অশরীরী আতঙ্ক – উপন্যাস – মানবেন্দ্র পাল
ভূমিকা
ভূত অনেকেই বিশ্বাস করেন না। কিন্তু ভূতের গল্প পড়তে ছোটো বড়ো কে না ভালোবাসে।
ভালোবাসার কারণ, মানুষ গল্প শোনার মধ্যে দিয়ে একটু ভয় পেতে চায়।
সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রে নটি স্থায়ী ভাব আর শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, আনক, বীভৎস, অদ্ভুত, শান্ত–এই নটি রস আছে। প্রকৃত কাব্য বা সাহিত্যের মর্যাদা পেতে হলে রচনাকে যে কোনো একটি রসকে অবলম্বন করতে হয় তবেই সেটি হয়ে ওঠে রসোত্তীর্ণ সাহিত্য।
ভূতের গল্পের স্থায়ীভাব হচ্ছে ভয় আর রস হচ্ছে ভয়ানক। তাই যখনই কোনো ভূতের গল্প স্থায়ীভাব ভয়কে অবলম্বন করে ভয়ানক রসে জারিত হয়ে বেরিয়ে আসতে পারলে তখনই তা সাহিত্য-পর্যায়ে উন্নীত হল।
নানা রকমের ভূতের গল্প লেখা হলেও ভয়ই ভূতের গল্পর প্রধান আকর্ষণ। এই ভটুকু না থাকলে ভূতের গল্প জমে না। র
অনেকে ভূতের গল্পর মধ্যে অবাস্তব গাঁজাখুরি ঘটনা দেখে নাসিকা কুঞ্চন করেন। তাঁদের জানা উচিত–ভূতের গল্প বাস্তব জীবনের কাহিনী নয়। ভূত নামক চরিত্রটি অন্য এক রহস্যময় জগতের বাসিন্দা–যে জগৎ মানুষের জ্ঞানের বাইরে। কাজেই বাস্তব জগতের চরিত্রের সঙ্গে তাদের কার্যকলাপের মিল খুঁজতে গেলে ভৌতিক চরিত্রের ওপর অবিচার করা হবে। ভৌতিক গল্প যে অলৌকিক কিছু, এটা মেনে নিয়েই পাঠককে অগ্রসর হতে হবে। তা না হলে তিনি ভৌতিক কাহিনীর রস উপভোগ করতে পারবেন না।
ভৌতিক কাহিনী–তা যতই অবাস্তব হোক পাঠককে আকর্ষণ করতে পারে লেখকের লেখার গুণে। ড্রাকুলার মতো অতি গাঁজাখুরি গল্পও শুধু লেখার গুণে তাবৎ পৃথিবীর পাঠককে কাঁপয়েছে।
বিদেশী সাহিত্যে এইরকম ভালো ভালো ভূতের গল্প বিস্তর আছে। ওসব দেশের সাহিত্যিকরা ভূতের গল্প লেখা সহজ অথবা অগৌরবের মনে করে না। শেক্সপীয়রই বোধ হয় সর্বপ্রথম অতিপ্রাকৃত উপাদানকে সাহিত্যে টেনে এনেছিলেন। হ্যামলেট কিংবা ম্যাকবেথ তার দৃষ্টান্ত। কোলরিজের হাতে অতিপ্রাকৃত উপাদান কিভাবে কাব্যের মধ্যে দিয়ে রসমূর্তি লাভ করেছে তা আমরা জানি। এডগার অ্যালান পোর গা-ছমছম-করা ভৌতিক গল্পর সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। আমাদের দেশে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়েই লিখেছেন তার কয়েকটি স্মরণীয় গল্প–সম্পত্তি সমর্পণ, কংকাল, মাস্টারমশাই, ক্ষুধিত পাষাণ, নিশীথে, মণিহার। এগুলির মধ্যে মণিহারই যে যথার্থ ভৌতিক গল্প সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
এবার আর একটি প্রশ্ন-ভূতের গল্প সবই কি লেখকের কল্পনা?
তা নয়। লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও অনেক সময়ে নিজের আত্মীয়-বন্ধুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লেখককে সাহায্য করে। আমার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু আমার অনেক গল্পের পিছনে পরিচিত জনের বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রেরণা যুগিয়েছে। এই উপন্যাসের মূলেও একটি,, আছে। নাম-ধাম গোপন রেখে সেই সূত্রটুকু জানিয়ে রাখি।—
আমার দেশেরই একটি মেয়ে আমার খুব অনুগত ছিল। আমি প্রায়ই তাদের বাড়ি যেতাম। মেয়েটি তখন এম. এ. ক্লাসের ছাত্রী। আমি গেলে মাঝে মাঝে সে আমার কাছে পড়া বুঝে নিত। তাকে কথায় কথায় প্রায়ই আমি কুসংস্কারমুক্ত হবার ব্যাপারে উৎসাহ দিতাম। সে শ্রদ্ধাভরে আমার কথা শুনত। মানবার চেষ্টাও করত।
তারপর একদিন তার ভালো ঘরে সুপাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের বছর দেড়েক পরে ওরা কলকাতায় উল্টোডিঙ্গির কাছে একটা ফ্ল্যাটে এসে ওঠে। তিন তলায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফ্ল্যাটটি। তখন ওর একটি বাচ্চাও হয়েছে।
এখানে আসার কিছুদিন পরেই গভীর রাত্রে তার ওপর অশরীরী থানা শুরু হয়। সে আতংকে অস্থির হয়ে ওঠে। তার স্বামী ডাক্তার। তিনি স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু একদিন রাত্রে একলা থাকার সময়ে কিছু না দেখলেও তিনি ভয় পেয়েছিলেন।
সেই অশরীরী আত্মাটি মেয়েটিকে ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবার জন্যে হুমকি দিত। এমন কি ফ্ল্যাট ছেড়ে না দিলে ছেলের ক্ষতি করবে বলেও শাসাতো। একদিন মেরে ফেলতেও গিয়েছিল। তখন বাধ্য হয়ে তাদের ফ্ল্যাট ছাড়তে হয়।
এই ঘটনা মেয়েটি আমাকে নিজে বলেছে। তার সব কথাই উড়িয়ে দিতে পারিনি।
এই সত্যটুকুর জোরেই এই উপন্যাসের সৃষ্টি। এর পরেও আরো একটু ঘটনা ছিল। বেশ কিছুকাল পর মেয়েটি কলকাতায় আর একজনদের বাড়িতে আলাপ করতে গিয়েছিল। সেখানে টেবিলের ওপর একজন মৃত ব্যক্তির ছবি দেখে সে চমকে ওঠে। এ তো সেই অশরীরী আত্মার আবছা মুখের মতোই মুখ!
কি করে এই মিল সম্ভব হল তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। যায়ও না।
আমার এই উপন্যাসে অবশ্য শেষের ঐ ঘটনাটা লিখিনি।
এই সব প্রায় মোলো-সতেরো বছর আগের ঘটনা। এর অনেক পরে এই ঘটনা নিয়ে আবির্ভাব নামে একটি গল্প লিখি। পরে নবকল্লোল সম্পাদক এবং নিউবেঙ্গল প্রেসের কর্ণধার প্রবীরবাবুর (প্রবীরকুমার মজুমদার) উৎসাহে এটিকে উপন্যাস করি। তারই আগ্রহে ও সহযোগিতায় উপন্যাসটি নবকল্লোল পত্রিকায় ধারাবাহিক ছাপা শুরু হয় কার্তিক ১৩৯৮ থেকে।
আমি আনন্দিত যে এখন লেখাটি বই আকারে প্রকাশ করছেন দেব সাহিত্য কুটির। ধন্যবাদ দিই মাননীয় অরুণচন্দ্র মজুমদারকে। আমার কাজটিকে তিনি সাফল্যের দিকে এগিয়ে দিতে সাহায্য করলেন।
বইটি পড়ে পাঠক যদি ভূতের গল্পর অতিরিক্ত সাহিত্যরস লাভ করেন তা হলেই আমার উদ্যম সার্থক হবে।
মানবেন্দ্র পাল
আশ্বিন ১৪০২ ৫২, মহাত্মা গান্ধী রোড
কলকাতা ৭০০ ০০৯
.
.
প্রথম পর্ব
০১.
অন্ধকার সিঁড়ি
এলাকাটা কলকাতার কালিন্দি-বাঙ্গুর-বরাটের কাছাকাছি। যশোর রোড থেকে একফালি রাস্তা হঠাৎ যেন ছুরির বাঁকা ফলার মতো ভেতরে ঢুকে গেছে।
বড়ো রাস্তার দুপাশে যথেষ্ট পরিবর্তন হলেও ফালি রাস্তার ভেতরে এই যে বিস্তীর্ণ জায়গাটা পড়ে আছে সেখানে তেমন পরিবর্তন হয়নি। এখনো সেখানে ঝোপ-ঝাঁপ, জলা, ডোবা দেখতে পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখলে কে বলবে–জায়গাটা কলকাতার মধ্যেই।
এখানে কয়েকটা টালির ঘর ছাড়া একটা বিশেষ বাড়ি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
চুন-বালি-খসা জীর্ণ তেতলা বাড়ি। পাঁচিল-ঘেরা কম্পাউন্ড। জায়গায় জায়গায় পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। তা পড়ুক। তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।
কম্পাউন্ডে ঢোকার মুখে লোহার গেট। নামেই গেট। সে-গেট বন্ধ করা। যায় না। একদিকের পাল্লাই নেই।
সেই ভাঙা গেট দিয়ে একদিন একটা ট্রাক এসে ঢুকল। ট্রাকভর্তি মাল। সঙ্গে এল একজন ভদ্রলোক, একজন মহিলা, একজন প্রৌঢ়া আর কোলে একটি শিশু।
বাড়ির সামনে পাথরের ভাঙা নারীর নগ্নমূর্তি। তার চারিদিকে খানকয়েক লোহার বেঞ্চি।
তখন বিকেল। এ-বাড়ির বৃদ্ধেরা বেঞ্চিতে বসে গল্প করছিল। ট্রাক ঢুকতে তারা অবাক হয়ে তাকালো।
–নতুন ভাড়াটে বোধহয়।
–হু। তিনতলাটা তো খালি ছিল।
–ভালোই হল। আমরা দলে ভারী হলাম।
–তা হয়তো হলাম। কিন্তু কেমন ফ্যামিলি সেটাই বড়ো কথা।
–দেখে তো মনে হচ্ছে ছোটোখাটো ভদ্র পরিবার। ওরা বোধহয় স্বামী-স্ত্রী।
–বোধহয় কেন, নিশ্চয়ই। আর ওটা ওদের বাচ্চা।
–কিন্তু বুড়িটা?
–হয় মেয়ের শাশুড়ি, নয় ছেলের শাশুড়ি।
বুড়িটাকে ছন্দপতন বলে মনে হচ্ছে। নইলে ছোটো পরিবার সুখী পরিবার-এর আদর্শ দৃষ্টান্ত।
প্রৌঢ়ের সরস মন্তব্যে সকলেই হেসে উঠল।
তরুণ ভদ্রলোকটির বোধহয় ভয় ছিল বাড়িটা স্ত্রীর পছন্দ হবে কিনা। তাই সসংকোচে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু মহিলাটি কম্পাউন্ডে ঢুকেই বলে উঠল-বাঃ! কতখানি জায়গা! বিকেলে এখানেই বেশ বেড়ানো যাবে। ওমা! কী চমৎকার বুনো ফুল! বলেই ছুটে গেল পাঁচিলের দিকে।
–এই! এসো এদিকে।
প্রৌঢ়া মাল-পত্তর আগলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভদ্রলোক বাচ্চা কোলে করে স্ত্রীর কাছে গেল।
–এগুলো কী ফুল বলো তো? চোখের ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করল মহিলা।
–জানি না।
ঢোলকলমী। আমাদের দেশের বাড়ির পুকুরের ধারে গাদা ফুটত। ওমা! কেমন একটা পুকুর!।
ভদ্রলোক হেসে বলল–পুকুর তো তোমার কি? চান করবে নাকি?
–দেশের বাড়ি হলে করতাম। ওটা দেখেছ?
বলে ছাতের দিকে আঙুল তুলে দেখালো। কিরকম অদ্ভুত, না?
হ্যাঁ, গম্বুজের মতো। সেকালের বাড়ি তো।
মহিলাটি মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ গম্বুজটার দিকে তাকিয়ে রইল। বিকেলের পড়ন্ত রোদ গম্বুজটার মাথায় তখন কেমন যেন বিষাদের আলপনা এঁকে যাচ্ছে।
চলো, ওপরে যাই। জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিতে হবে। ভদ্রলোকটি তাড়া দিল।
মহিলাটি যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, চলো। আসুন পিসিমা।
ওরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। উচিত ছিল ভদ্রলোকেরই আগে আগে যাওয়া। কেননা ভদ্রলোক এর আগে এসেছে। কিন্তু ভদ্রমহিলারই উৎসাহ বেশি। সে এগিয়ে এগিয়ে চলেছে যেন তার চেনা বাড়িতে ঢুকছে।
সিঁড়িটা অন্ধকার। দেওয়ালে হাজার ফাঁক-ফোকর। সিঁড়িগুলোও যেন দাঁত খিঁচিয়ে আছে।
সিঁড়িটা যেন গোটা বাড়ির বুক চিরে ওপরে উঠে গেছে। দুপাশে ঘর। দরজায় দরজায় পর্দা ফেলা। বুঝতে পারা যায় সব ঘরেই ভাড়াটে আছে। কোনো ঘরে রেডিও বাজছে, কোনো ঘরে কিশোরীকন্যার গানের রেওয়াজ চলেছে, কোথাও বা দুরন্ত ছেলেকে মা তারস্বরে ধমকাচ্ছে। ঘরে ঘরে জীবনের লক্ষণ।
–অন্ধকার। আস্তে আস্তে ওঠো। ভদ্রলোক স্ত্রীকে সাবধান করে দিল। চার ধাপ ওপরে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা ঘাড় ফিরিয়ে হেসে বলল, ভয় নেই। পড়ব না।
বলেই দু ধাপ উঠে গেল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আর্তনাদ করে উঠল–পড়ে গেলাম!
.
০২.
সূত্রপাত
রীণা মফস্বলের মেয়ে।
ওখানকার কলেজ থেকেই বি. এ. পাস করে বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে এম. এ পড়ছিল। পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেল। স্বামী ডাক্তার। শশুরবাড়ি বহরমপুরে। কিন্তু ডাক্তারিসূত্রে সঞ্জয়কে প্রথমেই আসতে হল কলকাতায়। রীণা খুব খুশি। কলকাতায় সংসার পাতবে এতখানি সৌভাগ্য কল্পনাও করেনি কখনো। তাছাড়া এখানে তার একটি বান্ধবীও আছে–মান্তু। তার সঙ্গেও দেখা হবে।
কলকাতায় চাকরি পাওয়া যদিও-বা সম্ভব, বাড়ি পাওয়া সহজ নয়। অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত এই বাড়িটা . পাওয়া গেল। পুরনো বাড়ি। জায়গাটাও গলির মধ্যে। তবুও কলকাতায় সংসার পাতার আনন্দে রীণা খুঁতখুঁত করল না।
তিনতলায় সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একফালি বারান্দা। তিনতলাটা একেবারেই ফঁকা।
সামনের ঘরটাকে রীণা করে নিল ড্রয়িংরুম। একটা টেবিল, খান-দুই স্টিলের চেয়ার, একটা মোড়া আর একটা ডিভান–এই নিয়েই ড্রয়িংরুম সাজাল। এরই পিছনে আর একখানা ঘর। সেটা হল ওদের বেডরুম। বিছানায় শুয়ে দুঘরের মধ্যের খোলা দরজা দিয়ে তাকালে সিঁড়ি পর্যন্ত দেখা যায়।
দরজা জানলাতে রীণা রঙিন পর্দা লাগাল। টেবিলে পাতল ওরই হাতে তৈরি সুন্দর টেবিল-ক্লথ। ওপরে রাখল পেতলের ফ্লাওয়ার ভাস।
দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিল রবীন্দ্রনাথের একখানি ছবি, আর সুদৃশ্য একখানি ক্যালেন্ডার।
রীণা খুব খুশি। সকালে সঞ্জয় বেরিয়ে যায় হাসপাতালে। দুপুরটা কাটে ঘুমিয়ে। বিকেলে সঞ্জয় ফিরলে ওরা দুজনে বেরিয়ে পড়ে।
পিসিমা এসেছিলেন ওদের নতুন সংসার গুছিয়ে দিতে। গোছানো হয়েছে। এবার তিনি দেশে ফিরে যেতে চাইছেন। রীণা ওঁকে আটকে দিল।
–এখুনি যাবেন কি? কালীঘাট দেখলেন না, দক্ষিণেশ্বর দেখলেন না—
ওর আন্তরিকতা অকৃত্রিম। তবু কিছু স্বার্থও আছে। পিসিমা থাকলে পুপুকে রেখে একটু বেরোন যায়।
প্রথম কদিন রীণার কাটল সিনেমা দেখে। একদিন থিয়েটারও দেখল।
তারপরই একদিন ছোটোখাটো একটা অঘটন ঘটল।
সঞ্জয় একদিন বলল, মহাজাতি সদনে দারুণ ম্যাজিক শো হচ্ছে।
রীণা বলল, তুমি যাও। ম্যাজিক আমার ভালো লাগে না।
সঞ্জয় অবাক। সে কী! ম্যাজিক ভালো লাগে না।
রীণা বলল, ছোটোবেলায় একবার ম্যাজিকে নররাক্ষসের খেলা দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে আর ম্যাজিক দেখি না।
সঞ্জয় হেসে উঠল, ওসব নৃশংস খেলা এখন আর হয় না।
রীণা তবু মাথা নাড়ল, না বাপু, ম্যাজিক দেখে কাজ নেই।
সেদিন আর কথা হল না। তারপর একদিন সঞ্জয় কিছু না বলে দুখানা টিকিট কেটে বাড়ি ঢুকল। রীণা খুশি হল না। তবু যেতে হল।
রবিবার। বেলাবেলি খাওয়া-দাওয়া সেরে পুপুকে পিসিমার কাছে রেখে দুজনে বেরিয়ে পড়ল।
রীণার উৎসাহ একেবারেই ছিল না। তাকে যেন জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেমন অন্যমনস্ক। তার তখন ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছিল। সেই অন্ধকার টিনের ছাউনি দেওয়া হলঘর। কালো পর্দা। পর্দা উঠল। স্টেজে মিটমিটে আলো। কালো পোশাক পরা কী ভয়ংকর মানুষটা! চুলগুলো পাননা, দুচোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। সে পাগলের মতো স্টেজের মধ্যে দাপাদাপি করছিল। তার কোমরে দড়ি বেঁধে তিনজন তোক টেনে ধরেছিল।
তারপর রাক্ষসটা যখন জ্যান্ত মুরগীটাকে ধরল–মুরগীটা পাখা ঝাঁপটাতে লাগল….মুরগীটা মরণডাক ডেকে উঠল। উঃ! তারপর আর মনে নেই। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।….
সেই ম্যাজিক দেখা, তারপর এই যাচ্ছে। এখন অবশ্য ঐসব ভয়ানক খেলা আর হয় না। তবু ভয় করছে। কিসের যে ভয় রীণা তা ঠিক বুঝতে পারছে না।
শো আরম্ভ হল। হলভর্তি দর্শক। ম্যাজিসিয়ান হাসতে হাসতে পায়ে ছন্দ তুলে স্টেজে ঢুকলেন। খেলা শুরু হল।
কি একটা খেলা দেখাবার পর ম্যাজিসিয়ান তার কালো টুপিটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার নিজের হাতে ধরতে গেলেন, ঠিক তখনই রীণা একটা অস্ফুট শব্দ করে সঞ্জয়ের বুকের ওপর ঢলে পড়ল।
অবশ্য বেশিক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকেনি। জ্ঞান ফিরতেই সঞ্জয় তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে রীণা চোখে-মুখে জল দিল। একটা কোল্ড ড্রিংক খেল।
–এখন কেমন? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।
–ভালো। এবার বাড়ি চলো।
সঞ্জয় একটা ট্যাক্সি নিল। ট্যাক্সিতে গা এলিয়ে বসেছিল রীণা। দুচোখ বন্ধ। সঞ্জয় ওর হাতটা তুলে নিল। হাতটা ঠাণ্ডা।
–তুমি আচ্ছা ভীতু তো! সঞ্জয় হেসে রীণার দিকে তাকাল।
রীণা উত্তর দিল না।
–কিন্তু কিসে এত ভয় পেলে? কোনো ভয়ের খেলা তো দেখায়নি।
রীণা এবার মাথাটা একটু নাড়ল। ক্লান্ত গলায় বলল, জানি না।
ট্যাক্সি যখন কম্পাউন্ডে ঢুকল তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। গলিপথটা নির্জন হয়ে গেছে। কম্পাউন্ডেও বুড়োরা কেউ বসে নেই।
আকাশে কৃষ্ণা চতুর্থীর চাঁদ। রীণা হঠাৎ চমকে ট্যাক্সি থেকে মুখ বাড়াল।
–কি হল?
দ্যাখো দ্যাখো গম্বুজটা!
গম্বুজটার ওপর হালকা চাঁদের আলো পড়ে কেমন রহস্যময় লাগছিল। তার চেয়েও রহস্যময়ী লাগছিল রীণাকে। তার মুখটা মনে হচ্ছিল যেন কাগজের তৈরি অন্য একটা যেন মুখ। সে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল গম্বুজটার দিকে।
–কি হল? নামো। সঞ্জয় বলল।
রীণা চমকে উঠল। তারপর সঞ্জয়ের হাতটা আঁকড়ে ধরে ধীরে ধীরে নামল।
.
০৩.
শেষ-দুপুরে আগন্তুক
ভাই মান্তু, শেষ পর্যন্ত কলকাতায় এলাম। তুই তো জানিস এ আমার কতদিনের সাধ! সেই সাধ এতদিনে পূর্ণ হল। এবার আশা করছি তোর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হবে। বাসাটা বেশ দূরে হল-বাঙ্গুর-কালিন্দির কাছে। তবু তো কলকাতা। এখান থেকে হাওড়া এমন আর কি দূর? রাস্তাটা চিনে নিলে যে কোনো সময়ে তার কাছে চলে যেতে পারব।
দুসপ্তাহ হল এসেছি। এখনো ঠিকমতো গুছিয়ে বসতে পারিনি। পিসিমা এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বলে পুপুকে তার কাছে রেখে কদিন খুব সিনেমা-থিয়েটার দেখে নিলাম। কিন্তু গোল বাধল ম্যাজিক দেখতে গিয়ে। ম্যাজিক দেখায় আমার বড় ভয়। শুনে ডাক্তার খুব হাসে। কিন্তু ওকে বোঝাই কি করে ম্যাজিসিয়ানদের দেখলেই আমার বুকের মধ্যে কেমন করে। কারণ আর কিছুই নয় ছোটবেলায় নররাক্ষস দেখার বীভৎস অভিজ্ঞতা। এই এতদিন পরে ম্যাজিক দেখতে গিয়ে আবার অজ্ঞান হয়ে যাই। ভাবতে পারিনি ম্যাজিক দেখতে গিয়ে এই বয়েসে অজ্ঞান হয়ে যাব। তারপর থেকে শরীরটা দুর্বল। মনটাও অকারণে বিষণ্ণ হয়ে আছে। কেবলই মনে হচ্ছে কি যেন ঘটবে–এমন কিছু যা মোটেই শুভ নয়। এরকম মনে হবার কোনো কারণ খুঁজে পাই না।
যাই হোক বাড়িটার কথা বলি। পুরনো বাড়ি। তিনতলা। বাড়িটা একটা গলির ভেতর। এখানে বড়ো রাস্তার ধারে, আশেপাশে প্রচুর নতুন বাড়ি উঠেছে। আমাদের কপালেই পুরনো বাড়ি জুটল। যাক, তবু তো জুটেছে। একতলায়, দোতলায় মোট চার ঘর ভাড়াটে। আমরা তিনতলায়। তিনতলাটা দেখলেই বোঝা যায় incomplete। কবে কোনকাল থেকে কেন যে এরকম অসম্পূর্ণ হয়ে আছে কে জানে! ছাদের ওপর একটা ভাঙা গম্বুজমতো আছে। সেটাই আমার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগে। ঠিক যেন সেকালের রাজা-রাজড়াদের দুর্গ! সেদিন ম্যাজিক দেখে ফেরার সময়ে চাঁদের আলোয় গম্বুজটাকে দেখেও কেন জানি না বেশ ভয় পেয়েছিলাম।
তবু মন্দ লাগে না। শান্ত পরিবেশ। বাড়ির পিছনে সার সার দেবদারু গাছ। কম্পাউন্ডের মধ্যে অনেকগুলো সুপুরিগাছও আছে। বাড়ির পিছনের দিকটা যেন রহস্যপুরী। এই কলকাতা শহরেও রাত্তিরবেলায় ঝিঁঝি ডাকে!
তুই একদিন চলে আয়। ও হাসপাতালে চলে গেলে সারা দুপুর বড্ড একা লাগে। পিসিমা চলে গেছেন। আমার সঙ্গী শুধু পুপু। ঘুমোতে চেষ্টা করি। ঘুম হলে বেশ ভালো থাকি। ঘুম না হলে কেমন ভয় করে। চোর-ডাকাতের ভয় নয়। আবার বলছি–কিসের ভয় জানি না।
ও হ্যাঁ। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। প্রথম যেদিন মনের আনন্দে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিলাম, তখন ডাক্তার আমায় সাবধান করে দিল যেন তড়বড়িয়ে না উঠি। পড়ে যেতে পারি। আশ্চর্য! ঠিক তখনই মাথাটা কিরকম করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে চার ধাপ নিচে পড়ে গেলাম। ভাগ্যি ও ধরে ফেলেছিল।
কিন্তু তোকে সত্যি কথা বলি। পড়বার আগের মুহূর্তেও ভাবতে পারিনি আমি পড়ে যাব! কি করে পড়লাম কে জানে!
কলকাতায় এসে এরই মধ্যে দুটো ধাক্কা খেলাম। প্রথম সিঁড়ি থেকে পড়া। দ্বিতীয় ম্যাজিক দেখতে গিয়ে….
চিঠি লেখায় বাধা পড়ল। শুনতে পেল সিঁড়িতে জুতোর অস্পষ্ট শব্দ। ওপরে কেউ আসছে। অবাক হল। কেউ তো আসে না।
ঠিক এই সময়ে পুপু ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাৎ কেঁদে উঠল।
চিঠি ফেলে রেখে রীণা বিছানায় গিয়ে পুপুর পিঠে হাত রাখল। কিন্তু কান্না থামল না।
কি হল? কিছু কামড়ালো নাকি? রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে তুলে নিয়ে বিছানা ওলোট-পালোট করে ফেলল। নাঃ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিছানা। কোথাও একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত নেই।
পুপুকে কোলে নিয়ে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে রীণা আবার বাইরের ঘরে এসে বসল। ঘড়ির দিকে তাকাল। পৌনে তিনটে।
যাক, বিকেল হয়ে এল। এর মধ্যে চিঠিটা শেষ করে ফেলতে হবে।
সবেমাত্র একটি শব্দ লিখেছে, অমনি দেখল স্যুটপরা কেউ একজন যেন সিঁড়ির দিকের জানলার পাশ থেকে চকিতে সরে গেল।
–কে?
সাড়া নেই।
রীণা আবার ডাকল–কে?
এবারও উত্তর নেই।
রীণা ভাবল জানাশোনা কেউ দেখা করতে এসেছে। লুকিয়ে একটু মজা করছে।
রীণা উঠে দরজার কাছে গেল। ঠিক তখনই পুপু আবার কেঁদে উঠল। তবু রীণা দরজা খুলে দিল।
না, কেউ নেই। শুধু জ্যৈষ্ঠের একফালি রোদ দেওয়ালের একটা জায়গায় বর্শার ফলার মতো এসে পড়েছে।
রীণা ঝুল-বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচের কম্পাউন্ড ফাঁকা। জনপ্রাণী নেই। অল্প দূরে যশোর রোডের ওপর দিয়ে সশব্দে বাস, ট্যাক্সি, লরি ছুটে চলেছে।
রীণা অবাক হল। কে এল এই অসময়ে? গেলই-বা কোথায়?
কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না। পুপু তখনও কাঁদছে। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়ল।
না, আর কাঁদছে না। বিছানার চাদরটা মুঠো করে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রীণা আবার বাইরের ঘরে এসে বসল। চিঠিটা শেষ করল কোনোরকমে। কিন্তু চিঠি লিখতে লিখতেও ভাবনাটা কিছুতেই সরিয়ে ফেলতে পারছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল–কে ঐ স্যুটপরা ভদ্রলোক? তার মুখ দেখতে পায়নি। দেখেছে শুধু কোটের একটা প্রান্ত। কেনই-বা অসময়ে এল! কেনই-বা চুপচাপ। চলে গেল!
ভদ্রলোক কে হতে পারে, রীণা সম্ভব-অসম্ভব অনেকের কথাই মনে করার চেষ্টা করছিল, এমনি সময়ে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
রীণার হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল।
–কে?
এইটুকু উচ্চারণ করতেই গলার স্বর কেঁপে উঠল।
–আপনার টেলিফোন।
–আমার টেলিফোন!
রীণা দরজা খুলে দিল। দেখল দোতলার নিখিলবাবুর মেয়ে বন্দনা। বদনা। বলল, আমাদের ঘরে আপনার ফোন এসেছে।
রীণা একে চেনে।
–কে ফোন করছে? অন্যমনস্কভাবে কথা কটা উচ্চারণ করেই রীণা তাড়াতাড়ি নেমে গেল। ঘরটা খোলাই পড়ে রইল।
কে তাকে হঠাৎ ফোন করতে পারে? ডাক্তার ছাড়া আর তো কেউ এ বাড়ির নম্বর জানে না। ডাক্তারই বা শুধু শুধু ফোন করতে যাবে কেন? তাহলে নিশ্চয় ডাক্তার কাউকে ফোন নম্বর দিয়েছে জরুরি কোনো খবর জানাবার জন্যে। কি সে জরুরি খবর? তবে কি ওর কিছু হয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট? হাসপাতাল থেকে করছে? স্যুটপরা ভদ্রলোক কি সেই খবর দেবার জন্যেই এসেছিলেন? নিজে মুখে খবরটা দিতে না পেরে ফোন করছেন? রীণা ঘামতে ঘামতে রিসিভার হাতে তুলে নিল।
–হ্যালো-হ্যালো–আমি রীণা বলছি। রীণা গুপ্ত–ডাক্তার সঞ্জয় গুপ্তর স্ত্রী ওপার থেকে হাসি শোনা গেল।
তুমি যে আমারই স্ত্রী, তোমার কাছ থেকে এই প্রথম শুনতে পেলাম।
ডাক্তারেরই গলা। রীণার বুকটা হালকা হল।
–ও তুমি! বাবাঃ! বাঁচলাম।
–কেমন অবাক করে দিলাম।
উঃ! যা ভয় পেয়েছিলাম!
–ভয়! কিসের ভয়?
–সে অনেক কথা। তুমি এলে বলব।
–আমার আজ ফিরতে দেরি হবে। চিন্তা কোরো না।
–দেরি? না-না, মোটেই আজ দেরি কোরো না। লক্ষ্মীটি।
–একটা জরুরি কাজ আছে যে।
–তা থাক। আমারও বিশেষ দরকার আছে।
ওপার থেকে এবার চট্ করে উত্তর এল না।
–হ্যা-লো
ডাক্তার মৃদু ধমক দিল।–অত চেঁচাচ্ছ কেন? আস্তে বলল।
সে কথায় কান না দিয়ে রীণা আবার চেঁচিয়ে উঠল–তাড়াতাড়ি আসছ তো?
–আচ্ছা, চেষ্টা করব। ছেড়ে দিচ্ছি।
রীণাও ফোনটা রেখে দিল। বন্দনার দিকে তাকিয়ে সলজ্জ একটু হেসে বলল, চলি।
বন্দনাও একটু হাসল, খুব ভয় পেয়েছিলেন?
—হ্যাঁ। হঠাৎ টেলিফোন পেলে রীণার মুখটা একটু লাল হল।–চলি। সময় পেলে এসো। কেমন?
রীণা তিনতলায় উঠতে লাগল। উঠতে উঠতে কি মনে হওয়ায় আবার নেমে এল।
–এই শোনো।
বন্দনা ফিরে দাঁড়াল।
–দুপুরে তুমি বাড়ি ছিলে?
–হ্যাঁ, ইস্কুলের ছুটি।
–কি করছিলে? ঘুমোচ্ছিলে?
–দুপুরে আমি ঘুমোই না। সেলাই করছিলাম।
–কোন ঘরে?
–এই ঘরে।
–আচ্ছা, কেউ একটু আগে–এই তিনটে নাগাদ তিনতলায় গিয়েছিল?
কই? না তো।
তুমি তো দরজা বন্ধ করে সেলাই করছিলে। কি করে দেখবে?
বন্দনা বলল, কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠলে জুতোর শব্দ শুনতে পেতাম।
রীণা মুহূর্তখানেক কী ভাবল। জুতোর শব্দ বন্দনা শুনতে পায়নি। কিন্তু সে নিজে পেয়েছিল। তাহলে ব্যাপারটা কি? ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। কেমন যেন একটা চাপা ভয়–তারপর আচ্ছা চলি বলে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এল। বেশ বুঝতে পারল বন্দনা অবাক হয়ে তাকে দেখছে। তারপরই হঠাৎ মনে পড়ল তাড়াতাড়িতে দরজা খুলে রেখেই এসেছে। ঘরে একা পুপু। তখনই রীণা হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল।
না, পুপু নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
রীণা তবু ঘুমন্ত ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল।
আবার মনে মনে সেই চিন্তা–এই যে পুপু একা আছে বলে পড়িমরি করে ছুটে এলকিসের ভয়ে? শুধু তো কধাপ নেমে দোতলায় গিয়েছিল। এর মধ্যে এমন কি আর ঘটতে পারত? চোর-টোর? তাহলেও তো দোতলার ঘর থেকেই দেখতে পেত।
তাহলে?
তাহলেও সেই এক প্রশ্ন–বেলা পৌনে তিনটে নাগাদ সে যে জুতোর শব্দ শুনেছিল, চকিতের জন্য যার পরনের স্যুট চোখে পড়েছিল সে কে? কেন এসেছিল? কেনই-বা দেখা না করে মুহূর্তে কোথায় চলে গেল?
.
সন্ধে হবার আগেই সঞ্জয় ফিরল। কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে ওপরের দিকে তাকাল। দেখল রীণা পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছে।
সঞ্জয় ডাক্তার মানুষ। স্বাভাবিক নিয়মেই একটু কঠিন। ভয়, ভাবনা, ভাবাবেগ কম। তবু আজ টেলিফোনে রীণার গলার স্বরটা শুনে একটু চিন্তায় পড়েছিল। কেমন যেন ভয়-পাওয়া গলা। কিন্তু কিসের ভয় বুঝতে পারছিল না। এখন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিশ্চিন্ত হল। সেই সঙ্গে একটু রাগও।
ঘরে ঢুকেই তাই বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপার বলো তো?
বলছি। আগে চা খাও।
সঞ্জয় লক্ষ্য করল রীণার চোখে-মুখে সত্যিই ক্লান্তির ছাপ। কিছু যে ঘটেছে তা বুঝতে পারল।
একটু পরেই রীণা ফিরল দুকাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে। সঞ্জয়কে কাপ এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা কাপ তুলে নিল।
–হ্যাঁ, বলো কী ব্যাপার? সঞ্জয়ের স্বরে কৌতূহল।
রীণা তখন দুপুরের সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলল। শুনে সঞ্জয় খুব খানিকটা হাসল।
–এই কথা শোনাবার জন্যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বললে?
রীণা মাথা নিচু করে বলল কথাটা কি ভাববার মতো নয়?
–পাগল হয়ে গেলে নাকি? বলেই সঞ্জয় উঠে শার্ট খুলে ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দিল।
রীণার মুখ লাল। সে বলল, পাগল বৈকি! আমি নিজে কানে জুতোর শব্দ শুনলাম। নিজে চোখে দেখলাম।
–কি দেখলে? কালো স্যুটপরা এক সুদর্শন পুরুষ বারান্দার জানলার সামনে দাঁড়িয়ে তোমায় নীরবে নিরীক্ষণ করছেন।
রীণা ধমকে উঠে বলল-বাজে বোকো না তো! আমি কচি খুকি নই যে আজে-বাজে বকব। আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিও না।
বেশ, এই আমি চুপ করলাম। বলেই ছেলেকে কোলে টেনে নিল।
–এসো তো পুপু সোনাতোমায় একটু আদর করি। বড়ো হলে তোমায় আমি কালো স্যুট তৈরি করে দেব। তোমার মামণি কালো স্যুট খুব ভালবাসে। বলেই রীণার দিকে তাকাল।
রীণ ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ঠাট্টা হচ্ছে? বলে হঠাৎ উঠে গিয়ে বিছানায় মুখ এঁজে শুয়ে পড়ল।
–আরে! এই দ্যাখো! রাগ করে একেবারে শয্যাশায়ী! বলতে বলতে ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠে এল সঞ্জয়।
সঞ্জয় পুপুকে শুইয়ে দিয়ে রীণার গা ঘেঁষে বসল। ওর ওপর ঝুঁকে পড়ে দুহাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরবার চেষ্টা করল।
আঃ! বিরক্ত কোরো না। বলে রীণা ছিটকে উঠে বসল।
–ঠিক আছে। আমি কাছে থাকলে এতই যখন বিরক্তি তখন বাইরের জরুরি কাজটা সেরেই আসি।
বলে সঞ্জয় উঠে পড়ল। রীণা ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে পথ আগলে দাঁড়াল, যাবে বৈকি!
সঞ্জয় হেসে বলল, তাহলে কুমড়োর মতো একটা গোমড়া মুখের সামনে বসে কি করব?
কুমড়োর মতো মুখ বৈকি! এই মুখের জন্যেই তো একদিন–পুপুকে দ্যাখো। আমি জলখাবার নিয়ে আসি। বলেই তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।
সঞ্জয় একটা জিনিস লক্ষ্য করল রীণা যেন আজ একটুতেই রেগে যাচ্ছে। ঠাট্টাটুকুও বুঝতে চাইছে না।
তখনকার মতো শান্তি। কিন্তু জের চলল রাত্রে ঘুমোবার আগে পর্যন্ত।
চুপচাপ শুয়েছিল রীণা। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল পাখার দিকে। কেমন উন্মনা দৃষ্টি। অথচ অন্যদিন ওর সারাদিনের যত গল্প–সব শোনায় এই সময়। সে সব গল্প এ বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের নিয়ে।
–এখনো রাগ পড়েনি?
–কিসের রাগ?
–ঐ যে তখন পাগল-টাগল বললাম কুমড়োর মতো মুখ।
রীণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুলো–নাগো, রাগের কথা নয়। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না। কিন্তু–আমি কী করে বোঝাব–
–তুমি কি সেই আবির্ভাবটিকে এখনো ভুলতে পারনি?
–কি করে ভুলব? প্রথমে ভেবেছিলাম আত্মীয়দের কেউ দেখা করতে এসেছে। একটু মজা করছে। কিন্তু দরজা খুলে যখন দেখলাম কেউ নেই তখন
বাধা দিয়ে সঞ্জয় বলল, আরে বাবা, নিশ্চয়ই কেউ ভুল করে তিনতলায় উঠে এসেছিল। তারপর নিজের ভুল বুঝে চুপি চুপি নিচে চলে গেছে। এই তো ব্যাপার। এই নিয়ে
রীণা এ উত্তরে নিশ্চিন্ত হল না। বলল, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নামেনি। আমি এক মুহূর্তের জন্যে লোকটাকে জানলার সামনে দিয়ে বাঁ দিকে যেতে দেখেছি। আর ফিরতে দেখিনি। তুমি নিশ্চয় জান ওদিকটা একেবারে ব্লাইন্ড। ওদিক দিয়ে চলে যাবার উপায় নেই।
সঞ্জয় চুপ করে শুনল।
তাছাড়া আমি বন্দনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও সারা দুপুর সিঁড়ির সামনের ঘরে বসেছিল। কাউকে উঠতে দেখেনি বা জুতোর শব্দ পায়নি।
রীণার এত কথার পর সঞ্জয় শুধু একটা প্রশ্ন করল, বন্দনা আবার কে?
রীণা বিরক্ত হয়ে বলল, দোতলার নিখিলবাবুর মেয়ে বন্দনাকে চেন না? কত বার এসেছে। দেখেছ।
–আমি নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য মেয়ের দিকে তাকাই না।
–ওঃ! ভারি সাধু–পুরুষদের চিনতে আমার বাকি নেই।
বলে পাশ ফিরে শুলো।
ঘরের মধ্যে হালকা নীল আলো। মাথার ওপর পাখার ঝড়। বাইরে অন্ধকার আকাশে লক্ষ তারার চোখ-টেপা হাসি।
–ঘুমোলে? গাঢ়স্বরে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।
–ঘুম আসছে না।
সঞ্জয় পাশ ফিরে ডান হাতটা ঝুলিয়ে দিল রীণার বুকের ওপর। একটু আকর্ষণ করল। রীণার হালকা দেহটা এসে পড়ল তার নিশ্বাসের মধ্যে।
–এবার ঘুমোও।
অমন করলে ঘুম হয়? বলে রীণা সঞ্জয়কে আঁকড়ে ধরল।
.
০৪.
রাত তখন গভীর
নতুন জায়গায় নতুন সংসারে রীণা কিছুটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তবু বেলা তিনটে বাজলেই ও একটু উৎকর্ণ হয়ে থাকে। একদিন যে এসেছিল সে কি আবার কোনদিন আসবে? কিন্তু না, বেশ কিছুদিন তো হয়ে গেল আর কাউকে দেখা যায়নি, জুতোর শব্দটুকুও না।
রীণা এখন বেশ নিশ্চিন্ত। কিন্তু ভারি লজ্জা করে সেদিনের কথা ভাবতে। কী যে হয়েছিল–শুধু শুধু ভয় পেয়ে গেল। ছিঃ।
গত রবিবার প্রফেসার রুদ্র এসেছিলেন। ইনি ডাক্তারের হোটোকাকার বন্ধু। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ে ওঁর কাছে ওকে প্রায়ই যেতে হতো। তাই সম্পর্কটা খুব ঘনিষ্ঠ।
প্রফেসার রুদ্র কলকাতার এক নম্বর ডাক্তারদের মধ্যে একজন। মানসিক রোগের চিকিৎসা করেন। কলকাতায় এসে পর্যন্ত ডাক্তার ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তারপর হঠাৎই গত রবিবার ও প্রফেসারকে নিয়ে এল।
বেশ ভালোই লাগছিল। এই প্রথম একজন চেনাশোনা বিশিষ্ট লোক তাদের বাড়িতে এল। কিন্তু ডাক্তার যখন খুব মজা করে সেদিনের ঘটনাটা প্রফেসার রুদ্রকে বলছিল রীণার তখন লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল।
প্রফেসার অবশ্য কোনো ঠাট্টা করলেন না। হাসলেন একটু।
এখন তাই সেদিনের কথা মনে হলে রীণার ভারি অস্বস্তি হয়।
কিন্তু সেদিন যা দেখেছিল তা কি ভুল? চোখ কি এত বিশ্বাসঘাতকতা করে? হবেও বা। ইংরিজিতে ইলিউসান নামে যে একটা কথা আছে তা বোধহয় এইই।
.
সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে সঞ্জয়ের বেশ রাত হয়ে গেল।
ওরা বেশি রাত জাগে না। সাড়ে নটার মধ্যেই রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ে। এদিন ওর ফিরতে রাত হওয়ায় রীণা ভয় পাচ্ছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরতে সঞ্জয়ের প্রায়ই রাত হয়। কিন্তু কোনোদিন ভয়-টয় করত না। আজ হঠাৎই কেমন ভয় করল। সে কথাটা আর বলল না। খেয়েদেয়ে ওরা শুয়ে পড়ল। রীণা পুপুকে নিয়ে খাটে শোয়। ডাক্তার শোয় মেঝেতে।
অনেক রাত্রে হঠাৎ রীণার ঘুম ভেঙে গেল। কেন যে ঘুম ভাঙল রীণা ঠিক বুঝতে পারল না। শুনতে পেল যশোর রোড দিয়ে একটা মাতাল চেঁচাতে চেঁচাতে যাচ্ছে। মাতালটা বোধহয় রোজই এই সময়ে যায়। এর আগেও শুনেছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে অশ্রাব্য গাল দিতে দিতে যায়। পরিচিত পরিবেশ। তবু কিরকম যেন গা-ছমছম্ করতে লাগল। মনে হল ঘরে বুঝি সে একা! সঞ্জয় বুঝি রুগী দেখে এখনও ফেরেনি। ঘোরটা কেটে যেতেই মনে পড়লনা, সঞ্জয় অনেকক্ষণ ফিরেছে। ঐ তো মেঝেতে শুয়ে আছে।
এমনি সময় পুপু হঠাৎ কেঁদে উঠল। ঠিক এইরকম ভাবেই কেঁদেছিল সেই সেদিন বেলা তিনটের সময়ে! কাঁদতে কাঁদতে পুপু ককিয়ে গেল। রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে তুলে নিয়ে টর্চ জ্বেলে বিছানা, বালিশের তলা দেখে নিল। না, কিছু নেই।
রীণা তখন পুপুকে বুকে চেপে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করল। পুপু ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে কাঁদছে। রীণা তখন ওকে শুইয়ে চাপড়াতে লাগল। তখনি হঠাৎ রীণার মনে হল কোথায় যেন কিসের শব্দ হচ্ছে। অস্পষ্ট শব্দ। মনে হল নিচের তলার কোনো ঘরে কেউ যেন দেওয়ালে পেরেক পুঁতছে।
হবেও বা। হয়তো মশারির দড়ি পেরেক উঠে এসেছে কারো ঘরে। তাই পেরেক ঠুকছে। রীণা পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু একটু পরেই আবার শব্দ–এবার সেই হালকা পেরেক পোঁতার শব্দটা ভারী হয়ে উঠছে। কেউ যেন কাঠের জুতো পরে একটা একটা পা ফেলে গুনে গুনে সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় উঠে আসছে। রীণা কান খাড়া করে রইল। এত রাতে কে আসছে অমন করে?
হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল।
শব্দটা কোথায় এসে থামল দেখার জন্যে ঘাড় ফেরাতেই রীণার শরীরটা হিম হয়ে গেল। দেখল আবছা একটা মূর্তি তাদের বসার ঘরে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে যেন কালো কোট, কালো প্যান্ট।
রীণা শুয়ে শুয়েই মানুষটাকে বোঝবার চেষ্টা করতে লাগল। না, চোখের ভুল নয়। একটা মানুষই। কিন্তু এত আবছা কেন? লোকটা কে হতে পারে?
পুপু আবার কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রীণা সচেতন হয়ে উঠল।
–ওগো, শুনছ! রীণা চাপা গলায় সঞ্জয়কে ডাকল। ওঠো না। তোমায় বোধহয় কেউ ডাকতে এসেছে।
–আমায়? কোথায়?
–ঐ যে বাইরের ঘরে। টেবিলের কাছে।
অন্ধকারের মধ্যে যতদূর সম্ভব দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে সঞ্জয় তাকাল, কই? কেউ তো নেই।
রীণা বিরক্ত হয়ে বলল, ঐ তো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সঞ্জয় তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে কিসে যেন ধাক্কা খেল। মশারির দড়িটা ছিঁড়ে গেল। অন্ধকারে দেওয়াল হাতড়ে সুইচ নামিয়ে দিল। আলো জ্বলল না। লোডশেডিং।
সঞ্জয় বিছানা থেকে বড়ো টটা নিয়ে জ্বালল। আর ঠিক তখনই কি যেন পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।
টর্চের আলো অন্ধকার দুফাঁক করে সোজা সিঁড়ির মুখে গিয়ে পড়ল।
কই? কোথায়?
–ঐ যে বাথরুমের দিকে। ঐ যে ঢুকছে রীণা চিৎকার করে উঠল।
সঞ্জয় টর্চ হাতে সেই দিকে ছুটল।
–যেয়ো না, যেয়ো না
সে কথায় কান না দিয়ে সঞ্জয় দৌড়ে বাথরুমে ঢুকল।
কিন্তু কোথায় কে? শুধু ফ্ল্যাশের পুরনো ট্যাঙ্ক চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ে যাচ্ছে।
–তোমার যত আজগুবি কাণ্ড! বলতে বলতে সঞ্জয় ঘরে ফিরে এল।
কী আজগুবি কাণ্ড? কেমন একরকম তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রীণা তাকাল। সে দৃষ্টি অস্বাভাবিক। সঞ্জয় সতর্ক হল। আর কিছু বলল না।
সে রাত্তিরে দুজনের কারোরই ভালো করে ঘুম হল না। সঞ্জয় খুবই বিরক্ত। বিরক্ত হবার কারণও আছে। সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি গেছে। ডিউটির পরও রুগী দেখতে ছুটতে হয়েছে। তারপর আবার এই ব্যাপার। রাত্তিরটুকুতেও যদি ঘুম না হয় তাহলে তো আর পারা যায় না। অন্ধকারেই কোনরকমে মশারির দড়ি ঠিক করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ঠিক কি দেখেছ বলো তো?
রীণা তখন অনেকটা স্বাভাবিক। সব ব্যাপারটা বলল।
সঞ্জয় কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা বিদ্রুপের সুরে বলল, আবার সেই ব্ল্যাক স্যুট! কি করে ভাবতে পারলে রাত দুপুরে একজন লোক এসে বাইরের ঘরে ঢুকেছে? এটা কি সম্ভব? দরজাটাও তো তুমি নিজে বন্ধ করেছিলে। ঐ দ্যাখো, দরজা এখনো বন্ধ। বলেই মশারির ভেতর থেকেই দরজার ওপর টর্চ ফেলল।
রীণা চুপ করে রইল। তারপর শুকনো গলায় বলল, কি একটা পড়ে ভেঙেছে।
সঞ্জয় বলল, সেও তোমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। কই আমি তো ভাঙার চিহ্নমাত্রও দেখতে পেলাম না।
রীণা কোনো একটিরও উত্তর দিতে পারল না। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।
সঞ্জয় হেসে বলল, নাঃ, তোমার দেখছি নার্ভ ফেল করছে। এরপর মাথাটা একেবারে যাবে।
–বিশ্বাস করো
রীণা মিনতির স্বরে আরো কি বোঝাতে যাচ্ছিল, সঞ্জয় বলল, ও সব কথা থাক। এখন একটু ঘুমোও তো। বলে নিজেই পাশবালিশ আঁকড়ে শুয়ে পড়ল।
.
সকালের রোদ খাটের ওপর পর্যন্ত উঠে এসেছে। সঞ্জয় তখনো ঘুমোচ্ছে। হয়তো আরো কিছুক্ষণ ঘুমোত। কিন্তু রীণার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।
–এ-ই শুনছ?
–উ।
–একবার এসো না।
দূর বাবা, ওখান থেকেই বলো না।
–বললে হবে না। তাড়াতাড়ি এসো।
উঃ! জ্বালালে! সকাল থেকেই
ঘুম জড়ানো চোখে সঞ্জয় উঠে এল।
–এসো এইখানে। এটা কি? রীণা আঙুল দিয়ে মেঝেটা দেখাল।
সঞ্জয় দেখল টেবিলের নিচে একটা গেলাস ভেঙে পড়ে আছে।
রীণা দুহাত কোমরে রেখে বলল, খুব তো বলেছিলে আমি পাগল হয়ে গেছি। এখন নিজের চোখেই দ্যাখো।
সঞ্জয় হেঁট হয়ে কাচগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। গেলাসটা উঁচু জায়গা থেকেই পড়ে ভেঙেছে। কেউ যেন টেবিল থেকে গেলাসটা ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে।
এখন বুঝছ?
সঞ্জয় বাসি মুখেই একটা সিগারেট ধরাল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, বলতে চাও ভূতে গেলাস ভেঙেছে?
–আমি আর কি বলব? তুমি নিজেই দ্যাখো।
–টেবিলের ধারে গেলাসটা রেখেছিলে, টিকটিকি-ফিটিকিতে ফেলে দিয়েছে।
না কক্ষণো ধারে রাখিনি। গেলাস কেউ টেবিলের ধারে রাখে না।
সঞ্জয় কোনো উত্তর দিল না। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে হেসে বলল, এতে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। বেড়ালের কাজ। যাও, এখন বেশ ফাস্ট ক্লাস করে চা করো দিকি। মেজাজটা আসুক। আমি ততোক্ষণ আর একটু শুই। বলে সঞ্জয় আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
রীণা দাঁড়িয়ে রইল জানলার সামনে। উদ্ভ্রান্ত মন। শহর কলকাতা জেগেছে। অতি পরিচিত সকাল। কিন্তু দিনের শুরু থেকেই মনটা ভারী হয়ে রইল।
.
০৫.
একখানি ছবি
হাসপাতালে বেরোবার সময়ে রীণা বলল, সন্ধের মধ্যে ফিরবে কিন্তু।
সঞ্জয় হেসে বলল, বাইরে বেশিক্ষণ থাকার তেমন কোনো আকর্ষণ এখনো পর্যন্ত নেই।
ঠাট্টা রাখো। সন্ধেবেলা লোডশেডিং হলে আমার খুব ভয় করে।
জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে সঞ্জয় বলল, খাস কলকাতা শহরে থেকেও ভয়? তাও তো তিনতলার ওপর।
উত্তরের অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল, রীণা বলল, আমার জিনিসগুলো আনতে ভুলো না।
–না, ভুলব না। তবে তুমিও একটা কথা মনে রেখো, রাত্তিরের ব্যাপারগুলো যেন তোমার বান্ধবীটিকে বলো না। এক কান থেকে পাঁচ কানে চলে যাবে। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।
–আমার আবার বান্ধবী কে? রীণার কপালে সুন্দর ভাঁজ পড়ল।
–ঐ যে নিচে বলে সঞ্জয় আঙুল দিয়ে দোতলার ঘরটা দেখিয়ে দিল।
–ওঃ! বন্দনার মা। রীণা একটু হাসল, বান্ধবী হতে যাবেন কেন? বয়েসে ঢের বড়ো। তবু ওঁরা কাছে থাকেন বলে গল্প করে বাঁচি।
–গল্প যত পারো করো। শুধু ভূতের গপ্প ছাড়া।
বলতে বলতে সঞ্জয় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।
.
সন্ধের আগেই সঞ্জয় ফিরল। হাতে কিছু জিনিসপত্তর ছিল বলে ট্যাক্সি করে ফিরতে হয়েছিল। ট্যাক্সি থেকে নামতেই মহিমারঞ্জনবাবু নমস্কার করে সামনে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে আরো কয়েকজন। এঁরা সবাই এ বাড়িরই ভাড়াটে। সকলের সঙ্গে আলাপ নেই। আলাপ করার সময়ও নেই। একজনের সঙ্গেই মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হয়। তিনি দোতলার নিখিলবাবু-বন্দনার বাবা। এঁদের মধ্যে সঞ্জয় তাকে দেখতে পেল না।
–কিছু বলবেন? সঞ্জয় প্রতি-নমস্কার করল।
কাল রাত্তিরে আপনার ঘরে একটা যেন গোলমাল শুনলাম!
সঙ্গে সঙ্গে আর একজন বললেন, আমরাও শুনেছিলাম। ভেবেছিলাম সকালেই জিজ্ঞেস করব কিন্তু এত ব্যস্ত হয়ে আপনি বেরিয়ে গেলেন যে
মহিমাবাবু কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আমার ওয়াইফ তো রাত্তিরেই খোঁজ নিতে যাচ্ছিলেন। বললেন, একই বাড়ির বাসিন্দে। বিপদ-আপদ হলে পাশে দাঁড়াতে হয়। তা আমি বারণ করলাম–এখুনি যেও না। আগে দ্যাখো গুরুতর কিছু কি না। তা ওয়াইফ আর গেলেন না। আমরা দুজনেই অনেকক্ষণ জেগে রইলাম। আর কিছু শুনতে পেলাম না। তখন নিশ্চিন্তে ঘুমুলাম।
সঞ্জয় একটু হাসল। ধন্যবাদ। ব্যাপার কিছুই নয়। একটা বাজে স্বপ্ন দেখে আমার স্ত্রী ভয় পেয়েছিলেন।
–তাও ভালো। আমরা ভাবলাম বুঝি চোর ডাকাত। যা দিনকাল পড়েছে।
আর একজন বললেন, কিন্তু ঝনঝন্ করে একটা কাচের জিনিস ভাঙার শব্দ পেলাম যেন।
-ও কিছু নয়। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি এড়িয়ে যেতে চাইলটেবিলে গেলাসটা ছিল। হুলো বেড়াল লাফিয়ে উঠতে গিয়ে
ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পড়লেন, হুলো বেড়াল! বলেন কি!
মহিমাবাবু মাথা নাড়লেন, এ বাড়িতে তো এতদিন রয়েছি। বেড়াল তো দেখিনি। বিভূতিবাবু কি বলেন?
বিভূতিবাবু সিগারেট খাচ্ছিলেন। একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললেন, হুলো বেড়াল! আজ পর্যন্ত একটা বেড়ালছানাও তো চোখে পড়েনি, বেড়াল থাকলে তো বেঁচে যেতাম। ইঁদুরের জ্বালায় অস্থির।
সঞ্জয় এঁদের অহেতুক কৌতূহলে বিরক্ত হচ্ছিল। কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে বলল, তাহলে হয়তো ইঁদুরেই ভেঙে থাকবে। আচ্ছা, আমি এখন যাই। আমার স্ত্রী অপেক্ষা করছেন।
বলেই সিঁড়ির দিকে চলে গেল। মহিমাবাবুরা কেমন একটু অবাক হয়ে সঞ্জয়কে দেখতে লাগল।
–ভদ্রলোক বড়ো অহংকারী।
আর একজন বললে-ডাক্তার কিনা।
খুবই বিরক্ত হয়েছিল সঞ্জয়। কাল রাত্তিরের ব্যাপারটা তাহলে জানাজানি হয়ে গেছে। ব্যাপারটা যে নিতান্তই তুচ্ছ তা ওঁরা যেন মানতে চাইছেন না। আসলে এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা যুক্তির ধার ধারতে চায় না। ভয় পেতে আর ভয় পাইয়ে দিতে ভালোবাসে।
পরক্ষণেই সঞ্জয়ের মনে হল, একটা গোঁজামিল কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সেটা ঐ গেলাস ভাঙা নিয়ে। সত্যিই তো এখানে এসে পর্যন্ত একটা বেড়ালও কোনোদিন চোখে পড়েনি। তাহলে কাল রাত্তিরে হঠাৎ বেড়াল এল কোথা থেকে? এলই যদি তো গেল কোথায়? আর এল এমন সময়ে যখন নাকি রীণা দেখছিল কিছু একটা! নাঃ, এর কোনো মীমাংসা নেই দেখছি।
বাবাঃ! কী এত গল্প হচ্ছিল ওঁদের সঙ্গে? হাসতে হাসতে রীণা এসে দাঁড়াল দরজার সামনে।
যাক, রীণাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে। মুখে বললে, গল্পই বটে। কাল রাত্তিরের ব্যাপারটা সব জানাজানি হয়ে গেছে। চেঁচামেচি করে যা একটা কাণ্ড করলে!
কাণ্ড তো আমিই করেছি! গেলাসটাও আমি ভেঙেছি না?
আবার সেই গেলাস! সঞ্জয় বিষয়টা ঝেড়ে ফেলবার জন্যে হেসে বলল, খুব খোশ মেজাজ দেখছি। আজ আর বুঝি তিনি দর্শন দেননি?
মুহূর্তে রীণার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
–দোহাই তোমার! আর মনে করিয়ে দিয়ো না। হাত মুখ ধুয়ে নাও। আজ কি জলখাবার করেছি বল দিকি?
–ঘুগনি-স্পেশালিস্টের হাতে ঘুগনি ছাড়া আর কি হবে?
–আহা! ঘুগনি ছাড়া আর যেন কিছু করি না? নিন্দুক আর কাকে বলে?
বলতে বলতে রীণা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।
একদিন রীণার কথাবার্তা শুনে, মুখ চোখের অবস্থা দেখে সঞ্জয় দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। আজ ওর এই হাসিখুশি ভাব দেখে যেন নিশ্চিন্ত হল।
পুপু শুয়ে শুয়ে খেলা করছিল। সঞ্জয় কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল।
গত রাত্তিরের আতঙ্ক ভোলার জন্যে আজ রীণা সারা দুপুর নানা কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিল। কিছুক্ষণ দোতলায় নেমে গিয়ে নিখিলবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করেছে। মহিলাটিকে রীণার খুব ভালো লাগে। ওপরে এসে কিছুক্ষণ নতুন-কেনা টেপটা বাজিয়েছে। মেশিনে পুপুর জন্যে একটা জামা সেলাই করতে বসেছিল। সাড়ে তিনটে নাগাদ রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকেছিল কেক তৈরি করার জন্যে।
কেক খেয়ে সঞ্জয় ভারি খুশি।
–আঃ! দারুণ! দাঁড়াও, আমিও কিছু এনেছি তোমার জন্যে। বলে ব্যাগ থেকে কতকগুলো প্যাকেট বার করল। এই নাও তোমার ডালমুট।
খুশিতে রীণার দুচোখ নেচে উঠল। ঝাল নয় তো? পুপু আবার খেতে শিখেছে।
–খেয়েই দ্যাখো। আর–এই পুপুর দুধ। এই চা। এবার খুব ভালো ফ্লেভারওলা চা এনেছি। এই তোমার সার্টিফিকেটের জেরক্স কপি।
যাক বাঁচলাম। কি ভাগ্যি সার্টিফিকেটগুলো হারাওনি।
—আমি সময়ে সময়ে হার মানি, কিন্তু চট করে কিছু হারাই না।
–থাক। হয়েছে। আজ পর্যন্ত কটা ছাতা, কটা টর্চ, কটা পেন হারিয়েছ তার হিসেব দেব? ওটা আবার কি? ব্যাগের মধ্যে!
–ঐ দ্যাখো, একদম ভুলে গেছি। অবশ্য এমন-কিছু নয়। একটা ছবি।
.
গত কাল হাসপাতাল থেকেই সঞ্জয় গিয়েছিল এক বৃদ্ধ রুগীকে দেখতে। বৃদ্ধ সঞ্জয়ের চিকিৎসায় ক্রমশ উন্নতি করছে।
রুগী দেখা হয়ে গেলে তার বাড়ির লোক অনুরোধ করল এক কাপ কফি খাবার জন্যে। সঞ্জয় খুব টায়ার্ড ছিল। খেতে রাজী হল।
বাইরের ঘরে বসে বৃদ্ধের ছেলের সঙ্গে সঞ্জয় গল্প করছিল। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে বাড়িটা দেখছিল। পুরনো বাড়ি। সামনে অনেকখানি উঠোন। ওদিকে ভাঙা পুজোদালান। বাড়ির একদিকটা ভেঙে পড়েছে।
সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, গোটা বাড়িটাই আপনাদের?
ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ।
–পুজোটুজো হতো দেখছি।
–হ্যাঁ, সে-সব বহুকাল আগে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো দুইই হতো। শুনেছি একবার বলি বেধে যাওয়ার পর থেকে পুজো বন্ধ হয়ে যায়।
বাড়িটা কবে তৈরি হয়েছিল?
ভদ্রলোক বললেন, তা বলতে পারি না। ঠাকুর্দা কিনেছিলেন জলের দরে, সেই বম্বিং-এর সময়ে।
সঞ্জয় কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা, আগে তখন এই-সব জায়গা কিরকম ছিল? :
ভদ্রলোক হাঙ্গলেন। বললেন, আমি ঠিক বলতে পারব না।
সঞ্জয় একটু লজ্জিত হল। বলল, তা ঠিক। আপনি আর কি করে বলবেন? আসল কথা কি জানেন, এইরকম পুরনো বাড়ি দেখলে আমার কেমন কৌতূহল হয় এর অতীতকে জানার জন্যে।
ভদ্রলোক বললেন, সে-সব জানতে হলে বাবার কাছে চলুন।
সঞ্জয় একটু ইতস্তত করল। রুগীর কাছে. ডাক্তার একই সময়ে দু বার গেলে রুগী ঘাবড়ে যেতে পারে।
ভদ্রলোক বললেন, আপনি ভাববেন না। আমি বাবাকে বলে আসছি।
ভদ্রলোক ওপরে চলে গেলেন। একটু পরে এসে বললেন, আসুন।
বৃদ্ধ খাতির করে সঞ্জয়কে বসালেন। বললেন, আপনি কি এ বাড়িটা সম্বন্ধেই কিছু জানতে চান?
সঞ্জয় বলল, না, শুধু এ বাড়িটাই নয়। এরকম বোধ হয় আরো অনেক পুরনো বাড়ি আছে। এই ধরুন আমি যে বাড়িটায় ভাড়া আছি
–সেটা কোথায়?
যশোর রোডের ওপরে বাঙ্গুরের কাছে। সে বাড়িটাও খুব পুরনো। তিনতলা বাড়ি। তিনতলাটা ইনকমপ্লিট। ওপরে আবার একটা ভাঙা গম্বুজের মতো আছে।
বৃদ্ধ বললেন, পুরনো বাড়ি সম্বন্ধে আপনার কৌতূহল আছে জেনে খুব ভালো লাগল। কলকাতায় বিশেষ করে মারাঠা ডিচের ওপাশের জায়গাগুলো একশো-দেড়শ বছর আগে কী ছিল তা কল্পনাই করা যায় না। এ বিষয়ে আমি একজনের নাম জানি, গোটা উল্টোডিঙি এলাকার অর্থাৎ আজ যাকে বলে লেকটাউন, কালিন্দী, বাঙ্গুর, বরাট এ-সব জায়গার ঠিকুজি-কুষ্ঠী তাঁর কণ্ঠস্থ। তাঁর নাম শিবানন্দ ভট্টাচার্য। থাকেন বাগুইহাটিতে। বয়েস একশো তিন। ইচ্ছে করলে তার কাছে যেতে পারেন।
–একশো তিন বছর বয়েস! সঞ্জয় অবাক হল।
–হ্যাঁ, এখনো তেতলা-একতলা করেন। সারাজীবন জ্যোতিষচর্চা নিয়ে থেকেছেন- জপ-তপ-ব্রহ্মচর্য—-ওসব মশাই আলাদা স্তরের মানুষ। দাঁড়ান, ওঁর ছবি দেখাচ্ছি।
এই বলে ছেলেকে ইশারা করলেন। ভদ্রলোক তখনই ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরেই ফিরে এলেন। হাতে জীর্ণ একটা খাম। বৃদ্ধ খাম থেকে জীর্ণতর বিবর্ণ একটা ফটোগ্রাফ বের করলেন।
–এই হলেন শিবানন্দ ভট্টাচার্য। আর তাঁর পদতলে আমি।
সঞ্জয় ছবিটা দেখল। পিছনে লেখা রয়েছে–পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান কপিলেশ্বর চৌধুরীকে মেহোপহার। নিচে তার স্বাক্ষর। সেই সঙ্গে ঠিকানা।
–ছবিটা আপনি নিয়ে যান। বয়েসের জন্যে ওঁর মেজাজটা এখন রুক্ষ হয়ে গেছে। যদি আপনি দেখা করতে যান তাহলে এই ছবিটা দেখিয়ে বলবেন আমি পাঠিয়েছি। তা হলে উনি বোধহয় আপনাকে ফিরিয়ে দেবেন না।
.
ছবিটা কাল রাত্তিরে আর বের করা হয়নি। বাইরের ঘরে ব্যাগের মধ্যেই ছিল।
ছবিটা রীণা খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখছিল। সঞ্জয় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, কি এত দেখছ?
–এত বয়েস কিন্তু চোখ দুটো দ্যাখো যেন জ্বলছে। মনে হচ্ছে যেন ত্রিকালদশী কোনো সাধক।
বলতে বলতে রীণার দু চোখও যেন কেমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠল।
সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, অমন করে দেখছ কেন?
–এঁকে কোথায় যেন দেখেছি। কোথায়
–এঁকে আবার দেখবে কি করে? বহুকাল কলকাতার বাইরে যাননি। তুমিও বড়ো একটা কলকাতায় আসনি।
রীণ কোনো উত্তর দিল না। হঠাৎ উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
কী হল?
–মাথার ভেতরটা কিরকম করছে!