ফেলে আসা দিন
আজ তার মনে পড়ছে সেই সব কথা। আজ উনিশশো সাতচল্লিশ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি। আজ এই দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত রাত্রে দ্রুত বেগে ধাবিত ঢাকা মেল ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায়। অকল্পিত, অভাবিত এই ভাবনা যে মেঘনাদকে এই পরিবেশে কোনওদিন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে, তা সে ভাবতে পারেনি। আজও যে সে ভাবছে, তাও একবার অতীতের অন্ধকারের মধ্যে নিজের জীবনের ঝড়তিপড়তি ও সঞ্চয়ের থলি হাতড়ে দেখবে বলে ভাবছে না। কেন না, সে ভাবতে বসেনি। অমন করে কোনওদিন ভাবতে শেখেনি সে। না শিখলে, ভাবব বলে ভাবা যায় না। ভাবনা একসময়ে আসে আচম্বিতে, কোনও সংবাদ না দিয়ে। এসে তার কাজ শেষ করে সে চলে যায়।
মেঘনাদের কাছেও ভাবনা এসেছে তেমনি করে। এসেছে, অন্ধকারের বুকে আচমকা প্রাণহারিণী কালসাপিনীর মতো। মুহূর্ত অবসর না দিয়ে বিষবতী ভাবনা ফণা বিস্তার করে দংশন করেছে। সেই হলাহলে আজ আকণ্ঠ পূর্ণ। ব্যথার তীব্র যন্ত্রণা এখন অস্তমিত সূর্যের ম্লান লাল আভার মতো ছড়িয়ে পড়েছে তার হৃদয়-আকাশ ভরে। এখন দংশনের সেই বিষজ্বালা নেই, দহনের তীব্রতা নেই, নেই অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকার ও দিগভ্রান্তের মতো দাপাদাপি করা। এখন সারা অঙ্গ বিষে জরজর। নেশাচ্ছন্নের মতো ঢল ঢল প্রাণ। বেদনা স্তিমিত ও ম্লান। কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর মতো অন্ধকার গ্রাস করবে, ছেয়ে ফেলবে তার হৃদয়। ভাবনা আজ এই রূপ ধরেই এসেছে তার কাছে।
না, এ তো ভাবনা নয়, স্মৃতি। অতীতের ভাবনার নাম স্মৃতি। ভবিষ্যতের চিন্তা হল ভাবনা। কিন্তু মেঘনাদের কাছে ভবিষ্যৎ হল মৃত্যুর মতো গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। নিজের থেকে সেদিনের কথা ভাবা দূরের কথা, এই গাড়ি যখন তাকে তার আপাত গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে, তখনও দাঁড়িয়ে থাকবে সে মুঢ়ের মতো।
তার মনের আয়নায় যে ছবি দেখেছে সে, এর নাম যে স্মৃতি, এই সামান্য বোধটুকুও মেঘনাদের সম্ভবত নেই। সে জানে না, হতাশ মানুষের সম্বল তার অতীতের স্মৃতি। অসহায় মানুষ যখন ছুটে এসে সামনের দরজা বন্ধ দেখতে পায়, তখন সে ছোটে পেছনের দিকে। ছোটে ঊর্ধ্বশ্বাসে, যদি কোনও পথ পাওয়া যায়। ভেবে ছোটে না, তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা যখন একেবারেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, তখন অতীতের পথ অতিক্রমণের সুখ ও দুঃখ, দুই-ই বড় সুখের হয়। সুখের না হোক, রোমন্থনের আরাম এনে দেয়।
কিন্তু এই যে স্মৃতির উদঘাটন, সেই বিচিত্রের ছায়াও মেঘনাদের সারা মুখে খুঁজে পাওয়া যায়। তার বলিষ্ঠ মুখ একটা জং-ধরা তামার ডেলার মতো দেখাচ্ছে। সেখানে হৃদয়ের আলোছায়ার কোনও রেখাপাতও নেই।
শুক্লপক্ষের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। পুঞ্জীভূত মেঘ-ছড়ানো আকাশে গাঢ় কালিমা নেই। মেঘের আড়ালে লুকানো চাঁদের আলোয়, সাদা ঘন কুয়াশার মতো সারা আকাশটা প্রাণহীন বিষণ্ণতায় ভরে রয়েছে। দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে নেই অন্ধকার। প্রদোষের অস্পষ্ট আলোর মতো সব ঝাপসা। বনপালা মাঠ ও গ্রামের ছবি চোখের সামনে ফুটি ফুটি করেও ফুটছে না। এরই মধ্যে কোথাও। ঝাপসা পটের উপরে মাঝে মাঝে গাঢ় কালি লেপে দেওয়ার মতো খোঁচা খোঁচা অন্ধকার রয়েছে। ঘাপটি মেরে। গোমড়া মুখে হাসির ঝিলিক ফুটেও না ফোঁটার মতো চাঁদ দেখা দেবে দেরে করে দেখা দিচ্ছে না। এখনই বৃষ্টি আসার কোনও আশঙ্কা নেই। কিন্তু গাড়ির বিপরীত মুখে দুরন্ত জলো। হাওয়া ঝাপটা মেরে চলেছে। অসহ্য গুমোট আর ভ্যাপসানিতে জলো হাওয়া একটুও আরাম দিচ্ছে। না। একটা বিশ্রী রকম পচানিতে সারা গায়ের মধ্যে যেন রি রি করে উঠছে। জলো হাওয়ার সঙ্গে থেকে থেকে ইঞ্জিনের কাঁচা কয়লার ধোঁয়ারাশি দিচ্ছে দম আটকে। ধুলোর মতো নাকমুখ ভরে যাচ্ছে কয়লার গুঁড়োয়।
রকমারি কণ্ঠের কলরবের মতো, এক এক রকম শব্দ করে মেল ট্রেনটা ছুটে চলেছে। গুমোট রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দেওয়ার অন্তহীন প্রয়াসে মেতে উঠেছে গাড়িটা।
চোখ বুজে আছে মেঘনাদ। শিথিল শরীরটা দুলছে তার। শুতে ইচ্ছা নেই, শক্ত হয়ে বসবার শক্তি নেই। মন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে গেছে অন্যত্র। তার নিজের কাছ থেকে সে চলে গেছে দূরে।
দেখে মনে হয় মেঘনাদ সুপুরুষ। অন্তত এককালে ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মেদহীন বিশাল শক্ত ও বলিষ্ঠ শরীর। গায়ের রংটা একসময়ে বেশ ফরসাই ছিল মনে হয়। ফরসা রং এখন তামাটে হয়ে উঠেছে। বয়স বছর চল্লিশ। কিন্তু দেখায় আরও বছর দশেক বেশি। কারণ, তার ঘন শক্ত ও ছোট ছোট কোঁকড়ানো চুলগুলি অধিকাংশ পোড়া সোনার রং ও ধূসরতায় ছেয়ে গেছে। তার চুল কোনওদিনই ঘন কালো ছিল না। কালোর মধ্যে ছিল কিছুটা বাদামির আভাস। স্বভাবতই তার চুল দেখলে বয়স্ক বলে মনে হয়। তা ছাড়া যে বস্তুটি তাকে তার বয়সের চেয়েও ভারী ও গম্ভীর করে তুলেছে সেটি তার গোঁফ। শার্দুলের মতো তার চওড়া গালের দুপাশে ঘন বিস্তৃত গোঁফ জোড়া যে শুধু তার গাম্ভীর্য এনে দিয়েছে তা নয় একটা চাপা নিষ্ঠুরতাও যেন লুকিয়ে রয়েছে গোঁফের মধ্যে। গোঁফের আকার ও ভঙ্গি ছেড়ে দিলেও তার মুখের দিকে তাকালেই মনে হয়, মানুষটা নিশ্চয়ই নিষ্ঠুর প্রকৃতির। এত বড় ভরাট মুখে, চোখ দুটি তার রীতিমত বড় আর বেশ টানা টানা। তবে মেঘনাদের মোটা ও কুঞ্চিত জ্বর তলায়, টানা টানা বড় চোখ বলতে যে মাধুর্যের কথা আমাদের মনে আসে, এ চোখ জোড়াতে সে চিহ্নও নেই। মাঝে মাঝে যখনই সে ক্লান্ত মোষের মতো চোখ মেলছিল, তখনই লালের আভাস ঝিলিক দিয়ে উঠছিল। মাধুর্য নেই, কিন্তু সারা মুখটাতে বুদ্ধির দীপ্তিও চোখে পড়ে না। একটা ভোঁতা অভিব্যক্তিতে তার সারা মুখটা আচ্ছন্ন, কিছুটা বা বোকাটে। ফলে এই মুখে যে চরিত্রের ছাপ ফুটে উঠেছে, তা যেন বর্বর নিষ্ঠুরতার সামিল। একটু খোঁচা খেলেই তার হৃদয়ের ভয়ঙ্কর তীক্ষ্ণ গর্জনে ফুটে বেরুবে যেন।
এই হল মেঘনাদ। মেঘনাদ দাশ। এখন তার মুখের ভাব হয়ে উঠেছে একটা বন্দি অসহায় ও যন্ত্রণাকাতর সিংহের মতো। গর্জন নেই, দাপাদাপি নেই, পড়ে আছে সে শরীর এলিয়ে দিয়ে, অজানিত পরিণতির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে। মেল ট্রেনের এ খাঁচা তাকে কোথায় নিয়ে চলেছে, কতদূর এল, এ সব জানবার তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ বা কৌতূহল নেই।
বেঞ্চির নীচে লুটিয়ে পড়েছে তার ধুতি। মোটা অথচ আধ ইঞ্চি চওড়া পাড়ের ঢাকাই তাঁতের ধুতি। বাগেরহাটের ময়ূরকণ্ঠী কাপড়ের একটা পাঞ্জাবি রয়েছে তার গায়ে। রাত্রিচর মুশকিল-আসানীদের মতো পাঞ্জাবিটা একটা আলখাল্লা বিশেষ। কিন্তু হাতাগুলি গেছে খাটো হয়ে। ময়ূরকণ্ঠী রঙের মতো মালুম হচ্ছে না, এত ময়লা হয়েছে জামাটা। মোষের সিংয়ের কালো কালো বোতামগুলি খোলা, বুকটা হা হা করছে। বুক পকেটটা ফুলে, ঝুলে পড়েছে জিনিসের ভারে।
আর এক জন, একটি মেয়ে তার হাঁটুর উপরে কনুই রেখে, ঘুমের ঢুলুনিতে একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে পড়ছে ঢুলে। নয়তো ঠকাম করে গাড়ির গায়ে ঠুকে যাচ্ছে মাথাটা। তারপর হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠে তাকাচ্ছে মেঘনাদের দিকে। সেখানে কোনও ভাবান্তর না দেখে যেন সঙ্কল্প করে নিচ্ছে আর কিছুতেই ঢুলবে না। এমনি ভাবখানা করে হাত পা কাপড় গুছিয়ে বসার পরমুহূর্তেই আবার ঢলে পড়ছে।
মেঘনাদের স্ত্রী। নাম তার লীলাবতী। কিন্তু সেটা পোশাকি নাম। আসল নাম ঝুমি। ওই নামেই তার পরিচয়, তার নিজের গণ্ডি ও আসরে। ওই নামেই ডাকাডাকি করা হয় তাকে। ঝুমঝুমি থেকে ঝুমি। বিয়ের সময় তার ভাইয়েরা একটা পদ্য উপহার ছাপিয়েছিল। কেবল সেইখানেই তার পোশাকি নামটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু লীলাবতীর স্থলে সেটা নীলাবতী হয়েছিল। কেন না, লীলা উচ্চারণটা খুব সহজ হলেও, সহজ ছিল না তার ভাইদের পক্ষে। তারা আজীবন নীলা-ই বলেছে, নৌকাকে বলেছে লৌকা। ধলেশ্বরী তীরের সুদূর চর থেকে ঢাকা শহরে এসে তারা সেই। পদ্য ছাপিয়েছিল। প্রেসের লোকও লীলাবতাঁকে নীলাবতী করায় কোনও আপত্তি খুঁজে পায়নি। কারণ বাজারে নীলা নামেরও যথেষ্ট ছড়াছড়ি আছে।
যাই হোক। ঝুমি অর্থাৎ লীলা কালো। ঘাম তেল মাখা প্রতিমার মতো ঝকঝকে কালো। জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রির মাঠে হিলহিল করে চলা কালনাগিনীর মতো কালো চকচকে। যে কালোতে হয় আলোর ফুরণ। সে লম্বা নয়, কিন্তু ছোট নয়। একহারা শক্ত শ্যাম কঞ্চি বাঁশের মতো তা নরম ও কচি বলে মনে হয়। অথচ বয়স প্রায় ত্রিশ স্পর্শ করতে চলেছে। কিন্তু কোথাও তার দাগ নেই। যেন এখনও বাড়বার মুখে কিশোরী ডগার মতো তার সর্বাঙ্গে শিহরিত যৌবন ফুটে উঠেছে রেখায় রেখায়। একটি সন্তান হয়েছিল তার। মাস কয়েকের হয়ে মারা গেছে। কালো মুখে তার সবই প্রায় নিখুঁত। বঙ্কিম তার ভূলতা। চোখ খুব বড় নয়, কিন্তু তার চরিত্রের প্রতিবিম্ব ওই খয়রা। চোখ যেন বিচিত্ররূপে সুন্দর হয়ে উঠেছে। সরু নাকে নাকচাবি। কপালে তার অজান্তে বেঁকে-যাওয়া সিন্দুরের রেখা। আর সিন্দুরের মতোই তার পান-খাওয়া পাতলা ঠোঁট দুটি লাল টুকটুকে। অন্ধকারে আগুনের মতো–যাকে বলে টিকেয় আগুন দেওয়ার মতো।
তার ঘোমটা খসে গেছে, ভেঙে পড়েছে খোঁপা। শখ করে পাতা কেটে আঁচড়ানো চুল ভাঙা ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছে কপাল ভরে। সাধ করে সেজে পরা ঢাকাই ছাপা শাড়ির আঁচল এলিয়ে পড়েছে বেঞ্চির উপরে। বুকে অন্তর্বাস পরার রীতি তাদের কোনওকালে ছিল না। না বাপের ঘরে, না স্বামীর ঘরে। এমনকী তাদের দেশের সমাজে ও প্রথায় এখনও একেবারেই অচল : বাঙালি হিন্দুর সেই পুরনো উদাসীনতা কোথাও অস্বাভাবিক করে তোলেনি লীলাকে। অসহ্য গুমোট ও গরমে খোলা তার জামার বুক। সুগঠিত স্তনের একাংশ প্রায় উন্মুক্ত। তেঁতুলে বিছের মতো একটি চওড়া সোনার হার ঢেউ দিয়ে এলিয়ে পড়েছে তার বুকে।
মেঘনাদের স্ত্রী লীলা। স্ত্রীকে বলে অর্ধাঙ্গিনী। কিন্তু মেঘনাদের মতো চিন্তা, সংশয়, দুর্ভাবনা লীলার আছে বলে মনে হয় না। তার সারা শিথিল অঙ্গ জুড়ে ব্যাপ্ত ঘুমের জড়িমা। মুখে তার কোথাও চিন্তার লেশ নেই। ক্লান্তি ও তার আবেশ মাখানো মুখ। অর্ধচেতন রক্তিম ঠোঁটের কোণে বরং সূক্ষ্ম একটি হাসির আভাস ফুরিত হচ্ছে। অর্ধচেতন, কিংবা হয়তো একেবারে নিজেরই অজান্তে।
বাইরের আকাশ ও মাঠের মতো অস্পষ্ট ও ঝাপসা মেঘনাদের ভবিষ্যৎ। তেমনি লীলারও। তবু এক জন বিষ জরজর। আর এক জন চিন্তাহীন নিদ্রাবেশে ঢুলুঢুলু। একজন গৌর-তামাটে বিশাল পুরুষ নিদ্রাহীন চিন্তিত। আর একজন আলোকময়ী কালো রূপবতী সোহাগিনীর মতো ঘুমো চোখে। লেপটে রয়েছে তারই গায়ে।
লীলা মেঘনাদের গায়ে ঢলে পড়ছে, তাতে বিরক্ত হচ্ছে মেঘনাদ। তার বিষআচ্ছন্ন দেহে সে এ স্পর্শ সহ্য করতে পারছে না। সে হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে লীলাকে। লীলা ঘুমো চোখে। অপ্রস্তুত ও অবাক হচ্ছে। ওই চকিত মুহূর্তেই অভিমানে বঙ্কিম হয়ে উঠছে ঠোঁট, চোখও পাকাচ্ছে। কিন্তু আবার পড়ছে ঢলে।
কামরাটাতে যাত্রী অল্প। মেল ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীতে যে রকম ঠেলাঠেলি হওয়া উচিত, সে রকম নয়। সমস্ত বগিগুলিরই এক অবস্থা। কামরার সকলেই প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন। এর মধ্যেই কেউ কেউ গাঢ় নিদ্রায় ডুবে গেছে। এমনকী নাক ডাকার শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। কেউ কাশছে খকখক করে। ঘুমো চোখেই হুস হুস করে টানছে বিড়ি নিতান্ত নেশাখোর যাত্রী। কেউ বসে ঘুমুচ্ছে, কেউ ঢুলছে শুয়ে শুয়েই।
মেঘনাদ ছাড়া শুধু একজন ঘুমোয়নি। একটি ছেলে। একটি অজ্ঞাতকুলশীল, পথের ছেলে। বিনা পয়সার যাত্রী। তার কোনও দুশ্চিন্তা আছে কিনা সে-ই জানে। খালি গায়ে বসে আছে সে। সারা গায়ে মশার কামড়ের দাগ। ধুলো-মাখা একমাথা চুল। কালো কালো লিকলিকে হাত-পা। পিলে উচনো নিটোল পেট। ড্যাবা-ড্যাবা দুটি হলদে চোখ।
প্রথম রাত্রিতে সে অনেকক্ষণ বকবক করেছে লীলার সঙ্গে। কেমন করে যে লীলার সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছিল, সে-ই জানে। আর লীলার একটুও বাধেনি এই পথের ছেলেটার সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে গল্প করতে। বরং এই ছেলেটার জগতের বিচিত্র সব কাহিনী তাকে চমৎকৃত করেছিল। সেও বকবক করেছে, খিলখিল করে হেসেছে ছেলেটার সঙ্গে। মেঘনাদ তাকিয়েও দেখেনি। অন্যান্য যাত্রীরা তাদের, একজন যাত্রিণী ও ভবঘুরে ছেলেটার হাসি ও কথা হাঁ করে শুনেছে। দেখে হয়তো কেউ অবাক হয়েছে। দেখেছে কেউ বারবার। লীলাকে না দেখাটাই বিস্ময়ের।
ছেলেটা বলেছে তার নাম, তার ধাম। তার যে আবার ধামও থাকতে পারে, সেটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের। লীলা আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করছিল তাদের গ্রামের কথা। বাপমায়ের কথা।
জীবনভর সে কত কাজ করেছে, জীবনের সে কাহিনীও লীলার মতো একজন শ্রোত্রীকে সে না শুনিয়ে পারেনি। লীলা গল্প শোনার মতো সবটা উপভোগ করেছে। মেঘনাদ একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়েছিল। যখন ছেলেটা বলছিল, গুনোহাটি বন্দরের বদরুদ্দিন মিঞার বিস্কুটের কারখানায় সে কাজ করেছে তিন মাসের জন্য। মাত্র একবারই তখন তাকিয়েছিল। আর একবার তাকিয়েছিল, যখন তার দিকে লীলা আর তাকাবার অবসর পায়নি।
কথা বলার ফাঁকে এক সময়ে ঢুলুনি এসেছে লীলার। যত সহজে সে গল্প শুনেছে ও কথা বলেছে, ততখানি সহজেই ঢলে পড়েছে সে। কেবল ছেলেটা লীলাবতীর এ লীলা একেবারেই বুঝতে পারেনি। যে এতক্ষণ ধরে তার কথা শুনছিল, সে যে এমন হঠাৎ ঢুলতে আরম্ভ করবে, তা ভাবতেই পারেনি। প্রথমটা আশাহত হয়ে চুপ করেই গিয়েছিল। পরমুহূর্তেই সবাইকে চমকে দিয়ে গান ধরে দিয়েছিল সে,
মান কইরা,
মুখ ফিরাইয়া
যাইও না গো সই।
মাথার কিরা দিয়া কই।
গানের সঙ্গে ভয়াবহ রকমে সে তার পিলেটার উপর সজোরে তাল ঠুকছিল। সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়েছিল তার দিকে। এমনকী, নিতান্ত রসিক দু একজন বাহবাও দিয়েছিল। মেঘনাদ তাকিয়েছিল তখন একবার। যেমন ঘুমন্ত সিংহ ইঁদুরের কিচিরমিচির শুনে একবার বিরক্তি ও অবহেলা ভরে তাকায়।
কিন্তু যাকে জাগাবার এত প্রয়াস, সে মাথার কিরা মানেনি। এরপরে আর তার গানও জমেনি। কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখেছে মেঘনাদকে। দেখেছে অনেকবার লীলাকে। বার কয়েক গেছে ল্যাটরিনে। তারপরে কখন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে।
কখনও আলো দেখছে, তাকাচ্ছে এদিক ওদিক আর বকবক করে চলেছে আপন মনে। কী বলছে সেই জানে। কিন্তু ঘুম তার চোখে নেই।
বাইরে কখনও অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে উঠছে। আবার ভরে উঠছে অস্পষ্ট আলোয়। সম্ভবত একটা খাল কিংবা নদীর উপর দিয়ে চলেছে গাড়িটা। গমগম শব্দ ছিটকে এসে ঢুকছে কামরার মধ্যে। আবার একটু পরেই অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি তুলে সে শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি যাওয়ার সংবাদ নিয়ে চলেছে দূরের অজানা ঘুমন্ত প্রান্তরে ও গ্রামে।
.
মেঘনাদ ডুবে গেছে তার মনের মধ্যে। মনের মধ্যের সেই তলায়, যেখানে চাপা পড়েছিল কালের স্তরের মধ্যে অতীতের ইতিহাস।
সেইখানে একটি ছেলে ভাসছে তার চোখের সামনে। এক ফালি থান কাপড় তার পরনে। গায়ে, কিছু নেই। শুধু থানেরই একটা চিলতের সঙ্গে লোহার চাবি বেঁধে পরানো রয়েছে তার গলায়। ছোট ছেলে বারো-তেরোর বেশি নয়। মাথায় তেলহীন রুক্ষ চুল, ফরসা মুখ, ডাগর চোখ। চোখের কোল বসে কালো দেখাচ্ছে চোখের চার পাশে।
ছেলেটি গ্রামের একটেরে বেতকাঁটা বনের ছায়ায় গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছে। মা তার অনেক দিন নেই। বাপ মারা গেছে কয়েক দিন। তাই পিতৃদশার করুণ বেশ তার দেহে। এখন আর তার কেউ নেই। ভাই নেই, একটি দিদি আছে তার শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু দিদির কাছে সে যেতে পারবে না। তার ভগ্নীপতি একদিকে যেমন অভাবগ্রস্ত, তেমনি চরিত্রহীন। দিদি সেখানে বউ নয়, ক্রীতদাসী। তার চোখের জলে মেশানো নোনা ভাতে ভাগ বসাতে গেলেও সে বাড়ির লোকেরা তাকে দূর দূর করে তেড়ে আসবে। তার বোনাই, কনুই বলে যাকে ডাকে সে, সে আসবে তেড়ে মারতে। বাপ বেঁচে থাকতেই বোনের বাড়ির এ পরিচয় মিলেছে তার। তা ছাড়া দিদির মুখের গরাস মুখে নিতে পারবে না সে। আর সে যে অনেক দূর। ঢাকা থেকে ফরিদপুর। অনেকের কাছে এ দূরত্ব কিছুই নয়, কিন্তু তার কাছে অনেকখানি সীমাহীন ও দুস্তর।
বর্ষান্তে শরৎ এসেছে। জল নাবির দিকে। তবু এখনও অনেক মাঠঘাট ও গ্রাম ভেসে রয়েছে। ডুবে রয়েছে টাবুটুবু জলে। জল শুকোচ্ছে যেখানে, সেখানে ভয়াবহ কাদা। যে কাদায় ডুবে মানুষের প্রাণ যায়। জলপথ ছাড়া উপায় নেই। নৌকা মা হলে সে পথও আর পথ নয়। শুধু জল-ই। পাটচাষি ছাড়া অধিকাংশ দরিদ্র গ্রামবাসী ঘরবন্দি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। বর্ষার আক্রমণে সমস্ত বাঁশের সাঁকোগুলি গেছে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে। চারদিকে এখনও জলো ঘাস, সাপলা-শেওলা, কলমিদাম ও কচুরিপানায় ভরা। বিষধর সর্পকুলও আশ্রয়হীন, আতঙ্কিত, দিশেহারা। সর্বত্র শুধু লক্ষ লক্ষ রক্তশোষা কালো জোঁকের রাজত্ব। শোল সিঙ্গির অবাধ বিচরণক্ষেত্র।
তবুও সকলেই কি আর ঘরবন্দি। যার ঘরই নেই, তার বন্দি হওয়ার কথা কি। তারা এই জল ও জলে-জঙ্গলের বুকেই ঘুরছে পেটের ধান্দায়। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে কেন, এমন, নিচু গ্রামও আছে, কিছু দিন আগে যেখানে ঘর থেকে ঘরে যেতে ভেলা ভাসাতে হয়েছে।
আকাশে এখনও মেঘের ঘনঘটা। দুর্যোগের লক্ষণ একেবারে যায়নি। তবু এরই মধ্যে মাঝে মাঝে আকাশে রোদের হাসি ফুটছে। মিঠে হাওয়ায় শিউরে উঠেছে বনপালা। শরতের আভাস ফুটে উঠেছে সর্বত্র। এরই মধ্যে কোনদিন ড্যাং ড্যাং করে বেজে উঠবে ঢাক ঢোলক কাঁসি।
বিশ্বাস কি, নবতম পর্যায়ে আসতে পারে বর্ষা। তা ছাড়া চারদিকে বর্ষার ভরা নদী। কোম্পানির জাহাজ স্টিমার ভেঁপু ফুকে যায় বটে। নৌকায় যেতে সেই নদীপথই এখন দুর্গম।
না, না, সে যাবে কোথায়। যাবার তার ঠাঁই নেই কোথাও। যাবার পথ সুগম হলেও, তার যাবার পথ নেই। ফরিদপুর বোনের বাড়ি কোনওদিনই যেতে পারবে না সে।
ভাবতে ভাবতে, মেঘনাদ নিজেই মাথা নাড়তে থাকে, দুপুর রাত্রে এই ঢাকা মেলের কামরায়। বসে। আজ ছাব্বিশ সাতাশ বছর বাদে সেই পিতৃমাতৃহীন ছেলেটার কথা মনে পড়ছে তার। সে। মুখ আপনি ভেসে উঠেছে মনের পটে। যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে উঠছে তার মুখ। বিষ-জর্জর অর্ধচেতন। দেহের চকিত অনুভূতি বেদনার মতো নাড়া দিয়ে উঠেছে বুকের মধ্যে।
সেই ছেলে, সেই মুখ। সে যে জীবনভর তার মনের মাঝে রয়েছে লুকিয়ে। সেই ছোট ছেলেটি অজান্তে ডাগর হয়ে উঠেছে তার এই বিশাল শরীরের মধ্যে। তার অতি অন্তরঙ্গ। অন্তরতম তার সেই ছোট দিশেহারা ছেলে। মদন দাসের ছেলে, একফোঁটা মেঘু, এই মেঘনাদ দাস। মেঘনাদ নিজে।
কিন্তু এতদিন সে একবারও দেখা দেয়নি। নাড়া দেয়নি মনের মাঝে। আজ সে আপনি দেখা দিয়েছে।
সেই ছেলে, কলঙ্কিত সাহা ঘরের ছেলে। কলঙ্কিত-ই তো। ব্যবসা বাণিজ্য নেই সাহার ঘরে, তার চেয়ে ব্যতিক্রম আর কী আছে।
সত্যি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে, কিছু না থাক সাহার ঘরে টাকা থাকে কিছু। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী এই হল অধিকাংশ সাহার নেশা ও পেশা। অন্তত মেঘনাদ তাই দেখেছে তাদের গ্রামে। ধর্মে গোঁড়া বৈষ্ণব, জাতে ও পেশায় খাঁটি ব্যবসাদার।
শীতগ্রীষ্মে এক বস্ত্র ও এক জামায় অমানুষিক পরিশ্রম করেও সাহা ব্যবসা ছাড়ে না। জীবনের সমস্ত সুখ সুবিধার বিনিময়ে কাঞ্চন সংগ্রহ ও সঞ্চয় একরকম মজ্জাগত। গদি তার প্রাণ, তার বসন-ভূষণ। গদি টিকিয়ে রাখার জন্য জীবনের অনেক দিক ছেড়ে দিতে সে রাজি। দেয়, দিয়েছেও।
লক্ষ্মীর এই কাঞ্চন-শ্রী এমনই মনোমোহিনী, এতই তীব্র যে, সরস্বতী বড় একটা পাত পান না। অর্গল বন্ধ নেই বটে, ভক্তের বড় অভাব। শহরে যদিও বা পরিবেশের গুণে সে পথ কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত, কিন্তু গ্রামে তার চিহ্নও নেই। ফলে রুচির অভাব অনেক সময় বড় নক্কারজনক হয়ে ওঠে।
খোঁজ নাও। যে গদিতে বসে আছে, তার খাওয়ার পরিপাটি নেই, পোশাকের চাকচিক্য নেই। খেতে বসতে সাধ নেই তার কাঞ্চন বিরহে। বিরহ তার নিজের সৃষ্ট। দিবানিশি তার এক চিন্তা, এক ভাবনা।
প্রকৃত শিল্পীর আপাত সৃষ্টির আনন্দের পরেই বিষাদ ভর করে তার মনে নতুনতর সুন্দর সৃষ্টির জন্য। সাহা ব্যবসায়ীর অর্থ পিপাসা যেন তেমনি। যা একবার গদিজাত হয়, তার চেয়ে বেশি না এলেই মেজাজ খারাপ।
তুলনার সঙ্গে পরিণতির মিল নেই। ওটা লক্ষ্মী আর সরস্বতীর সম্পর্কগত বিরোধের ফল।
পরনে যার পাঁচ হাত ধুতি আর গায়ে মাত্র ফতুয়া, তারও ঘুনসিতে বাঁধা চাবিকাঠিটি একমাত্র জীয়নকাঠি।
এ সাধনা অধ্যবসায় ও পরিশ্রম একটা মানুষের জীবনের পক্ষে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। অন্যদিকে সে যাই হোক। সিদ্ধিলাভ হল কাঞ্চন সঞ্চয় আর কিছু কৃষ্ণের কৃপা।
এমনি এক চরিত্রের সাহা ঘরের সদ্য বাপ-হারানো ছেলে মেঘনাদ নিজে। কিন্তু একটি পয়সা দূরের কথা, তার এক বেলা খাওয়ার ব্যবস্থাও নেই। সংসার অকূল পাথার, পারাবারহীন।
মেঘনাদ দেখছে সেই মেঘুকে। মদন সা’র ছেলে মেঘাকে। বেতকাঁটার ছায়ায় গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছে ছেলে। এই বয়সে সর্বহারা হয়েছে সে। ভিটেটুকুও বাঁধা আছে লক্ষ্মণ সা’র কাছে। বাপ তার জীবনভোর ঘুরে বেরিয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। কখনও ঢাকা শহরে, ময়মনসিংহ, কুমিল্লায়। কখনও ছুটে গেছে চাঁদপুর, বরিশাল, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম। ভাগ্যান্বেষণে ছুটে গেছে সুদূর আসামের পাহাড়ে জঙ্গলে।
কিন্তু মূলধন ছিল না। তাদের বংশগত ব্যবসা ছিল শীতলপাটি, মাদুর, হোগলা চালান দেওয়া। মস্ত বড় গদি ছিল সিরাজদিঘার বাজারে। কিন্তু ঠাকুরদার আমলেই সে ব্যবসা চলে গেল রসাতলে। সে আর এক ইতিহাস। আজ আর সে ইতিহাসের পাতা উলটে লাভ নেই। মদন সা মূলধন। নিয়েছিল লক্ষ্মণ সা’র কাছ থেকে। কিন্তু জীবনপাত করেও ঢাক-মুখো লক্ষ্মীর মুখে ফোঁটানো গেল না হাসি। মেঘু পড়ে ছিল ঘরে, মদন ঘুরেছে ওই লক্ষ্মণ সা’র মূলধন আর হরিনামের মালাটি সার করে। অবস্থা ফিরলে মুখ তুলে তাকানো যাবে ছেলের দিকে। চাই কি, প্রতিবেশীরা, যারা তাকে মাঝে মাঝে বিয়ের জন্য ধরপাকড় করে সে দিন তাদের কথারও একটা দাম দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে।
কিন্তু হল না। বিপদভঞ্জন মধুসূদন নৃসিংহাবতারের করাল রূপে দিল দেখা। মদন মরেনি, মদনকে হত্যা করেছে সে। মৃত্যুর সময়ে মদন তাই চিৎকার করে ডেকেছে ঠাকুরকে। ঠাকুর। মেরো না, মেরো না আমাকে এমনি করে। তোমার নামের কলঙ্ক কোরো না।
কিন্তু ঠাকুর বড় নিষ্ঠুর। মদনকে ছাড়ল না সে। মরণের পরে তাই তার সাঁড়াশির মতো কঠিন হাতে একটা কালো পুঁয়ে সাপের মতো যেটা ঝুলছিল, সেটা তার গলার ছিন্ন তুলসী মালা। ওটা আর সে গলায় রাখতে পারেনি ! টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল।
না, মেঘু কাঁদবে না। মায়ের মুখ মনে পড়ে না ছেলের। মাথা না থাকলে মাথা ব্যথা হয় না। মাতৃ-স্নেহ বঞ্চিত সে। যা পায়নি, স্বাদ জানা নেই, তার জন্য সে কাঁদেনি কোনওদিন : বাপের জন্যও সে কাঁদল না। কাঁদল না নয়, কান্না এল না। দুশ্চিন্তায় কুঁকড়ে উঠল সে। কচি প্রাণ পাথর হয়ে উঠল ভাবনায়।
বংশের রক্ত তারও দেহে রয়েছে। সে রক্তধারা আগুন জ্বালিয়েছে তার প্রাণে শিশুকাল থেকেই। ব্যবসা করতে হবে তাকেও। গদি করতে হবে, সিন্দুক ভরতি টাকা করতে হবে। শিশুকাল থেকে শুনে আসছে সে একই কথা। ব্যথা মানুষের একটাই জেনেছে সে। ধ্যান ও জ্ঞান করেছে মস্ত বড় গদি আর কাঞ্চন মূল্য। ব্রতকথা ও রূপকথার মধ্যেই ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখেছে সে।
সে ধনপতি সওদাগর হবে। সপ্ত ডিঙা তার বদর বদর করে খাল নালা নদ নদী পেরিয়ে পাড়ি দেবে অকূল সমুদ্রে। পৃথিবী যেখানে শেষ সেখানে সেই রাবণ রাজার লঙ্কাতে গিয়ে ঠেকবে তার সপ্তডিঙা নাও। পৃথিবীর হাটে হাটে বাণিজ্য করবে সে। কত দূর দূরান্তে যাবে। বছর ঘুরে যাবে, তবু সে ফিরবে না। বাপ যাবে নসীরাম গণকারের বাড়ি। দেখুন তো ঠাকুরমশায় গুনে গেঁথে মেঘুর সপ্তডিঙা ফিরছে কি না? নসীরাম একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে ঘর কাটবে, বিড়বিড় করে মন্ত্র আওড়াবে আর আঁক কষবে। তারপরে এক সময়ে বলবে, নাওয়ের মুখ তো দেখছি এদিকেই ফিরেছে। না, ঝড় জলের তো কোনও চিহ্ন দেখি না। শরীর? তা বেশ ভালই দেখছি। হ্যাঁ, শত্রু কিছু কিছু ঘাপটি মেরে আছে দূরে। তবে মেঘুর নায়ে দেখছি স্বয়ং বিপদভঞ্জন বসে আছেন। ভাবনা করো না মদন সা, এবার থেকে মা লাটাই চণ্ডীর ব্রত ধারণ করাও বংশে। বাপ তার খুশি হয়ে নসীরামকে দেবে একটি পয়সা, বে-জোড় কড়ি, আর ধামাখানেক চাল।
তার পরেই মেঘু ফিরে আসবে হিরে জহরত ধন রত্ন নিয়ে। ডিমডিম করে বাজবে কাঁসর, ঝাঁক বেঁধে মেয়ে বউরা দেবে উলু।
লক্ষ্মণ সা’র পেল্লায় গদি ঝাঁট দিতে দিতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মেঘু। পিতৃদশা কেটে গেছে। চাকরের কাজ জুটেছে তার লক্ষ্মণ সা’র গদিতে। ঝাঁট দেয়, জল তোলে, মালপত্র গোছগাছ করে, খাটে ছুটকো ফাঁইফরমাশ । আশা আছে, ভবিষ্যতে ব্যবসার কাজকর্ম শেখাবে তাকে। তেমন গুণের হলে গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবে দেশ দেশান্তরে।
তবুও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সপ্তডিঙা। ঝাঁট দিতে, জল তুলতে, কাজ করতে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে তার বুকে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় সুদূরে। দেখে, ধনপতি সওদাগরের বেশে বসে আছে সে।
স্বপ্ন ভেঙে যায় লক্ষ্মণ সা’র গোমস্তার খেকানিতে।–ওরে ছোঁড়া, কাজ কর, কাজ কর। হা করে ভাববার সময় পাবি অনেক। পেটের কাজ কর।
চমকে ওঠে মেঘু। কাজ করে ছুটে ছুটে। ঠিক, ঠিক বলেছে গোমস্তামশাই। পেটের কাজ কর। হতে পারে ছেলেমানুষ মেঘু। তবু নিজেকে খোঁচা দেয় মনে মনে, কী ছেলেমানুষের মতো ভাবছে সে। গদিতে কাজ, কাজ লক্ষ্মণ সা’র বাড়িতে। তাদের ভিটেয় এখন নতুন ঘর উঠেছে। সাহার কর্মচারীদের বাসস্থান হয়েছে সেই নতুন ঘরে। সে থাকে লক্ষ্মণ সা’র বাড়িতে। দিনে রাত্রে তার কত কাজ। বাড়িতে এক রাশ বউ ঝি। গা ভরতি সোনার অলঙ্কারে ঝলমল। রামধনু রঙের তাঁতের শাড়ির খসখস। চাপা খিলখিল হাসিতে অন্দর মহল জমজমাট। রাত্রেও কত কাজ। এই অন্দর মহলেও কত ফাঁইফরমাশ। পানের বাটা দাও, আলতা চিরুনি পেড়ে দাও, অমুক শোবার। ঘরটা ঝাঁট দিয়ে দাও একটু। থাকলই বা ঝি চাকরানি। বোকা হাবলা এক ফোঁটা ফুটফুটে মেঘুকে দিয়ে কাজ করাতে ভালও লাগে। মদন সা’র ব্যাটা। ছোঁড়াটা বেশ ভাল। আয়রে মেঘু, আয়, একটু মাথাটা টিপে দে, ডলে দে একটু হাত পা পিঠ। চুল এলিয়ে শাড়ি বিছিয়ে সুন্দরীরা মেঝেয় গড়াগড়ি দেয়। স্বামীরা গদিবাসী, সময় নেই আসার। শরীর আপনি ঢলে পড়ে, আইঢাই করে, ব্যথায় খিল ধরে যায়। আর মেঘু খিল ছাড়ায়। অসম্বৃত অর্ধনগ্ন ব্যথা জরজর দেহে আরাম এনে দেয়।
প্রতিদানে কখনও জোটে অসহ্য আদর ও সোহাগ। নরম তুলোর মতো তাকে চটকে চুপসে দেয়। হাঁফ ধরিয়ে দেয়। বারো-তেরোর রক্তে একটা দুর্বোধ্য যন্ত্রণা ও উত্তেজনা অনুভূত হয়। ইচ্ছা করে চিৎকার করে কাঁদতে। আচমকা একটা বিচিত্র কল্পনা পেয়ে বসে তাকে। কল্পনা করতে চেষ্টা করে মায়ের কথা। মা, সে মেঘুর মা। মেঘু তার বুকে পড়ে জাপটাজাপটি ধস্তাধস্তি করছে।
না, কিছুতেই ভাবা যায় না। দেহে শুধু এদেরই স্পর্শের যন্ত্রণার ছুঁচ ফুটতে থাকে। এর উপরেও উপরি পাওয়ানা আছে। একটা পয়সা, একটু আচার, পুরনো একখানা রেশমি রুমাল নয় তো বড় বড় খেলার কড়ি। এমনি অনেক সময়, অনেক কিছু।
কাজ, কত কাজ। ঘরে বাইরে কাজ। দিনে রাতে কাজ। পেটের কাজ। কাজ শেষ হয় অনেক রাত্রে। ছুটি যখন হয়, তখন নিশুতি রাত। খিদেও পায় অসহ্য। কিন্তু ভাত রোচে না। কেন, কে জানে। কচি দাঁত দিয়ে খালি কুটুস্ কুটুস্ করে কাঁচা লঙ্কা চিবোয় আর গরাস তোলে। যখন নাক মুখ কান সব জ্বলতে থাকে তখন খাওয়ার আরাম কিছুটা হয়। ঢোকে ঢেকে জল খেয়ে প্রাণ ঠাণ্ডা হয়।
তারপর শোয়ার আগে চলে যায় লক্ষ্মণ সা’র ঠাকুর ঘরের পেছনে, অন্ধকার মাঠ ও বাগানের ধারে। ঝিঁঝির ডাক আর জোনাকির ঝিকিমিকি। ঠাকুর ঘরের সেবক বোষ্টমের দীর্ঘ নিশ্বাসের সঙ্গে অস্ফুট আর্তনাদ ভেসে আসে, রাধে মাধব !
মেঘু অজান্তে আঁকড়ে ধরে গলার তুলসী মালা। টানে জোরে। ছিঁড়ে ফেলবে যেন এখুনি। বাবার সেই মৃত্যু দৃশ্য মনে পড়ে যায়। সারাদিনের গোলামি, ক্লান্ত দেহ কাঁপতে থাকে থরথর করে। মদন সা’র ব্যাটা গোলাম মেঘু। ধনপতি সওদাগর চাকর খাটে লক্ষ্মণ সা’র গদিতে। লক্ষ্মণ সা’র সপ্তডিঙার পাটাতন ঝাঁট দেয়। ছেঁড়া ন্যাকড়া পরনে। কৃশ দেহ উশকো খুশকো চুল। ভীত অসহায় চোখ। ধনপতি সওদাগর।
কিন্তু অভিশপ্ত সওদাগর হয়নি সর্বস্বহারা? আলগোছে হাত সরিয়ে নিয়ে আসে মেঘু তুলসীমালা থেকে। সব হারিয়ে সওদাগর ফেরেনি পথে পথে? ভিক্ষা মাগেনি দোরে দোরে? সওদাগরের বউ মাথা কুটেছে লক্ষ্মীর কাছে। ধান পান সুপুরি সিঁদুর দিয়ে কেঁদে পুজো করেছে। দোরে দোরে ঘট আর আমের পল্লব দিয়ে লক্ষ্মীর সম্বর্ধনা করেছে। সওদাগরও বউয়ের সঙ্গে কুটেছে মাথা।
আবার একদিন ডুবন্ত সপ্তডিঙা ভেসে উঠেছে সপ্তসিন্ধু পারে। ভিক্ষুক আবার হয়েছে। সওদাগর।
আশা মরে না। রক্তের মধ্যে তার বাণিজ্যের ডাক। ভেতরে ভেতরে তার সেই প্রবল বাসনা-ই মাঝে মাঝে তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে, ধিকৃত করে। সে কারবার করবে। ঘুনসিতে চাবি বেঁধে বসবে গদিতে। হবে মস্ত মহাজন।
অভিজ্ঞ স্থির বুদ্ধির ভাবনা নয়। কিশোরের স্বপ্ন। ভাবনাও কিশোরের মতো। কিন্তু মন ওই দিকেই পড়ে থেকেছে। বংশের রক্তধারা নিয়ত বয়ে চলেছে এক স্রোতে।
এই করে বছর ঘুরল। দু বছর গেল। তারপরে আবার এল ভাগ্যের তাড়না। লক্ষ্মণ সা’র গদিতে হল সামান্য ক্ষতি। এত সামান্য যে, আকাশের কোটি নক্ষত্র থেকে একটি খসে পড়ার মতো সামান্য, দৃষ্টির বাইরে।
কী ব্যবস্থা করা যায় এর। ব্যবস্থা মাত্র একটাই তারা করে। ডাকা হল নসীরাম গণক ঠাকুরকে। ঠাকুর এল। কালো কুচকুচে মুখে সাদা মোটা ভ্রু নাচিয়ে এল গদিতে।
চিন্তিত লক্ষ্মণ সা বলল, গুণে দেখুন ঠাকুর, ক্ষতি হল কেন। এ কীসের লক্ষ্মণ? ঠাকুর কাঁচা উঠানে বসল কাঠি নিয়ে। সাদা ডু নাচে টুক টুক। এদিক ওদিক দেখে কুতকুত করে। সরকার, গোমস্তা, চাকর, কত, ছেলে, সবাইকে। তারপর ঘর কাটে যোলো খুপরি, মন্ত্র আওড়ায় বিড়বিড় করে।
গদির উঠানে বোদ। সাঁ করে নিচু দিয়ে উড়ে গেল একটা চিল। তার চকিত ছায়া পড়ে নসীরামের আঁকা যোলো খুপরি ঘরে। নসীরাম সাদা ভু তুলে লক্ষ বছর বয়সী বুড়োর মতো গালে হাত দিয়ে আবার তাকায় এদিক ওদিক। তারপরে এক নজরে তাকিয়ে থাকে মেঘুর দিকে।
হয়েছে। পাওয়া গেছে ক্ষতির সন্ধান।
রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষারত লক্ষ্মণ সা চোখ বড় করে তাকিয়েছিল। তাকে গিয়ে কানে কানে বলল নসীরাম মদন সা’র অলক্ষ্মী ছায়া ঘুরছে তোমার গদিতে। সেই ছায়া হল মদনার ব্যাটা মেঘু। ওকে বিদায় করো।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। একটু অবাক হল না কেউ। হল আতঙ্কিত। স্বস্তির সঙ্গেই আতঙ্ক। একটুও গোলযোগ মনে হল না। মনে হল, ঠিক আসল জায়গাটি দেখিয়েছে নসীরাম। কেন যে মাথায় আসেনি। সত্যি মদনের পেছনে ঘোরা সর্বনাশী তো ঘুরছে মেঘুর পেছনে।
অতএব বিদায় করো ওই ছোঁড়াকে। দূর করো ওই কালো মেঘকে। যেমন কথা তেমনি কাজ। এক কাপড়ে বিদায় হল মেঘু। খাওয়া পেয়েছে পড়ে পাওয়া যোলো আনা হিসাবে। পাওয়ানা তার কিছুই নেই। মরা বাপের দেনাই এখনও বাড়ছে চক্রাকারে।
মেঘু বোঝা না বোঝার মাঝামাঝি, দাঁড়িয়ে থাকে হাঁ করে। বাজারের ব্যাপার। লালমিঞা হাঁ করে দেখছিল ব্যাপারটা। চাটগেঁয়ে লালমিঞার বিস্কুটের গদি লক্ষ্মণ সা’র গদির পাশে। গদি বলতে ঠিক দোকান বোঝায় না। যেখানে মহাজনের খোদ কারবার চলে খুচরো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে, সেই দপ্তরকে বলে গদি। লালমিঞার আছে মস্ত বড় বিস্কুটের কারখানা। বহু দূর দেশ অবধি বিস্তারিত তার কারবার। বেশ ধনী মুসলমান।
পীর দরগা মানত গনত, এ সবে তার অকুণ্ঠ বিশ্বাস। কিন্তু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে তার খোদাভক্ত হৃদয় গেল গলে। মদন সা’র কথাও জানত সে। খাঁটি মানুষ, অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু খোদা তাকে দেয়নি, সে কী করবে। তা বলে এই ছেলেটার কী গোস্তাকি। খোদা ! মর্জি করো, ফরমান জারি করো, বাচ্চাটাকে লাগিয়ে দিই তোমার লালমিঞার গদিতে, নয় কারখানায়। সে ডাকল, শোন তো সোনা মেঘু।
মেঘু তখন বোঝা না বোঝা থেকে, ঠিক কথাটি বুঝেছে। বুঝেছে এক অভাবিত অপরাধে অপরাধী হয়ে পড়েছে সে। কথা নেই তার মুখে। একটা যন্ত্রণাকাতর বোবা বাচ্চা জানোয়ারের মতো দাঁড়িয়ে রইল সে খানিকক্ষণ। কিন্তু তার কিশোর হৃদয়েও ক্ষোভে দুঃখে অপমানে যে কী ভীষণ ক্ষয় ধরেছে, কেউ জানত না সে কথা।
সে শুনল লালমিঞার ডাক। কিন্তু জবাব দিতে পারল না। সকলের ঘৃণিত, অপমানিত নজর ব্যুহ থেকে বেরিয়ে গেল সে। না থেমে চলতে লাগল। জোরে আরও জোরে। প্রাণপণে ছোটো। ঘৃণা ও অপমান, গোলামি ও অফুরন্ত ক্ষুধা তাড়া করে আসছে। ছোট ছোট দুরন্ত মেঘের মতো। কাল বৈশাখীর সর্বনাশা মেঘের মতো, বিদ্যুৎ ঝলকে, বজ্র ছড়িয়ে ছুটে চল মেঘু, মেঘ, মেঘা, মেঘনাদ।
হ্যাঁ, বজ্র জ্বলছে তার সর্বাঙ্গে। অজান্তে জল নেমে এসেছে চোখ ছাপিয়ে। কত কী, কত কী মনে পড়ছে। কে যেন বলেছিল, বলতও অনেকে অনেকবার, পিতৃমুখী পুত্র জীবনে কোনওদিন সুখী হয় না। তার কৈশোর রক্তে সেই সংস্কারাচ্ছন্ন প্রবাদের সন্দেহ প্রকট হয়ে উঠেছে। সে যে তার বাপের মতো অবিকল দেখতে। আরও কত কথা। অনেক কথা।
সে ছুটে চলল মাঠ ঘাট নালা গ্রাম গ্রামান্তর পেরিয়ে। পথের দিশা নেই। জল জঙ্গল মাড়িয়ে, মাথা সমান কাশবন দিয়ে ছুটে এসে থমকে দাঁড়াল।
পায়ের সামনে ধলেশ্বরী নদী। ধলেশ্বরী, ধবল জলের ঢেউ আছড়ে এসে পড়ল পায়ের উপর। সবুজ শস্য ভরা মাটির মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে শুভ্র ধলেশ্বরী।
এখানে ডুব দেবে মেঘু। বাঁকাশালের খালে ডুব দিয়েছিল নয়ন সার বউ, আর ওঠেনি। কেন ওঠেনি, সে তা জানে। বালক হলেও জানে। পানু চক্কোত্তি ডুব দিয়েছিল, আর ওঠেনি।
সে তেমনি ডুব দেবে ! টান মেরে ছিঁড়ে ফেলল সে গলার তুলসীর মালা। ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে, ঝাঁপ দিতে গিয়ে থমকে গেল। কী যেন ঝপ করে পড়ল একটা পাড় থেকে জলে।
তাকিয়ে দেখল, সাপ। মস্ত কালো সাপ, সাদা জলের উপর মন্থর গতিতে চলেছে এঁকেবেঁকে। মানুষের সাড়া পেয়ে, ভয় খেয়ে জলে নেমেছে।
চকিতে মেঘুর দৃষ্টি পরিবর্তন হল। ভয়ে ও কৌতূহলে আড়ষ্ট শরীর তার। কী বিচিত্র কিশোর মন। কিশোর নয়, বোধ হয় সমগ্র মানুষেরই। ঝাঁপ দিতে ভুলে গেল সে। বিস্মিত ভয়ে তাকিয়ে রইল স্রোতের বিরুদ্ধে চলা সেই সাপটার দিকে।