রতনে রতন চেনে।
ভালুক চেনে শাঁকালু ॥
পাঁপড়ভাজা আমি খাই না। ও আপনি নিয়ে যান। চিরকালের নাক-তোলা মাতুল, হাত নেড়ে, মাথা নেড়ে ভয়ংকর এক ভঙ্গি করলেন। যোড়শীর বদলে বৃদ্ধা তেড়ে এলে মানুষ এমন ছিটকে যেতে পারে। বর্ষার রাতে মুচমুচে পাঁপড়ে এমন বিতৃষ্ণা বড়ই বেমানান। কনক হকচকিয়ে গেছে। মাতুল আবার আপনি বলে বয়েস আর ব্যবধান দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছেন।
পিতা বললেন, ও হ্যাঁ, তুমি তো আবার চপকাটলেট ছাড়া অন্য কোনও মধ্যবিত্ত খানা পছন্দ করো না। পোস্ত, বড়ি, মুড়ি, পাঁপড়।
আজ্ঞে না, তা কেন? পোস্ত দিয়ে পরোটা আমি ভীষণ ভালবাসি। পাঁপড় কেমন যেন বুড়োটে খাবার।
তাই নাকি? তা হলে তুমি বিস্কুট খাও, কটেজ ক্রিম।
বিস্কুট তো রুগিরা খায়।
ও, রুগিরা খায়!
পিতা ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছেন। শ্যালক একের পর এক ফাঁকড়া বের করছেন। সামান্য খাওয়া নিয়েও মানুষের সংসারে কত ফ্যাচাং। এ ব্যাপারে মাতামহ আমার সোনারচাঁদ ছেলে। কোনও বায়নাক্কা নেই। একেবারে কোণের দিকে একটা বেতের চেয়ারে বসে আপন মনে একা একা পাঁপড়। চিবোচ্ছেন। যেন এ জগতের মানুষই নন। মা ছোট্ট ছেলেকে ধামিতে মুড়িমুড়কি দিয়ে বসিয়ে দিয়ে গেছেন যেন! শিশু ভোলানাথ খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, পাখি দেখছে, হাত নাড়ছে। চোখে কেবল মোটা করে কাজল আঁকা নেই, কপালে ধেবড়ানো টিপ নেই। কনকও ভীষণ বিপদে পড়েছে। এক পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে?
পিতা বললেন, তা হলে তুমি কেক খাও।
না না, কেক দাতে বড় জড়িয়ে যায়, জিবে বিচ্ছিরি একটা কোটিং পড়ে যায়।
তাই নাকি? তুমি টুথব্রাশ দিয়ে খাও। আমি তোমাকে নতুন টুথব্রাশ দিচ্ছি। এক কামড় করে খাও আর ব্রাশ দিয়ে ঘষে দাও।
সেটা একটা পাগলামো হবে।
পাগল তো পাগলামি করবেই। সেইটাই তো তার স্বভাব! বেশ, তুমি তা হলে ওমলেট খাও। কনক, তুমি ওমলেট করে নিয়ে এসো তো!
মাতুল বললেন, হ্যাঁ ওমলেট চলতে পারে, তবে পেঁয়াজ ছাড়া। আর মাখন দিয়ে নরম করে ভাজা।
কনক পাঁপড় নিয়ে চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছে, প্রতাপ রায় বললেন, আমাকে দিয়ে যাও। আমার খোলটা অনেক বড়।
কনক পাঁপড়ের ডিশটা প্রতাপ রায়ের সামনে কোনওরকমে নামিয়ে রেখে পালিয়ে বাঁচল। মেয়েরা মানুষ পড়তে পারে। চোখের ভাষা, মুখের মুচকি হাসি। বহু যুগের অ্যানিম্যাল ইন্সটিংক্ট। প্রতাপ রায় যেন রেডিয়ো ট্রান্সমিটার। যখন যেখানেই থাকুন না কেন, লাগাতার বিপ বিপ করার জন্যেই জন্মেছেন। আমাদের ভোমলা পাগলা। ডাকলেই বলবে, কী করতে হবে? ওই মেয়েটাকে চুমু খেতে হবে। সন্ধ্যা শিশি হাতে কেরোসিন তেল আনতে যাচ্ছে, ভোমলা দৌড়োল পেছন পেছন। ভোমলার পেছন পেছন দৌড়োলুম আমরা, ওরে, না-রে, না-রে, তোকে রুটি খাবার জন্যে ডেকেছিলুম। তিন দিন উপোস করে আছিস।
পিতা বললেন, তোমার স্বভাবের সাত খুন মাপ হয়ে যায়, তোমার একটি মাত্র গুণের জন্যে। সে হল তোমার সংগীত। তোমার বড়লোকি চালের জন্যে যখনই ঘৃণা করতে ইচ্ছে করে তখনই কানে ভেসে আসে তোমার সুর, কৈসে গুজার গই হায় জওয়ানি। সেই ছেলে, সেই এতটুকু ছেলে, স্কুলে আমার কোলে বসে গান গেয়েছিলে বাগেশ্রীতে, কোলে তুলে নে মা কালী। তাবড় তাবড় গুণী সেদিন কাত হয়ে গিয়েছিল। সময়, সময়! সময় কীভাবে চলে যায়। ব্রিজের ওপর দিয়ে যেন মেল। ট্রেন ছুটছে।
মেসোমশাই ওঘরে বাঘের মতো চিৎকার করে উঠলেন, মূর্খ! সেই সকাল থেকে চেষ্টা করছি, কিছুতেই তোমার মাথায় ঢুকছে না, শি অ্যাস, শি গোট। কোতের পজিটিভিজমের সারকথা কী? চিন্তাধারা পরপর তিনটি ক্রম পার হয়ে এগিয়েছে। কী কী? আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক। বলো, বারবার বলো। মুকু ঘুম-জড়ানো গলায় বলতে লাগল, আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক।
মাতুল এতক্ষণে জিজ্ঞেস করলেন, এঁরা কারা?
এঁরা হলেন মেজদার ভায়রাভাই আর তার দুই মেয়ে।
ও, এঁরাই তো সেই রেঙ্গুনে ছিলেন। ইভ্যাকুয়েশানের সময় আরাকানের জঙ্গলে স্ত্রী মারা গেলেন? আচ্ছা সব বড় বড় হয়ে গেছে। উনি আর বিবাহ করেননি?
কোনও সেনসিবল মানুষ দ্বিতীয় পক্ষ গ্রহণ করে? তোমার বাবা, আমি, ওই ভদ্রলোক। ইচ্ছে করলে আমরা আবার সংসারে ঢুকতে পারতুম। স্রেফ তোমাদের মুখ চেয়ে আমাদের এই স্যাক্রিফাইস। তোমরা এর দাম দিতে পারবে?
কেন পারব না?
ওই তো তার প্রমাণ। তোমার বৃদ্ধ পিতা গত তিন দিন অনাহারে ছিলেন। তুমি জানতে? তোমার স্ত্রী জানত?
অনাহারে থাকাটা ওনার একটা বিলাসিতা। কৃচ্ছসাধন। হোয়্যার ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস, দেয়ার ইট ইজ ফলি টু বি ওয়াইজ। মনে রেখো, তোমাদেরও দিন আসবে। সব, সব শোধ করে দিয়ে যেতে হবে।
কনক ওমলেট নিয়ে এল। বেশ একটা খিদেখিদে গন্ধ বেরোচ্ছে। প্রতাপ রায় হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিতে নিতে বললেন, উমার ভূমিকায় সুন্দর মানাবে। পরদায় একেবারে নিউ ফেস। ফেটে যাবে বুঝলে? একেবারে ফাটাফাটি হয়ে যাবে।
কনক অবাক হয়ে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে আবার কী রে বাবা! প্রতাপ রায় নতুন এক চাল ছেড়েছেন। ভেতরে বেগ এসেছে। মনের চালে শৃগালের হাহাকার। কনক, কনক। কোন মানুষ যে কখন কীভাবে পাগল হয়ে যাবে, কেউ জানে না। নিজেরও জানা নেই। ঘোড়ার মতো নাক ঘেঁদা করে লাগাম পরিয়ে রাখতে পারলে ভাল হয়। চার পা তুলে কখন যে চি-হি-হি করে উঠবে
মাতুল বললেন, তোর চোখ আছে প্রতাপ। বাংলা স্ক্রিনে নতুন নায়িকার বড় অভাব। এইসময় বাজারে ছাড়তে পারলে একেবারে ক্যান্টার হয়ে যাবে।
পিতা বললেন, তোমাদের আলোচনা কোন পথে চলেছে? পরদাফরদা কী বলছ? সিনেমা নাকি?
ধরেছেন ঠিক।
মাতামহ অন্ধকার কোণে স্প্রিংয়ের মানুষের মতো মোড়া থেকে ছিটকে উঠলেন, তোমাকে আমি ত্যাজ্যপুস্তুর করব। তোমার বায়োস্কোপ করা আমি ঘুচিয়ে দোব। এই কাপ্তেনটি কে? হাতি-ছাড়া বিশ্বকর্মা! মুখ দেখলে মনে হয় রামবাগানের আড়কাঠি।
মাতামহ বাঘের মতো এগিয়ে এসেছেন। পাঁপড়ের তেলহাত মাথার চুলে বুলিয়েছেন। আলো পড়ে পাকা চুল জরির মতো চিকচিক করছে। মেসোমশাই মুকুকে চড়া গলায় দর্শন বোঝাচ্ছেন, যদি ভূতমাত্রের হিতসাধন ধর্ম হয়, তবে একজনের হিতসাধন ধর্ম আবার একজনের হিতসাধন অপেক্ষা দশজনের তুল্য হিতসাধন অবশ্য দশগুণ ধর্ম। গুড অফ দি গ্রেটেস্ট নাম্বার। বাপস, বাংলা বটে। মুকু পরীক্ষার আগেই শুকিয়ে মরে যাবে। এরই মধ্যে কেমন যেন বাসি ফুলের মতো চেহারা হয়ে গেছে। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে ‘মিল’, ‘মিল’, ‘বেনথাম’, ‘বেনথাম’ বলে কেত পাড়ে।
মাতামহের আক্রমণে প্রতাপ রায়ের মুখের সেই অদ্ভুত হাসি মিলিয়ে গেল না। ওমলেট চিবোতে চিবোতে নির্বিকার মুখে বললেন, জ্যাঠামশাই, কেন যে আপনি আমাকে দেখতে পারেন না! সেদিন আপনি আমাকে খড়ম তুলে তাড়া করলেন। আপনার রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে।
ওহে ছোকরা, ভুল আমার হচ্ছে না। তুমি সর্পই, মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। ঘাটের মড়া। মাতুল বেশ চড়া গলায় বললেন, বাবা! বয়েসের চেয়ে আপনি বেশি বাতুল হয়ে পড়েছেন। আনকালচার্ড ফুল।
ঘরে যেন গ্রেনেড ফাটল। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ধোঁয়ায় চারপাশ আচ্ছন্ন। চতুর্দিকে ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। দেয়ালে ঘড়ি চলছে ঠাস ঠাস শব্দে। মুকুদের পরীক্ষার পড়াও থেমে গেছে। হাত স্থির। হাঁটু স্থির। মুহূর্ত প্রস্তরীভূত। বসাকদের বাগানবাড়িতে দেখেছিলুম, পেছন দিকের বাগানে জঙ্গলের মধ্যে একগাদা স্ট্যাচু। নগ্ন রমণী, স্নানরতা রমণী। দাড়িঅলা নগ্ন এক বৃদ্ধ ডিসকাস ছোঁড়ার ভঙ্গিতে স্থির। বছরের পর বছর রোদে আর জলে পড়ে থেকে মৃতের মতো বিবর্ণ। ভূতের মতো ভীতিপ্রদ। ঘরটাকেও এই মুহূর্তে বসাকদের পেছনের বাগানের মতো মনে হচ্ছে।
পিতৃদেব ধীরে ধীরে চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। এত ধীরে যে সামান্যতম শব্দও হল না। নৈঃশব্দ্যের মহড়া চলেছে। মাথা পিঠের দিকে সামান্য হেলে আছে। ফলে চিবুক সামনের দিকে সমকোণের চেয়ে একটু উঁচু। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল। ঝাউয়ের শাখায় একঝলক সমুদ্রের বাতাসের মতো। এতটুকু শব্দ না করে চেয়ারটাকে দুহাতে পেছনে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাতুলের থেকে বেশ সম্মানজনক দূরত্বে সরে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। ঘরে যেন চিতাবাঘ ঘুরছে।
চালচলনে এইবার সামান্য গতি লক্ষ করা গেল। বুকের কাছে হাত জোড় করে বললেন, আচ্ছা, তোমরা তা হলে এবার এসো।
মাতুল সাহস করে বললেন, তাড়িয়ে দিচ্ছেন?
অফকোর্স। আমাদের সামনে বসার তোমার কোনও অধিকার নেই। তুমি হলে বড়লোকের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। এ বাড়িতে তুমি আর কখনও না এলে আমি যারপরনাই সুখী হব।
হঠাৎ আপনার এই ভাবান্তর?
আমার আচরণের জবাবদিহি আপনার কাছে করতে আমি বাধ্য নই। আপনারা আসতে পারেন।
আপনি হঠাৎ এত রেগে গেলেন কেন?
হঠাৎ! সেই বেদের যুগ হলে তোমার মতো ইয়ার এতক্ষণে ভস্ম হয়ে যেত। গুরুজনদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তাই তো তুমি শেখোনি। উনি আলকালচার্ড ফুল, তুমি কী? তুমি হলে কালচারড মাঙ্কি। ক্লিয়ার আউট। ইমিজিয়েটলি ক্লিয়ার আউট।
উনি কেমন মানুষ আপনি কিছুই জানেন না। না জেনে নিজের অপরাধের বোঝা বাড়াচ্ছেন। হি ইজ ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। কঞ্জুষ দি গ্রেট, মাছির পিছন টিপে গুড় বের করেন।
শোনো শোনো, সক্রেটিস দি গ্রেট, উনি কেমন মানুষ আমাকে চেনাতে এসো না।
মাতামহ একচাকলা হাসি ছাড়লেন। সরতে সরতে কখন পিতার পাশে সরে এসেছেন। মুখ দেখলে মনে হবে ফোর্টের র্যামপার্টে বুক ঠুকে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশেই বীর গোলন্দাজ।
মেসোমশাই এতক্ষণে পাঠশালা থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রয়োজন বোধ করেছেন। বোধহয় মনে হয়েছে ‘হোয়েন রোম বার্নস, নিরো ফিডলস’ গোছের ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। মানুষটি একটু একবগ্ন হলেও গোষ্ঠীপতি হবার গুণ আছে। সেই বিধুজ্যাঠাকে কেমন তেড়ে গেলেন। আইনের রাজা। কিছুই তো তেমন জানা ছিল না। এইমাত্র পিতার কাছে আরও কিছু অতিরিক্ত পরিচয় পাওয়া গেল। জীবন একেবারে বেড অফ রোজেস ছিল না। রেঙ্গুন থেকে ভারতের হাঁটাপথে আরাকানের জঙ্গলে স্ত্রীকে হারিয়েছেন। এতক্ষণে বুঝেছি কেন একটু একবগ্না। কাপড় দুভাজ করে লুঙ্গির মতো পরেছেন। ভুড়ি বেড়েছে, সেই মাপে গেঞ্জি ছোট হয়েছে। কষির ওপর পেটের অংশ টুকি করছে। মাঝখানে সিথি করে কুচিকুচি চুল পেতে আঁচড়ানো। দুপুরে ছোটমেয়ে পিতাকে আদর করে সাজিয়ে দিয়েছে। অকৃতজ্ঞ পিতারা সেসব কথা লেখাপড়ার সময় বেমালুম ভুলে যান। মুকু বেচারার সেই সন্ধে থেকে আড়ং ধোলাই হচ্ছে।
মেসোমশাই রঙ্গমঞ্চে এবার নতুন ধরনের খেলা দেখালেন। কোনও কথা নেই। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে, ফোলাফোলা মুখে, থপথপ করতে করতে সেই রণাঙ্গন ভেদ করে উত্তরে বারান্দার দিকে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে বেশ তেড়ে গলা ঝাড়লেন। টিনের চাল ঝনঝন করে উঠল। এবার রিটার্ন জার্নি। উলটো রথ। সেইভাবেই তাকাতে তাকাতে ফিরে চললেন। ঘরের মাঝখান থেকেই উচ্চকণ্ঠে মেয়েকে বললেন, যতক্ষণ তোমার আয়ত্ত না হচ্ছে আজ ততক্ষণ চালাতে হবে। সে রাত একটা হোক, দুটো হোক, ভোর হোক। লাল মেঝের কালো বর্ডার বরাবর এসে বললেন, বেদান্ত বলছেন, স্বয়ে যথা দৃষ্টে, স্বপ্নে যেমন দেখা যায়, গন্ধর্ব নগরং যথা, মায়ায় দেখা দেয় গন্ধর্ব নগর। চৌকাঠে পা রেখে টাল খেতে খেতে বললেন, তথা বিশ্ব ইদং দৃষ্টং বেদান্তে বিচক্ষণেঃ। বৈদান্তিকের দৃষ্টিতে বিশ্বও তদ্রুপ। তদ্রুপ শব্দটা ইচ্ছে করেই মনে হয় অত জোরে বললেন। অনেকটা বিদ্রুপের মতো শোনাল।
মেসোমশাইয়ের আসা আর যাওয়াটা এত সুন্দর হল, লেডি ম্যাকবেথের ঘুমের ঘোরে হাঁটার মতো। আমাদের অধ্যাপক প্ল্যাটফর্মে চোখ বুজিয়ে সুব্লাড, সুব্লাড করে হাঁটতে হাঁটতে একদিন হিসাবের ভুলে দমাস করে পড়ে গিয়েছিলেন। স্কটল্যান্ডের মানুষ। পড়ে গিয়ে ব্লাডি বলেছিলেন দাঁত কিড়মিড় করে। দরজাটা ভেজাতে ভেজাতে মেসোমশাই বললেন, প্রয়োজন হলে ডাকবেন হরিদা।
প্রতাপ রায় বললেন, যাঃ বাবা।
মাতুল উঠে দাঁড়ালেন, কোলের ওপর থেকে কেঁচা পাটে পাটে, ধাপে ধাপে মেঝেতে নেমে এল। ভীষণ অপমানিত হয়েছেন। দুর্দান্ত রাগী মানুষ। এমন বেকায়দায় পড়েছেন রাগতেও পারছেন না। ফরসা মুখ জবাফুলের মতো টকটকে লাল। কেঁচা ঝেড়ে হাতে ধরে বললেন, বেশ আমি চলে যাচ্ছি। আপনার নির্দেশ মনে থাকবে।
প্রতাপ রায় বললেন, বাড়ি মর্টগেজের ব্যাপারটা তা হলে কী হবে? মিনিমাম দু’লাখ নিয়ে ফ্লোরে নামতে হবে।
সে হবে। এখন জামাইয়ের তোয়াজে আছেন। বাড়িতে তো ফিরতেই হবে। মর্টগেজ ডিড তৈরিই আছে, ধরে সই করিয়ে নোব। বাড়ি বাঁধা রেখে তো আর দু’লাখ হবে না। সীমার গয়না বেচে কয়েকদিন কাজ চালাই।
মাতামহ আর্তনাদ করে উঠলেন, ওকে তোমরা ধরো। ওকে বাঁচাও। ফতুর হয়ে যাবে। সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
পিতা বললেন, উতলা হবেন না। ভাগ্যকে ধরে রাখা যায় না। It is all a chequer-board of nights and days/where destiny with men for pieces plays. উতলা হবেন না। শুধু দেখে যান।
মাতুল রাগ-রাগ গলায় বললেন, ফিমের কিছুই যখন বোঝেন না, তখন মন্তব্য না করাই ভাল। আমি পুডোভকিন হব, আমি গদার হব, আমি আইজেনস্টাইন হব। হয়ে দেখাব।
মাতামহ বললেন, এসব কী বলছে গো? আমরা ছেলেদের তো বলতুম, বিদ্যাসাগর হও, বিবেকানন্দ হও, রবীন্দ্রনাথ হও। এরা আবার কারা?
পিতা বললেন, জানো যখন কিছুই বুঝি না, তখন দয়া করে বোঝাতে এলে কেন? তুমি হয়তো আবদুল করিম হতে পারতে, গোলাম আলি হতে পারতে। একেবারে দ্বিতীয় হতে না পারলেও কাছাকাছি যেতে পারতে। তোমার ভাগ্য। ভাগ্যের ঘোড়া ছুটল বেরাস্তায়। বয়েস হয়েছে, যা ভাল বোঝে তাই করো।
আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই করব। শুধু নাম নয় অর্থও। সাত দিন হাউসফুল হলে সব টাকা উঠে আসবে। চোদ্দো দিনে টাকা ডবল, আটাশ দিনে চার ডবল।
ব্যস ব্যস, তাই করো। সেই চটে শুয়ে মুটে রাজার গল্প। সেই ফেরিঅলার গল্প। মনে নেই দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে সব ভেঙে চুরমার করেছিল। আমি তোমার কথা নয়, কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
ওল্ড জেনারেশন আর নিউ জেনারেশনে এই হল তফাত। টাকা সিন্দুকে রাখলে বাড়ে না। ছাতা পড়ে যায়। টাকা বাড়ে ব্যবসায়ে খাটালে। কোনও নন-বেঙ্গলি ব্যাবসার নামে এমন আঁতকে ওঠে না।
বাঙালির ব্যাবসা আমার জানা আছে। তোমার এটা ব্যাবসা নয়, ফাটকা।
রাজকাপুরের নাম শুনেছেন? জেমিনি গণেশনের নাম শুনেছেন?
প্রতাপ রায় বললেন, উত্তেজনায় তুই নাম গোলমাল করে ফেলেছিস। শিবাজি গণেশন। জেমিনি স্টুডিয়োর নাম। চন্দ্রলেখা করে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেছিল।
চন্দ্রলেখা? তুমি চন্দ্রলেখা করবে? চন্দ্রলেখা?
কথায় কথায় পিতা কিঞ্চিৎ শান্তভাব ধারণ করছিলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ফেটে পড়লেন বলে। ভিসুভিয়াসের মুখ দিয়ে লাভ বেরোয়। পিতার মুখ দিয়ে লাভার বদলে চন্দ্রলেখা বেরোচ্ছে ছিটকে ছিটকে। কেউ না জানুক, আমি জানি কারণটা। এক ঢিলে দু’পাখি মারা হচ্ছে। চারদিকে তখন চন্দ্রলেখার খুব প্রচার। সাংঘাতিক, ফ্যাবুলাস, সার্কাস, সোর্ডফাইট। কে জানত ওর মধ্যে আরও সব উঁচু উঁচু ব্যাপার আছে। আমার কথাতেই পিতা সপুত্র সেই ছবি দেখতে গেলেন। সবচেয়ে দামি আসনে দু’জনে পাশাপাশি বসে আছি। অন্ধকার ঘরে পিতা কখনও হরীতকীর টুকরো, কখনও যোয়ান, কখনও পাতলা কাগজে মোড়া লজেন্স এগিয়ে দিচ্ছেন। জিভ নানা রসে একেবারে চুর হয়ে আছে আরকের মতো। কষা থেকে মিষ্টি, মিষ্টি থেকে ঝাল, ঝাল থেকে মিষ্টি। পিতার ওপাশে একত্সর যুবতী। আমার পাশে মধ্যবয়সি একসার গোঁত্তামারা ভদ্রলোক। অবশেষে বই শুরু হল হাতির তোলা শুড়ের জল ছিটোনো দিয়ে। প্রথমটায় অত বোঝা যায়নি। বেশ চলছিল রাজারাজড়ার ব্যাপার। হঠাৎ শুরু হল ঢাকের ওপর যুবতীর নৃত্য। দক্ষিণী শরীর। যেমন নিতম্ব, তেমনি বক্ষ। চোখ ঠিকরে কোটর ছেড়ে পরদায় গিয়ে ঠোক্কর মারছে। নীচে সামনের সারির দর্শকরা নেচে নেচে উঠছে। দু-একজন চেয়ার ভেঙে পড়েও গেল। পিতা বললেন, হরি। পেছনের দর্শকরা বললেন, চপ। নর্তকীরা হঠাৎ পেছন দিকে চেত্তা খেয়ে পড়তে লাগলেন। জীবনে অমন কুচ যুগ’ দেখিনি। কাঁচুলি ফেটে ফ্যাটাস করে বেরিয়ে না পড়ে। পিতা বললেন, হরেন্ডাস। পেছনের দর্শক বললেন, চোপ। এরপর মেয়েদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে ছেলেরা, ছেলেদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে মেয়েরা চলে যেতে লাগল। মত্তপ্রমত্ত অবস্থা। এরপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া। চন্দ্রলেখার কেরামতি দেখে রাজা কামার্ত হয়ে, হাউমাউ করে তেড়ে এলেন। পিতা বললেন, গেট আপ। হাত ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে প্যাসেজ পার করে হলের বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেললেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্রেফ দুটি কথা, আরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ, তোমার এই টেস্ট হয়েছে। মাই গড! ঠিক সেইসময় পাশ দিয়ে বোকাবোকা চেহারার এক ভদ্রলোক কাছাকোঁচা সামলাতে সামলাতে যাচ্ছিলেন, থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কী করেচে, নাক খুঁটেছে? শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে ঝাঁকুনি মেরে পিতা বললেন, বাক আপ। ধড়ফড় করে সামনে এগোতে এগোতে ভদ্রলোক বললেন, বাবা রে। পিতা হেসে উঠলেন। শেষ লজেন্সটি হাতে দিয়ে বললেন, তোমার দোষ নেই। যেমন শুনেছ তেমনি করেছ। এসব ছবি কক্ষনও দেখবে না। এসব হল নেগেটিভ পিকচার্স। ব্রেনওয়াশের জন্যে তৈরি। ক্যাপিটালিস্টদের চাল। নৈতিক ব্যাকবোন ভেঙে দিয়ে কল্পজগতের সরীসৃপ করে রাখার ষড়যন্ত্র। আর ইউ এ হিউম্যান ফডার ফর দেয়ার ক্যান? পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে একটা বাস চলে গেল ধুলো উড়িয়ে। নাকে চাপা নাকে চাপা বলে পিতা পকেটে রুমাল খুঁজতে লাগলেন। আঁধি উঠেছে আঁধি। সেই চন্দ্রলেখার নাম শুনে পিতা তো লাফাঁকেনই।
প্রতাপ রায় বললেন, চন্দ্রলেখা ভেরি সাকসেসফুল ছবি। বক্স অফিস স্ম্যাশ করে দিয়েছে। ভেরি সিম্পল ফর্মুলা। একটু বীররস, একটু রোমান্স, আর একটু সেক্স। (শেষ কথাটি বলার সময় ঠোঁটদুটো ছুঁচোর মতো সামনে উলটে এল, বাঁ চোখ ছোট হয়ে শর্টসার্কিট বাতির মতো তিড়িক করে লাফিয়ে উঠল।) সব একসঙ্গে তাল করে চিটেগুড় দিয়ে মেখে ফুরফুরে অম্বরী তামাক।
পিতা বললেন, তোমার ভূমিকাটা কী? তখন থেকে ফড়ফড় করছ! তোমার মুখ দেখলে এলিস ইন দি ওয়ান্ডারল্যান্ডের সেই চেশায়ার ক্যাটের কথা মনে পড়ছে, এ গ্রিন উইদাউট এ ফেস। কোনও কোনও প্রাণী শাঁকালু দেখলে ওইভাবে হাসে। তোমার এই বোকা সেন্টিমেন্টাল বন্ধুর টাকাকে শাঁকালু ভেবে হাসিটা মুখে পার্মানেন্ট হয়ে গেল নাকি?
পিতার কাঁধের পাশ থেকে মাতামহ বললেন, ওটা হল ফেউয়ের হাসি।
প্রতাপ রায়ের অসম্ভব সহ্যশক্তি। এতটুকু না রেগে বললেন, বড় বড় গাইয়েদের সঙ্গে তাল। মেরে ফিরি তাই হাসিটা মুখে লেগেই থাকে। এই ছবি করার ব্যাপারে আমার বিশেষ কোনও ভূমিকাই নেই। পিতৃদেব কিছু টাকা, একটা বাড়ি, বিলিতি একটা গাড়ি রেখে গেছেন, বিয়েথা করিনি, ওস্তাদ মেরে বেড়াই, সেই টাকারই কিছু শ্রাদ্ধ হবে। শাঁকালু আমি দেখিনি, শাঁকালু দেখেছে আপনার শ্যালক।
পিতা এবং মাতামহ দু’জনেই একেবারে থ হয়ে গেলেন। এও সম্ভব। জগতে তোক চেনা ভার মুখ দেখে। মাতুল বললেন, প্রতাপ, তুই শেষে আমাকে ভাল্লুক ভাবলি?
ওঁরা যে আমাকে ভাল্লুক ভেবেছিলেন?
পিতা বললেন, এমন একটা প্রতিভা ভুলপথে চলে নষ্ট হয়ে যাবে, তুমি বারণ করতে পারছ না?
করেছিলুম। শুনবে না। ব্যাপারটা জেদাজেদির পর্যায়ে চলে গেছে। হতে চেয়েছিল মিউজিক ডিরেক্টর। ল্যাং মেরে দিয়েছে। সেই থেকে গোঁ চেপেছে, নিজে ছবি করবে, সেই ছবির মিউজিক ডিরেক্টর হবে। নৌশাদ ফৌশাদ সব তলিয়ে যাবে।
পিতা হা হা করে প্রাণখোলা হাসি হেসে চেয়ারে বসলেন। আরে, বোসো বোসো। আমার একটা ঘটনা মনে পড়ছে হে।
মাতুল ইতস্তত করছেন। উঠে যখন পড়েছেন তখন বসা কি আর উচিত হবে। হাসি শুনে দর্শন ছেড়ে মেসোমশাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে?
আপাতত। বিনয়দা আসুন। অনেকক্ষণ কচলাকচলি করেছেন। মেয়েটাকে এবার একটু রেস্ট দিন। মাতুলের দিকে তাকিয়ে সামান্য বিরক্তির গলায় বললেন, কী হল তোমার? বসতে বললুম না?
বসার সাহস পাচ্ছি না।
সেকী? তুমি চন্দ্রলেখা করে ঢাকের ওপর মেয়েছেলে নাচাবে, তোমার সাহস নেই?
মেসোমশাই চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ঢাকের ওপর কেন? লাল মেঝেতে কিংবা কার্পেটের ওপর নাচালে ক্ষতি কী? ঢাকের ওপর থেকে দুম করে পড়ে গেলে কী হবে?
আরে মশাই, এ ঢাক সে ঢাক নয়, জয়ঢাক। শ্রাদ্ধের সঙ্গে তিলকাঞ্চন।
মাতুল বসে পড়লেন। আমতা আমতা করে বললেন, কই আমি তো চন্দ্রলেখার কথা বলিনি। আমি এমন একটা ছবি করব, যে-ছবি মানুষের চোখের জল টেনে বের করে আনবে। শিল্পীর বঞ্চিত জীবন। প্রতিভা আছে সুযোগ নেই। গোটা আঠারো গান থাকবে। সব রাগরাগিণীর ওপর। দরবারি, বাগেশ্রী, মালকোষ, দেশ। সব কম্পোজ করা হয়ে গেছে।
শেষ দৃশ্যে নায়কের টিবি?
আজ্ঞে হ্যাঁ, ধরেছেন ঠিক। দরবারির ওপর বেস করে গান। তেমনি বাণী!
হৃদয়বিদারক?
আজ্ঞে হ্যাঁ। এ জীবনে আর কোনও প্রয়োজন নাই। এক এক লাইন গাইছে, আর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কাশছে, এক ঝলক রক্ত উঠছে, আর দরবারিতে এ জীবন, এ জীবন করছে। তাই তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ, একেবারে অবিকল।
মাথায় আর কিছু এল না?
কেন?
দুঃখ, মৃত্যু, প্রেম, এ ছাড়া কিছু ভাবা যায় না? কেন, টকি অফ টকিজ কি মানময়ী গার্লস স্কুলের মতো একটা বই করা যায় না।
ওসব এখন চলবে না। মানুষের মনের ভেতর উঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোতে হবে। মানুষ এখন কাঁদতে চায়। বেদনায় জন্ম নেবে যন্ত্রণার শতদল, জীবনের ইতিহাস লেখা হবে রক্তের অক্ষরে, জীবনের মূল্য শুধু অশ্রুজল, তৃণশীর্ষে শিশিরের ক্ষণস্থায়ী বিন্দু।
ও, তোমার তো আর্টস ছিল। সবেতেই তাই এলিয়ে পড়ো। জীবনে চোখের জল তো আর ফেলতে হল না। তাই চোখের জল নিয়ে কাব্য করতে পারছ। তবে হ্যাঁ, যে-লাইনে নাক গলাতে চলেছ তার শেষটা অবশ্য অশ্রুজলেরই কাব্য। তুমি তো সাহিত্যের ছাত্র ছিলে, পড়েছ কি না জানি না, ভার্জিল থেকে দুটো লাইন বলি, Human deeds have their tears and morality touches the heart.
আমি তা হলে কী করব?
প্রথমে তুমি তোমার পিতার কাছে ক্ষমা চাইবে। তারপর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে, আমাকে শুভবুদ্ধি দাও।
আমার অপরাধ?
সেকী? তোমার অপরাধ, তুমি জানো না? প্রথম অপরাধ, পিতাকে অপমান।
মাতুল সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আপনারা দেখছি এজলাস বসিয়ে ফেলেছেন।
তা বলতে পারো। পাশে জজসাহেবও বসে আছেন, বিনয়দা। তোমার দ্বিতীয় অপরাধের বিচার এখন হবে না, হবে পরে। সেটা হল বুদ্ধিবৈকল্য।
মাতামহ বললেন, ক্ষমা চাইতে হবে না। ও তো ছেলেবেলা থেকেই এইভাবে কথা বলে। মা-মরা ছেলে।
পিতা বললেন, জানি জানি, ও তো আমার কাছেই মানুষ। আজই না হয় আতর-মাখা ওস্তাদ হয়েছে। অতীত সহজে ভুলতে পারে বলেই বর্তমানে মানুষের তুড়িলাফ। অতীতের সব ছবি আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। হয়তো বয়েস বাড়ছে বলেই। বর্ষার রাত। ওর দিদি ডিম দিয়ে খিচুড়ি বেঁধেছে। অনেক রাত হয়ে গেছে। ওই টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। চাদর মুড়ি দিয়ে এই বাবু তখন ঘুমে কাদা। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আমি। বিছানা থেকে পাঁজাকোলা করে তুলে আসনে বসিয়েছি। মাথা ঢুলে পড়ছে। আমি ধরে আছি, ওর দিদি একটু একটু করে খাইয়ে দিচ্ছে। এক এক চামচে তুলছে, ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে পাখির ঠোঁটে পুরে দিচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি। এমনকী ওর দিদির নাকের নাকছাবির হিরের ঝিলিকটি পর্যন্ত চোখের সামনে খেলে যাচ্ছে। কী অদ্ভুত মিল দুজনের মুখের। আমি ওকে দেখছি, ওর দিদির মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমরা তিনজন একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়েছি। ভোরে আমার এসরাজের সঙ্গে গলা সেধেছে। সে মিলন আর সে বিচ্ছেদ কোথায়? সেই রাত, সেই দিন, মাস, বৎসর কোথায়?
বোহ ফিরাক অওর বোহ্ বিসাল কহাঁ ॥
বোহ্ শব ও রোজ ও মাহ্ ও সাল কহাঁ ॥
মাতুল চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন, আমি ক্ষমা চাইছি।
মাথা নিচু করে প্রণাম করতেই পিতা পিঠে হাত রেখে বললেন, বড় রোগা হয়ে গেছ। সে যত্ন আর কোথায় পাবে? আমিও একটু কাব্য করে বলি, যারা ছিল তারা আর নেই, যারা পড়ে আছে, তারাও তো থাকবে না চিরদিন, কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে পারি, তারপর তুমি একা। তোমার শাস্তি, আমাদের গান শোনাও। আজ হল গজলের রাত। কী বিনয়দা, অসুবিধে হবে না তো?
কিছুমাত্র না। সেই সকাল থেকে পড়িয়ে পড়িয়ে নিজেকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে। টিয়াপাখি।
হ্যাঁ, ওই আধিভৌতিক, আধিদৈবিক কিছুক্ষণ জিরেন পাক।
প্রতাপ রায় বললেন, কিন্তু সেই গল্পটা?
ও, সেই গল্প! তুমি ঠিক মনে রেখেছ দেখছি! সেই ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিনের গল্প। পিতা হাসতে লাগলেন। আমি ফরাস বিছোতে শুরু করলুম। আসর বসবে।