খুব বেশিক্ষণ ঝিনুকের কথা বিনুর মনে থাকল না।
জীবনে এই তার প্রথম নৌকোয় ওঠা। ব্যাপারটা খুবই লোভনীয়, এর জন্য কাল সমস্ত রাত উত্তেজনায় ঘুমোত পারে নি। কিন্তু নৌকোয় উঠবার পর দেখা গেল, জলের ওপর সেটা ভীষণ দুলছে। ফলে মজার বদলে ভয় করতে লাগল বিনুর। মনে হল এই বুঝি পড়ে যায়, এই বুঝি পড়ে যায়। প্রাণপণে দু’হাতে পাটাতনের কাঠ চেপে ধরল সে।
লগি বাইতে বাইতে যুগল লক্ষ করেছিল। বলল, ডর নি লাগে ছুটোবাবু?
অন্য সময় হাজার ভয় পেলেও মুখ ফুটে বলত না বিনু। আর যার কাছেই হোক, যুগলের কাছে ভয়ের কথা বলতে মাথা কাটা যেত। কিন্তু জীবনে এই প্রথম টলমলে নৌকোয় উঠে বীরত্বের একটি কণাও নিজের ভেতর খুঁজে পেল না সে। কাঁপা গলায় বলল, হ্যাঁ। নৌকোটা বড্ড দুলছে। ডর নাই। পেরথম পেরথম উইরকম মনে হইব। দুই চাইর দিন নায়ে চড়েন, ঠিক হইয়া যাইব।
যুগল আশ্বাস দিল বটে, কিন্তু খুব একটা ভরসা বিনু পেয়েছে বলে মনে হয় না। বরং পাটাতন আরও জোরে আঁকড়ে ধরল।
কিন্তু ভয়ের ভাবটাও বিনুকে বেশিক্ষণ আছন্ন করে রাখতে পারল না। কেননা, যেদিকে যতদূর চোখ যায়, শরৎকাল তার সবটুকু মহিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে। মাথার ওপর সাদা সাদা ভবঘুরে মেঘ, তাদের ফাঁকে ফাঁকে নীল নয়নের চকিত চাহনির মতো আশ্বিনের আকাশ। মেঘ ছাড়া ওখানে পাখিও আছে–চেনা-অচেনা কত যে পাখি! আকাশের নীল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পাখি আর মেঘেরা বাতাসে গা ভাসিয়ে রেখেছে।
নিচে শুধু জল আর ধানের খেত। মাঝে মাঝে নলখাগড়া জলঘাসের বন, ঝাড়ওলা ধঞ্চে আর কালো মুত্রার ঝোঁপ। আর আছে বউন্যা গাছ, কাউফলের গাছ, লাল ফুলে-ভরা মান্দার গাছ। আকাশ যেখানে ধনুরেখায় দিগন্তে নেমেছে, সারি সারি তালগাছ সেখানে এক পায়ে দাঁড়িয়ে। জলঘাসের মাথায়, মুত্রাঝোপে এই সকালবেলায় রাশি রাশি ফড়িং উড়ছে–নানা রঙের চিত্রবিচিত্র ফড়িং। তাদের ধরবার জন্য এসেছে ছোট ছোট বগাই পাখি।
ইতিমধ্যে রোদ উঠে গিয়েছিল। তরল সোনার মতো আলোয় চারদিক ভরে গেছে। এই আশ্বিনে জল যেন ঝকমকে আরশি। তাতে বউনাগাছের ছায়া, কাউফল গাছের ছায়া, নলখাগড়ার ছায়া কাঁপছে।
কলকাতা থেকে এতদূরে এই জল-বাংলায় শরৎকালটা বুঝিবা এক আশ্চর্য যাদুকর। ঝাপির ভেতর থেকে একের পর এক বিস্ময় বার করে খুব দ্রুত বিনুকে জয় করে নিতে লাগল সে।
কখন মস্ত পুকুরটা পেরিয়ে এসেছিল, বিনুর মনে নেই। নৌকোর তলায় এবং দু’ধারে সর সর আওয়াজে একসময় চমকে উঠল সে। দেখল তারা ধানখেতের ভেতর এসে পড়েছে।
সমানে লগি ঠেলছিল যুগল। নিবিড় ধানবন দু’ধারে সরে সরে নৌকোটাকে পথ করে দিচ্ছে। ধানগাছ কি আর দেখে নি বিনু? অনেক বার দেখেছে। বাসে করে বাবার সঙ্গে কলকাতা থেকে ডায়মন্ডহারবার যাবার সময় রাস্তার দু’পাশে অবারিত ধানের খেত চোখে পড়েছে। কিন্তু সে তো দূরে থেকে দেখা। এত কাছে বসে দেখার কথা আগে কখনও কল্পনাই করে নি সে।
বিনুর ইচ্ছে হল, ঘন সবুজ ধানপাতাগুলোকে একবারে ছুঁয়ে দেখে। হাতও বাড়িয়েছিল সে, কিন্তু ধরবার আগেই যুগল চেঁচিয়ে উঠল, ধইরেন না ছুটোবাবু, ধইরেন না–
চকিত বিনু তক্ষুণি হাতটা সরিয়ে আনল। বলল, কেন?
ধরলেই হাত কাইটা যাইব, ধানের পাতায় জবর ধার।
বিনু আর কিছু না বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকল।
বাড়ি থেকে মনে হয়েছিল, ধানের খেত একটানা দিগন্ত পর্যন্ত বুঝি ছুটে গেছে। কিন্তু তা নয়, খানিক দূর যাবার পর দেখা গেল ধানবন শেষ। তারপর শুধু জল আর জল। কাঁচের মতো স্বচ্ছ টলটলে জল পারাপারহীন সমুদ্র হয়ে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে আছে। আশ্বিনের এলোমেলো অস্থির বাতাস তার ওপর অবিরাম ছোট ছোট ঢেউ তুলে যাচ্ছে। ঢেউ ছাড়া এখানে যা আছে তা রাশি রাশি শাপলা ফুল, আর আছে বড় বড় পদ্মপাতা, ফাঁকে ফাঁকে থোকা থোকা কচুরিপানা। কচুরিপানার মাথায় মুকুটের মতো সজীব নীলাভ ফুল। ফুলে ফুলে এই দূরবিস্তৃত জলরাশি ছেয়ে আছে।
যুগল লগি ছেড়ে এখন বৈঠা বাইছে। নৌকোর তলায় ছপ ছপ করে একটানা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
বিনুর বড় লোভ হল দুটো শাপলা তুলে নেয়। হাত বাড়াতে গিয়ে এবারও বাধা পড়ল। যুগল চেঁচিয়ে উঠল, বুইকেন না ছুটোবাবু, বুইকেন না। শাপলার লতা টানতে গেলে পইড়া যাইবেন, এহানে কিলাম (কিন্তু) আথাই (অথৈ) জল। আপনে তো আবার সাতর জানেন না। একটু থেমে আবার বলল, আমিই তুইলা দিতে আছি।
নৌকো বাইতে বাইতে টপাটপ অনেকগুলো শাপলা তুলে বিনুর দিকে ছুঁড়ে দিল যুগল।
কিন্তু নিজে তুলতে না পারলে সুখ কোথায়? বিরস মুখে চুপচাপ বসে থাকল বিনু।
যুগল বলল, পদ্মফুল নিবেন ছুটোবাবু?
ভারী গলায় বিনু বলল, না।
শালুক?
না।
কচুরি ফুল?
না।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর আর ক্রমাগত ‘না’ ‘না’ শুনে বিনুর মনোভাব খানিক যেন আন্দাজ করতে পারল যুগল। চিন্তিত মুখে বলল, গুসা নি করছেন ছুটোবাবু?
বিনু চুপ।
এবার একেবারে উদার হয়ে গেল যুগল। বরদানের ভঙ্গিতে বলল, আইচ্ছা তোলেন দুই চাইরটা। তয় (তবে) বেশি ঝুইকেন না।
বলমাত্র পদ্ম শাপলা এবং কচুরি ফুলে নৌকো বোঝাই করে ফেলল বিনু।
যুগল বলল, এইবার খুশি তো?
বিনুর মুখে হাসি ফুটল। কিছু বলল না সে।
জলজ ফুলের বনে আরও কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ এক জায়গায় এসে নৌকো থামিয়ে দিল যুগল।
অবাক হয়ে বিনু শুধলো, কী হল?
সামনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে চাপা গলায় যুগল বলল, উই দ্যাখেন ছুটোবাবু– তার স্নায়ুগুলো ধনুকের ছিলার মতো টান টান হয়ে গেছে। দৃষ্টি পলকহীন, প্রখর। সর্বাঙ্গ ঘিরে বিচিত্র এক সংকেত ফুটে বেরিয়েছে যেন।
যুগলের আঙুল যেদিকে, সেদিকে তাকিয়ে বিনু দেখতে পেল, বড় একটা পদ্মপাতার কাছে তামাটে রঙের অসংখ্য মাছের ছানা কিলবিল করছে। বিনু শুধলো, কী ওগুলো?
চিনতে পারলেন না?
না।
যুগল বলল, হেই তো, আপনে চিনবেন ক্যামনে? আপনে কইলকাতার মানুষ। উইগুলান শৈলের (শোলমাছের) পোনা।
বিনু বলল, শোলের পোনা তো বুঝলাম। নৌকো থামালে কেন?
দ্যাখেন না, কী বাহারের মজা হয়– রহস্যময় হেসে পাটাতনের তলা থেকে দশ বার হাত লম্বা একটা সরু বাঁশের টুকরো বার করল যুগল, সেটার মাথায় অনেকগুলো ধারাল লোহার ফলা আটকানো।
বিনু জিজ্ঞেস করল, এটা কী?
ট্যাটা।
কী হবে এটা দিয়ে?
ইন্টু সবুর করেন ছুটোবাবু, নিজের চৌখেই দেখতে পাইবেন। বলতে বলতে পাটাতনের ওপর উঠে দাঁড়াল যুগল, হাতে সেই তীক্ষ্ণমুখ অস্ত্রটা।
নৌকোটা থেমে গিয়েছিল ঠিকই, তবে স্থির হয়ে নেই। হাওয়ার টানে জলের ওপর সেটা দুলছিল। ট্যাটাটা বাগিয়ে ধরে নিষ্পলক, স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তামারঙের শোলের ছানাগুলোর দিকে তাকিয়ে কী দেখল যুগল, তারপর শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে অস্ত্রটা ছুঁড়ে দিল।
জলের তলায় কী ঘটল, বিনু বুঝতে পারল না। তবে চারদিক তোলপাড় করে প্রকান্ড দানবের মতো কী যেন একটা সমানে আছাড় খেতে লাগল। তার ফল হল এই, অনেকখানি জায়গা জুড়ে পদ্ম আর শাপলার বন ভেঙেচুরে ছিঁড়েখুঁড়ে একেবারে তছনছ। আর যুগলের সেই ট্যাটার বাঁশটা একবার জলের তলায় ডুবতে লাগল, আবার ওপরে ভেসে উঠতে লাগল। ডোবা আর ভাসা চলল অনেকক্ষণ ধরে।
এদিকে খুশিতে দু’হাত ওপরে তুলে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে যুগল, পড়ছে, পড়ছে। শালার শৈল (শোল) যাইবা কই?
কিছুক্ষণ পর পদ্মবন শান্ত হয়ে এল। ট্যাটার বাঁশটা এখন জলের ওপর অল্প অল্প কাঁপছে। শোলের সেই পোনাগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
বৈঠা বেয়ে নৌকোটাকে টাটার কাছে নিয়ে এল যুগল। জল থেকে অস্ত্রটা যখন ওপরে টেনে তুলল, দেখা গেল, সেটার ধারাল ফলায় আড়াই হাতের মতো লম্বা একটা শোল মাছ বিধে আছে।
ক্ষিপ্র হাতে টাটার মুখ থেকে মাছটা খুলে নিয়ে পাটাতনের তলায় ঢুকিয়ে দিল যুগল। তারপর ফলাগুলো ধুয়ে ট্যাটাটা মাছের পাশে রাখতে রাখতে বলল, বুঝলেন নি ছুটোবাবু
কী বলছ? তক্ষুনি সাড়া দিল বিনু। বষ্যাকালে শৈলমাছে পোনা ছাড়ে। যতদিন না পোনাগুলা ডাঙ্গর (বড়) হয়, নিজে নিজে ঘুইরা ফিরা খাইতে শিখে ততদিন মা-মাছটা তাগো লগে লগে থাইকা পরি (পাহারা) দ্যায়।
তাই নাকি?
হ। যুগল মাথা নাড়ল, ইট্টু আগে যে পোনাগুলা দেখছেন, এই মাছটা তাগো মা।
বিনু হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল, বিষণ্ণও। বলল, মাছটাকে তো মেরে ফেললে, ওর বাচ্চাগুলোর এখন কী হবে?
কী আবার হইব? অন্য মাছে ওগো খাইয়া ফেলাইব।
ইস! বিনুর চোখেমুখে কষ্টের রেখা ফুটল।
ছুটোবাবুর শরীলে বড় দয়ামায়া– যুগল হেসে ফেলল, বাচ্চার কথা ভাইবা যদিন মাছ না মারি, আমরাই বা খামু কী? এই লইয়া মন খারাপ কইরা থাইকেন না ছুটোবাবু। পিথীমিতে একজনেরে না মারলে আরেকজন বাঁচে না।
তবু বিনুর মন ভারাক্রান্ত হয়ে রইল।
ইতিমধ্যে যুগল আবার নৌকো বাইতে শুরু করেছে। অনেকখানি যাবার পর সে ডাকল, ছুটোবাবু–
বিনু তাকাল।
যুগল বলল, এই মাছটা লাইয়া অহন কী করি ক’ন দেখি। অহন তো হপায় (সবে) সকাল, হাট সাইরা ফিরতে ফিরতে রাইত দুফার হইয়া যাইব। ততক্ষণে মাছ যাইব পইচা। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাল।
সত্যিই তো, মাছটা নিয়ে এখন কী করা উচিত বিনুও ভেবে পেল না।
হঠাৎ সমস্যাটার যেন কিনারা করে ফেলেছে এমনভাবে যুগল বলে উঠল, হইছে ছুটোবাবু, হইছে–
কী হয়েছে? বিনু জিজ্ঞেস করল।
পথে আমার এক কুটুমবাড়ি পড়ব। আমার পিসাতো (পিসতুতো) বইনের হউর (শ্বশুর বাড়ি। ভাবতে আছি, মাছটা হেইখানে দিয়া যামু। শুদাশুদি পচাইয়া লাভ কী?
কিন্তু—
কী?
হাটে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে না? বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়তে সামনের দিকে তাকাল বিনু।
খানিক আগেও হেমনাথদের নৌকোটা তাদের সামনে শ’খানেক গজের ভেতর ছিল। এখন অনেক দূর চলে গেছে। এখান থেকে ধুধু বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে সেটা। বিনু চঞ্চল হল, দাদুদের নৌকো কোথায় চলে গেছে দেখ–
চোখের কাছে হাত এনে যুগল একবার দেখে নিল। তারপর হেসে বলল, যাউক না। হাটের পথ কি আমি চিনি না? কুটুমবাড়ি থিকা (থেকে) বাইর হইয়া একখান বাদাম খাটাইয়া দিমু, বড় কত্তাগো আগে হাটে পৌঁছাইয়া যামু।
বিনু চুপ করে রইল। তার মুখচোখ দেখে মনে হল না, যুগলের কথায় খুব একটা ভরসা পেয়েছে।
আশ্বিনের সূর্য পুব আকাশের খাড়া পাড় বেয়ে বেয়ে অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে। রোদে আর কোমল সোনালি আভা নেই। স্নিগ্ধতা মুছে গিয়ে তাতে ঝকঝকে রং লেগেছে। যতদূর তাকানো যায়, ছোট ছোট ঢেউ-এর মাথায় তপ্ত রোদ নেচে বেড়াচ্ছে। সেদিকে বেশিক্ষণ কেউ চোখ পেতে রাখবে, সাধ্য কী।
বৈঠা টানতে টানতে যুগল বলল, ছুটোবাবু আমার মনে একখান সাধ হইছে।
কী? বিনু জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
আপনেরে একখান গীত শুনামু।
গান শোনাতে চাইছ?
হ।
সেদিন গানের কথা বলেছিল বটে যুগল। সারি-জারি-রয়ানি-ভাটিয়ালি, হেন গান নাকি নেই যা সে জানে না। বিনু বলল, বেশ তো, গাও না–
বৈঠাটা নৌকোর ওপর তুলে বাঁ হাতে বাঁ কানখানা চেপে ডান হাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে গান ধরল যুগল :
ও ভাইটাল গাঙ্গের নাইয়া,
ময়ূরপঙ্খী নাও রে বাইয়া
কুন বা দ্যাশে
যাও।
এই ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা,
আমার একখান কথা লও।
এই তো নদীর উজান বাকে
সোনার বালুর।
হেইখানেতে আছে আমার
পরাণ বন্দুর ঘর।
কইও খবর বন্দুর কাছে,
জলছাড়া মীন কয়দিন বাচে,
বাচে রে এ-এ-এ–
এই কথাটি না যদি কও,
আমার মাথা খাও।
ও ভাইটাল গাঙ্গের নাইয়া,
নাইয়া রে-এ-এ-এ—
বেশ সুরেলা, ভরাট গলা যুগলের। চারদিকের পদ্ম আর শাপলা বন, কচুরি ফুলের বেগুনি শোভা, ঝকঝকে নীলাকাশ, তার গায়ে থোকা থোকা মেঘ, দিগদিগন্তে ছুটে-যাওয়া আশ্বিনের অথৈ জলরাশি, উড়ন্ত পাখির ছায়া–পূর্ব বাংলার এই সজল ভুবনটির সঙ্গে যুগলের গানের আশ্চর্য মিল রয়েছে। শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে গেল বিনু।
গান শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার রেশ এখনও জলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কাঁপছে। যুগল সাগ্রহে শুধলো, গান ক্যামন শুনলেন ছুটোবাবু?
বিনু বিভোর হয়েই ছিল। বলল, খুব ভাল।
দেখলেন তো, আপনেগো যুগইলা হেই দিন মিছা কয় নাই। অ্যামন গান আমার মেলা জানা আছে। আপনেরে শিখাইয়া দিমু ছুটোবাবু। যা যা জানি বেবাক শিখাইয়া দিমু। বলে আবার বৈঠা জলে নামাল যুগল।
সীমাহীন এই শাপলা-পদ্মের বনে বসে যেদিকেই তাকানো যায়, শুধু জল আর জল। দূরে ধানের খেত, আর দূরে নীলাভ বনরেখা। এর ভেতর কোথাও লোকালয় থাকতে পারে, তা যেন ভাবাই যায় না। কিন্তু আছে, মাঝে মাঝে দু’চারখানা কৃষাণ গ্রাম দ্বীপের মতো মাথা তুলে রয়েছে।
কোনাকুনি দক্ষিণে পাড়ি দিয়ে একটা গ্রামে এসে পড়ল যুগলরা। গ্রাম আর কি, বিশ পঁচিশখানা টিনের বাড়ি এলোমেলো ছড়িয়ে আছে।
যুগল যে বাড়িতে এনে নৌকো থামাল সেটা অদ্ভুত ধরনের। এমন বাড়ি আগে আর কখনও দেখে নি বিনু। উঁচু ভিতের ওপর মোট খানচারেক ঘর। উঠোন বলতে কিছু নেই–ঘর ছাড়া বাদ বাকি সব দু’তিন হাত জলের তলায় ডুবে আছে। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাবার জন্য উঠোনের ওপর দিয়ে সাঁকো পাতা।
এই সকালবেলা দু’তিনটে কালো কালো আধ-ন্যাংটো ছেলেমেয়ে সাঁকোর ওপর বসে বড়শি বাইছিল। উঠোনের জলে পুঁটি আর বাঁশপাতা মাছের ঝাঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড়শিতে ভাত গেঁথে ফেলার শুধু অপেক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে মাছ এক হ্যাঁচকা টানে জলতল থেকে উঠে আসছে।
যুগল নৌকো ভেড়ানোমাত্র ছেলেমেয়েগুলো চেঁচামেচি জুড়ে দিল, যুগলামামায় আইছে, যুগলামামায় আইছে–
নৌকোটাকে সাঁকোর বাঁশে বাঁধতে বাঁধতে যুগল বলল, তগো বাপে কই?
সবাই সমস্বরে উত্তর দিল, বাড়ি নাই।
মা?
ছেলেমেয়েগুলো চিৎকার করে ডাকতে লাগল, মা মা, দেইখা যাও ক্যাঠা আইছে—