প্রেমের তিন পর্ব
পারস্যের গালিচা। কে কিনেছিলেন জানি না। তবে রবিবার রবিবার এই বস্তু জীবন বের করে ছেড়ে দেয়। মানুষের চেয়েও যত্নে থাকে। নরম বুরুশ দিয়ে বুনোন বরাবর ঝাড়ো আর গোল করে গুটিয়ে রাখো। ব্রাশ অ্যান্ড রোল, রোল অ্যান্ড ব্রাশ। আবার খোলা মুখ দিয়ে ইঁদুর না ঢোকে। দুটো মাথায়। কাপড় জড়াও।
ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ সেই গালচে পড়েছে। বুকে লতাপাতার কারুকার্য। পাড় বসানো। নরম দুব্বো ঘাসের মতো জমি। কনক খুব সাহায্য করেছে। টানা হ্যাঁচড়ায় খোঁপা ভেঙে গেছে। পিঠের ওপর দুলছে সাপের কুণ্ডলীর মতো। আমার ওসব দেখা উচিত নয়। তবু নজর চলে যাচ্ছে। বয়েসের দোষ। বগলের কাছে ব্লাউজ টাকার মতো গোল হয়ে ঘামে ভিজে উঠেছে। হালকা নীল ওই জায়গাটা গাঢ় নীল হয়েছে। আবহাওয়া যত শীতলই হোক ওই জায়গাটা ঘামবেই। কঁধ আর ওপর বাহুর সন্ধিস্থল পায়রার বুকের মতো গরম। তোমার তাতে কী? কার্পেট পাতছ পাতো, অন্যদিকে নজর যাচ্ছে কেন? মিটমিটে শয়তান।
হামা দিয়ে বসেছিলুম। কনক সামনে ঝুঁকে কার্পেট সমান করতে করতে পিছু হটছিল, ঘাড়ে এসে উলটে পড়ল। রেগে গেছে। আচমকা এমন ঘটনা ঘটলে সবাই রাগবে। আমিও রেগে যেতুম। আমার পিঠের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পেছনে চিতপাত। পা জোড়া এখনও আমার পিঠে। মোমের মতো মসৃণ গোড়ালি দু’চোখের কোণে ঝিলিক মারছে। নিতম্বের ঘর্ষণে পিঠ গরম হয়ে উঠেছে। চোখে শাড়ির নিম্নাংশের ঝাঁপটায় জল এসে গেছে। ব্যাপারটা বিশ্রী হলেও মধুর। মানুষের মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ে, যুবতী ভেঙে পড়ার ঘটনা খুব কম কোষ্ঠীতেই লেখা থাকে। কনক যদি মাতুলের ছবিতে নায়িকা হয় আমি নির্ঘাত আত্মহত্যা করব।
পিঠ থেকে পা তুলে নিয়ে কনক বললে, কী যে তখন থেকে বেড়ালের মতো পায়ে পায়ে ঘুরছ। পইতেতে পা লেগেছে?
কী জানি? খেয়াল করিনি।
ইস পাপ হয়ে গেল। দাঁড়াও একটা প্রণাম করি।
প্রণাম? পাগল নাকি?
ওপাশের ঘরে চেয়ার সরাবার শব্দ হল। চট করে উঠে দাঁড়ালুম। দু’জনকে কার্পেটে এইভাবে গড়াতে দেখলে, এ বাড়িতে আমার দানাপানি বন্ধ হয়ে যাবে। এলোমেলো শাড়ি গুছিয়ে নিয়ে কনকও উঠে দাঁড়াল। কনকের পাপ হবে কেন? পাপে আমি নিজেই মজে গেছি। কদিন থেকেই নিজেকে লক্ষ করছি, পুণ্যের চেয়ে পাপের আকর্ষণ হাজার গুণ বেশি। দেবতা হবার বাসনা তলিয়ে গেছে। অসুর হতে চাই। আমায় দাও মা অসুর করে, কাজ নেই আমার দেবতা হয়ে। স্বর্গপুরীর হর্মে নাকি দেদার হুরি বসত করে/সেথায় নাকি অঢেল সুরার ঊর্মিমুখর ঝরনা ঝরে/পুণ্যবানের কাম্যভূমির মর্ম যদি এমনতর/দোষ কী তবে বরণ করার আগেই এদের মর্ত পরে? এসো খৈয়াম এসো। তোমাকে নিয়ে কোনও মরূদ্যানে পালাই। মধ্যবিত্ত বাঙালির সংসার বড় একঘেয়ে। Those who have gone before us, O Cupbearer, are sleeping in the dust of Self-pride. অহংকারের অট্টালিকায় নির্বাসিতের হাহাকার। বেশ বলেছিস ব্যাটা।
দেয়ালে আমার মাতৃদেবীর ছবি সন্ধের ঝোড়ো বাতাসে একটু হেলে গিয়েছিল। পায়ের আঙুলের ওপর ভর রেখে শরীর উঁচু করে কনক ছবিটাকে সোজা করছিল, এমন সময় মাতুলের প্রবেশ। আমার চেয়ে অন্তত হাতখানেক বেশি লম্বা। পদক্ষেপের আগে আগে কোঁচা চলেছে লাথি খেতে খেতে। কনকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম কনক?
কনকের গোড়ালি মাটি স্পর্শ করল। ছবি নিয়ে বেচারা তন্ময় ছিল। আমি সাহায্য করলে ব্যাপারটা নিমেষে হয়ে যেত। ইচ্ছে করেই করিনি। স্বার্থ ছিল। বেশ লাগছিল দেখতে। কেমন ডিঙি মেরে মেরে হুকের নাগাল পেতে চাইছিল। দীর্ঘকাল এ বাড়িতে শুধু পুরুষেরই রাজত্ব ছিল। সকাল সন্ধে মিলিটারি মার্চ করছে। আদেশ ছিটকোচ্ছে ছিটেগুলির মতো। অ্যাটেনশন। অ্যাবাউট টার্ন। ফরোয়ার্ড মার্চ। সেই কঠোরে কোমলের স্পর্শ লেগেছে। ফুটিফাটা জমিতে বৃষ্টি নেমেছে।
কনক হাসিহাসি মুখে ফিরে তাকাল, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার নাম কনক।
তুমি গান জানো? মাতুল কার্পেটে প্রমথেশ বড়ুয়ার মতো পায়চারি করতে করতে প্রশ্ন করলেন। গুনগুন করে গানের সুরও ভাঁজছেন। মেজাজ আসছে। আসতেই হবে। এ ঘরে কম গান হয়েছে? বড় বড় আসর বসেছে, রাতের পর রাত। এ ঘরের দেয়ালও গান গাইতে পারে।
কনক হাসিহাসি মুখেই বললে, অল্পস্বল্প।
সুর ভাজতে ভাজতে মাতুলের প্রশ্ন, নাচ আসে?
আজ্ঞে না।
আসা উচিত ছিল। তোমার বিউটিফুল নাচের ফিগার।
আমার দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে সুর ভাজতে ভঁজতে বললেন, কী রে! তোর রেওয়াজ টেওয়াজ কেমন হচ্ছে?
একেবারেই না।
তুই আমার নাম ডোবাবি ব্যাটা। আজ আমার সঙ্গে বোস। গানে গলা দিবি।
কোঁচায় লাথি মারতে মারতে, কার্পেটের ওপর দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে মায়ের ছবির সামনে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। চিত্রার্পিত পুত্তলিবৎ। পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বের করে কাঁচ মুছলেন। মৃতের সঙ্গে জীবিতের ভাষাহীন আলাপন চলেছে। কিছুক্ষণ স্থির থেকে বললেন, আজ তোমাকে গান শোনাব।
আমাদের দিকে যখন ফিরে তাকালেন, তখন অন্যভাব। মুখে বিষণ্ণতার প্রলেপ। রিমলেস চশমার আড়ালে জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। একটু যেন জল চিকচিক করছে।
যন্ত্র বের করো যন্ত্র বের করে বলে পিতা সদলে কুচকাওয়াজ করে ঘরে ঢুকলেন। হাতে দু’ফালি কাপড়। নিশানের মতো পতপত উড়ছে। একই সঙ্গে চামেলি আর বকুলের সুবাস। আতর ঢেলেছেন। বাতাস এখনও ভিজেভিজে। পাতা নড়লে এখনও জলের ফোঁটা ঝরছে। সেই বাতাস ফুলের গন্ধে কতদূর যে পৌঁছিয়ে গেল। কালিদাসের কালে। ওয়াজেদ আলির লক্ষ্মৌতে। সাজাহানের দিল্লিতে। ওমর খৈয়ামের পারস্যে। কাল কোথা থেকে কোথায় চলে গিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল। চরিত্রদের চেহারাও যেন পালটে গেছে। মাতামহকে মনে হচ্ছে পুত্রের হাতে বন্দি সাজাহান। পেছন পেছন মুকু আসছে জাহানারার মতো। মাতামহর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সব ভুলে গেছেন। সিনেমা, বাড়ি বন্ধক, গয়না বিক্রি, উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও আর মনে লেগে নেই। এখনই হয়তো অহীন্দ্র চৌধুরীর মতো কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকবেন, না, আমি আর সম্রাট হয়ে বসতে চাই না। আমার সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এ সাম্রাজ্য তুমি ভোগ করো পুত্র। এ মণিমুক্তো মুকুট তোমার! আর মার্জনা? ঔরংজীব, ঔরংজীব। না সেসব মনে করব না। ঔরংজীব! তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করলাম।
জাহানারার সকাল থেকেই সর্দি হয়েছে। ফুচুত করে হাঁচি হল। মুকু ঘাড় হেঁট করে হাঁচে। হাঁচার পর আরও কিছুক্ষণ নিচু হয়ে থেকে মুখ তুলে অপাঙ্গে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বড় লজ্জার কাজ করে ফেলেছে। হেঁচে ফেলেছে। নবাব ওয়াজেদ আলির মতো পিতা মধ্যমণি হয়ে বসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, অ্যাকোনাইট থার্টি। মাতামহ বললেন, মাঝরাতে এক ডোজ ডালকামেরা। প্রতাপ রায় কোঁচা সামলে বসতে বসতে বললেন, কিস্যু না, স্রেফ গরম জলে একটা পাতিলেবু কষকষে করে নিংড়ে একটু নুন দিয়ে খেয়ে নাও। মাতুল বললেন, কষা মাংস আর ফুলকো লুচি। মাতামহ বললেন, আদা দিয়ে গরম চা। মেসোমশাই বললেন, ভোরবেলা ঠান্ডা জলে স্নান। মুকু ধীরে ধীরে দরজার দিকে সরতে আরম্ভ করেছিল। টুক করে চৌকাঠ টপকে বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখান থেকে ফুচুত করে আর একটি হাঁচির শব্দ ভেসে এল।
কনক আর আমি যন্ত্রপাতি বের করছিলুম। হারমোনিয়ম, বায়াতবলা। পিতা বললেন, এসরাজটাও নামাও। অনেকদিন বাজানো হয়নি। ছড়টড় কী অবস্থায় আছে, কে জানে?
হারমোনিয়মটা বেজায় ভারী। দু’জনে ধরাধরি করে এনে কার্পেটের মাঝখানে ধপাস করে ফেললুম। প্রতাপ রায় উঠব উঠব করছিলেন। কোঁচায় কাছায় জড়াজড়ি হয়ে গেছে বলে রক্ষা পেয়ে গেল কনক। নয়তো তেড়ে এসে সরো সরো বলে আমাকে একপাশে চিতপাত করে দিয়ে কনকের সঙ্গে একটু দহরম-মহরম করার চেষ্টা করতেন।
পিতা খোল থেকে এসরাজ বের করে নরম একটুকরো ন্যাকড়া দিয়ে ধুলো পরিষ্কার করতে লাগলেন। আমাকে বললেন, ওহে রজনটা বের করো।
মাতুল হারমোনিয়মের রিডের ওপর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে এপাশ থেকে ওপাশে বারকতক আঙুল চালালেন। অনামিকায় আংটির পাথর ঝিলিক মেরে গেল। সুরের গমকে ঘরের বাতাস চমকে। চমকে উঠল। এসরাজে ছড় টেনে অষ্টকুটি একটা শব্দ বের করে পিতা বললেন, বহত্ আচ্ছা। তোমার মেজাজ এসে গেছে।
প্রতাপ রায় তবলায় তড়াং করে একটা চাঁটি মারলেন। মেরেই বললেন, অ্যাঃ, ঢ্যা ঢ্যা করছে। কতদিন হাত পড়েনি? হাতুড়ি কই, হাতুড়ি?
এই রে, তবলা ঠোকার সেই ছোট্ট হাতুড়ি যে প্রায়ই হারিয়ে যায়। খুঁজে পাওয়াই যে মুশকিল। পিতা অধৈর্য হয়ে বললেন, কী হল, পেলে না? পাবে না জানি। এ বাড়িতে কোনও একটা সিস্টেম নেই। না পাও কয়লা-ভাঙা হাতুড়িটাই আনন।
যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে সেই সুদৃশ্য হাতুড়ি অবশেষে বেরোল। এসরাজের ছড়ে রজন ঘষতে ঘষতে পিতা বললেন, কোথায় ছিল?
আজ্ঞে, আপনারই যন্ত্রপাতির বাক্সে।
প্রতাপ রায় তবলা ঠুকতে ঠুকতে বললেন, পাউডার আছে?
এ বাড়িতে পাউডারের পাট নেই। তবে ফ্রেঞ্চচক আছে। সে বস্তু যে-জায়গায় আছে তার নাগাল পেতে হলে চেয়ার চাই। কনক বললে, পাউডার? আমি এনে দিচ্ছি। খুব বাঁচিয়েছে। টঙে চড়ে আলমারির মাথা থেকে চক নামাতে হলে আসর মাথায় উঠত।
প্রচুর ঠোকাঠুকি করে তবলা সুরে বাঁধা হল। মাতুল বলতে লাগলেন, গাঁট্টায় মারো, গাঁট্টায় মারো। উঁহু ডান দিকটা এক পরদা নেমে আছে।
মাতুলের সাংঘাতিক কান। তার চেয়েও সাংঘাতিক কান পিতার। হাতে পাউডার ঢেলে তবলার গাবে প্রতাপ রায় ভাল করে মাখালেন। ওপর দিকে দু’হাত তুলে জয় নিতাইয়ের ভঙ্গিতে নিজের তালুতে বেশ করে ঘষলেন। মাতুল হারমোনিয়মে একটা সাপটা তাল বাজিয়ে সুরের মুখটি সবে ধরতে যাচ্ছেন, পিতা উঁহু উঁহু করে উঠলেন। মাতুলের ভুরু কোঁচকাল।
সুরটা দাও, সুর, যন্ত্রটা বেঁধে নিই।
তিন সপ্তক এসরাজ বাঁধার কাণ্ডকারখানা আমার দেখা আছে। এর চেয়ে ভীতিপ্রদ ব্যাপার আর কিছু নেই। শ্রোতাদের ধৈর্যের পরীক্ষা। তারে টুসকি মেরে মেরে, কানে মোচড় দিয়ে দিয়ে প্রতিটি পরদাকে সুরে ভেড়াতে হবে। মাতুল উসখুস করছেন। আঙুল মাঝে মাঝে টেপা সুরের বাইরে গিয়ে খেলে আসছে। গানের মুখ লিক করে বেরিয়ে পড়ছে। পিতা অমনি উঁহু করে ছটফটে মাতুলকে বশে আনছেন।
এইভাবে চললে রাত দুটোর আগে গানে আসা যাবে না। তরফের কান সহজে ঘুরতে চাইছে না। মটমট শব্দ করে সুরে পা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে। পিতা ঘোরাচ্ছেন আর বলছেন, গেল গেল।
মাতুল শেষকালে সাহস করে বললেন, আমার ভীষণ গান পেয়েছে। আর চেপে রাখতে পারছি না।
পিতা বললেন, আর একটু ধৈর্য ধরো, আর একটু, প্লিজ। এক মেটে বেঁধে ছেড়ে দিচ্ছি।
এসরাজ কাঁধে উঠল। মাতুল ইমনে আলাপ ধরলেন। নিখাদ থেকে কোমল ঋষভ হয়ে যখন সুরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন মনে হচ্ছে যেন অচেনা রাস্তা খুলে যাচ্ছে। কড়ি মধ্যম ছুঁয়ে যখন ওপরে উঠছেন সুর যেন আকাশের ব্রহ্মতালু স্পর্শ করছে। রাগিণীর বিরহী রূপ সুরের দু’-চার চলনেই স্পষ্ট। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি নীল শাড়ি পরা কনক। বাকি সব অবলুপ্ত। রাজকাপুরের ছবির ধোঁয়া ভেদ করে নার্গিস যেন বেরিয়ে আসছে। মৈঘৈম্মেদুরম্বরং বনভুবঃ শ্যামাস্তমালদ্মৈর্নক্তং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহংপ্রাপয়।
মাতুলকে পিতার এসরাজ জবরদস্ত অনুসরণ করেছে। দু’জনেই দু’জনকে বাহবা দিচ্ছেন। প্রতাপ রায়ের আঙুল তবলার ওপর ছটফট করছে। এখনও গানের মুখ আসেনি। বোল ফোঁটাতে পারছেন না। ঝট করে গানের মুখ এসে গেল। একেবারে সাচ্চা গজল,
সব কহাঁ কুছ লালা বগুল সেঁ নুমায়াঁ হো গয়ী।
খাক মেঁ ক্যা সুরতেঁ হোগি
কি পিনহাঁ হো গয়ী।
সব তো পাওয়া হল না। কিছু ফুল, কিছু পুষ্পবল্লরী, এতে আর কতটুকু প্রকাশ। মাটির যে আসল সৌন্দর্য সে তো সব লুকিয়েই রইল। সব কহাঁ কুছ লালা বগুল মে।
মাতুল-গর্বে বুক দশহাত হয়ে উঠছে। কী গাওয়াই গাইছেন। দুমড়ে মুচড়ে নিংড়ে হৃদয়ের আবেগ উজাড় করে দিচ্ছেন। এসব মানুষের কী দরকার কাউকে পরোয়া করে চলার? দুই বোন পাশাপাশি বসেছে। কনকের রাতের রান্না মাথায় উঠেছে। মেসোমশাই মাঝে মাঝে আহা আহা করে উঠছেন। মেসোর আহা শুনে মাতামহ হুহু করে এক ধরনের হাসি হাসছেন, যার অর্থ দেখো, ছেলে আমার কোন কোটির মানুষ! ঈশ্বরকোটির জীব।
হো গয়ী বলে মাতুল দুরূহ একটা কাজ সবে শেষ করেছেন এমন সময় সিঁড়িতে হুড়মুড় করে একটা শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে গলা শোনা গেল, সিলিপ করে পড়ে গেলুম যে রে বাপ। গাইয়ে, বাজিয়ে, তবলচি কেউ না শুনতে পান, আমার কানে এসেছে। অচেনা গলা। আসর ছেড়ে ওঠার আগেই তিনি দরজার সামনে চলে এসেছেন। জবা এসেছে? জবা?
আরে, এ যে সেই জবাদের বাড়ির ধেড়ে বাবুটি। মনে হয় জবার স্টেপ ফাদার। আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ, যার হেড সুখেন, এখনও পরিচয় বের করতে পারেনি। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, জবা এসেছে? জবা?
মাতুল গান বন্ধ করলেন, হারমোনিয়মে সুরের শেষ টানটি মেলায়নি। তবলার শেষ চাটি মাঝ-বাতাসে পাখির মতো উড়ছে। এসরাজ নিখাদে এসে ন্যাজ গুটিয়েছে। পিতা এসরাজটিকে কোলের ছেলের মতো সাবধানে কার্পেটে শুইয়ে রেখে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এই অসুর? কী চাইছেন?
মুখে সেই কদাকার কাঁঠাল-কোয়া হাসি। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, জবা আছে? জবা?
মাতামহ পালটা প্রশ্ন করলেন, কেন? রক্ষেকালী পুজো আছে নাকি আজ? এই রাতে জবাফুল পাবেন কোথায়? পিতা এসরাজ তুলে নিতে নিতে বললেন, চোখের জলে পুজো করুন, চোখের জলে পুজো বেস্ট পুজো। ভদ্রলোক কিছুই বুঝতে না পেরে আর একটু পরিষ্কার করে বললেন, সেই দুপুর থেকে জবাকে পাওয়া যাচ্ছে না, এত রাত হল, সে কি এখানে এসেছে?
পিতার এসরাজ আবার স্কন্ধচ্যুত হল। শূন্যে ছড়ি ঘুরিয়ে অর্কেস্ট্রার কনডাক্টরের মতো ভঙ্গি করে প্রশ্ন করলেন, ইনি কী চাইছেন বলো তো?
প্রতাপ রায় বাঁয়ায় গফা গফা আওয়াজ করে প্রশ্ন করলেন, কে জবা?
ভদ্রলোক বললেন, সেই জবা যাকে ওই ছেলেটি মাঝে মাঝে ছাত থেকে ফুল ছুঁড়ে দেয়।
অ্যায় মরেছে। ব্যাটা হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলে। এইবার কোথাকার জল কোথায় গড়ায় দেখো। কপালে আজ এই লেখা ছিল ঈশ্বর। পিতার হাত থেকে ছড়ি খসে পড়ল, কী বললেন? আমার ছেলে জবাকে চন্দ্রমল্লিকা ছুঁড়ে মারে? আপনি এতদিন আমাকে বলেননি কেন? ঘুমোচ্ছিলেন, থানায় ডায়েরি করেননি কেন?
মেসোমশাই বললেন, উঁহু, ডায়েরির স্টেজে এখনও আসেনি। যতক্ষণ না শ্লীলতাহানি হচ্ছে, ইনডিসেন্ট জেসচার হচ্ছে ততক্ষণ পানিশেবল অফেন্স হচ্ছে না। এ কেস ফেল করবে। যত বড় বাঘা ব্যারিস্টারই হোক না কেন আসামি খালাস পেয়ে যাবে। তারপর দেখতে হবে যাকে ফুল ছুঁড়ে মেরেছে সে সাবালিকা না নাবালিকা? সাবালিকা হলে তার কনসেন্ট ছিল কি না? যদি প্রতিবাদ করে থাকে তা হলে সে প্রতিবাদের সাক্ষী কে? তা ছাড়া ফুল যে ছুঁড়ে মেরেছে বলছেন তার কোনও সাক্ষী আছে? প্রমাণ কী ফুল ছুঁড়ে মেরেছে? কেস ডিসমিস্ট। আসামি বেকসুর খালাস। আসামি এখন অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারে। হাজার দশেক টাকা অবশ্যই পেয়ে যাবে।
মাতুল বললেন, মামলা যখন খারিজ হয়ে গেছে তখন আবার গান ধরা যেতে পারে?
পিতা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফলস অ্যালিগেশন। নাও ধরো।
ভদ্রলোক বললেন, আজ্ঞে, আমি মামলা করতে আসিনি। আপনার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগও নেই। তবে আজকাল ভাবভালবাসার যুগ পড়েছে তো, তাই ভাবলুম জবা যদি এখানে এসে থাকে। এত বড় বাড়ি, শুনেছিলুম একটিও মেয়েমানুষ নেই, উঠতি বয়েসের মেয়ে, উঠতি বয়েসের ছেলে, ঝড়বাদল হচ্ছে। বলা তো যায় না, কী থেকে কী হয়ে যায়। যদি একবার হয়ে যায়।
মাতামহ জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়ে যায়?
আজ্ঞে এই জোড়কলম আর কী।
মাতামহ বললেন, হরিশঙ্কর, অশ্লীল কথা বলছে, অনুমতি দাও। জুতোজাড়া এখনও প্রায় নতুন আছে। পিতা বললেন, দাঁড়ান দাঁড়ান, অ্যাকশন তো আমিও নিতে পারি; তার আগে অভিযোক্তাকে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, শপথ করো, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না, যাহা সত্য তাহাই বলিব।
প্রশ্ন: জবা কে?
একটি মেয়ে।
কোথায় থাকে?
যেদিকে চন্দ্রমল্লিকার টব, সেই ছাদের দিকের লাগোয়া বাড়িতে।
আই সি, যে বাড়ির মেয়েরা অন্তর্বাস পরে পুরুষদের সামনে বুক ফুলিয়ে বেড়ায়, আপনি সেই বাড়ির নিনকম-পুপ। আজ্ঞে, আপনি আসতে পারেন। ফুল ছুঁড়েছে? সে তো নরম জিনিস। ইট ছোঁড়া উচিত ছিল। থান ইট, আধলা ইট।
ভদ্রলোক বললেন, শুনেছি আপনি রাগী মানুষ। রাগী হলেও পরোপকারী, দয়ালু, শিক্ষিত, আদর্শবান। বিপদে পড়ে এসেছিলুম আপনার কাছে। আমার দাদা পাঞ্জাবে বড় চাকরি করতেন, বউদিরা সেখানেই ছিলেন, তাই বাঙালির হালচালের সঙ্গে মেলে না।
প্রতাপ রায় প্রশ্ন করলেন, বউদিরা মানে?
আজ্ঞে দুই বিবাহ।
অ্যাঁ বলেন কী, দু’দুটো বউ।
বলেন কেন, আর সামলাতে পারছি না।
প্রতাপ রায় কাবাবের গন্ধ পেয়েছেন। সাগ্রহে বললেন, বসুন, বসুন।
ভদ্রলোক এতক্ষণ কদমতলায় কেষ্টঠাকুরের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। কার্পেটের একপাশে বসলেন। সাবান আর পাউডারের বোদা গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে। মাথার চুলে ফুলেল তেল। প্রতাপ রায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে সামলাতে হচ্ছে কেন?
আজ বছর পাঁচেক হল, দাদা নিরুদ্দেশ। মনে হয় বেঁচে নেই। আত্মহত্যা করেছেন।
মেসোমশাই টাস টাস করে টুসকি মেরে কনক আর মুকুকে দরজার সামনে থেকে ওপাশে সরে যেতে বললেন। খারাপ খারাপ কথা হচ্ছে, মেয়ে বখে যাবে। মাতামহ বলে উঠলেন, বলেন কী, এক ঢিলে দু’পাখি। দু-দুটো বউ বিধবা!
বউদিরা অবশ্য বিধবার সাজপোশাক পরেন না। মাছ, মাংস, ডিম সবই চলে। দাদা মারা গেছেন সে প্রমাণ তো নেই। যা হবে সেই বারো বছর পরে।
পিতা প্রশ্ন করলেন, আপনার কী করা হয়?
পোস্তার বাজারে মশলার পাইকার।
মাতামহ অমনি বলে উঠলেন, ও, ব্যাটা গন্ধবেনে।
মাতুল ক্ষমা চাইলেন, কিছু মনে করবেন না, ব্যাটা বলাটা ওনার মুদ্রাদোষ।
প্রতাপ রায় বললেন, আপনার কি মনে হচ্ছে জবা পালিয়েছে?
মাতামহ বললেন, অমন বাপের মেয়ে পালাবেই। দ্রৌপদীর মতো পঞ্চস্বামী গ্রহণ না করে থামবে না। তারপর বস্ত্রহরণ। পিতা বললেন, বড় অসংলগ্ন কথা হচ্ছে। জবা পালাক ক্ষতি নেই। প্রেমের তিন পর্ব। প্রথম পর্বে বুদ্ধিবৈকল্য। কাঁচে কাঞ্চন ভ্রম। দ্বিতীয় পর্বে দ্বিত্ব। তৃতীয় পর্বে। যথাস্থানে দ্বিরাগমন ও খেল খতম। সবই হল অপসৃষ্টির উত্তাপ। যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায় ততই ভাল। আপনি তার খোঁজে এখানে এলেন কেন?
আপনার ছেলের সঙ্গে ছাতে-ছাতে একটু কথা চালাচালি হত তো। তা ছাড়া এই চিঠিটা হঠাৎ হাতে এসে গেল।
চিঠি? সভাসদরা সমস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ চিঠি। মনে হয় আপনার ছেলের লেখা।
মেসোমশাই বললেন, মনে থাকে যেন হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট কল করা হবে।
আমি তো মামলা করতে আসিনি। জবার সন্ধানে এসেছি।
পিতা বললেন, ঠিক আছে, আগে হস্তাক্ষর মেলানো হোক, তারপর কী লিখেছে দেখা যাবে। কনক!
পিতার ডাকে কনক দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
এর যে-কোনও একটা হাতের লেখা নিয়ে এসো তো।
কনক একটু ইতস্তত করে সরে গেল। আমি যেন বন্দি আসামি। সাক্ষ্য, প্রমাণ সব একে একে হাজির করা হবে। আমার তাতে কোনও হাত থাকবে না। একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছি না, জবাকে এক-আধটা ফুল এ ছাত থেকে ও ছাতে পাচার করেছি ঠিকই কিন্তু চিঠি তো আমি লিখিনি। চিঠি লিখব কেন? আমি তো জানি যত দানাই ছড়াই জবা তো তেমন পায়রা নয় যে উড়ে আসবে। ওর দানা আলাদা। মটরদানা, কাঁকনিদানা, কোনও দানাতেই ও পাখি বশ মানবে না। মাতুল কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, কী কাণ্ড বাধিয়েছিস। ব্যাটা ওমর খৈয়ামের চেলা।
বেশ লজ্জা লজ্জা করছে। ভয় তেমন লাগছে না। কী আর হবে? পিতা যদি বাড়ি থেকে লাথি মেরে বের করে দেন, লোটাকম্বল নিয়ে সরে পড়ব। কোথায় সরব জানি না। তবে এত বড় পৃথিবী, কোথাও কি একটা ডেরা জুটবে না।
কনক খুঁজে খুঁজে আমার ডায়েরিটা নিয়ে এসেছে। মরেছে। ওতে যেসব মনের কথা লেখা আছে, সেসব পড়লে সশ্রম কারাদণ্ডের পরিবর্তে জজসাহেব ফাঁসির হুকুম দেবেন। অনেক আধ্যাত্মিক চিন্তাও আছে। বরাতে কোন পাতাটা বেরিয়ে পড়বে কে জানে! জয় ঠাকুর।
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পিতা মাঝামাঝি একটা জায়গা খুলে আলোর সামনে মেলে ধরলেন। নীরব, নিথর, নিস্পন্দ প্রদীপ শিখা। কোন পাতাটা খুলেছেন। হে ভগবান, যে- পাতায় মায়া আছে,
যে-পাতায় কনক আছে, সেইসব পাতা যেন দুম করে বের করে দিয়ো না। কী কুক্ষণেই যে ডায়েরি। লেখার ইচ্ছে হয়েছিল। ভেবেছিলুম মহাপুরুষেরা ডায়েরি লেখেন, তা হলে ডায়েরি লিখলে। মহাপুরুষ হয়। লজিক।
পিতা মুখ তুলে বললেন, বাপস, কী সব লিখেছে?
প্রতাপ রায় বললেন, খারাপ কথা?
না না, অতি উচ্চমার্গের কথা। লিখছে, জীবনে পাওয়ার চেয়ে না-পাওয়াটাই বড়। পেলে হারাবার ভয় থাকে, যা পাইনি তা তো কোনওদিন হারাবে না। সোজা চলে যাও, কিছু ধরার চেষ্টা। কোরো না, কিছু তুলে নেবার চেষ্টা কোরো না। রিক্ত হবার সাধনা ক’জন করে। সকলেই তো দেহি দেহি করছে। সত্য একটাই, সব ছাড়োয়ে, সব পাওয়ে।
জবার কাকা উসখুস করে বললেন, হাতের লেখা কি মিলছে?
চিঠিটাই পেলুম না, তো হাতের লেখা মেলানো!
এই যে স্যার।
এতক্ষণে কাগজটা নজরে এল। এ সেই চিঠি। সুখেন ব্যাটা সেদিন দুপুরে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল। দেখেছ কাণ্ড! একটু বেশ জমিয়ে লেখ তো পিন্টু। বেশ একটু আবেগ দিয়ে মারাত্মক করে লেখ তো। বড় ফসকে ফসকে পালাচ্ছে। প্রথম লাইনেই মেরে দে, লেখ, আর কতকাল থাকব। বসে, পরান খুলে বঁধু আমার! রাসকেল একবারও আমাকে বললে না মেয়েটা কে? বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে আজ অবস্থা দেখো। অপরাধ স্বীকার করে নিলে সাজা কমে যায়। সেই পথেই এগিয়ে দেখি।
মেলাতে হবে না, ওটা আমারই হাতের লেখা। তবে অন্যের হয়ে লেখা। হাতের লেখা আমার হলেও লেখক অন্য।
ভদ্রলোক বললেন, আজ্ঞে, হাইকোর্ট দেখাতে চাইছে? একটু চাপ দিলেই বেরিয়ে পড়বে জবা কোথায়।
মেসোমশাই ধমকের গলায় বললেন, চুপ করুন, চিঠির শেষে কার নাম আছে দেখুন তো হরিদা?
পিতা পাতা উলটে বললেন, ইতি তোমার সুখাদ্য।
প্রতাপ রায় বললেন, বাবা, একেবারে খাদ্যখাদক সম্পর্ক।
মেসোমশাই বললেন, কাকে সম্বোধন করা হয়েছে?
পিতা ভাল করে দেখে বললেন, আমার শ্যামা মায়ের চরণতল।
প্রতাপ রায় বললেন, একেবারে ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ, কাম। বহত আচ্ছা।
মেসোমশাই বললেন, এ চিঠি কিছু প্রমাণ করে না। ইট মে বি এনিথিং। কয়েক লাইন পড়ুন তো হরিদা। পিতা চিঠিটা মাতুলের হাতে দিয়ে বললেন, আমি পারব না, তুমি পড়ো।
ভদ্রলোক বললেন, বেশ পাকা পাকা কথা লেখা আছে। ইচ্ছে করলে আমি চেপে ধরে জবার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতে পারি। দুঃখু নেই। পাত্র হিসেবে ছেলেটি তো খারাপ নয়।
কথা শুনে সকলেই নির্বাক। বলে কী রে! পোস্তার কারবারি। সেই ছড়া নাকি, শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে তোমার নাকি ছেলের বিয়ে। মাতুল চিঠিটা শুরু করার আগেই প্রতাপ রায় ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে পকেট থেকে সিগারেট লাইটার বের করে দপ করে আগুন ধরিয়ে দিলেন। চিঠি পুড়ছে, মাতুল চিৎকার করছেন, আগুন লেগে যাবে, ওরে আগুন লেগে যাবে।
ভদ্রলোক চিৎকার করছেন, আমার চিঠি, আমার চিঠি।
প্রতাপ রায় জ্বলন্ত চিঠিটা কার্পেটের পাশের মেঝেতে ফেলে দিয়ে খুব সহজ গলায় বললেন, এবার আপনি আসতে পারেন। জবা এখানে নেই। ভোরবেলা গাছে খোঁজ করবেন।
মাতামহ বললেন, আর একটা কথা বলেছ কী চ্যাংদোলা করে বাইরে ফেলে দিয়ে আসব।
মাতুল বললেন, উনি যা বলেন তাই করেন। তন্ত্রসাধক।
ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। মাতামহের দিকে ভক্তি গদগদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, বাবা, একটু আশীর্বাদ করুন। মাতামহ হাত তুলে বললেন, করলুম।
আশীর্বাদ করুন যেন এই অপমানের উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে পারি।
অ্যাঁ সেকী?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাদের ছেলে ছাত টপকে ফুল ফেলবে, চিঠি ফেলবে, আইবুড়ো মেয়ে অদৃশ্য। হয়ে যাবে, দেশে আইন বলে তো একটা কিছু আছে। মেয়ে যদি না ফেরে আমি থানায় যাব। তখন। যা হয় টানা হ্যাঁচড়া হবে। মেসোমশাই বললেন, আমি আছি।
পিতা খুব গম্ভীর গলায় বললেন, আপনারা একে ডিফেন্ড করবেন না। আমার ছেলে অপরাধী। শুধু অপরাধী নয়। চরিত্রহীন, লম্পট। হি ইজ এ সাফারার। বয়েসের অসুখে ভুগছে। শেম! শেম!