(ক) নিম্নস্তর—মানবজাতির শৈশব অবস্থা। মানুষ তখনো তার মূল আবাস-স্থল গ্রীষ্মমণ্ডল ও গ্রীষ্মমণ্ডলের সন্নিহিত বন-জঙ্গলে, অন্তত আংশিকভাবে বৃক্ষে অবস্থান করে; এছাড়া, অতিকায় শিকারী জানোয়ারদের মধ্যে তার অবিচ্ছিন্নভাবে তিষ্ঠিয়া থাকা কল্পনা করাও যায় না; ফল, শাঁস, মূল তার আহার্য দ্রব্য। মৌখিক ভাষার ক্রমবিকাশ এই যুগের প্রধান কীর্তি। এই ঐতিহাসিক যুগে বিদিত কোন জাতিকেই আর আদিম অবস্থায় দেখা যায় না। যদিও এই যুগ চলে হাজার বছর ধরে তবুও এমন কোন প্রত্যক্ষ নজির বা প্রমাণপত্র নেই যা দিয়ে এত অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে; কিন্তু প্রাণীরাজ্য থেকে মানবজাতির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ স্বীকার করার সঙ্গে এই পরিবর্তনের যুগটাকেও অবশ্যই মেনে নিতে হয়।
(খ) মধ্যস্তর—ভোজ্যবস্তুরূপে মাছ (কাঁকড়া, ঝিনুক ইত্যাদি জলজন্তু সহ) আগুন ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে এই স্তরের সূচনা। মাছ আর আগুন উভয়ে উভয়ের পরিপূরক; কারণ, একমাত্র আগুনের সাহায্য নিয়েই মাছ শরীরের পুষ্টিসাধন করতে পারে। এই নতুন ভোজ্যবস্তু আবিষ্কারের পর মানুষ জলবায়ু আর স্থানের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। এমন কি, সেই নিতান্ত অসভ্য অবস্থাতেও তারা নদী আর সমুদ্রোপকূল ধ’রে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই সব দেশান্তর গমনের প্রমাণস্বরূপ বলা যতে পারে যে, প্রত্যেক মহাদেশেই প্রাচীন প্রস্তর-যুগের (Stone Age) বা পেলিওলিথ (Paleolithic) নামে পরিচিত যুগের আনাড়ীভাবে তৈরী ভোঁতা পাথরের অস্ত্র দেখতে পাওয়া যায়; ঐ সমস্ত অস্ত্র বা উহার অধিকাংশের ব্যবহার সর্বতোভাবে বা প্রধানত এই যুগেই আরম্ভ হয়। নতুন অধিকৃত অঞ্চল, উদ্ভাবনের জন্যে অবিশ্রান্ত সক্রিয় তাগিদ বোধ, আর ঘর্ষণ দ্বারা আগুন তৈরীর ক্ষমতা মানুষকে নতুন নতুন ভোজ্যবস্তুর উদ্ভাবনে সক্ষম করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, মানুষ ক্রমে গুড়ো করার যোগ্য মূল ও কন্দ গরম ছাইয়ের গাদায় বা মাটির চুল্লিতে বসিয়ে ভোজ্যদ্রব্যে পরিণত করে। প্রথম অস্ত্র গদা বা বর্শা উদ্ভাবনের পর শিকারলব্দ প্রাণীও মাঝে মাঝে ভোজ্য-বস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু সাহিত্যে কেবল মাত্র মৃগয়াজীবী অর্থাৎ একমাত্র শিকারলব্দ প্রাণীর মাংস খেয়েই জীবনধারণে অভ্যস্ত যে-সব উপজাতির বিবরণী হামেশা চোখে পড়ে, কিন্তু সেই ধরণের কোন উপজাতি কোনদিনই ধরাপৃষ্ঠে বিচরণ করেনি। কারণ শিকারের প্রাণী যোগাড় করা তখন অত্যন্ত বিপজ্জনকই ছিল এবং কাজেই তা সম্ভবপর ছিল না। এই অবস্থায়, ভোজ্যবস্তু সরবরাহের অনবরত অনিশ্চয়তাবশত নরমাংস ভোজন প্রথাও উদ্ভূত হয়ে থাকবে। এই স্তর চলে আরও বহু দীর্ঘ সময় ধরে। অস্ট্রেলিয়ান বাসিন্দারা এবং পলেনেশিয়ার বহু জাতি এখনও অসভ্য অবস্থায় এই মধ্য স্তরেই আছে।
(গ) উচ্চস্তর—তীর-ধনুক উদ্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে এই স্তরের উৎপত্তি। তার ফলে শিকার-লব্ধ প্রাণী নিয়মিতভাবে ভোজ্য-বস্তু আর শিকার স্বাভাবিক বৃত্তিতে পরিণত হয়। ধনুক, রজ্জু ও তীর তখন অত্যন্ত জটিল অস্ত্ররূপে গণ্য। তীর-ধনুকের উদ্ভাবন মানুষের রীতিমতভাবে বুদ্ধিবৃত্তিতে শাণ এবং বহু বৎসরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পরিচায়ক; মোটকথা, আরও অনেক কিছু আবিষ্কারের পরিচয় এই নয়া আবিষ্কারের ইন্ধন জোগায়। আমরা দেখতে পাই, মৃন্ময়পাত্র ব্যবহারে অনভ্যস্ত, কিন্তু তীর-ধনুর সঙ্গে পরিচিত জাতিগুলি (মর্গ্যানের মতে এখান থেকে বর্বরযুগের দিকে পরিবর্তনের সূচনা) ইতিমধ্যেই পল্লিগ্রামগুলিতে বসবাস আরম্ভ করেছে। আর তারা ভোজ্যদ্রব্য উৎপাদনের উপায়ের উপরেও অনেকখানি প্রভুত্বলাভ করেছে। কাঠের জলপাত্র ও বাসনকোসন, গাছের ছালের তন্তু দিয়ে হাতে-বোনা (তাঁতের সাহায্যে নয়) বস্ত্র, গাছের ছাল বা পাতলা শাখা দিয়ে তৈরি ঝুড়ি, ধারালো পাথরের অস্ত্রও (Neolithic) আমাদের চোখে পড়ে। আগুন ও প্রস্তরের কুঠার উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে গাছের গুঁড়ি দিয়ে খোদাই করা নৌকার রেওয়াজও আরম্ভ হয়; লোকে কাঠের কড়ি আর তক্তা দিয়ে মাঝে মাঝে বসত-বাড়িও তৈরী করে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর-পশ্চিম আমেরিকায় ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে এই সমস্ত অগ্রগতির ছাপ এখনও দেখতে পাওয়া যায়। এরা তীর ধনুর ব্যবহার জানলেও মৃন্ময়পাত্র সম্পর্কে একেবারে অনভিজ্ঞ। বর্বর-যুগের লৌহ-নির্মিত তরবারি আর সভ্যতার আমলের আগ্নেয়াস্ত্রের মত অসভ্য যুগের তীর-ধনুকই চরম অস্ত্ররূপেই গণ্য।