কাল শুতে শুতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। সকাল হলেই নৌকোয় করে সুজনগঞ্জের হাটে যাবে, সেই উত্তেজনায় বাকি রাতটুকু ভাল করে ঘুমোতে পারেনি বিনু। শিয়রের দিকে একটা জানালা, বার বার তার বাইরে তাকিয়ে দেখেছে–কখন সকাল হয়, কখন সকাল হয়।
সারারাত চোখ টান টান করে থেকে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল বিনু, হেমনাথের ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসল।
রগড়ে রগড়ে চোখ থেকে ঘুমের শেষ রেশটুকু মুছে বিনু যখন তাকাল, পুব আকাশে আলো আলো আভা ফুটেছে।
হেমনাথ বললেন, চল দাদা, মুখটুখ ধুয়ে সূর্যস্তবটা সেরে নিই।
বিনুর মনে পড়ল, কাল হেমনাথ বলেছিলেন তাকে সূর্যস্তব শিখিয়ে দেবেন। তক্তপোশ থেকে নামতে গিয়ে দেখতে পেল স্নেহলতা বিছানায় নেই। কখন তার ঘুম ভেঙেছে, কখন উঠে বেরিয়ে গেছেন, কে জানে।
বাইরে এসে বিনুরা মুখটুখ ধুয়ে নিল। তারপর উঠোনের একধারে দোলমঞ্চের কাছে গিয়ে পুবদিকে মুখ করে চোখ বুজে হাত জোড় করে দাঁড়াল। তারও পর হেমনাথের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আবৃত্তি। করতে লাগল, ওঁ জবাকুসুমং সঙ্কাশং–
সূর্যমন্ত্র শেষ করে ফিরতেই দেখা গেল অবনীমোহন আর সুরমা উঠে পড়েছেন। উঠোনের একধারে দাঁড়িয়ে দাঁতন করছিলেন অবনীমোহন। চোখাচোখি হতে হেসে বললেন, দাদুর কাছে এসে বিনুবাবু দেখছি গুড বয় হয়ে যাচ্ছে। কলকাতায় তো আটটার আগে বিছানা ছাড়ত না। এখানে ভোর না হতেই ঘুম ভাঙছে। শুধু তাই নয়, সূর্যস্তবও আওড়ানো হচ্ছে।
বিনু লজ্জা পেয়ে গেল। হেমনাথ কিছু না বলে হাসলেন।
দেখতে দেখতে যুগল করিম শিবানী সুধা সুনীতি–একে একে সবাই উঠে পড়ল।
এ বাড়িতে এতকাল চায়ের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ, অবনীমোহনরা আসার পর এই পর্বটা নতুন শুরু হয়েছে।
চিঁড়েভাজা নারকেল কোরা আর ক্ষীরের নাড়র সঙ্গে চা খাওয়া যখন শেষ হয়েছে সেই সময় হইহই করতে করতে লারমোর এসে হাজির, হেম অবনী বিনুদাদা-সবাই রেডি তো?
হেমনাথ বললেন, ঘোড়ায় একেবারে জিন দিয়ে এসেছ, দেখছি।
ওই রকমই। সুজনগঞ্জ কি এখানে? সাত মাইল উজানে গেলে, তবে। যেতে কতক্ষণ লাগবে, খেয়াল আছে? নাও নাও, তাড়াতাড়ি উঠে পড়।
স্নেহলতা এই সময় বলে উঠলেন, একটু চা খেয়ে যান।
লারমোর আঁতকে ওঠার মতো করে বললেন, কি সর্বনাশ, আমি পি.সি.রায়ের ইনডাইরেক্ট শিষ্য। আমাকে চা খাবার কথা বলছেন!
অবনীমোহন বললেন, ইনডাইরেক্ট শিষ্য কিরকম?
লারমোর জানালেন, চায়ের ব্যাপারে হেমনাথ পি. সি. রায়ের সাক্ষাৎ শিষ্য। আমি আবার হেমনাথের শিষ্য। ইনডাইরেক্ট হলাম না?
লারমোরকে চা খাওয়ানো গেল না, বসানোও না। চিঁড়েভাজা ক্ষীরের নাড়ু খাবার কথা বলতে খানিক চঞ্চল হলেন তিনি। তারপর হাত বাড়িয়ে বললেন, দিন, এখন খাব না। সঙ্গে নিচ্ছি। রাস্তায় যেতে যেতে খাব।
স্নেহলতা বেতের ডালা বোঝাই করে চিঁড়েভাজা আর নাড়ু দিলেন। লারমোর সেগুলো ঢেলে ফতুয়ার পকেট ভর্তি করে নিতে নিতে তাড়া লাগালেন, চল হেম, চল–
হেমনাথ অবনী বিনু–যারা হাটে যাবে, উঠোনে নেমে এল।
এই সময় স্নেহলতা স্বামীর উদ্দেশে বললেন, হাটে তো চললে, কী কী আনতে হবে মনে আছে?
হেমনাথ বললেন, নিশ্চয়ই আছে। একটা কোষা নৌকো, একজোড়া হালের বলদ, আনাজ, মাছ, মশলাপাতি-এই তো?
স্নেহলতা বললেন, উঁহু, আরও আছে। এই মাসে নিত্য দাসের মেয়ের সাধ, তার জন্যে একখানা শাড়ি আনবে। ঠাকুরঝির কাপড় নেই, দুজোড়া থান কিনতে হবে। দুর্গাপুজো সামনে, নারকেল আট দশ গন্ডা এনো–
তালিকা শেষ হবার আগেই হেমনাথ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন, যুগল–যুগল—
যুগল কাছেপিঠে কোথাও ছিল, ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। হেমনাথ বললেন, তোর ঠাকুমা কী কী বলে শুনে নে। হাটে গিয়ে মনে করে কিনবি। একটা যদি ভুল হয়ে যায়, আস্ত রাখব না।
স্নেহলতা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন, দেখ, দেখ তোমরা। সংসারটা কার আর কাকে মনে করে। জিনিস কিনতে হবে? বলে স্বামীর দিকে ফিরে মধুর ভঙ্গ করলেন।
হেমনাথ রেগে উঠলেন, কেন, যুগল এ সংসারের কেউ নয়? ক’টা জিনিসের কথা মনে করে রাখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? বলে আগুন হয়ে যুগলের দিকে ফিরলেন, কি রে হারামজাদা, বল তুই কোন সংসারের লোক?
যুগল উত্তর দিল না। মুখ নিচু করে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উঠোনের মাটি তুলতে লাগল। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, হেমনাথের এ জাতীয় রাগটাগ তার কাছে নতুন নয়, বরং এতেই চিরদিন অভ্যস্ত সে।
বিনুর কেন যেন সন্দেহ হল, মুখ নামিয়ে যুগল হাসছে। মাথা হেলিয়ে একবার যুগলের মুখটা দেখতে চেষ্টা করল সে। হেমনাথের রাগ যুগলের কাছে হয়তো ভয় বা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয়, রীতিমত মজাদার ঘটনা।
হেমনাথ আরও উত্তেজিত হতে যাচ্ছিলেন, লারমোর মাঝখান থেকে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, এই সকালবেলা আর তোমাকে চেঁচামেচি করতে হবে না হেম। আমিই সব মনে করে রাখছি। বলুন গো বৌ ঠাকরুন, হাট থেকে কী আনতে হবে– বলতে বলতে স্নেহলতার দিকে তাকালেন।
স্নেহলতা মুখ বাঁকিয়েই ছিলেন। বললেন, থাক, যথেষ্ট হয়েছে। খোঁড়ার সাহায্যে ল্যাংড়া এগিয়ে এলেন। ভুলে টুলে গিয়েও ও তবু কিছু আনত। আপনাকে বললে কিছুই আর এসে পৌঁছবে না।
তা যা বলেছেন– লারমোর হাসতে লাগলেন।
স্নেহলতা বললেন, যা বলবার যুগলকেই আমি বলে দিচ্ছি।
হাটের ফর্দ শুনে নিয়ে যুগল নিচু গলায় বিনুকে বলল, দেখলেন তো ছুটোবাবু, বড়কত্তায় হাটে গ্যালে আমারে লগে যাইতেই হয়।
একটু পর হেমনাথদের পিছু পিছু বিনু পুকুরঘাটে চলে এল। ঘাটের পাড়ে দু’টো নৌকো লগির সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। একটা নৌকো বেশ বড় সড়, লম্বা ধাঁচের। মাঝখানে কাঁচা বাঁশের গোল ছাউনি। যুগল যে ছই’-এর কথা কাল বলেছিল, খুব সম্ভব ওটা তাই। গলুইর কাছে পাটাতনের ওপর দুটো মাঝি বসে আছে। এই নৌকোটা বোধহয় লারমোর নিয়ে এসেছেন। অন্য নৌকোটা বিনুর চেনা, তাতে গলুই বা ছাউনি কিছুই নেই, তেমন লম্বাও নয়, অনেকটা গোল ধরনের। প্রায় সারা দিনই। এ নৌকোটা এই ঘাটে বাঁধা থাকে।
ছাউনিহীন নৌকোটায় এক লাফে উঠে পড়ল যুগল, তারপর চোখের ইশারায় বিনুকে উঠতে বলল।
এদিকে লারমোর, হেমনাথ আর অবনীমোহন দ্বিতীয় নৌকোটায় উঠে পড়েছেন। হেমনাথ বিনুকে ডাকলেন, আয় দাদা
বিনু বলল, আমি যুগলের নৌকোয় যাব।
না না, ও বাঁদরের সঙ্গে যেতে হবে না। চারদিকে অথৈ জল, শেষে বিপদ আপদ ঘটে যাবে। ওটার আবার হুঁশটুশ কম।
বিনু কিন্তু শুনল না। কেঁদে টেদে জেদ ধরে ফুগলের নৌকোতেই উঠল। অগত্যা হেমনাথ যুগলকে সতর্ক করে দিলেন, সাবধানমতো দাদভাইকে নিয়ে যাবি।
আইচ্ছা– যুগল ঘাড় কাত করে বলল, আপনে ভাইবেন না।
একসময় বাঁধন খুলে নৌকো চলতে শুরু করল। হেমনাথদের নৌকোটা আগে আগে চলেছে, বিনুদেরটা পেছনে।
দু’জন মাঝি হেমনাথদের নৌকো বাইছে। চোখের পলকে পুকুর পেরিয়ে সেটা ধানখেতের ভেতর ঢুকে গেল। বিনুদের নৌকোটা এখনও মাঝপুকুরেই রয়েছে। হঠাৎ ঝুমঝুম ঘুন্টির আওয়াজে যুগল এবং বিনু পেছন ফিরে তাকাল। দেখা গেল, বাগানের গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে ঝিনুকদের সেই চমৎকার ঝকঝকে ফিটনটা বাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে। গাড়ির জানালায় ভবতোষ আর ঝিনুকের মুখও দেখতে পাওয়া গেল।
যুগল বলল, বড়কত্তায় তো বাইর হইল, উইদিকে ঝিনুক দিদিরা আইছে।
সেই কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, রুপোর কাজললতার মতো চোখ, গোলগাল জাপানি পুতুলের মতো মেয়েটা আবার এসেছে। বিনু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।