প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.১৭ আগে আগে চলেছেন অবনীমোহন

আগে আগে চলেছেন অবনীমোহন, পেছনে যুগল আর বিনু।

একটু পর সবাই সেই পুরনো আধভাঙা মন্দিরটার সামনে এসে পড়ল। ঘাড় ফিরিয়ে অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের মন্দির যুগল?

যুগল বলল, বিষহরির।

বিনু বুঝতে পারে নি। সে তাড়াতাড়ি শুধলো, বিষহরি কী?

মা মনসা। যুগল বলতে লাগল, আইতেন শাবণ মাসে, দেখতেন এইহানে পূজার কী ধুম! রাইজ্যের মানুষ উই সোময়টায় পাথরের খাদা-ভরা (পাথরের বাটিভর্তি) দুধ আর সবরি কলা নিয়া ভাইঙ্গা পড়ে।

মন্দিরের পর খানিকটা জঙ্গল মতো। ছোট বড় ক’টা তেঁতুল গাছ, কিছু বুনো কচু, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর থেকেই হাটের চালা শুরু হয়েছে।

আশ্বিন মাসের এই পড়ন্ত বেলায় রোদের তাপ দ্রুত জুড়িয়ে আসছে। চারদিকের গাছগাছালির মাথায় সোনালি আভা লেগেছে। এই সময় সুজনগঞ্জের হাট জমে উঠেছে। দরাদরি, হইচই আর চিকারে চারদিক সরগরম।

বিনুরা এখন হাটের যে অংশে এসেছে সেটা তরিতরকারির বাজার। চারদিকে বড় বড় বেতের ধামা আর বাঁশের চাঙারিতে সজীব, পরিপুষ্ট শাক এবং আনাজ সাজানো। ব্যাপারিরা সবাই চাষী শ্রেণীর মানুষ।

যেতে যেতে একটা ব্যাপারির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন অবনীমোহন। বললেন, তোমার বেগুন কত করে?

লোকটা বলল, দ্যাড় পহা স্যার (সের)।

অবনীমোহন অবাক, দেড় পয়সা!

হ, তয় আপনে যদিন এক পাসারি কিনেন তিন পহায় দিয়া দিমু।

পাসারি কী?

আড়াই স্যার।

আড়াই সের বেগুন তিন পয়সা। বল কী!

দর নি বেশি কইলাম বাবু? তাইলে এক পাসারি দুই পহাই দিয়েন।

এত শস্তা।

ব্যাপারি লোকটা মুসলমান। বিস্ময়-ভরা চোখে ভাল করে অবনীমোহনকে দেখে নিয়ে বলল, এরেই শস্তা কইলেন বাবু!

অবনীমোহন হতবাক, শস্তা নয়!

উঁহু। গেল সন এই আশ্বিন মাসে পহায় দুই স্যার বাগুন বেচছি। আইজ হেই বাগুনের পাইকারি দর উঠছে পহা পহা স্যার। দিনকাল যে কী পড়ল! হাটখান ঘুইরা দ্যাখেন, জিনিসপত্তরে আর হাত দ্যাওন যায় না। সগল কিছু আক্কারা, এক্কেরে আগুন।

অবনীমোহনের বিস্ময় বাড়ছিলই। বললেন, গেল বছর পয়সায় দু’সের বেগুন ছিল!

তয় আর কই কী। ভাল করে অবনীমোহনকে আরেক বার দেখে নিয়ে বেগুন ব্যাপারি বলল, বাবু নিয্যস আমাগো এইদিকে থাকেন না?

না।

আমিও হেই ভাবছি। এইহানের হইলে পহায় দুই স্যার বাগুন শুইনা আটাশ যাইতেন না (অবাক হতেন না)। বাবু থাকেন কই?

কলকাতায়।

কইলকাতার মাইনষের কথাই ভিন্ন।

কেন?

দশ পহা স্যার বাগুন হইলেও তাগো কাছে শস্তা। এক এক পূজায় তেনারা কইলকাতার থনে আসে আর এইখানে জিনিসপত্তরের দাম চেইতা (চড়ে) যায়। বলতে বলতে ব্যাপারি একটু থামল। তারপরেই কী ভেবে ডাকল, আইচ্ছা বাবু—

কী?

শুনছি কইলকাতায় নি পহা দিয়া মাটি কিনতে হয়!

হেসে অবনীমোহন মাথা নাড়লেন।

দু’ধারে হাটের চালা, মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা সরু পথ। যেতে যেতে চোখের সামনে যা পড়ছে–মানকচু, মেটে আলু, পটল, শুকনো লঙ্কা, নতুন আউশ চাল, মিঠে কুমড়ো–সব কিছুর দর করছেন অবনীমোহন। ব্যাপারটা তার কাছে যেন মজার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উনিশ শ’ চল্লিশ সালে চারদিকে যখন দুর্মুল্যের আঁচ লাগতে শুরু করেছে তখন কলকাতা থেকে কয়েক শ’ মাইল দূরে পূর্ব বাংলার সজল শ্যামল ভুবনটিতে সমস্ত কিছুই আশ্চর্য রকমের সুলভ। এত প্রাচুর্য এমন সুলভতা। আগে আর কখনও দেখেন নি অবনীমোহন। জীবনে এ এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা তাঁর।

এদিকে খিদেটা অনেকক্ষণ আগেই পেয়েছিল বিনুর। অবনীমোহনের পিছু পিছু ঘুরতে ঘুরতে পেটের ভেতরটা জ্বালা করছে। আর চলতে পারছিল না সে। তাকে খাওয়ানো এবং হেমনাথকে খুঁজে বার করবার জন্যই লারমোরের কাছ থেকে উঠে এসেছিলেন অবনীমোহন। জিনিসপত্রের দর করতে করতে এমন মজা পেয়ে গেছেন যে সে কথা খুব সম্ভব আর মনে নেই তার।

একসময় বিনু আস্তে করে ডাকল, বাবা–

অবনীমোহন চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়লেন। পেছন ফিরে বললেন, কী রে?

বড্ড খিদে পেয়েছে।

এবার মনে পড়ে গেল অবনীমোহনের। খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি, হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো। আমি একদম ভুলে গেছলাম। বলেই যুগলের দিকে তাকালেন, মিষ্টির দোকান কোথায় রে?

নদীর দিকে আঙুল বাড়িয়ে যুগল বলল, উই দিকে—

নিয়ে চল তো।

নদীর শিয়রে যেখানে মাঝিঘাট, তার একধারে সারি সারি হোগলার ছাউনিওলা অস্থায়ী মিষ্টির দোকান। পেতলের গামলা ভর্তি ধবধবে রসগোল্লা, বড় বড় কাঠের বারকোশে লম্বা লম্বা বাদামী চমচম, পাতক্ষীর আর মাখা সন্দেশ সাজানো রয়েছে। প্রথম দিন পূর্ব বাংলার মাটিতে পা দিয়ে রাজদিয়ার স্টিমারঘাটে এই রকম মিষ্টির দোকান দেখেছিল বিনু।

কাছাকাছি আসতে চারদিক থেকে দোকানিরা ডাকাডাকি করতে লাগল, এই দিকে আসেন বাবু, এই দিকে–

সামনে যে দোকানটা পাওয়া গেল, বিনুদের নিয়ে অবনীমোহন সেখানেই ঢুকে পড়লেন।

দোকানি লোকটা মধ্যবয়সী। পরনে আধময়লা খাটো ধুতি আর ফতুয়া। গলায় তিন লহর তুলসীর মালা। চোখে মুখে বিনীত ভঙ্গি। সে বলল, বসেন বাবুরা, বসেন–

দোকানের ভেতরে দু’খানা বেঞ্চি পাতা ছিল। অবনীমোহনরা বসলেন।

দোকানি এবার শুধলো, কী দিমু বাবু?

অবনীমোহন বিনু আর যুগলের দিকে তাকালেন, কী খাবি রে তোরা?

বিনু কিছু বলবার আগেই যুগল তার কানে ফিসফিস করল, তমস্ত দিন রৈদে (রোদে) ঘুরাঘুরি গ্যাছে ছুটোবাবু। রসগোল্লা পানিতুয়া খাওনের আগে ইট্টু মাঠা খাইয়া লন।

অবনীমোহন শুনে ফেলেছিলেন। বললেন, মাঠা কী?

যুগল লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকল। বিনুকে বলেছে বটে, তার নিজের মনেও কি মাঠার জন্য একটু লোভ ছিল না?

যুগলের হয়ে দোকানিই জবাব দিল, মাঠা হইল দইয়ের ঘোল।

অবনীমোহন উৎসাহিত হলেন, হ্যাঁ, আগে মাঠাই দাও–

খুব ভাল করে তিনটে বড় বড় কাঁচের গেলাস ধুয়ে ননীভরা সাদা ধবধবে ঘোলে ভর্তি করল দোকানি। বিনুদের দিতে দিতে বলল, খান বাবুরা, পরে মাখম দিমু।

ঘোলের গেলাস শূন্য হয়ে গেলে দোকানদার কলার পাতায় করে সবার হাতে এক দলা করে মাখন দিল।

অবনীমোহন বললেন, আবার মাখন কেন? মিষ্টিই তো খাব—

মাঠা আর মাখম আমরা একক্লগেই দেই। হের লেইগা পহা লাগে না।

মাঠা-মাখনের পর কিছু রসগোল্লা আর চমচম নিলেন অবনীমোহনরা। দু’একটা খাওয়া হলে দোকানি শুধলো, মিঠাই ক্যামন লাগল বাবু?

অবনীমোহন বললেন, চমৎকার। তোমার দোকান কতদিনের?

অনেক বচ্ছরের। জ্ঞান হওয়া ইস্তক এই কামই করতে আছি। এইটা আমাগো জাইত-ব্যবসা।

সুজনগঞ্জের হাটেই দোকানদারি কর? আইজ্ঞা না। দোকানি হাসল, হপ্তায় তো এইখানে মোটে তিনদিন হাট। তিনদিনের বিকিকিনিতে কি সোংসার চলে বাবু?

তবে?

আইজ সুজনগুঞ্জ, কাইল গিরিগুঞ্জ–এইভাবে হপ্তায় হগল দিনই কুনোখানে না কুনোখানে হাট থাকে। নানান খানে ঘুইরা দোকানপাতি করি।

অবনীমোহন বললেন, এই সব মিষ্টি কোথায় তৈরি করেছ? এখানে তো কোনওরকম সরঞ্জাম দেখতে পাচ্ছি না।

দোকানি বলল, মিঠাই বানাই বাড়িতে। হাট থিকা রাইতে বাড়ি গিয়া বানাইতে বসি। পরের দিন সকালে হেই হগল নায়ে তুইলা হাটে যাই।

অবনীমোহনের মনে হল, এই সুলভ প্রাচুর্যের দেশেও কারোর কারোর জীবনযাত্রা রীতিমতো কষ্টকর। তিনি বললেন, দিনরাত্রি তোমাকে তো বেশ খাটতে হয়।

হ বাবু– দোকনদার হাসল, না খাটলে প্যাট চলব ক্যামনে?

একটু চুপ করে থেকে অবনীমোহন বললেন, তা তো ঠিকই।

খাওয়া হলে লারমোর আর হেমনাথের জন্য দু’টো ছোট মাটির হাঁড়িতে মিষ্টি নিলেন অবনীমোহন। হাঁড়ি দু’টো যুগলের হাতে দিয়ে দাম মিটিয়ে দিতে দিতে বললেন, আলাপ টালাপ হল, তোমার নামটাই জানা হয় নি।

দোকানি বলল, আমার নাম হারান ঘোষ। হাটে আইলে আমার দোকানে আবার আইবেন বাবু।

আসব।

পন্নাম বাবু–

নমস্কার।

মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে নদীর পাড় ধরে ধরে অবনীমোহন হাঁটতে লাগলেন। বিনু দেখতে পেল, হাটের তলার সেই মাঝিঘাটের আরো অসংখ্য নৌকো এসে জমেছে। নৌকোয় নৌকোয় নদীর জল দেখা যাচ্ছে না। মাঝিঘাটের মাথায় খয়েরি রঙের চিল উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে, শয়ে শয়ে।

একটু পর নদীর পাড় থেকে হাটের ভেতর ঢুকে পড়ল সবাই। অবনীমোহন আবার দর শুরু করে দিলেন। যে জিনিসটি চোখের সামনে পড়ছে, ছেলেমানুষের মতো একবার হাতে তুলে দাম জেনে নেওয়া চাই তার।

মানুষের স্রোতে লক্ষ্যহীনের মতো কিছুক্ষণ ঘুরবার পর বিনু ডাকল, বাবা।

কী রে? অবনীমোহন অন্যমনস্কের মতো উত্তর দিলেন।

বিকেল হয়ে গেল। দাদুকে খুঁজে বার করবে না?

তাই তো। চল–চল– বলতে বলতে যুগলের দিকে ফিরলেন, হ্যাঁ রে যুগল, নিত্য দাসের দোকানটা কোন দিকে?

অখনই যাইবেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনই।

ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে বিনুদের নিয়ে নদীর আরেক ধারে এসে পড়ল যুগল। এখানে সারি সারি ধান চালের আড়ত। সেগুলোর ছাউনি মজবুত টিনের, বেড়াও টিনের, গায়ে শাল কাঠের শক্ত খিলান। রীতিমত স্থায়ী বন্দোবস্ত।

আড়তগুলো ঠিক নদীর ধার ঘেঁষে। তার ঠিক তলাতেই বড় বড় হাজারমণী পাঁচশমণী মহাজনী নৌকো অগণিত মাস্তুল আকাশের দিকে তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

দেখা গেল, একটা আড়তের সামনে খোলামেলা খানিকটা জায়গা। সেখানে বড়সড় একখানা চেয়ারে বসে আছেন হেমনাথ, আর তাকে ঘিরে অনেক মানুষ ঘন হয়ে বসে আছে। দেখেই টের পাওয়া যায়, লোকগুলো সুজনগঞ্জের দোকানি এবং আড়তদার। তাদের ভেতর গভীর কোনও পরামর্শ চলছিল।

বিনু ছুটে হেমনাথের কাছে চলে গেল। এতক্ষণ বিনুদের কথা খুব সম্ভব খেয়ালই ছিল না। একটুক্ষণ অবাক থেকে তিনি বললেন, দাদাভাই, তুই এখানে! তারপরেই বুঝিবা সব মনে পড়ে গেল, যুগল কোথায়?

বিনু দেখিয়ে দিল, ওই তো–

ঘাড় ফেরাতেই যুগলকে দেখতে পেলেন হেমনাথ। খুব রেগে দিয়ে বললেন, এই হারামজাদা, হাটে আসতে এত দেরি করলি কেন? গিয়েছিলি কোথায়?

ভয়ে ভয়ে যুগল বলল, ছুটোবাবুরে নিয়া আমি তো অনেকক্ষণ আইছি।

অনেকক্ষণ এসেছিস তো, ছিলি কোথায়?

কোথায় ছিল, যুগল বলল।

এবার অবনীমোহনের দিকে চোখ পড়ল হেমনাথের। বললেন, যুগল সত্যি কথা বলছে অবনী?

আজ্ঞে হ্যাঁ–অবনীমোহন মাথা নাড়লেন। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে এলেন।

যে লোকগুলো হেমনাথকে ঘিরে বসে ছিল, অবনীমোহনদের দেখে তারা কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। মুখে অবশ্য কিছু বলছে না, দৃষ্টি কিন্তু অত্যন্ত উৎসুক। হেমনাথ তাদের মনের কথা যেন পড়তে। পারলেন। বললেন, এরা আমার জামাই আর নাতি। দিন দুই হল কলকাতা থেকে এসেছে।

বলার সঙ্গে সঙ্গে দু’খানা চেয়ার এসে গেল। বিনু আর অবনীমোহন বসলেন। রাজদিয়ায় পা দেবার পর থেকে যে যত্ন, যে সমাদর আর মর্যাদা পেয়ে আসছেন, এখানেও তাই পেলেন অবনীমোহনরা। সেই এক মনোরম অভিজ্ঞতা।

সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর হেমনাথ অবনীমোহনকে বললেন, তোমরা একটু বসো অবনী। এদের সঙ্গে একটা কথা হচ্ছিল, সেটা সেরে নিই।

অবনীমোহন বললেন, আচ্ছা–

হেমনাথ এবার চারধারের লোকগুলোর দিকে তাকালেন, তা হলে ওই কথাই পাকা তো?

সবাই সমস্বরে বলল, নিয্যস পাকা। আপনে যা কইবেন বড়কত্তা, তার উপুর কুন শালায় রাও (শব্দ) করব?

হেমনাথ বললেন, না না, যদি কোনওরকম আপত্তি বা অনিচ্ছা থাকে, নিশ্চয়ই বলবে। এখন আরেক বার সবাই শুনে নাও। হাটের পুজোয় আড়তদারেরা পাঁচ টাকা করে চাঁদা দেবে, আর দোকানিরা দেবে আট আনা করে। চাঁদা তুলবার ভার নেবে হরিপদ মহেন্দ্র প্রাণবল্লভ নিবারণ বিনোদ–এই পাঁচজন। কে কী করবে তা ঠিক করে দেবে নিত্য দাস।

সকলে মাথা পাড়ল, হ হ, এইর থিকা ভাল ব্যবোস্তা আর কিছু হয় না।

হেমনাথ বললেন, ভাল করে ভেবেচিন্তে দেখ, কারোর কিছু বলবার আছে কিনা—

চারদিকের ভিড়টা হইচই করে উঠল, না, আমাগো কিছু কওয়ার নাই।

একটুক্ষণ নীরবতা। বোঝা গেল, দুর্গাপুজোর ব্যাপারে পরামর্শ-সভা বসেছে। হাটে আসার সময় এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন হেমনাথ।

এক সময় কে যেন বলে উঠল, হুদা (শুধু) দুগ্‌গা পূজাই হইব বড়কত্তা? অন্য বচ্ছরের লাখান আর কিছু হইব না?

আর কী? জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন হেমনাথ।

লোকটা বলল, দরিদ্র নারাণের স্যাবা (সেবা) করলে ক্যামন হয়?

হেমনাথ উৎসাহের সুরে বললেন, খুব ভাল কথা। পুজো হবে, ধুমধাম হবে, আর গরিবেরা দু’টো খেতে পাবে না, তাই কখনও হয়?

লোকটা বলল, চাউল ডাইল যা লাগে আমি দিমু।

হেমনাথ বললেন, তোমার উপযুক্ত কথাই বলেছ নিত্য দাস।

এই তা হলে নিত্য দাস। লোকটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ছোটখাটো মজবুত চেহারা। পরনে ধুতি আর মোটা কাপড়ের নিমা (একজাতীয় জামা)। লোকটার চোখেমুখে, সর্বাঙ্গে বিনয় এবং স্নিগ্ধতা মাখানো।

হেমনাথের কথায় কী প্রেরণা ছিল, কে জানে। আরেকটা লোক বলল, মশল্লাপাতি আর আনাজপাতির খরচ আমার।

ভিড়ের দূর প্রান্ত থেকে অন্য একজন বলে উঠল, পূজা হইব আর এক রাইত যাত্রা হইব না? হগল বারই হয় কিলাম।

হেমনাথ ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের কী মত?

সবাই বলল, অন্য অন্য বার যহন যাত্রা হয় এইবারও হইব।

বেশ।

কে একজন বলে উঠল, বরিশালের নট্ট কোম্পানির যাত্রা চাই। আর এক রাইত কবিগান।

অন্য একজন বলল, এক রাইত কাঁচ নাচ হউক—

আরেকজন বলল, এক রাইত কিলাম সারি গানও দিতে হইব বড়কত্তা–

কাজেই স্থির হল ষষ্ঠী-সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী, পর পর এই চার রাত যাত্রা কবিগান কাঁচনাচ এবং সারিগানের আসর বসবে।

শুনতে শুনতে বিনুর চোখ চকচক করতে লাগল। মনে পড়ল, যুগলও সেদিন যাত্রাপালা আর কবিগানের কথা বলেছিল। যুগল ভরসা দিয়েছিল, পুজোর সময় একদিন সুজনগঞ্জে নিয়ে আসবে। তবু দাদুকে ধরতে হবে। যাত্রা এবং কবিগানের জন্য, কাঁচনাচ আর সারিগানের জন্য সে উন্মুখ হয়ে আছে।

পুজোর ব্যাপারে কথা বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে চঞ্চল হলেন হেমনাথ। দ্রুত অবনীমোহনের দিকে ফিরে বললেন, বিনুদাদা তো সেই সকালবেলা চাট্টি খেয়ে বেরিয়েছে, তুমিও তাই। কিছু খেয়ে–

তার কথা শেষ হল না। তার আগেই অবনীমোহন বলে উঠলেন, আমরা এইমাত্র খেয়ে এসেছি। আপনার জন্যে আর লালমোহন মামার জন্যে মিষ্টি এনেছি।

হেমনাথ বললেন, আমি তো বাইরে বিশেষ খাই না। বরং লালমোহনকে পাঠিয়ে দাও–

যুগলকে দিয়ে লারমোরের কাছে মিষ্টির হাঁড়ি পাঠিয়ে দিলেন অবনীমোহন। এদিকে কে যেন বলে উঠল, আশ্বিনের অখন মাঝামাঝি, পূজা পড়ছে আটাইশ তারিখে। অখনও তো পরতিমা বানাইতে দেওয়া হইল না–

হেমনাথ বললেন, গেল বার ঠাকুর বানিয়েছিল কে?

নগা পাল।

কোন নগা? তালতলির?

হ।

লোক পাঠিয়ে নগাকে প্রতিমা বানাতে বলে দেব।

তাইলে তো খুব ভালা হয়–

আবার পুজোর কথায় মেতে উঠলেন হেমনাথ। ইতিমধ্যে লারমোরকে খাবার দিয়ে ফিরে এসেছে যুগল।

এদিকে সূর্যটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পশ্চিমের গাছগাছালির ওপারে সেটা অদৃশ্য হয়েছে। সূর্য নেই কিন্তু তার শেষ আভাটুকু এখনও চারদিক ছুঁয়ে আছে। হঠাৎলজ্জা-পাওয়া মেয়ের মুখের মতো আকাশ এখন লাল টুকটুকে। এরই মধ্যে পাখিরা অধীর হয়ে উঠেছে, ঝাঁকে ঝাঁকে তারা ঘরে ফিরে যাচ্ছে।

বেলাশেষের নিবু নিবু রক্তিম আলোর দিকে তাকিয়ে অবনীমোহন চঞ্চল হলেন। আস্তে করে ডাকলেন, মামাবাবু’ হেমনাথ তাকালে বললেন, সন্ধে হয়ে আসছে। মামীমা কী সব কিনে নিয়ে যেতে বলেছিলেন–

হঠাৎ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন হেমনাথ, ঠিক কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। বলেই ভিড়টার উদ্দেশে বললেন, আজ আর নয়। তোমার কেউ না কেউ রোজ একটা না একটা ব্যাপারে জড়াচ্ছ, আর আমার বাড়িতে প্রত্যেক দিন গৃহযুদ্ধ বাধছে।

সবাই একসঙ্গে বলল, আপনে ছাড়া আর কার কাছে যামু বড়কত্তা?

খুব হয়েছে। এখন চলি–

বিদায় নিয়ে অবনীমোহনদের সঙ্গে করে হাটের মাঝখানে চলে এলেন হেমনাথ। তারপর ঘুরে ঘুরে আনাজ কিনলেন, মশলা কিনলেন, পান-তামাক কিনলেন, ধুতি টুতি কিনলেন। মাছ কিনলেন দু’রকমের। কই আর চিতল। কই মাছ কেনার সময় একটা মজার ব্যাপার ঘটল।

হেমনাথ জেলেকে বললেন, তিন বাইশা কই দে—

বিনু শুধলো, বাইশা কি দাদু?

বাইশা মানে বাইশ।

কিন্তু দেখা গেল বাইশের বদলে জেলেটা তিন বার ছাব্বিশটা করে মাছ দিল। বিনু চেঁচিয়ে উঠল, দাদু লোকটা বেশি মাছ দিয়েছে—

হেমনাথ হাসলেন, বাইশার মানে যদিও বাইশ, তবু ছাব্বিশটা করে দেওয়া এদেশে নিয়ম।

কথাটা মনঃপূত হল না বিনুর। বাইশের জায়গায় কেন ছাব্বিশটা মাছ দেবে, সে ভেবে পেল না।

মাছটাছ কেনা হলে সুজনগঞ্জের আরেক প্রান্তে নৌকোহাটে এলেন হেমনাথরা। বিভিন্ন চেহারা আর নামের নতুন নতুন অগণিত নৌকোর মেলা বসেছে যেন এখানে।

দেখে শুনে বিনুর পছন্দমতো একখানা নৌকো কিনলেন হেমনাথ। নৌকোটা একমাল্লাই এবং ছইওলা। সঙ্গে একটা বৈঠা আর তল্লা বাঁশের লগি পাওয়া গেল।

নৌকোর দাম চুকিয়ে হেমনাথ যুগলকে বললেন, তুই নৌকোটা নিয়ে নদী ঘুরে মাঝিঘাটে আয়। আমরা লালমোহনকে নিয়ে আসছি।

হাটের সত্তা নিয়ে যুগল নতুন নৌকোয় উঠল। আর অবনীমোহনদের নিয়ে সেই বটগাছটার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন হেমনাথ।

অশ্বিনের সন্ধেটা যেন সরু সুতোয় ঝুলছিল। কেনাকাটা সেরে লারমোরের কাছে পৌঁছতে সুতোটা ছিঁড়ে ঝপ করে কোন পাতালে নেমে গেল।

হাটের চালায় চালায় বিকিকিনি বন্ধ হয়ে গেছে। সারা সুজনগঞ্জ জুড়ে এখন ভাঙা আসর। দরাদরি চিৎকারের সেই একটানা ভনভনে আওয়াজটাও নেই। তার বদলে মৃদু, অবসন্ন একটা গুঞ্জন চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সারাদিন ধরে এখানকার সুর যেন খুব চড়া একটা তারে বাঁধা ছিল। অন্ধকার নামবার সঙ্গে সঙ্গে সেটা দ্রুত স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে।

হাটুরে লোকগুলো বেশির ভাগই মাঝিঘাটে চলে গেছে। এখানে সেখানে দুচারজন ব্যাপারি কুপি জুলিয়ে পয়সা গুনছে। সারাদিনের বেচাকেনার হিসেব মিলিয়ে নিচ্ছে।

বটগাছতলায় এসে দেখা গেল, একটা রোগীও নেই। সেই মাঝিদু’টোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে লারমোর টিনের বাক্স গুছোচ্ছেন।

হেমনাথ বললেন, সমস্ত দিন বনের মোষ তাড়ানো হল?

লারমোর হাসলেন, তা একরকম হল। তোমার ঘোড়ার ঘাস কাটার খবর বল

হেমনাথ হো হো করে মনের সব কটি দরজা জানালা খুলে হেসে উঠলেন, ঘোড়ার ঘাস কাটা। বেড়ে বলেছ। বলেই হঠাৎ হাসি থামিয়ে গভীর স্বরে বললেন, কিন্তু সত্যিই কি আমরা ঘোড়ার ঘাস কাটি, বনের মোষ তাড়াই লালমোহন?

হেমনাথের কণ্ঠস্বরের গভীরতা লারমোরকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, না। একটু চুপচাপ। হেমনাথ বললেন, নাও, এখন চল–

যাবে তো, বৌঠাকরুন যা যা বলে দিয়েছিল, কিনেছ? নইলে অবার হোম ফ্রন্টে লড়াই বেধে যাবে।

কিনেছি কিনেছি। যুগলকে দিয়ে সে সব মাঝিঘাটে পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমার চিন্তা করতে হবে। এখন চল।

মাঝিঘাটে এসে মুগ্ধ হয়ে গেল বিনু। নৌকোয় নৌকোয় আলো জ্বলছে। নদীর জলে সেই আলো পড়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে।

মাঝিঘাটে এখন ঘরে ফেরার তাড়া। একের পর এক নৌকো ছেড়ে দিচ্ছে। কাছে দূরে যেদিকে যতদূর চোখ যায়, শুধু আলোর বিন্দু। ওগুলো যে নৌকোর আলো, বিনু জানে। তবু মনে হয় ওরা যেন রহস্যময় কোনও সংকেত, নদীময় ছোটাছুটি করে কাদের যেন বিভ্রান্ত করে চলেছে।

যে নৌকোগুলো এখনও রয়েছে তাদের কোনওটা থেকে মাছের ঝোলের উগ্র গন্ধ ভেসে আসছে, কোনওটা থেকে আসছে শান্ত নামাজের সুর, কোনওটা থেকে খোল-করতাল বাজিয়ে কীর্তনের পদ। ওরা বোধহয় আজ সুজনগঞ্জেই থেকে যাবে।

হেমনাথ খুঁজে খুঁজে যুগলকে বার করলেন। দেখা গেল বুদ্ধি করে নতুন একমাল্লাই নৌকা, নিজের ছোট কোষা নৌকো আর লারমোরের নৌকো–তিনটেকে পাশাপাশি এনে রেখেছে সে। অসংখ্য নৌকোর জঙ্গল থেকে কী করে যে লারমোরের নৌকোটাকে যুগল খুঁজে বার করল, কে বলবে।

নৌকো তিনটে, বাইবার লোকও মোট তিনজন। যুগল আর লারমোরের সেই মাঝি দুটো। স্থির হল, তিনজন তিনটে নৌকো বাইবে। যুগল বাইবে নিজের সেই কোষা নৌকোটা, মাঝি দু’জন বাকি নৌকো দুটো।

বিনুর ইচ্ছে ছিল, ওবেলার মতো এবারও যুগলের নৌকোতেই যায়। সে কথা বলতেই হেমনাথ মাথা নাড়লেন, উঁহু। রাত্তিরবেলা ওই বাঁদরের সঙ্গে নৌকোয় যেতে হবে না।

বিনুর মনে হল, হেমনাথের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু আছে যা অমান্য করা যায় না। হেমনাথ আবার বললেন, এই, সবাই উঠে পড়।

লারমোরের সেই নৌকোটায় একে একে সকলে উঠতে যাবে সেই সময় চিৎকার শোনা গেল, লালমোহন সাহেব–লালমোহন সাহেব–

সবাই চকিত হয়ে ফিরে দাঁড়াতেই দেখা গেল, তিন চারটি মুসলমান চাষী ছুটে আসছে। তাদের একেবারে সামনে যে রয়েছে তার বয়স কম–যুবক। ছুটতে ছুটতে এসে লারমোরের পায়ের কাছে। সে আছড়ে পড়ল,  বাঁচান আমার বাজানরে,  বাঁচান সাহেব–

বিব্রতভাবে লারমোর বললেন, কে রে, কে?

আমি আপনেগো গহরালি—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *