॥ ১ ॥
১৯২৯ সালের শীতকালের এক ভোরে হেমকান্ত চৌধুরির হাত থেকে দড়ি সমেত কুয়োর বালতি জলে পড়ে গেল। অসহনীয় শীতের সেই নির্জন ব্রাহ্মমুহূর্তের অন্ধকারে হেমকান্ত অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে শুনলেন জলে দড়ি ও বালতির পড়া ও ডুবে যাওয়ার শব্দ। তাঁর জীবনে এরকম ঘটনা এই প্রথম।
একটু দূরে উঁচু বারান্দার ধারে হ্যারিকেনটা রাখা। তার আলো কুয়োর পাড়ে খুব ক্ষীণ হয়ে আসছে। হেমকান্ত সেই একটুখানি আলোয় নিজের দুখানা হাতের পাতার দিকে চেয়ে দেখলেন। এই বিশ্বস্ত হাত থেকে গতকাল পর্যন্ত কখনো কুয়োর বালতি পড়ে যায়নি।
হেমকান্ত বিস্ময় ও অবিশ্বাসভরে নিজের দুখানা হাতের দিকে চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর সিদ্ধান্তে এলেন, তিনি বুড়ো হয়েছেন। যথেষ্ট বুড়ো।
বাড়িতে দড়ি আছে, বালতি তোলার কাঁটাও মজুত। ইচ্ছে করলে হেমকান্ত কেউ জানবার আগেই বালতিটা তুলে ফেলতে পারতেন। কিন্তু সে চেষ্টা আর করলেন না। কেনই বা করবেন? জীবনের অনেক কাজকেই আজকাল তাঁর তুচ্ছ বলে মনে হয়।
১৯২৯ বা তদানীন্তন কালে বয়স ত্রিশ পেরোলেই গড়পড়তা বাঙালী পুরুয় নিজেকে বুড়ো ভাবতেন। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়সে অনেকেরই নাতি-নাতনি হতে শুরু করত। কাজেই নিজেকে বুড়ো ভাবার দোষ ছিল না। সেই হিসেবে হেমকান্তকেও বুড়োর দলে ফেলা যায়। ঘটনার সময় তাঁর বয়স কমবেশী পঁয়তাল্লিশ। উনিশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় কিশোরগঞ্জের মোক্তার সুধীর চক্রবর্তীর মেজো মেয়ে সুনয়নীর সঙ্গে। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তিনি ছয় সন্তানের জনক হন। সাঁইত্রিশে বিপত্নীক। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কনককান্তির বয়স চব্বিশ। বিবাহিত এবং দুই সন্তানের পিতা। মেজো সন্তান মেয়ে সবিতা। তার বরিশালে বিয়ে হয়েছে। তৃতীয় জন ছেলে জীমূতকান্তি। সেও বিবাহিত, তবে সন্তান হয়নি। চতুর্থ ও পঞ্চম পর পর দুই মেয়ে ললিতা ও বিশাখ। ললিতার বিয়ে দিয়েছেন কলকাতায়। ষষ্টটি পুত্র সন্তান। বয়স দশের বেশী নয়। তার নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল কৃষ্ণকান্তি। হেমকান্ত পরে নিজের নামের আদলে কান্তির বদলে কান্ত যোগ করায় এখন সে কৃষ্ণকান্ত। বিশাখা ও কৃষ্ণকান্ত ছাড়া হেমকান্তর কাছে কেউই থাকে না। প্রকান্ড বাড়ি হা-হা করছে। আছে বিশ্বস্ত কয়েকজন দাস-দাসী, একটা বশংবদ দিশি হাউন্ড জাতীয় সড়লে কুকুর। একটা বুড়ো ময়ূর। কয়েকটা পোষা পাখি। গোটা দশেক গরু। কয়েকটা কাবলি বেড়াল।
জমিদার সুলভ কোনও বদ অভ্যাস হেমকান্তর বংশে কারও নেই। হেমকান্তও সে-সবের ঊর্ধ্বে। মদ ছোন না, বাইজী নাচান না, ইয়ারবন্ধুও বিশেষ নেই। এমন কি পাশা তাস ইত্যাদিরও নেশা নেই তাঁর। বড় ভাই বরদাকান্তর বাল্যকাল থেকেই একটা উদাসী ভাব ছিল। যৌবনে ভাল করে পা দেওয়ার আগেই সে একদল সন্ন্যাসীর সঙ্গে ভিড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বরদাকান্তর পরিত্যক্তা স্ত্রী প্রভা ঢাকায় তাঁর বাপের বাড়িতে আজও জীবন ধারণ করে আছেন। কেমন আছেন তা হেমকান্ত জানেন না। তাঁর ছোটো এক ভাই ছিল। নলিনীকান্ত। তার পরোপকারের নেশা ছিল। ব্রহ্মপুত্রে এক ঝড়ের রাত্রে তার নৌকাডুবি হয়। নৌকোর অন্যান্য যাত্রীরা বেঁচে গেলেও নলিনীকান্তর লাশ পাওয়া যায় ঘটনাস্থল থেকে তিন মাইল ভাঁটিতে। তিন ভাইয়ের স্বভাবেই মিল আছে। কেউই খুব বিষয়াসক্ত নন। এসরাজ বাজানো ছাড়া হেমকান্তর কোনো আমোদ-প্রমোদও নেই। একসময়ে ফুটবল খেলতেন। ব্যস আর কিছু নয়। তিনি স্বাবলম্বী, আত্মনির্ভরশীল, শান্ত ও হিসেবী মানুষ। কোনো ব্যাপারেই তিনি অসতর্ক নন। তাঁর জমিদারী খুব বড় নয়। অন্যান্য জমিদারের তুলনায় তিনি নিতান্তই চুনোপুঁটি। তবে হেমকান্ত কারো সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করেন না। তাঁর চাল-চলতিও জমিদারের মতো নয়। দাপট নেই, রাগ নেই, কর্তৃত্ব নেই। তাঁর কথা কম, হাসি কম, ভালবাসা বা আবেগও নগণ্য।
হেমকান্ত হ্যারিকেনটা বাইরে রেখে ঘরে ঢুকলেন। অন্যান্য দিন এই সময়ে তিনি আহ্নিক করতে বসেন। আজ বসলেন না। তাঁর শান্ত ও ভাবলেশহীন মন আজ কিছু চঞ্চল। বিলিতি টেবিল ল্যাম্পের সলতে ধরিয়ে তিনি বসলেন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে।
“ইহাই কি বার্ধক্য নহে? পেশীর দৌর্বল্য দেখা দিয়াছে, স্নায়ু আর আগের মতো সতেজ নাই। ক্রমে ক্রমে স্থবিরতা আসিবে। আয়ু ফুরাইবে। যৌবনে প্রায় কেহই মৃত্যুকে ভয় করে না। কিন্তু রক্তের তেজ কমিয়া আসিলে দিনান্তে একা বসিয়া প্রিয় ও মৃতদের কথা ভাবিতে গিয়া কখন যেন পৃথিবীর সহিত আসন্ন বিরহের কথা মনে করিয়া হৃদয় ভারাক্রান্ত হইয়া উঠে। সেদিন কোকাবাবুকে দেখিতে গিয়াছিলাম। উদুরিতে পেটটা ফুলিয়া ঢাক হইয়াছে। পিঠভরা বেডসোর। হাঁ করিয়া কষ্টে শ্বাস লইতেছেন। একেবারে শেষ অবস্থায় তাঁহাকে বাড়ির পিছন দিকে একটি ঘরে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে। ঘরে ঢুকলেই মনে হয় চারিদিক মৃত্যুর বীজাণুতে ভরা। ঘরের এক কোণে একটি ভাড়াটিয়া কীর্তনীয়া ছোট্ট করতাল লইয়া ক্লান্ত ও যান্ত্রিক স্বরে তারকব্রহ্ম নাম করিতেছিল। গুণ্ঠনবতী এক দাসী কেবল তাঁহার পরিচর্যা করিতেছে। বাহিরের ঘরে তাঁহার দুই পুত্র উদ্বিগ্ন মুখে বসা। মেয়েরাও আসিয়াছে। কান্নাকাটিও কিছু কিছু চলিতেছে। কোকাবাবুর স্ত্রী চিররুগ্না তাঁহাকে আমি বিশেষ হাঁটাচলা করিতে দেখি নাই। সেদিনও তিনি শয্যাশায়িনী ছিলেন। কোকাবাবুর জন্য যে বিশেষ শোক অনুভব করিতেছিলাম তাহা নহে। তাঁহার যথেষ্ট বয়েস হইয়াছে। কিন্তু সেই সময় একটি ঘটনায় সমস্ত চিত্রটিরই এক অন্যরূপ অর্থ প্রতিভাত হইল। কোকাবাবুর নাতি শরৎ অকস্মাৎ এক হাতে বন্দুক ও অন্য হাতে গোটাকয় মৃত বেলেহাঁস লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। বলিল ‘চর থেকে মেরে আনলাম বাবা, আজ আর খালিহাতে ফিরিনি’। তোমাকে কী বলিব। সেই ঘোষণায় এবং বেলেহাঁস দেখিয়া বাড়ির লোকজনের মধ্যে যেন একটা উত্তেজনা বহিয়া গেল। শরৎ কিশোর বয়স্ক। তাহার টিপ যে কি সাঙ্ঘাতিক হইয়াছে এবং তার সাহসও যে কত তাহাই তাহার বাবা গগন আমাকে বুঝাইতে লাগিল। শুনিতে শুনিতেই টের পাইলাম, ভিতর বাড়িতে বেলেহাঁস তরিবৎ করিয়া রাঁধিবার নানা তোড়জোড় চলিতেছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন কোকাবাবুকে সকলেই ভুলিয়া গেল। বার্ধক্যে ও মৃত্যুতে যে মানুষ কতটা একা ও নিঃসঙ্গ তাহা সেদিন বুঝিলাম। এও বুঝিলাম কোকাবাবুর আত্মীয়-পরিজনের মুখে যে উদ্বেগ ও আগাম শোকের ছাপ পড়িয়াছে তাহার সবটাই খাঁটি নয়, ছদ্মবেশও আছে। সেইদিনই মনে প্রশ্নের উদয় হইল, আমাদের প্রিয় পরিজনদের মধ্যে যে ভালবাসা সমবেদনা ও প্রেম দেখিতে পাই তাহার অনেকটাই বোধহয় আমাদের চোখের ভ্রম। সচ্চিদানন্দ, এবার একবার লম্বা ছুটি লইয়া আস। তোমারও আমার মতই বয়স হইয়াছে। জীবনের মেকী ও খাঁটিগুলিকে বাছাই করার জন্য তোমার সঙ্গে দীর্ঘ পরামর্শ আছে।….” পরদিন এই চিঠি হেমকান্ত তাঁর আবাল্য সুহৃদ সচ্চিদানন্দ বিশ্বাসকে।
হেমকান্তর দেশভ্রমণের নেশা নেই। বস্তুত বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাঁর ভীতি ও অজ্ঞতা সর্বজনবিদিত। নিজের জমিদারীরও সর্বত্র তিনি যাননি। অপরিচিত পরিবেশ ও অচেনা মানুষজনের মধ্যে তিনি বড় অস্বস্তি বোধ করেন। হেমকান্তর বন্ধু হোমিওপ্যাথ যোগেন্দ্র সিংহ প্রায়ই বলেন, তোমার বাপু এটি একটি মানসিক রোগ। পুরুষ মানুষের ঘরকুনো স্বভাব খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
কিন্তু হেমকান্ত ভাবেন, ঘরের বাইরে যে বিশাল পৃথিবী তার যত বৈচিত্র্যই থাকুক, নিজের গণ্ডীবদ্ধ জীবনেও যে তিনি বৈচিত্র্যের শেষ পান না। দুর্গাবাড়ির মণ্ডপের পিছনে একটি পোড়ো জমি আছে। এদিকটায় কেউই বড় একটা আসে না। এই ছাড়া-জমির একপাশে একটি শুকনো খাদে বাড়ির আবর্জনা ফেলা হয়। এই জমিটায় এক সময়ে হয়তো বাগান ছিল। এখন আগাছার নীচে মাটিতে মখমলের মতো শ্যাওলা পড়েছে। বাগানের শেষপ্রান্তে একটি ভাঙা ব্রুহাম গাড়ি পড়ে আছে কবে থেকে। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে উঠেছে লতানো গাছ। হেমকান্ত মাঝে মাঝে কামলা ডেকে কিছুটা করে পরিষ্কার করান। তাই জঙ্গল খুব ঘন হতে পারেনি। কিন্তু এই জায়গাটার বন্য ও পরিত্যক্ত ভাবটিকে কখনো নষ্টও হতে দেন না হেমকান্ত।
কেন এই জায়গাটা হেমকান্তর প্রিয় তার সুস্পষ্ট কোনো উত্তর তাঁর নিজেরও জানা নেই। তবে এই জায়গায় পা দিলেই তার ভিতরটায় একটা সুবাতাস বয়ে যায়। প্রায় আড়াই বিঘের এই ভূমিখণ্ডটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের গায়ে গায়ে চিরুনির দাঁড়ার মতো রুজু রুজু ঢ্যাঙা পাম গাছ। পৃথিবী থেকে আলাদা করে নেওয়া এই ভূমিখণ্ডে হেমকান্তর মন অবাধে বিস্তার লাভ করে। কত দার্শনিক চিন্তা আসে। ব্রুহাম গাড়িটার একটি পাদানী ঝেড়েঝুড়ে রোজ পরিষ্কার করে রেখে যায় চাকর রাখাল। হেমকান্ত বিকেলের দিকে প্রায়ই এসে সেই পাদানীতে বসেন। চারধারে কীট-পতঙ্গ পাখিদের শব্দ। বনজ একটা গন্ধ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কাশী বৃন্দাবন, হিমালয় বা সমুদ্র কোথাও যাওয়ার কোনো প্রয়োজন বা তাগিদ তিনি বোধ করেন না। তাঁর মনে হয়, এই তো বেশ আছি। মানুষের মন এক অদ্ভুত চিত্রকর। চেনা পরিচিত জায়গাতেও সে কত নিপুণ হাতে তুলির একটু-আধটু টানে কত অপরিচিত দৃশ্যই না ফুটিয়ে তোলে। ব্রুহাম গাড়ির পাদানীতে বসে হেমকান্ত তাঁর মনটিকে কাজ করে যেতে দেন! ধীরে ধীরে তাঁর সামনে ফুটে ওঠে অভ্রভেদী পাহাড়, তরঙ্গক্ষুব্ধ সমুদ্র, কনখলের রাস্তা বা ইংলণ্ডের মফঃস্বল।
মনোরোগ? না, তাঁর কোনো মনোরোগ নেই তো! তবে একটা দুঃখ আছে। খুব গোপন দুঃখ। কিংবা হয়তো তা গোপন এক সুখই আসলে। সেই দুঃখ বা সুখের কথা তিনি বড় একটা কাউকে বলেননি কখনো। শুধু সচ্চিদানন্দ জানে।
যেদিন কুয়োর বালতি হাত থেকে পড়ে গেল, সেদিন ভারী ও বিপুল বেলজিয়ামের কাচে তৈরি তিন খণ্ডের পূর্ণাবয়ব আয়নার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন তিনি। স্ত্রী-বিয়োগের পর একবার মৃত্যু-চিন্তা এসেছিল তাঁর। সেটা স্থায়ী হয়নি। বিসর্জিত অশ্রুই সেই মৃত্যু-চিন্তা ও শ্মশানবৈরাগ্যকে ধুয়ে নিয়ে গিয়েছিল। হেলে পড়া গাছ যেমন ঠেকনায় ভর দিয়ে বেঁচে থাকে, তেমনি স্ত্রী-বিয়োগের সময় তাঁকে ঠেকা দিয়ে রেখেছিল রঙ্গময়ী। শুধু রঙ্গময়ী বলেই পেরেছিল। নইলে তখনই হেমকান্তর সংসার ছাড়ার কথা।
বেলজিয়ামের খাঁটি ও মহান আয়না তাঁকে কিছুই বলল না। তিন খণ্ডে তাঁকে ভাগ করে বিশ্লেষণ করল, তাঁর তিনটি প্রতিবিম্বকে কোলে নিয়ে ভাবল অনেকক্ষণ কিন্তু কিছুই বলল না। সব কথা বলতে নেই। হেমকান্ত বিষন্নবদনে এসে বসলেন সেই ব্রুহাম গাড়ির পাদানীতে।
বিকেল হয়েছে। ফার্ণ জাতীয় কিছু সুন্দর গাছ গজিয়েছে ব্রুহাম গাড়িটার আশেপাশে। ভারী সুন্দর গাছগুলি। হেমকান্তর পায়ে মোজা এবং তালতলার চটি। সেই চটির ডগা দিয়ে তিনি গাছগুলিকে একটু আদর করলেন।
একটা আবছা ধোঁয়ার আস্তরণ হালকা মেঘের মতো ভেসে আছে সামনে। দুর্গাবাড়ির পিছনের অংশটা দেখা যাচ্ছে না। যে ঘাসে-ছাওয়া শ্যাওলায় পিছল আঁকা-বাঁকা পায়ে-চলা পথটি ধরে রোজ তিনি ব্রুহাম গাড়িটার কাছে আসেন সেটাও আজ ওই আবছায়ায় অর্ধেক আড়াল। সেদিকে চেয়ে তিনি ভোররাত্রির ঘটনাটা আবার তৈরি করতে লাগলেন মনে মনে। তুচ্ছ ও সামান্য একটা ঘটনা।
ইঁদারার মধ্যে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন হেমকান্ত। বাঁ হাতে দড়ির লাছি সতর্ক মুঠোয় ধরা, ডান হাতের আলগা মুঠির ভিতর দিয়ে পিছল সাপের শরীরের মতো নেমে যাচ্ছে পাটের মজবুত দড়ি। শীতকালে জল নেমে যায়। বালতি সেই অনন্ত গহ্বরে নামছিল তো নামছিলই। কোথাও অন্যমনস্কতার কোনো কারণ ছিল না। আর কেউ খবর রাখে না, শুধু হেমকান্তই জানেন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজেও তাঁর মতো সতর্ক লোক দ্বিতীয়টি নেই। এই গুণের জন্য গোপনে একটু গর্ববোধও আছে তাঁর। আচমকা দড়ির প্রান্তে বাঁধা বালতি জল স্পর্শ করল। শব্দ পেলেন হেমকান্ত। বহিরাগতের স্থূল স্পর্শে নিথর ঘুমন্ত জলে কুমারী-শরীরের মতো শিহরণ। বাঁ হাতের শক্ত মুঠিতে ছিল দড়ির লাছি এবং শেষ গিট। ডান হাতও সতর্ক ছিল। তবু কেন তাঁর দুটি হাতের কোনোটাই ধরে রাখল না দড়িটাকে? অসতর্কতা নয়, অন্যমনস্কতা নয়। হেমকান্তর মনে হয়, তাঁর দুটি হাত ছেড়ে দিতে চেয়েছিল দড়িটাকে, তাই দিল। হেমকান্তর কিছু করার ছিল না।
সেই দু’টি হাতের দিকে শীত অপরাহ্ণের পড়ন্ত ম্লান আলোয় কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন হেমকান্ত। শ্রমের কাজ জীবনে কমই করেছেন। হাত দুটি কোমল ও লাবণ্যময় এখনো। হাতের চেটো এখনো তুলতুলে, এখনো রক্তাভাময় লম্বা ও পুরন্ত শিল্পের আঙুল। ময়লাহীন নরুণে সুন্দর করে কাটা নখ। এ দু’টি হাতের কোনো আলাদা সত্তা নেই, হেমকান্ত জানেন। তবু আজ ভাঙা ব্ৰুহাম গাড়ির পাদানীতে বসে তাঁর মনে হল, এ দুটি হাত তাঁকে কিছু ইঙ্গিত করছে। বলছে, ছেড়ে দাও, পার্থিব যা কিছু আছে ছেড়ে দাও। বাঁধনে থেকো না তুমি। চলো।
কিন্তু চলো বললেই তো আর যাওয়া যায় না। কোথায় যাবেন বাইরের ধৃসর অচেনায়? এই তো তিনি বেশ আছেন। সংসারে কোনো বন্ধন তাঁর কখনো ছিল না, এখনো নেই। ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাউকেই তাঁর কোলেপিঠে মানুষ করতে হয়নি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছোটো দুটি ছেলেমেয়ের ভার নিয়েছিল পুরোনো ও বিশ্বাসী দাসীরা। আর দশভুজার মতো রঙ্গময়ী। এমন কি নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও এক অপরিমেয় দূরত্ব ছিল তাঁর। অন্দরমহল ও সাংসারিক কাজেই ব্যস্ত থাকতে হত সুনয়নীকে। শেষ কয়েক বছর দুরারোগ্য ক্ষতে শয্যাশায়ী ছিলেন। সুতরাং হেমকান্তর বন্ধন বলতে কিছু নেই। কেউ তাঁকে ধরে রাখেনি। তবু হেমকান্তের কোথাও যাওয়ার নেই। এই পোড়ো জংলা ভূমিখণ্ডই তাঁকে অনন্তের আস্বাদন দেয়।
কুয়াশার ভিতরে অস্পষ্ট এক ছায়ামূর্তিকে দেখে অন্যমনস্ক হেমকাত্ত একটু চমকে উঠলেন। উত্তরের পরিত্যক্ত দেউলের ভেঙে পড়া দেওয়ালের এক অংশ দিয়ে ছায়ামূর্তি ঢুকল। ওদিকে রাস্তা নেই। চারদিকে ইঁট ছড়িয়ে পড়ে আছে। লম্বা ঘাসের জঙ্গল। সাপের প্রিয় সে পথ ধরেই এগিয়ে আসছিল সে। চকিত পায়ে।
হেমকান্তর হাতের লাঠিটায় থুঁতনির ভর রেখে সকৌতুকে চেয়ে রইলেন। রঙ্গময়ী এখনো চকিত-চরণা, চকিত-নয়না, চকিত-রসনা।
বঙ্গময়ীর বয়স ত্রিশের আশেপাশে। তাকে হঠাৎ-সুন্দরী বলা যায় না। একপলক তাকিয়ে দেখলে তাম্রাভ গাত্রবর্ণের মেয়েটিকে তেমন নজরে পড়বে না। রঙ্গময়ীর শরীর কৃশ এবং কিছু দীর্ঘ। চোট দু’টি বড় এবং মাদকতাময়। সবচেয়ে সুন্দর তার ঝকঝকে দাঁত। লম্বাটে মুখখানায় একটু আপাত-কঠোরতা আছে বটে, কিন্তু বিন্দুমাত্র পুরুষালী ভাব নেই। গম্ভীর থাকলে রঙ্গময়ীকে ওরকম দেখায়। হাসলে মুখের আশ্চর্য রূপান্তর ঘটে। আশ্চর্য তার চোখ। একবার তাকালে আঠাকাঠির মতো চোখ লেগে থাকে। ফেরাতে ইচ্ছে করে না। কী গভীর মায়া, কত ছলছলে আর করুণ!
শীতের পোশাক বলতে রঙ্গময়ীর অঙ্গে শুধু একটা মোটা সূতীর চাদর জড়ানো। পায়ে চটি নেই। এই শীতে রঙ্গময়ীর পায়ের চামড়া ফেটে একাকার কাণ্ড। ফিতে-পেড়ে সাদা খোলের একটা শাড়ি পরনে।
হেমকান্তর স্নিগ্ধ মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটল। বললেন, বড় ঠাণ্ডা পড়েছে, খালি পায়ে ঘোরা ঠিক নয়।
রঙ্গময়ী বলল, আহ্লাদের কথা পরে হবে। ও-সব তোমার মুখে মানায় না। শরৎ খবর দিয়ে গেল কোকাবাবুর শ্বাস উঠেছে। একবার যাও।
হেমকান্ত নড়ে উঠলেন, খুব খারাপ অবস্থা নাকি?
এখন আর খারাপ নয়, একেবারে শেষ অবস্থা। একবার যাও।
হেমকান্ত গম্ভীর হলেন। বললেন, আমি গিয়ে কী করব? বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। গোটা কয়েক সান্ত্বনার বুলি আউড়ে যেতে হবে। এছাড়া আর কি?
রঙ্গময়ী খুব শান্ত স্বরে বলল, সেটুকুও তো করা দরকার।
আজ আমার শরীর ভাল নেই মনু। মনটাও খারাপ।
তাহলে যাবে না?
নাই গেলাম। এ-সব সামাজিকতা আমার ভাল লাগে না।
নাকি চোখের সামনে কাউকে মরতে দেখতে চাও না!
হেমকান্ত একটু হাসলেন। বললেন, তাও বটে।
রঙ্গময়ী হেমকান্তর দু হাত দূরত্বে দাঁড়ানো। তার গা থেকে একটা আঁচ আসছে বলে মনে হল হেমকান্তর। রঙ্গময়ী বলল, তুমি আমি সবাই একদিন না একদিন তো মরবোই। মরতে দেখা ভয়ের কী?
হেমকান্ত অন্য পন্থা ধরে বললেন, কোকাবাবু যদি মরেন তাহলে আমাকে তো আবার স্নান না করিয়ে ঘরে ঢুকতে দেবে না।
স্নান করবে। তাতে কি? গরম জল করা থাকবে। আগুন আর লোহা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকবে। আমি সব তৈরি রাখব।
রাখবে জানি। কিন্তু আজ আমার অত হাঙ্গামা ভাল লাগছে না।
রঙ্গময়ী একটু হতাশার গলায় বলে, কোনোকালেই তো কোনো হাঙ্গামা পোয়ালে না। এমন জড়ভরত হয়ে দিন কাটাতে ভাল লাগে তোমার?
হেমকান্ত বিষন্ন গলায় বললেন, সংসার বাস্তবিকই বড় জটিল জায়গা মনু। সুনয়নী গেছে, ভেবেছিলাম এরপর আর লোক-লৌকিকতা, ভদ্রতা অভদ্রতার ধার ধারতে হবে না। আপনমনে থাকব। এখন দেখছি, নিজেরমতো করে থাকবার উপায় নেই।
অত রেগে যাচ্ছো কেন? ব্যাপারটা খুব সামান্য। কোকাবাবু তোমাদেরই জ্ঞাতি। এক শহরে বাস। না গেলে কেমন দেখাবে? এ সময়ে শত্রুও তো যায়।
মনু, তুমি কোনোদিন আমার কোনো অসুবিধে বুঝলে না। কোনটা আমি ভালবাসি, কোনটা বাসি না সেটা জেনেও তুমি সবসময়ে অপছন্দের কাজটাই আমাকে দিয়ে করাতে চাও। মরার সময় নাই বা গেলাম, কোকাবাবুর অসুখের সময় তো আমি প্রায়ই দেখতে গেছি।
রঙ্গময়ী হাসল না বটে, কিন্তু তার মুখে কিছু কোমলতা ফুটল। যেমন শিশুর অসহায়তা দেখে মায়ের মুখে ফোটে। রঙ্গময়ী খুব মৃদু স্বরে বলল, সঙ্গে আমি গেলে?
হেমকান্ত এ কথায় হঠাৎ মুখ তুলে রঙ্গময়ীর দিকে তাকান। বিভ্রান্তের মতো বলেন, তুমি গেলে—তুমি গেলে—
সহিসকে গাড়ি যুততে বলো গে, আমি তৈরি হয়ে আসছি।
হেমকান্ত হঠাৎ বললেন, খারাপ দেখাবে না মনু?
রঙ্গময়ী যেতে যেতে মুখ ফেরাল। মুখে একটু হাসি। কী অপরূপ হয়ে গেল মুখটা! বিহ্বল হেমকান্ত চেয়ে রইলেন।
রঙ্গময়ী বলল, দেখাবে। তবু তোমার জন্যেই যেতে হবে।
বরং খবর পাঠিয়ে দাও, আমার শরীর খারাপ।
সেটা অজুহাত হল, অজুহাত কি ভাল?
মানুষের শরীর খারাপ হয় না?
হয়। তোমার হয়নি।
কে বললে হয়নি?
রঙ্গময়ী একটু ভ্রূ কুঁচকে চিন্তান্বিত মুখে বলে, সত্যি বলছো নাকি? শরীর সত্যিই খারাপ?
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, তোমরা তো কেউ আমার কোনো খবর রাখো না মনু। সে না হয় নাই রাখলে, কিন্তু মুখের কথাটুকু অন্তত বিশ্বাস কোরো।
রঙ্গময়ী এই অভিমানের কথায় মুচকি হেসে বলল, শরীর খারাপ তা বুঝব কি করে? দিব্যি তো ফুল-ফুল সেজে কুঞ্জবনে এসে বসে আছো।
হেমকান্ত ডাক-হাঁক বা প্রচণ্ড প্রতাপের মানুষ নন। তবে বন্ধ কপাটের মতো তার একটা নীরেট গাম্ভীর্য আছে। সেইজন্য সকলেই তাঁকে সমীহ করে। তাঁর মুখের দিকে চেয়ে তরল কথাবার্তা কেউই বলে না। অবশ্য রঙ্গময়ী তার ব্যতিক্রম। হেমকান্তও রঙ্গময়ীর কাছেই কিছু প্রগল্ভ হয়ে ওঠেন! রঙ্গময়ীর এ কথাটায় তিনি হাসলেন না। বোধহয় পুরোনো ক্ষতে ব্যথাতুর স্পর্শ পেলেন। বললেন, আজকের দিনটা আমার ভাল যাচ্ছে না মনু। মনটা মুষড়ে আছে। এর ওপর যদি কোকাবাবুর মৃত্যুটা চোখে দেখতে হয় তবে সারা রাত আর ঘুম হবে না।
রঙ্গময়ী তার মায়াবী চোখ দিয়ে যতদূর সম্ভব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে হেমকান্তকে। তারপর বলে, মনের আর দোষ কি? পুরুষ মানুষরা হাঁটে, বেড়ায়, আড্ডা দেয়, তাস পাশা খেলে। তোমার তো সে-সব কিছু নেই। কেবল বসে বসে আকাশ পাতাল কী যে ভাবো।
হেমকান্ত একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, আমি কি কেবল বসেই থাকি? কিছু করি না?
তা বলিনি। নিজের সব কাজ তুমি নিজেই করে নাও। কিন্তু সেটাও কি বাপু পুরুষ মানুষকে মানায়? নিজের ছাড়া কাপড় ধুচ্ছো, নিজের জল গড়িয়ে নিচ্ছো, নিজের মশারি টাঙাচ্ছো বা জুতো বুরুশ করছো, পুরুষ মানুষের এ কেমন ধারা? অত দাসদাসী তবে আছে কেন?
তাহলে কিছু করি বলছো?
করো, কিন্তু ওসব করো বলে আমি তোমার প্রশংসা করতে পারব না।
তোমার প্রশংসা! ওরে বাবা! সে তো নোবেল প্রাইজ পাওয়ার শামিল।
আমার প্রশংসা তো বড় কথা নয়। তোমার বউও দুঃখ করে বলত, উনি যে কেন সকলের এত ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেন।
বলত নাকি?
বলবে নাই বা কেন? তাকে তো তুমি স্বামীসেবার সুযোগই দাওনি। জ্বর হলে মাথাটা পর্যন্ত টিপে দিতে ডাকতে না।
সেটা ভাল হয়নি বুঝি?
ভাল কি মন্দ সে জানি না। মেয়েমানুষের বুদ্ধি অল্প, তার ওপর আমি মুখ্যু মানুষ। আমাদের চোখে ভাল লাগে না বলেই বলি।
রঙ্গময়ীর স্বরে একটু অভিমানের সুর ছিল কি? হেমকান্ত মনে মনে একটু উদ্বিগ্ন হলেন। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব যে মতগুলি আছে তা তিনি কদাচিৎ লোকের কাছে ব্যক্ত করেন। তর্ক করতে কেউ তাঁকে দেখেনি কখনো। হেমকান্ত মৃদু স্বরে বললেন, তোমার বুদ্ধি অল্প নয়। মূর্খও তোমাকে কেউ বলেনি। আমার সম্পর্কে তোমার সিদ্ধান্তও সঠিক। আমি নিজে আমার ত্রুটিগুলি খুব ভাল বুঝি। কিন্তু মনু, দোষ জেনেও কি সব সময়ে মানুষ সে দোষ ছাড়তে পারে?
রঙ্গময়ী ভ্রূকুটি করে বলে, তোমার দোষ দেখে বেড়ানোই বুঝি আমার কাজ? সে সব নয়। কিছু মনে কোরো না আমার কথায়। শরীর খারাপের কথা বলছিলে, কী হয়েছে তা তো বললে না।
এখনো তেমন কিছু হয়নি। হয়তো শরীর ততটা খারাপ নয়। মনটা খারাপ। আর মন খারাপ বলেই শরীরটাও ভাল লাগছে না।
চুপচাপ বসে থাকলে কি মন ভাল হবে? একটু বেড়িয়ে এসে গিয়ে। কোকাবাবুর বাড়িতে না যাও, অন্য কোথাও তো যেতে পারো।
হেমকান্ত হঠাৎ দাঁড়ান। বলেন, না তার দরকার নেই। চলো, বরং দুজনেই কোকাবাবুর বাড়িতে যাই।
এ কথায় রঙ্গময়ী যেন একটু খুশি হয়। একটা দীপ্তি ক্ষণেক খেলা করে যায় মুখে। চোখের গভীর দৃষ্টি যেন বলে, এই তো চাই।
রঙ্গময়ীর সঙ্গে হেমকান্তর বাইরের সম্পর্কটা খুবই পলকা। প্রায় কিছুই নয়। রঙ্গময়ী এ বাড়ির পুরুতের মেয়ে। পুরুত বিনোদচন্দ্র এখন খুবই বুড়ো হয়ে পড়েছেন। তাঁর ছেলে লক্ষ্মীকান্তই এখন পূজো-আর্চা করে। বিনোদচন্দ্রের অনেকগুলি ছেলেমেয়ে। তাদের অধিকাংশই লেখাপড়া শেখেনি। ভাল করে খাওয়াই জুটত না তাদের। রঙ্গময়ী বিনোদচন্দ্রের চতুর্থ কন্যা। তাঁর আশা ছিল জমিদার শ্যামকান্তর মধ্যমপুত্র হেমকান্তর সঙ্গে এই মেয়েটির বিয়ে হবে। শ্যামকান্তর স্ত্রী মেয়েটির সুলক্ষণ দেখে একবার এরকম অভিমত ব্যক্ত করেন। কষ্টেসৃষ্টে তিন মেয়ের বিয়ে দিলেও চতুর্থ রঙ্গময়ীর জন্য বিনোদচন্দ্র অন্যত্র বিয়ের চেষ্টা করেননি। বয়সে রঙ্গময়ীর চেয়ে হেমকান্ত প্রায় পনেরো বছরের বড়। কিন্তু রঙ্গময়ীর যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন হেমকান্তর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর বিনোদচন্দ্র, নলিনীকান্তর আশায় বসে রইলেন। কিন্তু শ্যামকান্ত বা তাঁর স্ত্রীর তরফ থেকে তেমন কোনো আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিত পেলেন না। তাঁর বড় তিনটি মেয়েই গরীবের ঘরে পড়েছে। তাদের একজন আবার অকাল বৈধব্যের কবলে। ছেলেরা কেউই মানুষ হয়নি। বিনোদচন্দ্র তখন রঙ্গময়ীকে জমিদারের ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া। পুরোহিত হলেও তাঁর নীতিজ্ঞান প্রখর ছিল না। গলগ্রহ এক বালবিধবা বোন তাঁর সংসারে আছে। কনকপ্রভা। কনকের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ, তবে বাঁকা। কনক একদিন বিনোদচন্দ্রকে বলল, সোনাভাই, যদি চৌধুরীবংশেই মনুকে দিতে চাও তো সোজা পথ ছাড়। বিনোদচন্দ্র সোজা পথ ছাড়তে রাজি, কিন্তু বাঁকা পথ পেলে তো!
কনক সেই বাঁকা পথের সন্ধান দিল না। তবে নিজেই দায়িত্ব নিল।
নলিনী বড় দালানে থাকত না। কাছারিঘরের পাশে খাজাঞ্চী মুহুরি বা ওই ধরনের কর্মচারীদের জন্য যে এক সারি ঘর ছিল তারই একটায় থাকত। বিলাসব্যসনের ধারেকাছেও ঘেঁষত না সে। ঘরে একটি তক্তপোশ, তাতে দীন বিছানা। কয়েকটা বইয়ের আলমারি আর লেখাপড়ার জন্য একটা টেবিল আর চেয়ার ছিল। অনেক রাত অবধি জেগে সে পড়াশুনো করত সেই ঘরে।
সেই ঘরে মাঝে মাঝে কনক রঙ্গময়ীকে পাঠাত। রঙ্গময়ীর কাজ ছিল গিয়ে জিজ্ঞেস করা, আপনার কি কিছু লাগবে?
এরকম নিরীহভাবে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল। নলিনীর ঘরে মাঝে মাঝে খাওয়ার জল বা ঘোলের সরবৎ দিয়ে আসত রঙ্গময়ী। কাজটা তাকে দিয়ে কেন করানো হচ্ছে তা অবশ্য সে বুঝত না। নলিনীর প্রতি সে কোনো যুবতীসুলভ আকর্ষণও বোধ করত না।
নলিনীও ছিল হৃদয়চর্চা থেকে বহুদূরের মানুষ।
কিন্তু কনক ধৈর্য হারাচ্ছিল। মেয়েটা হাবা, ছেলেটা গবেট।
সুতরাং আর একটু বাঁকা পথ নিতে হল কনককে। একদিন একটু বেশী রাত্রে সকলে ঘুমোনোর পর রঙ্গময়ীকে ঠেলে তুলে দিল কনক, যা তো, নলিনীর বোধহয় খুব জ্বর এসেছে। দেখে আয় তো।
রঙ্গময়ী ঘুমচোখে একটু অবাক হলেও তড়িঘড়ি গিয়ে ঢুকেছিল নলিনীর ঘরে। নলিনী পড়তে পড়তে মুখ তুলে অবাক হয়ে চাইল। এত রাত্রে রঙ্গময়ী!
কিছু বুঝবার আগেই বাইরে থেকে দরজা টেনে শিকল তুলে দিল কনক।
নলিনী চমকে উঠল।
আর থরথর করে কেঁপে উঠল রঙ্গময়ী!