1 of 2

১.১৮ ঠাকুমার সঙ্গে নবদ্বীপে আসায়

ঠাকুমার সঙ্গে নবদ্বীপে আসায় উৎসাহের অন্ত ছিল না চাঁপার। উঃ, ভগবান রক্ষে করেছেন যে মা জবরদস্তি করে নি। মা যদি জেদ করতো, যেতেই হত মায়ের সঙ্গে। ঠাকুমা যতই রাগী হোক, চাঁপাদের ব্যাপারে যে শেষ পর্যন্ত ঠাকুমার কথা খাটে না, মার কথাই বজায় থাকে, সে জ্ঞান জন্মে গেছে চাঁপার!

অতএব কাঁটা হয়ে ছিল চাঁপা, —ওই বুঝি মা বলে বসে, না, সবাই আমার সঙ্গে যাবে!

কিন্তু চাঁপার ঠাকুর ফুল নিলেন।

ঠাকুমা যখন বললো, চাপি মল্লিকা আমার সঙ্গে চলুক, চোখে চোখে থাকবে। ক্রমশ তো ডাগর হয়ে উঠছে। তখন সুবৰ্ণলতা না না করে উঠল। না। শুধু বললো, নিয়ে গেলে তো আপনারই ঝঞ্ঝাট। ওরা কখন খাবে, কখন শোবে, এই চিন্তা করতে হবে। একা গেলে যখন যা খুশি করলেন।

ঠাকুমাও বোধ করি আশঙ্কিত ছিলেন, তাই এক কথায় ছাড়পত্র পেয়ে হৃষ্টচিত্তে বলেন, সে কিছু অসুবিধে হবে না। শুধু আপনার হাত-পা নিয়ে বসে থাকার থেকে বরং কাজ থাকবে একটা। তীর্থে তীর্থে ঘোরা সে এক, এ তো একই ঠাঁই চেপে বসে থাকা। তাও দিন নির্দিষ্ট নেই, কবে কলকাতার অবস্থা ভাল হবে। চলুক ওরা।

অতএব চলুক।

নে থো করে গুছিয়ে নেওয়া, তবু ওরই মধ্যে মা কাপড়, জ্যাকেট, চুলের দড়ি-কাটা সব গুছিয়ে দিল। দুজনেরই দিল। মল্লিকার মা তো এদিকে তেমন গোছালো নয়। ভাড়ার গোছাতেই পটু। ছেলেমেয়েদের দিকটা তাকিয়েও দেখে না। আর সে না দেখাটাকেই সে বেশ একটু মহত্ত্ব ভাবে। বড় বড় মেয়েগুলোর সাজ-সজ্জার তদ্বির চাঁপার মা-ই করে। এতে যে চাঁপার হিংসে হয় না। তা নয়, কিন্তু সে হিংসে প্রকাশ করা চলে না। মা তাহলে জ্যান্ত পুতবে।

সে যাক, মা তো দিল গুছিয়ে দুজনকার। ঠাকুমার পুটলিও গুছিয়ে দিল। আহ্লাদে নাচতে নাচতে বেরোবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে মল্লিকা বিশ্বাসঘাতকতা করে বসলো। জেদ করে, কেঁদে-কেটে চলে গেল তার মার সঙ্গে।

বললো, ভাই-বোনদের জন্যে মন-কেমন করছে।

ভাই-বোনদের জন্য মন-কেমন!

বিশ্বাস করবে। চাপা এই কথা?

বলে দুদণ্ড ওরা চোখ ছাড়া হলে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচা যায়। রাতদিন উৎখাত করছে, রাতদিন চ্যাঁ-ভ্যাঁ করছে, খাটতে খাটতে প্ৰাণ যাচ্ছে ওদেরই জন্যে। আবার মন-কেমন।

চাপা তো বরং বলে না, কারণ সত্যি বলতে চাঁপার মা মেয়েকে পড়া পড়া করে ব্যস্ত করলেও অন্য কাজে তত খাটায় না। কিন্তু মল্লিকাকে খাটতে হয়, আর মল্লিকা বলতেও ছাড়ে না। বড়দের আড়ালে এলেই—কোলের ভাইটা-বোনটাকে ঠুকে ঠুকে বসায়, আর বলে, শতুর শত্ৰুর! একটু যদি শান্তি দেয়! মার যদি এই সাতগণ্ডা ছেলেমেয়ে না হত, একটু হাত-পা ছড়িয়ে বাঁচতম রে! এই চ্যাঁ-ভ্যাঁ গুলোর জ্বালায় জান নিকলে গেল!… জ্ঞান হয়ে পর্যন্তই কথা পাট করছি আর ছেলে বইছি!

অবিশ্যি চাপাও ও-দোষে দোষী।

পুতুলের বাক্স তার প্রাণ। কেউ হাত দিলে বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে না পড়ে পারে না। কিন্তু চাঁপা তো। ঢং করে বলতে যায় নি, ভাই-বোনের জন্যে মন-কেমন করছে!

মন-কেমন! রাতদিন যাদের বলছে মর মর, এক্ষুনি মীর লক্ষ্মীছাড়ারা! যমের বাড়ি যা, নিমতলার ঘাটে যা! তোরা মলে আমি হরির লুট দিই! তাদের জন্যে মন-কেমন! ন্যাকামি! চালাকি! শেষ অবধি ওর মা কিছু লোভটোভ দেখিয়ে কি ঘুষঘাষ দিয়ে মেয়েকে ফাঁদে ফেলেছে। জানে তো মেয়ে নইলে চলবে না!

বিয়ে হয়ে গেলে করবে কি?

তখন তো চালাতেই হবে!

মাঝখান থেকে চাঁপারই ঘোরতর কষ্ট!

তুলের বাক্সটা এনেছে চাঁপা, কিন্তু খেলার সঙ্গিনীই যে ভাগল্‌বা! মল্লিকার এই বিশ্বাসঘাতকতায় হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিল চাঁপার। তবু প্ৰথম দুচার দিন ঠাকুমার সঙ্গে মন্দিরে মন্দিরে ঠাকুর দেখে বেড়িয়ে, গঙ্গায় নেয়ে এবং ঠাকুমার গুরুবাড়ির সংসারযাত্রার নতুনত্ব দেখে একরকম ভালই কাটছিল, ঠাকুমাও মেয়েটা একা পড়েছে বলে একটু হৃদয়বত্তার পরিচয় দিচ্ছিলেন। কিন্তু সে অবস্থা আর থাকল না।

গুরুর নিজেরই মেয়েজামাই, নাতিনাতনী আর শ্বশুরবাড়ির দিকে কে সব এসে হাজির হল, কে জানে কী উপলক্ষে! তবে সেই উপলক্ষে চাপা মুক্তকেশীর আদর ঘুচিলো।

ঘরের অকুলান হওয়ায় দালানের চৌকিতে শুতে হল। ঠাকুমা-নাতনীকে, এবং গুরুমার ব্যাজার ব্যাজার ভাব যেন সর্বদাই স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল, তোমরা এখন অবান্তর। প্রশ্ন করতে লাগল, আর কতদিন?

অন্য কোথাও এ ভাব দেখলে নিৰ্ঘাত মুক্তকেশী পুঁটলি-বোঁচকা গুটিয়ে চলে যেতেন। কিন্তু জায়গাটা গুরুবাড়ি, দীনহীন হয়ে থাকাই নিয়ম। তাই মুক্তকেশী গুরুমার কাজের সাহায্য করেন, গঙ্গাজল বয়ে এনে দিয়ে মন রাখতে চেষ্টা করেন।

কিন্তু চাঁপার মন কে রাখবে?

মুক্তকেশী ওদিকে যতই আহত হন, ততই এদিকে ঝাল ঝাড়েন। উঠতে বসতে আপদ, বালাই, পায়ের বেড়ি, ঘাড়ের বোঝা ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করতে থাকেন নাতনীকে। নাতনীর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাটি মনঃপূত না হলে নাতনীকেই টিপে টিপে গঞ্জনা দেন এবং বলতে থাকেন, নিরিমিষ্যি মুখে রুচিছে না! সাহেবের গিন্নী হবেন! কত ভাগ্যে নারায়ণের অনুপেসাদ জোটে তা জানিস হারামজাদি?

বলা বাহুল্য, গুরুমার কানেই যায় কথাটা। কিন্তু নিরিমিষের কষ্ট পূরণ করতে এখন আর দুধ টুকু, দইটুকু, আচারটুকু, আমসত্ত্বটুকু পাতে পড়ে না। নারায়ণের বালভোগের জোড়া মণ্ডটি তো গুরুর ছোট নাতির একচেটি হয়ে গেল। অথচ প্রথম দিকে গুরুদের পূজো করে উঠে এসেই মেয়ে কই? মেয়ে কই? করে ডেকে ডেকে ওই মণ্ডটি হাতে দিতেন চাঁপার।

কিন্তু তাঁকেও দোষ দেওয়া যায় না।

চাঁপা একটা বুড়ো মেয়ে, ছোট্ট কেউ বাড়িতে নেই বলেই আদর জুটছিল তার। নাতি এল একটা, তিন-চার বছরের শিশু, আদরটা স্বভাবতই তার দিকে গড়াবে। আর নিজের নাতি এবং যজমানের নাতনীতে আদরের পার্থক্য থাকবে না, এ আবার হয় নাকি? সংসারত্যাগী যোগী গুরু নয়, ঘরসংসারী গৃহী গুরু। যজমান-ঘর বিস্তর, তাই অবস্থা ভাল। আর সেই জন্যেই যজমানরা নবদ্বীপ এলে ওঠে ওঁর কাছে। আদর্যযন্ত্বও পায়।

কিন্তু সে তো আর অনির্দিষ্ট কালের জন্যে নয়, ব্যাজার আসাই স্বাভাবিক।

ব্যাজার আসাই স্বাভাবিক, এটা মনে মনে হৃদয়ঙ্গম করেন মুক্তকেশী, তাতেই মেজাজ আরো খাপ্পা হয়। এবং সেই মেজাজটা চাঁপার উপরই পড়ে।

প্রথম প্রথম এখানে ঠাকুমার ভক্তিবিগলিত নম্র মূর্তি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল চাঁপা, কারণ ঠাকুমার এ মূর্তি তাদের কাছে অভূতপূর্ব। কিন্তু ভাগ্যে সাইল না। এখন ঠাকুমা উঠতে বসতে চাঁপাকে খিচোচ্ছেন। হয়তো নিরুপায়তার প্রকাশই এই। অধস্তনের উপর বীরত্ব ফলানো।

তাই পুরুষজাতি যখন দরবারে না মুখ পায়, তখন ঘরে এসে বৌ ঠ্যাঙায়।

চাঁপা এত মনস্তত্ত্ব বোঝে না, চাপা ঠাকুমার ভর্ৎসনায় মর্মাহত হয়। এবং তেমন দুঃখময় মুহূর্তে বলেও বসে, কেন আনলে আমাকে? মল্লির মতন মায়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেই হত?

তখন আবার আর এক হাত নেন মুক্তকেশী।

নিঃসঙ্গ চাপা অতএব বড়ই মনঃকষ্টে আছে। এখন ওর সর্বদাই মনে হয়, মা বকলেও এমন নিষ্ঠুরের মত বকে না। মা ঠাকুমার মতন এমন বিতিকিচ্ছিরী করে চুল বেঁধে দেয় না, মার কাছে থাকলে কখন কি পরতে হবে ভাবতে হয় না। ভাবতে হয় না। জ্যাকেট কাপড় শুকলো কিনা, ভিজেগুলো সময়ে মেলা হল কিনা।

গুরুমার মেয়ে আবার খুব সরেশ।

চাঁপা যে কিছু কাজ জানে না, সেটা ইতিপূর্বে ধরা পড়ে নি, ধরা পড়লো ওই মেয়ের চোখে। দুদিন না যেতেই সে বলে বসলো, নাতনী যে তোমার কুটো ভেঙে দুটো করতে শেখে নি মুক্তদি! শ্বশুরঘরে যেতে হবে না?

বাবার শিষ্য, অতএব দিদি!

আর বয়েস যাই হোক, তুমি!

মুক্তকেশী নিজের সাফাই গাইতে তাঁর মেজবৌমার গুণকীর্তন করেন, এবং ওই বেঁটির জন্যেই যে তাঁর নাতি-নাতনীকে সনাতন হিন্দুধর্মে তালিম দিতে পারেন নি, সে কথা ঘোষণা করেন।

চাঁপার মাতৃভক্তির খ্যাতি নেই, নিজেরা যখন জাঠতুতো পিসতুতো বোনেরা একত্র হয়, তখন চাঁপা মাতৃনিন্দায় পঞ্চমুখ হয়, কিন্তু নিতান্ত পরের সামনে এসব কথা ভালো লাগে না তার। তাছাড়া মার কাছ থেকে দূরে এসে কেমন যেন অসহায়-অসহায় লাগে নিজেকে।

কেউ কোথাও যেন নেই চাপোর—এমনি মনে হয়। বাড়িতে তো ঠাকুমাই ছিল পৃষ্ঠবল, এখানে কেন তেমন মনে হয় না কে জানে!

মনটা সর্বদাই দুঃখু-দুঃখু লাগে।

তাছাড়া শুধু কলকাতার জন্যেও যেন মন-কেমন করে। কলকাতার বাড়ি, কলকাতার রাস্তা, মামীঠাকুমার বাড়ি, গঙ্গার ঘাট, যা মনে করে তাতেই প্ৰাণ হুঁ-হুঁ করে ওঠে!

কলকাতায় যে কী আছে তা বলতে পারবে না চাপা, তবু যেন মনে হয় কত কী আছে!

আরো কষ্ট হয়েছে চাঁপার-ওই নতুন আসা লোকগুলোর মধ্যে একটা যে ছেলে এসেছে তার ব্যবহারে। গুরুর শ্বশুরবাড়ির কে যেন। শ্ৰীীরামপুর থেকে এসেছে। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ আছে খুব, কিন্তু কলকাতার নিন্দে ছাড়া কথা নেই মুখে!

কতই বা বয়েস?

চাঁপার থেকে ছোট হবে তো বড় হবে না, কিন্তু কী পাকা পাকা কথা! চাঁপা-মল্লিকাকে সবাই পাকা মেয়ে বলে, আর এই ছেলেটা কী?

মুখে মুখে আবার ছড়া বলে!

আর চেনা নেই জানা নেই, তুই!

খোঁচা খোঁচা চুল, মোটা মোটা পা, বেঁটে বেঁটে গড়ন—দেখলে গা জ্বলে যায়! আর সেইটা বুঝতে পারে বলেই উৎখাত করে চাঁপাকে, তোমাদের কলকাতায় আছে কি? কিছু না। খালি কায়দা আর কল! কাল আর কেতা, এই দুই নিয়ে কলকেতা! কেতা মানে জানিস? কেতা মানে কায়দা। কলকোত্তাই বাবুদের আছে শুধু কায়দা!

চাঁপাও অবশ্য নীরব থাকে না, রেগে উঠে বলে, থাকবেই তো কায়দা। যত সায়েবদের আপিস কলকাতায় না? লাটসায়েবের বাড়ি কলকাতায় না?

হি-হি করে হাসে ঘণ্টু।

বলে, তবে তো সবাই লাট, কি বলিস? তোর বাবা লাট, তোর কাকা লাট।

চাপা ক্রুদ্ধ গলায় বলে, এই, তুই আমার বাবা তুলে কথা বলছিস? বলে দেব?

ঘণ্টু কিন্তু রাগের ধার দিয়ে যায় না; বলে, দে না বলে! আমি বলবো, বাবার নাম করলেই বুঝি বাবা তোলা হয়? তাহলে তো ওকে ওর বাবার নাম জিজ্ঞেস করাও চলবে না।

মুখরা চাঁপা নিষ্প্রভ হয়ে যায়।

এবং বোকার মতই রাগে, তা কালকেতাকেই বা নিন্দে করবি কেন?

করবো! নিন্দের যুগ্যি তাই নিন্দে করবো!

নিন্দের যুগ্যি?

নিশ—চয়।

তা হলে তোদের শ্রীরামপুরও খুব বিচ্ছিরী! যত ইচ্ছে নিন্দে করবো!

ঘণ্টু চোখ পিটপিটয়ে হাসে। বলে, কর। দেখি কি নিন্দের কথা বার করতে পারিস!

চাপা অবশ্য পারে না।

কারণ শ্রীরামপুর নামটা শুনেছে সে এই ঘণ্টুদের দৌলতেই। কোথায় সেই পরমধাম, কী তার গুণাগুণ কিছুই জানে না। তাই বিপন্ন হয় চাপা।

ঘণ্টু পরিতুষ্ট মুখে বলে, পারলি না তো? পারবি কোথা থেকে? দোষ থাকলে তো? কলকেতা? হিহিহি!

কলকোত্তাই বাবু
এক ছটাকে কাবু!
কোঁচার বুলি লম্বমান,
উদর ফাঁকা মুখে পান।

আশ্চর্য, ওইটুকু ছেলে, মুখস্থও করেছে এত!

নিৰ্ঘাত ওদের বাড়িটা ঘোরতর কলকাতা-বিদ্বেষী, রাতদিন এরই চাষ চলে। চাঁপার এত হাতিয়ার নেই, ওর সম্বল শুধু রাগ। সেই সম্বলেই লড়তে আসে সে, আর তোদের শ্রীরামপুরে বুঝি কেউ পান খায় না?

খাবে না কেন? ভরা পেটে খায়।

কলকাতার লোক ভাত খায় না?

ঘণ্টু গম্ভীরভাবে বলে, সে গরীব-দুঃখীরা খায়। বাবুরা খায় শুধু চপ কাটলেট আর মদ!

মদ!

চাঁপার চোখ গোল হয়ে যায়।

চাঁপার মুখ লাল হয়ে ওঠে, মদ খায়! তার মানে আমরা মদ খাই?

তোরা? হি হি হি, তোরা কি বাবু? তোরা তো মেয়েমানুষ। হচ্ছে বাবুদের কথা। শুনবি আরো? চড়েন। বাবু জুড়ি গাড়ি, চেনেন খালি শুড়ির বাড়ি! শুড়ির বাড়ি মানে জানিস?

জানবে না কেন, কী না জানে চাপা? রাতদিন তো শুনছে। এসব। নিজেরাই ঝগড়ার সময় বলে, শুড়ির সাক্ষী মাতালা! কিন্তু সত্যি মানে ভেবে বলে নাকি? অথচ এই পাজী ঘণ্টুটা!

কক্ষণো তুই কলকাতার নিন্দে করবি না বলছি, চাপা অগ্নিমূর্তি হয়।

ঘণ্টু নির্বিকার।

ঘণ্টু নিৰ্ভয়।

ঘণ্টুর এই মেয়েটাকে ক্ষ্যাপানোই আপাতত শৌখিন খেলা। আর খেলোটাকে সে নির্দোষই ভাবে। তাই ঘণ্টু হঠাৎ তারস্বরে বলে ওঠে, আচ্ছা করবো না নিন্দে, বল তবে একটা ধান গাছে কখানা তক্তা হয়?

চাঁপা ক্ষোভে দুঃখে উঠে যায়।

ঘণ্টু মহোৎসাহে চেঁচায়, কলকেতার বিবিদের ছড়াটা শুনে গেলি না?

চাপা গিয়ে কেঁদে পড়ে, ঠাকুমা, ওই ঘণ্টুটা যা ইচ্ছে বলছে! বলছে কলকাতা ছাই-বিচ্ছিরি! থাকবো না। আর আমি!

মুক্তকেশীর অজানা নয় ব্যাপারটা, তাই ব্যাজার মুখে বলেন, ও ক্ষ্যাপাচ্ছে বলেই তুই ক্ষেপবি? বাড়িতে তো খুব দুদে, এখানে একেবারে কচি খুঁকি হয়ে গেলি যে!

গুরুকন্যা বলে ওঠেন, যা বলেছ মুক্তদি, নাতনীর তো তোমার বিয়ের বয়েস বয়ে যায়, কী ন্যাক বাবা! ঘণ্টু কি একটা মানুষ, তাই ওর কথায় ক্ষেপছে!

মুক্তকেশী আড়ালে গিয়ে চাপা গলায় বলেন, নেকি, তুমি রাতদিন ওই দস্যি ছোঁড়ার সঙ্গে মেশই বা কেন? ওসব হচ্ছে পাজীর পা-ঝাড়া! খবরদার ঘণ্টুর সঙ্গে মিশবি না।

চাপা কেঁদে ফেলে।

কলকাতার দুঁদে চাঁপার সব মর্যাদা ঘোচে। বলে, আমি কি মিশতে যাই? ওই তো আসে সোধে সোধে!

তা হোক। তুই আমার কাছে কাছে থাকিবি।

তোমার কাছে? তুমি যেন বড্ড থাকো? রাতদিন তো রাস্তায়। তার থেকে চলে যাই চল।

চলে যাই বললেই তো হয় না? তোর বাপ-জ্যাঠা হুকুম দেবে, তবে তো?

চাঁপা অতএব এদের ছাতে উঠে কাঁদতে বসে।

কলকাতার নিন্দেয় তার এমন জ্বালাই বা করে কেন? কলকাতার কথা মনে পড়লেই বা প্ৰাণের মধ্যে এমন হুঁ-হুঁ করে ওঠে কেন?

ছাতে নির্জনে বেশিক্ষণ বসা যায় না, বেলা পড়ে গেলেই গা ছমছম করে, আর দুপুরবেলা বুক টিপটিপ করে।

তবু আসে একবার একবার।

আলসের ধারেই একটা নারকেল গাছ, তার পাতাগুলো ঝিরবির করে, সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চাঁপার মনটা হারিয়ে যায়।..

যে বাড়ির দেওয়াল চারখানা চাঁপার মার কাছে জেলখানার দেওয়ালের মত লাগে, সে বাড়ির ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায় চাঁপার মন।… আর সকাল থেকে রাত অবধি যেখানে যা কিছু হয় সব মনে পড়ে যায়। বাবা জ্যাঠা কাকারা কে কি করেন, কখন খাওয়া হয়, কখন শোওয়া হয়। তাছাড়া সক্কালবেলায় মাথায় বড় একটা হাঁড়ি নিয়ে যে লোকটা গলির মধ্যে এসে হেকে যায়-মুড়ির চাকতি, ছোলার চা-কতি-সে লোকটার গলার আওয়াজ যেন এখান থেকেই কানে এসে বাজে।… কাজন বাজে চাই কুলপী।… মা—লাই কুলপী! কানো বাজে চুড়িউলির চুড়ি চা-ই চুড়ি! আতা চাই আতা, টেঁপারি, টোপাকুল, নারকুলে কু-ল?

চলছেই তো সারাদিন।

এখানেও শব্দের অবধি নেই। সে কেবল ঘণ্টা-কাঁসরের শব্দ।

ঠাকুর জাগছেন, ঠাকুর খাচ্ছেন, ঠাকুর ঘুমোচ্ছেন, ঠাকুর সাজছেন, সব কাঁসর পিটিয়ে পিটিয়ে জানানো! বাবাঃ! এই ঠাকুরের দেশে আর থাকতে সাধ নেই।.. ঢের ভালো ওই বহুবিধ শব্দতরঙ্গে তরঙ্গায়িত কলকাতা!… এখানে একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না—আশ্চৰ্য্য!…

এখানে পয়সা হাতে দিয়েই কী বলবেন ঠাকুমা?

পেন্নাম কর! পয়সাটা ওই থালায় ছুঁড়ে দে!

দূর!

অথচ ওখানে একটা পয়সা পেলে কত কী করা যায়! ডবল পয়সা পেলে তো কথাই নেই। আধলা একটা ঘরের মেঝোয় কুড়িয়ে পেলেও তা দিয়ে দুখানা মুড়ির চাকতি কিনে ফেলা যায়।

মা মোটেই পয়সা হাতে দিতে চায় না। আঁচলে পয়সার পুটলি নিয়ে বেড়ায়, তবু একটা পয়সা চাইলে দেবে না। চাইলেই বলবে, কী চাই শুনি? কি কিনতে হবে?

কি কিনতে হবে তা কি ঠিক থাকে? পয়সাটাই আসল। ওটা পেলেই কত কীই কেনা চলে। কিন্তু তা হবে না। বলতে হবে। অগত্যাই যা হোক একটা কিছু বলে ফেলতে হয়। পেয়ারা কি আতা, ঝালবিস্কুট কি তিলকুট!

ব্যস, গুষ্টির যে যেখানে আছে, মা সবাইয়ের জন্যে কিনতে বসবেন। এতে কি রোজ রোজ আবদার করা যায়? চাঁপার বাবার যে বেশী পয়সা, তার জন্যে আলাদা কোন সুখ নেই চাঁপার! অথচ বাবাদের ওই হেমা মাসী? তাদের বাড়িতে নাকি তাঁর বড় ছেলের ছেলেমেয়েরা মুড়ি খায়, আর ছোট ছেলের ছেলেমেয়েরা পরোটা খায়!

কেন?

ওই পয়সা কম বেশি বলেই।

মার সামনে বল দেখি ওসব কথা, খুন করবে!

চুড়িউলি এলে সবাই চুড়ি পরবে, মা দাম দেবে। কিন্তু চাঁপা একটু বেশি পরতে যাক দিকি? নয়তো রেশমী চুড়ি পরতে যাক? হবে না! পারলে সবাই পরবে।… তা এখন তো চুড়ি পরাও ঘুচেছে। চুড়ি নাকি বিলিতি! কে জানে বাবা!

তা বাবা দেয় পয়সা। লুকিয়ে দিয়ে বলে, খবরদার, তোদের মাকে দেখাস নে।

কিন্তু লুকিয়ে কিনে লুকিয়ে খাওয়া কী কম গেরো?

তবু আঁচলে দু-একটা পয়সা থাকলেই মনটা কি ভরাট থাকে! আর রাস্তা দিয়ে যখন ওলারা হেঁকে যায়, কী আহ্লাদ হয়!… আর হাকছেই তো চব্বিশ ঘণ্টা!.. সেই কলকাতাকে কিনা বলে খারাপ?

সন্ধ্যে হয়ে আসছিল।

নারকেলপাতায় ঝিরঝিরিনিটা যেন জমাট জমাট দেখাচ্ছে। নিচে নামবার জন্যে উঠে পড়ে চাঁপা…মনে পড়ে যায় কলকাতায় এ সময় রাস্তার গ্যাসবাতি জ্বালনেওয়ালারা মই ঘাড়ে করে বেরিয়ে পড়ে।

চাঁপাদের গলির বাঁকে একটা গ্যাস আছে, লোকটাকে চাঁপাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। বাতিওলা চলে যেতে না যেতেই ফুলওলার আওয়াজ পাওয়া যায়। গলিতে ঢোকে না, বড় রাস্তা থেকেই আওয়াজ আসে, চাই বেলফুল।… চাই কে—য়া ফুল!

ছোট খুড়ি কেয়াফুলের ধুলোগুলো দিয়ে কেয়া খয়ের বানায়। বাবাদের তাশের আডার লোকেরা বলে, আপনাদের বাড়ির পানটি ভালো!

যে কথাটাই মনে পড়ে যায়, প্ৰাণটা হু-হু করে ওঠে।

কলকাতা আর কলকাতার ওই বাড়িটা যেন চাঁপাকে লক্ষ বাহু দিয়ে টানতে থাকে।

আর এই আশঙ্কাটা এযাবৎ যেন চোখের সামনে একটি রঙিন ফুলের মত দুলছিল।

ইদানীং ঠাকুমাকে প্রায়ই লোকে বলতে শুরু করেছে, আর কি, চাঁপা-মল্লিকা তো দিব্যি বিয়ের যুগ্য হল, এবার নাতজামাই খোজো?

ঠাকুমাও অনুকূল একটা জবাব দিচ্ছেন। কাজেই অদূর ভবিষ্যতেই যে সেই দিনটি আসছে তা বুঝতে পারছে চাপা। আর সেই বুঝতে পারার আশেপাশে ঝলসে উঠছে নতুন গহনা, জরির শাড়ি, মালচন্দন, লোকজন, ডাক-হাঁকি, ঘটপটা।

টোপর পরা একটা ছেলেও আছে বৈকি এই সমারোহের কোনো একখানে।… কাজেই সবটা মিলিয়ে ওই একটি রঙিন ফুলই।

কিন্তু আজ, ঠিক এই মুহূর্তে ফুল উধাও হল। একটা বুনো জন্তু যেন হাঁ করে এল।

বিয়ে হওয়া মানেই তো ওই বাড়ি থেকে চলে যাওয়া। হয়তো বা কলকাতা থেকেও? কত মেয়েরই তো বিয়ে দেখছে চাঁপা, কই, কলকাতায় কোথা? অতএব চাঁপার ধরে নিতে হবে, কলকাতা থেকে বিতাড়ন!

হঠাৎ যেন ড়ুকরে। কান্না পায় চাঁপার।

যেন এখনই কলকাতা থেকে নির্বাসন ঘটে গেছে তার।

তা যাওয়াই।

আর বড় জোর ছ মাস এক বছর।

তার বয়সী কত মেয়েরই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

হায় হায়, কেনই বা বিয়েটাকে ভাল মনে হত তার!

আচ্ছা, যদিই বা কলকাতাতেই বিয়ে হয় তার ছোট পিসির মত, কিন্তু পড়তে তো হবে একটি দজ্জাল শাশুড়ীর হাতে, তার ঠাকুমার মত। পিসির শাশুড়ী কেমন চাপা জানে না, মা খুড়ির শাশুড়ীকেই দেখে আসছে জীবনভর। কাজেই শাশুড়ী শব্দটার সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তকেশীর মুখটাই ভেসে ওঠে। বলা বাহুল্য, তাতে বুকে খুব একটা বল আসে না।

সন্ধ্যার ছায়া মনে নিয়ে নিচে নেমে আসতে আসতে আরো একটা কথা মনটাকে তোলপাড় করে তোলে চাঁপার।

চাঁপার মার নাকি ন বছরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তার মানে চাঁপার বয়েস থেকে দু বছর আগে। আর মা বেচারীকে এসে পড়তে হয়েছিল। ঠাকুমার মত শাশুড়ীর হাতে!

উঃ কী কষ্ট! কী কষ্ট!

জীবনে এই প্রথম বোধ করি মাকে বেচারী ভাবল চাঁপা।

তারপর আরো আতঙ্ক গ্ৰাস করতে বসলো চাঁপাকে। শুনেছে মার ঠাকুমা নাকি মার মাকে লুকিয়ে, আর মাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে ফেলেছিলেন!

সেই রাগে মার মা, যিনি নাকি চাঁপাদের দিদিমা, সংসার ত্যাগ করে কাশী চলে গেছেন। জীবনে আর মা তার মাকে দেখতে পেল না।

চাঁপার ঠাকুমাও যদি হঠাৎ এইখানে কারুদের বাড়িতে বিয়ে দিয়ে ফেলে তার!

ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে চাঁপার। বলা যায় না, বিশ্বাস নেই! মার ঠাকুমা তো চাঁপার ঠাকুমার সইমা! একই রকম বুদ্ধি হতে পারে।

হে ঠাকুর, তা হলে কি হবে?

লোকে চাঁপার দিদিমার গল্প শুনে বলে, বাবা, এত রাগ? বলে, অনাচ্ছিষ্ট। বলে, মাথার দোষ ছিল বোধ হয়।

কিন্তু চাঁপার তা মনে হয় না।–

চাঁপার ঠাকুমা যদি আমন কাণ্ড করে বসে, চাঁপার মাও নির্ঘাত চাঁপার দিদিমা সত্যবতী দেবীর মতনই করে বসবে।

করবেই! সন্দেহ নাস্তি!

অথচ চাঁপার মা সুবৰ্ণলতা পাগল-টাগল কিছুই নয়। তা পাগল না হোক, চাপা কিন্তু কিছুতেই তার মার মতন হবে না। বাপ, রাতদিন যেন মারমুখী! তার থেকে সেজ খুড়ি, ছোট খুড়ি, জেঠি, পিসি সবাই ভাল।

দিদিমা ওইভাবে মাকে বাঘের মুখে ফেলে দিয়ে চলে যাওয়াতেই বোধ হয় মার মেজাজ। অমন খাপ্পা। সত্যি মা হয়ে তুমি দেখলে না একবার! কী নিষ্ঠুর!! চাঁপার মাও ঠিক তাই হবে। তাছাড়া আর কি হবে?… হে ভগবান, ঠাকুমা যেন চাঁপার বিয়ে দিয়ে না বসে!

আগে আগে, যখন চাপা ছোট ছিল, মাঝে মাঝে মাকে বলতে শুনেছে, সেই ন বছর বয়সে এদের সংসারে এসে পড়েছি, মা বস্তু কী তা ভুলেছি!

এখন আর বলে না।

সুবৰ্ণলতার যে কখনো কেউ ছিল, তা আর বোঝা যায় না।

ঠাকুমা যদি লুকিয়ে লুকিয়ে চাঁপার বিয়ে দিয়ে ফেলেন? তখনও তাহলে বোঝা যাবে না, সুবৰ্ণলতার একটা চাপা নামের মেয়ে ছিল।

আর বাঁধা মানে না।

উথলে উথলে কান্না আসে।

তাড়াতাড়ি পুতুল বাক্সটা টেনে বার করে খেলতে বসে!

কিন্তু খেলতেও তো সেই পুতুল-বৌয়ের শ্বশুরবাড়ির জ্বালা আর খাটুনি। তাছাড়া আর কী ভাবেই বা খেলা যায়? কিন্তু এখন যেন সব কিছুই মধ্যেই চাপা নিজের ছায়া দেখছে।

পুতুলও আকর্ষণ হারালো!

মুক্তকেশীর কাছে ড়ুকরে গিয়ে পড়লো, ঠাকুমা, আমরা আর এখানে থাকব না, বাড়ি চল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *