চীনের ছাত্র আন্দোলন
১৯৮১ সালে চীন দেশে এক অমায়িক দোভাষী আমাকে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন ওঁদের জাতীয় সঙ্গীতের কথা। গানের ভাষা বদলেছে। পুরনো গানের ভাবটা ছিল এইরকম, দাসত্ব যারা মানবে না ওঠো তারা, আমাদেরই দেহের রক্তে ও অস্থিতে তৈরি হোক চীনের নতুন প্রাচীর। নতুন গানে বলা হল, এগিয়ে চল কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে, মাওয়ের নেতৃত্বে। মনে প্রশ্ন উঠেছিল, দলবিশেষ ও ব্যক্তিবিশেষের নামের সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীতকে এইভাবে বেঁধে দেওয়া কি সুবিবেচনার কাজ হল? অন্তত এদেশে আমরা সেটা করিনি। ঐ প্রশ্নটাই আবার ফিরে আসছে এবছরের ছাত্র আন্দোলনের বৃত্তান্ত শুনে।
কমিউনিস্ট দলের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর, ঠিক চল্লিশ বছর পূর্ণ হবার মুখে, চীনের রাজধানীতে যে ছাত্র আন্দোলনের আবির্ভাব হল সেটা ইতিহাসে এক বিশেষ ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই আন্দোলন থেকে হাতে হাতে কতটা ফল পাওয়া গেছে তাই দিয়ে এর বিচার করতে যাওয়া ভুল। এর মহত্ত্ব বুঝতে হলে মনোযোগ দিতে হবে ছাত্রদের এই সংগ্রামের কয়েকটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের প্রতি।
প্রথম বৈশিষ্ট্য, সংগ্রামের ব্যাপকতা। যদিও পেইচিং মহানগরে ছাত্রদের এই আন্দোলন আরম্ভ হয় তবু সেটা চীনের রাজধানীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার ভিতর আবদ্ধ থাকেনি। কোনও সংগঠিত রাজনীতিক দলের সমর্থন ছাড়াই একটা প্রবল ভাবধারার মত ছাত্রদের দাবি প্রতিধ্বনিত হয়েছে দূর থেকে আরও দূরে। চীনের নানা প্রান্ত থেকে ছোট বড় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সমর্থন এসে পৌঁছেছে রাজধানীর সেই ঐতিহাসিক তিয়েনআনমেন চত্বরে, যেখানে দাঁড়িয়ে ১৯৪৯ সালে এক বিশাল জনসভায় মাও ঘোষণা করেছিলেন কমিউনিস্ট শাসনপ্রতিষ্ঠার বার্তা। ছাত্র সংগ্রাম শুরু হবার একমাস পরে, মে। মাসের ১৬ তারিখে, অনিবার্যভাবে পৃথিবীর দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হল আন্দোলনের আরও বড় এক আন্তজাতিক পরিপ্রেক্ষিত। সেদিন ঐ চত্বরেরই একাংশে যখন ছাত্রদের দাবির সপক্ষে সম্মিলিত হয়েছে হাজার হাজার যুবক-যুবতী তখন তারই অতি নিকটে বৃহৎ সভাকক্ষে মিলিত হলেন, ঐতিহাসিক এক শীর্ষ সম্মেলনে, চীনের নেতা তং শিয়াওফিং এবং সোভিয়েত নেতা গবার্চভ। আর সেই মুহূর্তেই আমাদের দৃষ্টির সীমানাটা হঠাৎ বহুদূর প্রসারিত হয়ে গেল। আমরা বুঝতে পারলাম যে, গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার সপক্ষে চীনের ছাত্রদের ঐ আন্দোলন একটি দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। চীনের ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি বৃহত্তর এক আন্দোলনের অংশ, চীন, সোভিয়েত দেশ, পোল্যান্ড সব দেশের ভিতর দিয়েই বয়ে চলেছে একই তরঙ্গ।
সমান তাৎপর্যময় চীনের আন্দোলনের অন্য এক বৈশিষ্ট্য। সম্প্রতি ভবানী সেনগুপ্ত এই বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। চীনের এই আন্দোলনের কৌশল অথবা পদ্ধতি লেনিনবাদী বা মাওবাদী চিন্তাভাবনার সঙ্গে মেলে না, বরং এর তুলনা গান্ধীবাদের সঙ্গে। আন্দোলনের নেতারা সযত্নে অহিংসার পথে চলেছেন। অনশনকে সংগ্রামী পদ্ধতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। রাজধানীতে যখন সৈন্যবাহিনী উপস্থিত হল, সেই উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তেও ছাত্রছাত্রীরা এক আশ্চর্য অনুত্তেজিত সাহসের সঙ্গে সৈন্যদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, গ্রহণ করেনি হিংসার পথ অথবা পলায়নের পথ। এই যুবক-যুবতীরা গান্ধীজীর চিন্তার সঙ্গে পরিচিত কি না আমরা জানি না। ঐতিহাসিক পরিস্থিতির ভিতর খুঁজে পেয়েছে এরা এমন এক সংগ্রামী পথ, যা গান্ধীকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। চীনের এই আন্দোলনের আরও এক বৈশিষ্ট্য, এর নেতৃত্ব কোনও বিশেষ শ্রেণীর হাতে আবদ্ধ নয়। সংগ্রামের পুরোভাগে নেই কোনও শ্রমিক সঙ্ঘ বা কৃষক সমিতি, আছে সেই ছাত্রছাত্রীরা যাদের শ্রেণীর সংজ্ঞায় বাঁধা যায় না। অথচ এই আন্দোলনের আবেদন ছোট ছাত্ৰগোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। একে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন চীনের চিন্তাশীল মানুষেরা। রাজধানীতে সামরিক ব্যবস্থা জারি করবার পর দেখা গেল অন্য এক দৃশ্য। সেনাবাহিনীর ভিতরও এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতির অভাব নেই।
শুধু নেতৃত্বের গঠনে নয়, আন্দোলনের ভাষাতেও একই বৈশিষ্ট্য। এই ছাত্রছাত্রীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার উচ্চারণে মার্ক্সবাদের নাম নেই। চল্লিশ বছর ধরে চীনদেশ কমিউনিস্ট শাসিত। সেই চীনে এই ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। আশৈশব এদের মাওবাদ বা মার্ক্সবাদে দীক্ষিত করার অক্লান্ত প্রচেষ্টা চলেছে এক সুসংবদ্ধ ক্ষমতাশালী দলের পক্ষ থেকে। অথচ আজকের ছাত্রছাত্রীদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের সঙ্কল্পে ও ভাষায় তার কোনও প্রভাব চোখে পড়ে না।
স্বভাবতই মার্ক্সবাদী নেতাদের অনেকেই এই আন্দোলনকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন। কেউ কেউ এর পিছনে বিদেশী হাত খুঁজছেন। কিন্তু ঐভাবে দেখে আন্দোলনের প্রকৃত পরিচয় জানা যাবে না। মনে রাখতে হবে এর বিরাট ব্যাপ্তি; কিছু বিদেশীর কি এমন সাধ্য আছে অথবা থাকা সম্ভব যে, চীন, সোভিয়েত দেশ, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি অবধি এই বিশাল তরঙ্গ তারা সৃষ্টি করতে পারে? মনে রাখতে হবে এর আশ্চর্য সংযম। বিদেশী ঘাতকদের কি সেই শক্তি আছে যাতে হাজার হাজার তরুণ তরুণীকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে অহিংস পথে পরিচালনা করা যায়? একটা আদর্শের শক্তি ছাড়া এসব কিছুরই কি ব্যাখ্যা হয়? স্থায়ী সংগঠনের অভাবে হয়ত এই আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হবে না, হয়ত সংগ্রাম সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে যাবে। শেষ পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা এবং হিংসার প্রবেশও একেবারে অসম্ভব নয়। তবু বিয়টাকে বুঝে দেখা দরকার।
শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন ঘটলেই তাতে বিদেশী চক্রান্তের গন্ধ পাওয়া কিছু নতুন ব্যাপার নয়। শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনকেও এইরকম সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। আর পৃথিবীটা আজ এমনই ছোট হয়ে গেছে যে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশী প্রভাব ছড়িয়ে পড়েও ঠিকই। তবু দেশের ভিতরের অবস্থাতেই নিহিত থাকে আন্দোলনের প্রধান কারণগুলি। তাকে উপেক্ষা করে বিদেশী চক্রান্তের রব তুললে তাতে বিভ্রম সৃষ্টি হয়, সমস্যার সমাধান অযথা কঠিন হয়ে ওঠে।
একটা ব্যাপার চীনে বারবারই ঘটছে। ছাত্র-আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসছে। রাজনীতির নেতারা সেই আন্দোলনকে প্রথমে কিছুটা সহানুভূতির চোখে দেখছেন, কিন্তু সেটা নিতান্তই সাময়িকভাবে আর ছোট সীমার ভিতর। আন্দোলন। ম্যাপক হয়ে উঠলেই শাসকদল ভয় পাচ্ছে, জারি হচ্ছে সরকারি বিধিনিষেধ। ১৯৭৬ সালে চৌ এন লাইয়ের মৃত্যুর পর গণতন্ত্রের দাবিতে এইরকমই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আবার ১৯৮৬-৮৭ সালে। আবারও হু ইয়াও বাং-এর মৃত্যুর পর এই ১৯৮৯ সালে। শাসকদল প্রতিবারই রাশ টেনে ধরেছে। চীনদেশে একদলীয় শাসনতন্ত্র এখনও যথেষ্ট মজবুত, সেটাকে ভাঙবার মত শক্তি ছাত্রদের নেই। কিন্তু এটাও লক্ষ করতে হবে যে, পদে পদে বাধা পেয়েও গণতন্ত্রের সপক্ষে আন্দোলন বার বার নতুন করে জেগে উঠছে। বোঝা যাচ্ছে, চীনের সমাজদেহের অভ্যন্তরে এমন কোনও পরিবর্তনের শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে যার স্বাভাবিক প্রকাশ গণতন্ত্রের দাবিতে।
মার্ক্স বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠিত আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ভিতরই এমন অবস্থার ক্রমে সৃষ্টি হয় যাতে সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। শাসকশ্রেণী সেই পরিবর্তনকে ভয় করে, কারণ প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সঙ্গেই তার স্বার্থ জড়িত। কিন্তু শেষ অবধি পুরনো ব্যবস্থাকে রক্ষা করা যায় না। যাকে রক্ষা করা যাবে না তাকেও আমরা ছাড়তে চাই না, মানুষের ইতিহাসে এই দুঃখকর পরিস্থিতি বার বার দেখা দেয়।
এই রকমই একটা পরিস্থিতি আজ দেখা দিয়েছে চীনসহ সারা সাম্যবাদী জগতে। কমিউনিস্ট শাসনের কাঠামোর ভিতরই শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাজের বাস্তব অবস্থা ক্রমে বদলে গেছে, বেড়ে উঠেছে এক নতুন প্রজন্ম, রূপগ্রহণ করেছে নব আশা আকাঙ্ক্ষা, নতুন দাবি যার সঙ্গে পুরনো ব্যবস্থা ও মতবাদের আর সামঞ্জস্য নেই। একই সঙ্গে আকার গ্রহণ করছে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের অন্য এক রূপরেখা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মধ্যে যাকে আর আঁটা যাচ্ছে না।
.
এই সত্যটার মুখোমুখি দাঁড়ানো কমিউনিস্ট দলের পক্ষে কঠিন। এ কথাটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, নতুন প্রজন্ম যা চাইছে, বাস্তবের যা দাবি, তাকে পুরোপুরি মেনে নিতে গেলে শেষ অবধি বিদায় নিতে হয় কমিউনিস্ট দলকেই, অন্তত তার একাধিপত্যকে। চীনের নেতারা ছাত্র আন্দোলনকে কুণ্ঠিত অভিনন্দন জানিয়েছেন, কারণ তাঁরা বাস্তববাদী। তবু যে ছাত্রদের দাবিকে তাঁরা ভয়ের চোখে দেখেন তাতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। একটি দল ও বিশেষ শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা নিজেদের স্বার্থকে একান্তভাবে জড়িয়ে ফেলেছেন তাঁদের পক্ষে ইতিহাসের এই অধ্যায়টিকে শান্তভাবে মেনে নেওয়া বড় কঠিন। অথচ পরিবর্তন অনিবার্য। শান্তিপূর্ণ পথে সেই পরিবর্তন ঘটবে কিনা সেটাই প্রশ্ন। এই রকমের প্রশ্ন আজ তীক্ষ্ণভাবে প্রাসঙ্গিক শুধুমাত্র ধনতান্ত্রিক দেশেই নয়, সাম্যবাদী সমাজেও।
চীন ও সোভিয়েত দেশের মানুষ ভিতরে ভিতরে নতুন এক বিপ্লবের জন্য তৈরি হচ্ছে। সেই বিপ্লবের অগ্রদৃত যুব সম্প্রদায়। শাস্ত্রের দোহাই অথবা দলীয় ফতোয়া দিয়ে বেশিদিন এদের পথ আটকানো যাবে না। মুক্ত সমাজ সম্বন্ধে আজকের এই যুবকদের ধারণাটাও শেষ কথা নয়। তবে এটা এগিয়ে যাবার পথে একটি ধাপ। আরও দূরে যেতে হবে। আগামী দিনের বিপ্লব শান্তিপূর্ণ হলেই পৃথিবীর পক্ষে মঙ্গল।
আজকাল, ৪ জুন, ১৯৮৯