১.১ প্রথম কাণ্ড। প্রথম প্রপাঠক

যজুর্বেদ-সংহিতা
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ–তৈত্তিরীয়-সংহিতা।]

প্রথম কাণ্ড। প্রথম প্রপাঠক

প্রথম অনুবাক

মন্ত্র- ইষে ত্বোর্জে ত্বা। বায়বঃ হোপায়বঃ স্থ। দেবো বঃ সবিতা পাৰ্পয়তু শ্রেষ্ঠতমায় কৰ্ম্মণ আ পায়ধ্বমঘিয়া দেবভাগমূৰ্জৰ্ষতীঃ পয়স্বতীঃ প্রজাবতীরনমীবা অযক্ষ্মা মা বঃ স্তেন ঈশত মাহঘশংসা রুদ্রস্য হেতিঃ পরি বো বৃণ।। বা অস্মিন্ গোপতৌ স্যাঁত বহুীঃ। যজমানস্য পশন পাহি ॥১॥

মর্মার্থ –হে ভগবন! অভীষ্ট প্রদানের নিমিত্ত আপনাকে আহ্বান করছি। অপিচ, হে ভগবন্! শক্তি এবং প্রাণ পাবার কামনায় আপনাকে আহ্বান করছি। হে দেববৃন্দ! আপনারা বায়ুর মতো গতিবিশিষ্ট হন; তাই প্রার্থনা করি, বায়ুর ন্যায় গতিতে শীঘ্ৰ আগত হয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হোন এবং আমাদের পরিত্রাণ করুন। সৎকর্মের প্রবর্তক জ্ঞানপ্রদ দেবতা, আমাদের সম্বন্ধী ভগবৎ-আরাধনা ইত্যাদি রূপ সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্কর্মে আমাদের সর্বতোভাবে পরিচালিত করুন। (আমরা যেন নিয়ত সৎকর্মে নিরত থাকি); লোকরক্ষয়িত্রী বলপ্রাণ-রূপিণী জ্ঞানপ্রদায়িকা অজরা অক্ষরা বিনাশরহিতা হে দেবিগণ! ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত আমার পূজা (ভক্তি-ভাব) আপনারা সবরকমে পরিবর্ধিত করুন; পাপের আশ্রয়স্থানীয় ইন্দ্রিয় ইত্যাদি রূপ চৌর, আপনাদের অনুগ্রহে যেন আমাদের হিংসা করতে সমর্থ না হয়। অপিচ, হে দেবগণ! রপ্ৰকৃতিসম্পন্ন হিংসক রিপুদলের আয়ুধ আপনাদের যেন পরিহার (পরিত্যাগ করে অর্থাৎ স্পর্শ করতে না পারে। সত্যস্বরূপ বুদ্ধিসমূহ যেন আমাদের হৃদয়কে জ্ঞানের আধারে পরিণত করে আপনাদের সেখানে বহন করে আনয়নে সমর্থ হয়। অথবা, হে দেবিগণ! আপনারা জ্ঞানের আধারভূত আমাদের হৃদয়ে অবিচলিত ভাবে অবস্থান করুন এবং বহুরূপে হৃদয়ে অবিচলিত ভাবে অবস্থান করুন এবং বহুরূপে সেখানে আর্বিভূত হোন। (ভাবার্থ–আমার হৃদয়ে এমন ধী সঞ্জাত হোক, যাতে আপনারা সর্বদা সেখানে অধিষ্ঠিত থাকেন)। হে ভগব! প্রার্থনাকারী, আমার পাশবৃত্তিগুলিকে সংহার করে, পাপের কবল হতে আমাকে পরিত্রাণ করুন। (ভাবার্থ এই যে, আমার পাপপ্রবৃত্তি-সমূহকে নাশ করে আমাকে মোক্ষপথে স্থাপন করুন। ১।

 [দশযাগে বিনিযুক্ত এই অনুবাকের মন্ত্র পলাশ-শাখার সম্বোধনে প্রযুক্ত বলে ভাষ্যকার সিদ্ধান্ত করেছেন। তার সিদ্ধান্তের অনুকূল প্রমাণ-পরম্পরা তিনি বৌধায়ন আপস্তম্ব প্রভৃতি সূত্র-গ্রন্থ থেকে উদ্ধার করে আপন মত প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াস পেয়েছেন। শুক্লযজুর্বেদের ব্যাখ্যায় মহীধরও এই পন্থারই অনুসরণ করেছেন। মন্ত্রের সম্বোধ্য, ভাষ্যমতে, পলাশ-শাখা। পলাশ-বৃক্ষে দেবত্বের অধিষ্ঠান ব্রাহ্মণ-গ্রন্থে কথিত হয়েছে। সেখানে পলাশের উৎপত্তি সম্বন্ধে এইরকম প্রস্তাবনা দেখা যায়। যথা,-স্বর্গের তৃতীয় লোকে সোম অবস্থিত ছিল। গায়ত্রী-মন্ত্রে উক্ত সোম আহরণকালে অভিঘাত-জনিত তার একটি পর্ণ ছিন্ন হয়ে ভূতলে পতিত হয়। কেউ কেউ বলেন,-পক্ষীরূপা গায়ত্রীর একটি পক্ষ ভূতলে পতিত হয়েছিল। যাই হোক, সোমের সেই বিচ্ছিন্ন পর্ণ থেকে পলাশ-বৃক্ষের উৎপত্তি। সেই সোম-পৰ্ণই ভূতলে পলাশরূপে আর্বিভূত হয়েছিল। পণ্ডিতবর্গ প্রশ্ন তুলে বলেন,–পর্ণের বৃক্ষত্ব কিভাবে নিষ্পন্ন হয়? উত্তর–বিধাতার অচিন্ত্য-শক্তিত্ব। তার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নেই। তারই বিচিত্র বিধানে সেই সোমপর্ণ থেকে পলাশের সৃষ্টি। জগৎ-নিম্পাদক ব্ৰহ্ম যেমন স্বতঃসিদ্ধ, যাগ-নিম্পাদক পলাশের ব্রহ্মত্বও সেইভাবে অবিসংবাদিত। এইভাবে পলাশের ব্রহ্মত্ব প্রতিপাদন করে ভাষ্যকার মন্ত্রের সম্বোধনরূপে ব্ৰহ্মত্বপ্রপাদিত পলাশকেই নির্ধারণ করে নিয়েছেন। তারপর এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার যে সব পদ অধ্যাহার করেছেন, ভাষ্যের সূচনায় তার যুক্তি-পরম্পরা নির্দিষ্ট হয়েছে। ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে ভাষ্যকারের সেই যুক্তিগুলির সারমর্ম প্রদত্ত হলো; যথা, পলাশবৃক্ষের বহু শাখা আহরণ করবার বিধি ব্রাহ্মণে উক্ত হয়েছে। পলাশবৃক্ষের পূর্বদিকের শাখা দেবলোক সম্বন্ধী, আর পশ্চিমদিকের শাখা মনুষ্যলোকসম্বন্ধী। যজমানের জন্য অধ্বর্য উক্ত উভয়প্রকার শাখাই কামনা করবেন। ইষে ত্ব প্রভৃতি মন্ত্রে সেই পলাশশাখা ছেদনের বিধি। সুতরাং বিনিয়োগ অনুসারে ছিদ্মি ক্রিয়াপদ অধ্যাহার করতে হবে। ইট পদে অন্ন বোঝায়। অন্ন সকল প্রাণীর আকাক্ষনীয়। আবার রসরূপে বলসঞ্চার করে বলে উবল হেতু রসঃ বাক্যে উর্জ পদে বলপ্রাণয়ো অর্থ পরিগৃহীত হয়। মন্ত্রাংশের অর্থ হয়–হে পলাশশাখে! দেবগণের ভাগরূপ অধ্বর্যর জন্য তোমাকে ছেদন করছি। আবার সেই দেবতার বলপ্রদরসের নিমিত্তও তোমাকে ছেদন করি। এই মন্ত্রের দ্বারা অধ্বর্য যজমানের ভোজনের জন্য অন্ন এবং বলের জন্য রস সম্পাদন করবেন।-মন্ত্রের আমরা যে অর্থ অধ্যাহার করলাম এবং ভাষ্যের আলোচনায় যে অর্থ সিদ্ধ হয়, দুই অর্থে অশেষ পার্থক্য লক্ষিত হবে। ভাষ্যকার প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্রে ছিনদ্মি (ছেদন করছি) ক্রিয়াপদ অধ্যাহার করেছেন; আমরা আহ্বায়ামি (আহ্বান করছি) ক্রিয়ার অধ্যাহারই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেছি। ভাষ্যকারের মতে, শাখা-দেবতাকে সম্বোধন করে ঐ মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে। আমরা বলি, শাখাদেবতা কেন, আপন আপন ইষ্ট দেবতা-মাত্ৰকেই সম্বোধন করে ঐ মন্ত্র প্রযুক্ত হতে পারে; সকলে সকল অবস্থায় সকল দেবতার উদ্দেশ্যেই ঐ মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারেন। ভাষ্যকার বলেন, মন্ত্রদ্বয় দশপূর্ণমাসযাগে পলাশশাখাছেদনে প্রযোজ্য। সে বিষয়ে আমরা অন্যমত খ্যাপন করছি না। তবে মন্ত্রের প্রার্থনা যে কেবল বৃষ্টির জন্য নয়, প্রার্থনা যে অভীষ্ট-পূরণের জন্য এবং প্রাণ ও শক্তি লাভের উদ্দেশ্যে, আমরা তা-ই বলছি। হিন্দুর সকল কর্মই যে ধর্মসহযুত, হিন্দুর প্রতি কমেই যে ভগবানের সম্বন্ধ সূচনা করা হয়, যজ্ঞে বৃক্ষ-শাখা-ছেদনে এই মন্ত্রের প্রয়োগ তা-ই শিক্ষা দিচ্ছে। শাখাদেবতার (শাখাধিষ্ঠাত্রী দেবতার) অনুধ্যানে বৃক্ষশাখার অভ্যন্তরে যে ভগবৎ-অধিষ্ঠান আছে, জগদীশ্বর যে সর্বব্যাপী, সেই ভাব প্রকাশ করে। বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান, বৃক্ষ ইত্যাদির সংজ্ঞা আছে প্রমাণ করে আজ গর্বোন্নত-শীর্ষ। কিন্তু শাখা দেবতার অর্চনায় এই মন্ত্র দুটির (প্রথম ও দ্বিতীয়) বিনিয়োগ, কত কাল পূর্বে হিন্দুদের যে সে জ্ঞান ছিল, তা সপ্রমাণ করছে।…যাই হোক, শাখা-দেবতার উদ্দেশ্যেই প্রযুক্ত হোক, আর নিজের ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যেই মন্ত্র দুটি উচ্চারিত হোক, মন্ত্রের উচ্চারণকারী সর্বতঃ আপন শ্রেয়ঃ কামনা করছেন,-মন্ত্রের এটাই তাৎপর্য। ভাষ্যকারের মতে,–তৃতীয় ও চতুর্থ মন্ত্রের লক্ষ্য–গোবস; তাদের বায়ুদেবতাক বলে কল্পনা করা হয়েছে। বায়ুদেবতাক বলে বায়ুর সাথে বৎসগণের অভেদ কল্পনা করা হয়; বৎসগণের বায়ুস্বরূপত্ব হেতু, তাদের রক্ষার জন্য অধ্বর্যগণ বৎসদের বায়ুকে সমর্পণ করছেন। এ পক্ষে ভাষ্যকার সায়ণের যুক্তি, মনুষ্যগণ গৃহ ইত্যাদি নির্মাণ করে তাতে বাস করে। গোবৎসগণ তা পারে না, অন্তরীক্ষই তাদের বাসগৃহ। অন্তরীক্ষের অধিপতি–বায়ু; বায়ু পশুদের রক্ষা করেন; সুতরাং পশুদের বায়ুরূপত্ব কল্পিত হয়। এ বিষয়ে শুক্লযজুর্বেদে ভাষ্যকার মহীধর এমন যুক্তি প্রদর্শন করেছেন; যথা,-বায়ু যেমন পাদপ্রক্ষালন ও নিষ্ঠিবন ইত্যাদি দ্বারা উপহত অপবিত্ৰকৃত ভূমিকে শুষ্ক করে পবিত্র করেন, গোবৎসও সেইরকম গোময় ইত্যাদি দান করে ভূমিকে পবিত্ৰীকৃত করে। এই কারণে বায়ুর সাথে বৎসের সাদৃশ্য সূচনা করা যায়। (দেখা যায়, মহীধরের এবং সায়ণের ভাষ্যের ভাব প্রায় একই রকম;–কেবল বাক্যবিন্যাসের পার্থক্য-মাত্র)!–পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্রের বিষয়েও আমাদের বক্তব্য ঐরকমই। ভাষ্যে প্রকাশ,–এই মন্ত্রে গাভীদের সম্বোধন করা হয়েছে। গাভীগণই যেন যজমানকে শাতিকী গতি দান করেন। গোজাতিতে দেবতার অধিষ্ঠান আছে, অস্বীকার করি না; কিন্তু, গোজাতিকে লক্ষ্য করে, তাদের মধ্যে দেবতার কল্পনায়, এই মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে বলা হোক, তাতেও আপত্তি নেই; কিন্তু বিশেষণগুলির ঐরকম ব্যাখ্যায়, অবিশ্বাসী জনের হৃদয়ে অবিশ্বাসের যে বিষবীজ উপ্ত আছে–তাতে জলসেক করা হয় মাত্র। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে অজরা অমরা অক্ষরা দেবীগণকে (দেববিভূতি-সমূহকে) অর্চনা করা হয়েছে বললেই সব-বিষয়ে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়। নবম মন্ত্র–শাখা-দেবতা বিষয়ক। এখানকার প্রার্থনা (ভাষ্যকারের মতে),-হে পলাশশাখে! আপনি উন্নত প্রদেশে অবস্থিত থেকে, দেখবেন-যজমানের পশুগুলি যেন নিঃশঙ্কে অরণ্যে সঞ্চরণ করতে পারে; তাদের রক্ষা করবেন; দেখবেন,-যেন চৌর-ব্যাঘ্র ইত্যাদি তাদের অপহরণ বা হনন না করে। তারা যেন নিরুপদ্রবে সন্ধ্যাকালে পুনরায় গৃহে ফিরতে পারে। ভাষ্যকার এ সম্বন্ধে উপসংহারে বলেছেন,-শাখা যদিও অচেতন, তথাপি তদভিমানিনী দেবতার উদ্দেশে ঐ মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে বলা যায়। শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিগণ শাস্ত্রদৃষ্টিবশতঃ যেমন অচেতন শালগ্রামে বিষ্ণুর সান্নিধ্য জ্ঞান করে বিষ্ণুসম্বোধনে যোড়শোপচারে তার পূজা করেন, শাখা-দেবতার সম্বোধনের বিষয়েও সেইরকম মনে করতে হবে। কোন্ দেবতার পূজার কি নিগুঢ় লক্ষ্য, সে তত্ত্ব প্রকাশ করার স্থান এখানে নয়। তবে স্থূলভাবে এই পর্যন্ত বলে রাখা যায়-স্মরণে মননে অর্চনে পূজনে, যাঁর স্মরণ, যার অর্চন, যাঁর বন্দন, যাঁর পূজন, তাতে প্রীতি আসে,তার গুণে গুণম্বিত হতে হতে তার স্বারূপ্য, তার সাযুজ্য ইত্যাদি লাভ ঘটে,-দেবতার পূজা-বন্দনা ইত্যদির এটাই মূল লক্ষ্য। শাখা-দেবতা যখন এখন বধিরতা-প্রাপ্ত হয়েছেন, অথবা আমাদের স্বর যখন তাদের কর্ণে এখন আর পৌঁছাতে সমর্থ হচ্ছে না, তখন কেন আর, কুট-কল্পনায় অর্থকে প্রচ্ছন্ন করি? অতএব আমরা সাধারণভাবেই মন্ত্রের মর্মার্থ প্রকাশ করলাম। যিনি যে দেবতার উদ্দেশ্যেই মন্ত্র প্রয়োগ করতে চান, তাতেই তিনি এ মন্ত্র প্রয়োগ করতে পারবেন। মন্ত্র বিশ্বজনীন ভাবপূর্ণ। কষ্ট-কল্পনায়, কেন তাকে একমাত্র শাখা-দেবতাতে আবদ্ধ রাখব? আমরা তাই মন্ত্রের শেষাংশের, অর্থ করতে চাই,-হে দেব! এই আমার পশুবৃত্তিগুলিকে বিনাশ করে আমায় রক্ষা (পরিত্রাণ) করুণ। ফলতঃ, মন্ত্রটি দেবতার উদ্দেশে বিনিযুক্ত বলে বোঝাই সঙ্গত। বিতর্কে প্রয়োজন নাই। আপনার অন্তরকে জিজ্ঞাসা করুন আমাদের অর্থ সঙ্গত কি না? অন্তরই সে প্রশ্নের উত্তর প্রদান করবে ] । ১।

.

দ্বিতীয় অনুবাক

মন্ত্র- যজ্ঞস্য ঘোষদসি। প্রত্যুষ্টং রক্ষঃ প্রত্যুষ্টা অরাতয়ঃ। প্রেয়মগাদ্ধিষণা বহিরচ্ছ মনুনা কৃতা স্বধয়া বিতষ্টা ত আ বহন্তি কবয়ঃ পুরস্কাদ্দেবেভ্যো জুষ্টমিহ বহিরাসদে। দেবানাং পরিষ্কৃতমসি বর্ষবৃদ্ধমসি। দেববৰ্হিৰ্মা ত্বাহমা তিৰ্য্যপর্ব তে রাধ্যাস। আচ্ছেত্তা তে মা রিষ। দেববহিঃ শতবশং বি রোহ সহস্ৰবশাঃ বি বয়ং রুহেম। পৃথিব্যাঃ সংপৃচঃ পাহি। সুসংভূতা ত্বা সং ভরাম্যদিত্যৈ রামাইসি। ইন্দ্রাণ্যৈ সংনহন। পূষা তে গ্রন্থিং গ্রপ্নাতু। স তে মাহস্থা। ইন্দ্রস্য ত্বা বাহুভ্যামুদ্যচ্ছে। বৃহম্পৰ্ম্মের্ধা হরামিব্বন্তরিক্ষান্বিহি। দেবং গমমসি। ২।

 মর্মার্থ- হে ভগব আপনি সকর্ম-সমূহের নির্বাহক বা পূরক হন। (ভাবার্থ,ভগবানই সৎকর্মস্বরূপ সর্বজ্ঞেশ্বর)। অথবা হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি সৎকর্মের সাধনভূত উপাদান-স্বরূপ হও। (ভাব এই যে,-হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বই সকল কর্মের প্রেরক বা সম্পাদক)। হে ভগব! অথবা হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনার অনুগ্রহে সপ্রতিবন্ধক শত্রু (আমাদের দুর্বুদ্ধি) সর্বতোভাবে ভস্মীভূত হোক; আমাদের রিপুশত্রুগণ প্রত্যেকে বিশিষ্টরূপে দগ্ধীভূত হোক। (ভাব এই যে, হে দেব! আপনার অনুগ্রহে অথবা আপনার প্রভাবে আমাদের দুষ্টবুদ্ধি এবং রিপুশত্রুসমূহ যেন সমূলে নাশপ্রাপ্ত হয়)।

শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ হে ভগব! আপনি সর্বাত্মক; কৃপা করে আমাদের এই সৎকর্মে প্রকৃষ্টরূপে আগমন করুন এবং আগমন করে, সকর্মের দ্বারা উত্তপ্রাপ্ত আমাদের এই হৃদয়রূপ যজ্ঞাগারকে প্রাপ্ত হোন; আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকের কৃতকর্মের দ্বারা সঞ্জাত এবং সংসারবন্ধননাশক শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আপনি সম্পূজিত হন; অপিচ, সৎ-ভাবসম্পন্ন জন সঙ্কর্ম সামর্থ্যের দ্বারা আপনাকে হৃদয়ে প্রতিস্থাপিত করেন; এতএব হে ভগবন্! দেবগণের প্রীতির নিমিত্ত আপনি আমাদের আরব্ধ এই সঙ্কর্মে বা আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–হে ভগবন্! আমাদের সকর্মে আগমন করুন এবং আমাদের আত্ম-উৎকর্ষ-সাধনের দ্বারা আমাদের মোক্ষপথে প্রতিষ্ঠাপিত করুন। হে আমার মন! তুমি দেবভাবসমূহের উৎপাদক সংবাহক, অতএব তুমি সদাবর্ধনশীল ও অভীষ্টবর্ষণের হেতুভূত হও। (মনই সর্বমূলাধার। মনের স্থৈর্যসাধনের দ্বারাই মানুষ পরম পদ প্রাপ্ত হতে পারে। এখানে আত্মসম্বোধনে মনের স্থৈর্যসাধনের জন্য সাধক আত্মাকে (আপনাকে) উদ্বোধিত করছেন)। হে মন! দুলোক-সম্ভুত নিখিল দেবভাবসমূহ যেন তোমাকে পরিত্যাগ না করে; ভুবিসম্ভব দেবভাবসমূহ যেন তোমার প্রতি বিরূপ না হয় এবং অন্তরীক্ষ-লোক-সম্ভব যে দেবভাব-সমুহ তারাও যেন তোমাকে পরিত্যাগ না করে। অপিচ, তোমার সম্বন্ধি চিত্তবৃত্তি-সমূহ যাতে শত্রুবর্গের দ্বারা হিংসিত বা বিপথগামী না হয়, সেইরকমভাবে তাদের সংযুম সাধন যেন করতে পারি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। এখানে চিত্তজয়ের জন্য উদ্বোধনা বর্তমান। চিত্তের স্থৈর্য-সাধন ভিন্ন ভগবৎপ্রাপ্তি কখনও সম্ভবপর হয় না। অতএব প্রার্থনা,নিখিল দেবভাব-সমূহ আমাদের মধ্যে উপজিত হোক। তার দ্বারা যেন আমরা ভগবানকে পেতে সমর্থ হই। হে আমার মন! তোমার সম্বন্ধি সঙ্কর্ম-বিঘাতক ভগবৎসম্বন্ধ বিচ্ছিন্নকারী কামক্রোধ ইত্যাদি রিপুশত্রু যেন তোমাকে হিংসা করতে সমর্থ না হয়। [কামক্রোধ] ইত্যাদি রিপুগণ যাতে ভগবৎসম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ না হয়, যেন সেরকম অবিচলিত হতে পারি)। হে দ্যোতমান স্বপ্রকাশ শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি বহুরূপ হয়ে, বিশেষভাবে আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হোন। তাতে প্রার্থনাকারী আমরা বহুসামর্থোপেত সৎ-ভাব ইত্যাদি সমন্বিত হয়ে বিশেষভাবে প্রবৃদ্ধ হতে পারব। (মন্ত্র দুটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে,-ভগবান্ আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাদের সৎ-ভাব-সমন্বিত করুন এবং পরমধন দান করুন। হে ভগবন্! পৃথিবীতে সম্ভাব্য পাপ-সম্পর্ক হতে (অর্থাৎ ইহজগতে অনুষ্ঠিত ভববন্ধনমূলক কর্মের সম্বন্ধ থেকে) আমাকে পরিত্রাণ করুন। (এই মন্ত্রে ভববন্ধন-ছেদনের জন্য প্রার্থনা আছে। ভাব এই যে,–যে কর্ম ভব-বন্ধন-মূলক, সেই কর্মের অনুষ্ঠানে আমাকে প্রতিনিবৃত্ত করুন)। হে চিত্তবৃত্তি! সর্বতোভাবে পিপক্লেদ-পরিশূন্য তোমাকে ভগবানের প্রীতির জন্য নিয়োজিত করি। সেই জন্য তুমি অনন্তস্বরূপ ভগবানের (প্রীতির জন্য) আমাদের ভক্তিসুধার আস্বাদ-প্রদানে সমর্থ হয়ে তাঁর রসনার মতো বিদ্যমান আছে। হে চিত্তবৃত্তি! তুমি ভক্তিরূপিণী দেবীর অর্থাৎ ভগবানের প্রীতি-হেতুভূত সম্যকরকমে বন্ধনমূল হও। (তাৎপর্য এই যে,মহান ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ ভক্তির দ্বারাই বশীভূত হন। অপিচ, ভক্তিতেই ভগবান ভক্তের সাথে সম্মিলিত হয়ে থাকেন)। হে মন! সর্বপুষ্টির বিধায়ক ভগবান্ তোমার ভক্তির বন্ধন দৃঢ় করুন। হে আত্মা (আত্মসম্বোধন)! এই রকমে তোমার ভববন্ধন যেন চিরকাল না থাকে অর্থাৎ তুমি ভববন্ধন হতে মুক্ত হও। হে হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! সকল শক্তির আধার ভগবানের বাহুযুগলের দ্বারা অর্থাৎ সকল রকম শক্তি লাভের জন্য তোমাকে নিয়োজিত করি। (ভাবার্থসিদ্ধি লাভের জন্য ভগবানের উদ্দেশ্যে শুদ্ধসত্ত্ব উৎসর্গ করি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের সম্বন্ধি অশেষ প্রজ্ঞার দ্বারা অর্থাৎ প্রজ্ঞান লাভের জন্য তোমাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করি। হে দেব! কলুষক্লেদ-পরিশূন্য শত্রুর উপদ্রবরহিত নির্মল হৃদয়কে লক্ষ্য করে আপনি আগমন করুন। (তাৎপর্যার্থ–নির্মল বিশুদ্ধ হৃদয়ই ভগবানের নিবাস-স্থান)। হে আমার মন! তুমি ভগবানের প্রতি গমনকারী হও। অথবা, হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবানের অঙ্গীভূত অর্থাৎ ভগবানের স্বরূপ হও। (মর্মার্থ,–এই ভাবে পরিস্তুত হয়ে অনন্যা-ভক্তির দ্বারা যেন ভগবানে আত্মস্থাপনে সমর্থ হই) ॥ ২॥

 [ এই অনুবাকের মন্ত্রগুলি বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হয়েছে। সে বিভাগগুলি যে প্রচলিত ভাষ্যেরই অনুসারী, ভাষ্যগুলি দেখলেই তা উপলব্ধ হয়। ভাষ্যকার মন্ত্রগুলির যে ব্যাখ্যা করেছেন, সে ব্যাখ্যা কর্মকাণ্ডের অনুসারী; আর আমাদের ব্যাখ্যা আধ্যাত্মিকতামূলক। ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা আধিভৌতিক সম্বন্ধ বিজ্ঞাপক। ব্যাখ্যাপদ্ধতি বিভিন্ন হলেও–ভাষ্যকারের যে লক্ষ্য, আমাদের লক্ষ্য তা থেকে ভিন্ন নয়। ভাষ্যের মতে প্রথম মন্ত্রের সম্বোধ্যঅশ্বপর্শ। আমাদের পরিগৃহীত পন্থার অনুসরণে আমরা মন্ত্রটিকে ভগবৎসম্বোধনমূলক বলেই মনে করি। আবার শুদ্ধসত্ত্ব-সম্বোধনেও এ মন্ত্র বিনিযুক্ত হতে পারে। দুটি সম্বোধনেই মন্ত্রে উচ্চভাব ব্যক্ত হয়। কিন্তু ভাষ্যকারের মত অনুযায়ী এই মন্ত্রের অর্থ হয়–হে অশ্বপ! তুমি যজ্ঞের সাধনভূত সামগ্রী হও।–দ্বিতীয় মন্ত্রের রক্ষ শব্দে ভাষ্যকার রাক্ষস-জাতিকে নির্দেশ করেন। তাতে ভাব আসে,-রাক্ষসগণ যজ্ঞে বিঘু উৎপাদন করতো, আর তাদের দগ্ধ করবার জন্যই প্রার্থনা করা হতো। আমরা কিন্তু এখানে রাক্ষস জাতির প্রতি অথবা যজ্ঞকারী লোকবিশেষের প্রতি আদৌ লক্ষ্য দেখতে পাই না। তাতে কালাকালেরও কোনও সম্বন্ধ নেই। অতীত অনাগত বর্তমান তিন কাল ধরে যে শত্রু মানুষকে অহর্নিশ উত্যক্ত করছে, যে শত্রুর প্রবল প্রতাপে সকল সৎকর্ম অনুষ্ঠিত হতে পারছে না; আমরা মনে করি, সেই শত্রুই মন্ত্রের লক্ষ্যস্থল। বহিঃশত্রুবর্গ আমাদের কতটুকু অনিষ্ট করতে পারে? ভগবানের আরাধনার পথে বিঘ্নদানের শক্তি তাদের নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু যে শত্রু সৎকর্মের বিঘাতক, সে শত্রু আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই বিচরণ করছে। সেই আমাদের নিত্যসহচর-কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুবর্গ, আমাদের বিভ্রান্ত পথে পরিচালিত করবার প্রধান পরামর্শদাতা। তাদের চেয়ে রাক্ষস শত্রু আর দ্বিতীয় কল্পনা করা যায় কি? আমরা তাই মনে করি, এখানে এই মন্ত্রে বলা হয়েছে–আমাদের অন্তরস্থ সেই পরম শত্রুগণ নিশ্চিহ্ন ভাবে বিদগ্ধ ও লুপ্ত হোক। তৃতীয় মন্ত্র প্রার্থনামূলক ও নিত্যসত্যপ্রকাশক। ভাষ্যমতে এই মন্ত্র বহিরাহরণে প্রযুক্ত হয়।–ভাষ্যমতে চতুর্থ মন্ত্র দর্ভ-সম্বোধনে প্রযুক্ত। আমাদের মতে মন্ত্রটি মনঃ সম্বন্ধমূলক। মনই সকল সৎ-ভাবের জনক, মনই ভগবানকে সংবাহিত করে আনে। মনই সকল মঙ্গলের হেতু ভূত-পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্র প্রায় একই ভাব দ্যোতনা করে। ভাষ্যকারে মতে এই মন্ত্র দুটি দেববহিঃ অর্থাৎ দেবসম্বন্ধযুক্ত বহিঃ সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছে।–ভাষ্যকারের মতে দশম মন্ত্রে দর্ভময় শৃন্বকে নামুষ্টি প্রক্ষেপে ভূমিতে স্থাপন করবার বিধি। তার মন্ত্ৰার্থ-হে রজ্জ্ব! ভূমিক কাঞ্চীগুণস্থানীয় রসনা হও। হে দর্ভমুষ্টি-সমুদায়, তোমাদের সুষ্ঠুভাবে সংগ্রহের নিমিত্ত যোগ রশনার দ্বারা সংগ্রহ করছি। একাদশ মন্ত্রের অর্থ পূর্বমন্ত্রানুসারী। ইন্দ্রাণী পদে ভাষ্যকার এক আখ্যায়িকার অবতারণা করেছেন। পূর্বজন্মে ইন্দ্রপত্নী ইন্দ্রাণী শতসংখ্যক যজ্ঞের অনুষ্ঠাতা যজমান কর্তৃক সেই সেই ক্রতুতে যুক্ত হয়েছিলেন। যজমান ইন্দ্রাণীকে বন্ধন করতে সমর্থ হয়েছিলেন বলে, ইন্দ্রাণীত্ব-রূপ সমৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সেই অবধি সমৃদ্ধিলাভের নিমিত্ত অর্ধযুগণ দর্ভের দ্বারা গ্রন্থি-বন্ধন করে থাকেন। আমাদের মতে দশম ও একাদশ মন্ত্র চিত্তবৃত্তির সম্বোধনে বিনিযুক্ত।-দ্বাদশ মন্ত্রে ভক্তিবন্ধন দৃঢ় করবার প্রয়াস, এয়োদশে ভববন্ধন-ছেদনের সঙ্কল্প, চতুর্দশে ভগবৎ কার্যে নিয়োজন। পঞ্চদশ মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্ব আহরণ, যোড়শ মন্ত্রে ভগবানকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা, সপ্তদশ মন্ত্রে সকল কর্মফল তাতে সমর্পণ করে তার সেবায় আত্মাকে নিয়োজিত করা ইত্যাদি–যেন কি এক অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বন্ধনে মন্ত্র কয়েকটি সংগ্রথিত রয়েছে। ভাষ্যমতে এই সব মন্ত্রের সম্বোধ্য যথাক্রমে-রক্ষ্ম, দর্ভ, বহিঃ প্রভৃতি ] । ২।

.

তৃতীয় অনুবাক

মন্ত্র- শুদ্ধধ্বং দৈব্যায় কৰ্ম্মণে দিব্যজ্যায়ৈ। মাতরিশ্বনো ঘৰ্ম্মোহসি দৌরসি পৃথিব্যসি বিশ্বধায়া অসি পরমেণ ধামা দুংহ মা হাঃ। বসূনাং পবিত্রমসি শতধারং বসুনাং বপিত্রমসি সহস্রধার। হুতঃ তোকো হুতো ভদ্রলোহপয়ে বৃহতে নাকায় স্বাহা দ্যাবাপৃথিবীভ্যাম্। সা বিশ্বায়ুঃ সা বিশ্বব্যচাঃ সা বিশ্বকর্ম। সং পৃচ্যধ্বমৃতাবরীরূৰ্ম্মিণীৰ্ম্মধুমত্তমা মা ধনস্য সাতরে। সোমেন ত্বাহনচুমীন্দ্রায় দধি। বিষ্ণো হব্যং রক্ষ ॥ ৩॥

মর্মার্থ- হে আমার সৎ-অসৎ-বৃত্তিনিচয়! তোমরা দেবসম্বন্ধি যাগ ইত্যাদি সৎ-ক্রিয়ার দ্বারা দেবসম্বন্ধি সৎ-জ্ঞান-বর্ধনরূপ কর্মে বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হও। (এই মন্ত্রের দ্বারা প্রার্থনাকারী নিজেকে উদ্বোধিত করছেন। চিত্তবিক্ষোভজনিত চাঞ্চল্যে মনের স্থৈর্য-সাধনের নিমিত্ত চিত্তবৃত্তির উদ্বোধনার জন্য সাধক নিজেদের প্রবুদ্ধ করছেন বলে মনে করা যায়)। হে ভগবন্! আপনি বায়ুর দীপক (প্রকাশক); অর্থাৎ বায়ুরূপে আপনি সর্বত্র পরিব্যক্ত। অপিচ, হে ভগবন্! আপনিই দ্যুলোক আবার আপনিই ভূলোক অর্থাৎ আপনি বিশ্বচরাচরাত্মক (বিশ্বাত্মক) সৰ্বরূপী সর্বব্যাপী। আপনার প্রকৃষ্ট তেজের দ্বারা আপনি বিশ্বকে ধারণ করে আছেন। আপনি আমাদের বর্ধিত করুন; অর্থাৎ আমাদের শ্রেয়ঃ সাধন করুন। আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখে, আমাদের প্রতি কুটিল (বিরূপ) হবেন না। (অতএব প্রার্থনা–আপনার অনুগ্রহে যেন সরল সৎ-ভাবসম্পন্ন সৎ হতে সমর্থ হই। হে দেব! আপনি ভগবানের নিবাসহেতুভূত সকর্মগুলিকে শত রকমে। (আপনার শতকরুণাধারা বর্ষণের দ্বারা পবিত্রতা-সাধন করেন। অপিচ, আপনার দ্বারা সহস্ররকমে সঙ্কমগুলি পুণ্যপ্রদ হয়। (প্রার্থনা–আপনার অনুগ্রহে আমাদের কর্মনিবহ যেন সর্বতোভাবে সৎসহযুত ও পবিত্ৰীকৃত হয়)। মহত্ত্ব ইত্যাদি গুণসম্পন্ন (সবগুণাধার গুণাতীত) বিশ্বকর্মী প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত আমাদের অনুষ্ঠিত সকর্মের সুফলসমূহ প্রদত্ত হচ্ছে; অপিচ, আমাদের সৎকর্মের দ্বারা সঞ্জাত সৎ-ভাবসমুহ (ভগবানের প্রীতির জন্য) উৎসর্গ করি। সেই উদ্বোধনরূপ যজ্ঞ অথবা আমার অনুষ্ঠিত সৎকর্ম ভূলোক ও স্বর্গলোক ব্যেপে প্রকাশ পাক। অথবা, দ্যাবাপৃথিবী-অভিমানিনী দেবতাকে অর্থাৎ নিখিল দেবভাবগুলিকে স্বাহা মন্ত্রে উদ্বোধিত করি। আমার যজ্ঞ (কর্ম) সুহুত সুসিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে,-জ্ঞানময় দেবতা উদ্বোধনরূপে বিরাজ করেন; তিনি স্বর্গ মর্ত্য অন্তরীক্ষ ত্রিলোক ব্যেপে আছেন; তাকে যেন আমরা সত্ত্বভাবের দ্বারা অধিগত করতে সমর্থ হই)। সেই দেবতা বিশ্বায়ুঃ অর্থাৎ নিখিল বিশ্বের জীবন স্বরূপ; সেই দেবতা বিশ্বব্যচাঃ অর্থাৎ নিখিল বিশ্ব ব্যেপে রয়েছেন; এবং সেই দেবতা বিশ্বকর্মা অর্থাৎ সকল কর্মের মূলীভূত! সকল সঙ্কর্মের অধিষ্ঠাত্রী অথবা প্রেরয়িত্রী হে দেবি! আনন্দস্বরূপিণী পরমানন্দদায়িণী আপনারা পরমধন দানের জন্য অথবা ভগবানে কর্মফল-সমর্পণের সামর্থ্য-প্রদানের নিমিত্ত অত্যন্ত মাধুর্যসম্পন্ন পরমানন্দদায়িণী রূপে আমাদের সাথে (আমাদের অন্তরে) সঙ্গতা হোন। হে হবনীয় সামগ্রী। দেবতার যজ্ঞভাগরূপ তোমাকে শুদ্ধসত্বভাবে বিশুদ্ধ ভক্তির দ্বারা দৃঢ়িকৃত করছি; অর্থাৎ আমার কৃত পূজা ভক্তিসহযুত হয়ে দৃঢ়তা প্রাপ্ত হোক। হে বিশ্বব্যাপক ভগব! হবনীয় আমার শুদ্ধসত্ত্বভাবকে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত রাখুন। ৩।

[ভাষ্যকার প্রথম মন্ত্রে পাত্ৰাদি, দ্বিতীয় কুন্ত তৃতীয় মন্ত্রে কুম্ভের উপর স্থাপিত-শাখা পবিত্র, ষষ্ঠ মন্ত্রে অপ, সপ্তম মন্ত্রে ক্ষীর প্রভৃতি সম্বোধন পদ অধ্যাহার করেছেন। আমাদের মতে প্রথম মন্ত্রের লক্ষ্য হৃদয়ে সৎ-অসৎ-বৃত্তিসমূহ। ভাষ্যকারের মতে, মন্ত্রে যজ্ঞপাত্রসমূহের সম্বোধন আছে। কর্মপদ্ধতির অনুসরণেই ভাষ্যকার এই অর্থ নিষ্কাশন করেছেন বলে মনে করা যায়। দ্বিতীয় মন্ত্রে ভাষ্যকার কুন্তকে আহ্বান করা হয়েছে বলে নির্দেশ করেছেন। সেই মতে মন্ত্রের অর্থ হয়,–হে কুম্ভ! তোমার অভ্যন্তরে বায়ুর সঞ্চার-স্থান আছে। সেইজন্য তুমি দীপক হও। অতএব অন্তরীক্ষলোক যেমন, তুমিও তেমন। আমরা মনে করি, আধ্যাত্মিক বিচারণায়, এখানে সেই সর্বকারণকারণ পরমেশ্বরকে লক্ষ্য করেই প্রার্থনা জানান হয়েছে। যজ্ঞের আনুষঙ্গিক ক্রিয়াদিতে মন্ত্র যে ভবেই প্রযুক্ত হোক, মন্ত্রের লক্ষ্য কিন্তু সেই একমাত্র পরাৎপর পরমেশ্বর।–তৃতীয় মন্ত্রের সম্বোধন–শাখাপবিত্র। কুম্ভের উপরিভাগে যে শাখা ও পবিত্র বা কুশ: স্থাপিত হয় ভাষ্যমতে সেইগুলিই এই মন্ত্রের সম্বোধ্য। সেই অনুসারে ভাষ্যকারের অর্থ,হে শাখাপবিত্র। কুম্ভমুখে স্থাপিত তুমি প্রাণনিবাসহেতুভূত বসুসমূহের শোধক হও। কর্মকাণ্ডের বিচারে এইরকম অর্থ সম্বন্ধে ভাষ্যকারের যুক্তি আছে অবশ্যই। কিন্তু আমরা মনে করি, মন্ত্র যে কার্যেই ব্যবহৃত হোক, মন্ত্রের যা লক্ষ্য, তাতে ভাবান্তর ঘটাই কেন? আমরা দেখেছি সব মন্ত্রেরই লক্ষ্য-পরব্রহ্মের সান্নিধ্যলাভ। জলে, স্থলে, অনলে, অনিলে–সর্বত্রই তিনি। ঋষিগণ যে স্থালীর অভ্যন্তরে, কুম্ভের অন্তরে, পলাশ-শাখার অভ্যন্তরে, গোবস প্রভৃতিতে, ভগবৎ-সান্নিধ্য অবলোকন করতেন, তা তাদের সর্বত্র ব্রহ্মদর্শনের ফল মাত্র।–চতুর্থ মন্ত্র আরও একটু জটিলতাসম্পন্ন। দ্রঃ ও স্তোকঃ পদদুটির অর্থেই যত কিছু বিতণ্ডার সৃষ্টি। কুম্ভের উপরিভাগে স্থাপিত শাখা-পবিত্রে সেচনকালে ক্ষীরবিন্দু কুম্ভের চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তাতে দুরকম ক্ষীরবিন্দুর উৎপত্তি হয়। ভাষ্যকারের মতে ক্ষুদ্র বিন্দু স্তোক, আর বৃহত্তর বা প্রৌঢ় বিন্দু দ্র নামে আখ্যাত হয়। মন্ত্রের অর্থ হয়,অল্প বিন্দু ও প্রৌঢ় বিন্দু উভয়কেই নাকনামক স্বর্গবাসী প্রৌঢ় অগ্নির এবং দ্যাবাপৃথিবীর উদ্দেশ্যে আহুতি প্রদান করি। কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যা-ই হোক, আধ্যাত্মিক বিচারে আমরা ভাষ্যকারের এই অর্থের কোনও সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারি না। আমাদের মতে, এই মন্ত্রে আত্মাকে উদ্বোধিত করা হয়েছে। মন্ত্র বলছেন–ভগবান্ স্বয়ং সৎকর্মের প্রেরণা নিয়ে সর্বভূতে অধিষ্ঠিত আছেন। এরপর পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম মন্ত্রের তাৎপর্য অনুধাবনীয়। পূর্বমন্ত্রের ভাষ্যে প্রশ্ন করা হয়েছিল,-হে দোহনকর্তা, তুমি কোন্ গাভীটিকে দোহন করেছ। আমাদের মনে হয়, পঞ্চম মন্ত্রে ভাষ্যকার সেই গাভীর গুণবর্ণন করেছেন। সে গাভী বিশ্বায়ুঃ, বিশ্বব্যচা, বিশ্বকর্মা। কল্প গ্রন্থ থেকে ভাষ্যকার গো-দহনের ক্রম উদ্ধৃত করে মন্ত্রের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। যাই হোক, ঐ তিনটি বিশেষণে গাভীর যে গুণব্যাখ্যান হয়েছে, তাতে এ গাভীকে, সাধারণ লৌকিক গাভী বলে মনে করা যায় না। আমরা মনে করি, এখানে সেই বিশ্বপিতার প্রতিই লক্ষ্য আছে।–সপ্তম মন্ত্রে ভাষ্যকার ক্ষীরকে লক্ষ্য করেছেন। বলা হয়েছে–হে ক্ষীর। তোমাকে দধিরূপ সোমের দ্বারা প্রক্ষিপ্ত করছি। তুমি সোমবল্লীর রসের সাথে কঠিনতা প্রাপ্ত হও অর্থাৎ দধিরূপ ধারণ করো। এখানে দুগ্ধে দম্বল দিয়ে দধিপ্রস্তুতের বিষয়ই কথিত হয়েছে। যাই হোক, দুগ্ধ বা ক্ষীর সোমলতার রসমিশ্রণে কঠিন হয়ে ইষ্ট দেবতার যজ্ঞাংশের মধ্যে গণ্য হোক,–এরকম উক্তি, কোনই শুভ উদ্দেশ্য প্রকাশ করে না। আমরা মনে করি এখানে যাজ্ঞিকের (প্রার্থনাকারীর নিজের) হবনীয় দ্রব্যসামগ্রীর প্রতিই লক্ষ্য পড়েছে। তিনি হবনীয় দ্রব্যকে লক্ষ্য করে স্বাগত বলেছেন-হে আমার। হবনীয় দ্রব্য! দেবতার উদ্দেশে উৎসৃষ্ট হবার জন্য তোমরা শুদ্ধসত্ত্বভাবান্বিত হও; আর, তোমাদের সে ভাব যেন দৃঢ়রূপে চিরপ্রতিষ্ঠিত থাকে। সোম শব্দে সত্ত্বভাব (ভক্তিভাব) বোঝায়। হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বেই সোম (সোম নামক মাদক-লতা নয়)। ভাষ্যকার বলেছেন, যদিও এখানে তঞ্চন (কঠিনী করণ) হেতু দধিনিষ্পন্নের ভাব আসছে, তথাপি ভাবনাশক্তির দ্বারা তার সোমত্ব সম্পাদিত হচ্ছে। ভাবনাতেই শত্রু মিত্র সংসূচিত হয়। বন্ধুভাবে ভাবিত হলে বন্ধুত্ব এবং শত্রুভাবে ভাবিত হলে শত্ৰুত্ব সঞ্জাত হয়ে থাকে। সোম যে ভাবনার সামগ্রী, হৃদয়ের বস্তু, তা-ই বুঝতে পারা যায়। সুতরাং বুঝতে পারি, এ মন্ত্র আত্ম-উদ্ভোধনমূলক; মন্ত্রে যাজ্ঞিক নিজের অন্তরকে ভগবানের আরাধনার জন্য দৃঢ় করছেন।–অষ্টম বা শেষ মন্ত্র-সেই দৃঢ়তারই পরিপোষক। এখানে প্রার্থনাকারী ভগবানকে সম্বোধন করে, প্রার্থনা জানাচ্ছেন,-হে ভগবান্ বিষ্ণুদেব! আপনি আমার হবনীয়কে রক্ষা করুন। অর্থাৎ আমি যেন আপনার পূজায় শুদ্ধসত্ত্বভাবে চিরনিরত থাকতে পারি।-ষষ্ঠ মন্ত্র, ভাষ্যমতে অপঃ-সম্বোধনে প্রযুক্ত। এই মন্ত্র পাঠে জলকে অভিমন্ত্রিত করে দোহনপাত্রে ঢালবার নিয়ম। যাই হোক, মন্ত্র যে ভগবানের সম্বন্ধে প্রযুক্ত, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। লক্ষ্য–ভগবান। উদ্দেশ্য–সর্বকর্মফল সমর্পণে তাতে আত্মলীন হওয়া। মন্ত্রে তাই প্রার্থনা হচ্ছে,–হে ভগবন্! আপনি আমার সাথে সঙ্গত হোন। আমার মধ্যে দেবভাবের প্রতিষ্ঠা করে আমাকে পরামুক্তি প্রদান করুন। এইভাবেই মন্ত্রটির দর্শন সার্থক ও সমীচীন ]। ৩

.

চতুর্থ অনুবাক

মন্ত্র- কৰ্মণে বাং দেবেভ্যঃ শকেয়ম্। বেষয় ত্বা। প্রত্যুষ্টং রক্ষঃ প্রতুষ্টা অরাতয়ঃ। খুরসি ধু ধূৰ্বন্তং ধূর্ব তং যোহম্মান্ধুৰ্ব্বতি তং ধূৰ্ব্বয়ং বয়ং ধূৰ্বামঃ। ত্বং দেবানামসি সম্নিতমং পপ্রিতমং জুষ্টতমং বহ্নিতমম্ দেবহুমমতমসি হবির্ধানং দৃহস্ব মা হাঃ। মিত্রস্য ত্বা চক্ষু প্রেক্ষে মা ভেৰ্মা সং বিকথা মা ত্বা হিংসিষম্। উরু বাতায়। দেবস্য ত্বা সবিতুঃ প্রসবেংশ্বিনোর্বাহুব্যাং পুষ্ণো হস্তাভ্যামগয়ে জুষ্টং নির্বপামি। অগ্নীষোমাভ্যাং। ইদং দেবানামিদমু নঃ সহ। স্ফ্যত্যৈ ত্বা নারাত্যৈ।। সুবরভি বি খ্যেষম্ বৈশ্বানরং জ্যোতিঃ। দৃংহাং দুৰ্যা দ্যাবাপৃথিববাঃ। উৰ্ব্বন্তরিক্ষমথিহি অদিত্যাস্ত্রোপন্থে সাদয়ামি। অগ্নে হবাং রক্ষস্ব । ৪।

মর্মার্থ- হে আমার হৃদয়নিহিত জ্ঞানভক্তি! অথবা হে আমার সৎ-অসৎ চিত্তবৃত্তি! ভগবানের প্রীতি-হেতুভূত সৎকর্মসাধনে তোমাদের নিয়োজিত করতে যেন সমর্থ হই। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধনমূলক। অনুষ্ঠানকারী আত্মসামর্থ্যে নির্ভর পরায়ণ হতে না পেরে, আত্মাকে উদ্বোধিত করছেন, ভগবানের কর্মসম্পাদনে চিত্ত বৃত্তিসমূহ যেন সখ্যসম্পন্ন হয়)। হে আমার মন! সৎ-ভাব-ব্যাপ্তির নিমিত্ত ভগবান তোমাকে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ জীবদেহে সংযুক্ত করেছেন; অথবা সৎ-ভাব-জননের জন্য তোমাকে নিয়োজিত করছি। (মর্মার্থ এই যে–ভগবান্ কৃপাপূর্বক মানুষের মধ্যে মন সংন্যস্ত করেছেন। তার অভিপ্রায়-মানুষ ভগবৎ-পরায়ণ হোক)। হে ভগবন্! সম্প্রতিবন্ধক শত্রু (আমাদের দুবুদ্ধি) সর্বতোভাবে ভস্মীভূত হোক; আমাদের রিপুশত্রুগণ, প্রত্যেকে বিশিষ্টরূপে দগ্ধ হোক। (ভাব এই যে, আপনি আমাদের দুর্বুদ্ধিকে এবং রিপুশত্রুদের সমূলে বিনষ্ট করুন। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ দেবতা! আপনি কাম-ক্রোধী ইত্যাদি রিপুশত্রুদের সংহারকর্তা; আমাদের অমঙ্গলসাধক শত্রুদের আপনি বিনাশ করুন। প্রার্থনাকারী আমাদের সর্বদাই হিংসা করবার জন্য যে শত্রু উদযুক্ত রয়েছে, আপনি তাদের উচ্ছেদ-সাধন করুন; আমরা যে শত্রুকে বিনাশ করতে উদযুক্ত হবে অর্থাৎ যাদের বিনাশ করা প্রয়োজন হবে, আপনি তাদের বিনষ্ট করুন। (এখানে সর্বশত্রুনাশের প্রার্থনা রয়েছে)। হে আমার অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞানস্বরূপ দেবতা! আপনি দেবগণের (দেবভাব-সমূহের) শ্রেষ্ঠ বহনকর্তা। আপনি দেবভাবসমূহের বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষণকারী; আপনি সৎ-ভাব-সমুহের সম্যরূপে পূর্ণতাসাধক; আপনি তাদের (দেবভাব-সমূহের) অতিশয় প্রিয়, এবং সেই দেবভাব-নিবহের শ্রেষ্ঠ আহ্বানকর্তা। অপিচ, আপনি সেই দেবভাবসমূহের ধারক ও পোষক। আপনি আমাদের আহবনীয় শুদ্ধসত্ত্বের আধার, আমাদের হৃদয়ের দৃঢ়তা সম্পাদন করুন অর্থাৎ ঐকান্তিকতা বিধান করুন। পরন্ত আপনি আমাদের প্রতি কুটিল হবেন না অর্থাৎ আমাদের কর্মবৈগুণ্যহেতু অথবা আমাদের ত্রুটিবিচ্যুতি দেখে আপনি বিরূপ হবেন না। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানের অনুগ্রহে যেন আমরা সরল সৎ-ভাব-সম্পন্ন হতে পারি)। হে চিত্তবৃত্তি! মিত্রভূত ব্যক্তির অর্থাৎ হিতাকাঙ্ক্ষীজনের দৃষ্টিতে যেন তোমাদের দর্শন করতে সমর্থ হই! (ভাব এই যে-যেন তোমাদের উৎকর্ষ সাধন করতে পারি, যেন বিপথগামী না হই); তোমরা ভীত হয়ো না। (ভাবার্থ- অবিচলিতভাবে যেন ভগবানকে আরাধনা করি); অন্তরস্থিত শক্রসমূহ যেন তোমাদের হিংসা করতে না পারে অর্থাৎ বিপথে পরিচালিত না করে। হে দেব (অথবা হে আমার অন্তর)!

আপনি (তুমি) সর্বগ বায়ুর ন্যায় বিস্তৃত হোন (হও)। (দেবপক্ষে অর্থ এই যে–হে দেব! আপনি বায়ুর মতো আমাদের দেহে সর্বব্যাপী হয়ে আমাদের পাপসমূহকে বিদূরিত করুন। মনঃপক্ষে অর্থ এই যে–হে আমার অন্তর! দেবসামীপ্য লাভের জন্য সঙ্কীর্ণভাব পরিত্যাগ করো; সকলের প্রতি অভিন্নভাব প্রতিষ্ঠিত হোক)। আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বভাবরূপ হে হবিঃ। সকলের প্রসবিতা জ্ঞানপ্রদ দীপ্তিমান ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবানের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, আত্মবাহুকে দেবগণের অধ্বযুস্থানীয় ভবব্যাধিনিবারক অশ্বিদ্বয়ের বাহুযুগলবৎ মনে করে, এবং আপন করযুগলকে দেবগণের হবির্ভাগপুরক পুষাদেবতার করস্বরূপ মনে করে, সেই বাহুযুগলের ও করদ্বয়ের দ্বারা তোমাকে অর্থাৎ ভগবৎ-উদ্দেশ্যে উৎসৃষ্ট হবিঃরূপ ভক্তিসুধা শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহকে প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত নিবেদন অর্থাৎ উপসর্গ করছি। (ভাব এই যে,ভগবৎ কর্মে নিজেকে বিনিযুক্ত করতে হলে, নিজের বাহুযুগলকে এবং করদুটিকে দেবতার বাহু ও হস্ত বলে মনে করা কর্তব্য। সর্বাত্মক ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হবিঃ মানুষ কিভাবে গ্রহণ করতে পারবে? দেবতার স্মরণ না করলে মানুষের অনৃতত্বরূপহেতু, তার অনুষ্ঠিত কর্ম নিষ্ফল হয় এবং তাতে অনিষ্ট-উৎপাদন ঘটে। সেইজন্য সকল কার্যেই দেবতার স্মরণ কর্তব্য। দেবগণ সত্যস্বরূপ। দেবগণের অনুস্মরণপূর্বক কর্মের অনুষ্ঠান করলে, তা ফল-উপধায়ক হয় এবং সত্যস্বরূপ হয়। মন্ত্রের এটাই তাৎপর্য। দেবভাবে ভাবম্বিত হয়ে কর্ম-অনুষ্ঠানের সার্থকতাই মন্ত্রে প্রখ্যাপিত)। হে আমার মন! জ্ঞান ও ভক্তি রূপ দেবতাদ্বয়ের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে উৎসর্গ করছি। (তাৎপর্যার্থ– জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা যেন সৎকর্মের সাধনে এবং অন্তরকে পরিসুত করতে সমর্থ হই)। মনঃসম্বন্ধযুত জ্ঞান, দেবসম্বন্ধি অর্থাৎ দেবভাব হতে সমুৎপন্ন; (ভাব এই যে–সৎ-ভাবই সৎ জ্ঞানস্বরূপ; তার দ্বারাই মানুষ পরাজ্ঞান লাভ করে); অথবা আমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্ম দেবগণের উদ্দেশ্যে অর্থাৎ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত যেন অনুষ্ঠিত হয়। (ভাব এই যে-সৎকর্মের প্রভাবেই সৎ-ভাব সমুদ্ভূত হয়); অতএব সেই জ্ঞান আমাদের সাথে সঙ্গত হোক; (অর্থাৎ সৎ-ভাব ও সৎকর্মের দ্বারা আমাদের মধ্যে পরাজ্ঞানের উদ্ভব হোক)। হে আমার অন্তর্নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবি! অভিবৃদ্ধির নিমিত্ত অর্থাৎ বিশ্বসেবায় তোমাকে উৎসর্গ করছি; আত্মসুখকামনায় আমি অনুপ্রাণিত নই। (ভাব এই যে–আত্মসুখ-কামনা না করে বিশ্বহিতসঙ্কল্পে যেন ভগবানের আরাধনা করি এবং শুদ্ধসত্ত্ব নিবেদন করতে সমর্থ হই। ভগবানে শুদ্ধসত্ত্ব নিবেদনের এটাই সার্থকতা)। হে ভগবন্! সকল সৎকর্মেই যেন বিশ্বের হিতসাধক বিশ্বপ্রকাশক জ্যোতিঃস্বরূপ আপনাকে দর্শন করি। (ভাব এই যে,–আমাদের অনুষ্ঠিত সকল রকম কর্মেই ভগবানের অধিষ্ঠান হোক)। হে হবিঃ। (অথবা, হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব)! তোমার প্রভাবে ইহলোক-পরলোক-সম্বন্ধি (অথবা, জনন মরণধর্মশীল) নবদ্বারবিশিষ্ট এই দেহরূপ গৃহের (যেন) দৃঢ়তা সম্পাদিত হয়, অর্থাৎ ভগবানের কর্মসম্পাদনে সামর্থ্যযুত হয়। মনুষ্যজন্ম সহস্র প্রলোভনে পরিপূর্ণ। অতএব আমার হৃদয় যেন দৃঢ়তা প্রাপ্ত হয়।

হে দেব! আপনি আমার কলুষক্লেদ-পরিশূন্য শত্রুর উপদ্রবরহিত সুনির্মল হৃদয়রূপ আধার ক্ষেত্রকে লক্ষ্য করে আগমন করুন। (তাৎপর্যার্থ–বিশুদ্ধ নির্মল হৃদয়ই ভগবানের নিবাস-স্থান। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমি যেন সর্বদা আপনাকে হৃদয়ে রাখতে সমর্থ হই। অনুকম্পা-প্রদর্শনে আপনি তার বিহিত করুন)। হে হবি! সুপ্ত শিশু যেমন মাতৃক্রোড়ে সংন্যস্ত হয়, তেমনই তোমাকে অনন্তস্বরূপ ভগবানের অঙ্কে স্থাপন করছি। হে জ্যোতির্ময় প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবন্! আপনি আমার সেই হবিঃ অর্থাৎ হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ আহবনীয়কে সংরক্ষণ করুন (অর্থাৎ ইহলোক-পরলোক-সম্বন্ধি শত্রুদের অপসারিত করে চিরতরে সুপ্রতিষ্ঠিত করুন)। (মন্ত্রের তাৎপর্য এই যে,-হে ভগবন! আপনি বিশ্বরূপ জেনে আমার সমস্ত অনুরাগ ও সৎ-ভাব আপনাতে সংন্যস্ত করছি। আমার সেই অনুরাগ সারা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হোক। আপনি আমার সৎ-ভাব সংরক্ষণ করুন) ॥৪॥

 [ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা ক্রিয়াকাণ্ডের অনুসারী। তাই যাগ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে, উপকরণ সামগ্রী কোন্ যজ্ঞে কি ভাবে প্রযুক্ত হবে, এবং কোন্ প্রকারে কি রকম পদ্ধতি-ক্রমে যজ্ঞে আহুতি প্রদান করলে কি ফললাভ হওয়ার সম্ভাবনা, ভাষ্যকার তা-ই প্রদর্শনের প্রয়াস পেয়েছেন। আলোচ্য মন্ত্রেও তিনি তা-ই করেছেন। বিনিয়োগ-সংগ্রহ এবং সূত্রগ্রন্থ ইত্যাদি থেকে প্রমাণ পরম্পরা উদ্ধৃত করে ভাষ্যকার এই মন্ত্র-সমূহের যে বিনিয়োগ নির্দেশ করেছেন, তারই জন্য তিনি প্রথম মন্ত্রে হস্তদ্বয়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রে শূর্প, চতুর্থ মন্ত্রে বহ্নি, পঞ্চম মন্ত্রে শকট, ষষ্ঠ মন্ত্রে বীহি-সমূহ, সপ্তম মন্ত্রে দ্বার, অষ্টম ও নবম মন্ত্রে পবিত্র, দশম একাদশ ও দ্বাদশ মন্ত্রে এবং তীর পরবর্তী মন্ত্রগুলিতে হবিঃ প্রভৃতি সম্বোধন অধ্যাহার করেছেন। যেমন,-ভাষ্যকার প্রথম মন্ত্রে হস্তদ্বয়কে সম্বোধ্য বলেছেন। লৌকিক কার্যে হস্তদ্বয় পরিশুদ্ধ না করলেও চলতে পারে; কিন্তু দেবতার কর্মে হস্তদ্বয়কে প্ৰক্ষালিত করে পরিস্তুত ও বিশুদ্ধ করে নিতে হয়। নচেৎ, দেবকার্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় না। এই জন্যই হস্তদ্বয়কে বিশুদ্ধ করবার প্রয়োজনে মন্ত্রের অর্থ হয়েছে–দেবকার্যে নিয়োগের উদ্দেশ্যে প্রক্ষালিত তোমাদের যেন দেবকার্যে নিযুক্ত করতে সমর্থ হই। এক হিসেবে আমরাও ভাষ্যকারের এই অর্থেরই অনুসরণ করেছি বটে; কিন্তু (আধ্যাত্মিক ভাবনায়) আমাদের সম্বোধ্য হয়েছে–জ্ঞানভক্তি বা সৎ-অসৎ-চিত্তবৃত্তি। তাই মন্ত্রের ভাব হয়েছে–হে জ্ঞানভক্তি অথবা হে আমার সৎ-অসৎ-চিত্তবৃত্তি! ভগবানের প্রীতিহেতুভূত সৎকর্মের সাধনে (ভগবানের কার্যে যেন তোমাদের নিয়োজিত করতে সমর্থ হই।–আমরা কর্মকাণ্ডের বিরোধী নই। কর্মকাণ্ড-অনুসারী ব্যাখ্যা প্রচুর আছে। আমরা আধ্যাত্মিক ভাবধারায় বিচার করেছি ] ॥ ৪৷৷

.

পঞ্চম অনুবাক

মন্ত্র- দেবো বঃ সবিতোপূনাত্বচ্ছিদ্রেণ : পবিত্ৰেণ বসো সূর্যস্য রশ্মিভিঃ। আপো দেবীরগ্ৰেপুৰা অগ্রেগুবোহগ্রং ইমং যজ্ঞং নয়তাগ্রে। যজ্ঞপতিং ধ যুম্মানিদ্রোহবৃণীত বৃত্ৰতুৰ্য্যে যুয়মিন্দ্রমবৃণীধ্ব বৃত্ৰতুৰ্যে প্রেক্ষিতাঃ স্থ। অগ্নয়ে বো জুষ্টং প্রেক্ষাম্যগ্নীষোমাভ্যাম। শুন্ধব্বং দৈব্যায় কর্মণে দেব্যজ্যায়া। অবধূতং রক্ষোহবধূতা অরাতয়ঃ। অদিত্যাগসি প্রতি জ্বা পৃথিবী বেত্ত্ব। অধিষবণমসি বানম্পত্যং প্রতি ব্যাহদিত্যান্বেত্ত্ব। অগ্নেস্তনুরসি বাচো বিসর্জনং দেববীতয়ে ত্বা গৃহ্নামি। অদ্রিরসি বানম্পত্যঃ স ইদং দেবেভ্যো হব্যং সুশমি শমি। ইষমা বদোজ্জমা বদ দুমদ্বদত বয়ং সংঘাতং জেন্ম। বর্ষবৃদ্ধমসি। প্রতি ত্বা বৃর্ষবদ্ধং বেত্ত্ব। পরাপূতং রক্ষঃ পরাপূতা অরাতয়ো। রক্ষসাং ভাগগাহসি। বায়ুৰ্বো বি বিন৷ দেবো বঃ সবিতা হিরণ্যপাণিঃ প্রতি গৃহ্নাতু ॥ ৫॥

মর্মার্থ- হে আমার সৎ ও অসৎ কর্ম! দ্যোতমান স্বপ্ৰকাশ জ্ঞানপ্রেরক দেবতা অথবা প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান, বিশুদ্ধ পবিত্রকারক বায়ুরূপে এবং জগৎ-নিবাস-হেতুভূত প্রজ্ঞানস্বরূপ বিশ্বপ্রকাশক ভগবানের বিশ্বপ্রাপক জ্যোতিঃ-নিবহের দ্বারা তোমাদের উৎকর্ষসাধনে পবিত্রতা সম্পাদন করুন। (অথবা, তোমরা জ্ঞানপ্রদ সবিতৃদেবের প্রেরণায় (অনুকম্পায়) ত্রুটি-পরিশূন্য বায়ুর ন্যায় পবিত্রকারক ও সূর্যরশ্মির মতো জ্ঞানপ্রদ হয়ে আমাদের উৎকর্ষ-সাধনে পবিত্র করো। (বায়ু ও সূর্যরশ্মি শুদ্ধিসম্পাদক। তাঁদের প্রভাবে আমাদের সৎ-অসৎ উভয় কর্ম পবিত্র হোক,–এটাই প্রার্থনা)। অগ্রগমনশীল অর্থাৎ মোক্ষপথে নয়নসমর্থ, অপহতিনিবারণে শোধনশীল অর্থাৎ মুক্তিদানসামর্থ-হেতু উৎকর্ষসম্পাদনে পবিত্রতা-বিধায়ক হে জলদেবতা অর্থাৎ দেবভাবসমূহ! আপনারা প্রবর্তমান যুগ ইত্যাদি সত্যকে সত্বর নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করুন অর্থাৎ সিদ্ধিযুক্ত করুন; অপিচ, যাজ্ঞিক কর্মের অনুষ্ঠাতাকে ভগবানের সন্নিকর্ষ-লাভে সমর্থ করুন; আমাদের কর্মসমূহে সর্বসিদ্ধিদাতা ভগবানকে আনয়ন করুন। অপিচ অন্তঃশত্রুনাশের নিমিত্ত পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান পরাশক্তি-দানে তোমাদের ভগবৎকার্যে নিযুক্ত করুন। এবং তোমরাও অন্তঃশত্রুনাশের নিমিত্ত ভগবানকে সম্ভজনা করো; আর হে আমার হৃদয়স্থিত সৎ-ভাবসমূহ! তোমরা শত্রুনাশের নিমিত্ত অসৎসম্বন্ধরহিত এবং সর্বথা ভগবকর্মে নিয়োজিত হও। অথবা–হে আমার সৎ-বৃত্তিনিবহ! শত্ৰু-সংহারের নিমিত্ত-রিপুশনাশের জন্য, সেই ভগবান্ ইন্দ্রদেব তোমাদের প্রেরণ করেছেন, আত্মশত্রু-নিপাতের জন্য তোমরা সেই ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে তোমাদের পরিচালক পদে বরণ করো! অর্থাৎ,–আত্মশত্ৰু-সংহারের জন্য সম্বন্ধযুত কর্মে অনুরক্ত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং আত্ম-উদ্বোধক। প্রার্থনার ভাব এই যে,হে দেব! আমাদের সৎ-চরিত্র দেবভাব সম্পন্ন করে ভগবানের সান্নিধ্য প্রদান করুন)। হে আমার সৎ-অসৎ চিত্তবৃত্তি-সমূহ! তোমাদের উৎকর্ষসাধনের নিমিত্ত, প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের এবং জ্ঞানভক্তিরূপী দেবতার উদ্দেশ্য, আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিকে উৎসর্গ করছি অর্থাৎ ভগবানের কার্যে নিয়োজিত করছি। হে আমার সৎ-অসৎ বৃত্তিনিবহ! তোমরা দেবসম্বন্ধি যাগ ইত্যাদি সৎক্রিয়ার দ্বারা দেবসম্বন্ধি সৎ-জ্ঞান-বর্ধনরূপ কর্মে বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হও। (এই মন্ত্রের দ্বারা প্রার্থনাকারী নিজেকে উদ্বোধিত করছেন। চিত্তবিক্ষোভজনিত চাঞ্চল্যে মনের স্থৈর্য সাধনের জন্য চিত্তবৃত্তির উদ্বোধনের উদ্দেশ্যে সাধক নিজেকে প্রবুদ্ধ করছেন বলে মনে করাই সঙ্গত)। তা হলে, আমার দুর্বুদ্ধিরূপ শত্ৰু বিকম্পিত হবে; এবং রিপুশত্রুগণ বিতাড়িত (নিপাতিত) হবে। হে আমার মন! তুমি অনন্তস্বরূপ ভগবানের অংশভূত হও; অতএব আমার হৃদয়রূপ আধারক্ষেত্ৰ তোমার সম্বন্ধি জ্ঞান প্রাপ্ত হোক। অথবা হে আমার মন! (চঞ্চলতা প্রভৃতি হেতু) তুমি অনন্তের সাথে মিলনের প্রতিবন্ধক হও; সেই অনন্ত তোমার প্রতি অনুগ্রহ করুন। হে মন! তুমি মহাবৃক্ষস্বরূপ অধিষবণের আধারভূত অর্থাৎ শনিবারণক্ষম দৃঢ় হও। অতএব অনন্ত ভগবানের করুণাধারা তোমাকে প্রাপ্ত হোক। (ভাব এই যে, বৃক্ষ যেমন ফল ছায়া ইত্যাদি দানে সকলকে পরিতুষ্ট করে, তুমিও তেমনই সকলের প্রীতির আস্পদ হও! তাহলে ভগবান তোমার প্রতি প্রসন্ন হবেন)। হে মন! তুমিই অগ্নিদেবতার অর্থাৎ আহবনীয় জ্ঞানের (বা আহবনীয়ের দেহস্বরূপ; তুমিই বাক্যের বা মন্ত্রের উৎপাদক উচ্চারণকারী; দেবতার প্রীতির নিমিত্ত আমি তোমাকে নিযুক্ত করছি। (ভাব এই যে,-মনই আহবনীয়; মনই মন্ত্র; মনের দ্বারাই ভগবানের অনুকম্পা লাভ করতে পারা যায়)। হে মন! তুমি মহাবৃক্ষস্বরূপ, তুমি মহত্ত্ব ইত্যাদি গুলোপেত, তুমি পাষাণের মতো দৃঢ়; অর্থাৎ তুমিই সর্বকর্ম-সম্পাদনে সমর্থ। সেই যে তুমি, আমাদের প্রদত্ত চিত্তবৃত্তিরূপ হবিঃ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত যাতে শান্ত ও শত্রুর উপদ্রব-পরিশূন্য হয়, সেইভাবে সংযমিত করো। অথবা–হে মন! সেই যে তুমি–দেবগণের প্রীতির জন্য সবরকম আহবনীয়রূপে সুষ্ঠুভাবে দেবসেবায় নিযুক্ত হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। চিত্তবৃত্তি যাতে ভগবানের অনুসারী হয়, সেই জন্য সাধক এখানে নিজেকে উদ্বোধিত করছেন)। হে ভগবন্! আপনি আমাদের অভীষ্ট প্রকৃষ্টরূপে পূর্ণ করুন; অপিচ, আমাদের মধ্যে বিশিষ্ট রূপে বলপ্রাণ সঞ্চার করুন। অপিচ, হে আমার হৃদয়নিহিত সৎ-বৃত্তিসমূহ! তোমরা জ্ঞানজ্যোতিতে উদ্ভাসিত হও। তা হলে প্রার্থনাকারী আমরা, শত্রুসঙ্ত অর্থাৎ অন্তঃশত্রুর উপদ্রব নিবারণ করতে সমর্থ হবো। অথবা, ইষে ত্ব উর্জে ত্ব প্রভৃতি মন্ত্র দুটি উচ্চারণে প্রার্থনা করো (অর্থাৎ অন্নরসপ্রাণ যাতে প্রাপ্ত হতে পারে, তার উপযোগী মন্ত্র ইত্যাদি উচ্চারণ করো)। তোমার সাহায্যে শ্রেয়োকামী আমরা অসৎ-বৃত্তিসমূহকে প্রতিরূদ্ধ করে জয়যুক্ত হই। (আত্মশক্তি উন্মেষণের জন্য মন্ত্রে প্রার্থনা রয়েছে। শত্রুনাশে অনিষ্টপরিহার এবং প্রজ্ঞানলাভে ইষ্টপ্রাপ্তি মন্ত্রে প্রখ্যাপিত। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন! আমাদের সকল অভীষ্ট পূরণ করুন। আমাদের এই অনুষ্ঠান মনঃ-প্রাণের অধিষ্ঠাত্ দেবতাসমূহের সাথে ঐক্যসম্বন্ধযুক্ত হোক)। হে মন! তুমি অভীষ্টবর্ষণের হেতুভূত হও। অতএব হে মন! তোমাকে অভীষ্টপূরণের হেতুভূত বলে ভগবান (যেন) জানতে পারেন। (অর্থাৎ, তোমার কর্মের দ্বারা ভগবান তোমার প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ হোন। তা হলে, দুর্বুদ্ধিরূপ শত্রু দূরীকৃত হবে, আর রিপুশত্রুগণ বিতাড়িত বিমর্দিত হবে। হে আমার অন্তরস্থিত অসৎ-বৃত্তিসমূহ! তোমরা দেবভাব বিরোধী অন্তঃশত্রুদের অংশস্বরূপ হও। হে অন্তরস্থ অসৎ-বৃত্তিসমূহ! সেই বিচ্ছিন্নকারক বায়ুদেব (প্রবলবেগে প্রবাহিত হয়ে) আমাদের অন্তর থেকে তোমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিন। হে অসৎ-বৃত্তিসমূহ! সেই মঙ্গলরূপ সুবর্ণহস্তবিশিষ্ট জ্ঞানপ্রদাতা দ্যোতমান্ পরমেশ্বর তাঁর কলঙ্করহিত হস্তের দ্বারা তোমাদের প্রতিগ্রহণ করুন; অর্থাৎ আমাদের অন্তর থেকে তোমাদের অপসারিত করুন। ৫।

[এই মন্ত্রগুলি ব্রীহ্যবঘাত-বিষয়ক। ধান ভেনে তণ্ডুল প্রস্তুত করবার সময়, তণ্ডুলের গাত্রে রক্তাভ যে তুষ ও ভোলা পরিদৃষ্ট হয়, শাস্ত্রমতে ভাষ্যানুক্রমণিকায় সেই তুষ রক্ষোভাগ বলে অভিহিত হয়। সেই তুষ ছাড়াবার সময়, বক্ষ্যমাণ এই মন্ত্ৰসমূহ উচ্চারণ করবার বিধি সূত্র গ্রন্থ ইত্যাদিতে উক্ত হয়েছে। প্রথমেই যে উৎপবন অর্থাৎ পবিত্রীকরণ মন্ত্র ব্যবস্থিত হয়েছে, তার কারণ-স্বরূপ একটি আখ্যায়িকার অবতারণা করা হয়। সেই আখ্যায়িকাটি এই, ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করেছিলেন। নিহত হবার পর বৃত্র উদকের অভিমুখে পতিত হয়। তাতে জল থেকে সার নির্গত হয়েছিল। দৈব ও মানুষ ভেদে সেই সার দুরকম। মলপ্রক্ষালন ইত্যাদির জন্য যে সার, তা মানুষ। আর শোধনের জন্য যে সার, তা-ই দৈব। দৈব আবার দুরকম,-পাপশোধক ও দ্রব্য-শোধক। স্নান ইত্যাদি বিষয়ক সার পাপ-শোধক; আর পোণ ইত্যাদি বিষয়ক সার দ্রব্য-শোধক। সেই জন্যই পূজার উপকরণ ইত্যাদিতে জল প্রক্ষেপ এবং পাপ-শোধনের নিমিত্ত অবগাহন ইত্যাদি প্রয়োজন। এখানে (কর্মকাণ্ডের বিচারে) সেই দুরকম সারই মেধ্য ও যজ্ঞীয় শব্দ দুটিতে বিক্ষিত হচ্ছে। সেই সার নির্গত হয়ে ভূমিতে পতিত হওয়ায় তা থেকে দুর্ভের উৎপত্তি হয়েছিল। সেই জন্যই দর্ভের পবিত্রতা প্রখ্যাপিত। বিনিয়োগ অনুসারে মন্ত্রের যে সম্বোধন-পদগুলি ভাষ্যকার অধ্যাহার করেছেন, তা এই,–প্রথম মন্ত্রের সম্বোধ্য আপ; দ্বিতীয়ের সম্বোধ্য জল-দেবতা; তৃতীয় মন্ত্রের হবিঃ; চতুর্থ মন্ত্রের যাগ-পাত্র-সমূহ; পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্রের কৃষ্ণাজিন; সপ্তম মন্ত্রের উদুখল; অষ্টম মন্ত্রের পুরোডাশীয় ব্রীহি-সমূহ; নবম মন্ত্রের মুসল পদার্থ; দশম মন্ত্রের দৃষৎ বা পাষাণ; একাদশ মন্ত্রের শূর্প; দ্বাদশ মন্ত্রের ব্রীহি-সমূহ ও ত্রয়োদৃশ মন্ত্রের তুষ; পঞ্চদশ ও ষোড়শ মন্ত্রের তণ্ডুল প্রভৃতি সম্বোধন পদ অধ্যাহৃত হয়েছে। সেই অনুসারে মন্ত্রের যে অর্থ ভাষ্যকার নিষ্পন্ন করেছেন, তা কর্মকাণ্ডের পক্ষে যথাযথ। কিন্তু, বলা বাহুল্য, আমাদের অর্থ (আধ্যাত্মিক বিচারণায় ও বিশ্লেষণে) সম্পূর্ণ বিপরীত পন্থা অবলম্বন করেছে। ক্রিয়াকাণ্ডের অনুসরণে, ভাষ্যকার যেমন প্রক্রিয়া ইত্যাদি সহকারে মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশন করেছেন, তা থেকেই অনেক স্থলে আমাদের মর্মার্থের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম হয় ] ॥ ৫॥

.

ষষ্ঠ অনুবাক

মন্ত্র- অবধূতং রক্ষোহবধূতা অরাতয়োহ দিত্যাগসি প্রতি জ্বা পৃথিবী বেত্ত্ব। দিবঃ স্তম্ভনিরসি প্রতি ব্ৰাহদিত্যান্বেন্তু। ধিষণাহসি পর্বত্যা প্রতি ত্বা দিবঃ স্কন্তনিৰ্বেত্ত্ব। ধিষণাহসি পার্বতেয়ী প্রতি ত্বা পর্বতিৰ্বেত্ত্ব। দেবস্য ত্বা সবিতুঃ প্রসবেংশ্বিনোৰ্ব্বাহুভ্যাং পুষ্ণো হস্তাভ্যামধি বপামি ধানমসি ধিনুহি দেবান। প্রাণায় বৃহপানায় ত্বা ব্যানায় ।। দীর্ঘামনু প্রসিতিমায়ুষে ধাম। দেবো বঃ সবিতা হিরণ্যপাণিঃ প্রতি গৃহ্নাতু ॥ ৬।

মর্মার্থ- হে আমার মন! (যখন তুমি সৎ-সহযুত হও তখন) দুবুদ্ধিরূপ শত্রু বিকশিত হয়, এবং রিপুশত্রুগণ বিতাড়িত (নিপাতিত) হয়। হে মন! (চঞ্চলতা প্রভৃতি হেতু) তুমি, অনন্ত-সহ মিলনে প্রতিবন্ধক-স্থানীয় হয়ে থাকো; অতএব সকল সৎ-বৃত্তির মূল সৎ-জ্ঞান ও সৎকর্ম তোমাকে অনুগ্রহ করুন। (চাঞ্চল্য-নিবন্ধন মন ভগবৎ-সম্মিলনের অন্তরায় হয়। সেই জন্য, ভগবানের অনুগ্রহ লাভের নিমিত্ত এই মন্ত্রে প্রার্থনা জানানো হয়েছে)। হে অসৎ-বৃত্তিনিবহ! তোমরা স্বর্গবাসিগণের অর্থাৎ হৃদয়রূপ স্বর্গপ্রদেশে অবস্থিত সৎ-বৃত্তিসমূহের স্তম্ভনকারী অর্থাৎ প্রতিবন্ধক হও। অথবা হে মন! (সৎকর্মের দ্বারা) তুমি দ্যুলোকবাসীরও স্তম্ভনকারী হও; (সৎ-কর্মের প্রভাবে মানুষ দেবগণকেও স্তম্ভিত করতে সমর্থ হন); অতএব অনন্তের অংশভূত শুদ্ধসত্ত্ব তোমাকে অনুগ্রহ করুন। (চাঞ্চল্য-নিবন্ধন চিত্তবৃত্তি-সমূহ অনন্তের সাথে মিলনের বাধক হয়। সেইজন্য অন্তরাত্মা আত্মাকে উদ্বোধিত করেন। প্রার্থনা এই যে, হৃদয়ে সৎ-ভাব সঞ্জাত হলে অসৎ ভাবও সৎ-ভাবে পরিণত হয়)। হে মনোবৃত্তি! তুমি সৎ-বুদ্ধি প্ৰদাত্রী এবং পর্বতের মতো দৃঢ় বলে অবিচলিত হও; অতএব হৃদয়স্থিত সবৃত্তির স্তম্ভনকারী প্রতিবন্ধকসমূহ তোমাকে পরিত্যাগ করুক। হে আমার মনোবৃত্তি! তুমি সৎ-বুদ্ধিদাত্রী হও; অনন্ত শক্তিশালিনী পরা প্রকৃতি তোমাকে পর্বতের মতো দৃঢ় (অচষ্ণল ও সৎ-ভাবসম্পন্ন) বলে জানুন অর্থাৎ অনুগ্রহ করুন। আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বভাবরূপ হবি! সকলের প্রসবিতা জ্ঞানপ্রদ দীপ্তিমান ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবানের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, আত্মবাহুকে দেবগণের অধ্বর্যস্থানীয় ভবব্যাধিনিবারক অশ্বিদ্বয়ের বাহুযুগলের মতো মনে করে, এবং নিজের করযুগলকে দেবগণের হবির্ভাগপূরক পূষাদেবতার করস্বরূপ মনে করে, সেই বাহুযুগলের ও করদ্বয়ের দ্বারা তোমাকে (অর্থাৎ ভগবানের উদ্দেশ্যে উৎসৃষ্ট হবিঃরূপ শুদ্ধসত্ত্ব ভক্তিসুধাকে) ভগবানের কার্যে সম্যরকমে নিয়োজিত করছি। হে মন! তুমি সকলের প্রীতিকারক হও; অতএব, (আমাদের অন্তরে) সমস্ত দেবভাবকে প্রীণন অর্থাৎ প্রেরণ করো। হে মন! তোমাকে আমার প্রাণবায়ু-সংরক্ষণের জন্য দীর্ঘজীবন কামনায় সংযত করছি। হে মন! তোমাকে আমার অপান বায়ু সংরক্ষণের জন্য (অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তি পরিহারের জন্য) সংযত করছি; হে মন! তোমাকে আমার ব্যানবায়ু সংরক্ষণের (শারীরবলরক্ষার্থ) নিমিত্ত সংযত করছি। হে মন! ইহ-সংসারে ভগবানের প্রীতিহেতুভূত সম্পাদনযোগ্য অশেষ সত্যৰ্ম আছে জেনে আয়ুঃ-বৃদ্ধির (অথবা ভগবানের পরিতৃপ্তির) নিমিত্ত তোমাকে সংযত করছি। বহু রকম সকর্ম সাধনার জন্যই মনুষ্য জীবন লাভ। সুদীর্ঘ আয়ুঃ ব্যতীত সে সকল সৎকর্ম সাধিত হতে পারে না। যোগসাধনাই আয়ুবৃদ্ধির একমাত্র উপায়। অসৎ-বৃত্তিসমূহ আয়ুঃ-হানিকর। অতএব, মন্ত্রের শেষাংশে (অষ্টম মন্ত্রাংশে) তাদের সম্বোধন করা হয়েছে)। অথবা, হে মন! অবিচ্ছিন্নভাবে ভগবানের প্রীতিহেতু ভূতকর্ম সম্পাদন করে এবং সদাকাল তার সন্তোষ-বিধান করে আয়ুবৃদ্ধির অথবা সুখবধর্নের নিমিত্ত তোমাকে সংযতভাবে নিয়োজিত করছি। (মন্ত্রটি উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে,হে মন! ভগবানের সন্তোষ বিধান করে আমাদের সন্তোষ-বর্ধন করো। তোমার দ্বারা সেবিত হলে ভগবৎ-প্রীতিতে আমরা প্রীতি লাভ করবো)। হে অসৎ-বৃত্তিসমূহ! সেই মঙ্গলরূপ সুবর্ণহস্তবিশিষ্ট জ্ঞানপ্রদাতা দ্যোতমান সবিতৃদেব, তোমাদের প্রতিগ্রহণ করুন; অর্থাৎ, আমাদের অন্তর থেকে তোমাদের অপসারিত করুন ৷৷ ৬ ৷৷

[পঞ্চম অনুবাকের মন্ত্রগুলি ব্রীহির অবঘাত-মূলক। এই ষষ্ঠ অনুবাকের মন্ত্রগুলি তলপেষণাত্মক। ব্রীহি অবগাত বলতে খড় থেকে ব্রীহি বা ধান ছাড়ানো, আর তলপেষণ বলতে সেই ধান ভেনে চাল প্রস্তুত করণ বুঝি। অবঘাতমূলক মন্ত্রগুলির মতো, পেষণসংক্রান্ত মন্ত্রগুলিতেও বিভিন্ন সামগ্রী উপলক্ষিত হয়েছে। আর উপলক্ষিত সেই সেই দ্রব্যে মন্ত্র প্রযুক্ত হওয়ায়, সেই সকল সামগ্রীই অনেক স্থলে মন্ত্রের সম্বোধ্য মধ্যে পরিগণিত হয়েছে। বিনিযোগ অনুসারে, মন্ত্রে উপলক্ষিত সামগ্রী সম্পর্কে, মন্ত্র যে ভাবে প্রযুক্ত হয়েছে, এখানে তার সম্পূর্ণ বিবরণ অনাবশ্যক। কারণ ক্রিয়াকাণ্ডের বিচারে, ভাষ্যমতে প্রথম মন্ত্রের সম্বোধ্য-শম্যা, দ্বিতীয় মন্ত্রের–পেষণসাধনভূত দৃষৎ। তৃতীয় মন্ত্রের হবিঃপুরোভাশ, চতুর্থ মন্ত্রের হবিবৃত্তিয় সম্বোধন পদ রূপে অধ্যাহৃত হয়েছে। পঞ্চম মন্ত্রে তুণ্ডল এবং ষষ্ঠ মন্ত্রে তণ্ডুল-পেষণকারিণী দাসী উপলক্ষিত হয়েছে। ফলে যেমন প্রথম মন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়েছে–হে শম্যে! তুমি দুলোকের ধারয়িত্রী হও। সুতরাং ভূমির ত্বকরূপ এই কৃষ্ণাজিন তোমাকে স্বভূত বলে মনে করুক। অর্থাৎ, কৃষ্ণাজিন পৃথিবীর ত্বকস্বরূপ; তুমি পৃথিবীর অস্থিস্বরূপ। তোমাদের পরস্পর মিলন হোক। তেমনই দ্বিতীয় মন্ত্রের অর্থ-হে দৃষৎ! তুমি পেষণে অভিজ্ঞ, সুতরাং অতিশয় দৃঢ়। পর্বত থেকে তোমার উৎপত্তি; সুতরাং তোমাকে পর্বতের ন্যায় দৃঢ় বলে মনে করি। তুমি দ্যুলোকধারিকা এই শম্যাকে জান অর্থাৎ তোমার সাথে তার মিলন হোক। (গদার মতো আকৃতিবিশিষ্ট ব্যাসার্ধ পরিমিত কাষ্ঠবিশেষ–শম্যা। সেই শম্যা দৃষতের পশ্চাৎ-ভাগ ধারণ করে। দৃষৎ বলতে যাঁতার ভাব মনে আসে। দুখণ্ড গোলাকৃতি প্রস্তরে যাঁতা প্রস্তুত হয়। নিম্নভাগস্থ প্রস্তরের কেন্দ্রস্থানে বিদ্ধ যে কাষ্ঠফলক উপরিভাগস্থ পাষাণখণ্ডকে ধারণ করে, তা-ই শম্যা পদবাচ্য বলে মনে করি)। আমরা কর্মকাণ্ডের বিরোধী নই। তবে কর্মকাণ্ডের দিক ছাড়াও আধ্যাত্মিকতার বিচারে যে এই মন্ত্রগুলি পঠিতব্য, সেটাই আমরা দেখবার চেষ্টা করেছি। আমরা তো মনে করি, এই অনুবাকের পঞ্চম থেকে অষ্টম পর্যন্ত মন্ত্র-সমূহে যোগসাধনার এক মহান্ উপদেশও বিদ্যমান। যেমন, পঞ্চম মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে মনকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে মন! তুমি ভগবৎপ্রীতিসাধনে বিনিযুক্ত হও। সকল দেবভাব তোমাকে প্রতিষ্ঠিত থাকুক। সেই দেবভাব কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? কি রকমে ভগবানের প্রীতিসাধনে প্রযুক্ত হতে সমর্থ হয়? পরবর্তী তিনটি মন্ত্রে তারই ব্যঞ্জনা আছে] ॥ ৬

.

সপ্তম অনুবাক

 মন্ত্র- ধৃষ্টিরসি ব্ৰহ্ম যচ্ছ। অপাগ্নেহপিমামাদং জহি নিব্যাদং সদাহদেব্যজং বহ।। নিৰ্দগ্ধং রক্ষো নিগ্ধা অরাতয়ো ধ্রুবমসি পৃথিবীং দৃংহাইয়ুৰ্দহ প্রজাং দৃংহ। সজাতানস্মৈ যজমানায় পহ।। ধর্মস্যন্তরিক্ষং দৃংহ প্রাণং দৃংহাপানং দৃংহ সজাতানস্মৈ যজমানায় পৰ্যহ ধরুণমসি দিবং দৃংহ চক্ষুঃ দৃংহ শ্রোত্রং দৃংহ সজাতানশ্মৈ যজমানায় পৰ্যহ চিতঃ স্থ প্ৰজামস্মৈ রয়িমস্মৈ সজাতানস্মৈ যজমানায় পৰ্যহ। ভৃগুণামরিসাং তপসা তপ্যধ্বম্। যানি ঘৰ্ম্মে কপালানপচিন্তি বেধসঃ। পূষ্ণস্তান্যপি ব্রত ইন্দ্ৰবায়ু বি মুঞ্চতাম্ ॥ ৭

মর্মার্থ- হে মন! তুমি শক্রসমূহের ধর্ষণে সমর্থ হও। অতএব তুমি পরব্রহ্ম (সত্ত্বভাব) প্রদান করো। অথবা হে মন! তুমি স্বতঃই প্রগম্ভ অর্থাৎ চঞ্চল আছ; অতএব তুমি ভগবানের কৃপালাভের নিমিত্ত তার প্রীতি-হেতুভূত কর্ম-সম্পাদনে প্রবুদ্ধ হও অর্থাৎ চাঞ্চল্য পরিহার করে স্থির হও। অথবা, হে মন! তুমি সকলের ধারক পরব্রহ্মস্বরূপ হও; অতএব তুমি সত্ত্বভাবরূপ পরমধন অর্থাৎ মোক্ষ প্রদান করো। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আপনি অপক জ্ঞান (বিভ্রম) বিদূরিত করুন। দুষ্টজ্ঞান অর্থাৎ পাপবুদ্ধিরূপ দহনজ্বালাপ্রদ শত্রুকে নিঃশেষ করুন। তার পর দেবভাবসাধক জ্ঞানাগ্নিকে আনয়ন করে আমাদের অন্তরে সর্বতোভাবে প্ৰদ্দীপিত করুন; অথবা, হে মন! দেবভাবসাধক জ্ঞানাগ্নিকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করো; অথবা হে অগ্নিদেব! দেবভাবসাধক জ্ঞানাগ্নিরূপে সর্বতোভাবে আপনি আমাদের অন্তরদেশে বিস্তৃত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, দাহক বা অজ্ঞানরূপ যে অগ্নি-প্রত্যক্ষীভূত হয়, তার অনুসরণে বিরত হও; জ্ঞানাগ্নিই সর্বসিদ্ধিকারক; তারই অনুসরণ করো)। হে দেব! আপনার প্রভাবে দুর্বুদ্ধিরূপ অন্তঃশত্রু নিঃশেষে বিদগ্ধ (বিনাশপ্রাপ্ত) হোক; অপিচ, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুশত্রু নিঃশেষে দগ্ধ (ভস্মীভূত) হোক। (ভাবার্থ এই যে, আমাদের সকল শত্ৰু নিঃশেষে বিনাশপ্রাপ্ত হোক)। হে মন! তুমি স্থির একাগ্র হও। সৎ-বৃত্তিমূল আধারক্ষেত্রকে দৃঢ় করো, সৎকর্মসাধন-সামর্থ্যকে অথবা সকর্মশীল পূর্ণজীবনকে রক্ষা করো, এবং লোকানুরাগ বা বিশ্বপ্রীতি দৃঢ় (রক্ষা) করো। তার পর হে মন! অথবা হে দেব! সকর্মে প্রবৃত্ত প্রার্থনাকারীর কল্যাণসাধনের জন্য তার জন্মসহজাত সম্প্রতিবন্ধক অর্থাৎ বন্ধনমূলক অসৎ-বৃত্তিসমূহকে অভিভূত বা অপসারিত করো। হে মন! তুমি সত্ত্বভাব-রক্ষক হও। অতএব অন্তরিক্ষের ন্যায় অনন্ত অর্থাৎ সত্ত্বভাব সমূহের সর্বব্যাপিত্ব দৃঢ় করো; আর সৎকর্ম-সাধনশীল প্রাণশক্তিকে এবং পরমাত্মার অংশভূত চৈতন্যকে তোমাতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করো। তার পর হে আমার মন! অথবা হে ভগবন্! তুমি সৎকর্ম-প্রবৃত্ত সাধনরত প্রার্থনাকারীর কল্যাণ কামনায় তার জন্মসহজাত সৎপ্রতিবন্ধক অর্থাৎ বন্ধনমূলক অসৎ-বৃত্তি-সমূহকে (সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা) সর্বতোভাবে আবরণ অর্থাৎ বিনাশ করো। হে মন! তুমি সৎ-বৃত্তিসমূহের ধারক ও পালক হও। অতএব তুমি শুদ্ধসত্ত্ব-দেবভাব দৃঢ় করো অর্থাৎ তোমাতে দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করো; সৎ বস্তুদর্শনসামর্থ্য দৃঢ় করো, সৎ-বাক্য-শ্রবণসামর্থ্য দৃঢ় করো। তারপর হে মন! সৎকর্মে প্রবৃত্ত সাধনরত প্রার্থনাকারীর কল্যাণ-কামনায় তার জন্মসহজাত সৎপ্রতিবন্ধক বন্ধন-হেতুভূত অন্তঃশত্রুদের (সৎ-ভাবের দ্বারা) আচ্ছাদিত করো অর্থাৎ অপসারিত করো। হে মন! তুমি প্রকাশশীল হও। অতএব তুমি সর্বদিকে পরিব্যাপ্ত সৎ-ভাবকে অর্থাৎ বিশ্বব্যাপক শুদ্ধসত্ত্বকে বা বিশ্বহিতসাধনের সামর্থ্যকে দৃঢ় করো অর্থাৎ তোমাতে দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করো; এবং সৎ-বৃত্তির মূল বা আধারকে দৃঢ় করো এবং লোকানুরাগ বা বিশ্বপ্রীতি দৃঢ় করো। তার পর হে আমার মন! সৎকর্মে প্রবৃত্ত সাধনরত প্রার্থনাকারীর (আমার) জন্মসহজাত বন্ধনমূলক সম্প্রতিবন্ধক অন্তঃশত্রুদের (সৎ-ভাবের দ্বারা) আচ্ছাদিত অর্থাৎ বিদূরিত করো। হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা ভগবৎ-অনুসারী হও। তার পর মোকামীকে (আমাকে) সৎ-ভাব-মূলক বিশ্বপ্রীতি প্রদান করো। অপিচ, মোক্ষকামীকে (আমাকে) পরমধন প্রদান করো; এবং সৎকর্মে প্রবৃত্ত সাধনরত প্রার্থনাকারীর (আমার) কল্যাণের জন্য জন্মসহজাত সৎপ্রতিবন্ধক বন্ধন মূলক অন্তঃশত্রুদের সৎ-ভাবের দ্বারা পরিবৃত করো। হে চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা অতি উচ্চ জ্ঞান-লাভের নিমিত্ত একাগ্রতার সাথে ভগবানের আরাধনায় নিরত হও। সৎকর্ম-সহজাত বিশিষ্ট জ্ঞান-লাভই ভগবৎ-প্রাপ্তির করাণ হয়ে থাকে। মেধাবী অর্থাল আত্মদর্শিগণ প্রকাশশীল অর্থাৎ প্রবর্ধমান জ্ঞানাগ্নিতে যে প্রসিদ্ধ জ্ঞানাবরণ-সমূহকে প্রক্ষিপ্ত করেন; জ্ঞান-শক্তি-প্ৰজনক হে ইন্দ্র-বায়ু দেবদ্বয়! আপনারা উভয়ে সৎ-ভাবপোষক (অনুষ্ঠাতার) যাগ ইত্যাদি সৎকর্মে (আবির্ভূত হয়ে) সেই সৎ-ভাবের অবরোধ আবরণ-সমূহকে বিমুক্ত অর্থাৎ অপসারিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক) । ৭।

[পঞ্চম অনুবাকে ব্রীহ্যবঘাত, ষষ্ঠে তলপেষণ এবং এই সপ্তম অনুবাকে কপালোপধান। কর্মকাণ্ডের অনুসরণে একে একে কেমন পর পর তণ্ডুল-প্রস্তুত-করণের প্রণালী মন্ত্ৰসমুহে বিধৃত রয়েছে। এই মন্ত্রে সর্বসমেত অষ্টবিধ কপাল স্থাপন করবার বিধি। যে কারণে এই অষ্টবিধ কপাল স্থাপন করতে হয়, তা এই,–গর্ভে অবস্থানকালে প্রথমে মানুষের শিরোরূপ একটি অখণ্ড কপাল উদ্ভূত হয়। তার পর সেই কপাল রেখা ইত্যাদি ক্রমে আটটি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে। পঞ্চম মন্ত্র আটটি কপালের সম্বোধনেই প্রযুক্ত হয়ে থাকে। চারদিকে অঙ্গার-আচ্ছাদন পূর্বক বলা হয়,-হে অষ্টকপাল! অঙ্গিরসের বংশীয় ভৃগুঋষির তপস্যার দ্বারা উদ্ভাবিত অগ্নির তাপ তোমরা প্রাপ্ত হও। কারও কারও মতে–ভৃগু ঋষির পূর্বে কেউ অগ্নির ব্যবহার অবগত ছিলেন না। তিনিই প্রথমে অগ্নির দাহিকা শক্তির বিষয় সংসারে প্রকাশ করেন। তাই মন্ত্রে তার নাম সন্নিবিষ্ট আছে। ষষ্ঠ বা শেষ মন্ত্র যজ্ঞের শেষে পঠিত হবার বিধি। মন্ত্রে অর্থ,–অধ্বর্যরূপে মেধাবিগণ যে সব কপালসমূহ ধ্রুবমসি প্রভৃতি মন্ত্রে প্রদীপ্ত অগ্নিতে স্থাপন করেন, সেই কপাল-সমূহ। বিমুক্ত করতে সমর্থ ইন্দ্ৰবায়ু পোষক যজমানের যাগরূপ ব্রত সমাপ্ত হলে বিমুক্ত করুন। ফলতঃ, চরুপ্রস্তুতের জন্য অগ্নিতে কপাল বা মালসা স্থাপনই যেন মন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য।–কর্মকাণ্ডের বিচার যাই থাক, আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি,–একই মন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন কার্যে প্রযুক্ত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মন্ত্রের একটি সর্বজনীন অর্থ আছে নিশ্চয়ই স্বীকার্য। আমরা জানি,–তদ্বিষ্ণো পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীর চক্ষুরাততং-ঋগ্বেদের এই মন্ত্রটি শাক্তের, শৈবের, বৈষ্ণবের–সকল সম্প্রদায়ের সকল রকম ইষ্ট-ক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। অথচ, বেদমন্ত্র বলে, ঐ মন্ত্রে কেউ কোনও সাম্প্রদায়িক ভাব আগমন করেন না। বেদের সকল মন্ত্রেই আমরা সেই সাম্প্রদায়িকতা-বিহীন ভাব প্রত্যক্ষ করি। তাতে একই মন্ত্র বিভিন্ন কার্যে প্রযুক্ত হওয়ার সার্থকতা প্রতিপন্ন হয়। সে দৃষ্টিতে দেখলে, সপ্তম অনুবাকের এই মন্ত্রগুলির যেমন অর্থ সঙ্গত হয়, আমাদের মর্মার্থে আমরা তা বিবৃত করেছি।–যেমন, আমাদের বিশ্লেষণের একটি উদাহরণ–পঞ্চম মন্ত্রে ভৃগুণাং এবং অঙ্গিরসাং শব্দ দুটিতে আমরা যে অর্থ গ্রহণ করেছি,আপাতঃদৃষ্টিতে তা সাধারণের পক্ষে বিসদৃশ বলে বোধ হবে। কিন্তু মন্ত্রার্থের পূর্বাপর সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হলে, ঐ পদ দুটিতে কখনই ঋষি বিশেষের প্রতি লক্ষ্য আছে বলে মনে হয় না। ধাতুর অর্থ ও শব্দের অর্থ অনুসরণে ভৃগু শব্দে অতি-উচ্চ এবং অঙ্গিরস শব্দে জ্ঞান অর্থ পরিগৃহীত হতে পারে। সেই অর্থই এখানে সুসঙ্গত। তপ্যধ্বং (ভগবন্তং আরাধয়ত) ক্রিয়াপদের সার্থকতা তাতেই প্রতিপন্ন হয়। অপিচ, ভৃগু ও অঙ্গিরা ঋষিদ্বয় ক্রান্তদর্শী হলেও তারা মানুষ। মনুষ্য-সম্বন্ধ প্রখ্যাপিত হলে বেদমন্ত্রের অপৌরুষেয়ত্বেও বিঘ্ন ঘটে; নিত্যত্বও সিদ্ধ হয় না। আমরা যে অর্থ নিষ্পন্ন করলাম, তাতে বেদমন্ত্রে নিত্যত্ব ও অপৌরুষেয়ত্ব অক্ষুণ্ণ রয়েছে ] । ৭।

.

অষ্টম অনুবাক

মন্ত্র- সং বপামি। সমাপো অদ্ভিগ্মত সমোষধয়োরসেন সং রেবতীর্জগতীভি-স্মধুমতীৰ্মধুমতীভিঃ সৃজধ্বম্। অভ্যঃ পরি প্রজাতাঃ স্থ সমদ্ভিঃ পৃচ্যধ্বম্। জনয়ত্যৈ ত্বা সং যৌমি। অগ্নয়ে ত্বাহগ্নীষোমাভ্যাম্। মখস্য শিয়োহসি। ঘম্মোহসি বিশ্বায়ুঃ। উরুপ্রথম্বোরু তে যজ্ঞপতিঃ প্রথম। ত্বং গৃহ্নী। অন্তরিতং রক্ষোহন্তরিতা অরাতয়ো। দেবস্তা সবিতা শ্ৰপয়তু বর্ষিষ্ঠে অধি নাকেইগ্নিস্তে তনুবং মাহতি ধা। অগ্নে হব্যং রক্ষস্ব। সং ব্ৰহ্মণা পৃচ্যস্ব। একতায় স্বাহা দ্বিতায় স্বাহা ত্রিতায় স্বাহা ॥৮

মর্মার্থ- হে আমার শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ! তোমাকে সম্যরূপে ভগবকার্যে নিয়োজিত করছি। (মন্ত্রটি উদ্বোধনমূলক। এখানে আত্মাকে পরমাত্মায় সংন্যস্ত করবার সঙ্কল্প বর্তমান)। আমাদের আপস্বরূপ শুদ্ধসত্ত্বভাব, সত্ত্বসমুদ্রের সাথে সম্যকমে সম্মিলিত হোক। অপিচ, আপস্বরূপ আমাদের সেই স্নেহসত্ত্বভাব, আমাদের এই ওষধীস্বরূপ কর্মফলের অবসানে ক্ষয়সূচক ওষধীর মতো জীবনসমূহকেও স্নেহরসময় ভগবানের সাথে অচ্ছেদ্যভাবে সম্মিলিত করুক। আমাদের শুদ্ধসত্ত্ববভাবসমূহ বিশ্ববাসী সকলের সাথে সম্মিলিত হোক; এবং আমাদের মাধুর্যভাবসমূহ মাধুর্যময় ভগবৎ-বিভূতির সাথে সম্মিলিত হোক। হে আমার শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ! তোমরা সম্যক্রমে সত্ত্বসমুদ্র হতে উদ্ভূত হয়েছ। অতএব তোমরা সেই সত্ত্বসমুদ্র ভগবানে সম্যরকমে সম্মিলিত অর্থাৎ বিলীন হও। হে মন্! সৎ-ভাব সংজননের জন্য তোমাকে ভগবানের সাথে সম্মিলিত করি অথবা ভগবানের কর্মে বিনিযুক্ত করি। হে মন! প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত অপিচ, জ্ঞানভক্তিরূপী দেবতাদ্বয়ের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে সুসংস্কৃত ও সৎপথের অনুবর্তী করছি। হে মন! তুমি সৎকর্মের শ্রেষ্ঠ সম্পাদক হও। (ভাব এই যে,-মনই মূল। মন ভিন্ন কোনও কার্যই সুসম্পাদিত হয় না। হে ভগবন্! আপনি প্রকাশরূপ বিশ্বপ্রাণ হন। (ভাব এই যে-ভগবানই বিশ্বের সকলকেই প্রকাশ করেন এবং তাদের প্রাণস্বরূপ হন)। হে ভগবন্! আপনি বহু রকমে প্রখ্যাত আছেন। আবার বহু ভাবে প্রখ্যাত হোন। (পাপিগণের পরিত্রাণের জন্যই ভগবান সবচেয়ে বেশী প্রখ্যাত। আমাদের মতো পাপীর পরিত্রাণ-সাধনে তার মাহাত্ম্য বহুবিস্তীর্ণ হোক)। হে ভগবন্! আপনার অর্চনাকারী বহুরকম সৎকর্মের দ্বারা বিশেষভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করুক। হে ভগবন্! আমার অজ্ঞানরূপ আবরণ–অহংকার অথবা আমার বহিরাবরণ-স্বরূপ এই পাষ্ণভৌতিক দেহকে গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে,-হে ভগবন! আমার অন্তরস্থ জ্ঞানের আবরণকারী অজ্ঞানকে জ্ঞানের আলোক প্রদান করে সর্বতোভাবে বিদূরিত করুন)। তাতে আমাদের দুর্বুদ্ধিরূপ শত্রু বিনষ্ট হোক; সৎ-ভাবের প্রতিবন্ধক রিপুশত্রুগণ বিদুরিত অর্থাৎ বিনষ্ট হোক। হে ভগবন্! আমার অন্তরস্থ দ্যোতমান্ জ্ঞানসূর্য (কর্মের দ্বারা সমুন্নত) আমার হৃদয়রূপ স্বর্গে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করুক। অপিচ, হে আমার হৃদয়স্থিত জ্ঞানাগ্নি! আপনার সম্বন্ধি আবরণকে অতিক্রম করে যেন আপনি গমন না করেন। (ভাবার্থ-ভগবৎসম্বন্ধি জ্ঞান যেন বিনাশপ্রাপ্ত না হয়)। অথবা, সংসার-সন্তাপরূপ অগ্নি যেন তোমাকে নিঃশেষে দগ্ধীভূত না করে (অঙ্গারে পরিণত না করে)। অথবা,হে মন! নির্মল জ্ঞানস্বরূপ সেই ভগবান তোমাকে চিরস্থায়ী চিরশান্তিময় স্থানে (স্থাপন করে) সৰ্বৰ্থা তোমার উন্নতিসাধন করুন। অপিচ, সংসার-সন্তাপরূপ অগ্নি যেন তোমাকে নিঃশেষে দগ্ধ করে অঙ্গারে পরিণত না করে। হে জ্যোতির্ময় প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবন্! আপনি আমার সেই হবিঃ অর্থাৎ হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ আহবনীয়কে সংরক্ষণ করুন (অর্থাৎ ইহলোক-পরলোক সম্বন্ধি শত্রুদের অপসারিত করে চিরতরে সুপ্রতিষ্ঠিত করুন)। (মন্ত্রের তাৎপর্য এই যে,-হে ভগবন্! আপনি বিশ্বরূপ জেনে আমার সমস্ত অনুরাগ ও সৎ-ভাব আপনাতে সংন্যস্ত করছি। আমার সেই অনুরাগ সারা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হোক, আপনি আমার সৎ-ভাব সংরক্ষণ করুন। হে শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ! তুমি ভগবানের সাথে সম্মিলিত হও। (আত্মা পরমাত্মায় প্রবেশ করুক–এখানে এই ভাব পরিব্যক্ত)। অথবা, হে জ্ঞানভক্তিরূপ হবিঃ! তোমরা আমার অনুষ্ঠিত কর্মের সাথে মিলিত হও। (আমার কর্ম জ্ঞানভক্তি সমন্বিত হোক)। হে মন! তোমাকে অদ্বিতীয় ব্রহ্মের উদ্দেশ্যে স্বাহা-মন্ত্রে নিয়োজিত করছি! আমার আত্মদানরূপ যজ্ঞ সুহুত বা সুসিদ্ধ হোক। (ভাবার্থ-মন যেন অদ্বিতীয় ব্রহ্মের জ্ঞানলাভে সমর্থ হয়)। হে মন! তোমাকে সেই প্রকৃতিপুরুষরূপে অথবা জ্ঞানক্রিয়ারূপে প্রকাশমান দেবতার উদ্দেশ্যে স্বাহামন্ত্রের উচ্চারণে প্রেরণ করছি। আমার আত্ম-উৎসর্গরূপ শুভ অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হোক! (যিনি পুরুষ ও প্রকৃতি–এই দুভাগে নিজেকে বিভক্ত করে জগতে আত্মপ্রকাশ করে আছেন, হে মন! তুমি সেই পরমাত্মার সন্ধানে নিযুক্ত হও)। হে মন! সত্ত্বরজস্তমোগুণাত্মক ত্রিদেবরূপে প্রকাশমান সেই ভগবানের উদ্দেশ্যে স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে নিবেদন করছি। আমার উদ্বোধনযজ্ঞ সুহুত বা সুসিদ্ধ হোক ॥ ৮

[এই অনুবাকের মন্ত্রগুলি পুরোডাশ-নিম্পাদক। সপ্তমে প্রজ্বলিত অঙ্গারের উপরে কপাল-স্থাপনের বিষয় কথিত হয়েছে; এখানে সেই উত্তপ্ত কপালে পুরোডাশ পণের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি নিবদ্ধ আছে। ক্রিয়া-কর্মে পূর্বের মতো প্রয়োগ অনুসারে ভাষ্যকার প্রথম মন্ত্রের অর্থ করেছেন–হে পিষ্ট! তোমাকে এই পাত্রে নিক্ষেপ করছি। দ্বিতীয় মন্ত্রে পিষ্ট-সমূহে (চালের গুঁড়াতে) প্রণীত উপসর্জনী (শিল বা যাঁতা ধোয়া জল) নিক্ষেপ করার বিধি। সেই অনুসারে মন্ত্রের অর্থ হয়,–এই প্রণীত জল-ভাগ পিষ্টের (পিঠার) জলীয় ভাগের সাথে মিলিত হোক; ওষধিভাগ পিষ্টের ওষধিভাগের সাথে মিলিত হোক, বেরতীভাগ, পিষ্টের জগতী-ভাগের সাথে মিলে যাক; মাধুর্যভাগ পিষ্টের মাধুর্য-ভাগের সাথে মিলিত হোক। ভাব এই যে, চালের গুড়া ও জল এক হয়ে যাক।–এইভাবে কর্মকাণ্ডের অনুসারে সমগ্র সপ্তম অনুবাকের মন্ত্রগুলি যথাযথ বিশ্লেষিত। আমাদের মতে প্রথম মন্ত্রে হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বভাবকে হবিঃস্বরূপে গ্রহণ করে ভগবানের উদ্দেশ্যে অর্পণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রের সাথে এই মন্ত্রের বেশ একটু সম্বন্ধ আছে বলে মনে বুঝতে পারি। ফলতঃ, এই মন্ত্রে এক বিরাট সম্মিলনের ভাব বিদ্যমান রয়েছে। শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানেরই বিভূতি তৃতীয় মন্ত্রে তা-ও প্রখ্যাপিত হয়েছে। চতুর্থ থেকে একাদশ পর্যন্ত মন্ত্রগুলি যে সব ক্রিয়া-কর্মে প্রযুক্ত হয়ে থাকে, তার আভাষ অনুমেয়। আমাদের মতে মন্ত্রের কোথাও পিষ্টের বা পুরোডাশের সম্বন্ধ নেই। মন্ত্রগুলির লক্ষ্য অন্যরকম। আধ্যাত্মিক বিচারে আমরা তা দেখিয়েছি। দ্বাদশ মন্ত্রের ব্যাখ্যা চতুর্থ অনুবাকের মর্মাথে পাওয়া যাবে। ত্রয়োদশ মন্ত্রেও এক বিরাট সম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। এই মন্ত্রে দুরকম অম্বয়ে সেই একই ভাব প্রকাশ পেয়েছে। চতুর্দশ মন্ত্রে একতায়, দ্বিতায় ও ত্রিতায় পদ তিনটিতে উচ্চ উচ্চ স্তরে অগ্রসর হওয়ার অবস্থাই প্রকাশ করছে। অতি উচ্চস্তরে সাধক বুঝলেন,-একতায় ত্বা। সে অবস্থায় সবই এক হয়ে,এল। তখন সেই অদ্বিতীয় ব্রহ্মের প্রতি সাধকের দৃষ্টি পড়ল। সাধক বললেন,–মন! কেন দ্বিধা ভাব পোষণ করো?একতায়–সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের প্রতি বিনিযুক্ত হও। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে, আর কোনও দ্বিধা ভাবই তোমার মধ্যে থাকতে পারবে না। তখন একমেবাদ্বিতীয়ং এই বাক্য সিদ্ধিলাভ করলো। সাধক তখন সর্বং খশ্বিদং ব্রহ্ম ভাবে বিভোর হয়ে পড়লেন। কিন্তু একটু নিম্নস্তরের সাধক যিনি, ভগবানের অদ্বিতীয়ত্ব ধারণা করতে যিনি সমর্থ হলেন না, দ্বিত অর্থাল প্রকৃতি পুরুষরূপে অথবা ক্রিয়া জ্ঞানরূপে তিনি বিদ্যমান বলে তার লক্ষ্য পড়ল। তখন তিনি বললেন, প্রকৃতি ও পুরুষ দুই ভাবে বর্তমান সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের দুই ভাবের প্রতি মন তুমি বিনিবিষ্ট হও। আরও নিম্নস্তরের সাধক যিনি, যিনি ভগবানকে এক বা দুই ভাবে বুঝতে তার কাছে তিনি ত্রিত-রূপে প্রতিভাত হলেন। তিনি বুঝলেন, ভগবান সত্ত্বরজস্তমোময়। তিনি ত্রিমূর্তিতে ত্রিলোক ব্যেপে বর্তমান। সেই অবস্থায় মনকে সম্বোধন করে বলাই স্বাভাবিক,–মন! তোমায় সেই ত্রিতায় অর্থাৎ তিন স্বরূপ নিযুক্ত করছি। একেই তিন আবার তিনেই এক। জলের মধ্যে অগ্নির লুক্কায়িত হওয়ার পৌরাণিক আখ্যানে (যা ভাষ্যকার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন), অজ্ঞানে জ্ঞান আবৃত হওয়ার এবং জ্ঞানের উন্মেষে ত্রিত, দ্বিত ও একত ভাবের বিকাশ, রূপকে বিবৃত হয়েছে বলে মনে করি। এই মন্ত্রের একতায় পদে অদ্বৈতবাদ, দ্বিতায় পদে দ্বৈতবাদ এবং ত্রিতায় পদে বহুবাদ প্রসঙ্গও মনে আসতে পারে। ত্রিতায় অর্থাৎ ত্রিগুণাতমক ঈশ্বর প্রসঙ্গে বলা যায়–রজোরূপে তিনি ব্রহ্মা, সত্ত্বরূপে তিনি বিষ্ণু, তমারূপে তিনি মহেশ্বর]। ৮

.

নবম অনুবাক

মন্ত্র- আ দদ।। ইন্দ্রস্য বাহুরসি দক্ষিণঃ সহস্রভৃষ্টিঃ শততেজা বায়ুরসি তিম্মতেজাঃ। পৃথিবী দেবযজনন্যাদ্যান্তে মূলং মা হিংসিষম্। অপহতোহররুঃ পৃথিব্যৈ। ব্ৰজং গচ্ছ গোস্থান। বৰ্ষতু তে দৌঃ। বধান দেব সবিতঃ পরমস্যাং পরাবতি শতেন। পাশৈর্যোহম্মান্দেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিম্মস্তমতো মা মৌ। অপহতোহররুঃ পৃথিব্যৈ দেব্যজন্যৈ ব্ৰজং গচ্ছ গোস্থানং বৰ্ষতু তে দ্যোৰ্বধান দেব সবিতঃ পরমস্যাং পরাবতি শতেন পাশৈযৰ্যাহম্মান্দেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিম্মশুমতো মা মৌগপহতোহররুঃ পৃথিব্যা অদেবযজনো ব্ৰজং গচ্ছ গোস্থানং বৰ্ষতু তে দৌধান দেব সবিতঃ পরমস্যাং পরাবতি শতেন পাশৈর্মোহম্মাদৃষ্টি যং চ বয়ম্ দ্বিম্মস্তমতো মা মৌ। অররুস্তে দিবং মা স্কা। বসবস্তাবা পরি গন্তু গায়ত্রণ ছন্দসা রুদ্রাত্ত্বা পরি গৃহ্নন্তু ত্ৰৈভেন ছন্দসাহদিত্যাস্তা পরি গৃহ্নন্তু জাগতেন ছন্দ। দেবস্য সবিতুঃ সবে কৰ্ম্ম কৃম্বস্তি বেধসঃ। ঋতমস্তসদন-মস্যশ্রীরসি।। ধা অসি স্বধা অৰ্ব্বী চাসি স্বী চাসি। পুরা নূরস্য বিসৃপো বিপশিমুদাদায় পৃথিবীং জীরদানুর্যামৈ রয়ঞ্চমসি স্বধাভিস্তাং ধীরাসো অনুদৃশ্য যজন্তে ॥ ৯৷৷

মর্মার্থ- হে আমার কর্মফল! তোমাকে সম্যকরকমে ভগবানে সমর্পণ করছি অর্থাৎ ভগবানে ন্যস্ত করছি। হে দেবচরণে সমর্পিত কর্মফল! তুমি অনন্ত বলশালী ভগবানের দক্ষিণ-বাহু হও অর্থাৎ ভগবানকে পরমানন্দ দান করে থাকো; তুমি অশেষ পাপ-নাশক, অমিততেজঃসম্পন্ন, দেব-সমীপে ক্ষিপ্রগমনকারী, পাপ-সমূহের দাহক এবং রিপুশত্রুগণের হননকারী হয়ে থাকো। (ভাবার্থ এই যে, -কর্মফল দেবতার উদ্দেশ্যে সমর্পিত হলে অনন্ত-ফলোপধায়ক এবং অশেষ পাপ-নাশক হয়ে থাকে)। অথবা,-হে কর্মফল! তুমি অনন্ত শক্তিশালী ভগবানের শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ বহু-সামর্থ্য-সম্পন্ন বাহু-স্বরূপ পরমানন্দদায়ক হও; অপিচ, তুমি অশেষ পাপনাশক অমিততেজ-সম্পন্ন, বায়ুর ন্যায় ক্ষিপ্রগমনকারী অর্থাৎ ভগবৎ-প্রাপ্তির হেতুভূত হও; অতএব তুমি তীব্রজ্বালাবিশিষ্ট অশেষ সন্তাপজনক রিপু-শত্রুদের হন্তারক হও অর্থাৎ তাদের বিনাশ করো। দেব-সম্বন্ধি কর্মের আধার-স্থানীয় হে আমার স্কুলদেহ! কর্মফলের অবসানে তোমার ক্ষয়ের কারণকে নষ্ট করো না। অর্থাৎ, এই স্থূল-শরীরের যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে–তা-ই করো। দেহের মঙ্গল সাধনের জন্য, দেব-সম্বন্ধি কর্মের আধারভূত হৃদয় হতে শত্রুগণ বিনষ্ট হোক। হে মন! তুমি তোমার কল্যাণাম্পদ প্রব্রজ্যা অবলম্বন করো; অর্থাৎ, সাংসারিক প্রলোভনে বৈরাগ্যযুক্ত হও। হে মন! দুলোকের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা তোমার অভীষ্ট পূরণ করুন অর্থাৎ তুমি দেবতার অনুগ্রহ লাভের উপযুক্ত হও। হে দ্যোতমান্ সবিতৃদেব! যে আমাদের হিংসা করে, অথবা আমরা যার হিংসা কামনা করি, সে সকল শত্রুকে এই পৃথিবীর সীমান্তস্থানে শত-পাপ বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখুন,কখনও তাদের ছেড়ে দেবেন না। (ভাবার্থ এই যে,-কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুবর্গ–আমাদের অন্তরস্থিত অসৎ বৃত্তিগুলি–আমাদের পরম শত্রু; আমাদের নিকট হতে তাদের দুরে রাখুন)। দেবগণের প্রীতিসাধক যাগ ইত্যাদি সৎক্রিয়ার সাধন-সমর্থ আমার হৃদয়-রূপ যজ্ঞ-প্রদেশ হতে আমার অন্তঃশত্রু বিনষ্ট হোক। হে মন! তুমি তোমার কল্যাণাস্পদ প্রব্রজ্যা অবলম্বন করো; অর্থাৎ সাংসারিক প্রলোভন ইত্যাদিতে বৈরাগ্যযুক্ত হও। হে মন! দ্যুলোকের অধিষ্ঠাত্ দেবতা তোমার কল্যাণ-সাধনের জন্য তোমার অভীষ্ট বর্ষণ করুন। হে দ্যোতমান্ সবিতৃদেব! যে আমাদের হিংসা করে, অথবা আমরা যার হিংসা কামনা করি, সে সকল শত্রুকে এই পৃথিবীর সীমান্তস্থানে শতপাশবন্ধনে আবদ্ধ করে রাখুন,–কখনও তাদের ছেড়ে দেবেন না। (ভাবার্থ এই যে,-কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপু-বর্গ আমাদের অসৎ-বৃত্তিগুলি–আমাদের পরম শত্রু; আমাদের নিকট হতে তাদের দূরে রাখুন)। হৃদয়-রূপ যজ্ঞ-প্রদেশ হতে দেবভাবের প্রতিবন্ধক শত্রু বিনষ্ট হোক। তাহলে হে মন! তুমি তোমার কল্যাণাস্পদ প্রবজ্যা অবলম্বন করবে; অর্থাৎ সাংসারিক প্রলোভন ইত্যাদিতে বৈরাগ্যযুক্ত হবে। হে মন! দ্যুলোকের অধিষ্ঠাত্ দেবতা তোমার কল্যাণ সাধনের জন্য তোমার অভীষ্ট বর্ষণ করুন। হে দ্যোতমান্ সবিতৃদেব! যে আমাদের হিংসা করে, অথবা আমরা যার হিংসা কামনা করি, সে সকল শত্রুকে এই পৃথিবীর সীমান্তস্থানে শতপাশ-বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখুন, কখনও তাদের ছেড়ে দেবেন না। (ভাবার্থ এই যে,-কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুবর্গ–আমাদের অসৎ-বৃত্তিগুলি আমাদের পরম শত্রু; আমাদের নিকট হতে তাদের দূরে রাখুন)। হে মন!–অন্তঃশত্রু যেন তোমার হৃদয়-রূপ দেব-স্থানে গমন করতে না পারে অর্থাৎ হৃদয় অধিকার না করে। (ভাব এই যে,-হৃদয় হতে অসৎ-ভাব অপসৃত হয়ে সৎ-ভাব সমুদ্ভুত হোক)। হে আমার চিত্তবৃত্তি! বসুদেবগণ অর্থাৎ জীবগণকে পরমপদে প্রতিষ্ঠাপক দেব-ভাব সমূহ তোমাকে গায়ত্রী-ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের দ্বারা অর্থাৎ পরিত্রাণ-সাধক অভীষ্টপূরক প্রভাবের দ্বারা সর্বতোভাবে ভগবৎ-সম্বন্ধে নিয়োজিত করুন। হে মনোবৃত্তি! রুদ্র-দেবগণ অর্থাৎ শত্ৰু-সংহারে রুদ্রভাব-সম্পন্ন দেবগণ তোমাকে ত্রিষ্টুভ ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের দ্বারা অর্থাৎ শত্রুবিনাশক অভীষ্টপূরক গামর্থ্যের দ্বারা সর্বতোভাবে ভগবৎ-কর্মে নিয়োজিত করুন। হে মনোবৃত্তি! আদিত্যগণ অর্থাৎ পাপ-নাশক প্রজ্ঞানদায়ক দেবভাব-সমূহ তোমাকে জাগতী-ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের দ্বারা অর্থাৎ অজ্ঞান-অন্ধকার- নাশক অভীষ্টপূরক প্রভাবের দ্বারা তোমাকে সর্বতোভাবে ভগবৎ-কর্মে নিয়োজিত করুন। দ্যোতমান্ প্রকাশনারূপ জ্ঞান-প্রেরক ভগবানের প্রেরণায় আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন জন ভগবানের প্রীতিকর যাগ ইত্যাদি সৎকর্ম (আপন আপন অভীষ্টপূরণের জন্য) সম্পাদন করেন। হে আমার অন্তর! তুমি সৎকর্মময় অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব স্বরূপ কর্মফল হও। অথবা, হে অন্তর! তুমি সৎকর্মের আধারভূত অর্থাৎ কর্মফল-সাধক হও। হে আমার অন্তর! তুমি সঙ্কর্মের আধার-স্বরূপ অর্থাৎ সঙ্কৰ্ম সাধনের নিমিত্ত সত্যের আশ্রয়ভূত হও। হে আমার অন্তর! তুমি শুদ্ধসত্ত্বরূপ কর্মফলের মাধুর্য সম্পাদন করে থাকো। (মন্ত্রের এই তিনটি অংশই প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,হৃদয়-নিহিত সৎ-বৃত্তিগুলির সাথে ভগবানের অবিচলিতভাবে অবস্থিতি হোক)। হে মনোবৃত্তি! তুমি দেবভাব-সমূহের ধারক হও। অথবা হে ভগবান্! তুমি বিশ্বের সকলের ধারক হও। হে মনোবৃত্তি! তুমি অহং-জ্ঞান-নাশক ভব-বন্ধন ছেদক হও। অথবা, হে ভগবন্! আপনি অহং-জ্ঞানের নাশক ভব-বন্ধনের ছেদক পূর্ণজ্ঞানের স্বরূপ হন। হে মনোবৃত্তি! তুমি বহুধারক হও। অথবা, হে ভগবন্! আপনি বিরাট বিশ্ব-রূপ হন। হে মনোবৃত্তি! তুমি বহু ধনবতী পরমধনদাত্রী হও। অথবা হে ভগবন্! আপনি সকলের নিবাস-হেতু ভূত-জগতের ধারণকর্তা হন। হে ভগবন! হিংসক সপ্রতিবন্ধক ইতস্ততঃ বিসর্পণ-শীল মহাপরাক্রান্ত শত্রুর উপদ্রব হতে আপনি যে পৃথিবীকে অর্থাৎ হৃদয়-রূপ আধারক্ষেত্রকে নিত্যকাল রক্ষা করে স্নিগ্ধসত্ত্ব-ভাব-সমম্বিত জ্ঞান-কিরণের দ্বারা উদ্ভাসিত করেন, আত্ম-উৎকর্ষ সাধনশীল জন সেই হৃদয়রূপ বেদিকে মনের দ্বারা অনুকম্পিত করে সৎ-জ্ঞান-সমম্বিত শুদ্ধসত্ত্ব সহকারে আপনার উদ্দেশ্যে (আপনার প্রীতিকর কর্মে নিয়োজিত করে থাকেন। অথবা, শব্দব্রহ্মরূপ হে পরমেশ্বর! আপনি (এই) হিংস্র রিপুশত্রুর সংগ্রামে জীবের প্রাণ-স্বরূপ শুদ্ধসত্ত্বকে পার্থিব পদার্থ-সম্বন্ধ হতে (পাপের সংগ্রহ থেকে) উর্ধ্বে গ্রহণ-পূর্বক মূধ্বনদেশে জ্ঞানের আধারে রক্ষা করে আমাদের নিত্যকাল অনুগৃহীত করুন। দেবগণ (দেবভাব-সমূহ) বেদজ্ঞানসহ যে শুদ্ধসত্ত্ব ভাবকে চন্দ্রলোকে (স্নিগ্ধ আলোকময় মূৰ্ধিন-প্রদেশে) সংরক্ষিত করেন; সারভূত সেই সামগ্রীকে পাবার কামনায় মেধাবিগণ সর্বদা আপনার আরাধনা করে থাকেন। (আমরাও যেন সেই সঙ্কল্পে আপনার আরাধনায় সমর্থ হই) ॥ ৯৷৷

 [কর্মকাণ্ড অনুসারে নবম অনুবাকের মন্ত্রগুলি যজ্ঞের জন্য বেদী নির্মাণে প্রযুক্ত হয়। বিনিয়োগ ও ভাষ্য অনুসারে, বোঝা যায়, মৃত্তিকা খননের জন্য স্ফা নামক মৃত্তিকা খননের উপযোগী যন্ত্র-বিশেষকে সম্বোধন করে প্রথম দুটি মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে। তাতে মন্ত্রের অর্থ দাঁড়ায়-হে স্যা! অশ্বিদ্বয়ের বাহুদ্বয়ের এবং পূদেবতার হস্তদ্বয়ের সাহায্যে দেবপূজার জন্য তোমাকে যজ্ঞে নিযুক্ত করছি। এই মন্ত্রের পর ঐ স্ফাকে–বাম হস্ত থেকে দক্ষিণ হস্তে গ্রহণ করে দ্বিতীয় মন্ত্রে বলা হয়–হে স্ফা! তুমি ইন্দ্রদেবের দক্ষিণ বাহু, তুমি বহুদীপ্তিশালী, বহু জীবের নাশক, উগ্রতেজের জন্য তুমি বহুদীপ্তিশালী, বহু জীবের নাশক, উগ্রতেজের জন্য তুমি বায়ুর সাথে তুলনীয়। এই যজ্ঞের বেদিপ্রস্তুতরূপ কার্য তোমার দ্বারা সম্পন্ন হোক। এরপর তৃতীয় থেকে সপ্তম পর্যন্ত মন্ত্রে বিভিন্ন সামগ্রীর সম্বোধন বর্তমান রয়েছে। যেমন তৃতীয় মন্ত্রে পৃথিবী; পঞ্চম মন্ত্রের সম্বোধ্য–তৃণসমূহ (মাটি কেটে যেগুলিকে পরিষ্কার করা হয়); ষষ্ঠ মন্ত্রে–বেদি; সপ্তম মন্ত্রের সম্বোধন সবিতা দেবতা)। অষ্টম মন্ত্রের বিভিন্ন অংশে মৃত্তিকাখননের এবং বেদি প্রস্তুত করবার প্রক্রিয়াপদ্ধতি পরিবর্ণিত। নবম মন্ত্র পাংসুসমূহরূপ উৎকরকে (খামারকে) সম্বোধন করে বিনিযুক্ত হয়েছে। দশম মন্ত্রের বিভিন্ন অংশ উচ্চারণ করে আহবনীয় এবং গার্যপত্যের মধ্যস্থলে ম্যায়ের দ্বারা এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তিন দিকে তিনটি রেখা অঙ্কিত করতে হয়। এই রেখাগুলি বেদির পরিগ্রাহ। সেই রেখাঙ্কিত দিকগুলিতে অধ্বর্য মনে মনে যথাক্রমে বসু, রুদ্র এবং আদিত্য দেবতাসমূহের অনুধ্যান করতে করতে মন্ত্র উচ্চারণ করবেন; ইত্যাদি। একাদশ মন্ত্রে বেদি খনন। দ্বাদশ মন্ত্র বেদি-সম্বোধন-মূলক। মন্ত্রের সাথে একটি পৌরাণিক উপাখ্যানেরও সংশ্রব-সুচনা দেখা যায়। সেটি এই–পূর্বে দেবাসুর-সংগ্রামের কালে দেবগণ ভীত হয়ে পৃথিবীর সারবস্তুকে এবং বেদকে চন্দ্রলোকে লুকিয়ে রাখনে। যুদ্ধে পরাজয় হলে ঐ অমূল্য সামগ্রী অসুরেরা অধিকার করে নেবে,এটাই তাঁদের আশঙ্কা ছিল; তখন ঐ দুই সুরক্ষিত সামগ্রীর সাহায্যে দেবতারা পুনরায় বলশালী হতে পারবেন,এটাই উদ্দেশ্য ছিল। তাই বেদি মার্জনা করবার সময় এই মন্ত্র উচ্চারিত হওয়ায়, কর্মকাণ্ডানুসারে মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের অর্থ দাঁড়িয়েছে,-ক্রুর অসুরদের যুদ্ধের সময় পূর্বকালে পৃথিবীর যে সারভাগ পরিগ্রহণ করে বেদের সাথে উধ্বদেশে চন্দ্রলোকে রক্ষিত হয়েছিল, হে যজ্ঞবেদি! তুমিই সেই সামগ্রী। সেই অনুসারে তোমাকেই লক্ষ্য করে মেধাবিগণ যজনা করছেন। এই দ্বাদশ মন্ত্রের মতো এই অনুবাকের আরও কয়েকটি মন্ত্র সম্বন্ধে উপাখ্যানের অবতারণা দেখতে পাওয়া যায়। সেইসব উপাখ্যানে ক্রিয়া-কর্মে মন্ত্রগুলি কিরকম পল্লবিত হয়েছে, তা বোধগম্য হয়।-আমরা কর্ম-পদ্ধতি বিষয়ে বিতর্কের কোনই প্রয়োজন দেখি না। আমাদের অভিপ্রায় এবং মন্ত্রের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আমাদের মর্মার্থেই পাওয়া যাবে। আমরা কোন কোন মন্ত্রের দ্বিতীয় অন্বয় অনুসারেও যে মর্মার্থ লিপিবদ্ধ করেছি, তা-ও লক্ষণীয় ] ॥ ৯।

.

দশম অনুবাক

মন্ত্র- প্রত্যুষ্টং রক্ষঃ প্রত্যুষ্টা অরাতয়োহগেৰ্বত্তেজিষ্ঠেন তেজসা নিষ্টপামি। গোষ্ঠং মা নির্মক্ষং বাজিনং ত্বা সপত্নসাহং মার্জি বাচং প্রাণং চক্ষুঃ শ্রোত্রং। প্রজাং যোনিং মা নিক্ষম বাজিনীং ত্বা সপত্নসাহাং সং মার্জি। আশাসানা সৌমনসং প্রজাং সৌভাগ্যং তনুম। অগ্নেরনুব্রতা ভূত্বা সং নহ্যে সুকৃতায় কম। সুপ্রজসত্ত্বা বয়ং সুপত্নীরূপা সেদিম। অগ্নে সপত্নদভমদাসো অদাভ্য। ইমং বি য্যামি বরুণস্য পাশং যমবঙ্গীত সবিতা সুকেতঃ। ধাতু যোনৌ সুকৃতস্য লোকে স্যোনং মে সহ পত্যা করোমি। সমায়ুষা সৎ প্রজয়া সময়ে বলা পুনঃ। সৎ পত্নী পত্যাহহম গছে সমায়া তনু মম। মহীনাং পয়োহস্যোষধীনাং রসস্য তেইকীয়মাণস্য নিঃ বপামি। মহীনাং পয়োহস্যোধীনাং রসোহদনে ত্বা চক্ষুযাইবেক্ষে সুপ্রজাস্কায়। তেজোহসি তেজোহনু প্ৰেহ্যগ্নিতে তেজো মা বি নৈৎ। অগ্নেজ্জিহ্বাহসি সুভুৰ্দেবানাং পায়ে পায়ে দেবেভ্যো যজুষে যজুষে ভব। শুক্রমসি জ্যোতিরসি তেজোহসি। দেবো বঃ সবিতোৎপুনাত্বচ্ছিদ্রেণ পবিত্ৰেণ বসোঃ সূর্যস্য রশ্মিভিঃ। শুক্রং ভ্রা শুক্রায়াং ধামে ধামে দেবেভ্যো যজুষে যজুষে গৃহমি। জ্যোতিসত্বা জ্যোতিষ্যর্জি ব্যাহৰ্চিষি ধামে ধামে দেবেভ্যো যজুষে যজুষে গৃহ্নামি। ১০।

মর্মার্থ- হে ভগব। সৎপ্রতিবন্ধক শত্রু (আমাদের দুর্বুদ্ধি) সর্বতোভাবে ভস্মীভূত হোক, আমাদের রিপুশত্রুগণ প্রত্যেকে বিশিষ্টরূপে দগ্ধ হোক। (অর্থাৎ,-হে দেব! আপনি আমাদের দুবুদ্ধিকে এবং রিপুশত্ৰু-সমূহকে সমূলে বিনষ্ট করুন)। জ্ঞানের দ্বারা উদ্ভাসিত হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমাদের অতি-উগ্ৰ অভীষ্টপূরক (ভগবৎ-প্রাপক) জ্ঞানজ্যোতিঃ অর্থাৎ কর্মশক্তির দ্বারা পুনরায় উদ্দীপিত করছি। হে মন! আমার সত্ত্বভাব যাতে বিনষ্ট না হয়, সেই ভাবে সঙ্কর্মের সাধনে সমর্থ তোমাকে সম্যকমে উদ্বোধিত করছি। হে আমার চিত্তবৃত্তি! আমার সত্যানুরাগ, সকর্মশীল জীবন, সৎ-বস্তুদর্শনের সামর্থ্য (জ্ঞানদৃষ্টি, দূরদৃষ্টি), ভগবৎ-মহিমা শ্রবণের সামর্থ্য, লোকানুরাগ (বিশ্বপ্রীতি), সৎ-বৃত্তিমূল (শুদ্ধসত্ত্ব) যাতে নিঃশেষে বিনষ্ট হয়, সেই ভাবে সৎকর্ম-সাধন-সমর্থের শত্রুনাশকারী তোমাকে উদ্বোধিত (উদ্দীপিত) করি। (ভাব এই যে, আমি যেন ভগবৎ-পরায়ণ হই। হে আমার চিত্তবৃত্তি! তুমি ভগবৎ প্রীতি, লোকানুরাগ এবং মোক্ষরূপ পরমেশ্বর্য ও কর্মফলার মানে কর্মক্ষয় কামনা করছ। এতএব জ্ঞানজ্যোতির অনুবর্তিনী হয়ে (অর্থাৎ পরাজ্ঞান লাভ করে) যাতে তুমি পরমানন্দ লাভ করতে পারো, সেইরকম ভাবে তোমাকে ভাব্যপ্রীতিহেতুভূত কর্মে সম্যভাবে নিয়োজিত করছি। অথবা, আমার যে চিত্তবৃত্তি জ্ঞানানুসারিণী হয়ে, ভগবৎপ্রীতি, লোকানুরাগ, মোক্ষরূপ পরমৈশ্বর্য, সৎকর্মশীল জীবন অথবা কর্মফলের অবসান কামনা করে; আমার সেই চিত্তবৃত্তি ভগবপ্রীতিহেতুভূত কর্মে যাতে নিত্যানন্দ প্রাপ্ত হয়, সেইভাবে তাকে সম্যভাবে বিনিযুক্ত করি। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! লোকানুরাগসম্পন্ন অর্থাৎ বিশ্বমঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ, সৎ-বুদ্ধি সমন্বিত, শত্রুর উপদ্রবরহিত, সৎকর্মশীল ব্যক্তি (আমরা) সর্বশত্রুবিনাশক অপরাজেয় আপনাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। মন্ত্রের মধ্যে সৎ-বুদ্ধি লাভের এবং লোকানুরাগ বর্ধনের নিমিত্ত সঙ্কল্প রয়েছে)। আমাদের কর্মের দ্বারা সঞ্জাত অর্থাৎ কামনা ইত্যাদি জনিত যে সংসার-বন্ধন আমরা দৃঢ় করেছি; শোভনপ্রজ্ঞ (প্রজ্ঞানাধার) জ্ঞানদাতা ভগবানের অনুগ্রহে সেই সংসার-বন্ধন যেন বিমুক্ত করতে সমর্থ হই। তাতে, সঙ্কর্মের ফলভূত পরমপদে অধিষ্ঠিত হয়ে, হৃদয়রূপ ভগবৎ অধিষ্ঠানে সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা পরিবৃত হয়ে, যেন পরমসুখ–পরমানন্দ লাভ করতে পারি। (এই মন্ত্রের প্রথমপাদে সঙ্কল্প এবং দ্বিতীয় পদে আত্ম-উদ্বোধনা বিদ্যমান রয়েছে। পরাজ্ঞানই বন্ধন-ছেদন। হৃদয় যদি জ্ঞানের দ্বারা উদ্ভাসিত হয়! বন্ধন-হেতুভূত কর্মমূল স্বতঃই বিনষ্ট হয়, আর তখনই ভগবানের অনুগ্রহ-লাভ সুগম হয়ে আসে। অতএব সঙ্কল্প–আমি যেন ভগবানের অনুসারী হই। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আমি যেন সকর্মান্বিত জীবন প্রাপ্ত হই। (অর্থাৎ আপনার অর্চনার দ্বারা যেন সকর্মশীল জীবন লাভ করি। ভাবার্থ-আমি যেন সদা সৎকর্মে রত থাকি)। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে যেন আমার জনহিতসাধনে লোকানুরাগ জন্মে। (অর্থাৎ ভগবৎ-আরাধনায় যেন জনহিতসাধন-সামর্থ্য লাভ করি অর্থাৎ পরোপকারই যেন জীবনের ব্রত হয়)। জ্ঞানদাতা হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আমি যেন জ্ঞানঃ-জ্যোতিসমন্বিত হয়ে, আপনাকে সম্যকমে আরাধনা করতে সমর্থ হই। (ভাব এই যে, আমি যেন ভগবৎপূজন-সামর্থ্য প্রাপ্ত হই)। প্রার্থনাকারী আমি, পত্নীর ন্যায় অনুগত হয়ে জগৎপতি ভগবানের সাথে যাতে অবস্থিতি করতে পারি, তা-ই যেন করতে সমর্থ হই। অপিচ, কখনও যেন বিয়োগ-সাধন না হয়। (পতিব্রতা রমণী যেমন ছায়ার মতো স্বামীর অনুগামিনী হয়, আমিও যেন তেমনই ভগবানের একান্ত অনুরাগী হই–মন্ত্রের এটাই ভাবার্থ)। আমার জীবাত্মা পরমাত্মায় গমন করুক। (এখানে আত্মায় আত্মসম্মিলনের সঙ্কল্প বর্তমান)। হে মন! তুমি বিশ্বের লোকসমূহের অমৃতস্বরূপ পরিরক্ষক অর্থাৎ জীবন-কারণ হও। হে মন! তুমি কর্মক্ষয়ের সুচক জীবনের অমৃতস্বরূপ (বা পরিরক্ষক) হও! হে মন! তথাবিধ ক্ষয়রহিত অর্থাৎ অক্ষয় অব্যয় তোমাকে ভগবৎ-কর্মে বিনিযুক্ত করছি। হে মন! তুমি বিশ্বের লোকসমূহের অমৃতস্বরূপ হও। (ভাব মা এই যে, আমাদের মন সবরকম সৎকর্মের সাধক হোক। সঙ্কল্পের এটাই তাৎপর্য)। অপিচ, হে মন বা কর্ম! তুমি কর্মক্ষয়ের দ্বারা ক্ষয়সূচক জীবনের অমৃত-স্বরূপ পরিরক্ষক হও। অতএব হে মন বা কর্ম! শুদ্ধসত্ত্ব-সংরক্ষণের নিমিত্ত অর্থাৎ জনহিত-সাধনের জন্য অতিশয় প্রীতিযুক্ত দৃষ্টিতে যেন তোমাকে সন্দর্শন করি। অথবা,-হে ভগব! আমার বিভ্রমরহিত (অথবা অদব্ধ অর্থাৎ অতিশয় প্রীতিযুক্ত) নেত্রের দ্বারা আমি যেন আপনাকে দর্শন করতে সমর্থ হই। হে আমার ভগবৎসম্বন্ধযুত কর্ম! তুমি জ্ঞানজ্যোতির দ্বারা দীপ্তিমন্ত হও। অতএব জ্ঞান-উদ্ভাসিত তুমি তেজোময় ভগবানের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হও অর্থাৎ ভগবানের সাথে সম্মিলিত হও। প্রজ্ঞানের আধার ভগবান্ যেন তোমার জ্ঞানকে অপনীত না করেন। (এই মন্ত্রে ভগবানে কর্মফল-সমর্পণের অপিচ আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা বর্তমান। কর্ম জ্ঞানসমম্বিত হলে ভগবপ্রাপ্তি মূলক হয়ে থাকে)। হে মন! তুমি প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের রসনাস্বরূপ অর্থাৎ আহ্বানকারী হও; অথবা জ্বালারূপ জিহ্বা দ্বারা অর্থাৎ তেজঃরূপ কিরণের দ্বারা তুমি অগ্নির উৎপাদকরূপে বিদ্যমান আছ। অতএব তুমি দেবগণের অর্থাৎ দেবভাবসমূহের সুখহেতুভূত হও। অথবা,-হে ভগবন্! আপনার অগ্নিরূপ রসনা বিদ্যমান রয়েছে। অতএব আপনি দেবভাবসমুহের সম্যক গ্রহীতা হন। অপিচ, হে মন! অথবা, হে ভগবন্! আমার সবরকম অবস্থিতির স্থানে, যাগ ইত্যাদি সকল সৎকর্মের অনুষ্ঠানে, সর্বদেবের অধিষ্ঠানের জন্য (আমাতে সর্ব দেবভাব বিকাশের জন্য) তুমি অথবা আপনি সুষ্ঠু আহ্বানকারী হও বা হোন। হে মন! অথবা, হে ভগবৎসম্বন্ধযুক্ত কর্ম! তুমি দীপ্তিমন্ত বিশুদ্ধ সত্ত্বস্বরূপ। তুমি জ্যোতিস্বরূপ প্রজ্ঞানাধার হও; অপিচ তুমি তেজোময় শক্তিমন্ত হও। (ভাব এই যে, মনই সকলের মূলীভূত)। হে আমার সৎ ও অসৎ কর্ম! দ্যোতমান স্বপ্ৰকাশ জ্ঞানপ্রেরক দেবতা অর্থাৎ প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান, বিশুদ্ধ পবিত্রকারক বায়ুরূপে এবং জগৎ-নিবাস-হেতুভূত প্রজ্ঞানস্বরূপ, বিশ্বপ্রাপক জ্যোতিঃ নিবহের দ্বারা তোমাদের উৎকর্ষ-সাধনে পবিত্রতা সম্পাদন করুন। অথবা, তোমরা জ্ঞানপ্রদ সবিতৃদেবের প্রেরণায়–অনুকম্পায়-ত্রুটি-পরিশূন্য বায়ুর মতো পবিত্রকারক ও সূর্যরশ্মির মতো জ্ঞানপ্রদ হয়ে আমাদের উৎকর্ষ-সাধনে আমাদের পবিত্র করো। (বায়ু ও সূর্যরশ্মি শুদ্ধিসম্পাদক। তাদের প্রভাবে আমাদের সৎ-অসৎ উভয় কর্ম পবিত্র হোক,–এই-ই প্রার্থনা)। হে চিত্তবৃত্তি! জ্ঞানজ্যোতির দ্বারা বিশুদ্ধতা-প্রাপ্ত তোমাকে আমাদের সকল অবস্থায় সর্ব-অবস্থানে এবং সকল রকম সৎ-অনুষ্ঠানে দেবতাদের প্রীতির নিমিত্ত অর্থাৎ সৎ-ভাব-জননের জন্য (আমাতে সবরকম দেবভাব বিকাশের জন্য) তোমাকে বিনিযুক্ত করি। অপিচ হে চিত্তবৃত্তি! ভগবান জ্যোতিঃস্বরূপ এবং তেজ (শক্তি) স্বরূপ হন। অতএব তোমাকে, আমাদের সকল রকম অবস্থিতির স্থানে এবং আমাদের সকল রকম সৎ-অনুষ্ঠানে সকল দেবতার প্রীতিসাধনের জন্য (আমাদের মধ্যে সবরকমের দেবভাব বিকাশের জন্য) জ্যোতিঃস্বরূপ এবং তেজঃ (শক্তি) স্বরূপ ভগবানে প্রতিষ্ঠিত করছি। (এখানে পরমাত্মায় আত্মসমর্পণের আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান রয়েছে। মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। মন্ত্রে প্রার্থনার ভাবও প্রকটিত রয়েছে) । ১০।

 [দশম অনুবাকের এই মন্ত্রগুলি বেদীতে প্রতিষ্ঠাপনের জন্য আজ্য ইত্যাদি হবিঃ-গ্রহণ-মূলক। ভাষ্যানুক্রমণিকায় প্রকাশ,-নবম অনুবাকের মন্ত্রগুলির দ্বারা বেদি নির্মিত হলে, যজ্ঞের জন্য আজ্য ইত্যাদি হবিঃ দশম অনুবাকের মন্ত্রের দ্বারা গ্রহণ করতে হয়। সেই অনুসারে প্রথম মন্ত্র সুকের সম্বোধনে বিনিযুক্ত। যজ্ঞের নিমিত্ত যজ্ঞাগ্নিতে ঘৃত প্রক্ষেপণের জন্য খদির ইত্যাদি কাষ্ঠনির্মিত পাত্রবিশেষ–সুক নামে অভিহিত ১ হয়। সাধারণতঃ সুক বলতে কাষ্ঠনির্মিত হাতা বোঝা যেতে পারে। দ্বিতীয় মন্ত্রের এক একটি অংশে সুক সমূহকে এক এক বার মার্জন করতে হয়। তৃতীয় মন্ত্রে যজমান নিজের পত্নীকে গার্হপত্য অগ্নির দক্ষিণ দিকে উপবেশন করিয়ে তার দুই হস্তে মুঞ্জের যোক্রু (ফাস বা অঙ্গুরীয়ক) পরিয়ে দিতে দিতে এই মন্ত্র পাঠ করবেন। চতুর্থ মন্ত্র যোক্র-বিমোচনে প্রযুক্ত হয়। সুতরাং এই মন্ত্রের অর্থ হয়,শোভনপ্রজ্ঞ সবিতা দেবতা এই যোক্ত-রূপ যে বরুণ-পাশ বন্ধন করেছিলেন, তার দ্বারা সেই পাশ মোচন করছি। তাতে ব্রহ্মযোনিতে অনুষ্ঠিত কর্মের ফলভূত লোকে পতির সাথে পত্নী সুখে বাস করতে পারবে।–পঞ্চম মন্ত্রে অগ্নিকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে-আমি যেন আয়ু লাভ করি, পতিব্রতালক্ষণরূপ শক্তি লাভ করি। আর তার দ্বারা পুনঃ পুনঃ এই পতির পত্নীর হয়ে যেন সুখে বাস করতে পারি। কখনও যেন আমাদের বিয়োগ সাধন হয়। আমার দেহে জীবাত্মা যেন চিরপ্রতিষ্ঠিত থাকে। ষষ্ঠ মন্ত্রে আজ্যের সম্বোধন-পূর্বক যজমান-পত্নী সেই আজ্য দর্শন করেন।–অষ্টম মন্ত্রে সমিধ-ধারণ।-নবম মন্ত্রও আজ্যকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত। পঞ্চম অনুবাকের প্রথম মন্ত্র এবং দশম অনুবাকের দশম মন্ত্র অভিন্ন।ইত্যাদি। আমরা কিন্তু কর্মকাণ্ড অনুসরণে ভাষ্যকারকে অনুকরণ করিনি। ভাষ্যকার যেখানে গো অর্থে গরু অর্থ করেছেন, আমরা সেখানে এবং অন্যত্র বা সর্বত্র জ্ঞানকিরণ অর্থ পরিগ্রহ করেছি নিরুক্ত গ্রন্থে জ্ঞান-পর্যায়ে গো শব্দ পরিদৃষ্ট হয়। প্রজা ও যযানি পদে জনহিতসাধনে এবং সৎ-ভাবসঞ্চয়ে চিরপ্রতিষ্ঠিত থাকবার ভাব প্রকটিত করেছে। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্রকে আমরা চিত্তবৃত্তির সম্বন্ধসূচক বলে মনে করেছি। তৃতীয় মন্ত্রটির দুরকম অন্বয় সেইজন্যই দেওয়া হয়েছে। এইভাবে ষষ্ঠ মন্ত্রের বিভিন্ন অংশে যথাক্রমে সৎকর্মশীল পূর্ণজীবন লাভের, লোকানুরাগ বর্ধনের, ভগবৎ-পূজনসামর্থ্য অর্জনের ও ভগবানে একান্ত ভক্তিসম্পন্ন হওয়ার পরিশেষে আত্মায় ও পরমাত্নায় সম্মিলনের সঙ্কল্প প্রকাশ করেছি। মানুষ নিজের কর্মফলের অধিকারী। সে কর্ম ভগবানের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হলেই শ্রেয়ঃ সাধক হয়। যজুর্বেদ কর্মকাণ্ডমূলক। তার প্রতি মন্ত্রই ভগবানের সংশ্রবযুত কর্মের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট। ভগবৎসম্বন্ধযুত কর্ম সূর্যরশ্মির মতো জ্ঞানপ্রদ। মন্ত্র তাই বলছেন মানুষ, তুমি কর্ম করো; ভগবৎসম্বন্ধযুত কর্মে প্রবৃত্ত হও; তোমার অভীষ্ট-সিদ্ধি অবশ্যই হবে। আমরা মনে করি,এই ভাবেই দশম অনুবাকের মন্ত্রগুলির সার্থকতা।] ১০

.

একাদশ অনুবাক

মন্ত্র- কৃষ্ণোইস্যাখরেষ্ঠোহগুয়ে ত্বা স্বাহা। বেদিরসি বহিষে ত্বা স্বাহা। বৰ্হিরসি সুভ্যস্তা স্বাহা।। দিবে ত্বাহন্তরিক্ষায় ত্বা পৃথিব্যৈ ত্বা। স্বধা পিতৃভ্য উৰ্গৰ্ভব বহিষ্য ঊজ্জা পৃথিবীং গচ্ছত। বিষ্ণোঃ স্তুপোহসি।। উর্ণদসং ত্বা সৃণামি স্বাসস্থং দেবেভ্যোঃ। গন্ধৰ্বোহসি বিশ্বাবসুর্বিশ্বম্মাদীযতো যজমানসা পরিধিরিড ঈড়িত ইন্দ্ৰাস্য বাহুরসি দক্ষিণে যজমানস্য পরিধিরিড ঈড়িতত মিত্রাবরুণৌ ছোত্তরতঃ পরি ধত্তাং বেণ ধৰ্ম্মণা যজমানস্য পরিধিরিড ঈড়িতঃ।। সূৰ্য্যা পুরস্তাৎ পাতু কস্যাশ্চিদভিশস্ত্যা। বীতিহোত্রং ত্বা কবে দুমন্তং সমিধীমহ্যয়ে বৃহত্তমধ্বরে। বিশো যন্ত্রে স্থা। বসুনাং রুদ্রাণামাদিত্যানাং সদদি সীদ। দুহরুপভূঞ্জবাহসি ঘৃতাচী নান্না প্রিয়েণ নামা প্রিয়ে সদসি সীদ। এ অসদৎ সুকৃতস্য ললাগে তা বিষ্ণো পাহি পাহি যজ্ঞং পাহি যজ্ঞপতিং পাহি মাং যজ্ঞনিয়ম ॥ ১১।

মর্মার্থ- হে মন! তুমি কলঙ্ক-কলুষিত হয়ে আছ; সকর্ম-সহযুত হও। অগ্নিদেবের অর্থাৎ প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে স্বাহা-মন্ত্রের দ্বারা নিয়োজিত করছি অথবা পরিশুদ্ধ করছি। অথবা,হে মন! তুমি অঙ্গারের মতো কলঙ্ক-কলুষিত হয়ে আছ। কলঙ্ক বিমোচনে তোমার উৎকর্ষ-সাধনের জন্য অগ্নিসংযোগে (অর্থাৎ জ্ঞানরূপ অগ্নিতে দগ্ধ করে) তোমাকে পরিশুদ্ধ অর্থাৎ সুসংস্কৃত করছি। হে ধী! তুমি দেবীস্বরূপা, সঙ্কর্মের আশ্রয়ভূতা হও। সকর্ম-সাধনের নিমিত্ত (বহির মতো) তোমাকে স্বাহা মন্ত্রে নিয়োজিত (সুসংস্কৃতি) করছি। (আমার অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হোক)। হে মন! দৰ্ভরূপ তুমি যজ্ঞ ইত্যাদি সৎকর্মের সাধক হও। সৎকর্ম সাধানের নিমিত্ত তোমাকে স্বাহা মন্ত্রের দ্বারা সুসংস্কৃত করছি। আমার অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হোক। হে আমার ভগবৎ-সম্বন্ধি কর্ম! তোমাকে দুলোকে অবস্থিত অর্থাৎ দ্যুলোক-সম্বন্ধি দেবভাব-লাভের জন্য নিযুক্ত (প্রেরণ) করছি। হে আমার ভগবৎসম্বন্ধি কর্ম! তোমাকে অন্তরিক্ষলোকে অবস্থিত (অন্তরিক্ষ লোসম্বন্ধি) দেবভাবসমূহ লাভের জন্য নিয়োজিত (প্রেরণ) করছি। হে আমার ভগবৎসম্বন্ধি কর্ম। তোমাকে পৃথিবীতে অর্থাৎ ইহজগতে অবস্থিত (ইহলোকসম্বন্ধি) দেবভাব লাভের জন্য নিয়োজিত (প্রেরণ) করছি। পিতৃগুণ-সমুহকে উদ্দেশ করে স্বাধা উচ্চারণ করছি। সেই গুণাবলিকে আহ্বান করছি (সেই গুণসমূহ আমাতে সজ্ঞাত হোক। অথবা,হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! আমার পিতৃগুণসমূহ উৎপাদনের জন্য (সৎ-ভাবের প্রাপ্তি-কামনায়) স্বধা-মন্ত্রে তোমাদের বিনিযুক্ত করছি। তোমরা আমার হৃদয়রূপ বহিসমূহে সঞ্জাত পিতৃগুণগুলির রসস্বরূপ পোষক অর্থাৎ পরমানন্দদায়ক হয়ে সঞ্চারিত হও? অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্বরূপ পিতৃগুণসমুহ! তোমাদের সম্বন্ধি বলপ্রাণরূপ সত্ত্বের প্রবাহ আমার হৃদয়রূপ সৎ-বৃত্তির মূলকে প্রাপ্ত হোক। মন্ত্রটি প্রার্থনা মূলক। পিতৃগুণ অর্থাৎ সত্ত্বভাব-সংজননের জন্য মন্ত্রে সঙ্কল্প বিদ্যমান)। হে-মন! তুমি সেই অনন্তস্বরূপ, ভগবানের ধারক হও। অথবা তুমি যজ্ঞ ইত্যাদি সৎকর্ম-অনুষ্ঠানের চূড়াস্বরূপ হও। হে মন! তুমি স্নিগ্ধ সত্ত্বভাবযুত হও; সর্বদেবভাবের অবস্থান করবার উদ্দেশ্যে তোমাকে আসনরূপে বিস্তৃত করছি। (ভাব এই যে,-হে মন! তোমাকে যেন শুদ্ধসত্ত্ব-সমম্বিত দেববাসের যোগ্য করে তুলতে পারি)। হে ভগবন্! আপনি সর্বগ সর্বব্যাপী হন। অতএব স্তবনীয় আপনি বিশ্বের সকল রকম শত্রু হতে অর্চকের সংরক্ষক হোন। হে মন অথবা শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবানের দক্ষিণ-বাহুস্বরূপ (শ্রেষ্ঠ অঙ্গ) হও। অতএব, সম্ভজনীয় তুমি (প্রজ্ঞান-সমন্বিত হয়ে) বিশ্বের সকল রকমের শত্রু হতে অর্চকের সংরক্ষক হও। হে মন! তোমার সত্যধর্ম পালনের ফলে, জ্ঞানভক্তিরূপ সেই মিত্রাবরণ দেবদ্বয় তোমাকে সর্বতোভাবে শ্রেষ্ঠ-লোকে স্থাপন করুন। তুমিও স্তবনীয় জ্ঞান-সহযুত হয়ে শত্রুর আক্রমণ হতে সবরকমে অর্চকের পরিরক্ষক হও (অর্থাৎ রক্ষা করো)। হে মন! সকল দেব-বিভূতির সম্যরূপে অর্চনার জন্য (প্রতিষ্ঠার জন্য) সেই পূর্ণজ্যোতি-স্বরূপ সূর্যদেব (স্বপ্রকাশ জ্ঞানময় ভগবান) সর্বতোভাবে তোমাকে পালন করুন। হে ত্রিকালজ্ঞ জ্ঞান-স্বরূপ অগ্নিদেব! মহান এবং দীপ্তিমান্ আপনাকে আমার ইষ্ট-লাভের জন্য, এই হিংসারহিত যজ্ঞে (আমার সৎকর্ম নিবহে–আমার হৃদয়-প্রদেশে) প্রতিষ্ঠিত করছি। হে মম ভগবৎসম্বন্ধযুত জ্ঞান ও কর্ম! তোমরা বিশ্বব্যাপক শুদ্ধসত্ত্বের নিয়ামক অর্থাৎ উৎপত্তি-হেতুভূত হও। হে মন! তুমি বিশ্বের সকলের নিবাসভূত (আশ্রয়ভূত) দেবগণের (অর্থাৎ দেবভাবসমুহের), শত্রু-বিমর্দক ঘোররূপ দেবগণের (দেবভাব-সমূহের), এবং জ্যোতিঃস্বরূপ (জ্ঞানদায়ক) দেবগণের (অর্থাৎ দেবভাবসমূহের) অধিষ্ঠানে প্রসারিত হও। (ভাব এই যে,হে মন! নিবাস-হেতুভূত শত্রু-বিমর্দক জ্যোতিঃস্বরূপ দেবভাবসমূহ পর্যায়ক্রমে তোমাতে শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চরের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত করান)। হে ধী! তুমি হবনপাত্র-স্বরূপা, দেবগণ-সমীপে হবির্ধারণকত্রী অর্থাৎ সৎ-ভাব-পোষিকা নিত্যস্বরূপা (সৎ-ভাবরূপা) হও। নামে তুমি জুহু অর্থাৎ হবিঃপূর্ণ–সত্ত্বসমন্বিত হয়ে প্রিয়বস্তুর আধার সত্ত্ব-ভাবের সাথে আমার হৃদয়রূপ অধিষ্ঠানে (আসনে অধিষ্ঠিত হও। (ভাব এই যে,-হে ধী! তুমি সৎ-ভাব-সমন্বিত হয়ে আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হও)। হে বিশ্বব্যাপক ভগব! সত্য-স্বরূপ সৎকর্মের উৎপত্তি-স্থান আমার হৃদয়ে নিত্যসত্যস্বরূপা যে শুদ্ধসত্ত্বসমূহ বিরাজিত আছে, সেই সবগুলিকে আপনি রক্ষা করুন; আমার যজ্ঞকে (সত্ত্ব ইত্যাদির কার্যকে) রক্ষা করুন; আমার যজ্ঞপালক সৎ-ভাবকে রক্ষা করুন; যজ্ঞকারী আমাকে রক্ষ করুন ॥ ১১।

 [এই একাদশ অনুবাকে ই অর্থাৎ হোমের কাষ্ঠ এবং বৰ্হি অর্থাৎ সঙ্গবদ্ধ (আঁটিবাঁধা) কুশের সাথে বেদীতে হবিঃ স্থাপনের উল্লেখ আছে। সুতরাং প্রথম মন্ত্রে যজ্ঞকাষ্ঠ, দ্বিতীয় মন্ত্র বেদি-সম্বোধনে এবং তৃতীয় মন্ত্রে কুশগুলিকে সম্বোধন করা হয়েছে। চতুর্থ মন্ত্রের দ্বারা হস্ত প্রক্ষালন করতে হয়। পঞ্চম মন্ত্র উদক-সম্বোধনে বিনিযুক্ত। ভাষ্যমতে ষষ্ঠ মন্ত্রে প্রস্তরকে এবং সপ্তম মন্ত্রে বহিকে সম্বোধন। অথচ ষষ্ঠ মন্ত্রে মনকে বিষ্ণোঃ স্কুপোহসি অর্থাৎ বিষ্ণুর সুপ বলা হয়েছে। সপ্তম মন্ত্রে উর্ণাদসং পদের অর্থ– ভাষ্যকারের ব্যাখ্যাতেই প্রকাশ-কোমলতা-সম্পাদক। আমরা তাই সেখানে শুদ্ধসত্ত্ব ভাব গ্রহণ করেছি। কারণ তারই সঞ্চারে মন স্নিগ্ধ কোমলতাসম্পন্ন হয়। ভাষ্যমতে অষ্টম মন্ত্র পরিধি সম্বোধনে বিনিযুক্ত। বেদীর পশ্চিম দক্ষিণ ও উত্তর তিন দিকের পরিধি নির্দেশ করে, সেই তিন পরিধিকে সম্বোধন-পূর্বক এই মন্ত্রের তিনটি বিভাগ বিহিত হয়েছে। নবম মন্ত্র আহবনীয়ের প্রতি লক্ষ্য করে উচ্চারিতব্য। সেই অনুসারে মন্ত্রের অর্থ,-হে আহবনীয়! পুরোভাগের সকল রকম বিঘ্ন হতে সূর্যদেব তোমাকে রক্ষা করুন। আমাদের মতে মন্ত্রটি মনঃ-সম্বোধক। মনই হৃদয়ে জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত করে। দশম মন্ত্রে অগ্নির আবাহন। একাদশ মন্ত্রে (ভাষ্যকারের মতে) দর্ভ-নির্মিত বিধৃতিদ্বয়ের সম্বোধন রয়েছে। আমাদের মতে, মন্ত্রে জ্ঞান ও কর্মের সম্বন্ধ সূচিত হয়েছে। দ্বাদশ মন্ত্রে (কর্মকাণ্ড অনুসারে) প্রস্তর গ্রহণ। আমাদের মতে, এই মন্ত্রে ধী-কে লক্ষ্য করা হয়েছে। ভাষ্যকারের মতে, ত্রয়োদশ মন্ত্র সুকের (জুহুর) সম্বোধনে এবং শেষ মন্ত্র হবিঃ-সম্বোধনে বিনিযুক্ত। আমরা এয়োদশ মন্ত্রেও ধী-কে সম্বোধ্য বলে মনে করেছি। মন্ত্রে ধী-র নামবিশেষণেরও পরিচয় পাওয়া যায়। শেষ মন্ত্রের অর্থ পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, সাধক ঐ ত্রিভাবান্বিত ধী-কে লাভ করবার জন্য ব্যাকুল হয়েছে। (আধ্যাত্মিক বিচারে) মন্ত্রে যেন পূর্ববর্তী মন্ত্রসমূহের উপসংহার হয়েছে] । ১১।

.

দ্বাদশ অনুবাক

মন্ত্র- ভুবনমসি বি প্রথস্বাগ্নে যঊরিদং নমঃ। জুহুেহ্যগ্নিস্তা হুয়তি দেব্যজ্যায়া উপভূদেহি দেবত্বা সবিতা হয়তি দেবযজ্যায়া। অগ্নাবিষ্ণু মা বামব ক্ৰমিষং বি জিহাথাং মা মা সং তাপ্তং লোকং মেলোককৃতৌ কৃণুত। বিষ্ণোঃ স্থানমসি। ইত ইন্দ্রো অকৃপোদ্বীৰ্য্যাণি সমারভ্যোপ্পো অধ্বররা দিবিহ্রতো যজ্ঞো যজ্ঞপতেয়িাবাৎ স্বাহা। বৃহদ্ভাঃ। পাহি মাহগ্নে দুশ্চরিতাদা মা সুচরিতে ভজ। মখস্য শিয়োহসি সং জ্যোতিষা জ্যোতিরক্তাম্ ॥ ১২।

মর্মার্থ- প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন! আপনি নিখিল বিশ্বের ভূত-সমষ্টির উৎপাদক অর্থাৎ নিখিল সৎ-ভাবের জনক হন। অতএব আপনি বিশেষভাবে বিস্তৃত অর্থাৎ আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে আমার সৎ-ভাব ও লোকানুরাগ বর্ধন করুন। আমার অনুষ্ঠিত ভগবৎ-উদ্দেশ্যে নিয়োজিত কর্ম আপনাকে প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। আমার কর্মের দ্বারা আমাতে সৎ-ভাবের সঞ্চার হোক এবং সেই কর্ম ভগবানকে প্রাপ্ত হোক)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি হৃদয়ে সঞ্চারিত হও। দেবযাগ সম্পাদানের জন্য (ভগবৎকর্ম সাধনের জন্য) প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান তোমাকে উদ্দীপিত করুন। সৎ-ভাব-পোষণকারিণী, দেবসমীপে হবিধারণকত্রী হে মনোবৃত্তি! তুমি হৃদয়ে প্রসারিত হও। দেবকার্য সম্পাদনে জন্য অর্থাৎ সকর্ম সাধনের জন্য জ্ঞানপ্রসরিতা স্বপ্রকাশ ভগবান তোমাকে সম্যক্ উদ্দীপিত করুন অর্থাৎ ভগবৎ-কর্মে নিয়োজিত করুন। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। সৎ-ভাব সৎ-জ্ঞানই সৎকর্মের মূলীভূত। আর সেই সৎ-ভাবের ও সৎ-জ্ঞানের প্রভাবেই ভগবানের প্রীতি-কামনায় এখানে সঙ্কল্প বর্তমান রয়েছে)। হে আমার জ্ঞান ও কর্ম! তোমাদের উভয়কে যেন আমি পরিত্যাগ না করি। তোমরাও যেন তোমাদের সম্বন্ধ হতে আমাকে বিযুক্ত করো না; অপিচ, অর্চনাকারী আমার সন্তাপ উৎপাদন করো না। পরন্ত সকলকে পরম পদে প্রতিষ্ঠাপক তোমরা আমার জন্য পরমস্থান বিধান করো। (ভাব এই যে,-জ্ঞান ও কর্মই সকল মঙ্গলের হেতুভূত। সৎ-জ্ঞান-সহকারে যদি সৎকর্মের অনুষ্ঠান হয়, তাহলে সেই জ্ঞান-সমন্বিত কর্মের প্রভাবেই মানুষ পরমপদ প্রাপ্ত হতে পারে। অতএব সৎ-জ্ঞান সহকারে কর্মের অনুষ্ঠানই যে কর্তব্য, মন্ত্রে সেই উদ্বোধনাই বর্তমান রয়েছে)। হে আমার অন্তর! তুমি বিশ্বব্যাপক ভগবানের শুদ্ধসত্ত্বের আধার-স্বরূপ হও। হে পরমেশ্বর! আপনি আমার এই হৃদয়ে শনাশের সামর্থ্য বিস্তার করুন; তাহলে, শক্রকৃত হিংসারহিত হয়ে আমার যজ্ঞ ঊর্ধ্বগতি লাভ করবে (অর্থাৎ, রিপুশ কর্তৃক প্রতিহত না হয়ে আপনার সান্নিধ্যলাভে সমর্থ হবে)। সৎকর্মের পালক ও অনুষ্ঠাতা আমার কর্ম, শত্রুর উপদ্রব-পরিশূন্য হয়ে বিশ্বব্যাপক কৌটিল্য-পরিশূন্য এবং ভগবৎ-প্রাপক হোক। আমার সেই কর্মকে আমি স্বাহা মন্ত্রে ভগবানে সমর্পণ করছি। আমার অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হোক অর্থাৎ ভগবানকে প্রাপ্ত হোক। হে মন! আমার জ্ঞানরশ্মিসমূহ যাতে ভগবৎ-প্রাপক হয়, তা-ই বিহিত করো। প্রজ্ঞানাধার হে ভগবন্! আমাকে পাপ হতে পরিত্রাণ করুন। পাপ নষ্ট করে আমাকে প্রকৃষ্টভাবে সৎপথে প্রতিষ্ঠাপিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। সৎপথ-অবলম্বনের জন্য এখানে প্রার্থনা বর্তমান)। হে মন! তুমি সঙ্কর্মের শ্রেষ্ঠ অঙ্গস্বরূপ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সম্পাদক হও। তুমি আমাতে পরমজ্যোতিঃ উৎপাদন করে সেই পরম জ্যোতির্মানের সাথে আমাকে সংযোজিত করো। ১২।

[কর্মকাণ্ড অনুসারে এই অনুবাকের মন্ত্রগুলি আধার-গ্রহণমূলক। আধার বলতে আজ্যহবিঃ-পূর্ণ সুক বোঝায়। তা থেকে পুরোডাশসাংনায্য প্রভৃতি বেদীতে স্থাপনের বিষয় উপলক্ষিত হয়। ভাষ্যানুক্রমণিকা থেকে প্রতিপন্ন হয়,-দ্বাদশ অনুবাকে যজ্ঞকাষ্ঠের উপরিভাগে হোম-নিম্পাদনের জন্য আধার-স্থাপনের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি পরিবর্ণিত হয়েছে। একাদশ অনুবাকে যজ্ঞকাষ্ঠ, কুশ এবং কাষ্ঠনির্মিত হাতা প্রভৃতিকে প্রোক্ষণাদির দ্বারা বিশুদ্ধীকরণের প্রক্রিয়া কথিত হয়েছে। এখন, এই অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে, যজ্ঞকাষ্ঠের উপরিভাগে কিভাবে হোমের জন্য আধার স্থাপন করতে হয়, তা-ই পরিবর্ণিত হয়েছে। বিনিয়োগ-সংগ্রহ মতে এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রের (ভুবনমসি প্রভৃতি) মন্ত্রের দ্বারা অঞ্জলিবদ্ধ করে দ্বিতীয় মন্ত্রের (জুহুহ্যগ্নিস্বা ইত্যাদি) দুটি অংশে জুহূপভৃৎ গ্রহণীয়। তার পর অগ্নাবিষ্ণু প্রভৃতি মন্ত্রে দক্ষিণ দিকে গমন করে বিষ্ণোঃ স্থানমসি মন্ত্রে ভূমি নির্দেশ পূর্বক ইত ইন্দ্রো প্রভৃতি মন্ত্রে সেই জুহু স্থাপনীয়। তার পর বৃহদ্ভাঃ প্রভৃতি মন্ত্রে সুক গ্রহণ করে পাহি প্রভৃতি মন্ত্রে সেই সুককে প্রতিনিবর্তন করে অর্থাৎ স্থাপন করে, মখস্য প্রভৃতি মন্ত্রে ধ্রুবাকে সেই সুকের সাথে সংযোজিত করণীয়। বেদির উপরিভাগে আজ্যহবিঃ- পূর্ণ সুক স্থাপন এরই দ্বারা প্রতীত হয়। বিনিয়োগ-সংগ্রহের অনুসরণেই ভাষ্যকার এই মন্ত্রগুলির যথাযথ ব্যাখ্যা করেছেন। এইজন্যই তাঁর মতে প্রথম মন্ত্রের সম্বোধন–আহবনীয় অর্থাৎ যাগনিম্পাদক অগ্নি। আমাদের মতে মন্ত্রের সম্বোধ্য–প্রজ্ঞান-স্বরূপ ভগবান। ভাষ্যমতে দ্বিতীয় মন্ত্রের প্রথম অংশ জুহু সম্বোধনে এবং দ্বিতীয় অংশ উপভৃৎ সম্বোধনে বিনিযুক্ত। জুহু অর্থাৎ সুককে অগ্নিদেবের উদ্দেশ্যে এবং উপভৃৎ অর্থাৎ সুক-ব্যতিরিক্ত আজ্যধারণক্ষম অন্য পাত্রকে সূর্যের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়েছে বোঝা যায়। আমাদের মতে মন্ত্রের প্রথমাংশে শুদ্ধসত্ত্বকে এবং দ্বিতীয় অংশে মনোবৃত্তিকে সম্বোধন করা হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্রে অগ্নির এবং বিষ্ণুর–যুগ্ম দেবতার সম্বোধন। ভাষ্যমতে মধ্যম পরিধির পুরোভাগে আহবনীয় অগ্নি এবং তার পশ্চাতে সুকের অগ্রভাগে শাস্ত্রদৃষ্ট যজ্ঞাভিমানী বিষ্ণু অবস্থিত। অগ্নি ও বিষ্ণু বলতে আমরা এখানে জ্ঞান ও কর্মকে বুঝেছি। ভাষ্যমতে, পঞ্চম মন্ত্রের সম্বোধন-ভূ-প্রদেশ; আর ষষ্ঠ মন্ত্র ইন্দ্রদেবতা সম্বন্ধি। আমাদের মতে চতুর্থ মন্ত্রে নিজের অন্তরাত্মাকে সম্বুদ্ধ করা হয়েছে। অন্তরই যে বিশ্বব্যাপক দেবতার আধার-মন্ত্রে সেটাই ঘোষিত হয়েছে। অন্তরে জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত হলে, তার মতো ভগবানের শ্রেষ্ঠ আধার আর অন্য কিছু হতে পারে কি? পঞ্চম মন্ত্রটি পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানকে লক্ষ্য করছে। ষষ্ঠ মন্ত্রে অগ্নির দীপ্তি যাতে অধিক হয়, অথচ জুহু দগ্ধীভূত না হয়,-ভাষ্যে এই ভাব পরিব্যক্ত। আমাদের মতে আত্ম-উদ্বোধনমূলক এই মন্ত্রে জ্ঞান যাতে ভগবৎপ্রাপক হয় অর্থাৎ দিব্যজ্ঞানলাভে যাতে মোক্ষপদ প্রাপ্ত হওয়া যায়, তার জন্য সাধক আত্মাকে উদ্বোধিত করছেন। সপ্তম মন্ত্রে, ভাষ্যমতে, জুহু ও উপভৃৎকে পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে স্থাপন করতে হয়। আমরা মনে করি, এই মন্ত্রে প্রার্থনাকারী পরিত্রাণ-লাভের প্রার্থনা জ্ঞাপন করছেন। ভাষ্যমতে অষ্টম বা শেষ মন্ত্রের সম্বোধন–আধারশেষ। ভাষ্যমতে মন্ত্রটির অর্থ হয়,-হে আধারশেষ! তুমি যজ্ঞের শিরের মতো উত্তম অঙ্গ হও। অতএব সেইভাবে জ্যোতির দ্বারা ষ্ট্ৰেীবাজ্যরূপ জ্যোতির সাথে সম্মিলিত হও। আমাদের মতে মন্ত্রটি আত্মসম্বোধনে বিনিযুক্ত ও উদ্বোধনমূলক। এখানে আত্মায় আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। এই আকাঙ্ক্ষা–হৃদয়ে জ্ঞানজ্যোতিঃ উৎপাদন করে জ্যোতিরাধারা সেই ভগবানের সাথে সম্মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষা।–কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনে ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা ক্রুটিহীন। আমরা কেবল আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে মন্ত্রের যে অন্যরকম অর্থও করা যায়, তা-ই দেখবার প্রয়াস পেয়েছি] । ১২।

.

ত্রয়োদশ অনুবাক

মন্ত্র- বাজস্য মা প্রসবেনোগ্রাভেলোদগ্রভীৎ। অথা সপত্নাং ইন্দ্রো মে নিগ্রাভেণাধরাং অকঃ। উদগ্রাভং চ নিগ্রাভ চ ব্ৰহ্ম দেবা অবীবৃধ। অথা সপত্নানিল্লাগ্নী মে বিমূচীনাম্বস্যতাম। বসুভ্যা রুদ্রেভ্যস্তৃাহদিত্যেভ্যস্তা। অক্তং রিহাণা বিয়ন্তু বয়ঃ।। প্রজা যযানিং মা নির্মূক্ষম। আ প্যায়ামাপ ওষধয়ো মরুতাং পৃষতয়ঃ স্থ দিব গচ্ছ ততো নো বৃষ্টিমেয়। আয়ুষ্প অগ্নেহস্যায়ুৰ্মে পাহি চক্ষুম্পা অগ্নেহসি চক্ষুর্মে পাহি। ধ্রুবাহসি। যং পরিধিং পৰ্য্যধখা অগ্নে দেব পণিভিক্মীয়মাণঃ। তং ত এমনু জোষং ভরামি নেদেষ হৃদপচেতয়াতৈ যজ্ঞস্য পাথ উপ সমিত। সংস্ৰাবভাগাঃ হেষা বৃহন্তঃ প্রস্তরেষ্ঠা বহিষদ দেবা ইমাম বাচমভি বিশ্বে গৃণ আসন্যাস্মিবহিষি মাদয়। অগ্নেৰ্বামপন্নগৃহস্য সদসি সাদয়ামি সুন্নায় সুমিনী সুমে মা ধং ধুরি ধুৰ্য্যো পাতম। অগ্নেদদ্ধায়োহশীততনো পাহি মাহদ্য দিবঃ পাহি প্রসিত্যৈ পাহি দুরিষ্ট্যৈ। পাহি দুরন্যৈ পাহি দুশ্চরিতাদবিষং নঃ পিতুম কৃণু সুষদা যোনিং স্বাহা। দেবা গাতুবিদা গাতুং বিত্ত্বা গাতুমিত মনসম্পত ইমম্ নো দেব দেবেষু যজ্ঞং স্বাহা বাঁচি স্বাহা বাতে ধাঃ ॥১৩৷৷

মর্মার্থ- হে ভগবন্! আপনি সঙ্কর্মের প্রেরণার দ্বারা ঊর্ধ্ব-গ্রহণে অর্থাৎ আত্ম-উন্নতিদানে পরমস্থান প্রাপ্ত করাবার জন্য আমাকে উর্ধ্বে নিয়ে যান অর্থাৎ আমার চরম-উৎকর্ষ সাধন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। সৎকর্মের সাধনে আত্ম-উৎকর্ষ-লাভে আমি যাতে পরম স্থান প্রাপ্ত হই, হে ভগবন্! কৃপা করে আমাকে সেই সামর্থ্য প্রদান করুন)। অনন্তর হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে ইন্দ্রদেব (আমার কর্মশক্তি) আমার সৎ-ভাব-অবরোধ অন্তঃ শসমূহকে শাসনের অর্থাৎ পীড়নের দ্বারা অভিভূত অর্থাৎ বিদূরিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে কর্মশক্তির প্রভাবে অন্তঃশত্রুদের বিনাশের জন্য সঙ্কল্প বর্তমান। ভাব এই যে–আমার কর্মের প্রভাবে অন্তঃশত্রুসমূহ-কাম-ক্রোধ ইত্যাদি-বিনাশপ্রাপ্ত হোক)। হে পরব্রহ্ম ভগবন! আপনার অনুগ্রহে সত্ত্ব ইত্যাদি দেবভাব-সমূহ হৃদয়ে উপজিত হয়ে, আমার ঊর্ধ্বগমন অর্থাৎ উৎকর্ষসাধন এবং শত্রুগণের নিষ্কর্ষ সাধন প্রকৃষ্টভাবে (নিশ্চয়ভাবে) প্রবর্ধিত অর্থাৎ সংসাধিত করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। সৎ-ভাবই অন্তঃ-শত্রুনাশক। সর্বত্র ভগবানের অনুগ্রহ লাভই মূলীভূত। অতএব প্রার্থনা-ভগবানের অনুগ্রহে হৃদয়ে সৎ-ভাবসমূহ উপজিত হোক। তাতেই সর্বশত্রুর বিনাশ সম্ভবপর হবে। শত্রুনাশে নির্মল চিত্ত হয়ে ভগবানকে আরাধনা করতে সমর্থ হবে)। অনন্তর হে ভগবন! আপনার অনুগ্রহে আমার জ্ঞান ও কর্ম (জ্ঞানশক্তি ও কর্মশক্তি) আমার জন্ম-সহজাত অন্তঃশত্রুদের যাতে স্বস্থানভ্রষ্ট করে বিদুরিত করতে সমর্থ হয়, আপনি বিশেষভাবে তা বিহিত করুন। অথবা, হে আমার কর্মশক্তি ও জ্ঞানশক্তি অথবা হে শক্তিজ্ঞানরূপী ইন্দ্রদেব ও অগ্নিদেব! আমার জন্মসহজাত অন্তঃশত্রুগণ যাতে অভিভূত হয়, আপনারা উভয়ে বিশেষভাবে তা বিহিত করুন। (ভাব এই যে,-সকর্ম ও সৎ-জ্ঞানের প্রভাবে আমার অন্তঃশত্রু বিনাশপ্রাপ্ত হোক)। হে আমার হে মন! তোমাকে সকলের নিবাসস্থানীয় (সকলের নিবাসহেতুভূত আশ্রয়স্থানীয়) দেবতার পরিতৃপ্তির জন্য নিয়োজিত করছি। হে মন! তোমাকে ঘোররূপী শাসক দেবগণের পরিতৃপ্তি সাধনের জন্য নিয়োজিত করছি। হে মন! তোমাকে জ্যোতিঃস্বরূপ (সৎ-জ্ঞান-প্রদায়ক) দেবগণের তৃপ্তি সাধনের জন্য নিয়োজিত করছি। হে মন! শুদ্ধসত্ত্বান্বিত তোমাকে আস্বাদন করে (তোমাতে সম্মিলিত হয়ে) দেবভাবসমূহ কান্তিযুক্ত হোক; অর্থাৎ, আমার হৃদয়ের সত্ত্বভাবের সাথে মিলিত হয়ে দেবভাব-সমূহ অধিকতর প্রদীপ্ত হোক। অপিচ, হে মন! আমার বিশ্বপ্রীতি (জনানুরাগ) এবং সৎ-বৃত্তির আধার বা উৎপত্তিস্থল যাতে বিনষ্ট না হয়, তুমি সেইরকমভাবে সুপ্রতিষ্ঠ হও। (ভাব এই যে,-আমার কর্ম যেন আমার বন্ধনের হেতুভূত না হয়। হে আমার কর্মফল-ক্ষয়কারী কর্মসমূহ! তোমরা আমার স্নেহসত্ত্বভাবসমূহকে প্রবর্ধিত করো। তোমরা সর্বগামী দেবগণের অর্থাৎ প্রাণবলের সংরক্ষক দেবভাবসমূহের প্রকৃষ্ট বাহক হও (অর্থাৎ বায়ুবেগে তাদের আনয়ন করো)। অনন্তর তোমারা ভগবৎসমীপে গমন করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামুলক। কর্মই কর্মক্ষয়ের এবং বন্ধনছেদনের হেতুভূত। কর্মের প্রভাবে ইহলোক-পরলোক সম্বন্ধি কল্যাণ এবং ভগবানের করুণাধারা অধিগত করতে সমর্থ হই, তেমনিভাবে যেন উদ্বুদ্ধ হই। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগব! কৃপা করে আমার কর্মবন্ধন ছিন্ন করে আমাকে উদ্ধার অর্থাৎ আপনাতে স্থাপন করুন)। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আপনি সকলের আয়ুর পালক অর্থাৎ সকর্মশীল জীবনের সংরক্ষক হন; অতএব আপনি আমার অকালমরণ পরিহার করে আমার পূণায়ুষ্কাল অর্থাৎ সত্ত্বশীল পুন্যজীবন সংরক্ষিত অর্থাৎ প্রদান করুন। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আপনি সকলের চক্ষু অর্থাৎ দর্শনেন্দ্রিয়কে রক্ষা করে থাকেন (দুরদৃষ্টি-বিধায়ক হন); অতএব আমার দর্শনেন্দ্রিয়ের অর্থাৎ আত্ম-উৎকর্ষ-সাধনের নিমিত্ত আমার জ্ঞান-চক্ষুকে (দূরদৃষ্টি অন্তদৃষ্টিকে) রক্ষা করুন। হে মনোবৃত্তি! তুমি স্থিরা অর্থাৎ সৎ-বুদ্ধিদাত্রী ও অচঞ্চলা হও। (অতএব আমাকে অচঞ্চলভাবে ভগবানে নিয়োজিত করো)। দ্যোতমান্ স্বপ্রকাশ প্রজ্ঞানস্বরূপ হে দেব! আপনি রিপুশত্রুগণ কর্তৃক সংরুদ্ধমান হয়ে (আমার) হৃদয়ে (সাধকগণের হৃদয়ে) যে শুদ্ধসত্ত্বভাব রূপ ব্যবধান স্থাপন করে থাকেন; আপনার প্রিয় সেই শুদ্ধসত্ত্বভাবকে আমি যেন হৃদয়ে পোষণ করি। সেই শুদ্ধসত্ত্বভাব রূপ পরিধি আপনার নিকট হতে আগত হতে জানে না (অর্থাৎ আপনাতেই বিদ্যমান থাকে)। অথবা,–দ্যোতমান্ স্বপ্রকাশ প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগব! স্তুতির দ্বারা প্রবর্ধিত হয়ে আপনি কৃপাপূর্বক জায়মান শুদ্ধসত্ত্বকে হৃদয়ে স্থাপন করেন। আপনার প্রীতিকর সেই শুদ্ধসত্ত্ব আপনারাই প্রীতির নিমিত্ত উৎসর্গ করছি। শুদ্ধসত্ত্ব আপনা হতে পৃথক অর্থাৎ ভিন্ন নয়। (ভাব এই যে,ভগবান ও শুদ্ধসত্ত্ব অভিন্ন। যিনি ভগবান, তিনিই শুদ্ধসত্ত্ব) হে আমার কর্ম ও ভক্তি! তোমরা উভয়ে সকর্মের ফলস্বরূপ শুদ্ধসত্ত্বকে (ভগবৎসামীপ্য) প্রাপ্ত হও। প্রস্তরের মতো স্থিরস্থাননিবাসী, রিপুশত্ৰুকর্তৃক উপদ্রব পরিশূন্য হৃদয়-নিবাসী, শুদ্ধসত্ত্ব হতে উৎপন্ন হে দেবভাব-সমূহ! আপনারা ভক্তি-সুধাতে অথবা অভীষ্টবর্ষণের দ্বারা পরিবর্ধিত হয়ে (সাধকদের) সংসর্গভাগী হন। হে দেবভাব-সমূহ। (আপনারা) আমার এই স্তুতিরূপ বাক্যকে সর্বতোভাবে সমাদরে শ্রবণ করে পরিদৃশ্যমান যজ্ঞে (এই আমার হৃদয়-দেশে) উপবেশন-পূর্বক তৃপ্তিলাভ করুন। অথবা,-হে দেবভাব-সমূহ! আপনারা আমাদের জ্ঞানভক্তিসহযুত সকর্ম-সমূহের সংসর্গভাগী হোন। হে দেবভাব-সমূহ! আপনারা সকলের আরাধনীয় প্রস্তরের মতো স্থিরস্থাননিবাসী হৃদয়রূপ বহিতে অবস্থানকারী অর্থাৎ সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা সমুদ্ভূত হন। অতএব হে বিশ্বদেবগণ! আপনারা আমাদের উচ্চারিত স্তুতিরূপ বাক্য প্রীতিসহকারে সর্বতোভাবে শ্রবণ করে আমাদের অনুষ্ঠিত এই যজ্ঞে অথবা আমাদের নির্মল অন্তঃকরণে উপবেশন পূর্বক হৃষ্ট অর্থাৎ আনন্দিত হোন। হে আমার জ্ঞান ও ভক্তি! তোমাদের অবিনশ্বর নিবাসস্থানীয় প্রজ্ঞানাধার ভগবানের প্রীতিসাধনের নিমিত্ত নিয়োজিত করছি। হে–সুখাবারভূতে জ্ঞান ও ভক্তি! তোমরা আমাকে পরমসুখে স্থাপন করো। হে জ্ঞানস্বরূপ দেব! হে ভক্তিস্বরূপ দেব! আপনারা (আমার) সৎকর্মের নির্বাহক জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগকে রক্ষা করুন। আপনারা সুখস্বরূপ হন; আমাকে সুখে রাখুন। অৰ্চনাকারিগণের মঙ্গলবিধাতা সর্বব্যাপক জ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! আপনি নিত্যকাল আমাকে রক্ষা করুন;শপ্রযুক্ত বজ্রতুল্য আয়ুধ হতে আমাকে রক্ষা করুন; বন্ধনহেতুভূত মায়াপাশ হতে আমাকে রক্ষা করুন; অসৎ-অৰ্চনা হতে আমাকে রক্ষা করুন; কু-ভোজন হতে আমাকে রক্ষা করুন; অসৎ-আচরণ হতে অর্থাৎ পাপাঁচরণ হতে আমাকে রক্ষা করুন; আমাদের পানীয় বিষশূন্য করুন; সম্যভাবে স্থিতিযোগ্য বিশ্বের উৎপত্তিস্থানভৃত পরব্রহ্মে আমাকে স্থাপন করুন; আমার অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে হুত হোক–এই অনুষ্ঠান (আপনার অনুগ্রহে) অবশ্যই সুন্দরভাবে হুত হবে। যজ্ঞ ইত্যাদি সৎকর্মে অভিজ্ঞ হে দেবভাবনিবহ! আমাদের সকর্মের ইচ্ছা বিজ্ঞাত হয়ে, সেই সকর্মকে প্রাপ্ত হোন। দ্যোতমান, মনের অধিষ্ঠাতা দেব! এই অনুষ্ঠিত সৎকর্ম (সৎকর্মের ফল) আপনাকে, দেবভাব সংজননের নিমিত্ত, সমর্পণ করছি। উৎকর্ষসাধনের দ্বারা শক্তিসঞ্চারের নিমিত্ত আমার উচ্চারিত স্তুতিমন্ত্র-সমূহ আপনাকে সমর্পণ করছি। আমার কর্মফল ভগবানে সমর্পিত হোক। হে দেবভাবনিবহ! আপনারা আমার সেই কর্মকে (কর্মফলকে) প্রাণ ইত্যাদি পঞ্চবায়ুর অধিষ্ঠাতৃ দেবতাকে নিহিত করুন (বায়ুর মতো অনন্ত করুন)। অর্থাৎ, আমার অনুষ্ঠান যেন মনঃপ্রাণের একতাতেই অনুষ্ঠিত হয়) । ১৩।

[দ্বাদশ অনুবাকে বেদীতে আধারস্থাপনের পর অধ্বর্য কিভাবে যাগনিম্পাদন করবেন এবং কিভাবে কোন্ প্রক্রিয়াপদ্ধতির অনুসরণে বেদিস্থিত সেই আধার-পাত্রে সুক বহন করতে হবে, এয়োদশ অনুবাকে, কর্মকাণ্ড অনুসারে, যথাক্রমে সেই পদ্ধতির বিবৃতি দেখা যায়। সেই অনুসারেই ভাষ্যকার অনুবাকের মন্ত্রগুলির ব্যাখ্যা ইত্যাদি যথাযথ নিষ্পন্ন করেছেন।–আমাদের মতে প্রথম মন্ত্রে অন্তঃশত্রুনাশে আত্ম-উৎকর্ষ-সাধনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ–অন্নপ্রাপ্তির জন্য মুষ্টিবদ্ধ জুহুর ঊর্ধ্বগ্রহণে আমরাও ঊর্ধ্বগ্রহণ সম্পন্ন হই; আর উপভৃৎকে নীচ-গ্রহণে আমার বৈরিসমূহ অধোগামী হোক। পরব্রহ্মদেব আমার উল্কর্য এবং বৈরিগণের নিষ্কর্ষ সাধিত করুন। অনন্তর ইন্দ্রাগ্নী দেবতাদ্বয় আমার সপত্নদের (শত্রুদের) বিশেষভাবে স্বস্থানভ্রষ্ট করুন। তার পর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্রেও একইরকমভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় মন্ত্রের তিনটি অংশে পরপর তিনটি পরিধিকে জুহু দ্বারা অভিষিক্ত করতে মন্ত্রের অর্থ হয়,হে মধ্যম পরিধি, হে দক্ষিণ পরিধি, হে উত্তর পরিধি, বসু-দেবতার প্রীতির জন্য, রুদ্রদেবতার প্রীতির জন্য এবং আদিত্যদেবতার প্রীতির জন্য তোমাদের অভিষিক্ত করছি। ভাব এই যে,-পরিধি তিনটিকে অভিষিক্ত করলে সবনত্রয়-অভিমানী দেবগণ প্রীত হন। বলা বাহুল্য এইভাবে অন্যান্য মন্ত্রগুলিতে যে অর্থ করা হয়েছে তা যেন নিতান্তই যজ্ঞ-ব্যাপারের অনুরোধেই নির্ধারিত।আমরা আধ্যাত্মিক বিচারে, সূক্ষ্ম-চিন্তা-সমন্বিত যুক্তির দ্বারা এই মন্ত্রগুলিতে যে উচ্চভাব-দ্যোতকতা দেখেছি, তা-ই মর্মার্থে লিপিবদ্ধ করেছি] । ১৩।

.

চতুর্দশ অনুবাক

মন্ত্র- উভা বামিন্দ্রাগ্নী আহুধ্যা উভা রাধসঃ সহ মাদয়ধ্যৈ। উভা দাতারাবিষাং রয়ীণামুবা বাজস্য সাতয়ে হুবে বাম্।। অশ্রবং হি ভূরিদাবত্তরা বাং বিজামাতুরুত বা ঘা স্যালাৎ। অথা সোমস্য প্ৰতী যুবভ্যামিন্দ্রাগ্নী স্তোমং জনয়ামি নব্যম। ইন্দ্রাগ্নী নবতিং পুরো দাসপত্নীরধুনুতম। সাকমেকেন কৰ্ম্মণা। শুচিং নু স্তোমং নবজাতমদ্যোগ্নী বৃত্ৰহণা জুষেখা। উভা হি বাং সুহবা জোহবীমি তা বাজং সদ্য উশতে ধেষ্ঠা। বয়মু ত্বা পথম্পতে রথং ন বাজতয়ে। ধিয়ে পূষন্নমুহি। পথস্পথঃ পরিপতিং বচস্যা কামেন কৃতো অভ্যানডর্ক। স নো রাসছুরুধশ্চন্দ্রাগ্রা ধিয়ং ধিয়ং সীমধাতি প্ৰ পুষা। ক্ষেত্রস্য পতিনা বয়ং হিতেনেব জয়ামসি। গাম পোষয়িত্বা স নঃ মৃড়াতীদৃশে। ক্ষেত্রস্য পতে মধুমন্তমূৰ্ম্মিং ধেনুরিব পয়ো অসু ধু। মধুশ্রুতং ঘৃতমিব সুপূতমৃতস্য নঃ পতয়ো মৃড়য়ন্তু। অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মাম্বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান। যুযোধ্যস্মৰ্জ্জুহুরাণমেনো ভূয়িষ্ঠাং তে নমউক্তিং বিধেম। আ দেবানামপি পন্থামগন্ম যচ্ছবাম তদনু প্রবোম। অগ্নিৰ্বিাস যজাৎ সেদু হোতা সো অধ্বরাস ঋতুন কল্পয়াতি। যদ্বাহিষ্ঠং তদষ্ময়ে বৃহদ… বিভাবসসা। মহিষীব ত্বদ্রয়িস্তদ্বাজা উদীরতে। অগ্নে ত্বং পিরয়া নবব্যা অস্মাৎ স্বস্তিভিরিতি দুর্গাণি বিশ্বা। পৃষ্ণ পৃথ্বী বহুলা ন উৰ্ব্বী ভবা তোকায় তনয়ায় শং যোঃ। ত্বমগ্নে ব্রতপা অসি দেব আ মর্তে। ত্বং যজ্ঞেীড্যঃ। । যদ্বো বয়ং প্রমিনাম ব্ৰতানি বিদুষাং দেবা অবিদুষ্টরাসঃ। অগ্নিষ্টদ্বিশ্বমাতৃণাতি বিদ্বান্যেভিৰ্দেবাঁ ঋতুভিঃ কল্পয়াতি ॥১৪৷৷

মর্মার্থ- শক্তিজ্ঞানপ্রদায়ক হে ইন্দ্রাগ্নী দেবতা! আপনাদের উভয়কে আহ্বান করতে (পুজা করতে) ইচ্ছা করেছি; আপনাদের আরাধনারূপ ধনের দ্বারা আপনাদের আনন্দিত করব সঙ্কল্প করেছি;আপনারা উভয়ে ইহলোকে প্রাণশক্তিপ্রদ অন্নের এবং পরলোকে পরমার্থপ্রদ ধনের দাতা হন। অতএব আপনাদের উভয়কেই, জয়-দানের জন্য আহ্বান (পূজা) করছি। (ভাব এই যে, জ্ঞানশক্তিপ্রদায়ক ইন্দ্রাগীদেবদ্বয় পরিতৃপ্তি লাভ করুন এবং আমাদের শক্তি ও জ্ঞান প্রদান করুন)। শক্তিপ্রদায়ক হে দেবদ্বয়! আপনারা প্রকৃষ্টদানশীল–এইরকম শুনেছি বা শুনতে পাই; অপিচ, বিশিষ্ট অপত্যের উৎপাদয়িতা হতে অর্থাৎ বিশিষ্টধনপ্রদাতা হৃদয়রূপ গৃহ হতে আপনারা রিপুশত্রুদের হন্তারক হন। তার পর অর্থাৎ আপনারা ঐরকম গুণোপেত জেনে, জ্ঞানের ও ঐশ্বর্যের অধিপতি হে দেবদ্বয়! আপনাদের জন্য সত্ত্বভাবের অংশ উৎসর্গের জন্য অভিনব চিরন্তন মন্ত্রকে হৃদয়ে উৎপাদন করছি, প্রতিষ্ঠিত রাখছি। (এই মন্ত্রটি দেবমাহাত্ম্য-খ্যাপক। প্রার্থনামূলক এবং সঙ্কল্পসূচক। তাই প্রার্থনা এই যে,-দেবতাদ্বয় পরম দাতা ও শত্রুনাশক; হৃদয়ে তাদের প্রতিষ্ঠার জন্য আমি সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছি)। জ্ঞান ও শক্তিদায়ক (যথাক্রমে অগ্নি ও ইন্দ্র) হে দেবদ্বয়! আপনারা সঙ্কর্মের উপক্ষয়িতা (প্রতিবন্ধক) শত্রুদের অধ্যুষিত অসংখ্য শত্ৰুপুরীকে (ভাব এই যে, নবদ্বারবিশিষ্ট অসংখ্য-শত্ৰুপরিবেষ্ঠিত-কাম-ক্রোধ-ব্যাধি-শোক ইত্যাদি দ্বারা পরিবেষ্টিত আমাদের এই দেহরূপ গৃহকে) সকল শনাশের দ্বারা রক্ষণ ও পালন করেন। শত্রুনাশরূপ কর্মের দ্বারা অদ্বিতীয়ত্ব হেতু আপনাদের মহিমার অন্ত নেই অথবা সকল কর্মে অদ্বিতীয় আপনারা উভয়েই অশেষ মহিমায় অন্বিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। মন্ত্রে ভগবানের মহিমা প্রদর্শিত হয়েছে। অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ ইত্যাদি সবই সেই এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের বিভূতি। সুতরাং সকল কর্মের মধ্যে বিদ্যমান সকর্মসম্পাদক পরমেশ্বর সকলকে সঙ্কর্মে নিয়োজিত করেন। তাতে সৎকর্মসাধনে শত্রুসমূহ বিনষ্ট হয়। শত্রুনাশের দ্বারাই লোকে ভগবানের অশেষ কীর্তি বিঘোষিত হয়ে থাকে এবং সাধক ভগবানকে প্রাপ্ত হন)। সর্বশত্রুনাশক হে শক্তিজ্ঞানদায়ক দেবদ্বয়! আপনারা সর্বকালে আমাদের অনুষ্ঠিত সকল সৎকর্মে (প্রকৃষ্টভাবে অনুষ্ঠিত ভক্তিসহযুত সকল সৎকর্মে) চিরনুতন স্তুতি বা প্রার্থনা (সৎ-ভাব-সমন্বিত সৎকর্ম গ্রহণ করুন (সম্পাদন করুন)। হে দেবদ্বয়! আপনারা উভয়েই প্রকৃষ্ট হবিদায়ক অর্থাৎ সৎ-ভাব-প্রবর্ধক হোন। অতএব আপনাদের উভয়কে পূজা (অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত) করছি। আপনারা উভয়ে মোক্ষকামী সাধকের (অর্চনাকারী শরণাগত আমাদের) অভীষ্টপুরণের জন্য শ্রেষ্ঠ পরমার্থধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবানের করুণা ভিন্ন কেউই তার অনুগ্রহ লাভে সমর্থ হয় না। অতি অভাজনও যদি তার শরণ গ্রহণ করে, সে নিশ্চয়ই পরিত্রাণ লাভ করে। অতএব প্রার্থনা–জ্ঞানের এবং কর্মশক্তির দ্বারা সকল শক্তির আধার ভগবানের করুণা লাভ করে যেন পরাগতি প্রাপ্ত হই। মন্ত্রে এইরকম সঙ্কল্পই প্রকাশ পেয়েছে)। সৎ-মার্গ-পালক অথবা সৎপথের প্রবর্তক হে পোষক (সৎ-ভাবের পোষক) দেব বা দেবভাব! প্রার্থনাকারী আমরা পরমধন লাভের নিমিত্ত এবং সৎ-বুদ্ধি লাভের জন্য (অথবা পরমধনপ্রাপক সত্যৰ্ম-সাধনের জন্য) রথের মতো সংবাহক (অর্থাৎ যেভাবে তুমি রথের মতো পরিত্রাণকারক ও ভগবৎ-প্রাপক হও, সেই রকমভাবে) তোমাকে নিয়োজিত করছি। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। সঙ্কল্প এই যে, আমার কর্ম যাতে পরমার্থপ্রাপক হয়, সেই ভাবে যেন তাকে নিয়োজিত করতে পারি)। সবরকম শোভনমার্গের অধিপতি অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ সৎ-পথ-প্রদর্শক সর্বদ্রষ্টা (সকলের আকাক্ষণীয়) সেই দেবতাকে দেবভাবকে, কর্মফলের দানে এবং জ্ঞানভক্তি-সমন্বিত স্তোত্রের বা কর্মের দ্বারা, কর্মফল-সমর্পণেচ্ছু আমরা যেন অভিব্যাপ্ত করতে পারি বা প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও আত্ম-উদ্ধোধক। সর্বকর্মফল সমর্পণে ভগবৎ-সম্মিলন লাভের ইচ্ছা মন্ত্রে সুচিত হয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে,–সর্বকর্মফল ভগবানে ন্যস্ত করে যেন তার অনুগ্রহ-লাভে সমর্থ হই)। অপিচ, সৎ-মার্গের পালক সেই দেবতা, আমাদের শত্রুপ্রতিবন্ধক, চন্দ্রের মতো পরমানন্দ-সাধক পরমধন প্রদান করুন। অথবা, সেই পোষক ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের শত্রুপ্রতিবন্ধক চন্দ্রের মতো পরমানন্দ-দায়ক শুদ্ধসত্ত্ব পরমধনের প্রাপক হোক। অপিচ, সৎ-ভাবের পোষক সেই দেবতা আমাদের সকল সকর্ম বা প্রজ্ঞা প্রসাধন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের কর্ম সুফলমণ্ডিত হোক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের সৎপথে প্রবর্তিত করে ভগবান আমাদের শপ্রতিবন্ধক পরমানন্দপ্রদ পরমধন প্রদান করুন। সবাণীর হিতের নিমিত্ত বিশ্বের মঙ্গল-সাধনে উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্চনাকারী আমরা হৃদয়রূপ ক্ষেত্রের অধিস্বামী ভগবানের অনুগ্রহে যেন জ্ঞানজ্যোতিঃ ও কর্মশক্তি লাভে সমর্থ হই। সেই ক্ষেত্ৰপতি পরব্রহ্মা, সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা প্রবর্ধিত করে, জ্ঞানশক্তিদানে আমাদের সুখবর্ধন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমাদের জ্ঞান ও কর্মশক্তি আমাদের সুখের হেতুভূত হোক)। আমাদের হৃদয়রূপ আধারক্ষেত্রের অধিস্বামি হে ভগবন্! ধেনু যেমন দুগ্ধ দোহন (প্ৰদান) করে, সেইভাবে আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের মধ্যে মধুর মতো মুহুর্মুহু ক্ষরণশীল, ঘৃতের মতো বিশুদ্ধ ও পরমানন্দপ্রদ, শুদ্ধসত্ত্বের প্রবাহ দোহন (উপাদন) করুন। অপিচ, হে ভগবন! সকর্মের অনুষ্ঠাতা আমাদের সুখে স্থাপন করুন (নিত্যকাল আমাদের রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-ভগবান আমাদের সৎ-ভাবসম্পন্ন করুন এবং আমাদের হৃদয়সঞ্জাত সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের সুখহেতুভূত হোক)। প্রেজ্ঞানস্বরূপ হে ভগব। শুদ্ধসত্ত্বজনক দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত বিশ্বের সবরকম প্রকৃষ্ট-জ্ঞানের (প্রজ্ঞানের) উন্মেষকারী আপনি আমাদের পরমধন দানের জন্য আমাদের শোভনমার্গে (সৎপথে) পরিচালিত করুন। (ভগবানের বিজ্ঞানশক্তির পরিমাণ বা পরিসমীমা নেই। সেই ভগবান আমাদের সৎপথে পরিচালিত এবং সৎপথে নিয়োজিত করুন)। অপিচ, হে দেব! আমাদের হতে অর্থাৎ আমাদের অনুষ্ঠিত আরব্ধ কর্ম হতে অভিলষিত ক্রিয়া প্রতিবন্ধক পাপকে বিযুক্ত অর্থাৎ পৃথক করুন। হে দেব! আপনার প্রীতির জন্য নমস্কর্ম-সহযুত স্তুতিবাক্য উচ্চারণ করছি। (সৎকর্মের প্রতিবন্ধক শত্রুর অন্ত নেই। প্রজ্ঞানরূপী ভগবানের প্রভাবে সকল বাধক শত্রুই বিনাশ-প্রাপ্ত হয়। অতএব প্রার্থনা–হে ভগব! আমাদের সকর্মের বিরোধী অন্তঃশত্রুদের বিনাশ করুন এবং সৎ-ভাবের উন্মেষণে আমাদের অভীষ্ট ফল প্রদান করুন)। দেবগণের স্বভূত শোভনমার্গ যাতে আমরা প্রাপ্ত হতে পারি, আমরা যেন সেইরকম সাধনায় সমর্থ হই। (যে কর্ম সম্পাদনের দ্বারা আমরা দেবগণকে পেতে পারি, প্রকৃষ্টজ্ঞানে ভক্তিসমন্বিত চিত্তে অবিচ্ছেদে যথানুক্রমে আমরা যেন সেই কর্ম সাধন করতে সমর্থ হই)। তার পর সেই সৎ-মার্গের প্রদর্শক (বিজ্ঞাপক) প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ (আমাদের) দেবগণের প্রীতিসাধক অনুষ্ঠানের বিষয় জানিয়ে দিন। সেই জ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ দেবগণের আহ্বাতা– দেবভাবজয়িতা হন। অতএব ভগবান্ (আমাদের) সকর্মসমূহকে শত্রুর উপদ্রবরহিত করুন। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পজ্ঞাপক এবং প্রার্থনামূলক। প্রথমার্ধে সঙ্কল্প এবং শেষার্ধে প্রার্থনা বর্তমান)। প্রার্থনার ভাব এই যে,জ্ঞানদেব আমাদের সৎপথে প্রবর্তিত করুন। তার অনুগ্রহে আমাদের অন্তঃশত্রু বিনাশপ্রাপ্ত হোক। তাতে, সঙ্কর্মের সাধনে আমরা যেন পরম-অভীষ্ট লাভে সমর্থ হই। যে কর্ম সৎ-ভাব-বর্ধক ও ভগবৎ-প্রতিসাধক, প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের পরিতৃপ্তির (তার অনুগ্রহ লাভের) নিমিত্ত সেই কর্মই সম্পাদন করা অবশ্য কর্তব্য। পরমধনাধিপতে হে ভগবন্! আপনি আমাদের শ্রেষ্ঠ ধন প্রদান করুন। আপনার নিকট হতেই পরমার্থ ধন আগমন করে এবং আপনার নিকট হতেই বলপ্রাণ উপজিত হয়। (ভগবান্ সকলেরই অধিপতি পরমধন-প্রদাতা। যিনি যা কামনা করেন, তাঁর অনুগ্রহে তিনি তা-ই প্রাপ্ত হতে পারেন; ভগবানের মহিমার অন্ত নেই)। প্রজ্ঞানস্বরপ হে ভগবন্! আপনি আপনার শরণাগত উপাসক আমাদের ভবসমুদ্রের পারে নিয়ে যান। অপিচ, আমাদের অনুষ্ঠিত চিরন্তন স্তুতির (সু-অনুষ্ঠিত সঙ্কর্মের) দ্বারা পরিতুষ্ট হয়ে আমাদের যাবতীয় পাপ-আচরণ অতিক্রমণের সামর্থ্য দিন। আপনার অনুগ্রহে আমাদের নিবাসহেতুভূত পরমস্থান বিস্তীর্ণ হোক। আমাদের সৎ-ভাব-সম্বর্ধনের নিমিত্ত আপনি আমাদের সুখসম্বন্ধযুক্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবান আমাদের মঙ্গলবিধান করুন! আমাদের প্রতি করুণাধারা বর্ষণ করুন)। হে জ্ঞানময় দেব! স্বপ্রকাশ আপনি সকল প্রাণীর সৎকর্মের পালক হন; আর সকল যজ্ঞে-সকল সৎকর্মের অনুষ্ঠানে–আপনি পূজনীয় হন। (ভাব এই যে, সকল কর্মেই ভগবানের প্রভাব বিদ্যমান)। হে দেবগণ! ভগবৎকর্মে অনভিজ্ঞ অকিঞ্চন শরণাগত আমরা, আপনাদের সম্বন্ধি কর্মে, আপনার জ্ঞাতসারে অথচ আমাদের অজ্ঞাতসারে (অজ্ঞানতা বশতঃ) যদি কোনও প্রত্যবায় ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটিয়ে ফেলি, সর্বজ্ঞ জ্ঞানময় ভগবান্ সেই কর্মজাত প্রত্যবায় সবরকমে পূরণ করুন। (ভাব এই যে,-অকিঞ্চন আমরা অজ্ঞানতা বা মোহ বশতঃ ভগবানের কর্ম সম্পাদনকালে যে কিছু প্রত্যবায় ও ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটিয়ে ফেলি, ভগবান্ সে সকল পূরণ করে, আমাদের কর্মকে সুফল-সমন্বিত করুন)। অপিচ, যে কর্মে যে কিছু অঙ্গহানি ঘটে, সকল দেবগণ তা পূর্ণ করুন (ভাব এই যে,–প্রত্যবায় সংঘটিত হলেও-ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও ভগবানের অনুগ্রহে কর্ম। ফল-সমম্বিত হোক)। ॥ ১৪ ৷৷

[প্রথম প্রপাঠকের উপসংহারে, চতুর্দশ অনুবাকের এই মন্ত্রগুলিতে, চরম প্রার্থনার সূচনা হয়েছে। ভাষ্যের অনুক্রমণিকায় প্রকাশ,-এয়োদশ অনুবাকে দশপূর্ণমাসে যজ্ঞের মন্ত্র কথিত হয়েছিল। এখন, এই চর্তুদশ অনুবাকে দশপূর্ণমাস যজ্ঞের বিকৃতি-মন্ত্রগুলি উল্লিখিত হলো। এইরকম অনুক্রমনি করে, মন্ত্রগুলির ব্যাখ্যা ব্যপদেশে ভাষ্যকার সেগুলির সাধনের উপযোগী নানা প্রক্রিয়া-পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন। অনুবাকের প্রথম মন্ত্র–উভা বামিন্দ্রাগ্নী প্রভৃতি। গার্হপত্য অগ্নি-স্থাপনে এই মন্ত্র প্রযুক্ত হয়। এখানে ইন্দ্র পদে ঐশ্বর্যযুক্ত এবং অগ্নি পদে গাহপত্য অর্থ ভাষ্যানুক্রমণিকায় কথিত হয়েছে। আমরা ইন্দ্রাগ্নী পদে ভগবানের শক্তিরূপ ও জ্ঞানরূপ বিভূতির প্রকাশ লক্ষ্য করেছি। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ বলা হয়েছে-রাধসঃ সহ মাদয়ধ্বৈ। প্রচলিত অর্থে রাধসঃ পদে ধন বোঝায় বটে; কিন্তু সে ধন-কোন্ ধন? আরাধনা অর্থমূলক রাধ ধাতু থেকে ঐ পদ উৎপন্ন। সুতরাং আরাধনা-রূপ পূজা-রূপ ধনের দ্বারা আপনাকে হর্ষান্বিত ও পরিতৃপ্ত করব–এই ভাবই এখানে ব্যক্ত দেখি। অনুবাকের দ্বিতীয় মন্ত্র–অশ্রবং হি প্রভৃতি। ভাষ্যে মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে, তা এই,-লোকে কন্যার অত্যন্ত প্রিয় বিশিষ্ট জামাতা দৌহিত্র ইত্যাদি-রূপ প্রজা বহুরূপে বৃদ্ধি করে। ভ্রাতা ভগ্নী-স্নেহবশতঃ ভগ্নীর গৃহধন রক্ষার নিমিত্ত দাসদাসী প্রভৃতি বহুল পরিমাণে প্রদান করে। আপনারা উভয়ে তাদেরই বহু ধন এবং বহু প্রজা প্রদান করেন শুনেছি। অতএব হে ইন্দ্রাগ্নী! সোমসদৃশ পুরোডাশ প্রদানে আপনাদের চিত্তে নূতন হৰ্ষরূপ চিত্তবৃত্তি উৎপাদন করে স্তুতি সম্পাদন করছি। ভাষ্য এবং প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদি থেকে আমাদের ব্যাখ্যায় এই মন্ত্রের ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। তৃতীয় মন্ত্রের ব্যাখ্যা নিষ্কাশনেও ভাষ্যকারের কর্মকাণ্ডানুসারী বক্তব্যের সাথে আমরা একমত হতে পারিনি। ভাষ্যের অনুসারী প্রচলিত ব্যাখ্যাতে বলা হয়েছে–হে ইন্দ্রাগ্নী! তোমরা একই উদ্যোগের দ্বারা দাসগণের নবতিসংখ্যক পুরী কম্পিত করেছিলে। আমাদের ভাষ্যে নবদ্বারবিশিষ্ট দেহ বলা হয়েছে। অপরাপর মন্ত্রে ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। যেমন,-বৃত্ৰাহা পদে, বৃত্ৰপ্রমুখ শত্রুগণকে ইন্দ্র ও অগ্নি দেবতা বিনাশ করেন–ভাষ্যে ও ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে তা-ই উপলব্ধ হয়। এই প্রসঙ্গে পুরাণের একটি উপাখ্যানের–ইন্দ্র কর্তৃক বৃত্রাসুর-বধের কাহিনীর–অবতারণা করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যায় বৃত্র–মূর্তিমান অন্ধকার ও কুকর্ম; বৃত্র সকল অসৎ-ভাবের–সকল অনর্থের জনক। পঞ্চম মন্ত্র সম্পর্কে ভাষ্যকারের মত–মন্ত্রটি সত্ৰ-পুরোনুবাক্যা। ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ,-হে সুমাৰ্গপতি পুষা (দেবতা)। আপনাকে রথের ন্যায় সংযোজিত করছি। আমাদের অনুষ্ঠিত কর্ম যাতে অন্নপ্রাপক হয়, সেই জন্য। অনুবাকের ষষ্ঠ মন্ত্রেও শোভন-মার্গের অধিপতি পুষা দেবতার অনুগ্রহে সৎপথে প্রবর্তিত হয়ে কর্মফলভাগী হবার এবং আত্মায় আত্ম-সম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। আমরা পূষণ শব্দে পোষক, সৎ-ভাবপোষক দেবতা বা দেবভাব বুঝি। ভাষ্যমতে সপ্তম মন্ত্র পুরোনুবাক্যা এবং অষ্টম মন্ত্র যাজ্যা। সেইজন্য সপ্তম মন্ত্রের অর্থ হয়,পুত্র ইত্যাদির হিতের নিমিত্ত যেমন গবাদি জয়, তেমনি ক্ষেত্রপতির সাহায্যে আমরা গো, অশ্ব এবং পোষক অন্ন ইত্যাদির দ্বারা জয়যুক্ত হই। সেই ক্ষেত্ৰপতি সেই রকম গো-অশ্ব ইত্যাদির দ্বারা আমাদের সুখ-সাধন করুন। অষ্টম মন্ত্রে অর্থ হয়, –হে ক্ষেত্রপতি! ধেনু যেমন পয়ঃ প্রদান করে, সেইরকম আপনি মাধুর্যোপেত ঊর্মির মতো পুনঃ পুনঃ আবৃত্তিসম্পন্ন, দ্রব্যান্তরে মাধুর্যম্রাবী, পযুষিতত্ব-দোষ-রহিত ঘূতের ন্যায় সুপূত নারিকেলফল-ইখণ্ড-গুড় ইত্যাদি ভোগপদার্থ সমূহ প্রদান করুন। যজ্ঞকর্তা আমাদের আনন্দ-বর্ধন করুন। এই মন্ত্র দুটিতে ক্ষেত্রস্য পতি বলতে আমরা কি বুঝেছি, মর্মার্থেই তা প্রকাশিত। নবম মন্ত্রে শোভন-মার্গে গমন করে, জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম মার্গের সাধনায় ভগবানের সন্নিকর্ষলাভের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। এ মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ মতান্তর ঘটেছে। ভাষ্যমতে মন্ত্রটি দশপূর্ণমাস যজ্ঞের পুরোনুবাক্যা। সেই অনুসারে মন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়েছে,–হে অগ্নি! আপনি দশপূর্ণমাস ইষ্টির ফলরূপ ধনলাভের নিমিত্ত আমাদের অতিপাদদোষরহিত সুমার্গে পরিচালিত করুন। হে দেব! আপনি সবরকম পথের বিষয়ই অবগত আছেন। নরকহেতুক কুটিল অতিপাদরূপ পাপকে আমাদের সম্বন্ধ হতে বিমুক্ত করুন। তাহলে আমরা বহুরকমে আপনার নমস্কার উক্তি করব। এটা যেন আমরা মানসিক করছি, দেবতাকে প্রলোভন দেখিয়ে ষোড়শোপচারে গো-মহিষ বলিদানের অঙ্গীকার করছি–দেবতা যেন আমাদের ইচ্ছা পূরণ করেন। আমাদের মতে মন্ত্রটি অগ্নিরূপী–জ্ঞানরূপী ভগবানের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত। কর্মকাণ্ড-অনুসারে দশম মন্ত্রটি যাজ্যা। ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ হয়,–আমরা পূর্বে যে পথ হতে ভ্রষ্ট হয়েছিলাম, দেবগণের সেই পথ ইদানীং আমরা প্রাপ্ত হয়েছি। কি জন্য? সেই পথে আমরা যে কর্ম সম্পাদনে সমর্থ হবো, সেই কর্ম সাধনের জন্য। যদি আমরা অবিচ্ছেদ সেই কর্ম সম্পাদনে সমর্থ না হই, তথাপি পথের কর্তা আমাদের সেই অপরাধ গ্রহণ করবেন না। তিনি দেবগণের আহ্বানকারী। তিনি আমাদের নিমিত্ত তা বিজ্ঞানপন করুন। তিনি যজ্ঞের ঋতুকাল প্রভৃতি বিষয় কল্পনা করে থাকেন। আমাদের আধ্যাত্মিক অর্থ থেকে ভাষ্যের অর্থ কি ভাবে কিরকম স্বাতন্ত্র অবলম্বন করেছে, মিলিয়ে পাঠ করলেই তা বোঝা যাবে। কর্মকাণ্ড অনুযায়ী একাদশ মন্ত্র পুনোরুবাক্যা এবং দ্বাদশ মন্ত্র যাজ্যা। ভাষ্যমতে একাদশ মন্ত্রের অর্থ প্রার্থনীয় হবিঃ অগ্নির উদ্দেশ্যে বৃহৎ হোক। হে বিভাবসো! আমার প্রদত্ত কার্পাসবীজ এবং তিলপিষ্টক ইত্যাদি (খৈল) ভক্ষণ করে মহিষী (স্ত্রী মহিষ) যেমন বহু ক্ষীর ইত্যাদি দ্বারা আমাকে সম্ভজন করে, আপনিও তেমনভাবে ফলপ্রদানে আমাকে প্রবার্ধিত করুন। আপনার প্রসাদে ধন লাভ করলে, অন্ন ইত্যাদির উৎকর্ষ-সাধনে সমর্থ হবো। দ্বাদশ মন্ত্রের অর্থ-হে অগ্নি! আমাদের অপরাধ পরিহারের জন্য ইদানীং প্রবর্তিত নূতন স্তরে পরিতুষ্ট হয়ে আমাদের কর্মের ফল প্রদান করুন। আমরা যেন শাস্ত্র-অনুমোদিত অনুষ্ঠানে অতিপাদ এবং অব্ৰত-রূপ যাবতীয় পাপ অতিক্রম করতে পারি। অপিচ, আমাদের নিবাসের জন্য নগর-জনপদ ইত্যাদি বিস্তৃত হোক; শস্য-সম্পত্তি পরিবৃদ্ধির জন্য আমাদের ভূ-সম্পত্তি বৃদ্ধি পাক। এবং আমাদের পুত্র-দুহিতা প্রভৃতি অপত্যের জন্য আপনি সুখপ্রদ হোন। অর্থাৎ ইহলৌকিক সুখ-সাধক যে সব সামগ্রী আকাঙ্ক্ষণীয়, মন্ত্র দুটিতে সেইরকম প্রার্থনার বিষয়ই ভাষ্যে সূচিত হয়েছে। লৌকিক যজ্ঞকর্মে এমন কামনাই স্বাভাবিক। আমাদের মত আমাদের মর্মার্থেই প্রকাশিত। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ মন্ত্র দুটি ভাষ্যে ব্রাতপত্য যথাক্রমে পুরোনুবাক্যা ও যাজ্যা রূপে প্রযুক্ত হয়ে থাকে। দীক্ষা-গ্রহণ কালে এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান; ব্রাত্য-দোষ পরিহার-কল্পেই এই যজ্ঞের পরিকল্পনা। সুতরাং ভাষ্যমতে ত্রয়োদশ মন্ত্রের অর্থ–হে অগ্নি! আপনি মনুষ্যগণের মধ্যে ব্রতপালক দেবতা হন। আপনি সকল যজ্ঞেই স্তুত হয়ে থাকেন। চতুর্দশ মন্ত্রের অর্থ–হে আপনাদের সম্বন্ধি আমাদের অনুষ্ঠেয় ব্রত-সমূহ অত্যন্ত অজ্ঞান আমরা যদি প্রকৃষ্টভাবে করতে না পারি, যজ্ঞবিৎ অগ্নিদেব সে সকল পূরণ করুন। ঋতু উপলক্ষিত কালবিশেষে অর্থাৎ যে কালে যে দেবপূজার বিধি সেই সেই কালোচিত ব্ৰতও অগ্নিদেব পূর্ণ করুন। ফলতঃ, ত্রয়োদশ মন্ত্র অগ্নির গুণ-ব্যাখ্যানে প্রযুক্ত এবং চতুর্দশ মন্ত্র অপূরণ পুরণে অগ্নির অনুগ্রহ প্রার্থনা করা হয়েছে। আমরা সর্বত্র অগ্নি অর্থে জ্ঞান-দেবতা বোঝাতে চেয়েছি। জ্ঞানই যে সৎকর্মের পালক ও রক্ষক এবং সকল সকর্মের অনুষ্ঠানেই যে জ্ঞান-দেবতার প্রাধান্য, তা আপনা-আপনি উপলব্ধ হয়। ত্রয়োদশ মন্ত্রে আত্ম-উদ্বোধনার ভাবের সাথে জ্ঞান-দেবতার সেই মাহাত্ম্য-কথাই বিধৃত। চতুর্দশ মন্ত্রে ত্রুটি বিচ্যুতি পরিহার এবং প্রত্যবায় নিরাকরণ হয়েছে। এটাই আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে আমাদের সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য–চতুর্দশ অনুবাকের অধিকাংশ মন্ত্রই ঋগ্বেদ-সংহিতা থেকে সংগৃহীত] । ১৪।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *