দেবেন্দ্রবিজয় তখনই মোবারক-উদ্দীনের সহিত দেখা করিতে বালিগঞ্জের দিকে চলিলেন। তাঁহার মন অত্যন্ত চিন্তাপূর্ণ এবং অত্যন্ত সন্দেহপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। তিনি পথে চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিলেন, মজিদ দিলজানকে কেন হত্যা করিবে ? আপাততঃ ইহার তেমন কোন কারণ দেখিতেছি না। সেদিন রাত্রে রুষ্টভাবে দিলজান মনিরুদ্দীনের বাটী ত্যাগ করিবার পরক্ষণেই মজিদও বাহির হইয়া যায়। ইহাতে বোধ হইতেছে, মজিদ নিশ্চয়ই কোন কারণে দিলজানের অনুসরণ করিয়াছিল। মেহেদী-বাগানের পথে সেই রাত্রে মোবারক-উদ্দীনও মজিদকে একা ফিরিতে দেখিয়াছিলেন। তাহা যেন হইল, কিন্তু দিলজান বাড়ীতে ফিরিবার অন্য সোজা পথ থাকিতে রাত এগারটার পর এই গলি পথে কোনা্ অভিপ্রায়ে প্রবেশ করিয়াছিল ? না, কুয়াসা ও অন্ধকারে হতভাগিনী পথ ভুল করিয়া ফেলিয়াছিল ? তাহার মত বুদ্ধিমতী যুবতী স্ত্রীলোকের কি সহসা এতটা ভুল হইতে পারে ? ইহা সম্ভবপর নহে। হয় ত পথে এমন কোন পরিচিত ব্যক্তির সহিত তাহার দেখা হইয়া থাকিবে যে , কোন কারণে তাহাকে এই গলির ভিতরে ডাকিয়া লইয়া যাইতে পারে; কিন্তু এত অধিক রাত্রে এই নির্জ্জন পথে কোন পরিচিতের সহিত দেখা সাক্ষাত্ হওয়াও অসম্ভব। অর্থলোভে কোন দুর্ব্বৃত্ত যে এ কাজ করিয়াছে, তাহাও বোধ হয় না। তাহা হইলে দিলজানের গায়ে যে দুই-একখানি স্বর্ণালঙ্কার ছিল; তাহা দেখিতে পাইতাম না। বিশেষতঃ এখনও এ দেশের তস্কর ও দস্যুদিগের মধ্যে বিষমাখা ছুরির ব্যবহার প্রচলন হয় নাই। তবে যদি কেহ, দিলজানের কাছে যে ছুরি ছিল, সেই ছুরি লইয়া-দূর হউক, এ সকল কোন কাজের কথাই নয়। যতক্ষণ না মজিদের সহিত দেখা করিয়া আমার জ্ঞাতব্য বিষয়গুলির সন্তোষজনক উত্তর পাইতেছি, ততক্ষণ এ জটিল রহস্যের উদ্ভেদ সুদূরপরাহত।
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় যখন বালিগঞ্জে উপস্থিত হইলেন, তখন বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। শ্যামল তরুশ্রেণীর অন্তরালে রক্তরাগোজ্জ্বল রবি সুবৃহত্ স্বর্ণপাত্রের ন্যায় দেখাইতেছে। তাহার হেমাভকিরণচ্ছটা পশ্চিমাকাশ হইতে সমগ্র আকাশে উজ্জ্বলভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বায়ুচঞ্চল বৃক্ষশিরে সেই স্বর্ণকিরণ শোভা পাইতেছে। এবং তখন হইতে সন্ধ্যার বাতাস ধীরে ধীরে বহিতে আরম্ভ করিয়াছে।
যখন দেবেন্দ্রবিজয় মোবারক-ইদ্দীনের বাসায় উপনীত হইলেন, তখন মোবারক একখানি ইংরাজী সংবাদপত্র হাতে লইয়া দ্বার-সম্মুখে ধীরে ধীরে পদচারণা করিতেছিলেন। এবং তাঁহার একটা পোষমানা কুকুর দ্বারপার্শ্বে দাঁড়াইয়া ঘন ঘন লাঙ্গুলান্দোলন করিতেছিল। দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া কুকুরটা লাফাইয়া গর্জ্জন করিয়া উঠিল। মোবারক তাহাকে একটা ধমক দিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে কহিলেন, “কি দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, এদিকে কোথায় ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আপনার কাছে।”
মোবারক-উদ্দীন ললাট কুঞ্চিত এবং ভ্রূযুগ সঙ্কোচ করিয়া বলিলেন, ” আমার কাছে কেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “সেই খুনের মামা্লা-”
বাধা দিয়া মোবারক বলিলেন, “হাঁ, তা’ কি হইয়াছে, আমি যাহা জানি, সকলেই তা আপনাদিগকে বলিয়াছি।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আরও দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার আছে।”
মোবারক বলিলেন, “বেশ, চলুন ঘরের ভিতরে গিয়া বসি।”
মুবারক দেবেন্দ্রবিজয়কে একটি ঘরের ভিতরে লইয়া গেলেন। কুকুরটাও লাঙ্গুলান্দোলন করিতে করিতে সেখানে গিয়া উপস্থিত হইল, এবং দুই-একবার এদিকা্ ওদিকা্ করিয়া ঘরের মাঝখানে শুইয়া পড়িল। দেবেন্দ্রবিজয় দ্বারপার্শ্বে একখানি চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিলেন। এবং মোবারক কিছু তফাতে ঘরের অপর পার্শ্বস্থ একটি ক্ষুদ্র শয্যার উপরে বসিয়া, সই ইংরাজী খবরের কাগজখানা নাড়িয়া-নাড়িয়া নিজের দেহের উপরে ব্যজন করিতে লাগিলেন। জিজ্ঞাসিলেন, “কেসা্টার কিছু সুবিধা করিতে পারিলেন কি ?”
ইতিমধ্যে যতটা সুবিধা করিতে হয়, তা’ করিয়াছি। অনেক সন্ধান-সুলভও হইয়াছে।”
“বটে, কে খুন করিয়াছে, তাহা কিছু ঠিক করিতে পারিলেন কি ? কে সে, কি নাম ?”
“খুনির নাম এখনও ঠিক করিতে পারি নাই; তবে যে খুন হইয়াছে, তাহার নাম পাইয়াছি।”
“বটে, কে সে, কি নাম ?”
“দিলজান।”
“কই, এ নাম ত পূর্ব্বে কখনও শুনি নাই; কে সে, কোথায় থাকিত ?”
“মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা। বামুন-বস্তিতে, লতিমন বাইজীর বাড়ীতে থাকিত। মনিরুদ্দীন তাহাকে কোথা হইতে আনিয়া সেখানে রাখিয়া ছিল, বলিতে পারি না।”
“অন্ধকার রাত্রে মেহেদী-বাগানে সেই অন্ধকার গলির ভিতরে সে কেন গিয়াছিল ? কিরূপে আপনি এ সকল সন্ধান পাইলেন ?”
“আমি সমুদয় আপনাকে বলিতেছি; কোন কোন বিষয়ে এখন আপনার সাহায্য আমাদের অবশ্যক হইতেছে।”
“সেজন্য চিন্তা নাই-আমি সাধ্যমত আপনাদের সাহায্য করিব-তাহার কোন ত্রুটি হইবে না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “মেহেদী-বাগানে যে লাস পাওয়া যায়, তাহার সেই রেশমের কাজ করা ওড়া্নাখানি অবলম্বন করিয়া আমি এতদূর অগ্রসর হইতে পারিয়াছি। আমি প্রথমে সেই ওড়া্নাখানি লইয়া করিমের মা’র কাছে যাই; সেখানে শুনিলাম, তাহারাই সেই ওড়া্না বামুন-বস্তির লতিমন বাইজীকে তৈয়ারী করিয়া দিয়াছিল। তখন আমি মনে করিলাম, তবে লতিমন বাইজীর খুন হইয়াছে; কিন্তু লতিমন বাইজীর বাড়ীতে গিয়া দেখিলাম, আমার সে অনুমান ঠিক নহে; লতিমন বাইজী বেশ সবল ও সুস্থদেহে বাঁচিয়া আছে। তাহার কাছে শুনিলাম, গত বুধবার রাত্রে দিলজান তাহার নিকট হইতে সেই ওড়া্নাখানি চাহিয়া লইয়াছিল। সেই ওড়া্না গায়ে দিয়া সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিল।”
মো। মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে কেন ?
দে। সৃজান বিবিকে লইয়া সরিয়া পড়িবার উদ্যোগ করিতেছিল, তাহা দিলজান কিরূপে জানিতে পারে; কিন্তু কার্য্যতঃ সেটা যাহাতে না ঘটে, সেই চেষ্টায় দিলজান রাত্রে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যায়; কিন্তু মনিরুদ্দীন তার আগেই বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল। সেখানে মজিদ খাঁ ছিলেন; তাঁহারই সহিত দিলজানের দেখা হইয়া যায়; তাহার পর লি কথা লইয়া দু’জনের কিছু বচসা হয়। রাত প্রায় বারটার পর দিলজান সেখানে হইতে বাহির হইয়া যায়; মজিদ খাঁ তাহার সঙ্গে সঙ্গে বাহির হইয়া পড়েন। মজিদ খাঁ দিলজানকে শেষজীবিত থাকিতে দেখিয়াছেন।”
মোবারক বলিলেন, “তা’ হইলে দিলজান রাত্রে আর বাড়ী ফিরে নাই। কিন্তু যখন সে দেখিল, মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার সাক্ষাত্ হইল না, তখন সে সেখান হইতে বরাবর নিজের বাড়ীতে না আসিয়া, এত অধিক রাত্রে মেহেদী-বাগানের সেই ভয়ানক অন্ধকার গলিপথে কি উদ্দেশ্যে গিয়াছিল, বুঝিতে পারিলাম না। মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে বামুন-বস্তিতে যাইবার ত একটা বেশ সোজা পথ রহিয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তা’ আমি ঠিক বলিতে পারি না। হয় সে পথ ভুল করিয়া থাকিবে, নতুবা ইহার ভিতরে আরও কোন লোক জড়িত আছে।”
মোবারক কহিলেন, ” এ কোন কাজের কথাই নয়। ইহার ভিতরে আবার কে জড়িত আছে ?”
দে। আছে-মজিদ খাঁ।
শুনিয়া মোবারক লাফাইয়া উঠিলেন; বলিলেন, “মজিদ খাঁ-কি সর্ব্বনাশ !” তালু ও জিহ্বার সংযোগে বারদ্বয় এক প্রকার অব্যক্ত শব্দ করিয়া বলিলেন, “না-ইহা কখনই সম্ভব নয়; আমি মজিদ খাঁকে বরাবর খুব রকমেই জানি; খুব ভাল চরিত্র-তিনি কখনই খুন করেন নাই; এমন একটা ভয়ানক খুন কখনই তাঁহার দ্বারা হইতে পারে না। আপনার এ সন্দেহ একান্ত অমূলক।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” শুনিয়াছি, সেদিন রাত্রে আপনি যখন বাসায় ফিরিতেছিলেন, দিলজানের মৃতদেহ আবিষ্কারের পূর্ব্বে এই মেহেদী-বাগানে মজিদ খাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হইয়াছিল। তাহা বোধ হয়, এখন আপনার স্মরণ আছে ?”
রুষ্ট ও উদ্বিগ্নভাবে মোবারক বলিলেন, “কি ভয়ানক লোক আপনি ! মজিদ আমার বন্ধু, যাহাতে তিনি বিপদে পড়েন, তাঁহার বিরুদ্ধে কোন কথা বলা আমার ঠিক হয় না। আপনি কি সেইজন্য এখানে আসিয়াছেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আপনি তখন মজিদ খাঁকে কিরূপে দেখিয়াছিলেন, আপনার সঙ্গে তাঁহার কি কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, সেই সকল জানিবার জন্য আমি আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি। আপনি কি তাহা আমাকে বলিবেন না ?”
মোবারক কহিলেন, “কেন বলিব না ? ইহাতে দোষের কথা কিছুই নাই। রাত্রে মেহেদী-বাগানে মজিদ খাঁকে দেখিয়াছি বলিয়াই যে, তিনি খুনী হইলেন এমন ধারণা ঠিক নহে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” কি ভাবে আপনি তাঁহাকে প্রথম দেখেন, আপনার সঙ্গে তাঁহার কি কি কথা হয় ?”
মোবারক কহিলেন, “অন্ধকারে আমি তাঁহার ভাব-ভঙ্গী দেখিবার সুবিধা পাই নাই। তিনি তাড়াতাড়ি ফিরিতেছিলেন। অন্ধকারে তিনি একবারে আমার গায়ের উপরে আসিয়া পড়েন। যে অন্ধকার ! তাহাতে এরূপ ঘটনা সচরাচর ঘটিয়া থাকে, তিনি যদি আমার গায়ের উপরে আসিয়া না পড়িতেন, হয় ত আমিই তাঁহার গায়ের উপরে গিয়া পড়িতাম। যাহা হউক, তার পর আমি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া নিজের বাসায় আনিবার জন্য জেদাজেদি করিলাম-মনিরুদ্দীনের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম-এই রকম দুই-একটী বাজে কথা হইয়াছিল।”
দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিতভাবে বলিলেন, “তাই ত ! ঠিক সেইদিন তেমন রাত্রে মেহেদী-বাগানে মজিদ খাঁর আবির্ভাব কিছু সন্দেহজনক বলিয়া বোধ হয়।”
মো। আমি ত ইহাতে সন্দেহের কিছুই দেখি না; যদি আপনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি অবশ্যই আপনাকে ইহার কারণ দেখাইবেন। বিশেষতঃ তিনি দিলজানকে খুন করিতে যাইবেন কেন-দিলজানের সহিত তাঁহার সংশ্রব কি ?
দে। খুন করিব মনে করিয়াই যে, মজিদ খাঁ দিলজানকে খুন করিয়াছেন, আমি এমন কথা বলিতেছি না; তবে দৈবাত্ কি রকম হ’য়ে গেছে। আপনি এই ছুরিখানা দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন।”
এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন বাইজীর বাড়ীতে যে ছুরিখানি পাইয়াছিলেন, তাহা বাহির করিয়া দেখাইলেন।