১.১ জীববিজ্ঞানের উপাত্ত
ভাগ ১ – নিয়তি । পরিচ্ছেদ ১ – জীববিজ্ঞানের উপাত্ত
নারী? খুবই সরল, বলেন সরল সূত্রের অনুরাগীরা : সে একটি জরায়ু, ডিম্বাশয়; সে একটি মেয়েলোক–এ-শব্দই তার সংজ্ঞার জন্যে যথেষ্ট। পুরুষের মুখে স্ত্রীলিঙ্গ কথাটি অবমাননাকর শোনায়, তবু পুরুষ তার পাশবিক স্বভাব সম্পর্কে লজ্জিত হয় না; বরং কেউ যদি তার সম্পর্কে বলে : ‘সে পুরুষ!’ তখন সে গর্ব বোধ করে। স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি অমর্যাদাকর, এ-কারণে নয় যে এটি জোর দেয় নারীর পাশবিকতার ওপর, বরং এজন্যে যে এটি তাকে বন্দী করে রাখে তার লিঙ্গের মধ্যে; আর এমনকি নিরীহ বোবা পশুর মধ্যেও লিঙ্গ ব্যাপারটি যে পুরুষের কাছে ঘৃণ্য ও ক্ষতিকর মনে হয়, তার মূলে আছে নারী, যে পুরুষের মনে জাগিয়ে রাখে এক অস্বস্তিকর বৈরিতা। সে জীববিদ্যার মধ্যে খুঁজে পেতে চায় তার ভাবাবেগের যৌক্তিকতা। স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি মনে জাগিয়ে তোলে এক ভীতিকর চিত্রকল্প–একটি বিশাল, গোল ডিম্বাণু প্লাবিত ও নপুংসক করছে একটি ক্ষিপ্র শুক্রাণুকে; দানবিক ও স্ফীত রানী পতঙ্গ শাসন করছে পুরুষ দাসদের; আরাধনাকারী নারী ম্যান্টিস ও মাকড়সা, প্রেমে পরিতৃপ্ত হওয়ার পর, ভেঙে চুরমার করে খেয়ে ফেলছে তাদের সঙ্গীদের; কামোন্মত্ত কুকুরী তার পেছনে দূষিত গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে ছুটে চলছে গলিপথ দিয়ে; বানরী অশীলভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে পাছা এবং তারপর পালিয়ে যাচ্ছে ছেনালিপনার সাথে; এবং অত্যুকৃষ্ট বন্যপ্রাণী–বাঘিনী, সিংহিনী, চিতাবাঘিনী–ক্রীতদাসীর মতো ধরা দিচ্ছে তাদের পুরুষদের রাজকীয় আলিঙ্গনের তলে। পুরুষ নারীর ওপর চাপিয়ে দেয় নিষ্ক্রিয়, আগ্রহী, চতুর, নির্বোধ, উদাসীন, কামুক, হিংস্র, নিচ প্রভৃতি বিশেষণ। এবং সত্য ঘটনা হচ্ছে সে স্ত্রীলিঙ্গ। তবে আমরা যদি মামুলি কথা অনুসারে চিন্তা করা বাদ দিই, তখন অবিলম্বে উত্থাপিত হয় দুটি প্রশ্ন : প্রাণীজগতে স্ত্রীলিঙ্গ কী বোঝায়? আর নারীর মধ্যে প্রকাশ পায় কোন বিশেষ ধরনের স্ত্রীলিঙ্গ?
পুরুষ ও নারী দু-ধরনের সত্তা, বিশেষ প্রজাতির মধ্যে যাদের পৃথক করা হয় তাদের প্রজনন ভূমিকা অনুসারে; তাদের সংজ্ঞায়িত করা যায় শুধু পরস্পরসম্পর্কিত ভাবেই। তবে প্রথমেই এটা মনে রাখতে হবে যে বিশেষ প্রজাতিকে দুটি লিঙ্গে বিভক্ত করার ব্যাপারটি সব সময় সুনির্দিষ্ট নয়।
প্রকৃতিতে এটা সর্বজনীনভাবে প্রকাশিত নয়। প্রাণীদের কথা যদি বলি, এটা সুবিদিত যে এককোষী আণুবিক্ষণিক রূপসমূহে–ইনফিউসোরিয়া, অ্যামিবা, স্পোরাজোয়ান, এবং এ-জাতীয়তে–সংখ্যাবৃদ্ধি যৌনতা থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন। প্রতিটি কোষ বিশ্লিষ্ট ও উপবিশ্লিষ্ট হয় নিজে নিজেই। বহুকোষী প্রাণীদের মধ্যেও যৌনতা ছাড়াই বংশবৃদ্ধি ঘটতে পারে, কখনো এটা ঘটতে পারে বিশ্লিষ্টীকরণ প্রণালিতে, অর্থাৎ একটি দুই বা বহু টুকরো হয়ে, যেগুলো পরে হয়ে ওঠে একেকটি নতুন প্রাণী, এবং কখনো ঘটতে পারে পৃথকীকরণ প্রণালিতে, অর্থাৎ কুঁড়ি পৃথক হয়ে গড়ে তোলে নতুন প্রাণী। মিষ্টি পানির হাইড্রা, স্পঞ্জ, পোকা, টিউনিকেইট প্রভৃতিতে কুঁড়ি পৃথকীকরণ বেশ পরিচিত উদাহরণ। অসঙ্গম বংশবিস্তারে কুমারী স্ত্রীটির ডিম পুরুষের দ্বারা নিষিক্ত না হয়েই বিকশিত হয় ভ্রূণরূপে; তাই নাও থাকতে পারে পুরুষের ভূমিকা। মৌমাছিতে সঙ্গম ঘটে, কিন্তু ডিম পাড়ার সময় সেগুলো নিষিক্ত হতেও পারে, নাও হতে পারে। অনিষিক্ত ডিমগুলোর বিকাশের ফলে জন্মে পুরুষ মৌমাছি এবং জাবপোকার বেলা পুরুষ অনুপস্থিত থাকে প্রজন্ম পরম্পরায়, এবং অনিষিক্ত ডিমগুলো থেকে জন্মে স্ত্রীলিঙ্গ জাবপোকা। অসঙ্গম বংশবিস্তারের প্রক্রিয়াটি কৃত্রিমভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে সমুদ্রশল্য, তারামাছ, ব্যাং, এবং অন্যান্য প্রজাতির ওপর। এককোষী প্রাণীদের (প্রোটোজোয়া) মধ্যে অবশ্য দুটি কোষ মিলে গঠন করতে পারে জাইগোট বা জ্বণাণু, আর মৌমাছিতে নিষিক্তকরণ দরকার হয় যদি ডিমগুলো জন্ম দিতে চায় স্ত্রী মৌমাছি। জাবপোকার ক্ষেত্রে পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ই আবির্ভূত হয় শরৎকালে এবং এ-সময়ে উৎপাদিত ডিম খাপ খাইয়ে নেয় শীতের সাথে।
অতীতে কোনো কোনো জীববিজ্ঞানী এসব ঘটনা থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন যে এমনকি যে-সব প্রজাতি সঙ্গমহীন বংশবিস্তারে সমর্থ, সেগুলোর ক্ষেত্রেও প্রজাতির বলিষ্ঠতা নবায়নের জন্যে মাঝেমাঝে দরকার পড়ে নিষিক্তীকরণ–দুটি সত্তার বংশানুক্রমিক উপাদান মিশিয়ে নবযৌবন অর্জন। এ-প্রকল্প অনুসারে জীবনের সবচেয়ে জটিল রূপগুলোতে যৌনতাকে মনে হয় এক অপরিহার্য ব্যাপার; শুধু নিম্ন প্রাণীসত্তাগুলোই পারে যৌনতা ছাড়া বংশবিস্তার করতে; এবং এখানেও একটা বিশেষ সময়ের পর নিঃশেষিত হয়ে পড়ে প্রাণশক্তি। তবে এখন মোটামুটিভাবে এ-প্রকল্প পরিত্যাগ করা হয়েছে; গবেষণার ফলে এটা প্রতিপন্ন হয়েছে যে উপযুক্ত অবস্থায় কোনো লক্ষণীয় অবক্ষয় ছাড়াই চলতে পারে সঙ্গমহীন বংশবিস্তার।।
শুক্র ও ডিম, এ-দু-রকম জননকোষ উৎপাদন অবধারিতভাবে বোঝায় না যে। থাকতেই হবে দুটি পৃথক লিঙ্গ; সত্য হচ্ছে যে ডিম ও শুক্র, দুটি অত্যন্ত পৃথক প্রজনন কোষ, উভয়ই উৎপাদিত হতে পারে একই ব্যক্তির দ্বারা। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে বংশবিস্তারের দুটি রীতি সহাবস্থান করে প্রকৃতিতে, তারা উভয়ই বিশেষ বিশেষ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে সমর্থ, এবং জননকোষকে দুটি ভাগে পৃথক করার ব্যাপারটি নিতান্তই আকস্মিক। তাই বিভিন্ন প্রজাতিকে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ বলে নির্দেশ করা পর্যবেক্ষণের ন্যূনতম সত্য মাত্র।
ব্যাখ্যা না করেই অধিকাংশ দর্শনে এ-ব্যাপারটিকে গ্রহণ করা হয়েছে স্বতসিদ্ধ বলে। পাততায়ী উপকথা অনুসারে শুরুতে ছিলো পুরুষ, নারী, ও উভলিঙ্গ। প্রতিটি ব্যক্তির ছিলো দুটি মুখ, চারটি বাহু, চারটি পা, এবং দুটি সংযুক্ত শরীর। এক সময়ে তাদের বিশ্লিষ্ট করা হয় দু-ভাগে; এবং সেই থেকে এক ভাগ পুনরায় মিলিত হতে চায় আরেক ভাগের সাথে। পরে দেবতারা ঘোষণা করে যে বিসদৃশ দুই অর্ধাংশ যোগ করে সৃষ্টি করা হবে নতুন মানুষ। তবে এ-গল্প দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চাওয়া হয়েছে। প্রেম; শুরুতেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে লিঙ্গবিভাজন। আরিস্ততলও ব্যাখ্যা করেন নি এ-বিভাজনকে; কেননা যদি বস্তু ও গঠনকে পারস্পরিক সহযোগিতা করতে হয় সব কাজে, তাহলে সক্রিয় ও অক্রিয় নীতিকে দুটি ভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তিতে পৃথক করার দরকার পড়ে না। তাই সেইন্ট টমাস নারীকে ঘোষণা করেন ‘আকস্মিক সত্তা ব’লে, পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বোঝায় যৌনতার আকস্মিক বা সংযত প্রকৃতি। তবে যুক্তির প্রতি হেগেলের সংরাগ অসত্য বলে গণ্য হতো যদি তিনি এর একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যার উদ্যোগ না নিতেন। তাঁর মতে যৌনতা নির্দেশ করে সে-মাধ্যমটিকে, যা দিয়ে কর্তা অর্জন করে বিশেষ এক জাতিতে অন্তর্ভুক্তির বোধ। কর্তার জাতিবোধ সমতাবিধান করে তার ব্যক্তিগত বাস্তবতার অসম বোধের, তার নিজের প্রজাতির কারো সাথে মিলিত হয়ে সে তার মধ্যে বোধ করতে চায় নিজেকে, সম্পূর্ণ করতে চায় নিজেকে, এবং এভাবে সে নিজের প্রকৃতিতে একীভূত করতে চায় জাতিকে এবং তাকে করতে চায় অস্তিত্বশীল। এই হচ্ছে সঙ্গম। (প্রকৃতির দর্শন, খণ্ড ৩, উপপরিচ্ছেদ ৩৬৯)। হেগেল পরে বলেন যে মিলনপ্রক্রিয় সম্পন্ন করার জন্যে প্রথমে থাকতে হবে লৈঙ্গিক ভিন্নতা। কিন্তু তার ব্যাখ্যা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আমরা মনে করতে পারি যে বংশবিস্তারের প্রপঞ্চটি রয়েছে প্রাণীর সত্তার মধ্যেই। তবে আমাদের সেখানেই থামতে হবে। প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে লৈঙ্গিক ভিন্নতার দরকার পড়ে না। তবে একথা সত্য যে প্রাণীদের মধ্য এ-ভিন্নতা এতো ব্যাপক যে একে অস্বিত্বের যে-কোনো বাস্তবসম্মত সংজ্ঞার মধ্যেই গ্রহণ করতে হয়। একথা সত্য শরীর ছাড়া মন এবং অমর মানুষ অসম্ভব, কিন্তু অসঙ্গমী ও উভলৈঙ্গিক সমাজের কথা আমরা কল্পনা করতে পারি।
দুটি লিঙ্গের ভূমিকা সম্পর্কে পুরুষ পোষণ করে এসেছে বিচিত্র ধরনের বিশ্বাস। প্রথম দিকে সেগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিলো না, সেগুলো প্রকাশ করতে শুধু সামাজিক কিংবদন্তি। দীর্ঘকাল ধরে ধারণা করা হতো, এবং আজো কোনো কোনো আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাস করা হয় যে গর্ভসঞ্চারে পুরুষের কোনো ভূমিকা। নেই। পূর্বপুরুষদের প্রেতাত্মা সজীব জীবাণুরূপে মায়ের শরীরে ঢোকে বলে মনে করা হয়। পিতৃতান্ত্রিক সংস্থাগুলোর উদ্ভবের সাথে পুরুষ ব্যথভাবে দাবি জানাতে থাকে। বংশধরদের ওপর। জন্মদানে মায়ের একটি ভূমিকা স্বীকার করে নেয়াও দরকার হয়, তবে এটুকু স্বীকার করে নেয়া হয় যে সে শুধু ধারণ ও লালন করে একলা পিতার দ্বারা সৃষ্ট সজীব বীজটিকে। আরিস্ততল মনে করতেন ভ্রূণ উদ্ভূত হয় শুক্রাণু ও ঋতুস্রাবের রক্তের মিলনে, যাতে নারী সরবরাহ করে অক্রিয় বস্তু, আর পুরুষ দান করে শক্তি, সক্রিয়তা, গতি, জীবন। হিপ্পোক্রাতিস পোষণ করতেন একই রকম ধারণা; তাঁর মতে বীজ দু-ধরনের, দুর্বল বা নারীধর্মী, সবল বা পুরুষধর্মী। আরিস্ততলের তত্ত্ব মধ্যযুগ ধরে চলেছে এবং আধুনিক কাল পর্যন্ত টিকে আছে।
সতেরো শতকের শেষের দিকে হারভে সঙ্গমের পরপরই হত্যা করে দেখেন মাদি কুকুরদের এবং জরায়ুর শৃঙ্গে তিনি দেখতে পান ছোটো ছোটো থলে, যেগুলোকে তিনি ডিম বলে মনে করেন, তবে ওগুলো আসলে ছিলো ভ্রূণ। ডেনমার্কের শবব্যবচ্ছেদবিজ্ঞানী স্টেনো নারীর জননগ্রন্থির নাম দেন ডিম্বাশয়, যাকে আগে বলা হতো ‘নারীর অণ্ডকোষ’; সেগুলোর ওপর দেখতে পান ছোটো ছোটো স্ফীতি। ১৬৭৭ অব্দে ফন গ্রাফ এগুলোকে ডিম বলে মনে করেছিলেন, এবং এখন এগুলোকে বলা হয় গ্রাফীয় ডিম্বথলি। ডিম্বাশয়কে তখনও মনে করা হতো পুরুষের গ্রন্থির সদৃশ বলে। তবে একই বছরে আবিষ্কৃত হয় শুক্রাণু অণুজীব এবং এটা প্রমাণিত হয় যে এগুলো প্রবিষ্ট হয় নারীর জরায়ুতে; তবে মনে করা হয় সেখানে এগুলো নিতান্তই লালিত হয় এবং সেখানেই উদ্ভূত হয় নতুন সত্তাটি। ১৬৯৪-এ একজন ওলন্দাজ, হার্টসাকের, ছবি আঁকেন শুক্রাণুর মধ্যে গুপ্ত এক ‘মনুষ্যপ্রাণীর’, এবং ১৬৯৯-এ আরেক বিজ্ঞানী বলেন যে তিনি দেখতে পেয়েছেন শুক্রাণু লোম ঝরিয়ে চলছে, যার নিচে আবির্ভূত হয়েছে একটি মানুষ। তিনি তার ছবিও আঁকেন। এসব কল্পিত প্রকল্পে নারীর কাজ হচ্ছে এক সক্রিয় সজীব নীতিকে লালন করা। এসব ধারণা সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয় নি, তবে উনিশ শতকেও এগুলোর পক্ষে যুক্তি প্রয়োগ করা হতো। অণুবীক্ষণযন্ত্র ব্যবহার করে ১৮২৭ অব্দে ফন বায়েরের পক্ষে গ্রাফীয় ডিম্বথলির মধ্যে আবিষ্কার করা সম্ভব হয় স্তন্যপায়ী প্রাণীর ডিম। অল্প কালের মধ্যেই সম্ভব হয় ডিমের বিদারণ পর্যবেক্ষণ করা–অর্থাৎ কোষ বিভাজনের মধ্য দিয়ে বিকাশের সূচনা-স্তরগুলো দেখা; এবং ১৮৩৫-এ আবিষ্কৃত হয় সারকোড, পরে যাকে বলা হয় প্রোটোপ্লাজম। এর মধ্য দিয়েই ধরা পড়তে থাকে কোষের আসল প্রকৃতি। ১৮৭৯ অব্দে পর্যবেক্ষণ করা হয় তারামাছের ডিমের ভেতরে শুক্রাণুর অনুপ্রবেশ, এবং এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি জননকোষের কেন্দ্র, ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর সমতুল্যতা। নিষিক্ত ডিমের ভেতরে তাদের মিলনের প্রক্রিয়া বিস্তৃতভাবে উদ্ঘাটন করেন বেলজিয়ামের প্রাণীবিজ্ঞানী ভ্যান বেনেডেন।
তবে আরিস্ততলের ধারণাগুলো একেবারে বাতিল হয়ে যায় নি। হেগেল ধারণা পোষণ করতেন যে প্রয়োজনেই দুটি লিঙ্গ ভিন্ন, একটি সক্রিয় এবং অপরটি অক্রিয়, এবং অবশ্যই স্ত্রীলিঙ্গটিই অক্রিয়। ‘তাই এ-পার্থক্যের পরিণতিরূপে পুরুষ হচ্ছে সক্রিয় নীতি আর নারী হচ্ছে অক্রিয় নীতি, কেননা সে তার সংহতির মধ্যে থাকে অবিকশিত’ (হেগেল, প্রকৃতির দর্শন)। এমনকি ডিম্বাণু সক্রিয় নীতিরূপে গৃহীত হওয়ার পরও পুরুষেরা এর শান্ততার বিপরীতে শুক্রাণুর সজীব গতিশীলতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছে। আজকাল অনেক বিজ্ঞানী দেখিয়ে থাকেন এর বিপরীত প্রবণতা। অসঙ্গম বংশবিস্তার সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে তারা দেখতে পেয়েছেন শুক্রাণুর ভূমিকা নিতান্তই এক শারীর-রাসায়নিক প্রতিক্রিয়াসাধকের। এটা দেখানো হয়েছে যে অনেক প্রজাতিতে কোনো এসিডের উদ্দীপনায় বা একটা সূচের খোচায়ও ডিমের বিদারণ ঘটতে পারে এবং বিকাশ ঘটতে পারে ভ্রূণের। এটা ভিত্তি করে প্রস্তাব করা হয়েছে যে শুক্রাণু গর্ভসঞ্চারের জন্যে জরুরি নয়, এটা বড়োজোর একটি ভ্রূণকে গজিয়ে তুলতে সাহায্য করে; সম্ভবত ভবিষ্যতে প্রজননে পুরুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে।
বিপুল সংখ্যক প্রজাতিতে পুরুষ ও নারী সহযোগিতা করে প্রজননে। তাদের পুরুষ ও নারী হিশেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় প্রধানত তাদের উৎপাদিত জননকোষ–যথাক্রমে শুক্রাণু ও ডিম, অনুসারে। কিছু নিম্নপর্যায়ের উদ্ভিদ ও প্রাণীতে যে-কোষগুলো মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে, সেগুলো অভিন্ন; এবং এ-সমজননকোষতার ঘটনাগুলো তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা তারা নির্দেশ করে জননকোষের মৌলিক সাম্য। সাধারণভাবে জননকোষগুলো পৃথক, তবে তাদের সাম্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য। দু-লিঙ্গেই একই ধরনের আদিকালীন জীবাণু কোষ থেকে বিকশিত হয় শুক্রাণু ও ডিম। আদিকালীন কোষ থেকে স্ত্রীলিঙ্গের ভেতরে বিকশিত অপুষ্ট ডিম্বকোষ ও পুরুষের ভেতরে উদ্ভূত অপুষ্ট শুক্রকোষ প্রধানত ভিন্ন হয় প্রোটোপ্লাজমে, কিন্তু সংঘটিত প্রপঞ্চগুলো একই ধরনের। ১৯০৩ অব্দে জীববিজ্ঞানী অ্যান্সেল মত প্রকাশ করেন যে আদিকালীন জীবাণু কোষটি নিস্পৃহ, এবং যে-ধরনের জননগ্রন্থিতে এটি থাকে, অণ্ডকোষে বা ডিম্বাশয়ে, সে-অনুসারে এটি বিকশিত হয় শুক্রাণু বা ডিমরূপে। তবে এটা যাই হোক, প্রত্যেক লিঙ্গের আদিকালীন জীবাণু কোষেই থাকে একই সংখ্যক ক্রোমোসোম (যা ধারণ করে বিশেষ প্রজাতিটির বৈশিষ্ট্য), যা পুং ও স্ত্রীলিঙ্গে একই প্রক্রিয়ায় হ্রাস পায় অর্ধেক সংখ্যায়। বিকাশের এ-প্রক্রিয়াগুলোর শেষে (পুরুষের ক্ষেত্রে একে বলা হয় শুক্রাণু উৎপাদন প্রক্রিয়া, আর নারীর ক্ষেত্রে বলা হয় ডিম উৎপাদন প্রক্রিয়া) জননকোষগুলো পূর্ণবিকশিত হয়ে রূপ নেয় শুক্রাণু ও ডিমের; কিছু ব্যাপারে তাদের মধ্যে থাকে বিপুল পার্থক্য, তবে সাদৃশ্য থাকে এতে যে এদের প্রত্যেকে ধারণ করে এক প্রস্থ সমমূল্যের ক্রোমোসোম।
আজকাল এটা ভালোভাবেই জানা যে সন্তানের লিঙ্গ নির্ণীত হয় গর্ভাধানের সময় ক্রোমোসমের সংগঠন দিয়ে প্রজাতি অনুসারে এ-কাজটি সম্পন্ন করে থাকে পুরুষ জননকোষ অথবা নারী জননকোষ। স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে এ-কাজটি করে শুক্রাণু, যাতে উৎপাদিত হয় সমসংখ্যক দু-ধরনের উপাদান, এক ধরনের উপাদানে থাকে একটি X ক্রোমোসোম (যা থাকে সব ডিমেই), আরেক ধরনের উপাদানে থাকে একটি Y ক্রোমোসোম (যা থাকে না ডিমে)। X ও Y ক্রোমোসোম ছাড়াও শুক্রাণু ও ডিমে থাকে সমানসংখ্যক এ-ধরনের উপাদান। যখন শুক্রাণু ও ডিম মিলিত হয়ে গর্ভসঞ্চার ঘটে, তখন নিষিক্ত ডিমটিতে থাকে পূর্ণ দুই প্রস্থ ক্রোমোসোম। যদি গর্ভসঞ্চার ঘটে কোনো X বাহী শুক্রাণু দিয়ে, তাহলে নিষিক্ত ডিমটিতে থাকে দুটি x ক্রোমোসোম, এবং এটি পরিণত হয় স্ত্রীলিঙ্গে (XX)। যদি Y বাহী শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হয় ডিমটি, তাহলে ডিমটিতে উপস্থিত থাকে মাত্র একটি X ক্রোমোসোম, এবং এটি হয় পুংলিঙ্গ (XY)। পাখি ও প্রজাপতির বেলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়, যদিও রীতিটি থাকে একই; ডিমই ধারণ করে X বা Y, তাই ডিমই নির্ধারণ করে সন্তানের লিঙ্গ। মেন্ডেলের সূত্র দেখিয়েছে যে বংশানুক্রমে পিতা ও মাতার ভূমিকা সমান। ক্রোমোসোমগুলো ধারণ করে বংশানুক্রমের নিয়ন্ত্রকগুলো (জিন), এবং এগুলো সমপরিমাণে থাকে ডিমে ও শুক্রাণুতে।
এ-পর্যায়ে যা আমাদের বিশেষভাবে লক্ষ্য করার কথা, তা হচ্ছে যে জননকোষের কোনো একটিকে অপরটি থেকে উৎকৃষ্ট মনে করতে পারি না; যখন তারা মিলিত হয় তখন উভয়েই নিষিক্ত ডিমের মধ্যে হারিয়ে ফেলে নিজেদের স্বাতন্ত্র। প্রচলিত রয়েছে দুটি সাধারণ অনুমান, যে-দুটি অন্তত জৈবিক স্তরে স্পষ্টভাবে ভুল। প্রথমটি, অর্থাৎ নারীর অক্রিয়তার ব্যাপারটি, ভুল বলে প্রমাণিত হয় এ-ঘটনা থেকে যে নব জীবনের উদ্ভব ঘটে দুটি জননকোষের মিলনের ফলে; জীবনের স্ফুলিঙ্গ এ-দুটির কোনোটিরই একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ডিমের কেন্দ্রটি শুক্রাণুর কেন্দ্রের মতোই এক জীবন্ত সক্রিয়তার এলাকা। দ্বিতীয় ভুল অনুমানটি অবশ্য প্রথমটির বিরোধী। এটির মতে প্রজাতির স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয় নারীর দ্বারা, পুরুষ নীতি নিতান্তই এক বিস্ফোরক ও অস্থায়ী প্রকৃতির। তবে সত্য হচ্ছে ভ্রূণ বহন করে পিতা ও মাতা উভয়েরই জীবাণু, এবং মিলিতভাবে সে-দুটিকে সঞ্চারিত করে দেয় সন্তানসন্ততির ভেতরে, যাদের কেউ পুরুষ কেউ নারী। এটা যেনো এক উভলিঙ্গ জীবাণু প্রাণরস, যা পুরুষ ও নারীকে পেরিয়ে বেঁচে থাকে যখন তারা উৎপাদন করে সন্তান।
এসব বলার পর আমরা চোখ দিতে পারি শুক্রাণু ও ডিমের গৌণ পার্থক্যগুলোর ওপর। ডিমের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর রয়েছে ভ্রূণ লালন-পালনের শক্তি; এটি সংরক্ষণ করে এমন বস্তু, যা দিয়ে ভ্রূণটি গঠন করে গ্রন্থি। পরিণামে ডিমটি হয়ে ওঠে বিশাল, সাধারণত গোলাকার ও তুলনামূলকভাবে প্রকাণ্ড। পাখির ডিমের আকার সুপরিচিত; কিন্তু নারীর ডিম অনেকটা আণুবিক্ষণিক, আকারে মুদ্রিত যতিচিহ্নের সমান (ব্যাস .১৩২-.১৩৫ মিমি), তবে পুরুষের শুক্রাণু আরো অনেক ছোটো (দৈর্ঘ্য .০৪-.০৬ মিমি), এতো ছোটো যে এক ঘনমিটারে থাকতে পারে ৬০,০০০টি। শুক্রাণুর রয়েছে সুতোর মতো একটি লেজ ও ছোটো, চ্যাপ্টা ডিম্বাকার মাথা, যাতে থাকে ক্রোমোসোমগুলো। এর ওপর নেই কোনো জড়বস্তুর ভার; এটি পুরোপুরি জীবন্ত। এর পুরো কাঠামোই গতিশীল। আর সেখানে ডিমটি, প্রাণের ভবিষ্যৎ নিয়ে বৃহৎ, স্থিতিশীল; নারীর দেহাভ্যন্তরে বন্দী বা বাহ্যিকভাবে জলের ওপর ভাসমান অবস্থায় এটি অক্রিয়ভাবে অপেক্ষায় থাকে নিষিক্ত হওয়ার। পুংজননকোষটিই একে। খুঁজে বের করে। শুক্রানুটি সব সময়ই একটি নগ্ন কোষ; আর প্রজাতি অনুসারে ডিমটি কোনো খোল বা ঝিল্লিতে সংরক্ষিত থাকতেও পারে, নাও পারে, কিন্তু সব সময়ই যখন শুক্রাণু ডিমের সংলগ্ন হয় তখন চাপ প্রয়োগ করে ডিমের ওপর, কখনো কখনো ঝাকুনি দেয়, এবং গর্ত করে ঢোকে এর ভেতরে। খসে পড়ে লেজটি এবং বৃদ্ধি পায় মাথা, গঠন করে পুংকেন্দ্ৰপরমাণু, এবং এটি এগিয়ে চলে ডিম কেন্দ্ৰপরমাণুর দিকে। এ-সময়ে ডিমটি দ্রুত তৈরি করে একটি ঝিল্লি, যা ভেতরে অনুপ্রবেশে বাধা দেয় অন্য শুক্রাণুদের। ডিমের থেকে অনেক ছোটো বলে শুক্রাণু উৎপাদিত হয় অনেক বেশি পরিমাণে; তাই ডিমের অনুরাগপ্রার্থী অসংখ্য।
তাই ডিম, তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যে, কেন্দ্ৰপরমাণুতে, সক্রিয়; কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে অক্রিয়; নিজের ভেতরে আটকানো এর সংহত ভর জাগিয়ে তোলে রাত্রির অন্ধকার ও অন্তর্মুখি দ্রিাতুরতার বোধ। প্রাচীনদের কাছে গোলকের গঠন নির্দেশ করতে সীমাবদ্ধ বিশ্বকে, অনুপ্রবেশঅসম্ভব অণুকে। গতিহীন, ডিমটি অপেক্ষায় থাকে; এর বিপরীতে শুক্রাণুটি–মুক্ত, হালকাপাতলা, ক্ষিপ্র–জ্ঞাপন করে অস্তিত্বের অধীরতা ও অস্থিরতা। তবে এ-রূপককে বেশি দূর ঠেলে নেয়া ঠিক হবে না। ডিমকে অনেক সময় তুলনা করা হয়েছে অন্তর্ভবতার সাথে আর শুক্রাণুকে সীমাতিক্ৰমণতার সাথে; বলা হয়েছে শুক্রাণু যখন বিদ্ধ করে ডিমকে, তখন হারিয়ে ফেলে তার সীমাতিক্ৰমণতা, চলনশীলতা; যখন এটি হারিয়ে ফেলে তার লেজ, এক নিশ্চল ভর একে গ্রাস করে অবরুদ্ধ করে, নপুংসক করে। এটা ঐন্দ্রজালিক কাজ, খুবই উদ্বিগ্নকর, যেমন সব অক্রিয় কাজই উদ্বিগ্নকর, আর সেখানে পুংজননকোষের কাজগুলো যুক্তিসঙ্গত; এটি হচ্ছে গতি, যা স্থানকাল দিয়ে পরিমাপ করা যায়। এসব ধারণা মনের খেয়াল ছাড়া আর কিছু নয়। পুং ও স্ত্রী জননকোষ সংমিশ্রিত হয় নিষিক্ত ডিমে; তারা উভয়ই নিষ্ক্রিয় হয়ে সৃষ্টি করে এক নতুন পূর্ণাঙ্গতা। এটা মিথ্যে কথা যে ডিমটি লুব্ধতার সাথে গিলে ফেলে শুক্রাণুটি, এবং এও একই রকম মিথ্যে যে শুক্রাণুটি বিজয়ীর মতো জোরপূর্বক দখল করে ডিমটির এলাকা, কেননা সংমিশ্রণের ফলে উভয়েই হারিয়ে ফেলে স্বাতন্ত্র্য। যান্ত্রিক মনের কাছে গতিকে এক মহান যৌক্তিক প্রপঞ্চ ব’লে মনে হতে পারে, কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কাছেও এটা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া জননকোষের মিলনের পেছনে কী কী শারীর-রাসায়নিক ক্রিয়া কাজ করে, তা প্রমাক্তিতভাবে জানি না। তবে দুটি জননকোষের তুলনা থেকে আমরা পৌঁছোতে পারি একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে। জীবনের রয়েছে দুটি পরস্পরসম্পর্কিত গতিময় বৈশিষ্ট্য : অতিক্রম করেই শুধু একে রক্ষা করা যায়, আবার একে রক্ষা করলেই শুধু এ পেরিয়ে যেতে পারে নিজেকে। এ-দুটি হেতু সব সময়ই কাজ করে একসঙ্গে, এবং এদের পৃথক করার চেষ্টা খুবই অবাস্তব কাজ। এ-জননকোষের দুটি যখন মেশে পরস্পরের সাথে, তখনই তারা নিজেদের অতিক্রম ও স্থায়ী করে। কিন্তু নিজের গঠনের মধ্যেই ডিমটি বুঝতে পারে ভবিষ্যৎ চাহিদাগুলো, একে গঠন করা হয়েছে এমনভাবে যে এর মাঝে দেখা দেবে যে-জীবন, তা পোষণ করতে হবে তাকে। শুক্রাণুটি নিজের জাগানো ভ্রুণটিকে বিকশিত করার মতো কোনো সম্পদই ধারণ করে না। আবার, ডিমটি এমনভাবে স্থান বদলে করতে পারে না, যাতে জ্বলে উঠতে পারে একটি নতুন জীবন, কিন্তু শুক্রাণুটি পারে এবং ভ্রমণ করে। ডিমটির দূরদৃষ্টি ছাড়া নিষ্ফল হতে শুক্রাণুর আগমন; তবে শুক্রাণুর উদ্যোগ ছাড়া ডিমটিও চরিতার্থ করতে পারতো না তার জীবন্ত সম্ভাবনা।
তাই আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারি জননকোষ দুটি পালন করে মূলত অভিন্ন ভূমিকা; একত্রে তারা সৃষ্টি করে একটি জীবন্ত সত্তা, যার মধ্যে তারা দুজনেই লুপ্ত হয় এবং অতিক্রম করে যায় নিজেদের।
এসব সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে যদি সিদ্ধান্ত নিই যে নারীর স্থান হচ্ছে গৃহ, তাহলে তা হবে গোয়ার্তুমি; তবে গোঁয়ার্তুমিপূর্ণ পুরুষ আছে অনেক। আলফ্রেড ফুইলি, তার ল্য তাঁপেরমাঁ এৎ ল্য কারাকতের বইতে, নারীর সংজ্ঞা তৈরি করেছেন সর্বতোভাবে ডিম ভিত্তি করে, পুরুষের সংজ্ঞা তৈরি করেছেন শুক্রাণু ভিত্তি করে; এবং সন্দেহজনক তুলনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেছেন একরাশ অনুমানসিদ্ধ সুগভীর তত্ত্ব। প্রশ্ন হচ্ছে এসব সন্দেহজনক ধারণা প্রকৃতির কোন দর্শনের অংশ; নিশ্চিতভাবেই বংশানুক্রম সূত্রের অংশ নয়, কেননা এসব সূত্রানুসারে নারী ও পুরুষ একইভাবে উদ্ভূত হয় একটি ডিম ও একটি শুক্রাণু থেকে। আমি অনুমান করতে পারি যে এসব ঝাপসা মনে আজো ভাসে মধ্যযুগের পুরোনো দর্শনের টুকরো, যা শেখাতে যে মহাবিশ্ব হচ্ছে এক অণুবিশ্বের অবিকল প্রতিবিম্ব–ডিমকে কল্পনা করা হতো একটি ছোটো নারী। বলে, আর নারীকে এক বিরাট ডিমরূপে। এসব ঘোর, সে-আলকেমির যুগ থেকেই যা সাধারণত পরিত্যক্ত, উকট উদ্ভটভাবে আজকের উপাত্তের বৈজ্ঞানিক যথাযথতার বিপরীত, আধুনিক জীববিদ্যার সাথে মধ্যযুগের প্রতীকের কোনো মিল নেই। কিন্তু আমাদের তত্তপ্রস্তাবকেরা বিষয়টিকে ঠিকমতো দেখেন না। এটা স্বীকার করতে হবে যে ডিম থেকে নারী খুবই দূরের পথ। অনিষিক্ত ডিমে এমনকি স্ত্রীলিঙ্গতার ধারণাও প্রতিষ্ঠিত হয় না। হেগেল ঠিকই বলেছেন যে লৈঙ্গিক সম্পর্ককে জননকোষের সম্পর্কের কাছে ফেরানো যাবে না। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে নারীসত্তাকে পূর্ণাঙ্গরূপে বিচার করা।
অনেক উদ্ভিদে ও কিছু প্রাণীতে (যেমন শামুকে) দু-ধরনের জননকোষের উপস্থিতির জন্যে দু-ধরনের ব্যক্তির দরকার পড়ে না, কেননা প্রতিটি ব্যক্তিই উৎপাদন করে ডিম ও শুক্রাণু উভয়ই। এমনকি যখন লিঙ্গরা পৃথক, তখনও তাদের পার্থক্য এমন নয় যে তাদের পৃথক প্রজাতির বলে মনে হতে পারে। পুং ও স্ত্রীলিঙ্গদের বরং মনে হয় একই সাধারণ ভিত্তিমূলের বৈচিত্র্য বলে। দুটি লিঙ্গের ভ্রূণবিকাশের সময় যে-গ্রন্থি থেকে পরে গোনাড বা জনগ্রন্থি গঠিত হয়, শুরুতে সেটি থাকে অভিন্ন; বিশেষ এক স্তরেই গড়ে ওঠে অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয়, একইভাবে অন্যান্য যৌন প্রত্যঙ্গেরও প্রথমে থাকে একটি আদি অভিন্ন পর্ব, এ-সময়ে ভ্রূণের বিভিন্ন অংশ, যেগুলো পরে ধারণ করে সুস্পষ্ট পুরুষ বা নারীর গঠন, সেগুলো পরীক্ষা করেও ভ্রণের লিঙ্গ বোঝা সম্ভব নয়। এটা আমাদের উভলিঙ্গতা ও লিঙ্গভিন্নতার মাঝামাঝি অবস্থা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে অনেক সময়ই একটি লিঙ্গ ধারণ করে অন্য লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যসূচক কিছু প্রত্যঙ্গ; এর উদাহরণ ভাওয়া ব্যাং, যাতে পুরুষটির ভেতরে থাকে একটি অবিকশিত ডিম্বাশয়, যা নিরীক্ষামূলক অবস্থায় ডিম উৎপাদন করতে পারে। প্রজাতির মধ্যে স্ংখ্যার দিক দিয়ে সমান ও শুরু থেকে একইভাবে বিকশিত পুং ও স্ত্রীলিঙ্গীয়রা মূলতঁ সমতুল্য। প্রত্যেকেরই রয়েছে প্রজনন গ্রন্থি–ডিম্বাশয় ও অণ্ডকোষ–যাদের ভেতরে সমতুল্য প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয় জননকোষ। এ-গ্রন্থিগুলো লিঙ্গানুসারে কম-বেশি জটিল নালির ভেতর দিয়ে নিঃসরণ ঘটায় তাদের উৎপাদিত বস্তু; স্ত্রীলিঙ্গে ডিম্বনালির ভেতর দিয়ে সরাসরি বাইরে বেরোতে পারে ডিম; বা বহিষ্কৃত হওয়ার আগে কিছু সময়ের জন্যে থাকতে পারে অবসারণী অথবা জরায়ুর মধ্যে; পুংলিঙ্গে বীর্য রক্ষিত হতে পারে বাইরে বা থাকতে পারো কোনো কামপ্রত্যঙ্গ, যা দিয়ে এটা ঢুকিয়ে দেয়া হয় নারীদেহে। এসব ক্ষেত্রে স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গ পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত থাকে এক সমরূপ সম্পর্কে।
স্ত্রীলিঙ্গ বা নারীর সাধারণভাবে সিদ্ধ কোনো সংজ্ঞা দেয়া অত্যন্ত কঠিন। নারীকে ডিমবহনকারী ও পুরুষকে শুক্রাণুবহনকারী বলে সংজ্ঞায়িত করা যথেষ্ট নয়, কেননা জননকোষের সাথে জীবটির সম্পর্ক বেশ অনিয়ত। আবার, সব মিলিয়ে জীবটির ওপর সরাসরি বিশেষ প্রভাব নেই জননকোষের পার্থক্যের।
জীবন জটিলতম রূপ পরিগ্রহ করে স্তন্যপায়ীদের মধ্যে, এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র হয় সবচেয়ে অগ্রসর ও বিশিষ্ট। সেখানে পরিপোষণ ও সৃষ্টি বাস্তবায়িত হয় লিঙ্গপার্থক্যের মধ্যে; এ-গোত্রে, মেরুদণ্ডীদের মধ্যে, জননীই সন্তানদের সাথে রক্ষা করে ঘনিষ্ঠতম সস্পর্ক, আর জনক তাদের প্রতি দেখায় কম আগ্রহ। স্ত্রীলিঙ্গ জীব সম্পূর্ণরূপে মাতৃত্বের সাথে খাপ খাওয়ানো ও মাতৃতুসহায়ক, আর কামের উদ্যোগ গ্রহণই হচ্ছে পুংলিঙ্গের বিশেষ অধিকার।
স্ত্রীলিঙ্গ তার প্রজাতির শিকার। বছরের বিশেষ বিশেষ সময় জুড়ে, প্রত্যেক প্রজাতির জন্যে যা নির্দিষ্ট, তার সম্পূর্ণ জীবন নিয়ত্রিত থাকে এক লৈঙ্গিক চক্র (ঋতুচক্র) দিয়ে, বিভিন্ন প্রজাতিতে যার স্থিতিকাল ও ঘটনাপরম্পরা ভিন্ন। এ-চক্রের আছে দুটি পর্ব : প্রথম পর্বে ডিমগুলো (প্রজাতি অনুসারে যাদের সংখ্যা বিভিন্ন) পরিপকু হয় এবং পুরু ও নালিময় হয় জরায়ুর আভ্যন্তর আবরণ; দ্বিতীয় পর্বে (যদি নিষিক্ত না হয়) ডিমগুলো লুপ্ত হয়, ভেঙে পড়ে জরায়ুর প্রাসাদ, এবং বস্তুরাশি প্রবাহিত হয়ে বেরিয়ে আসে, নারী ও বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের স্তন্যপায়ীদের বেলা যাকে বলা হয় ঋতুস্রাব। যদি গর্ভসঞ্চার ঘটে, তাহলে দ্বিতীয় পর্বের স্থানে দেখা দেয় গর্ভ। ডিমনিঃসরণের (প্রথম পর্বের শেষে) কাল ওয়েস্ট্রাস বা গর্ভসঞ্চারকাল নামে পরিচিত এবং এটা হচ্ছে কামোত্তেজনা বা সঙ্গমের কাল।
স্ত্রীলিঙ্গ স্তন্যপায়ীদের কামাবেগ সাধারণত অক্ৰিয়; সে প্রস্তুত ও অপেক্ষমাণ থাকে পুরুষটিকে গ্রহণ করার জন্যে। স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে এটা ঘটে কখনো কখনো–যেমন কোনো কোনো পাখির ক্ষেত্রে–নারীটি পুরুষটির প্রতি সনির্বন্ধ আবেদন জানায়, তবে সে ডাকাডাকি, প্রদর্শনী, ইঙ্গিতপূর্ণ ছলাকলার বেশি কিছু করে না। সে পুরুষটির ওপর সঙ্গম চাপিয়ে দিতে পারে না। পুরুষটিই সিদ্ধান্ত নেয় পরিশেষে। পাখি আর স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে পুরুষটিই জোর করে সঙ্গম করে, আর অধিকাংশ সময় নারীটি আত্মসমর্পণ করে উদাসীনভাবে, এমনকি বাধাও দেয় পুরুষটিকে।
এমনকি যখন নারীটি ইচ্ছুক, বা উত্তেজকও থাকে, তখনও পুরুষটিই নেয় তাকে, সে নীত হয়। শব্দটি অনেক সময় ব্যবহৃত হয় আক্ষরিকার্থে, কেননা বিশেষ কোনো প্রত্যঙ্গের সাহায্যেই হোক বা বেশি বলের ফলেই হোক, পুরুষটি দখল করে তাকে এবং ধরে রাখে বিশেষ আসনে; পুরুষটিই সম্পন্ন করে সঙ্গমের আন্দোলনগুলো; এবং, পতঙ্গ, পাখি, ও স্তন্যপায়ীদের মধ্যে পুরুষটি বিদ্ধ করে নারীটিকে। এবিদ্ধকরণের ফলে ধর্ষিত হয় তার অভ্যন্তরতা, সে একটি দেয়ালের মতো, যাকে ভেঙেচুরে ভেতরে ঢোকা হয়েছে। এতে পুরুষ তার প্রজাতির ওপর কোনো পীড়ন করছে না, কেননা নিয়ত নতুন হয়েই শুধু টিকে থাকতে পারে কোনো প্রজাতি, এবং শুক্রাণু ও ডিম মিলিত না হলে প্রজাতিটি ধ্বংস হয়ে যাবে; কিন্তু নারী, যার ওপর। ভার দেয়া হয়েছে ডিম রক্ষার, সে তা নিজের ভেতরে ঢেকে রাখে, এবং তার শরীর, ডিমকে আশ্রয় দিতে গিয়ে রক্ষা করে পুরুষের উর্বরায়ণের কর্ম থেকে। তার শরীর হয়ে ওঠে একটি প্রতিরোধ, যাকে ভেঙেচুরে ঢুকতে হয়, আর তাকে বিদ্ধ করে পুরুষ লাভ করে সক্রিয়তার মধ্যে আত্মসিদ্ধি।
পুরুষের আধিপত্য প্রকাশ পায় সঙ্গমের আসনেই প্রায় সব প্রাণীতেই পুরুষটি থাকে নারীটির ওপর। এবং পুরুষটি ব্যবহার করে যে-প্রত্যঙ্গটি, সেটি একটি জড় বস্তু; কিন্তু এটি এখানে দেখা দেয় উত্তেজিত অবস্থায় এটি একটি হাতিয়ার। আর এ-কর্মে নারী প্রত্যঙ্গটি থাকে জড় আধারের স্বভাবে। পুরুষটি পাত করে তার বীর্য, নারীটি গ্রহণ করে। এভাবে, যদিও নারীটি প্রজননে পালন করে মূলত সক্রিয় ভূমিকা, সে বশ্যতা স্বীকার করে সঙ্গমে, যা আক্রমণ করে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে এবং বিদ্ধকরণ ও আভ্যন্তর গর্ভাধানের মধ্য দিয়ে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় এক বিরুদ্ধ বস্তু। যদিও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নারী কাম বোধ করতে পারে, কিন্তু সে যেহেতু কামাবেগের সময় চায় পুরুষ, তাই সে কামের অভিজ্ঞতাকে এক আভ্যন্তর ঘটনা হিশেবেই বোধ করে, পৃথিবী ও অন্যদের সাথে কোনো বাহ্যিক সম্পর্ক রূপে নয়।
তবে স্তন্যপায়ী নারী ও পুরুষের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এখানে : শুক্রাণু, যার ভেতর দিয়ে পুরুষটির জীবন সম্প্রসারিত হয় আরেকজনের মধ্যে, ওই মুহূর্তেই তার কাছে হয়ে ওঠে অচেনা এবং বিচ্ছিন্ন হয় তার শরীর থেকে; তাই পুরুষটি তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে সে-মুহূর্তেই ঠিকঠাক ফিরে পায় যখন সে অতিক্রম করে যায় এটির সীমা। ডিমটি, অন্য দিকে, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে নারীর শরীর থেকে যখন সেটি পূর্ণ বিকশিত হয়ে থলি থেকে বেরিয়ে এসে পড়ে ডিম্বনালিতে; কিন্তু বাইরের কোনো জননকোষ দিয়ে নিষিক্ত হলে এটা আবার প্রথিত হয়ে সংযোজিত হয় জরায়ুতে। প্রথম ধর্ষিত হয়ে, তারপর বৈরী হয়ে–নারী আংশিকভাবে, হয়ে ওঠে নিজের থেকে ভিন্ন আরেকজন। সে তার পেটের ভেতরে বহন করে ভ্রূণ যে-পর্যন্ত না সেটি পৌঁছে বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে যা বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভিন্ন গিনিপিগ জন্মে প্রায় প্রাপ্তবয়স্করূপে, ক্যাঙ্গারু জন্মে প্রায় ভ্রূণরূপেই। অন্যের ভাড়া খেটে, গর্ভধারণের কাল ভরে যে ফায়দা লোটে তার ওপর, নারী একই সময়ে হয়ে ওঠে নিজে এবং নিজের থেকে ভিন্ন আরেকজন; আর জন্মের পর সে নবজাতককে পান করায় নিজের বুকের দুধ। তাই এটা স্পষ্ট নয় ঠিক কখন এ-নতুন সত্তাটিকে গণ্য করা যেতে পারে স্বায়ত্তশাসিত ব’লে : গর্ভসঞ্চারের মুহূর্তে, জন্মের মুহূর্তে, বুকের দুধ ছাড়ানোর মুহূর্তে? লক্ষণীয় যে নারীটি পৃথক ব্যক্তিসত্তারূপে দেখা দেয় যতোবেশি স্পষ্টভাবে, জীবন তার পার্থক্যের ওপর ততোবেশি কর্তৃত্বের সাথে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে। মাছ ও পাখি, যারা বিকাশের আগেই নিজেদের ভেতর থেকে বের করে দেয় ভ্রূণ, স্ত্রীলিঙ্গ স্তন্যপায়ীদের থেকে কম দাসত্বে বন্দী থাকে শাবকদের কাছে। যেসময়গুলোতে মুক্ত থাকে মাতৃত্বের দাসত্ব থেকে, তখন স্ত্রীলিঙ্গটি মাঝেমাঝেই সমান হয়ে উঠতে পারে পুংলিঙ্গ জীবটির; অশ্বী অশ্বের মতোই দ্রুতগামী, শিকারী কুকুরীর ঘ্রাণশক্তি পুরুষ কুকরের মতোই তীক্ষ্ণ, বানরীও দেখায় বানরের সমান বুদ্ধিমত্তা। তবে এ-স্বাতন্ত্রেকে দাবি করা হয় না নিজের বলে; প্রজাতির মঙ্গলের জন্যে স্ত্রীলিঙ্গটি ত্যাগ করে এ-দাবি। প্রজাতি তার কাছে দাবি করে এ-ত্যাগস্বীকার।।
পুংলিঙ্গের ভাগ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। পরবর্তী প্রজন্মের দিকে তার সীমাতিক্রমণের মধ্যে সে নিজেকে দূরে রাখে, এবং নিজের মধ্যে রক্ষা করে নিজের স্বাতন্ত্র। পতঙ্গ থেকে উচ্চতম প্রাণী পর্যন্ত এ-বৈশিষ্ট্যটি স্থির। কামনা ও তৃপ্তির মধ্যে রয়েছে দূরত্ব, পুরুষটি তা কাটিয়ে ওঠে সক্রিয়ভাবে; সে নারীটিকে ঠেলে, খুঁজে বের করে, ছোঁয়, শৃঙ্গার করে, এবং বিদ্ধ করার আগে তাকে ত্যাগ করে। এ-কাজে ব্যবহৃত প্রত্যঙ্গগুলো অধিকাংশ সময়ই নারীর থেকে পুরুষে উৎকৃষ্টতর রূপে বিকশিত হয়েছে। এটা লক্ষ্য করার মতো যে-জীবনপ্রণোদনা উৎপাদন করে বিপুল পরিমাণ শুক্রাণু, তা-ই পুংলিঙ্গে প্রকাশ পায় উজ্জ্বল পালকভারে, দ্যুতিময় আঁশ, শিং, শিংয়ের শাখা, কেশরে, তার কণ্ঠধ্বনিতে, তার প্রাণোচ্ছলতায়। আমরা আর বিশ্বাস করি না যে কামোত্তেজনার সময় পুংলিঙ্গ সাজে যে-’বিয়ের সাজসজ্জায়, সেগুলোর, বা তার প্রলুব্ধকর ঠাটঠমকের আছে কোনো নির্বাচনমূলক তাৎপর্য; তবে এগুলো প্রতীয়মান করে জীবনশক্তি, যা পুংলিঙ্গের মধ্যে উদ্ভিন্ন হয় অপ্রয়োজনীয় ও চমকপ্রদ মহিমায়। এ-জৈবনিক অতিপ্রাচুর্য, যৌনমিলনের উদ্দেশ্যে এসব কর্মকাণ্ড, আর সঙ্গমের সময় স্ত্রীলিঙ্গের ওপর তার ক্ষমতার আধিপত্যশীল দৃঢ় ঘোষণা–এ-সবই পুরুষটির জীবন্ত সীমাতিক্ৰমণতার স্বাধিকার জ্ঞাপন। এ-ক্ষেত্রে হেগেল পুরুষের মধ্যে দেখেছেন যে-আত্মগত উপাদান, তা ঠিকই, আর নারীটি মোড়া থাকে নিজের প্রজাতিতে। আত্মগততা ও পৃথকতা নির্দেশ করে বিরোধ। কামোত্তেজিত পুংলিঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আক্রমণাত্মকতা; একে কামসঙ্গী লাভের প্রতিযোগিতা বলে ব্যাখ্যা করা যায় না, কেননা স্ত্রীলিঙ্গের সংখ্যা প্রায় পুংলিঙ্গের সমানই; বরং একে ব্যাখ্যা করতে হবে যুদ্ধ করার ইচ্ছের প্রতিযোগিতা হিশেবে। সঙ্গম একটি দ্রুত কর্ম এবং এতে পুরুষের শক্তি ক্ষয় হয় খুবই কম। সে পিতাসুলভ কোনো সহজাত প্রবর্তনাই দেখায় না অধিকাংশ সময়ই সে সঙ্গমের পরই বর্জন করে স্ত্রীলিঙ্গটিকে। যখন সে কোনো পরিবার সংঘের–একপতিপত্নীক পরিবার, হারেম, বা যূথের প্রধান হিশেবে স্ত্রীলিঙ্গটির কাছে থাকে, সে পালন ও রক্ষা করে সারাটি গোষ্ঠিকেই; খুব কম সময়েই সে কোনো শাবকের প্রতি পোষণ করে বিশেষ আগ্রহ।
যেমন প্রায় সব পশুর ক্ষেত্রে তেমনি মানুষের ক্ষেত্রেও নারীপুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান, পশ্চিমে লৈঙ্গিক অনুপাত হচ্ছে যেখানে ১০৫.৫টি পুরুষ আছে নারী আছে ১০০টি। দুটি লিঙ্গেরই ভ্রূণগত বিকাশ ঘটে একইভাবে; তবে, নারী ভ্রূণে আদিম জীবাণুজাত এপিথেলিয়ম (যা থেকে বিকাশ ঘটে অণ্ডকোষ বা ডিম্বাশয়ের) বেশি সময় ধরে থাকে নিরপেক্ষ, তাই এটি দীর্ঘতর সময় ধরে থাকে হরমোনের প্রভাবে। এর ফলে অনেক সময়ই এর বিকাশ সম্পূর্ণ উল্টে যেতে পারে। এজন্যেই হয়তো অধিকাংশ ছদ্মউভলিঙ্গ জিনের ধাচ-অনুসারে নারী, যারা পরে পুরুষে পরিণত হয়। মনে করতে পারি যে পুংলিঙ্গ সূচনায়ই তার রূপ পরিগ্রহ করে, আর স্ত্রীলিঙ্গ ভ্রূণ তার নারীত্ব গ্রহণ করে বেশ ধীরে; তবে জণজীবনের এ-আদিপ্রপঞ্চ সম্পর্কে আমরা আজো বেশ কমই জানি, তাই নিশ্চিতভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না।
হরমোনের রাসায়নিক সূত্র বা শরীরসংস্থান দিয়ে নারীকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। তার ভূমিকাগত বিকাশই নারীকে বিশেষভাবে পৃথক করে পুরুষ থেকে।
পুরুষের বিকাশ তুলনামূলকভাবে সরল। জন্ম থেকে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত তার বৃদ্ধির প্রায় পুরোটাই নিয়মিত; পনেরো-ষোলো বছর বয়সে শুরু হয় তার শুক্রাণু উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং চলে বুড়ো বয়স পর্যন্ত; এর উদ্ভবের সাথে উৎপাদন শুরু হয় সেহরমোনের, যা গড়ে তোলে তার দেহের পুরুষসূচক বৈশিষ্ট্য। এ-সময় থেকে পুরুষের যৌনজীবন সাধারণত সমম্বিত হয় তার ব্যক্তিক অস্তিত্বের সাথে : কামনায় ও সঙ্গমে প্রজাতির দিকে তার সীমাতিক্ৰমণতা অভিন্ন হয়ে ওঠে তার আত্মগততার সাথে সে হচ্ছে তার শরীর।
নারীর কাহিনী অনেক বেশি জটিল। তার জণজীবনেই সরবরাহ শুরু হয়ে যায় ওসাইট বা অপুষ্ট ডিম্বাণুর, ডিম্বাশয় ধারণ করে প্রায় ৪০,০০০ অপরিণত ডিম। এদের প্রতিটি থাকে একটি করে ফলিকল বা থলিতে, এবং এগুলোর মধ্যে হয়তো ৪০০টি পৌঁছে পরিণতিতে। জন্ম থেকেই প্রজাতিটি কবলিত করে নারীকে এবং তার মুঠো ক্রমশ শক্ত করতে থাকে। ওসাইটগুলো হঠাৎ বৃদ্ধি পায় বলে পৃথিবীতে আসার সময়ই নারী লাভ করে এক ধরনের বয়ঃসন্ধির অভিজ্ঞতা; তারপর এক সময় ডিম্বকোষটি হ্রাস পেয়ে হয়ে ওঠে আগের আকারের পাঁচ ভাগের একভাগ, বলা যায় যেনো স্থগিত করা হয় শিশুটির শাস্তি। যখন বিকাশ ঘটতে থাকে তার শরীরের, তখন তার কামসংশ্রয়টি থাকে প্রায় স্থিতিশীল; কিছু ফলিকল আয়তনে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পরিণতি লাভ করে না। বালিকার বিকাশ বালকের বিকাশের মতোই; একই বয়সে বালিকা কখনো কখনো বেশি লম্বা থাকে বালকের থেকে এবং তার ওজন হয় বেশি। কিন্তু বয়ঃসন্ধির সময় প্রজাতিটি পুনরায় তোলে তার দাবি। ডিম্বাশয়ের নিঃসরণের প্রভাবে বিকাশমান ফলিকলের সংখ্যা বাড়ে, ডিম্বাশয়টি লাভ করে বেশি রক্ত এবং আকারে বাড়ে, পরিপক্কতা লাভ করে একটি ফলিকল, ঘটে ডিমনিঃসরণ, এবং শুরু হয় ঋতুস্রাবচক্র; কামসংশ্রয় ধারণ করে তার চূড়ান্ত আকার ও গঠন, শরীর ধারণ করে রমণীয় রূপরেখা, এবং প্রতিষ্ঠিত অন্তঃক্ষরণের ভারসাম্য।
এসব সংঘটন রূপ নেয় এক সংকটের। নারীর শরীর প্রতিরোধ ছাড়াই প্রজাতির হাতে নিজের অধিকার তুলে দেয় না, আর এ-যুদ্ধ দুর্বলকর ও ভয়ঙ্কর। বয়ঃসন্ধির আগে ছেলে ও মেয়ের মৃত্যুর হার সমান; চোদ্দো থেকে আঠারো বছর বয়সে যেখানে ১২৮টি মেয়ে মারা যায় সেখানে ছেলে মারা যায় ১০০টি, এবং আঠারো থেকে বাইশ বছর বয়সের মধ্যে যেখানে ১০৫টি মেয়ে মারা যায় সেখানে ছেলে মারা যায় ১০০টি। এ-সময়ে মাঝামাল্পৈলেখা দেয় পাণ্ডুরোগ, যক্ষ্মা, মেরুদণ্ডবক্রতা, অস্থিপ্রদাহ। অনেক ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি ঘটে অস্বাভাবিকভাবে অকালে, চার বা পাঁচ বছর বয়সে। অনেকের বেলা আবার বয়ঃসন্ধি ঘটেই না, তারা থেকে যায় শিশুসুলভ এবং ভোগে ঋতুস্রাবের বিশৃঙ্খলায় (রজঃরোধ বা ঋতুযন্ত্রণায়)। কিছু কিছু নারীর মধ্যে বৃক্কসংলগ্ন গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত রস ক্ষরণের ফলে দেখা দেয় পুরুষসূচকচিহ্ন।
এসব অস্বাভাবিকতা নিজের প্রজাতির ওপর ব্যক্তিসত্তার বিজয় নির্দেশ করে না; মুক্তির কোনো পথ নেই, যেহেতু এটা দাসত্বে বন্দী করে ব্যক্তিকে, তাই প্রজাতিটি একে যুগপৎ সমর্থন ও পরিতোষণ করে। এ-দ্বৈততা প্রকাশ পায় ডিম্বাশয়ের। ক্রিয়াকর্মের স্তরে, যেহেতু নারীর প্রাণশক্তির মূল রয়েছে ডিম্বাশয়ে, যেমন পুরুষের রয়েছে তার অণ্ডকোষে। উভয় লিঙ্গেই খোজা ব্যক্তিসত্তা শুধুমাত্র বন্ধ্যা নয়; সে ভোগে প্রত্যাবৃত্তিতে, সে অধঃপতিত হয়। ঠিকমতো গঠিত না হওয়ার ফলে সম্পূর্ণ জীবটিই হয় নিঃস্ব এবং হয়ে পড়ে ভারসাম্যহীন; এটি বাড়তে ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে শুধু তখনই যদি বাড়ে ও সমৃদ্ধি লাভ করে তার কামপ্রত্যঙ্গসংশ্রয়। আবার অনেক প্রজননগত প্রপঞ্চ তার জীবনের প্রতি নির্বিকার এবং হয়ে উঠতে পারে নানা বিপদের উৎস। স্তনগ্রন্থি, যার বিকাশ শুরু হয় বয়ঃসন্ধির সময়, নারীর ব্যক্তিগত কোনো কাজেই আসে না : জীবনের যে-কোনো সময়ে সেগুলো কেটে ফেলে দেয়া যায়। ডিম্বাশয়ের কিছু নিঃসরণ কাজ করে ডিমের কল্যাণে, সাহায্য করে তার পরিণতি লাভে এবং জরায়ুকে গড়ে তোলে তার চাহিদা অনুসারে; জীবটিকে সব মিলিয়ে ধরলে দেখা যায় এগুলো শৃঙ্খলার বদলে সৃষ্টি করে ভারসাম্যহীনতা–নারী নিজের চাহিদা অনুসারে নিজেকে না গড়ে নিজেকে খাপ খাওয়ায় ডিমের চাহিদার সাথে।
বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত নারী হচ্ছে তার ভেতরে অভিনীত এক নাটকের রঙ্গমঞ্চ এবং তার সাথে সে ব্যক্তিগতভাবে সংশ্লিষ্ট নয়। অ্যাংলো-স্যাক্সনরা ঋতুস্রাবকে বলে অভিশাপ’; সত্যিই ঋতুস্রাবচক্র একটি বোঝা, এবং ব্যক্তিটির দৃষ্টিকোণ থেকে এটা এক নিরর্থক বোঝ। আরিস্ততলের সময়ে বিশ্বাস করা হতো যে প্রত্যেক মাসে রক্তস্রাব ঘটে এ-কারণে যে যদি গর্ভসঞ্চার হয়, তাহলে ওই রক্তে গড়ে উঠবে শিশুর রক্তমাংস; এবং এ-পুরোনো বিশ্বাসের মধ্যে সত্যটা এখানে যে নারী বারবার অঙ্কন করে গর্ভধারণের ভিত্তিমূলের রূপরেখা। নিম্নস্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চারচক্র সীমিত থাকে বিশেষ ঋতুতে, এবং এর সাথে কোনো রক্তস্রাব ঘটে না; সর্বোচ্চ শ্রেণীর স্তন্যপায়ীদের (বানর, বনমানুষ, এবং মানবজাতি) ক্ষেত্রেই শুধু প্রতি মাসে কম-বেশি যন্ত্রণার সাথে ঘটে রক্তক্ষরণ। যে- গ্রাফীয় থলি ডিমগুলোকে ঢেকে রাখে, প্রায় চোদ্দো দিনে তার একটি আয়তনে বাড়ে ও পরিপক্ক হয়, এর ফলে নিঃসরণ ঘটে ফোলিকিউলিন (এস্ট্রিন) হরমোনের। ডিম্বনিঃসরণ ঘটে মোটামুটিভাবে চোদ্দো দিনের দিন : একটি থলি ডিম্বাশয়ের ভেতর দিয়ে বাইরে বেরোতে শুরু করে এবং ভেঙে বেরিয়ে যায় (এতে সামান্য রক্তক্ষরণ ঘটে), ডিমটি গিয়ে পড়ে ডিম্বনালিতে; এবং ক্ষতটি পরিণত হয় হলুদ বস্তুতে। হলুদ বস্তুটি নিঃসরণ ঘটাতে শুরু করে প্রোজেসটেরোন হরমোন, যা ঋতুচক্রের দ্বিতীয় পর্বে কাজ করতে থাকে জরায়ুর ওপর। জরায়ুর দেয়াল-আস্তরণ হয়ে ওঠে পুরু ও গ্রন্থিল ও রক্তনালিতে পূর্ণ, একটি নিষিক্ত ডিমকে গ্রহণ করার জন্যে জরায়ুর ভেতর তৈরি করে একটি দোলনা। কোষের এ-বিস্তার যেহেতু উল্টোনো অসম্ভব, তাই ডিম্বনিষিক্তি না ঘটলে এ-সৌধ টিকিয়ে রাখা হয় না। নিম্নস্তরের স্তন্যপায়ীতে এ-আবর্জনা ক্রমশ বেরিয়ে যায়; কিন্তু নারী ও অন্যান্য উচ্চস্তন্যপায়ীতে এ-পুরু দেয়াল-আস্তরণ (এন্ডোমেট্রিয়াম) হঠাৎ ভেঙে পড়ে, খুলে যায় রক্তনালি ও রক্তের এলাকা, এবং রক্তিম বস্তুরাশি রক্তপ্রবাহরূপে চুইয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর যখন প্রত্যাবৃত্ত হয় হলুদ বস্তু, তখন আবার গড়ে ওঠে জরায়ুর আস্তরণের ঝিল্লি এবং শুরু হয় চক্রের আরেক ডিম্বথলীয় পর্ব।
এ-জটিল প্রক্রিয়া, যা আজো তার নানা এলাকায় রহস্যপূর্ণ, চলে নারীর সম্পূর্ণ সত্তাটিকে জড়িয়ে। অধিকাংশ নারী–শতকরা ৮৫জনেরও বেশি–ঋতুস্রাবের সময় ভোগে কম-বেশি যন্ত্রণায়। ঋতুস্রাব শুরুর আগে বাড়ে নারীর রক্তচাপ এবং পরে যায় কমে; বাড়ে ধমনীর স্পন্দন ও মাঝেমাঝে শরীরের তাপ, তাই মাঝেমাঝেই দেখা দেয় জ্বর; তলপেট ব্যথা করে; কখনো কখনো দেখা দেয় কোষ্ঠকাঠিন্য ও তারপর। উদরাময়; মাঝেমাঝে দেখা দেয় যকৃতে প্রদাহ; অনেকের গলা জ্বালা করে ও অনেকে কানে কম শোনে চোখে কম দেখে; ঘাম বাড়ে, এবং রক্তস্রাবের শুরুতে দেখা দেয়। একটা দুর্গন্ধ সুই গেনেরিস, যা খুবই তীব্র এবং থাকতে পারে সারা ঋতুচক্র ভ’রে। বৃদ্ধি পায় মৌলবিপাকের হার। রক্তের লাল কণিকা হ্রাস পায়। আক্রান্ত হয় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, তার ফলে মাথা ধরে মাঝেমাঝেই, বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র স্নায়ুতন্ত্র; কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যে অসচেতন নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায়, দেখা দেয় খেঁচুনিপূর্ণ। প্রতিবর্ত, যার ফলে ঘটে মেজাজের খামখেয়ালিপনা। এ-সময়ে নারী হয় স্বাভাবিকের থেকে বেশি আবেগপরায়ণ, বেশি বিচলিত, বেশি খিটখিটে, এবং তার দেখা দিতে পারে মারাত্মক মানসিক বিকলন। ঋতুস্রাবের সময়ই নারী তার শরীরকে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে অনুভব করে এক অবোধ্য, বিরোধী জিনিশ হিশেবে; এটা এমন এক একগুঁয়ে ও বাহ্যিক জীবনের শিকার, যে প্রতিমাসে তার ভেতরে তৈরি করে ও ভেঙে ফেলে একটি দোলনা; প্রতিমাসেই সব কিছু প্রস্তুত করা হয় একটি শিশুর জন্যে, তারপর নিঃসরণ করে দেয় রক্তিম ধারায়। নারী, পুরুষের মতোই, নিজের শরীর; তবে তার শরীর তার নিজের থেকে ভিন্ন এক জিনিশ।
নারী অভিজ্ঞতা অর্জন করে আরো গভীর এক বিচ্ছিন্নতাবোধের, যখন ঘটে গর্ভাধান এবং বিশ্লিষ্ট ডিম এসে পড়ে জরায়ুতে ও বিকশিত হতে থাকে। এটা সত্য যে স্বাস্থ্য ভালো থাকলে গর্ভধারণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এটা মায়ের জন্যে ক্ষতিকর নয়; তখন তার ও ভ্রূণের মধ্যে ঘটে কিছু পারস্পরিক ক্রিয়া, যা তার জন্যে বেশ উপকারী। তবে সামাজিক প্রয়োজন থাকলেও গর্ভধারণ অবসাদের কাজ, যা শারীরিকভাবে নারীর ব্যক্তিগত কোনো উপকারে আসে না, বরং তার কাছে দাবি করা হয় বড়ো রকমের ত্যাগস্বীকার। প্রথম মাসগুলোতে মাঝেমাঝেই দেখা দেয় ক্ষুধাহীনতা ও বমনপ্রবণতা, যা কোনো গৃহপালিত স্ত্রীলিঙ্গ পশুতে দেখা যায় না; এটা নির্দেশ করে আক্রমণকারী প্রজাতিরবিরুদ্ধে নারীর বিদ্রোহ। প্রসবের সময় মাঝেমাঝে ঘটে নানা মারাত্মক দুর্ঘটনা বা গর্ভধারণের কালে তার মধ্যে ঘটে নানা বিকলন; আর নারীটি যদি শক্তিশালী না হয়, যদি না নেয়া হয় স্বাস্থ্যগত সাবধানতা, তাহলে বারবার গর্ভধারণের ফলে নারীটি হয়ে ওঠে অকালে বৃদ্ধ, বা ঘটে মৃত্যু, যা গ্রামের দরিদ্র নারীদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘটে। প্রসবের ব্যাপারটি যন্ত্রণাদায়ক ও ভয়ঙ্কর। এ-সংকটের সময় দেখা যায় যে নারীর শরীরটি সব সময় প্রজাতি ও ব্যক্তি উভয়েরই জন্যে সুবিধাজনক রীতিতে কাজ করে না; নবজাতকের মৃত্যু ঘটতে পারে, এটি জন্ম নিতে গিয়ে হত্যা করতে পারে মাকে বা তার মধ্যে জন্মাতে পারে দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি। বলা হয়ে থাকে যে নারীর ‘তলপেটে আছে দুর্বলতা’; এবং এটা সত্য যে তাদের অভ্যন্তরে থাকে এক বিরূপ উপাদান–তার মর্মস্থানে প্রজাতির এক ধারাবাহিক দংশন।
পরিশেষে নারী তার প্রজাতির লৌহমুষ্টি থেকে মুক্তি পায় আরেক গুরুতর সংকটের মধ্য দিয়ে : সেটি হচ্ছে ঋতুবন্ধ, বয়ঃসন্ধির যা বিপ্রতীপ, যা দেখা দেয় পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের মধ্যে। কমতে কমতে থেমে যায় ডিম্বাশয়ের ক্রিয়াকলাপ, যার ফলে হ্রাস পায় নারীটির জীবনশক্তি। দেখা দেয় উত্তেজনার নানা চিহ্ন, যেমন, উচ্চ রক্তচাপ, মুখের হঠাৎ তপ্ত রক্তিমাভা, বিচলন, এবং কখনো কখনো কামাবেগ বৃদ্ধি। অনেক নারীর শরীরে এ-সময় বাড়ে মেদ; অনেকে হয়ে ওঠে পুরুষধর্মী। অনেকের মধ্যে স্থাপিত হয় এক নতুন অন্তঃক্ষরণের ভারসাম্য। নারী এখন মুক্তি পায় তার নারীপ্রকৃতি কর্তৃক তার ওপর চাপিয়ে দেয়া দাসত্ব থেকে, কিন্তু তাকে খোজার সাথে তুলনা করা যায় না, কেননা তার জীবনশক্তি নষ্ট হয়ে যায় নি। তাছাড়াও, সে আর শিকার নয় বিপর্যয়কর শক্তিরাশির; সে হচ্ছে নিজে, সে আর তার শরীর এখন। অভিন্ন। কখনো কখনো বলা হয় যে বিশেষ বয়সে নারী হয়ে ওঠে একটি তৃতীয় লিঙ্গ’; এবং সত্য হচ্ছে এ-সময়ে তারা পুরুষ না হলেও তারা আর নারীও নয়। নারীশারীরবৃত্ত থেকে এ-মুক্তি কখনো কখনো প্রকাশ পায় তার স্বাস্থ্যে, ভারসাম্যে, বলিষ্ঠতায়, যা আগে তার ছিলো না।
প্রধান লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়াও নারীর আছে কতকগুলো অপ্রধান লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য, যা হরমোনের ক্রিয়ার ফলে প্রত্যক্ষভাবে কিছুটা কম-বেশি প্রথমটিরই। পরিণতি। সাধারণত নারী পুরুষের থেকে খাটো ও কম ভারি, তার কঙ্কাল অনেক বেশি ভঙ্গুর, এবং গর্ভধারণ ও প্রসবের প্রয়োজনে শ্রোণীদেশ বৃহত্তর; তার সংযোগী কলাতন্তুরাশি জমায় বেশি মেদ আর তার দেহরেখা পুরুষের থেকে বেশি গোলগাল। সাধারণভাবে আকৃতি গঠন, ত্বক, চুল–দু-লিঙ্গে স্পষ্টভাবে ভিন্ন। নারীর মধ্যে পেশিশক্তি অনেক কম, প্রায় পুরুষের তিন ভাগের দু-ভাগ, ফুসফুল ও শ্বাসনালি ছোটো বলে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শক্তিও কম। তার স্বরযন্ত্র তুলনামূলকভাবে ছোটো, এর ফলে নারীর কণ্ঠস্বর উচ্চ। নারীর রক্তের আপেক্ষিক গুরুত্ব কম এবং তাতে হিমোগ্লোবিন, লাল কণিকা, কম; তাই নারীরা কম বলিষ্ঠ এবং পুরুষের থেকে বেশি ভোগে রক্তাল্পতায়। তাদের ধমনীর স্পন্দন বেশি দ্রুত, তাদের সংবহনতন্ত্র কম সুস্থিত, তাই সহজেই গাল রাঙা হয়ে ওঠে, সাধারণভাবে অস্থিতিশীলতা নারীর সংস্থানের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এ-সুস্থিতি ও নিয়ন্ত্রণের অভাবই রয়েছে নারীর আবেগপরায়ণতার মূলে, যা জড়িয়ে আছে তার রক্তসংবহনের ওঠানামার সাথে–হৎপিণ্ডের কম্পন, গাল রঙ দুওেঠা ইত্যাদি–আর এজন্যেই নারী দেখিয়ে থাকে নানা উত্তেজনা, যেমন অশ্রুপাত, উন্মত্ত হাস্য, এবং নানা স্নায়বিক সংকট।
চারিত্রিক এসব বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলোই উদ্ভূত হয় নিজের প্রজাতির কাছে নারীর অধীনতার কারণে; এবং এখানেই আমরা পাই এ-জরিপের সবচেয়ে চমকপ্রদ উপসংহার : উদাহরণস্বরূপ, নারী সব স্তন্যপায়ী স্ত্রীলিঙ্গের মধ্যে এমন একজন, যে সবচেয়ে গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন (তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বাহ্যিক শক্তির শিকার), এবং যে এবিচ্ছিন্নবোধকে প্রতিরোধ করে সবচেয়ে প্রচণ্ডভাবে; আর কারো মধ্যেই প্রজননের কাছে দাসত্বের ব্যাপারটি এতো বেশি কর্তৃত্বব্যঞ্জক নয় বা আর কেউ এতো অনিচ্ছায় গ্রহণ করে না একে। বয়ঃসন্ধি ও ঋতুবন্ধের সংকট, মাসিক অভিশাপ’, দীর্ঘ ও অনেক সময় কষ্টকর গর্ভধারণ, বেদনাদায়ক ও অনেক সময় ভয়ঙ্কর সন্তানপ্রসব, অসুখ, অপ্রত্যাশিত রোগের লক্ষণ ও জটিলতা–এসব হচ্ছে মানব স্ত্রীলিঙ্গের বৈশিষ্ট্য। তার সাথে তুলনায় পুরুষ পেয়েছে অসীম সুবিধা : ব্যক্তি হিশেবে তার কামজীবন তার অস্তিত্বের বিরোধী নয়, এবং জৈবিকভাবে এর বিকাশ নিয়মিত, এর কোনো সংকট নেই এবং সাধারণত নেই কোনো দুর্ঘটনা। গড়ে নারী বাঁচে পুরুষেরই সমান, বা বেশি; কিন্তু তারা অসুস্থ থাকে বেশি, এবং অনেক সময় তাদের নিজেদের ওপর থাকে না তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ।
এ-জৈবিক ব্যাপারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীর ইতিহাসে এগুলো পালন করে প্রধান ভূমিকা এবং হয়ে ওঠে তার পরিস্থিতির এক অত্যাবশ্যক উপাদান। আমাদের পরবর্তী আলোচনা ভ’রে এগুলোকে আমরা সব সময় মনে রাখবো। কেননা, শরীর যেহেতু বিশ্বকে উপলব্ধি করার জন্যে আমাদের হাতিয়ার, তাই বিশ্বকে এক ধরনে উপলব্ধি করলে যেমন মনে হবে অন্য ধরনে উপলব্ধি করলে মনে হবে খুবই ভিন্ন জিনিশ বলে। এজন্যেই আমরা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি জৈবিক সত্যগুলো; এগুলো নারীকে বোঝার অন্যতম চাবি। তবে আমি স্বীকার করি না যে এগুলো তার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছে এক চিরস্থির ও অবধারিত নিয়তি। কোনো লৈঙ্গিক স্তরক্রম সৃষ্টির জন্যে এগুলো যথেষ্ট নয়; এগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে না নারী কেননা অপর; এগুলো নারীকে চিরকালের জন্যে অধীন ভূমিকায় থাকার দণ্ডে দণ্ডিত করে না।
মাঝেমাঝেই মনে করা হয়েছে যে শুধু শরীরসংগঠনেই খুঁজতে হবে এসব প্রশ্নের উত্তর : দু-লিঙ্গেরই কি ব্যক্তিগত সাফল্যের সুযোগ সমান? প্রজাতির মধ্যে কোনটি পালন করে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা? তবে মনে রাখতে হবে যে এসব পার্থক্যের মধ্যে প্রথমগুলো অন্যান্য স্ত্রীলিঙ্গের সাথে তুলনায় অনেক ভিন্ন নারীর বেলা; পশু প্রজাতিতে এগুলো স্থির এবং তাদের চিরস্থিরতার ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়–শুধু পর্যবেক্ষণ সংকলন করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারি অশ্বী অশ্বের সমান দ্রুতগামী কি না, বা বুদ্ধির পরীক্ষায় পুরুষ শিম্পাঞ্জি ছাড়িয়ে যায় কি না তাদের স্ত্রীলিঙ্গদের–কিন্তু মানবপ্রজাতি চিরকাল ধরে আছে পরিবর্তনশীল অবস্থায়, হয়ে উঠছে চিরকাল ধরে।
কিছু বস্তুবাদী পণ্ডিতপ্রবর সমস্যাটি আলোচনা করেছেন বিশুদ্ধ অনড় রীতিতে; মনোদৈহিক সমান্তরলতার তত্ত্ব দিয়ে প্রভাবিত হয়ে তাঁরা পুরুষ ও নারী প্রাণীসত্তার মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন গাণিতিক তুলনা–এবং তাঁরা কল্পনা করেছেন যে এসব পরিমাপ সরাসরিভাবে নির্দেশ করে দুটি লিঙ্গের ভূমিকাগত সামর্থ্য। উদাহরণস্বরূপ, পুরুষ ও নারীর মস্তিষ্কের ধ্রুব ও আপেক্ষিক ওজন সম্পর্কে বিস্তৃত তুচ্ছ আলোচনায় নিয়োজিত থেকেছে এসর ছাত্র–সব কিছু সংশোধনের পর পৌঁচেছে অসিদ্ধান্তমূলক ফলাফলে। তবে যা ঐসব সতর্ক গবেষণার আকর্ষণীয়তা নষ্ট করে, তা হচ্ছে মস্তিষ্কের ওজন ও বুদ্ধিমত্তার মাত্রার মধ্যে কোনো রকম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি। এবং পুরুষ ও নারী হরমোনের রাসায়নিক সূত্রের মানসিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়েও একই রকমে হতবুদ্ধি হতে হয়।
এ-পর্যেষণায় আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করি মনোদৈহিক সমান্তরলতার ধারণা, কেননা এটা এমন এক মতাদর্শ যার ভিত্তিমূলকে দীর্ঘকাল ধরে পুরোপুরিভাবে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি যে আদৌ এর উল্লেখ করছি, তার কারণ হচ্ছে এর দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দেউলেত্ব সত্ত্বেও আজো অনেকের মনে এটা প্রেতের মতো আনাগোনা করে। আমি সে-সব তুলনামূলক সংশ্রয়কেও প্রত্যাখ্যান করি, যেগুলো ধরে নেয় যে মূল্যবোধের আছে একটা প্রাকৃতিক স্তরক্ৰম বা মানদণ্ড–যেমন, একটা বিবর্তনমূলক স্তরক্রম। নারীশরীর কি পুরুষের শরীরের থেকে অধিকতর বালধর্মী বা বালধর্মী নয়, এটা কি কম-বেশি বানরের দেহের সদৃশ ইত্যাদি জিজ্ঞেস করা নিরর্থক এসব নিবন্ধ, যেগুলো একটা অস্পষ্ট প্রাকৃতবাদকে মিশ্রিত করে আরো অস্পষ্ট কোনো নীতিশাস্ত্র বা নন্দনতত্ত্বের সাথে, সেগুলো খাঁটি শব্দবাচালতা মাত্র। মানবপ্রজাতির নারী ও পুরুষের মধ্যে আমরা তুলনা করতে পারি শুধু মানবিক পরিপ্রেক্ষিতে। তবে পুরুষের সংজ্ঞা দেয়া হয় এমন একজনরূপে, যে চিরস্থির নয়, সে তা যা সে সৃষ্টি করে নিজেকে। মারলিউ-পোন্তি যথার্থই বলেছেন যে মানুষ কোনো প্রাকৃতিক প্রজাতি নয় : সে একটি ঐতিহাসিক ধারণা। নারী কোনো পরিসমাপ্ত বাস্তবতা নয়, বরং সে এক হয়ে ওঠা, এবং তার হয়ে ওঠার সাথেই তুলনা করতে হবে পুরুষকে; অর্থাৎ সংজ্ঞায়িত করতে হবে তার সম্ভাবনারাশিকে।
তবু এটা বলা হবে যে শরীর যদি কোনো বস্তু নাও হয়, তবে এটা একটি পরিস্থিতি, আমি আলোচনায় নিয়েছি এ-দৃষ্টিভঙ্গিই–হাইডেগার, সাত্র, ও মারলিউপোন্তির দৃষ্টিভঙ্গি : এটা বিশ্বের ওপর আমাদের অধিকার বিস্তারের হাতিয়ার, আমাদের প্রকল্পের জন্যে এটা একটি সীমাবদ্ধকর উপাদান। নারী পুরুষের থেকে দুর্বল, তার পেশিশক্তি কম, তার লাল রক্তকণা কম, ফুসফুসের শক্তি কম, সে। দৌড়োয় পুরুষের থেকে ধীরে, তুলতে পারে কম ওজন, পুরুষের সাথে কোনো খেলায়ই পেরে ওঠে না; সে পুরুষের সাথে মারামারিতে পারে না। এসব দুর্বলতার সাথে যোগ করতে হবে তার অস্থিতিশীলতাকে, তার নিয়ন্ত্রণের অশক্তি, এবং তার ভঙ্গুরতা : এগুলো সত্য। পৃথিবীর ওপর তার অধিকার তাই সীমিত; কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যে তার দৃঢ়তা কম ও স্থিরতা কম, তাই সাধারণত সে ওগুলো বাস্তবায়নের জন্যে কম সামর্থ্যসম্পন্ন। অন্যভাবে বলা যায় যে পুরুষের তুলনায় তার ব্যক্তিজীবন কম ঐশ্বর্যপূর্ণ।
নিশ্চয়ই এসব সত্য অস্বীকার করা যায় না–তবে এগুলোর নেই কোনো বিশেষ তাৎপর্য। একবার যদি আমরা গ্রহণ করি মানবিক পরিপ্রেক্ষিত, শরীরকে ব্যাখ্যা করি অস্তিত্বের ভিত্তিতে, তাহলে জীববিজ্ঞান হয়ে ওঠে এক বিমূর্ত বিজ্ঞান; যখন। শারীরবৃত্তিক তথ্য (উদাহরণস্বরূপ, পেশীয় নিকৃষ্টতা) অর্থ গ্রহণ করে, তখন এ-অর্থকে দেখা হয় সম্পূর্ণ পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল বলে; এ-দুর্বলতা প্রকাশ পায় শুধু পুরুষ কোন লক্ষ্য নিশে করছে, তার আছে কী কী হাতিয়ার, এবং সে কী বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করছে, তার আলোকে। যদি সে বিশ্বকে অধিকার করতে না চায়, তাহলে বস্তুর ওপর অধিকারের ধারণার কোনো তাৎপর্য থাকে না; এ-অধিকারের কাজে যখন নূ্যনতম বলের থেকে বেশি শারীরিক বলের সম্পূর্ণ প্রয়োগ দরকার হয় না, তখন বলের পার্থক্যগুলো বাতিল হয়ে যায়; যেখানে হিংস্রতা রীতিবিরোধী, সেখানে পেশিশক্তি আধিপত্যের ভিত্তি হতে পারে না। সংক্ষেপে দুর্বলতার ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে শুধু অস্তিত্ব, অর্থনীতি ও নৈতিক বিবেচনা অনুসারে। বলা হয়েছে যে মানবপ্রজাতিটি অ-প্রাকৃতিক, এটা ঠিক মন্তব্য নয়, কেননা মানুষ সত্য অস্বীকার করতে পারে না; তবে সে যেভাবে তাদের সাথে আচরণ করে সে-অনুসারেই প্রতিষ্ঠা করে তাদের সত্য : তার কাজের মধ্যে প্রকৃতি যতোখানি জড়িত প্রকৃতি তার কাছে ততোখানি বাস্তব–বাদ দেয়া হচ্ছে না এমনকি তার নিজের প্রকৃতিকেও। নিজের প্রজাতির কাছে নারীর দাসত্ব কম-বেশি প্রচণ্ড, সেটা ঘটে সমাজ তার কাছে কতোগুলো সন্তানপ্রসব চায়, সে-অনুসারে। উচ্চস্তরের পশুদের বেলা এটা সত্য যে ব্যক্তিগত অস্তিত্বের ব্যাপারটি স্ত্রীলিঙ্গের থেকে পুংলিঙ্গের পশুটিই জ্ঞাপন করে প্রবলতরভাবে, কিন্তু মানবপ্রজাতিতে ব্যক্তির সম্ভাবনা নির্ভর করে আর্থনীতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর।
আবার এখানে মানবিক পরিস্থিতিকে অন্য কোনো পরিস্থিতিতে পর্যবসিত করা যাবে না; প্রথমত মানুষদের একক ব্যক্তিসত্তারূপে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না; পুরুষেরা ও নারীরা কখনো পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয় নি; যুগলটি হচ্ছে এক আদি মিটজাইন, এক মৌল সমবায়; এবং কোনো বৃহৎ যৌথতায় এটা সব সময়ই দেখা দিয়েছে একটি স্থায়ী বা অস্থায়ী উপাদানরূপে।
এমন এক সমাজে প্রজাতির কাছে কোনটি বেশি দরকারি, পুরুষ না নারী? জননকোষের স্তরে, সঙ্গম ও গর্ভধারণের জৈবিক ভূমিকার স্তরে, আমরা যেমন দেখেছি পুরুষনীতি রক্ষণের জন্যে সৃষ্টি করে, নারীনীতি সৃষ্টির জন্যে রক্ষণ করে; তবে সামাজিক জীবনের বিভিন্ন রূপে এ-শ্রমবিভাজনের বিচিত্র বৈশিষ্ট্য কী? এ-সহযোগিতা চূড়ান্তভাবে অপরিহার্য হয়ে ওঠে সে-প্রজাতিতে, যাতে শাবকেরা দুধ ছাড়ার পর দীর্ঘকাল ধরে নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে অসমর্থ; এখানে পুরুষটির সহায়তা হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা যে-সব জীবন সে জন্ম দিয়েছে, তাকে ছাড়া সে-সব জীবন রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় না। একটি পুরুষ প্রতিবছর গর্ভবতী করতে পারে অনেকগুলো নারীকে; তবে সন্তানদের জন্মের পর তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, শক্রদের থেকে তাদের রক্ষা করার জন্যে, তাদের চাহিদা মেটানোর জন্যে প্রকৃতি থেকে সামর্থ্য ছিনিয়ে আনার জন্যে প্রতিটি নারীর দরকার পড়ে একটি পুরুষ।
এভাবে জীববিজ্ঞানের সত্যগুলো আমাদের দেখতে হবে অস্তিত্বের স্বরূপগত, আর্থনীতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবেশের আলোকে। প্রজাতির কাছে নারীকে দাসত্বে বন্দী করা আর ভারসক্তির নানা রকম সীমাবদ্ধতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য; নারীর শরীর পৃথিবীতে তার পরিস্থিতির মধ্যে একটি অত্যাবশ্যক উপাদান। তবে তাকে নারী হিশেবে সজ্ঞায়িত করার জন্যে তার শরীরই যথেষ্ট নয়; একজন সচেতন ব্যক্তি তার নিজের কাজের ভেতর দিয়ে যা প্রকাশ করে, তা ছাড়া আর কোনো সত্যিকার জীবন্ত বাস্তবতা নেই। আমাদের সামনে যে-প্রশ্নটি : নারী কেনো অপর?, তার উত্তর দেয়ার জন্যে জীববিজ্ঞান যথেষ্ট নয়। আমাদের দায়িত্ব কীভাবে। ইতিহাসব্যাপী নিয়ন্ত্রিত হয়েছে নারীর প্রকৃতি, তা আবিষ্কার করা; আমাদের খুঁজে বের করার বিষয় হচ্ছে মানবজাতি কী করে তুলেছে নারীকে।