প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.১৬ নৌকোঘাট থেকে যুগলের সঙ্গে

নৌকোঘাট থেকে যুগলের সঙ্গে ওপরে উঠেই বিনু অবাক। যেদিকে যতদূর চোখ যায়, সারি সারি হাটের চালা।

চালা বলতে বাঁশের খুঁটির মাথায় সামান্য হোগলার ছাউনি, আর সব দিক খোলা, বেড়া টেড়া কিছু নেই। সেগুলোর তলায় অস্থায়ী দোকান বসেছে। কোথাও একটানা অনেকগুলো চালা জুড়ে কাঁচা আনাজের বাজার, কোথাও তামাক হাটা, কোথাও মরিচ হাটা, কোথাও মাছের বাজার, কোথাও ক্ষীরাইয়ের (এক জাতীয় শসা) বাজার। আবার কোথাও বা রঙিন কাঁচের চুড়ি, লাল ঘুনসি, আয়না, কাকুই, ফুলেল তেল, এমনি নানান মনোহারী জিনিসের পসরা সাজানো।

দুধারে হাটের চালা, মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা সরু পথ দিগ্বিদিকে ছুটে গেছে।

দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে চোখ পেতে যে বিনু সুজনগঞ্জের হাটটা দেখবে তার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা যুগল তাকে এক মুহূর্তও দাঁড়াতে দিচ্ছে না, একখানা হাত ধরে উধ্বশ্বাসে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে।

ছুটতে ছুটতে বিনু লক্ষ করল, সে আর যুগলই শুধু নয়, হাটের সব মানুষই ছুটছে।

ঢেঁড়ার শব্দ ক্রমশ আরও জোরাল হয়ে উঠেছে। যুগল ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল, দেখাদেখি বিনুকেও বাড়াতে হল। পাশাপাশি যে হাটুরে লোকগুলো ছুটছিল তাদের ভেতর থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলল, আরে ধলা মিঞা, হইল কী? ঢেরা পড়ে ক্যান?

ধলা মিঞাই খুব সম্ভব উত্তর দিল, নিয্যস রং-তামশার ব্যাপার আছে।

তাই মনে লয় (হয়)।

আরেকজন বলল, অনেক কাল পর ঢেরা পড়ল সুজনগুঞ্জে—

অন্য একজন ব্যস্তভাবে বলল, হ। অহন লৌড়াও (দৌড়াও) দেখি সুনাভাই–

বেশ খানিকক্ষণ দুটবার পর হাটের মাঝমধ্যিখানে এসে পড়ল বিরা। এখানে হাটের চালা নেই। একটা প্রাচীন বট তার বিপুল বিস্তার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর খুশিমতো যেখানে পেরেছে ঝুরি নামিয়েছে। এই দুপুর বেলাতেও, সূর্য যখন খাড়া মাথার ওপর, বটতলা শীতল, ছায়াচ্ছন্ন। তার একধারে পুরনো ভাঙাচোরা একটা মন্দির। কিসের মন্দির বিন বুঝতে পারল না।

মন্দিরটার সামনের দিকে মস্ত পুকুর, তারপর অনেকখানি জায়গা খোলামেলা। সেখানে এই মুহূর্তে মেলা বসে গেছে যেন। অসংখ্য মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ঝকমকে চোখে মাঝখানে তাকিয়ে আছে। বিনুকে টানতে টানতে যুগল সেখানে নিয়ে এল। তারপর কনুই দিয়ে ঠেলে ঠেলে অদ্ভুত কৌশলে ভিড়ের ভেতর পথ করে একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল।

ভেতরে বেশ খানিকটা জায়গা গোলাকার এবং ফাঁকা। মানুষের ভিড় সেটা ঘিরে, বৃত্তের আকারে দাঁড়িয়ে। ফাঁকা জায়গায় তিনটে মোটে লোক। দু’জনের মাথায় কোঁচকানো বাবরি, একেবারে কাঁধ পর্যন্ত নেমে গেছে। বড় মোটা জুলপি তাদের, পাকানো গোঁফ। গায়ে জামাটামা নেই, পরনে মালকোঁচা দেওয়া খাটো ধুতি। দু’জনেরই হাতে রুপোর চৌকো তাবিজ, গলায় সোনা-বাঁধানো বাঘনখ। গায়ের রং এত কালো আর চকচকে, মনে হয়, গর্জন তেল মেখে আছে।

বাবরিওলারা বেশ জোয়ান, লম্বা-চওড়া বলিষ্ঠ চেহারা। তাদের গলায় মস্ত ঢাক বাঁধা। এই মুহূর্তে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে আর নেচে নেচে প্রচন্ডভাবে পিটিয়ে চলেছে। দুজনে ঢাকদুটো না ফাসানো পর্যন্ত থামবে না বোধ হয়।

দেখতে দেখতে বিনুর মনে হল, ওরা যেন যমজ। কুমোরের দোকানের মানিকজোড় পুতুলের মতো একই ছাঁচে গড়া।

ওরা ঢাক বাজাচ্ছে আর তৃতীয় মানুষটি একটা উঁচু প্যাকিং বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার শরীরে রসকষ কিছু নেই। ঢ্যাঙা তালগাছের মতো চেহারা। আখমাড়াই কলে ফেলে সবটুকু সার যেন বার করে নেওয়া হয়েছে, ফলে ছিবড়েটুকু পড়ে আছে। লোকটার গাল ভাঙাচোরা, চুল পাঁশুটে রঙের। সেই চুলই তেলে জবজবে করে পরিপাটি টেরি কেটেছে। কত বয়স, কে জানে। হাড় এমন পাকা, মনে হয়, টোকা দিলেই টং করে বেজে উঠবে। পরনে চিটচিটে ভোলা পাজামা আর রংবেরং এর হাজারটা তালি দেওয়া আল্লাখাল্লা, খালি পা। সার্কাস দলের ক্লাউনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। তার হাতে লম্বা একটা চোঙা।

এমন যার চেহারা তার চোখের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। সে দুটো যেমন রসালো তেমনি চুলাচুল। লোকটা প্যাকিং বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে ঘাড় হেলিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। যখন দেখল, হাটের প্রায় সব লোক চারপাশে জড়ো হয়েছে, হাতের ইশারায় বাবরিওলা দুটোকে থামিয়ে দিল। তারপর মুখের কাছে চোঙাটা ধরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, হিন্দু ভাইরা, মিঞাভাইরা, অনেক দিন পর আপনেগো সুজনগুঞ্জে ঢেরা দিতে আইলাম।

ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ বলল, হ, অনেক দিন পর আইলা। হেই গেল বচ্ছরের আগের বচ্ছর চৈত মাসে নীল পূজার সময় আইছিলা। হেইর পর এই আইলা।

আরেক জন বলল, অ্যাত দিন আছিলা কই?

ঢ্যাঙা লোকটা মুখ থেকে চোঙা নামিয়ে বলল, এই দ্যাড় বচ্ছরে কত কত মুল্লুক ঘুরলাম। হেই নুয়াখালি জিলা, ফরিদপুর জিলা, তিপুরা জিলা, কুমিল্লা, চানপুর, বরিশাল, আর হেইদিকে উজানে ভাটির দ্যাশ–না গ্যাছি কুনখানে?

ঢেরা দিতে গ্যাছ?

এ ছাড়া আর কুন কামে যামু কন? এই থিকাই তো আমর রুজিরুজগার, ভাত-কাপড়। ভিড়ের মধ্যেকার প্রশ্নকর্তা লোকটা মাথা নাড়ল, হ—

বোঝা যায়, দেশে দেশে ঢেঁড়া দিয়ে বেড়ানোই ঢ্যাঙা লোকটার কাজ এবং জীবিকা। ভিড়ের অন্য সবাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। তারা চেঁচামেচি জুড়ে দিল, গপ থুইয়া অখন আসল সম্বাদখান কও। শুইনা যাইগা। উই দিকে আবার হাটের বেইল (বেলা) যায়।

‘হ’ হ হঠাৎ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে ঢ্যাঙা লোকটা হাতের লম্বা চোঙাখানা মুখের কাছে আনল, তারপর কণ্ঠস্বর একেবারে চুড়োয় তুলে চিৎকার করে বলতে লাগল, মিঞাভাইরা, হিন্দুভাইরা, আপনেরা নাজিরপুরের নাম শুনছেন?

কুন নাজিরপুর?

নবীগুঞ্জ থানার ভিতরে পড়ে। পেল্লয় গেরাম।

ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ কেউ জানায়, নাজিরপুরের নাম তারা শুনেছে। তবে বেশির ভাগই শোনে নি।

ঢ্যাঙা লোকটা বলল, বাবু ভুবনমোহন দত্তচরি (দত্তচৌধুরী) নাজিরপুরের জমিন্দার। বয়েস হইব ষাইট। তেনির জবর দাপট। অ্যামন যে বাঘে গোরুতে একঘাটে জল খায়। কিন্তুক–

ভিড়টা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, কিন্তুক কী?

গ্যাল বচ্ছর জমিন্দারবাবু তেজপক্ষের (তৃতীয় পক্ষের) বিয়া সারছেন। এই পক্ষের বউ একেবারে লক্ষ্মী পতিমার লাহান দেখতে। বয়সখানও কম, মোটে আঠার। এই নিয়া একখান কথা রটছে—

চারদিক থেকে চড়বড়িয়ে খই ফোঁটার মতো অসংখ্য কণ্ঠস্বর ফুটতে লাগল, কী কথা? কী কথা?

ঢ্যাঙা লোকটা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর না দিয়ে সেই ঢাকী দু’টোকে চোখের ইশারা করল। কথাবার্তার ফাঁকে বসে বসে তারা জিরিয়ে নিচ্ছিল। ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র দামড়া মোষের মতো তড়াক করে লাফিয়ে উঠল এবং উদ্দামভাবে বাবরি ঝাঁকিয়ে ঢাক পেটাতে লাগল।

উৎসাহ দেবার জন্য বোধ হয় ঢ্যাঙা লোকটা প্যাকিং বাক্স থেকে নেমে পড়ল। হাতে হাতে তালি বাজাতে বাজাতে বলতে লাগল, জোরে ব্যাটারা, আরও জোরে–

ঢাকী দু’টো উৎসাহিত হয়ে এমন বাজাতে লাগল যে হাত দেখা যায় না।

ঢ্যাঙা লোকটা আগের মতোই তালি দিতে দিতে বলতে লাগল, ঘুইরা ফিরা শালারা, নাইচা নাইচা–

ঘুরে ফিরে ঢাকীদের নাচ শুরু হল।

বেশ খানিকক্ষণ বাজনার পর বাবরিওলা দুটোকে থামিয়ে আবার প্যাকিং বাক্সের মাথায় উঠল ঢেঁড়াদার। ততক্ষণে সবার কৌতূহল চূড়ান্তে পৌঁছেছে। চারধার থেকে ভিড়টা চেঁচাতে লাগল, কও, এইবার কও

ধীরেসুস্থে চোঙাটা মুখের কাছে এনে ঢ্যাঙা লোকটা বলতে লাগল, নাজিরপুরের বাবু ভুবনমোহন দত্তচধরির নামে যে কথাখান রটছে, তা হইল এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ থেমে গেল।

কী? কী?

তেজপক্ষের বিয়ার পর তেনি নিকি মাউগা হইয়া গ্যাছেন। (তৃতীয় পক্ষের বিয়ের পর তিনি নাকি স্ত্রৈণ হয়ে গেছেন)। কথাখান নারায়ণগুঞ্জ-মুন্সিগুঞ্জ-মানিকগুঞ্জ–স্বগ-মত্ত হগলখানে রইটা গ্যাছে। বলতে বলতে কণ্ঠস্বর শীর্ষবিন্দুতে তুলল ঢেঁড়াদার, কিন্তুক কথাখান সত্য না। হিন্দুভাইরা, মিঞাভাইরা, কেউ যদি অ্যামন কথা আপনেগো কয়, বিশ্বাস করবেন না।

সবাই বলল, ক্যান, বিশ্বাস করুম না ক্যান?

শত্তুরে শত্তুরতা কইরা এই কথা রটাইছে। আপনেরা শুইনা রাখেন, সগলে জাইনা রাখেন, নাজিরপুরের জমিন্দার বাবু ভুবনমোহন দত্তচধরি মাউগা (স্ত্রৈণ) না–মাউগা না–

লোকটা থামতে না থামতেই চারধারে হাসির রোল পড়ে গেল। রসিক কেউ একজন হরিধ্বনি দিয়ে উঠল, বল হরি —

ঢ়েঁড়া দেওয়া হয়ে গেছে। চারপাশের ভিড়টা জলোচ্ছ্বাসের ঢলের মতো এবার হাটে দোকানপাটের দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

লোকগুলো যাচ্ছে আর হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, বড় বাহারের সম্বাদ, বড় বাহারের সম্বাদ–

একজন বলল, শালায় বাপের জম্মে অ্যামন কথা শুনি নাই।

আরেকজন বলল, মাউগা না, হেই কথা হাটে হাটে ঢেরা পিটাইয়া নি কইতে হয়!

দেখতে দেখতে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। দামড়া মোষের মতো সেই জোড়া বাবরিওলাকে নিয়ে ঢ্যাঙা লোকটাও কখন যেন উধাও হয়েছে।

পাশে দাঁড়িয়ে যুগলও হাসছিল। হাসতে হাসতে তার হিলহিলে বেতের মতো শরীর বেঁকেচুরে যাচ্ছে।

এতগুলো লোক কেন হাসছিল, ঢেঁড়াদারের ঘোষণায় কৌতুককর ব্যাপারটা কী ছিল, কিছুই বুঝতে পারেনি বিনু। সে শুধু বিমূঢ়ের মতো একবার এর মুখের দিকে, একবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল।

সবাই চলে গেলে বিনু যুগলকে বলল, এই, অমন হাসছ কেন?

হাসুম না, কন কী ছুটোবাবু? হাসির বড় একটা ঢেউ যুগলের স্বর বুজিয়ে দিল।

বিনু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।

হাসিটা খানিক সামলে নিয়ে যুগল বলল, অ্যামন হাসনের কথা তিরভুবনে কেউ কুনোদিন শোনে নাই ছটোবাবু। কয় কিনা জমিন্দারবাবু মাউগা না’ বলে হাসতে হাসতে ফের শুয়ে পড়ে আর কি।

হঠাৎ যেন কথাটা মনে পড়ে গেল বিনুর। তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল, আচ্ছা, মাউগা মানে কী? লোকটা বলছিল–

বোঝেন নাই?

না।

হাসি থামিয়ে যুগল সোজা হয়ে দাঁড়াল। একটু চিন্তা করে বলল, আপনের না বুঝানেরই কথা ছুটোবাবু।

কলকাতার ছেলে বিনু ক্লাস সেভেনে পড়ে। যে কথা যুগল বুঝতে পারে, জল-বাংলার এই অশিক্ষিত পেঁয়ো হাটুরে লোকগুলো বুঝতে পারে, সেই কথাটা সে বুঝতে পারবে না? অব্যয়ীভাব আর কর্মধারয় সমাস বোঝে সে, পাটিগণিতের বাঘা বাঘা অঙ্ক বোঝে, নেসফিল্ডের গ্রামার থেকে জিরান্ড, অ্যাপ্রোপিয়েট প্রিপজিশন বুঝে বসে আছে, আর তুচ্ছ মাউগা শব্দটা অবোধ্য থেকে যাবে? নাক মুখ কুঁচকে বিরক্ত গলায় বিনু বলল, কেন, বুঝতে পারব না কেন?

আপনে পোলাপান যে।

পোলাপান অর্থে ছেলেমানুষ। আষাঢ় মাসে বারো পেরিয়ে তেরায় পা দিয়েছে বিনু, মাথায় ছোটদিকে ছাপিয়ে গেছে, তবু কিনা তাকে ছেলেমানুষ ভাবে যুগল! মনে মনে খুব রেগে গিয়ে। সে বলল, ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ করবে না।

তার গলায় এমন কিছু ছিল যাতে যুগল চমকে উঠল। বলল, আইচ্ছা, আর কমু না। এইবারটার লাখান মাপ কইরা দ্যান।

বিনু খুশি হল। সহজ, সদয় গলায় বলল, ঠিক আছে। এখন মাউগা’র মানে বল।

যুগল বলল, ছুটোবাবু মাউগা তারেই কয় যে তমস্ত দিন বউয়ের আচলের তলে থাকে, তার পিছে পিছে বিলাইছাওয়ের লাখান (বেড়াল-বাচ্চার মতো) ঘোরে। বউ যা কয় তাই করে। মোট কথা বউ-অন্ত পরাণ। একদণ্ড বউরে না দেখলে মূচ্ছা যায়।

তবু ব্যাপারটা বিশেষ বোধগম্য হল না। মাউগা’ শব্দটা শুনবার সঙ্গে সঙ্গে হাটুরে লোকগুলোর মধ্যে হাসির ধুম পড়ে গিয়েছিল। সেই কথাটা মনে হতেই বিজ্ঞের মতো একবার হেসে নিল বিনু। ভাবখানা, আমিও সব বুঝি। ছেলেমানুষ যা ভেবেছ, আমি তা আদপেই নই।

যাই হোক, ঢেঁড়ার পর্বটা শেষ হয়েছে। হঠাৎ হেমনাথদের কথা মনে পড়ে গেল বিনুর। তাড়াতাড়ি ব্যস্তভাবে সে বলে উঠল, দাদু বাবা আর লালমোহনদাদুকে খুঁজে বার করবে না?

যুগল বলল, হ। চলেন।

চল—

দু’পা এগিয়েছে, এমন সময় উঁচু গলার ডাক ভেসে এল, যুগল, এই যুগল–

ডান দিকে তাকাতেই বিনুরা দেখতে পেল, খানিক দূরে অবনীমোহন লারমোর আর লারমারের নৌকোর সেই মাঝি দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। মাঝিদের মাথায় দুটো বড় বড় টিনের বাক্স। চোখাচোখি হতেই লারমোর হাতছানি দিলেন।

বিনুরা বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল।

লারমোর যুগলের উদ্দেশে বললেন, কোথায় গিয়েছিলি রে হতভাগা, এত দেরি হল?

নিচের দিকে তাকিয়ে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে যুগল বলল, পথে এক কুটুমের লগে দেখা, হে (সে) আমারে তার বাড়িত ধইরা নিয়া গেল। তাই ইট্টু দেরি হইছে।

কুটুমবাড়ি যাবার কথাটা সত্যি। তবে তার সঙ্গে দেখা হওয়া এবং ধরে নিয়ে যাওয়াটা ডাহা মিথ্যে। বিনু একবার ভাবল, যুগলের মিথ্যেটা ধরিয়ে দেয়। কিন্তু ধরিয়ে দিলে তার ফলাফল কী হবে ভেবে চুপ করে থাকল।

লারমোর আবার বললেন, নৌকোয় উঠলে, জল পেলে, তুই আর মানুষ থাকিস না। তোর তো কিছু হবে না, পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরী আর সারা বর্ষার জলের সাধ্যি নেই তোর কিছু করতে পারে। ভয় ওই দাদাভাইটাকে নিয়ে আঙুল দিয়ে বিনুকে দেখিয়ে বলতে লাগলেন, আমরা এসেছি আর সারাক্ষণ ওর কথা চিন্তা করছি।

যুগল ফিসফিসিয়ে বলল, চিন্তার কিছু আছিল না। ছুটোবাবুরে আমার নায়ে তুলছি, আমার এট্টা দায়িত্ব নাই?

লারমোর সকৌতুকে হাসলেন, আছে নাকি! জেনে আশ্বস্ত হওয়া গেল। বলতে বলতে বিনুর দিকে ফিরলেন, তারপর দাদাভাই–

বিনু তাকাল।

লারমোর বললেন, ঢেঁড়া শুনেছ?

বিনু ঘাড় কাত করল, হ্যাঁ।

কী শুনলে বল তো।

নাজিরপুরের জমিদার মাউগা না।

সবাই মুখ টিপে হাসতে লাগল। হেসে হেসে লারমোর শুধোলেন, মানে বুঝেছ?

হুঁ।

হাসিটা হঠাৎ থমকে গেল লারমোরের। ঈষৎ সন্দিগ্ধভাবে শুধালেন, কী?

‘মাউগা’ শব্দের ব্যাখ্যা যুগলের কাছে যা শুনেছিল, গড়গড় করে বলে গেল বিনু। শুনে কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে রইলেন লারমোর। অবনীমোহনেরও সেই একই অবস্থা। কিছুক্ষণ পর লারমোর বললেন, এত সব কথা তুমি কেমন করে জানলে দাদাভাই? কে শিখিয়েছে?

শেখানোর কৃতিত্বটা আর যুগলকে দিতে মন চাইল না। বিজ্ঞের মতো মুখ করে গম্ভীর চালে বিনু বলল, কেউ শেখায় নি, আমি নিজেই জানি।

লারমোর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, অনেকগুলো হাটুরে তোক পুরনো ভাঙা মন্দিরটার দিক থেকে ডাকাডাকি করতে লাগল, লালমোহন সাহেব লালমোহন সাহেব, তরাতরি আসেন। বেলা যে যায়–

লারমোর চঞ্চল হলেন। ব্যস্তভাবে বললেন, চল, চল সব– বলে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিলেন।

ওই লোকগুলো কেন লারমোরকে ডাকছে, বিনু বুঝতে পারল না। যাই হোক, লারমোর আর অবনীমোহন আগে আগে চলেছেন। তাদের পেছনে বাক্স মাথায় সেই মাঝি দু’টো। সবার শেষে বিনু এবং যুগল।

যেতে যেতে অবনীমোহনের গলা শুনতে পেল বিনু। চাপা স্বরে তিনি লারমোরকে বলছেন, এমন ঢেঁড়াও লোকে দেয়!

লারমোর বললেন, মজার ব্যাপারটা সবাই জানল। অথচ তোমার মামাশ্বশুরই শুধু জানতে পারল না। হেমটা একেবারে পাগল। নৌকো থেকে নেমে ঘাড় বেঁকা করে কোন দিকে যে ছুটল!

মামাবাবু তো বললেন, নিত্য দাস না কার দোকানে যাবেন।

তুমিও যেমন অবনীমোহন, মামাবাবুটিকে তো এখনও চেন নি। নিত্য দাসের দোকান পর্যন্ত সোজা ও পৌঁছতে পারবে? তার আগেই হয়তো তারক ভূঁইমালী ধরে নিয়ে নিজের দোকানে বসাবে। সেখানে এক দুপুর কাটিয়ে দেবে হেম।

হেমনাথ সম্বন্ধে ঠিক এইরকম অনুযোগই করেছিলেন স্নেহলতা। অবনীমোহন হাসলেন।

লারমোর বলতে লাগলেন, চল্লিশ বছর ধরে দেখছি হেমকে। ওই এক রকমই থেকে গেল। কোনও পরিবর্তন নেই।

হঠাৎ কী ভেবে অবনীমোহন বললে, তা হলে তো ভারি মুশকিল হবে লালমোহন মামা–

কিসের মুশকিল? জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন লারমোর।

এক জায়গায় যেতে গিয়ে আরেক জায়গায় যদি আটকে যান, ওঁকে খুঁজে বার করব কী করে?

কিছু করতে হবে না। হেমই আমাদের খুঁজে বার করবে।

আমরা কোথায় আছি, উনি কেমন করে জানবেন?

লারমোর বললেন, ও জানে। সুজনগঞ্জের হাটে এলে মন্দিরের পাশের বটগাছতলায় আমি বসি। দেখো, ঠিক এসে পড়বে।

এদিকে যুগল বিনুকে বলছিল, জানেন ছুটোবাবু, কয়দিনে আপনে বেশ চালাক-চতুর হইয়া উঠছেন।

বিনু রেগে গেল, আমি আগেও চালাক ছিলাম।

যুগল বলল, হে (সে) তো জানি। তয় এই কয়দিনে আরও চালাক হইছেন।

ঈষৎ নরম হয়ে বিনু বলল, কী করে বুঝলে?

উই যে লালমোহন সাহেবরে যহন মিছা কইরা কইলাম, পথ থিকা আমার কুটুমে আমাগো ধইরা নিয়া গেছিল তহন আপনে চুপ কইরা থাকলেন। সত্য কথাখান কইলে লালমোহন সাহেব খুব চেইতা (রেগে) যাইত।

বিনু উত্তর দিল না।

যুগল আবার বলল, যহন যহন দরকার হইব, এইরকম বুদ্ধি খেলাইবেন ছুটোবাবু।

একসময় তারা মন্দিরের কাছাকাছি সেই ঝুপসি বটগাছটার তলায় এসে পড়ল।

খানিক আগে বিনু এই জায়গাটার ওপর দিয়ে ছুটে গেছে। তখন চোখে পড়েনি, এখন দেখা গেল, একটা শস্তা ছোট টেবিলের মুখোমুখি দুখানা হাতল ভাঙা চেয়ার সাজানো। সামনের দিকে জনাকয়েক লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের সবাই গরিব পেঁয়ো চাষী শ্রেণীর। সিকিভাগের মতো হিন্দু, বাদবাকি মুসলমান। চেহারা তাদের রুণ, দুর্বল। চোখেমুখে অসুস্থতার ছাপ মাখানো। লারমোরকে দেখে সবার চোখ, উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

এক পলক চেয়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে থেকে লারমোর বললেন, এতে তো হবে না, আরও দু’খানা চেয়ার লাগবে।

যে মাঝিদু’টো মাথায় করে বাক্স নিয়ে এসেছিল তার চঞ্চল হল। তাড়াতাড়ি বাক্স নামিয়ে হাটের দিকে ছুটল।

সামনের চেয়ারখানা দেখিয়ে লারমোর অবনীমোহনকে বললেন, বসো অবনী—

অবনীমোহন বসলেন। তার মুখোমুখি বসতে বসতে লারমোর এবার বিনুকে বললেন,যতক্ষণ চেয়ার আসে ততক্ষণ আমার কোলে বসো দাদাভাই। এস– বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

কারোর কোলে বসতে ঘোরতর আপত্তি বিনুর। কিছুতেই লারমোরের কাছে গেল না সে। নিচের ঘাসের ওপর যুগল বসে পড়েছিল। সে তার গা ঘেঁষে গিয়ে বসল।

বিনুর দিকে তাকিয়ে মধুর হাসলেন লারমোর, দাদাভাই মস্ত বড় হয়ে গেছে। কোলে বসতে তার খুব লজ্জা।

বিনু চোখ নামিয়ে চুপ করে থাকল।

ওদিকে সেই গ্রাম্য অসুস্থ লোকগুলো অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। তারা গুঞ্জনের মতো শব্দ করে বলতে শুরু করল, এইবার আমাগো দ্যাখেন লালমোহন সাহেব।

স্নেহময় সুরে লারমোর বললেন, এতক্ষণ বসে আছিস, আরেকটু সবুর কর বাবারা। চেয়ারটা আসুক। না এলে কোথায় বসিয়ে তোদের দেখব?

লোকগুলো শান্ত হল।

কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর একটু কী ভেবে গভীর স্বরে লারমোর ডাকলেন, অবনীমোহন—

আজ্ঞে– অবনীমোহন তক্ষুণি সাড়া দিলেন।

এটা কত সাল?

উনিশ শ’ চল্লিশ।

ঠিক চল্লিশ বছর আগে উনিশ শ’ সালে, তার মানে টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি সবে শুরু হয়েছে সেই সময় আমি রাজদিয়ায় এসেছিলাম। তখন আমার বয়েস পঁচিশ। রাজদিয়ায় আসার পরের দিন থেকেই আমি সুজনগঞ্জের হাটে আসছি। এই যে বটগাছটা দেখছ, এর তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই যুবক বয়েসে আমি খ্রিস্টধর্ম প্ৰিচ করতাম।

এখন প্রিচ করেন না?

না।

তবে?

লারমোর হাসলেন, এখন যা করি একটু পরেই দেখতে পাবে।

অবনীমোহন শুধোলেন, এখন আর প্ৰিচ করেন না কেন?

লারমোর হাসলেন। বললেন, খুব কঠিন প্রশ্ন করেছ অবনী। এর উত্তর তো এক কথায় দেওয়া যাবে না। দিতে গেলে আমার সারা জীবনের কথা বলতে হবে।

উৎসুক সুরে অবনীমোহন বললেন, বেশ তো, বলুন না। আমার খুব জানবার ইচ্ছে।

সামনের অসুস্থ, উদ্বিগ্ন লোকগুলোকে দেখিয়ে লারমোর বললেন, এখন যদি গল্প জুড়ে দিই, ওরা আমাকে আস্ত রাখবে না। পরে আরেক দিন শুনো–

আচ্ছা। আবনীমোহন বললেন, পরেই শুনব।

যুগলের কাছে বসে উদগ্রীব তাকিয়ে ছিল বিনু। লারমোর নামে এই মানুষটি সম্বন্ধে তার মনে অসংখ্য জিজ্ঞাসা, অসীম কৌতূহল। লারমোরের কথা জানবার জন্য প্রথম দিন থেকেই উন্মুখ হয়ে আছে সে। ভেবেছিল তার কৌতূহল এবার মিটবে। কিন্তু লারমোর নিজের সম্বন্ধে কিছুই বললেন না, ফলে বিনুর মন বেশ খারাপ হয়ে গেল।

অবনীমোহন আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন, সেই মাঝি দুটো দুখানা হাতল-ভাঙা চেয়ার নিয়ে ছুটতে ছুটতে ফিরে এল।

লারমোর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিনুকে একটা চেয়ারে বসতে বলে ভিড়ের ভেতর থেকে একজনকে ডেকে অন্য চেয়ারটার বসালেন। তারপর মাঝি দুটোর উদ্দেশে বললেন, বাক্স খোল

মাঝিরা সেই বড় টিনের বাক্স দুটো খুলে ফেলল। বিনু দেখতে পেল, তার ভেতর নানারকম ওষুধবিষুধ, নাক-কান-গলা-জিভ এবং বুক পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, ইঞ্জেকশানের ছোট চ্যাপটা লম্বাটে বাক্স।

যন্ত্রপাতি আর ইঞ্জেকশানের বাক্সটা টেবিলের ওপর সাজিয়ে অন্য চেয়ারের লোকটার দিকে তাকালেন, কেমন আছিস রে জিগিরালি?

লোকটা মধ্যবয়সী। মুখময় কাঁচাপাকা গোঁফদাড়ি খাড়া হয়ে আছে, ফলে শজারুর কাঁটার মতো দেখায়। চোখদুটি ঘোলাটে এবং রুগণ। কাতর সুরে জিগিরালি বলল, ভালা না সাহেব।

লারমোর শুধোলেন, কী হল আবার?

তিন দিন ধইরা ধুম জ্বর। হেই জ্বর আর ছাড়ে না।

বুকটুক পরীক্ষা করতে করতে লারমোর বললেন, গেল হাটে দেখে গেছি, ভাল। এর ভেতর জ্বর বাধালি কী করে? বলতে বলতে ভুরু কুঁচকে গেল, এ কী!

জিগিরালি বলল, কী সাহেব?

বুকে বিশ পাসারি ( এক পাসারি–মানে আড়াই সের) কফ জমল কী করে! গেল হাটে তো কফ দেখি নি।

জিগিরালি চুপ।

লারমোর ধমকে উঠলেন, হারামজাদা, মুখ বুজে থাকলে চলবে না। বল, কী করেছিলি–

ভয়ে ভয়ে একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল জিগিরালি। অস্ফুট গলায় বলল, মাছ মারতে নদীতে নামছিলাম। হেইর লেইগা–

নিপলক, স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন লারমোর। তারপর চিৎকার করে উঠলেন, তোকে না বলেছিলাম, ঠান্ডা লাগাবি না–

কী করুম সাহেব, মাছ না মারলে, হেই মাছ হাটে হাটে গিয়া না বেচলে সোংসার চলবে ক্যামনে? পোলাপান খাইব কী?

কেন, তোর বড় ছেলেটা করে কী? দুটো দিন সংসার চালিয়ে নিতে পারে না সে?

জিগিরালির মুখে নৈরাশ্যের ছায়া পড়ল। তিক্ত স্বরে সে বলল, তয় তো বাইচা যাইতাম। হে (সে) চালাইব সোংসার! তাইলে আমার দুঃখু ঘুচব ক্যান? ভাবছিলাম পোলা ডাঙ্গর হইছে, এইবার সুখের লাগুর (নাগাল) পামু। আ আমার বরাত! কপালে একটা চাপড় মেরে আবার শুরু করল, পোলায় হইছে কবিদার (গ্রাম্য কবিগান রচয়িতা এবং গায়ক)। মাথায় গন্ধত্যাল মাইখ্যা, চৌখে সুর্মা লাগাইয়া হে (সে) আসরে গান গায়। বাপের আসান করতে জলে লামব, মাছ মারব–এই হগল কি হেরে (তাকে) মানায়! সোম্মানে লাগে না।

লারমোর রেগে গেলেন, বাপ এদিকে মরছে আর উনি কবিদার হয়ে বসেছেন! কোথায় সেই উল্লুকটা?

আসনের সোময় বাড়িতেই দেইখা আইছি।

কালই আমার কাছে তাকে পাঠিয়ে দিবি।

হে (সে) কি আইব?

তার ঘাড় আসবে। আমার কথা বলবি। বলবি লালমোহন সাহেব যেতে বলেছে। বাঁশডলা দিয়ে তার কবিয়ালি ছুটিয়ে দেব।

লালমোরের যে চেহারাটা বিনুর মনে গভীর রেখায় আঁকা হয়ে গেছে সেটা মধুর স্নেহময় একটি মানুষের চেহারা। তার বাইরেও যে তার আরেকটা রূপ আছে, তিনি যে এত রেগে যেতে পারেন, বিনু তা কল্পনাই করতে পারে নি। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে থাকল।

পরীক্ষা টরীক্ষা করে জিগিরালিকে ওষুধ দিতে দিতে লারমোর বললেন, দিনে তিন বার খাবি। সকালে-দুপুরে-রাত্তিরে। আর সংসার রসাতলে যাক, জাহান্নামে যাক, না খেয়ে গুষ্টিসুষ্ঠু মরুক, তবু ঘর থেকে বেরুবি না। যদি শুনি এই জ্বর নিয়ে আবার জলে নেমেছ, লাঠি দিয়ে পা দুখানা গুড়ো করে দিয়ে আসব।

জিগিরালি মাথা নেড়ে জানায়, তিনবার করে ওষুধ খাবে এবং ঘর থেকে বেরুবে না। বলল, অখন তাইলে যাই। আদাব লালমোহন সাহেব

যাবি তো, পথ্যের পয়সা আছে?

জিগিরালি উত্তর দিল না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

লারমোর বললেন, পয়সা চাইতে বুঝি মিঞা সাহেবের মানে লাগে? পকেট থেকে একটা সিকি বার করে দিতে দিতে বলেন, এই নে। বার্লি টার্লি কিনে নিস।

জিগিরালি এবারও কিছু বলতে পারল না। ঠোঁটদুটো থরথর করল শুধু, আর কৃতজ্ঞতায় চোখ সজল হয়ে উঠল।

জিগিরালি চলে গেলে ভিড়টার দিকে তাকিয়ে লারমোর ডাকলেন, বুধাই পাল এস–

যে উঠে এল তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। খালি গা, খালি পা। গায়ের চামড়া খসখসে, খই ওড়া। গোল গোল হলদে চোখ। জয়টাকের মতো মস্ত পেটের ওপর সরু হাড় জিরজিরে বুক। গলাটাও সরু, তার ওপর প্রকান্ড মাথা। পাঁশুটে রঙের চুলে মাথাটা ঝুপসি হয়ে আছে। আচ্ছাদন বলতে নেংটির চাইতে সামান্য বড় একটা ময়লা চিটচিটে টেনি।

জিগিরালির খালি চেয়ারখানা দেখিয়ে লারমোর বললেন, বসো—

বুধাই পাল বসল না।

লারমোর বললেন, কী হল, বসো–

ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বিনীত সুরে বুধাই পাল বলল, আইজ্ঞা না, আপনের সামনে আমি চ্যারে (চেয়ারে) বইতে পারুম না।

কেন হে?

আপনের সামনে চ্যারে বসুম, আপনের এট্টা সোম্মান নাই?

ঠিকই তো, ঠিকই তো। রহস্য করে হাসতে হাসতে বুধাই পালের একখানা হাত ধরে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন লারমোর।

অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে পড়ল বুধাই পাল, এইটা কী করলেন লালমোহন সাহেব, এইটা করলেন কী?

ভয় নেই। তুমি চেয়ারে বসলে আমার সম্মানের একটুও ক্ষতি হবে না।

বাড়তি দু’খানা চেয়ারের কী প্রয়োজন, এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে বিনু। একটা তার জন্য, আরেকটা রুগীদের জন্য। প্ৰিচ করার বদলে আজকাল হাটে যত রুগী আসে, তিনি তাদের চিকিৎসা করে থাকেন।

লারমোর বললেন, তারপর পালমশাই, ক’মাস পর দেখা দিলেন?

আইজ্ঞা, দুই মাস।

এতদিন ছিলেন কোথায়?

গাওয়ালে গেছিলাম।

এই সময় বিনু বলে উঠল, গাওয়াল কী?

লারমোর বিনুর দিকে ফিরে হাসলেন, কুমোরেরা মাটির হাঁড়ি-কলসি-পাতিলে বড় বড় নৌকো বোঝাই করে নদীর চরের দিকে পাড়ি দেয়। হাঁড়ি-কলসির বদলে ওরা পয়সা নেয় না, ধান নেয়। দু’চার মাস পর নৌকো ভর্তি ধান নিয়ে তারা চর থেকে ফিরে আসে। একে বলে গাওয়াল করা।

ও।

এতক্ষণ বুধাই পাল খেয়াল করে নি। এবার তার চোখ এসে পড়ল বিনু আর অবনীমোহনের ওপর। হতজোড় করে বলল, এনারা?

লারমোর বললেন, তোমাদের হেমকর্তার নাতি আর জামাই।

খুব ব্যস্তভাবে এবং সম্ভ্রমভরে উঠে দাঁড়িয়ে মাথাটা অনেকখানি ঝুঁকিয়ে দিল বুধাই পাল, পন্নাম হই গো জামাইবাবু, নাতিবাবু। কী সুভাগ্যি, আমাগো হ্যামকত্তার নাতি আর জামাইরে দেখলাম।

ঠিক এই সময় জিগিরালি আবার ফিরে এল। মুখ কাচুমাচু করে লারমোরকে বলল, বড় অন্যায় হইয়া গ্যাছে গো সাহেব। অবনীমোহনদের দেখিয়ে বলল, এনাগো কথা জিগাইতে এক্কেরে ভুইলা গ্যাছি।

লারমোর অবনীমোহনদের পরিচয় দিলেন।

এরপর জিগিরালি আর বুধাই পাল, দুজনে মিলে একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে লাগল। অবনীমোহনরা কোথায় থাকেন? কলকাতায় থাকেন শুনে বলল, এতকাল আসেন নি কেন? এসেছেন যখন দু’চার মাস অন্তত এই জলের দেশে থেকে যেতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্নোত্তরের পর সসম্ভ্রমে সেলাম করে জিগিরালি চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল, শরীলটা ইট্টু ভালা হইলে হ্যামকত্তার বাড়িত যামু। আপনেগো লগে দুইখান কথা কইলেও পরাণ জুড়ায়।

অবনীমোহন অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। একটা অসুস্থ রুগ্‌ণ মানুষ শুধু তাদের পরিচয় জানবার জন্য জ্বর গায়ে আবার ফিরে এসেছে, আগে তাদের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিল বলে অসীম সঙ্কোচে বিব্রত হয়ে আছে–ভাবতেই অবাক হয়ে গেলেন তিনি। গাঢ় গলায় বললেন, তোমার আসতে হবে না। আমরাই একদিন তোমার বাড়ি যাব।

যাইবেন তো, যাইবেন তো? চোখ আলো হয়ে উঠল জিগিরালির।

যাব, নিশ্চয়ই যাব।

জিগিরালি চলে গেলে লারমোর বুধাই পালকে বললেন, এখন অন্য কথা নয়, এইবার আপনার পেটের কথা বলুন পালমশাই। কেমন আছেন তিনি?

মাঝে মাঝে বুধাই পালকে আপনি করে বলছেন লারমোর। বিনু বুঝল, ওটা ঠাট্টা।

এদিকে পেটের কথায় মুখখানা যেন কেমন হয়ে গেল বুধাই পালের।

নাকের ভেতর থেকে দুর্বল একটা সুর বার করে সে বলল, প্যাটের গতিক সুবিধা বুঝি না লালমোহন সাহেব।

কেন?

বুধাই পাল চুপ।

লারমোর বললেন, সামনে এস, পেটখানা দয়া করে দেখাও–

ভয়ে ভয়ে সামনে এসে দাঁড়াল বুধাই পাল। লারমোর পেটে হাত দিতে না দিতেই চেঁচিয়ে উঠল, উ-উ, লাগে–

লাগে নাকি?

হ সাহেব, বেজায় লাগে।

পেটটা আস্তে আস্তে টিপে লারমোর আঁতকে উঠলেন, দু’মাসে পেটটাকে করেছ কী!

আইজ্ঞা—

তোমার পেটে ক’টা পিলে হে?

সাহেবের য্যামন কথা! বুধাই পাল ফোকলা মাড়ির ওপর কটা হলদে দাঁত বার করে হাসতে লাগল, মাইনষের আবার কয়টা পিলা হয়? একটাই পিলা আমার।

লারমোর বললেন, একটাই ছিল, তবে এই দু’মাসে গাওয়ালে গিয়ে আরও গোটা পাঁচ-সাতেক জুটিয়ে এনেছ। আর এক একটা পিলে গায়েগতরে কোল বালিশের মতো।

বিনু যুগল অবনীমোহন, এমনকি অদূরে সেই অসুস্থ রোগগ্রস্ত লোকগুলোও হাসতে লাগল। সবার সঙ্গে বুধাই পালও পাল্লা দিয়ে হাসছে।

লারমোর শুধোলেন, পেটটার এমন দশা করলে কেমন করে? গাওয়ালে গিয়ে ভেবেছিলে, লালমোহন সাহেব তো সামনে নেই, কে আর বকাঝকা করবে? প্রাণের সুখে অপথ্য কুপথ্য করে গেছ, না?

তাড়াতাড়ি জিভ কেটে একসঙ্গে হাত এবং মাথা ঝাঁকিয়ে বুধাই বলল, গুরুর কিরা (দিব্যি) সাহেব, আপনে যা যা খাইতে কইছিলেন তার বাইরে দাতে কিছু কাটি নাই।

কিছু না?

না।

সরষে দিয়ে ইলিশ-ভাতে খাও নি?

উই জিনিস না খাইয়া পারি?

পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে শুঁটকি মাছ?

উইটাও খাইতে চাই নাই। তয়–

তবে খেলে কেন?

কিছুক্ষণ হাত কচলে, নিজের বুকে একখানা আঙুল রাখল বুধাই পাল। করুণ গলায় বলল, এইর ভিতরে যার বাস হেই আত্মায় চাইল যে। আমি কী করুম?

তাই তো, কী আর করা। তা হা হে পালমশাই, তেঁতুল দিয়ে পুঁটি মাছের টকের কথাটা বল–

বুধাই পাল চুপ।

লারমোর বললেন, লজ্জা কি, লজ্জা কি, বলেই ফেল না। পুঁটি মাছের টকটাও নিশ্চয়ই পরমাত্মা চেয়েছিল?

বুধাই এবার আর মুখ খুলল না, আস্তে করে মাথা হেলিয়ে বুঝিয়ে দিল।

লারমোর আঙুল দিয়ে তার চিবুকটা ঠেলে ওপর দিকে তুললেন, তারপর চোখের ভেতর তাকিয়ে বললেন, পালমশাই, ধন্বন্তরির বাপেরও সাধ্যি নেই আপনার রোগ সারায়। এক কাজ করুন–

বিপন্ন মুখে বুধাই পাল তাকিয়ে থাকল।

লারমোর বলতে লাগলেন, যমরাজকে খবর দিন, খুব তাড়াতাড়ি তিনি আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে একটা পুষ্পকরথ পাঠান।

হঠাৎ উবু হয়ে বসে লারমোরের দু’খানা পা চেপে ধরল বুধাই পাল। কাতর মিনতিপূর্ণ সুরে বলল, আমারে  বাঁচান সাহেব, প্যাটে বড় যন্ত। এইবার থিকা আর আপনের আবাইধ্য হমু না। য্যামন কইবেন ত্যামন চলুম।

তোমার কথায় বিশ্বাস নেই।

আরেক বার, খালি আরেকটা বার–গুরুর কিরা, আর উই সগল খামু না।

ঠিক?

ঠিক সাহেব।

ওষুধ টোষুধ দিয়ে লারমোর বললেন, তেল-টেল, পেঁয়াজ রসুন, সব বাদ। তিন মাস শুধু দুধ ভাত খাবে। নইলে পেটের পিলে আর ঘা সিধে তোমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবে।

বুধাই পাল বলল, দুধ খাওনের ক্ষ্যাতা কি আমাগো লাখান মাইনষের আছে?

লারমোর বললেন, না থাকে, দু’মাস তুমি আমার কাছে এসে থাকো। আমার তিনটে গরু আছে, সাত আট সেরের মতো দুধ হয়।

বিনুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, স্নেহলতা লারমোরকে তাদের বাড়ি গিয়ে থাকতে বলেছেন। এই নিয়ে স্নেহলতার কত রাগ, কত অভিমান। আর লারমোর কিনা তাঁর কাছে গিয়ে থাকবার জন্য লোক জোটাচ্ছেন! ব্যাপারটা ভাবতেই ভারি মজা লাগল বিনুর।

বুধাই পাল বলল, বাড়িঘর ব্যবসাপত্তর ফেলাইয়া আপনের কাছে গিয়া কি থাকতে পারি? সোংসার দেখব কে?

তা হলে এক কাজ করো, তোমার নাতিকে আমার ওখানে রোজ সকালে পাঠিয়ে দিও। দুধ দিয়ে দেব।

হেই ভাল। তাইলে অখন যাই। পন্নাম সাহেব, পন্নাম জামাইবাবু, নাতিবাবু’ বুধাই পাল চলে গেল।

বুধাই পালের পর ডাক পড়ল সোনা মিঞার, তারপর চন্দ্র ভূঁইমালীর, তারপর রজবালি তালুকদারের। এইভাবে একের পর এক রোগী দেখা চলল।

বুক-পেট পরীক্ষা করতে করতে শুধু রোগ সম্বন্ধেই খোঁজখবর নিচ্ছেন না লারমোর, অন্য কথাও বলছেন। রজবালিকে তিনি হয়তো বললেন, এবার কত কানি (চার বিঘেতে এক কানি) জমিতে পাট বুনেছিলি?

রজবালি জবাব দিল, আড়াই কানি।

গেল বার তো পাট বুনে লোকসান দিয়েছিলি। এবার লাভ থাকবে?

মনে তো লয় (হয়)। অহন খোদার ইচ্ছা।

হ্যাঁ। তার ইচ্ছা ছাড়া কী আর হয় বল—

চন্দ্র ভুঁইমালীকে হয়তো বললেন, এবারের বর্ষায় তোমার দক্ষিণের ভিটের ঘরখানা না পড়ে গিয়েছিল চন্দর?

হ। চন্দ্র মাথা নাড়ে।

সেটা উঠিয়েছ?

আপনেগো আশীৰ্বাদে উঠাইছি লালমোহন সাহেব। আগে চালে আছিল ছন, এইবার টিন দিছি নয়া ঢেউ-খেলাইনা (ঢেউ-খেলানো) টিন। খুব পোক্ত হইছে ঘর।

খুব ভাল, খুব ভাল।

একদিন গিয়া দেইখা আইসেন সাহেব। হ্যামকত্তারেও কইছি পায়ের ধূলা দিতে।

যাব যাব, নিশ্চয়ই যাব। হেমকে নিয়ে একদিন তোমার নতুন ঘর দেখে আসব।

অসুখ আর অসুখের বাইরে অন্য সব কথার ফাঁকে রোগীরা অবনীমোহন এবং বিনুর সঙ্গে যেচে আলাপ করে নিচ্ছে। হেমনাথের জামাই আর নাতি শুনে তাদের কী আনন্দ আর সমাদর!

দেখতে দেখতে ভিড়টা ফাঁকা হয়ে গেল। এখন আর একটিও রুগী নেই। বিনু লক্ষ করেছে, রোগী দেখে একটা পয়সাও নেন নি লারমোর। বরং বিনা পয়সায় সবাইকে ওষুধ দিয়েছেন, কারোকে কারোকে পথ্যের জন্য ফতুয়ার পকেট থেকে পয়সা বার করে দিয়েছেন। বিনুর মনে হল, একেই সেদিন লাভের কারবার বলে ঠাট্টা করেছিলেন হেমনাথ।

ওদিকে অবনীমোহনও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এবার বললেন, আপনি তো দেখলাম ওই রোগীদের সবাইকে চেনেন।

লারমোর হাসলেন, চিনি বৈকি।

নামও জানেন।

জানাই উচিত। চল্লিশ বছরের মতো এখানে কেটে গেল। বলতে বলতে চোখের মণিতে যেন ঘোর লেগে গেল লারমোরের, যখন এসেছিলাম তখন আমি যুবক, আর আজ বৃদ্ধ।

লারমোর যা বলে গেলেন, সংক্ষেপে এইরকম। রাজদিয়াকে ঘিরে ষাট সত্তর মাইলের ভেতর যত গ্রাম, যত জনপদ, যত মানুষ, এমনকি প্রতিটি বৃক্ষলতা আর পাখি–সব, সব তার চেনা। এই সজল বিশাল ভূখণ্ডে আয়ুর প্রায় সবটুকুই তো কাটিয়ে দিলেন। এখানে কোথায় কোন বাড়িতে শিশু জন্মাচ্ছে, কোথায় মৃত্যু ঘটছে–সমস্তই জানেন লারমোর। জন্ম-মৃত্যু, কোনও কিছুই তার আগোচরে হবার উপায় নেই। পূর্ব বাংলার এই স্নিগ্ধ, মনোরম অংশের ওপর তিনি ব্যাপ্ত হয়ে আছেন।

কথা বলতে বলতে আকাশের দিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ ঘোরটা কেটে গেল। লারমার চঞ্চল হলেন, ইস, বেলা হেলে গেল! এখনও হেমের দেখা নেই।

সত্যি সত্যিই সূর্যটা এখন আর মধ্যাকাশে নেই, পশ্চিমের আকাশ বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে খানিকটা নেমে গেছে। রোদের রং গেছে বদলে। তাতে নরম সোনালি আভা লেগেছে। ফলে চারদিকের গাছপালার পাতা সোনার ঝালর হয়ে দুলছে।

আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে লারমোর বললেন, হেমের একটা খোঁজখবর নেওয়া দরকার। কোথাও বসে গেলে উঠবার নাম নেই তার। বলতে বলতে বিনুর সম্বন্ধে সচেতন হলেন, আরে, দাদভাইটার মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে। শুকোবার কথাই। সেই কখন দুটি খেয়ে এসেছে। এই যুগল, চট করে দাদাভাইয়ের জন্যে রসগোল্লা আর সন্দেশ নিয়ে আয়। মনা ঘোষের দোকান থেকে আনবি। পয়সা বার করতে পকেটে হাত পুরলেন লারমোর।

এতক্ষণ দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে ছিল যুগল, বলামাত্র তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। আর সত্যিই খুব খিদে পেয়েছিল বিনুর, সেটা ধরা পড়ে যাওয়াতে লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকল সে।

লারমোর কিন্তু পয়সা বার করতে পারলেন না। তার আগেই বাধা পড়ল। অবনীমোহন বললেন, খাবার আনতে হবে না। আমি বরং বিনুকে খাইয়ে আনি, যুগলও সঙ্গে যাক।

তুমি আবার কষ্ট করে যাবে কেন?

কষ্ট কিছু না। আসলে—

লারমোর জিজ্ঞাসু চোখ তাকালেন, কী?

অবনীমোহন বললেন, পূর্ব বাংলায় এই প্রথম এলাম। এখানকার হাট টাট কিছুই তো দেখি নি। বিনুকে খাওয়াতে গিয়ে হাটটা ঘুরে দেখব।

লারমোর উৎসাহের সুরে বললেন, খুব ভাল। রোগীর কাছে বসে না থেকে একটু ঘুরে এস।

তা ছাড়া—

কী?

ঘুরতে ঘুরতে যদি মামাবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়–

তবে তো আরও ভাল। যাও–যাও–

একটু ভেবে অবনীমোহন বললেন, আপনিও চলুন না লালমোহন মামা—

লারমোর বললেন, আমি কী করে যাব?

আপনার রোগী-টোগী তো এখন নেই।

তা নেই। কিন্তু যে কোনও সময় এসে যেতে পারে। এত দূর দূর জায়গা থেকে ওরা আসে। দুদিন পর পর এখানে হাট। আমাকে না পেলে ওদের কত কষ্ট হবে বল তো?

দু’চোখে অসীম শ্রদ্ধা নিয়ে সেবাব্রতী, নিঃস্বার্থ মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন অবনীমোহন। অনেকক্ষণ পর ধীরে ধীরে বললেন, কতক্ষণ এখানে থাকবেন?

সেই সন্ধে পর্যন্ত। হাট ভাঙলে উঠব।

আপনিও তো সেই সকালবেলা খেয়ে এসেছেন। আমি কিন্তু খাবার নিয়ে আসব।

লারমোর মধুর হাসলেন, বেশ তো, এনো।

অবনীমোহন আর কিছু বললেন না, বিনু আর যুগলকে নিয়ে হাটের দিকে চললেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *