১.১১
পরদিন দুপুরে আবার খাবার নিয়ে মা কারখানার দুয়ারে এসে হাজির হলেন। আজ ভারি কড়া পাহারা। জামার পকেট থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত খুঁজে তবে এক-একজন লোককে ঢুকতে দেওয়া হয়। মা এগিয়ে বললেন, একবারটি ঢুকতে দাওনা, বাবা। বড্ড ভারি, আর বইতে পারিনে, পিঠ দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
যা যা বুড়ি, ভেতরে যা…দেখোনা, উনিও আসেন যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝাতে!
মা ঢুকে পড়লেন। তারপর যথাস্থানে খাবারের পাত্র দুটো নাবিয়ে রেখে ঘাম মুছে ফেলে চারদিকে চাইলেন। গুসেভ ভ্রাতৃদ্বয় কারখানায় কামারের কাজ করে—তারা তৎক্ষণাৎ কাছে এসে দাঁড়ালো। বড়ো ভাই ভ্যাসিলি ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করলো, পিরগ পেভে?
হাঁ, কাল আনবে।
এই ছিল নির্ধারিত গুপ্তসংকেত। দু’ভায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আইভান হৃদয়াবেগ কিছুতেই সামাল করতে পারলো না, বলে উঠলো, ওঃ, এমন মা আর হয় না।
ভ্যাসিলি মাটিতে আসন করে বসে খাবারের পাত্রটার দিকে ঝুঁকে পড়লো, আর অমনি এক বাণ্ডিল ইস্তাহার এসে তার বুকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। পরক্ষণেই তা তার জুতোর মধ্যে, পায়ের তলায় চলে গেলো।
এমন চটপট কাজটা হয়ে গেলে যে অন্য কেউ তা একদম লক্ষ্য করতে পারলো না। ভ্যাসিলিও তাদের ভুলিয়ে রাখার জন্য বাজে কথা বলছে, বাড়িতে না গিয়ে আজো এসো এইখানে, এই বুড়িমার কাছ থেকে খাবার খাই।
মা ক্রমাগত হাঁকেন, চাই টক্ কপির সুপ, গরম ঝোল, রোস্ট, মাংস, আর এক-এক করে ইস্তাহারের বাণ্ডিলগুলো আইভান ভ্যাসিলির কাছে চালান দেন। মজুরদল কাছে এসে পড়াতে মা ইস্তাহার দেওয়া থামিয়ে দিয়ে খাবারের হাঁক হাঁকতে লাগলেন। মজুররা এলো, খাবার খেলে, চলে গেলো। তারপর মা আবার তার কাজ শুরু করলেন এবং শেষ করলেন।
সাফল্যের আবেগে আনন্দে তার সমস্ত দিনটা এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যে কাটলো।
রাত্রে এণ্ড্রি এসে হাজির হল। সে কারামুক্ত হয়ে এসেছে অথচ পেভেল কোথায়?–-মা এণ্ড্রির বুকে মুখ লুকিয়ে ছোটো মেয়েটির মতো কাঁদতে লাগলেন। এণ্ড্রি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, কেঁদোনা মা, পেভেলের জন্য কোন ভাবনা নেই, সে তোফা আছে। শীগগিরই জেল থেকে সে ফিরে আসবে।
এণ্ড্রি, মার কাছে সবিস্তারে জেলের দৈনিক জীবনযাত্রাকাহিনী বর্ণনা করে যায়। মা একটু আশ্বস্ত হন, তারপর বলেন; আজ কি করেছি জানো?…
কি?
মা ইস্তাহার-বিলির কাহিনী বলেন। এণ্ড্রি, উল্লসিত হয়ে বললো, চমৎকার, মা! এতে যে আমাদের কাজ কতটা এগিয়ে গেলো, কতো সুবিধা হ’ল, তা বোধ করি তুমি নিজেও বোঝোনি!
মায়ের প্রাণ …একটুকুতেই খুলে যায় স্নেহাকাঙ্ক্ষী সন্তানের কাছে। এণ্ড্রির কাছেও মা তার করুণ জীবনকাহিনী বিবৃত করে বলেন : স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলের মুখ চেয়ে রইলুম! সেই ছেলে যখন বাপের মতো বিপথে পা দিলো, তখন কত যে ব্যথা পেলুম প্রাণে, তা তোমায় কেমন করে বোঝাবো, এণ্ড্রি? জানি, আমার এ ভালোবাসা স্বার্থ-দুষ্ট, সংকীর্ণ—তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা যেমন পরের জন্য দুঃখ বরণ করে নাও, আমি তো তা পারিনে! আমি আমার নিকট আত্মীয়দের ভালোবাসি, পেভেলকে ভালোবাসি, তোমাকে, ভালোবাসি–বোধহয় পেভেলের চাইতেও বেশি …পেভেল বড় চাপা…আমাকে কিছু বলে না। শশেংকাকে বিয়ে করতে চায় আমি মা, আমাকে একথাটাও জানালোনা।
এণ্ড্রি বললো, এ সত্যি নয় মা,–আমি জানি এ সত্যি নয়। পেভেল শশেংকাকে ভালোবাসে একথা ঠিক, কিন্তু বিয়ে করতে চায় না, বিয়ে করতে পারেনা, বিয়ে করবেনা।
বিষণ্ণ চোখে মা বললেন, হরে, এমনি করে কি তোরা নিজেদের বলি দিবি?
এণ্ড্রি, নিজের মনেই বলে চলে, পেভেল অসাধারণ মানুষ লোহার মতো শক্ত তার মন।
মা চিন্তাকুল কণ্ঠে বলেন, কিন্তু সে আজ বন্দী। মন প্রবোধ মানে না। যদিও জানি সোনার ছেলে তোমরা, মানুষের হিতের জন্য এই কঠোর জীবন বরণ করে নিয়েছে, সত্যের জন্য এই জীবন-ভর দুঃখকে স্বীকার করেছে। কি সে সত্য তাও আমি জানি—ধনী যতদিন থাকবে দুনিয়ায়, মানুষ কিছু পাবে না—সত্যও না, সুখও না। এ সাচ্চা কথা, এণ্ড্রি।
এণ্ড্রি ধীরে ধীরে বলে, ঠিক কথা, মা। কার্চে একজন ইহুদী কবি ছিলেন। একবার তিনি লিখলেন–
বিনা দোষে যারা ফাঁসি কাঠে দিল প্রাণ,
সত্য তাদের করিবে জীবন দান।
ঘটনাচক্রে কার্চের পুলিসের হাতেই তিনি খুন হলেন। হন, কথা তা নয়। কথা হলো, তিনি সত্য কি তা উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা প্রচার করার জন্য অনেক কিছু করেছিলেন, তিনি সত্য ব্যক্ত করেছিলেন।
এমনি করে সে রাতটা কাটলো।
.
১.১২
পরদিন কারখানার গেটে যেতেই রক্ষীরা বেশ রুক্ষভাবে মাল মাষ্টতে নাবিয়ে মাকে ভালো করে পরীক্ষা করলো।
মা বললেন, আমার খাবার জুড়িয়ে যাবে, বাবা!
চোপ রও—একজন রক্ষী বললো।
আর একজন বললো, ইস্তাহারগুলো নিশ্চয়ই বেড়ার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হয়।
মা রেহাই পেলেন।
বুড়ো শিজভ, এসে বললো চাপা গলায়, শুনেছে তো, মা?
কি?
ইস্তাহারগুলো আবার দেখা দিয়েছে। রুটির ওপর চিনির মতো করে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে ওরা। অথচ শাস্তি হ’ল এর জন্য আমার ভাইপোর, তোমার ছেলের। এখন পরিষ্কার দেখা গেলো, ওরা। নিরপরাধ।
তারপর দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোত বললো, বাবা, এ মানুষ নয় যে হুমকি দিয়ে দমিয়ে রাখবে। এ ভাবধারা—একে পোকার মতো টিপে মারা চলেনা।
মা বাবার হাঁকতে লাগলেন। কারখানায় সেদিন সে কী উত্তেজনা। মজুররা আলাপ-আলোচনা আনন্দে উতলা। একজন বলছে, বাছাধনরা সত্য কথা সইতে পারেন না।
কর্তারা ক্রুদ্ধ বিব্রত হয়ে ছুটাছুটি করছেন। একজন বলছেন, ব্যাটারা হাসছে দেখো। হাসবার মতো বিষয় কিনা—ম্যানেজার যা বলেন ঠিক—আমূল ধ্বংস করতে চায় ওরা। ব্যাটাদের শুধু আগাছার মতো ওপড়ালে হবে না, একেবারে চষে একশা করে দিতে হবে।
আর এক কর্তা বীর দর্পে অদৃশ্য দুশমনের উদ্দেশে আস্ফালন করে বলে, যা খুশি ছাপা, ব্যাটা বজ্জাত, কিন্তু খবর্দার আমার বিরুদ্ধে একটা কথা বলেছিস কি মরেছিস।
গুসেভ এসে মাকে বললো, আজ আবার তোমার কাছে খেতে এসেছি, মা। ওঃ যা খাবার তুমি দিয়েছ, মা, চমৎকার, অতি চমৎকার!
মা খুশি হলেন, ভাবলেন, আমাকে না হলে এদের চলবে কি করে?
অদূরে একজন মজুর বলছে, আমি পেলুম না একখানা কোথাও।
আর একজন বলছে, শুনতে বেশ লাগে কিন্তু। পড়তে না পারলেও এটা বুঝি, বাছাধনদের আঁতে বেশ একটু বা লেগেছে।
তৃতীয়জন বলে, বয়লার ঘরে চলো, পড়ে শোনাচ্ছি। গুসেভ ইঙ্গিত করে বললো, দেখছ না, মা, কেমন কাজ করছে?
মা খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। এণ্ড্রিকে বলেন, ওরা দুঃখ করছিল পড়তে জানেনা বলে। আমিও তো তাই—সেই ছোটবেলা যতটুকু যা শিখেছিলুম, স্রেফ ভুলে বসে আছি।
আবার শেখো, মা।
মরতে বসেছি, এখন শেখবো? ঠাট্টা করিসনি, বাছা!
এণ্ড্রি কিন্তু শেলফ থেকে একটা বই নিয়ে মাকে বর্ণ-পরিচয় করাতে লেগে গেলো। ছুরির ডগা দিয়ে একটা অক্ষর দেখিয়ে বললো, এটি কি?
আর।
এটা?
এ।
এমনিভাবে মার শিক্ষা শুরু হয়।
পড়তে পড়তে এক সময় মা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, এক পা যখন কবরে, তখন বসলুম বই নিয়ে।
এণ্ড্রি, সান্ত্বনা দিয়ে বললো, কেঁদোনা, মা, তোমার দোষ কি? জীবন তো আর তুমি ইচ্ছে করে অমন ভাবে কাটাও নি। তুমি তবু বুঝতে পাচ্ছ, কী শোচনীয় জীবন তোমাদের। অনেকে কিন্তু এই কথাটাই বুঝতে পারেনা। হাজার হাজার লোক গরু-বাছুরের মতো বেঁচে থেকে বড়াই করে, তোফা আছি। কিন্তু কোথায় তোফা তাদের জীবন! আজ কাজ শেষ হলে খাওয়া, কালও কাজ শেষ হলে খাওয়া, পরশুও তাই—দিনের পর দিন, বছরের পর বছর …ঐ একই রুটিন…কাজ আর খাওয়া, কাজ আর খাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে কাচ্চা-বাচ্চার দল আমদানি, দু’দিন তাদের নিয়ে আমোদ…তারপরে রুটিতে টান পড়লে তাদেরই ওপর রাগের ঝাল ঝাড়া, খালি গোগ্রাসে গেলা, বড়োও হয় না যে, কাজ করে একটু সাহাষ্য করবে। ছেলেমেয়েদের তারা ভারবাহী পশু করে তোলে। ছেলেমেয়েরা পেটের জন্য খাটে, জীবনটাকে টেনে নিয়ে চলে একটা চুরি-করা পচা ঝাড়নের মতো। প্রাণ তাদের চঞ্চল হয়ে ওঠেনা আনন্দের সাড়ায়, কখনো দ্রুত তালে বেজে ওঠেনা হৃদয়দ্রাবী ভাবের আবেগে। কেউ বাঁচে ফকিরের মতো ভিক্ষার ঝুলি সম্বল করে, কেউ জীবন কাটায় চোরের মতো পরের জিনিস নিয়ে। কর্তারা চোরের আইন তৈরি করেছে, লাঠি ধারী রক্ষীদল মোতায়েন করে তাদের বলছে, আমাদের তৈরি আইন রক্ষা কর! ভারি সুবিধার আইন এগুলো জনসাধারণের রক্ত শুষে নেওয়ার অধিকার আমাদের দিয়েছে। বাইরে থেকে মানুষকে চেপে পিষে নিঙরে নিতে চায় ওরা, কিন্তু মানুষ বাধা দেয়। তাই ভেতরে এই আইন চালানো-যুক্তি-শক্তিও যাতে তাদের পোপ পেয়ে যায়। মানুষ একমাত্র তারাই যারা মানুষের দেহের শৃঙ্খল নষ্ট করে, মানুষের মনের শৃঙ্খল অপসারিত করে। তুমিওতো তাই করতে চলেছে, মা তোমার সাধ্যমত।
আমি! আমি কী করতে পারব, এণ্ড্রি!
কি করতে পারবে না, মা? কেন পারবে না? বর্ষাধারার মতো আমাদের কাজ-এর প্রত্যেকটি ফোটা পরিস্ফুট করে বীজকে। যখন তুমি পড়তে শিখবে, মা, তখন…হাঁ, তোমায় শিখতেই হবে…ভাবো দেখি, পেভেল ফিরে এসে কতটা অবাক হবে!
মা মনোযোগী ছাত্রীর মতো বই নিয়ে উঠেপড়ে লেগে গেলেন।
.
১.১৩
দরজায় শব্দ হতে মা খুলে দিয়ে দেখেন রাইবিন।
রাইবিন বললো, তুমি একা, মা?
হাঁ।
তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। আমার একটা থিওরী আছে।
মা উদ্বেগে, আশঙ্কায়, রাইবিন কি যেন বলে ভেবে তার দিকে চাইলেন।
রাইবিন বললো, সবকিছুর মুলে চাই টাকা। এই ইস্তাহারগুলোত টাকা জোগায় কে?
মা বললেন, জানিনে তো!
রাইবিন বললো, তারপর, দ্বিতীয় জিগ্যাস্ত, এসব লেখে কারা? শিক্ষিত লোকেরা, কর্তারা। কর্তারা এই সব বই লিখে ছড়ায় এবং এই বইয়েতে তাদেরই বিরুদ্ধে কথা থাকে। এখন আমায় বল, মা, কেন, কোন্ স্বার্থে কর্তারা তাদের অর্থ এবং সময় ব্যয় করে, তাদের নিজেদের, বিরুদ্ধেই লোক ক্ষেপিয়ে তোলে?
মা ভীত হয়ে বলেন, তোমার কি মত?
রাইবিন বলে, আমার মত! যখন ঠিক পেলুম জিনিসটা, আমার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো।
কি—কি ঠিক পেলে?
প্রবঞ্চনা, প্রতারণা—হাঁ, ঠিক তাই। জানিনে ভালো করে, তবু অনুভব করি—কর্তারা কোন একটা লীলা করছেন। আমি ওসব চাই নে। আমি চাই সত্য এবং সত্য কি তা আমি বেশ জানি। কর্তাদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলবনা আমি। আমি জানি, ওদের সুবিধার জন্য যখন দরকার হবে, তখন ওরা আমাকে সামনে ঠেলে দেবে, তারপর আমার হাড় মাড়িয়ে ওরা ওদের ঈপ্সিত স্থানে পৌঁছাবে।
মা ব্যথিত সুরে বললেন, হা ভগবন, পেভেলরা কি তবে এ সব কথা বোঝেনা? না না, আমি এ বিশ্বাস করতে পারিনে। তাদের লক্ষ্য—সত্য, সম্মান, বিবেক…কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই তাদের।
কাদের কথা বলছ, মা?
সকলের কথা, প্রত্যেকের কথা। মানুষের রক্ত নিয়ে কারবার যার করে, তারা সে মানুষ নয়।
রাইবিন মাথা নীচু করে বলে, তারা না হতে পারে, মা, কিন্তু তাদের পেছনে তো এমন একদল লোক থাকতে পারে, যাদের উদ্দেশ্য স্বার্থসিদ্ধি—এমনি এমনি কেউ আর নিজেদের বিরুদ্ধে লোক ক্ষ্যাপায় না। তুমি আমার কথা ঠিক জেনে রেখো, মা, কর্তাদের কাছ থেকে কখনও কিছু ভালো পাওয়া যাবে না।
মা ভয় পেয়ে বলেন, তা তোমার মতটা কি বলত?
আমার মত! কর্তাদের কাছ থেকে তফাৎ থাকো, বাস—এইমাত্র!
তারপর কিছুক্ষণ চুপ-চাপ থেকে ধীরে ধীরে বলে, আমি চলে যাচ্ছি, মা, লোকদের সঙ্গে গিয়ে মিশব, তাদের সঙ্গে কাজ করব। এ কাজের যোগ্য আমি। লিখতে পড়তে জানি, খাটতে পারি, বোকাও নই। আর সব চেয়ে বড় কথা, লোকদের কি বলতে হবে তা আমি জানি। জানি, তাদের বিশ্বাস করা চলে না। জানি, মানুষের আত্মা আজ কলুষিত, বিদ্বেষ-বিষ-দুষ্ট, সবাই পেট বোঝাই করবার জন্য ব্যগ্র–কিন্তু খাবার কই? তাই তারা পরস্পর খাওয়া-খাওয়ি করে।…আমি যাবো গ্রামে…পল্লিতে…আর লোকদের জাগাবো। তাদের আজ নিজেদের হাতে কাজ নেওয়া দরকার, নিজেদের হাতে একাজ করা দরকার। তারা একবার বুঝুক, তারপর নিজেরাই নিজেদের পথ খুঁজে নেবে। আমি যাচ্ছি শুধু তাদের বোঝাতে, তাদের একমাত্র আশা তারা নিজেরা, তাদের একমাত্র বুদ্ধি তাদের নিজেদের বুদ্ধি, এই হচ্ছে সত্য।
মা ধীরে ধীরে বলেন, তোমায় ধরবে ওরা।
ধরবে, আবার ছেড়ে দেবে। আবার আমি এগিয়ে চলবো।
চাষীরাই তোমায় বাঁধবে, তোমায় জেলে দেবে।
দিক, কিছুকাল জেলে থেকে আবার বেরুব, আবার চলবো। চাষীরা একবার বাঁধবে, দু’বার বাঁধবে, তারপর তারা বুঝবে, আমাকে বাঁধা উচিত নয়, আমার বক্তব্য শোনা উচিত। আমি তাদের ডেকে বলবো, বিশ্বাস করতে বলেছিনে তোমাদের শুধু কথাগুলো শোন। আমি জানি, তারা যখন শুনবে, তখন বিশ্বাস করবে।
মা বলেন, তুমি মারা পড়বে, রাইবিন।
রাইবিনের কালো গভীর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মার দিকে চেয়ে বললো, খৃস্ট বীজের সম্বন্ধে কি বলেছিলেন জানো : তুমি মরবেনা, নতুন অঙ্কুরে জেগে উঠবে। আমি বিশ্বাস করিনে, আমি এত সহজে মরবো। আমি বুদ্ধি রাখি, সোজা পথে চলি; কাজেই গতি আমার অপ্রতিহত। শুধু জানিনে, কেন আমার প্রাণে ব্যথা জাগে। হাঁ…আমি যাবো…তাড়িখানায় যাবো…লোকদের কাছে যাবে।…কিন্তু এণ্ড্রি কই? এখনো আসছেনা যে! এরি মধ্যে আবার কাজে লেগেছে বুঝি!
হাঁ। জেল থেকে বেরুতে না বেরুতেই ওদের কাজ।
এইতো চাই। তাকে আমার কথা বোলো।
বলবো।
এবার উঠি।
কারখানার কাজ ছাড়বে কবে?
ছেড়ে দিয়েছি তো!
যাচ্ছ কখন?
কাল ভোরে।
রাইবিন চলে গেলো। মা একা বসে রইলেন। চারদিকে ঘন অন্ধকার। তার দিকে চেয়ে মা শিউরে উঠলেন, এই অন্ধকারের জীব আমি চিরজীবন।…
এণ্ড্রি এলে মারাইবিনের কথা বললেন। শুনে এণ্ড্রি নেচে উঠলো, যাচ্ছে?—চমৎকার! সত্যের ডঙ্কা বাজিয়ে যাক সে গ্রামে গ্রামে, শোকদের জাগিয়ে তুলুক,আমাদের সঙ্গে এখানে থাকা তার পক্ষে কষ্টকর।
মা বললেন, তাদের কথা বলছিল সে। সত্যিই কি তাই? কর্তারা কি তোমাদের প্রবঞ্চিত করছেন না?
এণ্ড্রি, বললো, তাই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ বুঝি, মা?…তা যা বলেছে, টাকা নিয়েই যত গোলমাল। ওঃ, টাকা যদি থাকতো, মা!…আমরা এখন আছি ভিখের ওপর…এইত ধরো নিকোলাই, পঁচাত্তর রুবেল মাইনে পায়, তার পঞ্চাশ রুবেলই আমাদের দেয়। অন্যান্য সবাইও তাই। ছাত্ররা খেতে পায় না, তবুও একটি একটি করে কোপেক জমিয়ে আমাদের পাঠায়। তাদের কথা বলছিলে, হাঁ, তাদের মধ্যেও রকমফের আছে বৈকি! কেউ আমাদের ঠকাবে, ছেড়ে যাবে, আবার কেউ আমাদের সঙ্গে থাকবে, সেই উৎসব-দিবসে আমাদের সহযাত্রী হবে। সে উৎসব-দিবস…জানি তা দুরে, বহু দূরে। কিন্তু পয়লা মে আমরা একবার তার অনুষ্ঠান করে আনন্দ করব।
তার কথায়, তার আনন্দে মার মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর হয়। এণ্ড্রি, ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতে লাগলো, তারপর আবার বললো, জানো, মা, প্রাণের মধ্যে মাঝে মাঝে এমন এক আশ্চর্য ভাব জাগে! যেখানে যাও, মনে হবে, সকল মানুষ তোমার কমরেড—সবার মাঝে একই আগুন দীপ্ত, সবাই আনন্দময়, সবাই ভালো। কথা নেই, অথচ সবাই সবাইকে বোঝে। কেউ কাউকে বাধা দিতে চায় না, অপমান করতে চায় না, তার আবশ্যকও বোধ করে না। সবাই একতাবদ্ধ, প্রত্যেকটি প্রাণ গায় তার নিজের গান। সমস্ত গানের তরঙ্গ সম্মিলিত হয়ে প্রবাহিত হয় এক বিশাল, বিরাট, মুক্ত-শ্রোতা আনন্দের নদী। যখন তুমি এই কথা ভাববে, মা, যখন ভাববে, এ হবে, এ না হয়ে পারে না, তখন বিস্ময়বিমুগ্ধ প্রাণ আনলে গলে যাবে। এতে আনন্দ যে, তা তুমি সামলাতে পারবে না, চোখ সজল হয়ে উঠবে।…কিন্তু এ স্বপ্ন হতে যখন জেগে উঠবে, যখন সংসারের দিকে চাইবে, দেখবে সবকিছু তোমার চারপাশে ঠাণ্ডা, নোঙরা,—সবাই শ্রান্ত, ক্ষুধার্ত, কর্মব্যস্ত সংসারের চলতি পথে মানবজীবন কাদার মতো মথিত হচ্ছে, পদদলিত হচ্ছে। …হাঁ…ব্যথা পাবে সন্দেহ নেই, কিন্তু তবু তোমায় মানুষকে অবিশ্বাস করতে হবে, ভয় করতে হবে, ঘৃণা করতে হবে। মানুষ বিভক্ত জীবন মানুষকে দু’টুকরো করে রেখেছে। তুমি তাকে ভালোবাসতে চাইবে, কিন্তু কি করে বাসবে? কি করে ক্ষমা করবে সে মানুষকে, যে তোমায় আক্রমণ করছে বন্য পশুর মত। বুঝছেনা যে তোমার মধ্যেও একটা আত্মা আছে, তোমার মুখে—মানুষের মুখে আঘাত দিচ্ছে। তুমি ক্ষমা করতে পারোনা–তোমার নিজের কথা ভেবে নয়, মানবজাতির কথা ভেবে। নিছক ব্যক্তিগত অপমান আমি ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু অত্যাচারীকে অপমান করার আস্কারা দিতে পারি না, মানুষকে মারার, হাত পাকাবার জন্য আমার পিঠ পেতে দিতে পারি না।…
মা চুপ করে শুনতে থাকেন। এণ্ড্রির চোখ জ্বলছে। দৃঢ়কণ্ঠে সে বলতে লাগলো, নোঙরা যা তা আমাকে আঘাত না দিলেও তাকে আমি ক্ষমা করবোনা। আমি একা নই দুনিয়ায়। আজ যদি আমি আমাকে অপমানিত হতে দিই–হয়তো আমি তাকে হেসে উড়িয়ে দিতে পারি, গায়ে না মাখতে পারি, কিন্তু অপমানকারী যে, সে আজ আমার ওপর শক্তি পরীক্ষা করে বর্ষিত-স্পর্ধায় কাল আর একজনের পিঠের চামড়া তুলবে। এই জন্যই আমরা বাধ্য হই, মানুষে মানুষে তফাৎ করতে—যারা অত্যাচারী তাদের দূরে রাখতে, যারা সত্যের জন্য লড়াই করছে তাদের আপনার বলে টেনে নিতে।…বিপদই হচ্ছে এইখানে। দু’রকম চোখ নিয়ে তোমায় দেখতে হবে, দু’রকম প্রাণ নিয়ে তোমায় অনুভব করতে হবে,—একটা বলে, সবাইকে ভালোবাসে, আর একটা বলে, হুলিয়ার, ও তোমার দুশমন। কেন? কারণ এটা অদ্ভুত হলেও সত্য যে, মানুষ আজও এক-সমতলে দাঁড়িয়ে নেই। মানুষের মধ্যে সাম্য আনতে হবে আমাদের, সকল মানুষকে এক সারিতে দাড় করাতে হবে আমাদের মাথা দিয়ে বা হাত দিয়ে মানুষ যতকিছু সুখ-সুবিধার সৃষ্টি করেছে সব আজ নিখিল মানুষের মধ্যে সমান ভাবে বেঁটে দিতে হবে। মানুষকে আর পরস্পরের ভয়ের এবং হিংসার গোলাম, লোভের এবং বোকামির দাস করে রাখবোনা।
এমনি কথাবার্তা প্রায়ই চলতো মা এবং এণ্ড্রির মধ্যে। পড়াও চললে মার। চোখ তার ক্ষীণদৃষ্টি। এণ্ড্রি, বললো, আসছে রববার শহরে নিয়ে গিয়ে তোমায় চশমা কিনে দেব।
তিন-তিনবার মা জেলে পেভেলের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, কিন্তু পারেন নি। জেলের কর্তা অতিরিক্ত বিনয়ের সঙ্গে, এখন হবে না, এই আসছে হপ্তায় বলে ফিরিয়ে দিয়েছে। মা এণ্ড্রি কে বললেন, খুব নম্র কিন্তু লোকটা।
এণ্ড্রি হেসে বললে, হাঁ, বিনয়ের অভাব নেই, হাসিরও অভাব নেই। ওদের যদি বলা হয়, দেখো, এই লোকটা সাধু, জ্ঞানী, কিন্তু ও থাকলে আমাদের বিপদ। ওকে ফাঁসিতে লটকাও। বাস, আর কথা নেই। ওরা হাসতে হাসতে তাকে ফাঁসিতে লটকাবে, এবং ফাঁসিতে লটকিয়ে ওরা হাসতে থাকবে।
মা বললেন, কিন্তু আমাদের ওখানে যে লোকটি খানাতল্লাশী করতে গিয়েছিল সে একটু ভাল।
এণ্ড্রি বললো, মানুষ ওরা কেউই নয়, মা। মানুষকে আঘাত দেবার, অভিভূত করার, তাকে রাষ্ট্রের চাহিদা মতো গড়ে নেবার যন্ত্র ওরা। কর্তারা যেমন খুশি ওদের চালান। ওরা না ভেবে, কেন, কি দরকার এ প্রশ্ন না করে কর্তাদের হুকুম তামিল করে যায়।
অবশেষে মা একদিন ছেলের দেখা পেলেন। অনেক কথা হলো। মা শেষটা বললেন, কবে ছেড়ে দেবে তোকে? কেন জেল হ’ল তোর? ইস্তাহার তো আবার বেরিয়েছে কারখানায়।
পেভেলের চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বেরিয়েছে? কবে? কতো?
রক্ষী বাধা দিয়ে বললো, ওসব কথ: বলা নিষেধ, পারিবারিক কথা বলো। অগত্যা পেভেল বললো, তুমি এখন কি করছ, মা?
মা ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠে বলেন, আমিই কারখানায় এইসব বয়ে নিয়ে যাই—টক, ঝোল, খাবার…
পেভেল বুঝলো। চাপা হাসির বেগে তার মুখের শিরাগুলো কাঁপতে লাগলো। বললো, তাহলে একটা ভালো কাজ পেয়েছ তুমি, মা। সময় তোমার মন্দ কাটছেনা।
মা বলেন, ইস্তাহার বেরুবার পর আমাকেও খুঁজে দেখেছিল।
রক্ষী বললো, আবার ঐ কথা।
এমনি করে সময় উত্তীর্ণ হল। মা-ছেলে চোখের জলের মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্ন হলেন, বিদায় নিলেন।
বাড়ি এসে মা এণ্ড্রিকে বললেন, আচ্ছা এণ্ড্রি, ওরা কেমন করে পারে, বলতো? আমার তো পেভেলের জন্য মুখে অন্ন রোচে না। আর ওরা দেখি ছেলেদের জেলে পাঠিয়ে দিব্যি আছে, খায়-দায়, হাসি-গল্প করে, যেন কিছুই হয়নি।
এণ্ড্রি বলল, এইটেই তো স্বাভাবিক। আইন আমাদের ওপর যতটা কড়া, ওদের ওপর ততটা নয়। আর আমাদের চাইতে আইনের দরকারও ওদের বেশি। এইজন্যেই আইন যখন ওদের নিজেদের মাথায় ঘা দেয়, ওরা কাঁদলেও জোরে কাঁদেনা—নিজের লাঠি নিজের মাথায় পড়লে তত লাগেনা! ওদের কাছে আইন রক্ষাকর্তা, আর আমাদের কাছে আইন শৃঙ্খল—যা আমাদের হাত-পা বেঁধে পঙ্গু, দুর্বল করে রেখেছে, আমাদের আঘাত দেবার শক্তি লোপ করেছে।
দিন তিনেক পরে নিকোলাই কারামুক্ত হয়ে পেভেলদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ঘরে আলো দেখতে পেয়ে সে এসে ঢুকলো, বলে, আমি সোজা জেল থেকে আসছি, মা।
তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত, দৃষ্টি বিষণ্ণ, সন্দিগ্ধ! মা কোনদিনই তাকে পছন্দ করতেন না, কিন্তু আজ এই ছেলেটির দিকে চেয়েও কেমন এক দরদে তার প্রাণ ভরে গেলো, বলেন, শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেছিস যে, বাবা! দাঁড়া, চা করে দিচ্ছি।
এণ্ড্রি রান্নাঘর থেকে বলে উঠলো, আমিই কচ্ছি চা!
মা তখন বলেন, ফেদিয়া মেজিন কেমন আছে রে? কবিতা লিখছে, না?
নিকোলাই মাথা নেড়ে বলে, হাঁ, কিন্তু আমি ছাই কিছু বুঝিনা তা। একটা খাঁচায় রেখেছে তাকে, আর সে গান করছে। একটা জিনিস আমি খাঁটি বুঝেছি—আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার।
মা সমবেদনার সুরে বলেন, ইচ্ছে থাকবে বা কেন! কিসের, মায়ায় সে পুরীতে যাবি?
নিকোলাই বললো, সত্যিই শূন্যপুরী, মা। শুধুই পোকা-মাকড়ের বাসা। এখানে আজকের রাতটা থাকতে পারি, মা?
মা বলেন, ছেলে মার কাছে থাকবে তারও কি আবার অনুমতি নিতে হয়, বাবা!
নিকোলাই আপন মনে কত কি বলে চলে। এণ্ড্রি, রান্নাঘর থেকে আসতে তার মুখের দিকে চেয়ে বলে, আমার মনে হয়, এমন কতকগুলো লোক আছে, যাদের মেরে ফেলা উচিত।
এণ্ড্রি গম্ভীরভাবে বললো, তাই নাকি। কিন্তু কেন শুনতে পারি কি?
যাতে তারা চিরদিনের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
বটে! কিন্তু জ্যান্ত লোকগুলোকে ঠাণ্ডা করার অধিকার তোমায় কে দিলে?
দিয়েছে তারা নিজেরা।…তারা যদি আমায় আঘাত দেয়, আমার অধিকার আছে জবাবে তাদের আঘাত করার, তাদের চোখ উপড়ে ফেলার। আমায় ছুঁয়ো না, আমিও তোমায় ছোঁব না। আমায় যেমন খুশি চলতে দাও, আমি চুপচাপ থাকবে, কাউকে ছোঁবও না। হয়তো বনে চলে যাবো, নদী-তীরে কুঁড়ে বেঁধে একা থাকবে।
এণ্ড্রি বললো, যাও না, খুশি হয় তাই গে থাকো।
এখন?…নিকোলাই ঘাড় নেড়ে বলে, এখন তা অসম্ভব।
কেন? অসম্ভব কেন? আটকাচ্ছে কে তোমায়?
আটকাচ্ছে মানুষ। আমরণ তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে হবে আমায়–অন্যায় এবং ঘৃণার বাঁধনে। শক্ত সে বাঁধন। আমি তাদের ঘৃণা করি, তাই তাদের ছেড়ে যাবো না। তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াবে, তাদের আলিয়ে মারবো আজীবন। তারা আমার শতা করেছে, আমিও তাদের শত্রুতা করব! কৈফিয়ৎ যদি দিতে হয় তোত দেব আমার নিজের কাজের কৈফিয়ৎ। আমার বাবা যদি চোর হয়… বলতে বলতে থেমে গেলো নিকোলাই। তারপর হঠাৎ উষ্ণ হয়ে বলে উঠলো, আইছে-গবর্ভব ব্যাটার মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব, দেখে নিয়ে।
এণ্ড্রি ব্যগ্র-কৌতুহলে বললো, কেন বলো তো?
ব্যাটা স্পাই, লোকের সর্বনাশ করে বেড়াচ্ছে। ব্যাটার জন্য আজ আমার বাবা পর্যন্ত স্পাই হবার মতলব করছেন।
এণ্ড্রি বুঝলল, নিকোলাইর প্রাণে কী মর্মন্তুদ ব্যথা, কী অসহ যাতনা-এর সান্ত্বনা নেই। যুক্তিতে এ প্রশমিত হয় না, শুধু বললো, ভাই, আমরাও ভুক্তভোগী, আমরাও একদিন অমনি করে ভাঙা কাঁচ মাড়িয়ে রক্তাক্ত পদে চলেছি জীবন-পথে, অন্ধকারে আমরাও অমনি আলোর অন্য হা-হা করেছি।
নিকোলাই বললো, তুমি আমায় বোঝাতে চেয়ো না, বন্ধু, বোঝাবার কিছু নেই। আমার বুকে হাত দিয়ে দেখো-মনে হচ্ছে যেন ক্ষুধার্ত ক্রুদ্ধ নেকড়ের দল গর্জন করছে।
এণ্ড্রি বলে, একদিন এ দূর হবে-সম্পূর্ণভাবে না হলেও, হবে। শিশুর হামের মতো এও মানুষের একটা ব্যাধি। সবাই আমরা এতে ভুগি। যারা শক্তিমান্ তারা ভোগে বেশি। যারা দুর্বল, তারা ভোগে কম। এ ব্যাধি কখন আসে, জানো? যখন মানুষ নিজেকে চিনেছে কিন্তু জীবনের পূর্ণ পরিচয় পায়নি, জীবন-যাত্রায় নিজের স্থান খুঁজে পায়নি। তা না পেয়ে নিজের দামও কষতে পারেনি। তখন তার কেবলই মনে হয়, দুনিয়ার বুকে অপুর্ব চিজ সে, কেউ তাকে মাপতে, পারে না কেউ তার দাম তলিয়ে দেখে না, সবাই চায় তাকে হজম করে ফেলতে। পরে সে বুঝতে পারে, অন্যান্য বহু মানুষের মধ্যে যে প্রাণ তাও তারই মতো…তখন থেকে তার মন নরম হতে থাকে, ন্যাধি উপশম হতে থাকে। লজ্জা জাগে, বোঝে যে, মন্দিরশীর্ষে উঠে একা নিজের ঘণ্টাটি বাজিয়ে লোককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা বৃথা—মন্দিরের বড় ঘণ্টা তার ক্ষুদ্র ঘণ্টাধ্বনিকে ডুবিয়ে দিয়ে বেজে উঠে। বড় ঘন্টার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাগতে হলে চাই ছোট ছোট ঘন্টাগুলির একত্র সম্মিলন। আমি কি বলতে চাচ্ছি, বুঝতে পাচ্ছ নিকোলাই?
হাঁ, কিন্তু বিশ্বাস করি না।
.
খাবার এলে। খেতে খেতে এণ্ড্রি, নিকোলাইকে বোঝাতে লাগলো, কারখানায় কেমন ভাবে সোশিয়ালিষ্ট মতবাদ প্রচারিত হয়েছে। নিকোলাই সব শুনলো, তার মুখ আবার গম্ভীর হয়ে উঠলো, বললো,বড্ডো ধীরে চলছে কাজ, বড্ডো ধীরে। আরও তাড়াতাড়ি হলে ভালো হয়।
এণ্ড্রি বলে, মানুষের জীবনটা তো ঘোড়া নয়, নিকোলাই, যে, চাবুক কষে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে।
নিকোলাই সেই একই সুরে বলতে লাগলো, কিন্তু বড্ডো ধীরে, ধৈর্য থাকে না আমার। কি করি, কি করি! তার অঙ্গভঙ্গিতে গভীর নৈরাশ্য ফুটে ওঠে।
এণ্ড্রি, বলে, আমরা করব জ্ঞান লাভ এবং জ্ঞান বিস্তার।
যুদ্ধ করব কবে? নিকোলাই সহসা প্রশ্ন করলো।
এণ্ড্রি, হেসে বলে, যুদ্ধ কখন করতে হবে তা জানি না, কিন্তু এটা জানি যে তার আগে আমাদের বহু প্রাণ আহুতি দিতে হবে, আর জানি যে, হাতের ছুরি শানাবার আগে শানাতে হবে মগজের বুদ্ধিকে।
এবং প্রাণকে—নিকোলাই যোগ করে।
হাঁ, প্রাণকেও।
কিছু পরে নিকোলাই উঠে শুতে গেলো। মা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ওর মনের মধ্যে কী একটা ভীষণ চক্রান্ত ঘুরছে, এণ্ড্রি।
হাঁ, মা, ওকে বোঝা বড়ো শক্ত, ব’লে এণ্ড্রি ও বিছানায় গেলো। শুনতে পেলো, মা বলছেন, ভগবন, পৃথিবীর যত মানুষ সবাই তো দেখছি কাঁদছে নিজ নিজ ব্যথায়। কোথায় মানুষ সুখী, কোথায় মানুষ আনন্দিত?
এণ্ড্রি, বললো, আসছে, মা, সে শুভদিন আসছে, যে-দিন মানুষ সুখী হবে, আনন্দিত হবে।…
.
১.১৪
জীবন বয়ে চলে এমনি দ্রুত তালে। নিয়মিতভাবে মার ওখানে কর্মীরা মেলে, মতলব আঁটে, কাজ করে। মা কারখানায় ইস্তাহার ছড়ান, ইস্তাহার বেরুবার পরদিন রক্ষীরা মাকে পরীক্ষা করে বিফলকাম হয়। মার আরদ্ধ-ব্রতের প্রতি নিষ্ঠা বাড়ে।
নিকোলাইর কারখানার কাজ গেছে, এখন কাজ করে এক কাঠের গোলায়, আর মোজ মার ওখানে মজলিসে যোগ দেয়। সবাই চলে যাবার পরও সে থাকে। একা এণ্ড্রির মুখোমুখি বসে প্রশ্ন করে, কিন্তু মানুষ যে আজ সর্বহারা, তার জন্য সব চেয়ে বেশি দায়ী কে—জার?
এণ্ড্রি বলে, দায়ী সেই, যে প্রথম উচ্চারণ করেছিল, এই আমার জিনিস। কিন্তু সে লোকটা মারা গেছে বহু হাজার বছর–তার ওপর রাগ ঝাড়বার উপায় নেই।
কিন্তু ধনী আর তাদের মুরুব্বীরা তাদের কথা কি বলছ? তারা কি নির্দোষ?
এণ্ড্রি তার জবাবে বহু যুক্তিপূর্ণ কথা বলে,—নিকোলাইর মন প্রসন্ন হয় না। সাধারণ মানুষও যে সব দোষের সঙ্গে জড়িত, একথাটা তার মন মানতে চায় না। একদিন সে বলে, দুনিয়া থেকে ঐ দুষ্ট আগাছগুলোকে নির্দয়ভাবে চষে ফেলতে হবে আমাদের।
মা বলেন, আইছেও এমনি কথা বলেছিল।
স্পাই আইছের নাম শুনে মুহূর্তে নিকোলাইর মন কঠিন হয়ে উঠলো। বললো, একজন দোষী ঐ। বলে চলে গেলো।
এণ্ড্রি বললো, সত্যিই আইছে বড় বেড়ে উঠেছে, মা। রাতদিন ও লোকদের ধরিয়ে দেবার মতলবে ঘরের আনাচে-কানাচে ঘুরছে। নিকোলাই একদিন ওকে ধরে আচ্ছা মতো দিয়ে দেবে। কর্তা জনসাধারণের মন কী পর্যন্ত বিষিয়ে তুলেছে দেখ। নিকোলাইর মতো লোকেরা যখন অন্যায়ের অত্যাচারে ধৈর্য হারাবে, তখন কী ভীষণ ব্যাপার হবে! পৃথিবী হবে রক্ত-রঞ্জিত, আকাশেও যেয়ে সে রক্তের ছোপ লাগবে।
.
একদিন অকস্মাৎ পেভেল এসে হাজির হল। মার বুক আনলে উদ্বেল হয়ে উঠলো। মা এণ্ড্রিকে ডাকলেন। তিন জনে প্রাণ খুলে কথা বলতে লাগলো। মা খাবার নিয়ে এলেন। খেতে খেতে এণ্ড্রি রাইবিনের কথা তুললো। পেভেল বললো, আমি থাকলে তাকে যেতে দিতুম না। কি সম্বল করে বেরুলো সে?–অসন্তোষ এবং অজ্ঞানান্ধকার।
এণ্ড্রি হেসে বলে, চল্লিশ বছর অবিরত সংগ্রাম করার ফলে অন্তর যার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে তাকে বাগ মানানো সোজা নয়, বন্ধু।
পেভেল কঠিন সুরে বললো, কেন? তুমি কি মনে কর, জ্ঞান মানুষের মনের পুঞ্জীভূত ভ্রান্তি দূর করতে পারে না?
এণ্ড্রি অর্থপূর্ণ ভাষায় বললো, একলাফে একেবারে আকাশে উঠতে যেয়ো না, পেভেল, দুর্গের চূড়ায় ঘা খেয়ে ডানা ভেঙে যাবে।
তারপর চললো দুই বন্ধুতে বিতর্ক। মা তার এক বর্ণও বুঝতে পারলেন না, শুধু বুঝলেন, পেভেল চাষীদের কথা ভেবে তাদের জন্য নির্ধারিত পন্থার একচুল এদিক-ওদিক যেতে রাজি নয়। এণ্ড্রি চাষীদের পক্ষে, বলে, তাদেরও শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। এর মধ্যে এণ্ড্রির মতটাই মার মনে লাগে। এমনি করে খাওয়া শেষ হয়, দিন কাটে।
.
১.১৫
মে মাসে মজুরদের একটা উৎসবের আয়োজন হ’ল। বন্দী মজুররা সবাই জেল থেকে এসেছে। উৎসবের ধরণ সম্বন্ধে দুদলের দু’মত। একদল বলে, সশস্ত্র হয়ে মজুরদল বেরিয়ে পড়ুক; আর একদল বলে, না। মজুররা দলে দলে নিশান হাতে সাম্য মন্ত্র ধ্বনি কবে শোভাযাত্রা করুক, শেষোক্ত দলই ভারি। আইভানোভিচ বললো, বন্ধুগণ, বর্তমানের এই ব্যবস্থাকে বদলে দেওয়া একটা মহান্ কাজ, কিন্তু তার জন্য সব্বার প্রথমেই চাই আমার জন্য একজোড়া ওভার-সু, এ ছেঁড়া জুতোর বদলে; কারণ এই ওভার-সুই সোসিয়ালিজমেব জয়যাত্রায় আমাদের সব চেয়ে বেশি কাজে লাগবে। এই পুরাণে ব্যবস্থাকে খোলাখুলি উলটে ফেলে না দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে একপাও যেতে চাই না আমি… তাই তো বলি, অস্ত্র এখন থাক।
মা তাদের বাদানুবাদ শুনতেন। তাদের মুখেই শুনলেন তিনি, একদল লোক, যাদের বলে বুর্জোয়া, তাই জনসাধারণের শত্রু। জার যখন ছিলেন, তখন তারা জনসাধারণকে ক্ষেপিয়েছে জারের বিরুদ্ধে, তারপর জনসাধারণ যখন জারকে সরিয়েছে সিংহাসন থেকে, তখন তারা ছলা-কলায় শক্তি আত্মসাৎ করে জনসাধারণকে কোণঠাসা করে বেধেছে,–জনসাধারণ এব প্রতিবাদ করলে তাদের হত্যা করেছে শতে শতে, সহস্রে সহস্রে, মানুষকে চিবিয়ে, পিষে, চুষে মারছে তারা। এই বুর্জোয়াদল…এই ধনীদল…সোনার ভারে প্রাণ তাদের চাপা পড়ে গেছে। এরা মানবজাতির নিষ্ঠু্রতম শত্রু, প্রধানতম প্রবঞ্চক, সর্বাপেক্ষা উগ্র বিষ-পতঙ্গ।
.
শশেংকাও আসে প্রায়ই। না একদিন আড়াল থেকে শুনতে পান পেভেল আর সে কথা বলছে।
তুমিই নিশান বয়ে নিয়ে যাচ্ছ?
হাঁ।
ঠিক হয়ে গেছে।
হাঁ, আমিই এর অধিকারী।
অর্থাৎ আবার তুমি জেলে যাবে। এ কি সম্ভব হত না…
কি?
যে, আর কেউ নিশান বয়ে নিয়ে যেতে?
না।
এবার ভেবে দেখ, কত প্রভাব তোমার। সবাই তোমায় কত পছন্দ করে। তোমার আর নাথোদকার মতো নামজাদা বিপ্লবপন্থী আমাদের মধ্যে আর নেই। একবার ভেবে দেখ, মুক্তিকল্পে কত-কি করার শক্তি আছে তোমার। তাই তো তোমাকে পেলে তারা ছাড়বে না, দীর্ঘকালের জন্য দূরে সরিয়ে ফেলবে তোমায়।
না শশা, আমি সংকল্প করেছি, কোন কিছুই সে সংকল্প থেকে আমায় টলাতে পারবে না।
পারবে না? যদি আমি অনুরোধ করে বলি, পেভেল…
এমন অনুরোধ তোমার করা উচিত নয়, শশা।
উচিত নয় পেভেল! আমি মানুষ, রক্ত-মাংসধারী মানুষ।
শুধু মানুষ নও, অতি-মানুষ। তাইতো তোমাকে আমি ভালোবাসি এবং জানি তুমি অমন অনুরোধ করতে পারে না।
তবে যাও পেভেল…বলে শশা তাড়াতাড়ি চলে যায়।
মার মন আবার আশঙ্কায় দুলে উঠে। পেভেলের সঙ্গে দেখা হলেই জিগ্যেস করেন, পয়লা মে আবার কি করতে চাস?
পেভেল বলে, নিশান হাতে শোভাযাত্রা চালিয়ে নিয়ে যাবে। এতে জেল হবে বলে মনে হয়।
মার চোখ সজল হয়ে এলো। পেভেল মার হাত ধরে বললো, আমায় এযে করতেই হবে, মা। এতেই আমার সুখ, তুমি কি এতে বাধা দেবে, মা!
না, বাধা দেবো না–মা ধীরে ধীরে বলেন।
তার বিষণ্ণ দৃষ্টি পেভেলের চোখ এড়ালোনা, বললো, দুঃখ করো, না, এতে তো আনন্দ করা উচিত। কবে আমাদের দেশে তেমন মা হবে, যারা হাসিমুখে ছেলেদের মৃত্যুর মুখে তুলে দেবেন?
এণ্ড্রি, চিমটি-কাটার মতো করে বললো, ওহে, একটু আস্তে আস্তে চালাও…
মা বললেন, না, তোমায় আমি বাধা দেবো না, পেভেল, কিন্তু কান্না…আমি কেমন করে রোধ করব…আমি যে মা…
এক রকমের ভালোবাসা আছে, যা মানুষের সমস্ত জীবনটাকে মাটি করে দেয়। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে এই কথা বলে পেভেল মার কাছ থেকে সরে যায়।
মা কেঁপে উঠলেন। পেভেল পাছে আরো এমনি নিষ্ঠুর আঘাত দেয়, সেই আশঙ্কায় তিনি বলেন, বাধা দেবো না, পেভেল, বাধা দেবো না। আমি বুঝি, সঙ্গীদের জন্য আজ তোকে একাজ করতেই হবে।
পেভেল বললো, সঙ্গীদের জন্য নয়, তাদের জন্য হলে না করেও পারতুম। এ আমার নিজের জন্য দরকার।
মা চলে গেলেন। এণ্ড্রি দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। এবার এগিয়ে এসে মায়ের ওপর পেভেলের অনাবশ্যক রূঢ়তার প্রতিবাদ করলো, বললো, এমন স্নেহময়ী মায়ের ওপর এমন আস্ফালন করার কোনই দরকার ছিল না, ওর এক কাণাকড়িরও কদর নেই।
পেভেল নিজের ভুল বুঝতে পেরে মার কাছে ক্ষমা চাইলো, অবুঝ ছেলেকে ক্ষমা কর, না।
মা ছেলের মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে আর্তকণ্ঠে বলেন, যা দরকার তা করিস বাবা, শুধু বুড়ো মাকে কাঁদাসনি।
এণ্ড্রিকে ডেকে বললেন, ও তোর অবুঝ ছোট ভাই, ওকে বকিসনি বাবা।
না বাবা, না বাবা, বলে মা এণ্ড্রির হাত ধরলেন।
এণ্ড্রি তখন বললো, তুমি পাগল হয়েছ, মা আমি পেভেলের গায়ে হাত দোব! আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি দেখতে পারি না হতভাগাকে। নতুন জামা পরেছেন উনি, তাই গরবে আর মাটিতে পা পড়ে না, যাকেই পায় তাকেই ঠেলা দিয়ে বলে, দেখ, কেমন জামা পরেছি। জামাটা ভালো, কিন্তু হ’ক ভালো, তাই বলেই কি লোককে এমনি করে ঠেলতে হবে? বলে, এমনিতেই মানুষ হয়ে আছে অতিষ্ঠ…
পেভেল হেসে বলল, কতক্ষণ মুখ চালাবে আর? কম তো বাক্যবাণ নিক্ষেপ করনি?
এণ্ড্রি মেঝেয় উনুনের সামনে পা ছড়িয়ে বসে ছিলো। লেভেল সুয়ে পড়ে তার হাত জড়িয়ে ধরলো।…তার কিছুক্ষণ পরেই দু’ভাইয়ে মতোই তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ হ’ল। দেখে মার চোখ আনন্দাশ্রুতে ভয়ে উঠলো। তারপর যেন তিনি লজ্জিত হয়ে বললেন, এ মেয়ে মানুষের চোখের জল, দুখেও ঝরে, সুখেও ঝরে।
পেভেল বললো, এ চোখের জলে লজ্জিত হবার কিছু নেই, মা।
এণ্ড্রি বললো, গর্ব করা উচিত নয় কিন্তু সত্যিই আমরা এক নবজীবনের আস্বাদ পাচ্ছি এখন। এ জীবন খাঁটি, মনুষোচিত, প্রেমে, মঙ্গলে পরিপূর্ণ।
পেভেল মার দিকে চেয়ে বললো, হাঁ।
মা বললেন, জীবনের ধারা যেন বদলে গেছে। আজ এসেছে নতুন রকমের দুঃখ, নতুন ধরণের আনন্দ। তা যে কী, তা জানি নে, বুঝি নে, ব্যক্ত করতে পারিনে ভাষায়।
এণ্ড্রি বললো, এই তো হওয়া উচিত। দুনিয়ার দিকে নজর দিয়ে দেখো, মা, একটা নতুন প্রাণের জন্ম হচ্ছে, একটা নতুন প্রাণ জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছে! এতকাল সকল প্রাণ ছিল স্বার্থের সংঘাতে নিপীড়িত, অন্ধলোভে জর-জর, হিংসা-বিদ্বেষে ভারাক্রান্ত, মিথ্য-ভীরুতা-হীনতায় দুষিত, রোগজীর্ণ, শঙ্কিত-জীবন, কুহেলির যাত্রী,–নিজের ব্যথাভারে ক্রন্দনোম্মুখ,–হঠাৎ তারি মধ্য থেকে জেগে উঠেছে এক নতুন মানুষ, যুক্তির আলোকে জীবনকে সে আলোকিত করেছে। মানুষকে ডেকে বলছে, ওগো পথ-ভ্রান্ত বন্ধুর দল, আজ দিন এসেছে এ সত্য উপলব্ধি করার যে, তোমাদের সবার স্বার্থ এক, তোমাদের প্রত্যেক মানুষের বাঁচবার দরকার আছে, বাড়বার দরকার আছে। আজও সে একা, তাই কণ্ঠস্বর তার এতো তীব্র। তার আহ্বানে খাঁটি কর্মীরা একপ্রাণ হয়ে দাঁড়ায়, বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করে নব বাণী, হে আমার দেশ-বিদেশের বন্ধুগণ, তোমরা মিলিত হয়ে এক নানগোষ্ঠী গঠন কর! তোমাদের জীবনের প্রতি প্রেম-ঘৃণা নয়। আমি শুনতে পাচ্ছি, বিশ্বময় আজ সেই ৰাই প্রতিধ্বনিত…রাতে বিছানায় শুয়ে…একা লেগে…সর্বত্র এই বাণী শুনি, আর প্রাণ নেচে ওঠে। দুঃখ, অন্যায়ের ভারে প্রপীড়িতা এই ধরণীও সে আহ্বানে সাড়া দেয়, কেঁপে কেঁপে ওঠে, আর মানুষের হৃদয়াকাশে উদিত নবারুণকে সৎবর্ধিত করে।…
পেভেল তাকে কি বলতে যাচ্ছিল, মা বাধা দিয়ে বললেন, ওর কথা শেষ করতে দে।
দীপ্রোজ্জ্বল চক্ষু তুলে এণ্ড্রি বললো, কিন্তু জানো, এখনো অনেক দুঃখ সইতে হবে মানুষকে, লোভের হাতে এখনো তার অনেক রক্তপাত হবে, কিন্তু আমাদের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত রক্তও কম মুল্যবান মনে হবে তার কাছে, যা আমরা এরি মধ্যে পেয়েছি উদ্বেল বক্ষে, চঞ্চল মনে, শিরায় শিরায়। তারা যেমন সোনার আলোকে ধনী, আমিও তেমনি ধনে ধনী হয়েছি। সমস্ত বোঝা আমি বইব, সমস্ত দুঃখ আমি সইব; কারণ প্রাণে আমার সেই আনন্দের সাড়া পেয়েছি, যা কেউ কোনোকিছুতে চেপে রাখতে পারে না। এই আনন্দের মধ্যে নিখিল শক্তি নিহিত।
নব-জীবনকে এমনিভাবে অভিনন্দিত করতে লাগলো তারা।