1 of 2

১.১৮ পূর্ব ইউরোপ মার্ক্সবাদ সাম্যবাদ

পূর্ব ইউরোপ মার্ক্সবাদ সাম্যবাদ

পূর্ব ইউরোপে নতুন যুগের জন্ম হল। ঐতিহাসিক একটি বছরকে আমরা সদ্য পেরিয়ে এসেছি। শুধু দুই জার্মানি নয়, খণ্ডিত ইউরোপ আজ নতুন করে ঐক্যের স্বপ্ন দেখছে। সাম্যবাদী দুনিয়া বিরাট পরিবর্তনের সম্মুখীন। কেউ আশান্বিত, কেউ বা শংকিত। আধুনিক যুগের ইতিহাসে ১৭৮৯ সাল যেমন এক স্মরণীয় সন্ধিক্ষণ ফরাসী বিপ্লবের গুণে, ১৯৮৯ তেমনি যুগান্তকারী বছর বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে সাম্যবাদী জগতে অভূতপূর্ব তোলপাড়ের কারণে। এমন একটি দেয়াল হঠাৎ ভেঙে পড়েছে যেটিকে আমরা অভঙ্গুর বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। যদিও কম্যুনিস্ট ব্যবস্থার আমি সমালোচক তবু স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, ১৯৮৯ সালের নাটকীয় পরিবর্তন আমার কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল, ১৯৮৬ সালের অশোককুমার সরকার স্মারক বক্তৃতায় এর পূর্বাভাস দিতে পারি নি।

মহাচীন নিয়ে ‘দেশ’-এর পাতায় লিখেছিলাম গত বছরে। এবারের আলোচনায় প্রাধান্য পাবে পূর্ব ইউরোপ। বিশেষ স্থান ও কাল নিয়ে যদিও আমাদের কথা শুরু তবু ধাপে ধাপে বিশেষকে অতিক্রম করে বৃহত্তর কিছু প্রশ্নে গিয়ে পৌঁছনোতেই আমাদের আগ্রহ। ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলির এইরকমই একটা আকর্ষণ আছে। তারা এক একটি দ্বার খুলে দেয়, দুয়ার পেরিয়ে মানুষ বর্তমান অতীত ও ভবিষ্যতের বিস্তৃত বিশ্বে গিয়ে দাঁড়ায়, নিজের অবস্থানটা নতুন করে বুঝবার চেষ্টা করে।

.

পূর্ব ইউরোপের ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের কিছু বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক। গত কয়েক বছরে আমাদের পরিচিত বহু দেশে, বিশেষত তৃতীয় দুনিয়ায়, প্রতিষ্ঠিত সরকারের পতন ঘটেছে সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে। ভারতের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে তো এ ঘটনা বার বারই দেখা গেছে। পূর্ব ইউরোপে কিন্তু ক্যুনিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে কোনো সামরিক চক্রের ষড়যন্ত্রের ফলে নয়। গণঅভ্যুত্থানই পূর্ব ইউরোপে পরিবর্তনের পথস্রষ্টা। এইসব আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন ছাত্র ও যুবশক্তি, শ্রমিক, লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী মানুষ। কোথাও শ্রমিকেরা অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন, যেমন পোল্যান্ডে। কোথাও ছাত্র ও যুবশক্তি আন্দোলন শুরু করেন, যেমন চেকোস্লোভাকিয়ায়। কিন্তু যেভাবেই আন্দোলন আরম্ভ হোক না কেন, অতি দ্রুত সেটা বহু মানুষের সমর্থন লাভ করেছে।

দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কথা এই যে, কম্যুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদী আন্দোলন একটি দুটি দেশে আবদ্ধ থাকেনি, বরং পূর্ব ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম, ছোটো দেশ আলবেনিয়া। কেউ কেউ আবার বলবার চেষ্টা করেছেন যে, ১৯৮৯ সালের এই আন্দোলন কিছু অযোগ্য শাসকের বিরুদ্ধে, ক্ষমতালোভী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে, কম্যুনিস্ট শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে নয়। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হত যদি প্রতিবাদী আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকত একটি দুটি দেশে। কিন্তু তা তো থাকেনি। তবে কি কম্যুনিস্টশাসিত পূর্ব ইউরোপে প্রতিটি দেশেই নেতারা অযোগ্য ও ক্ষমতালোভী? এমন সর্বব্যাপী অযোগ্যতার অন্য কোনো বৃহত্তর ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। যে-শাসনব্যবস্থার ভিতর থেকে এই নেতারা উঠে এসেছিলেন সেই ব্যবস্থা নিয়েই আবারও প্রশ্ন এসে যায়।

১৯৮৯ সালের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রায় প্রতিটি দেশেই গণআন্দোলন ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে শান্তিপূর্ণ, বিশাল তবু সংযত, যথাসম্ভব অহিংস। ব্যতিক্রম, রোমানিয়া। অন্যান্য দেশে তেমন কোনো রক্তপাত হয়নি। বিভিন্ন দেশে গণআন্দোলনের মুখে শাসকদলের প্রতিক্রিয়া যদিও বিভিন্ন ছিল তবুও সাধারণভাবে একটা। কথা বলা যায়। এবার অধিকাংশ দেশেই শাসকদল অল্পসময়ের ভিতরই বুঝে নিয়েছে যে, এই আন্দোলনকে ঠেকানো যাবে না। এই সুবুদ্ধির ফলে শেষ অবধি ব্যাপারটা গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়নি। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি দেশের কথা বলা যাক।

পোল্যান্ডে প্রতিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ। আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল শ্রমিক সংগঠন, সলিডারিটি। ১৯৮০ সালে ওয়ালেসার নেতত্বে শ্রমিক। ধর্মঘট হয়। ১৯৮১ সালে পোল্যান্ডে সামরিক শাসন জারি করা হয়। সলিডারিটি নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু এটাকে স্থায়ী ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। বলপ্রয়োগের নীতি ধাপে ধাপে প্রত্যাহৃত হয়। ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে গর্বাচভ ক্ষমতায় আসেন। তারপর সোভিয়েত দেশসহ সারা পূর্ব ইউরোপেই কমবেশি দ্রুত গতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। ১৯৮৯ সালে পোল্যান্ডে দেশব্যাপী নিবার্চন মোট ৪৬০ আসনের ভিতর ১৬১ আসনে সলিডারিটির প্রার্থীদের অংশগ্রহণ করবার সুযোগ দেওয়া হয়, এর ভিতর একটি ছাড়া আর। প্রতিটি আসনেই সলিডারিটি জয়যুক্ত হয়। ফলে জনমত কোন দিকে এবিষয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এইভাবে পোল্যান্ডে অকম্যুনিস্ট সরকার গঠনের পথ উন্মুক্ত হয়।

চেকোস্লোভাকিয়াতে ক্যুনিস্ট স্বৈরতন্ত্রের হিম শাসনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক প্রতিবাদী আন্দোলন ঘটে ১৯৬৮ সালের বসন্ত ঋতুতে। রাজধানী প্রাগ নগরে ডুবচেকের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন, যাকে আজও “প্রাগ বসন্ত” বলে উল্লেখ করা হয়, দ্রুত নিষ্পিষ্ট হয়ে যায় সোভিয়েত ট্যাঙ্কসহ নিষ্ঠুর সামরিক হস্তক্ষেপে। এরপর গণবিক্ষোভ আবারও অন্তত আপাতদৃষ্টিতে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে দীর্ঘকালের জন্য। ঐতিহাসিক মুহূর্ত ফিরে এলো ১৯৮৯-এর নভেম্বরে। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৩৯ সালের ১৭ই নভেম্বরে অত্যাচারী নাৎসীরা ন’টি ছাত্রকে হত্যা করেছিল। সেই দিনটিকে আন্তজাতিক ছাত্রদিবস বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৮-৯-এর নভেম্বরে প্রাগের ছাত্রসমাজ ঐ দিবসটি উদ্যাপন করবার জন্য সম্মিলিত হয়, আসলে ১৯৩৯-কে স্মরণ করে সব রকমের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। জানানোই উদ্দেশ্য। প্রাগে ছাত্রদের মিছিল যখন পুলিশের মুখোমুখি হল তখন কোনো সংঘর্ষের আশংকা করেনি আন্দোলনকারীরা, এমনকি কিছু ছাত্রী ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছিল। পুলিশের দিকে সৌহার্দের প্রতীক হিসেবে। অপ্রত্যাশিত ভাবে পুলিশ কিন্তু মিছিলের ওপর সেদিন আক্রমণ চালালো ব্যাটন ও কাঁদানে গ্যাস সহ।

এর ফলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। অত্যাচারের প্রতিবাদে ধর্মঘট ডাকা হল। কিছুদিনের ভিতরই শাসক গোষ্ঠীর ভিতর সুবুদ্ধির উদয় হল, কম্যুনিস্ট সরকার নতিস্বীকার করল। মন্ত্রীসভায় কিছু অ-কম্যুনিস্ট সদস্য নেওয়া হল। কম্যুনিস্ট দলই সারা দেশে একমাত্র নেতৃস্থানীয় দল এই পুরনো নীতি পরিত্যক্ত হল।

যে-বিশাল আন্দোলনের চাপে এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটল তার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ চরিত্র। মস্কোর নিউ টাইমস কাগজে প্রকাশিত সমসাময়িক প্রতিবেদনে এই রকম বলা হয়েছে “Over two weeks of massive manifestations and rallies, for all their verbal violence, not one lamppost or shopwindow was broken, not a single car was burnt down. What’s going on in Czechoslovakia is now commonly referred to as a tender revolution’ ‘‘ বিক্ষোভকারীরা একটি দোকানেও ভাঙচুরের চেষ্টা করেননি, একটি গাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করেননি। ভয়ংকর কিছুই ঘটেনি, ১৯৮৯-এ চেকোস্লোভাকিয়ার ঐতিহাসিক আন্দোলনকে তাই নাম দেওয়া হয়েছে “ন বিপ্লব”।

পূর্ব জার্মানিতে শেষ স্বৈরতন্ত্রী কম্যুনিস্ট নেতা এরিখ হোনেকের। গর্বাচভের উদারনীতি তিনি গ্রহণ করতে রাজী ছিলেন না। পূর্ব জার্মানিতে পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্তের প্রয়োজন নেই, এই ছিল তাঁর স্থির সিদ্ধান্ত। প্রতিবাদে অনেকেই দেশত্যাগ। করতে শুরু করলেন। পূর্ব জার্মানি থেকে সোজা পথে পশ্চিমে যাওয়া তখনও সম্ভব ছিল না, কিন্তু প্রতিবেশী কম্যুনিস্ট দেশ হাজারিতে যাবার পথ খোলা ছিল। ঐ পথেই অনেকে পূর্ব ইউরোপ ত্যাগ করে পশ্চিম যাত্রা করলেন। এসব কথা আজ এতোই পরিচিত যে বড় করে বলবারও প্রয়োজন নেই। হোনেকেরকেও শেষ অবধি পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে। পূর্ব জার্মানির জনমতকে বেশিদিন উপেক্ষা করা যায়নি। ১৯৮৯-এর নভেম্বর মাসেই বার্লিন দেয়াল ভেঙে ফেলবার কাজ শুরু হল। কম্যুনিস্ট ও অ-কম্যুনিস্ট দুনিয়ার ভিতর বিরোধের অতি শক্ত প্রতীক ছিল ঐ বার্লিন দেয়াল। এক বছর আগেও এটা কল্পনা করা যায়নি যে ঐ প্রাচীর এভাবে ভেঙে পড়বে। সেই অসম্ভব যখন সম্ভব হল তখন দুই জার্মানির মানুষই জানল যে একটা যুগ শেষ হয়েছে, এবার নতুন করে চিন্তা করতে হবে।

পূর্ব জার্মানির ক্যুনিস্ট দল তার নাম পালটে ফেলেছে। ১৯৯০-এর মার্চ মাসে বহুকাল পর স্বাধীন নির্বাচন হল। পুরনো কম্যুনিস্টরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এবার তাঁরা দলের নাম দিয়েছেন গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক দল (Party of Democratic Socialism)। পূর্ব জার্মানিতে প্রতি ছ’জন ভোটদাতার ভিতর একজন এই দলকে ভোট দিয়েছেন। রক্ষণশীল খ্রীষ্টান ডেমোক্র্যাটরা সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন; পশ্চিমী ধাঁচের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরাও কম্যুনিস্টদের তুলনায় বেশি গণসমর্থন লাভ করেছেন। সাধারণ মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষার একটা ছবি এই থেকে পাওয়া যায়।

দুই জার্মানির মানুষের মনেই ঐক্যের একটা স্বপ্ন আছে। কিছু মানুষ সেদিকে এগিয়ে যেতে চাইছেন দুত, কিছু মানুষ আরো সতর্ক পদক্ষেপে। দুই জার্মানিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কীভাবে কতটা ঐক্যবদ্ধ করা যায় সেটাই আজকের ভাবনা।

উদাহরণ বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন। প্রতিটি দেশের নিজস্ব সমস্যা আছে। পোল্যান্ডে আর্থিক অবস্থা যতটা কঠিন চেকোস্লোভাকিয়ায় তেমন নয়। দেশ বিভাগের জটিলতা পূর্ব জার্মানির বৈশিষ্ট্য। এই দেশগুলির ভিতর আরো নানা ধরনের ভিন্নতা আছে। কেবল একটি বিষয়ে এরা অভিন্ন। গত চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার পর পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশেই অধিকাংশ মানুষ কম্যুনিস্ট শাসন আর চাইছেন না। অধিকাংশ মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যে এসব দেশে কম্যুনিস্ট শাসন চলছিল একথাটা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আমাদের নিজ নিজ রাজনীতিক মতাদর্শ যাই হোক না কেন, ঘটনাটাকে আর অস্বীকার করবার উপায় নেই।

এবার দুয়েকটি মূল প্রশ্ন তোলা যাক।

পূর্ব ইউরোপের সাধারণ মানুষ কম্যুনিস্ট শাসন চাইছিলেন না কেন? এই অবাঞ্ছিত শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ ১৯৮৯ সালে এত দ্রুতগতিতে সব কটি দেশে ফেটে পড়ল কেন?

এইসব প্রশ্নের উত্তর আসলে জটিল নয়। তবু-যে জটিল মনে হয় তার একটা বিশেষ কারণ আছে। কম্যুনিস্ট প্রচারের গুণে এদেশে অনেকে বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন যে। কম্যুনিস্ট শাসন হল এক উচ্চতর গণতন্ত্র, যেখানে ক্ষমতা সাধারণ মানুষের হাতে, ধনিক শ্রেণীর হাতে নয়। এই মিথ্যা বিশ্বাসটা মন থেকে সরানোই কঠিন। এটা মন থেকে। সরিয়ে দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে ঘটনার দিকে তাকাতে পারলে ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে সোভিয়েত লাল ফৌজ পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে ঢুকে পড়ে। কম্যুনিস্ট শাসন ঐসব দেশে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। ব্যতিক্রম, যুগোস্লাভিয়া; সেখানে কম্যুনিস্ট শাসন স্থাপনে স্তালিনী সৈন্যবাহিনীর তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।

প্রথম দিকে অন্য যেসব দল ছিল কিছুকালের ভিতরই সেই সব দলের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বলতে বিশেষ কিছু রইল না। কার্যত কম্যুনিস্ট দলেরই একদলীয় শাসন সব দেশে পাকা হয়ে গেল। অনেক দেশের সংবিধানেও একথাটা লেখা হয়ে গেল যে, দেশের নেতৃত্ব। থাকছে ক্যুনিস্ট দলের হাতে। অর্থাৎ কম্যুনিস্ট দলকে নেতৃত্ব থেকে সরাবার চেষ্টামাত্রই সংবিধানবিরোধী। এইরকম বিধানই ছিল এতদিন সোভিয়েত ইউনিয়নে। পূর্ব ইউরোপে সেই স্তালিনী একদলীয় শাসনের মডেলটাই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চাপিয়ে দিয়েই লাল ফৌজ বিদায় নেয়নি, ঐ চাপানো ব্যবস্থাটাকে রক্ষা করবার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত থেকেছে।

কোনো দেশের মানুষই এই রকমের ব্যবস্থা পছন্দ করে না। পূর্ব ইউরোপের সাধারণ মানুষের ভিতরও অন্য দেশের মতোই জাতীয়তাবোধ আছে। বাইরের শক্তি এসে গায়ের জোরে কিছু চাপিয়ে দিলে সেটাকে পরাধীনতা মনে হয়। যদি স্তালিনী শাসনব্যবস্থার অন্য কোনো ত্রুটি না থাকত, তবু কেবল এই কারণেই কম্যুনিস্ট শাসন পূর্ব ইউরোপে সহজে জনপ্রিয় হত না। আসলে ঐ শাসনব্যবস্থার ভিতর য়ারো নানা দোষত্রুটি ছিল, বিকৃতি এসে গিয়েছিল। সেকথা পরে বলা যাবে। একই দল ___ ক্ষমতা হাতে নিয়ে বসে থাকলে তার ভিতর বিকৃতি এসে যায়, পূর্ব ইউরোপে তাই ঘটেছিল।

এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেষ্টা বার বারই হয়েছে, ১৯৮৯ সালের অনেক আগেই। শুধু অল্পকিছু মুক্তচিন্তকের প্রতিবাদ নয়, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষও বিক্ষোভ জানিয়েছেন, তাঁদের সাধ্য অনুযায়ী। ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানিতে, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে, ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় কম্যুনিস্ট শাসকদলের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়, সেসব কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু প্রতিবারই জনতার এই প্রতিবাদ অন্তত আপাতদৃষ্টিতে নিস্থল হয়। পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় বিরোধী আন্দোলনকে রক্তাক্ত অবসানের দিকে ঠেলে দেয়। কম্যুনিস্ট শাসনের পিছনে যথেষ্ট জনসমর্থন নেই, একথাটা নিরপেক্ষ দর্শকের কাছে বহুদিন থেকেই স্পষ্ট ছিল। কিন্তু এ থেকে নিষ্কৃতির পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

এরই ভিতর গর্বাচভ এলেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। অপ্রত্যাশিত একটা আশার আলো দেখা দিল। গর্বাচভ স্বদেশে স্তালিনী শাসনব্যবস্থার কঠোর সমালোচক, পরিবর্তন আনতে তিনি বদ্ধসংকল্প। পূর্ব ইউরোপে স্তালিনী ব্যবস্থার যাঁরা অবসান চান তিনি কি তাঁদের বাধা দেবেন? দেবার তো কথা নয়। তবু একটু সন্দেহ থেকে যাচ্ছিল। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে আবারও গণআন্দোলন যদি দেখা দেয় তবে শুধু ব্যবস্থাটার। পরিবর্তনই দাবি করা হবে না, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কম্যুনিস্ট দলের একচেটিয়া অধিকারও জনতা মানতে চাইবে না। অথচ কম্যুনিস্ট দল ক্ষমতাচ্যুত হলে পূর্ব ইউরোপের ওপর সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণও টিকবে না। সোভিয়েত সরকার কি এত বড় একটা পরিবর্তন বরদাস্ত করবেন? এ নিয়ে একটা সন্দেহ থেকে যাচ্ছিল।

সেই সন্দেহটা অনেক পরিমাণে দূর হল ১৯৮৯ সালের জুন মাসে। ওয়ালেসার নেতৃত্বে সলিডারিটিকে কম্যুনিস্ট দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়বার সুযোগ দেওয়া হল। পোল্যান্ডে একদলীয় শাসন শেষ হবে, এই সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠল। এবার পূর্ব ইউরোপের বিক্ষুব্ধ ছাত্র শ্রমিক জনতার মনে নতুন আশার সঞ্চার হল। এবার আন্দোলন হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ট্যাংকসহ সৈন্যবাহিনী উপস্থিত হবে না পুরনো শাসকদলকে উদ্ধার করবার জন্য। অথচ সৈন্যবাহিনীর সমর্থন ছাড়া শাসকদলের রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই। এই কথাটা যখন ১৯৮৯ সালের মাঝামাঝি স্পষ্ট হয়ে উঠল তারপর দ্রুত গতিতে পূর্ব ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে গণবিক্ষোভ উত্তাল হয়ে উঠল। গর্বাচভ কোনো চেষ্টা করলেন না ঐসব দেশের পুরনো নেতৃত্বকে রক্ষা করবার জন্য। নেতৃত্ব রক্ষা পেল না। সাধারণভাবে এই হল ঘটনাপরম্পরা। এটা বুঝবার জন্য কোনো কষ্টকৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।

পুরনো দৃষ্টিভঙ্গীতে বন্দী মার্ক্সবাদী কিছু তাত্ত্বিকের মুখ থেকে অন্য এক ধরনের ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে। সেটা একবার উল্লেখ করে রাখা যাক। মার্ক্সবাদে সমাজের আর্থিক “ভিত্তি” আর সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর ভিতর একটা পার্থক্য করা হয়। কিছু কিছু মার্ক্সবাদী বলতে চাইছেন যে, কম্যুনিস্ট দেশগুলিতে উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা লোপ পেয়েছে, অতএব সেখানে আর্থিক ভিত্তিটা যথার্থই প্রগতিশীল। নেতৃত্বে কিছু দোষ দেখা দিয়েছিল, সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো উপযুক্তভাবে। গড়ে তোলা হয়নি, আর এইজন্যই যত গোলমাল। এই ব্যাখ্যাটা নানা দিক থেকে অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। পুরনো কম্যুনিস্ট ব্যবস্থায় দোষ ঢুকেছে কেবল পরিকাঠামোতে নয়, ভিত্তিতেও। এ বিষয়ে পরে আস্লো কিছু বলা যাবে। আপাতত আমাদের এতাবৎ আলোচনার সূত্র ধরে এগিয়ে যাওয়া যাক।

.

গর্বাচভ স্তালিনী ব্যবস্থাকে স্বদেশে ভাঙতে চেয়েছেন, আর তারই ফলে পূর্ব ইউরোপে কম্যুনিস্ট শাসন ভেঙে পড়েছে। অন্তত গবাচিভের ঐ যুগান্তকারী প্রয়াসের ফলেই পূর্ব ইউরোপে পরিবর্তনের পথ সহজ হয়েছে, এই কথাটা একটু আগে আমরা বলতে চেষ্টা করেছি। এরপর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, গর্বাচভ স্বদেশে কী ধরনের পরিবর্তন চাইছেন আর কেনই বা সেটা চাইছেন? এই প্রশ্নেরও একটা সহজবোধ্য উত্তর সম্ভব।

গর্বাচভের নবকার্যক্রমের সঙ্গে দুটি শব্দ অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে গেছে, পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্ত। বেশ কয়েক বছর যাবৎই সোভিয়েত দেশের অর্থনীতিতে নানা রকমের সমস্যা গুরুতর হয়ে উঠছিল, কেমন একটা জড়তা ও দুর্নীতি যেন তাকে অধিকার করে বসছিল, উৎপাদনবৃদ্ধির হারও ক্রমেই কমে যাচ্ছিল। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় স্তালিন উৎসাহের সঙ্গে বলছিলেন, সোভিয়েত অর্থনীতি প্রধান প্রধান ধনতান্ত্রিক দেশগুলির তুলনায় দ্রুত এগিয়ে চলেছে, কয়েক বৎসরের মধ্যেই সে দেশের উৎপাদিকা শক্তি পশ্চিমী দেশগুলিকে ছাড়িয়ে যাবে। স্তালিনের মৃত্যুর পর যখন ত্রিশ বছরের বেশি কেটে গেছে তখন গর্বাচভ নেতৃত্বে এলেন। তিনি দেখলেন, সোভিয়েত অর্থনীতির উন্নতি একেবারেই। আশানুরূপ হচ্ছে না। আমাদের দেশের কোনো কোনো মার্ক্সবাদী বলছেন, সোভিয়েত দেশের আর্থিক অবস্থা তো দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের তুলনায় ভালো। এই তুলনাটা কিন্তু গর্বাচভের এবং সে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন। তাঁরা দেখছেন, সোভিয়েত দেশ যুদ্ধের সজ্জায় পশ্চিমী জগতের সমকক্ষ, সে দেশের সৈন্যবাহিনী পশ্চিমী। সৈন্যবাহিনীর চেয়ে অনেক বড়। তাঁদের মনে আশা ছিল, জীবনযাত্রার মানের দিক। থেকেও তাঁরা পশ্চিমের সমকক্ষ হয়ে উঠবেন। তাঁরা দেখছেন তাঁদের দেশ ক্রমেই যেন পিছিয়ে পড়ছে, গায়ের সাবানের মতো সাধারণ ভোগ্যবস্তুও সাধারণ মানুষের পক্ষে আজও সেদেশে সংগ্রহ করা কঠিন। গর্বাচভ নতুন প্রজন্মের মানুষ, এই প্রজন্মের ব্যর্থতাবোধের সঙ্গে তিনি পরিচিত। তিনি প্রথমেই তাঁর নবকার্যক্রমে যে শব্দটিকে তুলে ধরলেন সেটা হল, উস্করেনিয়ে, মানে দ্রুতীকরণ। এগিয়ে যাবার গতিটা দ্রুত করে তুলতে হবে।

কিন্তু একটা কথা থেকে অনিবার্যভাবে আরেক কথা এসে গেল। গর্বাচভ বুঝতে পারলেন, এগিয়ে যাবার গতি দ্রুত করতে হলে সোভিয়েত অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার একটা বড় রকমের পুনর্গঠন প্রয়োজন। আর সেই সঙ্গে সবাইকে, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষকে, তাঁদের অভাবঅভিযোগের কথা স্পষ্ট করে বলতে দিতে হবে। প্রকাশ্য সমালোচনার অভাবে সোভিয়েত শাসকবর্গ ও শাসনব্যবস্থা প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে, পরিবর্তনের শক্তি দুর্বল হচ্ছে। এই থেকে এল ঐ দুটি শব্দ, পেরেস্রোইকা আর গ্লাসনস্ত। ‘স্ত্রোইকা’ শব্দাংশটি একটি ধাতুর সঙ্গে যুক্ত (স্ত্রোইৎ) যার মানে হচ্ছে গঠন করা, আর প্রথমোক্ত উপসর্গের সঙ্গে জুড়ে পুরো শব্দটার মানে দাঁড়ায়, পুনর্গঠন। ‘গলাস’ মানে হচ্ছে কণ্ঠস্বর। ’নস্ত’ একটি প্রত্যয়, যা দিয়ে ভাবার্থক শব্দ গঠন করা যায়, যেমন আমাদের ভাষায় ‘ত্ব’ বা ‘তা’ দিয়ে হয়, মানব থেকে মানবতা। ‘গলাস’ আর ‘নস্ত’ দুয়ে মিলে ‘গ্লাসনস্ত’। এর অর্থের ব্যঞ্জনা হচ্ছে রুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে মুক্ত করা। মতপ্রকাশের ও সমালোচনার স্বাধীনতাই গ্লাসনস্তের মূল কথা। গর্বাচভ জানেন যে, পুনর্গঠন ও বাকস্বাধীনতার নীতি নিয়ে এগোতে গেলে সোভিয়েত সমাজে একটা তোলপাড় হবে, রক্ষণশীল শক্তি বিপন্ন হবে আর তারই ফলে গর্বাচভের নিজের জীবনও বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর দেশে এগিয়ে যাবার এটাই পথ, আর কোনো পথ নেই এবং এগিয়ে যাওয়াটা বড়ই জরুরী।

কেন জরুরী সেটা বুঝতে হলে, স্তালিনী অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার ভিতরের সমস্যা নিয়ে আরো দু’চারটা কথা যত সংক্ষেপেই তোক বলা দরকার।

ধনতন্ত্র থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের পথে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে কার্ল মার্ক্স ‘ডিক্টেটরশিপ অব দ্য প্রোটোরিয়াট বা শ্রমিকশ্রেণীর অধিনায়কতন্ত্র বা সার্বিকশাসনের কথা বলেছিলেন। লেনিন ও স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত দেশে সেটা কম্যুনিস্ট দলের সর্বগ্রাসী শাসনের রূপ নেয়। লেনিন কি এইরকম চেয়েছিলেন? সেই তর্কে আমরা যাচ্ছি না। এইরকমই হয়ে উঠেছিল, এইটুকুই আপাতত মনে রাখা প্রয়োজন।

সোভিয়েত দেশে এই একদলীয় শাসন মজবুত হল একটা যুদ্ধযুদ্ধ পরিস্থিতির ভিতর।

আর সেইসঙ্গে বৃদ্ধিলাভ করল একটা জঙ্গী অর্থনীতি। রুশ বিপ্লবের পরে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, ধনতান্ত্রিক কিছু দেশের হস্তক্ষেপের ফলে যেটা আরো বেড়ে ওঠে। তারপর আরম্ভ হয় অন্য এক গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘস্থায়ী, স্তালিনী নীতিরই ভয়ংকর পরিণাম, যাতে প্রাণ হারিয়েছে নানাভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ, সোভিয়েত দেশের বহু পরিবারের স্মৃতিতে যেটা আজও একটা বিভীষিকার মতো জেগে আছে। তিরিশের দশকের মাঝামাঝি হিটলারী যুদ্ধের আয়োজন শুরু হয়ে গেল, যার ধাক্কা এসে পৌঁছল স্তালিনের দেশে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নারকীয় অভিজ্ঞতা সইতে হয়েছে সোভিয়েত দেশকে, কমবেশি সারা ইউরোপকেই। ১৯৪৫ সালে মহাযুদ্ধের অবসান, আজ ১৯৯০। এটাও কিন্তু হয়ে উঠল। প্রধানত ‘ঠাণ্ডা লড়াই’-এর যুগ। সব মিলে অতিদীর্ঘ এক বিচিত্র ও ভয়ংকর যুদ্ধাপর্ব।

এর ভিতর দিয়ে যে শাসনব্যবস্থা সোভিয়েত দেশে গড়ে উঠেছে নানা কারণে সেটা আজ ওদেশের মানুষের কাছে অসহনীয়।

যে-কোনো দেশেই একদলীয় শাসন দীর্ঘকাল চললে শাসকদলের ও শাসনব্যবস্থার কিছু বিকৃতি দেখা দেয়। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধমুখী অবস্থায় সমস্যা আরো গম্ভীর হয়। মার্কিন দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিরক্ষার আয়োজন করতে গিয়ে সোভিয়েত সরকারকে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের একটা সিংহভাগ যুদ্ধের আয়োজনে নিযুক্ত করতে হয়েছে। মার্কিন দেশের হাতে সম্পদ বেশি, যুদ্ধের আয়োজনের পরেও ভোগ্যবস্তুর যথেষ্ট। আয়োজন সম্ভব হয়। সোভিয়েত দেশে অবস্থা অন্যরকম, প্রতিরক্ষার জন্য বড় রকমের বরাদ্দ করতে গিয়ে ভোগ্যবস্তুর ক্রমাগত অনটন মেনে নিতেই হয়। ওদেশের আর্থিক ব্যবস্থাও কিছু গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সামরিক কর্তৃপক্ষকে যুদ্ধের অস্ত্রের মানের দিকে দৃষ্টি রাখতেই হয়। কিন্তু ভোগ্যবস্তুর মানের প্রতি দৃষ্টি রাখার কোনো ভাল ব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় হয় তো বলা হল এত কোটি জোড়া জুতো তৈরি করতে হবে। কারখানা থেকে জুতো বেরিয়ে আসবার পর গুণে দেখা হল যে লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ হয়েছে কিনা। কিন্তু জুতোগুলি ভাল হল কি মন্দ হল, ব্যবহারের যোগ্য হল কতটা, এটা দেখবার মতো যথেষ্ট ব্যবস্থা সেখানে নেই। ফলে ওদেশে অনেক ভোগ্যবস্তুই গুণগত মানের দিক থেকে একেবারেই সন্তোষজনক নয়।

যুদ্ধের প্রয়োজনে ভোগ্যবস্তুর উৎপাদন কম, ব্যবস্থাপনার অভাবে যা তৈরি হয় সেটা নিম্নমানের, রাষ্ট্রপরিচালিত গবেষণার ধারাটা যুদ্ধমুখী বলে ভোগ্যবস্তুর উৎপাদনকৌশলে তেমন উন্নতির লক্ষণ নেই। কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ নয়। সীমাবদ্ধ ভোগ্যবস্তুর ভিতর যতটা অপেক্ষাকৃত আকর্ষণীয় বা উচ্চমানের সেটাও সাধারণ মানুষের হাতে গিয়ে সহজে পৌঁছয় না। সোভিয়েত সমাজে বিশেষ সুবিধাভোগী একটা শ্রেণী গড়ে উঠছে, ভালোমন্দ জিনিস তাঁদের হাতেই আগে গিয়ে পৌঁছয়। সাধারণ মানুষকে যতই বলা হোক না কেন, আপনারা দেশরক্ষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করুন, তাঁরা বিশেষ সুবিধার এই অপব্যবহার ভুলতে পারেন না। ক্যুনিস্ট দেশে সকলের সমান অধিকার এটাই প্রচার, কিন্তু যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁরা এই প্রচারকে মিথ্যা বলেই জানেন।

আসল ব্যাপারটা বুঝবার জন্য শুধু একটু নির্মোহ দৃষ্টিতে কম্যুনিস্ট শাসনকে দেখবার ও বুঝবার অভ্যাস প্রয়োজন হয়। বাকিটা কারোই বোধশক্তির বাইরে নয়। কম্যুনিস্ট সরকারের অধীনে কর্মে নিয়োগে ও উন্নতির ব্যাপারে দলের কিছু লোক বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। এই কথাটা বুঝতে পেরে সুযোগসন্ধানীরা যথাসম্ভব দলের ভিতর ঢুকে পড়ে। ফলে দলেরও গুণগত অবনতি ঘটে। সুযোগসন্ধানীরা ক্রমেই সর্বক্ষেত্রে নানা রকমের সুবিধা করে নেয়। সাধারণ মানুষের ভিতর বিরক্তি বাড়তে থাকে। শাসকশ্রেণীর কাছে এটাই আবার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। অসন্তোষ যাতে দানা বাঁধতে না পারে সেজন্য গুপ্ত পুলিসের ওপর নির্ভর করা হয়। সাধারণ মানুষ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে সাহস পায় না। এইভাবে কম্যুনিস্ট শাসনে গুপ্ত পুলিশই হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের চোখে একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক, ভয়ের ও ঘৃণার বস্তু। গত কয়েক মাসে পূর্ব ইউরোপের গণআন্দোলনের ভিতর দিয়ে এই ঘৃণা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

এই সব মিলে সৃষ্টি হয়েছে শ্বাসরোধকারী এক অবস্থা, গর্বাচভ যেটাকে আর অবহেলা করতে চাননি। অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন না ঘটলে সোভিয়েত সমাজে ভিতর থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের আশংকা আছে, যার পরিণাম কারোই নিয়ন্ত্রণের ভিতর থাকবে না। পরিবর্তন ঘটাবার চেষ্টাতেও ঝুঁকি আছে, পরিবর্তন ঠেকাবার চেষ্টাতেও। গর্বাচভ পরিবর্তন ঘটাবার ঝুঁকিটাই নিতে দৃঢ়সংকল্প। তাঁর নবরূপায়ণ কার্যক্রমে এটাই উদ্দেশ্য।

.

একদলীয় অতিকেন্দ্রিক সর্বগ্রাসী কম্যুনিস্ট শাসনের ভিতর যেসব সমস্যা জমে উঠেছে, গর্বাচভ যার সমাধান খুঁজছেন পেরেস্রোইকা ও গ্লাসনস্তের মাধ্যমে, তাই নিয়ে খানিকটা আলোচনা হল। এরই সূত্র ধরে এসে যায় অন্য এক প্রশ্ন, আজকাল যেটা অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছে। প্রশ্নটা এই : মার্ক্সবাদ কি অভ্রান্ত? নাকি কম্যুনিস্ট শাসনের যেসব সমস্যা। আজ আর কিছুতেই উপেক্ষা করা যাচ্ছে না, তার ভিতর দিয়ে মার্ক্সবাদেরও কিছু প্রান্তির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে?

যাঁরা গোঁড়া মার্কাদী তাঁদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা কঠিন। যেমন অনেকে বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাস করেন তেমনি কিছু মানুষ মার্ক্সবাদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাসী। শ্রুতি অভ্রান্ত কারণ সেটা ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত; মার্ক্সবাদ অভ্রান্ত কারণ সেটা “বৈজ্ঞানিক”। কোনো মতবাদকে আগে থেকেই অভ্রান্ত ধরে নেওয়াটা নিছকই বিশ্বাসের কথা। কোনো বিশেষ মানুষের নামের সঙ্গে যুক্ত মতবাদ চিরকালের মতো অভ্রান্ত হতে পারে না। মানুষ। ভ্রান্তিশীল, মার্ক্সও মানুষই ছিলেন। মার্ক্সবাদকে অভ্রান্ত বললে মার্ক্সকে ঈশ্বরের তুল্য বানানো হয়।

সবদিক থেকে মার্ক্সীয় চিন্তাধারার পর্যালোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে কম্যুনিস্ট জগতে গত কয়েক বছরের কিছু ঘটনা। এইসব ঘটনা থেকেই আবার উঠে আসে কয়েকটি মূল প্রশ্ন। তাই নিয়ে অতঃপর আমাদের আলোচনা।

আদর্শ সমাজের একটা ধারণা মার্ক্সের লেখাতে পাওয়া যায়, সেটা আকর্ষণীয়। কিন্তু সেটা মার্ক্সের চিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য নয়। তিনি শুধু একটা সুন্দর সাম্যবাদী সমাজের চিত্র। আমাদের উপহার দিতে চাননি। সেই সমাজে কীভাবে পৌঁছানো যাবে সেকথাই তিনি বিশেষভাবে বলে যেতে চেয়েছিলেন। পূর্ববর্তী ইউটোপিয়ান সোশ্যালিস্ট বা কল্পসাম্যবাদীরা কেবল আদর্শের কথাই বলে গেছেন, সেখানে পৌঁছবার পথের সন্ধান দেননি, এটাই ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে মার্ক্সের প্রধান সমালোচনা। মার্ক্স পথের সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন এইখানেই তাঁর প্রকৃত বৈশিষ্ট্য।

মার্ক্স বিশ্বাস করতেন, মানুষের ভাবনাচিন্তার একটা বাস্তব ভিত্তি থাকে। শ্রেষ্ঠ মানুষদের চিন্তায় কখনো কখনো এমন একটা মহৎ আদর্শের পরিচয় অবশ্য পাওয়া যায় যেটা স্থানকালের আবদ্ধতা থেকে অনেকখানি মুক্ত। কিন্তু সেই আদর্শকে কিছু পরিমাণে। মূর্ত করে তুলতে গেলেই তাকেও স্থানকালে স্থাপিত করতে হয়। মার্ক্সের ঝোঁক ছিল প্রায়োগিক তত্ত্বের দিকে। মানুষের ভাবনাচিন্তার একটা বাস্তব ভিত্তি থাকে, এটাকেই যদি আমরা নিয়ম বলে মেনে নিই, তবে মার্ক্সের চিন্তারও নিশ্চয়ই স্থানকালে আবদ্ধ একটা বাস্তব ভিত্তি ছিল। তিনি অবশ্য মানুষের সমাজের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করে তাঁর তত্ত্বে এসে পৌঁছেছেন। কিন্তু একটা বিশেষ স্থানকালে দাঁড়িয়েই তাঁকে ইতিহাসপর্যালোচনা করতে হয়েছে। সেই বাস্তব অবস্থানের ছাপ তাঁর চিন্তাতেও নিশ্চয়ই পড়েছিল।

উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে আশির দশকের শুরু অবধি মার্ক্স তাঁর মূল্যবান কাজ করে গেছেন। তাঁর কর্মস্থান ছিল পশ্চিম ইউরোপের এমন কয়েকটি দেশে যেখানে তখন “শিল্পবিপ্লব” কমবেশি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছিল। পুরনো একটা উৎপাদনব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল, বড় বড় নতুন শিল্পে শ্রমিকেরা সংগঠিত হচ্ছিল, মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের দ্বন্দ্ব চলছিল, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর ধনিক ও অভিজাতশ্রেণীর কর্তৃত্ব কঠোর ছিল।

এইখানে দাঁড়িয়ে মার্ক্স শ্রেণীদ্বন্দ্বের একটা চিত্র প্রত্যক্ষ করেন। আর এরই সূত্র ধরে সমগ্র মানবসমাজের ইতিহাস তাঁর চিন্তাভাবনায় একটা বিশেষ রূপ ধারণ করে। মানুষের ইতিহাসে অবশ্য নানা ধরনের দ্বন্দ্বই আছে, যেমন পরিবারে পরিবারে (মহাভারত স্মরণীয়), জাতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সংঘর্ষ। কিন্তু মার্ক্সের চিন্তায় শ্রেণীতে শ্রেণীতে দ্বন্দ্বটাই প্রধান ঘটনা। তিনি বিশ্বাস করতেন এরই ভিতর দিয়ে সমাজের মূল চরিত্র ও পরিবর্তনের ধারা বোঝা যায়, অগ্রসর হবার পথ চিনে নেওয়া যায়।

ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের প্রধান প্রধান উপকরণের তথা মূলধনের মালিকানা ধনিকশ্রেণীর হাতে। শ্রমিকের হাতে আছে শুধু তাঁর শ্রম। এটাই ধনতান্ত্রিক সমাজে অসাম্যের মূল কারণ। সাম্যবাদী সমাজ স্থাপন করতে হলে মুষ্টিমেয় ধনিকের হাত থেকে মূলধনের মালিকানা কেড়ে নিতে হবে, উৎপাদনব্যরস্থার ওপর স্থাপন করতে হবে শ্রমিকের কর্তৃত্ব। বিপ্লব হল এই সাম্যবাদী ব্যবস্থায় পৌঁছবার পথ।

মার্ক্সীয় বিপ্লবের পথে ধনতন্ত্র থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে আবশ্যক। এ বিষয়ে মার্ক্সের প্রথম জীবনের চিন্তা শেষ জীবনে কিছুটা নমনীয় হয়ে এসেছিল। কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যায় যে, তাঁর সামগ্রিক চিন্তার সঙ্গে এই সাময়িক ডিক্টেটরশিপের ধারণার যথেষ্ট সামঞ্জস্য আছে। মার্ক্স ও লেনিনের চিন্তায় রাষ্ট্র হল একটা শাসন ও শোষণের যন্ত্র। ধনতান্ত্রিক সমাজে ধনিকশ্রেণী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থের বিরুদ্ধে। বিপ্লবের পর রাতারাতি ধনতান্ত্রিক সমাজ রূপান্তরিত হয় না সাম্যবাদী সমাজে। সেজন্য সময়ের। প্রয়োজন। ধনিকশ্রেণী বেশ কিছুকাল ধরে ষড়যন্ত্র চালাবে ক্ষমতায় ফিরে আসবার জন্য। এই সময়ে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী কর্তব্য হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে এমনভাবে পুনরায় সংগঠিত করা যাতে সেটা ধনিকশ্রেণীকে চূড়ান্তভাবে দমন ও উচ্ছেদ করবার কাজে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে আবারও শাসন ও দমনের কাজেই নিযুক্ত করা হবে, কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থে, ধনিকের স্বার্থে নয়। এই কারণে এটাকে বলা হচ্ছে, শ্রমিকশ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ।

“গোথা প্রোগ্রাম” আলোচনা করতে গিয়ে মার্ক্স লিখেছিলেন “Between capitalist and communist society lies the period of the revolutionary transformation of the one to the other. There corresponds to this also a political transition period in which the state can be nothing but the revolutionary dictatorship of the proletariat.” এখানে দেখা যাচ্ছে যে, শ্রমিকশ্রেণীর এক বৈপ্লবিক ডিক্টেটরশিপ মার্ক্সের মতে সাম্যবাদী মুক্ত সমাজে পৌঁছবার জন্য একান্ত আবশ্যক। যেহেতু শ্রমিকশ্রেণীই সমাজের বৃহত্তর অংশ অতএব এই ডিক্টেটরশিপকে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে উচ্চতর গণতন্ত্রও বলা হয়েছে। ধনিকশ্রেণী যখন সম্পূর্ণ নির্মূল হবে তখন রাষ্ট্রের আর প্রয়োজন থাকবে না। এইভাবে অবশেষে রাষ্ট্র লোপ পেয়ে যাবে। এইরকমই ছিল মার্ক্সের ও মার্ক্সবাদীদের বিশ্বাস।

জীবনের শেষ দিকে মার্ক্স বলেছিলেন, কোথাও কোথাও শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু মোটের ওপর হিংসাত্মক বিপ্লবের কথাই মার্ক্স-লেনিনের তত্ত্বে প্রাধান্য পেয়েছে। রাষ্ট্র যদি মূলত দমন ও নিপীড়নের অস্ত্রই হয় আর সেই অস্ত্রটি শ্রেণীস্বার্থে ব্যবহার করাই যদি ধনিকশ্রেণীর স্বধর্ম হয়, তবে ধনিকের হাত থেকে ঐ অস্ত্রটি কেড়ে নিতে হিংসাত্মক উপায়ের প্রয়োজন হবে এটাই তো সহজ কথা। অন্যরকমের চিন্তাও মার্ক্সবাদীদের ভিতর খুঁজে পাওয়া যায়, তবে সেটা মূলধারা নয়। সেটাকে প্রাধান্য দিতে গেলে মার্ক্স-লেনিনের মূল প্রত্যয়গুলিরই সংশোধন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কতটা সংশোধনের পর মার্ক্সবাদ তবু মার্ক্সবাদই থেকে যায় তা নিয়ে তর্ক আছে। আমরা সে তর্কে যাচ্ছি না।

বিপ্লবের পর সাম্যবাদী সমাজে পৌঁছবার পথে ডিক্টেটরশিপ কেন প্রয়োজন এবিষয়ে মার্ক্স-লেনিনের চিন্তা যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ। হিংসার দ্বারা যে ক্ষমতা লাভ করা যায়, হিংসার দ্বারাই তাকে রক্ষা করা সম্ভব। বৈপ্লবিক উপায়ে ক্ষমতাদখলের পর যদি ধনিকশ্রেণীকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করতে হয় তবে শ্রমিকশ্রেণী তথা কম্যুনিস্টদলের একনায়কতন্ত্রেরই আবশ্যক। নয় তো ক্ষমতা আবারও হস্তচ্যুত হবার সমূহ সম্ভাবনা। এর পরও কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায়।

বিপ্লবের পর ক্ষমতারক্ষার জন্য ডিক্টেটরশিপ কেন প্রয়োজন সেটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু সেই অধিনায়কতন্ত্র কি মানুষকে পৌঁছে দিতে পারবে সাম্যবাদী মুক্ত সমাজে? “ডিক্টেটরশিপ অব দ্য প্রোলেটোরিয়াট”-এর পরিণতি মার্ক্স দেখে যেতে পারেননি। পরিণতি দেখা গেল গত সত্তর বছরে। এই পরিণতি নিশ্চয়ই মার্ক্সের প্রত্যাশার ভিতর ছিল না। কল্পসাম্যবাদীরা রেখে গিয়েছিলেন কিছু স্বপ্ন। মার্ক্সের মনেও একটা স্বপ্ন ছিল। সেখানে পৌঁছবার পথ তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, দেখাতে পারেননি।

মার্ক্সবাদীরা এরপরও বলবেন, শ্রমিকশ্রেণীর অধিনায়কতন্ত্রের অধঃপতনের জন্য মার্ক্স দায়ী নন, মার্ক্সীয় চিন্তা দায়ী নন। এটা নেতৃত্বের দোষ। মার্ক্স একটা শ্রেণীর অধিনায়কতন্ত্র চেয়েছিলেন, দলের নয়, ব্যক্তির নয়। শ্রমিকশ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ ধনিককে সংহার করবে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষের জন্য রক্ষা করবে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা, এইরকমই আশা ছিল মার্ক্সের। শ্রমিকশ্রেণীর নামে অল্পকিছু লোকের শাসন মার্ক্স চাননি। এইরকম কিছু কথা স্মরণীয়ভাবে উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন লেনিনের সমসাময়িক জার্মানির বিখ্যাত। কম্যুনিস্ট নেতা রোজা লুক্সেমবুর্গ। লেনিনের সঙ্গে তাঁর মতের মিল হয়নি। কিন্তু লেনিন তাঁকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন।

শ্রমিকশ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ সম্পর্কে রোজা বলেছিলেন “The dictatorship should be implemented by a class and not a leading minority acting on behalf of a class.’ তিনি আরো বলেছিলেন, “freedom only for the supporters of the Government, only for the members of one party…is no freedom. Freedom is always freedom for dissenters.” স্বাধীনতা থাকবে শুধু সরকারের সমর্থকদের জন্য, একটা বিশেষ দলের লোকের জন্য, এটা কোনো স্বাধীনতাই নয়। শ্রমিকশ্রেণীর নামে এক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নেতৃত্ব মার্ক্সবাদের পথ নয়।

লেনিনের সঙ্গে রোজার ঐ বিতর্কে স্বভাবতই আমাদের সহানুভূতি যাবে শ্রদ্ধেয়া জামান। নেত্রীর দিকে। তবু স্বীকার করতে হয় লেনিনের চিন্তাই ছিল বস্তুনিষ্ঠ, রোজার চিন্তা কল্পনাবিলাসী। বিপ্লবের পর লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ডিক্টেটরশিপ কি চালানো সম্ভব দলীয় সংগঠন ছাড়া? হিংসাত্মক বিপ্লবের পর উভয়শ্রেণী যখন উভয়শ্রেণীকে সংহার করতে। সর্বভাবে সচেষ্ট তখন গৃহযুদ্ধই প্রত্যাশিত, অন্য কোনো প্রত্যাশা বাস্তব নয়। বিপ্লব যখন একটি দুটি দেশেই সীমাবদ্ধ, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েনি, তখন যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধ বহুদিন। পর্যন্ত চলবে এইরকম অনুমানই বস্তুনিষ্ঠ। এই দীর্ঘ যুদ্ধকালীন অবস্থার ভিতর সরকারবিরোধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে, এই আশা অবাস্তব। শ্রমিকশ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ যে একদলীয় সর্বগ্রাসী অধিনায়কতন্ত্রের রূপ নিয়েছিল, এতে আমরা দুঃখিত হতে পারি কিন্তু বিস্মিত হবার কারণ নেই। মার্ক্স ও মার্ক্সবাদীরা যদি অন্য কোনো পরিণাম আশা করে থাকেন তো সেই দুরাশাকে “বৈজ্ঞানিক বলা যাবে না।

কম্যুনিস্ট শাসনের অধঃপতনের জন্য ব্যক্তিবিশেষকে মুখ্যত দায়ী করা ভুল। ব্যক্তির একটা ভূমিকা আছে ঠিকই, অন্তত মার্ক্স সেটাকে বড় করে দেখতেন না। ভিত্তি ও সৌধের পার্থক্য টেনে যাঁরা বলেন যে, কম্যুনিস্ট সমাজের ভিত্তিটা ভালো, দোষ সৌধে, তাঁদের সেই বিচারও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ক্যুনিস্ট অধিনায়কতন্ত্র ভিত্তি ও সৌধে মিলে একটি সমগ্র জিনিস, যদি পরিবর্তন প্রয়োজন হয়, তবে সেটা সর্বত্র প্রসারিত হবে। গর্বাচভ সংশোধনের পথে পা বাড়িয়েছেন, বিশ্বাসী মার্ক্সবাদীদের পক্ষে তিনি বিপজ্জনক সন্দেহ নেই।

রুশবিপ্লবের পর থেকেই একটা কথা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার বিশ্লেষণে মার্ক্সীয় পদ্ধতি কিছুটা বৈজ্ঞানিক, মার্ক্সের চিন্তা এখানে মূল্যবান। কিন্তু কম্যুনিস্ট দুনিয়ার ঘটনাপ্রবাহ মার্ক্সবাদীরা বৈজ্ঞানিকদৃষ্টিতে বিচার করতে গুরুতর অক্ষমতা দেখিয়েছেন, এইখানে তাঁরা কল্পনাবিলাসী। অভ্যস্ত মার্ক্সবাদী বিচারপদ্ধতিতে এই একটা অসম্পূর্ণতা ও আত্মখণ্ডন আছে। এই আত্মখণ্ডনই বিশ্বাসীর মনে বেশ একটা রহসময় উন্মাদনা এনে দেয়। এ থেকে মার্ক্সবাদকে মুক্ত করতে গেলে বিশ্বাসের ভিত্তিটাই টলে যাবে, মুক্ত না করলে মার্ক্সীয় বিচারের ভিতর একটা গুরুতর ত্রুটি থেকেই যাবে।

.

বিশেষ কোনো জাতি অথবা শ্রেণীতে সর্বপ্রকার দোষ অথবা গুণ কল্পনা করা ভুল।

মানুষ জীবটি যেমন আশ্চর্য তেমনি জটিল। মানুষের মতো হিংস্র ও নির্দয় জীব আর দ্বিতীয় আছে কিনা সন্দেহ। এই হিংস্রতা কোনো এক বিশেষ সমাজব্যবস্থা থেকে এসেছে। এমন নয়। সৃষ্টির আদিকাল থেকে নির্দয় প্রকৃতির ভিতর নখেদন্তে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী পশুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মানুষকে বাঁচতে হয়েছে, সেই যুগযুগান্তব্যাপী দানবীয় ইতিহাসের এক সঞ্চিত হিংস্রতা সব মানুষের রক্তে মিশে আছে। আবার মানুষের ভিতর কল্পনা, জিজ্ঞাসা ও আত্মত্যাগের যেমন শক্তি আছে, অন্য কোনো জীবের ভিতর নিসন্দেহে তেমন নেই। এই সব গুণও আদিম সাম্যবাদ বা ঐরকম কোনো বিশেষ যুগের। সৃষ্টি নয়। দীর্ঘ ইতিহাসের ধারায়, খ্যাত ও অখ্যাত বহু সাধকের সাধনায়, এই সব গুণ লালিত।

জাতিতে জাতিতে যুদ্ধের সময় যেমন আমরা স্বজাতিতে সব গুণ আর বিজাতিতে সব দোষ কল্পনা করি, শ্রেণীদ্বন্দ্বের তত্ত্বেও তেমনি শ্রমিক শ্রেণীতে সমস্ত গুণ আর ধনিক শ্রেণীতে সমস্ত দোষ আরোপ করার ঝোঁক আছে। বিশেষ বিশেষ বৃত্তি ও পরিস্থিতি বিশেষ বিশেষ দোষগুণকে বাড়িয়ে তোলে এ কথা স্বীকার করে নেবার পরও মনে রাখা ভালো যে, মানুষের হিংস্রতা অথবা করুণা নিতান্ত শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য নয়। জামান অথবা জাপানী শ্রমিক স্বভাবতই ছিল যুদ্ধবিরোধী, ধনিকের অপপ্রচারের ফলে সে যুদ্ধে আকৃষ্ট হল, এই রকমের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ সত্য নয়। কিছু দুর্বলতাকে মানুষী দুর্বলতা, মহত্ত্বকে মানবিক মহত্ত্ব, বলে চিনে নেওয়াই ঠিক। জাতি অথবা শ্রেণীর মতো একটা সমষ্টিকে নিয়ে উত্তেজনা ও বিদ্বেষ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন সেটা মানুষের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যকেই বিপন্ন করে। সতর্কভাবে বিদ্বেষমুক্ত কিছু মানবিক মূল্যবোধই শেষ অবধি আমাদের পথ দেখাতে পারে।

ধনতান্ত্রিক সমাজে যে সব অন্যায়, অবিচার ও বীভৎসতা আছে তার সঙ্গে আমরা দীর্ঘকাল থেকেই পরিচিত। ধনতন্ত্রের এমন একটা কল্পিত রূপ কেউ কেউ তুলে ধরেছেন। যেখানে এই সব দোষ প্রায় অনুপস্থিত। আমরা জানি যে, সেটা ধনতন্ত্রের বাস্তব চেহারা নয়।

কম্যুনিস্ট সমাজে যেসব অন্যায়, অবিচার ও বীভৎসতা আছে তার সঙ্গে আমাদের ভিতর অনেকেই দীর্ঘকাল পরিচিত ছিলেন না। কম্যুনিস্ট সমাজের একটা কল্পিত ছবি অনেকে তুলে ধরেছেন। আমরা এখন জানি যে, সেটা বাস্তব ছবি নয়!

সাম্যবাদীরা বলেন, অধঃপতিত সাম্যবাদী সমাজও ধনতান্ত্রিক সমাজের চেয়ে ভালো। এ নিয়ে তর্ক হয়েছে। আমাদের সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন, কয়েকটি সাধারণ তথ্য মনে রাখা ভালো।

কম্যুনিস্টশাসন থেকে পূর্ব ইউরোপ বেরিয়ে আসতে চাইছে বটে, কিন্তু কোনো প্রাচীন ধনতন্ত্রে তারা ফিরে যেতে চাইছে না। পশ্চিম ইউরোপে দীর্ঘ সমাজবাদী ও শ্রমিক আন্দোলনের ফলে ধনতন্ত্রের অনেকটা চরিত্রগত পরিবর্তন হয়েছে। যদিও ব্যক্তিগত মালিকানা সেখানে আছে তবু বলিষ্ঠ শ্রমিক সংগঠনের ফলে মালিক ও শিল্পপতি আজ আর নিরঙ্কুশ শাসন চালিয়ে যেতে পারেন না, সংঘবদ্ধ শ্রমিকের ইচ্ছাটাও কমবেশি প্রভাবশালী। তা ছাড়া, সমস্ত উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশেই আজ দুর্বল ও দরিদ্রের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের কিছু বিশেষ দায়দায়িত্বের কথা স্বীকৃত। ত্রুটিহীন না হলেও এই সামাজিক সুরক্ষার নীতি উপেক্ষণীয় নয়। আরো মনে রাখতে হবে যে, ধনতান্ত্রিক দেশেও কিন্তু। ব্যক্তিগত মালিকানার পাশাপাশিই সরকারী ও সাময়িক প্রতিষ্ঠান অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে।

পূর্ব ইউরোপ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাজার ব্যবস্থার দিকে ক্রমে ঝুঁকছে। কিন্তু বাজারব্যবস্থা বলতেই ব্যক্তিগত মালিকানার একচ্ছত্র রাজত্ব বোঝায় না। ব্যক্তিগত, সাময়িক ও রাষ্ট্রীয় নানারকমের প্রতিষ্ঠানেরই সহাবস্থান সম্ভব প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ব্যবস্থার সীমানার মধ্যেই। তা ছাড়া, কিছু কিছু সমাজসেবাকে বাজারব্যবস্থার বাইরে রাখার প্রয়োজনও। পাশ্চাত্ত্য গণতান্ত্রিক সমাজবাদীরা স্বীকার করে নিয়েছেন। ধনতন্ত্রের দিকে নয়, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের এক মিশ্র ব্যবস্থার দিকে আজ পূর্ব ইউরোপের ঝোঁক।

এই মিশ্র ব্যবস্থার সঙ্গেই গত সত্তর বছরের পরীক্ষিত কম্যুনিস্ট সমাজের তুলনা চলছে। কোনো উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের শ্রমিকরাই কম্যুনিস্ট ব্যবস্থায় যেতে চাইছেন না। কম্যুনিস্ট সমাজে লালিতপালিত হবার পরও কিন্তু ঐ সব দেশের মানুষেরা আজ মিশ্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকেই যেতে চাইছেন। এরপরও অবশ্য সমস্যা আছে। এমন হতে পারে যে, কম্যুনিস্ট স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার ঝোঁকে কোনো দেশ বা কিছু লোক অন্য এক স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঝুঁকবে। তবু আশা রাখতে হবে যে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করবার সতর্কতাও ঐ সব দেশের ভিতর থেকেই আসবে।

অনেকে বলছেন, উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে বিলাসদ্রব্যের যে প্রচলন হয়েছে, যে-ভোগবাদী সংস্কৃতি বেড়ে উঠেছে, তারই আকর্ষণে ক্যুনিস্ট দেশের নতুন প্রজন্ম পশ্চিমী সমাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। এখানে দুটি কথা ভেবে দেখতে হবে। প্রথম কথা, পূর্ব ইউরোপের সব দেশ সমান গরীব নয়, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় চেকোস্লোভাকিয়া অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অবস্থায় আছে। তবুও ঐ দেশের মানুষ কম্যুনিস্ট শাসন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এটা শুধু ভোগ্যবস্তুর আকর্ষণে নয়। পূর্ব ইউরোপের মানুষের কাছে গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতারও একটা বিশেষ মূল্য আছে। কম্যুনিস্ট ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অভাবই ঐ ব্যবস্থাকে অসহনীয় করে তুলেছে। এবার দ্বিতীয়। কথায় আসা যাক। ভোগবাদের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না, নতুন প্রজন্মে এটা আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ছে বটে। এটা চিন্তিত হবার মতো একটা সমস্যা ঠিকই। কিন্তু নতুন প্রজন্মকে শুধু দমননীতি দিয়ে কম্যুনিস্ট সমাজে আটকে রেখেই তো সমস্যার সমাধান হবে না। শেষ পর্যন্ত নতুন প্রজন্মকেও নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই শিক্ষালাভ করতে হবে। ভুল করবার, ভুলের ভিতর দিয়ে ভালোমন্দ চিনে নেবার, স্বাধীনতা তাদের চাই। প্রতি প্রজন্ম এইভাবেই এগিয়ে যায়। তিয়েনআনমেন চত্বরের সংহারনীতি যুগের পরিবর্তনকে নিষ্ঠুরভাবে বিলম্বিত করে মাত্র।

তৃতীয় বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের মুখে পশ্চিমের বিরুদ্ধে অন্য এক উদ্বিগ্ন অভিযোগ সর্বক্ষণই শোনা যায়। পশ্চিমী ধনতন্ত্রই তো আমাদের দুরবস্থার জন্য দায়ী, ওদের সঙ্গে আমাদের স্বাভাবিক শত্রুতা। এই আক্রোশ ও বিলাপ কিন্তু নিষ্ফল, এতে আমাদের আত্মশক্তি আরো দুর্বল হয়। যারা এগিয়ে যাবার তারা পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়ায়, তারপর এগিয়ে যায়। আত্মনির্ভরতার বিকল্প নেই। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির নিজেদের ভিতর সহযোগিতা বাড়াতে হবে, জাগতিক পরিস্থিতি ও ইতিহাসের গতি বুঝেসুজে পথ তৈরি করতে হবে। আজকের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বেরও কিন্তু দেবার আছে কিছু, যেটা পূর্ণ হবে না অনুকরণপ্রিয়তায় বা বিদ্বেষে।

ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের যে-সমন্বয়ের দিকে সারা পৃথিবী আজ পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেটাই কি মানুষের আদর্শ সমাজ? এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সর্বকালের আদর্শ সমাজ সেটা নয়। এমন কিছু সমস্যা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যাতে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সব মানুষই চিন্তিত। অন্য কোনো পথের অন্বেষণ শেষ অবধি করতেই হবে। সেই অন্য পথ ও অন্য সমাজ, আমাদের পরিচিত ধনতন্ত্রও নয়, পরিচিত সমাজতন্ত্রও নয়, এ দুয়ের যোগফলে গঠিত কোনো সমাজই নয়। কেন এ কথা বলছি, সংক্ষেপে হলেও তার একটু ব্যাখ্যা দরকার।

মালিকানা ব্যবস্থার সমস্ত পার্থক্য সত্ত্বেও আজকের ধনতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজের ভিতর উল্লেখযোগ্য মিল আছে। দুয়েরই লক্ষ্য শিল্পোন্নয়ন ও শিল্পের প্রাধান্য স্থাপন। প্রযুক্তি ও শিল্পসংগঠনের দিক থেকে আজকের আমেরিকার ও সোভিয়েত দেশের ভিতর পার্থক্য ততটা নেই যতটা পার্থক্য আছে দুশো বছর আগের আমেরিকার সঙ্গে আজকের আমেরিকার। আর এই থেকেই কিছু মৌল প্রশ্ন ও সমস্যা উঠে আসে।

যে-প্রযুক্তিকে আমরা আজ প্রাগ্রসর প্রযুক্তি বলছি, ধনতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী বহু দেশ যে-দিকে সমভাবে এগিয়ে যেতে চাইছে, সারা পৃথিবী জুড়ে সেই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে, গেলে কিন্তু এক ভয়ঙ্কর সঙ্কট দেখা দেবে। ইতিমধ্যেই পরিবেশদূষণ সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। পরিবেশদূষণের কোনো বিশেষ তন্ত্র নেই, দেশ নেই। চেনোবিলের দুর্ঘটনা সোভিয়েত দেশে না হয়ে মার্কিন দেশেও ঘটতে পারত। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার কোনো ভৌগোলিক পরিধি নেই। অন্য যে-সব জ্বালানি থেকে আধুনিক শিল্প ক্রমবর্ধমান। পরিমাণে শক্তি সংগ্রহ করছে তা থেকেও জাগতিক পরিবেশ ক্রমাগত দৃষিত হচ্ছে। রাসায়নিক সারের ওপর অতিনির্ভরশীল আধুনিক কৃষিও একই পরিণামের দিকে পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে।

অতিকেন্দ্রিকতার সমস্যার কথা আমরা আগেই বলেছি। সামাবাদী দেশের রাজনীতি এই সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে। ধনতান্ত্রিক দেশেও কিন্তু সমস্যাটা আছে। আসলে অতিকেন্দ্রীয়তার দিকে একটা ঝোঁক আধুনিক শিল্পের ভিতরই আছে। বাজারের অর্থনীতি এই ঝোঁককে আটকাতে পারে না। বাজার একদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ায় আবার অন্যদিকে সারা পৃথিবীব্যাপী আর্থিক ক্ষমতার কেন্দ্রীয়তাকেও বাড়িয়ে তোলে।

ভোগবাদ বিষয়েও একই কথা। ভোগবাদ একদিন ছোট এক অভিজাত শ্রেণীর ভিতর আবদ্ধ ছিল। আজ ভোগবাদী আকাঙ্ক্ষা সব দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এটা শুধু শিল্পের মালিকানার প্রশ্ন নয়। আধুনিক শিল্প ও প্রযুক্তি মানুষকে দিয়েছে জড় প্রকৃতির ওপর আধিপত্য, প্রকৃতিকে দাস হিসেবে দেখবার মানসিকতা। এই প্রভুত্বই আবার তাকে ভোগবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সুখ কাকে বলে এ বিষয়ে মানুষের ধারণাটাকেই পালটে দিচ্ছে। সব কিছুকেই আমরা সুখের উপকরণ হিসেবে দেখবার দিকে ঝুঁকছি। আর এরই ফলে ভিতরে ভিতরে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। সবই যদি উপকরণ হয় তবে কিছুর সঙ্গেই, কারো সঙ্গেই, অভেদ বা একাত্মতা অনুভব করা যায় না।

কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন কোন সমস্যায় তিনি সবচেয়ে উদ্বিগ্ন? তিনি বলেন, যে-হারে দেশের ভিতর মাদকদ্রব্য প্রবেশ করছে তাতেই তিনি সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। মাদকতার প্রকোপও আজ কোনো বিশেষ দেশে বা সমাজ ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ নেই। সাম্যবাদী সোভিয়েত দেশে, ধনতান্ত্রিক মার্কিন, আর আমাদের মতো তৃতীয় দুনিয়ার সীমানার ভিতরও নেশাগ্রস্ততা আজ গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

এই ক’টি উদাহরণই যথেষ্ট। আজকের ধনতন্ত্র আর আজকের সমাজতন্ত্রকে মেলাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধানে গিয়ে আমরা পৌঁছতে পারব এমন নয়। বাজারের তত্ত্ব যথেষ্ট নয়, শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বও নয়, যদিও দুই তত্ত্বেরই একটা সীমার ভিতর কিছু সদর্থ হয়।

বাণিজ্যকে আশ্রয় করেই মধ্যযুগের সীমানা ভেঙে আধুনিক মানুষ পৃথিবীময় যোগাযোগের পথ তৈরি করেছিল। বাজার একই সঙ্গে দুনিয়াটাকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, আবার বিভক্ত করেছে; পুরনো সংস্কার থেকে মুক্ত করেছে, আবার নতুন প্রলোভনে আবদ্ধ করেছে। পাশ্চাত্ত্য উদারনীতির শ্রেষ্ঠ ভাগ একদিন উনিশ শতকের কিছু শ্রেষ্ঠ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। তাকে অবজ্ঞা করে এগোতে গেলে মানুষের সাধনা অসম্পূর্ণ। থেকে যাবে, এমন কি গভীরতর বিপত্তির সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ঐখানেই যাত্রা শেষ এমন কথা কিছুতেই গ্রাহ্য করা যায় না। মার্কিন দেশ থেকে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা কিছুদিন আগে এক নিবন্ধে বলেছেন, পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের পরাজয় আর উদারনীতির অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ইতিহাস এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এমন লোমহর্ষক উক্তি, মানুষের সভ্যতার গভীরতর সমস্যা সম্বন্ধে বোধের এমন প্রচণ্ড অভাব, আমাদের স্তম্ভিত করে।

শ্রেণীসংগ্রামের নবদর্শন শ্রমিককে তাঁর আত্মশক্তিতে বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে, এই অবদান তুচ্ছ করবার মতো নয়। তবু প্রাগ্রসর প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল সভ্যতার যেসব সমস্যার কথা একটু আগেই বলা হল, শ্রেণীভিত্তিক চিন্তার ভিতর তাদের অটিবার চেষ্টা করা ভুল। ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা, পরিবেশদূষণের ভয়াবহ প্রসার অথবা আধুনিক মানুষের আত্মার যন্ত্রণা, এইসবের উত্তরে স্বাধীনতা আর মানুষের স্বধর্ম, সমাজে ব্যক্তির স্থান আর বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্ক, এই সব নিয়ে এমন কিছু চিন্তার প্রয়োজন যেটা যথার্থই এক নতুন যুগের চিন্তা। সভ্যতার এমন এক সঙ্কট ক্রমে গম্ভীর হয়ে উঠেছে যার সামনে সর্বানুষের স্বার্থের ঐক্যের কথাটাই বড়। মানুষী মূঢ়তা ও মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তি কোনো বিশেষ শ্রেণীর ভিতর খুঁজে পাওয়া যাবে না, মানুষই মূল।

ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের যে সমন্বয়ের চিন্তা আজ দেখা দিয়েছে এই পর্বে তার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাকেও অতিক্রম করে যেতে হবে। তবেই আমরা আগামী যুগের সেই সার্থক সমাজে পৌঁছতে পারব যার ভিত্তিতে থাকবে অহিংসা, বিকেন্দ্রীকরণ, প্রকৃতিপ্রেম, মানবতাবোধ।

সেই সমাজ হঠাৎ বিশ্বজয়ীর বেশে আসবে না। এখনো অন্য শক্তি প্রবল। তবু এরই ভিতর মানুষের মনে আর ছোট ছোট মরূদ্যানে নতুন সমাজের পায়ের চিহ্ন আঁকা হয়ে যাবে। পরস্পর স্বল্পপরিচিত, বিচ্ছিন্ন খণ্ড খণ্ড বিচিত্র পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়ে পথ তৈরি হচ্ছে নতুন মানবসমাজের। নানাদিক থেকে ভাবনাচিন্তা একই পথে এসে মিশেছে। অথবা হয় তো এক পথ নয়, একই দিশার নানাপথ। উপায়ের বিচারে মার্ক্সের সঙ্গে যোগ নেই, তবু উদ্দেশ্যের বিচারে হয় তো মিল আছে। মিল আছে কিছু কল্পসাম্যবাদীর সঙ্গেও।

সেই কল্পনার সমাজ এখনো দূরে। তবু তাকে ভুলে থাকা ভুল। মানুষের সভ্যতাকে শেষ অবধি ঐদিকে যেতেই হবে, নয় তো সংকট বেড়েই চলবে।

দেশ, ২১ এপ্রিল, ১৯৯০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *