এ এসে যদি দেখত ওকে নিতে কেউ আসেনি, মেজাজটা একেবারে খাট্টা হয়ে যেত কানাইয়ের।
নীলিমা অবশ্য অতশত বোঝেনি। “ভাবলাম চলে আসি। লুসিবাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে বেরোতে পারলে ভালই লাগে। কিন্তু সে যাকগে, ট্রেনে কোনও অসুবিধা হয়নি তো? বোর হসনি তো একা একা?”
“না না। আসলে একটা ইন্টারেস্টিং মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল, কথা বলতে বলতে চলে এলাম। আমেরিকান মেয়ে একটা।”
“তাই? এখানে কী করতে এসেছে?” জিজ্ঞেস করল নীলিমা।
“ওই ডলফিন-টলফিন জাতীয় প্রাণীদের ওপর রিসার্চ করছে। আমি ওকে বলেছি পারলে একবার লুসিবাড়ি ঘুরে যেতে।”
“বেশ করেছিস। আসবে আশা করি।”
“হ্যাঁ, আশা করি,” বলল কানাই।
চলতে চলতে আচমকা থমকে গিয়ে কানাইয়ের কনুইটা খামচে ধরল নীলিমা। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আমি তোকে নির্মলের একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম, তুই কি পেয়েছিলি?”
“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল কানাই। “সেটাই তো ট্রেনে পড়তে পড়তে এলাম। মেসো আমার জন্য যে প্যাকেট রেখে গেছে ওটা কি তার মধ্যে পেলে?”
“না না, এই লেখাটা তো বহুকাল আগের। একটা সময়–বেশ কিছুদিন–তোর মেসো সারাদিন কেমন মনমরা হয়ে থাকত। তখন আমি ভাবলাম যদি কিছু একটা কাজে ওকে জড়িয়ে রাখা যায় তা হলে হয়তো মনটা একটু ভাল লাগবে। তাই বললাম সুন্দরবন নিয়ে টুকটাক কিছু লিখতে তো পারো। ভেবেছিলাম পরে ওগুলোকে আমাদের ব্রোশিওর-টোশিওরে লাগিয়ে দেব। কিন্তু শেষপর্যন্ত ও যেগুলো লিখল, সেগুলো একটু অন্য ধাঁচের। তোর ভাল লাগতে পারে ভেবে তোকে পাঠিয়েছিলাম।”
“ও। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল ওই প্যাকেটের থেকে বের করে ওগুলো তুমি। পাঠিয়েছ।”
“না না। প্যাকেটটা আমি খুলিইনি,” বলল নীলিমা। “যেমন আঠা লাগিয়ে বন্ধ করা ছিল সেরকমই আছে। আমি জানি নির্মল চেয়েছিল তুই-ই ওই লেখাগুলো প্রথম পড়িস। আমাকেও ও তাই বলেছিল, মারা যাওয়ার ঠিক আগে।”
কানাই একটু ভুরু কোঁচকাল। “তোমার কখনও কৌতূহল হয়নি?”
মাথা নাড়ল নীলিমা। “কানাই, তুই যখন আমার বয়সে পৌঁছবি, দেখবি যেসব ভালবাসার মানুষরা চলে গেছে তাদের স্মৃতিমাখানো জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে কীরকম মন খারাপ লাগে। সেজন্যই আমি তোকে আসতে বলেছিলাম।”
স্টেশন চত্বর ছেড়ে ধুলোভরা একটা রাস্তায় নেমে এল ওরা। রাস্তার দু’ধারে গায়ে গায়ে লাগানো পানবিড়ি তেলেভাজার দোকান, আরও কত ছোটখাটো দোকান।
“কানাই, তুই যে শেষপর্যন্ত এসেছিস তাতে আমি কী খুশি যে হয়েছি–” নীলিমা বলল। “কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।”
“কী কথা?”
“তুই ক্যানিং দিয়ে কেন আসতে চাইলি? বাসন্তী হয়ে এলে কত সুবিধা হত। আজকাল তো এই রুটে কেউ আসেই না প্রায়।”
“তাই নাকি? কেন আসে না?”
“নদীর জন্য। নদীটা একেবারে পালটে গেছে তো।”
“পালটে গেছে? কীরকম?”
কানাইয়ের মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে নীলিমা বলল, “একটু অপেক্ষা কর, দেখতে পাবি এক্ষুনি।”
.
“যে-কোনও বড় নদীর কাছে গেলেই পুরনো দিনের কোনও না কোনও স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে।”
মেসো এর পর ওকে যে লম্বা লিস্টি শুনিয়েছিল তা পরিষ্কার মনে আছে কানাইয়ের :
মানাওসের অপেরা হাউস, কার্নাকের মন্দির, প্যাগানদের দশ হাজার প্যাগোডা… ক্যানিংকেও ওই তালিকায় তুলে দিয়েছিল মেসো, ভেবে হাসি পেল কানাইয়ের। “আমাদের এই মাতলার পাশের ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন হল পোর্ট ক্যানিং।”
ক্যানিং বাজার অঞ্চলের চেহারাটা একই রকম রয়ে গেছে দেখল কানাই–সরু সরু গলি, ঘেঁষাঘেষি দোকানপাট, নোনাধরা ঘরবাড়ি। ছোট ছোট দোকানে নানারকম পেটেন্ট ওষুধ বিক্রি হচ্ছে, ব্যথাবেদনা আর পেটের রোগের। বিচিত্র সব নাম ওষুধগুলোর হজমোজাইন, দৰ্দোসাইটিন। বাড়িঘরের মধ্যে চোখে পড়ার মতো আছে একমাত্র কিছু সিনেমা হল। বিশাল বিশাল হল সব, বালির বস্তার মতো কুৎসিত চেহারা নিয়ে চেপে বসে আছে জায়গাটার ওপর। যেন মাতলা যাতে শহরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে না পারে সেইজন্যই ওগুলিকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এখানে।
একটা ইটবাঁধানো রাস্তায় গিয়ে শেষ হয়েছে বাজারটা। রাস্তাটা চলে গেছে শহর থেকে নদীর দিকে; কিন্তু খানিকটা গিয়েই শেষ হয়ে গেছে–নদীতে পৌঁছনোর বেশ কিছুটা আগেই। রাস্তার একদম শেষপ্রান্তে এসে কানাই বুঝতে পারল নীলিমা কেন বলছিল নদী পালটে গেছে। ওর স্মৃতিতে যে মাতলা আছে সে এক বিশাল নদী, সেরকম আর কখনও ও জীবনে দেখেনি। কিন্তু এখন সামনে বেশ কিছুটা দূরে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটাকে বড়জোর একটা সরু খাল বলা যেতে পারে। ভাটা অনেকক্ষণ শুরু হয়ে গেছে, আর প্রায় কিলোমিটারখানেক চওড়া খাতের ঠিক মাঝখান দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে মাতলা। জলের ধার বরাবর সদ্য জমা পলি রোদে চকচক করছে, মনে হচ্ছে যেন পরতে পরতে জমে থাকা গলন্ত চকলেট। মাঝে মাঝেই এখানে ওখানে নদীর গভীর থেকে দু’-একটা বুদবুদ ভেসে উঠেই ফেটে যাচ্ছে, বৃত্তাকার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে বার্নিশ করা জলের ওপর। বুদবুদের শব্দগুলো যেন অস্ফুটে বলা কোনও কথার মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর গভীর থেকে ভেসে আসা কোনও কণ্ঠস্বর আপন মনে বকবক করে চলেছে।
“ওই দেখ,” নীলিমা বলল দুরের দিকে একটা আঙুল দেখিয়ে। ভাটার মাতলার ওপর দিয়ে জল ছিটিয়ে এগিয়ে আসছে একটা নৌকো। মিটার নয়েকের বেশি লম্বা নয়, কিন্তু শখানেকের বেশি মানুষ গাদাগাদি করে উঠেছে ওটার ওপর। কানায় কানায় ভর্তি নৌকোটা, কিনারাগুলো জলের ওপর কোনওরকমে মাত্র ইঞ্চি ছয়েক জেগে রয়েছে। নদীর ধারে এসে নৌকোর গতি কমতেই মাঝিদের একজন একটা লম্বা তক্তা বের করে পাড়ের কাদায় খুঁজে দিল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল কানাই। কী হবে এখন? এতগুলো লোক এই তলতলে কাদার সমুদ্র পেরিয়ে পাড়ে এসে পৌঁছবে কী করে?
নৌকোয় ততক্ষণে অবশ্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। মহিলারা শাড়ি গুটিয়ে, আর পুরুষরা যার যার লুঙ্গি, প্যান্ট হাঁটুর ওপর তুলে কাদায় নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তক্তা বেয়ে লোকগুলো এবার এক এক করে নামতে লাগল। হাঁ করে দেখছিল কানাই, মাটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকে কীভাবে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে থকথকে কাদায়। ঘন ডালের বাটিতে চামচ রাখলে সেটা যেমন ধীরে ধীরে ডুবতে থাকে, কাদায় ডুবন্ত যাত্রীদের ঠিক সেরকম মনে হচ্ছিল। বেশ কয়েকটা দীর্ঘ মুহূর্ত–কাদা একেকজনের প্রায় পাছা পর্যন্ত পৌঁছনোর পর শুরু হল ওদের সামনের দিকে এগোনোর পালা। প্রত্যেকের পা-ই কাদার নীচে, মানুষগুলোর শুধু ধড়টুকু দেখা যাচ্ছে–শরীরে মোচড় দিতে দিতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে আসছে শুকনো ডাঙার দিকে।
ভুরু কুঁচকে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল নীলিমা। “এদের দেখেই তো আমার হাঁটুতে ব্যথা করছে। আগে আমিও পারতাম রে এরকম কাদা ঠেলে আসতে, কিন্তু এখন আর পায়ে সে জোর নেই। আর মুশকিল কী জানিস তো? নদীতে জলও ভীষণ কমে গেছে আজকাল। ভাটার সময় তো থাকে না বললেই চলে। তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আজকে আমরা ট্রাস্টের লঞ্চ নিয়ে এসেছি, কিন্তু আরও অন্তত ঘণ্টা দুয়েকের আগে লঞ্চ এই অবধি আসতেই পারবে না।” একটু অভিযোগের দৃষ্টিতে বোনপোর দিকে তাকাল নীলিমা। “তুই যদি বাসন্তী দিয়ে আসতিস কত সহজ হত জার্নিটা বল তো?”
“আমি তো জানতাম না,” খেদের সুর কানাইয়ের গলায়। “তুমি যদি একবার বলতে… আমি তো এই রুটে এসেছি কারণ ১৯৭০-এ যখন লুসিবাড়ি গেলাম তখনও আমরা ক্যানিং হয়েই গিয়েছিলাম।”
চারিদিকে তাকিয়ে দৃশ্যগুলো যেন মনের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছিল কানাই। ওর স্পষ্ট মনে পড়ল আকাশের গায়ে বিরাট একটা সারসের মতো দেখতে নির্মলের সিলুয়েট। পাখির উপমাটা মনে এসেছিল মেসোর পোশাক আর ছাতাটার জন্য। নদীর হাওয়ায় নির্মলের ধুতি-পাঞ্জাবি পতপত করে উড়ছিল পালকের ডানার মতো। আর সরু ছাতাটাকে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন লম্বা ছুঁচলো পাখির ঠোঁট।
.
“ঠিক এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিল, আমরা যখন নৌকোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
“কে, নির্মল?”
“হ্যাঁ। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, হাতে ছাতা।”
হঠাৎ ওর কনুইটা শক্ত করে চেপে ধরল নীলিমা, “চুপ কর, চুপ কর কানাই, আর বলিস না।”
থমকে থেমে গেল কানাই। “এখনও তোমার এত মন খারাপ হয়ে যায় মেসোর কথা শুনলে? এত বছর পরেও?”
নীলিমা যেন শিউরে উঠল। “এই জায়গাটায়–ঠিক এই জায়গাটাতেই ওকে পাওয়া গিয়েছিল, জানিস? এই ক্যানিং-এর বাঁধের ওপর। তারপর আর কয়েকমাস মাত্র বেঁচে ছিল। নিশ্চয়ই বৃষ্টিবাদলের মধ্যে বাইরে বাইরে ঘুরেছিল–নিউমোনিয়া হয়ে গিয়েছিল তো।”
“আমি তো এতসব জানতাম না! কিন্তু মেসো ক্যানিং এসেছিলই বা কেন?”
“এখনও ঠিক জানি না কেন এসেছিল। শেষের দিকে ওর চালচলন কীরকম খাপছাড়া হয়ে গিয়েছিল–সব সময় যেন একটা চাপের মধ্যে থাকত। রিটায়ার করল হেডমাস্টার হয়ে, আর মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই চোখের সামনে কেমন বদলে গেল চেনা মানুষটা। যখন তখন কিছু না বলে কয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। আর সে সময়টাতেই মরিচঝাঁপির গণ্ডগোলও শুরু হয়েছে, আমি তো ভয়ে কাঠ হয়ে থাকতাম।”
“তাই নাকি?” কানাই একটু অবাক। “মরিচঝাঁপির ব্যাপারটা কী যেন? আমার ঠিক মনে নেই।”
“মরিচঝাঁপি ছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা দ্বীপ। রিফিউজিরা এসে দখল করে নিয়েছিল। সরকার যেই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল, অমনি শুরু হয়ে গেল মারদাঙ্গা। গভর্নমেন্ট ওদের জোর করে মধ্যভারতের একটা উদ্বাস্তু শিবিরে ফেরত পাঠাতে চাইছিল। প্রচুর বাস-ট্রাক বোঝাই করে মানুষগুলোকে নিয়ে যাচ্ছিল সেখানে। এদিকে সারা তল্লাটে তো নানা গুজব ছড়াতে লাগল। আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি–নির্মলকেও যদি নিজের মনে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে দেখে ওরা, কী যে হবে! শেষে মনে হয় ওকেও জোর করে ওরকম একটা বাসেই তুলে দিয়েছিল।”
“তাই নাকি?”
“আমার তাই ধারণা,” নীলিমা বলল। “পরে হয়তো কেউ ওকে চিনতে পেরে কোথাও একটা নামিয়ে দিয়েছে। তারপর ও কোনওরকমে ক্যানিং-এ চলে এসেছে। এখানেই তো ওকে দেখা গিয়েছিল–ঠিক এই বাঁধের ওপর।”
“তুমি জিজ্ঞেস করনি কোথায় গিয়েছিল?”
“জিজ্ঞেস করেছি রে কানাই। কিন্তু সে সময় ওর ঠিকমতো কোনও কথার জবাব দেওয়ার অবস্থাই চলে গিয়েছিল। মাথামুণ্ডু কী যে বকত… তারপর থেকে একবারই মাত্র সজ্ঞানে কথা বলেছিল–যখন তোকে ওই প্যাকেটটা দিতে বলল। আমি তো ভেবেছিলাম তখনও ভুল বকছে। কিন্তু পরে দেখলাম তা নয়।”
মাসিকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল কানাই৷ “খুব কষ্টে কেটেছে তোমার সেই সময়টা, না?”
চোখ মুছে নীলিমা বলল, “এখনও আমার পরিষ্কার মনে আছে ওকে যখন নিতে এসেছিলাম ক্যানিং-এ, সেই দিনটার কথা। ঠিক এখানটাতে দাঁড়িয়ে ও চিৎকার করছিল, ‘মাতলা জেগে উঠবে! মাতলা জেগে উঠবে!’ জামাকাপড় সব ধুন্ধুড়ে ময়লা, হাতে মুখে কাদা–সে চেহারাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না।”
বহুদিনের চাপা-পড়া একটা স্মৃতি কানাইয়ের মাথার মধ্যে চাড়া দিয়ে উঠল। “মাতলা জেগে উঠবে বলছিল? মেসো নিশ্চয়ই সেই গল্পটার কথা ভাবছিল।”
“কোন গল্প রে?” একটু চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল নীলিমা।
“তোমার মনে নেই? সেই যে লাটসাহেব এখানে বন্দর বানিয়েছিল, আর পিডিংটন বলে এক সাহেব–ওই যে, সাইক্লোন’ শব্দটা যার তৈরি–সে কীরকম ভবিষ্যৎবাণী করল যে মাতলা জেগে উঠবে আর পোর্ট ক্যানিং ভাসিয়ে নিয়ে যাবে?”
“চুপ কর!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠে হাত দিয়ে দু’কান চেপে ধরল নীলিমা। “আর বলিস না রে কানাই। এই স্মৃতিগুলো মনে এলেই আমার বুকের ভেতরটা যেন কুরে কুরে খেতে থাকে। সেজন্যই ওই প্যাকেটটা আমি নিজে খুলিনি, তোর হাতে দিয়ে দিতে চেয়েছি। ওসব কথা ভাবার মতো মনের জোরই নেই আমার।”
“সত্যি, খুবই কঠিন তোমার পক্ষে এ ঘটনাগুলো মনে করা,”কানাইয়ের গলায় অনুতাপ। “ঠিক আছে, এই প্রসঙ্গটা আমি আর তুলব না।”
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কানাইয়ের মনে পড়ল আগেরবারেও এই বাঁধের ওপর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল ওদের। ভাটার জন্য নয়, স্রেফ লুসিবাড়ির দিকে যাওয়ার কোনও নৌকো পাওয়া যাচ্ছিল না বলে। ও নীলিমার সঙ্গে একটা চায়ের দোকানে বসেছিল, আর নির্মলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাঁধের ওপর, নৌকোর খোঁজ করতে। সে কাজে অবশ্য নির্মলের মন ছিল না খুব একটা। কলকাতার একটা বইয়ের দোকান থেকে সদ্য কেনা রাইনার মারিয়া রিলকের দুইনো এলিজির একটা অনুবাদ তার হাতে ছিল। কবিতাগুলো অনুবাদ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু–নির্মলের এক সময়কার পরিচিত। নৌকোর জন্য নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল বটে, কিন্তু নির্মলের মন পড়ে ছিল ওই বইটার ওপর। নীলিমার ভয়ে খুলে পড়তে পারছিল না, তবে বুকের মধ্যে তেরচাভাবে চেপে ধরা বইটার দিকে সুযোগ পেলেই একবার তাকিয়ে নিচ্ছিল চুপি চুপি।
শেষপর্যন্ত অবশ্য নৌকোর জন্য নির্মলের ওপর ভরসা করতে হয়নি। এক মাঝি নিজের থেকেই এসে ওদের উদ্ধার করল। “আরে মাসিমা, আপনি এখানে?” গলাটা শুনে ওরা ফিরে তাকানোর আগেই বছর কুড়ি-বাইশের একটা ছেলে বাঁধের ঢাল বেয়ে দৌড়ে উঠে এসে নীলিমাকে প্রণাম করল।
“হরেন না? হরেন নস্কর তো তুই?” ছেলেটার মুখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল নীলিমা।
“হ্যাঁ মাসিমা।” বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা চেহারা ছেলেটার, চওড়া চ্যাপটামতো মুখ, রোদে কুঁচকে আছে চোখদুটো। পরনে খুব সাধারণ একটা লুঙ্গি আর গায়ে কাদার ছোপ লাগা গেঞ্জি।
“তুই ক্যানিং-এ কী করতে এসেছিস?” নীলিমা জিজ্ঞেস করল।
“কাল জঙ্গল করতে বেরিয়েছিলাম মাসিমা। বনবিবির দয়ায় অনেকটা মধু পেয়ে গেছি–তা প্রায় দু’বোতল হবে। তো সেইগুলোকে বেচতে এনেছি ক্যানিং-এ।”
হরেনের কথা শুনে নীলিমার কানে কানে ফিসফিস করে কানাই জিজ্ঞেস করেছিল, “মাসি, বনবিবি কে?”
“বনবিবি হলেন জঙ্গলের দেবী। এখানকার লোকেরা বিশ্বাস করে যে উনিই সমস্ত জঙ্গল আর জন্তু জানোয়ারকে শাসন করেন,” ফিসফিস করেই জবাব দিয়েছিল নীলিমা।
“ও!” এতবড় জোয়ান লোকটা এইরকম একটা গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করে দেখে অবাক। হয়ে গিয়েছিল কানাই। গুরগুর করে একটা হাসির দমক উঠে এসেছিল গলা বেয়ে।
“কানাই!” এক বকা দিয়েছিল নীলিমা। “এই সবজান্তা ভাবটা ছাড়ো। এটা তোমার কলকাতা শহর নয়, মনে রেখো।”
হাসির শব্দটা হরেনের কানে গিয়েছিল। নিচু হয়ে কানাইকে ভাল করে দেখে ও জিজ্ঞেস করেছিল, “এটা কে, মাসিমা?”
“আমার বোনপো। স্কুলে বাঁদরামি করেছিল বলে ওর বাবা-মা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, একটু শিক্ষা দিতে।”
“তা হলে ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন মাসিমা,” একগাল হেসে বলেছিল হরেন।
“আমার বাড়িতেও তো তিনটে বাচ্চা আছে; বড় ছেলেটার বয়স এর কাছাকাছিই হবে। এরকম ছেলেদের শিক্ষা দিতে খুব ভাল পারি আমি।”
“শুনলি তো কানাই?” ভয় দেখিয়েছিল মাসিমা। “এবার কোনও ঝামেলা করলে কিন্তু আমি তাই করব–একেবারে হরেনের বাড়ি দিয়ে আসব তোকে।”
সঙ্গে সঙ্গে মুখের হাসি-টাসি উবে গিয়ে কানাই একেবারে যাকে বলে সুবোধ বালক। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল ও যখন প্রসঙ্গটা এখানেই শেষ হল আর নীলিমার মালপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হরেন।
“আপনারা নৌকোর জন্য অপেক্ষা করছেন তো মাসিমা?”
“হ্যাঁ রে হরেন, অনেকক্ষণ ধরেই তো বসে আছি এখানে, কিছুই পাচ্ছি না।”
“তালে চলুন আমার সঙ্গে,”নীলিমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই একটা ভারী ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়েছিল হরেন। “আমার নৌকো আছে, আমিই আপনাদের লুসিবাড়ি পৌঁছে দেব।”
কানাইয়ের মনে পড়ল, হরেনকে বাধা দেওয়ার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করেছিল তার মাসি। “তোর তো অনেক ঘোরা হবে হরেন? কেন খামখা যাবি এত ঘুরপথে?”
“খুব একটা বেশি ঘোরা হবে না মাসিমা। আপনি আমাদের কুসুমের জন্য এত করেছেন, আর আমি আপনার জন্য এইটুকু করতে পারব না? আপনারা দাঁড়ান এখানে, আমি নৌকোটা নিয়ে আসি।”
চটপট পা চালিয়ে বাঁধের ওপর দিয়ে চলে গেল হরেন। ও একটু দূরে যেতেই কানাই জিজ্ঞেস করল নীলিমাকে, “লোকটা কে গো মাসি? ও কী বলছিল? কুসুম কে?”
হরেন আসলে একজন জেলে, নীলিমা ওকে বুঝিয়েছিল। লুসিবাড়ির কাছেই সাতজেলিয়া বলে একটা দ্বীপে থাকে। ওকে দেখে যেরকম মনে হয় তার থেকেও ওর বয়স অনেক কম, কুড়িও হয়নি হয়তো। কিন্তু এই ভাটির দেশের লোকেরা খুব কম বয়সেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। হরেনেরও বছর চোদ্দোতে বিয়ে হয়েছিল। এই বয়সেই তাই ও তিন বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে।
কুসুম ওদেরই গাঁয়ের একটা মেয়ে। বছর পনেরো বয়েস। লুসিবাড়ির মহিলা সমিতির কাছে ওকে দিয়ে গেছে হরেন, দেখাশোনা করার জন্য। কুসুমের বাবা জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে মারা যাওয়ার পর পেটের দায়ে ওর মা শহরে গিয়ে কাজ নিল। “মেয়েটা একা একা থাকত, কখন কী বিপদ আপদ ঘটে, তাই ওকে লুসিবাড়িতে দিয়ে গেছে হরেন,” নীলিমা বলেছিল। “কত রকমের লোকজন ওর ওপর নজর দিচ্ছিল। একজন তো ওকে বিক্রিই করে দেওয়ার তালে ছিল। হরেন না বাঁচালে কী যে হত ওর…”।
কানাইয়ের জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল হয়ে উঠেছিল। “কী হত মাসি?”
বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল নীলিমার চোখ। মানুষের যে দুঃখকষ্টের সমাধান তার হাতের বাইরে, সেগুলির কথা মনে এলেই এরকম একটা করুণ কোমল ছায়া নেমে আসে মাসির চোখে, সেটা কানাই আগেও দেখেছে। “কী হত? কুসুমকে ওর মান-ইজ্জত খোয়াতে হতে পারত। কত গরিবঘরের মেয়ের যে ওরকম সর্বনাশ হয়েছে…”
“ও,” কানাই গম্ভীরভাবে বলেছিল। একটু অকালপক্ক ও ছিল ঠিকই, তবে নীলিমার কথার ইশারা ইঙ্গিতগুলো সব বুঝতে পারেনি তখন। কিন্তু কথার ভাবটুকু যতটা ওর মাথায় ঢুকেছিল, তাতেই শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে গিয়েছিল।
“এখন কী করে মেয়েটা?” সাগ্রহে জিজ্ঞেস করেছিল কানাই।
“লুসিবাড়িতেই থাকে। মহিলা সমিতি ওর দেখাশোনা করে। দেখতেই পাবি গেলে।”
মাসির কথা শেষ হতে না হতেই বাঁধের গা বেয়ে দৌড় লাগিয়েছিল কানাই–একেবারে নির্মল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে পৌঁছে ব্যগ্র চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে খুঁজতে শুরু করেছিল কোথায় হরেনের নৌকো। এতক্ষণ পর্যন্ত লুসিবাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে ওর মনে একটা বিরক্তি মেশানো আপত্তির ভাব ছিল, কিন্তু কুসুমের কথা শুনে সে ভাবটা একেবারে কেটে গেল।
.
লঞ্চে
ক্যানিং বাজারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাড়িটার সামনে এসে থমকে গেল পিয়া। কাজের সূত্রে ওকে বনেজঙ্গলে নদীনালায় ঘুরতেই হয়, তাই বহু বছরের অভিজ্ঞতায় ফরেস্ট বা ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টগুলোর সম্পর্কে একটা তিতিবিরক্ত ভাব জন্মে গেছে পিয়ার মনে। এখানে আসার সময়ও ও ভাবছিল হয়তো দেখবে কতগুলো ঘুপচি নোংরা অফিসঘরে কিছু লোক বসে কলম পিষছে। কিন্তু তার বদলে ঝকঝকে রং-করা বাংলোটা দেখে একটু হকচকিয়েই গেল পিয়া। তবুও, গেট ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে মনটাকে শক্ত করে নিল ও : হাজার হোক সরকারি অফিস, কত আর তফাত হবে?
কিন্তু যেরকম ভেবেছিল শেষপর্যন্ত ততটা খারাপ দাঁড়াল না ব্যাপারটা। হ্যাঁ, দারোয়ানকে পেরিয়ে অফিসঘরের ভেতর ঢোকার জন্য ঝাড়া একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল, কিন্তু একবার ঢোকার পরে একেবারে ঝটপট হয়ে গেল সব কাজ। দেখা গেল কাকার যোগাযোগে কাজ হয়েছে–ঢুকতে না ঢুকতেই একজন ওকে সোজা নিয়ে গেল সিনিয়র রেঞ্জারের কাছে। ক্লান্ত চেহারার নম্র ভদ্রলোক এটা সেটা দু-একটা ভদ্রতার কথা বলার পর জুনিয়র অফিসারকে বললেন ওর ব্যাপারটা দেখে দিতে। সে ভদ্রলোকের পেছন পেছন ঘুরতে হল বেশ খানিকক্ষণ–এ করিডোর, ও করিডোর, বড় ঘর থেকে ছোট ঘর, আরও ছোট ঘর, এ টেবিল, সে টেবিল। মধ্যে মধ্যে দীর্ঘ চা-পানের বিরতি আর পানের ছোপ-লাগা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করার পালা চলল বেশ কিছুক্ষণ, কিন্তু সব মিলিয়ে ঘণ্টাচারেকের মধ্যেই দরকারি সমস্ত কাগজপত্র হাতে পেয়ে গেল ও।
জয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে অফিস থেকে বেরোতে গিয়েই একটা ধাক্কা খেল পিয়া। সরকারি নিয়মকানুনের পালা এখনও শেষ হয়নি। সার্ভের কাজের জন্য জলেজঙ্গলে যেতে হলে ওকে একজন ফরেস্ট গার্ড নিতেই হবে। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল পিয়ার। আগের অভিজ্ঞতায় ও দেখেছে এইসব সরকারি লোকজন সঙ্গে থাকলে অনেক সময় বেশ অসুবিধাই হয়, কখনও কখনও সার্ভের থেকে ওদের দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হয়। একা যেতে পারলেই সবচেয়ে ভাল হত–শুধু নৌকো চালানো আর রাস্তা দেখানোর জন্য একটা লোক থাকলেই চলত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সে সম্ভাবনা দূর অস্ত। এমনকী ইতিমধ্যে ওর জন্য একজন গার্ড ঠিকও হয়ে গেছে, সে-ই ওকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে, নৌকো ভাড়া করে দেবে, অন্যান্য যা যা দরকার সেসব ব্যবস্থাও করবে। যাক, এ নিয়ে আর ঝামেলা করে লাভ নেই, অন্তত পারমিট-টারমিটগুলো তো তাড়াতাড়ি পাওয়া গেছে।
সদ্য ভাঁজ-ভাঙা খাকি পোশাক-পরা ছুঁচোমুখো গার্ড লোকটা বিনয়ী হাসি হেসে সামনে এসে দাঁড়াল। মানুষটাকে দেখে অবশ্য খুব একটা খারাপ মনে হল না। কিন্তু যেই ও রাইফেল আর কার্তুজের পেটিটা বের করল, কেমন একটু অস্বস্তি লাগল পিয়ার। বন্দুক-টন্দুকের আবার কী দরকার? অফিসারের সঙ্গে কথা বলার জন্য সোজা অফিসঘরে ফিরে গেল ও। অফিসার বুঝিয়ে বললেন যেহেতু ওকে টাইগার রিজার্ভের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে, তাই বন্দুক ছাড়া একেবারেই চলবে না। কারণ যে-কোনও সময়েই অ্যাটাক হতে পারে। কী আর করা যাবে। পিঠব্যাগ কাঁধে তুলে গার্ডের পেছন পেছন ফরেস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে এল পিয়া।
খানিকদূর যেতে না যেতেই লোকটার হাবভাব অন্যরকম হয়ে গেল। একটু আগের বিগলিত হাসি-টাসি কোথায় মিলিয়ে গেল, চুপচাপ গম্ভীরভাবে ও পিয়াকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে সেসব জানানোর ধার দিয়েই গেল না। একটু বাদে বাঁধের ওপর একটা চায়ের দোকানে এসে থামল ওরা। একটা ডাকাত-ডাকাত চেহারার লোক সেখানে বসেছিল। ওদের কথাবার্তা পিয়া কিছু বুঝছিল না, কিন্তু যদূর মনে হল লোকটার নাম মেজদা। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, বিশাল থলথলে মুখ, গলায় আবার অনেকগুলো চকচকে চেন আর মাদুলি ঝুলছে। মেজদা বা গার্ড কেউই ইংরেজি বলতে পারে না, কিন্তু আশেপাশের দু’-একজনের ভাঙা ভাঙা অনুবাদে পিয়া যা বুঝল তা হচ্ছে–মেজদা একটা লঞ্চের মালিক। আর নাকি খুব ভাল গাইড, সুন্দরবনের নদীনালা সব ওর নখদর্পণে।
মেজদার লঞ্চটা একবার দেখতে চাইল পিয়া, কিন্তু জানা গেল সেটা এখন সম্ভব নয়। লঞ্চটা নাকি বেশ কিছুটা দূরে নোঙর করা আছে। সেখানে নৌকো করে যেতে হবে। ভাড়া যা বলল সেটাও যথেষ্ট বেশি। পিয়া পরিষ্কার বুঝতে পারছিল এই লোকগুলির মধ্যে যোগসাজস আছে। একটা শেষ চেষ্টা চালাল ও এদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে অন্য লঞ্চওয়ালার খোঁজ করার, কিন্তু খুব একটা লাভ কিছু হল না। মেজদা আর গার্ডকে দেখে ধারেকাছে ঘেঁষলই না কেউ।
পিয়া ভেবেচিন্তে দেখল ওর সামনে দুটো রাস্তা খোলা আছে এখন। এক হল ফরেস্ট অফিসে ফিরে গিয়ে এদের নামে কমপ্লেন করা, আর নয়তো এরা যা বলছে তাতেই রাজি হয়ে গিয়ে সার্ভের কাজ শুরু করে দেওয়া। কিন্তু সারাটা দিন যে অফিসটায় কাটিয়েছে সেখানে ফিরে যেতে আর মন চাইল না। শেষপর্যন্ত মেজদার লঞ্চ ভাড়া করাই ঠিক করল ও।
লঞ্চের দিকে যেতে যেতে একটু একটু খারাপ লাগছিল পিয়ার। মনে হচ্ছিল এ লোকগুলো হয়তো ততটা মন্দ নয়, হয়তো ও ওদের ভুল বুঝেছে। হতেই পারে ওরা সুন্দরবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। দেখাই যাক না কতটা কাজ হয় ওদের দিয়ে।
এবারের সার্ভের জন্য পিয়া একটা ডিসপ্লে কার্ড নিয়ে এসেছে, দু’রকম ডলফিনের ছবি আঁকা–গ্যাঞ্জেটিক আর ইরাবড়ি। এই দু’রকম ডলফিনই এই অঞ্চলের নদীতে পাওয়া যায়।
ডিসপ্লে কার্ডের ছবিগুলি অবশ্য খুব একটা ভাল নয়, আঁকা ছবি, ১৮৭৮ সালের একটা প্রবন্ধ থেকে কপি করা। পিয়া নিজেই এর থেকে অনেক ভাল ভাল ছবি দেখেছে–হাতে-আঁকা ছবি, ফটোগ্রাফ, দু’রকমই। কিন্তু কেন কে জানে, এই ছবিগুলো লোককে দেখিয়েই সবচেয়ে ভাল ফল পেয়েছে ও। লোকে অনেক সহজে এগুলো দেখে চিনতে পারে। অনেক সময় এমনকী ফটোগ্রাফেও এত ভাল কাজ হয় না।
এর আগে অন্যান্য নদীতে কাজ কররার সময় এই ধরনের ডিসপ্লে কার্ডগুলো খুব কাজে দিয়েছে। যেসব জায়গায় ভাষার সমস্যা ছিল না, সেখানে কার্ডের ছবি দেখিয়ে ও জেলেদের জিজ্ঞেস করেছে এরকম প্রাণী তারা কোথায় দেখেছে, কোন কোন জায়গায় থাকে এরা, প্রাণীগুলোর স্বভাব কীরকম, বছরের কোন সময় বেশি দেখা যায়–এই সব। আর যেখানে দোভাষীর সাহায্য পাওয়া যায়নি, সেই সব জায়গায় ও জেলেদের ওই কার্ডের ছবিগুলো দেখিয়ে জবাবের অপেক্ষা করেছে। বেশিরভাগ সময়ই কায়দাটা কাজে এসেছে। প্রাণীগুলোকে চিনতে পেরেছে জেলেরা, তারপর ওকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়েছে কোনদিকে গেলে তাদের দেখা যাবে। কিন্তু ছবি দেখে প্রাণীটাকে চিনতে পেরেছে শুধু সবচেয়ে ঝানু পোড়খাওয়া জেলেরাই। একটা গোটা ডলফিনের চেহারা আর ক’টা জেলেই বা চোখে দেখেছে? বেশিরভাগই তো দেখেছে শুধু জলের ওপর ভেসে ওঠা পিঠের পাখনা বা নাকের ফুটো। তাই ছবিগুলো দেখানোর পর অনেকসময়ই অনেক জেলে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলেছে। কিন্তু মেজদা যা বলল সেরকম প্রতিক্রিয়া পিয়া তার এতদিনের অভিজ্ঞতায় কখনও দেখেনি। কার্ডটাকে হাতে নিয়ে তো প্রথমে সেটা উলটো করে ধরল। তারপর নানাদিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল ওটা কোনও পাখি কি না। পিয়া কথাটা বুঝতে পারল কারণ ইংরেজিতে একটা শব্দ বারবার বলছিল মেজদা–”বার্ড? বার্ড?”
পিয়া এত আশ্চর্য হয়ে গেল যে ও নিজে ছবিটা আবার নতুন করে দেখল। ওটার সঙ্গে পাখির সাদৃশ্যটা কোথায় সেটাই বোঝার চেষ্টা করল খানিকক্ষণ ধরে। শেষে যখন ডলফিনটার লম্বা নাক আর সরু ছুঁচোলো দাঁতগুলোর দিকে মেজদা আঙুল দিয়ে দেখাল, তখন পিয়ার মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা। ইশনিস্ট ড্রয়িং-এর মতো ওর চোখের সামনেও যেন ডলফিনের ছবিটা পালটে যেতে থাকল। পিয়ার মনে হল ও যেন মেজদার চোখ দিয়ে ছবিটা দেখছে। কেন লোকটা ভুল বুঝেছিল সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল ও এতক্ষণে–জন্তুটার গোলগাল শরীরটা অনেকটা ঘুঘুপাখির মতো, আর লম্বা চামচের মতো ঠোঁটটার সঙ্গে বকজাতীয় পাখির কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। তা ছাড়া গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের সেরকম কোনও পিঠের পাখনাও নেই। বেচারা মেজদার আর কী দোষ! কিন্তু ডলফিনকে পাখি বলে ভুল করা–ব্যাপারটা এত হাস্যকর যে তাড়াতাড়ি কার্ডটা ফেরত নিয়ে হাসি লুকোনোর জন্য অন্যদিকে মুখ ঘোরাল পিয়া।
নৌকোয় যেতে যেতে বারবারই ঘটনাটা মনে পড়ছিল, আর নিজের মনে হেসে ফেলছিল পিয়া। কিন্তু মেজদার লঞ্চের চেহারাটা চোখে পড়তেই ওর মুখের হাসি মুখেই মিলিয়ে গেল। লঞ্চ বলে যেটাকে চালাতে চেষ্টা করছে লোকগুলো, সেটা আসলে একটা জরাজীর্ণ ডিজেল স্টিমার। টুরিস্টদের জন্য সারেং-এর ঘরের পেছনে কয়েকটা চেয়ার পাতা, মাথার ওপরে ঝুলকালো একটা তেরপল। এর থেকে তো একটা আউটবোর্ড মোটর লাগানো ফাইবারগ্লাসের ডিঙি নিলেই ভাল হত। ওরকম ছোট নৌকোতেই সার্ভের কাজ করতে বেশি সুবিধা। মেজদা আর গার্ডের কথায় রাজি হয়ে যাওয়ার জন্য এতক্ষণে একটু অনুশোচনা হল পিয়ার। কিন্তু আর ফেরার উপায় নেই এখন।
তক্তা বেয়ে লঞ্চে উঠতে উঠতে ডিজেলের গন্ধটা সপাট একটা থাপ্পড়ের মতো মুখে এসে লাগল পিয়ার। ওপরে জনা কয়েক ছোকরা হেলপার লঞ্চের ইঞ্জিনটা খুলে মেরামত করার চেষ্টা করছিল। অবশেষে সেটা যখন চালু হল, যা আওয়াজ বেরোল তাতে ডেকের ওপরেই কান প্রায় কালা হবার জোগাড়।
ছেলেগুলোকে ডেকে লঞ্চ থেকে নেমে যেতে বলল মেজদা। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেল পিয়া। তার মানে শুধু মেজদা আর গার্ড–এই দুটো মাত্র লোক লঞ্চটা চালিয়ে নিয়ে যাবে? বেশ একটু গোলমেলে ঠেকল ব্যাপারটা। ছেলেগুলো যখন এক এক করে লঞ্চ থেকে নেমে গেল কেমন একটু ভয় ভয় করতে লাগল পিয়ার। দুশ্চিন্তাটা আরও বাড়ল মেজদার মূকাভিনয় দেখে। ব্যাপারটা হল, ঘটনাচক্রে পিয়া আর মেজদা একই রংয়ের পোশাক পরেছিল–নীল ট্রাউজার্স আর সাদা শার্ট। ও নিজে প্রথমে খেয়াল করেনি ব্যাপারটা, কিন্তু মেজদা ঠিক লক্ষ করেছিল। নানারকম ইশারায়, অঙ্গভঙ্গিতে নিজের দিকে আর পিয়ার দিকে দেখিয়ে ওদের মধ্যে মিল-অমিলগুলো ও বোঝানোর চেষ্টা করছিল–দু’জনের একইরকম পোশাক, একইরকম গায়ের রং, কালো চোখ আর ছোট করে কাটা কোঁকড়া চুল। তবে সবশেষে যে ভঙ্গিটা মেজদা করল সেটা বেশ একটু গোলমেলে আর অশ্লীল মনে হল। একবার নিজের জিভের দিকে আর একবার ঊরুসন্ধির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে হো হো করে হাসতে লাগল মেজদা। এই অদ্ভুত ইশারার মানেটা ঠিক ধরতে না-পেরে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখটা তাড়াতাড়ি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল পিয়া। বেশ খানিকটা পরে ওর মাথায় এল যে ওটা আসলে ওদের দুজনের ভাষা আর লিঙ্গের পার্থক্যের রহস্যের বিষয়ে মেজদার নিজস্ব ভাষ্য।
কিন্তু তারপরে যে হাসির হররাটা উঠল তাতেই আরও অস্বস্তি লাগল পিয়ার। এমনিতে সরকারি নজরদারির মধ্যে ও আগে কখনও কাজ করেনি এমন নয়; মাত্র বছরখানেক আগেই ইরাবড়ি নদীতে যখন সার্ভে করছিল তখন সরকারি আদেশে (কাগজে-কলমে যদিও ‘পরামর্শ’) তিনটে বাড়তি লোককে নিতে হয়েছিল ওর নৌকোয়। লোক তিনটের হুবহু একরকম পোশাক–গল্ফ শার্ট, চেক-কাটা সারং আর স্টিল ফ্রেমের অ্যাভিয়েটর সানগ্লাস। পরে ও শুনেছিল ওরা ছিল মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের লোক–সরকারের স্পাই। কিন্তু ওদের সঙ্গে থেকে কাজ করতে ওর কখনও অস্বস্তি লাগেনি, কোনও বিপদের আশঙ্কাও হয়নি। আসলে ও যা কাজ করে, ওই ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে টলমলে নৌকোয় খাড়া দাঁড়িয়ে দুরবিন চোখে জলের দিকে তাকিয়ে থাকা আর আধঘণ্টা পর পর ডেটাশিট ভর্তি করা–সে কাজের ধরনটাই যেন একটা নিরাপত্তাবেষ্টনীর মতো ওকে সবসময় ঘিরে রাখে বলে মনে হয় পিয়ার। ইরাবড্ডি, মেকং বা মহাকাম নদীতে কাজ করার সময় অবশ্য আরও একটা জিনিস ওর পক্ষে বর্মের মতো কাজ করেছিল; সেটা হল ওর বিদেশি চেহারা। পিয়া নিজে অবশ্য তখন ব্যাপারটা লক্ষ করেনি, তবে ওর মুখের আদল, ছোট করে কাটা কালো চুল আর রোদেপোড়া গায়ের রঙে স্পষ্ট বোঝা যেত যে ও ওই অঞ্চলের লোক নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই সুন্দরবনে–যেখানে ওর নিজেকে সবচেয়ে বেশি পরদেশি বলে মনে হচ্ছে, ওর সেই বিদেশি চেহারার বর্ম আর কাজ করছে না। ওর জায়গায় যদি আজ একজন সাদা চামড়ার ইয়োরোপিয়ান বা জাপানি মেয়ে থাকত তা হলে কি এই লোকগুলো এরকম ব্যবহার করার সাহস পেত? মনে হয় না। এমনকী ওর কলকাতার আত্মীয়দের সঙ্গেও এরা কোনও দুর্ব্যবহার করতে পারত না। কারণ ওদের চেহারার মধ্যে একটা উচ্চমধ্যবিত্ত কালচারের ছাপ-মারা রয়েছে। সেটাই প্রায় লেসার-গাইডেড মিসাইলের মতো এইসব জায়গায় ওদের রক্ষা করে। আর সে অস্ত্র এইসব লোকেদের ওপর কীভাবে প্রয়োগ করতে হয় সেটা ওরাও ভাল করেই জানে। ওদের সামাজিক হিসাবে কার কোথায় জায়গা সেটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এই বিশাল এবং সূক্ষ্ম সমাজ সংস্থানের মধ্যে ওর নিজের জায়গাটাই পিয়া ঠিক করে জানে না, অন্যে পরে কা কথা।
আর ওর সেই অজ্ঞতারই সুযোগ নিচ্ছে এই লোকগুলো–সেটা এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছিল পিয়া।
.
লুসিবাড়ি
কানাই আর নীলিমাকে নিয়ে ট্রাস্টের লঞ্চ যখন লুসিবাড়ির ঘাটে গিয়ে ভিড়ল, নদীতে তখন ভাটার টান। জল এত নীচে যে দ্বীপের ধার বরাবর টানা বাঁধটাকে পাহাড়ের মতো উঁচু মনে হচ্ছিল। বাঁধের ওপারের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না লঞ্চ থেকে। ডাঙায় নেমে পাড় বেয়ে ওঠার পর নীচে তাকিয়ে তবে অবশেষে দেখা গেল গ্রামটাকে। সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিতে আঁকা একটা ম্যাপ যেন খুলে গেল মাথার ভিতর, আর কানাই দেখতে পেল গোটা লুসিবাড়িটা ওর চোখের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে।
লম্বায় প্রায় দু’ কিলোমিটার দ্বীপটা দেখতে অনেকটা শখের মতো। দক্ষিণ থেকে শুরু হয়েছে ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। চওড়ায় পঞ্চাশ কিলোমিটার সেই গভীর বন শেষ হয়েছে একেবারে বঙ্গোপসাগরের প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে। আর এই পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে আর একটি দ্বীপেও কোনও জনবসতি নেই। আশেপাশে দ্বীপ আরও বেশ কয়েকটা আছে বটে, কিন্তু চারটে নদী চারদিক থেকে ঘিরে লুসিবাড়িকে তাদের থেকে আলাদা করে রেখেছে। নদীগুলোর মধ্যে দুটো মাঝারি মাপের, আর একটা এতই ছোট যে ভাটার সময় জল প্রায় থাকেই না। কিন্তু দ্বীপের ছুঁচলো দিকটা–মানে শাঁখের একেবারে মুখের কাছটা–যে নদীতে গিয়ে শেষ হয়েছে, তার থেকে বড় নদী এই ভাটির দেশে কমই আছে। সে নদীর নাম রায়মঙ্গল।
জোয়ারের সময় লুসিবাড়ি থেকে দেখলে রায়মঙ্গলকে নদী বলে মনেই হয় না, মনে হয় যেন ওটা সাগরেরই অংশ, একটা উপসাগর, নিদেন একটা বিশাল নদীমুখ। আসলে পাঁচটা নদী এসে মিশেছে এখানে, ফলে একটা বিশাল মোহনার সৃষ্টি হয়েছে যার এপার ওপার প্রায় দেখাই যায় না। এখন ভাটার সময় অবশ্য দূরে দূরে অন্য নদীর মুখগুলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে–সেগুলোকে মনে হচ্ছে যেন বিরাট বড় গোল একটা সবুজ গ্যালারির মধ্যে মধ্যে লোক যাতায়াতের জন্য দৈত্যাকার প্রবেশপথ। তবে কানাই জানে যে জোয়ারের সময় এই পুরো অঞ্চলটারই চেহারা বদলে যাবে একেবারে। জঙ্গল, নদী আর নদীমুখ সবই চলে যাবে ঘোলাটে জলের নীচে। ওপরে জেগে থাকবে মাত্র কয়েকটা কেওড়া গাছের মাথা। ওগুলো না থাকলে মনে হত যেন চোখের সামনের আদিগন্ত এই জলরাশির কোনও শুরু শেষ নেই। জোয়ারের তারতম্য অনুসারে এই দৃশ্য কখনও অপূর্ব, কখনও ভয়ংকর। ভাটার সময় যখন বাঁধের অনেক নীচে নেমে যায় জল, তখন লুসিবাড়িকে মনে হয় বিশাল এক মাটির জাহাজের মতো, স্থির হয়ে ভাসছে। কিন্তু জোয়ার এলেই পরিষ্কার দেখা যায় নদীর জল দ্বীপের মাটির অনেক ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই যে দ্বীপকে মনে হচ্ছিল বিশাল জাহাজ, সেটাকে তখন মনে হয় যেন একটা ছোট্ট থালা, টলমল করে ভাসছে জলের ওপর। যে-কোনও সময় সেটা উলটে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে যাবে নদীর তলায়।
দ্বীপের সরু দিকটা থেকে একটা মাটির চড়া বের হয়ে জলের মধ্যে বেশ কিছুটা চলে গেছে। বাতাসের গতিপথ বোঝার জন্য অনেকসময় বড় নৌকো বা জাহাজের মাস্তুলে যে হালকা উইন্ডসক ঝোলানো থাকে, এই চড়াটাও যেন অনেকটা সেরকম–স্রোতের দিক বদলের সাথে সাথে সরে সরে যায়। তবে স্থান পালটালেও গোড়াটা কিন্তু সবসময়ই লেগে থাকে দ্বীপের সঙ্গে। নৌকোর মাঝি বা লঞ্চওয়ালাদের অবশ্য খুব সুবিধা হয়েছে ওটা থাকায়, আলাদা করে আর জেটির দরকার হয় না; মালপত্র কি প্যাসেঞ্জার নামানোর জন্য চড়াটাই ওরা ব্যবহার করে। এমনিতে লুসিবাড়িতে কোনও ডক বা জেটি তৈরি করাও যায়নি নদীর তীব্র স্রোতের জন্য।
দ্বীপের সবচেয়ে বড় গ্রামটার নামও লুসিবাড়ি। গ্রাম শুরু হয়েছে চড়াটার একেবারে গোড়ার দিকটায়, বাঁধের আড়ালে। বাঁধের ওপর থেকে প্রথম দর্শনে লুসিবাড়িকে বাংলাদেশের আর পাঁচটা গ্রামের মতোই লাগে–সেই পরপর ছাঁচের বেড়ার ঘর, খুপরি খুপরি দোকান, খড় বা হোগলাপাতায় ছাওয়া। কিন্তু একটু ভাল করে নজর করলেই সাধারণ গ্রামের সাথে তফাতটা চোখে পড়ে।
গ্রামের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটা বড় মাঠ। রুলে-টানা নিখুঁত চতুর্ভুজ না হলেও মোটামুটি চৌকোনাই বলা চলে। মাঠের একধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে হাট–গায়ে গায়ে লাগা পরপর সব দোকানঘর। শনিবার জমজমাট হাট বসে, সপ্তাহের অন্যদিন খালি পড়ে থাকে চালাগুলো। হাটের ঠিক উলটোদিকে স্কুল। মাঠের ধার ঘেঁষে যেন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কুলের বাড়িটা। নতুন লোকেদের কাছে এই স্কুলটাই এ গাঁয়ের সবচেয়ে বড় চমক। এমনিতে খুব কিছু বিশাল না হলেও, চারপাশের ঝুপড়ি বস্তি আর কুঁড়েঘরের মধ্যে স্কুলবাড়িটাকে হঠাৎ দেখলে আকাশছোঁয়া প্রকাণ্ড একটা গির্জার মতো মনে হয়। বাড়িটাকে ঘিরে ইটের পাঁচিল, মেনগেটে স্কুলের নাম আর প্রতিষ্ঠার বছর লেখা–স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন হাই স্কুল, ১৯৩৮। সামনের দিকে একটা লম্বা ঢাকা বারান্দা, মাঝে মাঝে পলকাটা থাম, দরজা-জানালার ওপরের দিকগুলো তিনকোনা নিওক্লাসিকাল ঢঙের। খানিকটা আরবি ধরনের খিলান আর সে আমলের স্কুলবাড়ির স্থাপত্যের আরও দু-একটা টুকিটাকি চিহ্ন এদিক ওদিকে। ঘরগুলো বড় বড়, প্রচুর আলো-হাওয়া, লম্বা লম্বা জানালাগুলিতে খড়খড়ি বসানো।
স্কুলের কাছেই একসারি গাছের আড়ালে রয়েছে আরেকটা ঘেরা চত্বর। জায়গাটার ঠিক মাঝখানে একটা বাড়ি, স্কুলবাড়ির থেকে অনেকটা ছোট। এমনিতে চোখের আড়ালে থাকলেও, এটার চেহারা অনেক বেশি নজরকাড়া। পুরো কাঠের তৈরি বাড়িটা মিটার দুয়েক উঁচু কয়েকটা খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ধাঁচটা অনেকটা পাহাড়ি বাংলোর মতো, ভাটির দেশে একটু যেন বেমানান। চালাটা খাড়াই পিরামিডের মতো–সারি সারি খুঁটি, পিলার, জানালা আর পিল্পের ওপর বসানো। দেওয়াল জোড়া বিশাল বিশাল জানালা, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত খড়খড়ি দেওয়া। পুরো বাড়িটার চারদিক ঘিরে ঢাকা বারান্দা। সামনে একটা শালুক ফুলে ভরা পুকুর, পাড় ঘেঁষে ইট বাঁধানো পথ–শ্যাওলা-ধরা।
কানাইয়ের মনে পড়ল, ১৯৭০ সালে এ বাড়িটা ছিল একেবারে নির্জন, শুনশান। গাঁয়ের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় হলেও, আশেপাশে ঘরবাড়ি বিশেষ ছিল না তখন। খানিকটা যেন সম্ভ্রমের বশেই দ্বীপের অন্য বাসিন্দারা এই কুঠিবাড়িটার থেকে একটু দূরে দূরে থাকত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই পালটে গেছে। একনজরেই বোঝা যায় এই উঠোন দিয়ে এখন যথেষ্ট লোক চলাচল হয়। আঙিনার চারপাশ ঘিরে গজিয়ে উঠেছে নতুন ঘরবাড়ি, পান-বিড়ির গুমটি আর মিষ্টির দোকান। পাশের আঁকাবাঁকা রাস্তাটা গমগম করছে ফিল্মি গানের সুরে, বাতাসে সদ্য-ভাজা জিলিপির গন্ধ।
আড়চোখে তাকিয়ে কানাই দেখল নীলিমা মহিলা সমিতির দুই কত্রীর সঙ্গে ট্রাস্টের কাজকর্ম নিয়ে কথা বলছে। পাশ থেকে চুপি চুপি সরে এল ও। বাইরের গেটটা ঠেলে ঢুকে পড়ল চত্বরটায়, তারপর শ্যাওলা-ঢাকা পথ দিয়ে মূল বাড়িটার দিকে এগোল। আঙিনাটায় ঢোকামাত্র একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল কানাইয়ের। বাইরে এত আওয়াজ, কিন্তু ভেতরে তার কিছুই প্রায় শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ মনে হল সময়টা যেন থমকে থেমে গেছে। বাড়িটাকে এই মনে হচ্ছে খুব পুরনো আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে আনকোরা নতুন। কাঠগুলো বহু বছরের রোদে জলে অনেক পুরনো কোনও গাছের বাকলের মতো একটা রুপোলি রং নিয়েছে। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ায় প্রায় স্বচ্ছ মনে হচ্ছে সেগুলোকে খানিকটা গিলটি-করা ধাতুর ওপরের পাতলা ছালের মতো। পড়ন্ত বিকেলের আকাশের ছায়ায় গোটা কুঠিটা একটা নীলচে আভা ছড়াচ্ছে।
খুঁটিগুলোর সামনে এসে বাড়ির নীচের দিকটা একবার উঁকি দিয়ে দেখল কানাই। একরকম রয়ে গেছে আলোছায়ার জ্যামিতিক নকশাগুলো। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে কুঠির দরজার সামনে যেতেই যেন মেসোর গলা শুনতে পেল ও।
“ওদিক দিয়ে ঢোকা যাবে না, মনে নেই?” নির্মল বলছিল। “সামনের দরজার চাবি তো কবেই হারিয়ে গেছে। বাড়ির পেছনের দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে ঢুকতে হবে আমাদের।”
আগেরবার কোথা দিয়ে গিয়েছিল মনে করে করে বারান্দা ধরে এগোতে লাগল কানাই। ব্যালকনির কোনাটা ঘুরে কুঠির পেছন দিকটায় গিয়ে একটা ছোট দরজা। আলতো করে ঠেলতেই খুলে গেল পাল্লাদুটো। ঘরে ঢুকেই প্রথম যে জিনিসটা কানাইয়ের চোখে পড়ল সেটা হল কাঠের সিট-ওয়ালা পুরনো ঢঙের একটা কমোড়। পোর্সেলিনের। তার পাশেই বিশাল একটা লোহার বাথটাব, ধারটা গোল করে বাঁকানো, পায়াগুলো নখওয়ালা থাবার প্যাটার্নে ঢালাই করা। মাথার কাছে একটু ঝুঁকে আছে ঝাঁঝরি, নরম বোঁটার ওপর ঝিমিয়ে পড়া ফুলের মতো।
যা দেখে গিয়েছিল তার থেকে একটুও বদলায়নি জিনিসগুলো, শুধু আর একটু বেশি মরচে ধরেছে। ছোটবেলায় প্রথমবার এসে ঘরের জিনিসপত্রগুলো যেন চোখ দিয়ে গিলছিল ও, মনে পড়ল কানাইয়ের। সেবার লুসিবাড়িতে এসে থেকেই নির্মল আর নীলিমার মতো ওকেও পুকুরেই স্নান করতে হচ্ছিল, ঝাঁঝরিটা দেখে তাই প্রচণ্ড লোভ হয়েছিল ওটার নীচে গিয়ে দাঁড়ানোর।
“এটা হল সাহেবি চৌবাচ্চা, বুঝলে? সাহেবরা এটাতে বসে স্নান করে”, টাবটা দেখিয়ে ওকে বলেছিল নির্মল। বাথটবের এই বর্ণনাটা কানাইয়ের মন্দ লাগেনি। কিন্তু মেসো এমন করে কথাটা বলেছিল যেন ও এক্কেবারে গেঁয়ো, এসব কখনও দেখেনি। মনে মনে তখন একটু রাগই হয়েছিল কানাইয়ের। “আমি জানি, এটা বাথটাব,” নির্মলকে বলেছিল ও।
বাথরুমের অন্যদিকের আরেকটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর দিকটায় যাওয়া যায়। পাল্লাটা ঠেলা দিয়ে খুলে গুহার মতো বিশাল একটা ঘরে এসে পড়ল কানাই। ঘরের দেওয়ালগুলো কাঠ দিয়ে বাঁধানো। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে সামান্য আলো এসে পড়েছে। ভেতরে। আলোর সেই রেখাগুলির মধ্যে ঘন ধুলো যেন জমাট বেঁধে আছে। মাঝখানে পড়ে আছে লোহার তৈরি বিরাট একটা পালঙ্কের কাঠামো। দেওয়ালে দেওয়ালে মোটা ফ্রেমে বাঁধানো বিশাল বিশাল সব পোর্ট্রেট ঝুলছে–লম্বা পোশাক-পরা মেমসাহেব, হাঁটু অবধি ব্রিচেসওয়ালা সাহেব। বহুদিনের অযত্নে রং জ্বলে ঝাপসা হয়ে এসেছে ছবিগুলো। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে একটা পোর্ট্রেটের সামনে এসে থেমে গেল কানাই। ছবিটা একটা কমবয়েসি মেয়ের, লেস-লাগানো পোশাক পরা। ছোট ছোট হলুদ ফুলে ভরা একটা ঘাসজমির ওপর পা মুড়ে বসে আছে মেয়েটা, খাড়াই উঠে গেছে পেছনের জমি, তার খাঁজে খাঁজে বেগনি রংয়ের ঝোঁপড়া গাছ। দূরে পাহাড়ের মাথায় বরফ জমে আছে। ছবির নীচে ময়লাটে একটা পেতলের পাতের ওপর লেখা, ‘লুসি ম্যাককে হ্যামিলটন, আইল অব অ্যারান।
“লুসি হ্যামিলটন কে ছিল?” কানাই যেন নিজের ছেলেবেলার গলার আওয়াজ শুনতে পেল।
“ওর নামেই নাম দেওয়া হয়েছে এই দ্বীপটার।”
“ও এখানে থাকত? এই বাড়িটায়?”
“না। ইউরোপ থেকে এখানে আসার পথেই জাহাজডুবি হয়ে মারা গিয়েছিল। এ বাড়িটা ও চোখেই দেখেনি। কিন্তু ওর জন্যই যেহেতু এটা বানানো হয়েছিল, লোকে তাই এটাকে বলত লুসির বাড়ি। পরে মুখে মুখে সেটা হয়ে গেল লুসিবাড়ি। আস্তে আস্তে গোটা দ্বীপটার নামই লুসিবাড়ি হয়ে গেল। এই বাড়িটাকে কিন্তু আর কেউ ওই নামে ডাকে না। লোকের কাছে এটা এখন হ্যামিলটনের কুঠি।”
“কেন?”
“কারণ এটা বানিয়েছিল যে সাহেব তার নাম ছিল স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন, লুসির কাকা। হ্যামিলটন সাহেবের নাম দেখনি তুমি স্কুলের দরজায়?”
“উনি কে ছিলেন?”
“ওনার কথা জানতে চাও তুমি?”
“শোনো তা হলে,” গাঁট-পাকানো তর্জনী তুলে বলেছিল মেসো। “শুনতে চেয়েছ যখন, তা হলে বলি। মন দিয়ে শুনবে। একবর্ণও কিন্তু বানানো গল্প নয়।”
.
পতন
সন্ধে প্রায় ঘনিয়ে এসেছে, এমন সময় দূরে একটা নৌকো নজরে এল পিয়ার। শুরুতে একেবারে বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছিল নৌকোটাকে–দিগন্তের কাছে অনেকগুলি নদীর মোহনায় যেন স্থির একটা কালো দাগ। খানিক বাদে দাগটা একটু বড় হতে বোঝা গেল সেটা একটা ছইওয়ালা ছোট্ট মাছধরা ডিঙি। দুরবিন চোখে লাগিয়ে একজনই মাত্র জেলেকে দেখতে পাচ্ছিল পিয়া। নৌকোর ওপর সোজা দাঁড়িয়ে লোকটা একটা জাল ছুঁড়ে দিচ্ছে, একটু পরে আবার নিচু হয়ে টেনে টেনে তুলছে।
তিন ঘণ্টা হয়ে গেল লঞ্চের সামনের দিকটায় ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পিয়া। দূরবিনটা একবারও নামায়নি চোখ থেকে, জলের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করেছে যদি একটা শুশুক কোথাও দেখা যায়। তবে লাভ কিছু হয়নি এখনও পর্যন্ত। একবার মুহূর্তের জন্য একটু আশা জেগেছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা গেল জল থেকে যেটা লাফিয়ে উঠেছে সেটা আসলে একটা শংকর মাছ। শূন্যের মধ্যে লেজওয়ালা প্রাণীটাকে মনে হচ্ছিল যেন একটা উড়ন্ত ঘুড়ি। তার মিনিট দুয়েক পরেই হঠাৎ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওপরে দৌড়ে এল মেজদা। ওর প্রপেলারের মতো হাত-পা নাড়া দেখে পিয়ার মনে হল নিশ্চয়ই শুশুক-টুশুক কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। কিন্তু এবারেও ব্যর্থ আশা। পাড়ে শুয়ে রোদ পোয়ানো কয়েকটা কুমির দেখানোর জন্যে দৌড়ে এসেছে মেজদা। তবে ওর উৎসাহের কারণটা বোঝা গেল এর পর। ডান হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে ইশারা করে ও জানাল এই গুরুদায়িত্ব সম্পাদনের জন্যে কিছু বকশিস লাগবে। খুব রাগ হল পিয়ার। বিরক্ত একটা ভঙ্গি করে ও বুঝিয়ে দিল বকশিস-টকশিস কিছু হবে না।
মেজদা দেখানোর অনেক আগেই কুমিরগুলো নজরে এসেছিল পিয়ার। দূরবিন দিয়ে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেই ওদের দেখতে পেয়েছিল ও। দানবের মতো বিশাল চারখানা সরীসৃপ, সবচেয়ে বড়টা লম্বায় প্রায় এই লঞ্চটার সমান। এগুলির একটার মুখোমুখি পড়লে কী যে হবে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল পিয়ার।
কুমির আর শংকরমাছ ছাড়া এই তিন ঘণ্টায় আর কিছুই চোখে পড়ল না। কিছু যে দেখা যাবেই ঠিক সেরকম যে আশা করেছিল পিয়া তা নয়, তবে সারা দুপুরটা এইরকম নিষ্ফলা যাবে তাও ভাবেনি। এই অঞ্চলের নদীতে একসময় যে প্রচুর শুশুক ছিল সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই। ঊনবিংশ শতকের অনেক প্রাণিবিজ্ঞানীই এদের বিষয়ে লিখে গেছেন। গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের আবিষ্কর্তা’ উইলিয়াম রক্সবার্গের লেখায় রয়েছে, মিষ্টিজলের শুশুকরা “কলকাতার দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্বের নদী-খাড়িগুলিতে থাকতে পছন্দ করে”। অথচ এই অঞ্চলটাতেই এতক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও কিছুই চোখে পড়ল না। পিয়া ভেবেছিল পথে কোনও পোড়-খাওয়া জেলের সঙ্গে দেখা হলেও কিছু খোঁজখবর হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সেরকম জেলে নৌকোও খুব বেশি নজরে পড়েনি আজ সারাদিনে। ভিড়ে ঠাসা খেয়া
নৌকো আর স্টিমার দেখা গেছে বেশ কয়েকটা, তবে জেলে নৌকো এতই কম চোখে পড়েছে যে একেক সময় মনে হয়েছে হয়তো এই অঞ্চলে মাছ ধরা নিষেধ। এই জেলে ডিঙিটা তো, দেখা গেল বেশ অনেকক্ষণ পর। ওরা মনে হয় নৌকোটার কয়েকশো মিটার মাত্র দূর দিয়ে যাবে। লঞ্চটা একটু ঘুরিয়ে ওটার কাছাকাছি নিয়ে যেতে বলবে কিনা ভাবছিল পিয়া।
বেল্ট থেকে রেঞ্জফাইন্ডারটা খুলে হাতে নিল ও। খানিকটা দূরবিনের মতো দেখতে যন্ত্রটার একদিকে দুটো আইপিস, আর অন্যদিকে একটা সাইক্লোপিয়ান লেন্স। ডিঙিটার দিকে ফোকাস করে একটা বোতাম টিপল, কয়েক মুহূর্ত পরেই বিপ করে একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে নৌকো আর লঞ্চের মধ্যের দূরত্বটা ভেসে উঠল যন্ত্রের পর্দায়–১.১ কিলোমিটার।
ডিঙির ওপর মাছ ধরতে ব্যস্ত লোকটাকে এতদূর থেকে খুব একটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ও যে পাকা জেলে সেটা দিব্যি বোঝা যাচ্ছিল। থুতনি আর গালে সাদা ছোপ ছোপ দুরবিন দিয়ে দেখে মনে হল খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। মাথায় পাগড়ি মতো কিছু একটা জড়ানো, কিন্তু সারা গা খালি; শুধু কোমরে একটুকরো কাপড় মালকেঁচার মতো করে বাঁধা। শরীরটা কঙ্কালসার ক্ষয়টে মতো, নোনা হাওয়া আর রোদ্দুরে যেন দেহের সব চর্বি-মাংস খেয়ে গেছে–সারাজীবন জলে জলে কাটালে যেমন হয়। অন্য অনেক নদীতে এরকম জেলেদের দেখেছে পিয়া, এদের কাছ থেকেই বেশিরভাগ সময় ভাল খোঁজখবর পাওয়া যায়। ও ঠিক করল একটু ঘুরে গিয়ে লোকটাকে একবার ওর ফ্ল্যাশকার্ডগুলো দেখিয়ে নেবে। যদি কিছু লাভ হয়।
এর আগেও দু’বার পিয়া মেজদাকে এদিকে-সেদিকে লঞ্চ ঘোরাতে বলেছিল, কিন্তু ওই কুমিরের ব্যাপারটার পর থেকে কীরকম একটু তিরিক্ষি হয়ে আছে লোকটা। আর বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দিচ্ছে না ওকে। কিন্তু এবারে পিয়া ঠিক করেছে যে-কোনও ভাবেই হোক লঞ্চটাকে নিয়ে যাবে ওই নৌকোর কাছে।
কাঁচ-লাগানো সারেংএর ঘরটার মধ্যে পাশাপাশি বসেছিল মেজদা আর গার্ড–মেজদার হাতে স্টিয়ারিং। লঞ্চের সামনের দিকটা থেকে সরে এসে ওদের দিকে এগোল পিয়া। ওকে দেখেই চট করে চোখটা নামিয়ে নিল মেজদা। ওর চোর চোর ভাবটা দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল ওকে নিয়েই ওরা আলোচনা করছিল এতক্ষণ।
একটা ফ্ল্যাশকার্ড বার করে সারেং-এর ঘরের সামনে এসে মেজদার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়াল পিয়া। কাঁচের ওপর একটা হাত রেখে বলল, “স্টপ!” ওর আঙুল বরাবর তাকাতেই দূরের ডিঙি নৌকোটার দিকে নজর পড়ল মেজদার; ডিঙিটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন। “ওই দিকে চলুন–ওই নৌকোটার দিকে। এই ছবিটা ও চিনতে পারে কিনা দেখব,” হাতের কার্ডটা তুলে দেখাল পিয়া।
সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে খুলে গেল সারেং-এর ঘরের দরজাটা, আর খাকি প্যান্টটা টেনে তুলতে তুলতে বাইরে বেরিয়ে এল ফরেস্ট গার্ড। ডেকের সামনের দিকে লঞ্চের একেবারে কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল লোকটা, এক হাতে রোদ্দুর আড়াল করে ঝুঁকে পড়ে ডিঙিটার দিকে তাকিয়ে রইল। দেখতে দেখতে ভুরু কুঁচকে উঠল গার্ডের, বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল সারেংকে। দু’জনে কী বলাবলি করল খানিকক্ষণ, তারপরে মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি স্টিয়ারিং ঘোরাল মেজদা। আস্তে আস্তে লঞ্চের মুখ ঘুরতে লাগল ডিঙিটার দিকে।
“গুড,” খুশি হল পিয়া। কিন্তু গার্ডটা কোনও পাত্তাই দিল না ওকে। তার সমস্ত মনোযোগ এখন ওই নৌকোটার দিকে। লোকটার হাবভাবের একাগ্রতা দেখে একটু আশ্চর্য হল পিয়া। কেমন একটা হিংস্র ভাব ওর চোখেমুখে। দেখে একটুও মনে হল না যে স্রেফ পিয়ার কথা রাখার জন্যই নৌকোটার দিকে যাচ্ছে ওরা।
ডিঙির জেলেটা তখন আরেকবার জাল ফেলার জন্য তৈরি হচ্ছে। নৌকো একই জায়গায় স্থির, একটু একটু করে আকারে বড় হয়ে উঠছে। এখনও এক কিলোমিটারের বেশি দূরে রয়েছে ডিঙিটা।
লঞ্চের মুখ ঘোরার পর একবারও ওটার দিক থেকে দূরবিন সরায়নি পিয়া। জেলেটা এতক্ষণ খেয়াল করেনি ওদের, কিন্তু লঞ্চের দিক বদলানোর সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল টের পেল ও, সতর্ক হয়ে বন্ধ করল জাল ফেলা। ঘুরে তাকাল ওদের দিকে, চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। দূরবিন দিয়ে ওর চোখদুটো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল পিয়া। পাশের দিকে মুখ ফেরাল লোকটা, ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল, মনে হল কাউকে কিছু বলছে। পাশে ফোকাস করে পিয়া দেখল ও একা নয়, আরও একজন আছে ডিঙিটাতে। একটা বাচ্চা ছেলে, হয়তো নাতি বা ভাইপো-ভাগনে কেউ হবে। ডিঙির আগায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে বাচ্চাটা। পিয়ার মনে হল ও-ই লঞ্চটা দেখতে পেয়ে লোকটাকে বলেছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এখনও লঞ্চটারই দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে ছেলেটা।
দুজনেই ওরা খুব ভয় পেয়েছে মনে হল। লোকটা তাড়াতাড়ি ভেতর থেকে একজোড়া বৈঠা বের করে ঊর্ধ্বশ্বাসে নৌকো বাইতে শুরু করল, আর ছেলেটা দৌড়ে ডিঙির পেছন দিকে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল ছইয়ের আড়ালে। মিটার পঞ্চাশেক দূরের সরু একটা খাঁড়ির মুখের দিকে এখন সোজা এগোচ্ছে নৌকোটা। ভরা জোয়ারের সময় খাঁড়ির দু’ ধারের ঘন জঙ্গল অর্ধেক ডুবে আছে জলে, আর একবার যদি সে বনের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে পারে, কোনও লঞ্চের সাধ্য হবে না ওই খুদে ডিঙিকে খুঁজে বের করে। জল এখন বেশ গভীর, নৌকোটা খুব সহজেই জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে পালাতে পারবে।
ব্যাপারটা বেশ একটু অদ্ভুত লাগল পিয়ার। ইরাবড়ি বা মেকং-এ ও অনেক সময় দেখেছে যে জেলেদের সাথে কথা বলতে গেলে তারা অচেনা লোক বা সরকারি লোকেদের দেখে ভয় পেয়েছে, কিন্তু কোনও জেলেই কখনও ডিঙি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেনি।
ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে পিয়া দেখল লঞ্চের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে আছে ফরেস্ট গার্ড–কাঁধে রাইফেল। পিয়া যখন একদৃষ্টে নৌকোটার দিকে দেখছিল সেই সময়ে ভেতরে গিয়ে বন্দুকটা নিয়ে এসেছে ও। এতক্ষণে বোঝা গেল কেন পালাচ্ছে ডিঙিটা। পিয়া গার্ডের দিকে ফিরল। আঙুল দিয়ে বন্দুকটাতে খোঁচা মেরে বলল, “এটা কেন এনেছেন? কী করবেন রাইফেল দিয়ে? যান, রেখে আসুন ওটা।” ঝটকা মেরে পিয়ার হাতটা সরিয়ে দিয়ে লোকটা মেজদাকে চেঁচিয়ে কী একটা বলল। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনের ধকধকানি বেড়ে গেল, আর তিরবেগে লঞ্চটা এগিয়ে চলল নৌকোর দিকে।
পিয়া বুঝতে পারল ওর নিজেরই শুরু করা ঘটনাক্রম এখন আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। কী যে হচ্ছে, সেটাই ভাল করে মাথায় ঢুকছিল না। এক হতে পারে এটা নিষিদ্ধ এলাকা আর ওই জেলে বেআইনিভাবে মাছ ধরছিল, তাই ফরেস্ট গার্ড ওকে তাড়া করেছে। তাই যদি হয় তা হলে যে-কোনও ভাবেই হোক এই ইঁদুর-বেড়াল খেলাটা এক্ষুনি বন্ধ করতে হবে। কারণ একবার যদি খবর রটে যায় যে ও স্থানীয় লোকেদের পেছনে লেগেছে, সার্ভের কাজের একেবারে বারোটা বেজে যাবে।
সারেং-এর ঘরের দিকে ফিরে ও মেজদাকে বলল, “লঞ্চ থামান, আর যেতে হবে না। থামুন বলছি।” কথাটা শেষ করে কেবিনটার দিকে এগোতে গিয়েই শুনল ফরেস্ট গার্ড চিৎকার করে নৌকোর জেলেটাকে ধমকাচ্ছে। ওদিকে চেয়ে দেখল রাইফেলটা কাঁধের কাছে তুলে ধরে ডিঙির দিকে তাক করছে লোকটা, মনে হল যে-কোনও সময়ে গুলি চালিয়ে দেবে।
মাথায় রক্ত উঠে গেল পিয়ার। “ভেবেছেনটা কী আপনারা? যা ইচ্ছে তাই করবেন নাকি?” দৌড়ে গিয়ে একহাত দিয়ে গার্ডের কনুই ধরে আরেক হাতে বন্দুকের নলটা অন্যদিকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করল ও। কিন্তু লোকটা অনেক বেশি ক্ষিপ্র। কিছু বোঝার আগেই ওকে কনুই দিয়ে প্রচণ্ড একটা গুতো মারল কাঁধের হাড়টার কাছে। ছিটকে পড়ল পিয়া ডেকের ওপর, হাত থেকে ডিসপ্লে কার্ডটা উড়ে গিয়ে পড়ল খানিকটা দূরে।
ডিঙির লোকটা ওদিকে দাঁড় টানা থামিয়ে দিয়েছে। মেজদাও লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ করল। হঠাৎ করে যেন চারপাশটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে নৌকোর পাশে গিয়ে স্থির হল লঞ্চটা। চেঁচিয়ে কিছু একটা বলে গার্ড ডিঙিটার ওপর একটা দড়ি ছুঁড়ে দিল। দড়িটা ধরে নিয়ে নৌকোর সঙ্গে বেঁধে দিল জেলেটা। পিয়া দেখতে পেল ছইয়ের আড়ালের আবছা অন্ধকার থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে রয়েছে বাচ্চাটা।
গার্ডের ধমক খেয়ে বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলল নৌকোর লোকটা। জবাবটা মনোমতো হয়েছে মনে হল, কারণ মেজদার দিকে ফিরে একটা আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল গার্ড। তারপর খানিক গুজগুজ করে কী সব বলাবলি করল দু’জনে, শেষে পিয়ার সামনে এসে ফরেস্ট গার্ড খানিকটা অভিযোগের সুরে বলল, “পোচার”।
“কী?” একেবারে হাঁ হয়ে গেল পিয়া। বলে কী লোকটা? এ তো রাতকে দিন করে দিতে পারে! মাথা নেড়ে ও বলল, “হতেই পারে না। ও স্রেফ মাছ ধরছিল।”
“পোচার”, গার্ড তার বক্তব্যে অনড়। রাইফেল দিয়ে জেলেটার দিকে দেখিয়ে আবার বলল, “পোচার”।
কী ঘটেছে এতক্ষণে বুঝতে পারছিল পিয়া। এই লোকটা নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ এলাকায় মাছ ধরছিল; এমন একটা জায়গাও তাই বেছে নিয়েছিল দরকার হলে যেখান থেকে খুব সহজেই পালানো যেতে পারে। পিয়াদের লঞ্চটাকে ও মনে হয় ভেবেছিল সাধারণ টুরিস্ট লঞ্চ, তার মধ্যে যে একজন সশস্ত্র ফরেস্ট গার্ড থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারেনি। এখন বাঁচতে হলে ওকে হয় ফাইন দিতে হবে, নয়তো ঘুষ দিতে হবে।
ক্লান্ত চেহারার লোকটা দাঁড়ে ভর দিয়ে খাড়া দাঁড়িয়েছিল নৌকোর ওপর। কাছ থেকে ওকে দেখে চমকে গেল পিয়া। দুরবিন দিয়ে দেখে যেরকম মনে হয়েছিল লোকটা আদৌ সেরকম সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো নয়। বয়সে ওর কাছাকাছিই হবে, খুব বেশি হলে সাতাশ-আটাশ। শরীরের কাঠামোটাও মোটেই ক্ষয়টে ধরনের নয়, শুধু একটু বেশি রোগা। লম্বা লম্বা হাত-পাগুলোতে এতটুকু চর্বি বা বাড়তি মাংসের চিহ্ন নেই, হাড়ের ওপর দড়ির মতো পাকিয়ে পাকিয়ে আছে পেশিগুলো। দূর থেকে যেগুলোকে দেখে পিয়া পাকা দাড়ি ভেবেছিল, সেই সাদা সাদা কুচিগুলো আসলে শুকনো নুনের গুঁড়ো–সারাদিন নোনা জলের ওপর কাটানোর ফল। লোকটার মুখটা সরু তিনকোনা মতো, আর এত ভীষণ রোগা যে তার ওপর চোখগুলোকে বিশাল বড় বড় মনে হচ্ছে। হতদরিদ্র চেহারাটা আরও ফুটে বেরোচ্ছে কোমরে জড়ানো আধময়লা ত্যানাটার জন্য। তবু ওর এই আপাত প্রতিরোধহীন হাড়-বেরোনো চেহারার মধ্যেও কোথাও একটা বিদ্রোহের ভাব রয়েছে মনে হল পিয়ার। একটু সতর্ক চোখে গার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখছে লোকটা, যেন কত টাকা খোয়াতে হবে সেটা আঁচ করার চেষ্টা করছে। অন্তত এক সপ্তাহের রোজগার তো হবেই, মনে মনে ভাবল পিয়া; এক মাসেরও হতে পারে।
লঞ্চের ডেকের ওপর থেকে ডিসপ্লে কার্ডটা তুলে নিল ফরেস্ট গার্ড–মনে হল যেন পিয়ার এখানে কী কর্তব্য সেটা খেয়াল করিয়ে দিতে চায় ওকে। শিকার জালে পড়ে গেছে, তাই ওর ভাবভঙ্গিতে আর ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র নেই। ধীরেসুস্থে কার্ডটা পিয়ার হাতে দিয়ে নৌকোর দিকে ইশারা করল জেলেটাকে একবার দেখিয়ে নেওয়ার জন্য।
লোকটা ওকে ওর কাজ চালিয়ে যেতে বলছে, যেন কিছুই ঘটেনি! ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছিল না পিয়া। মাথা নেড়ে হাত সরিয়ে নিল ও। কিন্তু নিরস্ত না হয়ে আবার কার্ডটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল গার্ড। ওর হাতের সঙ্গে সঙ্গে এবার বন্দুকটাও মনে হল এগিয়ে এল, যেন গুঁতিয়ে ওকে পাঠাবে জেলেটার দিকে। “ঠিক আছে তা হলে,” কাঁধ আঁকাল পিয়া। কোমর থেকে যন্ত্রপাতির বেল্টটা খুলে নিল ও, তারপর দূরবিন-টুরবিন সুদ্ধ ওটাকে ঠেসে ঢোকাল পিঠব্যাগটার মধ্যে। ডিসপ্লে কার্ডটা তুলে নিয়ে লঞ্চের মুখের দিকে এগিয়ে গেল। পিয়ার ঠিক নীচে এখন নৌকোটা, লঞ্চের একেবারে গায়ের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা। জেলেটার মুখটা ঠিক ওর হাঁটুর সামনে।
হঠাৎ মুখের সামনে পিয়াকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল লোকটা। এতক্ষণ আসলে ওর সমস্ত মনোযোগটাই ছিল গার্ডের দিকে, লঞ্চে যে কোনও মহিলা থাকতে পারে সেটা ভাবতেই পারেনি। এখন পিয়াকে দেখতে পেয়ে হঠাৎই ও আত্মসচেতন হয়ে উঠল। মাথায় যে কাপড়ের টুকরোটা জড়ানো ছিল এক টান মেরে নামিয়ে আনল সেটাকে। গোটানো কাপড়টা খুলে গিয়ে পর্দার মতো গায়ের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কোমরের কাছে একটা গিট মেরে বেঁধে দেওয়ার পর পিয়া বুঝতে পারল এতক্ষণ যে পাকানো কাপড়টাকে ও পাগড়ি বলে ভাবছিল সেটা আসলে লুঙ্গি। লোকটার বিবেচনা আছে দেখা যাচ্ছে। আর ওর উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ভাবটাতেও মনে মনে খানিকটা স্বস্তি পেল পিয়া। মনে হল লঞ্চে ওঠার পর থেকে এতক্ষণে এই প্রথম ও একজন স্বাভাবিক মানুষের কাছাকাছি এল। তবে এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও কিন্তু ওর মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে–কখন জেলেটাকে দেখাবে ফ্ল্যাশকার্ডটা।
এক হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের ওপর ভর দিয়ে নিচু হয়ে জেলেটার মুখোমুখি বসল পিয়া। দু’জনের মাথা এক উচ্চতায় আসার পর কার্ডটা ওর সামনে ধরল। একটু হাসারও চেষ্টা করল ওকে আশ্বস্ত করার জন্য, কিন্তু কিছুতেই ওর চোখের দিকে তাকাল না লোকটা। তবে ছবিগুলোর দিকে নজর পড়তেই হাত তুলে ও নদীর উজানের দিকে একটা জায়গা দেখিয়ে দিল। এত দ্রুত আর দ্বিধাহীন প্রতিক্রিয়া দেখে পিয়ার একবার মনে হল লোকটা বোধহয় বুঝতে পারেনি ও কী জানতে চাইছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য সরাসরি চোখে চোখে তাকাতেই মাথা নাড়ল ও, যেন বলতে চায়, হ্যাঁ, ঠিক ওই জায়গাতেই এরকম শুশুক দেখেছি আমি। কিন্তু কোন ধরনের শুশুক ও দেখেছে সেটা ঠিক বোঝা গেল না। আবার কার্ডটা এগিয়ে দিল পিয়া, মনে মনে ভাবল নিশ্চয়ই গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনের ছবিটার দিকে দেখাবে ও। কারণ এই প্রজাতির শুশুকই বেশি দেখা যায়। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা ইশারা করল অন্য ছবিটার দিকে। মানে ও ইরাবড্ডি ডলফিন দেখেছে এই নদীতে? ওর্কায়েলা ব্রেভিরোসি? এবার মুখ খুলল লোকটা। বাংলায় কী একটা বলে দু’হাতের ছ’টা আঙুল তুলে দেখাল।
“ছ’টা?” পিয়া উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছিল না। “তুমি ঠিক দেখেছ?”
হঠাৎ একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ওর কথা থেমে গেল। তাকিয়ে দেখল ওদের কথাবার্তার সুযোগ নিয়ে কখন নৌকোটায় নেমে গেছে ফরেস্ট গার্ড। ছইয়ের ভেতর রাখা পোঁটলা-পুঁটলিগুলো হাতের রাইফেলটা নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখছে। বাচ্চাটা এক কোনায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে, হাত দুটো বুকের কাছে মুঠো করে ধরা। আচমকা যেন ছোঁ মেরে ওকে টেনে তুলল গার্ড। জোর করে আলগা করল মুঠি। দেখা গেল সামান্য কয়েকটা টাকা ওর হাতে, সেগুলোকেই লুকোনোর চেষ্টা করছিল এতক্ষণ। গার্ড ওর কাছ থেকে টাকাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে নিজের পকেটে পুরল, তারপর ধীরেসুস্থে লঞ্চে গিয়ে উঠল।
ওপর থেকে দেখতে দেখতে হঠাৎ নিজের কোমরের বেল্টে বাঁধা টাকার ব্যাগটার কথা মনে পড়ল পিয়ার। চুপি চুপি সেটার চেন খুলে একগোছা টাকা বের করে আনল ও। টাকাগুলোকে পাকিয়ে শক্ত করে মুঠোর মধ্যে ধরে অপেক্ষা করতে লাগল লঞ্চটা চালু হওয়ার জন্য। গার্ড পেছন ফিরতেই ঝুঁকে পড়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল ও জেলেটার দিকে। প্রায় ফিসফিস করে বলল, “এই যে, এদিকে তাকাও একবার”। কিন্তু ইঞ্জিনের ভটভট শব্দে ওর গলা চাপা পড়ে গেল। চলতে শুরু করেছে লঞ্চ, নৌকো আর লঞ্চের মাঝে জল দেখা যাচ্ছে নীচে, কিন্তু পিয়ার মনে হল আর খানিকটা উঁচুতে দাঁড়াতে পারলেই টাকাটা ছুঁড়ে দিতে পারবে ও। একটা প্লাস্টিকের চেয়ার ছিল কাছে, সেটাকে লঞ্চের ধারে টেনে নিয়ে এল। ওটার ওপর কোনওরকমে ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে দিল টাকাটা নৌকোর দিকে। “এদিকে তাকাও, এদিকে,” বলেই একটা জোরালো হিসহিসে আওয়াজ করল মুখ দিয়ে। এবার শুনতে পেল জেলেটা, চমকে প্রায় লাফিয়ে উঠল। কিন্তু শব্দটা কানে যেতে গার্ডও তিরবেগে দৌড়ে এল ডেকের অন্য প্রান্ত থেকে। লোকটার একটা পা এসে লাগল চেয়ারটায়, আর ভারসাম্য রাখতে না পেরে শূন্যে ছিটকে গেল পিয়া। টের পেল ও পড়ে যাচ্ছে, ঘোলাটে বাদামি জল দ্রুত এগিয়ে আসছে ওর মুখের দিকে।
.
স্যার ড্যানিয়েল
“ভাটির দেশের সঙ্গে মরুভূমির অনেক মিল আছে”, বলেছিল নির্মল। “যেমন ধরো, মরুভূমির মতো এখানেও মরীচিকা দেখা যায় যা নেই তাও দেখতে পায় মানুষ। স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটনও দেখেছিলেন। ভাটির দেশের কাঁকড়ায় ভরা নদীতীর দেখে স্কটল্যান্ড থেকে আসা সাহেবের মনে হয়েছিল কাদামাটি নয়, সোনার চেয়েও ঝকমকে কিছু দিয়ে তৈরি এ জায়গাটা। কত দাম হতে পারে এখানকার এই কাদার, বলেছিলেন উনি। ‘বাংলাদেশের এক একর জমি পনেরো মণ ধান ফলাতে পারে। কিন্তু এক বর্গমাইল সোনায় কী ফসল হবে? কিছুই না।’ “
আঙুল তুলে দেওয়ালে ঝোলানো একটা পোর্ট্রেট দেখিয়েছিল নির্মল। “দেখো, এই হল ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের নাইটহুড পাওয়ার দিনের ছবি। এইদিন থেকেই স্যার উপাধি বসল ওঁর নামের আগে–উনি হলেন স্যার ড্যানিয়েল।”
ছবির সাহেবের পায়ে মোজা, বকলস-বাঁধা জুতো, হাঁটু অবধি ব্রিচেস আর পরনে জ্যাকেট, পেতলের বোতাম আঁটা। নাকের নীচে ঝুপো সাদা গোঁফ, কোমরে বেল্টের সঙ্গে মনে হয় একটা তলোয়ার বাঁধা; সেটার বাঁটটা শুধু দেখা যাচ্ছে। চোখদুটো দেখলে মনে হয় সরাসরি তাকিয়ে আছে দর্শকের দিকে, মায়ামাখা দৃষ্টিতে খানিকটা কঠোরতার ছায়া। তার সঙ্গে মিশে আছে একটু রূঢ়তা আর কিছুটা খ্যাপামি। সব মিলিয়ে চোখদুটোতে এমন একটা কিছু ছিল, যে অস্বস্তি হচ্ছিল কানাইয়ের। ছবির হ্যামিলটনের নজর এড়ানোর জন্যে মেসোর আড়ালে সরে গিয়েছিল ও।
“স্যার ড্যানিয়েলের শিক্ষা শুরু হয়েছিল স্কটল্যান্ডে,” বলে চলেছিল নির্মল। “সে দেশের প্রকৃতি ছিল রুক্ষ আর পাথুরে, প্রচণ্ড ঠান্ডা আর নির্মম। ইস্কুলে মাস্টারমশাইদের কাছে উনি শিখেছিলেন কঠোর পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। একমাত্র পরিশ্রম দিয়েই সবকিছুকে জয় করা যায়–পাহাড় পাথর সবকিছু। কাদামাটিও। তো, সে সময়কার বেশিরভাগ স্কটল্যান্ডবাসীর মতো ড্যানিয়েল হ্যামিলটনও একদিন বের হলেন ভাগ্যের সন্ধানে। যাওয়ার জায়গা ছিল একটাই–স্বপ্নের দেশ, সোনার দেশ ভারতবর্ষ। এসে পৌঁছলেন কলকাতায়। পারিবারিক যোগাযোগের সূত্রে কাজও জুটে গেল একটা, ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জিতে। ম্যাকিন ম্যাকেঞ্জি তখন পি অ্যান্ড ও জাহাজ কোম্পানির জন্য টিকিট বেচত। জাহাজের ব্যবসায় সেকালের দুনিয়ায় পি অ্যান্ড ও-র ধারেকাছে কেউ ছিল না। হ্যামিলটনের জোয়ান বয়স, খাটতেও পারতেন খুব, দিনরাত পরিশ্রম করে প্রচুর টিকিট বিক্রি করে দিলেন–ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস, স্টিয়ারেজ–সবরকমের টিকিট। কলকাতা বন্দর থেকে একেকটা জাহাজ ছাড়ত আর শত শত টিকিট বিক্রি হত। টিকিট এজেন্ট মাত্র একজন। কাজেই হ্যামিলটনের তো পোয়াবারো। উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠতে উঠতে কিছুদিনের মধ্যেই একেবারে কোম্পানির কর্তা হয়ে বসলেন। বিশাল ধনসম্পত্তির মালিক হ্যামিলটন হয়ে উঠলেন ভারতের সবচেয়ে ধনী লোকেদের একজন। উনি ছিলেন, যাকে বলে মনোপলি ক্যাপিটালিস্ট। এত ধনসম্পদ উপার্জন করার পর অন্য যে-কোনও লোক হয় এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরে যেত, নয়তো আরাম-বিলাসে পয়সা ওড়াত–এটাই ছিল সে সময়ের দস্তুর। কিন্তু স্যার ড্যানিয়েল ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া।”
“কেন?”
“ধীরে বৎস, ধীরে। সে কথায় আসব আমরা। তার আগে একবার দেওয়ালের ওই ছবির দিকে তাকাও, তারপর চোখ বন্ধ করে কল্পনা করো, এই সায়েব, স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন, খাড়া দাঁড়িয়ে আছেন পি অ্যান্ড ও কোম্পানির জাহাজের ডেকে, ভেঁপু বাজিয়ে জাহাজ কলকাতা ছেড়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। সহযাত্রী অন্য সাহেব-মেম যাঁরা আছেন তারা যে যার মতো হাসছেন গাইছেন পানভোজন ফুর্তিতে মেতে আছেন। স্যার ড্যানিয়েল কিন্তু সেসবের মধ্যে নেই। ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি তখন দু’ চোখ ভরে পান করছেন চারপাশের দৃশ্য–এই বিশাল নদী, এই কাদামাটির চর, এই ম্যানগ্রোভে ঢাকা দ্বীপ। দেখতে দেখতে সাহেবের মনে হল, ‘এই জায়গাগুলো খালি পড়ে আছে কেন? কেন কেউ এই দ্বীপগুলিতে থাকে না? এতসব জমি শুধু পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে?’ জংলা দ্বীপগুলোর দিকে সাহেবকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে জাহাজের এক খালাসি এগিয়ে এল। আঙুল তুলে দূরে ইশারা করে বলল, “ওই দেখুন স্যার, জঙ্গলের মধ্যে একটা মন্দির দেখা যাচ্ছে। আর ওইদিকে দেখুন, একটা মসজিদ। এসব জায়গায় একসময় মানুষের বাস ছিল, কিন্তু ঝড়-ঝঞ্ঝা আর বাঘ-কুমিরের উপদ্রবে লোকে টিকতে পারেনি। তাই নাকি? স্যার ড্যানিয়েল বললেন, ‘একসময়ে যদি এখানে মানুষের বাস থেকে থাকে, তা হলে তো নতুন করে আবার বসতি গড়ে তোলাই যায়। আর এমন কিছু দূরধিগম্যও নয় জায়গাটা, ভারতের প্রবেশপথই বলা যেতে পারে বিশাল একটা উপমহাদেশে ঢোকার দরজায় একেবারে। পুবদিক থেকে এসে যারাই গাঙ্গেয় সমভূমিতে ঢোকার চেষ্টা করেছে তাদের প্রত্যেককে এখান দিয়ে যেতে হয়েছে, সে তোমার আরাকানিদেরই বললো, কি খমেরদেরই বলো অথবা যবদ্বীপের লোকেদের, কি ওলন্দাজ, মালয়ি, চিনে, পর্তুগিজ, ব্রিটিশ সক্কলকে। অনেকেই জানে এই ভাটির দেশের সবকটা দ্বীপে মানুষ থাকত কোনওনা-কোনও সময়। কিন্তু দেখে বলবে কার সাধ্যি? আসলে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বৈশিষ্ট্যই হল এই। শুধু দ্বীপের পর দ্বীপ গিলে ফেলেই ক্ষান্ত হয় না, সময়কে একেবারে মুছে ফেলে দেয় এ জঙ্গল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নতুন নতুন প্রেতের জন্ম দিয়ে চলে।
“কলকাতায় ফিরে এসেই হ্যামিলটন খোঁজ শুরু করলেন, কার কাছে এইসব জায়গার সম্পর্কে আরও খবর পাওয়া যায়। বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানতে পারলেন ওখানকার সব সমস্যার চেয়ে বড় সমস্যা হল খোদ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট। পুরো সুন্দরবনটাকে ওরা ওদের জমিদারি মনে করে। কিন্তু ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে গোড়াই কেয়ার করেন হ্যামিলটন। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভাটির দেশের দশ হাজার। একর জমি কিনে নিলেন উনি।”
“দশ হাজার একর! সেটা কতটা জায়গা?”
“সে বহু দ্বীপ কানাই, বহু বহু দ্বীপ। সরকার অবশ্য খুশি হয়েই বেচে দিয়েছিল সেগুলি। ফলে গোসাবা, রাঙ্গাবেলিয়া, সাতজেলিয়া–এইসব জায়গা চলে এল হ্যামিলটনের দখলে। এই নামগুলির সঙ্গে পরে যোগ হল আমাদের এই দ্বীপের নাম, এই লুসিবাড়ির। সায়েব অবশ্য চেয়েছিলেন তার নতুন জমিদারির নাম হবে অ্যান্ড্রপুর, স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রর নামে। এই সেন্ট অ্যান্ড্র শুরুতে ছিলেন খুব গরিব, সোনাদানা তার কিছুই ছিল না। পরবর্তী জীবনে তিনি প্রচুর টাকার মালিক হন। কিন্তু অ্যান্ড্রপুর নামটা চলল না। লোকের মুখে মুখে জমিদারির নাম হল হ্যামিলটনাবাদ। দিনে দিনে তোক যত বাড়তে লাগল, নতুন নতুন সব গ্রাম গজিয়ে উঠল, আর স্যার ড্যানিয়েল সেগুলোর নতুন নতুন নাম দিতে লাগলেন। যেমন একটা গ্রামের নাম দিয়েছিলেন সব নমস্কার’, আরেকটার নাম ‘রজত জুবিলি’, এইরকম। এই দ্বিতীয় নামটা বোধহয় কোনও রাজা মহারাজার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে দেওয়া হয়েছিল। এর পরে সাহেব তার আত্মীয়স্বজনদের নামে বিভিন্ন গ্রামের নাম দিতে শুরু করলেন–জেমসপুর, অ্যানপুর, এমিলিবাড়ি। এই লুসিবাড়ির নামটাও সেভাবেই হয়েছে।”
“কারা থাকত এইসব জায়গায়।”
“শুরুতে কেউই থাকত না। একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে–সে সময় এই জায়গাগুলি ছিল গভীর বন। কোনও লোকজন ছিল না, বাঁধ ছিল না, খেতজমি কিছু ছিল । শুধু কাদার বাদা আর ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। জোয়ারের সময় বেশিরভাগ অঞ্চল জলে ডুবে যেত। আর চারদিকে হিংস্র বন্য জন্তু–বাঘ, কুমির, কামট, লেপার্ড।”
“তা হলে লোকে কেন এল এখানে?”
“জমির জন্য এল। একটা সময় ছিল যখন লোকে এক-দু’ বিঘা জমির জন্য নিজেদের বিক্রি করে দিত। আর এই জায়গাটা তো দেশেরই মধ্যে, কলকাতা থেকে বেশি দূরেও নয়। জাহাজে করে বার্মা কি মালয় কি ফিজি কি ত্রিনিদাদ তো যেতে হল না। আর সবচেয়ে বড় কথা এখানে জমি পাওয়া যাচ্ছিল বিনে পয়সায়, একেবারে মুফতে।”
“সেইজন্য লোকে চলে এল?”
“শুধু চলে এল নয়, হাজারে হাজারে এল, আসতেই থাকল। হ্যামিলটন সাহেব বলেছিলেন যে কেউ গতরে খাটতে রাজি থাকবে সেই জমি পাবে। তবে হ্যাঁ, একটা শর্তে। ওইসব বিভেদ-বিবাদ জাতপাত এখানে চলবে না। তুমি বামুন কি শুদ্র, বাঙালি কি উড়িয়া সেসব ভুলে যেতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে খেটে যেতে হবে। যেই না এ খবর ছড়িয়ে পড়ল, অমনি স্রোতের মতো মানুষ আসতে লাগল উত্তর উড়িষ্যা থেকে, পুব বাংলা থেকে, সাঁওতাল পরগণা থেকে। নৌকো করে এল, ডিঙি করে এল, হাতের সামনে যা পেল তাতে করেই চলে এল। হাজারে হাজারে। ভাটার সময় তারা দা-কাটারি দিয়ে জঙ্গল সাফ করত, আর জোয়ার এলে মাচার ওপর বসে অপেক্ষা করত কখন জল নামবে। রাত্তিরে তারা উঁচু গাছের ওপর দোলনার মতো বানিয়ে তার ওপর ঘুমোত, জোয়ারের জলে যাতে ভেসে না যায়।
অবস্থাটা একবার কল্পনা করার চেষ্টা করো: প্রতিটা দ্বীপে অসংখ্য নদী-খাঁড়ি আর জঙ্গলে বাঘ, কুমির, সাপ কিলবিল করছে। তাদের তো একেবারে ভোজ লেগে গেল। শত শত লোককে বাঘে খেল, কুমিরে নিল, সাপে কাটল। এত লোক মরতে লাগল যে স্যার ড্যানিয়েলকে পুরস্কার ঘোষণা করতে হল। যে-ই একটা বাঘ বা কুমির মারতে পারবে সে-ই পুরস্কার পাবে।”
“কিন্তু কী দিয়ে মারবে?”
“খালি হাতে মারবে, ছুরি দিয়ে মারবে, বাঁশের তৈরি বর্শা দিয়ে মারবে। যা পাবে তাই দিয়ে মারবে। হরেনকে মনে আছে তোমার? যে আমাদের ক্যানিং থেকে নৌকো করে নিয়ে এল?”
“মনে আছে,” মাথা নাড়ল কানাই।
“ওর কাকা বলাই একবার মাছ ধরতে যাওয়ার সময় একটা বাঘ মেরেছিল। স্যার ড্যানিয়েল ওকে দু’ বিঘে জমি দিলেন, এই লুসিবাড়িতে। তারপর তো বহু বছর বলাই এ দ্বীপে বীরের সম্মান পেত।”
“কিন্তু স্যার ড্যানিয়েল কেন করেছিলেন এসব? টাকার জন্যে?”
“না। টাকার আর দরকার ছিল না সাহেবের। উনি চেয়েছিলেন একটা নতুন ধরনের সমাজ গড়তে, একটা নতুন দেশ গড়তে। ওঁর ইচ্ছে ছিল সে দেশটা চলবে সমবায় পদ্ধতিতে। সেখানে প্রত্যেকের জন্য জমি থাকবে, কেউ কাউকে শোষণ করবে না। এ নিয়ে মহাত্মা গাঁধী রবীন্দ্রনাথের মতো সব বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন স্যার ড্যানিয়েল। বুর্জোয়ারা তার সঙ্গে একমত হলেন। ঠিক হল একেবারে অন্যরকম একটা দেশ তৈরি হবে এখানে একটা আদর্শ দেশ।”
“কিন্তু এটা দেশ কী করে হবে? তখন তো কিছুই নেই এখানে রাস্তাঘাট নেই, ইলেকট্রিসিটি নেই…”
নির্মল একটু হেসেছিল। “সে সবই হয়েছিল।” দেওয়ালের দিকে দেখিয়ে বলেছিল, “ওইদিকে একবার তাকাও।” কানাই তাকিয়ে দেখল দেওয়ালের ধার ঘেঁষে একটা রং জ্বলে যাওয়া ইলেকট্রিকের তার চলে গেছে ঘরের একদিক থেকে অন্যদিকে। “দেখেছ তো? বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিলেন স্যার ড্যানিয়েল। শুরুর দিকে একটা বিশাল জেনারেটর ছিল এখানে, ঠিক স্কুলটার পাশে। পরে ওটা খারাপ হয়ে যায়। তদ্দিনে সাহেবও মারা গেছেন, আর অন্য কেউ উদ্যোগ নিয়ে ওটা সারাবার ব্যবস্থা করেনি।”
একটা টেবিলের পাশে নিচু হয়ে বসে আরেক গোছা তার দেখিয়েছিল নির্মল। “এই দেখো। টেলিফোনও ছিল এখানে। এমনকী কলকাতাতেও ফোন চালু হওয়ার আগে গোসাবায় টেলিফোন এনেছিলেন স্যার ড্যানিয়েল। সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা করেছিলেন সাহেব এই দ্বীপগুলিতে, কিচ্ছু বাকি রাখেননি। গোসাবায় একটা সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ছিল, এমনকী আলাদা টাকাও ছিল–গোসাবা মুদ্রা।”
দেওয়ালের গায়ে সারি সারি বইয়ের তাকগুলোর কাছে গিয়ে একটা ধূলিধূসরিত ঘেঁড়া কাগজের টুকরো নামিয়ে এনেছিল নির্মল। “এই দেখ, একটা ব্যাঙ্কনোট। কী লেখা আছে দেখেছ? ‘এ শুধু নিষ্প্রাণ মুদ্রা নয়, এই নোটের পেছনে আছে জীবিত মানুষ। এমনিতে এর দাম কানাকড়িও নয়, কিন্তু এর প্রকৃত মূল্য প্রচুর–যতটা জঙ্গল সাফাই হবে, যতগুলি পুকুর কাটা হবে, যতগুলি ঘরবাড়ি তৈরি হবে, তার একশো শতাংশ। এক সুস্থ, পরিপূর্ণ জীবনের সমান এ ব্যাঙ্কনোটের মূল্য।”
কাগজটা কানাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল নির্মল। “ভাল করে দেখে নাও। পড়ে মনে হয় যেন খোদ কার্ল মার্ক্স লিখেছেন। এ তো পরিষ্কার লেবার থিয়োরি অব ভ্যালু। কিন্তু নীচে সইটা দেখো। কী লেখা আছে? স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন।”
কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখছিল কানাই। “কিন্তু উনি কীসের জন্য করেছিলেন এইসব? পয়সা রোজগারের দরকার না থাকলে এত কষ্ট কেন করতে গেলেন হ্যামিলটন? আমার তো মাথায় ঢুকছে না।”
“তোমার কী মনে হয় কানাই?” জিজ্ঞেস করেছিল নির্মল। “আসলে সাহেবের একটা স্বপ্ন ছিল। যারা স্বপ্নের পেছনে ছোটে তারা যা চায়, স্যার ড্যানিয়েলও তাই চেয়েছিলেন। উনি চেয়েছিলেন একটা দেশ গড়তে যেখানে কোনও শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না, সমাজে উঁচু-নিচু ভেদ থাকবে না, তুচ্ছ সব বিষয় নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ থাকবে না। উনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটা জায়গার যেখানে সব্বাই পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সক্কলে–সকালবেলায় হবে চাষি, দুপুরে কবি, আর সন্ধ্যাবেলায় ছুতোরমিস্ত্রি।”
হো হো করে হেসে উঠেছিল কানাই। “কী হাল হয়েছে সেই স্বপ্নের। রয়ে গেছে শুধু কতগুলো পোকায়-খাওয়া ইঁদুরে-কাটা দ্বীপ।”
এইটুকু একটা বাচ্চা ছেলের থেকে এতটা বিদ্রূপ ঠিক আশা করেনি নির্মল। একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। খানিকটা খাবি খাওয়ার মতো ভাব করে শেষে বলেছিল, “হেসো না কানাই। আসলে এসব কিছুর জন্য তখনও প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেনি এই ভাটির দেশ। কে বলতে পারে, হয়তো কোনওদিন সত্যি হয়ে উঠতে পারে হ্যামিলটন সাহেবের সেই স্বপ্ন।”
.
স্নেল’স উইন্ডো
খোলা সমুদ্রের পরিষ্কার জলে যখন সূর্যের আলো পড়ে তা সমুদ্রতল থেকে একটু তেরচা ভাবে নীচে গিয়ে ঢোকে। জলের ভেতর থেকে ওপরে তাকালে সে আলো একটা উলটানো শঙ্কুর মতো চোখে এসে পড়ে। স্বচ্ছ বৃত্তের মতো সেই শঙ্কুর ভূমি ঝুলতে থাকে দর্শকের মাথার ওপরে, মনে হয় ঠিক যেন এক ভাসমান জ্যোতির্বলয়। সমুদ্রের নীচের আলোর তৈরি এই জ্যামিতিক আকারের নাম স্মেলস উইন্ডো। এই আলোর জানালা দিয়েই ডলফিনরা সমুদ্রগর্ভ থেকে বাইরের পৃথিবীকে দেখে। জলের তলায় যেদিকেই তারা যায়, ঝকঝকে রুপোলি রং-এর অনন্ত এক ঝাপসা বিস্তারের মধ্যে সেই ভাসমান আলোকবৃত্ত তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে।
গঙ্গা বা ব্রহ্মপুত্রের মতো নদীতে কিন্তু এই আলোর জানালা ঢাকা থাকে ভারী পলির পর্দায়। পলির পরিমাণ এই নদীগুলিতে এতটাই বেশি যে জলের মধ্যে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার যাওয়ার পরেই সূর্যের আলো পথ হারিয়ে ফেলে। সেই ভাসমান পলির স্রোতের মধ্যে একহাত দূরেও দৃষ্টি চলে না। পথ দেখাবার মতো কোনও আলোকবৃত্তও থাকে না বলে খুব সহজেই দিক ভুল হয়ে যেতে পারে। ওপরে না নীচে, আগে না পেছনে কোন দিকে যেতে হবে সেটা বুঝে ওঠা যায় না। এই সমস্যার জন্যই মনে হয় গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনরা সাঁতরায় কাত হয়ে–নদীর তলের সমান্তরালে। একদিকের পাখনা ঝুলে থাকে নীচের দিকে, নোঙরের মতো; সেটা দিয়ে নদীর তলার সেই অন্ধকারের রাজ্যে ওরা দিশা ঠিক রাখে।
পিয়া যদি নৌকো থেকে সমুদ্রের জলে পড়ত, তা হলে সামলে উঠতে ওকে বেশি বেগ পেতে হত না। এমনিতে ও যথেষ্ট ভাল সাঁতার জানে, স্রোতের টানের মুখেও নিজেকে ভাসিয়ে রাখার ক্ষমতা আছে। কিন্তু সুন্দরবনের নদীর ঘোলা জলের নীচে ঝাপসা আলোয় দিশাহারা হয়ে ভয় পেয়ে গেল পিয়া। দম দ্রুত ফুরিয়ে আসছে আর মনে হচ্ছে অদ্ভুত উজ্জ্বল একটা পলির স্তর আস্তে আস্তে ওকে ঢেকে নিচ্ছে, কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না কোন দিকে গেলে ভেসে ওঠা যাবে। মাথার ভেতরে কেমন একটা ঘ্রাণের বোধ, অথবা ঘ্রাণ ঠিক নয়, যেন একটা ধাতব স্বাদ। রক্তের স্বাদ নয়, সেটা এই অবস্থাতেও বোঝা যাচ্ছিল–কাদামাটি ঢুকে গেছে মুখে। নাকে চোখে গলার মধ্যে–সর্বত্র মাটি, একটা পলিমাটির পর্দা যেন নেমে আসছে চারদিক থেকে, ঘোলাটে সেই চাদর ধীরে ধীরে জড়িয়ে নিচ্ছে ওকে। এই শেষ তা হলে? একটা মরিয়া চেষ্টা করল পিয়া পলির চাদরটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার–আঁচড়ে, ঘুষি মেরে, লাথি মেরে–কিন্তু পিচ্ছিল দেওয়ালের মতো সেটা বার বার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ পিঠের ওপর যেন কর্কশ কিছুর একটা ঘষা লাগল। মুহূর্তের জন্য মনে হল সেটা কোনও সরীসৃপের ছুঁচোলো নাক। আঁকুপাঁকু করে উঠল পিয়া, ঘাড় ফেরাল পেছনে, কিন্তু জলের দুর্ভেদ্য ঘোলাটে রং ছাড়া আর কিছুই নজরে এল না। বাতাসের অভাবে শক্ত হয়ে আসছে শরীর, তাও শেষ শক্তিটুকু দিয়ে প্রবল চেষ্টায় হাত ছুড়ল। এবার মনে হল তীব্র বেগে কিছু একটা এগিয়ে আসছে মুখের ওপর; পিয়া বুঝতে পারল কেউ ওকে জলের মধ্যে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে সামনের দিকে, কিন্তু বাধা দেওয়ার শক্তি ওর ফুরিয়ে গেছে। এরপর হঠাৎই যেন হালকা হয়ে গেল মাথাটা, সারা শরীরে একটা ফুরফুরে ভাব–বাতাসের ছোঁয়া। কিন্তু জলে আর কাদায় বন্ধ হয়ে আছে মুখ নাক, নিশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা আর নেই।
জলের ওপর হাতের চাপড় মেরে উঠে আসার চেষ্টা করল পিয়া, সঙ্গে সঙ্গে আবার একটা প্রচণ্ড ঝাঁপটা লাগল মুখে। কোথা থেকে একজোড়া হাত এসে ওর বুকের চারপাশে জড়িয়ে ধরল। একটা ঝাঁকি দিয়ে কেউ ওর মাথাটা হেলিয়ে দিল পেছনের দিকে। পিয়া বুঝতে পারল নিজের দু’পাটি দাঁতের মধ্যে অন্য কারও দাঁত চেপে বসে যাচ্ছে। মুখের মধ্যে থেকে মনে হল কেউ কিছু শুষে নিচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে কী যেন উঠে আসছে গলা বেয়ে। শ্বাসনালিতে যেই বাতাসের স্পর্শ টের পাওয়া গেল, আরও দম নেওয়ার জন্য খাবি খেতে লাগল পিয়া। একটা হাত এখনও শক্ত করে তুলে ধরে রেখেছে ওকে জলের ওপর, বাঁদিকের কাঁধের ওপর কাটাকাটা কিছুর খোঁচা লাগছে। শ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁসফাস করতে করতেও আবছায়া চৈতন্যে পিয়ার মনে হল ওই ডিঙি নৌকোর জেলেটাই ধরে আছে ওকে, আর ওরই দাড়ির ঘষা লাগছে কাঁধের কাছে। ওই খোঁচা খোঁচা ভাবটাতেই ওর মাথাটা যেন অনেকটা সাফ হয়ে গেল। জোর করে ভয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া পেশিগুলোকে আলগা করে দিল পিয়া, শরীরটাকে শান্ত করে রাখল, যাতে ওকে বয়ে নিয়ে সাঁতার কাটতে লোকটার অসুবিধা না হয়।
স্রোতের টানে বেশ খানিকটা দূরে ভেসে চলে এসেছিল ওরা। স্থির হয়ে না থাকলে নৌকো পর্যন্ত ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। জলের ওপর গড়িয়ে গিয়ে তাই চিত হল পিয়া, পিঠটা একটু বাঁকিয়ে দিল আর-একটা হাত জেলেটার হাতের মধ্যে গলিয়ে দিয়ে শরীরটাকে প্রায় ভারশূন্য করে ভেসে রইল। কিন্তু নদীর স্রোত এখানে প্রায় মাধ্যাকর্ষণের মতো তীব্র। পিয়াকে টেনে নিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতেও প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল লোকটার, মনে হচ্ছিল যেন একটা ভারী মাল ঘাড়ে ধীরে ধীরে চড়াই ভেঙে উঠতে হচ্ছে ওকে।
অবশেষে নৌকোর সামনের দিকটা পিয়ার হাতের নাগালে এল। জলের মধ্যে জেলেটা কর্কশ্রুর মতো ঘুরে গেল একপাক, নীচ থেকে চাপ দিয়ে পিয়ার শরীরটাকে ঠেলে তুলল ডিঙির ওপর। উপুড় হয়ে পড়ল পিয়া, আর সঙ্গে সঙ্গে পেট থেকে ফোয়ারার মতো জল উঠে এসে দম বন্ধ করে দিল। হঠাৎ মনে হল আবার যেন ডুবে যাচ্ছে ও, নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে জল। দু’হাত দিয়ে গলার কাছটা চেপে ধরল পিয়া, হাঁসফাস করে খামচাতে লাগল, যেন একটা ফাস আটকে আছে সেখানে, আর সেটাকে ও আলগা করার চেষ্টা করছে। আবার জেলেটা দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরল ওর কাঁধ দুটো, ওর শরীরটাকে উলটে দিয়ে একটা পা আড়াআড়ি রাখল কোমরের কাছে। আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকল, মুখে মুখ লাগিয়ে পিয়ার গলার ভেতর থেকে শুষে নিতে থাকল জল আর সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া পাম্প করতে থাকল ফুসফুসে।
পিয়ার শ্বাসনালিতে বায়ু চলাচল আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসতে মুখ সরিয়ে নিল লোকটা। শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছিল পিয়া, থুতু ফেলছে ও মুখের থেকে পিয়ার বমির স্বাদ ধুয়ে পরিষ্কার করছে।
ধীরে ধীরে শ্বাসপ্রশ্বাসের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরতে লাগল, কানে এল কথাবার্তার আওয়াজ। আস্তে আস্তে চোখ খুলল পিয়া। দেখল লঞ্চের রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফরেস্ট গার্ড আর মেজদা। আড়চোখে ওর দিকে দেখছে আর ফিসফিস করে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। ওকে চোখ মেলতে দেখে নিজের ঘড়ির দিকে আর আকাশের দিকে ইশারা করল গার্ড। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে, সারা আকাশ লালে লাল। লোকটা কী বলতে চাইছে প্রথমে ঠিক ধরতে পারেনি পিয়া। শেষে যখন হাত নেড়ে ডাকতে লাগল, তখন ওর মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা : সন্ধে নেমে আসছে, তাই ও চাইছে পিয়া তাড়াতাড়ি লঞ্চে উঠে আসুক, তারপর যেখানে যাওয়ার যাওয়া যাবে।
এই অবস্থার মধ্যেও গার্ডের এই তাড়া দেওয়া দেখে গা জ্বলে গেল পিয়ার। লোকটা ধরেই নিয়েছে যে এখন ওর আর গত্যন্তর নেই, ওদের কথা শুনেই ওকে চলতে হবে এবার, যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে। প্রথম থেকেই এই লোকদুটোকে নিয়ে পিয়ার মনে একটা অস্বস্তির ভাব ছিল। এখন লঞ্চে ফিরে গেলে তো ওদের কাছে নিজের অসহায় ভাবটাই প্রকাশ করা হবে। আর এই পরিস্থিতিতে এই গার্ড আর মেজদার খপ্পরে পড়া মানে ওরা বুঝে যাবে যে পিয়া এখন ওদের হাতের মুঠোর নিরীহ শিকার। নাঃ, কোনওমতেই আর ফেরা চলবে না লঞ্চে। কিন্তু কী করবে ও তা হলে? আর কী রাস্তা খোলা আছে?
হঠাৎ বিদ্যুৎঝলকের মতো একটা শব্দ মনে এল পিয়ার। এত অপ্রত্যাশিত ভাবে মাথায় এল কথাটা যে একটু আশ্চর্যই হয়ে গেল ও। তাড়াতাড়ি উঠে বসে জপ করার মতো বিড়বিড় করে বার বার বলতে লাগল শব্দটা, যাতে হারিয়ে না যায়। মুখ ফিরিয়ে দেখল জেলেটা এখন ডিঙির সামনের দিকটায় উবু হয়ে বসে আছে। খালি গা, শুধু কোমরে একটুকরো কাপড় জড়ানো। জলে ঝাঁপ দেওয়ার সময় লুঙ্গিটা ছিঁড়ে খুলে ফেলেছিল, সেটা দিয়ে বাচ্চা ছেলেটা এখন ওর মাথা মুছিয়ে দিচ্ছে। পিয়া উঠে বসতে বাচ্চাটা ফিসফিস করে কিছু বলল। ঘুরে তাকাল লোকটা। চোখাচোখি হতেই মাথার মধ্যে শব্দটা হারিয়ে যাওয়ার আগে সময় নষ্ট না করে বলে ফেলল পিয়া, লুসিবাড়ি?’ ভুরু কোঁচকাল লোকটা, যেন বলতে চায় ঠিক শুনতে পায়নি কথাটা। তাই আবার পিয়া বলল, ‘লুসিবাড়ি?’ আর একটা শব্দও জুড়ে দিল, ‘মাসিমা?’ এবার মাথা নাড়ল লোকটা। নামগুলো ওর চেনা।
বিস্ময়ে গোল গোল হয়ে গেল পিয়ার চোখ। এই লোকটা চেনে ওই মহিলাকে? সন্দেহ নিরসনের জন্য আবার বলল ও, ‘মাসিমা?’ আবার লোকটা মাথা নাড়ল, একটু হাসির আভাসও দেখা গেল ঠোঁটের কোনায়। যেন বলতে চায় ও ঠিকই বুঝতে পেরেছে কার কথা বলতে চাইছে পিয়া। কিন্তু এখনও ধাঁধা রয়ে গেছে পিয়ার মনে, ওর পুরো বক্তব্যটা কি লোকটা বুঝেছে? এবার একটা অন্য রাস্তা নিল ও। লোকটা নৌকোয় করে ওকে লুসিবাড়িতে পৌঁছে দিতে পারবে কি না সেটা বোঝাতে একবার নিজের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল, আর একবার দেখাল দূরে, দিগন্তের দিকে। আবার মাথা নাড়ল ও, ব্যাপারটা যে বুঝেছে সেটা জানানোর জন্যই যেন মুখেও বলল, ‘লুসিবাড়ি’।
‘হ্যাঁ।’ এতক্ষণে একটা নিশ্চিন্ত স্বস্তির শ্বাস ফেলল পিয়া। চোখ বন্ধ করল, অবসাদে শিথিল হয়ে এল পেশিগুলো।
ওদিকে লঞ্চের ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে তুড়ি দিচ্ছিল ফরেস্ট গার্ড, যেন ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করছে ওকে। কোনওরকমে নৌকোর ছইটা ধরে উঠে দাঁড়াল পিয়া, ইশারায় লোকটাকে ওর পিঠব্যাগগুলো নামিয়ে দিতে বলল। প্রথম ব্যাগটা চুপচাপ নামিয়ে দিল লোকটা, কিন্তু দ্বিতীয়টার জন্য হাত বাড়াতেই ও বুঝল যে পিয়া আর লঞ্চে ফিরবে না। মুহূর্তে গার্ডের হাসি হাসি ভাবটা মিলিয়ে গেল, চোখ রাঙিয়ে ও জেলেটাকে চিৎকার করে ধমকাতে শুরু করল। জেলেটা কিন্তু নির্বিকার, শুধু বিড়বিড় করে কী একটা বলল। তাতে আরও খেপে গেল গার্ড, ঘুষি পাকিয়ে ভয় দেখাতে লাগল, পারলে তেড়ে আসে এরকম একটা ভাব।
ভীষণ রাগ হল পিয়ার। চেঁচিয়ে বলল, “ওকে ধমকাচ্ছেন কেন? ওর কী দোষ?” এবার অপ্রত্যাশিত একটা সমর্থন পেল পিয়া। লঞ্চের ওপর থেকে মেজদাও মনে হল আপত্তি করল, পশ্চিমের সূর্যের দিকে আঙুল দেখিয়ে গার্ডকে কিছু একটা বলল। তাতে যেন সম্বিত ফিরে পেল লোকটা, ফের মনোযোগ দিল পিয়ার দিকে। দ্বিতীয় পিঠব্যাগটা একহাতে তুলে ধরে অন্য হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ইশারায় বোঝাল কিছু টাকা না খসালে ওটা ও হাতছাড়া করবে না।
এতক্ষণে টাকাপয়সার কথা খেয়াল হল পিয়ার। ভাগ্যিস ওর ওয়াটারপ্রুফ টাকার ব্যাগটা বেল্টের সঙ্গে বাঁধা ছিল। ব্যাগের চেনটায় হাত দিয়ে হাঁফ ছাড়ল পিয়া। যাক বাবা, এত কাণ্ডের পরও সব ঠিকঠাকই আছে। নৌকোর ভাড়া আর গার্ডের একদিনের পারিশ্রমিক হিসেব করে কিছু টাকা গুনে বের করল ব্যাগটা থেকে। টাকাটা গার্ডের হাতে দিতে গিয়েও কী মনে করে আরও কয়েকটা নোট জুড়ে দিল সঙ্গে। যথেষ্ট হয়েছে একদিনের পক্ষে, যত তাড়াতাড়ি এই ঝঞ্জাট থেকে রেহাই পাওয়া যায় ততই মঙ্গল। লোকটা চুপচাপ হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিল, তারপর ব্যাগটা ছুঁড়ে দিল নৌকোর ওপর।
এত সহজে ঝামেলা মিটে যাবে আশাই করেনি পিয়া। ও ভেবেছিল আরও খানিকটা চিৎকার চেঁচামেচি করবে লোকগুলো, হয়তো আরও টাকা চাইবে। কিন্তু যতটা সহজে পার পেয়ে গেছে ভেবেছিল পিয়া দেখা গেল তার থেকে একটু বেশিই খসাতে হয়েছে ওকে। লঞ্চের ওপর থেকে একটা দামি ওয়াকম্যান হাতে তুলে দেখাল গার্ড, এর মধ্যে এক ফাঁকে পিয়ার ব্যাগ থেকে ওটা ও হাতিয়ে নিয়েছে। চুরির আনন্দে কোমর বেঁকিয়ে আর দু’হাতে অশ্লীল ভঙ্গি করে নাচতে লাগল ডেকের ওপর।
কিন্তু এসব কিছুই আর গায়ে লাগছে না পিয়ার এখনওদের দুজনের হাত থেকে যে অবশেষে মুক্তি পাওয়া গেছে তাতেই ও খুশি। ভটভট শব্দটা আস্তে আস্তে দুরে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ও চোখ বন্ধ করে রইল।