দ্বিতীয় কালান্দর ফকিরের কাহিনী
প্রথম কালান্দার নিজের জায়গায় সরে যেতে দ্বিতীয় কালান্দার এগিয়ে এসে তার কাহিনী শুরু করলো :
আমিও এক চোখ কানা হয়ে জন্মাইনি, মালকিন। আজ আমার এই ফকিরের বেশ, কিন্তু আদপে আমি ফকির ছিলাম না। আমিও এক বাদশাহর সন্তান। আমার বাবা শুধু ঐশ্বর্যবানই ছিলেন না, বিদ্যায় বুদ্ধিতে তার মতো বিচক্ষণ ব্যক্তি কমই জন্মায়। আমাকেও তিনি প্রচুর লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। আমাদের প্রাসাদে পৃথিবীর সেরা সব বই ছিলো। দিনরাত সেই বইপত্র নিয়েই আমার কাটতো। নিজের প্রশংসা নিজে করা ঠিক না, তবে লোকে বলতো আমি নাকি পণ্ডিত। অনেক নাকি আমার জ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি। দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়লো আমার পাণ্ডিত্যের কথা। বাদশাহ, সুলতানরা আমাকে আদর করে ডেকে নিয়ে যেতো। সম্মান করতো। একবার সমরখন্দের এক বাদশাহর কাছ থেকে আমার আমন্ত্রণ এলো। বাবার অনুমতি নিয়ে রওনা হলাম। অনেক দিনের পথ। খাবার দাবার, পোশাক আশাক বিলাসব্যসন এবং লোক লস্করে ছয়খানা জাহাজ বোঝাই করা হলো। এক মাস ধরে জাহাজ চলছে। একদিন এক বন্দরে ভেড়ানো হলো। ঘোড়া আর উটগুলোকে নামানো হলো। তাদের পিঠে বোঝাই করা হলো নানা জাতের নানা ধরনের মনোহারী উপহার-সামগ্ৰী। বাদশাহকে ভেট দিতে হবে। বন্দর থেকে বাদশাহের দরবার ঘণ্টাখানেকের পথ। কিছু দূর এগোতেই প্রচণ্ড ঝড় উঠলো। ধুলোয় অন্ধকার হয়ে গেলো চারদিক। ঝড়ের ঘূর্ণিতে কে কোনদিকে কোথায় যে উড়ে গেলাম কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না। অবশেষে বর্ষণ শুরু হলো এবার ঝড় থেমেছে। অন্ধকার কেটেছে। দেখলাম, আমরা এক বিশাল মরুপ্রান্তরে জনা ষাটেক সশস্ত্র ডাকাতের একটা দল পরিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। বুঝলাম, প্ৰাণ-সংশয় উপস্থিত। বললাম, শাহেন শাহর জন্যে উপহার সামগ্ৰী নিয়ে চলেছি আমরা। সুতরাং আমাদের কোন ক্ষতি না করে পথ ছেড়ে দাও।
কিন্তু তারা সিংহের মতো গর্জে উঠলো, শাহ-ফাহ জানি না আমরা। আমরা আরব দাসু্য। এই সব সামান আমরা লুঠ করে নেবো।
এমন সময় ডাকাতদের কে একজন আমাদের একজন ক্রীতদাসকে খুন করে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রাণভয়ে চিৎকার দিয়ে যে যেদিকে পারলো চো দৌড় দিতে লাগলো। আমিও ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে লাগলাম। চাচা আপন বাঁচা। কে কোথায় রইলো, কিছু দেখার ফুরসৎ নেই তখন।
দৌড়তে দৌড়তে এক পাহাড়ের মাথায় উঠে এলাম। সেখানে এক গুহায় রাতটা কাটলো। পরদিন সকালে গুহা ছেড়ে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। শেষে, এক সুন্দর শহরে এসে হাজির হলাম। যেদিকে তাকাই, চোখ জুড়িয়ে যায়। চারিদিকে প্রকৃতির বিচিত্র সমারোহ। এখানে শীত গ্ৰীষ্ম বর্ষা বলে কিছু নেই। সারাটা বছরই বসন্তকাল। শহরের পথ দিয় হেঁটে চলেছি। একসময় দেখলাম, এক দর্জিতার দোকানে বসে কাপড় রিপু করছে। আমাকে বোধহয় বিদেশী দেখেই হাসলো। আমিও হেসে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে বসতে দিলে সে। তারপর জানতে চাইলো আমার কথা। সব শুনে তার চোখে মুখে ভয়ের ভাব ফুটে উঠলো। বললো তোমার বাবার সব চেয়ে বড় শত্রু এদেশের বাদশাহ। তোমাকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনার উদ্দেশ্য হলো হত্যা করা। তোমার পরিচয় জানতে পারলে কেউ তোমাকে আশ্রয় দেবে না।
সে আমাকে খেতে দিলো। আমরা একত্রে বসে আহার করলাম। গভীর রাত পর্যন্ত অনেক কথা, অনেক গল্প হলো। তারপর আমার জন্যে একটা মাদুর আর চাঁদর নিয়ে এসে বললো, নাও এবার শুয়ে পড়ে।
দোকানের এক পাশে শুয়ে রাত কাটালাম। এইভাবে তিন দিন তিন রাত্রি সেই দর্জির দোকানে কাটলো। এক সময় দর্জি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এমন কোন বিদ্যা কি তোমার জানা আছে—যা দিয়ে তোমার জীবিকা নির্বাহ হতে পারে?
–নিশ্চয়ই, আমি বাবলাম, আমি আইনে পণ্ডিত। এছাড়া সাহিত্য দর্শন শাস্ত্রে আমার অনেক পড়াশুনা আছে। হিসাব শাস্ত্রও আমার নখদর্পণে।
—কিন্তু, সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, তোমার ঐ বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে এ শহরে কী ব্যবসা হতে পারে? এখানে কেউ ওসবের কদর করবে না। এখানকার লোকের একটাই লক্ষ্য, কি করে পয়সা বানানো যায়।
আমি বললাম, কিন্তু আমি তো। এছাড়া অন্য কিছুই জানি না।
তখন দর্জি বললো, ঠিক আছে, বাছা, আল্লাহ আছেন, তিনিই ব্যবস্থা করবেন, কোন চিন্তা করো না।
একখানা কুঠার এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন, বনে গিয়ে কাঠ কেটে এনে শহরে বিক্ৰী করো। দেখবে খাওয়া পরার পয়সা রোজগার হয়ে যাবে।
অন্যান্য কাঠুরেদের সঙ্গে বনে গিয়ে প্রতিদিন এক-মোট কাঠ কেটে এনে বিক্ৰী করতে লাগলাম। এক মোটের দাম এক আধুলী। সামান্য কিছু খরচ করে খানা খেতাম, আর বাকীটা সযত্নে জমাতাম। এইভাবে পুরো একটা বছর কেটে গেলো। প্রতিদিন কাজ করি আর রাত্রে এসে দর্জির দোকানে ঘুমোই।
একদিন কাঠ কাটতে গিয়ে আমার সঙ্গীদের ছেড়ে আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। মোটা মোটা অসংখ্য গাছ। আমি একটা মরা গাছ বেছে নিয়ে কাটতে লাগলাম। গাছের গোড়ায় কোপ চালাতে চালাতে এক সময় আমার কুঠারের মুখে একটা তামার বালা উঠে এলো। একটু অবাক লাগলো। খানিকটা মাটি কেটে তুলতেই দেখি, একটা কাঠের পাটাতন। দু’হাত দিয়ে পাটাতনটা সরাতেই চোখে ধাঁধা লাগলো। মাটির নিচে এক মনোরম প্রাসাদ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। একটা ঘরে পালঙ্কে শুয়ে আছে বেহেস্তের পরীর মতো পরম সুন্দরী একটি মেয়ে।
মেয়েটি আমাকে প্রশ্ন করে, তুমি মানুষ না দৈত্য?
আমি বললাম, আমি মানুষ।
মেয়েটি বললো। আজ কুড়িটা বছর কেটে গেছে, কোন মানুষের মুখ আমি দেখিনি, তুমি কী করে এখানে এলে?
–খোদাই আমাকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছে সুন্দরী। এতো দিন ধরে যত দুঃখ কষ্ট পেয়েছি, আজ তোমাকে দেখে তা সব লাঘব হয়ে গেলো।
আমার জীবনের দুঃখের কাহিনী তাকে বললাম। শুনে তার চোখে জল এলো। তার নিজের জীবনের করুণ কাহিনী শোনালো আমাকে :
আমি ইফাতিমাসের সুলতানের কন্যা। আমার চাচার ছেলের সঙ্গে আমার শাদী হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শাদীর দিনে বাজমুস দৈত্যের পুত্র জারজিস আমাকে উধাও করে নিয়ে এসে এই পাতালপুরীতে বন্দী করে রেখেছে। অন্য কোন দিকে কোন অভাব সে রাখেনি আমার। আমি যা খেতে চাই তাই এনে দেয়। দামি দামি সাজপোশাকে ভরে দিয়েছে আমার ঘর। দশ দিন পর এক দিনের জন্য আসে সে আমার কাছে। সারা দিন রাত আমার সঙ্গে থাকে। আমার সঙ্গে খানা খাদ্য, আমার সঙ্গে সহবাস করে। তারপর সকালবেলা চলে যায়। আবার দশ দিন পরে আসে। অবশ্য যদি কোন কারণে এই দশদিনের মধ্যে আমার দরকার হয়, তবে তাকে স্মরণ করলে তখুনি সে এসে হাজির হবে। পাশে একটা ছোট ঘর আছে। সেই ঘরের দেওয়ালে দু’টো লাইন মন্ত্র লেখা আছে। সেই লেখাটার ওপর হাত রেখে তাকে ডাকলেই সে এসে পড়বে। চার দিন আগে সে এসেছিলো। আরও ছয় দিন বাকী তার আসার। সুতরাং নিশ্চিন্তে পাঁচটা দিন কাটাতে পারো তুমি আমার সঙ্গে। জারজিস আসার আগে তুমি চলে যেও, কেমন?
—ঠিক আছে, তাই হবে।
আমি রাজি হওয়াতে খুশিতে নেচে উঠলো মেয়েটি। আমাকে টানতে টানতে তার বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসালো। আমার হাতের মধ্যে ওর হাত। ধমনীতে রক্ত প্রবাহ দ্রুততর হয়ে ওঠে। সে বললো, তোমাকে এই পাতালপুরোটা ঘুরিয়ে দেখাই।
একটার পর একটা সাজানো গোছানো ঘর দেখতে দেখতে এক সময় হামাম ঘরে এলাম আমরা। দামি আতরের গন্ধ মাতিয়ে তুললে আমাকে। প্রকাণ্ড বড় একটা বৃত্তাকার চৌবাচ্চা। তার ঠিক মাঝখানে একটা সুন্দর ফোয়ারা। দিবারাত্ব জলের তুবড়ী ছুটিয়ে চলেছে। পোশাক-আশাক খুলে চৌবাচ্চার পাড়ে এসে বসলাম দু’জন। নিচে হালকা নীল জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করে কাটালাম। তারপর আমার সারা শরীরে খুব ভালো করে তেল মাখালো সে। আমিও তাকে মাখিয়ে দিলাম। মেয়েটির নরম হাতের স্পর্শে আমার দেহমন উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। ওর মুখে তখন দুষ্টুমীর হাসি। কী আমন করছে। কেন?
এই বলেই আচমকা একটা ঠেলা দিয়ে জলের মধ্যে ফেলে দিলো আমাকে। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো। ফোয়ারার মতই সে হাসি অনগাল, অবারিত। সেও ঝাঁপিয়ে পড়লো। এগিয়ে এসে চেপে ধরলে আমার পা। বুকের ওপর টেনে নিলাম নেকক্ষণ ধরে অনেক জলকেলী করে গোসল সারলাম আমরা। মাকে সাবান মাখালো সারা শরীরে। আমিও তাকে মাখলাম। ল থেকে উঠে আবার জামা কাপড় পরে তার শোবার ঘরে ফিরে এলাম আমরা। আমাকে আদর করে সে বললো, এবার সোনা ছেলের মতো ঘুমোও দেখি। এখন কিছু হবে না। ঘুমিয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করে নাও। তারপর রাতের বেলায়… ঘুম থেকে উঠে আমরা খানা খাবো। মুরগীর মাংস আর শেরী। দেখবে, তারপর কত মজা হয়। এবার ঘুমাও।
আমার চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে আদর করতে লাগলো সে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ ঘুমে কেটেছে। কার যেন হাতের স্পর্শে ঘুমটা ছেড়ে গেলো। চোখে তখনও তন্দ্ৰা। আমি বুঝতে পারছি একটা নরম হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার সারা শরীরের ওপর দিয়ে। বুঝতে পারলাম। মেয়েটি খেলা করছে আমার দেহটা নিয়ে। না জাগার ভান করে ওর আদর খেতে থাকলাম। একটু পরে সে টিপতে লাগলো আমার পা দু’টো, উরু, কোমর। আঃ কী ভালোই না লাগছে! সারা শরীর চনমান করে উঠলো। আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। কাছে টেনে নিলাম।
বিস্ময়ে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো আমার দিকে; ওরে দুষ্টু-এতক্ষণ তাহলে ঘাপটি মেরে ছিলে?
আমি আরও নিবিড় করে নিলাম ওকে।
ও বললো, ওঠে, এবার খানা-পিনা করবো আমরা। খেতে খেতে অনেক সুখ দুঃখের কথা হলো। ও বললো, তুমি এলে, তাই আমার মুখে হাসি দেখছো। আজ বিশটা বছর আমি শুধু কেঁদে কাটিয়েছি। উপরে আল্লাহ আছেন, তিনি আমার কান্না শুনে তোমাকে পাঠিয়েছেন। না হলে কোনও মানুষের পক্ষে কি এখানে আসা সম্ভব?
গুনগুনিয়ে গান ধরলো সে–
আগে যদি জানতেম সখা, আসবে আমার ঘরে,
ফুলের শয্যা বিছিয়ে দিতাম, তোমার পথের পরে।
দেখতে আমার সাজের বাহার, রূপের বাহার যতো।
রাঙিয়ে দিতাম হৃদয় তোমার, লাল গুলাবের মতো।।
কি মিষ্টি গলা। মনটা ভরে গেলো গান শুনে। এতোদিনের ক্লান্তি আমি মুছে ফেলে নতুন করে জীবনের আনন্দ ভালোবাসার স্বাদ পেলাম। হাত ধরাধরি করে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম। শৌরী নিলাম দুজনে। অনেকক্ষণ ধরে অনেক সরাব খেলাম। কাবাব, রোস্ট, চাপ, রোটি, শাহী-হালওয়া আরও কত সুন্দর সুন্দর খানা খেলাম, খুব তৃপ্তি করে। আজ বছর খানেক পোড়ারুটি আর ডাল খেয়ে মুখ আমার হেজে গিয়েছিলো।
খানা পিনা শেষ করে বিছানায় এসে শুলাম দু’জনে কিছুক্ষণের মধ্যেই একের দেহ-মন-প্ৰাণ অন্যের মধ্যে হারিয়ে গেলো। বেহেস্ত কোথায় জানি না, সেখানে অপাের সুখ আছে, সুধা আছে—শুনেছি। কিন্তু সে রাত্রে যে সুখ আমি পেয়েছি, যে সুধা আমি পান করেছি। তার কোনও তুলনা নাই। আল্লাহ আমাকে বহুৎ কষ্ট সহ্য করিয়েছেন, সেই রাত্রির সুখের স্বাদ, সেই জন্যেই বুঝি এতো বেশী করে পেলাম।
খুশি খুশি মেজাজ নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম সকালে। ওকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার চোখে তখন ভালোবাসার রঙ ধরেছে। বললাম, তোমাকে এই পাষাণ পুরীতে রেখে যাবো না আমি। দৈত্যটা তোমার দেহ ছিড়ে খাবে, আমি ভাবতেই পারছি না।
—আহা, কী ভালোবাসার কথা গো, মেয়েটি কটাক্ষ হেনে বললো, ইচ্ছে করে, কলজেটা ছিড়ে দিই তোমাকে। কিন্তু সোনা, তুমি আমন অধৈৰ্য হয়ে না। সবুরে মেওয়া ফলে। দৈত্যটা তো দশদিন অন্তর একদিন আসে। তাতে আর কী যায় আসে। বাকী ন’ দিন তো আমরা এক হয়ে
থাকতে পারবো?
আমি তখন প্রেমে পাগল। ওর এই কথা আমার পছন্দ হলো না; বললাম, না, না, সে হয় না। আর একটা দিনও ব্যাটাকে ভোগ করতে দেবো না তোমাকে। তুমি শুধু আমার। আমি ওই শালার লেখাটা এখুনি মুছে ফেলবো। তাহলেই তো সে এসে পড়বে। আর আসলেই আমার হাতে তার মৃত্যু অবধারিত।
ছোটবেলা থেকেই আমার খুব ঝোক দৈত্যের সঙ্গে লড়বো। দৈত্যকে মারতে পারলে খুব পুণ্য হয় শুনেছি।
প্রেমের নেশায় হয়ো না অন্ধ,
ঝোঁকের মাথায় করো না কোন ভুল
হারিয়ে যাবে তুমি, ফুরিয়ে যাবে প্রেম
(তখন) কে রবে দুঃখী বলো, আমার সমতুল?
সুন্দর করে আবৃত্তি করলে সে। কিন্তু এ কবির সার কথায় কৰ্ণপাত করলাম না আমি। ছুটে গিয়ে আফ্রিদির সেই যাদু করা লেখাটার ওপর প্রচণ্ড ঘা মারলাম কুঠারখানা দিয়ে।
এই সময় শাহরাজাদ দেখলো প্রভাত সমাগত। গল্প থামালো।
ত্রয়োদশ রজনীতে আবার শুরু হলো কাহিনী। শুনুন, শাহজাদা, সেই দ্বিতীয় কালান্দার তার কাহিনী বলে চলেছে :
আমি যখন সেই দেওয়ালের লিখনে কুঠারের আঘাত করলাম, চিৎকার করে কেঁদে উঠলো মেয়েটি। হায় আল্লাহ, এ কি করলে তুমি? এখুনি এসে হাজির হবে দৈত্য। তোমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে আছাড় দেবে। তোমার পায়ে পড়ি, তুমি পালাও। যে পথ দিয়ে এসেছিলে সেই পথ দিয়ে পালিয়ে যাও। আমার কথা শোন।
আমি সিঁড়ির দিকে ছুটিলাম। পড়ি মারি করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। সরাব আর প্রেমের নেশা তখন ছুটে গেছে আমার। ভয়ে বুকটা শুকিয়ে গেলো। হঠাৎ মনে পড়লো, পায়ের জুতো আর কুঠারখানা ফেলে এসেছি। আবার তরতর করে নেমে ফিরে এলাম ওর ঘরে। এই ফিরে আসাই কাল হলো। মেদিনী কাঁপিয়ে এসে হাজির হলো সেই দৈত্য। কী ভীষণ দেখতে। এমন বীভৎস যে, চেয়ে দেখা যায় না। মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কড়মড় করতে করতে বললো, এই অসভ্যতার মানে কী? আমি তো ভাবলাম তোমার কোন বিপদ আপদ ঘটেছে। ব্যাপার কী? হয়েছে কী?
মেয়েটি বললো, কিছুই ঘটেনি। আমি একটু নেশা করে টলে পড়ে গিয়েছিলাম দেওয়ালের গায়ে।
কিন্তু দৈত্যটা সে কথা বিশ্বাস করলো না। আমার জুতো আর কুঠার নজরে পড়লো তার। ওরে হারামজাদী, মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাওনি। এগুলো কী? শিগ্নির বল, কার এগুলো?
মেয়েটি বললো, সত্যি, বিশ্বাস করো, তুমি দেখালে তাই দেখলাম। এর আগে আমার নজরে পড়েনি। আমার মনে হয় তুমিই কখনও নিয়ে এসেছিলে।
—থামো। বিকট চিৎকার করে উঠলো দৈত্যটা, ওসব বুজরুকী অন্য জায়গায় ঝেড়ো। এখন সত্যি কথা বল শয়তানী, না হলে দেখ তোর কী করি।
এই বলে মেয়েটাকে একেবারে ন্যাংটো করে মাটিতে শোয়ালো। হাত দু’টো আর পা দুটো ক্রুশ-এ গেথে দিলো মাটির সঙ্গে। তারপর চালাতে লাগলো নৃশংস অত্যাচার। চোখে দেখা যায় না সে দৃশ্য। আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ। এবার সিঁড়ির দিকে চলে এলাম, পা টিপে টিপে। নিজের বোকামীর জন্যে ঠোঁট কামড়াতে লাগলাম। শুধু আমার দোষে, একটা ফুলের মতো মেয়ের জীবন শেষ করে দিলাম। অনুতাপে পুড়ে যেতে লাগলো বুকটা। মেয়েটা আজ কুড়িটা বছর বন্দী হয়েছিলো এখানে। কিন্তু তবু তো জানে বেঁচেছিলো। আর আজা! আজি তো সে মরে যাবে। শুধু আমার জন্যে—শুধু আমার জন্যে তাকে আজমিরাতে হলো। হায় আল্লাহ, এ পাপ আমি কোথায় রাখবো?
যখন সেই দর্জির দোকানে এসে হাজির হলাম দর্জি তো আমাকে দেখে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো। বললো, কাল সারারাত আমি বসে বসে কাটিয়েছি। সবাই ঘরে ফিরলো।
কিন্তু তুমি ফিরে এলে না। আমার ভয় হলো, হয়তো কোন জানোয়ারের মুখে পড়েছে তুমি! তোমাকে খেয়ে ফেলেছে। যাক, খোদার দোয়ায় ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছে, আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
তার পাশে বসে আগাগোড়া সব ঘটনা সবিস্তারে বলতে লাগলাম। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে দর্জি উঠে গেলো। একটু পরে ফিরে এসে বললো এক পার্শি সাহেব! তোমার জুতো জোড়া আর কুঠারখানা নিয়ে এসেছে। তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চায়।
দর্জির কথা শুনে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। কী করি, কী বলি, কিছুই ভাবতে পারলাম না। মাথাটার মধ্যে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগলো। মনে হতে লাগলো, এখুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো।
দর্জি বললো, যাও না, দেখা করে এসো। তোমার উপকার করতেই তো এসেছেন। অতো ঘাবড়াবার কি আছে? জুতো জোড়া আর কুঠারটা নিয়ে উনি ঘুরেছেন অনেক। শহরের কাঠকুড়ানোওয়ালারা যে অঞ্চলে বাস করে সেখানে গিয়েছিলেন প্রথমে। তাদের একজন তোমার জুতো জোড়া চিনতে পেরে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। যাও, দরজার সামনে গিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলে। শুক্ৰিয়া জানিয়ে এসো।
ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিলো আমার পা। কোনরকমে উঠে দরজার কাছে গিয়ে একটু ফাঁক করে দেখলাম, এক সুদৰ্শন পার্শি দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে জুতো অন্যহাতে কুঠার। চিনতে ভুল হলো না, আমারই! ভাবছি, দরজাটা খুলে ওর সামনে দাঁড়াবো কি দাঁড়াবো না। এমন সময় দরজার ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে খপ করে আমার একখানা হাত চেপে ধরলো। দেখলাম, সে-হাতের থাবাটা কোনও মানুষের না। দৈত্যের। একটা বিকট আওয়াজ তুলে সে আমাকে হ্যাঁচকাটানে বের করে ফেললো। তারপর এক লাফে উঠে গেলো মহাশূন্যে। তার হাতের মুঠোয় আমি ঝুলতে ঝুলতে চললাম। কোথা দিয়ে কিভাবে আবার সেই পাতালপুরীর প্রাসাদে আমাকে এনে ফেললো, বলতে পারবে না। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। আমি যখন জ্ঞান ফিরে এলো, দেখি, আমার সামনে সেই সুন্দরী-বিবস্ত্রা রক্তাপুত দেহে গোঙাচ্ছে।
তাই হারমজাদী, ফিরে দেখ, দৈত্যটা গর্বে উঠলো, তোর পরতের নাগরকে ধরে এনেছি।
মেয়েটা বললো, আমার কোন পিরিতের মানুষ নাই। আমি কাউকে চিনি না। এই বলে মেয়েটা আমার দিকে তাকালো। তারপর আবার বললো, না, একে আমি কখনও দেখিনি, চিনি না।
—কী? গর্জে উঠলো দৈত্যটা, চেনো না? মিথ্যুক কাঁহিকা। যাকে নিয়ে ব্যভিচার করেছিস, তাকে চিনতে পারছিস নে। ঠিক আছে, এই নে তলোয়ার। কাট-কেটে ফেল ওর গর্দান। আমি দেখতে চাই নিজের চোখে।
মেয়েটা হাত পেতে নিলো তলোয়ারখানা। এগিয়ে এলো আমার সামনে। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো আমার মুখ। চোখের ইশারায় মিনতি জানালাম, মেরো না আমাকে। আড়চোখে দুগুলো আমার ইশারা। তার পর চিৎকার করে উঠলো, তোমার জনোই আমাদের যত
তারপর করুণ একটা গানের কলি গাইলো :
দুঃখের দিনে কেন এলে?
সইবে কি গো, চোখের পানি।
ওই ইশারায় বলতে যা চাও,
অনেক আগেই হৃদয় দিয়ে জানি।
মাথা মোটা দৈত্যটা বুঝলো না, এই গানের মর্মার্থ। আমি বুঝলাম। মেয়েটা তলোয়ারখানা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। দৈত্যটা কুড়িয়ে নিয়ে আমার হাতে তুলে দিলো। সেখানা। বললো, তোমার মেহবুবার গর্দানটা যদি কেটে ফেলতে পারো তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবো আমি। কোন ক্ষতি করবো না। জবান দিচ্ছি।
তলোয়ারখানা নিয়ে মেয়েটার সামনে এগিয়ে গেলাম। হাতটা ওপরে তুলতেই তার চোখের কাতর মিনতি আমাকে বিমূঢ় করে দিলো। তাই তো, এতো অত্যাচার সত্ত্বেও সে তো ভালোবাসার অপমান করেনি। তবে আমি নিজের স্বার্থের জন্যে এই চরম বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাচ্ছি কেন তার সঙ্গে? কান্নায় চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম তলোয়ারখানা। তারপর দৈত্যকে কাতরভাবে বললাম, তুমি দৈত্য অধিপতি, তোমার হুঙ্কারে সারা দুনিয়া কেঁপে ওঠে। আমার আর্জি-তুমি আমাকে এই নৃশংস কাজ করতে হুকুম করো না। আমি পারবো না। তুমি তো দেখলে, সে আমাকে হত্যা করলো না। কারণ আমি তার কোন ক্ষতি করিনি কখনও। আমার সঙ্গে তার পরিচয় নাই। আমারও সেই কথা। সে যখন আমাকে হত্যা করতে পারলো না, আমিই বা তাকে হত্যা করবো কোন অপরাধে? আমি পারবো না। এর চেয়ে আমাকে জহর। এনে দাও। আমি খেয়ে মরতে রাজি আছি, কিন্তু বিনা দোষে একজনকে কোতল করতে পারবো না।
–হুম, দৈত্যটা বিজ্ঞের মতো বললো, এবার বুঝলাম, কিরকম মহব্বতে হাবুডুবু খাচ্ছো তোমরা।
তারপর শুনুন, মালকিন, দ্বিতীয় কালান্দর বলতে থাকে, সেই পাষণ্ড দৈত্যটা বেহেস্তের পরীর মতো দেখতে ঐ মেয়েটার দু’খানা হাত আর দু’খানা পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। এই লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে তখন আমার দশা কী, ঠাওর করতে পারছেন? মনে হতে লাগলো, এ দৃশ্য দেখার চেয়ে আত্মহত্যা অনেক ভালো। তখনও মেয়েটার ধড়ে জানি ধুকধুক করছিলো। আমাকে চোখের ইশারা করলে সে। দৈত্যের নজর এড়ালো না তার এই ইশারা। গর্জে উঠলো, ওরে খানকীর মেয়ে এখনও পিরিত করতে সাধ হচ্ছে। দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি।
এই বলে গর্দানটা কেটে আলাদা করে ফেললো। আমার দিকে চেয়ে বললো, শোনো মানুষের বাচ্চা, আমাদের দৈত্যকুলে নিয়ম আছে ব্যভিচারিণীর একমাত্র সাজা-মৃত্যু। এই মাগীটাকে তার বিয়ের দিনে উধাও করে নিয়ে এসে, মানুষের অগম্য এই পাতালপুরীতে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তখন বয়স তার বারো! আজি কুড়িটা বছর সে আমার সঙ্গে সহবাস করছে। অথচ আমার ওপর তার ভালোবাসা জন্মালো না। মহব্বত করলো। সে তোমার সঙ্গে। একদিনেই তুমি তার দেহ-মন সব জয় করে নিলে? যাই হোক, সবই আমার ধারণা। নিজের চোখে আমি দেখিনি তোমাদের ব্যভিচার। সেই জন্যে তোমাকে জানে মারতে চাই না। কিন্তু আমার যাদু-মন্ত্রে তোমাকে আমি কোনও একটা জন্তু-জানোয়ার বানিয়ে রাখতে চাই। এখন তোমার কী ইচ্ছে, বলো? কী জন্তু হয়ে থাকতে চাও? শিগ্নির বলে। নষ্ট করার মতো সময় আমার নাই। জলদি করো।
আমি বললাম, কিন্তু আমি তো কিছুই ভাবতে পারছি না, কী হয়ে থাকলে আমার ভালো হবে।
—এখনও ভালো করে ভেবে বলে। গাধা, কুকুর, না খচ্চর, না কাক, না বাঁদর? কী হতে চাও, বলো?
আমি কোনও জবাব দিতে পারলাম না। তখন সে ভীষণ রেগে গেলো। বাঁ হাতের থাবায় কোমরটা চেপে ধরে শো করে শূন্যে উঠে গেলো। উড়তে উড়তে এক পাহাড়ের মাথায় গিয়ে নামলো। এক মুঠো মাটি তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে কি সব মন্ত্র পড়লো। তারপর আমার গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, বাঁদর হয়ে যা। আর সঙ্গে সঙ্গে একশো বছরের বুড়ো লোম চর্ম এক বঁদের বনে গেলাম আমি। ভয়ে, দুঃখে আর্তনাদ করে উঠলাম। আর দৈত্যটা খিক্ খিক করে হেসে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। বাদশাহজাদা আমি। আমার কত বিদ্যা বুদ্ধি, জ্ঞান গরিমা। আজ আমি এক ঘূণ্য বঁদরে পরিণত হয়ে গেলাম। নিয়তির অভিশাপ!
পাহাড়ের চুড়া থেকে নিচে নোমলাম। কাছেই সমুদ্রতীর। সারাদিন সমুদ্রের কূলে কুলে ঘুরে বেড়াই। গাছের ফল আর নদীর জল খাই। রাত্রে গাছের ডালে ঘুমোই। এইভাবে দিন কাটে। একদিন দেখলাম, জাহাজ আসছে। জাহাজটা ক্রমশ কাছে এলো; আমি বিরাট এক লাফ দিয়ে উঠে এলাম জাহাজের ডেকে। ধর ধর, মার মার শোর পড়ে গেলো জাহাজময়। লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে এলো সবাই। কেউ বলে তাডিয়ে দাও। কেউ বলে, না মেরে ফেলো। একজন তেড়ে এলো একখানা তলোয়ার নিয়ে। আমি কায়দা করে এক থাবায় কেড়ে নিলাম। ওরা ভয় পেয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলো। আমি তলোয়ারখানা পাশে রেখে কঁদিতে লাগলাম। নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করে ওদের বোঝাতে চাইলাম, আমাকে মেরো না, তোমরা। আমি কোন ক্ষতি করবো না তোমাদের। ওরা বোধহয় আমার নীরব ভাষা বুঝলো। জাহাজের কাপ্তেন এগিয়ে এসে সবাইকে বললো, মনে হয়, বাঁদর আমাদের আশ্রয় চাইছে। যাই হোক, ওকে তোমরা মেরো না। দেখা যাক, কী করে।
আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো তার কেবিনে। অনেক ভালো কথা বললো। আমি সবই বুঝতে পারলাম। কিন্তু জবাব দিই। কী করে? আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তুমি যা করতে বলবে। আমি ঠিক ঠিক তাই করবো।
কপ্তেনের ব্যক্তিগত নোকরের কাজে রাখা হলো আমাকে। আমার কাজে কাপ্তেন সাহেব মহা খুশী। যা যা বলে, ঠিক ঠিক করি। কোন ভুলভ্রান্তি হয় না।
এইভাবে পঞ্চশ দিন পরে এক বন্দরে নোঙর করা হলো জাহাজ। সে দেশের সুলতানের আমির আমলারা এসে সেলাম জানালো জাহাজের বণিকদের। সুলতানের লোকজনদের হাতে তুলে দেওয়া হলো নানা উপটৌকন। তারা বললো, আমাদের সুলতানের উজির সম্প্রতি মারা গেছেন। তিনি নানা বিদ্যায় বিশারদ ছিলেন। তার উজিরের সমকক্ষ পণ্ডিত কোন ব্যক্তিকে সুলতান উজিরে বহাল করতে চান। কিন্তু তেমন কোন লোক আমরা জোগাড় করতে পারছি না। আপনাদের মধ্যে যদি তেমন কোনও যোগ্য ব্যক্তি থাকেন, সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। একটা জড়ানো পাট্টা খুলে দেখালো তারা। যে সব লোক উজিরের পদপ্রার্থী-তারা সকলে স্বহস্তে তাদের নাম স্বাক্ষর করে তার পাশে তাদের যোগ্যতার বিবরণ লিখে দিয়েছে।
ওদের হাত থেকে খপ করে কেড়ে নিলাম পাট্টাটা। শশব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা। এই বুঝি কাগজটা ছিড়ে ফেলি আমি। কেউ আমাকে ভোলাতে চেষ্টা করলো। আবার কেউ ভয় দেখালো, মেরে ফেলবে। আমি যখন ইশারায় তাদের বুঝলাম, আমিও লিখতে পড়তে জানি তখন ওরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাপ্তেন সাহেব এগিয়ে এসে বললো, ঠিক আছে। ওকে দোয়াত কলম দাও। লিখুক, দেখি!
কাপ্তেনের কথা মতো দোয়াত কলম এলো। আমি অতি সহজভাবেই গোটা গোটা অক্ষরে একটা শায়েরী লিখলাম। সবাই অবাক হয়ে আমার লেখা দেখছে। পরপর আরও তিনটে শায়েরী লিখে দিলাম। এবার কাগজখানা তুলে দিলাম ওদের হাতে। আমলারা কাগজখানা নিয়ে গিয়ে সুলতানের সামনে পেশ করলো। পাট্টায় আরও অনেকের লেখা ছিলো। সুলতান আমার লেখায় মুগ্ধ হয়ে আমলাদের বললো, তোমরা দামি দামি পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে গিয়ে দও এই মহা পণ্ডিতকে। আর আমার সবচেয়ে মূল্যবাদ খচ্চরকে বাদশাহী কেতায় জাঁকজমক করে সাজিয়ে নিয়ে যাও। খচ্চরের পিঠে তাকে বসিয়ে কাঁড়ানাকাড়া বাজিয়ে সসম্মানে নিয়ে এসো। আমার দরবারে। আমি তাকে উজিরের পদে বহাল করবো।
সুলতানের কথা শুনে হাসি চাপতে পারলো না কেউ কি করেই বা পারবে? একটা বাঁদরকে বাদশাহী কায়দায়…
সুলতান কিন্তু ক্রুদ্ধ হলো। হাসার কি কারণ ঘটতে পারে এ কথায়? আমি হুকুম দিচ্ছি, আর তোমরা শুনে হাসছে? এতো বড় স্পর্ধা!
গোস্তাকি মাফ করবেন জাঁহাপনা, আপনার কথা শুনে হেসে উঠবো, এমন দুঃসাহস আমাদের কখনই হতে পারে না। কিন্তু সব কথা শুনলে আপনি নিজেও না হেসে পারবেন না। আপনি যাকে মহাপণ্ডিত বলছেন আসলে সে কোন মানুষ না, একটা বুড়ো বাঁদর। ঐ জাহাজের কাপ্তেনের কাছে আছে।
ওদের কথা শুনে সুলতান তো থ! এমন একটা অদ্ভুত জীব জীবনে দেখেনি সে। যত টাকা লাগে বাঁদরটা সে কিনে নেবে। সুলতান বললো, তোমরা মূল্যবান পোশাক-আশাক আর আমার সবচেয়ে দামী খচ্চরটাকে জাকজমকভাবে সাজিয়ে নিয়ে যাও। জাহাজ থেকে তাকে বাদশাহী মর্যাদায় খচ্চরে চাপাবে। তারপর ঢাক-ঢোল, কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে মহা সমারোহে শহরের সদর রাস্তা পরিক্রমা করে নিয়ে আসবে আমার দরবারে।
সুলতানের হুকুমে কাপ্তেনের কাছে এসে প্রচুর ইনাম দিয়ে আমাকে কিনে নিলো তারা। তারপর সুলতানের নির্দেশ মতো মহাসমারোহে নিয়ে হাজির করলো দরবারে। আমি মাটিতে দুহাত ছুইয়ে সেলাম জানালাম সুলতানকে। তারপর হাত জোড় করে দাঁড়ালাম তার সামনে। আমার নিখুঁত দরবারী আদব কায়দায় মুগ্ধ হয়ে গেলো সুলতান। মুগ্ধ হলো সবাই আমির অমাত্য, পারিষদ। আমার নির্দিষ্ট আসনে বসলাম আমি। সুলতানের ইশারায় দরবার ফাঁকা হয়ে গেলো। শুধু রইলাম আমি, সুলতান, একটা দশ বছরের প্রিয় চাকর, আর হারেমের প্রধান খোজা। আমি যা যা খেতে ভালোবাসি, জেনে নিয়ে, সেই সব খানার ফরমাশ করলো। সঙ্গে সঙ্গে খানা সাজানো হলো ফরাসে। সুলতান আমাকে খানা খেতে অনুরোধ জানালো। নিখুঁত দরবারী আদব কায়দা দেখিয়ে আমি খানাপিনা সারলাম।
দোয়াত কলম কাগজ দেওয়া হলো আমার সামনে। কয়েকটা বিখ্যাত পারস্য শায়েরী লিখলাম আমি। সুলতানের সামনে তুলে ধরলাম কাগজ খানা। সুলতান তো অবাক! আমার হাতের লেখা মুক্তোর মতো। কবিতার লাইনগুলো পড়লো সে।—এ কি করে সম্ভব! একটা বঁদর—সে কী করে লিখতে পড়তে পারে। খোদার মহিমা অপার। এ সবই তার লীলাখেলা।
দাবার ছক আর ঘুটি আনা হলো। সুলতান জিজ্ঞেস করলো, জানা আছে কি?
আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম, জানি। দাবার ছকটা বিছিয়ে ঘুটিগুলো সাজালাম। আমার সঙ্গে দাবায় মেতে উঠলো সুলতান। দুদুবার মোক্ষম চালে মাৎ করে দিলাম সুলতানকে। একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলো সে। দাবা খেলায় তার জুডি নাই দেশে। অথচ মাত্র গোটা কয়েক চালেই বাজি মাৎ করে দিয়েছি আমি। সুলতান বলতে থাকে, তুমি যদি মানুষ হতে তবে দুনিয়ার সেরা পণ্ডিত বলে মেনে নিতো লোকে।
এই অদ্ভুত দৃশ্য তার প্রাণ-প্রতিমা কন্যাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছিলো না। সুলতান। হারেমের প্রধান খোজাকে ডেকে বললো, শাহজাদীকে তলব দাও।
একটু পরে শাহজাদী এলো। ঘরে ঢুকেই দু’পা পিছিয়ে গিয়ে নাকাবে মুখ ঢেকে নিলো। বললো, আব্বাজান, তুমি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। শুনলাম, মজার একটা জানোয়ার এসেছে। সে নাকি লিখতে পারে। দাবা খেলায় তোমাকেও নাকি হারিয়ে দিয়েছে! কিন্তু এই বিদেশীর সামনে তুমি আমাকে ডেকে বে-আব্রু করালে কেন? আব্বাজান?
সুলতান অবাক হয়। বিদেশী-বে-আব্রু? তুমি কি বলছে মা? এখানে আমি আর এই খোজা ছাড়া আর কাকে দেখলে তুমি?
—তুমি যাকে বঁদের মনে করছে আসলে সে শাহজাদা। শাহেনশাহ ইফিতামারাসের পুত্র। ফার দেশের বাদশাহ। আফ্রিদি জারজিসের যাদুতে সে বাঁদর হয়ে গেছে। এই শাহজাদা জ্ঞানে গরিমায় অনেক নাম যশের অধিকারী। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনায় আজ লোক চোখে হেয় এক বাঁদর ছাড়া কিছুই না।
সুলতান প্রশ্ন করে, তুমি যা বললে, সব সত্যি, মা?
শাহজাদী বললো, তুমি ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখো না?
সুলতান আমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। আমার চোখে তখন জলের ধারা। ঘাড় নেড়ে জানালাম। সবই সত্যি।
শাহজাদীর প্রতি এবার সুলতানের জিজ্ঞাসা।–তুমি এসব জানলে কেমন করে, মা?
—আমি যখন খুব ছোট, তখন এক বুডি পরিচারিকা ছিলো আমাদের প্রাসাদে। সে-ই আমাকে শিখিয়েছে এই যাদুবিদ্যা। অবশ্য তারপর আমি নিজে বহু চৰ্চা করেছি। অনেক পড়াশুনা করেছি। হাতে কলমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি। অনেক। প্রায় একশো সত্তরটা মন্ত্র আমি শিখেছি। এবং তা কাজে লাগাতে পারি। আমি এমন বিদ্যা রপ্ত করেছি, আব্বাজান, যদি বলো, মুহুর্তে তোমার এই বিশাল প্রাসাদ এক ফুৎকারে শূন্যে উডিয়ে দিতে পারি। চাইকি, গোটা শহরটাকে এক তুডিতে মরুভূমি বানিয়ে ফেলতে পারি। শহরের ও প্রান্তে যে কাফ পর্বতমালা—তাকেও উর্বর শস্যক্ষেত্রে পরিণত করে দিতে পারি মাত্র এক আজলা পানি ছিটিয়ে। আর পাহাড়ের ওপারে যেখানে তোমার প্রজারা সুখে-স্বাচ্ছন্দে বসবাস করছে তাও হয়ে যেতে পারে বিশাল এক সায়র। তোমার প্রজারা সাঁতার কেটে খেলা করে বেড়াতে পারে নানা রঙের মাছ হয়ে।
—এমন অলৌকিক বিদ্যা তুমি জানো, আমি তো জানতাম না। যাই হোক, এই বেচারীকে যাদুমুক্ত করে ওকে মানুষ করে দাও, মা! কি কষ্টে দিন কাটাচ্ছে সে, বলে। কত জ্ঞানীগুণী মানুষ সে। তাকে আমি আমার প্রধান উজির করে রাখবো। তুমি যা জানো, সেই বিদ্যা দিয়ে, এই অভিশপ্ত জীবন থেকে অব্যাহতি দাও ওকে।
শাহজাদী বললো, আপনার আদেশ শিরোধাৰ্য, আব্বাজান।
এই সময় শাহরাজাদ দেখলো, প্রভাত সমাগত। সে চুপ করে গেলো।
চতুৰ্দশ রজনীর দ্বিতীয় যামে আবার কাহিনী শুরু করে শাহরাজাদ।
শুনুন, মহানুভব শাহজাদা, সেই দ্বিতীয় কালান্দার তার আত্মকাহিনী বলে চলেছে বড় বোনের
সামনে।
একখানা ছুরি নিয়ে এলো শাহজাদী। প্রাসাদের সভাকক্ষের ঠিক মাঝখানে হিব্রুভাষায় কয়েকটি কথা লিখনো সেই ছুরির ফলা দিয়ে। এবং লেখাটাকে কেন্দ্র করে বিরাট এক বৃত্ত এঁকে দিলো। এবার সে বৃত্তের মাঝখানে সেই খোদাই করা লেখাটার উপর দাঁড়ালো। তারপর বিড় বিড় করে দুর্বোধ্য ভাযায় কি সব আওরাতে থাকলো। মুহুর্তের মধ্যে সারা প্রাসাদকক্ষ ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেলো। এমন অন্ধকার যে কোন কিছুই দেখা যায় না। হঠাৎ মনে হলো, সারা প্রাসাদটা দুলছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার কাটতে থাকে। প্রাসাদকক্ষে দেখা গেলো ভয়ঙ্কর দর্শন সেই আফ্রিদি জারজিসকে। গাইতির মতো তার হাত, মাস্তুলের মতো তার পা। চোখ দু’টো আগুনের গোলা সদৃশ। শাহজাদী ছাড়া আমরা সবাই ভয়ে শিউড়ে উঠলাম।
শাহজাদীর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এসো, আফ্রিদি, তোমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছি।
দাঁত মুখ খিচিয়ে আফ্রিদি হুঙ্কার দিয়ে উঠলো।—যে বিদ্যা শিখেছো তার মর্যাদা রাখতে পারলে না তুমি। কথা ছিলো, আমরা কারো কাজে বাধা হবে না। একে অন্যের বিরুদ্ধে কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করবো না—এই ছিলো আমাদের হলফনামা। তুমি আজ সেই সত্যভঙ্গ করেছে। এর প্রতিফল তোমাকে পেতে হবে। এবং এক্ষুণি।
চোখের পলকে সেই আফ্রিদি দৈত্যটা এক হিংস্ব সিংহের রূপ ধারণ করলো। শাহজাদীর দিকে থাবা বাড়িয়ে গর্জন করতে লাগলো। তার সেই ভয়ঙ্কর মুখের হা দেখে আমাদের আত্মারাম তখন খাঁচা-ছাড়া। মনে হলো এখুনি বুঝি শাহজাদীকে মুখের মধ্যে পুরে ফেলবে সিংহটা।
কিন্তু না। শাহজাদী ক্ষিপ্রহাতে মাথার একগাছি চুল ছিড়ে মন্ত্র পড়তেই মস্ত এক তলোয়ার হয়ে গেলো। সেই শাণিত তলোয়ারের আলোর ঝালকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো আমাদের। সিংহের ধড় আর কাল্লা দু’খানা হয়ে গেলো শাহজাদীর এক সুখ। কোপে। কিন্তু কি আশ্চর্য, সিংহের মুণ্ডটা এক প্রকাণ্ড কাঁকড়াবিছে হয়ে শাহজাদীর পায়ের দিকে ছুটে এলো কামড়াতে। চোখের পলকে এক বিষধর সাপের আকার ধারণ করলো শাহজাদী। তখন লড়াই শুরু হলো কঁকড়াবিছে আর সাপে। সে কি প্রচণ্ড লড়াই। অনেকক্ষণ ধরে চললো। এক সময় দেখলাম, কঁকড়াবিছেটা হয়ে গেলো একটা শকুনী। আর তক্ষুণি সাপটািও ঈগলপাখীর রূপ ধরলো। শকুনি আর ঈগলের যুদ্ধও চললো ঘণ্টাখানেক। এরপর শকুনি হলো এক বন-বিড়াল, ঈগল হয়ে গেলো নেকড়ে বাঘ। বিড়াল আর নেকড়ের লড়াই-এ বিড়ালটা কাবু হয়েছে প্রায়, এমন সময় দেখলাম, একটা প্রকাণ্ড বড় ডালিম হয়ে লাফিয়ে গিয়ে বসলো দরবার প্রাঙ্গণের ফোয়ারাটার চারপাশের গোলাকৃতি চৌবাচ্চার ওপর। নেকড়েটাও কাঁপিয়ে পড়লো সঙ্গে সঙ্গে। ডালিমটা এক লাফে উঠে গেলো শূন্যে। কিন্তু প্রাসাদ কক্ষের ছাদেবাড়ি খেয়ে গিয়ে পড়লো একটা থামের গায়ে। আর প্রচণ্ড শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়লো নিচে মারবেলের মেজের ওপর। সারা ঘরাময় ছড়িয়ে গেলো ডালিমের দানা। নেকড়েটা তখন একটা মোরগ হয়ে সেই দানাগুলো খুঁটে খুঁটে খেয়ে ফেলতে লাগলো; এইভাবে একটা দানা বাদে সমস্তগুলোই খেয়ে নিলো। শেষ দানাটাও খাবে বলে ঠোঁটে করে তুলেছে এমন সময়, ভাগ্যের কি পরিহাস, ঠোঁট থেকে পিছলে পড়ে গেলো একখানা ফাটা মারবেলের ফাটলের মাঝখানে। ঠোঁটটা আর ঢোকাতে পারলো না মোরগ। তখন চিৎকার করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। ঠোঁটটা নেড়ে চেড়ে কি যেন একটা বোঝাতে চাইলো। কিন্তু তার ইঙ্গিত অনুধাবন করতে পারলাম না আমরা। পরে বুঝেছিলাম, সে বোঝাতে চেয়েছিলো, তোমরা ঐ মারবেল-এর টুকরোটা তুলে দাও। আমি ঐ শেষ দানাটা খাবো। ওটা খেতে পারলেই আফ্রিদিকে পুরো হজম করে ফেলতে পারবো। কিন্তু ভবিতব্য কে খণ্ডাতে পারে। যা হবার তাই হবে। আমরা তার ভাষা বুঝলাম না। সে প্রচণ্ড শব্দে চিৎকার করতে লাগলো। তার চিৎকারে প্রাসাদটা দুলতে। থাকে। বুঝিবা এখুনি হুড়মুড় করে ধসে পড়বে আমাদের মাথায়।
মোরগটা ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে চলেছে মারবেলটার ওপর। এক সময় দেখা গেলো, মারবেলের ভাঙা একটা টুকরো তুলে ফেলে দিয়ে সেই শেষ দানাটা ঠোঁটে করে তুলে নিলো সে। কিন্তু কি ব্যাপার, বুঝতে পারলো না। ডালিমের দানাটা ছিটকে গিয়ে পড়লো চৌবাচ্চার জলে। আর সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেলো একটা মাছ। মোরগটা তার রূপ পালটে হলো পানকৌডি। চৌবাচ্চার জলে ডুব দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলে সে। প্রায় এক ঘণ্টা কেটে গেলো, পানকৌডি আর ওঠে না।
এক সময়ে প্রচণ্ড এক গোঙানীর শব্দে চমকে উঠলাম আমরা। দেখলাম, উথালি পাথাল করছে চৌবাচ্চার জল। এবার দেখলাম, আফ্রিদি তার আসল চেহারা নিয়ে উঠে আসছে। জল থেকে। তার শরীরটা এক জ্বলন্ত অঙ্গার। গানগনে আগুনের এক বিরাট চাই। সে কি ভয়াবহ দৃশ্য! তার নাক চোখ মুখ দিয়ে উদ্গিরণ হচ্ছিলো চিমনীর ধোঁয়া। তার পিছনে পিছনে শাহজাদীও উঠে। আসে। ঠিক আগের মতো এক রূপবতী যুবতী। কিন্তু তার দেহটাও লাল টকটকে। আগুনে দগ্ধ এক ধাতব মূর্তি।
ক্রমশ তারা দুজনেই আমাদের দিকে এগুতে থাকে। ভয়ে শিউড়ে উঠলাম। ঐ আগুনের প্রচণ্ড উত্তাপে ভষ্ম হয়ে যাবো আমরা। কি করবো কিছু ভাবতে পারছি না। পালাবার পথ নাই। ঠিক করলাম চৌবাচ্চার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই আগুনের হাল্কা থেকে নিজেকে বাঁচাই। কিন্তু দেখলাম, আফ্রিদিটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একমুহূর্ত। তারপর বিকট এক চিৎকার দিয়ে বাঁপিয়ে পড়লো-দরবার প্রাঙ্গণে-ঠিক আমাদের মাঝখানে। এক ঝলক আগুনের হোঙ্কা এসে লাগলো আমার চোখে মুখে। এমন সময় শাহজাদীর জুলন্ত দেহটা এসে জাপটে ধরলো আফ্রিদিকে। দুই অগ্নিপিণ্ডের সে উদ্দাম লড়াই। আগুনের উত্তাপ দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। আফ্রিদির মুখ-নিঃসৃত একটা উষ্কার মতো আগুনের ফলা এসে ঘায়েল করে দিলো আমার এই বঁ। চোখটা। আর একটা হাল্কা এসে লাগলো সুলতানের থুতনীর কাছে। পুড়ে ঝলসে গেলো। নিচের ঠোঁটটা খসে ঝুলতে লাগলো। আর নিচের পাটির দাঁতগালো ঝুপ ঝুপ করে পড়ে গেলো মার্বেলের মেজের ওপর। আর একটা তির্যক আগুনের ফলা এসে বিধিলো সেই হারেমের প্রধান খোজার বুকে। ব্যাচারী। সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেলো সে।
এই সময়কালের মধ্যে আফ্রিদি আর শাহজাদীর যুযুৎসুর লড়াই চলছিলো। আফ্রিদি চেয়েছিলো আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাইকে জীবন্ত দগ্ধ করে ফেলতে। কিন্তু শাহজাদীর প্যাচে পড়ে আর এগুতে পারলো না সে। তাই আগুনের স্মৃলিঙ্গ নিক্ষেপ করে হত্যা করতে চেয়েছিলো সবাইকে। আমরা দুজনে অঙ্গহানির ওপর দিয়ে বেঁচে গেলাম। কিন্তু খোজাটা প্ৰাণ হারালো।
এমন সময় আর্তনাদ করে উঠলো আফ্রিদি। আল্লাহ, আমাকে তোমার কোলে টেনে নাও। তুমিই একমাত্র ভরসা। তুমি ছাড়া আমার অন্য কোন গতি নাই। জীবনে যতো পাপ করেছি—তার শাস্তি আমাকে পেতেই হবে। তোমার দেওয়া সব শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো, মালিক। তোমার পায়ের কাছে আমাকে একটু ঠাই দাও।
হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো আফ্রিদির আর্তনাদ। পাহাড়ের মতো তার ঐ বিশাল জ্বলন্ত বপুটা লুটিয়ে পড়ে গেলো মার্বেলের মেজের উপর। আগুনের তেজ কমে আসতে লাগলো। একটু পরে একেবারে নিভে ছাই-এর পাঁজা হয়ে পড়ে রইলো তার দেহটা।
শাহজাদী এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। বললো, শিগ্নির-শিগ্নির নিয়ে এসো এক গেলাস পানি।
জল এলো। সে বললো, আমার মুখের সামনে তুলে ধরো গেলাসটা। জলের গেলাসটা সামনে ধরতে বিড়বিড় করে কি সব দুর্বোধ্যমন্ত্র আওড়ালো খানিকটা। তারপর বললো পানিটা ছিটিয়ে দাও ঐ বোদরটার ওপর।
আমার গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হলো সেই মন্ত্রপুত জল। সেই সঙ্গে শাহজাদী পরিষ্কার আরবীতে বললো, সর্বশক্তিমান—একমাত্র পরমসত্য আল্লাহর দোয়ায় তুমি তোমার আগের চেহারায় ফিরে এসো।
তখনি, আমি আমার আসল রূপ ফিরে পেলাম। মানুষের রূপ। শুধু ফিরে পেলাম না। আমার বাঁ চোখটা—আগুনের হাল্কায় কানা করে দিয়েছিলো—।
আমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে দেখে শাহজাদী দুঃখ করলো খুব। কি করবে বলো। আগুন যাকে স্পর্শ করবে তাকেই দহন করবে। এই তার ধর্ম। বাবার ঝলসানো পোড়া মুখটা দেখেও তার অন্তর মথিত হতে লাগলো।
তারপর শাহজাদী বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। বিষাদ বিবশ কণ্ঠে বলতে লাগলো, আব্বজান, আমারও যাবার সময় হয়ে এলো, আল্লাহর দরবারে ডাক পড়েছে আমার। বিধিলিপি এড়ানো যায় না। না হলে, দৈত্যটা যখন ডালিমন্দানা হয়ে ঘরাময় ছড়িয়ে পড়লো আমি তার প্রতিটি দানাই পেটে পুরে নিয়ে ছিলাম—শুধু মাত্র একটি ছাড়া। ঐ দানাটা, আমার দুর্ভাগ্য, মার্বেলের ফাটলের মধ্যে আটকে গিয়েছিলো। ওটাকে যদি খেয়ে ফেলতে পারতাম।–তবে, সেই মুহূর্তে আফ্রিদির মৃত্যু ঘটতো। কিন্তু নিয়তি কে খণ্ডন করবে, বলো! না হলে সব দানা খেয়ে শেষ করলাম আর ঐ একটা দানাই বা ফসকে পড়ে যাবে কেন, মুখ থেকে। যাক, এ নিয়ে দুঃখ শোক করো না, আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই হয়েছে, হবে।
একটু থেমে শাহজাদী আবার বলতে থাকে, আমার আর আফ্রিদির এই প্রচণ্ড লড়াইএ আগাগোড়াই আমি তাকে ঘায়েল করে গিয়েছি। আর প্রাণপণে আঘাত প্রতিরোধ করার চেষ্টামাত্র করে গেছে সে। পাল্টা আক্রমণ কোন সময়ই হানতে পারেনি। সে দিক থেকে এ লড়াই জয় আমার অবধারিত ছিলো। কিন্তু নিয়তি বড় নিষ্ঠুর-বড় নির্মম। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে কোনও লড়াই—এই সে যখন সুবিধে করতে পারলো না তখন সে নিজেই বেছে নিলো শেষ মারণাস্ত্ব। অগ্নিকুণ্ডের দরজা খুলে ঝাপ দিলো সে। আমার হাতে মরতে তার পৌরুষ অহমিকায় বাধলো। কিন্তু আমার মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। ওকে আত্মঘাতী হতে দেবো না আমি। নিজে হাতে খতম করবো, এই আমার জেদ। আর সে জন্যই কোন দিকে ভ্বক্ষেপ না করে আমিও সেই অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। টুটি চেপে তুলে নিয়ে এলাম ওপরে। নিজে হাতে খতম করবো তাকে—এই আমার তখন একমাত্র রোখি।
সবই নিয়তির পরিহাস, আব্বাজান। না হলে আফ্রিদি তো বিলকুল হেরে গিয়ে আত্মহত্যাই করতে গিয়েছিলো; আমি আবার কেন তার পিছে পিছে ধাওয়া করে সে আগুনে ঝাপ দিলাম। তার কোন দরকার ছিলো না। সে তো ঐ আগুনেই পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কিন্তু এই রকমই ঘটতে হবে। এই আল্লাহর অভিপ্ৰায়। এ-ই বিধিলিপি! আল্লাহ তোমাকে রক্ষণ করুন। আমার ধ্যান জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ। তিনি ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব আমি বিশ্বাস করি না। তাঁর সমকক্ষ দ্বিতীয় কেউ নেই। মহম্মদ আল্লার পয়গম্বর।
এই বলে মেজের ওপর লুটিয়ে পড়ে গেলো-শাহজাদী। আফ্রিদির দেহাবশেষের পাশে তার নির্বাপিত দেহটাও পড়ে রইলো-একটা ছোট্ট ছাই-এর ডেলা হয়ে।
আমরা অনেক কাঁদলাম। এর চেয়ে আমার নিজের মৃত্যুই ভালো ছিলো। আমার মুক্তির জন্য তার আত্মাহুতি আমাকে দগ্ধ করতে লাগলো। কৃতজ্ঞতায় অন্তর ভরে গেলো।
কন্যার শোকে ডান্মাদের অবস্থা হলো সুলতানের। কপাল চাপড়াতে লাগলো বারবার। নিজের হঠকারিতার জন্যে মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলো। কেন সে তার মেয়েকে বললো, বোদরকে মানুষ করে দিতে। কেনই বা সে তাকে দরবারে ডেকে পাঠালো। হায় আল্লাহ, এ দুর্মতি কেন হলো তার? অনুতাপে দগ্ধ হতে লাগলো সমস্ত অন্তরাত্মা। কন্যার ভস্মীভূত দেহটার পাশে গিয়ে শিশুর মতো কঁদিতে লাগলো সুলতান। কাঁদতে কাঁদিতে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো সে।
হারেমের বেগমরা এলো। ক্রীতদাসীরা এলো। বাদশাহী মর্যাদায় সাতদিন ধরে শোক পালন করা হলো শাহজাদীর উদ্দেশে।
শোক-সপ্তাহ শেষ হলে সুলতানের হুকুমে হাজার হাজার ক্রীতদাস আর হাজার হাজার বেগার মজদুর খাটিয়ে এক শাহজাদী স্মৃতি-মিনার গড়ে তোলা হলো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। দিবা-রাত্র চব্বিশ ঘণ্টার জন্য আলোর মালায় সাজানো হলো মিনারটা।
শোকে দুঃখে দিন দিন কৃশকায় হতে থাকে সুলতান। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলো। কারো সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে না। দরবারে বসে না নিয়ম মতো। সারা প্রাসাদ এক বিষাদের ছায়া। কারো মুখে হাসি নাই। সবাই যেন কেমন বিষণ্ণ—চুপচাপ। এইভাবে মাসাধিককাল কাটলো। একদিন সুলতান আমাকে ডেকে পাঠালো।
—শোনো, বাবা, তুমি এখানে আসার আগে আমরা বেশ সুখে স্বচ্ছন্দে বসবাস করছিলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো আমাদের। কিন্তু তুমি যে দিন এলে, সেই দিন থেকেই আমার সৌভাগ্যের চাকা উল্টোদিকে ঘুরছে। দুঃখ, শোক, দুর্বিপাকে জীবন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে আমার। আমার ইচ্ছে নয়, তুমি আর এখানে থাকে। তোমার মুখ আর আমি দেখতে চাই না। আমার কথায় মনে কোনও দুঃখ করো না, বাবা। তোমার কোনও দোষ নাই। দোষ তোমার ভাগ্যেরা। তোমার ভাগ্যের সঙ্গে ভাগ্য জড়াতে যাবে যে তারই ভাগ্য-বিড়ম্বনা ঘটবে-এই নিয়তি। তাই তোমাকে বলছি, বাবা, তুমি এদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাও। এদেশে তুমি থাকলে সারা দেশটাই উচ্ছন্নে যাবে আমার। তুমিই আমার প্রাণ প্রতিমা কন্যার মৃত্যুর একমাত্র কারণ। তোমার জন্যেই আমার মুখটা পুড়ে কদাকার হয়ে গেছে। দাঁতগুলো হারিয়েছি। তুমি এদেশে না এলে আমার একান্ত বিশ্বাসী প্রধান খোজার প্রাণনাশ ঘটতো না। কিন্তু মনে করো না, বাবা, তোমাকে দোষারোপ করছি। তোমার কি দোষ? দোষ তোমার দুর্ভাগ্যের। তোমাকে সত্যিই আমি ভালোবাসি। আমার কন্যা তার নিজের জীবন দিয়ে তোমাকে শাপমুক্ত করে দিয়েছে। তুমি তোমার আসল রূপ ফিরে পেয়েছে। এবার তুমি এসো। আমার ভাগ্যে যা লেখা ছিলো তাই ঘটেছে। নিয়তি এড়ানো যায় না। ঢের সায়েছি শোকতাপ। এবার ফিরে যাও, শাহজাদা। আমাদের একটু শান্তিতে বাস করতে দাও, বাবা।
মালকিন বিশ্বাস করুন, তখন সেই মুহূর্তে, আমার নিজেকে মনে হলো দীন, হীন, আপয়া, অপদার্থ এক হতভাগা। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে এলো আমার কণ্ঠ। চিৎকার করে বলতে চাইলাম, ধরণী দ্বিধা হও, আমি ঢুকি। কিন্তু পারলাম না। মাতালের মতো টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম প্রাসাদ প্রাঙ্গণ ছেড়ে। তারপর পথ আর পথ। শুধু পথ চলা। কোথায় চলেছি কিছুই জানি না-জানতে চাই না। শুধু উদ্দেশ্যবিহীনভাবে চলতে লাগলাম। চলতে চলতে অবশেষে আজ সন্ধ্যায় এসে হাজির হলাম এই বাগদাদ শহরে।
বাগদাদ আমার ছোটবেলার স্বপ্ন-শহর ছিলো। এখানে কেউ দুঃখে দিন কটায় না, শুনেছি। এখানকার সুলতান নাকি পরম ধাৰ্মিক দয়াবান মহান। তাকে চোখে দেখার বাসনা আমার বহু কালের। এই হতভাগার জীবনের করুণ কাহিনী তাকে শোনাবার বড় সাধ আমার। কী পাপ করেছি। আমি, যার জন্যে এতো দুঃখ এতে কষ্ট আমাকে পেতে হচ্ছে। মনে পড়ে, সেই মরুভূমির ডাকাতদের হাতে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে সেই দর্জির আশ্রয়ে এসে কাঠুরিয়ার জীবন। আজ মনে পড়ে, পাতালপুরীতে চিরবন্দিনী আমার সেই দুদিনের প্রিয়া। কেনই বা তার কাছে গেলাম, কেনই বা আফ্রিদির হাতে তাকে হত্যা করলাম! সেই অনুতাপে নিয়ত দগ্ধ হচ্ছি আমি। আর আমার দুর্ভাগ্য—না হলে আফ্রিদির যাদুতে কেনই বা হবো। আমি বঁদর! মনে পড়ে, শাহজাদা হয়েও নোকরের কাজ করেছি। আমি, জাহাজের কাপ্তেনের। এমনকি শনির দশা আমার-যে, সুলতানের সুখের সংসার আমি বিষাদের সায়রে ডুবিয়ে দিয়ে এসেছি। তার প্রাণাধিক কন্যার মৃত্যুর কারণ হয়েছি। সুলতানের মুখটাও পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে আমারই জন্যে। তার বিশ্বস্ত নফর, ব্যাচারী খোজা, তার কি দোষ, সে কেন প্ৰাণটা হারালো? সেও তো আমার জন্যেই। আমিও অবশ্য হারিয়েছি আমার এই বঁ। চোখটা। তা আমার দুর্ভাগ্যের ফল তো আমি পেতেই পারি? কিন্তু ওরা? ওরা কেন এই ভয়াবহ বিষময় ফল ভোগ করলে আমার কারণে? আমার একটা চোখ গেছে, তবু তো আর একটা আছে। সব তো যায়নি। কিন্তু ওরা তো। সব খুইয়েছে। আর আমিই সে জন্যে একমাত্র দায়ী। একমাত্র অপরাধী।
নানা পথ হেঁটে অবশেষে আজ সন্ধ্যায় এই বাগদাদ শহরে এসে পৌঁছলাম এক ফকিরের বেশে।
শাহজাদা নাই-এক কালান্দার ফকির। একটা চোখ কানা। দাডিগোঁফ কামিয়ে আমার নিজেকে বেমালুম পাল্টে ফেলেছি। কেউ আমাকে চিনবে না—আমি এক বাদশাহজাদা।
এক চৌরাস্তার মোড়ে এসে দেখি, আমারই মতো আর এক কালান্দার। তারও বাঁ চোখ কানা। দাডিগোঁফ কামানো। সেও আশ্রয় আস্তানা খুঁজছে আমারই মতো। তার কাছে এলাম। একটু পরে আর এক কালান্দার এসে মিলিত হলো আমাদের সঙ্গে। অবাক কাণ্ড, তারও বা চোখ কানা। সেও দাডিগোঁফ হীন। এই তৃতীয় কালান্দার। তারও একই সমস্যা। রাতের মতো কোথাও আশ্রয় পাওয়া যায়। কিনা সেই চিন্তা।
তারপর আমরা তিন কালান্দার মিলে আশ্রয় সন্ধান করতে করতে তোমাদের দরজাতেই করাঘাত করেছিলাম, মালকিন। সবই তার ইচ্ছে। আমরা নিমিত্ত মাত্র।
এই আমার জীবনের করুণ ইতিহাস।
সবাই রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলো এতক্ষণ। দ্বিতীয় কালান্দার তার কাহিনী শেষ করতেই বড়বোন বাহবা দিলো তাকে। বাঃ, বড় চমৎকার তোমার কাহিনী। আমি খুশি। এবার তোমার যেখানে ইচ্ছে যেতে পারো। তোমার ছুটি।
দ্বিতীয় কালান্দার বললো, কিন্তু এই তৃতীয় কালান্দারের কাহিনী না শুনে যাবো না। এই আমি গ্যাট হয়ে বসলাম।