প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.১১ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল, মনে নেই। একসময় আবছাভাবে পর পর ক’টা ডাক বিনুর কানে এল, এই বিনুবিনু, দাদাভাই–দাদাভাই–তারপরেই হাত ধরে টেনে কে যেন তাকে বসিয়ে দিলেন।

চোখভর্তি ঘুম। বসে বসেই ঢুলতে লাগল বিনু। সেই গলাটা আবার শোনা গেল, চোখে জল দে দাদাভাই। এই যে জল–

নিজে থেকে জল দেবার মতো অবস্থা নয়। যিনি কথা বলছিলেন তিনিই তার চোখেমুখে খানিকটা জল ছিটিয়ে দিলেন।

এবার ঘুম অনেকখানি ছুটে গেল। চোখ মেলে বিনু দেখতে পেল- হেমনাথ।

হেমনাথ বললেন, খাবি না? চল চল, সবাই খেতে বসে গেছে।

দু’হাতে বিনুকে কোলে তুলে হেমনাথ রান্নাঘরের বারান্দায় চলে এলেন। এখানে সারি সারি নকশা কাটা আসন পাতা। অবনীমোহন সুধা সুনীতি হিরণ লারমোর–সবাই একেকটা আসন দখল করে বসে আছেন। সামনের দিকে স্নেহলতা সুরমা এবং এ বাড়ির দু’টি আশ্রিতা বিধবা ভাতটাত নিয়ে প্রস্তুত। এখন হেমনাথ আর বিনু বসে গেলেই হয়।

কোণের দিকের দুটো আসন ফাঁকা। হেমনাথ একটা আসনে নিজে বসলেন, অন্যটা কাছে টেনে এনে বিনুকে বসালেন।

স্নেহলতা হেমনাথের উদ্দেশে বললেন, দাদাভাই কি তোমার সঙ্গে খাবে?

হ্যাঁ। হেমনাথ মাথা নাড়লেন, রাত্তিরবেলা কাটা টাটা বেছে খেতে পারবে না। তার ওপর চোখে ঘুম রয়েছে। আমিই ওকে খাইয়ে দেব’খন।

ঘরশত্রু ছোটদিটা এই সময় নাক কুঁচকে বলে উঠল, এত বড় ধেড়ে ছেলে, তাকে আবার খাইয়ে দিতে হয়।

বিনুর কান লাল হয়ে গেল। লজ্জায় ঘাড় গুঁজে জোরে জোরে প্রবল বেগে সে মাথা নাড়তে লাগল, না না–

হেমনাথ খানিক আন্দাজ করেছিলেন। মৃদু হেসে বললেন, কী হল দাদাভাই?

বিনু মুখ না তুলে বলল, আমি তোমার সঙ্গে খাব না।

সবার চোখেমুখে কৌতুকের হাসি খেলে যাচ্ছিল। হেমনাথ ঈষৎ ঝুঁকে বললেন, তবে কার সঙ্গে খাবি?

কারোর সঙ্গে না। আলাদা খাব।

কিন্তু ইলিশ মাছে বড্ড সরু সরু কাঁটা, বেছে খেতে কি তুই পারবি দাদা? একটা যদি গলায় ফুটে যায়–

ক্লাস সেভেনে পড়ে বিনু। কিন্তু এখনও কাঁটা বেছে খেতে শেখে নি, কাঁটা সম্পর্কে তার দারুণ ভয়। বিনু কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই চিমটি কাটার মতো করে সুধা বলল, একলা খেলে নির্ঘাত ও কাঁটা ফোঁটাবে। তারপর চেঁচিয়ে মেচিয়ে এক কান্ড করে বসুক। মাঝখান থেকে লাভ হবে এই, আমরা ভাল করে খেতে পারব না। এতখানি বয়েস হলে কী হবে, এখনও একেবারে কচি খোকা।

বিনু এবার মুখ তুলল, এমনভাবে সুধার দিকে তাকাল যেন ভস্মই করে ফেলবে। জিভ ভেংচে কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, তার আগেই মৃদু ভৎর্সনার সুরে অবনীমোহন সুধাকে বললেন, কী হচ্ছে সুধা! কেন ওর পেছনে লেগেছিস?

সুধা আর কিছু বলল না। তবে ঠোঁট উলটে দিয়ে, ঘাড় বাঁকিয়ে, চোখ নাক কুঁচকে কেমন করে যেন বিনুকে একবার দেখে নিল, তারপর অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

হেমনাথ বললেন, তা হলে আমার সঙ্গেই খা দাদাভাই’

আড়ে আড়ে সুধার দিকে তাকিয়ে বিনু বলল, কিন্তু ছোটদিটা

না না, সুধা কিছু বলবে না।

বিনু চুপ করে রইল। বোঝা গেল, হেমনাথের সঙ্গে খেতে তার আর আপত্তি নেই।

সবাই বসে পড়েছে। স্নেহলতা পাতে পাতে গরম ভাত দিতে লাগলেন। জুই ফুলের মতো ধবধবে সাদা ভাত। তাকে সাহায্য করতে লাগলেন সুরমা। নির্দেশমতো সেই বিধবা দু’টি রান্নাঘর থেকে মাছ-ডাল-ভাজা-টাজা নিয়ে আসতে লাগল।

প্রথমে সরবাটা ঘি, জলসেঁচি শাক ভাজা, উচ্ছে ভাজা, আলুভাজা, মানকচুর বড়া। তারপর এল ইলিশ মাছ ভাজা।

ইলিশ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন লারামোর। এক টুকরো ভাজা মাছ ওপরে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে একেবারে গানই জুড়ে দিলেন।

‘এসো মনোহর         রসের আগর
নবনী-মাখানো অঙ্গ।
তোমারে দেখিয়া          তোমারে চাখিয়া,
মোহিত এ ভূমি বঙ্গ।’

গানের মধ্যে সবাই মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল। লারমোর থামলে হেমনাথ বললেন, ইলিশ দেখে যে খেপে উঠলো।

বিনু লক্ষ করেছে, দেখেই শুধু নয়, ইলিশের কথা উঠলেই লারমোর একেবারে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছেন।

হাসিমুখে লারমোর বললেন, ব্যাপার কি জানো হেম, এ মাছটা দেখলে আমার আর আর জ্ঞান থাকে না।

সে তো বুঝতেই পারছি।

লারমোর থামেন নি। গলায় ঈষৎ উত্তেজনা মিশিয়ে বলতে লাগলেন, পৃথিবীতে কোনও খাদ্যবস্তু নিয়ে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে কিনা, জানি না। আমার ধারণা ইলিশ মাছ নিয়ে একখানা মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে।

হেমনাথ বললেন, বেশ তো, নতুন মহাভারত শুরু করে দাও।

লাইনে লাইনে মিল দিয়ে পদ্য ফঁদতে পারলে কি এতদিন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি?

লারমোর আরেক প্রস্থ ইলিশের গুণগান করতে যাচ্ছিলেন, বাধা দিয়ে হেমনাথ বললেন, যথেষ্ট হয়েছে, এবার খাও দেখি। ভাত জুড়িয়ে জল হয়ে যাচ্ছে।

আরে তাই তো– চকিত লারমোর আবার থালায় মনোনিবেশ করলেন।

তারপর একে একে ইলিশভাতে এল, ইলিশের ঝোল এল, ইলিশের ডিম দিয়ে টক এল। খেতে খেতে একসময় মুখ তুলে অবনীমোহনের দিকে তাকালেন লারমোর, আচ্ছা অবনী–

আজ্ঞে- অবনীমোহন সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলেন।

রাজদিয়ায় এবারই তো প্রথম এলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। অবনীমোহন ঘাড় হেলিয়ে বললেন, রাজদিয়া কেন, পূর্ব বাংলাতেই এই আমার প্রথম আসা।

তোমাদের দেশ ছিল কোথায়?

শুনেছি বীরভূম জেলায়।

শুনেছি মানে?

কোনওদিন যাই নি কিনা। দু’পুরুষ ধরে আমরা কলকাতাতেই আছি।

লারমোর শুধোলেন, দেশে যাও নি কেন?

অবনীমোহন বললেন, ঠাকুরদা সত্তর আশি বছর আগে বাস উঠিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। দেশে বাড়িঘর বলতে কিছু নেই। কোথায় যাব?

তা বটে।

একটুক্ষণ নীরবতা। খানিক ভেবে নিয়ে লারমোর বললেন, তোমরা তো খাঁটি পশ্চিম বঙ্গীয়

আজ্ঞে হ্যাঁ- অবনীমোহন হাসলেন।

আমাদের ইস্টবেঙ্গল কিরকম দেখছ বল।

কতটুকু আর দেখেছি। স্টিমারে আসতে আসতে যা চোখে পড়েছে আর মামাবাবু আজ যেটুকু ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন তার বাইরে সবই এখনও অদেখা, অজানা। তবে সামান্য যা দেখেছি তাতে মুগ্ধ হয়ে গেছি। কী ভাল যে লাগছে–

কিছুই দেখা হয়নি। বলতে বলতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন লারমোর, দেখ দেখ, ঘুরে ঘুরে এর আকাশ দেখ, মেঘ দেখ, ফুল দেখ, ধানের খেত, খাল-বিল-নদী আর মানুষ দেখ। শুধু দেখলেই চলবে না, বুকের ভেতর অনুভবও করতে হবে। বুঝলে অবনী, ইস্টবেঙ্গল না দেখলে, তাকে না জানলে বাংলাদেশকে দেখা বা জানা সম্পূর্ণ হয় না। বাংলাদেশই বা বলি কেন, সারা ভারতবর্ষের সব চাইতে সরস আর প্রাণবন্ত অংশটাই অদেখা, অজানা থেকে যাবে।

লারমোরের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, আশ্বিনের বাতাসে ভেসে ভেসে যা সবার বুকে ঢেউ তুলে যেতে লাগল। অবনীমোহন বা অন্য কেউ কিছু বললেন না, অভিভূতের মতো বসে থাকলেন। একজন বিদেশি মানুষ এদেশকে কতখানি ভালবেসেছেন, আপন অস্তিত্ব লুপ্ত করে দিয়ে কিভাবে নিজেকে পূর্ব বাংলার পাখি-মেঘ-ফুল-ফসল-মানুষ এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাকার করে দিয়েছেন অবনীমোহন যত ভাবছিলেন ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। এখানকার আকাশে বাতাসে, মাঠে ঘাটে, শ্যামল বনানীতে নিজেকে শুধু হারিয়ে ফেলেন নি লারমোর, এই সজল সরস বাংলাদেশকে নিয়ে তার গৌরবেরও শেষ নেই।

লারমোর আবার বললেন, জানো অবনী, যৌবনে আমি এদেশে এসেছিলাম। তারপর চল্লিশ পঞ্চাশ বছর ধরে পূর্ব বাংলাকে দেখছি, দেখেই যাচ্ছি। প্রথম দিন দেখে যতখানি মুগ্ধ হয়েছিলাম, বিস্মত হয়েছিলাম, আজও সেই মুগ্ধতা সেই বিস্ময় আমার কাটে নি। বলতে বলতে হঠাৎ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে ডাকলেন, হেম–

পাতের ভাত নাড়াচাড়া করছিলেন হেমনাথ। চোখ তুলে বললেন, কী বলছ?

দিনরাতই তো তুমি চরকি কলে ঘুরছ। দু’চারটে দিন ঘোরাফেরা একটু বন্ধ রেখে অবনীমোহনদের চারদিক ভাল করে দেখিয়ে দাও।

চরকি কলে আমি একলাই ঘুরি? তুমি ঘোরো না?

বাঁ হাতে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে লারমোর হেসে ফেললেন, তা অবশ্য ঘুরি।

হেমনাথ বললেন, ভাগনী ভাগনী-জামাই নাতি-নাতনী আমার একার নয়, তোমারও। এ দেশ ঘুরিয়ে তোমাকেও দেখাতে হবে।

লারমোর উদীপ্ত হয়ে ওঠেন, হাজার বার। বলে কী একটু ভেবে আবার শুরু করলেন, শুভস্য শীঘ্রম। কাল থেকেই শুরু করে দেওয়া যাক। কাল সুজনগঞ্জের হাট আছে। আমাকে ওখানে যেতে হবে। মেয়েরা তো এদেশে হাটে-বাজারে যায় না, কাজেই রঘুরা যাবে না। অবনীকেই নিয়ে যাব। আর–

হেমনাথ বললেন, কী?

তোমাকেও ছাড়ব না, আমাদের সঙ্গে তোমাকেও যেতে হবে।

হেমনাথ বললেন, তুমি নিয়ে যাবে কি, নিজের গরজেই কাল আমাকে সুজনগঞ্জে যেতে হবে।

লারমোর শুধোলেন, তোমার আবার কিসের গরজ?

একটা কোষ নৌকো কিনতে হবে। সুবিধেমতো পেলে একজোড়া হালের বলদ কিনব। কিছু মশলাপাতি আনাজ টানাজ কেনা দরকার। তা ছাড়া–

তা ছাড়া?

সুজনগঞ্জের দোকানীরা এবার দুর্গাপুজো করতে চাইছে। সে ব্যাপারে আমার সঙ্গে কী যেন পরামর্শ করবে। তাই–

কিছু না বলে লারোর হাসতে লাগলেন।

ভুরু কুঁচকে হেমনাথ বললেন, হাসছ যে!

হাসি পেলে কী করব?

শুধু শুধু লোকের হাসি পায়?

তাই কখনও পায়? পেল তোমার কথায়। মশলাপাতি-নৌকো-বলদ কেনাটা বাজে ব্যাপার। আসলে দুর্গাপুজোর পরামর্শ দিতেই সুজনগঞ্জে যাচ্ছ।

হেমনাথ হঠাৎ রেগে গেলেন, তোমার কি ধারণা, চারদিকে পরামর্শ দিয়ে বেগার খেটে বেড়ানোই আমার কাজ? নিজের বাড়ির কিছুই দেখি না? তাহলে এই সংসার চলছে কী করে?

স্নেহলতা এবার উত্তরটা দিলেন, ভূতে চালাচ্ছে সংসার।

চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে হেমনাথ হেসে ফেললেন, তা যা বলেছ। আমার ভরসায় থাকলে এ সংসার আর চলত না।

হেমনাথের দেখাদেখি অন্য সবাই হেসে উঠল।

খানিকক্ষণ হাসাহাসির পর লারমোর বললেন, অবনীকে নিয়ে তুমি তৈরি থেকে। আমি খুব ভোর ভোর এসে তোমাদের নিয়ে যাব।

হেমনাথ বললেন, তুমি নৌকো নিয়ে আসবে?

হ্যাঁ।

তা হলে তোমার নৌকোতেই সুজনগঞ্জে যাওয়া যাবে।

অনেক আগেই বিনুর ঘুম ছুটে গিয়েছিল। খেতে খেতে অবনীমোহন লারমোর হেমনাথ আর স্নেহলতার কথাবার্তা শুনছিল সে। কিছু কিছু বুঝেছিল, কিছু কিছু আবার বুঝছিল না। নৌকোয় করে সুজনগঞ্জ যাবার কথা কানে যেতে আর চুপ করে থাকতে পারল না বিনু। আচমকা বলে উঠল, আমিও হাটে যাব।

লারমোর বললেন, তুই হাটে যেতে চাইছিস দাদা? নাই বা গেলি—

তুমি তো তখন বললে, মেয়েরা হাটে যায় না। আমি মেয়ে? তবে কেন যাব না?

রাইট। আমারই ভুল হয়েছিল, তুমি একেবারে খাঁটি মাসকিউলিন জেন্ডার। কিন্তু–

কী—

ভারি কষ্ট হবে যে তোর। আমার বেরুব সেই ভোরবেলায়, ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।

হোক রাত, আমার একটুও কষ্ট হবে না।

ঠিক তো?

ঠিক।

হাল ছেড়ে দেবার মতো লারমোর বললেন, তাহলে তুমিও তৈরি থেকো।

কাল প্রথম নৌকোয় চড়বে, আনন্দে বিনুর বুকের ভেতরটা ঢেউয়ের মতো দুলতে লাগল।

খাওয়া দাওয়া হয়ে গিয়েছিল। উঠোনের একধারে আঁচাতে আঁচাতে হঠাৎ চঞ্চল হলেন লারমোর, এখন কত রাত হবে বল তো হেম?

চারদিক নিঝুম নিশুতি হয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে হেমনাথ বললেন, দু’প্রহর পেরিয়ে গেছে, মনে হচ্ছে।

ইস, এত রাত হয়েছে! কথায় কথায় গল্পে গল্পে একদম খেয়াল ছিল না। এক্ষুণি আমাকে ফিরতে হবে। কাঁদেরের সকাল থেকে জ্বর, ফিরে গিয়ে ওকে ওষুধ খাওয়াতে হবে, বার্লি টার্লি জ্বাল দিয়ে দিতে হবে।

বিনু শুনেছে লারমোরের কেউ নেই। অথচ এই রাত্রিবেলা ফিরে গিয়ে তাকে বার্লি টার্লি জ্বাল দিতে হবে, কাদের নামে একটা লোককে ওষুধ খাওয়াতে হবে। নিতান্ত আপনজন না হলে কেউ কারও জন্য এতখানি চঞ্চল বা চিন্তিত হয় না।

বিনু শুধালো, কাদের কে? লারমোর বললেন, কাদের মিঞা। আমার গাড়ি চালায়।

সেই বুড়ো রুগ্ণ মসুলমান কোচোয়ানটি চোখের সামনে ভেসে উঠল। বিনু বলল, তোমার কাছেই থাকে কাদের মিঞা?

কোথায় আর থাকবে বল দাদা? লারমোর বলতে লাগলেন, তিরিশ বছর ধরে আমার কাছেই আছে। আমার মতো সংসারে ওরও কেউ নেই।

লারমোর কোথায় থাকেন, বিনুর একবার ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়। কী ভেবে আর করল না।

লারমোর এবার হেমনাথের দিকে ফিরলেন, সেই কথাটা কিন্তু ভুলে যেও না হেম।

হেমনাথ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন, কোনটা বল তো?

ওই যে তখন বললাম, ওষুধ টোষুধ সব ফুরিয়ে এসেছে। দু’চারদিনের ভেতর কিছু যদি আনিয়ে না দাও খুব মুশকিল হবে। বাসাইলের চন্দ্র ভূঁইমালী, সিরাজদীঘার ফণী শেখ, হাসাড়ার মানিক মিঞা, রসুনিয়ার গোঁসাইদাস সা, আরও কতজনের নাম বলব? সবারই কঠিন অসুখ। ঠিকমতো ওষুধ না পড়লে তোকগুলো মরে যাবে।

হেমনাথ বললেন, ওষুধের একটা লিস্ট করে দিও। পরশু হিরণকে দিয়ে আনিয়ে দেব। কি রে হিরণ, পরশু একবার ঢাকায় যেতে পারবি না?

হিরণ কাছেই ছিল। বলল, পারব।

তাহলে এখন চলি।

বিনুরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা ভেতর-বাড়ির উঠোন। পুবদুয়ারী ঘরটার ওধারে যে মস্ত উঠোনটা তার একধারে অন্ধকারে সেই ফিটনটা দাঁড়িয়ে আছে। লারমোর সেদিকে চলতে লাগলেন।

হেমনাথ যুগলকে ডেকে বললেন, একটা হেরিকেন নিয়ে আয়।

হেরিকেন এলে সবাই ওধারের উঠোনের দিকে গেল। পেছনে রান্নাঘরের বারান্দা থেকে স্নেহলতা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, কাল থেকে কিন্তু এ বাড়িতে খাচ্ছেন।

ঘাড় ফিরিয়ে হাসতে হাসতে লারমোর বললেন, নিশ্চয়ই।

রান্নাবান্না করে ভাত-তরকারি যদি আবার ফেলতে হয় তা হলে কিন্তু কপালে দুঃখ আছে সাহেব।

আমি শিরচ্ছেদের জন্য প্রস্তুত সম্রাজ্ঞী।

এধারের উঠোনে এসে দেখা গেল, ফিটনের তলায় বুড়ো দুর্বল ঘোড়াটা নির্জীবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। লারমোর ডাকলেন, গোপাল–এই গোপাল–

ঘোড়াটা কান খাড়া করল।

লারমোর বললেন, একটু কষ্ট করে চল দাদা। একেবারে বাড়ি গিয়েই ঘুমোস।

ঘোড়াটা আস্তে আস্তে চোখ মেলে।

বিনু অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। ঘোড়ার যে আবার নাম থাকতে পারে, তার সঙ্গে কেউ যে। কথা বলে, বিনুর কাছে এসব পরম বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। সে বলল, তোমার কথা ঘোড়াটা বুঝতে। পারে লালমোহন দাদু?

অন্যমনস্কর মতো লারমোর বললেন, পারে বৈকি। পনের যোল বছর আমার কাছে রয়েছে, দু’টো কথা বুঝতে পারবে না? বলেই আবার ঘোড়াটার দিকে ফিরলেন, তোর নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গেছে। দাঁড়া চাট্টি ছোলা দিই।

ফিটনের ভেতর থেকে ছোলাভর্তি একটা থলে বার করে এনে মুখের সামনে ধরলেন লারমোর। ঘোড়াটা মুখ ফিরিয়ে নিল, অর্থাৎ খাবার ইচ্ছে নেই।

লারমোর বললেন, আমার হাতে তুই তো আবার খাস না। চল কাদেরই তোকে খাওয়াবে’খন। ছোলার থলেটা ফিটনের ভেতর রেখে ঘোড়াটাকে গাড়ির সঙ্গে জুতে চালকের জায়গায় গিয়ে বসলেন তিনি।

হিরণ হঠাৎ বলে উঠল, আমিও তোমার সঙ্গে যাব লালমোহন দাদু। আমাদের বাড়ির সামনে একটু নামিয়ে দিয়ে যেও।

লারমোর ডাকলেন, আয়—

হিরণ গাড়ির মাথায় উঠে লারমোরের পাশে গিয়ে বসল।

হেমনাথ নিচে থেকে বললেন, তোর রেকর্ড টেকর্ড, গ্রামোফোন সব পড়ে রইল যে—

হিরণ বলল, থাক। কাল এসে নিয়ে যাব।

একটু পর ঝুমঝুম ঘুন্টি বাজিয়ে ফিটন চলতে শুরু করল। দেখতে দেখতে বাগানের ঝুপসি অন্ধকারে লারমোররা অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

হিরণরা চলে গেলে বাইরের উঠোন থেকে ভেতর-বাড়ির দিকে ফিরে আসছিল সবাই। হঠাৎ ফিসফিসানির মতো একটা আওয়াজ শুনতে পেল বিনু, ছুটোবাবু–দুটোবাবু

চমকে ডান ধারে তাকাতেই বিনু দেখতে পেল, যুগল তার খুব কাছে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতে গলা আরও নামিয়ে বলল, কাইল সুজনগুঞ্জের হাটে আপনে আমার নায়ে যাইবেন।

বিনু কিছুটা অবাক হয়ে বলল, তুমি কাল হাটে যাবে নাকি?

নিয্যস। বড়কত্তা হাটে গ্যালে তেনার লগে আমারে যাইতেই হয়। বড়কত্তায় তো লালমোহন সাহেবের নায়ে যাইব। আমি আরেকখান ছোট কোষা নায়ে যামু, আমার লগে আপনে যাইবেন। একটু থেমে কী ভেবে নিয়ে আবার বলল, বড়কত্তার লগে গ্যালে আপনেরে ছইয়ের বাইরে বইতে দিব না। চুপচাপ ভিতরে বইসা থাকতে হইব। আমার লগে গ্যালে মেলা (অনেক) মজা পাইবেন।

‘ছই’ কী, বিনু জানে না। তবু উৎসাহিত হয়ে সে বলল, আমি তোমার সঙ্গেই যাব যুগল।

কথায় কথায় একসময় তারা ভেতর-বাড়িতে ফিরে এল।

এ বাড়িতে ছোটবড় মিলিয়ে মোট আটখানা ঘর। পশ্চিমের ভিটের একখানা ঘরে সেই আশ্রিতা বিধবা দু’জন থাকে। যুগল আর করিম থাকে বাইরের দিকের দু’টো ঘরে। শিবানী থাকেন দক্ষিণের ভিটের একটা ঘরে। স্নেহলতা হেমনাথের জন্য পুবদুয়ারী বড় ঘরখানা নির্দিষ্ট। বাকি ঘরগুলো এতকাল ফাঁকাই পড়ে থাকত। অবনীমোহনরা আসার পর একটা ঘর তাকে আর সুরমাকে দেওয়া হয়েছে, আরেকটা দেওয়া হয়েছে সুধা সুনীতিকে। বিনু অবশ্য আলাদা ঘর পায় নি, হেমনাথ স্নেহলতার ঘরখানাই দখল করে বসেছে, তাদের মাঝ-মধ্যিখানে শুয়ে ঘুমোয় সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *