জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে
যদিও জাতীয়তাবাদ আধুনিক ইতিহাসের একটি বিরাট শক্তি তবুও এর স্থায়ী মূল্য সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করেছেন এ-যুগের একাধিক মহৎ চিন্তানায়ক। ‘ভূদান’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় (৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২) বিনোবা ভাবে মত প্রকাশ করেছিলেন একদিকে পল্লী। অন্যদিকে বিশ্ব, এই নিয়ে হবে ভবিষ্যতের পৃথিবী (“In the future set-up we shall have only two things, the village and the world’’)। এই কথাটির তাৎপর্য সহজ। আত্মীয়তাবোধের দুটি স্বাভাবিক বৃত্ত আছে। মানুষ হিসাবে মনুষ্যজাতির সঙ্গে আত্মীয়তার। বন্ধন অনুভব করা যায়। আবার প্রতিদিনের জীবনে যারা সুখদুঃখের নিত্য সাথী, যাদের প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব আমাদের চেতনার ওপর বার বার দাগ ফেলে যায়, তাদের নিয়ে অন্তরঙ্গ গোষ্ঠী হিসাবে পল্লীর একটি বিশেষ স্থান আছে ব্যক্তির জীবনে। পল্লী মানুষের স্বাভাবিক নীড় মানবজাতি তার আকাশ; এ দুয়ের মাঝখানে কোনো স্থায়ী অথবা স্বাভাবিক আশ্রয় নেই।
‘Nationalism’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ একদা লিখেছিলেন “Even though from childhood I had been taught that the idolatry of Nation is almost better than reverence for God and humanity I believe I have outgrown that teaching, and it is my conviction that my countrymen will gain truly their India by fighting against the education which teaches them that a country is greater than the ideals of humanity.”
অর্থাৎ, যদিও বাল্যাবধি একথাই তিনি বার বার শুনে এসেছেন যে, সব পূজার ঊর্ধ্বে দেশ পূজা, তবু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, মানুষের চেয়ে দেশ বড় এই কুশিক্ষাকে ত্যাগ করে তবেই ভারতবর্ষকে আমরা গভীরতর অর্থে গ্রহণ করতে পারব।
জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে আমাদের ভিতর যার শেষ সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন, এ বিষয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে ও চিন্তার প্রয়োজন আছে এ কথাটা ধরে নিয়েই আলোচনা শুরু করা ভালো।
জাতীয়তাবাদের একটা সদর্থক দিক আছে, আবার নঙর্থক িআছে। এর পরিপূর্ণ মূল্যায়নে এই দুয়েরই বিশ্লেষণ আবশ্যক।
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে হাতিয়ার হিসাবে জাতীয়তাবাদ একটি বিশেষ মূল্য স্বীকার্য। সে কথা বিশেষত আমাদের দেশে বলাই বাহুল্য। স্বাধীনতালাভের পর অন্য এক দিক থেকে আলোচনা আবশ্যক। সমাজগঠনের মৌল ও সদর্থক নীতি হিসাবে জাতীয়তাবাদের মূল্যায়ন এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার উদ্দেশ্য।
জাতীয়তাবাদের সদর্থক দিকটা কী? এই প্রশ্নের একটি প্রচলিত উত্তরের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। জাতীয়তাবাদ আন্তজাতিকতার দিকে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। অর্থাৎ, মানবতাবোধ অথবা বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠাই আমাদের পরম উদ্দেশ্য, কিন্তু সেই লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হবার পথে জাতীয়তাবাদ একটি অপরিহার্য সোপান। গান্ধী, নেহরু প্রমুখ এদেশের মহান নেতারা জাতীয়তাবাদের এই সদর্থক সংজ্ঞাটি বার বারই তুলে ধরেছেন।
তত্ত্বের সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখা এবং এ দুয়ের ভিতর বিরোধকে মুক্ত মন নিয়ে স্বীকার করা আবশ্যক। জমানি একদিন বহু ক্ষুদ্ররাজ্যে বিভক্ত ছিল। জাতীয়তাবাদ জমানিকে একটি বৃহত্তর আনুগত্যে সংবদ্ধ করেছে। ইয়োরোপের যে-ইতিহাস আমরা উদঘাটিত হতে দেখেছি তাতে কিন্তু জমান জাতীয়তাবাদকে আন্তজাতিকতার পথে পদক্ষেপ মনে করা সহজ হয়নি। লেনিন প্রমুখ নেতারা আন্তজাতিক চিন্তায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। বিপ্লবের পর ক্রমশ রুশ দেশে জাতীয়তাবোধ আবার শক্তিশালী হয়েছে। এতে আন্তজাতিকতার পথ প্রশস্ত হয়েছে কিনা সে কথা তর্কসাপেক্ষ।
যদি বলা হয় যে, জাতীয়তাবোধ স্বাভাবিক, তবে সে কথাটা হয়তো মেনে নেওয়া যায়। যাঁরা আপত্তি করেন তাঁরাও দেখেছি অনেক সময় স্বদেশের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে আবার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে অন্ধ মমত্বে আবদ্ধ হন, অর্থাৎ একপ্রকার বিপরীত জাতীয়তাবোধে ধরা পড়েন। এতে বোঝা যায় যে, নিরপেক্ষ মানবতাবোধে উত্তীর্ণ হওয়া সহজ নয়। কিন্তু জাতীয়তাবোধকে স্বাভাবিক বললেই তার মহত্ত্ব প্রমাণিত হয় না। উপজাতীয় আনুগত্য কি আরও ‘স্বাভাবিক নয়?
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, উপজাতীয় সমাজে মানুষের প্রকৃতির একটা সহজ প্রকাশ আছে। সেখানে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্কের জৈবিক ভিত্তি সরল ও সুস্পষ্ট। উপজাতীয় সমাজের নিয়মগুলি পালিত হয় দুটি প্রধান কারণে পারস্পরিক স্নেহ ও নির্ভরতাবোধ থেকে এবং নানাপ্রকার অতিপ্রাকৃতিক ভয়ের শাসনে। উপজাতীয়দের ভিতর যে-সততা ও সত্যবাদিতা লক্ষিত হয় তার পিছনে কোনো যুক্তিধৃত বিবেকের প্রাধান্য নেই। তাদের সারল্যই আমাদের মুগ্ধ করে।
সামাজিক বিবর্তনের একটি উচ্চতর স্তরে বিভিন্ন উপজাতি নিয়ে গঠিত হয় মহাজাতি। এই বৃহত্তর সমাজের নিয়মগুলি অপেক্ষাকৃত জটিল। আদি আত্মীয়তাবোধের কাছে এইসব নিয়মের অর্থ অস্পষ্ট, আবেদন দুর্বল। বৃহৎ সমাজের অভ্যন্তরে উপজাতীয় কলহ গুপ্ত থাকে অথবা তারই আধুনিক প্রকারভেদ প্রকাশ পায়। এ অবস্থায় সামাজিক সংহতি রক্ষা করাও একটা সমস্যা হয়ে ওঠে। এই সমস্যার কোনো সরল সমাধান নেই। অনেকে বিশ্বাস করেন যে সম্পত্তির মালিকানাই দ্বন্দ্বের মূল কারণ। বস্তুত ব্যাপারটা এত সহজ নয়। সাম্যবাদী সমাজেও বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভিতর ক্ষমতার অতএব স্বার্থের দ্বন্দ্ব যে কত ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, গত অর্ধশতাব্দীর ইতিহাস জুড়ে তার রক্তাক্ত সাক্ষ্য উপেক্ষা করা যায় না। বৃহৎ সমাজে বিভিন্ন স্বার্থের এমন কোনো সমন্বয় সম্ভব নয় যেটা উপজাতীয় সংহতির মতোই অনায়াসে সকলের অন্তরে স্বীকৃত।
কোনো আর্থিক বিন্যাসের দ্বারাই ব্যক্তি ও বৃহৎ সমাজের ভিতর সেই তাৎক্ষণিক একাত্মবোধ সৃষ্টি করা যায় না, ব্যক্তি ও আত্মীয়গোষ্ঠীর ভিতর যে ঐক্যানুভূতি স্বাভাবিক। আজকের জটিল সমাজে যদি এমন কোনো নিয়মতন্ত্র কল্পনা করা যায় যাতে সকলের স্বার্থের ভিতর সামঞ্জস্য সুরক্ষিত, তবু সেই নিয়মের শ্রেষ্ঠত্ব স্বতঃপ্রকাশিত নয় বরং শুধু একটি ব্যাপ্ত দৃষ্টিতেই তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব। সমাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানেও যদি কেউ চুরি করে এবং ধরা না পড়ে, তবে ব্যক্তিগতভাবে সেটা তার লাভ, যদিও সমাজের পক্ষে। সেটা ক্ষতি। চোর সমাজের অংশ, অতএব সমাজের ক্ষতিতে সেও অংশীদার, এই যুক্তিতে কাজ হয় না; কারণ চোরের লাভটা এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও সামগ্রিক, ক্ষতিটা তেমন নয়। সোভিয়েত দেশে যৌথ খামারের সম্পত্তি চুরির দায়ে অপরাধীকে কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ অন্যান্য সমাজের মতোই সাম্যবাদী দেশেও সমাজবিরোধী কার্যকলাপ আছে এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থাও প্রচলিত। দণ্ডের প্রয়োজন স্বীকার্য হলেও শুধু দণ্ডের উপর কোনো সমাজব্যবস্থা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। নীতির অপর ভিত্তি যুক্তি ও বিবেক। অথচ নিরাসক্ত যুক্তির প্রভাবও সীমাবদ্ধ। অতএব বৃহৎ সমাজের সংহতি ও স্থায়িত্বের জন্য নৈর্ব্যক্তিক যুক্তির সঙ্গে ব্যক্তিগত আনুগত্যের একটা বন্ধন প্রয়োজন।
আধুনিক যুগে সামাজিক উন্নয়নের জন্য কতগুলি বিশেষ গুণ ও নিয়মের প্রয়োজন হয়, যেমন, নাগরিক কর্তব্যবোধ এবং জাতীয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির প্রতি যত্ন। দৈনন্দিন কাজকর্ম যেখানে পরিবারের পরিধির ভিতর সম্পন্ন হয় সেখানে আত্মীয়তাবোধের জোরেই কিছু নিয়ম ও দায়িত্ব আমরা সহজে পালন করি। কিন্তু আধুনিক সংগঠনে যাঁরা নানা কর্মে নিযুক্ত তাঁদের ভিতর কোনো আদিম বন্ধন নেই। এই অবস্থায়, বিশেষত আধুনিক যুগধর্মে আরোহণের প্রথম পর্বে, বৃহৎ সমাজে কর্তব্যের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তি হিসাবে জাতীয়তাবাদের একটা বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা স্বীকার্য। যে সমাজে জাতীয়তাবাদ ব্যাপ্তি ও গভীরতা লাভ করেনি, অথচ উপজাতীয় সংকীর্ণতার ওপর আন্তজাতিকতার একটা প্রলেপ পড়েছে, সেখানে গ্রাম্য সংস্কারের সঙ্গে একপ্রকার বিশ্বমানবতার বাণীর সংযোগ দেখা যায় মাত্র, কিন্তু নাগরিক কর্তব্যবোধের বিশেষ উদোষ ঘটে না।
আঠার শতকের শেষে ও উনিশ শতকের গোড়ায় ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি জামান পণ্ডিতেরা আকৃষ্ট বোধ করেন। কালিদাসের শকুন্তলায় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যেললিত সম্পর্ক বর্ণিত আছে তাতে বহু জমান মনীষী তখন মুগ্ধ বোধ করেছিলেন। ভারতের ধর্ম ও দর্শন, পুরাণ ও মহাকাব্য আস্বাদন করে অনেকে বিহ্বল হয়েছিলেন। সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হেগেলের পরিণত বয়সের লেখায় কিন্তু এই বিহ্বলতার ভিতরও একটা সমালোচনার সুর লক্ষ করা যায়। হেগেলের সেদিন মনে হয়েছিল যে, ভারতীয় সংস্কৃতি ও মানসে কোথাও একটা দুর্বলতা আছে, যে জন্য রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও সংহতি এদেশে দুর্বল। প্রকৃতির সান্নিধ্যে ও আদিম গোষ্ঠীজীবনকে আশ্রয় করে যে-লালিত্য ও নীতিবোধ ভারতীয় সংস্কৃতিকে বৈশিষ্ট্য দান করেছে, আধুনিক যুগে সামাজিক বিবর্তনের আঘাতে তার ভঙ্গুরতা ধরা পড়বে এই সন্দেহ তিনি গোপন করেননি। সাম্প্রতিক ইতিহাসে হেগেলের নিজ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপদের দিকটা দেখা গেছে। কিন্তু জমান চরিত্রে আধুনিক যুগে যে-সব গুণ প্রশংসা লাভ করেছে তাও বহুপরিমাণে জাতীয়তাবোধেই বিধৃত, এ কথা স্বীকার্য।
জাতীয়তাবোধ যুক্তির মতো নৈর্ব্যক্তিক ও নিরাসক্ত নয়, আবার উপজাতীয় আনুগত্যের মতো সংকীর্ণ নয়। প্রাচীন সমাজে কে মান্য আর কে অধীন এ বিষয়ে সন্দেহের তেমন অবকাশ ছিল না। কিন্তু আধুনিক যুগে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ও সমালোচনাধর্মিতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন নীতিবোধ দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং সমাজের প্রতি কর্তব্যবোধের চেয়ে সমাজের কাছে আমাদের দাবী প্রবল হয়ে ওঠে। জাপানে উনিশ শতকের শেষ দিকে এই রকম একটা যুগসন্ধিক্ষণে জাতীয় সংহতির ভিত্তি হিসাবে শিন্টো ও কনফিউসীয় ধর্মের, কিংবা জাতীয়তাবাদ ও সামাজিক কর্তব্যবোধের, সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা গুরুত্ব লাভ করে। জাতীয়তাবাদের উগ্রতা জাপানের আধুনিক ইতিহাসে লক্ষণীয়। কিন্তু ঐ দেশের বিস্ময়কর উন্নতির মূলে যে জাপানী জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্যস্বরূপ, সমান বিস্ময়জনক একটা কর্তব্যনিষ্ঠা আছে এ কথাও অবশ্য স্বীকার্য। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের সুফল ও তার আতিশয্যের বিপদ দুই-ই জাপানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সমান প্রত্যক্ষ।
জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক আধারে গঠিত স্বদেশপ্রীতি এবং তারই সমবৃত্তিক কর্তব্যবোধ ছাড়া আরও একটি বস্তু আছে, সেটি জাতীয় শক্তির সাধনা। এই শক্তির সাধনা কর্তব্যনিষ্ঠায় একপ্রকার দার্চের সংযোজন করে, আবার তার বিকারেরও কারণ হয়। যে-পরিমাণে জাতীয়তাবাদ ব্যবহারিক নীতিকে বৃহত্তর সামাজিক সহানুভূতি ও কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত করে, সেই পরিমাণে তার পরিচয় সদর্থক। যেখানে জাতীয়তাবাদ নীতিবোধের মানবিক বিস্তৃতির পথে বাধা, সেখানে তার সংজ্ঞাও নঙর্থক। ঐতিহাসিক পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করেই এর বিচার সম্ভব। কারণ একই বস্তু ইতিহাসের বিবর্তনের কোনো এক পর্যায়ে বৃহত্তর লক্ষ্যের পথে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়, আবার অন্য কোনো পর্যায়ে অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়।
পল্লী ও নগর (১৯৭৩)