কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
হিস্টিরিয়া, হিস্টিরিয়া, নাকের সামনে জুতোটা ধরুন। হ্যাঁ হ্যাঁ জুতোর গন্ধেই জ্ঞান আসবে। আমার মাসিমার মূৰ্ছা রোগ আছে। যেই ভিরমি যায় মেসো অমনি নাকের কাছে কঁচা চামড়ার জুতো ধরেন। ব্লটিং পেপারে শুকনো লঙ্কা গোল করে পাকিয়ে আগুন ধরিয়ে সিগারেটের মতো ধরতে পারলে আরও তাড়াতাড়ি কাজ হত।
আচ্ছন্ন ভাব কেটে আসছে। যে-কল্পজগতে সহসা ঢলে গিয়েছিলুম সেই জগৎ থেকে ধীরে ধীরে ফিরে আসছি। সেই ঘাট, সেই নদী, সেই ঢেউ, সেই শব্দ। আকাশের রংটাই যা কেবল পালটে গেছে। অন্ধকারের আয়োজন চলেছে। একটি-দুটি তারা ইতিউতি চোখ খুলব কি খুলব না করছে। কে একজন গলাজলে দাঁড়িয়ে অস্ত-আকাশের দিকে মুখ করে স্থির হয়ে আছে।
মাতামহ বলছেন, কেন হিস্টিরিয়া হিস্টিরিয়া করছেন। এ অন্য ব্যাপার।
আমার কানের কাছে মুখ এনে বলতে শুরু করলেন, হরি ওম তৎসৎ, হরি ওম তৎসৎ।
এতক্ষণে নিজের অবস্থা টের পেলুম। শ্যাওলা-ধরা ঘাটের পইঠেতে থেবড়ে বসে আছি। পাশে মাতামহ। তার বুকের ওপর আমার মাথা। তিনি দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। পিটপিট করে তাকালে সামনে ঝুঁকে থাকা এক ভদ্রলোককে দেখতে পাচ্ছি। হাঁটুর ওপর দুটো হাত। পেছন দিকটা তোলা উনুনের মতো ঠেলে আছে। দু’ভাগ করে আঁচড়ানো চুল। চোখে রিমলেস চশমা। গায়ে গিলে করা পাঞ্জাবি। এতক্ষণ তিনিই জুতো শোকাবার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। ভদ্রলোক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, অন্য ব্যাপার মানে? গাঁজা নাকি?
আরে না মশাই। গাঁজা হবে কেন?
তা হলে? অন্য ব্যাপার মানেটা কী?
মাতামহ রেগে গিয়ে বললেন, আচ্ছা নেইআঁকুড়ে দাদা তো? অন্য ব্যাপার, মানে অন্য ব্যাপার।
ও, ভাল করতে গেলে মন্দ হয়। বিপদে পড়েছেন দেখে ওপর থেকে নীচে নেমে এলুম, এখন মেজাজ দেখানো হচ্ছে? এক্ষুনি ভাবছিলুম একটা চামচে এনে দাঁতি লাগা ছাড়াবার ব্যবস্থা করব। এক গেলাস খাঁটি গোরুর দুধ খাওয়াব, এইমাত্র দোয়া হল। ঠিক আছে, আমার কী? নিজের ম্যাও নিজেই সামলান।
দুধের নামে মাতামহ নরম হয়ে গেলেন। বললেন, ও আপনি বুঝি এই বাড়িতেই থাকেন?
হ্যাঁ, এই ঘাটও আমাদের। পশ্চিমে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিলুম, দেখলুম ছেলেটা মাথা ঘুরে পড়ে গেল। থাকতে পারলুম না নেমে এলুম। পরোপকারে আমার পিতৃদেব দেউলে হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। তস্যাঁতস্য পিতা উমেদারের জ্বালায় খুন করে জেলে। যাবজ্জীবন কাটিয়েছিলেন। সেই রক্তের ধারাই তো আমার শরীরে বইছে।
মাতামহ ঘাটের ওপর ঠেলে ওঠা তিনতলা বাড়ির দিকে ঘাড় তুলে তাকালেন। আমিও পিটপিট করে একপলক তাকিয়ে নিলুম। ভাঙাভাঙা হলেও বিশাল বাড়ি। একটা পাশ প্রায় ধসে পড়েছে। বটের ঝুরি নেমেছে। একসময় সাদা রং ছিল। এখানে-ওখানে ছাপকা ছাপকা সেই স্মৃতিচিহ্ন মরা হাতি লাখটাকার কথা ঘোষণা করছে। মাতামহ বললেন, মনে কিছু করবেন না, বয়েসে মেজাজ তিরিক্ষি। কী হয়েছে তা হলে বলি, এ হল ঈশ্বরাবেশ।
আমি ফিসফিস করে বললুম, দাদু।
কানে মোচড় দিয়ে তানপুরার তার নামানোর মতো আমার কণ্ঠ নামিয়ে দিলেন। বোঝাতে চাইলেন, চুপ, লোকটাকে একটু খেলাই।
ভদ্রলোক বললেন, ঈশ্বরাবেশ মানে?
আমার এই নাতিটি ক্ষণজন্মা পুরুষ। মাঝে মাঝেই সমাধিস্থ হয়ে যায়। ঈশ্বরানুভূতিতে শরীর স্থির। দেহ এ জগতে চেতনা অন্য জগতে। তখন দর্শনটর্শন হয়। একথা তো সকলকে বলা যায় না!
অ্যাঁ, তাই নাকি? বলেন কী? সমাধি তো মশাই ঠাকুর রামকৃষ্ণের হত। তিনি কি আবার ফিরে এলেন নাকি? গীতা অবশ্য বলেছেন, যদা যদা হি ধর্মস্য; কিন্তু এঁর চেহারায় তো তেমন চেকনাই নেই। গেঁজেল দুধ না পেলে যেমন হয় অনেকটা সেইরকম। কী জানি বাবা!
অ্যায়? ওই জন্যেই অবিশ্বাসীদের কিছু বলতে নেই। কাঠিয়াবাবার নাম শুনেছেন?
আজ্ঞে না। গাঠিয়ার নাম শুনেছি। গুজরাটিরা আদাকুচি দিয়ে খায়।
তিনি ছিলেন যোগী, তান্ত্রিক। ছ’ফুট লম্বা। কাঠির মতো চেহারা। আসনে বসে হাত বাড়িয়ে গাছ থেকে নেবু পেড়ে আনতেন।
এই উদীয়মান মহাপুরুষেরও কি সেইরকম কোনও শক্তি আছে?
থাকলেও দেখায় না। হরি ওম তৎসৎ।
আমি আর আড় হয়ে শ্যাওলা গঙ্গামাটি মাখামাখি ঘাটে শুয়ে থাকতে পারছিলুম না। মশায় সর্ব শরীর ছিঁড়ে দিচ্ছে। ঘোর কেটে গেছে। পুরো ব্যাপারটাকেই এখন স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। ওম তৎসৎ বলামাত্রই তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়লুম। ভদ্রলোক ওরে ব্বাবারে বলে তিরবেগে দৌড়োলেন। মহাপুরুষের ভয়ে মানুষ এমন তিরবেগে দৌড়োতে পারেন, জানা ছিল না। যেন বাঘ দেখেছেন।
মাতামহ বললেন, যাঃ সব মাটি করে দিলি। দু’গেলাস খাঁটি গোরুর দুধ হাতছাড়া হয়ে গেল। সবে দোয়া হয়েছে। এখনও গরম। ফ্যানা উঠছে।
এইভাবে ধাপ্পা মেরে দুধ খাবেন! এক গেলাস দুধ তো আপনি বাড়িতেই পেতে পারেন। চলুন। খাইয়ে দেব।
আরে ধুস, সে দুধ আর এ দুধ! পকেটে আফিমের গুলি৷ টুক করে মুখে ফেলে, এক গেলাস ফ্যানাফ্যানা দুধ চোঁচোঁ মেরে দাও। যত রাত বাড়ছে তত মৌতাত বাড়ছে। অন্যায়টা কী হত! সত্যিই তো তোর সমাধি হয়েছিল। আমি লক্ষণ মিলিয়েই বলছি। সমাধির তুই কী বুঝিস?
সমাধি না হাতি। ভবিষ্যতের ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম। সতীমা যা বলে গেলেন, তাই যদি সত্যি হয়?
ধর্মের লাইনে অনেক বুজরুকি আছে। সহজে ওসব বিশ্বাস করিসনি। তোকে বিভূতি দেখিয়ে গেলেন। যাঁরা কথায় কথায় বিভূতি দেখান, তারা হলেন প্রথম স্তরের সাধু।
কীসে কী, সে পরে ভাবা যাবে, বাড়ি গিয়ে কী বলবেন তাই ভাবুন। কাল সকালেই তো ধুনুরি আসবে।
মাতামহ দুর্ভাবনায় আবার উবু হয়ে বসে পড়লেন। ঘুসুরি থেকে আমাদের তুলে আনার কথা। কাল সকালেই পিতার প্রিয় ধুনুরি গফুর মিঞা আসবে। তোশক তৈরি হবে। তিন অতিথির শুতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে। তুলো এল না। মিঞা সায়েবকে ফিরে যেতে হবে। যেদিন যা হবার কথা, সেদিন তা না হলে পিতৃদেব তুলোধোনা করে ছেড়ে দেবেন। নদী তরতর করে বেশ চলছে, বাধা। পেলেই উদ্দাম, ক্ষিপ্ত।
মাতামহ বললেন, কী আছে, সত্যি কথাই বলব। এমন ঘটনা তো সহজে ঘটে না।
উনি বিশ্বাস করবেন না।
ওর বাপ করবে।
হ্যাঁ, তখন বুঝবেন ঠ্যালা। ঈশ্বর সিদ্ধে প্রমাণাভাবাৎ বলে যখন ঠেসে ধরবেন তখন আমার পিতামহ অয়েল পেন্টিংয়ে যেমন বসে আছেন তেমনি বসে থাকবেন। বাঁচাতে আসবেন না।
তা হলে আমি পালাই। তোমার বাবাকে তুমিই সামলাও। আমার তো জামাই।
তা তো বটেই। একে বলে সুবিধেবাদী। আমাকে বাঘের মুখে ঠেলে দিয়ে নিজে গিয়ে বসবেন বেটির কাছে।
তা যা বলেছিস! মাতামহ উঠে দাঁড়ালেন। ওই সাধিকার মতো শক্তি থাকলে আকাশে হাত বাড়িয়ে মেঘ থেকে পাঁজা তুলো ধরে আনতুম। বৃথাই সাধনা। রাতটা ভাগাভাগি করে বকুনি খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাক।
আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণ বারকতক চমকে উঠল। এক চাকলা মেঘ জমেছে। লক্ষণ ভাল না। বেশি রাতে বৃষ্টি নামতে পারে। মাইলখানেক হাঁটতে হবে। একটা দোকানে গরম শিঙাড়া ভাজছে। সেদিকে তাকিয়ে মাতামহ বললেন, তুলোর পয়সার কিছু সদ্ব্যবহার করে গেলে হয়! কীরকম হাবুডুবু খাচ্ছে দেখেছিস। একেবারে গরম গরম। এক এক কামড়ে হা হা করতে হবে। তোর বেশ দুর্বল দুর্বল লাগছে না? একটু চা না খেলে এতটা হাঁটতে পারবি?
বৃদ্ধর খুব লোভ হয়েছে। তুলোর পয়সা এদিক-ওদিক করা আর ব্যাঙ্কের ক্যাশ ভাঙা একই অপরাধ। বুকপকেটে নিজস্ব একটি টাকা মজুত আছে। মায়া সিনেমা দেখতে চেয়েছিল। অন্ধকার ঘরে দু’জনে পাশাপাশি বসে চিনেবাদাম চিবোতে চিবোতে নদের নিমাই দেখব। কতদিনের পরিকল্পনা আমাদের। সেই টাকাতেই এখন শিঙাড়া হোক।
শিঙাড়া আর চা খেতে খেতেই আকাশ বেশ ঘোর হয়ে এল। যে ক’টা তারা চোখ মেলেছিল তাদের চোখ বুজে এল। পা চালা পা চালা বলে মাতামহ দৈত্যের মতো হাঁটতে শুরু করলেন। বৃদ্ধ হলেও তিনি আমার চেয়ে যুবক। পেছন পেছন আমি চলেছি নেচে নেচে।
বাড়ির সদরে পা রাখতেই দমকা হাওয়া শুরু হল। ভৈরব আসছে তেড়ে। দোর ভাঙার শব্দ হচ্ছে। দুই বোনে মনে হয় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জানলা দরজা একটা-আধটা নয় তো! উত্তর থেকে দক্ষিণে ঘুরে আসতে আসতেই একটা-না-একটা দিক ভেসে যাবেই। সদর খোলা ছিল। গলিতে কাদের একটা ছাড়া-গোর ঢুকে বসে আছে। ভোস ভেঁস করে জাবর কাটছে।
প্রথমেই কনকের সঙ্গে দেখা হল। একগাদা শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ বুকের কাছে ধরে ঘরে ঢুকছে। আমি আগেই উঠে এসেছি ওপরে। মাতামহ এখনও নীচে। গোরুর বাঁট পরীক্ষা করছেন। যে-দুধ ছেড়ে এসেছেন ওঁর ধারণা সেই দুধ বাড়ি বয়ে এসেছে। সাধিকার সঙ্গ বিফলে যাবার নয়। এখন থেকে অলৌকিক ব্যাপারস্যাপার ঘটতেই থাকবে।
কনক হাসিমুখে বললে, যাক বাবা, এসে গেছ। আকাশ যা হয়েছে। ভেঙে পড়ল বলে।
হুস করে প্রবল একটা হাওয়া এল। রান্নাঘরের সামনের বারান্দা থেকে কয়লা তোলার খালি গামলাটা গড়াতে গড়াতে উনুনের দিকে চলে গেল।
ধরো ধরো, বলে কনক কাপড়জামার বোঝা ধরিয়ে দিয়ে দুদ্দাড় করে রান্নাঘরের দিকে দৌড়োল। গেল গেল সব গেল। কী গেল কে জানে? হয়তো কিছু নামিয়ে এসেছিল। রান্নার এখন খুব তরিবাদি চলছে তো! মরাগাঙে বান এসেছে। আমি এদিকে লক্ষ্মণ ফল ধরে হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে থাকি। প্রকৃতিতে প্রলয় নাচন, মনেও তাই। এ তুমি কী ধরালে প্রভু! বড় গরম লাগছে। গরম কী রে গাধা! ধুর, বৃষ্টির শীতল বাতাস ভলকে ভলকে বয়ে আসছে। এক এক ঝাঁপটায় পেয়ারাগাছের ডাল ঝড়াস ঝড়াস করে বারান্দার টিনের চালে আছড়ে পড়ছে।
এ যে শাড়ি! সকালে কনকের শরীরে পেঁচিয়ে ছিল। এ যে ব্লাউজ! এখনও শরীরের ঘ্রাণ লেগে আছে। এ যে সেই, যা আরও তলায় থাকে। হে জগদম্বে! ভেতরে ভিসুভিয়াস ভসর ভর করছে।
মাতামহ ওপরে উঠে এসেছেন। পেছন থেকে বললেন, কী হে, আবার সেই সমাধি নাকি?
আজ্ঞে না।
তা হলে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছ কেন? ওই তো পায়রার মতো বুক! নীলমণি হলে কে দেখবে!
পাপীর মন। কী যেন একটা চাপা দিতে চাইছে। আলিঙ্গনাবস্থায় গুরুজনের কাছে ধরা পড়ে গেছি নাকি? চোরের মন, সবসময় বোঁচকার দিকে। ঝড়ের ঝাঁপটা চলছে রান্নাঘরের দিকে তেড়ে। একহাতে মাথা আর মুখ আড়াল করে দেয়ালে কাধ ঘেঁষে ঘেঁষে কনক এদিকে এসে বললে, দাও। তুমি ঘরে ঢুকে গেলে না কেন?
মাতামহ সাধক মানুষ। মনে সবসময় সুবাতাস বইছে। আমার মতো কুবাতাসে পাড়ি দিয়ে হাবুডুবু খেয়ে মরেন না। গ্রাহ্যই করলেন না কী ঘটে গেল অন্তঃপুরে। একগাল হেসে বললেন, কিস্যু নেই। ব্যাটা শুকনো হয়ে শুয়ে আছে।
ঢুকে পড়ুন ঢুকে পড়ুন, বলতে বলতে ঝড়ের ঝাঁপটার সঙ্গে কনক আমাদের নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। বারান্দায় চটাপট চটাপট বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে টুং-টাং শব্দ হচ্ছে। মনে হয় শিল পড়ছে। মাতামহ বললেন, অকৃতজ্ঞ দুনিয়া, শোবে এক জায়গায় দুধ দেবে আর এক জায়গায়।
কাপড় কোঁচাতে কেঁচাতে কনক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে, সে আবার কী?
ওই যে গোরুটা। নীচে শুয়ে আছে। দুধটুকু দিয়ে এসেছে মালিককে।
থাকলে কী করতেন?
একবার চেষ্টা করে দেখতুম।
পটাং পটাং করে শিল পড়ছে। ন্যাপথলিনের বলের মতো বারান্দার মেঝেতে লাফালাফি করছে। শিল পড়ছে শিল। আধ-কোচানো কাপড় মেঝেতে ফেলে রেখে কনক ছুটল। দু’জনে নিচু হয়ে হয়ে শিল কুড়োচ্ছি আর মুখে পুরছি। বৃষ্টির ছাট এসে গায়ে লাগছে। এক-একটা শিল পড়ে পিংপং বলের মতো লাফিয়ে উঠছে। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
এই যে এই একটা। এই আর একটা। এটা কত বড়! তুমি নাও, তুমি নাও।
বয়েস, পরিবেশ ভুলে, দু’জনে ভীষণ ব্যস্ত। পেছনে পেছন ঠেকে যাচ্ছে। মাথায় মাথা ঠুকে যাচ্ছে। বাতাসের আর্দ্রতায় কনকের সুন্দর মুখ আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। টাটকা-ফোঁটা ভিজে গন্ধরাজের মতো। এবার কিন্তু সত্যিই আমি ভালবেসে ফেলব। তারপর যা থাকে বরাতে। কিন্তু ওই সাধিকা যে বলে গেলেন, কখনও কাউকে ভালবাসার চেষ্টা কোরো না, কাউকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা কোরো না। সে চেষ্টা তো আমি একবারও করিনি মা। আমার মতো বোকচৈতন পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকেই তো ভালবেসে বেকুব হতে পারে। তাতে কার কী যায় আসে! মূর্খরা ভালবেসে মরে। চালাকে কাজ গুছোয়।
মেসোমশাই এতক্ষণ ভেতরের ঘরে মুকুকে নিয়ে বোধহয় ব্যস্ত ছিলেন। কখন পেছনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন আমরা কেউই লক্ষ করিনি। বেশ রাগরাগ গলায় বললেন, কনক, তুমি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছ। একেই তোমার সেপটিক টনসিল, হঠাৎ ঠান্ডা লেগে গেলে তোমার আর কী বলল, বিপদে পড়ব আমি।
কনক উঠে দাঁড়াল। বারান্দার আলোটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। ঝোড়ো বাতাসে তার দুলে উঠলে আলো কাপে। নিবেও যেতে পারে। কনকের ধারালো চোখে কেমন যেন একটা ছায়া নেমে এল। আমি জানি অভিমান কাকে বলে। মন কীভাবে টসটসে হয়ে ওঠে। দরজা খুলে মানুষ কীভাবে জগতের বাইরে ছিটকে চলে যায়। আমার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে কনক ভেতরে চলে গেল। পেছনের দিকে গোড়ালির কাছে লেসের কাজ করা সায়ার অংশ ভিজে গেছে। সে যুগের ঋষিরা কত সাধারণ কথা কেমন অসাধারণ করে যুগের এপারে ওভার বাউন্ডারি করে দিয়ে চলে গেছেন। প্রথম বয়সে মেয়েরা পিতার সম্পত্তি, তারপরই স্বামীর। মেসোমশাই মানুষটি তেমন সহজ সরল নন। অহংকারের পুরিয়া।
মাতামহ চেয়ারে চুপ করে বসে আছেন। ইচ্ছে থাকলেও নিজের ডেরায় ফিরে যাবার উপায় নেই। বেশ ঝেপে বৃষ্টি এসেছে। মেসোমশাই আবার ভেতরের ঘরে চলে গেছেন। মুকুকে পড়াতে। বসেছেন। মেয়েকে প্রেমাদ রায়চাঁদ করে ছাড়বেন। কনক বকুনির ধাক্কা সামলে উঠেছে। আমার। মতো ওর ঠোঁট বেশিক্ষণ ফুলে থাকে না। সহজেই সামলে নিতে পারে। মেয়েদের তা না হলে তো চলবে না। প্রথম জীবনে পিতাকে সামলাও, শেষ আর মধ্যজীবনে স্বামীকে খেলাও। মাছ ধরার মতো। সুতো ছাড়ো আর সুতো টানো। আমার আর কতটুকু জ্ঞান। চার পাশে যা দেখছি আর কী! মেয়েছেলে যদি খেলোয়াড় না হয় তার অশেষ দুর্গতি। ওই জবা, জবার মা, মা কি না সঠিক বলতে পারব না, জবার মাসি, মাসিই হবে, দু’জনকে প্রায় একই রকম দেখতে, ওদের মতো হলে সুখের শেষ নেই। সুখেন সব জানে। নিজেও মাঝে মাঝে দেখি তো। এই তো সেদিন! দুপুরবেলা বাড়িতে বোধহয় দুই মাতব্বরের কেউই ছিল না, যে ছেলেটাকে ওরা পিসতুতো ভাই বলে এতকাল চালিয়ে আসছে, সেই ষণ্ডামার্কাটা জবাকে পাঁজাকোলা করে বারান্দায় গোল হয়ে ঘুরছিল। কী খেলা কে জানে? সে জিনিস সিনেমা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। দুপুরবেলা সব কাজ ফেলে এক মদ্দা সোমত্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে মরছে। নাও বোঝে ঠ্যালা। কে বাবা সেই উপদেশ মনে রাখছে, ওরে দাগ রেখে যা, দাগ রেখে যা। উলটো বুঝলি রাম! তাবৎ মানুষ চরিত্র দাগবাজ করে পস্তে মরছে। মেসোমশাই কি আর সাধে গোঁফ পাকিয়ে তেড়ে এসেছিলেন! কনক হয়তো আমাকে গ্রাহ্যই করে না। কিন্তু আমার চালচলন তো দেখতে হবে। ফোঁস করে ছোবল মেরে দিলে কে সামলাবে। মানুষ তো আর ঢোঁড়া সাপ নয়। খড়ম মার্কা কেউটে। মেয়ে আমার নীলবর্ণ হয়ে যাবে। ভালবাসার ছোবল আর বাঘের কামড় কোনওটাই কম যায় না। আঠারো ঘা।
জানলা ফাঁক করে কনক এতক্ষণ বৃষ্টি দেখছিল। গাছপালা সব জবুথবু হয়ে ভিজছে! একদল দৌড়বীরের মতো বৃষ্টি রাস্তার ওপর দিয়ে ধর ধর করে দৌড়েই চলেছে। ছোটার যেন শেষ নেই। পাল্লা বন্ধ করে কনক মাতামহর কাছে সরে এসে বললে, কী, চা খেতে ইচ্ছে করছে?
মাতামহ সুবোধ বালকের মতো মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ।
পাঁপড়ভাজা।
মেসোমশাই যে-ঘরে বসে মুকুর সঙ্গে তর্কশাস্ত্র নিয়ে ধস্তাধস্তি করছেন সেই ঘরের দিকে উঁকি মেরে ভয়ে ভয়ে বললেন, বুডোর খাইখাই দেখে তোমার বাবা যদি রেগে যান!
কনক হেসে বললে, বা রে, রেগে যাবেন কেন?
আমতা আমতা করে মাতামহ বললেন, তা ছাড়া জামাইটা বাইরে এই দুর্যোগে কোথায় এখন ভিজছে কে জানে? আমরা বেকারের দল মজা করে চা-পাঁপড় খাব, আর সে বেচারা ভিজে জাব হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি আসবে। সেটা কি ভাল দেখাবে নাতনি!
নীচে একটা হ্যাটহুট শব্দ শোনা গেল। যাক পিতৃদেব বেশি না ভাবিয়েই ফিরে এসেছেন। প্রকৃতির কাছে হেরে যাবার মানুষ তিনি নন। মাঝে মাঝে গর্ব করে বলেন, আমি একটা ট্যাঙ্ক। এমন কোনও শক্তি নেই আমাকে থামিয়ে রাখতে পারে।
পিতার গলা আবার শোনা গেল, দুধ খাবে একজন, আর গোবরে মাখামাখি হবে আর একজন। ব্যাটা, এটা তোমার মামার বাড়ি?
মাতামহ আনন্দে আটখানা, ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে। চলো চলো আমরা যাই। গোবরকুণ্ড থেকে উদ্ধার করে আনি।
সামান্য গোলমাল, তাইতেই মেসোমশাই বিরক্ত। তুমি পড়ো তুমি পড়ো, বলতে বলতে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। একটা মানুষ বটে! যাই বলো বাবা, বেশ স্বার্থপর! কনক কিন্তু একেবারে অন্যরকম। দু’জনের তফাত একেবারে উত্তরমেরু দক্ষিণমেরু। কনক নীচে নেমে গেল। আমরা দুজনে সিঁড়ির মাথায় বৃষ্টিধৌত বীরকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে স্থির দণ্ডায়মান।
মারাত্মক কিছু একটা সিঁড়ির দু’পাশের দেয়ালে ঠকাস ঠাস করে ধাক্কা খেতে খেতে ওপরে উঠছে। পিতা কি শেষে বর্ম শিরস্ত্রাণ পরে ফিরে এলেন! কিছুই বিশ্বাস নেই। সব পারেন। ধনুকের মতো কী একটা ঘাড়ে করে উঠছেন। পেছনে কনক। একেবারে বাধ্য মেয়ে। মেসোমশাইয়ের চেয়ে আমার পিতার সঙ্গে যেন বেশি মানিয়েছে।
মাতামহ বললেন, বাঃ বাঃ, বেশ মানিয়েছে হে। মহাভারতের পাতা থেকে যেন গাণ্ডীব ধারণ করে উঠে এলে! বস্তুটা কী গো! কোথাও হরধনু ভঙ্গের কমপিটিশন হচ্ছিল নাকি আজ?
একটা দিক কনকের কাঁধে। জিনিসটাকে ধীরে ধীরে দেয়ালে ঠেসিয়ে রেখে পিতা কনকের পিঠে দু’বার তারিফের চাপড় মেরে বললেন, তুমিই হলে রিয়েল কর্মী। আর এঁরা হলেন মহামান্য দর্শক। ন্যাজ নাড়েন শিকার ধরেন না। হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন? হরধনু ভঙ্গ! তা হলে তো একটি সীতাও আসত বুড়ো রামচন্দ্রের পেছন পেছন।
মাতামহ গ্রাহ্যই করলেন না। গীতার মহাপুরুষ। আক্রমণ অনাক্রমণে স্থির, অচঞ্চল। তিনি সেই যন্ত্রের ছিলেতে আঙুলের টুসকি মারলেন। ব্যাঙাও ব্যাঙাও করে শব্দ হল। বাঃ যন্ত্রটি বেশ তো! দক্ষিণ ভারতীয় সংগীতের সঙ্গে জমবে ভাল। ইল্লেহেহে কুড়হুহু।
আপনার সংগীতের সঙ্গেও মানাবে ভাল। তবে বাজাতে পারবেন না। এ চালাতে হলে ষাঁড়ের ডালনা খেতে হবে বছর দুই।
মাতামহ বললেন, তোব তোবা, তা হলে আনলে কেন?
কনক বললে, মেসোমশাই, এটা তুলোধোনা যন্ত্র না?
আঃ ঠিক ধরেছ। ভেরি ইনটেলিজেন্ট, ভেরি ইনটেলিজেন্ট। তোমার মতো একজন কেউ আমার পাশে থাকলে সংসারে ফুল ফুটিয়ে ছেড়ে দিতুম।
পিতা ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটা হাফ মুগুর। ওইটা দিয়ে তাতে আঘাত করলে ব্যাঙাও ব্যাঙাও করে শব্দ হয়। ছটফট ছটফট করে চার পাশে তুলো লাফাতে থাকে। শৈশবে বাড়ির বিশাল ছাতে ধুনুরি এসে বসলে আমাদের উত্তেজনা বেড়ে যেত। মুগুরটাকে অনেকটা মিনারের মাথার মতো দেখতে। কনক হাত থেকে নিয়ে ঘরের এক পাশে সাবধানে রেখে দিল। এই প্রথম চিন্তাটা মনে। উঁকি দিয়ে গেল, কনক যদি আমার মা হয়ে এই সংসারে বেশ আঁকিয়ে বসে, তা হলে কেমন হয়? মন্দ কী? বয়েসে একটু ছোট হবে। তা হলেও, মা ছোট হলেও মা। ছেলে হিসেবে আমি একটু বেমানান হয়ে যাব। এই যা সমস্যা! ট্রেনের টিকিট চেকার সেই সুখেনকে ধরেছিল। হাফ টিকিটে ওপরের বাঙ্কে চাদর মুড়ি দিয়ে বোম্বাই যাচ্ছিল। চাঁদরের বাইরে পা বেরিয়ে পড়েছে। চেকারের হাতে টিকিট,নজর পায়ের দিকে, এতনা মোটা গোড়, এতনা লম্বা বাল, হাফ টিকিট? সুখেনের দাদা বলছেন, মোটা হুয়া তো কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া সাহাব। লোকে হয়তো বলবে, আহা মেয়েটার কী ভাগ্য, একেবারে রাজহাঁসের মতো ছেলে নিয়ে চলেছে। ধেড়ে গলায় যখন ম্যা ম্যা করে ডাকে তখন প্রাণ একেবারে জুড়িয়ে যায়? কেন যে এসব চিন্তা আসছে। বড় পাপ ঢুকেছে মনে। হিংসে, অভিমান, লোভ, কামনা, সব মিলেমিশে মন নয় তো, জগাখিচুড়ি।
মাতামহ বললেন, হঠাৎ তুমি এই যন্ত্রটা কিনতে গেলে কেন হরিশঙ্কর! ভাল দেখে একটা তানপুরা কিনলেই পারতে!
ভিজে জামা খুলতে খুলতে পিতা বললেন, তাতে তো আর তুলো ধোনা যেত না!
তুমি তুলো ধুনবে? সব ছেড়ে তোমার এমন অদ্ভুত ইচ্ছে কেন?
সংসারে সবকিছু শেখা দরকার। সেলফ হেলপ। পরমুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকব কেন? নিজের কাজ নিজে করে নোব। সংসারের সাশ্রয়।
এটাও কি তুমি ডিসপোজাল থেকে কিনলে?
আজ্ঞে না। দেখি কী তুলো আনলেন? ভিজে যায়নি তো!
মাতামহ মাথা নিচু করলেন। এইবার সেই মুহূর্ত এসেছে। জীবন-মরণ সমস্যা। আমতা আমতা করে বললেন, তুলে আনা হয়নি হরিশঙ্কর।
কেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? দিবানিদ্রা?
না না, সে এক অলৌকিক ব্যাপার।
তার মানে? তুলো উড়ে গেছে?
না না, সে এক মহা অলৌকিক ব্যাপার।
আপনাদের সবেতেই দেখছি অলৌকিক ব্যাপার! থাকেন লৌকিক জগতে, কাজকারবার সব অলৌকিক জগতে! মজা তো মন্দ নয়। আপনারা আমার সব প্ল্যান বানচাল করে দিলেন। বললেই পারতেন, পারব না।
কনক বললে, মেসোমশাই, এখন আর মেজাজ খারাপ করবেন না। পাঁপড়ভাজা আর চা খান, তুলোর চিন্তা পরে করা যাবে।
তুমি বলছ বটে, তবে আমার সমস্ত পরিকল্পনা একেবারে ভেস্তে গেল।
বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। এই ঝড়ের রাতে কার আবার অভিসার! দরজা খোলা। আর বন্ধের শব্দ। এই বাড়িতেই কেউ এলেন। গাড়ি চেপে কার আগমন? সুরেলা গলা উচ্চগ্রামে খেলে গেল, পিন্টু, পিন্টু।
মাতুল এসেছেন। আরে বাপ রে! মহামান্য অতিথি। তটস্থ হয়ে থাকতে হবে। পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। আসুন আসুন। অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে কাছা কেঁচা খুলে যাবার মতো অবস্থা। সেই পরিচিত সুবাস সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। সেই পরিচিত জুতোর শব্দ। সেই ফিনফিনে শৌখিন মানুষটি এবার দৃশ্যমান। আর একটু ফরসা হলে মনে হত ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সাহেব। আলো পড়ে বুকের একসার হিরে-বসানো বোম জলতরঙ্গের মতো হাসছে। কখনও এটা কখনও ওটা। মাতুলের পেছনে আর এক ভদ্রলোক। যে-কোনও বিয়েবাড়িতে এমন কাঠামোর মানুষ প্রায়ই দেখা যায়। হৃষ্টপুষ্ট। লাগাম ছাড়লেই ফচকেমিতে ভেসে যাবেন। সমস্ত মহিলাই এঁর বউদি। চিরন্তন ঠাকুরপো। ঝুলনতলার নাচের তাবুতে লোকটি কনুইয়ের খোঁচা মেরে বলেছিল, মাগির রস আছে। মহিলারা এই মানুষটিকে অবশ্যই বলবেন, মিনসের রস আছে। গা থেকে সেই পরিচিত গন্ধ বেরোচ্ছে। পুরুষালি ঘাম, সিগারেট আর সেন্ট। ব্যাকব্রাশ চুল। যৌবনের ব্রণ মুখে দু-চারটে ক্ষত রেখে চলে গেছে। এমন মানবের সঙ্গে মেশার আগে মহিলাদের খতিয়ে দেখা উচিত, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়! অকারণে মুখে যে-হাসি লেগে আছে, সে হাসি দেখলেই পিতা বলতেন, উজবুকের মতো হাসছ কেন বলো তো? পৃথিবীটা কি এতই আনন্দের জায়গা।
মাতুল আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, সব ঠিক আছে তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আবহাওয়া অনুকূল না প্রতিকূল?
আলেকজান্ডার সেই পুরুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন না! তুমি কীরকম ব্যবহার প্রত্যাশা করো? মাতুলের প্রশ্নের উত্তর আমাকে আর দিতে হল না। পিতা পেছন থেকে আলেকজান্ডারের কণ্ঠে পালটা প্রশ্ন করলেন, তুমি কীরকম আবহাওয়া চাও?
মাতুল পুরুর মতোই বীর দর্পে বললেন, মৃদু এবং মোলায়েম। ময়েন দেওয়া লুচির মতো।
তৈরি করে নাও।
এসে যখন পড়েছি, অনুমতি পেলেই হাত লাগাব। বেতলব দে তো মজা উস-র্মে সিবা মিলতা হৈ। বোহগদা জিস-কো নহ হো খু-এ সবাল, আচ্ছা হৈ। না চাইতেই যদি দেন তো তার স্বাদই আলাদা; সেই তো শ্রেষ্ঠ ভিখারি, হাতপাতার অভ্যেস হয়নি যার।
আহা গালিব দিয়ে শুরু করলে! সব মাটি করে দিলে। বেশ একটা রাগ-রাগ ভাব আসছিল। তোমাকেও ফায়ার করার ইচ্ছে হচ্ছিল।
আমাকে? আমার অপরাধ?
তোমার অপরাধ? তোমার উপেক্ষা। এই ঝড়ের রাতে পারিবারিক হাড়ি খুলে পচাই বের করতে চাই না। আজ হল শ্যাম্পেন নাইট। তুমি স্রেফ তরে গেলে গালিবের জন্যে, তরে গেলে এই ভদ্রলোকের জন্যে।
ও হ্যাঁ, পরিচয় করিয়ে দিই। প্রতাপ রায়। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। অসাধারণ ভাল তবলা বাজায়।
প্রতাপ রায়ের কাণ্ডজ্ঞান আছে। প্রণামটি চট করে সেরে নিল। মাতুল সাধারণত কারুর কাছে। মাথা নিচু করেন না। তবে ভগিনীপতির কাছে অহংকার খাটো করার অভ্যাস বজায় রেখেছেন।
পিতা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি হঠাৎ এলে কেন? তুমি তো সহজে আসো না। তোমার জগৎ তো আলাদা। এ কি তোমার মতিভ্রম!
মাতুল বললেন, ধরেছেন ঠিক। পৃথিবীকে আপনি যতটা চেনেন, আর কেউ ততটা চেনে না। আপনারই কথা, ধোঁয়া দেখলেই বুঝবে আগুন। আমরা এসেছি আপনাদের দুজনকে ধরতে।–
হঠাৎ। নিশ্চয়ই স্বার্থ আছে।
অবশ্যই।
টাকাপয়সার ব্যাপার?
অবশ্যই।
তা হলে পরিবেশ বিষিয়ে ওঠার আগে একটু চা খেয়ে নেওয়া যাক।
প্রতাপ রায় ঠিক তালে ছিলেন। কনককে দেখেই বললেন, এক গেলাস জল খাওয়াবে ভাই।
সুন্দরীরা বড় তৃষ্ণার্ত করে তোলে বুঝি!