My good blade carves the casques of men.
সারারাত জ্বরের ঘোরে পিতা বলতে লাগলেন, তুমি এসেছ? তুমি এসেছ?
আমি তো পাশেই বসে আছি। কী করব কিছুই জানি না। ডাক্তারবাবুকেও ডাকা হল না। গল্পে গল্পে রাত বেড়ে বসে রইল। রাত অনেকটা সরীসৃপের মতো। ক্রমশ বড় হতে হতে বড় হতে হতে, ভোরের দিকে অন্ধকারের ন্যাজটি টেনে নেয়।
তুমি এসেছ বলায় প্রথমে ভেবেছিলুম, আমাকেই বলছেন বোধহয়। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি এসেছি। পিতা বললেন, একটু দাঁড়াও, আমিও আসছি।
তখনই বুঝলুম, এ তুমি আমি নই, অন্য কেউ। জ্বর বাড়লে জলপট্টি লাগায়। সে চেষ্টাও করে দেখলুম। এমন হাতের ঝাঁপটা মারলেন, জলের বাটি উলটে বিছানার চাদর ভিজে গেল। চাঁদরের তলায় পাট পাট খবরের কাগজ ঢুকিয়েছি।
শব্দহীন মধ্যরাত। ঘড়ির পদধ্বনি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। সময়ের সান্ত্রি যেন কয়েদের বাইরে পায়চারি করছে। ফঁসির আসামি শেষ রাত জাগছে। পরমায়ু থেকে একটি দিন না নিয়ে সে যাবে না। ভোরের শমীবৃক্ষে দিনের প্রাণদণ্ড। সায়েব হলে ইংরেজিতে কবিতা লিখতুম, এভরি মর্নিং এ ডে ইজ হ্যাঁঙ্গড। মিনিট গলে যাচ্ছে ঘণ্টায়, ঘণ্টা চুঁইয়ে পড়ছে দিনে। দিন যায়, আর আসে না।
ভোরের আকাশ কতদিন দেখিনি! কে যেন সিঁদুর ঢেলে দিয়েছে। রুগি এখন শান্ত। পৃথিবীর যত কিছু বাড়াবাড়ি সবই যেন মধ্যরাতে। খুনির খুন, চোরের চুরি, সাধকের ঈশ্বর দর্শন, রুগির রোগ, সবই যেন তুঙ্গে আরোহণ করে বসে থাকে। শুনেছি আত্মহত্যার ইচ্ছেও প্রবল হয়ে ওঠে। পাগলের পাগলামিও বেড়ে যায়। রাতের কী মহিমা!
মানসবাবু খুরথুরে একটা কুকুরের বুকে চামড়ার ক্রস বেল্ট বেঁধে প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি। চোখ জ্বালা করছে। রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। মুখেচোখে ভোরের ঠান্ডা বাতাস বেশ লাগছিল। মানসবাবু হঠাৎ গোঁত করে আমাদের সদরে ঢুকে পড়ে কড়া নাড়তে শুরু করলেন। নাও বোঝো ঠ্যালা। সাতসকালেও শান্তি নেই। কুকুরটা মেয়েলি গলায় খেউ খেউ করছে।
দরজার খিল খুলতেই মানসবাবু লম্বা পা ফেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন, হরিশঙ্কর, হরিশঙ্কর।
বাবার খুব জ্বর, শেষরাতে সবে একটু ঘুমিয়েছেন।
ধমকের সুরে মানসবাবু বললেন, ঘুমিয়েছেন বলে আমি একটু খোঁজখবর করব না! তোমার আচ্ছা আবদার তো! তুমি আগে জন্মেছ, না আমি আগে জন্মেছি হে ছোকরা!
মানসবাবু আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলেন। উঠছেন আর বলছেন, ব্বাবাঃ সিঁড়ি করেছ বটে! কাশীর সিঁড়িকেও হার মানায়!
আমাকে পেছন পেছন উঠতে দেখে কুকুরটা খুব অসন্তুষ্ট হচ্ছে। ফিরে ফিরে তাকায় আর ফিনফিনে গলায় ঘেঁউ ঘেঁউ করে ওঠে। এইসময় মাতামহ থাকলে বুঝিয়ে দিতেন ঠ্যালা। বাড়িতে ডাকাত পড়ার অবস্থা। পিতা মশারির ভেতর উঠে বসেছেন। না বসে উপায় কী!
মানসবাবু দরজার সামনে। কুকুর চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের ভেতরে। এই যে হরিশঙ্কর, উঠেছ?
কুকুর সেই এক প্রশ্ন নিজের ভাষায় রিপিট করল। মশারিটা আঁচড়াবার খুব ইচ্ছে। বকলশে টান পড়ছে বলে তেমন সুবিধে করতে পারছে না।
পিতা বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমি কীরকম গুড স্যামারিটান দেখো, ভোর না-হতেই তোমার খবর নিতে এসেছি। দু’দিন মেয়ের বাড়িতে ছিলুম। জামাই নতুন গাড়ি কিনেছে। বুড়োকে খুব ক’দিন ঘোরালে। কাল রাতে তুমি গাড়ির শব্দ শোনোনি?
অতটা খেয়াল করিনি।
রাত ন’টার সময় জামাইয়ের গাড়িতেই তো ফিরলুম। আজ সকালের প্লেনে দিল্লি যাবে। ওই করে বেড়াচ্ছে বুঝলে? কদিন আর কলকাতায় থাকে? হিল্লিদিল্লি করেই জীবন কাটালে। আর উপায় কী বলো? অত বড় ইঞ্জিনিয়ার ভারতে ক’জন আর আছে। হাতে গোনা যায়। অ্যাঁ, কী বললে!
কুকুরের ডাকের পাংচুয়েশনে কথা চলেছে। কমা ফুলস্টপের গোলমালে শ্রোতারা তেমন মর্মোদ্ধার করতে পারছেন না। পিতা ছোট্ট একটি হাই তুলেছিলেন।
কই না, কিছু বলিনি তো?
মানসবাবু আদুরে গলায় কুকুরকে ধমক লাগালেন, যেন বক্তার স্ত্রীকে থামাতে চাইছেন, আঃ, বিউটি, চুপ করো না। ও তো আমাদের হরিশঙ্কর। ওকে অত ঘেউ ঘেউ করার কী আছে। ও, মাথায় মুড়ি দিয়ে বসে আছে বলে তোমার অপছন্দ হচ্ছে। কী কুকুরই হয়েছ তুমি? একেবারে সায়েব বাসা! অ্যাঁ, কী বললে?
আজ্ঞে, না, কিছু বলিনি তো?
শুনলুম, তুমি নাকি নারীঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছ!
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সে-এ-এ, কীই-ই? আমরা যে বলতুম, চরিত্র দেখতে চাও তো হরিশঙ্করের চরিত্র? সেই চরিত্রে তা হলে স্পট পড়ে গেল?
আজ্ঞে হ্যাঁ। স্পটেড ডিয়ার।
অ্যাঁ, কী বললে?
ছিলুম বাঘ, এখন হয়েছি গুলবাঘ।
হ্যাঁ, চরিত্র ঠিক রাখা বড় কঠিন ব্যাপার! মুনি ঋষিদের জীবনটাই দেখো না। বিন্ধ্যাচল থেকে হিমালয় থেকে সাধন ভজন করে ঊর্ধরেতা হয়ে সমতলে নেমে এলেন। জেলেনি জাল ফেলছে জলে। ব্যস হয়ে গেল। খেল খতম, পয়সা হজম। বউমা মারা যাবার পর তোমাকে আমি। বলেছিলুম, বারবার বলেছিলুম, আমার একটি বয়স্কা শালি আছে। গুণে তার তুলনা নেই। রূপেই যা একটু গড়বড়ে। মুখে একটু পক্সের দাগ। তুমি কিছুতেই দার পরিগ্রহে রাজি হলে না। বয়েস তোমার এখনও যায়নি হরিশঙ্কর। বলো তো রাস্তা ওপেন আছে।
উচ্ছিষ্টে আমার রুচি নেই।
অ্যাঁ, কী বললে?
আজ্ঞে, উচ্ছিষ্টে অরুচি।
তার মানে?
আপনার স্ত্রীর আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা! সে তো স্টোভ ফেটে মারা গেল।
আপনি তাই বলেন, আপনার গুড স্যামারিটানরা তা বলে না। তারা একটু অন্যরকম গন্ধ পায়।
ডিফ্যামেসান কেস করব।
সময় পেরিয়ে গেছে।
তুমি ছোটলোক, ইতর।
মানুষ সম্পর্কে মানুষের ধারণা মেলে না। ওপিনিয়ান ডিফারস।
আমি কিন্তু তোমার শত্রু হয়ে রইলুম। সুযোগ পেলেই এর শোধ নোব।
এই যে একটু আগে বললেন, আপনি আমার গুড স্যামারিটান।
আমি উইথড্র করছি।
দেন ইউ ক্যান সেফলি ক্লিয়ার আউট। ডোন্ট পোক ইয়োর আগলি নোজ ইন মাই অ্যাফেয়ারস।
তোমার বাঁশ তৈরি হচ্ছে, হরি।
বাঁশ আমি খুলতে জানি। বাঁশঝাড়ের দেশের মানুষ আমি। বাঁশ দিতেও জানি, বাঁশ খুলতেও জানি। দেখা যাক আপনার বংশ কোন জাতের।
মানসবাবু কুকরটাকে কোলে তুলে নিলেন। ঘেউ ঘেউ কিছুতেই থামেনি। বাচ্চা-কোলে সিনেমা দেখতে এসেছিলেন কোনও মা। কান্না যেন আর থামে না। আঁচল সরিয়ে অন্ধকারে স্তন্যপান করাও। তবে যদি শান্ত হয়। মানসবাবুর তো স্তন নেই। গোঁফ আছে বিরাট।
সিঁড়ির একটা ধাপ নেমে বললেন, মনে থাকে যেন!
আজ্ঞে হ্যাঁ, থাকবে।
শুভানুধ্যায়ীকে শত্রু করলে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, ক্যামোফ্লেজ আর রইল না। যুদ্ধ সহজ হবে। আপনার সেই ভাইয়ের কী হল? মকর্দমা মিটেছে?
দ্যাটস নান অফ ইয়োর বিজনেস।
আমারও ওই একই উত্তর, তবে ইংরেজিতে নয়, বাংলায়–নিজের চরকায় তেল দিন।
মানসবাবু সরে পড়লেন। পিতা মশারি ঠেলে বেরিয়ে এলেন। গতকাল দাড়ি কামানো হয়নি। কদমফুল ক্ষীরে পড়ে গেলে যেরকম চেহারা হয়, মুখের চেহারা সেইরকম। আমাকে বললেন, কী বুঝলে?
খুব খারাপ।
খারাপ? খারাপ কেন?
ক্রমশই শত্রু বাড়ছে।
তুমি কি এতকাল সব বন্ধু ভাবতে? ইও আর এ ফুল। মানুষ কখনও বন্ধু হয়? বিশেষত প্রতিবেশী। ভাল হল, ভাল। খোঁচা মারলেই সরীসৃপের জাত বেরিয়ে পড়ে। জাত চেনা হয়ে গেলে নাড়াচাড়া করতে আর অসুবিধে হয় না। জেনে রাখো, তুমি এবং তুমিই। বুঝলে কিছু?
আজ্ঞে না।
এক দিকে তুমি, আর এক দিকে তোমার জগৎ। চালিয়ে যাও লড়াই। শক্তি থাকে জিতবে, নয়তো হেরে ভূত হয়ে যাবে।
মানুষকে শুধু শুধু চটিয়ে লাভ কী?
মানুষ? মানুষ নামক জন্তুকে তুমি কতটুকু চেনো? প্রায় হাফ এ সেঞ্চুরি ধরে আমি মানুষকে দেখছি। মানুষের মতো নিষ্ঠুর, পরশ্রীকাতর, নীচ, স্কিমিং, ক্যালকুলেটিং প্রাণী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় পাবে না। তুমি তো এখন যুবক?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তোমার সব গ্ল্যান্ডসই এখন ফুল সিক্রিশনে। হরমোন, থাইরয়েড, পিটুইটারি। তোমার জানা উচিত সাবকনশাস কীভাবে কনশাসে উঠে আসে। মানুষ কোন উৎস থেকে তার আচার আচরণের নির্দেশ পায়, মন কাকে বলে, তার কতটা সাব-মার্জড কতটা ফ্লোটিং, এ বিষয়ে তোমার কোনও পড়াশোনা আছে?
আজ্ঞে না।
ব্রাহ্মণের ছেলে। পইতে হয়েছে! ত্রিসন্ধ্যা করো। ভূতশুদ্ধি কাকে বলে জানো?
আজ্ঞে না।
সবেতেই তোমার না। কী জানো হে তুমি? পাপ পুরুষের ছবি দেখেছ? দেখোনি? তান্ত্রিক সন্ধ্যোপাসনায় আছে। শিরে ব্রহ্মহত্যার চিন্তা, বাহুতে চৌর্যবৃত্তি, হাত নিসপিস করছে, কী করে মেরে নোব। আর কটিদ্বয়। সবচেয়ে মারাত্মক স্থান। ব্যভিচারের উৎস। হোয়াট ইজ লিবিডো?
আজ্ঞে, আমি যে ওসব কিছুই জানি না।
তোমার মুখ দেখলে আমার মায়া হয়। দিস ওয়ার্লড ইজ নট ইয়োর প্লেস, মাই ডিয়ার সান। তোমার জন্যে চাই কিং আর্থারের আইল্যান্ড ভ্যালি অফ অ্যাভালন। মৃত্যুর পর যে-দ্বীপে গিয়ে তিনি আর ফেরেননি।
Where falls not hail/or rain/or any snow/
nor ever blows wind loudly/but it lies.
Deep meadowed/fair with orchard lawns.
কোথায় পাবে তুমি সেই সুখের দ্বীপ। পৃথিবী বড় কঠিন জায়গা। তাই তো জন্মের মুহূর্তে আমরা ককিয়ে কেঁদে উঠি। মাই প্যারাডাইস ইজ লস্ট। যদি মেয়ে হও পুরুষের লালসার জেলিতে আযৌবন বগবগ করবে। যেই বার্ধক্য হল, চলে গেলে আঁস্তাকুড়ে। যদি ছেলে হও, তোমাকে ক্রীতদাস বানাবার জন্যে জগৎ চাবুক হাতে তেড়ে আসবে। ক্ষমতাশালী বলবে, নে ব্যাটা আমার পদলেহন কর। দুর্বলও তোমাকে ছাড়বে না। মাছির মতো ভনভন করবে চারপাশে। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, উপহাসের ছিটে মেরে উত্যক্ত করবে। সো, হাউ টু লিভ? তেড়ে ওঠো। বৈষ্ণব নয়, শাক্তের শক্ত হুংকার,
My good blade carves the casques of men/
My tough lance thrusteth sure/
My strength is the strength of ten/
Because my heart is pure.
আপনি এইসব বলছেন? প্রেম বলে কি কিছু নেই? আমাদের বন্ধু বলে কি কিছু নেই? এমন সাংঘাতিক নিষ্করুণ পৃথিবী আমার কল্পনায় আসে না।
পৃথিবীতে তুমি করুণা খুঁজতে এসেছ? মাই ডিয়ার ফুল। ওই বইটা নিয়ে এসো। থার্ড ফ্রম দি লেফট। হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটা। গিরীন্দ্রশেখর বসুর স্বপ্ন। দাও। হিয়ার ইট ইজ। নাও পড়ে দেখো। গল্পের বই কবিতার বই না পড়ে মাঝে মাঝে এইসব বই পড়ে দেখতে পারো। নিজেকে জানতে পারবে। মানুষকে জানতে পারবে।
বইটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাথরুমের দিকে চলে গেলেন। ভোর হতে-না-হতেই কী অশান্তি! পেনসিলে সূক্ষ্ম দাগ দেওয়া অংশটা পড়ে দেখতেই হচ্ছে। এরপরেই যে প্রশ্ন হবে, উত্তর না দিতে পারলেই তো মাই ডিয়ার ইডিয়েট। ‘পরকে মারিব, এই ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইচ্ছা, নিজে মার খাওয়া।’ পাশে মুক্তাক্ষরে নোট, পাতা ৮৩, চিহ্নিত অংশ। ‘কামবৃত্তির বিকাশ কোনও একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নহে। কামগন্ধহীন পবিত্র প্রেমও সেই আদি কামভাবেরই রূপান্তর নহে। সেইরূপ, সখিত্ব বন্ধুত্ব ইত্যাদির মূলেও কামগন্ধ রহিয়াছে।’ পরের চিহ্নিত অংশ, ‘দুইটি বিরুদ্ধ ভাবের মধ্যে একটি রুদ্ধ ইচ্ছারূপে মনের মধ্যে থাকিয়া যায়। পুরুষের নিপীড়িত হইবার ইচ্ছা, স্ত্রীলোকের নিপীড়নের ইচ্ছা, পুরুষের রূপ দেখাইবার ইচ্ছা ও স্ত্রীলোকের রূপ দেখিবার ইচ্ছা অজ্ঞাতভাবে মনের মধ্যে থাকে। পরের অধীনে চাকরি করিবার ইচ্ছা পুরুষের নিপীড়িত হইবার ইচ্ছার রূপান্তর মাত্র।‘ পাশে খুদে অক্ষরে সংস্কৃত দু’ছত্র, কামস্তদগ্রে সমবৰ্ত্ততাধি। মনসো রেতঃ প্রথমং যদাসীৎ ॥ বিশ্বজগৎ কামনা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে।
বাথরুমে স্নানের শব্দ। সর্বনাশ, জ্বরের রুগি স্নান করছেন।
চান করছেন নাকি?
ঝরনা যেন উত্তর দিল, কেন, আপত্তি আছে?
আপনার জ্বর, পা ক্ষতবিক্ষত, চান করছেন কী?
একে বলে হাইড্রোথেরাপি। শরীরের গরম বার করে দিচ্ছি। ভয় পাবার কিছুই নেই। মোটরগাড়ি দেখেছ?
দেখিছি।
র্যাডিয়েটার কাকে বলে জানো?
জানি।
জল ঢেলে ইঞ্জিনকে ঠান্ডা রাখতে হয়। প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব।
তোড়ে জল পড়তে শুরু করল। কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ির সামনের রাস্তায় হুড়মুড় করে একগাদা টিনের কৌটো পড়ার শব্দ হল। তিরিক্ষি গলায় কে যেন বললেন, যাঃ শালা।
পরমুহূর্তেই হুড়মুড় করে আর একটা শব্দ হল। শব্দের পরেই নারীকণ্ঠ, লাথি মারছ কেন?
পুরুষকণ্ঠ, না লাথি মারবে না, নাতজামাইকে আদর করবে!
কথা শেষ হতে না-হতেই আবার শব্দ। একটা ঢোল গড়িয়ে পড়লে যেরকম শব্দ হতে পারে সেইরকম। পুরুষকণ্ঠ গর্জন করে উঠল, মারেগা শালা এক থাপ্পড়।
হামারা কেয়া কসুর?
একটা চড় মারার শব্দ। নারীকণ্ঠ, শুধু শুধু লোকটাকে মারছ কেন?
না মারবে না, দাড়ি ধরে চুমু খাবে!
কী হচ্ছে কী? জানলার ধারে গিয়ে দেখতে হচ্ছে। বাড়ির সামনে একটা টানা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। চুল-ওলটানো খেকুরে চেহারার এক ভদ্রলোক। গায়ে লেসের কাজ করা পাঞ্জাবি। হাতায় মিহি গিলে। ভদ্রলোক খুব হম্বিতম্বি করছেন। বুড়োটে রিকশাঅলা গামছা নেড়ে নেড়ে বলছে, কাহে হাত উঠায়া, কাহে হাত উঠায়া?
ভদ্রলোক তিড়বিড় তিড়বিড় করতে করতে বলছেন, তুম হামারা সর্বনাশ কর দিয়া। রিকশায় এক ভদ্রমহিলা কোনওরকমে বসে আছেন। বেশ স্বাস্থ্যবতী। তাজা টেপারির মতো দেখতে। কোলের ওপর একগাদা জিনিসপত্র। রাস্তায় গোটাকতক টিনের কৌটো গুরুর সামনে ভক্তের মতো গড়াগড়ি যাচ্ছে। একটা বড় কৌটো ভেতরের মাল ছেড়েছে। একগাদা বড়ি ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে। একটা তবলা একপাশে ডিগবাজি খেয়েছে।
ভদ্রমহিলা বলছেন, আর বসতে পারছি না। কতক্ষণ পায়ের ভরে বসে থাকা যায়।
ভদ্রলোক দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, নেমে এসো না সুন্দরী। কেউ তো তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে টঙে উঠে বসে থাকতে বলেনি।
মহিলাও একই রকম খিঁচিয়ে উত্তর দিলেন, কোলের জিনিসগুলি না ধরলে নামা যায়?
এঁরা কারা? কোথায় চলেছেন? হঠাৎ এখানে থামলেন কেন?
ভদ্রলোক হঠাৎ ওপর দিকে তাকাতেই আমার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। তোবড়ানো গালে একমুখ হাসি। নিমেষে এমন ভাবান্তর ভাবা যায় না। চেঁচিয়ে বললেন, এই যে মাস্টার, ফাদার কোথায়?
ভদ্রমহিলা সেই মুহূর্তে নামার চেষ্টা করায় কোল থেকে আবার একটা কৌটো সশব্দে গড়িয়ে। পড়ল। রত্নগর্ভা শুনেছি, এমন কৌটোগর্ভা কদাচিৎ দেখা যায়।
ভদ্রলোকের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। মহিলাকে দাবড়ে উঠলেন, তেরি নোলে খেলি। এ আবার কী ভাষা! আবার ওপর দিকে তাকালেন। সেই গাল-ভাঙা হাসি। মেঘ-ভাঙা রোদের মতো। ফাদার, মাস্টার কোথায়!
যাঃ উত্তেজনায় সব গুলিয়ে ফেলেছেন! ডেকে দোব?
ইয়েস, ইয়েস। ডেকে দাও। উই কাম।
ভদ্রলোকের চালচলন যেন দু’মুখো ছুরির মতো। একবার এদিকে কাটছেন, একবার ওদিকে কাটছেন। মহিলার দিকে ফিরে বললেন, নামতে পারছ না? তখনই বলেছিলুম ভীম ভবানীর মতো গতর কোরো না।
পিতা সবে বাথরুম থেকে বেরিয়েছেন। গায়ে তোয়ালে জড়ানো। পায়ের ব্যান্ডেজ জায়গায়। জায়গায় সামান্য ভিজেছে।
সস্ত্রীক এক ভদ্রলোক আপনাকে ডাকছেন।
আকৃতি?
চেহারার বর্ণনা শুনে বললেন, ও, প্রফুল্ল এসেছে। কোনও নোটিশ না দিয়েই চলে এল! বিপদে ফেললে।
তোয়ালে জড়ানো অবস্থায় জানলার সামনে গিয়ে বললেন, কী খবর প্রফুল্ল?
আমার আসার ঠিক ছিল না। হঠাৎ চলে আসতে হল।
বেশ করেছ, চলে এসো ওপরে।
আর এক খেপ মাল আসবে। নিয়ে আসি তা হলে।
যাও নিয়ে এসো।
এই স্ত্রীলোকটি রইল।
ওপরে পাঠিয়ে দাও। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হবে না।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি একটু তদারকি করো। নীচে অনেক ঘর পড়ে আছে, সেইখানেই থাকবে। অনেক আগে একবার বলেছিল। কথার কথা। আজ দেখছি এসেই পড়েছে। নীচেটা ভূতের বাসা হয়ে আছে, এতদিনে মানুষের হাত পড়বে।
মাহেশে রথ দেখতে গিয়ে মাতামহ এক মহিলাকে দেখে বলেছিলেন, আহা! মা যেন রাবণলক্ষ্মী।
রাবণলক্ষ্মী কী জিনিস দাদু!
মালক্ষ্মী একটু স্থূলাঙ্গী হলেই যক্ষপুরীর লক্ষ্মী হয়ে যান।
প্রফুল্লবাবুর স্ত্রীকে দেখে আমার সেইরকমই মনে হল। বেশ একটা জমজমাট অস্তিত্ব। এত চওড়া পাড় শাড়ি আমি আগে দেখিনি। ঠোঁটদুটো লাল টুকটুকে। স্যানাটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে এলে মানুষের এইরকম দুধেআলতা চেহারা হয়। কী মানুষের কী স্ত্রী। প্রবীণা মহিলা হলে বলতেন বাঁদরের গলায় চাঁদমালা।
একগাদা জিনিসপত্রের মাঝে মহিলা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন।
আপনি ওপরে চলুন।
বড় বড় চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, আমাকে যে এখানেই দাঁড়াতে বলে গেল।
তাতে কী হয়েছে।
এসে দেখতে না পেলে কুরুক্ষেত্র করবে। আমি বরং এই রকটায় বসি।
একটা ছাগল এসে বড়ি খাচ্ছিল বেশ তারিয়ে তারিয়ে, চোখ বুজিয়ে। হু হু করে মাঝেমধ্যে শব্দ ছাড়ছিল। হঠাৎ তিড়বিড় করে লাফাতে শুরু করল।
মহিলা বললেন, ঝাল লেগেছে। এর নাম পাঞ্জাবি বড়ি। কত কষ্ট করে দিয়েছিলুম। সব রাস্তায় পড়ে গেল। সব ব্যাপারে এত হকপাক করে।
রকে বসে পড়লেন। চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আমাদের নীচেটা যেন যক্ষপুরী। এখানে বসবাস করবেন কী করে! অন্ধকার সঁতসেঁতে।
মহিলা বললেন, সারাটা দিন চলে যাবে এইসব পোষ্কারঝোষ্কার করতে। কী হয়ে আছে! মেয়েদের হাত না পড়লে বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ফেরে না।
ছাগলটা আবার বড়ি খেতে শুরু করেছে। ঘাসপাতা খাওয়া মুখে নতুন ধরনের স্বাদ। ছাগলের কখনও পেট খারাপ হয় না। এমন লিভার, যাই খাক না কেন, সেই ছাগলনাদি।
বাকি মালপত্র নিয়ে প্রফুল্লবাবু এসে পড়লেন। তিন ভাগ পাকা, এক ভাগ কঁচা চুল, টান টান করে পেছনে ওলটানো মুখে একটা সিগারেট। কথা বললেই পিড়িক পিড়িক করে নাচছে।
পিতা চাবির গোছা নিয়ে নীচে নেমে এলেন, খুব সাবধানে, ধীরে ধরে ধরে। প্রফুল্লবাবু বললেন, জুতো মেরে চলে এলুম।
সেকী, মামাকে কেউ জুতো মারে?
জুতো মারার কাজ করলে জুতোই মারতে হবে। ফুল গেঁদুয়া নয়। নাও নাও, প্রণাম করো। ব্রাহ্মণ মানুষ। একী তোমার পায়ে আবার কী হল?
চোট লেগেছে।
তা হলে নেমে এলে কেন? ব্যাটাচ্ছেলে আমার তবলাটা দুম করে রাস্তায় ফেলে দিলে। দেখি একবার, ঘাটফাট সব ঠিক আছে কি না!
রকে বিড়ে সমেত তবলা বসিয়ে টাই করে একটা চাটি মেরে কিছু কুচো বোল ছাড়লেন। যেন চকমকি খেলে গেল। দেখতে যেমনই হোক গুণী মানুষ।
পিতা বললেন, আহা আহা, একটা হাত করেছ বটে প্রফুল্ল। ঘুরিয়ে এনে তেহাইয়ে ফেলো।
প্রফুল্লবাবু তিনটে তেহাই মেরে ডান হাতটা আকাশের দিকে তুলে দিলেন। শ্রীমতী প্রফুল্ল মাথায় ঘোমটা টেনে কলাবউয়ের মতো একপাশে দাঁড়িয়ে।
মুখোমুখি দুটো ঘর খোলা হল। একটা বেশ বড়, আর একটা একটু ছোট। ছোট ঘরটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। দিনের বেলাতেই চোখ চলে না। প্রফুল্লবাবু ঘর দেখে বললেন, বাঃ বাঃ বেশ হবে, একটা শোবার, একটা রাধার। নাও হে লেগে পড়ো। পারবে তো সব গোছগাছ করতে!
পিতা বললেন, আমার পা-টা ঠিক থাকলে তোমাদের সঙ্গে লেগে যেতুম।
না না, ও একাই পারবে। আমাকে আবার এখুনি বেরোতে হবে। মুরগিহাটায় কাজ আছে।
সেকী, একা সব সামলাবে কী করে, যেখানে এক রেজিমেন্ট লোকের প্রয়োজন।
ওঃ, তুমি ওকে চেনো না। একাই একশো।
ভদ্রমহিলা দেয়ালের দিকে মুখ করে বললেন, ওঁকে জিজ্ঞাসা করো, শরীর যখন খারাপ, আমি কি বেঁধে দোব? আমার ছোঁয়া খেতে ওনার যদি আপত্তি না থাকে!
ঠিক বলেছ। ঠিক বলেছ। সত্যিই তো। শরীর যখন খারাপ তোমারই সেবা করা উচিত। হরি, তোমার কি জাতের বিচার আছে?
জাত! তা হলে তো আমাকে বড় বিপদে ফেললে। যদি বলি আছে, তা হলে দুঃখ পাবে, যদি বলি নেই, তা হলে রাঁধতে বসবে। আমি আমার জন্যে কাউকে খাটাতে চাই না।
শ্রীমতী প্রফুল্ল নিচু হয়ে প্রণাম করে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। প্রফুল্লবাবু বললেন, মারো গোলি।