১.১২ অতি পুরাতন ভৃত্য

অতি পুরাতন ভৃত্য

(লুথরা হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার আশিক আহমেদ)

হুইস্কি, রাম, ভদকা, ওয়াইন, ব্র্যান্ডি। পরিপাটি সাজানো সুদৃশ্য ড্রয়িং রুমের লিকার ক্যাবিনেটে। দেশি নয়, বহুমূল্য বিদেশি ব্র্যান্ডের সব। সাধারণ পানীয়পিপাসুর নাগালের বাইরে।

হইহুল্লোড়ের পার্টি শেষে যেমন চেহারা হয় উচ্চবিত্তের বসার ঘরের। সোফার কুশন অবিন্যস্ত। কাচের সেন্টার টেবলে প্লেট গোটাতিনেক, কাঁটাচামচ সমেত। একটায় চিকেন রেশমি কাবাব দু’ টুকরো। পনির পকোড়ার আধখাওয়া অংশ আর একটায়। শসা-পেঁয়াজ-টমেটোর কয়েক কুচি তিন নম্বর প্লেটে। ফেলে ছড়িয়ে খাওয়ার পর যেমন পড়ে থাকে অবশিষ্ট। হাত মোছার পর দাগ ধরে যাওয়া পেপার ন্যাপকিন পড়ে ইতিউতি। দুটো গ্লাসে সোনালি তরলের তলানি, হুইস্কি।

তিনটে রংবেরং মোমবাতি জ্বলছে টেবিলে। গড়পড়তা সাইজের নয়, পেল্লায়। ক্রিকেটের উইকেটের থেকে একটু ছোট। পুড়তে সময় লাগে বেশ কয়েক ঘণ্টা। নেভেনি এখনও, জ্বলছে।

এহ বাহ্য। বিশাল ফ্ল্যাটের তিনটে প্রশস্ত বেডরুমের একটার দৃশ্য আমোদপ্রমোদের চিহ্নহীন। একটা লেপে বুক অবধি মোড়ানো, মহিলা পড়ে আছেন মেঝেতে। প্রাণ নেই আর, ঝলকের দেখাতেই বোঝা যায় দিব্যি। ডাক্তার না হলেও চলে।

বয়স যে পঞ্চাশ ছাড়িয়ে একান্ন, বোঝাই যায় না। দেখলে মনে হবে, খুব বেশি হলে কত আর, মাঝচল্লিশ। বয়সানুপাতে মহিলার চেহারা নির্মেদ। শরীরচর্চার অভ্যেস ছিল?

নিজেকে বাঁচাতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আততায়ীর কাছে বিনা যুদ্ধে জমিও ছাড়েননি, স্পষ্ট। লড়েছিলেন আপ্রাণ, প্রমাণ ধরা রয়েছে ডান হাতের মুঠোর মধ্যে আটকে থাকা কয়েক গাছি চুলে। এ চুল খুনির, বুঝতে গোয়েন্দা হওয়ার প্রয়োজন নেই। গলায় শুধু ফাঁসের দাগ নয়। হুক জাতীয় কিছুর আঁচড়ও দেখা যাচ্ছে। নখের কোণে ময়লার ছোপ। নিশ্চিত, ওই ছোপও ঘাতককে প্রতিরোধকালীন। বাঁচতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন, জানান দিচ্ছে চোখ-মুখ-ঘাড়-গলায় আত্মরক্ষাজনিত আঘাতের আভাস।

শ্বাসরোধ করে খুন, নির্মম এবং পরিকল্পিত। কে এভাবে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলল? কে, না কারা?

একটা ল্যাডার দরকার।

হ্যাঁ, তা ছাড়া তো আর উপায়ও নেই। দাঁড়ান, দেখছি।

দুধের প্যাকেটগুলো পড়ে আছে ফ্ল্যাটের বাইরে, মাটিতে। রোজ বাস্কেট থাকে রাখার জন্য। আজ নেই। অযত্নে পিঠোপিঠি পড়ে আছে টাইমস অফ ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা আর ইকনমিক টাইমস। দুধ যিনি দেন রোজ, কাগজ যিনি বিলি করেন দৈনিক, বেল বাজিয়ে বাজিয়ে ধৈর্য হারিয়ে চলে গিয়েছেন। আরও কত বাড়ি যাওয়ার আছে। সময় কোথায় অপেক্ষার? অন্যদিন একবার বেল বাজালেই দরজা খুলে দেয় নিক্কু। দীর্ঘদিনের কর্মচারী এ বাড়ির। আজ খোলেনি।

ঝাঁকা নিয়ে সবজিওয়ালা অবশ্য অপেক্ষায়। এ বাড়ি তার চেনা। ‘বালিগঞ্জের ভাবি’ প্রতি সপ্তাহেই টেলিফোনে অর্ডার দেন টাটকা শাকসবজির। যদুবাবুর বাজারের ‘মাইতি ভেজিটেবলস’-এর কর্মীকে হুকুমমাফিক সবজি দিয়ে যেতে হয় ফি হপ্তায়। অপেক্ষায় আরও দু’জন। কাজের লোক রাধা আর ড্রাইভার আয়ুব। সকাল ন’টা বেজে গেল। এমন হয়নি কখনও, হওয়ার তো কথা নয়। মেমসাহেবের যদি ঘুম কোনও কারণে না-ও ভেঙে থাকে, নিক্কু তো অন্তত খুলবে। সে কী করছে?

উলটোদিকের ফ্ল্যাট থেকে চিন্তিত মুখে বেরিয়ে এলেন অশোক পোদ্দার। অসিতমোহন লুথরা ব্যবসার কাজে দক্ষিণ ভারত গিয়েছিলেন গত পরশু। ভাইজ্যাগ থেকে ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে গত সন্ধেতেও। আজ সকাল থেকে মোবাইলে ফোন করে যাচ্ছেন সহধর্মিণীকে। নো রিপ্লাই। ল্যান্ডলাইনও নিরুত্তর। উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করেছেন প্রতিবেশী মিস্টার পোদ্দারকে। —দেখুন না একটু, কী হল?

ঘড়ির কাঁটা তখন সোয়া ন’টা ছাড়িয়েছে। অশোকের ফোনেই আয়ুবের সঙ্গে কথা বললেন অসিত লুথরা।

—গাড়িগুলো গ্যারেজে আছে?

—আছে সাব।

‘গাড়িগুলো’ বলতে দুটো। একটা টয়োটা করোলা, অন্যটা হন্ডা সিটি। দরজা খুলছে না দেখে আধঘণ্টা আগেই একতলার গ্যারেজে ঢুঁ মেরে এসেছেন আয়ুব। এই ভেবে, মেমসাহেব নিজেই কোথাও বেরিয়েছেন হয়তো জরুরি কাজে। সাহেব-মেমসাহেব দু’জনেই তো ভাল ড্রাইভিং জানেন।

গাড়ি গ্যারেজেই? দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল মিস্টার লুথরার।

—আয়ুব, এক্ষুনি পারভিন ম্যাডামের বাড়ি যাও। খোঁজ নাও ওখানে আছে কি না।

—জি সাব।

ডোভার রোডে বাড়ি তলোয়ার দম্পতির। সুদেশ আর পারভিন। দু’জনেই সদ্য পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। সুদেশের ব্যবসা চামড়ার সামগ্রী রফতানির। স্ত্রী পারভিন বাড়িতেই জিম চালান বেশ কয়েকবছর ধরে। লুথরা পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা তলোয়ারদের। একে অন্যের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত। পারভিনের জিমে সপ্তাহে তিনদিন ঘাম ঝরাতেন অসিতের স্ত্রী রবিন্দর কউর লুথরা।

না, তলোয়ারদের বাড়িতেও নেই। আয়ুবের সঙ্গেই সুদেশ-পারভিন ছুটে এলেন লুথরাদের ফ্ল্যাটে। ভিড় জমে গিয়েছে ততক্ষণে কেয়ারটেকার আর নিরাপত্তাকর্মীদের। বেরিয়ে এসেছেন অন্যান্য ফ্ল্যাটের আবাসিকরাও। কৌতূহল-উদ্বেগ-আশঙ্কা, গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ।

জি প্লাস সেভেন বহুতল। আটতলায়, টপ ফ্লোরেই ফ্ল্যাট লুথরাদের। মূল দরজায় অটোমেটিক লক। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে ছাদে। ছাদের মাঝামাঝি একটা বেশ উঁচু দেওয়াল। টপকে এদিক-ওদিক পারাপার অসম্ভব। দেওয়ালটা ছাদকে ভাগ করে দিয়েছে। পশ্চিম অংশটা লুথরাদের ব্যক্তিগত মালিকানায়। সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে কেউ যে ওই অংশে ঢুকে পড়বে, জো নেই।

ঢুকতে হলে ফ্ল্যাটের ভিতরের সিঁড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। যা বসার ঘরের পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে ছাদে। ছাদে লুথরাদের দিকের অংশে একটা গেট থাকে তালাবন্ধ, ভিতর থেকে। ফ্ল্যাটের ভিতরের সিঁড়ির মুখে একটা দরজা, তার পাশে চাবি রাখা থাকে গেটের। সেটা নিয়ে কেউ ছাদে উঠে গেট খুলে দিলে তবেই দেওয়ালের ওপার থেকে লুথরাদের অংশে আসা সম্ভব।

ছাদটা ভারী সুন্দর, চোখের আরাম। এক দিকে সার্ভেন্টস্ কোয়ার্টার, যেখানে নিক্কু থাকে। কাচ দিয়ে ঘেরা একটা ঘর পাশেই। পোষা দুটো ল্যাব্রাডর, ‘ফ্যান্ডি’ আর ‘বিগল’-এর রাত্রিবাস ওই ঘরেই। ঘাসের এক চিলতে লন, ফুলের বাগান ছিমছাম। পাথরের স্তূপের মধ্য থেকে কৃত্রিম ঝরনা। জল উছলে পড়ছে অনর্গল। মন ভাল হয়ে যায় দেখলে, আরও একটু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

তিনটে গেট আবাসনের। একটা গাড়ি এবং লোকজনের ঢোকার। একটা বেরনোর। তৃতীয়টা ইমার্জেন্সি গেট, বন্ধই থাকে সাধারণত। আবাসিকরা থাকেন দুটো ব্লকে। ‘এ’ আর ‘বি’। দুটো ব্লকই আটতলার। একতলায় পার্কিং-এর ব্যবস্থা। ‘এ’ ব্লকে প্রতি তলায় তিনটে করে ফ্ল্যাট। Unit-I, Unit –II আর Unit-III। ‘বি’ ব্লকে দু’তলায় একটা ফ্ল্যাট। বাকি ফ্লোরগুলোয় দুটো করে। নাম ওই ‘Unit’ দিয়েই। সব মিলিয়ে চৌত্রিশটা ফ্ল্যাট, দুটো ব্লক মিলিয়ে। লুথরারা থাকতেন ‘বি’-তে।

নিরাপত্তায় বিনিয়োগে কার্পণ্য করেননি আবাসিকরা। দায়িত্ব দিয়েছিলেন ‘ম্যাক সিকিউরিটি সার্ভিস’ নামের বেসরকারি নিরাপত্তাসংস্থাকে। গেটে এবং দুটো ব্লকের একতলার রিসেপশনে তিন শিফটে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারায় থাকতেন একজন সুপারভাইজার এবং তিনজন নিরাপত্তাকর্মী।

লিফট এবং সিঁড়ি, দুটো করে প্রতি ব্লকে। একটা লিফট ইমার্জেন্সির জন্য, বন্ধ থাকত। লিফটম্যান ছিল না। আবাসিকরা নিজেরাই লিফট অপারেট করতেন। রিসেপশনে বন্দোবস্ত ক্লোজ় সার্কিট ক্যামেরার। যার সংযোগ প্রতিটি ফ্ল্যাটের সঙ্গে ভিডিয়ো লিঙ্কেজের মাধ্যমে। অপরিচিত কেউ কোনও ফ্ল্যাটে যেতে চাইলে রিসেপশন থেকে ছবি পাঠানো হত সংশ্লিষ্ট ফ্ল্যাটে, জানানো হত ইন্টারকমে। সবুজ সংকেত পেলে তবেই ছাড়পত্র মিলত লিফট বা সিঁড়িতে ওঠার। রোজকার পরিচিত গৃহকর্মীদের ছাড় ছিল এই সুরক্ষাবলয় থেকে। আবাসিকদের পরিচিত আত্মীয়বন্ধুদেরও, নিয়মিত যাতায়াতে যাঁদের মুখচেনা হয়ে গিয়েছে।

ফ্ল্যাটে ঢুকতে হলে ছাদে উঠে দেওয়াল টপকানো ছাড়া উপায় নেই, ল্যাডার দরকার একটা। জোগাড় হল। ওই মই বেয়ে কোনওমতে দেওয়াল টপকালেন আয়ুব। চাবি রাখা ছিল যেখানে থাকার। ফ্ল্যাটের ভিতর দিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়ির পাশে। গেট খোলার পর বাকিরা ঢুকলেন। নিক্কু কই? নেই কোত্থাও।

পোষা কুকুর দুটো কাচের ঘরে। তালাবন্দি, অস্থির। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, চিৎকার করছে। কখনও ফ্যান্ডি আর বিগলসকে এভাবে আটকে থাকতে হয় না। প্রতিটা ঘরে দিনভর স্বচ্ছন্দ বিচরণ বাধাহীন। সোচ্চার প্রতিবাদ স্বাভাবিকই।

বসার ঘরে গ্লাস-প্লেট-পানীয় আর বেডরুমে রবিন্দর কউর লুথরার মৃতদেহ। বিবরণ দিয়েছি শুরুতে। বাড়তি যেটুকু বলার, লেপ সরিয়ে দেখা গেল, মৃতার শরীরে ফুলফুল নীলরঙা ম্যাক্সি। পায়ে মোজা। গলায় ফাঁসের দাগ ছাড়া অন্য কোনও শারীরিক হেনস্থা হয়নি।

বেডরুমের আলমারি-ড্রয়ার লন্ডভন্ড। মিসেস লুথরা হাতে হীরের আংটি পরে থাকতেন সবসময়। সেটা তো গেছেই, সঙ্গে ড্রয়ার আর আলমারিতে থাকা প্রচুর গয়নাগাটি। নগদ সাড়ে তিন লক্ষ টাকা, যা ছিল চামড়ার ব্যাগে। এবং প্রায় চারশো মার্কিন ডলার। মোদ্দা কথা, মূল্যবান যা ছিল, সব লোপাট।

পুলিশে ইনফর্ম করা দরকার ইমিডিয়েটলি, আতঙ্কের ঘোর কাটিয়ে প্রথম মুখ খুললেন অশোক পোদ্দার। সায় দিলেন সুদেশ তলোয়ার, জাস্ট আ মিনিট। লালবাজার কন্ট্রোলের নম্বর সেভ করা আছে আমার। পারভিনের কাছে নম্বর ছিল বালিগঞ্জ থানারও। ফোনের কনট্যাক্টস লিস্টে তিনিও চোখ বোলাচ্ছেন দ্রুত।

সোয়া দশটায় ফোন বাজল কলকাতা পুলিশের কন্ট্রোল রুমে। তারও মিনিটখানেক আগে বালিগঞ্জ থানায়।

—মার্ডার, শিগগিরি আসুন, অ্যাজ় আর্লি অ্যাজ় পসিবল। ওসি আছেন?

—মার্ডার? কোথায়?

ত্রিপুরা এনক্লেভ। ৫৯, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। শহরের অন্যতম অভিজাত এলাকায় উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা আবাসন। পূর্বদিকে এগোলেই বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ। পশ্চিমে হাঁটা দিলে সেন্ট লরেন্স হাইস্কুল আর বালিগঞ্জ মিলিটারি ক্যাম্প।

সিকিউরিটি এজেন্সির রমরমা ব্যবসা ছিল চুয়ান্ন বছরের অসিত লুথরার। GI Securities। পরিধি বিস্তৃত দেশের বিভিন্ন শহরে, এমনকী বিদেশেও।

মিসেস লুথরা

সুখী পরিবার। বড়ছেলে কবীরের বয়স পঁচিশ। দক্ষিণ ভারতের ব্যবসা দেখাশোনা করেন। ছোট অঙ্গদ, কুড়ির কোঠা পেরিয়েছেন সদ্য। পড়াশোনা করেন লন্ডনে। ব্যবসার কাজে মিস্টার লুথরাকে প্রায়ই ট্যুরে যেতে হয়। যেমন গিয়েছিলেন ১৩ ফেব্রুয়ারি। ফেরার কথা ছিল একুশে। ফিরতে হল ১৫ তারিখ দুপুরের ফ্লাইটে, নৃশংসভাবে স্ত্রীর খুন হওয়ার খবর পেয়ে।

ফ্ল্যাটে যার থাকার কথা ছিল এবং নেই, সেই নিক্কু যাদব বছর চব্বিশের যুবক। বিহারের বাঁকা জেলায় বাড়ি। গত সাত বছর ধরে এ বাড়িতে কাজ করছে। যখন স্রেফ ষোলো-সতেরোর কিশোর, তখন থেকে। রান্নাবান্না করে, পাশাপাশি বাজারহাট, টুকটাক ফাইফরমাশ খাটা।

আয়ুব আরও পুরনো, বয়স প্রায় ষাট। লুথরাদের গাড়ি চালায় তেরো বছর হল। মিতা এবং সরস্বতী দুই দিনরাতের কাজের লোক। দু’জনেই ছুটি নিয়েছেন গত ১১ তারিখ থেকে। সাময়িক কাজ চালাতে রাধা বলে এক মহিলাকে দিন সাতেকের জন্য রাখা হয়েছে। প্রতিবেশীদের প্রশ্নের উত্তরে যিনি জানালেন, গত রাতে সাড়ে আটটায় মেমসাহেব ছেড়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আজ সকাল-সকাল চলে আসতে। যখন রাতে রাধা ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়েছিলেন, ঘরে এক ভদ্রলোক ছিলেন। নিক্কু তো ছিলই।

খুন এই আবাসিক বহুতলেই

কে ভদ্রলোক?

প্রদীপ লাল। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, টিনের কনটেনার তৈরির জমাটি ব্যবসা। থাকেন কাছেই, রোল্যান্ড রোডে। প্রদীপ ও তাঁর স্ত্রী সুনীলার বহুদিনের সামাজিক সখ্য লুথরা-পরিবারের সঙ্গে। অসিত লুথরার সঙ্গে আড্ডা দিতে প্রদীপ এসেছিলেন গতকাল সন্ধে সোয়া সাতটায়। অসিত নেই দেখে ঘণ্টাদেড়েক গল্পগুজব করেছিলেন মিসেস লুথরার সঙ্গে। খুনের খবর পেয়ে ত্রিপুরা এনক্লেভে চলে এসেছেন সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে। গতকাল সন্ধেবেলা এসেছিলেন, নিজেই বললেন প্রতিবেশীদের।

বেশ। কিন্তু নিক্কু কোথায়? ভ্যানিশ?

ত্রিপুরা এনক্লেভ। ৫৯, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড।

রবিন্দর কউর লুথরা হত্যা মামলা। বালিগঞ্জ থানা কেস নম্বর ১৭/২০০৭। তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি। ধারা ৩০২/৩৯৪ আইপিসি। খুন ও লুঠ।

বালিগঞ্জ থানার অফিসাররা পৌঁছলেন। একটু পরেই চলে এলেন হোমিসাইড শাখার অফিসাররা। কন্ট্রোল রুম মারফত খবর ছড়িয়ে গিয়েছে।

এলে কী হবে, ঢুকতে পারলে তো! কমপ্লেক্সের প্রধান ফটক বন্ধ, সামনে জড়ো হয়েছেন আবাসিকরা। পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। প্রায় লাগোয়া বহুতল ‘সপ্তপর্ণী’-র বাসিন্দারাও খবর পেয়ে নেমে এসেছেন। শুনতে হচ্ছে, যা পুলিশকে সচরাচর শুনতে হয় এমন কোনও ঘটনার পর স্পটে গেলে।

এখন আর এসে কী লাভ, যা হওয়ার তো হয়ে গিয়েছে। কী করে আততায়ী এসে খুন করে যায় এভাবে? পুলিশের টহলদারি ভ্যানকে তো চোখেই পড়ে না এ তল্লাটে। আজ আটতলায় হয়েছে, কাল পাঁচতলায় হবে। পরশু চারতলায়।

এসবে অভ্যস্ত আমরা। বুঝিয়েসুঝিয়ে কোনওমতে ঢোকা হল। বাড়তি ফোর্স পৌঁছল লালবাজার থেকে।

ফ্ল্যাটে আঙুলের ছাপ মিলল একাধিক। আলমারিতে, গ্লাসে, সোফার হাতলে, বেডরুমের আয়নায়, ড্রয়ারে। নগরপাল প্রত্যাশিতভাবেই তদন্তের ভার দিলেন গোয়েন্দা বিভাগের হোমিসাইড শাখাকে। দায়িত্ব পড়ল তৎকালীন সাব-ইনস্পেকটর আশিক আহমেদের উপর, যিনি বর্তমানে তপসিয়া থানার ওসি।

হইচই হওয়ার কথা খবর ছড়িয়ে পড়ার পর। হচ্ছিলও। মাত্র তো বছর এগারো আগের কথা। শুরু হয়ে গিয়েছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রমরমা। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সার দিয়ে সংবাদমাধ্যমের গাড়ি। গোটাদুয়েক ওবি ভ্যানও। ‘ব্রেকিং নিউজ়’ টিভি খুললেই, ‘বহুতলে নৃশংস হত্যা, অন্ধকারে পুলিশ’ কিংবা ‘নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে লালবাজার’। এবং নানা মুনির নানা মত।

হোমিসাইড শাখা অবশ্য এসবে বিচলিত হওয়ার কারণ দেখছিল না কোনও। খুব খাটাখাটনি যাবে না কিনারায়। আগামীকাল বা পরশুর হেডলাইন চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছিলেন আশিক, ‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কিনারা মহিলা খুনের, ধৃত গৃহভৃত্য।’

সমাধান তো স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। সোজা মামলা, ‘open and shut case’। ওই নিক্কু বলে চাকরটা খুন করে গয়নাগাটি-টাকাপয়সা হাতিয়ে পালিয়েছে। মার্ডার ফর গেইন। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়, আর কতক্ষণই বা?

মোবাইল ফোন ভারতে এসে গিয়েছে ঘটনার বারো বছর আগে। মুঠোফোন তখন সবার হাতে। নিক্কুরও ছিল। পাওয়াও গিয়েছে নম্বর। যদি বন্ধও করে দেয়, শেষ টাওয়ার লোকেশন আর কল ডিটেলস নিয়ে খুঁজে বার করতে বড়জোর আটচল্লিশ ঘণ্টা। কপাল ভাল থাকলে তারও কম। কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে technical surveillance-এর। বাংলা কী হবে? প্রযুক্তি-প্রহরা?

আত্মতুষ্টির ঘোর কাটল লুথরাদের ফ্ল্যাটে বসে বেডরুমের স্কেচ ম্যাপ তৈরি করার সময়ই। ফোন বাজল ল্যান্ডলাইনে।

‘হ্যালো, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল থেকে বলছি। একজন বাইশ-তেইশের যুবককে এখানে ভরতি করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ট্রাফিকের লোক দেখতে পেয়ে অ্যাডমিট করেছে। রোড অ্যাক্সিডেন্ট, হেড ইনজুরি আছে। মানিব্যাগে আই ডি কার্ড থেকে ফোন নম্বরটা পেলাম। ছবিও আছে। নাম নিক্কু যাদব। আপনাদের বাড়ির কেউ? আমরা পেশেন্টকে এসএসকেএম-এ ট্রান্সফার করছি, কন্ডিশন আনস্টেবল।’

এটা কী হল? নিক্কু দুর্ঘটনাগ্রস্ত! হিসেব মিলছে না তো! আরও বড় অঙ্ক আছে খুনের নেপথ্যে, যার পরিণতি নিক্কুর প্রাণনাশের চেষ্টা?

টিম ছুটল এসএসকেএম-এ। নিক্কু কথা বলার অবস্থায় নেই, অচৈতন্য। চোখের কোণে জমাট বাঁধা রক্ত। ডাক্তার বললেন, সাইকেল থেকে মুখ থুবড়ে পড়েছে ফুটপাথে। ছড়ে গিয়েছে চোখমুখ। শক্ত কিছুতে আঘাত লেগেছে মাথায়। পেশেন্টের CT Scan জরুরি অবিলম্বে। জ্ঞান ফেরা দরকার। মাথার আঘাত বেশি হলে নিউরোলজিতে রেফার করা হবে, বাড়াবাড়ি হলে আইসিইউ তো রয়েইছে।

তদন্তকারী দলের একজন বললেন, ‘জ্ঞান ফিরলে ওর সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। একটু আর্জেন্ট। শুনেছেন তো, একটা ব্রুটাল মার্ডার হয়েছে বালিগঞ্জে। ওই বাড়িতে কাজ করত ছেলেটি। ওর স্টেটমেন্ট ভাইটাল।’

ডাক্তারবাবু এমন ভঙ্গিতে তাকালেন, যেন ভস্ম করে দেবেন। মুখে বললেন, ‘প্রাণ বাঁচানো বোধহয় আপাতত বেশি ভাইটাল। জ্ঞান ফিরুক, আই মিন, যদি আদৌ ফেরে। তারপর কথা বলবেন।’

কেসের সমাধান সহজেই হতে চলেছে, এমন ধারণা হলে একটা প্রাথমিক ঢিলেঢালা ভাব আসেই। যেটা নিমেষে কেটে গেল নিক্কুর দুর্ঘটনায়। দ্রুত স্থির হল তদন্তের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি। উঠে এল অনেক প্রশ্ন, সম্ভাব্য থিয়োরির জল্পনাকল্পনা।

এক, সিসিটিভি ফুটেজ আদ্যোপান্ত খতিয়ে দেখা দরকার। কে কে কখন ঢুকেছে, কখন বেরিয়েছে লুথরাদের ব্লক থেকে গত চব্বিশ ঘণ্টায়। কিন্তু মুশকিল, রিসেপশনের ক্যামেরার অবস্থানটাই এমন, কেউ রিসেপশনের কাছে এসে কোনও ফ্ল্যাটে যেতে চাইলে তবেই ছবি উঠবে। রোজকার পরিচিত কেউ, সে বাসিন্দাই হোন বা ফ্ল্যাটগুলির নিত্যদিনের কর্মচারী বা নিতান্ত অপরিচিত, পাশ দিয়ে চুপচাপ সরাসরি লিফটে উঠে গেলে ছবি ওঠার প্রশ্ন নেই। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো।

অসিত লুথরার নিজের সিকিউরিটি এজেন্সির ব্যাবসা, এই গোড়ার গলদটা চোখে পড়েনি? যাক গে, ফুটেজ দেখতেই হবে খুঁটিয়ে। যা পাওয়া যায়।

দুই, সমস্ত নিরাপত্তারক্ষী ও কাজের লোকদের তালিকা তৈরি করতে হবে। আবাসনের দুটো ব্লকেরই। জানতে হবে তাদের ঠিকুজিকুষ্ঠি। কারওর কি অপরাধের গোপন পূর্বইতিহাস আছে? কারওর সঙ্গে কি কোনও কারণে শত্রুতা তৈরি হয়েছিল লুথরা দম্পতির? জানতে হবে। অসিত লুথরার পেশাগত দিকটাও দেখা দরকার, কোনও গুরুতর ব্যবসায়িক শত্রুতা ছিল কারও সঙ্গে?

তিন, আবাসিকরাও সন্দেহের বৃত্তে। দ্রুত গতির জীবনযাপনে বিশ্বাসী ছিলেন শ্রীমতী লুথরা। বস্তুত, আবাসনের অধিকাংশ পরিবারই। বিলাসবহুল গাড়ি, জিম-টেনিস-গলফ-ক্লাব-কিটি পার্টি।

খুনের দিনটাও মাথায় রাখতে হবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেনটাইনস ডে। এখন তো বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই কোনও না কোনও দিবস। বছরটা সাতশো তিরিশ দিনের হলেই ভাল হত, মনে হয় এক এক সময়। দ্বিগুণ ‘অমুক ডে’, ‘তমুক ডে’ উদযাপনের সুযোগ পাওয়া যেত!

তখন, এগারো বছর আগে, এত হরেকরকম দিবসের চল ছিল না। বিত্তশালী মহলে ভ্যালেনটাইনস ডে-র ধুমধাম অবশ্য তখনকার দিনেও শুরু হয়ে গিয়েছে। লুথরাদের ফ্ল্যাটে পার্টি হয়েছিল সে-রাতে। মিস্টার লুথরার অনুপস্থিতিতে কে বা কারা এসেছিলেন প্রেমদিবসের নৈশবাসরে? কতক্ষণ ছিলেন? আবাসিকদের কেউ? না কি কোনও বহিরাগত? দুটো গ্লাস ছিল টেবলে। মিসেস লুথরা ছাড়া তা হলে কি একজনই ছিলেন? কে?

চার, আবাসিকদের প্রত্যেকের, সমস্ত গৃহকর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কল ডিটেলস আর টাওয়ার লোকেশন নিতে হবে। একজনও যেন বাদ না যায়। কে ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন, জানতে হবে সব, পুঙ্খানুপুঙ্খ। নিতে হবে প্রত্যেকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট, মিলিয়ে দেখতে হবে ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত নমুনার সঙ্গে।

পাঁচ, সবসময়ের দুই কাজের লোক সরস্বতী ও মিতাকে ডেকে পাঠাতে হবে। দু’জনেরই একই সময় ছুটিতে যাওয়ার দরকার পড়ল? আর রাধাও তো সবে কাজে ঢুকেছে দিন পনেরো হল। এমন তো কতই হয়, উদাহরণ আছে অসংখ্য, বিত্তশালী পরিবারে গৃহকর্মী হিসেবে যোগ দিয়ে সব ঘাঁতঘোঁত জেনে নিয়ে ডাকাতির ছক।

ছয়, এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ, নিক্কুর দুর্ঘটনা। যদি নিক্কুই খুনি হত, যেমন ভাবা হয়েছিল শুরুতে, অনায়াসে সরে পড়তে পারত। যদুবাবুর বাজারের কাছে যখন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখেন ট্রাফিক কনস্টেবল, সঙ্গে কোনও ব্যাগ-ট্যাগ ছিল না। টাকাপয়সা-গয়নাগাটি নিক্কুই নিয়ে থাকলে একটা কিছু তো দরকার সেগুলো ভরার জন্য। সিকিউরিটি গার্ড বলেছেন, নিক্কু পৌনে ছ’টা নাগাদ বেরিয়েছিল বড় চটের ব্যাগ নিয়ে। ব্যাগটা গেল কোথায়? নিক্কু কি এমন কিছু দেখে ফেলেছিল, দরকার ছিল পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়ার? প্রত্যক্ষদর্শী থাকাটা আততায়ীর পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারত?

না কি দুর্ঘটনাটা নিক্কুই সাজিয়েছে? সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নই নেই, সে যতই চিকিৎসাধীন থাক। ভুললে চলবে না, যেভাবে খুনটা হয়েছে, যদি জড়িত থাকে একাধিকও, পরিচিত কাউকে থাকতেই হবে ষড়যন্ত্রে। হতেও পারে, নিক্কুই আততায়ীর জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল গভীর রাতে।

সাত, আততায়ীর জন্য, না আততায়ীদের জন্য? মিসেস লুথরা শারীরিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। তাঁকে কাবু করা একজনের পক্ষে অত সহজ নয়। নিক্কুর সঙ্গে যোগসাজশে অন্য কেউ বা কারা খুনটা করল, এবং পাছে লুঠের বখরা দিতে হয় বা ব্ল্যাকমেলের শিকার হতে হয়, তাই সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল নিক্কুকে? অথবা, লুঠপাট স্রেফ পুলিশকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে, আদৌ নয় “murder for gain”, অন্য কারণ আছে?

আট, লুথরাদের দাম্পত্য সম্পর্কে কি কোনও টানাপোড়েন ছিল? জানা জরুরি। প্রদীপ লালের ভূমিকাতেও প্রশ্ন। বলছেন, বন্ধু অসিতের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। নেই দেখে মিসেস লুথরার সঙ্গে দেড়ঘণ্টা গল্প করেছিলেন। মোবাইল ফোনের যুগে প্রদীপ জানতেন না, অসিত বাইরে আছেন? বিশ্বাসযোগ্য? আর যদি ধরেও নিই, খোঁজ নেননি সেভাবে, বন্ধুপত্নীর সঙ্গে সৌজন্যের হাই-হ্যালো বা চা-বিস্কুট-কোল্ডড্রিঙ্ক বড়জোর আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিটে মিটে যাওয়ার কথা। ঘণ্টাদেড়েকটা একটু বেশি ঠেকছে না?

ধোঁয়াশা অনেক, খটকা বিস্তর। কী কী জানা দরকার, কী কী করা দরকার, নোটবইয়ে তালিকা বানাচ্ছিলেন তদন্তকারী অফিসার আশিক। যত সহজ হবে ভেবেছিলেন, তেমন আর হল কই? পিঠে হাত রাখলেন ওসি হোমিসাইড, ‘কী রে, কী এত ভাবছিস?’

আশিক তাকালেন, ‘কমপ্লিকেটেড লাগছে স্যার।’

ঘটনার যা ঘনঘটা, বাস্তবের গোয়েন্দা তো বলবেনই, ২১, রজনী সেন রোডের বাসিন্দা হলেও নিশ্চিত বলে ফেলতেন, “গোলমাল লাগছে রে তোপসে!”

এসএসকেএম হাসপাতালে হত্যে দিয়ে পড়েছিলেন গোয়েন্দারা। নিক্কুর জ্ঞান ফিরল বিকেল নাগাদ। সৌভাগ্যের কথা, CT Scan-এর রিপোর্ট জানাল, মাথায় চোট আছে। তবে ইন্টারনাল হেমারেজ নেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে ব্যথা কমার ওষুধ দিয়ে।

—ডাক্তারবাবু, ওর কাছে কিছু জানতে চাওয়ার ছিল। কথাবার্তা বলা যাবে?

—আজই বলতে হবে? পেশেন্ট ট্রমায় আছে এখনও।

—যদি সম্ভব হয়…

—দেখবেন, যেন বাড়তি স্ট্রেস না হয়…

ফের ডাক্তারবাবুর সেই ভস্ম-করা চাউনি। এবার উপেক্ষা করলেন অফিসার। ডাক্তার তাঁর কাজ করবেন। পুলিশ পুলিশের। নিক্কুর বয়ানেই রহস্যভেদের জাদুকাঠি লুকিয়ে থাকতে পারে, ডাক্তার কী করে বুঝবেন?

লালবাজারে তখন যুদ্ধকালীন ব্যস্ততায় কাজ চলছে। গোটা পঞ্চাশেক মোবাইল নম্বরের CDR (Call details record) এবং TL (tower location) সংগ্রহ করার কাজে নেমে পড়েছে technical wing। রাধা, আয়ুব আর নিরাপত্তারক্ষীদের বেশ কয়েকজনকে আনা হয়েছে লালবাজারে। যদুবাবুর বাজারের সবজির দোকানের মালিক মদন মাইতিকেও। তলোয়ার দম্পতি, অশোক পোদ্দার আর প্রদীপ লালও এসে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যে। আর কাকে কাকে আজই ডাকা প্রয়োজন, তার তালিকা তৈরি হচ্ছে। কেউ না কেউ হয় মিথ্যে বলছেন নয় সত্য গোপন করছেন। বয়ানে অসংগতি খুঁজে বার করতে হবে।

আয়ুব কেঁদেই চলেছেন। এক স্থানীয় সোর্স খবর দিয়েছে, মাইনে বাড়ানো নিয়ে নাকি লুথরাদের সঙ্গে কিছুদিন আগে মনকষাকষি হয়েছিল আয়ুবের। চেপে ধরতে আয়ুব কেঁদে ফেললেন, ‘মেমসাহেব আমাকে খুব ভালবাসতেন। আমি এত বড় পাপ করতে পারি না স্যার!’

নিক্কুকে যখন লালবাজারে আনা হল, ধুঁকছে। চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। দ্বিধায় পড়লেন অফিসাররা, একে বেশিক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা ঠিক হবে? হাঁটতেই তো পারছে না ভাল করে। জলটল খাওয়ার পর নিক্কু যেটুকু বলল, তাতে ফের নাটকীয় মোড় নিল তদন্ত।

‘মিস্টার লাল গত রাতে ন’টা নাগাদ চলে গিয়েছিলেন। রাধা সাড়ে আটটার সময়। এক পুরুষ এবং এক মহিলা রাত এগারোটা নাগাদ আসেন। মেমসাহেব নিজেই দরজা খুলেছিলেন। মহিলা জিনস আর টপ পরে ছিলেন। ভদ্রলোক কুর্তা-পাজামা, দু’জনকে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।

মেমসাহেব খুব ভাল রান্না করতেন। চাইনিজ-কন্টিনেন্টাল-মোগলাই, সব রকম রান্না আমাকে শিখিয়েছিলেন। রাতের খাওয়ার পর আমাকে কিচেনেই থাকতে বলেছিলেন। গেস্ট আসার কথা আছে, বলেছিলেন সোয়া দশটা নাগাদ।

ওই দু’জন আসার পর আমাকে কাবাব, পকোড়া বানাতে বললেন। বানালাম, স্যালাডও তৈরি করলাম। মেমসাহেব আর ভদ্রলোক ড্রিঙ্ক করছিলেন। অন্য মহিলা শুধু জল চেয়ে খেয়েছিলেন। আমি ট্রে–আইসবক্স সব সাজিয়ে দিয়েছিলাম। ফ্ল্যাটে প্রায়ই বেশি রাত অবধি পার্টি হত, জাগতে হত আমায়। ভোর রাত অবধি পার্টি চলছিল গতকাল। আমি কিচেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। তখন ক’টা বাজে মনে নেই। আড়াইটে-তিনটে হবে। মেমসায়েবের সঙ্গে ওই মহিলার তর্ক হচ্ছিল। ভদ্রলোক থামাতে চেষ্টা করছিলেন। মহিলা রেগেমেগে বেরিয়ে গেলেন। কুর্তা-পাজামা পরা ভদ্রলোক থেকে গেলেন। তারপর আর ঘুম হয়নি।

মেমসাহেব আমাকে বলেছিলেন, ভোরভোর বেরিয়ে পুজোর ফুল আর কিছু ওষুধ আনতে। আমি সাড়ে পাঁচটা-পৌনে ছ’টার মধ্যে বেরিয়ে পড়েছিলাম সাইকেল নিয়ে।’

—তখনও ভদ্রলোক ছিলেন?

—হ্যাঁ, মেমসাহেব আর উনি বেডরুমে ছিলেন। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল।

—তারপর?

—যখন যদুবাবুর বাজারের দিকে যাচ্ছি ফুল কিনতে, পিছন থেকে একটা বাইক এসে ধাক্কা দিল। মেরে বেরিয়ে গেল। ল্যাম্পপোস্টে মাথা ঠুকে গেল। ফুটপাথে পড়ে গেলাম। তারপর আর মনে নেই।’

গোয়েন্দারা ধন্দে পড়লেন। সকালের শিফটের নিরাপত্তারক্ষীর বয়ানের সঙ্গে নিক্কুর বেরনোর সময়টা মিলে যাচ্ছে। যিনি নিক্কুকে বেরতে দেখেছিলেন ব্যাগ হাতে। খুনটা কি তা হলে হয়েছে নিক্কু বেরিয়ে যাওয়ার পর? না কি তারও আগে, বন্ধ বেডরুমে? মহিলা কে, যিনি রেগেমেগে চলে গেলেন আড়াইটে-তিনটে নাগাদ? কুর্তা-পাজামা পরিহিতেরই বা কী পরিচয়?

—ভদ্রলোককে দেখলে চিনতে পারবি? মহিলাকে?

—নিশ্চয়ই স্যার। একবার দেখলেই পারব।

ছবি-আঁকিয়েকে ডাকা হল সঙ্গে সঙ্গে। বর্ণনা অনুযায়ী শুরু হয়ে গেল ‘Portrait Parle’ আঁকা। পুরুষ-মহিলা, দু’জনেরই। সমস্ত আবাসিকদের ও কর্মীদের দেখানো হবে সেই ছবি, স্থির হল।

সেই দুপুর থেকে টানা চলছে খোঁজখবর, একে-তাকে জিজ্ঞাসাবাদ। দুপুর-বিকেল-সন্ধে গড়িয়ে রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। ঠিক হল, আজ রাতের মতো ইতি টানা যাক জিজ্ঞাসাবাদে। Technical wing-এর বিশ্লেষণ থেকে কিছু নির্দিষ্ট দিশা আবাসিকদের গতিবিধি সম্পর্কে মিলতে বাধ্য কাল সকালের মধ্যে। সরস্বতী-মিতাকে খবর পাঠানো হয়েছে। কাল এসে পড়বে। অন্য আবাসিকদের বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ বাকি, কাল হবে।

আশিক ভাবছিলেন, যতটুকু দেখা হয়েছে সিসিটিভি ফুটেজ, কুর্তা-পাজামা এবং জিনস-টপ পরা মহিলার ছবি ধরা পড়েনি। তা হলে? অবশ্য সিসিটিভির যা পজিশন, ফাঁকি দিয়ে ঢোকা যায় সহজে। না কি ওই দু’জন ওই ব্লকেরই কোনও আবাসিকদের অতিথি, নিক্কু চিনত না? অনেক ফ্ল্যাটেই ভ্যালেনটাইনস ডে-র খানাপিনা-নাচাগানা হয়েছে সে-রাতে। অপরিচিত অতিথি এসেছিলেন অনেক। তাঁদের মধ্যেই কেউ?

রাত পৌনে বারোটা। তলোয়ার দম্পতি, অশোক পোদ্দার আর প্রদীপ লাল নিজেদের গাড়িতে বেরিয়ে গেলেন আর এক প্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদের পর। রাধা-আয়ুব-নিক্কুর জন্য লালবাজারের ট্রান্সপোর্ট সেকশন থেকে গাড়ি ডাকা হল।

আশিক তখন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তিনজনেই যেন কাল দশটার সময় উপস্থিত থাকে ত্রিপুরা এনক্লেভে। কথা আরও বাকি আছে। গাড়িতে ওঠার সময় কাঁধে হাত রেখে নিক্কুকে বললেন, ওষুধগুলো খাবি ঠিক করে।

নিক্কু মাথা নাড়ে, এবং একই সঙ্গে মুখ থেকে ছিটকে বেরোয়, ‘উঃ!’

আশিক কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নেন, ‘কী হল রে?’

—চোট আছে স্যার। ও কিছু নয়।

গাড়িতে উঠতে যাওয়ার মুহূর্তে থামান আশিক।

—এক মিনিট দাঁড়া। কোথায় চোট?

—ঘাড়ের কাছে।

এই সেই মুহূর্ত, ক্লান্তি-শ্রান্তি-ক্ষুধা-তৃষ্ণা বন্ধক রেখে তদন্তকারীর স্নায়ু নিজের অজান্তেই অতিসক্রিয় হয়ে ওঠার।

—দেখা তো, কোথায় চোট?

—পুরনো চোট স্যার।

—পুরনো কি নতুন, আমরা বুঝব। জামাটা খোল।

জামা খোলায় প্রবল অনীহা নিক্কুর চোখমুখে। এতক্ষণের যন্ত্রণাপীড়িত মুখে হঠাৎই দ্বিধা আর উদ্বেগের আঁকিবুকি।

ট্রান্সপোর্ট বিভাগের গাড়ির আর স্টার্ট দেওয়া হল না। তিনজনকেই ফের নিয়ে যাওয়া হল ইন্টারোগেশন রুমে। শার্ট খোলার পর নিক্কুর ঘাড়ের কাছে দেখা গেল গভীর আঁচড়ের দাগ। নখ চেপে বসলে যেমন হয়। ডাক্তাররা স্বাভাবিকভাবেই নিক্কুর মাথার আঘাত নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, হয় গুরুত্ব দেননি ওই আঁচড়কে, নয় নজর এড়িয়ে গিয়েছিল।

—এটা কী করে হল?

—পড়ে গিয়ে স্যার। ওই যে বাইক ধাক্কা মারল সকালে…

—তবে যে বললি, পুরনো চোট? পড়েছিস তো মুখ থুবড়ে। ঘাড়ের পিছনে লাগল কী করে?

নিক্কু ঘামতে শুরু করেছে তখন। আশিকের এক সহযোগী অফিসার তেড়ে যান নিক্কুর দিকে, ‘কী হয়েছিল বল? স্যার, দুটো ঠিকঠাক পড়লেই সব উগরে দেবে গড়গড় করে। দেব?’

নিরস্ত করেন আশিক, ‘আঃ, হেড ইনজুরি আছে ওর। ছাড়ো, এমনিতেই বলবে।’

এমনিতেই বলল। একটা মিথ্যে ধরা পড়ে গেলে পোড়খাওয়া অপরাধীরও রক্ষণ ভেঙে পড়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, অভিজ্ঞতা আমাদের। নিক্কু তো তুলনায় নেহাতই আনাড়ি, কী করে ব্যতিক্রম হবে? বলতে শুরু করল, আর স্তম্ভিত গোয়েন্দারা শুনতে থাকলেন।

—বেশ কিছুদিন ধরে প্ল্যান করেছি স্যার। যা মাইনে পেতাম, ওতে কোনওমতে সংসার চলত। বিহারের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে নিজের হাতে আর কিছু থাকত না। ভাবতাম, এভাবেই কি চাকরগিরিতে জীবনটা কেটে যাবে? সাহেব বাড়িতে থাকলে সম্ভব হত না কিছু করার। মাঝেমাঝেই ব্যবসার কাজে বাইরে যেতেন সাহেব। তেমন একটা সুযোগ খুঁজছিলাম।

—বুঝলাম। কিন্তু খুনটা করলি কেন? চুরি করেও তো পালাতে পারতিস?

—কোথায় পালাতাম স্যার? আপনারা বাড়ি থেকে ধরে আনতেন। ছবি আর ঠিকানা তো সাহেবের কাছে ছিলই। আমার ইচ্ছে ছিল গ্রামে জমিজমা কিনে চাষবাসের। তাই এমন কিছু করতে হত যাতে টাকাটা হাতে আসে, আর ধরাও না পড়ি।

—হুঁ…

—গত কাল সন্ধেয় মিস্টার লাল এলেন, চলে গেলেন পৌনে ন’টা নাগাদ। রাধা তার আগেই চলে গিয়েছিল। আমি খেয়েদেয়ে শুতে গেলাম। মেমসাহেবও ডিনার করে শুয়ে পড়লেন। ফ্যান্ডি আর বিগলসকে রাত্রি সাড়ে এগারোটা নাগাদ ছাদের কাচের ঘরে বন্ধ করে দিলাম। ওদের গলার বেল্টটা নিজের কাছে রাখলাম।

—বলে যা।

—একটা নাগাদ ছাদের কোয়ার্টার থেকে নেমে ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। মেমসায়েবের বেডরুমে নক

করলাম। উনি বেশ কিছুক্ষণ পরে ভিতর থেকে বললেন, ‘কে?’ বললাম, ‘নিক্কু। প্রচণ্ড শরীর খারাপ লাগছে। খুব মাথা ব্যথা করছে। একটা ওষুধ দেবেন?’ উনি দরজা খুলে দিলেন। ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওঁর উপর। উনি প্রস্তুত ছিলেন না, হকচকিয়ে গেলেন। আমি ধাক্কা দিয়ে ওঁকে মেঝেতে ফেলে বেল্ট দিয়ে গলায় ফাঁস দিলাম। উনি জিম করতেন, খুব ফিট ছিলেন। ঘাড়ে-পিঠে আঁচড়ালেন। হাতে হিরের আংটি পরে থাকতেন, চোখে খুব জোরে ঘুষি মারলেন।

—চোখের ওই রক্ত জমে যাওয়াটা তা হলে ঘুষি থেকেই?

—স্যার।

—বলতে থাক।

—মেমসাহেব পারলেন না। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল একটু পরে। এরপর আলমারির চাবি খুলে টাকাপয়সা-গয়নাগাটি নিয়ে ড্রয়ারে থাকা একটা চামড়ার ব্যাগে ভরলাম। সেদিন ভ্যালেনটাইন না কী যেন ছিল। ইশক-মহব্বতের দিন। বেলুন টাঙানো হয়েছিল অনেক ফ্ল্যাটে। প্রায়ই পার্টি হত তো ফ্ল্যাটে। ভাবলাম, পার্টির মতো করে সাজাই বসার ঘরটা।

মেমসাহেব যখন পড়ে আছেন বেডরুমে, আমি কিচেনে ঢুকে রান্না শুরু করলাম। চিকেন কাবাব, পনির পকোড়া। ক্যাবিনেট থেকে বোতল বার করে দুটো গ্লাসে মদ ঢাললাম অল্প। মোমবাতি রান্নাঘরেই ছিল, জ্বালালাম। ন্যাপকিন-কাঁটাচামচ সাজিয়ে টেবিলে এমন ভাবে রাখলাম, যাতে মনে হয় অনেক রাত অবধি পার্টি চলেছিল। সে রাতে রাধা চলে যাওয়ার পর আর কেউ আসেনি ফ্ল্যাটে। সব বানিয়ে বলেছি।

—বেরলি তো ভোর পৌনে ছ’টায়?

—হ্যাঁ, তার আগে বেরলে সন্দেহ করত সিকিউরিটিরা। শীতকাল ছিল, মাথার উপর দিয়ে একটা মাফলার জড়ালাম। যাতে আঁচড়গুলো তেমন চোখে না পড়ে। চটের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বেরিয়ে STD booth থেকে বাবলুকে ফোন করলাম।

—কে বাবলু?

—বাবলু মন্ডল। বিহারে আমার জেলাতেই বাড়ি, পরিচিত। আলিপুরের অনন্ত অ্যাপার্টমেন্ট থাকে। নরেন্দ্র বাগলিয়া সাহেবের বাড়িতে রান্নার কাজ করে। ওর কাছে টাকাগয়না ভরতি ব্যাগটা রেখে এলাম কাগজে মুড়ে। বাবলু অসুস্থ ছিল কিছুদিন ধরে। ওকে ঘটনার কথা কিছু বলিনি। বলেছিলাম, পরে এসে ব্যাগটা নিয়ে যাব। ও সরল মনে বিশ্বাস করেছিল। চটের ব্যাগটা রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলাম।

—চামড়ার ব্যাগটা বাবলুর কাছেই আছে?

—হ্যাঁ স্যার।

—এখনই যাব। তার আগে অ্যাক্সিডেন্টের গল্পটা বল।

—যদুবাবুর বাজারের কাছে ইচ্ছে করে সাইকেল নিয়ে ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা মেরেছিলাম। জানতাম, লাগবে। অজ্ঞান হয়ে যেতে পারি। চেয়েওছিলাম, অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি দু’দিন। এত তাড়াতাড়ি ছাড়া পেয়ে যাব, ভাবিনি।

—যদি মরে যেতিস বেকায়দায় লেগে?

—ওটুকু ঝুঁকি নিতেই হত স্যার। পালিয়ে গেলে তো সবাই আমাকেই সন্দেহ করত।

নিক্কু দম নেয় একটানে এতটা বলে। আশিক মোবাইলে ধরেন ডিসি ডিডিকে।

—স্যার, কেস ক্র্যাকড। নিক্কু কনফেস করছে। He only created the party scene.

রাতেই লালবাজার রওনা দিলেন গোয়েন্দাপ্রধান। এবং যখন মুখোমুখি হলেন নিক্কুর, আশিক বলে ফেললেন, ‘কঠিন জিনিস স্যার। শুনুন একবার গল্পটা। অস্কার না হোক, ফিল্মফেয়ারের বেস্ট অ্যাক্টর অ্যাওয়ার্ড এর বাঁধা।’

পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এগোল প্রত্যাশিত পথে। সে-রাতেই অনন্ত অ্যাপার্টমেন্টে বাবলুর কোয়ার্টারে হানা দিল পুলিশ। বাবলুর কাছ থেকে পাওয়া গেল চামড়ার ব্যাগ। উদ্ধার হল সমস্ত টাকা-ডলার-গয়নাগাটি। যে বেল্টের ফাঁস দিয়ে খুন করেছিল রবিন্দর লুথরাকে, সেটা নিক্কু লুকিয়ে রেখেছিল ছাদের ঝরনার পাথরের চাঁইয়ের নীচে। পাওয়া গেল। পোস্টমর্টেম আর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতামত জানাল, মৃতার গলায় আঁচড়ের দাগ বেল্টের হুক থেকেই হয়েছিল খুব সম্ভব। আর আঙুলের ছাপ তো ছিলই একাধিক জায়গায়। যা হুবহু মিলে গিয়েছিল নিক্কুর সঙ্গে।

খুনের প্রত্যক্ষদর্শী অমিল। কিন্তু পারিপার্শ্বিক প্রমাণ ছিল এতটাই সংশয়াতীত, চার্জশিট-উত্তর বিচারপর্বে আলিপুর জেলা ও দায়রা আদালত নিক্কু যাদবকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন।

হাইকোর্টে আবেদন হল যথানিয়মে। সাজা কমে দাঁড়াল যাবজ্জীবন কারাবাসে।

ঘটনা ফিরে দেখলে মনে হয়, বিশ্বাস এক আশ্চর্য অনুভূতি। যখন সত্যিই করে কেউ, চেনা-পরিচয়ের সড়কপথে বেশ কিছুটা দূরত্ব অতিক্রমের পর, তা হয় শর্তহীন। ঠিক যেমন নিক্কুকে করেছিলেন মিসেস লুথরা। স্নেহ করতেন নিখাদ, বিশ্বাসও প্রশ্নহীন। টাকাপয়সা-গয়নাগাটি আলমারিতে খোলা রেখে বেরতেন নিশ্চিন্তে, নিক্কুর ভরসায়।

দূরতম কষ্টকল্পনাতেও ভাবেননি, বিশ্বাসভঙ্গ হবে প্রাণের বিনিময়ে। আর, কে ঘটাবে বিশ্বাসের অপমৃত্যু?

অতি পুরাতন ভৃত্য!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *