1 of 2

১.১৯ ঐক্য ও শান্তি

ঐক্য ও শান্তি

বহু জাতি গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় নিয়ে মানুষের বৃহৎ সমাজ। এদের ভিতর সহযোগ ও সংঘর্ষ একই সঙ্গে চলছে প্রাচীন কাল থেকেই। শুধু সংঘর্ষের কথা বললে সম্পূর্ণ সত্য বলা হয় না, আবার শুধু সহযোগের কথা বললেও সবটা বলা হয় না। আসলে সহযোগ ও সংঘর্ষ মিলেই একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, মানুষের সমাজ ও ইতিহাসের সঙ্গে যেটা মিশে আছে। ওতপ্রোতভাবে।

আমরা ভিতরের অথবা বাইরের দিকে যতদূরই যাই না কেন, এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা থেকেই যায়। যদি বলি জাতি, শ্রেণী বা সম্প্রদায়বিশেষের অভ্যন্তরে আছে একা, আর দুই জাতি, দুই সম্প্রদায়ের ভিতর চলে পারস্পরিক সংঘর্ষ, তবে আবারও কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। প্রতিটি জাতি, শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরেও আছে একই সঙ্গে সংঘর্ষ ও সহযোগ। এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা আমাদের পরিচিত সংসারে অন্তৰ্য্যাপ্ত ও সর্বত্র প্রসারিত। এর পরও কেউ প্রশ্ন করেন, কোনটা প্রধান? সংঘর্ষ না সহযোগ? একদিক থেকে দেখতে গেলে এ প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না। শুধু সহযোগের উপর ভিত্তি করে একটা আদর্শ সমাজের কল্পনা করা যায় বটে, কিন্তু বাস্তবে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সমাজ বস্তুটা পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, এই পরিবর্তনকে দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্ত করে সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকেও অবশ্য বিষয়টা দেখা সম্ভব, সে কথা পরে বলব।

দ্বন্দ্বে বিধৃত যে সংঘর্ষ-সহযোগের কথা এইমাত্র বলা হল তার একটা সাধারণ বাস্তব ভিত্তি আছে, যেটা বোঝা যায় সহজেই। ধনলাভের দুটি উপায়, এক হল অন্যের কাছ থেকেআকাঙ্ক্ষার বস্তু কেড়ে নেওয়া আর দ্বিতীয় উপায় ধনোৎপাদন করা। সন্তান থেকে শুরু করে সব রকমের ধনোৎপাদনের জন্যই শেষ অবধি কোনো না কোনো প্রকারের সহযোগিতা আবশ্যক হয়। কেড়ে নেওয়ার পদ্ধতির নানা বৈচিত্র্য আছে, সহযোগিতারও। বিভিন্ন অবস্থার ভিতর দিয়ে সংঘর্ষ ও সহযোগের ধরনটা কীভাবে বদলে চলে, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে সেটা আমরা জানবার চেষ্টা করি।

উৎপাদন না হলে কেড়ে নেবার মতো বিশেষ কিছু থাকে না। সেই অর্থে উৎপাদনকে প্রাথমিকতা দেওয়া অসঙ্গত নয়। যারা সমাজের শাসকতা তাদেরও এই কথাটা মেনে নিতে হয়, শুধু লুঠতরাজের ওপর সমাজকে বেশিদিন রক্ষা করা যায় না।

আরও একটা গভীর অর্থে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষেরা তাঁদের বিশ্ববীক্ষায় ঐক্য ও সহযোগকে সংঘর্ষের চেয়ে বড় সত্য বলে স্থান দিয়েছেন। এদের চিন্তায় একটা নিছক দূরের আদর্শের কথা বলা হয়নি, বরং তার ভিতর একটা নিত্যসত্যও আছে। এঁরা বলছেন, হিংসাই যদি প্রধান হত, সহযোগের চেয়ে যদি সংঘর্ষের শক্তি বড় হত, তবে মানুষের সমাজ এতদিনে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ত। যেমন পরিবারের ভিতর কলহই যখন প্রধান হয়ে ওঠে তখন সেই পরিবার ভেঙে পড়ে, বৃহত্তর সমাজেও তেমনি একটা কার্যকর। ঐক্যের ভাবনা আবশ্যক। সংঘর্ষটা চোখে পড়ে বেশি, ঐক্য প্রায়শ নিঃশব্দে চলে, তবু সেটা সত্য। হিংসা ও কলহের চিন্তা যখন আমাদের চেতনাকে অধিকার করে বসে তখন অবশ্য বৃহত্তর ঐক্যের ভাবনাকে আমরা ব্যঙ্গবিদৃপ করি, কিন্তু পরিবার ও সমাজ একেবারে। ভেঙে পড়লে এমন কোনও জায়গা খুঁজে পাওয়াও কঠিন হয় যেখানে দাঁড়িয়ে কলহ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।

কোনও দূর ভবিষ্যতের জন্য নয়, এই বহতা কালেই, সংঘর্ষের পাশাপাশি সহযোগ ও সহাবস্থানের চিন্তা মানুষের পক্ষে জরুরী। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে একটা নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। আর সেই সঙ্গে আমাদের স্বদেশচিন্তা ও ইতিহাসবীক্ষাতেও। এই দৃষ্টিভঙ্গী একটা বিশেষ মূল্য লাভ করেছে। পৃথিবীময় এই ভাবনায় ভারতভাবনার একটা বিশেষ স্থান আছে।

.

উত্তরে হিমালয় আর দক্ষিণে সাগরে বেষ্টিত এই যে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ, এখানে প্রাচীনকাল থেকেই বহুজাতি ও ভাষা, বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির ভিতর স্থায়ী সহাবস্থানের সূত্রের অম্বেষণ চলেছে। এদেশের ইতিহাস ও ভূগোলের সঙ্গে এই অন্বেষণের যোগ আছে। হিমালয় অতিক্রম করে, বিশেষত উত্তরপশ্চিমের গিরিবর্ত্ত ধরে, একে একে বহু জাতি ভারতের সমভূমিতে এসে পৌচেছে। সমুদ্র অতিক্রম করেও নানা ধর্মের নানা মানুষ এদেশে এসেছে। এইভাবে প্রাচীনকাল থেকে যারা একের পর এক এই উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে তাদের অনেকেই আর ফিরে যায়নি, কয়েকটি প্রজন্মের ভিতরই এইসব বিচিত্র জাতিভাষাধর্মের মানুষেরা এদেশরই সন্তান হয়ে উঠেছে। এদের সবাইকে নিয়েই এদেশের বৃহৎ ও বহুত্বে চিহ্নিত সমাজ।

বহুত্বের ভিতর ঐক্য রক্ষার একটা সহজ উপায় প্রাচীন কাল থেকেই ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ এদেশে নিজ নিজ আচারের বিভিন্নতা নিয়ে পাশাপাশি বাস করেছে। পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে রাজা ও সম্রাট পর্যন্ত সবাই এই বিভিন্নতাকে মান্য করে চলেছে। গড়ে উঠেছে স্থানীয় ও জাতিভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন। রাজভাষা বা পণ্ডিতদের ভাষা যদিও বিশেষ সম্মানের। অধিকারী হয়েছে তবুও প্রাকৃত ভাষাও সংস্কৃতের দ্বারা একেবারে আচ্ছন্ন হয়নি। অধ্যাত্ম ও ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে নানা মতবাদ, ঈশ্বর অথবা মুক্তি সাধনার নানা পথ, সেকালে পাশাপাশি স্থান পেয়েছে। কোনও একটি সত্যধর্ম অন্য সব ধর্মকে গ্রাস করে নেয়নি।

একথাটা অবশ্য সবাই মেনে নেবেন না। আপত্তি তুলবার মতো কিছু সঙ্গত যুক্তিও আছে। প্রাচীন সমাজে ব্রাহ্মণের একটা বিশেষ স্থান ছিল। সেই আধিপত্যের আসনের ওপর আক্রমণ ব্রাহ্মণের কাছে সহনীয় ছিল না। যজমানি ব্যবস্থা ও পুরোহিতের কিছু বিশেষ অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেত না, অত সাধারণ সংসারী মানুষের জন্য প্রাচীন হিন্দু সমাজে এই ছিল কঠোর বিধান।

তবুও একথা স্বীকার্য যে, ব্রহ্মজিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে বা সত্যাসত্যের বিচারে প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাভাবনায় এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গী পাওয়া যায় যাতে ঐক্যের সঙ্গে সঙ্গে বহুত্বের মূল্য বিশেষভাবে স্বীকৃত। এই দৃষ্টিভঙ্গী সম্বন্ধে ভালোমন্দ দু’রকমের কথাই শোনা গেছে, কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করা যায় না। বিষয়টা সামান্য ব্যাখ্যা করে বলা যাক।

মনুষ্যজাতির ধর্মীয় চেতনার বিবর্তনের একটা ছক বিশেষত পাশ্চাত্ত্য চিন্তায় পাওয়া যায়। মানুষ কোনও এককালে গাছপাথর কত কিছুতেই অতিপ্রাকৃত শক্তি আরোপ করতে অভ্যস্ত ছিল, তার ধর্মে ছিল জাদুবিদ্যার প্রাধান্য। এককালে বহু দেবদেবীর পুজো ধর্মবোধের অঙ্গ ছিল, তার প্রচলন বহুবিস্তৃত ছিল। একেশ্বরবাদ ধর্মচেতনার এক উচ্চতর স্তর। ইহুদী ঐতিহ্যে এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন অপেক্ষাকৃত ভ্রান্ত ধারণাকে খারিজ করেই অপেক্ষাকৃত নির্ভুল তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, ধর্মীয় চেতনার বিবর্তনে এইরকম হওয়াটা ন্যায়সঙ্গত। একেশ্বরবাদের সত্যে যারা পৌচেছে তাদের কর্তব্য হল বহু দেবদেবীর পুজো বর্জন করা। ঈশ্বর বা আল্লাহ এক, সত্য এক, বহু মিথ্যা অথবা অর্ধসত্যকে পরাস্ত করেই এই সত্যকে জয়ী হতে হবে।

হিন্দুদের ভাবনাচিন্তা এইরকমের ছিল না। এখানে প্রাচীন ও নবীন অকাতরে পাশাপাশি বাস করেছে। বহু দেবদেবীর পুজোর পাশেই একেশ্বরবাদ স্থান করে নিয়েছে। আবার একেশ্বরবাদকেও অতিক্রম করে প্রাচীন ভারতের অধ্যাত্মচিন্তা সগুণ ও নিগুণ ব্রহ্মের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হয়েছে। মুক্তি বা নির্বাণের পথের অম্বেষণটাই প্রধান কথা। আধ্যাত্মিক সত্য নানা মানুষের কাছে নানা ভাবে আসে, সম্পূর্ণ রূপে সেই সত্য অনির্বচনীয়। যা প্রকাশ করা যায় তা হয় তো আংশিক সত্য। এদেশে তর্কের অভাব ছিল না। কিন্তু বহুরূপে সত্যের প্রকাশ সম্ভব এইরকম চিন্তা, অনেকান্তবাদী সম্ভাবনার ধারণা, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের ঐতিহ্যে স্থান পেয়েছিল।

এইভাবে নানা বিচিত্র আচার ও বিচারকে একই সঙ্গে গ্রহণ করে ভারতীয় ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। এগারো শতকে মহাপণ্ডিত আল বেরুনী যখন এদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় লাভ করেন তখন এই জিনিসটা তিনি বিশেষ ভাবে লক্ষ করেন। তিনি বলেন, এদেশের জ্যোতির্বিদ্যায় ও অন্যান্য চিন্তায় মুড়িমুড়কি এক হয়ে যায়, “মল ও মণিমুক্তো” মিলে মিশে থাকে। এরা বিশ্বাস করে যে, রাহু চন্দ্রসূর্যকে গিলে খায়, অথচ গ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও এদের অজানা নয়। “এদের চোখে দুইই সমান মান্য।” (“l can only compare their mathematical and astronomical literature, as far as I know it, to a mixture of pearl shells and sour dates, or pearls and dung…..Both kinds of thing are equal in their eyes.”)

সমালোচকের দৃষ্টি নিয়ে বলা যায়, ভারতীয় ঐতিহ্যে কুসংস্কার ত্যাগ করবার শক্তি দুর্বল। আবার প্রশংসার ভাষায় বলা চলে, আমাদের ঐতিহ্যে বহু মত ও পথকে একই সঙ্গে মান্যতা দেবার সহিষ্ণুতা বেশি। যাই বলি না কেন, ভারতীয় প্রাচীন ঐতিহ্যের এই এক বৈশিষ্ট্য। এদেশের ইতিহাসে, বিশেষত সাধারণ জীবনের স্তরে, ধারাবাহিকতা বেশি, ছেদ কম। এদেশের ঐতিহ্য বহু বিচিত্রকে গ্রহণ করতে করতে শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রম করে চলেছে, দীর্ঘ যাত্রাপথে ভারতের সমাজ ও চেতনা অপরিবর্তিত থাকেনি, তবু প্রাচীনকে বর্জন করেনি। ক্ষমতা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে লড়াই এদেশেও চলেছে, তবু ভারতের বৈশিষ্ট্য সেখানেও তার চিহ্ন রেখে গেছে।

.

“ভালো” “মন্দ”, সত্যাসত্য, সব কিছুকে সমদৃষ্টিতে দেখবার যে-প্রবণতা আল বেরুনী ভারতীয়দের ভিতর লক্ষ করেছিলেন সেটাকে তাঁর সমর্থনযোগ্য মনে হয়নি, বরং এদেশীয় বিচারবিমূঢ়তাই সেখানে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ইহুদী ঐতিহ্য ইসলামেরও জনক, অন্তত এ-দুয়ের মধ্যে একটা অনস্বীকার্য যোগসূত্র আছে। ভ্রান্তধর্মকে উৎপাটিত করে সত্যধর্মের প্রতিষ্ঠাকে এই ঐতিহ্যে কর্তব্য বলে মনে করা হয়েছে। একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রচারকে ইসলাম একদিন তার ঐতিহাসিক কর্তব্য বলেই গ্রহণ করেছিল। মোহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম একশ’ বছরের ভিতর সেই নতুন ধর্মের বিজয় অভিযান ছিল এমনই নাটকীয়, পশ্চিম এশিয়া থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা অতিক্রম করে ইউরোপ অবধি তার বিস্তৃতি ঘটেছিল এমনই দ্রুতগতিতে, যে, সারা দুনিয়ায় এই ধর্ম অচিরেই শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে এইরকম একটা ধারণা সৃষ্টি হওয়া সেদিন অস্বাভাবিক ছিল না। যতদিনে ভারতের অভ্যন্তরে ইসলাম স্থায়ী রাজশক্তির রূপ নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ততদিনে অবশ্য তার আদিপর্বের তেজ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। তবু ভারতের ইতিহাসে ইসলামের আবিভাব যে একটা নতুন যুগের সৃষ্টি করেছিল এবিষয়ে সন্দেহ নেই।

ধর্মীয় বহুত্বকে রক্ষা করবার কোনও প্রতিজ্ঞা নিয়ে ইসলাম এদেশে প্রবেশ করেনি। তবু কালক্রমে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে মোহাম্মদের সংগ্রামী ধর্মকে একটা রফা করতে হল। এব্যাপারে পারস্য আর ভারতের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করবার মতো। প্রাচীন। আর্যধর্মের সুবাদে ভারতের সঙ্গে পারস্যের কোনও এককালে মিল ছিল। সেই অগ্নিপূজকদের দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবও একদিন গিয়ে পৌঁছেছিল। ইসলামের আগমন ইতিহাসের পরবর্তী যুগে। মোহাম্মদের ধর্মেরও অবশ্য কিছুটা রূপান্তর ঘটেছে, ইরানের ধর্ম আর আরবদেশের ধর্ম একবস্তু নয়। তবু ইসলাম পারস্যে দেশজোড়া আসন লাভ করেছে, ওদেশের প্রাচীন ধর্ম কার্যত লোপ পেয়েছে। ভারতে এইরকম ঘটেনি। কয়েক শতাব্দীব্যাপী মুসলমান শাসনের পরও এই দেশটা বহুধর্মের দেশই থেকে গেছে, ইসলাম ভারতে অধিকাংশের ধর্ম হয়ে ওঠেনি।

এথেকেই কিছু প্রশ্ন ওঠে। ইসলাম ভারতের অন্যতম ধর্ম। শুধু কি অস্ত্রবলে এই ধর্ম এদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুসলমান শাসকেরা তো দীর্ঘকাল ধরেই এদেশে রাজত্ব করেছে। এদেশের অধিকাংশ মানুষ তবে অ-মুসলমান থেকে গেল কীভাবে? দিল্লীর নিকটবর্তী যেসব অঞ্চলে মুসলমান শাসন সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল সেখানেও তো সবাই মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়নি। অযোধ্যাতেও একসময় মুসলমান শাসক ছিল। সারা উত্তরভারতেই পাওয়া যাবে সংখ্যাধিক হিন্দুধর্মীর সঙ্গে মুসলমান শাসকের দীর্ঘ সহাবস্থান।

পূর্ববঙ্গে মুসলমানেরা সংখ্যায় অধিক। এখানে ধর্মন্তরগ্রহণের নিশ্চয়ই একটা ব্যাখ্যা আছে। নীচুজাতের হিন্দুরাই অধিক সংখ্যায় ধর্মান্তরিত হয়। ওখানকার জমিদারেরা। অধিকাংশই ছিল হিন্দু, প্রজাদের ভিতর মুসলমানই বেশি। মুসলমান নবাব কিছু ছিল বটে, কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান দরিদ্রই থেকে গেছে। নিতান্ত অস্ত্রের শক্তিতে অথবা অর্থের। লোভ হিন্দুদের মুসলমান ধর্মগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল এই ব্যাখ্যা দাঁড়ায় না। হিন্দুধর্মের ভিতরই এমন কিছু দুর্বল ছিল যেটাকে বাদ দিয়ে মুসলমানধর্মের প্রভাব ব্যাখ্যা করা যায় না। দেশ স্বাধীন হবার পরেও আমাদের চোখের সামনেই অস্পৃশ্য ও নীচুজাতের হিন্দুরা

অপমানজনক সামাজিক অসাম্যের প্রতিবাদে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছে। শিখধর্মেরও এইরকম একটা আকর্ষণ স্বীকার করতে হয়। এদেশে সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সঙ্গে ধর্মান্তরগ্রহণের একটা যোগ আছে। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা একথাটা সহজে মানতে চায় না, তবু কথাটাকে উপেক্ষা করাও যায় না।

তুর্কী ও মোগল যোদ্ধারা অসিবলে ভারতের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের অনেকটাই জয় করে নিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন হিন্দুসমাজের দুর্বলতা সত্ত্বেও তারা এদেশের সর্বত্র মুসলমানধর্মের প্রতিষ্ঠা করবার কোনও স্থায়ী ও চূড়ান্ত চেষ্টা করেনি। এর কিছুটা কারণ সহজেই বোঝা যায়।

যারা দেশ জয় করতে এসেছিল তারা সাম্রাজ্য স্থাপন ও দেশশাসন করতে চেয়েছে, নতুন অভিজাতশ্রেণীর স্বার্থে স্থায়ী রাজস্বসংগ্রহের ব্যবস্থা করতে চেয়েছে। ধর্মস্থাপন করা। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না, অনেকের কাছেই প্রধান উদ্দেশ্যও ছিল না। জোরজুলুম করে সারাদেশে মোহাম্মদের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এদেশে যুদ্ধবিবাদ ও অসন্তোষের আগুনকে বাড়িয়ে তোলা হবে, তাতে অর্থব্যয় যতটা বৃদ্ধি পাবে রাজস্ব ততটা বাড়বে না, সাম্রাজ্যে শান্তি ও স্থায়িত্ব আনবার পথ সেটা নয়। এইরকম একটা বোধ মুসলমান শাসকদের ভিতর কাজ করেছিল। ঔরঙ্গজেব যতটা গোঁড়া মুসলমান ছিলেন অন্যান্য মোগল সম্রাটেরা তেমন ছিলেন না। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা, সদ্ভাব বজায় রাখা, এটাই তাঁদের কাছে অপেক্ষাকৃত জরুরী ছিল।

বহুত্বের বিনাশ নয়, বরং হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে একটা ধর্মীয় সমম্বয়ের চেষ্টা উল্লেখযোগ্য সেই যুগে। এর যে-প্রকাশ ঘটেছিল ভক্তি আন্দোলনের ভিতর তার কথা আমরা অনেকেই অল্পবেশি জানি। এদেশে এমন সুফী পীর ও সাধকের অভাব নেই যাঁরা হিন্দু-মুসলমানের কাছে সমভাবে শ্রদ্ধেয়, এমন দরগা ও পুণ্যস্থানও অনেক আছে, যেখানে উভয় ধর্মের মানুষেরই ভিড় দেখা যায়। পারস্যের মরমিয়া কবি ও সাধকদের সঙ্গে এদেশের সাধকদের মিল অসাধারণ। সাম্রাজ্যের উত্থানপতন অতিক্রম করে এই বোধ মূল্যবান হয়ে আছে। এসবই ভারতের প্রবহমান ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে।

মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রতিষ্ঠিত হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ইংরেজ শাসকেরা ধর্মে খ্রীষ্টান। বহুদেবদেবীর পুজোয় এদেরও বিশ্বাস নেই, পৌত্তলিকতাকে এরা ভ্রান্তধর্ম বলে মনে করে। খ্রীষ্টধর্মের প্রচারে মিশনারিদের অক্লান্ত চেষ্টার কথা আমরা জানি। তবু খ্রীষ্টের ধর্মও ভারতের প্রধান ধর্ম হয়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ শাসকেরা এব্যাপারে একটা সতর্ক নীতি গ্রহণ করেছিল। এদের কাছেও ধর্মসংস্থাপনের চেয়ে রাজস্বসংগ্রহ ও সাম্রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করাই বেশি জরুরী মনে হয়েছে। বিশেষত ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর এদেশের আচারে হস্তক্ষেপ না করাটাই সাধারণভাবে বিদেশী শাসকদের রাষ্ট্রনীতি হয়ে উঠেছিল। এইভাবে ইংরেজ শাসনেও ভারত রয়ে গেছে বহুধর্মের বহু সম্প্রদায়ের বাসভূমি।

আধুনিক যুক্তিবাদী ভাবনাচিন্তা পশ্চিম থেকে এদেশে পৌঁছল। দেশের ভিতরও অবশ্য প্রাচীন যুক্তিধর্মী বিচারের একটা ধারা স্বীকার্য, যেমন হিন্দুদর্শনে তেমনি ইসলামে, তবে ভক্তিবাদ আর আচারসর্বস্বতাই ছিল অপেক্ষাকৃত প্রবল। এদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে। পাশ্চাত্য ভাবধারার অনিবার্য দ্বন্দ্ব উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যুক্তিবাদের একটা ঐক্যমুখী ঝোঁক আছে। রামমোহনের ধর্মবিচারে তার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তুলনামূলক ধর্মবিচারের ক্ষেত্রে তিনি একজন অগ্রণী পথিকৃৎ। তিনি বললেন, বিভিন্ন ধর্মের ভিতর যেখানে মিল, সেটাই তাদের সার, সত্যবস্তু। অসত্যের ভিতরই পরস্পর বিরোধ থাকে, সত্যে সত্যে বিরোধ নেই। রামমোহনের ধর্মসমন্বয় চিন্তার মূলে আছে এই ধারণা।

এই থেকে একটা প্রশ্ন এসে যায়। রামমোহন জানতেন বিভিন্ন ধর্মের আচারে অনুষ্ঠানে পার্থক্য আছে। তবে কি আচার অনুষ্ঠান মিথ্যা? ধর্মের সত্যবস্তুর সঙ্গে তার যোগ নেই? আচার অনুষ্ঠান ত্যাগ করে কি ধর্ম সম্ভব, সেই ধর্মের কি সমাজে অবস্থান সম্ভব?

সত্যধর্ম ব্যক্তিকে সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে, বৃহত্তর কিছুর সঙ্গে যুক্ত করে। ব্যক্তি নিজের ধর্মচেতনাকে প্রকাশ করতে গেলে কিন্তু একটা বিশেষ রূপের ভিতর দিয়েই সেই। প্রকাশ ঘটে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান এইরকম কিছু রূপে আশ্রিত। তারই ভিতর দিয়ে রূপকে অতিক্রম করে যাবার শক্তি ও আগ্রহ যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সেটা সত্যধর্মের সঙ্গে যুক্ত, তা নইলে সেটা মানুষকে বেঁধে ফেলে সংকীর্ণতার মধ্যে। সেই সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিকে মানুষের উচ্চতর ধর্ম বলে কিছুতেই মানা যায় না। উৎসব অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্যে দোষ নেই, কিন্তু তাকে আশ্রয় করে আমাদের মন যখন খণ্ড খণ্ড সাম্প্রদায়িকতায় ও বিভেদকারী উত্তেজনায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে তখনই বিপদ।

তুলনীয় সিদ্ধান্ত আমরা খুঁজে পাই গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের স্বদেশীসমাজ নিয়ে ভাবনায়। ধর্মের একটি শর্ত, মানুষের সেবা। কিন্তু সব মানুষকে তো আমরা নাগালের ভিতর পাচ্ছি না। যারা আমাদের কাছের মানুষ, আমাদের স্বদেশবাসী, কাজ আরম্ভ করতে হবে তাদের নিয়েই। তাদের ভিতর দিয়ে সর্বমানবের কাছে পৌঁছনোটাই আমাদের উচ্চতর অভীপ্সা। আমরা বিশ্বের অভিমুখী হব কি না, এই আভিমুখ্যটাই প্রধান কথা। তা যদি হয় তবেবৈচিত্র্যও হয়ে ওঠে ঐক্যমুখী। তা নইলে দেখা দেয় বিনষ্টির সম্ভাবনা। সেই বিনষ্টি থেকে স্বদেশকে ও বৃহত্তর সমাজকে কী করে রক্ষা করা যায়, এই প্রশ্নের মুখোমুখি মানুষকে দাঁড়াতে হয়েছে বারবার।

স্বার্থপরতা ও সাম্প্রদায়িকতা বুদ্ধিকে সম্পূর্ণ উন্মুল করা যায় না। এসবই সহনীয় কিন্তু একটা মাত্রার মধ্যে। মাত্রারক্ষা না হলে, আর যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সহযোগিতার নিত্য নতুন উপায় উদ্ভাবন করতে না পারলে, কারও স্বার্থই শেষ অবধি রক্ষা পায় না। এইরকম একটা অবস্থার মুখোমুখি আমরা এসে দাঁড়িয়েছি আবারও। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, এই পুরনো চিন্তাকে নতুন রূপদানের সময় এসে গেছে। আর সেই সঙ্গে শান্তির প্রশ্ন আজ নানা কারণে সমস্ত শুভচিন্তক মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রে এসে গেছে।

.

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে রোধ করা গিয়েছিল। সেই সাফল্যই হয় তো একটা মোহসৃষ্টিতেও সহায়ক হয়েছিল। এদেশের অনেক জাতীয়তাবাদী মানুষের বিশ্বাস ছিল, ভারতের ঐক্য এমনই দৃঢ় যে তাকে আর ভাঙা যাবে না। ১৯৪৭ সালে কিন্তু দেশ বিভাগ রোধ করা গেল না। সেই মোহভঙ্গের তিক্ততা আমরা অনেকেই আজও অতিক্রম করতে পারিনি।

হিন্দুরা দেশবিভাগের জন্য ___ মুসলমানদের সাম্প্রদায়িকতাকে দায়ী করে থাকে। মুসলীম লীগ ও মহম্মদ আলী জিন্নাকে বিশেষভাবে দোষী মনে করা হয়েছে। অধিকাংশ মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গী স্বাভাবিক ভাবেই ভিন্ন। আসলে নিজেকে হিন্দু অথবা মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করে সমালোচকের আসনে বসালে নিরপেক্ষ বিচার সম্ভব হয় না। এবিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার স্থান এটা নয়, সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া যাক।

জিন্না মানুষটি প্রথম থেকেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। মনে রাখতে হবে যে, সরোজিনী নাইডু ও গোপালকৃষ্ণ গোখলের মতো শ্রদ্ধেয় নেতারা একদা জিন্নাকে “হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের শ্রেষ্ঠ রাজদূত” বলে অভিনন্দিত করেছেন। তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়সে জিন্নার চারিত্র্য ও রাজনীতিক ভূমিকার যে পরিচয় আমরা পাই তাতে ভালোমন্দ যাই থাকুক না কেন, সাম্প্রদায়িকতার কালিমা ছিল না। পরবর্তী ইতিহাস নিয়ে অনেক মতভেদ আছে।

সাম্প্রতিক আলোচনা ও গবেষণা থেকে একথা মনে হয় যে, জিন্না দেশবিভাগের জন্য বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। তিনি পাকিস্তানের দাবি তুলেছিলেন অনেকটা দর কষাকষির জন্য। পাকিস্তানের জন্য তিনি কিছু বিশেষ সুবিধা চেয়েছিলেন, দেশভাগ না করেই যদি সেটা পাওয়া যেত তবেই তিনি বেশি খুশি হতেন। হিন্দু নেতাদের মধ্যে যাঁরা প্রভাবশালী তাঁদের অনেকেই মুসলমানদের বিশেষ সুবিধা দেবার চেয়ে বরং দেশবিভাগটাই মেনে নেওয়া শ্রেয় মনে করলেন। তাঁরা সেদিন ভুল করেছিলেন কি ঠিক করেছিলেন, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।

কেউ হয়তো বলবেন, মুসলমানদের জন্য বিশেষ সুবিধা চাওয়াটাই সাম্প্রদায়িক বুদ্ধির কথা। এবিষয়ে পরে কিছুটা আলোচনা করা যাবে। তার আগে অন্য দুয়েকটি বিষয় ছুঁয়ে যেতে চাই।

১৯৯০ সালে দাঁড়িয়ে অন্তত একথাটা স্পষ্ট। সম্প্রদায়বিশেষের জন্য ভিন্ন রাজ্য দাবি করা বা বিশেষ সুবিধা চাওয়াতে দোষ গুণ যাই থাকুক না কেন, এটা মুসলমান সম্প্রদায়ের একার বৈশিষ্ট্য নয়। শিখদের একটা প্রবল অংশ আজ “খালিস্তান” চাইছে। আয়ারল্যান্ডে প্রোটোস্ট্যান্ট ও রোমান ক্যাথলিকদের ভিতর সংঘর্ষ চলছে। আজারবাইজানে আর্মেনীয় খ্রীষ্টান ও আজেরি মুসলমানের ভিতর দ্বন্দ্ব উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এইরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। কখনও ধর্ম, কখনও ভাষা, কখনও জাতির ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক, আর্থিক ও রাজনীতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি আজ পৃথিবীর দিকে এমনই ছড়িয়ে পড়েছে যে এটাকে এযুগের একটা উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঝোঁক বলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

গণতন্ত্রের নামে এদেশে এমন একটা কথা আজকাল শোনা যাচ্ছে যে-বিষয়ে আমাদের সাবধানে ভাবতে হবে। ভারতে হিন্দুরা সংখ্যায় গরিষ্ঠ। বলা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের নামই তো গণতন্ত্র, কাজেই এদেশে গণতন্ত্রের মানে হবে হিন্দুর রাজত্ব, রাষ্ট্রীয় বিধানে হিন্দুর কর্তৃত্ব। এটা ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত। কেন ভ্রান্ত সেটা বলবার চেষ্টা করছি।

গণতন্ত্রের মূলে আছে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনই নয়, মানুষের মৌল অধিকার সম্বন্ধে আরও কিছু প্রত্যয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ মানুষরা সংখ্যায় গরিষ্ঠ। এঁরা যদি একমত হয়ে বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মৌল মানবিক অধিকার কেড়ে নেয় তবে কি সেটাকে গণতন্ত্রসম্মত বলা যাবে? যেমন ব্যক্তির ___ সাম্প্রদায়বিশেষেরও কিছু অধিকার মানুষের স্বাধীনতার মৌল শর্ত। জার্মানিতে ___ ইহুদীদের সব অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ইহুদীনিধন যজ্ঞের নেতা হিটলারের পিছনে জনসমর্থন ছিল। সেই অত্যাচারকে গণতন্ত্রের নামে কিছুতেই সমর্থনযোগ্য বলা যাবে না। সংখ্যালঘুদের প্রতিও একটা ন্যূনতম শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা গণতান্ত্রিক জীনবদর্শনের জন্য অপরিহার্য। সে জিনিস রক্ষা না পেলে গণতন্ত্রও রক্ষা পায় না।

এদেশের ইতিহাসে দীর্ঘকাল থেকে বহুত্বধর্মিতার দিকে যে প্রয়াস দেখা যায়, এযুগের গণতান্ত্রিক সংবিধানেও তাকে নতুন রূপে রক্ষা করা প্রয়োজন। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় যদি ঐক্যের নামে ভারতের বহুত্বকে নিষ্পিষ্ট করতে চায় তবে তাকে গণতান্ত্রিক নীতির দিক। থেকে সমর্থন করা অন্যায় হবে। এদেশে যারা গণতান্ত্রিক জীবনদর্শনের বিকাশ চায় তাদের এই কথাটা বিশেষভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে। আধুনিক যুগে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রসর্বস্বতা বারবার দেখা দিয়েছে গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে। এর বিরুদ্ধে সতর্কতা আবশ্যক। সংযম ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা ছাড়া গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

জিন্না মুসলমানদের জন্য কিছু রক্ষাকবচ চেয়েছিলেন। সেই দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠল। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। শিখ সম্প্রদায়কে হিন্দুরা চিরকাল প্রীতির চোখেই দেখেছে, তবু আজ তারা বিশেষ সুবিধা চাইছে। হিন্দু ও মুসলমানের ভিতর প্রতিবাক্যের পাশে পাশেই গড়ে উঠেছিল অস্পৃশ্যতার ব্যবধান, অবিশ্বাসের কালো ছায়া। স্বাধীনতার পূর্বাহ্নে এই আশঙ্কাটা মুসলমানের মনে ক্রমেই বড় হয়ে উঠছিল যে, গণতন্ত্রের নামে ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠের সর্বগ্রাসী শাসন স্থাপিত হবে।

দেশবিভাগের ভিতর দিয়ে সমস্যার সমাধান হয়নি। তবু জিন্নার আশঙ্কা অমূলক ছিল না। সমস্যাটা তিনি বুঝেছিলেন। সমাধানে তিনি পৌঁছতে পারেননি। আমরাও পারিনি। এজন্য সংস্কৃতির যে রূপান্তর আবশ্যক, আমরা কি সে দিকে অগ্রসর হচ্ছি? মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের ভিতরই আজ “মৌলবাদী” প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠছে, সেটা কিন্তু আমাদের ঠেলে দিচ্ছে উলটো পথে। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের কিছু আর্থিক কারণ ছিল, আজও আছে। কিন্তু সেটাও একমাত্র কথা নয়। কাশ্মীর আজারবাইজানে যে সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে, আর্থিক কারণ থেকে তার পুরো ব্যাখ্যা মিলবে না। আসলে সাম্প্রদায়িকতা নিজেই একটা ব্যাধি, আর এমন উদাহরণ সহজেই দেওয়া যায় যেখানে আর্থিক সংকটকে সে আরো ভয়ংকর করে তুলেছে।

১৯৪৭ সালে ভারতবিভাগ রোধ করবার উপায় ছিল কি না তা নিয়ে তর্ক আজ নিষ্ফল। আমাদের ভাবতে হবে ভবিষ্যতের কথা। যে-নতুন প্রজন্ম আজ বড় হয়ে উঠেছে, দেশবিভাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তারা কোনওভাবেই যুক্ত ছিল না। পুরনো। শত্রুতাতে তাদের আবদ্ধ থাকবার কারণ নেই। কোনও নতুন শত্রুতা গড়ে তুলবারও অর্থ হয় না।

অথচ ভারতে ও পাকিস্তানে যুদ্ধের আয়োজন বেড়ে চলেছে। দু দেশেই সামরিকবাহিনী সুসজ্জিত। এই সেদিনের খবর, ফরাসী দেশ থেকে পাকিস্তান লাভ করবে পরমাণু চুল্লি। পাকিস্তান কি পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলেছে? ভারতও কি তৈরি করেছে। দুই দেশের ভিতর সমরাস্ত্রের সংগ্রহ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। পৃথিবীর দুটি দরিদ্রতম দেশের ভিতর যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এইরকমের ঊর্ধ্বশ্বাস প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে তখন সেটা শোচনীয় অমানবিকতার একটা অসহনীয় উদাহরণ হয়ে ওঠে। কোটি কোটি মানুষের অন্নবস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা নেই, শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই, অথচ প্রতিরক্ষার নামে অর্থের বরাদ্দ বেড়েই চলেছে। যদি যুদ্ধ বাধে তবে কেও দেশেরই সাধারণ মানুষের তাতে কোনও উপকার হবে না। আর যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় অথবা পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হয় তবে তো সর্বনাশ।

এই যুক্তিহীন অবস্থার কি অবসান সম্ভব নয়? সারা ভারতীয় উপমহাদেশ নিয়ে একটি পরিসংঘ বা সম্মিলিত রাষ্ট্র গড়ে উঠবে, সমগ্র উপমহাদেশের জন্য সৈন্যবাহিনী থাকবে শুধু একটি, অধিকাংশ গঠনমূলক কাজের দায়িত্ব থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলির হাতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিকেন্দ্রিত হবে যথাসম্ভব, এই চিত্র আজ অবাস্তব মনে হয়। অথচ পৃথিবীতে গতকালের। কত “অবাস্তব” সম্ভাবনা আজ বাস্তবতা লাভ করছে। বার্লিন দেয়াল ভেঙে পড়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির ভিতর ঐক্যের কথা শোনা যাচ্ছে। ইউরোপে সম্মিলিত রাষ্ট্রের। চিন্তা শুরু হয়ে গেছে।

.

ভারতীয় উপমহাদেশে যদি শান্তি ও ঐক্য ফিরে আসে তবে সেটা আজ সম্ভব শুধু অহিংসা ও গণতন্ত্রের পথে। ভারত কখনো পাকিস্তানকে জয় করে নেবে অথবা পাকিস্তান ভারতকে, এচিন্তা উন্মাদের চিন্তা। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানকে সৈন্যবাহিনী দিয়ে পদানত করে রাখতে পারেনি, ভারত পাকিস্তানকে অথবা পাকিস্তান। ভারতকে পায়ের নিচে রাখতে পারবে এটা মূর্খের কল্পনা। স্থায়ী ঐক্য সম্ভব শান্তির পথে। আজ নয়, কাল নয়, তবু কোনও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতে এটা সম্ভব হবে, এ আশায় বুক বাঁধা ছাড়া উপায় কি? যুদ্ধের আয়োজন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে শুধু সামগ্রিক ধ্বংসের দিকে। শান্তি ও ঐক্যই বাঁচবার পথ।

উপমহাদেশে ঐক্য প্রতিষ্ঠার আগে দেশের অভ্যন্তরে শাস্তি চাই। আমাদের সমস্ত সমম্বয়ী চিন্তাকে উপহাস করে চলেছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও পৌনঃপুনিক দাঙ্গা। এই উন্মত্ততা থেকে আমরা কি দেশকে উদ্ধার করতে পারব? দেশের ভিতর শান্তির উদ্যোগ আর ভারত-পাকিস্তান বাংলাদেশের ভিতর যুদ্ধবিরোধী সংকল্প দিয়ে কাজ শুরু হতে পারে। দূরের লক্ষ্যটিকে মনের ভিতর লালন করবার মতো সাহস চাই। প্রতি পদক্ষেপে এই প্রশ্নটাই যেন প্রধান হয়ে ওঠে, আমরা শান্তি ও ঐক্যের লক্ষ্যের দিকেই চলেছি তো?

ভারতে গণতন্ত্রের শত্রুরা বলছে, এই উপমহাদেশে অনাত্র কোথাও গণতন্ত্র নেই, সংখ্যালঘুদের প্রতি সুবিচার নেই, এখানেই কেন গণতন্ত্র রক্ষা করতে হবে? প্রশ্নের গোড়াতেই ভ্রান্তি আছে। আমরা গণতন্ত্র চাই আমাদেরই স্বার্থে এবং সকলের স্বার্থে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে সংহার করবার নীতি একবার মেনে নিলে তার কোনও শেষ নেই। বহু সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ভারতের বৃহৎ সমাজ। হিন্দুদের নিজেদের। ভিতরই আছে নানা জাতি ও সম্প্রদায়। বহুত্বকে মর্যাদা দেবার অভ্যাস যদি আমরা ত্যাগ করি তবে স্বজাতি ও ভিন্ন জাতি সহ ভারতের সমগ্র সমাজই ভেঙে পড়বে। অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার কোনও একজাতিতে আবদ্ধ নয়। এই সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সংগ্রাম। অবশ্যই চাই। আত্মসমালোচনার প্রয়োজন সকলেরই, যেমন হিন্দুর তেমনি। মুসলমানেরও। সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে আছে আত্মসমালোচনার অক্ষমতা, এমন অসহিষ্ণুতা, এমন অন্ধতা যাতে শেষ অবধি অন্যায় দীর্ঘজীবী হয়, সুস্থ ও স্বাধীন জীবনের। উপযোগী জীবনাদর্শ ___ হয়, ক্রমপ্রসারিত বিদ্বেষ সবাইকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়।

ভারতের একটা ঐক্য আছে। সেটা কিন্তু মূলত সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় নয়। রাষ্ট্রের ঝোঁক ক্ষমতার দিকে। রাষ্ট্রের ঝোঁক অতিকেন্দ্রিকতার দিকে। রাষ্ট্রসর্বস্বতায় বিপদ আছে। রামকে “রাষ্ট্রীয় পুরুষ” করে তোলাতে বিপদ আছে। ঈশ্বরকে রাষ্ট্রের সঙ্গে একাকার করে দেওয়া ঠিক নয়। রাষ্ট্রসর্বস্ব সংস্কৃতি সবাইকে একটা ছাঁচের মধ্যে ফেলতে চোয়। এর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এদেশে গণতন্ত্রকে হতে হবে বহুত্বনিষ্ঠ। সব দেশেই তাই, এদেশে আরো বিশেষভাবে। শান্তি ও গণতন্ত্র চাই প্রত্যেকের জন্য, সকলের জন্য। এটাকেই লক্ষ্য বলে মানতে হবে। সংঘর্ষ সম্পূর্ণ দূর করা যাবে না। তবু যারা সহযোগে বিশ্বাসী, যারা একথা মানে যে ঐক্য একটা পূর্বনির্মিত বস্তু নয় বরং সেটা ক্রমাগত সৃষ্টি হয়ে চলেছে, তাদের যদি পরাজয় ঘটে তবে সেটা হবে সারা দেশেরই পরাজয়।

অবিশ্বাসীরা বলে, সাম্প্রদায়িকতায় তারাই উসকানি দিচ্ছে রাজনীতি যাদের ব্যবসা, তাদের ঠেকানো যাবে কী করে? আমাদের ছোটো ছোটো চেষ্টা কি ব্যর্থ হতে বাধ্য নয়? উত্তরে দু’টি কথা বলা যায়। সাম্প্রদায়িকতায় যারা আক্রান্ত তারা ভ্রান্ত, কিন্তু সবাই মন্দ নয়। যুক্তি ও নতুন চিন্তার প্রয়োজন আছে। ছোটো ছোটো বৃত্ত থেকেই কাজ শুরু হতে পারে, সব স্থায়ী কাজের ভিত্তি সেইখানে। রাজনীতির ব্যবসায়ীদের ইচ্ছাতেই ইতিহাসের পথ তৈরি হয় এমন তো নয়। তাই যদি হত তবে মানুষের ইতিহাসের অনেক যুগান্তকারী পরিবর্তনেরই ব্যাখ্যা পাওয়া যেত না। ছাত্র ও যুবশক্তি, সংগঠিত শ্রমিক, নারীশক্তি, নবচিন্তক, এরা অঘটন ঘটাতে পারে, এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে অতি সাম্প্রতিক ইতিহাসেও। আসলে মানুষ জীবটি শুধু ব্যবসায়িকী বুদ্ধি দিয়ে চলে না। তার ভিতর আছে অন্য এক বেগ। সেই নিগূঢ় শক্তি একই সঙ্গে সৃজনধর্মী, বৈচিত্র্যমুখী আবার ঐক্যসন্ধানী। সেই শক্তিতে বিশ্বাস হারানো ভুল।

দেশ, ৩১ মার্চ ১৯৯০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *