১.১৬-২০ মানিকতলার নীলু দত্ত

১.১৬ মানিকতলার নীলু দত্ত

পাড়াপড়শীরা বলে, ব্যাপার কি হে নীলু দত্ত, হাতের আঙুল দিয়ে এক ফোঁটা জল গলে না, আর অতবড় বাডিটা সাহেবকে বিনা ভাড়ায় থাকতে দিলে, বলি মতলবটা কি?

নীলু দত্ত লোকটা স্বল্পভাষী, আর অধিকাংশ স্বল্পভাষী লোকের মত আত্মগোপনপ্রয়াসী। অনেকের অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর একদিন উত্তর দিল, আরে ভাই, একে বিদেশী তাতে আবার গরিব পাদ্রী, না হয় দিলাম দুদিন থাকতে, পড়েই আছে তো বাড়িটা।

পড়শীরা বলে, ওহে দত্ত, অনেক মোহর পড়েই তো আছে তোমার সিন্দুকে, কই দাও দেখি দুদিনের জন্যে আমাদের?

তাদের কথা শুনে নীল নীরবে হাসে।

নীলু দত্ত হঠাৎ-ধনী। কোম্পানির প্রথম আমলে ব্যবসা করে হঠাৎ কিছু টাকা করে ফেলে। ঐটুকুতে তার শ্রম ও বুদ্ধির আবশ্যক হয়েছিল। তার পর সে রইল, নিষ্ক্রিয়, তার টাকা হয়ে উঠল সক্রিয়। নদীস্রোত ও টাকার স্রোত একই নিয়মের অধীন। গোড়ায় মূল গতিবেগটা একবার সঞ্চার করে দিতে পারলে নিত্য নূতন ধারা সংগ্রহ করে নিয়ে বর্ধিততর বেগে স্ফীততর দেহে চলতে থাকে নদী ও অর্থপ্রবাহ। নীলু দত্ত একসময়ে দেখতে পায় যে তার সাধের তরণী স্রোতের প্রবল ঠেলায় কখন অজ্ঞাতসারে সার্থকতার সমুদ্রসঙ্গমে উপনীতপ্রায়। পাড়ার সকলে বলাবলি করে, এবারে একটা ডুব দিয়ে উঠলেই নীলু দত্তর জীবন্মুক্তি। এমন অবস্থায় মাথা ঘূর্ণিত হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু এক্ষেত্রে তেমন অঘটন ঘটল না, নীলু দত্ত তৃণাদপি সুনীচ হয়েই থাকল। এখন তার একমাত্র খেদ এই যে, তার অর্থ আছে অথচ কৌলীন্য নেই; ঐ যে ঘোষেদের বাড়ির ইটগুলো খসে পড়েছে, ওর কৌলীন্য নীলুর চেয়ে অনেক বেশি। তখন সে কৌলীন্য সংগ্রহে মনোনিবেশ করল। তখনকার দিনে সাহেব-সান্নিধ্য ছিল কৌলীন্য অর্জনের সহজতম পন্থা লোক বলত, যেমন তেমন সাহেব লাট সাহেব। তাই রাম বসু কেরীকে আশ্রয় দানের প্রস্তাব করবামাত্র লাফিয়ে উঠে সে রাজী হল।

একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হিদেন জাতিকে আলোকদানের আশায় সপরিবারে কেরী কলকাতায় আসেন, আদর্শের আতিশয্যে পূর্বাপর ভালরূপে চিন্তা করবার সুযোগ পান নি, সঙ্গে ছিল ভাববাতিকগ্রস্ত টমাসের প্ররোচনা। টমাস তাকে বুঝিয়েছিল গ্রাসাচ্ছাদন ও আশ্রয়ের চিন্তা করবার প্রয়োজন নেই, জাহাজঘাটাতে উপস্থিত হলেই দেখতে পাবে যে হাজার হাজার হিদেন নরনারী তোমার মত ‘প্রেরিত পুরুষ’কে মাথায় বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। বলা বাহুল্য, কেরীর এ কয়দিনের অভিজ্ঞতায় টমাসের উক্তি সমর্থিত হয় নি। কেরী দেখল যে এই বৃহৎ নগরে আলোপ্রাপ্তচ্ছু ‘হিদেন’ যদি কেউ বা থাকে তবে সে এখনও পর্যন্ত একান্ত গোপনেই আছে। আর, আশ্রয়? সে তো দিয়েছে জর্জ স্মিথ। কিন্তু এখানে তো অনির্দিষ্টকাল থাকা চলে না। তার উপরে কেটির অন্তর্ধান, ডরোথির উন্মাদবৎ অবস্থা কেরীকে আরও বিব্রত করে তুলল। সে স্থির করল অবিলম্বে অন্যত্র যাওয়া কর্তব্য। তাই রাম বসু নীলু দত্তর বাড়িতে গিয়ে বাস করবার প্রস্তাব করামাত্র কেরী সম্মত হল। কেরী মনে মনে আয়ের দিকটা হিসাব করে দেখতে পেল হাতে আহে কেটারিঙের মিশন কর্তৃক স্বীকৃত মাসোহারা ষাট টাকা, দি হোলি বাইবেল ও মনের অদম্য আকাঙ্ক্ষা। আর ব্যয়ের দিকটা হিসাব কবে দেখল—নিত্য ও নৈমিত্তিক অসংখ্যপ্রকার খরচ। তদুপরি ডরোথির হিস্টিরিয়া আর টমাসের অব্যবস্থিতচিত্ততা। এবম্প্রকার বাজেট সন্দর্শনে সাধারণ লোকের মূহ যাওয়ার কথা। কিন্তু একথা একশ বার স্বীকার্য যে, কেরী সাধারণ লোক ছিল না। সে ঈষৎ কুণ্ঠার সঙ্গে বাড়ি-ভাড়ার প্রসঙ্গ তুলতেই রাম বসু বলে উঠল—ও কথা মুখে আনবেন না, ‘ডোন্ট ব্রিং টু মাউথ।’

সে জানাল নীলু দত্ত একজন ভক্ত লোক।

কিন্তু সে ত হিদেন।

রাম বসু বলল, হিদেন হলে কি হয়, মনে মনে খাঁটি খ্রীষ্টান। কৃষ্ণ কৃষ্ণ জপ করতে করতে খ্রীষ্ট খ্রীষ্ট বলে ফেলে। ডাঃ কেরী, আপনার শুভাগমন সংবাদ আমার মুখে শুনে বলল,ভায়া, পাদ্রী-বাবাকে বল যে, দয়া করে এসে আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো অর্থাৎ ‘ডাস্ট অব দি ফীট’ দিয়ে বাস করুন।

তার পর সে বলল, এখন তার বাড়িতে গিয়ে বাস না করলে খুব দুর্নাম, কি ্না ব্যাড নেম হবে। যে-সব হিদেন এখন কৃষ্ণ বলতে খ্রীষ্ট বলে ফেলে তাদের সবারই আবার কৃষ্ণপ্রাপ্তি ঘটবে। ওখানে যেতেই হবে।

কেরী দেখল এমন অনুনয়ের পরে রাজী না হবার আর কারণ থাকতে পারে না। পরদিন কেরী ও টমাসকে নিয়ে রাম বসু নীলু দত্তর মানিকতলার বাড়ি দেখিয়ে আনল। মারহাট্টা খালের ঠিক ধারেই বাড়িটি বেশ বড়, ভিতরে অনেকটা জায়গা, কেরীর পছন্দ হল।

রাম বসু ভাবে, এবার কেরীকে শক্ত করে বাঁধা গেল, এমন সুন্দর বৃহৎ বাড়ি ছেড়ে আর সে অনিশ্চয়ের মুখে ভাসবে না, আর জালি বোটের মত তাকেও পিছনে পিছনে ভেসে চলতে হবে না। সে আরও ভাবে যে, এ হল ভাল, কলকাতাতেও থাকা হবে আবার মাসিক কুড়ি টাকা বেতনও মিলবে। গাছের ও তলার ফল দুই-ই হবে তার করায়ত্ত। ভয় ছিল তার কেরীকে, এ কয়দিনেই বুঝেছিল যে কেরী ও টমাস এক উপাদানে গঠিত নয়। টমাস যত শক্তই হক, তবু ধাতুময়, আঘাতে বাঁকে, উত্তাপে গলে, কিন্তু কেরী গঠিত নিরেট পাথরে, আঘাতে ভাঙতে পারে কিন্তু উত্তাপে গলবার নয়। সেই কেরী এত সহজে স্থায়ী হল দেখে সে নিশ্চিত হল, চিন্তা ছিল না টমাসের জন্য, কারণ তাকে আগেই বেঁধে ফেলেছিল।

.

সেদিনটা ছিল রবিবার। সেন্ট জত্ন গির্জায় উপাসনায় যোগ দিয়ে টমাসের ফিরতে প্রায় মধ্যাহ্ন হয়েছিল। বাড়ি এসে দেখে রাম বসু অপেক্ষা করছে। কি ব্যাপার?

একবার দেখা করতে এলাম।

বেশ বেশ, চল না আজ সন্ধ্যায় শহরটা একবার ঘুরে দেখে আসি।

শহরটা বলতে কতখানি কি বোঝায় জানবার উদ্দেশ্যে বসু বলে ওঠে, অমনি ডাঃ কেরীকে সঙ্গে নিলে হত না?

টমাস শিউরে উঠে বলে, আরে না না, তাকে আর বিরক্ত করা কেন, তুমি আমি দুজনেই যথেষ্ট।

বসুজা খেলোয়াড় লোক, মরা পাখীকে খেলিয়ে তবে আয়ত্ত করে। বলে, বেশ বেশ, চলুন শহরের গির্জাগুলো দেখে আসি, দেখলেও মনটা পবিত্র হয়।

বসু তুমিও দেখছি ধর্মবাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়লে। দেখ, ধর্ম খুব উত্তম, কিন্তু জীবনের অন্য অঙ্গও তো নিন্দনীয় নয়।

বসু নিতান্ত জিজ্ঞাসুর মত শুধায়, এবিষয়ে প্রভু যীশুখ্রীষ্ট কি বলেন?

“Give unto Caesar what is Caesar’s”, তবে দেখেছ যে, সীজারের সম্পত্তি প্রভু অস্বীকার করেন না।

রাম বসু ছাড়ে না; বলে, প্রভু স্বীকার করলেও ডাঃ কেরী বোধ হয় স্বীকার করবেন না।

আরে তাকে একসঙ্গে ধর্মের শেয়ালে আর জ্ঞানের বাঘে আক্রমণ করেছে। শেয়ালের হাত থেকে যদি রক্ষা করা যায়, বাঘের হাত থেকে রক্ষা করবে কে? সারাদিন অভিধান ব্যাকরণ প্রভৃতি নিয়ে মশগুল হয়ে পড়ে আছে। সারাদিন কি ঐ সব ভাল লাগে, তুমিই বল না। মানুষেরা তো একটু ফুর্তি করতেও চায়।

চাই বই কি ডাঃ টমাস।

তবে চল আজ সন্ধ্যায় ঘুরে আসা যাক।

.

সন্ধ্যাবেলা রাম বসু টমাসকে এক জুয়ার আড্ডায় নিয়ে গেল। দুজনে যখন বেরিয়ে এল—টমাস একেবারে গজভুক্তকপিখবৎ শূন্য।

টমাস কপাল চাপড়ে বলে উঠল-বসু, আমি নিঃস্ব হলাম।

বসু বলল, ক্ষতি কি! স্বয়ং প্রভু যে নির্দেশ দিয়েছেন—”Give unto Caesar what is Caesar’s!” ও ছাই গিয়েছে ভালই হয়েছে।

টমাস প্রভুর নির্দেশনায় খুব বেশি সান্ত্বনা পায় না। বলে, প্রভুর পক্ষে বলা সহজ, তিনি ছিলেন সন্ন্যাসী, আমি যে গৃহী।

গৃহ নেই, গৃহিণী নেই; কেমন গৃহী?

বসু, গৃহ আর গৃহিণী দুই-ই মনে, চালচুলো না থাকলেও, জরু গরু না থাকলেও অধিকাংশ মানুষই গৃহী।

তার পরে একটু থেমে থেকে শুধায়, তোমার জানা কোন money-lender আছে?

রাম বসুর মধ্যস্থতায় গঙ্গারাম সবকাব মাত্র শতকরা পঁচিশ টাকা সুদে টমাসকে টাকা ধার দেয়। সে আভূমিনত সেলাম করে জানায় যে, সরকারী কর্মচারী হলে সুদটা কিছু কম হত, কিন্তু

কিন্তু, বলে টমাস, আমরা যে আরও বড় সরকারের কর্মচারী, পাদ্রী, প্রভুর প্রেরিত–

এবারে গঙ্গারাম আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা নমস্কার করে, বোধ করি পূর্বোক্ত প্রভুর উদ্দেশেই, তার পরে বলে, পাদ্রী সাহেবের কথা যথার্থ, কিন্তু কি জানেন, এসব বৈষয়িক ব্যাপারে প্রভুর কর্মচারীর চেয়ে কোম্পানির কর্মচারীর গুরুত্ব বেশি।

তার পর টমাসকে খুশি করবার আশায় বলে, কোনরকম জামিন না রেখে যে আপনাকে টাকা দিলাম, তার কারণ আপনার সাদা চামড়া।

রাম বসু বলে, ওর চেয়ে বড় জামিন আর কি হতে পারে, এটা যে আস্ত একটা রুপোর খনি, কি না silver mine।

টমাসের ধারণা হল যে, মস্ত একটা রসিকতা হয়ে গেল, তাই একবার হাসবার চেষ্টা করল, কিন্তু শতকরা পঁচিশ টাকা মনের মধ্যে খোঁচা দিতে থাকায় হাসিটি তেমন প্রকট হল না।

একটিমাত্র শর্ত রইল যে, টাকা শোধ না হওয়া পর্যন্ত টমাস কলকাতা ছাড়তে পারবে না।

সেকালে ইংরেজরা, বিশেষ কোম্পানির ইংরেজ চাকরেরা দেশী মহাজনদের কাছে এমনভাবে বাঁধা পড়ত যে, তাদের নড়বার-চড়বার শক্তি থাকত না। নবাগত তরুণ writer (পরবতীকালের সিভিলিয়ান)-গণ পিতৃশাসনের কৃপোদক থেকে এখানে এসে পড়ত যথেচ্ছাচারিতার মহাসমুদ্রে, এদেশের মাটিতে পা দিয়েই উচ্ছলতার চৌঘুড়ি হাঁকাতে শুরু করত। কিন্তু টাকা? কোম্পানির তনখায় গ্রাসাচ্ছাদন চলাই দায়, অতিরিক্ত খরচ যোগায় কে? যোগাত এইসব মহাজন। কিন্তু মহাজনদের টাকা শুধত কে? Writer গণই শুধত। কলকাতায় শিক্ষানবিশি পর্ব সমাধা করে জেলার ভার নিয়ে মফস্বলে যেতেই বেরুত তাদের অতিরিক্ত খানকতক হাত। উৎকোচ, প্রজাপীড়ন, দুর্বিচার প্রভৃতির মূল এখানে। অল্পকালের মধ্যে দেনা শোধ করে দিয়ে মহাপ্রভুরা প্রভূত অর্থ সঞ্চয় করে স্বদেশে ফিরে যেত, ভারতীয় জাদুদণ্ডের স্পর্শে জুড়িগাড়ি, বাড়িঘর, লাটঘরানা পত্নী ও পার্লামেণ্টের আসন প্রভৃতি জুটতে বিলম্ব হত না। এরাই তৎকালে ইংরেজ সমাজে ‘Nabob’ নামে পরিচিত। মুসলমানী নবাবী শাসনের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী ফিরিঙ্গি নবাব।

অবশ্য এই ক্ৰমে ব্যতিক্রম টমাস। টমাসের মত ব্যক্তি সর্বযুগে সর্বসমাজে সর্বদেশেই ব্যতিক্রম।

নীলু দত্ত বলে, ভায়া, এবারে বড় বজরাখানা ঘাটে ভিড়িয়েছি, আর ভয় নেই।

রাম বসু উত্তর দেয়, কিন্তু ঐ ডিঙি নৌকোখানাকে একেবারে অবহেলা কর না। সংসারে বজরা আর ডিঙি দুয়েরই প্রয়োজন হয়।

সে কি আর আমি জানি নে! তুমি তো তাকে এরই মধ্যে গঙ্গারামী কাছিতে বেঁধে ফেলেছ।

কিন্তু আর একটা উপরি বাঁধন দিতে দোষ কি?

কি করতে চাও শুনি।

তখন রাম বসু আরম্ভ করে, অনেককাল টমাসের সঙ্গ করছি, দেখছি যে, প্রভু যীশুখ্রীষ্টের উপরে ওর যত টান, মেরি ম্যাগলেনের উপর টান তার চেয়ে কিছু বেশি।

নীলু দত্ত শুধায়, সে বেটী আবার কে?

গোড়ায় ছিল খানকী, পরে প্রভুর কৃপায় হল মস্ত তপস্বিনী।

সব খানকীরই দেখছি এক ধারা। তা তুমি এত কথা জানলে কোথায়?

বাইবেল পড়ে। পড় পড় দত্ত মশাই, বইটা পড়। জাত যাবে না, অনেক কেচ্ছা জানতে পাবে।

এইসব কেচ্ছা আছে নাকি বইখানায়? তবে যে ধর্মগ্রন্থ তাতে আর সন্দ নেই।

ওর পুরনো অংশে অনেক লচ্ছেদার কেচ্ছা আছে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমাদের রামায়ণ-মহাভারতের কাছে কেউ নয়।

তখন নীলু দত্তের বেনিয়ান-আচ্ছাদিত লোমশ বক্ষে হঠাৎ আর্যগৌরব উদ্বেল হয়ে উঠল—সে দুই হাত মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ভায়া, ওসব আর্যঋষিদের সৃষ্টি হবে না?

তার পর একটু থেমে বলল, তা এমন একখানা ভাল বই, বাংলা তর্জমা হলে যে পড়া যেত।

সে আশা শীগগিরই মিটবে—ঐ কাজ করবে বলেই তো কেরী এ দেশে এসেছে।

বেশ বেশ, সাত-শীগগির করে ফেলুক, দুপুরবেলা পড়া যাবে। কিন্তু টমাসের কথা কি বলছিলে?

ওকে নারীঘটিত বাঁধন পরিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।

এই কথা! এ আর কঠিন কি? পরশুদিন আমার বাগানবাড়িতে নিকি বাইজীর নাচ হবে, অনেক সাহেব-সুবো আসবে। টমাসকে নিয়ে এস না।

সে কথা আভাসে একরকম তাকে জানিয়ে রেখেছি, এখন কেরী জানতে পেরে গোলমাল ঘটায়।

তা ও বেটাকেও আন না কেন?

সে বড় কঠিন ঠাই!

তবে সহজটাকেই নিয়ে এস। কিন্তু নিকির মত বনেদী বাইজী কি ঐ বুড়ো পাদ্রীর উপর নেকনজর দেবে?

রাম বসু বলে, ভয় কর না, সে কাজ আমি অন্য লোককে দিয়ে করিয়ে নেব টুশকিকে নিয়ে আসব।

নিজেদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের গৌরবে স্ফীত নীলু বলে, এবারে দেখা যাক ও বেটারাই আমাদের খিরিস্তান করে, না আমরাই ওদের জেণ্টু করি।

রাম বসু বলে, দত্তমশাই, আর দেরি করব না, তাড়াতাড়ি গিয়ে শুভ সংবাদটা টমাসকে শুনিয়ে আসি।

নীলু বলল, পরশু সন্ধ্যাবেলা, শনিবার!

রাম বসু দূর থেকে হাত নেড়ে ইশারায় জানায় যে সমস্ত তার মনে আছে।

.

১.১৭ নিকি বাইজী (?)

দোতলার হল-ঘরটায় নাচ চলছে। বারান্দার এক কোণে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নীলু দত্ত ও রাম বসু কথা বলছিল।

রাম বসু বলে, দত্তমশাই, টুশকিকে যে নিকি বলে চালিয়ে দিলে, যদি ধরা পড়ে যায়?

পাগল হলে ভায়া? মদের এমন ঢালাও বন্দোবস্ত করেছি যে টুশকি-নিকিতে তফাৎ বোঝা দূরে থাক, মোহর-সিকিতে তফাৎ করবার ক্ষমতাও আর ওদের নেই। ঐ শোন

একটা নাচের অন্তে বিজাতীয় কণ্ঠে উল্লাস-হুঙ্কার উঠল—

বেভো, ক্যাটালিনি অব দি ঈস্ট।

নীল দত্ত বলল, দেখলে তো কাঙ্খানা। ওদের কি আর হঁশ আছে! ঐ যে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে নিকি বাইজী, ব্যস, এখন যদি পাড়ার কেক্তি বুড়িও এসে নাচে তবু সে নিকি।

ব্রেভো নিকি, মাই ডারলিং।

যাক, তোমারও কম সুবিধে হয় নি। নিকি না আসাতে অনেক টাকা বেঁচে গেল।

ভায়া, সে গুড়ে বালি।

কেমন?

নিকি আসতে পারবে না শুনেই মদের বরাদ্দ বাড়িয়ে দিতে হল। নিকির রূপের অভাব মদের প্রভাবে ঢেকে দিতে হবে তো, নইলে যে বেটারা কুরুক্ষেত্র কাজ করে বসবে।

কেমন, শুনি।

আগে ভেবেছিলাম ম্যাসওয়ানস বিয়ার আনব, কোয়ার্ট বোতল সাড়ে তিন টাকা ডজন। নিকি না আসাতে স্টোনস বাস বিয়ার আনাতে হল, কোয়াট বোতল সাড়ে পাঁচ টাকা ডজন। তার পর দেখ, ন্যাশনাল মার্কা ব্রাঙি চৌদ্দ টাকা বোতলের বদলে আনতে হল বী-হাইভ বাইশ টাকা বোতল, ডেনিস মুনি চব্বিশ টাকা বোতল, হেনেসি সাতাশ টাকা বোতল। সবসুদ্ধ মিলে নিকির খরচের উপর দিয়ে গেল।

রাম বসু শুধায়, দু-এক ফোঁটা প্রসাদ পাওয়া যায় না?

পাগল হয়েছ নাকি ভায়া! তলানিযুদ্ধ না খেয়ে বেটারা যাবে না।

যাই হক, বোতল বিক্রি করেও কিছু খরচা উঠবে। বিলিতি মদের বোতলের চড়া দাম, চার টাকা ডজন।

বসু, তুমি দেখছি এতকাল সাহেবের সঙ্গ করেও এদের স্বভাব জান না।

কেন, কেন?

যাওয়ার আগে বেটারা মাতাল হয়ে বোতল নিয়ে গদাযুদ্ধ আরম্ভ করবেঝাড়লণ্ঠন ভেঙে, কৌচ-চেয়ার গুঁড়িয়ে তবে বিদায় নেবে।

তবে এই কাণ্ড ফি বছর করতে যাও কেন?

কর্মফল! পাড়ায় খাতির বাড়বে, বনেদী ধনী ঘোষেদের উপর টেক্কা দিতে হবে।

তার পর সে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে-জানাম্যধর্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ।

গীতার মহদুক্তির পটভূমিতে হলঘরের মধ্য হতে ধ্বনিত হয়

বিগিন ডারলিং বিগিন,
ক্যাটালিনি অব মাই হার্ট।

একটি মদমত্ত কণ্ঠ সুরা ও সুর-বিজড়িত স্বরে গেয়ে ওঠে–

You’re quite all right inside the bar,
But khubarder, the Caviare!

রাম বস বলে, নাঃ, একেবারে পাষণ্ড, গীতার মাহাত্ম্য বোঝে না, সব মাটি করে দিল।

নীল দত্ত বলে, গীতার মাহাত্ম না বুঝলেও মহাভারতের অমর্যাদা করবে না।

ঠিক সেই মুহূর্তেই হলঘরে হাসির খিলখিল বেলোয়ারী আওয়াজ উঠল।

নাও, ঐ বোধ হয় সভাপর্বের অভিনয় শুরু হল। এখন দুর্যোধন দুঃশাসন—এক শ ভাই মিলে এক দ্রৌপদীকে নিয়ে টানাটানি শুরু করলে এখানেই না দ্রৌপদীপতন ঘটে।

সেই আশঙ্কাতেই তো রহিমাৰিবি, হাফ কালী আর প্রমদাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।

উচ্ছ্বসিত হাসি, ঘুঙুরের রব, গেলাসের টুংটাং, মদ্যবিজড়িত প্রণয়হুঙ্কার, হিন্দী ইংরেজী গানের দু-একটা ছিন্ন কলি আসতেই থাকে।

ওরা বলে ওঠে, কেলেঙ্কারির একশেষ।

নীলু বলে, মেয়েমানুষগুলোকে খুন-জখম না করে যায়।

রাম বসু পরামর্শ দেয়, মদের এত খরচা করলে, ঐ সঙ্গে একটা ডাক্তার যদি এনে রাখতে।

তাতে মাতালের সংখ্যা আর একটা বাড়ত বই তো নয়। এর পরে মেয়েমানুষগুলোকে খেসারত দিতে হবে, তারপরে আছে কসাইটোলা বাজারের ইউনিয়ন ট্যাভানের বিল শোধ। জেরবার হয়ে গেলাম ভাই, জেরবার হয়ে গেলাম।

নিকি এলে বোধ করি এত হাঙ্গামা হত না।

নীলু বলে, কে জানে! কিন্তু সে আসবে কেন, মহারাজা নবকৃষ্ণের বাড়ির বায়না ফেলে মানিকতলার নীলু দত্তর বাড়িতে আসতে যাবে কেন? ওকথা মনে করিয়ে আর দুঃখ দিও না। ও সব থাক।

প্রসঙ্গ পালটিয়ে শুরু করে, তোমার বিলম্ব দেখে ভাবলাম যে, টমাসকে বুঝি আনতে পারলে না।

প্রায় সেই রকম ব্যাপার দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ কেরী বলে বসল, না না, টমাস গেলে চলবে কেন, আজ সন্ধ্যায় দুজনে বসব বাইবেল তর্জমা করতে। শোন একবার কথা! কেরীর কথা শুনে টমাসের তো গেল মুখ শুকিয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। তখন আমি কেরীকে লম্বা এক সেলাম করে বললাম, মানিকতলার এক মুদি খ্রীষ্টান হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তাকে জানিয়েছি যে, সাচ্চা এক পাদ্রী নিয়ে এসে প্রভু খ্রীষ্টের মহিমা শোনাব। এখন ডাঃ টমাস না গেলে লোকটা কি ভাববে! বুঝলে দত্তমশাই, আমার কথা শোনবামাত্র কেরী আর টমাসের মুখ আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পাছে বেটা কেরীও সঙ্গে আসতে চায়, টমাসকে নিয়েই দিলাম ছুট।

এখন টমাসে আর টুশকিতে ভেট করিয়ে দিতে হয়।

সেটা মহাপ্রস্থানিক পর্বের আগে—স্ত্রীপর্বে।

টুশকিকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছ তো?

টুশকিকে শেখাতে হয় না, সে তোমাকে আমাকে সকলকে শেখাতে পারে।

চল তবে একবার খানার ঘরটা দেখে আসি, সব ঠিক আছে কি না।

হাঁ, দেবতার ভোগে ত্রুটি হওয়া কিছু নয়।

দেবতাকে ভয় না করলেও চলে, এরা যে ব্ৰহ্মদত্যি, একটু কোথাও ভুলচুক হলে ঘাড় মটকে সর্বনাশ করে দেবে।

তবে এগুলোকে ডাক কেন?

লোকে বেতালসিদ্ধ হতে চায় কেন? দু

জনে খানার ব্যবস্থা পরিদর্শনের উদ্দেশে প্রস্থান করল।

সেকালে নীলু দত্তর মত অভাজনের বাড়িতে প্রচুর খানাপিনার লোভেও ইংরেজ পদার্পণ করত না। তবে এরা কারা? কলকাতার ইংরেজ সমাজের প্রত্যতম প্রান্তে কোট-প্যান্ট-হ্যাট-ধারী ইংরেজীভাষী যে এক মিশ্র ফিরিঙ্গি সমাজ গড়ে উঠেছিল—এরা তাদেরই সুযোগ্য প্রতিনিধি। ইংলভের সঙ্গে এদের অধিকাংশেরই সম্বন্ধ জনশ্রুতিযোগে। দু-চারজন খাঁটি ইংরেজও আছে। দেউলিয়া হওয়া বা ঐ-জাতীয় কারণে খাঁটি স্বদেশী সমাজে অপাঙক্তেয় হয়ে তারা এখন এদের গোষ্ঠীভুক্ত হয়েছে। টমাসকেই একমাত্র খাস ইংরেজ বলা চলে। মোট কথা, নীলু দত্ত ভারতীয় সমাজের যে-স্তরভুক্ত তার অতিথিরাও ইংরেজ সমাজে প্রায় সেই স্তরের। এইখানেই ভগবানের সমদর্শিতা। তিনি ভক্ত ও ভক্তির পাত্র এক ছাঁচে ঢালাই করে থাকেন, যাতে ভক্তির পাত্র না বলতে পারে ভক্ত পেলাম না, আবার ভক্ত না বলতে পারে ভক্তির পাত্র জুটল না। ভগবান যখন নিতান্ত কুৎসিত কালো মেয়ে গড়েন তখন সেই সঙ্গেই অনুরুপ রুচি দিয়ে একটি পুরুষ গড়তেও ভোলেন না। কেবল কালো কুৎসিত বলে কোন মেয়ের বিয়ে হল না, এমন তো শুনি নি। বাজারে টাটকা মাছ ও পচা দুই-ই আমদানি হয়, বাজার শেষ হয়ে গেলে দেখা যায়, দুই-ই উঠে গেছে। এই সব দৃষ্টান্তের পরে ভগবানকে আর কখনই একদেশদশী অপবাদ দেওয়া উচিত নয়।

গভীর রাত্রে মদোন্মত্ত নিমন্ত্রিতের দল বিদায় হয়ে গেল। বলা বাহুল্য সকলকেই লোকের সাহায্যে ঠেলেঠুলে গাড়ি, পালকি, তাঞ্জাম প্রভৃতি যানবাহনে তুলে দিতে হল। নীলু দত্ত মদের বরাদ্দ এমন সুপ্রচুর করেছিল যে ঝাড়লণ্ঠন ভাঙবার শক্তি আর তাদের অবশিষ্ট ছিল না-ভাঙাচোরার পালা গেলাস ও বোতলের উপর দিয়েই গেল। নীল বলল, মদের খরচা বাড়িয়ে ঝাড়লণ্ঠনের খরচা বাঁচালাম।

বাকি রইল কেবল টমাস—তাকে নিয়ে যাবে রাম বসু। এই ব্যবস্থার কারণ স্বতন্ত্র, আর শীঘ্রই তা প্রকাশ পেল।

হলঘরটায় একটা কৌচের উপর হেলায়িত দেহে আসীন ছিল টমাস। হঠাৎ টুশকি কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে করুণভাবে বলে উঠল—টমাস সাহেব, তুমি আমার খসম, তুমি নাকি আমাকে ছেড়ে যাবে?

টমাস এই রকম ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত ছিল না। নাচের সময়ে আর সকলের মত সে-ও টুশকিকে সুপ্রসিদ্ধ নিকি মনে করে বাহবা দিয়েছিল, ঘাঘরা-ওড়নার রহস্যাবৃত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিল, তার সুরাখলিত পা দুখানার তালে তালে নিজেকে নর্তিত করেছিল, কিন্তু সেই নিকি (?) যে তাকে হঠাৎ এমন আপন মনে করেছে তা কল্পনায় আসে নি। টুশকির কথায় হঠাৎ কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না।

টুশকি তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, তুমি চলে গেলে আমার জান বেরিয়ে যাবে, তুমি জানানা বধের পাপে পড়বে।

এবার আর কিছু না বললে চলে না, তাই টমাস বলল, না না, আমি কোথায় যাব।

টুশকি এবারে অঝোরে চোখের জল ছেড়ে দিল, বলল, মানিক আমার, মানিকতলায় থাকবে যেন, মদনমোহনতলায় আমার বাড়ি কি নেই? এস এস, আমার আর একটু কাছে এস।

এই বলে একটু টান দিতেই পাকা ফলটির মত টমাস ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল। টমাস দেখল টুশকির চোখে জল, সে তার ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, নিকি ডিয়ার, তোমার বাড়িতেই থাকবার ইচ্ছ, কিন্তু ঐ কেরীর জন্য তা সম্ভব হবে না।

কেরী তোমার কে? সেই মুখপোড়া অর্থাৎ burnt-face তোমার কে?

টুশকি রাম বসুর কৃপায় দু-চারটে ইংরেজী কথা শিখেছিল।

টুশকির প্রমাতিশয্যে টমাস এবারে ভেঙে পড়ল, রুদ্ধ আবেগে বলে উঠল, কেউ নয়, কেউ নয়, নিকি, তুমি আমার সব।

তবে তিন সত্যি কর—অর্থাৎ three truth বল যে আমাকে ছেড়ে যাবে না?

টমাস বলল, না, কখনই যাব না।

তবে চল আমার ও ঘরে।

কি কর্তব্য বুঝতে না পেরে টমাস যখন ইতস্তত করছে এমন সময়ে রহিমা বিবি ছুটে এসে বলল, এ কি তোর ব্যাভার ঘুড়ি, আমার খসমকে বাগাবার চেষ্টা করছিস!

টুশকি বলল, চালাকি রাখ। টমুকে দেখে অবধি আমি পাগল হয়েছি।

আর তোর টমু যে আমাকে দেখে অবধি পাগল হয়েছে তার খোঁজ রাখিস? নাচের সময় আমার দিকে তাকিয়ে এমনিভাবে সে চোখ মারছিল

বলে সলোল দৃষ্টি নিক্ষেপের অভিনয় করে দেখাল।

যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা বলে টুশকি মারল রহিমাকে এক ধাক্কা। তার ফলে রহিমা এসে জড়িয়ে ধরল টমাসকে। রহিমা ও টুশকির মধ্যে টমাসকে নিয়ে টানাটানির প্রতিযোগিতা পড়ে গেল।

তখন সেই বিষম সঙ্কটকালে টমাসের মনে পড়ে গেল অগতির গতি, অনাথের নাথ ভগবানকে। সে নতজানু হয়ে করজোড়ে আবৃত্তি শুরু করল-”প্রভু, আমার প্রার্থনা শ্রবণ কর; শত্রুর কবল হইতে আমার জীবন রক্ষা কর। দুষ্টের মন্ত্রণা হইতে আমাকে রক্ষা কর–অন্যায়কারিগণের আক্রমণ হইতে আমাকে রক্ষা কর।”

টমাস বাংলা ভাষাতেই আবৃত্তি করছিল, বোধ করি ‘শত্রু’ ও ‘অন্যায়কারিগণের’ মনে বিবেক জাগ্রত করবার আশাতেই।

নতজানু যুক্তকর টমাস প্রার্থনা করে, আর রহিমা ও টুশকি সেই প্রার্থনার তালে তালে তার দুই গালে চুম্বন করে—পাপের আক্রমণ ও সেই পাপনিরোধপ্রচেষ্টার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জগতের ধর্মসাহিত্যে অসম্ভব না হলেও নিতান্ত বিরল।

টমাস গল্পকণ্ঠে আবৃত্তি করে—

“তোমার ভৎসনায় তাহারা পালাইল, তোমার বজ্রের আদেশে তাহারা প্রস্থান করিল। তাহারা পাহাড়ের চূড়ায় উঠিল, তাহারা গভীর উপত্যকায় নামিয়া বিধি-নির্দিষ্ট স্থানে চলিয়া গেল।”

শেষোক্ত প্রার্থনা শুনে টুশকি বলে উঠল-দুঃখ কেন খসম আমার! আমার সঙ্গে চল—এমন পাহাড়ের চূড়া দেখাব যার চেয়ে উঁচু নেই, এমন গভীর উপত্যকা দেখাব যার চেয়ে নীচু নেই—আর সেই স্থানে নিয়ে যাব যা একমাত্র তোমার জন্যেই বিধি-নির্দিষ্ট।

কি লো হুঁড়ি, পারবি তুই?

শেষোক্ত বাক্য রহিমার উদ্দেশে।

টমাস টুশকি দুজনেই দেখল যে প্রচণ্ড হাসির আবেগে রহিমা ঘরময় লুটোচ্ছে।

টুশকি বলল, দেখলে তো টমাস সাহেব-পারবে না বলে এখন সরে পড়েছে।

বটে রে, সরে পড়েছি!

এই বলে রহিমা ওড়নাখানা কোমরে জড়িয়ে ‘রণং দেহী’ মূর্তিতে উঠে দাঁড়াল। টুশকিও পশ্চাৎপদ হবার নয়, সে-ও ওড়না কোমরে জড়িয়ে বলল, আয় দেখি।

সেই যুযুধানদ্বয়ের ভীমবল্লভ মূর্তির দিকে তাকিয়ে টমাস দেখল দুজনেই পর্বতচূড়ার অধিকারিণী। ভয়ে তার প্রাণ উড়ে গেল।

হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে মুন্সী’ ‘মুলী’ বলে রাম বসুর উদ্দেশে সবেগে প্রস্থান করল।

টুশকি ও রহিমা ‘মেরি জান, কোথায় যাও’, ‘খসম আমার, পালাও কেন’–চীৎকার করতে করতে ছুটল খলিতপদ পলায়নপর টমাসের পিছু পিছু।

নাঃ, বোসজার সঙ্গে পালিয়েছে—বলতে বলতে তারা ফিরে এল।

এবারে রহিমা শুধাল, হারে টুশকি, ব্যাপারটা কি?

রহিমা ষড়যন্ত্রের কিছু জানত না, টুশকি বুঝিয়ে বলতে সে আর এক দফা হেসে উঠল।

তার পরে শুধাল, কিন্তু সত্যি থাকবে কি? না নেশা কাটলেই সাহেবও শিকলি কাটবে?

কাটবে না বলেই মনে হচ্ছে, দেখা যাক কতদূর কি হয়।

এমন সময়ে রহিমা বিবি সবিস্ময়ে চীৎকার করে উঠল, ও আবার কি ঢং রে প্রমদা?

হাম প্রমদা নেই হ্যায়, হাম কর্নেল জবরজঙ্গ প্রিংলি সাহেব হ্যায়।

দুজনে দেখে প্রমদা কোথা থেকে একটা পুরনো জঙ্গী কোর্তা সংগ্রহ করে পরেছে, মাথায় দিয়েছে পালক-গোঁজা জঙ্গী টুপি, পরেছে আঁট প্যান্টলুন, আর মুখ রাঙিয়ে নিয়েছে সাদায়-লালে মেশাননা রঙে।

দুজনে একসঙ্গে শুধায়, ও আবার কি ছিরি।

ছিরি-বিচ্ছিরি মৎ বোল। আও বিবিলোগ, কর্নেল সাহেবকে সাথ বলডান্স করনে পডেগা।

এতক্ষণে তারা বুঝল যে আজকের পালা শেষ হয়নি, এবারে সাহেবী নাচের নকলে নাচ চলবে। এতে তারা মোেটই বিস্মিত হল না। কেননা, তখনকার দিনে বাইনাচের অন্তে সাহেব-বিবিগণ প্রস্থান করলে নর্তকীগণ নিজেদের মধ্যে সাহেবী নাচের অনুকরণ দেখিয়ে কৌতুক অনুভব করত।

প্রমদা রহিমাকে লক্ষ্য করে বলল, আও বিবি, তুমহারা সাথ ডান্স করেগা।

রহিমা বলল, তবে দাঁড়াও কর্নেল সাহেব, আমি আগে বিবি সেজে নিই।

এই বলে যথাসাধ্য ফিরিঙ্গি রমণীর সাজে সজ্জিত হয়ে সে গিয়ে দাঁড়াল প্রমদার কাছে। অমনি প্রমদা তার কোমর জড়িয়ে ধরে পূর্ণোদ্যমে ঘুরপাক খেয়ে শুরু করে দিল বলডান্সের প্রবল অনুকরণ।

তবলচি ও বাজিয়েরা অনেকক্ষণ চলে গিয়েছিল, তাই টুশকি বলে উঠল, বাজনা

হলে কি ভাই নাচ জমে!

কিন্তু শীঘ্রই সে দুঃখ দূর হল। ঘরের ভিতর কি চলছে দেখবার জন্যে চাকর বাকরের দল প্রবেশ করে সোন্নাসে চীৎকার করে উঠল-‘বাঃ বিবিসাহেব বেশ’, ‘খালা’, ‘খুবসুরত’, ‘আর ছুরি মারিসনে পাগলি’, ‘কেটে দে মা বদর বেরিয়ে যাক’!

টুশকি বললে, শুধু বাহবা দিলেই হয় না, বাজনার যোগাড় কর।

অমনি তারা হাতের কাছে যা পেল বোতল, গেলাস, প্লেট, চেয়ারের হাতল, টেবিলের পাটাতন–বাজাতে শুরু করল।

ক্রমে নাচ জমে উঠল। তখন একজন বলে উঠল, একটা গান হলে বেশ জমত।

টুশকি বলল, জমত তো গাও না কেন, মিছে ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছ কেন?

ঠিক বলেছ প্রাণ আমার! বলে সে ধরল–

“দেখো মেরি জান
কোম্পানি নিশান।
বিবি গিয়া দমদম
উড়া হ্যায় নিশান।
বড়া সাহেব ছোটা সাহেব
বাঁকা কাপতান,
দেখো মেরি জান
লিয়া হ্যায় নিশান।”

এবারে আর কোন অঙ্গের অভাব রইল না-নৃত্য, বাদ্য, গীত সবেগে সরবে সোৎসাহে চলল—মদের গন্ধ ও পোড় মোমের গন্ধে ঠাসা সেই অর্ধস্তিমিত নাচঘরের অর্ধরাত্রির প্রহরে। এখানেই এ পালার সমাপ্তি ঘটলে যথেষ্ট হল বলা চলত, কিন্তু না, কৌতুকময় জাদুকরের টুপির মধ্যে আরও কিছু কৌতুক সঞ্চিত ছিল।

ক্ষণিক নাচের বিশ্রামের অবকাশে রহিমা ও প্রমদা সাহেবী কণ্ঠের অনুকরণ শুরু করল–

আবদা পেগ লাও।
নেহি নেহি ছোটা পেগ নেহি,
বড়া পেগ।

একদম ওয়ারেন হস্তিনকা হস্তিনীকা মাফিক বড়া পেগ।

তাদের দৃষ্টান্তে সকলেই যথাসাধ্য সাহেব বিবির জীবনযাত্রার অনুকরণ শুরু করে দিল—আর প্রত্যেক উক্তির শেষে হাসির হররায় ছাদের কড়িকাঠগুলো কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

এমন সময় গর্জন উঠল-কৌন হ্যায় রে বদমাশ!

সকলে সচকিত হয়ে ভাবল, এ তো নকল সাহেবী কণ্ঠ নয়, একবারে খাঁটি বিলিতি জিনিস!

শীঘ্রই তাদের সন্দেহ সমূলে দূর করে কৌচের অন্তরাল থেকে মাথা তুলল মিঃ জনসন। হেনেসি ব্রান্ডির কৃপায় কৌচের আড়ালে ধরাশায়ী মিঃ জনসন এতক্ষণ কারও চোখে পড়ে নি।

জনসনের রসভঙ্গকর আবির্ভাবে সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে যথাসম্ভব বিনীতভাবে দাঁড়াল।

কিন্তু তাতে জনবুলী উম্মা কমবার লক্ষণ দেখা গেল না। তিন-চার বার চেষ্টার পর সে পদস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে সাচ্চা জনবুলী কণ্ঠ ও ভাষা ছুটিয়ে দিল-You bastards, you blackies, you rascals! You insult Britons! But…but–

একটা শূন্য মদের বোতল কুড়িয়ে নিয়ে ফুসফুসের তাবৎ প্রশ্বাস প্রয়োগে গর্জন করে উঠল—Rule Britannia, Britannia rules the waves!

আর সেই সঙ্গে শুন্য মদের বোতল গদার মত ঘোরাতে ঘোরাতে ব্রিটনসন্তান গণের অপমানকারীদের উদ্দেশে সে ছুটল-But, but, Britons never shall….

কিন্তু ব্রিটনগণের সঙ্কল্প প্রকাশের সুযোগ হল না, তৎপূর্বেই জনসন সশব্দে মেঝেতে পড়ল, বোতলটা শতখঙ হয়ে দর্শকদের গায়ে এসে লাগল। মহৎ সঙ্করের এমন আকস্মিক পতন কদাচিৎ দৃষ্ট হয়।

খুন হল, খুন হল-বলে সবাই হল্লা করে উঠল।

শব্দে আকৃষ্ট হয়ে নীল দত্ত ঘরে ঢুকে বলল, তাই বল, জনসন সাহেব এখানে! যাও সবাই মিলে ওকে গাড়িতে তুলে দাও, ওর কোচম্যান বড় ভাবিত হয়ে উঠেছে।

তখন নীলু দত্তর অনুচরগণ সমুদ্রশাসনদক্ষ ব্রিটন-সন্তানকে ধরাধরি করে গাড়ির উদ্দেশে নিয়ে চলল।

.

১.১৮ ডিনার ও ডুএল

কেরীদের মানিকতলার বাড়িতে যাওয়ার সঙ্কল্প জানতে পেরে জর্জ স্মিথ স্থির করল যে বিদায়ের আগে একদিন বড় রকমের একটি ভোগের অনুষ্ঠান করবে। জন ও এলিজাবেথ পিতাকে সমর্থন করল, বলল, এই উপলক্ষে আমাদের পরিবারের বন্ধু বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করা যাবে, তাদের সঙ্গে কেরী-পরিবারের পরিচয় করিয়ে দেবার এ সুযোগ ছাড়া যায় না। কাজেই পিতা পুত্র ও কন্যা তিনজনে আসন্ন ভোজের আয়োজনে লেগে গেল এবং কেরীদের কথাটা জানিয়ে দিল। কেরী বলল, আপনাদের অযাচিত বন্ধুত্বের ফলেই আমাদের বিদেশ-বাসের প্রথম পর্বটা সুসহ হয়েছে, আপনাদের কোন সঙ্কল্পে আমি বাধা দিতে চাই নে।

কিন্তু সঙ্কট বাধিয়ে দিল মিসেস কেরী। সে জেদ ধরে বসল, ভোজে কেটি ও তার স্বামীকে নিমন্ত্রণ করতে হবে।

বিস্মিত কেরী বলল, সে কি করে সম্ভব!

কেন সম্ভব নয়? ওদের তো রীতিমত বিয়ে হয়েছে। শুধু তাই নয়, মিঃ দুবোয়া খুব ভদ্রলোক, পাছে আমাদের মনে সন্দেহ থেকে যায় তাই সে বিবাহের রেজিস্ট্রিপত্রের যথাযথ নকল পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন আর তাদের অপাঙক্তেয় করে রাখবার কি কারণ থাকতে পারে?

ডরোথি, মনে রেখো যে ভোজর আয়োজন করেছে স্মিথ পরিবার। নিমন্ত্রিত বাহবার ভার তাদের উপরে, তুমি আমি পরামর্শ দেবার কে?

তুমি কেউ নও জানি, কিন্তু আমি নিশ্চয়ই পরামর্শ দেব, কারণ কেটি আমার বোন আর মিঃ দুবোয়া এখন আমার ডিয়ার ব্রাদার-ইন-ল।

কেরী মহাবিপদে পড়ল। কেটি জনকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এ তথ্য ডরোথি জানত না, আর জানলেও কিছু বুঝত কিনা সন্দেহ। তবু শেষ চেষ্টা হিসাবে বিষয়টি উত্থাপন করতেই ডরোথি কেরীর পিতামাতা সম্বন্ধে যে সব উক্তি প্রয়োগ শুরু করল তা ডরোথির মুখেও নূতন বটে। তাতেও কেরীকে নিরুত্তর দেখে শেষ অস্ত্র প্রয়োগে কৃতসর হল নরম দেখে গোটা দুই বালিস টেনে নিয়ে ডরোথি বলল, আমার গা কেমন করছে।

কেরী বলল, তুমি শান্ত হও, আমি যাচ্ছি।

ডয়োথির অভিপ্রায় কানা-ঘুষায় স্মিথ পরিবারের কানে উঠতে লিজা চাপা অর্জনে বলল, না, তা কখনও সম্ভব নয়।

পিতা একবার মেয়ের একবার পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল।

জন বলে উঠল, কেন সম্ভব নয় লিজা? ওঁরা পিতার অতিথি, ওঁদের অসম্মান হলে পিতার অপমান; নিশ্চয়ই নিমন্ত্রণ করতে হবে মি: ও মিসেস দুবোয়াকে।

কৃতজ্ঞ পিতা জনের করমর্দন করে বলল, থ্যাঙ্কস জন! ইউ আর এ ব্রেভ ফেলো।

ওদের নিমন্ত্রণ করাই স্থির হল।

লিজা চাপা স্বরে বলল, ডাইনী বুড়িটা! মরেও না!

সেকালের কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজে মোটের উপর তিনটি জাত ছিল। উৎসব ব্যসন উপলক্ষে গভর্নরের কুঠিতে যারা নিমন্ত্রণ পেত—এই বিচিত্র বর্ণাশ্রমসমাজের তারা উচ্চতম থাক। যাদের উৎসব ব্যসনের অনুষ্ঠান হত টাউন হলে অর্থাৎ মেয়রের আদালত নামে পরিচিত অট্টালিকায় তারা মাঝারি থাক। আর একেবারে নিম্নতম থাকের উৎসবাদির নির্দিষ্ট কোন স্থান ছিল না। অল্প মাশুলের কোন ট্যাভার্নে তারা মিলিত হত। সামাজিক ব্যাপারে শেষোক্তদের উচ্চতম ও মাঝারি থাকে প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। প্রয়োজন। হলে অর্থাৎ নিমন্ত্রণস্থলে এরা সামাজিক মর্যাদাহীন ধনী নেটিভদের বাড়িতেও পদার্পণ করত।

নীলু দত্তর বাগানবাড়িতে এদেরই আমরা দেখেছিলাম। উচ্চতম থাকের শ্বেতাঙ্গগণ উচ্চতম থাকের ‘নেটিভ’দের বাড়িতে যেত। ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস প্রভৃতি সকলেই মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুরের বাড়িতে পদধূলি দিয়েছে।

স্মিথ পরিবার মাঝারি থাকের শ্বেতাঙ্গ, তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবও মাঝারি থাকভুক্ত, স্মিথদের মত অধিকাংশই ব্যবসায়ী। এরাই স্মিথদের নিমন্ত্রিত।

আর নিমন্ত্রণ করে পাঠানো হল মশিয়ে ও মাদাম দুবোয়াকে। স্মিথদের আশা ছিল দুবোয়ারা আসবে না।

জর্জ বলল, তুমি চঞ্চল হয়ো না লিজি, ওরা কখনও আসবে না।

লিজা হেসে বলল, বাবা, তুমি নিতান্ত সেকেলে লোক, কিছু জান না, ওরা নিশ্চয়ই আসবে।

জন বলল, ক্ষতি কি, আসবে আশা করেই তো লোকে নিমন্ত্রণ করে।

লিজা বিরক্ত হয়ে বলল, জন, তুমি চুপ কর। একটা অপরিচিত নবাগন্তুককে নিয়ে মাতামাতি করেই তুমি এই বিপদটি বাধিয়েছ।

কন্যার অভিযোগে পুত্রের ব্যথিত মুখ দেখে পিতার কষ্ট হল, সে বলল, এ তোমার অন্যায় লিজি, কেটিকে তো মন্দ বলে মনে হয় না।

ঝাঁজিয়ে উঠে লিজা বলল, না, মন্দ বলে মনে হয় না! ও একটি চাপা শয়তান। আমি লক্ষ্য করেছি ব্রুনেট মেয়েগুলো কখখনো ভাল হয় না।

লিজা নিজে ব্লণ্ড।

অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ চাপা দেবার উদ্দেশ্যে পিতা বলল, উচিত মনে করলে আসবে, এলে আমরা শিষ্ট ব্যবহার করতে ভুলব না।

প্রসঙ্গটা এখানেই চাপা পড়ল, কিন্তু লিজা বুঝে নিল যে জনের মনে কেটির আসন আজও শূন্য হয় নি। ভাবল, এখন ভালয়-ভালয় নিমন্ত্রণ ব্যাপারটা চুকে গেলে হয়।

পুরুষের চোখ সৃষ্টি করেছেন বিধাতা বৃহৎ বস্তু দেখবার উদ্দেশ্যে, মেয়েদের চোখের সৃষ্টি সূক্ষ্ম দর্শনের নিমিত্ত। আদমের চোখ দেখেছিল আস্ত আপেল গাছটাকে, ইভের চোখ পড়ল গিয়ে কিনা তার ঐ ছোট্ট ফলটায়।

বেলা দুটোয় ডিনার। সেদিন কি-একটা ছুটি ছিল তাই ঘণ্টা-দুই আগে থেকে নিমন্ত্রিতদের অভ্যাগম শুরু হল। ক্ৰমে ফিটন, বুহাম, ব্রাউনবেরি নানা শ্রেণীর শকটে স্মিথদের বাড়ির প্রকাণ্ড হাতা ভরে উঠল। অধিকাংশই এল সস্ত্রীক, যদিচ অবিবাহিত এককের সংখ্যাও অল্প নয়। একক হক আর যুগল হক প্রত্যেকের সঙ্গে এল খানসামা, সরদার, হুঁকোবরদারের ছোট্ট একটি বাহিনী।

জর্জ, জন ও এলিজাবেথ অতিথিদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে বসাতে লাগল ড্রয়িংরুমে; তার পর চলল কেরী পরিবারের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দেবার পালা। টমাস পুরনো বাসিন্দা, প্রায় সকলেরই পরিচিত।

জন ও লিজা যথারীতি অতিথিদের পরিচর্যা করছিল বটে, কিন্তু দুজনারই মনে একটা উগ্র চিন্তা সমস্তক্ষণ ঠেলা মারছিল। সস্ত্রীক দুবোয়া কি সত্যিই আসবে? লিজা ভাবছিল ভদ্রতার খাতিরে দুবোয়া এলেও আসতে পারে, কিন্তু কেটি নিশ্চয় এমন নির্লজ হবে।

যে আসবে! জনের মনেও ঐ চিন্তা ছিল একটু ভিন্ন আকারে। যদি তারা না আসে? সেটা খুব ভাল হয়, স্বস্তি পাওয়া যায়। কিন্তু তখনই আবার কেমন একটুখানি আশাভঙ্গের খোঁচা অনুভব করে জন। সত্যি কি আসবে না? কেন, না আসবার কি কারণ? কিন্তু যদি আসে, কি রকম ব্যবহার সে করবে ওদের সঙ্গে, মানে কেটির সঙ্গে? লিজা বলেছিল যে, কেটি তার সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছে; কিন্তু সেজন্য কেটিকে দায়ী করতে জনের মন সরে না। ওর কি দোষ? লিজা বলে, কেটি সোনা ফেলে কাচ বেছে নিয়েছে। কিন্তু সংসারের সহস্র বিভ্রান্তির মধ্যে সোনা ও কাচ বাছা কি সব সময়ে সম্ভব? কেটির পক্ষে জনের ওকালতিতে লিজা রাগ করে বলে, তুমি কাপুরুষ। জন মুখে না বললেও মনে মনে ভাবে ঐ কাপুরুষের মধ্যেই যে আছে পুরুষ। পুরুষ ভালবাসতে পারে, রাগ করতে পারে, কিন্তু একবারে নির্লিপ্ত হয় কিভাবে? কেটিকে কখনও কখনও সে মনে মনে দোষ দিয়েছে বটে, কিন্তু পরমুহূর্তেই হয়েছে ঠিক উল্টো প্রতিক্রিয়া-অধিকতর আকর্ষণ অনুভব করেছে তার প্রতি। লিজা বলে, আসল দোষ কেটির—জন বলে, না, দুবোয়ার। লিজা বলে, দুবোয়ার কি দোষ? বনের মধ্যে থাকে, সাতজন্মে সাদা মেয়ে দেখতে পায় না, যেমনি কেটিকে দেখেছে টুপ করে গিলেছে—তার দোষটা কি। কিন্তু ধন্য ঐ কেটিকে, শেষে কিনা আত্মসমর্পণ করল একটা ফরাসী শয়তানের কাছে।

ফরাসী শয়তান! জন ভাবে অভিধাটা একেবারে নিরর্থক নয়, যে ব্যক্তি শত গঞ্জনাতেও রাগে না, সব অবস্থাতেই মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে পারে শয়তান ছাড়া সে আর কি? ফরাসী শয়তান আর তার গুরু ম ভলতেয়ার। ভলতেয়ারের একখানা ছবি জন দেখেছিল—মুখমণ্ডলের সমস্তটাই যেন একটা নিশ্চল বিদ্রুপের হাসি। সেই থেকে জনের মনে শয়তান ও হাসিতে একটা নিত্যসম্বন্ধ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সে ধারণা দৃঢ়তর হল দুবোয়াকে দেখে। ফরাসী শয়তান! শেষে কিনা তারই ভাগে পড়ল ঐ সোনার আপেলটা!

সোনার আপল শুনে লিজা রেগে উঠে বলে—তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। মাকাল ফল, মাকাল ফল!

না লিজা, তুমি অবিচার করছ।

এ তর্কের আর শেষ হয় না। এমন সময়ে বাইরে চাকার শব্দ শুনে উঁকি মেরে দেখেই লিজা বলে উঠল—ঐ নাও, তোমার ফরাসী শয়তান এসেছে।

জনের মুখে আশাভঙ্গের পলাতক ছায়া দেখে লিজা বাক্যটা সম্পূর্ণ করল—সঙ্গে তোমার সোনার আপেলটিও এসেছে, ভয় নেই।

আশাভঙ্গের ছায়া অপসারিত হতেই অজ্ঞাত একপ্রকার ভয়ের ছায়ায় জনের মুখ এক লহমার জন্য পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেল, কিন্তু পরমুহূর্তেই জোর করে হাসি টেনে এনে বলল, চল লিজা, অভ্যর্থনা করি গে।

লিজা বলল, চল।

জন দেখল, লিজার মুখে শিষ্ট হাসির মুখোশ। লিজা দেখল, জনের মুখেও মুখখাশখানা শিষ্ট হাসির বটে, কিন্তু দু-একটা সাচ্চা মুক্তো যেন চোখের কোণে আভাসিত।

ভাইবোন ছুটে গিয়ে দুবোয়া দম্পতিকে অভ্যর্থনা করে নামাল, বলল–আমাদের পরম সৌভাগ্য যে তোমরা এসেছ।

কেটিকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে আগাগোড়া মুখমণ্ডল সলজ্জ বিনম্র জামাতৃসুলভ হাসিতে বিমণ্ডিত করে দুবোয়া বলল, সে কি কথা। আমাদের আগেই আসা উচিত ছিল, তবে কিনা মাদাম দুবোয়াকে নিয়ে সুন্দরবনের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখাতে ব্যস্ত ছিলাম। মাদাম বনটা দেখে খুব খুশি হয়েছে, বনটির নতুন নামকরণ করেছে—ফরেস্ট অব বিউটিফুল উইমেন।

জন ও লিজা নিমেষের জন্য পরস্পরের দিকে তাকাল, তার পর একসঙ্গে কেটির দিকে। কেটি চকিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিল অন্যদিকে।

লিজাকে প্রশংসা করবার উদ্দেশ্যে দুবোয়া বলল, এখন দেখছি এ শহরটিও সুন্দর শহর হয়ে উঠেছে-টাউন অব বিউটিফুল উওম্যান।

লিজার কানের ডগা লাল হয়ে উঠল—ক্রোধে। সে ভাবল, আমি আদেখলে মেয়ে নই।

মুখ বলল, চল তোমাদের মিসেস কেরীর ঘরে নিয়ে যাই, সে খুব ব্যস্ত হয়ে অপেক্ষা করছে।

মিসেস কেরী নিজ প্রকোষ্ঠের নিভৃতে একাকী বসে প্রাকডিনার ক্ষুধোদ্রেক-চেষ্টায় খান-দুই চপ ভোজন করছিল, এমন সময়ে তাদের ঘরে ঢুকতে দেখেই ‘ও মাই ডারলিং’, ও মাই ব্রাদার-ইন-ল’ বলে সখেদে চীৎকার করে উঠে বিনা ভূমিকায় মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল।

এখন তার ঘন ঘন মূছায় আর কেউ ভয় পায় না, কেটি তো আগে থেকেই অভ্যস্ত। যথাসময়ে মুহাভঙ্গের অপেক্ষায় সকলে বসে রইল।

দুবোয়া বলে উঠল, মিসেস কেরী আমার ডিয়ার সিস্টার-ইন-ল না হলে ভাবতাম চপের ভাগ দেবার আশঙ্কাতেই মুহাটি ঘটল।

কেটি বলল, এমন করে বলা তোমার অন্যায়।

সে হেসে মৃদুস্বরে বলল, আমার সাধ্য কি এমন কৌতুকজনক সত্য কথা বলি–এ হচ্ছে গিয়ে ম ভলতেয়ারের উক্তি। তুমি নিশ্চয়ই জান তার নাম? বলে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল জনের দিকে।

দুবোয়ার গলার স্বরটি বিচিত্র, খুব দামী অথচ ব্যবহৃত রেশমের কাপড়ে বাতাস লাগলে যেমন একপ্রকার মৃদু মসৃণ শব্দ ওঠে, অনেকটা তেমনি।

মিসেস কেরীর মূছা ও মূহুভঙ্গ দুটোই সমান আকস্মিক। যেমন হঠাৎ সে মূৰ্হিত হয়ে পড়েছিল তেমনি হঠাৎ তার মূর্হভঙ্গ হল—আর উঠে বসেই দুই বাহুতে কেটি ও দুবোয়াকে জড়িয়ে ধরে গদগদ কণ্ঠে ‘মাই ডিয়ার সিস্টার’ ‘মাই ডিয়ার ব্রাদার’ বলে অবিরল অশ্রুপাত শুরু করে দিল। কেটি অপ্রস্তুতভাবে নতমুখে বসে রইল, কিন্তু দুবোয়া সংসারে অপ্রস্তুত হওয়ার জন্যে জন্মায় নি, ‘mon chere, mon chere’ বলতে বলতে সেও অশ্রুধারা খুলে দিল।

পারিবারিক অশ্লবর্ষণের মধ্যে আর থাকা উচিত নয় মনে করে জন ও লিজা সরে পড়ল। বলল, আমরা খাওয়ার ব্যবস্থা দেখি গে।

বেরিয়ে এসে লিজা বলল, জন, ওরা কি কান্নার জোলাপ খেয়েছে নাকি?

জন বলল, চল দেখি গে ওদিকের কতদূর কি হল।

.

প্রকাণ্ড ডাইনিংটেবিল ঘিরে অতিথিদের নিয়ে বৃদ্ধ জর্জ স্মিথ ভোজনে বসেছে। মিসেস কেরী দুপাশে বসিয়েহে কেটি আর দুবোয়াকে, মুহাভঙ্গে সে যে ওদের বগলদাবা করেছিল—এখনও ছাড়ে নি, মুহূর্তে অচ্ছেদ্যসঙ্গী করে তুলেছে। জজ দুপাশে কেরী ও টমাসকে নিয়ে বসল। দুবোয়া এমনি নির্লজ্জ যে জনের হাজার আপত্তি সত্ত্বেও তাকে পাকড়াও করে পাশে বসাল, বলল, মিঃ স্মিথ, তুমি হচ্ছ শুভসূচনার দূত। জনের ইহা হল তার নাকে একটা প্রবল ঘুষি বসিয়ে দেয়—কিন্তু অতিথি, তাই ‘শুভসূচনার দূত’কে স্বয়ং শয়তানের দূতের পাশে স্থান গ্রহণ করতে হল। কেটি চেষ্টা করেছিল লিজাকে পাশে বসাবে, কিন্তু সে কাজের অছিলা দেখিয়ে ছিটকে গিয়ে মেরিডিথ ও রিংলার নামে দুইজন পরিচিত বন্ধুর মাঝখানে আসন গ্রহণ করল। তার আসন-গ্রহণের তাৎপর্য অনুমান করে কেটি হাসল। লিজা মনে মনে বলল, মাদাম টাইগার, তুমি অধঃপাতে যাও। ইতিমধ্যেই সে মনে মনে সুন্দরবন-নিবাসী দুবোয়া দম্পতির নামকরণ করে ফেলেছে মশিয়ে ও মাদাম টাইগার।

কেরী বিলাতে থাকতে শুনেছিল যে গ্রীষ্মপ্রধান ভারতে শ্বেতাঙ্গদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা একবারে লোপ পায়, তারা কেবল জলবায়ু ও কৃষ্ণাঙ্গদের মঙ্গলসাধন-সঙ্কলের উপরে নির্ভর করে জীবনধারণ করে। কিন্তু এ-কয়দিন সে যা দেখেছে ও শুনেছে তাতে ঠিক পূর্বশ্রুতির সমর্থন পায় নি। আর এখন এই ভরদুপুরে গ্রীষ্মমণ্ডলের সূর্য যখন মাথার উপরে তখন এতগুলি শ্বেতাঙ্গ নরনারী টেবিলের উপরে স্থূপীকৃত আহার্য সম্বন্ধে প্রচ্ছন্ন ও প্রকট যে আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগল, তাতে কেরীর বুঝতে কষ্ট হল না যে, দ্বৈপায়ন ভ্রাতা-ভগ্নীগণের আভ্যন্তরীণ আর যে শক্তিই হ্রাস পেয়ে থাকুক জঠরেন্দ্রিয় স্ব-মাহায্যে অটুট আছে। কেরী এক নজরে টেবিলের আগাগোড়া জরিপ করে নিল-খাদ্যের বৈচিত্র্য ও পরিমাণ সত্যই বিস্ময়কর। সুপ, রোস্ট ফাউল, কারি রাইস, মটন পাই, ফোরকোয়ার্টার অব ল্যাম্ব, রাইস পুডিং, টার্ট, চীজ, টাটকা মাখন, টাটকা রুটি….

কেরী দেখল তালিকার এখানেই শেষ নয়, অজ্ঞাত ও পরিজ্ঞাতনামা বিচিত্র মৎস্য, আর সর্বোপরি প্রকাণ্ড রজতপাত্রে রক্ষিত শ্বেতাঙ্গ-সমাজের অতি প্রিয় ‘Burdwan stew” নামে খাদ্য।

আর সর্বশেষে আছে কেরী ভাবল, সর্বশেষেই বা কেন, ও বন্ধু তো আদিতে অন্তে মধ্যে, সর্বক্ষণ ও সর্বত্র আছে—উঁচু নীচু, ছোট বড়, স্থূল ও সূক্ষ্ম বিচিত্র বোতলাধারে মেডিরা, ক্যারেট, বিয়ার, বী-হাইভ ও হেনেসি ব্রাণ্ডি!

অদূরে দরজার পাশে আর একখানা ছোট টেবিলে সারিবদ্ধ সোডা-ওয়াটারের বোতল, কাছেই উদ্যত ক্ষিপ্রহস্ত চার-পাঁচজন আবদার বিখ্যাত লাল শরাব প্রস্তুত করছে। কেরী শুনেছিল যে, প্রবাস-দুঃখ ভোলবার মস্ত একটা উপায় Loll Shrub পান।

আনুষ্ঠানিক ভোজসভা কেরীর অভিজ্ঞতায় এই প্রথম। এই প্রভূত খাদ্য, অথচ খাদক মাত্র বারো-চৌদ্দজন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই যখন ক্ষীণাঙ্গী কেটিকে আড়াই পাউন্ড চপ আত্মসাৎ করতে দেখল, তখন খাদ্যের পরিণাম সম্বন্ধে তার মনে যে বৃথা দুশ্চিন্তা। দেখা দিয়েছিল, তা অপগত হল–আর সেই সঙ্গে বুঝল সুন্দরবনের জলহাওয়া স্বাস্থ্যের বিশেষ অনুকুল। কিন্তু তার সব চেয়ে বিস্ময়ের কারণ হল চাকরবাকরদের ব্যবহার। গৃহস্বামী ও অভ্যাগতদের ভৃত্যদের মিলিত সংখ্যা কম পক্ষে শতাধিক। কিন্তু এই একশ লোক কখন যে নীরবে ডাইনিং রুমে ও ডাইনিং রুমের বাইরে স্ব স্ব নির্দিষ্ট স্থান গ্রহণ করেছে, তা সে টেরও পায় নি। এমন শিক্ষা, এমন অভ্যাস, এমন কর্তব্যপরতা সৈন্যবাহিনীতেও দেখা যায় না। কেরী দেখল যে প্রত্যেক ভোস্তার পিছনে জন দুইতিন ভৃত্য দণ্ডায়মান, তন্মধ্যে একজন একখানা চামর দোলাচ্ছে—উদ্দেশ্য মক্ষিকা বিতাড়ন। মক্ষিকার অভাব হলেও প্রথারক্ষা অনিবার্য, নইলে তার চাকুরি থাকবে না।

তার পর বৃদ্ধ জর্জের ইঙ্গিতে ক্ষিপ্রহস্ত নীরবচরণ বাবুর্চির দল চঞ্চল হয়ে উঠল, আদারগণ কর্তৃক পরিবেশিত Loll Shrub বিস্ময় ও বাহবার উদ্রেক করল, আর সোডার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ফেনায়িত সুরা দর্শনে, স্পর্শনে, ঘ্রাণে ও স্বাদে পঞ্চেন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধনে লেগে গেল। সেই সঙ্গে শুরু হল কাঁটা চামচ ও ছুরির টুংটাং নিক্কণ।

দুবোয়া ও কেটির কাহিনী কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজ শুনেছিল, অতিথিরাও জানত; কাজেই সকলেই মনে মনে অস্বস্তি বোধ করছিল, ভাবছিল কথাবার্তা কোথা থেকে শুরু করা যাবে। এমন সময়ে সকলের সব সমস্যার অবসান ঘটাল স্বয়ং মশিয়ে দুবোয়া। দুবোয়া অতিশয় ধূর্ত, অল্পক্ষণের মধ্যেই অথিতিদের অসাড়তার কারণ সে বুঝে নিয়েছিল—তাই সমস্ত আবহাওয়াটাকে নাড়া দেবার উদ্দেশ্যে আরম্ভ করল–ভলতেয়ার বলে গেছেন, আবহাওয়া সৃষ্টির দুটো উদ্দেশ্য, একটা হচ্ছে জীবের প্রাণরক্ষা, আর একটা হচ্ছে সামাজিক সৌজন্য রক্ষা।

মেরিডিথ বলল, সে আবার কেমন?

আবহাওয়া তত্ত্ব দিযে কথোপকথন শুরু করা যায়।

কেউ কেউ হাসল।

মেরিডিথ আবার বলল, শুনেছি যে তোমার ম ভলতেয়ার ভগবান মানে না, তবে আবহাওয়া সৃষ্টি করল কে?

দুবোয়া দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে স্মিতবিকশিত মুখে অবাধে বলল—The other fellow!

টেবিলসুদ্ধ সবাই বিস্ময়ে ক্রোধে লজ্জায় সমস্বরে বিরক্তিসূচক অব্যক্ত ধ্বনি করল। কেরী ও টমাস বুকে ক্রস-চিহ্ন অঙ্কন করল, কেবল মিসেস কেরী বুঝে উঠল না যে ব্যাপারটা কি ঘটল—সে মূঢ়ের মত একবার দুবোয়ার একবার কেটির মুখে বৃথা অর্থ সন্ধান করে বুঝল যে এই কঠিন সমস্যার তুলনায় Burdwan stew অনেক বেশি তরল আর অনেক বেশি সুপেয়। সে বেশ খানিকটা নিজের প্লেটে ঢেলে নিল।

জর্জ স্মিথ অবাঞ্ছিত আলাপের প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে দুবোয়াকে লক্ষ্য করে বলল, ম দুবোয়া, তোমার সঙ্গে এখনও ডাঃ কেরীর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নি। ডাঃ কেরী এসেছেন এদেশে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করবার আশা নিয়ে।

উপবিষ্ট অবস্থায় যতটুকু ‘বাউ’ করা যায় তেমনি একটা ভঙ্গী কেরীর প্রতি করে দুবোয়া বলল, বিলক্ষণ। যদিও ব্যক্তিগতভাবে ডাঃ কেরীর সঙ্গে আমার এখনও আলাপ হয় নি, কিন্তু ওঁর কথা যথেষ্ট শুনেছি আর ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছি যে, খ্রীষ্টধর্ম প্রচারে ডাক্তার সফলকাম হবেন।

কেরী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাকাল দুবোয়ার দিকে। দুবোয়া নিজ উক্তির ভাষ্যস্বরুপ বলল, ডাক্তার কেরী আনীত শান্তির কপোত এসেই বাসা বেঁধেছে আমার গৃহে—এই বলে সে কেটিকে দেখিয়ে দিল।

কেটি স্বামীর বাচালতায় লজ্জিত হয়ে উঠেছিল, এবারে সে ভাব আরও ঘনীভূত হল, সে মাথা হেঁট করল।

দেখ ডাক্তার কেরী, তোমার শান্তিদূত কেমন নীরব ও নম্র।

তার পরে একটু থেমে বলল, কিন্তু রাত্রে বড় ঠোকরায়।

তার অশিষ্ট ইঙ্গিতে সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেল।

শেষরক্ষার আশায় জর্জ বলল, ডাঃ কেরী স্থির করেছেন যে কলকাতাতেই স্থায়ী হয়ে বসে হিদেনদের মধ্যে প্রেমধর্ম প্রচার করবেন।

দুবোয়া বলল, ডাঃ কেরী যথার্থই আমার ব্রাদার-ইন-ল। কারণ আমিও অনেক বছর হল সুন্দরবনে প্রেমধর্ম প্রচার করছি, বিশেষ করে হিদেন নারীদের মধ্যে।

এই অসভ্য লোকটির দুঃসাহসে সকলে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, ভাবছিল কেউ যদি একটা সমুচিত উত্তর দেয় তো ভাল হয়।

মেরিডিথ বলল, তবে তো তোমার পক্ষে শান্তি-কপোত বাহুল্য।

স্বভাবসিদ্ধ মৃদুহাস্যে দুবোয়া বলল, আদৌ বাহুল্য নয়, পোষাপাখী দেখিয়ে বুনোপাখী ধরতে হয়, তা কি জান না?

মেরিডিথ বলল, তোমার উত্তি বড় অশিষ্ট।

বিস্ময়ের ভান করে দুবোয়া বলল, কি আশ্চর্য, ডিনার টেবিল তো গিঞ্জের বেদী নয় যে, সদুপদেশ বর্ষিত হবে।

তবু ভুললে চলে না যে, এখানে ভদ্রমহিলা আছে।

নইলে অশিষ্ট কথা বলায় আনন্দ কি? আর তাছাড়া অশিষ্ট কথাই বা কি এমন বলেছি। পড়তে ম ভলতেয়ারের Candide বইখানা, দেখতে অশিষ্ট কথা কাকে বলে।

কেরী বলল, তার চেয়ে হোলি বাইবেল কি ভাল নয়?

সোৎসাহে দুবোয়া বলে উঠল, নিশ্চয়, নিশ্চয়। সংস্ অব সলোমন অতি উপাদেয় রচনা–স্বয়ং ম ভলতেয়ারও ওর সীমা লঘন করতে পারেন নি।

সকলে বুঝল যে এই ফরাসী বাচাল কিছুতেই থামবে না। তাই সকলে আলাপের সূত্র ছেড়ে দিয়ে খাদ্য গ্রহণে অধিকতর মননিবেশ করল। নীরব টেবিল কাঁটা-চামচের নিক্কণে, সোডাবোতল খোলবার সশব্দ উচ্ছ্বাসে, মদ ঢালবার লোভনীয় আওয়াজে মুখর হয়ে উঠল।

একজন আন্দারের উদ্দেশ্যে বলল, আউর থোড়া বরিফ।

জর্জ স্মিথ বলল, বরফের প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল, শুনলে তোমরা নিশ্চয় আনন্দ অনুভব করবে। সেদিন আমার হেড খানসামাকে বরফ বলেছিলাম। যতটা বরফ আনতে বলেছিলাম তার অর্ধেক মাত্র নিয়ে আসায় আমি বিস্মিত হলাম। শুধালাম, ব্যাপার কি, এতটুকু কেন? লোকটা অনেকদিন আমার কাছে আছে, কিছু কিছু ইংরেজী শিখেছে তার কথাগুলো তার বিচিত্র ইংরেজীতেই বলছি, ও-ইংরেজী একবার শুনলে ভোলবার নয়।

আমি শুধালাম-How is this?

সে বললে–Master, all make met.

Did you rap it well in the cloth?

No, Sahib, that make ice too muchee warm.

Did you close the basket?

No, Master, because that make ice more warm.

Then the ice had the full benefit of sun and air. Idiot!

ঘটনাটি শুনে সকলে হো হো করে হেসে উঠল।

হাসল না কেবল দুবোয়া।

মেরিডিথ বলল, মনে হচ্ছে দুবোয়ার কাছে ঘটনাটা বিচিত্র লাগে নি।

দুবোয়া বলল—সত্যি তাই। এ আর এমন বিচিত্র কি? মেয়েরাও ঐ বরফের মত, খুলে রাখলেও খোয়া যায়, ঢেকে রাখলেও খোয়া যায়। আলো হাওয়া আদায় করে নেয় নিজ নিজ প্রাপ্য, অবশেষে যখন ঘরে এসে পৌঁছয় হতভাগ্য স্বামী আধখানার বেশি পায় না।

কেটি বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, তুমি আজ বড় বাড়াবাড়ি কবছ।

কিন্তু ফল হল উল্টো। মিসেস কেরী তাকে ধমক দিয়ে বলল-তুমি একরত্তি মেয়ে, ওকে শাসন করবার কে? ভদ্রসমাজের উপযুক্ত কথাবার্তা বলতে হবে তো, এ তো পাদ্রীর গৃহকারাগার নয়।

সকলের লজ্জিত নীরবতা।

কেবল দুবোয়া মিসেস কেরীকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, mon chérc mon chére।

খানা শেষ হয়ে গিয়েছিল, টেবিল পরিষ্কার করে নেওয়া হল। আর সেই সঙ্গে প্রত্যেক কোবরদার ধূমায়িত ফরসী নিয়ে নিঃশব্দে প্রবেশ করে নিজ নিজ প্রভুর পিছনে দাঁড়াল, মেঝেতে একখণ্ড করে কার্পেট পেতে তার উপরে ফরসীটি স্থাপিত করে কুলায়িত নলের রুপোর মুখনলটি প্রভুর হাতে তুলে দিল। তখন ঘরময় কেবল অম্বুরী তামাকের সুগন্ধ আর গদগদ সুশ্রাব্য শব্দ। মহিলাদের এ ব্যবস্থা ছিল না। খুব সম্ভব তারা ঘরের আবহাওয়া থেকে মৌতাত সংগ্রহ করে।

সেকালে মহিলারা তামাক সেবন করত না বটে কিন্তু কখনও কোন পুরুষকে আপ্যায়িত করবার ইচ্ছা হলে তার কাছ থেকে নলটি চেয়ে নিয়ে দু-চার টান দিত। কেটি, লিজা ও অন্যান্য মহিলারা সে রকম ইচ্ছা প্রকাশ করল না। কিন্তু মিসেস কেরীর কথা স্বতন্ত্র। ডিয়ার ব্রাদার-ইন-ল’কে আপ্যায়িত করবার উদ্দেশ্যে মুখনলটি চেয়ে নিয়ে এক টান দিয়েই সে এক কাণ্ড করে বসল। কাসতে কাসতে দম বন্ধ হয়ে মৃতি-প্রায় অবস্থায় সে ঢলে পড়ল দুবোয়ার কাঁধের উপরে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে জন ফুটল স্মেলিং সল্ট-এর শিশির উদ্দেশে। যখন শিশিটি নিয়ে সে ফিরল, ডরোথি তখন লব্ধসম্বিৎ। তাড়াতাড়িতে নিজের চেয়ারে বসতে গিয়ে জন ডিঙিয়ে ফেলল দুবোয়ার ফরসীর নল। ব্যাপারটা অনেকেরই চোখে পড়ল, জনের চোখে প্রকাশ পেল লজ্জা ও দুঃখ, দুবোয়ার চোখে রোষ ও বিস্ময়। উপস্থিত সকলে প্রমাদ গুনল। কিন্তু কেবল এক পলকের জনা মাত্র দুবোয়ার ভাবান্তর ঘটেছিল, পলকপাতে তার মুখে ফুটে উঠল অত্যন্ত রেশমী হাসি, চোখে দেখা দিল অভ্যস্ত কৌতুককণিকা। সে জনকে টেনে নিয়ে পাশে বসাল। সকলে ভাবল, যাক, সঙ্কট কেটে গেল।

সেকালে কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজের বৈঠকে একজনের ফরসীর নল অপর জন কতৃক লঘন সামাজিক অশিষ্টাচারের চরম বলে গণ্য হত—এর একমাত্র প্রতিকার ছিল লঙ্ঘিত-নল ও লঙ্ঘনকারীর মধ্যে ডুএল। এমন এল সেকালে অনেক ঘটত। বর্তমান ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কাই দেখা দিয়েছিল।

ডিনার শেষ হলে অধিকাংশ নিমন্ত্রিত ব্যক্তি চলে গেল, রইল কেবল মেরিডিথ ও রিংলার। তারা এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, খুব সম্ভব তারা লিজার মধ্যে মধুচক্রের সন্ধান পেয়েছিল। আর রইল কেটি ও দুবোয়া। মিসেস কেরীর নির্বাতিশয্যে তাদের দু-চার দিন থাকবার জন্যে অনুরোধ করতে বাধ্য হয়েছিল জর্জ স্মিথ।

তখনকার কলকাতায় ডিনারের পরে শ্বেতাঙ্গ সমাজ ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ঘুমিয়ে নিত, তখন শ্বেতাঙ্গ পাড়ায় বিরাজ করত মধ্যাহ্নে মধ্যরাত্রির নীরবতা।

সকলে যখন বিশ্রামে মগ্ন, দুবোয়া জনকে নিয়ে এসে দাঁড়াল বাগানের বাদাম গাছটির তলায়। তার পরে স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হাস্যে বলল, জন, আজকের ব্যাপারটার জন্যে নিশ্চয় তুমি দুঃখিত। কিন্তু হলে কি হয়, সামাজিক প্রথা বলে একটা জিনিস তো আছে,

আমাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হওয়া আবশ্যক।

জন বুঝলে যে এ হচ্ছে ডুএলের আহ্বান।

তাকে নীরব দেখে দুবোয়া শুধাল, তুমি কি বল জন?

জন বলল, দয়া করে আমাকে মিঃ স্মিথ বল।

বেশ তাই হবে, এখন কি বল?

এতে আর বলবার কি আছে! সামাজিক প্রথা রক্ষা করতে হবে বইকি।

কিন্তু এখানে second বা দোসর পাওয়া যায় কোথায়?

জন বলল, তোমার আপত্তি না থাকলে মেরিডিথ ও রিংলারকে ডাকি।

আপত্তি কি? দুজনেই আমার বন্ধু।

জন ভাবল, বিচিত্র এই ফরাসী জাতটা, সকলেই তার বন্ধু, সব দেশই তার দেশ, সব নারীই তার mon chére!

জন মেরিডিথ ও রিংলারকে ডেকে নিয়ে এল। সব ব্যাপার শুনে মেরিডিথ ও রিংলার সম্মত হল, স্থির হল মেরিডিথ হবে জনের দোসর, রিংলার হবে দুবোয়ার দোসর। আরও স্থির হল যে আগামীকাল খুব ভোরে বির্জিতলার দিঘিটার কাছে নির্জনে দ্বন্দ্বযুদ্ধ হবে, বারো গজ দূর থেকে দুজনে পর পর দুটো পিস্তলের গুলি ছুঁড়বে, জন আগে ছুঁড়বে, দুবোয়া তার পরে। আর ঘটনার আগে পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারটা গোপন রাখবার প্রতিশ্রুতি দিল সকলে।

দুবোয়া হেসে বলল, বির্জিতলার মস্ত গুণ এই যে কাছেই প্রেসিডেন্সি হাসপাতাল। মেরিডিথ বলল, আশা করি সেখানে কারও যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।

নিশ্চয়ই নয়, নিশ্চয়ই নয়, বলে দুবোয়া চারটে সিগারেট বের করল। জন প্রত্যাখ্যান করে বলল, ধন্যবাদ।

দুবোয়ার এই আচরণের কারণ কি? কেবলই কি সামাজিক প্রথা রক্ষা, না জন ও কেটির যে পূর্ব-সম্বন্ধ কখনও কখনও খচ খচ করে বেঁধে দুবোয়ার বুকে, সেই কাঁটাটি উৎপাটন করে ফেলবার ইচছা? কিন্তু তাই বা কেমন করে বলি? সে তো জানত না। যে জন ফরসীর নল ঘন করে এমন সুযোগ দেবে। দুবোয়া সেই শ্রেণীর সৌভাগ্যবান, সুযোগ এগিয়ে এসে যাদের কাছে ধরা দেয়। মানুষ সুযোগের সন্ধানে থাকে, আর সুযোগ থাকে শয়তানের সন্ধানে।

.

ওরা অবশ্য ভাবল যে ঘটনাটি গোপন রাখবে কিন্তু গোপন থাকল না। লিজা নারীসুলভ স্বভাবগত সন্দেহপরায়ণতায় সমস্ত বিষয়টা আঁচে আন্দাজে অনুমান করে নিল। অবশ্য কাউকে সন্দেহের কথা বলল না, একা একা সঙ্কটমোচনের চিন্তায় নিযুক্ত হল।

অনেক রাতে কার স্পর্শে জনের ঘুম ভেঙে গেল, সবিস্ময়ে সে দেখল আলো আঁধারিতে দাঁড়িয়ে আছে কেটি।

তবু সে শুধাল-কে?

কেটি বলল, চিনতে পারছ না জন? আমি কেটি।

ও, মাদাম দুবোযা!

না জন, আমি কেটি।

এতো রাতে কেন?

তোমার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ পাই নি, তাই।

কি কথা বলবে?

চল আমরা কোথাও পালিয়ে যাই।

এ রকম কথার জন্য জন প্রস্তুত ছিল না, সে চুপ করে রইল।

কেটি আবার বলল, বুঝলে না? চল এখনই আমরা কোথাও পালিয়ে যাই।

জন এবারে বলল, তা কি করে সম্ভব হয়। তা ছাড়া কাল সকালে আমার একটা কাজ আছে।

কি এমন কাজ?

কাজ যাই হক—কিন্তু ওটা পারব না, তুমি আমাকে মাপ কর।

রাতের যে অন্ধকার আকাশের সহস্র অশ্রুবিন্দুকে প্রকাশ করে, সেই অন্ধকারই কেটির সদ্যঃপাতী অশ্রুবিন্দু দুটিকে গোপন করে রাখল।

কিছুক্ষণ দুজনে নীরব থাকবার পর কেটি সহসা তাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে বলল, জন, আমি তোমাকে ভালবাসি।

জন নিজেকে বন্ধনমুক্ত করে নিয়ে বলল—কেটি, আমাকে দুর্বল কর না, তুমি যাও। এই বলে সে এক রকম জোর করেই তাকে বিদায় করে দিল।

তার পরে তার কি মনে হল জানি না, টেবিলের দেরাজ থেকে পিস্তল বের করে গুলি বের করে নিয়ে খালি পিস্তল রেখে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল, কিছুক্ষণের মধ্যেই পড়ল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখল-দুবোয়ার সঙ্গে তার দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছে। দুবোয়া তাকে লক্ষ্য করে অব্যর্থ গুলি ছুঁডেছে—এমন সময়ে কোথা থেকে কেটি এসে বুক পেতে দাঁড়াল, গুলি তার বুকে লাগল। সে যেমনি কেটিকে তুলেছে, দেখল কেটি নয়, লিজা। সে ভাবল, লিজা কখন এল!

কিছুক্ষণ পরে লিজা ধীরপথে ঘরে ঢুকল। অতি সন্তর্পণে টেবিলের দেয়াজ খুলে পিস্তলটি বের করে নিয়ে দেখল চেম্বার শূন্য, তখন গুলি দিয়ে চেম্বার ভর্তি করে পিস্তলটি যথাস্থানে রেখে দিয়ে যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনি নিঃশব্দে আবার প্রস্থান করল। জন কিছুই জানতে পেল না।

পরদিন খুব ভোরে, তখনও কেউ জাগে নি, জন দুবোয়া মেরিডিথ ও রিংলার পদব্রজে গিয়ে উপস্থিত হল বির্জিতলার দিঘিটার ধারে। চারিদিক নিঃশব্দ, নির্জন। তারা দিঘির ধারে একটা পরিষ্কার জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়াল। মেরিডিথ ও রিংলার বারো ধাপ ব্যবধান চিহ্নিত করে নিয়ে দুবোয়া ও জনকে দাঁড় করিয়ে দিল।

দুবোয়া করমর্দন করবার উদ্দেশে হাত বাড়িয়ে দিল, জন প্রত্যাখ্যান করল।

দুবোয়া হেসে বলল, আশা করি, রুই হও নি, এ কেবল সামাজিক প্রথা রক্ষা।

জন কোন উত্তর দিল না।

মেরিডিথ দুজনকে সতর্ক করে দিল—মেরিডিথ হাতের রুমাল নিক্ষেপ করে সঙ্কেত জানাল।

জন পিস্তল ছুঁডলগুলি দুবোয়ার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল।

গুলি এল কোত্থেকে, জনের মনে এই রহস্যময় প্রশ্নের মীমাংসা হওয়ার আগেই রিংলারের রুমাল-সংকেতে দুবোয়া গুলি ছুঁড়ল। গুলি জনের দক্ষিণ বাহু ভেদ করে বিদ্ধ হল, সে নীরবে মাটিতে পড়ে গেল। বিদ্যুৎ-চকিতে তার মনে রাতের স্বপ্নটা খেলে গেল আর সেই সঙ্গে মনে পড়ল, ‘জন, তোমাকে আমি ভালবাসি।’

তিনজনে ছুটে গিয়ে শুধাল—আঘাত কি গুরুতর?

উত্তর না পেয়ে নত হয়ে বসে দেখল জন মূর্ছিত।

তখন তারা তিনজনে জনকে তুলে নিয়ে নিকটবর্তী প্রেসিডেন্সি হাসপাতালের দিকে চলল।

দুবোয়া ক্রমাগত বলতে লাগল—আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমি অত্যন্ত দুঃখিত।

ওটা তার মনের কথা নয় সন্দেহ করে মেরিডিথ বলল, এখন দয়া করে চুপ করবে কি?

নিরুপায় দুবোয়া দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে উঠল যেমন তোমার অভিরুচি।

.

১.১৯ শয়তানের শহর

দুবোয়া-স্মিথ ডুএলের সংবাদ প্রচারিত হওয়ামাত্র কলকাতার শ্বেতাঙ্গ-সমাজে অপ্রত্যাশিত আলোডন দেখা দিল। সকলেরই মুখে এক কথা—এ অত্যন্ত গর্হিত, এ অত্যন্ত বাড়াবাড়ি, কোথায় গেল সেই ফরাসী শয়তানটা! তখনকার দিনে শ্বেতাঙ্গ-সমাজে এমন ডুএল আকছার ঘটত, কেউ কিছু মনে করত না, এমন কি ওয়ারেন হেস্টিংস ও সার ফিলিপ ফ্রান্সিসের মধ্যে ডুএল ঘটবার পরে ব্যাপারটা একটা ফ্যাশনের জলুস লাভ করেছিল। এ হেন অবস্থায় এ এলে এমন অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া ঘটবার আসল কারণ তখন ইউরোপে ফরাসী দেশ ও ইংলণ্ডে যুদ্ধ বেধে গেছে—সে যুদ্ধও আবার ফরাসী বিপ্লবের ইডিওলজি-ঘটিত। কাজেই কলকাতার শ্বেতাঙ্গ-সমাজের ঘনীভূত ফরাসী বিদ্বেষ-ফরাসী জাতির ঐ একটিমাত্র প্রতিনিধির উপর গিয়ে পড়ল। ইংরেজে ইংরেজে ডুএল, হাঁ, তার অর্থ বোঝা যায়, কিন্তু ইংরেজ ফরাসীতে, তাতে কিনা আবার ঐ শয়তানটা হল বিজয়ী! সকলে সন্ধানে নিযুক্ত হল কোথায় গেল সেই ফরাসী শয়তানটা!

দুবোয়া শয়তান ঠিক না হতেও পারে কিন্তু প্রেসিডেন্সি হাসপাতালে পৌঁছেই বুঝে নিয়েছিল যে আবহাওয়া প্রতিকূল, ইংরেজ ডাক্তার রোগী প্রভৃতি সকলেরই সুর চড়া। সে বুঝল যে, এখন পলায়নটাই আত্মরক্ষার প্রশস্ততম পথ, সে মনে মনে আলোচনা করে দেখল, এ বিষয়ে ভলতেয়ারের নির্দেশ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কাজেই সে কেটির উদ্দেশে একখানা চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে হাসপাতাল থেকেই সুন্দরবনে যাত্রা করল।

স্মিথ আহত হয়েছে সংবাদ বাড়িতে পৌঁছনো মাত্র লিজা পিতাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হল, এমন যে ঘটতে পারে সে আগেই জানত।

নিরপরাধ কেটি সমবেদনা জানাতে এলে লিজা সংক্ষেপে বলল, খুকি আর কি, কিছু জান না! যাও।

সংক্ষিপ্ত উক্তির সঙ্গে নিক্ষিপ্ত হল ঘৃণা ও ধিক্কারপূর্ণ কটাক্ষ।

হতভম্ব, মর্মাহত কেটি গিয়ে ঘরে দরজা দিল।

গাড়িতে যেতে যেতে লিজা বলল, এ সমস্ত দুর্দৈবের মূলে ঐ বুড়ি শয়তান মাগীর আব্দার!

জর্জ বলল—সে যাই হক, এমন দুঃসময়ে অযথা ক্রোধে বিদ্বেষে মনকে আর অধিক বিচলিত করে তুলো না।

তুলব না? কেন তুলব না? ও বেটীর আব্দারেই তো নিমন্ত্রণ করতে হল ওর ডিয়ার ব্রাদার-ইন-ল’কে। আর তুমি বলছ রাগ করব না?

জর্জ বলল—আসল কথা কি জান, মিসেস কেরী ঠিক সুস্থমস্তিষ্ক ব্যক্তি নয়।

আর আমার মস্তিষ্কটাই খুব সুস্থ আছে, না? এই বলে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

জর্জ নীরবে তার মাথায় হাত বুলোত লাগল।

জনের আঘাত গুরুতর নয়, ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল এবং দিনসাতেকের মধ্যেই হাসপাতাল ত্যাগ করে বাড়িতে ফিরে এল।

কিন্তু রক্তজিহ্ব পিস্তল তার বলি না নিয়ে ফিরল না, আর সে বলিটাও কিনা শেষে সংগ্রহ করল নিতান্ত মর্মান্তিকভাবে।

কেটি ও দুবোয়ার কি হল কেউ খোঁজ করে নি, খোঁজ করবার মত মনের অবস্থা কারও ছিল না—আর খোঁজ করবার ভার তো একমাত্র লিজার উপরে, বাড়ির গিন্নি সে। সে দিবারাত্রি জনকে নিয়ে ব্যস্ত, হাসপাতালেই থাকত, কখনও কখনও এক আধ ঘণ্টার জন্য মাত্র বাড়িতে আসত। দুবোয়া ও কেটিকে না দেখে বাড়ির সবাই ধরে নিয়েছিল যে, ওরা কোন এক সুযোগে সকলের অলক্ষ্যে পালিয়ে গিয়েছে।

এমন সময়ে, ডুএলের তিনদিন পরে, ক্ষণিকের জন্য বাড়ি ফিরে লিজা যখন রিংলার ও মেরিডিথের সঙ্গে চা পান করছিল-চাকরে এসে খবর দিল যে, নঈ তলাও-এ একটা মৃতদেহ ভাসছে। কৌতূহলী হয়ে তারা চলল বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড ও চৌরঙ্গী রোডের মোড়ে সদ্যখনিত পুকুরটার দিকে। পুকুরের ধারে পৌঁছে দেখল-হা মৃতদেহই বটে, আর সেটা স্ত্রীলোকের। তিনজনের মনে একই সঙ্গে একই সন্দেহের বিদ্যুৎ চমক মেরে গেল। তার পরে পশ্চিম দিকের নলখাগড়া ঝোপের আড়াল থেকে একটা হ্যান্ডব্যাগ হাতে করে চাকরটা এসে দাঁড়াল।

কেটি!

হ্যান্ডব্যাগ খুলতে বেরুল একখানা চিঠি, দুবোয়া লিখছে কেটিকে।

মেরিডিথ পড়ে দিল রিংলারকে, বলল, পড়ে দেখ, মানুষ কত নৃশংস হতে পারে! রিংলার পড়ে সংক্ষেপে মন্তব্য করল, হৃদয়হীন পাষণ্ড।

চিঠিখানা পড়তে পড়তে লিজার চোখ ছলছল করে উঠল, বুঝল কেটির প্রতি সে অবিচার করেছিল, বুঝল যে ভুলের কথা জানত না সে, আরও বুঝল যে কোন উপায়ে জনকে নিহত ও কেটিকে পরিত্যাগ করবার অভিপ্রায়েই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে কলকাতায় এসেছিল সে, দুবোয়া। দুবোয়া লিখছে–

Mon chére, প্রিয় আমার,

তোমার ভূতপূর্ব প্রণয়ীর এক ছটাক রক্তপাতে এখানকার বেরসিক ইংরেজগুলো বড়ই ক্ষেপে উঠেছে। অথচ দেখ ঠিক এই মুহূর্তে আমার সুন্দর ফরাসী দেশে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার নামে হাজার হাজার টন রক্তপাত চলছে, এমন কি সাধারণের লাল রক্তপাতে সন্তুষ্ট না হয়ে সেখানকার লোকে রাজা-রানীর নীল রক্তপাত ঘটিয়েছে। অথচ এখানে কত প্রভেদ! ইংরেজগুলো বড়ই রক্ষণশীল, তারা নিজেদের রক্ত রক্ষা করতে চায়—যদিচ সুবিধা পেলেই আমার দেহে কতটা রক্ত আছে পরীক্ষা করে দেখবে নিশ্চয়। এ রকম ক্ষেত্রে কর্তব্য সম্বন্ধে মঁ ভলতেয়ারের নির্দেশ সুস্পষ্ট—তিনি বলেছেন, বীরত্বের চেয়ে বিচারের মূল্য বেশি। অতএব আমি এখান থেকেই সুন্দরবনে যাত্রা করলাম। তোমাকে কার কাছে রেখে গেলাম? কেন, রইল তোমার ভূতপূর্ব প্রণয়ী এবং খুব সম্ভব ভাবী স্বামী। দু-চার দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠে লোকটা বাড়ি যাবে তখন আর কি, তোমরা দুজনে সুন্দরবনে, ‘ফরেস্ট অব বিউটিফুল উইমেন’ নামে অরণ্যে স্বাধীন মুগ্ধ কপোত-কপোতীর মত আনন্দের কুজন করে উড়ে বেডিও। যখন সেই লোকটা তোমাকে বাহুবন্ধনে বদ্ধ করে বিশ্রদ্ধ সুরে ডাকবে কিট কেট কেটি, তখন তার দক্ষিণ বাহুমূলে মৎকৃত ক্ষতচিহ্ন দেখে আশা করি আমাকে মনে পড়বে আর সেখানে চুম্বন করবে দু একবার, সে চুম্বনের স্পর্শ পৌঁছবে আমার নাকের ডগায়—যেটি ছিল তোমার খুব প্রিয় স্থান। তুমি হয়তো জিজ্ঞাসা করবে যে, কেন তোমাকে ছেড়ে গেলাম? এসব গুরুতর বিষয়ের উত্তর মহাজনবাক্যে দেওয়াই সমীচীন-তাই আমাদের সাহিত্যের অন্যতম মহাজন রশফুকোর ভাষায় বলি—এক খনিতে বুদ্ধিমান ব্যক্তি বেশিদিন নামে না। যদিচ এ-ও নিশ্চয় জানি এমন মণিরত্নে পূর্ণ খনি বেশি দিন খালি থাকবে না, তোমার ভূতপূর্ব প্রণয়ী— তোমার ভাবী স্বামী সাগ্রহে সেখানে অবতরণ করে নিজেকে ধন্য মনে করবে। কাজেই তোমাকে বেঘোরে ফেলে যাচ্ছি এমন অপবাদ নিশ্চয় দেবে না, নিশ্চয় মনে করবে না যে, আমি হৃদয়হীন। অতএব বিদায়, mon chere, বিদায়! চোখের জলে চারিদিক ঝাপসা হয়ে গিয়েছে তাই আর কলম চলছে না, বলবার কথার কি শেষ আছে— অহো, হো। ইতি–

তোমার চিরকালের দুবো।

চিঠি পড়ে তিনজনে অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইল। প্রথম কথা বলল লিজা। সে বলল—এই চিঠির পরে কেটি যা করেছে তা ছাড়া করবার আর ছিল কি? আহা, বেচারাকে আমি ভুল বুঝেছিলাম।

মেরিডিথ বলল—এখন ওঠ, পরবর্তী ব্যবস্থার আয়োজন করা যাক।

তাই বটে। সংসারের রথ এক মুহূর্তও নিশ্চল থাকে না, চরম দুঃখ ও পরম আনন্দকে সমান উপেক্ষা করে তার রথচক্র নিত্য ঘর্ঘরিত। হয়তো ঠিক সেইজন্যই মানুষের জীবনধারণ সম্ভব হয়, নতুবা হয়তো মুহূর্তের সুখ-দুঃখই চিরন্তন হয়ে বিরাজ, জীবন পড়ত অচল হয়ে। জীবনের যাবতীয় সুখ-দুঃখের সমষ্টির চেয়েও যে জীবনটা অনেক বড়, অনেক বেশি গুরুভার, এই সত্যটির উপলব্ধিতেই হয়তো জীবনের চরিতার্থতা।

পর পর কয়দিনের অতর্কিত আঘাতে স্বভাবত অস্থিরমতি মিসেস কেরী উন্মাদবৎ হয়ে গেল। একাকী ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নীরবে বসে থাকত,তার পর হঠাৎ ফুকরে উঠতটাইগার, টাইগার! আর তার পরেই চৌকি, পালঙ্ক, টেবিল প্রভৃতির নীচে উঁকি মেরে দেখত বাঘ লুকিয়ে আছে কি না। স্মিথ পরিবারের পক্ষে সে হয়ে উঠল প্রকাণ্ড একটি সমস্যা।

ডুএলের সংবাদ পাওয়ার পরে ডাঃ কেরী গম্ভীর হয়ে পড়েছিল, তার পর দুবোয়ার পলায়ন ও কেটির মৃত্যুতে সেই গাম্ভীর্য তাকে আত্মজিজ্ঞাসায় নিরত করল। এ কয়দিন কেরী নিতান্ত গতানুগতিক দু-চারটি কথা বলা ছাড়া কারও সঙ্গে বড় বাক্যালাপ করে নি, এমন কি টমাসও তার কাছে ভিড়তে সাহস পেত না। কেটির মৃত্যুর তিন দিন পরে একদিন সকালে টমাসকে সে বলল, ব্রাদার টমাস, কলকাতায় আমাদের বাস করা চলবে না।

এমন আশঙ্কা টমাসের মনে কখনও আসে নি, তাই আকাশ থেকে পড়ার বিস্ময়ে শুধাল—তার মানে! তবে কি দেশে ফিরে যাবে?

দেশে ফেরবার জন্যে এত খরচ করে এতদূরে আসি নি।

টমাস আবার শুধায়–তবে?

বাংলাদেশের অন্যত্র কোথাও গিয়ে বসতে হবে।

কিন্তু এখানে নয় কেন?

কেন যে নয় সেটা আমার চেয়ে তোমার জানার কথা বেশি। এ শহর সডম ও গমরার চেয়েও গুরুতর পাপে পূর্ণ, চিকিৎসার অতীত এর অবস্থা।

টমাস কলকাতা ছাড়তে রাজী নয়, তাই সে উল্টো জেবা করে বলল-কিন্তু সেই জন্যেই তো এখানে ধর্মপ্রচারের আবশ্যকতা বেশি।

হতে পারে, কিন্তু সে আমার মত লোকের সাধ্যাতীত, কোন প্রেবিত পুরুষ যদি আসেন তিনি চেষ্টা করবেন।

তার পরে বার দুই পায়চারি করে—গভীর চিন্তার সময়ে পায়চারি করা কেরীর স্বভাব-সে বলল, এখন বুঝতে পারছি ‘ইভের মত লোককেও কেন স্বীকার করতে হয়েছিল যে, কলকাতা শয়তানের শহব।

টমাস আবার শুধায়—কিন্তু যাবে কোথায়? সবই যে অনিশ্চিত।

এক বছর আগেও কি নিশ্চিত ছিল যে, কলকাতায় আসতে হবে আমাকে।

তার পর দুই পায়ের উপর সুপ্রতিষ্ঠিতভাবে দাঁড়িয়ে কেরী বলল, ব্রাদার টমাস, আর তর্ক নয়, আমি সিদ্ধান্তে এসেছি, অবিলম্বে আমাদের নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে হবে। যাও তুমি গিয়ে গোছগাছ কর গে–আর মুন্সীকে বল আমার সঙ্গে যেন একবার দেখা করে।

ভগবানের কৃপাতেই হক আর ঘটনাচক্রের আবর্তনেই হক শেষ পর্যন্ত কেরীদের ঠিক নিরুদ্দেশের মুখে যাত্রা করতে হল না।

জর্জ উডনী নামে ধর্মপ্রাণ এক ব্যবসায়ী ছিল। বাংলাদেশের নানাস্থানে তার নীল ও রেশমের কুঠি ছিল। এইসব কুঠির কাজ তদারক করে ঘুরে বেড়াতে হত তাকে। কলকাতায় ফিরে এসে উড়নী খবর পেল যে ডাঃ কেরী ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছে আর কলকাতাতেই আছে। উডনী এসে কেরীর সঙ্গে পরিচয় করে নিল, কেরীর উদ্দেশ্যের প্রতি সহৃদয় সমর্থন জানাল। তার পরে যখন শুনল যে কলকাতা পরিত্যাগ করে পীবঙ্গের কোনস্থানে বসতে কেরী সঙ্কল্পিত, তখন তার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। মালদহ জেলার মদনাবাটিতে এবং দিনাজপুর জেলার মহীপালদিঘিতে উডনীর নীলকুঠি ছিল। তার প্রস্তাবে কেরী মদনাবাটির ও টমাস মহীপালদিঘির নীলকুঠির নেজারি পদ গ্রহণ করতে সম্মত হল।

উডনী বলল বেশ ভাল হয়, আমার কাজও হবে, তোমাদের কাজও হবে, ম্যানেজারের দায়িত্ব অল্প, ধর্ম-প্রচারে বাধা হবে না। আর তা ছাড়া, ও দুটো জায়গার মধ্যে ব্যবধান মাত্র ১০/১২ মাইলের, কাজেই তোমাদের দেখাসাক্ষাৎও চলতে পারবে।

টমাস উডনীর কাছে বেতনের কিছু টাকা আগাম চেয়ে নিয়ে মহাজনের দেনা শোধ করে যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল।

কলকাতা ছেড়ে মদনাবাটি যেতে হবে, তাও আবার অবিলম্বে, শুনে রাম বসু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। কিন্তু বসুজা সেই শ্রেণীর লোক, হাল ভাঙলেও যারা হাল ছাড়ে না, আর প্রতিকূল বাতাসকে অনুকূলে আনতে হলে কিভাবে পাল খাটাতে হয় সে কৌশল জানে।

পাদ্রীদের সঙ্গে স্বামীকে বিদেশে যেতে হবে শুনে অন্নদা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, বলল, তবে আর কি, এবারে খিরিস্তানগুলোর সঙ্গে মিলে ধিঙ্গিপনা কর গে, বারণ করবার আর কেউ রইল না।

বসুজা বলল, নরুর মা, ধিঙ্গিপনা কাকে বলে জানি নে, জানি কেরী সাহেবকে, একবার পড়া শুরু করলে দুই প্রহরের কমে হাড়ে না, ধিঙ্গিপনা করবার ফুরসৎ কোথায়?

সেখানে গিয়ে কি করবে না করবে তা তো আর দেখতে যাব না। পারতাম চোখ-জোড়া সঙ্গে পাঠাতে!

তুমি সঙ্গে না গেলেও ন্যাড়ার চোখ-জোড়া তো সঙ্গেই যাচ্ছে—সে চোখ তো এখন তোমারই চোখ।

অনেক বিবেচনার পরে অন্নদা ন্যাড়াকে আনিয়ে নিয়েছে। অন্নদার চোখে ন্যাডার অনেক গুণ; ন্যাড়া খায় কম, খাটে বেশি আর মন রাখা কথা বলতে তার জুড়ি নেই।

ন্যাডাকে স্বগৃহে ভর্তি করবার আগে উভয়ের মধ্যে নিম্নোক্তরূপ প্রশ্নোত্তর ঘটেছিল।

হারে ন্যাড়া, তোরা তো কায়স্থ, কি বলিস?

তুমিই তো বললে দিদিঠাকরুন, আমি কি আর অন্য কথা বলতে পারি।

এবারে গলা একটু খাটো করে জিজ্ঞাসা করল—হ্যাঁরে, অখাদ্য খাস নি তো?

কি যে বল দিদিঠাকরুন, অখাদ্যের দাম অনেক বেশি, আমার ভোগে জুটবে কেন?

তবে কি খেয়েছিস?

ডাল ভাত আর গঙ্গাজল।

গঙ্গাজল!

অন্নদা বিস্মিত হয়। বলিস কি রে!

গঙ্গাতীরে গঙ্গাজল ছাড়া আর কি জুটবে?

তবে ওতেই সব শুদ্ধ হয়ে গিয়েছে, কি বলিস?

অশুদ্ধ হল কোথায় যে শুদ্ধ হবে!

খুশি হয়ে অন্নদা বলে, বস দেখি এখানে।

তার পরে এক কলসী গঙ্গাজল এনে ন্যাড়ার মাথায় ঢেলে দিয়ে বলেনে, এবারে গা মুছে এই শুকনো কাপড়-জামা পর।

এইভাবে সংক্ষেপে অথচ পরিপূর্ণরূপে খ্রীষ্টানগৃহবাসের পাপ সংস্কার করে ন্যাড়াকে ঘরে তোলে মনস্বিনী অন্নদা।

জাতি-নাশ সহজ বলেই তার সংশোধনের পথ সুগম।

এখন ন্যাড়া কর্মকুশলতায় ও মধুর বাক্যপ্রয়োগ-গুণে অন্নদার প্রিয় এবং নির্ভরস্থল। পুত্র নরু নেড়ুদা বলতে পাগল।

প্রবাসী স্বামীর তত্ত্বাবধান সম্বন্ধে ন্যাড়াকে রীতিমত তালিম দিতে লেগে গেল অন্নদা।

ন্যাড়া বলত–কায়েৎ দাদার জন্যে তুমি ভেবো নি দিদিঠাকরুন। কায়েৎ দাদা অভিধাটি সে টুশকির কাছে শিখেছিল।

কেরী-পরিবারের যাত্রার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিয়ে উডনী টমাসকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।

পাঁচ-সাত দিন পরেই সপরিবারে কেরী রাম বস, পার্বতী ব্রাহ্মণ ও ন্যাড়াকে নিয়ে নৌকাযোগে মদনাবাটির উদ্দেশে যাত্রা করল।

.

১.২০ একটি অবান্তর পরিচ্ছেদ
তবে বাদ না দেওয়াই ভাল

পলাশীর যুদ্ধের পরে নবাবভীতি দূর হওয়ায় কলকাতার শ্বেতাঙ্গ পাড়া পুব দিকে দক্ষিণ দিকে পেখম মেলে দিতে শুরু করল। এতকাল চির-অভাবগ্রস্ত নবাব ও তার উজীর-নাজিরদের ভয়ে সঙ্কুচিতকলাপ হয়ে যে সমাজ বাস করছিল এখন আর তাদের সে ভয়ের কারণ রইল না; যখন-তখন যে-কোন উপলক্ষে কলাপের চন্দ্ৰকগুলো ভিন্ন করে নিতে পারত যে পুরুষ বাহু তা এখন নিবীর্য, কোম্পানি মুখে অন্ন তুলে দিলে তবে তার আহার সম্পন্ন হয়। অতএব আর সঙ্কোচের কারণ কি।

এতাবকাল লালদিঘিকে কেন্দ্র করে শ্বেতাঙ্গ শহর নানা দুদেবের মধ্যে কোন রকমে মাটি আঁকড়ে পড়েছিল। গঙ্গার উপরেই কেল্লা, কেল্লার নীচেই ঘাট, ঘাটে জাহাজ, প্রয়োজনকালে পালাবার অসুবিধা নেই। সিরাজদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের সময়ে এইভাবে এই পথে কোম্পানির লোকজন পালিয়ে ফলতায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। যারা পালায় নি, লড়াই করেছিল, তারা হেরেছিল। এ রকম ঘটনা এখন পুনরাবর্তনের অতীত। এতদিন কলকাতা ছিল মুর্শিদাবাদের আশ্রিত, এখন থেকে মুর্শিদাবাদ হল কলকাতার আশ্রিত। অবশ্য দিল্লীতে মুঘল বাদশা এখনও বিরাজমান, কিন্তু কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্ব যে গ্রহান্তরের দূরত্ব। অতএব নির্ভয়ে চারদিকে হাত পা ছড়িয়ে দাও। হাতে যদি কিছু মূল্যবান ঠেকে সংগ্রহ কর, পায়ে যদি কিছু বাধা বলে মনে হয় পদাঘাত কর। হাত-পা ছড়াবার অনেক সুবিধা।

শ্বেতাঙ্গ-সমাজে যারা প্রবীণ তাদের স্মৃতি অনেক দূর যায়। প্রত্যক্ষ বা অচিরলব্ধ জনশ্রতিযোগে তারা জানে, মাত্র সত্তর বছর আগে ঘনবর্ষণ প্লাবিত শ্রাবণের এক অপরারে খান দুই জাহাজ সুতানুটির ঘাটে এসে ভিড়েছিল। জব চার্নক দলবল নিয়ে ডাঙায় নেমে দেখে যে, আগের বারে তারা যে ঘরবাড়ী তৈরি করেছিল তার চিহ্নমাত্র নেই, না আছে চাল না আছে চুলো। তবু না থেকে উপায় নেই, কারণ ফেরবার পথ রুদ্ধ করে বিরাজমান হুগলির ফৌজদারের অসন্তোষ। জব চার্নক রয়েই গেল। তার পরের ইতিহাস সর্পিল, কুটিল, সংশয় ও সাহসে জড়িত।

বছর পঁচিশ পরে সুতানুটির দক্ষিণে কলকাতা গ্রামে গড়ে ওঠে কোম্পানির কেল্লা। অবশ্য বাদশার অনুমতি নিতে হয়েছিল, ব্যাধি চিকিৎসা নিরাময় প্রভৃতির সঙ্গে সে অনুমতির ইতিহাস জড়িত। কত সন্তর্পণে পদক্ষেপ, কত স্কুতি-বিনম্র ভঙ্গীতে সম্ভাষণ, কত অকাতরে নীরব নির্যাতন বহন। সেদিনকার প্রসাদপ্রার্থীরা আজ প্রসাদ-বিতরণে উদ্যত, সম্মুখে প্রসারিতকর স্বয়ং নবাব-অচিরে বাদশাকেও ভর্তি হতে হবে নবাবের দলে। প্রবীণ শ্বেতাঙ্গগণ তুলনায় দেখত এই দুই যুগের হবি। কিন্তু বেশি লোকের দেখবার সুযোগ ঘটত না, আবহাওয়া ও ভয়াবহ ব্যাধির কল্যাণে পঞ্চাশ না পার হতেই অধিকাংশকেই সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করতে হত।

কলকাতার দক্ষিণে গঙ্গার ধারে গ্রাম গোবিন্দপুর। সেখানে গড়া শুরু হল নূতন কেল্লা, বিলাত থেকে এল কারিগর। নৃতন কেল্লার উত্তরে চাঁদপাল ঘাট আর কাঁচাগুড়ি ঘাট বরাবর ফুলের গাছ ও ছায়া-তরুতে সাজিয়ে পত্তন হল এসপ্লানেডের। এতদিন যারা লালদিঘির হাওয়া খেয়ে ক্ষুধাবৃদ্ধি করত এবারে তারা এল নৃতন বাগ-বাগিচার প্রশস্ততর ক্ষেত্রে। এসপ্লানেডের উত্তরে পাশাপাশি কাউন্সিল হাউস আর গভর্নরের কুঠি। রনো কেল্লা রইল অকেজো পড়ে, কতক ঘর মালগুদাম, কতক ঘর খালি, একটা বড় ঘর কিছুদিনের জন্য আসর যোগাল রবিবাসরীয় উপাসনার। এমন অদ্ভুত ব্যবস্থা ভক্তির

অভাবে নয়, অভাব অর্থের। লালদিঘির উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত সেন্ট অ্যাস গির্জা সিরাজদ্দৌলার আক্রমণে ভগ্ন, নূতন গির্জা গড়বার অর্থ কই-কাজেই। এত যে বাড়িঘর পথ হচ্ছে, তবে গির্জা গড়বার পয়সা হয় না কেন? গির্জার প্রয়োজন একাহমাত্র, কাজেই অগ্রাধিকার ও-সব বস্তুর।

কেল্লার পশ্চিমে গঙ্গাগর্ভ খানিকটা ভরাট করে নিয়ে বের করা হল নূতন রাস্তা। কেল্লার দক্ষিণে হাসপাতাল, হাসপাতালের পাশে কলকাতায় প্রাচীনতম খ্রীষ্টীয় গোরস্থান, কোম্পানির-শহর-প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নকের সমাধি তাকে দিয়েছে প্রাচীনত্বের আভিজাত্য। এবারে হাসপাতাল উঠে চলে গেল ডিহি-ভবানীপুরে, কলকাতার তিন-চার মাইল দক্ষিণে—আর নূতন গোরস্থানের পত্তন হল শহরের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে, সুন্দরবনের মধ্যে। সেই সুবাদে চৌরঙ্গী রোড থেকে গোরস্থানে যাওয়ার রাস্তার নাম হল বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড। পরবর্তী কাল মানুষের সুনিশ্চিতপরিণামসূচী কর্ণকটু রাস্তাটার নাম বদলে রাখল পার্ক স্ট্রীট-এক সময়ে সার এলিজা ইম্পের Deer Park বা মৃগদাব ছিল কাছাকাছি। তখনকার দিনে এ জায়গাটা শহর থেকে অতিশয় দূরে গণ্য হওয়ায় বিশেষ রাহা-খরচ দিতে হয় পাদ্রীকে যখন সে যেত সমাধি-সত্তারের জন্য। পুরনো গোরস্থানের পশ্চিম অংশের খানিকটা নূতন রাস্তা-ভূক্ত হয়ে গেল। বাকিটা পড়ে থাকল, পরে উঠবে এখানে সেন্ট জন্স চার্চ।

লালদিঘির উত্তর দিক বরাবর একটানা তেতলা এক বাড়ি গড়ে উঠল ১৭৮০ সাল তক। এ বাড়ির তৈরির ও পরবর্তীকালের ইতিহাস বড় বিচিত্র। Lyon নামে একজন ইংরেজকে জমির পাট্টা দেওয়া হয় ১৭৭৬ সালে। পরে ওয়ারেন হেস্টিংসের কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য বারওয়েল বাড়িটা কিনে নিয়ে গভর্নমেন্টকে দেয় ভাড়া। কিন্তু সার ফিলিপ ফ্রান্সিসের মতে বাড়িটা গোড়া থেকেই বারওয়েলের, বর্তমান Lyon’s Range-এর Lyon ছিল বারওয়েলের বেনামদার। বাড়িটাতে উনিশ প্রস্থ suite বা কক্ষাদি ছিল, ভাড়া প্রতি প্রস্থ মাসিক দুই শত টাকা।

এর আগে কোম্পানির Writerগণ (পরবর্তী পরিভাষায় Civil Service চাকুরে) শহরে বাসা খুঁজে নিয়ে বাস করত, বাসা ভাড়া পেত সরকার থেকে। ১৭৮৫ থেকে সিদ্ধান্ত হল যে তিনশো টাকার কম বেতনের Writerগণ দু-দুটি ঘরের এক প্রস্থ বাসস্থান পাবে এই বাড়িতে, আর সেই সঙ্গে একশো টাকা ভাতা।

বাড়িটার এইরকম ব্যবহার চলল দীর্ঘকাল। তার পরে একসময়ে এর নীচের তলায় বসল প্রসিদ্ধ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ, তখনও উপরতলায় থাকত পড়য়া Writer গণ। তার পরে আবার পালাবদল হল। writerগণ আবার নিজ নিজ বাসস্থান খুঁজে নেবার স্বাধীনতা পেল। বাড়িটা কিছুদিন খালি পড়ে থাকল, আবও কিছুদিন সওদাগরী অফিস হয়ে ভাড়া খাটাল, তার পরে আবার এল ফিরে সরকারী হাতে। অবশেষে পরিবর্ধিত পরিমার্জিত ও গম্বুজসমন্বিত হয়ে পরিণত হল বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে। এখনও সেই ব্যবহার চলছে।

লালদিঘির দক্ষিণে একফালি জমি, গভর্নরের দেহরক্ষী সৈন্যদের প্যারাড় করবার জায়গা, প্রয়োজনকালে শ্বেতাঙ্গ স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যরাও এখানে প্যারাড় করত। আর পুব দিকের প্রথম সারে বেঙ্গল ক্লাবের প্রকাণ্ড বাড়ি, দ্বিতীয় সারে ও মিশন চার্চের গির্জা। লালদিঘি বা ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের ভিতরে উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল বিশাল এক তেঁতুলগাছ, যত রাজ্যের পাখীর বাসা গাছটায। ১৭৩৭ সালের মহাঝটিকায় গাছটা উপড়ে পড়ে যায় উত্তরদিকের পথ বন্ধ করে। পার্কের বাইরে উত্তর-পুর্ব কোণে আদালত, যেখানে বিচার হয়েছিল নন্দকুমারের। সেই বাড়িটাই টাউনহল রূপে ব্যবহৃত হত—শেতাঙ্গদের নাচগান খানাপিনার আসর। লালবাজার স্ট্রীটের, বিদেশী নাবিক খালাশী মাল্লাদের ফ্ল্যাগ স্ট্রীটের দক্ষিণে শহরের প্রাচীনতম জেলখানা-এখানেই থাকতে হয়েছিল নন্দকুমারকে। পরে জেলখানা উঠে যায় ময়দানে দক্ষিণতম অংশে–এই হল হরিণবাড়ির জেল। এরই পশ্চিমে টালির নালার কাছে ফাঁসি হল নন্দকুমারের। কসাইটোলা স্ট্রীট পার হয়ে লালবাজার স্ট্রীটের পুব দিকের বাড়তি রাস্তাটা ‘দি অ্যাভিনিউ’–দুপাশে গড়ে উঠল শৌখিন সমাজের বাসস্থল। কসাইটোলা, রাধাবাজার আর চীনাবাজারের শ্রেষ্ঠ বিপণি ঠাসা ভর্তি থাকত দেশী বিদেশী পণ্যে।

এই সময়টাকে বলা চলে কলকাতার ট্যাভার্ন বা সরাইখানার যুগ। শহরের সবচেয়ে নামজাদা হারমনিক ট্যাভার্ন লালবাজারে। এখানে শ্বেতাঙ্গ-মহলের হোমরা-চোমরাদের মিলিত হওয়ার আসর। খোদ ওযারেন হেস্টিংস পৃষ্ঠপোষক, মিসেস ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে প্রসাদপ্রার্থীরা এখানে সাক্ষাৎ করত। ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশ ত্যাগ করার পরে বন্ধ হয়ে যায় হারমনিক ট্যাভার্ন। ভ্যানসিটার্ট রো-তে লন্ডন ট্যাভার্ন, সেন্ট জন গির্জার কাছে নিউ ট্যাভার্ন, ৪৫নং কসাইটোলাতে ইউনিয়ন ট্যাভার্ন, বৈঠকখানায় ব্রেড অ্যান্ড চীজ বাংলো, ১নং ডেকার্স লেনে পা ট্যাভার্ন-উৎকৃষ্ট তপসি মাছ ভাজা খাওয়ার লোভে যেখানে খদ্দেরের ভিড় জমত, আর ছিল ক্রাউন অ্যাংকর ট্যাভার্ন নূতন কেল্লার কাছে, যেখানে ২৪ ঘণ্টার চার্জ লাগত চার গিনি।

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে শ্বেতাঙ্গ-কলকাতা অত্যন্ত দুর্মূল্য স্থান ছিল। ফিলিপ ফ্রান্সিস একটি বাড়ির ভাড়া দিত বছরে বারোশো পাউণ্ড। মধ্যবিত্ত গৃহিণী মিসেস কে দিত দুশো পাউণ্ড, হিকি নামে এক আইন-ব্যবসায়ীকে হাজার পাউন্ড খরচ করতে হয়েছিল গৃহসজ্জার জন্যে।

১৭৯৩ সালে এক পাউঙ চায়ের দাম ছিল সাড়ে চার টাকা, এক ডজন সৃতি মোজা প্রায় ন পাউণ্ড, একদিনের গাড়িভাড়া দু-গিনি, এক রাত্রির জন্যে পিয়ানোেভাড়া ত্রিশ টাকা, আপেল টাকায় আটটা, আঙুর চার টাকা সের, সোডাওয়াটার ভজন দশ টাকা; ধোবী খরচ-পুরুষের কাপড় শতকরা তিন টাকা, মেয়েদের কাপড় সাড়ে চার টাকা; চুল-ছাঁটাই ও কেশ-বিন্যাস বারো টাকা। থিয়েটারের টিকিটের মূল্য অনুরুপ চড়া চৌরঙ্গী থিয়েটার বক্স সীট বারো সিকা টাকা, পিট ছয় সিক্কা টাকা; ১৫নং সার্কুলার রোডের থিয়েটারে একটা আসন এক মোহর।

এখানেই শেষ নয়। এত খরচ করেও সাহেব-সুবোরা টাকার টানাটানি অনুভব করত না। ফিলিপ ফ্রান্সিস একরাতের জুয়োখেলায় জিতেছিল কুড়ি হাজার পাউন্ড, বারওয়েল হেরেছিল চল্লিশ হাজার পাউণ্ড। এমন হার-জিত নিত্য চলত।

তাক লেগে যায় যখন ভাবি এই দরিদ্র দেশে হঠাৎ আলাদিনের প্রদীপ আবিষ্কৃত হল কি-ভাবে। সেভাবেই আবিষ্কার হক, আলাদিনের প্রদীপের সোনার-ফসল-বাহী শ্বেতাঙ্গগণ যখন স্বদেশে ফিরে যেত, প্রকট ঘৃণায় আর প্রচ্ছন্ন ঈর্ষায় সকলে তাদের বলত Nabob, কি না-নবাব। শ্বেতাঙ্গ নবাব ইতিহাসের এক বিচিত্র জীব। তো নবাবের আদি ও শ্রেষ্ঠ লর্ড ক্লাইভ কলকাতা সম্বন্ধে বলতে বাধ্য হয়েছে—চরাচরের নিকৃষ্টতম স্থান; দুনীতি, লাম্পট্য, বিবেকহীনতা শ্বেতাঙ্গ-মহলকে গভীরভাবে পেয়ে বসেছে আর তার কৃপায় সকলে অল্পকালের মধ্যে ধারণাতীত অর্থগৃধু, অমিতব্যয়ী ও বিত্তশালী হয়ে উঠেছে।

মোট কথা, অষ্টাদশ শতকের কলকাতা কামিনী কাঞ্চনের শ্রীক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। আবহাওয়া যেমন ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলকে প্রভাবিত করে এ বিষয়েও সেই নিয়ম খাটে। প্রথমে সর্বশ্রেষ্ঠের কথাই নেওয়া যাক। ক্লাইভ যখন গভর্নর, বিলাত থেকে কাউন্সিলের নূতন সদস্য এসে পৌঁছলে, দলে ভেড়ানোর উদ্দেশ্যে সোজাসুজি ক্লাইভ জিজ্ঞাসা করত, বলি কত টাকা চাও?

ওয়ারেন হেস্টিংসের পদ্ধতিটাও ছিল প্রায় একই রকম তবে টাকার পরিমাণ সদস্যের মর্জির উপর না ছেড়ে দিয়ে জনপ্রতি লক্ষ পাউন্ড পর্যন্ত খরচ করতে রাজী ছিল গভর্নর জেনারেল।

ক্লাইভ ও হেস্টিংসের আচরণ এক রকম হলেও, এমন দুটি ভিন্ন জাতের মানুষ কম দৃষ্ট হয়। ক্লাইভ ষোড়শ শতকের ইংরেজ বোম্বেটেগণের সুযোগ্য উত্তরপুরুষ-দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী, ন্যায়নীতিজ্ঞানশূন্য, অসাধারণ কর্মকুশল ও দেশপ্রেমিক। আর ইউরোপীয় ইতিহাসে যে-ভাবসমষ্টিকে অষ্টাদশ-শতকীয় বৈশিষ্ট বলা হয়, ওয়ারেন হেস্টিংসের চরিত্রে তার বিচিত্র ছায়াতাপ পড়েছিল; সে ছিল পূর্ণভাবে অষ্টাদশ শতকের সন্তান। জ্ঞানের সঙ্গে কর্মের যে অদ্ভুত সংমিশ্রণে অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ভলতেয়ার-চরিত্র গঠিত, তারই একটি ক্ষুদ্রতর প্রতিকৃতি যেন ওয়ারেন হেস্টিংস! সামান্য কুঠিয়ালের পদ থেকে নবজিত সাম্রাজ্যের ক্ষত্ৰপপ্রধানের পদপ্রাপ্তি কুলকৌলীন্যহীন ব্যক্তির পক্ষে সেকালে সামান্য কৃতিত্ব নয়। এই একটি বাক্যে তার অসাধারণ কর্মকুশলতার পরিচয়। আবার জ্ঞানের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ অষ্টাদশ শতকের বিশুদ্ধ জ্ঞানস্পৃহাকে প্রকাশ করে। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য ও ফারসী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব যারা প্রথম স্বীকার করেছিল তাদের মধ্যে হেস্টিংসের নাম অগ্রগণ্য; নিজের খরচে গীতার প্রথম ইংরেজী অনুবাদ ছাপিয়ে দিয়েছিল যে-ব্যক্তি, আর যাই হক ক্লাইভের মত সে গোয়ার ছিল না। লাটিন ও ফারসী সাহিত্যে ছিল তার অসামান্য দখল; লাটিনে এপিগ্রাম রচনায় বা ফারসীতে রুবাই তৈরিতে সেকালে এদেশে তার জুড়ি ছিল না।

এডমন্ড বার্কের প্রচণ্ড বাগিতার হাতুড়ির প্রত্যাঘাত করার ক্ষমতা তার ছিল না, কিন্তু অক্ষম রোষে এপিগ্রামের ছোবল মারতে বাধা কি?

Oft have I wondered that on Irish ground
No poisonous reptiles ever yet were found:
Revealed the secret stands, of Nature’s work,
She saved the venom to create a Burke!

মিতাহারী, মিতাচারী হেস্টিংস পালকির ডাক বসিয়ে চলেছে কাশী; কুরুপাণ্ডবের বীরত্ব কাহিনীর আকর্ষণে মন উধাও; কাশীতে নেমে চেৎ সিংকে এক গুতো দিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা পকেটস্থ করে আবার ফিরল পালকি; এবার হয়তো শাহনামার যুদ্ধ বিবরণ। পথে পড়ল এক দেশীয় রাজ্য; হুমকির হুঙ্কারে কতকগুলো জহরৎ এসে ভর্তি হল আর এক পকেটে; আবার চলল পালকি, এবারে একমনে ফারসী বয়েৎ রচনার পালা; দুদিকে হিন্দুস্থানের ধূসর রৌদ্রদীপ্ত দিগন্ত, মাঝখানে হস্পাহমা তালে চলেছে পালকি, যার মধ্যে প্রশস্তললাট, কৃশমুখমণ্ডল, ক্ষীণদেহ, অষ্টাদশ-শতকের ব্যক্তিত্ব বিরাজমান। এসব কথা খুব বেশি বদল-সদল না করে ভলতেয়ার সম্বন্ধেও অনায়াসে লেখা যেতে পারত। ক্লাইভ ও হেস্টিংস গায়ে গায়ে সংলগ্ন হওয়া সত্ত্বেও দুজনের মুখ ছিল দুদিকে; ক্লাইভ অতীত আর হেস্টিংস ভবিষ্যৎ।

বিশুদ্ধ জ্ঞান ও বিশুদ্ধ দস্তার মধ্যে এক রকম করে সমন্বয় করেছিল অষ্টাদশ শতক (ভলতেয়ারের প্রভূত বিত্তের অধিকাংশই উপার্জিত হয়েছিল চোরাবাজারে, ঘুষের কডিতে এবং অনুরুপ পন্থায়), তেমনি বিশুদ্ধ কাম ও বিশুদ্ধ প্রেমের মধ্যেও অপূর্ব সেতুবন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে যুগে। হেস্টিংসের দ্বিতীয় পক্ষের পত্নী ভূতপূর্ব ব্যারনেস ইমহফ। প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ এবং হেস্টিংসের সঙ্গে তার বিবাহ যে সম্পূর্ণ আইনানুগ হয় নি এমন কানাকানি তখনকার কালেও (কি কাল!) শোনা গিয়েছিল। হেস্টিংস তবু পটে ছিল, আইনের সূক্ষ্ম পর্দায় অতীতের সর্বকীর্তি প্রচ্ছন্ন না হলেও অতীতের উপরে যবনিকাপাত বলেই তোক ধরে নিয়েছিল। অন্য অনেকে সে পরিশ্রমটুকুও স্বীকার করে নি।

ফিলিপ ফ্রান্সিস, গভর্নরের কাউন্সিলের অন্যতম প্রধান সদস্য, হেস্টিংসের প্রবলতম প্রতিপক্ষ, কলকাতার শ্বেতাঙ্গ-সমাজের ভূষণস্বরূপ, এ হেন ফিলিপ ফ্রান্সিস রাতের অন্ধকারে নিজেকে মিশিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে কালো পোশাক পরে একখানা আস্ত মই বগলে নিয়ে রাজপথ দিয়ে চলেছে–পাঁচিল ডিঙিয়ে গ্রাঙের মাদাম গ্রাঙের সঙ্গে নৈশ সম্ভাষণের আশায়। তার পর হঠাৎ সে নৈশ আলাপে ব্যাঘাত ঘট, ম গ্রাঙের দারোয়ান চাপরাসী ফ্রান্সিসকে আটক করল, ফ্রান্সিস দেয়াল টপকে পালাল, ম গ্রাঙ মামলায় খেসারত পেল-এ সব তথ্য তখনকার কালেও (কি কাল!) শহরে চাঞ্চল্য এনেছিল। এতে আর যারই ক্ষতি হক-মাদাম গ্রাম্পের কোন ক্ষতি হয় নি। বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে কিছুকাল ফ্রান্সিসের রক্ষিতা রূপে থাকবার পর অদৃষ্টের দাবা-খেলোয়াড়ের হাত তাকে নিয়ে চলে গেল ফরাসী দেশে। নেপোলিয়নের সর্বশক্তিমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম ত্যালেরা র চোখে পড়ল ভুতপূর্ব মাদাম গ্রাঙ-আর মে মাদাম ত্যালেরা ও প্রিন্সেস ত্যালের রূপে জীবনাবসান ঘটল এই স্বৈরিণী মনস্বিনী নারীর।

উপরতলায় যেখানে এই অবস্থা, নীচের তলার অবস্থা সেখানে সহজেই অনুমেয়। সেকালের প্রায় প্রত্যেক সিভিলিয়ানের দেশী রক্ষিতা থাকত। ফোর্ট উইলিয়মের এক মেজরের একটি ছোটখাটো হারেম ছিল, বিবির সংখ্যা যোল জন। কৌতূহলী বন্ধুর ‘এতগুলোকে কি করে সামলাও’ প্রশ্নের উত্তরে সৌভাগ্যবান মেজর বলেছিল-খুব সহজ। ওদের পেট ভরে খেতে দিই, আর একটু ঘুরে ফিরে বেড়াতে সুযোগ দিই, তবে লক্ষ্য রাখি যাতে বেশি দূরে গিয়ে না পড়ে।

মেজরের উত্তরটা সেকালের অধিকাংশ সিভিলিয়ানের উত্তর। একদিকে অমিতব্যয়ের দেনা, অন্যদিকে অমিত-বিহারের সন্তান-সন্ততির ভার—দুয়ে মিলে সিভিলিয়ানদের নীচের দিকে টানত, অন্যদিকের পথ বন্ধ।

তবে তাদের একবারে অকৃতজ্ঞ বলা যায় না। কিছুকাল পরে যখন সিভিলিয়ানদের পরিবারের জন্য ভাতার প্রশ্ন উঠল, পুরনো আমলের সিভিলিয়ানগণ জারজ সন্তানদের জন্য ভাতা দাবি করল। নৃতন আমলের ছোকরার দল করল ঘোর আপত্তি। পুরনো দল ঠাট্টা করে লিখল—জিতেন্দ্রিয় সাধুপুরুষের দল!

আর ছোকরার দল বুড়োদের ঠাট্টা করে ব্যঙ্গচিত্র আঁকল-বুড়ো সিভিলিয়ানের পিছনে চলেছে এক দেশী রমণী, তার পিছে এক দেশী বালক।

বুড়োর দল হয়তো মনে মনে ভাবল–হায়, যদি একটিমাত্র হত!

আর যে-সব উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক রীতিমত বিয়ের আশা পোষণ করত, টাকা-কড়ির পেখম মেলে দেওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না। প্রজাপতির প্রধান দৌত্য করত জুড়িগাড়ি।

একবার এক যুবক দামী জুড়িগাড়ি কিনে ঈপ্সিতা তরুণীর মনোহরণ করতে পেরেছে কি না জানবার আশায় জিজ্ঞাসা করেছিল-বলি জটা কেমন দেখছ?

তরুণী নিরীহের মত শুধিয়েছিল, কোন্টা, যেটা টানছে না যেটা হাঁকাচ্ছে?

খিদিরপুরে অনাথ শ্বেতাঙ্গিনী বালিকাদের একটি সংরক্ষণাবাস ছিল। বিবাহেচ্ছু যুবকগণ সেখানে গিয়ে অনেক সময় ভাগ্য-পরীক্ষা করত। আর ভাগ্য-পরীক্ষার ক্ষেত্র ছিল জাহাজঘাটায়, নূতন জাহাজ পৌঁছবার শুভক্ষণে। বেওয়ারিশ তরুণী দেখলে যুবকের দল ঘেঁকে ধরত।

সেকালে চাল ডাল ঘি আটা মাছ মাংস প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য শ্বেতাঙ্গ সমাজের আর্থিক সামর্থ্যের অনুপাতে খুব সুলভ ছিল, কিন্তু অধিকাংশ গৃহেই এ সব বস্তু দুমূল্য হয়ে পৌঁছত। মিসেস ফে ১৭৮৯ সাল নাগাদ লিখছে যে তার খানসামা বলছে পাঁচ সের দুধ আর তেরোটা ডিম লেগেছে দু ডিশ পুডিং তৈরি করতে; আর জনপিছু দৈনিক বারো আউন্স মাখনের খরচা দেখায় লোকটা!

এখন একটিমাত্র খানসামার হাতটান যদি এমন হয়, তবে যে বাড়িতে ছোটয় বড়য় হরেক নামে তেষট্টিজন চাকরবাকর, সে বাড়িতে চিরদুর্ভিক্ষ তো বিরাজ করবেই; তবু তো মিসেস কে মধ্যবিত্ত গৃহিণী মাত্র, ধনী পরিবারে চাকরবাকরের সংখ্যা একশো-র অনেক উপরে।

টাকার অভাব? দোকানদাররা পরস্পরের মধ্যে পাল্লা দিয়ে জানিয়ে যেত, হজুর, আমি তিন হাজার টাকার মাল ধার দেব; মেমসাহেব, আমি দেব পাঁচ হাজার টাকার মাল।

তার পরে যখন টাকা শোধবার অপ্রীতিকর সময় আসত তখন বিপদে মধুসূদন বেশে আসরে অবতীর্ণ হত বাড়ির সরকার।

হুজুর, দত্তরাম চক্রবর্তী আমার দোস্ত, আত্মীয় বললেই হয়, অমন সাধুলোক আর হয় না। হুজুর ইশারা করলেই এখনই টাকার থলি নিয়ে হাজির হয়।

যুগপৎ আশায় ও উদ্বেগে হুজুর শুধায়–সুদ কত নেবে?

হুজুরের কাছে কি বেশি নিতে পারে? মাত্র শতকরা চল্লিশ টাকা।

কিন্তু আইনে যে মাত্র বারো টাকা বলে।

এবারে সরকার এমন একটি স্মিতহাস বিকশিত করে, যার ভাষ্য করতে গেলে মহাভারত লিখতে হয়। সে হাসিতে একসঙ্গে আইনের প্রতি আনুগত্য ও অবিশ্বাস; কোম্পানির প্রতি অশ্রদ্ধা ও হুজুরের প্রতি নির্ভরশীলতা, হুজুরের কল্যাণ ও পাওনাদারের আসন্ন তাগিদের স্মৃতি প্রকাশিত হয়।

তবে হুজুর চক্রবর্তীকে ডেকে পাঠাই?

সুদূর মাতৃভূমিব দুর্লভ স্মৃতি মনের মধ্যে একবার চেখে নিয়ে প্রচণ্ড একটা দীর্ঘনিশ্বাস চেপে হুজুর বলে—আচ্ছা তাই হক।

আব দা, ব্রাণ্ডি!

গ্রীষ্মের দুপুরে নির্জলা ব্রাণ্ডিতে লিভার পাকে পাকুক, তমসুক পেকে না উঠলেই আপাতত হুজুর খুশি।

হুজুর!

বড়সাহেব মনে মনে ভাবে, বন্দী। মোটের উপর–ঋণে, রক্ষিতায়, জারজ সন্তানে, দুরারোগ্য ব্যাধি ও অকালমৃত্যুতে বিজিত কলকাতা বিজয়ী মিঃ জনকে সম্পূর্ণ কবলিত করে ফেলেছিল। ক্লাইভ-বর্ণিত শয়তানের শহরের এই হচ্ছে প্রকৃত রূপ। তেমন করে খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, শয়তানও একবারে কৃপার অযোগ্য নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *