1 of 3

১.১৩ বাগানে নতুন গোলাপ চারা

বাগানে নতুন গোলাপ চারা পোঁতবার জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে একটা সাপ বেরিয়েছে। মালি ও দারোয়ানেরা সাপটাকে পিটিয়ে মেরেছে সঙ্গে সঙ্গে, বাড়ির সবাই সেটাকে দেখতে এসে দাঁড়িয়েছে নিচের বড় বারান্দাটায়।

বেশ লম্বা একটা দাঁড়াস সাপ, শীতকালে ওরা এমনিতেই নেতিয়ে থাকে,একটা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, তাও বেচারি নিস্তার পেল না। ওকে মারবার জন্য বেশি বীরত্বেরও প্রয়োজন হয়নি। মালির কোনো ঘেন্নাপিত্তি নেই, সে মৃত সাপটাকে হাতে ধরে তুলে দেখাচ্ছে সেটা কত বড়।

সত্যেন বুলার দিকে ফিরে বললেন, আমাদের নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে একটা এই রকম বাস্তুসাপ ছিল, তোমার মনে আছে?

নারায়ণগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে বুলা বেশি দিন থাকেন নি, ছুটির সময় কয়েকবার গিয়েছেন মাত্র, সেখানকার বিশেষ কিছু স্মৃতি নেই তাঁর। বিয়ের পর তাঁর স্বামী নরেন কলকাতাতেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। বুলা মুখটা ফিরিয়ে নিলেন, তাঁর গা শিরশির করছে ঐ মড়া সাপটাকে দেখে। না দেখাই উচিত ছিল।

বিভাবতী বললেন, এটা তো পুরুষ সাপ, এর নিশ্চয়ই জোড়াটা রয়ে গেছে। ওরে বাবা, সেটা তো এখন রেগে থাকবে। ছেলে-মেয়েরা বাগানে খেলা করে—

সত্যেন বললেন, এখন শীতকাল, ভয়ের কিছু নেই।

মালি-দারোয়ানদের দিকে একটা দশ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে তিনি বললেন, অন্য সাপটা খুঁজে বার করো। যে পাবে তাকে আমি আরও দশ টাকা দেবো প্যাঁড়া খাবার জন্য!

তিনি যে ভয় পান না সেটা বোঝাবার জন্য সত্যেন নিজেই নেমে এলেন বাগানে এবং হাতের ছড়িটা দিয়ে পেটাতে লাগলেন ঝোঁপঝাড়। কলকাতায় বিভাবতীর শরীর সারছে না বলে তাঁরা এখানে তিন মাসের জন্য থাকতে এসেছেন। অযত্নে পড়ে থাকা বাড়িটিকে সাজাচ্ছেন নিজেদের পছন্দ মতন। এই বাড়িটা একেবারে কিনে ফেলার চিন্তাও সত্যেনের মাথায় ঘুরছে। বিভাবতাঁকে তাহলে এখানেই রাখা যায়, তিনিও মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবেন। পাবনার এক প্রাক্তন জমিদার-পরিবার এ বাড়ির মালিক, তাদের অবস্থা এখন খুব পতনশীল, এত বড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতাই নেই তাদের। হাজার তিরিশেক টাকা দর দিলেই তারা লুফে নেবে মনে হয়।

মানুষের জীবনে সব দিক থেকে সুখ আসে না,। পশ্চিম বাংলায় এসে স্থায়ী হবার পর সত্যেনের আর্থিক সমৃদ্ধি ও প্রতিপত্তি হয়েছে যথেষ্ট, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট, টালিগঞ্জ সর্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির চেয়ারম্যান, অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের একজন পেট্রন, ক্যালকাটা ক্লাবের মেম্বার, কলকাতার উঁচু সমাজের মানুষেরা তাঁকে চেনে জানে; এহ সবই তাঁর অহমিকায় সুখ-প্রলেপ দেয়, কিন্তু তাঁর দাম্পত্য আনন্দ নেই। গত দশ বছর ধরে তাঁর স্ত্রী হাজার রকম রোগে ভুগছেন, সেই জন্য মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে উঠছে। গানবাজনার আসর কিংবা পার্টিতে যাওয়ার কোনো উৎসাহই নেই বিভাবতীর। স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করেন নি সত্যেন, চিকিৎসার চূড়ান্ত করেছেন, তবু তাঁর ঠিক যে কী অসুখ তা বোঝা. যায় না, চেহারাটা যেমন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, সেই রকমই সব সময় মন-মরা ভাব।

সত্যেন পেছনে ফিরে বুলার দিকে হাতছানি দিয়ে বললেন, এদিকে শোনো। একটা জিনিস। দেখবে এসো।

বুলা আড়চোখে বিভাবতীর দিকে তাকালেন। সত্যেন ইদানীং এ রকম ব্যবহার শুরু করেছেন, স্ত্রীকে বাদ দিয়ে বুলাকে আলাদা করে প্রায়ই ডাকেন। সম্পর্কে দেওর। একটু ফাজলামি-মস্করা করার অধিকার তাঁর আছে ঠিকই, কিন্তু বিভাবতী যে এটা পছন্দ করেন না, তা বুলা বুঝতে পারেন।

বুলা বললেন, চলো দেখে আসি, ওখানে আবার কী!

বিভাবতী বললেন, তোমায় ডাকছে, তুমি যাও, আমার মাথার যন্তোন্না হচ্ছে।

বুলা বললেন, আমিও এখন স্নান করতে যাবো।

সেই কথাটা সত্যেনকে জানিয়ে বুলা পিছন ফিরতে গিয়ে দেখলেন সুরকি-ঢালা পথ দিয়ে হেঁটে আসছে পিকলু আর বাবলু। বিভাবতীর বোনপো মলয়ের সঙ্গে ওদের বেশ ভাব হয়েছে, এ বাড়িতে ওরা প্রায়ই আসে। বেশ সুন্দর ছেলে দুটি। ওদের দেখামাত্র বুলার নিজের ছেলের কথা মনে পড়লো। তাঁর ছেলের ডাকনাম বাপ্পা, আর তার ভালো নাম জ্যোতির্ময়। তার বয়েস এই বাবলু আর পিকলুর মাঝামাঝি, ক্লাস নাইনে পড়ে। সে কিছুতেই দেওঘরে এলো না। জ্যোতির্ময় বয়েজ স্কাউটের মেম্বার, তাদের স্কুলের স্কাউট টিম এই সময়ে দার্জিলিং-এ এক্সকারশানে যাচ্ছে, জ্যোতির্ময় জেদ ধরে সেখানেই গেল।

জ্যোতির্ময়ের বাবা নেই বলে বাড়ির সবাই তাকে অতিরিক্ত আদর ও প্রশ্রয় দেয়। বাচ্চা বয়েস থেকেই সে বুঝে গেছে যে, সে যা চাইবে তাতে কেউ না বলবে না। সেই জন্য সে যখন। তখন আবদার করে, ইচ্ছে করে জিনিসপত্র ভাঙে, বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, তবু কোনো শাস্তি পায় না। বুলা বুঝেছিলেন, তাঁর ছেলের শিক্ষা ঠিক হচ্ছে না, তিনি নিজে একটু কঠোর হয়ে ছেলেকে শাসন করতে গিয়ে ফল হলো উল্টো, ছেলে আর মায়ের কাছ ঘেঁষতে চায় না।

নরেন যখন বিলেতে ফিরে যান মেমস্ত্রীর কাছে, তখন জ্যোতির্ময়ের বয়েস আড়াই বছর। বাবাকে তার তেমন মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু সে জানে তার বাবা কোথায় আছেন। প্রায়ই সে বলে, স্কুল ফাঁইনাল পাশ করেই সে বিলেতে বাবার কাছে চলে যাবে। বুলা বুঝতে পেরেছেন, ছেলেকে আটকানো যাবে না। ঐ দেশটা বেড়াল-চোখো মেয়েতে গিগি করে। ওখান থেকে কি ছেলে আর ফিরে আসতে পারবে? বাবার কাছেই বা সে কী রকম ব্যবহার পাবে কে জানে! বিদেশিনী সৎ মা কি ওকে বাড়িতে স্থান দেবে? এই সব কথা ভাবলেই বুলার বুকের মধ্যে গুড় গুড় শব্দ হয়। সমস্ত দুনিয়াটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

বুলা হাতছানি দিয়ে ডাকলেন, বাবলু, শোনো—

বাবলুর সাপ দেখাতেই বেশি আগ্রহ, সে সেখানে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললো, যাচ্ছি বুলামাসি।

পিকলু সাপটার দিকে এক নজর দেখে এগিয়ে এলো বুলার দিকে।

এই ছেলেটি বড় বেশি লাজুক, বুলা লক্ষ করেছেন যে, পিকলু তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না, চোখ নিচু করে থাকে।

পিকলু বুলার পায় হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই তিনি বললেন, আরে, আরে, রোজ রোজ দেখা হলেই প্রণাম করতে হবে নাকি!

পিকলু তবু বুলার পা স্পর্শ করলো।

পিকলুর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বুলা জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বাড়ির সব খবর ভালো তো!

তাদের বাড়ির অবস্থা এখন খুবই খারাপ, অসিতবরণের মৃত্যু সংবাদ কোনোক্রমে সুহাসিনীর কানে পৌঁছে গেছে, তারপর থেকে তিনি এত কান্নাকাটি করছেন যে, প্রায় পাগলের মত হয়ে উঠেছেন, তাঁকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না, কিন্তু এই সব কথা বুলাকে জানাতে ইচ্ছে করলো না পিকলুর। দুঃখের খবর, খারাপ খবর কারুর কারুর সামনে এলে খুব অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায়। বুলার পা ছুঁয়েই পিকলুর সারা শরীরে একটা শিহরণ এসেছে। গরম হতে শুরু করেছে তার সব কটা আঙুলের ডগা।

সে ঘাড় নেড়ে বললো, হ্যাঁ।

বাবা এখানে নেই বলে পিকলুবাবলুর স্বাধীনতা অনেক বেড়ে গেছে। আজ ভোরে দুই ভাই এসেছিল নন্দন পাহাড়ে, রাস্তা তাদের মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে। তখনও সূর্য ওঠেনি, আধো-অন্ধকারের মধ্যে দু-জনে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে উঠেছিল ওপরে। তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে তারা সূর্যোদয় দেখলো। ঠাণ্ডা, নীল আলোর মধ্য থেকে যখন রক্তিম গোলকটি উঠে এলো, তখন হঠাৎ বুলা মাসির কথা মনে পড়েছিল পিকলুর। এই দৃশ্যটির সঙ্গে বুলা মাসির মুখের খুব মিল আছে। এ রকম মনে হওয়ায় পিকলু নিজেও খুব অবাক হয়েছিল। অন্য কেউ তো এই মিলটা দেখতে পাবে না, অথচ সে স্পষ্ট দেখছে।

পিকলু সাহস করে এখন বুলা মাসির মুখের দিকে তাকালো। হ্যাঁ মিল আছে, ভোরের ঠাণ্ডা নীল আলোর সঙ্গে, প্রথম সূর্য ওঠার সঙ্গে। এই কথাটা বুলা মাসিকে জানাতে খুব ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু কেউ যেন তার জিভ টেনে ধরেছে।

একটা কিছু তো বলতে হবে, তাই সে বললো, আমরা নন্দন পাহাড়ে সানরাইজ দেখতে গিয়েছিলাম। আপনি দেখেছেন কখনো?

বুলা ছেলেমানুষের মতন উৎসাহিত হয়ে বললেন, ওমা, কই না তো! তোমরা গেলে, যাবার সময় আমাদের ডেকে নিয়ে গেলে না কেন?

–আপনি যাবেন? কাল যদি আবার যাই?

–হ্যাঁ। ঠিক আসবে তো, আমি তা হলে তৈরি হয়ে থাকবো। তোমরা সেই সকালে বেরিয়েছে, তারপর আর বাড়ি ফেরোনি? নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে তোমাদের, ভেতরে এসে বসো।

ওদিকে বাগানের মধ্যে একটি অতসীগাছে সত্যেন একটা বেশ বড় মতন টিপ পোকা দেখতে পেয়েছেন, চকচকে সবুজ ধাতুর মতন তার গা, তার ওপরে নানা রঙের ফোঁটা। সেটা তিনি বুলাকে দেখাতে চান। তিনি আবার বুলাকে ডাকলেন।

বুলা এবার আর উপেক্ষা করতে না পেরে নেমে এলেন বাগানে। ততক্ষণে টিপ-পোকাটা উড়ে গেছে। সত্যেন বললেন, যাঃ, তুমি দেরি করলে…..

তারপর কণ্ঠস্বর একটু নিচু করে বললেন, আমার জরুরি কাজ পড়েছে, দু এক দিনের মধ্যে কলকাতায় যেতে হবে। তুমি আমার সঙ্গে ফিরবে?

বুলা জিজ্ঞেস করলেন, আর বিভা?

সত্যেন বললেন, ও তো বেশ কিছুদিন থাকবে। এখানকার জল খেয়ে উপকার হচ্ছে যখন।

বুলা বললেন, আমিও এখানেই থাকবো।

–তুমি আমার সঙ্গে চলো না কলকাতায়।

–না, আমার এখানেই ভালো লাগছে।

সত্যেন স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন বুলার দিকে। বুলা চোখ সরিয়ে নিলেন। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সত্যেনের কণ্ঠস্বর ইঙ্গিতময়। বুলা বুঝতে পারছেন যে, সত্যেন তাঁর জীবনে অশান্তি ডেকে আনছেন। তিনি আর সেখানে দাঁড়ালেন না।

পিকলুর মনে হলো, আজকের সকালটি তার জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান। কালকের সকালটি আরও ভালো হবে। কাল বুলা মাসি তার সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছেন। কাল সে বাবলুকে আনবে না, একা আসবে। ঠাণ্ডা নীল আলোর মধ্যে রক্তিম সূর্যোদয় দেখে বুলা মাসি কি চিনতে পারবেন নিজেকে? সেটা জানার জন্যই তার তীব্র কৌতূহল। সে তৃষ্ণার্তের মতন তাকিয়ে রইলো বুলা মাসির দিকে।

বুলা বারান্দায় উঠে বললেন, তুমি একটু বসো পিকলু, ছোট ভাইকে ডাকো, আমি মলয়কে পাঠিয়ে দিচ্ছি!

ভেতরে চলে যেতে যেতে বুলার মনে হলো, তাঁর নিজের ছেলেটা যদি এই পিকলুর মতন হতো! কী নম্র আর বিনয়ী, গুরুজনদের দিকে চোখ তুলে কথা বলে না। পড়াশুনোতেও কত ভালো! তাঁর ছেলে জ্যোতির এই বয়েসেই কথার মধ্যে একটা চ্যাটাং চ্যাটাং ভাব আছে।

দোতলায় উঠে এসে বুলা নিনার হাত দিয়ে ছেলেদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আর নিচে নামলেন না। মনটা ক্রমেই বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে। সকালবেলাতেই একটা মরা সাপ দেখার কোনো মানে হয়?

মন খারাপের সময় বাথরুমটাই শ্রেষ্ঠ জায়গা। গরম জলে স্নান করা তাঁর অভ্যেস, এখন জল গরম করতে সময় লেগে যাবে, তিনি ঠাণ্ডা জলেই স্নান সেরে নেবার জন্য ঢুকে পড়লেন।

প্রথমে খানিকক্ষণ কাঁদলেন নিঃশব্দে। ঠিক যে দুঃখে তা নয়, অপমানবোধে। সত্যেন ও রকম ফিসফিসিয়ে গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে তাঁকে কলকাতায় যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন?

অনেকদিন পর তাঁর স্বামী নরেনের মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ঐ মুখ বুলা মনে রাখতে চান না, তবু ফিরে ফিরে আসে। সুশ্রী, প্রফুল্ল মুখচ্ছবি তাতে কোনো পাপের রেখা নেই। নরেনের সঙ্গে চার বছর বিবাহিত জীবনে একদিনের জন্যও বুলা স্বামীকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি। আশ্চর্য, কোনো মানুষ এমনভাবে তার জীবনের একটা অংশ গোপন রাখতে পারে? বুলার সঙ্গে তাঁর কত গল্প হয়েছে, প্রবাস জীবনের কত মজার মজার কাহিনী শুনিয়েছেন কিন্তু কখনো ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ পায় নি যে বিলেতে নরেনের আর একটি স্ত্রী রয়েছে। ও পক্ষের দুটি ছেলে-মেয়ে আছে, তাদের কথাও কি নরেনের মনে পড়তো না? তিনি কি ভেবেছিলেন যে, ইংরেজ স্ত্রীকে ঠকিয়ে নিজের দুটি সন্তানকেও তিনি চিরকালের মতন বিস্মৃত হতে পারবেন?

নরেনকে বুলার বাপের বাড়ির সবারই খুব পছন্দ হয়েছিল। তাঁর স্বভাবে বেশ একটা মিষ্টত্ব ছিল। দোষের মধ্যে ছিল তাঁর আলস্য। শুয়ে গড়িয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন, জীবিকা অর্জনের কোনো আগ্রহ ছিল না। অবশ্য পারিবারিক আয় ছিল যথেষ্ট, সংসারে কখনো টাকার টান পড়েনি। ডিটেকটিভ বই পড়তে পড়তে শেষ হলো না বলে সেদিন কোর্টে যাওয়া হলো না, এ রকম কোনো ব্যারিস্টারের কথা কেউ কখনো শুনেছে!

সেই মেম বউ এসে পড়ে যখন ঝাট বাধায় তখন বুলা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। অনেকে বলে, সেটাই নাকি বুলার ভুল হয়েছিল, স্বামীর পাশটি আঁকড়ে থাকা উচিত ছিল, কিছুতেই স্বামীকে ছাড়া ঠিক হয়নি। কিন্তু তখন বিশ্বাসভঙ্গের আঘাত এমন সাঙ্ঘাতিক তীব্রভাবে লেগেছিল যে বুলা যে-কোনো মুহূর্তে আত্মহত্যা করে ফেলতে পারতেন। কলেজে পড়ার ইচ্ছে ছিল বলে বুলা প্রথমে বিয়ে করতে চান নি সে সময়, কিন্তু যখন বিয়ে হলোই, তখন তিনি স্বামীকে সমস্ত মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন, অক্লান্তভাবে চেষ্টা করেছেন নিজেকে স্বামীর যোগ্য করে তোলার। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শিক্ষয়িত্রী রেখে ইংরিজি উচ্চারণ শিখেছেন, কাঁটা চামচে খাওয়া অভ্যেস করেছেন। মন যদি ভেঙে যায় তবে স্বামীকে জোর করে আটকে রেখেই বা কী লাভ! নরেন যখন চলে যান, বুলার সঙ্গে একবার দেখাও করে যাননি, ওদেশে গিয়ে একটাও চিঠি লেখেননি। মাঝে মাঝে শুধু সত্যেনকে চিঠি লেখেন নিজের অংশের টাকা চেয়ে।

এগারো বছর হয়ে গেল, আর কেউ নরেনের আসার আশা করেন না। এর পর ফিরে এলেও কি বুলা তাঁকে গ্রহণ করতে পারবেন? যে ফিরে আসবে সে তো অন্য মানুষ, এগারো বছর আগে সে বুলার সমস্ত সাধ-স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।

বুলা সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া বন্ধ করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাতে তাঁর মায়ের প্রবল আপত্তি। বুলা অবশ্য বলেছে আর এক বছর কেটে গেলে সে আর কিছুতেই মানবে না, শাস্ত্র অনুসারেই। ত দ্বাদশ বর্ষ নিরুদ্দিষ্টকে মৃত বলে গণ্য করা উচিত।

বুলার বাবার অকাল মৃত্যু হয়েছে, মা থাকেন ছোট ভাইয়ের সংসারে। অল্প বয়েসেই চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে বলে বুলার ছোট ভাই বিমান বেশি লেখাপড়া শিখতে পারেনি, তার চাকরিটাও ছোট। তার বাড়িতে গিয়ে বুলা দু-একদিনের বেশি থাকতে চান না। টালিগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতেই কিছুটা ভাগ পেয়েছেন, সে বাড়িতে সত্যেন ছাড়া আরও তিনজন ভাসুর-দেওরের পরিবার আছে, দূর সম্পর্কের আশ্রিতও বেশ কয়েকজন। পারিবারিক এস্টেট থেকে বুলা ও তার সন্তানের ভরণ-পোষণের খরচ দেওয়া হয়, বুলা নিজস্বভাবে তাঁর জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু এদেশে পুরুষরক্ষী ছাড়া কোনো যুবতাঁকে কেউ নিরালায় থাকতে দেয় না।

সত্যেনের অন্য রকম মতিগতি দেখা যাচ্ছে অতি সম্প্রতি, এর আগে সত্যেন ব্যবসাপত্র নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতেন, বুলার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো খুব কম। বুলার জীবনে প্রথম উপদ্রব ঘটাতে আসেন নরেনেরই এক বন্ধু ত্রিদিব, কলকাতার তিনি একজন অ্যাডভোকেট। নরেন যখন উত্তর কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, তখন সেখানে ত্রিদিব প্রায়ই আসতেন। বেশ রগুড়ে ধরনের মানুষ, খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপারে খুব শৌখিন, প্রায়ই গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে খাবারের প্যাকেট নিয়ে আসতেন বন্ধুর বাড়িতে। ত্রিদিব বিবাহিত কিন্তু তাঁর স্ত্রীকে কোনোদিন দেখা যায়নি, তাঁদের বাড়িতে পর্দা প্রথা। এক একদিন আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতেন রাত এগারোটার পর। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে, কলকাতা শহর প্রায় ফাঁকা, লাস্ট ট্রামে দু-তিন জনের বেশি যাত্রী থাকে না, ত্রিদিব তাতেও ভয় পেতেন না।

নরেন বিলেতে প্রথমা স্ত্রীর কাছে ফিরে যাওয়ায় ত্রিদিব মর্মাহত হয়েছিলেন। বুলাকে তিনি বোঝাতে লাগলেন যে, নরেনকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না, তাকে শাস্তি দিতে হবে। অন্তত বিলিতি আইন অনুযায়ী তাকে খোরপোশ দিতে হবে। বুলা যে এসব কিছুতেই আগ্রহী নন ত্রিদিব তা শুনবেন না। ত্রিদিব নাছোড়বান্দা। এমন কি বুলাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বিলেত যাবার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।

প্রথম দু-তিন বছর বুলা যখন বাবা-মায়ের কাছে থাকতেন, তখন ত্রিদিব সেখানে যেতেন মাঝে মাঝে। তারপর বুলা যখন টালিগঞ্জের বাড়িতে চলে এলেন, সেখানে ত্রিদিব আসতে লাগলেন রবিবার ছাড়া আর প্রত্যেকদিন। বুলার ছেলের জন্য তিনি আনেন নিত্য নতুন উপহার আর বুলার জন্য রাশি রাশি খাবার। সন্ধেবেলা এসে তিনি অনেকক্ষণ বসে থাকেন, প্রত্যেকদিন প্রায় একই ধরনের কথা। বুলাকে গান গাইবার জন্য ঝুলোঝুলি অনুরোধ। ক্রমে তাঁর আচরণে স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে বুলাকে তিনি রক্ষিতা হিসেবে পেতে চান। জানবাজারে তাদের একটি বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে, সেখানে বুলা অনেক আরামে থাকতে পারবেন, সে গানবাজনাচর্চারও কোনো অসুবিধে হবে না। ত্রিদিব যে-ধরনের পরিবারের মানুষ সেখানে বাড়ির বউকে ঘরে বন্দী রেখে বাইরে একটি মেয়েমানুষ পোয্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বুলা প্রথম প্রথম বুঝতে পারেন নি। ত্রিদিবের পীড়াপীড়িতে একদিন দু-দিন গান শুনিয়েছেন মাত্র, অন্যদিন ভদ্রতা রক্ষা করেছেন শুধু। তার মধ্যেই তাঁর নামে কুৎসা রটে যায়। স্বামী চলে গেলেও বুলার শরীর ভাঙেনি, কোনো রকম একটানা রোগ হয়নি, এটা যেন তাঁর অপরাধ। নারীর শরীরে যৌবন থাকলেই তা পুরুষের খাদ্য হবে, এটাই যেন নিয়ম।

ত্রিদিব একদিনই মাত্র বুলার কোমরে হাত রেখেছিলেন। এতগুলি বছরে বুলার সেইটুকুই মাত্র পরপুরুষ স্পর্শ। ত্রিদিবের মত আরও অনেক লোভী এসেছে, বুলা প্রত্যেককেই নিজের শরীরের থেকে অন্তত এক হাত দূরত্ব থাকতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কঠোরভাবে সংযম পালন করে চলেছেন, যদিও তাঁর বিশেষ কোনো ব্ৰত নেই। কোনো অহংকারও নেই, সংযমের জন্যই যেন সংযম। কেউ তাঁর শরীরটাকে লোভের সামগ্রী মনে করছে, এটা বুঝতে পারলেই বুলার বড় অপমান হয়।

সত্যেনের সঙ্গে এতদিন বেশ পরিষ্কার সম্পর্ক ছিল। বড় গিন্নি সম্বোধন করে মাঝে মাঝে কৌতুক করতেন, কিন্তু কখনো শালীনতার সীমারেখাঁটি লঙঘন করেন নি। দেওঘরে সত্যেন প্রায় জোর করেই নিয়ে এসেছেন বুলাকে। এসে বেশ ভালোই লাগছে তাঁর। কিন্তু এখানে এসে। সত্যেন প্রায়ই আড়ালে বুলার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন, যখন তখন হাত চেপে ধরেন। প্রত্যেক বারই বুলার কান্না পায়। বিভাবতী যে বুলার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠছেন দিন দিন, সে জন্য তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। মেয়েরা সব বুঝতে পারে।

দেওঘরে এসে প্রতাপদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কতদিন পর। প্রতাপদার ওপর কোনো রাগ বা অভিমান নেই বুলার। পরে বুলা চিন্তা করে বুঝতে পেরেছেন, প্রতাপদা সেদিন ঠিকই করেছিলেন। কলেজে পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় বুলা সে সময় বিয়েটা ভাঙতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন প্রতাপদার পক্ষে তাঁর বাবাকে এসে সে বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব ছিল না। দুই পরিবারেই তা হলে অনেক গণ্ডগোল হতো।

রাগ নেই, অভিমান নেই তবু প্রতাপদার সঙ্গে কেন সহজ হতে পারছেন না তা বুলা নিজেই বুঝতে পারেন না। তাঁর মনে হয়, প্রতাপদার সঙ্গে খানিকটা দূরত্ব রেখে দেওয়াই ভালো, বেশি কাছে এলে প্রতাপদাও যদি ত্রিদিব. বা অন্যদের মতন হয়ে যান!

বাথরুমের জানলা দিয়ে দূরের একটা সবুজ মাঠ দেখা যায়। ওটা বাড়ির পেছন দিকে। ওদিকে কোনোদিন যাওয়া হয়নি। এই জানলা দিয়ে ঐ জায়গাটা সবুজ মখমল পাতা স্বর্গীয় উদ্যানের মতন মনে হয়। অনেক প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছে, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে এ রকম তিনটি ছাগলছানা লাফালাফি করছে সেখানে। অশ্রুসজল চোখে বুলা সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। ওখানে তিনি কোনো দিন যাবেন না ঠিক করলেন। এ রকম কিছু কিছু জায়গা দূরে থাকা ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *