১.১৬
পরদিন ভোর হতে না হতেই কর্সুনোভা ছুটে এলো, শীগগির এসো, আইছেকে কে খুন করেছে।
শুনেই মার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। আততায়ী বলে চকিতে একজনকে তিনি সন্দেহ করলেন। বললেন—কে খুন করলো?
খুনী কি এখনো সেখানে বসে আছে?
কর্সুনোভা বললো, ভাগ্যিস্ তোমরা সবাই বাড়ি ছিলে? আমি দুপুর রাতে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে গিয়েছিলুম!
পথে যেতে যেতে মা ভীত হয়ে বললেন, কি বলছ তুমি? আমরা খুন করেছি, একথা কারু স্বপ্নেও আসতে পারে?
পারে। তোমরা ছাড়া মারবে কে! তোমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করত সে, এ তো রাজ্যসুব্ধ লোক জানে।
মার মনে আবার নিকোলাইর কথা জেগে উঠে।
কারখানার দেয়ালের অদুরে লোকের ভিড়-সেখানে আইছের মৃত দেহ। রক্তের চিহ্নমাত্র নেই। স্পষ্ট বোঝা যায়, কেউ গলা টিপে মেরেছে।
একজন বলে উঠলো, পাজী ব্যাটার উচিত শাস্তি হয়েছে!
কে–কে বললো একথা, বলে পুলিসরা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো শবের কাছে। লোকরা ছুটে পালালো। মাও বাড়ি চলে এলেন। এণ্ড্রি পেভেল বাড়ি এলে জিগ্যেস করলেন, কাউকে ধরেছে?
শুনিনি তো, মা।
নিকোলাইর কথা কিছু বলছে না?
না। এ ব্যাপারে তার কথা কেউ ভাবছেই না। সে কাল নদীতে গেছে, এখনো ফেরেনি।
মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।
খেতে বসে চামচে রেখে পেভেল হঠাৎ বলে উঠলো, এইটেই আমি বুঝি নে।
কি?—এণ্ড্রি বললো।
পেভেল বললো, উদরপূরণ করার জন্য যে হত্যা, তা অত্যন্ত বিশ্রী! হিংস্র জানোয়ারকে হত্যা—হাঁ, তা বুঝতে পারি,–মানুষ যখন হিংস্র পশুতে পরিণত হয়ে মানবজাতির ওপর অত্যাচার করতে যায়, তাকে আমি নিজ হাতে হত্যা করতে পারি। কিন্তু এইরূপ ঘৃণ্য তুচ্ছ কীটকে হত্যা করা—আমি বুঝিনে কেমন করে এ কাজে মানুষের হাত ওঠে।
এণ্ড্রি বললো, কিন্তু হিংস্র জানোয়ারের চাইতে সে বড় কম ছিল না।
তা জানি।
আমরা মশা মারি–যৎসামান্য রক্ত সে খায়, তা জেনেও।
পেভেল বললো, আমি ও সম্বন্ধে কিছুই বলছিনে। শুধু বলছি, এ অত্যন্ত ছোট কাজ।
এণ্ড্রি বললো, কিন্তু ও ছাড়া কি করতে পারো তুমি?
পেভেল বহুক্ষণ নিরুত্তর থেকে বললো, তুমি পারো অমনভাবে একটা মানুষকে খুন করতে?
এণ্ড্রি দৃঢ়কণ্ঠে বললো, নিজের জন্য কোনো জীবিত প্রাণীকে আমি ছোঁবও না; কিন্তু ব্রত সিদ্ধির জন্য, বন্ধুদের হিতার্থে আমি সব-কিছু করতে পারি—এমন কি তার সর্বনাশ সাধনও করতে পারি—নিজের ছেলেকে পর্যন্ত…
মা শিউরে বললেন, কি বলছ বাবা!
এণ্ড্রি হেসে বললো, সত্যি বলছি, মা, এ আমরা করতে বাধ্য…এই আমাদের জীবন।
পেভেল চুপ করে রইলো। এণ্ড্রি, হঠাৎ যেন কি এক ভাবের প্রেরণায় উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো, বললো, মানুষ কি করে একে ঠেকিয়ে রাখবে? মাঝে মাঝে অবস্থার ফেরে পড়ে বাধ্য হয়ে এক একটা মানুষের ওপর এমন কঠোর হয়ে উঠতে হয়, সেই নবযুগকে আহ্বান করে আনার জন্য, যখন মানুষের পক্ষে সম্ভব হবে, পরস্পরের সঙ্গে প্রেমের সম্বন্ধে জড়িয়ে পড়ার। জীবনের অগ্রগতির পথে বিঘ্ন যারা নিজেদের শান্তি এবং সম্মানের খাতিরে মানুষকে বিক্রয় করে যারা অর্থ সঞ্চয় করে তাদের বিরুদ্ধে তোমার দাঁড়ানো চাই-ই। সাধু লোকদের পথে দাঁড়িয়ে গোপনে তাদের সর্বনাশ করতে চায় যে যুডাস তাকে বাধা না দিলে আমিও যুডাসের মতো অপরাধী হবো। এ পাপ? এ অন্যায়? আমি জিগ্যেস করি, ঐ যে কর্তারা–ওরা কোন অধিকারে সৈন্য রাখে? জল্লাদ রাখে? কারাগার, দণ্ডনীতি, ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে মানুষকে দাবিয়ে রেখে নিজেদের সুখ-সুবিধা, নিরাপত্তার পথ খোলসা করে? যদি কখনো এমন হয় যে, তাদের দণ্ড দেবার ভার আমি তুলে নিতে বাধ্য হই, তখন আমি কি করব? হাঁ, আমি দেবব ওদের দণ্ড, ভয় খাবো না। ওরা মারে আমাদের দশে দশে, শ’তে শ’তে। আমারও অধিকার আছে হাত ভোলার,–সব চেয়ে কাছে যে শত্রু, সব চেয়ে যে বাধা জন্মায় তাকে আঘাত করার। এই হচ্ছে যুক্তি, কিন্তু তবু আমি স্বীকার করি, ওদের মারা নিষ্ফল—বৃথা রক্তপাত। সত্য জন্মায় একমাত্র আমাদের নিজেদের বুকের রক্ত-ভেজা জমিনে। আমি জানি তা, কিন্তু আমি এ পাপ করব—দরকার যখন হবে তখন নির্মম হ’বো। আমি একমাত্র আমার কথাই বলছি। আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এ পাপ মুছে যাবে, ভবিষ্যতের গায়ে তার কোনো চিহ্ন থাকবে না, আর কারুর নাম এতে কলঙ্কিত হবে না।…
এণ্ড্রি অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলো ঘরময়। তারপর বললো, জয়যাত্রার পথে এমন অনেক সময় হবে যখন তোমার নিজে বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে নিজেকে, তোমার প্রাণ, তোমার যথা-সর্বস্ব ত্যাগ করতে হবে। প্রাণ দেওয়া, ব্রতকল্পে জীবন উৎসর্গ করা—সে তো সোজা। আরো চাই, আরো দাও। তাই দাও, মা তোমার জীবনের চাইতেও প্রিয়। তখনই তুমি দেখবে, জীবনের প্রিয়তম বস্তু যে সত্য, তার অদ্ভুত জীবনীশক্তি।
ঘরের মাঝখানে সে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। তারপর চোখ আদ্দেক বুজে বিশ্বাস-দৃঢ়কণ্ঠে বলতে লাগলো আবার, … এমন সময় আসবে জানি, যখন মানুষ মানুষের সাহচর্যে আনন্দ পাবে, যখন নক্ষত্রের মতো একে অন্যকে আলো দেবে, যখন মানুষমাত্রের কানে বাজবে মানুষের কথা সঙ্গীতের মতো। মানুষ হবে সেদিন মুক্তিতে মহান, খোলা প্রাণে ঘুরবে ফিরবে তারা। হিংসা থাকবে না, বিদ্বেষ থাকবে না, লোভ থাকবে না, মানুষের যুক্তি অজ্ঞাত হবে না। জীবন হবে মানুষের সেরা। মানুষ উন্নতির চরম শিখরে উঠবে-কারণ তখন সে মুক্ত। তখন আমরা জীবন কাটাবো সত্যে, স্বাধীনতায়, সৌন্দর্যে। তখন তারাই হবে তত শ্রেষ্ঠ, যারা যত বেশি প্রাণ দিয়ে পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরতে পারে, মানুষকে যত বেশি ভালোবাসতে পারে। সব চেয়ে মুক্ত যারা, তারাই হবে সব চেয়ে মহান্ সব চেয়ে সুন্দর। তখন গৌরবমণ্ডিত হবে জীবন, গৌরবমণ্ডিত হবে জীবনের অধিকারী মানুষদল।…এই জীবনের জন্য আমি সবকিছু করতে প্রস্তুত। দরকার হলে আমি নিজ হাতে নিজের হৃৎপিণ্ড উপড়ে আনবো, নিজ পায়ে তা দলিত করব।…
উত্তেজনায় এণ্ড্রি কাঁপতে লাগলো। পেভেল মৃদুকণ্ঠে জিগ্যেস করলো, কি হয়েছে তোমার, এণ্ড্রি?
শোনো, আমিই তাকে খুন করেছি।
পেভেল বুঝলো, তাই এণ্ড্রি আজ এত চঞ্চল। এণ্ড্রির জন্য সহানুভূতিতে তার বুক ভরে গেলো। মাও এই ব্যথিত ছেলেটিকে স্নেই দিয়ে ঢেকে রাখতে চাইলেন।
এণ্ড্রি বললো, তাকে কেন খুন করলুম, জানো? আমায় অপমান করেছিল—মানুষের পক্ষে চরম অপমান। এমন অপমান করতে আমায় কেউ কখন সাহস করেনি। আমি কারখানার দিকে যাচ্ছি, সে আমার পিছু নিয়ে বলতে লাগলো, আমাদের সবার নামই নাকি পুলিসের খাতায় আছে, পয়লা মের আগে সব্বাইকে শ্রীঘরে যেতে হবে। আমি কোনো জবাব দিলুম না, হাসলুম; কিন্তু রক্ত আমার টগবগ করে ফুটে উঠলো। তারপর সে বললো, তুমি চালাক লোক…এ পথে না চলে তোমার উচিত আইনের কাজে প্রবেশ করা, অর্থাৎ গোয়েন্দা হওয়া..ওঃ, কি অপমান, পেভেল! এর চাইতে মুখের ওপর ঘুসি মারলো না কেন সে! তাও হয়তো সইতে পারতুম। কিন্তু এ অসহ্য! মাথায় খুন চেপে গেলো। পেছন দিকে এক ঘুসি চালালুম… তারপর চলে গেলুম। ফিরে তাকালুমও না। শুনলুম সে ধপ করে পড়ে গেলো নীরবে। মারাত্মক যে কিছু হয়েছে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি শান্তভাবে চ’লে গেলুম, যেন আর কিছু করিনি, একটা ব্যাঙকে লাথি মেরে পথ থেকে সরিয়ে রেখেছি।…তারপর কাজ করতে করতে শুনলুম, আইছে খুন হয়েছে। কথাটা আমার এমন-কি বিশ্বাসও হ’ল না–কিন্তু হাত যেন কেমন অসাড় হয়ে এলো…এ পাপ নয় আমি জানি, কিন্তু এ নোঙরা কাজ…সমস্ত জীবনেও যার কালিমা আমি ধুয়ে ফেলতে পারব না।
পেভেল সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে বললো, তা এখন কি করতে চাও, এণ্ড্রি?
কি করব?…আমি খুন করেছি, একথা কবুল করতে ভয় খাইনে আমি। কিন্তু লজ্জা হয়…এমন একটা তুচ্ছ কাজ করে জেলে যেতে লজ্জা হয়। কিন্তু অন্য কেউ যদি এর জন্য অভিযুক্ত হয়, তাহলে আমি গিয়ে ধরা দেবো; নইলে যেমন আছি তেমনি থাকবে।
সেদিন কেউ আর কাজে গেলো না। পেভেল আর মা এণ্ড্রির কথাই বলতে লাগলো। পেভেল বললো, এই তো দেখ, মা, আমাদের জীবন। এমনভাবে আমরা আছি পরস্পর সম্পর্কে যে ইচ্ছে না থাকলেও আঘাত করতে হয়। কাদের? ঐ সব ঘৃণ্য নির্বোধ জীবদের, সৈন্য, পুলিস, গোয়েন্দাদের…যারা আমাদের মত মানুষ, কিন্তু যাদের রক্ত আমাদেরই মতো শোষিত হচ্ছে অহর্নিশ, যারা আমাদেরই মত মানুষ হয়েও মানুষ বলে গণ্য হচ্ছে না। কর্তারা একদল লোকের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন আর একদল লোক …ভয় দেখিয়ে তাদের অন্ধ করে রেখেছেন: হাত-পা বেঁধে নিঙরে শুষে নিচ্ছেন তাদের রক্ত… এক দলকে দিয়ে আর একদলকে করছেন আঘাত। মানুষকে আজ তারা পরিণত করেছেন অস্ত্রে, আর তার নাম দিয়েছেন সভ্যতা।
তারপর কণ্ঠ আরও দৃঢ় করে বললো, এ পাপ, মা। লক্ষ লক্ষ মানুষকে, লক্ষ লক্ষ আত্মাকে হত্যা করার জঘন্য পাপ। হাঁ, আত্মাকে হত্যা করে তারা। তাদের আমাদের তফাৎ দেখ, মা। এণ্ড্রি না বুঝে খুন করেও কেমন বিষঃ, লজ্জিত অস্থির হয়ে পড়েছে। আর তারা হাজার হাজার খুন করে যাবে শান্তভাবে-একটু হাত কাঁপবে না, দয়া হবে না, প্রাণ শিউরে উঠবে না। তারা খুন করবে আমাদের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে। কেন জানো, মা? তারা সবাইকে সমস্ত কিছুকে টুটি টিপে ধরে মারে শুধু ওদের বাগানবাড়ি, আসবাবপত্র, শোনা রূপা কোম্পানীর কাগজ এবং লোককে দাবিয়ে রাখবার যতকিছু সাজ-সরঞ্জাম, নিরাপদ রাখতে। ওরা খুন করে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে নয়– ওদের সম্পত্তি বাঁচিয়ে রাখতে।…এই অন্যায়, এই অপমান, এই নোঙরামি…এই-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, আমরা যে সত্য নিয়ে লড়াই করছি তা কত বড়, কত গৌরবময়।
বাইরে লোকের পায়ের শব্দ হল। দু’জনে চমকে চাইলেন, পুলিস নয় তো!
.
১.১৭
দোর খুলে ঢুকলো রাইবিন।
রাইবিন সেই শহর ছেড়ে বেরুলো সত্যপ্রচারে–আড্ডা গাড়লো গিয়ে এডিলজেভ বলে এক গ্রামে। যাবার সময় সে মেলাই গরম গরম বই ও ইস্তাহার নিয়ে গিয়েছিল,–তাই দিয়ে সে সত্য প্রচার করতে। বইগুলোর বেশ চাহিদা ছিল। আরো বইয়ের দরকার বলে রাইবিন ইয়াফিম বলে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে শহরে এসেছে।
পেভেল রাইবিনকে সাদরে অভ্যর্থনা করলো।
রাইবিন সেই ক্রুদ্ধ বিদ্রোহীই আছে। কর্তাদের ওপর, বুর্জোয়াদের ওপর আজো সে তেমনি চটা। কথাপ্রসঙ্গে বললো, আমার বেশ সুবিধা আছে, নিষিদ্ধ বই ছড়ানো, আর পুলিশ টের পেলে ধরবে ও অঞ্চলের দু’জন শিক্ষককে, আমায় সন্দেহ করতে পারবেনা।
পেভেল বললো, কিন্তু এটাতো উচিত নয়, রাইবিন।
কোনটা।
তুমি কাজ করবে, আর তার দুঃখ ভোগ করবে অন্যে!
রাইবিন জবাব দিলো, তুমি ভুল বুঝেছে, পেভেল! প্রথমত, শিক্ষকরা বুর্জোয়া, তাদের কোনো ভয় নেই। কর্তারা শাস্তি দেবেন যেসব পল্লিবাসীর কাছে বই পাবেন, তাদেরই। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের বইয়েতে কি নিষিদ্ধ কথা কিছু নেই? আছে, তবে তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লেখা, আমার বইয়ের মতো সোজা খোলাখুলি লেখা নয়। তৃতীয়ত, বুর্জোয়াদের সঙ্গে বনিবনাও করে চলতে চাই না আমি। পায়ে যে হাঁটছে তার কি সাজে ঘোড়-সওয়ারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা? সত্য কথা বলতে কি, ওদের এই গায়ে-পড়ে দেশের কাজ করাটাকে আমি দস্তুরমত সন্দেহ করি। ওদের উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই খুব সাধু নয়। তাই ওরা বিপদে পড়লে আমি দুঃখিত হব না। সাধারণ পল্লিবাসীর ওপর অবশ্য এ রকমটা করতুম না।
মা বললেন, কিন্তু কর্তাদের মধ্যেও এমন দু’চারজন আছেন, যারা আমাদেয় জন্য প্রাণ দেন।
রাইবিন বললো, তাদের কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু বেশির ভাগের সঙ্গেই আমাদের অহি-নকুল সম্পর্ক। আমরা ‘হাঁ’ বললে, ওরা বলবে ‘না’ আর আমরা ‘না’ বললে, ওদের ‘হাঁ’ বলাই চাই—আমার পেট ভরে খেলে ওদের ঘুম হয় না, এই ওরা। পাঁচ বছর ধরে আমি শহরে শহরে, কারখানায় কারখানায় ঘুরেছি, তারপরে গেলুম গ্রামে—কিন্তু গিয়ে যা দেখলুম, তাতে বুঝলুম, আর এমন করে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তোমরা শহরে থাকো, ক্ষুধা কি জানো না, অত্যাচার কি প্রত্যক্ষ কর না। কিন্তু গ্রামে সমস্ত জীবন ক্ষুধা মানুষের সঙ্গী হয় ছায়ার মতো ক্ষুধা মানুষের আত্মাকে ধ্বংস করে–তার আকৃতি থেকে মানুষের ছাপ লোপ করে দেয়। মানুষতো গ্রামে বেঁচে নেই, তারা অপরিহার্য অভাবে পচে মরছে, আর তারই চারদিকে কর্তারা শ্যেনদৃষ্টি বিস্তার করে বসে আছে একটি টুকরোও যাতে তাদের মুখে এসে না পড়ে–পড়লে, যাতে তাদের মুখে ঘুসি মেরে তারা তা ছিনিয়ে নিতে পারে।
রাইবিন চারদিকে চাইলো, তারপর পেভেলের দিকে নুয়ে পড়ে টেবিলের ওপর হাত রেখে বলতে লাগলো, এমনি জীবন দেখে গা আমার রি রি করে উঠলো—ইচ্ছে হ’ল ছুটে শহরে চলে যাই। কিন্তু গেলুম না, গ্রামেই রইলুম। কর্তাদের চর্ব্যচোষ্য যোগাবার জন্য নয়, তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। মানুষের ওপর অনুষ্ঠিত এই অন্যায়, এই অত্যাচারের জ্বালার বাহন আমি—শানিত ছুরিকার মতো এই অন্যায় অহর্নিশ আমার প্রাণে কেটে কেটে বসছে…আমায় সাহায্য কর পেভেল–এমন বই দাও, যা পড়ে মানুষ আর স্থির থাকতে পারবে না—তার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠবে, এমন সত্য আজ তাদের শিক্ষা দাও যা গ্রামকে উত্তপ্ত করে তুলবে, যা শুনে মানুষ মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়বে।…
তারপর হাত তুলে প্রত্যেকটা কথার ওপর জোর দিয়ে বলতে লাগলো, মৃত্যু আজ শোধ করুক মৃত্যুর ঋণ–মৃত্যু আজ উদ্বুদ্ধ করুক নব-জীবন। সহস্র সহস্র প্রাণ আজ উৎসর্গীকৃত হ’ক বিশ্বমানবকে নবভাবে জাগিয়ে তোলার জন্য।…এই চাই। শুধু মরা নয়-সে তে সোজা। চাই নব জীবন, চাই বিপ্লব…
মা চা নিয়ে এলেন। পেভেল বললো, বেশতো, মাল-মশলা দাও, পাড়াগাঁর জন্যও আমরা একটা কাগজ বের করছি।
দেবো। যতদুর সম্ভব সোজা ভাষায় লিখো…একটা ছোট ছেলে যেন বুঝতে পারে।
তারপর হঠাৎ বলে উঠলো, আহা, যদি ইহুদী হতুম আমি! খৃস্টান সাধুরা অপদার্থ…ইহুদী প্রফেট এমন ভাষায় কথা কইতে পারতো, যা শুনলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। তারা গির্জায় বিশ্বাসী ছিল না, ছিল আত্মবিশ্বাসী; তাদের ভগবান ছিল তাদেরই অন্তরে। তাই তারা মানতো একমাত্র অন্তরের নীতি। মানুষ আইনের দাস নয়, সে মানবে তার অন্তরকে। তার অন্তরে সমস্ত সত্য নিহিত। সে পুলিসের দারোগাও নয়, গোলামও নয়-সে মানুষ, মার সমস্ত আইন তার মধ্যে।
রান্নাঘরের দোর খুলে এক যুবক এসে ঢুকলো। এই ইয়াফিম। রাইবিন তাকে পরিচিত করে দিলো পেভেলের সঙ্গে। তারপর বই বাছা শুরু হল। বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে ইয়াফিম বললো, মেলাই বই দেখছি আপনাদের, কিন্তু পড়বার ফুরসুং বোধ হয় কম, গ্রামে কিন্তু পড়ার সময় প্রচুর।
কিন্তু ইচ্ছে বোধ হয় কম?—পেভেল বললো।
কম? কম কেন হবে। যথেষ্ট ইচ্ছে তাদের। দিনকাল কেমন পড়েছে জানেন তো! ভাববার শক্তি হারিয়ে যে নিশ্চিন্ত থাকতে চায়, তার মৃত্যু অবধারিত। মানুষ তো আর মরতে চায় না, তাই ভাবতে শুরু করেছে। তাইতো বই’র চাহিদা…ভূতত্ত্ব—এটা কি?
পেভেল ভূতত্ত্ব কি বুঝিয়ে বলতে ইয়াফিম বললো, জমির উদ্ভব হল কি করে চাষীরা তা তত জানতে চায় না, যত জানতে চায় জমি কি করে তাদের বেহাত হয়ে জমিদারের হাতে গেলো। পৃথিবীটা স্থির থাকুক, ঘুরুক, দড়িতে ঝুলুক, যা খুশি হ’ক—কোনো আপত্তি নেই তাদের–তারা শুধু চায় খাবার।
এমনিভাবে বই বাছাই চলতে লাগলো। পেডেল ইয়াফিকে জিগ্যেস করলো, তোমার নিজের জমি আছে?
হাঁ, ছিল, কিন্তু জমি চষে আর রুটি মেলে না, তাই ছেড়ে দিয়েছি। ভাবছি, এবার সৈন্যদলে ঢুকবো। কাকা বারণ করেন, বলেন, সৈন্যদের কাজ তো লোকদের ধরে ঠেঙানো। কিন্তু আমি যাবো, বহুযুগ ধরে মানুষদের সৈন্যের সাজে সাজিয়ে রাখা হয়েছে—আজ তার অবসান করার দিন এসেছে। কি বলেন?
দিন এসেছে সত্য, কিন্তু কাজটা শক্ত। সৈনিকদের কি বলতে হবে, কেমন করে বলতে হবে, তা জানা চাই।
তা জানবো, শিখবো।
কর্তারা টের পেলে গুলি করে মারবে।
তা জানি। জানি যে তারা কোনো দয়া দেখাবে না। কিন্তু লোক তো জাগবে। আর এই জাগরণই তো বিদ্রোহ। নয় কি?
এবার ওঠা যাক।
রাইবিন, ইয়াফিম উঠে পড়লো। বইগুলো হাতে নিয়ে ইয়াফিম…বললো, আজকাল এ-ই আমাদের আঁধারের আলো।
তারা চলে গেলে পেভেল এণ্ড্রিকে বলে, রাইবিনের তেজ আছে দেখছি।
এণ্ড্রি বললো, হাঁ, আমিও তা লক্ষ্য করেছি।…চাষীদের মন আজ বিষিয়ে উঠেছে। ওরা যক্মহন জাগবে, ওরা যখন নিজেদের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবে, সমস্ত জিনিস ওরা ওলট-পালট করে দেবে। ওরা চায় মুক্তি, জমি–তাই সমস্ত কিছু প্রতিষ্ঠানকে ওরা ভেঙে-চুরে পুড়িয়ে ভূমিসাৎ করে দেবে মুষ্টি-মুষ্টি ভস্মের মধ্যে বিলুপ্ত হবে তাদের ওপর যুগ-যুগান্ত ধরে অনুষ্ঠিত অন্যায়।
পেভেল বললো, তারপর তারা লাগবে আমাদের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে।
না পেভেল। আমরা তাদের দলে টানতে পারব। বোঝাতে পারব যে, মজুর আর চাষী একই ব্যথার ব্যথী, একই পথের পথিক। আমি জানি, তারা আমাদের কথায় বিশ্বাস করবে, আমাদের দলে যোগ দেবে।
.
১.১৮
দিন কয়েক পরে নিকোলাই এসে হাজির হলো। বললো, ব্যাটাকে আমিই সাবাড় করবো মনে করেছিলুম, কিন্তু মাঝখান থেকে কে এসে মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিলে।
পেভেল স্নেহভরা কণ্ঠে বললো, চুপ চুপ, যা-তা বলো না।
নিকোলাই বললো, কি করবো আমি। দুনিয়ার কোথায় আমার স্থান–কিছুই বুঝি না। চোখে সব দেখি, মানুষের ওপর যে অন্যায় হচ্ছে, তা’ মর্মে মর্মে অনুভব করি; কিন্তু তা খুলে বলার ভাষা পাই না।…বন্ধু, আমায় কাজ দাও…একটা কঠিন কাজ দাও…এই অন্ধ, অকেজো, জীবন আর সহ্য করতে পাচ্ছি না আমি তোমরা এক মহান কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সে কাজ ক্রমশ এগোচ্ছে, দেখছি…অথচ আমি দূরে দাঁড়িয়ে। কাঠ তুলি, তক্তা ফাড়ি …অসহ্য। আমায় একটা শক্ত কাজ দাও, ভাই।
পেভেল বললো, দেবো।
এণ্ড্রি বলে উঠলো, চাষীদের জন্য আমরা একখানা কাগজ বের কচ্ছি। তুমি টাইপ সাজানো শিখে তার কম্পোজিটারের কাজ কর। আমি তোমায় শিখিয়ে দেবো।
নিকোলাই বললো, তা যদি দাও, তাহলে এই ছুরিখানা তোমায় উপহার দেবো।
এণ্ড্রি হেসে উঠলো, ছুরি! ছুরি নিয়ে কি করব?
কেন, ভালো ছুরি, দেখো না!
আচ্ছা, সে দেখা যাবে। এখন চল, বেড়িয়ে আসি।
তিন জনে বেড়াতে বেরিয়ে গেলো।
দিন বয়ে চললো এম্নি করে। পয়লা মে’র উৎসবের আয়োজনও চলতে লাগলো পূর্ণ মাত্রায়। পথে, ঘাটে, কারখানায়, দেয়ালে, থানার গায়ে, লাল ইস্তাহারের ছড়াছড়ি। পেভেল এণ্ড্রি, দিন-রাত সমানে খাটে। মার ওপরও বহুৎ কাজের ভার থাকে। মা সারাদিন তাই নিয়ে ছুটোছুটি করে বেড়ান। স্পাইতে পল্লি ভরে গেছে কিন্তু কাউকে হাতে-কলমে ধরতে পাচ্ছেনা। পুলিসদের শক্তিহীনতা দেখে তরুণদের আশা এবং উৎসাহ বাড়ছে।
তারপর এলো সেই পয়লা মে।
মা সব্বার আগে জেগে উনুন ধরিয়ে চায়ের জল চাপালেন। জল ফুটে গেলো, কিন্তু তিনি ছেলেদের ডাকলেন না। আজ ওরা একটু ঘুমোক, এ ক’দিন অতো খেটেছে।
কারখানার পয়লা বাঁশি বেজে গেলো। তখনো তাদের ঘুম ভাঙলো না। দ্বিতীয় বাঁশি বাজাতে এণ্ড্রি, উঠে পেভেলকেও ডেকে তুলল। তারপর চা খেতে গেলে মায়ের কাছে।
মা এণ্ড্রিকে একান্তে বললেন, এণ্ড্রি, ওর কাছে-কাছে থাকিস বাবা!
নিশ্চয়ই। যতক্ষণ সম্ভব, থাকবো।
পেভেল বললো, চুপি-চুপি কি কথা হচ্ছে তোমাদের?
কিছু না। মা বলছিলেন, হাত-মুখ বেশ করে ধুতে, যাতে মেয়েরা আমাদের দিকে চেয়ে আর না চোখ ফেরাতে পারে। বলে এণ্ড্রি, হাতমুখ ধুতে চলে গেলো।
পেভেল গাইতে লাগলো মৃদুস্বরে, ওঠো, জাগো, মজুরদল…
মা বললেন, শোভাযাত্রার বন্দোবস্ত করলে পারতিস এখন।
বন্দোবস্ত সবই ঠিক হয়ে আছে, মা।
যদি আমরা ধরা পড়ি আইভানোভিচ এসে যা করার করবে। সে-ই তোমার সব রকমে সাহায্য করে।
বেশ…মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন।
ফেদিয়া মেজিন যৌবনোচিত উৎসাহ এবং আনন্দ-দীপ্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, শুরু হয়ে গেছে। সবাই রাস্তায় বেরিয়েছে। নিকোলাই, গুসেভ, শ্যামোয়লোভ কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। বেশির ভাগ লোক কারখানা ছেড়ে বাড়ি চলে এসেছে। চলো, আমরাও যাই, এই ঠিক সময়। দশটা বেজে গেছে।
যাচ্ছি।
দেখবে, মধ্যাহ্নভোজের পর সবাই জেগে উঠবে।
মেজিন, এণ্ড্রি, পেডেল, মা-–চারজনেই বেরিয়ে পড়লেন পথে। দোরে, জানালায়, পথে, সর্বত্র লোকের ভিড় এবং কোলাহল। সবাই এণ্ড্রি পেভেলের দিকে চাইছে, সবাই তাদের অভিনন্দিত করছে। এক জায়গায় একজন চিৎকার করে উঠল, পুলিস ধরবে ওদের; তা হলেই সব শেষ।
আর একজন জবাব দিলো, ধরুক, তাতে কি হয়েছে!
আর একটু দুরে জানালা দিয়ে ভেসে আসছে এক রমণীর অরুদ্ধ কণ্ঠস্বর…একবার ভেবে দেখ, তুমি কি একা?—একা নও। ওরা সব অবিবাহিত। ওদের কি …
যোশীমভের পা কবে কাটা পড়েছিল বলে কারখানা থেকে সে মাসোয়ারা পেতো। তার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে সে জানালা দিয়ে মুখ বের করে চেঁচিয়ে উঠলো, পেভেল, পাজি, তোর মুণ্ডুটা ওরা ছিঁড়ে না নেয় তো কি বলেছি।
মা শিউরে উঠলেন, ক্রুদ্ধ হলেন। তারা কিন্তু কিছুমাত্র গায়ে না মেখে দিব্যি সাত-পাঁচ গল্প করতে করতে চললো। মিরোনোভ বলে এক মজুর এসে তাদের বাধা দিয়ে বললো, শুনচি নাকি তোমরা দাঙ্গা করতে যাচ্ছ, সুপারিন্টেণ্ডেণ্টের জানালা ভাঙতে যাচ্ছো?
পেভেল বললো, সে কি! আমরা কি মাতাল?
এণ্ড্রি বললো, আমরা যাচ্ছি শুধু নিশান নিয়ে শোভাযাত্রা বের করতে, আর মজুরদের গান গাইতে। সে গান তোমরাও শুনতে পাবে। সেতো শুধু গান নয়, সে মজুরদের মন্ত্র, মজুরদের মতবাদ!
মিয়োনোভ বললো, সে সব আমি জানি। আমি তোমাদের লেখা পড়ি কিনা…তারপর মা, তুমিও বুঝি বিদ্রোহ করতে চলেছে।
হাঁ। মৃত্যু যদি আসে, আমি সত্যের সঙ্গে গলাগলি হয়ে পথ চলবো।
ওরা দেখছি নেহাৎ মিথ্যে বলেনি যে, তুমিই কারখানা, ইস্তাহার ছড়াও।
কারা বলেছে? পেভেল জিগ্যেস করলো।
লোকেরা! আচ্ছা, আসি তাহলে।…
মিরোনোভ চলে যেতে পেভেল বললো, তুমিও দেখছি, মা, জেলে যাবে।
যাই যাবো–-মা ধীরে ধীরে বলেন।
সূর্য ওপরে উঠলো। বেলা বাড়ছে। লোকের উত্তেজনাও বাড়ছে। বড় রাস্তার গায়ে এক গলির মাথায় শ’খানেক লোকের ভিড়। তার মধ্য দিয়ে আসছে নিকোলাইর গলা…মুগুরের ঘায়ের মতো…ওরা আমাদের রক্ত নিঙরে নিচ্ছে, ফল থেকে রস যেমন করে নেওয়া হয়।
সত্যি কথা—একযোগে অনেকগুলি কণ্ঠ বেজে উঠলো।
এণ্ড্রি, বললো, সাবাস, নিকোলাই! বৃলেই সে তার কর্ক্সক্রুর মতো দেহটা ভিড়ের মধ্যে গলিয়ে দিলো! পরক্ষণেই বেজে উঠলো তার গলা, বন্ধুগণ, ওরা বলে, পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন জাতি ইহুদী, জার্মান, ইংরেজ, তাতার…কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করিনে। দু’টি মাত্র পরম্পর-বিদ্বেষী জাত আছে দুনিয়ায়—ধনী এবং দরিদ্র। ধনীদের পোশাক বিভিন্ন হতে পারে, ভাষা স্বতন্ত্র হতে পারে, দেশ হিসাবে তারা ফরাসী, জার্মান অথবা ইংরেজ হতে পারে, কিন্তু মজুরদের সঙ্গে কারবারের বেলা তারা সবাই একজাত, সবাই তাতার। নিপাত যাক এই ধনীর দল!
শ্রোতাদের মধ্যে একটা উল্লাসের ঢেউ বয়ে গেলো।
এণ্ড্রি, বলতে লাগলো, এবার চাও মজুরদের দিকে। ফরাসী মজুর, জার্মান মজুর, ইংরেজ মজুর—সবাই কাটাচ্ছে আমাদের রুশ-মজুরের মতোই কুকুরের জীবন।
ভিড় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। এণ্ড্রি গলা চড়িয়ে বলতে লাগলো, বিদেশের মজুররা আজ এই সোজা সত্য বুঝতে পেরেছে। আজ পয়লা মে’র এই উজ্জ্বল দিবসে তারা আবদ্ধ হচ্ছে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে; কাজ ছেড়ে, বাস্তায় এসে দলে দলে মিলিত হয়ে তারা আজ পরস্পরকে দেখছে, আর হিসাব নিচ্ছে তাদের বিপুল শক্তির। এইদিনে মজুরদের মধ্যে স্পন্দিত হচ্ছে একটি প্রাণ,-মজুরদের যে কী বিপুল শক্তি, এই জ্ঞানে সকল প্রাণ আলোকিত; সমস্ত হৃদয়ে আজ বন্ধুত্বের স্পন্দন; সঙ্গীদের সুখের জন্য, তাদের মুক্তি এবং সত্য লাভের জন্য যে যুদ্ধ, তাতে আত্মদান করতে সবাই আজ প্রস্তুত।…
কে একজন চেঁচিয়ে উঠলো, পুলিস।
.
১.১৯
চারজন অশ্বারোহী পুলিস ‘ভাগো’ ‘ভাগো’ বলে ছুটে এলো। পলকে মজুররা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। এণ্ড্রি তখনও রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ঘোড়া তার গায়ে এসে পড়ার উপক্রম দেখে সে সরে দাঁড়ালো, আর তক্ষুণি মা তাকে টেনে নিলেন, তুমি না কথা দিয়েছে, পেভেলের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে!
ঘাট হয়ে গেছে, মা, তাই থাকবো।
আবার চলতে লাগলো তারা।
গির্জার বাগানে এসে থামলো। চার-পাঁচশো লোকের ভিড়। ছেলে মেয়ে, বুড়ো ছুটোছুটি করছে চারদিকে প্রজাপতির মতো আনন্দে। জনসমুদ্র দুলছে একবার এদিকে, একবার ওদিকে। ভড়ের মধ্যে শিজভের গলা,…না, আমাদের ছেলেদের আমরা ত্যাগ করবনা। জ্ঞানে ওরা আমাদের শ্রেষ্ঠ, সাহসে ওরা আমাদের শ্রেষ্ঠ। জলাভূমির জন্য অন্যায় কর হতে কারা আমাদের রক্ষা করেছে?–ওরা! এ কথাটা ভুললে চলবে না। এ করে ওরা জেলে গেছে, কিন্তু সুফল ভোগ করছি আমরা—আমরা সকলে।…
বাঁশি বেজে উঠলো, জনতার কলরবকে ডুবিয়ে দিয়ে। সবাই চম্কে উঠলো। যারা বসে ছিল, উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এক মুহূর্ত সব মৃত্যুর মতো নীরব, নিথর। সবারই সতর্ক দৃষ্টি, মলিন-মুখ। তার মধ্যে আচমকা ধ্বনিত হ’ল পেভেলের দৃঢ় কণ্ঠ, বন্ধুগণ!…
মা’র চোখের সামনে জ্বলে উঠলো যেন আগুনের দীপ্তশিখা…সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করে তিনি নিজের দেহটা পেভেলের পেছনে এনে দাঁড় করালেন। সকলের দৃষ্টি ফিরলো পেভেলের দিকে…চুম্বক যেন টানছে লৌহ-শলাকাকে।
বন্ধুগণ! ভাইগণ! আজ লগ্ন উপস্থিত…আজ বর্জন করতে হবে আমাদের এই জীবন, এই লোভ, ঈর্ষা, অন্ধকারের জীবন, এই হিংসা মিথ্যা অপবিত্র জীবন, এই জীবন-যেখানে আমাদের কোন স্থান নেই, যেখানে আমরা মানুষ বলে পরিগণিত নই।…
পেভেল থামলো, জনতা নিঃশব্দে তার দিকে আরো চেপে দাঁড়ালো। মা ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন…কী গৰ্বপূর্ণ সাহস-দীপ্ত জলন্ত ছেলের চোখ!
… বন্ধুগণ, আমরা সংকল্প করেছি, মুক্তকণ্ঠে প্রচার করব আমরা কে! …আমরা আজ নিশান তুলে ধরব আকাশে…যুক্তির নিশান, সত্যের নিশান, স্বাধীনতার নিশান! এই সেই নিশান।
জনতার মধ্য দিয়ে মজুরদের লাল ঝাণ্ডা লাল পাখির মতোই ঊর্ধ্বে উত্থিত হ’ল পেভেলের হাতে। তারপর হঠাৎ তা নুয়ে পড়তেই দশ বাবোখানা হাত তা ধরে ফেললো…তার মধ্যে মাও ছিলেন। পেভেল জয়ধ্বনি করে উঠলো, মজুরের জয়!
শত শত কণ্ঠে তার প্রতিধ্বনি হ’ল।
সোশ্যাল-ডিমোক্রেটিক মজুরদলের জয়! সকল দেশের সকল মজুরের জয়!
জনতা যেন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। নিশানের অর্থ যারা বোঝে, তারা ভিড় ঠেলে তার দিকে এগোয়। মা পেভেলের হাত চেপে ধরে আনন্দে, আবেগে কাঁপতে থাকেন। নিকোলাইও পেভেলের পাশে এসে দাঁড়ায়।
সকল কোলাহল ছাপিয়ে এণ্ড্রির কণ্ঠ ধ্বনিত হ’ল, বন্ধুগণ, আমরা আজ এক পবিত্র জয়যাত্রার সূচনা করলুম…নবীন এক দেবতার নামে। আমাদের সে দেবতা হচ্ছে—সত্য, আলোক, যুক্তি, মঙ্গল। এই পবিত্র জয়যাত্রার পথ যেমন দীর্ঘ, তেমনি কণ্টক-সংকুল। আমাদের লক্ষ্য দুরে, অতি দূরে। কাঁটার মুকুট আমাদের সামনে নাচছে, আমাদের অপেক্ষায়। যারা সত্যের শক্তিতে বিশ্বাসী নও, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সত্য রক্ষা করার সাহস যাদের নেই, আত্মশক্তিতে যারা বিশ্বাস করে, দুঃখের নামে যারা শঙ্কিত হও—তারা তফাতে সরে দাঁড়াও। আমরা তাদেরি আহ্বান করছি, যারা বিশ্বাস করে, জয়ী আমরা হবোই। আমাদের লক্ষ্য সম্বন্ধে যারা সন্দিগ্ধ, তারা আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করে চলে যাক…তারা চিরদিন পাবে শুধু দুঃখ। সঙ্গীদল, সজ্জিত হয়ে দাঁড়াও, বলো, জয়যুক্ত হ’ক এই পয়লা মে…জয়যুক্ত হক মুক্ত মজুর সংঘের এই উৎসব-তিথি।
হাজার হাজার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে, জনতা চেপে দাঁড়ালো। পেভেল লাল-নিশান তুলে ধরলো…তাতে সূর্যের রক্তবর্ণ কিরণ এসে ঝকঝক করে জ্বলতে লাগলো। ফেদিয়া মেজিন চেঁচিয়ে উঠলো, পুরাণে জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে পড় যাত্রীদল।…
যাত্রা শুরু হল। সবার আগে নিশান হাতে পেভেল। তারপরেই অন্যান্য নায়কদল। সবাই মজুরদের বিজয়-সংগীত গাইতে গাইতে চলেছে!
ওঠো, জাগো, মজুরদল!
ক্ষুধিত মানব যুদ্ধে চল।
পথের দু’ধার থেকে দলে দলে লোক সোল্লাসে নিশানের দিকে ছুটে আসে, ভিড়ে মিশে যায়, তারপর বিপ্লব-সংগীতে গগন আলোড়িত করে অগ্রসর হয়।
মা এ গান এর আগেও শুনেছেন বহুবার। কিন্তু আজ যেন প্রথম এর সুর তার প্রাণে গিয়ে লাগলো,–
দুঃখী সঙ্গী কাঁদিছে হায়!
সেথা যেতে হবে…আয়রে আয়…
জনতা গানের সুরে মেতে উঠতে লাগলো।
এক মা যাত্রী ছেলেকে বেঁধে রাখার চেষ্টায় কেঁদে উঠছেন, মিতিয়া, কোথায় যাচ্ছিল, বাবা!
মা তাকে বললেন, ছি বোন, যেতে দাও, ভয় পেয়োনা, ভয় কি? আমিও প্রথম প্রথম ভয় পেতুম; কিন্তু এখন ঐ দেখ, আমার ছেলে সবার আগে-নিশান হাতে-ঐ…
শঙ্কিতা মাতার কানে তা গেলো না। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন আর্তকণ্ঠে, ডাকাতরা করছে কি? কোথায় যাচ্ছে? সৈন্যেরা যে ওদের মেরে ফেলবে গো!…
মা বললেন, অধীর হয়োনা বোন! মহৎ কাজের ধরণই এই। এই যীশুখৃস্ট…তিনিই কি যীশুখৃস্ট হতে পারতেন, যদি না শত সহস্র লোক তার জন্য মরতো?
গানের সুর তখন আরও চ’ড়ে গেছে
জারের যখন সৈন্য চাই
ছেলে দাও, নইলে রক্ষা নাই…
শিজভ জোর গলায় বলে উঠলো, সাবাস্ জোয়ান, ভয়ডর কিছু নেই তোমাদের।…আমার ছেলে, সে যদি আজ বেঁচে থাকতো! কারখানা তাকে খুন করেছে। হাঁ, খুন করেছে।
মার বুকের রক্ত দ্রুততালে নেচে উঠলো। কিন্তু ভিড়ের অসম্ভব চাপে তিনি কোণঠাসা হয়ে এক দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন, জন-স্রোতের বিচিত্র গতি। হাজারে হাজারে উন্মত্ত লোক মনে হয় যেন একটা বৃহৎ কাঁসার জয় ঢাকের প্রলয়ংকর ধ্বনি তাদের মাতিয়ে তুলেছে কেউ মাতছে যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষায়, কেউ মাতছে একটা অস্পষ্ট আনন্দে, একটা নতুন কিছুর সম্ভাবনায়, একটা জ্বলন্ত কৌতুহলে! বহু বছরের পুঞ্জীভূত কণ্টকিত ব্যথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যেন আজ সংগীতের মধ্য দিয়ে বেরুচ্ছে।
সবাই ঊর্ধ্বে নিশানের দিকে চেয়ে পথ চলেছে, সবাই চিৎকার করছে, কিছু-না-কিছু বলছে, কিন্তু সমস্ত কণ্ঠ ডুবিয়ে বেজে উঠছে সেই গান নতুন গান…এ সে পুরাণে দুঃখ-করুণ সুর নয়, এ সে অভাবক্লিষ্ট ভয়াতুর ব্যক্তিত্বহীন নিরানন্দ নিঃসঙ্গ নিশি-যাত্রীর আর্ত-বিলাপ নয়, এ সে রুদ্ধ-শক্তির অভিব্যক্তি বেদনা নয়।…ভালোমন্দ দুই-ই অবিভেদে নাশ করে যে-এ সে ক্রুদ্ধ সাহসের উত্তেজিত সুর নয়! এ সে পশুশক্তি নয়, যা শুধু মুক্তির জন্যই মুক্তি চাই বলে চিৎকার করে, যা অন্যায়ের প্রতিহিংসাবশে শুধু ধ্বংসই করে চলে, সৃষ্টি করতে পারে না। দাসত্ব-দুষিত, পুরাণো জগতের কোন কিছু নেই এতে। সোজা… সরল সুদৃঢ় শান্ত এ সংগীত। মানুষকে এ মাতিয়ে নিয়ে চলে দীর্ঘ অন্তহীন পথে, সুদূর সমুজ্জ্বল ভবিষ্যতের অভিমুখে। পথের দুঃখ এ গোপন করে না। এর স্থির অচঞ্চল আগুনে জ্বলে পুড়ে গলে যায় মানুষের স্তূপীকৃত দুঃখ-বেদনা, তার চিরাভ্যন্ত মলিন সংস্কার-ভার, নব-যুগের সম্বন্ধে তার মিথ্যা আশঙ্কা।
সেই বিশাল জন-সমুদ্র এই সংগীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে চললো। পেছনে সংশয়ী বিজ্ঞদল। এ অভিনয়ের কখন কোথায় অবসান হবে, তা যেন তারা আগে থেকেই জানে। মা শুনলেন তাদের কথা।
একদল সৈন্য স্কুলের কাছে, আর একদল কারখানার কাছে।
গভর্ণর এসে পড়েছে।
তাই নাকি?
হাঁ, আমি স্বচক্ষে দেখলুম তাঁকে।
একজন তা শুনে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠলো, আমাদের ওরা কম ডরায় মনে করেছে? এইতো দেখো–গভর্ণর স্বয়ং সৈন্য নিয়ে হাজির হয়েছেন।…
বিজ্ঞদের কথা মার ভালো লাগছিল না। ভিড় ঠেলে তিনি সামনে এগিয়ে চললেন।
হঠাৎ মনে হল, জন-স্রোতের অগ্রভাগ যেন কি একটা কঠিন জিনিসের ওপর ঘা খেয়ে পেছনে টলে পড়ছে…জনতার মধ্য দিয়ে উঠছে একটা মৃদু কিন্তু আতঙ্ক-ভরা গুঞ্জন। গানের সুরটাও একবার কেঁপে উঠলো, তারপর ধ্বনিত হ’ল আরো উচ্চ এবং দ্রুত তালে। কিন্তু আবার গানের তাল ভঙ্গ হ’ল গায়কদল একে একে সরে পড়তে লাগলো দল থেকে …এদিকে ওদিকে দু’চারটি কণ্ঠ গানকে বাঁচিয়ে রাখার দুরূহ চেষ্টায় চেঁচাতে লাগলো।
ওঠো, জাগো, মজুরদল,
ক্ষুধিত মানব যুদ্ধে চল…
শোভাযাত্রার সামনে কি ব্যাপার হচ্ছে তা চোখে দেখতে না পেভেলও মা যেন ভাবতে পারলেন। দ্রুতপদে তিনি ভিড় ঠেলে এগিয়ে চললেন।
.
১.২০
এগিয়ে পেভেলের গলা পেলেন।
…বন্ধুগণ, সৈনিকেরাও আমাদের মতোই মানুষ। তারা আমাদের মারবে না। কেন মারবে? সকলের হিতার্থে আমরা সত্য প্রচার করি বলে? এ সত্য ঐ সৈনিকদেরও হিতকর। এখন ওরা একথা বুঝছে না বটে, কিন্তু দিন আসছে যখন ওরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে, যখন ওরা সমবেত হবে—ঐ ডাকাত এবং খুনীদের পতাকা–যে পতাকাকে ঐ মিথ্যাবাদী পণ্ডদল গৌরবের এবং সম্মানের পতাকা বলে অভিবাদন করতে ওদের বাধ্য করে তার তলে নয়, আমাদের এই মুক্তির এবং মঙ্গলের পতাকা তলে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এ পতাকা নিয়ে, যাতে তারা সত্বর এ সত্য উপলব্ধি করতে পারে। এগোও, বন্ধুগণ, দৃঢ়পদে এগিয়ে চলো।
পেভেলের কণ্ঠ দৃঢ় এবং স্পষ্ট। কিন্তু জন ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। একে একে ডাইনে বাঁয়ে, বাড়ির দিকে, বেড়ার পাশে ভেগে যেতে লাগলো লোক। জনতার আকৃতি হয়ে পড়লে গোঁজের মতো, আর তার আগায় নিশান হাতে পেভেল।
পথের শেষে বাগানের বাইরে যাবার পথ বন্ধ করে বেয়োনেটধারী একদল সৈন্য…দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে।
মা আরো এগিয়ে গেলেন।
পেভেল বললো, সঙ্গীগণ, সমস্ত জীবনভোর অগ্রসর হও। আর কোন গতি নেই আমাদের। গাও…
…ওঠো, জাগো, মজুরদল!
ক্ষুধিত মানব যুদ্ধে চল…
নিশানটা আরও ঊর্ধ্বে উঠে ঢেউ খেলে খেলে সৈন্য-প্রাচীরের দিকে এগিয়ে গেলো। মা শিউরে উঠে চোখ বুজলেন। জনতা সভয়ে থমকে দাঁড়ালো। এগোলো শুধু পেভেল, এণ্ড্রি শ্যামোয়লোভ ও মেজিন।
মেজিনের কণ্ঠে বেজে উঠলো সংগীতের সুর… ভীষণ রণে… ভয়-চকিত মোটা গলা পেছন থেকে গেয়ে উঠলো,
সঁপিলে প্রাণ…
গানের দু’টো চরণ বেরিয়ে এলো দু’টো দীর্ঘনিশ্বাসের মতো। জনতা আবার পা বাড়ালো সামনের দিকে তাদের পদধ্বনি স্পষ্ট শোনা গেলো। গান আবার নতুন, জোরের সঙ্গে নতুনভাবে বেজে উঠলো।
…ভীষণ রণে সঁপিলে প্রাণ
পর তরে দিল আত্মদান…
কে যেন ঠাট্টার সুরে বলে উঠলো, আহা হা, ব্যাটারা গান ধরেছে দেখোনা, যেন শ্রাদ্ধ-সংগীত।
আর একটি ক্রুদ্ধ কণ্ঠ এলো, ম্যার ব্যাটাদের!
মা বুকে হাত চেপে ধরলেন, চেয়ে দেখলেন, সেই বিরাট জনতা চঞ্চল, সচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এগিয়ে চলেছে নিশান হাতে জন বারো লোক–তারাও আবার এক এক করে ছিটকে যাচ্ছে দল থেকে …পায়ের তলার মাটি যেন হঠাৎ তেতে আগুন হয়েছে, এমনি ভাবে। ফেদিয়া গেয়ে উঠলো, …শেষ হবে এ অত্যাচার…
সমবেত সুর ধ্বনিত হল। —মানুষ জাগিবে পুনর্বার…
হঠাৎ সুর ভঙ্গ হয়ে তীক্ষ্ণ আওয়াজ এলো, সঙিন চালাও।
মুহূর্ত মধ্যে সঙিনগুলো একসঙ্গে ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়ে সূর্যালোকে ঝলমল করে উঠলো।
মার্চ।
ঐ রে, আসছে, বলে একজন খোঁড়া একলাফে রাস্তার একপাশে গিয়ে সরে দাঁড়ালো।
মা নিষ্পলকে চেয়ে রইলেন। সৈন্যদল গোটা রাস্তাটায় ছড়িয়ে পড়ে সঙিন উঁচিয়ে মার্চ করে আসছে–শান্তভাবে। খানিকদুর এসে তারা স্থির হয়ে দাঁড়ালো। মা ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন এণ্ড্রি পেভেলের আগে গিয়ে নিজের দীর্ঘ দেহ দিয়ে তাকে আগলে রেখেছে, আর পেভেল তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচাচ্ছে—সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। এণ্ড্রি মাথা উঁচু করে মহোৎসাহে গান গাইছে, পেভেল তাকে ঠেলা দিয়ে বলছে, পাশে যাও, নিশান সামনে থাক্।
‘ভাগো’ বলে একজন সামরিক কর্মচারী সজোরে ভূমিতে পদাঘাত করে চকচকে একখানা তলোয়ার খেলাতে লাগলো। তার পেছনে আবার আরও একজন কর্মচারী।
মা যেন শূন্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রতি মুহূর্তে তার বুক ফেটে যাবার উপক্রম হল। দু’হাতে বুক চেপে তিনি এগোতে লাগলেন—জ্ঞানশুন্য, চিন্তাশূন্য। পেছনে জনতা পাতলা হয়ে যাচ্ছে-শীতল বাতাহত পত্রের মতো তারা ঝড়ে পড়ছে দল থেকে।
লাল-নিশানের চারদিকে মজুররা আরও ঘেঁসাঘেঁসি হয়ে দাঁড়ালো। সৈনিকেরা সঙিন দিয়ে তাদের তাড়া করতে লাগলো। মা শুনলেন, পেছনে পলাতকদের শঙ্কিত পদশব্দ আর কণ্ঠস্বর–
পালাও, পালাও—
দৌড়ে যাও, মা—
পিছিয়ে এলো, পেভেল।
নিশান ছাড় পেভেল, আমায় দাও, আমি লুকিয়ে রাখছি–বলে নিকোলাই নিশানটা ধরলো। বারেকের জন্য নিশান পেছনে হেলে পড়লো। পেভেল বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলো, ছাড়ো নিশান।
নিকোলাই হাত টেনে নিলো, যেন হাত তার আগুনে পুড়ে গেছে। গান থেমে গেলো। সঙ্গীরা পেভেলকে ঘিরে দাঁড়ালো, পেভেল তাদের ঠেলে বেরিয়ে এলো সামনে। অকস্মাৎ সকল কোলাহল থেমে গিয়ে দেখা দিলে এক গভীর নীরবতা।
তারপরেই শোনা গেলো সামরিক কর্মচারীর হুকুম, নিশানটা ছিনিয়ে নাও, লেফটেনেন্ট!
হুকুমপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট একলাফে পেভেলের কাছে গিয়ে নিশানটা ধরে টানতে লাগলো, ছাড়ো, ছাড়ো।
নিশানটা দুলে উঠলো, একবার ডাইনে হেললো, একবার বাঁয়ে। তারপর আবার সোজা হয়ে উড়তে লাগলো আকাশে।
লেফটেনেন্ট পিছিয়ে বসে পড়লো, নিকোলাই ঘুষি বাগাতে বাগাতে তীরবেগে ছুটে গেলো মার পাশ ঘিঁষে।
ধরে ব্যাটাদের–সামরিক কর্মচারী গর্জন করে উঠলো। তক্ষুণি অনেকগুলো সৈন্য সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লে সঙিন উঁচিয়ে। নিশানটা প্রবলভাবে দু’লে উঠে পড়ে গেলে নিচে, আর পলকে অদৃশ্য হয়ে গেলো সৈন্যদের মধ্যে।
একজন আর্তনাদ করে উঠলো, উহু! মা ক্ষিপ্তা ব্যাঘ্রীর মতো চীৎকার করে উঠলেন, পেভেল! সৈন্যদের মধ্য থেকে স্পষ্ট কণ্ঠে জবাব এলো পেভেলের, মা, বিদায়, বিদায়!
তবে বেঁচে আছে সে!…মনে আছে আমাকে–মার প্রাণে এই দু’টো ভাব স্পন্দিত হয়ে উঠলো।
সঙ্গে সঙ্গে এলো এণ্ড্রির কণ্ঠ, মাগো, চললুম।
মা হাত তুলে নাড়ালেন, বুড়ো পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে পেভেল-এণ্ড্রিকে দেখতে লাগলেন। এণ্ড্রিকে দেখা যাচ্ছিল। মা চেঁচিয়ে উঠলেন, এণ্ড্রি, পেভেল!
সৈন্যদলের মধ্য থেকে তারা ধ্বনি করে উঠলো, বন্ধুগণ, বিদায়, বিদায়!
প্রতিধ্বনি হলো অজস্র কণ্ঠে–বাড়ির ছাদ থেকে, ঘরের জালা থেকে, ছত্রভঙ্গ জন-সমুদ্র থেকে।
লেফটেনেন্ট মাকে ঠ্যালা দিয়ে চেঁচাতে লাগলো, ভাগে, ভাগো!
মা চেয়ে দেখলেন, নিশানটা ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে, একটা টুকরোতে লাল কাপড়টা জড়ানো। নুয়ে সেটা তুলে নিতেই কর্মচারী মার হাত থেকে তা ছিনিয়ে নিলো এবং একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সদর্পে গর্জন করে উঠলো, যাও বলছি এখান থেকে।
সৈন্যদের মধ্য থেকে গানের সুর ভেসে এলো,
ওঠো, জাগো, মজুরদল।
চারদিকে সব-কিছু ঘুরছে, দুলছে, কাঁপছে। টেলিগ্রাফের তারের ঝংকারের মতো একটা গাঢ়, ভীতিপ্রদ ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে। সামরিক কর্মচারিটি সক্রোধে হুংকার করে উঠলো, ব্যাটাদের গান বন্ধ কর, সার্জেন্ট ক্রেনড। মা টলতে টলতে গিয়ে সেই ছুঁড়ে-ফেলা নিশান টুকরো আবার তুলে নিলেন।
মুখ বন্ধ কর ব্যাটাদের।
গানের সুর প্রথমটা এলোমেলো হ’ল তারপর কাঁপতে কাঁপতে বন্ধ হ’ল।
একজন সৈন্য মাকে পেছন থেকে টেনে মার মুখ ঘুরিয়ে ঠেলে দিলো, বাড়ি যা, বুড়ি।
মার যেন পা আর চলে না। সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে।
পালা না ডাইনী, বলে একজন তাঁকে এক ঠ্যালায় রাস্তার পাশে সরিয়ে দিলো। মা নিশানের লাঠিটায় ভর দিয়ে চলতে লাগলেন দ্রুত পদে। পা তার ভেঙে এলো। দেয়াল এবং বেড়া ধরে ধরে চলছেন। সৈন্যেরা খালি হাঁকছে, যা যা, বুড়ি।
মা চলে যাবেন ভাবলেন, কিন্তু অজ্ঞাতে তাঁর পা যেন তাকে আবার সামনের দিকে চালিয়ে নিলো। পথ শূন্য। মা দাঁড়ালেন। দুর থেকে অস্পষ্ট শব্দ কানে এলো। শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চললেন তিনি। রাস্তার মোড়ে একদল লোক উত্তেজিত কণ্ঠে কোলাহল করছে।
ওরা শুধু বাহাদুরী দেখাবার জন্য সঙিনের সামনে বুক পেতে দিচ্ছেন।—এটা মনে রেখো।
দেখ দিকি ওদের দিকে চেয়ে, সৈন্যরা এগোচ্ছে আর ওরা নির্ভীক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে।
একবার পেভেলের কথা ভাবো। আর এণ্ড্রি, সেও কি কম?
ঐ কর্মচারী ব্যাটার রকম দেখ–-দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন–ব্যাটা শয়তান।
মার মনের কথা যেন কণ্ঠ দিয়ে ঠেলে বেরোতে চাচ্ছিলো। ঠেলে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, প্রিয় বন্ধুগণ, …
সবাই সসম্ভ্রমে তাকে পথ করে দিলো।
একজন বললো, দেখ দেখ, ওঁর হাতে নিশান! আর একজন কঠিন কণ্ঠে বললো, চুপ।
মা হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন, বন্ধুগণ, শোনো। মানুষ তোমরা, একবার প্রাণ খুলে দাঁড়াও। নির্ভয়ে, নিরাতঙ্কে চোখ খুলে চাও। দেখো, আমাদের ছেলেরা আজ জয়-যাত্রায় বেরিয়েছে। আমাদের সন্তান…আমাদের রক্ত আজ সত্যের রণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অন্তরে তাদের ন্যায়ের দীপ্তি। তারা উন্মুক্ত করছে আজ এক নতুন পথ— সহজ এবং বৃহৎ-সকল মানুষের জন্য, তোমাদের সকলের জন্য, তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য এই পবিত্র ব্রতে আত্মোৎসর্গ করছে তারা। আবাহন করছে এক চির-উজ্জ্বল নবযুগের সূর্যকে। তারা চায় নব-জীবন…সত্য-ন্যায়-মঙ্গল-মণ্ডিত জীবন।
মার প্রাণ যেন ফেটে যাচ্ছে, বক্ষ সংকুচিত হচ্ছে, কণ্ঠ তপ্ত শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে! অন্তরের অন্তস্তলে উথলে উঠছে এক মহান বিশ্ব-প্লাবী প্রেমের বাণী। জিভ পুড়ে যাচ্ছে—এমনি প্রচণ্ড তার শক্তি, এমনি মুক্ত তার গতি। জনতা নির্বাক হয়ে কান পেতে তার কথা শুনছে। এরাও যাতে পেভেলের মতো সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাই ভেবেই যেন না তাদের উত্তেজিত করতে লাগলেন, আমাদের ছেলেরা আজ করাঘাত করছে সুখ-নিকেতনের রুদ্ধ দ্বারে। তাদের অভিযান আমাদের সকলের জন্য। তাদের অভিযান আজ সকল-কিছুর বিরুদ্ধে, যা দিয়ে মিথ্যাচারী ঈর্ষাপর হিংসাব্রতী শত্রুদল আমাদের ধরে বেঁধে পিষে ফেলছে। হে আমার বন্ধুগণ, তোমাদের—শুধু তোমাদেরই জন্য আজ তরুণের এ বিদ্রোহ। তারা যুদ্ধ করছে সমস্ত মানুষের, সমস্ত পৃথিবীর, সমস্ত মজুরের পক্ষ হয়ে। তারা মুক্ত করছে এক সত্যোদ্ভাষিত শুভ্রপথ তোমাদেরই চলার জন্য। সেই তোমরা কি আজ তাদের ছেড়ে চলে যাবে? ত্যাগ করবে? বর্জন করবে? নিজন কণ্টক-সংকুল পথে তাদের একা রেখে পালাবে?–না। তোমরা তোমাদের সন্তানদের মুখ চাও, তাদের গভীর ভালবাসার কথা স্মরণ কর…নিজেদের দুর্গতির কথা ভাব, ছেলেদের প্রাণশক্তিতে বিশ্বাস কর। ওরা যে সত্যের বর্তিকা জ্বেলেছে, তা ওদের অন্তরে জ্বলছে, ওরা তাতে পুড়ে মরছে। ওদের বিশ্বাস করে, বন্ধুগণ, ওদের সাহায্য কর…
গভীর উত্তেজনায় রুদ্ধ-কণ্ঠ হয়ে মা ঢলে পড়লেন। পেছন থেকে একজন তাঁকে ধরে ফেলে। সবাই যেন গরম হয়ে উঠেছে, বলছে, ঠিক কথা, সাঁচ্চা কথা আমরা কেন ভয়ে পালাবে ছেলেদের ছেড়ে।
বুড়ো শিজভ বুক টান করে দাঁড়িয়ে বললো, আমার ম্যাটভি কারখানায় মারা পড়েছে। সে যদি আজ বেঁচে থাকতো, আমি নিজে তাকে ওদের দলে ভিড়িয়ে দিতুম। আমি নিজে তাকে বলতুম, ম্যাটভি, তুমি যাও ঐ সত্যের রণে, ন্যায়ের রণে।…মা ঠিক কথা বলেছেনআমাদের ছেলেরা চেয়েছিল জীবনকে প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তি এবং সম্মানের ওপর। আর সেই অপরাধে আমরা তাদের ত্যাগ করে ভীরুর মতো পালিয়ে এসেছি।
জনতা চঞ্চল হয়ে উঠলো। সবার দৃষ্টি মায়ের ওপর। মার দুঃখ যেন সবার অন্তরকে স্পর্শ করেছে, মার আগুন যেন সবার প্রাণ দীপ্ত করে তুলেছে।
শিজভ মার হাতে সেই নিশান-টুকরো গুঁজে দিয়ে তাঁকে বাড়ি নিয়ে চললো। জনতাও পেছনে পেছনে গেলো। তারপর দুজনে ঘরে ঢুকতে জনতা যে যার বাড়ি চলে গেলো।
[ প্রথম খণ্ড সমাপ্ত ]