দ্য বিলিয়ন ডলার কেস
[হোটেল পেঙ্গুইন হত্যামামলা
তদন্তকারী অফিসার শুভাশিস ভট্টাচার্য]
“নো স্যার! টেলিফোন ইয়েস, টেলিগ্রাফ ইয়েস, টেলিস্কোপ ইয়েস, টেলিপ্রিন্টার ইয়েস, বাট টেলিপ্যাথি?… নো স্যার!”
‘সোনার কেল্লা’-র দৃশ্য মগজে হানা দিয়ে যায় লেখা শুরু করতে গিয়ে। কপালজোরে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ‘আসল’ ড. হাজরা, সারা মুখে ব্যান্ডেজ, সাহায্য চাইতে এসেছেন রাজস্থানের থানায় অপহৃত মুকুলের খোঁজে। কৌতুক আর অবিশ্বাসের মিশেল ইনস্পেকটরের চোখেমুখে। ড. হাজরা ‘প্যারাসাইকোলজিস্ট’ হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে কিছুটা ঘাবড়েই গেলেন অফিসার, এ শব্দ কস্মিনকালে শোনেননি। ড. হাজরা তবু শেষ চেষ্টা করলেন মরিয়া, “আপ টেলিপ্যাথি জানতে হ্যায়?” এর পরই অফিসারের সেই “নো স্যার!…”
বিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন ইয়েস, বিলিয়ন ডলার স্মাইল ইয়েস, বিলিয়ন ডলার ডিল ইয়েস, বাট বিলিয়ন ডলার নোট?
আমাকে-আপনাকে প্রশ্ন করলে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হবে ওই অবধারিত “নো স্যার!” যেমন হয়েছিল আমাদের হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দাদের, আজ থেকে বছর পনেরো আগে বউবাজার থানার একটি খুনের মামলায়। কিনারা হওয়ার পর আদালতের বিচারপর্বে যে কেসের নামই হয়ে গিয়েছিল, ‘দ্য বিলিয়ন ডলার কেস।’
কেস নম্বর ৪৯, তারিখ ০৭.০২.২০০৩। থানা, আগেই লিখেছি, বউবাজার। খুনের মামলা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায়।
ধর্মতলা থেকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ধরে উত্তর দিকে হাঁটা দিলে ডান হাতে পড়ে যদুনাথ দে রোড। মধ্য এবং উত্তর কলকাতার বহু পুরনো রাস্তাগুলি যেমন হয়। চাকচিক্য নেই, আভিজাত্য আছে। নতুনের দেখনদারি নেই, পুরনো সেই দিনের কথা আছে। ‘হোটেল পেঙ্গুইন’ এই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই। এ অঞ্চলে যথেষ্ট নামডাক আছে এই হোটেলের। গুগল ম্যাপে ‘যদুনাথ দে রোড’ লিখে সার্চ দিলে দুটো কাছাকাছি দিকচিহ্ন পাবেন। একটা সেন্ট জোসেফস্ কলেজ, অন্যটা এই হোটেল পেঙ্গুইন।
৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩। সকাল গড়িয়ে একটু বেলার দিকে ফোন বাজল বউবাজার থানায়, স্যার, হোটেল পেঙ্গুইন থেকে বলছি। তাড়াতাড়ি আসুন, মার্ডার! থানা থেকে গাড়িতে খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব, অফিসাররা ছুটলেন। খবর গেল ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে। তড়িঘড়ি রওনা দিলেন হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারাও।
কী ব্যাপার? হোটেলের দু’তলায় রুম নম্বর ১০২, ডাবল-বেড। ৬ তারিখ সকালে দু’জন এসে ওই রুমে ওঠেন। রেজিস্টারে নাম রয়েছে, সুমন বিহারি আর মতিলাল সাউ। সন্ধের দিকে মতিলাল হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। রাতে ফিরতে দেখেনি কেউ। পরের দিন সকালে হোটেলের হাউসকিপিং-এর কর্মীরা নিয়মমাফিক ঘরে ঘরে যাওয়া শুরু করলেন। শুধু ১০২ নম্বরের দরজা কিছুতেই খুলছে না, বারবার বেল বাজানো আর ‘নক’ করা সত্ত্বেও। কর্মীরা অপেক্ষাও করলেন কিছুক্ষণ। হয়তো বেশি রাত করে শুয়েছেন বোর্ডাররা, গভীর ঘুম ভাঙছে না সহজে। আধঘণ্টা পর আবার ডাকাডাকি, দরজায় শুধু টোকা নয়, এবার রীতিমতো ধাক্কা। তবু কোনও সাড়াশব্দ নেই। সন্দেহ এবং আশঙ্কা গাঢ় হল। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খোলার সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যানেজার।
হোটেল পেঙ্গুইন
ঘরের ভিতরের দৃশ্য এইরকম। অবিন্যস্ত একটি বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে আছেন সুমন বিহারি। নাড়ি টেপার দরকার নেই, এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়, প্রাণহীন শরীর। মৃতের শরীরে সাদা শার্ট, হাফ-হাতা ক্রিমরঙা সোয়েটার, ছাই রঙের ট্রাউজার। নাকমুখ দিয়ে চুঁইয়ে পড়া রক্ত জমাট বেঁধে আছে আশেপাশে। শরীরে আর কোথাও কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই। লক্ষণ যা, সম্ভবত শ্বাসরোধ করে খুন। একটি খালি বিয়ারের বোতল ঘরের এক কোণে। আর ঘরের ডেস্কের উপর ৬ তারিখের ‘সংবাদ প্রতিদিন’ কাগজটি পড়ে। বারো পাতার কাগজের একটি পাতা নেই।
অনেকেই জানেন হয়তো, অপরাধের ঘটনাস্থলকে পুলিশি পরিভাষায় বলে P.O. (Place of Occurrence)। যে-কোনও অপরাধের তদন্তে P.O. হল সেই প্রথম সিঁড়ি, যার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণেই শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছনোর চাবিকাঠি লুকিয়ে থাকে কখনও কখনও। গোয়েন্দারা কিচ্ছু বাদ দিলেন না ঘরের। বিয়ারের বোতলটি খুঁটিয়ে দেখা হল। ‘ডেভেলপ’ করার মতো স্পষ্ট হাতের ছাপ নেই। তবু নেওয়া হল, যৎসামান্য যা পাওয়া গেল। ৬ তারিখের ‘সংবাদ প্রতিদিন’ কাগজটি সংবাদপত্রের অফিস থেকে আনা হল চটজলদি। যে পাতাটি ঘরে পাওয়া কাগজে ছিল না, সেটি দেখা হল মন দিয়ে। নাহ্, তদন্তে সাহায্য করার মতো কিছু নেই। ঘরে পাওয়া কাগজটির বাকি পাতাগুলিতেও কোথাও কিছু নেই হাতে লেখা, যা দিশা দেখাতে পারে।
রুম নং ১০২
বিছানার চাদর-বালিশ-তোশক, ডাস্টবিনের আনাচকানাচ, খাট-চেয়ার-টেবিল, আয়না-সিলিং ফ্যান-এসি, মায় বাথরুমের বেসিন-কমোড-সিস্টার্ন, ঘরের প্রতিটি সেন্টিমিটার-মিলিমিটার চিরুনিতল্লাশি করেও এমন কোনও সূত্র মিলল না, যা দিয়ে আততায়ীর কাছে পৌঁছনোর প্রাথমিক দিকনির্দেশ সম্ভব। মৃতের ট্রাউজ়ারের পকেট থেকে একটি নোটবুক ছাড়া, যাতে বেশ কিছু নাম-ঠিকানা, কিছু ফোন নম্বর। বেশ উৎসাহব্যঞ্জক ‘ক্লু’, ভাবলেন অফিসাররা।
নোটবুকের আদ্যোপান্ত দেখা হল। লিখে রাখা নাম-নম্বর যাচাই করে নিহত ব্যক্তির শনাক্তকরণ বিশেষ কষ্টসাধ্য হল না। মৃতের নাম সুমন বিহারি নয়। ভুল নামে উঠেছিলেন হোটেলে। আসল নাম তপন দাস, থাকতেন তপসিয়া থানার রাইচরণ পাল লেনে পেয়িং গেস্ট হিসেবে। পূর্ণচন্দ্র সাহা নামের এক মাঝবয়সির বাড়িতে। সাহাবাবু দেখা গেল নিপাট ভদ্রলোক, শনাক্ত করলেন মৃতকে। বললেন, তপন কম কথা বলতেন। মাঝে মাঝে কিছু লোকজন দেখা করতে আসতেন তাঁর সঙ্গে। তপন বলেছিলেন ব্যবসা করতেন, তবে ঠিক কীসের ব্যবসা, বিশেষ কিছু জানেন না সে ব্যাপারে। তবে তপন যে অবিবাহিত, এটুকু জানতেন। আত্মীয় বলতে নিহতের এক ভাইয়ের খোঁজ পাওয়া গেল খড়দহে। যিনি জানালেন, তপনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল না দীর্ঘদিন।
দাহ হওয়ার আগে ময়নাতদন্তে পাওয়া গেল প্রত্যাশিত তথ্য, খুন শ্বাসরোধ করেই।
‘হোটেলের ঘরে সঙ্গীকে খুন করে আততায়ী ফেরার, অন্ধকারে পুলিশ’ জাতীয় হেডিং দিয়ে খবর হল কাগজে। শহরে নাগরিক-নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা শুরু হল। আর অবধারিত চাপ তৈরি হল গোয়েন্দা বিভাগের উপর। কিনারা চাই, এবং দ্রুত। খুনিকে, সে যে-ই হোক, ধরে আনতে হবে।
লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে! সত্যিই তখন অন্ধকারেই পুলিশ। হোটেলের কর্মীরা যাঁরা ছিলেন ৬ তারিখ ভোর থেকে পরের দিন ঘরের দরজা ভাঙা পর্যন্ত, কথা বলা হল সকলের সঙ্গে। কেমন দেখতে ছিল মৃতের সঙ্গীকে? উত্তরে যা পাওয়া গেল, তাতে এক ইঞ্চিও এগোল না তদন্ত। মাঝারি উচ্চতা, গায়ের রং সামান্য চাপা, চেহারা একটু মোটার দিকে। এটুকুতে হয়? এমন চেহারার শ’পাঁচেক লোক তো হোটেলের এক কিলোমিটারের মধ্যে পাওয়া যাবে অনায়াসে। চশমা ছিল? না। টাক ছিল? না। অন্য কোনও বিশেষত্ব চেহারায়, কোনও কাটা দাগ মুখে, বা খুঁড়িয়ে হাঁটার প্রবণতা? না স্যার, মনে পড়ছে না। কথা বলার কোনও বিশেষ ভঙ্গি? খেয়াল করিনি স্যার, হিন্দিতে কথা বলছিল রেজিস্টারে নাম লেখার সময়, তবে বাংলা টান ছিল।
মৃত যে বাঙালি, সে তো জানাই হয়ে গিয়েছে। ধরে নেওয়া গেল, সম্ভাব্য আততায়ী ‘মতিলাল’-ও বাঙালি। কিন্তু এই তথ্যের থেকেও ঢের বেশি জরুরি প্রশ্ন, ভুল নাম-ঠিকানা কেন রেজিস্টারে? নিজেদের হিন্দিভাষী বলে প্রমাণ করার চেষ্টা কেন? অপরাধের মতলব ছিল কোনও? থাকলে কী অপরাধ? সেখানেই কি লুকিয়ে রহস্যভেদের ঠিকানা?
মৃতের পকেট থেকে পাওয়া নোটবুকের প্রতিটি নাম-ঠিকানা, প্রতিটি নম্বরের ঠিকুজিকুষ্ঠি নিয়ে পড়লেন গোয়েন্দারা। প্রায় সব নম্বরই উত্তর চব্বিশ-পরগনার। বিস্তর তথ্যতালাশ করে জানা গেল, নানা ধরনের জালিয়াতিই ছিল মৃত তপনের পেশা বলুন বা জীবিকা। চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে বেকার যুবক-যুবতীদের টাকা আত্মসাৎ করা, তাড়াতাড়ি ব্যাংক থেকে লোন পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোক ঠকানো, আরও এই জাতীয়।
পাওয়া গেল আরও একটি তথ্য। সম্প্রতি এক অভিনব প্রতারণা-চক্রের পান্ডাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল তপনের। অনেকের মনে থাকতে পারে, সেসময় ‘চাল টানা’-র গুজবে রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার গ্রামাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অংশে। কাগজেও লেখা হয়েছিল বিষয়টি নিয়ে। ‘চাল টানা’ মানে? গুজব ছড়িয়েছিল, পুরনো দিনের হাঁড়িকুড়ি-বাসনপত্র নাকি চুম্বকের মতো টেনে নিচ্ছে কাছাকাছি থাকা চালের স্তূপকে। আর যে বাসনপত্র চাল টানছে, তা যে ধাতু দিয়ে তৈরি তার দাম নাকি আন্তর্জাতিক বাজারে আকাশছোঁয়া। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে একরকম প্রতিযোগিতাই শুরু হয়ে গেল বাড়িতে বাড়িতে। যে যার বাসনপত্র আর চাল জড়ো করে হা-পিত্যেশ করে ‘চাল টানা’-র অপেক্ষায়। তৈরি হল অশিক্ষা, গুজব আর লোভের ত্রিভুজ।
সুযোগটা লুফে নিয়েছিল কিছু প্রতারক। যারা ধাতু বিক্রির এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে ঘরে ঘরে ঢুঁ মারতে শুরু করল। এবং প্রতিশ্রুতি দিল, কিছু টাকা অগ্রিম দিলে তারা বাসনকোসনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেবে। অনেকে বিশ্বাস করে ঠকলেন। উল্লেখ্য, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের অন্যান্য রাজ্যেও বিভিন্ন সময়ে এই ‘rice pulling trick’-এর নামে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছিল।
উত্তর চব্বিশ পরগনায় ‘চাল টানা’-র সক্রিয় চক্রগুলির কয়েকটিকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। কিন্তু লাভ হল না বিশেষ। শ্যামবর্ণ মাঝারি উচ্চতার মোটা লোকের কথা কেউ কেউ বলল বটে, কিন্তু ওটুকুই। নাম-ঠিকানার হদিশ মিলল না। যে তিমিরে ছিল, তদন্ত রয়ে গেল সেই তিমিরেই।
আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন সূত্র অধরা থাকে, তখন হতাশাগ্রস্ত না হয়ে পড়াটা দক্ষ তদন্তকারীর আবশ্যিক গুণের মধ্যে পড়ে। গোয়েন্দারা ঠিক করলেন, আবার শূন্য থেকে শুরু করবেন। ফিরে যাওয়া হল হোটেলে। শুরু হল আর এক প্রস্থ প্রশ্নোত্তর হোটেলকর্মীদের নিয়ে। ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনন্ত ধৈর্য লাগে একই প্রশ্ন অনেককে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অসংখ্যবার করতে। তবু করে যেতেই হয়, কার কথায় কী কখন বেরিয়ে আসে তার অপেক্ষায়। বারবার তোতাপাখির মতো আউড়ে যেতে হয়, আর একটু ভেবে দেখুন, আর কিছু মনে পড়ছে?
সম্ভাব্য সূত্র বেরিয়েও এল এক কর্মীর কথায়। রুম সার্ভিসে কাজ করেন। জানালেন, ৬ তারিখ দুপুরে এক প্লেট চিকেন পকোড়া আর স্যালাডের অর্ডার এসেছিল ১০২ নং রুম থেকে। এ তথ্য আমরা হোটেলের নথি থেকে আগেই পেয়েছিলাম, অজানা ছিল না। প্রথম অর্ডারের কিছুক্ষণ পর রুম সার্ভিসে এসেছিল দ্বিতীয় অর্ডার, চিকেন পকোড়া আর এক প্লেট। এটাও জানাই ছিল। বাড়তি কিছু জানালেন কর্মীটি। বললেন, দ্বিতীয় বার যখন খাবার দিয়ে বেরিয়ে আসছেন, দুই বোর্ডারের মধ্যে তর্কাতর্কি হচ্ছিল। কী নিয়ে তর্ক? কর্মীটির যতদূর মনে পড়ছে, ‘সার্কাস’ শব্দটি শুনেছিলেন কয়েকবার।
‘সার্কাস’? এ-ই কি তা হলে সেই কাঙ্ক্ষিত সূত্র? এরা কি সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল কোনও ভাবে? ঘটনার আগের দিন সার্কাস দেখেছিল? ঠকিয়েছিল কোনও সার্কাসের কর্মীকে?
আজকাল সার্কাসের সেই রমরমা নেই। যখনকার কথা লিখছি, তখন ছিল। শহরে তো বটেই, গ্রামেগঞ্জেও তুমুল জনপ্রিয় ছিল সার্কাস। খুনের ঘটনা ফেব্রুয়ারি মাসের, শীত তখনও ছুটি নেয়নি। সার্কাসের দলগুলিও তাঁবু গোটায়নি। হইহই করে বেরিয়ে পড়া হল, চষে ফেলা হল শহর ও আশেপাশের জেলার নামী-অনামী সার্কাস। সম্ভাব্য আততায়ীর ছবি (বিবরণ অনুযায়ী হাতে আঁকা) দেখিয়ে অনুসন্ধান হল যতরকম ভাবে সম্ভব। ফল কিন্তু শূন্য, আততায়ীর পরিচয়ের সামান্যতম ইঙ্গিতও পাওয়া গেল না।
এ বার? কূলকিনারা পাওয়ার আর রাস্তা কই? হতাশ তদন্তকারী দল ফিরছিল নৈহাটির একটি সার্কাসের খোঁজখবর নিয়ে, শূন্য হাতেই। কেসের কিনারা বোধহয় আর হল না, এই আক্ষেপকে সঙ্গী করে। কিন্তু ওই যে, “কখনও সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে, ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা…”। কলকাতা ফেরার পথেই কিনারাসূত্র এল আচম্বিতে, পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতোই।
গাড়ি ছুটছিল নৈহাটি পেরিয়ে জগদ্দলের দিকে, ঘোষপাড়া রোড ধরে। পরিশ্রান্ত অফিসারেরা ঠিক করলেন, কোথাও গাড়ি থামিয়ে একটু চা খাবেন। ড্রাইভারের বাড়ি নোয়াপাড়ায়। বললেন, সামনেই সার্কাস মোড়। ওখানে দাঁড় করাচ্ছি, ভাল দোকান আছে। গাড়ি দাঁড়াল জগদ্দলের সার্কাস মোড়ে। চা খেতে খেতে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখলেন এক অফিসার। অন্যদের বললেন, আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, রুম সার্ভিসের ছেলেটা পুরোটা খেয়াল করেনি। সার্কাস মোড়ের ‘সার্কাস’-টুকু শুধু স্মৃতিতে থেকে গিয়েছে। আততায়ী যে প্রতারকদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছিল, সবই তো উত্তর চব্বিশ পরগনার। সার্কাস মানে এই সার্কাস মোড় নয় তো? অন্যরা ভাবলেন, সত্যিই তো, কর্মীটি তো আর আড়ি পাততে ঘরে ঢোকেনি। অত খেয়াল করা বা মনে রাখার কথাও নয়। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ‘সার্কাস’-ই হয়তো শুধু মনে করতে পেরেছে। খোঁজ নিয়ে দেখাই যাক না সার্কাস মোড়ের সংলগ্ন এলাকায়।
একাধিক অভিজ্ঞ সোর্স লাগানো হল জগদ্দলে, যারা সিঁধিয়ে গেল এলাকার অলিগলি-মহল্লায়। দিন দুয়েকের মধ্যেই খোঁজ মিলল একজনের, জগদ্দলেই বাড়ি। ‘মতিলাল’-এর চেহারার বর্ণনার সঙ্গে মিল প্রচুর, এলাকায় সুনাম নেই তেমন। আটক করা হল। আসল নাম জানা গেল, বাপি মুখার্জি। খুচরো চড়-থাপ্পড়ও দেওয়ার দরকার পড়েনি। লালবাজারের ‘ইন্টারোগেশন রুমে’ কড়া পুলিশি ধমকেই কাজ হল। এবং বাপির মুখ থেকে বেরোল সেই পাঁচটি শব্দ, যার থেকে বেশি শ্রুতিমধুর কিছু তদন্তকারী অফিসারদের কাছে হতে পারত না, ‘মারবেন না, সব বলছি স্যার!’
যে খুন হল এবং যে খুন করল, দু’জনেই ছিল ঝানু প্রতারক। বাপির সঙ্গে তপনের আলাপ হয় মাসখানেক আগে জগদ্দল স্টেশনে, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই, হওয়ারই ছিল। কিন্তু পরিণতি যে এত বিয়োগান্ত হতে যাচ্ছে, দু’জনেরই বোধহয় কল্পনার বাইরে ছিল। তপন একটা বিলিয়ন ডলারের জাল নোট পেয়েছিল তার কোনও প্রতারক বন্ধুর থেকে। এমন জাল মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের নোট বিক্রি করার চেষ্টা করে ধরা পড়ার বেশ কিছু ঘটনা ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পাবেন। অতীতে ঘটেছে দেশের বিভিন্ন প্ৰান্তে, ঘটেছে বিদেশেও। বাপির লোভ হয় দেখে। জানত না, এমন নোটের অস্তিত্ত্বই নেই। আবার তপনও ছিল এলেমদার জালিয়াত, ‘চাল-টানা’-র ঠগবাজির সঙ্গে বাপি জড়িত জানতে পেরে দুষ্টুবুদ্ধি খেলে যায় মাথায়। বাপিকে বলে, এই ব্যবসায় সে পুরনো খিলাড়ি। তার অনেক চেনাজানা এজেন্ট আছে, যারা দুর্মূল্য ধাতুর বেচাকেনার কারবার করে। বিলিয়ন ডলার নোটপ্রাপ্তি তো এই কারবার করেই। কিছু টাকা দিলে বাপির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে তাদের।
তপন বুনো ওল হলে বাপিও ছিল বাঘা তেঁতুল। বিশ্বাস অর্জনের জন্য কিছু টাকা দিয়েও দেয় তপনকে। তপনও প্রতিশ্রুতিমতো বাপিকে নিয়ে রওনা দেয় কলকাতায় এজেন্টের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে বলে। সম্ভবত ভেবেছিল, ভুলভাল কিছু লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে আরও কিছু টাকা হাতিয়ে নেবে। বাপি অন্য ছক কষেছিল, হোটেলে রাত্রে তপন ঘুমিয়ে পড়লে বিলিয়ন ডলারের নোটটি হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেওয়ার। দুই প্রতারক একে অপরকে ঠকানোর উদ্দেশ্যে এসে উঠল হোটেলে, নিজেদের আসল নাম গোপন করে।
ঘটনার দিন দুপুরে বিয়ার খেতে খেতেই বাগবিতণ্ডার সূত্রপাত। এজেন্টের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য আরও টাকা দাবি করে তপন। ক্ষিপ্ত বাপি উত্তরে আগে দেওয়া টাকা ফেরত চায়। স্পষ্ট বলে দেয়, তার মনে হচ্ছে, পুরোটাই ধাপ্পাবাজি। দরকার নেই তার বহুমূল্য ধাতু বেচে বিলিওনেয়ার হওয়ার। তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতি। তপনের বিলিয়ন ডলার নোট ছিনিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করে বাপি। ধস্তাধস্তি শুরু হয় প্রবল। একসময় মরিয়া বাপি গলা টিপে ধরে তপনের। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে। ঠান্ডা মাথায় ঘরে চাবি দিয়ে বেরিয়ে যায় সূর্য ডোবার পর, পকেটে নোটটি নিয়ে। পালানোর আগে সকালে কেনা ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর একটি পাতা বার করে নিয়েছিল। তাতে মুড়ে রেখে দিয়েছিল চাবিটি, যা উদ্ধার হয় জগদ্দলের বাড়ি থেকেই।
নোটটির কী হল? কয়েকবার একে-ওকে বিক্রি করার ব্যর্থ চেষ্টার পর বাপি বুঝে যায়, কানাকড়িও মূল্য নেই ওই কাগজের টুকরোর। ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল হতাশায়।
কিনারা তো হল, কিন্তু শাস্তি? গ্রেফতার-পরবর্তী তদন্ত একদিনের ক্রিকেট নয়, টি-২০-র বিনোদনী জগঝম্প তো নয়-ই। এ হল ধ্রুপদী টেস্ট ক্রিকেট, যা চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয় ক্রিকেটারের ধৈর্য-সংকল্প-মনোসংযোগ-অধ্যবসায়ের। রান আসছে না ওভারের পর ওভার, বোলার দাপট দেখাচ্ছে নিরঙ্কুশ, তবু দাঁত কামড়ে লোটাকম্বল নিয়ে বাইশ গজে পড়ে থাকা। উইকেট পড়ছে না কিছুতেই, নির্বিষ পিচে আয়েশি আধিপত্য কায়েম করছে ব্যাটসম্যান, তবু লেংথ-লাইন অভ্রান্ত রেখে বোলারের অপেক্ষা করা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা অসতর্ক স্ট্রোকের জন্য। তদন্ত-ও তাই, হতাশার জায়গা নেই কোনও। লেগে থাকতে হবে, নয়তো বিচারের শেষে হাতে থাকবে শুধু পেনসিল। মিথ্যে হয়ে যাবে প্রাক্-গ্রেফতার পর্বের ঘাম ঝরানো।
হোমিসাইড বিভাগের সাব-ইনস্পেকটর শুভাশিস ভট্টাচার্য তদন্ত করেছিলেন। পদোন্নতির পর বর্তমানে ইনস্পেকটর হিসেবে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অ্যান্টি-চিটিং শাখায় কর্মরত। তুখোড় তদন্ত করেছিলেন।
‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর বাকি পাতাগুলি এবং খোওয়া যাওয়া পাতাটি যে একই কাগজের, সেটা প্রমাণ করতে হয়েছিল ফরেনসিক পরীক্ষায় । অভিযুক্তের হাতের লেখার নমুনা সংগ্রহ করে তার সঙ্গে হোটেলের রেজিস্টারে থাকা লেখার তর্কাতীত সাদৃশ্য প্রমাণ করা হয়েছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। যে চাবি দিয়ে ঘরের তালা বন্ধ করে পালিয়েছিল খুনি, বাজেয়াপ্ত হওয়া চাবিটি যে সেটিই, প্রমাণ করতে হয়েছিল তা-ও। চার্জশিটের জাল কেটে বেরনোর পথ ছিল না। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় অপরাধী, এখন সংশোধনাগারে।
মামলার নির্যাস? বিষে বিষে বিষক্ষয়!