সাম্ভালা ট্রিলজি (অখণ্ড) – শরীফুল হাসান
এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা
‘সাম্ভালা ট্রিলজি’ নিয়ে কিছু কথা
২০১২ বইমেলায় ‘সাম্ভালা’ যখন বের হলো আমি খুব লজ্জিত, কম্পিত হয়ে বাতিঘরের স্টলের সামনে যাই, একপাশে দাঁড়িয়ে দেখি, কেউ এই নতুন বইটা নেয় কিনা। অদ্ভুত নামটা দেখে অনেকেই কৌতূহলি হয় কিন্তু সাহস করে না। নতুনে বাজি ধরার লোকের সংখ্যা খুব বেশি তো নয়। বাতিঘরের ম্যানেজার আতিকভাইয়ের জোরাজুরিতে অল্প কিছু পাঠক আগ্রহে কিংবা অনাগ্রহে বইটি কেনেন। প্রকাশক নাজিমভাই অবশ্য শুরু থেকেই ছিলেন দারুন আশাবাদি। নাম নিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছি তিনিই উদ্ধার করলেন আমাকে। তিনি তার নিয়মিত পাঠকদের বললেন, বইটি পড়ে দেখতে। তারপর এক এক করে ফিডব্যাক আসতে থাকল। সেই ফিডব্যাকের স্রোত এখনও থামেনি। মাঝে ভারত থেকেও প্রকাশিত হয়েছে এর ইংরেজি সংস্করন।
এরপর আরো বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছি, সেগুলোও পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে, কিন্তু সাম্ভালার তিন পর্বের আবেদন অন্যরকম। পাঠকের দর্ঘিদিনের দাবি এবং এই আবেদনের প্রেক্ষিতেই প্রকাশিত হলো ‘সাম্ভালা ট্রিলজি’ অখন্ড। এখানে তিনটি পর্ব থাকছে একসঙ্গে। গল্পে কোন পরিবর্তন হয়নি। অল্প কিছু অংশ পরিমার্জিত করা হয়েছে, বানান ভুল নিয়ে কাজ করা হয়েছে। তারপরও যদি কোন ভুল থেকে যায়, আশা করি পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন।
পাঠকের কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। সবাই ভালো থাকবেন।
শরীফুল হাসান
৫/২/২০১৮
সিদ্ধেশ্বরী, ঢাকা
*
উৎসর্গ :
নিপা’কে
যার ধারনা আমি রোবট টাইপের মানুষ। কিন্তু তার এই ধারনা ভুল।
*
অধ্যায় ১
গভীর রাত, বাইরের বারান্দায় ছোট একটা চৌকি বিছিয়ে ঘুমাচ্ছে নুরুদ্দিন। হঠাৎ খুটখাট শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার। ইঁদুরের কাজ ভেবে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। পুরো অমাবস্যা। একফোটাঁ আলোও নেই কোথাও। বাড়ির চারপাশটা গাছগাছালিতে ভরা। বারান্দায় ঘুমাতে গিয়ে মাঝে মাঝে তাই গা ছমছম করে নুরুদ্দিনের। কিন্তু একবার ঘুম এসে গেলে সেই সকাল। তখন আর ভয়ের কী আছে।
কিন্তু আজকের রাতটা যেন অন্য রকম। আবারো খুটখাট শব্দ। চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে নুরুদ্দিন। নড়ছে না। ভয় যেন আজ তাকে সাপের মতো জড়িয়ে ধরেছে। ইঁদুর তো আছেই। কিন্তু শব্দটা আসছে অন্য কোন জায়গা থেকে। মাদরের ফাঁক দিয়ে তাকাল সে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। উল্টোদিকের টিনের চালা ঘরে বেপারিসাহেব ঘুমান তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে। পাশের ঘরটা ফাঁকা। বেপারির ঢাকায় পড়ুয়া ছেলেটা থাকতো এ ঘরটায়। দিনরাত পড়াশোনা করতো। এখন তালাবন্ধ। নুরুদ্দিন যে ঘরটার সামনের বারান্দায় শুয়েছে সেখানে থাকেন বেপারির বাবা, বুড়ো মানুষ। মূলত ইনার সেবা যত্ন করার জন্যই নুরুদ্দিনকে রাখা হয়েছে। শব্দটা আবার এলো। এবার খুব কাছ থেকে।
চোখ বন্ধ করে ফেলল নুরুদ্দিন। দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বুড়োটা কি উঠলো নাকি? পেছন ফিরে তাকাবে চিন্তা করেও তাকাল না সে। এখন উঠলেই এটা সেটা করতে বলবে বুড়ো।
দরজা খুলে গেছে। বুড়ো বের হয়ে এসেছে ঘর থেকে, নিজের পায়ে হেঁটে, অন্যসময় যে নুরুদ্দিনের উপর ভর না দিয়ে চলতেই পারে না। চাদর ফাঁক করে আবার একটু তাকাল নুরুদ্দিন। ভয় কেটে গেছে তার। বুড়ো না বুঝলেই হয় যে সে জেগে আছে। তাহলেই ডাক দিয়ে বসবে।
বুড়ো বাড়ির মাঝখানের উঠোনটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একবারে সটান হয়ে। অন্যসময় লাঠি ছাড়া চলতেই পারে না। আকাশের দিকে হাত দুটো তুলে কি যেন বলছে বিড়বিড় করে। নুরুদ্দিন কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল, কি বলছে লোকটা। কিন্তু শব্দগুলো একেবারেই অপরিচিত। জীবনে কখনো শোনেনি সে। একটু আগে পশ্চিম দিকে ফিরে বিড়বিড় করছিল লোকটা, এবার ঘুরল দক্ষিন দিকে, ঠিক যেদিকে তাকালেই নুরুদ্দিনকে দেখা যাবে।
দম বন্ধ করে রাখলো নুরুদ্দিন। কোন নড়াচড়া করা যাবে না। বুড়োটার কারবার ভালো ঠেকছে না। কাল সকালেই এখান থেকে পালাবে সে, প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে।
চোখ বন্ধ করে রেখেছিল কিছুক্ষন, কেমন গরম লাগছে চাদরটা গায়ে দিয়ে, বাতাস যেন একেবারে থেমে গেছে। তাই চোখ খুলল আবার। উঠোনটায় বুড়ো নেই। একেবারে ফাঁকা জায়গাটা। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ।
‘কিছু দেখেছিস তুই?’ ফিসফিস করে কে যেন বলল কানে কানে, ঘ্যাসঘ্যাসে গলা, পরিচিত, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল নুরুদ্দিনের। গলাটা বুড়োর।
উত্তর দিতে পারলো না নুরুদ্দিন। গলা থেকে কোন আওয়াজ বের হতে চাইছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে সে সাহসও করতে পারছে না। এতো তাড়াতাড়ি লোকটা কিভাবে এলো এখানে? ‘দেখেছিস কিছু?’ আবারো একই প্রশ্ন।
মাথা নাড়াল নুরুদ্দিন। একটু পর টের পেল একজোড়া শক্তিশালী হাত ওর গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। নড়ারও সময় পেলো না সে, তার আগেই মট একটা একটা শব্দ হলো। সকালে পালাবে ভেবেছিল সে, কিন্তু সকাল…এখনো অনেক দেরি।
* * *
একজন মানুষ কতো বছর বাঁচে, প্রশ্নটা প্রায়ই ভাবায় রাশেদকে। একশ, দেড়শ, বড়জোর দুইশ, যদিও দুইশ বছর বেঁচে আছে এমন কাউকে পাওয়া যায়নি,গেলে সেটা ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হয়ে যেতো। সেদিন গিনিস ঘাটাঘাটি করে জানা গেল এখনকার সবচেয়ে দীর্ঘজীবি লোকটার বয়স হচ্ছে একশ তেরো। গ্রামবাংলায় এমন অনেক বুড়ো-বুড়ি আছে যারা তাদের বয়সই জানে না, কিন্তু এদের মধ্যে এর চেয়েও বেশি বয়স নিয়ে বেঁচে আছে এমন লোক কম হবে না। যাই হোক সেটা, কিন্তু এই প্রশ্নটা মাথায় ঘোরাঘুরি করে কেন এটাও একটা অবাক করা ব্যাপার রাশেদের কাছে।
ইউনিভার্সিটিতে পড়া শেষ হয়নি এখনো, ইচ্ছে আছে পড়াশোনাটা আরো অনেকদূর চালিয়ে যাবার। মা মারা গেছেন আগেই, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। চিন্তা শুধু বুড়ো দাদুটাকে নিয়ে। একা একা থাকেন বেচারা। যত্ন করারও কেউ নেই। এখন নাকি বাচ্চা একটা ছেলে সারাক্ষণ থাকে বুড়োর সাথে, কিন্তু ওকে দিয়ে কি সব কাজ হয়?
শুয়ে শুয়ে এলোপাথারি চিন্তা করছে রাশেদ। মায়ের মুখটাও ঠিক মতো মনে নেই তার। কবে মারা গেছেন। তারপর একাই মানুষ। দাদুর অবদান ছিল না বললে ভুল হবে। ব্যবসায়ী বাবা দোকান-পাট আর মহাজনী কারবার করেই সময় কাটিয়েছেন। ছেলের দিকে তাকানোর সময় ছিল না তার। একা থাকতে না পেরে শেষে বিয়েও করেন আরেকটা। সে ঘরে অবশ্য কোন সন্তান জন্মায়নি এখনো। সৎ মাও তাই নিজের ছেলের মতোই আদর করে তাকে।
অনেকদিন যাওয়া হয় না গ্রামটায়। ঢাকা থেকে অনেকদূরে। ট্রেনে বা বাসে করে যেতে অনেক সময় লাগে। আর একবার গেলে সহজে ফিরেও আসা যায় না। এবার ফাইনালটা শেষ হলে গ্রামে গিয়ে দিন পনেরো থেকে আসবে বলে ঠিক করলো রাশেদ।
বারোটা বাজতে যাচ্ছে, কিন্তু ঘুম আসছে না রাশেদের। এই রুমটায় একাই থাকে। ছোট্ট একটা জায়গা, একটা বিছানা, টেবিল চেয়ার এবং ছোট একটা আলমারি আছে, এছাড়া আছে রাশেদের বই রাখার সেলফ। নীলক্ষেত থেকে প্রায় সবধরনের বইই কেনে সে সস্তা দামে। আরো কিছু ধার করে শামীম নামে এক বন্ধুর কাছ থেকে। বই পড়াটা একটা নেশা ছোট বেলা থেকেই।
বইয়ের কথা মনে হতেই দাদুর কথা মনে পড়ে গেল আবার। বাড়িতে ছোট একটা টিনের ঘর আছে, সবসময় তালা দেয়া থাকে ঘরটা। কেউ ঢুকতে পারেনা সেই ঘরে একমাত্র দাদু ছাড়া। কি আছে ঐ ঘরে অনেকবার জানতে চেয়েছে, দাদু শুধু হাসে, উত্তর দেয় না কথার। বাবাও কখনো ঢুকতে পারেনি। এবার বাড়ি গেলে যেভাবেই হোক ঢুকতে হবে ঘরটায়। দাদু স্বেচ্ছায় না দিলে চুরি করে হলেও ঢুকতে হবে, প্রতিজ্ঞা করে রাশেদ।
‘রাশেদ, আছিস রুমে?’ শামীমের কণ্ঠ শোনা গেল। দরজার বাইরে।
একটু অবাক হলো রাশেদ। এতো রাতে শামীমের আসার কথা না। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে না করলেও উঠল রাশেদ।
‘দাঁড়া,’ বলল সে।
দরজা খুলল। শামীম দাঁড়িয়ে আছে। বিভ্রান্ত চেহারা, মাথায় উস্কোখুস্কো চুল, চোখের নিচে কালি পড়েছে। মনে হচ্ছে খুব দুঃচিন্তায় আছে।
‘কি রে, এতো রাতে?’ জিজ্ঞেস করল রাশেদ।
‘আজ রাতে তোর এখানে থাকবো, শামীম বলল।
হাসল রাশেদ। ছোট বিছানাটার দিকে তাকাল। দু’জন হবে এই বিছানায়?
‘খেয়েছিস কিছু?
‘না, তবে খিদেও নেই,’ বলল শামীম।
চিন্তিত হয়ে পড়ল রাশেদ। এতো রাতে দুম করে এসে পড়ার লোক শামীম নয়। পুরো নিয়মমতো চলাফেরা করে ছেলেটা। সময়মতো ঘুমায়, সময়মতো পড়াশোনা করে। বাজে কোন নেশা নেই, বই পড়া একটা নেশা ওর। কিন্তু তাকে তো বাজে নেশা। বলা ঠিক হবে না।
‘কোন সমস্যা?’ রাশেদ বলল।
‘না, এমনিই,’ বিছানায় বসে বলল শামীম।
সমস্যা কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছে রাশেদ। কিন্তু নিজ থেকে না বললে কখনোই জানা যাবে না সেটা। কাজেই জিজ্ঞেস করে লাভও নেই কিছু।
‘শুয়ে পড় তাহলে,’ রাশেদ বলল।
‘ঠিক আছে,’ বলে শুয়ে পড়ল শামীম এবং শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল।
অবাক হলো রাশেদ। এরকম কখনো দেখেনি সে। শোয়ামাত্র ঘুম। দারুন ব্যাপার। কিংবা এমনও হতে পারে ঠিক মতো ঘুমায় না বলে শোয়ামাত্র ঘুমাতে পেরেছে। শামীম। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল রাশেদ।
অঘোরে ঘুমাচ্ছে শামীম। কিন্তু এখনো ঘুম আসছে না রাশেদের। মনে হচ্ছে। সামনে খুব খারাপ দিন আসছে। কেন এরকম চিন্তা মাথায় এলো বুঝতে পারছে না। একসময় ঘুমের মাঝে তলিয়ে গেল সেও।
* * *
নুরুদ্দিন গায়েব, কোথায় যে পালালো ছোঁড়াটা, ভেবে পাচ্ছেন না আজিজ ব্যাপারি। বিপদ হয়ে গেল একটা। এখন বুড়ো বাপের জন্য আবার লোক ঠিক করতে হবে। লোক পাওয়া যায় না ইদানিং। আবার বুড়ো মানুষের সেবা যত্ন করতে হবে শুনলে কেউ সহজে রাজিও হতে চায় না।
উঠোনে বসে রোদ তাপাচ্ছে বুড়ো। ঘরের মাঝখান থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ধপধপে সাদা গায়ের রঙ, মাথার চুলও তাই। কিন্তু তার নিজের গায়ের রঙ এমন হয়নি কেন ভেবে প্রায়ই আফসোস করতেন আজিজ ব্যাপারি। হয়তো মায়ের দিকের কালোটা পেয়েছেন তিনি। কপাল ভালো ছেলেটা তার মতো হয়নি। হয়েছে দাদার মতো। ফর্সা, লম্বা। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ব্যাপারির, কে জানে কেন?
গদিতে যাওয়ার সময় হয়েছে, সকালের নাস্তা করা শেষ। এখন বের হবেন, বাড়ী ফিরবেন আটটা-নয়টার দিকে। সারাটা দিন নানান কাজে-কর্মে সময় কেটে যায়, বুড়ো বাপটার সাথে কথা বলার মতো অবসর নেই। কিংবা এমনও হতে পারে কথা বলতে ইচ্ছেই করে না। মনে হয় বুড়ো ইচ্ছে করে ঢং করছে, লোকটার শরীর তেমন কিছু খারাপ নয়। নিজের বাবার সম্পর্কে এমন কথা ভাবতেই লজ্জা পেলেন আজিজ ব্যাপারি।
হেঁটে উঠোনে এলো সে, লুঙ্গির এক কোনা ধরে আছে। কেমন আছো, বাজান? জিজ্ঞেস করলেন।
বুড়ো তাকাল। কিছু বলল না। হাতে একটা টিনের পাত্রে কিছু মুড়ি।
‘তোমার কিছু খাইতে ইচ্ছা করে বাজান?’ আবারও জিজ্ঞেস করলেন।
এবারও উত্তর নেই। বুড়ো একমনে মুড়ি নাড়াচাড়া করছে, কিন্তু খাচ্ছে না।
‘আমি যাই তাইলে, এমনেই দেরি হইয়া গেছে।’ বলে আর দাঁড়ালেন না আজিজ ব্যাপারি।
বুড়োর মুখে একটু হাসির ছাপ দেখা গেল। যেন খুব মজা পেয়েছে ছেলের কথায়।
‘আইজ সন্ধ্যায় কিন্তু একলা একলা বাড়ি ফিরবি না, দুই চাইর জন লোক সাথে রাখবি,’ পেছন থেকে বলল বুড়ো।
শুনলেন আজিজ ব্যাপারি। মাথা নাড়লেন বুড়োর দিকে তাকিয়ে। দুনিয়ায় শত্রুর অভাব নেই তার। সামনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াতে চান। কাজেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে গেছে অনেকেই। এছাড়া পুরানো অনেক শক্রতা তো আছেই। এর আগে তিনবার মরতে মরতে প্রানে বেঁচেছেন। প্রতিবারই অনেকটা অলৌকিকভাবে। বুড়ো সেসব দিনেও সাবধান করে দিতো তাকে। কিন্তু মানেননি,তাই বিপদে পড়তে হয়েছিল। জান যায় যায় অবস্থা। কিন্তু এখন বাপের কথার অবাধ্য হন না। দু’চারজন না, বেশ কিছু লোককে নিয়েই ফিরবেন। পথে যাতে কেউ আক্রমন করার আগে একশ বার চিন্তা করে।
নিজেকে প্রশ্ন কমই করেন আজিজ ব্যাপারি। কিন্তু বুড়ো আগে ভাগেই এভারে সাবধান করে দেয় কিভাবে? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খায়, কিন্তু উত্তর মেলেনি আজও।
*
অধ্যায় ২
আটাশ নাম্বার বাড়িটার কাছে একটা গাড়ি দাঁড় করানো আছে, সেই সকাল থেকে, বাসায় কে ঢুকছে বের হচ্ছে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছে একজন। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে বানানো বাড়িটা। অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ি। কোন একসময় মন্ত্রী ছিলেন। এখন রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। এক ছেলে এবং এক মেয়ে ভদ্রলোকের। মেয়েটার বিয়ে দিয়েছেন, স্বামীসহ দেশের বাইরে থেকে। ছেলেটা এখনো পড়াশোনা করছে, ইউনিভার্সিটিতে। ছেলেটার নাম শামীম এবং এই শামীমের খোঁজেই সকাল থেকে বসে আছে সে।
ছেলেটা কি টের পেয়ে গেছে কিছু, পালিয়েছে, নাকি বাসায়ই আছে, ভাবছে লোটা। বেশ পড়াশোনা করা ছেলে, কাজের। এরকম একটা কাজের ছেলেকে হারানো চলবে না। উপর থেকে এমন নির্দেশই এসেছে। এখন বসে বসে বিরক্ত হতে হচ্ছে। তাকে। কি এমন গোপন কথা জেনে ফেলেছে ছেলেটা, কে জানে। কিংবা এমনও হতে পারে গুরুতর কোন অপরাধ করে ফেলেছে, যা তাকে জানানো হয়নি। যাই হোক, তার কাজ হচ্ছে নজর রাখা এবং খবর জানানো। এর বেশি কিছু না।
তেমন কারো আসা যাওয়া নেই বাড়িটায়। গেটে দারোয়ান ঢুলছে অনেকক্ষন ধরেই। শামীম আছে কিনা ওর কাছে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না, ভাবল লোকটা। চেহারা দেখানোর ঝুঁকি নেবার কোন দরকার নেই।
একটা রিক্সা এসে থেমেছে বাড়িটার সামনে। অল্প বয়স্ক একটা ছেলে নেমেছে রিক্সাটা থেকে। বেশ লম্বা, স্বাস্থ্যবান, মাথায় ঝাকড়া চুল। শামীম না। ওর কোন বন্ধু হতে পারে? কে জানে? এমনও হতে পারে ওদের কোন আত্মীয়-স্বজন, কারো সাথে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু কি জানি খোঁচাতে লাগল মনের ভেতরে। মনে হচ্ছে শামীমের বন্ধু এই ছেলেটা। এর কাছেই শামীমের খবর পাওয়া যাবে।
বাসায় ঢুকে গেছে ছেলেটা, তারমানে দারোয়ান চেনে ভালো করে। অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো লোকটা। সিগারেট ধরাল একটা। সময় কাটতেই চায় না। বেরিয়ে আসছে ছেলেটা। ঘড়ি দেখল সে। দশ মিনিট কাটিয়েছে বাড়িটায়। হাতে একটা ব্যাগ। ঢোকার সময় ব্যাগটা ছিল না হাতে। ট্রাভেল ব্যাগ বলা চলে এবং ভারি মনে হচ্ছে। একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়েছে ছেলেটা।
এখন কি করা উচিত তার? অনুসরন করবে? নাকি এখানেই অপেক্ষা করবে শামীমের জন্য ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায়, কিন্তু…অনুসরন করার সিদ্ধান্তই নিলো সে। হাতপায়ে খিল ধরে গেছে বসে থাকতে থাকতে। একটু বেড়িয়ে দেখা যাক, ছেলেটা কোথায় যাচ্ছে এই ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে।
* * *
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে শুয়ে আছে রাশেদ। পাশে টেবিল ফ্যানটা ঘুরছে, কিন্তু কোন বাতাস গায়ে লাগছে না। ঘুম আসছে আবার একই সাথে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। চাইলে একটা বই নিয়ে পড়া যায়। গতকালই নতুন একটা থ্রিলার কিনেছে সে নীলক্ষেত থেকে। বইটা হাতে নিলে সময় বেশ ভালোই কেটে যাবে। বইটা নেয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠতেও ইচ্ছে করছে না তার। মাথায় আসলে অন্য একটা চিন্তা ঘুরছে। শামীমের কোন খবর নেই। আজ ক্লাস ছিল সকালে। এতোক্ষনে চলে আসার কথা। ওর মোবাইলে কল করলো সে। সুইচড অফ। ওর আচার-আচরন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। রাতে তো কোন কথাই হয়নি। সকালে বলল বাসায় গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে আসতে। আর কিছু না। সে নাকি তার মাকে ফোন করে বলে দেবে তার রুমে রাখা ব্যাগটা যেন রাশেদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। ব্যাগটা নিয়ে আসতেও কোন সমস্যা হয়নি। শামীমের মা বের করে রেখেছিলেন। অদ্ভুত মহিলা, একটা প্রশ্নও করেননি তিনি রাশেদকে।
একটা সিগারেট ধরালো রাশেদ। ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু দুঃচিন্তা মাথায়। কি আছে ঐ ব্যাগে? শামীম কি ঢাকার বাইরে যাচ্ছে কোথাও? নাকি স্থায়ীভাবে তার সাথে থাকার চিন্তা করছে। স্থায়ীভাবে থাকলেও কোন সমস্যা নেই, শুধু ঘুমানোর সময়টা ছাড়া।
সিগারেট ফেলে দিলো রাশেদ। কিছুই ভালো লাগছে না ইদানিং। লিলির সাথেও দেখা নেই কয়দিন ধরে। দেশের বাইরে গেছে বাবা-মার সাথে। কি জন্যে কে জানে। বিয়ের শপিং করতে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। লিলির সাথে অনেকদিন ধরেই সম্পর্ক রাশেদের। লিলি যেভাবে ভালোবাসে হয়তো এতোটা ভালোবাসা পেতে ভালোও লাগে না তার। কিন্তু এখন মেয়েটা নেই কিছুদিনের জন্য, সবকিছু কি পানসে লাগছে! হয়তো কিছু ভালো না লাগার এটাও একটা বড় কারন হতে পারে।
দরজায় টোকা পড়েছে। শামীম বোধহয়।
হ্যাঁ, শামীমই।
খুবই পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে সারা ঢাকা শহর হেঁটে এসেছে। চাইলেই গাড়ি চলে আসে যার জন্য তিন-চারটা, সে কেন দুপুররোদে হেঁটে ঘুরবে! আজব ব্যাপার।
‘কোথায় ছিলি?’ জিজ্ঞেস করল রাশেদ।
‘ক্যাম্পাসে,’ ছোট করে উত্তর দিল শামীম।
‘বস, রেস্ট নে, তারপর খাওয়া-দাওয়া করিস।’
উত্তরে কিছু বলল না, শার্টটা খুলে খালি গায়ে দাঁড়াল শামীম, ফ্যানের নিচে।
চোখ আটকে গেছে রাশেদের, শামীমের পিঠে। অনেকগুলো উল্কি আঁকা। পুরো পিঠটা জুড়েই। অদ্ভুত সব প্রানী, অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ছাগল, বিশাল বড় একটা সাপ পেঁচিয়ে আছে পুরো পিঠটা জুড়ে। ক্রুশ চিহ্নও দেখা যাচ্ছে, উলটো করে ঝোলানো। এছাড়া ছুরির ছবি আছে একটা যেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে।
‘পিঠে উল্কি আঁকিয়েছিস তুই?’ অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো রাশেদ।
‘ও কিছু না, শখ করে আঁকিয়েছিলাম,’ বলল শামীম।
‘কিন্তু তুই তো জানিস আমাদের ধর্মে এসব একেবারে হারাম।’
‘তা জানি।‘
‘ভালোমতো ডলে গোসল করে তুলে ফেল, চাইলে আমি তোকে সাহায্য করি।’
রাশেদের দিকে তাকিয়ে হাসল শামীম, যেন বোকার মতো কথা বলে ফেলেছে। ‘এ আর উঠবে না, চামড়া তুলে ফেলতে হবে তাহলে।‘
আর কথা বাড়ালো না রাশেদ। পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা তার। খুব সাধারন ছেলে বলেই হয়তো, কিংবা গাঁয়ের ছেলে বলেই এইসব আধুনিকতা পছন্দ হয় না তার। শামীম হয়তো বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা, শার্টটা পড়ে ফেলল সে। টেবিলের দিকে তাকাল। খাবার প্লেট ঢাকা আছে, সাথে একগ্লাস পানি।
‘তুই খেয়েছিস?’ জিজ্ঞেস করল শামীম।
‘হ্যাঁ, তোর জন্য এনে রেখেছিলাম ক্যান্টিন থেকে, খেয়ে নে, এখানে কিন্তু খাবার গরম করার জন্য ওভেন নেই, রাশেদ বলল।
আবার হাসল শামীম। ওর হাসিটা সুন্দর। যে কোন মেয়েই পাগল হবে ওর জন্য, কিন্তু এসব দিকে ওর কোন নজরই নেই।
খেতে বসেছে শামীম কিন্তু মনোযোগ নেই খাওয়ায়। কী যেন চিন্তা করছে গভীরভাবে। বিছানায় শুয়ে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টানোর ফাঁকে ওকে লক্ষ্য করছে রাশেদ।
‘তোদের বাসার রান্নার মতো হবে না, বুঝিস তো হলের ক্যান্টিনের খাবার,’ রাশেদ বলল।
‘আরে নাহ, ভালোই তো লাগছে,’ খেতে খেতে বলল শামীম, আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল সে।
‘এই যে ব্যাগটা আনালি, তুই কি কোথাও যাচ্ছিস?’
‘ঠিক নেই, যেতেও পারি।’
‘আমাকে বলা যাবে না? বললে আমিও হয়তো যেতে পারি।’
‘কোথাও গেলে তো তোকে অবশ্যই জানাবো।
‘আচ্ছা,’ আবার ম্যাগাজিনে মনোযোগ দিল রাশেদ।
হাবিজাবি চিন্তা মাথায় আসছে রাশেদের। মন বসছে না ম্যাগাজিনটায়। শামীমের কথাবার্তা ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে জোর করে কথা বলছে। কি এতো চিন্তা করছে ছেলেটা? বাসায় কোন সমস্যা? বাপের সাথে ঝগড়া? হতেও পারে।
‘বিকেলে একটু বাইরে যাবো, খাওয়া শেষ হয়েছে শামীমের। হাত ধুয়ে রাশেদের পাশে এসে বসেছে।
‘আমারও তেমন কোন কাজ নেই, আমি যাই সাথে?
‘না রে, অনেক কাজ আমার, তুই বিরক্ত হয়ে যাবি, রাতে এসে সব বলবো, একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল শামীম।
ওর বাঁ-হাতটা লক্ষ্য করলো রাশেদ। অনেকগুলো কাটাকুটির দাগ। আগে কখনো চোখে পড়েনি ভেবে অবাক হলো সে। এখন জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করছে না। কে জানে মাইন্ড করে বসে কি না, হয়তো একান্তই ব্যক্তিগত কোন ব্যাপার।
কথা বলতে বলতে চোখ লেগে আসছে রাশেদের। দুপুরে খাবারের পর এই ঘুম এড়ানোর কোন পথ তার জানা নেই। লিলি প্রায়ই ঠাট্টা করে এই ব্যাপারটা নিয়ে।
এর মধ্যে জামাকাপড় পড়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে শামীম।
‘আমি যাই তাহলে,’ বলে বেরিয়ে গেল শামীম।
ঘড়ির দিকে তাকাল রাশেদ। সাড়ে তিনটা বেজে গেছে।
* * *
হল থেকে শামীমকে বের হতে দেখেই মোবাইলটা কানে তুলে নিলো লোকটা। গাড়ি স্টার্ট দিল। একটা রিক্সা ভাড়া করছে ছেলেটা।
‘শামীম বের হয়েছে, কি করবো আমি?’ মোবাইলে বলল লোকটা।
ওপাশ থেকে খুব ভারি গলায় কোন একটা নির্দেশ দেয়া হল।
‘আচ্ছা,’ বলে মোবাইলে পকেটে পুরে রাখল সে।
রিক্সা চলছে, এতো ধীর গতির একটা বাহনকে গাড়ি নিয়ে অনুসরন করা মুশকিল। সন্দেহ জাগতে পারে। তাই কিছুটা সময় অপেক্ষা করলো সে, রিক্সাটা চোখের আড়াল হওয়ার আগে এক্সেলেটরে চাপ দিল।
আজ ছেলেটার পিছু ছাড়া যাবে না। কোন ভুল করার অবকাশ নেই। ভুলের একমাত্র মাশুল মৃত্যু।
***
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ঘামে ভিজে গেছে রাশেদের পুরো শরীর। ভীষন বাজে একটা স্বপ্ন দেখছিল সে, এক চাকু হাতে একটা লোক তাড়া করছিল তাকে স্বপ্নে, লোকটার শরীর মানুষের, কিন্তু মাথাটা শূয়োরের। অন্য হাতে একটা কিছু ছিল তার, কি জিনিস কিছুতেই মনে পড়লো না রাশেদের।
টেবিল ফ্যানটা ঘুরছে বনবন করে, তারপরও এতো ঘেমে গেছে দেখে অবাক হলো রাশেদ। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, ঢাকায় আত্মীয়স্বজনও নেই কেউ, খুব অল্প কিছু মানুষের সাথে মেশে রাশেদ। এটা হয়তো তার চরিত্রের প্রধান দোষ। ইচ্ছে করলেই হলের বাকি ছেলেদের সাথে মিশতে পারে, কিন্তু কেন জানি ইচ্ছে হয় না তার। একা একা থাকতেই ভালো লাগে। করিডোরটা পার হয়েই বাথরুম এবং টয়লেট। একপাশে বেসিন এবং বাথরুম, অন্যপাশে টয়লেটের সারি। এখন পুরো জায়গাটাই ফাঁকা। ছেলেরা সব বাইরে চলে গেছে, কেউ টিউশনি করতে, কেউ আড্ডা দিতে, কেউ প্রেমিকা নিয়ে ঘুরতে। একমাত্র রাশেদেরই যেন কোন কাজ নেই। বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে আয়নাটার দিকে তাকাল। কি স্বাভাবিক প্রানবন্ত চেহারা।
লাইব্রেরিতে যাবে বলে ঠিক করল রাশেদ। ঘুরে দাঁড়াতে যাবে মনে হলো কেউ এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। কোন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়নি, কিংবা কোথাও কিছু নড়ে ওঠেনি, অদ্ভুত একটা ভয় জেঁকে ধরল রাশেদকে। মনে হলো খুব বাজে কিছু দেখতে হবে পেছনে তাকালে। ঘাড়ের উপর যেন কারো নিঃশ্বাস পড়ছে। আয়নায় নিজের দিকে তাকাল রাশেদ। পেছনটা একেবারে ফাঁকা। ফিসফিস করে একটা শব্দ যেন কেউ বলে গেল, ঠিক কানের গোড়ায়। সরসর করে পেছনের সব চুল দাঁড়িয়ে গেল তার।
শব্দটা ছিল ‘সাবধান’।
*
অধ্যায় ৩
বাঁশখালির হুজুরের পানি পড়াতে কাজ হয়নি বোঝাই যাচ্ছে, এর আগে আরো নানাধরনের চিকিৎসা করিয়েছেন সালেহা। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এদিকে বয়সও থেমে নেই। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই করছে। সন্ধ্যা পার হয়েছে। নামাজ শেষ করে বাইরে উঠোনে এলেন তিনি। বুড়ো শ্বশুড়কে একটু দেখে আসা দরকার।
বুড়ো এখনো উঠোনে বসে আছে। সালেহা কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ঘোমটা দিয়ে।
‘কিছু লাগবে বাবা?’
‘পানি খামু,’ আস্তে আস্তে বলল বুড়ো।
পানি আনতে রান্নাঘরে গেল সালেহা। এসে দেখল বুড়ো নেই উঠোনে। কি আজব! চারপাশে তাকাল সালেহা। কোথাও দেখা যাচ্ছে না বুড়োটাকে। নিজের ঘরে ঢুকল নাকি, কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি?
কই, পানি হাতে নিয়া দাঁড়াইয়া আছো কেন? দাও, বুড়োর কণ্ঠ শোনা গেল, ঠিক পেছনেই।
আরেকটু হলেই মূৰ্ছা যেত সালেহা। নিজেকে কোনমতে সামলে নিল।
পানির গ্লাসটা হাতে দিল সালেহা। ঠিক একই ভঙ্গিতে চেয়ারটায় বসে আছে লোকটা। কিন্তু একটু আগেই তো জায়গাটা ছিল ফাঁকা।
‘শোন, বেশি চিন্তা করবা না, শরীর খারাপ হইব, মাথা কাজ করবো না,’ বুড়ো বলল। খালি গ্লাসটা ফেরত দিল সালেহার হাতে।
‘জি,বাবা।‘
‘তোমার যা দরকার পাইবা তুমি, একটু ধৈর্য ধরো।‘
‘জি,বাবা।‘
‘যাও, নামাজ কালাম পড়ো গিয়া, বাঁশখালীর হুজুরের পড়ায় কাজ হবে না।’
সালেহা চুপ করে রইলো। বাঁশখালীর হুজুরের কথা কাউকে জানায়নি সে। বুড়োর তো জানার প্রশ্নই উঠে না। নুরুদ্দিনকে পাঠিয়েছিল একদিন। ঐ ছোঁড়া কি বলে দিয়েছে। দিতেও পারে।
তবু মনে খচখচ নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল সালেহা। রাশেদের বাপ আসলে কথাটা বলতে হবে।
* * *
লোকমান, জয়নাল, আলী, সামসু-এই চারজনকে চারদিকে নিয়ে ঠিক নয়টায় রওনা দিলেন আজিজ ব্যাপারি। গঞ্জটা পার হলেই মাটির রাস্তা। হেঁটে হেঁটে যেতে হবে অনেকটা পথ। বাপ যে কথা বলে দিয়েছে তার বাইরে যাবার ঝুঁকি নেয়নি সে। কে জানে কোথায় কি ঘটে।
এই চারজনের দুইজন তার দোকানে কাজ করে। বাকি দুজনকে টাকার বিনিময়ে আনা। ওরা হচ্ছে জয়নাল আর সামসু। দুইজনই মারাত্মক। খুন-খারাপি ওদের কাছে ব্যাপারই না। ওদের দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছেন তিনি। আজও সাথে অস্ত্র আছে ওদের। রাম-দা আর কিরিচ। জিনিসগুলো দেখলেই ভয়ে বুক কাঁপে ব্যাপারির। এই দুজনকে পুরোপুরি বিশ্বাসও করেন না তিনি। তাই বাকি দুজনকেও অস্ত্র দিয়েছেন তিনি ওদের না জানিয়েই। সাবধানতা।
ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, সামনে খাল আছে একটা। ওটা পার হলেই একটা বিপদজ্জনক জায়গা আছে। তিনটা বড়ো বড়ো বটগাছ, ওগুলোর পেছনে দশ-বারোজন লোক লুকিয়ে থাকলেও বোঝার কোন উপায় নেই। খালটা পার হয়ে একটা বিড়ি ধরালেন ব্যাপারি। সিগারেট খেতে পারেন ইচ্ছে করলেই, কিন্তু টেনশনের সময়গুলোতে বিড়িটাই যেন শান্তি দেয় তাকে।
জয়নাল, সামসু দুজনের দিকে তাকালেন। চেহারায় কোন পরিবর্তন আছে কিনা দেখতে চাইলেন। একেবারে স্বাভাবিক চেহারা। কে জানে এটাই হয়তো ওদের মুখোশ।
‘তোরা চাইরজন আমার চাইর কিনারে থাক,’ আস্তে করে বললেন ব্যাপারি।
চারজন দাঁড়িয়ে গেল চারপাশে। মাঝে ব্যাপারি।
‘ব্যাপারি সাব, চিন্তার কিছু নাই,’ জয়নাল বলল অভয় দিয়ে, কোমরে গোঁজা অস্ত্রটা একঝলক দেখাল সে।
কিছু বললেন না ব্যাপারি।
ঐ গাছ তিনটা পার হলেই সামনে ফকফকা রাস্তা।
আস্তে আস্তে এগুচ্ছে সবাই। লোকমান এবং আলীর দিকে তাকালেন ব্যাপারি। দুজনেই ঘেমে গেছে, ভীতুর ডিম কোথাকার।
থপ করে একটা শব্দ হলো কোথাও। ব্যাপারি ঘুরে তাকালেন। সামসু পড়ে গেছে। অন্ধকারেই বুঝতে পারলেন একটা ছুরি ঢুকে গেছে ওর পেটে। জয়নাল সামনে চলে এলো তার।
‘আপনে আমার পেছনে থাকেন,’ জয়নাল বলল।
নিজের বিশাল শরীরটা দিয়ে প্রায় আড়াল করে ফেলল ব্যাপারিকে।
‘কোন সমুন্ধীর পুত আছোস, সামনে আয়,’ হাক দিলো জয়নাল।
বটগাছটার পেছনে নাড়াচাড়া দেখা গেল। চার-পাঁচজনের কম হবে না।
‘ঐ শালা, তোর রামদাটা দে,’ লোকমানকে হুকুল করল জয়নাল। লোকমান কথা বাড়িয়ে পিঠের পেছনে গোঁজা রামদা বাড়িয়ে দিল জয়নালকে।
‘ব্যাপারিরে নিয়া যাইতাছি, সাহস থাকলে সামনে আয়,’ আবারো হাঁক দিল। সাম্ভালা
ব্যাপারি দাঁড়িয়ে আছেন, কিছু মাথায় ঢুকছে না তার। এই জয়নাল কি পাগল? সবার সাথে একাই লড়বে?
‘ব্যাপারি সাব, হাঁটেন আমার পেছন পেছন, কোন শালা আগাইব না,’ জয়নাল বলল।
শরীরের সাথে শরীর লাগিয়ে হাঁটছে ওরা চারজন। সামসুর লাশ পড়ে আছে পেছনে। কিন্তু সেদিকে তাকানোর সময় নেই এখন।
রামদাটা হাতে নিয়ে এগুচ্ছে জয়নাল, পেছনে বাকি তিনজন। কি জানি কেন, বাকি পথটা আসতে আর সমস্যা হলো না, হয়তো জয়নালের এমন মারমুখীভাব দেখে এগুতে সাহস পায়নি ওরা।
নিজের বাড়ীর সামনে এসে আত্মায় পানি পেলেন ব্যাপারি। লোকমান, আলী রাতটা এখানেই থাকবে, জয়নালকেও থাকতে বললেন তিনি। কিন্তু রাত কাটাবে না সে এখানে। কোন মতেই আটকানো গেল না লোকটাকে। কে জানে এখনো হয়তো বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। কিন্তু থোরাই কেয়ার করে জয়নাল এসবের, রামদাটা উঁচু করে চলে গেল সে।
উঠোনে এখনো বসে আছে বুড়ো। ঠিক যেভাবে সকালে দেখেছিলেন ব্যাপারি।
‘বাজান, আইজ তো অনেক বাঁচা বাঁচলাম,’ বুড়োর পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন ব্যাপারি।
‘হমম।‘
‘তুমি আগে থাইক্যা বইল্যা দিলা ক্যামনে?’
‘বেশি কথা পছন্দ হয় না আমার, যা, ঘুমা গিয়া, গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠেন বুড়ো।
ঘাটাবার সাহস পায় না ব্যাপারি। ক্ষুধা নেই পেটে, গিয়ে সটান ঘুম দিতে হবে।
* * *
চারদিক শুনশান। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে। নিজের ঘরটায় বসে আছেন বুড়ো। ঘুম কমে গেছে অনেক। পুরানো দিনের অনেক কথা মনে করেন তখন। পুরানো! অনেক পুরানো সেই কথা!
এই অঞ্চলটায় এসেছেন প্রায় ষাট বছর আগে। কি সব দিন ছিল সেসব! কেউ তাকে চেনে না, জায়গা দিতে চায় না বাড়িতে। নাম-পরিচয়হীন একটা মানুষকে কেনই বা জায়গা দেবে কেউ। ফর্সা টকটকে গায়ের রঙ, চুল কুচকুচে কালো, ঘাড় পর্যন্ত নামানো, সহায় বলতে বড় দুটো ট্রাঙ্ক সাথে।
শেষে জায়গা দিলেন রহিম ব্যাপারি। বুড়ো মানুষ। গঞ্জে বড় ব্যবসা। তিনটা মেয়ে, ছেলে নেই একটাও। বুড়ো হয়েছেন। মেয়েদের বিয়ে দেননি কারো। তিনি রাখলেন ছেলেটাকে। টুকটাক দোকানের কাজ করবে, রাতে সেখানেই ঘুমাবে। নিজের ট্রাঙ্কগুলো নিয়ে দোকানের পেছনের ঘরেই থাকা শুরু করলো ছেলেটা। আস্তে আস্তে রহিম ব্যাপারির প্রিয় হয়ে উঠল সে। নিজের পরিচয় কিছুই বলতে পারতো না ছেলেটা। রহিম ব্যাপারি ভাবলেন এমন একটা ছেলেকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। নিজের বড় মেয়ে জমিলার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন তাকে। দোকান করে দিলেন একটা। ছেলের একটা নামও দিলেন। আব্দুল মজিদ ব্যাপারি। ছেলেটা আপত্তি করেনি তাতে।
রহিম ব্যাপারি মারা গেছেন ক’বে। জমিলাও মারা গেছে বিশ বছর হলো। একটাই মাত্র ছেলে, আজিজ, বাকি দুজন জন্মের পরপরই মারা গেছে। জমিলা বেঁচে থাকা অবস্থায়ও দোকান-পাট করতেন বুড়ো। তারপর সব ছেড়ে দিলেন ছেলের হাতে।
কিন্তু এভাবে আর কতোদিন। এখানকার পাট চুকানোর সময় কি হয়ে যায়নি? তালাবদ্ধ ঘরটা মাঝে মাঝে ডাকে তাকে। কিন্তু সে ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছে করে না তার। আবার সব নতুন করে শুরু করতে হবে। নতুন করে শুরু করা সবসময়ই কঠিন। কিন্তু সেই সময় কি এসে গেছে? কিছু লক্ষন অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তিনি অপেক্ষা করছেন আসল সংকেতটা পাওয়ার জন্য।
* * *
রাত আড়াইটার দিকে ঘুম ভাঙল ব্যাপারির। কিসের যেন অস্থিরতা অনুভব করছেন তিনি, হাঁসফাঁস লাগছে, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে, সালেহা ঘুমাচ্ছে মরার মতো, তাকে ডেকে লাভ হবে না। নিজেই উঠে পাশের টেবিলে গ্লাসে রাখা পানিটা খেলেন। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে।
পূর্ণিমা নয় আজ, কিন্তু চাঁদের আলোয় চারদিক কেমন ঝকঝক করছে, গা কেমন ছমছম করে উঠলো ব্যাপারির। যদিও ভূত বা এই জাতীয় কোন ব্যাপারে বিশ্বাস নেই তার। হেঁটে উঠোনে চলে এলেন তিনি। উল্টোদিকের বুড়ো বাপের ঘরটার দিকে তাকালেন। দরজাটা কি ভোলা? তাই তো মনে হচ্ছে। এতো রাতে লোকটা গেল কই?
ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। খালি। টিমটিম করে হারিকেনটা জ্বলছে শুধু। ঘরগুলো থেকে একটু দূরেই বাথরুম বানিয়েছেন তিনি, বুড়ো হয়তো সেখানেই গেছে। নুরুদ্দিন থাকলে চিন্তার কিছু ছিল না। সবসময় দেখাশোনা করতে পারতো। কিন্তু এখন, চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। একটা লোক রাখতে হবে সার্বক্ষণিক, একা একা কোথাও পড়ে থাকলেও এখন দেখার কেউ নেই।
বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন ব্যাপারি। কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এখানেও নেই মনে হচ্ছে। সামনে গিয়ে খোঁজা দরকার।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে এসেছেন তিনি। এখন সামনে একটা খোলা মাঠ। ধান কাটা শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে, এখন ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে। বিশাল ফাঁকা মাঠটা চাঁদের আলোয় কেমন চকচক করছে। একটা অদ্ভুত সুর কানে এলো হঠাৎ। এরকম সুর আগে কখনো শোনেননি ব্যাপারি। গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো তার। বাঁশি বাজাচ্ছে কেউ? এটা কি বাঁশির সুর? নাকি বেহালার? বেহালারই মনে হচ্ছে। কিন্তু এই এলাকার কেউ বেহালা বাজাতে পারে বলে জানেন না তিনি। আর এরকম সুরে বাজানো তো রীতিমতো অসম্ভব। সুরটা একবার উপরে উঠছে চড়া হয়ে আবার নামছে, সবকিছু শান্ত করে দিচ্ছে নিজের শক্তিতে। ব্যাপারির মনে হলো তিনি নিজেও যেন সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছেন। কি একটা জাদুর মতো আছে সুরটায়। অপার্থিব একটা সুখে মনটা ভরে দিচ্ছে।
অনেক অনেক দূরে পাতলা করে একটা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে এখন। লম্বা,ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়ানো, কাঁধে ভর দেয়া একটা বেহালা। দৌড়ে লোকটাকে দেখার ইচ্ছে হলো ব্যাপারির। এই গ্রামের কেউ না এটা নিশ্চিত। কারো বাড়িতে কি বেড়াতে এসেছে শহর থেকে? হতেও পারে।
‘এতো রাইতে এখানে কি করছ?’ খসখসে গলার প্রশ্নটা শুনে চমকে গেলেন হব্যাপারি।
বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। আব্দুল মজিদ ব্যাপারি। মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ঝোলানো।
* * *
সকাল দশটায় ঘুম ভাঙল রাশেদের। এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না কখনো। গতকাল রাতে শামীম ফেরেনি রুমে। হয়তো বাসায় ফিরে গেছে। একবার জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেনি ছেলেটা। আজব। এছাড়া সেই ট্রাভেল ব্যাগটাও নিয়ে যায়নি। পড়ে আছে। খাটের তলায়। একটা বই নিয়ে পড়েছিল রাশেদ গতকাল রাতে। শেষ করতে করতে রাত তিনটা। তারই ফল দেরি করে ঘুম ভাঙ্গা।
তেমন কাজও নেই অবশ্য। ক্লাস আছে একটা বারোটায়। ইদানিং ক্লাস তেমন করতে ইচ্ছে করে না রাশেদের। লিলিও নেই। অন্যান্য ক্লাসমেটদের সাথে কেন জানি হৃদ্যতা গড়ে উঠেনি কি এক বিচিত্র কারনে। পুরো ভার্সিটিতে তাই কাছের লোক দুজনই, একজন শামীম, অন্যজন লিলি।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো এই সময়। লিলির নাম্বার ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে।
‘হ্যালো,’ বলল রাশেদ।
‘এখন ঘুম থেকে উঠলে তুমি?’ ওপাশ থেকে মিষ্টি একটা কণ্ঠ শোনা গেল, লিলির কণ্ঠ। অনেকদিন পর খুব ভালো লাগতে লাগল রাশেদের। আয়নার দিকে তাকাল, মোবাইলটা হাতে নিয়ে, কেমন বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। সেভ নেই গত কয়েকদিন ধরে, চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে।
‘তুমি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল রাশেদ।
‘ক্যাম্পাসে, তাড়াতাড়ি এসো, রাখলাম।‘
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলো রাশেদ। অনেকদিন পর প্রিয় মানুষের সাথে দেখা হবে, মনের মধ্যে ইদানিং কেমন একটা টেনশন কাজ করছিল নিজের অজান্তেই, লিলির ফোন পাওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে। টেনশনের কিছুই নেই।
কিন্তু অনেক বাজে কিছুই হয়তো অপেক্ষা করছে রাশেদের সামনে।
* * *
লিলির সাথে দেখা হয়ে গেল কলাভবনের সামনে। চোখাচোখি হতেই রাশেদের দিকে এগিয়ে এলো মেয়েটা।
‘কেমন আছো, রাশেদ?’ জিজ্ঞেস করল লিলি।
‘ভালো।’
‘এই হাল কেন চেহারার?’
‘কি হাল?’
‘মনে হচ্ছে রাতের পর রাত ঘুমাও না, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে নাকি?’
‘না তো, খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, তুমি কোথায় ছিলে?’
‘ব্যাংকক গিয়েছিলাম বেড়াতে।‘
‘এতো দিন?
‘এতো দিন কোথায়? পনেরো দিন কি খুব বেশি?’
উত্তর খুঁজে পেল না রাশেদ। পনেরো দিন হয়তো আসলেই খুব বেশি সময় না। যাই হোক, ক্লাস শুরু হবার সময় হয়ে গেছে।
‘চলো, ক্লাসটা করে আসি, রাশেদ বলল।‘
‘না, আজ আমরা ঘুরবো।‘
‘কোথায় ঘুরবো?’
‘যেখানে খুশি।’
হাসল রাশেদ। ক্লাস করতে এমনিতেও ইচ্ছে করে না তার। ঘুরে বেড়ানো যায়। অনেকদিন বাইরে বেড়ানো হয় না। লিলির ড্রাইভারকে বসিয়ে রেখে ওরা একটা রিক্সা নিয়ে নিলো, সারাদিন ঘুরবে পুরো ঢাকা শহর।
* * *
গাড়ি নিয়ে রিক্সাকে ফলো করা আসলেই জটিল একটা কাজ। দু’একদিন আগেই কাজটা করতে হয়েছে, এখন আবার। বিরক্তিতে থুথু ফেলল লোকটা। মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে। যতো হুজ্জোত পোহাতে হচ্ছে তাকে। বস তো হুকুম দিয়েই খালাস। সব সর্বনাশের মূল ঐ ছোঁড়া। শামীম। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বদমায়েসি করার। ঠেলা। জন্মের শিক্ষা হয়ে গেছে, যদিও সেই শিক্ষা কোন কাজে লাগবে না তার।
বেইলি রোডের একটা ফাস্টফুডের দোকানের সামনে থেমেছে রিক্সাটা। গাড়িটা একটু দূরত্বে পার্ক করলো লোকটা। এই ছেলেটাকে ফলো করার কোন মানে আছে? কি আছে ওর কাছে? শামীমের কাছ থেকে সব উদ্ধার করা যায়নি? কে জানে? এতোদূর জানার অধিকার নেই তার। তার কাজ হচ্ছে শুধু ফলো করা। ব্যস।
ক্ষুধা পেয়েছে খুব। কিন্তু খাওয়ার উপায় নেই। কোনমতে পিছ ছাড়া করা যাবে না। যদিও ওর থাকার জায়গাটা ভালো করে চেনা আছে। এতে রোমান্টিক একটা ছেলে! প্রেমিকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি আনন্দময় এর জীবন! কিন্তু ওর কাছে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে জীবনটা বিষময় করে তুলতে একটুও দেরি করবে না তার বস। বের হয়েছে ওরা। হাস্যোজ্জ্বল দুটি মুখ। গাড়ি স্টার্ট দিল লোকটা। কোথায় কোথায় যে ঘুরতে হয় কে জানে?
***
রাত এগারোটায় হলে ফিরে এলো রাশেদ। এই সময়টায়ও চঞ্চল থাকে হলটা। ছেলেরা আসছে, যাচ্ছে। অনেকে টিভি রুমের উদ্দেশ্যে, অনেকে রিডিং রুমের দিকে। কিছু ছেলের দল হলের সামনের মাঠটায় একসাথে গোল হয়ে বসে গল্প করছে। কিছু ছেলে আবার আড্ডা দিচ্ছে চায়ের দোকানের সামনে। হঠাৎ দেখলে খুব সুখি মনে হয় সবাইকে। কেমন নিশ্চিন্ত, নিরাপদ জীবন। কিন্তু এটা শুধু বাইরে থেকে দেখা। হলে সাধারন ছাত্রদের জীবনটা কখনোই খুব নিশ্চিন্ত নয়, নিরাপদ তো নয়ই।
লিলি চলে গেছে সেই বিকেল বেলায়। তারপর কিছুক্ষন সময় লাইব্রেরিতে কাটিয়ে, খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরল সে। সারাদিন কম করেও পঞ্চাশ বার চেষ্টা করেছে। শামীমের মোবাইলে কল করার। কিন্তু বন্ধ। ছেলেটার আচরন একেবারেই রহস্যময় মনে হচ্ছে। ঘরে ওর ট্রাভেল ব্যাগটা পড়ে রয়েছে। থাক পড়ে, বিড়বিড় করল রাশেদ। ওর যখন দরকার পড়বে তখন এসে নিয়ে যাবে।
সারাদিন যদিও লিলির সাথে থেকেছে, কিন্তু অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি তাড়া করে ফিরেছে তাকে। যেন কেউ অনুসরন করছে তাকে। দূর থেকে। যদিও তেমন কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু অস্বস্তিকর অনুভূতিটা যায়নি। এমনকি এই রাত এগারোটার সময় নিজের রুমে বসেও মনে হচ্ছে কেউ যেন দেখছে তাকে। দরজার বাইরে হাঁটাহাঁটি করছে কেউ। কিংবা জানালা দিয়ে নিচে তাকালে দেখা যাবে কেউ একজন তাকিয়ে আছে তার রুমটার দিকেই। গতরাতে ঠিক মতো ঘুম হয়নি। আজো হবে বলে মনে হচ্ছে না। বিছানায় শুয়ে গা এলিয়ে দিল রাশেদ। ক্লান্ত লাগছে। অনেকদিন পর ঘোরাঘুরিটা একটু বেশি হয়ে গেছে। একটা সিগারেট ধরালো। নিকোটিন কি টেনশন কে সরিয়ে রাখবে কিছুক্ষনের জন্য? মনে হচ্ছে না। টেনশনটা আরো বাড়ছে।
চোখ বুজে আসছে ঘুমে। এমনটা হবার কথা নয়। তন্দ্রাচ্ছন অবস্থায় রাশেদ দেখলো রুমের ষাট ওয়াটের বাতিটার আলো কেমন নিভে যাচ্ছে, আবার বেড়ে যাচ্ছে। ভোল্টেজে সমস্যা? হতে পারে। জানালাটা খোলা। প্রবল বেগে বাতাস ঢুকছে রুমটাতে। টলতে টলতে কোনমতে উঠে জানালাটা বন্ধ করে দিলো সে। বাতিটা এখনও সেরকম জ্বলছে নিভছে। এরকম কখনো দেখেনি রাশেদ। কারেন্ট চলে গেলে যাক না। বিরক্ত লাগছে তার। ঘুম চলে আসছে। আজব। একটু আগেও ভাবছিল ঘুম না আসলে কোন বইটা পড়বে। নেশা নেশা লাগছে। যদিও আজই সবচেয়ে কম সিগারেট টানা হয়েছে, ব্যাপারটা আর কিছু নয়, লিলির সাথে থাকার ফল।
গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে একটা কণ্ঠস্বর কানে কানে কিছু বলে গেল তার, ‘ব্যাগটা সাবধানে রাখিস, দোস্ত।‘
কণ্ঠটা শামীমের।
*
অধ্যায় ৪
সময়টা ১৭৮৮, প্যারিস, ফ্রান্স। রোববার সকাল। কাউন্টেস ডি আইমের তৈরি হচ্ছিলেন বাইরে যাবার জন্য। রাণী হয়তো অপেক্ষা করছেন তার জন্য। এইসময় গৃহভৃত্য এসে জানালো এক ভদ্রলোক এসেছেন দেখা করতে। কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় নেই এখন, কিন্তু চলে আসা অতিথিকে ফেরত পাঠাতেও ইচ্ছে করলো না কাউন্টেসের।
বসার ঘরটাতে ঢুকেই চমকে গেলেন কাউন্টেস। কে বসে আছে ওখানে? খুবই পরিচিত মুখ। অনেক অনেক বার দেখা হয়েছে লোকটার সাথে। কাউন্ট দ্য সেইন্ট জারমেইন। শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় চৌদ্দ বছর আগে। রাজা পঞ্চদশ লুই মারা গেলেন যে বছরটায়। এতোদিন কোথায় ছিল লোকটা? আর চেহারার কোন পরিবর্তন নেই কেন? বসার ঘরে সাজানো আয়নাটার দিকে এক নজর তাকিয়ে নিলেন কাউন্টেস। এই চৌদ্দ বছরে তার চুলে প্রায় পাক ধরে গেছে অথচ এই লোকটার বয়স তখন ছিল পয়তাল্লিশের মতো, এখন দেখে মনে হচ্ছে একদিনও বয়স বাড়েনি ওঁর।
‘শুভ সকাল, মাদমোয়াজেল, উঠে দাঁড়িয়ে কাউন্টেসকে সম্ভাষন জানালেন ভদ্রলোক।
‘আপনাকেও,’ বলে উল্টোদিকের সোফায় বসলেন কাউন্টেস।
‘এই সকালে এসে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী আমি, কিন্তু ব্যাপারটা এতোই জরুরি, না এসে থাকতে পারিনি, ভদ্রলোক বললেন মার্জিত সুরে।
কাউন্টেস তাকিয়ে আছেন লোকটার দিকে। বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি এখনো। এতে সজীব, এতো প্রানবন্ত চেহারা! চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে। কেমন একটা সম্মোহন আছে যেন ওখানে, তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে।
‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি ঠিক আগের মতোই আছেন, কাউন্ট,’ কাউন্টেস বললেন, মুখে একটু হাসি নিয়ে, যাতে লোকটা আবার কিছু মনে না করে বসে।
‘আমি রাণীর সাথে দেখা করতে চাই, আগেও আমাদের দেখা হয়েছে, কিন্তু এবার আমি আপনার মাধ্যমে তার সাথে দেখা করতে চাই, সরাসরি দেখা করা হয়তো নিরাপদ হবে না আমার জন্য,’ কাউন্টেসের কথা এড়িয়ে গেলেন সেইন্ট জারমেইন।
‘কিন্তু দরকারটা কি সেটা আমাকে জানতে হবে, আমি যদি মনে করি সত্যিকারের কারন রয়েছে তাহলে অবশ্যই আপনার সাথে রাণীর দেখা হবে,’ কাউন্টেস বললেন।
সেইন্ট জারমেইন ভাবছেন। সময় নিচ্ছেন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য।
‘আপনার জন্য চায়ের কথা বলি,’ কাউন্টেস বললেন।
‘ধন্যবাদ, আমি চা খেয়ে এসেছি,’ মৃদু স্বরে বললেন সেইন্ট জারমেইন।
লোকটাকে চিন্তা করার সময় দিলেন কাউন্টেস। নিজেও ভাবার চেষ্টা করলেন আসলে কি কারনে আসতে পারে লোকটা। পঞ্চদশ লুইয়ের খুব ঘনিষ্ট এবং প্রিয় মানুষ ছিলেন সেইন্ট জারমেইন। বিশাল বড় একটা প্রাসাদ উপহার দিয়েছিলেন লুই তাকে। নানাধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে নাকি গবেষনা করা হতো সেই প্রাসাদের ভেতরের একটা আলাদা অংশে। যেখানে একমাত্র রাজা ছাড়া বাকি সবার প্রবেশ নিষেধ ছিল।
‘আপনাকে বললে ক্ষতি নেই, কারন রাজতন্ত্রের বিশ্বস্ত এবং যোগ্য কর্মচারি আপনি, পরিস্থিতির গুরুত্ব নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারবেন,’ খুব ধীর গতিতে কথাগুলো বললেন সেইন্ট জারমেইন।
‘আপনি বলুন এবং নিশ্চিত থাকুন।‘
‘রাজতন্ত্র চরম বিপর্যয়ের মুখে আছে, বিশাল এক বিপ্লবের সম্ভাবনা কড়া নাড়ছে দরজায়। এখনই সাবধান হতে হবে রাজাকে, বিপ্লব শুরু হবার আগেই থামিয়ে দিতে হবে একে, কাউন্টেসের মুখের দিকে তাকালেন সেইন্ট জারমেইন কথাগুলো বলে, প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই হয়তো।
‘এই বিপ্লব মারাত্মক আকার ধারন করবে যদি আগেই দমন করা না হয়, পুরো ফ্রান্স এবং ইউরোপ এই ঝুঁকির মুখে আছে। একমাত্র মহামান্য রাজাই পারেন সব ঠিক করে ফেলতে।
‘আপনি কি নিশ্চিত?’ কম্পিত কণ্ঠে বললেন কাউন্টেস।
‘আমি নিশ্চিত।‘
‘ঠিক আছে, আজ আমি রাণীর কাছে খবরটা জানাবো।’
‘আমি মহামান্য রাণীর সাথে দেখা করতে চাই।’
‘ওহ, আচ্ছা, ঠিক আছে, কাল সকালে আপনি চলে আসবেন রাজপ্রাসাদে, আমি দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবো।
‘অনেক ধন্যবাদ,’ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন সেইন্ট জারমেইন, লক্ষ্য করলেন কাউন্টেস লোকটার আসলেই কোন পরিবর্তন হয়নি,ঠিক আগের মতো পিঠ সোজা করে দাঁড়ায় লোকটা, বয়সের কোন ছাপই নেই।
‘কাল দেখা হচ্ছে,’ আবার বললেন সেইন্ট জারমেইন। একটু নিচু হয়ে সম্মান জানিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন বাইরে।
কাউন্টেস তাকিয়ে রইলেন লোকটার গমন পথের দিকে। তারপর নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মানুষ মাত্রই কি মরনশীল।
* * *
পরদিন সকালেই হাজির কাউন্ট। পরিপাটি করে সেজে এসেছেন। অবশ্য এমনিতেও তার রুচির প্রশংসা পুরো ইউরোপ জুড়ে। প্রতিবার নিত্যনতুন জুতো পড়েন তিনি এবং দামি সব পাথর লাগানো থাকে সেই জুতোগুলোয়। পাথরগুলোর মধ্যে হীরেই বেশি।
কাউন্টেস আগেই তৈরি ছিলেন। রাণীকেও বলা আছে সব। উনি দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন লোকটার সাথে। বাইরে চারঘোড়ায় টানা জুড়ি গাড়ি তৈরি। কাউন্টেস বেরিয়ে এলেন বাইরে। আরো একটা জুড়িগাড়ি দাঁড় করানো আছে। কাউন্ট হয়তো সাথে করেই নিয়ে এসেছেন। দামি সব উপাদান ব্যবহার করে বানানো হয়েছে জুড়িগাড়িটা। মনে মনে লোকটার রুচির প্রশংসা না করে পারলেন না কাউন্টেস।
রাজপ্রাসাদের ভেতরের অংশে রাণী থাকেন। সেইন্ট জারমেইন গাড়ি থেকে নামলেন ধীরেসুস্থে, চারদিকে তাকালেন। যেন কারো চোখে পড়তে চাচ্ছেন না, ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়াল না কাউন্টেসের। ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। কাউন্টকে ইশারা করলেন অনুসরন করার জন্য।
বেশ কিছু বারান্দা এবং করিডোর পার হয়ে বড় একটা হলরুমে চলে এলেন দুজন। রাণীর এলাকা এটা। অতিথি এলে এখানেই বসার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও রাণীর সামনে বসার অনুমতি নেই কারো।
রাণীকে খবর দিতে হলো না। বড় একটা সিংহাসনের মতো চেয়ারে বসে আছেন তিনি।
‘অভিবাদন, মহামান্য রাণী,’ মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন সেইন্ট জারমেইন।
‘কোন বিশেষ কাজে আমার সাথে দেখা করতে চান বলে শুনলাম,’ রাণী বললেন।
আপনি হয়তো জানেন আমি ফ্রান্স রাজতন্ত্রের একজন অনুগত সেবক, মহামান্য রাজা পঞ্চদশ লুই আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন, মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন সেইন্ট জারমেইন।
‘এখনো ফ্রান্সে আপনাকে সেই একই মর্যাদা দেয়া হবে। আপনি কি আবার ফ্রান্সে স্থায়ী হবেন?’
‘হয়তো এই শতকে না। আমি বিশেষ একটা বার্তা দিতে চাচ্ছিলাম আপনাদের, দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না এই বার্তার ভিত্তি কি-’ বলে একটু থামলেন সেইন্ট জারমেইন, তাকালেন চারদিকে, পুরো হলরুমটায় আর কেউ নেই, কাউন্টেস অবশ্য আছে, কিন্তু তার উপর চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস করা যায়।
‘–একটা বিপ্লব সমাগত, সেই বিপ্লবে এমনকি রাজতন্ত্রের ভিত টলে যেতে পারে, কাজেই বিপ্লব হওয়ার আগেই রাজা ষোড়শ লুই যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন, তাহলে হয়তো এই বিপ্লব এড়ানো সম্ভব।‘
‘বিপ্লব করবে কারা?’
‘সাধারন জনগন, তাদের সাথে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ও হয়তো যোগ দেবে, সবার আক্রমনের শিকার হতে হবে রাজতন্ত্রে অনুগত এবং সমাজের উচ্চশ্রেনীর লোকদের। শুরুতে রাজপরিবারের গুরুত্বপুর্ন কেউ থাকবে এর পেছনে, পরবর্তীতে তাকেও ছাড় দেবে না দুষ্কৃতিকারীরা।‘
‘আপনার এই ধারনা ভিত্তি কি?’
‘মহামান্য রাণী, শুরুতেই বলেছি এর পক্ষে কোন বাস্তব প্রমান দেয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে, কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়নি কেউ।‘
‘কিন্তু মহামান্য রাজা যথেষ্ট যুক্তি-প্রমান ছাড়া আপনার এই ধারনায় বিশ্বাস করবেন না।
‘আপনি যদি আমাকে মহামান্য রাজার সামনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন, তাহলে হয়তো তাকে বোঝাতে পারবো ব্যাপারটার গুরুত্ব।’
‘ঠিক আছে, আমি দেখছি কি করা যায়।‘
‘আপনার অশেষ কৃপা,’ মাথা নিচু করে বললেন সেইন্ট জারমেইন।
সেদিন চলে এসেছিলেন সেইন্ট জারমেইন, রাজার সাথে দেখা করেছিলেন তার পরদিনই। কিন্তু রাজাকে ঘটনার গুরুত্ব এবং ভয়াবহতা বোঝাতে সক্ষম হননি তিনি, এছাড়া রাজার অনুগত কিছু মোসাহেব সেইন্ট জারমেইনের এই ধারনা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন। এমনকি পুলিশ লাগিয়ে দেয়া হয় তার পেছনে, বন্দী করার আদেশ দেন রাজার মন্ত্রীদের একজন। ব্যথিত মনে প্যারিস ত্যাগ করেন তিনি। জুলাই ১৪, ১৭৮৯-এ একটা চিঠি পাঠান তিনি রাণীকে, তার ভাষা ছিল, আমার কথায় আপনারা কর্নপাত করেননি এবং সেই সময় এসে গেছে। আপনার চারদিকের সব বন্ধু এবং বাকি সবাই এগিয়ে চলেছে নির্মম মৃত্যুর দিকে।
এরপর একটি বিদায়ী চিঠি পাঠান তিনি কাউন্টেসকে উদ্দেশ্য করে, সেখানে লিখেছিলেন, ‘সব শেষ, কাউন্টেস। এই রাজতন্ত্রের আলো নিভে যেতে বসেছে। আমার কথায় বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এখন সেই সময়ও নেই। কিছু করার নেই এখন। হাত-পা বাঁধা আমার।’
তার কিছুদিন পরই শুরু হয় বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লব । প্রান হারান রাজা ষোড়শ লুই এবং রাণী মেরি। গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করা হয় তাদের। ষোল থেকে চল্লিশ হাজার মানুষকে মৃত্যুর সম্মুক্ষীন করা হয় এই বিপ্লবকালীন সময়ে। এরপরই উত্থান ঘটে এক মহানায়কের। তিনি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
* * *
বাংলাদেশে অনেক গরম, কথাটা জানতেন ড. কারসন, নিকোলাস কারসন, মা রাশিয়ান, বাবা ব্রিটিশ। বেড়ে উঠা লন্ডনে, পড়াশোনা হার্ভার্ডে। এখন পুরোদস্তুর গবেষক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার গবেষনা কাজে টাকা যোগায় হার্ভার্ড অথবা ব্রিটিশ সরকার। খোঁড়াখুঁড়িতে ওস্তাদ লোক তিনি। এশিয়া মহাদেশের এমন কোন দেশ নেই ঘুরে বেড়াননি। বাংলাদেশে এর আগে একবার এসেছিলেন, সেটা অনেক আগের কথা। এখন অনেক বদলে গেছে সবকিছু। তিনিও এখন আর তরুন নেই। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই করছে।
এবার বাংলাদেশ সরকারের পুরাকীর্তি সংরক্ষন বিভাগের বিশেষ আমন্ত্রনে এসেছেন তিনি। ঘুরে বেড়াবেন বেশ কিছু প্রাচীন স্থানে। কিভাবে স্থাপত্যকীর্তিগুলোর ক্ষতি না করে সংরক্ষন করা যায় সে ব্যাপারে হাতে-কলমে প্রশিক্ষন দেবেন তিনি।
মে মাসের ঝাঁঝাঁ রোদে পুরো শহর যেন পুড়ে যাচ্ছে। বয়স্ক একজন ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন অধ্যাপক ড. কামাল আরেফিন। পেছনের সিটে পাশাপাশি বসে আছেন ড. শাখাওয়াত আলী এবং ড. কারসন। দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। এখন সরকারী প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে ড. শাখাওয়াত আলীর বয়স পঞ্চান্ন-ছাপান্ন এবং ড. কামাল আরেফিনের বয়স পয়তাল্লিশ হবে, ধারনা করলেন ড. কারসন।
‘আমরা কি বগুড়া যাচ্ছি?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।
‘হ্যাঁ, প্রথমে বগুড়ায়, সেখানে তিনদিন থাকার পর যাবো রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর।‘ উত্তর দিলেন ড. শাখাওয়াত।
‘হ্যাঁ,’ ড. কারসন সম্মতি জানালেন।
‘ড. কারসন, একটা প্রশ্ন করবো, কিছু মনে যদি না করেন,’ খুব দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ড. কামাল আরেফিন।
‘প্লিজ, সংকোচ করবেন না,’ ড. কারসন বললেন হেসে।
‘এশিয়ার সব দেশেই তো গিয়েছেন আপনি, এর মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় লেগেছে। কোন দেশটা?’ সময় নিয়ে আস্তে আস্তে বললেন ড. কামাল আরেফিন, অনেকটা সাংবাদিক স্টাইলে।
‘সত্যি কথাই বলবো, ইন্ডিয়া এবং তিব্বত সবচেয়ে রহস্যময় জায়গা বলে মনে হয়েছে আমার।’ ড. কারসন বললেন, তাকালেন দুজনের দিকে।
‘তিব্বত আপনার খুব প্রিয়, কোথায় যেন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন আপনি, সেখানে বলেছিলেন শেষ জীবনটা তিব্বতে কাটাতে চান।‘
‘অনেক আগে কোন এক জায়গায় বলেছিলাম, এখনো একই কথা বলবো, তিব্বত হচ্ছে চমৎকার একটা রেস্টিং প্লেস। বাইরের পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক এখনো অনেক কম দেশটার। এছাড়াও হিমালয়ের ঐ অঞ্চলটা অনেক রহস্যময়। সভ্য সমাজের সাথে সম্পর্ক ছাড়াই দিনের পর দিন কাটিয়েছে ওখানকার মানুষ।‘
‘হ্যাঁ, তিব্বত সম্পর্কে আমরাও খুব কম জানি।’ বললেন ড. শাখাওয়াত।
‘এই অঞ্চল থেকে অতীশ দিপংকর গিয়েছিলেন তিব্বতে, ১০৪১ সালের দিকে, তখন সেখানে তাকে রাজকীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়, তিনি মারাও যান সেখানে।’ ড. কামাল আরেফিন বললেন।
ড. কামাল আরেফিনের দিকে তাকালেন ড. শাখাওয়াত, যেন বলতে চাইলেন এতো কথা বলতে বলেছে কে তোমাকে।
‘অতীশ দিপংকর সম্পর্কে জানি আমি,’ ড. কারসন বললেন, বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে তার ব্যপক ভূমিকা ছিল। তিব্বতীরা গৌতম বুদ্ধের পরই তাকে সম্মান করতো, এতোটাই সম্মানিত ছিলেন তিনি।
‘বাংলাদেশেও বৌদ্ধ ধর্ম ব্যপক প্রসার লাভ করেছিল একসময়। আমাদের বিভিন্ন পুরাকীর্তিতে তার নিদর্শন দেখতে পাবেন আপনি।’ ড. শাখাওয়াত বললেন।
‘আমরা তো মহাস্থানগড় যাচ্ছি এখন, তাই না?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন, প্রসংগ পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন তিনি।
‘প্রথমে বগুড়া শহরে ঢুকবো, রাতটা সেখানে কাটিয়ে পরেরদিন সকালে চলে যাবো স্পটে।‘
‘কি দরকার, সরাসরি চলে গেলেই তো পারি,’ ড. কারসন বললেন।
‘একটু রেস্ট নেয়া দরকার আপনার, গতকাল রাতেই তো এলেন, একটু বিশাম না নিলে কি হয়।‘
‘ঠিক আছে, আপনারা যা ভালো বোঝেন।’ ড. কারসন বললেন, একটু বিরক্ত হয়েছেন তিনি, উপমহাদেশের মানুষদের এ ব্যাপারটা পছন্দ হয় না তার, কোন কিছু তাড়াতাড়ি করতে চায় না, ধীরে সুস্থে, সময় নিয়ে করতে চায়, সময়ের মূল্য অনেক কম এদের কাছে।
ল্যাপটপটা বের করলেন একটা ব্যাগ থেকে। সবসময়ই ইন্টারনেট সংযোগ রাখেন। এখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে গেলেন তিনি অনেকটা দুই ডক্টরের হাত থেকে বাঁচার জন্যই যেন।
***
সকালে ঘুম ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো রাশেদ। কখন ঘুমিয়েছে রাতে সে? কয়টা বাজে এখন? জামা-কাপড় না খুলেই শুয়ে পড়েছিল সে। হাত-ঘড়িটার দিকে তাকাল। সাড়ে সাতটা বাজে মাত্র। এখন কি করা যায়, আবার ঘুমাবে নাকি নাস্তা করে নেবে, চিন্তা করতে লাগল। কাজ নেই কোন, আরো কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নিলেই অসুবিধা কি।
বালিশে আবার মাথা ঠেকাল রাশেদ। কি যেন একটা সমস্যা তৈরি হচ্ছে চারদিকে। চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করল সে। এমন একটা কিছু ঘটছে যা হয়তো কারো কল্পনাতেই নেই। খুব সাদাসিদে জীবনযাপন করে অভ্যস্ত সে। একটু এদিক সেদিক হলেই কেমন অস্থির লাগে। কিন্তু এই অস্থিরতা, এই ভয় কি নিয়ে, জানে না রাশেদ। শামীমের ব্যাপারটা ছাড়া কোন খাপছাড়া ঘটনা ঘটেনি এখনো। ছেলেটা কোথায় কে জানে। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে শামীমের নাম্বারে কয়েকবার চেষ্টা করল রাশেদ। মোবাইল সুইচড অফ। বিরক্ত লাগছে তার। মোবাইল যদি বন্ধই থাকে সবসময় তাহলে সেই জিনিস নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কেন? নাকি কোন সমস্যায় পড়েছে ছেলেটা? এতো চিন্তিত দেখিয়েছে কিছুদিন, হয়তো আসলেই কোন সমস্যায় আছে, যা বলতে পারছে না কাউকে। এরপর ওর সাথে দেখা হলে যে করেই হোক জানতে হবে সমস্যাটা কি।
বহুদিন বাবার সাথে কথা হয় না। বাবার সাথে শুধু টাকার সম্পর্ক। মাসের টাকা যেদিন পাঠান তিনি সেদিনই কথা হয় শুধু।
দুবার রিঙ হতেই ধরলেন বাবা।
‘স্লামালেকুম, বাবা, কেমন আছেন?
‘ভালো,’ খুব গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর এলো ওপাশ থেকে। ঘুমজড়ানো।
‘আপনি ঘুমাচ্ছেন, আমি তাহলে পরে কল করি?’
‘না, কি বলবা বলো।‘
‘এমনিই কল করলাম, আপনার সাথে কথা হয় না কতোদিন।‘
ওপাশ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। সব চুপচাপ।
‘আছেন আপনি?’ খুব নরম গলায় বলল রাশেদ।
‘তুমি বাড়ি আসো, তোমার সাথে অনেক কথা আছে।
‘কি কথা?’
‘সাক্ষাতে বলবো, আর শোনো, ফোন রাখছি এখন, আমার ঘুম দরকার, তুমি যতো তাড়াতাড়ি পারো আসো, ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে,’ বলল রাশেদ।
মোবাইলটা বিছানার উপর ফেলল রাশেদ। ঘুম আসবে না এখন। শামীমের কথা মাথায় আসছে। ও কি বাসায় চলে গেল? অসুস্থ কোন কারনে? একবার একটা ফোন করলেই চিন্তামুক্ত হওয়া যায়। ওদের বাসার টেলিফোন নাম্বার আছে মোবাইলে। কিন্তু এতো সকালে ফোন করা ঠিক হবে না। বিরক্ত হতে পারে বাসার লোকজন।
নিচে নেমে নাস্তা করে নিল রাশেদ। তারপর পত্রিকা পড়ার জন্য পেপার রুমে ঢুকলো।
*
অধ্যায় ৫
কালো অন্ধকার একটা রুমে গোল হয়ে বসেছে পাঁচজন লোক। পরনে কালো আলখেল্লা। মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে অনেকটা স্টার প্রতাঁকের মতো করে। সেই আলোতেই যতোটুকু দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত তারা।
‘আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি,’ বলে উঠলো পাঁচজনের একজন, গম্ভীর কণ্ঠস্বর তার, বোঝা যাচ্ছে এই ছোট দলটার নেতা তিনি, ‘সংখ্যায় কমে গেলাম আমরা। কিন্তু তাতে কোন ক্ষতি হয়নি,আমাদের চাই নিবেদিতপ্রান আত্মা, বেইমান নয়। বেইমানীর শাস্তি কি, দেখেছেন তো সবাই?’
‘মৃত্যু,’ বাকি চারজন বলল একসাথে।
‘লুসিফারের শপথ নিয়েছি আমরা, আমাদের রক্ত এখন কালো রক্ত, আমাদের আত্মা এখন কালো আত্ম, ষষ্ঠজন নেই আমাদের সাথে, লুসিফার তার কল্যান করবে এখন, কিন্তু আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি আমরা, তাই না?
‘পালন করেছি,’ বাকি চারজন বলল একসাথে।
‘না, পালন করিনি আমরা,’ গর্জে উঠল লোকটা। ‘আমাদের জিনিস এখনো আমাদের হাতে আসেনি। মহামূল্যবান সেই বই, হাজার বছরের গুপ্তবিদ্যার আধার, এখনো আমাদের হাতে নেই। কেন?’
‘আমরা উদ্ধার করবো,’ বলল সবাই।
‘হ্যাঁ, খুঁজে বের করুন, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে হলেও, রক্ত ঝড়িয়ে হলেও সেই বইটা আমাদের চাই।’
‘মহান লুসিফার, শক্তি দিন আমাদের,’ সমস্বরে বলল সবাই।
বিড়বিড় করে প্রাচীন কিছু মন্ত্র আওড়ালেন দলনেতা। বাকি সবাই যোগ দিলো তাতে। পুরো ঘরটায় আবহাওয়া যেন শীতল হয়ে পড়েছে। মোমবাতির আলোগুলো কাঁপছে অল্প অল্প করে।
চারজনের একজন উঠে গেল। সবার সামনে একধরনের পাত্র রাখল সে, দেখলেই বোঝা যাবে জিনিসগুলো প্রাচীন। হাজার বছরের কম হবে না এগুলোর বয়স। কালো একটা মোরগ নিয়ে এলো এরপর। বেশ হৃষ্টপুষ্ট। হাঁটু গেড়ে বসে একটানে মাথাটা ছিঁড়ে ফেলল সে মোরগের। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তাজা সেই রক্ত পাত্রগুলোতে ঢেলে দিল সে।
‘মহান লুসিফারের নামে,’ বলে পাঁচজন পাত্রগুলো তুলে নিলো হাতে। তারপর একনিঃশ্বাসে গিলে ফেলল রক্ত।
‘আমাদের আরো সংগঠিত হতে হবে, সংখ্যায় আরো বাড়তে হবে, তাহলেই লুসিফার তুষ্ট হবেন,’ দলনেতা বললেন সবাইকে উদ্দেশ্য করে, এই মুহূর্তে ভয়ংকর দেখাচ্ছে তাকে, ঠোঁটের কোনে লাল রক্ত লেগে আছে কিছুটা।
‘আপনি আমাদের পথ দেখিয়ে দেবেন,’ বাকি চারজন বলল একসাথে।
‘এমন লোক প্রয়োজন আমার যারা হতাশাগ্রস্ত, বিশ্বাস হারিয়েছে সমাজে, রাষ্ট্রে এবং ধর্মে, তাদের দরকার যারা আমাদের অস্ত্র হতে পারবে, লুসিফারের চেতনা ছড়িয়ে দিতে পারবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।’
‘কিভাবে তেমন মানুষ খুঁজে বের করবো আমরা?’ প্রশ্ন করল একজন।
‘তোমাকে যেভাবে খুঁজে বের করেছিলাম আমি, মনে পড়ে?’
‘আমি ধন্য হয়েছি লুসিফারের ছায়ায় আসতে পেরে।‘
‘কিন্তু বিপথগামী হওয়া চলবে না, তার শাস্তি সবাই দেখেছে, আগামীকাল পুরো দেশ দেখবে।‘
কেউ কোন কথা বলল না। এই রুমটার পাশের রুমেই পড়ে আছে একটা লাশ। নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। লুসিফারের সীমানার বাইরে যাবার অপচেষ্টা করেছিল সে। শাস্তিও পেয়েছে। পুরো নিয়ম মেনে খুন করা হয়েছে ছেলেটাকে। লুসিফারকে খুশি করার জন্য যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠান মেনে শেষ করা হয়েছে কাজটা। বুড়িগঙ্গায় লাশটা ফেলে আসা হবে একটু পর। দেহটা যাবে শুধু। মাথাটা আলাদা করে রাখা হয়েছে একটা বাক্সে। বিকৃত একটা চেহারা। দেখলে কেউ বুঝতেও পারবে না কি মায়া কাড়া চেহারা ছিল ছেলেটার। মৃত্যুর সময় যে বিভীষিকা দেখেছে ছেলেটা তা যেন এখনো ওর চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে। মাথাটা সংরক্ষন করা হবে প্রাচীন অ্যালকেমি অনুসারে। রাখা হবে ভবিষ্যতে যারা সংগঠনের বাইরে যেতে চাইবে তাদের জন্য একধরনের বিপদসংকেত হিসেবে।
কিন্তু আসল জিনিস পাওয়া যায়নি ছেলেটার কাছে। যদিও ধারনা করা হচ্ছে। কোথায় পাওয়া যাবে সেটা। আগামীকালই অপারেশনে নামতে হবে। অনেক গুরুত্বপুর্ন বই। যোগ্যলোকের হাতে পড়ার আগেই উদ্ধার করতে হবে যে কোন শর্তে।
দোতলা বাড়িটার সামনে ছোট একটা জিপ দাঁড়ানো। অনেক রাত হয়ে গেছে। দুজন লোককে বের হতে দেখা গেল বাড়িটা থেকে। বড়সড় একটা ট্রাঙ্ক ধরাধরি করে নিচে নামাচ্ছে তারা। জিপের পেছনটা খোলাই ছিল। ট্রাঙ্কটা তুলে দিয়ে সামনে চলে গেল দুজন। জিপটা স্টার্ট দিয়েছে একজন। গন্তব্য দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু।
* * *
‘তোমাকে ইদানিং খুব অন্যমনস্ক দেখায় রাশেদ, কি ব্যাপার, আমাকে বলা যাবে?’ জিজ্ঞেস করল লিলি। পাশাপাশি বসে আছে দুজন। ইউনিভার্সিটির ভেতরেই খোলামেলা একটা মাঠে।
কিছু বলল না রাশেদ। সিগারেট ধরা ছিল হাতে। ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। লিলির দিকে তাকাল।
‘আমি নিজেও বুঝতে পারছি না, মনে হচ্ছে সব ঠিক আছে, আবার মনে হচ্ছে কিছুই ঠিক নেই,’ রাশেদ বলল বিড়বিড় করে।
‘তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি,’ লিলি বলল।
‘আমিও না,’ বলে হাসল রাশেদ।
লিলিও হাসল।
‘তুমি বাড়ি যাও, থেকে এসো কয়েকটা দিন, তাহলে হয়তো ভালো লাগবে,’ পরামর্শ দিল লিলি।
‘আমিও তাই ভাবছি, বাবাও বললেন যেতে, উনি কখনো জোর করেন না। কিছু একটা সমস্যায় আছেন মনে হলো।‘
‘তাহলে তো যাওয়া দরকারই তোমার, ইদানিং ক্লাসও নেই তেমন,’ লিলি বলল।
‘আমাকে তাড়াতে চাইছো মনে হচ্ছে।’
‘তোমার এই চিন্তাযুক্ত চেহারা দেখার চেয়ে তোমাকে বাড়ি পাঠানোই ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।‘
‘দেখি, যাবো, ওখানেও কিছু কাজ আছে।‘
‘শামীম কোথায়? ওর খবর জানো? আমি ঢাকায় ফেরার পর একদিনও দেখলাম ক্যাম্পাসে,’ লিলি বলল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাশেদ। কিছু বলল না।
শামীম কোথায়, কি হয়েছে ওর জানতে পারবে সে খুব শিগগিরিই।
* * *
রাতে ভালো ঘুম হয়নি ড. কারসনের। অনেক গরম এখানে। এছাড়া রুমের এসিটাই চলছিল না। ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছেন, একটা কলা, দুপিস পাউরুটি। দুই ডক্টরের দেখা নেই এখনো। এতো ঢিলেঢালা এরা! নয়টা বেজেছে কখন!
‘গুড মর্নিং ড. কারসন,’ ড. আরেফিনকে দেখা গেল ছোট রেস্টুরেন্টটার দরজায়।
‘গুড মর্নিং,’ ছোট্ট করে উত্তর দিলেন ড. কারসন।
‘ঘুম হয়েছে ঠিকমতো আপনার?’
‘হয়েছে,’ ড. শাখাওয়াত কোথায়?
‘এই তো এসে পড়বেন,’ বলে পাশের চেয়ারে বসলেন ড. আরেফিন।
এবার অপেক্ষার পালা, কখন আসবেন ড. শাখাওয়াত। দুজনের নাস্তা করা শেষ হলেই রওনা দেবেন ওরা। মহাস্থানগড়ে যেতে একঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না।
আরো আধঘণ্টা পর এলেন ড. শাখাওয়াত। কিন্তু তিনি বেশি সময় নিলেন না। এক কাপ চা খেয়েই উঠে পড়লেন রওনা দেবার জন্য। মাইক্রোবাস একটা দাঁড়ানোই ছিল তাদের জন্য। রওনা দিয়ে দিলেন তিনজন, তখন প্রায় এগারোটা বাজতে চলল।
সিটে বসেই ল্যাপটপ খুলে বসলেন ড. কারসন, এই দুজনের বকরবকর শোনার চেয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকা ভালো।
‘ড. কারসন, যদি কিছু মনে না করে একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি,’ বললেন পাশের সিটে বসে থাকা ড. আরেফিন।
বিরক্তবোধ করলেও হেসে তাকালেন ড. কারসন। ড. শাখাওয়াত চুপচাপ তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে।
‘বলুন, কি প্রশ্ন করতে চাইছেন?’
‘আপনি কি এলিক্সির অফ লাইফে বিশ্বাস করেন?’
একটু সময় নিলেন ড. কারসন উত্তর দেবার আগে, ‘এখনো এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি,আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কিছু যায় আসে না, হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
‘জানি না কেন? কিছুদিন ধরেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছিল।’
‘প্রাচীন অ্যালকেমিতে উল্লেখ আছে ফিলোসফারস স্টোনের, যদিও তার অস্বিত্ব আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি,এলিক্সির অফ লাইফও এমন একটা বিষয় যা যুগ যুগ ধরে গবেষনা হয়ে আসছে, আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু আজও এর সন্ধান মেলেনি,হয়তো হমিলবেও না। এটা আসলে একটা বিশ্বাস। অমরত্বের সন্ধানে বিভিন্ন যুগের মানুষ। বিভিন্ন দিকে ছুটেছে। কিন্তু খোঁজ পায়নি কেউই। বিভিন্ন দেশে একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়, যেমন এক চীনেই প্রায় হাজার খানেক নামের সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা, ভারতে বলা হয় অমৃত-রস বা অমৃতা, আবে-হায়াত, হোলি গ্রেইল এ ধরনের আরো অনেক নাম আছে এর, ড. কারসন বললেন।
‘জি, ঠিক বলেছেন,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘তুমি হঠাৎ অমৃত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন আরেফিন?’ এবার জিজ্ঞেস করলেন ড. শাখাওয়াত।
‘কিছু না, শুধু কৌতূহল,’ নরম স্বরে বললেন ড. আরেফিন। এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না, ঢাকায় ফিরে ড. শাখাওয়াত সবার সাথে বলাবলি করবে, হাসাহাসি করবে, এটা মোটেই পছন্দ হবে না তার।
‘কৌতূহলি হবার মতোই বিষয়,’ ড. কারসন বললেন।
‘অবাস্তব, কাল্পনিক ব্যাপার।’
‘ড. শাখাওয়াত, পৃথিবী এতোই রহস্যময় যে কোন কিছু হেসে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না আমাদের,’ ড. কারসন বললেন। তাকালেন ড. আরেফিনের দিকে। একটু সাহায্য করা গেছে বোধহয় লোকটাকে।
‘তাও ঠিক আপাতদৃষ্টিতে যাকে অনেকসময় অবাস্তব মনে হয়, পরবর্তীতে তা অনেকক্ষেত্রেই বাস্তবে পরিণত হয়েছে,’ স্বীকার করলেন ড. শাখাওয়াত।
‘মহাস্থানগড় আর কতোদূর?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. কারসন।
‘চলে এসেছি প্রায়,’ ড. শাখাওয়াত বললেন।
বাকি পথে আর কোন কথা হলো না। দুই ডক্টর দুদিকে তাকিয়ে রইলেন, ড. কারসন ব্যস্ত রইলেন তার ল্যাপটপ নিয়ে। মহাস্থানগড় চলে এসেছে।
‘ড. কারসন, আপনি কি এখনি ভেতরে ঢুকবেন, নাকি একটু চা খেয়ে নেবেন আগে?’ জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিন।
‘কিছু খাবো না এখন আমি, জায়গাটা দেখে আসি আমি, কেমন যত্নে রেখেছেন আপনারা সেটা আগে দেখি,’ ড. কারসন গাড়ি থেকে নামলেন।
ঢুকতেই নানা ধরনের কুটির শিল্প নিয়ে বসে আছে লোকজন, লোকজ সংস্কৃতির অংশ এটা। ভালোই লাগলো দেখতে। দু’একটা জিনিসের দরদামও করলেন ড. কারসন। একেবারে সস্তা।
এরকম জায়গা আগেও দেখেছেন ড. কারসন। একধরনের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা পুরো এলাকাটা এবং আশপাশের এলাকা থেকে অনেক উঁচু। একসময় দুর্গনগরী ছিল। জায়গাটা সম্পর্কে বইয়ে আগেই পড়েছিলেন, সাথে ছবিও ছিল। কাজেই দেখতে খুব অপরিচিত মনে হলো না তার কাছে। দুই ডক্টর দু’পাশে হাঁটছে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে। এখানে হাজারবার এসেছে তারা। দেখা জিনিস বারবার দেখতে হয়তো ভালো লাগেনা ওদের, ভাবলেন ড. কারসন।
‘এখানকার সভ্যতাটা অনেক প্রাচীন, এক হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে এখানে রাজত্ব করতো পরশুরাম বলে এক রাজা,’ বললেন ড. আরেফিন।
‘এইসব ইতিহাস উনি জানেন,’ বিরক্ত কণ্ঠে বললেন ড. শাখাওয়াত।
‘বলতে দিন ওনাকে, হয়তো নতুন কোন তথ্য জানতেও পারি তার কাছ থেকে,’ ড. কারসন বললেন।
‘বলা হয় হযরত সুলতান আহমেদ বলখী এখানে এসেছিলেন মাছের পিঠে চড়ে, তার কবরও আছে এখানেই, পরশুরামকে পরাজিত করে এই অঞ্চলে তিনি মুসলিম ধর্ম বিস্তার করেছিলেন,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘এটাও আমাদের সবার জানা,’ ড. শাখাওয়াত বললেন।
‘কিন্তু একটা তথ্য আপনাদের জানা নেই,’ দুজনের দিকে তাকালেন ড. কারসন, ‘সেই সময় একজন ইউরোপীয় ভদ্রলোকও এখানে এসেছিলেন!’ ড. কারসন বললেন।
দুই ডক্টর দুজনের মুখের দিকে তাকালেন। হা হয়ে গেছেন তারা। এক হাজার বছর আগে কোন ইউরোপিয়ানের এই অঞ্চলে আসার প্রশ্নই ওঠে না!
‘আপনি কি নিশ্চিত ড. কারসন? কোন সাক্ষ্য-প্রমান আছে? ভারত মহাদেশ আবিষ্কারের কাহিনী তাহলে নতুন করে লিখতে হবে,’ ড. শাখাওয়াত বললেন।
‘কোন প্রমান নেই আমার কাছে, প্রমান সংগ্রহ করতেই এখানে আসা আমার,’ ড. কারসন বললেন।
দুই ডক্টর দুজন দুজনের তাকালেন আবার। বলে কি এই লোক, এতোক্ষন ভালোই মনে হচ্ছিল ড. কারসনকে তাদের কাছে, এখন মনে হচ্ছে লোকটা পাগল, নয়তো মাথা খারাপ।
ড. কারসন গটগট করে হেঁটে যাচ্ছেন পুরাকীর্তিটার দিকে। এসব জায়গায় আসলেই কেমন গা ছমছম করে উঠে তার। হাজার বছর আগে এখানে মানুষের বসতি ছিল। লোক গমগম করতো এখানেই। বাড়িঘর ছিল, চাষাবাদের জমি ছিল, রাজা ছিল, রাজত্ব ছিল, এখন কিছুই নেই। সময়কে জয় করার শক্তি নেই কারো। সময়ের আঘাতেই বদলে গেছে সবকিছু।
* * *
দরজার কাছে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষন ধরে। লক্ষ্য করছে রাশেদ। ছায়া দেখা যাচ্ছে শুধু ভেতর থেকে। রাত এগারোটা বাজে। কে আসতে পারে?
‘কে ওখানে?’ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল রাশেদ।
উত্তর এলো না এবং ছায়াটা সরেও গেল না। বিছানা ছেড়ে উঠলো রাশেদ। হাতে একটা বই ছিল, টেবিলে রাখল সে বইটা।
পা টিপে টিপে এগুচ্ছে সে। দরজা খোলার আগেই যেন পালিয়ে না যায়। দু’পা এগিয়েছে রাশেদ। দেখল ছায়াটা নেই। তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলল। আজব ব্যাপার। একেবারে খালি করিডোরটা। পাশের রুমের ছেলেটা এখনো হয়তো রুমে ফেরেনি, তাই তালাবদ্ধ রুমটা। অন্য পাশের রুমে একজন থাকে, কালে ভদ্রে দেখা হয় ছেলেটার সাথে। এখন হয়তো রুমেই আছে। সেই ছেলে কি এই কাজ করবে? মনে। হয় না। ছায়াটা কি সত্যিই ছিল? নাকি চোখের ভুল।
দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় চলে এলো রাশেদ।
বইটা হাতে নেবে এই সময় আবারো মনে হলো দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে কেউ। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই রাতে এইসব ফাজলামির কোন মানে হয়?
এই সময় ছোট্ট একটা খাম ঢুকল দরজার তলা দিয়ে। সময় নিয়ে বিছানা ছাড়ল রাশেদ। কেউ হয়তো মজা করছে। ভয় পেলে ওরা হয়তো আরো বেশি মজা পাবে।
খামটা তুলে নিলো রাশেদ। ভেতরে লাল রঙের একটা চিরকুট। তাতে লেখা :
‘সাবধান! সাবধান!!’
চারপাশে কেমন আজব ধরনের ছবি, শামীমের শরীরে যে ধরনের উল্কি আঁকা ছিল অনেকটা সেধরনের।
ফিক করে হেসে ফেলল রাশেদ। শামীমই হয়তো ফাজলামি করছে। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। পুরো হলটাই যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শামীমই যদি খামটা দরজার তলা দিয়ে ফেলে যায়, তাহলে এতো তাড়াতাড়ি গায়েব হয়ে গেল কি করে? এই হলে ওর আরো কেউ পরিচিত থাকার কথা না।
দরজা বন্ধ করে রুমে ফিরে এলো রাশেদ। ঘুম পাচ্ছে, লাইট বন্ধ করে দিলো। জানালাটা খোলা। বাইরে থেকে ঝিরিঝিরি বাতাস আসছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে।
অন্ধকার ঘরটা যেন আরো অন্ধকার হয়ে গেছে। সেই অন্ধকারে কতগুলো ছায়া শরীর যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুঁজছে কিছু একটা, তন্নতন্ন করে। বিছানার পাশে এসে বসল একজন যেন। আধো ঘুমে কিংবা পুরো ঘুমেই ঘটনাগুলো ঘটছে বলে রাশেদের মনে হলো। এখানে তার কিছুই করার নেই। ছায়ামূর্তিগুলো এলোমেলো করে ফেলছে সবকিছু, কিন্তু রাশেদ এখন দর্শক।
বিছানার তলা থেকে বড় ট্রাঙ্কটা বের করেছে ছায়ামুর্তিদের একজন। তালা না খুলেই যেন দেখে নিলো ভেতরের জিনিসগুলো। নিজেদের মাঝে কথা বলল ফিসফিস করে। তারপর মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
ব্যাপারটা স্বপ্নই, ভাবল রাশেদ। কিংবা হেলুসিনেশন। মাথা কাজ করছে না তার একেবারে। ডাক্তার দেখানো দরকার। আস্তে আস্তে সত্যিকারের ঘুমেই হারিয়ে গেল।
* * *
লাশটা ফেলে আসা হয়েছে বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর নিচে। কাল সকালেই কারো না কারো চোখে পড়বে, কিংবা আজ রাতেও পড়তে পারে। সংবাদপত্রগুলোতে হেডলাইন হবে। খুনিকে খুঁজে বের করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে পুলিশ, গোয়েন্দাসহ সকল আইনশৃংখলা বাহিনীর লোকজন। লাশের পরিচয় বের করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। কারন সারাদেহে যে উল্কি আঁকা ছিল তা পরিবারের সকলেই জানে। সাবেক এক মন্ত্রীর ছেলে ছিল লাশটা। তিনি তার সবর্শক্তি দিয়ে ছেলের হত্যাকারীকে বের করতে চাইবেন, এটা জানা কথা। কিন্তু কিছুই করতে পারবেন না তিনি। খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করে। তাদের আশ্রয়দাতা স্বয়ং শয়তান, লুসিফার।
কালো আলখেল্লা পড়া পাঁচজনের দলটার দলনেতা একা বসে আছেন। পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করছেন। ছেলেটাকে খুব পছন্দ হয়েছিল তার। পড়াশোনা করা ছেলে। জানার আগ্রহ ছিল ব্যাপক। সামনে একেই নেতৃত্বে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বোকার মতো বেইমানী করে বসল।
পাশের রুমে চারজন ধ্যানে বসেছে। অনেকটা মানসিক একটা খেলার মতো ব্যাপারটা। এদের দেহ এখানে থাকলেও এদের আত্মা এখন এখানে নেই। খুঁজতে পাঠিয়েছেন ওদের তিনি। যদিও সশরীরে খোঁজার লোকও আছে তার। টাকার বিনিময়ে যে কোন কাজ করে লোকটা। কিন্তু সবকাজে ওর উপর বিশ্বাস রাখা যায় না।
হেঁটে পাশের রুমে চলে এলেন। কাজ শেষ হয়েছে মনে হয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওদের শরীরে এখন আত্মা প্রবেশ করেছে।
‘যা খোঁজা দরকার তা পেয়েছো তোমরা?’ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন দলনেতা।
হুশ ফিরে পেয়েছে ওরা। কেমন নেতিয়ে পড়েছে। এ ধরনের ধ্যানে অনেক মানসিক শক্তির পাশাপাশি শারীরিক শক্তিও খরচ হয়ে যায়। অনেকে নাকি দু’তিনদিন বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারে না।
‘খুঁজে পেয়েছি আমরা, ছেলেটার রুমেই আছে এখনো, একটা ট্রাঙ্কে লুকানো,’ বলল চারজনের একজন।
‘চমৎকার।‘
‘এখন আমাদের করনীয় কি?’ জিজ্ঞেস করল একজন।
‘করনীয়ও কি বলে দিতে হবে তোমাদের?’
মাথা নিচু করে রইল চারজন।
‘কালকের মধ্যে চাই আমি জিনিসটা। যেভাবেই হোক, ট্রাঙ্কটা চাই আমার, শামীমের পুরো ব্যাগটা দেখতে চাই আমি। ছেলেটাকে যদি খুনও করতে হয় পিছ পা হবে না কেউ। এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।‘
‘জি।’
‘কাল সন্ধ্যায় তোমরা চারজনই যাবে, ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা চলবে না এখানে।‘
‘মহান লুসিফারের জয়।’ চারজন বলে উঠলো একসুরে।
‘মহান লুসিফারের জয়!’ দলনেতার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।
*
অধ্যায় ৬
পেপাররুমে এসেছে রাশেদ। সকাল ন’টা বাজে মাত্র। নাস্তা করতে ইচ্ছে করছে না তার। একপাশে বাংলা, একপাশে ইংরেজি সব দৈনিক সারি করে রাখা। সবচেয়ে চালু বাংলা পত্রিকাটা তুলে নিলো রাশেদ।
হেডলাইনে সাধারনত যা থাকে তাই আছে। সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থা। কিছু বিজ্ঞাপন। শেষ পাতার নিচের দিকে ছোট্ট করে একটা হেডিং চোখ এড়ালো না রাশেদের।
নৃশংস হত্যাকাণ্ড
নিজস্ব প্রতিবেদক: বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর নিচে গতকাল রাত এগারোটায় কে বা কারা একটি মৃতদেহ ফেলে গেছে। উল্লেখ্য, মৃতদেহটি ছিল মস্তকবিহীন। সার্চপার্টি পুরো এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও খন্ডিত মস্তকটি পাওয়া যায়নি। এছাড়া মৃতদেহটির শরীরে নানা ধরনের উল্কি আঁকা ছিল। মৃতদেহটির পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। পোস্টমর্টেমের জন্য দেহটি ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না রাশেদ। পত্রিকাটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। উল্কি ব্যাপারটা একেবারে মিলে যাচ্ছে। এছাড়া শামীম গত কয়েকদিন ধরেই গায়েব। শামীমের এই করুন পরিণতি মানতে কষ্ট হচ্ছে রাশেদের। কিন্তু সত্যিই কি শামীমের লাশ ওটা? নিশ্চিত হওয়ার উপায় অবশ্য আছে। শামীমের বাসায় ফোন করে শামীমের মায়ের সাথে কথা বললেই সব জানা যাবে।
পেপাররুম থেকে বের হয়ে এলো রাশেদ। সত্যিই যদি শামীমের লাশ হয় ওটা তাহলে সামনে তার জন্য দারুন বিপদের সম্ভাবনা আছে। কারন শামীমের সাথে শেষ দেখা হয়তো তার সাথেই হয়েছিল। এছাড়া শামীমের বাড়ি থেকে ব্যাগটা আনার জন্য সে-ই গিয়েছিল। শামীমের মা হয়তো এতোক্ষনে তার নাম বলেও দিয়েছে। পুলিশ তো অবশ্যই আসবে তার কাছে। এমনও হতে পারে তাকেই আসামী বানিয়ে ফেলতে পারে শামীমের মা। এ ধরনের কেসে যে কোন কিছুই সম্ভব।
তাড়াহুরো করে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রাশেদ। এখান থেকে সরে যেতে হবে। এক্ষুনি। ট্রাঙ্কটা খুলে শামীমের রেখে যাওয়া ট্রাভেল ব্যাগটা বের করল। নিজেরও একটা ব্যাগ আছে, সেটাও বের করল। ছোট্ট আলমীরা থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় বের করে নিজের ব্যাগে ঢোকাল। জামা-কাপড় পালটে নিলো তাড়াতাড়ি। এই হয়তো পুলিশ কড়া নাড়ছে দরজায়, বার বার মনে হলো রাশেদের। কিন্তু সে তো কোন দোষ করেনি,ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু মনকে বোঝাতে পারছে না। পুলিশকে অসম্ভব ভয় পায় সে ছোটবেলা থেকেই।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো এই সময়। লিলি ফোন করেছে।
‘বল লিলি, রাশেদ বলল।‘
‘তুমি কি ব্যস্ত?’ জিজ্ঞেস করল লিলি।
‘না, ব্যস্ত না, কিছু বলবে?’
‘দুঃসংবাদ আছে একটা। শামীম মারা গেছে। আজ পেপারে এসেছে।’
‘পত্রিকা পড়েছি আমি, কিন্তু লাশটা যে শামীমের সেটা বুঝলে কি করে?’
‘পুলিশে আমার এক ভাই আছে, তিনি বললেন একটু আগে, শামীমের মা গিয়ে সনাক্ত করে এসেছেন।‘
চুপ করে থাকল রাশেদ। খারাপ ধারনাটাই সত্যি হলো। শামীমের জন্য হু হু করে উঠলো মনটা। কিছু একটা বিপদে ছিল সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু চাপা স্বভাবের ছেলেটা কাউকেই নিজের সমস্যার কথা বলেনি।
‘কি, চুপ করে আছো যে,’ লিলি বলল ওপাশ থেকে।
‘লিলি, শামীম খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল আমার,’ রাশেদ বলল।
‘আমারো খুব খারাপ লাগছে।’
‘আচ্ছা, আমি রাখি, রাশেদ বলল। আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এখন সরে যেতে হবে এখান থেকে।
‘তুমি কি কোন সমস্যায় আছো, রাশেদ?’
‘না।’
‘আমি তোমার গলা শুনেই বুঝতে পারছি, খুলে বলো আমাকে, হয়তো তোমাকে সাহায্যও করতে পারি আমি, লিলি বলল।
‘না, কিছু না।‘
‘বলো না, প্লিজ, তোমার কোন সাহায্য করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে।’
‘লিলি, আমি হল ছেড়ে দিচ্ছি, কোথায় উঠবো বুঝতে পারছি না।
‘হঠাৎ করে হল ছেড়ে দিচ্ছো কেন, কি হয়েছে?’
‘দেখা হলে বলবো সব।’
‘তোমাকে সাহায্য করতে পারি আমি,’ লিলি বলল।
‘কিভাবে?’
‘গাজীপুরে আমাদের একটা বাগান বাড়ী আছে, কেউ থাকে না সেখানে, কেয়ারটেকার আছে একজন। আমি ওকে বললে ওখানে যতোদিন খুশি থাকতে পারবে।’
‘কিন্তু কি করতে ওখানে থাকবো আমি, কেয়ারটেকারকে কি বলবে আমি কি করি?’
‘ওকে বলে রাখবো তুমি একজন লেখক, নিরিবিলিতে লেখালেখি করার জন্য এসেছো।‘
‘কোন সমস্যা হবে না তো?’ রাশেদ বলল সন্দেহের সুরে।
‘একদম না, আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো।‘
‘ঠিকানাটা এসএমএস করে দাও আমাকে, ঠিক দুইঘণ্টার মধ্যে আমি চলে যেতে পিরবো গাজীপুর।‘
‘ঠিক আছে, আমি এসএমএস করছি।’
ফোনটা রেখে দিল রাশেদ। এভাবে চলে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? পুলিশ তো তাহলে আরো বেশি সন্দেহ করবে? যাই হোক, পুলিশের জেরার মুখে পড়ার আগে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থেকে দেখা যাক। এমনও হতে পারে, শামীমের মা রাশেদের নামই বলেনি।
বড় একটা ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে। দুটো ব্যাগ এখন রাশেদের সাথে। শামীমের ট্রাভেল ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছে ম্যানিব্যাগটা খুলে দেখে নিলো। বেশ কিছু টাকা আছে সাথে। কাজেই চিন্তার কিছু নেই। রুমটা আরো একবার দেখে নিলো রাশেদ। জরুরী কিছু ফেলে গেলে পরে সমস্যা। এখানে আবার কবে ফিরতে পারবে কে জানে? তালা লাগিয়ে বের হয়ে এলো রাশেদ। সিঁড়ি দিয়ে নামছে।
রাশেদ যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন অন্যপাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠছে চারজন লোক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছাত্র নয় তারা। একই রকম পোষাক পরনে, কালো জিন্সের প্যান্ট, সাদা টি-শার্ট। দ্রুতগতিতে সিঁড়ি পার হয়ে করিডোরে চলে এলো ওরা। রাশেদের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। রুম তালাবদ্ধ দেখে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল ওরা। সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিচ্ছে। তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকবে না কি বের হয়ে যাবে এখান থেকে। এমনিতেই হলে ঢুকতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে ওদের। দাড়োয়ান এবং হল পুলিশকে বুঝিয়ে এসেছে ওরা গোয়েন্দা সংস্থার লোক। খোঁজখবর নিতে এসেছে। এখন কারো রুমের তালা ভাংতে গেলে কেউ না কেউ প্রশ্ন করবেই, আইডেন্টিটি দেখতে চাইবে, তখন আরো সমস্যা হয়ে যেতে পারে। কাজেই হাঁটা শুরু করলো ওরা। দলনেতা কি বলবে এসব ভেবে এর মধ্যেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওদের। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো ওরা।
এসেই দেখতে পেলো রাশেদকে। একটা সিএনজি ভাড়া করছে। দৌড় দিল একজন। হাতে নাতে ধরতে হবে ছেলেটাকে। ওর হাতে দুটো ব্যাগ, তার মধ্যে কাঁধে ঝোলানো ট্রাভেল ব্যাগটাই ওদের টার্গেট। কিন্তু এর মধ্যেই সিএনজিতে উঠে পড়েছে ছেলেটা। চারজনই দৌড় দিলো। একটু সামনেই গাড়ি পার্ক করা আছে ওদের। ছেলেটা চোখের আড়াল হবার আগেই ধরে ফেলতে হবে।
হলের সবাই দেখল এই অদ্ভুত দৌড়াদৌড়ি। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল পুরো সিনেমা স্টাইলে একটা সিএনজির পিছু নিয়েছে একটা প্রাইভেট কার।
* * *
‘খে-লান ভাতৃসম্প্রদায় পুরো তিব্বত এবং উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল; তাদের মধ্যে একজনকে ডাকা হতো পেহ-লিং বলে যার অর্থ ছিল শ্বেত লামা, বিংশ শতকের শুরুতে যিনি পা রাখেন এই এলাকায়, পশ্চিম থেকে, একজন আদর্শবাদী বুদ্ধিষ্ট, একমাস প্রস্তুতির পর যাকে খে-লান ভাতৃসম্প্রদায়ে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। প্রতিটা ভাষা জানতে সে, এমনকি তিব্বতিয়ান ভাষাও, সেই সাথে জানতো প্রতিটি অঞ্চলের শিল্প ও সাহিত্য, লোকাঁচার তাই বলে। তার আত্মিক বিশুদ্ধতা এবং কর্ম তাকে এই অঞ্চলে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ করে দেয়। শেবারন, যারা তিব্বতিদের মধ্যে সবচেয়ে ধার্মিক বলে পরিচিত, তিনি তাদের একজন বলে বিবেচিত হন। বর্তমানকালের তিব্বতীরাও তার স্মৃতি ধারন করে আছে, যদিও তার সত্যিকার পরিচয় একমাত্র শেবারনরাই জানে।
এইচ, পি, ব্লাটাভাস্কি।
নোটবুকে লেখা এই অংশগুলো পড়লেন ড. কারসন। এই লোকটাকে বের করার জন্যই তার এতোদূর আসা। এই বিশাল ভারত উপমহাদেশেই এখন তার স্থায়ী আবাস। কিন্তু এ যেন খড়ের গাঁদায় সূচ খোঁজার মতো ব্যাপার।
নোটবুকে আরো একটা অংশ পড়লেন তিনি।
‘আগামীকাল রাতে আমি চলে যাবো। কনস্ট্যান্টিপোলে এখন আমার বেশি প্রয়োজন, ইংল্যান্ডের চেয়ে, সেখানে আমি দুটি নতুন উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করবো, যা তোমরা আগামী শতকের শুরুতে পাবে- ট্রেন এবং বাস্পচালিত জলযান। শতকের শেষ অংশে ইউরোপ থেকে হারিয়ে যাবো আমি, নিজেকে নিয়ে যাবো হিমালয়ের কোলে। সেখানে বিশ্রাম নেবো আমি; বিশ্রাম নিতেই হবে আমাকে। হয়তো আরো পঁচাশি বছর পর আমাকে আবার হয়তো তোমরা দেখতে পাবে। বিদায়।‘
ক্লেইন ওয়েনারের স্মৃতিকথা থেকে।
দুটো অংশের মাঝে পরিস্কার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি ইউরোপ ছেড়ে তিব্বতে চলে এসেছিলেন। সেখানেও অনেক সম্মান পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তারপরই উধাও হয়ে যান। হারিয়ে যান বলা চলে। ইউরোপে অনেক মানুষই তার সাথে দেখা হয়েছে বলেছেন, কিন্তু কোনটারই তেমন বিশ্বাসযোগ্য কোন প্রমান নেই।
সন্ধ্যার পরপরই হোটেলে ফিরেছেন ড. কারসন। মহাস্থানগড় দেখে ভালোই লেগেছে তার। সংরক্ষনের ব্যবস্থাও ভালো। নতুন কিছু করার প্রয়োজন নেই আপাতত। শুধু নিয়মিত লক্ষ্য রাখতে হবে, যা আছে তা যেন কেউ ক্ষতি করতে না পারে। কাল সকালে আবার যাবেন পুরাকীর্তিটা দেখতে। পাশেই একটা মিউজিয়াম বানানো হয়েছে। যেখানে মহাস্থানগড় এবং আশপাশের এলাকার বিভিন্ন প্রাচীন জিনিস রাখা হয়েছে প্রদর্শনীর জন্য। কাল সেই মিউজিয়ামে ঢু মারতে হবে একবার।
কিন্তু সেই ব্রিটেন থেকেই বিশেষ এক পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন ড. কারসন। বাংলাদেশ পুরো দেখা হলে যাবেন ভারতে, সেখান থেকে তিব্বতে। কাউন্ট দ্য সেইন্ট জারমেইন কি সত্যি কিছু, না একটা মিথ-এটা তাকে জানতেই হবে।
দরজায় টোকা পড়ল। ড. কারসন টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজগুলো ভাঁজ করে একটা ফাইলে ঢুকিয়ে ফেললেন। দুই ডক্টরের মধ্যে কেউ হবে, এরা দুজনই সাধ্যমত চেষ্টা করছেন তার সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে, কোন একটা কারন নিশ্চয়ই আছে ওদের।
‘মে আই কাম ইন?’ ড. আরেফিনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল দরজার বাইরে।
‘আসুন প্লিজ,’ ড. কারসন বললেন।
খুব লাজুক ভঙ্গিতে ঢুকলেন ড. আরেফিন, ড. কারসনের উল্টোদিকের সোফায় বসলেন।
‘ড. কারসন, যদি কিছু মনে না করে একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি,’ বললেন ড. আরেফিন।
মনে মনে হাসলেন। এই একই কথা দিয়ে শুরু করেন ড. আরেফিন। ইন্টারেস্টিং।
‘বলুন না, প্লিজ।‘
‘প্রসঙ্গটা হচ্ছে সেই এলিক্সির অফ লাইফ।‘
‘ঐ ব্যাপারে তো কথা হলোই,’ভু কুঁচকে বললেন ড. কারসন।
‘আমি আরো একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি, আমার ধারনা এলিক্সির অফ লাইফ এই বাংলাদেশেই আছে।’
ড. কারসন তাকালেন ড. আরেফিনের দিকে। লোকটা কি বলছে তা কি সে জানে!
‘ড. আরেফিন, এলিক্সির অফ লাইফ ধারনাটাই ইউরোপীয়, আপনি যদি বলতেন, অমৃতের সন্ধান পেয়েছেন, কিছুটা হলেও বিশ্বাস করতাম আমি, যাই হোক, আমি যতোদূর বুঝি পুরো ব্যাপারটাই একটা মিথ ছাড়া আর কিছুই না।‘
‘কিন্তু আমি মোটামুটি নিশ্চিত, এর পেছনে কারনও আছে, আমার পরিচিত একটা ছেলে, ওর কাছে বারকয়েক এলিক্সির অফ লাইফের কথা শুনেছি আমি। ওর কাছে একটা প্রাচীন বই আছে, সেখানে হয়তো জিনিসটা খুঁজে পাবার ম্যাপ অথবা জিনিসটা কিভাবে তৈরি করতে হয় তার নির্দেশনা দেয়া আছে।’
‘আচ্ছা।’
‘ঐ বইটা নিয়ে ছেলেটার আসার কথা আমার কাছে, কিন্তু গত দু’তিনদিন ছেলেটার মোবাইল বন্ধ, কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। ছেলেটা বলেছিল প্রাচীন এক লিপিতে লেখা আছে সবকিছু, যার পাঠোদ্ধার করা এখানে বাংলাদেশের কোন পন্ডিতের পক্ষে করা সম্ভব না।‘
‘এমনও হতে পারে, পাঠোদ্ধার করার পর দেখা গেল সেটা সম্পূর্ন ভিন্ন একটা জিনিস যার সাথে এলিক্সির অফ লাইফের কোন সম্পর্কও নেই।‘
‘তা হতে পারে,’ একটু দমে গেলেন যেন ড. আরেফিন, এই ব্যাপারটা হয়তো তার থায় আসেনি আগে। কিন্তু যদি সত্যি হয়, তাহলে চেষ্টা না করাটা একটা বোকামি হয়ে যাবে না?
‘তা ঠিক বলেছেন, কিন্তু এই ব্যাপারে আমি কি করতে পারি?
‘যতোদূর জানি আপনি প্রাচীন অনেক ভাষা জানেন, অনেক পুরানো লেখার পাঠোদ্ধার করেছেন। সেই বইটা আমি আপনার কাছে এনে দেবো, যাতে আপনি বের করতে পারেন এই এলিক্সির অফ লাইফের রহস্য।‘
‘চেষ্টা করবো, কিন্তু না দেখে আগেই বলতে পারছি না।’
তারপর সেই এলিক্সিরের রহস্য জানবো শুধু আমরা তিনজন, আমি, আপনি এবং সেই ছেলেটা, যার কাছে এই বইটা আছে।
‘আচ্ছা,’ বেশ মজা পেলেন ড. কারসন, আগে থেকেই দিবাস্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন ড. আরেফিন।
দরজা লাগানো হয়নি,একটু ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন ড. শাখাওয়াত।
‘ড. আরেফিন, আপনি এখানে?’
উঠে দাঁড়ালেন ড. আরেফিন, ‘ভাবলাম ড. কারসন একা আছেন, একটু গল্প-গুজব করি।’
‘আচ্ছা,’ ড. শাখাওয়াত বললেন, তাকালেন ড. কারসনের দিকে, ‘কোন সমস্যা হলে বলবেন আমাদের, আমরা পাশের রুমেই আছি।’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই।‘
‘গুড নাইট,’ বলে ড. শাখাওয়াত বের হয়ে গেলেন, ড. আরেফিনকেও ইশারা করলেন যেন বের হয়ে আসে।
ড. আরেফিন বের হয়ে গেলে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন ড. কারসন, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছেন তিনি। চিন্তা করছেন। ড. আরেফিনের সামনে ঠিকমতো আগ্রহটা প্রকাশ করতে পারেননি তিনি, তাতে হয়তো লোকটা পেয়ে বসতো তাকে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই চিন্তার উদ্রেক করার মতো। অমরত্ব পাওয়ার নেশা মানুষকে পাগল করে তোলে বলে শুনেছেন ড. কারসন। তার নিজের কখনো অমর হবার ইচ্ছে হয়নি। তাহলে বেঁচে থাকার চেয়ে বিরক্তিকর কাজ আর কিছু হবে না বলে তার ধারনা। কিন্তু একজন বোধহয় অমরত্ব নিয়ে বসে আছেন হাজার হাজার বছর ধরে। তার অমরত্বের উৎস কি? এলিক্সির অফ লাইফ? এই এলিক্সির অফ লাইফ জিনিসটা কেমন? কঠিন, তরল বা বায়বীয়? সম্ভবত তরল।
রাতের ঘুমটা মাটি হয়ে গেল ড. কারসনের। এতোদিন শুধু মাথায় খেলেছে সেইন্ট জারমেইন, এখন যোগ হলো এলিক্সির অফ লাইফ। অবশ্য সেইন্ট জারমেইন এবং এলিক্সির অফ লাইফ পরস্পর সম্পর্কিত।
আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক হলেন ড. কারসন। সেইন্ট জারমেইনের শেষ গন্তব্য জানা গিয়েছিল হিমালয় এবং ভারত উপমহাদেশ। সেই সময় বাংলাদেশ বলে আলাদা কিছু ছিল না। অন্যদিকে, এলিক্সির অফ লাইফের সন্ধান এই বাংলাদেশেই পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে না। তিব্বতে বেশ কিছু বছর কাটিয়ে সেইন্ট জারমেইন সম্ভবত নেমে এসেছিলেন সমতলে, ভারতের বিস্তীর্ন এলাকা চষে বেড়িয়ে শেষে হয়তো স্থায়ী হয়েছেন এই বাংলাদেশে। হয়তো একেবারেই অর্থহীন এসব চিন্তা। কিন্তু এসব আজগুবী চিন্তা থেকে কে জানে হয়তো আসল সত্যও বের হয়ে আসতে পারে!
সিগারেট ধরালেন ড. কারসন। একা একা লাগছে। বাইরে একটু হেঁটে আসা যাক।
*
অধ্যায় ৭
আজিজ ব্যাপারি বসে আছেন দোকানে। কাষ্টমার কম আজকে। একটা বালিশ রেখেছেন তিনি আরাম করে বসার জন্য। এখন সেখানেই আরাম করে বসে আছেন তিনি। ঘুম আসছে। ইদানিং ঘুম বেশ সমস্যা করছে। রাতে ঘুম আসতে চায় না, হাবিজাবি চিন্তা মাথায় খেলা করে। জীবন নিয়ে ভাবনা আসে, বুড়ো বাপ, মৃত মা, দূর হয়ে যাওয়া ছেলে, দ্বিতীয় বৌ, দোকান, ব্যবসা, আরো কতো কি। সবচেয়ে বড় যে চিন্তা সেটা হচ্ছে মৃত্যুচিন্তা। অতি কাহিল হয়ে পড়েন তখন তিনি।
‘স্লামালেকুম।’
তাকালেন আজিজ ব্যাপারি। বিরক্তবোধ করছেন তিনি, যথেষ্টই, চোখ দুটো লেগে এসেছিল মাত্র।
‘আমি সালাম, নুরুদ্দিনের বাপ।‘
ব্যাপারি তাকালেন। চিনলেন লোকটাকে, সালাম তার দোকানেও কাজ করেছে কিছুদিন, ফাঁকিবাজ।
‘কি বলবা বলো, আজিজ ব্যাপারি বললেন।‘
‘নুরুদ্দিন কিরুম আছে?’
‘নুরুদ্দিন কিরুম আছে মানে? পোলাডা পলাইছে তো বেশ কয়েকদিন হইয়া গেল।‘
‘কি কন হুজুর, পলাইবো ক্যা? পলাইয়া যাইবো কই?’
‘ক্যা, বাড়িতে?’
‘সে তো আসে নাই, নুরুদ্দিনের মা খারাপ স্বপ্ন দেখছে, আমারে পাঠাইছে পোলাটারে দেইখ্যা আসার জন্য,’ কাচুমাচু হয়ে বলে সালাম।
‘দেখ, ফাইজলামি করবা না আমার সাথে, নুরুদ্দিন নাই।‘
‘নুরুদ্দিন নাই, এইড্যা কি কইলেন? আমার এতো ছোড পোলা, কই যাইবো?’
‘তা আমি কি জানি?’
এই পর্যায়ে কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। আজিজ ব্যাপারি এতোক্ষন চোখ বন্ধ করেই কথা বলছিলেন, এবার তাকালেন। ঘুম কেটে গেছে তার।
সালাম কাঁদছে। সত্যিকারের কান্না বলেই মনে হচ্ছে আজিজ ব্যাপারির কাছে।
কান্দনের কি আছে? কয়েকদিন হইল পোলাডারে দেখি না, বাজানও কিছু বলতে পারে না, বুড়া মানুষ তো, আমি তো মনে করলাম কামের ডরে ভাগছে পোলাডা, যায় নাই বাড়িতে?
‘না, গেলে কি আর খবর নিতে আহি?’ চোখ মুছতে মুছতে বলে সালাম।
পাঞ্জবীর পকেট থেকে একটা একশ’ টাকার নোট বের করেন আজিজ ব্যাপারি। সালামের হাতে দেন।
‘বাড়িত যাও, চিন্তার কিছু নাই, একেবারে দুধের শিশু তো না, খুঁজে খুঁজে ঠিকই বাড়ি চলে যাবে একদিন।‘
‘ওর মা’রে কি বুঝামু?’
‘সেটা তুমি জানো, এখন যাও, এখন কামের সময়, আর আমি পাইলে তোমার বাড়িত পাঠাইয়া দিমুনে।
‘আইচ্ছা, যাই।’
বলে চলে গেল সালাম। নতুন চিন্তা যোগ হলো এখন, নুরুদ্দিন। কই যে গেল ছেলেটা, এতোদিন নিশ্চিন্ত ছিলেন, বাড়ি চলে গেছে ভেবেছিলেন, এখন তো দেখা যাচ্ছে ধারনা পুরোই ভুল।
মোবাইলটা হাতে নিলেন ব্যাপারি। রাশেদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কি করে, কি খায়, কোথায় থাকে, আজ পর্যন্ত জানার চেষ্টা করেননি ব্যাপারি। কেমন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ছেলেটার সাথে। শুধু টাকা পাঠিয়েই খালাস। কিন্তু ইদানিং ছেলেটাকে কাছে রাখতে ইচ্ছে করে তার। এতো পড়াশোনা করে কি হবে?
ফোন করলেন। কিন্তু বন্ধ মোবাইলটা। আবার করলেন, এবারো বন্ধ। কি হলো ছেলেটার, মোবাইল করে রাশেদকে পাননি এমন কখনো হয়নি। বুকের ভেতর কোথাও চিনচিন করে উঠলো, বিপদ হয়েছে নাকি কোনও। সব পিতাই কি সন্তানের জন্য এমন অনুভব করে? সালাম যেমন একটু আগে নুরুদ্দিনের জন্য চোখের পানি ফেলে গেল? তিনি নিজে যেমন এখন একটু অস্থিরবোধ করছেন। তার বুড়ো বাপ, আব্দুল মজিদ ব্যাপারিও কি এমন বোধ করেন কখনো? কে জানে? লোকটা সারাজীবন কেমন রহস্যময় থেকেছে, কথা বলেছে কম, ইদানিং রহস্য আরো বাড়ছে। রাতের বেলা বাইরে কি সব অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, বেহালার সুর শোনা যায়, আরো কতো কি? ভয়ে রাতে বাইরে বের হওয়া বন্ধই করে দিয়েছেন ব্যাপারি। এছাড়া খুন হয়ে যাওয়ার ভয় তো আছেই।
সেই রাতের আক্রমনের পর থেকে জয়নালকে নিজের পাকা লোক করে নিয়েছেন ব্যাপারি। অন্তত রাতে বাড়ী ফেরার সময় তার কাজ হচ্ছে ব্যাপারিকে পাহারা দেয়া। এখন আর তেমন ভয় করে না তার। জয়নালের মতো সাহসী লোকের ধারেকাছেও আসে না কেউ এটার স্বাক্ষী তো তিনি নিজে।
‘ব্যাপারি, ঘুমাও নাকি?’
আবার তাকাতে হলো ব্যাপারিসাহেবকে। সামনে নছু মোড়ল দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা বদ একটা লোক। একসময় অনেক জায়গা জমির মালিক ছিল এদের পরিবার। এখন সামান্য কিছু আছে। কিন্তু আগের সেই ভাবটা আনার চেষ্টা করে নছু মোড়ল, ভাব আসে না।
‘না, ঘুমাই না, কিছু কইবা নাকি?’ উঠে বসলেন ব্যাপারি। আজ দুপুরের ঘুম একেবারে বাতিলের খাতায়।
‘তেমন কিছু না, ইদানিং এলাকায় আজব আজব সব কারবার ঘটতাছে, শুনছ না কি কিছু?’ নছু মোড়ল বলল, সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসতে বসতে।
‘না, কি কারবার, আমি তো শুনি নাই কিছু।‘
‘তোমার বাড়ির এলাকায় তো হয় বেশি, রাইতে বিরাইতে কে জানি বেহালা বাজায়,’ ফিসফিস করে বলে নছু মোড়ল।
‘বেহালা বাজাইলে সমস্যা কি? বেহালা তো ভালো জিনিস।‘
‘কি কও না কও মিয়া! এই অঞ্চলে বেহালা বাজায় এমন কাউরে চিনো তুমি, তাও যাত্রা পালার বেহালা না, অন্যরকম সুর।‘
‘কি রকম সুর?’
‘অন্যরকম, যারা শুনছে তারা বলে গায়ের পশম নাকি দাঁড়াইয়া যায়।‘
‘আচ্ছা।’
‘চিন্তা করছি হুজুররে দিয়া পুরা এলাকা বান্ধান দিমু, বালা-মসিবতের লক্ষন এগুলা,’ নছু মোড়ল বলল।
একটু রাজনীতির গন্ধ পেলেন ব্যাপারি। নছু মোড়লও নাকি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দাঁড়াতে চায়, হয়তো মানুষের কাছে ভালো সাজার জন্যই এতো মানবদরদী সাজতে চাচ্ছে লোকটা।
‘ইমাম সাব আমারে খুব পছন্দ করেন, আমি বললে সে মানা করবে না,’ ব্যাপারি বললেন।
‘তা ঠিক, দেখো, তোমার এলাকা, তুমিই করো, তয় দেরি কইরো না, না পারলে আমি তো আছিই,’ দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল নছু মোড়ল।
‘আইজই ব্যবস্থা করবো,’ ব্যাপারি বললেন।
‘ঠিক আছে, আমি যাই তাইলে, কাম আছে অনেক,’ বলে উঠে চলে গেল নছু মোড়ল।
আজব সেই বেহালার সুর অনেকেই শুনেছে তাহলে! সেই রাতে বুড়ো বাপের মুখোমুখি হওয়ার কথাটা মনে পড়ে গেল ব্যাপারির। এতো রাতে উনি কি করছিলেন ওখানে?
* * *
গাজীপুরের অনেক ভেতরে এই বাগান বাড়ীটা। আশপাশে ঘনজঙ্গল। মাঝেখানে এই বাড়ী। চারপাশে ইটের দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে জায়গাটা। দুদিন হলো এখানে এসেছে রাশেদ। প্রথম দিন কেটেছে ঘুমিয়েই। দ্বিতীয় দিন পুরো বাগান বাড়ীটায় চক্কর লাগিয়েছে। তিনটা পুকুর ভেতরে, মাছ চাষ করা হয়। এছাড়া নানা ধরনের গাছ-গাছালিতে ভর্তি জায়গাটা। এমন একটা জায়গার মালিক লিলির বাবা ভাবতেও অবাক লাগছে রাশেদের। লিলিরা বড়লোক জানা ছিল, কিন্তু এতোটা কখনোই ভাবেনি।
খুবই টেনশনে সময় কাটছে এখানে। টিভি আছে, কিছু বই আছে। কিন্তু কতোক্ষন টিভি দেখে আর বই পড়ে কাটান যায়, কেয়ারটেকার একজন আছে, কথাবার্তা বলতে যেন কষ্ট হয় লোকটার। সবকিছু হ্যাঁ কিংবা না’তে শেষ।
হল থেকে বের হয়ে সোজা চলে এসেছে রাশেদ গাজীপুরে। পথে লিলির সাথে কথা বলে ঠিকানা চিনে নিতে হয়েছে।
এছাড়া আরো বড় একটা বিপদ থেকে বাঁচা গেছে সেদিন। সাদা একটা প্রাইভেট কার পিছু নিয়েছিল সিএনজির। সেই হল থেকে বের হবার সাথে সাথেই। গাড়িতে কে বা কারা আছে বুঝতে পারেনি রাশেদ। কি জন্যেই বা পিছু নিয়েছে সেটাও জানে না সে, তবে আন্দাজ করতে পেরেছে। সিএনজি চালকের দক্ষতায় প্রাইভেটটাকে পিছু ছাড়ান গেছে, তা না হলে কি হতো কে জানে।
গত দুদিন ধরে মোবাইলেও খুব বেশি কথা বলেনি রাশেদ। লিলির সাথে কথা হয়েছে কয়েকবার। বাকি সময় মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। এখানে চাইলে অনেক দিন থাকা যাবে, কিন্তু এটা তো কোন সমাধান না। আসলে সমস্যা কি হয়েছে সেটাই বুঝতে পারছে না। তার খোঁজে কি নেমে পড়েছে পুলিশ? প্রাইভেট কারে যারা পিছু নিয়েছিল তারা কি পুলিশের লোক না অন্যকিছু?
বিছানার পাশে অবহেলায় পড়ে আছে শামীমের ট্রাভেল ব্যাগটা। ঠিক মতো এখনো খুলে দেখেনি রাশেদ। এই ব্যাগটাই কি সব নষ্টের গোড়া?
ব্যাগটা খুলে দেখতে কখনোই ইচ্ছে করেনি রাশেদের। কিন্তু এখন খুলে দেখার সময় এসেছে। শামীম নেই। এই ব্যাগের মালিকানা এখন কার? শামীমের পরিবারের? তাই হবার কথা। কিন্তু ব্যাগটা ওদের হাতে দেবার আগে অন্তত ভেতরের জিনিসপত্রগুলো দেখে নেয়া দরকার।
চেইন খুলে ফেলল রাশেদ এবং প্রথমেই পাওয়া গেল একটা খাম। খয়েরী রঙের খাম। খামটা বের করে বিছানার উপর রাখল। হাত ঢোকাল একটু ভেতরে। কাগজের তৈরি কিছু একটা হাতে লাগল তার। বের করল। অনেক অনেক পুরানো একটা জিনিস, দেখেই বোঝা গেল, একটা বই। খুব সাবধানে বিছানার উপর বইটা রাখল। মলাটটা নরম হয়ে এসেছে, ভেতরের পাতাগুলোর অবস্থাও নিশ্চয়ই খুব সুবিধার হবে না।
এরপর একটা বান্ডিল পাওয়া গেল, কাগজে মোড়া। কাগজ সরিয়ে ফেলল রাশেদ এবং চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। একহাজার টাকার নোটের বান্ডিল, কয়েকটা, গুনল। পাঁচটা বান্ডিল, একসাথে লাগানো ছিল। তারমানে পাঁচ লাখ টাকা। শামীম এতো টাকা নিয়ে কি করছিল? এইরকম একটা ব্যাগে এতো টাকা নিয়ে ঘোরার মানে কি?
টাকাগুলো নিজের বড় ব্যাগটাতে ঢুকিয়ে ফেলল রাশেদ। কেয়ারটেকার লোকটা নেই আশপাশে।
বিছানায় পা তুলে বসল। বইটা আর খামটা পাশাপাশি রাখা আছে। খামটা খুলল রাশেদ। সেখানে লেখা : ‘প্রিয় রাশেদ,
এই লেখাটা যদি তোর হাতে পড়ে তারমানে খুব খারাপ কিছু হয়েছে আমার। হয়তো এতোক্ষনে আমি মৃত। আগুন নিয়ে খেললে হাত পুড়াতে হয়। আমার হয়তো তাই হয়েছে।
তুই জানিস আমি খুব বড়লোক বাবার সন্তান। কোনদিন অভাব কাকে বলে বুঝতে পারিনি। কিন্তু একইসাথে বাবা-মা’র আদর কখনো উপলদ্ধি করিনি। বাবা ব্যস্ত থাকতেন সবসময়, হয় রাজনীতি নিয়ে, নয় ব্যবসা নিয়ে। মা ছিলেন গ্রামের মহিলা। তিনি শহরের জীবনে অভ্যস্ত হতে পারেননি। চুপচাপ কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনটা। আমি একা একাই বড় হয়েছি। স্কুলে গিয়েছি, কলেজ-ভার্সিটি গিয়েছি, শুধু টাকা পয়সার সমস্যায় পড়িনি,কিন্তু একা বড় হতে হতে অসামাজিক আর ঘরকুনো হয়ে উঠেছিলাম। বন্ধু-বান্ধব ছিল না কোন।
তারপর ভার্সিটিতে দেখা হল তোর সাথে, লিলির সাথে। তোকে বন্ধু বানিয়ে ফেললাম, লিলিকেও। কিন্তু লিলিকে দেখতাম একটু অন্যচোখে। ভালোবেসে ফেলেছিলাম মেয়েটাকে। কিন্তু যখন দেখলাম মেয়েটা তোর প্রতি অনুরক্ত নিজেকে সরিয়ে নিলাম সাথে সাথে। তোদের কাউকে বুঝতেও দেইনি।
যাই হোক, আরো একা হয়ে পড়লাম আমি। নিজের কথা কারো সাথেই শেয়ার করতে পারছিলাম না। বই পড়েই সময় কাটাতাম। তারপরই ঘটল আজব ঘটনা।
একদিন নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বই ঘাটাঘাটি করছিলাম। সেখানে অদ্ভুত একটা বই দেখে লোভ সামলাতে পারিনি,বইটা ছিল ব্লাক ম্যাজিক নিয়ে। এই জাতীয় বই আগে কখনো পড়িনি,পাইওনি। কাজেই লুফে নিলাম বইটা। বিশাল বড় একটা বই ছিল সেটা। দিনের পর দিন কাটিয়েছি বইটা পড়ে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব আচার-অনুষ্ঠানের কথা লেখা ছিল বইটাতে। অনেক মন্ত্র ছিল। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে এই সব আচার-অনুষ্ঠান করে শয়তানের কাছে তা চাইলেই নাকি পাওয়া যায়। কিন্তু তার আগে শয়তানের কাছে সমর্পন করে দিতে হয় নিজের আত্মা। তারও আছে অনেক নিয়ম-কানুন। আমি হতাশাগ্রস্ত ছিলাম, সমাজের বাইরের একজন মানুষ ছিলাম, ধর্ম-কর্মে মনোযোগী হইনি কোনদিন। ভাবলাম, চেষ্টা করে দেখি। কোন ধরনের শক্তি যদি পেয়ে যাই, মন্দ হয় না, হোক না সেটা শয়তানের কাছে প্রার্থনা করে।
নীলক্ষেতের সেই দোকানে আবার গেলাম। এ ধরনের বই পেলাম আরো কয়েকটা। সবই পুরানো, পাতা ঝরে ঝরে যাচ্ছে এমন অবস্থা। ল্যাটিন এবং ইংরেজিতে লেখা বইগুলো। তুই তো জানিস টুকটাক ল্যাটিন জানি আমি। কাজেই এই বইগুলোও কিনে ফেললাম। দাম দিয়ে চলে আসবো, এমন সময় দোকানী একটা চিরকুট দিল আমাকে। দারুন অবাক হলাম। হাতে নিলাম চিরকুটটা।
সেখানে লেখা ছিল, ‘আপনি যে ধরনের বই কিনছেন, সে ব্যাপারে আপনার বেশি কিছু জানার থাকলে ই-মেইল করুন এই ঠিকানায়, এরপর একটা ই-মেইল আইডি দেয়া ছিল। দোকানীকে জিজ্ঞেস করলাম কে দিয়ে গেছে এই চিঠি। দোকানী বলল, এই বইগুলো যে বিক্রি করে গেছে, সেই এই চিরকুট রেখে গেছে।
বাসায় চলে এলাম। বইগুলো পড়লাম। ছটফট করলাম সারারাত। নিষিদ্ধ এক আকর্ষন বোধ করলাম বিষয়টার উপর। বইগুলোর পাতায় পাতায় ছবি, শয়তানের বিভিন্ন রুপের, আরো দেখলাম শয়তান কিভাবে প্রভাব বিস্তার করছে পুরো দুনিয়ায়, পড়লাম ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতে কতশত মানুষ শয়তানের পূজা করছে।
নিজেকে নিয়ন্ত্রন করলাম অনেক। ভার্সিটি আসা শুরু করলাম, ক্লাস করলাম নিয়মিত, কিন্তু মাথা থেকে চিরকুটের কথা সরাতে পারলাম না। যেন টানছে আমাকে এক অদ্ভুত আকর্ষন। সেই আকর্ষনের টানে একদিন মেইল করে বসলাম। তারপর উত্তেজনা বেড়ে গেল আরো উত্তরের অপেক্ষায়। একদিন গেল, দুদিন গেল। উত্তর আসে না। আমি চব্বিশ ঘণ্টা কম্পিউটারের সামনে। তারপর এলো সেই মেইল, যা বদলে দিল আমার জীবন, জীবন সম্পর্কে সব ধারনা।
সেদিন ছিল শনিবার, সকালে মেইল চেক করে দেখি কাঙ্খিত উত্তরটা পেয়ে গেছি আমি, সন্ধ্যায় দেখা করতে বলছে মেইলপ্রেরক, জায়গাটা তোকে আর নাই বললাম।
গেলাম সেখানে, একটা রেস্টুরেন্ট, কোনার দিকে একটা টেবিলের কথা বলা ছিল, সেখানে বসলাম। তখনই দেখলাম লোকটাকে, এবং দেখেই কেন জানি তাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেল আমার।
পরিচিত হওয়ার পর কফি খেলাম আমরা। লোকটাকে দেখলাম কথা-বার্তায় খুব সাধারন এবং বিনয়ী, প্রচন্ড জ্ঞানীও ভদ্রলোক, প্রচন্ড বললাম, কারন সে এমন কিছু জানে, এমন নতুন কিছু বলল আমাকে যা আগে কখনোই শুনিনি। নিজের পরিচয় সে দিয়েছিল আকবর আলী মৃধা বলে। যদিও নামটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি আমার কাছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে ছিলাম সেদিন, চলে আসার সময় আরো একটা বই ধরিয়ে দিল লোকটা, বলল উপহার। আমি যদি চাই, তাহলে আবারো দেখা হতে পারে আমাদের, তেমন কোন কথা না দিয়ে চলে এলাম সেদিন।
এরপর পুরো সপ্তাহটা কাটলো বই পড়ে, বিচিত্র এক পৃথিবীর খোঁজ পেলাম, যা আমার সহপাঠী, পরিচিত স্বজন, কিংবা অনেক পন্ডিত মানুষের কাছে একেবারেই অজানা। আকবর লোকটার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
তুই কি বিরক্ত হচ্ছিস, এতো বড় লেখা পড়ে? প্লিজ, পুরোটা পড়িস।
যাই হোক, দেখা করলাম আকবরের সাথে। শান্তিনগর এলাকার একটা বাড়ি। দোতলায় ভদ্রলোক একাই থাকেন। গিয়ে দেখি আরো দুতিনজন আছে। আমার মতোই বয়েস, কেমন ভরসা হারানো দৃষ্টি। কিছুক্ষন বসে থাকার পর তিনি এলেন। কালো পাঞ্জাবী-পায়জামা পরনে, বেশ ভালোই দেখাচ্ছিল ঐ পোশাকে।
তিনি আমাদের ড্রইং রুমে বসালেন। তিনজন বসলাম আমরা। তারপর বলা শুরু করলেন। তার বিষয় ছিল বিচিত্র। শুরু থেকে বললেন। সৃষ্টির শুরু থেকে। মনোযোগ দিয়ে শুনলাম আমরা। আমার সাথে দুজনের সাথে এর মধ্যেই পরিচিত হলাম। একজনের নাম কায়েস, অন্যজন সোহেল।
তারপর তিনি বললেন, শয়তানের পূজা করেন তিনি। অনেক শক্তি অর্জন করেছেন, এবং সামনে আরো শক্তি অপেক্ষা করছে তার জন্য। এখন তার দরকার কিছু সহায়ক, যারা এই শক্তি অর্জনে তাকে সহায়তা করবে। বিনিময়ে তারাও পাবে সেই শক্তির কিছু ভাগ, রোগ-জরা থেকে মুক্তি, সাধারন ধর্ম যা দিতে পারবে না সেই মানসিক প্রশান্তি, আরো অনেক কিছু। আমরা তিনজন তার সাথে যোগ দিতে রাজি আছি কি না জিজ্ঞেস করলেন তিনি। সাবধান করে দিলেন বার বার, চাইলে এখনই চলে যেতে পারি, কেউ আটকাবে না। কিন্তু একবার যোগ দিলে ফেরার পথ নেই কোন, কায়েস-সোহেল রাজি হয়ে গেল সাথে সাথেই। আমিও রাজি হলাম, আমার সমগ্র স্বত্তা যেন বলছিল, এখানে যোগ দেয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই।
তারপরের দিন যোগদান অনুষ্ঠান। নোংরা, কুৎসিত, লোমহর্ষক কিছু আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা তিনজন যোগ দিলাম শয়তানের দলে। মহান লুসিফারের জয় হোক, এই ছিল আমাদের মূলমন্ত্র। আচার-অনুষ্ঠান শেষ হলে বিশেষ এক ধরনের পানীয় খেলাম আমরা, মনে হলো শুন্যে ভাসছি আমি, এলকোহল ছিল না সেটা। সেদিন থেকে পুরোপুরি স্যাটানিষ্ট হয়ে গেলাম আমি।’
রাশেদের হাত কাঁপছে থরথর করে। চিঠি এখনো অনেকটাই পড়া বাকি। কিন্তু মোবাইলটা বাজছে। লিলি ফোন করেছে।
‘হ্যালো, রাশেদ, ওপাশ থেকে লিলির কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
‘বলো।’
‘একটা বাজে খবর শুনলাম।‘
‘কি?’
‘তোমাকেও খুঁজছে পুলিশ।‘
‘আমাকে? কিভাবে জানলে?’
‘তোমাকে তো বলেছি, আমার এক ভাই আছে পুলিশে, তার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোন হদিস করতে পেরেছে কি না খুনি কে, যেহেতু শামীম আমার পরিচিত, তিনি বললেন, শামীমের মা বলেছেন রাশেদ নামে একজন নাকি এসেছিল শামীমের একটা ব্যাগ নেয়ার জন্য, এছাড়া শামীমও তার মাকে বলে গিয়েছিল সে রাশেদের রুমে উঠছে কয়েকদিনের জন্য, পরীক্ষার প্রিপারেশন নেয়ার জন্য।‘
‘এখন?’
‘পুলিশ তোমাকে খুঁজছে রাশেদ, হন্যে হয়ে, শামীমের বাবা উঠে পড়ে লেগেছেন, তার একটাই মাত্র ছেলে ছিল।‘
‘কিন্তু আমি তো কিছু করিনি,কিছু জানি না।’
‘তুমি যেহেতু নিরপরাধ, ভালো হয়, তুমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করো।‘
‘আত্মসমর্পন করবো?’
‘আমি চাই তুমি এই ঝামেলা থেকে বের হয়ে এসো, যতোদিন পালিয়ে থাকবে ততো তোমার উপর পুলিশের সন্দেহ বাড়বে।‘
‘দেখি, ভাবনা-চিন্তার সময় দাও আমাকে।‘
‘ঠিক আছে, ভাবো, আমাকে জানিয়ে, আর সব ঠিক তো?’
‘সব ঠিক।‘
‘খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে ঠিক মতো?’।
বলা যায় রাজার হালে আছি,’ হাসল রাশেদ। লিলির হাসির শব্দ পাওয়া গেল। মন খারাপ ভাবটা চলে গেল রাশেদের।
‘আচ্ছা, রাখি, লিলি বলল।
‘আচ্ছা।’
মোবাইল ফোনটা রেখে বিছানার উপর বসল রাশেদ। চিন্তাভাবনা করা দরকার। কি করা উচিত এখন? ধরা দেবে? তারপর? পুলিশ কি বিশ্বাস করবে তার কথা? শামীমের দেয়া চিঠিটা দেখানো যায়, কিন্তু ওরা কি বিশ্বাস করবে?
অনেক প্রশ্ন গিজগিজ করছে মাথায়। সবার শেষে একটা সিদ্ধান্তেই আসা যায়, সেটা হচ্ছে আত্মসমর্পন করা।
কিন্তু রাশেদ ভাবছে অন্যকিছু। চিঠিটা পুরোটা পড়তে হবে আগে, এখনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসেনি।
*
অধ্যায় ৮
মহাস্থানগড়ের জাদুঘরটা দেখে তেমন মুগ্ধ হতে পারলেন না ড. কারসন। উপমহাদেশেই এরচেয়ে গোছানো অনেক জাদুঘর তিনি দেখেছেন, এছাড়া এখানকার সংগ্রহও তেমন কিছু নেই, যা দেখে অবাক হওয়া যাবে। এখনো বের হয়ে আসেননি ভেতর থেকে। ঘুরছেন, দুই ডক্টর অপেক্ষা করছে। বাইরে বেরিয়ে আসবেন এই সময় বুড়ো একজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়াল তার সামনে।
ড. কারসন অনেক লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ। তার সামনে এই বৃদ্ধকে খুবই ছোট দেখাচ্ছে।
‘কিছু বলবেন আমাকে?’ যতোটা সম্ভব সহজ ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করলেন ড. কারসন।
লোকটা কিছু বলল না, তাকাল ড. কারসনের দিকে, যেন কি বলবে গুছিয়ে উঠতে পারছে না।
বিড়বিড় করে কি যেন বললেন বৃদ্ধ, বুঝলেন ড. কারসন, লোকটা তার বাসায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রন করছে।
‘কেন? কোন দরকার?’
এবারও কি বললেন বৃদ্ধ পরিস্কার বুঝতে পারলেন না ড. কারসন, তবে এটুকু বুঝতে পারলেন কিছু একটা দেখাতে চাইছে এই বুড়ো মানুষটা।
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন তিনি। এই বুড়ো কি ক্ষতি করতে পারবে তার?
হাঁটতে থাকলেন ড. কারসন, পেছনে বৃদ্ধ লোকটা। মিউজিয়ামের বাইরে এসে দেখলেন দুই ডক্টরের কেউ নেই আশপাশে। মনে মনে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। এই দুজনকে না পেয়ে ভালোই হলো।
একটা রিক্সা নিলো দুজন, বেশি দূর যেতে হলো না, প্রায় আধঘণ্টা চলার পর বৃদ্ধ থামতে বলল রিক্সাটাকে। একতলা একটা বাড়ী, অনেক পুরানো। বট-অশ্বত্থ গজিয়ে গেছে দেয়ালে দেয়ালে।
গা ছমছম করে উঠলো ড. কারসনের। জায়গাটা অস্বাভাবিক নিরব। এছাড়া এভাবে চলে আসাটাও ঠিক হয়নি বলে মনে হচ্ছে এখন। কিছু হয়ে গেলে কেউ জানতেও পারবে না ড. কারসন কোথায় গিয়েছিলেন, কার সাথে গিয়েছিলেন, কিন্তু এখন যেহেতু এসেই পড়েছেন, ভয় পেলে চলবে না।
সিঁড়ি পেরিয়ে একটা ঘরে ঢুকলেন ড. কারসন, বাইরে রোদ থেকে এসেছেন, তাই ঘরটা পুরো অন্ধকার লাগছে, দৃষ্টি সয়ে আসতে দেখলেন ঘরের একপাশে একটা বিছানা পাতা, সেখানে বেশ বয়স্কা একজন মহিলা শুয়ে আছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অসুস্থ। একপাশে পুরানো আমলের সোফা সেট। বৃদ্ধ ইশারায় সোফায় বসতে অনুরোধ করলেন ড. কারসনকে।
বসলেন ড. কারসন।
তাকালেন ঘরটার চারদিকে। মৃত্যুর গন্ধ চারদিকে। এই দুজন বোধহয় একাই থাকে এখানে। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। বৃদ্ধলোকটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুম থেকে বের হয়ে গেছে মাত্র।
‘আপনি কেমন আছেন ড. কারসন?’ কোথা থেকে কণ্ঠটা আসছে বুঝতে একটু সময় লাগলো ড. কারসনের।
বিছানায় শোয়া বৃদ্ধা উঠে বসেছেন। পরিস্কার ইংরেজিতে তিনিই প্রশ্নটা করেছেন ড. কারসনকে।
‘আমি ভালো, আপনি?’
‘খুব ভালো নেই, দুঃখিত, আপনাকে হঠাই নিয়ে এসেছে সে, আমার স্বামী।’
‘না, না, ঠিক আছে, কথা খুঁজে পাচ্ছেন না ড. কারসন।
‘আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে একাই থাকি এখানে, ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে, তারা এখন আমাদের সাথে থাকে না, সবাই থাকে দেশের বাইরে, আমাদের নিতে চায়, কিন্তু আমরা এখানেই থাকবো, বৃদ্ধা বললেন।
‘আচ্ছা,’ বললেন ড. কারসন। বৃদ্ধা অসুস্থ ও গলার স্বর বেশ পরিস্কার। মনে মনে প্রশংসা করলেন তিনি।
‘আপনাকে ডেকেছি, বিশেষ একটা জিনিস হস্তান্তর করার জন্য, যোগ্য লোক খুঁজছিলাম আমরা, যদি না পেতাম জিনিসটা আমাদের সাথেই হারিয়ে যেতো, যাইহোক, তাতে কিছুটা আফসোস থাকতো আমাদের। কিন্তু আপনাকে যোগ্য বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে। লন্ডনে আপনার সম্পর্কে খবরও নিয়েছি আমার বড় ছেলের কাছ থেকে।‘
‘আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।‘
‘আসলে না বোঝারই কথা, আমি বেশি কথা বলে ফেলছি, আসল কথা বাদ দিয়ে।‘
এই সময় বৃদ্ধ ঢুকলেন ঘরটায়। একটা ট্রেতে কিছু বিস্কিট, গ্লাসে সরবত সাজিয়ে। মেহমানদারি দেখে একটু অবাকই হলেন ড. কারসন। বাঙ্গালীরা অতিথিপরায়ন জাতি, তা যেন আরেকবার প্রমানিত হলো।
সোফার সামনে ছোট একটা বাক্স রাখা, চোখে পড়লো ড. কারসনের। সরবতের গ্লাসটা তুলে নিলেন তিনি। হয়তো খুব স্বাস্থ্যসম্মত জিনিস হবে না, কিন্তু এতো কষ্ট করে বানিয়েছে বুড়ো মানুষটা না খেলে খারাপ দেখায়।
‘আপনার সামনে একটা বাক্স দেখতে পাচ্ছেন,’ বৃদ্ধা বললেন, ‘এই বাক্সটা আমরা খুঁজে পেয়েছি প্রায় বিশ বছর আগে, একটা টিউবওয়েলের জন্য গর্ত খুঁড়তে গিয়ে। আপনি খুলুন।
সরবতের গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন ড. কারসন। চিন্তা করছেন। বাক্সটায় কি আছে? বাক্সটা খোলা মাত্র যদি কোন বিপদ হয়ে যায়? কিন্তু কৌতূহলের জয় হলো শেষপর্যন্ত। তিনি খুললেন বাক্সটা। এবং চোখ সরাতে ভুলে গেলেন।
একজোড়া জুতো। চকচক করছে। কালো রঙের। আর জুতোর গায়ে লাগানো জিনিসগুলো ঝলমল করছে। কি ওগুলো? হীরা ছাড়া আর কিছুই হবার কথা নয়!
বাক্সটা হাতে নিলেন ড. কারসন। অনেক বড় হীরা। দুটো জুতোয় মোট ছয়টা হীরা লাগানো। কোটি টাকা দাম হবে এগুলোর।
কথা খুঁজে পাচ্ছেন না ড. কারসন। এ কি দেখছেন ভিন দেশের এই অজ পাড়া গায়ে? কেমন অদ্ভুত লোক এরা, বিশ বছর আগে খুঁজে পেয়েছে এই রত্ন, অথচ কাউকে জানায়নি?’
‘ড. কারসন, আমার শ্বশুড়সাহেবের বাবার বাবা এই অঞ্চলে এসে প্রথম আবাস গড়ে তোলেন, যদিও তার এলাকা ছিল অন্যদিকে। কোন কারনে তিনি পালিয়ে এসেছিলেন। এই বাক্স উদ্ধারের পর আমরা বুঝতে পারি কেন তিনি পালিয়ে এসেছিলেন নিজের এলাকা ছেড়ে। তিনি কাউকে এই জুতো জোড়া সম্পর্কে কিছু বলে যাননি। কিন্তু বাক্সে একটা চিঠি লিখে যেতে ভুল করেননি। লিখেছিলেন, সাদা চামড়ার এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে চুরি করেছেন এই জুতো জোড়া। সেই লোক তাকে খুঁজছে হন্যে হয়ে, তাই তিনি এই জনমানবহীন এলাকায় এসে থাকা শুরু করেন, এখানেই বিয়ে করেন। তারপর কোন একদিন, সময় বুঝে, জুতোজোড়া মাটির নিচে লুকিয়ে রাখেন তিনি। প্রায়ই স্বপ্নে দেখতেন, এই হীরাগুলো খুলে বিক্রি করতে গেলে মহাবিপদ ঘটবে তার। কাজেই ভয় পেয়ে এগুলোর কথা আর কাউকে বলেননি।‘
‘আপনাদের কাছে সেই চিঠিটা কি আছে?’
‘না, অনেক আগে লেখা জিনিস, নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু কথাগুলো মনে আছে আমার।’
‘কিন্তু আমি এখন এগুলো দিয়ে কি করবো?’
‘আমাদের ইচ্ছা কোন জাদুঘরে এই জুতোজোড়া রাখবেন আপনি। ছেলেদের দেইনি কারন ওরা এগুলো বিক্রি করে ফেলতো। কিন্তু এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। ওরা এগুলোর কথা জানেও না। এছাড়া আমাদের দুজনের ধারনা জুতোজোড়া অভিশপ্ত। মাটির নিচে ছিল ভালোই ছিল।’
‘অভিশপ্ত? কেমন?
‘যেদিন আমরা বাক্সটা উদ্ধার করলাম, সেদিনই আমাদের শ্বশুড় মারা যান। এরপর মারা যায় আমার এক মেয়ে, বাকি ছেলেরা সব এক এক করে বিদেশ চলে গেল। এখন আমরা দুজন কোনমতে বেঁচে আছি।‘
‘আমি এখন কি করবো, বুঝতে পারছি না?’ বিড়বিড় করে বললেন ড. কারসন।
‘অযথা ভয় পাচ্ছেন আপনি, আপনি যে হোটেলে উঠেছেন সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসবে আমার স্বামী, বাক্সটা নিয়ে যান, লন্ডনে অথবা প্যারিসের ভালো কোন মিউজিয়ামে দিয়ে দেবেন, আমাদের ধারনা জুতোজোড়ার উৎস এর কোন একটা হবে।‘
‘কি করে বুঝলেন?’
‘অনেক কিছুই লিখেছিলেন তিনি চিঠিতে, এখন আর সব মনে নেই,’ বৃদ্ধা কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছেন।
ড. কারসন বুঝলেন উঠার সময় হয়েছে। বাক্সটা একটা ব্যাগে ভরে দিলো বদ্ধ লোকটা।
‘ভালো থাকবেন,’ বললেন ড. কারসন, বৃদ্ধাকে উদ্দেশ্য করে, বৃদ্ধা মাথা নাড়ালেন উত্তরে।
বাইরে এসে দাঁড়ালেন ড. কারসন। বৃদ্ধ এখনো আসেনি। সামনের রাস্তাটা পুরো খালি। এখন ফিরবেন কিভাবে হোটেলে? এখান থেকে কমপক্ষে একঘণ্টা লাগার কথা? পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলেন। দুই ডক্টরকে ফোন করে দেখা যায়।
বৃদ্ধ লোকটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ড. কারসন জায়গাটার নাম জিজ্ঞেস করলেন ইশারায়। বৃদ্ধ বলল।
মোবাইলে ড. শাখাওয়াতকে পেলেন ড. কারসন।
‘হ্যালো?’ ড. কারসন বললেন।
‘ড. কারসন, আপনি কোথায়? আমরা আপনাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান, ওপাশ থেকে ড. শাখাওয়াতের উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল।
‘আমি বেশি দূরে যাইনি,আপনি গাড়ি পাঠিয়ে দিন,’ বলে জায়গাটার নাম বললেন ড. কারসন।
‘ঠিক আছে, ড্রাইভার পাঠাচ্ছি, না, আমিই আসছি, আপনি থাকুন, বেশিক্ষন লাগবে না।’
বৃদ্ধকে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন ড. কারসন। ড. শাখাওয়াত এখানে এসে বৃদ্ধ লোকটাকে দেখলে অনেক প্রশ্ন করতে পারে। হাতে ব্যাগটা নিয়ে একটু অস্বস্তি হচ্ছে, ড. শাখাওয়াত জানতে চাইতে পারে কি আছে এর মধ্যে। যাই হোক, একটা কিছু উত্তর দেয়া যাবে।
বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। মেঠো রাস্তাটায় একা একা অপেক্ষায় রইলেন ড. কারসন।
***
‘একদিন অদ্ভুত একটা জিনিস পেলাম, বই, প্রাচীন একটা বই, কতো প্রাচীন হবে আন্দাজও করতে পারছি না, বইটা এমন জায়গায় লুকানো ছিল যে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আমরা যে সোফায় বসি, সেই সোফার নিচে টেপ দিয়ে আটকানো ছিল। আমার পকেট থেকে একটা কলম পড়ে গিয়েছিল, সেটা তুলতে গিয়ে সোফার নিচে চোখ চলে গিয়েছিল আমার। প্রথমে ভেবেছিলাম সোফারই একটা অংশ, পরে হাত দিয়ে বুঝলাম অন্য কিছু। অপেক্ষায় রইলাম কখন একা হবো, কায়েস-সোহেলও ছিল রুমটায়, কি নিয়ে যেন কথা বলছিল।
সেদিন আর সুযোগ নিলাম না, পরেরদিন বাকি দুজনের আসার আগেই আমি চলে এলাম শান্তিনগরের বাসাটায়। আকবর ছিলেন না বাসায়, আমি ড্রইংরুমে একা, তখনই সুযোগটা নিলাম, বের করে আনলাম বইটা। ভারি একটা জিনিস, কোথায় রাখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কাজেই ঝুঁকি নিলাম না কোন, বের হয়ে এলাম বাসা থেকে। বেরুনোর পথে কায়েস-সোহেলের সাথে দেখা, ওদের বললাম বাসায় একটু কাজ পড়ে গেছে, পরে আসবো। কোনমতে বের হয়ে এলাম সেই বিকেলে, সরাসরি চলে এলাম বাসায়, তারপর খুললাম বইটা।
অদ্ভুত! ভেতরে অনেক রকম দুবোধ আঁকাঝোকা, বনগুলো পুরোই অপরিচিত। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না এই জিনিস নিয়ে। এভাবে বইটা নিয়ে আসা কি ঠিক হলো? ভাবছিলাম কি করা যায়।
তখনই ভার্সিটির এক টিচারের কথা মনে পড়ল, তিনি আমার দূরসম্পর্কে আত্মীয়। প্রাচীন অনেক ভাষা জানেন, প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে গবেষনা করেন। ড. আরেফিন। ফোন করে সময় নিলাম দেখা করার জন্য। বইটা দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন তিনিও। অনেক বর্নমালা দেখেছেন তিনি, হায়ারোগ্লিফিকসের উপরও ভালো ধারনা আছে, কিন্তু এই বইটাতে যে বনগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা হায়ারোগ্লিফিকসের সমসাময়িক, কিন্তু হায়রোগ্লিফিকস না। অন্য কোন প্রাচীন বর্ণমালা বলে মনে হলো তার। তারমানে বইটার বয়স অনেক। বিশেষ উপায়ে কোন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে বলে দীর্ঘজীবন লাভ করেছে এই বই।
ভেতরের কিছু পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখ মুখ আরো গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল সেদিন ড. আরেফিনের। বুঝতে পারছিলেন এই জিনিসের মর্ম উদ্ধার করা তার পক্ষে সম্ভব না। তবে তিনি আমাকে জটিল একটা আইডিয়া দিয়েছিলেন। তার ধারনা এটা প্রাচীন কোন রসায়নবিদের বই, যেখানে অমর হবার জন্য এলিক্সির অফ লাইফ তৈরি করার কৌশল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বুঝতে পারছিস তুই, বইটা কতো মূল্যবান? যে এই বর্ণমালা পাঠোদ্ধার করতে পারবে সে জানতে পারবে কিভাবে অমর হওয়া যায়। কিন্তু আমি ভাবছিলাম এই বই আকবরের কাছে গেল কি করে? কিন্তু এখন এটার মালিক আমি। আবার এখন যেহেতু আমার এই চিঠি পড়ছিস তুই, তারমানে বইটা এখন তোর কাছে, মালিক তুই।
তুই ড. আরেফিনের কাছে যেতে পারিস, তিনি কি সাহায্য করতে পারবেন বলতে পারছি না। উনার সাথে বিশ্বের অনেক নামী-দামি আর্কিওলজিষ্ট, ভাষাতত্ত্ববিদদের সাথে পরিচয় আছে। কাজেই তিনি কিছু না কিছু করতে পারবেন।
আকবর, সোহেল, কায়েস, এরা আমার পিছু নিয়েছে। আমাকে ছাড়বে না। রক্ত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মহান লুসিফারের ছায়ার তলাতেই থাকবো, কিন্তু এখন আমাকে ওরা বিবেচনা করছে বেঈমান হিসেবে, এবং বেইমানীর সাজা মৃত্যু।
চাইলে বইটা পুড়িয়েও ফেলতে পারিস, তোর ইচ্ছে।
আরো অনেক কিছু লেখার ছিল। সময় নেই হাতে। তুই ভালো থাকিস।
বিদায়…তোর বন্ধু…শামীম।‘
চিঠিটা পড়ে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলো রাশেদ।
কি করবে এখন সে। ড. আরেফিনকে খুঁজে বের করতে হবে, ইউনিভার্সিটির টিচার, খুঁজে বের করতে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু এখন এই এলাকার বাইরে যাওয়াকে নিরাপদ মনে হচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে লিলিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। লিলি পারবে ড. আরেফিনের নাম্বার জোগাড় করে দিতে, তারপর তার সাথে দেখা করার একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বইটার দিকে তাকাল রাশেদ। এতো পুরানো একটা জিনিস, এখনো অক্ষত আছে। অমরত্ব পাওয়ার কৌশল বলা আছে নাকি বইটাতে। আজব ব্যাপার। এইসব জিনিসে কি এখনো বিশ্বাস রাখে মানুষ! তন্ত্র-মন্ত্র আর টুকিটাকি রসায়নিক কিছু জানলে মৃত্যুকে ঠেকানো যায়! বিশ্বাস হয় না রাশেদের। কিন্তু তারপরও এই বইটার জন্যই তার জীবন এখন চরম ঝুঁকিতে। প্রিয় একজন মানুষ মারা গেছে এর মধ্যে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রাশেদ। বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি। দুপুরে খাওয়া দিয়ে গেছে কেয়ারটেকার লোকটা। তারপর আর কোন খবর নেই। সাথে থাকা সিগারেটও প্রায় শেষ হবার পথে। জানালা দিয়ে আবার তাকাল। একটা বড় গেট এই বাংলো বাড়িতে প্রবেশ করার জন্য। চারদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মূল দরজায় সারাক্ষন পাহারা দেয় একজন গার্ড।
কেউ এসেছে দরজায়। কে বোঝা যাচ্ছে না এখান থেকে। গার্ড কথা বলছে। অনেক দূরে থাকায় কিছু শুনতে পাচ্ছে না রাশেদ। তবে কথা কাটাকাটি হচ্ছে এটুকু বোঝা যাচ্ছে। পরিস্কার দেখার জন্য মুখটা আরো একটু এগিয়ে দিল এবং দিয়েই বুঝলো অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। গার্ডের সাথে যে লোকটা তর্ক করছিল সে দেখেছে। রাশেদকে। দেখেই গার্ডকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
বিপদ আসছে বুঝতে পারল রাশেদ। গার্ড ওই লোকটাকে আটকাতে পারবে না, এই লোক এসেছে রাশেদের খোঁজেই। পালাতে হবে এখান থেকে। কিন্তু কিভাবে?
তাড়াতাড়ি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো রাশেদ জিনিসগুলো। বই, চিঠি, টাকার বান্ডিল, কিছু কাপড়-চোপড়, মোবাইল-চার্জার। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাড়ীটার চারদিকে উঁচু প্রাচীর। ডিঙ্গাতে হবে যে করেই হোক। সোজা ছাদে চলে গেল রাশেদ। কেয়ারটেকার লোকটাকে দেখতে পেলো। কাত হয়ে পড়ে আছে। বিল্ডিংটার নিচে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। তেমন পছন্দ হয়নি লোকটাকে রাশেদের, কিন্তু এখন খুব খারাপ লাগছে। সেই লোকটা আসছে, হাতে একটা রিভলভার, সাইলেন্সার লাগানো মনে হচ্ছে। এধরনের জিনিস আগে কখনো দেখেনি। রাশেদ, শুধু মুভিতে ছাড়া। মৃত্যু এগিয়ে আসছে। বিল্ডিংটা মাত্র তিনতলা। তিনতলা ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয়ার কথা কল্পনাও করতে পারছে না রাশেদ। কিন্তু এখন এছাড়া কোন উপায়ও নেই। নিচে সিঁড়িতে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি ভেঙে উঠছে লোকটা।
রেলিং-এ দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল রাশেদ। ঝাঁপ দিতে হবে এক্ষুনি। পিঠে ঝোলানো ব্যাগটা দেখে নিয়ে চোখ বন্ধ করল, তারপর বিসমিল্লাহ করে পড়ে গেল নিচে।
অদ্ভুত ব্যাপার, হাঁড়-গোড় ভাঙ্গেনি, শরীরে তেমন ব্যথাও পায়নি সে। পড়েই উঠে দাঁড়াল রাশেদ। পিছু ফিরে ছাদের দিকে তাকাল। লোকটা ছাদে উঠে গেছে। তাকিয়ে আছে তার দিকে, একটু অবাক দৃষ্টিতে, হয়তো ভাবছে এতো উঁচু থেকে ঝাঁপ দিয়েও কিভাবে দৌড়াচ্ছে ছেলেটা।
দৌড়াচ্ছে রাশেদ। একেবেঁকে। লোকটা ছাদ থেকে ঝাঁপ না দিলেও ওর কাছে একটা আগ্নেয়াস্ত্র দেখেছে সে। আশপাশে হিসসস শব্দ করে দু’একটা বুলেট চলে গেল বলে মনে হলো তার। আর একটু এগুলেই পাঁচিল। অনেকটা দূর থেকেই ঝাঁপ দিয়ে পাঁচিলের উপরটা ধরে ফেলল রাশেদ। ছোট ছোট কাঁচের টুকরো বসানো ঘন ঘন করে। হাত দুটো কেটে গেল রাশেদের। অনেক ব্যথা করছে। কিন্তু এখন জান বাঁচানোর সময়। হাত একটু কেটে গেলে করার কিছু নেই। মাথার পাশ দিয়ে আরো একটা বুলেট চলে গেল মাত্র। লোকটা সময় নিয়ে নিশানা করছে। সময় নেই একেবারে। নিজের শরীরের সমস্ত ভার হাত দুটোর উপর দিল রাশেদ, তারপর একটানে উঠে পড়ল পাঁচিলটার উপর। পা ছড়ে যাচ্ছে, কাঁচের টুকরো বেশ কিছু ঢুকে গেছে এখানে সেখানে। শেষবারের মতো তাকাল সে বাংলো বাড়ীর ছাদটার উপর। লোকটা তাকিয়ে আছে এখনো, হাতের অস্ত্রটা তাক করা, একটা বুলেট ঠিক মাথার কিছু চুলের উপর দিয়ে চলে গেল তখন। হাত ছেড়ে দিলো রাশেদ। এবার সে পড়ছে, কিন্তু কিছুই টের পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে সে পড়েই যাচ্ছে, পড়েই যাচ্ছে।
আগে শরীরটা পড়ল, তারপর মাথা। এবার ভালোই ব্যথা পেয়েছে রাশেদ। মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। উঠার মতো শক্তি পাচ্ছে না শরীরে। ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। চারপাশে জঙ্গল। লোকটা এখনই হয়তো আসবে। সে জানে রাশেদ কোথায় পড়েছে। এখনই পালানো শুরু না করলে রক্ষা পাওয়া যাবে না সাক্ষাৎ ঐ যমদূতের হাত থেকে।
সারি সারি গাছ, সেগুন, গর্জন, গায়ে গায়ে লাগানো, যে করেই হোক এই জঙ্গল থেকে বের হতে হবে আগে। তারপর ফিরতে হবে ঢাকায়। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল রাশেদ। লিলিকে জানাতে হবে। দৌড়াতে দৌড়াতেই নাম্বারে ডায়াল করল।
‘হ্যালো লিলি,’ হাপাতে হাপাতে বলল রাশেদ।
‘কি ব্যাপার, এভাবে কথা বলছো কেন?’ ওপাশ থেকে লিলির উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা গেল।
‘পালাচ্ছি আমি, এখানে আট্যাক করেছে একজন, ওরাই মেরেছে শামীমকে। আমি…’ কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে রাশেদের।
‘তোমার কিছু হয়নি তো?’
‘না, তেমন কিছু না, তবে এখনো নিরাপদ নই, শোন, তোমাদের বাংলো বাড়ির গার্ড আর কেয়ারটেকারকে মেরে ফেলেছে।‘
‘ওহ, আল্লাহ।‘
‘শোন, তুমি চুপচাপ থাকো, পুলিশকে কিছু বলো না, কেউ জানে না ওখানে আমি ছিলাম, কাজেই সাধারন ডাকাতি মনে করবে ওরা।‘
‘আচ্ছা, কিন্তু কেয়ারটেকার চাচার জন্য খুব খারাপ লাগছে আমার,’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল লিলি।
কিছুক্ষন চুপ করে রইল রাশেদ। ঐ দু’টো মৃত্যুর জন্য সেই দায়ী।
‘এখন রাখছি, পরে ফোন করবো।‘
ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল রাশেদ। অনেকক্ষন এলোপাথারী দৌড়েছে সে। ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু জঙ্গল থেকে বের হওয়ার কোন পথই দেখা যাচ্ছে না। সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। হাত দুটোর দিকে তাকাল। বেশ কিছু গর্তের সৃষ্টি হয়েছে দুই হাতেই, অনর্গল রক্ত বেরুচ্ছে সেখান থেকে। পা থেকেও রক্ত ঝরছে। জিন্সের প্যান্টটা ভিজে গেছে রক্তে। চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে। সবকিছু অদ্ভুত মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছে রাশেদ জ্ঞান হারাতে চলেছে। দূরে চলমান একটা কিছু চোখে পড়ল। মানুষ না কি গরু-ছাগল? সামনে আসছে জিনিসটা। হ্যাঁ, মানুষই। কিছু বলছে। কিন্তু কোন কথা বুঝতে পারলো না রাশেদ। জ্ঞান হারালো।
*
অধ্যায় ৯
কয়েকদিন পত্রিকা পড়া হয়নি ড. আরেফিনের। আজ অনেক সকালে ঘুম ভেঙেছে তার। নিচে এসে রেস্তোরাঁয় চায়ের অর্ডার দিলেন তিনি। ওয়েটারকে বলেছিলেন কোন পত্রিকা থাকলে দেয়ার জন্য, সে মাত্রই একটা রেখে গেছে টেবিলে।
প্রথম পাতায় চোখ বুলালেন ড. আরেফিন, গতানুগতিক সব খবর। শেষ পাতায় কোনার দিকে একটা খবরে চোখ আটকে গেল। একটা খুনের খবর। খুনটা হয়েছে তার অতি পরিচিত একজনের। দম আটকে এলো ড. আরেফিনের। শামীম ছেলেটা মারা গেছে। খবর অনুযায়ী আরো তিন দিন আগে, অথচ পত্রিকা পড়া হয় না বলে তিনি জানতেও পারেননি। প্রতিদিন ছেলেটার মোবাইলে চেষ্টা করে গেছেন, অপেক্ষা করেছেন কখন সেই ছেলেটা ফোন করবে। হাতের কাছে নামকরা একজন ছিল যে হয়তো বইটার অর্থ বের করতে পারতো, কিন্তু এখন সব পানিতে গেছে। দারুন আশা নিয়ে ছিলেন। কিন্তু এখন হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, যতোটা না শামীম মারা গেছে এই দুঃখে, তারচেয়ে বইটা আর পাওয়া যাবে না এই বেদনায়। ড. কারসনের সাথে বসে হয়তো বইটা থেকে সব তথ্য বের করে নেয়া যেতো, অমরত্ব পাওয়ার কোন কৌশলও যদি বইটায় থাকতো, তাহলে সেই তথ্য কেবল এই দুই-তিনজন মানুষের কাছেই থাকতো।
কিন্তু এখন সব শেষ। শামীমের মৃত্যু হয়েছে মর্মান্তিকভাবে। কেউ খুন করেছে ছেলেটাকে, মাথা আলাদা করে ফেলেছে। তারমানে নৃশংস কিছু মানুষ আছে এর পেছনে যারা প্রয়োজনে রক্ত ঝরাতেও দ্বিধাবোধ করে না। বইটা চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেল। ড. কারসনের সাথে এই মহাস্থানগড়ে না আসতে হলে বইটা হয়তো হাতছাড়া হতো না। শামীম বলেছিল তার জীবন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে, তখন গুরুত্ব দেননি তিনি, এখন আফসোসে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে।
‘গুড মর্নিং,ড. আরেফিন,’ ড. কারসন কখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন লক্ষ্য করেননি ড. আরেফিন।
‘গুড মর্নিং,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘এখানে আমার কাজ তো শেষ, আজই ফিরতে চাচ্ছি ঢাকায়, ড. কারসন বললেন পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে।’
‘হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম, তবে ড. শাখাওয়াতের সাথে আলাপ করে নিতে হবে, এই যে, চলে এসেছেন তিনি।‘ বললেন ড. আরেফিন
ড. শাখাওয়াত ঢুকলেন মাত্র, ঘুম এখনো কাটেনি উনার। ড. কারসনের পাশে গিয়ে বসলেন তিনি। নাস্তার অর্ডার দিলেন সবার জন্য।
‘ড. শাখাওয়াত, ড. কারসন বললেন, ‘আজ ঢাকা ফিরতে চাচ্ছি আমি।’
‘আজই? অবশ্য এখানকার কাজ শেষ, চলুন ফিরে চাই, এরপর তো আবার সিলেটের দিকে যেতে হবে,’ ড. শাখাওয়ার বললেন একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে।
‘তাহলে একথাই রইলো, আমি রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছি,’ উঠতে উঠতে বললেন ড. কারসন।
‘নাস্তা করে যান,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘না, ভালো লাগছে না, থ্যাঙ্ক য়ু,’ বলে বেরিয়ে গেলেন ড. কারসন রেস্তোরাঁ থেকে।
একে অন্যের দিকে তাকালেন ড. শাখাওয়াত এবং ড. আরেফিন।
‘কি ব্যাপার বলো তো, উনার মুখটা ভার মনে হলো,’ ড. শাখাওয়াত জিজ্ঞেস করলেন ড. আরেফিনকে।
‘জানি না, আসলে এখানকার আবহাওয়া হয়তো সহ্য হচ্ছে না,’ ড. আরেফিন বললেন।
‘কি জানি,’ ভ্রূ কুচকালেন ড. শাখাওয়াত, ‘গতকাল বিকেলে একা একা কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন, পড়ে আমি উনাকে নিয়ে এলাম প্রায় পঁচিশ কিলো দূরের একটা জায়গা থেকে। হাতে দেখি একটা বাক্সের মতো জিনিস, জিজ্ঞেস করলাম কি ওখানে, এড়িয়ে গেলেন তিনি, আজব ব্যাপার।’
‘তাহলে তো স্যার, বাক্সটা দেখা দরকার আমাদের, কেন না এমনও হতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু খুঁজে পেয়েছেন তিনি, এখন লুকিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, কিন্তু এটা তো মানতে পারি না আমরা, আমাদের দেশের জিনিস আমাদের দেশেই থাকবে!’
‘কি করা যায় বলো তো?’ একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন ড. শাখাওয়াত।
‘চিন্তার কিছু নেই, যাত্রা পথে যখন কোথাও থামবো আমরা, ধরেন ফ্রেশ হওয়ার জন্য, তখন ড. কারসনকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি দূরে চলে যাবে, তখন আপনি ওর ব্যাগ খুলে দেখেন নেবেন বাক্সটায় কি আছে।‘
‘চুরি হয়ে যাবে না ব্যাপারটা? এছাড়া ব্যাগে তো তালা মারা থাকবে মনে হয়।’
‘তা ঠিক, তাহলে আপনিই বলুন কি করা যায়?’
‘আমরা সরাসরি জিজ্ঞেস করবো, উনার উত্তর যদি আমাদের পছন্দ না হয় তাহলে তাকে বলবো বাক্সটা খুলে দেখাতে।‘ ড. শাখাওয়াত বললেন।
‘এটাই ভালো, কিন্তু প্রশ্নটা আপনি করবেন, এসব কাজে আমি খুব একটা দক্ষ নই।’
‘ঠিক আছে,’ ড. শাখাওয়াত বললেন।
নাস্তা চলে এসেছে। দুজন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তার সৎকার করতে।
***
বুড়ো বসে আছেন উঠোনের ঠিক মাঝখানটায়, প্রতিদিন যেভাবে বসেন। রোদ এসে পড়ে গায়ে, ভালো লাগে এই তাপটুকু! এখানে থাকার সময় ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। আর কতো। অনেক অনেক বছর কাটানো হয়ে গেছে এই অঞ্চলটায়। যে মায়া কখনো জন্মেনি মনে সেই মায়াই যেন বাসা বেঁধেছে। উদাস দৃষ্টিতে উঠোনের সাথে লাগোয়া রান্নাঘরটার দিকে তাকিয়ে আছেন বুড়ো আব্দুল মজিদ ব্যাপারি। রান্না করতে বসেছে সালেহা, বেচারীর জন্য খারাপ লাগে। সারাদিন সংসারের এটা-ওটা করে সময় কাটানোর চেষ্টা করে মেয়েটা, কিন্তু সময় কি আর কাটে? একটা সন্তান থাকলে হয়তো কেটে যেতো। কিন্তু ওর বরেরও তেমন আগ্রহ নেই, হয়তো আগের স্ত্রীর একটা সন্তান থাকার কারনেই এমনটা হয়েছে। সালেহার জন্য একটা কিছু করবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন মজিদ ব্যাপারি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একবার সালেহার সন্তান হয়ে গেলেই কথাটা চাপা থাকবে না, দলে দলে মানুষ আসবে, নিঃসন্তান দম্পতির তো অভাব নেই দেশে। ছোট একটা ওষুধ দিলেই বেচারীর এই সমস্যাটা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এখনো সেই সময় আসেনি,চলে যাবার আগে ওর সমস্যার সমাধান করে যাবেন বলে ঠিক করলেন মজিদ ব্যাপারি।
নাতিটার কথাও মনে পড়ে সবসময়, পড়ুয়া একটা ছেলে, দাদার কোলেই বড় হয়েছে বলা যায়। এখন ঢাকা একা একা থাকে, বছরে আসে দু’একবার। গতকাল রাতে ওকে নিয়ে বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছেন মজিদ ব্যাপারি। আজ সকাল থেকেই তাই মনটা খুব খারাপ। কোন সমস্যায় পড়েছে ছেলেটা। কি সমস্যা বুঝতে পারছেন না তিনি, কিন্তু সমস্যাটা জটিল।
মাঝে মাঝেই স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করেন মজিদ ব্যাপারি। অনেক অনেক দিন আগের কথা ভাবেন। মায়ের কথা ভাবেন, বাবার কথা চিন্তা করেন। কিন্তু সেসব মনে হয় পূর্বজন্মের কথা। একসময় কতো কিছু আবিষ্কার করতে ইচ্ছা করতো, পৃথিবীর যাবতীয় রহস্য জানতে এবং জানাতে ইচ্ছে হতো। এখন কিছুই ইচ্ছে করে না। মনে হয় মানুষ তো উন্নতি করছেই। এর সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। একসময় যা চিন্তাও করা যেতো না, সেই সব জিনিস তৈরি করেছে মানুষ। চাঁদে গেছে, প্লেগ রোগ দূর হয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে, যক্ষা এখন আর ভয়ানক কিছু নয়। বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে অনেক দূর। তার সাথে এখন তাল মেলাতে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু তিনি নিজে যে রহস্য বহন করে চলেছেন তা কি কখনো বের করতে পারবে এখনকার মানুষ। মনে হয় না। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে, কিছু জিনিস সে রেখে দিয়েছে নিজের হাতে। মানুষ আজো সেসব উদ্ধার করতে পারেনি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে মৃত্যুকে থামিয়ে দেয়া। কিছু গবেষক অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে এর উপর। কিন্তু সমাধান তারাও দিতে পারবে না।
সালেহা এক কাপ চা নিয়ে এসেছে মাথায় ঘোমটা দিয়ে।
‘চা খামু তোমারে কে কইল?’ মজিদ বাপারি বললেন গম্ভীর কণ্ঠে।
‘গুড়ের চা, আপনি পছন্দ করেন।‘
‘তুমি আর কার কার পানি পড়া খাইছ?’ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললেন মজিদ ব্যাপারি।
‘বাঁশখালীর হুজুরের পর আর কারো কাছে যাই নাই,’ সালেহা বলল মিনমিন করে।
‘নামাজ-কালাম পড়ো, আল্লাহর কাছে চাও, পাইবা।’
‘আব্বা, আমি যাই, চুলায় তরকারি বসাইছি,’ বলে পালিয়ে বাঁচল যেন সালেহা।
মজিদ ব্যাপারি বুঝলেন লজ্জা পাচ্ছে মেয়েটা। চায়ে চুমুক দিলেন তিনি। গুড়ের চা হলে মাঝে মাঝে খান তিনি। চাটা ভালোই বানিয়েছে মেয়েটা। এর পুরষ্কার ওকে দিতেই হবে।
***
শিকার হাত ছাড়া হয়ে গেছে। খুনও হয়ে গেছে দুই দুইটা। কাজেই এই এলাকায় থাকাটা নিরাপদ হবে না এখন। পিস্তলটা সাবধানে কোমরে গুঁজে ছাদ থেকে নামল কায়েস। ছেলেটা এতোক্ষনে নিশ্চয়ই পগার পার হয়ে গেছে ভাবল সে। গেট দিয়ে বের হয়ে এলো ধীরে সুস্থে। কেউ এখনো টের পায়নি।
হেঁটে প্রধান সড়কে চলে এলো কায়েস। ওস্তাদকে ফোন করে জানাতে হবে ঘটনাটা। কি কৈফিয়ত দেবে ভেবে পেলো না। কাজে ভুল করার কোন অবকাশ নেই এখানে। ভয়ে ভয়ে নাম্বার ডায়াল করলো।
‘কি, কাজ হয়েছে?’ ওপাশ থেকে ভারি কণ্ঠ শোনা গেল।
ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে কায়েসের। ‘জি না, পোলাটা আগেই বুঝে ফেলছে। দাড়োয়ান আর একটা লোককে মারতে হয়েছে। কিন্তু ওকে ধরতে পারিনি। বইটা নিয়ে পালিয়েছে।
‘চলে এসো, এক্ষুনি।’
‘জি, আসছি,’ বলল কায়েস। ফোন রেখে দিয়েছে ওপাশ থেকে।
রাস্তায় গাড়ি নেই তেমন একটা। হাঁটতে থাকল কায়েস। বিকেল হয়ে এসেছে। হাঁটতে খারাপ লাগছে না। বইটার কথা চিন্তা করছে। কি এমন আছে ঐ বইয়ে যে ওস্তাদ একেবারে হন্যে হয়ে পিছু লেগেছে! শামীম ছেলেটা কতো ভালো ছিল, মায়া লাগতো চেহারাটা দেখলেই। কি নৃশংসভাবেই না খুন করা হলো ছেলেটাকে। সে নিজেও ছিল ঐ খুনের সময়। কিন্তু তখন এমন কিছুই মনে হয়নি। বরং একধরনের রাগে গরগর করে উঠেছিল সে নিজেও। মাথাটা এমনভাবে…
নাহ, এসব কথা ভাবতে ভালো লাগছে না কায়েসের। হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। খেয়াল করেনি পেছনেই দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে একটা ট্রাক। চারপাশ থেকে লোকজন হৈচৈ করছে, সরে যাওয়ার জন্য বলছে রাস্তার মাঝখান থেকে। কিন্তু কিছুই লক্ষ্য করেনি কায়েস। ট্রাকটা ব্রেক করার অনেক চেষ্টা করেও পারেনি। কায়েসের ঠিক মাথার উপর দিয়ে উঠে গেল ট্রাকের চাকা! মট করে ভেঙে গেল খুলিটা।
***
রাত বেশি একটা হয়নি,নিজের রুমে একা বসে আছেন আকবর আলী মৃধা, সন্ধ্যা থেকেই এক ধরনের আশংকা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। কায়েসকে চলে আসতে বলেছেন, এবারও ব্যর্থ হয়েছে তার লোক। রাশেদকে বোকাসোকা মনে হয়েছিল শুরুতে, এখন তা মনে হচ্ছে না। আরো কার্যকর কোন প্ল্যান করতে হবে, যাতে রাশেদ নিজে থেকে এসে ধরা দেয় তার কাছে, সেটা কী হতে পারে তা মাথায় আসছে না।
একা একা কিছুক্ষন পায়চারি করলেন আকবর আলী মৃধা, ক্রমাগত কায়েসের নাম্বারে ডায়াল করেছেন, কল যায়নি। বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করলেন, গভীর মনোযোগে কিছু একটা দেখার চো করলেন। না, হচ্ছে না। সব কিছু কেমন ঝাপসা। তার আরো শক্তি দরকার। আরো অনেক শক্তি, তার জন্য দরকার আরো রক্ত। আরো প্রান।
রাগে শরীর কাঁপছে তার, কায়েসের উপর রাগ হচ্ছে না এখন, ছেলেটা এখন সব কিছুর উর্ধে। কিছু কিছু ব্যাপারে তার এক ধরনের অনুভূতি হয়, কায়েসের ব্যাপারেও হচ্ছে। ছেলেটা বেঁচে নেই, এরকম একটা ছেলে হারানো মানে অনেক ক্ষতি। তবে চিন্তার কিছু নেই। নতুন নতুন ছেলে আসছে, আসবে, দলে দলে। তার দল দিন দিন ভারি হবে।
বোম্বের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সেই বিশেষ দিনের কথা।
‘তোকে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি,’ পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন গুরু। ‘যাকে আমি পছন্দ করি, তাকে বেশিদিন সাথে রাখি না, মেরে ফেলি,’ বলে হাসলেন। হাসিটা অকৃত্রিম।
কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছিল, দিনের বেলাতেও। আধো অন্ধকারে গুরুর চেহারাটা রহস্যময় দেখাচ্ছে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন গুরু, তার পায়ের কাছে বসে আছে আকবর, তার বয়স তখন অনেক কম। এই ঘরটায় ঢুকলে দম বন্ধ হয়ে আসতো আগে, গুমোট, ভ্যাপসা একটা গন্ধ, এছাড়া অশুভ কিছু একটা যেন ঘোরাফেরা ছোট এই জায়গাটায়। দিনের বেলায়ও সবসময় কামরাটা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। একটা খাট, ছোট একটা বইয়ের তাক আর একটা টেবিল, এই হচ্ছে আসবাব-পত্র। বইয়ের তাকের সবগুলো বই ইতিমধ্যে পড়া হয়ে গেছে আকবরের। কালো জাদুর উপর প্রাচীন সব বই, গ্রীস কিংবা মিশরের প্রাচীন কালো জাদু, ভুডু থেকে শুরু করে খৃস্টপূর্ব যুগে প্রাচীন ভারতীয় সব কালো জাদুর উপর অদ্ভুত সব বই। গুরু নিজেই সব পড়ে শুনিয়েছেন, কিছু প্রাচীন বর্নমালা আর চিত্রের উপর প্রাথমিক ধারনা দিয়েছেন। তবে একটা ব্যাপার গুরু এড়িয়ে গেছেন সবসময়। বইয়ের তাকের ডান দিকের ছোট্ট একটা অংশ, যা তালাবদ্ধ থাকে সবসময়। যুবকের ধারনা এই তালাবদ্ধ অংশেও বিশেষ কোন বই আছে, কিংবা আছে অন্য কোন গুরুত্বপূর্ন জিনিস যা গুরু কারো কাছে এখন পর্যন্ত খুলে বলেননি। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেছে যুবক আকবর, উত্তর পায়নি। এমনকি কোন প্রশ্ন করলে রেগে যান গুরু, যা চোখ এড়ায়নি আকবরের। কাজেই এ ব্যাপারে আর কোন। আগ্রহ দেখায়নি আকবর, যদিও তার মনটা সবসময় পড়ে থাকে তালাবদ্ধ এই অংশটায়, কী আছে এখানে? জানতে বড় ইচ্ছে হয়।
বোম্বের শহরতলীর এক প্রান্তে দোতলা একটা বাড়িটার নীচ তলায় ছোট এই কামরাটার অবস্থান।
অনেক দিন ধরেই এখানে নিজের স্থায়ী আবাস করে নিয়েছেন গুরু, তার সাথে থাকে অল্প কিছু ভক্ত, সেই ভক্তের মধ্যে আকবর নিজের জন্য বিশেষ একটা জায়গা করে নিয়েছে গত কয়েক বছরে। এছাড়া সারা দেশ জুড়ে আছে গুরুর রয়েছে অসংখ্য ভক্ত আর অনুরাগী। এই ভক্ত আর অনুরাগীরা এক বিশেষ শ্রেনির মানুষ। তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, সেই সাথে বিশ্বাস করে শয়তানেও। জাগতিক সব সুখ পাওয়া যাবে শয়তান উপাসনায়, এই বিশেষ তত্ত্বটি তাদের মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে ঢোকাতে সক্ষম হয়েছেন গুরু। তাকে সবাই গুরু বলেই ডাকে, অন্য কোন নাম বা বিশেষন প্রয়োজনহীন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও শারীরিকভাবে অনেক তরুনকেই কাত করে ফেলতে পারেন তিনি, টানা দৌড়াতে পারেন মাইলের পর মাইল।
আকবরের বয়স অনেক কম হলেও এই বয়সেই চেহারায় ক্রুরতা ফুটে উঠেছে। ভয়াবহভাবে। তার ভেতরটা মনে হয় সবসময় জ্বলছে, এর পেছনে খুব গোপন কোন কারন আছে বলে মনে করে সবাই, যদিও সামনে বলতে সাহস পায় না। আকবর দেখতে মোটেও সুশ্রী নয়, শারীরিকভাবে শক্ত-পোক্ত, বিশালদেহী। প্রায় তিন বছর হয়ে গেল গুরুর সাথে আছে সে। এর মধ্যে নিজের পরিবারের কাছে ফেরার কথা তার একবারও মনে হয়নি। গুরুর সেবার মধ্যেই যেন নিজের জীবনের সুখ খুঁজে নিয়েছে সে।
‘মারলে মারবেন, আমার কাছে আপনিই সব, গুরু,’ মৃদু স্বরে বলেছিল যুবক। গুরুর চেহারায় প্রশান্তির ছাপ দেখা দিল। কেন তোকে এতো পছন্দ করি জানিস?
মাথা ঝাঁকাল আকবর, অপ্রস্তুতবোধ করছিল, সে জানে না, জানতে চায়ও না।
‘তোকে যা শিখিয়েছি, তার ছিটেফোঁটাও পায়নি কেউ আমার কাছ থেকে,’ গুরু বললেন, ‘আমি শয়তানের পূজারি, তিনিই আমার সব। আমার জীবন-যৌবন, মেধা, সব ঢেলে দিয়েছি তার পেছনে। এবার সময় হয়েছে সব ফিরে পাবার।‘
‘সব ফিরে পাবার?’ কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করল আকবর, জীবন-যৌবন সব কি ফিরে পাওয়া যায়? হ্যাঁ, এটা ঠিক, তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছেন গুরু, শয়তানের উপাসনা, সম্মোহন থেকে শুরু করে বিশেষ কোন আত্মার উপর নিয়ন্ত্রন, আত্মার পরিভ্রমন, এই ধরনের অনেক কিছুই। কিন্তু বিশেষ একটা ব্যাপার গুরু সবসময়ই আড়াল করে রেখেছেন, একটু আগেই যার উল্লেখ করলেন, জীবন-যৌবন সব ফিরে পাবার কৌশল। সে নিজে এখনো যুবক, যৌবন ফিরে পাবার কোন প্রয়োজন নেই এখন, কিন্তু এক সময় সে বৃদ্ধ হবে, গুরুর মতো। তখন এই কৌশল তাকে কে শেখাবে?
‘এখন যা, ভাগ।’
উঠে দাঁড়াল আকবর, গুরু এই সময় একা থাকতে পছন্দ করেন, এই সময় বিরক্ত করা নিষেধ। ঘরের মাঝখানে মেঝেতে একটা বৃত্ত আঁকা, বৃত্তের ঠিক মাঝখানে এক জোড়া খুলি, খুলি দুটো গত বছর বলি হওয়া কুমারি দুজন মেয়ের। যার কৃতিত্ব তার নিজের, এই ধরনের কাজে যে ধরনের হিংস্রতা দরকার, অবিশ্বাস্য হলেও অল্পদিনেই তা আয়ত্ব করেছে আকবর। বিছানা থেকে নেমে গুরু বৃত্তের মাঝখানে গিয়ে বসেছেন, যজ্ঞ শুরু করার আগে ধ্যানে বসবেন।
বেরিয়ে এলো আকবর, দীর্ঘক্ষন অন্ধকারে থেকে চড়চড়ে আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল তার। গত কিছুদিন ধরেই মানুষ জন দেখলে কেমন খুন করতে ইচ্ছে করে, মনটা কেমন দিন দিন বিষিয়ে যাচ্ছে। এই শহর এখন আর ভালো লাগছে না। গুরুর কাছে যা কিছু শিখেছে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এরচেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। এবার দেশে ফেরা দরকার।
ঘুরে আবার কামরায় প্রবেশ করলো আকবর। মোমবাতির আবছা আলোয় গুরুকে চোখে পড়ল, ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। বিড়বিড় করে আদিম কোন মন্ত্র পড়ছেন। কেউ ঢুকেছে ঘরে তা টের পাননি। বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল আকবর। কী করবে বুঝতে পারছে না। আজ রাতে বড় একটা অনুষ্ঠান আছে। তারই পূর্ব প্রস্তুতি চলছে। এই মুহূর্তে গুরুকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
বেরিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল আকবর, ঘরের তাপমাত্রা ক্রমশ কেমন শীতল হয়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে লক্ষ কোটি চোখ দিয়ে কেউ তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার তাকাল গুরুর দিকে। লোকটা এখন গভীর ঘোরের ভেতর চলে গেছে। বিদ্যুৎ চমকের মতো কিছু একটা মনে পড়ল তার। হ্যাঁ, কাজটা করার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়।
ধীর পায়ে গুরুর দিকে এগিয়ে গেল আকবর। জটাধারী গুরু কালো রঙের একটা আলখেল্লা পড়ে আছেন, চাবির গোছাটা থাকে কোমরে। গুরুর ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে, ইতস্তত করছে। অনেক বড় ঝুঁকি আছে, বাইরে গুরুর অনুগত কিছু শিষ্য এখনো ঘোরাঘুরি করছে। কী করবে ভাবতে ভাবতেই বুঝল দেরি হয়ে গেছে, তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছেন গুরু। কিছু একটা বলার আগেই গুরুর মাথা আঁকড়ে ধরল আকবর। বৃদ্ধ এখনো প্রচন্ড বলশালী, দুই হাত দিয়ে মাথাটা ধরে রাখতে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। এই সময় ঘরে অন্য কেউ ঢুকলে তার রেহাই নেই। অন্যদিকে গুরুকে একেবারে মেরে ফেলতেও কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু গুরুকে এখন বাঁচিয়ে রাখারও কোন উপায় নেই। একবার যখন আক্রমন করে বসেছে যে কোন একজনকে মরতে হবে আর এতো তাড়াতাড়ি নিজেকে মৃত ভাবতে চায় না আকবর।
দুই হাত দিয়ে গলায় চাপ বাড়াল সে। দুই পা দিয়ে মেঝেতে ক্রমাগত আঘাত করছেন বৃদ্ধ গুরু। এবার হাত দিয়ে উল্টো আকবরের চোখের উপর আঘাত হানলেন। ব্যাপারটা পুরো অপ্রত্যাশিত ছিল, চোখ বাঁচাতে গিয়ে বৃদ্ধের গলা থেকে হাত ছুটে গেল আকবরের। ঠিক এই মুহূর্তটার অপেক্ষা করছিলেন গুরু, ঠিক নাক বরাবর একটা ঘুষি বসালেন, ফলে দুই হাতই গলা থেকে সরে গেল তার। চোখে অন্ধকার দেখছিল আকবর, কিন্তু মাথা কাজ করছিল। অন্ধের মতো ডান দিক থেকে।
গোলাকার জিনিসটা হাতে তুলে নিলো সে, মাথার খুলি। বৃদ্ধ গুরুর মাথার তালু বরাবর বসিয়ে দিল। কড়াত করে শব্দ হলো, কোনমতে বৃদ্ধের মুখে হাত চাপা দিল আকবর। কিন্তু তার প্রয়োজন ছিল না, বৃদ্ধ গুরু হয় মারা গিয়েছেন নয়তো জ্ঞান হারিয়েছেন। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল আকবর, হাতে বেশি সময় নেই। বৃদ্ধের কোমর থেকে চাবির গোছাটা বের করে আনল। বেশ কয়েকটা চাবি আছে, বেশিরভাগই চেনা, নীচ দিকে ছুরির মতো বাঁকানো চাবিটা বের করে আনল গোছা থেকে। বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়াল।
তার চোখ দুটো এখনো জ্বলছে, তালাবদ্ধ অংশটায় চাবি বসিয়ে মোচড় দিতেই খুলে গেল। যা ধারনা করেছিল, তাই! কালো কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা জিনিস, বই ছাড়া আর কিছু হবে না। আরো কিছু জিনিস আছে, টাকা। প্রচুর টাকা। টাকাও খুব দরকারি জিনিস, কাজেই পরনের কালো আলখেল্লায় যতোটা পারল ভরে নিলো আকবর। এই টাকাগুলো তার খুব কাজে লাগবে, খালি হাতে দেশে ফিরে যাওয়া অসম্ভব একটা ব্যাপার।
কালো কাপড়টা সরালো আকবর, ধীরে ধীরে, হ্যাঁ, অতি প্রাচীন একটা বই দেখা যাচ্ছে। উপরের লেখাগুলো তার অচেনা। পাতা উল্টাতে ইচ্ছে হলেও কোনমতে নিজেকে দমন করল। এখন এই জায়গা ছাড়তে হবে, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
এরপরের কয়েকদিন কাটল পালানোতে। প্রায় পনেরো দিন পর ঢাকার মাটিতে পা রাখল। একেবারে নতুন একজন মানুষ হিসেবে নতুন করে পথ চলা শুরু হলো।
বর্তমানে ফিরে এলেন আকবর আলী মৃধা, উঠে দাঁড়ালেন। আজ রাতে বিশেষ একটা অনুষ্ঠান আছে, তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার ব্যাপার আছে। প্রয়োজনীয় সব জিনিস জোগাড় করা আছে, এই রুমেই আছে সব কিছু। মনটাকে শান্ত করে রুমের বাতি নিভিয়ে দিলেন তিনি। টকটকে লাল সিঁদুর দিয়ে উল্টো করে বড় একটা ত্রিভুজ আঁকলেন মেঝেতে। ওটার ওপর সোজা আরেকটি ত্রিভুজ। দেখতে হলো ছয় কোনা তারা। তারাটাকে ঘিরে দিলেন আতপ চালের গুড়োয় আঁকা প্রকান্ড একটি বৃত্ত দিয়ে। ত্রিভুজের ভেতর ছয়টি কোণে সাপের কাটা লেজ, পেঁচার নখ, বাদুড়ের মাথা, ঘোড়ার খুর, শিশুর পাঁজরের হাড়, বানরের থাবা রাখলেন। বৃত্তচাপ এবং তারার পয়েন্টগুলো মিলে আরও ছয়টি কোণ তৈরি করেছে। এরপর এই কোণগুলোতে হালকা লাল রঙের কালি দিয়ে অদ্ভুত সব চিহ্ন আঁকলেন। দুটো ত্রিভুজের মাঝখানে যে পেন্টাগ্রাম তৈরি হয়েছে, ঠিক সেখানে দুটো লাল মোরগ দুটো জবাই করলেন, মোরগ দুটো আগে থেকেই বাঁধা ছিল। রক্তে মাখামাখি হলো জায়গাটা। এক পাশে রাখা একটি টিনের বালতিতে রাখা শুকনো বালুমাটি ছড়িয়ে দিলেন, দ্রুত রক্ত শুষে নিল। এরপর সেখানে খালি গায়ে বসলেন, পদ্মাসনে।
তার সামনে বেশ বড় একটা পাত্র রাখা, পাত্রটার পেছনে ছোট ছোট কিছু কাঁচের বোতল সাজানো। কাঁচের বোতলে রাখা উপাদানগুলো সংগ্রহ করতে হয়েছে অনেক কষ্ট করে। এরমধ্যে কুমারি মেয়ের রক্ত যেমন আছে, আছে পাহাড়ি কিছু বিষাক্ত উদ্ভিদের নির্যাস, আছে সদ্য গজানো টিকটিকির লেজের গুড়ো। অন্যান্য উপাদানের মধ্যে আছে ঘোড়ার রক্ত, গর্ভবতী নারীর প্রস্রাব, মৃত চড়ুই পাখি। এবার সবগুলো উপাদান অল্প অল্প করে সামনে রাখা পাত্রটায় ঢাললেন, মৃত চড়ইয়ের মাথা ভেঙে মাথাটা ছুঁড়ে দিলেন দূরে। তার হাতে ঝকঝকে একটা ছুরি দেখা গেল, ডান হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছেন ছুরিটা, বাম হাতটা পাত্রের উপর ধরলেন, তারপর ছুরি বসিয়ে দিলেন বাম হাতের তালুতে, ধীরে ধীরে হাতের তালু কাটলেন তিনি, টপটপ করে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে পাত্রটায়। চোখ বন্ধ করে এক দমে কিছু আদি শ্লোক আওড়ালেন তিনি। সুদূর ব্যবিলন, সিরিয়ার শয়তান উপাসকদের কাছ থেকে পাওয়া এইসব আদি শ্লোক শিখেছিলেন গুরুর কাছ থেকে। এবার চড়ুইয়ের দেহটা পাত্রে জমে থাকা থকথকে তরলে ডুবিয়ে নিয়ে কামড় বসালেন। কড়কড় করে উঠলো হাড়গুলো, অদ্ভুত শিহরন বয়ে গেল পুরো শরীরে। আধো তন্দ্রায় ডুবে গেলেন তিনি। এই জিনিস দিয়েই কাবু করতে হয় শিষ্যদের। ওদের জন্য এই তরলের এক ফোঁটাই যথেষ্ট যা তিনি পানি, চা বা অন্য কোন খাবারে মিলিয়ে দেবেন।
রাত বারোটায় বসবেন শিষ্যদের সাথে, ওদের সম্মোহিত করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আকবর আলী মৃধার ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা গেল।
*
অধ্যায় ১০
ভারতবর্ষ অনেক বড় জায়গা। এখানে শেষবার তিনি এসেছিলেন লর্ড ক্লাইভের সাথে। সে অনেক বছর আগের কথা। ১৭৭৫ সাল হবে হয়তো। এরপর আবার ফিরে গিয়েছিলেন ইউরোপে। অনেকদিন কাটিয়ে আবার ফিরছেন এখানে। ফ্রান্স, রাশিয়া, সুইডেন, জার্মানী, ইংল্যান্ডে অনেক সময় কাটানো হয়ে গিয়েছিল। লোকজনও চেনা শুরু করে দিয়েছিল। বার বার নাম বদলে আর কতো। বেশভুষাই বা কতো বদলানো যায়। তারপর ফ্রান্সের বিপ্লবের ঘটনার পর মনটাই ভেঙে গেল একেবারে। এতে সাবধানবানী, কিন্তু কেউ কানেই তুলল না।
যাই হোক, সাগর পাড়ি দিয়ে আবার চলে এসেছেন ভারতবর্ষে। এই দেশটা সম্পর্কে দারুন শ্রদ্ধাশীল তিনি। যদিও ধর্মীয় ও সামাজিক অনেক ব্যাপারই তার মাথায় ঢোকে না। সমাজে নানা ধরনের উঁচু নিচু প্রভেদ। একশ্রেনীর লোক অপরশ্রেনীর লোককে মানুষ বলেই গন্য করতে চায় না এখানে। কিন্তু সাদা চামড়ার ব্যাপার ভিন্ন। ককেশীয় মানুষ দেখলেই বুঝে নেয় প্রভুর জাত। সম্মান করে। যদিও এসব মোটেও ভালো লাগে না তার।
এবার গন্তব্য হবে সুদূর তিব্বত। প্রাচীন এক সভ্যতা পাহাড়ের কোলে, বরফের দেশে। সেখানে কিছুদিন বিশাম নিতে হবে, শিখতে হবে অনেক কিছু। ওদের ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, সবকিছুই দেখতে হবে। লামারা নাকি অনেক যাদুর শক্তির অধিকারী। শিখতে হবে এরকম অনেক কিছুই। বিনিময়ে নিজের জ্ঞান ভান্ডারও উজার করে দেবেন তিনি, শুধুমাত্র লুকিয়ে রাখবেন দুই-একটা জিনিস, যা কাউকে দেয়া সম্ভব না। হয়তো তার অসদ্বব্যবহারে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে গোটা মানবজাতি।
খুব সাধারন বেশভুষা তার। ইংরেজদের এই রুপে দেখে অভ্যস্ত নয় ভারতবাসী। তারা খুব অবাক চোখে তাকায় তার দিকে। কাছে আসে, কথা বলতে চায়। কিন্তু তিনি মুখ খোলেন না, কারো কাছ থেকে কিছু খান না। না খেলেও তার চলে। এই শরীর এখন পুরোপুরি তার বশে। খাওয়া-দাওয়া এখন খুব গৌন একটা ব্যাপার। বড় দুটো সুটকেসই হচ্ছে আসল সমস্যা। এই দুটিতেই তার সমস্ত অর্জন রাখা আছে। এগুলো টেনে নিতে খুব বেশি কষ্ট হয় না তার। কিন্তু লোকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। পয়তাল্লিশ-ছয়চল্লিশ বছরের একজন লোক দুটি ভারি সুটকেস নিয়ে অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছে। অনেকের চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখা যায়। কাজেই একজন মুটে নিয়েছেন। লোকটার মাথায় ব্যাগ দু’টো চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে হাঁটেন তিনি। লোকটাকে অবশ্য ভালো টাকাই দিচ্ছেন এবং সামনে আরো দেবেন। কোনরকম প্রশ্ন ছাড়া লোকটা সুটকেস দুটো টানছে। বলশালী লোক, দেখলেই বোঝা যায়।
হিন্দি ভাষা অনেকটাই জানা আছে তার। মাঝে মাঝেই লোকটার সাথে গল্প জুড়ে দেন তিনি। সেসব গল্প শুনে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে লোকটা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যেন। হয়তো এই ধরনের গল্পের লোভেই লোকটা লেগে আছে তার সাথে, কে জানে।
তিব্বতে যাননি আগে কখনো। ম্যাপে দেখেছেন। হিমালয় পর্বতমালা কোথায় সেটাও দেখেছেন। হিন্দুদের পবিত্র মানস সরোবর, কৈলাস সরোবর, সবকিছুই চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন তিনি ম্যাপটাতে। যাওয়ার অনেক ইচ্ছে আছে এই জায়গাগুলোতে।
এখন একটা বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। বদ্ধ গ্রাম। এই এলাকার লোকজন সাদা চামড়ার মানুষ খুব একটা দেখেনি আগে। চারপাশে ভিড় জমে গেছে। মুটে লোকটা পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় সুটকেস দুটো নিয়ে। অনেক শীতল এই এলাকা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় পাঁচহাজার ফুট উপরে এর অবস্থান। লোকজন সবাই হিন্দু। যদিও এরা অনেকটা যাযাবর টাইপের। বিরুপ আবহাওয়াই এর কারন। হিমালয়ের কাছে হওয়ায় শীত এখানকার জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ। জায়গাটার নাম বাগসু, এখান থেকে সোজা তিব্বত যাওয়া যায়, অথবা দক্ষিনে নেপাল, সেখান দিয়েও যাওয়া যায় তিব্বতে। কি করবেন এখনো ঠিক করেননি তিনি। মুটে লোকটার ক্ষিদে পেয়েছে, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাই ঠিক করেছেন এখানেই কিছুক্ষনের বিরতি নেবেন তিনি। পারলে আশপাশে কোথাও রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকাল সকাল রওনা দেবেন।
‘হুজুর, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না,’ মুটেটা বলল, কাতর স্বরে।
‘ঠিক আছে, সুটকেসগুলো রাখো, দেখো, কি পাওয়া যায় এখানে?’
খুব সাবধানে সুটকেসগুলো নামিয়ে রাখল মুটে লোকটা। সেভাবেই নির্দেশ দেয়া আছে তাকে।
ষন্ডা গোছের একটা লোক এগিয়ে এলো। উদ্দেশ্য খুব একটা ভালো মনে হলো না। এখানে এখনো ব্রিটিশ রাজ সেভাবে পৌঁছায়নি। কাংরা পর্যন্ত ব্রিটিশরা জেঁকে বসেছে, কিন্তু এখানে এখনো আসেনি,কিংবা আসার প্রয়োজন বোধ করেনি। তাই এখানকার বাসিন্দারাও ব্রিটিশদের চরিত্র সম্পর্কে খুব একটা জানে না। মুটে লোকটার সাথে কথা বলছে ষন্ডাটা। এমনিতেই স্বাস্থ্য ভালো লোকটার, তারপর গায়ে হাজার রকমের জিনিস চড়িয়েছে, রীতিমতো দানবের মতো দেখা যাচ্ছে ওকে।
কি কথা বলছে বুঝতে পারছেন না তিনি। একেবারেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে লোকটা, সাধারন হিন্দি হলে হয়তো বোঝা যেতো। হাত ইশারা করে ডাকলেন তিনি মুটে লোকটাকে।
‘কি বলছে?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘আমরা কে? কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাচ্ছি, এসব আর কি?’
‘তুমি কি বলেছো?’
‘বললাম দিল্লি থেকে এসেছি, তিব্বত যাবো, লাসায়।’
‘আচ্ছা, আর?’
‘লোকটা বলছে তার বাড়িতে রাতটা কাটাতে পারবো আমরা, বিনিময়ে কিছু উপহার চায় লোকটা, আমি না করে দিয়েছি।’
‘উপহার? কি উপহার?’
‘আপনার মাথায় যে টুপিটা আছে, সেটা খুব পছন্দ হয়েছে ওর, আমি বললাম সম্ভব না।
‘ঠিক আছে, রাতে এখানে থাকার কি ব্যবস্থা?’
‘হুজুর, কোন ব্যবস্থা করিনি,হয়ে যাবে।
‘এক কাজ করো, লোকটাকে বলল, আমার টুপিটা সে পাবে, আমরা আজ রাতে ওর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহন করবো।’
‘কি বলছেন হুজুর? আপনার এতো সুন্দর টুপি ঐ হাতিটাকে দিয়ে দেবেন? ওকে মানাবে?’
‘যা বলছি তাই করো।’
‘ঠিক আছে,’ মাথা নিচু করে চলে গেল মুটে।
দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আশপাশে লোকজন এখন কমতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। কাজেই আজকের মতো যাত্রার সমাপ্তি এখানেই।
লোকটা একাই থাকে, ছোটখাট একটা টিলার উপর কাঠের বাড়িটা। ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে আছে মুটে লোকটা। এই ধরনের ঠান্ডায় অভ্যস্ত নয় সে। একটু আগে খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে, ভেড়ার মাংস দিয়ে কি একটা রান্না করেছিল দানব লোকটা। তিনি খাননি। মুটে খেয়েছে চেটেপুটে।
বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বেশ রাত হয়ে গেছে। আতিথ্য গ্রহন করেছেন ঠিকই, কিন্তু লোকটাকে কেমন সন্দেহ হচ্ছে তার। সামান্য একটা টুপি এই লোকের আসল লক্ষ্য না। দুজনকে মেরে সুটকেস দুটো রেখে দিতে চায় সে। মানুষের চোখ দেখেই মনের কথা অনেকটা বুঝতে পারেন তিনি। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ চোখ দেখেছেন জীবনে, আরো অনেক দেখবেন। কাজেই কেউ ফাঁকি দিতে পারবে না তাকে।
অনেক দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। তারা দেখছেন, হাজার হাজার বছর ধরে এই তারারাই তার সাথি। উত্তর-দক্ষিন, কোন গোলার্ধেই এরা তার পিছু ছাড়েনি। মাঝে মাঝেই জীবনটা অর্থহীন মনে হয়, মনে হয় এভাবে জীবনটা টেনে নেয়ার কোন মানে নেই। কিন্তু যখন মনে হয়, অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে, অনেক রহস্যই রয়েছে চোখের আড়ালে, তখনই তিনি বেড়িয়ে পড়েন। সৃষ্টিরহস্য খোঁজেন। নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। সেই আবিষ্কারের উদ্দেশ্যেই এই তিব্বত যাত্রা।
তিব্বত, লোকচক্ষুর আড়ালে আছে এখনো। পশ্চিমা দুনিয়ায় এখনো যায়নি তিব্বতের জ্ঞানের আলো। প্রাচীন এক সভ্যতা লুকিয়ে আছে সেখানে। বৌদ্ধ ধর্মকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে তিব্বতীরা। ভাষাও অনেক ভিন্ন। এখনো অনেক মানুষ শুধুমাত্র জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবার আশায় পার্থিব সব সুখ বিসর্জন দিয়ে বেছে নিয়েছে আমার জীবন। একাকী সেই জীবন। শুধু জ্ঞান সাধনা। বোধি পাবার নিরন্তর চেষ্টা। ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাবার কি দারুন আকাঙ্খ। তারা স্বাভাবিক জীবনের সব কিছু ত্যাগ করে পাহাড়ের গুহায় বেছে নিয়েছে আশ্রয়। দীর্ঘজীবনের সাথে সাথে অনেক অলৌকিক গুনও নাকি ধারন করেন এই লামারা। এইসব জানার জন্যই তিব্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন তিনি।
মুটে লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। ওর নাম রামপ্রসাদ তিওয়ারি। মুখ থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ আসছে এখন।
‘হুজুর,ঘুমাবেন না?’
‘না, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন তিনি।’
‘আমি ঘুমাতে যাই?’
‘যাও, কিন্তু ঘুমাবে না, চোখ বুজে পড়ে থাকবে শুধু, নাক-কান খোলা রেখো, অনেক বিপদের মধ্যে আছি আমরা।’
‘কি রকম বিপদ হুজুর?’
‘যা বলছি তা করো।
রামপ্রসাদ চলে গেল, হুজুরের কথা পছন্দ হয়নি। যার এখানে আতিথ্য নিয়েছে তারা সে নিতান্তই ভদ্রলোক, দেখতেই একটু গুন্ডা-পান্ডাদের মতো লাগে। কিন্তু মন একেবারে সাফ। একটা টুপির বিনিময়ে কি আপ্যায়নই না করলো ওদের। মাংস, মদ, শীতের রাতে উ আশয়। কিন্তু হুজুর না বুঝে কিছু বলে না। নিশ্চয়ই কোন কারন আছে। স্যুটকেস দুটো বিছানার কাছে রেখে ঘুমাতে গেল রামপ্রসাদ, ঘুমাতে না বলে শু’তে গেল বলাই যুক্তিযুক্ত হবে।
ঘুমাবে না ঘুমাবে না করেও ঘুমিয়ে পড়েছিল রামপ্রসাদ। অনেক রাতে ঘুম ভাঙল তার। চারদিকে অনেক খুটখাট শব্দ। কিসের শব্দ? তাকাল রামপ্রসাদ। চার-পাঁচজন লোক ঘরটায় এখন। সুটকেস দুটো ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। এতে বলশালী লোক এরা, কিন্তু কিছুতেই যেন কাবু করতে পারছে না জিনিসদু’টোকে।
চোখ পুরোপুরি খোলেনি রামপ্রসাদ। জেগে আছে টের পেলে মেরেও ফেলতে পারে। হুজুর কোথায় এখন? ওরা কি তাকে মেরে ফেলেছে? রাম রাম করছিল সে। এর মধ্যেই ঘরের দরজায় ছায়া দেখা গেল একজনের। ঘরের সবাই ফিরে তাকাল। সুটকেস দুটোর মালিক এসে দাঁড়িয়েছে।
ষন্ডাগুলো থেকে দুজন তেড়ে গেল, হাতে হাতুড়ির মতো এক ধরনের জিনিস, পাহাড়ে ওঠার কাজে ব্যবহার করে ওরা, প্রয়োজনে অস্ত্র হিসেবেও কাজ করে। একটা ভেল্কির মতো হুজুরের হাতে একটা তলোয়ার চলে আসতে দেখলো রামপ্রসাদ এবং মুহূর্তেই দুজনকে কচুকাটা করে ফেললেন তিনি। বাকি তিনজন উঠে দাঁড়িয়েছে এবার সুটকেস ছেড়ে। গৃহকর্তাও আছে এদের মধ্যে। তিনজন একসাথে আক্রমন করেছে লোকটাকে। একজন প্রশিক্ষিত, বীর যোদ্ধার মতো তিনজনকে একসাথে সামলাচ্ছেন। তিনি। রামপ্রসাদ এবার উঠে বসেছে। তার হুজুরের মতো বয়স্ক মানুষ যদি মারামারি করতে পারে, তাহলে এভাবে শুয়ে থাকা তার শোভা পায় না।
কিন্তু কিছুই করতে হলো না তাকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনজনকে চরম শিক্ষা দিয়ে দিলো তার হুজুর।
রামপ্রসাদ, ভারি স্বরে ডাক শুনতে পেল রামপ্রসাদ।
‘জি, হুজুর।’
‘সুটকেসগুলো নিয়ে তৈরি হও, এখনি রওনা দেবো আমরা।’
‘এক্ষুনি?’
‘হ্যাঁ, ভোর হতেও খুব বেশি বাকি নেই।’
অনিচ্ছাস্বত্তেও সুটকেসগুলো তুলে নিলো রামপ্রসাদ।
সামনে অনেকটা পথ পড়ে রয়েছে, এই পথও নিরাপদ নয়। আরো কতো কী বিপদ মোকাবেলা করতে হবে কে জানে? নিজেকে রক্ষার অনেক কৌশলও জানা আছে তার। এধরনের লোককে শায়েস্তা করা খুবই সহজ ব্যাপার। ভোরের আলো ফোঁটার অনেক দেরি এখনো। কিন্তু এখানে থাকা নিরাপদ হবে না আর। পড়ে থাকা লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। মৃত্যুদাতার নামও জেনে গেল না বেচারারা। জানলেই বা কি? সে নাম কি কাউকে বলার সুযোগ দিতেন তিনি?
কাউন্ট দ্য সেইন্ট জারমেইন। এই নামের সমাপ্তি সেই ইউরোপেই টেনে এসেছেন তিনি, এই পাহাড়ের কোলে এই নাম কেউ নাই বা জানলো।
***
কততক্ষন পড়ে ছিল জানে না রাশেদ। চোখ খুলতেই নিজেকে একটা বিছানায় শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করল। প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়তে গেল, কিন্তু ব্যথায় নিজে নিজেই শুয়ে পড়ল আবার। মাটির একটা ঘর, আসবাবপত্র কিছু নেই। মানুষও নেই ঘরটায়। বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে খোলা দরজা দিয়ে লক্ষ্য করলো।
বাংলো বাড়িটার চারপাশটাই ঘন বন বলে শুনেছে। মানুষজন কেউ থাকেনা এখানে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ধারনা ভুল।
ধারনাটা সত্যি ভুল প্রমান করতে ঘরে ঢুকলো একজন লোক, প্রৌঢ় না বলে বৃদ্ধই বলা যায়। উঠে বসতে গেল রাশেদ। হাত ইশারায় নিষেধ করল লোকটা।
‘বাবাজী, বেশি নড়াচড়া কইরেন না, হাড্ডি ভাঙ্গে নাই, মচকাইছে,’ বিছানার পাশে এসে বসলো লোকটা।
উত্তর দিলো না রাশেদ। হাত মাথায় চলে গেছে নিজের অজান্তেই, একটা কাপড় দিয়ে পেঁচানো, বুঝতে পারল। মাথা হয়তো ফেটে গেছে ঐ পাঁচিল থেকে পরে গিয়ে।
‘কততক্ষন ধরে অজ্ঞান আমি?’ জিজ্ঞেস করল রাশেদ।
‘গতকাল বিকালে আপনেরে পাইছি আমি, এখন রাইত, তারমানে একদিনের বেশি,’ বলল লোকটা।
‘কি বলছেন, মাথা খারাপ নাকি?’
‘মাথা খারাপ হবে কেন বাবাজী, বনে একা একা থাকি, কিন্তু মাথা ঠিক আছে এখনো,’ এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিতে দিতে বলল লোকটা।
পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল রাশেদ। খাওয়া ঠিক হবে কি না ভাবছে। ক্ষতি যদি করতেই হতো তাহলে ঘুমন্ত অবস্থায় করতে পারতো। তা যখন। করেনি এখন নিশ্চয়ই করবে না।
‘আমার জিনিসপত্র কোথায়?’
‘সব আছে, খাটের তলে রাখছি।’
‘এক্ষুনি দিন আমাকে।’
‘বাবাজী, আমি বুড়া মানুষ, ধন-দৌলত, টাকা-পয়সার লোভ আমার নাই, আপনে সুস্থ হন, তারপর নিয়েন, অসুবিধা কি?’
বুড়োর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু এভাবে অসহায় অবস্থায় এখানে পড়ে থেকে কোন লাভ নেই। কোথায় কি হচ্ছে কিছুই জানে না সে। শামীমের খুনি ধরা পড়েছে কি
কে জানে? লিলির সাথে কথা বলা দরকার। মোবাইলটা ঐ ব্যাগে আছে।
‘ব্যাগটা দিন আমাকে।’
অনিচ্ছাস্বত্তেও খাটের নিচ থেকে ব্যাগ বের করে দিলো লোকটা। অনেকগুলো টাকা আছে ব্যাগে, মোবাইল আছে, সেই বইটাও আছে। ব্যাগটা খুলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাশেদ। সবগুলো জিনিসই আছে, অক্ষত অবস্থায়। এবার লোকটার দিকে তাকাল। সত্যিই একজন ভালো লোকের হাতে পড়েছে, অন্য যে কেউ হলে এতোক্ষনে কোন কিছুই পাওয়া যেতো না, এমনকি রাশেদকে বাঁচিয়ে রাখা হতো কি না সন্দেহ।
এখনো চার্জ আছে মোবাইলে। লিলির নাম্বার ডায়াল করলো রাশেদ। মোবাইল বন্ধ। আরো দু’তিনবার চেষ্টা করল। বারবার বন্ধ পাওয়া গেল।
চিন্তায় পড়ে গেল রাশেদ। লিলিদের বাংলোবাড়িতে গতকাল দু’দুটি লাশ পাওয়া গেছে। বেচারী নিশ্চয়ই ঝামেলায় আছে। কেউ যদি জেনে থাকে, লিলি রাশেদকে পাঠিয়েছিল বাংলোবাড়িটায় থাকার জন্য, তাহলেই সমস্যা। লিলিকেও ছাড়বে না পুলিশ। তবে আশার কথা লিলির বাবার যোগাযোগ অনেক উপরমহলে। তিনি হয়তো ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতা পারবেন।
বাবার সাথে কথা বলা দরকার। তিনি হয়তো চো করেও রাশেদের সাথে কথা বলতে পারেননি,কে জানে?
‘হ্যালো।‘
‘বাবা, তুমি কোথায়?’ ওপাশ থেকে আজিজ বেপারির উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা গেল। এমন কণ্ঠে কথা তিনি কখনোই বলেননি।
‘আমি আছি, ঠিক আছি,’ রাশেদ বলল।
‘আমি তোমারে মোবাইলে পাই না, এলাকার একটা ছেলেরে খবর দিলাম, সে তোমার হলে গিয়ে দেখে তোমার রুম তালা মারা, এদিকে তোমার মোবাইলও বন্ধ, আমি তো চিন্তায় বাঁচি না।
‘ঠিক আছে বাবা, ঢাকার বাইরে এসেছি, একটা কাজে, তোমাকে পরে বলবো।‘
‘পরে কি বলবা জানি না, আসল কথা শোন, তোমারে পুলিশ খুঁজে ক্যান বাবা? আমাদের বংশে কেউ কোনদিন থানায় যায় নায়, এলাকায় আমার একটা ইজ্জত আছে, সামনে ইলেকশনে দাঁড়ামু, তুমি কিছু করছে, না এইগুলা আমার বিরোধী পক্ষের ষড়যন্ত্র, বুঝতে পারছি না।’
‘আমি একটু ঝামেলায় আছি, যাই হোক, এখন রাখি, পরে ফোন করবো,’ বলল রাশেদ, কেটে দিল ফোনটা।
পুলিশ গিয়েছে গ্রামে। ঘটনা তো অনেকদূর গড়িয়েছে। কয়েকদিন পত্রিকা পড়া হয়নি, লিলির সাথে কথা বলা হয়নি,কাজেই বাইরে কি ঘটছে সে সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই রাশেদের। মোবাইল ফোনটা নিয়ে সমস্যা। এটা সাথে রাখা যাবে না। ট্র্যাক করে ফেলবে পুলিশ। হয়তো এর মধ্যে ওর অবস্থান বেরও করে ফেলেছে, কে জানে? ঝুঁকি নেয়া যাবে না। একবার পুলিশের হাতে পড়লে নিজেকে নিরপরাধ প্রমান করা কঠিন হয়ে যাবে। এই এলাকা ছাড়তে হবে এক্ষুনি।
‘চাচা মিয়া, আমি যাই,’ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল রাশেদ। যদিও পিঠে টান লাগছে, কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই হবে তাকে এখন।
‘এতো রাইতে? মাথা ফাডা, পেটে কিছু পড়ে নাই, আপনের কি মাথা খারাপ হইল নি?’ বুড়ো বলল, চিন্তিত স্বরে।
‘অনেক উপকার করেছেন আপনি, আমি থাকলে ঝামেলায় পড়তে পারেন,’ ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে পিঠে ঝোলাল রাশেদ।
‘যাইতে চাইলে তো আটকাইতে পারবো না, তয় এখান থ্যাইকা বের হওয়া সমস্যা, আমিও যাই আপনের সাথে,’ বুড়ো বলল।
‘আপনি থাকেন, আমি যেতে পারবো।’
‘পাগল নাকি, আমি নিজেই পথ হারাইয়া ফেলাই মাঝে মাঝে,’ বুড়ো বলল।
আর মানা করলো না রাশেদ। পথ দেখিয়ে দিতে চাচ্ছে যখন অসুবিধা কি। এতে তারই সময় বাঁচবে।
মাটির কুঁড়েঘরটা থেকে বের হয়ে এলো দু’জন। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। আজ পূর্ণিমা। কিন্তু এখন এই জোছনা উপভোগ করার সময় নেই রাশেদের হাতে। তাকে ছুটতে হবে অনেক জোরে, পেছনে আছে পুলিশ, আছে শামীমের ঘাতকেরা।