মাতৃভাষা, ইংরেজী ও হিন্দী
এ বিষয়ে মতভেদের অবকাশ কম যে, শিক্ষার প্রধান বাহন হওয়া উচিত মাতৃভাষা। শুধু বিদ্যালয়ে নয়, উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রেও এ ব্যবস্থাই যথাসম্ভব শীঘ্র চালু হওয়া একান্ত। বাঞ্ছনীয়। যে-ভাষায় আমাদের মনে অভিজ্ঞতা প্রথমে আকার গ্রহণ করে, জীবনের। বিচিত্র সমস্যা যে-ভাষায় আমাদের চেতনায় স্বভাবত উদিত হয়, যে-ভাষা আমাদের কাছে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো সহজ, সে ভাষায় বিগলিত হয়ে যে-শিক্ষা আমাদের মনে প্রবাহিত হয় সেই শিক্ষারই উপলব্ধির গভীরতম স্তরে সঞ্চার সম্ভব।
উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে এদেশে মাতৃভাষার পাশে, দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে, ইংরেজীরও একটি স্থান থাকা বাঞ্ছনীয়। কারো কারো মতে অহিন্দীভাষী অঞ্চলে মাতৃভাষার পাশে এই দ্বিতীয় স্থান হিন্দীরই প্রাপ্য, ইংরেজীর নয়। এ মত গ্রহণের অযোগ্য। হিন্দীর সাহায্যে যা পাওয়া সম্ভব মাতৃভাষার সাহায্যে তা সবই পাওয়া যায়। উপরন্তু যা-কিছু জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইংরেজীর মাধ্যমে পেতে পারি হিন্দীর কাছ থেকে তা পেতে পারি না বিশ্বের চিন্তা ও কর্মের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু হতে পারে ইংরেজী, হিন্দী নয়। এই সেতুটিকে সযত্নে রক্ষা করা আমাদের চিন্তা ও কর্মের প্রসারের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়। সাহিত্য ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইংরেজী আমাদের একটি উচ্চতর মানের নির্দেশ দেয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজীর একাধিপত্য হানিকর এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রস্তাব সাধু। কিন্তু আধিপত্য নয়, ইংরেজীর সাহচর্য আমাদের মাতৃভাষারই উন্নতিতে সহায়ক।
জাপানে শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার পরই দ্বিতীয় স্থান ইংরেজীর! এমন কি রুশ দেশ সম্বন্ধেও একথাই সত্য। আন্তজাতিক যোগাযোগের উদ্দেশ্যে এসব দেশে ইংরেজী একটি বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে। জাপান অথবা রুশদেশের চেয়েও আমাদের দেশে ইংরেজীর প্রয়োজন আরও বেশী। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা হিসেবেই নয়, ভারতের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগের অন্যতম ভাষা হিসাবেও এদেশে ইংরেজীকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
আন্তর্ভারতীয় যোগাযোগের একমাত্র ভাষা হিসাবে হিন্দীকে নির্বাচন করবার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।
এদেশের বিদ্বজ্জনসমাজে এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের চিন্তার আদান-প্রদান চলে আজ প্রধানত ইংরেজীর মাধ্যমে। একটি উদাহরণ ধরা যাক। পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনা সারা ভারতের পরিকল্পনা। দেশজোড়া অর্থনীতিবিদদের এ বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং চলা প্রয়োজন। যে সমস্ত সাপ্তাহিক, মাসিক এবং ত্রৈমাসিক কাগজে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের। অর্থনীতিজ্ঞদের উচ্চাঙ্গ আলোচনা চলছে সেকাগজগুলির ভাষা প্রধানত ইংরেজী। শুধু অর্থনীতি বিষয়ে নয়, জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি বিষয়েই এ-ধরনের ভারতীয় পত্রিকার প্রয়োজন আছে, যাতে কলকাতার বিদ্বজ্জন, মাদ্রাজ বা দিল্লীর সমধর্মীর প্রবন্ধ পড়তে পারবেন ও সরাসরিভাবে পাল্টা বক্তব্য জ্ঞাপন করতে পারবেন। এখন ধরা যাক যে, আন্তভারতীয় চিন্তার আদান-প্রদানে ইংরেজীর স্থলে হিন্দী প্রতিষ্ঠিত হলো। বাংলার বিদ্বজ্জন সর্বভারতের জন্য এবার লিখতে বাধ্য হবেন হিন্দী ভাষায়। অবশ্য বাংলা বা অন্য যে-কোনো ভাষা থেকে হিন্দীতে অনুবাদ সম্ভব। কিন্তু আলোচনা এবং উত্তর প্রত্যুত্তরের যে সচল ধারা অবিরাম চলছে তার জন্য একটি প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ভাষা অপরিহার্য। যদি এই প্রত্যক্ষ যোগাযোগের একমাত্র ভাষা হিসাবে হিন্দী গৃহীত হয় তবে অহিন্দী ভাষীর পক্ষে হিন্দী ভাষার সঙ্গে শুধু সাধারণ পরিচয়ের সম্পর্ক স্থাপন করা যথেষ্ট হবে না; হিন্দী ভাষায় নিজের চিন্তাকে নিপুণভাবে প্রকাশ করে হিন্দীভাষী পণ্ডিতদের সঙ্গে সমপর্যায়ে তর্ক চালিয়ে যাবার যোগ্য হিন্দী জ্ঞান তাঁকে লাভ করতে হবে। তিনটি ভাষার সঙ্গে সাধারণ পরিচয় লাভ খুব কঠিন নয়; কিন্তু তিনটি ভাষায় নিপুণভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারা বুদ্ধিমান লোকের পক্ষেও প্রায়ই অসম্ভব। যদি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা অর্জনের জন্য অহিন্দীভাষী বিদ্বান ব্যক্তি হিন্দীর প্রয়োগে পাণ্ডিত্য ও কৌশল অর্জন করতে বাধ্য হন তা হলে মাতৃভাষা অথবা ইংরেজী অথবা দুই-ই অবহেলিত হতে বাধ্য এবং যেহেতু মাতৃভাষা অথবা ইংরেজীকে সর্বাংশে অবহেলা করা সহজ হবে না, অতএব মাতৃভাষা যাঁদের হিন্দী তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অহিন্দীভাষী অসুবিধা এড়াতে পারবেন না।
যদি হিন্দী ভারতবর্ষের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃত হয় তা হলে এই বিপদ বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে। হিন্দী রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হলে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর হিন্দীভাষীদের কর্তৃত্ব স্থাপন অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। এ আশঙ্কা বিশেষভাবে প্রবল এই কারণে যে, হিন্দীভাষীরা ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভারে শক্তিশালী। এই বিশেষ গোষ্ঠীর ভাষাই যদি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হয় তবে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক জীবনের উপর এদের আধিপত্য প্রতিরোধ্য হবে।
এই আশঙ্কার উত্তরে কেউ কেউ কেন্দ্রীয় সরকারী পরীক্ষায় চোদ্দটি ভারতীয় ভাষার সমান ব্যবহার এবং কেন্দ্রীয় শাসনকার্যে কর্মচারী নিয়োগে এক ধরনের প্রাদেশিক বাঁটোয়ারা ব্যবস্থার প্রস্তাব তুলেছেন। এ-ব্যবস্থার নানা অসুবিধা আছে; কিন্তু অন্যান্য অসুবিধার কথা ছেড়ে দিয়েও এব্যবস্থার দ্বারা শাসনযন্ত্রের উপর হিন্দী ভাষাভাষীদের কর্তৃত্ব রোধ করার চিন্তা অবাস্তব। সরকারী পরীক্ষা ও নিয়োগ প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু মাত্র। আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতা কর্মজীবনে। যদি হিন্দী একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হয় তবে সারা কর্মজীবনেই হিন্দী ভাষাভাষীরা তাঁদের মাতৃভাষার সৌভাগ্যে একটি বিশেষ সুবিধার অধিকারী হবেন। অহিন্দীভাষীদের অসুবিধা প্রাদেশিক বিদ্বেষ ও তিক্ততার সৃষ্টি করবে। এই বিদ্বেষের পরিমণ্ডলে প্রাদেশিক বাঁটোয়ারা ব্যবস্থা দেশবিভাগের চিন্তার দিকেই আবার আমাদের ঠেলে নিয়ে যাবে।
কেউ কেউ এই প্রসঙ্গে ভারতের প্রধান চোদ্দটি ভাষাকেই কেন্দ্রীয় সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করবার কথা বলে থাকেন। এ প্রস্তাবও সম্পূর্ণ কার্যকরী নয়। কেন্দ্রীয় দপ্তরে যদি প্রতিদিন বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বিভিন্ন ভাষায় চিঠিপত্র, রিপোর্ট ইত্যাদি আসতে থাকে তো চোদ্দটি ভাষা থেকে ক্রমাগত একটি দুটি ভাষায় এই চিঠিপত্রাদির অনুবাদ প্রয়োজন হবে, কারণ কোনো মন্ত্রী বা অধস্তন কর্মচারী চোদ্দটি ভাষা বুঝতে পারবেন আশা করা যায় না। কেন্দ্রীয় সরকারের যে-সব বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন অঞ্চলের জনসাধারণের অবগতির জন্য পাঠানো হয় সেগুলি অবশ্য সেই সেই অঞ্চলের প্রধান ভাষাসমূহে লিপিবদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অনুবাদের কাজে একটা সীমা থাকাও প্রয়োজন। প্রাদেশিক সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের ভিতর নিত্যনৈমিত্তিক পত্রাদি বিনিময়ে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আভ্যন্তরীণ কাজে যে বিপুল বহরের লিখন-পঠন প্রতিনিয়ত চলছে তাতে চোদ্দটি ভাষাকে এক সঙ্গে ব্যবহার করা কোনো কার্যকরী ব্যবস্থাই নয়। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় দপ্তর একটি অতিকায় অনুবাদের যন্ত্রে পরিণত হতে চলবে। এতে যে পরিমাণে অর্থ এবং সময় ক্ষয় হবে তা যুক্তিযুক্ত নয়।
সমস্যা তা হলে এই : কেন্দ্রীয় শাসনকার্যে চোদ্দটি ভাষার সমান ব্যবহার সম্ভব নয়; অথচ একমাত্র হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করবার ফলাফল গুরুতর। ভারতের অন্যান্য সকল ভাষার মতো হিন্দীরও সমৃদ্ধি আমাদের কাম্য। হিন্দী বিদ্বেষ সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু হিন্দীকে যদি সর্বভারতীয় রাজাসনে অধিষ্ঠিত করতে হয় তো তার ফলাফল সম্বন্ধে নির্মোহ ধারণা রাখাই শ্রেয়। হিন্দীকে ভারতের একমাত্র যোগাযোগের ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করবার ফলে বাংলা, গুজরাতী ইত্যাদি অহিন্দী অথচ হিন্দীর। নিকটবর্তী ভাষাগুলি আগামী পঞ্চাশ বছরে ক্রমশ ক্ষয় পাবে, এবং খড়ীবোলী হিন্দীর তুলনায় আজ মৈথিলীর যে অবস্থা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিন্দীর তুলনায় বাংলা ইত্যাদি অন্যান্য ভাষাও প্রায় সেই অবস্থাতেই প্রাপ্ত হবার পথে ক্রমে অগ্রসর হবে।
কারও মনে হতে পারে যে, বাংলা-গুজরাতী-পাঞ্জাবী-মারাঠী ইত্যাদি ভাষার ভবিষ্যৎ অবলুপ্ত করেও হিন্দীর ভিত্তিতে এক জাতি, এক প্রাণ, একতার বনিয়াদ সুদৃঢ় করা দূরদর্শিতা। কিন্তু এ চিন্তা যাঁদের মনে স্থান পেয়েছে তাঁদেরও একটি কথা বিচার করে দেখতে বলি। হিন্দীকে ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করবার ফলে সত্যি কি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে? ঐক্যের স্থলে অনৈক্য প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনাই কি বেশী নয়? হিন্দী অঞ্চলের সঙ্গে অহিন্দী অঞ্চলের উত্তর ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের–অনৈক্য কি এই ব্যবস্থার ফলে অনিবার্য হয়ে উঠবে না? এ বিষয়ে শ্রীরাজাগোপালাচারির সতর্কবাণী উপেক্ষণীয় নয়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ একবার বিভক্ত হয়েছে; ভাষার ভিত্তিতে আবারও বিভেদ ডেকে না আনাই মঙ্গল।
ভারতীয় ঐক্যের জন্যে প্রয়োজন এমন একটি ভাষাকে কেন্দ্রীয় শাসনকার্যের প্রধান ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা যে-ভাষা কোনো অঞ্চলবিশেষের ভাষা নয়। ভারতবর্ষে এমন। ভাষা আজ দু’টিই আছে; ইংরেজী ও সংস্কৃত। সংস্কৃতের স্থান গৌরবময় কিন্তু নানা কারণে আজ সংস্কৃতের মাধ্যমে এই বিরাট দেশের শাসনকার্য চালানো অসম্ভবপ্রায়। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় শাসনকার্যের ভাষা হিসাবে ইংরেজীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য চালু রাখাই সমীচীন মনে হয়।
বলা হয়েছে যে, ইংরেজী এদেশের অধিকাংশের পক্ষে অবোধ্য। তথ্য হিসাবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু ইংরেজীকে কেন্দ্রীয় দপ্তরের ভাষা হিসাবে বহাল রাখবার ব্যাপারে এই তথ্যটি কতখানি প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ তাও বিচার করে দেখা দরকার।
কেন্দ্রীয় দপ্তরে অথবা শাসনযন্ত্রে যাঁরা নিযুক্ত হবেন তাঁরা কিছু পরিমাণ উচ্চ শিক্ষা। লাভ করেই আসবেন। যেহেতু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজীর একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। রক্ষা করাই বাঞ্ছনীয় এবং সর্বস্বীকৃত নীতি, অতএব কেন্দ্রীয় শাসনযন্ত্রে নিযুক্ত কর্মচারীদের এতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
প্রতি প্রদেশে সেই প্রদেশের প্রধান ভাষায় শাসনকার্য চলবে এ প্রস্তাব আজ স্বীকৃতি লাভের পথে। জনসাধারণের সঙ্গে শাসন ব্যবস্থার সাক্ষাৎ যোগাযোগ প্রধানত প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে। কেন্দ্রীয় দপ্তরে যে-ভাষাই গৃহীত হোক না কেন, প্রদেশে-প্রদেশে শাসনকার্যের ভাষা হবে জনসাধারণের বোধগম্য। কেন্দ্রীয় সরকারের যে-সব বিজ্ঞপ্তি জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রচারিত সে-সব বিজ্ঞপ্তি দেবনগরী লিপিতে এবং হিন্দী ভাষায় প্রকাশিত হলে অহিন্দীভাষী অঞ্চলে জনসাধারণের অবোধগম্যই থেকে যাবে। কাজেই এ ধরনের বিজ্ঞপ্তিগুলি যে যে অঞ্চলে প্রেরিত হবে, যথাসম্ভব সেই সেই অঞ্চলের প্রধান ভাষাতে লিপিবদ্ধ হওয়াই সমীচীন। লোকসভায় সভাপতির অনুমতি সহ যে-কোনো ভাষায় বক্তৃতা দেবার অধিকার তো থাকাই বাঞ্ছনীয়।
বৈচিত্রের ভিতর ঐক্যের প্রতিষ্ঠা, বহুর ভিতর সমন্বয়ের স্থাপনা ভারতের আদর্শ, এমন একটি কথা বহুবার বলা হয়েছে। ভাষা সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এই কথাটিই নূতন করে ভেবে দেখা আবশ্যক। এদেশে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিন্দু ধর্মের পাশে মুসলমান ধর্মকে গ্রহণ করে নিয়েছে। খৃষ্টধর্মকেও আমরা বিজাতীয় জ্ঞানে বিতাড়িত করিনি। এই গ্রহণধর্মিতাই ভারতীয় ঐতিহ্যের গৌরবের দিক। ভাষার ক্ষেত্রেও এই উদার গ্রহণধর্মিতাই আমাদের সমস্যা সমাধানের পথে একমাত্র নির্ভরযোগ্য নীতি। বহুধর্মের মতো বহু ভাষাকেও আমাদের অকুণ্ঠিত স্বীকৃতি দিতে হবে। এ-দেশে যুগের পর যুগ নূতন নূতন সভ্যতার স্রোত বয়ে গেছে। দ্রাবিড় সভ্যতার উপর আর্যসভ্যতার পলিমাটি পড়েছে। তারপর মুসলমান এসেছে, ইংরেজ এসেছে। বহু সভ্যতার বিবিধ উপাদান নিয়ে এদেশের বিচিত্র সভ্যতা। এর কোনো একটি উপাদানকে বর্জন করতে গেলে অবশিষ্ট উপাদানগুলির ভিতর ভারসাম্য ভঙ্গ হয়ে নৃতন সংঘর্ষ সৃষ্টির আশঙ্কা। যে মনোবৃত্তি আজও ইংরেজীকে “বিদেশী ভাষা বলে বর্জন করবে, সেই মনোবৃত্তিই হয়তো কাল খৃষ্টান এবং মুসলমান ধর্মকেও বিজাতীয় আখ্যা দেবে। এই বর্জনধর্মী, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য হলো এক হিন্দুধর্ম এবং হিন্দী ভাষার উপর হিন্দুস্থানের ঐক্য প্রতিষ্ঠা। উত্তর ভারতের এই সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার দক্ষিণী প্রতিধ্বনি আর্যবিরোধী উগ্র দ্রাবিড় আন্দোলনে। এই সাম্প্রদায়িকতা ভারতবর্ষকে শুধু আভ্যন্তরীণ হানাহানি এবং মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে। এদেশের ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সমম্বয়ধর্মিতা সৌখিনতা নয়, অথবা শুধু ঔদার্য বলেই আদরণীয় নয়, বরং সুস্থ জীবনযাত্রার অতি প্রয়োজনীয় পাথেয়।
প্রগতির পথ (১৯৬৮)